মণিবন্ধের পুঁতিগুলি ছিটকে পড়লো
তুমি বললে এমনতরো বিপর্যয় তো আর ঘটেনি
পর্দা ফেলো, জ্বালাও আলো খুঁটিয়ে তোলো
ভাগের কড়ি সিকের মধ্য গুছিয়ে রাখা
শীতের জামা।
সত্যি তখন মানবজমিন কোমরজলে
এদিক ওদিক ঠিকরে পড়ে ঝড়ের পাতা পাখির পালক ধুলোয় চাপা আলোর দানা
কীটপতঙ্গ মরিয়া হয়ে ঘরে ঢুকছে।
হৃদয় তখন বাম পকেটে দুপুর ঘুমে
আমরা কিন্তু খুব সতর্ক, পলক সামাল।
রোদের মধ্যে ছায়ার মধ্যে নক্সাকাটা
শিরায় শিরায় বাক্স বাক্স বাড়ি ঘরদোর
দেখতে দেখতে যখন দেরাজ তোরঙ্গদের
অন্ধকারে হারিয়ে গেল মণিবন্ধ
তুমি বললে এমনতরো বিপর্যয় তো আর আসেনি
আমরা বরং শরৎ নিয়ে পদ্য লিখি।
কিন্তু তখন ঝুপসিমত গুল্মলতা
দেখতে গেছি পতঙ্গদের চটক আলো
ঝিমোচ্ছিলাম দ্রব্যগুণে চেয়ার কষে
মণিবন্ধের পুঁতিগুলি গুছিয়ে রাখা।
পৃথিবী নেহাত থাউকা এবং অনিশ্চিত।
সাত বছর আগের তোরঙ্গ থেকে বের করে আনা পাঞ্জাবীতে দেখি ছেঁড়া সুতো, খয়ের, মৃত্যুর দাগ, তাকে ইস্তিরি করে চেপেচুপে সিধে করে ছবি তুলি, আলো লাগে চোখে।
বাঘাযতীন স্টেশনে এক বুড়ি এসেছিল, সে খালি বাড়ি যেতে চায়, তার ছেলেকে খবর দিতে বলে, কিন্তু তার বাড়ি গেছে অন্য দেশে, ছেলেটিও যদ্দুর বোঝা গেল এই স্থানকালে অবর্তমান, লোকে তাকে নিয়ে তামাশা করে। খেতে দেয়, রসিয়ে রসিয়ে জানতে চায় পিঠে তার তারকাঁটার দাগ আছে কিনা। সাউথ লাইনের স্টেশনে স্টেশনে এইরকম ব্যাপার, যদিও তৎকালীন রেলস্টেশনে কী সুন্দর রোদই না উঠতো, যাদু হতো ঘুর্ণি হাওয়ায়, ইউক্যালিপটাসের পাতা টাতা, বয়েসটাই ছিল তারাপদবাবুর ভালোবাসার নীল পতাকার মত। কিন্তু এখন দেখি শুকনো মৃত্যুর দাগ লেগে গেছিল, খুঁটলে নখে উঠে আসে।
এইসবই আজাইরা গল্প, আরো কতকাল আগে মধ্যরাতে হাসপাতালের সামনে হুইলচেয়ারে মুমূর্ষু আর নর্দমায় মাতাল দেখা একই রকম ভয়ের ছিল, যদিও তখন ঘাসে ঘাসে বিস্ময়, দিগন্তরেখা বিরল নয় মোটে, ভিখিরি এসে আশীর্বাদ করে নিয়ে যেত খুদ, আপাতনিরীহ পৃথিবীর পেটে পেটে ছিল কত প্যাঁচ।
এখন পথের দিকে তাকালে দেখা যায় লোকজন হেঁটে হেঁটে গেছে নানাদিকে, কাটাকুটি খেলে, পদ্মা হুগলি সবরমতি গন্ডক গোমতী, দয়ানদীর ধার ঘেঁষে।
ঐসব ঘটে যায়, তোমার নিকটে যাই, পাশে বসে বসে খুঁটে তুলি উদাসীন মৃত্যুর দাগ, কৌটোয় ভরে, ছন্দ টন্দ দিয়ে খুব করে ঝাঁকিয়ে নিয়ে, শালপাতার ঠোঙায় ভরে দিই, তোমার নিকটে যাই, বসে বসে দেখি কীরকম চলে যায় সারি সারি অনিশ্চিত, থাউকা সময়।
আমি বুঝিনা কেন মানুষকে ডাকবো বক কিংবা সুবর্ণগোধিকা কিংবা লতছই বলে
বুঝিনা কেনই আমি বিফল যাপনকে আনবো চিটপিটে সিজলার সস দিয়ে গরম গরম সব পাঠক সমুখে
মানুষের রক্তপিপাসা মনুষ্যোচিত নয়, এই কথা কেন আমাকে ক্লিওপাট্রার মসলিন শাড়ির মত সাতপল্লা করে লিখতে হবে সাজিয়ে গুছিয়ে যেন একটু একটু দেখা যায় শুধু
দুর্দ্দুর পোষায়না আর, এই কথা বলতে গেলে কেন জাগে পয়ারবাসনা,
পাহাড়ের মাথাগুলি ন্যাড়া হয়, খাড়াচুল গাছেদের ধূসর কান্ড জেগে থাকে, আদিগন্ত শীতকালে গ্রীষ্মের দেশের দিকে উড়ুক্কু পাখি ও বিমান।
আর কিছু উত্তরাধিকার দেওয়ার নেই শুধু আজাইরা বিকেলে ঝিমিয়ে থাকা ছাড়া
অন্যমনে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে আগুনটুকু ছিটকে পড়ে এমন অপচয়
অঙ্ক সঙ্গীত কাব্য বা রাজনীতি এইসব কিছুই নেই ইচ্ছাপত্রের দলিলে, শুধু
রাতের ট্রেনে বেরিয়ে পড়লে কীরকম মজা হতো ঐসব বদখেয়াল।
জানলার বাইরে যে বিড়াল গুলি প্রাজ্ঞ ঋষির মত দেখে ঝানু কাঠবিড়ালির আনাগোনা
দীর্ঘিকার ধারে ছিপ ফেলে বসে থাকে মেছো লোক হাটবার ফেলে
অনর্থক হাইওয়ে পেরুতে গিয়ে বেঘোরে রোমাঞ্চপিয়াসী
যে নদী বুজিয়ে দেবে, যে পাহাড় দুদিন পর কাটা পড়বে, যে ফসল নিয়ে যাবে মেঠো ইঁদুরেরা দুর্ভিক্ষের ভয়ে, অরণ্যে বাঁশের ফুল, বিভুতিবাবুর লেখা তেলাকুচো ফল, অনর্থক দৃশ্য দেখা, এইসবে মাছভাত হয়না জোগাড়।
অস্থির বেদনা আছে, চকমকি পাথর আনতাবড়ি শষ্যদানা খোঁটা
যেচে দেওয়া গর্দান, সূর্যের ওঠা নামা ঝুটো পাথরের অঙ্গুরীয়, প্রবোধ ইতি আদি - ইচ্ছাপত্রে এইসব থেকে আর কী হবে, এতে মাছ ভাত মদ্য মাংস জোটে না সহজে।
স্বপ্নে পাওয়া তুষারের শীত, জলে ভয়, খাদের কিনারে মাথা ঝিম
এইসব অনিচ্ছার ইচ্ছাপত্র, এইসব আজাইরা উত্তরাধিকার, সঙ্গীত কাব্য অঙ্ক সমাজের ফেউ, এসবই আসবে পিছু পিছু, এইসব নিয়ে যেও যতদূর পারো।
তোমাকে ডাকেনি কেউ তাই তুমি এ দিবস খাও
রোদের রেখায় ওড়ে ধুলো তুমি তাতেও সওয়ার
গর্জন করে দিন, গোঙায়িল তাগড়া বিষাদ
ভ্রমণ বাতিল হলে বনে ওড়ে বাদামের ঘ্রান।
স্বপ্নে অদর্শন সুবর্ণ রেখার মত জল
জলতলে যে আলোক তাতে তুমি রেখেছো মদির
নদীতটে ফেলে রাখা হেলাফেলা খড়ের জীবন
যে জীবনে খুঁটে খায় ঘাসবীজ চটক বায়স।
কাকের চক্ষু দেখ, কী প্রখর অশেষ অতল
কাকের পক্ষ্ম শুষে নিয়ে নেয় অহেতুক আলো
অনেক দেখেছো তুমি ফেলে দেওয়া খবরের কালি
সমাপিকা বাসনায় কত গলি শহরে নগরে।
এ দিবস খাও তুমি, অন্ধ বা বেখেয়ালে রাগী
এই আলো ছুঁয়ে দাও, অনাহূত ভীড়ের বিবাগী।
দুয়েক কথায় অমরত্ব বাঁধা কিন্তু
সেসব বড়ই ক্ষণস্থায়ী, প্রেম,
সরলেরেখায় রৌদ্র এলে নিকট থেকে দূর
আঙুল সরাও যেমন করে পরিবাহীর বিষ।
সেসব কথা লেখাই আছে, দস্তাবেজে বাঁধা
রঙিন ফিতেয় অক্ষরে আহ্নিকে
কেমনতরো জেগে আছো, যাচ্ছো কিনা দূরে
অদ্যবধি কোন ওষধি বাহুতে মুষ্টিতে।
এক পৃথিবী এদিক ওদিক এক জাবেদা পদ
দুয়েক কথায় অমরত্ব, অক্ষরে তৃষ্ণাতে।
স্মৃতিহীন প্রজাপতি পোকামাকড়েরা উড়ে এসে বারান্দায় বসে, মিহি ধুলোর আস্তরনে পায়ের ছাপ না ফেলেই সামাজিকতা করে, চিনি খায়, নুন খায়, ন্যূনতম প্রয়োজন, শৌখিনতা নেই তাদের কোন। ফেনিয়ে কথাও বলে না কিছু, ব্যস্তসমস্ত কেন এত তাদের, স্মৃতিহীন, যত আনুগত্য তাদের প্রবৃত্তির স্মৃতিগুলি ঘিরে, এইভাবে ওড়ো, এরকম বৃত্ত করো, এরকম অঙ্কের জটিল নিয়ম, ঐ দিকে উড়ে গিয়ে নিয়ে এসো ফুলের মধু বা তার অভাবে গুড়ং।
অথবা সফেন পিকনিকে গেলে দেখা যায় দল বেঁধে মাকড়, পোকারা, পিপীলিকা, ঘাসে ঘাসে প্রজাপতি, কেমন স্বাধীন, আমি যাই তাহাদের সবুজ উঠোনে, বারান্দা ঘেঁষে বসি চাদর বিছিয়ে, জ্যাম জেলি মাখনের কৌটোটি নিয়ে, রুটির গুঁড়োর বোঝা কাঁধে নিয়ে চলে যায় বুদ্ধিহীন স্মৃতিহীন পিপীলিকা দল।
বারান্দায়, পিকনিকে তারা তড়িঘড়ি শীতের খাবার, প্রভুর রসদ, জিনের চাহিদা নিয়ে অনর্থক জীবন তাদের যদি গুণে দেখি তাদের বেদনাহীনতা।
মনে পড়ে, বাড়ির কিনারে ঝুটো দেবদারু গাছ, তাতে তোমার একাকীপনা, আপ্যায়ন, হাসাহাসি বয়ে গেছে, কত ঢং, মানুষের অবিমৃষ্য শরীরের খেলা, মেঝেতে প্রতিচ্ছবি, উঠোনের টুকরো কাগজ, ইস্কুল কলেজের চিঠি, আপিসের যতেক দলিল!
একদিন ছাতের ওপরে বসি, রাবার কাঠের নরম টেবিল পেতে, পেয়ালা পিরিচ নিয়ে, দূরে সন্ধ্যা হয়ে যাক, দূরে নস্থানে ডুবে গেলে শহরের প্রবল গর্জন। জানো তো সন্ধ্যা হলে ঘরে ফেরে কীট, পোকা, পিপীলিকা, গাছেদের ছায়া। আমরা বরং বসি, সন্ধ্যার বটবৃক্ষ, শৌখিন ইউক্যালিপটাস, ঘরোয়া প্রজাপতির ডানা, সেইসব নিয়ে যদি তোমার নিকটে যাই, স্মৃতিহীন, বেদনারহিত হয়ে, উড়ুক্কু যে প্রজাপতি তার স্মৃতি শুধু প্রবৃত্তিকে ঘিরে।
এরকমই লেখো, বেশি চ্যাঁচায়ো না, এরকম নিজেকেই বলি
ব্যক্তিগত পরাঙ্মুখ গ্রীষ্মের ছুটি জুড়ে মরিচাদি ঘ্রাণ
অন্য লোক কী কী বলে তার ভিড়ে শহরের লন্ডভন্ড পথ।
নদী ও বাঁধের মাঝে যেটুকু সামান্য ফারাক, তাতে
বাসা বাঁধে দূর থেকে আসা লোক,
গেরস্থালি দ্রষ্টব্য কাগজ ডোবে প্রতি বর্ষাতে
যেন পলিমাটি জমে জমে তার নীচে অশ্বত্থের পাতা
কাঁটাতার পেরিয়ে আসে পাহাড় ডিঙিয়ে আসে জলে ভাসে শিলা
সেই জল ছুঁয়ে বলি, লেখো এরকম, হইহল্লা করো না অধিক।
শুরুতে একটি ছিল লেবু ফুল, দেবদারু গাছে বাকলে আঁকা ছবি
কলম কাগজ কালি, আকাশবানীতে শোনা পথের সুলুক।
যে কিশোর ঝাঁপাঝাঁপি খেলে নদীজলে, কাঠের পলকা সেতু থেকে
ঝাঁক বেঁধে হাঁসেদের দল, যে আকাশে গাঢ় হয় আকস্মিক বৈশাখী মেঘ
যে পথ দুদিকে রাখে সবুজ শষ্যক্ষেত, অনাবাদী জমি
তারা দিনে কোলাহল করে, জিরোয় বিকেলে।
তাদেরকে লিখে রাখি, ব্যক্তিগত ঋতুরঙ্গ জুড়ে
যে লোক বেঁধেছে বাসা নদী ও বাঁধের পথটিতে
তাদের বাসনা জুড়ে রোদ ওঠে
তোমার নিকটে যেতে সেই রোদ, সেই আবছায়া
নীরবে সেটুকু পথ, ব্যক্তিগত বিষাদের সেতু,
ভাটির শিথিল স্রোতে তার ছায়া চলে।
সে পদ্যটা লেখাই হয়নি, পছন্দসই শব্দগুলি
কিবোর্ড গলে উল্টোদিকে খুঁড়তে খুঁড়তে মেঝের ঢালাই
হারিয়ে গেল। তাদের তেমন অপরধ নেই, সেই তো হেজে
মজে যাওয়া বসত ছেড়ে জলের মতন, সুর পাবে না।
শব্দগুলির ভবিতব্য, এক গোড়ালি ঘাসের ভিড়ে
গঙ্গাফড়িং যেমন খেলে, কোথাও তাদের ছাপ থাকে না
পছন্দসই শব্দগুলির স্থান হলো না, ফেরার পথে
কুড়িয়ে নেওয়ার দরকার নেই। বইতে থাকুক গাড়ির নদী
সকাল হলে, রাস্তা জুড়ে।
একা ল্যাম্পোস্টের আলো যতটুকু জুড়ে থাকে ততটা বিষাদ
পেরিয়ে তোমার নিকটে বসি,
মনে করি তোমাকে না ছোঁয় যেন ঝিরিঝিরি আলো এই
অপয়া কাতর।
মুশকিল হল এই উপমা কোথাও পড়েছি মনে হচ্ছে। অনিচ্ছাকৃত প্ল্যাজিয়ারজমের বিপুল সম্ভাবনা।
প্যাডেল ঠেলে অন্ধকারের গলি
চলছে কোথায় শহর হিজল ঝোপে
একটা দুটো একলা দোকা কুকুর
রাত বারোটায় টহল দিচ্ছে জোর।
ঝিম ধরে যায় কোন তারে তার আঙুল
যুদ্ধফেরত গান লিখিয়ে উদাস
তার পকেটে না পড়া সব চিঠি
কাফন কেটে জোব্বা সেলাই করা।
তার কিশোরী দুঃখ বেদনাটি
মধ্যবিত্ত ঝরোখাতেই ছিল
তার বিগত স্পৃহার কোমল হাতে
উড়ে পুড়েই খন্দ ভরা পথ।
তাদের হাতে পাথর, হাতে কঠিন
তাদের মনে কাফন, মনে কোমল।