এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব  মোচ্ছব

  • আহিরণ নদীঃ ১৫ পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | মোচ্ছব | ১১ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৯৭৭ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯
    ৫)

    বিয়ের ঝামেলা কেটে গেল একটা ঘোরের মধ্যে। বাড়িতে এত লোকের ভিড় ও আগে দেখেনি। ওদের যে এত আত্মীয়স্বজন আছে তাও রূপেশের জানা ছিল না। ও জানত যে ওরা মাত্র দুইপুরুষ আগে, মানে ওর ঠাকুর্দার রেলের চাকরির সুবাদে, বিহারের বখতিয়ারপুর থেকে ছত্তিশগড়ের ভিলাইয়ে এসেছে। ছোটবেলায় প্রতি বছর শীতের মুখে ছট পরবের সময় দুর্গের কাছে সিরসাঘাটে বা ভিলাইয়ের তালপুরির দীঘিতে গিয়ে সবার সঙ্গে সুর্যদেবকে অর্ঘ্য দিয়েছে , পটাকা ফাটিয়েছে এবং প্রসাদী মিষ্টি খেয়েছে। এর বেশি কিছু জানা ছিল না।

    গায়ে হলুদের হুল্লোড় ওর ভাল লাগেনি। কিন্তু দেখল বড়বৌদি ও টাটানগর এবং সমস্তিপুর থেকে আসা বয়স্ক মহিলারা কেমন কিশোরীদের মত উচ্ছল হয়ে উঠছেন। আর রাত্তিরে ছাদের থেকে ঢোলকের আওয়াজ শুনে ও উপরে গিয়ে দেখল যেন হাট বসেছে। বড়বৌদির ঢোলকের থাপের সাথে তাল মিলিয়ে দুই পাকা চুল মহিলা নিমপাতা খাওয়া মুখ করে ওদের দেশের বিয়ের কোন গেঁয়ো গান ধরেছেন। উচ্চারণ যেন কেমন! ওর দিকে চোখ পড়তেই সবাই হইহই করে উঠল, তারপর ওকে ভাগ- ভাগ করে তাড়িয়ে দিল। ওর কানে এল একটা লাইন-“ছিয়া ছিয়া জেঠজি!”

    ( ছিঃ ছিঃ ভাসুরঠাকুর!)

    কিন্তু গোল বাঁধল সুহাগরাত বা ফুলশয্যার সময়। ফুল দিয়ে সাজানো নিজের ঘরে বসে ও ভাবছিল-- একটা সিগ্রেট খেলে কেমন হয়! নিমকি কি কিছু মনে করবে? নীল বেনারসীতে ওকে দূর থেকেই দারুণ লাগছিল। যেন নীলপরী! ইউরেকা! ওকে নীলপরী বলে ডাকলে কেমন হয়? নীলপরী কি একটু ফিল্মি? ও হেসে উঠবে না তো? তাহলে নীলিমা! এটাই বেশ হবে। ও জানে সময়ের ঘসা লেগে নীলপরী বা নীলিমা একসময় নীলু হয়ে যাবে । হোক নীলু, ওই নিমকি টিমকির মত গেঁয়ো নয়।

    চিন্তায় ছেদ পড়ল। ঘরে ঢুকেছেন পাঁচজন মহিলা।বড়ীভাবীজি ধরে ধরে নিয়ে আসছেন সরলা বা নিমকিকে, ওর নতমুখে কনেচন্দনের আভা। রূপেশের কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। বৌদি সরলাকে ছেড়ে রূপেশের গালে ঠোনা মেরে বললেন—নাও, এবার নিজের সম্পত্তি বুঝে নাও। আর সারাজীবন আগলে রেখো দেবরজি।

    কিন্তু রূপেশ কিছু বলার আগে এগিয়ে এসেছেন দুই পাকাচুল মহিলা--একজনের হাতে একটি কাঁসার বগি থালা, অন্যজনের হাতে একটা শিলনোড়া আর নারকোল। তৃতীয়জন পেছনে থেকে বললেন—শুভকাজটা আগে হয়ে যাক।

    --জরুর, জরুর।

    মেজেতে থালা নামিয়ে রেখে তার উপর নারকোল আর শিলনোড়া রেখে ওরা বললেন—নাতিসাহেব, এগিয়ে এস। থালায় পা’ রেখে দাঁড়াও। নাতবৌ নারকোলটা ভেঙে জলটা দিয়ে এই থালার উপর তোমার পা ধোয়াবে , নিজের চুল দিয়ে তোমার পা মুছিয়ে দেবে। তারপর তুমি বিছানায় উঠবে। লজ্জা কর না, এস, এগিয়ে এস।

    রূপেশ হতভম্ব; এসব তো কেউ আগে বলেনি। ওর কী করা উচিত? সরলার দিকে তাকায়। সরলা কাঠের মত দাঁড়িয়ে। কেউ কোন কথা বলছে না ।

    সবচেয়ে বয়স্কা মহিলাটি এসে ওর হাত ধরলেন—চল, দেরি কর না; রাত হয়েছে।

    রূপেশ আবার সরলার দিকে তাকায়। ও এখন চোখ তুলে রূপেশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।

    রূপেশের বুক ঢিপ ঢিপ করে । দিদিমা বা ঠাকুমা ওর হাত ধরে টান দেবার চেষ্টা করতেই ও এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কেমন যেন কৃত্রিম আওয়াজে কেটে কেটে বলে—এসব কিছু হবে না । কোন মেয়ে আমার পা ধোয়াবে না ।

    একটা অস্ফুট স্বর। কেউ বললেন –ইয়ে হমারী প্রাচীন পরম্পরা হ্যায় বেটা, না নহীঁ করতে; অমঙ্গল হোগা।

    রূপেশ নিজের বুকের ধকধক শুনতে পাচ্ছে।

    --ও জব হোগা, তব দেখেঙ্গে। অব আপলোগ ইহাঁসে জাইয়ে; রাত বহোত হো গয়ী।

    প্রাচীনার চোখে জল। ঊনি বিড়বিড় করতে লাগলেন। তৃতীয়জন বললেন—চলো রে, ছোঁড়াটার আর তর সইছে না।

    রূপেশ বড়বৌদির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়, ওঁর চোখে কেমন দুষ্টু হাসি। ঘর দ্রুত খালি হয়ে যায়। বৌদি যাবার আগে বলে যান—দেবরজী! পহলী রাত মেঁ হী বিল্লি মারনা হ্যায়! ভুলনা মত!

    রূপেশ ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানায় পা তুলে বসে ঘামতে থাকে। বুকে আবার ধুকপুকি। সরলা ওর কাছে ঘন হয়ে আসে। ধুকপুকি বেড়ে যায়। রুপেশের কানে সরলার ঠোঁট , ওর সুগন্ধে ভরা নিঃশ্বাস। সরলা ফিসফিসিয়ে বলে—জানলার ওপাশে কয়েকজোড়া কান খাড়া হয়ে রয়েছে। আমরা আজ কিছু করব না। লাইট নেভাব না । খানিকক্ষণ গল্প করে দুদিকে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ব। কিছু ভেব না, সব হবে। আস্তে আস্তে।

    ওরা গল্প করে। সরলা বলে ওর কলেজজীবনের কথা , আজ যে বন্ধুরা এসেছিল ওদের কথা। রূপেশ কলেজ প্রসংগ পাশকাটিয়ে যায় , ও বলে ছুরি গাঁয়ের কথা, বারউৎসবের কথা, আহিরণ নদী, কোসগাই পাহাড় ও ঝোরাসিরকি গাঁয়ে পিকনিকের কথা। সরলা উদগ্র হয়ে শোনে, কিন্তু রুপেশ ভালুমার দ্রুপতীর গল্প এড়িয়ে যায় ।

    ক’টা বাজে? আরে রাত তিনটে! এবার ঘুমুতে হবে। আমি দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুচ্ছি, তুমি ওদিকে ফিরে শোও।

    রূপেশ পাশ ফেরে, কিন্তু কানে আসে ফিসিফিসানি। --তুমি পাশ করে গেছ, ম্যানেজার, উইথ ডিস্টিংশন। যেভাবে বুড়িগুলোকে ভাগালে! ওয়াহ! আমি অপেক্ষা করছিলাম। তুমি ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে গেলে আমি মুখ খুলতাম। চুল দিয়ে পা মোছা? মাই ফুট!

    শেষরাতে জলতেষ্টায় রূপেশের ঘুম ভেঙে যায়। কেউ ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে একটা বেডল্যাম্প জ্বালিয়ে দিয়েছে ; মৃদু নীলচে আলো। অঘোরে ঘুমুচ্ছে সরলা। না ; এখন ও পুরোপুরি নীলিমা।

    জানলা দিয়ে কড়া রোদ্দূর বিছানায় এসে নানান নকশা তৈরি করেছে। এবার আঠা হয়ে লেগে থাকা চোখ খুলতেই হয় । বাইরের ঘরে হাসির হররা, গল্পগুজব, চায়ের আসর জমজমাট। রূপেশ মুখটুখ ধুয়ে টেবিলে আসতেই কোরাস—আ গয়ে! আ গয়ে!

    নানান চিমটি কাটা উড়ো মন্তব্যের মাঝখানে রূপেশ চুপচাপ চায়ে চুমুক দেয় । ওর চোখ নীলিমাকে খোঁজে, কিন্তু কোথায় ও?

    বাবা বারান্দায় বসে খবরে কাগজ পড়ছেন। বড়দা দরজার কাছে ডেকরেটার্সের বিল মেটাচ্ছে। এখন চায়ের টেবিলে শুধু অল্পবয়েসিদের গুলতানি। বিয়ে উপলক্ষে আসা কিছু রিস্তেদার ও মেহমান। বড়বৌদি এই আসরের মধ্যমণি। সরলা ওঁর তুতো বোন হওয়ায় উনি একাধারে বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসি। একজন প্রগলভা মুচকি হেসে বৌদিকে বললেন— কল রাতকো ক্যা হুয়া? বিল্লি মারী গয়ী কি নহীঁ ? হ্যায় কোই খবর?

    বৌদি মুখ ভ্যাঙচালেন—হুঁ; ইয়ে রৌয়া ক্যা বিল্লি মারেগা? মেরে পাস পাক্কি খবর—বিল্লা মর গয়া।

    (এ ছোঁড়া কী বেড়াল মারবে? হুলোটাই অক্কা পেয়েছে, পাকা খবর।)

    রূপেশ উঠে বাগানে চলে যায় ।

    পরিবারের বড়ে বুজুর্গের অভিমত হল রূপেশ আগে ডিউটি জয়েন করে ছোটি বহুকে রাখার মত একটা ঠিকঠাক বাসস্থান খুঁজে নিক, তারপর বৌমা যাবে। বৌমার ভাই গিয়ে দিদিকে ছেড়ে আসবে।

    ছুটি ফুরিয়ে এল। সরলা স্বামীর স্যুটকেস গুছিয়ে দিচ্ছে। বলছে তাড়াতাড়ি ঘর খোঁজ, এখানে সারাক্ষণ ঘোমটা দিয়ে দিয়ে আমার ঘাড়ে গলায় ঘামাচি ভরে গেছে।

    ওরা গিফট পেয়েছে অনেক। ইস্পাতনগরী ভিলাইয়ের লোকজন; সমানে স্টিলের বাসনকোসন দিয়েছে । তিনটে নানা মাপের প্রেসার কুকার, কেক ওভেন, থার্মোফ্লাস্ক, টি- সেট , আরও কত কি । সরলার ইচ্ছে বেশির ভাগ এখানে রেখে যাবে , নেহাৎ যতটুকু দরকার তাই নিয়ে যাবে ।

    শাড়ি সালোয়ার কামিজ আগেই আলমারিতে তোলা হয়ে গেছল। এখন ও ছোটখাটো গিফটগুলো প্যাকেট খুলে খুলে আলাদা করে রাখছিল। দেবীদয়াল কোম্পানির স্টিলের চা-খাওয়ার মগ এখন নতুন ফ্যাশন। এটার এসেছে দুটো সেট। ও দুদিকে দুটো সেট রেখে বলল—এটা এ’বাড়ির জন্যে , অন্যটা ও বাড়ির, মানে আমরা নিয়ে যাব।

    শাশুড়ি ঝাঁজিয়ে উঠলেন। এ’বাড়ি ও’বাড়ি আবার কি! সব তো একই—ইয়ে সমঝ লো বহু।

    সরলা জবাব না দিয়ে শাশুড়ির চোখে চোখ রেখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল, উনি উঠে রান্নাঘরে চলে গেলেন ।

    ঘোরাপাট কলোনিতে ২/২৮ নম্বর লেবার কোয়ার্টার চামারসায়ের নামে কয়লা কোম্পানির খাতায় চড়েছে একবছর আগে। রূপেশ দেখেটেখে বলল একবার চুণকাম করানো দরকার আর ব্লিচিং পাউডার ও সাবান দিয়ে গোটা বাড়ি, ভেতরের সিমেন্টবাঁধাই চাতাল –সব ভালো করে রগড়ে সাফ করা দরকার। কোথাও বৃষ্টির জলের দাগ, কোথাও শ্যাওলা জমে আছে। সামনের আঙিনায় কিছু আকন্দের চারা, বটের চারা এবং কাঁটাঝোপ গজিয়েছে। এসব কেটে ফেলতে হবে। এদিকে করেত আর চিতি সাপের উপদ্রব। চারদিকে এবং নালায় গ্যামাক্সিন বা নিদেনপক্ষে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দিতে হবে। কোয়ার্টারগুলোর দুটো লাইন থেকে খানিক এগিয়ে রেললাইন শুরু হয়েছে। কয়লার ছোট ছোট ট্রলি এবং খোলা ওয়াগন চলার কোল ইন্ডিয়ার নিজস্ব ন্যারোগেজ।

    তারপরেই আহিরণ নদী, এখানে ক্ষীণস্রোতা, রোগা ক্লান্ত ক্রনিক অ্যানিমিক চেহারা; ছুরি কাটঘোরার উচ্ছল আহিরণকে এখানে চেনা যায় না। কারণ, দশ কিলোমিটার আগে তৈরি হয়েছে বিশাল চেক ড্যাম, সেচের সুবিধের জন্যে। তাতে বিলাসপুর জেলার কৃষিতে এসেছে পরিবর্তন। বর্ষা কম হলেও খরিফের ধান মার খায় না এবং কিছু এলাকায় এখন রবি ফসল ও শাকসব্জীর চাষ হয়।ওখানে মিলেছে দুটি জলধারা—হসদেও আর আহিরণ।

    আজকে ব্যাংকে ঢোকার মুখে রূপেশের মেজাজ বিগড়ে গেল। বাইরের দেয়ালে স্টেনসিল করে মাপা অক্ষরে লেখা ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর স্লোগানঃ দুলহন ডোলি মেঁ, নিরোধ ঝোলি মেঁ।

    (বৌ চড়েছে দোলায়, নিরোধের প্যাকেট ঝোলায়।)

    এসব কি?

    সাহাব, স্বাস্থ্যবিভাগ সে আদমী আকে লিখকে গয়ে ।

    তুই কী করছিলি মনবোধি? মানা করিসনি?

    করে হন সাহাব, ও কহিস—সরকারি আদেশ, হর মকান কে দিওয়ার মা লিখনা জরুরী, হিসাব দেনা পড়থে, তব পগার মিলথে।

    (সবকটা বাড়ির দেয়ালে লিখতে হবে, হিসাব মিললে তবে মাইনে পাবে।)

    লোকটা কে? ডেকে আন দিকি।

    পান চিবুতে চিবুতে হাজির হল মঙ্গলরাম। বলল ওর কোন দোষ নেই। ভেলইবাজারে নতুন মিনি পিএইচ সি বা প্রাইমারি হেলথ সেন্টার খুলেছে। সেখানকার ইনচার্জ ডাক্তার মহাকালেকর ওকে বলেছেন ব্যাংকের গায়ে যেন লিখতে ভুল না হয় ।কারণ ম্যানেজার সাহাব নতুন বিয়ে করেছেন। ওঁকে সতর্ক করা আমাদের পরম কর্তব্য। রোজ আসতে যেতে চোখে পড়বে, তাহলে ভুল হবে না। ডাক্তারসাহেব আরও বলেছেন ওটাকে জোর করে মুছতে গেলে দেয়াল নোংরা হবে। তারচেয়ে কিছুদিন থাক, পরে আমরা ওর উপরে নতুন শ্লোগান লিখে দেব।

    রূপেশ দেখল চারপাশের সবাই মিটিমিটি হাসছে, এমনকি ওর ক্লার্ক এবং ফিল্ড অফিসারেরও দাঁত বেড়িয়ে এসেছে। ও আর এ নিয়ে কথা বাড়ালো না। কিন্তু ফিল্ড অফিসার খান্ডেকে বলল মুভমেন্ট রেজিস্টারে এন্ট্রি করে ১৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি গ্রাম আমাখোখরাতে রিকভারি করতে যেতে হবে। অন্ততঃ সাতজন ডিফল্টার আছে। চাপরাশি মনবোধিকে সঙ্গে নিয়ে যাক । মোটরবাইকের ডিকিতে ইন্সপেকশন কার্ড, ডিপোজিট স্লিপ এবং অংগুঠা বা বুড়ো আঙুলের ছাপ নেওয়ার জন্যে স্ট্যাম্প প্যাড নিতে যেন না ভোলে।

    বিকেল চারটে বেজে গেছে। ক্যাশ বন্ধ হয়ে গেছে। রূপেশ আর ক্যাশিয়ার নরেশ মিলে দিনের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে—ডে বুক, ক্যাশ বুক, জেনারেল লেজার, পোস্টিং চেকিং । তারপর ক্যাশ মিলিয়ে সিন্দুকে ভরেছে কি হাসিমুখে মকান মালিক দাদুসাব এসে হাজির। আজ বোধহয় গল্প করার মুডে এসেছেন। নিজেই চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললেন—দেখলামএখন ভিড় প্রায় নেই। আর বিয়ে করে এসেছেন তারপর কথাবার্তাই হয়নি। ম্যাডামকে নিয়ে আসার পর একদিন কিন্তু আমার গরীবখানায় দুটি ভাত খেতে হবে, আগেভাগে বলে রাখলাম। এ নেমন্তন্ন আমি নয় , আমার ঠাকুরাইনের পক্ষ থেকে, না করতে পারবেন না।

    আসলে চাপরাশি বুধরামকে চোর অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেয়াটা রূপেশ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে ও এতদিন দাদুসাহেবের হাভেলি মাড়ায় নি।

    আজ নতুন চাপরাশিও অফিসারের সঙ্গে তল্পিবাহক হয়ে ফিল্ড ভিজিটে গেছে। তাই রূপেশ নিজেই কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে দাদুসাবকে দিল। অবস্থা বুঝে উনিও নিজের গরু-মোষকে জাব দিতে থাকা কামিয়াকে ডেকে হুকুম করলেন—যা, ভেতর বাড়ি থেকে তিনকাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়। তাজা দুধ দিয়ে, মালাই শুদ্ধু।

    নানান কথাবার্তার পর গলার স্বর নামিয়ে বললেন—সেদিন গিরিধারী পাটোয়ারি এসেছিল না? ও কিন্তু জলের উপরে যতটা তার চারগুণ নীচে; মহা গুরুঘন্টাল।

    --কি যে বলেন! ও তো রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পাওয়া পাটোয়ারি, এই জেলায় একমাত্র।

    --আরে, পুরস্কার লোকে নানান নিয়মের ফাঁকে পেয়ে যায় । ঠিক আছে, চা এসে গেছে, চুস্কি নিতে থাকুন আর আমার গল্প শুনুন।পাঁচবছর আগের কথা , গিরিধারি এই রেভিনিউ সার্কেলে নতুন যোগ দিয়েছে । দুটো মাস গেল না ওর নামে চারদিক থেকে কমপ্লেইন। শিকায়েত গুলো বেশ সিরিয়াস। ও নাকি পয়সা খেয়ে কোন বিধবার জমি কোরবা শহরের কোন নগরশেঠকে বেচে দিয়েছে। ও সরকারে খাস জমি ডাইভার্সন করিয়ে বেনামে নিজের ছেলের জন্যে কিনেছে। চেন দিয়ে মাপার সময় বড়ভায়ের জমি ছোট ভায়ের অংশে দেখিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে তারপর শোধরাবার নাম করে দুদিক থেকেই পয়সা খেয়েছে। বিলাসপুরে অ্যাডিশনাল কলেক্টরের দপ্তরে ওর নামে একটা আলাদা ফাইল খুলে গেল। কিন্তু ওপরতলায় ওর এত সুনাম যে কেউ বিশ্বাস করল না , ভাবল কুচুটে হিংসুটেদের কারসাজি। ফলে কোন এনকোয়ারি হল না ।

    এবার এল একটা কমপ্লেইন যে ও নাকি আহিরণ নদীর পারে ছোটকি ছুরি গাঁয়ে কোন আদিবাসীর জমি আদিবাসী নয় এমন কাউকে বেচতে সাহায্য করেছে, তার জন্যে রেভিনিউ রেকর্ডে কারচুপি করেছে। এই কমপ্লেইন আবার কোন এক আদিবাসী মহাসভা ফরওয়ার্ড করেছে। সবার টনক নড়ল। স্থানীয় সাব-ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে অনুসন্ধান দল এল। সমস্ত কাগজপত্র উলটে পালটে দেখল, অভিযোগকর্তাদের সবার সঙ্গে কথা বলল।

    শেষে কী পেল? প্রত্যেকটা অভিযোগ মিথ্যে, এসব কিছুই হয়নি। আর যাদের নাম তারা কেউ অভিযোগ করেনি, ব্যাপারটা পুরো জালি। কী বুঝলেন?

    --- মানে আগের ধারণাটাই ঠিক; কোন হিংসুটে স্বার্থপর কেউ—

    মিটিমিটি হাসেন দাদুসাহেব—ম্যানেজার মহোদয়, আপনি কিস্যু বোঝেননি। অবশ্যি কলেক্টরের অফিসও কিচ্ছু বোঝেনি। আসলে ওই সব জাল শিকায়তগুলো পাটোয়ারি নিজেই করিয়েছিল – মানে প্রথম বছরে এবং নিজের বিরুদ্ধে। এর ফলে প্রশাসনের ধারণা হল যে গিরিধারি পাটোয়ারি একেবারে ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য ওর নাম পাঠিয়ে দেওয়া হল। যথাসময়ে পেয়েও গেল।

    তারপরের বছর থেকে ও দেদার ঘুষ খেতে লাগল, তবে কাগজপত্রে সাবধান থাকত। যখন সত্যি সত্যি কমপ্লেইন গেল, রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের কর্তারা কেউ বিশ্বাস করল না। ভাবল সব জালি; এই পাটোয়ারি বড়জোর ডাল-ভাতের সঙ্গে নুন মিশিয়ে খেয়েছে।

    বুঝলেন তো! একটু সামলে থাকবেন।

    ইতিমধ্যে হাজির দুই শ্রীমান—ফিল্ড অফিসার খান্ডে ও মনবোধি চাপরাশি। মোটরবাইক থেকে নেমে হলে ঢুকে ব্রিফকেস টেবিলে রাখল। সাতহাজার চারশ’ টাকা রিকভারি এসেছে, আগামী দিনের অ্যাকাউন্টে এন্ট্রি হবে। কিন্তু দু’জনের দাঁত বেরিয়ে আছে, কিছু একটা মজার ঘটনা শোনাতে চায়?

    --স্যার, আজ আপকে মনবোধি তো ফোড় ডালা। এক হোঁশিয়ারচন্দ কী বোলতী বন্দ করওয়া দী। এক উপরচালাকের মুখ বন্ধ করে ছেড়েছে।

    রূপেশ কৃত্রিম গম্ভীর মুখে বলে—কী করেছিস রে মনবোধি? কোন ঝগড়া বাঁধাস্ নি তো?

    ও মাথা নাড়ে। রূপেশ ফিল্ড অফিসারকে বলে- অ্যাই খান্ডে, তুই খুলে বল দিকি।

    --স্যার , দশ কিলোমিটারের মাথায় ঘোগরা নালা আছে না ? তার পাশে একটা জায়গায় রাস্তাটা বড্ড সরু, দুটো সাইকেলও পাশাপাশি যেতে পারেনা । হয়েছে কি, উলটো দিক দিয়ে একটা সাইকেল আসছিল, কিছুতেই রাস্তা ছাড়বে না। এদিকে আমাদের রাজদুত মোটরবাইক কোনরকমে বেরিয়ে যাবে। ওই জায়গাটায় পিছিয়ে আসা মুশকিল। শুরু হল তক্কাতক্কি। মনবোধি বলল আমরা ব্যাংকের জরুরি কাজে যাচ্ছি। রাস্তা ছেড়ে দাও। সেই ওপরচালাক বলে কি বেশি ব্যাংক দেখিও না। গাঁয়ে থাকি বলে গেঁয়ো নই , আমিও গ্র্যাজুয়েট। কিসের গ্র্যাজুয়েট? বিএ? নাকি বি কম? ও বলল আমি ল’ গ্র্যাজুয়েট। মনবোধি মুখ ভেঙচে বলল—এঃ ল’ গ্রাজুয়েট! পুরো ডিগ্রিটা বল।

    --এল এল বি; মানে ব্যাচেলর অফ ল’।

    --ভুল; ব্যাচেলর অফ লজ। বহুবচন হোগা, কিঁউকি কানুন এক নেহি, অনেক হোতে হ্যায়।

    হতভম্ব দেড় হোঁশিয়ার রাস্তা ছেড়ে দিল।

    --সাবাশ! এটাতো সেলিব্রেট করার মত। যা, বনোয়ারির হোটেল থেকে আমার নামে এক পো ভাজিয়া (ফুলুরি) আর পাঁচটা চা নিয়ে আয়।

    এমন সময় খান্ডে জিগ্যেস করে—স্যার, ভাবীজি কব পধারেঙ্গে? কমরে কা সাফ সাফাই পোতাই সব হো গয়া হ্যায়। ঘর পরিস্কার করা চূণকাম সব হয়ে গেছে।

    --আগামী রোববার। আমার শালা নিয়ে আসছে।

    দাদুসাহেবের চেহারা কোন অজ্ঞাত কারণে উজ্বল হয়ে ওঠে।

    --তাহলে বহুজি আসার পরের রবিবার আমার বাড়িতে –দোপহর কা ভোজন? ইয়াদ রাখেঙ্গে না?

    তৃতীয় ভাগ


    ৬ )

    নিমকি থুড়ি সরলাকে নিয়ে ওর ছোটভাই মনীশ ঠিক পরের রোববারেই হাজির হল। সেই ভিলাই থেকে এই গেওরা কয়লাখনি এলাকা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূর; সকালে রওনা দিলেও পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। রূপেশ একটা জীপ ভাড়া করে ওদের স্টেশন থেকে আনতে গেছল। দেখল নেই নেই করেও ছোট বড় সাতটা স্যুটকেস এসেছে, আবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত একটা পোর্টেবল টিভি।

    মনীশ সদ্য কলেজে ঢুকেছে। ক্লান্ত হলেও চারদিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছে। কোয়ার্টারের কাছে আহিরণ নদী! ভারি মজা তো।খালি বলল—জীজাজি, আপনার এখানে এত গরম, কোন কুলার নেই? আর কোয়ার্টারের ছাদ এত নীচু কেন? তাই এরকম লাগছে। একটা ভাল দেখে কোয়ার্টার নিন না!

    রূপেশ বলে যে কয়লাখনি অঞ্চলে লেবার কোয়ার্টার এমনই হয়।মনীশ একটু অবাক হল, জীজাজি তো ব্যাংক ম্যানেজার, লেবার কোয়ার্টারের কথা উঠছে কেন? তাহলে কি বিয়ে দেওয়ার সময় ওর দিদিকে ঠকানো হয়েছে? ব্যাজার মুখে দিদিকে বলে --খাট-টাট না এনে ভাল করেছিস। এত ছোট দরজা দিয়ে ঢুকতো না ।

    রূপেশ বোঝায় যে গ্রামীণ ব্যাংক খনিবিভাগের ব্যাংকার নয় , তাই ওদের কোন কোয়ার্টার দেবার প্রশ্নই ওঠে না । গাঁয়ে পাকা বাড়ি নেই বলে আপাততঃ এক লেবার কোয়ার্টারে ঠাঁই হয়েছে। তবু মনীশের মুখের মেঘ কাটে না । বলে – আপনার ব্যাংক সরকারি ব্যাংক তো? কোন প্রাইভেট বা কো-অপারেটিভ ব্যাংক না তো?

    রূপেশ হেসে বলে—আজ রোববার । কাল তোমাকে গেওরা গাঁয়ে আমার ব্যাংকে নিয়ে যাব। তাহলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।

    দিদি এবার ভাইকে মৃদু বকুনি লাগায়। হয়েছে হয়েছে; এবার চান করে ভাত খেয়ে একটু গড়িয়ে নে। সেই সকালে বেরিয়েছিস।

    সন্ধ্যের মুখে শালা জামাইবাবুর যৌথ প্রচেষ্টাতেও চোদ্দ ইঞ্চির সাদা কালো ছোট টিভি সাড়া দিল না । স্ক্রীনে শুধু ঝিলমিল ঝিলমিল বা সাদা সাদা দানা, যেন কাঁচের জানলায় বৃষ্টির ফোঁটা । মনীশ গজগজ করে।

    আপনার কি আসে যায়? আপনি তো ব্যাংকের কাজে ব্যস্ত থাকবেন। আমার দিদি সারাদিন কী করবে? এই অশিক্ষিত লেবার পাড়ায় একটা কথা বলার লোক নেই।

    রূপেশ সরলার দিকে তাকায়। সরলা চোখের ইশারায় মানা করে। তারপর ভাইকে বলে—তোকে এতসব ভাবতে হবে না । কাল সন্ধ্যে নাগাদ তোর জীজু কোরবা থেকে একজন মেকানিককে নিয়ে আসবে। ও ছাদে উঠে এলুমিনিয়ামের পাঁচকাঠিওলা এরিয়েল লাগিয়ে দেবে । তারপর দেখবি।

    মনীশ আস্বস্ত হয় , কিন্তু জিদ ধরে কাল বিকেল নাগাদ লোক্যাল ট্রেন ধরে ও বাড়ি ফিরে যাবে । রূপেশ বলে –কাল আমার ব্যাংক দেখে নাও। তারপর বিকেলের দিকে আমি তোমাকে নিয়ে কোরবা বাজার থেকে এরিয়েল কিনে আনব। পরশু সকালে বাড়ির জন্যে রওনা দিলেই হবে। আমি নিজে গিয়ে বাসে তুলে দেব।

    পরের দিন জামাইবাবুর সঙ্গে ব্যাংক দেখতে গিয়ে মনীশ যারপরনাই হতাশ। এটা ব্যাংক? ক্যাশ কাউন্টার নেই, আলাদা ভল্ট রুম নেই, বন্দুক হাতে গার্ড নেই। হলের কোনে একটা পর্দার পেছনে সিন্দুক আর গোল্ড লোনের ছোট দাঁড়িপাল্লা! ছোঃ এ তো দুর্গের ভোলা শেঠের গদ্দীর মত ব্যাপার। জামাইবাবু হাসে, বলে নতুন ব্র্যাঞ্চ, আগামী তিনমাসের মধ্যে ক্যাশ কাউন্টার ইন্সটল হবে।

    এমনসময় হাজির হল নুর মুহম্মদ আর সোমন সোনকর। স্টেশনের কাছেই ওদের দুজনের পার্টনারসশিপের ভাত-ডাল-চিকেন এবং দেশি মদের ভোজনালয়। সপ্তাহের শেষে মজুরি পাওয়া খাদানের মজদুরেরা সোজা যায় ওর দোকানে। ভরপেট খাবার এবং যত ইচ্ছে মদ গিলে কেউ দোকানের বাইরেই মাটিতে শুয়ে পড়ে , কেউ রাস্তায় বমিটমি করে ধূলোর মধ্যেই গা এলিয়ে দেয় । নুর ওদের গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে বিড়বিড় করে—মর মর! খেয়ে মর শালারা! যত হাড়হাভাতের দল জুটেছে। নুর মদ ছোঁয় না, সুদের ব্যবসা করে না আর স্টেশনের কাছে গজিয়ে ওঠা মেয়েমানুষের ঝোপড়ার দালালি করে না।

    ওরা এসে এ মাসের স্টক স্টেটমেন্ট এবং সুদ শুদ্ধু কিস্তি জমা করে দিল। তারপর রূপেশকে অনুরোধ করল আগামী তিনমাসের মধ্যে ওদের ক্যাশ ক্রেডিট লিমিট বাড়িয়ে দিতে । কয়লা খাদান ছড়াচ্ছে, কয়লা তোলা শুরু হয়েছে। সরকার নতুন দুটো গাঁ নিয়ে নেবে বলে নোটিস দিয়েছে। মজুরের সংখ্যা বাড়ছে, ওর ভোজনালয়ের খদ্দেরও খুব বেড়েছে। সাহেব একটু বিবেচনা করুন।

    সাহেব বলে যে খদ্দেরদের ভিড় সামলে বিকেল নাগাদ ও এদের লোন প্রপোজাল নিয়ে আলোচনা করতে পারে, তার আগে নয় ।

    ঠিক আছে, আমরা ততক্ষণ শালাবাবুকে কোরবা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। রূপেশ কিছু বলার আগে মনীশ লাফিয়ে ওঠে। হ্যাঁ, হ্যাঁ; সেটাই ভাল। জীজাজি এখন ব্যাংকের কাজে ব্যস্ত থাকবেন। আমি গিয়ে টিভির এরিয়েল কিনে আনি।

    রূপেশ নুর মহম্মদকে সতর্ক করে। ওরা যেন রেলপুলের ওপর দিয়ে না গিয়ে আহিরণ নদী নীচের রফটা দিয়ে পেরোয়।

    সোনকর সঙ্গে সঙ্গে মাথা হেলায়। সে আর বলতে! আপনার একলৌতা শালেসাহাব। হম কোই রিস্ক নহীঁ লেঙ্গে। ‘সারে দুনিয়া এক তরফ, জরু কা ভাই এক তরফ’ ।

    (গোটা দুনিয়া একদিকে তো গিন্নির ভাই আরেকদিকে।)

    ওরা বেরিয়ে পড়ে। নুরের ইয়েজদি মোটরবাইকে ওরা তিনসোয়ারি। মাঝখানে মনীশ। আহিরণ নদীর পাড়ে রেললাইনের সামনে এসে নুর বাইক থামায়। একটি ছেলে এসে মোটরবাইকের হ্যান্ডল ধরে, নুর ওর হাতে একটা টাকা গুঁজে দেয়। মনীশ অবাক হয়ে দেখে ওই ছেলেটি অবলীলায় বাইকের গিয়ার নিউট্রাল করে রেললাইনের উপর গাড়ির চাকা তুলে বাইকটা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। ও পা রাখছে কাঠের স্লিপারের উপরে। কিন্তু দুটো স্লিপারের মধ্যে বিশাল ফাঁক, নীচে আহিরণ এখন ক্ষীণকায়া। পুলটা পেরোতে অন্ততঃ পাঁচ সাত মিনিট লাগবে। এর মধ্যে যদি রেল আসে। ওঃ , ও তো সকালে একবার, বিকেলে একবার। কিন্তু মালগাড়ি? কয়লা বোঝাই? তা হতে পারে । তখন মাঝে মাঝে যে সাইডে একটা টাওয়ারের মত করা আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াবে। সময় পাওয়া যায়? আরে ট্রেন এখানে স্পীড কম করে সিটি বাজাতে বাজাতে আসে।

    এবার নুর মনীশকে জিজ্ঞেস করে।

    --তোমার জামাইবাবু বলেছেন রেললাইনের উপর দিয়ে না যেতে, নীচের রফটা বা রামের সেতুবন্ধ দিয়ে যেতে। একদম সেফ। কিন্তু তুমি এখন অ্যাডাল্ট, ভোট দেবে । তুমি কি বল?

    -- রিস্ক নেই?

    --আছেও আবার নেইও। মানে আমরা পাশাপাশি চলব দুদিক দিয়ে, তোমার হাত ধরে। তাহলে কোন রিস্ক নেই।

    --তাহলে নীচে পাইপ, বাঁশ ও বালি ফেলে ওই সেতুবন্ধ কেন তৈরি হয়েছে?

    --ওটা সীজনাল। এখন বর্ষা থেমে গেছে, জল কমে গেছে তাই। পাঁচ মাস টিকবে। তারপর রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, পয়সা লাগে না । রফটায় মানুষ পিছু আট আনা। দেখ কত মেয়েরা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে নদী পার হচ্ছে। তুমি নওজোয়ান, পারবে না?

    ওরা লাইনের উপর পা রাখে। মনীশ বুঝতে পারে এদের কথায় না নেচে নীচের রফটা দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। অন্ততঃ পঁচিশ ফুট নিচে দিয়ে বইছে আহিরণ, জল কমে যাওয়ায় জেগে উঠেছে উটের পিঠের মত পাথরের বড় বড় বোল্ডার। সোনকর সাবধান করেছিল—নীচের দিকে তাকাবে না, নইলে স্লিপারের ফাঁক দিয়ে জল আর পাথরের দিকে চোখ পড়লে মাথা ঘুরবে। তুমি সামনে দেখ, খালি আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটার পর একটা স্লিপারে পা ফেলতে থাক। আর কিচ্ছু ভাববে না । হঠাৎ দেখবে ওপারে পৌঁছে গেছ। ওরা ওকে অন্যমনস্ক করতে গল্প করতে থাকে। মনীশ শুধু মনে মনে ভগবানকে ডাকে—যেন কোন মালগাড়ি না আসে। কিন্তু ভগবানকে একমনে ডাকা এত সহজ নয়। উলটো দিক থেকে আসছে পুরুষ ও মেয়ের দল, কেউ সাইকেল ঠেলছে, কারও কাঁধে ব্যাগ, কারও মাথায় বোঝা। একটা মেয়ে ওর মুখোমুখি, সাইড চাইছে—থোড়কন খসকো সাহাবজি! একটু সরে দাঁড়াও গো সাহেব।

    কিন্তু ও কোথায় সরবে? তাহলেই তো নীচে জল আর –। ওর হাঁটু কাঁপে থরথর করে।

    নুর হেসে মেয়েটিকে বলে—নয়া আদমি। মেহমান। তঁয় খসক না ও!

    মনীশ অবাক হয়ে দেখে মেয়েটি নিজের একপায়ের পাতায় আর একপা তুলে ত্রিভঙ্গমুরারী পোজে ব্যালান্স সামলায়। ইতিমধ্যে আরেকটি বাইক ঠেলে এপারে ফিরে আসতে থাকা ছেলেটি চেঁচিয়ে নুরকে জানিয়ে দেয় যে ওর ইয়েজদি ওপারে গয়ারামের হাতে।

    ওপারে পৌঁছে মনীশ একটা পাথরের উপর বসে পড়ে, ওর মুখ ফ্যাকাশে। নুর ওর পিঠ চাপড়ে দেয় । তারপর নুর ওকে পাঞ্জাবি ধাবার দালচিনি দেওয়া গরম চা খাওয়ায়। বলে –চল আগে শহর ঘুরিয়ে আনি। সীতামড়ি, পাওয়ার হাউস, মানিকপুর কলিয়ারি। তারপর ওই জায়গাটা দেখাব যেখানে রাস্তাটা নীচে, আর নদী আমাদের মাথার উপর দিয়ে যাবে। সে আবার কী? চলই না, নিজের চোখে দেখলে তবে বুঝবে। দু’ঘন্টা ধরে ওরা নতুন গড়ে ওঠা কোরবা-বালকো বাইকে করে চষে ফেলে। এরমধ্যে একজায়গায় তড়কা রুটি খাওয়া হয়ে যায়।

    --সিগ্রেট খাও? লজ্জা কর না। জীজাজিকে বলব না । কেনা হয় টিভির জন্যে এলুমিনিয়ামের এরিয়েল, নুরের চেনা থাকায় ১০% কমদামে। ফেরার সময় ওরা রফটা দিয়ে নদী পার হয় । তার আগে এপারে সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দিরে পূজো দিয়ে সোনকর আর মনীশ এক টাকা করে প্রণামী দেয় । পূজারী ওদের দুজনের কপালে গোলা সিঁদুরের টিকা লাগিয়ে দিয়ে নারকোলকুচি আর নকুলদানার প্রসাদ দিলে মনীশ দিদি জামাইবাবুর জন্যে খানিকটা নিজের রুমালে বেঁধে নেয় ।

    নুর বাইকের উপর বসেছিল। হেসে বলে –ব্যস, এবার নিশ্চিন্ত। ওই টিকা দেখলে সাহেব আর কিছু জিগ্যেস করবেন না ।

    সন্ধ্যেবেলা চালু হল টিভি। কোন মেকানিক নয়, সোনকর নিজে এসে এরিয়াল কোরবার দিকে মুখ করে ফিট করে দিয়েছে। কালো ছবিতে শুরু হয়ে গেল জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘নুক্কড়’। মানে সরু গলি । মুম্বাইয়ের চাল এবং তাতে মাথা গোঁজা নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের কৌতুকের ছোঁয়া লাগা গল্প। মনীশের মুড এক্কেবারে হলিউড জলিগুড। খেতে বসে কথায় কথায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কুড়ি ফুট উঁচু ন্যাড়া রেললাইনের স্লিপারে পা রেখে এগোতে লাইনের ফাঁক দিয়ে আহিরণকে দেখে কেমন বুক ধুকপুক করছিল।

    মনীশের মুখ গম্ভীর। নুর মুহম্মদ কাজটা ঠিক করেনি। মনীশ ওর হয়ে সাফাই দেবার চেষ্টা করল –ইতনী ঘাবড়ানে কী ক্যা হ্যায় জীজাজি? কিতনী লড়কিয়াঁ সর পে বোঝা লেকে লাইন পার কর রহী থী? বারিশ কী মৌসম মে ভী –। মতলব নুর ভাইয়া বোল রহে থে কি --

    ধমকে উঠল রূপেশ।

    তোমার নুর ভাইয়া এটা বলেছে কি প্রতি বর্ষায় অন্ততঃ তিনজন মেয়ে -পুরুষ পা পিছলে ওখান থেকে নদীতে পড়ে ভেসে যায় আর ওদের বডি তিনচার কিলোমিটার দূরে নদীর পাড়ে ফুলে ঢোল হয়ে ভেসে ওঠে? গত মাসে আমার ক্লায়েন্ট দুরপা গাঁয়ের বীরবল স্কুটার নিয়ে লাইন পার করছিল। ট্রেন আসায় ওই পাশের লোহার মাচানের মত তাতে গিয়ে দাঁড়াল স্কুটারটা ধরে। খেয়াল করেনি যে স্কুটারের পেছনের দিকটা লাইনের অনেকটা কাছে। হল কি, ট্রেনের লোহার ফুটবোর্ডটা ওর স্কুটারকে ছুঁয়ে গেল। সেই ধাক্কায় ও স্কুটার সমেত উড়ে গিয়ে নদীতে পড়ল। দু’দিন পরে লাশ ভেসে উঠল ।

    সবাই খানিকক্ষণ চুপ। দূরদর্শনে কবিতা শ্রীবাস্তব নিউজ পড়ছেন। খানিক পরে নিমকি উঠে গিয়ে টিভি বন্ধ করে দেয় । মনীশ অস্বস্তি কাটাতে গিয়ে বলে—জানেন জীজাজি, দূরদর্শনে আর একজন নিউজ পড়ে—নজমা সুলতান। দারুণ দেখতে কিন্তু কি গম্ভীর! আমাদের কলেজের একজন বাজি ধরেছে নজমা নিউজ পড়ার শুরুতে বা শেষে যেদিন একটু হাসবে সেদিন ও আমাদের সবাইকে দোসা খাওয়াবে।

    পরের দিন সকালে উঠে মনীশ ব্যাগ গোচ্ছাচ্ছে, সরমা ব্যস্ত জলখাবার বানাতে। রাত্তিরে এখানে হল্ট করা অশোক বাস সার্ভিসের গাড়ি স্টেশনের কাছ থেকে ঠিক সাড়ে সাতটায় ছেড়ে দেয় । সরমা ভাইয়ের এয়ারব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে। ধরা গলায় বলল – বাড়ি ফিরে নাঙ্গা রেললাইনের উপর দিয়ে সার্কাস করার গল্পটা কাউকে বলার দরকার নেই।

    মনীশ এবার দিদি-জামাইবাবুর পা ছুঁয়ে কাঁধে ব্যাগ তুলে নিল। রূপেশ ওর বাইকটা বের করে ইগনিশনের চাবি লাগিয়ে দিয়ে স্টার্ট দিতে যাবে, এমনসময় একটা খ্যানখেনে গলার চিৎকারে শান্ত নিস্তরঙ্গ সকাল খানখান হয়ে গেল। গায়ে গায়ে লাগা লেবার কোয়ার্টারের লাইনের ওমুড়ো থেকে এক বুড়ির অশ্রাব্য গালাগাল। সে কোন অদৃশ্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশ্লীল শব্দের তুবড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে ।

    আশেপাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না । শুধু প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে উনুন ধরিয়ে রাখা হয়েছে। পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে নীলচে আর সাদা ধোঁয়া । খানিকক্ষণ পরে উনুন ধরে গেলে ধোঁয়া ওঠা বন্ধ হয়ে গনগনে আঁচ দেখা দেবে। তখন সবাই উনুনগুলো ভেতরে নিয়ে যাবে। এ তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু আজকের এই ঘটনায় সবাই হতভম্ব।

    সরলা শুধোয়—ইয়ে কা শুরু হুয়া? সুবহ সুবহ? সাতসক্কালে এসব কী শুরু হল?

    রূপেশ বাইক স্টার্ট করে বলে—এসে দেখছি। এখন সময় নেই, বাস ছেড়ে দেবে।

    যথাসময়ে বাস ছেড়ে দিল। দিদিকে একা ছেড়ে যাচ্ছে, মনীশের গলা ধরে যায় । জামাইবাবু, দিদিকে একটু দেখবেন। দিদি খুব ভালো, কিন্তু বড্ড অভিমানী।

    ফিরে এসে দেখল ধুন্ধুমার লেগে গেছে। চারপাশের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসেছে গোটা ভারতবর্ষ। সর্দার হিম্মৎ সিং ডোজার ড্রাইভার, পঞ্চপকেশন ইলেক্ট্রিশিয়ান, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার মাইতি, পাম্প অপারেটর দেবাঙ্গন এবং কার্পেন্টার লাকড়া; কে নেই? হইহট্টগোলের মধ্যে অনেক কষ্টে যা বোঝা গেল তা হল পটেল বুড়ির বাড়ি থেকে কে বা কাহারা একটি মুর্গী চুরি করিয়াছিল দিন দুই হইল। গতকল্য প্রতিবেশি কোয়ার্টারের সাহু ম্যাসন বা রাজমিস্ত্রির নববিবাহিত বৌয়ের পাকশালা হইতে মাংস রন্ধনের সুগন্ধ বুড়িমার নাকে প্রবেশ করে। তাহার সন্দেহ উহা চুরির মাংস। সাহু ম্যাসনের বৌটি একটি পাকা চোর। গত সপ্তাহে বেড়াইতে আসিয়া সে বুড়ির ঘেরা আঙিনায় চরিতে থাকা দশটি মুরগীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিপাত করিতেছিল। বুড়ির চক্ষে তাহা ধরা পড়িয়াছিল। এইরূপ অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে বুড়ি সাহুবৌয়ের নামে সোজাসুজি অভিযোগ করিলে যুবতীটি অস্বীকার করে কিন্তু বুড়ির গালাগালির এবং অভিসম্পাতের তোড়ে পলাইয়া গিয়া নিজগৃহে কপাট বন্ধ করিয়া কাঁদিতে থাকে।কারণ বুড়ি ছত্তিশগড়ি প্রাকৃত বুলিতে যাহা বলিতেছিল তাহার নিগলিতার্থ হইল এই বৌটি স্বভাবতঃ বারভাতারি, বাপভাতারি এবং ভাইভাতারি!

    তামিল ইলেক্ট্রিশিয়ান পঞ্চপকেশন এবং কার্পেন্টার লাকড়া বুড়ির সন্তানকে বুঝাইতে চেষ্টা করে যে উক্ত মাংস কাল সাহু ইহাদের সঙ্গে বাজারে নুর মুহম্মদের হোটেলের পাশের দোকান হইতে কিনিয়াছে। উহারাও একই সময়ে কিনিতেছিল। অতএব তুমি তোমার মাতা ঠাকুরাণীকে ঘরের ভিতরে লইয়া গিয়া এক গেলাস গরম চা খাওয়াও। ইহা কলিয়ারির ভদ্রলোকের পাড়া । সবাই সজ্জন এবং সংস্কৃতিবান। এবংবিধ ভাষা ও সম্বোধন। তোমার মাতাঠাকুরাণী আমাদের সবার প্রণম্য, নহিলে---। এখন সবাইকে ডিউটি যাইতে হইবে। বৃথা কালক্ষয় করিও না।

    গালির স্রোত বন্ধ হয়েছে। সরলা মাটিতে আসন পেতে স্বামীকে ভাত বেড়ে দেয়। রূপেশের রওনা হবার সময় বলে – এ পাড়ায় বেশিদিন থাকা যাবে না মনে হয় ।

    রূপেশ আশ্বস্ত করে জানায় যে ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় এবং স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে; সঙ্গেকিছু দু-বেডরুমের ভালো কোয়ার্টার । সেখানে একটা কোয়ার্টার ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে।

    সরমার চোখমুখ উজ্বল হয়। আচ্ছা? তা কতদিন লাগবে মনে হয়?

    --বেশিদিন না। ধর মেরেকেটে বছরখানেক।

    --সে কি! তুমি কি আগামী বছরও এখানেই থাকবে নাকি ম্যানেজার? ট্রান্সফার হবে না?

    -- হতেও পারে। কিন্তু তার জন্যে মালা জপতে শুরু না করে চারপাশটা ভাল করে ঘুরে নাও। এখানের কয়লা খাদান, আহিরণ নদী, অজগরবাহারের জঙ্গল আর ডলোমাইট বক্সাইটে ভরা ফুটকা পাহাড়ে পিকনিকের কথা ভাব। প্রত্যেক রোববারে আমরা কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাব। দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে যাবে ।

    ব্যাংক বন্ধ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে সাতটা। এসে দেখে আজ পাড়ায় কলিয়ারি থেকে ফ্রিতে সিনেমা দেখানোর কথা। একটা মাঠের মত, তাতে ১৬ মিলিমিটারের পর্দা টাঙানো, সামনে প্রোজেক্টর ফিট করে খুটখাট কাজ চলছে। আজকের ফিল্ম মেহমুদ অভিনীত “সব সে বড়া রূপাইয়া”। শুরু হবে আটটা নাগাদ। সবাই উৎসাহের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে। ঘরে ঘরে গরম রূটি সেঁকার গন্ধ; খেয়েদেয়ে সপরিবারে মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে বা খবরের কাগজ পেতে বসে ফুল মস্তি।

    ঘরে গিয়ে দেখে সারাদিনে সরলা ঘর গুছিয়ে নিয়েছে সুন্দর করে।

    জান, পাশের বাড়ির দেবাংগন গিন্নি এসেছিল। একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাব কিনা জিজ্ঞেস করছিল। বললাম মাত্র এসেছি, ঘর গোছানো বাকি। পরের বার নিশ্চয়ই যাব। টিভি চালাই?

    --নাঃ, ছেলেটা এত শখ করে এনেছিল। আজ ও নেই, কাল থেকে চালাব।

    খাওয়ার পাট চুকিয়ে সরলা বাইরের দিকের জানলাটা বন্ধ করে দেয় । রূপেশ দেখেও দেখেনা। ঘরে জ্বলছে জিরো পাওয়ারের নাইট ল্যাম্প; নীল রঙের। সরলা শাড়ি পালটে একটা নাইটি পড়েছে। রূপেশ নিজের পরিবারে কাউকে নাইটি পরতে দেখেনি। ওর চুলও অন্যরকম করে বাঁধা । বিছানার চাদরে বালিশে জেসমিনের সুগন্ধ। সরলা প্রশ্ন করে—তুমি আমাকে কী দেবে?

    মানে?

    না, মানে দ্বিরাগমনে ভিলাই গেলে সহেলিরা জিজ্ঞেস করছিল –তোর বর তোকে সুহাগরাতে কি দিয়েছে? আমি বলতে পারিনি। বলেছি আগে ওর ঘরে যাই তবে তো!

    আচ্ছা, আমাকে কেউ বলেনি যে এসময় কিছু দিতে হয় ।

    ইটস ওকে ম্যানেজার। ওসব পরে দেখা যাবে। তুমি জল খাবে?

    রূপেশের কিছু মনে পড়ে। ও উঠে গিয়ে নিজের অফিসের ব্যাগ খুলে একটা প্যাকেট বের করে। নীলিমা তাকিয়ে আছে। বেরিয়ে আসে একটা টেপ রেকর্ডার কাম ক্যাসেট প্লেয়ার। প্যানাসোনিক কোম্পানির। গতমাসেই কোরবার কপুরচন্দ এন্ড সন্স থেকে ইন্সটলমেন্টে কিনে এনে ব্যাংকের আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছিল। গজল ভালো লাগে তোমার?

    একটু পরে প্লেয়ারে জগজিত সিংয়ের দরদী গলায় বেজে ওঠে—সরকতে যায়ে রুক সে নকাব, আহিস্তা, জনাব আহিস্তা।

    (মুখের থেকে খসে পড়ছে মুখোশ, ধীরে বন্ধু, আরও ধীরে।)

    সরলা ধীরে ধীরে প্রথমে নিমকি হয়, তারপর মায়াবী নীল আলোয় নীলিমা হয়ে যায়। রূপেশ কোন কথা না বলে ক্যাসেট পালটে দেয় । আমজাদ আলীর সরোদে মালকোষ, ওর খুব প্রিয়। প্রথমে আলাপ; দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় তরফের তারে অনুরণনের ঢেউ ওঠে। ধীরে ধীরে রাগের মধ্যে রাত্রির মায়া ও তার মাদক রূপ ফুটে ওঠে। আলাপের পর জোড়ে যেন আপাত এলোমেলো ছড়ানো টুকরোগুলো যুক্ত হচ্ছে। লয় বাড়ছে। এবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। জোড় শেষ করে ঝালার তীব্রগতির সময় রূপেশের পিঠে নখ বসিয়ে ধরা গলায় নারী জিজ্ঞেস করে—তোমার কী চাই ম্যানেজার? বল, বল কী চাই?

    শিউরে উঠে পুরুষ। নারীর কানের লতিতে দাঁত বসিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে—তোকে চাই নীলু, শুধু তোকে।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অরিন | ১২ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:০৯733337
  • ভারি সুন্দর!


    "দূরদর্শনে কবিতা শ্রীবাস্তব নিউজ পড়ছেন"


    কবিতা নয়, সাধনা শ্রীবাস্তব হবে | 

  • গুরুপোকারী | 2600:1700:4540:5210:bcd6:d51:f392:1707 | ১২ ডিসেম্বর ২০২০ ০৩:২৩733338
  • লেখকের অনুরোধ অনুসারে একটি লেখা ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে, এবং, এই সিরিজের সমস্ত পর্বগুলিকে লিংক করে দেওয়া হয়েছে, আশা করা যায় এতে পড়তে সুবিধে হবে

  • Ranjan Roy | ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ ১০:৩৬733340
  • অরিন, 


        ঠিক ঠিক, সাধনা শ্রীবাস্তব। আপনার  মনে আছে দেখছি!


    আমার টিন এজ শালা ওর ফ্যান ছিল। পর্দায় দেখা গেলে আমি খ্যাপাতাম। শাশুড়ি ওকে বকতেন--- ও যে তোর দিদির বয়েসি!


    গুরুপোকারী,


      অনেক ধন্যবাদ,।

  • syandi | 2a01:c23:7c9c:3900:dc9f:7ba3:e068:7ba3 | ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০৪:০৮733363
  • রন্জন দা, আপনার লেখা পড়ার পর একটা অদ্ভূত রেশ থেকে যায়। কোন মন্তব্য করতে ইচ্ছা হয় না। আপনি লেখালেখিকে পেশা হিসাবে নিলে অনেক লেখকের ভাতে টান পড়ত এটুকু বুঝতে পারি। 

  • Ranjan Roy | ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:০১733376
  • স্যান্ডি,


      আপনার পোস্ট পড়ে বেলুন হয়ে গিন্নিকে দেখালাম।


      ভাবখানা-- হুঁ হুঁ বাবা, দেখলে? তোমার স্বর্গত পিতৃদেব ভুল করেননি। খামোকা এতদিন হা-হুতাশ করলে।


    গিন্নি-- কমেন্ট পড়ে আমার গুরুচন্ডালির স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। 

  • syandi | 2a01:c22:d4cc:eb00:5cc5:8e86:9aaa:bbab | ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:০৬733377
  • রঞ্জনদা ,


    আপনার এই লেখাটা তো অসম্ভব ভালো লাগছেই, কিন্তু  ইন জেনারেল আপনার লেখা ভালই হয়। আমি ছত্তিসগড় কোনদিন যাইনি, আর টিপিক্যাল ছত্তিসগড়ি লোকজনের দৈনিক জীবন প্রত্যক্ষ করারও সুযোগও হয়নি। কিন্তু তার জন্য রিলেট করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ছত্তিসগড়ের গ্রামের লোকজনের  সারল্য, নীচতা, ওপরচালাকি এসব মানবিক এবং অমানবিক গুণ আর কেউ এত ভালভাবে চরিত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে আঁকতে পারত না। আপনার লেখাটি ছত্তিসগড়ের গ্রাম্য জীবন ভিসুয়ালাইজ করবে দিচ্ছে। 


    আর বৌদি আপনার সাহিত্য প্রতিভাকে পাত্তা দিচ্ছেন না, এটা নিয়ে ভাববেন না। দেখেননি যে কড়া গার্ডিয়েন ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় ভাল করলেও কখনো বলে না যে ভাল রেসাল্ট হয়েছে ?  :-)

  • স্বাতী রায় | ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:১৫733381
  • মাঝখানের কটা পর্ব পড়া হয় নি। আজ সব ব্যাকলগ ক্লিয়ার করলাম। একটা অচেনা ভারতের গল্প পড়ছি । খুবই ভাল লাগছে। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন