এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • রাজরক্ত (রহস্য গল্প) : ১০ম পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ২৫ জুলাই ২০২১ | ২২২৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮
    (১১) সৌরভ ২৯/০৩/২০০২ রাত ১১.৪০

    ভাবলাম, বাঁচা গেল। কারণ, ছোড়দি মানে কুন্দনন্দিনী যে আমাকে উপেক্ষা করছেন তা আমার একেবারে ভালো লাগছে না। আমার কী দোষ? অথচ উনি একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। আমার কাছে মোবাইলটা জমা রাখবার সময়ে হোক বা স্টেটমেন্ট সাইন করে কলম ফেরৎ দেবার সময় – ওঁর দৃষ্টি রঞ্জন রশ্মির মত আমাকে ভেদ করে আরপার হয়ে পেছনের দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছে। এই যে সেদিন এতঘন্টা একসঙ্গে একই কোচে এসেছি, সন্ধ্যের সময় থেকে ছিন্নমস্তার মন্দির রাজওয়াড়া হয়ে দূর্ঘটনাটা ঘটা পর্য্যন্ত ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছি, পূজারীজির কাছে ওসব ফালতু গা গুলিয়ে ওঠা গল্প শুনেছি আর ওঁরা যুবরাজের মেসেজ পেয়ে পাগলের মত দিওয়ানা হয়ে রাজওয়াড়ার দিকে গেলে ওঁদের ভালমন্দের কথা ভেবে সেই রাক্ষুসে ঘড়িয়াল জন্তুটার এলাকায় পুকুর পাড়ে অপেক্ষা করেছি, তার কোনই দাম নেই?

    না থাকলেই ভাল। কিন্ত এখানে আমাকে ওঁরা বাতিল কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়ার আগে একবার ভেবে দেখুন যে, যদি আমি সেদিন বুড়ারে না আসতাম, এলেও পরিচয় না করতাম, করলেও যুবরাজ মার্ডারের পর তক্ষুনি মোবাইলে ফোন করে বসকে জানিয়ে না দিতাম, তাহলে গতকালই ওঁদের শাহডোলের সেশন্স কোর্টে চালান জমা করে পুলিশ জেলে পুরত।

    না, আমি বদলে কোন কৃতজ্ঞতা, কোন এহসান চাইছি না। তবে আমাকে এড়িয়ে গিয়ে এভাবে আমার অওকাত বা জায়গাটা দেখিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল? এটুকু আশা করাটা কি অনায্য? যাকগে মরুকগে! আমার কী? দিদি? বড়দি ছোড়দি? ইঃ, একেবারে কোন বাবাকেলে দিদি রে! এখন ফাইল টাইল গোটালে হয়! বড্ড হাই উঠছে। কালকে আবার সকালে উঠে তৈরি হতে হবে। বিলাসপুরে ফিরে যাব। আমিও বসেদের সঙ্গে ওদের গাড়িতেই ফিরব। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঝিমুনি এসে গেছল। এমন সময় বস কিছু বললেন।

    -- সৌরভ, যাও গিয়ে পুসওরামকে পাঠিয়ে দাও। পুসওরাম কে মনে আছে তো?
    - হ্যাঁ; মেন গেটের চৌকিদার। কিন্তু এখন এত রাতে ওকে কোথায় খুঁজব?
    -- ঠিক, আগে শান্তিরামকে ধর। ওই তোমাকে পুসওয়ের কাছে নিয়ে যাবে।

    পুসওরাম

    পুসওরাম এল। শীতে কুঁকড়ে থাকা আধবুড়ো একটা লোক, মাথায় একটা ছোট চাদর পাকিয়ে পাগড়ি করে পরা, গায়ে জড়ানো শস্তা মলিদা গোছের কাপড়, হেঁটো ধুতি, পায়ে টায়ারের চপ্পল। দরজার বাইরে চপ্পল খুলে খালি পায়ে ভেতরে ঢুকল, তারপর হাতের পেতল ও তামার তার জড়ানো লাঠিটা দেয়ালের গায়ে ঠেকিয়ে মাথার পাগড়ি খুলে লাঠির উপর রেখে সবাইকে জোড়হাতে নমস্কার করল। এবার মাথার টাক স্পষ্ট হল। তারপর ওর ঘোলাটে দৃষ্টি যেন শাস্তি পাবে এমনই ভাবে সবার দিকে পালা করে তাকিয়ে এসপি শ্রীবাস্তব সাহেবের মুখে স্থির হল।

    -- তুমহারা নাম? ক্যা কাম করতে হো?
    - পুসওরাম মালিক। চৌকিদার হুঁ।
    -- ইঁহা কিতনে সাল হো গয়ে?
    - কোই দো ধন দশ সাল, মালিক। এই দশ-বারো সাল।
    -- তুমি থাকতে যুবরাজ সাহাব খুন হয়ে গেলেন? কিসের চৌকিদার তুমি?

    পুসও প্রায় সাষ্টাঙ্গ হয়ে শ্রীবাস্তব সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে।

    মোলা বাঁচালে মালিকমন। ম্যাঁয় কুছু নহী জানন। জাড়া লাগিস, ওতি আগি তাপে বর রসৌই তরফ গয়ে রহেন। মোলা নোকরি লে নিকাল দেইহ তো মোর নান নান দুঠন নাতি-নাতিন হাবে, ওমন কে কা হোই?

    আমায় বাঁচাও মালিকেরা। আমি কিছু জানিনা। শীত করছিল, তাই রান্নাঘরে আগুনে হাত সেঁকতে গেছলাম। আমায় নোকরি থেকে বের করে দিলে আমার ছোট ছোট দুটো নাতি-নাতনি কোথায় যাবে? ওদের কী হবে?

    শ্রীবাস্তবজি অপ্রস্তুত; কোন রকমে পা ছাড়িয়ে নিয়ে বলেন - এসব কী? কে তোর চাকরি খেয়ে নেবে?

    -- শান্তিরাম বলেছে ছোটে মালিক বহোত গুসসে মেঁ হ্যায়। আমাকে বলেছে আমি যেন আপনাদের কাছে সব ঠিক ঠিক বলে দিই, কিছছু যেন না লুকোই! নইলে চাকরি যাবে।
    - ঠিক বলেছে। কিছু লুকোচ্ছিস কি?
    -- নহীঁ মালিক। কুছু নহীঁ ছুপাওথন। কিচ্ছু লুকোচ্ছিনা, রামজী জানেন।
    - তাহলে বল তুই ওই দুই বঙ্গালি দিদিদের কখন গেট দিয়ে ঢুকতে দেখলি?
    -- আমার গেট দিয়ে রাত্তিরে কোন দিদি-টিদি ঢোকেনি।
    - তুই বারান্দায় ওই দিদিদের রাস্তা আটকে ব্যাগ জব্দ করিস নি?

    পুসও দু’কানে হাত ঠেকায়। নহীঁ মালিক।

    -- তাহলে ওরা গেট পেরিয়ে বারান্দায় উঠে যুবরাজ সাহেবের ঘরে ঢুকলো কী করে?

    পুসও চুপচাপ দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

    - একটা কথা বল। তুই সারাক্ষণ গেটে দাঁড়িয়েছিলি? কক্ষণো গেট ছেড়ে যাসনি?

    কোসলে স্যার শান্ত গলায় বলেন - ঝুট বললে আমরা ঠিক বুঝে যাব, আর তোর চাকরি কাল সকাল থেকে শেষ।

    ও আবার হাত জোড়ে।

    - ঝুট নেহী, রামজি জানেন। একবার গেছলাম। বহোত জাড়া লাগিস। বিড়ি খতম হো গইস। তাই রান্নাঘরে পাচকের কাছে বিড়ি আনতে গেছলাম। হ্যাঁ, ওখানে উনুনের কাছে হাত সেঁকতে সেঁকতে একটু দেরি হয়ে গেছল।

    -- তুমি সত্যি কথা বলছ না। বিড়ির জন্যে যাওনি। অন্য একটা কাজে গেছলে?

    কোসলে স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন।

    আমার বস তাঁর শান্ত নির্মম মূর্তিতে, ওঁর এই অবতার আমার চেনা। পুলিশ স্টেশনে জেরা করার সময় হঠাৎ দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সোজা কোমরের লেভেলে একটা লাথি কষানো! এটা ওঁর স্পেশাল ট্রিটমেন্ট,ঘাগু ক্রিমিনালদের জন্য।

    কিন্তু এই গোবেচারা চৌকিদার! ওর জন্যেও কি একই দাওয়াই?

    আমি জানি এবার কিছু ঘটবে। আমি ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় টানটান।

    পুসও ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে থাকে। তবে ওর চেহারায় কি ফাঁদে পড়া খরগোসের ভাব ফুটে উঠেছে?

    কিন্তু আমি যা ভেবেছিলাম তেমন কিছুই ঘটল না।

    কোসলে স্যার একই রকম ঠান্ডা গলায় বলে চললেন — আমি বলছি তুমি মিথ্যে কথা বলছ। আমি বলছি তুমি বিড়ি আনতে যাওনি। আমি বলছি তুমি রান্নাঘরে গিয়ে পাচকের সঙ্গে গাঁজা খেতে গেছলে। আমি বলছি এটা তোমার রোজকার অভ্যেস, তুমি রাত্তিরে ওই সময়ে গাঁজায় দম দিতে যাও।

    এবার ঘটনা ঘটল। পুসও ঠিক আগের মত ডাইভ মেরে কোসলে স্যারের পা ধরতে গেছল, কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে শ্রীবাস্তব স্যারের একটা লাথিতে ও ছিটকে পড়ে গেল। কোসলে স্যার চুলের মুঠি ধরে ওকে টেনে তুলেছেন। আর ঠান্ডা গলায় বলে চলেছেন - সচ সচ বতা। সচ সচ বতা।

    শ্রীবাস্তব স্যার কোমরের বেল্ট খুলছিলেন তার আগেই পুসও বলে ওঠে - মোলা ঝন মারিহ সাহাবমন। সচ্চি বতাথন।

    আমায় মেরো না গো সাহেবরা। বলছি, সব সত্যি বলছি।

    হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। গরীব মানুষ, গাঁজা খাই; শীতের দিনে একটু বেশি খাই। গা’ গরম হয়। রোজ ওই সময়েই রান্নাঘরে পাচক শুয়ে পড়ার আগে যাই, দুজনে মিলে —।

    - বাকি দিনের কথা ছাড়, তখন রাজোয়ারা প্রায় খালি থাকে। সেদিন যুবরাজ সাহেব ছিলেন। পুজোর দিন। তখন কার ভরসায় গেট ছেড়ে গেলি।
    -- ওহি তো বাত হ্যায়। সেদিন দেখলাম বারান্দায় দু’জন মানুষ পায়চারি করছেন। তাই ভাবলাম এই ফাঁকে টুক করে দুটো টান দিয়ে আসি। আর যুবরাজরা সপরিবারে এসেছেন। কুমারসাহেবও এসেছেন। শান্তিরাম আছে। এখানে কোন বাইরের লোক রাত্তিরে কেন আসবে?

    শ্রীবাস্তব স্যার উত্তেজিত। দু’জন মানুষ? তাঁরা কারা? ঠিক দেখেছিস? ঠিক করে বল।।

    পুসও ইতস্তত করে। তারপর কানে হাত দিয়ে বলে - রামজীর কসম, বারান্দার মশাল নিভে গেছল, অল্প আলোয় ভাল করে দেখতে পাইনি। বুঝেছি রাজাসাহেবদের পরিবারেরই কেউ হবেন। তাই আর কিছু ভাবিনি।

    -- কিন্তু কিছু একটা তো মনে হয়েছিল? কুছ আন্দাজ? সেটাই বলে ফেল।

    ভয়ে কেঁপে ওঠে পুসওরাম। বলে বড় মানুষদের ব্যাপারে নাম নেওয়া ঠিক নয়। ভুলচুক হতে পারে। মাঝখান থেকে এই গরীব মারা পড়বে।

    -- তোর কোন ভয় নেই, কেউ জানবে না। কারা সেই দুইজন? লম্বা না বেঁটে? ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল নাকি আলাদা আলাদা পায়চারি করছিল? পরনে কী ছিল? প্যান্ট না ধুতি না পাজামা?

    -- নেহীঁ, নেহীঁ। একজন আউরত থী, শাড়ি পহনে হুয়ে। আর একজন বড়ে ইয়া ছোটে মালিক জেইসা লাগত রহিস।

    না না। একজন তো মহিলা, শাড়ি পরা। অন্যজন হয় বড়ে মালিক, অথবা ছোটে মালিক।

    উত্তেজনায় শ্রীবাস্তবজীর গলার স্বর কর্কশ। ঠিক করে বল হাঁদারাম, বড় না ছোট? যুবরাজ নাকি কুমারসাহেব?

    -- দুনো হো সকে!
    - ধ্যাৎ গাধা। আচ্ছা, এবার তুই যা। এখানে যা বলেছিস বাইরে যেন পাঁচকান করিস না। তাহলে চাকরিও যাবে, জেলের ভাতও খেতে হবে, জেনে রাখিস।

    ওকে আর কোন কাগজে সই বা টিপছাপ দেওয়ানো হয় না।

    আমি জানি, আজ রাত্তিরে আমার ঘুম আসবে না। সে না আসুক, বিছানায় বডি ফেলতেই হবে, আর পারছি না।

    কুন্দনন্দিনীর কথা ৩০/০৩/২০০২ ভোর সাড়ে চারটে

    রাত্তিরে অনেকক্ষণ ঘুম আসেনি। আমি আর দিদি অনেকক্ষণ গেস্ট হাউসের জোড়া খাটে শুয়ে এপাশ ওপাশ করেছি। দিদি খুব ঠাকুর দেবতা মানে, ভগবান মানে। ও সমানে নানান প্রার্থনা আর স্তোত্র বিড়বিড় করে চলেছে। আবার একটু পরে পরেই - ছোটু, এবার কী হবে?

    - কিছু না, কাল থেকে সব ভাল হয়ে যাবে। আমাকে ওই অফিসার বলেছেন যে কাল আমাদের বিলাসপুর ফেরার ব্যবস্থা করে দেবেন। এখানে যা অবস্থা! তবে ওরা না সব কিছু যাচাই করে দেখছে। মনে হয় আমাদের দু’বোনের কথা বিশ্বাস করেছে।
    -- ঠিক বলছিস?
    - হ্যাঁ দিদি। তোর আর আমার বয়ানের মধ্যে কোন কন্ট্রাডিকশন নেই, বিশ্বাস করবে না কেন?
    -- আর আমরা তো সত্যি কথাই বলেছি। দুজনেই।
    - হ্যাঁ, আমাদের লুকোবার কী আছে? উই হ্যাভ নো স্কেলিটন ইন আওয়ার কাবার্ড। কিন্তু একটা কথা।
    -- কী? ওই সৌরভ বলে বাঙালি ছেলেটা—
    - হ্যাঁ, কী হল?
    -- ছেলেটা খুব খারাপ। ওকে বিশ্বাস করা যায় না।
    - কেন, তোর সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করেছে?
    -- ধ্যৎ, সেসব কিছু নয়। ওকে বিশ্বাস করে আমরা যা যা বলেছিলাম ও বোধহয় সব ওর বসকে বলে দিয়েছে।
    - সেকী? কেন বলতো?
    -- দেখ, ও আগে আমাদের কাছে মিথ্যে কথা বলেছে। ও নাকি যুবরাজের নতুন পিএ। তায় বাঙালি। সেইজন্যে ওর উপর ভরসা করেছিলাম। এখন দেখছি ও হল পুলিশের খোচর। আ মোল। আ স্পাই! টিকটিকি!
    - শান্তিনিকেতনে এইসব খোচরদের আমরা ঘৃণ্যজীব মনে করতাম।
    -- আমি একদম পাত্তা দিইনি, না চেনার ভান করেছি । ও পুলিশের চাকর, চাকরের মতই থাকুক। তুই যেন দিদি বড়দি শুনে আর গলে যাসনি। কাল বিলাসপুরের পৌঁছে সোজা রায়পুরের ট্রেন নয়তো বাস ধরব। ব্যাস্‌। এই অভিশপ্ত ঘটনা, এইসব ছিন্নমস্তা-টস্তা ভুলে যাব। খুব শিক্ষে হয়েছে।
    - কিন্তু ছোটু, তোর কেন মনে হোল ও বসকে আমাদের নামে চুগলি করেছে সেটা তো বললি না?
    -- আসলে আমাকে এমন কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল যে —
    - কে জিজ্ঞেস করল? কাল লোকটা? যে বেশ স্মার্ট? নাকি বয়স্ক একটু ভুঁড়িওলাটা?
    -- ওই ভুঁড়িওলা। বলছিল — জানতে চাইছিল, শান্তিনিকেতন ছাড়ার পরে আমি শেষ কবে যুবরাজকে দেখেছি? সত্যি বলছি কিনা!
    - আরেঃ ওই লোকটা আমাকেও একই প্রশ্ন করেছিল? বারবার বলছিল সত্যি বলছি তো? আমি বলেছি যে ট্রেনের জি কেবিনে। ঠিকই তো বলেছি।
    -- আমিও তাই বলেছি।
    - তাহলে তো চুকেই গেল।
    -- একটা কথা দিদি, সেভাবে দেখলে আমি তো শেষবার দেখেছি সেই দশবছর আগে। যখন আমরা দুজনে বিলাসপুরে ওদের সো কল্ড প্যালেসে গেছলাম।
    - কিন্ত তুই তো বলেছিলি সে ঠিক বীরেন্দ্রপ্রতাপ বলে মনে হয়নি, শুধু তোকে চিনতে পারেনি বলে নয়, চেহারাটাও কেমন কেমন।
    -- হ্যাঁ দিদি। কিন্তু এই লোকটাই সেই যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপ।
    - তাহলে ও নিজেকে বীরেন্দ্রপাল সিং কেন বলছিল? সৌরভ বলেনি যে চেকারের সঙ্গে ঝগড়া করে নাম বীরেন্দ্রপাল লিখিয়েছিল? অবশ্য ও অসুস্থ, চিকিৎসা চলছে সেটাও তো জেনেছি।
    -- বেশ, তাহলে বীরেন্দ্রপ্রতাপ কে? শান্তিনিকেতনে কে পড়তে গেছল? এ তো বলছিল বাংলা জানেনা, জীবনে শান্তিনিকেতনে যায়নি, আর রায়পুরের রাজকুমার কলেজ থেকে পড়াশুনো করেছে, তাও কেমিস্ট্রি নয়, ইংলিশ লিটারেচার নিয়ে। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
    - দেখ ছোটু, এসব ভেবে মাথাখারাপ করার কোন দরকার নেই। বোম্বাগড়ের যুবরাজ, বীরেন্দ্রপ্রতাপ বা বীরেন্দ্রপাল যাই হোক, আর আমাদের মধ্যে নেই। ঈশ্বর ওকে মুক্তি দিয়েছেন। ওর ন্যায়-অন্যায়ের বিচার এখন ভগবানের হাতে। আমাদের হাত পরিস্কার। এখান থেকে কাল আমরাও মুক্তি পাব। এখন ঘুমো, কাল সকালে উঠতে হবে।

    দিদি বললেই কি ঘুম আসে? আমি অন্য কথা ভাবছি। আমাকে যে লোকটা জাপটে ধরে খুনি সাজালো, হ্যাঁ জাপটেই ধরেছিল, সেসব পুলিশকে বলব কেন? হ্যাঁ, সেই লোকটা কে? সবাই যাকে কুমারসাহেব বলছে। ও নাকি রাজবাড়ির ছোট পুত্তুর? পুরো নামটা কী? এই কি বীরেন্দ্রপ্রতাপ? যখন জাপটে ধরেছিল তখন ওর গা থেকে একটা গন্ধ আমার নাকে এল। ওই ভ্য়ংকর সময়েও মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। তাই যখন জোর জবরদস্তি করে আমার ব্যাগ খোলা হোল আমি ঠিকমত বাধা দিতে পারি নি।

    ওই গন্ধ যে আমার বিশেষ পরিচিত। শান্তিনিকেতনে ছেলেদের মধ্যে একজনই ওই ক্যালভিন ক্লাইনের এর ‘অবসেশন’ নামের দামি পারফিউমটি ব্যবহার করত। ওর গন্ধ আমায় পাগল করে দিত। তাহলে? তাহলে ও কে? বুড়ার ছাড়ার আগে এই রহস্য আমায় ভেদ করতে হবে। কাল শান্তিরামকে কুমারসাহেবের নাম জিজ্ঞেস করলেই হবে। সো ইজি, সো সিম্পল! এই কথা দিদিকে বলা যাবে না। পুলিশকে তো একদম না।

    সৌরভ ৩০ শে মার্চ, সকাল আটটা

    ভোর ছ’টায় মোবাইল বেজে উঠল। কাল অনেক রাত্তির হয়ে গেছল। চোখে ঘুম আঠা হয়ে লেগে আছে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরতে ধরতেই কেটে গেল। উঠে লাইট জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখলাম। ফোন আবার বেজে উঠল। ডায়ালে নাম ফুটে উঠল ‘বস’। মেরেছে!

    -- কীরে ঘোড়া বেচে ঘুমুচ্ছিলি নাকি? এতবার রিং বেজে গেল!
    - গুড মর্নিং বস! আমি বাথরুমে ছিলাম, তৈরি হচ্ছিলাম।
    -- শোন, ওই দুই বাঙালি দিদির সঙ্গে আর একবার মোলাকাত জরুরি। তুই দেখ, ওরা যাতে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়। ওদের সঙ্গে নিয়ে বিলাসপুর যাব। ধর ন’টা নাগাদ। তার মধ্যে রাণীসাহেবার প্রশ্নোত্তরি পর্ব সাইনি্ মেয়েটা সেরে ফেলবে। ও আধঘন্টার মধ্যে কাজ শুরু করে দেবে। তুই নাস্তা-টাস্তা ভুলে যা! আমরা রাস্তায় কোন ধাবায় সেরে নেব। মেয়েদের বল সাড়ে সাতটার মধ্যে প্যাকিং করে তৈরি হতে। ওরা তোর সঙ্গে আসবে, কিন্তু হেঁটে নয়। লোকজন খেপে আছে, কোন রিস্ক নেওয়া উচিত হবে না।

    থানেদার পবন পান্ডে আরও ফোর্স আর গাড়ি নিয়ে আসছে। ও তোদের তিনজনকে নিয়ে আসবে। আটটার মধ্যে এখানে পৌঁছুতে হবে।

    এভাবেই আমরা পৌঁছে গেলাম রাজওয়াড়ায়। কালো ডগগায় চেপে, গাড়িতে মহিলা পুলিশও ছিল দু’জন। ভালই হল । দুই দিদি আমার সঙ্গে কথা বলছিল না, তবে কথা শুনে ঠিক সময়ে তৈরি হয়ে গেছল, বোধহয় বিলাসপুর যাবার খুশিতে।

    বস আর শ্রীবাস্তবজীকে দেখছি এই শীতের মধ্যেও সাতসকালে উঠে দাড়ি কামিয়ে স্নান-টান সেরে একেবারে ফিট। ওরা আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। কালকের রুম। আরও একটা এক্সট্রা চেয়ার। কারণ শিবাঙ্গী সাইনিও একশীট কাগজ নিয়ে রেডি, একটা ফোল্ডার দেখে বুঝলাম রাণীসাহেবার ইন্টারভিউ নেয়া হয়ে গেছে। বসের ইশারায় বুঝলাম আজ জবানবন্দীর নোটস নেয়ার কাজ সাইনি ম্যাম করবে। বাঁচা গেল। ওর হাতের লেখা আমার চেয়ে ভাল।

    ভাবলাম, এবার দুই বোনকে ডাকা হবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, ড্রেসিং গাউন পরে ঢুকছেন কুমারসাহেব।

    - আমায় ডেকেছেন?
    -- হ্যাঁ, দু’একটা প্রশ্ন বাকি ছিল।
    - এখনও? আজ শেষ হবে না?

    কোসলে স্যার এর উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করেন।

    -- যুবরাজ সাহেব কোথায় পড়াশুনো করেছেন?
    - রাজকুমার কলেজ, রায়পুরে।
    -- আপনি কোথায় পড়েছেন?

    কুমারসাহেব কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে তারপর বললেন - শান্তিনিকেতনে।

    - আপনার বিষয় কী ছিল?
    -- কেমিস্ট্রি।
    - তাহলে আপনি ওই দুই বোনকে চিনতেন? আলাপ ছিল?
    -- অমন চেনা হোস্টেল লাইফে সবাই সবাইকে চেনে। ওদের হিউম্যানিটিজ। আমার সায়েন্স।
    - আর্টস সায়েন্সে কি বন্ধুত্ব হয় না?
    -- হতে পারে, কিন্তু আমার হয় নি। কেন? ওরা কি আপনাদের কাছে তেমন কিছু ক্লেইম করেছে নাকি?
    - না না; ওরা বোধহয় আপনাকে চিনতেই পারে নি।
    -- দেখলেন তো? তেমন পরিচয় থাকলে কি চিনতে পারত না?
    - ঠিক কথা। আপনি চিনেছিলেন কি?
    -- না, তাহলে ওদের চোখে চোখে রাখতাম।
    - কেন?
    -- কী আর বলব? ওরা দুইবোন খুব ধান্দাবাজ মেয়েছেলে। ওদের বাবা ছিলেন শান্তিনিকেতনে নামজাদা প্রফেসর। কিন্তু ওরা --।

    এবার কুমারসাহেব হতাশভঙ্গীতে মাথা নাড়েন।

    - কী হয়েছিল?
    -- বলছি, প্লীজ এটা কোথাও পাঁচকান করবেন না; আমাদের পরিবারের সম্মানের ব্যাপার। বছর দশক আগে এরা দু’বোন কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে এসে ভরা দরবারে দাদাকে বলে ওই বাচ্চাটি নাকি দাদার। এ একেবারে অসম্ভব কথা। দাদা দিলেন ঘাড়ধাক্কা।

    শ্রীবাস্তব স্যারের ভুরু কুঁচকেই রয়েছে। বললেন, "বুঝলাম; কিন্তু ওইরকম ঘটনার পর আপনারা ওদের নেমন্তন্ন করে নিয়ে এলেন কেন?"

    - সেটার উত্তর দাদা দিতে পারত, কিন্তু এখন--।
    -- চিঠিটা তো বাংলায় লেখা!
    - তাতে কী? বিলাসপুরে রেলওয়ে পাড়ায় একাধিক বাংলা প্রেস আছে। ওদের কাজ হোল বাংলায় বিয়ের চিঠি, নিমন্ত্রণ পত্র এসব ছাপানো। দাদা দরকার মত কাউকে ইংরেজিতে, কাউকে হিন্দিতে পত্র পাঠান। ওদের এসবের রেডি টেমপ্লেট থাকে। নাম ঠিকানা, তারিখ বদলালেই হোল। এদের বাংলাতে পাঠিয়েছে আর কি! তবে এ’নিয়ে আমায় কিছু বলে নি।
    -- এদের যে ডাকা হয়েছে সেটা আপনি টের পেলেন কখন?
    - সেদিন সন্ধ্যে বেলা বুড়ারে এসে শান্তিরামের কাছ থেকে।
    -- ঠিক আছে, আপনি যেতে পারেন। কিন্তু আগামী তেরদিন মানে অশৌচের সময় বুড়ারের বাইরে যাবেন না। আপনি বা শান্তিরাম দুজনেই। আপনাদের সেফটি দেখা আমাদের কর্তব্য। কোন এমার্জেন্সি হলে থানেদার পবন পান্ডেকে জানিয়ে দেবেন। সাবধানের মার নেই।

    যাবার সময় পেছনে ডাকতে নেই। কিন্তু কেন যে কোসলে স্যার ওই কাজটাই করলেন।

    - ক্রিকেট খেলতেন? শান্তিনিকেতনে বা বিলাসপুরে?
    -- হ্যাঁ কলেজের দিনে খেলেছি বইকি! আমি ছিলাম মিডিয়াম পেস বোলার।
    - ব্যাট কি গাঙ্গুলির মতন করতেন?
    -- না না। দাদা ঠহরে ওপেনিং ব্যাটসম্যান অউর খব্বু, বাঁয়া হাথ। পর মিডিয়াম পেস বোলিং করতে থে ডাহিনা হাথ সে। ম্যাঁয় হুঁ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। পর ব্যাটিং বোলিং দোনো মেঁ ডাহিনাহাথি।
    - আর আপনার ম্যানফ্রাইডে শান্তিরাম?

    হেসে ওঠেন কুমারসাহেব। উয়ো তো ডান্ডাগিল্লি খেলতে হ্যাঁয়। তারপর বেরিয়ে যান।

    এরপর ডাকা হয় দুই দিদিকে, একসঙ্গে। আর জিজ্ঞাসাবাদের কাজটা শুরু করেন আমার বস।

    - আপনাদের কাল বার বার বলেছি সত্যি কথা বলতে, কিন্তু আফশোস, আপনারা আমার কথা শুনলেন না। পুলিশকে এত বোকা ভাবেন কেন?

    আমি দুই দিদিকে দেখছি। দুই দিদির চোখের তারা বড় বড়, অবাক হয়ে গেছে। বড়দির ঠোঁট কাঁপছে। তবু ছোটদিদি থেমে থেমে বললেন — এসব কী বলছেন? মিথ্যে কথা বলেছি?

    শৈবলিনী বোধহয় সাহস পেলেন - দেখুন, আমরা সব সত্যি কথা বলেছি। কিচ্ছু লুকোই নি। কাল আপনি এসব কিছু বলেন নি। আর আজ—

    ধমকে উঠলেন শ্রীবাস্তবজি।

    কাল আপনাদের দূ’বোনকে জিজ্ঞেস করা হল — আপনারা যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপকে শেষ কবে জীবিত দেখেছেন? তো আপনারা বললেন — বুড়ার আসার পথে ট্রেনের কামরায়, তাই তো !

    শৈবলিনী ডেসপারেট, শৈবলিনী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

    - উঃ , বার বার সেই এককথা। যেটা সত্যি তাই বলেছি। মিথ্যে বলব কেন?
    -- আচ্ছা, আজ থেকে দশ বছর আগে আপনারা দু’বোন বিলাসপুরে বোম্বাগড় প্যালেসে যুবরাজকে ব্ল্যাক মেইল করতে যান নি? আবার বলছেন কিচ্ছু লুকোই নি?

    শৈবলিনীর মুখ ফ্যাকাসে। কিন্তু এবার উনি চেরা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

    -- কে বলেছে আমরা ব্ল্যাক মেইল করতে গেছলাম? কে বলেছে আমরা ওখানে বীরেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে দেখা করেছি ? হ্যাঁ গেছলাম, দেখা করতে, ব্ল্যাক মেইল করতে নয়। আর আমাকে তো দেখা করতে দেয় নি। প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। এর মধ্যে মিথ্যে কোথায়?
    - আর ছোট বোন? আপনি গিয়ে ভরা দরবারে যুবরাজ সাহেবের নামে অভিযোগ করেননি? অনেক লোক সাক্ষী আছে।
    এইসব কথা কাল আপনি লুকিয়েছেন, তারপরও বড় গলা? চোরি অউর সীনা জোরি? চোরের মা’র বড় গলা? অ্যাঁ?

    কুন্দনন্দিনী চেঁচালেন না। কেটে কেটে বললেন - শুনুন, আপনার ফ্যাক্ট সব ভুল। আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আগে যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিনা? আমি বলেছি - হয় নি। এরমধ্যে কোন ভুল নেই। আমি গেছলাম যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখি সে অন্য লোক। এখন জেনেছি তার নাম বীরেন্দ্রপাল সিং, হ্যাঁ যিনি গত ২৭ তারিখে মারা গেছেন। বীরেন্দ্রপ্রতাপ সিংয়ের সঙ্গে দেখাই হয়নি। তাঁকে আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি, এর মধ্যে মিথ্যে কোথায়? বিশ্বাস না হয় আপনাদের খোচর ওই মিটমিটে শয়তান সৌরভকে জিজ্ঞেস করুন।

    -- ও বাবা! আপনি দেখছি উকিলের মত আর্গুমেন্ট করছেন? ভাল।
    - আরও শুনুন আমি ওনার সামনে গিয়ে খালি নিজেদের পরিচয় দিতে পেরেছিলাম। আর কোন কথা বলার সুযোগই পাই নি, আর আপনি বলছেন ব্ল্যাকমেইল! বেশ বলুন না, ওনার কাছে কী প্রপোজাল নিয়ে গেছলাম? আপনার সাক্ষীদের ডাকুন।

    রাগে শ্রীবাস্তব সায়েবের মুখ থেকে খানিকক্ষণ কোন কথা বের হল না। তবে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন — একজন সাক্ষী ডাকছি। পুসওরাম কো বুলাও।

    পুসওরাম এল; আজ যেন কাল রাতের তুলনায় বেশ সজীব। আজ ও শুধু শ্রীবাস্তবজীকে নমস্কার করল।

    -- এই দুই মহিলাকে চেন?
    - হাঁ, এহীমন দুনো যুবরাজ সাহাবকে হত্যারিন হাবে।

    এরাই তো যুবরাজ সাহেবের হত্যারিন।

    - শাট আপ!

    চেরা গলায় চেঁচিয়ে উঠেছেন ইংরেজির টিচার কুন্দনন্দিনী, যেন ক্লাসে কোন বেয়াদপ স্টুডেন্টকে বকছেন।

    কোসলে স্যার হাত তুললেন। শান্ত গলায় অনুরোধ করলেন মিছেমিছি উত্তেজিত না হতে। বললেন এরপর দিদিদের কথাও শোনা হবে। কাজেই ওঁরা যেন কো-অপারেট করেন।

    শ্রীবাস্তবজী মৃদু ধমক লাগিয়ে বললেন - যতটা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ওর জবাব দাও, ফালতু কথা বলবেনা। কখন দেখেছ ওনাদের?

    -- উসদিন রাত কো! চীখ পুকার সুনকর হম অউর পাচক রসোই সে দৌড়কর আ গয়ে। দোনো দিদিমনলা কুমারসাহেব অউ শান্তিরাম কসকে পকড়ে রইসে। ওকর বাদ একজনকে ঝোলাসে খুন লগে ছুরা নিকলিস। ব্যস্‌।

    সেদিন রাতে চেঁচামেচি শুনে আমি আর রান্নার ঠাকুর দৌড়ে এসে দেখি দুইদিদিকে কুমারসাহেব ও শান্তিরাম কষে ধরে রেখেছে। তারপর ওদের একজনের ঝোলা থেকে রক্তমাখা ছোরা বেরোল, ব্যস্‌।

    --আগে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখনি?
    - নহীঁ।
    -- তুমি ওদের বারান্দায় রাস্তা আটকে ব্যাগ জমা নিয়েছিলে?
    - নহীঁ। মোর ডিউটি বড়ে গেট পর। বারান্দা মেঁ নহীঁ।

    এবার শ্রীবাস্তবজী কুন্দনন্দিনীর দিকে ফিরে বললেন —

    -- একে আগে দেখেছেন?
    - মনে পড়ছে না।
    -- এই কি আপনার রাস্তা আটকে ব্যাগ জমা নিয়েছিল?
    - না, এ একটু বেঁটে।
    -- আপনারা যখন মেন গেট দিয়ে ঢুকেছিলেন তখন গেটে কেউ আটকায়নি?
    - না; গেটে কেউ ছিলনা।
    -- তাহলে যে আপনার ব্যাগ নিয়েছিল তাকে আর দেখেন নি?
    - না।
    -- পুসও, এখানে পাচক, দারোয়ান আর চাকরবাকর মিলিয়ে তোমরা ক’জন আছ? পাঁচজন? সবাইকে এখানে ডেকে আন।

    বস আমাকে ইংরেজিতে বললেন — গো উইথ দ্য বাগার সৌরভ, বি আলার্ট। নো ওয়ান শুড এসকেপ।

    পাঁচমিনিটের মধ্যে সেই পাঁচজন এসে লাইন দিয়ে দাঁড়াল কামরার মধ্যে। ওদের মধ্যে একজন মহিলা। পাচকের বৌ।

    -- দেখুন তো দিদিরা। এদের মধ্যে সেই লোকটা আছে কিনা? মানে যে আপনাদের ব্যাগটি জমা রেখেছিল?

    এঁরা দু’বোন ভাল করে দেখে বললেন - ঠিক বলতে পারছি না। মশালের আলো, পাগড়ি পরা ছিল।

    -- ঠিক আছে্‌ তোমরা যাও।

    এবার কোসলে স্যার খানিকটা এগিয়ে এসে ছোট বোনের সামনে দাঁড়ালেন।

    -- একটা প্রশ্ন ছিল। আপনি কাল রাতে বাঁ হাতে সাইন করলেন। আমার কথা হল , আপনি কি খালি সাইন মারতেই বাঁহাতের ব্যবহার করেন, নাকি অন্য কাজের জন্যেও?

    কুন্দনন্দিনীর ভুরু একটু ওপরে উঠল। তারপর সামান্য হেসে বললেন —খাওয়া ছাড়া প্রায় সব কাজই বাঁহাতে করি।। কলেজে ব্যাডমিন্টনে ইন্টারডিপার্টমেন্ট সিঙ্গলস চ্যাম্পিয়ন ছিলাম, লেফট হ্যান্ড।

    - আচ্ছা, তাহলে মামলা কোথায় দাঁড়াল? একটা একটা করে বলি।

    এক, সেদিন রাত্তিরে আপনারা দুবোন যুবরাজ সাহেবের কামরায় গেলেন। পাঁচমিনিট বা দশমিনিট পরে চেঁচাতে চেঁচাতে বেরিয়ে আসলেন। শান্তিরাম আপনাদের পথ আটকে জানতে চায় কী হয়েছে।

    দুই, এদিকে সেই চিৎকার শুনে কুমারসাহেব ভেতরে গিয়ে দেখলেন যুবরাজ উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন, কাঁধের কাছে একটা ছোরার ঘা। ওঁর চিৎকারে শান্তিরাম বড় বোনকে ধরে ফেলে। উনি ছোটবোনকে আটকান।

    তিন, আপনার কাঁধের ব্যাগে রক্তের দাগ চোখে পড়ায় জোর করে ব্যাগ খোলানো হয়। ভেতরে শালে জড়ানো রক্তমাখা ছোরা পাওয়া যায়।

    চার, আপনাদের ব্যাখ্যা হল, কোন সিকিউরিটি গার্ড আপনার ব্যাগ জমা নিয়েছিল। সম্ভবতঃ সেই ভেতরে ছোরাটা ঢুকিয়ে ব্যাগ বারান্দায় ফেলে পালিয়েছে।

    পাঁচ, কিন্তু সেই সিকিউরিটি গার্ড এখানকার কর্মচারিদের মধ্যে কেউ নয়, তাকে কেউ দেখেনি। আপনাকে কেউ মাটি থেকে ব্যাগ কুড়িয়ে নিতে দেখেনি। বরং রক্তমাখা ব্যাগটি আপনার কাঁধেই সবাই দেখেছে।

    আমাদের সন্দেহ সত্যিই কোন গার্ড ব্যাগ জমা নিয়েছিল কি?

    ছয়, আজ সকালে থানেদার পবন পান্ডের মাধ্যমে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমাদের হাতে এসেছে। জেলা সদর শাহডোলের সিভিল সার্জনের রিপোর্টের হিসেবে যুবরাজের মৃত্যু হয়েছে রাত আটটার থেকে সাড়ে ন’টার মধ্যে। কাঁধে ছোরার আঘাতটা পেছন থেকে করা হয়েছে। এবং যিনি করেছেন অনুমান তিনি বাঁহাতি।

    এবার কিছু বলবেন?

    থরথর করে কাঁপছেন শৈবলিনী। কুন্দনন্দিনীর চেহারায় কেউ একপোঁচ কালি ঢেলে দিয়েছে। দু’জন মহিলা পুলিশ বারান্দা থেকে এগিয়ে এসে এঁদের হাত ধরে ফেলে।

    এসপি শ্রীবাস্তবজি নিরুত্তাপ গলায় বলেন — শৈবলিনী ও কুন্দনন্দিনী চট্টোপাধ্যায়! আপনাদের দু’জনকে বোম্বাগড়ের যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপ উর্ফ বীরেন্দ্রপাল সিংকে ছোরা মেরে হত্যার অপরাধে গ্রেফতার করা হচ্ছে। হত্যার উদ্দেশ্য কথিত অপমান এবং প্রতারণার বদলা নেওয়া। এখনও ফরেনসিক রিপোর্ট আসা বাকি। আরও জিজ্ঞাসাবাদ দরকার। তাই বুড়ার থানায় জিরো নম্বর এফআইআরের ভিত্তিতে আপনাদের পুলিশ কাস্টডিতে বিলাসপুরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

    কাল দুপুর নাগাদ বিলাসপুর সেশন্স কোর্টে পেশ করা হবে। তখন আপনারা উকিলের সাহায্য নিতে পারবেন ।

    দু’জন মহিলা পুলিশ এঁদের হাত ধরে ঠেলতে ঠেলতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কালো ডগগায় তোলে। না, কোন হাতকড়ি লাগানো হয় না। শিবাঙ্গী ফাইলগুলো গুছিয়ে বড় ব্রীফকেসে ভরতে থাকে।

    আগে টের পাইনি, বাইরে অনেক মানুষের ভীড়। সেখান থেকে জয়ধ্বনি ওঠে। তারপর শ্লোগান ওঠে - হত্যারিন কো ফাঁসি দো! ফাঁসি দো!

    একটা মেঘলা মন খারাপ নিয়ে আমি শ্রীবাস্তব সাহেবের জিপসিতে পেছনের রো তে বসে পড়ি। আমার পাশে শিবাঙ্গী সাইনি। কিন্তু আমার এখন কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

    গাড়ি বিলাসপুরের জন্যে রওনা হয়। পেছনে পবন পাণ্ডের কালো ডগগায় দুই মহিলা পুলিশের মাঝে ওঁরা দুই বোন। ভীড়কে পেছনে ফেলে কাঁচা রাস্তা ছাড়িয়ে কাফিলা পিচের রাস্তায় উঠতেই সামনের পলাশ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে দু’জন। তারা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাতে বলছে।

    কাছাকাছি আসলে বয়স্ক কাঁচাপাকা দাড়িওলাকে চিনতে পারি। ইনি তো ছিন্নমস্তা দেবীর পূজারী।

    -- কী ব্যাপার?
    - সায়েব, আপনারা চলে যাচ্ছেন?
    -- হ্যাঁ, আমাদের তাড়াতাড়ি আছে, বলে ফেলুন।
    - সাহেব, ওই খুনি ঘড়িয়ালকে মারার একটা ব্যবস্থা করুন। ও আজকাল হরদম উঠে এসে শিকার করছে । পুকুরে একটাও মাছ নেই। কাল আমার ধলা গাইয়ের পা ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কোনরকমে বেঁচেছে। ঢোর হাসপাতালে ডাক্তার ওর একটা পা কেটে ফেলেছে। দেখুন বাঁচে কিনা। এখানকার কোন শিকারী ওটাকে মারবেনা। ওটা নাকি পিশাচ। আপনারা যদি কিছু করেন।
    -- আমরা বিলাসপুরে বনবিভাগের রেঞ্জারকে খবর করে দেব। ওখান্ থেকে শিকারী আসবে। আপনার কাজ হয়ে যাবে। ততদিন গাঁয়ের লোকদের বলুন সাবধান থাকতে। কেউ যেন পুকুরপাড়ের জলো ঘাসে গরুছাগল না চরায়।

    গাড়ি গীয়র বদলায়।

    (প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮
  • ধারাবাহিক | ২৫ জুলাই ২০২১ | ২২২৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 68.184.245.97 | ২৫ জুলাই ২০২১ ২০:৩৩496086
  • দ্বিতীয় পর্বের জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি!

  • বিপ্লব রহমান | ২৭ জুলাই ২০২১ ০৭:২২496122
  • বাপ্রে! শেষে দুই বোন ধরা পড়লেন? মোটিভ খুব জোরাল নয়, তাছাড়া এত কাঁচা খুন কেউ করে? 


    রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে 

  • :|: | 174.255.134.131 | ০১ আগস্ট ২০২১ ০৪:১৪496265
  • দ্বিতীয় পর্ব কখন আসবে? এই দুইবোন খুন করেছেন বিশ্বাস হয় না। নির্ঘাত দ্বিতীয় পর্বে আসল আততায়ী ধরা খাবেন। 

  • Ranjan Roy | ০৩ আগস্ট ২০২১ ০১:০৪496342
  • চতুর্ভুজ


      আর ক'টা দিন। এই সপ্তাহের শেষে। আসলে বিদ্যাসাগরে হাত লাগিয়ে এই রহস্যকাহিনীর প্রতি সুবিচার করতে পারছিনা। এই সপ্তাহের শেষে ফের হাত লাগাবো।

  • গবু | 2402:3a80:ab7:e329:810f:6e68:5194:f4b7 | ০৩ আগস্ট ২০২১ ০৩:৩০496344
  • জমে গেছে। এত তাড়াতাড়ি ধরা পড়লো মানে খুব সম্ভব এরা খুনি নয়।


    অপেক্ষা করছি।

  • :|: | 174.255.134.131 | ০৫ আগস্ট ২০২১ ০২:৫৭496424
  • আশ্বাস দেবার জন্য ধন্যবাদ। এখন অপেক্ষা --"উইকেন্ড কখন আসবে সুপর্ণা?" 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন