এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • বাঙালবাড়ির কিস্‌সা : ষষ্ঠ পর্ব

    রঞ্জন রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ০৮ নভেম্বর ২০১০ | ৯৪৯ বার পঠিত
  • বাঙ্গালবাড়ির কিস্‌সা

    (৬)

    এলেম আমি কোথা থেকে(পুন:)

    না:! প্রশ্নটা পেছন ছাড়ে না। তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই যে "" অতল জলের আহ্বান'' বলে একটি ফিলিমে একটা গান ছিল না, হেমন্তর ছাত্রী সুজাতা গেয়েছিলেন---"" প্রশ্ন করি নিজের কাছে কে আমি? কোথায় ছিলাম কোথায় যাবো এই আমি''।

    একটা পরিচয় তো জানি-- আমরা রিফিউজি, উদ্বাস্তু। এটা আমার গোষ্ঠী পরিছয়। আর ব্যক্তি পরিচয়? কেন, হরিদাস পাল। মহা ন্যালা ক্যাবলা গোছের লোক। স্লিপে দাঁড়িয়ে অনায়াসে ক্যাচ্‌ মিস করে ফুটপাথের ক্রিকেট ম্যাচে, তাই পরের ম্যাচগুলিতে তাকে কেউ নিতে চায় না। সে সত্যি কথাটা বলতে পারে না। বলতে পারে না যে ও আসলে তখন পাশের দোতলা বাড়ির জানলা বেয়ে আসা তপতীর গান শুনছিল। ওই সময়টায় তপতী রোজ গানের রেয়াজ করে। জানলা দিয়ে ভেসে আসে ""তুফান যদি এসেই থাকে তোমার কিসের দায়, চেয়ে দেখ ঢেউয়ের খেলা কাজ কি ভাবনায়?''

    না:, ও কি শুধুই ঢেউয়ের খেলা দেখে দিন কাটাবে? কিন্তু গান ভেসে আসে--"" তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার, ওরে ভীরু!'' সত্যি , ও যে একনম্বরের ভীতুর ডিম। পড়ে শিশু বিদ্যাপীঠ গার্লস্‌ স্কুলের ক্লাস ফাইভে, বেকবাগানের কাছে কর্ণেল বিশ্বাস রোডে। ওদের ক্লাসে পড়ে ওই মেয়েটি--তপতী। কিন্তু সেদিন কী যে হল! অপর্ণাদি ক্লাস নিতে আসার আগে ও নিজের জায়গা ছেড়ে ক্লাসের মনিটর তপতীর সীটের পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় আগড়ম-বাগড়ম বকছিল। সামনেই সরস্বতী পূজোয় কেমন প্রোগ্রাম করতে হবে এইসব। তপতী মৃদু হেসে সায় দিচ্ছিল। কখন যে ইতিহাসের টিচার অপর্ণাদি এসে রোলকল করে পড়াতে শুরু করেছেন ওরা খেয়ালই করেনি। শুধু গোটা ক্লাস হঠাৎ চুপ মেরে যাওয়ায় ওদের খেয়াল হল কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে।

    কিন্তু তখন আর ফিরে যাওয়া যায় না। প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়েও ওরা কথা চালিয়ে গেল, অতিশয় নিচুগ্রামে। অপর্ণাদি মাঝে মধ্যেই ওদের দিকে দেখছিলেন, কিন্তু ওদের কিছু না বলে নিজের মত করে পড়িয়ে গেলেন। ছেলেদের বেঞ্চ থেকে ফিস্‌ফিস আওয়াজে সাবধানবাণী আসছিল--- ঢের হয়েছে, এবার নিজের জায়গায় ফিরে আয়! করছিস টা কি?

    ক্লাস শেষ হল। অপর্ণাদি চলে যেতেই ছেলের দল মুখর হল। তোরা দুজন অপর্ণাদিকে অপমান করলি, দেখবি, এবার হেডমিস্ট্রেসের রুমে ডাক পড়বে। তখন আমাদের হেডু ছিলেন ম্যাডাম উনি নাকি তখন প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা, ভাল বক্তা। ছিপছিপে একহারা গম্ভীর চেহারা। ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ আছে। উনি নাকি দেশের কাজ করতে গিয়ে বিয়ে করেন নি। নেতাজী সুভাষ বোসের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন নাকি? ভয়ে ভয়ে দিন দুই গেল। হেডমিস্ট্রেসের চেম্বার থেকে কোন ডাক এলো না।

    কিন্তু ক্লাস ফাইভে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়লে কি হঠাৎ করে ওদের মধ্যে প্রাকৃতিক ভাবেই "" জেন্ডার সেনসিটাইজেশন''( রাষ্ট্রÌভাষায় এর পরিভাষা হল-- লিঙ্গ সংবেদীকরণ!) শুরু হয়ে যায়? নইলে এতগুলো ক্লাস একসঙ্গে পড়ার পর এবার কেন ছেলেরা মেয়েরা আলাদা লাইন করে বসতে লাগল? এটাই কি অমর্ত্য সেন মশাইয়ের একটি আইডেনটিটিকে বিশেষ প্রাধান্য দেয়া? কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে এটাও রিমোট দিয়ে ম্যানুফাকচার্ড। শিশুবিদ্যাপীঠ গার্লস্‌ স্কুল, সাকিন- কর্নেল সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাস রোড, বেকবাগান, পার্কসার্কাস আসলে আদ্যন্ত একটি মেয়েদের স্কুল। পড়ান প্রাইমারি সেকশনে মাসিমারা, ডে-সেকশনে দিদিরা। কারিকুলামে কোথাও ক্রিকেট ফুটবল ভলিবল নেই। খো-খো আছে। গানের ক্লাস আছে, ড্রইং আছে। সেলাইয়ের ক্লাস কম্পালসারি। ফলে হরিদাস পাল ন্যালা-ক্যাবলা রনজনও শিখে যায়--- রান, হেমিং, ক্রসস্টিচ্‌, চেনস্টিচ্‌। শীতকালে শেখে সোজা কাঁটা, উল্টো কাঁটা বুনতে। আর প্রতিপদে শিক্ষিকারা বুঝিয়ে দেন যে এখানে ছেলেরা মাইনরিটি। ক্লাসে অনায়াসে কয়েকজন বলেন যে ছেলেরা বেসিক্যালি অপদার্থ, ফাঁকিবাজ। রনজনের মনে হয় -- হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।

    তাই বড় হয়ে মাইনরিটিদের একাকীত্ব-বিচ্ছিন্নতা ও আলাদা হওয়ার ইচ্ছে ও সহজেই বুঝতে পারে, ওদের সঙ্গে একধরণের একাত্মতা বোধ করে। তাই বিটি ট্রেনিং করতে আসা অল্পবয়সী দিদিটি যখন গেমস্‌ পিরিয়ডে একটা রবারের বল নিয়ে মাঠে ওদের হ্যান্ডবল নামে একটি খেলা শেখাতে চেষ্টা করছিলেন তখন বন্ধুদের বার খেয়ে রনজন বল্লো-- ওই সব খেলা মেয়েদের শেখান গে'। আমাদের ফুটবল খেলতে দিন। ট্রেনিংয়ের প্র্যাকটিক্যাল আসা বিব্রত দিদিটি বল্লেন-- না, আমার লেসন চার্টে এই গেমই আছে। আমি এটাই শেখাব।

    রন্‌জন বলটা ওনার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পেছন ফিরে মাঠ ছাড়ে। দেখতে পায় না যে বলটা লেগেছে অপ্রস্তুত দিদিটির নাকে। পরের দিন ফোলা নাক নিয়ে দিদি কমপ্লেন করেন ক্লাস টিচার লাবণ্যদির কাছে।

    লাবণ্যপ্রভা দাশ। বাংলা কবিতার সোনালী দিনের অসামান্য কবি জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। সাদা শাড়িতে টিকোলো নাকে ছোটখাট চেহারার এক ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। তখন জীবনানন্দ বালিগঞ্জের ট্রামলাইনের ফাঁকে ঘাস দেখতে দেখতে আত্মমগ্ন হয়ে ট্রামের ধাক্কায় মারা গেছেন মাত্র বছর দুই হয়েছে। সেই দিনটির বার্ষিকীতে লাবণ্যদি ক্লাসে আসতেন, রক্তচাপ কমানোর ট্যাবলেট খেতেন কিন্তু একটি বিশেষ পিরিয়ডের সময় পড়াতেন না, চুপ করে বসে থাকতেন। বলতেন-- এই সময়েই উনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন।

    সেদিন উনি বল্লেন-- তোমার থেকে এ'রকম বর্বর ব্যবহার আশা করিনি। যাও, আজ পেছনের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে থাকো।

    ছেলেরা হেসে উঠল। মেয়েরা তপতীকে চিমটি কাটলো।

    পরের পিরিয়ডে আবার সেই দিদির ক্লাস। হরিদাস পাল কোন প্রশ্নের উত্তর দিল না। সারাক্ষণ হাতে পেন দিয়ে ফুল-পাতা আঁকায় মগ্ন রইলো। কিন্তু খেয়াল করলো না সবচেয়ে পেছনের সারিতে এসে চুপচাপ বসে আছেন একজন অপরিচিত বয়স্ক মহিলা। তিনি মাঝে মাঝে একটি ডায়েরি খুলে কীসব নোট নিচ্ছেন।

    পরের দিন কাঁদো -কাঁদো হয়ে ক্লাসে এলেন সেই দিদিটি। সঙ্গে লাবণ্যদি। ওনার চোখে আগুন ঝরছে।

    ---- তুমি কী করেছ জান? কালকে সেকন্ড পিরিয়ডে বিটির প্র্যাকটিক্যাল নম্বর দেয়ার জন্যে এক্সটার্নাল এগ্‌জামিনার এসেছিলেন। তুমি সারা ক্লাসে অবাধ্য ঢিট হয়ে বসেছিলে, হাতে কালি মেখে। ফলে উনি এই মেয়েটিকে প্র্যাকটিক্যালে ফেল করিয়েছেন। সব তোমার জন্যে!

    হরিদাস পাল হতভম্ব। গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। ওর পার্কসার্কাসের সংযুক্ত পরিবারের বাড়িতে যে পিসেমশাই মারা যাওয়ায় দিদি বিটি পড়ে চাকরির চেষ্টা করছে। পেলেই দাদুর দস্তানার মত বাড়িটির ভীড় থেকে মা-ভাইকে নিয়ে আলাদা বাসা পাতবে। একটু সম্মানের স্বত¿ত্র জীবন শুরু করবে।

    -- দিদি, অন্যায় হয়ে গেছে, আর কখনো---।

    --- চল, আমার সঙ্গে। দেখি, একস্টার্নালের সামনে তুমি সত্যি কথা বলে মাপ চাইলে উনি একে পাশ করান কিনা!

    কিন্তু হরিদাস পাল বুঝে যায় যে ওর এখন উচিৎ অন্য স্কুলে যাওয়া। ক্লাস টিচার শতদল মাসিমা বল্লেন-- তোমরা যারা পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিফিউজি হয়ে এসেছ তারা এই ফর্ম নিয়ে গিয়ে ঘর থেকে ফিল আপ করিয়ে গার্জেনের সিগনেচার করিয়ে কাল জমা দাও। তাহলে রিফিউজি স্টাইপেন্ড পাবে। মাইনে ফ্রি হয়ে যাবে।

    ফ্রি হয়ে যাবে? পড়তে পয়সা লাগবে না? মহানন্দে দুইভাইয়ের জন্যে দুটো ফর্ম নিয়ে এলাম। রাত্রে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ফিরে পিতৃদেব সলিলকুমার রেগে আন। ফর্ম দুটো ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। আমার গালে পড়ল এক থাপ্পড়! হাঁউমাউ করে দাদুর ঘরে আশ্রয় নিলাম। আমার দোষ কী কিছুই বুঝতে পারছিলান না। স্টাইপেন্ড তো জলপানি পাওয়া! সে তো গর্বের বিষয়। তাহলে?

    পাশের ঘরে সলিলকুমার গর্জাচ্ছেন-- আমরা রিফিউজি? সরকারের দয়ায় বাঁইচ্যা আছি? এর থেইক্যা ফাঁকি কিছু হয়!

    পরে রাত্তিরে মা বোঝলেন-- আমরা পাকিস্তান থেইক্যা আইছি বটে! কিন্তু ভাড়া বাড়িতে সম্মানের লগে আছি। আমাদের স্টাইপেন্ডের দরকার নাই। যারা ক্যাম্পে আছে, অন্য কোথাও থাকার জায়গা নাই, সরকারী ডৌল পাইয়া বাঁইচ্যা আছে তারা হইল আসল রিফিউজি। এই স্টাইপেন্ড তাদের জইন্য, আমরা নিলে ওদের কম পড়বো।

    অর্থাৎ, আমরা রিফিউজি হইয়াও রিফিউজি নই, স্বীকার করতে মন চায় না। রিফিউজি আইডেন্টিটি মানি না। অমর্ত্য সেন? আপনে শুনতে আছেন?

    দাদু, তা হইলে আমরা কী? আমাদের নিজেদের বাড়িঘর নাই, ভাড়া বাড়িতে আছি। আমরা কী?

    দাদু সতীশচন্দ্র নিরুত্তর। যেন ময়মন্সিংহের জেলা কোর্টে মুন্সেফের আদালতে দেওয়ানী মামলায় বিপক্ষের উকিল আচমকা নতুন কোন ডকুমেন্ট পেশ করেছে।

    -- ইশ্‌কুলে পড়াইছে যাদের ভাত জুটে না হের‌্যা হইল হা-ভাতে, যাদের ঘর জুটে না হেরা হইল হা-ঘরে। তাইলে আমরা কি হাঘরে?

    --- চুপ কর! ব্যাক্কলডা! অক্করে প্যাট- ব্যাক্কল( বে-আকল?)! ( গর্জে উঠেছেন সতীশচন্দ্র, নাতি ভয়ে তক্তপোষ থেকে নেমে পড়ে প্রায়)।

    তাহইলে শুন,--- আমরা হইলাম তালুকদার। মানে আমরা ইংরেজবাহাদুরকে সিধা খাজনা দিতাম। আমাদের আর সরকার বাহাদুরের মইধ্যে আর কোন মধ্যসত্ত্বভোগী , মিডলম্যান, ছিল না। আমাদের তিন গাঁওয়ের জমি ছিল খাস। আমার পূর্বপুরুষ জয়দেব ইন্দ্র নীলকর সাহেবের নীলের নৌকা মেঘনা নদীতে ডুবাইয়া দিছিলেন। আমরা মাথা তুইল্যা বাঁইচ্যা আছি, মাথা নওয়াইয়া না। তুই আমারে কস্‌ হাঘরে?

    --- আচ্ছা, দাদু! বুঝছি। আমাদের ক্লাস ফোরের বইয়ে একটা কবিতা ছিল:

    ""তালুকদারের ভালুক গেল শালুক খেতে পুকুরে,
    এমন সময় করলো তাড়া জমকালো এক কুকুরে।
    কুকুরটা যেই করলো ধাওয়া আর হল না শালুক খাওয়া,
    ছুটলো ভালুক বাড়ির পানে সেদিন বেলা দুকুরে।''

    আমরা কি হেই তালুকদার, যাদের পুস্কুনিতে বেলা দুফরে শালুক খাইতে ভালুক আসে?

    ----- আরে অলম্বুষ! তর মতন এমুন আউয়াখানা আর--।

    শুন, হগ্‌গলকথা এখন বুঝবি না। বড় হইয়া পড়বি--- পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট যারে আইজকাইল কয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এইডা খালি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায়। বাকি ভারতে কিন্তু মালজারি বন্দোবস্ত। তারপর পড়বি পূর্ব ভারতে সম্পত্তির অধিকারের ""দায়ভাগ'' নিয়ম। পন্ডিত জীমূতবাহনের তৈরি। সারা ভারতে কিন্তু মিতাক্ষরা নিয়ম। তখন বুঝতে পারবি আমি কী কইতে আছি।

    হে ভগবান! বড়রা সোজা সাপটা প্রশ্নের সোজা উত্তর দেয় না কেন? আমরা কোত্থেকে এলাম সেটা জানতে বা বুঝতে হলে এতসব পড়তে হবে! ইল্লি আর কি! রনজনের বয়ে গেছে। কবে বড় হবে, কবে এর উত্তর পাবে? তাই রনজন কথা ঘোরায়।

    ---- দাদু, আমরা আইলাম ক্যারে? দেশ ভাগ হইল দেইখ্যা? তাহইলে ময়মনসিং সদরে বাবার ছুটমামা ডাক্তার নীলমণি রায়, তাদের ছেলে মেয়েরা,আমার মশাত্ব ভাই অমিতাভদা-- হ্যারা কেমনে পাকিস্তানে শ্যাকের রাজত্বে আছে?

    অনেকক্ষণ কোন কথা নেই।

    উত্তর না পেয়ে হরিদাস পাল মুখ তুলে অবাক হয়ে যায়।

    সতীশচন্দ্রের পরিষ্কার করে দাড়ি কামানো চাঁচাছোলা কালো চেহারায় রং পালটে ছাইগাদার আভাস যে! হলটা কী? কিছু অনায্য বলে ফেলেছে নাকি?

    ---দাদু?

    ----কইতাছি দাদুভাই, একটু সবুর কর। তুমি হইলা নাতিদের মইধ্যে বড়। আমার বড়ছেলের বড় ছেলে। একটা গোপনকথা তুমারে কই, কাউরে কইয়ো না, অন্যেরা বুঝবো না, তর বাবা জানে। দেশ ছাড়ছি আমার পাপে, উদ্বাস্তু হইছি আমার পাপে।

    আমরারে যে পিতৃপুরুষের ভিটা ছাইড়া, দেশ ছাইড়া , উদ্বাস্তু হইয়া কইলকাতায় আইতে হইল তাতে দেশভাগ, কংগ্রেস-মুসলিম লীগের রাজনীতি হইল নিমিত্ত কারণ। যারে সায়েন্সে কয় ক্যাটালিস্ট। আসল কারণ বা উপাদান কারণ( এইটা সাংখ্যদর্শনের ভাষা, বড় হইয়া পড়বি) হইল আমার পাপ। একজন নিরপরাধরে তার ভিটামাটি থেইক্যা বঞ্চিত করছিলাম, সেইপাপে ভগবান শাস্তি দিছেন। আমারে সপরিবারে ভিটমাটি থেইক্যা উচ্ছেদ করছেন। আমি আনন্দ মেস্তরিরে ঘরছাড়া-গ্রামছাড়া করছিলাম। ঈশ্বর আমারে দেশছাড়া করছেন।

    এরপর হরিদাস পাল রনজনকে কিছু বলতে হয় না। সতীশচন্দ্র তার দিক তাকাচ্ছেন না। জানলার সবজেটে পাল্লার ওপরে বসে কিচিরমিচির করতে থাকা একজোড়া চড়ুইপাখির দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে এক অদ্ভুত নিচু গলায় বলতে শুরু করলেন।

    --- আমাদের পূর্বপুরুষ ফকিরচন্দ্র ইন্দ্র সম্ভবত: রাঢ়দেশ থেইক্যা বর্গীর তাড়া খাইয়া জানপ্রাণ লইয়া প্রথম উদ্বাস্তু হইয়া গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-ধনু নদী পার হইয়া ময়মনসিংহের আঠারবাইড়া গাঁয়ে দম নিলেন। তখন এইসব ঘন জঙ্গল ছিল। সাপ-বাঘ-হায়েনার বাসা। এইদিকে নদী বড় খর। এই শুকনা, এই জইষ্ঠ মাসে জল বাড়তে আছে। হিমালয়ের বরফ গইল্যা ব্রহ্মপুত্র দিয়া গারো পাহাড়ের পাশ দিয়া ময়মনসিংহ জেলায় যত উপনদী, শাখানদী সবের শিরার মইধ্যে ঠান্ডা জল নিয়া বিয়া যায়। তারপরে বৃষ্টি হইলে তো কথা নাই। তাই এইদেশে হয় জলিধান। জলের স্তরের সঙ্গে মাথা উঁচা কইর‌্যা তার গাছ একবাঁশ মতন উঁচা হয়।

    তাই বৃষ্টি নামাইতে মুসলমান বেটিরা গান গায়--

    ম্যাঘরাজারে, তুইনি আমার সোঁদর ভাই,
    একফোঁটা পানি দিলে জলির ভাত খাই।

    হেই লাইগ্যা তাইন, মানে ফকিরচন্দ্র একটা উঁচা টিলা দেইখ্যা তার উপর বাড়ি বানাইলেন। আটচালা বাড়ি। মাঝখানে ঊঠান। চাইরদিগে টানাবারান্দা আর তার গায়ে গায়ে ঘর। হেইডা করতে গিয়া বাঘ-সাপ-খাটাশ কিছু মাইর‌্যা কিছু তাড়াইয়া জঙ্গল সাফ করলেন। এইডা ছিল তাঁর প্রথম বছর। পরের বছর বাড়ির সামনে বিশাল পুষ্কুনি কাটাইলেন। লোকে কইতো দীঘি। সেই দীঘি পারাপার করা কঠিন ছিল। সারা বছ্‌ছর গভীর কালোজল। মাইয়ামাইনষে বুকে কলস লইয়া চেষ্টা করতো, কিন্তু পারাপার হইতো মা। সেই দীঘি আজও আছে। খালি তার মইধ্যে আইজ বাবর আলি মুন্সীর হাঁসেরা সাঁতার কাটে। যাউকগিয়া, তিনি উদ্যোগীপুরুষ ছিলেন। কয় বছরের মইধ্যে পাটের চাষ আর অন্য কৃষিকার্য কইর‌্যা সম্পত্তি বাড়াইলেন। আঠরবাড়িয়া-বাজিতপুর-ময়মনসিংহ সদরে বাড়ি করলেন।

    পরের বছর তিনি বৈষ্ণবম¿ত্র লইলেন ত্রিপুরার পত্তনের গোস্বামী পরিবারে। তাঁরা আইজও আমাদের গুরু পরিবার, আমরা যজমান। তার পরের বছর গেলেন বৃন্দাবনধামে, গরুর গাড়ি কইর‌্যা, একমাস লাগলো। তারপর সেইখান থেইক্যা শালগ্রামশিলা মাথায় কইর‌্যা কিছু পদব্রজে, কিছু গোরুর গাড়িতে ফির‌্যা আইলেন। বাড়িতে পাক্কা দালান দিয়া গোবিন্দজীউয়ের নাটমন্দির বানাইয়া তাতে শালগ্রামশিলা স্থাপন কইর‌্যা তবে দম নিলেন।

    আমার বাবা ঈশ্বর গগনচন্দ্র স্যার রাসবিহারী বোসের জুনিয়র। ভাল সিভিল ল'ইয়ার ছিলেন। কিন্তু নিষ্ঠাবান হিন্দু। পঞ্চাশোর্ধ্বে বনং ব্রজেৎ । তাই প্র্যাকটিস ছাইড়া বাণপ্রস্থ অবলম্বন কইর‌্যা শেষ বয়সে বৃন্দাবনে মাধুকরী কইর‌্যা কাটাইলেন।

    আর আমি? আমার বিশেষ উচ্চাশা ছিল না। প্র্যাকটিস মোটামুটি, হইলাম বার লাইব্রেরির সেক্রেটারি। সম্পত্তি বাড়াই নাই, বরং ১৯৩০শে বিশ্বব্যাপী মন্দার সময় পাটের দাম পইড়া গেল। তাই আমার বড়মেয়ে বকুলের বিয়ার কর্জ ( কমুনিষ্ট নেতা ভুপেশ গুপ্তের বাপ মহেশ গুপ্তের কাছে) শোধ করতে কিছু জমি বেইচ্যা দিতে হইল।

    কিন্তু মনে ছিল পরিবারের সম্পত্তি বাড়াইতে কিছু করা উচিত। আমাদের চকমিলান বাড়ি আর পুষ্কুণির পাড়ে ছুতার আনন্দমেস্তরির কয়েক কাঠা জমিতে বসতবাড়ি আর বাগান। তাতে কলাডা-মূলাডা হয়। কচুশাক-লাউডগা-চালকুমড়া সবই। ভাল দো-আঁশ জমি। আমি কইছিলাম কিন্যা নিব, বেচবা? বদলে পুস্কুনির অন্য পাড়ে সমান জমিন দিয়াম আর কিছু নগদ টাকা। তা' সে ব্যাডা কয়--- বেচতাম না। কি করি? অনেক বুঝাইলাম।

    --- দেখ রে ! এই জঙ্গল কাইট্যা জমিন সাফ কইর‌্যা গাঁও বানাইছে কেডা? আমার পূর্বপুরুষ। তরা অনেক পরে আইছস, বাইরের থেইক্যা। তরা হইলি নানকার। এই জমি তো তরা কিনস নাই। আমরা তোদের দিছি এইটাতে থাক,কামাও আর সমস্ত গাঁয়ের ছুতারের কাম কর। সে গোরুর গাড়ির চাক্কাই বানাও, কি লাঙ্গল বানাও , না কি মাইনষের বাড়ির চৌকাঠ-দরজা-জানালা-চৌকি বানাও। কাজেই এইডা মূলত: আমাদের জমি। এখন ফিরত চাইতাছি, বদলে অন্য জমিন ও ট্যাহাও দিতে রাজি-, তাতে আমাদের পুকুরপাড়ের জমিন চৌরস হইব-- অন্যায্য কি কইছি! ব্যাডা মানে না। আমিও অপেক্ষায় রইলাম।

    দেশভাগের আগের বছর ওদের ঘরে জ্বরজারি, বৃষ্টি নাই, ফসল নষ্ট, আবার বড় মেয়ের বিয়া দিব। পাঁচশ' টাকা ধার চাই। একবছরে ফিরৎ দিব। না দিলে সেই জমিন আমার হইব। আমি নিজে উকিল। তবু প্রতিবেশি উকিল উমানাথ বাবুরে দিয়া পাক্কা এগ্রিমেন্ট বানাইলাম।

    আর টাকা শোধের তিনদিন আগে আমি গেলাম ট্রেইনে চইড়া কইলকাতা। ফিরলাম সাতদিন পরে। আইয়া শুনলাম আনন্দ ঠিক সময়ে ধারের টাকা সুদ সুদ্ধ ফিরৎ দিতে আইছিল। কিন্তু আমি স্ট্রিক্ট অর্ডার দিয়া গেছলাম--- কেউ যেন টাকা না নেয়। সেইমত সবাই কইল-- তুমার জমির কাগজ কর্তার কাছে জমা আছে। কাজেই উনি ফিরলে পড়ে ওনার হাতেই ট্যাহা দিও আর জমির কাগজ লইয়া যাইও। হক কথা, আনন্দ ফিরৎ গেল। কুন সন্দেহ করে নাই।

    আমি ফিরলাম সাতদিন পরে। ততদিনে শোধ দেয়ার শেষতারিখ পার হইয়া গেছে।

    আরও সাতদিন পরে আমি উমানাথবাবুরে দিয়া আনন্দদের জমিবাড়ির স্বামিত্ব ও দখলের জন্য কোর্টে মামলা ঠুইক্যা দিলাম। এর মইধ্যে আনন্দ কয়বার আমার সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করছে,--আমার বাড়িতে, কাছারিতে, কোর্ট যাওয়ার রাস্তায়। কত অনুনয়-বিনয় করছে সুদসুদ্ধ টাকা ফেরৎ নিয়া মামলা শেষ করতে, জমির কাগজ ফিরৎ দিতে। কিন্তু আমি একবারও কথা কই নাই। মামলা সাব জুডিস।

    শেষে হারল, বাড়ি খালি কইরা অন্য গাঁয়ে গেল। মেস্তরির জমি-বাড়ি আমাদের হওয়ায় গোটা জমিট চৌরস হইল। নাটমন্দিরে ধুমধাম কইর‌্যা পূজা হইল। কিন্তু আমার মনে আনন্দ নাই, শান্তি নাই। তর বাবা আমারে কইল-- কাজটা ভাল কর নাই।

    আর কয়েক বছরের মইধ্যে দেশভাগ হইল। আমরা দেশছাড়া-ঘরছাড়া হইয়া আনন্দ মিস্ত্রির চেয়ে খারাপ অবস্থায় কোনরকমে কইলকাতা পৌঁছলাম।

    একটা কথা মনে রাইখো। মাইনষেরে জমিন না দিতে পার, জমিন কাইড়ো না।

    খাওন না দিতে পার, মুখের গরাস কাইড়া নিও না।

    লজ্জানিবারণের কাপড় না দিতে পার, পরণের কাপড় খুইল্যা নিও না।

    (চলবে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৮ নভেম্বর ২০১০ | ৯৪৯ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন