এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পাহাড়যাপন ৪

    Sudeep Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ জুন ২০২১ | ৯৭০ বার পঠিত
  • ঝিমপাহাড় আর সবুজ বনের ঠিক মাঝখানে  দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটা। দূর থেকে দেখলে 'হ্যামলেট' কথাটাই মনে আসে প্রথমে। গ্রামের এক প্রান্তে অতলস্পর্শী খাদ, সেখানে অতিকায় বৃক্ষরা জড়ামড়ি করে নেমে গেছে অরণ্যের বুকে। অন্যদিকে সবুজের সিড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে বরফাচ্ছাদিত চুড়ার উদ্দেশে। 


    ইজারায়েলের ব্যাকপ্যাকাররা বছর চল্লিশ আগে খুঁজে বের করেছিল এই রত্ন, চার দশকের শত হাঙ্গামাতেও তার ঔজ্জ্বল্য একফোঁটাও মলিন হয়নি। হয়নি যে, সেটা সত্যি আশ্চর্য! মাত্র ঘন্টা চারেকের দূরত্বে অবস্থিত পার্বতী নদীর ধারে একটা কংক্রিটের জঙ্গল গড়ে উঠেছে প্রায়। পার্টি ক্রাউডের জ্বালায় গ্রামের মানুষ তো বটেই, বনের পাখিরাও অস্থির। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবিশ্বাস্যভাবে এই গোপন গ্রামটা বেঁচে গেছে। 


    ভাগ্যিস! এই অচিনপুরের ডাকে সাড়া না দিলে সত্যি আফসোস থেকে যেত। বৃষ্টির ছাঁট মাথায় নিয়ে হারিয়ে যাওয়া হত না মেঘেদের দেশে, সবুজে গা ডোবানোর অভিজ্ঞতাও রয়ে যেত অধরা। অথচ এখানে যাওয়া প্রায় ছেলেখেলা। ট্রেকিং প্রায় করতে হয় না বললেই চলে, হাইকিং ট্রেলও ঘন্টাখানেকের চেয়ে বেশি নয়। কিন্তু নির্ভেদ্য অরণ্য এখানে এখনও একইরকম সচল, একইরকম জীবন্ত। 


    জংলি নালা পিছু ছাড়ে না মুহুর্তের জন্য, কাটাকুটি করে জলের সোঁতা এগিয়ে গিয়েছে বন কেটে। পাখির ডাক আর ভ্রমরের গুঞ্জন শুনতে শুনতে হাঁটা। ক্রমে সবুজের প্রলেপ ঘন হয়ে আসে। এমন সময় আমাদের চমকে দিয়ে উন্মোচিত হয় একটা ঝরনা। আমাকে আর পায় কে? সটান জুতো খুলে পাহাড়ি নদীর জলে পা ডুবিয়ে দিই, তারপর জলপ্রপাতের ধারে পাথরের উপর গা এলিয়ে দিই। ঠান্ডা জলের ছিঁটে মুখে এসে লাগছে, ততক্ষণে আমার মনের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা ক্যাওড়া কবি একটা কবিতার বইয়ের নাম ভেবে ফেলেছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন 'জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে'; আমি না হয় লিখব 'জলপ্রপাতের ধারে ঘুমাবো বলে!'


    ওঠার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু উঠতেই হয়। দুপুর হতে না হতেই পাহাড়ে আকাশের মুখভার হয়। বৃষ্টি হলে এই হাইকিং রুটে এগোতেই পা পিছলে আলুর দম হতে হবে। ফিরতি মেঘের পানসে মুখ দেখে পাহাড়ে ওঠা শুরু হয়। এইবার একটু চড়াই এসেছে বটে! শুকনো ফুল মাড়িয়ে ঝোপঝাড় ঠেলে এগোচ্ছি, মাঝেমাঝে রাস্তা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। সুঁড়িপথগুলো সযত্নে এড়িয়ে মেইন ট্রেলে এগোচ্ছি তখন। বাকিগুলো কাঠুরিয়া আর ঘোড়ার চলার রাস্তা। এই বনে আরো কিছু ছোটছোট গ্রাম আছে, সেখানেও যাওয়া যায় ইচ্ছে হলে। কিন্তু পথ না জানলে হয়রানি হতে পারে। 


    বিকেলের আগেই গন্তব্যে এসে উপস্থিত হলাম। সবুজের ঘনঘটা থেকে তখন মনের ভিতর লাবডুব লাবডুব শব্দ হচ্ছে। এই সবুজের রঙ লিখে বোঝানো যায় না। এত পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি, কিন্তু অন্তত দিন তিনেকের পায়ে হাঁটা পথ না হাঁটলে এমন মারদাঙ্গা সবুজের সঙ্গম তেমন চোখে পড়ে কই! ভাগ্য ভালো হলে বেদেনি বুগিয়াল বা কাশ্মীরের বেতাব ভ্যালিতে কাছাকাছি মশলা পেতে পারেন, না'হলে আল্পস ছাড়া গতি নেই। অবশ্য পাহাড়ের মায়া না থাকলে কেরলের পালক্কড়, সাইলেন্ট ভ্যালি আর মুনরো আইল্যান্ডের সবুজও মগজদখল করতে পারে, কিন্তু তার মেজাজ একদম আলাদা।


    যাই হোক, লাফাতে লাফাতে চললাম। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। খাদের ধারে কাঠের বাড়ি, ঢালু জমিতে গমের খেত, সবজি বাগান। হিমাচলি মহিলারা মাথায় কাপড় বেঁধে খেতে কাজ করছে। কিছুটা দূরে ঢেউয়ের মতো ঘাসের মাঠ, সেখানে ঘোড়া চরছে। দু'টো পাহাড়ে ভাগাভাগি করে কয়েকটি বাড়ি, মাঝখানে দিয়ে বয়ে গেছে নালাটা। নালার উপরের কাঠের সাঁকো পেরিয়ে অন্যদিকে চলে এলাম। খুঁজেপেতে একটা হোমস্টে নেওয়া হল। যতটা না বাড়ি, তার চেয়ে বেশি বাগান। রকমারি ফুল ফুটে আছে, তাছাড়া বাঁধাকপি, বেগুন, টম্যাটো, লঙ্কা তো আছেই।


    স্থানীয় খাবার খেয়ে চাঙ্গা হয়ে পাড়া বেড়াতে বের হলাম। একপশলা বৃষ্টি হয়ে সবুজের রঙ আরো গাঢ় হয়েছে, তার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। বাহুল্য নেই, কিন্তু যত্নের ছাপ স্পষ্ট। 


    ফুলকাটা বারান্দা, জানলা, রেলিংকাঠ, খড়ের গাদা, গোয়ালের গরুর ঘণ্টি....ছাড়া ছাড়া কয়েকটা হোমস্টে। লাল রোয়াক আর খোলা বারান্দা থেকে ভেসে আসা পুরোনো গানের সুর। রেডিও বাজছে। হঠাৎই এক ভালো লাগা মনখারাপ জড়িয়ে ধরে, দলছুট মন পথ হারিয়ে ছুটে যায় অতীতে। এরকম কোনঠাসা দুপুর অথবা টিউশনি সন্ধ্যের ভিজে মরশুমে রেডিও শোনার অভ্যেস আমার বহুদিনের, সে সব দিন এখন স্বপ্ন বলে মনে হয়। 'ছায়াগীত' আর 'আপকি ফরমাইশ' এর মায়াজাল ছিঁড়ে জোর করে হাঁটা দিই, কানে লেগে থাকে সেই বাগানসুরের মূর্ছনা...


    এক চিলতে গ্রাম। গ্রামের পর খেত। খেতের পর পাহাড়। গম থেকে আলু, কপি থেকে সরষে... প্রায় সব কিছুর ফলন হয় এই গ্রামে। দেখতে গেলে একেবারে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট, শহরের উপর কোনও নির্ভরশীলতা নেই। আগে বিদ্যুৎও ছিল না, বছরকয়েক হল এসেছে। মোবাইল কভারেজ নেই, কিন্তু মোবাইল আছে সকলের কাছেই। সেই মোবাইলে আকাশবাণীও বাজে, আবার বাদশাও বাজে। মার্ফির পুরোনো রেডিওর স্মৃতিভেজা অনুষ্ঠান আর সরগম আমাদের নস্টালজিয়ার জগতেই বেঁচে থাক। 


    সবুজে গা ভিজিয়ে একটা জায়গায় বসলাম। চা খেতে হবে। চা, পাহাড় আর বৃষ্টির সঙ্গম বড় একটা হয় না, তাই আমি যে আহ্লাদে আটখানা সে কথা আলাদা করে বলার নেই। গ্রিন টি না হয়েও চায়ের রঙ সবুজ দেখায় আমার চোখে। সেই ক্লোরোফিল ভাসা চায়ে চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। আলো কমছে, সন্ধ্যের আসর নেমেছে জঙ্গলের বুকে। আড্ডার আড়ালে যে কথোপকথন চলছে, তার নাগাল পাওয়া কঠিন। আমরা শুধু চিন্তাজলের সলতে হাতে অপেক্ষা করে থাকি, ছবিঘর বাঁধি মনে মনে। 


    রাত নামে। মুর্গির ধোঁয়া ওঠা মাংস আর রুটি নিয়ে ততক্ষণে আমরা পুরোদস্তুর টুরিস্ট। হিমরাত জাগে চিকচিক পাথরে, চাঁদের আলো বাঁধ ভেঙে ঝাঁপিয়ে  পড়েছে আদিম বনের উপর। 


    পরদিন ফিরে এসেছিলাম। আমার দলছুট মন অবশ্য প্রতিবারের মতো ফিরে আসতে নারাজ। আজও সে সবুজে গা ডুবিয়ে বসে রেডিও শুনছে।



    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2600:1001:b016:62c2:d1dd:8280:917c:5a36 | ২৭ জুন ২০২১ ০০:২৭495336
  • কী যে ভাল 

  • π | ২৭ জুন ২০২১ ১৩:২৭495347
  • কী ভাল।  কোথায় কী নাম আর জিগেশ করলাম না, এই যে লেখেননি এই ভাল।


    তবে সবুজই বললে, পশ্চিমঘাটের সবুজও নেশা ধরানোর মত।  

  • kk | 68.184.245.97 | ২৮ জুন ২০২১ ০৮:১৯495382
  • আপনার লেখা খুব সুন্দর। ছবিও। চিরকালের জন্য এই জায়গাটায় চলে যেতে ইচ্ছে করছে।

  • Sudeep Chatterjee | ২৮ জুন ২০২১ ১৩:০৬495391
  • ধন্যবাদ 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন