বন জঙ্গল, পাহাড় টানত অনেক আগে থেকেই। স্কুলে থাকতেই আমাদের শেরপুরে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত ঘেঁষে যে পাহাড় গুলো আছে তা জয় করা শেষ করে ফেলেছিলাম। সাইকেল নিয়ে পাহাড়ে চলে যাওয়ার মত ঘটনা আমাদের অনেকের জীবনেই স্বাভাবিক ছিল। একটু বয়স হতেই বুঝতে পারি আমাদের সীমান্তে যে পাহাড় গুলো আছে তা ঠিক পাহাড় না, মাটির উঁচু টিলা বলা যেতে পারে বড় জোর। তখন থেকেই আফসোস শুরু আমাদের। সমস্ত বড় পাহাড় নিয়ে নিছে ভারত। এরপর সিলেট গিয়েও একই অনুভূতি হয়েছিল আমার। মনে হয় রেডক্লিফের কাঁচি বেছে বেছে আমাদেরকে বাদ দিয়ে সমস্ত পাহাড় দিয়ে দিয়েছে ভারতকে। আফসোস হত, দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। এরপর বগালেক, কেউকারাডং দেখে প্রথম তৃপ্তি পেলাম, চোখ ও মনের শান্তি আসল। আর তখনই জানলাম বান্দরবনের অপার সৌন্দর্যের কথা। জানলাম এ কিছুই না। এর ভিতরে লুকিয়ে আছে নানান মনি মুক্তা। বদি নামের আমাদের এক বড় ভাই বন্ধুর কাছে জানলাম তার রুদ্ধশ্বাস সব ট্র্যাকিঙের গল্প। গহীন বনের মাঝে কী অলৌকিক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তার প্রথম খবর পাই বদির কাছেই।
কিন্তু ট্র্যাকিং? এই জিনিস আমার দ্বারা হবে? ভাবি কিন্তু কুল কিনারা পাই না। সাহস করি কিন্তু সঙ্গী পাই না। বদি ততদিনে সব দেখে একটু জিরাতে বসেছে। আমার কপালে সঙ্গী জুটে না। এরপর বহু পানি গড়াল, জীবনে নানান উত্থান পতন আসল। আব্বা অসুস্থ হলেন, আমি ঢাকা ছেড়ে শেরপুরে স্থির হলাম। আব্বার সাথে সর্বক্ষণ আমি থাকি। আমার আর কোন কাজ নাই। এর ফলে যা হল তা হচ্ছে আমার ঘর থেকে দূরে কোথাও যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। গত তিন বছর দশ মাস আমি একটা রাত বাড়ির বাইরে থাকিনি। যে আমি পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি সেই আমি ঘরের বাহিরে যেতে পারি না। এর মধ্যে সোহাগের সাথে পরিচয়। জিডিএমের দেখা পেলাম। বুঝলাম স্বপ্ন পূরণ যদি সম্ভব হয় তাহলে জিডিএমের মাধ্যমেই হবে। সোহাগকে ওর কোন পোস্টের নিচে মন্তব্য করে ছিলাম যে সুযোগ পাওয়া মাত্র ওদের সাথে বান্দরবনের গহীনে চলে যাব। আমি সুযোগ বলতে কী বুঝিয়েছি জানি না। তবে যে সুযোগ পেলাম তা যে আমি চাইনি তা পরিষ্কার। আব্বা চলে গেলেন অক্টোবরের একুশ তারিখে। আমি হলাম পরিপূরণ বেকার। এখন আমার দুনিয়া ঘুরে দেখলেই ফেরায় কে? এই চার বছরে আমি আব্বার সাথে এমন একটা রুটিনে চলে গেছিলাম যে আমার জন্য এই রুটিন হয়ে দাঁড়াল কষ্টদায়ক। আমি এর থেকে বের হতে চাচ্ছিলাম। খবর পেলাম নভেম্বরের পনেরো তারিখ জিডিএম আমিয়াখুম, নাফাখুম যাবে। সোহাগের সাথে সম্ভবত দুই একটা কথা বলেই টাকা পাঠিয়ে নিজের জন্য জায়গা ঠিক করি। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই ভ্রমণ আমার জন্যই হচ্ছে। ওই মুহূর্তে আমার চেয়ে বেশি সম্ভবত আর কেউ চাচ্ছিল না সমস্ত চেনা জগতের বাহিরে, সমস্ত নেটওয়ার্ক থেকে দূরে যেতে। আমি আমার মাঝে ডুবে থাকতে চাচ্ছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত পনেরো তারিখের ট্যুরটা বাতিল হয়ে যায়। সোহাগ আমাকে টাকা ফেরত নেওয়ার বা অন্য ট্যুরে যাওয়ার জন্য বলে ছিল। আমি কোনটাই করি নাই। আমি এই ট্যুর কবে হবে জেনে তার জন্যই অপেক্ষা করব বলে দেই। নিজের শরীর নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম, চার বছর বাড়িতে বসে থেকে ঘুণে ঝরেঝরে অবস্থা আমার। তাই শুরু হল মাঠে ধাপাধাপি। এর উপকার বান্দরবনে শত ভাগ পেয়েছিলাম।
যাওয়ার আগে আগে যুক্ত করলাম সারোয়ার ভাইকে। আমার যুক্ত করার আসলে কিছু ছিল না। উনাকে বলা মাত্রই বুঝলাম কাজ হইছে, এই লোক যাচ্ছে। আমার পুরো ভ্রমণে সারোয়ার ভাইয়ের উপস্থিতি বাড়তি শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আমি কেমন মানসিক অবস্থা নিয়ে গিয়েছি তা সারোয়ার ভাই আর সোহাগ ছাড়া পুরো গ্রুপের আর কেউ জানত না। সে যাই হোক, যাত্রা শুরু হল। ঢাকা থেকে বান্দরবন বা থানচি যাওয়ার বর্ণনা দেওয়ার কিছু নাই। যেটা দেওয়া যায় তা হচ্ছে জিডিএমের যাত্রাপথে আতিথেয়তা। উনারা যে আমাদের ব্যাপারে আন্তরিক তা উনাদের কথায় কাজে ফুটে উঠছে। এই ধরনের কোন গ্রুপের সাথে ভ্রমণের কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় আমি দারুণ কৌতূহল নিয়ে এদের কাজ কাম দেখতেছিলাম।
এবার শুরু হল আমাদের পথ চলা। এবার হন্টন। আমাদের গাইড মালা আর ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস ত্রিপুরা আর মালা হচ্ছে বম। মালা সামনে ফ্রান্সিস পিছনে। এরপরেই যেন ঘোর লেগে গেল আমার। আমি জানি না প্রায় তিন চার ঘণ্টা কী করেছি আমি। হেঁটে গেছি তা জানি। কিন্তু কীভাবে এত দীর্ঘ সময় হাঁটলাম আমি জানি না। চারদিক শ্রেষ্ঠ শিল্পী তার সমস্ত নৈপুণ্য দিয়ে দারুণ সব চিত্রকর্ম এঁকে দিয়ে গেছেন। আমরা মুগ্ধ দর্শক শুধু হা করে দেখে দেখে পথ চলছি। কয়বার পানিতে নামতে হয়েছে, উঠতে হয়েছে তার কোন হিসাব নাই। বিশ্রাম নিয়েছি, আবার চলছি। আমাদের দুই গাইড সহ মোট ত্রিশ জন বিভিন্ন উপ দলে ভাগ হয়ে গেছে হাঁটার ছন্দে। সামনে কিছু, তারপর কিছু, মাঝে কিছু পিছনে কিছু। এই ভাবে চলছে পথ চলা। ঝকে ঝকে পানি, নিঃশব্দ নিস্তব্দ চারদিক। আমাদের নিজেদের মাঝে টুকটাক কথা বলা। আর কোথাও কোন শব্দ নাই। মাঝে মধ্যে দেখা হচ্ছে আদিবাসীদের সাথে। দেখা হচ্ছে মাটির সাথে, পাখির সাথে, জলের সাথে। সেই যে ঘোর লাগল আমার তা সম্ভবত এখন পর্যন্ত পুরোপুরি কেটে উঠেনি।
আমি সামনের দিক থেকে একটু পিছনের দলের সাথে ছিলাম। হাঁটার গতি মৃদু মন্দ ছিল। সন্ধ্যার আগে আগে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের প্রথম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য নাফাখুমে। সন্ধ্যার আলোয় অপার্থিব এক জগত যেন উমুক্ত হল আমার কাছে। আমার জীবনে এমন কোন কিছু চোখের সামনে দেখিনি। মুগ্ধ হওয়াও যেন ভুলে গেলাম আমি। তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছবি যা তুলেছি তা আমার জন্য না। পুরো অভিযানেই আমি যা ছবি তুলেছি তা আমার জন্য না। তাদের জন্য যারা সহজেই যেতে পারছে না এই অলৌকিক জায়গায়। ক্লান্ত আমি এরপর চলে গেলাম আদিবাসীদের পাড়া নাফাখুম পাড়া। এটা ত্রিপুরা পাড়া। আমাদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে রাখা আছে। আমরা উঠলাম থমাস ত্রিপুরার ঘরে। নাফাখুম বেশ বাণিজ্যিক ভাব সম্পন্ন গ্রাম। দোকান আছে, দোকানে চা কফি পাওয়া যায়। আমরা এখানে রাত থাকব। সকালে উঠে শুরু হবে আমাদের আবার হন্টন পরীক্ষা।
রাতে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে ভাত, মুরগি, আলু ভর্তা আর চাল কুমড়ার এক অদ্ভুত ঝোল। এই জিনিস সব জায়গায়ই খেয়েছি। সম্ভবত পাহাড়ে চাল কুমড়া বেশি হয় তাই প্রতি বেলাই চলে এই জিনিস। আমাদের খাবারের আগে অন্য একটা কাজ হল। আমাদের পিছনের দল এসে পৌঁছায় গেল। ওদের দেরির কারণ হচ্ছে অরিন্দমের পা মোচকে যাওয়া। ওরা এই পাহাড়ি পথে অন্ধকার রাতে টর্চ জ্বেলে হেঁটে এসেছে। অরিন্দমের পথ বন্ধ হয়ে গেল এখানেই। পরেরদিন ও আর এগুতে পারেনি। ওকে এই পাড়ায় রেখেই আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে নিয়ে ফিরেছি আমরা। আরেকটা কাজ করলাম আমি। অন্ধকারের মধ্যেই নাফাখুমের পানিতে ডুব দিলাম একটা। সবাই হাত মুখ ধূলেও আমার মনে হল শরীর একটা গোসল চাচ্ছে। দারুণ তৃপ্তি নিয়ে গোসল করে তারচেয়েও বেশি তৃপ্তি নিয়ে রাতের খাবার খেলাম। এরপর আগুন জ্বলানো, টুকটাক গল্প তারপর গাদাগাদি করে এক রুমে সবার ঘুম। বাঁশের বেড়ার ঘর। সমানে বাতাস আসছে যাচ্ছে। একটা কম্বলে এই বাতাস সামাল দেওয়ার কথা না। সামাল দেওয়াও যায়নি। কোনমতে পার করি রাত। মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। ওরা যেহেতু সংখ্যায় কম ছিল তাই সম্ভবত শীতে কষ্ট বেশি পেয়েছে ওরা। আমারা অন্তত মানুষ বেশি থাকার কারণে একটু উষ্ণতা বেশি পেয়েছি হয়ত।
সকালে নাফাখুমের পানিতে দাঁত ব্রাস। এবং এই শেষ। এরপর এই কয়দিন আর দাঁত মাজার কথা আমার মনেই পরেনি। ঢাকা ফিরে মনে হয়েছে, আরে, দাঁত কবে থেকে মাজি না? আবার কিছু ছবি তোলা, সকালের খাবার। আবার পথ চলা। গন্তব্য নিকোলাস পাড়া। দীর্ঘ পথ। অনেক চড়াই উতরাই আছে। আমাদের বলা হল যেন ভাল করে খেয়ে নেই কারণ চলতি পথে দুপুরের খাবারের কোন ব্যবস্থা থাকবে না। এই খবর আমারা আগে থেকেই জানতাম। তাই গ্রুপ থেকে আমাদের শুকনো খাবার দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই খাবারই ভরসা এবার। এবারের পথও একই রকম দৃশ্য নিয়ে হাজির। মজা হল একই রকম হলেও একবারের জন্য, একটা মুহূর্তের জন্যও কোথাও একটুও এক ঘেয়েমি লাগেনি আমার। আমি শুধু চোখ ভরে দেখে গিয়েছি রূপের ডালী। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পরে একটা দোকান পেলাম। এদিক দিয়ে প্রচুর শহুরে মানুষ আমাদের মত ট্র্যাকিং করে যায় বলে সম্পূর্ণ অসম্ভব এক জায়গায় দোকান খুলে বসে আছে এরা। গ্রামের নাম উইলাওয়া। সম্ভবত এরাও ত্রিপুরা। আমি সঠিক জানি না। অবাক কাণ্ড হচ্ছে এই দোকানে কোক বিক্রি হচ্ছে! বিশ টাকার কোক ত্রিশ টাকা। জিজ্ঞাস করলাম কোক কোম্পানি দিয়ে যায়? না, থানচি থেকে ঘাড়ে করে, যেভাবে আমরা পথ পারি দিয়েছি সেইভাবে এই কোক নিয়ে এসেছে তারা। আমি বুঝলাম না এমন পরিবেশের মাঝে মানুষের কোকের মত জিনিস কেন খেতে মনে চাইবে? ঢাকা থেকে কোক খাওয়ার জন্য এত কষ্ট করে আসে মানুষ? আমি জানি না। কিন্তু কোক যে প্রচুর চলে তা চোখের সামনে ভালই দেখতে পেলাম। আমি ওদের বুদ্ধি দিলাম যে কষ্ট করে ওরা কোক এতদূরে নিয়ে আসে, তাদের উচিত একটা কোক অন্তত ষাট টাকা
করে রাখা, নিদেন পক্ষে পঞ্চাশ টাকা। বুঝছে কী না জানি না।
সমাজ এখানে কোন তরিকায় চলে জানি না। এই আদিম সমাজের মানুষ আমাকে প্রতি মূহুর্ত অবাক করে। অল্প সময়ে পুরো গল্প জানা হবে না। আমি অবাক হয়ে অর্ধেক বা তারচেয়েও অল্প জেনে চলে যাব। সভ্য সমাজ নামের প্রহসন অপেক্ষা করে রয়েছে আমাদের জন্য। এরা এখানেই থেকে যাবে। আদিমতম জীবন যাপন করে যাবে। আমরা বা আমাদের মত মানুষ আসবে, কিছু টাকা দিয়ে ওদের ঘরে উঠে যাবে, সামন্য কিছু টাকার বিনিময়ে ওদেরকে বলব খাবার দিতে। ওরা দিবে আমরা ভাবব আমরা খুব উপকার করলাম ওদের। হাস্যকর কাজ করে যাব। ওদের শিশুরা ভাববে সভ্য নামক মানুষরা বুঝি এমনই। এরা অদ্ভুত গলায় চিৎকার করে গান গায়, জোরে জোরে হাসে! অন্যদের সুবিধা অসুবিধা এই শহুরে লোকেরা ভাবে না।
নিজেদের জন্য বা কোন উৎসবের জন্য হয়ত মুরগি পালতেছিল। আমাদের জন্য হালাল হল। এর কী বিনিময় দিব? আমরা হিসাব করি সব টাকা দিয়ে। আমরা ভাবি টাকা দিয়ে কিনে নিলাম। ওরা যে নিজের ঘর ছেড়ে দিল তার মূল্য দেওয়া সম্ভব না। মুশকিল হচ্ছে আমরা ভাবিও না। নিকোলাস পাড়া যেন আমাকে স্তব্দ করে দিয়ে গেল। আমি পুরো তিন দিন যত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়েছি তারচেয়ে হাজার গুণ তাজ্জব হয়েছি নিকোলাস পাড়া দেখে। আমি বরাবরই মানুষের গল্প, মানুষের সৌন্দর্য দেখতে আগ্রহী। আফসোস হচ্ছে আমি সেই সুযোগ পাইনি। দুই রাত এখানে থাকার পরেও পাইনি। কারণ এত ক্লান্ত ছিলাম নিজেরা যে সময় হয়ে উঠেনি তাদের গল্প শোনার। টুকটাক কিছু কথা নিকোলাসের কাছ থেকে শোনা ছাড়া আর কিছুই জানি না। আমি জানতে চাই তাদের পুরো গল্প। তাদের প্রেম ভালবাসা, জীবিকা, কলহ, দ্বন্দ্ব ভাল খারাপ সব। শুধু নিকোলাস পাড়া না, পুরো বান্দরবন জুড়ে যত গ্রাম আছে তাদের প্রতিটাতে যদি এক মাস করে থাকা যায় তাহলেও কী শোনা হবে সব গল্প? সত্য হচ্ছে অসম্ভব তৃষ্ণা নিয়েই মারা যাব একদিন।
পরেরদিন ভোরে উঠে অভিযানের জন্য প্রস্তুতি শুরু। আমাদের এই অভিযানের সবচেয়ে কঠিন পর্ব। দেবতা পাহাড় বেয়ে নামা, ভেলাখুম, মাতভরাখুম, আমিয়াখুম, সাতভাইখুম দেখা। দেবতা পাহাড় বেয়ে নামা এখন আগের চেয়ে হয়ত সহজ হয়েছে। অনেক মানুষ নামর কারণে এখন সহজ হয়েছে নামা। খাঁজ কাটা আছে, বাঁশ দেওয়া আছে। নামের মতই বিশাল এই খাঁড়া পাহাড় বেয়ে নামা তবুও আমাদের জন্য কঠিন এক পরীক্ষা হিসেবেই হাজির হল। কিন্তু এরপরের গল্প অনেক জায়গায় অনেকেই দিয়েছে। আমিয়াখুমের সৌন্দর্য, মাতভরাখুমের মুগ্ধ করা বর্ণনা অনেক পাওয়া যায়। আমি নতুন করে কী বলতে পারি? আমার আমিয়াখুমে লাফ দেওয়ার কথা বলব? একবার না দুইবার লাফ দিয়েছি বরফ শীতল সেই পানিতে। এর পিছনের কথা বলি একটু। এর পিছনে আর কিছু না। শুরুতে যে বলেছি আমার মানসিক অবস্থার কথা, তাই দায়ী। আমি আমাকে হুট করেই ভাঙতে চাইছি। মনে হল এ আর বাদ থাকে কেন? একবার দেওয়ার পরে মনে হল আবার হোক। আমি আরও কয়েকবার হয়ত দিতাম নিজের ভিতর থেকে নিজেকে খুঁজে নিতে। কিন্তু অসম্ভব বরফ ঠাণ্ডা পানি আর আর দেয়নি আমাকে কিছু করতে। আমিয়াখুমের পাড়ে বসে খাবার খাওয়াটাও চিরদিন মনে রাখার মত অভিজ্ঞতা ছিল। এ সবই সবাই হাজার বার বর্ণনা করছে।
থানচি যখন নামলাম তখন আমার জীবন যায় যায়। রেমাক্রিতে গোসল করেছিলাম। কাপড় পরিবর্তনের সুযোগ না পাওয়ায় ভেজা কাপড়েই উঠে বসি নৌকায়। দুপুর তখন, তাই শীত করবে এমন কথা মাথায় আসেনি। কিন্তু বান্দরবনকে বুঝতে আমার বাকি ছিল কিছু। দুপুর বেলায়ই পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল সূর্য। মনে হল সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফলাফল তীব্র শীতে কাপাকাপি শুরু। থানচি নেমে দ্রুত কাপড় বদল করে নেওয়া, তারপর দৌড়ে গাড়িতে উঠা। এর ফাঁকে যে ভুলটা আমি করলাম, যা আমাকে এখন পর্যন্ত কষ্ট দিচ্ছে তা হচ্ছে আমাদের গাইড ফ্রান্সিস ও মালার কাছ থেকে বিদায় না নেওয়া। ফ্রান্সিসের সাথে দারুণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল। আমিয়াখুমে আমাকে লাফ দেওয়া দেখে আমার পিঠ চাপড়ে সাবাসি জানিয়েছিল ফ্রান্সিস। কোন এক রহস্যময় কারণে সারোয়ার ভাইকে কলিগ ডাকা মালার কাছ থেকেও বিদায় নিতে পারিনি। এমনটা আমার স্বভাব না। এরপর কোনদিন গেলে অবশ্যই মনে করব দুইজন সহজ সরল আদিবাসীর কথা। যারা পুরোটা সময় আমাদের ভাল মন্দের চিন্তা কর গেছে।
দীর্ঘ লেখা হয়ে গিয়েছে। শেষ করব। তার আগে যে বিষয়ে কিছু বলি নাই তা একটু বলে নেই। তা হচ্ছে আমার সফর সঙ্গীরা। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ থেকে উঠে আসা একেকজন এত চমৎকার ভাবে সব সামলে নিয়ে এই কয়দিন কাটালেন তা অবিশ্বাস্য। পরিচিত মানুষের সাথেই এক আধটু ঠুকাঠুকি লেগে যায় কোথাও ঘুরতে গেলে। কিন্তু অপূর্ব এক ব্যাপার ঘটে গেছে এখানে। সবাই অমায়িক আচারন করে গেলেন পুরোটা সময়। একা একা ঘুরতে এসেছে এমন মেয়েরাও ছিল দলে। একজনও বলতে পারবে না তারা একা আসছে এ জন্য কোন প্রকার অস্বস্থি বোধ করেছে এক মুহূর্তের জন্য। এ এক কথায় অসাধারন একটা ব্যাপার।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। নাফাখুম পাড়ায় নাফাখুমের উপড়ে সরকার ব্রিজ তৈরি করছে! এই রকম দুর্গম একটা জায়গায় উন্নয়নের নামে এই ব্রিজ কেন দরকার? কিছুই না সৌখিন মানুষদের টেনে আনার ফন্দি। নাফাখুম পর্যন্ত হয়ত রাস্তা হবে, পাহাড়ে কটেজ তৈরি হচ্ছে। তুমুল ফুর্তি হবে। আর যে আদিবাসীরা না জেনে না বুঝে এই কাজে সমর্থন দিচ্ছে তাদের হয়ত আগামী দশ বছর পরে ওই এলাকায় আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আমরা উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ধ্বংস বুঝি। ফেরার সময় নাফাখুমের একটা অংশ হুট করেই পরিষ্কার করা শুরু করি আমরা। মুহূর্তের মধ্যে এক বস্তা আবর্জনা সাফ করি। তারচেয়েও কয়েক গুণ ময়লা রেখে চলে আসি আমরা। কী হবে যদি আরও মানুষ সহজে যায়? তিন বস্তা আবর্জনা? আমার জানা নাই। আমরা উন্নয়ন বলতে ইট কাঠ লোহা বুঝি কেন জানি। আমি যতটুকু গহীনে গিয়েছি তা বান্দরবনের তুলনায় কিছুই না। অথচ এই অল্প অংশের কোথাও কোন স্কুল দেখিনি, দেখিনি প্রাইমারি স্কুল। মাতৃভাষায় শিক্ষা দান শুরু হয়েছে তা সুদূর শেরপুরে বসে পত্রিকায় পড়ে যা জেনে ছিলাম বাস্তব যে তারচেয়ে বহুলাংশে কঠিন তা যেন চোখের সামনে দেখলাম। এই দিকে উন্নয়নে আমাদের আগ্রহ কম। ম্যালেরিয়ার পোস্টার দেখেছি গ্রামে। কেউ পড়তে পারে কিনা তা নিশ্চিত হতে পারেনি। এমন হচ্ছে উন্নয়নের ধরন! মানুষের উন্নয়ন না করে যদি ব্রিজ বানানোকে আমরা উন্নয়ন বুঝে তাহলে বুঝতে হবে রসাতলে যাওয়ার আর বাকি নাই!
অদ্ভুত সুন্দর মানুষ আর অদ্ভুত সুন্দর ভূমি বিদেশিদের জন্য নিষিদ্ধ। এই ব্যাপার আমার ভারতীয় বন্ধুদের জন্য দুঃখজনক। আপাতত কিছু ছবি দিচ্ছি, ভারতের অপার সৌন্দর্যের তুলনায় হয়ত কিছু না, কিন্তু সব কিছুর কি আর তুলনা চলে? সৌন্দর্যের বিষয়ে তো আরও চলে না!
বা: , নিজের ইয়ুথ হোস্টেল টিমের সঙ্গে ছত্তিশগড়ে লাফাগড় পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে।
এক কথায় অপূর্ব।