স্টেটস্ম্যান পত্রিকায় উনসত্তর সালের গোড়ায় একটি ছোট্ট খবর বেরিয়েছিল --- বস্তারের সদর জগদলপুর শহরে মাওবাদী পোস্টার দেখা গেছে, পুলিশ সন্দেহ করছে বাইরে থেকে আসা কিছু যুবককে। শেষে ধরা পড়লেন ইস্পাতনগরী ভিলাইয়ের দুই বাঙালী। তাঁদের কিছুদিন জেলহাজতে রাখা হল। একজন অল্পদিনেই মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। অন্যজন কিছুদিন পরে জামিনে ছাড়া পেলেন। ইতিমধ্যে কোলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে মে দিবসের জনসভায় কানু সান্যাল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) গঠনের ঘোষণা করেছেন। এবার রাজ্য কমিটিগুলো গঠনের পালা । তখন ছত্তিশগড় বিশাল মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত একটি অঞ্চল মাত্র। আর কেরালার চেয়ে সামান্য বড় বস্তার ছিল ছত্তিশগড়ের একটি জেলা। কাজ শুরু হল ভিলাইয়ের ইস্পাত কারখানার কিছু কর্মচারি ও অন্যান্য পেশার লোকজনকে নিয়ে। এদের মধ্যে বেশ ক'জন বাঙালী, কিছু অন্ধ্র প্রদেশ থেকে আসা তেলেগু আর জনাদুই মালয়ালী। শুরুতেই ফাটল ধরল। জগদলপুর থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়া যুবক কেন্দ্রীয় কমিটিতে অভিযোগ করলেন যে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসা অন্যজন পার্টিবিরোধী কাজ করেছেন। জবাবে অন্য যুবকটির বক্তব্য ছিল যে প্রাথমিক প্রচারের স্তরে ক'টি পোস্টার মেরে খামোকা জেলের ভেতরে বসে থাকা আসলে সময় ও শক্তির অপচয়। কেন্দ্রীয় কমিটি যুবকটিকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করল। একদশক পরে ওই যুবকটিকে গোটা দেশ চিনল ছত্তিশগড়ের খনি এলাকার অন্য ঘরানার শ্রমিকনেতা হিসেবে, -- তাঁর নাম শংকর গুহনিয়োগী। "দেশব্রতী" পত্রিকায় প্রকাশিত ছোট্ট বিজ্ঞপ্তিতে বহিষ্কারের কোন কারণ বলা হয় নি। আসল কারণ ছিল চারু মজুমদারের ট্রেড ইউনিয়ন থেকে দূরে থাকার নির্দেশের বিরোধিতা করা। বিপ্লবের সময় ট্রেড ইউনিয়ন নামক কথিত রূপে জঙ্গি অর্থনীতিবাদের আঁতুড়ঘর গণসংগঠন থেকে দূরে থাকাই কাম্য --- এহেন সরল ফরমান গুহনিয়োগী মেনে নিতে পারেন নি।
স্বাভাবিকভাবে অভিযোগকারী যুবক হয়ে গেলেন ভিলাই কেন্দ্রিক ছত্তিশগড় আঞ্চলিক কমিটির সেক্রেটারি। বীরভূমের এক সম্ভ্রান্ত ভূমধ্যকারী পরিবার থেকে আসা যোগেন্দ্রনাথ রায় বা যোগী রায় বাইশে এপ্রিল ১৯৭০, লেনিনের জন্মদিনে প্রকাশ্য ঘোষণা করে ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের লোভনীয় চাকরিটিতে ইস্তফা দিলেন। বল্লেন যে উনি সিপিআই( এম-এল) দলে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে যোগ দিচ্ছেন। ফলে প্রথম দিন থেকেই ওঁর পেছনে পুলিশ লেগে গেল। ভিলাইয়ের পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে যোগী রায় চলে গেলেন সরগুজা জেলার চিরিমিরি খনি অঞ্চলে। সেখানে বাঙালী ও স্থানীয় যুবকদের নিয়ে প্রায় একবছরের মধ্যে গড়ে তুললেন একটি সংগঠন। স্বপ্ন দেখলেন যে পাহাড়-জঙ্গল অধ্যুষিত এই এলাকা আর পাশের দক্ষিণ বিহারের পালামৌ-রাঁচি এলাকা নিয়ে গড়ে তুলবেন এক গেরিলা জোন।
ইতিমধ্যে চারু মজুমদারের নির্দেশিত খতম অভিযান বঙ্গে ও বিহারের ব্যাপক এলাকায় আলোড়ন তুলেছে। দরকার শুধু এখানেও শুরু করা। খনি এলাকায় সুদখোরদের নাম নিয়ে "খতম" এর লিস্টি বানানো হল। এবার হাতিয়ার কিনতে হবে। একজন সঙ্গীকে নিয়ে যোগী রায় চললেন ভিলাই। যদিও ভোল পাল্টে ফেলেছিলেন , হাঁটার চাল বদলেছিলেন, কিন্তু ভিলাইনগরে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সময়ে সাদা পোশাকের পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে চিরিমিরি নিয়ে যায়। ধরপাকড় শুরু হয় দুটো শহরেই। গ্রেফতার হন ভিলাইয়ে নকশালপন্থী সংগঠনের প্রায় সবাই। তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্ম নিচ্ছে। ইন্দিরা সরকার বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-অন্ধ্র জুড়ে ব্যাপক দমন অভিযান চালাচ্ছেন। পুলিশের থার্ড ডিগ্রি যোগী রায়ের মনোবল ভাঙতে পারেনি। কিন্তু কয়েকবছর পরে ছাড়া পেয়ে দেখলেন চারু মজুমদার নেই। সিপিআই( এম-এল) এর সর্বভারতীয় নেতাদের মধ্যে অধিকাংশই হয় জেলে, নয় এন্কাউন্টারে নিহত। বিহারে সত্যনারায়ণ মিশ্র আলাদা হয়ে নিজের উপদলকে আই এস ও মার্কামারা আসল বিপ্লবী পার্টি বলছেন। সরোজ দত্ত মারা গেছেন।
যোগী রায়ের মনে পড়ল চারু মজুমদার- সুশীতল রায়চৌধুরি বিতর্কে উনি চারু বাবু ও সরোজ দত্তের লাইনকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ কোলকাতার একটি নার্সিংহোমে যখন সুশীতল রায়চৌধুরি মারা গেলেন তখন ঘটনাচক্রে যোগী রায় কোলকাতায় উপস্থিত ছিলেন এবং ওনার শেষযাত্রায় কাঁধ দিয়ে ছিলেন ।
এবার ছত্তিশগড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অধিকাংশ কমরেডই "খতম অভিযান সব সমস্যার সমাধান' গোছের ওয়ান-লাইনার সরলীকরণে আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। প্রয়োগের ঝুলিতে রয়েছে কয়েকবছর আগে রাজধানী রায়পুর শহর থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে গুটুরিয়া গ্রামে এক বিজেপি সমর্থক মালগুজার( জোতদার) এর ওপর অসফল হামলা। তিক্ত স্বাদ নিয়ে যোগী রায় ফিরে গেলেন জন্মভূমি বীরভূমের গাঁয়ে। আজ সত্তরের বুড়ি ছোঁয়া যোগী রায় নিজের গাঁয়ের উন্নয়নমূলক কাজকর্মে নিবেদিত প্রাণ সমাজকর্মী। বিয়ে করেন নি, একাই একজন সহায়ককে নিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করেন। নিজেদের পৈতৃক জমির অনেকটাই বিলিয়ে দিয়েছেন ভূমিহীনদের মধ্যে। সমাজপরিবর্তনের জন্যে হিংসার অনিবার্যতায় আজ উনি বিশ্বাস করেন না। ছত্তিশগড়ের মধবিত্ত শিক্ষিত স্বপ্নদর্শীদের নকশালবাদী বিপ্লবের প্রচেষ্টায় এভাবেই যবনিকা পড়ল।
কিন্তু , এই সময় ছত্তিশগড়ে মাথা তুলে দাঁড়াল প্রাক্তন নকশালপন্থীদের আর একটি ধারা। পার্টি গঠনের গোড়াতেই দল থেকে বিতাড়িত শঙ্কর গুহনিয়োগী চলে গেলেন ভিলাইয়ের ইস্পাত কারখানার লৌহ আকরিক সাপ্লাইয়ের খনি এলাকা রাজাড়ায়। সেখানে কিছুদিন চুপচাপ থেকে শিখলেন ছত্তিশগড়ি উপভাষা, নিজের নাম নিলেন শংকর লাল সাহু। বিয়ে করলেন স্থানীয় ছত্তিশগড়ি মজদুর নেতা সহদেব সাহুর বোনকে। লিখতে শুরু করলেন হিন্দি ও ছত্তিশগড়িতে। জন্ম নিল খনিজ ও বনসম্পদে পূর্ণ ছত্তিশগড় কিভাবে আলাদা হয়ে শ্রমিক-কৃষকদের পরিচালনায় একটি সমৃদ্ধ বিকশিত রাজ্য হয়ে উঠতে পারে তার গুহনিয়োগী-রোডম্যাপ। শংকর শুরু থেকেই খারিজ করেছেন গণ আন্দোলন বিহীন শ্রেণীশত্রু খতমের লাইন। কিন্তু, উনি বিশ্বাস করতেন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় জঙ্গি আন্দোলনে। তাঁর নির্দেশনায় ভিলাইয়ে ব্লাস্ট ফার্নেস কর্মীদের ধর্মঘট স্টিল ম্যানেজমেন্টকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করল-- কারণ, কিছু নির্ধারিত পিরিয়ডের বেশি বন্ধ থাকলে অকেজো হয়ে যাবে ব্লাস্ট ফার্নেস। বন্ধ হবে ইস্পাত উৎপাদন। লোকসান অপরিমেয়। আবার বিখ্যাত সেতারী পন্ডিত বুধাদিত্য মুখার্জীর বাবা বিমল মুখার্জী, তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার (মাইনস্)কে লম্বা সময় ঘেরাও করে রাখল গুহনিয়োগীর শ্রমিক সংগঠন। বিরাট পুলিশবাহিনী ওনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল কয়েকদিন পর। এরপর গুহনিয়োগীকে গ্রেফতার করতে এলে সংগঠিত শ্রমিকেরা বাধা দিলেন। বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে বন্দী করে রাখলেন পুলিশদলকে। এল বড়সড় বাহিনী, -- শ্রমিকনেতাকে গ্রেফতার করতে নয়, নিজেদের সাথী পুলিশকর্মীদের ছাড়িয়ে নিতে।সেটা সম্ভব হল গুলিতে ছ'জন মজদূর ঘটনাস্থলেই মারা যাবার পর। গুহনিয়োগী গ্রেফতার হলেন, নেগোশিয়েশনে ছাড়া পেলেন। ছত্তিশগড় মজদূর আন্দোলনে ওনার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। ওনার সংগঠন "ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চা" বা "ছ-মু-ম" আর তার লালটুপিধারী ক্যাডারদের দৃপ্ত কুচকাওয়াজ্ ছত্তিশগড়ের ভিলাই-রায়পুর-বিলাসপুর-কোরবা শিল্পবলয়ে মালিকদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করল। আবার ওনার লেখা ছত্তিশগড়ি জননাটক-গণসংগীত কিছু এলাকায় জনপ্রিয় হল। রাজাড়ায় শ্রমিকদের নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসার জন্য শংকর শুরু করলেন "শহিদী হাসপাতাল"। তার দায়িত্বে কোলকাতা থেকে এলেন ডঃ পুণ্যব্রত গুণ, প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা স্ট্যাটিসটিকসের প্রফেসর ডঃ অতীন্দ্রমোহন গুণের ছেলে। মূলত: ওনার চেষ্টায় জনসাধারণ শিক্ষিত হতে লাগল কি করে গরীবেরা দামি ওষুধ না খেয়েও বৈকল্পিক শস্তা জেনেরিক নামের ওষুধ ব্যবহার করে ( যেমন ক্যালপল-ক্রোসিনের বদলে প্যারাসিটামল নামের শস্তা কিন্তু বেশি কার্যকরী ওষুধটি কেনা) এবং শস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ে প্রিভেন্টিভ হেল্থ কেয়ারের প্রয়োগে সুস্থ থাকতে পারে। এর জন্যে এঁরা প্রকাশিত করতে লাগলেন দুই বা তিন টাকা দামে সরল হিন্দিতে লেখা আন্ত্রিক জ্বর-ম্যালেরিয়া-টিবি ইত্যাদি রোগের বিরুদ্ধে লড়ার জন্যে প্রাথমিক শিক্ষার বই। আর বিনে পয়সায় প্রশিক্ষিত করতে লাগলেন প্রিভেন্টিভ হেল্থ কেয়ারের জন্যে স্বেচ্ছাসেবীদের।
সময়টা ছিল ভারতের পূর্ব-পশ্চিম জুড়ে নতুন ধরণের শ্রমিক আন্দোলনের। মুম্বাই এলাকায় দত্তাসামন্ত, ছত্তিশগড়ে শংকর গুহনিয়োগী ও ধানবাদ খনি এলাকায় অরুণ কুমার রায়। আন্দোলনের একটি স্তরে এরা সবাই সংসদীয় রাস্তাকে ব্যবহার করার কথা ভাবলেন। দত্তাসামন্ত ও অরুণ রায় সংসদে গেলেন। গুহনিয়োগীর ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চা থেকে জনকলাল ঠাকুর বিধায়ক হলেন। নিয়োগী নিজে নির্বাচনে দাঁড়ান নি।
কিন্তু এদের পরিণতি প্রায় একইরকমের হল। অরুণ কুমার রায় কয়েকবার প্রাণঘাতী হামলার থেকে বরাতজোরে বেঁচে গেলেন, মারা পড়লেন ঘনিষ্ঠ সহযোগী কমরেড চ্যাটর্জি। সুপারিকিলারের হাতে মারা গেলেন দত্তাসামন্ত ও শংকর গুহনিয়োগী। উত্তরপ্রদেশের ভাড়াটে খুনি পল্টন মাল্লা , ভিলাইয়ের সিম্প্লেক্স কারখানার মালিকপরিবারের চন্দ্রকান্ত ও কজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাবাসের সাজায় দন্ডিত হলেও পাকা প্রমাণের অভাবে হাইকোর্টে ছাড়া পেয়ে গেল। আস্তে আস্তে ছ্ত্তিশগড় মুক্তিমোর্চা ভেঙে গেল, তারপর একদশকের মধ্যে মিলিয়ে গেল। ডঃ পুণ্যব্রত গুণ কোলকাতায় ফিরে এসে আন্দুলমৌরির কাছে "শ্রমজীবি হাসপাতাল' এ যোগ দিয়ে নিজের কাছ করে যাচ্ছেন। আজ ছত্তিশগড় পৃথক রাজ্য হয়েছে। যাঁরা এর স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন হিসেবে শংকর গুহনিয়োগীকে এখনো লোকে মনে রেখেছে।
কিন্তু সত্তরদশকের শ্রমিক-কৃষকের জঙ্গি আন্দোলনের ধারাটি বর্তমান ছত্তিশগড়ে অবলুপ্ত প্রায়।
(চলবে)
আলোকচিত্রঃ লেখক