এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা

    শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৪ জুন ২০২১ | ১০৮২ বার পঠিত
  • আস্তে আস্তে সমস্ত পোশাক খুলে রাখবো একদিন। সব আবরণ একে একে ছেড়ে বেরিয়ে আসবো। এই পরিচয়ের ঢ্যারা বয়ে বেড়ানো অসম্ভব ক্লান্তিকর। যা কিছু দিয়ে দাগিয়ে নিচ্ছি নিজেকে, বা আশেপাশের মানুষ চিনে নিচ্ছে আমায়, আমি আসলে তা নই মোটেই। হলেও, শুধু সেটুকুই নই। 


    এই যে পড়ি, পড়াই, লিখি, এর কোনোকিছুতেই নিজেকে পুরো খুঁজে পাই না। আমি যে আছি, নিজের কাছে এগুলো তার প্রমাণমাত্র। আমি নই। এর বাইরে, একে ছাড়িয়ে আমার মাথার উপর প্রবহমান আকাশ, তার মেঘ আমার পরিচয়ের একাংশ। সেই অংশের ভিতরে আবার গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ এমনভাবে আরও পরিচয়, তারও মধ্যে শুধু বর্ষাতেই হাজারখানেক পরিচয় আমার জড়িয়ে আছে মেঘের অবস্থানে, উপস্থিতিতে। একইভাবে, সূর্য, চাঁদ, তারা, পান্থপাদপ গাছ, দুই রাস্তার জুড়ে এক হয়ে যাওয়া, আবার ভেঙে তিন হওয়া, প্রতিটি বইয়ের পাতার অক্ষরসমূহ, হাতে লেখা চিঠি, সুর, প্রতিটি মানুষের কণ্ঠস্বরের যে জমি, নুয়ে থাকা ধানক্ষেত, রবীন্দ্রনাথের 'আত্মপরিচয়', বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক', ভাতের সাদা রঙ, ঘুঘু পাখির ডাক, সন্ধের আলোয় মাছের রুপোলি আঁশ, কান্না, প্রতিবাদের স্বর, ভীতি, হেরে যাওয়ার পর নিজের সঙ্গে বেপরোয়া প্রেস কনফারেন্স, এই সব ভেঙে চলেছে আমায়, আমার পরিচয়কে। আমি এই সব; বস্তুত আমি এর কিছুই নই। 


    প্রতিটা মুহূর্ত, পল কী কৌতুকভরে আলাপ করে নিচ্ছে আমার সঙ্গে! সাংঘাতিক ভেঙে পড়ার ক্ষণে সে কেমন আমার ভিতর বসে বসে পা দোলায় নির্লিপ্তভাবে, আবার কোনও কারণ ছাড়াই "কাল ছিল ডাল খালি/ আজ ফুলে যায় ভরে/ বল দেখি তুই, মালী/ হয় সে কেমন করে" ভেবে একেবারে বিহ্বল, অভিভূত হয়ে পড়ি। কী কৌতুকভরে প্রতিটা মুহূর্ত আমার সঙ্গে আলাপ সেরে আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে, বা আমি চলে যাচ্ছি, আর তা দিয়ে আমরা কেমন সুন্দর মেপে নিচ্ছি অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ। আমার যা কিছু প্রাপ্তি বস্তুগত, সে আমাকে জীবনধারণ করাচ্ছে ঠিকই --- পেটে দানাপানি পড়ছে, তরল পদার্থ পড়ছে, গায়ে জামা চড়িয়ে বেরোচ্ছি সভ্য সমাজে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি, অসুখ হলে ওষুধ কিনছি, খাতা কলম কিনে লিখছি, উৎসবে সাজছি, উপহারে বই পাচ্ছি বা দিচ্ছি --- কিন্তু তাতে আমার স্থায়িত্ব বাড়ছে না এতটুকু মোটে, তাতে আমি কিছু বেশি জোর দিয়ে বলতে পারছি না, এই হলাম আমি! বা এইটা আরও বেশি করে আমি।


    আমি যা, আমি সেটুকুই। যাকে স্থায়িত্ব বলছি, সে আসলে আমার পুঙ্খানুপুঙ্খ ভেঙে যাওয়া। আমরা মানুষেরা বড় আশ্চর্য এক জীব --- আমরা ভাঙার ধনে ধনী। প্রাপ্তিতে আমরা যা পাচ্ছি, তার চেয়ে অনেক বেশি পাই অপ্রাপ্তিতে। এই সমস্ত কিছুই যে আমারই পরিচয়, অথচ এর একটির উপরেও যে আমার তিলমাত্র অধিকার বর্তায় না, এর মাঝে নাকি আমি শুভংকর! আমি নাকি পুরুষ! আমার নাকি ধর্ম, কর্ম, ঠিকানা, দলগত আদর্শ, শিক্ষাগত যোগ্যতা (হিহি), গাদাগুচ্ছের সম্পর্কের সাতমহলা বাড়ি! বাপ রে, উফ, দরজা জানলা সব খুলে দেবো! একদিন ভেঙে দেবো সব জানলার কাঁচ, যাতে কেউ বন্ধ করে দিলেও বাতাস, বৃষ্টি সবই ঢুকতে থাকে। একদিন সমস্ত জামা, আবরণ খুলে রেখে দেবো। যদি খুলতে না-ও পারি, এটুকু স্মরণে রাখবো যে পারিনি। বলবো, পারিনি। আবার চেষ্টা করবো। স্থায়িত্বই নেই যেখানে, ভেঙে চলা ছাড়া দ্বিতীয় পথও নেই কোনও। একান্তই যদি কোনও রূপ দিতে হয় নিজেকে, আমি না হয় 'পথের পাঁচালী'র শেষের সেই পথ হবো, যে চলতে থাকে কেবল; বা গঙ্গায় ভেসে থাকা কচুরিপানা, যে উজানে যায় আর ভাটায় আসে, কিন্তু কূল পায় না।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যদুবাবু | ০৫ জুন ২০২১ ০৫:২৯494566
  • ভালো লেগেছে। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন