এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় - ঈশ্বরের গদ্যভাষা

    Somnath
    বইপত্তর | ০৩ নভেম্বর ২০১২ | ৭৭০৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • .... | 127.194.195.52 | ০৩ নভেম্বর ২০১২ ০১:৪৫577434
  • বিবলিওগ্রাফিঃ

    প্রবন্ধ সংকলন
    ১) স্থানাঙ্ক নির্ণয় - (?) - ১৯৭৭
    ২) অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন - রক্তকরবী - ১৯৮৯
    ৩) নাশকতার দেবদূত - বদ্বীপ - ১৯৯৬
    ৪) হে চলমান চিত্রমালা - কোডেক্স - ২০০৩
    ৫) অন্যান্য ও ঋত্বিকতন্ত্র - চলচ্ছবি - ২০০৫
    ৬) পাতালের চিরকুট - সন্দর্ভ প্রকাশ - ২০১১
    ৭) ইবলিশের আত্মদর্শন সম্পর্কিত
    ৮) অনভিজাতদের জন্য অপেরা
    ৯) দিনযাপনের উপাখ্যান

    অনুবাদ
    ১) মাস্কুলা ফেমিনা - ১৯৮৩
    ২) অরফি - জঁ ককতো
    ৩) মৃত্যুত্রয়ী - জঁ ককতো
    ৪) সাইলেন্স - ইঙ্গমার বার্গম্যান
    ৫) পিয়েরো ল্যো ফু - জঁ লুক গোদার

    শেষ তিনটি প্রবন্ধ সংকলন কিনা জানা নেই, তবে হওয়াই বেশি সম্ভব। যন্ত্রস্থ বলে উল্লেখ পেয়েছি অন্য বইয়ের পাতায়। শেষ তিনটি অনুবাদ ও তাই।
  • .... | 127.194.195.52 | ০৩ নভেম্বর ২০১২ ০২:০১577445
  • মূলতঃ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের গদ্য আমি পড়ি গদ্যভাষামুগ্ধতার শৃঙ্গারোহনহেতু। গোটা একটি চারপাতা প্রবন্ধে তাঁর বলার কথা থাকে হয়তো একপাতা। কিন্তু পাঠককে তিনি উপহার দেন যে মুগ্ধতার বর্ণপরিচয়, বিষয় তথা সিনেসমালোচনাটি বা কখনো সাহিত্যপাঠ-প্রতিক্রিয়াটির প্যারাগ্রাফবিন্যাস বরাবর তিনি যেভাবে চলতে থাকেন পাঠককে পাশে নিয়ে, অঙ্গুলিসঞ্চালনে দেখাতে থাকেন তাঁর বিস্ময় তাঁর রোমাঞ্চ, উঃ, অনন্যপাঠপূর্ব।

    একটু আগে যা বলছিলাম, প্রথম পড়ার পর, মনে আছে, একটাই কথা মনে হয়েছিল, বাংলা ভাষা কি অসাধারণ ঐশ্বর্যশালীনী হয়ে ওঠে তাঁর হাতে , রাজরাজেন্দ্রাণী যেন, গর্বিত, ব্যক্তিত্বময়ী, অচপলা, অপ্রগলভ। তাঁর গদ্যে ভাষামুগ্ধতাই সেই হ্যামলিনের বাঁশি - আমাদের পুরো রচনার মধ্যে দিয়ে যা টেনে নিয়ে চলে নির্নিমেষ । বাংলা ভাষা-ভালোবাসায় ভিজতে থাকি আমরা - তাঁর পাঠকেরা।

    যেখানে যতটুকু সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় পাই, আমি তাই চেটেপুটে গোগ্রাসে খাই, কৃতাঞ্জলি হয়ে।
  • .... | 127.194.195.52 | ০৩ নভেম্বর ২০১২ ০২:১০577456
  • লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রের অধ্যাপক। রূপকলাকেন্দ্রের ডাইরেক্টর। ছায়াছবির যেমন দৃশ্যবিভাগ, ঠিক সেভাবেই তাঁর কথায় জন্ম নেয় অনন্ত চিত্রপট। যুক্তি, তর্ক আর গল্পের সরস মিশেলে সংস্কৃতির যে কোনও বিভাগেই তাঁর সহজ বিচরণ। (আনন্দবাজারের ব্লগ সেকশন থেকে কপি করলাম)

    কিছু স্যাম্পেলঃ ব্লগগদ্য

    রান্নাঘর ওগো
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    আজকাল কোন বিয়েবাড়িতে গেলে মনে হয় বাঙালীর সত্যিই কোন আত্মপরিচয় নেই। অতিথিকে দেওয়ার মতো কোন শকুন্তলার আংটি নেই তার় পৃথিবীর আর কেউ অতিথিকে ডাকলে নিজের খাওয়ার খাওয়ায় – নিজের রান্না, দেখায়। বাঙালীর রান্নাঘর নেই, সে রান্নার কলাম পড়ে। তার ছেলের মুখেভাতে মেয়ের জন্মদিনে কাশ্মিরী আলুর দম, হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী, এমনি দিনে বাড়িত‍ সে চিলি পুঁই খায়। টিভিতে যে সব রান্না করার গল্প শোনে – সে সব মশলা এমনই যে ভূতেরাও অলৌকিক ভেবে কুলকুচি করে ফেলে। বাঙালী ‘নভরতন কারি’ খায়, তার লাবড়া ও ছ্যাঁচড়া উঠে গেছে। নারকোলবাটা, একটু সর্ষে দিয়ে মানকচুবাটা তো প্রায় হেরিটেজ সাইট। ছোট কলাই শাক, বেতো শাক, মেথি শাক প্রাইভেট গোয়েন্দার মতো। ভাবা যায় হাজার বছর আগে এই বাঙালী শাক দিয়েই মৌরলা মাছ মতান্তরে দারিদ্র ঢাকত ! আমরা বাঙালরা বলি ‘মুইঠ্যা’, চিতল মাছের সেই মুইঠ্যা কতদিন যে খাই না ! যা বাঙালি দোকানে বাহারের দামে বিক্রি হয় তা অবাঙালি রান্না। রামমোহন রায় থেকে সত্যজিৎ রায় যে মাছের ঝোল খেয়ে বড় হলেন – সেইসব ‘নর্মাল’ মাছের ঝোল কোথায় গেল? শুধু পাতুড়ি – কেননা তেল নেই। আমাদের মার হাতের তেল কই কোথায় গেল ? যেন কোলেস্টরল ছাড়াই বাঙালী উনিশশতক গড়ে ছিল। একটা জাতির মাঘ-ফাল্গুন শুধু পনির মশালা আর বোনলেশ হিলসা খেয়ে গোল্লায় গেল।
    চমৎকার ভিয়েন বসেছিল আমার দাদার বিয়েতে, পঞ্চাশ দশকে। আজ আর বাঙালী মিস্টি নেই, মঙ্গলাচরনে দই নেই। আইসক্রীম এখন শেষ পাতে। বাকীটা টিসু পেপার। অথচ একটা জাতি তো বড় হয় রান্নাঘরেই। রূপকথা আর রান্নাঘর ছাড়া ইতিহাস লেখা যায়? মহাভারত লেখাই হবে না শৈশব আর অন্দরমহলের আখ্যান বাদ দিয়ে় যাদের অসনে পথখাদ্য, বসনে হাফপ্যান্ট, উচ্চারণে টেলিসিরিয়ালের ইংরেজী ও জীবন স্মৃতি এস এম এস, তাদের তো ডেকাডেন্সের আভিজাত্যটুকুও হারিয়ে গেছে। স্বপ্নে ঘি খেতে গেলেও তো একটা করুণ রঙিন পথ পার করে আসতে হয়। বাঙালীর মুখে ‘কিন্তু’ ছাড়া আর কিছু নেই যে !

    সিনেমার মধ্যবিত্ততা
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    আজি কালি বড় গোল শুনা যায় যে, প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের গলা ধার করে বলি বাংলা সিনেমার বড় শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে। টালিগঞ্জে নাকি চাঁদ উঠেছে, স্টুডিও পাড়ার কদমতলায় আবার ফুল ফুটেছে। এককথায় বাঙালীর সিনেমায় পুনরুত্থান। আবার স্ব্রর্ণযুগ, মিডিয়ার ঢাকের বাদ্যি থেকে একটু দূরে গেলেই কিন্তু বোঝা যাবে কাগজে যাদের ছবি ছাপা হয় তারা কাগজের বাঘ। উদারীকরণের অর্থনীতি কিছু বড়োলোকের, হঠাৎ বাবুর জন্ম দিয়েছে। তারা ভাবছে তারা পল্লীসমাজের নয়় অতএব কিছু ফ্লাইওভার ও রেস্তোরাঁ, বিয়ার মগ ও শপিং মল, মুক্ত বসনা কিন্নরী ও রোমশ কন্দর্প আমাদের ‘নাগরিক’ করে দিল। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক, আমাদের সত্যজিৎ রায় বা অজয় কর কাউকেই আর দেবতা মনে করার দরকার নেই। আমাদের ছবির দেওয়ালে ঋত্বিক সুতরাং আমরা ইতিহাসে ‘স্বাক্ষর দান’ করলাম। অথচ পঞ্চাশ ষাট দশকে উত্তমকুমারের অবুঝ চাউনি, হেমন্ত কন্ঠ, সুচিত্রা সেনের আহত ভ্রুবিলাস ছিল। আজ সংগঠিত প্রচার সত্ত্বেও কোন গান পাঁচ বছরের বেশি আয়ু পাবে? কোন নায়িকাকে দেখে আমাদের সুন্দরী উদ্যান সভায় কটাক্ষ করে? আর কমপিউটারের আশ্চর্য তৎপরতা ও ডিজিটাল বিপ্লব না হলে এসব ছবির ঝাঁজ কোথায় থাকত? সাড়ে চুয়াত্তর / হারানো সুর / পলাতক / সপ্তপদী যে স্তরের কারিগরী দক্ষতা দেখায় তা কিভাবে যে অনুরণণ / শুকনো লঙ্কা / অটোগ্রাফ / অন্তহীন দাবি করতে পারে। একজন সাহিত্যিক দেখলাম ‘মনের মানুষ’ কে প্রায় ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘মেঘে ঢাকা তারার’ অদূরে তুলেছেন। ধন্য বঙ্গ সংস্কৃতি, ইতিহাস ছাড়া ঋত্বিক সত্যজিৎ কে দেখবার তাহলে আর কেউ রইল না! আসলে বিকেল ঘনিয়ে এলে বেটে লোকেদের ছায়া লম্বা দেখাবেই। স্বধীনতার পরে মধ্যবিত্তের যে চাহিদা নির্মল দে বা অজয় করকে তৈরি করে সেই মধ্যবিত্ত আর নেই। রেস্তোরাঁর আড্ডা নেই, চাটুজ্জেদের রোয়াক পাড়ার দাদা, বৌদির আঁচল, মুদি দোকান কিছুই নেই।। বাঙালি মধ্যবিত্ত এখন সম্পুর্ণ সিনথেটিক , তার ছেলে মেয়ে দেশি আন্টিদের কাছে বিদেশি উচ্চারণ শিখে টেলি ধারাবাহিক করে, ফলে হয় পুরুষেরা তেলুগু ছন্দে হাঁটছে, বিদ্যাসাগর ও রামমোহনের সাহায্য ছাড়াই কুলকুন্ডলিনী জাগ্রত হচ্ছে অথবা উত্তর-চল্লিশ নারীপুরুষের হরমোন বিপর্যয় থেকে তৈরি হচ্ছে ‘সম্পর্কের ‘ ছবি! তারা মানুষের ছদ্মবেশে বেশির ভাগ সময় পুতুলের কথা বলে।

    পাত্রী স্বাস্থ্যবতী ও সুন্দরী ঃ বাংলা কবিতা
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    হৃদয় নামের বস্তুটি বুকের বাঁ দিকে থাকে বলেই মানুষের ধারণা। উপরন্তু মানুষ মূলবদ্ধ জীব। আত্মার তবু বামফ্রন্ট গড়ে ওঠে নি আজো। ভাগ্যক্রমে একা করবার মতো কিছু কাজ মানুষের কররেখায় নির্দিষ্ট হয়ে আছে। যেমন কবিতা লেখা। প্রায় হাজার বছর পরে দেখি আমাদের কবিতা খানিকটা পৃথুলা গিন্নীর মতো; ইতিহাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে বুঝে উঠতে পারছেন না কোনদিকে তার গমনপথ। জীবানানন্দ দাশ ও মুকুন্দ দাস – বরিশালের এই দুই বাঙালের মধ্যে কাকে সে সঙ্গী হিসেবে মেনে নেবে।
    চর্যাপদ থেকে আজ পর্যন্ত নানা অদল বদলের ভূগোল ও ইতিহাস আমাদের কাব্যের জন্য একটি নিরাপদ মান ও পরিকাঠামো তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের গদ্য নাটক ও ছবিতে মানচিত্র সেরকম নয়। ফলে এখন কবিতা লেখা হাতের পাঁচ। নানারকম ছন্দোবদ্ধ আখ্যান ও সুশ্রাব্য কাহিনী কবিতার মতো সাজগোজ করে সময়ের রাম্পে হেটে যায়। নানারকম সামাজিক হিতোপদেশ হিসেবে কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে। কবিরা পোল্যান্ড ও বেলজিয়ামে যান। পেজথ্রিতে খুচরো শিল্পপতি তাকে করমর্দন করে। কবিদের আয় আছে, কাব্যচর্চা আর সামাজিক অপরাধ নয়; বোদলেয়ারের প্যাঁচার মতো তাকে আর রাতে জেগে থাকতে হয় না। আপাত ভাবে কবিতার ত্বক তো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে!
    অথচ কবিতা তো নন্দীগ্রাম ও স্টেশনের ওপারে তোমাকে ছাড়িয়ে দূরে যেতে চেয়েছিল। নবীন চাঁদের মত স্তন ও স্মৃতিচিহ্নের পাশে মাধবীলতা দুলে উঠছে দেখা তার কাজ নয় আর। যিনি তাকে মিছিলে হাটার অনুমতি দিয়েছিলেন, মেট্রো রেলের প্রান্তিক স্টেশন আজ তার নাম। পঁচিশে বৈশাখ ও মোবাইল সন্ধ্যা ; কবিতা রূপসীদের ঠোঁটে মিলিয়ে যায় আইস ক্রীমের মতো।
    আমিষ গন্ধে মম করছে স্বর্গের বাগান, যে সবচেয়ে বেশি অমান্য করবে, সে সবচেয়ে বেশি কুর্ণিশ করছে। একটি বিপ্লবী তার সোনারূপো ভালোবাসতে শুরু করেছে। আগেও বিপদ ছিল। কবিতা দিবসের শশীলেখার মতো কৃশকায়া ছিল একদিন চৈত্রপবনে। তারপর স্তনযুগভারে ঈষৎনতা কবিতা কঁকিয়ে উঠলে জীবনানন্দ দেখে ফেলেছিলেন নন্দনতত্ত্বের রাং, অপরূপ চিতলের পেটি শক্তি চট্টোপাধ্যায় জানতেন অলৌকিকতার কাছে সবার আকৃতি ঝরে যায়। কবিদের কেন যে মনে হয় শূন্যতাই শেষপর্যন্ত নক্ষত্রনারীর কেশপাশ !
    রবীন্দ্রসদনের স্লোগানে আসীন হে অমল বাঙালী, স-বিষাদে খেয়াল করুণ, কবি কবিতার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে; পরপুরুষ। সে বুঝতেই পারছে না প্রেমপত্র, ইস্তেহার ও নকশালপন্থির মেঘদূত তাকে পরিত্রান করবে না, সে ভাষার পাতকুঁয়োয় পড়ে গেছে। তাকে টেনে তুলবে কে? নিসর্গ? পয়ার? গড়িয়াহাটের চকিতা হরিণী? কবিতা যদি বাসনালঘু শ্রুতিচপল ও বাস্তব হয় তবে লাবণ্য অভিশপ্ত বিভা সত্ত্বেও সে অমরতার বিকল্প হয়ে ওঠে না। কবির কাজই হল ভাষার অস্থিতি ঘোষণা – মহাকরণে যে-ই থাকুক না কেন !

    বিদ্যার মোচ্ছব ঃ সেমিনারোলজি
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    অবশ্য বিদ্যার কার্নিভালও বলা যেতে পারে। জামাই ষষ্ঠী আর ভ্যালেন্টাইন তিথিতে আমাদের বিদ্যে বোঝাই বাবুমশায়ের মন আর ওঠে না। এখন আমাদের বুদ্ধিজীবীদের জন্য, বিশিষ্ট ও বিদ্বজ্জন নির্বিশেষে একটি নতুন অভয়ারণ্য সংরক্ষিত হয়েছে। যার নাম, সেমিনার। এ এমন অভিজাত অন্তরাল, যেখানে ডক্টর অমুক অধ্যাপক অমুকের মুখ দেখেন ততক্ষন, যতক্ষন জীবনানন্দের ভাষায় দেখাদেখি চলে। আগে মাস্টারি জীবনে এত ঝড় ছিল না। তারকনাথ সেন ও শশীভূষণ দাশগুপ্তরা ধুতি-পাঞ্জাবী, পাদুকায় ক্লাসঘরে প্রবেশ করতেন। তাদের পেটে না হলেও মাথায় বিদ্যা ছিল। নির্ভুল বাংলা ও ইংরেজি বাক্যে তাঁরা কথা বলে যেতে পারতেন। ছাত্র ও কতিপয় ছাত্রী ‘নোটস’ নিত।

    আজ আর তা নয়। তিনিও, প্রায় বাহুবলে, সেলিব্রিটি। কর্ণের কবচ-কুন্ডলের মতো তার কিংবদন্তী প্রসিদ্ধ দারিদ্র এখন অস্তমিত। আর তার ঠিকুজিতে যুক্ত হয়েছে সেমিনার; সেই সুত্রে কিছু ‘কাগজ’, সঙ্গে সম্মেলনতাড়িত ক্কচিৎ বিদেশভ্রমণ। নবীন এই ‘পত্রপাঠ’-এর অভ্যেস আমাদের সারস্বত চর্চায় প্রায় বসন্ত সমাগম। যা নিত্যপালনীয় ছিল সেই ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ কোন গুরুত্ত্বই পায় না এখন। এত তার বাহার!

    বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার প্রায় নিজেই এক শিল্প কাঠামো! জাতীয় হলে একরকম; ‍আন্তর্জাতিক হলে আরেক রকম। মানে টাকার ঝনৎকারই অন্যরকম। কোনক্রমে একজন শেতাঙ্গ পরিযায়ীকে পৌষ–মাঘে অথবা মাঘ-ফাল্গুনের দিনে উড়িয়ে আনতে পারলেই হল(বিদেশীরা এদেশে শীত পছন্দ করে)। আজকাল অবশ্য বিদেশ বলতে বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কাও বোঝায়। এরপরে ব্যাগ শিল্পঃ শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যাওয়ার জন্য হালকা স্যুটকেশ হবে, না লোকশিল্পের ঝোলা, তা নিয়ে সাব কমিটির বিতর্ক। আসলে বিদেশি এলে সুবিধা হয়; ফান্ডিং বেশি; সুতরাং জাঁকজমক তো রইলই উপরন্তু শীতে আপনি এলে, গরমে আমি যাব। দিবে আর নিবে – মিলাবে মিলিবে।

    এরপরে ভোজন তালিকা অর্থাৎ বাটার চিকেন ও আইসক্রিম বিষয়ক তুমুল কোলাহল। এছাড়া দৃশ্য বিন্যাসের খুঁটিনাটি তো অজস্র। যেমন জেরক্স, ডটপেন, ফাইল। অতিথি আপ্যায়নে গোলাপ সুন্দরী, ‘গ্ল্যামার’ সম্পন্ন অন্তত দুজন বক্তা – মানে যাদের মিডিয়ায় যোগাযোগ আছে। যারা, নিয়োগ কমিটির সদস্য থাকেন প্রায়ই এমন দু’জন।

    কুলীন সেমিনারের ভাষা অবশ্যই দুর্বোধ্য ইংরেজি। ফরাসি পন্ডিত ফুকো ও লাকাঁর নাম প্রায়ই উঠে আসে। আর সেইসব উদ্ধৃতির ‘শিকাগো’ রীতিতে ঘটবে, না এম এল এ স্টাইলে – তা নিয়ে মৃদু বাদানুবাদও হয়। এ বিষয়ে অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত তুলনা রহিত। ‘আপনি কোটেশ্যন ভালোবাসেন, না ফুটনোটে আপনার অনুরাগ? যদি কোটেশ্যন বা ফুটনোটের প্রয়োজন হয়, তবে কোন ভাষা হইতে দিব, তাহাও লিখিবেন। ইউরোপ ও এশিয়ার সকল ভাষা হইতে আমার কোটেশ্যন সংগ্রহ করা হইয়াছে – আফ্রিকা ও আমেরিকা কতকগুলি ভাষার সন্ধান পাই নাই। কিন্তু সেই সকল ভাষার কোটেশ্যন, আমি অচিরাৎ প্রস্তুত করিব। আপনি চিন্তিত হইবেন না।’
    আমরা আদৌ চিন্তিত নই। চুক্তিবদ্ধ টুর্নামেন্টের মতো এসে পড়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব, যেখানে তরুণ অধ্যাপক বা গবেষক দীর্ঘ মন্তব্য অর্থাৎ গুরুভজনা করেন ও গুরু স্মিতমুখে তা উপভোগ করেন। উত্তর বাংলার চা-বাগান থেকে দক্ষিণ বাংলার ভেড়ি এলাকা পর্যন্ত, শিক্ষককুলের এই সেমিনার রঙ্গে প্রবেশ না করে উপায়ও নেই। পদোন্নতি বা ভালো পড়ানো, কোনও গুণই নয় ইউজিসি নির্দেশিকায়। শিক্ষকের কৃতিত্ত্বের মধ্যে ক্লাসরুমে ভূমিকার থেকে অনেক বড়ো গুরুত্ত্বের বিষয় এই সেমিনার। কারণ, এই আলোচনাচক্রে, এই কনফারেন্সের ফলে এক সেমিনার থেকে অন্য সেমিনারের কাগজের স্তূপ জমতে থাকে; জমতেই থাকে। সে সব মৃত শব্দে মেধং আর কতটুকু?

    বাঙালির মধ্যবিত্ততা
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    প্রায়ই শুনি, আমাদের পাড়ার বাজারে, বাস্তুহারা বাজারে দোকানি বলে – আমাদের এখানে কোন দুনম্বরি জিনিস পাবেন না! আমাদের সবই নাম্বারি মাল। আমাদের ছোটবেলায় ইস্কুলে শুনতাম খুব ভালো কোন ছাত্রের সম্পর্কে ‘হি হ্যাজ নেভার স্টুড সেকেন্ড ইন হিজ লাইফ’। তখন বাচ্চা বলে ভূগোল স্যারকে বলতে পারি নি সে তাহলে আমরা যারা প্রথম পঞ্চাশজনের মধ্যেও এলাম না, তাদের সম্পর্কেও কি একই কথা বলা যাবে? এরকম ভাবেই পাড়ার মেসোমশাই অসুস্থ হয়ে পড়লে বলা হয় – অমুখ কার্ডিওলজিস্টকে দেখানো হয়েছে – উনিই তো এখন এক নম্বর শুধু এখানে নয় এশিয়ায়! যেমন সপ্তাহান্তিক বিয়ারের আড্ডা ঘনীভূত হলে ঈষৎ স্ফীত মধ্যপ্রদেশের কোন বন্ধু আমাদের জানান – যাই বলো গুরু! মাথায় এখনো বাঙালি একনম্বরে! আমার বিনীতভাবে জানতে ইচ্ছে করে এসব গ্রেডেশন কে করে? কোথায় হয়?
    এদিকে গ্যুন্টার গ্রাসের ‘টিনড্রাম’ উপন্যাসের অস্কারের মতো একটা জাতি আর বড়ো হতে চাইছে না, হ্যাফপ্যান্ট পরে আমাদের কালীঘাটে সবাই সবাইকে ‘গুডমর্নিং’ জানায় ; মোবাইলে গুরুপূর্ণিমায় দশপয়সায় এস এম এস করার স্কিম পাকা ; ফোন রেখে দেওয়ার সময় সদ্য রিটায়ার্ড দাদা মোজাইকের দোকানে বলেন টাটা !
    রাসবিহারীর মোড়ে দেখলাম সমস্ত অটো-ইউনিয়ন সরস্বতী পুজো করছে, বিশ্বকর্মা পুজোর গ্ল্যামার তো আকাশ ছোঁয়া – এদিকে শিল্প বলতে তো রোল শিল্প, কিছু চুন বালি সাপ্লাই। আর বিদ্যা বলতে কোচিং সেন্টার; নাম – ‘নিরালায়’ ! বাঙালি নাকি আর প্রশাসন পছন্দ করছে না – তাই বাঙালি আই।এ।এস দেয় না। কিন্তু বাবা-মারা তো কেজি থেকেই এঞ্জিনিয়ারিং পড়াবে বলে বদ্ধ পরিকর। তাহলে অন্য অন্য আইআইটি গুলোর কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, খড়গপুরেই – বাঙালি ছাত্র হাতে গোনা কেন? জবাব নেই। হয়ত বাঙালি গ্লোবালি ‘মনের মানুষ’ দেখে লোকালি ‘স্থানীয় সংবাদ’ শোনে।
    প্রথম পাঁচশো জন বড়লোকের মধ্যে একজনও বাঙালি নেই। রবিশঙ্কর ও অমর্ত্ত্য সেন ছাড়া আর কোন বাঙালির নাম দেশের সীমানা ছাড়ায় না সচরাচর। মান্না দে, মৃণাল সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে আমাদের পৌরাণিক সর্বভারতীয়তার বদলে জেলায় জেলায় খ্যাতিমানদের খুঁজে পেতে হবে।
    এই মধ্যবিত্ত দাঙ্গা দেখে নি, দেশভাগ দেখে নি, মন্বন্তর দেখে নি। এরা মনিক বন্দোপাধ্যায় বা জীবনানন্দ দাশকে পায়চারি করতে দেখে নি, এদের সত্যজিৎ-ঋত্বিক কেউই নেই। এমনকি টেনিদার জন্য রেখে যাওয়া চাটুজ্জ্যেদের রোয়াক-ও বহুতল বস্তি হয়ে গেল!
    ডেকাডেন্সের আভিজাত্যও আর বাঙালি মধ্যবিত্তের রইল না!
  • .... | 127.194.195.52 | ০৩ নভেম্বর ২০১২ ০২:২৬577467
  • কিছু স্যাম্পেলঃ২ ব্লগগদ্য

    বাঙালির দ্বৈতবাদ
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    বাঙালির নিজস্ব রাধাকৃষ্ণ আছে। আর তাদের জন্য দুটি ছোট ছোট পাখি আছে শুক-সারি। প্রবন্ধের বই, গবেষণাপত্র ইত্যাদি অ্যাকাডেমিক পরিসর বাদ দিলে বাঙালির মিথোলজিতে কোন অদ্বৈতবাদ নেই। সে কম্পিউটারের মতন। বাইনারি তার রক্তে। আমরা বিদ্যাসাগরের আগে পরে রামমোহনকে মিলিয়ে নেই। পরমহংস রামকৃষ্ণ, তাঁকেও বাঙালি শিষ্য বিবেকানন্দের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি। কোনও সেকুলার মনোভাবই ইস্টবেঙ্গল–মোহনবাগান ব্র্যাকেটে মহমেডান স্পোর্টিংকে ঢুকতে দিল না। অমন ভোকাল টনিক বিলিয়েও চুনী-বলরামের সঙ্গে পা মেলাতে পারলেন না পিকে। সুতরাং আমাদের আছে সিঙ্গুর – নন্দীগ্রাম, হেমন্ত-মান্না, উত্তম-সৌমিত্র কিংবা সুচিত্রা-উত্তমের যুগল সম্মিলন়অনিল চট্টোপাধ্যায় কিংবা সুপ্রিয়া চৌধুরী তো নেহাত-ই উত্তমসঙ্গী বা সঙ্গিনী।
    আসলে বাঙালির এটা স্বভাব যে সে এক ধরনের যুগ্ম বৈপরীত্য ঘটাবে ও সে উক্ত বন্ধনীতে কাউকে আর জায়গা দেবে না। না,বাঙালির স্কুলে কোনও থার্ডবয় হয় না। সত্যজিৎ-ঋত্বিককে নিয়ে বাঙালি গত চল্লিশ বছর ধরে ঝগড়া করে গেল যে, কে প্রথম। সেখানে মৃণাল সেন কোথায়? এমন ভাবেই পঞ্চাশ দশকের কাব্যে শক্তি –সুনীল। এটা প্রতিভার কথা নয় যে, শঙ্খ ঘোষ বা আর কেউ এমন যুগলবন্দিতে বাজলেন না। শঙ্খ ঘোষ তাঁর সম্ভ্রান্ত এলাকায় ততটাই একা যতটা তৃণমূলে মমতা।
    হ্যাঁ,বলা যায় রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে পাহারা দেওয়ার জন্য আমরা আধুনিকরা যে চলমান অশরীরী জীবনানন্দকে নিয়োগ করেছিলাম, একথাও অবিসংবাদিত সত্য। সুতরাং বাঙালি কাউকেই একা হাঁটতে দেবে না। প্রমোদ-জ্যোতি থেকে বুদ্ধ-বিমান কাউকেই সে ইতিহাসের রাস্তায় একা ছাড়ে নি। কিন্তু যেটা বলার সে হরগৌরীর এই মিলন আসলে চাপা যুদ্ধ ঘোষণা। এখানে সংযোজক অব্যয় মোটেই ‘এবং’ নয় বরং ‘বনাম’। অর্থাৎ আমরা জীবন ও মৃত্যু এভাবে ভাবি না। বাঙালিরা হয় জীবন নয় মৃত্যুর অনুগামী। সে যুগের দানিবাবু- শিশির ভাদুড়ির গল্প থাকুক। একালে যারা উৎপল দত্তকে পছন্দ করে তারা স্বভাবতই শম্ভু মিত্রের প্রতি সদয় নয়, আর শম্ভু মিত্রতে যারা মজে আছে, তারা উৎপলের প্রতি প্রীতিপরায়ণ নয়। বাঙালির জীবনে হয় ঘর, নয় বাহির। কিন্তু কোনও ঘরে-বাইরে নেই। আমাদের জীবন সন্দীপ আর নিখিলেশকে যুক্ত করে নিতে পারল না। তিরিশের দশকে বুদ্ধদেব বসু আর বিষ্ণুদের দ্বৈরথে আমরা হয় বৌদ্ধ, নয় বৈষ্ণব। আমরা তর্ক করি জয়ের পতাকা ওড়ানোর জন্য, আবিষ্কারের নতুন দেশে নোঙর ফেলব বলে নয়। তবু আমাদের কলহ যে প্রণয়ের প্রতি প্রস্তাব সেটা বুঝতে গেলে অবশ্য বাঙালি না হয়ে গতি নেই। ‘দি থার্ড ওয়ান হু অলওয়েজ ওয়াকস বিসাইড ইউ’ – এসব এলিয়ট সাহেবদের জন্য লিখেছিলেন। আমাদের মধ্যবর্তিনী বা তৃতীয় পথ নেই। বাঙালির যা চিরকালীন তা নিবিড় দাম্পত্য। ‘কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ’ – কথাটার মানে তো ঈশ্বর পাটনিও ধরতে পারে নি।

    বাঙালিনির উত্তমকুমার
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    এই যে তন্বী, এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। তার চোখের কোলে একটু করে শ্রাবণের মেঘ, দাঁড়িয়ে আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নং গেটে, সে কি আশা করে উত্তমকুমার আজও তার আহত ভ্রূ-বিলাস কে শুশ্রূষা করে দেবেন! স্তনযুগভারে ঈষৎ নত, ওগো ললিতা, তুমি কি উত্তমকুমারকে মনে রেখে এখনও কদম্বরেনু বিছাইয়া ফুল শয়নে?

    কোন ক্যুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ না নিয়েও বলা যায়, এমন কি এই একুশ শতকেও রূপসীরা অনেকেই মনে করেন, যদি ভ্রূ-পল্লবে আমন্ত্রণ থাকে তবে উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁদের দেখা হবেই চন্দনের বনে।

    স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের সন্দেহ ছিল। তাঁর সমালোচক অ্যান্ড্র রবিনসনকে তিনি জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্সির বুদ্ধিমতি ছাত্রীরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে হয়তো তুলনায় বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করবেন। অন্যদিকে সহকর্মী অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ বা সৌমিত্রের তুলনায় তাঁর মুখশ্রী অসুন্দর। রূপের দিক থেকে উত্তম দেব-দুর্লভ নন। শালপ্রাংশু মহাভূজ শারীরিক সুষমাও তাঁর মধ্যে নেই। ‘কন্যা বরয়তি রূপং’ বলা যাবে না। তবু তিনিই নক্ষত্র; তিনিই নায়ক।

    কন্দর্প-নিন্দিত কান্তি প্রিন্স বড়ুয়া যদি দেবতা হন, তবে পরেই ভারি ঠোঁট ও চ্যাপ্টা নাকসহ উত্তমকুমার তো এলেবেলে পাড়ার ছেলে! তাহলে কি তাঁর অনার্য মুখ আসলে সময়ের এক সেতু যা ‘অ্যলিওরস দি প্যাসেজ ফ্রম অ ট্রু চার্ম’। এই তো সেদিন ‘হারানো সুর’ –এ দেখলাম সেই স্বর্গীয় আনস্মার্টনেস, রাস্তায় সুচিত্রার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে লাজুক ও বিহ্বল যুবকটি গাছের পাতা ছিঁড়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। পরিবেশবিদরা আপত্তি করতে পারেন, কিন্তু সুচিত্রা সেনেদের মুগ্ধতার এমন পরিসর তো উপমারহিত। আসলে উত্তমকুমার স্বাধীনতার পরে এমন যুবক নন যিনি শাপভ্রষ্ট দেবদূত। তিনি আমাদের দোতলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মায়াহরিণীর আয়ত্ত্বে; এখানেই তাঁর জয়। লক্ষ করার বিষয় যে তার নায়িকাদের স্তনবিভাজিকা বা শ্রোণিযুগ তাঁকে ততটা আকৃষ্ট করে না, যতটা আলোড়িত করে তাঁদের দ্বিধাকম্পিত ওষ্ঠপ্রদেশ। বাঙালি নারীও তাঁকে শরীরের তীব্রতায় চেনে নি, বরং অপাঙ্গ দৃষ্টিপাতে হৃদয় দিয়েছে।

    পঞ্চাশ দশকের এই যে সুচিত্রা সেন – চিরবালিকা, অবুঝ ও অভিভাবকের প্রত্যাশায় প্রেমপাগলিনী। অনেকসময় মনে হয় তিনি ‘স্বাধীকারপ্রমত্তা’! ‘হারানো সুর’-এর সেই বিখ্যাত গান ‘তুমি যে আমার’ পর্বে সুচিত্রাই সক্রিয়, তবু আমরা জানি এই নবীন নাগরিকা ততটা স্বাধীনতা-প্রিয় নন, যতটা পুরুষের প্রশ্রয় ও স্নেহের জন্য আকুল।

    ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকে ‘সপ্তপদী’ পর্যন্ত সুচিত্রা সেনের চোখের বিন্যাস, গ্রীবাভঙ্গি ও উচ্চারণে যে অতিরঞ্জন তা পয়ারের মতো প্রেমের স্বাভাবিক ছন্দ হয়ে ওঠে। উত্তমকুমারের তুলনামূলক চাপা অভিনয়ে সুচিত্রা জানতেন – ‘তোমার আছে তো হাতখানি’! কর্তৃত্ত্বময়ী সুপ্রিয়া চৌধুরী, ব্যাক্তিত্ত্বের রেখাচিত্র – অরুন্ধতী দেবী, অভিমানিনী সাবিত্রী বা পাড়ার চেনা মেয়েটি মাধবী– এমনকী সুমিত্রা বা অঞ্জনা ভৌমিক উত্তম সান্নিধ্যে স্বচ্ছন্দে গীতিকবিতার মত হয়ে থাকতেন। কেননা, উত্তম বাঙালি সমাজের বাস্তবতাকে কখনওই উপেক্ষা করেন নি। তিনি শেষ পর্যন্ত প্রেমিক – বৈষ্ণব পদাবলী থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্নেহময় ও ক্ষমাশীল প্রতিচ্ছায়া। কিন্তু প্রায় কখনওই দায়িত্ত্বহীন বয়ফ্রেন্ড নন। প্রণয়িনী যদি তাঁকে প্রেমিকের বদলে শয়তান হিসেবেও দেখে তবু বিচলিত হবেন না। উত্তমকুমারের হাসিটুকুই তাঁর প্রায়শ্চিত্ত, অন্য সবাই কৈফিয়ৎ দিতে গিয়ে হেরে গেছে। উত্তম আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছেন, আর জুলাই-অগস্টে তাই বাঙালিনি তাঁকে দেখে।

    উত্তমকুমার কে ছিলেন?
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    উত্তমকুমার কে ছিলেন ?

    অনেক রকম উত্তর পাওয়া যেতে পারে। তার মধ্যে নায়ক বা অভিনেতার ভূমিকা সবথেকে গৌণ। চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করবার বিশ বছরের মধ্যেই তিনি বাঙালির মিথোলজির অন্তর্ভুক্ত হন। ষাট দশকের মাঝামাঝি তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে ফিল্ম সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবী বাঙালি ইগোকে প্রতিস্থাপিত করে উত্তমকুমারের উপকথা। খেয়াল করার যে, এই ছবির চরিত্রলিপিতে উত্তম কোথাও নেই। অন্দর মহলে সংসারের দুপুরের অবসরে হালকা সিনেমা পত্রিকা থেকে উত্তমচরিত মানস গঠন করেন দুই মহিলা আর এই বাড়িরই তরুণতম প্রতিনিধি ফিল্ম সোসাইটির আদলে ‘ত্রুফো’ উচ্চারণ করে। উত্তমরহস্য এভাবেই সংস্কৃতির অচেনা স্তর থেকে স্তরান্তরে ছড়িয়ে যায়।

    যে কোনও চরিত্রই অতিকথার জন্ম দিতে পারে যদি তা কোনও সন্দর্ভের প্ররোচনা পায়। উত্তমকুমার আমাদের সমাজে, গল্পে – গুজবে, কেশবিন্যাসে ও চালচলনে শুধু ‘স-জীবনী’ অভিনেতা নন, তিনি যে অতিকথার জন্ম দিলেন তা তাঁর অভিনয় প্রতিভার জন্যও নয়। বরং সেই মুহূর্তগুলির জন্য যা এই অভিনয়কে বাস্তবায়িত করে। মনস্বী রল্যাঁ বার্ত থাকলে বলতেন মিথ এমন একটি বাচন যা ইতিহাসের দ্বারা নির্বাচিত। কিংবদন্তীরও ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে।

    আসলে সুভাষচন্দ্র বসু যে কারণে স্বাধীনতার পরে নেতাজি হয়ে গেলেন। উত্তমকুমারও প্রায় সে কারণেই মহানায়ক হয়ে গেলেন। দুজনেরই ইতিহাস থেকে অন্তর্ধানের সুযোগ ঘটেছিল। সত্যি কথা বলতে কি তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনার পর সুভাষচন্দ্রের আর কোনও দায় রইল না ইতিহাসের কাছে জবাবদিহির। সে কারণেই তিনি বিভাজনোত্তর দেশে, অন্তত পশ্চিমবাংলা ও পাঞ্জাবে, যে কোনও অত্যাচার ও বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে সামরিক উর্দি পরিহিত নেতাজি হিসেবে দেখা দেন। তিনি আছেন এই তো যথেষ্ট! সম্ভবামি যুগে যুগে! বলাবাহুল্য উত্তমকুমারের সাংস্কৃতিক কৌলিন্য না থাকাই তার প্রধান ছাড়পত্র। অর্থাৎ তিনি জনসাধারণের একজন।

    ‘শাপমোচন’-এর নায়কের ‘অপরাজিত’-র নায়ক অপূর্ব কুমার রায়ের মত সাংস্কৃতিক আভিজাত্য নেই, কিন্তু প্রায় একই সময়ে সে অপূর্বর মতো কলকাতায় আসে। গ্রাম থেকে শহরে আসার এই আখ্যানে উত্তমকুমার প্রায় অস্টারলিটজ ফেরত নেপোলিয়নের মতই জনসাধারণের মন লুঠ করে নেন। শহরের মধ্যে এক অলীক গ্রাম তৈরি হয় এবং উত্তমকুমার সেই নগরপল্লিতে লোকগাথার অবিসম্বাদিত সম্রাট হয়ে ওঠেন।

    উত্তমকুমার, না বিধান রায় না জ্যোতি বসু, তার ক্যারিসমা একের পর এক সংকট অনায়াসে পার হয়ে যায়। উপরন্তু শেষ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সামাজিক দোলাচলের দিকে তাকালে মনে হয় ছবির পর্দায় এমন এক শান্তিনিকেতন তিনি গড়তে পারছিলেন যেখানে স্থিতাবস্থাই সত্য। ‘শাপমোচন’ ও ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ এবং ‘দেয়া–নেয়া’ গানের বদলে প্রেমের আদর্শকেই তুলে ধরে। তাঁর গরিব চরিত্ররা বড়লোক হওয়ার শর্তেই নায়িকাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়। মূল মতাদর্শ তাঁর উপস্থিতিতে কখনোই বিপন্ন বোধ করে না। যতই তিনি বড় অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করেন ততই শিল্প সিনেমার উপেক্ষা, বঞ্চনার সত্য হিসেবে জনসাধারনের হৃদয় মথিত করে। তাঁর রাজ্যপাট নিরঙ্কুশ হয়ে যায়।

    বস্তুত উত্তমকুমারকে বাংলার মুখ বলা যদি অতিশয়োক্তি হয়ও, তিনি বাঙালিয়ানার এক ধরনের মুদ্রা। যে আংটি দেখে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চেনেন, যা হারানো সুর় আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় বাঙালিকে চেনার সেরকম আংটি , সেরকম সুর, নিশ্চিতভাবেই উত্তমকুমার। অথচ উত্তমকুমার বাঙালির মানস পটে অনুপস্থিতির সত্য, জীবৎকালে সংস্কৃতির নীল রক্ত তার ললাট টীকা হয়ে দেখা দেয়নি, আপাতভাবে এই কারণ তাকে বারবার ফিরিয়ে এনেছে। যেন তিনি সত্যিই প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু। আসলে গরিবের ছেলের বঞ্চনার একটা প্রতিকার গরিবরা চাইবেন। বাংলা ছবিতে অনেকসময়ই উত্তমকুমার কাজ করে যাচ্ছেন এই প্রতিকার্য হিসেবেই।

    সত্যজিৎ রায় যে ম্যাটিনি আইডল হিসেবে উত্তমবাবুকে বেছে নিয়েছিলেন তা প্রায় নির্বিকল্প হয়েই। বস্তুত অরিন্দমের অন্য কোনও অভিনেতা থাকা সম্ভব নয়। বাঙালি নক্ষত্রের কাছে যে যে কারণে হাত পাতে, উত্তম তার প্রায় সবকটি পূরণ করতে পারতেন। নায়কের ‘নায়ক’ অভিনয় বাঙালির সবচেয়ে প্রামাণ্য বাস্তব। সত্যজিৎ রায় শিল্পী বলেই জানতেন, উত্তমকুমার যখন শিল্পী নন তখনও নায়ক। এবং দিগন্তের ঈষৎ দূরে় যেন দেবদাস় আমাদের চেতনায় প্রয়শ্চিত্তের অপর বিন্দু় মদ, নারী ও নরক, দেবদাস বা উত্তমকুমারের পা টলায় না। উপন্যাস, সিনেমা ও খবরের কাগজের পরপারে তারা আমাদের জ্যান্ত রূপকথা।

    বাঙালির রবীন্দ্রনাথ
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    ক) এর আগে তবু কেউ কেউ কোনও কোনও লেখা বাংলায় পড়েছিলেন। দেড়শো বছর বাদে প্রায় সব অধ্যাপক ইংরেজিতে পড়তে চাইছেন তাকে। কারণ এক ও অদ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার। সেখানে তো উদ্ধৃতি ইংরেজিতেই দিতে হবে। একই কারণে বাঙালি ‘চারুলতা’ দেখার সময় সাবটাইটলড্ কপি চায়।

    খ) কবিরা ভবিষ্যতদ্রষ্টা হয়। যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তিনিই তো লিখেছিলেন – পুলিশেও গায় দেখি রবীন্দ্রসঙ্গীত! এরপর থেকেই পুলিশের সঙ্গে অপরাধীর ‘রাবীন্দ্রিক’ সংলাপের সূচনা। দিন দুপুরের রাসবিহারী মোড়; সিগন্যাল রক্তচক্ষু; পুলিশের ক্যাসেট জানাল দীপ নিভে গেছে মম! পুলিশের নান্দনিকতা অথবা ডার্কনেস অ্যাট নুন।

    গ) রবীন্দ্রনাথ এখনোও অপ্রতিরোধ্য – মেগা সিরিয়াল সেখানে দাঁত বসাতে পারেনি। কেননা মৃত্যুর পরে শোকসংগীত আর কেউ শেখেননি – না সলিল চৌধুরী না বাংলা ব্যান্ড!

    ঘ) আমাদের একদিন- পঁচিশে বৈশাখ। ওদের দুদিন – বাইশে শ্রাবণ। বাঙালির তিনদিন – সপ্তমী অষ্টমী নবমী।

    চিরসখা হে – দেবব্রত বিশ্বাস
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    তানসেন গান গাইলে নাকি বৃষ্টি নামত! কিন্তু আহিরিটোলার প্রখর মধ্যদিনে আমি নিজে দেখেছি দেবব্রত বিশ্বাস রেডিওতে ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’ গাইছেন আর আকাশ জুড়ে নীলাঞ্জনছায়া় এমনকী তিনি ‘আষাঢ়’ শব্দটি উচ্চারণ করলে, উজ্জ্বয়িনী বা বিদিশা নয়, আমাদের কালীঘাটেও বৃষ্টি নামত। তারপর থেকেই আমার মনে হয় আর কোন বাঙালি গায়ক কি ‘আষাঢ়’ শব্দের উচ্চারণ জানেন?
    এরকম যাদুবিদ্যা তিনি নানা সময়ে দেখাতেন।
    লেনিন শতবর্ষে (১৯৭০) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা মাঠে রাত সাড়ে এগারোটার সময়ে ছাত্রদের আমন্ত্রণে তিনি গেয়েছিলেন ‘গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর’ – মঞ্চে লেনিনের বিরাট কাট আউট। একটা প্রেমের গানে যে অত রাজনৈতিক দ্যোতনা আনা যেতে পারে সেই প্রথম জানলাম। অত রাতে বাঙালির যৌবন ‘প্রেম’ শব্দটির অর্থ জেনে শিহরিত হয়। আর একটু পরেই তিনি দ্বিতীয়বার আমাদের জয় করে নিলেন ‘তুমি রবে নীরবে’ গেয়ে। জীবনে প্রথম সবিস্ময়ে খেয়াল করলাম দ্বিতীয় স্তবকে তিনি ‘মম জীবন যৌবন, মম সফল স্বপন’ গাওয়ার সময় ঈষৎ পালটে ‘সকল স্বপন’ গাইলেন, আমাদের সুন্দরীতমাদের অনেকেই ভেবেছিলেন ভুলে হল এরকম। পরে শুনেছি জর্জ বিশ্বাসের বিশ্বাস ছিল যে প্রেমিকার সৌরভ ছাড়া তো স্বপ্ন সফলতায় পৌঁছতেই পারে না; সুতরাং ‘সকল স্বপন’ হবে (এখন প্রমাণ হয়েও গেছে যে রবীন্দ্রনাথের পান্ডুলিপিতে ‘ক’ ও ‘ফ’ খুব প্রভেদ না রাখায় এই মুদ্রণ বিভ্রাট ঘটেছিল) যা থমকে আছে প্রিয় নারীর সুগন্ধের প্রত্যাশায়।
    আজ আর বলতে দ্বিধা নেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশ্বে তিনি সর্বাধিক ভাবে সেরিব্রাল। অচলায়তনের বাসিন্দা হতে তিনি অস্বীকার করেছিলেন; বিশ্বভারতীর নায়েব গোমস্তাদের সতর্ক বাণী সত্ত্বেও খরাতপ্ত তৃষাদগ্ধ প্রাণের এই প্রদেশে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঋষ্যশৃঙ্গের মতো মৌন তপস্বী যার আগমনে ঘোষিত হয় সমাগতোরাজবদুন্নত ধ্বনি – গানের বারিধারা - আমাদের নব মেঘদূত।

    এই ছদ্মবেশী দেবতাকে আমরা যৌবনের দিনে কত দেখেছি! তখনও রাসবিহারীর মোড় মেট্রোবিহীন। তখনও বাইককে মোটর সাইকেল বলা হত, তাতে চড়ে তিনি আসতেন, ওষুধের দোকানে দাঁড়াতেন, কখন মোড়ের বিরাট আয়না লাগানো বরফের চাঁই বিছানো পানের দোকান থেকে পান কিনতেন হাসিমুখে। গুন গুন করে কিছু একটা গাইছেন। তখন তো বুঝতে পারি না যে ইনি বাঙালির পল রবসন! দুর্ভাগ্য দেবব্রতর যে এদেশে যথার্থ সমালোচক নেই। যিনি, পল রবসনের তথাকথিত ‘চ্যুতি’ যেমন ইতিহাসের মাত্রা পায়, তেমন ভাবে জর্জ বিশ্বাস কে খোঁজার জন্য জাতীয় চৈতন্যের গহন শিকড়ে নেমে যাবেন। পল রবসনের কথা মনে হল কেননা দেবব্রত ও শেষপর্যন্ত একজন আশ্রমিক গীতিকার ও সুরকারকে জনপরিসরে নিয়ে আসার প্রয়াস করেছিলেন। যাকে বলে হার্লেম রনেসঁস তার সঙ্গে আইপিটিএ-র দেবব্রত যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে পুনরাবিষ্কার করেছিলেন তার মিল রয়েছে।
    রবসন নিগ্রো আধ্যাত্মিকতাকে ক্রমশ মুক্তি দিতে চাইছিলেন় মার্কিনি শ্রমজীবীর মূল সংস্কৃতিতে আর দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর পূজা পর্যায়ের গানে ব্রাহ্ম রক্ষণশীলতাকে মুক্তস্রোতা করে দিলেন। রবীন্দ্রসংগীতের মৌলবাদ তাকে ব্রতভ্রষ্ট মনে করে অথচ জর্জ বিশ্বাস রবীন্দ্রচর্চার সীমানার বাইরেও জনসমর্থন পেয়ে যান; অনেকটাই রবসন যেমন কালো সমাজের ।

    দেবব্রত বিশ্বাসকে কি তবে একধরনের ক্রসওভার শিল্পী বলব? আসলে দেবব্রত যখন সক্রিয়, যেমন রবসন অন্তত ১৯২৪-৪৫ কালপর্বে, তখনও আমরা বুঝিনি সংস্কৃতির নির্দিষ্ট ফ্রেমের বাইরে কীভাবে চলে যাওয়া যায়। আজ হয়ত দেবব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রগানের একটি উপসংস্কৃতিও হয়ে উঠতে পারেন, যেমন হয়ত বিটল ঘরানায় পল ম্যাকার্টনি। নিগ্রো স্পিরিচুয়াল ও ব্রাহ্ম উপাসনারীতি আসলে উপলক্ষ ছিল। বিপ্লবী হয়ে ওঠা ছিল দুজনেরই নিয়তি়

    পুজো নামচা
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    ভূতলে মেট্রো স্টেশনে ভরা গরমে বীরেন ভদ্রের ক্যাসেট শুনে ভেবেছিলাম আমাদের পাড়ায় কোন শেফালিবনের মনের কামনা ছিল না। ব্যানারে অবশ্য আমরা ছোটবেলাতেই ‘দুর্গার’ দুর্গতি দেখেছি। তখন পুজো আসত বাটার স্লোগানে ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো।’ সে জুতো না পড়ায় পায়ে ফোস্কা। আমরা বড় হয়ে উঠেছি সলিল চৌধুরীর পুজো গানের রেকর্ডে। দুরন্ত ঘুর্ণি তখন কলকাতার গলি উপগলিতে; এমনকি লাজুক বউটিও কড়াইয়ে জিরে ফোড়ন দিয়ে ভাবত আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা! আমাদের পাড়ার দেবুদা ড্রেনপাইপ প্যান্ট পড়ে অপেক্ষা করত জ্যোৎস্নাদির জন্য রাসবিহারী মোড়ে। পাড়ার বৌদি-মাসিমারা বলতেন – জ্যোৎস্নার তো দেবুর সঙ্গে ‘ভাব’ !

    তখন কলকাতা অনেক সরল ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে ভাব করত। অগস্ট মাস থেকেই পাড়ার দাদারা ফাঁকা রাস্তায় দুহাতে দুটো ইঁট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্র্যাকটিস করতেন; উদ্দেশ্য হাতের মাসল ফোলানো। সপ্তমীর দিন দুপুরে রোগা চন্দন দা মুখে ভেজা গামছা দিয়ে শুয়ে আছে, বিকেলে যদি আশেপাশের পাড়া থেকে কোন তরুণী ইমপ্রেসড হয়। পত্রিকার শারদসংখ্যা বেরোত মহালয়াতেই; ঘোর বর্ষায় নয়। তাতে লিখতেন তারাশঙ্কর, বিমল মিত্র, সমরেশ বসু। ‘বিবর’ পড়ে আমাদের যৌবনোদ্গম হল। বিজয়া দশমীতে বাড়িতে বাড়িতে ছাঁচের সন্দেশ, কুচো নিমকি। ফাঁকা প্যান্ডেল দেখে সারা পাড়াই জলভরা চোখে চোখে বলত – আসছে বছর আবার এসো মা। মোট কথা উত্তর-দক্ষিণে কোন পুজো প্যান্ডেল ছিল না যার থিম ছিল এবার পুজোয় জঙ্গলমহল হোক মঙ্গল মহল! ক্যাম্পেন ছাড়াই আমাদের রাত পোহাত শারদপ্রাতে। আর আজ?

    বিসর্জনের পড়ের দিন প্যান্ডেলে মন্ডপে ঘুরলে মনে হয় ডেকাডেন্সের আভিজাত্যও আর বাঙালি মধ্যবিত্তের নেই। কালীঘাটের কুরোশোওয়া বাদামতলায় ফুল ফুটিয়েছে। এবার চাঁদ উঠলে সে এসএমএস করবে। এমনকি অসুররাও মানবাধিকারের চাপে বেশ মনুষ্যোচিত। তাদের রোষকলায়িত লোচন ও বিপুল রোমরাজি আর নেই। বরং তারা বেশ ম্যাচো! কোলাকুলি তো উঠেই গেছে; দু-একদিন দু-তিনজন সত্তরোত্তীর্ণ বৃদ্ধ কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি মারেন।

    কেন জানি না আমার মনে পড়ে বঙ্কিম থাকলে ভাল হত। মনে পড়ত কমলাকান্তকে; তারও তো ‘দুর্গোৎসব’ ছিল। আমাদের কিশোর বয়সে জানতাম বিপ্লব হচ্ছে জনগনের উৎসব। এখন এই যৌবনাবাসনে মনে হয় দুর্গোৎসব হচ্ছে জনগনের বিপ্লব। উদ্যোক্তারা সদাব্যস্ত; বারমুডা ও মোবাইল সহযোগে কর্পোরেট ভজনায় অতন্দ্র। কয়েকবছর আগেও অষ্টমীর অঞ্জলিতে গোড়ালি পর্যন্ত ঝুল ও হাতে লাল সুতোর কবজি বন্ধ ও টকটকে সিঁথির এত ভীড় ছিল না। ধর্মের ব্যক্তিগত ও মুক্তরেখ চিহ্ন সমূহ এখন সংগঠিত হিদুঁয়ানির প্রথা হয়ে জড়িয়ে ধরেছে আমাদের যুব জনতাকে। এটাই কৌতুক যে বিশ্বায়নের পরে ‘দক্ষিণেরর’ ফিউজলতন্ত্রকে সমর্থন করে ‘উত্তরের’ বহুজাতিক সংস্থা । আর আমাদের মেট্রোপলিটান মন চায় শারদোৎসব দ্রুত চিহ্নিত হোক অটাম হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল নামে। প্রতিমাদর্শনের প্রবল কুচকাওয়াজে অংশ নিতে নিতে জনতা জানবেই না দেবতা তাকে পরিণত করেছে পুতুলে! আর যুবক?

    ভয় হয় যে সে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’র একশো বছর পরে জন্মেছে। অর্থাৎ সে হাবা। সব অর্থেই ঠিকানাহীন। যথার্থ মধ্যবিত্ত। ‘চাঁদা নিলে না তো?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে রঙিন চুলে পাড়াপুজোর সচিব জানালেন- এখন আর চাঁদায় পুজো হয় না কাকু – বোঝেন তো স্পনশররাই।।।।।।
    কমলাকান্তর জন্য বারোয়ারির ফুল বেলপাতা নেই। তাকে একাই বলতে হবে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু।।।।।।’

    মৃত্যুর রতিমুদ্রা-জীবনানন্দ
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    কার্ত্তিক মাসে আজ আর হিম পড়ে না। রাসবিহারীর ট্রামলাইনে আজ আর ঘাস নেই। তবু সম্মুখ সমরে পাড়ি বীরচূড়ামণি জীবনানন্দ দাশ-কে আমি দেখতে পাই দেশপ্রিয় পার্কের অদূরেই। আকাদেমিয়ার আপাত নিরীহ দাঁত-নখ যে সমরপতিদের অনুরূপ – একথা জানার জন্য জীবনানন্দ দাশকে ফুকো পড়তে হয়নি। শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময় আমাদের সভ্যতাকে যে সমস্ত মেধাবী যন্ত্রণা উপহার দিয়েছে তা কখনও উত্তর কলকাতার মেসবাড়ি, কখনও দক্ষিণ কলকাতার ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে সৌন্দর্যের সারা‍ৎসার – নশ্বরতা থেকে অমরতা।
    আমাদের অবিরাম পতনের মধ্যে আমরা কি চন্দন ও মালার কোন দেবতাকে বেছে নেব পরিত্রাণের আলোকবিন্দু হিসেবে? না, বরং দময়ন্তীর স্বয়ংম্বর সভায় যেমন ছদ্মবেশী দেবতাদের থেকে মানুষ নলকে আলাদা করে যেমন চেনা গিয়েছিল। তার দেহে ঘামের দানা ছিল‌, তার মালায় ফুল শুকিয়ে এসেছিল । তেমনভাবেই আমরা আমাদের স্বেচ্ছা-নির্বাচিত প্রান্তিকতা উৎসর্গ করেছি জীবানন্দ দাশকে। অবিরাম আবৃত্তি, নির্দেশপ্রাপ্ত গীতিকার, রাষ্ট্র-অনুমোদিত বাগ্মীদের এই নরকের মধ্যেই আমাদের খুঁজে পেতে হবে পরিত্যক্তদের কক্ষ। তাঁকে আর আমাদের মডেলমথিত উড্ডয়নশীল প্রদেশের কথ্যভাষায়, পয়ার ও উদ্ধৃতিতে ধরা যাবে না। শাপগ্রস্ত আমাদের ভাষাশহরের শরীরকে পরিত্যাগ করে তার কাব্যের আত্মা চলে গেছে অন্যত্র। আমাদের, অতএব খুঁজে পেতেই হবে প্রত্যাখ্যানের মুদ্রা। জীবনানন্দই শেষ বিপ্লব। বৃহন্নলা সমাবেশে তিনিই এখনও বিবেক ও পোতাশ্রয়। যার রাজনৈতিক আশ্রয় ছিল না, সাহিত্যকুলপতিদের বৈঠকখানা যাকে নিরাপত্তাচ্যুত করেছে, এমন একজন যিনি বিপন্নতাকে বন্দনা করেছেন, বিপন্নতার দ্বারা ব্যবহৃত হবেন এরকম সংকল্প থেকে জীবনকে শাসন করেছেন তাঁর রচনা যদি প্রসাধনগ্রন্থ হয়, মায়ার দর্পণ হয় তাকে আমরা কীভাবে সুরক্ষিত রাখব?

    কবিকে আর্বান পুরোহিত অথবা পপচারণ হতে হবে না। সমাজ তাঁর কাছ থেকে আরোগ‍্য কামনাও করে না। তিনি দৈনিক -সাপ্তাহিক-মাসিক কোনওকিছুরই সম্মান ও প্রচার বাড়াতে পারেন না। এ পর্যন্ত বিজ্ঞাপনকর্মী ও ইমপ্রেসারিওরা তাকে দেখে থতমত খেয়েছে। একজন কবি তাহলে কী করেন? তিনি আমাদের ভাষাস্থাপত্য পালটে দেন। তার অন্তর্ঘাতনা এটুকুই যে সম্পূর্ণ নিঃসম্বল ও একাকী কোনও ছত্রীসেনার মতো আমাদের চিন্তার বিন্যাস তিনি পালটে দেন আমাদের অজ্ঞাতেই।

    যেমন ধরা যাক, হাতের পাঁচ, কোনও উদাহরণ। ‘নীড়’ শব্দটি বাংলা কবিতায় অনেক কিছুর মত খ্যাতি পায় রবীন্দ্রনাথের হাত যশে। “পাখি আমার নীড়ের পাখী” পদবন্ধ যখন জীবনানন্দের হাতে “পাখি নীড়ের মতো” হয়ে গেল – এ যেন হেগেল থেকে মার্কস, এক অলৌকিক উল্টে দেওয়া – আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলাম দ্বিতীয়টিতে। সংস্কার থেকে শব্দ প্রতিস্থাপনের দায় কবির মৌলিক দায়। একেই ভাষাবিহার বলে। আইজেনস্টাইন একবার বলেছিলেন, এল গ্রেকো ও ভ্যানগগের শ্রেষ্ঠ আত্মপ্রতিকৃতি হল তাদের ল্যান্ডস্কেপসমূহ। প্রাথমিক বিস্ময়ের পর আমরা বুঝতে পারি শিল্পীরা যে অনিঃশেষ অবলোকন করে থাকেন তা শেষ পর্যন্ত নিজেকেই দেখা। লেখকেরা লেখে হয়ত ডান হাত দিয়ে। কিন্তু তাতে পড়ে বা হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ। এ ছাপের কোনও নকল হয় না। যার বৃদ্ধাঙ্গুলী নেই, সে লেখকই নয়। মৃত্যুকে ভাষাশিল্পী জীবনানন্দের উপহার ওই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ। পৃথিবীতে তো আর দ্বিতীয় জীবনানন্দ দাশ হয় না।

    সিনেমার উৎসব
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    পুজোর শেষটাই উৎসবের শুরু কিনা, জানি না। কলকাতায় কিন্তু গত ১৭ বছর ধরেই হেমন্তকালটা সিনেমার ঋতু। আবার নন্দন চত্বরে উত্তেজনা! অহঙ্কারী তরুণ আর সপ্তমীর চাঁদের মতো নারী। আর জটলা থেকে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্ন ঃ “সঞ্জয়দা, ‘ফিল্ম সোসাইলিজম’ আগেই দেখেছ তো তুমি না?” বা, “প্লিজ, একটু বল কিয়ারোস্তামি ।।।”। সিনেমার মাস্টারমশাই হতে আমারও যে খুব খারাপ লাগে তা নয়। বছরের এই একটা সময়েই তো আমাদের যা দাম; বাকি সময়টা তো শুধুই যাদবপুরের ক্লাসরুম! আর এই ফেস্টিভালের শুরু থেকেই আছিও তো! মনে পড়ে যেন এই তো সেদিন, ১৯৯৪-তে, কী অবাক হয়ে দেখছিলাম, একদিকে নন্দনের রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন লাতিন আমেরিকার কিংবদন্তী, ব্লিচ করা রূপোলি চুল, ফার্নান্দো সোলানাস। কি দেখছেন তিনি? চোখের অনুসরণ করি। ওমা! হুইলচেয়ারে স্বয়ং আন্তোনিওনি, যাকে বাদ দিয়ে ছায়াছবির ইতিহাসই পড়া যাবে না।

    সেই সোলানাসের সঙ্গে কত গল্প হল বছর তিনেক আগে। দেখলাম একটু বুড়ো দেখাচ্ছে কিন্তু হোটেলের লাউঞ্জে ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে কীভাবে তিনি ছাত্রদের শেখাচ্ছেন আর্জেন্টিনায়। বলার সময়ে তার কোনও ক্লান্তি ছিল না। বরং বনধের কলকাতা বুয়েনস আইরেসের মত কিনা জানতে একটু আগেই ঘুরে এসেছেন নিজের দায়িত্বে মৃণাল সেনের বাড়ি থেকে। পরোয়া করেননি নিরাপত্তারক্ষীর সতর্কবার্তায়। একইভাবে মনে পড়ে অন্য এক তুলনায় অখ্যাত তরুণকে। জাফর পানাহি। এখন তো শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি সারা দুনিয়ায় সংবাদ শিরোনাম; তাঁর ছবি বানানোর অধিকার কেড়ে নিয়েছে ইরানের মৌলবাদী কাজির বিচার। কিন্তু সেদিন লাজুক তিনি আমাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করেছিলেন – “এই অফিসিয়ালসদের সঙ্গে সাইটসিইং আমার ভাল লাগে না; কলকাতার ইন্টেলেকচুয়ালরা, ছাত্ররা যে সব জায়গায় আড্ডা মারে, যাওয়া যাবে সেখানে? আমাকে নিয়ে চলুন না”। একইভাবে তুর্কি পরিচালক আলি ওজসেনক্রুককে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। পুজোর পরে বেশ ফাঁকা, কুমোরটুলিতে। ‘দি ন্যুড’ ছবির পরিচালক আমাকে জানিয়েছিলেন বিশালাকার এইসব নগ্ন দেবদেবীর কথা জানা থাকলে ছবির চিত্রনাট্য তিনি হয়ত একটু বদলাতে পারতেন। কুমোরপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে হাসিঠাট্টাও করেছিলেন। এরকমভাবেই নিবিড় আড্ডা দিয়েছি চিলির মিসেল লিতিনের সঙ্গে। কলকাতা, জোড়াসাঁকো এসবই তাঁকে উসকে দিয়েছিল ভাবতে যে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পো সম্পর্ক নিয়ে ছবি করলে কেমন হয়! তাতে ঔপনিবেশিকতার সাংস্কৃতিক ইতিহাস থাকবে, যেমন এশিয়ার, তেমন লাতিন আমেরিকার। লিতিনের প্রস্তাবিত লোকেশন ছিল তিন মহাদেশ জুড়ে। জানি না এ ছবির বাজেট বা প্রযোজক চূড়ান্ত হয়েছে কিনা।

    নন্দনে দুপুর একটায় যে শো শেষ হয়, আবার শুরু তিনটেতে। কোনও কাজ থাকে না। অতিথিরা, দর্শকরা যে যার মত খেতে গেছেন। কনফারেন্স রুমের এক কোণে অলস অন্যমনে আমি আর জঁ-ক্লদ কারিয়ে। কে জঁ-ক্লদ? বিশ্বের প্রথম সারির এক চিত্রনাট্যকার যিনি শুধু হলিউডের ছবির স্ক্রিপ্ট করেন না; বরং তার প্রধান পরিচয় তিনি বুনুএলের অবিচ্ছেদ্য চিত্রনাট্যকার। গোদারের একটি ছবিরও চিত্রনাট্য লিখেছেন। গোদার আর বুনুএল নিয়ে কী চমৎকার তুলনাই না টেনেছিলেন তিনি! বুনুএল কালা ছিলেন বলে আমার কথা বলা নিষেধ ছিল। যা জানার বা বোঝার তা দিনের শেষে হবে। হোটেলের বাগানে আসি। মাঝে মাঝে কালো কফি। কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। বুনুএল বলছেন। কখনও বিরাট সময় জুড়ে চুপচাপ। আমাকে অপেক্ষা করতে হত যে কখন আবার মুখ খুলবেন। কাজের সময় কোনও অবান্তর কথা তাঁর পছন্দের ছিল না। আর গোদারের সঙ্গে কাজ করা বেশ ঝামেলার। এই বলছেন কিছু, একটু পরেই বদলাবেন। কোনও ব্যাখ্যা দেবেন না। কিন্তু বুঝতে চাইলে বিরক্ত হবেন না। আমার ভাল লাগেনি গোদার সঙ্গ।

    আর দর্শকেরা? সত্তর দশকের কলকাতায় তবু ছবি দেখার পরিসর ছিল। অ-মার্কিন দুনিয়াও এসপ্ল্যানেডের হাতের মুঠোয় ছিল। লবিতে ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, মেরলিন ডিয়েট্রিশের ছবি, ছোট্ট একটি পানশালা, কি সুন্দর ষড়যন্ত্র! তখনও কলকাতার চোখ এত দুঃস্থ হয়ে যায়নি। আমরা আন্তোনিওনির ব্লো-আপ দেখেছিলাম মেট্রোতে, এলিটে ভিসকন্তির আউটসাইডার। নিউ আ্যম্পায়ারে ছিল মজা, পঁচাত্তর পয়সার সবচেয়ে কম দামি টিকিটে চারতলায় ছুট। সেখানে অলিখিতভাবে স্মোকিং অ্যালাউড। ভিসকন্তির ‘ডেথ ইন ভেনিস’ দেখতে দেখতে সিগারেট আমরা ঠোঁটছাড়া করিনি। সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ছিল ‘টাইগার’। আজ দোকান। তারাও ক্লোদ লেলুশের ‘নারী-পুরুষ’ দেখত।

    আজকে অবশ্য আমাদের ছেলেমেয়েরা টরেন্ট থেকে ডাউনলোড করে। কম্পিউটারে ছবির চলাচল। আজকের মাল্টিপ্লেক্স হয়তো প্রাচুর্যকে সংরক্ষিত রেখেছে, কিন্তু ‘দেখে’কে? দিন, ঋতু, ক্ষণ থমকে আছে সিনথেটিক আবহাওয়ায়। ‘হল’ ছিল মনোযোগের জায়গা আর ‘মাল্টিপ্লেক্স’ তো সংগঠিত অন্যমনস্কতার। আসনের নীচে বাতি। আসনের হাতলে পানীয়, আসনে আসনে জ্বলতে থাকা মোবাইল পর্দা, চাপা গুঞ্জনে চঞ্চল দর্শককুল – এখানে ছায়াছবি গৌণ। ভ্রমণ ও দোকানবিলাসের অন্তর্বর্তী স্তর এই মাল্টিপ্লেক্স। ফরাসি মণীষী রল্যাঁ বার্ত-এর কথায় পরিবাহিত অচলতা – এক ধরনের উইন্ডো শপিং। অন্দরের ফ্যান্টাসমাগোরিয়া। সিঁড়ির ওঠা নামায় চলমান অশরীরি।

    একদিন অপুর সংসারের নবীন দম্পতি হলে সিনেমা দেখতে এসেছিল। আজকের স্বপ্নহীন কলকাতায় অপূর্ব আর অপর্ণারা যদি হলে ভিড় করে তাহলে হয়ত আবার অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে স্বপ্নবৃষ্টি হবে। উৎসবের মানে তো অলীক স্বর্গেরই হাতছানি।

    বড়লোক
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    কি জানি কেন, হয়ত টিভি ছিল না বলেই, বা হয়তো হিন্দি সিনেমা দেখা প্রায় পাপকর্ম ছিল বলেই আমরা যখন ছোটলোক, মানে ছোটছিলাম, তখন বড়লোক বলতে কি বোঝায় বা বড়লোকেরা ঠিক কি করে, এ বিষয়ে আমাদের কোন ধারনা ছিল না। আমাদের একজন পিসেমশাই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ‘ত্যাগ’ বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন দেশসেবা শুরু করার আগে তার ধুতি ও রুমাল নাকি প্যারিস থেকে ইস্ত্রি হয়ে আসত! আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। আমাদের একবারও মনে হয়নি যে প্যারিসের ধোপাদের হাতে দেশবন্ধুর ধুতি থাকলে এখানে তিনি কি পরবেন? আর যখন প্লেন নেই, একটা রুমাল কেন দু’মাস ধরে জাহাজে ঘুরবে – এ প্রশ্ন আমাদের মাথায়ই আসেনি। আমরা জানতাম, জেনে খুশি ছিলাম, যে বড়লোকেরা আলাদা। এরকমভাবেই আমাদের কেউ জানিয়েছিল সে যুগের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর স্বাস্থ্যরক্ষার দাওয়াই – দৈনিক একটি মুর্গমসল্লম খাওয়া!

    এখানে বলা দরকার ষাটের দশকের শুরুতে মুর্গি আজকের মতো সুলভ ছিল না। অনেক বাড়িতে মুর্গি ঢুকতেই পারত না; যেমন আমাদের ব্রাহ্মণ বাড়িতে। তবু নিস্পন্দ মনে একবারও কৌতূহল জাগেনি যে প্রধানমন্ত্রী হলে‍ও রোজ রোজ আস্ত মুর্গমসল্লম খেলে শরীর টিকবেই না। আসলে পেটরোগা আমরা তো জানতামই না মুর্গমসল্লম কি, ধরনের খাওয়ার। জীবনের উচ্চাশা ছিল মুর্গমসল্লম খাওয়ার একদিন নিশ্চয়ই ।।।।

    আমাদের পাড়ায় একজন বড়লোকের বাড়ি ছিল ফোয়ারা শুদ্ধু। তখনও কলকাতায় গণতন্ত্র এত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি যে সারা শহরটাই বস্তি বস্তি লাগবে বেঢপ কিছু উঁচু বাড়ির জন্য। তিনি বাইরে ব্যবসা করতেন; আসতেন বছরে দু’একবার। নাম ছিল সম্ভবত চাঁদমল রাজঘোড়িয়া বা এরকম কিছু। তার হলঘরে আয়না মোড়া দেওয়াল আকর্ষণীয় ছিল; কিন্তু আমরা ভাবতাম তার খাদ্যতালিকা হয়তো আরও আকর্ষণীয়। এমন অবস্থায় একদিন আমাদের পাশের বাড়ির ভোন্তা জানায় যে তিনি নাকি রোজ ব্রেকফাস্টে পোলাও আর ডিমসেদ্ধ খান! বড় বড় হাঁসের ডিম – ভোন্তা নিজে দেখেছে! পোলট্রিবিহীন আমাদের শৈশবে একবারও সন্দেহ হয়নি একজন মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী এরকম অবাস্তব প্রাতঃরাশ খাবেন কেন? ব্রেকফাস্টে এরকম অদ্ভুত কম্বিনেশন থাকা সম্ভব?

    মাইকেল মধুসূদন দত্ত খুব বড় লেখক ছিলেন। কেন? না, তিনি একই সঙ্গে ছ’জনকে শ্রুতিলিখনে বসিয়ে কাউকে মেঘনাদ বধ, কাউকে বীরাঙ্গনা, কাউকে সনেট, কাউকে প্রহসন লেখাচ্ছেন ডিক্টেশন দিয়ে – একবারও মনে হয়নি যে হতে পারে না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ার আগেই আমাদের জানা ছিল মাইকেল অতিমানব; সুতরাং সম্ভব।

    তারপর একদিন কি কুক্ষণে যে আমরা সবাই বড়লোক হয়ে গেলাম! জীবনরহস্য ঘুচে গেল। জানলাম বড়লোকেদের ব্লাড প্রেসার। বড়লোকের ডায়বেটিস, বড়লোকের পারকিনসন’স ।।। জানলাম মিডিয়া যা লেখে ও লেখায় তাকে বলে অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদন। যখন ছোটলোক ছিলাম, এত জানা ছিল না। ছোটলোকেরা একটাই জিনিস জানে, সহজে জানে ঃ রূপকথা। বড়লোকের স্মৃতিতে এত সৌরভ থাকে না।

    তিনতরঙ্গ
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    ১। একজন কবি কখন প্রকৃত অর্থে চিরজীবী হয়ে ওঠেন তার সংস্কৃতিতে? অরফিউস, সে বাতাস বহন করত অর্থা‌ৎ তার অদৃশ্য থাকা একধরনের রূপক। কবিকে ইতিহাস অদৃশ্য হতে পরামর্শ দেয়। সংস্কৃতির ভূমিগর্ভে, শিকড়ে বাকড়ে কবি চলে যান; প্রবাদে, প্রবচনে, লোকশ্রুতিতে তার রচনা ব্যবহৃত হয়; তার নাম জানা হয় না; লেখাও পড়া হয় না। তবু তিনি শাশ্বত আর তিনিই শাশ্বত কেননা তিনি তখন জাতির মগ্ন চেতনায় স্বাক্ষরবিহীন পাতালের চিরকুট। এরকমই চর্যাপদের হরিণী, আষাঢ়শ্য প্রথম দিবসের কালীদাস ও বাংলার মুখের জীবনানন্দ। ছিনু মোরা সুলোচনে – মধুসূদন। রবীন্দ্রনাথ ও তুলসিদাস এরকমই। নিশ্চয়ই পশ্চিমে দান্তে। শেক্সপীয়র এভাবেই পাঠ-অতিরিক্ত স্মরণীয়তা পেয়েছেন।

    ২। জঁ রনোয়ার লা রেগলে দ্য জু (খেলার নিয়ম) ছবিটি আলোচনা করার সময়ে বিখ্যাত বাস্তববাদী তাত্ত্বিক আঁদ্রে বাজাঁ এক ধরনের ‘কাস্টিং এরর’ বিষয়ে সপ্রশংস উল্লেখ রেখেছেন। ‘জংলী’ ছবিতে ‘এহসান তেরা’ – মহম্মদ রফির এই গানে শাম্মী কপূর হয়তো চরিত্রলিপির ভুল। আসলে স্টার হিসেবে শাম্মী কপূরের নৈরাজ্য এলভিস প্রিসলেকে অনুকরণের প্রয়াস কোথাও মহম্মদ রফির অশেষ নিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য খুঁজে পায় না। হয়তো এই বৈপরীত্য থেকেই গানটির ধ্রুপদী তীব্রতা নির্মিত হয়। এই গানের যে প্রণাম – তা তো ঈশ্বরের প্রতি। ‘যদি চাও তো গড়ে তোল, যদি চাও শেষ করে দাও – আমি তোমার স্তব ছাড়ব না’ – এ তো বিদ্যাপতির ‘মাধব বহুত মিনতি করি তোয়’ বা রবীন্দ্রনাথের ‘চিরসখা হে’ বা মীরার ‘ম্যায় না ছোড়’!

    হিন্দি জনপ্রিয় ছবির গান সাধারণত এই শৃঙ্গারোহন পর্ব পায় না। জনপ্রিয়তার নুড়ির মধ্যে এমন সব পরশ পাথর লুকিয়ে থাকে। এই গানটি মহম্মদ রফি পুরুষের জন্য সংরক্ষিত রেখেছেন; এমনকি লতা মঙ্গেশকারের মতো গায়িকাও তা ছুঁতে পারেন না!

    ৩। নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে আর কতদিন, কতবার কত গান গেয়ে যেতে হবে আমাদের? কাজের দিদি বা মালতি মাসির সেজ ছেলে আমরা কেরোসিনের লাইনে ইঁট রাখতে রাখতে সত্যিই বাবুদের বাড়ির পাস্তা-নুডলসে মানুষ হওয়া বুবুনকে পাশ কাটিয়ে জিতে নেব বোর্ত্তি পাশ?

    কি জানি গরীবদের আজ বড় দুর্দিন! মাথায় টাঙানোর মত ইডিওলজির তেরপল নেই। কিন্তু রাগ করার অধিকার তো ফুরিয়ে যায়নি গরীবদের। আমাদের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে ভবিতব্যের দিকে – আগুন যদি শেষ রগড় দেখায়!
  • .... | 127.194.195.52 | ০৩ নভেম্বর ২০১২ ০২:৩৭577478
  • কিছু স্যাম্পেলঃ৩ ব্লগগদ্য

    আড্ডা
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    খুব সকালে আজ আবিষ্কার করলাম বাঙালির আর আড্ডা নেই। চন্ডীমন্ডপ তো সেই কবেই উঠে গেছে; যদি কিছুটা থেকে থাকেও তো বাংলা খবরের কাগজে - মোটেই গ্রামে ও মফঃস্বলে নয়। কমলাকান্ত যে নসিবাবুর বৈঠকখানায় বসত, তা আর আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির স্থাপত্য অনুমোদন করে না। বনমালি নস্কর লেনের মেসবাড়িতে যেই থাকুক ঘনাদা অন্তত নেই। চাটুজ্জেদের রোয়াক নেই যে পাড়ায় পাড়ায় সদলবলে টেনিদা ছড়ি ঘোরাবে। বাড়িগুলো থেকে ছাদ নামক পদার্থই তো উঠে গেল; কবে রাঙামাসিমা পাশের বাড়ির ঝুনু, রুনু আর একতলার ফুলবউদিকে ডেকে নিয়ে রোদ পোহাতে পোহাতে লাউ-বড়ির তরকারির সুগন্ধ বিতরণ করবেন – এ প্রসঙ্গই তো অবান্তর হয়ে গেল। চায়ের নির্দোষ ক্যান্টিন আজ আর শহরে বিশেষ নেই। এমনকী হারিয়ে গেছে আমাদের যৌবনের ‘লালকেল্লা’- কফিহাউসের মেজাজ। এক শনিবার বিকেলে গিয়ে দেখলাম কিরকম দুঃস্থ; কফিঘরকে একটু দুঃখী দেখাল যেন একুশ শতকের কলকাতার দুয়োরানী।

    কেমন ছিল কফিহাউস আমাদের ছোটবেলায় – সত্তর দশকে? কফিহাউস বলতে আমি অবশ্য কলেজ স্ট্রিটের-টিকেই বোঝাচ্ছি। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউরটি যদি বা তুলনারহিত – একদা সবান্ধব সত্যজিৎ রায় আর এই সেদিনও সমর সেন বাতি জ্বালিয়ে রাখতেন – তবু বড্ড অভিজাত, সাংবাদিকনন্দিত। আর যাদবপুরের এইট বি মোড়ে এখনও কোনও বনেদিয়ানা নেই। আমাদের কলেজ স্ট্রিট সেদিক থেকে দেখলে প্রাচীন গ্রীসের স্নানঘর – সোক্রাতেস, ঈসকাইলাস আর ইউরিপিদিসের অবিরত আনাগোনা, সেনেটর হিসেবে আমরা ছোট ছোট কবি আর পুলিশের ‘আদর’ পাওয়া ছাত্রনেতারাও কিছু ফালতু ছিলাম না।

    গরমের ঠাঠা দুপুর। ভাবলেশহীন গম্ভীর মুখে নির্মাল্য আচার্য প্রুফ দেখছেন ‘এক্ষণ’ পত্রিকার। হায়! সেই মায়াঝরা সন্ধ্যা! সোনালি তরলের বদলে কালো কফিতে চুমুক দিচ্ছেন সদলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়। অতবড় ঘর গমগম করছে শনিবারের বিকেলে; কবিতার ব্যান্ডমাস্টার তুষার রায় হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন টেবিল থেকে টেবিলে। দণ্ডায়মান ‘রাজকুমার’ সন্দীপন ঠোঁটের কোণে একটু বাঁকা হাসি নিয়ে কিছু ভাবছেন। তখন কফিহাউস দুপুরে রাজনীতির ফ্রানজ ক্যানন, চে গুয়েভারা, মাও সে তুং নামগুলো ঝরে পড়ে আর রাতে কবিদের সাহিত্যের সাম্রাজ্য দখল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দক্ষিণগামী দোতলা টুবি-তে লাফিয়ে উঠে পড়ি আমরা। তখনও কফিহাউস স্ত্রীভূমিকাবর্জিত। যদি দৈবাত স্থির দামিনীতুল্য কোনও নারী-কবি বা ছাত্রনেতার বান্ধবী দেখা দিতেন মুহূর্তে থেমে যেত যাবতীয় কথাশিল্প। এককথায় কফিহাউস মানে তখন পকেটে রেডবুক উদ্ভ্রান্ত কিশোর, দেওয়ালে কমরেড কাকা লাল সেলাম। তাঁর দরজায় স্বপ্নের দলিল হাতে তরুণ কবি।

    ১৯৬৯-৭০ সালে আমরা যখন কফিহাউসে পা রাখলাম তখন সে যে কি রূপসী! প্যারিসের রাজপথের আরকেড বোদলেয়ারের মতন আধুনিক কবিদের জন্য যতটা ভাবনার পরিসর, সমগ্র সত্তর দশকের আড্ডা কফিহাউসে তেমন তীর্থ পেয়েছিল। আর কলকাতার কলেজ স্ট্রিট যেন নিউইয়র্কের গ্রিনউইচপল্লী – লম্বা, রুক্ষ, আলুথালু চুল, অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি, জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে শাপভ্রষ্ট দেবদূতেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় পাতায়। এমন আশ্চর্য ভুলভুলাইয়া ভারতের আর কোনও শহরে আছে? একটা কফি দু’জনে বা তিনজনে ভাগ করে সারা বিকেল কাটিয়ে দিতে দিতে নিজেদের সত্যি সত্যি ফরাসি আভাঁসার্দ মনে হত। সারাদেশ তখনও স্বপ্ন বলতে শপিংমল বোঝেনি। মার্কস ও কালোকফির এই সন্তানদল কেউ কেউ মনে করেছিল কৃষিবিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়ল বলে – অন্যেরা ভাবত কবে যে সংস্কৃতির সদর দপ্তরে কামান দাগা হবে।

    এখন লোকেরা এসএমএস করে ‘বসার’ কথা বলে। মদ্যপান শাস্ত্রানুমোদিত হয়ে গেল। বারিস্তায় চা খাওয়া ‘বেশ অন্যরকম’ বলে অনেকে বাতানুকূল হয়ে ওঠে। কলকাতার সাংবাদিকরা নিজেদের মিডিয়ার লোক ভেবে পার্টিতে যায়। আজ মনে হয় চল্লিশ বছর আগেও তো জ্যোৎস্না ফুটলে পরিরা নেমে আসত কফিহাউসে! কতিপয় চন্দ্রাহত যুবক তাদের দিকে তাকিয়ে থাকত অপলক। আড্ডার বাঙালি পথের পাঁচালী বানাতে পারত। কাজের বাঙালি সেই 'আড্ডা' নিয়ে পিএইচডি করে। সময় যে কিভাবে পাল্টায়!

    বইমেলার বিবর্তন
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    মার্কসের যেমন ‘হ্যাভস’ আর ‘হ্যাভ নটস’, কলকাতাতেও তেমন দু’ধরনের লোক; যারা বইমেলায় যায় আর যারা বইমেলায় যায় না। যারা অ্যাকাডেমিতে নাটক করে, নন্দনে সিনেমা দেখে, ডোভার লেনে গান শোনে, মেট্রো চত্বরে অনশন দেখে, যারা নন্দীগ্রামে ও সিঙ্গুরের পক্ষে বা বিপক্ষে, যারা ভোট দেয়, যারা অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে, এমনকী যারা বাংলা ব্যান্ড শুনবে বলে ছেলেমেয়েকে ইংরেজি পড়ায়, সোজা কথায় যারা রাজ্য-রাজনীতির খোঁজ রাখে তার বইমেলায় যায়।

    উপায়ও নেই। একশো বছর আগে রাজধানী দিল্লিতে চলে যাওয়ায় আমাদের কোনও আর ব্র্যান্ড নেই যে করে খাব। দিল্লিতে ক্ষমতা, টাটা থেকে মাফিয়া মুম্বইতে, সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে বেঁটে ও রোগা আমাদের হাতিয়ার হবে বই। সুতরাং সংস্কৃতির রকমফেরে আমাদের গাড়ির ডিকিতে ও সিন্থেটিক ঝোলায় ফেলুদা ও শরদিন্দু; সফটওয়্যার ও গার্ডেনিং এবং কখনও সখনও খাগড়ার কাঁসার বাসনের ওপর দ্বিতীয় শ্রেণীর পশ্চিমী পণ্ডিতের চতুর্থ শ্রেণীর অনুবাদ।

    আসলে বছর কুড়ি আগেও বইচর্চার একটা বড় সুযোগ থাকত বিয়ের উপহারে। প্রত্যেক বাড়িতেই বেশ কয়েক কপি সঞ্চয়িতা, ভারত প্রেমকথা ও হিন্দু নারী থাকত। পৈতে, মুখেভাত তো গেছেই, এখন ভ্যালেন্টাইনস ডে-তেও এসব অসভ্যতা বরদাস্ত করা হয় না। আমাদের আছে লোকাল বুটিক ও গ্লোবাল ‘তানিস্ক’। এমন অবস্থায় বইমেলার থিম সং ‘বই ডাকছে বই।।।’ শুনে গত বছর মনে হয়েছিল নিরক্ষরদের গ্রামে হ্যামলিনের না হোক সাক্ষরতার বাঁশিওয়ালা এসে পৌঁছেছে। গ্রামের সার্কাসের তাঁবুতে বাজনা বাজছে – খোকা খুকু আয়!

    এবার তো বাংলার পুলি পিঠে আর ইংরেজি শোনার আসর, লিটারারি মিথ। চাটুজ্জে বাড়ির বঙ্কিম-শরৎ, বাড়ুজ্জে বাড়ির মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর আর নাকি লোক টানতে পারছে না। লোকে ঠাকুরবাড়ির রবির লেখাও ইংরেজিতে পড়তে চায়। এখন আর ‘ভার্নাকুলার’ দিয়ে চলবে গ্লোবাল বাঙালির সেমিনার?

    বইমেলার ধুলোর ভেতরে হারিয়ে যেতে থাকা জনৈক তরুণ ও তার বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে এবার মাঘে মনে হবে মোমের আলোয় আজ গ্রন্থের কাছে বসে থাকার মতো আয়ু আমাদের জীবনে আর বেশি নেই। আজ বাতায়ন পাশে মাইক্রোপ্রসেসর খচিত সন্ধ্যা। সুইচ অন করলেই শুরু হয়ে যায় রূপকথা – উর্বশীর উদারনৃত্য, ক্যুইজ সফলতা। দাঙ্গা মন্বন্তর দেশ-বিদেশ সত্তর দশক আমাদের বিস্ময় কেড়ে নিয়েছে। শৈশব আমাদের ঠেলে দিয়েছে বিষণ্ণ, হাবা এক যৌবনে।

    আজ শুধু দৃশ্যের মিছিল। আজ শুধু শ্রুতির শ্লোগান। আজ কে আর কৌতূহলভরে কবিতা পড়বে অথবা জীবনানন্দের শান্তিশেখরের মতো মালার্মে বা মার্কসের না-পড়া বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকার বিলাস পুষতে পারেন? আমাদের আড্ডা আর হাসাহাসির দলিল এখন ফেসবুক, উইকিপিডিয়ায়, গুগল ও মাইক্রোসফটের জানালায়! আজ শুধু ই-বইয়ের দিন। বইমেলা তো পরাবাস্তবতার, শুধু নির্জ্ঞানরহিত।

    সেলুলয়েডে বাঙালি প্রেম
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    প্রিয়তমাষু,

    একদা ছাদ ছিল। ফলে মাধবী ঝুঁকে পড়লে ফুটপাথের জয়ন্তদা ছোটদের রামায়ণের হরিণশিশুর মতো করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকতে পারত। তখন দ্বাপর যুগ; ‘বিকেলে দেখা কোরো’ – এই চিরকূটটি খাতার ভেতর গুঁজে দিয়ে তবলার তরুণ মাস্টার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত লেকের পাশে। তখনও সেমিনার করে পরিবেশ সংরক্ষণ শুরু হয়নি। ফলে গাছেরা নিরাপদে ছিল। আর তাদের কোলে, কদম্বরেণু বিছাইয়া ফুল শয়নে প্রেমিক যুগল। যারা একটু বাংলায় ভাল, প্রেমপত্র লেখা, তাদের একস্ট্রা-কারিকুলার অ্যাকটিভিটি কেন না অধিকাংশ বাঙালি প্রেমিক মনের কথা মুখে গুছিয়ে বলতে পারেনি। তাদের তো অপেশাদার সহকারি লাগবেই, সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের যেমন অজিত। কম্পিউটারের জানলা খোলা না থাকায় মেয়েদেরও সে-সব চিঠি পড়ার সুযোগ ছিল।

    অধিক আর কি বলি, স্বয়ং উত্তমকুমারও তো সাড়ে চুয়াত্তরে রাস্তায় সুচিত্রা সেনের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তোতলামি এড়াতে গাছের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তালুতে ঘষতে থাকেন! পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রেম ও নারায়ণশিলা – দুই-ই সমান বিশ্বাস্য হওয়ায় যুবকরা প্রেমের পরিণতি নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে ‘এই বালুকাবেলায় আমি দেখেছিনু’ গানটির সময়ে বিশ্বজিৎকে কিছুই করতে হয়নি। অভিনয় সমুদ্রের আর গলা হেমন্তর। বিখ্যাত ‘তুমি যে আমার’ গানে উত্তমকুমার ততটাই নিষ্ক্রিয় যতটা বেহুলার ভেলায় লখিন্দর। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে আয়েষা মুখে বলেছিল – ‘এই বন্দি আমার প্রাণেশ্বর!’ কিন্ত গোপনে একটি গরলাঙ্গুরীয় রেখেও দিয়েছিল। আমাদের ছবিও ক্রমাগত একটি আংটি লুকিয়ে রাখে; তা প্রেমের।

    ধরা যাক ‘শাপমোচন’। এই ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালের মে মাসে। তার ঠিক তিনমাস বাদে ‘পথের পাঁচালী’। আমার ছোটমামা তো সগর্বে তার দিদিকে জানায় – পথের পাঁচালী ‘ডকুমেন্টারি’ ছবি; অন্যেরা এত সচ্চরিত্র ও নির্ভীক না হলেও শাপমোচনে সে মজেছিল তাতে সন্দেহ নেই। ‘পথের পাঁচালী’ অন্তত কালীঘাট, আহিরিটোলা ও বেলঘরিয়ায় ‘শাপমোচন’ থেকে অনেক পিছিয়েছিল। এই দুটি ছবি মোটামুটিভাবে বাংলা ছবিকে আধুনিকতার মার্কশিট তুলে দেয়। যদিও অনেকেই বলেছিল

    ‘বিভূতিবাবুর প্লে’ তবু পথের পাঁচালী মূলত শহরের এলিট মানুষের যারা বাঁকুড়ার ঘোড়ায় চড়ে অথবা জলসায় মিঞা কি মল্লার শুনে যৎপরোনাস্তি অভিভূত বোধ করে। অন্যদিকে আমরা যারা হয় মেমারি ও গুসকরা থেকে নয়তো পাবনা বা ফরিদপুর থেকে হাইকোর্টসঙ্কুল কলকাতায় চলে এসেছি তারা ‘প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’ শুনতে পাই। আর ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ তো সময়ের পালাবদল। গ্রাম থেকে শহরে আসার কাহিনির যে রাজনীতি তা উত্তমকুমারকে জড়িয়ে থাকে আর বাকিটা আমাদের অলিখিত ইতিহাস বা পুরাণকথা যা পঞ্চাশ দশকের নাগরিকতাকে ঐতিহ্যের শিলমোহর ছেপে দেয়। দুর্বাশার অভিশাপ ও সাবিত্রীর তপস্যা নতুনভাবে বাঙালি চেতনার স্মৃতিফলকগুলিকে নাড়া দিয়ে যায়।

    ‘শাপমোচন’ দেখে মনে হয় সিনেমা সত্যিই শহুরে লোকনাট্য, যেখানে যুধিষ্ঠিরপ্রতিম অগ্রজ পাহাড়ি সান্যাল, উদভ্রান্ত যৌবন উত্তম, সন্ধ্যাদীপের শিখার মতো প্রণয়পথে দীপ্ত সুচিত্রা। যে যুবক কোনওদিন শ্রাবণে বা বৈশাখে স্তব্ধ প্রণয়-মুহূর্ত খুঁজে পাননি, গ্রামীণ সমাজ যাকে নির্জনতা দেয়নি সুচিত্রা সেন ও তার আহত ভ্রূ-বিলাস তাকে উপহার দিয়েছিল সীমা ছাড়ানোর সীমা। ‘সপ্তপদী’র কৃষ্ণেন্দু মিশনারি হয়ে যেতে পারে কিন্তু তার মুখাবয়ব ধরে রাখে একজন সাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রণয়-আদল। একজন বাঙালি তরুণ তার প্রণয়িনীর কাছে যে সামান্য স্পর্শের আঁচ পেতে চায় তা কি অসামান্যভাবে ট্র্যাজেডির আগুন জ্বালাতে পারে তা ওথেলো দেখে আমরা বুঝেছিলাম। আর মত্ত মাধবীলতার মতো রিনা ব্রাউন যখন ট্রেনের ধাতব শব্দে কাঁপতে থাকা আয়নায় কৃষ্ণেন্দুকে ভাঙতে দেখে ভ্রষ্টস্মৃতি উদ্ধার করে, সেই মুহূর্তটি?

    আজ বাঙালি প্রেম করতে কার্সিয়াং যায় অথবা ব্যাঙ্ককে। সেখানে খালি গায়ে নাচে অথবা বিয়ার খায়। যৌবনের কারুবাসনাকে সরিয়ে দিয়েছে প্রৌঢ়র হরমোন বিপর্যয় ও মাস্তানজঙ্গল কাব্য। কুয়ালালামপুরের রাস্তায় নায়কের নাচানাচি দেখে মনে হয় কলকাতার রাস্তায় গাছ থাকলে তো মালয়েশিয়ার জনজীবনে এত বিপর্যয় নেমে আসত না! রাতের শো-তে একদিন ‘নির্জন সৈকতে’ দেখে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি হয়ে গেছে; হাজরা মোড়ে জমা জলে পড়ে রয়েছে চাঁদ; আজ শপিংমলে অনশনক্লিষ্ট নায়িকা। হয়তো ফেম একবারই এসেছিল জীবনে। গৌরকিশোর ঘোষ বেঁচে থাকলে বলতেন – প্রেম নেই।

    কলকাতায় ফাল্গুন
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    ১।কলকাতায় ফাল্গুন

    খবরের কাগজ খুলে দেখি চোখের নহবৎ শোনানোর বদলে দেখানো হচ্ছে সোনির হাততালি। সোনার স্বপ্নদোষে ম ম করছে দিগন্ত। আমার আত্মজীবনী অন্যেরা লিখছে নিয়মিত কিস্তিতে কিস্তিতে। এ পর্যন্ত ঘনঘোর শ্রাবণের দিন।
    তারপর চিড়িয়ামোড়ে ফুটে উঠল পলাশ। যেন রাজহংসী; অহঙ্কারী গ্রীবা; ধূলিধূসর ও হতশ্রী সড়কে একটি দেবললনা গোপনীয়তার বর চেয়ে নিল জনৈক তপস্বীর থেকে। মেয়েটির গালে পোস্টার ঃ পুরনো দেওয়ালে ইটের লাল! সে কে? খররৌদ্রের দিবসে ফুটে ওঠা শিল্পের কুসুম! না কি নির্বাচিত জনরোষ – মিছিলের পায়ে পায়ে হেঁটে আসে মল্লিকবাজার থেকে?
    একদিন গভীর রাতে আকুল সেতারের মত তোমায় পড়ে থাকতে দেখলে তোমার তৃতীয়ার চাঁদের মত স্তনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বে কলকাতা।

    ২। অলীক কুকাব্য রঙ্গে

    দেশজুড়ে সাবান-সুন্দরীরা স্নানঘরের দরজা হাট করে খুলে স্নান সারছে এমন সময়ে মেঘনাদবধ কাব্যের দেড়শো বছর পূর্ণ হল। চারিদিকে অবসন্ন অক্ষরবৃত্ত। মাত্রাবৃত্তের টুংটাং, স্বরবৃত্তে লেখা সম্পাদকীয় – আর তখনই ‘সম্মুখ সমরে পড়ি বীরচূড়ামণি’ ঃ শ্রী মধুসূদন!
    পৃথিবীর মহৎ কবিরা সকলেই শোকগ্রস্ত। শোক থেকে উৎপন্ন বলেই তাকে আমরা শ্লোক বলি। ক্রৌঞ্চমিথুনের সময় প্রণয়ীর মৃত্যুতে প্রণয়িনীর রোদন বাল্মীকিকে প্রেরণা দেয় আদি কবিতা রচনায়; মা নিষাদ ।।।। পশ্চিমে একইভাবে পত্নীর অন্তর্ধানে বিধুর অর্ফিউস কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। আর মধুসূদন, আমাদের আধুনিকতার পথিকৃৎ। মৃত্যুর সহবাসে অভ্যস্ত হয়েছেন কবিতার সূচনায় ও অন্তিমে; যথাক্রমে বীরবাহু ও ইন্দ্রজিৎ প্রয়াণে।‘বিসর্জ্জি প্রতিমা সেন দশমী দিবসে’! – বাঙালির জাতীয় শোকের উদ্বোধন। এই মুহূর্তটুকুর পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছিলেন জীবনানন্দ ‘রূপসী বাংলা’য় বেহুলার সূত্রে ও ঋত্বিক ঘটক ‘মেঘে ঢাকা তারায়’ ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানটির চিত্রায়নে।
    আমাদের সাহিত্যে একটিই অন্তঃপুর। একবারই অন্তরযাত্রা। তা চতুর্থ সর্গ। যেখানে ‘একটি কুসুম মান অরণ্যে যেমতি’ ঃ সীতা।
    ‘পাখিটি তার আঙুল দিয়ে গান গায়’ – আপলিনেয়ার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন ককতোকে। মেঘনাদের মৃত্যুদিনে বিলাপবাক্য রচনার যোগ্যতা – দীন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে – আমরা কবে আর ফিরে পাব?

    মোবাইল, কবি, কবিতা
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    ১। মোবাইল নামচা

    একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক আমার কাছে জীবনানন্দ দাশ ও কমলকুমার মজুমদারের মোবাইল নম্বর জানতে চান। আমি জানি না, সুতরাং তাকে আমি মধুসূদন দত্তের নম্বর দিই; হয়তো মধুসূদন জানতেও পারেন!

    কে কাকে সেভ করে? কে মেসেজ করে, কে পায়? অনেক বার্তা আমি পেয়েছি যা আমার নয়। আমার আত্মজীবনী দেখলাম অন্য কেউ এসএমএসে লিখে যাচ্ছে, ‘মিটিং-এ আছি; শেষ করেই কথা বলব’ – এই কথা সাহিত্য শেষ হওয়ার নয়। কেন যে রোদ্দুর, কেন নিমডালে কাক, কেন এসএমএস ছাড়া কোন শুভবার্তা নেই।

    ‘আমি সিঁথির মোড়ে; কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে আমি তোমায় একটা মিসড কল দেব’ – যে জানাল সে অশোকনগরে – ট্রেন সিগন্যাল পায়নি। জীবনের এই সব ঘূর্ণায়মান মিথ্যা কথা শোনার দায় নিয়ে আমাকে শুনতে হয় – আপনি কি রকম পাবলিক কাকু, আমাদের প্রাইভেট কথায় কান পাতছেন! দেশ-কাল পরিসীমার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এই যুবক নিত্যযাত্রীকে আমার সুর রিয়্যালিস্ট দেবদূত মনে হয়।

    ছোটবেলায় চাকরির ইন্টারভিউ শেষ হলে – ‘উই উইল লেট ইউ নো’ শুনে ভেবেছি অন্তত কোনও মরণশীল ডাকপিয়ন একদিন দেখা দেবেই। এখন দেখছি প্রত্যেকেই বলে – ‘এইটে আপনার নম্বর তো; আমি করে নেব ।।।’ এই মহৎ পরোপকার বৃত্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমি অপেক্ষায় থাকি। নিয়তি একদিন দেখা করে বলে – কি স্যুইট!

    ২। মাধ্যমিকের সিলেবাস

    সেইদিন সংস্কৃতিসম্পন্ন এক তরকার দোকানে শুনলাম ধনঞ্জয় কণ্ঠ ঃ ‘দুটি মিষ্টি কথা শুনতে এলাম বৃষ্টিভেজা রাতে, আর কিছু নয়’। এরকমই কিশোরকণ্ঠ ঃ ‘আশা ছিল, ভালবাসা ছিল। আজ আশা নেই, ভালবাসা নেই’। মুক্তিবাদের এই অমর ঘোষণা গানে শুনে আমার মনে হয় এরাই প্রেমের উপপাদ্য; এরাই প্রেমের সম্পাদ্য। এই গান শোনার পর পৃথিবীর কোন জ্যামিতিই আর অঙ্গে অঙ্গে বাঁশি বাজায় না।

    ৩। কবিতা পরিচয়

    যাদের আমরা কবি কবি চেহারার বলে জানি তারা কেউই কবি নয়। যারা র‌‌‌্যাম্পে কুচকাওয়াজ করে তারা আবৃত্তিকার; কবি নয়। আকাশকুসুম তবু ফুটে উঠছে লিখে রাখা পাপড়ি অনুসারে। নানা লেখা ঃ মর্ষকাম-আত্মনিগ্রহ – ইনভার্টিব্রেটের অভিমান; দেবদাসের যোনিদর্শন ও তদ্বিচয়ক কিছু আলুলায়িত পয়ারের সমারোহ। মাত্রাবৃত্তের টুংটাং অথবা ফুর্তিবাজ ছড়া ও স্টেশনের ওপারে তুমি মতান্তরে নকশালপন্থার মেঘদূত।

    কবি কবিতার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে; পরপুরুষ। যাকে সবচেয়ে বেশি বলতে হবে, সে মৌন। জনৈক বিনীত অনুমোদন প্রার্থীর বদলে অবাধ্য অন্তর্ঘাতক নাই। আমাদের টেবিলে একমাত্র জীবিত ধর্মপুস্তক – সাতটি তারার তিমির।

    হে প্রতিবন্ধী অর্ফিউস, অপ্রতিরোধ্য অন্ত্যমিলের বদলে আপনার বাঁশি প্রসব করুক আত্মার পক্ষে উপকারী পথ্য ও পানীয়। ওই বইটি নিঃসঙ্গতা কেটে যাক।

    ৪। পরণকথা

    একটা আপেল একদিন আধুনিকতার আকার নিয়ে বসেছিল জনৈক চিত্রকরের সামনে। ভদ্রলোক যতবার আপেলের ছবি আঁকতে যান ততবার আপেলটা নড়ে ওঠে। শিল্পী ভেবে ভেবে আকুল। ফলটা তার রগড় না থামালে ছবি বুঝি আর আঁকা হয় না। এমন সময় পিকাসো সেখানে এলেন। দেখলেন সব। বুঝলেন। খেয়ে ফেললেন আপেলটাকে। ক্যানভাসে ফুটে উঠল আপেল। অভিবাদন জানাল সে পিকাসোকে।

    অর্থাৎ আধুনিকতা, শেষ পর্যন্ত কবির কাছে হজমের বস্তু, দেখানোর নয়। জরুরি একটি উপলক্ষ্য শুধু। ওই আপেলটি টুক করে নিউটনের মাথায় খসে পড়লে মহাকর্ষ নামে কবিতার জন্ম হয়। আর্কিমিদিসের মাথায় পড়লে হত না। সেখানে উপলক্ষ্য অন্য। তাঁকে ভাসায় জল।

    রবীন্দ্রসদনের সোপানে আসীন হে অমল বাঙালি, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কথা পরে বলা যাবে, সহর্ষে লক্ষ্য করুন আমরা বন্দনা করি যুক্তির ল্যাংটো ভেনাস কিন্তু পরিহার করি কুযুক্তির রেশম জর্জর ভেনাস। যে কোনও কিছুই ঘটতে পারে। আপনার পার্শ্ববর্তিনীর দহনক্লিষ্টা ও মুখমণ্ডলকে শ্রী মুখমণ্ডল মনে করে পুড়ে খাঁক হল ট্রয়। একটি বিবাহিতা মহিলার রুমালপাত শিল্পের রাগমোচন সম্ভব করে। মাংসে পোকা পড়লে ‘যুদ্ধজাহাজ পটেমকিনে’ শুরু হয় শীতপ্রাসাদ দখলের মহড়া। সুতরাং বিষয় গৌণ; আমরা বক্তব্য চাই। যেমন ইলিয়াড; যেমন ওথেলো; যেমন অক্টোবর বিপ্লব।

    আজ তোমাকে চিনব কী করে এলা?
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    এলা প্রিয়তমাসু,

    আমার তোমাকে মনে পড়ল এমন দিনে, রৌদ্রের অপেরায় যখন কালাসনিকভ আর নগ্নতা একই রকমের ক্লান্তিকর। ঈশ্বরের সমাধি, নারীর ওষ্ঠঃ মানুষ কোনও দিকে তাকাল না। নরকের পথে চলে গেল একা একা।

    আজ আমার ধর্ম নেই; সংস্থা আছে। প্রতিষ্ঠানের থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে আমি দেখলাম, ভয় ছাড়া মানুষের আর কোনও উত্তরাধিকার নেই। ইতিহাস খুঁড়ে সে দেখতে পেয়েছে তার একমাত্র পরিত্রাণ– এই ভয়!

    তখন উদ্যত চৈত্রাবসান। তখন ইউক্যালিপটাসের নন্দিত ভাষণ। তখন আকাশ ঃ তোমার কেঁপে ওঠা বুকে নরম লুব্ধক। গুলির শব্দে তারায় তারায় একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি হলে তুমি আকুল সেতারের মতো মূর্ছিত হয়ে পড়তে এলা; ভাবতাম তোমার নবীন চাঁদের মতো স্তনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ব আমি। দেওয়ালে দেওয়ালে আমাদের অক্ষরমালা এঁকে রাখত তোমার মিথুনশৈলী।

    সময় বুদ্বুদ; তাকে আঙুলে ছুঁতে নেই। আমরা জানতাম না। আমরা ভেবেছিলাম তুমি, এলা, সময়প্রতিমা, দামিনীর বিভা যেন জাহ্নবীর তীরে। আজ দেখতে পাই, তুমি স্বপ্নের বিপর্যয় রাশি। স্নিগ্ধ আকাশবাণী নও। স্তব্ধ পদছন্দ নও। নরিম্যান পয়েন্ট থেকে বউবাজার স্ট্রিট পর্যন্ত ছেয়ে আছে উপদংশক্ষত। বারে বারে ফিরালে মোরে।

    হতে পারো তুমি অলৌকিক মুগ্ধতা– যেমন তক্ষশিলা কিংবা অশোকের অনুশাসন; ময়ূর সিংহাসন ও পানিপথের মতো কোনও লুপ্ত গৌরব– লুকোনো চুম্বন তুমি! তবুও খেয়াল করছে তোমাকে কি কোনও অদৃশ্য আততায়ী?

    বাস্তবিক যে ‘চার অধ্যায়’ রবীন্দ্রনাথের, সেখানে প্রমত্ত গণিকার ঊরুবিস্তার আড়াল করে রাখত না তোমার প্রহর শেষের আলোয় রাঙা কপোল। সেখানে কাব্য ছিল। রাক্ষসের হাতছানি ছিল, কিন্তু সে রজনীগন্ধা বনের ঝড়ে হস্তক্ষেপ করেনি। অথচ আজ যে রক্তগন্ধ তা তোমাকে চিনবে কী করে এলা? এতদিন পরে আজ সহস্র চোখ না যোনি কলকাতায় ইন্দ্রের শরীরে!

    তোমাকে আমার যা বলার ছিল, যা নথিভুক্ত হয়ে আছে, তা ইতিহাসের প্রণয়প্রস্তাব। তুমি প্রেম নও কিন্তু তুমি প্রতিষ্ঠানও নও। যৌথ নির্মাণের অবসরে তুমি একা হওয়ার গীতবিতান। নিয়মের বাধা সড়কে তুমি অনিয়মের কারুবাসনা। আর আজ খেয়াল করার যে, আমার সঙ্গে তোমার অভিসার মাধবীবিতান ও হিরোশিমা– দুই প্রান্তেই ঘটতে পারত।

    মৃত্যুর সাত বছর আগে তোমার স্রষ্টা তোমাকে সেই ভাষা উপহার দিয়েছিলেন যা বিপর্যয়ের লাবণ্য, যা রতিবিরতিকে প্রত্যক্ষ করার অবকাশ। তোমার বাহুডোর ছিল অমরতার বিকল্প। আজ আমার এই আকাশ ছুঁই ছুঁই অ্যাপার্টমেন্টের থেকে একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়া আর দেখা যায় না। এই ফ্লাইওভার ও শপিং মল। আমাদের পাল্টে যাওয়া জীবনের পর্দা ও চুমুকে তুমি কীভাবে বলবে– শেষ চুম্বন আজ অফুরান হল অন্ত।

    বাঙালির হাওয়াবদল
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    বলা নেই কওয়া নেই এই যে বাঙালি কাউকে না জানিয়ে বিশ্বপথিক মানে গ্লোবাল হয়ে গেল, এর ফলে কত যে লোকাল স্মৃতির তাক-আলমারি খালি করতে হল! সেই সব পুরনো তেতুল কি পুঁতির মালা বা হিন্দুনারী অথবা কাজললতা আর রইল না। হাতের পাঁচ সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে তুলসি চক্রবর্তী যেভাবে পৈতে দিয়ে পিঠ চুলকেছিলেন – আহা! যেন সেতারমগ্ন রবিশঙ্কর – তা আর পাব কোথায়! ধর্মনিরপেক্ষতা প্রায় সিকি আধুলির মতো উঠে যাওয়ার মুখে; ফলে পৈতে হচ্ছে আকছার কিন্তু সে ব্রহ্ম-চর্য একদিনের আর সেখানে স্প্রিং চিকেন অন লিচি ঃ হরপ্পা স্টাইল! আজকাল যুবকেরা বেশ লাল সুতো দিয়ে জয়মঙ্গলার ব্রত করে কিন্তু হংকং পার হলেই সে সব ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড হয়ে যায়। এথনিক বাঙালি দেখতে হলে বছরে একবার সায়েন্স সিটির পাশে মিলনমেলায়; সেখানে কাতারে কাতারে বাঙালি পুলিপিঠে খাবে বলে বইমেলায় ডানা মুড়ে বসে!
    অথচ হিন্দু ভদ্রমহোদয়গণের জন্য কত না সুব্যবস্থা ছিল আমাদের কালীঘাটে। মা লক্ষ্মী ভোজনালয়। প্রো ঃ ওঁ সুবল চন্দ্র দাস তস্যপুত্র রমণীরমণ দাস। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই আমাদের বৈশিষ্ট্য। বাঙালি হিসেবে আমাদের কখনও মনে হয়নি যে পরিচ্ছন্নতা তো খাওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক; বরং আমরা মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ডের মতো জেনেছিলাম এ আসলে বলার রকমফের; আসলে তো মাটির লাল ভাড় ও কলাপাতাই জীবনরহস্য। তাকে আবার বোতলবন্দী কর্পোরেট জল দিয়ে ধুতে হবে কেন?
    আমার বড় পিসিমা তিনবার স্থানান্তরে গিয়েছিলেন ইহজীবনে। বিয়ের পর বরিশাল থেকে ফরিদপুরে শ্বশুরালয়। দেশ বিভাগের পর ফরিদপুর থেকে কালীঘাটের মহামায়া লেন। ছোট মেয়ের বিবাহঅন্তে স্বামীর সঙ্গে কেদার-বদ্রি। ভাড়াটে বাড়িতে প্রত্যাবর্তিত হলে আমরা সকলেই আশা করেছিলাম আমাদের পুণ্যশীলা পিসিমা আধ্যাত্মিকতা ও নিসর্গ বিষয়ে একটি চমৎকার সেসন পরিচালনা করবেন। ধন্য আশা কুহকিনী! পিসিমা বরং বারে বারে বিস্ময়াভূত হয়ে ভ্রমণ-এজেন্সির ভূয়সী প্রশংসা করলেই যে তারা কেদার প্রবেশের আগে সকালে কি আশ্চর্য প্রতিভায় ফুলকো লুচি ও আলুর তরকারির ব্যবস্থা করেছিলেন যাত্রীদের জন্য! পিসিমা প্রকৃত বাঙালিনী। তিনি জানতেন দেবতা গোপালরূপে বাড়িতেই আছেন; নিসর্গ যুগে যুগে ক্যালেন্ডারের পাতায়; যৌবনাবসানে পতি সহবাসের বিকল্প হিমালয়ের লুচি। প্রকৃতি ও ভগবান নিয়ে বাষ্পাকুল লোচনে হা-হুতাশ তার বাহুল্য মনে হয়েছিল সঙ্গত কারণেই।
    এ ভাবেই একবার জুনাগড় ফোর্টের সামনে অনতিতরুণ এক দম্পতিকে দেখি। বলা নিষ্প্রয়োজন যে আমাকে বাঙালি বুঝতে পেরেই তারা জিয়ল মাছের খোঁজ করেন। রাজস্থানের মরুশহরে জিয়ল মাছ জটায়ু ও ফরাসি সুর রিয়্যালিস্টদের পক্ষেও হজম করা অকল্পনীয়; তবু কাতর কণ্ঠে মৃগনয়না জননীর নিবেদন ছিল তাদের শিশুকন্যার পেটটা মোটেই সুবিধের নয়। সুতরাং ক্রমাগত শাকাহারের বদলে যদি একটু শিং মাছের ঝোল ।।। ইত্যাদি। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র থেকে হরিপদ কেরানী সকলেই এন্টারোকুইনলবৎ থানকুনি পাতা ও শিং মাছের ঝোলকে ভবজলধিরত্ন ভেবেছেন। হায়, সেই মায়াঝরা সন্ধ্যা! আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র মুড়ি ও স্যর আশুতোষ সন্দেশ খাচ্ছেন যথাক্রমে। আর তাদের সন্তান-প্রতিম বাঙালি পুরী, গয়া, কাশী ও বৃন্দাবনে বৌদি বা মাসির ভাতের হোটেলে স্থিরচিত্র। তখন বাঙালির একটা বলিষ্ঠ বাঙালিয়ানা ছিল। ধর্মতলার দোকানে মাঙ্কি টুপি দেখলেই বোঝা যেত – আষাঢ়ে যেমন মেঘদূত, মাঘে ফুলকপি – দার্জিলিং জমজমাট অথবা বাঙালির ‘আপকান্ট্রি’ ভ্রমণ সমাগত।
    পাহাড় বলতেই মনে পড়ল চা খেতে এই সেদিনও আপিস-আদালত ফেরতা বাঙালি মির্জাপুরের ফেবারিট কেবিন তো বটেই, ক্ষমতা অনুযায়ী পার্ক স্ট্রিটের ফ্লুরি থেকে নদীয়ার মুড়াগাছা পর্যন্ত ছুটে গেছে। তারপর একদিন পলাশির আম্রকাননে ইংরেজের মতো তার সমাজ জীবনে কমিউনিস্টের প্রাদুর্ভাব। লেবু-চা’র সূচনা। কালের গতিতে সিপিআই ভেঙে সিপিএম নকশাল। চা থেকে লেবুটুকুও গেল! লাল চা। চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন যদি বা ঘুচল, বাতানুকূল বারিস্তার মূকাভিনয় ঘুচল না আর। কেন যে মোটা মোটা লিটল ম্যাগাজিন বাঙালি যুবক-যুবতীর পরাগ সংযোগে অনাদির মোগলাই বা কার্জন পার্কের চিনেবাদাম নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল না অদ্যাবধি! আসলে বাঙালির ইতিহাস বলতে আদর্শ হিন্দু হোটেল। বিভূতিভূষণপূজিত রানাঘাটের সেই ভোজনালয় এখন দু’টুকরো। হীনবল ডেলি প্যাসেঞ্জার সেখানে এখন সম্পূর্ণ হিন্দুমতে চাউমিন খায়।

    ভাষা সঙ্কট
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    ১। সময় নিজে পাল্টায়। পাল্টে দেয় অনেক কিছু। যে বয়সে আমরা কোকশাস্ত্র পড়তাম, এখন সে বয়সে কোক খায়। কিন্তু আমাদের বাস্তুহারা বাজার যে এত ম্যানার্স সচেতন তা জানা ছিল না। হয়েছে কী, শ্রাবণের পটল দেখলে সন্দেহ হবেই। জিজ্ঞেস করেছি, ‘বেশি বিচি হবে না তো রে’? জবাবে বিক্রেতা আমাকে জানায়, ‘ছিঃ দাদা, আপনাকে না টিভিতে দেখায় – আপনি এসব বলছেন’!

    অতঃপর আমি – ‘খারাপ তো কিছু বলিনি ভাই’ ।।।

    দোকানি – ‘আর বাদটা কি রাখলেন – এখান দিয়ে কত মা-বোন যায়’।

    আমি – ‘তো, কী বলতে হবে’?

    দোকানি – ‘বিচি না বললেই নয়, দানা বলুন, দানা’।

    সেই থেকে জানলাম বাজারের কাঁঠাল, কুমড়ো, করলা – সব কিছুতেই দানা আছে, কিন্তু বিচি নেই। আশা করা যায়, অনতিবিলম্বে ক্রেতারাও দানাদার হয়ে উঠবে।

    ২। একইভাবে বিজ্ঞান অনুন্নত থাকায় যৌবনে আমরা আড্ডায় যা প্রচুর ছিঁড়েছি, এখন তা আর সম্ভব নয়। টিভি সুন্দরীরা বাল-মাহাত্ম্য বর্ণনা করার সময়ে অত্যন্ত সম্ভ্রমে তাকিয়ে থাকি। হাসলে ফেমিনিস্টরা অসভ্য ভাববে!

    ৩। বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস লিখতেন। রবীন্দ্রনাথ কবিতা। সলিল চৌধুরী সুর দিতেন। উৎপল দত্ত অভিনয় করতেন। এঁরা তো বটেই, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত অভিধান প্রণয়ন করতেন। বিজ্ঞানেও, যতদূর মনে পড়ে, জগদীশ, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ গবেষণা করে গেছেন। তাদের হাতে এত ‘কাজ’ ছিল না। এখন দেখি যে সকলেই কাজ করছে; ঔপন্যাসিক ও কবি আসলে কর্মবীর। তাদের কাজের সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি নিয়ে আরও অনেক কাজ হয়। কেউ এমনকী বাজে কাগজের ঝুড়িতে কিছু ফেলেও না; শুধু কাজ করে।

    ৪। ‘শ্রাদ্ধ’ শতবর্ষে ‘ভাগ্যহীন’ রবীন্দ্রনাথকে ভেবে খানিকটা বিমর্ষ যে হয়েছিলাম তা সত্যি। কিন্তু দেখলাম এই শ্রাদ্ধই রবীন্দ্রনাথের পরিত্রাণের একমাত্র পথ। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রকের টাকায় সন্দেশ, চিলি চিকেন, বিরিয়ানি ও প্যাকেটে শশা-টম্যাটোর কুচি বাদ দিয়েও গম্ভীরা নৃত্য থেকে দাবা প্রতিযোগিতা সম্পন্ন হয়েছে নির্বিঘ্নে। যাকে বলে ‘কাজ’ তেমন অনেক সংকলন মহাপ্রস্থানের দিকে যাত্রাও শুরু করেছে ইতিমধ্যে। আমাদের যাদের সর্বনামে চন্দ্রবিন্দু লাগে না, তাদের সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছিল – আর যাই হোক – ‘ওঁর’ গানটা থাকবে।

    আজকাল অবশ্য স্মরণসভা বলে, শ্রাদ্ধ বলে না। তাতেই দেখলাম গানটা থাকল। বাংলা ব্যান্ড বা সুমন এখনও জীবনমুখী; মৃত্যুর গান তেমন তো নেই, জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, সুতরাং রবীন্দ্রনাথ টিকে গেলেন!

    কালীঘাটের পট
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাসে যেমন মাসন্দো আমাদের কালীঘাট অনেকটা তেমন। তার অবস্থান না ছিল মাখনলাল রায়চৌধুরীর ‘ভারত ও ভূমণ্ডলে’; না আছে গুগলের ম্যাপে – সে অলীক কিন্তু ঐতিহাসিক।

    অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন আপনি এখনও কালীঘাটে? উহ্য এই যে, বাইপাসে না হোক বেহালায় তো যেতে পারতেন অন্তত। কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি। দেশি আন্টিরা যাদের বিদেশি চামচ ধরা শেখাল, যারা সবুজ বাসস্টপে দাঁড়িয়ে হলুদ গাড়িতে উঠে যায় ও বাড়িতে নিয়ে আসে ইকো-ফ্রেন্ডলি চকোলেট, মাকে মামি বলে এল যারা, যাদের বাবা বাড়িতে তুলসি গাছটিও রাখেনি কিন্তু অফিস-বান্ধবীকে উপহার দিয়েছে পাতাবাহার, তেমন শিশুদের বদলে আমি দেখছি তিনটি কাঁঠাল গাছ জ্যোৎস্না গরাদ আড়াল করে হামি খাচ্ছে। অথচ আমাদের পাড়া প্রায় বস্তি, পুরোটা হতে পারেনি কেননা প্রোমোটার পুরোটার দাম নেয়নি। আমাদের ‘ব্লু লেগুন’ বা ‘হ্যাপি আইল্যান্ড’ নেই; সোয়া দু’শো টাকা মাইনের উর্দিপরা গ্র্যাজুয়েট সিকিউরিটি নেই। বাড়ির দেওয়ালে ওম হরি সহায় বা মাতৃধাম। কী করে যে লায়ন না হয়েও, রোটারিয়ান না হয়েও, ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই আমাদের বাড়িতে কাঠগোলাপ গাছ, একটি করে জবা ও শিউলি গাছ। আচার্য জগদীশচন্দ্র জানলে কত খুশি হতেন!

    বড়লোকের পাড়ায় ছাদ নেই। ঘরে ঘুলঘুলি নেই। ফলে চড়াই লুপ্ত হয়ে গেল। বঙ্গীয় শব্দকোষ ছাড়া খড়কুটো নেই কোথাও। কালীঘাটে অ্যাসবেস্টসের চালের ফাঁকে ফাঁকে এই বসন্তেও চড়াই এল। সারা জানলা দিয়ে কামিনী গাছের ঝাড় দেখা যায়। তাতে বুলবুলি। শিউলি গাছে টিয়া। সকালবেলায় ভয়ে ভয়ে থাকি যদি এসব গোবিন্দভবন ট্যুরিস্টব্যুরো কিনে নেয়। একটু পরেই মাইকে বেজে ওঠে ‘রূপ তেরা মস্তানা ।।।’। উপলক্ষ্য জাতীয় সংহতি। সংক্ষেপে সকাল ও দুপুরে রাস্তার পাশে বিদেশি পাখির প্রদর্শনী। বাহারের ম্যাকাও ও কাকাতুয়া – কেন জানি না লুঙ্গি পরে বাজার থেকে কেউ ফিরলে তারা খুশি হয়ে চ্যাঁচাতে থাকে। রাতে দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শনীতে বাইসেপ ও ট্রাইসেপ। তখন কাকাতুয়ারা ঘুমে কাদা।

    বৃষ্টি হয়। ষাটের দশকে গাওয়া মান্না দে’র গান শুনে তল্লাটের লোকেরা চোখের জল মোছে। চাঁদনি চক থেকে কিনে আনা চাঁপাডাঙার বৌ, সদানন্দের মেলা বা ওরা থাকে ওধারে দেখা পাড়ার সদ্য প্রৌঢ়েরা ভাবে উত্তমের, পাহাড়ি সান্ন্যালের রোল করার লোক পরে পাওয়া যাবে না। শ্যাওলা ধরা দেওয়াল, একটা বাড়ির দুটো ঠিকানা; প্রথমটা কালীঘাট রোডের দ্বিতীয়টা কালী লেনের। চোরাকুঠুরির মতো ঘর। দুপুরে ষাট ওয়াটের বাল্ব জ্বেলে মেজবাবু মন্দিরের খুচরো সাজাচ্ছে। কোনটা আধুলির মনুমেন্ট, কোনটা দু’টাকার কুতুব, গিন্নি দরজায় শেকল তুলে মোক্ষদা ঝির ঘরমোছা আটকে রেখেছেন। মোক্ষদার উপায় নেই, সে মন্দিরের মৌরিবাটা সহ ও পেঁয়াজহীন মাংসের ঝোল ও খিচুড়ি ভোগ নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ইতিমধ্যে অবশ্য তার ছেলে যে বলির পাঁঠার দালালি করে, সে সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই স্ত্রীকে প্রাপ্য দ্বিপ্রাহরিক যৌনপ্রহার উপহার দেয়।

    মশলাবাটার শিল কাটার আওয়াজ, পায়রার বকমবকম, ‘জয় তারা’ মানে তারকবাবুর বড় ছেলে স্নানঘরে ঢুকল, বেতো শাশুড়ির পুজোর ঘরে লাগবে বলে লাজুক বউটি জলচৌকি দর করতে শুরু করলে উপায়ান্তর না দেখে তার কোলেরটি রাস্তায় হিসু করছে। জব চার্নকের এই শহরে কালীঘাট বাজার রেনেসাঁ ও সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ কাউকেই পাত্তা দিল না।

    স্মরণীয় সুমন
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    তোমাকে চাই যখন জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার, আবার রক্ত জুড়ে রক্তের গলিতে উপগলিতে কথা আর সুর আবার মিছিল করে গেল কেন? জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখি এই গানে কোথাও সময় চুমু খেয়ে গেছে, এ তো খবরের কাগজের পাতায় ফ্যাশন মডেলের ঠোঁট নয় যে দাগ চট করে উঠে যাবে। এই গানে একটা পুণ্য ‘অস্থিতি’ ছিল। বামফ্রন্টের তিনটি নির্বাচনী জয়ের পর বাঙালি মধ্যবিত্ত বুঝে গেছে আইনশৃঙ্খলার তেমন অবনতি হবে না; এখন দু’জনে চাকরি, মাতৃভাষা যেহেতু মাতৃদুগ্ধ সুতরাং ছেলেকে হরলিকস্ পানের জন্য ইংরেজি মাধ্যমে পাঠানোই সঙ্গত, হাত বাড়ালে পূর্ব কলকাতার চাঁদ ও অ্যাপার্টমেন্ট, বছরে দু’বার ভ্রমণ, সপ্তাহান্তে বিধিসম্মত মদ্যপান ও পরদারগমনবাসনা। দিল্লিতে অর্থনীতির মলাট পালটালো। মধ্যবিত্ত দেশ জুড়ে ঝলমল করে ওঠার সম্ভাবনায় বাড়িতে বসে দেখল যে টিভির পর্দায় ঝরে পড়ছে আকাশের প্রসিদ্ধ নীলিমা। ‘তোমাকে চাই’ গানটা একটা অস্বস্তি হয়ে ফুটে উঠল সেই আকাশে। শিশ্নোদরপরায়ণ বাঙালি জানল গানে তারও অধিকার ছিল একদা।

    রামপ্রসাদ-রবীন্দ্রনাথ-সলিল চৌধুরীর দেশে গান তো গোল্লায় যাচ্ছিল! সারা পৃথিবীর দেওয়াল কাঁপছে; পশ্চিমবাংলায় সীমানাহীন হয়ে উপচে পড়ল রাগের সাদা ফেনা। সরকার ভাঙাগড়া, অবরোধ, কারফিউ, বাহিরিয়া এল কারা মা কাঁদিছে পিছে।।। আর গান লেখা হচ্ছে- ‘তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ’? ভাবা যায় এরকম দাদের মলম! আশি সালে জ্যোতিবাবু দ্বিতীয়বার শপথ নেবেন জেনেই হয়তো লেখা হল ঃ

    লজ্জা! এ কি লজ্জা!

    মরে যাই এ কি লজ্জা!

    তুমি না এলে যে কাঁটাতে ভরে গো

    আমারি ফুলের শয্যা,

    মরে যাই এ কি লজ্জা!

    আসল লজ্জা তো আমাদের, যারা এই কামকাতরতা, এই চিৎকারকে গান বলেছিলাম। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদলে যদি এই গান সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছোঁওয়া পেত, তবে এই একই শয্যা অনেক মর্মান্তিক হয়ে যেত। স্মরণ করুন ‘রানার’-এর সেই অবিস্মরণীয় বেদনা ঃ ‘ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে’। কবিয়ালের সঙ্গে কবির যে পার্থক্য, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই পার্থক্য। সুমন আবার আমাদের কানে কবিতার অধিকার তুলে দিলেন। তখনকার সুমন চট্টোপাধ্যায় ও আজকের কবীর সুমন কোনও আকস্মিকতা নয়; বরং বাংলা গানের প্রকৃত উত্তরাধিকার। সিনেমার নামে যারা সত্তর ও আশিতে গীতিকার সেজেছিলেন, তারাই অনধিকার প্রবেশকারী; ট্রেসপাসার।

    সুমনের গানের কাছে আমাদের প্রধান কৃতজ্ঞতা যে তাতে অযথা মেদুর হাম্বাধ্বনি অথবা জলকেলি নেই। অর্থাৎ ন্যাকামি নেই। সুমন ততটাই রোম্যান্টিক, যতটা মায়াকোভস্কির ‘পাৎলুনপরা মেঘ’ সপ্রেম; ‘স্তব্ধরাত্রে তুমি কেন বাইরে যাও’- সমর সেন এই চরণে যতটা রাজনৈতিক। আমাদের চশমা যখন ভ্রুসন্ধির ঘামে পিছলে গেছে, এসপ্ল্যানেড চত্বরে যখন হাতের অরণ্য, তখন আমরা সুমনকে খুঁজে পাই।

    ভয়ের কথা আবার বাংলা গান নির্বোধ কোমলতায় ফিরে যাচ্ছে। মানুষ স্তন্যপায়ী জীব। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালির মতো কেউ সচিৎকারে ঘোষণা করে না। কেউ নিজের মতো করে থাকবে বা গুছিয়ে নেবে- এ নিয়ে বয়ঃসন্ধির পরে তো ভাবার দায় জাতীয় স্তরে নয়। সুমন ঠিক এখানেই আমাদের ভাসান যেন পুনরুত্থিত ভিক্টর হারা। মিছিলের মাথায় মেঘমায়া থাকতে পারে, কিন্তু ‘পাৎলুনপরা মেঘ’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলি, ঃ ‘ণো সেনিলে তেন্দের্নেস্স দোএস ইত হোল্দ’।

    আমরা তো ইতিহাসের সন্তান। আমাদের চলার পথে আপনার গান বাঁচুক সুমন। আমরা জানব রামপ্রসাদ-রবীন্দ্রনাথ-সলিল চৌধুরী আপনারও অগ্রজ।

    পাতালের প্রেম
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    সত্যি কথা বলতে কী, মহিষাসুর বলতে তেমন খারাপ ধারণা আমার কোনও কালেই ছিল না। বরং কার্তিক সম্বন্ধে একটা সন্দিগ্ধ মনোভাব ছিলই। মা যখন পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে বরণ করতে যেত, আমি তো অসুরকে মনোযোগ দিয়ে প্রণামও করেছি। তখনও কালীঘাটে কালচার স্টাডিজ নামে উপদ্রব ছিল না। মনে করার সুযোগই পাইনি যে দেবীর সঙ্গে একচালায় থাকায় অসুর মেনস্ট্রিম ও কার্তিক প্রান্তিক! এমনকি এমন ধারণাও জন্মায়নি যে কার্তিক নির্লোম বলে মেট্রোসেক্সুয়াল; আমরা মহিষাসুরের বক্ষে ও বগলে বিপুল রোমরাজিতে আস্থা রেখেছি অনায়াসে। তার রোষকষায়িত লোচনের সামনে বড়ছেলে গণেশকে রেল গুদামের বড়বাবু মনে হত আর কার্তিককে ময়ূরবাহনে পলায়নোদ্যত দেখে কত যে হাসাহাসি করেছি, যে দেবসেনাপতির কী হাল! পৃথিবী যে অসুরদের রেস্তোঁরা হয়ে থাকবে চিরকাল!

    কিন্তু আজ প্রকৃতই মনে হয় ছোট ছিলাম তো! অসুরকে চিনতে পারিনি। কী অসামান্য প্রেমিক সে! সুনীল-নীরা প্রণয়গাথা তো তুচ্ছ, ওথেলো নিজেও দেসদিমোনাকে এমন সর্বস্ব দিয়ে কামনা করেনি। রূপসীরা একটু নিষ্ঠুর হয় কিন্তু মুক্ত কেশের পুঞ্জ মেঘের কী অপলক, উপমারহিত, চেয়ে থাকল সে আমরণ! সৌন্দর্যকে আর কোন প্রণাম সে জানাতে পারতো? শেকসপীয়র ইংরেজি বসন্তে, জীবনানন্দ বাঙালি হেমন্তে এত হতবুদ্ধি হননি, যতটা অ্যাজেন্ডাহীনভাবে মৃত্যুর আগে এই যুবকটি সর্বোত্তমাকে হৃদয়াসন বিছিয়ে দিল চরণ-স্থাপনের জন্য! বস্তুত মৃত্যুর জন্য সে প্রস্তুত হয়েই ছিল, কেননা অসুর সম্ভবত কলাকৈবল্যবাদী ড্যান্ডি। সে জানতো জীবনের উদ্দেশ্য সৌন্দর্যযাপন। নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে গেছে সুরভিত চন্দনবনে নয়, শোণিতলিপ্ত রণাঙ্গণে। কিন্তু মুগ্ধ হওয়ার জন্য বাঙালি কবিরা যেমন ন্যাকা হয়, উদ্যান কি স্বর্ণালী সন্ধ্যা খোঁজে, অসুর তা নয়; সে অস্ত্ররক্তঘামে যন্ত্রণার সনেট লিখতে দ্বিধা করে না। এমনকি আগুনে ঝলসানো চাঁদের মতো রূপসী হলেও, প্রণয়িনী যে বিবাহিতা ও সন্তানবতী, তা জেনে, প্রেমিকার সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে সে নিজেকে লুকিয়েও রেখেছিল নিসর্গে ও সেনাসমাবেশে। কিন্তু স্বয়ং কালরাত্রি যেকে ডেকে নেয়, সর্বনাশে মরণ-বাসরেই তার ফুলশয্যা ও শুভরাত্রি।

    মহিষের ছদ্মবেশ, অতএব, ছুঁড়ে ফেলে সে সহস্রকুসুমদলসমা নারীকে জীবন নিবেদন করে। তার বিচ্ছুরিত রক্তধারা দেবীর অধরতাম্বুল হতে পারত, কিন্তু পদযুগল রাঙিয়ে দেয়; যেন আলতা! দেবী নিজে জানতেন নিহত প্রেমিক তাঁকে স্পর্শ করতে চেয়েছিল; আঘাত করা তাঁর স্পর্শাতীত। এই তথ্য খবরের কাগজে ছাপা হওয়ায়, অতঃপর নিশ্চিন্ত, বারোয়ারি পুজোয় তবু প্রতিমার শ্লীলতাহানির দায়িত্ব নেয়।

    সুন্দরের ষড়যন্ত্র ঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নাস্তিক ছিলেন। কী আশ্চর্য! বাঙালির শারদোৎসবের অবসান-বিসর্জ্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে সুনীল প্রয়াণ একাকার হয়ে গেল তবু, আজ বোঝা যাচ্ছে সুনীল নেহাত সাহিত্যিক ছিলেন না; নানাভাবে হয়ে উঠেছিলেন আমাদের সাংস্কৃতিক নাগরিকতার প্রতিভূ। ছোট পত্রিকার স্থানীয় স্তর থেকে প্রতিষ্ঠানের সর্বভারতীয় পরিসর কৃত্তিবাস থেকে সাহিত্য অকাদেমি সুনীলের ক্রম উত্থান শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কল্প-বাসনা; এই তো আমরা চেয়েছিলাম ফরিদপুরের বাঙাল বাড়ির ছেলে সাহেবপাড়ার পার্টিতে সাদরে আমন্ত্রিত! আমরা পূর্ণমনস্কাম। একজন কবি, একজন কাহিনিকার ও গদ্যশিল্পী, সম্পাদক, সাংবাদিক, কলমলেখক, সুকথক, সংস্কৃতি প্রশাসক, প্রফুল্ল প্রেমিক আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর ম্লান প্রজন্মের প্রত্যাশা কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছিল। একজন অনভিজাত কী করে সম্রাট হয়ে উঠতে পারেন সে কিংবদন্তিই সুনীলজীবনকথা।

    কিন্তু তাঁকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করব? প্রথমত ও শেষত্ব তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যকর্মী।দেখতে পাই ইতিমধ্যেই তাঁর নীরা আবৃত্তিকারের প্রণয়িনী, তাঁর প্রস্থান সংবাদ, বৈদ্যুতিন লিপিতে বাহিত হচ্ছে তিনটি উপন্যাসের সূত্রে 'প্রথম আলো' 'সেই সময়' ও 'মনের মানুষ'।হয়তো এসব আখ্যান ইতিহাস বা ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে আমাদের নানা কৌতূহল নিরসন করে;হয়তো সুনীল নিজেও ভাবতে চাইছিলেন তার লেখার ডালপালা নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়ুক; তবু আমি বলব সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পদলালিত্য বা গবেষণার তুলনায় অনেক সফল সুন্দরের সঙ্গে দাম্পত্য রচনায়। ভবিষ্যৎ, সত্যভাষী হলে, একদিন বলবেই যে তিনি সময়ের ফুল্লকুসুম হয়ে উঠেছিলেন।'আমি কি রকম ভাবে বেঁচে আছি' জাতীয় রচনায় মধ্যষাটে, এমনকী সমরেশ বসুর বিবর-এর পরের বছর যখন তাঁর 'আত্মপ্রকাশ' প্রকাশিত হল ১৯৬৬-তে, জনপ্রিয় উপন্যাসের মোড় ঘুরে গেল।নবোকভের লোলিতার থেকে আমাদের যমুনা কত পৃথক কিন্তু তাঁর হাত ধরে স্বর্গভ্রমণের ইচ্ছা যে যুবকের সেদিন হয়নি সে নিপাত যাক।

    বিদ্যাপতিও ভারত চন্দ্র কিংবা ঈশ্বর গুপ্ত নাগরিক কিন্তু আধুনিক নন। আমি যে মনোবৃত্তির কথা বলছি তা সমর সেনের কবিতায় প্রথম দেখা দেয়। তার কবিতায় তিক্ততা ও বিদ্রুপের তর্জনী থেকেই সুনীলের উদ্ভব কিন্তু সুনীলের সরস্বতী লাবণ্যের বশীভূতা ও ক্ষণপ্রভ। নীরা আমাদের জন্য বাসস্টপে তিন মিনিট অপেক্ষা করে বলেই স্বপ্নের বহুক্ষণ আমাদের সঙ্গিনী হতে পারে।

    মনে আছে একটি ব্যর্থ প্রেমিকের মুখে 'মরণাহত হাসি' লক্ষ করে কী পরিমাণ অভিভূত হয়েছিলাম;যৌনতার কি সুগন্ধ ছিল তাঁর লেখায়! আমাদের আহত হতে হয়েছিল সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নীরা হেসে ওঠায়! শরীরের যুদ্ধ থেকে উদাসীন সঙ্গমের রেখাচিত্র কত না দ্বিপ্রহরে আমাদের বুকের কুঠুরিতে জমা হয়েছে!আর তার এই সৌন্দর্যটা রূপবান সন্ন্যাসীর মতো চলমান, অন্তর্বর্তী, জরুরি কিন্তু স্থায়িত্বের প্রতিশ্রুতি নয়। বোদলেয়ারের পর থেকে এই চকিত চাহনি কাব্যকে মথিত করে এসেছে। এক চঞ্চলমতি পয়ারপ্রিয় যুবক আমাদের অমরতাকে তাচ্ছিল্য করার পরামর্শ তো দিতে পেরেছিলেন। বেলগাছিয়ায়, ধুলো আর ঘামে, যে নেমে যায় সে, সে-ই তো আমাদের সুন্দরী। নবীন কিশোরকে মেঘলা আকাশ উপহার দেওয়ার আপাতত কেউ রইল না। এখন হৃদয় শূন্য যেমন রাত্রির রাজপথ।

    'হঠাৎ যেন বাতাস মেঘ রৌদ্র বৃষ্টি এবং
    গলির মোড়ের ঐ বাড়িটা, একটি দুটি পাখি
    চলতি ট্রামের অচেনা চোখ, প্রসেশনের নত মুখের শোভা
    সমস্বরে ডেকে বলল, তোমায় চিরকালের
    বিদায় দিলাম, চিরকালের বিদায় দিলাম, বিদায়;
    চতুর্দিকে প্রতিধ্বনি বিদায়, বিদায়, বিদায়।'

    সুনীলকে মনে রাখা বাংলা কবিতার, বাংলা ভাষার মূল অধিকার।সুনীলকে মনে রাখা বাংলা কবিতার, বাংলা ভাষার মূল অধিকার।
  • .... | 127.194.195.52 | ০৩ নভেম্বর ২০১২ ০২:৪৪577485
  • ‘ণো সেনিলে তেন্দের্নেস্স দোএস ইত হোল্দ’ = ‘No senile tenderness does it hold’
  • ranjan roy | 24.97.185.141 | ০৪ নভেম্বর ২০১২ ১৩:১০577487
  • -------,
    মুগ্ধ বিস্ময়ে সব কটা লেখা পড়লাম। কিছুই জানতাম না। আজকের রোববারটা সত্যি ভাল যাবে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যাবাদ। যেখানে পাবো, পড়বো।
  • PM | 96.22.56.206 | ০৪ নভেম্বর ২০১২ ১৭:০৫577488
  • প্রথম পড়লাম সন্জয়বাবুর লেখা। সত্যি খুব ভালো লেখেন। সোমনাথবাবুকে ধন্যবাদ
  • sri | 127.194.8.57 | ০৪ নভেম্বর ২০১২ ১৮:১৪577435
  • সঞ্জয় দা-র লেখা আগেও পড়েছি।। আমার ভালো লাগে।। ভালো লাগার প্রথম কারণ পরিষ্কার সোজা-সাপ্টা লেখা।। কিন্তু সত্যি বলতে যেটা ভালো লাগেনা সেটা হলো ইংরেজি নাম গুলোর বাংলায় অনুবাদ।
  • Kaju | 69.93.198.148 | ০৪ নভেম্বর ২০১২ ১৯:৪০577436
  • সোমুদা একদম আমার মুখের কথা তুলে দিয়েছে ! গর্ব হয় এরম লেখা দেখে। উনি কথাও বলেন যখন, টিভিতে কদিন আগে অব্দি রোববার রাত এগারোটায় 'মনে পড়ে'-তে বাংলা সিনেমার অনেক হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেগুলো রেকর্ড করে as it is লিখে দিলে এই লেখ্যভাষার থেকে খুব তফাৎ হবে না। এতটাই ঋদ্ধ। বাংলা ভাষা শেখার জন্যে শুধু ওনার কথা শুনি আর লেখা পড়ি।

    তবে হ্যাঁ, উনি নাকি তরুণ কাউকে দেখলে জিগেস করেন '৮০-র আগে জন্ম না পরে, কারণ ওনার মতে, '৮০-র পরের জাতকরা বইটই পড়ে না।
  • sri | 127.194.8.57 | ০৪ নভেম্বর ২০১২ ২০:১৯577437
  • হ্যা,, ঠিক কথা। আমাকে সঞ্জয় দা একবার বলেছিলেন (তাও বছর ৪ এক আগে), তোমার এখনো পড়াশোনার বয়স হয়নি,, তুমি আরও কদ্দিন রান্নাবাটি খেলে নাও। :P
  • শিবাংশু | 127.197.244.171 | ০৪ নভেম্বর ২০১২ ২০:৩৫577438
  • আশ্চর্য লাগছে, এঁর লেখা আমি আগে পড়িনি কেন। বাংলাশব্দ ও গঠনের অন্তস্থঃ সম্ভাবনাগুলিকে নিয়ে এই চিন্তা দেখে বিশ্বাস জাগে বাংলার মূলভূখন্ডে ব্যান্ডের গানমার্কা 'কুল' বিড়ম্বনা ব্যতিরেকেও এই ভাষার প্রতি সম্ভ্রমবোধ বেঁচে আছে, বেড়ে উঠছে।

    সোমনাথকে অনেক ধন্যবাদ।
  • Rit | 213.110.243.23 | ০৪ নভেম্বর ২০১২ ২১:২৩577439
  • ৮০ র পরের জাতকরাও দিব্বি বইটই পড়ে। ঃ)
  • ranjan roy | 24.96.181.47 | ০৪ নভেম্বর ২০১২ ২২:১৩577440
  • "ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ"--- সোমনাথ নাকি?
    "হে ঈশ্বর! একি অপরূপ?"
    সোমনাথকে ডবল ধন্যবাদ।ঃ))))
  • aka | 85.76.118.96 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ০০:১৩577441
  • একটাই লেখা পড়লাম "স্মরণীয় সুমন" কিন্তু বুঝলাম না। যাঁরা বুঝলেন তাঁরা একটু বুঝিয়ে দিলে ভালো হয়। কতকগুলো বিক্ষিপ্ত আপ্তবাক্য, সেগুলোকে কোয়ালিফাই করার কোন প্রচেষ্টাও নেই। সুমনের গানের সাথে 'লজ্জা মরি মরি একি লজ্জার' কি সম্পর্ক? বা পুলক বন্দোপাধ্যায় এবং সুকান্তরও বা কি সম্পর্ক? মোদ্দা কথা কিছুই বোধগম্য হল না।

    আর 'লজ্জা একি লজ্জা' খারাপ গান? চিৎকার? মানতে পারলাম না। যাহোক সে অন্য প্রশ্ন। এক নারীর সোচ্চার কামকাতরতা হজম নাই হতে পারে, পাওলি দামের সেক্স সিনও হয় নি।
  • Blank | 69.93.198.65 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ০০:৩৪577442
  • মিশ্র অনুভুতি। তবে মনে রাখার মতন কিছু পেলাম না। কিছু জায়গা ক্লান্তিকর লাগলো।
    মোটের ওপর অবশ্য খারাপ না। মানে পেলে পড়বো, খুঁজবো না।
  • lcm | 34.4.162.218 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ০১:৫২577443
  • "...যে বয়সে আমরা কোকশাস্ত্র পড়তাম, এখন সে বয়সে কোক খায়... "
    - ধুস, বাজে ভাটে ভরপুর। এরকম ভাটশাস্ত্র তো গুরুতে লোকজন বেটার লেখে।
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ০২:১৭577444
  • সঞ্জয় বাবুর অন্য লেখা ভালো হতে পারে, পড়িনি, সুমনকে নিয়ে আবাপ-র ব্লগের লেখাটা এর আগে পড়েছিলাম। আমার পুরো লেখাটাই আগডুম বাগডুম বকা লেগেছিল। সুমন বাদে সব আছে। আমি ব্লগেই কমেন্ট করে এসেছিলাম।

    ওপরে কমেন্টে যা পড়লাম, ৮০-র পরের জাতকেরা বইটই পড়ে না, এই অ্যাবসোলুট চিন্তাভাবনা, লাইনে লাইনে একটা ফ্রিতে 'জ্ঞান' গুঁজে দেবার প্রবণতা খুব ক্লান্তিকর লাগে। লেখাটাতে "শিশ্নোদরপরায়ণ বাঙ্গালি" এই টাইপের অ্যাটিচ্যুড দেখলে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে যায়, 'কেন আপনার কোনটাই নেই?'

    বাকি লেখাগুলো ধীরেসুস্থে পড়ে দেখতে হবে।
  • h | 127.194.229.69 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ০৭:১৭577446
  • ওভার অল এমন কিসু লাগে নি। সোমনাথ, ইউ হ্যাভ ছড়াও-ফায়েড।
  • | 24.99.41.96 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ০৭:৩২577447
  • এত লোক আগে সঃ মুঃ পড়েন নি! অথচ এদিক ওদিক চোখ রাখলেই বেশ কিছুদিন হল দিব্বি পাওয়া যায় ওনার লেখা। ঐ প্রথম পড়ে একটা হাল্কা চমকমত লেগেছিল, বাঃ বেড়ে লেখেন তো! ব্যাস! ঐখানেই শেষ। আজকাল অনেক লেখাই বেশ হ্যাজানো টাইপ লাগে। দেখলে পড়ি, তবে ঐ আর কি ----- খুঁজে পড়ি না।
  • aranya | 154.160.98.31 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ০৭:৪১577448
  • ঋত্বিকের ওপর 'এই সময়ে' সঞ্জয়ের লেখাটা পড়লাম, ভাল লাগল।
  • সায়ন | 170.83.97.84 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১০:১২577449
  • সোমু'কে এগুলো শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ, তবে, নাহ্‌, "কৃতঞ্জলি হয়ে" পড়ার মত কিছু পেলাম না। অনেকটাই বক্কাবাজি মনে হল। এরকম খন্ড-অখন্ড গদ্য আগেও পড়েছি। মূল বক্তব্যকে জোরদার বানাতে গিয়ে সঞ্জয়বাবু মিছিমিছি বারবার শপিং মল ফ্লাইওভার ইত্যাদি ভেঙে ফেললেন।
  • সায়ন | 170.83.97.84 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১০:১৩577450
  • ** "কৃতাঞ্জলি"
  • শ্রী সদা | 127.194.200.132 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১০:১৫577451
  • সঞ্জীব চট্টোর একটু ইন্টেলেকচুয়াল এডিশন মনে হল, মাইনাস রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ।
  • dd | 120.234.159.216 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১০:৪০577452
  • বাবারে। পাব্লিক ওপিনিয়ন কি ভয়ংকর।

    ২৪ ঘন্টায় মোহমুগ্ধকর ঐশ্বরীয় গদ্য একেবারে পা লিছলে আলুদ্দম।

    আমার ভালো লাগলো। বেশ ঝরঝরে ভাষা, তবে বক্তব্য গুলো নেহাৎই জেঠু সুলভ। স্টাইল ও কনটেন্ট, দুটোই বেশ পরিচিত। নব আবিষ্কার কিছু নয়।

    কিন্তু এই রকম কলাম জাতীয় লেখাকে "ঈশ্বরের গদ্যভাষা" বললে বেশ আঁতকে উঠি।

    পঁচিশ তিরিশ পঁয়তিরিশ বছর আগেও এক্ষাক্টলি এই ধরনের "জহুরী মনষ্কতা" মনে পরছে। খুব অবস্কিওর বা সামান্য পরিচিত কোনো লেখককে "বাংলা সাহিত্যের মাইলস্টোন' বা এরকম কিছু উপাধি দিয়ে খুব একটা মাতামাতি (যারা করতেন তাঁরাও লিতিল ম্যাগই চালাতেন) করা হতো। সব ক্ষুদ্র গোষ্ঠী/পত্রিকা তাঁদের নিদৃষ্ট এরকম আরাধ্য দেব দেবী ঠিক করে ফেলতেন।

    সব মিলিয়ে একটা খুব খেলো আর নন সিনসিয়ার প্রচেষ্টা মনে হতো।
  • | 24.99.25.193 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১০:৪৩577453
  • ঠিক নন-সিনসিয়ার নয়, কিছুটা অ্যামেচারিশ মনে হয়।
  • Rit | 213.110.243.21 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১১:৩৪577454
  • লেখাগুলো পড়লাম। এমনি ভালই। তবে ঐ বড্ড 'আমাদের সময়ে সব ভাল' অ্যাটিটিউড। ৮০ র জাতক পড়ে ক্ষেপে গেছি।
    কাল ওনার একটা লেকচারও শুনলাম। সুমন এর তোমাকে চাই এর ২০ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে বললেন। এমনিতে ঠিকই আছে। কিন্তু অনুপম কে ব্যঙ্গোক্তি না করলেই পারতেন।

    আর আঁতেল রম্যরচনা পড়তে হলে চন্দ্রিল পড়াই ভাল। নতুন একটা বই বেরোচ্ছে নাকি 'উগো বুগো চৌকো চুগো'।
  • Kaju | 131.242.160.180 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১১:৪৯577455
  • বক্তব্যের সাথে সহমত না হতেই পারেন অনেকে, জেঠুসুলভ মতপোষণ, সে আমারও মনে হয়েছে। কিন্তু বলার ধরণটা সত্যিই খুব আকৃষ্ট করে। বিশেষতঃ ডিকশনে। এগুলো ছোট লেখা। নবপত্রিকা ১৪১৭, ১৮, ১৯ তিনবারেই লিখেছেন। কেউ পড়েছেন সেগুলো?
  • Kaju | 131.242.160.180 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১১:৫৩577457
  • হ্যাঁ রিট, '৮০ পরবর্তী কেউ পড়াশুনো করে না তেমন, শুনে আমিও খুব ক্ষেপে গিছিলুম। আম্মো তো ওই দলে। না হয় নেরুদা, বোদলেয়ার, ফুকো, ব্রেখট আরো কী কী সব পড়িনি, তাই বলে বই-বিমুখ কেউ বলুক তো !
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন