এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • কালী : একটি অনার্য অডিসি

    শিবাংশু লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ নভেম্বর ২০১৩ | ৩৭৪৬ বার পঠিত
  • কালী : একটি অনার্য অডিসি
    -------------------------------

    তব রূপং মহাকালো জগৎসংসারকারকঃ। মহাসংহারসময়ে কালঃ সর্ব্বং গ্রসিষ্যতি।।
    কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকাল প্রকীর্তিতঃ। মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পয়া।।
    কালসংগ্রসনাৎ কালী সর্ব্বেবামাদিরূপিণী। কালত্বাদাদিভূত ত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়তে।।

    --- জগৎসংহারকারক মহাকাল তোমার একটি রূপমাত্র, এই মহাকাল মহাপ্রলয়ে সমুদয়পদার্থকে গ্রাস করিবেন। সর্ব্বভূতকে গ্রাস করেন বলিয়া তাঁহার নাম মহাকাল, তুমি মহাকালকে গ্রাস করো বলিয়া তোমার নাম কালী, সকলের আদিকালত্ব, আদিভূতত্ব নিবন্ধন লোকে তোমাকে আদ্যাকালী বলিয়া থাকে। (মহানির্বাণতন্ত্র-চতুর্থ উল্লাস এবং কালীতন্ত্র)

    ১.

    হরপ্পা সভ্যতার উৎখননে প্রচুর পোড়ামাটির নারীমূর্তি পাওয়া গিয়েছিলো। এই মূর্তিগুলি সচরাচর বিবসনা, কারুকেশসজ্জা বিশিষ্টা। কিন্তু মূর্তি গুলির শিল্পমান অপেক্ষাকৃত নিরেস। এ জন্য একটি অনুমান আছে এই মূর্তিগুলি অভিজাতবর্গের সংগ্রহযোগ্য, কুশল মৃৎশিল্পীদের সৃষ্ট নয়। এসব ইতরবর্গের ব্যবহৃত বিগ্রহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই নিদর্শনগুলির মধ্যে একটি নারীমূর্তি পাওয়া গেছে, যার জঠর থেকে একটি উদ্গত উদ্ভিদের নিশানা স্পষ্ট দেখা যায়। এই মূর্তিটিকে পৃথিবীদেবীর প্রতীক হিসেবে চিণ্হিত করা হয়েছিলো। হরপ্পা সভ্যতার জনতা মধ্যপ্রাচ্যের অনুসরণে পৃথিবীকে প্রজননসমর্থা জননীদেবী রূপে কল্পনা করতো। এই দেবীর পূজার্চনাও করা হতো মিশরিয় নীলনদের দেবী আইসিসের মতো করে। হরাপ্পায়মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিলো কি না জানা নেই। বৈদিক সাহিত্যে পৃথিবী দেবীর কিছু উল্লেখ পাওয়া গেলেও তাঁরা গৌণ অস্তিত্ব। ব্রাহ্মণ্যধর্মে মাতৃদেবী, যেমন দুর্গার, প্রভাব এসেছে বহু পরে, ষষ্ঠ শতক পেরিয়ে এসে। অম্বা, কালী বা চন্ডীর উপাসনা শুরু হয়েছিলো পুরাণযুগে এবং তন্ত্রসাধনার সূত্রে। পরবর্তীকালে দেখা যায় বিভিন্ন কৌম সমাজের নিজস্ব অধ্যাত্মিক প্রয়োজনে অগণন মাতৃদেবী নানারূপে আবির্ভূত হয়েছেন।

    ২.

    হরপ্পার বিভিন্ন উপজাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব উপাস্যা দেবীর মূর্তি দেখে তাদের বিভিন্নতা অনুমান করা যায়। কল্লি উপজাতির দেবী ( ২৫০০-২০০০ খ্রি পূ), ঝব উপজাতির দেবী( ২৫০০-২০০০ খ্রি পূ) বা সামগ্রিকভাবে হরপ্পা সংস্কৃতির দেবী (২০০০ খ্রি পূ), এঁদের মূর্তি প্রজননতন্ত্রী মাতৃদেবীর লক্ষণাক্রান্ত। লক্ষ্যনীয়, এই সব প্রাকৃতিক প্রজননশীলতার প্রতীক দেবীমূর্তি শুধু অনার্য জনগোষ্ঠীর উপনিবেশ থেকেই পাওয়া গেছে। অবশ্য ঝব সংস্কৃতিতে লিঙ্গপ্রতীকের উপস্থিতিও রয়েছে। এই সব দেবীমূর্তির সঙ্গে পৌরুষের প্রতীক হিসেবে শুধু বৃষভ অবয়বের সংযোজন করা হয়েছিলো, নতুবা এঁদের কোন পুরুষ দেবতার সঙ্গিনী হিসেবে কল্পনা করা হয়নি। অস্তিত্বের বিচারে তাঁরা সম্পূর্ণা ও স্বাধীনা। আর্য প্যান্থিয়নে কিন্তু এমনটি ভাবা যায়না।

    অনার্যদের মধ্যে অনেকক্ষেত্রে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থাকলেও সেটাই যে মাতৃপূজা বা শক্তিপূজার প্রধান কারণ তা নয়। অনেক পিতৃতান্ত্রিক সমাজেও শক্তিপূজার প্রচলন দেখা যায়। যেমন আমাদের দেশের মহিষমর্দিনী দেবীর পূজা প্রচলিত হবার বহু আগে ভূমধ্যসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপে, বিশেষতঃ ক্রিট দ্বীপে এক সিংহবাহিনী পর্বতবাসী (পার্বতী) দেবীর পূজা প্রচলিত ছিলো। হরপ্পাযুগ থেকে গুপ্তযুগ পর্যন্ত ভারতীয় কুলীন সমাজে মাতৃদেবীরা পাত্তা পান'নি। সরস্বতী ব্যতিরেকে ( অবশ্যই অন্য কারণে) সমস্ত দেবীমূর্তিই অনেক পরের সংযোজন আর সবাই এসেছেন বিভিন্ন পুরুষ দেবতার সঙ্গিনী হিসেবে। উল্লেখযোগ্য, আর্যচিন্তায় যেসব দেবী কল্পনায় মাতৃভাবের অনুষঙ্গ রয়েছে, অর্থাৎ প্রকৃতির প্রজয়িতাসত্ত্বা যে সব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছে, সেই সব দেবীই মূলতঃ অনার্য কল্পনার ফসল। নারীর প্রজননক্ষমতাকেই 'শক্তি' আখ্যা দিয়ে দেবীরূপে কল্পনা করা হতো। কিন্তু আর্য দেবতাদের সঙ্গিনী দেবীরা নিজপরিচয়ে স্বনির্ভর ছিলেন না। তাঁরা সবাই সঙ্গী পুরুষ দেবতার শক্তিরূপিণী হয়ে পূজিতা হতেন। মূলতঃ অনার্য দেবতা, পরে আর্যস্বীকৃত, শিবের সঙ্গিনী হিসেবে যে সব দেবী কল্পিত হয়েছিলেন তাঁরা পার্বতী, মহাদেবী, সতী, গৌরী, অন্নপূর্ণা, দুর্গা, কালী এবং চন্ডী। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থায় স্বাধীনা অনার্য দেবীদের ক্ষমতা খর্ব করে তাঁদের শুধু পুরুষ দেবতাদের শক্তির আধার হিসেবে গণ্য করা শুরু হলো। অবশ্য শুধু ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থাতে কেন, মন্ত্রযান, বজ্রযান, কালযান, সহজযান এ সব বৌদ্ধ ব্যবস্থাতেও দেবীরা সমান্তরালভাবে পুরুষদেবতার 'সঙ্গিনী' হিসেবেই পর্যবসিত হয়ে ছিলেন।

    ঘটনাক্রমের এমত বিকাশে শেষ পর্যন্ত সমস্ত শাক্ত শাস্ত্রেই দেখি শক্তির কোনও একক গরিমা নেই। তিনি 'শিব'রহিত হতে পারেন না, তাঁর যাবতীয় মহিমা শিবসহিত। আবার শুধু শিব নয় বহু স্থানে দেখা যাচ্ছে তিনি বিষ্ণুরও সঙ্গিনী। অর্থাৎ কোনও পুরুষমাত্রা ছাড়া শক্তি পূর্ণ মর্যাদা লাভ করতে পারছেন না। আসলে প্রকৃতিবাদী প্রাক ও মূল বৈদিক ধর্মে যাবতীয় ঐশীশক্তি (অর্থাৎ ভৌত প্রাকৃতিক শক্তিগুলি, যেমন অগ্নি, মরুৎ, বরুণ প্রভৃতি) পুরুষ দেবতা হিসেবেই কল্পিত হয়েছিলো। কিন্তু অনার্য সংস্কৃতিতে শক্তিকে 'ভগবতী' অর্থাৎ 'ভগবানে' র নারী সংস্করণ রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে আর্যরা যখন উপলব্ধি করেছিলো এদেশে 'অনার্য'দের, অর্থাৎ মূল কৌম অধিবাসীদের অধ্যাত্ম ঐতিহ্য তাদের থেকে কোনও অংশে ন্যূন তো নয়ই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার প্রভূত ব্যপ্তি রয়েছে, তখন চতুর আর্যব্যব্স্থা সঙ্গতভাবেই 'অবহেলিত' ও 'উপেক্ষিত' অনার্যমননের সঙ্গে অধ্যাত্মস্তরে সমন্বয়ের প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগী হয়। আর্য দেবতার প্যান্থিয়নে রুদ্রের পরিবর্তে শিবের অভিষেক এবং তাঁর অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে বিভিন্ন প্রচলিত ও নতুন শক্তি দেবীরা আর্য মূলস্রোতের মধ্যে এভাবেই আত্তীকৃত হয়েছিলেন। এই সময় ভারতভূখন্ডে যে যে সামাজিক তোলপাড় ঘটেছিলো, সেখানে কৌম জনতার ভিতরে বৈদিক ভাবধারা এবং ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্যের দুর্গে মাতৃতান্ত্রিক অনার্য উপাসনা পদ্ধতি, মসৃণভাবে প্রবিষ্ট হয়ে যায়। এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী স্রোতের সঙ্গম থেকে উঠে এসেছিলো একটি অধ্যাত্মব্যবস্থা, যাকে সামগ্রিকভাবে সংক্ষেপে তন্ত্রসাধনা বলা হয়।

    ৩.

    আদি তন্ত্রসাধনার বিকাশ হয়েছিলো এক ভিন্ন ধরনের উপাসনাপদ্ধতির মাধ্যমে। যেহেতু তান্ত্রিক উপাসনাপদ্ধতি প্রাথমিকভাবে একটি লোকাচারনির্ভর ক্রিয়া এবং লোকাচারের রূপ, সময় ও গণরুচির বিবর্তনের সঙ্গে ক্রমশঃ পাল্টে যায়, তাই এই পদ্ধতি কোনও অচলায়তন নয়। অধিকন্তু তন্ত্র শুধুমাত্র উপাসনাপদ্ধতি নয়, এটি একটি সাধন প্রক্রিয়া। জন্মসূত্রে অহিন্দু তন্ত্রসাধকও দেখা গেছে। বাউলসাধনা ও তন্ত্রসাধনা প্রায় সমান্তরাল দুটি ধারা। দুটি পথই মূলত কৌম সমাজের অবলম্বন। ব্রাহ্মণ্য অনুপ্রবেশ ঘটলেও এই ধারণাগুলি মূলতঃ হৃদয়সঞ্জাত, গোষ্ঠীগত ধর্মচেতনার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।

    এর উদাহরণ হিসেবে আমাদের পরিচিত পরিধির দু'জন মনস্বী মানুষ, যাঁরা তন্ত্রসাধনা ব্যতিরেকে অন্য পরিচয়ে আমাদের প্রিয়ত্ব ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। যেমন রামপ্রসাদ সেনের তন্ত্রসাধনা। রামপ্রসাদ পুরো দস্তুর বীরাচারী বা কুলাচারী তন্ত্রসাধক ছিলেন। এই মার্গে পঞ্চ-ম-কারের স্বীকৃতি রয়েছে। রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দর কাব্যে সুন্দরের সস্ত্রীক শ্মশানে বসে শবসাধনা, শবের উপর মহাশঙ্খ মালাজপ, ভগবতীর আবির্ভাব ইত্যাদি কৌলাচারের বিবরণ আছে। এইসব কার্যকলাপ ছিলো গুহ্যসাধনা, জনসমক্ষে অপ্রকাশ। কুলক্রিয়া সমাপনান্তে তিনি যখন ভাবোন্মাদ হয়ে বাইরে আসতেন তখন কুমারহট্ট পন্ডিতসমাজের শিরোমণি বলরাম তর্কভূষন তাঁকে 'মাতাল' বলে নিন্দা করতেন। এই প্রসঙ্গে রামপ্রসাদের জবাবটি তো সকলেরই জানা আছে,
    ' মন ভুলোনা কথার ছলে
    লোকে বলে বলুক মাতাল বলে
    সুরাপান করিনা আমি
    সুধা খাই জয় কালী বলে
    আমায় মন-মাতালে মাতাল করে
    আর মদ-মাতালে মাতাল বলে...'

    প্রথাগত তন্ত্রসাধনার ঊর্ধে রামপ্রসাদ ছিলেন একসঙ্গে এক কালজয়ী কবি ও সঙ্গীতকার। সাধারণ ও 'অসাধারণ' ( যার মধ্যে তৎকালীন বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলাও ছিলেন) গুণগ্রাহীদের কাছে তাঁর সেই রূপটি অধিক প্রোজ্জ্বল, তাই রামপ্রসাদের গুহ্যতন্ত্র সাধনার সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়টি জনমানসে গুরুত্ব পায়নি। তিনি প্রথমে কবি, পরে তন্ত্রসাধক।

    স্বামী সারদানন্দ বলছেন রামকৃষ্ণ পরমহংস ১২৬২ থেকে ১২৭২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত নানা মতে অধ্যাত্মসাধনা করেন। এর মধ্যে ১২৬৬ থেকে ১২৬৯ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত চার বছর কাল ভৈরবী ব্রাহ্মণীর উপদেশে ও নির্দেশে তন্ত্র-সাধনা করেন। দক্ষিণেশ্বরে আসার আগে কামারপুকুরের শ্মশানে তিনি প্রেতসিদ্ধি জাতীয় অলৌকিক পদ্ধতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তবে আমরা স্বামী বিবেকানন্দের মাধ্যমে যে সাধকের কথা জানতে পারি, তিনি ছিলেন এ দেশের চিরকালীন ধর্মীয় সমন্বয়বাদের প্রধান প্রবক্তা ও চালিকা শক্তি। তন্ত্রসাধক হিসেবে তাঁর পরিচয়, রামপ্রসাদের মতো-ই এই গরীয়ান ভাবমূর্তির সামনে ম্লান হয়ে গেছে।

    আবার তন্ত্রসাধকদের সঙ্গে অনেক সময় কাপালিকদের এক করে দেখা হয়। কিছু স্থূল সাদৃশ্য থাকলেও এই দু'টি ভিন্ন সাধনধারা। কাপালিকরা নামে এক ধরনের শৈব যোগী গোষ্ঠী রয়েছেন, যাঁরা নরকপালে পানভোজন করে থাকেন। এঁদের সাধনা মূলতঃ কিছু অতিজাগতিক অতীন্দ্রিয় শক্তি অধিগত করা। চামুন্ডাপূজক বামাচারীদের মধ্যেও কাপালিক দেখা যায়। লোককথা অনুযায়ী শিবের অংশে জাত উপদেবতা কালভৈরব প্রথম কাপালিক, যিনি শিবের নির্দেশে প্রজাপতি ব্রহ্মার পঞ্চম মুন্ডটি কর্তন করে সেই করোটিতে রক্তপান করেন। এই যোগীরা বস্তুত অঘোরপন্থী এবং এরা সর্বদা নরকরোটি ও নর-অস্থি দন্ড-কমন্ডলু হিসেবে ব্যবহার করে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এরা নিয়মিত নরবলিও দিতো।

    তন্ত্রসাধকের কাছে তন্ত্র একটি সাধনা আর তান্ত্রিকের কাছে তা পেশাগত চর্চামাত্র। অনেকক্ষেত্রেই তা নগদবিদায়ের অবলম্বন।

    ৪.

    দেবী কালী অন্য সব দেবতাদের থেকে যে লক্ষণে প্রকটভাবে পৃথক হয়ে যান, তা হলো তাঁর সামগ্রিক রূপকল্পনা।
    সব সভ্যতাতেই মানুষ দেববিগ্রহের রূপরেখা নিজের আদলেই নির্মাণ করে। বিভিন্ন অনার্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানা বিষয়ে বহু পার্থক্য থাকলেও ত্বকের বর্ণ অনুযায়ী তাঁরা সবাই ছিলেন মেঘবর্ণ। তাই তাঁদের কল্পিত দেবদেবীরাও তাঁদের নিজেদের মতো শ্যামলবর্ণ হবেন, এটাই স্বাভাবিক। অসংখ্য অকুলীন বা অমুখ্য ইতরযানী দেবদেবীদের কথা যদি ছেড়েও দিই, নীলাচলের নিষাদজাতির আরাধ্য দেবতা জগন্নাথ এবং মূলতঃ বাংলা ও অসমের কৌমজনতার আরাধ্যা দেবী কালী তাঁর নানা অবতারে বিবিধ রূপে থাকলেও বর্ণবিচারে ঘোর কৃষ্ণই থেকে গিয়েছেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে বেদের রাত্রিসূক্তকে কেন্দ্র করে যে রাত্রিদেবীর কল্পনা পরবর্তীকালে দেখা যায় তিনিই এই কালিকারূপিণী দেবীর পূর্বসূরি। শতপথ ব্রাহ্মণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কৃষ্ণা ভয়ঙ্করী যে নৈঋতি দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় পরবর্তীকালের কালী দেবীর সঙ্গে তার বিশেষ মিল রয়েছে। শতপথ ও ঐতরেয়তে এই দেবীকে কৃষ্ণা, ঘোরা ও পাশহস্তা বলা হয়েছে। ত্রয়োদশ শতকের প্রথমভাগে সংস্কৃত গ্রন্থ 'সদুক্তিকর্ণামৃত'তে ভাসোক নামে এক কবি কালীর বর্ণনায় লিখেছেন,

    'ক্ষুৎক্ষামহকান্ডচন্ডী চিরমবতুতরাং ভৈরবী কালরাত্রি।।'

    সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে ( এই সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে) বাঙালি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ 'তন্ত্রসার' গ্রন্থে কালীধারণার যে রূপ ও প্রকৃতিকে লিপিবদ্ধ করেন সেটাই বাংলাদেশে কালীদেবীর স্বীকৃত মডেল। এই দেবীই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের তন্ত্রসাধনা ও মাতৃপূজার আরাধ্যা হয়ে যান। তন্ত্রসারের বর্ণনা অনুযায়ী এই দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুন্ডমালাবিভূষিতা। অধো বাম-হস্তে সদ্যচ্ছিন্ন শির ও ঊর্দ্ধহস্তে খড়্গ।অধো দক্ষিণহস্তে অভয় ও ঊর্দ্ধহস্তে বর। দেবী মহামেঘের মতো শ্যামবর্ণা। তাই বাংলাদেশে এই দেবীর নাম 'কালী' নয়, শ্যামা। ইনি দিগম্বরী, ঘোরদ্রংষ্টা, করালাস্যা, পীনোন্নতপয়োধরা,ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী,শ্মশানগৃহবাসিনী। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়োপরি সংস্থিতা, শিবাকূল দ্বারা চতুর্দিকে সমন্বিতা। তিনি মহাকালের সঙ্গে বিপরীতরতাতুরা, সুখপ্রসন্নবদনা ও স্মেরাননসরোরূহা।

    মহানির্বানতন্ত্রে দেবী কালীর ( বা শ্যামার) উল্লেখিত রূপের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। 'ব্রহ্মযামলে'র আদ্যাস্তোত্রে আদ্যাদেবী কোন কোন দেশে কী রূপে পূজিতা হন তার বিবরণ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ' কালিকা বঙ্গদেশে চ' অর্থাৎ বঙ্গদেশে দেবী কালিকারূপেই পূজিতা হন। যদিও তন্ত্র আরাধনা ষোড়শ শতক পর্যন্ত এক গুহ্যসাধনপদ্ধতি ছিলো, কিন্তু সপ্তদশ শতক থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এই শ্যামামূর্তির, প্রকাশ্যে, অর্থাৎ জনগণের সমক্ষে মন্দিরে ও ব্যক্তিগত গৃহস্থ পরিসরে নিত্যপূজা প্রচলিত হয়েছে। এই নিত্যপূজা ছাড়াও বাৎসরিক দীপাবলী উৎসবের রাত্রে যে শ্যামাপূজা আজ আমরা দেখতে পাই তার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের 'কালীসপর্যাবিধি' গ্রন্থে। এই গ্রন্থটিতে বাংলাদেশে কালীপূজা করার পক্ষে মানুষকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরিত করা হয়েছিলো। এর থেকে বোঝা যায় সেই সময়ের আগে এদেশে কালীপূজা তেমন প্রচলিত ছিলোনা। আর একটি কিম্বদন্তী আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই বাধ্যতামূলকভাবে প্রজাদের কালীপূজা করতে আদেশ করেছিলেন। এর ফলেই বাংলাদেশে কার্তিকের কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাতে শ্যামা ও মাঘের কৃষ্ণাচতুর্দশীতে রটন্তী নামে কালীপূজার প্রচলন হয়েছিলো।
    এভাবেই ক্রমপর্যায়ে অনার্য রমণীর রূপকল্পে নির্মিত শক্তিরূপা মাতৃদেবী নিশ্ছিদ্র ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মদুর্গে নিজের স্থান শুধু করে নিলেন তাই নয়, এক বিস্তীর্ণ ভূভাগে ব্রাহ্মণ্য পুরুষ দেবতাদের প্রভাব খর্ব করে নিজের রাজত্বও স্থাপন করলেন। মহানির্বাণতন্ত্র ও ব্রহ্মযামলে দেবীর কৃষ্ণবর্ণকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানা দার্শনিক রূপকের আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বর্ণ কৃষ্ণা অনার্যমাতৃকার স্বীকৃতিমাত্র।

    ৫.

    'কালী' নামক নামপদটির বিভিন্ন উৎস রয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে 'কালী' শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মুন্ডক উপনিষদের এই শ্লোকটিতে।

    কালী করালী চ মনোজবা চ
    সুলোহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা।
    স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচি চ দেবী
    লেলায়মানা ইতি সপ্তজিহ্বাঃ।।

    এখানে কালী যজ্ঞাগ্নির সপ্ত জিহ্বার একটি জিহ্বা। কালীর মাতৃরূপ নিয়ে বৈদিক সাহিত্যে কোনও সন্দর্ভ নেই। পরবর্তীকালের পুরাণের মধ্যে মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে পাওয়া যায় দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা যখন রাত্রিকালে পান্ডব শিবিরে নিদ্রিত বীরদের হত্যা করছিলেন তখন এই বীরেরা রক্তাস্যনয়না, রক্তমাল্যানুলেপনা, পাশহস্তা, ভয়ঙ্করী, সংহারিনী, কালরাত্রিরূপিনী কালী দেবীকে দর্শন করেছিলেন। কালীর এই এই উল্লেখ সম্ভবত পরবর্তী কালের বিক্ষিপ্ত সংযোজন। এই কালী ভয়াল সংহারের বিগ্রহ, কোনও প্রধানা দেবী নন। কালিদাসের রচনাতেও, কুমারসম্ভব ও রঘুবংশে, কালীর গৌণ উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু কালিদাসের নামকরণ দেখে মনে হয় সে সময় কৌম সমাজে কালী বা কালিকার স্বীকৃতি ছিলো।

    পরবর্তীকালের সংস্কৃত সাহিত্যে এই নামে এক রক্তলোলুপা, ভয়ঙ্করী দেবীর উল্লেখ পাই, যিনি মদ্যমাংসপ্রিয়া, শবর, বর্বর, পুলিন্দগণ কর্তৃক পূজিতা হতেন ( খিল হরিবংশ)। সপ্তম শতকে বাণভট্টের 'কাদম্বরী'তে এবং সমসময়ে ভবভূতির 'মালতীমাধব' নাটকে শবরদের নরমাংস বলিদানে পূজিতা রক্তলোলুপা চন্ডী বা করালা দেবীর কথা পড়া যায়। এই দেবী কৃষ্ণবর্ণা, উগ্রা, বনপ্রদেশ সমীপে শ্মশানে অধিষ্ঠান করেন। এই দেবী বস্তুত চামুন্ডা এবং পরবর্তীকালে ইনি কালী বা কালিকা দেবীর সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছেন। মূলস্রোতের আর্য লেখকদের রচনায় এই দেবীর প্রতি যে মনোভাব দেখা গেছে তাতে বোঝা যায় তিনি তখনও আর্যদেবীদের সম্মান লাভ করেননি। মার্কন্ডেয় পুরাণের 'চন্ডী' অধ্যায়ে চামুন্ডা, কালী, কালিকা, কৌশিকী ( ইনি গৌরী), অম্বিকা, পার্বতী সবার সমন্বয় করে এক করালবদনা কালীর রূপকল্প প্রস্তুত হলো।

    ' বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা।
    দ্বীপিচর্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।।
    অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা।
    নিমগ্নরক্তনয়না নাদ্যপূরিতদিঙ্মুখা।।
    (চন্ডী-৭/৭-৮)

    এই কালী দেবী ঘোর যুদ্ধের পর চন্ড ও মুন্ডের শিরচ্ছেদ করে চন্ডিকাকে উপহার দিলেন এবং অট্টহাস্য করে বললেন চন্ডিকা নিজে শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করবেন। এই কালীর রূপকল্পকে দেবী চন্ডিকা চামুন্ডা নাম দিলেন। পুরাণ, উপপুরাণ ও বিভিন্ন তন্ত্রাদিতে কালী বা কালিকার যে বিবর্তন ঘটেছে তা ব্যপক ও বিচিত্রমুখী। বস্তুত কালী প্রাথমিকরূপে শবারূঢ়া, শিবারূঢ়া নন। পরবর্তীকালে সাংখ্যের নির্গুণ পুরুষ ও ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য শবরূপী শিব ও বলরূপিনী শক্তির কল্পনা করা হয়েছে। অধিকন্তু তন্ত্রের 'বিপরীত রতাতুরা' অর্থাৎ বিপরীত রমণে শক্তি দ্বারা নিষ্ক্রিয় পুরুষ শিবের পরাজয় প্রতিষ্ঠা করার তাগিদও যেন দেখা যায় এই কল্পনায়। তবে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে যখন তন্ত্রশাস্ত্রের প্রকৃত বিন্যাস হতে শুরু করে তখন কালীই অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে ব্রাহ্মণ পুরোহিততন্ত্রে নিজের প্রাধান্য বিস্তার করেন।

    ৬.

    কালী সম্বন্ধে এ পর্যন্ত যে আলোচনা হলো তার উপজীব্য বেদভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের শক্তিসাধনা অনুসারী তত্ত্বকথা ও তার প্রয়োগপ্রয়াস। মাতৃপূজা বা শক্তিপূজার প্রাথমিক প্রচলন অনার্য সংস্কৃতির মধ্যে থাকলেও তা বৈদিক সংস্কৃতিতে ভালোভাবেই অনুপ্রবেশ করেছিলো। ঋগবেদের প্রাচীনতম অংশ পুরুষদেবতা প্রধান হলেও পরবর্তী কালের যজুর্বেদ বা অথর্ববেদে শক্তিপূজার উল্লেখ বিভিন্ন সময় পাওয়া যায়। অনার্য সংস্কৃতির মতো প্রভাবী না হলেও বেদে শক্তি আরাধনার প্রসঙ্গ উপেক্ষিত হয়নি। বেদ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, '' হিন্দুকুলের পবিত্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তু এবং নিত্য ও অপৌরুষেয় বলিয়া বিশেষ সম্মাননার সমগ্রী''। পুরাণ, স্মৃতি, সংহিতা বা তন্ত্র সেই পর্যায়ের না হলেও তা 'দেববাক্যবৎ' ও ' হিন্দুসমাজে অচলভাবে প্রতিষ্ঠিত'। এই পর্যবেক্ষণটি করা হয়েছে ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত 'মহানির্বাণতন্ত্রমে'র ভূমিকায়। এ ব্যাপারটি সবার জানা যে পুরাণ হলো বিভিন্ন কল্পিত দেবদেবীর মাহাত্ম্যপ্রচারের আখ্যানমালা। 'স্মৃতি' সামাজিক মানুষের আচরণীয় বিধিব্যবস্থা। 'সংহিতা' বলা হয় অধ্যাত্মবাক্যের বিভিন্ন সঞ্চয়নকে। যদিও এগুলির সঙ্গে একনিঃশ্বাসে তন্ত্রের নাম নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা কিঞ্চিৎ কষ্টকৃত প্রয়াস মনে হয়। কারণ প্রথম তিনটি চর্চার ধারা মূলতঃ পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য আর্য পরিপ্রেক্ষিত থেকে উঠে এসেছে।
    আমাদের পুরাণ ও তন্ত্রাদির বিবর্তন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রথমে পার্বতী উমা, তার পর সতী ও তারও পরে দুর্গা চন্ডিকার উদ্ভবের মধ্যে দিয়ে একজন 'মহাদেবী'র উৎপত্তি ও মাহাত্ম্যবিস্তারের প্রয়াস ক্রমান্বয়ে চলছে প্রায় পাঁচ- ছশো বছর ধরে। এই ত্রিধারার সঙ্গে বাংলাদেশের অল্পবিস্তর যোগাযোগের ইতিহাস আছে, কিন্তু কালক্রমে এর সঙ্গে একটি চতুর্থ ধারাও যুক্ত হয়েছিলো। পরবর্তীকালে সেই ধারাটিই হয়ে দাঁড়ালো এই দেশে মুখ্য সাধনপন্থা। ধারাটি কালিকা বা কালী নামক ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের শক্তিসাধনাতে দেবী কালীই সর্বেশ্বরী। বস্তুত সামগ্রিকভাবে এই নিয়মটি অনুসরণ করেই দেশীয় কৌমসমাজের প্রকৃতিবাদী অনার্য ধারণা, ব্রাহ্মণ্য সম্প্রসারনবাদী ধী-জগতের মধ্যে 'তন্ত্র' নামে সমায়িত হয়ে গিয়েছিলো। পুরাণ, স্মৃতি বা সংহিতার থেকে তন্ত্র এজন্যই একটি পৃথক লক্ষণের চিন্তাধারা।

    ৭.

    বেদোক্ত শক্তিদেবীর দুটি অবতার কল্পনা করা হয়েছিলো। প্রথমযুগে তিনি পৃথিবীদেবী, অর্থাৎ আকাশদেবতা 'দৌ'য়ের সহধর্মিনী, যাঁর নাম দ্যাবাপৃথিবী। যিনি 'দৌ'রূপ পিতার রেতঃ অর্থাৎ বৃষ্টির ঔরসে প্রজননশালিনী হন এবং পৃথিবীকে শষ্যপূর্ণা করেন। যাঁর উল্লেখ ঋগবেদে এরকম,
    ' উচ্ছ্বংচস্ব পৃথিবী মা নি বাধথাঃ
    সূপায়নাস্মৈ ভব সূপবচনা।
    মাতা পুত্রং যথা সিচাভ্যেনং
    ভূম ঊর্ণিহি।।' ঋগবেদঃ ১০/১৮/১০-১১

    শেষ দুই পংক্তির অর্থ, ' যেরূপ মাতা আপন অঞ্চলের দ্বারা পুত্রকে আচ্ছাদন করেন, তদ্রূপ তুমি ইহাকে আচ্ছাদন কর।'

    ঋগবেদে এই মাতৃমূর্তি এখানেই শেষ হয়ে যায়না। এর পরে রয়েছেন দেবমাতা অদিতি ও দিতি। যদিও পুরাণে আদিত্যমাতা অদিতি ও দৈত্যমাতা দিতি দুই ভগিনী, কিন্তু ঋগবেদে অদিতি সীমাহীন অখন্ড বিশ্বের জননী এবং দিতি সীমায়িত খন্ডবিশ্বের জননী হিসেবে রূপায়িত করা হয়েছে। বেদপরবর্তীযুগে অদিতি কোথাও দক্ষজননী, কোথাও দক্ষকন্যা,। আবার এই দক্ষকন্যার রূপ একসময় সতীরূপে বর্ণিত হতে থাকে। এই সতী পর্বতকন্যা পার্বতী, পরবর্তীকালে অনার্য উমার ধারণার সঙ্গে মিলে গিয়ে অনার্যদেবতা শিবের শক্তিরূপিনী হয়ে ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্রের স্থায়ী অংশ হয়ে যান। কৌমসমাজে শিবের প্রতিপত্তির পুরস্কার হিসেবে শিব হয়ে যান দেবাদিদেব মহা ঈশ্বর, কালক্রমে বুদ্ধদেবের পরিবর্তিত জনসমাদৃত রূপে মহাদেব। ঐ মাতৃশক্তির দেবী শিবের সঙ্গিনী হয়ে বিশ্বের রহস্য বিষয়ে শিব অথবা মহাকালকে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন। এই প্রশ্নোত্তরকে লিপিবদ্ধ করেই বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্র প্রণীত হয়। মহাকালের শক্তিরূপিণী দেবী মহাকালী তন্ত্রমতের প্রধান আরাধ্যা দেবী হয়ে ওঠেন। এই কালীকে কালক্রমে নানা অবতারে প্রকট হয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মূর্তিতে পূজিতা হতে দেখা যায়। 'পদ্মপুরাণে'র সৃষ্টিখন্ডে বিষ্ণু সাবিত্রীদেবীকে স্তব করে বলছেন,
    ' সর্বগা সর্বভূতেষু দ্রষ্টব্যা সর্বতোহদ্ভূতা।
    সদসচ্চৈব যৎকিঞ্চিদ্দৃশ্যং তন্ন বিনা ত্বয়া।।
    তথাপি যেষু স্থানেষু দেঅষ্টব্যা সিদ্ধিমীপ্সুভিঃ
    স্মর্তব্যা ভূতিকামৈর্বা তৎ প্রবক্ষ্যামি তেহগ্রতঃ।।' (১৭/১৮২-৮৩)
    এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যদেবতা বিষ্ণু অর্গলহীন প্রশস্তিতে দেবীকে প্লাবিত করছেন। এই প্রশস্তির পরে অতিদীর্ঘ তালিকা আছে কোন স্থানে দেবী কোনরূপে পূজিতা হবেন। যেমন পুষ্করে সাবিত্রী, বারাণসীতে বিশালাক্ষী, নৈমিষারণ্যে লিঙ্গধারিণী, প্রয়াগে ললিতাদেবী ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ সারাদেশে বিভিন্ন রূপে পূজিতা অনার্য শক্তিদেবীরা একস্ট্রোকে ব্রাহ্মণ্য প্যান্থিয়নের অংশ হয়ে আর্য মূলস্রোতে মিশে গেলেন। অবশ্য এটি হলো সমগ্র ভারতবর্ষের হিসেব। বাংলাদেশের আবার নিজস্ব স্থানীয় শক্তিদেবীর তালিকা আছে। মাণিক গাঙ্গুলীর 'শ্রীধর্মমঙ্গলে' উল্লেখ পাই, ফুলায় জয়দুর্গা, বৈতালে ঝকবুড়ি, খপুতে খেপাই, আমতায় মেলাই, কালীঘাটে কালী, সৌলায় রঙ্কিনী, বিক্রমপুরে বিশালা ইত্যাদি।

    ৮.

    আদিমকাল থেকেই প্রকৃতিপূজায় আরাধ্যাকে নারীরূপে কল্পনা করা এবং প্রজনন উর্বরতার সাধনাকেই স্ট্রাকচার্ডভাবে মানুষের মূলস্রোতের পূজাপদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটা সচেতন প্রয়াস কৌম সমাজের মধ্যে সর্বত্র দেখা যায় । মাতৃতান্ত্রিকতার এই প্রভাবী লক্ষণটি প্রথম পর্যায়ে আর্যব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অংশ ছিলোনা । সংখ্যাগুরু জনতার চাপে ব্রাহ্মণ্যশক্তি এই ধারণাটিকে গ্রহণ করতে কিছুটা বাধ্য হয়, কিন্তু তা এক অনিচ্ছাকৃত আপোসমূলক সমঝোতা ছিলো । ইতরযানী জনসমষ্টির কাছে দেবীশক্তির 'প্রশ্নাতীত' মহিমাকে কিছুটা তরলীকৃত করার উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে পুরুষমহিমাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে আর্যীকরণ করে নেওয়া হয় । প্রায় সব তন্ত্রেই দেখা যায় পুরুষদেবতা শিবই কথক ও ব্যাখ্যাকারী এবং পার্বতী বা নারীদেবী শুধুই শ্রোতা ও প্রশ্নকারিণী । অর্থাৎ সব গূঢ় প্রশ্ন, প্রসঙ্গ, প্রচয়, প্রতিমার উত্তর বা সমাধান, শিবের ধারণবিশ্বে ধৃত রয়েছে । তিনি প্রকৃতিদেবীর মাধ্যমে তাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। মহানির্বাণতন্ত্রে দেখছি,
    পার্বতী উবাচ, '' হে দেব-দেব, জগন্নাথ, আপনি আমার নাথ ও দয়ার সাগর; হে দেবেশ, আমি আপনার অধীনা এবং সর্বদা আপনার আজ্ঞাচারিণী । আপনার অনুমতি না হইলে, আমি আপনার নিকটে কোনও কথা বলিতে পারিনা; (যাহা হউক) যদি আমার প্রতি আপনার কৃপাকণা প্রকাশ থাকে এবং আপনি যদি আমার প্রতি স্নেহপ্রবণ হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার মনের বাসনা আপনার নিকটে প্রকাশ করিতে পারি;'' ইত্যাদি ইত্যাদি,

    উত্তরে শিব বলছেন, " হে প্রাণবল্লভে, তুমি অতিশয় বুদ্ধিমতী, তুমি কী জানিতে ইচ্ছা করিয়াছ , বলো ; যাহা গণেশ বা কার্তিকের নিকট প্রকাশ করি নাই, তোমার নিকট তাহা বলিতে আমার বাধা নাই । যদি বিশেষ গোপনীয়ও হয়, তাহা হইলে আমি তাহা তোমার নিকটে ব্যক্ত করিব ; ত্রিলোকমধ্যে এমত কোনও বিষয় দেখিতে পাইনা, যাহা তোমার নিকটে গোপন থাকিতে পারে । হে দেবি, তুমি আমারই স্বরূপ, 'তোমাতে' আর 'আমাতে' কোনও ভেদ নাই ; তুমি সর্বজ্ঞা হইয়াও অনভিজ্ঞের ন্যায় আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ।''

    এই কল্পিত কথোপকথনটি ঊদ্ধৃত করার পিছনে উদ্দেশ্য হলো এর থেকে ভাবমূর্তি সৃষ্টির একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন উঠে আসছে । শিব একজন পত্নীপ্রাণ গৃহী, সংসারী মানুষ এবং পার্বতী তাঁর অনুগতা, আত্মনিবেদিতা ভার্যা । তাঁরা অন্য আর পাঁচটা সাধারণ পারিবারিক মানুষের মতো গার্হস্থ্য আলোচনার ঢঙে ভূমাবিশ্বের রূপরহস্য আলোচনা করছেন। ব্রাহ্মণ্যব্যবস্থা অনুমোদিত পরিবারের স্ট্রাকচারটিই শুধু নয়, তার সদস্যদের আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্কটিও এক্ষেত্রে জ্ঞাপন করা হলো, যা এদেশে একটি শাশ্বত মডেল হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়, শিব বলছেন যে পার্বতী তাঁর মতো-ই 'সর্বজ্ঞা', তবু 'অনভিজ্ঞা'র মতো শিবের কাছে রহস্য জানতে চাইছেন। অর্থাৎ পার্বতী স্বামীর মতো শক্তিশালিনী হওয়া সত্ত্বেও পত্নী হিসেবে লো প্রোফাইল হয়ে থাকাই স্বীকার করছেন । এখানে ইঙ্গিতে পুরুষপ্রধান ব্যবস্থার 'প্রাধান্য'কে স্বীকার করে নেওয়া হলো এবং একজন নিবেদিতা 'স্ত্রী'র ভূমিকায় পার্বতী সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন । সনাতন শাস্ত্রীয় পরিকাঠামোতে পিতৃতন্ত্রের আরেকটি সফল পৌরাণিক প্রতিস্থাপন সম্ভব হলো।

    ৯.

    বিবিধ লোকমান্যতার ভিত্তিতে পুরাণ, উপপুরাণ ও তন্ত্রশাস্ত্রকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ ধরনের মাতৃপূজাবিধি গড়ে ওঠে। কিন্তু দ্বাদশ শতকের আগে এর ব্যাপক প্রসার দেখা যায়না। গুহ্যতন্ত্রসাধনাও ষোড়শ শতক পর্যন্ত এক বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। এর পর বিদেশী মুসলমান রাজশক্তির নিষ্পেষনে যখন মূলস্রোতের ব্রাহ্মণ্য পূজা-আরাধনা প্রকাশ্যে, সমারোহ সহকারে উদযাপন করার পথে অন্তরায় দেখা দিলো তখন উচ্চকোটীর বিপর্যস্ত ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রচলিত বিষ্ণুকেন্দ্রিক বিগ্রহপূজা পরিবর্তে শরণ নিলো এইসব কৌম সমাজের দেবীকূলের আশ্রয়ে। এর মূল কারণ হয়তো শাক্তমতে পূজার্চনা প্রকাশ্যে পালন করা হতোনা। রাজশক্তির অগোচরেই এই সাধনপদ্ধতি অভ্যাস করা যেতো। এই সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলস্বরূপ তন্ত্রশাস্ত্র, পূর্বতন এলোমেলো অসংগঠিত রূপ থেকে ব্রাহ্মণ্যমেধার যোগদানে এক বিস্তৃত, বিন্যস্ত স্ট্রাকচার্ড মাত্রা নিয়ে বিকশিত হয়েছিলো। বৌদ্ধতন্ত্র ও সনাতনধর্মীয় তন্ত্রের মধ্যে বস্তুত কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভেদ নেই। আসলে সেভাবে দেখলে তন্ত্র কোনও ধর্মীয় মতবাদ নয়, তন্ত্র এক সাধনপদ্ধতি মাত্র। মনুষ্যদেহকে এক যন্ত্রস্বরূপ বিচার করে সেই সূত্রে এক গুহ্যসাধনপদ্ধতিকেই তন্ত্র বলে। এই সাধনপদ্ধতিতে অনুগামীদের বিভিন্ন দেবীর নামে দীক্ষা নিতে হয়। আগে যে তালিকার কথা উল্লেখ করেছি সেই মতো অসংখ্য দেবী থাকলেও আমাদের দেশে ( বাংলায়) শাক্তরা জগদ্ধাত্রী মন্ত্রেই অধিক দীক্ষিত হন। তারা, অন্নপূর্ণা, ত্রিপুরা ও ভুবনেশ্বরী মন্ত্রে দীক্ষিত শাক্তদের সংখ্যা বঙ্গদেশে অপেক্ষাকৃত কম।

    ১০.

    ইতিহাসের কোন সময়কাল থেকে দেবী কালী শক্তি আরাধনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করলেন সে বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে।
    যদি দেবীপুরাণ ( সপ্তম-অষ্টম শতক) মানি, তবে জানা যাচ্ছে রাঢ়া-বরেন্দ্র-কামরূপ-কামাখ্যা-ভোট্ট দেশে ( তিব্বত) বামাচারী শাক্তমতে দেবীর পুজো হতো। তাহলে এর সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে সপ্তম-অষ্টম শতকের আগেই বাংলাদেশে শক্তিপূজার প্রচলন হয়ে গেছিল। এর কিছু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্তোত্তর যুগে উজ্জয়িনী কেন্দ্রিক মধ্য-ভারতের ইতিহাসে। যেখানে জয়দ্রথ-যামল গ্রন্থে ঈশান-কালী, রক্ষা-কালী,বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী প্রভৃতি নানারূপের কালীর বর্ণনা আছে। এছাড়া ঘোরতারা, যোগিনীচক্র, চক্রেশ্বরী প্রভৃতিরও উল্লেখ আছে। অতএব বোঝা যাচ্ছে আমাদের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী শাক্ত আরাধনার উৎসভূমি শুধুমাত্র বাংলা নয়। তা গুপ্ত বা গুপ্তোত্তর যুগে পশ্চিম ও মধ্য ভারত থেকে এসেছিলো যার প্রমাণ, আগম ও যামল গ্রন্থগুলি। তবে এটা স্বীকৃত ঐ আগম বা যামল গ্রন্থের ধ্যান ও অন্যান্য কল্পনার থেকেই বাংলা দেশে বিস্তৃত তন্ত্রসাহিত্য ও ধর্মের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিলো। যদিও দ্বাদশ শতকের আগে কোনও তন্ত্র-গ্রন্থের প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। পাল-চন্দ্র-কাম্বোজ লিপিমালা বা সেন-বর্মণ লিপিমালাতে গুহ্য তন্ত্র সাধনার স্পষ্ট উল্লেখ যদিও নেই কিন্তু তৎকালীন শাক্ত ধ্যান ধারণায় তান্ত্রিক ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। পালযুগের অসংখ্য শক্তিরূপা দেবীমূর্তি কিন্তু তন্ত্রোক্ত দেবী নয়, সেগুলি শৈবধর্মের আগম ও যামল অনুসারে কল্পিত শিবশক্তি মূর্তি। শৈব ধর্মের শক্তি ও শাক্তধর্মের দেবী পাল যুগ থেকেই পৃথক। বঙ্গদেশে পরবর্তীকালের কালীধারণা কিন্তু অতীতের বিচ্ছিন্ন দেবীকল্পনার বিবিধতাকে সমন্বিত করে এক 'মহাদেবী' রূপকল্পকে স্পষ্ট করে তোলার প্রচেষ্টায় প্রয়াসী হয়েছিলো।

    ১১.

    সনাতন ধর্মের শাক্তঐতিহ্যের সঙ্গে বৌদ্ধ মহাযানী শক্তিচর্চাকে সতত মিলিয়ে দেখতে হবে। কারণ বাংলাদেশে তন্ত্রচর্চার প্রধান ধারাটি মূলতঃ বজ্রযানের পথেই এসেছিলো। বৌদ্ধধর্মের মূল কেন্দ্র মগধ হওয়ার জন্য প্রতিবেশী বঙ্গ, বরেন্দ্র, রাঢ়দেশে বৌদ্ধ প্রভাব প্রথম থেকেই বেশ প্রবল। সংযুক্তনিকায় গ্রন্থে লিখছে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ কিছুদিন পশ্চিম বঙ্গের শেতক নগরে বসবাস করেছিলেন। বোধিকল্পলতা এবং উয়াং চুয়াং ( হিউয়েন সাং) বলছেন গৌতম বুদ্ধ পুন্ড্রবর্ধন, সমতট ও কর্ণসুবর্ণে ধর্মপ্রচারের সূত্রে বেশ কিছুকাল অতিবাহিত করেছিলেন। মহাযান সাহিত্যে লিখছে প্রাচীনতম ষোলোজন মহাস্থবিরদের মধ্যে একজন তাম্রলিপ্তের মানুষ ছিলেন। এর পর ফা হিয়েনের বিবরণীতে আছে তিনি তাম্রলিপ্তিতে বাইশটি বৌদ্ধবিহার দেখেছিলেন এবং এই সব বিহারে তিনি দুবছর বাসও করেছিলেন।সপ্তম-অষ্টম শতক পর্যন্ত যেসব চিনা পর্যটক ও বৌদ্ধ অতিথিরা এদেশে এসেছিলেন, সবার লেখায় বাংলাদেশে যথেষ্ট মাত্রায় বৌদ্ধ প্রভাবের উল্লেখ লিপিবদ্ধ আছে। অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত পাল রাজত্বে মহাযান বৌদ্ধমত রাজধর্ম ছিলো। গোপাল থেকে শুরু করে দ্বিতীয় ধর্মপাল পর্যন্ত এই ধারা চলেছে। যদিও গোপালের ক্ষমতা অধিকারের সময় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের শশাঙ্ক শাসনের চাপ ও মাৎস্যন্যায়ের ফলশ্রুতি হিসেবে বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ অবনতি হয়েছিলো, কিন্তু পাল সাম্রাজ্যের কালে মহাযানী বৌদ্ধ মত বিশেষরূপে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে। পাল বংশ সম্ভবত এদেশের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র ইতরযানী গোষ্ঠী যাঁরা আদিম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন ও নবম শতকে দেবপালের সময় গুর্জর, কর্ণাট ও পাণ্ড্য রাজত্ব ব্যতিরেকে আসমুদ্র হিমাচল, কম্বোজ থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত তাঁদের অধিকারে ছিলো। দশম-একাদশ শতকের মানুষ অতীশ দীপঙ্করের সময় এদেশে বজ্রযান নামক তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে। এই ধর্মমত বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিলো। এই মতের দুটি মূল শাখা, কালযান ও সহজযানের কথা সর্বজানিত। এই সহজযানের প্রবর্তক ছিলেন লুইপাদ নামের এক বাঙালি সিদ্ধাচার্য।

    ১২.

    পন্ডিত ও গবেষকদের ধারণা তন্ত্রের সিদ্ধান্ত ও আচারের উৎপত্তি অনেক আগেই এদেশে হয়েছিলো, কিন্তু তা ছিলো গুরুশিষ্য পরম্পরার নিগূঢ় সাধনা। পালরাজাদের সময় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এই দর্শন ও সাধনা প্রকাশ্যে বিকশিত হয়। বজ্রযানের চারটি পীঠস্থান, উড্ডীয়ান, কামাখ্যা, শ্রীহট্ট ও পূর্ণগিরিতে এই মতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বজ্রযোগিনীর মন্দির ছিলো। উল্লেখ্য অতীশ জন্মেছিলেন বর্তমান ঢাকার কাছে বজ্রযোগিনী নামে এক গ্রামে। এই তন্ত্রের গূঢ়সাধনপদ্ধতি যে গ্রন্থে সংকলিত হয় তার নাম 'গুহ্যসমাজতন্ত্র'। এই গ্রন্থটি অনুমান করা হয় পূর্বোল্লেখিত আচার্য অসঙ্গের রচনা। বলা হয় মোট বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা চুয়াত্তর, কিন্তু বিনয়তোষ ভট্টাচার্য বলেছেন এজাতীয় গ্রন্থের সংখ্যা বহু সহস্র।

    বজ্রযানী বৌদ্ধ দেবতামন্ডলীতে অসংখ্য দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই দেবতাদের মধ্যে প্রধান আদিবুদ্ধ এবং তাঁর সঙ্গে আছেন পঞ্চ ধ্যানী বুদ্ধ ও তাঁদের শক্তিরা। যেমন অক্ষোভ্য-মামকী, অমিতাভ-পান্ডরা, অমোঘসিদ্ধি-তারা, বৈরোচন-লোচনা, রত্নসম্ভব-বজ্রধাত্বীশ্বরী এবং বজ্রসত্ত্বা-বজ্রসাত্ত্বিক। এর পরবর্তী স্তরে আছেন সপ্ত মানুষী বুদ্ধ ও তাঁদের শক্তি, বোধিসত্ত্বগণ ও তাঁদের শক্তি এবং নানা অসংখ্য দেবদেবী। এইসব দেবদেবীরা বস্তুত বিভিন্ন ইতরযানী কৌম সমাজের আরাধ্য লোকদেবতা। বৌদ্ধমতের প্রচারক ও সংগঠকেরা এই সংখ্যাগুরু জনসমাজের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি করার জন্য তাদের সমস্ত দেবদেবীদের বৌদ্ধমতে আত্তীকরণ করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে একই রণনীতিতে সনাতন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিনিধিরা বজ্রযানী বৌদ্ধমতের তন্ত্রসাধনার উপর নিজস্ব মোহর লাগিয়ে তাকে আত্মস্থ করে নেন। উভয় পদ্ধতিরই মূল দুটি শর্ত হচ্ছে, গুরু ব্যতিরেকে তন্ত্র সাধনা নিষেধ আর বোধিচিত্ত তথা শক্তিপূজা করতে গেলে নরনারীর শারীরমিলন অনিবার্য অবশ্যকৃত্য।

    বজ্রযান থেকে উদ্ভূত সহজযানকে সহজিয়া ধর্মও বলা হয়। ব্রাহ্মণ্য দর্শনের জটিল বহুস্তর তত্ত্ব ও অগণন লোকাচারের বিপরীতে সহজযান বা সহজিয়া ধর্ম স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইতর মানুষের অবলম্বন হয়ে উঠেছিলো। চর্যাপদ থেকে বাউলদর্শনের দেহতত্ত্ব পর্যন্ত সব কৌমদর্শন ও লোকাচারে এই সহজিয়া ধর্মই এ দেশে ব্যপ্ত হয়ে আছে। বাংলাদেশে এই সাধন পদ্ধতিটি অতি লোকপ্রিয়। সহজিয়া পন্থায়, বৈষ্ণব ও তন্ত্র উভয় মতেরই আচার ও বিশ্বাস সর্বপ্রথম একই মঞ্চে আসীন হয়েছিলো।

    ১৩.

    কালী ও তন্ত্র পরস্পর অবিচ্ছেদ্য দু'টি প্রসঙ্গ। একটি বিগ্রহ, অন্যটি পরিগ্রহ। দীর্ঘকাল ধরে কালীতত্ত্ব ও তন্ত্রসত্ত্ব একযোগে বিকশিত হয়েছে। কালী ভাবনার উৎপত্তি ও বিবর্তন, তন্ত্রসাধনের সঙ্গে সমানুপাতিক ভাবে প্রসরমান।

    তন্ত্রের উৎপত্তি বিষয়ে সনাতনপন্থীরা বলেন তন্ত্রধর্মের বীজ বৈদিক ধর্মের মধ্যে রয়েছে। আবার বৌদ্ধদের দাবি গৌতমবুদ্ধ প্রবর্তিত মুদ্রা, মন্ত্র, মন্ডল, ধারণী, যোগ ইত্যাদি ধারণাগুলিই তন্ত্রের মূল সূত্র। 'সূত্রকৃতঙ্গ' নামের একটি অতিপ্রাচীন জৈন গ্রন্থ জানাচ্ছে তন্ত্রের অতি গূঢ় সাধনপদ্ধতি ও আচার অনুষ্ঠান শবর, দ্রাবিড়, কলিঙ্গ ও গৌড় দেশবাসী ও গন্ধর্বদের মধ্যে প্রচলিত ছিলো। তাই একথা প্রমাণিত যে তন্ত্রধর্ম প্রকৃতপ্রস্তাবে একটি ব্রাত্যধর্ম এবং বৌদ্ধ ও সনাতনধর্ম নিজস্ব উদ্দেশ্য সাধিত করার জন্য তাকে আত্তীকরণ করেছিলো। তন্ত্রের জগতে কোনও জাতিভেদ নেই। এছাড়া ব্রাহ্মণ্যমতে ঘৃণাত্মক ক্রিয়াকলাপ, যেমন, শবসাধনা, পঞ্চমুন্ডি-আসন, পঞ্চ-ম-কার ইত্যাদি আর্যমতের ভ্রষ্টাচার, ইতরযানী মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ছিলো।

    ১৪.

    ষোড়শ/ সপ্তদশ শতকের পর বিভিন্ন সূচক ও মানকের সাহায্যে তন্ত্রবিদ্যাকে নথিবদ্ধ করা হয়। তার পর থেকে সরলীকৃত পরিভাষায় শক্তি ( অর্থাৎ শিব ভার্যা) উপাসকদের 'শাক্ত' বলে চিণ্হিত করা হয়। শাক্তদের উপাসনা পদ্ধতির নাম তন্ত্রাচার। তন্ত্রাচার বৈদিক উপাসনা পদ্ধতির থেকে বিশেষরূপে ভিন্ন। এই আচারে দেবতার ( অথবা দেবীর) প্রতিমূর্তি নির্মান করে মন্ত্র দিয়ে তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তার পর ঐ প্রতিমূর্তিকে সাক্ষাৎ সজীব দেবতা জ্ঞানে আহ্বান করা হয়। এই পূজা পদ্ধতির বিভিন্ন অঙ্গ হচ্ছে পাদ্য, অর্ঘ্য, স্নানীয়, গন্ধ, নৈবেদ্য, বস্ত্র প্রদান ও সাধকের অধিকারী ভেদে পঞ্চ ম-কার সহযোগে অর্চনা করা।

    একটি প্রচলিত অনুমান অনুযায়ী ভারতে ১৯২টি তন্ত্র প্রচারিত হয়েছিলো। এর মধ্যে তিনটি সম্প্রদায় রয়েছে। গৌড়বঙ্গে প্রচারিত ও ব্যবহৃত ৬৪টি তন্ত্রের অনুগামীরা বিষ্ণুক্রান্ত নামে পরিচিত। বিষ্ণুক্রান্ত সম্প্রদায়ের ৬৪টি তন্ত্র থেকে আহরণ করে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ 'তন্ত্রসার' নামে একটি সংকলন প্রস্তুত করেন। বিষ্ণুক্রান্ত সম্প্রদায় ব্যতিরেকে যে সম্প্রদায়টি নেপাল ও উত্তরের বিভিন্ন প্রান্তে অপর ৬৪টি তন্ত্রের বিধি অনুসরণ করেন, তাঁদের নাম 'রথাক্রান্ত'। মহানির্বাণ প্রভৃতি তন্ত্র এই রথাক্রান্ত সম্প্রদায়ের অনুসৃত পথ। মূল বৌদ্ধ তন্ত্র আপামর জনসাধারণের কথিত ও স্বীকৃত ভাষা পালিতে গ্রন্থিত হতো। কিন্তু পুরাণযুগের মধ্যপর্যায়ে, অর্থাৎ দশম-একাদশ শতাব্দী থেকে এগুলি সংস্কৃতে সংকলিত হতে শুরু করে। তন্ত্রের ব্রাহ্মণীকরণের প্রক্রিয়া পুরোদমে চালু হয়ে যায় সংস্কৃতকে আত্তীকরণের মাধ্যমে। বিভিন্ন তন্ত্র নাড়াঘাঁটা করে একটা ব্যাপার আমার বোধ হয়েছে যে অধুনালব্ধ তন্ত্রগুলির সংকলকেরা সকলেই ব্রাহ্মণ পন্ডিত বা পুরোহিত সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা বিভিন্ন তন্ত্রের ভূমিকা থেকে শুরু করে ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে দুটি শব্দ বা শিকড়কে ধরে রাখতে চেয়েছেন। এই আশ্রয় দুটি হলো, বেদ ও ব্রহ্ম। এঁরা প্রত্যেকে ঘোষণা করেছেন তন্ত্রধারণার মূল বেদে সন্নিহিত এবং তন্ত্রসাধনার লক্ষ্য ব্রহ্মলাভ করা। তন্ত্রের ইতিহাস ও বিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করলে এই দাবিটি অর্বাচীন মনে হয়। তন্ত্র কোনও পৃথক অধ্যাত্মদর্শন বা মানুষের গভীর আত্মবিশ্লেষণের সাক্ষ্যবাহী ভূমা অর্জন নয়। প্রথম থেকেই এটি একটি আচারভিত্তিক উপাসনাপদ্ধতি, যা প্রকৃতিবাদী জনগোষ্ঠী নিতান্ত ঐহিক প্রাপ্তির মাধ্যম হিসেবেই সৃষ্টি ও বিকশিত করেছিলো। ঊনবিংশ শতক থেকে সমস্ত লিপিবদ্ধ তন্ত্রেই অনুসারীদের পারত্রিক সিদ্ধির থেকে ঐহিক প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অধ্যাত্মসাধনার যে স্তরে পৌঁছোতে পারলে সাধকদের আত্মিক ও পারমার্থিক নির্বাণলাভ হয় সেই স্তরটি সাধারণ পর্যায়ের তন্ত্রচর্চা থেকে স্বতন্ত্র একটি সিদ্ধি। তন্ত্র সেখানে উপনীত হবার একটি প্রাথমিক সাধন মাত্র, তার বেশি নয়।

    ১৫.

    বেদে তন্ত্রের 'উল্লেখ' বলতে যা উদ্দেশ্য করা হয়, তার অভিমুখ অথর্ববেদের দিকেই থাকে। বহু ধীমান দার্শনিক অথর্ববেদকে বেদের অংশ হিসেবে স্বীকার করেন না। অথর্ববেদ বস্তুতঃ আদিম কৌম সমাজের নানা বিধিব্যবস্থা, রীতিপদ্ধতি, আচারবিচারের সম্পাদিত সংকলন, যা ব্রাহ্মণ্যব্যবস্থা নানা সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে স্বীকার করে নিয়েছিলো। এই বেদটির একটি বিরাট অংশ জুড়ে অকাল্টচর্চার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে বিশদ সংলাপ রয়েছে যা কোনোভাবেই আর্যদর্শনের মূলস্তম্ভগুলির সঙ্গে সংযুক্ত নয়। তন্ত্রসাধনার মূল লক্ষ্য হিসেবে মানুষের স্নায়ুতন্ত্র সম্বন্ধিত কুলকুন্ডলিনী জাগরণ বিষয়ক যে সন্দর্ভ প্রাধান্য পেয়ে থাকে, তার সঙ্গে এদেশে দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা ব্রহ্মকেন্দ্রিক গভীর অধ্যাত্মদর্শন সম্পৃক্ত ভাবনাচিন্তা সমস্তরে মেলেনা। বরং এই প্রক্রিয়াটি প্রাকৃত যোগসাধনের সূত্রে অর্জন করা একটি অতীন্দ্রিয় উপলব্ধিকেই সূচিত করে।

    কিন্তু আমরা মহানির্বাণতন্ত্রেরই দ্বিতীয় উল্লাসে ব্রহ্মের যে বর্ণনা দেখছি, তা উপনিষদ ও সেমেটিক ধর্মের একেশ্বরবাদের সঙ্গে বিশেষভাবে মিলে যায়। ''... তিনি এক, অদ্বিতীয়, সত্য, নিত্য, পরাৎপর ও স্বপ্রকাশ ; তিনি সতত পূর্ণ ও সচ্চিদানন্দ। তিনি নির্বিকার, নিরাধার, নির্বিশেষ, নিরাকুল,গুণাতীত, সর্বসাক্ষী, সর্বাত্মা ও সর্বদ্রষ্টা। তিনি গূঢ়ভাবে সর্বভূতে অবস্থিতি করেন, তিনি সর্বব্যপী ও সনাতন। তিনি সমুদয় ইন্দ্রিয় ও তাহার শক্তি প্রকাশ করিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহার ইন্দ্রিয় নাই'' ইত্যাদি। ব্রহ্মের এই বর্ণনার সঙ্গে ঊনবিংশশতকের ব্রাহ্মসমাজের ধ্যানধারণা অবিকল মিলে যায়। কিন্তু যে সাধনপদ্ধতি একান্তভাবে প্রকৃতিপূজনের আদিম রূপকল্পকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে উঠেছে সেখানে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যপ্রাপ্তির এই বিমূর্তভাব সন্ধান বেশ কৌতূহল উদ্রেক করে। এমন কি তন্ত্রসাধনার পথে সেই পরমেশ্বরকেও উপলব্ধি করা সম্ভব '' যিনি বেদান্তবেদ্য যৎ সৎ শব্দে উপলক্ষিত, যিনি ভগবান'', এরকম দাবিও চোখে পড়ে।

    ১৬.

    বস্তুতঃ তন্ত্রসাধনের মতো একটি আদ্যন্ত জটিল ও বহুমুখী আচারভিত্তিক উপাসনা পদ্ধতি, যা পঞ্চ-মকারের মতো অনার্য, অব্রাহ্মণ, ইতরযানী লোকাচারের স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত, তা'কে এভাবে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বেদান্তবৃত্ত দিয়ে ঘিরে ফেলা আর্যসংস্কৃতির অন্তঃস্থ শক্তিই প্রকাশ করছে। যদি আমরা পঞ্চ-মকারের আপাত তাৎপর্য আর ব্রাহ্মণ্য ব্যাখ্যায় তার পরিশীলিত রূপ মিলিয়ে দেখি তবে এই ব্যাপারটি হয়তো স্পষ্ট হতে পারে।

    ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রশাস্ত্রে পঞ্চ-মকারের প্রসঙ্গ বৌদ্ধ বজ্রযান থেকে গৃহীত হয়েছে। বজ্রযান ও মন্ত্রযান এই আচারগুলি গ্রহণ করেছিলো প্রাক-বৈদিককাল থেকে প্রচলিত ইতরযানী উপাসনা পদ্ধতির অংশ হিসেবে। এই আত্তীকরণের ফলে সংখ্যাগুরু অনার্য কৌম সম্প্রদায়, যাদের বৌদ্ধ আচরণীয় ধর্মের সমতাভাবের প্রতি দীর্ঘকাল ধরে পক্ষপাত ছিলো, সহজেই এই নতুন উপাসনাপ্রথার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। সাধারণ ইতর শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার সঙ্গে পঞ্চ-মকারের উপাদানগুলি সহজ স্বতঃস্ফূর্ততায় বিজড়িত ছিলো। কিন্তু অভিজাত অধ্যাত্মচর্চার যে ভুবন ব্রাহ্মণ্য শাসক ও পুরোহিতদের মৌরসিপাট্টা ছিলো সেখানে এই সব ম-কারযাপনকে রীতিমতো অস্বীকার্য, বস্তুতঃ ঘৃণ্য বোধ করা হতো। কিন্তু কালক্রমে সময় ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির চাপে যখন এই আচারগুলিকে সনাতনধর্মের মূলস্রোতে স্থান দিতে হলো, তখন তার পরিপ্রেক্ষিত ও বিশ্লেষণে শুদ্ধতার মর্মরপ্রলেপ বেশ প্রকটভাবে চোখে পড়ে।

    ১৭.

    বর্তমানে প্রচলিত তন্ত্রশাস্ত্রের বৃহত্তর অংশটি মহাযানী বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনার প্রায় হাজার বছরের চর্চার ফসল। এই চর্চা সনাতনধর্মীয় শাক্তসাধনার সমান্তরালে বয়ে চলেছে অধিকতর নিষ্ঠা নিয়ে। কারণ তন্ত্র মূলতঃ ইতরজনের বিকশিত অধ্যাত্মসন্ধান। ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মই প্রথম ইতরজনের অধ্যাত্ম প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। সাধারন, দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষেরও যে একটা অধ্যাত্মিক প্রয়োজন থাকতে পারে, ক্ষুধা আর শোষণের চাপে নীরবে মরে যাবার আগে তারও একজন ' দরিদ্রের ভগবানে'র প্রয়োজন আছে, এই কথাটি গৌতম বুদ্ধের আগে বিশেষ কেউ আমল দেননি। আর্য প্যাগান সভ্যতার নানা প্রকৃতিপ্রতীক দেবতার স্তর পেরিয়ে আসার পরও কিন্তু সংখ্যাগুরু অনার্য মানুষের কাছে প্রকৃতির মাতৃতন্ত্র ও পুরুষের সৃজন তন্ত্রের তত্ত্ব সন্ধানই প্রধান অধ্যাত্ম কৃত্য ছিলো। এই স্রষ্টা ও সৃষ্টির চিরন্তন দ্বান্দ্বিক অবস্থান ও এর ফলে গড়ে ওঠা এই পৃথিবীর প্রাণের জগতের রহস্যভেদই মানুষের অধ্যাত্মসন্ধানের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিলো। অনার্য মনীষার এই দিকটি কিছু পরে আর্যরা আংশিকভাবে স্বীকার করলেও সামগ্রিক ভাবে তাকে বৈদিক সংস্কৃতিতে আত্তীকরণ করেনি। যদিও অথর্ববেদের কালে নানা তান্ত্রিক পূজাপদ্ধতি ও লোকাচারের উল্লেখ লিপিবদ্ধ আছে। তাই কৌম সমাজের মানুষের কাছে তান্ত্রিক অধ্যাত্ম দর্শনের আবেদন চিরকাল থাকলেও গোষ্ঠীবদ্ধ বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তাকে সরাসরি স্বীকার করেনি। কিন্তু নানা অনিবার্য তাকে সর্বতো ত্যাগও করতে পারেনি। পরবর্তী যুগে ব্রাহ্মণ্য জ্ঞানচর্চা ও দর্শনের শিখরকালে তন্ত্রকে কৌম সমাজের অধিকার থেকে হরণ করে একটা পৃথক সন্ধানের ধারা করে তোলা হয়েছিলো। অনার্য দেবতা শিব এবং তাঁর সহচরী শক্তির পরস্পর কথোপকথনের আঙ্গিকে তন্ত্রদর্শনকে প্রথম একটা স্ট্রাক্চার্ড রূপ দেওয়ার প্রয়াস করা হয়। এই শৈলী পরবর্তী কালেও অনুসৃত হয়েছে।

    ১৮.

    কতোটা নথিবদ্ধ ইতিহাস তা জানা নেই, হয়তো নিছক কিম্বদন্তীই হবে। দ্বিতীয় শতকের পন্ডিত নাগার্জুন, যিনি দক্ষিণ অন্ধ্র প্রদেশের অধিবাসী ছিলেন, যখন জানতে পারেন যে বৈশালী প্রদেশে বৌদ্ধরা সঙ্ঘারামে বারো বছর ধরে ঘন্টাধ্বনি বন্ধ রেখেছে, কারণ এক ব্রাহ্মণ পন্ডিত তর্কযুদ্ধে বৌদ্ধদের পরাজিত করেছেন। এই ব্রাহ্মণকে 'প্রেতসিদ্ধ' বলা হয়েছে। যে রকম বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হয় এই ব্রাহ্মণ বামাচারী বা বীরাচারী তান্ত্রিক ছিলেন। নাগার্জুন এই কথা শুনে তথাগত বুদ্ধের পরম পবিত্র আবাস বৈশালীতে আসেন এবং ঐ ব্রাহ্মণকে পরাজিত করে সঙ্ঘারামে আবার ঘন্টাধ্বনির প্রচলন করেন। বৌদ্ধ পুথিপত্রে নাগার্জুনকে বোধিসত্ব হিসেবে স্বীকার করা হয়েছিলো।

    এর পরবর্তীকালে হিউ এন সাং ভারতবর্ষে ছিলেন ৬৩০ থেকে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর স্মরণপঞ্জীর দুটি ভাগ আছে। একটি তাঁর ভ্রমণপঞ্জী এবং অপরটি তাঁর জীবনী। এই জীবনী অংশটির প্রামাণ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ সেখানে তাঁর মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য শিষ্যরা বহু অতিশয়োক্তি নথিভুক্ত করেছিলেন। তবে তাঁর রচনায় উল্লেখ রয়েছে যে ব্রাহ্মণরা বহুদিন থেকেই অথর্ববেদ অনুযায়ী তন্ত্রমন্ত্রের সাধনা করে। তিনি শীলাদিত্য হর্ষবর্ধনের আশ্রিত ছিলেন তাই তাঁর রচনায় কোথাও আমি বৌদ্ধরা কোথাও ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা করছে তার উল্লেখ পাইনি, বরং তিনি সতত বৌদ্ধ ধর্মে এসব অনাচারকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়না বলে দাবি করেছেন। একটা উল্লেখ আছে, তবে সেটা ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে।

    ১৯.

    সনতারিখ নিয়ে প্রচুর গোলমাল রয়েছে। যথাসম্ভব সংক্ষেপে বলি অমরকোষ রচয়িতা অমরসিংহকে বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের একজন বলা হয়েছে। যদি তিনি বরাহমিহিরের সমসাময়িক হন তবে ষষ্ঠ শতাব্দীর মানুষ। অমরকোষে এই সব পুরাণের উল্লেখ নেই। তিনি পুরাণের যেসব লক্ষণের উল্লেখ করেছেন সেই অনুযায়ী অষ্টাদশ পুরাণ ও বাইশটি উপপুরাণ ষষ্ঠ শতকের পরবর্তী ব্যাপার ( বৃহদ্ধর্মপুরাণ মূল অষ্টাদশ পুরাণের অন্তর্গত নয়)। আবার রঘুনন্দনের (চতুর্দশ শতক) রচনায় এই সব পুরাণ উপপুরাণের কিছু উল্লেখ আছে, কিন্তু তার সংখ্যা অনেক কম। অতএব এই সব পুরাণের প্রকৃত বিকাশ শ্রী চৈতন্যের পরবর্তীকালে। ব্রহ্ম, ব্রহ্মান্ড, ব্রহ্মবৈবর্ত, মার্কন্ডেয়, ভবিষ্য ও বামন, এই পুরাণগুলিকে রাজস পুরাণ বলা হয়। এ গুলিতে ব্রহ্মা, বিষ্ণুর সঙ্গে শিব ও শক্তি দেবতারও মাহাত্ম্য বর্ণনা আছে। তন্ত্রে মোটামুটি ভাবে এই পুরাণগুলি বা এর উপপুরাণগুলিকেই উল্লেখ করা হয়। তবে কূর্মপুরাণে ভৈরব, বাম, যামল, করাল প্রভৃতি তন্ত্র শাস্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। অমরকোষে তন্ত্রশাস্ত্রের উল্লেখ নেই। কামধেনু, প্রপঞ্চসার ও বর্ণোদ্ধার তন্ত্রে বর্ণসমুদায়ের বর্ণনা বিশেষভাবে বাংলা অক্ষরপদ্ধতির সঙ্গে মেলে। তাই প্রিন্সেপ সাহেবের মত অনুযায়ী এই সব তন্ত্র নিঃসন্দেহে দশম খ্রিস্টাব্দের পরে রচিত হয়েছে। তবে সব তন্ত্রকেই 'গৌড়ীয়' তন্ত্র হিসেবে গণ্য করা সমীচীন নয়। এর ব্যতিরেকে আফঘানিস্তান, কাশ্মির, পঞ্জাব, রাজস্থান, কচ্ছ, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি এলাকায় প্রভূত তন্ত্রচর্চার প্রচলন ইতিহাসে নথিবদ্ধ আছে।

    এই সময়কালের প্রামাণ্যতা প্রসঙ্গে ব্যাশাম সাহেব যা লিখেছেন সেটা স্বীকার করতে হবে। কারন Wonder, that was India যখন প্রকাশিত হয়েছে তখন হরপ্রসাদ জীবিত ছিলেন আর ক্ষিতিমোহন, গোপীনাথ তো পূর্ণমাত্রায় সৃষ্টিশীল। তাঁরা কেউ এর বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। আমার কাছে হিউ এন সাংয়ের যে ভ্রমণ বৃত্তান্ত রয়েছে সেখানে এই বিষয়টির উল্লেখ পাইনি। তা ছাড়া প্রবোধ চন্দ্র বাগচি মশায় লিখেছেন খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকের মধ্যভাগে হিউ এন সাং যখন শীলভদ্রের কাছে নালন্দায় যোগাচার দর্শন অধ্যয়ন করছিলেন তখনো সেখানে তান্ত্রিক মতের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে মনে হয়না। তিনি বলেছেন বৌদ্ধ তন্ত্রযান অষ্টম শতক থেকেই নালন্দা, বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরীতে প্রচলিত হয়। পালযুগের আগে বৌদ্ধ মহাযানপন্থায় বজ্রযান বা তৎপরবর্তী সহজযানের কোনও উল্লেখ কোথাও পাইনি। গান্ধার রাজ্যের পুরুষপুরজাত আচার্য অসঙ্গকে জড়িয়ে একটি প্রচার রয়েছে, যে তাঁর চিন্তা অনুসারেই বজ্রযানের সূত্রপাত হয়েছিলো। কিন্তু এই ধারণাটির কোনও স্বীকৃত সূত্র পাওয়া যায়না। আচার্য অসঙ্গ 'তন্ত্রসাধনা'র পথিকৃৎ কদাপি ছিলেন না। তাঁর যোগাচার, যাকে বিজ্ঞানবাদ বলা হয়, কোনোভাবেই তন্ত্রানুসারী মতবাদ নয়। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের নির্দিষ্ট আচারগুলির সঙ্গে তৎকালীন ইতরজনসমাজের কৌম লোকাচারগুলিকে সম্মিলিত করেছিলেন। এর কারণ ধর্মীয় নয়, নেহাৎ রাজনৈতিক। সংখ্যাগুরু ইতর জনগণ বর্ণাশ্রম বিরোধী বৌদ্ধদর্শনের প্রতি প্রথম থেকেই আকর্ষণ বোধ করতো। কিন্তু আচার্য অসঙ্গের সময় মহাযানী বৌদ্ধধর্মের সেরিব্রাল গঠনটি বেশ জটিল হয়ে গিয়েছিলো। কৌম সমাজের অকুলীন সংখ্যাগুরু মানুষজন ঐ পর্যায়ের বৌদ্ধিক বাতাবরণে স্বচ্ছন্দবোধ করতোনা। তাই আচার্য অসঙ্গ এই জনসমষ্টিকে বৌদ্ধধর্মের মূলস্রোতে আত্তীকৃত করার জন্য তাদের মধ্যে স্বীকৃত যাবতীয় দেবতা, উপদেবতা, অপদেবতা এবং অলৌকিক ও অতিলৌকিক বিগ্রহগুলিকে বৌদ্ধ মহাযানী ব্যবস্থার মধ্যে স্থান করে দিলেন। ক্ষমতাদখলের এই পর্যায়ের লড়াইতে ব্রাহ্মণ্য শক্তিগুলি মাৎ খেয়ে গিয়েছিলো।

    ২০.

    বৌদ্ধ তন্ত্রযানের যে তিনটি প্রধান ধারা আছে, কালচক্রযান, বজ্রযান ও সহজযান, তার মধ্যে সহজযান অর্বাচীনতম আর এর মধ্যেই বৌদ্ধ দর্শনের চূড়ান্ত অবক্ষয় ও তন্ত্রের নামে ব্যভিচারের বন্যা নামে। শংকরের পূর্বসূরি যে মালাবারের ব্রাহ্মণ ( মতান্তরে মিথিলা বা বারাণসী) কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধ সংহারের নায়ক ছিলেন, তিনি সপ্তম শতাব্দীর মানুষ। শংকর সম্ভবত অষ্টম-নবম শতকের লোক। তাঁর সময়কালের আগেই লোকপ্রিয় সহজযানী বৌদ্ধ মতের পাপে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি টলে যায়। বৌদ্ধবিহারগুলি এই সময় অত্যন্ত ধনশালী হয়ে পড়েছিলো। ফলতঃ সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলির প্রশাসক বা প্রচালকরা ধন ও প্রতিষ্ঠার গর্বমত্ততায় বৌদ্ধদর্শনের মূলদিশা থেকে আমূলচ্যুত হয়ে পড়েন। পঞ্চশীলের বাণী বাতিল হয়ে পঞ্চরিপুর আরাধনা প্রাধান্য পেয়ে যায়। চারিত্রিক অবক্ষয়ের মাত্রা এক মারাত্মক রূপ গ্রহণ করে। নব উজ্জীবিত ব্রাহ্মণ্যবাদ এই সুযোগ ব্যর্থ হতে দেয়নি।
    এর আগে মৌর্যসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যদিও ব্রাহ্মণ বিষ্ণুগুপ্তের জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বে বেশ প্রভাবিত ছিলেন, কিন্তু শরণ নিয়ে ছিলেন জৈন ধর্মের। তাঁর উত্তরসূরিরা প্রাথমিকভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুসারী হলেও প্রিয়দর্শী অশোক শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ দর্শনে আশ্রয় পান। যেহেতু মৌর্য রাজবংশ শুরু থেকেই অন্ত্যজ মানুষের উত্থান সূচিত করেছে, তাই ব্রাহ্মণ্য শক্তি কোনদিনই মৌর্য সাম্রাজ্যে খুব প্রাধান্য পায়নি। পরবর্তী সম্রাট পুষ্যমিত্র ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং শেষ মৌর্য রাজা বৃহদ্রথের সেনাপতি। বৃহদ্রথকে হত্যা করে পুষ্যমিত্র সুঙ্গ ক্ষমতায় আসেন। তিনি খুব গুণী রাজা ছিলেন। তাঁর বা তাঁর বংশধরদের নামে বৌদ্ধনিধনের যে অভিযোগ আছে তা মনে হয় অতিরঞ্জিত। যেহেতু সুঙ্গ রাজত্বে বৌদ্ধদের প্রতি রাজাদের নানা পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস নথিবদ্ধ আছে, তাই এ বিষয়ে শেষ কথা বলা বোধ হয় সমীচীন হবেনা। কিন্তু এই পরিপ্রেক্ষিতে বৌদ্ধ তন্ত্রের বিকাশ ও গৌতম বুদ্ধের ধর্মের অবনমন কীভাবে হয়েছিলো মধ্যেই সীমায়িত থাকাই ভালো। বৌদ্ধ আদর্শের ক্রমাগত অবক্ষয় এবং ব্রাহ্মণ্যশক্তির শক্তিসঞ্চয়, এই দ্বন্দ্বসূত্র থেকেই 'তন্ত্র' নামক জটিল উপাসনা পদ্ধতিটি উঠে আসে। এর মধ্যে ওতোপ্রোত মিশে আছে কৌম, বৌদ্ধ ও সনাতন ধর্মের নানা উপাদান।

    ২১.

    ইতিহাসের এই গতিপথ অনুসরণ করলে দেখা যাচ্ছে বস্তুতঃ মৌর্য সাম্রাজ্যের আগে থেকেই এদেশে রাজনীতির দুটি ভার্টিকাল রয়েছে। ব্রাহ্মণের স্বপক্ষে বা ব্রাহ্মণের বিপক্ষে। এর মধ্যে 'হিন্দু'ত্বের কোনও ভূমিকা নেই। ইসলামি বা ঔপনিবেশিক শাসনকালে এই বিভাজনটি প্রত্যক্ষ রাজতন্ত্র থেকে সরে গিয়ে বৃহত্তর সমাজজীবনে আশ্রয় নিয়েছিলো, বর্ণাশ্রম ইত্যাদির ছলে। তাই যথেষ্ট দীর্ঘকাল ধরে প্রান্তিক অন্ত্যজজনের যুদ্ধের সঙ্গে কালী ও তন্ত্রের সাব অল্টার্ন ব্যাখ্যা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

    অন্ত্যজগোষ্ঠীর দৈবী আত্মসমর্পণের আশ্রয় হিসেবে বিভিন্ন অনার্য, অব্রাহ্মণ ধর্মীয় লোকাচার সারা দেশে প্রচলিত থাকলেও স্ট্রাকচার্ড তন্ত্রসাধনা ও ব্যবস্থার উদ্ভব আচার্য অসঙ্গের চার-পাঁচশো বছর পরের ব্যাপার। আদিম কৌম প্রাকৃত শক্তিপূজা থেকে তন্ত্রসম্ভব সাধনার ব্যবধান প্রভূত। অষ্টম ও নবম শতকে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মে অভিনব গুহ্য সাধনতত্ত্ব, নীতিপদ্ধতি ও পূজা আচারের প্রসার দেখা যায়। এর মূল হিসেবে যে কারণ আমরা পাই তাও বেশ অভিনব। আচার্য অসঙ্গ অরণ্য পর্বতবাসী বৃহত্তর কৌম সমাজকে বৌদ্ধ ধর্মের সীমার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য সেই সমাজের প্রচলিত ভূত, প্রেত, যক্ষ, রক্ষ, যোগিনী, ডাকিনী, পিশাচ ও মাতৃকাতন্ত্রের নানা দেবীকে মহাযানী প্যান্থিয়নের মধ্যে স্থান করে দেন। নানা গুহ্য, মন্ত্র, যন্ত্র, ধারণী, বীজ, মন্ডল ইত্যাদি, যা আদিম কৌম সমাজের জাদুশক্তিতে বিশ্বাসের অঙ্গ ছিলো, মসৃণভাবে, সমাজতান্ত্রিক যুক্তি মেনে, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিভিন্ন ভাব কল্পনা ও ধর্মগত আচার অনুষ্ঠানে অনুপ্রবেশ করে।

    ২২.

    ইতিহাসের এই পর্ব থেকে সমাজের উচ্চবর্গীয় প্রতিনিধিদের ( ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মের ধ্বজাধারী) মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, এই বৃহত্তর ইতরযানী কৌম সমাজকে কোনপক্ষ নিজের দিকে টেনে আনতে পারে। আচার্য অসঙ্গ শুধু একজন বিশাল পন্ডিতই ছিলেন না, একজন অতি নিপুণ সংগঠকও ছিলেন। তাই এই সোশ্যাল চার্নিংয়ের প্রথম দফায় তিনি এই কৌম সমাজকে তাদের সংস্কার-কুসংস্কার, দেব-দেবী ভূত-প্রেত সহ সেকালের মূলস্রোতের ধর্ম মহাযানে আত্তীকৃত করলেন। ইতরযানী মানুষ ও বৌদ্ধ গোষ্ঠীগত ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে এই কামারাদোরি চলেছে পরবর্তী এক হাজার বছর ধরে। সমাজব্যবস্থায় সমতার দাবি নিয়ে আসা বৃহত্তর ইতর মানবগোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে চেয়েছিলো।

    ২৩.

    তন্ত্রসাধনার মূল স্রোতটি যে আচারপদ্ধতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, তা হলো পঞ্চ ম-কার ক্রিয়া। এই পদ্ধতিটি নিয়ে আবহমানকাল ধরে নানা ধরনের পরস্পর বিপ্রতীপ মতামত প্রচলিত রয়েছে। প্রায় সোয়াশো বছর আগে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবার উপক্রমনিকা হিসেবে একটি কৈফিয়ৎ যেমনভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো, ''...ভারত-প্রচলিত তান্ত্রিক উপাসনার প্রকৃত মর্ম ও পঞ্চ মকারের মূল উদ্দেশ্য আমাদের জ্ঞানে যতদূর উদ্বোধ হইয়াছে এবং ইহার আধ্যাত্মিক-তত্ত্ব যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে....'' ইত্যাদি। অর্থাৎ এই ব্যাখ্যাটির প্রামাণ্যতা নির্ভর করছে দু'টি বিষয়ের উপর, 'আমাদের জ্ঞান' ও ''যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে''। এ বিষয়ে সাক্ষী মানা হয়েছে 'আগমসার' নামের একটি প্রাচীন গ্রন্থের। এই গ্রন্থে প্রথম-ম, অর্থাৎ 'মদ্য' সাধন বিষয়ে বলা হয়েছে,
    '' সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে।
    পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ।।''
    তাৎপর্যঃ- '' হে পার্বতি ! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক।

    মাংসসাধনা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, ''মা, রসনা শব্দের নামান্তর, বাক্য তদংশভূত ; যে ব্যক্তি সতত উহা ভক্ষণ করে, তাহাকেই মাংসসাধক বলা যায়। মাংসসাধক ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে বাক্যসংযমী মৌনাবলম্বী যোগী।''

    মৎসসাধনার তাৎপর্য আরও গূঢ় ও প্রতীকী। '' গঙ্গা-যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য সতত চরিতেছে, যে ব্যক্তি এই দুইটি মৎস্য ভোজন করে, তাহার নাম মৎস্যসাধক। আধ্যাত্মিক মর্ম গঙ্গা ও যমুনা, ইড়া ও পিঙ্গলা; এই উভয়ের মধ্যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস, তাহারাই দুইটি মৎস্য, যে ব্যক্তি এই মৎস্য ভক্ষণ করেন, অর্থাৎ প্রাণারামসাধক শ্বাস-প্রশ্বাস, রোধ করিয়া কুম্ভকের পুষ্টিসাধন করেন, তাঁহাকেই মৎস্যসাধক বলা যায়।''

    মুদ্রাসাধনার তাৎপর্য এ রকম, '' .... শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্মে মুদ্রিত কর্ণিকাভ্যন্তরে শুদ্ধ পারদতুল্য আত্মার অবস্থিতি, যদিও ইহার তেজঃ কোটিসূর্য্যসদৃশ, কিন্তু স্নিগ্ধতায় ইনি কোটি চন্দ্রতুল্য। এই পরম পদার্থ অতিশয় মনোহর এবং কুন্ডলিনী শক্তি সমন্বিত, যাঁহার এরূপ জ্ঞানের উদয় হয়, তিনিই প্রকৃত মুদ্রাসাধক হইতে পারেন।''

    মৈথুনতত্ত্ব সম্বন্ধে 'অতি জটিল' বিশেষণ আরোপ করা হয়েছে আগমসার গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে, মৈথুনসাধক পরমযোগী। কারণ তাঁরা '' বায়ুরূপ লিঙ্গকে শূন্যরূপ যোনিতে প্রবেশ করাইয়া কুম্ভকরূপ রমণে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন।'' আবার অন্য ঘরানার তন্ত্রে বলা হচ্ছে,'' মৈথুনব্যাপার সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ, ইহা পরমতত্ত্ব বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে। মৈথুন ক্রিয়াতে সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং তাহা হইলে সুদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে।''

    যে 'সাধারণ' লোকেরা তন্ত্রের প্রথম উদ্গাতা ছিলো এবং ম-কার যাদের দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ, তাদের প্রতি পুরোহিতশ্রেণীর আশংকা, ''.... সাধারণ লোকে উদ্দেশ্য ও প্রকৃত মর্ম বুঝিতে না পারিয়া তন্ত্রশাস্ত্র ও তন্ত্রোক্ত পঞ্চ-মকারের প্রতি ঘোরতর ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন।'' উল্লেখ্য, বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য, উভয় ঘরানার তন্ত্রেরই আকর উৎস বিভিন্ন আগমশাস্ত্র। আগমশাস্ত্র বস্তুতঃ আদি প্রযুক্তিপ্রকৌশলের গ্রন্থিত সংগ্রহ। খেটেখাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষই আদিতে যাবতীয় আগমশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিলো। কালক্রমে এইসব ভৌতশাস্ত্র আধিদৈবিক অতীন্দ্রিয় কর্মকান্ডের রূপ পরিগ্রহ করে ইতরজনের নাগালের বাইরে চলে যায়। 'সাধারণ' জনগোষ্ঠীর নৈতিকতায় 'মৈথুন' কখনই ''কদর্য, কুৎসিত'' বোধ হয়নি। এই বোধটি আর্যায়নের সঙ্গে এসেছিলো। শাস্ত্রকার এভাবে ব্যাখ্যা করছেন, ''....আপাততঃ মৈথুন ব্যাপারটি অশ্লীলরূপে প্রতীয়মান হইতেছে, কিন্তু নিবিষ্টচিত্তে অনুধাবন করিলে, তন্ত্রশাস্ত্রে ইহার কতদূর গূঢ়ভাব সন্নিবেশিত আছে তাহা বুঝা যাইতে পারে। যেরূপ পুরুষজাতি পুংঅঙ্গের সহকারিতায় স্ত্রীযোনিতে প্রচলিত মৈথুন কার্য করিয়া থাকে, সেইরূপ 'র' এই বর্ণে আকারের সাহায্যে 'ম' এই বর্ণ মিলিত হইয়া তারকব্রহ্ম রাম নামোচ্চারণরূপে তান্ত্রিক অধ্যাত্ম-মৈথুন ক্রিয়া নিষ্পাদিত হইয়া থাকে।''

    শারীরিক মৈথুনের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন, আলিঙ্গন, চুম্বন, শীৎকার,অনুলেপ, রমণ ও রেতোৎসর্গ, তেমনই আধ্যাত্মিক মৈথুন ও যোগক্রিয়ায় তার সমান্তরাল কৃত্যও কল্পনা করা হয়েছে। সেখানে 'তত্ত্বাদিন্যাসের' নাম আলিঙ্গন, ধ্যানের নাম চুম্বন, আবাহনের নাম শীৎকার, নৈবেদ্যের নাম অনুলেপন, জপের নাম রমণ আর দক্ষিণান্তের নাম রেতঃপাতন। এই সাধনাটির নাম 'ষড়ঙ্গসাধন' এবং শিবের ইচ্ছায় একে 'অতীব গোপন' মোহর দেওয়া হয়েছিলো। তা ছাড়া '' কলির জীব পঞ্চ ম-কারের মর্ম বুঝিতে পারিবে না বলিয়া কলিতে ইহা নিষিদ্ধ হইয়াছে।'' অতএব ইতরজনের জন্য এইসব দর্শন 'নিষিদ্ধ' হয়ে গেলো এবং উচ্চবর্গ তাদের হাতে শেষ পর্যন্ত পেন্সিল ছাড়া আর কিছু থাকতে দিলোনা।

    ইতরজন ও নারীজাতি এই সব শাস্ত্র প্রণয়নের সময় একই ধরনের সম্মান(?) লাভ করতো। সাধনসঙ্গিনী নির্বাচনের যে প্রথাপ্রকরণ এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, সেখানে নারীকে একধরনের বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বোধ হতে পারে। নামে নারীই 'শক্তি', কিন্তু শক্তি সাধনের ষটকর্মে সাধনসঙ্গিনীর যে সব লক্ষণ নির্দেশ করা হয়েছে তার থেকে সম্মাননা বা অবমাননার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু উল্লেখ করা যায়। যেমন, সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পদ্মিণী নারী শান্তিদায়িনী। সে হবে গৌরাঙ্গী, দীর্ঘকেশী, সর্বদা অমৃতভাষিণী ও রক্তনেত্রা। শঙ্খিণী নারী হয় মন্ত্রসিদ্ধকারী। সে হবে দীর্ঘাঙ্গী এবং নিখিল জনরঞ্জনকারিণী। যে নারী নাগিনী গোত্রের, তার লক্ষণ হলো শূদ্রতুল্যদেহধারিণী, নাতিখর্বা, নাতিদীর্ঘ, দীর্ঘকেশী, মধ্যপুষ্টা ও মৃদুভাষিণী। এর পর কৃষ্ণাঙ্গী, কৃশাঙ্গী, দন্তুরা, মদতাপিতা, হ্রস্বকেশী, দীর্ঘঘোণা, নিরন্তর নিষ্ঠুরবাদিনী, সদাক্রুদ্ধা, দীর্ঘদেহা, মহাবাবিনী, নির্লজ্জা, হাস্যহীনা, নিদ্রালু ও বহুভক্ষিণী নারীকে ডাকিনী বলা হয় (যোগিনীতন্ত্রম)।

    ২৪.

    শাক্তদের মধ্যে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের নাম পশ্বাচারী ও বীরাচারী। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল প্রভেদ হচ্ছে বীরাচারে পঞ্চ-ম কারের প্রচলন আছে, পশ্বাচারে তা নেই। কুলার্ণবতন্ত্রে এই দু প্রকার আচারকে আবার সাত ভাগ করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বেদাচার উত্তম ( এই বেদাচারের সঙ্গে বৈদিক আচারের কোনও সম্পর্ক নেই), বেদাচারের থেকে বৈষ্ণবাচার উত্তম, বৈষ্ণবাচার থেকে শৈবাচার উত্তম, শৈবাচার থেকে দক্ষিণাচার উত্তম, দক্ষিণাচার থেকে বামাচার উত্তম, বামাচার থেকে সিদ্ধান্তাচার উত্তম, সিদ্ধান্তাচারের চেয়ে কৌলাচার উত্তম। কৌলাচারের চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই ( '... রামপ্রসাদ বলে নিদানকালে পতিত হবি কুল ছাড়িলে/ মন ভুলোনা কথার ছলে...' এখানে 'কুল' শব্দ দ্ব্যর্থবোধক। তা বংশসম্প্রদায় ও কৌলাচারের প্রতি আনুগত্য দুইই বোঝায়)।

    ২৫.

    বিভিন্ন দেবতার যেমন নিজস্ব বিশেষ বীজমন্ত্র আছে, বিভিন্ন তান্ত্রিক ক্রিয়ারও বিশেষ বীজ আছে। কালিকার বীজ একাক্ষর, তারার বীজ ত্র্যক্ষর এবং বজ্রবৈরেচনীর বীজ একাদশাক্ষর। যোগিনীতন্ত্রে এই কথা শিবের উক্তিতে দেওয়া হয়েছে। দেবীর এই তিন রূপের মধ্যে তারা ও বজ্রবৈরেচনী মূলতঃ বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী। পূর্ণাভিষেকের সময় স্বয়ম্ভূ-কুসুমাদির প্রতি যে শুদ্ধিমন্ত্র উচ্চারিত হয় তা এরকম, " প্লূং ম্লূং স্লূং শ্লূং স্বাহা'। আবার ব্রহ্মশাপ বিমোচন মন্ত্র, শুক্রশাপ বিমোচন মন্ত্র বা কৃষ্ণশাপ বিমোচন মন্ত্র মদ্যের প্রতি উৎসর্গিত হয়। এই সব শুদ্ধি মন্ত্র বা উৎসর্গ মন্ত্রে যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়া তা এরকম। 'খপুষ্প' মানে রজস্বলা স্ত্রীলোকের রজ, স্বয়ম্ভূ পুষ্প বা স্বয়ম্ভূ কুসুম মানে স্ত্রীলোকের প্রথম রজ ( '....যত বিষয় মধু তুচ্ছ হল, কামাদিকুসুম সকলে...: কমলাকান্ত), কুন্ডপুষ্প মানে সধবা স্ত্রীলোকের রজ, গোলকপুষ্প মানে বিধবা স্ত্রীলোকের রজ এবং বজ্রপুষ্প মানে চন্ডালীর রজ ( তন্ত্রসাধনায় এই 'চন্ডালী' নারীর বিশেষ কদর আছে)। এই লক্ষণটি তন্ত্রচর্চায় ইতরযানী স্বীকৃতির নিদর্শন। এই সব 'পুষ্প' বামাচারী তন্ত্র সাধনার জরুরি উপকরণ। বাউলচর্যাতেও আমরা এজাতীয় পদ্ধতির প্রচলন দেখতে পাই।

    ২৬.

    তন্ত্রশাস্ত্রে বিভিন্ন ইষ্ট দেবতা আছেন। ব্যক্তি বিশেষে কেউ কালী, কেউ তারা, কেউ বা জগদ্ধাত্রীকে ইষ্টজ্ঞানে পূজার্চনা করেন। এছাড়াও অন্যতর দেবীরাও আরাধ্যার ভূমিকায় রয়েছেন। উক্ত সব শক্তিদেবীর মিলিত তালিকা বেশ দীর্ঘ। তন্ত্র সাধন প্রণালীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা অতি জরুরি বিষয়। বিভিন্ন তন্ত্রে, যেমন পিচ্ছিলা তন্ত্র, বিশ্বসার তন্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতিতে গুরুর বিভিন্ন স্বীকৃত লক্ষণ বিবৃত হয়েছে। গুরুকে সর্ব শাস্ত্র পরায়ণ, নিপুণ, সর্ব শাস্ত্রজ্ঞ, মিষ্ট ভাষী, সুন্দর, সর্বাবয়ব সম্পন্ন, কুলাচার বিশিষ্ট, সুদৃশ্য, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী ইত্যাদি গুণশীল হতে হবে। একই নিয়মে শিষ্যের জন্যও নানা লক্ষণ নির্দিষ্ট রয়েছে।

    তন্ত্রসাধনায় মন্ত্রের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। শিষ্যের দীক্ষাকালে গুরু তাকে বীজমন্ত্র উপদেশ দেন। বীজমন্ত্র বিভিন্ন ইষ্ট দেবীর জন্য পৃথক হয়। সব ধরনের বীজমন্ত্রই অতীব গুহ্য, তাই তন্ত্রকারেরা তাদের গোপন রাখার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ও তার নতুন অর্থ সৃষ্টি করেছেন। এই সব শব্দের যে সব অর্থ করা হয় তা শুধুমাত্র তন্ত্রশাস্ত্রে অধিকারী ব্যক্তিরাই উদ্ধার করতে পারেন। একেবারে ক্ল্যাসিফায়েড কোডিং প্রসেস।

    এক আধটা উদাহরণ দিই। 'কালীবীজ' মন্ত্র, ' বর্গাদ্যং বণহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম'। এখানে 'বর্গাদ্য' শব্দের প্রতীক হচ্ছে 'ক', 'বণহি' শব্দের 'র', 'রতি' শব্দে 'ঈ' এবং তাতে বিন্দু যুক্ত। সব মিলিয়ে যে প্রতীকী শব্দটি তৈরি হলো তা হচ্ছে 'ক্রীং'। এভাবে 'ভুবনেশ্বরী বীজ' 'হ্রীং', 'লক্ষ্মীবীজ' 'শ্রীং'। যৌগিক বীজও আছে, যেমন 'তারাবীজ' ' হ্রীং স্ত্রীং হূ ফট' বা 'দুর্গাবীজ' 'ওঁ হ্রীং দূং দুর্গয়ৈ নমঃ'। এই তালিকাটি অতি দীর্ঘ ও এখানে আলোচনার উপযুক্ত নয়। এছাড়া এমন কিছু বীজ আছে যেগুলি বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

    ২৭.

    দেবী কালী (বা শক্তি) এবং তন্ত্রচর্চার সঙ্গে আরো একটি আচার, বিবিধ প্রকার বলিদান, অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এই জগৎজোড়া, প্রাগৈতিহাসিক ধর্মীয় লোকাচারটি আদিকাল থেকে বিভিন্ন কৌমসমাজে প্রচলিত আছে। 'বলিদান' একটি অতি প্রাচীন প্রথা। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু প্রাপ্তির আশায় জীবহিংসা করে গেছে। যদি সুমের সভ্যতাকে আদিতম ধরি, তখন থেকেই বলিদান প্রথা নথিবদ্ধ আছে। আসলে 'বলিদান' যাকে বাংলায় স্যাক্রিফাইস বলা হয়, তার কোন নির্দিষ্ট অধিষ্ঠাতা দেবতা নেই। এই প্রথাটি মূলত প্রজননতন্ত্র বা ফার্টিলিটি কাল্টের সঙ্গে যুক্ত। ভালো ফসল হওয়া, যুদ্ধে জয়ী হওয়া, সম্পদ আহরণ করা, ইত্যাদি, যেখানেই দেহি দেহি সেখানেই বলিদানের রমরমা। ধরা যাক মিশর বা ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতা, সেখানে রাজা মারা গেলে তার রানি ও সমস্ত দাসদাসী, সভাসদদের জীবন্ত রাজার সঙ্গে কবর দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে সব সেমিটিক ধর্মেই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলিদান করার প্রথাকে প্রচুর গরিমান্বিত করা হয়েছে। আব্রাহাম তাঁর পুত্র স্যামুয়েলকে ( ইব্রাহিম ও ইসমাইল) 'ঈশ্বর'কে প্রীত করার জন্য যখন বলি দিয়েছিলেন তখন থেকেই ইহুদি, খ্রিস্টিয় ও ইসলাম ধর্মে বলিদানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে। আমাদের মহাভারতেও শিবিরাজার পুত্রবলির বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। এই সব 'ঈশ্বর' তো পুরুষ। এ ছাড়াও মিশর থেকে আজটেক সভ্যতা সব স্থানেই সূর্যদেবতাকে (পুরুষ) প্রসন্ন করার জন্য নরবলি দেওয়া হতো। আমাদের প্রথম নাগর সভ্যতা অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতাতেও বলিদান বেশ প্রচলিত ছিলো। এই সময় দেবতারা সবাই পুরুষ। পুরাণযুগের বিখ্যাত অশ্বমেধযজ্ঞের বলি তো পুরুষ দেবতা অগ্নির উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হতো। প্রাক ইসলামি যুগে মক্কার কাবায়, যেখানে অসংখ্য স্থানীয় পুরুষ দেবমূর্তির পূজা হতো, সেখানেও বলিদান অতি প্রচলিত প্রথা ছিলো। হেলেনিক ও রোমান সভ্যতা, উভয় ক্ষেত্রেই প্রচুর নরবলির কথা শোনা যায়। হেলেনিক যুগে তো পাগান পুরুষ দেবতার উদ্দেশ্যে নারীবলির গপ্পো-ও লেখা আছে। খ্রিস্টিয়দের মধ্যে বলিদান নিষেধ হলেও স্ট্র্যাংসাহেবের অনুগামীরা গত শতকে বলিদান প্রথা অনুসরন করতো। এ যুগে মুসলিমদের মধ্যে ঈদ-এ-অধা ও হিন্দুদের পূজাস্থলে ছাগ, উট, ভেড়া, বা মহিষবলি সহর্ষে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। তবে বলি গ্রহণ শুধু শক্তিদেবীদেরই মৌরসিপাট্টা নয়, পুং দেবতারাও পুরোমাত্রায় এর সঙ্গে রয়েছেন।
    নারীপশু বা মানুষী বলি না দেওয়ার প্রথা মূলতঃ আমাদের দেশেই দেখা যায়। এর প্রধান কারণ এদেশে আদিকাল থেকে বলি দেওয়া হয়েছে পৃথিবীদেবীকে প্রসন্ন করার জন্য। নারীদেবতার উদ্দেশ্যে নারী পশু বা মানবীকে বলিদান করার প্রথা সম্ভবতঃ এই জন্যই রহিত হয়েছিলো। দ্বিতীয়ত পুরাণযুগের আগে থেকেই 'ভগবতী তত্ত্ব' অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রজয়িতা নারীরূপের ব্যপক স্বীকৃতিহেতু এদেশে নারী পশু বা মানুষ এই হিংস্র লোকাচারটি থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলো।

    ২৮.

    তন্ত্রে ও পুরাণে বলিদান একটি বেশ চর্চিত প্রসঙ্গ। মানুষের বোধের জগৎ অগ্রসরের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় লোকাচারের মধ্যে যে সব পরিবর্তন দেখা যায় বলিদানক্রিয়ার বিবর্তনও তার ছাপ বহন করে। পশুবধ থেকে উদ্ভিদবলি সেই যাত্রাপথেরই নিশানা দেয়। প্রথম যখন বড়িষা শীলপাড়ায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়িতে দুর্গাপূজার সময় মহিষবলি প্রত্যক্ষ করেছিলুম, সেই অভিজ্ঞতাটিকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমার বিসর্জন বা রাজর্ষি পড়ার দরকার হয়নি। মাইথনের কল্যাণেশ্বরী মন্দির, রাজরপ্পায় ছিন্নমস্তা মন্দির বা রামচন্ডীতে চন্ডীমন্দির, সম্বলপুরে সম্বলেশ্বরী মন্দির বা হায়দরাবাদে বকরিদ, বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষ্যে পশুহত্যার যে উল্লসিত উদযাপন চোখে পড়ে, তা এই লোকায়ত ঐতিহ্যেরই প্রাচীন সন্ধান। উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন পুরাণে বলিদান নিয়ে বৈচিত্র্যের কিছু নমুনা এখানে দিচ্ছি।
    কালিকাপুরাণে বলা হচ্ছে বলিদানের জন্য পক্ষী, কচ্ছপ, কুম্ভীর, মৎস,নয় প্রকার মৃগ, মহিষ, গোধিকা, গো, ছাগ, নকুল, শূকর, গন্ডার, কৃষ্ণসার, সরভ, সিংহ, ব্যাঘ্র, মনুষ্য, স্বীয় শরীরের রক্ত সবই চন্ডিকা-ভৈরবাদির বলিদানের জন্য প্রশস্ত এবং এই বলিদানের দ্বারা মুক্তি ও স্বর্গসাধন হয়। আবার পদ্মপুরাণ বলছে,

    'মদর্থে শিব কুর্বন্তি তামসা জীবঘাতনম।
    আকল্পকোটি নিরয়ে তেষাং বাসো ন সংশয়োঃ।।

    অর্থাৎ পার্বতী বলছেন, 'হে শিব, যে সব তামসিক ব্যক্তি আমার নিমিত্ত জীবহত্যা করে তাদের নিঃসংশয়ে কোটিকল্প নরকবাস হয়।'

    স্ববিরোধের নামই ভারতবর্ষ।

    ২৯.

    বাংলাদেশে শক্তিউপাসকেরা পশুভাব ও বীরভাব, মুখ্যত এই দুই ভাগে বিভক্ত। আগেই লিখেছি পশ্বাচারে পঞ্চ-মকারের প্রচলন নেই, যেটা বীরাচারে আছে। কুলার্ণবতন্ত্রে এই দুইভাবকে এইরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

    'সর্বেভ্যশ্চোত্তমা বেদা বেদেভ্যো বৈষ্ণবং মহৎ।
    বৈষ্ণবাদুত্তম শৈবং শৈবাদ্দক্ষিণমুত্তমম।।
    দক্ষিণাদুত্তমং বামং বামাৎ সিদ্ধান্তমুত্তমম।
    সিদ্ধান্তাদুত্তমং কৌলং কৌলৎ পরতরং ন হি।।'

    নিত্যাতন্ত্র অনুসারে বেদাচার ও বৈষ্ণবাচারে হিংসা, নিন্দা, কুটিলতা,মাংসভোজন, রাত্রিতে মালা ও যন্ত্রস্পর্শ তথা মৈথুন পরিত্যজ্য। শৈবাচারে পশুহত্যার বিধান আছে। দক্ষিণাচারে ভগবতীর পূজা ও রাত্রিকালে বিজয়গ্রহণ করে মন্ত্রজপ করতে হয়। বামাচারে মদ্য-মাংস পঞ্চতত্ত্ব ও খপুষ্প সহকারে বামাস্বরূপা কুলস্ত্রীর পূজা করতে হয়। সিদ্ধান্তাচারে অহরহ দেবপূজায় অনুরক্ত থেকে দিবাভাগে বিষ্ণুপরায়ণ ও রাত্রিতে যথাবিধি মদ্যাদি দান ও সেবন করতে হয়।

    কৌলাচারের কোনও দিক, কাল, তিথিনক্ষত্র ইত্যাদির নিয়মবদ্ধতা নেই। কৌলাচারী শিষ্ট-ভ্রষ্ট, ভূত-পিশাচ,কর্দম-চন্দন, পুত্র-শত্রু, কাঞ্চন-তৃণ বা শ্মশান-গৃহে ভেদজ্ঞান করেন না। কৌলাচারের পূজাপদ্ধতি যদি একটু বিশদে গিয়ে দেখি তবে তার সঙ্গে বিষ্ণুপ্রধান আর্য পূজা উপচারের মৌলিক ফারাকটি লক্ষ্য করা যাবে। তন্ত্রকল্পদ্রুম গ্রন্থে দেখছি যে সাধক অভীষ্ট মন্ত্র বা নাম সারাদিন বিভিন্ন প্রহরে সহস্রবার জপ করে বা করায় সে কালীকে তুষ্ট করতে সক্ষম হয়। কালী নিজে তার মধ্যে আবির্ভূতা হ'ন এবং সে কালিকারূপ ধারণ করতে পারে। মন্ত্রজপকালীন যে পূজা, তার উপচার হচ্ছে, স্বয়ম্ভূকুসুম, লিঙ্গপুষ্প, কুন্ডগোলোদ্ভব পুষ্প, সংযোগামৃত পুষ্প, অম্বুবাচীর সময় কামাখ্যাপীঠে নিঃসৃত স্রোতে রঞ্জিত বস্ত্র, অপরাজিতাদি পুষ্প, পীঠের জল, শক্তিচক্রক্ষালিত জলবিন্দু, কস্তুরী, কুঙ্কুম, নখি, কালাগুরু, গন্ধাষ্টক অর্থাৎ শ্বেতচন্দন, অগুরু, রক্তচন্দন, কর্পূর,শঠী,কুঙ্কুম, গোরোচনা, জটামাংসী ও গাটিয়ালা, ধূপ, দীপ, জবা, বক, রক্তচন্দন, সিন্দূর, মৎস্য,মাংস ইত্যাদি, পিষ্টক, মধু, পায়স,ক্ষীর,শোধিত রক্ত, মহোপচার, কটু, তিক্ত, কষায়, অন্ন, লবণ ও মধুর এই ষড়রসাশ্রিত নৈবেদ্য। এই উপচার দ্বারা 'মহাকাল কর্ত্তৃক উপসেবিত মহাকালী'র অর্থাৎ মহাকালী ও মহাকালের পূজা করতে হবে। এই পূজা শুরুর আগে পূর্ণগিরি, উড্ডীয়ন, জালন্ধর ও কামরূপ পীঠের উদ্দেশ্যে পূজা নিবেদন আবশ্যক। এবম্বিধ নির্দেশের অর্থ এই চারটি পীঠস্থান তন্ত্রঐতিহ্যে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। পূর্ণগিরি নামক শক্তিপীঠটি উত্তরাখন্ডে কুমায়ুঁতে অবস্থিত। উড্ডীয়ন পশ্চিম ওড়িশায়, জালন্ধর মধ্য পঞ্জাবে আর কামরূপ গুয়াহাটির কাছে, অসমে। প্রতিটি স্থানই পরস্পর থেকে বহুদূরে অবস্থিত এবং উড্ডীয়ন ছাড়া বাকি তিনটি পীঠেরই কোনও বৌদ্ধ যোগাযোগ নেই। পীঠমালাতন্ত্রে শিবের জবানিতে বলা হয়েছে,
    '' ত্রিদন্ডী চ ভবে`দভক্ত, বেদাভ্যাসরতাঃ সদা।
    প্রকৃতিবাদরতাঃ শাক্তা, বৌদ্ধাঃ শূন্যাভিবাদিন।।
    অতর্দ্ধোগামিন য়ে বা তত্বজ্ঞা অপি তাদৃশা।
    সর্ব্বং নাস্তীতি চার্ব্বাকা জল্পন্তি বিষয়াশ্রিতা।।''

    অর্থাৎ, যাঁরা বেদপাঠ করেন তাঁরা ত্রিদন্ডী, যাঁরা প্রকৃতিবাদী তাঁরা শাক্ত এবং যাঁরা শূন্যাদিবাদ নিরত তাঁরা বৌদ্ধ। বিষয়াশ্রয়ী চার্ব্বাকগণ এসমস্ত জানার পরেও নাস্তিক হয়ে থাকে। তারা কোনও কিছুরই অস্তিত্ত্ব স্বীকার করেনা।

    একটিমাত্র শ্লোকে ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ অধ্যাত্ম ঐতিহ্যের সার ধরে ফেলা হয়েছে। খুবই ইন্টারেস্টিং।

    ৩০.

    তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য পূজক বা সাধকের প্রতি অর্চনার যে বিধি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা এইরকম।
    '' যে কালীভক্ত একাগ্রচিত্তে সিন্দূরতিলকান্বিত হইয়া, তাম্বুলপূরিত মুখে, মুক্তকেশ, দিগম্বরবেশে শবযোনি অথবা শক্তিযোনিতে স্থিত অবস্থায়, অথবা শ্মশানে সুরতান্বিত হইয়া, শূন্যালয়ে, সিদ্ধপীঠে অথবা পুষ্পদ্বারা সুসজ্জিত শিবালয়ে মূলাধারস্থিত কুন্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করিয়া সহস্রদল কমলস্থ শিবের সহিত যোগ করিয়া খেচরী মুদ্রা দ্বারা সহস্রদল কমলনিঃসৃত অমৃতপান করে, সে কালীর দর্শন পায়।'' তন্ত্রে দু"টি মুদ্রার উল্লেখ রয়েছে, খেচরী মুদ্রা ও শাম্ভবী মুদ্রা। খেচরী মুদ্রায় মন অবলম্বন বিনা স্থির থাকে। প্রাণবায়ু সমাধি ছাড়াই স্থিরভাব ধারণ করে আর দৃষ্টিতে কোনও দর্শন থাকেনা। শাম্ভবী মুদ্রা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, '' বালক ও মূর্খের মন যেরূপ শয়ন না করিয়াও নিদ্রা যায়, তদ্বৎ যিনি বিনা অবলম্বনেই গমন করিতে পারেন'' তিনিই শাম্ভবী মুদ্রার অধিকারী।

    ৩১.

    ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে দেখি স্বয়ং নারায়ণের জবানিতে পাঁচজন দেবীকে প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। এঁরা হলেন,
    '' গণেশজননী দুর্গা, রাধা, লক্ষ্মীঃ, সরস্বতী।
    সাবিত্রীচ সৃষ্টিবিধৌ পরকৃতিঃ পঞ্চধা স্মৃতা।।''

    অর্থাৎ, তন্ত্রোক্ত প্রকৃতিদেবীদের কোনও রকম স্বীকৃতিই দেওয়া হলোনা। শুধু 'গণেশজননী দুর্গা, ''যিনি শিবরূপিণী শিবের প্রিয়তমা পত্নী, তিনিই নারায়ণী, পূর্ণব্রহ্মস্বরূপিণী বিষ্ণুমায়া।'' 'দুর্গা'নামক শক্তিদেবীর রূপটি হয়ে গেলো শুধু 'গণেশজননী', শিবের প্রিয়তম ভার্যা এবং 'বিষ্ণুমায়া'। ইতিহাসের এই পর্যায় থেকে অভিজাত আর্য বিষ্ণুপূজকেরা তন্ত্রোক্ত অগণিত প্রবল পরাক্রমী একেশ্বরী শক্তিদেবীর প্রতীকসমূহকে ডোমেস্টিকেটেড করে এক পুত্রবতী, স্বামীসোহাগী গৃহবধূতে রূপান্তরিত করে দিলেন। ভয়াল, ভয়ঙ্কর, ঘোরা, রক্তপিপাসিনী কালিকা দেবীর পরিবর্তে নিরীহ বাঙালি মানসে ঘরের মেয়ে গৌরী, আর্যায়িত গৃহিণী দুর্গা অনেক বেশি সমাদৃত ও স্বীকার্য বোধ হলো। দেবী দুর্গার অভিব্যক্তির এই ব্যঞ্জনাটিই আজ বাঙালিদের মধ্যে সমধিক প্রচলিত। শুধু এই দেবীর শারদীয় বা বাসন্তী পূজার্চনার সময় মার্কেন্ডেয় পুরাণের মন্ত্র উপচারের ছকটি অনুসরণ করা হয়। এই পুরাণে শ্রীশ্রী চন্ডী অংশে বলা হচ্ছে চন্ডিকাদেবী সত্যযুগে শ্রীদুর্গা রূপে মহিষাসুরকে বধ করতে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। তার পর শুম্ভনিশুম্ভ প্রভৃতি অসুরকে বধ করার জন্য শ্রীকৌষিকী বা অম্বিকাদেবী বা শ্রীকালী মূর্তিতেও আবির্ভূতা হয়েছিলেন। আবার তিনিই ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র রূপে আবির্ভূত হয়ে রাবণবধ এবং দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হয়ে কংসবধ করে ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ্য ধর্মস্থাপন করেছিলেন। সেই দেবীই কখনও বুদ্ধরূপে, কখনও শঙ্করাচার্যরূপেও জগতে আবির্ভূতা হ'ন।

    অসুরজাতির পূজিত যে নারীদেবতা পশ্চিম থেকে সিন্ধুনদ পেরিয়ে পূর্বদিকে হরপ্পায় এসে প্রজয়িতা প্রকৃতিদেবীর রূপে ভারতবর্ষে প্রথম প্রবেশ করেছিলেন, তিনিই অসংখ্য আলোড়ন ও রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে কালক্রমে চন্ডী বা দুর্গারূপ ধারণ করে অসুরনিধনেই নিযুক্ত হচ্ছেন। আবার তিনিই সময়ের সঙ্গে হয়ে যাচ্ছেন শ্রীকালী, শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ বা শঙ্করাচার্য।

    কী নাম দেওয়া যায় এর? সমন্বয় না স্ববিরোধ ? পাশ্চাত্যের মানুষ এখনও তার জবাব খুঁজে পেলোনা।

    ৩২.

    তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রে সমগ্র ভারতবর্ষের নানাপ্রান্তের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান দীর্ঘকাল ধরে নথিবদ্ধ আছে। আদিম কৌম সমাজের প্রকৃতিপূজা, জাদুভেল্কি, অলৌকিকের প্রতি কৌতূহল ইত্যাদি ক্রমশঃ পরিস্রুত হতে হতে একটা অন্যধরনের সাধনপদ্ধতি হয়ে গড়ে উঠেছিলো। প্রাথমিকভাবে আর্য বৈদিক ও পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি, একে আমল না দিলেও বৌদ্ধ আচার্য অসঙ্গের প্রত্যুৎপন্নতায় তা মহাযান বৌদ্ধ সংস্কৃতির মধ্যে বিকশিত হতে থাকে। কিন্তু বজ্রযান বা সহজযান যুগের পর যখন এদেশে বৌদ্ধধর্ম নিজস্ব স্ববিরোধের কারণে ক্রমশ বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে যায় তখন নবপর্যায়ের সনাতনধর্ম নিজের মতো করে এই সাধনপদ্ধতিটিকে আত্মস্থ করে নেয়। বাংলাদেশ ভিন্ন অন্যত্র সনাতনধর্মে দেবীপূজার চলিত আচারবদ্ধ প্রথাটিকে অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয় । তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে দেবীপূজার অংশটি সাধারণভাবে গুরুত্ব পায়না। কিন্তু বাংলাদেশে দেবীতত্ত্বকে কেন্দ্রে রেখে তন্ত্রসাধনার ধারাটিই মুখ্য হয়ে ওঠে। ষোড়শ শতক থেকে দেবী হিসেবে কালী এবং দশমহাবিদ্যার সাধনা তন্ত্রচর্চার প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিলো। এইসময় কালীপূজার বিধান রচনা করেন বিখ্যাত শাক্তসাধকেরা। এঁদের মধ্যে প্রধান নামগুলি কৃষ্ণানন্দ, ব্রহ্মানন্দ এবং পূর্ণানন্দ। এছাড়া ত্রিপুরার মেহরগ্রামের সর্বানন্দ ঠাকুর ছিলেন অতি প্রসিদ্ধ সাধক। কথিত আছে তিনি ভৃত্য পূর্ণানন্দের দেহের উপর আসীন হয়ে শবসাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন এবং দশমহাবিদ্যার সাক্ষাৎও লাভ করেন। তান্ত্রিকসাধনার ক্ষেত্রে তাঁর বংশধরেরা 'সর্ববিদ্যার বংশ' নামে খ্যাত ছিলেন। এছাড়া ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার সাধক দ্বিজদেবের কন্যা জয়দুর্গা, যিনি 'অর্ধকালী' নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন, স্বয়ং মহেশ্বরী হিসেবে তন্ত্রজগতে পূজিতা হতেন।

    ৩৩.

    স্ববিরোধের নামই ভারতবর্ষ !! আবার ভারতবর্ষ মানে সমন্বয়ের শেষ কথা। বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ভাবধারার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোটির ইতরজনের অধ্যাত্মসাধনা তন্ত্রদর্শনে এসে মিলে গিয়েছিলো। আর্যজনোচিত শ্বেতগন্ধপুষ্প বিলীন হয়ে গেলো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা হিবিস্কাস রোজা সাইনেন্সিস, পঞ্চমুখী রক্তজবার সঙ্গে। আমাদের চিন্তার ভুবনে কালীদেবী ও তাঁর রক্তজবা, পরস্পর ওতোপ্রোত দু'টি মাত্রা, সম্পূর্ণ ভিন্ন উৎস থেকে জন্ম নিয়েও কী করে 'এক' হয়ে গিয়েছিলো বা কোন মন্ত্রে এই পঞ্চদল ম্লেচ্ছপুষ্প বাঙালির কাছে পবিত্রতম অধ্যাত্ম অর্ঘ হয়ে উঠলো, তার রহস্য শুধু একজন ভারতীয়ই বুঝতে পারবে। সমন্বয়ের ঐতিহ্য একজন ভারতীয়কে চিন্তার জগতে একটা অন্যরকম গরিমা এনে দিতে পারে, আর্য-অনার্যবোধটি সেক্ষেত্রে নিতান্ত গৌণ। যাবতীয় কাতর আবেগকে পাত্তা না দিয়েও ''সার্থক জনম আমার ....'', উচ্চারণ করতে আমাদের দ্বিধা হওয়া উচিত নয়।

    ৩৪.

    তরুণ বয়স থেকেই বিভিন্ন জায়গায় কালীপূজা তথা শ্যামাপূজার রীতিপদ্ধতি অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করতুম। সেই সব পূজাস্থলে, গৃহ, মন্দির বা শ্মশানক্ষেত্রে, দীর্ঘরাত্রিব্যপী সর্বত্র হয়তো আমিই থাকতুম একমাত্র ব্যক্তি যে সম্পূর্ণ ভক্তিরহিত, কৌতূহলী এবং যার ঐ বিগ্রহের কাছে কোনও অনুকম্পার প্রত্যাশা নেই। শুধু বোঝার প্রয়াসে থাকতুম কীভাবে এই বিশেষ পূজাপদ্ধতিটি এদেশের অন্যান্য আর্যায়িত আরাধনাবিধির থেকে ভিন্ন। কারণ যে সব মন্ত্র ও অন্যতর আচারাদি এক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়, তার মধ্যে আমাদের দীর্ঘকালের আর্থ-সামাজিক ইতিহাস ওতোপ্রোত হয়ে আছে। শুধুমাত্র দৈবী অধ্যাত্ম আত্মসমর্পণ থেকে এর রহস্য উন্মোচন করা যাবেনা। আমার পক্ষে তন্ত্রসাধনার ইতিহাসের উৎসে পৌঁছোতে চাওয়া নেহাৎ পুথিগত ব্যসন। কারণ প্রায়োগিক আচার অনুষ্ঠান থেকে এই সাধনার স্বাদ পেতে গেলে যে প্রস্তুতির প্রয়োজন তা একান্তভাবেই আমার নাগালের বাইরে। তবে আসলকথা হলো, আমার পর্যায়ের অধ্যাত্মমননে বিগ্রহবিরোধী, ভক্তিহীন, দৈবমহিমায় অবিশ্বাসী 'পাপী'র থেকে এর থেকে অধিক কোনও প্রত্যাশাও করা উচিত নয়। কিন্তু বিস্ময়বোধ তো ফুরায় না, ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। সেই সব বিষয়ী, স্মার্ট, জ্ঞানী ব্যক্তিদের ঈর্ষা করি, যাঁদের কাছে বিশ্বসংসার হস্তধৃত আমলক বোধ হয়। বিস্ময়বোধের ছেলেমানুষিতে যাঁরা কাতর হন'না।কিন্তু তাঁদের সৌভাগ্যের স্বাদ বোধ হয় আমার জন্য নয়।

    তাই খুঁজে যাই, বইপত্রে খুঁজতে গিয়ে নানা চমকপ্রদ তথ্য ও বিবরণের সন্ধান পাই। সেসব অতি দীর্ঘ সাগরপ্রতিম বিস্তৃত শাস্ত্র। আরো অনেক অনেক প্রসঙ্গ নিজের জোরেই আসতে পারতো। কিন্তু থামতেও তো জানতে হবে। সেটাই তো আসল শিল্প। তবু শেষ পর্যন্ত একটা ব্যাপার যেন বিশ্বাস হতে থাকে, কালীতত্ত্ব, প্রকৃতপক্ষে ইতরবর্গীয় সংখ্যাগুরু দেশবাসীর আত্মপ্রতিষ্ঠার একটি স্বীকার্য খতিয়ান। আমি নিজে গোষ্ঠীগত অধ্যাত্মবৃত্তের বাইরের মানুষ, তাই নিজস্ব অপটু বোধে বিনির্মানের এই তত্ত্বকে বুঝতে চেষ্টা করি। হয়তো তা শেষ পর্যন্ত একটি ধী-হীন ধূলিমলিন অমেধাবী অপচয় হয়েই থেকে যাবে।

    ৩৫.

    এই লেখাটি যখন শুরু করি তখন এতোটা বিস্তৃত হবার কথা ভাবিনি। কারণ জনা দশেক পাঠকবন্ধু ছাড়া এই লেখা পড়ে ভারাক্রান্ত হবার ঝুঁকি কেউ নেবেন না বলেই মনে হয়েছিলো। খুব সামান্য সংখ্যক বন্ধুই এই ধরনের একটি বিষয়ে আগ্রহবোধ করবেন। যদিও এই বিষয়ে কিছু লেখা অত্যন্ত শ্রমসংকুল। কিন্তু লিখতে লিখতে দেখা গেলো স্বল্প হলেও কিছু বন্ধু লেখাটিতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন, তখন কিছু বিশদ হবার প্রয়াস পেলুম। যদিচ মূল আকর্ষণ, লিখতে গিয়ে নিজের শিক্ষার বৃত্তটি প্রসারিত করা। অ্যাকাডেমিকভাবে এই জাতীয় রচনাতে বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে অসংখ্য টীকা ও আকরস্রোতের প্রসঙ্গ নিয়ে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু এই পাতায় সে জাতীয় 'পন্ডিতি' করতে ঘোর অনিচ্ছাবোধ করলুম। তবু লেখাটি চলাকালীন যেসব আকরগ্রন্থ তথ্যসূত্র হিসেবে আলমারি থেকে আমার ডেস্কে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলো, তাদের একটি তালিকা নীচে সংলগ্ন করলুম। এ প্রসঙ্গে একটি আগাম অনুরোধ, এই তালিকা যেন আমার পন্ডিতম্মন্যতার নিদর্শন না হয়ে দাঁড়ায়। যদি কেউ মূল আকর গ্রন্থ থেকে আরো অগ্রসর পর্যায়ে যাবার ইচ্ছে করেন, তবে এই তালিকা হয়তো কাজে আসতে পারে। এই নামাবলী সংযোজন করার মূল কারণ ততোটুকুই।

    ঘনাদা, কল্লোলদা, de, tatin, শঙ্খ, সুমিতদা, PM, প্রমুখ যাঁরা লেখাটি প্রসঙ্গে তাঁদের ভালো লাগা জানিয়েছেন, তাঁদের অনেক ধন্যবাদ।

    শেষ পর্যন্ত গুরুর কাছে প্রার্থনাটুকু তো রইলো-ই, ''যেন আমার গানের শেষে, থামতে পারি সমে এসে.....''

    তমাম শুদ....

    কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্রঃ
    ১. ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ঃ অক্ষয় কুমার দত্ত
    ২. তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গঃ প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়
    ৩. বাঙ্গালীর ইতিহাসঃ আদি পর্বঃ নীহার রঞ্জন রায়
    ৪. ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্যঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত
    ৫. উপনিষদঃ স্বামী লোকেশ্বরানন্দ
    ৬. বাঙ্গালার ইতিহাসঃ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
    ৭. পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিঃ বিনয় ঘোষ
    ৮. রচনাবলীঃ সুধীর চক্রবর্তী
    ৯. প্রাচীন ভারত-সমাজ ও সাহিত্যঃ সুকুমারী ভট্টাচার্য
    ১০. ট্যাভার্নিয়রের দেখা ভারতঃ অনু-প্রেমময় দাশগুপ্ত
    ১১. ভবঘুরে শাস্ত্রঃ রাহুল সাংকৃত্যায়ন
    ১২. ভারতীয় আর্য্যজাতির আদিম অবস্থাঃ লালমোহন বিদ্যানিধি ভট্টাচার্য
    ১৩. বিষ্ণুপুরাণঃ অনু- রামসেবক বিদ্যারত্ন
    ১৪. বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতাঃ অনু-শরচ্চন্দ্র দাস
    ১৫. বৌদ্ধ গান ও দোহাঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
    ১৬. কালীতন্ত্রমঃ সং- জগন্নাথ দাস
    ১৭. কালিকা পুরাণ
    ১৮. মহানির্ব্বাণতন্ত্রঃ কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন
    ১৯. প্রাচীন ভারতঃ যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার
    ২০. পীঠমালা মহাতন্ত্রঃ অনু- রোহিণীনন্দন সরকার
    ২১. তন্ত্রকল্পদ্রুমঃ অনু-নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায়
    ২২. যোগিণীতন্ত্রমঃ অনু-শঙ্করাচার্য্য কাপালিক
    ২৩. প্রসাদপ্রসঙ্গ (রামপ্রসাদ সেনের জীবনী):দয়ালচন্দ্র ঘোষ

    i. The Wonder that was India : A.L.Basham
    ii. Hindu Manners, Customs & Ceremonies: Abbe J.A.Dubois
    iii. India's Ancient Past : Ram Sharan Sharma
    iv.India: Historical Beginnings and the concept of the Aryan: Romila Thapar et al
    v. The History of Ancient India : R.C.Dutt
    vi. The History of Early India : Romila Thapar
    vii. India: Al Biruni
    vii. Medieval India: The Study of a Civilisation: Irfan Habib
    viii. History of Medieval India: Satish Chandra
    ix. The Indian Buddhist Iconography: Binaytosh Bhattacharyya
    x. Indo Aryans : Rajendra Lala Mitra
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ নভেম্বর ২০১৩ | ৩৭৪৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Ramkrishna Bhattacharya | 125.187.50.241 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ০২:৪১45664
  • অতুলনীয় লেখা
  • শিবাংশু | 127.201.166.112 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ০৭:৫৭45663
  • ৭.
    বেদোক্ত শক্তিদেবীর দুটি অবতার কল্পনা করা হয়েছিলো। প্রথমযুগে তিনি পৃথিবীদেবী, অর্থাৎ আকাশদেবতা 'দৌ'য়ের সহধর্মিনী, যাঁর নাম দ্যাবাপৃথিবী। যিনি 'দৌ'রূপ পিতার রেতঃ অর্থাৎ বৃষ্টির ঔরসে প্রজননশালিনী হন এবং পৃথিবীকে শষ্যপূর্ণা করেন। যাঁর উল্লেখ ঋগবেদে এরকম,
    ' উচ্ছ্বংচস্ব পৃথিবী মা নি বাধথাঃ
    সূপায়নাস্মৈ ভব সূপবচনা।
    মাতা পুত্রং যথা সিচাভ্যেনং
    ভূম ঊর্ণিহি।।' ঋগবেদঃ ১০/১৮/১০-১১

    শেষ দুই পংক্তির অর্থ, ' যেরূপ মাতা আপন অঞ্চলের দ্বারা পুত্রকে আচ্ছাদন করেন, তদ্রূপ তুমি ইহাকে আচ্ছাদন কর।'

    ঋগবেদে এই মাতৃমূর্তি এখানেই শেষ হয়ে যায়না। এর পরে রয়েছেন দেবমাতা অদিতি ও দিতি। যদিও পুরাণে আদিত্যমাতা অদিতি ও দৈত্যমাতা দিতি দুই ভগিনী, কিন্তু ঋগবেদে অদিতি সীমাহীন অখন্ড বিশ্বের জননী এবং দিতি সীমায়িত খন্ডবিশ্বের জননী হিসেবে রূপায়িত করা হয়েছে। বেদপরবর্তীযুগে অদিতি কোথাও দক্ষজননী, কোথাও দক্ষকন্যা,। আবার এই দক্ষকন্যার রূপ একসময় সতীরূপে বর্ণিত হতে থাকে। এই সতী পর্বতকন্যা পার্বতী, পরবর্তীকালে অনার্য উমার ধারণার সঙ্গে মিলে গিয়ে অনার্যদেবতা শিবের শক্তিরূপিনী হয়ে ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্রের স্থায়ী অংশ হয়ে যান। কৌমসমাজে শিবের প্রতিপত্তির পুরস্কার হিসেবে শিব হয়ে যান দেবাদিদেব মহা ঈশ্বর, কালক্রমে বুদ্ধদেবের পরিবর্তিত জনসমাদৃত রূপে মহাদেব। ঐ মাতৃশক্তির দেবী শিবের সঙ্গিনী হয়ে বিশ্বের রহস্য বিষয়ে শিব অথবা মহাকালকে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন। এই প্রশ্নোত্তরকে লিপিবদ্ধ করেই বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্র প্রণীত হয়। মহাকালের শক্তিরূপিণী দেবী মহাকালী তন্ত্রমতের প্রধান আরাধ্যা দেবী হয়ে ওঠেন। এই কালীকে কালক্রমে নানা অবতারে প্রকট হয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মূর্তিতে পূজিতা হতে দেখা যায়। 'পদ্মপুরাণে'র সৃষ্টিখন্ডে বিষ্ণু সাবিত্রীদেবীকে স্তব করে বলছেন,
    ' সর্বগা সর্বভূতেষু দ্রষ্টব্যা সর্বতোহদ্ভূতা।
    সদসচ্চৈব যৎকিঞ্চিদ্দৃশ্যং তন্ন বিনা ত্বয়া।।
    তথাপি যেষু স্থানেষু দেঅষ্টব্যা সিদ্ধিমীপ্সুভিঃ
    স্মর্তব্যা ভূতিকামৈর্বা তৎ প্রবক্ষ্যামি তেহগ্রতঃ।।' (১৭/১৮২-৮৩)
    এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যদেবতা বিষ্ণু অর্গলহীন প্রশস্তিতে দেবীকে প্লাবিত করছেন। এই প্রশস্তির পরে অতিদীর্ঘ তালিকা আছে কোন স্থানে দেবী কোনরূপে পূজিতা হবেন। যেমন পুষ্করে সাবিত্রী, বারাণসীতে বিশালাক্ষী, নৈমিষারণ্যে লিঙ্গধারিণী, প্রয়াগে ললিতাদেবী ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ সারাদেশে বিভিন্ন রূপে পূজিতা অনার্য শক্তিদেবীরা একস্ট্রোকে ব্রাহ্মণ্য প্যান্থিয়নের অংশ হয়ে আর্য মূলস্রোতে মিশে গেলেন। অবশ্য এটি হলো সমগ্র ভারতবর্ষের হিসেব। বাংলাদেশের আবার নিজস্ব স্থানীয় শক্তিদেবীর তালিকা আছে। মাণিক গাঙ্গুলীর 'শ্রীধর্মমঙ্গলে' উল্লেখ পাই, ফুলায় জয়দুর্গা, বৈতালে ঝকবুড়ি, খপুতে খেপাই, আমতায় মেলাই, কালীঘাটে কালী, সৌলায় রঙ্কিনী, বিক্রমপুরে বিশালা ইত্যাদি।

    ৮.
    আদিমকাল থেকেই প্রকৃতিপূজায় আরাধ্যাকে নারীরূপে কল্পনা করা এবং প্রজনন উর্বরতার সাধনাকেই স্ট্রাকচার্ডভাবে মানুষের মূলস্রোতের পূজাপদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটা সচেতন প্রয়াস কৌম সমাজের মধ্যে সর্বত্র দেখা যায় । মাতৃতান্ত্রিকতার এই প্রভাবী লক্ষণটি প্রথম পর্যায়ে আর্যব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অংশ ছিলোনা । সংখ্যাগুরু জনতার চাপে ব্রাহ্মণ্যশক্তি এই ধারণাটিকে গ্রহণ করতে কিছুটা বাধ্য হয়, কিন্তু তা এক অনিচ্ছাকৃত আপোসমূলক সমঝোতা ছিলো । ইতরযানী জনসমষ্টির কাছে দেবীশক্তির 'প্রশ্নাতীত' মহিমাকে কিছুটা তরলীকৃত করার উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে পুরুষমহিমাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে আর্যীকরণ করে নেওয়া হয় । প্রায় সব তন্ত্রেই দেখা যায় পুরুষদেবতা শিবই কথক ও ব্যাখ্যাকারী এবং পার্বতী বা নারীদেবী শুধুই শ্রোতা ও প্রশ্নকারিণী । অর্থাৎ সব গূঢ় প্রশ্ন, প্রসঙ্গ, প্রচয়, প্রতিমার উত্তর বা সমাধান, শিবের ধারণবিশ্বে ধৃত রয়েছে । তিনি প্রকৃতিদেবীর মাধ্যমে তাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। মহানির্বাণতন্ত্রে দেখছি,
    পার্বতী উবাচ, '' হে দেব-দেব, জগন্নাথ, আপনি আমার নাথ ও দয়ার সাগর; হে দেবেশ, আমি আপনার অধীনা এবং সর্বদা আপনার আজ্ঞাচারিণী । আপনার অনুমতি না হইলে, আমি আপনার নিকটে কোনও কথা বলিতে পারিনা; (যাহা হউক) যদি আমার প্রতি আপনার কৃপাকণা প্রকাশ থাকে এবং আপনি যদি আমার প্রতি স্নেহপ্রবণ হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার মনের বাসনা আপনার নিকটে প্রকাশ করিতে পারি;'' ইত্যাদি ইত্যাদি,

    উত্তরে শিব বলছেন, " হে প্রাণবল্লভে, তুমি অতিশয় বুদ্ধিমতী, তুমি কী জানিতে ইচ্ছা করিয়াছ , বলো ; যাহা গণেশ বা কার্তিকের নিকট প্রকাশ করি নাই, তোমার নিকট তাহা বলিতে আমার বাধা নাই । যদি বিশেষ গোপনীয়ও হয়, তাহা হইলে আমি তাহা তোমার নিকটে ব্যক্ত করিব ; ত্রিলোকমধ্যে এমত কোনও বিষয় দেখিতে পাইনা, যাহা তোমার নিকটে গোপন থাকিতে পারে । হে দেবি, তুমি আমারই স্বরূপ, 'তোমাতে' আর 'আমাতে' কোনও ভেদ নাই ; তুমি সর্বজ্ঞা হইয়াও অনভিজ্ঞের ন্যায় আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ।''

    এই কল্পিত কথোপকথনটি ঊদ্ধৃত করার পিছনে উদ্দেশ্য হলো এর থেকে ভাবমূর্তি সৃষ্টির একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন উঠে আসছে । শিব একজন পত্নীপ্রাণ গৃহী, সংসারী মানুষ এবং পার্বতী তাঁর অনুগতা, আত্মনিবেদিতা ভার্যা । তাঁরা অন্য আর পাঁচটা সাধারণ পারিবারিক মানুষের মতো গার্হস্থ্য আলোচনার ঢঙে ভূমাবিশ্বের রূপরহস্য আলোচনা করছেন। ব্রাহ্মণ্যব্যবস্থা অনুমোদিত পরিবারের স্ট্রাকচারটিই শুধু নয়, তার সদস্যদের আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্কটিও এক্ষেত্রে জ্ঞাপন করা হলো, যা এদেশে একটি শাশ্বত মডেল হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়, শিব বলছেন যে পার্বতী তাঁর মতো-ই 'সর্বজ্ঞা', তবু 'অনভিজ্ঞা'র মতো শিবের কাছে রহস্য জানতে চাইছেন। অর্থাৎ পার্বতী স্বামীর মতো শক্তিশালিনী হওয়া সত্ত্বেও পত্নী হিসেবে লো প্রোফাইল হয়ে থাকাই স্বীকার করছেন । এখানে ইঙ্গিতে পুরুষপ্রধান ব্যবস্থার 'প্রাধান্য'কে স্বীকার করে নেওয়া হলো এবং একজন নিবেদিতা 'স্ত্রী'র ভূমিকায় পার্বতী সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন । সনাতন শাস্ত্রীয় পরিকাঠামোতে পিতৃতন্ত্রের আরেকটি সফল পৌরাণিক প্রতিস্থাপন সম্ভব হলো।

    (ক্রমশঃ)
  • Ramkrishna Bhattacharya | 125.187.60.225 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৩ ০২:৩৪45666
  • শিবাংশুকে অনুরোধ, একটা এপিসোড ছোট করে লেখ । মানে ভাগ ভাগ করে । তাহলে পড়তে সুবিধে হবে । আর তোমার লেখা কমেন্টে দিচ্ছো কেন ?

    দেখবে- নীচে আছে ( লগড ইন থাকলে ) অ্যাড টু দি ফার্ষ্ট পোষ্ট । ওভাবে লিখলে মূল লেখার সাথে যুক্ত হবে ।

    আমি পড়ে যাচ্ছি গুরুতে লেখা, এই সম্পদ
  • de | 190.149.51.69 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৩ ০৬:৫৮45667
  • সত্যিই সম্পদ - লেখাটা পুরো হলে একসাথে প্রিন্ট নিয়ে রাখবো - খুব ভালো লাগছে!
  • কল্লোল | 125.242.191.249 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৩ ১২:৪১45665
  • এক্ষুনি সাব্বাশ লিখতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু না, লেখাটা শেষ হোক।
  • tatin | 127.197.82.40 (*) | ২৪ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:১৯45668
  • অসা! কিন্তু সহজযানকে এককথায় ব্যাভিচার বলা কি ঠিক?
  • শঙ্খ | 169.53.46.143 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৩ ০৭:৫৭45669
  • দাপুটে লেখা! কুর্ণিশ!!
  • sumit roy | 184.44.188.234 (*) | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০১:৪৪45670
  • সুবিন্যস্ত, সুলিখিত, বিদ্বজ্জনমোহন-- শিবাংশুর কাছে যেমনটি আশা করা যায়। সাধু!
    "কৌম" শব্দের অর্থ জানাবেন, খুঁজে পাচ্ছি না।
  • শঙ্খ | 169.53.174.143 (*) | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০২:৪৩45671
  • যদ্দূর জানি কৌম মানে কম্যুনিটি।
  • শিবাংশু | 127.197.234.55 (*) | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:২৪45672
  • সুমিতদা,
    'কৌম' মূলতঃ একটি আরবী শব্দ । বাংলায় এর অর্থ করা হয়, জনগোষ্ঠী বা জনসমাজ । উর্দুতে এর বহুবচন 'অকওয়াম' এবং অর্থ হিসেবে বর্ণ, জাতি ও রাষ্ট্র, তিনটিই বোঝায় । বাংলায় ভাবার্থে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীই বোঝানো হয়ে থাকে ।
  • তাতিন | 127.197.65.72 (*) | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:২৮45673
  • কৌল শব্দটা কীসের থেকে এসেছে?
  • শিবাংশু | 127.197.234.55 (*) | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৬:১৬45674
  • তাতিন,

    'কৌল' গঠনগতভাবে 'কুল' শব্দের বিশেষণ । তবে তন্ত্রে এর তাৎপর্য আলাদা। এই শাস্ত্রে 'কৌল' শব্দ নানা ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করা হয় । কুলাচার বা বীরাচার এক ধরনের তন্ত্রসাধনপদ্ধতি। কুলাচারকেই কৌলাচারও বলা হয়ে থাকে। তাই তন্ত্রে 'কৌল' অর্থে 'কুলাচাররত', 'কুলাচারবিৎ',কুলাচার প্রবর্তক,কুলাচার অনুসারে শক্তিপূজক, দিব্যভাবরত তান্ত্রিক,বামাচারী, বামাচারীর ধর্ম ও অনুষ্ঠান ইত্যাদি সবই বোঝায় ।
  • কল্লোল | 125.241.75.76 (*) | ২৭ নভেম্বর ২০১৩ ১২:৫৬45675
  • অ শিবাংশু তাপ্পর?
  • PM | 37.130.247.169 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৩ ০৩:৫৮45676
  • এরকম একটা ক্ষীর নামাতে কী পরিমান দুধ নিয়ে ঘাটতে হয়েছে শিবাংশুবাবুকে ভাবতেই শিহরিত হচ্ছি
  • Nina | 78.37.233.36 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৩ ০৬:৫৭45677
  • শিবাজি
    গুরুতে আসা সার্থক হল । আমার।
  • নী-পা | 37.125.200.19 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৩ ০৭:১০45678
  • কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলি : তামাম ন্ শুদ্ ।।
  • i | 147.157.8.253 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৩ ০৯:০৮45679
  • শিবাংশুদা,
    প্রণাম রইল।
  • তাতিন | 132.252.251.244 (*) | ২৯ নভেম্বর ২০১৩ ০৬:১৭45680
  • এই সাধনয়ার্গকে কুলাচার বলা হয় কেন সে নিয়ে কিছু জানা যায়? 'কুল' শব্দটি বিভিন্নক্ষেত্রে পরিবার বা পরম্পরা বোঝাতে ব্যবহার হয়। সেই 'কুল' আর কুলাচারের সম্বন্ধ জানা গেলে সমাজ সভ্যতার ইতিহাসকে ভীষণ অন্যভাবে দেখতে পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয়। সিম্পলি 'শ্যাম রাখি না কুল রাখি' বাক্যাংশই সাধনমার্গের তত্ত্ব হিসেবে সামনে চলে আসতে পারে। বংশপরম্পরার পিছনে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ছাড়াও বিভিন্ন প্র্যাক্টিসের বহমানতাও হয়তো দেখতে পাওয়া যায়। এমন কী বর্ণ-বিবাহেরও একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে কি?
  • শিবাংশু | 127.197.241.95 (*) | ২৯ নভেম্বর ২০১৩ ০৬:৪৪45682
  • প্রথমে তাতিন,

    ১. সহজযানী সাধনাকে এককথায় 'ব্যভিচার' কখনই বলা যায়না। আমিও তা বলিনি। তবে যেকোন অধ্যাত্মদর্শনে আয়ু সঞ্চার করতে গেলে কিছু ন্যূনতম অনুশাসন পালন করতে হয়। সত্যিকথা বলতে কি এই অনুশাসনের মেরুদন্ডকে নির্ভর করেই সব গোষ্ঠীগত ধর্মভাবনা টিকে থাকে। এই সত্যটি, রেনেশাঁসের পরে গড়ে ওঠা মানুষের রাজনৈতিক বোধভিত্তিক গোষ্ঠীনির্মাণের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। 'সহজ' হতে হতে একদিন এই গোষ্ঠীটির ক্রিয়াকর্ম অবক্ষয়ের রসাতল স্পর্শ করে। রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে সামগ্রিকভাবে তন্ত্রদর্শন বিষয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা প্রকৃতপক্ষে সহজযানী তন্ত্রকে উদ্দেশ্য করেই রচিত হয়েছিলো।
    ''To the historian, the Tantra literature represents, not a special phase of Hindu thought, but a diseased form of the human mind, which is possible only when the national life has departed, when all political consciousness has vanished, and the lamp of knowledge is extinct.'' (The History of Ancient India-1914)
    ব্রাহ্মদের কথা ছেড়েই দিচ্ছি, ঊনবিংশ শতকে সনাতনধর্মীয় সুশীল সমাজের একজন প্রধান প্রতিভূর এই ধারণাটি বস্তুতঃ সামগ্রিকভাবে একটি সামাজিক অবস্থানকেই সূচিত করছে। যদিও সহজযান ছাড়াও তন্ত্রের অসংখ্য মাত্রা রয়েছে, কিন্তু এই সাধনপদ্ধতির অবক্ষয়ের দিকটিই সে সময় তন্ত্রচর্চার মূলস্রোত হিসেবে গৃহীত হয়েছিলো। এখনও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি ।

    ২. তন্ত্রমতে কুলাচারের 'কুল' প্রচলিত অর্থে জাতি, গোষ্ঠী, বংশ বা সমুদায়কে সূচিত করেনা। এই 'কুল' এসেছে 'কুলকুন্ডলিনী' নামক পরিভাষাটি থেকে। এই 'কুল' মানে ' মূলাধারচক্রে সার্ধত্রিবলয়াকারে স্বয়ম্ভূলিঙ্গবেষ্টিত' স্নায়ুব্যবস্থা। এই কুলকে জাগ্রত করাই কুলাচারের শেষ অভীষ্ট। কারণ এই স্থানেই 'কুন্ডলাকৃতি শিবশক্তি' নিদ্রিত অবস্থায় থাকেন । তিনি জাগ্রত হলে সাধক নিজেই শিবত্ব প্রাপ্ত হ'ন। 'কুল' শব্দের আরো একটি অর্থ আছে, 'দেহ'।

    নিনা, ইন্দ্রাণী, নী-পা আমাকে কিঞ্চিৎ লজ্জিত করলেন যে ... :-)

    আর সত্যিকথা বলার জন্য ঋত্বিকের জন্য বাহবা রইলো।
  • Rit | 213.110.246.230 (*) | ২৯ নভেম্বর ২০১৩ ০৯:১২45681
  • পড়লাম। সব বুঝতে পারলাম না। আবার পড়তে হবে।
  • শিবাংশু | 127.201.164.123 (*) | ৩০ নভেম্বর ২০১৩ ০৩:২৬45684
  • আরে কল্লোলদা,

    অতো লুটিস দিয়ে শেষ করলুম যে, তার পরেও ... :-)
  • কল্লোল | 125.241.112.228 (*) | ৩০ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:৫০45683
  • হতাশ ইমো।
    ক্রমশঃ দিয়ে একটা ল্যাখা শেষ হয়ে গেলো।
    দ্যাখা হলে পাক্কা এক মিনিট কথাই বলবো না।
  • rivu | 140.203.154.17 (*) | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৬:০৪45686
  • কি দুর্ভাগ্য যে এই লেখাটা মিস করে গেছিলাম। একটু একটু করে পড়ছি । কিন্তু একটু খটকা লাগলো শুরুতে, যেখানে শিবাংশুদা বলছেন, " রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দর কাব্যে" ইত্যাদি। বিদ্যাসুন্দর ভারতচন্দ্রের না?

    আর শিবাংশুদার কাছে অনুরোধ রইলো (আগেও করেছি একবার :-) ), যদি দুর্গার বর্তমান রূপের (এই লক্ষী, সরস্বতী, শিব, কার্তিক গনেশ সকলকে নিয়ে একটা ফ্যামিলি পিকনিক) ব্যাপারে একটু লেখেন সময় করে।

    গুরুর সমুদ্র মন্থনে অমৃত উঠছে, আরো উঠবে।
  • মারকন্ড পুরানে দেবীর ধ্যানমন্ত | 111.210.223.109 (*) | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৬:৫৮45685
  • মারকন্ড পুরানে দেবীর ধ্যানমন্ত্র কোথায় পাবো ?
  • শিবাংশু | 127.197.253.144 (*) | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৮:১০45687
  • rivu,
    ".... রামপ্রসাদ রাজদত্ত নিষ্কর ভূমি ও কবিরঞ্জন উপাধি প্রাপ্ত হইয়া কৃতজ্ঞতার প্রতিদানে একখানা কাব্য রচনা করতঃ 'কবিরঞ্জন বিদ্যাসুন্দর' নাম দিয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে উপহার প্রদান করেন । এই কাব্যরচনায় তিনি আপন রুচি ও উদ্দেশ্যের প্রতি দৃকপাত না করিয়া, কেবল যাহাতে রাজার তুষ্টিসাধন হয়, তাহাই করিয়াছেন ।"

    দয়ালচন্দ্র ঘোষ 'প্রসাদ প্রসঙ্গ অর্থাৎ সজীবনী-প্রসাদী-সঙ্গীত কাব্য' নামে একটি গ্রন্থ লেখেন ১৮৮৬ সালে । উপরের ঊদ্ধৃতিটি সে বইটি থেকে নেওয়া । রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের 'বিদ্যাসুন্দর' আর কবিরঞ্জন রামপ্রসাদের 'বিদ্যাসুন্দরে'র আখ্যানভাগে মিল থাকলেও দুজনের রচনারীতি বা প্রকাশভঙ্গির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। দয়ালচন্দ্রের মন্তব্যের মধ্যে একটা অ্যাপোলোজেটিক সুর চোখে পড়বে । কারণ রামপ্রসাদের মতো একজন ঐশী সমর্পিত সাধক কেন 'বিদ্যাসুন্দরে'র মতো একটি আদিরসাত্মক (?) রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন ? হতে পারে রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতার চিণ্হ হিসেবে । কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর কালীকীর্তন শুনে । রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বৌদ্ধিক স্তর তাঁর সমসাময়িক সামন্ততান্ত্রিক রাজাগজাদের থেকে বেশ খানিকটা উপরে ছিলো । যাই হোক, 'বিদ্যাসুন্দর' কাব্য লিখতে গিয়েও রামপ্রসাদ তাঁর কুলাচারী তান্ত্রিক সত্ত্বাটিকে জাগরূক রেখেছিলেন, তাই আমরা এই কাব্যের একটি ভিন্নতর রূপ পেয়েছিলুম ।
    ----------------------------------------
    পরিবারকর্ত্রী দুর্গা এক ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের সমাজতাত্ত্বিক মাত্রার ফসল । কখনও সময় পেলে পৃথকভাবে নিশ্চয় লিখবো ।
  • rivu | 140.203.154.17 (*) | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৯:৩৫45688
  • ধন্যবাদ শিবাংশুদা।
  • b | 135.20.82.164 (*) | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৪:০১45689
  • রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দর দেখেছি। সেখানে ভারতচন্দ্রীয় বৈদগ্ধ্য এক্কেবারে নেই।
  • শিবাংশু | 127.197.245.225 (*) | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৫:১২45690
  • b,
    ভারতচন্দ্র তেলরঙের শিল্পী, রামপ্রসাদ জলরঙের। তুলনাটা বোধ হয় একটু বেমানান । সব চেয়ে বড়ো কথা রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দর লেখার জন্যই লেখা, সেটা তো সবাই মানে।
  • pall lobe | 24.195.232.110 (*) | ৩১ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:২৯45691
  • খুব ভালো লেখা !
  • কল্লোল | 116.216.180.156 (*) | ০২ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:৩৫45692
  • মাথা নুয়ে আসে।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন