এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • শব্দকল্প

    রুমেলা সাহা লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২১ জুলাই ২০২০ | ২১৫৪ বার পঠিত
  • এই বাড়িটায় প্রথম এলাম আমি। বিশাল বড়ো রাজপ্রাসাদের মতন বাড়ি। ব্রিটিশ আমলের মোটামোটা থাম, কাঠের গোল গোল ঘোরানো বড়ো বড়ো চওড়া সিঁড়ি, উঁচু সিলিং। বাড়িটায় আসা পর্যন্ত চারদিক সমানে দেখেই চলেছি। আর যতই দেখছি ততই মনের আশ মিটছে না। এখনও কত সুন্দর করে গোছানো, কত যত্ন, ইতিহাস থমকে আছে বাড়িটায়। সিঁড়ির ধারে দেয়ালে বড়ো বড়ো পোর্ট্রেট টাঙানো। সময়ের ক্রমানুযায়ী পরপর আজ পর্যন্ত যতগুলো মহামহিম সিংহাসনে বসেছেন তাঁদের সবার ছবি লাগানো আছে দেয়ালে। সব ছবিতে সিংহাসনটা কিন্তু একই, শুধু মানুষ বদলে গেছে। ছবি দেখতে দেখতে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নীচে নামছি।

    দুপুরে সূর্যের আলো, জালনার রংবেরঙের কাঁচের ভেতর থেকে ঘরে ঢুকছে। কোনো অদৃশ্য মাকড়সার নিপুণ বুননের মতো সূর্যরশ্মি রঙিন মায়াজাল বুনছে প্রসাদ জুড়ে। কোথাও বারোটা বাজার আওয়াজ হল। ঢং ঢং ঢং। গুনে গুনে ১২ ধাপ নীচে নামলাম আমি। দরজা থেকে বেরোনোর আগে একটা জায়গায় সিকিউরিটি অফিসাররা বসে আছে। চওড়া কাঁধ, নিখুঁত গড়ন, সুশ্রী মুখশ্রী। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল তাদের সবাইকে প্রায় একই রকম দেখতে। পরনে একই উর্দি, একই ধরনের জুতো, বুকে একই ব্যাচ এবং সকলেরই একই রকম ঠান্ডা চাহনি। ভালো করে দেখলে মনে হয় সামনের চেয়ারগুলোতে একটাই মানুষ বসে আছে, বাকিগুলো তার প্রতিবিম্ব।

    তাদের একজনের কাছে নিজের গলার বকলেসটা খুলে দিলাম। সে সেটাকে স্ক্যান করে আমাকে ফেরত দিল। কুকুর বা অন্যান্য জন্তুর সঙ্গে মানুষের তফাতটা বোধহয় এখানে যে, মানুষ নিজের বকলেস নিজেই পরে আবার নিজেই খোলে। কিন্তু অন্য জন্তুজানোয়ারদের জোর করে বকলেস পরাতে হয়, আবার খোলাতেও হয়। ভাবি অসহায়তাটা কার বেশি, মানুষের না জন্তুর?

    সেই রাজপ্রাসাদের গোল শ্বেতপাথরের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম। সামনে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক বিশাল বাগান। বাগান পেরিয়েই সামনে আরও বিশাল একটা দরজা। এখানে ঢোকার সময় খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন দেখছি দরজাটা বড্ড বড়ো। উপরের আকাশ ফুঁড়ে গেছে। বাইরের কোনো কোলাহল, দূষণ, কোনো স্বাভাবিকতা ওই দরজা পেরিয়ে এখানে প্রবেশ করতে পারে না। তাই এই বাগানে সব সময় বসন্ত বিরাজ করে। অন্যান্য ঋতু এখানে প্রবেশের অধিকার পায় না। প্রতিটা গাছ ফুলে ফলে নুয়ে আছে। তবে গাছগুলো দেখতে ভারী অদ্ভুত। একটা গাছ ও চেনা বলে মনে হল না।

    আস্তে আস্তে বিশাল দরজাটার দিকে এগোচ্ছি, হঠাৎই একজন আর্মি অফিসার আমাকে ডাকল। ঘুরে দেখি শহরের শপিংমলে দাঁড় করানো ম্যানিকুইন সদৃশ্য এক আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। 56 ইঞ্চি চওড়া কাঁধ, সরু কোমর, পুরুষ্টু বীরাপ্পানের মতো গোঁফ।

    উনি আমার হাতে একটা চশমা দিয়ে বললেন, “তাড়াতাড়ি পরে নিন।” আমি কোনো কথা জিজ্ঞেস করার আগেই উনি নিজে থেকে চশমাটা আমার চোখে লাগিয়ে দিলেন‌। তারপর হাতে বেশ কিছু কাগজপত্র দিয়ে বললেন, “এতে প্রশ্নগুলো লেখা আছে। আপনি ঠিক এই প্রশ্নগুলোই মহামহিমকে করবেন।”

    সঙ্গে বেশ কিছু কলম এবং সাদা কাগজ আমার হাতে দিয়ে বললেন, “সিকিউরিটি চেকিং-এর সময় আপনার ব্যাগ থেকে কলম আর কাগজগুলো আমরা নিজেদের হেফাজতে নিয়েছি, এখন থেকে আপনি লেখার সময় কেবলমাত্র এই কাগজ আর এই কলমগুলোই ব্যবহার করবেন।”

    আমি অবাক হয়ে নিজের ব্যাগ হাতড়ে দেখলাম, আমার ব্যাগে সত্যিই আমার কোনো কাগজ বা কলম নেই। মানে কী! বিষয়টা ঠিক বুঝলাম না। আমি এখানে এসেছি মহামহিম-এর ইন্টারভিউ নেবার জন্য। বহু বছর অপেক্ষা করে তারপর এই সুবর্ণসুযোগ আমি পেয়েছি। আমি একজন স্বাধীন সাংবাদিক। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তবে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। মহামহিমের কাছে যাওয়ার আগে এই বাড়িতে আমার সমস্ত কাগজপত্র সিকিউরিটি চেক করার পর, এখন আমাকে মহামহিমের কাছে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাহলে কেন আমার লেখার সব কাগজ আর কলম এরা নিয়ে নিল? এখানকার ব্যাপার-স্যাপার দেখে তো তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি। বাইরের দুনিয়া আর ভেতরের জগত, এই দুটো একই পৃথিবীর অংশ বলে মনে হয় না।

    হতভম্ব হয়ে আর্মি অফিসারের দেওয়া কাগজ আর কলম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর্মি অফিসার বললেন, “আমাকে অনুসরণ করুন।”

    ।।২।।

    সেই রাজপ্রাসাদের একদম পেছনে আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম। একটা ছোট্ট গেট থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে একটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলাম। বেশ কিছুটা জঙ্গলে রাস্তা পেরিয়ে একটা বিশাল বড়ো প্রান্তরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। অফিসার হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছে। আমার এত জোরে হাঁটার অভ্যেস নেই। আমি হাঁপিয়ে যাচ্ছি।

    বেশ কিছুটা হাঁটার পর হঠাৎ অনেক শব্দ শুনতে পেলাম। এখানে আসার পর এই প্রথম এত শব্দ কানে আসল। শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। শব্দ নয় তীব্র কোলাহল। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী যেন ভেঙে পড়ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও কিছু নেই তো। কিন্তু আমার গায়ে ধুলোর ঝাপটা আসছে। মাটি কাঁপছে । শব্দগুলো ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। সামনে তো সবকিছু পরিষ্কার? কোথাও তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চোখে হাত দিয়ে বুঝলাম চশমাটা রয়েছে। চশমাটা খুলে ফেললাম।

    অমনি দেখতে পেলাম সেই অনন্ত প্রান্তরের দিগন্ত রেখা থেকে ধুলোর ঝড় উঠেছে। হাতের চশমাটা চোখে পরলাম, আবার দেখি সব শান্ত কোথাও কিচ্ছুটি নেই। চশমা পকেটে চালান করলাম।

    হঠাৎ দেখি সামনে থেকে জঙ্গল ভেঙে সমস্ত বন্য জন্তুরা পিলপিল করে ছুটে আসছে। দাবানলের অগ্নিগ্রাস থেকে প্রাণ বাঁচাতে জঙ্গলের জীবজন্তুরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেমন ভাবে ছোটে, ঠিক তেমনই ঊর্ধ্বশ্বাসে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে। এ এক দিগন্ত বিস্তৃত অভিপ্রায়ণ।

    আমি কী করব বুঝতে পারছি না। কয়েকটা হরিণ, একটা চিতাবাঘ আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ওরা আমাকে পাত্তাই দিল না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু বুঝলাম এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ওদের সমবেত অভিপ্রায়ণের মধ্যে আমাকে চাপা পড়তে হবে। আর্মি অফিসার ছুটতে ছুটতে এসে বললেন, “লুকানোর জন্য একটা জায়গা খুঁজে নিন। পালান।”
    —কোথায় পালাব? কিছুই তো চিনি না। আপনি একটু সাহায্য করুন।
    —আত্মনির্ভরশীল হন। এটাই স্ববলম্বনের সঠিক সময়।
    কথাটা বলে উনি নিজে যেভাবে দৌড়ে এসেছিলেন সেভাবেই ছুটতে ছুটতে পাশের টিলাগুলোর মধ্যে হারিয়ে গেলেন। আমিও জান্তব তাগিদে ওদিকে ছুটলাম। আমার পেছনে প্রলয়ের তাণ্ডব নৃত্যের মতন বন্য জন্তুর দল ধেয়ে আসছে। ছুটতে ছুটতে একটা পাথরের খাঁজে একটু ফাঁক দেখতে পেলাম। অতি সন্তর্পণে কোনোমতে নিজেকে টেনেহিঁচড়ে সেই খাঁজের মধ্যে গলিয়ে দিলাম।

    ভেতরে একটা সরু, সংকীর্ণ গুহা রয়েছে। বাইরে থেকে অবশ্য বোঝা যায়নি। আমি উত্তেজনায় কাঁপছি। অনভ্যাসে এতটা দৌঁড়ে হৃৎপিণ্ড ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। একটু ধাতস্থ হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখি, কোনার প্রায়ান্ধকারে দুটো হাতির বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম এত সংকীর্ণ ফাঁকা দিয়ে হাতির বাচ্চাগুলো কী করে আসল। ওরাও নিশ্চয়ই আশ্রয়ের খোঁজে এসেছে। ওদের শান্ত নিরীহ চোখ দেখে মনে হল ওরা ভয় পাচ্ছে আমাকে।

    আস্তে আস্তে ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। যেন নিজেকেই আশ্বস্ত করতে চাইলাম, এই ঘোরতর বিপদে ওরা অন্তত পাশে আছে। আমি একা নই। জানি না ওরা কতটা আশ্বস্ত হল, তবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। প্রাচীনকাল থেকেই হাতিকে আমাদের দেশে সমৃদ্ধি, রাজকীয়তা, সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মানা হয়। তাই সিংহদুয়ার, রাজদ্বারের এর দুপাশে, মন্দিরগাত্রে হাতি খোদিত থাকে। কিন্তু আজ এই ভীষণ দুর্বিপাকে সৌভাগ্যলক্ষীকেও গুহাশ্রিত হতে হয়েছে।

    আমি এক কোনায় গিয়ে বসলাম। সংকীর্ণ ফাঁকটা দিয়ে বাইরের একটু সূর্যের আলো আসছিল, আর সেই আলোতে ধাবমান জীবজন্তুর ছায়া দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে । আমি ছায়ার চলচ্চিত্র দেখছিলাম। যেন একটা বিশাল রেলগাড়িতে বসে আছি, আর জানলার বাইরের জগত ক্রমশ ছুটে চলেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটার গতিও বাড়ছে। পাথরের গুহাটা মুহুর্মুহু কেঁপে উঠছে। মাটিটা উত্তেজিত হৃৎপিণ্ডের মতো ছটফট করছে। আমার খুব ভয় লাগছে। যে-কোনো মুহূর্তে পরিযায়ী পশুগুলোর ধাক্কায় এই আশ্রয়স্থলটা ভেঙে যাবে, আর এখানে আমি ওই হাতির বাচ্চাগুলো সহ চাপা পড়ে মরে যাব ।

    আমি একজন অতি সাধারণ সাংবাদিক। বিগত কয়েক বছর ধরে অনেক চেষ্টা করে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আজ একটা সুযোগ পেয়েছি। মহান-দপ্তর থেকে আমাকে পাঁচ মিনিটের সময় দেওয়া হয়েছিল সাক্ষাৎকারের জন্য। আমি এতেই খুশি। এই সুযোগই বা কজন পায়। মহামহিম তো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাই বলেননি বহু বছর। এটাই আমার জীবনের সব থেকে বড়ো টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। কেউ পোছে না, ধরনের সাংবাদিককে এত বড়ো একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য মহামহিমের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
    মহান-দপ্তরের দেওয়া প্রতিটা নির্দেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। ওরা যা বলেছে তাই শুনছি। বলেছিল সব সময় মাটির দিকে তাকিয়ে যাতায়াত করতে, আমি তাই করেছি। সামনে-পেছনে-উপরে-নীচে কোথাও চোখ তুলে তাকাইনি। কোনো প্রশ্ন করিনি। কিন্তু এখন এসব করেও তো বাঁচব বলে মনে হচ্ছে না।

    মাতৃগর্ভে শিশু যেমন গুটিসুটি ভাবে হাতের মুঠো বন্ধ করে রাখে, আমিও সেভাবে বসে আছি। এই স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার, ছোটো জায়গায়, মনে হচ্ছে আমি আবার মাতৃগর্ভে আশ্রয় নিয়েছি। আবার আমি জন্ম নেব।

    চোখ খুলে দেখি হাতির বাচ্চাগুলো নেই। ওরা কখন আমায় একা করে চলে গেছে। এসেছিল যে পথে, ফিরে গেছে সেই পথেই। কারণ সামনের ওই সংকীর্ণ ফাটল দিয়ে ওদের চলাচল অসাধ্য। বাইরে তখনও তুমুল শব্দ। প্রাণীগুলো প্রাণপণ ছুটে চলেছে। কী জানি ওদের কে ক্ষেপিয়ে দিল। কোন্‌ ধ্বংসের আঁচ পেয়ে ওরা সব ভেঙে তছনছ করে নিজেদের পথ নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছে।

    আমার ভয় লাগছে। এই অন্ধকার মাতৃজঠরে আমি একা। চারিদিক কী অনন্ত অন্ধকার! আমার শীত করছে। শীতে কাঁপছি আমি। আমার অস্থিমজ্জা ভেদ করে একটা একাকিত্বের শিরশিরানি ঢেউয়ের মতন বারবার আছড়ে পড়ছে। কতক্ষণ এভাবে, কতদিন এভাবে থাকতে হবে জানি না। এখান থেকে বেরিয়ে কি সেই একই পৃথিবী দেখতে পাব, যা আমি শেষ দেখেছিলাম!

    কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ মনে হল আর কোনো শব্দ আসছে না। একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা কানে বাজছে। আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে সেই ফাটলের মুখ থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখন সন্ধ্যা নামছে। সমগ্র স্থাবর-জঙ্গম জুড়ে অদ্ভুত নৈরাশ্য। চারদিকে তাকিয়ে দেখি একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত জঙ্গলের মাঝে, বড়ো বড়ো ক্ষতচিহ্ন যুক্ত একটা খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি। চারিদিকের গাছগুলো কে যেন ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে রেখেছে। যেন পৃথিবীতে জঙ্গলের কোনো অস্তিত্বই সে রাখবে না।

    হঠাৎ নিজের দিকে খেয়াল হল আমার। সারা শরীর ধুলোয় ঢেকে আছে। আমি নিজের পোশাকের রং চিনতে পারছি না। সারা শরীর আমার নোংরা। এত ধুলো কীভাবে লাগল? ভাবছি, আর তখনই আর্মি অফিসার হন্তদন্ত হয়ে আসলেন। তাঁর শরীরে কোনো ধুলো নেই। পরিষ্কার পোশাক। এসে বললেন, “আপনার চশমা কোথায়, চশমা পরে নিন জলদি।”

    সেটা পকেটের মধ্যে রাখা আছে। বের করে চোখে পরে নিলাম। আর্মি অফিসার খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, “এবার আসুন আমার সঙ্গে।” আমি আবার ওনাকে অনুসরণ করলাম।

    ।।৩।।

    জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে আবার আমরা একটা সুসজ্জিত নগরে প্রবেশ করলাম। কী চমৎকার অত্যাধুনিক নগর। লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কথা বলছে। হাসি, গল্প, প্রাণোচ্ছ্বলতা, আনন্দ যেন কোনো উৎসবের মরশুম।

    জঙ্গল ধ্বংসযজ্ঞের কোনো রেশ নেই এখানে। যেন সব কল্পনা, ওরকম কিছু ঘটেইনি। ঘটতেই পারে না। এই নগরে সবার চোখে চশমা। সবাই আমার মতো চশমা পরে আছে। সবাই কত সুখী, কত খুশি। কে নেই সেখানে! কৃষক আছে, শ্রমিক আছে, কারিগর আছে, চাকুরিজীবী আছে, ব্যবসায়ী আছে, শিল্পী আছে, বিজ্ঞানী আছে, ছাত্র-ছাত্রী আছে, বৃদ্ধ আছে, সমাজের হোমরা চোমরা সবাই আছে। এখানে কোনো কিছুর অভাব নেই। এটা সব পেয়েছির দেশ।

    হাঁটতে হাঁটতে একটা জিনিস লক্ষ করে অবাক হয়ে গেলাম। এখানে কিছু মানুষের ডান হাতের তর্জনীটা নেই। তারপর খেয়াল করলাম অনেকেরই তর্জনী নেই। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। আর্মি অফিসার তাড়া দিলেন, বললেন, “মহামহিম আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।” সত্যিই তো আর দেরি করা চলে না। দ্রুত হেঁটে একটা সুবিশাল বাড়িতে পৌঁছোলাম।
    আর্মি অফিসার আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কোথায় যেতে হবে। আর-এক প্রস্থ সিকিউরিটি চেকিং হয়ে গেল। কিন্তু আমি পড়লাম চূড়ান্ত অস্বস্তিতে। আমার সারা শরীর ভরতি ধ্বংসের ধুলো। এই ধুলো নিয়ে মহামহিমের কাছে কীভাবে যাব? পরিষ্কার হওয়া দরকার। কিন্তু কিছু বলার আগেই আর্মি অফিসার চলে গেলেন। কী মুশকিল! এখন কাকে বলব বাথরুমটা কোন্‌দিকে? এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। বাথরুম খুঁজে পেতেই হবে, একটু পরিষ্কার হওয়া খুবই দরকার।

    অদ্ভুত ভাবে এত বিশাল বাড়িতে কোনো বাথরুম খুঁজে পেলাম না। কাউকে যে জিজ্ঞেস করব, এমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। বাথরুম নেই, এটা হতে পারে না। চলতে চলতে একটা মস্ত বড়ো আয়নার সামনে নিজের ধুলোমলিন চেহারাটা ভালো করে লক্ষ করলাম। অদ্ভুত দেখতে লাগছে আমায়। মনে হচ্ছে এইমাত্র মাঠ থেকে চাষ করে উঠে এসেছি। সাংবাদিক নয়, আমাকে এখন খেটে-খাওয়া মানুষদের প্রতিনিধি হিসেবে মানাচ্ছে ভালো। একটু ভালো করে খেয়াল করে বুঝতে পারলাম আমার চোখের চশমার কাঁচটা খুব পরিষ্কার। আমি হাত দিয়ে দেখলাম, কাঁচ নেই! ফাঁকা। চশমাটা চোখ থেকে খুলতে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন বেজে উঠল। এতক্ষণ কোনো সিকিউরিটি গার্ডকে দেখিনি, এবার দেখলাম তারা আমাকে ঘিরে ধরেছে।
    তাদের মধ্যে ধবধবে সাদা উত্তরীয় আর ধুতি পরিহিত দশ বছরের এক তাপস বালক আমার সামনে এসে দাঁড়াল। সে আমাকে বলল, “চশমা খোলা বেআইনি। এখানে আপনি চশমা খুলতে পারবেন না। আপনি তো মহামহিমের সাক্ষাৎকার নেবেন। আমার সঙ্গে আসুন।”

    আমি চললাম তাপসের পিছু পিছু। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাজপথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা আমি একটু পরিষ্কার হতে চাই। আমার গায়ে ধুলো ভরতি। এখানে কোথায় রেস্ট রুম পাওয়া যাবে?”

    তাপস স্নিগ্ধ হেসে বলল, “আপনি তো মহামহিমের কাছে যাচ্ছেন! তিনি সবার পিতা। পিতার সামনে ধুলো গায়ে গেলে কিছু হবে না। তিনি এসব কিছু মনে করেন না। আপনি লজ্জা পাবেন না। তিনি সর্বজ্ঞ।”

    বাবা..! বাচ্চা তো নয়, এ তো চৌবাচ্চা।

    যেতে যেতে দেখলাম একটা বিশাল গুদামঘর। সেই ঘরে স্তুপীকৃতি করে রাখা আছে চশমা। বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন সাইজের চশমা। “এখানে এত চশমা কেন ?” প্রশ্নটা নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। তাপস থামল। তারপর ঘুরে আমার দিকে ফিরে বলল, “এ রাজ্যে সবাইকে চশমা প্রদান করা হয়, বিনামুল্যে বিতরণের বিনিময়। যাদেরকে চশমা বিতরণ করা হয়, তাদের থেকে তাদের পুরোনো চশমাগুলো জমা রাখা হয়। এগুলো সেই জমা পড়া চশমা।”
    —কিন্তু কেন? যাদের চশমা আছে, তারা কেন আপনাদের চশমা পরবে?
    বালক জ্ঞানীর মতো হেসে বলল, “আমাদের চশমা পডরলে চোখের কোনো রোগ হয় না। ডাক্তারের পেছনে খরচ কমে যায়।”
    —আর যাদের চশমা নেই তারা?
    বালক সামনের দিকে আঙুল তুলে বলল, “ওই দুটো চশমার ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট। ওখানে সূর্য চশমা আর পাশেরটাতে চন্দ্র চশমা বানানো হয়। যাদের চশমার প্রয়োজন নেই, তাদেরকে এই চশমাগুলো বিতরণ করা হয়। ওগুলো পডরলে কখনও চোখের কোনোরকম সমস্যা হবে না।”
    আমি বালকের দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোমার তো চশমা নেই।”

    বালক হেসে বলল, “আমরা যারা এখানে জন্মেছি আমাদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই চক্ষুদান করা হয়েছে। তাই আমাদের আর কখনও কোনো চশমার প্রয়োজন পড়বে না।” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “চক্ষুদান তো দেবতাদের হয়, মানুষের ও হয় নাকি?” বালক বলল, “হ্যাঁ, আমাদেরও হয়। আমাদের জন্মের পর চোখে একটা বিশেষ লেন্স বসিয়ে দেওয়া হয়। তাতেই আমরা সারা জীবন সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাই। আমাদের আর কখনও চোখের জন্য ডাক্তারের প্রয়োজন পড়বে না।”

    বালক এগিয়ে গেল। আমি বালকের পিছন পিছন চললাম। চলতে চলতে আমরা আর-একটা বিশাল বাড়ির সামনে এসে পৌছোলাম। বাড়ি বললে ভুল হবে, এটা একটা মস্ত কারখানার মতো। চশমাবাড়ি থেকে অনেক বড়ো।
    —এখানে কী কাজ হয়?
    বালক বলল, “এটা ঋণ আশ্রম। এখান থেকে সবাইকে ঋণ দেওয়া হয়।”
    —ঋণ তো ব্যাংক থেকে দেয়। আশ্রম থেকে ঋণ দেবে কেন?
    বালক বিরক্ত হয়ে আমাকে বলল, “আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন।”
    —আমি সাংবাদিক। প্রশ্ন করা আমার অধিকার।
    বালক আরও রেগে গিয়ে বলল, “আপনি বাইরে থেকে এসেছেন, তাই এখনও এখানকার নাগরিকদের মতন সুসভ্য হয়ে ওঠেননি। এখানকার সাংবাদিকরা অত্যন্ত সভ্য। তারা এত প্রশ্ন করে না।”

    মনে মনে রাগ হল। বাচ্চা ছেলেটার গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে হল। পাকা পাকা কথা বলে চলেছে তখন থেকে। যাইহোক, রাগটাকে কোনোরকমে গিলে আবার প্রশ্ন করলাম, “ঋণ আশ্রমের কাজটা ঠিক কী?”

    বালক পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার চশমাটা দেখল তারপর বলল, “এই নগরে যত মানুষ বাস করে, তাদের প্রত্যেকে এখান থেকে ঋণ দেওয়া হয়।”
    আবদারের সুরে তাপসকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভেতরে ঢুকে দেখা যায়?”

    সে নীরবে আমাকে ভিতর নিয়ে গেল। ভেতরটা দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। দু-তিনটে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন অনায়াসে এখানে ঢুকে যাবে। বিশাল বড়ো হলঘর। তার ধারে অজস্র ছোটো ছোটো ঘর। প্রত্যেকটা ঘরের ওপরে লেখা—কৃষিঋণ, কারিগরি ঋণ, শিক্ষাঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ, চিকিৎসাঋণ, গাড়িঋণ, শিশুঋণ, বিনোদন ঋণ, মননশীলতার ঋণ, কবিঋণ, লেখকঋণ, নাট্যঋণ, তীর্থঋণ, ধর্মীয় ঋণ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের ঋণ। এখন যদিও রাত তাই কোনো মানুষ নেই। এই জায়গাটা থেকে কেমন একটা হাসপাতাল হাসপাতাল গন্ধ আসছিল। অপারেশন থিয়েটারের মতো জায়গাও আছে একটা দেখলাম।

    তাপসকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মানুষেরা ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে এখান থেকে কেন ঋণ নেয়?”

    সে বলল, “এখান থেকে ঋণ নিলে সুদ দিতে হয় না। সময়মতো আসলটা ফেরত দিলেই হল।” খটকা লাগল। তারপর মনে হল, হতেই পারে। মহামহিমের মহানুভবতার কথা কে না জানে। তাও জিজ্ঞেস করলাম, “সুদ না হয় নাই দিল, কিন্তু কিছুই কি দিতে হয় না?”

    বালক বলল, “এখানে বন্ধক রাখতে হয়। তার বদলে ঋণ পাওয়া যায়।”
    সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বন্ধক রাখতে হয়?”
    বালক—“ডান হাতের তর্জনী।”
    —কী?
    —এখানে যারা ঋণ নিতে আসে, তাদের ডান হাতের তর্জনী বন্ধক দিতে হয়। তর্জনীর বদলে তিনি একাধিকবার ঋণ নিতে পারেন। একটা ছোট্ট অপারেশন করে তর্জনী কেটে নেওয়া হয়। তারপর যখন তিনি ঋণ শোধ করবেন, তখন আবার অপারেশন করে তর্জনী লাগিয়ে দেওয়া হয়।
    আমার চোখ তখন কপালে উঠেছে।
    —যতবার ঋণ নেবে তত বার তর্জনী কাটবে?
    —না না, একবারই।
    —কতদিনে এই ঋণ শোধ করতে হয়?
    —সেটা কী ধরনের ঋণ তার ওপর নির্ভর করে। ৫/১০/১৫ বছর সময় দেওয়া হয় ঋণ শোধ করার।
    —যারা ঋণ শোধ করতে পারে না, তাদের কী অবস্থা হয়?
    —যারা ঋণ শোধ করতে পারেন না, তাঁদের ঋণ শোধ করার জন্য আবার ঋণ দেওয়া হয়।
    চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “এত কিছু থাকতে তর্জনী কেন বন্ধক রাখতে হয়?”
    বালক কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে বলল, “বন্ধকি তর্জনীগুলো মমি করে মহাফেজখানায় রাখা হয়। পরিবর্তে লাগানো হয় মহামহিমের তর্জনীর ক্লোন। এখানে সবার তর্জনীর মাপ ও কাজ এক। ওটা মহামহিমের তর্জনী।
    —মানেটা কি? আমি চিৎকার করে উঠি। তারপর বালকের ছোটো, সরু আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলি, “তোমার তর্জনীটা আসল না ক্লোন?”
    বালক অজ্ঞতায় হেসে উঠে বলে, “আমার ১৮ বছর বয়স হলে, আমিও মহামহিমের তর্জনী ধারণ করতে পারব।” বালকের চক্ষুদানের চোখে গর্বের দম্ভ।
    —কিন্তু তুমিতো ঋণ নাওনি।
    —আমরা যারা এখানে জন্মেছি, তারা সবাই মহামহিমের কাছে ঋণী। তাই আমাদের আলাদা করে ঋণ নিতে হয় না। আমরা নিজেদের উৎসর্গ করেছি মহামহিমের শ্রীচরণে। আমরা চিরঋণী।

    আমি আর-একটু হলে হোঁচট খেয়ে পড়ছিলাম। বালক চিৎকার করে উঠল, “চশমা সাবধানে।”

    বালক বোঝেনি চশমার খোল আস্ত থাকলেও কাঁচ ভেঙে গেছে। আমি নিরুপায় হয়ে চললাম বালকের পিছু পিছু।

    এরপর একটা বিশাল বাগান শুরু হল, সেই বাগানের এক ধারে দেখি একটা গাছের ডাল থেকে ফলের মতন টাকা ঝুলছে। গাছটা কাচের দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। টাকার গাছ! আবার কিছুটা এগোনোর পর দেখি একটা জায়গায় ফোয়ারা থেকে জলের বদলে পয়সা বেরোচ্ছে। পয়সার ফোয়ারা! সেটাও কাঁচ দ্বারা বেষ্টিত। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল।

    তারপরেই এল সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত রাজপ্রাসাদ। এই রাজপ্রাসাদের ছবি আগে বহুবার বহু জায়গায় দেখেছি। দেশের সব মহামহিমরা এই রাজপ্রাসাদে থাকতেন। মহামহিম হলে পরে এখানে থাকতে হয়। একটা নির্দিষ্ট সিংহাসনে বসতে হয়।

    সেখানে একটা অতি সুসজ্জিত জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল ঘরে বসে আমাকে বসিয়ে তাপস বলল, “এখানেই অপেক্ষা করুন, মহামহিম আসবেন।” তারপর সে চলে গেল।
    আমি আমার ধূলিধূসরিত ব্যাগ থেকে কাগজ আর কলম বের করলাম। সঙ্গে সেই আর্মি অফিসারের দেওয়া প্রশ্নগুচ্ছ বের করলাম। প্রশ্নগুলো পড়ে রাগ হল, এসব প্রশ্ন কেন করব? আমি আমার মতন প্রশ্ন করব।

    ওদিকের পর্দা সরিয়ে সাদা পোশাকে মহামহিম প্রবেশ করলেন। কেমন একটা ঈশ্বরসুলভ চেহারা। সাধে কি এত কোটি কোটি মানুষ ওনাকে পুজো করে। গায়ের পোশাক কত দামি কে জানে! হাতের ঘড়ি, চোখের রোদচশমা থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। তিনি বসলেন আমার উলটো দিকে। মাঝে একটা ৮ ফুটের টেবিল। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর দু-একটা কুশল বিনিময় হল। আমার হাতে বেশি সময় নেই, মোটে পাঁচ মিনিট। কাজেই আমি শুরু করলাম। কিন্তু মুশকিলটা হল, আমি যে প্রশ্ন করি না কেন মহামহিম কিন্তু অন্য উত্তর দিচ্ছেন। আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলাম আমার হাতে যে প্রশ্নবিচিত্রা ধরা আছে, এক এক করে তারই উত্তরগুলো তিনি দিয়ে চলেছেন মুখস্ত বলার মতন। এবং আরও আশ্চর্য ব্যাপার আমার কলম নিজে নিজেই সেসব উত্তরগুলো আমার আঙুলকে দিয়ে লিখিয়ে চলেছে। আমি অন্য প্রশ্ন করছি, কিন্তু মহামহিম যেন শুনতে পাচ্ছেন না। আমি অন্য শব্দ লিখতে চাইছি, কিন্তু অদ্ভুত! কলম থেকে কোনো কালি পড়ছে না! আমি পাগলের মতন ব্যাগ উলটে ব্যাগ থেকে সমস্ত কলম বের করলাম। কিন্তু কোনো কলমে মহামহিমের দেওয়া উত্তর ছাড়া অন্য একটি শব্দও লিখতে পারলাম না। অথচ মহামহিমের শব্দগুলো কিন্তু ঠিক লেখা হয়ে যাচ্ছে। আমি টেবিলের উপরে রাখা কলমগুলো তুলে নিলাম। সেগুলো দিয়ে লেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনো দাগ পড়ল না।

    এদিকে মহামহিম বলেই চলেছেন। আমি সারা ঘরে এদিক ওদিক করে কলম খুঁজছি, ওনার দৃষ্টি কিন্তু সেই চেয়ারটির দিকে যে চেয়ারটিতে আমি বসেছিলাম। আমার কেমন জানি একটা অস্বস্তি হতে শুরু করল। আস্তে আস্তে মহামহিমের কাছে গেলাম উনি এখনও কথা বলে চলেছেন। অসীম সাহসে ওনার হাতে হাত রাখলাম। কিছু হেরফের হল না। ওনার চোখ থেকে চশমাটা তুলে নিলাম, আমার শিরদাঁড়া দ্বারা বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ওখানে তো কোনো চোখ নেই। এটা আসলে একটা রোবটিক ম্যানিকুইন।

    আতঙ্কে আমি দৌড়ে পাশের ঘরে গেলাম। সেখানেও আর একটা মহামহিম অন্য সাজপোশাকে অন্য কাজ করছে। আমি আস্তে আস্তে সব কটা ঘরে গেলাম। সবকটা ঘরে এক-একটা সাজপোশাকের মহামহিম নিজের কাজে ব্যস্ত আছেন।

    আমার মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে গেল। আসল মানুষটা কোথায়? আর সেই সিংহাসন। আজ পর্যন্ত যত মহামহিম হয়েছেন, তাঁদের সবাইকে ওই সিংহাসনে বসতেই হয়েছে। আসলে যারা সেই সিংহাসনে বসে, তারাই মহামহিম হয়। সেই অসীম ক্ষমতাধর, চরম প্রতাপশালী, সমস্ত শক্তির উৎস, সাত রাজার ধন এক মানিক খচিত, ১৩৭ কোটি আঙ্গুলের ছাপ দেওয়া সেই সিংহাসন কোথায়?

    সব ঘরে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। পুরো ঘরটা কাঁচ দিয়ে আটকানো। ঘরের ভেতরে যাওয়া যায় না। আমি দরজার পর্দা সরিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সেই ঘরে একটা মস্ত বড়ো শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপাশে সিংহাসনটা রয়েছে। সিংহাসনে কোনো মানুষ বসে নেই, সিংহাসনের ওপর দাঁড় করানো রয়েছে একটা কমলা পতাকা। পতাকাটা পাথরের তৈরি, পতাকার চাপে সিংহাসনে ইতিমধ্যে মধ্যে ফাটল ধরেছে।

    আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম। প্রবল ভয়ে নীচে নামছি, দেখি নীচে সেই তাপস বালকটি একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে হেসে বলল, “সাক্ষাৎকার ভালো হয়েছে তো?”
    কাঁপা কাঁপা গলায় কোনোরকম বললাম, “হ্যাঁ।”

    তারপর সে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। আমি ভাবলাম হ্যান্ডশেক করবে, আমিও ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। চুরুট কাটার ছোটো যন্ত্রের মতন একটা যন্ত্র দিয়ে আমার তর্জনীটা মুহূর্তের মধ্যে কেটে ফেলল। আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে মেঝেতে বসে পড়লাম। আমার হাত দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। আমার চিৎকারে কোনো শব্দ নেই, আমি যেন বোবা হয়ে গেছি। বালকটি কাটা জায়গায় ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে আমাকে বলল, “এখন থেকে আপনি আমাদের সদস্য হলেন। মহামহিম আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এটা তারই পুরস্কার।” তারপর বলল, “আপনি এখন কয়েকদিন এখানেই থাকুন। ক্ষত সেরে গেলে আপনাকে নতুন তর্জনী লাগিয়ে দেওয়া হবে। তখন আপনিও মহামহিমের তর্জনীকে বহন করবেন। তারপর আপনার জায়গাতে ফিরে যাবেন।” আমার রোরুদ্যমান চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “অপারেশন করে এত নিখুঁতভাবে আপনার নতুন তর্জনী লাগিয়ে দেওয়া হবে যে আপনি ভুলে যাবেন ওটা আপনার তর্জনী নয়।” আমার কাটা তর্জনীটা আমারই চোখের সামনে বালক একটি কৌটোবন্দি করে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেল।

    আমাকে ওখান থেকে অন্য একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমাচ্ছে আমি আমার চশমা, আমার ব্যাগ সমস্ত কিছু সেই ঘরে রেখে চুপিসারে সেখান থেকে পালিয়ে এলাম।

    ।। ৪।।

    রাতের অন্ধকারে সেই জঙ্গলের পথটি দিয়ে জঙ্গলে পৌঁছোলাম যে পথ দিয়ে এখানে এসেছিলাম। জঙ্গলের পথ আমি চিনি না, তার মধ্যে গভীর রাত। একটা বড়ো গাছের নীচে আশ্রয় নিলাম। আঙুলের ব্যথাটা এখন আর নেই। হাতের দিকে না তাকালে বুঝতেই পারছি না তর্জনীর জায়গাটা শূন্য। সকালে ওরা আমাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজবে। আমার সঙ্গে কিছু নেই। ব্যাগ, বকলেস, চশমা, কলম, আনুষঙ্গিক যা যা ছিল সব ওখানে রেখে এসেছি। সারাটা দিন কী হল সেটা ভাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু ভাবনাগুলো বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

    আজ সকালে উঠে আমি আনন্দের সমুদ্রে ভাসছিলাম। মহামহিম, যার জন্য সমস্ত দেশ গর্ব করে, তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ আমি পেয়েছি। আমি এক অতি নগণ্য, নিরীহ সাংবাদিক। মহামহিম সাধারণত কাউকে সাক্ষাৎকার দেন না। আর ওনার দপ্তর থেকে কিনা আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হল। মহামহিম সবার ভালো চায়, এমন মানবদরদি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।

    কিন্তু বাস্তবে যা ঘটল সেগুলো কী। ওরা আমার কলম আটক করল। আমার লেখার অধিকার কেড়ে নিল। আমি নাগরিক, ওরা আমার তর্জনী কেটে আমার নির্বাচনের অধিকার ছিনিয়ে নিল। আর যাকে আমরা মহামহিম বলে জানি, আসলে সেই মহামহিম বলে তো কেউ কোথাও নেই। এত বছর আমাদের একটা রোবটিক ম্যানিকুইন দেখিয়ে বোকা বানানো হয়েছে। আসলে মানুষের জায়গায় একটা পতাকা সিংহাসনে বসে রাজত্ব করছে। আমি দুই হাত দিয়ে আমার মাথা চেপে ধরলাম। আমি ভাবতে পারছি না। সবাইকে এই কথা জানাতে হবে। এই চরম সত্য জানার অধিকার প্রত্যেকটা মানুষের আছে। কিন্তু কীভাবে। কোথায় লিখব, কাকে বলব? কে শুনবে? কে বিশ্বাস করবে এ কথা?

    কিন্তু আমাকে তো লিখতেই হবে। সাংবাদিক হিসেবে আমার কর্তব্য করতেই হবে। সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে।

    অন্ধকার একটু একটু করে ফিকে হচ্ছে। আমি জঙ্গলে পথ ধরে আরও গভীর জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলাম। অনেকটা যাওয়ার পর দেখি একজন অন্ধ যুবক পাথরের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ওকে বললাম, “কী করছ তুমি?”
    সে বলল, “এ পাহাড়ের উপরে চূড়াতে ওঠার চেষ্টা করছি।”
    —তুমি তো চোখে দেখতে পাও না। অত উপরে কী করে উঠবে?
    —কী করে উঠব জানি না। তবে চেষ্টা তো অবশ্যই করতে হবে।
    —কেন?
    —এই পাহাড়টার নাম স্বাধীনতা। এর একদম চূড়ায় পৌঁছালে স্বাধীনতা পাওয়া যায়।
    —তাই‌! আমি তো জানতাম না।
    —শহরের লোকেরা গহীন জঙ্গলের খবর কী করে জানবে?
    আমি হাসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কী করে জানলে আমি শহরের লোক, তুমি তো দেখতে পাও না?”
    —শহরের লোকদের গা থেকে দূষণের গন্ধ আসে, আমি সে গন্ধ পাই।
    —তুমি কীসের থেকে স্বাধীনতা চাও? তোমার এই অন্ধত্ব থেকে?
    অন্ধ চোখে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ দেখলাম আমি। যুবক দৃঢ় কন্ঠে জানাল, “না। এই নগরে যাদের চোখ থাকতেও অন্ধ তাদের বোধের স্বাধীনতা চাই আমি।”
    আমি পায়ে পায়ে যুবকের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, “তুমি লিখতে পারো?”
    সে হেসে বলল, “হ্যাঁ। আমি জন্মান্ধ নই। আমাকে ওরা চশমা দিয়েছিল। আমি পরতে রাজি হয়নি। তাই আমার চোখ দুটো নষ্ট করে দিয়েছে।”
    আমি দেখলাম যুবকের তর্জনী কাটা নয়। বললাম, “এটা তোমার নিজের তর্জনী?”
    সে বলল, “হ্যাঁ, অন্তত তর্জনী কাটতে দেব না, তাই শহর ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে এসেছি।”
    —তুমি আমাকে কিছু কথা লিখে দেবে? আমি সাংবাদিক কিন্তু ওরা আমার কাগজ-কলম হস্তগত করেছে। এমনকি আমার তর্জনীও কেটে নিয়েছে। আমি এখন আর লিখতে পারি না। তুমি আমাকে কিছু কথা লিখে দেবে?
    সে বলল, “হ্যাঁ, দেব। কিন্তু কোথায় লিখব আর কে লিখব?”
    আমি তাকে অপেক্ষা করতে বলে জঙ্গলের কাঁটা গাছ থেকে কিছু কাঁটা তুলে আনলাম। সেগুলো যুবকের হাতে দিলাম।
    —বেশ, এই দিয়ে না হয় লিখব। কিন্তু কোথায় লিখব।

    সত্যিই তো কোথায় লিখবে? আশেপাশে তো লেখার মতন কোনো কিছুই নেই। তারপর নিজের দিকে তাকালাম। আমি আস্তে আস্তে আমার শরীর থেকে সব পোশাক খুলে ফেললাম। আমার হাত, মুখ আর গলা ছাড়া শরীরের আর কোথাও একফোঁটা ধুলো লাগেনি। ধুলোগুলো আসলে পোশাকে লেগেছিল।

    আমার অনাবৃত শরীর যুবকের সামনে মেলে দিয়ে বললাম, “তুমি আমার শরীরে লেখো।”

    আমার সারা শরীরে যুবক কাঁটা দিয়ে সৃষ্টি করে চলল এক-একটা অক্ষর। আল্পনার মতন রক্ত-লেখায় ভরে গেল আমার শরীর। আমি বলে চললাম প্রতিটি শব্দ। আমার পিঠে, বুকে, স্তনে, কোমরে, নাভিমূলে, নিতম্বে, উরুতে, প্রতিটি অনাবৃত স্থানে লিখিত হল সত্য। রক্তস্নানে অবশেষে আমি শুচি হলাম। প্রতিটা অক্ষর উত্তপ্ত লোহার মতো আমার নরম ত্বক চিরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল। আমি জীবন্ত বর্ণমালায় পরিণত হলাম। অলক্ষ্যে বিদ্যাসাগর মশাই হাসলেন।

    অবশেষে অন্ধ যুবককে ধন্যবাদ জানিয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। পাথরের রাস্তা আমার রক্তে পিছল হয়ে যাচ্ছে বারবার। খুব সন্তর্পণে পা ফেলছি আমি। অনেকটা যাওয়ার পর দেখি পাথরের উপর মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত শরীরটা পড়ে রয়েছে। শুভ্র শাড়ি, ধবধবে চুল, ব্রহ্মকমলের মতন জ্যোতির্ময়ী এক দেবী। আমি অতি সন্তর্পণে তাঁর পাশ থেকে তাঁর লাঠিটা তুলে নিলাম। সেই লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে চললাম উত্তরণের পথে।

    অনেক চড়াই পেরিয়ে অনেক উৎরাই বেয়ে, মোজেস-এর তিতিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলেছি। শুধু মনে আছে, আমায় চূড়ায় পৌঁছোতে হবে। অবশেষে পৌঁছোলাম। এবার স্ব-অধীনতা। কিন্তু কীসের স্বাধীনতা চাই আমার?

    সূর্যের আদর গায়ে মেখে, পাখির মতো দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়ালাম। আমার শরীরে খোদিত শব্দগুলোকে স্বাধীন করে দিলাম। প্রত্যেকটা শব্দ আমার শরীর থেকে প্রজাপতির মতন পাখনা মেলে উড়ে চলল। উড়তে উড়তে তারা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত উপত্যকায়। কেউ বসল কৃষকের হালে, কেউ বসল কুমোরের চাকায়, কেউ বসল শ্রমিকের কবজিতে, কেউ গেল ছাত্র-ছাত্রীর পাঠ্যপুস্তকের উপর। কেউ বসল দোকানদারের তুলাদণ্ডে। কেউ আবার ভিক্ষুকের ভিক্ষাভাণ্ডে, কেউ উড়তে উড়তে গিয়ে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন প্যাড গিয়ে বসল। কেউ আবার উকিলের কালো কোটে, কেউ শিক্ষকের চশমাতে, কেউ প্রবেশ করল কবি-লেখকদের হৃদয়ে। কিছু শব্দ মায়েদের মুখ থেকে শুনল তাদের গর্ভজাত সন্তানরা। কিছু শব্দ নারীর ঠোঁটে অবয়ব ধারণ করল।

    এভাবে নিজেকে নিঃশেষ করে আমি পাহাড়ের চূড়ায় মাটির সঙ্গে মিশে গেলাম। আমার সবকিছু প্রকৃতি গ্রহণ করল। শুধু আমার শব্দগুলো রয়ে গেল। আমি জানি, আগামীতে এই শব্দ থেকেই তৈরি হবে সেই হাতিয়ার, যা ওই সিংহাসনকে মুক্তি দেবে। আমি অপেক্ষায় রইলাম তাদের, যারা এই শব্দের হাত ধরে সমস্ত মিথ্যের অচলায়তন ভেঙে তর্জনী তুলে নির্বাচন করবে নিজেদের আগামী ভবিষ্যৎকে। আমি অপেক্ষায় রইলাম সেই যুগসন্ধিক্ষণের।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ২১ জুলাই ২০২০ | ২১৫৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Chandrima | 2409:4060:210c:5ca:9439:9a2b:7ff5:7a19 | ২২ জুলাই ২০২০ ০০:৫৮95410
  • Beautiful concept! Aro golpor pratashai roilam!

  • Deshika | 2402:3a80:a50:1d1f:0:49:a2e6:8501 | ২২ জুলাই ২০২০ ০৬:২৩95413
  • অসাধারণ....

  • dc | 103.195.203.17 | ২২ জুলাই ২০২০ ০৮:০৬95414
  • সুন্দর গোরুর রচনা হয়েছে। তবে শিং এর উপকারিতা সংক্রান্ত অংশটুকু বাদ পড়ে গেছে, তাই ১০ এ ৭ নম্বর দিলাম। পরেরবার আরও ভালো মুখস্থ করা চাই।
  • বিপ্লব রহমান | ২২ জুলাই ২০২০ ০৮:৪০95416
  • সাইবার স্পেসের গুচ্ছের অপচয়!      

  • মৃণাল রায় | 103.109.218.95 | ২২ জুলাই ২০২০ ১৩:০৩95421
  • খুব ভাল লাগল লেখাটি পড়ে। কল্পনাশক্তি ও চিন্তাশক্তি দুইই খুব প্রখর। বীভৎস রাজনীতির শেকলে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে আজ আমরা ভয়াবহ দিন কাটাচ্ছি। হাতের কব্জিও কেটে রেখে দিচ্ছে যাতে লেখার স্বাধীনতাটুকুও না থাকে। কিন্তু শত হলেও প্রতিবাদী স্বর ক্ষীন হলেও বেঁচে থাকে যাতে ভর করে মানুষ স্বাধীনতা বস্তুটির স্বাদ পেতে চায়। ছড়িয়ে দিতে চায় সে স্বাদ সবার মধ্যে। ‘কুকুর বা অন্যান্য জন্তুর সঙ্গে মানুষের তফাতটা বোধহয় এখানে যে, মানুষ নিজের বকলেস নিজেই পরে আবার নিজেই খোলে।‘-লাইনটি অনবদ্য। কি সুন্দর উপমা দিয়েছেন লেখিকা।সে রকমই আরেকটি লাইন হল - ‘প্রাচীনকাল থেকেই হাতিকে আমাদের দেশে সমৃদ্ধি, রাজকীয়তা, সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মানা হয়। তাই সিংহদুয়ার, রাজদ্বারের এর দুপাশে, মন্দিরগাত্রে হাতি খোদিত থাকে। কিন্তু আজ এই ভীষণ দুর্বিপাকে সৌভাগ্যলক্ষীকেও গুহাশ্রিত হতে হয়েছে।‘সমাপ্তিও টেনেছেন অতি সুন্দর আশার বানী দিয়ে -‘আমি জানি, আগামীতে এই শব্দ থেকেই তৈরি হবে সেই হাতিয়ার, যা ওই সিংহাসনকে মুক্তি দেবে। আমি অপেক্ষায় রইলাম তাদের, যারা এই শব্দের হাত ধরে সমস্ত মিথ্যের অচলায়তন ভেঙে তর্জনী তুলে নির্বাচন করবে নিজেদের আগামী ভবিষ্যৎকে। আমি অপেক্ষায় রইলাম সেই যুগসন্ধিক্ষণের।‘

  • Madhu | 2409:4065:11:f2aa::259a:b8a4 | ২২ জুলাই ২০২০ ১৬:০৮95425
  • Bahhh khub valo concept

  • ত্রিভ | 117.194.39.99 | ২২ জুলাই ২০২০ ২৩:৩১95428
  • বেশ ভাল লেখা। কলমের জোরও প্রশংসার। আরও লেখা পাব এই প্রত্যাশায়।

  • b | 14.139.196.11 | ২৩ জুলাই ২০২০ ০১:০৭95429
  • ভালো লগলো
  • | ২৩ জুলাই ২০২০ ১০:৪৭95438
  • আমারও ভালই লাগল।
    আরেকটু সাটল হলেও মন্দ হত না অবশ্য।
  • পার্থ চক্রবর্তী | 106.211.138.213 | ২৬ জুলাই ২০২০ ২৩:১২95584
  • দুর্দান্ত

  • পার্থ চক্রবর্তী | 106.211.138.213 | ২৬ জুলাই ২০২০ ২৩:১২95583
  • দুর্দান্ত

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন