এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  গান

  • আধুনিক বাংলা গানের কথা (২)

    pi
    গান | ২৮ এপ্রিল ২০১২ | ১২৪১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • tatin | 122.252.251.244 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ০৯:১৮542519
  • শুরু করতে- সুমন আর চন্দ্রিল বাদ দিয়ে শক্তিশালী গীতিকার বলতে (যার লিরিক সুরের দাসত্ব করেনা) শিলাজিৎ এর নাম সর্বাগ্রে মনে আসে।
  • SC | 63.131.47.69 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১০:০৫542630
  • সকালে কাজ ছিলো। ব্যাকলগ কিলিয়ার করি।
    'আমি যে রিসকাওলা' সাথে পেটকাটি চাঁদিয়ালের তুলনা নিয়ে কথা হচ্ছিলো।
    সুমনের গানে একটা শ্রেণীচেতনার লাল টুকটুকে ভোর খুব সরলরেখার মতো আসে, সেখানে শৈল্পিক মুন্সিয়ানা নেই, এটা ঈকবারেই মেনে নেওয়া গেলো না।
    সুমনের গানে স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি এসেছে, শ্রেণীচেতনার কথা এসেছে, কিন্তু খুব গোদাভাবে এসেছে? একেবারেই না।
    শ্রেণিচেতনার জায়গা থেকে নয়, সুমনের রাজনীতিবোধ অনেক বেশী তাড়িত empathy থেকে। এবং শিল্পী হিসেবে সুমন গানের ক্যানভাসে কিছু মুহুর্তেকে তুলে ধরেন, দু একটা এমন মোক্ষম মুহুর্ত যা শিরদাঁড়া দিয়ে রক্তস্রোত বইয়ে দেয়, আধ মিনিটের জন্য চুপ করিয়ে দেয়।
    উদাহরণ দিই। 'দশ ফুট বাই দশ ফুট', আমার খুব প্রিয় গান। সুমন শুরু করেছেন সেই নিম্ন মধ্যবিত্তের ঘুপচি ঘর, তার দমবন্ধ করা একটা হাঁস্ফাস ভাব, আস্তে আস্তে গানের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠছে। হঠাৎ সুমন লিখলেন,
    'ছেলেমেয়ে দেখে আধো তন্দ্রায়, বয়স্ক দুই দেহ মিলে যায়'
    হঠাৎ যেন গানটা এক অন্য মাত্রা পেলো, ঐ একটা ছবি চোখের সামনে ভাসতে থাকলো, দারিদে্‌র্‌যর তীব্র অসহায়তা, মধ্যবিত্ত মুল্যবোধে বড় হওয়া দুটো মানুষ, নিজের জীবনের সবচেয়ে গোপনতম মুহুর্ত,সেটাকেও আড়াল করতে পারছে না নিজের সন্তানের কাছ থেকে। একদিকে তার শরীরের ক্ষুধা, অন্যদিকে তীব্র লজ্জা, ছেলেমেয়ে শুয়ে আছে একই ঘরে। ঐ একটা ছবি তার দারিদে্‌র্‌যর অসহায়তা, তার বুক ফেটে যাওয়াকে যেভাবে দেখায়, পাঁচশোটা স্ট্যাটিস্টিক্স কোনোদিন দেখাতে পারতো না, আস্ত নাটক নভেল লিখেও দেখানো যেতো না। শিল্পী একটা উচ্চারনে সেই জায়াগাটা ধরতে পারলেন।অএখানেই শিল্পীর মুন্সিয়ানা, ঐরকম কিছু মুহুর্তকে ধরতে পারা, ভালো গান এইরকম কিছু লাইনকে সম্বল করেই কালজয়ী হয়ে ওঠে।
    সুমনের গানে লাল টুকটুকে ভোরের কথাও যেখানে এসেছে, সেখানেও একেবারে আলাদা আঙ্গিকে, আর পাঁচটা বামপন্থী গানের মতো করে একেবারেই নয়। একটা আপাত নিরীহ গান, 'সূর্য বললো ইস', শেষ লাইনে এসে হঠাৎ বলে উঠলেন, 'মানুষ জাগলে তবেই কাটবে অন্ধকারের ঘোর'। এই যে সহজ ছোট্ট গান কখন একটা profoundlypolitical উচ্চারণে পরিণত হয়ে গেলো, গানের মধ্যে রাজনীতিকে এভাবে আর কজন আনতে পেরেছিলেন।

    গানের মধ্যে যখন শ্রেণীচেতনা এসেছে, অদ্ভুত শৈল্পিক ব্যাবহার গানের। গাইলেন, 'ধর্মতলার মোড়, লেনদেন লেনদেন লেনিন'। ঐ লাইনটা ঠিক লিখে বোঝানো যাবে না, সুমনের উচ্চারণে না শুনলে বোঝা অসম্ভব। শহরের হকার, জীবিকার জন্য বিশাল বাজারে তার লড়াই, খদ্দের ধরার প্রতি মুহুর্তের স্ট্রাগল, এই ছবিগুলিই পেলাম, শেষ শব্দটা শোনার আগে অবধি। তারপরে একদম অতর্কিতে সেই হকারের চিৎকার, বাজারের কোলাহল, তাদের সকলের সম্মিলির মুখ ফেড হয়ে গিয়ে, সমস্ত কিছুর মধ্যে হঠাৎ 'লেনিন', কি অসাধারণভাবে প্লেস করলেন একটা শব্দকে। এই যে আমি ম্যাংগো পাব্লিক, চল্লিশ লাইন ধরে বোঝাতে পারলাম না, সুমন কিন্তু ঐ লেন দেন লেন দেন শব্দ নিয়ে খেলতে এক লাইনে অনায়াসেই সেই বাজারের কোলাহলে, তার লড়াইয়ের মধ্যে থেকে উঠে আসা চেতনা, সেখান থেকে উঠে আসা রাজনীতির কথা সঊওব, সঊওব ঐ এক লাইনে লিখে দিলেন। না:, এসব ঠিক লিখে বোঝাতে পারলাম না মনেহয়, কিন্তু না বোঝাতে পারারই কথা।

    সুমনের গানের রাজনীতি মার্ক্সীয় কপিবুক নয়, সেই রাজনীতির মধ্যে অনেকে হয়ত নাইভেটে খুঁজে পাবেন, কিন্তু ঐ আগেরবার যেটা লিখেছিলাম, সুমনের নব্বইয়ের গান মানে একটা লোকের দু চোখ ভরা স্বপ্ন। লোকটা বিশ্বাস করে, একদিন সব পাল্টে যাবে, এবং সেই বিশ্বাস আঁকড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা।অএটাই পেয়েছি। এবং পেয়েছি ঐ গানের ক্যানভাসে অনায়াসে ছবি আঁকা। ঐ জিনিস তারপরে আর কেউ পারলেন কই।
  • tatin | 122.252.251.244 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১০:২৯542728
  • আমি তাও সরলরৈখিক বলবো, কারণ ধর্মতলার মোড়ের লেনিন স্ট্যাচুটার সবচেয়ে সরাসরি ডেস্ক্রিপশন এইটাই।
  • Siddhartha | 131.104.241.62 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১০:৩৪542739
  • দুখেদা, ন্যাড়াদা আর তাতিনের কথার পিঠে আমার কিছু কথা এই প্রসংগে মনে পড়ল। তাই একটু বলি। একটু নেম ড্রপ করতে হবে, আর একটু ধান ভানতে শিবের গীত। জেহেতু আড্ডা, মনে হয়না কেউ কিছু মনে করবে। চেষ্টা করব যা বলছি তা বিশদে বোঝাতে।

    বাংলা গানের কথা আধুনিক হল না বলছি, কিন্তু একবার-ও বলছি না আধুনিক মানে কি বুঝি। দুখেদা ঠিক-ই বলেছে, সুচিত্রা ভটচাজ মানেই আধুনিক? রাবণ বার্মুডা পরে টুইস্ট নাচলেই কি রামায়ণ আধুনিক হয়ে যাবে, সমসাময়িক হয়ে যাবে? না, তা নয়। আধুনিকতা কোনো দেশকালনিরপেক্ষ আইডিয়া না। প্রত্যেক যুগের সময়ের চিহ্নগুলো ধারণ করে সে যুগের শিল্প। আবার এক-ই সংগে তার মধ্যে কিছু দেশকালনিরপেক্ষ উপাদান থাকে। এই দুখানা ফ্যাক্টরের দ্বান্দিক সম্পর্ক হয়। একটা ফ্যাক্টর শিল্পকে টানে তার মাটির কাছে ফেরানোর জন্য, আরেকটা ফ্যাক্টর শিল্পকে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাতে বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম ফ্যাক্টরটা জয়ী হয়, এবং শিল্প হয়ে পড়ে ভীষণভাবে রিলেটেড টু ইটস ওন টাইম এন্ড স্পেস। বারান্দায় রোদ্দুর আজ থেকে পাঁচ বছর আগে যা জনপ্রিয় ছিল আজ থেকে দশ বছর বাদে তার সিকিভাগ-ও থাকবে না। নিমাই ভটচাজের উপন্যাস-ও তাই। প্রচুর লোক পড়েছে এককালে। আজকাল অনেকে নাম-ই শোনেনি।

    কালজয়ী শিল্প সেটাই হয় যার মধ্যে এই দুখানা ফ্যাক্টরের ব্যালেন্স থাকে। যেমন সেক্সপিয়ারের নাটকগুলো। নিজের সময়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল কারণ আমোদগেঁড়ে পাব্লিক তার মধ্যে ইংল্যান্ডের সময় খুঁজে পেত, ডিরেক্ট নাম না করে হলেও প্যারালাল টানতে অসুবিধে হত না। এমনকি হ্যামলেটে একটা বাস্তব পাব-এর উল্লেখ আছে, যা ফিফটিন্থ সেঞ্চুরি-তে লন্ডনে খুব জনপ্রিয় ছিল। এটা তো খুচরো এক্সাম্পল। সেকি্‌স্‌পয়ারের নাটকে সমসাময়িক ইংল্যান্ড কিভাবে ধরা দিয়েছে তা নিয়ে দিস্তা দিস্তা বই লেখা হয়েছে। আবার সেই নাটকগুলোর মধ্যে কিছু অদ্ভুত ইউনিভার্শাল আইডিয়া থেকে যায়, যে কারণে ৫০০ বছর পরেও চুড়ান্তভাবে অভিনীত হয় নাটকগুলো।

    তাহলে আধুনিক কাকে বলব? সময়ের চিহ্ন যে শিল্প ধারণ করে, তার সময়ের বিচারে তা আধুনিক, নাকি যে শিল্প অ্যাবস্ট্রাক্ট মানবতাবাদী, তাকে, নাকি এই দুখানার ককটেলকে? এর কোনো ডেফিনিট উত্তর নেই। সময়ের চিহ্ন মানে শুধুই বরানগর হত্যাকান্ড বা জেসিকা লাল মার্ডার নয়। একটা যুগের যে দ্বন্দগুলো থাকে, সংকট থাকে, সেগুলোর প্রভাব পড়তে হবে। তাতে একটাও সমসাময়িকতার কথা না বলেও চুড়ান্ত আধুনিক হওয়া যায়। এই হিসেবে আরণ্যক আধুনিক, ইছামতি আধুনিক। জগদীশ গুপ্ত আধুনিক। বারো ঘর এক উঠোন আধুনিক। আবার অনেক শিল্প-ই থাকে যেগুলো তার সময়ে সমসাময়িকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু হয়ত কুড়ি কি পঞ্চাশ বছর পর তা নতুন করে আবিষ্কৃত হয়। কাফকার কথা সকলে জানে। হাতের কাছে খুব ভাল উদাহরণ হল বিভুতিভূষণের মেঘমল্লার গল্পটা। বৌদ্ধ যুগে এক তান্ত্রিক দেবী সরস্বতীকে বন্দী করে রেখেছে, আর তাঁকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এক যুবক। কোথায় এর মধ্যে সময়ের চিহ্ন? কিন্তু নেই কি? সরস্বতী, মানে জ্ঞানকে বন্দী করে রাখছে ক্ষমতা, কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে নিজের কাছে। তাকে আবার জালমুক্ত করবে প্রেম। ঠিক সসমসময়েই এক কবি আবার লিখে বসছেন জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই। এর থেকে চুড়ান্ত আধুনিকতা আমার কাছে অন্তত ধরা দেয়নি আর। তার মানে দেখছি, একটা শিল্পকে আধুনিক করে তুলতে পারে তার সমসাময়িকতা, অথবা বিশ্বজনীনতা, দুটোর জে কোনো একটা। কাফকার গল্প উপন্যাসে আমলাতন্ত্র, ক্ষমতার প্যানাপটিকন স্ট্রাকচার বা সর্বোপরি সমষ্টির কাছে ব্যাক্তিমানুষের শ্বাসরোধী হেরে যাওয়া তার নিজের সময়েই চুড়ান্ত সমসাময়িক ছিল, পাঠক খুঁজে না পেলেও। আবার বিভুতিভূষণের মেঘমল্লারে আধুনিক সময়ের একটাও উপাদান ছিল না। কিন্তু ঐ যে অ্যাবস্ট্রাক্টনেস, বাস্তব থেকে আপাত বিযুক্তি, সেটাই আলটিমেটলি গল্পটাকে নতুন করে পড়তে শেখায়।

    একটা ফ্যাক্টর ডিরেক্ট, আরেকটা সিমুলেটেড। হাজার চুরাশীর মা ডিরেক্ট ফ্যাক্টরের কারনে আধুনিক হয়ে ওঠে। আবার মেঘমল্লার বা সেক্সপিয়ারের নাটকের সিমুলেশন ঘটে আমাদের মাথায়। তার ইন্টারপ্রিটেশন করে চলি অবিরত। যদিও এই কথাটাও গোদা হয়ে গেল, কারণ প্রথম ফ্যাক্টরের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে সিমালক্রা, মানে তার সমসাময়িক উপাদানের মধ্যে থেকেও ভবিষ্যতে যুগোপযোগী আইডিয়া সিমুলেট করে নেওয়া যায়, এন্ড ভাইসি ভার্সা। তাই রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় শুধু পরাধীন ভারতের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ইতিবৃত্ততেই আটকে থাকে না। তাকে নক্সাল আন্দোলন, এমনকি সোভিয়েত বিপ্লবের ব্যর্থতার প্রেক্ষিতেও সিমুলেট করা যায়। আবার উল্টোদিকে, এ মণিহার আমার নাহি সাজে গানটা শুধুই বিশ্বজনীন আইডিয়ার কথা বলে না। জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদটুকুও ধরা থেকে যায়। এ জন্যই বলেছি যে এই দুখানা ফ্যাক্টরের সম্পর্ক দ্বান্দিক।

    রবীন্দ্রসংগীত এই কারণেই আধুনিক। কারণ তার দ্বিতীয় ফ্যাক্টরটা প্রথমটাকে ওভারকাম করে যায়, এবং সিমালক্রার উপাদানগুলো বজায় থাকে। । গোধুলিগগনে শুনে আমার যেমন নক্সাল আন্দোলনের কথা মনে হয়, ঠিক সেই সময়েই জন-অরণ্য সিনেমায় বুর্জোয়াজির শ্বাসরোধী নৈতিক অধ:পতন এবং ফড়ে দালালদের ঘন হতে থাকা ছায়াপুঞ্জের চালচিত্রে সত্যজিত রায় অমোঘ বাজিয়ে তোলেন `ছায়া ঘনাইছে বনে বনে`, লোডশেডিং-য়ের মোমকাঁপা আলোতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

    কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একটা সর্বগ্রাসী ভাষা তৈরী করে গেছেন। সেটার আদল থেকে মুক্ত হতেও আমাদের বহুদিন সময় লেগেছে। যাঁরা মুক্তি পেয়েছেন, টিকে গেছেন। যাঁরা পাননি, হারিয়ে গেছেন। উদাহরণস্বরুপ, রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের মধ্যে একদিকে কল্লোল কালিকলম গোষ্ঠী দানা বেঁধে উঠেছে, যাঁরা নিজেদের ভাষা খুঁড়ে গেছেন, রয়ে গেছেন জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে বা সুধীন্দ্রনাথ, যাঁদের ভাষা দীর্ঘদিনের নিরলস সাধনায় একটু একটু করে তৈরী হয়ে উঠছে। আবার অন্যদিকে আছেন কুমুদরঞ্জন, কালিদাস রায়, যতিন্দ্রমোহন বাগচী, যাঁরা পুরোপুরি রবীন্দ্র অনুসারী। এই দ্বিতীয় দলটা আস্তে আস্তে মুছে গেছেন। স্কুল পাঠ্য বৈ-য়ের বাইরে এদের বই পাওয়া কঠিন। অথচ মোটামুটি এক-ই সময়ের বুদ্ধদেব বসু বিষ্ণু দে-দের নিয়ে সেন্সিবল পাঠক এখনো ভাবনা চিন্তা করে। মুল কারণ ওটাই। যেটা রবীন্দ্রনাথ পারতেন, সেটা এনারা পারেননি। সমসাময়িকতার ফ্যাক্টরকে সার্বজনীনতার ফ্যাক্টর দিয়ে ওভারকাম করানো অসামান্য প্রতিভাবান শিল্পী ছাড়া সম্ভব নয়। তিনি নিজে নিজের জন্য প্রায় একটা গোটা ভাষা আবিষ্কার করেন। মুশকিলটা হল, তাঁকে অনুকরণ করতে গেলে চাপ আছে। সেই লেভেলের ট্যালেন্টেড হলে তাঁকে অনুকরণ করেও নিজের ছাপ রেখে দেওয়া যায়। কিন্তু না হলে সময় মনে রাখে না। তেমনটাই হল কালিদাস কুমুদরঞ্জনদের। সময়ের প্রয়োজনে তাই বিষ্ণু দে বা অমিয় চক্রবর্ত্তীকে নিজের ভাষা নিজে খুঁড়ে নিতে হয়। ডাজ নট ম্যাটার তাঁদের কবিতায় দুর্ভিক্ষের কথা আসল কিনা। কিন্তু, ঐ যে হার্বার্ট মার্কুইজ বলেছিলেন না, যে শিল্পী আঁকেন ডানহাতে কিন্তু তাঁর শিল্পে পড়ে থাকে তাঁর বাঁ হাতের বুড়ো আংগুলের ছাপ। সেটা দেখেই শিল্পীকে চিনে নেওয়া যায়। এদের বুড়ো আংগুলের ছাপ হল এদের ভাষা। এই কবিদের। নিজের নিজের বুড়ো আংগুলের ছাপ না থাকলে সেটা শিল্প-ই নয়।

    গানের ক্ষেত্রেও কিন্তু এক-ই ব্যাপার সত্যি। কবিতা আর গানের ভাষা এক নয়। কিন্তু সেখানেও ভাষাটাকে তৈরী করে নিতে হয়। এক-ই সময়ে যখন কল্লোল কালিকলম কি কৃত্তিবাস রাস্তা চলছিল, সমাজের অস্থিরতা ফেটে পড়ছে, একটা সদ্য স্বাধীন দেশ তার শরীরের দগদগে ক্ষতচিহ্নগুলো খুলে দেখাচ্ছে বিশ্বের সামনে, সেখানে গান চুড়ান্তভাবে রাবীন্দ্রিক। গীতিকারেরা কি দ্বিতীয় ফ্যাক্টরের ওপর ভরসা রেখেছিলেন? ভেবেছিলেন অনুপম প্রেম তাঁদের চিরজীবী করে রাখবে? মানে তাঁদের সৃষ্টিকে? কোনো সমসাময়িকতার দরকার নেই? কিন্তু সেটার জন্য তো অকল্পনীয় প্রতিভার দরকার। ডিরেক্ট অ্যাপ্রোচে আধুনিক হওয়া সহজ, সিমুলেশনের মাধ্যমে জনগ্রাহী হতে গেলে দানবিক ক্ষমতা চাই। সেটা এঁদের কতজনের ছিল? ফলে যা হবার তাই হয়েছে। `যেথা`, `মোর`, `তরী`, এইসব প্রায় অবসোলেট শব্দ নিয়ে গরে উঠেছে একটা গোটা জাতির গানের সম্ভার।

    তা বলে কি এই শব্দগুলো নিয়ে খেলা করা যায় না? নিশ্চয় যায়। কমলকুমার করেছেন, শক্তি করেছেন। কিন্তু শব্দ নিয়ে খেলা করা এক জিনিস, আর শব্দের ক্রীতদাস হয়ে ওঠা আরেক। শক্তি বা কমলকুমার চুড়ান্ত আর্বান স্মার্ট বাংলা লিখেই তার পাশাপাশি মতিলাল পাদরী লিখেছেন, আজ সেই ঘরে এলায়ে পরেছে ছবি লিখেছেন। ফলে কোনো টাইপের ভাষার-ই দাসত্ব করেননি। শক্তি সাধু ভাষার কবিতাতেও আধোলীন, হৃদয়পুর টাইপ চমকপ্রদ শব্দ ইউজ করে গেছেন। কমলকুমার গোলাপ-সুন্দরী শুরুই করছেন একটা ফরাসীতে লেখা কবিতা দিয়ে। অর্থাত, ভাষা এঁদের কাছে খেলার মাধ্যম। এমন নয় যে কোনো একখানা ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলে এঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে। এঁরা তখন অন্য ভাষায় লিখবেন। আর তাই শক্তির কবিতাগুলো শুধুই অবসোলেট ভাষার ব্‌য়্‌বহার থাকে না। আমরা কৌতুহলী হয়ে পরি ফর্ম নিয়ে তাঁর পরীক্ষা নীরিক্ষায়। সেই কৌতুহল আসে কারণ সেই ভাষা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে অ্যানাক্রোনিস্টিক। স্বাভাবিক নয়। তাই ধাক্কা লাগে। সুনীল তাঁর সফিস্টিকেশন ছেড়ে বেরিয়ে এসে জখন শতভিষা পত্রিকায় কবিতা লেখেন `সেই যে এক বাউল ছিল সংক্রান্তির মেলায়` তখনো তাই বিতর ওঠে পাঠক সমাজে। বলা হয় কৃত্তিবাস এবার ধড়াচুড়া ফেলে নব্য ব্রাম্ভ হয়ে উঠলেন।

    কিন্তু গানের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। ৯৯% সেখানে ঐ প্রাচীন ভাষায় কথা বলেন। স্থবিরতাই সেখানে স্বাভাবিকতা। অ্যানাক্রোনিজ্‌ম-ই নিয়ম। ফলস্বরূপ চুড়ান্ত অ্যালিয়েনেশন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোটা বাংলার শিল্পীমহল উত্তাল হয়ে উঠেছিল। গান কটা লেখা হয়েছিল? একখানা। হ্যাঁ, ছাপার ভুল নয়। অংশুমান রায় একখানা গান লিখেছিলেন। আর একটাও কোনো গান নেই। তখনো চাঁদের মলিন বদনে বিরহের ছাপ আবিষ্কার করতে
    ব্যাস্ত গীতিকারেরা।

    ফলে না এসেছে সমসাময়িকতার ছাপ, না এসেছে দ্বিতীয় ফ্যাক্টরটা। হ্যাঁ প্রেম নিয়ে অনেক ভাল ভাল কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বহু ব্যবহারে অনেক ভাল জিনিস-ও ক্লিশে হয়ে যায়। এটা ঠিক-ই যে ন্যাড়া দা যা বললেন, ঐ সময় সিনেমাতেও দু তিন বছরে একখানা সত্যজিত কি মৃণাল, বাদবাকি সব-ই চর্বিত চর্বণ। গল্প উপন্যাসেও ফাল্গুণি মুখোপাধ্যায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়দের বই অনেক বেশি বিক্রি হয় বিমল মিত্র বা দ্বীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ের তুলনায়। ঠিক। কিন্তু সেই সাথে এটাও ঠিক যে এই সত্যজিত ঋত্বিকদের ধারাটাও কিন্তু ছিল। একটা প্যারালাল স্রোত শীর্ন হলেও ছিল। বাংলা গানে সেটাও ছিল না। আইপিটিএ, মানে চল্লিশ দসকের গান ভাংগিয়ে আশি পর্যন্ত চলেছে। একমাত্র পরেশ ধর মনে হয় কিছু চেষ্টা চরিত্র করেছিলেন। কিন্তু প্যারালাল কোনো স্রোতের বিন্দুমাত্র নেই। ভাষা কি লিরিকাল হয়েছিল এই অ্যালিয়েনেশনের ফলে? না তো! খুব কাব্যময় গান কতগুলো মনে পড়বে ভাবলে? আমার দু-হাতের দশ আংগুলের মধ্যেই ধরে যাবে। `বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা`, `ওগো কাজল নয়না হরিণি` (চমকপ্রদ ছন্দ), এরকম কয়েকটা।

    সুর বুঝি না। কিন্তু এটুকু বুঝি যে সুমনের থেকে তখনকার সুরকারেরা বেটার ছিলেন। যখন গুনগুন করে শুধু সুর গাই নিজের মনে, সুমনের গান খুব কম আসে। তার কারণ গুনগুন করে গাইতে গেলেই মনে হয় সুমনের কথাগুলো নিজের কানে শুনতে চাই। উচ্চারণ না করলে লাভ নেই। ফলে খুব স্বতস্ফুর্‌ত্‌ব্‌হাবেই মুখ দিয়ে গানটা বেরিয়ে আসে, আর গুনগুনানি থাকে না। এটা হয়, কারন সুমনের তুলনামুলক স্ট্রং লিরিক আর দুর্বল সুরের জন্য। ঠিক উল্টো ব্যাপারটা হয় পুরনো গানে। প্রচুর গুনগুন করে নিজের মনে সেসব গানের সুর ভাঁজি। কিন্তু বেশিরভাগের-ই শব্দ-ও মনে নেই। তাতে ক্ষতি নেই, কারন ঐ সব গানের শব্দ আওড়াতে লাগেনা। নিজের মনে যখন আনমনে কাজ করি সুর ভাঁজলেই হয়ে যায়। ব্যাপারটা প্রায় অচেতনে ঘটে। কিন্তু সুমনের গান কিছুতেই অচেতনে থাকতে দেয়না। সচকিত করে তোলে। গানটা জোরে গাইতে বাধ্য করে।

  • SC | 63.131.47.69 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১০:৩৯542750
  • হ্যাঁ,তাতিন, এক্কেবারে ডিরেক্ট ইন্টারপ্রেটেশন সেটাই, কিন্তু ঐ শব্দের খেলা তার বাইরেও আরও অনেকদূর যায়।
  • dd | 110.234.159.216 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১০:৪৯542761
  • হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাতো বিলকুল ঠিক কথা।
    সুমনের বেশীর ভাগ গানই নিজের মনে গুনগুন করে গাওয়া যায় না।
  • SC | 63.131.47.69 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১০:৫৭542772
  • সিদ্ধার্থ, কথাটা ঠিকই। তবে সেটা মনেহয় এইজন্যই যে সুমনের সুর তার কথার সঙ্গে খুব অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত।
    তবে হ্যাঁ, সুমন সুরকার হিসেবে সেই উচ্চতায় উঠতে পারেননি সেটাও ঠিক।
  • tatin | 122.252.251.244 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১১:২৬542783
  • বাসটা ছুটছে যত, লোকটা ছুটছে তত জোরে, ডান হাত দিয়ে আছে দেখ পেছনের হাতল ধরে। বাঁহাতে চটের ব্যাগ, ভারি আর বেঢপ চেহারা-

    কজন উঁচু সুরকার এধরণের লিরিকে সুর করেছেন সেটাও দ্যাখার
  • riddhi | 108.218.136.234 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১১:৪০542409
  • সবি বুঝলাম , কিন্তু বাংলা কবিতা সাবালক হল, এই কিছুদিন আগে বাংলা ছবিও হল, গানের বেলায় কি? আঁতেল তো কম পরেনি, তো এত দেরী হচ্ছে কেন ?
    সুমন চন্দ্রিল সব কটা চুড়ান্ত ব্যর্থ সেই ভাবে বাংলা গানে সেক্স আনতে পারেনি, যেভাবে বাংলা হিন্দি ছবিতে এসেছে। বিশাল ব্যর্থতা। চন্দ্রিল একটু আধটু এনেছে কিন্তু সেখানেও ফাজলামি 'ছাদের ঘরে একলা পেলে' বা 'একলা ক্লাসে জোর করেছি'। লোকটা কি সেক্স করতেও করতেও হাসে? বেশী সেন্স ওফ হিউমার মাঝে মাঝে
    ইরোটিকাকে মেরে দেয়, এটা আমি ইয়ুং এর বইয়ে পড়েছি।

    আর এটা শুধু লিরিক্সের ক্ষেত্রে, বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের সাবালকত্বের এর সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কারণ তিন দশক আগে থেকেই সুনীল এর পার কবিতায় ওন এভারেজ দেড়খানা 'চুমু' পাওয়া যাচ্ছে। এদের ডেটাবেসে চুমু কিন্তু পাবেন না। আসলে, ঘাড় গুজে একটা কবিতা লিখে দিলাম, হয়ে গেল। কিন্তু গান লিখলে সেটা তো একবার না অনেকবার অনেক লোকের সামনে গাক গাক করে গাইতে হবে। আমাদের স্মার্ট সুনীল কেই দেখেছি, ওর কোন পুরনো রসাত্মক রোমহর্ষক কবিতা মেয়েরা অনুরোধ (আজকালকার মামনিরা তো কম খচ্চর নয়, একজন ভদ্রলোক কে উত্যক্ত করে একটা বিকৃত আনন্দ লাভ ) করলে একেবারে যাকে বলে 'হেঁ হেঁ' অবস্থা, 'ছোটোবলায় লেখা, যৌবনের গ্রীষ্ম' এইসব যাস্টিফিকেশান দিয়ে আমতা আমতা করে আবৃত্তি করে। তো গান তো অন্য স্কেলের ব্যাপার।
    সেই ভয় বা লজ্জাটা ষোল আনা আছে। চন্দ্রবিন্দু স্টেজে এত কেরামতি দেখায়, (যেগুলো সবি আগে থেকে সেটিং করে রাখা) ঐ 'গান ভলোবেসে গান' লাইনে অনিন্দ্য চিয়ারলিদারের মত হাত নারবে, 'তুমি আমার সিপিএমে' চন্দ্রিল ওর রোগা কাপালিকের মত মুখটা সিরিয়াস করে ঢোক গিলবে উপল 'গাব গুবা গুবে' ইডিয়টের মত হাসবে, কিন্তু এই একগাদা অল্প বয়েসী মেয়ে আর বৌ দিদের সামনে চুমু শন্দটা কিভাবে উচ্চরিত হবে,বা তখন এই গায়ক দের মুখ আর ঠোটের অভিব্যক্তি কি হওয়া উচিত সেটা আগে থেকে প্রোগ্রাম করা নেই। চন্দ্রিলের তো বাঙ্গালীর হিপোক্রিসি নিয়ে রাতের ঘুম চলে গেছে ও তিনটে চুমু দিয়ে একটা গান লিখে নেক্সট বঙ্গ সম্মেলনে প্রেসেন্ট করে দেখাক না। একটা না হয় ওর ফাজলামি কোটায় গেল, ঝুমুর সাথে ছন্দ মিলিয়ে কিছু একটা বদমায়েশী করল। বাকি দুটো একটু গাঢ়, সিরিয়াস? অন্তত? গুরুর খোলা পাতায় চ্যালেন্‌জ ছুড়লাম।
    পরের পয়েন্ট টা পরে লিখছি।

  • tatin | 122.252.251.244 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১১:৪৩542420
  • এ তো সুমনই করে গ্যাচেন:


    শিলাজিৎ গেয়েছে: তোমার অন্দরমহলে ঢুকে যাবো
  • Siddhartha | 131.104.241.62 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১১:৪৫542431
  • চুমুকে চুমু বললে আমাদের সতীত্বে নিউমোনিয়া ধরে।

    বলতে হবে চুম্বন।
  • riddhi | 108.218.136.234 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১১:৪৮542453
  • একটা পাওয়া গেল। এক হাজারের মধ্যে এক ও যা,শূণ্যও তাই।

  • tatin | 122.252.251.244 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১১:৪৮542442
  • জাস্ট ভুলভাল বলছে লোকে: সুমন বার্বার চুমু বলেছে: সিঁড়িতে তোমায় চুমু খাবো/ এবার ছুটিতে ছাদে যাবো
  • Siddhartha | 131.104.241.62 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১১:৫২542464
  • আর তারথেকেও খোরাক যৌণতা বিষয়ে কথা। খোলাখুলি বলতে পারে না। তোমার অন্দরমহলে যাব তোমার হাইওয়ে দিয়ে জাহাজ চালাব টাইপ বালছাল কথাবার্তা। রিয়েল লাইফে অন্তরংগ মুহুর্তে কোনো মামনিকে যদি বলি তোমার হাইওয়ে দিয়ে জাহাজ চালাব বা তমার জংগলে হাতি খুঁজতে যাব খচেমচে গিয়ে লাথি ছুঁড়ে অস্থানে কুস্থানে আঘাত করার প্রচুর সম্ভাবনা থেকে যায়।
  • Tim | 98.249.6.161 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১১:৫৪542475
  • বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি?
  • apu | 117.194.104.201 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১১:৫৭542486
  • আহা, ছাদে তো গাছে জল দিতেও যেতে পারে তাতিন :-)

  • riddhi | 108.218.136.234 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১২:০৩542497
  • টিম ওটা ডিসকাউন্ত। কাকে চুমু, সেটা না বললে অনেক মানে হতে পারে। দাস ক্যাপিটাল কেও হতে পারে। আমি কূট তর্ক করছি না। এই চুমু সেই চুমু না।
  • Tim | 98.249.6.161 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১২:০৮542508
  • বোঝো! এই চুমু ঝুটা হ্যায়? :-)

    আচ্ছা, এই সবেতেই সাবালকত্ব খোঁজাটা কেন এত প্রয়োজন? মানে সবই যদি স্বাভাবিক নিয়মে আসে তো এলো, না এলে সেটা এলোনা বলেই সৃষ্টি অসম্পূর্ণ হয়ে গেল?
  • kallol | 115.184.45.89 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১২:১৬542520
  • সামান্য চুমু নিতে অ্যাত্তো??
    সেই কব্বে, শিব্রাম চকরবরকতি কবিতা লিখে গেছেন - চুমু, না চুম্বন নয় চুমু।
    শিব্রামের ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসায় সন্দেশ দেওয়া চুমুর বর্ণনা আছে।
  • tatin | 122.252.251.244 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১২:৩০542531
  • কোহেনের মতন ১০০০ কিসেস ডিপ বলে কেউ গান বাঁধেন নি
  • dukhe | 117.194.235.68 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১৩:৪৮542542
  • অ ঋদ্ধি, আমাদের খ্যামটার লিরিকে চুমু ছিল না? তা লিরিকে চুমু না থাকলেও তো মিউজিক ভিডিও বানিয়ে গানকে সাবালক করা যায় - রণে বনে জলে জঙ্গলে পাওলি তো আছেনই।
    তবে সাবালক গান বা ছবি কাজে দেয় বয়:সন্ধির সময়, এই বৃদ্ধ বয়সে আর ওসব লইয়া কী করিব?

    আর পাই, পথের প্রান্তে আমার অতি প্রিয় গান। কিন্তু উহাও বোধহয় নাবালকের কোঠায় পড়িবেক।
  • ppn | 112.133.206.20 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১৩:৪৯542553
  • "ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড কর প্রেমের পদ্যটাই/
    বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকেই চাই' - এটা পড়ে দাস ক্যাপিটালের কথা মনে আসছে?!
  • dukhe | 117.194.235.68 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১৩:৫৭542564
  • আর সিদ্ধার্থ শেষে যেটা লিখলেন ওটা আমারও মনের কথা। সুমনের গান (অনেকগুলো) আমার চেতনকে ছোঁয়, পুরোনো গান বেশির ভাগই অবচেতনে ঢুকে পড়েছে। মানুষের একলা মনটাকে ছোঁয়াও তো গানের একটা কাজ।
  • dd | 110.234.159.216 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১৪:১৮542575
  • আমার এই পাকামিটা শুনুন। একটি নিঁখুত কাব্যিক পাকামি।

    কোনো দুটো মানুষই একই গান কখনো শোনেন না। যে কোনো গান "শোনা"টা খুব ব্যক্তিগত,খুব নিজস্ব ঘটনা। সেই সময়টা ,সেই মানুষটা আর সেই গানটি - এই তিনটে নিয়েই একটি নিটোল বৃত্ত (হয়,হয়,ত্রিভুজ ছাড়াও বৃত্তও হয়)থাকে।

    যেমতি,"এ কি লাবণ্য পুর্ন প্রান".... আমি যে ভাবে শুনি,আমার যেটুকু ভালো লাগে সেটা অন্য কারুর সাথে মিলবে না। বড়জোর কাছাকাছি হবে। কিন্তু আমি যা এই গান শুনি সেটা আপনারা শোনেন না।

    অ্যাকচুয়ালি আমি যা লিখলাম তার সাথে এই টইএর কোনো সম্পর্কও নেই,কিন্তু তাও ও লিখে দিলাম।
  • dukhe | 117.194.225.114 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ২১:৩৮542586
  • শৈশব হল সেরকম একটা গানের মতো, যেটা আমারই শুধু মনে পড়ছে। কিন্তু আমার চারপাশে যারা আছে এখন তাদের মনে পড়ার কোন উপায় নেই। কারণ তারা তো কেউ আমার শৈশবের দিনগুলোতে উপস্থিত ছিল না। শৈশবে আমার চারিদিকে যারা উপস্থিত ছিল তাদের অনেকেই এ পৃথিবীতে নেই আর। আর অন্য যারা, তারা দূরে দূরে আছে, কেমন হারিয়ে আছে। এই মুহূর্তে ধরো একটা গান তোমার মনে পড়ছে, কিন্তু গানটা কিছুতেই তুমি শোনাতে পারছ না কাউকে। কারণ তুমি কি আর গেয়ে শোনাতে পারবে!

    শৈশব হল সেইরকমই একটা গান যা গেয়ে শোনানো যায় না। যা একা একা গাওয়া যায়। মনে মনে গাওয়া যায়। যে আমার শৈশবের সেইসব দিনে আমার সঙ্গে ছিল না, সে যদি সেই গান বা শৈশব শোনে, বলবে, ও আচ্ছা। এইরকম বুঝি? বা:, বেশ তো! ভারি সুন্দর কিন্তু! এইটুকু বলবে সে, যাকে বলে অ্যাপ্রিসিয়েট করার, করবে। কিন্তু আমার আসল অনুভবের একটি কণিকার বেশি যে তার কাছে পৌঁছল না, সেটাও বেশ বুঝতে পারা যাবে।

    ধরা যাক অনুপম রায় ও রূপম ইসলামের গানে মুগ্‌ধ আমার মেয়ের কোনও বন্ধুদল হুড়মুড় করে ঢুকে দেখল আমার ঘরে গান বাজছে। কী গান? কান্তকবির দৌহিত্র দিলীপকুমার রায়ের 'রুমক ঝুমক রুম ঝুম'। অথবা সন্তোষ সেনগুপ্তের ' কত গান তো হল গাওয়া'। কিংবা মঞ্জু গুপ্তের 'যাব না যাব না ঘরে'। অথবা সর্বাণী সেনের যে গান এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না, সেই 'আনন্দে রুমক ঝুম বাজে'। আমি যেই প্লেয়ারটা বন্ধ করে দিলাম তারা কী বলবে! বলবে, চলুক না, চলুক। বন্ধ করলেন কেন জেঠু। আমরা তো গান ভালবাসি।

    আবার চালিয়ে দিলাম। শুনে তারা ভাল ভাল বলতে বলতে ঘর ছাড়ল। কিন্তু স্পষ্টই বোঝা গেল গানগুলো তাদের হৃদয়ে যায়নি। তারা যে চেয়ারে বা খাটে বসেছিল, গানগুলো সেইসব চেয়ার বা খাটের তলার মেঝের ওপর পড়ে গিয়েছে। ওদের মধে যে একটু সাহসী বা কী-এসে-যায় ভাব নিয়ে চলে, সে হয়তো বলল, এঁদের প্রোনানসিয়েশনটা এরকম কেন? আমি হাসি হাসি মুখে চুপ করে রইলাম। কী করে আর বলব, উচ্চারণের ওই বিশেষ ধরনটাই যে আমার মনে কী মধুরতা সঞ্চার করে? কী করে বোঝাব সে কথা। বোঝানোর কোনও উপায় নেই। কারণ আমি যে ওই গানগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়েছি। ওরা, ঐসব গান, কত ছোট থেকে আমার সঙ্গে সঙ্গে আছে।

    - জয় গোস্বামী

    বোঝাই যাচ্ছে এই টইয়ের সঙ্গে বা এমনকি ডিডিদার পোস্টের সঙ্গেও কোন সম্পর্ক নেই। দিতামই, সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। সুযোগ না পেয়ে এমনিই দিলাম। পরের অংশ দেব না, এমন গ্রান্টিও নাই।
  • siki | 122.177.16.128 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ২১:৫১542597
  • SC যা লিখেছেন, সুমনের সুটো একটা গানের উদাহরণ দিয়ে যেভাবে বুঝিয়েছেন, তারপরে সত্যি আর নতুন কিছু বলার নেই। পুরো ক। সঙ্গে ন্যাড়াদা, তিনেন / তিনওয়াই-কেও।

    সত্যি ঘটনা বোধ হয় নয়, মিথই হবে, তবে সলিল চৌধুরির নামে এই গল্পটা খুব শুনেছি ছোটবেলায়। কোনও এক জমায়েতে খুব উত্তাল তর্ক চলছিল, ভালো গানের জন্য ভালো লিরিক দরকার আছে কিনা। আর কে কে ছিলেন, মনে নেই, প্রায় সকলেই একমত হয়ে যাচ্ছিলেন যে, হ্যাঁ, ভালো লিরিক না হলে ভালো গান তৈরি হয় না। একমাত্র মেনে নেন নি সলিল। তাঁর দাবি, কথা যেমন খুশি হোক, সুরকার তাতে সত্যিকারের সুর বসালে সে জিনিস ভালো গান হবেই হবে।

    উপস্থিত জনতা তখন তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে। সামনে পড়ে ছিল টাইমস অফ ইন্ডিয়া কাগজ। তার এডিটোরিয়ালটা খুলে ধরে বলা হয়, আপনি এটাতে সুর বসাতে পারবেন? সলিল নাকি আধঘণ্টা সময় চেয়ে পাশের ঘরে চলে যান কাগজটা নিয়ে, এবং সেই ইংরেজি এডিটোরিয়ালের প্রথম চার লাইনে একটা চমৎকার সুর বসিয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে।

    একটা গান দুভাবে ভালো হয়, সত্যিই। ভালো কথা, ভালো সুর। এবার এদের মধ্যে কীভাবে, কোন মিশ্রণে, কোন অনুপাতে যে বিক্রিয়া ঘটালে "কালজয়ী' তৈরি হয়, কেউ তার উত্তর জানে না।

    রবিঠাকুরের গান একভাবে গেয়ে গেলেন সবাই, সুরের দোলায় মাতল সারা বাংলা, দশকের পর দশক। যতক্ষণ না দেবব্রত বিশ্বাস এলন। তাঁর গায়কীতে প্রথম লোকে জানল, রবিঠাকুরের গানে কথাকে উপজীব্য করেও উপস্থাপিত করা যায় শ্রোতাদের কাছে। লোকে সেই প্রথম খেয়াল করে দেখল, দেবব্রতর গায়কীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধু আপনমনে গুণগুণ করে গাওয়া যাচ্ছে না। কথাগুলোও উচ্চারণ করতে হচ্ছে।

    বিশ্বভারতী নিতে পারল না সেই গায়কী। তারা চোখ রাঙাল। কিন্তু আজ, এতদিন পরেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের বোদ্ধাদের কাছে হেমন্ত বা দ্বিজেনের থেকেও বেশি গ্রহণীয় রয়ে গেছেন দেবব্রত বিশ্বাস। কালজয়ী হয়ে গেছে দেবব্রতর গায়কী।

    ন্যাড়াদার মত গানের জ্ঞান আমার নেই, নিতান্তই আমজনতা। ভালো গান শুনলে ভালো লাগে, এই আর কি। স্বর্ণযুগের গান শুনেছি, মনের খেয়ালে গুনগুনিয়ে গেছি, গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে শুনতে শুনতে একটা বোধ তৈরি হচ্ছিল, কোন গানটা শুনতে ভলো লাগছে, কোনটা নয়। রবীন্দ্রনাথের গান সম্বন্ধে একটা বিরাগ তৈরি হচ্ছিল। সেই সময়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সোর্স বলতে ছিল আকাশবাণী আর মায়ের গান।

    পোষাচ্ছিল না। টোটাল বৈচিত্র্যহীন, আমার জ্বলেনি আলো, দীপ নিভে গেছে, বিজন ঘরে নিশীথ রাতে, পুরো ধুত্তেরি কেস চলছিল, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।

    খুব ছোটবেলায় চেতনায় আঘাত হানার যেসব গান শুনতাম বর্ধমানে থাকাকালীন, সেইরকম গান, চেতনাকে নাড়া দেবার মত গান পেলাম না।

    বর্ধমান থেকে মুর্শিদাবাদ, মুর্শিদাবাদ থেকে মেদিনীপুর, সেখান থেকে অবশেষে হুগলি। গ্রামজীবন ছেড়ে অবশেষে মফস্‌সল। কলকাতার কাছের মফস্‌সল। ততদিনে বেশ খানিকটা বড় হয়েও গেছি। কিন্তু গান বলতে বাড়িতে সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতি, আর রেডিওতে অনুরোধের আসর। টিভি তখনও ঢোকে নি। একটি সেমি-বখাটে ছেলে বন্ধু হয়েছিল আমার। সে আমাকে গান শোনাতে শুরু করল। ক্যাসেট দিয়ে দিয়ে।

    কিন্তু কান তৈরি হয় নি তখনও। বাড়ির ব্রেনওয়াশ, হিন্দি গান মানেই কুরুচিকর, অপসমোস্কিতি ততদিনে মাথায় বেশ গেঁড়ে বসেছে। কিশোরকুমার শুনি নি, লতা মঙ্গেশকর শুনি নি, আশা ভোঁসলে শুনি নি, মানে হিন্দিগুলোর কথা বলছি, কেবলই বাংলা গান, বাংলা গান আর লিমিটেড বাংলা গানই।

    সেই বন্ধু আমাকে ইজাজতের ক্যাসেট দিয়েছিল, সেই প্রথম আরডি বর্মনের সঙ্গে মোলাকাত। আজ ভাবলে অবাক লাগে, সেদিন গানগুলো ভালো লাগে নি। বন্ধুও শুনে হাঁ হয়ে গেছিল। তারপরে সে দিল মাইকেল জ্যাকসন। থ্রিলার। ব্যাড। ডেঞ্জারাস। ততদিনে এসে গেছে বাবা সেহগল। অ্যাপাচে ইন্ডিয়ান। র‌্যাপ আর রেগে খেয়ে নিচ্ছে সুপারহিট মুকাবিলার অধিকাংশ স্পেস। দূরদর্শনে বিকেলবেলায় দুঘণ্টার জন্য তখন এমটিভি দিত। টপ টুয়েন্টি কাউন্টডাউন। আস্তে আস্তে বাইরের গানের জগতটা খুলে যাচ্ছিল সামনে। প্রথাগত রাবীন্দ্রিক ঢংয়ের চাঁদতারাফুলপাখিসখিআঁচল এসব ছাড়াও যে অন্যভাবে গান বাঁধা যেতে পারে, সমসাময়িক জীবন থেকেও যে গানের শব্দ তুলে আনা যায়, তাই দিয়ে অন্য ভাষাতেও যে সুন্দর গান বাঁধা যায়, সেইসব বুঝতে পারছিলাম।

    সেই সময়ে সে দিল সুমনের ক্যাসেট। উনিশশো বিরানব্বই, ক্লাস নাইন। তোমাকে চাই শুনিই নি। বসে আঁকো-তে গিয়ে যখন ঝটকা খেয়ে ফিরে গিয়ে তোমাকে চাই শুনলাম, বুঝলাম আগে না শুনে কী মিস করেছি।

    ঠিক কী কারণে ভালো লেগে গেল এত? জানি না। এসসি এবং অন্যান্যরা যেভাবে বলেছেন, ঠিক সেইভাবেই গানগুলো চেতনে আঘাত করল। গানগুলো কথা-বেসড। এবং কোন কথা ঠিক কোন জায়গায় কোন অভিঘাতে থ্রো করলে গানটা সম্পূর্ণতা পায়, সে সম্বন্ধে প্রথম ভাবতে শিখলাম।
    সুমনের গান আমাদের মত ম্যাঙ্গো পাবলিককে প্রথম এই জিনিসগুলো খেয়াল করাতে শেখাল। একেবারে লে-ম্যানস অ্যাপ্রোচে বোঝাতে শেখালো রিক্সা চালানো বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে লেখা গান গাইতে গেলে রিক্সার ছন্দটা গানে আনা জরুরি।

    আমারও তো বয়েস হচ্ছে, রাতবিরেতে কাশি, ... একেবারে খাদে, একজন বয়স্ক মানুষের অস্বস্তি, আর পরের লাইনেই পুরোপুরি সেই সমস্ত অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে উঠে ... কাশির দমক থামলে কিন্তু বাঁচতে ভালোবাসি। একেবারে গলা ফাটিয়ে চিৎকার, কিন্তু এতটুকু মনে হল না কোথাও সুরের বিচ্যুতি ঘটল, মনে হল যেন, এই তো, এখানটাতে তো ঠিক এই নোটগুলোই লাগবার কথা ছিল! বাংলা গানে তার আগে জিলিপি-সন্দেশ আসে নি, আমাদের চারপাশের অতিপরিচিত দুটো তিনটে জিনিস, চায়ের দোকান, চায়ের গেলাস, লেড়ো বিস্কুট, এবং বাঙালির আমরণের সঙ্গী নস্টালজিয়া, সলিল চৌধুরির ফেলে আসা গানে, চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত তানে, ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে, সেই কবেকার অনুরোধের আসরে, তোমাকে চাই। কী অনায়াসে বাংলা গানের বিভিন্ন রকমের শ্রোতাদের একসঙ্গে ধরে ফেললেন সুমন। যে লোকটা সলিল চৌধুরি মন দিয়ে শোনে, আর যে লোকটা চৌরাশিয়ার বাঁশি শোনে, দুটো কিন্তু এক ঘরানার, একরকমের কানওলা, এক রকমের সুরবোদ্ধা সঙ্গীতবোদ্ধা লোক নয়। দুটো কমপ্লিটলি আলাদা এনটিটি, যে অনুরোধের আসরের ভক্ত, আর যে হিমাংশু দত্তের গান শোনে। ঠিক সেই সময়ে কিন্তু, মফস্‌সলে হিমাংশু দত্ত বা তাঁর ক্যাসেট শুনতে পাওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। হিমাংশু দত্তের নামই শোনে নি মফস্‌সলের বেশির ভাগ লোক। পাতি লোকজন। যারা গানবাজনার খবর রাখে না। কিন্তু বিবিধভারতী শোনে, ছায়াছবির গান, অনুরোধের আসর শোনে। রোববার দুপুরে মাংস খেতে খেতে।

    সুমন এই বিভিন্ন ক্লাসকে একসাথে একাকার করে দিলেন। এবং প্রত্যেককে ঘাড় ধরে গানের কথা শুনতে বাধ্য করলেন, এবং লোকে শুনে বুঝতে বাধ্য হল যে, হারমোনিয়াম তবলা ছাড়াও অন্যভাবে বাংলা গান গাওয়া যায়।

    কত উদাহরণ দেব? সবাই জানে। :) দশফুট বাই দশ ফুট বা গড়িয়াহাটার মোড় নিয়ে তো ইতিমধ্যেই অনেকে লিখে দিয়েছেন, চলে যাই বরং গানওলা ক্যাসেটে, ক্যাকটাস তুমি কেঁদো না।

    চারটে এনটিটিকে বলা হচ্ছে, তুমি কেঁদো না। ক্যাকটাস, পাথর, আকাশ, ইতিহাস। একজন যেন বড় আপন, অন্যজন তেমন যেন আপন নয়, কিন্তু খুব কাছাকাছির লোক। আকাশ অনেক দূরের, তার সঙ্গে তেমন ইনফর্মাল সম্পর্ক নয়, তাকে চেঁচিয়ে বলতে হচ্ছে, আকাশ, তুমি কেঁদো না। আর যখন বলা হচ্ছে, ইতিহাস, তুমি কেঁদো না, যেন যুগযুগান্তের ওপার থেকে বড় আবেগী ভাবে ডাকা হচ্ছে ইতিহাসকে, যাতে সে শুনতে পায়।

    পাথর, তুমি কেঁদো না, তথাগত তিনি স্থানু
    তাঁর ধ্যানস্থ রক্তে চরাচর নতজানু।

    এই দ্বিতীয় লাইনে কী সুন্দরভাবে ধাপে ধাপে সুরটাকে নামিয়ে নামিয়ে শেষে নিচের নোটেই ভাসিয়ে দেন গায়ক।

    তিনি বৃদ্ধ হলেন, বৃদ্ধ হলেন, বনস্পতির ছায়া দিলেন, সারাজীবন।

    মাঝের দিকটায় কথার একঘেয়েমি এসে যায়। সব লাইনের শুরুতেই একটা করে "ছিল'। ছিল কলম্বিয়ার বাঘের ছাপ্পা, কুকুর শোনে বাংলা টপ্পা ... একটা পজ। শ্রোতা ঠিক রিলেট করেও করতে পারছে না। সুমন তখন রহস্য উন্মোচন করে দিলেন ... "চোঙা মুখে'। ফট করে এইচএমভির লোগোটা সামনে এসে যায়।

    তো, এই যে এতগুলো ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে প্রতিটা গানে, শ্রোতা শুনে অ্যানালাইজ করতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিটা লাইনের এক্সপ্রেশন, ইনার মীনিং, গানের ব্যাপারে অশিক্ষিত হওয়া সত্বেও, এইটা কিন্তু একান্তই সুমনের ইউএসপি। কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সরাসরি তিনি ঢুকে পড়লেন এলিট, আঁতেল এবং পাতি মধ্যবিত্তের বেডরুমে। একসাথে।

    এটা মহীন পারে নি, এমনকি সত্তরের আশির দশকে সুমনও পারেন নি। হয় তো শ্রোতা তৈরি ছিল না, হয় তো অন্য কোনও কারণ। গানের ক্যাসেট বা ক্যাসেট প্লেয়ার সহজলভ্য হতে শুরু করে আশির দশকের শেষ থেকেই। এর বাইরেও, সুমন মিডিয়া স্পনসরার হিসেবে পাশে পেয়ে গেছিলেন আজকালকে। প্রায় প্রথম দিন থেকেই। সেইটাও আর কেউ পায় নি। সুমনের তোমাকে চাই একেবারে সঠিক সময়ের সঠিক প্রোডাক্ট। ঐ সময়ে অন্য কেউ ঐ রকম একটা অ্যালবাম বের করতে পারলে তিনিই ট্রেন্ড সেটার হতে পারতেন কিনা, সেটা আজ আর বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই সময়ের নিরিখে সুমনের মধ্যে ট্রেন্ডসেটার হবার সমস্ত গুণাবলী বর্তমান ছিল। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় তাঁর ডোজ প্রয়োগ করেছেন। কাজ না দিতেই পারত। কিন্তু কাজ দিল।

    বাকিটা, ইতিহাস বলবে। সবে তো কুড়ি বছর হল।
  • siki | 122.177.16.128 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ২২:০২542608
  • দুখে একঘর। :) মাল্টিলাইনারেও।

    কী করে বোঝাবো, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই "ন্যাকা-ন্যাকা' রোমান্টিক উচ্চারণের ঘুম-ঘুম-চাঁদ ঝিকিমিকি তারা, বা গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু মনের মধ্যে কী রসায়নের সঞ্চার করে? এ বোঝানো যায় না। সন্ধ্যাকে ঠিক ঐ উচ্চারণশৈলীর জন্যেই এত ভালো লাগে। যেমন ভালো লাগে মুকেশের সর্দিবসা গলায় শুনতে, কহিঁ দূর জব দিন ঢল জায়ে বা জিনা য়ঁহা মরনা য়ঁহা। জগন্ময় মিত্রর গলায় খোনা খোনা স্টাইলে ... বলেছিলে তাই চিঠি লিখে যাই কথা আর সুরে সুরে / মন বলে, তুমি বড় কাছে আছো, আঁখি বলে, কত দূরে।

    আজকের সময়ের নিরিখে তারা পারফেক্ট নয়। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে সংযোগহীনতা সত্বেও তাঁরা এইসব গায়কী, এই উচ্চারণপদ্ধতি, এই সব ন্যাকামো দিয়েই এক দুই দশক ধরে শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন, ব্যক্তিগতভাবে আজও আমায় মাতান।

    এ জিনিস বোঝানো যাবে না, ঠিক কী কারণে এত ভালো লাগে এসব শুনতে। শুধুই ছেলেবেলার নস্টালজিয়া? বোধ হয় নয়। আরও কিছু। যা ব্যাখ্যার অতীত।

    কোন জিনিস কাকে কীভাবে নাড়াবে, সেটা যার যার ব্যাপার। আমার জীবনানন্দ শুনলে সামহাউ হেব্বি জ্বলে। টলারেট করতে পারি না। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ভালো লাগে না। শেষের কবিতা অনেকের অসহ্য লাগে, অসম্ভব নেকু নেকু ব্যাপারের জন্য, আমি আবার তার মধ্যে অন্য রস পাই। :)

    ক্ষী করা যাবে!
  • omnath | 117.194.202.81 | ২৯ এপ্রিল ২০১২ ০০:২৫542619
  • সিকি পাঠ-সংকলনের পরে শেষ কবে জীবনানন্দ পড়েছে জানতে আগ্রহী রইলাম।
  • tatin | 117.197.69.126 | ২৯ এপ্রিল ২০১২ ০০:২৯542631
  • শঙ্খ ঘোষ পড়লে আমারও প্রায় অনুরূপ হয়। আমি পাঠ-সংকলনের পরেই শংখ যা পড়ার পড়েছি
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন