নন্দীগ্রাম দিবস ও কিছু কথা--- প্রসূন আচার্য
আজ ১৪ মার্চ। নন্দীগ্রাম দিবস।
২০০৭ সালের এই দিন নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ বাহিনীর সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। তারমধ্যে ১২ জন পুলিশের গুলিতে। ২ জন অন্য ভাবে। এই ঘটনা রাজ্যের পালা বদলের ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। বাকি কথা পরে অন্য ভাবে বলবো।
রাজ্যের সাধারণ মানুষ, কিছু সৎ ও ভালো তৃণমূল নেতা- কর্মী এবং উল্টোদিকে চোর, জোচ্চোর, ডাকাত, তোলা বাজ , জেল খাটা , দুর্নীতিগ্রস্থ তৃণমূলী উভয় পক্ষকেই দিনটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। কারণ দ্বিতীয় পক্ষ দিনটির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ক্ষমতায় আসার পরে শুধু কাটমানি, অবৈধ কামাই, ব্যাংক ব্যালেন্স, সম্পদ তৈরি, বিদেশে টাকা পাচার, নারী সঙ্গ, পাড়ায় পাড়ায় দাদাগিরিকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে।
বর্তমানে নেত্রী ও ভাইপোর চারপাশে ঘুরঘুর করা রাজনৈতিক দালাল, ফড়ে, কবি, লেখক, শিল্পী, সিনেমা পরিচালক, সাংবাদিক, IAS, IPS , WBCS অফিসারদের একটি তৃতীয় শ্রেণীও আছে। এই তৃতীয় শ্রেণীভুক্তরা ওই দিন পক্ষান্তরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের পাশে ছিলেন। এমনকি তারমধ্যে অনেকে আবার প্রকাশ্যেই এই গুলি চলনাকে সমর্থন করেছিলেন। এঁদের কেউ বর্তমানে দলের মুখপাত্র। কেউ সাংস্কৃতিক শাখা দেখেন। কেউ আবার শ্রমিক সংগঠনের মাথায় বসেছেন ! দুই জন আবার মন্ত্রীও হয়েছেন!
সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ!
যে সব পুলিশ অফিসাররা ওই দিনের ঘটনায় যুক্ত ছিলেন, তাঁদের শাস্তি হওয়া তো দূরের কথা, পরবর্তী কালে তাঁরা ভালো প্রমোশন ও পোস্টিং পেয়েছেন। যে অসীম গিরি নন্দীগ্রামের প্রতিটি সভা শুরুর আগে গাইতেন, মানুষকে উজ্জীবিত করতেন, তৃণমূল তাঁকে কবেই ভুলে গিয়েছে!
আসলে এটাই হয়। এটাই বোধহয় মানুষ নামক নেমকহারাম জীবটির ধর্ম।
১৪ মার্চের সেই মর্মান্তিক ঘটনার পরে মেদিনীপুর জেলার একজন তৃণমূল নেতা ও বিধায়ক হিসেবে শুভেন্দু অধিকারীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে মনে রাখার মত। বিশেষ করে তিনি যেভাবে নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষ এবং মমতা ব্যানার্জির পাশে একটানা দাঁড়িয়েছিলেন। অর্থ ও লোকবল নিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
ঠিক যেমন রঞ্জিত - সহ মাওবাদীদেরও এই আন্দোলনে ভূমিকা ছিল। রঞ্জিত, কিষানজি - সহ মাওবাদীরাও একটানা মমতার পাশে ছিলেন। যদিও মমতা ক্ষমতায় আসার পরেই শাসকের গুলিতে কিষেন এর দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ছত্রধর মহাতোর বিধবা বৌদি সুচিত্রা মাহাতো (রাষ্ট্রের যৌথ বাহিনীর হাতে খুন হওয়া শশধর মাহাতোর বউ) তৃণমূল সরকারের কাছে অন্য ভাবে পুরস্কৃত হন। বর্তমানে সুচিত্রা আবার বিয়ে করে এক তৃণমূলী পঞ্চায়েত নেতার বউ।
যাই হোক, একটা কথা কিন্তু মনে রাখতে হবে। নন্দীগ্রামের এই ঘটনার আগে ও পরে বিজেপি বা RSS এর কোনও ভূমিকাই ছিল না।
রাম মন্দির তৈরি বা এই ধরনের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি ছাড়া বিজেপি বা তাদের জন্মদাতা RSS সাধারণ মানুষের স্বার্থে আজ অব্দি কোনও আন্দোলন করেনি। স্বাধীনতার আগেও না। পরেও না।
ব্রিটিশ আমলে যেমন RSS এবং বিজেপির পিতা হিসেবে পরিচিত বিনায়ক সাভারকার মুচলেকা দিয়ে আন্দামান জেল থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিজেকে শতহস্ত দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি ইংরেজদের হয়ে দালালি করতেন এবং পেনশন নিতেন। ঠিক তেমনি ২০০৭-২০০৮ সালে বিজেপি নেতারাও নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে শতহস্ত দূরে ছিলেন।
তাই তাঁরা যদি এই নন্দীগ্রাম দিবস পালনে কোনও ভূমিকা নেয়, বা নিজেরা নন্দীগ্রাম আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন বলে দাবি করেন, তাহলে সেটা হবে ইতিহাসের ঘোরতর কলঙ্ক। এর সর্বাত্মক বিরোধিতা করতে হবে। কারণ, ইতিহাসকে বিকৃত করা এবং সেটা করতে গিয়ে বার বার মিথ্যে কথা বলাই ফ্যাসিস্টদের কাজ। অতীতে জার্মানি , ইতালিতে হয়েছে। এখন ভারতে হচ্ছে।
যাঁরা দেশকে ভালবাসেন; দেশের মাটি, বাতাস, পাহাড়, জঙ্গল, জমি, মানুষকে ভালবাসেন, তাঁদের একই সঙ্গে দুর্নীতি এবং ফ্যাসিবাদ এই দুয়ের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে। তবেই আগামী প্রজন্ম আপনাকে মনে রাখবে। না হলে ভবিষৎ প্রজন্ম কোনও দিন আপনাকে ক্ষমা করবে না।