এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • প্রবন্ধ: কবিগুরুর শেষ যাত্রা 

    Lipikaa Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ আগস্ট ২০২০ | ১১৮৩ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • কবি গুরুর শেষ যাত্রা ---


    সেদিনও ছিল ৭ আগস্ট, বাইশে শ্রাবণ। সালটা ছিল ১৯৪১ খ্রিঃ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) বৃহস্পতিবার। কবিকে ততদিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আনা হয়েছে। ঠাকুরবাড়িতে আগের রাতে (রাখী পূর্ণিমার রাতে) কেউ ঘুমোয় নি। ভোর থেকেই বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা বেড়েছে। একটা আশঙ্কা চারদিকে কেমন একটা চঞ্চলতা তৈরী করেছে। ততক্ষণে ঈশ্বরের উপাসনা ও ব্রহ্মসংগীত শুরু হয়েছে। কবি গুরুর খাটের পাশে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় উপাসনা করলেন আর তাঁর পায়ের কাছে পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী এসে মাটিতে বসে ঔপনিষদিক মন্ত্র উচ্চারণ করলেন ---

    "ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি, নমস্তেহস্তু মা মা হিংসী ---"

    তখন তাঁর নাড়ি চলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। ডাঃ জ্যোতিষচন্দ্র রায় তখন কবিগুরুর নাড়ি ধরে বসে আছেন কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। কিছুক্ষণ পরে ডাঃ অমিয় সেন এসে কব্জিতে না পেয়ে কনুইয়ে খুব কষ্টে নাড়ির সচলতা খুঁজে পেলেন। নাড়ির গতি অত্যন্ত ক্ষীণ। ডাক্তারের মুখ তখন বিষণ্ণ।

    বেলা ন'টায় অক্সিজেন দেওয়া শুরু হল। নিঃশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল। হাত পায়ের তলা আসতে আসতে ঠান্ডা হয়ে আসছে।

    তখনও ভিতরে বাইরে একটানা উপাসনা ও মন্ত্রোচ্চারণ চলছে। কবির কানে মুখ এনে শোনানো হল - "শান্তম্ শিবম্ অদ্বিতীয়ম্।"

    সকাল সাড়ে দশটায় কোরামিন ইনজেকশন দেওয়া হল কবিকে। পা দুটো আরো ঠাণ্ডা হয়ে এল। হৃদস্পন্দন ও কমে এল।

    অক্সিজেন নিতেও তিনি অক্ষম, বেলা বারোটা নাগাদ অক্সিজেন খুলে দেওয়া হল। শেষ মুহূর্তে কবি ডান হাতটা তুলে কপালে ঠেকাতেই পড়ে গেল। ঘড়িতে তখন ১২টা বেজে ১০ মিনিট। শুধু তাঁর নয়, সমগ্র বাঙালির হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেলো চিরতরে।

    "সমুখে শান্তি পারাবার,
    ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।
    তুমি হবে চিরসাথি,
    লও লও হে ক্রোড় পাতি,
    অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারা কার।"

    শান্তিনিকেতন থেকে এসে শিল্পী নন্দলাল বসু কাঠমিস্ত্রিদের নিয়ে কাঠের পালঙ্ক তৈরি করেছেন। এবার তো তাকে নিয়ে যাবার পালা! তাই শেষ শয্যা তৈরী করলেন।

    স্নানপর্ব শেষ হবার পর নাতনি নন্দিতাদেবী কবিকে পরিয়ে দিলেন দুধ-সাদা বেনারসি জোড় ও গরদের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি, সাদা উত্তরীয়। কপালে সাদা চন্দনের ফোঁটা দেওয়া হল। গলায় পরানো হল ফুলের মালা। বুকের ওপরে থাকা ডান হাতে রাণী চন্দ ধরিয়ে দিলেন একটা অর্ধস্ফুট পদ্মকোরক। তাঁর সেই শান্ত স্নিগ্ধ মুখে কষ্টের কোনো চিহ্ন নেই। ভালো করে সাজানোর আগেই গুরুদেবের ঘরে হুড়োহুড়ি করে লোক ঢুকে পড়ল। খুব উৎসাহী রবীন্দ্র-গুণমুগ্ধ এরা।

    বেলা তিনটের সময় কবিকে নীচে নামিয়ে সুসজ্জিত পালঙ্কে শোয়ানো হল। তারপর জনসমুদ্রের ওপর দিয়ে যেন একখানা ফুলের নৌকা ভেসে চলল। আকাশ, বাতাস মুখরিত করে উঠলো শ্লোগান ---- "জয় বিশ্বকবির জয় - জয় রবীন্দ্রনাথের জয় - বন্দেমাতরম।"

    যদিও গুরুদেব এভাবে জনসমুদ্রে সওয়ার হয়ে মহাশ্মশান যাত্রা হোক চান নি। কবিগুরুর ইচ্ছা ছিল শান্তিনিকেতনের শান্ত পরিবেশে যেন তাঁকে সমাহিত করা হয়। কিন্তু তখন সবটাই রবীন্দ্র-পাগল বাঙালির হাতে চলে গেছে। গুরুদেবের আত্মীয়-পরিজনেরাও তাঁর পার্থিব দেহের অধিকার থেকে তখন বহু যোজন দূরে! আর কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে, গুরুদেবের শেষ ইচ্ছা সম্পন্ন করার জন্য যে মনের জোর দরকার, তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। শান্তিনিকেতনের ছাত্র প্রদ্যুত্ কুমার সেন অনেক চেষ্টা করেও উন্মত্ত জনতা কে বোঝাতে পারেন নি।

    একপ্রকার লুণ্ঠিত হয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির ধারেকাছে যারা কোনোদিন ঘেঁষতে পারে নি, তাদেরই কাঁধে চেপে কবিগুরু চললেন নিমতলা মহাশ্মশানের পথে।

    তিনি চলে গেলেও তাঁর সৃষ্টি কর্ম অমর হয়ে আছে বাঙালির বুকে, বিশ্ববাসীর মনে। বিশ্ব কবির কাব্যসুধা আমাদের প্রাণের সঞ্জীবন হয়ে আছে আজও। ধ্রুবতারার মতো আমাদের আলো দিয়ে চলেছেন, অক্ষয় অবিনশ্বর আলো!

    প্রণাম


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Guruchandali | 136.228.209.53 | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৩৫97521
  • যাঁরা খেরোর খাতায় নতুন লেখালিখি করছেন, গুরুচণ্ডা৯-র টেকনিকাল ফীচারগুলো তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য আগামী শনিবার ভারতীয় সময় রাত ৮-১০টা আমরা একটা ওয়েবিনার করছি গুগল মীট-এ। ইচ্ছে আছে আগামী কয়েক সপ্তাহ জুড়ে প্রতি শনিবার ঐ নির্দিষ্ট সময়ে ওয়েবিনার করার। আপনাদের কী কী অসুবিধে হচ্ছে লিখতে বা একটা সামাজিক মাধ্যম হিসেবে গুরুচণ্ডালির পূর্ণ স্দ্ব্যবহার করতে, সেটাও আমরা নোট করব, যাতে এটাকে আরও উন্নত করা যায়, প্রযুক্তিগতভাবে। সম্ভব হলে থাকবেন। শনিবার রাত আটটায় নিচের লিংকে ক্লিক করেই মীটিং এ জয়েন করা যাবে। 


     https://meet.google.com/ydz-ekww-see

  • Lipikaa Ghosh | ০১ জুন ২০২১ ২১:৫৭106713
  • নিশ্চয়ই 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন