এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • 'আমপান' আপডেট: সুন্দরবন থেকে

    গুরুচণ্ডা৯ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৩ মে ২০২০ | ৩৯৩৬ বার পঠিত
  • 'আমপান' আছড়ে পড়ার পরে চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময় কেটে গেছে। সুন্দরবন অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীপের অবস্থা খুবই শোচনীয়। আমরা গুরুচন্ডালির তরফ থেকে সুন্দরবনের কিছু দ্বীপে থাকা বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। এখানে যেটা বলার সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলেই মোবাইল নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই সমস্যাজনক এবং বিশেষ একটি মাত্র মোবাইল সংযোগকারী সংস্থার পরিষেবা ছাড়া অন্যান্য সংযোগকারী সংস্থাগুলি পরিষেবা কার্যত স্তব্ধ। সর্বোপরি কোন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় চালু থাকা মোবাইল ফোনগুলিও ক্রমে সুইচ অফ হয়ে যাচ্ছে।

    গোসাবা অঞ্চলের বালি এক নম্বর পঞ্চায়েতের মথুরাখন্ড মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা বাপ্পা ঝড় আসার কয়েক ঘন্টা আগে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন আমাদের সাইটে। পরের দিন বহু চেষ্টার পরে বাপ্পার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছিল। পঞ্চমুখী নদীর পাড়ে থাকা বাপ্পাদের গ্রামের বাঁধ এবারে ভেঙে না গেলেও বেশ কিছু জায়গার ফাটল আরো চওড়া হয়েছে। প্রচণ্ড ঝড়ে বহু বাড়ির খড়, টিন এবং অ্যাসবেস্টার এর ছাদ উড়ে গেছে। ফ্লাড সেন্টার প্রায় সাত-আট কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ঝড় আসার আগে বাপ্পারা প্রতিবেশী যাদের ইটের তৈরি পাকা বাড়ি আছে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। হতাহতের খবর সেভাবে কিছু না থাকলেও বেশ কিছু গবাদিপশু গাছপালা ভেঙে মারা গেছে। এছাড়াও নদী তীরবর্তী অঞ্চলে থাকা পুকুরে নোনাজল ঢুকে যাওয়ায় প্রচুর মাছ মরে ভেসে উঠেছে। ঝড়ের দাপটে দ্বীপের মধ্যে প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত নোনা জলের ঝাপটা আসায় বেশ কিছু গাছপালাও ক্ষতিগ্রস্ত। নির্বিচারে গাছ কেটে চলায় গত কয়েক বছরে সুন্দরবনের দ্বীপগুলিতে ম্যানগ্রোভের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। তবুও যেটুকু ম্যানগ্রোভ নদীবাঁধ সংলগ্ন অঞ্চল জুড়ে আছে, সেগুলোর জন্যই এবারের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কম। তবে এখনো পর্যন্ত গোসাবায় থাকা বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কাউকে গ্রামে দেখতে পাওয়া যায়নি। পর্যাপ্ত ত্রানেরও অপ্রতুলতা রয়েছে। এছাড়াও ছোট ছোট বাচ্চাদের বই খাতা, জামাকাপড় জলে কাদায় ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেগুলির ব্যবস্থা করাও একটা জরুরী বিষয়। সাধারণ কিছু কিছু রোগের ওষুধও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। ফলত একটা মেডিকেল ক্যাম্পের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিছু কিছু সংস্থা আসতে চাইলেও মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক না থাকায় তাঁরা সমস্যায় পড়ে যাচ্ছেন। একেবারে হতদরিদ্র পরিবারগুলিতে কিছু পরিমাণ অর্থসাহায্য করা যায় কিনা সেটাও দেখা দরকার। সবমিলিয়ে বলা চলে গত আয়লা ঝড়ে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল এবারে তার 70 শতাংশের কাছাকাছি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

    অর্ঘ্য মৃধার বাড়ি হিঙ্গলগঞ্জে। সেখানে নদী বাঁধ কিছু জায়গায় ভেঙে গেলেও স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বাঁধ মেরামত করে দিয়েছে। এমনিতে ঝড়ের দাপটে ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ার চিত্র সমস্ত দ্বীপেই কমবেশি এক। তবে অর্ঘ্য জানালেন হিঙ্গলগঞ্জে তাঁরা ত্রান হিসেবে খাবার-দাবার পেলেও এখনো পর্যন্ত কোন পলিথিন পাননি। তাই পলিথিনের একটা চাহিদা গ্রামবাসীদের রয়েছে। হতাহতের কোনো খবর নেই। পাশের দুলদুলি গ্রামেও বাঁধ ভাঙার কোন খবর সেভাবে পাওয়া যায়নি।

    উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত সুন্দরবনের একেবারে প্রান্তসীমার একটি গ্রাম হেমনগর। আমরা যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম এখানকার বাসিন্দা ভূপেন মিস্ত্রি এবং শুভদীপ রায়ের সঙ্গে। হেমনগরে কোন বাঁধ না ভাঙলেও পাশের গ্রাম সর্দারপাড়ায় বাঁধ ভেঙে বহু মানুষ প্লাবিত হয়েছেন। তাঁরা আপাতত ফ্লাড সেন্টারে আশ্রয় নিলেও কিছু মানুষের নিখোঁজ থাকার কথা ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হওয়ায় সেই সংখ্যা নিয়ে একটা জটিলতা রয়েছে। সামান্য দূরের যোগেশগঞ্জ গ্রাম থেকে অবশ্য বাঁধভাঙ্গা জনিত কোন খবর আসেনি।

    সুন্দরবনের একটা বড়ো অংশে যেতে হলে ধামাখালি থেকে মূলত বোট অথবা ভুটভুটি ধরতে হয়। ধামাখালির কাছে কালিন্দী নদীর বাঁধ ভেঙে রমাপুর গ্রামে জল ঢোকার খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় যুবক বাপন জানিয়েছে যে প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে এগোবে।

    মরিচঝাঁপি ও তার সংলগ্ন কুমিরমারী দ্বীপের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। কুমিরমারীর বাসিন্দা অভীক চ্যাটার্জী জানালেন, তাঁদের গ্রামে বাঁধ ভাঙার একটা আশঙ্কা থাকলেও, দু-এক জায়গায় কিছু ছোট ছোট ফাটল ছাড়া বাঁধ মোটামুটি অক্ষতই আছে। ফাটল ধরা জায়গাগুলিতেও জেসিবি মেশিনের সাহায্যে দ্রুত বালির বস্তা ফেলে ভরাট করা সম্ভব হয়েছে।ক্ষয়ক্ষতি বলতে মূলত প্রচুর গাছপালা ভেঙে পড়েছে এবং বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে সারা গ্রাম বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। সর্বোপরি মাটির বাড়িগুলির অধিকাংশই সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। তবে বাসিন্দারা আগেই কাছের ফ্লাড সেন্টারে সরে যাওয়ায় নিরাপদে আছেন। প্রশাসনের তরফ থেকে এখনো পর্যন্ত ত্রাণ দেওয়ার কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। সেটা তাড়াতাড়ি করতে পারলে ভালো হয়।

    বাঁধ ভাঙার খবর আরো পাওয়া গেছে কুমিরমারীর পাশের দ্বীপ ছোট মোল্লাখালি আর পুঁইজালিতে। ছোট মোল্লাখালিতে এক জায়গায় প্রায় আট কিলোমিটার এরিয়া জুড়ে বাঁধ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন এবং গ্রামবাসীরা খুবই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। পুঁইজালিতেও প্রায় এক কিলোমিটার বাঁধ ভাঙার ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দুই জায়গাতেই জরুরী ভিত্তিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

    আয়লার সময়ে দেখা গিয়েছিল সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলই বাঁধ ভেঙে কার্যত জলমগ্ন। আমপানের তাণ্ডবের পরে কিছু দ্বীপের বাঁধ ভেঙে বন্যা পরিস্থিতি যেমন হয়েছে তার পাশাপাশি বেশ কিছু সংখ্যক দ্বীপের বাঁধ মোটামুটি অক্ষত আছে। অবশ্যই এমন প্রচুর গ্রাম রয়ে গেছে যেগুলিতে আমরা কোন খোঁজ খবর নিতে পারিনি। তবে এটা ঠিক বহু সংখ্যক মানুষ ঝড়ের তীব্রতার কারণে মাথার ছাদ হারিয়েছেন। লকডাউন এর ফলে ধুঁকতে থাকা সুন্দরবনের গ্রামীণ অর্থনীতিতে কার্যত মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা বসিয়েছে আমফান। জরুরী ভিত্তিতে পর্যাপ্ত ত্রানের ব্যবস্থা, মেডিকেল ক্যাম্প এগুলির ব্যবস্থা না করা গেলে মানুষের হাহাকার আরো তীব্র হবে। দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের মেরামতি, বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের বৃদ্ধি এগুলিও সমান্তরালভাবে চালিয়ে না গেলে সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ অচিরেই আরো বিপন্নতর হয়ে পড়বে।

    ছবিঃ সৌরভ মনি
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৩ মে ২০২০ | ৩৯৩৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:9ea0:ac85:f473:ae9f:31ac | ২৪ মে ২০২০ ১০:৩০93587
  • ম্যানগ্রোভ - একমাত্র আশা। এর পরেও যদি মানুষের লোভ বাঁধ না মানে ..
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন