এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গোপন কথা

    ফ‌জিলাত লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ এপ্রিল ২০২১ | ১৭২৫ বার পঠিত | রেটিং ৪.৮ (৪ জন)
  • মোজা‌ম্মেল হক আরাম ক‌রে হেলান দেওয়ার ভ‌ঙ্গি‌তে ব‌সে আ‌ছেন। মু‌খে দু‌নিয়ার যাবতীয় সুখ। প‌কেটে রাখা বি‌দেশী সিগা‌রে‌টের প্যা‌কেটটা হ‌লো খু‌শির কারণ। তবু তাঁ‌কে কর্কশ গলায় ডাকাডা‌কি কর‌তে দেখা গেল। “কই তারার মা, পোলাও মাংস রাঁধ‌তে বল‌সিলাম না‌কি। একটা কাজ য‌দি ক‌রে ঠিক ম‌তো”। তাঁর ম‌তে, ঘ‌রের মে‌য়েমানুষ‌দের স‌ঙ্গে ছাঁড় দি‌য়ে কথা বল‌তে হয় না। বল‌লেই বিপদ, এরা দাম দি‌বে না। মাথায় চ‌ড়ে ঢং-আহ্লাদ কর‌বে। ধম‌কের উপর রাখ‌লে সে সাহস গজা‌বে না। কৌশলটা মোজা‌ম্মেল হক শি‌খে‌ছেন তাঁর এক চাচার কাছ থে‌কে। য‌দিও চাচাজা‌নের একটা অভ্যাস তাঁর ভা‌লো লা‌গে না। অভ্যাসটা হ‌লো গা‌য়ে হাত তোলা। খুব মারধর কর‌তেন চাচাজান। বউ-সাবালক মে‌য়ে-ধামড়া ছে‌লে একাধা‌রে। মোজা‌ম্মেল হক নি‌জেও একবার একটা ছোটখা‌টো থাবড়ার মু‌খোমু‌খি হ‌য়ে‌ছি‌লেন। ঘটনা অবশ্য খুব ছোট‌বেলার।


    মোজা‌ম্মেল হক ছোট ক‌রে একটা নিঃশ্বাস ফেল‌লেন। চাচাজা‌নের মৃত্যুও হ‌য়ে‌ছিল মূলত মারধ‌রের কার‌ণেই। তিন মে‌য়ে, মা‌কে সমা‌নে পি‌টি‌য়ে এ‌সে বারান্দায় বস‌লেন। হাঁফ ধ‌রে গে‌ছি‌লো নিশ্চয়ই। হয়‌তো মাথায় পা‌নি ঢাল‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন। মে‌য়ে তিনটা‌কে ডাক‌লেই পার‌তেন। মে‌য়েগু‌লো খুব ভদ্র। খুব যত্ম ক‌রে হাত বু‌লি‌য়ে বু‌লি‌য়ে মাথা ধুই‌য়ে দেয়। আবার হা‌তের পিঠ দি‌য়ে নি‌জের চো‌খের পা‌নিও মো‌ছে ফা‌কে ফা‌কে।


    চাচাজান কিন্তু সে‌দিন পা‌নি ঢালা‌তে ডা‌কেন‌নি। কা‌ঠের ভা‌রি চেয়ারসহ মুখ থুব‌ড়ে প‌ড়ে‌ছি‌লেন। মাইল্ড ‌স্ট্রোক। তাঁর মে‌য়েরা ম‌নে ক‌রে‌ছি‌লো, রা‌গে তা‌দের বাবা চেয়ারটা লা‌থি মে‌রে ফে‌লে দি‌য়ে‌ছেন। চাচাজান মারা গে‌লেন তাঁর মাথায় আঘাত লাগার কার‌ণে। স্ট্রো‌কের পর যে কয়‌দিন বেঁচে ছি‌লেন, খুব শান্ত হ‌য়ে গে‌ছি‌লেন। বিছানায় শু‌য়ে থাক‌তে হ‌তো। নাক দি‌য়ে ক্রমাগত পা‌নি পড়‌তো। না‌কের হাড়টাও গে‌ছিল।


    চা‌চিজান কাঁদ‌তেন আর বল‌তেন, মগ‌জের পা‌নি নাক দিয়া গড়ায় প‌ড়ে। এই রুগী কেম‌নে বাঁচ‌বো গো খোদা!


    মে‌য়েগু‌লো খুব কাঁদতো দিনভর। সব‌চে‌য়ে বেশী মায়া লাগ‌তো বড় মে‌য়েটার জন্য। মে‌য়েটা একটু শ্যামলা, ত‌বে গলা মি‌ষ্টি। মার খাওয়ার সময় শুধু বল‌তো, “আব্বাজান খুব কষ্ট লাগ‌তে‌সে, আর মাই‌রেন না”। চাচাজান বিছানায় পড়ার পর বল‌তো, “আব্বাজান, খুব কষ্ট লাগ‌তে‌সে? আ‌রেকটু পা‌নি খা‌বেন?” এরপর একচামচ পা‌নি নি‌য়ে ধর‌তো ঠোঁটের কা‌ছে।


    মোজা‌ম্মেল হক শ্যামলা মে‌য়েটার প্রেমে প‌ড়ে‌ছি‌লেন। কিন্তু মে‌য়েটা যে‌হেতু বয়‌সে মাত্র দু’বছ‌রের ছোট আর তি‌নি তখন কেবল ক‌লে‌জে ভ‌র্তি হ‌য়ে‌ছেন, তাই মে‌য়েটার আশা ছেড়ে দি‌য়ে‌ছি‌লেন। তাছাড়া মে‌য়েটার জন্য তখন পাত্র খোঁজা হচ্ছি‌লো। ‌সে হি‌সে‌বে তি‌নি ঠিক ক‌রে রে‌খে‌ছি‌লেন ছোট মে‌য়েটা‌কে বি‌য়ে কর‌বেন। তত‌দি‌নে তার নি‌জের চাক‌রিও হ‌য়ে যা‌বে। ছোট মে‌য়েটার গলাও ভা‌লো, গা‌য়ের রং একটু ফর্সা। তিন‌বো‌নের চেহা‌তে খুব মিল।


    তারার মা চায়ের কাপ রাখ‌তেই মোজা‌ম্মেল হক চোখ গরম ক‌রে তাকা‌লেন। ত‌বে রাগী রাগী ভাবটা তেমন জোড়া‌লো হ‌লো না। তি‌নি এখন দামী সিগা‌রে‌টের প্যা‌কেট খুল‌তে ব্যস্ত। একটামাত্র সিগা‌রেট খরচ হ‌য়ে‌ছে। কিন্তু কোথায়, কখন, ক‌বে খাওয়া হ‌য়ে‌ছে তা জা‌নেন না। কারণ প্যা‌কেটটা তি‌নি কে‌নেন‌নি।


    সে‌দিন দোকা‌নে রোজকার ম‌তো ব‌সে দুল‌ছি‌লেন। রেকর্ডারে গান বাজ‌ছি‌লো। দুপুর, তাই কাস্টমার নেই একদম। একজন বু‌ড়ো ভদ্রলোক এ‌লেন। চো‌খে সোনালী ফ্রেমের চশমা। এ‌সেই চশমার বাক্স, একটা রুমাল আর একটা সিগা‌রে‌টের প্য‌কেট টে‌বি‌লে রে‌খে বই খুঁজ‌তে লাগ‌লেন। বল‌লেন, শী‌র্ষেন্দুর বইগু‌লো কোন‌দি‌কে? মোজা‌ম্মেল হক দে‌খি‌য়ে দি‌য়ে বল‌লেন, দাঁড়ান আরও কিছু আ‌ছে, সেগু‌লিও বের ক‌রে দিই।


    মোজা‌ম্মেল হক খুঁ‌জে খুঁ‌জে কিছু বই রাখ‌লেন টে‌বি‌লের ওপর। ভাঁজ করা দাবার বোর্ডটা স‌রি‌য়ে রাখ‌তে গি‌য়ে সিগা‌রে‌টের প্য‌কেটটার ওপর চোখ পড়ল। তি‌নি বু‌ঝেও না বুঝার ভান কর‌লেন।‌ বোর্ড স‌মেত প্যা‌কেটটা এমন এক জায়গায় স‌রি‌য়ে রাখ‌লেন, যেটা বু‌ড়ো ভদ্রলো‌কের চো‌খে পড়‌বে না, পড়‌লেও মোজা‌ম্মেল হ‌কের দোষ হ‌বে না। ‌


    মোজা‌ম্মেল হক কখনই তেমন ক‌রে চু‌রি ক‌রেন‌নি। ত‌বে যে জি‌নিস নেওয়ার মা‌লিক নেই, তি‌নি তা নি‌য়ে নেন। এই যেমন, এক‌দিন সিএন‌জি‌তে বস‌তে গি‌য়ে দেখ‌লেন কি যেন একটা চকচক কর‌ছে। হা‌তে নি‌তে গি‌য়ে দেখ‌লেন একটা সোনার চেইন। কো‌নো বাচ্চার চেইন হ‌বে, খুব ছোট। মোজা‌ম্মেল হক স্যাকরার দোকা‌নে গি‌য়ে আর কিছু ধাপ বা‌ড়ি‌য়ে নি‌য়ে এ‌লেন। তারা পড়‌তে পার‌বে। তারার মা‌কে বল‌লেন অন্য কথা। তাঁর বন্ধু বজলুর দি‌য়ে‌ছে। অ‌নেক দিন পর দেখা। বন্ধু বি‌দেশ থে‌কে ফি‌রে‌ছে। চেইনটা তার এক ভা‌স্তির জ‌ন্যে এ‌নে‌ছি‌লো। মোজা‌ম্মেল হ‌কের মে‌য়ে আ‌ছে শু‌নে ধ‌রি‌য়ে দিলো।


    কথাগু‌লো বলার পরই নি‌জের গা‌লে ক‌ষি‌য়ে একটা চড় মার‌তে ইচ্ছা করছিল তার। এতগু‌লো টাকা খরচ ক‌রে চেইনটা বড় ক‌রে গ‌ড়ি‌য়ে আন‌লেন। আর নাম হ‌লো বন্ধুর। য‌দিও বজলুর নামে তার কো‌নো বন্ধু নেই।


    চা-সিগা‌রেট খে‌য়ে বে‌রি‌য়ে পড়‌লেন। স্কুল ক‌লেজ শুরু হয় আটটা-সাড়ে আটটায়।‌ কিছু ছে‌লে‌মে‌য়ে আ‌ছে স্কু‌লে যাওয়ার আ‌গে আ‌সে, কিছু আ‌সে ছু‌টির পর।


    চেয়া‌রে ব‌সে প‌ত্রিকার ভাঁজ খুল‌তেই একটা ছে‌লে ঢুক‌লো। এ‌সেই আলমা‌রিগুলোর কা‌ছে চ‌লে গেল। কিছুক্ষণ পর পাঁচটা বই এ‌নে রাখ‌লো টে‌বি‌লের ওপর। বল‌লো, মোট কত টাকা হ‌বে?


    -চার‌শো সত্তর।


    ছে‌লেটা বইগু‌লো একটু উ‌ল্টেপা‌ল্টে দেখলো। একটা বই স‌রি‌য়ে বল‌লো, এই চারটা?


    - তিন‌শো সত্তর।


    টাকাটা বের কর‌তে ছে‌লেটার প্রায় পাঁচ মি‌নিট লাগ‌লো। স্কুল ব্যা‌গের সমস্ত বইখাতা বের ক‌রে ছোট্ট একটা পুঁট‌লি ‌বের কর‌লো। ওটার মধ্যে তিন‌শো পঞ্চাশ টাকা। সবগু‌লি নোট দশ টাকা- বিশ টাকার। প‌কেট থে‌কে বের কর‌লো একটা দশ টাকার নোট, একটা পাঁচ টাকার নোট আর দু’টা দুই টাকা। তবু এক টাকা কম।


    মোজা‌ম্মেল হক বুঝ‌তে পার‌লেন আজ হয় ছে‌লেটা টি‌ফিন খা‌বে না, নয়তো হেঁটে হেঁটে বা‌ড়ি ফির‌বে। তি‌নি ছে‌লেটার দি‌কে তাকা‌লেন। সরল গো‌ছের শান্ত দোহারা চেহারা। চার‌কোনা ফ্রেমের চশমায় মু‌খে একটা গাম্ভী‌র্যের ছাপ প‌ড়ে‌ছে। চুলগু‌লো একপা‌শে সি‌থি করা।


    মোজা‌ম্মেল হক ছে‌লেটা‌কে কিছু বল‌তে পার‌লেন না। এমন‌কি ছে‌লেটা যখন বল‌লো এক টাকা প‌রে এ‌সে দি‌য়ে যাব, তখন বল‌তে পার‌লেন না "এক টাকা দি‌তে হ‌বে না"।


    ২. ভোর পাঁচটা-সা‌ড়ে পাঁচটা। তারার মা ঘুম থে‌কে উ‌ঠেই মাগো ব‌লে চাপা একটা চিৎকার কর‌লেন। মোজা‌ম্মেল হক‌কে সোজা হ‌য়ে ব‌সে থাক‌তে দে‌খে তি‌নি ভয় পে‌য়ে গে‌ছেন। বু‌কে থু দি‌য়ে উ‌ঠে দাঁড়া‌লেন। ডিম লাইট নি‌ভি‌য়ে এনা‌র্জি বাল্ব জ্বাল‌লেন। বাথরু‌মে যখন যা‌বেন, তখন "তারার মা" ডাক শুনে আৎ‌কে উঠ‌লেন। 


    মানুষটার চোখ টকট‌কে লাল। কো‌নো অসুখ-বিসুখ হয়‌নি তো?


    গতকাল রা‌তে বা‌ড়ি ফি‌রে মোজা‌ম্মেল হক খে‌য়ে দে‌য়ে শু‌য়ে প‌ড়ে‌ছি‌লেন । প্রতি‌দিন তা-ই ক‌রেন। কিন্তু কাল ঘুমা‌তে পা‌রেন‌নি। ছে‌লেটার ম‌ধ্যে তি‌নি তি‌রিশ বছর আ‌গে দেখা আ‌রেক ‌ছে‌লে‌কে আ‌বিষ্কার কর‌লেন। সারাটা রাত কেবল ভাব‌লেন বেচা‌রি‌কে কি বলা উ‌চিত ছিল। আর কো‌নো‌দিন য‌দি সে তাঁর দোকা‌নে আ‌সে কি কি কর‌বেন। তি‌নি ঠিক ক‌রে‌ছেন, ছে‌লেটা‌কে কিছু বই বিনামূ‌ল্যে দি‌য়ে দে‌বেন। সে হয়‌তো নি‌তে চাই‌বে না। সেজ‌ন্যে একটা ভা‌লো বু‌দ্ধিও এ‌সে‌ছে তাঁর মাথায়। 


    ইদা‌নিং লোকজন কত লটা‌রি-ফটা‌রি ক‌রে। এমন ‌কিছু একটা ছাঁ‌পি‌য়ে রাখ‌বেন। স্কুলের ছে‌লে মে‌য়ে‌দের কা‌ছে বি‌লি কর‌বেন।তারপর সেই ছে‌লেটা‌কে জি‌তি‌য়ে দে‌বেন। পরমূহু‌র্তেই ম‌নে হ‌য়ে‌ছে, এত কা‌হিনী করার কী দরকার। ছে‌লেটা নিশ্চয়ই আবার তাঁর দোকা‌নে আস‌বে, সময়টা হ‌তে পা‌রে সকাল বেলা। তখন ও‌কে কিছু বই দি‌য়ে বলা যে‌তে পা‌রে, "আজ‌কের দিনটা আমার জীব‌নের একটা বি‌শেষ দিন। আ‌মি ঠিক ক‌রে‌ছি আজ প্রথম কাস্টমার‌কে কিছু বই উপহার দেব"। 


    বেচা‌রি ‌নি‌শ্চিত খুব খু‌শি হ‌বে। মধ্য‌বিত্ত কিছু বাচ্চা ছে‌লে‌মে‌য়ে খুব কল্পনা‌বিলাসী হয়। এ‌রা প্রায়ই ভা‌বে, এক‌দিন অ‌লৌ‌কিক উপা‌য়ে তা‌দের সব আশা পূরণ হ‌বে। 


    দুটা কা‌হিনীর ম‌ধ্যে কোনটা করা উ‌চিত সেটা মোজা‌ম্মেল হক ঠিক কর‌তে পার‌লেন না। প্রশ্নটা শেষ‌মেষ তারার মা‌কেই কর‌লেন। উত্তর হি‌সে‌বে তারার মা বল‌লেন, আপ‌নে কিছু মু‌খে দিয়া শুইয়া প‌ড়েন। এক‌দিন দোকা‌নে না গে‌লে কিছু হ‌বে না।


    মোজা‌ম্মেল হক একমূহুর্ত ভাব‌লেন, আজ‌কে কি ছে‌লেটা আস‌তে পা‌রে। না, আসার সম্ভাবনা নেই। বই কেনার ম‌তো টাকা জমা‌তে তার য‌থেষ্ট সময় লাগ‌বে। তি‌নি বাধ্য ছে‌লের ম‌তো পাউরু‌টি খে‌য়ে শু‌য়ে পড়‌লেন। ঘু‌মের ম‌ধ্যে ম‌নে হ‌লো, এমনও তো হ‌তে পা‌রে একটা বই‌য়ের কিছু পাতা ‌নেই, ছে‌লেটা সেটা বদলা‌তে আস‌লো।


    ৩. ঘুম তার ভে‌ঙে‌ছে। ত‌বে পু‌রোপু‌রি ভা‌ঙে‌নি। আ‌ধো ঘুম আ‌ধো জাগ্রত অবস্থা। চারপা‌শের শব্দ শুন‌তে পা‌চ্ছেন। সেসব কোলাহলগু‌লো আবার স্বপ্ন হি‌সে‌বে দেখা দি‌চ্ছে। একপর্যা‌য়ে ঘুম ভে‌ঙে গেল। তবু শু‌য়ে রই‌লেন চুপচাপ। বারান্দার কথাবার্তা কান পে‌তে শুন‌তে লাগ‌লেন। তারার মা আর পা‌শের ফ্ল্যা‌টের রেহানা ভা‌বি গল্প কর‌ছেন।


    -ভাই‌য়ের কি হই‌সে ভা‌বি? শরীর খারাপ, আজ‌কে সারা‌দিন বাসায় যে?


    - না, না। কাল‌কে রা‌ত্রে ঘুমাই‌তে পা‌রে নাই। কাজ কর‌সেন কিছু। 


    -ও।


    আরও কিছু টুকটাক কথাবার্তা। এস‌বের বেশীরভাগই মোজা‌ম্মেল হ‌কের কা‌নে গি‌য়েও গেল না। কথায় কথায় তারার মা বিড়‌বিড় করে বল‌তে লাগ‌লেন, বুঝ‌লেন ভাবি, মানুষটার মন ভা‌লো। একটু লাজুক। মিথ্যা কথা একদম বল‌তে পা‌রে না।


    হঠাৎ মোজা‌ম্মেল হক প্রায় বো‌বাকালা হ‌য়ে গে‌লেন। রেহানা ভা‌বি কী বল‌লেন ঠিক বুঝ‌তে পার‌লেন না। ত‌বে বা‌কি সময়টুকু নিঃশ্বাস বন্ধ ক‌রে রই‌লেন।


    -ওই‌দিন যে হ্যান্ডব্যাগটা দেখাইলাম আপনা‌রে, ওইটার ঘটনা শু‌নেন। উ‌নি বাসায় ফিরা বল‌লেন, "তারার মা, আমার এক বন্ধু কিছু‌দিন আ‌গে ব্যাগটা কিন‌লো। তার স্ত্রীর জন্য কি‌নছে। বউ ছে‌লে-পে‌লে থা‌কে দে‌শের বা‌ড়িতে। এরম‌ধ্যে বেচা‌রির মা‌নিব্যাগটা পড়‌লো প‌কেটমা‌রের খপ্প‌রে। এখন গা‌ড়িভাড়া তো দূ‌রে থাক মে‌সে খাওয়ার পয়সাও নাই। বাধ্য হইয়া আমা‌রে জোরাজু‌রি কর‌লো। আ‌মি বললাম, ব্যাগ রা‌খেন ভাই, শখ ক‌রে কিন‌লেন। টাকা দি‌তে‌ছি, প‌রে শোধ ক‌রে দি‌য়েন। বল‌লো, অ‌নেক ধার জম‌ছে। আবার ধার কর‌লে শোধ করার উপায় থাক‌বে না। 


    তাই নি‌য়ে এলাম। কোয়া‌লি‌টি তেমন ভা‌লো না"।


    - এইখা‌নে মিথ্যা কোনটা?


    - পুরা কা‌হিনীটাই মিথ্যা। আস‌লে পছন্দ হই‌সে তাই কিনা ফেল‌ছে। সাম‌নে ঈদ আ‌ছে, তারার মামার বিবাহ আ‌ছে। জা‌নে যে আমার ভা‌লো ব্যাগ নাই। 


    মিথ্যা বলার দরকার কি ছিল! পুরুষমানুষ এত লাজুক হয়!


    কিছুক্ষণ প‌রে আবার চেইনটার কথাও তুল‌লেন তারার মা। এ ঘটনার যু‌ক্তি হি‌সে‌বে বল‌লেন, তারার আব্বার কত বন্ধুই তো বাসায় আ‌সে। কই, বজলুর না‌মের তো কেউ আস‌লো না। এত খা‌তি‌রের বন্ধু যে সোনার চেইন গিফট দেয়, সে বাসায় আস‌বে না!


    মোজা‌ম্মেল হক উ‌ঠে বস‌লেন। প্রথ‌মে রাগ কর‌লেন, যেন অনুভব কর‌তে পার‌লেন ঠিক কী কার‌ণে চাচাজান মে‌য়েমানুষ‌দের সা‌থে এমন ব্যবহার কর‌তেন। কিছুক্ষণ পর সে রাগ রুপান্ত‌রিত হ‌লো অনু‌শোচনায়। নি‌জে‌কে পৃ‌থিবীর সবচাই‌তে খারাপ‌ লোক ব‌লে ম‌নে হ‌তে লাগ‌লো।


    ৪. ম্যা‌ট্রিক পরীক্ষার কে‌ন্দ্রের মা‌ঠ। একটা ছে‌লে খুব ম‌নো‌যো‌গের স‌ঙ্গে চিন্তা কর‌ছে গতকাল শ্রমের মর্যাদা রচনাটার উপসংহার লি‌খে‌ছিল কিনা। এটা তার মুদ্রা‌দোষগু‌লোর ম‌ধ্যে একটা। একটু প‌রেই ইং‌রে‌জি পরীক্ষা তবু চিন্তাটা দূর কর‌তে পার‌ছে না। 


    হঠাৎ একটা কথা শু‌নে তার ধ্যানভঙ্গ হ‌লো। 


    "কেমন চোখ বড় বড় ক‌রে তাকা‌য়ে আ‌ছে, দেখ‌লেন? ‌যেন কো‌নো‌দিন কমলার শরবত খায় নাই!" আ‌রেকটা ক‌ণ্ঠ, "আহা রে এইভা‌বে বল‌ছেন কেন। বেচারার পিপাসা পে‌য়ে‌ছে হয়‌তো" ।


    ছে‌লেটা আ‌বিষ্কার কর‌লো, সে নি‌জেই কাজটা কর‌ছে। সাম‌নে বসা একটা ছে‌লের জুস খাওয়া দেখ‌ছে। দেখ‌ছে নিষ্পলকভা‌বে!


    নি‌জে‌কে তার খুব অসহায় ম‌নে হ‌লো। সে যে খুব গ‌রিব, এটা তার আ‌শেপা‌শের মানুষজন কিভা‌বে যেন বু‌ঝে যায়। যে নতুন জায়গায় যাক না কেন, যত ভা‌লো জামা পরুক না কেন! গ‌রি‌বি অভ্যাসগু‌লো সবকিছু ফাঁস ক‌রে দেয়।


    এ পর্যন্ত লি‌খে মোজা‌ম্মেল হক পৃষ্ঠা উল্টা‌লেন। আ‌রেকটা কা‌হিনী লিখার আ‌ছে।


    আস‌লে এক‌দিন লু‌কি‌য়ে লু‌কি‌য়ে তারার ডা‌য়ে‌রি প‌ড়ে‌ছি‌লেন তি‌নি। তারার রোজকার ডা‌য়ে‌রি। সেখা‌নে যত খু‌ঁটিনা‌টি লেখা থা‌কে। এমন‌কি তারা সারা‌দিনে কার স‌ঙ্গে কোন মিথ্যাটা ব‌লে‌ছে সেটাও। মোজা‌ম্মেল হক ভাব‌লেন, ভা‌লোই তো! পু‌রো দু‌নিয়ায় এমন একজন থাকা দরকার, যা‌কে মন খু‌লে সব বলা যায়।


    তি‌নি নি‌জের জ‌ন্যে একটা ডা‌য়ে‌রি কিন‌লেন। প্রথম প্রথম লিখ‌তে পার‌লেন না। সত্য লেখাটা খুব ক‌ঠিন। বলার চে‌য়েও ক‌ঠিন। বি‌শেষ ক‌রে সেটা য‌দি হয় লজ্জাকর কিছু। আ‌স্তে আ‌স্তে স‌য়ে গেল।


    শি‌রোনা‌মের জায়গা ফাঁকা রাখ‌লেন। ‌তি‌নি শি‌রোনাম লে‌খেন সবশে‌ষে।


    প্রায় তিন বছর হ‌য়ে গেল, সেই ছে‌লেটার দেখা পেলাম না। চেহারাও প্রায় ভুল‌তে ব‌সে‌ছি। ছে‌লেটা হয়‌তো আর এ এলাকায় থা‌কে না। কিংবা কে জা‌নে, হয়‌তো অ্যা‌ক্সি‌ডেন্ট ক‌রে ক‌বেই ম‌রে গে‌ছে। কিন্তু এরকম আ‌রেকটা ছে‌লের দেখা পে‌য়ে‌ছিলাম কিছু‌দিন পরই। এবার বু‌দ্ধি ক‌রে নামটা জে‌নে রাখলাম। 


    জ‌হির, খুব রোগা। হাতগু‌লো অস্বাভা‌বিক সরু। চুল উশ‌কো-খুশ‌কো। মুখটা কেমন দুঃখী দুঃখী। এ ছে‌লে বই পছন্দ করল দশটার ম‌তো। দাম খুব কম রাখলাম।


    সাত‌শো।


    আরও দুইটা বই এ‌নে যোগ কর‌ল। 


    এবার এক হাজার বিশ। প‌কেট থে‌কে বিশ টাকা বের ক‌রে এক হাজার টাকা গুন‌তে লাগলো। নোটগু‌লো ছিল মোজার ভেতর। এর নোটগু‌লি সব দশ-‌বিশ টাকা নয়, এক‌শো টাকাও আ‌ছে।


    - টি‌ফি‌নের টাকা সব?


    - কি বল‌লেন?


    - বললাম, টি‌ফিন না খে‌য়ে জমা‌লে?


    উত্তর দিল না। বল‌লো, আং‌কেল একটু তাড়াতা‌ড়ি ক‌রে বেঁধে দিন না।


    এর ক‌য়েক মাস পর এক দুপুর‌বেলায় এক দল ছে‌লে এ‌লো। ও‌দের ম‌ধ্যে কে যেন জ‌হির নামটা উচ্চারণ কর‌লো। আ‌মিও জি‌জ্ঞেস করলাম। কারও নাম জ‌হির না, ত‌বে এ না‌মের এক বন্ধু আ‌ছে ও‌দের।


    আ‌মি আমার দেখা জ‌হি‌রের কথা বললাম। মি‌লে গেল। একজন বল‌লো, জ‌হির তো চ‌লে গে‌ছে এ স্কুল থে‌কে।


    আ‌রেকজন বল‌লো, ও‌কে টি‌সি দি‌য়ে বের ক‌রে দি‌য়ে‌ছে।


    -কেন?


    -‌চোর ছিল ও।


    -চোর না, পাগল। আমা‌দের টাকা চু‌রি ক‌রে আমা‌দের জন্ম‌দি‌নেই গিফট কর‌ত। সবার জন্মতা‌রিখ মুখস্ত ছিল ওর।


    মু‌খে বললাম এ‌কি! ম‌নে ম‌নে বললাম, আহা রে। বেচারি অভাব মান‌তে চাই‌তো না!


    আমার হঠাৎ ম‌নে হ‌লো,আ‌রেকটু বু‌দ্ধি থাক‌লে এমন দাগী চোর হতাম। ভা‌গ্যিস, আমার বু‌দ্ধি বেশী নেই।


    মোজা‌ম্মেল হক শে‌ষের দু'টা লাইন কে‌টে ফেল‌লেন। লেখাটার শি‌রোনাম দি‌লেন না।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ই‌তি | 113.21.228.162 | ২৩ এপ্রিল ২০২১ ০৭:০৮105035
  • বাহ ভা‌লো লাগলো খুব

  • π | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ১১:৩২105135
  • বেশ লাগল!  

  • নিরমাল্লো | 220.158.144.34 | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ১২:০১105145
  • দারুণ গল্প, তেমনি বলার ভঙ্গী। খুব ভালো লাগল

  • Gouri | 2409:4061:2d0d:df84::cd8a:e80c | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ১২:২৫105146
  • Khub sundar লেখাটা 

  • Prativa Sarker | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ১২:৩৩105147
  • সহজ কথা সহজ ভাবে বলা কষ্টকর, কিন্তু এখানে সেই সহজিয়াকে পেলাম।

  • ফ‌জিলাত | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ১৮:৫৩105166
  • ধন্যবাদ আপনা‌দের সবাই‌কে!! দারুণ অনুপ্রেরণা পেলাম। গুরুচন্ডা‌লি‌তে এটা আমার প্রথম লেখা।

  • Ramit Chatterjee | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ১৯:১২105168
  • অসাধারণ

  • Sumona Choudhury | ২৬ এপ্রিল ২০২১ ০৮:৩৮105189
  • খুব ভালো লাগলো গল্পটা। খুব সাবলীল ভাবে লেখা। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন