এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সমাজ  বুলবুলভাজা

  • দুই বিদেশির গল্প

    কমল চক্রবর্তী
    আলোচনা | সমাজ | ২৬ মার্চ ২০২১ | ৩৪৭৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বিদেশি শব্দটা আসামে এখন অতি সুলভ। কোনও একজন মানুষ, হয়ত জানতে পারলেন, তাঁর প্রতিবেশী, বা খোদ তিনি নিজেই বিদেশি। এমন সব বিদেশিদের নিয়ে একটা আস্ত বই রচনা করে স্বউদ্যোগে প্রকাশ করেছেন আসামের বাসিন্দা কমল চক্রবর্তী। তারই অংশবিশেষ প্রকাশিত হল গুরুচণ্ডা৯-তে।

    (লেখকের নিজের উদ্যোগে প্রকাশিত “ আসামে নাগরিকত্ব হরণের দহনলিপি” বইয়ের অংশ বিশেষ)

    ১) জয়দেব ঘোষ

    জয়দেববাবু থাকেন বদরপুরের এসটি রোডে। জেলা করিমগঞ্জ। যখন আসামে ১৯ লক্ষ এন‌আরসি ছুটদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে বলা হয়েছিল, ঠিক সেই সময় বদরপুরে রেলওয়ে কলোনিতে “ঝিনুক সাংস্কৃতিক সংস্থা” এন‌আরসি-ছুটদের সাহায্যকল্পে একটি হেল্প ডেস্ক সেন্টার খোলা। সেখানেই আমাদের পরিচয় জয়দেব ঘোষের ভাই দীপক ঘোষের সঙ্গে। তিনি ২০ সেপ্টেম্বর,২০১৯ তাঁদের মা বাবার সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে হেল্পডেস্কে আসেন। ঝিনুক থেকে আমাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জয়দেব ঘোষের কেসটি দেখভাল করার জন্য। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম এটা যেনে যে দীপকবাবুর কাছে করিমগঞ্জ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে দেওয়া 'জাজমেন্ট অর্ডারের কপি অবধি নেই ! অর্থাৎ, একজনকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, অথচ জয়দেব ঘোষ বা তার পরিবার কে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে ইস্যু করা জাজমেন্ট অর্ডার কপি অবধি দেওয়া হল না। শুধু বলা হল, ২০১৯ সালের মে মাসের দুই তারিখ ওর দাদা কে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং কেসটি এখন গুয়াহাটি হাইকোর্টের অধীনে।
    বেশিরভাগ আইনজীবী নিরক্ষর অসহায় মানুষকে অন্ধকারে রেখে কাজ করে, অথচ প্রয়োজনীয় পারিশ্রমিক পকেটে ভরে নেয়। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে জাজমেন্ট অর্ডারের কপি তাঁরা পান না।

    পরবর্তী কালে দীপকবাবু করিমগঞ্জের কিছু সহৃদয় মানুষ এবং আইনজীবীর সহায়তায় গুয়াহাটি হাইকোর্টের কেস নাম্বার পান, কেসটি যথাযথভাবে দাখিল হয়। আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী 'জয়দেব ঘোষ'-এর কেস লড়তে শুরু করেন। কিন্তু, তারপর থেকে অনবরত চাপ সৃষ্টি করে যাওয়া হাফিজ রশিদ চৌধুরি মহাশয় কে।

    জয়দেববাবু, এর আগে, ২০১৮ সালে নোটিশ পেয়ে বিভিন্ন তারিখে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে হাজিরও হয়েছিলেন । শেষের দুটো তারিখে হাজির হতে পারে নি, কেন না তার সতেরো বছর ছেলের ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত একমাত্র ছেলের চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে বাইরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। আইনজীবীর কাছে এ সংক্রান্ত লিখিত আবেদন দিয়ে গেলেও ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল জয়দেব ঘোষকে একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দশ তারিখ তার একমাত্র ছেলেটির মৃত্যু হয়। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জয়দেব। “মানবিক” ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের সদস্য (বা বিচারক) জয়দেববাবুকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। মজার ঘটনা হচ্ছে, উক্ত বিদেশি জয়দেব ঘোষ ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে লোকসভা নির্বাচনে ভোট‌ও দিয়েছিল !! এই হিংটিংছট প্রশ্ন ট্রাইবুনালসকে কিন্তু কামড়াতে আসে না যে, ২০১৯ সালে যে ব্যক্তি ভোট দিতে পারে, তাকে কীভাবে ডি ভোটার করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়!!

    জয়দেব ঘোষ এর মা-র নাম বীণা রানি ঘোষ। মায়ের নামেও বিদেশি নোটিশ এবং পরবর্তীতে এক তরফা রায়ে 'বিদেশি' ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের চার নভেম্বর বীণাদেবী কে ভারতীয় ঘোষণা করেন ট্রাইবুনাল। এক‌ই ঘটনা ঘটে তার আরেক ভাই সুবোধ ঘোষের নামে। যেখানে মা – বাবা – ভাই ভারতীয়, সেক্ষেত্রে আরেক ভাই জয়দেব ঘোষ “বিদেশি”ঘোষিত হয় কীভাবে? করিমগঞ্জে কেস চলাকালীন তাঁর আইনজীবী বদরপুরের রাজু দাস কিন্তু খুব সহজেই তার মা এবং ভাইয়ের “ভারতীয়’ হ‌ওয়ার অর্ডারটি কোর্টে জমা দিয়ে জয়দেব কে ভারতীয় প্রমাণ করতে পারতেন। কিন্তু, সেটি কার্যত হয় নি।
    যাই হোক, হাফিজ রশিদ চৌধুরি হাইকোর্টে কেস ওঠালেন। কেস নং ডব্ল্যুপি(সি)৪২১৫/২০১৯ । হাফিজ রশিদ চৌধুরি মহাশয় হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ আনলেন, এই (২০২০) বছরের মার্চ মাসের তিন তারিখে আবার করিমগঞ্জ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল নং থ্রি-তে হাজির হতে। সেই সঙ্গে আপাতত জামিনে মুক্তি পাওয়ার জন্য আবেদন করতে। হাফিজ রশিদ চৌধুরি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায়ে এবং কোর্টের রেকর্ড হিসেবে যা পাঠানো হয়েছিল হাইকোর্টে, তার মধ্যে গরমিল পেয়ে তিনি অবাক হলেন। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের মেম্বারদের বললেন, জয়দেব ঘোষ কে ভারতীয় প্রমাণ করতে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী তেসরা মার্চ জয়দেব ঘোষকে কোর্টে তোলার কথা। তিন তারিখ দীপক ঘোষ তার মা'কে সঙ্গে নিয়ে সময়মতো করিমগঞ্জ কোর্টে গিয়ে হাজির, কিন্তু জয়দেব ঘোষ কোর্টে আসলেন না! করিমগঞ্জের এসপি (বর্ডার) জয়দেব কে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে আনতে ভুলেই গেলেন!! আসলে মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। আবার তারিখ দেওয়া হলো পাঁচ তারিখ।

    অবশেষে পাঁচ মার্চ, ২০২০ সালে জয়দেব ঘোষ ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে জামিনে মুক্তি পেলেন দশ মাস পর। জয়দেবের মা ছেলেকে পেয়ে খুব খুশি।
    হাইকোর্টে এই মামলা লড়তে গিয়ে হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরি বলেছেন, এই রাজ্যে ট্রাইব্যুনালগুলো কীভাবে চলছে, কিছু মেম্বার কতটা অনুভূতিহীন হলে পর জয়দেবের পিঠে বিদেশি তকমা বসিয়ে দিতে পারেন এবং তার জেরেই ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরতে পারেন। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার একটা নতুন নাম দিয়েছে – HOLDING CENTRE!! এই হচ্ছে আমাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের উৎকৃষ্ট নমুনা। এখানেই শেষ নয়!! আরো আছে! করিমগঞ্জের তিন নং ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিচারক তাঁর চূড়ান্ত রায়ে তাঁকে বেমালুম মহিলা বানিয়ে দিয়েছিল! আসাম রাজ্যে কিছু এফটি মেম্বার ( বিচারক) কতটা দায়িত্বশীল, নিষ্ঠাবান ও মনোযোগী সেটা বেশ টের পাওয়া যায় ওই রায়ের প্রতিলিপিতে চোখ বোলালেই! কারন, এতে একেবারে স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে, নোটিশ পেয়ে জয়দেব একবারও এফ-টি তে হাজির হননি। আবার কী অদ্ভুত, অর্ডার শিটে রয়েছে এর উল্টো বয়ান! কী, না, তিনি কোর্টে হাজির হয়েছিলেন। এই ধরনের উদ্ভট বিচারে গুয়াহাটি হাইকোর্টের দুই বিচারপতি মনোজিত ভূঁইয়া এবং পার্থিবজ্যোতি শইকিয়া বাধ্য হয়ে করিমগঞ্জের ৩ নং ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায় খারিজ করে দিয়ে জয়দেববাবুকে আবার করিমগঞ্জ কোর্টে হাজির হয়ে জামিনে মুক্তি দেওয়ার আদেশ দিলেন।

    ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লকডাউনের জন্য জয়দেব ঘোষের কেস করিমগঞ্জ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবার উঠতে সময় নিল। পরবর্তীত শুনানির তারিখ এল ২৭ নভেম্বর, ২০২০।

    হাফিজ রশিদ চৌধুরি মহাশয়, আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন। আপনি ব্যস্ততম মানুষ। অনেক জ্বালাতন করেছি এই কেস নিয়ে। আসলে আপনিও বোঝেন ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা। এরপর‌ও হয়তো আপনাকেই বিরক্ত করবো।

    বদরপুরের ঝিনুক সাংস্কৃতিক সংস্থার মেম্বারদের দুর্দান্ত প্রয়াসের ফলেই আজ তা সম্ভব হয়েছে। ঝিনুক না থাকলে জয়দেবের খোঁজ পেতাম না। কাজেই, অভিনন্দন ঝিনুকেরও প্রাপ্য।

    ২) সুখদেব রী।

    সুখদেব রী-র ঠিকানা মোহনপুর গ্রাম, খণ্ড নং ৫ , থানা-আলগাপুর, জেলা- হাইলাকান্দি। সুখদেব বিগত দুইদশক কাজ করতেন Burnie Braes Tea Estate – এ। অর্থাৎ পেশায় তিনি চা শ্রমিক। ‘সুখদেব রী’ নামের ব্যক্তি সন্দেহভাজন বলে হাইলাকান্দির এসপি (বর্ডার) থেকে ২০১২ সালে এক নোটিশ আসে। নোটিশ পেয়ে শরণাপন্ন হন এক আইনজীবীর। ২০১৩ সালের সাতই মার্চ কেসটি হাইলাকান্দি কোর্টে উঠে। সুখদেববাবু বহু কষ্টে জোগাড় করা সমস্ত কাগজপত্র কোর্টে জমা দিলেন ২০১৩ সালের আঠারোই জুলাই। এরপর কোর্টে Cross Examination – এর জন্য লাগাতার তারিখ দেওয়া হয় । কিন্তু, কোনো অজানা কারণে সুখদেববাবু বা তার পরিবারের কেউই কোর্টে হাজির হন নি বা হতে পারেন নি। ফলত ২০১৬ সালের চার এপ্রিল তারিখে সুখদেব রী-কে একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষণা করা হয়। তাঁকে পাঠানো হয় শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে ।

    সুখদেব রী’র বাবার আসল নাম ধীরাজ বাউরী। চা বাগানের শ্রমিকরা অধিকাংশই নিরক্ষর। আসলে যেখানে দুমুঠো খাবারের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেখানে শিক্ষা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের কাছে এখনো সৌখিন মজদুরি ছাড়া কিছু নয়। এবার, কখন বা কীভাবে তাঁর বাবার পদবী ‘বাউরী’ থেকে রী হয়ে গেছে তা তাঁরা খেয়ালই করে নি। চা বাগান অঞ্চলে এই ধরণের সমস্যা প্রায় প্রতি ঘরেই আছে। তবুও তাঁরা একটা Affidavit এ বিষয়ে জমাও দিয়েছিলেন।

    শিলচর District Legal Services Authority- র সেক্রেটারি পার্থ ভট্টাচার্য মহাশয় ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে আমাকে নিয়ে যান রিসোর্সপার্সন হিসেবে। আমার এতোদিনের কাজের স্বপ্নপূরন হলো। জীবনে প্রথম ডিটেনশন ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছি!! সে এক আশ্চর্য অনুভূতি। কারণ আমি খুব কাছ থেকে এদের দেখতে পাচ্ছি সেখানে। শিক্ষার অভাবে বা প্রয়োজনীয় নথি না থাকায় যে অনেককে জেলে বন্দি হতে হয়েছে তা আমি জানতাম। সেখানেই সুখদেব রী’সহ অন্যান্য ভুক্তোভোগীদের দেখা পেলাম। সুখদেববাবুর সঙ্গে আমার আগের পরিচয় ছিল না । তার ব্যাপারে কিছুই জানতাম না । তিনি বাগানের শ্রমিক হয়েও ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি শুনে অবাক হলাম! বাড়ির ঠিকানা সহ ফোন নং সংগ্রহ করে মোহনপুর গ্রামে (৫ নং) গিয়ে দেখি একটি জঙ্গলের মধ্যেই ওনার বাড়ি ! না, বাড়ি নয়, আস্তানাই বলা যায়। একটা ভাঙা ঘরের মধ্যেই বর্তমানে ওনার পরিবারের দিন যাপন! একটা ভাঙা চেয়ারেই বসতে দিয়েছিলেন তাঁরা। বহুদূর অতিক্রম করে এসে ইচ্ছে হচ্ছিল যদি একটু চা খাওয়ার। কিন্তু তাঁদের হতদরিদ্র সংসারের চেহারা দেখে নিজের সেই ইচ্ছা সংযত রাখতেই হলো। এইরকম একটা জঙ্গলের মধ্যে ওরা থাকেন! ভীষণভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ এই স্থানকে গ্রাম বললে হয়তো ভুল হবে। জঙ্গলের মধ্যে বস্তুত তাঁদের জীবনযুদ্ধে চলছে। মনে মনে ভয়‌ও পাচ্ছিলাম! যাই হোক, সুখদেববাবুর স্ত্রী শিশুবালার কাছে Judgement Order দেখে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কেন কোর্টে হাজির হলেন না, এতোদিন সময় দেওয়ার পরও? উত্তরে শিশুবালা দেবী বললেন, “যখনই আইনজীবীর কাছে যাই, প্রতিদিনই আইনজীবী দুই হাজার তিন হাজার টাকা ওনাকে দিতে হতো। আমরা অনেক টাকা ধার করে আইনজীবীকে দিয়েছি। আর কতো দেবো? আমাদের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। কপালে যা আছে তাই হবে!” আমরা জানি আজকের দিনেও বাগান শ্রমিকদের যে দৈনিক মজুরি দেওয়া হয় সেই টাকা দিয়ে এক জায়গায় দুই হাজার জমানো চাট্টিখানি কথা নয় । তবুও তাঁরা প্রয়াস চালিয়েছিল । কিন্তু শেষ অবধি পেরে উঠলেন না। ফলে তাঁর স্বামীর আশ্রয় হল শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে।

    তাঁদের এক ছেলে । নাম সুজিত, ক্লাস ফোরে পড়ে। শিশুবালা দেবী নিজেই চা বাগানে কাজ জুটিয়ে নিয়েছেন ছাঁটাই শ্রমিকের। সব সময় কাজ থাকে না। যখন ডাক পড়ে যায় কিছু টাকা পান। সেই টাকা দিয়ে শাশুড়ি মা সহ তিনজনের তিন বেলা খাওয়া জোটানো প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। বাকি দুজনের তো জুটতোই না এমনকি ছেলেটির‌ও মাঝেমধ্যে তিনবেলা খাওয়া জুটতো না! জীবনে যে এমন অন্ধকার মুহূর্তে থাকতে হবে তা তাঁরা আগে ভাবতে পারেন নি।

    যাদের ঘরে এক কাপ চা দেওয়ার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই সেখানেই মনে মনে সংকল্প নিয়েছিলাম যে শিশুবালা দেবীকে তার আগের সংসার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সর্ব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো । আমি সুখদেব- কে ডিটেনশন ক্যাম্পের বেড়াজাল থেকে মুক্তি করবোই।

    সেখান থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মান্দারের সুপ্রিম কোর্টের কেসের রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি। সেখানে বলা হয়েছিল ডিটেনশন সেন্টারে যাঁরা তিন বছর অতিক্রান্ত করেছেন সেইসকল মানুষের মুক্তির কথা।

    ততদিনে সুখদেব রী- ডিটেনশন ক্যাম্পে তিন বছরের অধিক সময় কাটিয়ে নিয়েছেন । কিন্তু মুক্তির জন্য দু’জন ব্যক্তির একলক্ষ টাকা করে জামিনদারের ব্যবস্থা করতে হবে । সেই কথাটাই ফোনে জানালাম শিশুবালাকে। তিনি প্রথমে খুব খুশি হলেও মুহূর্তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। জামিনদার সহ এত মোটা অঙ্কের টাকা কোথায় পাবে! তবুও তিনি নাছোড়বান্দা । জামিনদারের খোঁজে ছুটলেন । অবশেষে অনেক ঝুট ঝামেলা পেরিয়ে দুজন জামিনদারও পাওয়া গেল। টাকা জোগাড় করতে হলো আমাকে। আমার সহধর্মিণী শ্রীলেখা সেনগুপ্ত এগিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করলেন। সেই সময়ে শ্রীলেখা সাহায্য না করলে আমি কী করতাম, ঠিক জানি না। চা – শ্রমিকদের জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ইউনিয়ন থাকা সত্ত্বেও ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ব্যক্তিদের জন্য বা কোনো “ডি ভোটার” – দের জন্য লড়াই করার জন্য কাউকেই এগিয়ে আসতে অন্তত আমি দেখিনি!

    আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে বারবার বলা হচ্ছিল যে আসামের ডিটেনশন ক্যাম্পে যারা আছেন তারা সবাই ‘বাংলাদেশি।‘
    সুখদেব রী’র বাবার আসল নাম বীরাজ বাউরী এবং ঠাকুরদার নাম মনু বাউরী। তাঁরা বংশানুক্রমেই চা বাগানের শ্রমিক। তাদের ১৯৬৫ সালের ভোটার লিস্টে নাম আছে, ১৯৭০ সালের ভোটার লিস্টেও নাম আছে এবং স্বাভাবিক ভাবেই এন‌আরসিতেও নাম এসে গেছে পরিবারের সবার, শুধুমাত্র সুখদেব ছাড়া, যেহেতু সুখদেব ডিটেনশন ক্যাম্পে আছে । কাজেই সরকার যা বলছে সেটা সত্যি নয়। সুখদেব রী কোনোভাবেই বাংলাদেশি হতে পারে না। সরকারের নির্দেশেই যাকে তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ডিটেনশন ক্যাম্পে'কোটা' পূরণ করাটাই মূখ্য উদ্দেশ্য সেটা স্পষ্ট ছিল আমার চোখের সামনে। সেক্ষেত্রে ‘ভারতীয় বা অ -ভারতীয়' বিচার্য নয়।

    এইবার ‘ভারতীয়’ প্রমাণ করতে হলে ‘সুখদেব রী' কে বা তার পরিবারকে এখন হাইকোর্টেই আবেদন করতে হবে, যা অসম্ভব তাদের পক্ষে। সারা জীবন ‘বিদেশি’ তকমা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে সুখদেব রী’কে।

    চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য আমাদের দেশের আইন কী বলে সেটা জেনে নেওয়া জরুরি। হয়তো ভবিষ্যতে বন্ধুদের কাজে আসতেও পারে :
    Tea Garden Tribes falls in Entry No. 24/50 declared by resolution No. 12011/68/93-BCC © dtd. 10.09.1993. All the members of Tea Tribes shall cover under “Original Inhabitants of Assam” category in respect with the “The Citizenship( Registration of Citizens and issues of National Identity Card) Rules 2003 “under clause 3(3). So, in that case, Sukhdev Ree should be 'Original inhabitant of Assam, a citizen of India.

    ২০২০ সালের ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারি বুধবার সুখদেব রী শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে জামিনে ছাড়া পেলেন। সুখদেব ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সাংবাদিকদয়ের সামনে আমাকে বললেন, “ আপনারা এতোদিন কোথায় ছিলেন ? এখন এসেছেন আমার সঙ্গে কথা বলতে?” ঘর বাড়ি জমি বিক্রি করে 'বিদেশি' হয়েছি, আর এখন এসেছেন আমার সঙ্গে কথা বলতে?” পরেরদিন সকালে সুখদেব ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করে আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। সুখদেব বাবুর মা তাঁকে বকাবকি করেছিলেন আমার সঙ্গে ব্যবহারের জন্য।

    ওনারা ভালোই আছে। মাঝেমধ্যে কথাও হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা ব্যস্ততার খাতায় একটু বিরাম পেলে অবশ্যই সুখদেব - শিশুবালা'র বাড়িতে যাবো । এবার গিয়ে নিজেই চা চেয়ে খাবো ।

    হর্ষ মান্দার সাহেবকে আন্তরিক অভিনন্দন। উনি এগিয়ে না আসলে, সুখদেব যে কবে মুক্তি পেতো বা আদৌ মুক্তি পেতো কি না আমরা জানি না !!
    সুখদেব রী’র খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় পৌঁছে যাওয়ার পর গুয়াহাটিতে আমার পরিচিত একজন সাংবাদিক বিধায়ক দাস মহাশয় সুখদেব রী’র সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। আরেকটি সুখবর, গুয়াহাটি হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ওমান ওয়াদুদ কথা দিয়েছেন আমাকে, উনি বিনামূল্যে সুখদেব রী'র কেস হাইকোর্টে লড়বেন। দেখা যাক কী হয়!! আপাতত সুখদেব বাবু পরিবারের সঙ্গে সুখ-অসুখ মিলিয়ে জীবন কাটাচ্ছে । আর জীবন মানেই হয়তো সুখ-দুঃখের মিলন । আমরা তার সাক্ষী মাত্র ।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৬ মার্চ ২০২১ | ৩৪৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Prativa Sarker | ২৭ মার্চ ২০২১ ১০:০১104131
  • কী যে ভয়াবহ অবস্থা !  


    বইটির প্রকাশনা উল্লেখ থাকলে ভাল হতো। অবশ্য সংগ্রহের তালিকায় পড়ে। 

  • বিপ্লব রহমান | ২৭ মার্চ ২০২১ ১০:২০104133
  • দেশপ্রেমিক দল ও সংগঠনগুলোর উচিৎ হবে জয়দেব ও সুখদেবের কেসস্টাডি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে সর্বত্র তা ছড়িয়ে দেওয়া, সফেদ দাড়ির নব্য হিটলার মোদি কোং- এর মাস্ক বিশ্ব দরবারে উন্মোচন করা। 


    আর ভবিষ্যতে জয়দেব ও সুখদেবকেই ভোটের প্রার্থী করে এনার্সির গালে চপেটাঘাত করা। 


    সেল্যুট কমল চক্রবর্তী, আপনার সাফল্য কামনা। 

  • Somnath Roy | ২৭ মার্চ ২০২১ ১০:২৫104134
  • প্রতিভাদি, বইটি কমল বাবু স্ব-উদ্যোগে সীমিত প্রকাশ করেছেন। 

  • Kamal Chakrabarty | ২৭ মার্চ ২০২১ ২১:৫০104148
  • আমার ব‌ই প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি,২০২১। গুরুচণ্ডা৯'র কাছে আমি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ আমার লেখা ব‌ইয়ের দু'টি ঘটনা এখানে প্রকাশ করার জন্য। আমার এই ব‌ইটির মধ্যে ২২ টি কেস স্টাডি আছে, যাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। তাদের করুণ কাহিনী তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এবং দেখানোর চেষ্টা করেছি, আসামে কীভাবে ভারতীয়দের ধরে ধরে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।


    আপনাদের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা র‌ইল।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:

NRC, Assam NRC, CAA, Detention Camp, BJP NRC, CAA Assam, Assam Bangladeshi
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন