এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা

  • কলিম খান, গরুর রচনা ও তর্কশীল বাঙালি

    দেবতোষ দাশ লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ জুন ২০১৮ | ৭৮৫৭ বার পঠিত
  • অকস্মাৎ আকাশ হইতে টুপ করিয়া কলিম খানের আবির্ভাব ঘটিল এই বঙ্গদেশে এবং তিনি নিত্যনতুন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সুধীবৃন্দকে চমকে দিচ্ছেন, ব্যাপার এমন নয়। যাস্ক, পাণিনি ও অন্যান্য কোষকার, প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাষা-বিষয়ক জ্ঞানভাণ্ডারের হোতা। নীরব নিষ্ঠায় একালে এঁদের অনুসরণ করেছেন 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলিম খান এই সমৃদ্ধ কিন্তু বিস্মৃত জ্ঞানভাণ্ডারের যোগ্য উত্তরাধিকার। কিন্তু কলিম কেবল ভাষাতত্ত্ব নিয়ে থেমে থাকলেন না, পুনরুদ্ধার-করা শব্দতত্ত্ব নিয়ে ঢুকে পড়লেন প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে। এই ঢুকে-পড়াটাই হয়ে গেল বিপজ্জনক। একে অন্তর্ঘাত হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। কেমন সেই অন্তর্ঘাত? উদাহরণ ইস্তেমাল করে দেখা নেওয়া যাক। ‘গো’ নিয়ে ইদানিং যথেচ্ছ গরু খোঁজা চলছে, আমরা এই ‘গো’ শব্দটি দিয়েই শুরু করতে পারি।

    হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ 'গো' শব্দের ৪১টি অর্থ দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি অর্থ গরু। এছাড়া গো মানে বৃষরাশি, সূর্য্য, চন্দ্র, ইন্দ্রিয়, ঋষিবিশেষ, গায়ক, গৃহ, পৃথিবী, আকাশ ইত্যাদি। প্রথমেই গো শব্দের অর্থ দিয়েছেন বাক্যের সাহায্যে - যে যায়। কেবল গো-এর ক্ষেত্রে নয়, বেশিরভাগ শব্দের ক্ষেত্রেই তিনি বাক্য-অর্থ দিয়েছেন। তারপর দিয়েছেন তার অন্যান্য প্রতিশব্দ। কেন এমন করলেন তিনি? বর্তমানে চালু আমাদের কোনও বাংলা অভিধানে তো এই রীতি মানা হয় না! তাহলে? ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ মন্থন করে কলিম খুঁজে পেলেন এর উত্তর। এক্ষেত্রে হরিচরণ নিশ্চল নিষ্ঠায় অনুসরণ করেছেন আমাদের দেশের প্রাচীন বৈয়াকরণদের। তাঁর পূর্বসূরীদের। আমাদের দেশে শব্দের মানে শব্দের বাইরে ছিল না, ছিল শব্দের ভেতরেই। শব্দের ভেতর থেকে অর্থ-নিষ্কাশন একটি কৌশল, প্রাচীন ভারতে এই কৌশলের নাম 'নির্বচন'। শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে যা করতে হয়। আমাদের বাংলা ব্যাকরণের সমাস ও তার ব্যাসবাক্য নির্ণয়ের মধ্যে যার কিছুটা ভগ্নাংশ এখনও রয়ে গেছে। শব্দের ভেতরের অর্থটিকে বাক্যের সাহায্যেই প্রকাশ করা হয়। বৌদ্ধযুগের 'অমরকোষ' এই কাজটি করেছেন নিখুঁতভাবে। পরে অন্যান্য কোষকারগণ এই রীতিই মেনেছেন।

    সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে বাচক-অর্থ বা অন্যান্য প্রতিশব্দের মাত্রা বেড়েছে, পেছনে পড়ে গেছে 'বাক্য-অর্থ'। হরিচরণও নিষ্ঠার সঙ্গে তাই করেছেন। শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে যে বাক্য-মানে বেরোয় সেই বাক্যটি লিখেছেন। তারপর এক এক করে দিয়েছেন অন্যান্য বাচক-অর্থ বা প্রতিশব্দ। সেই প্রতিশব্দ প্রদানেও তিনি স্বেচ্ছাচারী হননি। ওই অর্থ তিনি কোথা থেকে পেয়েছেন, সেইসূত্রও উল্লেখ করেছেন তিনি। কোনও অর্থই তাঁর স্বকপোলকল্পিত নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে যত কোষগ্রন্থ ও অভিধান রচিত হয়েছিল, প্রায় সবগুলিই তিনি অনুসরণ করেছেন।

    যাস্ক, পাণিনি, মুগ্ধবোধ, অমরকোষ, শব্দকল্পদ্রুম, মেদিনীকোষ ইত্যাদি সবই তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত, সাংখ্য-যোগ-তন্ত্রবিষয়ক গ্রন্থাদি থেকে রবীন্দ্রকাব্য পর্যন্ত নানা গ্রন্থে শব্দসমূহের ব্যবহার অধ্যয়ন করে তিনি তাদের অর্থ সরবরাহ করেছেন। একটি শব্দের বহু অর্থ, আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, তিনি কেবল সততার সঙ্গে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর মতো কলিম খান শব্দ ও তার শেকড় খুঁড়ে বের করতে চাইলেন ইতিহাস। একটি সচল ভাষা তো ধারণ করে ইতিহাস। গো শব্দের ৪১টি অর্থ তো একদিনে তৈরি হয়নি! সমাজবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছে নানা অর্থ। কয়েক হাজার বছরের ঐশ্বর্য এই অর্থভাণ্ডার। মহাপুরুষ হরিচরণ তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে ৪১টি শব্দের পুরো তালিকাটাই লিপিবদ্ধ করেছেন। আর এইযুগের স্বেচ্ছাচারী অভিধানকারেরা 'গো'-এর ৪০টি অর্থ ফেলে কেবল 'গো মানে গরু' লিখে দিলেন। ছিঁড়ে ফেললেন আমাদের অসীম উত্তরাধিকারের সূত্রগুলো। কলিমের ভাষায়, একেই বলে 'বাপের নাম ভুলিয়ে দেওয়া'। এইভাবে আমরা নিজেরাই নিজেদের অ-নাথ করেছি, করে চলেছি।

    আমরা যে হ্যাঁগো, ওগো, কীগো ইত্যাদি বলি কথায় কথায়, কেন বলি? এই ‘গো’টি কে বা কারা? এই গো মানে কি গরু? স্ত্রী স্বামীকে বলছেন, হ্যাঁগো আজ অফিস যাবে না? বা চাষি মাঝিকে বলছেন, ওগো তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে, বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে। এখানে গো মানে নিশ্চয়ই গরু নয়! স্ত্রী স্বামীকে বলছেন, ও গরু আজ অফিস যাবে না? বা চাষি মাঝিকে গরু বলে সম্বোধন করছেন, এমন নিশ্চয়ই নয়! তাহলে কী? হরিচরণ অনুসরণ করে কলিম বলছেন, এখানে গো মানে গামী, 'হে গামী'-অর্থে সম্বোধন করা হচ্ছে চলমান কারুকে।

    যে যায়, সেই তো 'গো'। তার মানে, প্রতিটি গামী বা চলমান সত্তাই 'গো'। আমাদের পূর্বসূরী বাংলাভাষিগণ যে সমস্ত গামীকে গো শব্দে চিহ্নিত করেছেন, তার সংখ্যা তাই অনেক। সেগুলিকে বিচার করতে গিয়ে দেখা যায়, অতি উচ্চ মার্গের গামী যেমন রয়েছে, অতি নিম্ন মানের গামীও তেমনি রয়েছে।

    কলিম নির্দিষ্ট করছেন, গো শব্দের সর্বোচ্চ অর্থ হল তত্ত্বজ্ঞান ( theoretical knowledge ) এবং সর্বনিম্ন অর্থ হল গরু (cow)। মাঝে রয়েছে অনেক প্রকার অর্থ; সেগুলির মধ্যে ‘হে গামী’ (হ্যাঁগো, ওগো) অর্থে শব্দটির ব্যবহার সর্বাধিক। দ্বিতীয় স্থান ‘পণ্য’ অর্থে গো শব্দটির ব্যবহার। কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাভারত-এ বলছেন – ‘গো প্রভৃতি পবিত্রতা- সম্পাদক পদার্থসমূহের মধ্যে সুবর্ণই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ।’ তার মানে, এক কালে গরু বিনিময়ের মাধ্যম বা মুদ্রা রূপে ব্যবহৃত হত। টাকা সচল হয়, অচলও হয়; সচল টাকা তো ‘গো’ হবেই। মুদ্রারূপে ব্যবহারের কারণে সেই গো-এর ব্যবহারের আধিক্য ছিল স্বাভাবিক।

    ধরা যাক আরও দু'একটা শব্দ এবার, যেমন - গবেষণা। ছোটবেলায় সন্ধি করেছিলাম, গো + এষণা = গবেষণা। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ দেখতে পাচ্ছি এষণা অর্থ ১. গমন বা ২. অন্বেষণ বা ৩. ইচ্ছা। গো যদি গরু হয় তাহলে কি গবেষণা মানে গরুর গমন বা গরু খোঁজা/অন্বেষণ বা গরু বিষয়ক ইচ্ছা বোঝাবে? তা তো বোঝায় না! গবেষণার অর্থ জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস দিয়েছেন, কোনও বিষয়ের তত্ত্ব নিরূপণার্থ অনুসন্ধান। ইংরাজিতেও বলে রিসার্চ, যেখানে সার্চ বা অনুসন্ধান শব্দটি আছে। নির্বোধ গো-রক্ষক কোনও সঙ্ঘ, স্নিফার সারমেয়র মতো ফ্রিজে গরু খুঁজতে পারেন, কিন্তু একজন পিএইচডি স্কলার নিশ্চয়ই পাঁচ বছর ধরে গরু খোঁজেন না! তাহলে এই ‘গো’ কী? এখানে খুব স্পষ্ট, গো মানে কেবল গরু নয়। তত্ত্ব-কথাও বোঝায়।

    কিন্তু আমরা কিছুতেই বুঝব না, আমাদের বৈয়াকরণ ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতরাও বুঝবেন না! তাঁরা গো অর্থ কেবল গরুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবেন। ফলত পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার সামলাতে না-পেরে আমরা আজ দীন ভিখারি। আর এই সুযোগ নিয়ে 'ধর্ম বেওসায়ী ভক্ত'বৃন্দ গো-রক্ষা বাহিনী গড়ে ফেলেছেন পাড়ায় পাড়ায়। গরু-খেকো যবন ও ম্লেচ্ছদের ঢিট করে, দরকার হলে খুন করে, গরুকুলকে রক্ষা করতে হবে!

    যেমন গোবর্দ্ধন শব্দটি, যে বা যিনি গো-বৃদ্ধি করেন; অথবা, এখানে গো অর্থ পণ্য বা প্রোডাক্ট। গোবিন্দ = যিনি সর্ব প্রকারের গো-গণ বিষয়ে বিদিত। তিনি হলেন শ্রীকৃষ্ণ। গোবিন্দের সর্বোচ্চ অর্থ, যিনি তত্ত্বজ্ঞান-সমূহের রস দান করেন এমন এক বৃহস্পতি বা তত্ত্বদর্শী। গোবিন্দের সর্বনিম্ন অর্থ, যে রাখাল চাইলে ভাল দুধ জোগাতে পারে। কলিম তাই বলেন, গোবিন্দ'র গো কেবল গরু হলে অনর্থের আর সীমা থাকে না!

    গোস্বামী শব্দের গো মানে কী? যাঁরা গো-গণের স্বামী তাঁরাই গোস্বামী। এখানে গো মানে তত্ত্ব। গোস্বামী শব্দের সর্ব্বোচ্চ অর্থ, যিনি মানবজাতির অর্জিত জ্ঞানসম্পদের মুকুটমণি তত্ত্বসমূহের অধিকারী। সর্বনিম্ন অর্থে, যিনি গরুসমূহের অধিকারী বা মালিক। গোস্বামী'র গো যদি গরু হয় তাহলে রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী কারা? গরুর পাইকার? আমাদের বঙ্গীয় ভাষাবিদেরা কী বলেন? একই নিয়মে, অতএব, গোবর-গোমূত্র বলতে সে গরুর মলমূত্রই বোঝে, এবং যেহেতু প্রসাদ হিসেবে খাওয়ার নিদান আছে, সবাইকে তা খেতেও হবে! আমরা ভাবি, নিঃসন্দেহে ঐ গোবর-গোমূত্রের ভিতরে অলৌকিক শক্তি আছে। অতএব, গোপথ্যি ও পঞ্চগব্য নিয়ে শেষমেষ ‘রাজসূয় যজ্ঞ’ শুরু হয়ে যায়। শুরু হয় রামদেবের রমরমা। কলিম খান বিস্মিত হন, এ কেমন শাইনিং ইণ্ডিয়া, যেখানে লোকেরা গরুর মলমূত্র খায় এবং প্যাকেটে ও বোতলে ভরে লেবেল সেঁটে বিক্রি করে? মহিষ, গাধা, ছাগল, ভেড়া সকলের দুধ খায় এরা, মাংসও খায় কিন্তু তাদের মলমূত্র খায় না। ওদিকে গরুর দুধ ও মলমূত্র সবই খায় কিন্তু তার মাংস খায় না!

    জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চাকারীদের ভালোর জন্য বোঝাতে যে ‘গো-ব্রাহ্মণ হিতায়’ কথাটি বলা হত, এখন তার মানে দাঁড়িয়েছে, গরুর ও ব্রাহ্মণের ভালোর জন্য! যে ব্রাহ্মণ ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী, ভারতবর্ষে যাঁর অর্জন বিশাল, ভাগ্য তাকে কিনা, নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল গরুর সমান মর্যাদায়!

    এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গো-মাতা শব্দের অর্থ-বিপর্যয়। গো-মাতা তো সুরভি, বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীর মা। সে তো কেবল দুধ, মাখন, মণ্ডা, মিঠাই প্রসব করত না; অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্যসামন্তও প্রসব করতে পারত। কেননা, নন্দিনী তো আসলে মহর্ষি বশিষ্ঠ পরিচালিত বিপুল বাহ্যসম্পদ উৎপাদনকারী এক বলিষ্ঠ সম্প্রদায়। গো-মাতার সে সব অর্থ আমরা স্রেফ ভুলে গেছি। এখন গো-মাতা মানে যে-গরুর দুধ খাওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হল, যার দুধ খাওয়া হয়, তাকেই 'মাতা' বললে ছাগ-ভেড়া-গাধা-মহিষ-উট সবাইকেই 'মাতা' বলতে হয়; কেননা তাদের সকলের দুধও আমরা খাই। তাদের মাংস খেলেও তো 'মাতা'র মাংস খাওয়া হয়! না, সে সব যুক্তি-তর্কের অবকাশ নেই। ‘গো’ শব্দের অর্থকে শুধুমাত্র গরুতে স্থির করে নিশ্চল করে দিলে যে-যে দুর্গতি হওয়া সম্ভব তা সবই হয়েছে বা হয়ে চলেছে।

    এইসব প্রশ্ন করলে আমাদের ভাষাত্ত্বাতিক পণ্ডিতরা নিশ্চুপ থাকেন। এড়িয়ে যান। যে মহাপুরুষ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মের সার্দ্ধ-শতবর্ষ পালন হল ২০১৭ সালে, তাঁর অভিধান সাহিত্য অ্যাকাডেমির সম্পদ হলেও, পণ্ডিতরা এই অভিধান পড়তে সরাসরি বারণ করেন। এক শব্দের বহু অর্থ তাঁরা মেনে নিতে পারেন না। অ্যাকাডেমিক জগৎ ছাত্রছাত্রীদের এই সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে। কারণ, এটা মেনে নিতে পারে না পুঁজিও। বাজারের দুনিয়ায় এক শব্দের বহুরৈখিক অর্থ হলে বড় গোলমাল। ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনেই পড়েন বিপদে। ক্যাপিটাল তা মানবে কেন? তাঁর চাই এক শব্দের একটাই অর্থ।

    বহুত্ব বা বহুরৈখিকতা পুঁজির পক্ষে বাধাস্বরূপ। ফলত, পুঁজির দালাল শিক্ষাকেন্দ্রগুলি হরিচরণকে ব্রাত্য করে রাখে। নমো-নমো করে জন্মের ১৫০ বছর তারা পালন করে বটে, তবে তা 'পূজা'র উদ্দেশ্যেই, তাঁকে অনুসরণের বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাদের নেই। এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম, এক আইনের ধারক-বাহকেরাও তাই চায়, বহুরৈখিক ভারতীয় সংস্কৃতি ধ্বংস হোক। পুঁজি, শিক্ষাকেন্দ্র আর মৌলবাদীদের এক নির্বিকল্প গাঁটবন্ধন গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে দাপাচ্ছে, হরিচরণের মতো মহর্ষির স্থান সেখানে কোথায়! কলিম খান এই অন্যায় গাঁটবন্ধনকে চিহ্নিত করলেন। ফলত, তাঁকেও ব্রাত্য করল অ্যাকাডেমি।

    এই বিকারগ্রস্ত সময়ে কলিম প্রায়ই বলতেন, ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত থেকে এই বাংলাকে রক্ষা করছে তিনটি শক্তি। কী সেই ত্রিশক্তি? বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, একটি সরোবর কত বড়ো ছিল, বোঝা যায় সেটি শুকিয়ে গেলে। আমরা সেই শুকনো সরোবরের তীরে দাঁড়িয়ে আছি এখন। ট্র্যাজেডি হল, এখনও বুঝতে পারছি না বা চাইছি না ক-ত জল ছিল একদা সেই সরোবরে। ভাষা ও সংস্কৃতির বিপুল উত্তরাধিকার হারিয়ে আমরা আজ ভিখারি। সুযোগ পেয়ে গো-রক্ষকদের তাণ্ডব তো চলবেই! রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'সভ্যতার সংকট'-এ লিখেছিলেন 'অতীতের সঙ্গে ভারতের নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ'। নৃশংস শব্দ ছাড়া এই আত্মবিচ্ছেদকে সত্যিই বর্ণনা করা যায় না। আমরা ঐশ্বর্যহীন হয়েছি স্বেচ্ছায়, ফলত প্রতি পদে পদে সহ্য করতে হবে 'মুর্খ ভক্ত'দের তাণ্ডব। কলিম-বর্ণিত ‘ত্রি’ফলা’র ফলাগুলো নষ্ট করেছি বা করে চলেছি অহরহ। নিজেদের শক্তিহীন করে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করব কীভাবে?

    ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই, কলিম খান যখন ক্রমশ প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন, চিরবিদায় নিলেন তিনি অকস্মাৎ। উপেক্ষা বা ব্যঙ্গ, এই সময় কোনও শস্ত্রই তাঁর দিকে না-ছুঁড়ে, তাঁর ভাবনা-ভুবনে সামান্য অনুপ্রবেশ করলে ক্ষতি কী? একটু চর্চা, ভাব-বিনিময় কি তর্কশীল বাঙালি করতে পারে না? অবশ্য বাঙালির সঙ্গে ‘প্রগতিশীল’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ খুব যায়, কিন্তু তর্কশীল? আপনি কী বলেন?


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ১৭ জুন ২০১৮ | ৭৮৫৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • i | 783412.157.89.253 (*) | ২২ জুন ২০১৮ ১২:৫৩84416
  • দেবতোষ দাসের মূল লেখা আর বক্তব্য মনে হয় বুঝতে পেরেছি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক শব্দের বহু অর্থ এবং কোথয় কি ভবে ব্যবহৃত তা লিপিবদ্ধ করেছেন। কলিম খান খুঁজতে চাইলেন এই ভিন্নতা কি ভাবে এলো, সামগ্রিক ইতিহাস আর কি । এইখানেই বিতর্ক শুরু । জাতীয়তা বাদী অবস্থান ইত্যাদি ... সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
    দেবতোষ বাবু বলছেন, তর্কশীল বাঙালীকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ সরিয়ে রেখে কলিম খানের ভাবনার ভুবনে প্রবেশ করতে।
    তাই করতে গেলে, বিতর্কের কচকচি সরিয়ে রেখে আম পাঠককে পড়াশোনা করে নিতে হবে অনেক খানি। নিজের কথাই বলছি আর কি।
    আমাকে কেউ যদি কিছু বই সাজেস্ট করেন-কী ভাবে শুরু করব- তো উপকৃত হই।
  • Q | 781212.194.7845.66 (*) | ২২ জুন ২০১৮ ১২:৫৭84435
  • হাতী গেলে বাজার
    কুকুর ডাকে হাজার।

    ঠিক লিখেছেন দেবতোষ বাবু। চালিয়ে যান।

    দু-এক জন সিরিয়াসলি ভাবছেন দেখলাম। সেগুলো খেয়াল রাখুন।

    ফালতু মন্তব্যগুলোতে কান দেবেন না।
  • Debasis Bhattacharya | 561212.187.4534.238 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০১:২৬84448
  • অ, কলিমেও তবে ষড়যন্ত্র ? এ যে দেকি ষড়যন্ত্রের ফ্র্যাক্টাল জ্যামিতি !!!
  • ss | 7845.15.5645.33 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০১:৩৭84449
  • হ্যাঁ, ক্রিববাদীরা প্রতিটি বর্ণের মানে বের করেন। তাঁদের বর্ণের পর্যায় সারণী আছে.

    যেমন, "টুটুন" শব্দের মানে হবে ( আবার পরিশ্রম করে হিউমার করছি। ক্ষমা করবেন। স্বভাবের মুদ্রাদোষ!):

    "গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে..." (এরকম সাইটেশন ক্রিববাদীরা দেন না)

    তাহলে ক্রিয়াভিত্তিক মানে হলো গিয়ে ভেঙে যাওয়া-- ধাতু স্পষ্টতই √টুট্ (সমোসক্রিতে নেই)

    এবার বর্ণভিত্তিক মানে:

    ট -এর মানে "টঙ্কারণ" (একটা ভূত মাথায় গাঁট্টা মেরে কইলো, "কি করে জানলি এমন মানে? মেথডোলজি বাৎলা দেখি!)
    উ-এর মানে "নবরূপে উর্তীর্ণন" (ভূত বলে, "ওঃ, এরা পারেও বটে! বকবক-করার ওপর বকবক করে। এমন meta-বকবক যে চক্রক দোষে দুষ্ট তা আর এরা জানবে কবে?)
    ন-এর মানে "নাকরণ,অনাকরণ" (খিকখিক করে ভূত হাসতে থাকে। তারপর আমার চাঁদিতে চাঁটি মেরে পালায়। এখনো ব্যথা করছে। মাথায় বরফ দিতে হবে। মাথায় বরফ দিতে গিয়ে দেখলুম,আহা, ভদকার বোতল। ভদকা আর উদক পরস্পর সম্পর্কিত শব্দ [wed-উদক-water-vodka] । ভদকাকে উদক জ্ঞানে বরফ ঢেলে...... আমি আর কিছু বলতে পারবো না।)

    পুনঃ আমি শর্টকাটে ভাষাতত্ত্ব শেখাতে অপারগ। মেড ইজি লেখার ক্যালি আমার নেই। ভাষাতত্ত্ব শিখিতে গেলে আপুনাদিগকে খাটিতে হইবে। ঐরকম ঝটিতি মন্তব্য যাঁরা করেন, তাঁরা শ্লো মোশন রিডিং-এ অভ্যস্ত নন এবং স্পীড ক্যাপিটালিজমের দাস। একটু ধৈর্যের পরীক্ষা তো দিতে হইবে। (গুরুচণ্ডালী স্বেচ্ছাকৃত)
  • dc | 011212.227.672323.77 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০১:৪৯84450
  • বাঃ এইতো আমার মনোমতো টপিক এসে গেছে। চার প্রকারের ভদকা অতি সুস্বাদু মনে হয়েছেঃ অ্যাবসোলুট, কেটেল ১, স্টলিচনায়া (আদর করে একে শুধু স্টলি নামেও ডাকা হয়), আর গ্রে গুজ। এদের মধ্যে স্টলি আমার সবচাইতে প্রিয়, তবে একই সাথে এটা সবচাইতে কড়া, তাই সবসময়ে খাই না। আর দামের দিক থেকে গ্রে গুজের বোতল হলো চার থেকে সাড়ে চার হাজর, বাকিগুলো মোটামুটি দু হাজারের কম বেশী। তাই গ্রে গুজও সচরাচর খাওয়া হয় না। বাকি থাকলো কেটেল আর অ্যাবসোলুট। এদের মধ্যে কেটেল খেতে বেশী ভালো লাগে, তবে অ্যাবসোলুটের দুয়েকটা ফ্লেভারও ভালো (ফ্লেভারগুলোর অবশ্য দাম বেশী)।
  • dc | 011212.227.672323.77 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০১:৫৪84451
  • আর ইয়ে কলিম খান নিয়ে গুগল করে এটা পেলামঃ

    From this point of view, the basic difference between Bangla and all other languages in the world, except Hebrew that also carries part of this characteristic, is verb-based semantics. According to Kalim Khan, this has made Bangla the most important and unrivalled language in the world. Bangla holds the key to building a universal, super language of the future global village

    https://www.thedailystar.net/news-detail-227465

    এ কি সত্যি? বাংলাই কি সেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা? বাংলাই কি হবে ভবিষ্যতের লিংগুয়া ফ্রাংকা?
  • ss | 7845.15.8912.59 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০২:০৩84452
  • dc মশাই, দয়া করে এইরকম ট্রোল করবেন না!

    সোশ্যাল সাইটে তর্ক করা বড্ডো ঝকমারি। তাই, সর্বজনহিতার্থে তর্ক করার তরিকা বাতলে নিই, খানিকটা বাধ্য হয়েই... কেননা, ক্রিববাদীরা বড্ডো আউট অফ ট্র্যাক হয়ে গালি করে, ট্রোল করে.....

    কয়েকটা অনেকান্ত (ন+এক+অন্ত) লীলেখেলার প্রস্তাব রাখছি ইয়ে যাকে বলে রুলস অফ দি গেম(স) :
    ১. মনোভঙ্গিমা/মনোপ্রতিন্যাসগত লীলেখেলা: আপনার মতামত আমার পছন্দ নয়, কিন্তু তা বলে আপনাকে "বর্জন" নয়, আপনাকে "ত্যাগ" দেওয়া নয়, আপনার মতামতকে একটি বৈধ "সম্ভাবনা" ধরে নিয়ে "স্বীকৃতি" (=লেজিটিমেট পসিবিলিটি) দিয়ে শুধু বলবো, "আমি আপনাকে অস্বীকৃতিগ্রহণ (ন+স্বীকৃতি+গ্রহণ) করলাম।" আর যদি মতে মেলে তাহলে অবশ্যই স্বীকৃতিগ্রহণ করবো আর সেটাই কমিটমেন্ট! এটা সহিষ্ণুতার রাজনীতির প্রথম পাঠ ।
    ২. পদ্ধতিগত লীলেখেলা বা তক্কো করার তরিকা :
    (ক) অন্যের মতামত, যাকে বলবো "পূর্বপক্ষ", খন্ডন না করে কেউ স্বপক্ষ বা "উত্তরপক্ষ" বা নিজ-মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন না।
    (খ) নানান বিষয়ে নানানভাবে ঝগড়া হতেই পারে, তবে শ্রেষ্ঠ ঝগড়া হলো গিয়ে "বাদ": শুধুমাত্র তত্ত্বজিজ্ঞাসার জন্য হারাজেতাহীন সংলাপ; মাঝারিমাপের ঝগড়ায় হারাজেতার ব্যাপার থাকে--সে ঝগড়ার নাম "জল্প"; আর ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে, খিস্তিখেউড় করে, পরস্পর মাথাফাটি করে ঝগড়ার নাম "বিতন্ডা"। "জল্প" আর "বিতন্ডা"-কে অস্বীকৃতিগ্রহণ (ন+স্বীকৃতি+গ্রহণ) করলাম।
    এমন প্রতর্কনির্ভর সংলাপী সমাজ বানাতে আমরা রাজি আছি কি? তাহলে এগোবো।
  • dc | 011212.227.672323.77 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০২:০৭84453
  • আচ্ছা আচ্ছা সরি চেয়ে নিলাম। আসলে অনেকদিন পর হাতে একটু সময় পেলাম আর টই খুলেই দেখি ভোদকা। তাই আর কি ঃ)
  • দাড়ি | 7878.247.128912.165 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০২:১১84454
  • খাবলা খাবলা দাদুর দাড়ি না আনলেই হলো
  • dc | 011212.227.672323.77 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০২:১২84456
  • *রাজি
  • dc | 011212.227.672323.77 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০২:১২84455
  • "এমন প্রতর্কনির্ভর সংলাপী সমাজ বানাতে আমরা রাজি আছি কি?"

    আমি সম্পূর্ণ রাকি। ইন ফ্যাক্ট যেকোন মত বিনিময়ে এটাই দেখতে চাই - খোঁচাখুঁচি না করে, ব্যক্তিকে টেনে না এনে শুধু বক্তব্য সমর্থন বা খন্ডন। এই টইতে অনেক পোস্টই বুঝতে পারছি না, কিন্তু কয়েকজনের পোস্ট পড়তে খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে। ss কে অনুরোধ নিজের মতো করে লিখতে থাকুন, সবসময়ে মেড ইজি লিখতেই হবে তাই না, কঠিন জায়গাটা নাহয় দুতিনবার পড়ে দেখবো। আপনাদের লেখা আগ্রহ সহকারে পড়ছি।
  • ss | 7845.15.8912.59 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০২:১৯84457
  • dc মশাই, ধন্যবাদ। এই সুতোর মুশকিল হলো এই যে একই সঙ্গে ভাষাতত্ত্বের হাড়হদ্দ জানতে হবে, আবার ক্রিববাদীদের ট্র্যাশও জানতে হবে। ব্যালান্স করা মুশকিল।
  • modi | 7890012.231.122323.211 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০২:৩২84458
  • প্রতিটি বর্ণের অর্থ আছে শুনতে কেমন আধিদৈবিক শোনায়। অবশ্য, শব্দশক্তিতে আধিদৈবিক ব্যাপারের আরোপ আরো আছে। পানিনির মহেশ্বর সূত্রের অলৌকিক ক্ষমতা আছে এরকম গুজোরব শোনা যায়।
  • dc | 011212.227.672323.77 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০২:৩৮84459
  • এমনিতে যে কোন শ্রেষ্ঠত্বের দাবী শুনলেই ফ্ল্যাট আর্থের কথা মনে পড়ে যায়।
  • ss | 7845.15.23.84 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০৭:২৭84441
  • দ্বিতীয় খেপ: বর্ণভিত্তিক মানে-খণ্ডন এবং logocentric বাচন
    প্রথম পর্ব

    পূর্বপক্ষ (ক্রিববাদী) : আমাদিগের বিশ্লেষণ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক (action based phoneme-centric).সব শব্দের উৎসে ক্রিয়া। বর্ণের পর্য্যায় (sic) সারণীতে প্রতিটি বর্ণের অর্থ নির্দিষ্ট করা আছে।

    উত্তরপক্ষ: আপাতত "বর্ণ" শব্দের সংজ্ঞার্থ বুঝিব। বর্ণ phoneme নহে। পরিভাষা ঠিক করুন মহাই। আমরা জানি বর্ণ -র পরিভাষা grapheme (রং দিয়া লিখা হইতো বলিয়া বর্ণ)-- ধ্বনি (speech sound/phone ) হইতে তাহা ভিন্ন। যে সকল ভাষায় ধ্বনিনির্ভর লিখনপ্রণালী চালু আছে, তাহাদিগের ভিতর সার্বত্ৰিক ভাবে ধ্বনি ও বর্ণের এক-এক সঙ্গতি বা one to one correspondence নাই ( যেমন, বাংলা [æ] সম্মুখ নিম্ন (এই বিবরণ শারীরতত্ত্ব-নির্ভর) স্বরধ্বনির জন্য বর্ণ নাই; বর্ণ আছে ধ্বনি নাই: ঊ, ষ, ণ [কিছু allophonic ক্ষেত্র বাদে] ইত্যাদি)।

    আপুনারা বর্ণ ও ধ্বনি শুধু গুলাইয়া ফেলেন নাই, "ধ্বনি"-র ব্যুৎপত্তিগত মানে বাহির করিয়া ধ্বনিকে ‘meaningful (!?) active sound’ ঠাওরাইয়াছেন। মনুষ্যদেহ নিঃসৃত ধ্বনির (speech sound) চারটে ব্যাপার আছে: ১. তাহার শারীরিক উৎস থাকিবে (physiological অরিজিন); ২. তাহার ভৌততরঙ্গগত বৈশিষ্ট থাকিবে (acoustic quality); ৩. তাহার শ্রুতিগ্রাহ্যতা থাকিবে (অডিবিলিটি)তথা তাহার প্রান্তীয় ও কেন্দ্রীয় স্নায়বিক প্রক্রিয়ায় গ্রহণের সুনির্দিষ্ট তরিকা থাকিবে।

    ফোন আর ফোনিম আবার আলাদা ব্যাপার। ফোনিমের নির্দিষ্ট ভাষা-ঠিকানা থাকে। যেমন, বাংলায় velar nasal ধ্বনি [ŋ] শব্দের প্রথমে বসিবে না, শব্দ-মধ্যে আর শেষে বসিবে: ব্যঙ্গ /bæŋgo/ আর ব্যাঙ /bæŋ/. ফোন বা ধ্বনি ভাষার substance আর phoneme হলো ফর্মাল উপস্থাপন। form আর substance-এর তফাৎ বিস্তারিত বুঝিলে non-arbitrariness লইয়া ইহারা ভাটাইতেন না। বেসিক ভাষাতত্ত্ব জানিলে এমন পরিভাষাও ব্যবহার করিতেন না। আপনাদিগের তাই গোড়ায় বা বিসমিল্লায় গলদ।

    'শতরঞ্জ কে খিলাড়ি' গপ্পোটা পড়েছেন বা ফিলিম দেখেছেন? দুজন দাবাড়ুর দাবার ঘুটিগুলোর কাঁচামাল [সাব্স্টান্স] বারংবার বদলে গেলেও তাঁরা খেলা চালাচ্ছিলেন কিসের জোরে? নিয়ম।আকারতন্ত্র [ফর্মাল সিস্টেম]। এই আকার দেয় কে? চমস্কি বলবেন, মগজ। কাঁচামাল [সাব্স্টান্স] বদলে গেলেও তাই কিস্সু যায় আসে না। ভাষায় কাঁচামালের ভূমিকা নেহাতই তাই যা-ইচ্ছে-তাই।

    আপুনারা কেবল কাঁচামাল [সাব্স্টান্স] লইয়া মত্ত। ভাবিতেছেন না, অশোক শিলালেখ পাঁচ জায়গায় পাঁচ রকম বানামে আর ভাষায় লেখা। সুনীতিবাবু আর ফেলুদা দুজনেই ডাইরি লিখতেন বাংলাভাষায় কিন্তু গ্রীক বর্ণে। বর্ণের যদি থাকিবেই মানে, তা'লে বোধনা হয় কি করিয়া?
    শার্লক হোমস গুপ্তলিপির পাঠোদ্ধার কি করে করলেন? গুপ্তলিপিই বা কি করে তৈরি হলো যদি বর্ণগুলোর থেকে যায় "নির্দিষ্ট" মানে? ("The Adventure of the Dancing Men")। আমি কই, 'আঁকুপাঁকু করছে শরীর" আর বাঁকড়ো এলাকায় কয়, 'আঁটুপাঁটু"-- ক আর ট -এর এই বিকল্পন হইলেও কথাবার্তা তো চলিতেছে। কি করিয়া?

    আদতে আপুনারা সাক্ষর সমাজের লিখিত লিপি-নির্ভর বর্ণের মানে বাহির করিয়া লম্ফঝাম্প করিতেছেন। প্রিন্ট ক্যাপিটালিজম এক ভাষার সন্নীতকরণ তথা কেন্দ্রীকরণের সুবিধার্থে যে বানামবিধি লাগু করিয়াছে তাহাকে সংস্কৃতায়িত করিয়া আপুনারা এক কিম্ভুত কুলুজির খোয়াব (genealogical fantasy) রচ্ছেন। জাতীয়বাদের দস্তুরই তাই, "স্বর্ণ" (?) অতীতকে গৌরবান্বিত করা।

    রবিবাবুকে ফের উদ্ধার করিয়া ব্যাপারটা আরেকটু বুঝি। যাহা যাহা কইলুম, তাহার মোটামুটি সামারি মিলিবে:

    "‘সহ্য’ শব্দটাকে বাঙালি তৎসম বলতে কুণ্ঠিত হয় না। বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে, বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই হয়। এমন-কি কোনো নতুন সংস্কৃত শব্দ আমদানি করলে বাংলার নিয়মে তখনি প্রাকৃত রূপ ধরবে। ফলে হয়েছে, আমরা লিখি এক আর পড়ি আর। অর্থাৎ আমরা লিখি সংস্কৃত ভাষায়, ঠিক সেইটেই পড়ি প্রাকৃত বাংলা ভাষায়।" (বাংলাভাষা-পরিচয়)

    কিন্তু আপুনাদিগের বানামবিধি নিদারুন সমোসক্রিতো; আপুনারা বিশুদ্ধতাবাদী; আপুনারা লেখা আর বলে তফাৎ করেন না; আপুনারা সংলাপের স্বতঃস্ফূর্ততাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাইয়া প্রেসক্রিপশন দেন; আপুনারা সিভিল সোসাইটির ভাষা-পুলিশ, ভাষা-জাজ, ভাষা-ম্যানেজার। এখানেই আপুনাতে-আমাতে তফাৎ।

    পূর্বপক্ষ (ক্রিববাদী): ভায়োলেন্স, একাডেমিক ভায়োলেন্স। আপনার কথায় logocentric বাচনভঙ্গি। এক অটোডিডাক্টকে শেষ করার জন্য টাকা খেয়ে আপনার মতো একাডেমিক মাফিয়া রাস্তায় নেবেছেন। আপনি গুন্ডা। "টমি ছু" বলে আপনার পেছনে কুকুর লেলাবো।

    উত্তরপক্ষ: এই বাচনভংগিমার জন্যই আপুনাদের ধর্মীয় কোনো গুরু-"ভাজা" সম্প্রদায় বলে মনে হয়। Logocentric বাচন আর ক্রিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণ নিয়ে এই খেপেরই দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করবো।

    ^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^

    ভাষার বিশুদ্ধতার প্রকল্পও এক ধরণের নেশন স্টেটিস্ট (রবিবাবু সংগত কারণেই 'নেশন' শব্দের তর্জমা করেন নি) প্রকল্প-- এমন কতাই কয়েছিলেন একবার গায়ত্রী চক্কোত্তি স্পিভ্যাক (দ্রঃ ব্রেস্ট স্টোরিজ-এর ভূমিকা)।

    ##

    মনে আছে, ৯১ সাল নাগাদ, NLM- এর সৌজন্যে যখন সাক্ষরতা অভিযানের মূল্যায়নে বেরোই, তখন আমরা সবাই ঠিক করেছিলুম যে কেউ যদি 'পনচআএত'-এর মতো বানান লেখেন, তাহলে তাও গেরাহ্যি (accepability)করা হবে, কেননা এমন 'বানাম' তো কম্যুনিকেট ('সম্প্রেষণ' তর্জমা করলে কম্যুনিকেট করতেই পারতুম না) করছে। হেটেরোগ্রাফিকে মর্যাদা দিচ্ছিলুম আর কি!

    ##

    আর যাই হই, আমি তো ভাষা-পুলিশ, ভাষা-জজ বা ভাষা-ম্যানেজারদের মতো সিভিল(-আইজড) সোসাইটির লোক নই কিনা, বরং না-নেশনের বাসিন্দে হবার চেষ্টা করি।

    ##
    আপাতত ফুটুদার দোকানে 'মামলেট' সাঁটিয়ে আসি, জানি ওমলেট পাবোই। (আরবিট্রারিনেস খেয়াল করুন)

    মামলেট খেতে ক্ষেত্রে ফের গাইতে থাকি "পিনাকেতে লাগে ট"! ("টঙ্কার" বলার আর দরকার নেই তো! ট বর্ণের মানে তো "টঙ্কারণ"!!!!!!!!!!!!!!!!!!!)

    ক্রমশ....
  • | 2378.52.7878.103 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০৮:০৫84442
  • স্ট্রিম অফ কনশাসনেস অ্যাপ্রোচ সাথে চেষ্টাকৃত হিউমার, সাথে সাধু ভাষা...বিকট ব্যাপার। কলিম খান ক্র্যাকপট হলেও আরেকটু রিডেবল
  • T | 565612.69.1290012.252 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০৮:৪৯84443
  • হ্যাঁ, সিরিয়াস বক্তব্য এই পরিশ্রমী হিউমারের চোটে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
  • ss | 2345.110.015612.27 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০৯:০০84444
  • ক্ষ্যামা দিন। ক্ষান্ত হলুম।
  • ভাষাতত্ত্ব | 0189.254.455612.105 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০৯:১০84445
  • আমারও মনে হয় জোর করে হিউমার বা সাধুভাষা ব্যবহার না করে একটু উদাহরণ দিয়ে সহজবোধ্যভাবে বোঝানোর ভঙ্গিতে লিখলে বেটার হয়। এখানে কারুরই লিঙ্গুইস্টিক্সএ খুব কিছু জ্ঞান আছে বলে মনে হয় না। তাই লেখার মধ্যে একটু পড়ানোর বা একেবারে লেম্যানকে বোঝানোর ভঙ্গি এলেও সমস্যা হবে না। সার্কাস্টিক অংশগুলোর থেকে সোজাসাপ্টা অংশগুলো বুঝতে সুবিধে হচ্ছে। যেমন ধ্বনি আর বর্ণকে গুলিয়ে ফেলার ব্যাপারটা খানিকটা বুঝলাম বলে মনে হল। এগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয়। কলিম খান অর নো কলিম খান, কিছু জ্ঞানগম্যি বাড়লে মন্দ হয় না।
  • বিদ্যুৎ ব্যানার্জী | 2345.110.894512.220 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০৯:১৩84446
  • বর্ণের যে মানে আছে সেকথা কলিম সাহেব বলেছেন এমনটা নয়!কলিম সাহেবের শিষ্য শুভাশিস(বর্ণ সঙ্গীত নামক বইয়ের রচয়িতা )একটি পোস্টে এটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে এই ভাবনার প্রবক্তা আনন্দমার্গ ও আমরা বাঙালীর প্রতিষ্ঠাতা প্রভাত রঞ্জন সরকার! এরপর এও বলেছে যে যারা বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করে তাদের প্রভাত রঞ্জন সরকার এর বই অবশ্য পাঠ্য!
    তাহলে হিসেবটা কি দাঁড়ালো! হিসেবে দাঁড়ালো এই যে কলিম সাহেব যে কাজটি করেছেন সেটি আনন্দমার্গ এর ভাবধারার একটি কন্টিনিউটি মাত্র! এবার তো আর লুকোচুরি খেলার কোনো জায়গা নেই!আলোচনার ক্ষেত্র এবার তাহলে হোক,আনন্দমার্গী ভাবধারায় কলিম খানের অবদান!কলিম সাহেবের চাতুর্য ঈর্ষণীয়!উনি দুনিয়ার বইয়ের কথা বলেছেন কিন্তু চেপে গেছেন প্রভাত রঞ্জন সরকারের কথা! শুভাশিস সেটি পোস্ট করে দিয়েছিলো!দ্রুত কলিম সাহেবের নির্দেশে পোস্ট ডিলিটও করে দেয়!কিন্তু কিছু বাজে লোক তার স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছে! কি কেলো বলুন তো!
  • pi | 4512.139.122323.129 (*) | ২৩ জুন ২০১৮ ০৯:৪৫84447
  • এটা ভাল বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু শেষেরটাতে বাক্যে বাক্যে শব্দে শব্দে খুবই হোঁচট খেলাম।

    Re: কলিম খান, গরুর রচনা ও তর্কশীল বাঙালি
    Comment from ss on 22 June 2018 13:42:40 IST

    এই ট মানেই টন্কার এমনি কিছু আছে?
  • ss | 7845.15.011212.26 (*) | ২৪ জুন ২০১৮ ০৮:০৭84460
  • ভেবে দেখলুম, ব্লগে আমার দ্বারা ভাষাতত্ত্ব শেখানো সম্ভব নয়। ব্যাপারটা দীর্ঘমেয়াদি আর পাঠকের ধৈর্যও একটা যেমন ব্যাপার তেমনি আমার বাংলা টাইপে অক্ষমতাও দায়ী। টাইপ করতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলি। আপনারা মাফ করবেন নিশ্চয়ই।

    তার থেকে বরং ভাষাতত্ত্বের বুনিয়াদি লেখার এই তালিকা আমার ম্যাস্টরের থেকে নিয়ে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। শ্লো মোশন পাঠে হয়তো আপনারা "আদত" (?!) ভাষাতত্ত্ব-এর খোঁজ পাবেন এবং না-ভাষাতত্ত্বের সঠিক সমালোচনায় নামতে পারবেন। হামাগুড়ি দিতে দিতেই তো আমরা হাঁটতে শিখি!

    ভাষাতত্ত্ব সহজপাঠ আর কড়াপাক
    লিংক:https://t.co/gaZKlYvRBT

    সবচেয়ে বড়ো কথা, এই লেখাগুলোর কয়েকটায় যে গ্রন্থপঞ্জী দেওয়া আছে, তা হয়তো আপনাদের দীর্ঘমেয়াদি পাঠে সাহায্য করবে।
  • h | 2345.110.676712.37 (*) | ২৪ জুন ২০১৮ ১০:২৬84461
  • ss ক্ষ্যামা দেননি ভেবে অসম্ভব খুশি হয়েছিলাম।বিনে পয়সা একটু শেখার মত কিসু পেলে কার না ভালো লাগে। রিডিঙ্গ লিস্ট অসম্ভব কাজের। থ্যান্ক্স। বাই দ্য ওয়ে আমার মনে হয়নি ওনার লেখার স্টাইল বক্তব্যের পাঠযোগ্যতার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করেছে, আমার তো ঐটে তেই সুন্দর লাগছিল বেশি। পৃথিবীর সমস্ত লেখা সরল গোল গাল অথবা ঝর ঝরে হতে হবে এর মানে কি। তাহলে ফেলুদার বেশি সহিত্য পড়া হবে না, আবাপ র ক্রীড়া সাঙ্গবাদিককে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধকার বলতে হয়।
    বিদ্যুত বাবু দেবাশীসবাবু মোদি বাবু সকলে লিখেছেন বলেই খুশি। গুড দিলাম☺☺☺☺☺। আলোচনা আপাতত শেষের দিকে পৌছোলে, মূল প্রবন্ধকার কে একটা রিজয়েন্ডার লেখার অনুরোধ করা যেতে পারে, অবশ্য সোশাল নেটওয়ারেকিঙ্গ সিরিয়াল ঠান্ডামাথার লঙ্গ টারম এনগেজমেন্ট সম্ভব নাও হতে পারে। থ্যাকন্স টু অল।
  • h | 2345.110.676712.37 (*) | ২৪ জুন ২০১৮ ১০:২৮84462
  • *সিরিয়াস
  • ss | 7845.15.0112.149 (*) | ২৫ জুন ২০১৮ ০৫:৫০84463
  • অনেক ধন্যবাদ h, পেন্নাম নেবেন।

    অনেকগুলো কথা বলা হল না।.

    বিশেষত যেসব ভাষাতাত্বিক পরিভাষা তাঁরা (ক্রিববাদীরা) ব্যবহার করেন, সেগুলো গোলমেলে।
    অর্থাৎ, বুনিয়াদি ধারণায় গন্ডগোল।

    তাঁরা "ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক (action based phoneme-centric)" বিশ্লেষণ করেন।
    ব্র্যাকেটে ইংরেজি শব্দগুলো লক্ষ্য/লক্ষ (স্বেচ্ছাকৃত বানাম heterography জিও)করুন। ভুলভাল।

    যেমন, grapheme (বর্ণ )-কে phoneme ঠাওরান।
    phone, phoneme, grapheme গুলিয়ে ফেলেন।
    এগুলোর তফাৎ না বুঝে কেবল বর্ণ-বিশ্লেষণ করেন।
    মনে রাখেন না, #কথা-বলা আগে, লিপি পরে#।

    কখনো বলেন,
    নাম আর নামীর সম্পর্ক যাচ্ছেতাই নয়।
    আবার কখনো বলেন,
    শব্দ আর শব্দার্থের সম্পর্ক যাচ্ছেতাই নয়।
    -- এই দুটি বচন সম্পূর্ণ আলাদা।
    প্রথম বচন যদি signified আর signifier-কে বোঝায়,
    তাহলে
    দ্বিতীয় বচন মানেতত্ত্বের (semantics, অরিন্দম চক্রবর্তীর তৈরি বাংলা পরিভাষা) সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

    আমরা যারা নাম আর নামীর সম্পর্ক যাচ্ছেতাই বলে মনে করি, তাঁদের এনারা বলেন, লোগোসেন্ট্রিক চিন্তক।
    logocentrism কী?

    খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে,
    signified/object আর signifier-এর শেকলে যাঁরা অতিক্রান্ত বস্তুকে (transcendental object) কল্পনা করেন, তাঁরাই লোগোসেন্ট্রিক চিন্তক। (Plato's Cave বুঝতে হবে)।

    signified/object নরকেন্দ্রিক (anthropocentric) সীমার দরুন যেহেতু অজ্ঞাত আর অজ্ঞেয়,
    সেহেতু, আসলি (আধিবিদ্যক) বস্তু অন্যত্র আছে--তার ছায়া দেখে নামকরণ করা হয়।
    বস্তুর মধ্যে আসলি মালের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি নিয়েই লোগোসেন্ট্রিক চিন্তাভাবনা।

    মুশকিল হলো, এমন আধিবিদ্যক লোগোসেন্ট্রিক ভাবনায় নিমজ্জিত না হয়েও আপেক্ষিক অবাধ চিহ্ন নিয়ে কথা কওয়া যায়। যেমন, আমরা, না-ধার্মিকরা, বলি।

    বরং, বর্ণে অর্থের উপস্থিতি নিয়ে যাঁরা ভাবেন, যেমন ক্রিববাদীরা, তাঁরাই দৈবে বিশ্বাসী।

    #

    এবার "ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক (action based phoneme-centric)" সম্পর্কে কয়েকটা কথা:

    ওনাদের ব্যবহৃত "ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ( action based phoneme-centric)" পদবন্ধে, ওনাদের তর্জমায়

    ক্রিয়া=action (verb নয়)

    ক্রিয়া তো নানান ধরণের হয়;
    state: পাহাড়টা দাঁড়াইয়া আছে;
    process: সে অনেকক্ষন ধরিয়া মাটি কুপাইতেছে;
    event: এল্লাথি মারিলো ইত্যাদি ইত্যাদি...
    সবসময় ক্রিয়া যে action হইবে তা' নয়।

    আবার, সবকিছুকে ক্রিয়ার খোপে ফেলে দিয়ে বস্তুর যে বর্গমালা ("অর্ডার অব থিংস" আ লা ফুকো) রচা হয় তা' প্রাক-নির্ধারিত এক নির্মাণ মাত্র।
    এই ধরণের determinism মানেতত্ত্বের অন্যান্য ধারাকে কাঁচকলা দেখায়।

    মানেতত্ত্বের অন্যান্য ধারা নিয়ে নোটস:

    "ওলে বাবা, হালুম বাঘ, কাম্মে দেবে।"
    চিড়িয়াখানায় বাঘ দেখিয়ে মা ঠিক এমন ভাবেই বাঘ চেনালেন তিন বছরের হিজি বিজ্‌ বিজ্‌-কে।যদিও হিজি বিজ্‌ বিজ্‌ ছবির বইতে আগেই বাঘ দেখে নিয়েছে আর মায়ের ওই কথাটা তার কণ্ঠস্থ, তবুও জ্যান্ত বাঘ দেখে সে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠেই আবার ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে বললো, "দোলাকাতা বাগ, কাম্মে দেবে, বাবা।"
    পাশের আরেক বাচ্চা, বয়েস বছর পাঁচেক, সে হঠাৎ করে খাঁচার সামনে এসে "তাইগাল, তাইগাল" করে চেঁচাতে লাগলো।

    -----------------------------------------------------

    ১. বাচ্চাদের সঙ্গে বড়োরা বাচ্চাদের মতো করেই যদি আধো আধো কথা কন, তাহলে তাকে বলে শিশুভাষ বা baby talk.

    ২. দ্যোতিত/চিহ্নিত বস্তু (signified, object) বা তার ছবির বইতে উপস্থাপনকে আঙুল দিয়ে (সব সংস্কৃতিতে আবার আঙুল [বিশেষত তর্জনী] দিয়ে বস্তুনির্দেশের প্রথা নেই) এইভাবে নির্দেশ করার নাম হলো অস্টেনসিভ ডেফিনেশন: নির্দেশক সংজ্ঞার্থ।

    ৩. অস্টেনসিভ ডেফিনেশন যে সবসময় কাজ করে তা নয়, বিমূর্ত ধারণার ক্ষেত্রে নানান ভাবেই চিহ্ন চেনানো হয়; কিন্তু, যেটা লক্ষণীয় বিষয়

    ৪. একই দ্যোতিতের জন্য একাধিক চিহ্ন বা দ্যোতক ব্যবহার; নাম আর নামী, দ্যোতক আর দ্যোতিত, চিহ্ন আর চিহ্নিত বস্তু "প্রাকৃতিক" ভাবে গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকে না। এ বলে বাগ বা বাঘ তো ও বলে তাইগাল। ঠাকুর বলেন যে জল, পানি, ওয়াটার, একোয়া ইত্যাদি যাই বলো না কেন জল হলো গিয়ে জল! প্রসঙ্গত, পিটার বিকসেলের একটা গপ্পের কথা মনে পড়ছে, "টেবিল হলো টেবিল". সেখানে কথা কওয়ার সামাজিক প্রথা তথা চুক্তি ভেঙে এক বুড়ো বানিয়ে তোলে তার প্রাইভেট ভাষা: টেবিলের নাম দিলো গালচে, গালচের নাম দিলো দেরাজ...
    .
    ৬. বাচ্চাটা বাঘকে চিনছে (মানে বুঝছে) কতকগুলো স্বলক্ষন দিয়ে, "বাঘ" শব্দটার ব্যুৎপত্তি বের করে নয়! স্বলক্ষনগুলো এরকম:

    দোলাকাতা X হালুম ডাক X কাম্মে দেয় ইত্যাদি। এইভাবে কম্পোনেন্টস ধরে ধরে সাংস্কৃতিকভাবে মানে বোঝার এই প্রক্রিয়াকে বলে "Componential Analysis"।

    ৭. Cognitive Psychology-র একটি ঘরানা মনে করে যে এরকম খন্ড-খন্ড স্বলক্ষন দিয়ে নয়, বস্তুকে চিনি সমগ্র (gestalt) প্রত্যক্ষে. সাংস্কৃতিকভাবে কতকগুলি "ধারণা" খেলা করে বেড়ায়। ধরুন, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করলুম -- "একটা পাখির নাম বলুন তো!" আপনি বললেন, "কাক"। সাহেব বললেন, "রোবিন"। এই "কাক" বা "রোবিন" স্টিরিওটাইপগুলোকে কেন্দ্র করে মনের মধ্যে নানান পাখির একটা সেট তৈরী হয়। সেই সেটে চড়াই, টুনটুনি, বুলবুলি, টিয়া ইত্যাদি থাকতে পারে।

    সেই সেটের ভেতরে-বাইরে ঘোরাফেরা করবে পেংগুইন, উটপাখি, আরশোলা বা পিঁপড়ে। এই মানসিক সেট এক-এক সংস্কৃতিতে একেকরকম। মানেতত্বের ক্ষেত্রে একে বলা হয় "theory of stereotypes"। Psychoanalysis-এর অস্থবির archetype-এর সঙ্গে এটাকে মিলিয়ে পড়তে পারেন।

    ক্রিববাদী না হয়েও দেখুন কেমন মানে বের করা যায়! হায়!

    পুষ্পিকা: দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
    প্রায় পুরোটাই তাঁর এফবি পোস্ট থেকে টুকে মেরে দেওয়া!
  • সৈকত | 340112.99.675612.98 (*) | ২৫ জুন ২০১৮ ০৬:০০84464
  • ছোট করে একটাই কথা দেবপ্রসাদবাবুকে বলার, লেখাটা চালিয়ে যান। আপনার লেখা আমি আগে কোথাও পড়েছি, কোন পত্রিকায় (বিষয়মুখ ?)। অ্যাকাডেমিক বিষয় নিয়ে (ভাষাতত্ত্ব তো অ্যাকাডেমিকই)
    নন-অ্যাকাডেমিক ভাবে লেখা, সেরকম লেখা ছোট পত্রিকায় বা গুরুতে হবে না তো আর কোথায় হবে !!
  • ss | 7845.15.78900.94 (*) | ২৫ জুন ২০১৮ ০৬:০৩84465
  • [আগের পোস্টে ৬, ৭ আদতে ৫,৬--এডিটের সময় গন্ডগোল হয়ে গেছে]

    পাঙ্গা!
    ক্রিববাদীদের চ্যানেঞ্জ-১:

    নিচের ঘটনাটার ক্রিবভিত্তিক বিশ্লেষণ করুন দেকি:

    'গোটা পাঁচেক কলা' আনতে বললে কটা কলা আনবেন?
    'জনা পাঁচেক লোক' বলতে আপনি কতজন লোক বোঝেন?
    'লাখ পাঁচেক টাকা' আপনার কাছে চাইলে আপনি কতো দেবেন আর আম্বানি কতো দেবেন?
    'খান দশেক সন্দেশ' বলতে কটা সন্দেশ আপনি বোঝেন আর আপনার পেটুক বন্ধু কটা বোঝেন?
    'সাত-পাঁচ' ভেবে, 'যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন'না করে এই প্রত্যেক ক্ষেত্রে

    এক-এর ভ্যালু বলতে পারবেন?

    উত্তর দিতে গিয়ে 'নয়-ছয়' করে ফেলবেন না!

    সূত্র: ফাজি লজিক আর মানেতত্ত্ব
  • ss | 7845.15.90056.105 (*) | ২৫ জুন ২০১৮ ০৬:২৩84466
  • শ্রদ্ধেয় সৈকতবাবু,

    ১. এটা দেবপ্রসাদবাবুর লেখা নয়, বরং তাঁর বিভিন্ন লেখা থেকে টুকে মারা। আমি তাঁর অক্ষম ছাত্তর মাত্তর।
    ২. দেবপ্রসাদবাবুর লেখা প্রায় সব অ/প্রতিষ্ঠিত লিটল ম্যাগে বেরিয়েছে। বইপত্তরও আছে। আন্তর্জালেও আছে ( https://spbu.academia.edu/DEBAPRASADBANDYOPADHYAY)
    বিষয়মুখে তাঁর কোনো লেখা বেরোয় নি, বরং গুরুতে বেরিয়েছে। একটু সোহলেখকদের খোঁজপত্তর রাখলে ভালো লাগে।
  • ss | 7845.15.90056.105 (*) | ২৫ জুন ২০১৮ ০৬:২৪84467
  • *সহলেখকদের
  • ss | 7845.15.562312.136 (*) | ২৫ জুন ২০১৮ ০৭:২৬84468
  • পাঙ্গা!
    ক্রিববাদীদের চ্যানেঞ্জ-২:

    নিচের ঘটনাটার ক্রিবভিত্তিক বিশ্লেষণ করুন দেকি (ফাঁক বা নীরবতার মানে):

    "করছোটা কি?" শৃংগারকালে, প্রাক্ক -সঙ্গমক্রিয়ার সময়ে, এমন জিজ্ঞাসায় থমকে গিয়ে ভাবতে বসি:

    'করছো'-ক্রিয়াবিভক্তি-অন্তে তো -'টা' নিয়মমাফিক বসতে পারে না। '-টা'-এর মতো পরাধীন/বদ্ধ রূপমুলের (bound morpheme) আগে তো একটা কিছু বসবে, সেটা কোথায় গেল? ওখানে ফাঁক আছে, যদিচ লিখনে তা ধরা পড়ে না। কিভাবে তাকে, ওই হারিয়ে যাওয়া নিধিকে (বর্গ না পদ?) পুনরুদ্ধার করবো?

    শৃংগার চুলোয় যায়। চমস্কির Empty Category Principle, deletion, trace ইত্যাদি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু, এগুলো এখন বাতিল বোধহয়। জানিনা। চমস্কির এই underworld/-ground (samizdat) linguistics-এর আপডেটস নানান ঝামেলায় রাখতে পারিনা, অধুনালুপ্ত তৃতীয় বিশ্বের ঝাড় খাওয়া আঁতেল তো!

    ন্যায়-বৈশেষিকে খুঁজে পাই 'অভাব' বলে একটা পদার্থ। ডুবে যাই নব্যন্যায়ে। চমস্কির logical form দিয়ে নয়, নৈয়ায়িক স্থৈর্যএ খুঁজে পাই ওই ফাঁকের মানে।

    কিন্তু, একি! আমার বিছানা ফাঁকা।

    ফাঁকের মানে খুঁজতে গিয়ে কখন যে সংগী, "fuck you" বলে বিছানা ফাঁকা করে চলে গেছে, তা আমি নিজেও জানি না!

    নীরবতাকে কিভাবে বিশ্লেষণ করেন ক্রিববাদীরা?

    সূত্র: Empty Category Principle (ECP), অভাব, trace, deletion, recoverability principle, Silenceme বুনিয়াদি ধারণাগুলো ফের ঝালিয়ে নিন: https://debaprasad.wordpress.com/2018/06/24/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AC-%E0%A6%B8%E0%A6%B9%E0%A6%9C%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A0-%E0%A6%86%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%9C%E0%A6%BE/
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন