এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি  সিরিয়াস৯

  • উপরোক্ত কেউ নয়

    কল্লোল
    আলোচনা | রাজনীতি | ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৩৭২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • সিরিয়াস৯-র এবারের বিষয় ভোট। আসন্ন বা বিগত কোনও ভোটের কথা নয়, ভোট নামক ধারণা, অনুশীলন ও অভ্যাসের কথা। ভোট সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণাকে ধারণাগতভাবেই বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্য এই সংখ্যার। এবারে গণভোট নিয়ে লিখেছেন শুভময় মৈত্র, ভোট বয়কট নিয়ে লিখেছেন অভিজ্ঞান ও নোটা নিয়ে লিখেছেন কল্লোল।

    মানুষ, ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার মোটামুটি ২৯ লক্ষ ৩০ হাজার বছর পর প্রথম বিপ্লবটি ঘটে মানুষের জীবনে, বা বলা ভাল হোমো প্রজাতির জীবনে, যাকে অধিকারীজন আখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব নামে। (এই প্রসঙ্গে, স্যাপিয়েন্স – মানুষের ইতিহাস, ইউভাল নোয়া হারারি। ভাষান্তর সুফিয়ান লতিফ, শুভ্র সরকার, রাগিব আহসান। পৃঃ ১৭ থেকে ১৩৩ – দ্রষ্টব্য।) এই প্রথম মানুষ ভাবতে, নাহ, ভাবতে শিখেছে মানুষ অনেক আগেই, এই প্রথম মানুষের বিমূর্ত ভাবনার বিকাশ ঘটল। মানুষ প্রবৃত্তি ও বাস্তবের বাইরে বেরিয়ে এমন কিছু ভাবতে শিখল যা বাস্তবে বিরাজ করে না বা প্রবৃত্তি শেখায় না। এই বিমূর্ত ভাবনার ফলে মানুষ গোষ্ঠী তৈরি করল। আর এই গোষ্ঠী তৈরির সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বিষয় জড়িয়ে গেল তাদের চিন্তায়। কাদের সঙ্গে গোষ্ঠী হবে, কাদের সঙ্গে হবে না। অর্থাৎ পছন্দের প্রশ্ন, বেছে নেওয়ার প্রশ্ন উঠে এল।

    সেই থেকে মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে বেঁচে থাকা নিছক বেঁচে থাকা নয়। বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে মানুষ তার হাতে থাকা সমস্ত সুযোগ ও আর তার সমস্ত বিকল্পগুলোকে নিয়ে, এমনকি যে বিকল্পগুলো আপাতভাবে হাতের বাইরে, পছন্দমত তাদের প্রয়োগ করে চলেছে জীবনের চলার পথের বাঁকে বাঁকে। আমরা তুচ্ছাতিতুচ্ছ থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই চলেছি ক্রমাগত।

    যদিও আমাদের উপনীত হওয়া সমস্ত সর্বদা সচেতনপ্রক্রিয়াসঞ্জাত তা নয়। বহু সিদ্ধান্ত আমরা নিয়ে ফেলি অবচেতনেই। কিন্তু এও ঠিক যে আমাদের সিদ্ধান্তের একটা বড় অংশ আমরা সচেতনভাবে নিই, বিভিন্ন যুক্তিবোধের ভিতর দিয়ে একটার পর একটা বিকল্প বাতিল করতে করতে। যদিও কে যেন বলেছিলেন জীবন আসলে তোমার সঙ্গে ঘটে চলা ঘটনাপূঞ্জের সমষ্টি যা ঘটে চলে যখন তুমি অন্য কোন পরিকল্পনায় ব্যস্ত।

    জীবনে এমন অনেক কিছুই ঘটে, যা আমাদের আয়ত্তের বাইরে। যেখানে আমাদের বেছে নেওয়ার কোনও সুযোগ থাকে না, স্রেফ মেনে নিতে হয়।কখনও কখনও আমাদের সিদ্ধান্তগুলো অন্যেরা নিয়ে নেয়, এমনটাও ঘটে। আমরা তা মেনে নিতে বাধ্যও হই। এমনটা ঘটে যখন বিকল্পের অতি আধিক্য আমাদের ক্লান্ত ও অসহায় করে দেয়।

    কিন্তু এই পছন্দের প্রক্রিয়াটি আমাদের কাছে বেশ ঝামেলার। বিশেষ করে যখন বিকল্প সংখ্যায় বেশি হয় । আমার মনে হয় এখানে ভাবা দরকার যে বিকল্প সংখ্যায় বেশি হলে অর্থাৎ দুইয়ের বেশি হলে কিছু বেশি ঝামেলায় পড়তে হয়। এই পছন্দগুলোকে ক্রম-অনুসারে সাজানো যায়। কোনটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ, কোনটা তার থেকে একটু কম, কোনটা তার থেকে আরও কম। আমাদের মানুষ হিসাবে বেড়ে ওঠার মধ্যেই রয়ে গেছে এই ঝামেলার কারণটি। ধরুন, আজ লাঞ্চে কী খাবো, ডাল ভাত মাছ, নাকি পরোটা মাংস, নাকি স্যান্ডুইচ কফি কিংবা লুচি আলুরদম, এও আমাদের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সবই ভালো লাগে, কিন্তু সবই একসঙ্গে খাওয়া যায় না। কোনটা রাখি, কোনটা ফেলি! এই যে মহাসমস্যাটি আমাদের বিব্রত করে, তার কারণ ২৯ লক্ষ ৩০ হাজার বছর ধরে আমরা যখন বেড়ে উঠছিলাম তখন আমাদের সামনে কোনও বেছে নেওয়ার সমস্যা ছিলো না, কারণ বেছে নেওয়ার মতো কিছু থাকত না। বেশিরভাগ সময় দুটি বিকল্পও থাকত না।  একটা ম্যামথ মারা হলে সেটাই পরের এক সপ্তাহ ধরে লাঞ্চ, ডিনার, ব্রেকফাস্টে খাওয়া হতো, আর কোন বিকল্প থাকতো না। ফলে আমরা পছন্দে অভ্যস্থ নই। আমাদের মস্তিষ্ক পছন্দের ব্যাপারে তাই স্বস্তি বোধ করে না।  পছন্দ বিষয়টি মানুষকে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ‘শিখতে’ হয়। বলা ভাল পছন্দ করার কাজটি আদৌ মানুষের সহজাত নয়।  

    কিন্তু প্রায় ৭০ হাজার বছর ধরে একটু একটু করে আমাদের পছন্দ করার প্রক্রিয়াটির সঙ্গে ঘর করতে হয়েছে। তবু এই ৭০ হাজার বছরের প্রায় ৬০ হাজার বছর মোটামুটি শান্তিতে গেছে কারণ বাছতে বাধ্য হলেও খুব বেশি বিকল্প ছিল না। কিন্তু শেষ ১০ হাজার বছর কৃষি বিপ্লবের কারণে আরও বিশেষ করে শেষ ৫০০ বছর বিজ্ঞান বিপ্লবের ঠেলায়, হাজার হাজার বিকল্প আর পছন্দের ঝড় বয়ে গেছে আমাদের উপর এবং বিকল্পগুলি ও পছন্দের ব্যাপারটি ক্রমাগত জটিল হয়ে উঠছে এবং তা ক্রমবর্ধমান।

    এখানে কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা যেতেই পারে। এই যে বলছি ‘বিপ্লব’, সে বস্তুটি সত্যি কী? বিপ্লব না ঘোড়াড্ডিম সেটা বোঝা সামান্য দরকারি। আমাদের একটা ধারণা আছে যে এই সব ‘অগ্রগতি’ মানুষের বোধবুদ্ধি বেড়ে যাবার লক্ষণ। মানুষ শিকারী-সংগ্রাহক অবস্থাতেই উদ্ভিদ ও প্রাণীদের প্রজনন সম্পর্কে জানত। শিকার ও সংগ্রহ করতে গেলে এসব জানা জরুরি ছিল, কোথায় কী কী ফল-মূল-উদ্ভিদ পাওয়া যায়, কোন কোন প্রাণীর প্রজননের সময় কখন। ফলে তারা এই সব জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে যে খুব তালেবর হয়ে উঠেছিলো এমনটা মোটেই নয়। এমনকি তাদের জীবনের মানও আদৌ উন্নত হয়নি। তারা শিকারী-সংগ্রাহক অবস্থায় অনেক বৈচিত্রপূর্ণ খাবার খেত। বিভিন্ন পশুপাখীর মাংস, ফল-মূল-উদ্ভিদ থাকত তাদের খাদ্যতালিকায়। কৃষিকাজে জুটে যাবার পর তারা অল্প কিছু ফল-মূল, অল্প কিছু পশুমাংস, এবং চাষ থেকে উৎপাদিত দ্রব্য আহার করত। ফলে তাদের খাবারের ধরন সীমিত হয়ে গেল। একে কি উন্নতি বলা চলে? বরং আগের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে না-থেকে তারা এক জায়গায় অনেকে থাকতে শুরু করলো, পশুপালন ও কৃষিকাজের শ্রমের জোগান দিতে। ফলে তারা বেশি করে ছোঁয়াচে রোগের শিকার হতে থাকল, তাদের দৈনন্দিন ঠোকাঠুকি বাড়লো, তারা আগের চাইতে অনেক বেশি কাজ করতে বাধ্য হল, অবসর কমে গেলো উল্লেখজনকভাবে। কৃষিকাজ মানুষের খাদ্যের মজুদ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এই অতিরিক্ত খাবার বরং ডেকে এনেছে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, তৈরি হয়েছে ক্ষমতার সোপান, যেখানে এই অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের চাবিটি অধিষ্ঠান করে। ফলে অসাম্য, অবিচার গাজিয়ে ওঠে মানুষের জীবনে। এসব ধরলে বলতেই হয় বিপ্লব না ঘোড়াড্ডিম।

    বিজ্ঞান ও শিল্প বিপ্লবের বিষয়টা এতোদিনে বেশ খোলসা হয়ে এসেছে, পরিবেশদূষণের কল্যাণে। এই দুই বিপ্লব যে আমাদের বসবাসের জায়গাটিকে ক্রমশ বিষাক্ত ও অবসবাসযোগ্য করে তুলেছে, সে নিয়ে তর্কের অবকাশ ক্রমেই কমে আসছে।

    এর মধ্যে অন্য এক ঝামেলা এসে এই পছন্দের বিষয়টিকে ঘুলিয়ে দিয়েছে - সম্মতির নির্মাণ। লেখা বা বড় অর্থে মুদ্রণ মানুষকে প্রভাবিত করেছে ভীষণভাবে। মুখের কথা উপর মুদ্রিত কথা সবসময়েই গুরুত্ব বেশি পেয়েছে, সম্ভবত তার স্থায়িত্বের জন্য। আর একটি বিষয়ে লেখা টেক্কা দিয়েছে মুখের কথাকে, তার সর্বব্যাপ্তির কারণে। একজন মানুষ একসময় এক জায়গাতেই থাকতে পারেন। ফলে তার মুখঃনিসৃত কথাও সেই ভৌগোলিক স্থানে ও যতদূর পর্যন্ত শোনা যায় ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ। লিখিত ভাষা একই সঙ্গে বহু জায়গায় বহু মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। এক্ষত্রে সে প্রায় ঈশ্বরতুল্য, একই সঙ্গে একই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় বিরাজমান। ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রকাশিত হয় পাথরে খোদাই করে, রাজার প্রতিনিধিত্ব করে রাজার শিলমোহর, শিলালিপি, তাম্রশাসন, আদেশনামা। ফলে বেশিরভাগ মানুষের এই বিশ্বাস প্রায় ১০ হাজার বছর ধরে ক্রমশ বিকশিত হতে হতে কমবেশি ২৫০ বছর ধরে ন্যস্ত হয়েছে গণমাধ্যমের উপর। কাগজে যা ছাপা হয় তা অভ্রান্ত, দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে যা দেখান হয়, তা সত্য, এমন একটি বিশ্বাস জোরালো, ক্রমশ জোরালো হয়েছে। ছাপা ও বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমগুলি তাদেরই প্রচারযন্ত্র, এটাই সত্য। যদিও তারাই লেখে ও প্রচার করে যে তারা নিরপেক্ষ ও নির্ভীক। এ কথাটিও একটা বড় অংশের মানুষ ঐ একই কারণে বাধ্যতামূলকভাবে বিশ্বাস করে। খবরের পরিবেশনা, সম্পাদকীয় নিবন্ধ, আলোচনা, বিতর্ক সবই পরিচালিত হয় ক্ষমতার নির্দিষ্ট করে দেওয়া পথে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভিতরে দ্বন্দ্ব থাকে ও তার গণ্ডিও থাকে। যা কিছু বিবাদ বিসংবাদ ঐ লক্ষ্মণরেখাটির ভিতরেই আবদ্ধ থাকে। ঠিক যেভাবে বিজ্ঞাপনগুলি দেখানো হয়। ধরা যাক চুলে মাখার শ্যাম্পু। বাজারে বিভিন্ন রকমের শ্যাম্পু আছে। তাদের নানান গুণাগুণ বিবৃত হয় বিজ্ঞাপনগুলিতে। এটির গন্ধ মনোহর, এটি স্বাস্থ্যকর, এটি সস্তা ইত্যাদি। কিন্তু কোন বিজ্ঞাপনই শুধু রিঠার কথা বলবে না। এই উপমহাদেশের মানুষ রিঠা দিয়ে মাথা ‘ঘষছে’ হয়ত বা পাঁচ হাজার বছর ধরে। কিন্তু রিঠা আমাদের পছন্দের তালিকার বাইরে থেকে যাবে কারণ আমাদের কাছে মাথা ‘ঘষার’ জন্য যে যে পণ্য তুলে ধরা হয়েছে তাতে রিঠার স্থান নেই। বড়জোর অমুক শ্যাম্পুতে রিঠা আছে বলা হবে। একই সঙ্গে রিঠা কেনার জন্য আর পাওয়া যাবে না, সাধারণ লবণ আর পাওয়া যাবে না, কাপড় কাচার গোলা সাবান আর পাওয়া যাবে না, ঘানি থেকে দোকানে আসা সর্ষের তেল আর পাওয়া যাবে না, কারণ এগুলো ক্রেতার মননে আর বিরাজ করে না। এরা ‘না’ হয়ে গেছে। কারণ এদের বিজ্ঞাপন হয় না। 

    এই একই ধারা কাজ করে রাজনীতির ক্ষেত্রেও। সরকার ও সরকার-বিরোধী এই দুটি পাল্টাপাল্টিযোগ্য বর্গে ভাগ হয় একটি দেশের রাজনীতি।  এর বাইরে দেশের জন্য কেউ ভাবতেই পারে না। যদি কেউ ভাবে তবে তারা উগ্রপন্থী-দেশদ্রোহী বা নেহাৎই পাগল-ছাগল জাতীয়। এভাবেই তাদের গণ্ডীর বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়। এদের কাজকর্মের খবর হয় না। হলেও তা দেশদ্রোহিতা ও সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের মোড়কে দেখানো হয় বা যেসব সমাজসেবীরা ‘রাজনীতি’র বাইরে থেকে মানুষের ভালর জন্য কাজ করেন  তাঁদের উপর এমন এক দেবত্ব আরোপ করা হয় যাতে একটা কথা নিরুচ্চারে সোচ্চার হয় – এরা নেহাৎই ‘ভালোমানুষ’, দেশ চালানোর যোগ্য নন।

    ফলে আমাদের মধ্যে সরকারি রাজনৈতিক দলগুলি ও সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মান্যতা গড়ে ওঠে শাসক/হবু শাসক হিসাবে। তাই যখন নির্বাচন হয়, তখন আমরা তালিকাভুক্ত কোনও একজন প্রার্থীকে পছন্দ করতে বাধ্য হই। বিষয়টি এরকমই চলছিল। ১৯৭৬ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা রাজ্যে প্রথমবারের জন্য কাউকেই পছন্দ নয় ব্যালটপত্রে লিখিত ভাবে রাখা হয়, যেখানে সম্মতিদান চিহ্ন দেওয়া যাবে। ভারতে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এটি চালু হয় ২০১৩ সালে।

    যদিও কোনও মতের পক্ষে বা বিপক্ষে না থাকার অধিকার আমাদের সেবকেরা বহুদিন ধরে ভোগ করছেন। সংসদীয় খবরে এটা প্রায়ই দেখা যেতো প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন কেউ কেউ। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন কেউ কেউ। কেউ কেউ ভোটদানে বিরত থাকেন। সেবকদের অধিকার ছিল পক্ষে বা বিপক্ষে কোনটাতেই না থাকার। অথচ তাঁরা যাঁদের সেবা করেন তাদের সেই অধিকারটি ছিল না। ২০১৩ পর্যন্ত আমরা বাধ্য থাকতাম কাউকে না কাউকে বেছে নিতে। না-হলে ভোটটি বাতিল বলে গণ্য হত। ২০১৩ থেকে আমরাও অধিকার পেয়েছি আমাদের অপছন্দের কথা আইনমাফিক জানাতে। মানবাধিকার আন্দোলনে এই দাবিটি বহুদিনের। অপছন্দের অধিকারও একটি মৌলিক অধিকার। এটির প্র্য়োগ শুধু রাজনৈতিক মতদানের ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও গুরুতর। উদাহরণ - যে কোনও মানুষ তো বটেই এমনকি বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ স্ত্রী ও পুরুষ যৌনমিলনের ক্ষেত্রে তাদের অপছন্দ, ফলত অসম্মতি জানাতে পারেন, সেটাও তাঁদের অধিকার।
     
    এখন পর্যন্ত কাউকেই পছন্দ নয়- এ সংখ্যা বিভিন্ন প্রার্থীদের দেয় মোট প্রদত্ত ভোটের সামান্য অংশ। কখনও যদি তা সমস্ত প্রার্থীদের পাওয়া ভোট সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায় তখন দাবি উঠতেই পারে আবার নতুন প্রার্থী নিয়ে মতদানের। যদিও ভারতে এখনও তা আইনত স্বীকৃত নয়।
    আসলে নির্বাচন বলতে আমরা গড়পড়তা ভারতীয়রা বুঝি, একজন একটাই ভোট একজনের জন্য। তাতে প্রায় সবসময়েই মাত্র তিরিশ শতাংশের আশেপাশে ভোট পেয়ে একটি দল সরকার গঠন করে। ফলে প্রায় সব সরকারই সংখ্যালঘু মানুষের সমর্থনে সরকার। অন্যান্য পদ্ধতিও আছে নির্বাচনের। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, পছন্দের ক্রমানুসার, এরকম নানা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় নানান দেশে। সব পদ্ধতিরই কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, কিছু ভাল দিক আছে। এই আপেক্ষিক দুনিয়ায় বিশুদ্ধ বলে কী আর কিছু হয় রে ভাই!

    আমাদের গত লোকসাভা নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছেন সেই ৫৪৩ জন সাংসদের মাধ্যে ২৩৪ জনের বিরুদ্ধে মোট ১০৩৭টি ফৌজদারি মামলা আছে। অর্থাৎ প্রায় ৪৩% সাংসদ ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত। এরা দেশ চালাবেন, আইন বানাবেন আর আমাদের সেটা মেনে চলতে হবে!
    পছন্দের অধিকার, পছন্দের স্বাধীনতার উল্টোবাগে অপছন্দের অধিকার, অপছন্দের স্বাধীনতা আমাদের করায়ত্ত। যদি কোন প্রার্থীকে পছন্দ না হয় – উপরোক্ত কেউ নয় - বোতামে চাপ দিন বা খোপেতে ছাপ দিন।

    আবার এমনটা নয় যে ইহাই স্বতঃসিদ্ধ। কত সময় এমনও হয় কাউকেই পছন্দ নয়, কিন্তু কোন একটা কর্তব্যের ডাক থাকে। তখন হয়তো অপছন্দের কাউকে পছন্দ করতেই হয়, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে।  

    আমার মনে হয় এখানে ভাবা দরকার যে বিকল্প সংখ্যায় বেশি হলে তা বাইনারি চয়েসের থেকে বেশি কিছু অফার করে। এই চয়েসগুলোকে ক্রম-অনুসারে সাজানো যায়। কোনটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ, কোনটা তার থেকে একটু কম, কোনটা তার থেকে আরও কম।

    এই সময় চয়েজগুলো বাইনারি ছিল। সেটা ‘ফ্লাইট অর ফাইট’ গোছের উদাহরণ দিয়ে বোঝান যায়।

    আসলে আমাদের মস্তিষ্ক বাইনারি চয়েসে বেশি অভ্যস্ত। সাদাকালোতে বেশি অভ্যস্ত। বলা যায় গ্রে-স্কেলে দেখতে শিখতে হয়। সরকার গঠনের জন্যে নির্বাচনে এই দুটি বর্গই তো সম্ভব। যে রাজনীতি সরকার গঠনে বিশ্বাস করে না, অথচ নির্বাচনে অংশ নিতে চায় তাদের চয়েসের সমস্যার কথাই বলা হচ্ছে এখানে। কিন্তু সেটা স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার। সমাজসেবী কেউ সরকার গঠনে বিশ্বাস করলে তার এই দুটি বর্গে সমস্যা থাকবে না।

     আরও স্পষ্ট করে বললে সমস্যা হল, যেখানে মাত্র একজনকে বেছে নিতে হবে সরকার ও সরকার-বিরোধী দুটি বর্গের মধ্যে থেকে, সেখানে সরকার গঠনে বিশ্বাস করে না এমন গোষ্ঠী ভোটে অংশ নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চাইলে সেখানেই সমস্যা। কারণ মাল্টি-পার্টি সিস্টেমে সরকারপন্থী বর্গেও অনেক চয়েস থাকে, বিরোধী বর্গেও তাই। দুই-পার্টি সিস্টেমে অবশ্য এই চয়েস আরও কম।

     সমস্যাটা আরও বেশি হবে যদি  ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ সিস্টেম থাকে। যা আমারা ইনহেরিট করেছি। সেখানে কাউকেই পছন্দ নয়’ বলার তাও একটা মানে আছে। কিন্তু যদি প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশান সিস্টেম থাকে (ইউরোপের ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশেই যা আছে), সেখানে নোটার প্রাসঙ্গিকতাও বদলে যায়। কারণ এই পদ্ধতিতে বাইনারি চয়েসের বাইরে কাকে কতটা পছন্দ তার ক্রম অনুসারে ভোট দেওয়া যায়। সেখানে অনেক চয়েসের মধ্যে ‘হয় একে নয় ওকে’ - এর বাইরে গিয়ে পলিসির ভিত্তিতে কে কতটা আপনার কাছাকাছি সেটা জানানোর জায়গা থাকে।
    আমেরিকার সঙ্গে কিন্তু একটা বড় তফাত আছে। আমেরিকায় চয়েস মাত্র দুটি পার্টির মধ্যে।

    পছন্দের অধিকার নিশ্চিত করতে নোটা-সমেত ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট সিস্টেমের থেকে কিন্তু প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশান অনেক ভালো।

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৩৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অরিন | ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০৬:১৬101427
  • "পছন্দের অধিকার নিশ্চিত করতে নোটা-সমেত ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট সিস্টেমের থেকে কিন্তু প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশান অনেক ভালো।"


    আমারও তাই মনে হয়, একদম মনের কথা লিখেছেন!


    এর সঙ্গে আরেকটু যোগ করা যেতে পারে, প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন থাকুক, তার সঙ্গে ব্যক্তি ভোটও থাকুক (মিক্সড মেজরিটি প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন)। তার মানে নাগরিক ভোটিং বুথে গিয়ে দুটি ভোট দেবেন, একটি পছন্দের পার্টি কে, একটি পছন্দের ক্যানডিডেটকে | এতে করে স্থানীয় বিধায়ক মশাইকে পছন্দ নয়, অথচ পার্টিটিকে পছন্দ করেন, শ্যাম/কূল দুইই রইল। অবিশ্যি এর সঙ্গে আরো একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে, এতে করে পার্টি তাদের ক্যানডিডেটদের দুটি তালিকা তৈরী করবে, একটি যারা সরাসরি ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, আর একটি রিজার্ভ  বেঞ্চ, যাতে করে  উমেদর হারলেও পার্টি জিতলে আরেকজনকে এগিয়ে দেওয়া যায়। 


    ভারতের মতন দেশে এতে করে কোয়ালিশন সরকার গড়ার ব্যাপারটা আরো জটিল হবে অবশ্য, তাতে একদিকে ভালই, একটি মেজরিটি পার্টি এবং বকলমে একনায়কতন্ত্রের কুফল ৬০ এর দশকের শেষ থেকে দেশ ভোগ করছে (মাঝের কয়েক বছর বাদ দিলে), আজও সেও ট্র্যাডিশন চলেছে। এর একটা শেষ হওয়া আশু প্রয়োজন। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা কে বাঁধে?

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন