এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অপার বাংলা

  • রসুইঘরের রোয়াক

    স্মৃতি ভদ্র লেখকের গ্রাহক হোন
    অপার বাংলা | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৭৯০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • জালি কলাই, মৌরি ফোড়ন আর আদা বাটায় চালকুমড়ো দিয়ে মাসকলাইয়ের ডাল।

    সেসব দিন বিনা উৎসবেই আনন্দমূখর হয়ে উঠতো। চালকুমড়ার মাচায় ফুল এলেও আনন্দ, আবার ঢেঁকির গড়ে শস্য পড়লেও আনন্দ। দিনগুলোর গা জুড়ে এক অদ্ভুদ সুখ লেপ্টে থাকতো।

    আমাদের বাড়িতে আলাদা কোনো ঢেঁকিঘর ছিল না। প্রকাণ্ড বরই গাছের তলায় পাতা থাকতো আমাদের ঢেঁকি। তাই সুযোগ পেলেই ঢেঁকিকে গাড়ি বানিয়ে আমি চলা করতাম।

    গিন্নি তোমার গাড়িতে আমাকে নেবে? দাদুর প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েই আবার গাড়ির বেগ বাড়াতাম, ভুঁওওওও।

    সকালের স্নান সেড়ে ঠাকুমা উঠোনে কাপড় মেলছে। দিদি, তুমি সাহেব কাকুর মতোন আমাকে ছেড়ে বিদেশ যাবা? এই প্রশ্নে কী হতো জানি না, আমি আকাশের দিকে একবার তাকিয়েই, ঢেঁকি গাড়ি ফেলে ছুটে যেতাম ঠাকুমার কাছে। কিন্তু জড়িয়ে ধরতে পারতাম না। ঠাকুমার নিত্যপূজা হয়নি তখনো।

    না, আমি আমার দিদিকে যেতে দিলে তো! আমরা দুইবোন এই বাড়িতেই থাকবো—-আমার সকল উৎকন্ঠা এক নিমেষেই দূর করে দিতো ঠাকুমা।

    আমি তখন নির্ভার মনে ঢেঁকি গাড়ি ভুলে কাঁসার বাটি ভরে মুড়ি নিয়ে বসি দাদুর পাশে, বাইরবাড়ির দেবদারু তলায়। বাটির মুড়ি পেটে যায় কম, মাটিতে ছড়ায় বেশী। নিজের বাটির গুড়ের বাতাসা শেষ করেই দাদুর বাটিতে চোখ।

    ও দাদু, তোমার বাতাসা ফুরায়নি? আমার মুড়ির বাটিতে দাদু নিজের বাতাসাটি ফেলতেই ঠাকুমার নিত্যপূজার ঘন্টা বেজে উঠতো।

    আর তা ছাপিয়ে যায় ‘মাঠা.......মাঠাআআআ....’হরিপদ ঘোষের হাঁক।

    মাঠার ভাঁড় নামে আমাদের বাইরবাড়িতে। তাঁতঘড়ের চাল ছুঁয়ে আসা অল্প রোদে ঝলমল করে ওঠে মাঠার হাড়ি।

    ও মনিপিসি, দাদুর পান্জাবি কই? আমাকে আটআনা দাও। মাঠা খাবো।

    মনিপিসিটা এমনই, যখনই খুঁজি বাড়িতে থাকেনা। দেরী হলে হরিপদ ঘোষ ভাঁড় নিয়ে চলে যাবে যে।

    ঠাকুমা আহ্নিক শেষ করে ডাকে, মনি। পূজার কৌটা থেকে আটআনা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলে, পূজা শেষ হয়ে গেছে নমো করে যাও।

    আমি লাল মেঝেয় কোনোরকমে কপাল ছুঁইয়ে এক দৌড়ে বাইরবাড়ি। তাঁতিরা ততক্ষণে হরিপদ ঘোষের ভাঁড়ের মাঠা অর্ধেক করে ফেলেছে।

    ও হরিপদ নতুন হাড়ি খোলো, আমার গিন্নিকে বেশী করে ভাসা মাখন দিয়ে মাঠা দাও, দাদুর হুকুম মেনে গ্লাসে মাঠা পড়ে আমার ভাগের।

    আমি আনন্দে হাত বাড়িয়ে যতই একগ্লাস মাঠা নেই না কেন, দু’এক চুমুক কোনোরকমে খেয়েই ভাসতে থাকা সব মাখন আঙুল চুবিয়ে খেয়ে নিতাম। ব্যস্, আমার মাঠা খাওয়া শেষ।

    সেদিন আর সকালে আমাদের বাড়িতে ঘি ফেলা ফেনা ভাত হতো না। আটআনায় কেনা দু’জগ মাঠায় চিড়া আর মুড়কি ভিজিয়ে হতো জলখাবারের আয়োজন। সাথে থাকতো চিনিচম্পা কলা আর গুড়ের বাতাসা।

    সকালের কাজের চাপ কম থাকায় ঠাকুমা বড়ঘরের বারান্দায় পাঠ করতে বসতো শ্রীচৈতন্যের অমৃতকথা অথবা মহাভারত। আমি পেয়ারা গাছের তলায় ভাঙা খোয়া দিয়ে মানুষ আঁকতে আঁকতে দেখতাম পাঠে ঠাকুমার তন্ময় হয়ে যাওয়া।

    দেবরাজ ইন্দ্র নিরবিচ্ছিন্ন মুষলধারে বৃষ্টি করিতে লাগিলেন, কিন্তু অর্জুন তাহাতে কিছুমাত্র শংকিত না হইয়া দিব্য শরজাল বিস্তার করত সেই বৃষ্টি নিবারণ করিয়া........

    আমি ঠাকুমার কন্ঠে বৃষ্টিজলের আভাস পেয়ে মানুষ আঁকানোয় ভুল করে ফেলি।

    বাবু বাজার পাঠাইছে, বাজারের দুটো ব্যাগ উঠোনে থপ করে ফেলেই রিক্সাওয়ালা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়।

    আমাদের বাড়ির আলসে সময় চন্চল হয়ে ওঠে।

    আজ উনুনে দুই পাক উঠবে। প্রথম পাকে বাড়ির সবার জন্য আমিষ রান্না, আর পরের পাকে ঠাকুমার পারণের নিরামিষ রান্না।

    ঝক্কি অনেক, তাই সময় নষ্ট না করে রান্নাঘরের উনুন জ্বলে ওঠে। যতই তাড়াহুড়ো হোক না কেন আমিষ পাকে বেলা অর্ধেক গড়িয়ে যায়। বাড়ির সবার খাওয়া শেষে উনুন আর রান্নাঘর লেপেমুছে শুরু হয় পারণের রান্না।

    বেশী কিছু না, জালি কলাই আর জালি কুমড়ার চাক ভাজি।

    ভাজা মাসকলাইয়ের ডাল সেদ্ধ বসিয়ে ঠাকুমা জালি কুমড়োর আগার দিক ডুমো করে নেয় ডালে দেবার জন্য। আর গোড়ার দিক চাক করে কেটে নেয় ভাজার জন্য।

    ডাল ফুটে উঠলেই লোহার ডাল ঘুটনি দিয়ে ঘুটে তাতে আরেকটু গরম জল দিয়ে হলুদ লবণ ফেলে দেয় ঠাকুমা। এরপর কয়েকটি বুকচেরা কাঁচামরিচ আর ডুমো জালি কুমড়া ফুটতে থাকা ডালের ভেতর পড়েই হাবুডুবু খায়।

    মা'র বেটে রাখা মৌরি কুমড়ো একটু নরম হয়ে এলেই ডালে ফেলে ঠাকুমা।কলাই ডালে সাথে মৌরি বাটার মিলমিশ হতেই অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ রান্নাঘর ছেড়ে উঠোনে মেলে রাখা বাতাসে উড়তে থাকা শুকনো কাপড়গুলোর সাথে ঘুরপাক খেতে শুরু করে।

    এরপর জালি কুমড়ো ভালভাবে সেদ্ধ হয়ে গেলে ডালের কড়াই উনুন থেকে নেমে আসে। সে জায়গা দখল করে পেতলের খাবড়ি। উনুনের আঁচে খাবড়ি তেতে উঠলেই তাতে তেল পড়ে। এরপর অপেক্ষা না করেই ঠাকুমা তেজপাতা আর শুকনো মরিচ তেলে দেয়। তেতে ওঠা তেলে শুকনো মরিচ পড়তেই রঙ বদলে ফেলে। এরপর গোটা মৌরি ফোড়ন। ঠাকুমা কড়াইয়ের ডাল ঢেলে দেয় ফোড়নে।

    একটা দমকা ধোঁয়া কড়াইয়ের ভেতর থেকে উঠে পালিয়ে যায় রান্নাঘরের জানালা দিয়ে, ফোড়নের সব ঘ্রাণ ডালে মেশার আগেই। এরপর টগবগ করে ফুটতে থাকা জালি কলাইয়ের ডালে ছেঁচে রাখা আদা পড়ে বেশ খানিকটা।

    ঠাকুমা অল্প চিনি ছড়িয়ে নামিয়ে নেয় ডালের খাবড়ি।

    এরপর জালি কুমড়োর চাক ওঠে উনুনে। আমি ততক্ষণে ইতুদের বাড়িতে খেলতে চলে গেছি।

    আমাদের বাড়ির রান্নাঘরের ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দ ইতুদের উঠোন পর্যন্ত আসছে।

    আমরা খেলছি পলান টুক টুক। কয়েকবার জেতার পর যেই না ইতু আমাকে প্রথমবারেই খুঁজে পেয়েছে, আমি আঁড়ি দিয়ে চলে এসেছি বাড়ি।

    রান্নাঘরের ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দ ততক্ষণে থেমে গিয়েছে।

    ঠাকুমা খেতে বসেছে। কাঁসার বগি থাল থেকে ভাত তুলে যখন ঠাকুমা মুখে দেয়, তখন পড়ে যাওয়া বেলার মরা রোদ আমাদের উনুনের পাশে নিভৃতে এসে গা মেলে।

    আর আমি ঠাকুমার পাশে বসতেই আছরের নামাজ শেষ করে গোলেনুর উঠোনে দাদী এসে দাঁড়ায়, দোয়া পড়ে আমাকে ফুঁ দেবে বলে।

    আমি যে ঘুমের ভেতর সারাদিন যা করি তাই আওড়াই।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অপার বাংলা | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৭৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 97.91.195.43 | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৪:২৪96932
  • এই লেখাটা আমার খুব ভালো লাগলো। ছবির মত। খুব ভিজুয়াল।
  • বিপ্লব রহমান | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৮:৪০96939
  • কি অপূর্ব মায়াময় শৈশব। লেখনীও খুব সরল সুন্দর। আরও লিখুন।       

  • বিপ্লব রহমান | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৮:৪৩96940
  • পুনশ্চঃ গুরুচণ্ডা৯ তে স্বাগতম!    

  • Kausik Ghosh | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০০:০৩498641
  • "তখন পড়ে যাওয়া বেলার মরা রোদ আমাদের উনুনের পাশে নিভৃতে এসে গা মেলে।"
    শব্দের এইরকম সব মায়াময় সারি যদি আমার লেখনী থেকে নিঃসৃত হতো...
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন