এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি  ইলেকশন

  • ম্যাংগো পীপল, ম্যাংগো ফ্যাসিজম 

    দেবসত্তম পাল
    আলোচনা | রাজনীতি | ২৫ এপ্রিল ২০২১ | ৩৭৬৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • আচ্ছা দাদা, হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। বলছি যে, আপনি কি ফ্যাসিস্ট? 

    ওই দেখো, রাগ করছেন কেন? প্লীজ় আমাকে ভুল বুঝবেন না। একান্তই অ্যাকাডেমিক কৌতূহলবশে জানতে চাইছি। আসলে এমন তো হতেই পারে, তাই না, যেমন ধরুন আপনি হয়তো মনে প্রাণে জানেন বা বিশ্বাস করেন যে আপনি ফ্যাসিস্ট নন, মানে কিছুতেই হতে পারেন না, অথচ ভেতরে ভেতরে আপনার অজান্তেই আপনি কখন যেন ফ্যাসিস্ট হয়ে গেছেন?

    এই! এই! কী করছেন কী? আপনি তো তেড়ে আসছেন। সরি সরি। প্লীজ় আমায় ভুল বুঝবেন না। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি মেনে নিচ্ছি আপনি ফ্যাসিস্ট নন।  মানে, হতেই পারেন না। সেটা মেনে নিয়েই বলছি, ধরুন এমন তো হতেই পারে যে, আপনি মনে মনে যেটাকে ফ্যাসিজ়ম ভাবছেন (বা ভাবছেন না) সেটা হয় তো ফ্যাসিজ়ম নয় (বা তাই হয়তো ফ্যাসিজ়ম)। 

    ওই দেখো, আপনি আবার আমায় গালাগাল দিচ্ছেন। কী বললেন? কনডিসেন্ডিং, অস্টেন্টেসিয়াস, লিবটার্ড? কী আশ্চর্য! ওপরের কথাগুলো লেখার সময় আমার নিজের সম্বন্ধে ঠিক এই বিশেষণগুলোই মাথায় এসেছিলো। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এর কোনোটাই আমি নই। মানে জ্ঞানত নই। নিজেকে ন্যায়-নীতিজ্ঞানের বিধাতার আসনে বসিয়ে পৃথিবীশুদ্দু মানুষকে জ্ঞান দেওয়াটা একেবারেই আমার উদ্দেশ্য নয়। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবে সত্যি বলতে কী, এই লেখার পেছনে আমার একমাত্র উদ্দেশ্য নিজেকে যাঁচাই করে দেখা। 

    ফ্যাসিজ়ম নিয়ে পড়াশুনো করতে করতে হঠাৎ যখন মাথায় প্রশ্নটা এলো যে, ‘আমি কি ফ্যাসিস্ট?’ বিশ্বাস করবেন না, উত্তরটা নিজের মনের ভেতর খুঁজতে গিয়ে নিজেই আঁতকে উঠেছিলাম।  তাই বলছি, আপনিও একবার ভেবে দেখুন তো, আপনি কি ফ্যাসিস্ট?

    বুকে হাত রেখে যদি সত্যিটা বলে ফেলতে হয়, তাহলে আমার বলা উচিত যে ফ্যাসিজ়ম সত্যি সত্যি কী সেটা এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি সঠিকভাবে জানতামই  না। সত্যি বলছি, জানতাম না। না, না, ফ্যাসিজ়ম কথাটাই কোনোদিন শুনিনি - তা নয়। আসলে অনেক বেশিই শুনেছি। যেমন ধরুন ছোটবেলায় শুনতাম রাজ্যের শাসকদলের নেতারা প্রায়ই বিরোধীদের “ফ্যাসিবাদী” “ফ্যাসিবাদী” বলে গালাগাল করতেন। তখন ব্যাপারটা ওই গালাগালের বেশি কিছু মনে হতো না।  মানে কাউকে “শালা” বলার মতোই অনেকটা - ওটা তো একটা গালি, যাকে  “শালা” বলছি তার দিদি তো  আর সত্যি সত্যি আমার স্ত্রী নয়। সেরকমই, “ফ্যাসিবাদী” মানেই সেই ব্যক্তি ফ্যাসিজ়ম-এ বিশ্বাস করেন সেটা মনে করার কোনো কারণ ছিল না।  তাই “ফ্যাসিবাদী” মানে ঠিক কী, বা কোন মতাদর্শে বিশ্বাস করা মানে ফ্যাসিবাদী হওয়া - এসব প্রশ্ন কখনোই মনে আসেনি। তবে হ্যাঁ, গালাগালটা উচ্চারণের ভঙ্গিতেই বুঝেছিলাম যে ফ্যাসিবাদী হওয়া ব্যাপারটা খুব খারাপ কিছু একটা। 

    গোলমালটা ঘটে গেলো ফ্যাসিজ়ম-এর গোড়ার কথা নিয়ে যখন একটু চিন্তাভাবনা করতে বসলাম তখন। দেখেশুনে, ভেবেচিন্তে যা বুঝলাম তা হলো, আমরা ছোটবেলা থেকে স্কুলে যা শিখেছি, মানে আমার ছোটবেলার উত্তরবঙ্গের মফস্সল শহরের স্কুলে, যে ইতিহাসের পাঠ আমরা পেয়েছি, যে মতাদর্শের জয়গান আমরা শুনেছি, তাতে আমাদের বড় হয়ে ফ্যাসিস্ট না হওয়াটাই আশ্চর্যের কথা! কী বললেন? এ কী অলক্ষুণে কথা? ঠিক আছে, আরেকবার একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলি তাহলে। মানে ছোটবেলা থেকে আমরা স্বাদেশিকতা, দেশপ্রেম, দেশমাতৃকার চরণে জীবনপাত - এসবের গুনকীর্তন যা শুনে এসেছি, দেশপ্রেমী বিপ্লবীদের এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মবলিদানের যে গৌরবান্বিত গাঁথা পড়েছি, তাতে আমাদের সবার মনে দেশের প্রতি যে ভালোবাসা, প্রেম, শ্রদ্ধা ইত্যাদি জন্মেছে, সেই আবেগগুলির এক চরম ক্লাইমেক্সের অনুভূতির নাম ফ্যাসিজ়ম। কি? বিশ্বাস হচ্ছে না? কিছু করার নেই, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না।  যদি আরো তলিয়ে দেখতে চান তাহলে আপনি এই লেখার শেষে আমি আমার যে তথ্যসূত্রগুলোর উল্লেখ করেছি সেগুলো যাঁচাই করে দেখতে পারেন।  

    যা বলছিলাম, তাহলে এখন এই প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে যে, আমি যা বলছি সত্যি-ই যদি সেটাই ফ্যাসিজ়মের গোড়ার কথা হয়, তাহলে পৃথিবীজুড়ে সমাজবিজ্ঞানীরা কেন একে খারাপ বলে এসেছেন এতদিন ধরে? দেশপ্রেম তো একটা অত্যন্ত পবিত্র ব্যাপার, তাই না? জাতীয়তাবোধ তো একটা গর্বের বিষয়। আমরা তো সবাই চাই আমাদের দেশ সত্যিই ভীষণ উন্নতি করুক।  সারা পৃথিবীতে যেন আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারি যে, আমরা এই দেশের নাগরিক বলে গর্বিত। তাহলে ফ্যাসিজ়ম যদি এই কথাগুলোই আমাদের শিখিয়ে থাকে তাহলে “ফ্যাসিবাদী” কথাটা গালাগালের মতো করে কেন বলা হয়? তারই সঙ্গে আরেক ধাঁধা: আমরা যে ছোটবেলায় শুনতাম ফ্যাসিস্টরা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সারা ইউরোপ জুড়ে কোটি কোটি মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল, তার সাথে দেশপ্রেমের কী সম্পর্ক? 

    সম্পর্ক আছে।  আর ভয়টাও সেখানেই। আসুন তাহলে একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। 

    ফ্যাসিজ়ম কী: খায়, না মাথায় মাখে?
    ফ্যাসিজ়ম শব্দটার একটা সর্বজনসম্মত সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন; ১৯১৯ সাল (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি) থেকে ১৯৪৫ সাল (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়) পর্যন্ত ইউরোপ-এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে, বিশেষতঃ মধ্য-পূর্ব-দক্ষিণ ইউরোপে, একরকম গোঁড়া জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শের ঢেউ এসেছিলো। সামগ্রিক ভাবে এই মতাদর্শকে নাম দেওয়া হয়েছিল ফ্যাসিজ়ম। যদিও সমসাময়িক হলেও বিভিন্ন দেশে এর রূপ এবং প্রকাশের রকম  ছিল ভিন্ন, তবুও এই মতাদর্শগুলির কিছু মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দিয়ে ফ্যাসিজ়মকে মোটামুটিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়।



    ফ্যাসিজ়ম কথাটা প্রথম জনপ্রিয় হয় ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টির প্রধান বেনিতো মুসোলিনির হাত ধরে। মুসোলিনি তাঁর “ফ্যাসিস্ট পার্টি”র নামকরণ করেছিলেন ল্যাটিন fasces  শব্দটি থেকে, যার আক্ষরিক মানে হলো একটা কুড়ুলের চারপাশে জড়িয়ে থাকা একগোছা বেত একত্র করে বাঁধা। মুসোলিনির পার্টির চিহ্ন-ও ছিল এই অদ্ভুতদর্শন বস্তুটি (১ নম্বর ছবিতে দেখুন)। বলা হয়ে থাকে যে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে নাকি এই বিশেষ চিহ্নটিই ছিল বিচারকের (মানে দণ্ডদাতার) চিহ্ন। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের বিচারকদের চিহ্নকে নিজের পার্টির চিহ্ন বানিয়ে মুসোলিনি কী প্রমান করতে চেয়েছিলেন আমার জানা নেই।  

    ইতালিয়ান ফ্যাসিস্ট পার্টি এবং তাদের দোসর জার্মানির নাজ়ি পার্টি, এবং আরো অন্যান্য অনেক ফ্যাসিস্ট পার্টিদের মতাদর্শের মধ্যে নানারকম সূক্ষ্ম-স্থূল পার্থক্য থাকলেও কতকগুলো  মূলগত সাধারণ ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই মতাদর্শগুলি দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মূলগত আদর্শগুলির মধ্যে অন্যতম হলো: উগ্র জাতীয়তাবাদ, নির্বাচনভিত্তিক ডেমোক্রেসির প্রতি অবিশ্বাস এবং ক্ষোভ, উদারপন্থার প্রতি সন্দেহ এবং ঘৃণা, পুরোনো ঐতিহ্যের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, এবং আরেকটি দৃঢ় বিশ্বাস যে দেশ/জাতি/ঐতিহ্যের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে সমস্ত জনগণকে একত্র হয়ে দরকারে হিংসা পর্যন্ত করতে তৈরী থাকতে হবে।

    প্রথমেই বলেছি ফ্যাসিজ়মের যথাযথ সম্পূর্ণ সংজ্ঞা দেওয়া হয়তো অসম্ভব; কারণ এর নানাবিধ বাহ্যিক রূপ এবং বহিঃপ্রকাশ। তবে উপরোক্ত মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলোর সাহায্যে মোটামুটিভাবে ফ্যাসিজ়মকে চিহ্নিত করা যেতে পারে।  কিন্তু, এ তো গেলো তত্ত্বকথা, অ্যাকাডেমিক চর্বিতচর্বন। এর সাথে আপনার আমার ফ্যাসিস্ট হওয়ার কী সম্পর্ক? আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষ তো রোজকার দিনপাত করতেই ব্যস্ত, উগ্র জাতীয়তাবাদ দিয়ে আমি কী করবো? উদারপন্থা ভালো না খারাপ তাতে আমার কী এসে যায়? নির্বাচনভিত্তিক ডেমোক্রেসি থাকলো বা না থাকলো, তাতেই বা আমার কী? আমার একটা ভোটে কীই বা পার্থক্য হয়? বেশ। ঠিক কথা, মেনে নিলাম।  কিন্তু মজার কথাটা কী জানেন, দেশে দেশে, যুগে যুগে, এই কথাগুলোই সত্যি ছিল, কিন্তু এর সাথে সাথে এও সত্যি যে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন সাধারণ জীবনের ঊর্ধ্বে উঠে ফ্যাসিজ়মের মতাদর্শে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়ে এসেছেন, এখনো আসছেন। 

    একটু ভেবে দেখুন, হিটলার আর তাঁর নাজ়ি পার্টি যে কোটি কোটি ইহুদী, রোমানি, স্লাভ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন, সেটা যতটা না অবিশ্বাস্য, তার চেয়ে লক্ষগুণ অবিশ্বাস্য এই যে কোটি কোটি সাধারণ জার্মান নাগরিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই হত্যালীলায় সমর্থন জুগিয়েছিলেন। কী করে একজন শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ, আম জনতা, এই হত্যার মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন?

    কেন ফ্যাসিজ়ম এতো আকর্ষণীয়?
    এটা কিন্তু একটা ভীষণ কঠিন প্রশ্ন! অনেক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হয়ে গেছে এই বিষয়ে।  সেগুলো পড়তে বা শুনতে বেশ ভালো-ও লাগে। লাগবে না-ই বা কেন? এইধরণের তত্ত্ব যা মানুষের ভালোলাগা-মন্দলাগার হিসেব ক’ষে দিতে পারে, সে তো জীবনের গভীর রহস্যগুলো খুলে দেওয়ার জাদুকাঠি। (আমাদের দেশের সিনেমা পরিচালক-প্রযোজকরা বোধ হয় মন দিয়ে এসব তত্ত্ব পড়েননি, পড়লে তাঁদের পক্ষে ছবি হিট করানো খুব সহজ হয়ে যেতে পারতো।) কিন্তু আমার পক্ষে সেসব করতে যাওয়া নিতান্তই ধৃষ্টতা। কোটি কোটি মানুষের মনের গতিপ্রকৃতি অংকের উপপাদ্যের মতো কতকগুলো নিয়ম মেনে চলবে - এ কথা ভাবতেও আমার কেমন যেন ভয় করে।  মানুষকে যেন ল্যাবরেটরির ইঁদুর মনে হয়। 

    কিন্তু আবার একথাও তো সত্যি যে, পৃথিবীর ইতিহাসে নানান সময়ে নানান দেশে ফ্যাসিজ়মের আদর্শ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, এবং কোটি কোটি মানুষ সত্যিই সেই মতাদর্শকে সমর্থন করেছেন এর পরিণতির কথা না ভেবেই। তাহলে কি সত্যিই ফ্যাসিজ়মের আইডিয়ার মধ্যে কোথাও কিছু এমন ব্যাপার আছে যা মানুষকে এর প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য করে?

    আগেই বলেছি, এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারে এমন মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে যাওয়া আমার ক্ষমতার বাইরে। আমার সে যোগ্যতা আছে বলেও আমি মনে করি না।  তার চেয়ে বরং আমরা একটা কাজটা করে দেখি: আসুন ভেবে দেখি যে, ফ্যাসিজ়ম আমাদের নিজেদের কাছেই বা কেন আকর্ষণীয় মনে হয়? কেন মনে হয় যে, যদি ফ্যাসিজ়মের ইতিহাস সম্বন্ধে অবগত না থাকতাম তাহলে আমার ফ্যাসিস্ট হতে কোনো আপত্তি থাকতো না?

    প্রথমে আসি জাতীয়তাবাদ বা “ন্যাশনালিজম”-এর কথায়। জাতীয়তাবাদের প্রতি আমরা আকৃষ্ট হবো না কেন তাই তো বুঝে পাই না। সেই কোন ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা। নেতাজি, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা, বিনয়-বাদল-দীনেশ, ভগত সিং, মাতঙ্গিনী, প্রীতিলতা - এঁরা সবাই ছিলেন আমাদের ছোটবেলার এক একজন সুপারহিরো। ছোট থাকতে এই অসামান্য বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গল্প শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো। মনে হতো, ‘ইশ, যদি ওই ভীষণ সময়টায় জন্মাতাম, তাহলে নিশ্চয়ই সশস্ত্র বিপ্লবের আগুনে এদ্দিনে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। নিজের জীবন দিয়ে দেশমাতৃকাকে বিদেশিদের হাত থেকে স্বাধীনতা এনে দিতাম।’ এইসব সুপারহিরোদের তুলনায় বরং গান্ধীজিকে মনে হয়েছে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় পার্শ্বচরিত্র (কখনো বা একেবারে ভিলেন), আর নেহরু ক্ষমতালোভী লম্পট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবি-সাহিত্যিক হিসেবে শ্রদ্ধা করেছি, কিন্তু কক্ষনো কস্মিনকালেও ওঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমকক্ষ একজন পেট্রিয়ট বলে মনে হয়নি। আর আম্বেডকরের কথা তো কিছুই জানতাম না; খালি বলা হতো উনি ব্রিটিশদের থেকে টুকে আমাদের সংবিধান লিখেছেন! 
    কীভাবে এই ধারণা তৈরী হয়েছিল, সেই বিশ্লেষণে যাচ্ছি না - স্কুলের পড়ার সাথে সাথে আরো যে সমস্ত আইডিয়াগুলো গ্রামবাংলার বাতাসে ভেসে ভেসে থাকে, সেরকম বাতাবরণে থেকে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্ত ধারণা আমাদের মনে গেঁথে বসেছিল। আমি অনেকটাই নিশ্চিত যে এই ব্যাপারে আমি একা নই, আমার মতো আরো অনেকেই মেনে নেবেন যে তাঁদের অভিজ্ঞতা-ও কতকটা এরকমই ছিল। 

    এহেন চিন্তাভাবনা দিয়ে যখন আমাদের মননের ভিতটা তৈরী, তখন আজকের দিনে যদি পেট্রিওটিজ়মের হাতছানি পাই, তাতে সাড়া না দেওয়াটাই তো অস্বাভাবিক। তার ওপর এখন তো জাতীয়তাবাদী হওয়া বা দেশপ্রেমী হওয়া ভীষণ সোজা; ফেসবুকে দিনে গোটাদশেক জ্বালাময়ী পোস্ট দেওয়া (অবশ্যই সেগুলো নিজে লিখে বা বানিয়ে নয়, কোথাও থেকে টুকে নিয়ে), হোয়াটসঅ্যাপ-এ গোটা বিশেক ফরওয়ার্ড করা, যেসব মানুষকে দেখতে পারি না তাঁদের পোস্টে গিয়ে গালাগাল দিয়ে আসা, ব্যাস। এই তো! এই করলেই যদি দেশপ্রেমী হয়ে থাকা যায়, তো বেশ ভালোই তো। নিজেকে তখন সেই ছোটবেলায় পড়ে আসা বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীর মতোই মনে হয়।  ইদানিং কালের বিখ্যাত ঐতিহাসিক য়ুভাল নোয়া হারারি বোধ হয় এই কারণেই বলেছেন, ফ্যাসিজ়মের আয়নায় নিজেকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। “বিয়ার গগল” কথাটা অনেকে শুনে থাকবেন। বিয়ার খেলে অন্যান্য মানুষকে স্বাভাবিকের চেয়ে নাকি বেশি সুন্দর মনে হয় - এর-ই নাম বিয়ার গগল। ফ্যাসিজ়মের আয়না ব্যাপারটা  কতকটা সেইরকমই, পার্থক্য শুধু এই যে, ফ্যাসিজ়মের মাদকতার গগলে শুধু নিজেকেই সুন্দর লাগে। রবি ঠাকুরের “ঘরে বাইরে”তে তাই যখন দেখি জাতীয়তাবাদকে নেশার সাথে তুলনা করা হয়েছে, তখন এই নিজেকে দেখার বিয়ার গগলের কথাই মনে পড়ে। 

    জাতীয়তাবাদের মতোই আরেকটা আইডিয়া যা আমরা ছোটবেলা থেকে শ্রদ্ধা করে এসেছি তা হলো অপ্রিয় সত্যি কথাটা বুক চিতিয়ে বলতে পারার সৎ সাহস। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ফ্যাসিস্ট নেতারা চিরকাল সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে এসেছেন যে সমাজের গড়পরতা নেতাদের মতো তাঁরা মিথ্যেবাদী বা তোষণবাদী নন, তাঁরা অপ্রিয় সত্যি কথাটা বলতে ভয় পান না। এই মিথ্যেবাদী হওয়ার অভিযোগটা যদিও শুধু গড়পরতা নেতাদের ওপর দেওয়া হয় না, প্রায়শই দেখা যায় যে চিন্তাশীল-উদারপন্থী মানুষরাও চিরকাল ফ্যাসিস্টদের কাছ থেকে মিথ্যেবাদী, ষড়যন্ত্রী, তোষণবাদী, সুবিধেবাদী, ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে এসেছেন। আমরা সাধারণ মানুষরা ফ্যাসিস্ট নেতাদের এসব কথার সাথে খুব একাত্ম বোধ করতে পারি। আমাদের মনে হয় যেন আমাদের মনের গোপন কথাগুলো, যেগুলো আমরা সত্যি বলেই জানি, কিন্তু কোন এক অজানা ভয় বা দ্বিধা থেকে বাইরে সবার সামনে স্বীকার করতে পারি না; সেই সত্যি কথাগুলো যাকে সাংবিধানিক-গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জরুরি মনে করা তো দূরের কথা, সত্যি বলে মেনে নিতেই নারাজ - সেই কথাগুলো ফ্যাসিজ়ম শুধু স্বীকৃতি-ই দেয়না, বরং আমাদের জানিয়ে দেয় এই কথাগুলো আমাদের অন্যতম প্রধান বিচার্য বিষয়। এই মিথ্যেবাদীদের ভীড়ে, ফ্যাসিস্টরা যেন “উলঙ্গ রাজা”র সেই অকুতোভয় বাচ্চাটার প্রতিভূ হয়ে বলে ওঠে, “রাজা তোর কাপড় কোথায়?”

    এরকম নির্ভীক এক মতাদর্শ নিঃসন্দেহে আকর্ষনীয়। তবে দুঃখের বিষয়, এই নির্ভিকতার ছবিটা কতটা আসল আর কতটা আমাদের ভাবাবেগকে এয়ার কন্ডিশনারের ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে মনে মনে বিশ্বাস করিয়ে দেওয়া - তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আছে। 

    ‘বহিরাগতরা আমাদের চাকরি খেয়ে নিয়েছে।’
    ‘গরীব মানুষকে ভাতা দেওয়া মানে আয়করদাতার কষ্টার্জিত ধনের অপব্যবহার।’
    ‘গণতন্ত্র আসলে শিক্ষিত মানুষদের একটা ষড়যন্ত্র।’
    ‘সেক্যুলারিজ়ম-এর নামে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি করা হয়।’
    ‘এক বিশেষ সম্প্রদায়ের নিজের দেশের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই, তাদের আনুগত্য কেবল তাদের সম্প্রদায় বা ধর্মের প্রতি।’

    এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে সেই তথাকথিত “অপ্রিয় সত্যি কথা”গুলোর। তবে ওপরের কথাগুলি শুধু যে ইদানিং কালের সাথে মানানসই তা কিন্তু নয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ইহুদিবিদ্বেষের (অ্যান্টিসেমিটিজ়ম) ইতিহাসে এই কথাগুলির প্রতিধ্বনি-ই যেন শোনা যায়। তখন বলা হতো ইহুদিদের যেহেতু কোনো দেশ নেই তাই তার কোনো দেশের প্রতি-ই অনুগত নয়, বিশেষ করে যে “জার্মান অভিমান”এ বলীয়ান হয়ে জার্মানি সারা পৃথিবীকে কাবু করতে চায়, সেই অভিমান জার্মান ইহুদিদের নেই। তাই তারা দেশের শত্রু, তারা দেশের সর্বনাশকারী ষড়যন্ত্রী। তখন আরো বলা হতো যে ইহুদিরাই হচ্ছে সব নষ্টের গোড়া, কারণ গোটা বিশ্বকে তারা তাদের ব্যাঙ্ক থেকে লোন দিয়ে দিয়ে নিজেদের হাতের মুঠোয় করে রেখেছে। ত্রিশের দশকে যে দুনিয়া জোড়া আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছিলো, যাকে বলা হয় “দ্য গ্রেট ডিপ্রেশান”, তার কারণ হিসেবেও বলা হতো ইহুদিদের হাতে কুক্ষিগত থাকা মূলধন। তখন এই অপ্রিয় সত্যি কথা বলার কৃতিত্বের গৌরবে বলীয়ান হয়েই উত্থান হয় মুসোলিনি আর হিটলারের। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে এখনকার দিনেও আমরা ঠিক এই কথাগুলো-ই শুনতে পাই, শুধু নাটকের চরিত্রগুলো পাল্টে গেছে। 

    আমি বলছি না যে, সাধারণ মানুষ যে সব প্রশ্নের উত্তর হিসেবে ফ্যাসিজ়মের দেওয়া “অপ্রিয় সত্য”গুলোকে বেছে নেন, সেই প্রশ্নগুলোই অবান্তর। এমনটা দাবি করা নিতান্তই অন্যায়। বরং প্রত্যেকটা প্রশ্নই আজকের দিনে আমাদের সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলির অন্যতম। এই প্রশ্নগুলোর মূলে রয়েছে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট: সম্পদের অসমবন্টন, কর্মক্ষেত্রে কাজের ভার ও পারিশ্রমিকের হিসেবে গরমিল, যোগ্যতার তুল্যমূল্য কাজের সন্ধান না পাওয়া, বিত্তশালীর বিত্ত ক্রমশঃ বাড়তে থাকা, গণতন্ত্রে খাতায় কলমে সাধারণ মানুষের হাতেই সব ক্ষমতা থাকার কথা বলা হলেও আদতে ক্ষমতা শুধু প্রতিপত্তিশালীদের হাতেই থেকে যাওয়া, এবং এরকম আরো অনেক অনেক প্রশ্ন। এরকমই কিছু প্রশ্ন থেকে সমাজজীবনে সৃষ্টি হওয়া “এলিয়েনেশন” বা ভিন্নায়ন নিয়ে আমার আগের লেখায় লিখেছি (https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=20402)।   

    এই প্রশ্নগুলির সঠিক কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা সমাজতাত্ত্বিকদের, অর্থনীতিবিদদের গবেষণার বিষয়বস্তু। কিন্তু সমস্যা হলো, তাঁরা যে সবসময় সবকিছুর সদুত্তর দিতে পারেন এমনটা নয়। অনেকসময় এমনও হয় যে তাঁরা এসব  সমস্যার উদ্রেকের কারণ যদিও বা ব্যাখ্যা করতে পারেন, সেই সমস্যার সুরাহা কী করে হবে তা বলতে পারা প্রায়শঃ হয়ে ওঠে দুষ্কর। কিন্তু এই প্রশ্নগুলি আমাদের জীবনকে প্রতিনিয়ত এতটাই ধাক্কা দেয়, যে এসব তাত্ত্বিক আলোচনা এবং সমস্যার সত্যিকারের সমাধান দিতে তার অসমর্থ হওয়া আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। তাই যে সহজ ব্যাখ্যা আমরা ফ্যাসিজ়মের কাছ থেকে, বা ফ্যাসিস্ট নেতার কাছ থেকে পাই, তা আমাদের মনে গাঢ় হয়ে বাজে। সেই সহজ ব্যাখ্যা আরো বেশি করে আমাদের মনে ধরে কারণ আমাদের নিজেদের মনের ভেতরেই তো কোথায় যেন এই ব্যাখ্যা লুকিয়েই ছিল, কিন্তু শিষ্টাচার, বিবেক এসব ছেঁদো আইডিয়ার শেকলে জড়িয়ে থেকে কথাগুলো সবার সামনে বলতে পারছিলাম না।  ফ্যাসিজ়ম এসে সেই শেকলগুলো ছিঁড়ে দিয়ে বলে, ‘গুরু তুমি যা ভাবছিলে সেগুলোই ঠিক কথা, অর্থনীতিবিদরা এই কথা স্বীকার করে না কারণ তারা ভয় পায়, নয় তো তারা সব বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তিশালী লোকেদের সুবিধাভোগী।’ 

    ছোট থাকতে আমার ঠাকুমার কাছে প্রায়ই শুনতাম, ‘স্মৃতি সততই সুখের।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে একরাশ বিষন্নতা নিয়ে ঠাকুমা এই কথা বলতেন। তখন ব্যাপারটা খুব বেশি বুঝতে না পারলেও এখন মোটমুটি বুঝি তিনি কী বলতেন। এখন মনে হয় এই ব্যাপারটা বোধ হয় আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। ফেলে আসা দিনগুলোকে সত্যিই মনে হয় অনেক ভালো ছিল। ছোটবেলায় হাতে যেন কত সময় ছিল, এখন নেই। ছোটবেলায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে সম্পর্কের টান দৃঢ় ছিল। এমন কি ছোটবেলায় আবহাওয়াও ছিল অনেক বেশি ভালো: গরমে বেশি গরম পড়তো না, শীত ছিল মনোরম। ফ্যাসিজ়ম এক জাদুবলে মানুষের মনের এই দুর্বল জায়গাটা জুড়ে জাঁকিয়ে বসে পড়ে। পুরোনো ঐতিহ্যের বড়াই করে আমাদের বর্তমান জীবনের দুঃখকে চাগিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যেন সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে  যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই অতীতসুখবিলাসের সাথে জাতীয়তাবাদের আরক মিশে সেই উপলব্ধির সৃষ্টি করা হয় যে, আমাদের দেশের গৌরবমন্ডিত ঐতিহ্য আজ হারিয়ে গেছে, এবং সেটা আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।

    ভয়টা কোথায়?
    এতক্ষণ ফ্যাসিজ়ম সম্বন্ধে যা যা চিন্তাভাবনা করলাম সেগুলো দেখে কি মনে হলো যে এর মধ্যে ভয়ের কিছু আছে? খুব সম্ভবতঃ সেরকম কিছু মনে হয়নি। সে আপনি জাতীয়য়তাবাদ বলুন, ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা বলুন, অপ্রিয় সত্যি বলতে পারার সৎ সাহস বলুন, এগুলো সবই অত্যন্ত সমীহ করার মতো গুণ। মানছি যে ফ্যাসিজ়ম হয়তো এই ব্যাপারগুলোকে এক মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়, কিন্তু সে তো কোনো ক্ষমার অযোগ্য  দোষ নয়; “অধিকন্তু ন দোষায়”। বা কখনো কঠিন সমস্যার অতি সরলীকরণ এবং তার সাথে কোনো সম্প্রদায়কে দোষী সাব্যস্ত করা - ফ্যাসিজ়মের এই দোষ-ও রয়েছে। কিন্তু, সেখানে তবু সমস্যার স্বীকৃতি আছে।  অন্যান্যরা যেখানে সমস্যার অস্তিত্বই স্বীকার করে না, সেখানে অতিসরলীকরণ হোক আর যাই হোক, ফ্যাসিজ়ম সেই সমস্যাকে স্বীকৃতি তো অন্তত দেয়। তাই মোটের ওপর হিসেবে করলে মনে হতেই তো পারে যে, ভালোর দিকের পাল্লাই বেশি ভারী। তাহলে ভয়টা ঠিক কোথায়? 

    এই লেখার শুরুতে বলেছিলাম, ছোটবেলায় দেখতাম শাসকদলের মন্ত্রীমশাই বিরোধীদের “ফ্যাসিস্ট” বলে গালাগাল দিচ্ছেন। বড়ো হয়ে একটু আধটু যা পড়াশুনো করেছি, তাতে দেখেছি গোটা পৃথিবীতেই “ফ্যাসিস্ট” কথাটা মোটামুটি গালির পর্যায়েই পড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প, মেরিন ল্যপেন, বরিস জনসন, ভ্লাদিমির পুতিন - এইসমস্ত মহান মানুষদের নিন্দুকেরা প্রায়ই “ফ্যাসিস্ট” বলে থাকেন।  তাই বলছিলাম যে, কথাটা যখন একটা গালাগাল হিসেবে দাঁড়িয়েছে, তখন এটা যে নিতান্তই ভালো একটি গুণ, শুধুমাত্র নিন্দুকদের চক্রান্তে এর আজ বদনাম - এমনটা হওয়া বেশ কঠিন। কাজেই, ফ্যাসিজ়মের ঢেউয়ে সবাই যদি নিজেকে ভাসিয়ে দেয়, তাহলে কোথায় যেন একটা ভয়ের ব্যাপার আছে - এটুকু মেনে নিতে আশা করি কারুর আপত্তি থাকবে না। সেই ভয়টা কোথায়? আবারো আমরা আমাদের সেই আগের পদ্ধতিটা কাজে লাগাতে পারি। মানে আর পাঁচজন কীরকম ভাবছে তার হিসেব তো আর আমি করে উঠতে পারবো না, তার চেয়ে বরং দেখে নিই যে, আমি নিজে যদি ফ্যাসিজ়মের মোহে মুগ্ধ হয়ে যাই তাহলে কী কী বিপদ ঘটতে পারে। 

    প্রথমেই যেটা মনে হয় তা হলো, ফ্যাসিজ়মের আবেদনের সিংহভাগটাই হলো মানুষের আবেগের ওপর দাঁড়িয়ে। ফ্যাসিজ়মের একদম গোড়ার কথাটাই হলো যে, এমন একটা আদর্শের দিকে মানুষকে চালিত করা যা যেকোনো ব্যক্তিবিশেষের থেকে অনেক বড়ো, যেখানে ব্যক্তিগত সুখদুঃখের প্রশ্নের কোনো স্থান নেই, আছে শুধুমাত্র এক বৃহত্তর আদর্শের আহবান। আর সেইজন্যই মানুষের আবেগকে এক্কেবারে গুঁড়ি থেকে মুড়ো অব্দি নাড়িয়ে দেওয়ার মতো আদর্শের আয়োজন-ও দরকার। এই আবেগের তাড়নায়, নিজের নিস্তরঙ্গ জীবনের তুচ্ছতাকে ছাপিয়ে ওঠার তাগিদে, আমরা কখন যে নিজের বিচারবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে ফেলব, তা কিন্তু আমরাও হলফ করে বলতে পারি না। তখন এই সুযোগে ফ্যাসিস্ট নেতা নিজের ইচ্ছেমতো যা খুশি করে ফেলতে পারেন, সেই আদর্শের ধোঁয়া দিয়ে, সেই আবেগের মূলে সুড়সুড়ি দিয়ে, আমরা হয়তো বুঝব-ও না, মেনে নেবো যে সেই বৃহত্তর স্বার্থেই এই কাজটা করতে হচ্ছে।

    এই ঘটনার এক জ্বলন্ত উদাহরণের জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ত্রিশের দশকের জার্মানিতে। ১৯৩৩ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী। এডল্ফ হিটলার মাত্র চার সপ্তাহ আগে জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে, তখন-ও তিনি জার্মানির সর্বাধিনায়ক “ফ্যুরার” হননি। যে পদে তিনি আসীন তার ক্ষমতা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে খুব একটা বেশি নয়। পার্লামেন্টের সদস্যদের ভোটের ভিত্তিতেই সমস্ত আইন-কানুন নির্ভর করে তখনও। তার ওপর হিটলারের নাজ়ি পার্টির মাইনোরিটি গভর্নমেন্ট, নিজের মর্জিমতো কিছুই করার উপায় নেই। এহেন অবস্থায়, সেই ঘটনাটা ঘটে গেলো। ২৭শে ফেব্রুয়ারী, সোমবার, ১৯৩৩, জার্মানির পার্লামেন্ট বিল্ডিং “রাইখস্টাগ”-এ লেগে গেলো ভয়ানক অগ্নিকান্ড! বিধ্বংসী আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো জার্মান রাইখস্টাগ। প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে ফায়ার ফাইটারদের নিরলস পরিশ্রমে আগুন শান্ত হলেও রাইখস্টাগ বিল্ডিংকে সেই আগুন এক নিছক ধংসস্তূপে পর্যবসিত করে ছাড়লো। 

    মজার কথা হলো যে, এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ তার প্রাথমিক খানাতল্লাশীতেই পেয়ে গেলো এমন স্বাক্ষ্য প্রমাণ যা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই অগ্নিকান্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত!

    হিটলার আর নাজ়ি পার্টি সাথে সাথে দোষারোপ করতে শুরু করলেন রাজনীতির ময়দানে তাঁদের চরমতম শত্রু কম্যুনিস্টদের। এই অগ্নিকাণ্ড এবং তাতে বিরোধীদলের জড়িত থাকার অভিযোগের সুবাদে হিটলার রাতারাতি ঘোষণা করলেন জরুরীকালীন অবস্থা। বাকস্বাধীনতা, সাংবাদপত্রের স্বাধীনতা তুলে নেওয়া হলো, পুলিশের হাতে ক্ষমতা এলো নির্বিচারে যেকোনো মানুষকে গ্রেফতার করার, পাবলিক প্লেসে একত্র হওয়া বেআইনি ঘোষিত হলো, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আশা করি বুঝতে পারছেন কীরকম অবস্থার কথা বলছি।

    সেই থেকেই শুরু হিটলার আর তাঁর নাজ়ি পার্টির কান্ডকারখানা। এরপর থেকে দীর্ঘ বারো বছরের ইতিহাস আমরা সবাই অল্পবিস্তর জানি। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই এমন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে চ্যান্সেলর হওয়া এডল্ফ হিটলার এই এক ঘটনার পরে দেশোদ্ধারের ধোঁয়া তুলে হয়ে গিয়েছিলেন একটা আধুনিক সভ্য দেশের একনায়ক, এমন দেশ যা দুদিন আগেও ছিল গণতান্ত্রিক। যে দেশোদ্ধারের জিকির তিনি তুলেছিলেন, দীর্ঘ বারো বছর ধরে তাঁর শাসনাধীন থাকার পর সেই দেশের হাল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ইতিহাস তার সাক্ষী আছে। তবে সবচেয়ে তাজ্জবের কথাটা এখনো বলা হয়নি। যে ঘটনার থেকে হিটলারের উত্থানের সূচনা, সেই রাইখস্টাগ অগ্নিকাণ্ড, অনেক পরে জানা যায় যে, সেই কান্ড ঘটিয়েছিল নাজ়ি পার্টি-ই। নাজ়ি পার্টির উদ্দেশ্যই ছিল এই অগ্নিকাণ্ডের দোহাই দিয়ে জার্মানিকে ধীরে ধীরে একটা এক পার্টির অধীন একনায়কতন্ত্রে পরিণত করা।

    হিটলারের দেশোদ্ধারের গল্প রাইখস্টাগ অগ্নিকাণ্ডের পরের দিন সবাই মেনে নিয়েছিল। হয়তো মেনে নিতে চাইছিলো বলেই মেনে নিয়েছিল। আর মানবে নাই বা কেন? হিটলার যে শিরদাঁড়া ভেঙে যাওয়া একটা দেশকে তাঁর হৃত গৌরব ফিরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। ফ্যাসিজ়মের নেশা যে এইরকমই - ঠিক-ভুল, ন্যায়-অন্যায় এইসবের ঠুনকো হিসেব কোথায় হারিয়ে যায়!

    ফ্যাসিজ়মের প্রধান অস্ত্র যেহেতু মানুষের আবেগ, তাই এর এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো জনসাধারণের মেরুকরণ। আবেগজনিত ভালোলাগার শেষটা দাঁড়ায় ভক্তিতে। আর ভক্তি স্বভাবতই বিচারবুদ্ধির ধার ধরে না। সেই ভক্তি ধরে রাখতে যুক্তির প্রয়োজন হয় না। ফলস্বরূপ, যে ফ্যাসিস্ট নেতাকে আমি ভালোবাসবো, তার কোনো ভুল-ত্রুটি-ই আমার চোখেই পড়বে না, বা চোখে পড়লেও হয় আমি তা এড়িয়ে যাবো, বা নিজেকে বোঝাবো যে দেশের ভালোর জন্যই এই কাজ করা হয়েছে। সেই নেতাটির প্রতি আমার সমর্থন তাই হবে অটুট, এবং তাঁর বিরুদ্ধে কোনো কথাই  আমি সহ্য করবো না।  পরিণতি, আমার অত্যন্ত কাছের লোকের সাথেও এই ব্যাপারে মতের অমিল হলে আমি তাঁকে দেশের শত্রু হিসেবে দাগিয়ে দেব। আর ফ্যাসিজ়মের আদর্শের ব্যাপারগুলো যেহেতু ব্যক্তিবিশেষের চেয়ে অনেক অনেক বড়ো বলে জানি, তাই সেই কাছের মানুষের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নটাও যেন এই আদর্শের উঁচু অট্টালিকার পাশে খাটো হয়ে যায়।  এরই অমোঘ পরিনাম মেরুকরণ।

    এই মেরুকরণ ফ্যাসিস্ট নেতার পক্ষে কিন্তু বেশ সুবিধেজনক। ইংরেজদের ব্যবহৃত “ডিভাইড এন্ড রুল”-এর নীতি ছোটবেলা থেকে পড়ে পড়ে এখন একটা ক্লিশে হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটার সারমর্মে সত্যতা রয়েছে একথা অনস্বীকার্য। সমাজ যত বিভক্ত, যত এইসব বড়ো বড়ো প্রশ্ন নিয়ে জেরবার, যত নেতাবিশেষের ভক্তিতে নিমজ্জ - ততই তার মনে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার প্রবণতা কম। আর যত এরকম প্রশ্ন যেমন - “পেট্রোলের দাম কেন বেশি?” “কেন ভালো হাসপাতাল নেই?” “সরকার কেন নতুন হাসপাতাল খোলার বদলে হাতে বীমা ধরিয়ে দেয়?” “কেন প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি হয় না?” “কেন আমি পড়াশুনো করে, চাকরির পরীক্ষায় পাশ করেও চাকরি পাই না?” - মানুষের মনে কম আসে ততই তো যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁদের সুবিধে। 

    তবে ফ্যাসিস্ট পার্টির পক্ষেও কিন্তু কাজটা সহজ নয়। ফ্যাসিস্টদের প্রতি জনগণের সমর্থন যেহেতু সিংহভাগটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে মানুষের আবেগকে সম্বল করে, সেই আবেগটাকে দীর্ঘদিন ধরে চাগিয়ে রাখা স্বভাবতই একটা বেশ কঠিন কাজ। আর একথা অনস্বীকার্য যে, যে অনুভূতি আমাদের সামগ্রিক ভাবাবেগকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়, তা হলো ভয়। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে বলে “ফিয়ার সাইকোসিস”। সেই জন্যই ফ্যাসিস্ট পার্টিকে সর্বদাই দেশের বা সমাজের জন্য নতুন নতুন ভয় বা সংকটের প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসতে হয়। ফ্যাসিজ়মের আদর্শের সাথে তাল মিলিয়ে চলার তাগিদে এই সংকটগুলিকেও স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তিজীবনের তুলনায় অনেক গুণ বড়ো মাপের কিছু হতে হয়। স্পষ্টতঃই এরকম নতুন নতুন বিশালকায় সংকট খুঁজে পাওয়া চাট্টিখানি নয়। তাই চেনাশোনা সংকটগুলো আর ধোপে না টিকলে সংকট উদ্ভাবন করতে হয়। এর শেষ কোথায় বলা সম্ভব না। জার্মানির ক্ষেত্রে এই সংকটের চরমরূপটি দেখা দিয়েছিলো হিটলারের ভাষায় “ফাইনাল সল্যুশন”-এর রূপে: গোটা ইউরোপ জুড়ে ইহুদীদের (এবং আরো অনেক, নাজ়ি পার্টির চোখে, আপাত নীচ জাতির মানুষদের) মেরে শেষ করা। 

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে মার্কিন সাংবাদিক মিল্টন মায়ার গিয়েছিলেন জার্মান মহানগর ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে একটা গ্রামে। উদ্দেশ্য: গ্রামের সাধারণ মানুষদের সাথে কথা বলে বোঝা যে, নাজ়ি পার্টির শাসনে থাকাটা সাধারণ গ্রাম্য জার্মান নাগরিকের চোখে কেমন ছিল। মায়ার সেখানে দশ জন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন, এবং তাঁদের সাথে কথা বলে তাঁদের চিন্তাভাবনা বুঝে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। মায়ার আবিষ্কার করেন যে, সেই দশজনের মধ্যে কেবলমাত্র একজন (হ্যাঁ, ঠিক-ই ভাবছেন, মানে মাত্র ১০ শতাংশ)  মনে করতেন যে, হিটলারের নাজ়ি পার্টির শাসন ছিল স্বৈরাচারী শাসন। বাকিদের কাছে নাজ়ি পার্টি ছিল সর্বোতভাবেই জনদরদী! ভালো রাস্তাঘাট, সরকারের ভাতায় ভ্রমণের ব্যবস্থা, সস্তার পাবলিক ট্রান্সপোর্টের পরিকাঠামো - এইসব-ই ছিল সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু হিটলারের নির্মম হত্যালীলার কথা কি এঁরা কিছু জানতেন না? ষাট লক্ষ ইহুদী, এবং প্রায় ততই জিপসি, রোমানি, স্লাভ, কম্যুনিস্ট, বিকলাঙ্গ, বা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ, যে খুন হলেন হিটলার এবং নাজ়ি পার্টির পরিকল্পিত ফাইনাল সল্যুশনের কারণে, সেই কথা কি এই দশজন জানতেন না?

    ওঁরা জানতেন। কিন্তু এই যে সংখ্যাটা, মানে প্রায় এক কোটি, এতগুলো জ্বলজ্যান্ত মানুষকে নির্বিচারে সুপরিকল্পিতভাবে খুন করা, এই সংখ্যাটার যে বিষম ধাক্কা, এই ধাক্কাটা এঁদের লাগেনি। কারণ হয়তো তাঁদের কাছে এই অন্যায়গুলো ঘটার খবর এসেছে ধাপে ধাপে, ক্রমে ক্রমে। অনাচার একটু একটু করে বেড়ে বেড়ে গা-সওয়া হয়ে হয়ে যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন আর কিছুই সেরকম মনে হয়নি। আর মনে হলেই তো আরেক সমস্যা, বিবেকের দংশন। তার চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভালো ভালো দিকগুলোর দিকে মন দেওয়া অনেক সহজ; আজকাল-ও তেমনি শুনতে পাই নেতা বলছেন, “বী পজিটি়ভ”।

    ভয়টা এখানেই। 

    আম জনতা, “ম্যাংগো পীপল”, ভালো খারাপ মিশিয়ে হলেও, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার হাল দেখলে বলতে হবে মোটের ওপরে তাঁরা খারাপ নন। তাঁরা যখন ফ্যাসিজ়মকে সমর্থন করেন, তখন ভালো ভেবেই সমর্থন করেন। মুশকিলের কথা হলো ফ্যাসিজ়মের দাবিটাই আসলে এমন যে, একে সমর্থন করার মানে বিচারবুদ্ধি ফেলে আবেগে ভেসে যাওয়া। নিত্য নতুন মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সংকটের প্রশ্নে জড়িয়ে গিয়ে ভালো-মন্দের হিসেব গুলিয়ে ফেলা। আর আজকের দিনে হোয়াটস্যাপ, টুইটার, ফেসবুক-এর মাধ্যমে এই সংকট ছড়িয়ে দেওয়া তো অত্যন্ত সহজ কাজ। চাই শুধু অনেক কর্মচারী এবং বুদ্ধিমান কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, আর এই কর্মকান্ড চালানোর মতো অঢেল টাকা-পয়সা, যার যোগান বড়ো শিল্পপতিরা দেওয়ার জন্য হাত খুলে দাঁড়িয়েই আছেন। তাই ফ্যাসিজ়মের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে, দেশপ্রেমের নকল চশমায় নিজেকে সুন্দর করে দেখার নেশায়  মজে মজে, হোয়াটসঅ্যাপের ফরওয়ার্ডেড মেসেজ দেখে একে তাকে দেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার গর্বে বুক ফুলিয়ে ফুলিয়ে, কখন যে দেখবো সেই ঢেউ সুনামি হয়ে গেছে আমরা হয়তো বুঝতেও পারবো না? ততক্ষণে যদি অনেক দেরি হয়ে যায়? ভয়টা এখানেই।     

    সূত্র:
    ১) য়ুভাল নোয়া হারারি, “Why Fascism is so tempting - and how your data could power it”, টেড টক্,


    ২) এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা, “Fascism”, https://www.britannica.com/topic/fascism
    ৩) কলিন হোরগান, “This is how it happens”, GEN, https://gen.medium.com/this-is-how-it-happens-c289765df373
    ৪) মিল্টন মায়ার, “They thought they were free”, ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস, ১৯৫৫

          

    ছবি: উইকিমীডিয়া কমন্সের সৌজন্যে।        
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৫ এপ্রিল ২০২১ | ৩৭৬৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    রণছোড় - Chayan Samaddar
    আরও পড়ুন
    রণছোড় - Chayan Samaddar
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kallol Dasgupta | ২৬ এপ্রিল ২০২১ ১২:৩১105199
  • "ভালো রাস্তাঘাট, সরকারের ভাতায় ভ্রমণের ব্যবস্থা, সস্তার পাবলিক ট্রান্সপোর্টের পরিকাঠামো - এইসব-ই ছিল সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি।"   ভারতের গ্রামে ​​​​​​​গ্রামে এরকম সুবিধা আছে তাহলে? কি জানি !! পেট্রোল আর ডিজেলের দাম বাড়ায় যাতায়াতের খরচ তো বেড়েইছে, তাতে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও খুব বেড়েছে। ফসলের দাম পাচ্ছে না চাষী। হিটলারের জার্মানীর গ্রাম তো বেশ ভালোই ছিলো।  মোশার ভারতের গ্রাম বেশ খারাপ। 

  • Ranjan Roy | ২৬ এপ্রিল ২০২১ ২১:০৩105207
  • অত্যন্ত জরুরি লেখা। 


    কিন্তু হিটলারের নির্বাচনে হারা নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিমত পোষণ করছি।


    বার্নি স্যান্ডার্স গত জুন মাসে ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর আয়োজিত ইভেন্টে বলেছিলেন যে হিটলার ১৯৩২ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসেছিল। তারপর ওয়াশিংটন পোস্ট জানায় যে এটা ভুল। হিটলার পরাজিত হয়েছিল। তাহলে সত্যিটা কী? 


     মার্ক রসমান-- ব্লুমিংটনের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'আধুনিক ইউরোপ ও জার্মানির ইতিহাস'এর অধ্যাপক  জনিয়েছেন  ব্যাপারটা অমন সাদাকালো নয়। আমেরিকা এবং ভারতের চেয়ে জার্মানির নিয়ম আলাদা। ওখানে ৫০% ভোট না পেলে একা সরকার গড়া যায় না, কোয়ালিশন সরকার গড়তে হয়। এখন ১৯৩২ সালে পাঁচটি নির্বাচন হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট পদের দুটি, তাতে হিটলার হেরে যায়, হিন্ডেনবুর্গ প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু পার্লিয়ামেন্টের জন্যে ন্যাশনাল ইলেকশন হয় দু'বার। দুটো বারেই হিটলারের নাজিরা বিপুল জনসমর্থনে (৪০%)ভোট পেয়ে জুলাই ও নভেম্বরে কোয়ালিশন সরকার গড়ে। প্রথম বার জুলাইয়ে ৬০০ সিটের মধ্যে ২৩০,, নভেম্বরে ১৯৬।  পরের বার সিট কমার কারণ ওদের সিট অ্যালটমেন্ট হয়ে কত প্রতিশত লোক ভোট দিয়েছে তার প্রতিশত পাওয়া ইত্যাদি জটিল হিসেবে। হিন্ডেনবুর্গ সবচেয়ে বেশি ভোট প্রতিশত এবং সিট পাওয়া দলকে কোয়ালিশন সরকার গড়ার আমন্ত্রণ দেন। ওদিকে কমিউনিস্ট এবং সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে জোট হয়নি। ওদের এককভাবে ভোটের প্পতিশত নাজিদের ধারে কাছেও ছিল না। ১৯৩৩ সালে হিটলার চ্যান্সেলর হয়। বাকিটা ইতিহাস। 


    আমার বক্তব্য ওয়াইমার রিপাবলিকের ব্যর্থতা, হাইপার-ইন্নফ্লেশন, অপমানজনক ভার্সাই চুক্তির ফলে আহত জাত্যাভিমান এবং ইহুদিদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সরল আবেগঘন ন্যারেটিভ হিটলারকে বিপুল জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। প্রটেস্টান্ট, ক্যাথলিক, চাষি ও শ্রমিকদের মধ্যেও। গোড়ায় ইলেকশন জিতে এসে ক্রমশঃ সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে পদদলিত করে।


    আজকের ভারতের ছবিটা খুব আলাদা নয়। একক দল হিসেবে ভোটের প্রতিশত ৪০% এর কাছাকাছি। ঐক্যহীন এবং সমান্তরাল কোন ন্যারেটিভহীন বিপক্ষ, ইহুদীদের বদলে মুসলিম, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ভোটে জেতার পর ক্রমশঃ সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে অকেজো করে এক মহানায়কের ন্যারেটিভ।


    আমার তথ্যে ভুল থাকলে ধরিয়ে দেবেন। 

  • Sunando Patra | ২৭ এপ্রিল ২০২১ ১৭:৪৭105227
  • মনের মতো লেখা। ভড়ং ছাড়া, কিছু না ধরে নেওয়া, লিঙ্ক-টিঙ্ক দিয়ে গুছিয়ে লেখা। কোন শব্দের শর্টফর্ম (যেমন সেকু, মাকু, তাঁত, চাড্ডি, হাড্ডি ইত্যাদি) নেই, অযথা গুঁতো নেই। "কাছে এসো, জ্ঞান নাও, নইলে মাথা খাও" - ভাবখানা নেই। খুব ভালো লেগেছে পড়তে।


    একটাই ইয়ে... যাচাইকে যাঁচাই টা নিতে পারছি না। বেজায় চোখে লাগছে।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন