আগের পর্বে আমরা ছিলাম নব্য প্রস্তর যুগের শুরুতে। আজকে আরো পিছিয়ে যাব। আজকের পর্বে দেখব সমাধিকৃত মানুষের উপহার সামগ্ৰী।
১) সাঙ্গির সমাধি: রাশিয়ায় য়ুরোপীয় অংশে মস্কো থেকে ২০০ কিমি দূরে সাঙ্গির। সেখানে পাওয়া গেছে ৩৫০০০ বছর পুরনো কিছু কবর। এগুলো প্রাচীন প্রস্তর যুগের, এবং সে যুগে মানুষ শিকার জোগাড় করেই বাঁচতো। তবে এটা প্রাচীন প্রস্তর যুগের শেষ দিককার যে সময়টাকে বিহেভিওরাল মডার্নিটি বা কগনিটিভ রিভলিউশনের যুগ বলা হয়। আগের পর্বে বলেছি এই সময়টাতে মানুষ ধীরে ধীরে ভাষা, গান, কারুশিল্প, ধর্ম ইত্যাদির বিকাশ করতে শুরু করে যদিও তখনো মানুষ চাষবাস শেখেনি। আগের পর্বে বলেছি নবীন প্রস্তর যুগের শুরুতে মানুষ যখন চাষবাস শিখলো, সেই সময়েই জমি, পরিবার, উত্তরাধিকার এসবের ধারণা আসতে থাকে এবং সমাজে বৈষম্য দেখা দিতে থাকে। এই সময়ে বা বলা ভালো আরো পরে তাম্রযুগে, কবরের আড়ম্বর ও সেই আড়ম্বরের বৈচিত্র্য দেখা যেতে থাকে, যা বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু তার থেকে অনেক পুরনো এই সাঙ্গিরের কবরগুলোতে আড়ম্বরপূর্ণতা ও বৈষম্যের আভাস আমরা দেখব।
তাম্র যুগের কবরে কী কী থাকতো? মূলত বাসন-কোসন আর গয়না। প্রাচীন প্রস্তর যুগে বাসন তো ছিলনা কিন্তু গয়না ছিল। এই সাঙ্গিরের কবরগুলোতে আমরা দেখব মানুষকে কত কত অলংকার সহকারে সমাধিস্থ করা হয়েছে। একটি বছর চল্লিশেক বয়সের মানুষের কবরে ম্যামথের দাঁতের আইভরির পুঁতি প্রায় ৩০০০ টি এবং অনেকগুলি শেয়ালের দাঁতের পুঁতি পাওয়া গেছে। আবার ওখানেই দুটি ১০-১২ বছরের প্রতিবন্ধী বাচ্চার অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ কবর পাওয়া গেছে যেখানে ম্যামথের দাঁতের পুতি প্রায় ১৩ হাজার খানি পাওয়া গেছে।
দুটি জিনিস লক্ষ্য করুন। এক তো ঐ মানের ১৩০০০ খানা ম্যামথের দাঁতের পুতি বানাতে ১০০০০ ঘন্টা সময় লাগে বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান। অর্থাৎ একজন মানুষ দিনে ১২ ঘন্টা কাজ করলে তার এই পুরো কাজ শেষ করতে প্রায় আড়াই বছর লাগার কথা। হয় একদল মানুষ অনেক অনেক সময় বার করে এই কাজগুলো করেছে অথবা একজন মানুষ ছিল যার হাতে প্রচুর সময় ছিল। দুটোই কিন্তু শ্রমবিভাজন বা ডিস্ট্রিবিউশন অফ লেবারের ইঙ্গিত দেয় যেটা প্রাচীন প্রস্তর যুগের শিকার জোগাড় করা মানুষের পক্ষে বেশ কঠিন ছিল। শ্রমবিভাজন ব্যাপারটাকে আগে ঐতিহাসিকরা নব্য প্রস্তর যুগের চাষবাসের ফল হিসেবে ভাবতো কিন্তু এই কবরগুলো কিছুটা তাদেরকে ভুল বলে প্রমাণ করে।
ওই সমাধি ক্ষেত্রে অন্তত তিন রকমের কবর পাওয়া গেছে। কিছু অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ, কিছু সাদামাটা আর কিছু একেবারে মাটিতে ফেলে দেওয়া শবদেহ। এটাও কিন্তু বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়। যারা বলে প্রাচীন প্রস্তর যুগে বৈষম্য ছিল না তাদেরকে এগুলো ভুল বলে প্রমাণ করে।
শিকার জোগাড় করা মানুষেরা প্রতিবন্ধীদেরকে নিজেদের গোষ্ঠীতে রাখত না, বাচ্চা বয়সেই হত্যা বা পরিত্যাগ করত- এরকম আগে ভাবা হতো, কিন্তু এখন অনেক উদাহরণ পাওয়া গেছে যেখানে দেখা গেছে প্রতিবন্ধী মানুষদেরকে অনেক বয়স অবধি গোষ্ঠীর সবল মানুষেরা ভরণ-পোষণ করেছে, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছে।
প্রশ্ন জাগে ওই প্রতিবন্ধী বালক দুটিকে কেন এত অতিরিক্ত আড়ম্বর সহকারে কবর দেওয়া হলো? এক তো তাদেরকে অনেক বয়স অবধি ভরণপোষণ করা হয়েছিল, তার উপর এত এত অলংকার। তারা কি কোন গোষ্ঠী প্রধানের সন্তান ছিল? না কি ওই গোষ্ঠীতে প্রতিবন্ধীদেরকে বিশেষ দৈব ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হতো? না কি তাদের বলি দেওয়া হয়েছিল আড়ম্বর সহকারে?
প্রথম সম্ভাবনাটি বৈষম্যের আভাস দেয়। শেষ দুটি সম্ভাবনা কিন্তু একটা ধর্মীয় আচরণের ইঙ্গিত দেয়। আর কবরের মধ্যে উপহারসামগ্রী রাখাটাও পরলোকে বিশ্বাসের ইঙ্গিত দেয়।
অর্থাৎ ধর্মের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি- যেমন অসাম্য, পরলোকে বিশ্বাস, কাল্পনিক বস্তুর প্রতি আকর্ষণ- এগুলো এখানে দেখা যায়। এছাড়াও এখানে মৃতদেহগুলিকে সাজানো হয়েছে লাল গিরিমাটি (ochre) দিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঐযুগের কবরে লাল গিরিমাটির ব্যবহার একটা দূরপ্রসারিত বিশ্বায়িত সাধারণ বিশ্বাসের ইঙ্গিত দেয়। কেন কবরে লাল গিরিমাটি ব্যবহার হত তার নানারকম ব্যাখ্যা আছে, তবে এটা পরলোক বা পরজন্মের প্রতীক বলেই মনে করা হয়। মাতৃগর্ভের রক্তের রঙ এবং নূতন করে একটি গর্ভে জন্ম নেবার প্রতীক বলে অনেকে লাল গিরিমাটিকে ভাবেন। যাই হোক এই একটা সাধারণ উপাচার অস্ট্রেলিয়া থেকে য়ুরোপ এতদূর প্রচলিত ছিল- সেই যুগে- এটা আশ্চর্যের।
(ছবিতে সাঙ্গিরের আইভরির পুঁতি দিয়ে অলংকৃত শবদেহ, image credit: https://www.cambridge.org/core/journals/antiquity/article/diversity-and-differential-disposal-of-the-dead-at-sunghir/B7672FB594E94A505A35E10C869F3808/core-reader)
২) হরপ্পা: নব্য প্রস্তর যুগের কথা আগের পর্বেই হয়েছে, অতএব এবার আমরা লাফিয়ে চলে আসব তাম্রযুগে। আমাদের বহু পরিচিত সিন্ধু সভ্যতায়। এখানে বিদায় উপহার হিসাবে থাকত বাসন- রং করা, নকশা করা বাসন- ছোট বড় মাটির ঘড়া- তাতে শস্যও রাখা থাকত। অর্থাৎ পরলোকযাত্রায় খাবারের রসদও থাকত। এছাড়া সোপস্টোন আর কড়ি-ঝিনুকের গয়না পরানো হত বিদায়যাত্রার শুরুতে। মহিলাদের অনেক সময় একটা বাড়তি জিনিস সঙ্গে দেয়া হত- তামার আয়না।
মোট কথা মানুষ যাতে পরলোকে একটু খেয়ে পরে সেজেগুজে "বেঁচে" থাকে তার ব্যবস্থা।
সমসাময়িক সুমের, ব্যাবিলন বা মিশরের তুলনায় হরপ্পায় বৈষম্য কম ছিল এটা কবরের আয়তনের বৈচিত্র্যের অভাব থেকে বলা হয়। তবে অসাম্য ছিল না, তা কিন্তু নয়। উপহারসামগ্রী কিন্তু কম বেশি থাকত। একটি কবর যেটিকে কোনো সর্দারের কবর বলে মনে করা হয় সেটিতে ৭০ টা মাটির ঘড়া পাওয়া গেছে। ধনী মানুষের পরলোকেও কিছু বাড়তি রসদের প্রয়োজন হয়!
(ছবিতে হরপ্পার কবরের বাসন, image credit: https://www.harappa.com/slide/painted-burial-pottery)
৩) মিশর: অন্ত্যেষ্টি শিল্পের পরাকাষ্ঠা বলা যায় তাম্রযুগের মিশরকে। উপহারসামগ্রীর বৈচিত্র্য চরম বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়। তবে মিশরীয় সংস্কৃতি কতটা আড়ম্বরপূর্ণ ছিল তারও সাক্ষ্য এরা বহন করে। সবচেয়ে আড়ম্বড়পূর্ণ কবরে থাকত: সোনা ও রূপার কারুকৃত সামগ্ৰী, কাঠ এবং মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি বোর্ড গেমস, বিছানা, চেয়ার, গয়না, পোশাক এবং পুতুল। থাকত সুন্দর সুন্দর দেয়ালচিত্র। কফিনের উপর একটা চিত্রিত মুখ থাকত যেটা মানুষটা কেমন দেখতে ছিল তার ইঙ্গিত দেয়।
এছাড়াও সহমরণে পাঠানো দাসদাসীরাও বিদায়োপহারের তালিকায় অনেক সময় থাকত। এটা অবশ্য প্রথম রাজবংশের যুগে হত। সহমরণে যে সবসময় জোর করে পাঠানো হত তা নয়। অনেকে স্বেচ্ছায় যেত তার কারণ এতে তার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সামাজিক অবস্থানের উন্নতি হত। স্বয়ং দেবতুল্য ফারাওয়ের সাথে একই ঘরে পরলোকবাসের সুযোগ, একজন রাজপুরুষের সমান সমান আড়ম্বড় (অর্থাৎ সম্মান) পাবার সুযোগ! বুঝুন, পরলোকে বিশ্বাস ও একটা কাল্পনিক আদর্শ কতটা জোরদার হলে মানুষ এগুলো করে। তবে প্রথম রাজবংশের পতনের পর এই প্রথা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়- দাসের জায়গায় আসে দাসপুত্তলিকা। সম্ভবতঃ মানুষ বুঝতে পারে ফারাওরা একেবারে ভগবান নয়- তাদের বংশেরও পতন হয়!
কবরের উপহার সামগ্ৰী সেযুগের সমাজের একটা জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে- অনেক হাজার বছরের ইতিহাসকে এরা বাঁচিয়ে রেখেছে। পশ্চিমী দেশগুলোতে খৃষ্টধর্ম ও ইসলামের প্রসারের ফলে উপহারসামগ্রীর আড়ম্বর কমে আসে, আর ভারতেও শবদাহের প্রচলনের ফলে কবরের ব্যবহার কমতে থাকে। যাই হোক এই উপহারগুলো শুধুই পরলোকগত মানুষের প্রতি উপহার নয়- এগুলো আমাদের মত ইতিহাসপিপাসু ও তথ্যোৎসাহী মানুষের জন্য সেযুগের মানুষের দেয়া উপহারও বটে।
পরের পর্বেও থাকবে মিশর। তবে একটু অজানা মিশর।
(চলবে)
পরবর্তী পর্ব: https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=17805
(তুতেনখামেনের জন্য সমাধি-উপহার, image credit: Patty, . (2017, April 20). Antechamber of Tutankhamun's Tomb. Ancient History Encyclopedia. Retrieved from https://www.ancient.eu/image/6525/)
(সমাধিগৃহের দেয়ালচিত্র, image credit: Nebamun fowling in the marshes, Tomb-chapel of Nebamun, c. 1350 B.C.E., 18th Dynasty, paint on plaster, 83 x 98 cm, Thebes
© Trustees of the British Museum)
(মিশরের একটি সুচিত্রিত সমাধিকক্ষ, image credit: JAKUB KYNCL, https://www.telegraph.co.uk/travel/destinations/africa/egypt/articles/inside-the-valley-of-the-kings/)
তথ্যসূত্র:
https://en.wikipedia.org/wiki/Sungir
https://en.wikipedia.org/wiki/Ancient_Egyptian_retainer_sacrifices
Harappa: miscellaneous sources like harappa.com, Dilip Chakrabarti, Early Indians etc.
কার্গেন আর কার্গেন হাইপোথিসিস সম্বন্ধে সম্প্রতি পড়েছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই পর্বের লেখাটা, বিশেষতঃ সাঙ্গির সমাধির অংশটা ইন্টারেস্টিং লাগছে। তাম্রযুগের যে কবরের কথা বলেছেন সেটা সাঙ্গিরের অনেক পরে,বোধহয় কার্গেন কালচারের সময়ের কথা বলছেন। এই সময়ের সমাধিতে লাল গিরিমাটি বার বার দেখা যায়। কিন্তু এটা সেকেন্ড অ্যান্ড থার্ড মিলেনিয়াম বিসি। মানে আজ থেকে চার-পাঁচ হাজার বছর আগের ব্যাপার। সাঙ্গিরেও যদি রেড ওকার পাওয়া যায়,তার মানে এই রীতি তিরিশ হাজার বছর ধরে চালু ছিল।
এটাও বলার যে কার্গেন হাইপোথিসিস মতে কার্গেন কালচারের পথ প্রোটো-ইন্ডো-ইউরোপিয়ান হয়ে ইন্ডো-ইউরোপিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজের বিস্তার ঘটেছে। তার মধ্যে ইন্ডো-ইরানিয়ান হয়ে ওল্ড-ইন্ডিক মানে সংস্কৃতও রয়েছে। পরের একটা পর্বে দেখলাম গুপ্ত যুগের অন্ত্যেষ্টির পর্বে স্তুপের কথা লিখেছেন। স্তুপ তো সেই কার্গেনই হল। তাহলে কি স্তুপ কালচার কার্গেন কালচারের বহমান ধারা?