এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • মহামারী, কোয়ারেন্টাইন ও দেশকাল - পর্ব ১

    দীপঙ্কর দাশগুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০৫ জুলাই ২০২০ | ৪৪৫৩ বার পঠিত
  • ভূমিকা

    মহামারীর প্রাদুর্ভাব নতুন কিছু নয়। বেদ-বাইবেল-পুরাণের যুগ থেকে শুরু করে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে নানান কালান্তক রোগের সংক্রমণ পীড়িত করেছে মানব সভ্যতাকে। দেশ-বিদেশের সমাজ রোগের অভিঘাত মোকাবিলা করেছে বিচিত্র ভঙ্গিতে। চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতি ঘটেছে, তবে তারই পাশাপাশি এলিজাবেথান ইংল্যান্ড বা ঔপনিবেশিক বঙ্গে রোগকে ঘিরে উৎপত্তি হয়েছে কৌতুককর ঘটনার, পাখা মেলেছে মানুষের অন্ধবিশ্বাস, আধিপত্য বিস্তার করতে, চলেছে কৌশলী রাজনীতির খেলা। আর নিরুপায় সাধারণ মানুষ আশ্রয় খুঁজেছে দৈব নির্ভরতায়।



    মহামারির প্রতিফলন শিল্প-সাহিত্যে


    সাত পর্বের এই লেখাটিতে মহামারীকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে সাতটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে। কোথাও যেমন সমকালীন সাহিত্যে তার প্রতিফলন খোঁজা হয়েছে, তেমনি কোথাও আবার উঠে এসেছে রোগের বিচিত্র চিকিৎসা-পদ্ধতি এবং মারী -কেন্দ্রিক রঙ্গ-রসিকতা। ঔপনিবেশিক বঙ্গে জাতীয়তাবোধের উন্মেষের সন্ধান করতে গেলে তারও একটি সূত্র মিলবে দেশজ চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার আগ্রাসী ছায়া বিস্তারে। আবার কলেরার হানায় ব্রিটিশদের আতঙ্ক প্রকাশ পেয়েছে তিনশ বছর আগে হাওড়া ও কলকাতায় খোদ ব্রিটিশ সওদাগরের অর্থে ওলাবিবির মন্দির গড়ে ওঠার ঘটনায়। আর করোনা আতঙ্ক থেকে বাঁচতে এই একুশ শতকে লৌকিক দেবদেবীর তালিকায় নবতম সংযোজন করোনা মাতা। সাহিত্য, ইতিহাস, বেদ-পুরাণ তো হলই, হাল আমলে করোনার সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হচ্ছে আরও দুটি শব্দ -- মাস্ক এবং স্যানিটাইজার। নথিপত্র বলছে, এরাও কিন্তু নতুন আমদানি নয়। দেশে দেশে চিরকালই এরা ছিল মারীর সহচর। খুঁজে দেখলে এদের নিয়েও চিত্তাকর্ষক তথ্য কিছু কম নেই। শেষ দুটি পর্বে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বৃত্তান্ত।


    লকডাউন

    "পাস নহিঁ আইয়ে, হাথ না লগাইয়ে ...
    কীজিয়ে নজারা দূর-দূর সে ...
    কীজিয়ে ইশারা দূর-দূর সে ..."

    মনে হতেই পারে, এ যেন করোনা-আতঙ্কে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলায় জন-সচেতনতা বাড়াতে কোন পাবলিক সার্ভিস ক্যাম্পেন! এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে আশ্চর্য মিলে গেলেও আসলে এই গানটি মধুবালা ও প্রেমনাথ অভিনীত ১৯৫২ সালের হিন্দি রোম্যান্টিক ক্লাসিক ফিল্ম সাকি-র। "জনতা কার্ফু"-র জেরে বাড়িতে বসে মহামারি-চর্চা করতে গিয়ে গানটি নজরে এল। (গানের ইউটিউব লিঙ্ক লেখার নিচে রইল। আগ্রহীরা শুনতে পারেন)

    এই মুহূর্তে যে কয়েকটি শব্দ সবচেয়ে আলোড়ন তুলেছে সেগুলি হল, লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং, কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন। কালান্তক যে ভাইরাসের অতর্কিত আক্রমণে গোটা দুনিয়া দিশেহারা, যার এখনও কোন প্রতিষেধক বা আরোগ্যের হদিস নেই তার সংক্রমণ প্রতিহত করতে হলে সামাজিক দূরত্ব রচনা করা ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই। সঙ্গরোধ, অন্তরীন, গৃহবন্দী যে নামেই একে অভিহিত করা হোক না কেন এবং এই স্বেচ্ছা-নির্বাসন মেনে নিতে যত অসহ্যই লাগুক না কেন সমাজের প্রতিটি মানুষ মন থেকে মেনে নিয়ে তা আন্তরিক ভাবে পালন না করলে কেবল সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুশাসনে মহামারির ছোবল আমরা রুখে দিতে পারব না।

    জনস্বাস্থ্যের এমন বিপন্নতায় আজ যখন আমরা সামাজিক দূরত্বের ওপর এত গুরুত্ব আরোপ করছি তখন ভেবে অবাক হতে হয়, প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে ১৬৬৫-৬৬ সালে লন্ডনে বিউবোনিক প্লেগের হানার সময় রোগের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্রিটেনের খনি শ্রমিকদের ছোট্ট একটি গ্রাম এয়াম নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে সে আমলেই প্রথম 'লকডাউনে'র নজির গড়েছিল। বিলেতের অপরিচ্ছন্ন অঞ্চল থেকে ওই গ্রামে রোগের আমদানি হয়েছিল কাপড়ের পুঁটলির সঙ্গে আসা মাছির মাধ্যমে। গ্রামের যাজকের পরামর্শে সেই স্বল্প-শিক্ষিত, সাধারণ মানুষেরা বুঝতে পেরেছিলেন, ছোঁয়াচে রোগটিকে বাগে আনতে গেলে অন্যের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। গ্রামে ঢোকার পথ আটকে দেওয়া হল বিরাট এক পাথরের চাঁই দিয়ে। পাথরটিতে ছটি ছিদ্র করা হল। সেখানে গ্রামবাসীরা খাবার ও ওষুধপত্রের দাম হিসেবে কিছু মুদ্রা রেখে দিতেন আর পাশের গ্রাম থেকে পড়শিরা খাবার-দাবারের যোগান দিতেন। প্লেগে অনেক গ্রামবাসীর মৃত্যু হলেও সেখান থেকে অন্যত্র রোগ আর ছড়াতে পারে নি। এয়ামের আত্মত্যাগের কাহিনী কিংবদন্তীতে পরিণত।

    বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কালে ভয়াল মহামারি হানা দিয়েছে বারবার নানা রূপে। আমাদের ভাগবত পুরাণ বা পাশ্চাত্যের বাইবেলেও যার উল্লেখ রয়েছে সেই প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ, স্মলপক্স বা গুটি বসন্ত, কলেরা বা ওলাওঠা, পোলিও, কুষ্ঠ, হাম, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা কিংবা এইচ আই ভি/এইডস প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের নানা দেশ এবং মানব সমাজকে ছারখার করে চলেছে। তবু সীমাহীন বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায় নি। কালান্তক ব্যাধিকে শেষ পর্যন্ত জয় করেছে বা দমিয়ে দিতে পেরেছে মানুষই। তাই করোনা-আতঙ্কে অযথা বিপর্যস্ত না হয়ে আমরা বরং একটু পিছন ফিরে তাকাই। মহামারির বিপদ থেকেই কিন্তু আবার জন্ম হয়েছে মহৎ সাহিত্যের এবং অতুলনীয় সেবাব্রতের।

    ১৫৬৪ সালের জুলাই মাস। শেক্সপিয়ার তখন তিন মাসের শিশু। স্ট্রাটফোর্ড-অন-আভন পাড়ার হেনলি স্ট্রিট প্লেগের আতঙ্কে দিশেহারা। দুধের সেই শিশুকে রোগের ছোবল থেকে বাঁচাতে মা মেরি আর বাবা জন বাড়ির দরজা-জানালা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। তখনকার যুগেও সামাজিক সঙ্গরোধের অনুশীলন আর ঘর-দোর সাফ-সুতরো রাখার কল্যাণেই সম্ভবত পরবর্তী কালের বিশ্ব সাহিত্যিক সপরিবারে রক্ষা পেলেন। এর ৪০ বছর পরেও আবার খ্যাতির মধ্য গগনে থাকা শেক্সপিয়ার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেলেন। সেবারও প্লেগের হানা। তিনি তখন লন্ডনে সেন্ট গাইলস গির্জার কাছে সিলভার স্ট্রিটে ছোট একটা ঘরে থাকেন। তাঁর গ্লোব থিয়েটার ছাড়াও সোয়ান, ফরচুন, রোজ সহ আরও কয়েকটি নাট্যশালা রমরমিয়ে চলছে। আর তাকে ঘিরে জমজমাট ব্যবসা নৌকার মাঝি, পানশালা, রেস্তোঁরা, গণিকালয় আর গোমস্তাদের। প্লেগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রুখতে রানির হুকুমে বন্ধ হয়ে গেল সব। শেক্সপিয়ারের নাট্যদল "দি কিংস মেন"-এর অনেক বালক অভিনেতাও কালান্তক রোগের বলি হল। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থাতেও শেক্সপিয়ারের কলম থামে নি। বরং রচিত হয়েছে বিখ্যাত সনেটগুচ্ছ, এন্টোনি এন্ড ক্লিওপেট্রা এবং কিং লিয়ারের মতো ট্রাজেডি।

    বিশ্বের প্রাচীনতম ছোঁয়াচে রোগ হিসেবে মহামারির ইতিহাসে ঠাইঁ পেয়েছে প্লেগ। প্যালেস্তিনীয়রা যে প্লেগের কবলে পড়েছিল সে কথা বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে -- "Mice that marred the land"। ইঁদুরের সঙ্গে রোগটির যোগসূত্রের কথা জানা ছিল এশিয়ার প্রাচীন সভ্যতায়। অনুরূপ ইঙ্গিত রয়েছে ভাগবত পুরাণেও। ইতিহাস বলে, প্লেগের আদি উৎসভূমি ছিল মধ্য এশিয়া। সিল্ক রুট দিয়ে সেই রোগের অনুপ্রবেশ ঘটে ক্রিমিয়ায় ১৩৪৩ সালে। সেখান থেকে ভূমধ্যসাগরের বুকে বাণিজ্যতরী বেয়ে ইউরোপ এবং অবশেষে তা পরের পাঁচ বছরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডে। সেকালের লন্ডন শহরের বিভিন্ন মহল্লা ছিল সংকীর্ণ অলিগলি আর নোংরা, আবর্জনায় ভরপুর। অষ্টম এডোয়ার্ড তখন সিংহাসনে। মৃত্যুমিছিল আর নাগরিকদের হাহাকারে একসময় বিচলিত হয়ে তিনি রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নগরপালিকাদের শহর পরিষ্কার করার নির্দেশ দেন। কিন্তু অসহায় টাউন কাউন্সিল জানিয়ে দেয়, কিছুই করার নেই কারণ প্লেগের দাপটে সব সাফাই কর্মীরও মৃত্যু হয়েছে। মহামারির ব্যাপকতা এমনই ছিল যে ইতিহাসের পাতায় তা "ব্ল্যাক ডেথ" হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। সমগ্র ইউরোপ, অটোমান সাম্রাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের বহু স্থানেও তা থাবা বসিয়েছিল।



    লন্ডনে প্লেগ আক্রান্ত বাড়ির দরজা


    এর তিনশ বছর পরে শেক্সপিয়ারের আমলে আবার যখন প্লেগ হানা দিল সে সময়েও লন্ডন শহরের পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। জনতার ভিড়ে উপচে পড়া পূতিগন্ধময় তল্লাটে স্তূপীকৃত আবর্জনায় অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইঁদুরের পাল। কাঁচা নর্দমার সব নোংরা গিয়ে পড়ছে টেমস নদীর জলে। সে শহর যে রোগের ডিপো হবে তাতে আর আশ্চর্য কী! আর সমাজের ছিরিও ছিল তথৈবচ -- অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছিল যৌন লাম্পট্য। ইঁদুরের গায়ে বসা মাছির থেকে ছড়িয়ে পড়া প্লেগের প্রকোপ লন্ডনকে তচনচ করেছে বারবার -- ১৫৬৩, ১৫৭৮-৭৯, ১৫৮২, ১৫৯২-৯৩ এবং ১৬০৩ সালে রোগের হানায় একেকবারে সাফ হয়ে গেছে লন্ডনের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ করে প্রাণ। এছাড়াও ছিল বসন্ত, যৌনরোগ সিফিলিস, ম্যালেরিয়া এবং উকুন-বাহিত জ্বর টাইফাসের আক্রমণ। শেক্সপিয়ারের রচনায় ঘুরে ফিরে এসেছে এইসব রোগের প্রসঙ্গ। যেমন কিং লিয়ার নাটকে জ্যেষ্ঠা কন্যা গনেরিলের সীমাহীন অকৃতজ্ঞতাকে তুলনা করা হয়েছে প্লেগের সঙ্গে --

    "But yet thou art my flesh, my blood, my daughter;
    Or rather a disease that's in my flesh,
    Which I must needs call mine: thou art a boil,
    A plague-sore, an embossed carbuncle,
    In my corrupted blood."

    আবার রোম্যান্টিক কমেডি রোমিও এন্ড জুলিয়েট-এ আমরা দেখি, কোয়ারেন্টাইনের প্রসঙ্গ। সে সময় লন্ডনে প্লেগের কবল থেকে বাঁচতে যাবতীয় বড়লোক শহর ছেড়ে পালিয়েছিল। কিন্তু গরিব মানুষের সে সঙ্গতি ছিল না। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে তাদের মৃত্যু হত বিনা চিকিৎসায় গৃহবন্দী অবস্থায়। রোগ-কবলিত সব বাড়ির দরজায় লাল রঙে এঁকে দেওয়া হত ক্রস চিহ্ন। নিয়তির শরণাপন্ন হয়ে লেখা থাকত -- “Lord have mercy on us.” রাস্তায় টহল দিতে দিতে পাহারাদাররা নজর রাখত, কেউ যেন অভিশপ্ত বাড়ি থেকে বেরোতে বা ঢুকতে না পারে। কোয়ারেন্টাইনে ছিল বলেই তখন ফ্রায়ার লরেন্স সেই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটা রোমিওর হাতে পৌঁছে দিতে পারে নি --

    Friar Lawrence:
    “…the searches of the town, suspecting that we
    both were in a house
    where the infectious
    pestilence did reign…
    sealed up the doors,”

    আর পরোক্ষে হলেও রোমিও-জুলিয়েটের মৃত্যুর পিছনে ছিল প্লেগের ভূমিকা। পঞ্চদশ শতকে ইউরোপ-জুড়ে ছড়িয়েছিল মারণ রোগ সিফিলিস। আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে ১৪৯৩ সাল নাগাদ স্পেনীয়রা রোগটি বহন করে এনেছিল আমেরিকা থেকে। রানি এলিজাবেথের যুগে বিলেতে রোগটি নানা নামে পরিচিত ছিল -- ফ্রেঞ্চ পক্স, স্প্যানিশ সিকনেস, গ্রেট পক্স ইত্যাদি। ধুম জ্বর, প্রবল বেদনা এমনকি অন্ধত্ব বা উন্মাদ হয়ে যাওয়াও ছিল এর নানা উপসর্গ। রোমিও এন্ড জুলিয়েট নাটকের ফার্স্ট কোয়ার্টোতে এর উল্লেখ আছে একটি সংলাপে -- "A pox of your houses". সিফিলিসের কথা শেক্সপিয়ারের রচনায় বহুভাবে এসেছে। তখন এন্টিবায়োটিক ছিল না। রোগ সারাতে আজগুবি নিদান ছিল -- পারদের বাষ্প শ্বাসের সঙ্গে নিলে নাকি সিফিলিসের উপশম হবে।

    শেক্সপিয়ার তাঁর টাইমন অব এথেন্স নাটকে সেই সর্বনাশা দাওয়াইকে উপহাস করতে ছাড়েন নি --

    "Give them diseases, leaving with thee their lust.
    Make use of thy salt hours: season the slaves.
    For tubs and baths; bring down rose-cheeked youth.
    To the tub-fast and the diet."

    ১৫৮৫ সালে লন্ডনের পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হয়েছিল যে সিফিলিস আক্রান্ত অগুনতি মানুষের জন্যে হাসপাতালে কোন শয্যা অবশিষ্ট ছিল না।

    এই প্রসঙ্গে মনে পড়া খুবই স্বাভাবিক সম্প্রতি ইরানে এক মোল্লা করোনা রোধে পশ্চাদ্দেশে ল্যাভেন্ডারের প্রলেপ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। কাজেই ৫০০ বছর পরে একুশ শতকেও পৃথিবী যে অনেক ক্ষেত্রে বদলায় নি তাতে সন্দেহ নেই।

    টাইফাস-জ্বরের প্রকোপের বিবরণ পড়লেও শিউরে উঠতে হয়। রানি এলিজাবেথ এবং রাজা প্রথম জেমসের আমলে লন্ডনের কারাগারগুলিতে কয়েদির ভিড় উপচে পড়েছিল। নিউগেট জেলের নোংরা কুঠুরিতে গ্রেফতার হওয়া দরিদ্র ভিখিরি, মাতাল, নেশাখোর, ছিঁচকে চোর সহ বিভিন্ন কয়েদি থাকত ঠাসাঠাসি করে। স্নান করার উপযুক্ত ব্যবস্থাও ছিল না। ফলে তাদের গায়ে ছিল উকুনের বাসা। শরীর চুলকানিতে ভরে যেত আর চুলকিয়ে ছাল-চামড়া উঠে গেলে সেখানে উকুনের বিষ্ঠা থেকে রক্তে সংক্রমণ ছড়াত। ক্ষতস্থানে পচন ধরে প্রবল জ্বর আসত। জ্বরের ঘোরে কয়েদিরা ভুল বকত আর বন্দিদশা শেষ হওয়ার আগেই বহু কয়েদি বিনা চিকিৎসায় মারা যেত। কয়েদিদের বেদনার কথা মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন শেক্সপিয়ার। হেনরি দ্য সিক্সথ নাটকে তিনি রোগাক্রান্ত বন্দিদের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে সওয়াল করেছেন --

    "If we mean to thrive and do good, break open the gaols and let out the prisoners."

    করোনা মহামারির আবহে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে সদ্য ঘটে যাওয়া বন্দিদের বিদ্রোহ শেক্সপিয়ারের নাটকের সংলাপ টিকে মনে করিয়ে দেয়।



    কলেরা সংক্রামিত দেশগুলি থেকে আসা যাত্রীদের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ। ১৮৬৫-৬৬ সালে ফ্রান্স-ইতালি সীমান্তে।


    ম্যালেরিয়ার কবল থেকেও লন্ডনে কারও নিস্তার ছিল না। পাঁকে-ভরা টেমস নদী ছিল মশার আড়ত। স্যাঁতসেতে পরিবেশে সাউথওয়ার্কের থিয়েটার পাড়ায় ঘোরাফেরা করলে কাঁপুনি দিয়ে ম্যালেরিয়ার জ্বরে পড়তেই হত। খোদ কিং জেমস কিংবা শেক্সপিয়ারের বন্ধু মাইকেল ড্রেটন কেউই নিস্তার পান নি। সেযুগের লন্ডনে লোকের বিশ্বাস ছিল, জলাভূমি থেকে বাষ্প শুষে নিয়ে জ্বর ছড়িয়ে দিত সূর্যের তাপ। শেক্সপিয়ারের নাটকের চরিত্রের সংলাপে আভাস মেলে তার। টেম্পেস্ট নাটকে প্রসপেরোকে অভিশম্পাত দিতে গিয়ে ক্যালিবান সেই প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছে --

    "All the infections that the sun sucks up
    From bogs, fens, flats, on Prosper fall and make him
    By inch-meal a disease!"

    মহামারির প্রেক্ষাপটে মানুষের প্রতিক্রিয়ার বিবিধ অভিঘাত প্রতিফলিত হয়েছে কালজয়ী সাহিত্যে। হোমারের ইলিয়াডে ট্রোজান ওয়ার ঘিরে আগামেমনন এবং একিলিসের কলহই শুধু নয়, প্রতিটি চরিত্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিচ্যুতি এবং কাহিনীর জটিলতা ঘনিয়ে উঠেছে একেবারে শুরুতে প্লেগের পটভূমিতেই। আর যে ইতালি আজ করোনা-সংক্রমণে বিধ্বস্ত সেই দেশের সাহিত্যিক বোকাচিও লিখেছিলেন এক আশ্চর্য গদ্য-কাহিনী "ডেকামেরোন" ১৩৪৯ - ১৩৫৩ সালের মধ্যে। মহামারি প্লেগ-কবলিত ফ্লোরেন্স থেকে পালিয়ে গিয়ে তিন পুরুষ আর সাত নারী স্বেচ্ছা -নির্বাসন নিয়েছিল ফিসোল নগরীর এক সুরম্য ভিলায়। ঠিক হল, প্রতিদিন প্রত্যেককে একটা করে গল্প বলতে হবে। তা থেকেই জন্ম নিল শত গল্পের সংকলন। প্রতিটি গল্পের শেষে আবার ছিল চমৎকার একটি করে গান। কাহিনীগুলি গড়ে উঠেছিল নৈতিকতা, প্রেম, যৌনতার রাজনীতি, বাণিজ্য এবং ক্ষমতার আস্ফালনকে কেন্দ্র করে। মহামারির দাপটে পর্যুদস্ত দৈনন্দিন জীবনকে কিভাবে আবার 'স্বাভাবিক' করে তোলা যায়, এই গল্পগুলি সেকথাও বলে।

    আবার পরবর্তী কালে ঊনবিংশ শতকে এডগার আলান পো-র বিখ্যাত ছোট গল্প “The Masque of the Red Death” ফুটিয়ে তুলেছে মৃত্যুর কাছে শেষ পর্যন্ত মানুষের যাবতীয় দম্ভের অবসানের কাহিনী। শুরুর এই অনুচ্ছেদটা পড়লেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আর মনে হয়, এই বর্ণনায় আজকের ভয়াল পরিস্থিতির ছবিই দেখছি না তো?

    “The “Red Death” had long devastated the country. No pestilence had ever been so fatal, or so hideous. Blood was its Avatar and its seal—the redness and the horror of blood. There were sharp pains, and sudden dizziness, and then profuse bleeding at the pores, with dissolution. The scarlet stains upon the body and especially upon the face of the victim, were the pest ban which shut him out from the aid and from the sympathy of his fellow-men.”



    দ্য মাস্ক অব রেড ডেথ: এডগার আলান পো


    বিলেত সহ বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো কালান্তক প্লেগ মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল আমাদের কলকাতা এবং মুম্বই শহরে। বর্মায় প্রাথমিক উদ্ভব হলেও রোগটি ১৮৯৪ সালে চিন ও হংকং হয়ে ক্রমে উত্তর আমেরিকা সহ নানা মহাদেশে সংক্রামিত হয়েছিল। মূলত বাণিজ্যিক পণ্যের সঙ্গে জাহাজে ইঁদুরের মাধ্যমে সমুদ্র বন্দর মারফত প্লেগ হানা দিয়েছিল ভারতে। আশ্চর্যজনক ভাবে রক্ষা পেয়েছিল মাদ্রাজ। ১৯১৮ সালের মধ্যে এই মহামারীর প্রকোপে প্রাণহানি হয়েছিল এক কোটিরও বেশি মানুষের। কাকতালীয় ভাবে কলকাতায় প্লেগ হানা দিয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার ঠিক পরের বছরেই ১৮৯৮ সালে। স্বামী সদানন্দ সহ আরও কয়েকজন সন্ন্যাসীভ্রাতাকে সঙ্গে নিয়ে আর্তজনের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। সেই সংকটের সময়েই কলকাতা প্রথম প্রত্যক্ষ করল সেবাকাজে এক বিদেশিনী কন্যার অতুলনীয় আত্মনিবেদন। আতঙ্কিত মানুষের মনে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার করার জন্যে স্বামী বিবেকানন্দ বাংলা ও হিন্দি ভাষায় প্রচার করেছিলেন বিখ্যাত "প্লেগ ইস্তাহার"। সেখানে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন বাড়ি ঘর-দোর, জামা-কাপড়, বাসন-পত্র, নালা-নর্দমা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ওপর। তিনি বলেছিলেন, পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করলে আপনা থেকেই রোগ-বালাইয়ের ভয় দূর হবে। আজ এই করোনা-আতঙ্কে বিবেকানন্দের সেই প্লেগ ম্যানিফেস্টো সকলেরই আবার পড়া উচিত।

    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৫ জুলাই ২০২০ | ৪৪৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অনিন্দিতা | 103.87.56.13 | ০৫ জুলাই ২০২০ ১২:১৯94868
  •  কলকাতার প্লেগের সেই সময়কার বর্ণনা ‘মহাস্থবির জাতক’-এ পাওয়া যায়। অন্যান্য নানা মহামারীর কথা শরৎচন্দ্র বিভূতিভূষণ প্রমুখের সাহিত্যে ছড়িয়ে আছে। কত ভূতের গল্প তো লেখাই হয়েছে মড়কে উজাড় হয়ে যাওয়া একদা সম্পন্ন এখন জনহীন গ্রামের পটভূমিকায়। 

  • b | 14.139.196.11 | ০৫ জুলাই ২০২০ ১৬:২৮94873
  • খুব ভালো লাগলো। এই দীপংকর দাশগুপ্তই কি দিল্লি আইএসআই-এর ডিডিজি ?
  • Prativa Sarker | ০৯ জুলাই ২০২০ ১২:০৬95012
  • সুলিখিত প্রবন্ধটির মধ্যে মোল্লা শব্দটির ব্যবহার ধাক্কা দিল কি ?  শব্দটি তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হয়, এখানেও কি তাই ? 

  • মধুমিতা dobe | 103.50.81.136 | ০৯ জুলাই ২০২০ ১৮:৫২95033
  • Khub shundor  তথ্যসমৃদ্ধ মনোগ্রাহী লেখা

    আরো লেখা চাই 

  • কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় | 113.19.112.71 | ১২ জুলাই ২০২০ ১২:৫৪95155
  • সুলিখিত গদ্যে বহু তথ্য একত্রে সন্নিবিষ্ট করেছেন এই লেখক। শ্রী দাশগুপ্ত কে ধন্যবাদ।

  • Dipankar Dasgupta | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১০:০৯96973
  • সাত-পর্বের এই ধারাবাহিকটি পড়ে যাঁরা সুচিন্তিত ও মূল্যবান অভিমত প্রকাশ করেছেন এবং ক্রমাগত আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন তাঁদের সকলকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।  

  • অমর্ত্যালোক ব্যনার্জী | 45.112.241.37 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:৩৭102294
  • এই দীপঙ্কর দাশগুপ্তই কি ত্রিদিব সেনগুপ্ত? 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন