এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি  বুলবুলভাজা

  • আজকের ভারতে অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্পর্ক: স্বাতী ভট্টাচার্য ও অমিত ভাদুড়ীর কথোপকথন (শেষ পর্ব)

    গুরুচণ্ডা৯
    আলোচনা | রাজনীতি | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ২৪৩০ বার পঠিত
  • ফেসবুক পেজ আমরা মনভাসি বেশ কিছুদিন ধরে এমন কিছু আলোচনা সামনে নিয়ে আসছে, যা প্রকৃত অর্থেই মূল্যবান। গত ১১ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক অমিত ভাদুড়ীর সঙ্গে সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্যের একটি কথোপকথন ওই পেজে প্রচারিত হয়। সেই অডিও ভিজুয়াল আলোচনার লিখিত রূপের প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল গুরুচণ্ডা৯-র এই বিভাগে, ২৩ ফেব্রুয়ারি। আজ দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব। এই আলোচনার লিখিত রূপ প্রকাশের অনুমতি দেওয়ার জন্য আমরা মনভাসিকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।

    স্বাতী ভট্টাচার্য— এমএসপি সরকারের হাতে একটা পজিটিভ ইন্সট্রুমেন্ট হতে পারে একটা ভালো উপায় হতে পারে পরিবেশ রক্ষা করার এবং চাষির যা প্রয়োজন এবং সাধারণ ক্রেতার যেটা প্রয়োজন এই সবটা একসঙ্গে ম্যানেজ করার, সবটা পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার। স্যার, আপনার একেবারে গোড়ার যে পেপারটা, সেখানে আপনি যে দুটো কথা বলছেন, যে, যার জমি রয়েছে, যে অন্য লোককে চাষ করতে দিচ্ছে বা যার জমি আছে সে নিজেও কিন্তু চাষি, কিছুটা হয়তো চাষ করে আবার কিছুটা অন্যকে ভাগে চাষ করতে দিচ্ছে বা আজকাল আমরা যেটা বেশি দেখি, ঠিকায় চাষ করতে দিচ্ছে, লিজ নিয়ে চাষ করছে। তো এখানে যেটা হয় যে একটু বড় চাষি আর একটু ছোট চাষি বা প্রান্তিক বা ভূমিহীন চাষি তাদের স্বার্থের একটা সংঘাত—নানা ধরনের সংঘাত তৈরি হয়, যেটা আপনি বলছেন, খুব হাই রেটে, যার জমি তারই হয়তো সারের দোকান, কীটনাশকের এজেন্সি, সেই হয়তো বীজের স্টকিস্ট এবং সে নানা সময় নানা জিনিস ধার দিচ্ছে, বা টাকাই হয়তো ধার দিচ্ছে। এর ফলে একটি সংঘাত হয়, কিন্তু আপনার কি এই কৃষি আন্দোলনটা দেখে মনে হচ্ছে যে এখন যেন কোথাও একটা এই সংঘাতগুলো অতিক্রম করে একটা কমিউনালিটি অফ ইন্টারেস্ট তৈরি হয়েছে, অর্থাৎ একসঙ্গে সবাই এসেছে, নাকি সেটা এখনও হয়নি যেটা আমরা পশ্চিমবঙ্গে বা দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো এখনও সেভাবে সক্রিয় হয়নি এই আন্দোলনে, যতটা উত্তর ভারতের চাষিরা হয়েছে?

    অমিত ভাদুড়ী—নিজেকে অ্যাডভার্টাইজ করা উচিত নয়, কিন্তু আমি ঠিক এর উপরেই একটা লেখা লিখেছি, দিন দু-তিন পরেই বেরোনোর পশ্চিমবঙ্গের টেলিগ্রাফে বেরোনোর কথা। এবার আমি আপনার প্রশ্নে আসি, প্রথম হচ্ছে আমি শুধু নয় আরও অনেকেই যেটা মনে করেছিল, সরকারি ভাবে ঘোষণাও করা হয়েছিল, এরা হচ্ছে বড় চাষি, যারা এসেছে পাঞ্জাব থেকে তারা হচ্ছে বড় চাষি। কথাটা খুব একটা মিথ্যেও নয়। অনেকেই বড় চাষি, বড় এবং ছোট চাষির মধ্যে সংঘাত কেন হয়নি, কেন চাষিদের মধ্যে এক ধরনের একাত্মবোধ তৈরি হয়েছে, তার বড় উদাহরণ হল সেটা না হলে এই আন্দোলন কখনোই এভাবে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত না এবং সেটা যত দিন দিন বাড়ছে, তত আপনি দেখতে পাচ্ছেন এটা ইউপিতে ছড়িয়ে গিয়েছে, পশ্চিম ইউপিতে ছড়িয়ে গিয়েছে, আমি এখন বর্তমানে যেখানে আছি সেই কর্ণাটকে বেশ ইমপ্যাক্ট হয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার চেনাশোনাদের কাছ থেকেও শুনতে পাচ্ছি, ট্রাক্টর মার্চ হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। কারণ লোকে বুঝতে পারছে যে সরকার যেটা চায় সেটা যদি হয়, মানে তুমি জানো নরেন্দ্র মোদী, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কী বলছেন - যে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস ছিল আছে থাকবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে উনি তো অনেক কথাই বলে থাকেন। কতটা সিরিয়াসলি নেওয়া হবে, কতটা নেওয়া হবে না সেটা আলাদা প্রশ্ন। কিন্তু সেটা বাদ দিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও মমতা ব্যানার্জির যেটা অ্যাড্রেস করা উচিত এবং উত্তর দেওয়া উচিত সেটা হচ্ছে শুধু একটা সাপোর্ট প্রাইস দিলেই হয় না, সেই সাপোর্ট প্রাইসে মান্ডির মতো সিস্টেম মানে দোকান যেখানে ছোট চাষি ও বিক্রি করতে পারে এরকম কতগুলো জায়গা পশ্চিমবঙ্গে আছে। আমি যখন ছিলাম তখন ভার্চুয়ালি এসব জিনিস ছিলই না। সুতরাং এইসব প্রশ্ন ওঠেইনি। কিন্তু সেটা বহুদিন আগের কথা। এখন যদি সেটা না হয়ে থাকে তাহলে একটা প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে মিনিমান সাপোর্ট প্রাইস দিলেও সেটা আপনি কোথায় বেচতে পারবেন? এখন পাঞ্জাব হরিয়ানা এবং পশ্চিম ইউপি হচ্ছে একমাত্র অঞ্চল, যেখানে মান্ডি সিস্টেমটা ধান এবং গমের জন্য মোটামুটি ভালোই আছে। এবং আখ — আখের প্রশ্নটা একটু আলাদা। কারণ যারা আখটা কেনে তাদেরই মিনিমাম প্রাইসটা দিতে হবে। এটা সরকারকে দিতে হয় না। সুতরাং আপনি যেটা দেখছেন, সেটা হচ্ছে অ্যাকচুয়ালি গোদী মিডিয়ার ফলস প্রোপাগান্ডা। এবিষয়ে আমি এখন খুবই আত্মবিশ্বাসী। তার কারণ এই আন্দোলন ক্রমশ বাড়ছে এবং আপনি ঠিক বলেছেন, আগে যতগুলো কৃষক আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে দুটো প্রধান ডিমান্ড ছিল, একটা ডিমান্ড এখনও আছে, সেটা হল ঋণ মকুব। কিছু কিছু ঋণ মকুব হয়েছে, কিন্তু ঋণ মকুবের মুশকিলটা হচ্ছে আপনি ঋণ মকুব করলেই কিন্তু আবার কিছুদিন পরে যদি অন্য প্রবেলমগুলোর সমাধান না হয় তাহলে আবার ঋণ হবে। এবং সেই জন্য ফ্রিকোয়েন্টলি আপনি যদি ঋণ মকুব না করেন অন্তত দুতিন বছর অন্তর, তাহলে আবার পুনর্মূষিক ভব — মানে, একই অবস্থা হবে।

    অন্য যে জিনিসটা এই আন্দোলনে বার বার উঠে এসেছে কৃষি আন্দোলন, মানে বামপন্থীরা সবসময়ে যেটা ভেবে থাকেন, জমির লড়াই। জমি নিয়ে লড়াই অর্থাৎ প্রপার্টি নিয়ে লড়াই, অর্থাৎ ডিরেক্টলি যার হাতে জমি আছে আর যার হাতে জমি নেই কিংবা কম জমি আছে, তাদের দুজনকে আপনি ডাইরেক্ট একটা কনফ্রন্টেশনে টেনে আনছেন। কিন্তু এখনকার যে ডিমান্ডগুলো আসছে সেই ডিমান্ডগুলোয় এই জিনিসটা নেই। ভারতবর্ষের নানা জায়গা ঘুরে আমার নিজের ধারণা যে, এই জিনিসটা বিহার বাদ দিলে এবং পূর্ব ইউপির কয়েকটা পার্ট বাদ দিলে বোধ হয় এই দাবি খুব একটা কাজের জিনিসও হবে না। মানে এই ল্যান্ড রিফর্মের আন্দোলন এখনও চালিয়ে যাওয়া খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যেটা অনেক বেশি দরকার সেটা হচ্ছে আপনি যে জিনিসগুলো খুব তাড়াতাড়ি বললেন সেগুলোই—চাষের জন্য যে খরচ সেই খরচগুলো কীভাবে প্রপারলি কন্ট্রোল করা যায় এবং দু-নম্বর কীভাবে কম জল খরচ করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়। এখন আমি প্রায় কনভিন্সড, ইংরেজিতে বললে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট — ভালো করে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট করতে পারা এবং দ্বিতীয় হচ্ছে কোথায় কী চাষ করা হবে তা ঠিক করা। সেইটা অনেক বেশি দরকার। ছোট জমির উৎপাদনশীলতা কীভাবে বাড়বে, সেটা আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া চাই। এবং তার জন্য যে সবচেয়ে বড় জিনিসটা দরকার, আপনি বললেন বলে বলছি, ‘ডেভলপমেন্ট টু ডিগনিটি’-তে এই বিষয়টাই খুব অনুচ্চ ভাবে বলেছিলাম, গ্রামের দিকে আপনি যাদের কাজ দিচ্ছেন, তাদের যদি জমি লেভেল করে দিতে পারেন আপনি যদি ল্যান্ড কনসোলিডেশন করতে পারেন। সেটা তো কোনো সরকার বলেই না।

    স্বাতী ভট্টাচার্য— এটা তো বৈপ্লবিক ব্যাপার।

    অমিত ভাদুড়ী— না, সেটা একেবারেই বৈপ্লবিক ব্যাপার নয়। এগুলোই অ্যাকচুয়ালি করা সম্ভব। বর্গা মুভমেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি, এরপর আবার বর্গা মুভমেন্ট করব কিংবা পশ্চিমবাংলায় প্রচুর শিল্প নিয়ে আসব এসব আজে বাজে কথা না বলে এগুলোই করা উচিত। এটা কেন সম্ভব হবে না? ধরুন আপনার একটা জমি আছে, আমার একটা জমি আছে। আমার জমি তিনটে ভাগে ভাগ, আপনার জমি দুটো ভাগে ভাগ। আপনি আমাকে আপনার জমিতে থাকতে দেন না, আমি আমার জমিটা ছাড়তে চাই না। কিন্তু এক্সচেঞ্জটা একটা ল্যান্ড ব্যাংকের থ্রু দিয়ে কেন হতে পারে না? আপনার জমি যদি বেটার হয় আমি আপনাকে এক্সট্রা পয়সা দেব। এই এক্সট্রা মেকানিজমটা কীভাবে করা যায়? সেটা তো ডেফিনেটলি করা যায়। পাঞ্জাবে করা হয়েছে। আজকে আমরা বলি পাঞ্জাব হরিয়ানার জায়গাগুলোয় এত বেশি উৎপাদন হচ্ছে, ওগুলোও এরকম ফ্র্যাগমেন্টেড ছিল, কিন্তু ওইগুলো প্রতাপ সিং কাইরঁ যখন নিয়েছিলেন, জোরাজুরি করে করেছিলেন...

    স্বাতী ভট্টাচার্য— আপনি বলছেন যে প্রশাসনিক দিক থেকে একটা এমন বৈধ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা দরকার যার মধ্যে ল্যান্ড কনসলিডেশন চাইলে যারা প্রাইভেট ওনার বা ব্যক্তিগত মালিকানা যাদের আছে জমির, তাঁরা চাইলে ওর মধ্যে পার্টিসিপেট করতে পারেন, চাইলে অনেকগুলো জমি একসাথে করে একত্রে চাষ করতে পারেন।

    অমিত ভাদুড়ী— একত্রে চাষ করার দরকার নেই, আপনি ইন্ডিভিজুয়ালিও চাষ করতে পারেন। আপনি সেই জন্যই ভাবছেন বৈপ্লবিক। কিন্তু আমি সেটা ভাবছি না। ধরুন আপনার জমি তিনটে ভাগে ভাগ। আপনার জমিটা আপনি আপনার তিনজন ছেলের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। এরকম হরদম আপনি দেখবেন। এর ফলে জমি এত ফ্র্যাগমেন্টেড হয়ে গিয়েছে যে এতে আপনি ভাল করে জল সরবরাহ পর্যন্ত করতে পারবেন না। আপনি যদি একটা টিউবওয়েল বসান, সব থেকে সহজ একজাম্পল, বা জমিতে আল বসিয়ে আপনি যদি জল নিয়ে আসেন, সেটা তো একটা জমিতে সম্ভব কিন্তু তিনটে জমিতে তো সম্ভব নয়। গ্রামে ঘুরলে আপনি দেখবেন এগুলো এক্সটেন্সিভ প্রবলেম। এবং এই প্রবলেম এতদিন ধরে চলে আসছে এবং এত বেশি—এটা ঋণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই ঋণ নিয়ে কথা বলি, কারণ ঋণটা বলা খুব সহজ। কিন্তু এই জিনিসগুলোকে স্পট করে কাজ করতে পারাটাই আসলে সত্যিকারের কৃষিতে চ্যালেঞ্জ।

    স্বাতী ভট্টাচার্য— আপনি এনআরইজিএ-র প্রসঙ্গটা বললেন। সেখানে আমি একটু বলি, আপনি যেটা বলছেন সেটা ঠিকই। উচিত হচ্ছে, দরিদ্র মানুষদের উৎপাদনের মধ্যে নিয়ে আশা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। কিন্তু তারপরেও আমাদের গ্রামগুলোতে মস্ত বড় লেবার ফোর্স বা শ্রমিক বাহিনী রয়েছে যারা নানা সময় নানা কাজ করে, কৃষিমজুর হিসাবেও কাজ করে এবং এখন তো এই অতিমারীর পরে অনেক বেশি চাহিদা বেড়ে গেছে এমন কাজের, যেটা তারা গ্রামে থেকে করতে পারে। ফলে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই আমরা দেখেছি যে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কয়েক লক্ষর বেশি লোক যারা আগে কখনও নাম লেখায়নি, তারা এখন জব কার্ডের জন্য আবেদন করেছে। এনআরইজিএ-এর জব কার্ড পাওয়ার জন্য। এটা হচ্ছে একটা এমন সময়ে যখন কেন্দ্র কিন্তু এনআরইজিএ-র বরাদ্দটা টেকনিকালি বলতে হয় বাড়াচ্ছে না, কিন্তু বাস্তবিক কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় যে কমছে। এইটার সলিউশন আপনি কী দেখতে পান বা এই সমস্যাটাকে আমরা কীভাবে বুঝব?

    অমিত ভাদুড়ী— দেখুন আপনি আমাকে যে প্রশ্নটা করেছেন তার কোনো উত্তর আমার কাছে আছে কি না আমি জানি না। কিন্তু আমি দুটো জিনিস বলছি। প্রথম হচ্ছে, কিছু লোককে আপনাকে জাস্ট জমি চাষ করার থেকে বাইরে বার করতে হবে। সেটা ঠিকই। কিন্তু তাদের আপনি ইন্ডাস্ট্রিতে এনে চাকরি দেবেন এটা আপনি অত্যন্ত বোকা বা কাণ্ডজ্ঞানশূন্য না হলে বলবেন না। অ্যাকচুয়ালি সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের পরে সিপিএমের যে ডিজাস্টারটা হল, তার কারণ হল, আমার মনে আছে, তখন তো অনেকে আমার কাছে কলেজে পড়ত, এরা যেটা একেবারেই বুঝতে পারত না যে, আপনি বড় শিল্পে কত লোককে চাকরি দেবেন? কারণ তার প্রোডাক্টিভিটি অনেক বেশি, সেখানে অনেক বেশি ক্যাপিটাল খরচ করতে হয়। সিঙ্গুরে প্রথম যখন ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল, আমি বিষয়টাতে যুক্ত ছিলাম। বলা হয়েছিল ১৯০০ লোককে চাকরি দেওয়া হবে। তার বদলে ১৭০০০ লোকের জমি চলে যাবে। সুতরাং, আমাদের দেশে এমপ্লয়মেন্ট প্রবলেম সলভ করার জন্য জমি নিয়ে নিয়ে আমি সেটা ইন্ডাস্ট্রিকে দেব, এটা একধরনের বাতুলতা। তাহলে সলিউশনটা কী? আমার মনে হয় দুটো জিনিস করা যেতে পারে। একটা হল, আপনি যেহেতু অতিমারীর কথা বললেন, কয়েকটি পরিষেবার জায়গা আছে যেখানে ৬-১২ মাস ট্রেনিং দিয়ে আপনি তাদের চাকরি দিতে পারেন। যেমন ধরুন এলিমেন্টারি নার্সিং, ছেলেদের জন্যও, মেয়েদের জন্যও। এলিমেন্টারি ওল্ড পিপলস কেয়ার, এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ানো, এলিমেন্টারি খাবার তৈরি। নানা ধরনের সার্ভিস যেগুলো গ্রামের দিকে দরকার, সাধারণ লোকের যেগুলো খুব বেশি দরকার, সেই সার্ভিসগুলো দিতে পারেন। এবং এর থেকে প্রচুর এমপ্লয়মেন্ট জেনারেট করতে পারেন। বিশেষত আমার নিজের ধারণা, স্বাস্থ্যর ব্যপারে এত বেশি এমপ্লয়মেন্ট জেনারেট করা যায়, কিন্তু তার কিছুই করা হয়নি।

    আর-একটা জিনিস যেটা সম্ভব তা হল, আমাদের মতো মোটামুটি সচ্ছল মধ্যবিত্তরাও তো আছে, তারা বাড়িতে লোকজন রাখে বাড়িতে চাকরি দেয়, এগুলোকে কেন ইউনিয়নাইজ করা হয় না? এগুলোকে আপনি ইউনিয়নাইজ করতে পারেন এবং এগুলোকে আপনি সার্ভিস হিসেবে ট্রিট করতে পারেন। যেমন ধরুন দশ ঘণ্টা কাজ করবে তার বিনিময়ে সে একটা পারিশ্রমিক পাবে। তার জন্য মিডল ক্লাস ক্যান বি টোল্ড টু, ইউ নো? সার্ভিস সেক্টর মানে আইটি নয়। এই জাতীয় সার্ভিস হচ্ছে সব থেকে বড় এরিয়া, যাতে আপনি প্রচুর এমপ্লয়মেন্ট দিতে পারেন। এটা আমাদের দেশের বেলায়ও সত্যি, এটা ইউরোপের বেলায়ও সত্যি। আমি ইউরোপটা মোটামুটি বেটার জানি। আমেরিকার কথা আমি বলব না, আমেরিকায় প্রচুর ইমিগ্রেশন থাকে, অনেক রকম প্রবলেম আছে। কিন্তু ইউরোপের বেলায় আমি বলব এটা সত্যি এবং আমাদের মতো দেশের বেলায় এটা আরও বেশি সত্যি। আপনি যেহেতু গ্রামের মধ্যেই নানারকম কাজের কথা বলছেন, তার একটা সবথেকে ভালো একজাম্পল হচ্ছে এটা। রিসেন্ট স্টাডি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতবর্ষের অল ইন্ডিয়ায় ফিগার হচ্ছে ৮২% অফ দ্য রুরাল হাউসহোল্ডের ২ হেক্টরের নীচে জমি এবং তার মধ্যে ৬০%-এর জমির পরিমাণ ১ একরের নীচে, যা দিয়ে চাষ করা যায় না। দু-একটা ফসল হয়তো ফলানো যায়, কিন্তু তা দিয়ে কোনো শস্য চাষ হয় না, এত কম জমি। কিন্তু এসব লোক বেঁচে থাকে কী করে? এইসব লোকেরা বেঁচে থাকে ওইসব নন-এগ্রিকালচারাল জব ইন দ্য রুরাল এরিয়া, এটা হচ্ছে প্রায় ৫৫% টু ৬০% ইনকাম ভারতবর্ষে এবং এগুলোর কিন্তু কোনো স্ট্যান্ডার্ডইজড ফর্ম নেই, এগুলোকে আমরা ইনফরম্যাল সেক্টর বলে ছেড়ে দিই এবং ডিমনিটাইজেশন-এ এদের সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু এই জিনিসগুলোকে যদি আমরা মন দিয়ে যোগ করি — লোকে তো আর এমনি এমনি বেঁচে থাকে না! ঘরামিকে বাড়ি বানাতে হয়, আজকাল অনেক জায়গায় ইলেক্ট্রিসিটি এসে গেছে, ইলেকট্রিশিয়ান দরকার হয়, পাম্প নষ্ট হয়ে গেলে পাম্প ঠিক করা দরকার। এগুলোর জন্য আপনাকে কেন শহরে আসতে হবে? এগুলোর জন্য কী লাগে? বড় শিল্প লাগে, টাটাকে ডেকে আনব, এইসব না করে যদি ওরা এগুলো চেষ্টা করত, তাহলে নিশ্চয়ই এগুলো করা যায়। আমি বিশ্বাস করি না যে এগুলো প্রচণ্ড শক্ত জিনিস। এগুলো হচ্ছে সত্যিকারের উন্নতি বলতে যা বোঝায়, মানে আজকে আমি পশ্চিমবঙ্গে ডেভেলপমেন্ট বলতে যা বুঝি। অর্থাৎ, আজকে আমি পশ্চিমবঙ্গে এই অবস্থা আছি, কালকে আমি জার্মানির মতো হয়ে যাব, বা জাপানের মতো হয়ে যাব—এটা তো আর সম্ভব না। যা স্টেজ আছে, এই স্টেজে এটাই সম্ভব। জমিকে কনসোলিডেট করুন। ছোট ছোট জলের ব্যবস্থা করুন।

    স্বাতী ভট্টাচার্য— আপনি যেটা বলছেন, সেগুলো একেবারেই ঠিক, এবং আমরা যারা গ্রামে গিয়ে ঘুরি, কথা বলি, আমরাও বুঝতে পারি এক এনআরইজিএ প্রকল্প দিয়ে কাজের এই বিশাল চাহিদা মেটানো খুব কঠিন হবে এবং তাতে এ প্রকল্পে দুর্নীতিই কেবল বাড়বে, যে কাজ নেই সেগুলোকেও কাজ বলে দেখানো হবে। ফলে আপনার কথায় বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ও অন্যান্য ছোটখাটো সার্ভিসে প্রচুর কাজ তৈরি করা যায়, সেই কাজগুলোতে মানুষকে নিয়োগ করলে, বিশেষত মেয়েদের নিয়োগ করলে সেখানে একটা তাদের রোজগারের বড় নিরাপত্তা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু স্যার, এখানে একটা সমস্যা আমরা দেখি। এমনকি সরকারও কিন্তু ন্যূনতম মজুরি যা হওয়া উচিত, সেটা দেয় না, যার জন্য একজন মিড ডে মিল কর্মী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে, কিন্তু এখনও ১৫০ জন ছেলেমেয়ের জন্য রেঁধে দিনে মাত্র ৪০ টাকা রোজগার করে...

    অমিত ভাদুড়ী— সত্যিই এত কম?

    স্বাতী ভট্টাচার্য— হ্যাঁ। কারণ সে মাসের শেষে যা পায় তাকে যদি আপনি ২৭ বা ২৬ দিন দিয়ে ভাগ করেন তাহলে আমরা দেখেছি সেটা ৪৫ টাকা থেকে ৭০ টাকার মধ্যে দাঁড়ায়। আপনি তো জানেন আশা কর্মীদের কী অবস্থা, তাঁরাও অত্যন্ত কম টাকা পান, তাঁরা ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কাজ করলেও, অর্থাৎ মাটি কাটার কাজেও যে টাকা পেতেন, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের এতগুলো মানুষকে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিয়েও সে টাকা তারা পান না। আপনি জানেন ঠিকা কাজ যাদের দিয়ে করানো হয়, কী পরিমাণ সুরক্ষার অভাব নিয়ে তাদের কাজ করতে হয়, কী পরিমাণ শোষণ চলে, সেটা তো আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের দিয়েই বুঝতে পারলাম। আর-একটি প্রশ্ন —পশ্চিমবঙ্গে মানুষ যে মান্ডিতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করবে, তার দূরত্ব এত বেশি যে সে নিয়ে যেতে পারে না।

    অমিত ভাদুড়ী— যেটা আমি বললাম যে শুধু মিনিমাম প্রাইস দিলেই হয় না, যদি যথেষ্ট মান্ডি না থাকে। সেটা একমাত্র পাঞ্জাব ছাড়া আর কোথাও নেই।

    স্বাতী ভট্টাচার্য— আমাদের রাজ্যে অবশ্য ১৮৬ টা কৃষক বাজার এখনও অবধি তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। তবে সবকটাই যে খুব সচল সক্রিয়, তা নয়। সবকটা ব্লকেও এখনও তৈরি করা যায়নি। আমাদের তো চারশোর উপর ব্লক। আমরা আলোচনার প্রায় শেষে পৌঁছে গিয়েছি। আপনি নিজে যদি কিছু বিষয় উল্লেখ করতে চান, তাহলে সেটা নিয়ে কথা বলার পর আমরা শেষ করব।

    অমিত ভাদুড়ী— আমি দুটো জেনারেল জিনিস বলি, স্পেসিফিক কিছু না বলে। একটা হল, আমি বেশ কিছুদিন স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় নরওয়ে, সুইডেনে, বিশেষত নরওয়েতে থেকে থেকেই পড়াতে যেতাম একটা ইউনিভার্সিটিতে। সুইডেনেও। তখন আমি প্রথম ওইসব দেশে লোকে কেন সোশ্যাল ডেমোক্রাসিতে এত সাকসেসফুল হয়েছিল, সেইটা নিয়ে ওখানকার বন্ধুবান্ধবদের সাথে আলোচনা করি এবং বেশ কিছু পড়াশোনাও করি। তখন আমার যে জিনিসটা স্ট্রাইক করে, সেটা হল নাইন্টিন টোয়েন্টিজ-থার্টিজ-এ ওরা দুটো জিনিস করে। প্রথমত ওরা বলে যে উই আর নট গোইং টু সোশ্যালাইজ আওয়ার মিনস অফ প্রোডাকশন, মানে আমাদের ক্ষেত্রে যেটা জমি, বাট উই উইল সোশ্যালাইজ কনজাম্পশন। তার মানেটা কী? তার মানেটা হচ্ছে গিয়ে, শুধু আমরা ইনকাম ডিস্ট্রিবিউশন ট্যাক্স করে করব, তা নয়। সেটা ওরা করেছিল, কিন্তু সেটা অনেক পরে। কিন্তু ওরা প্রথম যেটা করে, সেটা হল ওরা বলে যে, ওয়েজের একটা বড় পার্ট হবে সোশ্যাল ওয়েজ। মানে ধরুন, আপনি যে এরিয়াতে আছেন, সেটা কলকাতা শহরই হোক বা একটা গ্রামেই হোক, সেই এরিয়ার লোকাল স্কুলে আপনার ছেলেমেয়ে পড়বে। সেই এরিয়ার লোকাল ডাক্তারের কাছে আপনাকে প্রথম যেতে হবে, তারপর তিনি যদি বলেন তখন আপনি অন্য হাসপাতালে যাবেন। এতে যাদের সব থেকে বেশি লাভ হবে, তারা হল গরিব লোক। এবং আপনি যদি সরকারি চাকরি করেন, তাহলে আপনাকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করতে হবে। আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম, একদম শেষের দিকে হলেও যে প্রধানমন্ত্রী ট্রামে করে অফিস যাচ্ছেন। তিনি একজন মোটাসোটা ভদ্রমহিলা, হয়তো এভাবে বলা উচিত না, যাইহোক, তিনি ছুটে ছুটে ট্রাম ধরে সময়মতো কাজে পৌঁছোচ্ছেন। আপনি এই কতগুলো জিনিস আমাদের দেশে চালু করে দিন। আপনি দেখবেন অটোম্যাটিক্যালি করাপশন কমছে। এই যে আমরা এত ধরনের করাপশনের কথা বলি... নানা ধরনের করাপশন তো সবাই করছে! আপনি দেখবেন গাড়ি ছাড়া আপনি যেতে পারেন না। অথচ বাসেট্রামে অসম্ভব ভিড়! আপনাকে যদি সেটা পাঁচ দিন করতে হয় আপনার ইন্টারেস্ট চলে আসবে। আপনার কতগুলো সিলেক্টেড স্কুল! দুর্নীতির সঙ্গে সোশ্যালাইজেশন অফ কনজাম্পশন অর্থাৎ ওয়েজের একটা বড় অংশ শুধু টাকায় না দিয়ে আমি লোকের কাছে লোকালি যা সম্ভব সেটা পৌঁছে দেব, এইটা হচ্ছে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সবথেকে বড় ব্লেসিং, আমি মনে করি, যদি এটা করা যায়। আমি ভিয়েতনামেও ছিলাম। সেখানেও দেখেছি, এখন অনেক কমে গিয়েছে, কিন্তু একটা সময় থাকে যখন এইসব দেশেই এই জিনিসগুলো সব থেকে এক্সট্রাঅর্ডিনারি ভাবে লোকের মধ্যে সাড়া দেয়।

    আমাদের দেশে এসব ভাবা বাতুলতা। কিন্তু শুধু বড় বড় কথা না বলে এগুলোর কিছু কিছু তো করা যেতে পারে। এবং আমি যেটা বুঝতে পারি না, আমরা সর্বজনীন পূজা নিয়ে এত হইচই করি, আমাদের যে কমিউনিটি ফিলিং নেই তা নয়। আমাদের মধ্যে সর্বজনীনতা আছে। কিন্তু সেগুলো কী করা হয়, সেগুলো শুধু পুজোকেন্দ্রিক। এই যে ধরুন রাম মন্দির করা হচ্ছে। এই করেই তো সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোকে কী করলে লোকাল লোকের এবং নিজের ভালো হবে, সেইটা যদি ঠিক করা যায়, তাহলে আমার নিজের ধারণা অনেকটা করা সম্ভব। এটা কিছুটা যেমন ইকোনমিক্সের প্রশ্ন, কিছুটা আবার সংস্কৃতিরও প্রশ্ন। আপনি টাকা দিতে রাজি হচ্ছেন গ্রামের ক্লাবকে, আমি জানি না, ভোট করার জন্য বা কী জন্য। কিন্তু আপনি সেই টাকাটা এতদিন ধরে অন্য কাজে দিতে পারেননি, যাতে কমিউনিটিতে অন্য কোনো কাজের কাজ হয়। তাই দিয়ে আপনি কিছুটা কমিউনিটি ফিলিং তৈরি করতে পারেননি? এটা তো শুধু এই সরকার নয়, অন্য সরকার তো আরওই খারাপ ছিল, পার্টির বাইরে কিছুই ভাবত না। কিন্তু এই যে জিনিসগুলো এইটা যারা সত্যিকারের সোশ্যাল ডেমোক্রেসি চালু করেছিল, কিংবা প্রথম দিকে সত্যিকারের বিপ্লব করেছিল, যেমন আমার নিজের চোখে দেখা ভিয়েতনাম, কারণ আমি ওই বিপ্লবের শেষের দিকেই ছিলাম। তাদের পক্ষে তো এগুলো অসম্ভব নয়। তারা তো করেছে। এবং তারা যে খুব এক্সট্রাঅর্ডিনারি লোক, তারা যে দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, এমনটা নয়। সবই ছিল। আমি সিস্টেমটা বদলানোর কথা বলছি না, কিন্তু সিস্টেমটা যদি না জানে যে সে কী করতে চায়! যেমন আপনি বললেন না, জমির কনসোলিডেশন? একবার যদি শুরু করা হয়, একটা অঞ্চল ধরে, তখন দেখা যাবে এটা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়। একটা সরকার যদি ঠিক করে যে এটা করবে, তাহলে এমন কিছু অসুবিধা নেই। এইটা হল একটা বিষয়— সোশ্যাল ওয়েজ শ্যুড বি আ পার্ট অফ দ্য হোল নোশন অফ হোয়াট ইস ওয়েজ। এবং সেজন্য সরকারকে শিওর হতে হবে সরকারি হাসপাতাল, স্কুল, এগুলোকে এমন ভাবে করতে হবে যতে সত্যি সত্যিই সবথেকে গরিব লোকেরদের সুবিধা হয়।

    আর দ্বিতীয় যে জিনিসটা আমি বলতে চাই, ঋণ মকুব ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ের সবগুলোই যদি আপনি কোথায় টাকা খরচ হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে দেখেন তাহলে সত্যি সত্যি কিছুটা ঋণ মকুব করা, কিছুটা গরিব লোকেদের জন্য আরও সুবিধা বাড়ানো এমন কিছুটা একটা ভয়ংকর শক্ত জিনিস নয়। খুব একটা বেশি হয়তো আপনি বাড়াতে পারবেন না। কিন্তু কিছুটা বাড়াতে পারবেন। শুধু আপনাকে ঠিক করতে হবে কার কনজাম্পশন কমিয়ে কার কনজাম্পশন বাড়াবেন। সেইটা আসলে আমরা কেউই চাই না। সেটা আপনি আমাদের দেশের এমপি এমএলএ-দের মাইনে দেখলেই বুঝতে পারবেন। আমারই চেনা সিপিএম-এর মিনিস্টার যাঁরা আগে বাসে-ট্রামে চড়তেন, এখন গাড়ি ছাড়া চলতে পারেন না। প্রচুর বড়লোক দেশে মানে যেগুলো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দেশ, কমিউনিস্ট দেশে অন্যরকম সমস্যা আছে, সেগুলো আমি বাদই দিচ্ছি, কিন্তু সেখানে তো এই সমস্যা এত তাড়াতাড়ি দেখা দেয়নি। এই সমস্যা আমাদের দেশে কেন এত দেখা দিচ্ছে? তার একটা কারণ হচ্ছে ওপরের দিকে সব বললেও আমি বলব মমতা ব্যানার্জির একসময় প্রচুর নিজের সাহস ছিল, ইন্ডিভিজুয়ালি কারেজ যাকে বলে, নার্ভ এবং কারেজ দুটোই ছিল। আর-একটা জিনিস হল পার্টি যাই করুক, মমতা ব্যানার্জি সাধারণ মানুষের মতো থাকতেন। এখন অবশ্য কী করেন আমি জানি না। তবে এইগুলো মানুষের কাছ আবেদন রাখত। এইগুলোর জন্যই তো মমতা ব্যানার্জি, ধরুন সুব্রত মুখার্জি বা অন্যদের তুলনায় মমতা ব্যানার্জি যে এত বেশি লোকের মধ্যে জনপ্রিয় তার এই দুটোই প্রধান কারণ। মানে মতাদর্শ তেমন কিছুই ছিল না। যদিও এমন ভাবে বলা উচিত নয়, কিন্তু আমি এগুলো দেখেছি, শুনেছি। অরিজিনালি তো উনি কিছুই ভাবতে পারতেন না। কিন্তু এগুলো তো করতেন। নিজের ওই সাহস, নার্ভ প্লাস একধরনের সিমপ্লিসিটি। সেইটা যদি কিছুটা পার্টি হিসেবেও লোকের উপরে সত্যি সত্যি এনফোর্স করা যায়। এবং আর-একটা হচ্ছে লটারি সিস্টেম। মানে আপনি ধরুন ফ্ল্যাট তৈরি করলেন গরিবদের জন্য, যে ইঞ্জিনিয়ার তাঁকে বললেন তুমি এর মধ্যে একটা ফ্ল্যাট পাবে। কিন্তু কোন্‌ ফ্ল্যাট তা আগে বলা হবে না। এটা লটারি সিস্টেমে তৈরি হবে। এই স্কুলগুলোর একটায় তোমার ছেলেমেয়ে যাবে, কিন্তু কোন্‌টায় আমি বলতে পারব না। আগে তো এই বিল্ডিংগুলো করো, তারপর কোনো একটা বিল্ডিংয়ে পাবে তা দেখা যাবে। এবং আপনি দেখবেন, লটারি সিস্টেম দিয়ে এধরনের দুর্নীতি অনেক কমানো যায়। কিন্তু এইধরনের সহজ জিনিস করার জন্য দরকার সরকারের যারা উপরতলায় আছে তাঁদের দিয়ে শুরু করা। তা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সাধারণ লোককে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

    স্বাতী ভট্টাচার্য— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমাদের মনের খুব কাছের একটা কথা বলেছেন। আমরা বারবারই দেখি যে সার্থক অর্থনীতি বা সার্থক রাজনীতি — এই দুটোরই মূলে রয়েছে শেষ অবধি অন্যের দুঃখের অন্যের অসুবিধার সহভাগী হওয়ার একটা ইচ্ছা। স্বেচ্ছায় অন্যের দুঃখটা বুঝতে পারা এবং সেটা ভাগ করে নেওয়া, এটার মানসিকতা যেন সব কিছুর একেবারে মূলে রয়েছে। তা থেকেই ভালো রাজনীতি ভালো অর্থনীতি হয়। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমরা এটাও লক্ষ করি যে এই যে দলীয় রাজনীতি বা দলাদলির রাজনীতি এবং এই যে নির্বাচনে একটা বিপুল টাকা খরচ, এখন যেমন ভোট হয় না, ভোট করানো হয়, এই পুরো জিনিসটা যেন মানুষের যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অন্যকে সাহায্য করার অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার, সেখানে একটা বাধা তৈরি করেছে। আর আপনি যেটা বারবারই বলছেন যে রাজনীতিই পারে এখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে একটা কিছু করার। সেটা লটারি সিস্টেমের মতো করেই হোক—যে আমি জানি না কে পাবে, হয়তো আমিও তার মধ্যে আছি, হয়তো পাব, হয় তো পাব না। সেম চান্সেজ, এই ফেয়ারনেসটা যেন আমাদের সমাজ থেকেও আমরা যথেষ্ট অনুশীলন করতে পারছি না। আমাদের সবাই মিলে করতে হবে। আমাদের ক্ষমতা আছে। মানুষ একসঙ্গে হয়ে কত কিছু করে ফ্যালে, পুজো থেকে শুরু করে আরও অনেক সমাজসেবার কাজ, যেটা আমরা অতিমারীর সময় দেখলাম। কী অসামান্য ভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ছাত্র যুব সংগঠনগুলো। দলীয় নয় সম্পূর্ণ নির্দলরাও অনেক করেছে। আবার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও করেছে। অথচ যখন এই অর্থনীতির প্রশ্ন আসে তখন সব কিছুই কেমন যেন স্বার্থগোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায়।

    অমিত ভাদুড়ী— ঠিক বলেছেন। একেবারে ঠিক বলেছেন। আসলে কোপিং উইথ আ ডিজাস্টার যাকে বলে... মানে খুব বড় একটা বিপর্যয় হল সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজ করলাম, এটার জন্য যে ধরনের মানসিকতা আর একটা কোথাও সাস্টেইন্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য মানসিকতা, যেটাকে আপনি বলছেন অর্থনীতির ব্যাপার, মানে কীভাবে একটা গ্রামের উন্নয়ন করব — এদুটো জিনিস এক নয়। এবং এ দুটোর মানসিকতাও এক নয়। এবং দ্বিতীয় মানসিকতাটা শুধু পার্টি-পলিটিক্সে যদি আপনি জোর দেন যে আমার পার্টির লোকরাই করবে, তাহলে হবে না। সাধারণ লোক কোনো পার্টির লোক নয়, এবং তাদের জন্য আপনাকে সাধারণ লোকদের অংশ হিসেবে বুঝতে হবে।

    স্বাতী ভট্টাচার্য— এটাই আজকের ভারতে রাজনীতি এবং অর্থনীতির সম্পর্ক। এটা নিয়েই আমরা শুরু করেছিলাম এবং এখানে এসেই আমরা শেষ করলাম। আমি অনেক অনেক ধন্যবাদ দিই অধ্যাপক অমিত ভাদুড়িকে আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য। এবং মনভাসিকেও আমি আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ জানাই এই আলোচনার আয়োজনের জন্য।

    অমিত ভাদুড়ী— আমিও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং সেই সঙ্গে আমি এটাও বলছি যে বিশেষ না ভেবে বা আগে থেকে তৈরি না হয়ে কথা বলতে ভালোই লাগে, কিন্তু তার থেকে অন্যলোকের কোনো উপকার হয় কি না আমি জানি না। তবে নিজের উপকার হয়। ধন্যবাদ।

    স্বাতী ভট্টাচার্য—ধন্যবাদ স্যার।



    গুরুচণ্ডা৯-র গ্রাহক হোন


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ২৪৩০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Anindita Roy Saha | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:০৬103082
  • ভারতবর্ষে কর্মসংস্থানের মতো অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির পেছনে বিপুল জনসংখ্যারও একটা ভূমিকা আছে। সেই দিকটাও যোগ করে ভাবা দরকার। 

  • শিক্ষিত বেকার হার্মাদ | 2409:4060:31d:5d84:80af:c900:e323:14fc | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৩:২৭103109
  • আমরা বড়ো শিল্প না করলে, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষমতা না বাড়ালে স্মার্টফোন গাড়ী ট্র্যাক্টর পাম্প  কম্পিউটার ইলেকট্রিসিটি মোবাইল টাওয়ার ইন্টারনেট  এসব কোথা থেকে আসবে? চীন আমেরিকা ইউরোপের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবো কি আমরা চিরকাল? আমরা কি শুধু চাষ করে যাবো? তাহলে পড়াশুনা করে লাভ কি? এডুকেশন সেক্টর, বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গুলো তুলে দেওয়াই ভালো। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা না করার জন্য ভারতবর্ষ ব্রিটিশের অধীন হয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা না করে এই পৃথিবীতে স্বাধীন দেশ হিসাবে টিকে থাকা যাবে কি? 

    শিল্প না করলে, প্রযুক্তির উন্নতি না হলে, মেডিকেল সেক্টরে যে কোটি কোটি টাকা দিয়ে আমেরিকা জার্মানি থেকে ইকুইপমেন্ট আমদানি করতে হয় সেটা আমাদের এখানে কোনোদিন তৈরি করা যাবে না, সারাই করা যাবে না। আমদানি করা কোটি কোটি টাকার  ইকুইপমেন্ট  আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যাবে? ওই আমদানি করা যন্ত্রের টাকাটা তো রপ্তানি হয়ে গেলো বিদেশে চলে গেলো। আমরা কি রপ্তানি করবো? শিল্প না হয়েও কি বেকার নেই? আরবান unemployment আজকে মারাত্মক আকার নিয়েছে। শিক্ষিত বেকার রা এখন চায়ের দোকান বা সবজি বাজার নিয়ে রাস্তায় বসছে। যে উদাহরণ তৈরি হচ্ছে তা থেকে ছোট বাচ্চারা শিখছে যে পড়াশুনা করে কোনো লাভ নেই, অশিক্ষিত থাকাই ভালো। এই মুড়ি মিছরি এক দর ব্যবস্থা আসলে সমাজের চূড়ান্ত অবক্ষয়। শিল্প না হলে,  শিক্ষিত বেকার চাকরি না পেলে অবক্ষয় আরো বাড়বে। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:

Singur Land Movement, Farmers Movement, MSP, Singhu Border, Singur and Singhu, Delhi Farmers, Punjab Farmers, Corruption In India, Water Management In Farm land
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন