এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • চলন্তিকা বোর্ডিং (৩)___মির্জা গালিব

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ১১ অক্টোবর ২০২০ | ২০১৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (৩ জন)


  • ১৮২৮ এ কলকাতায় এলেন গালিব। সিমলে পাড়ায় উঠলেন। বছর দেড়েক ছিলেন কলকাতায়। তারমানে ১৯৩০ ধরে নেওয়া যাক।

    “হাম থে মরনে কো খাড়ে, পাস না আয়া না সহি,
    আখির উস্ শোখকে তারকাশমে কোয়ি তীর ভি থা -?”

    - আমি তো মরবার জন্যেই দাঁড়িয়ে ছিলাম; সে-ই তো কাছে এলো না। আচ্ছা, মারবার জন্য কোনো তীরই কি ছিল না আজ রূপময়ীর তূণে?

    সে সময় কোথায়ই বা বেথুন রো আর কোথায়ই বা রামদুলাল সরকার স্ত্রীট বা মানিকতলা স্ট্রীট ! ১৩৩ নম্বর বাড়ির চারদিকই বেশ ফাঁকা ফাঁকা। বেথুন স্কুল কলেজ তো সেদিনের ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, রোজ সকালে উঠেই গালিব সাহেব দেখতেন তাঁর ভাড়া বাড়ির পূব দিকেই সিমলে বাজারের ব্যস্ততা। হৈ হৈ, হাঁক ডাক। আর এপাশে ওপাশে তখনো কিছু হোগলা’র বনবাদাড়। দু একটা শিমূল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সন্ধ্যে হলেই নিরালা নিঃঝুম আশপাশ। হয়তো মাঝরাতে শেয়ালের ডাক।

    ঐ মেঠো রাস্তা ধরেই কোনো কোনো বিকেলে বেরোতো সঙের মিছিল। এদিকে ওদিকে বেশ কয়েকটি পাঠশালা। আর সেই পাঠশালার ছাত্ররা আবার মাঝে মাঝে গান গাইতে গাইতে সকাল বেলায় চলে যেত গঙ্গাস্নানে।

    হেদুয়া তালাও পেরিয়ে আরো কিছুটা পূব দিকে গেলে মানিক পীরের আস্তানা। সেখানে পীরের কবর আজও আছে মানিকতলায়। কলকাতার এক পুরোনো ম্যাপে যা কিনা আপজন সাহেব তৈরি করেছিলেন ১৭৪২ এ, সেখানে মানিকতলা স্ট্রীটের অস্তিত্ব থাকলেও কোনো নাম ছিল না। তবে ১৭৯২/৯৩ সালে ঐ সাহেবের তৈরি আরেকটা ম্যাপে মানিকতলা স্ট্রীট এর নাম পাওয়া যায়।

    তবে গালিব কিন্তু খেয়ে যেতে পারেন নি নকুড়ের সন্দেশ। ১৮৪৪ সালে মানিকতলা স্ট্রীটের ধারেই খোলার চালের এক বাড়িতে সন্দেশের দোকান খোলেন হুগলী’র থেকে আসা গিরীশচন্দ্র দে। তখন শুধুই গিরীশ ময়রার সন্দেশ। পরবর্তীকালে গিরীশচন্দ্রের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করেন নকুড় নন্দী। শ্বশুড়ের কাছে হাতখড়ি হয় নকুল নন্দীর। পরে ওই জায়গা কিনে নিয়ে নতুন পাকা দোকান করেন নকুড়চন্দ্র। সেই থেকে দোকানের নামে জুড়ে যায় নকুড় নন্দীর নাম। গিরীশচন্দ্র দে / নকুড়চন্দ্র নন্দী’র মিস্টির সুবাসে ভেসে যায় সিমলে পাড়া।

    সে সময়ে গালিব সাহেবকে বড়লাটের অফিসে যেতে হ’ত মেঠো রাস্তা দিয়ে চিৎপুর রোড পৌঁছে, সেখান থেকে টাঙা বা পদব্রজে। নামেই ছিল চিৎপুর রোড। আসলে ওই পুরনো রাস্তাটিও কাঁচা ছিল। চারদিকে ঝোপ ঝাড় আর পুকুরের আসপাশ দিয়ে চলে যাওয়া এই রাস্তাটির কথা আমরা সেই চণ্ডীমঙ্গলের যুগ থেকেই পাই। এটাই ছিল চিত্তেশ্বরী মন্দির থেকে কালীঘাট যাবার প্রধান রাস্তা।

    আবার ফিরি গালিবের গল্পে…

    আগ্রার এক মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু। সে সময় মুসলিম শিক্ষায় আরবী ভাষাই ছিল একমাত্র বাহন। এছাড়াও পড়তে হ’ত ফার্সি। ১৮১০ সালের ৮ আগস্ট তের বছরের কম বয়সে গালিব নওয়াব ইলাহী বখশ খানের কন্যা ওমরাও বেগমকে বিয়ে করেন। এই সময় থেকেই দিল্লীতে বাস শুরু হয় গালিবের। আগ্রায় থাকাকালীনই শুরু হয় শায়েরি লেখা। কিছু শায়েরি ফার্সিতে লেখার পরে গালিব উর্দুকেই বেছে নেন শায়েরি লেখার জন্য।

    গালিবের সে সময় বিরহ প্রবল হয়ে ওঠে। মদ আর জুয়ায় দিন কাটতে থাকে। আগ্রা থেকে মা আর দিল্লী থেকে শ্বশুরমশাই আহমদ বক্স খাঁ তাঁকে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য করতেন। শ্বশুরের টাকা আসা কমে যাওয়ায় গালিবের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়। ধার দেনায় জর্জ্জরিত হয়ে যান গালিব।

    এর পরে পরেই গালিবের কলকাতায় আগমন। আগেই বলেছি যে ১৩৩ নং বেথুন রো’র বাড়িতেই প্রথমে এসে উঠেছিলেন গালিব। তাঁর চিঠিতে বারবার সিমলা বাজার, গোল তালাও, চিতপুর বাজারের নাম উঠে এসেছে। চিঠিতে আর আছে একটা কুয়োর কথা। সেই কুয়ো বোজানো হয়েছে ১৯৫৫ সালেই। গালিবের চিঠি থেকেই জানা যাচ্ছে, বাড়িওয়ালা মির্জা আলি সওদাগর আর বিলায়েত হুসেনের কাছে ৬ আর ১০ টাকা ভাড়া দিতেন তিনি। গালিব জানিয়েছেন, বাড়িটি বেশ বড়সড়। ১৮২৭/২৮ সালে এমন একটা আধাকাঁচা বাড়ির ভাড়া শুনলে কেমন যেন লাগে !

    ধর্ম নিয়ে অবশ্য কোনও বাড়াবাড়ি ছিল না গালিবের। সিপাহী বিদ্রোহের সময় এক ব্রিটিশ কর্নেল তাঁর পোষাক দেখে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, আপনি কি মুসলিম। গালিবের জবাব ছিল, আধা। মানে কী ? গালিব বলেছিলেন, আমি মদ খাই আর শুয়োরের মাংস খাই না।

    গালিব তাঁর শায়েরমালার ‘সফর-এ কলকাত্তাহ’-তে জানাচ্ছেন শিমলা বাজারের কাছে ১৩৩ নম্বর হাভেলিতে তাঁর বসবাসের কথা। লিখে রাখছেন কিছুটা দূরের চিৎপুর বাজারের কথা। বলছেন কলকাতার মতো এমন মন জয় করা জমি তামাম দুনিয়া আর কোথাও নেই।ই।

    এবার গালিবের পুরোনো দিনে ফিরি।

    তাঁর মন মাতানো শায়ের পৌঁছে যায় দিল্লির মোগল বাদশা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফর এর কাছে। বাদশা তাঁকে দাবির-উল-মুলুক আর নজম-উদ-দউল্লা উপাধি দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন। দিল্লির বাদশাহ নিজেও একজন মহান কবি। গালিবের শায়ের ছাড়া তাঁর সময় কাটে না। বাদশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে লেখার পাশাপাশি চলে বিকেলবেলার ঘুড়ি ওড়ানো।

    তখন মুঘল আমলের প্রায় শেষ বিকেল। বাদশা নিজেই তখন ব্রিটিশ সরকারের পেনশন ভোগী। শুধু তাই নয়, দিল্লি আর আশেপাশের নামমাত্র কয়েকটি জায়গা ছাড়া তাঁর শাসনের দৌড় সীমা বেশি বড় নয়। তাও বাদশা গুণীজনের কদর করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বাদশাকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকেন ইংরেজরা। কিছু লোকজনের আনাগোনা তারা ভালো চোখে নিচ্ছেন না তখন। এমন কি দরবারের কবিকেও তারা সন্দেহ করতে শুরু করেন। ইংরেজ বিরোধী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গেই যেন এঁর বেশি প্রকার দহরম মহরম। হঠাৎ একদিন গালিব ফরমান পেলেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তাঁর পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হল। স্বয়ং নবাবও কিছু করতে পারলেন না। দিল্লি থেকে কখনও পায়ে হেঁটে কখনও ঘোড়ায় চড়ে আবার খানিকটা বজরায় বা ডিঙি নৌকোয় তিনি পাড়ি দিলেন কলকাতার পথে। কারণ স্বয়ং বড়লাট যদি একটু সদয় হন তাহলেই একমাত্র তাঁর পেনশন মিলতে পারে।

    কলকাতায় এসেছিলেন মির্জা গালিব। বেড়াতে নয়, অর্থের প্রয়োজনেই। কিন্তু বিফল হয়েছিলেন। অধিকন্তু, লাঞ্ছনার অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল। লিখেছেন অতনু সিংহ। ‘কলকাতার উর্দু কবি মহলের সঙ্গে কাব্য, ধর্ম ও সমাজসংক্রান্ত বিষয়ে চালিয়েছেন বাহাস। কবিতাও লিখেছেন এই শহরকে নিয়ে। ঘুরে বেড়িয়েছেন রাস্তায় রাস্তায়। কলকাতায় থাকার সময় মৌলালীর দরগা আর কাঠবাগান মসজিদে যেতেন। ক্যালকাটা মাদ্রাসা কলেজেও (আজকে যেটা আলিয়া মাদ্রাসা বা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস) গিয়েছেন। কলকাতায় থাকার সময় কবির সঙ্গে দেখা হয় রাজা রামমোহন রায়ের। দুজনের নাকি বেশ আড্ডাও হয়েছে কয়েকবার। এমনকি রাধাকান্ত দেবের সঙ্গেও গালিবের মোলাকাত হয়েছে’।

    কবিতার কলকাতা কিন্তু গালিবকে চুড়ান্ত অসম্মান করেছে একটা সময়। তালতলার এক মাদ্রাসা গালিবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল একটা মুশায়েরায়। সেখানে গালিব পড়লেন ফার্সি আর উর্দু’তে তাঁর রচিত কয়েকটি শায়ের। একটি ‘শের’ নিয়ে আপত্তি জানালেন মির্জা কাতিলের শিষ্যরা।

    অতনু সিংহ লিখছেন ‘গালিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, গালিব ফার্সি ব্যাকরণ জানেন না! হাফিজের কবিতা উদ্ধৃত করে গালিব দেখাতে চাইলেন, তিনি যেভাবে ভাষার কাব্যিক প্রয়োগ করেছেন, তাতে ব্যাকরণ অশুদ্ধ হয়নি; ঠিক একইভাবে হাফিজের কবিতাতেও ব্যাকরণ উঠে এসেছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, কে বড় কবি— হাফিজ, নাকি মির্জা কাতিল? মির্জা কাতিলের লেখা পড়ে যারা ফার্সি ভাষা শিখে গালিবকে চ্যালেঞ্জ করছে, তাদের দিকেই গালিব এই প্রশ্নটা ছুড়লেন। আরও বললেন, ‘ফার্সি ভাষা হলো আমির খসরু, শিরাজি ও ইস্পাহানিদের মাদার-ই-জুবান (মাতৃভাষা)। আমি তাঁদের লেখা পড়ে ব্যাকরণ শিখেছি।’ কিন্তু মির্জা কাতিলের অনুরাগীদের অভিযোগ তাতেও প্রশমিত হলো না। তাদের মতে, গালিব ফার্সি ভাষাকে অপমান করেছেন, তাঁর মুন্ডুপাত করা উচিত। পরিস্থিতিকে কোনোভাবে মোকাবিলা করে সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে এলেন। কিন্তু কলকাতার উর্দু ও ফার্সি কবিতার বৃত্তে গালিবের নামে কুৎসা শুরু হলো। পোস্টার লাগানো হলো তাঁর বিরুদ্ধে। গালিবের মন ভারাক্রান্ত হলো কলকাতার এই চেহারা দেখে। যদিও তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বোঝালেন যে আসলে তাঁর প্রতিভা আর পান্ডিত্যের কারণে ঈর্ষার আগুনে জ্বলছে কলকাতার মধ্য মেধার উর্দু-ফার্সি কবিসমাজ’।

    ‘কলকাতা থেকে গালিব পেনশন উদ্ধার করতে পারেননি। উপরন্তু তাঁর কপালে জুটেছিল লাঞ্ছনা! বিষাদগ্রস্ত গালিব ফিরে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। যেভাবে গালিব উপমহাদেশের এক শহর থেকে অন্য শহরে এসেছিলেন আর্থিক প্রয়োজনে, পরে ওই শহরকেই আপন করে নিয়েছিলেন, ওই শহরের মানুষের সঙ্গে, শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে, দিনযাপনের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন, গলাধাক্কা খেয়েছেন। আজ গালিবকে নিয়ে আমরা কতই না মাতামাতি করি, গালিবের নামে কলকাতার রাস্তার নাম জ্বলজ্বল করে। একদার ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের নাম বদলে মির্জা গালিবের নামে করা হয়েছে। আজকের এই মির্জা গালিব স্ট্রিটের অদূরেই তালতলায় একদিন গালিবের মুন্ডুপাত করতে চেয়েছিল নির্বোধের দল’। আমাদের গৌরবের কলকাতা !

    দিল্লী ফিরে গেলেন গালিব।

    এক বন্ধুর পরামর্শে ১৮৪১ সালে প্রকাশ করেছিলেন প্রথম দিওয়ান। এতে এগার’শ শায়ের ছিল তাঁর। দিল্লী কলেজের ফার্সি ভাষাশিক্ষার চাকরির দরখাস্ত জমা দিলেন। সে সময় দিল্লি কলেজের পরিদর্শক ছিলেন জেমস্ থমসন। ফার্সি ভাষায় গালিবের দক্ষতা শুনে তার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলো পড়ানোর জন্য। গালিবও প্রস্তাব মেনে থমসনের বাড়ি আসলেন। অপেক্ষা করলেন অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নেবার। কেউ এলো না, গালিবও গেলেন না ভেতরে। কিছুক্ষণ পরে থমসন নিজে বেরিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ভেতরে না যাবার কারণ। জানালেন, আগে প্রতিবারই তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে; এখন ব্যতিক্রম হবার কারণ কী? থমসন স্পষ্ট করে দিলেন বিষয়টি। আগে প্রতিবার গালিব ছিলেন দরবারের অতিথি, আর এখন একজন চাকুরে। শুনে সাথে সাথেই চাকুরি না নিয়ে ফিরে আসেন মির্জা গালিব। এই ঘটনাই নির্ধারণ করে দেয় কবির আত্মসম্মান।

    ১৮৫৯ সালে দক্ষিণাত্যের মৌলভি মোহাম্মদ হুসেইন তাবরেজির বিখ্যাত ফারসি অভিধান “বুরহানে কাতেতে” (যুক্তির অস্ত্র) নিয়ে একটা বিশ্লেষণী মতামত লিখলেন তিনি। ১৮১৮ সালে কলকাতা থেকেই ছাপা হয়েছিল তাবরেজির এই বই ক্যাপ্টেন রিবুক এর প্রকাশনায়। বন্ধুদের অনুরোধ ফেলতে না পেরে ওই মতামতের ওপরে নিজের লেখা নোট ছাপালেন গালিব। নাম দিলেন “কাতেই বুরুহান”। গোটা দিল্লী জুড়ে অসংখ্য শিষ্য ছিল এই মৌলভী তাবরেজি’র। হৈ হৈ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা গালিবের ওপরে। গালিবের বিরুদ্ধে প্রচুর বই প্রকাশ হয়ে গেল। ‘এর মধ্যে একজন শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন—মৌলভি আহমেদ আলী শিরাজি জাহাঙ্গীরনগরী। নামেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ঢাকার লোক। গালিবের বিরুদ্ধে তিনি লিখলেন মুয়াইয়িদে বুরহান নামে একটি বই। গালিবও রচনা করলেন একটি পুস্তিকা—তেগে তেজ (ধারালো তরবারি)। এর জবাবে আগা আহমদ আলী ইস্পাহানি (১৮৩৯–১৮৭৩) নামে আরেকজন লিখলেন শামসিরে তেজতর (তীক্ষ্ণতর তরবারি)। তিনিও ঢাকার মানুষ। ছিলেন বাঙালি শিক্ষাবিদ এবং কলকাতা মাদ্রাসার ফারসি ভাষার শিক্ষক। তো, গালিবের কাছে দিনে গোটা দশেক বেনামি চিঠি আসতে লাগল। তাতে অকথ্য গালিগালাজ। ১৮৬৬ সালে পাতিয়ালার আমিনউদ্দিন খুব নোংরা ভাষায় আক্রমণ করে বই ছাপলেন; এবং সেখানে তাঁকে মাতাল, দেনাদার, অবিশ্বাসী, দিল্লির শুঁড়িখানার খদ্দের, জুয়াবাজ—কিছুই বলতে বাকি রাখেননি তিনি। এবার ব্রিটিশ কমিশনারের আদালতে মামলা ঠুকে দিলেন গালিব। বড় পণ্ডিতেরা আমিনউদ্দিনের পক্ষে এগিয়ে এসে বললেন, গালিব যেসব অর্থ করছেন, এর আসলে ভাষাতাত্ত্বিকভাবে অন্য অর্থও হয়। আর সেটাই আসল অর্থ। এ মামলায় বিচারক ছিলেন একজন ইংরেজ, যিনি বহু কষ্টে বেশি হলে হুক্কা লাও, পানি লাও পর্যন্ত বলতে পারেন। তত দিনে দিল্লির পুরোনো অভিজাতদের কেউ বাকি নেই যে গালিবের পাশে এসে দাঁড়াবে। নোংরামির চূড়ান্ত দেখে ১৮৬৭ সালে মামলা প্রত্যাহার করলেন গালিব। তত দিনে তিনি রিক্ত, শরীর ভেঙে পড়েছে, কানে শুনতে পান না। সাত মৃত সন্তানের পর পোষ্য নেওয়া ভাতিজাও মারা গেছে ২৩ বছর বয়সে। দেনার দায়ে ডুবে আছেন আকণ্ঠ। ভুগছেন ডায়াবেটিসে। এই বেদনা আর অপমান নিয়েই বছর দুয়েক পর মারা যান কালজয়ী উর্দু কবি মির্জা গালিব’। গালিব হয়ে গেলেন ধ্বংসকারী।

    ‘দিল্লির এক মহাজন, তিনিও টাকা ধার দিয়েছিলেন মির্জা গালিবকে। সময়মতো টাকা শোধ করতে না পারায় মহাজনটি গালিবের নামে মোকদ্দমা ঠুকে দিলেন কোর্টে। শাস্তিস্বরূপ গালিবকে গারদ খাটতে হলো বেশ কয়েক মাস। কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি একদিন তার বাড়ির উঠোনে বসে আম খাচ্ছিলেন, তখন তার এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওহে গালিব! জেলখানায় দিনগুলো কেমন কাটল? মির্জা গালিব প্রতি উত্তরে বললেন, মন্দ নয়, তবে জেল খেটেছি বলে মনে তেমন একটা খেদ নেই, কিন্তু জেলার ব্যাটা যদি আমাকে আমের মৌসুমটি পার করে ছাড়ত তবে তাকে আমি কোনো দিনও ক্ষমা করতে পারতাম না। মির্জা গালিব আম ফলটির প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে যদি তার কোনো কবিতাপ্রেমী কিংবা অনুরাগী তাকে কিছু একটা দিতে চাইত তবে তিনি অম্লান বদনে বলতেন, 'ভালো জাতের কিছু সুস্বাদু আম পাঠিয়ে দিও তাতেই আমি সন্তুষ্ট।' মির্জা গালিব পাকা আম টিপে টিপে তুলতুলে করে চুষে খেতে বেশ পছন্দ করতেন’।

    ১৮৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি মহান কবি গালিব মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারের কাছে দাফন করা হয়৷ আজও নিরালা সেই প্রাঙ্গনে পড়ে রয়েছেন তামাম হিন্দুস্থানের এক অসহায় কবি মির্জা গালিব।

    “জান দি দি হুয়ি উসি কি থি
    হক তো য়ে হ্যায় কি হক আদা না হুয়া”

    যে প্রাণ দিলাম তোমায় সে তো তোমারই দেয়া
    আসল কথা এই—তোমাকে কিছুই দেয়া হলো না।

    একটা কথা বলা যেতেই পারে যে গালিব সাহেব সম্ভবত কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট তৈরির শেষ পর্বটা দেখেছিলেন। ১৮২৬ সালের ৯ জুন এর লটারি কমিটির এক রিপোর্টে আছে “Cornwallis Street has been open to the public sometime and little remain to complete it.” কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট তৈরি হওয়ার পর থেকেই এই চত্বরের গ্রাম্য চেহারা পালটাতে শুরু করে। তখনো চিত্তরঞ্জন এ্যাভেনিউ তো দূরের স্বপ্ন।

    এই সিমলে চত্বর আরো কতো ঘটনা’র সাক্ষী।

    ## ©গৌতমদত্ত ##



    ####
    কৃতজ্ঞতা -
    ১) মির্জা গালিব: নিয়তির হরফে লেখা জীবন - Ahmed din Rumi – রোর ডট মিডিয়া/বাংলা।
    ২) কলকাতায় মির্জা গালিব - আশিস ঘোষ – ক্যালকাটানিউজ ডট টিভি।
    ৩) মির্জা গালিবের ক্যানভাসে ধরা রইল পুরনো কলকাতা - দেবদত্ত গুপ্ত – বঙ্গদর্শন ডট কম।
    ৪) গালিবের শহর কলকাতা - অতনু সিংহ – ক্যানভাস ডট কম ডট বিডি।
    ৫) মির্জা গালিবের নিন্দুকেরা – প্রথমআলো ডট কম।
    ৬) মধুময় মধুমাস সম্রাট বাবর, মির্জা গালিব ও রবীন্দ্রনাথ - সাইফুর রহমান – বিডি-প্রতিদিন ডট কম।
    ৭) কলিকাতার রাজপথ সমাজ ও সংস্কৃতিতে – অজিতকুমার বসু।
    ৮) কলকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা - মহেন্দ্র নাথ দত্ত।
    ৯) এবং অবশ্যই গুগুল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • π | ১১ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৩১98278
  • "অতনু সিংহ লিখছেন ‘গালিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, গালিব ফার্সি ব্যাকরণ জানেন না! হাফিজের কবিতা উদ্ধৃত করে গালিব দেখাতে চাইলেন, তিনি যেভাবে ভাষার কাব্যিক প্রয়োগ করেছেন, তাতে ব্যাকরণ অশুদ্ধ হয়নি; ঠিক একইভাবে হাফিজের কবিতাতেও ব্যাকরণ উঠে এসেছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, কে বড় কবি— হাফিজ, নাকি মির্জা কাতিল? মির্জা কাতিলের লেখা পড়ে যারা ফার্সি ভাষা শিখে গালিবকে চ্যালেঞ্জ করছে, তাদের দিকেই গালিব এই প্রশ্নটা ছুড়লেন। আরও বললেন, ‘ফার্সি ভাষা হলো আমির খসরু, শিরাজি ও ইস্পাহানিদের মাদার-ই-জুবান (মাতৃভাষা)। আমি তাঁদের লেখা পড়ে ব্যাকরণ শিখেছি।’ কিন্তু মির্জা কাতিলের অনুরাগীদের অভিযোগ তাতেও প্রশমিত হলো না। তাদের মতে, গালিব ফার্সি ভাষাকে অপমান করেছেন, তাঁর মুন্ডুপাত করা উচিত। পরিস্থিতিকে কোনোভাবে মোকাবিলা করে সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে এলেন। কিন্তু কলকাতার উর্দু ও ফার্সি কবিতার বৃত্তে গালিবের নামে কুৎসা শুরু হলো। পোস্টার লাগানো হলো তাঁর বিরুদ্ধে। গালিবের মন ভারাক্রান্ত হলো কলকাতার এই চেহারা দেখে। যদিও তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বোঝালেন যে আসলে তাঁর প্রতিভা আর পান্ডিত্যের কারণে ঈর্ষার আগুনে জ্বলছে কলকাতার মধ্য মেধার উর্দু-ফার্সি কবিসমাজ’।"


    অতনু সিংহ কোথায় লিখেছেন ? তাঁর মূল তথ্যসূত্র কী ?

  • π | ১২ অক্টোবর ২০২০ ০০:৩৩98309
  • @Goutam Dutt


    এই ট্যাগটাও হলনা। 

  • | ১৩ অক্টোবর ২০২০ ১২:২৫98397
  • হ্যাঁ আমারও একই প্রশ্ন। অতনু  সিংহ কোথায় লিখেছেন? সোর্স কী? 

  • Goutam Dutt | ১৯ অক্টোবর ২০২০ ১২:৪২98628
  • Goutam Dutt | ১৯ অক্টোবর ২০২০ ১২:৪৭98629

  • অনির্বাণ বসু | ১৯ অক্টোবর ২০২০ ১৬:১৩98633
  • প্রথম লাইনে কি  "১৯৩০" এর বদলে "১৮৩০" হবে?

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন