এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  শনিবারবেলা

  • করোনার দিনগুলি - দ্বিতীয় ঢেউ - প্রথম কিস্তি

    ঐন্দ্রিল ভৌমিক
    ধারাবাহিক | ১০ এপ্রিল ২০২১ | ২৮৭০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • "অনেকদিন বাদে করোনার দিনগুলির স্মৃতি ফিরে আসছে। রাতে চেম্বার সেরে ঘরে ফেরার পর রোজই দু-তিনটে ফোন পাচ্ছি, ‘ডাক্তারবাবু, মানে ইয়েটা করতে দিয়েছিলেন না... ওটা পজিটিভ এসেছে। কী করব?’..." করোনার দিনগুলির পর শুরু হল ঐন্দ্রিল ভৌমিকের ধারাবাহিক, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে।
    ~~ ১ ~~

    ভ্যাকসিন- নেব কি নেবনা

    অনেকদিন বাদে করোনার দিনগুলির স্মৃতি ফিরে আসছে। রাতে চেম্বার সেরে ঘরে ফেরার পর রোজই দু-তিনটে ফোন পাচ্ছি, ‘ডাক্তারবাবু, মানে ইয়েটা করতে দিয়েছিলেন না... ওটা পজিটিভ এসেছে। কী করব?’

    আজ একজন ফোন করলেন। তিনি স্কুল শিক্ষক। স্ত্রীকে জ্বর নিয়ে দেখাতে এসেছিলেন। করোনা ধরা পড়েছে। সব কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার বাবা- মা দুজনের বয়সই সত্তরের কাছাকাছি। একই বাড়িতে থাকেন। ওদের কি আগামীকাল করোনার ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। করোনার ভ্যাকসিন দিয়ে নিলে ওদের আর করোনা হবে নাতো?’

    বললাম, ‘এতোদিন কী করছিলেন? ঘুমাচ্ছিলেন?’

    ‘আসলে ডাক্তারবাবু, ভ্যাকসিন নিয়ে অনেকে মারা যাচ্ছে তো। তাই দিতে সাহস পাইনি। আমারোতো ভোটকর্মী হিসাবে নেওয়ার সুযোগ আছে। এতোদিন নিতে সাহস পাইনি। ভাবছি কালকে নিয়ে নেব।’

    অবাক হয়ে বললাম, ‘ভ্যাকসিন নিয়ে মারা যাচ্ছে এই তথ্য পেলেন কোথায়? পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন গড়ে তিনলক্ষ বয়স্ক মানুষ ভ্যাকসিন পাচ্ছেন। পার্শ্বপতিক্রিয়া হলে লোকজন তো ডাক্তারের কাছে আগে আসবেন। সেরকম কেউই তো আসছেন না।’

    ভ্যাকসিন নিয়ে সবার মধ্যে এতো ভয়, অথচ করোনা নিয়ে কারও মন কোনো ভয় আছে বলে মনে হচ্ছে না। সব দলই ভোটের আগে জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ইশতেহারে দারুণ দারুণ কথা লিখেছেন। কিন্তু সেসব দলের মিছিল, জনসভা দেখলেই টের পাওয়া যায়, ওই কথাগুলি কেবল কথার কথা। নিশ্চিতভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন বাংলায় ঢুকে পড়েছে, তখনও তারা জনসভায়, মিছিলে ভিড় বাড়াতে ব্যস্ত। যেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্কের ব্যবহার ইত্যাদির কোনো অস্তিত্ব নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে নীতি- আদর্শগত নানা রকম পার্থক্য আছে, কিন্তু এই একটা ব্যাপারে তারা মোটামুটি একই রাস্তায় হাঁটছে।

    যারা জনপ্রতিনিধি হতে চলেছেন, প্রচারের সময় তাঁদেরও অনেকের মুখে মাস্ক নেই। দুঃখের ব্যাপার আমাদের মতো খুপরিজীবী চিকিৎসকদের থেকে এনাদের কথাকে মানুষ অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। জনসভাগুলিতে পারস্পরিক খিস্তি-খেউরে মাতার আগে তারা যদি একবারও সকলকে মাস্ক পরার জন্য এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আবেদন করতেন, তাহলে সচেতনতা অনেক বাড়তো।

    তাঁর বদলে তারা যেটা করেছেন, সেটা সব রাজনৈতিক দলই বছরের পর বছর ধরে করে এসেছে। ভোটের প্রচারে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ঘুষখোর ও রাক্ষস হিসাবে তুলে ধরেছে এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যাবতীয় ব্যার্থতার দায় তাঁদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে।

    আগে এসবে রাগ হতো। আজকাল আর রাগটাগ হয়না। সব ব্যাপারেই কেমন উৎসাহ হারিয়ে ফেলছি। প্রশংসা শুনলে, হাততালি দিলে বা থালা বাজালে, এমনকি হেলিকাপ্টার থেকে পুষ্প বৃষ্টি করলেও উত্তেজনা হয় না। সবকিছুই কেমন সাজানো সাজানো মনে হয়।

    শ্রমজীবী মানুষেরা অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ডাক্তারবাবু, ভোটের পরে নাকি লকডাউন হবে? সত্যি...? তাহলে একেবারে শেষ হয়ে যাবো?’

    কী উত্তর দেব? সত্যিই যদি তাই হয়, তাহলে আবার সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের লংমার্চ, মানুষের হাহাকার, হাততালি, পুষ্পবৃষ্টি- সব মিলিয়ে এক অসহ্য নাটক। যাক, সেসব নিয়ে ভোটের পর ভাবা যাবে।



    ~~ ২ ~~

    খুপরির গল্প

    বাংলায় ভোটের খেলা চলছে। সকলে তাই নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। তবে আমার মতোও কয়েকজন রয়েছে যাদের ভোট নিয়ে আগ্রহ নেই।

    খবরের কাগজ পড়া হয় না অনেকদিন, টিভি দেখা হয় না তার চেয়েও বেশি দিন। ফলে নানা গুরুত্বপূর্ণ খবর অজানা থেকে যায়। যেমন আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবো না কোন অভিনেতা এবার কোন দল থেকে কোথায় দাঁড়িয়েছেন।

    তবে আমি একেবারেই অসামাজিক নই। সকাল থেকে রাত অবধি মানুষের সাথেই কারবার। তাদের জ্বালা যন্ত্রণার গল্প শুনি। তাদের কাছে নানা খবরা-খবর পাই। সেসব খবর কোনো সংবাদপত্রে ছাপলে পাবলিক খাবে না।

    ঘামতে ঘামতে দাস মেডিকেলের খুপরিতে রোগী দেখছিলাম। এই খুপরিতে বেজায় গরম। চারদিক আটকানো। শুধু একটা ঘড়ঘড়ে দেওয়াল পাখা চলে। সেটা আবার ঘুরে ঘুরে হাওয়া দেয়। কিছুতেই স্থির করা যায়না। ঘুরতে ঘুরতে যেটুকু দমকা হাওয়া গায়ে এসে লাগে, সেটুকুই শান্তি।

    আশ্চর্যের বিষয় হলো খুপরির দেওয়ালে একটি এসি বিরাজ করছে। তবে এসিটা চলেনা।

    স্টেথো দিয়ে এসিটা ঠুকে ঠুকে দেখেছি। কেমন ফাঁপা আওয়াজ। সম্ভবত ভেতরে যন্ত্রপাতি নেই। খোলসটা টানিয়ে খুপরিটাকে থ্রি স্টার চেম্বার বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে।

    মন মেজাজ খিঁচড়ে রয়েছে। খুপরিতে ঢুকতে দেরি হয়েছে।

    আমি ঠিক সময়ে খুপরিতে ঢোকা ডাক্তার। আজও সময়ের মিনিট পাঁচেক আগেই ঢুকে যেতাম। কিন্তু রাস্তা জুড়ে এক রাজনৈতিক দলের বিশাল মিছিল বেড়িয়েছে। ব্যাণ্ড পার্টি, ছৌ নাচ, ঘোড়ার গাড়ি, রণ পায়ে চড়া লোক- কী নেই সেখানে। একেবারে হই হই কাণ্ড, রই রই ব্যাপার। সবই আছে, শুধু কারো মুখে মাস্ক নেই।

    গতকালও আমার চারজন রোগীর করোনা ধরা পড়েছে। তার মধ্যে একজনের অবস্থা সুবিধার নয়। কালকে রাতেই তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাওতো অধিকাংশ জ্বরের রোগী পরীক্ষা করাচ্ছে না। সবাই পরীক্ষা করালে কেস অনেক বাড়তো।

    দরজা ঠেলে একটি সাতেরো- আঠেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে তার মা ঢুকলেন। ছেলেটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে গতকাল দোলের দিন সে চুটিয়ে রঙ খেলেছে।

    জিজ্ঞেস করলাম, 'কী হয়েছে?'

    ছেলেটির মা বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, মনে হচ্ছে জণ্ডিস হয়েছে।'

    'কী দেখে মনে হচ্ছে?'
    'কাল সারা রাত ও বমি করেছে। জল খেলেও ওয়াক ওয়াক করছে। চোখ দুটোও কেমন হলুদ হলুদ দেখাচ্ছে।'
    'কী রে, এখন আর বমি পাচ্ছে?'

    ছেলেটি জবাব দিল, 'না স্যার। এখন ঠিক আছি। কোনো অসুবিধা নেই।'

    বললাম, 'কী আজব জণ্ডিস। সারাদিন আপনার ছেলে চুটিয়ে রঙ খেলল। রাত্রে জণ্ডিস হল। আবার সকাল হতেই ঠিক হয়ে গেল!'

    ‘ডাক্তারবাবু, আপনি ওকে একটু ভালো করে দেখুন। রাত্রে ও কেমন যেন করছিল। বারবার বলছিল, মা কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি এখুনি মরে যাব। অতবড় ছেলে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল।' বলতে বলতে ওর মা কাঁদতে আরম্ভ করলেন। 'একমাত্র ছেলে ডাক্তারবাবু, আপনি পরীক্ষা নিরীক্ষা লিখে দিন। আলট্রাসাউন্ড, লিভারের পরীক্ষা- সবকিছু।'

    আমি ছেলেটির চোখে চোখ রেখে বললাম, 'কী খেয়েছিলি? সিদ্ধি?'

    ভদ্রমহিলা হাউমাউ করে উঠলেন, 'না না ডাক্তারবাবু, ও তেমন ছেলেই নয়। ও কোনো নেশা করে না।'

    জোড়দার ধমক দিতে বাধ্য হলাম, 'চুপ, একদম চুপ। প্রশ্নটা আমি আপনাকে করিনি। কী খেয়েছিলিস বল।'

    ছেলেটি মাথা নীচু করে বলল, 'সিদ্ধি খেয়েছিলাম। বন্ধুরা জোর করে... '

    মুহূর্তের মধ্যে ভদ্রমহিলা মমতাময়ী মা থেকে ঝগড়ুটে পিসি হয়ে গেলেন। তিনি ছেলেটির হাত ধরে টেনে তুললেন, 'হতচ্ছাড়া, তোর জন্য আমি এত করছি, আর তুই নেশা করে বেড়াচ্ছিস। বাড়ি চল...'

    ভদ্রমহিলার রুদ্র মূর্তি দেখে হকচকিয়ে গেলাম। মিনমিন করে বলতে গেলাম, 'ইয়ে আমার ভিজিট টা...'

    উনি শুনতে পেলেন বলে মনে হল না। যাক গে, একজনের ভিজিট না পেলেও আমার দিব্যি চলে যাবে।

    পরপর রোগী দেখছি। বেশ ছন্দ এসে গেছে। বিড়ি খেয়ে হাঁপানির রোগী দেখলাম। মদ খেয়ে প্যানক্রিয়াটাইটিসের রোগী দেখলাম। সব সিলেবাসের মধ্যে। রোগীরা ঢুকছে আর বেরোচ্ছে।

    ছন্দ কাটল একটি কম বয়সী মেয়ে। একটি বয়স্ক মানুষকে ধরে ধরে সাবধানে খুপরিতে ঢুকছে।

    বললাম, 'একটু তাড়াতাড়ি।'

    'দুঃখিত ডাক্তারবাবু একটু সময় লাগছে। বাবা একেবারেই দেখতে পায়না তো।'

    যত্ন করে মেয়েটি বয়স্ক ভদ্রলোককে টুলে বসিয়ে দিল। বলল, ‘ডাক্তারবাবু, দেখুন না, বাবার বড্ড ঠাণ্ডা লেগে গেছে। এমনিতেই টানের দোষ আছে।'

    বুকে স্টেথো বসালাম। দিব্যি সপ্তসুর শোনা যাচ্ছে। বললাম, 'ভালোই ঠাণ্ডা লাগিয়েছেন। তা লাগালেন কী করে?'

    ভদ্রলোক লাজুক মুখ করে বললেন, ‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, দার্জিলিং গেছিলাম। বড্ড ঠাণ্ডা, অভ্যাস নাই তো।'

    অবাক হয়ে বললাম, 'দার্জিলিং? বেড়াতে গেছিলেন? আপনি তো চোখেই দেখেন না!!'

    ভদ্রলোক হাতড়ে হাতড়ে মেয়েটির কব্জি চেপে ধরলেন। বললেন, 'এই যে, এ মেয়ের জেদ। কতবার বারণ করেছি, শুনলো না।'

    মেয়েটির চোখে অভিমান, 'তুমি আমাকে বলোনি, তোমার পাহাড় দেখার ইচ্ছে? আমি চাকরি পেলে আমার সাথে পাহাড়ে যাবে বলোনি?'.

    'তখন তো চোখে দেখতাম। আর এখন...'
    'আর এখন কী? তুমি এখনো যথেষ্ট সুস্থ। দাঁড়াও এবার তোমার চোখটা ভালো করে দেখাতে হবে। ডাক্তারবাবু, রেটিনার সমস্যার জন্য কোথায় দেখালে ভালো হয়?'

    বাবা আর মেয়ে ছাড়া ওদের বাড়িতে কে আছে জানি না। মেয়েটি কী চাকরি পেয়েছে তাও জানি না। তবে ওদের ভালোবাসার উত্তাপ দিব্যি টের পাচ্ছিলাম।

    ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, 'তা দার্জিলিং কেমন লাগলো?'

    উনি হাসলেন, 'খুব ভালো লেগেছে। কী ঠাণ্ডা হাওয়া। উঁচু নীচু রাস্তা। আর ও এতো বকবক করছিল। যা দেখছিল আমাকে শোনাচ্ছিল।'

    ভদ্রলোক আরও কীসব বলে যাচ্ছিলেন। সন্তানের চোখ দিয়ে প্রথমবার পাহাড় দেখার আনন্দে উনি এখনো মশগুল হয়ে আছেন।



    ~~ ৩ ~~

    করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

    পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে একটাও করোনার কেস পাইনি। মার্চের মাঝামাঝি থেকে আবার পেতে আরম্ভ করেছি। তারপর যত দিন যাচ্ছে, করোনার কেস বাড়ছে। শুধু গতকালই আমার ৯জন রোগীর করোনা ধরা পড়েছে। কেউ ফোনে জানাচ্ছেন, কারও বাড়ির লোক রিপোর্ট নিয়ে আসছেন, কেউ আবার রিপোর্ট হাতে নিয়ে নিজেই চলে আসছেন।

    যারা এভাবে চেম্বারে চলে আসছেন তাঁরা কিন্তু আদৌ অশিক্ষিত নন। কিন্তু শিক্ষা ও সচেতনতার মধ্যে পার্থক্য আছে। করোনা পজিটিভ রোগী দিব্যি বাজার করে দুই ব্যাগ ভর্তি মালপত্র নিয়ে দেখাতে আসছেন। গালি দিচ্ছি, ‘এই অবস্থায় ঘুরে ঘুরে বাজার করলেন?’

    অনুশোচনাহীন ভাবেই উত্তর দিচ্ছেন, ‘কী করব? বাড়ি শুদ্ধু সবাই পজিটিভ। জানাজানি হওয়ার পরে প্রতিবেশীরা যদি বাড়ি থেকে বেরোতে না দেয়।’

    চৈত্রের গরমেও জ্বরের রোগীও অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। জ্বরের সাথে গলা ব্যথা, জ্বরের সাথে পেট খারাপ, জ্বরের সাথে খুশ খুশে কাশি- পরীক্ষা করলেই পজিটিভ আসছে। দ্বিতীয় ঢেউ যে বাংলায় ঢুকে পড়েছে এই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এখন দেখার এটা কতদিনে প্রথম ঢেউয়ের ক্ষয় ক্ষতিকে পেরিয়ে যায়।

    সংবাদ মাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ কারোরই তাপ উত্তাপ নেই। সকলেই ভোট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর সময়েও একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। মিত্রপক্ষের দেশগুলিতে যেমন আমেরিকা, ইংল্যান্ডে ফ্লু’র দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল সুনামির মতো। মানুষ মারা যাচ্ছিল হাজারে হাজারে। অথচ সে সব দেশের সংবাদ মাধ্যম রোগের ভয়াবহতা প্রকাশ করেনি। সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল- কারণ রোগের ভয়াবহতা প্রকাশ পেলে সৈনিক ও দেশের মানুষদের মানসিক জোর, দেশপ্রেম কমে যেতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যতজন মানুষ মারা গেছিলেন, শেষ পর্যন্ত স্প্যানিশ ফ্লুতে তার থেকে বেশি মানুষ মারা গেছিলেন। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যান।

    স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তি কিন্তু স্পেনে নয়। স্পেনে স্পানিশ ফ্লু খুব বেশি তাণ্ডবলীলা চালাতেও পারেনি। তবু এই অতিমারির নাম স্প্যানিশ ফ্লু হল কেন? স্পেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল। অন্যান্য দেশের সংবাদ মাধ্যম এই মহামারীকে গুরুত্ব না দিলেও স্পেনের সংবাদ মাধ্যম প্রথম থেকেই মুক্তভাবে যথাযত গুরুত্ব দিয়ে এই মহামারীর খবর প্রকাশ করেছিল।

    ভারতবর্ষে প্রায় দুকোটি মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা গেছিলেন। কিন্তু বৃটিশ সরকারের বদান্যতায় সে সব খবর খুব বেশি প্রচার পায়নি।

    যদিও পশ্চিমবঙ্গের ভোট আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে কোনো তুলনা করা যায় না, তবু ভোটের কল্যাণে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আপাতত কারও মাথাব্যথা নেই। লোকজন দিব্যি মাস্ক ছাড়াই জ্বর গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মিছিলে, জনসভায় মারমার- কাটকাট ভিড় হচ্ছে। শারীরিক দূরত্ব, স্বাস্থ্য বিধি মানার কোনো বালাই নেই। করোনা আবার নিশ্চিতভাবে গুরুত্ব পাবে। তবে মে মাসের ২ তারিখের পর থেকে।

    অনেক রোগীই জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ডাক্তারবাবু, ৩ মে থেকে কি লকডাউন হবে? আরেকবার লকডাউন হলে মারা পড়ব। তার চেয়ে করোনা হওয়া অনেক ভালো।’

    সকলেই জানেন ভোট শেষ হওয়ার আগে আর কিছু হবে না। যেমন চলছে চলবে। যা হওয়ার ভোটের পরে হবে।



    ~~ ৪ ~~

    গরমকাল, করোনা এবং ভোট

    আমি নতুন করে লকডাউন এর ঘোরতর বিরুদ্ধে। আবার লকডাউন হলে মানুষের আর ভোগান্তির সীমা থাকবে না। আগের বছর লকডাউনের সময় সাধারণ মানুষের এত অসহায়তা দেখেছি, সারা জীবনে ভুলতে পারা মুশকিল।

    লকডাউনে কত মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গেছেন, কত শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন- এসব অর্থনীতিবিদেরা বলতে পারবেন। একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে নিজের চোখে যেটুকু দেখেছি সে টুকু বলতে পারি।

    দীর্ঘমেয়াদী অসুখে আক্রান্ত বহু মানুষ যারা সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধ খেতেন, লকডাউনের সময় ওষুধ ও চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর পেছনে প্রধানত দুটি কারণ ছিল। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য যানবাহনের অভাব এবং হাসপাতালে গেলেই করোনা হবে এই ভয়।

    যারা ওষুধ কিনে খেতেন অনেকেই অর্থের অভাবে ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রেশার, সুগারের অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বন্ধ করায় অনেকেই স্ট্রোক, হার্টের মারাত্মক অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন।

    আমাদের মত খুপরিজীবি চিকিৎসকদের ডেথ সার্টিফিকেট খুব বেশি লিখতে হয় না। শহরাঞ্চলে অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে শেষ চেষ্টা করা হয়। লকডাউনের সময় রোজই প্রায় তিন-চারটি ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হয়েছে। হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে দুপুরে দেখে বলেছি, এখুনি কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সেই রোগীর বাড়ির লোক রাত্রে ডাকতে এসেছেন। রোগীকে তাঁরা কোথাও নিয়ে যেতে পারেননি। বাড়িতেই মারা গেছেন।

    একটা জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়কে ঠেকানোর জন্য লকডাউন আরো বড় জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। লকডাউন এর পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয় তার জন্য দরকার ছিল কোভিড আচরণবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা। আমরা তাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। আর ভোটের বাঁশি বেজে যাওয়ার পর মনেই হচ্ছে না আমরা একটা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে রয়েছি।

    মধ্যমগ্রামের এক ভোট প্রার্থীর বিনা মাস্কেই সাক্ষাৎকার শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, 'আমরা রোদের মধ্যে রয়েছি। সেখানে একটা মিনিমাম টেম্পারেচারের পর করোনা তো থাকে না। এখানে কারো করোনা হবে না। আমি প্রত্যেককে বলে দিয়েছি বাড়ি ফিরে গরম জলে (প্রথমে সম্ভবত গঙ্গাজল বলতে গিয়ে সামলে নিয়েছেন) স্নান করতে, হ্যান্ড ওয়াশ করতে, গরম জলে গার্গেল করতে- কোনো প্রবলেম হবে না। সারাদিন এতো হিটের উপর আছি তাতে করোনা আসবে বলে মনে হয় না। ডক্টর বলেছে চারদিনের মধ্যে আমরা যদি নিজেকে ট্রিটমেন্ট এর মধ্যে রাখি তাহলে কিছু হবে না।'

    সঞ্চালক যখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে মাস্ক পরার দরকার নেই?'

    উনি জবাব দিলেন, 'আমার কাছেও মাস্ক রয়েছে। যখন বাইরে গেছি, ভেতরে গেছি তখনও ছিল। সেগুলো ঠিকঠাক করেই রেখেছি। ওই নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই।'

    তবে একটু চিন্তা হয় বইকি। এনাদের কথা বহু মানুষ শুনছেন, প্রভাবিত হচ্ছেন।

    ১. গতবছর গোটা গরমকাল করোনা দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। বরঞ্চ শীতকালে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে কেস অনেক কমে গেছিল।
    ২. দ্বিতীয় ঢেউয়ে মহারাষ্ট্র, রাজস্থানের অবস্থা খুবই খারাপ। এই রাজ্য দুটিতে নিশ্চয়ই বরফ পড়ে না।
    ৩. বাংলাতে গরম ও ভোটের গরম যত বাড়ছে করোনার কেস প্রায় গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ছে।
    ৪. ৩৮ ডিগ্রী গরমে বাড়ি ফিরে গরম জলে স্নান করলে আর যাই হোক করোনা পিছু হটবে না।
    ৫. পকেটে মাস্ক যত্ন করে রেখে দিলে করোনা আটকাবে না। মাস্ক দিয়ে নাক- মুখ ঢাকলে তবেই করোনা আটকাবে।
    ৬. চারদিনের মধ্যে ট্রিটমেন্ট- বস্তুটা সম্ভবত ওঁর মস্তিষ্কপ্রসূত।

    অথচ উনি যদি নিজে মাস্ক পরে ক্যামেরার সামনে বলতেন, সকলে মাস্ক পরুন, ভ্যাকসিন নিন- তাহলে বহু মানুষের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছাতো।

    এই করোনাকালে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে। ১ বছরের অধিক সময় স্কুল বন্ধ। যারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া তারা যেটুকু শিখেছিল, পুরোটাই ভুলে যাচ্ছে।

    সকলেই ভেবেছিল ভোটের পর স্কুল খুলে যাবে। কিন্তু যে ভাবে করোনা আবার ছড়াচ্ছে- এ বছর স্কুল খুলবে কিনা বলা মুশকিল। এই নিয়ে এবার ভাবনা চিন্তা করার সময় এসেছে।



    ~~ ৫ ~~

    গরমকাল, করোনা এবং ভোট

    দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা প্রথমবার এক লাখ ছাড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

    আগের বছর প্রথম ঢেউ এর সময় রোগীর সংখ্যা আস্তে আস্তে বেড়েছিল। তখন লকডাউন চলছিল। লকডাউন ওঠার পরও লোকাল ট্রেন অনেক দিন চলেনি। লোকজনও সচেতন ছিলেন।

    এবছর রোগীর সংখ্যা বাড়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার চিহ্ন মাত্র নেই। সামান্য মাস্ক পরেই রোগের ছড়ানোটা অনেক কমানো যেতো। কিন্তু ৯০% লোকই মাস্ক পরছেন না।

    পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে ভোটের জন্য। নেতা- নেত্রী থেকে প্রশাসনের সকলের এখন পাখির চোখ ভোট। ভোটের পরে আবার করোনা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হবে।

    রাজনৈতিক দলগুলি এই মহামারীর মধ্যেও যেভাবে জমায়েত করছে সেটা রীতিমতো অপরাধ। এব্যাপারে ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী- সব দলই এক। কিন্তু তাঁরা সব নিয়ম কানুনের ঊর্ধ্বে।

    একটাই ভালো ব্যাপার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মৃত্যু হার এখনো ১% এর কম। না হলে এতোদিনে ঘরে ঘরে হাহাকার শুরু হয়ে যেতো।

    তা বলে হাল ছেড়ে বসে থাকা একেবারেই উচিৎ নয়। মহামারী বারবার তার চরিত্র বদলায়। ফলে মৃত্যু হার যে পরবর্তী কালে আচমকা বেড়ে যাবে না, সেটাও বলা মুশকিল।

    আমাদের মতো খুপরিজীবি চিকিৎসকদের কাছে সময়টা মোটেও সুখের নয়। আগের বছর লকডাউনের সময় মনের উপর যতই চাপ থাক, রোগীর চাপ অনেক কম ছিল। এবছর রোগীর চাপ সামলানো মুশকিল হচ্ছে। তাছাড়া দিনের পর দিন একঘেয়ে রোগী দেখতে বেশ ক্লান্তি লাগছে।

    বাংলায় শতাধিক চিকিৎসক করোনায় মারা গেছেন। এভাবে সহকর্মীদের অকালে চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কষ্টকর। সাধারণ মানুষের মাস্ক ব্যবহারের অনীহা দেখে রাগ আরও বাড়ছে।

    নানা রকম অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি। বয়স্কদের ভ্যাকসিন দেওয়া বেশ কিছুদিন শুরু হয়েছে। এতোদিন বেশিরভাগ মানুষই তা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। ঘরের পাশে করোনা এসে যাওয়ায় সকলেরই টনক নড়েছে।

    দলে দলে মানুষ আসছেন। একটাই প্রশ্ন 'আমি কি ভ্যাকসিন নিতে পারি? আমার নানা রকম অসুখ আছে।'

    একই উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখ ইত্যাদি রোগে ভ্যাকসিন দেওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বস্তুত এনাদেরই আগে ভ্যাকসিন নেওয়া উচিৎ। কারণ অন্য অসুখ থাকলে করোনায় মৃত্যু হার বেড়ে যায়।

    ভ্যাকসিন রোগ কতদূর প্রতিরোধ করে এখনো বলা মুশকিল। কিন্তু এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। আর ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ নিয়ে নিলেও কিন্তু মাস্ক ব্যবহার করা উচিৎ।

    অদ্ভুত অদ্ভুত কারণেও অনেকে আসছেন। যেমন একজন ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়ে ফিরছিলেন। রাস্তাতেই কুকুরে কামড়েছে। তাঁর প্রশ্ন কুকুরে কামড়ানোর ভ্যাকসিন কি এই অবস্থায় নেওয়া যেতে পারে?

    মানুষের জিজ্ঞাসার শেষ নেই। 'ভ্যাকসিন নেওয়ার আগের দিন কি নিরামিষ খেতে হবে? ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে কি টক খাওয়া চলবে?'

    'ভ্যাকসিন দেওয়ার পর রাত্রে জ্বর আসেনি। তাহলে কি ভ্যাকসিন কাজ করবে না?'
    'দু-রকম ভ্যাকসিন আছে শুনেছি। কোনটা নেওয়া ভালো?'
    'দিদিমণিরা বলেছেন চার সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ নিতে। অথচ খবরের কাগজে দেখলাম ৪৫ দিন বাদে নিলে ভালো কাজ করবে। কী করবো?'
    'বাবা বিছানায় শয্যাশায়ী। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কোনো ভাবে কি বাড়িতে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়?'

    অনেক প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেও স্পষ্ট নয়। মাঝে মাঝে ধৈর্য্যও হারিয়ে ফেলছি।

    তবে এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি এবারের লড়াইটা আগের বারের থেকে অনেক কঠিন। আমরা নেতৃত্ব বিহীন সাধারণ সৈন্যদল একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

    সকলের কাছে করজোড়ে অনুরোধ মাস্ক পরুন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। আবার লকডাউন আমরা কেউই চাই না। লকডাউনকে ঠেকানোর জন্য মাস্ক পরুন।

    খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থে, পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থে মাস্ক পরুন।

    ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো এক বছরের উপর স্কুলে যায়নি। বদ্ধ ঘরের মধ্যে তাদের মানসিক বিকাশ থমকে গেছে। বাচ্চাগুলোর স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে মাস্ক পরুন।

    বাংলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে করোনায় মৃত্যু হার বেশ বেশি। তাঁদের বাঁচতে দিন- মাস্ক পরুন।



    ~~ ৬ ~~

    করোনা, ভোট এবং লাইফ রিস্ক

    প্রথম ঢেউয়ের সময়ে করোনার কেস বেড়েছিল ধীরেসুস্থে। এবারে ঝড়ের গতিতে বাড়ছে। মানিয়ে গুছিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে।

    আজ প্রায় অর্ধেকের বেশি রোগীই জ্বরের। কয়েকদিন আগেও বেশ সুগারের, প্রেশারের, হাঁটু ব্যাথার রোগী দেখে দিন কাটাচ্ছিলাম। জ্বরের রোগী সংখ্যায় ছিল নগণ্য। দিন পনেরোর মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। জ্বরের রোগীর চাপে অন্যসব রোগী পিছু হটছে। জ্বরের সাথে কাশি, গলা ব্যথা, পেট খারাপ। বেশ কয়েকজনের আবার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ হয়ে গেছে।

    এক- একটি বাড়ি থেকে পাঁচজন- সাতজন দেখাতে চলে আসছেন। প্রত্যেকেরই জ্বর আসছে। জ্বরের কারণ কী বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। যেটা অসুবিধা হচ্ছে সেটা হল জ্বরের রোগীরা অনেকেই আগের থেকে নাম লেখাচ্ছেন না। ফলে সঞ্জয়দার সাথে ঝামেলা লাগছে।

    রোগীর ভিড়ে হাঁসফাস করছি। সকলেরই প্রায় একই সমস্যা থাকায় একটি বাড়ির সব সদস্যদের জন্য একটাই প্রেসক্রিপশন করে বলছি সবাই মিলে এক ওষুধ খেতে। গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়ে সকলকে করোনা পরীক্ষা করতে বলছি। বেশিরভাগেরই রিপোর্ট পজিটিভ আসছে।

    দুর্ভাগ্যজনক ভাবে জ্বরের রোগীরা অনেকেই আসছেন মাস্ক না পরে। তাঁদের মাস্ক পরে আসতে বললে অনেকে অসন্তুষ্ট হচ্ছেন। দু-একজন গোঁয়ারের মতন তর্ক করছেন।

    আমি ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ পেলেও আমার এসিস্ট্যান্ট দুজন সঞ্জয়দা ও গৌড়ের ভাগ্যে ভ্যাকসিন জোটেনি। ৪৫ বছরের নীচে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু না হলে ওদের পাওয়ার আশাও নেই। অথচ দুজনেই প্রচুর করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসছে। আমি অপরাধ বোধে ভুগছি।

    সকলে মাস্ক ব্যবহার করলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ছড়িয়ে পরা অনেকটাই শ্লথ করা যেতো। কিন্তু সাধারণ মানুষ মাস্ক না পরে করোনাকে আটকানোর জন্য অন্যান্য অনেক কিছু করছেন।

    এক মহিলা চেম্বারে ঢুকে চেয়ার টেবিলে স্যানিটাইজার ছড়িয়ে নিলেন। অথচ তাঁর মাস্ক থুতনির নীচে।

    তাঁকে বললাম, 'এভাবে আপনি করোনাকে আটকাতে পারবেন না।'

    উনি বললেন- সেটা উনিও জানেন। কিন্তু এভাবে স্যানিটাইজারের ব্যবহার তাঁর অভ্যাস হয়ে গেছে। বাইরে যেখানেই বসেন, স্যানিটাইজার ছড়িয়েই বসেন। না হলে অস্বস্তি হয়। কোথাও গেলে বাড়ি ফিরে এই গরমেও গরম জলে স্নান করেন, জামা- কাপড় সব কাচেন।

    এটাই অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজওর্ডার। আমাদের অজান্তেই নানা রকম মানসিক রোগের মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে।

    এই জটিল সময়ে যাদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা তাঁরা সকলেই ভোট নিয়ে ব্যস্ত। মাস্ক ছাড়াই জনসভায় নানা রকম গরম গরম ভাষণ দিচ্ছেন। বক্তব্যের কোথাও একবারও করোনা মহামারী নিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করার প্রয়াস নেই।

    এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ। কিছু স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েরা অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের অনেকেই মোবাইলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অনেকেই ঘাড়ের ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের সমস্যায় ভুগছে।

    নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্রমশ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। তারা যেটুকু শিখেছিল, সেটুকুও ভুলে যাচ্ছে।

    তবে তার মধ্যেও দু-একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। এক পরিচিত স্কুল শিক্ষক রাতে ফোন করলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি করোনা পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন। এ যাত্রা বেঁচে গেলাম।'

    আমি বললাম, 'নেগেটিভ এসেছে? এখনই আনন্দ করবেন না। র‍‍্যাপিড টেস্টে অনেকেরই নেগেটিভ আসছে। আর টি পি সি আর- এর রিপোর্ট আগে আসুক।'

    'না না ডাক্তারবাবু, আমার র‍‍্যাপিড টেস্টেই পজিটিভ এসেছে।'

    অবাক হয়ে বললাম, ‘তাহলে বেঁচে গেলেন বলছেন কেন?'

    ‘ডাক্তারবাবু, ভোটের ডিউটিতে আর যেতে হবে না। করোনার থেকে ভোটের ডিউটিতে লাইফ রিস্ক অনেক বেশি।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১০ এপ্রিল ২০২১ | ২৮৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১০ এপ্রিল ২০২১ ১৬:১৩104599
  • যে হারে বাড়ছে সে হারে খবর করছে না মিডিয়া। খুবই বিচ্ছিরি অবস্থা।


    ভিডিওগুলো নেই এখানে। সম্ভবতঃ ওঁর ফেবু দেয়ালে আছে। 

  • ar | 96.230.106.154 | ১০ এপ্রিল ২০২১ ১৮:০০104601
  • "যারা জনপ্রতিনিধি হতে চলেছেন, প্রচারের সময় তাঁদেরও অনেকের মুখে মাস্ক নেই। দুঃখের ব্যাপার আমাদের মতো খুপরীজীবী চিকিৎসকদের থেকে এনাদের কথাকে মানুষ অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। জনসভাগুলিতে পারস্পরিক খিস্তি-খেউরে মাতার আগে তারা যদি একবারও সকলকে মাস্ক পরার জন্য এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আবেদন করতেন, তাহলে সচেতনতা অনেক বাড়তো।"

    ডাঃ ভৌমিক, মাপ করবেন,
    গুরুর ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৫৯ বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানের লিংকটা এইখানে দিয়ে রাখলাম।
    শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা আর সকলের মাস্ক পরা আবেদন তখনো ছিল তো!!!

    https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=9879&page=19

  • alos mostisko | 43.231.243.226 | ১৩ এপ্রিল ২০২১ ০৫:২০104715
  • মাইরি। মাস্ক পরতে বললে অযথা তর্ক করবে । এমনকি  আপনার কী ? জিগাবে। আচ্ছা চৈত্র সেলে মাস্ক পর্লে  ছাড় পাবেন।  না পরলে ডবল দাম!  এরকম নিয়ম করা যায় না? 

  • :|: | 174.251.169.217 | ১৪ এপ্রিল ২০২১ ০৪:২৮104737
  • প্রথম ঢেউয়ের সময়ই আপনার লেখা পড়েছিলাম। দ্বিতীয় ঢেউও সমান উপভোগ্য। একটা অনুরোধ: আপনি গুণী লেখক -- একটু পড়া/পরার ব্যবহার আর পার্থক্যটা বুঝে ফেললে আরও ভালো হবে।

  • Dhiman Mandal | ১৫ এপ্রিল ২০২১ ২৩:১০104787
  • পুরোটাই পড়লাম।ভালো লাগল।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন