এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • মলয়ের লেখাপত্তর

    pi
    বইপত্তর | ২৪ মার্চ ২০১২ | ১৯৭১৮৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • basab roy | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:২৩541351
  • বাসব রায় : মলয় সম্পর্কে দু’একটা কথা
    ১. মলয় রায়চৌধুরী আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেন মাত্র দুটো কারণে। ফিফটিজ-এ লেখালিখি শুরু করলেও তাঁর ভাষায় একেবারে রাবীন্দ্রিক ছাপ নেই। তখন যাঁরা লিখছিলেন বাংলা ভাষায়, মলয় ঠিক তার উলটোদিক থেকে লিখেছেন এবং লিখতে লিখতে নিজস্ব একটি ভাষা তৈরি করেছেন। চলমান গদ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তাকে অস্বীকার করে লেখা সত্যিই কঠিন বিষয় ছিল, এমনকি আজও তা সমান সত্য। এখানে অজিত রায়ের ভাষার কথা বলতে হয় যে তিনি সমকালকে অতিক্রম করেছেন, অন্তত ভাষার দিক থেকে।

    এবং মলয়ের নিজেকে উপুড় করে দেওয়ার ক্ষমতাকে আমি সেলাম করি। মলয় নিজেকেই যেন ছুরি দিয়ে কোপাতে থাকেন, আর তখন যে রক্তপাত হয় সেটাই তাঁর লেখালিখি। ছোটলোকের ছেলেবেলা, ডুবজলে, মেধার বাতানুকূল, নামগন্ধ যাই পড়ি না কেন, মলয় সেখানে নিজের মাংসের টুকরোই সাজিয়ে রেখেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার যে মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী লেখক হতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন বাঁক বদলের জন্য, যেন সেটাই তাঁর কাজ। মলয়ের সেরা লেখা কোনটা? আমি জানি না, সম্ভবত মলয়ও জানেন না। কেননা তিনি সেরা লেখা লিখতে চাননি কখনো, চেয়েছিলেন চলমান সাহিত্যের ওপর হাতুড়ির ঘা মেরে নিজের ভাষাটাকে প্রতিষ্ঠা করতে। এবং কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি সফল।

    আজ অজিত রায়, এর আগে নবারুণ, যে ভাষায় লিখছেন সেটা মলয় রায়চৌধুরীরই লিগ্যাসি।

    ২. শুধুই লিটল ম্যাগাজিনের লেখক বলে কিছু হয় না। যে কোনো লেখকই লেখেন পাঠকরা পড়বেন বলে। লিটল ম্যাগাজিনে সিরিয়াস লেখালিখি করা যায়, অধিকাংশ বাণিজ্যিক পত্রিকা যা ছাপায় না। কিন্তু শুধুই লিটল ম্যাগাজিনে লিখবেন বলে কোনো লেখক পণ করেন না। লেখকের লেখাটাই কাজ, কোথায় ছাপা হচ্ছে সেটা দ্বিতীয় বিষয়। লিটল ম্যাগাজিন শুরু হয়েছিল বা এখনও হয় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে কোনো লিটল ম্যাগাজিন নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়। এটা চমস্কির তত্ত্ব, যে একটা মত প্রবল হতে থাকলে তার বিরুদ্ধ মত উঠে আসে। এবার দ্বিতীয় মত শক্তিশালী হলে আসে তৃতীয় মত। খেলাটা চলতেই থাকে। এবং এভাবে লিটল ম্যাগাজিনে লিখেও কখন যে লেখক প্রতিষ্ঠান বা আপনার কথায় লিটল ম্যাগাজিনেই লিখে ফেলেন, এটা বোঝা যায় না।

    মলয় রায়চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, আমার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই, আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নই। আমার লেখাটা যদি ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠান ছাপায় তাহলে আমার লেখা দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু ওরা তা ছাপবে না, তাই বলা যায় আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নই, প্রতিষ্ঠান আমার বিরোধী।

    ৩. আমরা যাঁদের লেখালিখি-জীবন দেখে কবিতার জগতে এসেছিলাম, কবিতা লিখেই সমাজের ঝুঁটি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন যিনি, আমার সম্পর্কিত দাদা, ওহঃ হো, মেজোকাকার কবিতা পড়ুন। আরেকটি তথ্য আমার জন্মের দুবছর আগে কবিতা লিখে জেলে গিয়েছিলেন ওই অসভ্য, বুনো, প্রথাবিরোধী বা নতুন প্রথার জন্মদাতা....
    ‘মলয়দাস বাউলের দেহতত্ব’

    ডোমনি, তুইই দয়াল, যখন বিদেশে যাস কেন রে আনিস কিনে সেক্সটয় ?
    ভাইব্রেটর, ডিলডো, বেন-ওয়া-বল, গুহ্যের মুক্তমালা ?
    ডোমনি, তুইই দয়াল,জানি কেন বিডিএসএম কবিতার বই এনেছিস,
    জি-বিন্দু হিটাচির ম্যাজিকের ছড়ি ? নিপল টিপে কাঁপাবার ক্লিপ ?
    ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত-পায়ে দড়ি চোখে ঠুলি আমাকে চেয়ারে
    উলঙ্গ বেঁধে রেখে দিয়েছিস, নিজের ফাঁস খুলে তলাতল রক্তের স্বাদটুকু দিলি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, শুদ্ধ প্রেমে মজল যারা কাম-রতিকে রাখলে কোথায়
    চাবুক মারিস তুই, চুলের মুঠি ধরে ক্ষিরোদধারাকে চুষে বের করে নিস
    ডোমনি, তুইই দয়াল, চাতক স্বভাব নাহলে অমৃতের দুধ তুই দিবিনাকো
    আমার খিদে নেই, মুখের ভেতরে কৃষ্ণের বিশ্বরূপ খেয়ে মজে গেছি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, যতো ইচ্ছে আনন্দ কর, দেহ নিয়ে খেল
    আমি একটুও নড়ব না, আহ উহ করব না, যতো চাই ধাতুবীজ নিস
    ( দহগ্রাস পত্রিকায় প্রকাশিত )

    ৪. সমীর রায়চৌধুরী মারা গেলেন। কে তিনি? না সুনীল-শক্তি-সন্দীপন-দীপকের বন্ধু, হাংরি খ্যাত মলয় রায়চেৌধুরীর দাদা। এমন নয় যে সমীর রায়চেৌধুরী অন্যদের পরিচয়েই পরিচিত। তাঁর নিজেরও কিছু উচ্চমানের লেখা আছে। হাওয়া ৪৯ নামে দুরন্ত একটা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনাও করেছেন বেশ কিছুদিন। আনন্দবাজারীয় সাহিত্যের পাঠকরা অবশ্য সমীরকে শুধু সুনীল-শক্তির চাইবাসার বন্ধু বলেই জানেন।
    এর বাইরে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন আত্মজৈবনিক লেখালিখিতে সমীরকে আবিষ্কার করা যায়। অ্যালেন গিনসবার্গের কাশী যাত্রায় সমীর সম্ভবত সঙ্গী ছিলেন কিছুদিন। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে ওঠাবসা ছিল সমীরের, পরে চাইবাসায় চলে যান। জনশ্রুতি তাঁর বোনের সঙ্গেই প্রথম প্রেম শক্তির। তবে সমীর রায়চৌধুরীকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন হাংরির নকল গ্রুপ। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত খুব মোটা একটা বই আছে বাজারে। যার সম্পাদনা করেছেন সমীর চেৌধুরী। মজার ব্যাপার ওই বইটিতে হাংরির শেষকথা মলয় রায়চেৌধুরীর কোনো লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অথচ তাঁর দাদাই কি না সম্পাদক! সত্যটা হচ্ছে এই সম্পাদক সমীর চৌধুরী আজ মারা যাননি, অনেক আগেই হারিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্য থেকে। কেননা ওই বইয়ের সম্পাদক মলয়ের দাদা নন। এটাই মজা।

    ইদানীং সমীর কিছুই লিখছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন গত ষাট বছরের বাংলা লেখালিখির এক আশ্চর্য দলিল। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সব খবর রাখতেন। তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ধারালো হয়েও মলয় রায়চৌধুরী এই জায়গায় কিছুটা পিছিয়ে আছেন (যদি তুলনা করতেই হয়), মলয় বেশ কয়েক বছর লেখালিখির বাইরে ছিলেন। সমীর রায়চেৌধুরীর মৃত্যু মানে ইতিহাসের ইতিহাসে চলে যাওয়া।
    তাঁকে শ্রদ্ধা…

    ৫. দায়িত্ব না নিয়ে একটু হাস্যচ্ছলে বলি, হাংরি লেখকদের মধ্যে কেউ আধুনিকতাবাদীদের মতো 'ডক্টরেট' ছিলেন না, ----- সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান কোন কিছুতেই একজনও 'উলেমা' ছিলেন না ... ঠিকই, কিন্তু এঁরা সকলেই প্রচুর পড়াশোনা করতেন, মলয়-সমীর সবচেয়ে বেশি পড়েছেন। শৈলেশ্বর কাছাকাছি থাকবেন। অরুণেশ একটু পেছনে।

    ৬.ইদানীং, না, ইদানীং নয়, যখন হাংরি আন্দোলন প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে, মানে সবাই যখন বলতে শুরু করেছেন হাংরিরা নতুন কিছু শুরু করেছিল, ভালোই করেছিল। লক্ষ করেছি, তখনই এই শৈলেশ্বর জাতীয়রা খোপ থেকে বেরিয়ে গলাবাজি করছেন যে আমিও ছিলাম... আমিই স্রষ্টা। এরকম আরো কেউ কেউ আছেন। শৈলেশ্বর অন্য এক সমীর চৌধুরীকে দিয়ে ঢাউস বই সম্পাদনা করিয়েছেন হাংরি আন্দোলন, প্রজন্ম নিয়ে। সেখানে মলয় রায়চৌধুরীর কোনো কবিতা নেই, লেখা নেই। হতে পারে ! মলয়কে ছাড়া হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে একটা বাক্য লেখা সম্ভব? কিন্তু সেটাই হয়েছে। শৈলেশ্বর কয়েকটা ভালো কবিতা লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু চরিত্রে গোলমাল আছে... কিংবা এটাই হয়তো অনেকের পছন্দের চরিত্র ।

    ৭. “আপনারা গত ৪৭ বছরে কোন বালডা ছিড়ছেন ; রাজনীতি মেধায় লাথি মারছে…; রাজা আছে, নীতি নাই
    নেতা চোদার টাইম নাই ; লাঠির ভয় দেখাবে না। লাঠি একদম ভরে দিব।”
    আমার কথা নয়, বাংলাদেশে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পোস্টারের ভাষা। এবং আমার কথাটা হল যে এটাই ভাষা। এটাই সভ্য ভাষা। সমাজ বদলে যাচ্ছে, পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, সংস্কার বদলে যাচ্ছে, মানসিকতা বদলে যাচ্ছে আর তাই এটাই মান্য ভাষা।

    বাংলাভাষায় হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট প্রথম এরকম ভাষা ব্যবহার করেছিল, তার অপ্রত্যাশিত সমালোচনা হয়েছে, যদিও এখন অনেকেই ওই আন্দোলনের ক্ষীর খেতে চাইছেন। তো সেটা অন্য কথা, যা বলার তা হল এই যে যাঁরা বৈষ্ণব সাহিত্যের পর, বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বিভূতি-শরতের পর, আর পড়েননি, খুব বেশি হলে সুনীল-শঙ্খ, তাঁদের বলার, আপনারা একটু মলয়-অজিত-নবারুণ-সন্দীপন পড়ুন।
    এখন আর প্রেম করছি বা ভালোবাসি নয়, বলুন প্রেম পাচ্ছে। সংস্কার বদলে যাচ্ছে, চরিত্র-চরিত্রহীনতার সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে... আপনারা আর ভাষার শুদ্ধতা আশা করবেন না... সংস্কারের শুদ্ধতা আশা করবেন না... জীবনকে দেখুন.. শুধু বেঁচে না থেকে জীবনকে যাপন করুন... আনন্দে থাকুন... আত্মাকে কষ্ট দেবেন না... যা মন থেকে করতে ইচ্ছে যাচ্ছে সেটাই করুন... সবাইকে কষ্ট দিন, শুধু নিজেকে কষ্ট দেবেন না... গালি দিন...প্রেম করুন... মূল কথা আনন্দে থাকুন... নির্মল থাকুন...।

    ৮.”একাই লড়েছিলুম; কেউ বলেনি হোক কলরব । একাই নেমেছিলুম ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সিঁড়ি বেয়ে। সেদিন একাই কলকাতার পথে ঘুরেছিলুম সকাল পর্যন্ত ।” বলেছেন মলয় রায়চৌধুরী । লড়াইটা শুরু একাই করতে হয়, পরে সহযাত্রী হয় অনেকে, যেমন এখন হয়েছি, আমরা

    ৯. ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, "হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করার জন্য মলয় ইচ্ছে করেই আমার আমেরিকা-বাসের সময়টা বেছে নিয়েছিল"।

    ১০. সাইয়েদ জামিলের কবিতা কারো ভালো লেগেছে, কারো ভালো লাগেনি, যা স্বাভাবিক। সেই প্রসঙ্গে একটা বা দুটো কথা যা আমার বলতে ইচ্ছে করছে, তা হল, আজ, এই ২০১৮ সালে, সাহিত্যে শুদ্ধতা আর আশা না-করাই ভালো। এখন আর কেউ বলছে না ‘কুৎসা রটাচ্ছে’, বরং ‘কুৎসা করছে’ চলছে। শব্দের ব্যবহার বদলে যাচ্ছে, ভাষা বদলে যাচ্ছে ; বদলে যাচ্ছে সংকেত, প্রতীক, চিত্রকল্প। ফেসবুক করছ, গুগল করুন... এসব বেশ চলছে। বিদেশে এটা অনেক আগেই প্রতীয়মান। দু-একটি উল্লেখ মনে হয় সংগত।
    America when will we end the human war?
    Go fuck yourself with your atom bomb.
    I don’t feel good don’t bother me.
    এই কবিতা ১৯৫৭ সালে লিখেছেন অ্যালেন গিনসবার্গ।
    ষাটের দশকে ‘আমায় দিয়ে করিয়ে নিল তিন বিধবা’ লিখেছেন অরুণেশ ঘোষ। এই সেদিন ‘ভুলে যাবেন না, অনেক কিছুর উপরই পেচ্ছাপ করে যেতে হবে আমাদের’ লিখলেন বন্ধু-কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর। আর যে কবিতা দিয়ে এই পোস্ট শেষ করব সেটা হল আরেকটা কবিতা, অংশ নয়, গোটা...
    ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
    আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
    আমি কী কোরবো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
    সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
    শুভা আমাকে তোমার তরমুজ আঙরাখার ভেতর চলে যেতে দাও
    চুরমার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
    সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
    আর আমি পারছি না, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
    আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
    প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
    শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
    মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
    তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমো খেতুম
    কিন্তু কিছুই ভলো লাগছে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না
    একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়
    ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন
    কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে
    এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ
    সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
    ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব
    শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়
    দিতেই হবে শুভাকে
    ওঃ মলয়
    কোলকাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
    কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কী কোরবো বুঝতে পারছি না
    আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
    আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
    আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
    প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি
    অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
    শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার
    অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্থতা
    যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতন ঘামের সুস্থতা
    আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
    আমি বুঝতে পারছি না কী জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
    আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণচৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি
    আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোরতে হবে
    শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
    জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
    আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
    তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
    শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
    তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
    আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
    আমার বাবা-মা আন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
    সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওরফে আমি হতে পারতুম ?
    আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
    শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
    ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
    শুভা, ওঃ শুভা
    তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
    পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
    যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়
    ১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
    তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
    পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
    হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
    আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
    মরে যাব কিনা বুঝতে পারছি না
    তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়
    সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
    শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোব
    কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
    শুভা
    আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোরতে দাও
    দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
    বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে
    কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?
    কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি ?
    কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায় ?
    অথচ আমার নীচে চিত আধবোজা অবস্থায়
    আরামগ্রহণকারিণী শুভাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আমার
    এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
    আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
    এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
    মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
    আমি মরে যাব
    ওঃ এসমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে
    আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না
    পায়জামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
    ৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
    ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
    এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
    হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপরচুলায়
    ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মারমুখি আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
    কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি।
    এই কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে, কার কবিতা এবং কবিতার নাম কী বলার জন্য কোনো পুরস্কার নেই।

    ১১. এখনকার কলেজ পড়ুয়াদের তো আর মলয়ের মেধা নেই ।

    ১২. বহু আগে আর্থার মিলার বলেছিলেন, ‘ভাষাকে যে আক্রমণ সরে সেই ভাষাকে বাঁচায়।’ এখানে আমি অজিত রায়ের নামটি উল্লেখ করতে চাই, যিনি ভাষাকে আক্রমণ করে বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই আক্রমণের বিষয়টি অবশ্য সবাই সাদরে আমন্ত্রণ জানাবেন না। কেননা তাঁর লেখায় উল্লেখ না করলেও একটা শ্রেণির প্রতি তাচ্ছিল্য, শ্লেষ ধরা পড়ে। এবং এখান থেকেই তিনি হয়ে যান ব্রাত্য, যেভাবে একদিন মলয় রায়চৌধুরীকে কলকাতা রেখেছিল একটু দূরে। আজ তিনিই কি না বাংলাভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জীবিত ব্যক্তিত্ব।

    .
  • nabanita | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:২৯541352
  • মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    মলয় রায়চৌধুরী ( ১৯৩৯ ) একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রবন্ধলেখক ও অনুবাদক । পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকে যে চারজন হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন ( অন্যেরা হলেন দেবী রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সমীর রায়চৌধুরী ), তিনি তাঁদের অন্যতম । কবিতা লেখার জন্য ১৯৬৪ সালে তাঁকে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল । এ মকদ্দমা তিনি হাইকোর্টে জিতে যান । তাঁর ‘জখম’ কবিতাটি বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে । ১৯৬৮ সালে তিনি মধ্যপ্রদেশের রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন । বর্তমানে তিনি মুম্বাইতে কাণ্ডিভালি শহরতলিতে একটি বহুতলে একরুমের ফ্ল্যাটে সস্ত্রীক থাকেন । তাঁর মেয়ে, জামাই নাতনিরা বিদেশে থাকেন এবং ছেলে ও ছেলের স্ত্রী থাকেন কলকাতায় ।

    প্রশ্ন : নিজের লেখালিখির আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করেন ?
    উত্তর: কোনো মূল্যায়ন করি না । যেমন খিদে পায়, ঘুম পায়, পেচ্ছাপ পায়, তেমন লেখা পায় বলে লিখি । খিদের যেমন মূল্যায়ন করি না, তেমনই লেখালিখির । মূল্যায়ন করতে হলে অন্যের ধরে থাকা আয়না দরকার । আমি তো নিজের জন্য অন্যের আয়নার প্রয়োজন বোধ করি না ।
    প্রশ্ন : আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই ।
    উত্তর : আমার প্রথম লেখা দুটি কবিতা, প্রকাশিত হয়নি, কেননা সেদুটি ছিল প্রেমানুভূতি ; একটি বাংলায়, স্কুলের উঁচু ক্লাসের সহপাঠিনী নমিতা চক্রবর্তীকে, যিনি আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে সুমিতাদি ; আরেকটি ইংরেজিতে, চুম্বনের দাম হিসাবে, স্নাতকস্তরে নেপালি সহপাঠিনী ভূবনমোহিনী রাণাকে, ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসের রাণো । প্রথম প্রকাশিত লেখা ইংরেজিতে ১৯৬১ সালের নভেম্বরে হাংরি ম্যানিফেস্টো, বাংলায় এপ্রিল ১৯৬২তে হাংরি ম্যানিফেস্টো। যে উথালপাথাল ঘটিয়ে ছিল তা কল্পনাতীত । সম্ভবত হ্যাণ্ডবিলের মতন বিলি করা কাগজে তখনও পর্যন্ত সাহিত্য করার কথা ভাবা হয়নি, আর হ্যাণ্ডবিলের মতন ছিল বলে দ্রুত পৌঁছে যেতে পেরেছিল সর্বত্র । প্রথম বই ছিল ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ যে বইটি প্রকাশিত হবার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উল্টোডাঙার বস্তিবাড়ির সামনে পেটরল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছিলুম । বইটা বের করার ভার দিয়েছিলুম শক্তিদাকে; উনি ম্যাসাকার করে দিয়েছিলেন, কাউকে দিয়ে প্রূফ দেখাননি, নিজে দেখেননি, অত্যন্ত বাজে কাগজে ছাপিয়েছিলেন এবং পুরো পাণ্ডুলিপি কমপোজ করাননি । আমার উপন্যাস ‘রাহুকেতু’তে আমি ঘটনাটা দিয়েছি । তার পরের বই, যাকে প্রকৃত অর্থে বলা যায় পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়া বই, তা হল ‘কৃত্তিবাস’ থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’, প্রকাশক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । বইটি এবং আমাকে নিয়ে কলকাতায় হইচই হচ্ছে জেনে তিনি আমেরিকা থেকে ১৩ জুন ১৯৬৪ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, “আপনি মলয়কে এত পছন্দ করছেন -- কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে বিশ্বাস করেন না ।” আবার কলকাতা ফিরে যখন দেখলেন যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেছেন, তখন উনি তুরুপের তাসটি খেলে আমার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেলেন ! জীবনের এমনতর ঘটনাকে কী বলবেন ?
    প্রশ্ন : বাংলাসাহিত্যের কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন ?
    উত্তর: কবিতা তো অবশ্যই, এবং প্রবন্ধ । কবিতা লেখার জগতটা কারোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকছে না, কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক কলকাঠি নাড়া সত্ত্বেও । আর এখন ইনটারনেট হয়ে এলাকাটা সম্পূর্ণ স্বাধীন ; শব্দ, বাক্য, ছন্দ, বিন্যাস নিয়ে যথেচ্ছ বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন তরুণ কবিরা, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় যে কবিতা লেখা হচ্ছে, যেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ পড়ার সুযোগ পাচ্ছি, তার পাশে বাংলা কবিতাকে রাখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়। গল্প-উপন্যাস এখনও বিষয়নির্ভর হয়ে রয়েছে, আলোচকরা গপপো নিয়ে চিন্তিত, যেকারণে আমরা জয়েস, প্রুস্ত, কাফকা, ফকনার, মার্কাজের মতন গদ্যশিল্পী পাইনি; গল্প-উপন্যাসের বাংলা গদ্য এখনও ইউরোপীয় ভাষাগুলোর স্তরে তাই পৌঁছোয়নি ।
    প্রশ্ন : বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে ?
    উত্তর : প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলুম না । জীবনের প্রতিফলন সাহিত্যে ? নাকি সাহিত্যের প্রতিফলন জীবনে ? পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমনই হাল যে ভালো ফলাফল করলেই ছাত্ররা রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে পালান, তারপর বিদেশে পালান ।
    প্রশ্ন : আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি ?
    উত্তর : সারা জীবন কেবল একজন তো আর প্রিয় লেখক হতে পারেন না ; বয়সের সঙ্গে, পাঠ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে যাঁদের লেখার প্রতি আকর্ষিত হয়ে্ছি, তাঁরা পালটে যেতে থেকেছেন । তবে কিছুকাল আগে যে বই দুটো আমি বহুবার পড়েছি তা হল ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড’ এবং পামুকের ‘রেড’ । আমি কিন্তু বই সংগ্রহ করি না ; বইয়ের লাইব্রেরি নেই আমার । বই আর পত্রিকা পড়া হয়ে গেলে বিলিয়ে দিই । আমার কোনো স্টাডিরুম, লেখার টেবিল, পড়ার ঘর জাতীয় ব্যাপার নেই । আর আজকাল তো কাগজ-কলমও ব্যবহার করি না । যাঁরা বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে আসেন, তাঁদের পিলে চমকে যায় ।
    প্রশ্ন : আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটা এবং কেন ?
    উত্তর : ‘নখদন্ত’ নামে একটি সাতকাহন । রামায়ণ থেকে সাতকাহনের আইডিয়া আর মহাভারত থেকে গল্পের ভেতরে গল্পের ভেতরে গল্প টেকনিক প্রয়োগ করেছি, সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত রোজনামচার টুকরো-টাকরা, আর পশ্চিমবাংলায় পাট চাষ-চট শিল্পের বিলুপ্তির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপট । এটা প্রিয় এইজন্য যে এই বইটা লিখে আমি হ্যাপি ফিল করেছিলুম ।
    প্রশ্ন : আপনার লেখালিখির পেছনে মূল প্রেরণা কি ?
    উত্তর : এটা অ্যাডিকশান । অ্যাডিকশানের বোধ হয় প্রেরণা হয় না ।
    প্রশ্ন : শর্তসাপেক্ষে লেখালিখি ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন ?
    উত্তর : জানি না ভারতের সাহিত্য একাডেমিকে লেখা আমার চিঠিটা বাংলাদেশে পৌঁছেচে কিনা । চিঠিটা আমি এখানে তুলে দিচ্ছি ; মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া আছে চিঠিটিতে ।
    April 30, 2004
    Prof K. Satchidanandan
    Secretary
    Sahitya Akademi
    Rabindra Bhaban
    35 Ferozeshah Road
    New Delhi

    Dear Sir
    Refusal to accept Sahitya Akademi Award

    Thanks for your telegram dated 30.4.2004 conveying that my translation work of Dharmaveer Bharati’s “Suryer Saptam Asva” has been awarded the Sahitya Akademi Translation prize.
    I am constrained to refuse this award. As a matter of principle I do not accept literary and cultural prizes, awards, lotteries, grants, donations, windfalls etc. They deprave sanity.
    My decision to refuse the award is in no way to affront late Dharmaveer Bharati, who was a great admirer of my work, and had supported me during my literary ordeals in 1960s when most of the Bengali intelligentia had conspired against the Hungryalist movement. Your magazine the “indian Literature” itself had never bothered to write about this movement.
    Sincerely
    Malay Roychoudhury
    আর কী শর্ত থাকতে পারে ? জেনিফার লোপেজের সঙ্গে মহাকাশযানে করে অন্তরীক্ষে এক পাক খেয়ে আসা বা ক্যাটরিনা কাইফের সঙ্গে জাহাজের রেলিঙে দাঁড়িয়ে পেংগুইনদের সাঁতার দেখা ?
    প্রশ্ন : একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষসত্তাকে’ আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন ?
    উত্তর : কোনো লোক লেখক হয়েছে বলেই তো আর তার ভেতরের মানুষসত্তাটা পালটে যেতে পারে না । সে লেখক না হলেও তার মানুষসত্তাটা যা ছিল তাই থাকবে । আসেপাশে লেখকদের যা সব কাণ্ড-কারখানা দেখি, তা থেকে স্পষ্ট যে তারা লেখক না হলেও ওই সমস্ত কাজ-কারবারই করত । আমি লেখক না হলেও মানুষটা আমি যা রয়েছি তা-ই থাকতুম । আমার সত্তা জিনিশটায় যদি বাইরের কোনো উপাদানের অবদান থেকে থাকে তাহলে তা শৈশবের বিহারি অন্ত্যজ আর দুস্হ মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ার একলেকটিক পরিবেশ ; যেকোনো বাড়িতে যেকোনো সময়ে প্রবেশ করতে পারতুম, এমনকি পাড়ার মসজিদেও, যা বর্তমান ভারতীয় সমাজে অকল্পনীয় ।
    প্রশ্ন : মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন ?
    উত্তর : সত্যি বলতে কি, মৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশ কনফিউজড ।
    প্রশ্ন : লেখালিখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয় ?
    উত্তর : আমি খেতে ভালোবাসি । বয়সের কারণে নানা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে গিয়েও যতটা পারা যায় খাওয়ার ব্যাপারটায় রদবদল করতে থাকি । আমি রাঁধতেও পারি । আমি আর দাদা রান্নাঘরে মাকে টুকিটাকি সাহায্য করার সময়ে অনেককিছু রাঁধতে শিখে গেছি । মাঝে ভেবেছিলুম যা রান্নার রেসিপি নিয়ে একটা বই বের করব, তা আর হল না । আমি বিরক্ত হই আমার একাকীত্ব বিঘ্নিত হলে, এমনকি আশেপাশের আওয়াজও আমার একাকীত্বকে নষ্ট করে বলে বিরক্ত হই । আমি বেসিকালি একজন লোনার, একা থাকতে ভালোবাসি ।
    প্রশ্ন : সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শত্রুকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন ?
    উত্তর : বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা আর আমার নেই । স্কুল-কলেজে ছিল আমার তিনজন বন্ধু, সুবর্ণ-বারীন-তরুণ । তারপর থেকে আমি বন্ধুহীন । আমার একাকীত্বপ্রিয়তার জন্যই বোধহয় আমি বন্ধুহীন । এই এখন হঠাৎ যদি আমার স্ত্রীর কিছু হয়, এমন কেউই নেই যাকে ডাক দিতে পারব । অমন পরিস্হিতিতে ডাক দিতে হবে অ্যাম্বুলেন্সকে । শত্রুও নেই । কেনই বা কেউ শত্রুতা করবে ? লেখালিখির জগতে অনেকে অনেক কিছু লেখে আমার বিরুদ্ধে ; তার জন্য তাদের শত্রু তকমা দেয়া উচিত হবে না ।
  • Subhasree | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২০541353
  • মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা
    শুভশ্রী দাস, অধ্যাপক, কবি সুকান্ত মহাবিদ্যালয়
    বিশ্বসাহিত্যের মনমর্জি বদলায় সময়ের হাওয়া । আমরা কি লিখব, কি বলতে চাই তা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সময়, সমাজ । মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে সময় খেলা করে । রাজনীতি, অর্থনীতি মানুষের চিন্তাশক্তিকে প্রভাবিত করে । ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ কথাটি একটি মিথের মতো । আছে, কিন্তু বাস্তব উপস্‌ইতি খুব স্পষ্ট নয় । ‘সভ্য’ বিশ্বে বলার অধিকার দেব, কিন্তু কি বলবে তা পপত্যক্ক্ষে বা পরোক্ষে আমিই নির্দিষ্ট করে দেব -- উপনিবেশবাদের এই প্রচলিত কাঠামোর বাইরে খুব বেশি এগোনো যায়নি আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও । তবু কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ টিকে থাকতে চায় প্রতিবাদ নিয়ে, সত্যকে আঁকড়ে । পারিপার্শ্বিকের প্রবল চাপেও অনড় হয়ে থাকা এই একরোখা মানুষের হাতেই তৈরি হয় এক-একটি কশাঘাতের মতো শিল্প-সাইত্য, যা আছড়ে পড়ে শাসকের মুখে । শোষিত জনগোষ্ঠী থেকেই জন্ম নিয়েছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যাঁর কলমে রূঢ় বাস্তব হল জাদু, আর যে জাদু চপেটাঘাত করল বাস্তবকে । এমনই সব জাতি থেকে মাথা তুললেন সলমন রাশদি, আলেহো কার্পেন্তিয়ের, ওরহান পামুক, নবারুণ ভট্টাচার্যরা । যাঁরা শিখিয়ে দিলেন ঠাট্টা করতে, যাঁরা এতদিনের কুড়িয়ে পাওয়া লাঞ্ছনা, অপমান দিয়ে তৈরি করলেন শানিত অস্ত্র । জাদুবাস্তবতার ইতিহাস একটি সম্পূর্ণ জাতির ইতিহাস। পাশাপাশি পৃথিবীতে যেখানে যতো জাদুবাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে বা হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইতিহাস একটি বিশিষ্ট ভূমিকা নেবে ।
    লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপট থেকে জন্ম নিয়েছিল জাদুবাস্তবতা, বাংলা কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবের প্রবেশ কবে, কখন, কিভাবে ঘটল তা ঠিক নির্দিষ্ট করে বলা যায় না, যেমন বলা যায় না লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রেও। স্পেনীয় ও পরে লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে অকথ্য অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বহুকাল ধরেই প্রতিবাদের পন্হা খুঁজছে মানুষ । মার্কেস তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সময়ে বলেন, জাদুবাস্তবতা হল ‘exaggerated proportion of reality’. তিনি জাদুবাস্তবতার ব্যাখ্যায় নোবেলপ্রাপ্তির দিন বলেছিলেন :
    “লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয় অঞ্চলের মানুষদের জীবনে এই জাদুবাস্তবতা কোনো আরোপিত ব্যাপার নয় । এটা তাদের সঙ্গেই বাঁচে সব সময় । প্রতি মুহূর্তে নির্ধারিত করে দেয় অসংখ্য মৃত্যুকেও।” ( গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও একশো বছরের নিঃসঙ্গতা, সুচেতন মিত্র, মহাযান সাহিত্যপত্র, ৯ম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১০, পৃষ্ঠা ৩৪ ) ।
    জাদুবাস্তবতা আসলে একটি ধারণা, যার আত্মা ঘোর বাস্তব এবং শরীর কল্পনা ও উপকথা দিয়ে গড়া । দীর্ঘদিনের কিছু অবদমিত লাঞ্ছনা, অত্যাচারের ক্ষত ব্যুমেরাং করে শাসকের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি জাদুবাস্তব রচনাধারার মধ্যে রয়েছে ।
    প্রায় দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের পর ভারতবর্ষের অলিগলিতে যে কলোনিগুলি ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ বহন করে চলেছে, জিবন সেখানে থমকে দাঁড়ায় । দুশো বছরের শাসনের প্রভাব প্রায় হাজার বছর ধরে অবদমন করবে ভারতীয় চিন্তা চেতনাকে । যুদ্ধপরবর্তী সময় থেকেই ভারতীয় যুবসমাজের উপর পরিচয়হীনতার যে অভিশাপ নেমে আসে, তাতে জেরবার হয়ে শিক্ষিত যুবকের দল শুরু করেন নানা সাহিত্য আন্দোলন । এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের তরুণ সম্প্রদায়ের কয়েকটি আন্দোলন তাঁদের পথ দেখায় । বিহার ও বাঙলার শিক্ষিত যুবকদের সৃষ্ট এমনই একটি সাহিত্যনির্ভর ও ইস্তাহার নির্ভর বহুবিতর্কিত আন্দোলন ‘হাংরি জেনারেশন এর বহু লেখায় জাদুবাস্তবের বিমূর্তরূপ ধরা পড়ে ।
    ‘অতলান্তিক’ সাহিত্যপত্র থেকে হাংরির সূত্রপাতের ইতিহাস কিছুটা উদ্ধৃত করব : “১৯৬১ সনে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র বাইশ বছরের বাঙালি যুবক মলয় রায়চৌধুরী কবি চসারের ‘ভয়ানক কবিতা টুকরো In the sowre hungry tyme’ পড়ে hungry শব্দের দ্যোতনা ও অভিঘাতে অনুরূপ উত্তেজিত হন ।”( নন্দলাল শর্মা, হাংরি জেনারেশন সংখ্যা, ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১৮ ) ।
    ঢেকে রাখা ‘সভ্য’ সমাজের ছ্যুঁৎমার্গ ও নিম্ন অর্থনৈতিক সঙ্গতির মানুষকে তাদের না-করা অপরাধের শাস্তি দিতে আগ্রহী হিন্দু সমাজের প্রচলিত পন্হার প্রতিস্পর্ধায় মাথা তোলে হাংরি আন্দোলন । যাঁরা দিতে পারেননি নিরাপদ ভবিষ্যত, দেহ মনের সুস্হ গঠনের সাহায্য করতে পারেননি, তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্খা সুখ স্বপ্ন যৌনতা কোনো কিছুর ভারই যে সমাজ বা যে পরিবার নেয় না, সেই সমাজের দেওয়া রুক্ষ ও ক্রুর নিয়মের ভণ্ডামিকে দুহাত দিয়ে ছিঁড়তে চেয়েছেন এই তুণরা । মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়া এই আন্দোলনে অরুণেশ ঘোষ, দেবী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, সুবো আচার্য, পপদীপ চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ প্রমুখ প্রতিভাবান কবি-লেকক যুক্ত থেকেছেন নানা সময়ে ।
    এই সন্দর্ভের মূল আলোচ্য মলয় রায়চৌধুরীর ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’, ‘নামগন্ধ’ একত্রে ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’, ‘এই অধম ওই অধম’ ও ‘নখদন্ত উপন্যাস ।
    ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসটি গুরুচণ্ডালী প্রকাশনার চটি সিরিজের মাত্র ৯৬ পাতার উপন্যাস । এই স্বল্প পরিসরেই উপন্যাসটি যেন সংস্কারের সাজানো সাজানো পাঁচিলে একটি ইঁট সরিয়ে নেওয়া । মিশ্র সংস্কৃতি ও সংকর সংস্কৃতির ফাঁকে পড়ে বাঙালি সমাজে প্রচ্ছন্নভাবে প্রবাহিত হয়েছে পঙ্কিলতা, এসেছে স্বৈরাচারিতা । উপন্যাসের শুরুতে যে দুজনের উল্লেখ পাই, তারা আধুনিকতার শীর্ষে বসবাসকারী দুজন বাঙালি যুবক-যুবত, বাংলা পড়তে-লিখতে রীতিমত অনভ্যস্ত । ব্যানার্জি বংশের মেয়ে ইন্দিরার তেইশ বছর বয়সে একটি গুজরাতি বিয়েও সংলগ্ন ডিভোর্স দুইই সারা হয়ে গেছে । সুবীর দত্তও শিক্ষিত, ভালো চাকুরে যুবক খ একটি ফিরে পাওয়া ডায়েরির সূত্রে উভয়ের আলাপ, কিন্তু সেই ডায়রি আবিষ্কার করবে তাদেরই পূর্বপুরুষের শরীরী উদ্দামতার পাশবিক কাইনি । পুরুষত্বহীন স্বামীর হাতে মার খাওয়া কেকা একের পর এক পুরুষদের ব্যবহার করে পৌঁছে যায় এমন এক উপলব্ধিতে যেখানে শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকা যায় । অন্য দিকে শিশির বা অতুলরা মজেছে শ্বেতাঙ্গিনীদের শরীরী নেশায় । নেপালের, বেনারসের পথে ঘাটে পাওয়া সেই সব মুক্ত বিহঙ্গ-বিহঙ্গীর দল জীবনের নামে জয়ধ্বজা উড়িয়েছিল । মলয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘রাহুকেতু’-তে লিখেছেন
    “ষাটের দশকের কথা তো । সে সময়ে ফান ফুড ফ্রিডাম ফ্রিক আউট আর ফাকিং-এর উদ্দেশ্যে দলে দলে তরুণ তরুণী আমেরিকা ইউরোপ এমনকি জাপান থেকেও নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন ; লণ্ডন বা আমস্টারডাম হয়ে বাসে, ট্রেনে হিচহাইক করে তুরস্ক ইরান আফগানিস্তান পাকিস্তান ভারত হয়ে শেষ গন্তব্য নেপাল । “ ( পৃষ্ঠা ৬২ )
    শিশিরের কাছেও শরীর ও শারীরীক উথ্থান-পতন ভিন্ন কোনো মানসিক অনুভূতির প্রয়োজন নেই । অতুলও নারী থেকে নারীতে যাতায়াত করে ও শেষে ডিপ্রেশনের শিকার হয় । এই বিস্তীর্ণ পটভূমি ও এতগুলি চরিত্র আসলে একটি সময়ের সাক্ষী । রাবীন্দ্রিক বাণী তাই ‘এঁটোকাঁটা’য় পর্যবসিত হয় । বলিউডি ছবির অনুকরণে কেকার সম্ভোগকলা, শিশিরের লেখা দিনলিপির জড়তাময় ভাষা আরেকবার বিদ্রুপের ব্যুমেরাং ছুঁড়ে দেয় শ্লীল বাংলা সংস্কৃতির দিকে । আসলে সুস্হ জীবন প্রসবে অক্ষম এই মেকি শ্লীল সমাজের বিদ্রূপভারই মলয়ের জাদুবাস্তবতার মূল উপাদান ।

    ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ ও ‘এই অধম ওই অধম’
    মার্কেস জাদুবাস্তব আলোচনায় বলেছেন, লাঞ্ছনার ইতিহারে পরিবারের ভূমিকা থাকে । জাদুবাস্তবের একটি উপাদান মাকফেস ও মলয়ের জীবনে সমান্তরাল ঘটেছে । তা হল, উভয়েই নিজের বয়স্কা আত্মীয়ার কাছে অলৌকিক গল্প বলার পাঠ পেয়েছেন । মার্কেস একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন,
    “তিনি ( মার্কেসের ঠাকুমা ) সেইসব জিনিস বলতেন যেগুলোকে অতিপ্রাকৃত আর আজগুবি শোনাত, কিন্তু তিনি বলতেন সেগুলো একেবারে স্বাভাবিকভাবে ।” ( ‘দীর্ঘ সাক্ষাৎকার : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস’, পিটার এইচ স্টোন, বয়ান, ত্রৈমাসিক পত্রিকা, মার্কেস স্মরণ সংখ্যা, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, জুন ২০১৪ )
    মলয় যেমন বলেছেন, বড়ো জ্যাঠাইমার অসামান্য গল্পরচনার প্রতিভা:-
    “আমরা দালানে ওনাকে গিরে বসতুম, আর লন্ঠনের আলো কমিয়ে উনি নিয়ে যেতেন গল্পের দেশে ।...জেঠিমার গল্পের জগত ছিল অলৌকিক…” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা, পৃষ্ঠা ৪৫ )
    সস্তার জীবন যাপনের জন্য বিহারী ছোটোলোকদের পাড়ায় বসবাসকারী বালকের ন্যারেশন ভোজপুরি মগহি পরিচারকদের সান্নিধ্যে শেখা তুলসীদাসি দোহা, হতদরিদ্র প্রতিবেশীদের পোকামাকড়ের মতন জীবনযাপন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের নগ্নচিত্র দেখায় । সংকরায়িত পরিবেশে আত্মপরিচতি খোঁজা বয দুরূহ কাজ । তার ওপর যুক্ত হয় লৌকিক বিশ্বাস, তুক-তাক, আচার-বিচার ও যৌনতার নতুন সব অনুভূতি । মামাবাড়ির ভদ্র পরিবেশ আরো স্পষ্ট দেখায় পাটনার নিম্নমানের জীবনযাপনের গ্লানি । বালক মলয় শিখে যান :-
    “মামার বাড়ির কেউ কখনও পাটনায় যান না । আমরা তো ছোটোলোক।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা, পৃষ্ঠা ৫৯ )
    অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের পাশাপাশি বালক জেনেছিল মেজদা, অর্থাৎ বড়জ্যাঠার পালিত পুত্র আসলে তার ‘কেনা ভাই’ । ‘দেবতুল্য’ জ্যাঠামশাই এক পাঞ্জাবি বউয়ের কাছে দেড়শো টাকায় কেনা বাচ্চাটি আসলে জেঠামশাইয়ের অবৈধ সন্তান । যাকে ফিরে পুষ্যি নিয়ে ক্রমাগত স্লো পয়জনিং করেছেন জ্যাঠা-জ্যেঠিমা । পড়তে পড়তে মনে হয় ইমলিতলার কোনো বাস্তবিক ভৌগলিক অবস্হান না থাকলেও চলত । নাম-কা-ওয়াস্তে স্বাধীনতা পাওয়ার পর পুরো ভারতবর্ষই বোধহয় কমবেশি ইমলিতলা ছিল । শিক্ষাহীন, স্বাস্হ্যহীন, স্মৃতিহীন স্বাধীনতা উত্তরকালের ভারতবর্ষের চেহারা ছত্রে-ছত্রে বহন করে এই যুগ্ম উপন্যাস । উপন্যাসে অনেক জাদুর পাশাপাশি কিছু অসামান্য বাস্তব আছে । ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ গ্রামগুলির চেহারা এতদূর কদর্য ও অর্থনৈতিক অবস্হা এমন পঙ্গু হওয়ার জন্য ছিল দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা :-
    “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে, পুঁজি বানাবার কলকাঠি কব্জা করার ধান্দায় সাবেকি গ্রামের সমাজকে দুমড়ে মুচড়ে তার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছিল ইংরেজরা । ব্যাটারা মহা ঘোড়েল । যাবার সময় চাদ্দিকময় হেগে রেখে গেছে ।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা/এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ১১২ )
    এই বিষ্ঠা আসলে সেই স্মৃতিহীন মানব সমাজের দেহে মনে মাখামাখি হয়ে বিষাক্ত করে তোলে, দুর্গন্ধময় পঙ্কিল করে তোলে তাকে । ‘এই অধম ওই অধম’-এ পূর্ব কাহিনির নিরবচ্ছিন্নতা বজায় থাকে, শুধু যুক্ত হয় লেখকের স্মৃতিতে রয়ে যাওয়া সেই সব তুলসীদাসী পঙক্তিগুলি, যেগুলির সাথে জড়িয়ে রয়েছে লেখকের শৈশবস্মৃতি । ইমেল আদান-প্রদানে মলয় জানিয়েছিলেন :-
    “হিন্দি কোটেশানগুলো তুলসীদাস-এর রামচরিতমানস, কবির এবং রহিম-এর দোহা থেকে নেয়া । বাড়ির চাকরদের তো আমাদের বকুনি দেবার অধিকার ছিল না, তাই ওরা কোটেশানের মাধ্যমে উপদেশ দিত ; তারা নিরক্ষর হলেও, শৈশব থেকে শুনে-শুনে ওগুলো তাদের স্মৃতি থেকে উৎসারিত । বইটায় আমার ন্যারেটিভের সমান্তরাল এগিয়েছে ওদের ন্যারেটিভ।”
    ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, মেজদা বুড়ো অর্থাৎ পাড়ার বুঢ়ুয়া কেবলই রক্তমাংসের অস্তিত্ব নিয়ে নেই, তার অবয়ব আসলে রূপকায়িত করে পোস্টমডার্ন কলোনিয়ালিজমের সেই অপরিণত সময়কে, যাকে দাঁড়াতে হয়েছিল শত্রুপক্ষীয় স্বজন, লক্ষহীন ভবিষ্যৎ, প্রবৃত্তির নিষিদ্ধ লোভনীয় হাতছানির প্রতিস্পর্ধায় । ভোজপুরি যে মাকে তার পিতা সন্মান দেননি, সেই ক্ষোভ নিয়ে সে পিতার গোষ্ঠীবিরোধিতা করে ।
    “ভোজপুরি মগহিতে গালাগাল ছিল মেজদার নান্দনিক ঔদ্ধত্য । ভাষার আদরায় রদবদল করে জীবনে পরিবর্তনের সংকেত পাঠাতে চাইত।” ( এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ৯৭ )
    আসলে পাটনার ছোটোলোকপাড়ার অবস্হান বঙ্গসংস্কৃতির খণ্ডহরস্বরূপ । যার ঝুরঝুরে চুনসুরকি খসা অস্তিত্ব মানতে পারা সহজ নয় ।
    “জমিদারি বেনেদিয়ানার ধুলোবালি ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াতে চাইছিলুম আমরা ছোটোরা সবাই,....মেজদা ঝেড়ে ফেলতে চাইছিল অতীতত্বের ক্ষীণ রেশটুকু, যা ঘাপটি মেরেছিল আমাদের পারিবারিক ভাষার আদরায়।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা/এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ৯৫ )
    সাস্কৃতিক ধ্বসন ঠেকানোর উপায় নেই বলে গড়ে ওঠে প্রতিস্পর্ধা । হাতিয়ার করে জাদুবাস্তবকে । সাতজন বন্ধু মিলে একটা আইসক্রিম চেটে খাওয়া, নোংরা নর্দমা থেকে হাত দিয়ে বল তুলে নেওয়া, মৌর্যদের চৌর্যবৃত্তি এক বাস্তব, আর জেঠিমার গল্প, পুঁটির গল্প, ছোটোকাকিমার শাক্তবচন, সীতাদেবীর কুঁয়োয় ঝাঁপ, জাদুটোনা, ‘কালিদাসের কলম দিয়ে লেখা মেয়েমানুষ’, বিহারি পুলিশ অফিসারের মতন কেঁদো কুকুর...একের পর এক ছবি, যা দিয়ে গড়া হয় জাদু । এই সরস উপাখ্যান শেষ হয় একটি চাবুকের দ্বারা:-
    “জেঠিমা ছোড়দিকে বলছেন, ‘করুণার ঘর থেকে বুড়োর সমস্ত জিনিসপত্তর নিয়ায়...কবচ-কুণ্ডল সব, চিতার সঙ্গে ওগুলোও ছাই করে ফেলতে হবে । কোনো রেশ যেন না থাকে।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা/এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ১৪৪ )
    আমাদের পূর্বপুরুষরা আসলে এভাবেই মুছে দেবেন প্রমাণ । প্রতিবাদের, পপতিস্পর্ধার । আর তার বদলে আমরাও ছুঁড়ব ঠাট্টার ব্যুমেরাং । মলয় আসলে প্রতিনিইত্ব করলেন ক্রীড়ানক প্রজন্মের যাদের সুশীল সমাজ সর্বদা বিদ্রূপই করেছে । মলয়ের একটি অসামান্য কবিতা এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা আবশ্যক:-
    “আমার মাকে যেন বলবেন না”
    আমি কবিতা লিখি
    কি লজ্জার, না ?
    আমার বাবা কখনও স্কুলে পড়েননি
    কি লজ্জার, না ?
    আমার মা কখনও স্কুলে পড়েননি
    কি লজ্জার, না ?
    আমার ঠাকুর্দা বাংলা লিখতে পারতেন না
    কি লজ্জার, না ?
    আমার ঠাকুমা শুদ্ধ বাংলা বলতে পারতেন না
    কি লজ্জার, না ?
    ………...।”
    এই লজ্জা তাঁর একলার নয় । আসলে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কারণ ভারতের উত্তরঔপনিবেশিক দশা । শাণিত প্রতিবাদের ধার উপন্যাসের নামকরণ থেকে শুরু করে শেষ বাক্যটি অবধি নানা রঙের জাদুয়ি বিস্তার দেখালো ।

    নখদন্ত
    ‘নখদন্ত’ মলয়ের আরেকটি অসামান্য পোস্টমডার্ন উপাখ্যান । এই নতুন ধরণের উপন্যাসে লেখকের প্রাত্যহিক দিনলিপি ও তাঁর নিজের লেখা কয়েকটি গল্পের প্লট ও ন্যারেটিভ পাশাপাশি চলে । মেইলে কথাবার্তায় মলয় জানিয়েছিলেন :-
    “নখদন্ত ন্যারেটিভটাকে আমি শুরু থেকে একটা অন্তর্ঘাতমূলক টেক্সট হিসাবে লিখতে চেয়েছিলুম।”
    রামায়ণের সপ্তকাণ্ডের আদলে সাপ্তাহিক দিনলিপিতে আধুনিক এক সংস্কৃতিময়, সৃজনশীল মানুষের বৈচিত্র্যময় অবসর জীবনের চিত্র পাওয়া যায় । পশ্চিমবঙ্গের দ্রুত পচনশীল সমাজের ভাগাড়ে রোজ পচতে থাকা মানবাত্মার তীক্ষ্ণ চিৎকার যেন তাঁর কলমে বরাবরই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে । ‘নখদন্তে’ পাই সেই সৃষ্টির পৃষ্ঠভূমি । নিজের কয়েকটি গল্পের উল্লেখ রেখেছেন মলয় এই দিনলিপির ফাঁকে । প্রথম ‘শেষ হাসি’ গল্পে কাংগাল চামারের ওপর অসহ্য অমানুষিক অত্যাচারের পরেও মুখের হাসিতে জাদুর ছোঁয়া বজায় রাখেন তিনি । চামড়া ভেদ করে বেরুনো ভাঙা পাঁজরের হাড়ের গোলাপি সাদা রঙ যেন সজোরে চপেটাঘাত করে কোমলতার সাথে গোলাপি অস্তিত্বকে । কন্সটেবল হত্যার জন্য বস্তিতে ‘হিন্দি ফিলিম’ হয় ।
    ‘চামার’ হয়ে ‘রাজপুত’কে হত্যার অপরাধে কাংগাল চামারকে ছিঁড়েখুঁড়ে হত্যা করে পুলিশ । ক্ষমতা ও অর্থ দখলের বাজারে সাইনবোর্ড আর টেবিল চেয়ার পেতে ট্রেড ইউনিয়নের ধামাধারীরা চটকলগুলিকে ভুতের আড্ডা বানিয়ে চলেছে । আর কাংগাল চামাররা আমারান্তা উরসুলার ( মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ ) মতো মৃত্যুকালেও মুখে সন্তুষ্ট হাসি ঝুলিয়ে রাখেন । উপেক্ষার, তামাশার হাসি । ‘শহিদ’ ও ‘জিরো নম্বর মানুষ’ একই পটভূমির ভিন্ন আঙ্গিকের কাইনি । দুটোতেই মলয় চটকল শ্রমিকের বেঁচে থাকার অলৌকিক লড়াই ও সহ্যশক্তির সাথে প্রশাসন তথা ক্ষমতালোভীদের অপার্থিব নিষ্ঠুরতার গল্প জাদুর মোড়কে পরিবেশন করলেন । ‘জিরো নম্বর মানুষ’ আবার মনে করায় আইডেনটিটি ক্রাইসিস । আত্মপরিচয়হীন মানুষ কেবলই ‘লাশ’ হয় । সে লাশের মৃত্যুর কারণ পাওয়া যাক আর না যাক, তার ধর্ম পাওয়া যায় । হিন্দু মুসলিম লাশেরা জায়গা বদলায় । চেনার উপায় শুধুই ‘নুনু’ । প্রতিবাদীতা সবই কাড়ে । সবশেষে কাড়ে পরিচয় । ‘খোসা ছাড়ানো নুনু ওয়ালা খালেদালি মণ্ডল লোপাট হয়ে যায় :-
    “খালেদালি মণ্দলের দেহও নেই, আইডেনটিটিও নেই । জিরো ? অ্যাঁ !” ( ‘নখদন্ত’ পৃষ্ঠা ৫৭ )
    মনে করায় মার্কেসের সেই ভয়াবহ স্মৃতি, যুদ্ধে গুলি খাওয়া এক ট্রেন শব স্রেফ লোপাট হয়ে গেল ।
    সমান্তরালে ‘ভাগ্যলিখনে হরফ দরকার নেই’ গল্পে শিক্ষিত বেকার যুবসম্প্রদায়ের কীটপতঙ্গের মতো অপমানের জীবন একটি বাস্তব । কিন্তু গান গেয়ে প্রতিবাদের ঐক্যবদ্ধ হাঁক পাড়ায় জাদু আছে । চাকরির ‘কুল্লে কুড়িটা’ পোস্টের জন্য অপেক্ষমাণ আগারোশো ক্যাণ্ডিডেট চূড়ান্ত ভণ্ডামি ও বশৃঙ্খলার ধিক্কারে যে সমবেত হুমহুনা বোল ধরে, তার সাথে লণ্ডন বা জার্মানির গণহত্যার জন্য সারিবদ্ধ বন্দীর গানে মিল আছে । অসউইৎজ এর চেম্বারে ঢোকার আগেও কি এভাবেই গলা মেলাতে চাইতেন না শিকলবাঁধা বন্দিরা ?
    ‘অট্টহাস্য বিনির্মাণ’ গল্পটির আগা গোড়াই বিদ্রূপের তীক্ষ্ণতায় জর্জর । পতাকা বহুবার টেস্ট করেই রাখা হয় উত্তোলনের আগে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর টানে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকার ভূমিতে পতন আসলে একটি অসামান্য বিদ্রূপাত্মক রূপক । প্রশাসন ও রাজনীতি, ভারতবর্ষকে যেখানে স্হাপন করল, তা আসলে নেতার পদযুগল । জাদু ও বাস্তবের খেলার অসামান্য শব্দশৈলী রীতিমত ঈর্ষনীয় :-
    “গরম-শেষের বুড়ো ঘাসেরা যৌনতাবর্ধক বৃষ্টিফোঁটার অপেক্ষায় । শালিকশিশুকে কেঁচো কিংবা পিঁপড়ে খুঁটতে শেখাচ্ছেন ওর মাম্মি-ড্যাডি ।...ওপারে গোটাকতক রুডিয়ার্ড কিপলিঙ টাইপের নেড়ি কুকুর।” ( ‘নখদন্ত’, হাওয়া৪৯, পৃষ্ঠা ৮০ )
    বস্তুত পোস্টমডার্ন ভারতবর্ষের প্রতিটি স্তরে যে পাঁক প্রবিষ্ট হয়েছে, তার থেকে নিস্তার পাওয়া অসম্ভব, তাই:-
    “বাঙালির জিম্মায় হাসাহাসি করা ছাড়া আর কিছু টিকে নেই।” ( ‘নখদন্ত’, হাওয়া৪৯, পৃষ্ঠা ৮১ )
    ‘নখদন্ত’র নোটগুলি সম্পর্কে মলয় তাঁর মেইলে জানিয়েছিলেন :-
    “নোটগুলো ইংরেজিতে এই জন্য যে ইংরেজরাই চটকলগুলো স্হাপন করেছিল এবং ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষার মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলুম তারা কেমনতর ধ্বংস করে দিয়ে গেছে --- সমাজে, সংস্কৃতিতে, ভাষায়, নৈতিকতায় ইত্যাদি । সাবভার্শনের কৌশল হিসাবেই নোটগুলো যেখানে সেখানে ঢোকানো --- যাতে নোটগুলোও রৈখিকতার সীমালঙ্ঘন করে যেতে পারে ।”
    তাঁর নোটগুলির অবস্হান ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে তাঁর এই বক্তব্য এতই সম্পূর্ণ ও স্পষ্ট যে আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না ।
    মানসিক চেতনার এই রূপকায়ন হল দীর্ঘ এক আত্মপ্রবঞ্চনার ফলাফল । মলব লিখেছেন :-
    “রাজনীতির সেল্ফকনট্যামিনেশন তো পশ্চিমবাংলায় দেখেই চলেছি । নিজেদের আদর্শের দ্বারা নিজেরাই কলুষিত হয়ে চলেছে রাজনীতি-করিয়েরা।”
    জবরদখল হতে হতে বাঙালি তার অস্তিত্ব হারিয়েছে, শুধু জমি নয়, সংস্কৃতিও বিক্রি করেছি আমরা । প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে পার্টি নির্বিশেষে সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা অগুনতি । আবিলতায় ঢেকেছে আসমুদ্রহিমাচল । মলয়ের এই সাহিত্যধারা সেই স্মৃতিহীন অস্তিত্বহীনতার ক্ষুদ্র এক প্রতিবিম্ব ।

    নামগন্ধ
    শেষ যে উপন্যাসটি আমার আলোচ্য, তা হল ‘নামগন্ধ’ । ঔপনিবেশিকতা ও উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গ যে কতদূর পচনের সীমালঙ্ঘন করেছিল, তার একটা অসামান্য দলিল এই উপন্যাস । যৌনতার এক ভিন্ন পরীক্ষামূলক সম্পর্কের পাশাপাশি উপন্যাসের প্লটিঙ-এ রয়েছে দৃঢ়তা ও রহস্য । ভবেশকারা আসলে সেই ‘মার্জিনাল মেন’, আঞ্চলিক দেবতা । যাঁদের ভোগ প্রস্তুত না করে কোনো গঠনমূলক কাজ করা সম্ভব নয় । দেশভাগের পর বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা পুনর্বাসন পান বা না পান, উদ্বাস্তু নেতাদের আখের গোছানো ছিল দৃষ্টিকটু রকমের । মলয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল এই পংক্তি :-
    “পথে পোড়ানো ট্রামের ছাই মেখে বাঙালির যে সৎসমাজ, ভবেশকা আজ তার অগুন্তি সন্তানদের একজন।”
    খুশিদি, যিশু, ভবেশকার এই ত্রিভূজের মাঝে জাল বিস্তার করেছে প্রাকৃতিক মায়াজালে ঘেরা নীরবতা, যৌনতার রহস্যময়তা ও বারব্রত-ঝাড়ফুঁকের কাহিনি । ব্যুমেরাং করে ছুঁড়ে দেওয়া গোপন প্রেম, দেহপুজা । যেখানে যত দারিদ্র, অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, সেখানে জ্যোতিষের কদর, ওঝার আদর তত বেশি । অর্থপিশাচ দাঙ্গাবাজ ভবেশকা তাই ঝাড়ফুঁকের ওঝা হয় :-
    “অসীম তালোধি, ওর মেয়ের ভুতের ব্যারাম আচে । দাদা ওষুধ পথ্যি করে । রোগবালাই ঝাড়ার জন্যে রাসপা ত্রিফলা হিং রসুন শুঁঠ নিশিন্দে কুচিলা বেড়ালা হত্তুকি চিতেমূল সব বাটছিলুম একসঙ্গে ।”
    ভুত ঝাড়ার মন্ত্রের সাথে মিলে মিশে যায় প্রণয় নিবেদনের মন্ত্র । খুশিদিকে এক অদ্ভুত স্হবিরতার মধ্যে আটকে রাখতে পেরে ভবেশকা পায় অধিগ্রহণের আনন্দ । কিন্তু শাপভ্রষ্টা নারীর মতো খুশিদি চায় পূজা, বন্দনা, আরাধনা, তৃপ্ত হতে চায় পুরুষের মুগ্ধতা গায়ে মেখে । ভবেশকা খুশিদিকে ভোগ করেছে কিনা বা না করলেও তা কেন করেনি তার উল্লেখ লেখক করেননি । পোস্টমডার্ন তৃতীয় বিশ্বের গ্রামের চেহারা ডায়াস্পোরিক সমাজের ভণ্ডামির প্রতিস্পর্ধী হয় । শাসন ও হুমকির ভয়ে জড়সড় গ্রামীণ সমাজের প্রতিস্পর্ধায় মাথা তোলে যিশু ও খুশিদির শরীর পূজাময় প্রেম । গার্সিয়া ‘মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর’-এ সেই শেষ প্রজন্ম আরোলোয়ানো ও আমারান্তা উরসুলার মিলনের মতো অলৌকিক এই প্রেম । স্বার্থপরের জিইয়ে রাখা অভাবে ও শোষণে জর্জর বঙ্গভূমির ছিবড়ে হয়েছে কল্পপ্রেমের জ্বালানি ।
    “ওঃ মলয়
    কলকাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
    কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কি করব বুঝতে পারছি না
    আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
    আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
    আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি।”
    ( ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, ‘অতলান্তিক’ হাংরি জেনারেশন সংখ্যা, ৬ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৪০ )
    মলয়ের সেই বিখ্যাত কবিতার এই পংক্তিগুলি চিৎকার করে সাক্ষ্য দেয় সেই অস্তিত্বহীন শিকড়হীন সময় ও সমাজের ক্ষুধাতাড়িত যুবসমাজের, যাদের অনুভব অনুভূতির কোনো দায় দায়িত্ব পূর্বপুরুষ বা অভিভাবকরা নেন নি । তাঁদের সেই ক্ষুধার তৃপ্তিতে তাঁরা সাহিত্যের কানাগলি অবধি সন্ধান করেছেন, কিন্তু বাংলা বাজারের শ্লীল সাহিত্যের সাথে, খাপ খাওয়াতে না পেরে সৃষ্টি করেছেন চাবুকের মতো এই সাহিত্যধারার, যা বহন করেছে জাদুবাস্তবের আগাম বীজ । বাংলা সাইত্যের লেখক-পাঠক কেউই খুব সহজে মান্যতা দিতে পারেননি হাংরিদের। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিস্ময়াদীর্ণ হয়ে বলেছিলেন এই সাহিত্য কি পিতা মাতার সামনে পাঠ করতে পারবেন এই লেখকরা ? পিতা মাতা গুরুজন অভিভাবকের নীতি আদর্শের রক্ষণশীলতার আড়ালে নিজেরা ফুরিয়ে যেতে চাননি এই তরুণরা । ডাডাইজমের প্রবর্তক ত্রিস্তান জঁরা যেমন বলেছিলেন, আমার আগে মানুষ আদৌ ছিল কিনা আমি জানতে চাই না, তেমনি মলয়, সমীর, বাসুদব, অরুনেশরা জানতে চাননি অতীতকে, যে অতীত তাঁদের সন্মুখীন করেছে এক ক্লেদাক্ত, নোংরা সমাজের সামনে । দিয়েছে কেবলই শৃঙ্খল ও পরিচয়হীনতা । প্রতিস্পর্ধায় কন্ঠ তুলতে তাঁরা স্বঘোষিত প্রতিলেখক ।
    হাংরিরা যে হেনস্তা হবেনই, তা পূর্বনির্ধারিত ছিল । কিন্তু সময় বলে দিচ্ছে প্রতিস্পর্ধার আগুন ছড়াবেই । জাদুবাস্তবের প্রয়োজন আজ সমগ্র পৃথিবী অনুভব করছে । আমার তৃতীয় বিশ্বের পূর্বসূরীদের এই বিচক্ষণতাকে সন্মান জানানোই এই সন্দর্ভের মূল উদ্দেশ্য ।
    ( পলাশ খাটুয়া সম্পাদিত ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম ও বাংলা সাহিত্য’, ২০১৬, বই থেকে নেয়া হয়েছে )
  • Bahata Angshumali | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২৩541354
  • বহতা অংশুমালী
    মলয় রায়চৌধুরীর ডিটেকটিভ উপন্যাস : অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস
    উপন্যাস এর নামটা আমাকে বুঝতেই দেয় নি ভিতরের খনিজের উপস্থিতি । প্রচ্ছদে যুবতীর ছবি দেখে মনে হয় কোনো রগরগে রবিবাসরীয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছি। বুঝি নি এই অতি সংক্ষিপ্ত উপন্যাসের প্রতিটি লাইন এক বিরল জীবনদর্শনের মুখোমুখি করে দেবে আমাকে । এক অন্যধরণের সত্যানুসন্ধান , সাধারণ খুনের মামলার প্রেক্ষাপটে যা এক যুবক যুবতীর উৎকেন্দ্রিক আরণ্যক ভালোবাসা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে। তেলেগুতে এনক্রিপ্টেড, বাংলায় লেখা , সিডিতে সংরক্ষিত ডায়রিলেখনে বন্দী হয়ে থাকে সেই জীবনকাহিনী । আর কংকাল প্রেমিক এর জীবন ও মৃত্যু রহস্য উন্মোচিত হয় নোংরা পরীর হাতে।
    নোংরা পরী , ববিটাইজিং ভীতির কার্যকারিতা আর সারল্যের সংজ্ঞা
    নোংরা পরী বেরিয়ে এসেছে Edith Wharton এর বর্ণিত The Age of Innocence এর পর্দা কেটে । ইন্সপেক্টর রিমা খান অপরাধীর চোখের গতির ভিত্তিতে ক্রিমিনাল ঠ্যাঙায় । যে ক্রিমিনালরা জেরা করার সময়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের দু-ডিগ্রি , যারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের থার্ড ডিগ্রি । বুকের দিকে তাকিয়ে থাকারা নাকি তুলনামূলক ভাবে স্বাভাবিক, রিমা খানের ভাষায় তারা প্রকৃতির মাদার-সান-ইন্সটিংক্ট মেনে চলে। তাদের ঠেঙিয়ে কথা আদায় করে না , সাবইন্সপেক্টারের ওপর ছেড়ে দেয় ।
    রিমা খানকে উপন্যাসের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নাম দিয়েছে "নোংরা পরি" । নোংরা- কারণ সে সিমেন-দি-বভার সেকেণ্ড-সেক্স হতে রাজী নয়। সে আদ্যোপান্ত পুলিশ , প্রফেশনাল সমস্ত অর্থে , এমনকি ছুটকো ঘুষ নেবার ক্ষেত্রেও । সে দুর্দান্ত , দুঁদে । তার ভয়ে তার অঞ্চলের ক্রিমিনালরা লোক্যালিটি বদলে ফেলে ।
    বেটি ফ্রিড্যান যে ফেমিনিন-মিস্টিক কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তা এখনো আজকের সমাজেও পৃথিবী জুড়ে বর্তমান । এই নারীত্বের রহস্য শতকের পর শতক কখনো চীনে মেয়েদের পা জুতোয় ঢুকিয়ে ছোটো করতে বাধ্য করে , আফ্রিকার উপজাতির মেয়েদের মরাল গ্রীবাকে দীর্ঘায়িত করতে ধাতব বালায় বালায় বরবাদ করে দেয় ঘাড়ের মাথাকে ধরে রাখার কার্যকারীতাটুকু। এই নারীত্বের সন্ধানে ইউরোপের শিক্ষিতা মহিলা প্রেমপত্রে বানান ভুল করে, পদার্থবিদ্যার ডিগ্রি না নিয়ে পড়তে চায় সুললিত আর্টস।
    রিমা খানের মধ্যে সেই সারল্যটুকু নেই , সভ্যতা যে সারল্য শেখায় মেয়েদের, কাঁচের-পাথরবাটির মতো । যে শিক্ষিত সারল্যে মেয়েরা দুই বাচ্চার মা হয়ে গিয়েও সেক্সটকের অধিকার পায় না, বলে "ইস ছি ছি ছি", আজকের জমানাতেও । রিমা খান বিন্দাস গালিগালাজ করে। রিমা আবিষ্কার করে ফেলেছে যে ববিটাইজ করার ভয় দেখালে আবালবৃদ্ধ-ক্রিমিনাল খুব আকুল হয়ে পড়ে । তাতে অরগ্যাজম হয় রিমা খানের । এখন যে যুগ এ জিন্স এর সঙ্গে এক-হাত লাঠি-চুড়ি পরে মডার্ন ফেমিনিন ঘুরে বেড়ায় , স্ট্রিপটিজ দেখে আবার সন্তোষীমা-ও করে , সেখানে এই ডিলডো প্রেমী পুলিস অফিসারটি নোংরাও বটে পরীও বটে। তাকে কোথাও প্লেস করা যায় না, কোনো গ্রাফ এ ফেলা যায় না ! তার উলঙ্গ সত্ত্বায় কোনো কালো-দস্তানা-মোজা পরা লজ্জার ভেজাল ভঙ্গিমাও নেই । তাই সে মানুষী নয়। মানুষের ভোগ্যাও নয় হয়তো । বাঘিনী বাঘের জন্যে ভার্জিনিটি-টুকু বাঁচিয়ে রেখে ছিল । তা চারদিকে তো শুধুই ছাগল গবাদি পশু তার । তাই কুমারীত্ব ঘোচেনি কোনোদিন । এক ব্যতিক্রম কংকাল প্রেমিক ।
    যে কংকাল সে শুধু প্রেমিক
    প্রেম কয়প্রকারের হয়ে থাকে ? বহু প্রকারের হয়ে থাকে প্রেম। মেয়ে মাকড়শার সামনে পুরুষ মাকড়শার সুইসাইডাল প্রেম, মক্ষীরাণীর সামনে খুদে মৌমাছি শ্রমিকের প্রেম , রেপিস্ট হাঁসের প্রতি হংসিনীর প্রেম, ডলফিনের হরণ বা অপহরণ মূলক প্রেম , সতী নারীর পতিপ্রেম , বড়োলোকের বেশ্যাপ্রেম এবং সমান্তরাল ভাবে সন্তানের মায়ের প্রতি প্রেম এমন অনেক রকমের ।
    আমাদের কংকাল , যিনি কিনা ইন্সপেক্টর রিমা খানের আবার চাকরি ফিরে পাবার পাসপোর্ট, তিনি ছিলেন গণিতবিদ । এখানে মলয় রায়চৌধুরী বোধ হয় গণিতের অবতারণা করেছেন কুয়াসাহীন শুদ্ধচিন্তার প্রতীক হিসেবে। নিরঞ্জন, ওরফে কঙ্কাল , বুঝে গিয়েছিলেন তিনি বহুগামী । তাই কোন মহিলাকে এবং নিজেকে সমস্যা না দিতে চেয়ে , বিয়ে টিয়ে না করে , শুদ্ধ গণিত ও শুদ্ধ যৌনতার চর্চা করেছেন প্রেমে পড়ার আগে অব্দি। মলয় রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন তাঁর দুরকম প্রেম ।
    নিম্নগামী প্রেমটি (মস্তিষ্ক থেকে শীষ্ণ হয়ে এসে হৃদয়ে যা ইকুইলিব্রিয়াম পেলো , মাসিকের আবর্তনে মাপলো সময় )
    একজন জীবন খুঁজতে পালিয়েছিল , অন্যজন গিয়েছিল শুধু পলায়নপরাকে দেখে । মায়া পাল পুরোদস্তুর আধুনিক যুবতী , যিনি কুড়ুমুড়ে ইংরেজী বলতে বলতে অনায়াসে উচ্চপদের চাকরি পেতে পারেন , তিনি সুপুরুষ গণিতবিদের হাত ধরে বললেন "চলুন পালাই" । আর কামুক বিশ্বামিত্র ও তাঁর সঙ্গিনী চললেন অরূপের সন্ধানে, অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যারাইটস খনি অঞ্চলে । তাঁদের অতিপ্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃতিক প্রেম সেই অরণ্যে যাপিত হয়। অতিপ্রাকৃতিক কারণ মলয় রায়চৌধুরী এখানে খুঁজতে চেয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবী ভাবে যাপিত জীবনের দিকটি । বাছুরকে দুধ থেকে বঞ্চিত না করে, মুরগীর ছাল ছাড়িয়ে না নিয়ে, ভেড়ার লোম কেটে না নিয়ে বাঁচার পদ্ধতি । মায়ার এনভায়রনমেণ্টালিজম, জীবপ্রেম ।
    মলয় রায়চৌধুরী এখানে মনে করিয়ে দেন আমাদের ভুলে যাওয়া নারী পুরুষের প্রেমের রূপটিও । এখানে এক মানুষীর গায়ের গন্ধটি প্রেমিক চেনেন । প্রেমিক প্রেমিকাকে আলিঙ্গন করতে থাকেন মনের তাপে, আর রোজ আলিঙ্গন করতে করতে বুঝতে পারেন তাপের তারতম্য , ডিম্বাণুর আবির্ভাব। তাঁরা প্রেমটুকু চেয়েছিলেন , বীজটুকু নয়। তাই নিরোধ প্রক্রিয়া , অদ্ভুত আত্মনিয়ন্ত্রণ । মায়া নিরঞ্জনকে সেই প্রেম শেখান যাতে শরীর বড় হয়েও ওঠে না অযথা , ছোটও হয় না। যতটুকু আসে সহজে আসে। এই প্রথম নিরঞ্জন কোনো নারীর আলিঙ্গনে উত্তেজিত না হয়ে শান্ত হন।
    এখানে খুব সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে দুজন মানুষের একে অন্যকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার আনন্দ। এখানে নিরঞ্জন ঘড়ির অভাবে মায়ার মাসিক বা ঋতূস্রাব এর দিন গুলিকে গাছের গুঁড়িতে খোদাই করে রাখেন । আর হিসেব রাখেন দিন মাস বছরের । "Metaformic theorists also discuss how cultures, like the Romans and Gaelic used the same words for menstruation and the keeping of time, while the Mayan calendar was directly influenced by women's menstrual cycles."(উইকিপিডিয়া থেকে উদ্ধৃত) উইকিপিডিয়া আর গুগল আমাদের বলে দেবে , মহাজাগতিক ক্যালেণ্ডারটি অনেক ক্ষেত্রেই কিভাবে প্রাচীন কালে নারীর শরীরের ঋতূচক্রের দিকে তাকিয়ে বানানো হয়েছিল । কখনো উনত্রিশ কখনো ত্রিশ দিনের বিরতিতে।
    এই প্রেমে এক মানুষী বলেন আমি সবটুকু দেব, আর পুরুষটি বলেন আমি সবটুকু নেব । আর ঋতূস্রাবের পরে প্রেমিক ধুইয়ে দেন পরম আদরে প্রেমিকার রসস্থল , আরণ্যক দিনে ।
    ঊর্ধ্বগামী ভালোবাসা (সখীর জন্যে বীজ শুয়ে আছে বরফে)
    শরীরের ভালোবাসাকে আমরা মাঝে মাঝেই একটু নিম্নমানের বলি, পর্দা তুলে দিই । "রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়" । যেন কামগন্ধ খারাপ বস্তু । যেন আমাদের সব্বার উৎস্য লজ্জার । এই ক্রিশ্চান ওরিজিন্যাল-সিন এর পাপবোধ যা আমাদের উপরে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে , যে পাপবোধ থেকে আজ বহু মেয়ের অঙ্গ কেটে দেওয়া হয় যাতে তারা "শয়তানি আনন্দ" উপভোগ না করে শুধু সন্তান প্রসবের যন্ত্র হিসেবে নিজেদের বহন করতে পারে, সেখানে মিলি একদমকা খোলা হাওয়া । মিলি কিশোর আনাড়ি নিরঞ্জন কে "ভালোবাসতে" শেখায় । তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজেদের শরীর নিয়ে খেলে , জানতে পারে যান্ত্রিক ভঙ্গীতেই বিভিন্ন আনন্দের উৎস্যমুখ । সে তো সেতার বাজাবার আগে টুংটাং টুকু না করলেই নয়।
    মিলি ভালোবেসেছিল কংকালকে। নিরঞ্জন ভালোবাসেননি সেই অর্থে। তিনি তখন-ও পুরুষ নন। বৃন্দাবনবিলাসী কিশোর , যে পালিয়ে যাবে , পালিয়ে গেছে। কিন্তু মিলি বিয়ে করেন নি । আর নিরঞ্জনের সন্তান পাওয়ার জন্যে জোরাজুরিও করেছেন বহু বছর পরে দেখা হলে ।
    নিরঞ্জন ভালোবেসেছেন মায়াকে । কিন্তু মিলির জন্যে মৃত্যুর আগে রেখে গেছিলেন শুক্র, ডাক্তারের কাছে ।
    মিলি সন্তান চেয়েছিল, মায়া চায়নি । এখানে শিষ্ণ থেকে উঠে গেছে ভালোবাসা হার্ট এ । কি মন্ত্রে কে জানে।
    এক্ষেত্রে মলয় রায়চৌধুরীর একটি ইণ্টারভিউ মনে পড়ে গেল Alexander Jorgensen কে দেওয়া। " Alex: If you could walk a mile in whatever circumstance, where would you choose to do it ?
    Malay : I would go to the bank of river Ganges, at the place where I had kissed my Nepali classmate Bhuvanmohini Rana. My first and memorable kiss. I do not know where she is now. Must have become old or might have died ; she was two years older than me. I would sit at the same spot at the same time of autumn evening to revisit her tenderness." । আমার যেন মনে হয় ভুবনমোহিনী কোথাও মিলি , তার সমস্ত কোমলতা নিয়ে, যেখানে নিরঞ্জনের কৈশোর আটকে আছে।
    মায়ার সত্যি নিরঞ্জনের সত্যি , মায়ার জীবনদর্শন
    কাহিনীটি তো ডিটেকটিভকে নিয়ে। সত্যানুসন্ধান ! Akira Kurosawa র Rashomon যেমন দেখিয়ে দেয়, বিষয়গত তথ্য আর বিষয়ীগত সত্য এক নয় , প্রেমিক নিরঞ্জন ও প্রেমিকা মায়ার সত্যিও আলাদা।
    মায়া আধুনিক , কিন্তু পুনরাধুনিক। তিনি জানতে চেয়েছেন জীবনের যাপনগত সত্যটা । মানুষ ঠিক কোন আঙ্গিকে সভ্য , জীবহত্যার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবীতার মাধ্যমে বাঁচা যায় কিনা, তাই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই দুধের শিশুকে ছেড়ে, স্বামীর ও সমাজের দেওয়া অসহিষ্ণুতা ও অপমান থেকে পালিয়ে যেতে , তিনি "খপ করে" নিরঞ্জনএর হাত ধরে বলেছিলেন "চলুন পালাই " ।
    “No, it is impossible; it is impossible to convey the life-sensation of any given epoch of one’s existence--that which makes its truth, its meaning--its subtle and penetrating essence. It is impossible. We live, as we dream--alone.” -- Joseph Conrad এই জাতীয় উক্তি কে মেনে নিতে পারেননি ইংরাজির ছাত্রী মায়া পাল। নিরঞ্জন লিখেছেন , "সে আমাকে টমাস হবস, জোসেফ কনরাড, অ্যান্টনি বারজেস, উইলিয়াম গোলডিং আরো কারা কারা যেন, প্রতিটি নাম মনেও নেই এতদিন পর , এনাদের লেখালিখির কথা শোনাতো । তার জীবনের অতীতসূত্র কেবল এই সাহিত্যদর্শনকে ঘৃণা । তার অতীত সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানি না, সে বলতে চায়নি । বলত ওনারা জীবনের ভুল ব্যাখ্যা করে গেছেন । ওনারা নাকি বলে গেছেন একজন মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত, সে একাকী, কেউ নেই তার, যত বৈভব থাক না কেন সে প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র , পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল, জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট ও বর্বর । সে বলত, জীবনের এই আশাহীন দৃষ্টিকোণ অসত্য । "
    কিন্তু নিরঞ্জন এর সত্য আলাদা। তিনি মূলতঃ প্রেমিক । তিনি নিজেকে দেখেন এইভাবে -"মায়ার পাশে বসে একই ভাবনা ঘুরছিল আমার মগজে, যা বহুকাল থেকে বাসা বেঁধে আছে । তা এই যে, আমি একজন কুকুর । যে মালকিনির হাতে পড়েছি, সে যেরকম চেয়েছে, যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছি : প্রেমের কুকুর, কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর , পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, অনধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই আছে । থাকবে । এখন টাইপ করতে বসেও জানি, লেজটা অমনই রয়েছে ।" এই আকাশমুখী লেজ এই গণিতবিদের জীবনচেতনা ।
    নিরঞ্জনের জীবনচেতনার অন্য একটি দিক দেখা যায় , তাঁর চেতনায় "পবিত্র" শব্দটির অভিঘাতে । নিরঞ্জন লিখছেন - "আমার দিকে না তাকিয়েই মায়া বলেছিল, আমরা সারা জীবন নিজেদের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞের পবিত্র গভীরতায় রাখব । তুমি-তুমি ওগো-হ্যাঁগোর ছেঁদো নোংরা রুটিনে বাঁধা পড়ব না। বলেছিলুম, পবিত্র ? এই ধরণের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না প্লিজ । "
    নিরঞ্জন এক জমির মতন পড়ে থাকেন সমস্ত জীবন । নানান মেয়ে , মহিলা তাঁর উপর দিয়ে বয়ে যান , তাঁকে উর্বর করেন , তাঁকে ভেঙ্গে দেন । তাঁর ল্যাণ্ডস্কেপ পালটে দেন। এভাবেই মানবজমিনের চাষ করে গেছেন নিরঞ্জন । শেষ দিন অবধি। তিনি কোনো মহিলা কে "ডিমিন" করেন নি কখনো । দেহ ব্যবসায়িনীর "গিগলিং" টুকুকেও নয়। "পৃথিবী নামের ছোট্টো দ্বীপটায়, নারী ছাড়া আমি একা, নিঃসঙ্গ, অন্তরীণ । জীবনে নারী নেই ভাবলেই মনে হয় মরে যাবো, মরে যাচ্ছি, মরে গেছি ; ফাঁকা, ফোঁপরা, খালি । জানতেই পারতুম না আহ্লাদ কি, আঘাত কি, বেদনা কি, হাহাকার কি । " - নিরঞ্জন এমনই ভাবেন, বলেন , বাঁচেন। এই নারীসঙ্গ ইচ্ছা সামগ্রিক শারীরীক কাম নয় একেবারে। তিনি শেষ বয়সেও ‘শেষনীর’ সঙ্গ চান উত্থানরহিত অবস্থায় । যেমন "অ্যালিস ইন দ্য ওয়াণ্ডার ল্যাণ্ড" এর লেখক লুই ক্যারল এর স্নেহের ডাকে খোকারা সুবিধে করে উঠতে পারতো না। তিনি খুকিদের বলতেন গল্প শুনতে আসতে। আর বলতেন ভাইদের ঘরে রেখে এসো । যে তার যে সুরে বাজে, সে তার সেই সুরেই বাজে । অন্যথা পচে যায় , যেমন আমরা পচে যাই অহরহ ।
    সত্যানুসন্ধান কি? ভিলেন কারা কারা ? কাঠগড়ার এপারে ওপারে ।
    ফেলুদা, ব্যোমকেশ , কাকাবাবু সন্তু এই সব্বার থেকে আলাদা নোংরা পরী , ডিটেকটিভ রিমা খান । ১) তিনি পুলিশ , সখের গোয়েন্দা নন ২) তিনি মহিলা, প্রথম , একমাত্র মহিলা সত্যানুসন্ধানী বাংলা উপন্যাসের । তিনি ক্ষমতাশালী, ইনফর্ম্যার কনস্টেবল ইত্যাদি প্রয়োগে সমর্থ । যদিও তিনি সাসপেণ্ডেড । ববিটাইজ-করার ভয় দেখাবার প্রক্রিয়ায় নোংরা ।
    রাষ্ট্রই ভিলেন নম্বর ওয়ান
    এই উপন্যাসে, প্রথম বাংলা উপন্যাসে আমরা দেখতে পেলাম অপরাধ জগতের ব্যক্তিনির্ভরতার ঊর্ধ্বে সিস্টেমটাকে । আমরা দেখতে পেলাম রাষ্ট্র কোথায় অপরাধী । কিভাবে তুরুপ উপজাতির মানুষদের উৎখাত করে ফেলে খনি-মাফিয়া খনির লোভে । কিভাবে ক্যাপিটালিজম এর , ব্যবসায়িক উদারনীতির , শিকার হয় অরণ্যের মানুষ । যাদের রাষ্ট্র কিচ্ছু দেয় না, যাদের "সমাজ" ব্যবস্থা , নীতি ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র স্বীকারই করে না , যাদের ভোটাধিকার নেই, পৌরসুবিধা নেই , তাদের কিভাবে অনায়াসে একটি মাত্র পুলিশ চৌকির অন্তর্গত করে ফেলে রাষ্ট্র। মায়া ও নিরঞ্জন যখন তুরুপ গোষ্ঠীর বাচ্চাদের শিক্ষিত করতে থাকেন , কিভাবে সেই মানবিক প্রচেষ্টাকে পুলিশ অবলীলায় বলে "উপজাতিদের পড়াশুনা শিখিয়ে তোমরা যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছিলে সে সংবাদ আছে আমাদের কাছে ।" এই ভারসাম্য ফেরত আসে , যখন সমস্ত আদিবাসী অরণ্য ছাড়া হয়ে খনি শ্রমিকে পরিণত হয়। কনজিউমার সোসাইটির প্রয়োজন তো সত্যই , কিন্তু আরণ্যক উপজাতির সত্যটুকুর কোনো দাম থাকে না রাষ্ট্রের চোখে । সবুজ নষ্ট হয়ে যায় । মাটিতে বড় বড় হাঁ করা গর্ত তৈরি হয়। কারণ খুঁড়েছে মাফিয়া, কোন বিবেকবান রাষ্ট্র নয় ।
    মায়ার "আচ্ছা চলি"র পিছনে রাষ্ট্র নামক ভিলেনের কি অবদান তা বোঝার জন্যে পড়ে দেখুন উপন্যাসটা
    ভিলেন নম্বর দুই
    বলব না। তাহলে আর কী পড়ে দেখবেন । কিন্তু রিমা বুঝতে পেরেছিলেন ভিলেন কে। কংকাল প্রেমিকের ঘাতক কে । আর সেই ভিলেন কে বানিয়েছিল মধ্যবিত্ত সমাজের হাশহাশ নীতি, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা । যারা ভালবাসা দেখতে পায় না। ভালবাসার অভাব দেখতে পায় না । পবিত্র বিবাহগ্রন্থির নীচে চেপে রাখতে চায় সব রকম অতৃপ্তির চিৎকার । আর গ্রন্থিমুক্ত হতে চাইলে আঘাত করে সেই মানুষটিকে সুপরিকল্পিত ভাবে।
    ভিলেনের স্মৃতিসৌধ
    মায়ার "আচ্ছা চলির" পরে , মায়ালিঙ্গার পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হবার পরে , তুরুপ প্রজাতির জঙ্গুলে মানুষই পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনে নিরঞ্জনকে। মায়া ছিলেন তাদের জন্য শিক্ষিকা , মাতৃরূপিণী , জীবন্ত দেবী , আম্মা। আর মায়াগারু সেই দেবীর জীবনের অঙ্গ । তুরুপ গোষ্ঠীর এই মানুষদের সমাজচেতনা আলাদা। তারা মায়া-নিরঞ্জনকে গ্রহণ করেছিল খুব সহজ ভাবে , বর্তমানে নির্ভর করে, তাদের অতীত না খুঁড়ে। তাঁদের চলে যাওয়ার পরে তারা কুঁড়ে ঘরটাকে মন্দিরের সম্মান দেয় । কোন বিগ্রহহীন মন্দির। কিন্তু মায়ার আকস্মিক প্রস্থানের জন্য দায়ী ক্ষমতা গোষ্ঠী , কুঁড়েটাকে ধর্মের দোকান বানিয়ে ফেলে অচিরেই । বহু পরে রিমা খান অকুস্থলে গিয়ে দেখতে পান, এক অদ্ভুত মূর্তি সহকারে মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে । সেখানে মায়া পাল-এর ভাবমূর্তি বেচে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে খনি-মাফিয়ার দল বেশ দু পয়সা আয়ও করে নিচ্ছে ।
    এভাবেই আমাদের দেশে সতী প্রথা থেকে শুরু করে অনার-কিলিং অব্দি বিভিন্ন ভাবে একটি মেয়ের সত্ত্বা ও অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর তাকে "ধার্মিক" প্রমাণ ক'রে , দেবী প্রমাণ ক'রে, তার ব্যক্তিসত্তা ছিনিয়ে নিয়ে সমাজ তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় নিজের মধ্যে ।
    যৌনতার অর্ধেক আকাশ ,যান্ত্রিক ও মানবিক অরগ্যাজম , অশ্লীল মলয় রায়চৌধুরী
    মায়া
    মলয় রায়চৌধুরী সেই অর্থে অশ্লীল যে অর্থে ডি এইচ লরেন্স বা গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ অশ্লীল ছিলেন । যখন 'লেডি চ্যাটার্লিস লাভার্স-এ কনির মনে হয় নারীকে তার নারীত্ব থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে আজকের পুরুষ আর সমাজ , বহু বায়বীয় কথার মধ্যে দিয়ে তার শরীরী রহস্য আর দেহোত্তীর্ণতা দুটোকেই নষ্ট করছে, তখন কংকাল প্রেমিক পরম যত্নে ধুইয়ে দেন প্রেমিকার অঙ্গ প্রেমিকার অনুজ্ঞায় , ঋতূস্রাবের পর । এই স্পর্শ আমাদের পরিচিত যৌনতার থেকে অনেক ঊর্ধ্বে । এখানে ভালোবাসা যে-কোনো ইজমকে অতিক্রম করেছে। লজ্জা ঘৃণা ভয় ত্যাগ করেছেন কৃষ্ণ এখানে , শুধু রাধা বা গোপিনীর দল নয় । এই ভালোবাসায় নিরঞ্জন নিষিক্ত হতে থাকেন মায়ার সঙ্গে , সভ্যতা-ছেঁকে পাওয়া সভ্যতায় ।
    মিলি
    মেয়েদের যৌনতাকে সমাজ সাধারণতঃ অশ্লীল মনে করে। এই উপন্যাস-এ লেখক সেই ঢেকে যাওয়া অর্ধেক আকাশকে টেনে নিয়ে এসেছেন অনেকখানি । নিরঞ্জনের কৈশোরে মিলি , তাদের খেলাধূলোয় কেবল কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা দেখায় না। সে আগে নিজে তৃপ্ত হয়ে নেয় নিরঞ্জনের মাধ্যমে । তারপর নিরঞ্জনকে নিয়ে যায় শিখরে । এই দেয়া নেয়ার সহজ হিসেবটুকু এই টেণ্ডারনেসের সঙ্গে আমি সচরাচর পাই নি কোন বাংলা উপন্যাসে । এই প্রসঙ্গের অবতারণা যখনই হয়েছে, কিছু বিকৃতির সঙ্গে করা হয়েছে । আবার লরেন্সের থেকে ভাবটি উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করে- স্পর্শ ছাড়া কিই বা টিকে থাকে , শেষ পর্যন্ত দেহে মনে অস্তিত্বের শিকড়ে ? যদি স্পর্শ তেমন স্পর্শ হয় ।
    রিমা খান
    RACHEL P. MAINES এর "The Technology of Orgasm "Hysteria," the Vibrator, and Women's Sexual Satisfaction" রচনা যেটি Johns Hopkins University Press থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, তার প্রথম পরিচ্ছেদের নাম হলো " THE JOB NOBODY WANTED " যে-কাজটি-কেউ-চায়নি । শতকের পর শতক মেয়েরা তাদের যৌন চেতনাকে ঢেকে রেখেছে , সেবামূলক ও প্রদান-ভিত্তিক মিলনের আড়ালে। তাই তার চেপে রাখা "হিস্টিরিয়া" টুকুকে কখনোই অনুরণনে পরিণত হতে দেয় নি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ । সেটা শুধু চিকিৎসা-সাপেক্ষ গোঙ্গানি হয়ে থেকে গেছে। তাই রিমা খান যখন ডিলডো ব্যবহার করে খুশী হয়, তৃপ্ত হয় , ফুরফুরে হয় , আমি তখন আবার উদ্ধৃত করি " When the vibrator reemerged during the 1960s, it was no longer a medical instrument; it had been democratized to consumers to such an extent that by the seventies it was openly marketed as a sex aid. Its efficacy in producing orgasm in women became an explicit selling point in the consumer market. The women's movement completed what had begun with the introduction of the electromechanical vibrator into the home: it put into the hands of women themselves the job nobody else wanted. " RACHEL P. MAINES এর রচনা থেকে ।
    আমি এই "অশ্লীল" , নারীবাদী , মানবতাবাদী লেখককে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
    উপন্যাসের ফর্ম , Anachronism , সাহিত্যের ডিটেকটিভদের টাইম ট্রাভেল , রাজনৈতিক গণহত্যা ও ডিটেকটিভ বিলাসিতা
    টাইম ট্রাভেল ও ডিটেকটিভ দের চোখে সামাজিক অবক্ষয়
    এই উপন্যাসে বেশ কটি মজার পয়েণ্ট রয়েছে । Anachronism বা সময়ের হেরফের ব্যবহার করে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ কনফারেন্সে মলয় রায়চৌধুরী আবির্ভূত করেছেন দেশ বিদেশের বহু সত্যান্বেষীকে , সাহিত্যের পাতা থেকে উঠিয়ে তাদের জীবন্ত করে তুলে, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাতে চেয়েছেন আজকের সমাজে ডিটেকটিভদের অপ্রাসঙ্গিকতাটুকু ।
    দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ কনফারেন্সে "প্রায়ভেট ডিটেকটিভ এসেছিলেন চেন কাও , ডেভিড স্মল, নিও উল্ফ, ভি আই ওয়ারশসস্কি, শন স্পেনসার, স্যাম স্পেড, শার্লক হোমস, কিনসে মিলোনে, এরকিউল পয়েরো, লিউ আর্চার, পল আর্টিজান, লিন্ডসে গর্ডন, জো ক্যানোলি, রেক্স কার্ভার, এলভিস কোল, হ্যারি ড্রেসডেন, ড্যান ফরচুন, ডার্ক জেন্টলি, এলেনি কুইন, এমারসন কড, কেট ব্যানিংগান, ক্লিফ হার্ডি, মাইক হ্যামার, টমাস ম্যাগনাম, ভেরেনিকা মার্স, ফিলিপ মারলো, জিম রকফোর্ড, জন শাফ্ট আর ম্যাথিউ শাডার ।" দেবেন্দ্রবিজয় , অরিন্দম , বাংলাদেশের কিশোর পাশা, মাসুদ রাণা আর মুসা আমন; আমাদের হুকাকাশি, কল্কেকাশি, নিশীথ রায়, ইন্দ্রনাথ রুদ্র, জয়ন্ত-মাণিক-সিন্দরবাবু জুটি , গুপি-পানু-ছোটোমামা জুটি, গোন্ডালু, কিকিরা, পাণ্ডব গোয়েন্দা, ট্যাঁপা-মদনা জুটি, গোগোল এরাও সবাই দেখা দিয়েছেন কনফারেন্সে ।
    এঁরা সব্বাই একবাক্যে বলেছেন, যেখানে দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পচছে , রাজনৈতিক ফুসলানিতে তৈরী দাঙ্গায় মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ , সেখানে খুচরো দু একটা খুনের কিনারা করতে গোয়েন্দা পোষা , বিলাসিতা মাত্র, সরকারের ধুলো দেয়া জনতার চোখে । এইভাবে সাহিত্যের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সাহিত্যের সমালোচনা অভিনব ও বেনজির ।
    সংক্ষিপ্ত উপন্যাস এর সুবিশাল গণ্ডী
    এই উপন্যাসটি অত্যন্ত চটি , টানটান । এটি সম্ভব হয়েছে একটি বিশেষ ফর্মের কারণে । সেটা হলো , ফ্ল্যাশব্যাক বা ডায়রি-লিখনের মাধ্যমে উপন্যাস এর বেশীরভাগ অংশ বর্ণিত হয়েছে। কঙ্কাল প্রেমিকের অতীত , রিমাখানের বর্তমান, এই দুই এর মধ্যে ঘুরেছে সমস্ত ঘটনা । অতি স্বল্প পরিসরে ভালোবাসা, সামাজিক সমস্যা , রাজনৈতিক কূটকচালি আর একটা লোমহর্ষক গোয়েন্দাকাহিনী এক সাথে বর্ণিত হয়েছে । লেখকের "অরূপ তোমার এঁটোকাটা " উপন্যাসেও ডায়রি লিখনের মাধ্যমে খুব স্বল্প পরিসরে অনেকটা ক্ষেত্র দেখানো গিয়েছিল । এই পদ্ধতিটি বেশ অভিনব বাংলা সাহিত্যে , যদিও কিছু কিছু এমন নজির আছে (যেমন "স্ত্রীর পত্র" শুধু পত্র লিখনের মাধ্যমে জীবনের সত্যিটুকু তুলে ধরতে পেরেছিল )।
    পুলিশের গোয়েন্দাগিরির পদ্ধতিটাও খুব ভালো ভাবে ধরা পড়েছে এখানে, যে পদ্ধতি শখের বা প্রাইভেট গোয়েন্দার পদ্ধতির চেয়ে অনেক আলাদা। ইনফরম্যার-এর ব্যবহার, ছিঁচকে অপরাধীকে ভয় দেখিয়ে ছোটখাটো কাজ করিয়ে নেওয়া , ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট এর মতামত নিয়ে আইনতঃ প্রমাণ সাজানো , দরকার পড়লে অনিচ্ছুক লোকের বাড়ির ফোনের তার কেটে টেলিফোন কোম্পানির লোক সেজে ঢুকে পড়ার ফিকির ইত্যাদি অনেক রকম উপায় সম্পর্কে আমরা অবহিত হই ।
    আবার কোন একটি কেস হঠাত করে পুলিশের কাছে দরকারি হয়ে পড়ে কেন, জমির বা রিয়াল এস্টেটের মাফিয়া কেন চায় যে একটা কোন সম্পত্তি দুর্নাম মুক্ত হোক, তা সে সত্যি বার করেই হোক বা বিশ্বাসযোগ্য সত্যি ক'রে , এই নানান জটিলতা ধরা থাকে এই উপন্যাসে ।
    মলয় রায়চৌধুরী নিজেই এই উপন্যাসের একটি চরিত্র হয়ে শেষ দৃশ্যে উদয় হন ; কাহিনির সত্যতাকে পাঠকচেতনায় সংশয়ে রাখার প্রয়াসে । আর উপন্যাসের শেষে , অন্ততঃ একজন অপরাধীর উত্তরণ দেখা যায় মানুষ হিসেবে।
    শেষকথা
    সবটুকু মিলিয়ে বলা যায় যে এরকম প্রেমের উপন্যাস , যা কিনা অনেকগুলি বহুমুখী সত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা বহুভূজের মধ্যে আমাদের এক অন্যরকম জীবনচেতনার মুখোমুখি করে দেয়, খুব বেশী লেখা হয় নি বাংলা ভাষায় । বিষয় বৈচিত্র ও সাহসী মনোজ্ঞ বর্ণনায় এই উপন্যাসটি বড্ড আলাদা, উৎকেন্দ্রিক , ঠিক এর লেখকের মতোই । পড়ে দেখতে পারেন সময় করে । মনের জটগুলো খুলে যাবে (অন্ততঃ আমার তো গেছে ) , আলো আসবে মনে।
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২৬541355
  • পৌঁছে-যাওয়া মানুষ - ডাকাতের আশীর্বাদধন্য আমি
    --------------------------------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    বিশ্ববিদ্যালয় হইতে পথে নামিবার পরই, প্রথম যে চাকুরিটিতে যোগ দিয়াছিলাম তাহা, দশটা-পাঁচটা চক্র না হইলেও, অত্যন্ত বিরক্তিকর ছিল বলিয়া অন্যপ্রকার একটি চাকুরির সুযোগ পাইতেই তাহাতে যোগ দিলাম কেননা আমি একই গৃহে একই পাড়ায় একই শহরে থাকিতে অভ্যস্ত নই ; ভালো লাগে না , অন্যত্র পলাইতে ইচ্ছা করে । একই মানুষদের দ্বারা পরিবৃত থাকিবার ফলে জীবন ও জীবনবীক্ষা মামুলি ও ক্ষুদ্র হইয়া পড়ে । নতুন কিছু ঘটিবার সম্ভাবনা সীমিত বোধ হয় । যদিও আমি রেকলুজ প্রকৃতির, একা থাকিতে পছন্দ করি, কম কথা বলি, কিন্তু আমার চতুর্দিকের মানুষদিগের কথাবার্তা ও জীবনযাত্রায় আগ্রহের কারণে, ওই যে বলিলাম, একই গৃহ-পাড়া-শহরের বৃত্তে পাক খাইয়া সেই একই মানুষদিগের মুখ দেখিয়া ও কথাবার্তা শুনিয়া কিয়ৎকালের ভিতরই ক্লান্ত বোধ করি । হ্যাঁ, ঠিকই, অন্যের জীবনের ঘটনাহীনতা আমার জীবনকেও ঘটনাহীন করিয়া তুলিতে পারে , তোলেও।
    প্রতিটি ঘরের নিজস্ব উদাসীনতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট সুবাস হয়, প্রতিটি গৃহের নিজস্ব নয়নসুখ আলো-বিচ্ছুরণ , প্রতিটি পাড়ার নিজস্ব গুঞ্জনমালা বাতাসকে ভারাক্রান্ত করিয়া ভাসে, প্রতিটি শহরের নিজস্ব কথাপ্রণালীর কাহিনিময় শব্দতরঙ্গ চতুর্দিক মথিত করে । সেকারণে চিরকাল নূতন সুবাস, আলো, গূঞ্জন ও শব্দতরঙ্গের অনুসন্ধানে ক্ষণিক-তীর্থের উদ্দেশ্য-সন্ধানী যাযাবরের ন্যায় চরিয়া বেড়াইবার প্রয়াস করিয়াছি ।
    প্রথম চাকুরিটি পাইতে অসুবিধা হয় নাই কেননা আমার পক্ককেশ ইনটারভিউ গ্রহণকারীগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল পর্যাবেক্ষণান্তে অর্থশাস্ত্রের কয়েকটি তাত্ত্বিক প্রশ্নের উত্তরে সন্তুষ্ট বোধ করিয়া , যদিও সে-সকল তত্ত্ব বর্তমানে মানবচরিত্রের ব্যাখ্যাহীনতার কারণে খারিজ হ‌ইয়া গিয়াছে, তৎক্ষণাত চাকুরিটিতে যোগ দিতে বলেন । চাকুরিটি খারাপ ও ভালো লাগার কারণটিও একই । প্রতিনিয়ত ট্যুরের চাকুরি হইলেও, এবং ট্যুরজনিত রোজগার মনোরম হইলেও , চাকুরিটি ছিল অন্যের দোষ ও কারচুপি অন্বেষণ সংক্রান্ত । যেথায় যাইতাম, শহরতলি হউক বা শহর, তথাকার কর্মচারীগণ তটস্হ হইয়া থাকিত। কেহই সন্নিকটে আসিতে চাহিত না । তাহাদের ও আমার বরাত এতই খারাপ যে হাতে কলম তুলিয়া লইতেই কারচুপি খুঁজিয়া পাইতাম । ফিরিয়া প্রতিবেদন জমা দিবার কয়েক মাস পরে শুনিতাম অমুকের চাকুরিটি আমি খাইয়া লইয়াছি অথবা তমুকের পদোন্নতি বিঘ্নিত করিয়াছি। প্রতিনিয়ত নূতন-নূতন স্হানে যাইতে ভালো লাগিত, নূতন জনপদ ও শহরের জনগণকে শুনিবার , জানিবার , বুঝিবার সুযোগ হইত, নবনব খাদ্যবস্তুর স্বাদ পাইতাম । কিন্তু কাহারও চাকুরি খাইয়া লইতে বা পদোন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করিতে একেবারেই ভালো লাগিত না ।
    অন্য চাকুরি খুঁজিতে ছিলাম । দরখাস্ত জমা দিবার পর যথারীতি ইনটারভিউয়ের ডাক পড়িল । এই চাকুরিটি ছিল কৃষি উন্নয়ন সংক্রান্ত । চাষবাস সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা তৎপূর্বে , ছাদের টবে মৌসুমি ফুলে সীমিত ছিল । সুতরাং কৃষি বিষয়ক গ্রন্হাদি সংগ্রহ করিয়া রাত জাগিয়া পড়াশুনা করিলাম । তথ্যাদি মুখস্হ করিলাম । আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া পরামর্শ লইলাম । ইনটারভিউতে আমাকে কৃষি বিষয়ক একটিও প্রশ্ন করা হইল না , কেবল সাধারণ জ্ঞান যাচাই করিবার নিমিত্ত কয়েকটি প্রশ্ন করা হইল যেগুলির সঠিক উত্তর দিতে অসুবিধা হইল না । ইনটারভিউ দিবার পর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিয়ে যখন পিছন ফিরিয়াছি, ইনটারভিউ পরিষদের চেয়ারম্যান কহিলেন, একটু দাঁড়ান । পুনরায় তাঁহার মুখোমুখি হইতে, তিনি বলিলেন, ওই ফুলদানিটি দেখিতেছেন, উহাতে কয়েকটি শষ্যের শুকনো শিষ রহিয়াছে, আপনি উহার মধ্য হইতে ধানের শিষটি লইয়া আসুন ।
    নির্দেশ শুনিয়াই বিপদে পড়িলাম । একত্রে এতপ্রকার ফসলের শিষ বা ছড়া দেখি নাই । বস্তুত বাল্যকাল হইতে শহরের ঘিঞ্জি নিম্নবিত্ত পাড়ায় জীবন যাপন করিবার কারণে, এবং প্রথম চাকুরিটি কেবল নথিপত্র যাচাই করিবার ছিল বলিয়া চাষবাস সম্পর্কে জ্ঞানান্বেষণের সুযোগ হয় নাই । খেতে গিয়া কোন ফসলের শিষ দেখিতে কীরকম তাহা জানিবার সুযোগ হয় নাই । চালের সহিত যে ধানগুলি মিশিয়া থাকে সেই ধান নিকট হইতে দেখিবার সুযোগও হইত না, কেননা ভাত রাঁধিবার পূর্বে মা-জেঠিমা চাল হইতে তাহা বাছিয়া ফেলিয়া দিতেন । সেসময়ে টিভি ইত্যাদি গণমাধ্যম থাকিলে কোনোও না কোনো চ্যানেলে ধানের ছড়ার সহিত পরিচয় হইত নিশ্চয়, যেরূপ বর্তমানের শিশু-কিশোরদিগের হয় ।
    ফুলদানিটির নিকটে গিয়ে দুইটি অল্প-পরিচিত শিষ পর্যবেক্ষণ আঁচ করিলাম যে সেগুলি যব ও গমের । সরস্বতী পুজার পূর্বে আমাদের গৃহের ছাদে টবে গম পুঁতিয়া দিদিগণ পুজার জন্য শিষ সংগ্রহ করিতেন । অন্য শিষগুলি বোতল পরিষ্কারের ব্রাশের ন্যায় দেখিতে এবং সেগুলিতে ধানের দানা নজরে পড়িল না । কয়েকটি ছড়া দেখিয়া ঘাসের শিষের ন্যায় প্রতিভাত হইল । অগত্যা যে শিষটি অবশিষ্ট তদ্দর্শনে অনুমান করিলাম যে উহা নিশ্চয়ই ধানের হইবে । সেইটি তুলিয়া আনিয়া চেয়ারম্যানের সন্মুখে রাখিলাম । এক মাসের ভিতর নূতন চাকুরির নিয়োগপত্র পাইলাম, লখনউতে যোগ দিবার নির্দেশসহ ।
    লখনউতে যোগ দিবার প্রথম দিনই আমাকে বলা হইল যে আমার জন্য বুন্দেলখণ্ড এলাকাটির কৃষি-উন্নয়ন পর্যালোচনার ও প্রতিবেদন তৈয়ারির কর্ম বরাদ্দ হইয়াছে এবং কল্যই আমি যেন ইটাওয়া-ললিতপুর-জালাউন ইত্যাদি অঞ্চল পরিদর্শনে যাত্রা করি । অধস্তন আধিকারিকগণের কথা শুনিয়া অনুমান করিলাম যে কার্যালয়ের রাজনীতির খেলায় নূতন অধিকারীদের এই প্রকার প্রত্যন্ত অঞ্চল, কৃষিজ্ঞানের পরীক্ষা লইবার জন্য ,নির্ধারিত হয় । অঞ্চলগুলিতে রাত্রিবাসের জন্য হোটেল , যানবাহন ও খাওয়া-দাওয়ার অভাব সহজেই কাবু করিয়ে তোলে ।
    সৌভাগ্য যে ইটাওয়ার জেলা কৃষি আধিকারিক শার্দুল মীনাকে আমাদের অফিসের কেহ আগেভাগে, আমি যোগ দিবার পূর্বেই, যেহেতু বুন্দলেখণ্ড আমার জন্য চিহ্ণিত হইয়াছিল, আমার সম্পর্কে বিস্তারিত সংবাদ সরবরাহ করিয়া দিয়াছিল । কথাপ্রসঙ্গে জানিলাম, তিনি আমার স্নাতকস্তরের সহপাঠী অভিমন্যু মীনার অগ্রজ । তাঁহার সরকারি বদান্যতায় অতিথিভবনে রাত্রিবাসের ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্হা হইয়া গেল । ক্ষেত্রসমীক্ষায় সহায়তা করিবার নিমিত্ত তিনি তাঁহার বিভাগের একজন বয়স্ক অফিসার, শ্রীসুগ্রীব নিমচকে আমার সঙ্গে দিলেন । ভালোই হইল । সরকারি জিপ ব্যবহারের সুযোগ পাইলাম ।
    তিন দিনের ক্ষেত্রসমীক্ষায় আমার কর্ডুরয় প্যান্ট , ডোরাকাটা শার্ট , চোখের পাতা, মাথার ও ভুরুর চুল গেরুয়া ধুলায় , এবং কাগজপত্র সংখ্যা ও তথ্যে ভরিয়ে উঠিল । গেঞ্জি ও আন্ডারওয়্যার কেবল পরিবর্তন করিতাম , কেননা মাত্র চার দিনের ভ্রমণ বলিয়া দুইটি সেট শার্ট-প্যান্ট লইয়াছিলাম ।
    অঞ্চলটি বর্ণনাতীত । পথের দুইধারে গভীর ও সঙ্কীর্ণ গিরিখাতের শুষ্ক ও বিমূর্ত ভুলভুলাইয়ার প্রায় জনহীন বিস্তার ধূলা উড়াইয়া সতত অধঃক্ষিপ্ত জলরাশির প্রত্যাশায় ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যকে করিয়া তুলিয়াছে কৌতূহলোদ্দীপক ও দূরভিসন্ধিপূর্ণ । দ্বিপ্রহরের পূর্বেই দিগন্ত আবরিত হয় গেরুয়া কুয়াশায় । পুষ্পিকা ও প্রাণীকুল এতদঞ্চলে ছলনাময় । চতুর্দিকে থম মারিয়া আছে মায়াময় অস্হিরতা । একটিই নদী বহিয়া গেছে যাহা উটের পিঠে বসিয়া পারাপার করিয়া থাকে স্হানীয় গ্রামবাসীগণ ।
    চতুর্থ দিন কিয়দ্দূর রওনা হইবার পর শ্রীনিমচ একটি মন্দিরের নিকট জিপগাড়ি পার্ক করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলে বুঝিতে পারিলাম যে উহা একটি কালীমন্দির । অবাক লাগিল । সাধারণত কয়েকঘর বাঙালি যে অঞ্চলে বসবাস করেন সেখানেই কালীমন্দির গোচরে পড়ে । শ্রীনিমচকে প্রশ্ন করিতে উনি বলিলেন যে মন্দিরটি শপ্তদশ শতকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন আতেরের মহারাজা বদন সিংহ। তিনি শক্তির উপাসক ছিলেন । এতদঞ্চলের শক্তি-উপাসকগণ সুকর্ম সমাপনান্তে মন্দিরে ছাগ-বলি দিয়া থাকেন ।
    পুরোহিত শ্রীনিমচকে কহিল, বাবাসাহেব নিকটের একটি গ্রামে আসিয়াছেন । প্রত্যুত্তরে নিমচ কহিল, বহুদিন পর বাবাসাহেব নদীর এই পারে আসিলেন । দেখা করিয়া লইব । সেই পরবের সময় আশীর্বাদ লইয়াছিলাম, আর তো দেখা হয় নাই ।
    --বাবাসাহেব ? সাধুসন্ত হ্যাঁয় কেয়া ? জিজ্ঞাসা করিলাম ।
    --জি হাঁ । পঁহুচে হুয়ে আদমি হ্যাঁয় । শ্রীনিমচ প্রত্যুত্তর করিল । অভিব্যক্তিটি অদ্ভুত লাগিল । পৌঁছে-যাওয়া মানুষ ! মহাকাশে, চাঁদে, সমুদ্রগর্ভে সর্বত্র মানুষ পৌঁছাইয়া গিয়াছে । সাধুসন্তরাও সাধনালব্ধ ক্ষমতার বলে পৌঁছাইয়া যান হয়তো তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্যে ।
    কাঁচা রাস্তায় জিপগাড়ি ছুটিল আমার পোশাক ও ত্বকে গেরুয়া মিহিন ধুলার আস্তরণ সংগ্রহ করিতে-করিতে । কিছুটা যাইবার পর লালকাঁকরের পথের মাঝখানেই কয়েকজন গ্রামবাসী বসিয়াছিল বলিয়া চালক গাড়ি থামাইল; তাহারা চালককে বলিল যে এই রাস্তাটি খারাপ হইয়া গিয়াছে , আপনারা পাশ্ববর্তী গ্রামের ভিতরের পথ দিয়া চলিয়া যান। বাতাসকে আরও ধুলিধূসরিত করিয়া সাত-আট কিলোমিটার যাইবার পর দেখিলাম একটি বিশাল বটবৃক্ষের তলায় প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন গ্রামবাসী একজন তামাটে পেটমোটা মোড়লের সন্মুখে বসিয়া, সম্ভবত তাঁহার বাণী শুনিতেছে। তদ্দর্শনে চালক সেই দিকে জিপগাড়িটি লইয়া গিয়া থামাইল । শ্রীনিমচ নামিল, আমিও তাঁহার সহিত নামিলাম । মোড়ল লোকটির বাবরিচুল উস্কোখুস্কো, উর্ধাঙ্গে পোশাক নাই, নিম্নাঙ্গে একটি চাককাটা লুঙ্গি। তিনি বসিয়া আছেন মাটির উঁচু বেদির উপরে ।
    শ্রীনিমচ মোড়লের নিকট গিয়া হাতজোড় করিতে তিনি কোঁচড় হইতে একমুষ্টি মুড়ি দিলেন এবং নিমচ তাহা তৎক্ষণাত ভক্ষণ করিয়া লইল । মোড়ল আমাকে দেখিয়া শ্রীনিমচকে জিজ্ঞাসা করিল, সরকার বাহাদুর ?
    --জি হাঁ । শ্রীনিমচের বিনয়ী প্রত্যুত্তর ।
    মোড়ল আমাকে ডাকিয়া বলিল, সরকার বাহাদুর, তুম ভি লো । যত্রতত্র ভক্ষণ সম্পর্কে আমার পেট খারাপের ভীতি আছে । আমি পকেট হইতে রুমাল লইয়া তাঁহার প্রদত্ত মুড়ি বাঁধিয়া লইলাম, পরে ফেলিয়া দিব । আমার আচরণে মোড়ল প্রীত হইলেন, বলিলেন, আও । আমি আরও নিকটে গেলে তিনি আমার মাথার উপর হাত রাখিয়া বলিলেন, জিতে রহো।
    আমরা জিপগাড়িতে গিয়া বসিলাম । কিয়দ্দূর যাইবার পর শ্রীনিমচ বলিল, আপনি বুন্দেলখণ্ডের চম্বলঘাটিতে যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারেন, কেহ আপনার কোনো ক্ষতি করিবে না, বাবার আশীর্বাদ পাইলেন । প্রশ্ন করিলাম, ইনি কি এতদঞ্চলের কোনো ধর্মগুরু ? পোশাক দেখিয়া তো মনে হইল বয়স্ক চাষি । শ্রীনিমচ কহিল, স্যার উনি ডাকাত সর্দার বাবা মুস্তাকিম, সরকার ওনার মাথার দাম রাখিয়াছে এক লক্ষ টাকা । যাহারা ঘাসের উপর বসিয়াছিল তাহারা ওনার দলের ডাকাত ।
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩১541356
  • আমার মেজদা চোর ছিলেন
    ---------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    আমার মেজদা অরুণ রায়চৌধুরী, ডাক নাম বুড়ো, ছোটোবেলায় মনে হয়েছিল হঠাৎ, পরে বুঝতে পারি, হঠাৎ নয়, তার কারণ ছিল, চুরি-ডাকাতি-গুণ্ডামির জগতে, বলা চলে বুক ঠুকে, বয়ঃসন্ধিকালেই, ঢুকে পড়েছিলেন । পাটনার কাহার কুর্মি দুসাধ পাশি আর অতিদরিদ্র শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ায়, চারিদিকে গোলটালির বস্তিবাড়ির মাঝে, আমাদেরটাই ছিল দু-তলা ইঁটের দাঁত বেরোনো পাকা বাড়ি । ইমলিতলায় বড়ো জ্যাঠা বাড়িটা তৈরি করেছিলেন কেননা অমন এলাকায় ভদ্রলোকেরা ঢোকে না বলে জমিজমা সস্তা ছিল । আমরা জানতুম যে পাড়ার লোকেদের পেশা হল প্রধানত চুরি করা, আর পুলিস তাদের খোঁজে আসলে গোলটালির ওপর দিয়ে দৌড় লাগিয়ে পেছনের আম বাগানে পালানো । পাড়ায় পুলিশ ঢুকলে কুকুরগুলো ঘেউ-ঘেউয়ের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছে দিত আর ধরা পড়ে যাবে আঁচ করে অনেকে পালাতো । চুরি সফল হলে ভোজ হতো পাড়ায়, পাঁঠার নাড়িভূঁড়ির রান্না আর পাঁঠির থন পিষে কাবাব, খাওয়া হতো তাড়ি সহযোগে । তাড়িও চুরি করে আনা । কোন গাছ থেকে তাড়ি চুরি করে আনা হবে, তাল গাছের গায়ে দাগ দিয়ে তাড়ি চোরের দলকে তা জানিয়ে দেয়া হতো। আমার, মেজদার আর দাদার তাড়ি খাবার হাতেখড়ি ছোটোবেলাতেই, পাড়ার চোরেদের পাল্লায় পড়ে । পাড়ায় দাদার এক বন্ধু ছিল বদ্রি পাটিকমার নামে ; সে চুরি করাকে ঘৃণ্য বলে মনে করত, কেননা সে ছিল পকেটমার, আর পকেট মারতে হলে ‘তরকিব’ দরকার ।
    হিন্দি গালাগাল, যাকে বাঙালিরা বলেন অশ্লীল, তাও আমরা ছোটোবেলায় ইমলিতলা পাড়াতেই শিখি । অশ্লীল গালাগাল দিয়ে ফেললে তিনবার ‘ওং বিষ্ণু’ বললে দোষ কেটে যায় । আমার শৈশবের বন্ধু কপিলের দাদু শিশুদের গালাগাল শেখার ক্লাস নিতেন । আমাদের বাড়ির সামনের কলে যারা জল ভরতে আসত তাদের গালাগাল দিতে উৎসাহিত করতেন কপিলের দাদু, যিনি রাতে আমাদের বাড়ির লাল সিমেন্টের রোয়াকে শুতেন; ওনার মাথায় দেবার বালিশ এত তেলচিটে হয়ে গিয়েছিল যে মনে হতো চামড়ার তৈরি । অবাধ যৌনতার শিক্ষাও এই পাড়াতেই পেয়েছিলুম ছোটোবেলায়, বিশেষ করে দোলের দিন যেদিন পাড়ার মহিলারা দল বেঁধে বেরোতেন আর কিশোরদের ওপর জোরাজুরি করতেন, এমনকি নিজের স্বামীর সামনেই চুমু খেতেন আর যেখানে-সেখানে হাত ঢুকিয়ে হাসাহাসি করতেন । বাড়ি থেকে কড়া নির্দেশ ছিল যে দোলের দিন মহিলাদের দল চলে না যাওয়া পর্যন্ত বেরোনো যাবে না । কিন্তু বেপরোয়া বিহারি বউদের ডাক এড়ানো যেত না ।
    আমাদের বাড়ির কুড়িজন সদস্যের আর্থিক দায় বর্তেছিল প্রধানত আমার বাবার ওপর ; তাই বাবা ভোর বেলা বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতেন রাত করে । বড়ো জ্যাঠা প্রথমে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী হিসেবে পাটনা মিউজিয়ামে যোগ দেন; পরে পদোন্নতি পেয়ে কিপার অফ পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার হন । তিনিও সকালে বেরিয়ে রাতে আড্ডা দিয়ে ফিরতেন । মেজজ্যাঠা আর কাকাদের মনে করা হতো অপ্রকৃতিস্হ ; তাঁদের বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হতো না । ইলেকট্রিসিটি ছিল না : আমরা ভাইবোনরা সবাই একটা লন্ঠন ঘিরে পড়াশোনা করতুম । রাতের খাওয়া হয়ে গেলে বড়জেঠিমা লন্ঠনের আলো কমিয়ে দিয়ে আমাদের গল্প শোনাতেন । জেঠিমা-মা-কাকিমা কেউই স্কুলে যাননি কখনও, জানি না বড় জেঠিমা ইশপের আর আরব্য রজনীর গল্পগুলো কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন । বাবার ছয় ভাইয়ের মধ্যে নতুনকাকা ছাড়া আর কেউ স্কুলে যাননি ; চাকরি পেয়েই নতুনকাকা ইমলিতলার বাড়ি ছাড়েন ।
    মেজদা, যিনি চোর-ডাকাত-গুণ্ডা হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বড়জেঠার ছেলে । বাবা প্রধান রোজগেরে হলেও বাড়িতে কারোর প্রতি কোনো পক্ষপাত করা হতো না । ছোটোদের জন্য যা কেনা হতো তা মেজদার জন্যও কেনা হতো । পাড়ার প্রভাবে মেজদা চুরি-ডাকাতি-গুণ্ডামির জগতে প্রবেশ করেননি, রাজনৈতিক কর্তাদের চাপেও নয় । নিজের অন্তরজগতের ডাকে তিনি ওই পথে যান । ছোটোবেলায় আমরা সবাই বিভিন্ন স্কুলে পড়তুম । মেজদা প্রথমে পড়তেন টি কে ঘোষ অ্যাকাডেমিতে, যে স্কুলটা সেসময়ে বেশ নাম করা ছিল। হঠাৎই মেজদা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, বইপত্র বেচে দিলেন, ফলে স্কুল থেকে নাম কাটা গেল । দাদার উপনয়ন বেশ কম বয়সে হয়ে গিয়েছিল । মেজদা চাইছিলেন যে দাদার পর ওনার উপনয়ন হোক, তেরো বছর বয়সেও যখন মেজদার উপনয়ন হল না, মেজদা খেপে গিয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন । বড়জেঠা আর জেঠিমা অনেক বুঝিয়ে , যে, যখন আমার উপনয়ন হবে তখন মেজদারও একই সঙ্গে হবে, মেজদাকে আরেকটা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন, পাটলিপুত্র স্কুলে, সেসময়ে বলা হত যে স্কুলটা বজ্জাত ছেলেদের জন্য । মেজদা কিছুদিন ক্লাস করার পর বইটই বেচে দিয়ে এই স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিলেন । আমরা সবাই লন্ঠন ঘিরে পড়তে বসলেও মেজদা বসতেন না, বাড়িতেও থাকতেন না । স্কুল ছাড়ার পর মেজদা বাড়ির বাইরেও লুঙ্গি পরে বেরোনো আরম্ভ করলেন, অনেক সময়ে কেবল গেঞ্জি পরে । মেজদা আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলাও বন্ধ করে দিলেন । সবায়ের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলা আরম্ভ করলেন । কেন যে মেজদার চরিত্রে আচমকা এরকম বদল ঘটছে, তার ব্যাখ্যা কেবল বয়স্কদের কাছেই ছিল । হয়ত দাদার কাছেও ছিল, কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ করার পর দাদাকে আদিবাড়ি উত্তরপাড়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ।
    বাড়িতে দেখা গেল যে মাঝে মাঝে পেতলের বাসনপত্র লোপাট হয়ে যাচ্ছে । কাজের লোক শিউনারায়ণ বা শিউনন্নি আমাদের বাড়িতেই থাকত, তাই তার হাত নেই বলেই মনে করলেন বয়স্করা । একদিন পাড়ার শিয়া মুসলমান মসজিদের ইমাম সাহেব এসে বললেন যে মেজদা মসজিদে ঢুকেছিলেন, তারপর থেকে ওনার পেতলের বদনাটা লোপাট । ইমাম সাহেবের সামনেই মেজদাকে বড়জেঠা জেরা করলেন ; মেজদার যুক্তি শুনে আর মুখ দেখে ইমাম সাহেবের মনে হল কাজটা মেজদার নয় । এর কিছুদিন পর, বড়জেঠা সকালে সবাইকে ধমকানি দেয়া আরম্ভ করলেন, কেননা কালকে উনি মাইনে পেয়ে সুটকেসে এনে রেখেছিলেন, সকালে বাজার যাবার জন্য সুটকেস খুলে দ্যাখেন কিচ্ছু নেই, টাকা হাপিস । তার সঙ্গে মেজদাও বাড়ি থেকে হাপিস । মেজদা যে চুরি করা আরম্ভ করেছেন তা স্পষ্ট হল ।
    মাস খানেক পর মেজদাকে বাড়িতে এনে রেখে গেল একজন লালপাগড়ি কন্সটেবল, এ কথা জানিয়ে যে মেজদা সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করছিল । তবুও মেজদার মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেল না । দিনকতক পরে ডুণ্ডাসিং ঠাকুরবাড়ির আখড়ার জনৈক কুখ্যাত গুণ্ডা জানিয়ে গেল যে মেজদাকে যেন সামলানো হয়, কেননা মেজদা যেভাবে কুকাজ আরম্ভ করেছে যেকোনো দিন খুন হয়ে যেতে পারে । ওদের আস্তানায় মেজদার খোঁজে পুলিশ কয়েকবার এসে খোঁজ করে গেছে । বয়স্করা কিছু বললেন না মেজদাকে । বড়জেঠিমা ওনার পাড়াতুতো বান্ধবী জনৈক কামারের বউ রামপতিয়ার পরামর্শে মেজদাকে বশীকরণের সুতো বাঁধা, মাথায় ফুল রাখা ইত্যাদির মন্ত্রপূতঃ ঘুগনি খাওয়ানো আরম্ভ করলেন । ছোলার ঘুগনি খেতে ভালো লাগত মেজদার । মন্ত্রপূতঃ ঘুগনিতে রামপতিয়া মিশিয়ে আনত শুকনো ধুতরোর গুঁড়ো । মেজদার ক্রমশ রোগা আর খিটখিটে হয়ে উঠল । একদিন রাতে সদর দরজার খিল মাটিতে পড়ার আওয়াজে বাড়ির সবায়ের ঘুম ভেঙে যেতে দেখা গেল যে মেজদা নিজের ঘরে একজন বেশ্যাকে এনেছিলেন । বউটি তো দ্রুত বেরিয়ে চলে গেল, কিন্তু মেজদাকে বড়জেঠা কানমুলে মার দেয়া আরম্ভ করলেন, চিৎকার করতে লাগলেন, “বাড়িতে বেবুশ্যে মাগি আনা…” । বেশ্যাকে যে বেবুশ্যে বলে তা জানলুম । মাঝরাতে বউটির পেছন-পেছন বেরিয়ে গেলেন ষোলো বছরের মেজদা ।
    প্রতিবেশিরা, যাদের অনেকেই চুরি-পকেটমারি করত, তাদের মুখেই শোনা যেতে লাগল যে মেজদা চুরি-ডাকাতি-গুণ্ডামি আরম্ভ করেছে। বয়স্করা আমাদের আদেশ দিলেন যে মেজদার দেয়া কোনো জিনিস যেন আমরা না নিই, কেননা ওগুলো চুরি করে আনা । বয়স্করা কেউই বুঝতে পারছিলেন না মেজদাকে কি ভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবেন । জেঠা-বাবা-কাকারা আর মেজদা সম্পর্কে আগ্রহ দেখাতেন না : বড়জেঠিমা কেবল কাঁদতেন, সারাদিন কাঁদতেন, আর ঘুগনিতে শুকনো ধুতরোর গুঁড়ো মিশিয়ে বশীকরণের মাধ্যমে মেজদাকে স্বাভাবিক করতে চাইতেন ।
    একদিন স্কুলে যাবার সময়ে বৈঠকখানা ঘরে তুমূল চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে দেখলুম যে মেজদা ভোজপুরি-মগহি-হিন্দিতে তুই-তোকারি করে বড়জেঠিমাকে নানা কথা বলে চলেছেন । বড়জেঠিমা ফুঁপিয়ে চলেছেন নিঃশব্দে । মেজদা বলে চলেছেন যে বড়জেঠিমা ওনার মা নয় তা কেন এতদিন জানানো হয়নি ; মেজদাকে যে দেড়শো টাকায় একজন বেশ্যার কাছ থেকে কেনা হয়েছিল তা কেন জানানো হয়নি ; কে মেজদার আসল মা, কে মেজদার আসল বাবা, তারা কোথায় থাকে, জাতের ঠিকঠিকানা নেই বলেই উপনয়ন দেয়া সম্ভব নয় তা কেন আগে জানানো হয়নি, প্রচণ্ড চিৎকার করতে-করতে শানবাঁধানো লাল সিমেন্টের মেঝেতে, কুয়োবোজানো গোল দাগটার মধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে গেল মেজদা ।
    চেঁচামেচি শুনে পাড়াপ্রতিবেশিরা বৈঠকখানায় এসে জড়ো হয়েছিল । তাদের একজন ঝুঁকে মেজদার বুকে কিছুক্ষণ কান রেখে ঘোষণা করল যে মেজদা মারা গেছে । শবযাত্রীরা তৈরি হবার পর বড়জেঠা ঘোষণা করলেন যে একজন চোরের মুখাগ্নি তিনি করবেন না । বড়জেঠার বড়মেয়ের স্বামীকে সে-কাজ করার জন্য ডেকে পাঠানো হল । চলে গেলেন মেজদা, পাড়ার লোকেদের ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ ধ্বনির সঙ্গে, তাদের কাঁধে চেপে । মেজদাও চেয়েছিলেন নিশ্চয়ই যে হরিবোল নয়, রাম নাম সৎ হ্যায় ধ্বনিই উঠুক তাঁর শবযাত্রায়। আমাকে বলা হল যে অত কম বয়সে শ্মশানে যাওয়া অনুচিত । বাড়ির কেউই গেলেন না, বড়জামাইবাবু ছাড়া ।
    পরে, পুরুতমশায়, যিনি জেঠা-বাবা-কাকাদের বন্ধু, তিনি আর বড়জেঠা সন্ধ্যাবেলায় চুপচাপ বসেছিলেন, সেই ঘরেই যেখানে মেজদা মারা গিয়েছিলেন । শুনলুম পুরুতমশায় বলছেন, ‘উপনয়নটা দিয়ে দিলেই পারতে, তখনই বলেছিলাম তোমাকে, দিয়ে দাও, ব্রাহ্মণ পুরুষের পুত্রসন্তান ব্রাহ্মণই হয়, তার মা শুদ্রাণী না মুসলমান না নেপালি তা তুমিই জানো, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না । চুরি-ডাকাতি করলেই বা, সে তো ব্রাহ্মণের ছেলে ।’
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩৭541357
  • আবু সয়ীদ আইয়ুব, অ্যালেন গিন্সবার্গ ও হাংরি আন্দোলন
    ---------------------------------------------------------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার কিছুকাল পর থেকেই কলকাতার তখনকার এলিটরা লালবাজারে প্রতিনিয়ত ফোন করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নিতে অনুরোধ করছিলেন । ফলে লালবাজারের প্রেস সেকশানকে অ্যাক্টিভেট করা হয়েছিল এবং দুজন ইনফরমারকে কলেজ স্ট্রিট কফিহাউস এবং আন্দোলনকারীরা যেসব ঠেকগুলোয় যেতেন আর কবিতা পাঠ করতেন সেখানে-সেখানে নজর রাখতে বলা হয় । এঁরা দুজনে, পবিত্র বল্লভ এবং সমীর বসু, মামলার সময়ে যাঁরা আমার বিরুদ্ধে ভুয়ো সাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, আন্দোলনের বুলেটিন ও বইপত্র যোগাড় করে লালবাজারের প্রেস সেকশানে জমা দিতেন । আমাকে আর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে যখন পুলিশ কমিশনারের ঘরে একটা বিশেষ ইনভেসটিগেটিং বোর্ড জেরা করেছিল, তখন দুটো ঢাউস ফাইল দেখেছিলুম গোলটেবিলের ওপর, তাতে আমাদের যাবতীয় লেখালিখি সংগ্রহ করে ফাইল করা ছিল ।
    আমাদের বিরুদ্ধে যে এলিট ভদ্রলোকরা নালিশ ঠুকেছেন তা পুলিশ কমিশনার নিজেই আমাদের বলেছিলেন । পরে, কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর সচিব শ্রী এ. বি.শাহ যখন পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন, তিনি জানতে পারেন যে আমাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নেবার জন্য সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব আর সন্তোষকুমার ঘোষ । কলকাতায় র‌্যাডিকাল হিউমানিস্ট-এর দপতরে শ্রী শাহ-এর সঙ্গে মকোদ্দমা নিয়ে আমার আলোচনা হয়েছিল । সন্তোষকুমার ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলুম, তিনি রাজি হননি। বুদ্ধদেব বসুও আমার সঙ্গে দেখা করতে চাননি, আমার নাম শুনেই মুখের ওপর দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । সমর সেন তখন ইংরেজি ‘নাউ’ পত্রিকার সম্পাদক, ওনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে উনি বলেছিলেন, ‘কারা আপনাদের বিরুদ্ধে পুলিশে মৌখিক অভিযোগ দায়ের করেছেন তা আমি জানি, কিন্তু তাঁদের নাম আপনাদের বলব না ।” একই কথা বলেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ । আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর বাড়িতে গিয়ে আমি আর দাদা দেখা করেছিলুম ।
    মজার ব্যাপার হল যে আইয়ুব সাহেব নিজেই ছিলেন ‘ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম’-এর চতুর্মাসিক ম্যাগাজিন ‘কোয়েস্ট’-এর সম্পাদক ; ( পত্রিকাটি আমেরিকার সি, আই. এ.-র সাহায্য পায় এমন সংবাদ প্রচারিত হলে, বন্ধ হয়ে যায় ), অথচ অ্যালেন গিন্সবার্গকে একটি চিঠিতে উনি জানিয়েছিলেন যে উনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন এবং ওনার কোনো পদমর্যাদা নেই । পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক ছিলেন অম্লান দত্ত, যাঁর সঙ্গে আমরা দেখা করিনি কেননা জানতে পারি যে পুলিশের হস্তক্ষেপে ওনার কোনো ভূমিকা নেই। আইয়ুব সাহেব, যাকে বলা হয় ‘সফ্ট স্পোকেন’, তেমন মানুষ ছিলেন, কিন্তু আমাকে আর দাদাকে দেখে দৃশ্যত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন, ক্রোধ সামলাবার জন্য কাঁপছিলেন বলা যায় । দুজন যুবক দেখা করতে চাইছে শুনে উনি আশা করেননি যে ওনার সামনে দুই মুর্তিমান হাংরি আন্দোলনকারী গিয়ে দাঁড়াবে । প্রতিষ্ঠিত ঔপনিবেশিক নান্দনিক সাহিত্যতন্ত্রের সঙ্গে উত্তরঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানবিরোধীর সংঘাত ! আমি আর দাদা পাটনার ইমলিতলার স্লাম থেকে উঠে আসা যুবক, আর উনি কলকাতার ওপরতলার সম্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবি । ওনার সঙ্গে আমাদের যে কোনো বিষয়েই মিল নেই তা কথা বলে বোঝা যাচ্ছিল । কিন্তু কেন উনি নালিশ ঠুকেছেন, তা স্পষ্ট করতে চাইলেন না । উনি সম্ভবত আমাদের পড়াশোনার গভীরতা আশা করেননি ; কানাঘুষোয় শুনে ভেবেছিলেন কলকাতার বাইরের খোট্টা ছোটোলোকের দল। তখনকার দিনে এরকম ধারণাই ছিল এলিট মহলে, যে, স্লাম বা বস্তি বা উদ্বাস্তু কলোনিতে যারা থাকে তাদের জ্ঞানগম্যি বিশেষ নেই।
    আমাদের বিরুদ্ধে আইয়ুব সাহেবের নালিশের বিষয়বস্তু আমরা জানতে পারি অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা ওনার চিঠি থেকে । চিঠিতে, আমেরিকার একজন কবি, অ্যালেন গিন্সবার্গ, আমাদের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, আর বাংলা ভাষার এক প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, যিনি ঘোষিতভাবে কবি-লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে, তিনি আমাদের জেলে পাঠাবার ব্যবস্হা করছেন ! আইয়ুব সাহেবের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে উনি আমাদের বুলেটিন আর পত্রিকা কিছুই পড়েননি ; শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া উনি আর কারোর নাম শোনেননি, উৎপলকুমার বসুর নামও নয় । আমি আর দাদা যে ওনার সঙ্গে দেখা করেছি, তাও উনি লিখেছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গকে । প্রত্যুত্তরে গিন্সবার্গ তাঁর চিঠিতে আইয়ুব সাহেবকে লিখেছিলেন, “বেচারা মলয় -- যদি ও একজন নিম্নমানের লেখকও হয় -- তা হলেও ওর জায়গায় আমি থাকলে আপনার সন্মুখীন হতে আমি ঘৃণা বোধ করতাম ।”
    ‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ লেখা কাগজের মুখোশ, দানব রাক্ষস জন্তু-জানোয়ার পাখি ইত্যাদির মুখোশ আমরা ওনাকে পাঠাইনি কিন্তু উনি জানতেন যে অমন মুখোশ পাঠানো হয়েছে মন্ত্রী আমলা সাংবাদিকদের। কিন্তু তাও ওনার ক্রোধের কারণ ছিল না । ওনার ক্রোধের কারণ ছিল একটা বিয়ের কার্ড, যা মূলত সাহিত্যিকদের এবং সাংবাদিকদের পাঠানো হয়েছিল ; যে কার্ডে ছাপানো ছিল Fuck The Bastards Of The Gangshalik School of Poetry. উনি বোধহয় নিজেকে তথাকথিত ‘গাঙশালিক’ স্কুলের দিকের মানুষ হিসাবে মনে করে থাকবেন । দ্বিতীয়ত, ওনার সম্ভ্রান্ত শ্রেণিতে ‘ফাক’ এবং ‘বাস্টার্ড’ শব্দ দুটি ছোটোলোকদের অভিধান থেকে নেয়া মনে হয়ে থাকবে । আমি আর দাদা যখন আইয়ুব সাহেবের সঙ্গে দেখা করি তখন উনি বিয়ের কার্ডটি আর তাতে ছাপানো শ্লোগান প্রসঙ্গ একেবারেই তোলেননি অথচ অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা চিঠিতে উনি লিখেছিলেন যে এই বাক্যটি ‘প্রশ্নাতীতভাবে আপত্তিকর’ । তিনি এও লিখেছিলেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরা বিটনিকদের প্রতিচ্ছায়া । বস্তুত স্লাম-বস্তি-উদ্বাস্তু কলোনির ছোটোলোক স্তর থেকে উঠে আসা বাঙালি যুবকদের সম্পর্কে আইয়ুব সাহেবের কোনো ধারণা ছিল না বলে মনে হয় ।
    আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা চিঠিগুলোয় অ্যালেন গিন্সবার্গ হাংরি আন্দোলনকারীদের, বিশেষ করে আমার, ম্যানিফেস্টোগুলোর, প্রশ্ংসা করছিলেন, তাও বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ করে থাকবে ওনাকে । আইয়ুবকে লেখা গিন্সবার্গের চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :

    ৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : মলয় মানুষ হিসাবে আমার পছন্দের এবং ওঁর ইংরেজিদুরস্ত ম্যানিফেস্টোর প্রাণোচ্ছলতা আমার সত্যিই ভালো লাগে --- আমার মতে যে-কোনও ভারতীয়-ইংরেজি গদ্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত ।

    ৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : Fuck The Bastards of Gangshalik School of Poetry-র মতো একটি বাক্য নিয়ে অশ্লীলতা সম্পর্কে আপনার যা বিশ্লেষণ, তার সঙ্গে আমি একেবারেই সহমত নই । এটা যে কোন ‘স্কুল’ তা আমি জানিও না । কিন্তু প্যারিস কিংবা কলকাতার কাফেতে, ত্রিস্তঁ জারার পুরোনো ম্যানিফেস্টোতে এটাই চলতি সাহিত্যভাষা -- মুখের ভাষা এবং প্রকাশিত লেখাতেও । সাহিত্যে এই কায়দা, এই আবেগ, বুদ্ধিদীপ্ত হালকা বদমাইশি বিশ শতকের ‘গ্রন্হাগার পুড়িয়ে দাও’ চিৎকারের মতোই ।

    ৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : অনুবাদ পড়ে আমি যেটুকু বুঝেছি, মলয় এবং অন্যান্য কবিদের, যাঁদের গ্রেপতার কিংবা জেরা করা হয়েছে, কবিতা এবং ম্যানিফেস্টো যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক ।

    ৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এঁদের কাজে আধুনিক জীবনের নানা চিহ্ণ সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে । এঁরা জিনিয়াস বা অসাধারণ, এমন দাবি না করেও বলা যায়, সমাজব্যবস্হার প্রতি তাঁদের যে মনস্তত্ত্বগত অনাস্হা, সেটি তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন স্পষ্ট ও মৌলিক ভাষায় । অন্যদিকে, এঁদের সমসাময়িক এবং অগ্রজরা এখনও ধ্রুপদি ভক্তিভাব বা সামাজিক ‘উন্নত’ ভাবনা, মার্কসবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কেই অধিক আগ্রহী । আমার মনে হয় না এই লেখকদের বিটনিক আখ্যা দেওয়া উচিত, বিট-অনুকারকও নয়, কারণ শব্দটাই অত্যন্ত কাগুজে বাঁধাধরা বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি আমেরিকার মাপদণ্ড অনুযায়ী ‘বিটনিকদের’ সঙ্গে এরা খাপ খায় না ।

    ১১ নভেম্বর ১৯৬৪ : এ একদম অসুস্হকর এক পরিস্হিতি । এরকমভাবেই সব চলতে থাকবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে আমি আসলে আপনাকে তড়িঘড়ি, অতি দ্রুত চিঠি লিখেছিলাম । কারণ পুলিশ শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমার ভারতে থাকতেই হয়েছে । এখন কিন্তু পরিস্হিতি যথেষ্ট সংকটপূর্ণ । প্রবীণ, দায়িত্ববান কোনোও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হস্তক্ষেপ না করলে এর থেকে নিষ্পত্তি সম্ভব নয় । বোধহয় ‘ক্যালকাটা কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম’ এর প্রতি চিঠি আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা আমার উচিত হচ্ছে না । যদি তাই হয়, তাহলে কলকাতার কংগ্রেসের দপতরে এ-বিষয়ে ভারপ্রাপ্তের হাতে দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দেবেন । আপনাকে রুষ্ট করে থাকলে মার্জনা করবেন । তবে, চিঠিতে অন্তত আপনাকে সোজাসুজি কথাগুলো বলছি । এই মুহূর্তে আপনার আমার মতানৈক্যের থেকেও পুলিশ পরিস্হিতিই প্রকৃত চিন্তার বিষয়।

    বলা বাহুল্য যে কলকাতার কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর কেষ্টবিষ্টুরা কেউ আমাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেননি । এই সময়েই, ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে TIME ম্যাগাজিনে আমাদের ফোটোসহ হাংরি আন্দোলনের সংবাদ বেরোয়, আর তা প্রতিষ্ঠানের কেষ্টবিষ্টুদের আরও ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল ।
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩৯541358
  • আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী
    --------------------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    মহারাজা রঞ্জিত সিংহের গালগল্পে প্রভাবিত হয়ে ঠাকুমা, যাঁর নাম ছিল অপূর্বময়ী, বাবার অমন নাম রেখেছিলেন । আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী জন্মেছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের লাহোর শহরে, ১৯১২ সালে । পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ সম্প৩ই নভেম্বর ১৭৮০ । বাবাও জন্মেছিলেন ১৩ই নভেম্বর । ছয় ভাই আর এক বোনের মধ্যে বাবা ছিলেন তৃতীয় বা সেজ ভাই । অন্যান্য ভাইদের পোশাকি আর ডাক নাম দুটিই থাকলেও, বাবার ওই একটি নামই ছিল, রঞ্জিত । ঠাকুর্দার আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় । ১৭০৯ সালে উত্তরপাড়া শহরটির পত্তন করেছিলেন দাদুর পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী ।
    ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী, পোরট্রেট আঁকতে পারতেন, এবং সেই সূত্রে তিনি বিভিন্ন রাজপরিবারের ডাকে সপরিবারে ভারতের এক রাজ দরবার থেকে আরেক রাজ দরবারে চলে যেতেন । লাহোরে গিয়ে তিনি ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরায় ফোটো তুলতে শেখেন, যাতে ফোটো তুলে তা থেকে ছবি আঁকতে সুবিধা হয় এবং রাজ পরিবারের মহিলাদের এক নাগাড়ে বসে থাকতে না হয় । সেসময়ে মেয়ো স্কুল অফ আর্টসের অধ্যক্ষ এবং লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটার ছিলেন রাডিয়ার্ড কিপলিঙের বাবা জন লকউড কিপলিঙ, যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের ও তাঁর অধীনে কাজ করার সূত্রে তাঁর কাছ থেকেই তিনি ফোটো তোলা শেখেন । ফোটো তোলা হতো সরাসরি ব্রোমাইড পেপারে । পরে, কাচের প্লেটে নেগেটিভ ফিল্ম তোলা হতো, সেই নেগেটিভকে রসায়নে চুবিয়ে রেখে ফোটো গড়ে উঠত; তারপর সেই প্লেটের ওপর ফোটোর কাগজ রেখে, প্রয়োজনীয় আলো দেখিয়ে ফোটো প্রিন্ট করা হতো, আর সেই প্রিন্টকে রসায়নে চুবিয়ে, শুকিয়ে, স্হায়ীত্ব দেয়া হতো ।
    ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরা ছিল বেশ ভারি ; বাইরে গিয়ে ফোটো তুলতে হলে তাকে বয়ে নিয়ে যাবার লোক দরকার হতো । বাইরে তোলা হচ্ছে বলে একসঙ্গে অনেকগুলো তুলে যেটা ভালো হল সেটা থেকে ফোটো তৈরি করা হতো । ফোটো তোলা হতো ক্যামেরা স্ট্যাণ্ডের ওপরে ক্যামেরা রেখে । ফোটো তোলার সময়ে হাত দিয়ে লেন্সের ঢাকনা খুলে, ‘স্মাইল প্লিজ’ বলে দু’এক সেকেণ্ডে আবার লেন্স পরিয়ে দেয়া হতো । স্টুডিওতে ফোটো তুলতে হলে প্রথম দিকে কুঁজোর মাপের হাজার-দুহাজার ওয়াটের বাল্বের আলোয় ফোটো তুলতে হতো, পরে অবশ্য বাল্বের মাপ ছোটো হয় । এখন প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে যে ড্যাগেরোটাইপের ঝঞ্ঝাটকে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক । বাবা এই প্রযুক্তি দেখে যেতে পারলেন না । শৈশবে তাঁকে দেখতুম শহরের বাইরে ফোটো তুলতে যাচ্ছেন কাজের লোক রামখেলাওন সিংহের কাঁধে ক্যামেরার বাক্স চাপিয়ে, নিজে ক্যামেরা তিন-ঠেঙে স্ট্যান্ড আর মাথায় চাপা দেবার কালো মোটা কাপড় । বাবা মারা যাবার পর যখন পাটনার বাড়ি ছেড়ে চলে আসলুম, দেখেছিলুম তিনতলার একটা ঘরে থাক-থাক কাচের প্লেট, কড়িকাঠ থেকে র‌্যাকে সাজানো । ইতিহাসবোধ না থাকলে যা হয়, আমি বা দাদা আমরা কেউই সেগুলো সংরক্ষণের প্রয়াস করিনি ।
    দাদুর ছেলেরাও ফোটো তোলা আর ছবি আঁকায় সড়গড় হলে দাদু ১৮৮৬ সালে ফোটোগ্রাফির ভ্রাম্যমান ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন, এবং সংস্হাটির তিনি নাম দেন ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ । হুগলি জেলায় গঙ্গা নদীর ধারে উত্তরপাড়ার পাশে এখন যেখানে বালি ব্রিজের সংলগ্ন ফ্লাইওভার, তখন একটা রাস্তা ছিল, সেখানে একটা দপতর খুলে নকাকাকে চালাতে বলেছিলেন । কিন্তু নকাকা তা সামলাতে পারেননি, হঠাৎ বৈরাগ্যে আক্রান্ত হবার কারণে ।
    দাদুর অমন ঘোরাঘুরির কারণে বড়জেঠা, মেজজেঠা, বাবা, পিসিমা আর নকাকার স্কুলে পড়া হয়ে ওঠেনি । দাদু হঠাৎ মারা যাবার পর তাঁর ছেলেরা পাটনায় থিতু হতে বাধ্য হন এবং তখন নতুনকাকা আর ছোটোকাকাকে স্কুলে ভর্তি করা হয় । নতুনকাকা নিয়মিত স্কুল করলেও ছোটোকাকার আগ্রহ না থাকায় তিনি পড়াশোনা ত্যাগ করেন । জেঠাকাকাদের যেটুকু পড়াশোনা হয়েছিল তা রাজদরবারগুলোর শিক্ষকদের অবদান । দাদু সংস্কৃত আর ফারসি লিখতে-পড়তে পারতেন । বাবা ইংরেজি ভাষা আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন ।
    দাদু বিভিন্ন সময়ে আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার এবং পাকিস্তানের বাহাওলপুর, চিত্রাল, হুনজা, ফুলরা, মাকরান ও লাহোরে ছিলেন। আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর লাহোরে চলে যান । বড়জেঠার মুখে শুনেছি যে বাহাওলপুরের সেই সময়ের ডাকটিকিটে আমিরের পোরট্রেট ছিল দাদুর আঁকা । ওই অঞ্চলের ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির মাংস আর শুঁটকিমাংস খাওয়ার সঙ্গে বাবার ভাইরা নিজেদের মানিয়ে নিলেও বাবা পারেননি, এবং তিনি সারা জীবন শাকাহারী হয়ে যান । বাবার মুখে শুনেছি যে বাজারে ঝোলানো গোরু, মোষ, ইয়াক আর কাটা উটের মাংস দেখার পর উনি আর মাংস খেতে পারতেন না, তাই নিরামিশাষী হয়ে যান । দুম্বা একরকমের ভেড়া যার ল্যজের জায়গায় বাড়তি মাংস গজায়, আর বাড়তি লেজের মাংস, বড়জেঠার বক্তব্য অনুযায়ী, ছিল খুবই সুস্বাদু ।
    ফোটোগ্রাফির সূত্রেই দাদুর সঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগণার পাণিহাটি-নিবাসী আমার দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়েছিল । কিশোরীমোহন ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের উৎস আবিষ্কারক রোনাল্ড রসের সহগবেষক । রোনাল্ড রস স্বদেশে ফিরে যাবার পর কিশোরীমোহন ম্যালেরিয়া রোগের কারন ও তা প্রতিরোধ করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ম্যাজিক লন্ঠনে স্লাইড দেখিয়ে প্রচার করতেন । এই স্লাইডগুলো তৈরি করে দিয়েছিলেন দাদু । কিশোরীমোহন তাঁর বড় মেয়ে অমিতার সঙ্গে বাবার বিয়ে দেন । বিয়ের সময়ে মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর । কিশোরীমোহন সম্পর্কে উইকিপেডিয়া আর নেটে অন্যত্র তথ্য আছে । বাবা নিজে শাকাহারী হলেও মাকে বাধ্য করেননি তাঁর আহারের রুচি অনুসরণ করতে ; আমি আর দাদা দুজনেই আমিষাশী । দাদু প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময়ে উত্তরপাড়া ফিরে যেতেন ; ছেলেদের বিয়ে দেয়ার কাজটাও সেরে নিতেন সেই সময়টুকুর মধ্যে ।
    দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার জন্য ডাক পড়লে দাদু সপরিবারে পাটনায় যান, আর সেখানেই হৃদরোগে মারা যান । পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিল দাদুর ওপর ; তিনি মারা যেতে ঠাকুমা বিপদে পড়েন । তাঁরা একটি মাটির দেয়ালের ওপর টালির চালার বাসা ভাড়া করে বিভিন্ন উপায়ে টাকা রোজগারের চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছুতেই সফল না হতে পারায় বাবা দাদুর প্রতিষ্ঠিত সংস্হা ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ছবি আঁকা আর ফোটো তোলার একটি স্হায়ী দোকান চালাবাড়ির কাছেই, বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে, খোলেন । ঠাকুমার জাঠতুতো ভাই কলকাতা মিউজিয়ামের সহকিউরেটার লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশে বড়জেঠা পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ বর্গের একটি চাকরি পান । পরে অবশ্য তিনি নিজের যোগ্যতার দরুন পদোন্নতি পেয়ে পাটনা মিউজিয়ামের ‘কিপার অব পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার’ হয়েছিলেন। বড়জেঠা মাটির মূর্তি তৈরি করায় আর অয়েল-পেইন্টিং আঁকায় দক্ষ ছিলেন । ছোটোবেলায় ছুটির দিনে আমি মিউজিয়ামের এক থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়াতুম, চৌকাঠ ডিঙোতেই প্রাগৈতিহাসিক থেকে মহেঞ্জোদরোয়, সেখান থেকে অশোকের রাজত্বে !
    দাদু মারা যেতে, ঠাকুমা উত্তরপাড়ার বসতবাড়িতে, যা অবহেলায় খণ্ডহরের চেহারা নিয়ে ফেলেছিল, থাকতে চলে গেলে, পরিবারের আর্থিক ভার পুরোপুরি এসে পড়েছিল বাবার কাঁধে । ঠাকুমা ছেলেদের আর তাদের বোউদের বলে দিয়ে যান যে আমার মা সংসারটাকে সামলাবেন । যেকোনো কারণেই হোক মেজজেঠা, নকাকা আর কাকাবাবুর স্বভাব আর আচরণ এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আমরা শৈশবে শুনতুম যে এঁরা কিছুটা অপ্রকৃতিস্হ । দোকানের কাজে তাঁদের তেমন আগ্রহ ছিল না ; তাঁরা প্রকৃতই শিল্পীচরিত্রের বিপন্ন বিস্ময়ে আক্রান্ত অস্বাভাবিকতা পেয়েছিলেন । মেজজেঠা ঘুম থেকে উঠতেন দুপুরবেলা, তারপর জলখাবার খেতেন কোনো দোকান থেকে লুচি আলুর তরকারি কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কখনও চুল আঁচড়াতেন না, বাড়ি ফিরে দাঁত মেজে স্নান করে বিকেলের দিকে দোকানে পৌঁছোতেন, এবং একটি ফোটোর সামনে বসে তাকে মাসখানেকে আঁকা অপূর্ব ছবিতে দাঁড় করাতেন । নকাকা অনেক ভোরে উঠতেন, সবাইকে, শিশুদেরও ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, স্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না, জুতো পরার অভ্যাস ছিল না, কোরা ধুতি পরতেন, নিজের ধুতি-শার্ট নিজেই কাচতেন, কোনো এক ফাঁকে দোকানে গিয়ে বাড়িতে করার জন্য বাবার কাছ থেকে ‘কাজ’ চেয়ে আনতেন । ছোটোকাকা মাঝরাতে নিজের ঘরে ছোটোকাকিমার নানা আঙ্গিকের পোশাকহীন ফোটো তুলতেন আর দোকানে গিয়ে বাবাকে সাহায্য করার নাম করে ডার্করুমে ঢুকে সেই ‘অপ্সরা’ ফোটোগুলো প্রিন্ট করে নিতেন । উনি যখন উত্তরপাড়ায় পাকাপাকি চলে গেলেন তখন তাড়াহুড়োয় অ্যালবামগুলো নিয়ে যেতে ভুলে যান । ছোটোকাকা ৯০ বছর বয়সে মারা যান, নিঃসন্তান ; উত্তরপাড়ার বাড়ির অংশ ছোটো শালার প্রথম পক্ষের মেয়েকে দিয়ে গেছেন ।
    বিহারের ভূমিকম্পে চালাবাড়ি ধ্বসে পড়ার পর বড়জেঠা ঠাকুমার আর বড়জেঠিমার গয়নাগাটি বেচে ইমলিতলা নামে একটি নিম্নবর্গ ও গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত পাড়ায় বাড়ি কেনেন । তখন নিম্নবর্গের লোকেদের বলা হতো অস্পৃশ্য, আর সেকারণেই দুসাধ-মুসহর-কাহার-ডোম-চামার পরিবার অধ্যুষিত ঘিঞ্জি নিচুচালা-বস্তির সস্তা এলাকায় বাড়ি কেনা সহজ হয়। তেঁতুলগাছটা দাদার জন্মের সময়ে ছিল, আমি দেখিনি, কেননা তেঁতুলগাছটা কেটে সেই জায়গায় জলের কল আর গ্যাসবাতির থাম বসিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার । পাটনার অন্যান্য বাঙালিরা ইমলিতলাকে বলতেন ছোটোলোকদের পাড়া । সেকারণে আমাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ওই ছোটোলোক ছাপ্পা পড়ে গিয়েছিল । পাটনার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান বাঙালিরা ওই সরু গলির ভেতরে ঢুকে দিনের বেলাতেও আমাদের বাড়ি আসতেন না । বড়জেঠা যেতেন তাদের বাড়ি, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য । আমি যখন স্কুলে ঢুকলুম তখন স্কুলের বন্ধুরাও ইমলিতলা শুনে আমাদের বাড়ি আসতে চাইত না ; অনেকে নাম শুনেই ভয় পেত, অঞ্চলের কুখ্যাত নিবাসীদের কাজকর্মের দরুন । মেজদা, যাকে শিশু অবস্হায় এক বেশ্যার কাছ থেকে বড়জেঠা কিনেছিলেন, পাড়ার চাপ এড়াতে না পেরে পুলিশের নথিতে গুণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, মাদকের দরুন কম বয়সে মারা গিয়েছিল ।
    বাবা ভোরবেলা বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতেন বেশ রাত করে । ফোটো তোলা, জিনিসপত্র বিক্রি আর ডার্করুমের কাজ তাঁকে একা করতে হত বলে ভোরবেলা জলখাবার খেয়ে সোজা গিয়ে ডার্করুমে ঢুকতেন, তারপর রাতে দোকান বন্ধ করার পর আবার ঢুকতেন ডার্করুমে । বিহারে সেসময় তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, তাই কাজ পেতে অসুবিধা হতো না । মা আর বাবা দুজনের চরিত্রেই যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল সবায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলা । বাবা বাড়ির প্রধান রোজগেরে হলেও নিজের ভাইদের আর তাদের ছেলে-মেয়েদের, মানে আমাদের জাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনদের, সমান চোখে দেখতেন। বড়জেঠা ইমলিতলা বাড়ির ট্যাক্স আর সবজি কিনতেন, বাবা বাদবাকি সমস্ত খরচ করতেন, ঠাকুমাকে টাকা পাঠাতেন, উত্তরপাড়ার বাড়ির ট্যাক্স দিতেন । চালগমের দোকানদারকে মাসে একবার, মায়ের তৈরি ফিরিস্তির কাগজ, দোকানে যাবার পথে বাবা দিয়ে যেতেন আর সে ইমলিতলার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত । পরিবারের সদস্যদের পোশাকের জন্য বাবা দর্জিকে বলে রেখেছিলেন, তার দোকানে গিয়ে মাপ দিয়ে দিতে হতো, সে তৈরি করে বাড়ি পাঠিয়ে দিত । একইভাবে ছিল জুতোর দোকানের সঙ্গে বন্দোবস্ত । চুল কাটার জন্য মাসে একবার নাপিত আসত, পরে বাবার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিত ।
    ইমলিতলার বাড়িতে বাবা-মা-দাদা-আমি যে ঘরটায় থাকতুম সেটাই ছিল বাড়ির সবচেয়ে ছোটো ঘর । লন্ঠনের আলোয় পড়াশুনা করতে হতো । চেয়ার-টেবিল ছিল না, দোকানের মালপত্র যে প্যাকিংবাক্সতে আসত তার ওপর চাদর পেতে বই রাখার ব্যবস্হা ছিল । পাড়ার কুসঙ্গ-কুখ্যাতির প্রভাব দাদার ওপর পড়তে পারে অনুমান করে ম্যাট্রিক পাশের পর ১৯৪৯ সালে দাদাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল পাণিহাটিতে থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করার জন্য । কলকাতায় দাদা সিটি কলেজে ভর্তি হন । কলেজে বন্ধু হিসেবে পান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচী প্রমুখ তরুণ কবিদের । দাদা বিহার সরকারের মৎস্য বিভাগে চাকরি পেলে তাঁর পোস্টিঙের জায়গায় বন্ধুরা একা বা দলবল নিয়ে পৌঁছোতেন । ছোটোবেলায় আমি একবার তাড়ি খেয়েছিলুম, মানে পাড়ার এক সর্বজনীন দাদু খাইয়ে দিয়েছিল । মুখে তাড়ির গন্ধ পেয়ে মা আমায় আমাদের ঘরে শেকল তুলে বন্ধ করে দিয়েছিলেন ; বাবা রাতে বাড়ি ফিরলে শেকল খোলা হয় । মায়ের সব সময় আশঙ্কা ছিল যে আমরা দুই ভাইও মেজদার মতন অসামাজিক চরিত্রের মানুষ হয়ে যেতে পারি । পাড়ায় মেলামেশায় কোনো নিষেধাজ্ঞা কিন্তু ছিল না । ছোটোবেলায় চোর-পুলিশ খেলতে গিয়ে অনেকের শোবার ঘরে ঢুকে খাটের তলায় লুকোবার স্মৃতি আছে ।
    ইমলিতলার বাড়িতে জলের কল ছিল না ; বড়জেঠা তো অফিস চলে যেতেন, জল ভরে এনে দেবার লোক না এলে দুপুরে বাবা যখন দোকান থেকে আসতেন, অনেক সময়ে নিজের স্নান করার জল নিজেই কল থেকে ভরে আনতেন। শীতকালেও ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেন । দাদা আর আমি ইমলিতলায় রাস্তার কল থেকে জল ভরে এনেছি, রাস্তার কলে স্নান করেছি । বাবার নির্দেশ ছিল যে বাড়ির সব কাজ আমাদেরও করতে হবে, প্রয়োজনে কয়লা ভাঙা আর উনোন পরিষ্কার, জঞ্জাল ফেলে আসাও । বাবা রাস্তার কলে স্নান করতে লজ্জা পেতেন । ২০০৫ - ২০০৮ নাগাদ আমি কলকাতার রাস্তা থেকেও খাবার জল ভরে আনতুম পেপসির বোতলে করে, কেননা তিন তলায় কোনো ভারি জলের টিন নিয়ে বা মিনারাল ওয়াটারের বড়ো বোতল নিয়ে রিকশাঅলা উঠতে চাইত না । মাঝে-মাঝে দাদার বাড়ি গিয়ে দুটো থলেতে পেপসির বোতলে জল ভরে আমি আর আমার স্ত্রী সলিলা রিকশা করে নিয়ে আসতুম নাকতলার বাড়িতে। এই সমস্ত অসুবিধার জন্যেই নাকতলার ফ্ল্যাটটা বেচে মুম্বাইতে একরুমের ফ্ল্যাটে চলে আসতে হয়েছে ।
    বাবা চিরকাল শাদা পাঞ্জাবি, ধুতি আর পায়ে পামশু পরতেন । তাঁর ভাইয়েরা শাদা ছাড়া অন্যান্য রঙের শার্ট বা পাঞ্জাবি পরলেও বাবার পোশাকের অন্যথা হতো না, শীতকাল ছাড়া, যখন উনি নস্যি রঙের শাল গায়ে দিতেন, বা ওই রঙের উলের পাঞ্জাবি পরতেন । দোকানে যাবার তাড়ায় বাবার দ্রুত হাঁটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । ইমলিতলায় থাকতে দুবার ওনার পা দোকানে যাবার পথে ভেঙে গিয়েছিল ; বাবার পা ভাঙা মানে আর্থিক দিক থেকে বেশ বিপজ্জনক অবস্হা ; দাদাকে গিয়ে দোকানে বসতে হত । উত্তরপাড়া থেকে চাকুরিহীন কোনো জ্ঞাতির ছেলেকে নিয়ে এলেও তাদের অবাঙালি পরিবেশে মানিয়ে নিতে এতই অসুবিধা হত যে কয়েক দিনেই তারা ফেরত চলে যেত । পরে দরিয়াপুরে গিয়ে বাবার যখন আরেকবার পা ভেঙেছিল তখন আমি দোকানদারি করেছি । গরিব হলে যা হয়, গতি কেবল সরকারি হাসপাতাল, সেখানে কিউ, কেননা প্রায়ভেটে কোনো নার্সিং হোম ছিল না সেসময়ে ; এখন তো প্রতিটি রাস্তায় একজন করে হাড়ের ডাক্তার । বড়জেঠির এক বান্ধবীর স্বামী ছিল ছুতোর ; ওনার পা ভেঙে যেতে, জেঠিমার বান্ধবীর কথামতো বাবার পায়ে বসাবার জন্য ছুতোরকে দিয়ে কাঠের খাপ তৈরি করিয়ে পায়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্হা হয়েছিল । প্রথমবার বানিয়ে দেয়া খাপটা দ্বিতীয়বার কাজে লেগে গিয়েছিল ।
    বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল সেই বাড়ির মালিক উঠে যাবার নোটিস দিলে বাবা পড়েন মহাবিপদে । বিকল্পের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি তখনকার বারি রোডে দরিয়াপুরে একটা চালাবাড়ি কেনেন ; সেটা ছিল একজন কামারের হাপর-বসানো ঘর, পেছনে আর পাশে সামান্য জমিতে ঝোপ । এই এলাকাটাও সেসময়ে গরিবদের পাড়া ছিল, ধারণার অতীত দুস্হ সুন্নি মুসলমানদের পাড়া । বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল তার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা চলে বেশ কয়েকবছর ; সেই সুযোগে দরিয়াপুরে দোকানঘর তৈরি করে ফেলা হয় । তৈরি হয়ে গেলে পুরোনো দোকানের পাট গুটিয়ে বাবা চলে আসেন দরিয়াপুরে । ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’-এর খ্যাতির কারণে পুরোনো খদ্দেররা দরিয়াপুরে আসত । এখন এই সংস্হা চালায় দাদার বড় ছেলে হৃদয়েশ ।
    দরিয়াপুরে যখন দোকান তৈরি হচ্ছিল তখন আমি ওই বাড়িতে একা থাকতুম, কেননা ইমলিতলার প্রাত্যহিক মাতালদের চেঁচামেচি আর ঝগড়াঝাঁটির দরুন পড়তে বসে বেশ অসুবিধা হত । তাছাড়া দরিয়াপুরে ইলেকট্রিসিটি ছিল, কলের জল ছিল। ছোটোদের হাতখরচের জন্য বাবা টাকা দিতেন না ; বলতেন যার যা চাই জানিয়ে দাও, কিনে এনে দেব । স্কুলের বাৎসরিক ফলাফলের রিপোর্টে বাবা কখনও কাউকে ‘গুড’ দিতেন না । নব্বুইয়ের কোঠায় মার্কস পেলেও দিতেন না ; বলতেন আরও বেশি পেতে হবে । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকলে আমার চরিত্রদূষণ ঘটতে পারে অনুমান করে বছরখানেক পরে মা আর বাবা রাতে শুতে আসতেন । মা টিফিন ক্যারিয়ারে করে রাতের খাবার আনতেন । দিনের বেলা ইমলিতলায় গিয়ে খেতে হতো । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকার সময়ে বন্ধুদের নিয়ে কিঞ্চিদধিক চরিত্রদূষণ যে ঘটত না তা বলা যাবে না ।
    বাবা আর মা দুজনেই মন্দিরে গিয়ে পুজো দেয়া বা তীর্থকর্ম করা ইত্যাদিতে আগ্রহী ছিলেন না ; আমার মনে হয় কাজের চাপে উনি সংস্কারমুক্ত করে ফেলেছিলেন নিজেকে । । আমি কখনও তাঁদের তীর্থক্ষেত্রে বেড়াতে যেতে দেখিনি । জেঠা-কাকারাও কেউ আগ্রহী ছিলেন না ; পাটনার বাইরে যেতে হলে তাঁরা যেতেন কেবল দেশের বাড়ি, অর্থাৎ উত্তরপাড়ায় । তবে বাবা নিয়মিত পৈতে বদলাতেন, একাদশীর দিন লুচি খেতেন । কালীঘাটের কালী আমাদের পারিবারিক দেবতা, যেহেতু তা আমাদের কোনো পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত, সেকারণে বাড়িতে পারিবারিক দেবতা আর তার সেবাযত্ন করার প্রয়োজন হতো না । পৈতে পরতেন বড়জেঠা আর ছোটোকাকা, যদিও খাওয়ার কোনো নিষেধ মানতেন না, মেজজেঠা কখনও পৈতে পরতেন আবার কখনও কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দিতেন । দাদার আর আমার ছোটোবেলায় পৈতে হয়েছিল বটে কিন্তু আমরা স্বরূপে এসে জলাঞ্জলি দিয়েছিলুম । পৈতেহীন হবার কারণে বাবা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন বলে মনে হয় না ; এই প্রসঙ্গে কখনও কোনো কথা তোলেননি ।
    মা, বাবা এবং শিক্ষক, যে তিনজন মানুষ ব্যক্তিজীবনের অভিমুখ গড়ে দেয়, আমার জীবনে মা আর বাবার ভূমিকাই প্রধান । প্রকৃত অর্থে আমি কোনো শিক্ষক সেই সময়ে পাইনি যখন তা জরুরি ছিল । প্রাইমারি স্তরে ক্যাথলিক কনভেন্টে পেয়েছিলুম সিসটার আইরিনকে আর যাযক ফাদার হিলম্যানকে । শৈশবের বইতে বর্ণিত সমস্ত জিনিস যাতে নিজের চোখে দেখে যাচাই করতে পারি তার দিকে খেয়াল রাখতেন সিসটার আইরিন আর স্বদেশ আয়ারল্যাণ্ডে গেলে অনেককিছু সংগ্রহ করে আনতেন, স্কুল সংল্গন ফার্মে নিয়ে গিয়ে ফল, ফুল, গাছ, জন্তুতের চাক্ষুষ করাতেন । ফাদার হিলম্যানের সৌজন্যে আমি কনভেন্টে ভর্তি হয়েছিলুম ; উনি ফোটো তুলতে ভালোবাসতেন আর বাবার সঙ্গে ওনার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, আমাকে দোকানে দেখতে পেয়ে সাড়ে তিন বছর বয়সে নিয়ে গিয়ে ট্রানজিশান ক্লাসে ভর্তি করে দেন; সপ্তাহে একদিন চার্চে বাইবেল ক্লাসে নিয়ে গিয়ে ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্টের কাহিনি শোনাতেন । পরে যখন ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন সেমিনারিতে ক্লাস সিক্সে গিয়ে ভর্তি হলুম, কোনো শিক্ষকের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে উঠল না ; এই স্কুলে যিনি আমাকে বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী করলেন, তিনি গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী , আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসের সুমিতাদি।
    মা আর বাবার কাছ থেকে যা পেয়েছি তা হল সততা, নিজের বিশ্বাসের সমর্থনে একক লড়াই করার চারিত্র্য । বাবা দোকানদার হয়েও সৎ ছিলেন, যা আজকের দিনে অকল্পনীয় । কেবল সৎ নয়, তাঁর ছিল সৎসাহস । হাংরি আন্দোলনের সময়ে আদালতের মামলায় বন্ধুরা যখন আমার বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে রাজসাক্ষী হয়ে গেল, আর লড়াইটা আমার একক হয়ে দাঁড়াল, তখন আমি আমার চরিত্রগঠনে মা আর বাবার অবদানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলুম । বাবা কলকাতায় লালবাজারে গিয়ে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন যে অমন মকদ্দমা কেন করা হয়েছে আর তখনই জানা যায় যে কলকাতার কয়েকজন সমাজকর্তা-বুদ্ধিজীবীর নালিশ কাজ করেছে এর পেছনে, যাদের বলা হয় এসট্যাবলিশমেন্টের ধারক-বাহক । মকদ্দমা চলার সময়ে বাবা কয়েকবার পাটনা থেকে দুএক দিনের জন্য দোকান বন্ধ করে কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে আসতেন । যারা আমার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিল আর চামড়া বাঁচাবার জন্য রাজসাক্ষী বা সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেল তাদের পরিবারের কাউকে কোনো দিন আসতে দেখিনি কোর্টে ; অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের ছেলের সাহিত্যকর্মকে সমর্থন করতে পারেননি।
    বাবা আমাদের বাড়ির ক্ষমতাকেন্দ্র হলেও ছোটোদের কাউকে শাসন করতেন না । তাঁর কাছে অভিযোগ জানালে তিনি বলতেন, “অ, ও শুধরে নেবে ।” তারপর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে বলতেন, “কী, শুধরে নিবি তো ? বড় হয়েছিস, শুধরে নিতে শেখ।” বড়জেঠা শাসন করতেন, নিজে থেকে নয়, জেঠিমা-কাকিমারা অভিযোগ করলে, কিন্তু অভিযোগ করলে তিনি বিরক্ত হতেন । বড়জেঠার দুই মেয়ের বিয়ে আমার শৈশবেই হয়ে গিয়েছিল । মেজজেঠা আর কাকাদের মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্হা করেন বাবা, তাঁদের শৈল্পিক উদাসীনতায় ওদের বয়স বেড়ে যাচ্ছিল ; তাছাড়া বিয়ের খরচের ব্যাপারটাও ছিল । মেজজেঠার এক মেয়ে মীনাক্ষী একজন বিহারি ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলে মেজজেঠা অমত জানান ; মেজজেঠার অমত হওয়ায় বাবা তাঁকে বোঝালেও তিনি রাজি হননি । বাবা তাঁর বিরুদ্ধতা করে মেজজেঠাকে অপমানিত করতে চাননি । শেষে আমাকে টাকাকড়ি দিয়ে বলেন যে ওরা কোথায় গিয়ে বিয়ে করতে চাইছে সেখানে গিয়ে সম্প্রদান করে আয় । আমার ছোটোশালী এক যুবককে বিয়ে করতে চাইলে নাগপুরে অভিভাবকরা রাজি হলেন না, তখন তার বিয়েও দরিয়াপুরের বাড়ি থেকে হল ।
    দাদা যখন চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন সেখানে সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে বেলার সঙ্গে পরিচয় হয়, আর দাদা পাটনায় গিয়ে বাবাকে বিয়ের কথা জানাতে তিনি তক্ষুনি রাজি হয়ে যান । আমি অফিসের কাজে নাগপুরে গিয়ে কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় আর সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ের প্রস্তাব দিতে ওর অভিভাবকরা সেদিনেই সায় দেন । বাবাও টেলিগ্রামে অনুমোদন জানিয়ে দেন । কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই এই বিয়েকে মা আর বাবা বলতেন, “তোদেরটা বৈপ্লবিক বিয়ে, পরিবারদের মাথা গলাতে হল না, হপ্তার পর হপ্তা রোদ-বৃষ্টি ঠেঙিয়ে প্রেম করতে হল না, ব্যাস, একজন আরেকজনকে বললি বিয়ে করব, করে ফেললি ।”
    আমি লেখালিখির চেষ্টা করছি, মায়ের কাছে সেকথা জানতে পেরে ১৯৫৮ সালে বাবা আগফা-গেভার্ট কোম্পানির একটা দামি ডায়েরি দিয়েছিলেন, আর তাতেই আমি কবিতা মকসো করা শুরু করেছিলুম । বাড়িতে ইংরেজি ভাষার পছন্দের বইয়ের সংগ্রহ গড়তে চাই জানতে পেরে বাবা বলতেন বইয়ের তালিকা তৈরি করে দিতে । বইয়ের দোকানে গিয়ে বই পছন্দ করে নিতুম আর পেয়ে যেতুম । বাংলা বই, বিশেষ করে কবিতার বই দাদা কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন । পরে বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকেও প্রচুর বই আর পত্রিকা পেতুম । হাংরি আন্দোলনের সময়ে কলকাতার পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করতে এসে আমার বইগুলো নিয়ে সারা ঘরে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেছিল । বাবার দোকানের কাচের আলমারি ভেঙে দিয়েছিল । মায়ের বিয়ের তোরঙ্গ ভেঙে লণ্ডভণ্ড করার সময়ে ওনার বিয়ের পুরোনো বেনারসি ভাঁজ থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল । কিন্তু আমাকে যখন কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে গেল পুলিশ তখন বাবাকে বেশ বিচলিত দেখেছিলুম, যা উনি সচরাচর হতেন না । ছোটোবেলায় আমি বাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার পালিয়েছি ; ফিরে এসে মনে হয়নি যে বাবা বিচলিত ; উনি আমাকে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা জিজ্ঞাসাও করতেন না । পরে, আমার মেয়ের কাছে গল্প করেছিলেন যে আমি ওনাদের না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতুম ।
    অ্যালেন গিন্সবার্গ আমাদের দরিয়াপুরের বাড়িতে এসে ছিলেন কয়েক দিন । তিনি নানা শহরে ঘুরে বেশ কিছু ফিল্মে ফোটোম তুলেছিলেন আর সেগুলো বাবাকে দেন ডেভেলাপ করার জন্য । বাবা ডেভেলাপ করে দ্যাখেন গিন্সবার্গ কেবল নুলো, ভিখারি, দুস্হ, পথের পাশে অসুস্হ লোক, কুষ্ঠরোগি-- এদের ফোটো তুলেছে । তখন গিন্সবার্গের সঙ্গে ওনার একচোট ঝগড়া হয়েছিল । বাবা গিন্সবার্গকে বলেছিলেন, “তোমরা যতই বড় কবি-লেখক হওনা কেন, আমাদের দেশটাকে এইভাবেই দেখাতে চাইবে ; কেন ? ফোটো তোলার আর কোনো বিষয় কি নেই !” গিন্সবার্গ সম্পর্কে যে গবেষকরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাঁদের সবাইকে এই ঘটনার কথা জানালেও, কেউই নিজেদের লেখায় এই বিতর্কটা অন্তর্ভুক্ত করেননি । পরে , পাটনার বাড়িতে বা কলকাতায়, বিদেশিরা এলে আমি তাঁদের বলতুম যে ফোটো তুলে থাকলে দেশে ফিরে ডেভেলাপ আর প্রিন্ট করিও ।
    আমি প্রথম চাকরিটা পাই পাটনাতেই । তারপর ১৯৭৯ নাগাদ গ্রামোন্নয়নের চাকরি পেয়ে স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চলে যাই লখনউ । দাদা সপরিবারে পাটনা ফেরার পর মা আর বাবা আমার কাছে লখনউ চলে আসেন । লখনউতে ১৯৮২ সালের ১৮ই নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মা মারা যান । মা মারা যেতে বাবা বেশ একা বোধ করতেন, কেননা আমি আর সলিলা দুজনেই অফিসে চলে যেতুম আর ছেলে-মেয়ে চলে যেতে স্কুলে । দাদা তাই বাবাকে পাটনায় নিয়ে যান । লখনউ থেকে আমি ১৯৮৭ সালে বদলি হয়ে মুম্বাই চলে যাই । বাবাকে তখন মুম্বাই নিয়ে গেলে ভালো হতো ; মুম্বাইতে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা পাটনার চেয়ে উন্নত । ১৯৯১ সালের ৮ই অক্টোবর বাবা পাটনায় মারা যান ।
  • মলয় | 012312.60.4523.107 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৪১541359
  • আমার মা অমিতা রায়চৌধুরী
    ---------------------------------------------
    মলয় রায়চৌধুরী
    আমার মায়ের জন্ম ১৯১৬ সালে, পানিহাটিতে । মায়ের ডাক নাম ভুল্টি । মায়ের বাবা, কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, পানিহাটির রামচাঁদ ঘাট রোডে ‘নিলামবাটী’ নামে এক একান্নবর্তি পরিবারের সদস্য ছিলেন । কিশোরীমোহন ছিলেন, কলকাতা ও সেকেন্দ্রাবাদে, ম্যালেরিয়া রোগের কারণ নির্ণয়কারী ও ১৯০২ সালে সেকালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ডাক্তার রোনাল্ড রস-এর সহকারী । তাঁর অবদানের জন্য ১৯০৩ সালে দিল্লি দরবারের সময়ে কিশোরীমোহনকে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছিল । ২০১৩ সালে প্রকাশিত তাঁদের ‘দি ফ্লাইং পাবলিক হেল্হ টুল : জেনেটিকালি মডিফায়েড মসকিটোজ অ্যান্ড ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল’ ( সায়েন্স অ্যাজ কালচার, ল্যাংকাস্টার, ইউ কে ) গবেষণাপত্রে উলি বিজেল এবং ক্রিস্টোফ বোয়েট অধ্যাপকদ্বয় জানিয়েছেন যে উপনিবেশের নেটিভ হবার কারণে কিশোরীমোহনের নাম রোনাল্ড রসের সঙ্গে সুপারিশ করা হয়নি । সমাজ সেবার কাজে স্ত্রীর গয়না এবং পৈতৃক সম্পত্তি বেচে, আর সঞ্চয়ের পুঁজি খরচ করে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান, আর মায়ের বিয়ের কয়েক বছর পরই মারা যান ।
    দেউলিয়া অথচ খ্যাতিপ্রাপ্ত অমন একটি বাংলা-ইংরেজি পড়া আধুনিক পরিবার থেকে মা আমাদের সংস্কৃত-ফারসি পড়া গঙ্গার অপর পাড়ের উত্তরপাড়া নিবাসী পরিবারে এসেছিলেন । উত্তরপাড়ার জমিদারবাড়ি তখন খণ্ডহরে রূপান্তরিত হওয়া আরম্ভ হয়েছে । আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ ছিলেন কিশোরীমোহনের বন্ধু । ম্যালেরিয়া রোগ সম্পর্কে প্রচারের জন্য পেইন্টার-ফোটোগ্রাফার ঠাকুর্দা কিশোরীমোহনকে ম্যাজিক লন্ঠনের জন্য স্লাইড তৈরি করে দিতেন । বিয়ের সময় মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর । বাবা, রঞ্জিত, জন্মেছিলেন লাহোরে । ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার ঠাকুর্দা বহুকাল আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার আর বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ছিলেন । অর্থাৎ মা এসে পড়েছিলেন এমন একটি পরিবারে যার সদস্যদের সাংস্কৃতিক চরিত্রগঠন ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছিল ।
    ছয় ভাই আর এক বোনের সেজভাই ছিলেন আমার বাবা । বড়জেঠিমা নন্দরানি নয় বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন । মেজজেঠিমা এসেছিলেন তেরো বছর বয়সে । কাকিমারা এসেছিলেন তাঁদের বয়স যখন সতেরো । দাদু তাঁর ছেলে আর তাদের স্ত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন রাজপরিবারের অতিথি হয়ে তার সদস্যদের ফোটো তুলে পেইনটিঙ তৈরি করে দিতেন । পাটনায় দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার সময়ে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । দাদু মারা যাবার পর বড়জেঠা পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ শ্রেনির কাজ পান ; কিন্তু ওইটুকু মাইনেতে এতজনের পরিবারের খরচ সামলানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল । বছর দশেক পরে অবশ্য উনি পদোন্নতি পেয়ে কিপার অফ পেইন্টিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচাসর হন । ভাই আর তাদের পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে বাবা ফোটোগ্রাফির স্হায়ী দোকান খোলেন পাটনায় । এই সময় থেকে আমাদের পরিবারে মায়ের গুরুত্ব বেড়ে যায় । দারিদ্র্য সামলাতে না পেরে ঠাকুমা মায়ের হাতে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে চলে যান উত্তরপাড়ার খণ্ডহরে একা থাকতে । ভূমিকম্পের পর ইমলিতলার অন্ত্যজ পাড়ায় বিহারি কাঠামোর একটি বাড়ি কিনে পুরো পরিবার সেখানে চলে আসেন । দলিত বিহারি এবং অতিদরিদ্র শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ার মাগধি আর ভোজপুরি ইথসকে সহজেই মা আ্ত্তীকরণ করে নিতে পেরেছিলেন ।
    সংসারের ক্ষমতা মায়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবার পর মায়ের চরিত্রে লুকোনো কিশোরীমোহন বেরিয়ে আসে । প্রায়ই দেখতুম ইমলিতলার প্রতিবেশিরা এসে মায়ের কাছে নিজেদের আর্থিক দৈন্য আর পারিবারিক দুর্দশার গল্প করছে, আর মা তাদের সাহায্য করছেন, পয়সাকড়ি দিয়ে তো বটেই, চাল-ডাল, পুরোনো বাসনপত্র আর ব্যবহৃত জামাকাপড়, পুরোনো হয়ে আসা জুতো ইত্যাদি দিয়ে দিয়ে । মায়ের বোনেদের বিয়ে আরও গরিব পরিবারে হয়েছিল বলে পুজোয় পাওয়া শাড়ি-চটি ইত্যাদি নিজে না পরে বোনেদের বা নিলামবাটীর দুস্হ জ্ঞাতিদের পাঠিয়ে দিতেন বা যখন নিজে যেতেন তখন নিয়ে যেতেন । যদিও মা পরিবারের ডি ফ্যাক্টো কর্ত্রী ছিলেন, কিন্তু ইমলিতলার বাড়িতে মা-বাবা-দাদা-আমি থাকতুম সবচেয়ে ছোটো ঘরটায় । লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনা, রাস্তার কল থেকে জল ভরে আনা । দাদার এক ভায়রাভাই অত্যন্ত গরিব ছিলেন, চাকরি পাননি, তাঁদের পরিবারকেও মা নিয়মিত র‌্যাশান দিয়ে আসতেন, আমার মেয়ের ফ্রক আর জুতোও অনেক সময়ে লুকিয়ে দিয়ে এসেছেন যা আমরা এতোদিন পর জানতে পারছি সেই ভায়রাভাইয়ের মেয়ের কাছ থেকে ।
    সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকার চারিত্রবৈশিষ্ট্যের দরুণ বড়জেঠা সংসারের সমস্ত ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করতেন । আমার মনে আছে, ১৯৫১ সালে যে বছর প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, কোন দলকে ভোট দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনার শেষে মায়ের নির্ণয় সবাই মেনে নিয়ে ছিলেন, অর্থাৎ যার যে দলকে ইচ্ছে ভোট দেবে । কলকাতায় নাকতলায় থাকতে অবাক লাগত দেখে যে বাড়ির কর্তা যে দলের সমর্থক, পরিবারের সকলেই সেই দলকে ভোট দ্যায়, অথচ তারাই আবার ডাইন্যাস্টিক পলিটিক্সের তর্ক তোলে !
    স্কুলে ভর্তি হয়ে টের পাই যে মা শুদ্ধ হিন্দি জানেন না, ইমলিতলার ‘ছোটোলোকি’ বুলি দখল করে ফেলেছেন, আর তার বহু শব্দ যে শুদ্ধ হিন্দিতে অশোভন, এমনকি অশ্লীল, তা উনি অনেক পরে জানতে পারেন, যখন আমরা ইমলিতলা ছেড়ে দরিয়াপুরে সুন্নি মুসলমান পাড়ায় চলে যাই । পানিহাটিতে মেয়েদের স্কুল তখনও ছিল না বলে মা নিরক্ষর হয়েই এসেছিলেন ; নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন দাদা স্কুলে ভর্তি হবার পর । নভেল আর বাংলা সংবাদপত্র পড়া অভ্যাস করেন । একটা হিসাবের খাতা লেখা আরম্ভ করেন ।
    ইমলিতলার বাড়িতে হিন্দুত্ব সামলাবার কাজ ছিল পুজারী বাড়ি থেকে আসা বড়-জেঠিমার । সেকারণে মা এবং কাকিমারা প্রতিদিনের ধর্মাচরণ থেকে নিজেদের আর আমাদের মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন । জনৈক পাদরির আর্থিক সৌজন্যে প্রাইমারি স্তরে আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম ; মা ঘটিতে গরম জল ভরে আমার শার্ট-প্যান্ট আয়রন করে রাখতেন। আমার বাংলা বনেদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বলে মায়ের নির্দেশে আমাকে ব্রাহ্ম স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করা হয়েছিল ।
    দরিয়াপুরের বাড়িতে আমি একা থাকতুম বলে, এবং এর-তার কাছে শুনে, আমার চরিত্রদূষণ আটকাতে বাবা আর মা প্রতি রাতে ইমলিতলার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া সেরে, দরিয়াপুরে থাকা আরম্ভ করেন । দাদা ১৯৪৯ সালে কলকাতার সিটি কলেজে পড়তে চলে গিয়েছিলেন, দরিয়াপুরের বাড়িতে দাদা ফেরেন চাকরির শেষ বছরে, তখন আমি মা-বাবাকে নিয়ে লখনউ চলে গেছি । ইমলিতলার বাড়ি থেকে মা প্রতিদিন রাতে টিফিন ক্যরিয়ারে করে আমার আর বাবার খাবার নিয়ে দরিয়াপুরে আসতেন, প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে।
    দরিয়াপুরে পাকাপাকি চলে আসার পরও ইমলিতলার সদস্যদের দায়িত্ব মা ছাড়েননি ; সপ্তাহে এক দিন গিয়ে টাকাকড়ি আর চাল-ডাল-আনাজের ব্যাপারটা সামাল দিয়ে আসতেন । গোলা রোডের এক বানিয়ার দোকানে তালিকা দিলে সে যাবতীয় জিনিস ইমলিতলা আর দরিয়াপুরে পাঠিয়ে দিত । পুজোর সময়ে পোশাকের ভেদাভেদ মেটাতে সবায়ের জন্য ছিল একই কাপড়ের শার্ট আর ফ্রক, এমনকি জেঠা-কাকারাও সেই কাপড়ের শার্ট পরতেন ।
    স্কুলের পর্ব শেষ করে যেটুকু সময় ছিল আর ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে আমি আমার বন্ধু তরুণ শুরের মামার ট্রাকে করে নানা জায়গায় চলে যেতুম, বাড়িতে বলে যেতুম না, বললে বাবা-মা যেতে দেবেন না অনুমান করে । বলা যায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতুম । ফিরে আসার পর মা কিছুই বলতেন না । পরে আমার মেয়েকে উনি বলেছিলেন যে ওনাদের না জানিয়ে আমি বাড়ি থেকে পালাতুম ।
    দাদা চাকরি পাবার পর দাদার চাকুরিস্হলে গিয়ে মা মাঝেমধ্যে সপ্তাহখানেকের ছুটি কাটিয়ে আসতেন । দরিয়াপুরের বাড়িতে কাজের মাসি রান্না করে দিত । নিম্নবর্ণের হাতে রাঁধা ভাত বাবা খেতেন না বলে ভাতটা আমিই বসিয়ে দিতুম । রান্নায় মাকে সাহায্য করতে হতো বলে ডাল-তরকারিও রাঁধতে শিখে গিয়েছিলুম । এখনও মাঝে-মাঝে স্ত্রীকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করি । মা বলতেন, ডাল আমি ভালো রাঁধতে পারি ।
    হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার আর আমার বন্ধুরা কোর্টে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে গেছেন শুনে মা, যিনি ছিলেন অত্যন্ত চাপা প্রকৃতির, নিজের ক্রোধ সামলাতে পারেননি । আমি তাদের চিঠি ইত্যাদি ছিঁড়ে ফেলছি দেখে বলেছিলেন, ‘সব নিয়ে গিয়ে গুয়ের ডাবায় ফ্যাল ; সব কটাই আহাম্মক, অকৃতজ্ঞ ।’ আমার আর দাদার লেখালিখি সম্পর্কে উনিই ছিলেন প্রধান উৎসাহদাত্রী । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে যে কবিতাটা নিয়ে মকদ্দমা হয়েছিল সেটা মা-বাবা-ঠাকুমা সকলেই পড়েছিলেন ।
    নাগপুরে অফিসের কাজে গিয়ে রাজ্যস্তরের হকি প্লেয়ার ও সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ে করতে চাই জানিয়ে পাটনায় খবর পাঠালে মা চিঠি লিখে পাঠান যে ‘সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে আসলেই হবে ।’ তার কারণ আমার বন্ধুনিদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকতেন উনি । আমার সম্পর্কে নানা গালগল্প শুনে বেশ উদ্বেগে থাকতেন । এমনকি আমার পেছনে কয়েকজন ঘটককে লাগিয়ে দিয়েছিলেন যারা প্রায়ই আমার অফিসে একজন তরুণীকে নিয়ে হাজির হতো । বাড়িতে এসে মায়ের কাছে এই বিষয়ে অভিযোগ করলে উনি বলতেন, এছাড়া আমার অন্য উপায় নেই, কোনো একজনকে তো পছন্দ কর ।
    লখনউ বদলি হয়ে আমরা চলে গেলে মা একা হয়ে গিয়েছিলেন, রান্নার মাসি রাখা হয়েছিল ওনার দায়িত্ব কমাবার জন্য । আসলে উনি আমার মেয়ে আর ছেলের সঙ্গে সময় কাটানোয় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের অভাব বোধ করতেন । একাকীত্ব কাটাবার জন্য পাটনার বিভিন্ন বাঙালি পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে গল্প করতে চলে যেতেন প্রতি সন্ধ্যায় । দাদা পাটনায় চলে আসার পর মা আর বাবাকে আমি লখনউ নিয়ে চলে আসি । লখনউতে মায়ের হৃদরোগ আর আরথ্রাইটিস ধরা পড়ে ।
    হৃদরোগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে তখন আমরা ততটা পরিচিত ছিলুম না, মাও তাঁর কষ্টের কথা বলতেন না। লখনউতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮ই নভেম্বর ১৯৮২ মারা যান । মা মারা যেতে আমি লখনউয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলুম ।
  • TSC | 012312.60.8912.247 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:১৫541361
  • Interview with Malay Roychoudhury

    By The Sunflower Collective
    Malay Roychoudhury is an Indian Bengali poet and novelist who founded the Hungryalist Movement in the 1960s. He was awarded a Sahitya Akademy award for translating Dharamvir Bharati’s Suraj Ka Satvan Ghoda in 2003 but he refused to accept it. He spoke to The Sunflower Collective at length about his work, Hungryalist Movement, Allen Ginsberg, other writers associated with the Movement, politics and rifts with other poets, publishers, and the establishment during the Movement.
    The Sunflower Collective: Young poets are calling themselves Hungryalists in West Bengal again, as you said in a recent interview. Jeet Thayil is making a BBC documentary on Ginsberg’s time in India for which he met you. Deborah Baker wrote a book about the same not so long ago. Internationally, several films about the Beats hit the screens in quick succession in recent years. Do you see it as a revival of the two movements that were linked willy-nilly?
    Malay Roychoudhury: I don’t think so. Saileswar Ghose, Subhas Ghose, Basudeb Dasgupta had been editing Hungryalist magazines, Kshudharta and Kshudharta Khabor, before they died a few years back. Pradip Choudhuri is still publishing Phoo and Swakal. Rasaraj Nath and Selim Mustafa are still publishing Anarya Sahitya. Ratnamoy Dey is still publishing Hungryalist Folder. Aloke Goswami had published Concentration Camp before he concentrated on writing novels and short stories. Arunesh Ghose continued publishing Giraffe before he died a couple of years back. Since these magazines are in Bengali and they are not active on social media, you don’t hear about them. Pradip Choudhuri has done a lot of translation of Hungryalist work in French.
    Prior to Jo Wheeler and Jeet Thayil, another producer, Dominic Byrne, had come and made a radio programme exclusively on our movement. Marina Reza had come from Weslyan University for research on our movement. Daniella Limonella had come from Italy for the same purpose. University of Exeter has published an interview of mine in their Exeposé online newspaper. Mrigankasekhar Ganguly has made a film based on my poem, ‘Stark Electric Jesus.’ A debate is going on for a decade, for and against this poem on a Bangladeshi news portal.
    Deborah Baker neither met any Hungryalist nor consulted any written material available at Kolkata’s Little Magazine Library Research Centre. Most of the information is wrong and concocted, though she claims to read and write Bengali. This Research Centre has an exclusive section on Hungryalist periodicals, bulletins, manifesto, and books.
    Students at IIT, Kharagpur, Jadavpur University, Rabindra Bharati University, Visva Bharati University, Calcutta University, and Assam University have been doing PhD and M Phil, etc. on our work for more than a decade as a matter of academic routine.
    Academic interest in the Beats, especially Allen Ginsberg, continues. He had himself established a Trust to look after the interest of all the Beats and his own work with the million dollars he got from Stanford University by selling his collections. Bill Morgan, one of the Trustees, had visited me when I used to reside at Kolkata.
    We, the Hungryalists, have not even been able to bring out an anthology of our work in English and Hindi, as there is no commercial interest in our work from the publishers. And none of us are well to do. Hindi being the prime Indian language, the Sahitya Academy should have evinced interest in bringing out an anthology.
    TSC: Ginsberg was concerned that the Beats did not receive the amount of academic attention in America they deserved. Do you feel the same about the Hungryalists, as far as the Indian academia is concerned? In the case of the painter Karanajai, it appears even the critics abandoned him after a while leading to a very embittered existence. What are your thoughts on this?
    MRC: Yes, he was worried during his lifetime that the American Establishment is not ready to award them with governmental and academic recognition. However, presently a lot of academic work is being done on the Beats due to the next generation of poets, who took an interest in them. Even if the Beats were anti-Establishment, they were typical products of the American capitalist world. Ginsberg created his trust with a huge fund to carry on his legacy. Kerouac’s manuscript roll was sold for 2.40 million dollars, enough to carry on his legacy by his Trustees for eternity. Ferlinghetti opened City Lights Bookstore on West Front in order to regularly publish the Beats. In Greenwich Village, they had Barney Rosset’s Grove Press, James Laughlin’s New Directions and the Village Voice newspaper for support. They regularly interacted with the digital companies and brought out their recitations and films, etc. They appointed secretaries to enable them to get paid invitations for poetry readings from various European and American cities.
    As I told you just now, there has been continuous academic work on Hungryalist poets and writers. Sahitya Academy has awarded prizes to Utpalkumar Basu, Sandipan Chattopadhyay, Binoy Majumdar, Saileswar Ghosh, and Subimal Basak. Since I do not accept literary and cultural prizes, I had refused their award. The point is we do not get publishers like Ferlinghetti or James Laughlin in Kolkata to bring out our works and arrange for distribution. And we do not get translators who would translate and publish our works in Indian periodicals. There is still a strong lobby against us at Kolkata, though it has weakened after Sunil Gangopadhyay’s demise; nevertheless Sunil’s trained disciples are still active.
    After receiving the Lalit Kala Academy prize at a young age in 1972, Anil Karanjai started sympathizing with the Naxalite Movement; his studio at Benaras was ransacked by police. To avoid the repression, he married an American lady and went to Wahington DC to live there. He was soon disillusioned with the Western world and came back a few years later after divorcing the lady. He got involved in social activities and avoided the dirty machinations that painters had started resorting to at that time. Karuna Nidhan also fled from Benaras and went to Patna, where my elder brother Samir opened a coloured fishes shop for him. When Anil returned to Delhi, Karuna joined him. Anil married Juliet Reynolds and settled at Dehradun to avoid the Delhi painters’ circus. Anti-Establishment writers and artists in that circuit are rare these days.
    TSC: What are your views on Shakti Chattopadhyay leaving the movement?
    MRC: Shakti Chattopadhyay testified against me because Shakti had fallen in love with Samir’s sister-in-law, Sheela, at Chaibasa. He felt that he could not marry Sheela because of Samir, who did not want her to get married to an unemployed drunkard. That Sheela was living at our Patna residence at that time for post graduate study at Patna University added fuel to Shakti’s fire.
    This, along with instructions from a newspaper group which was against us, and which offered Shakti a sub-editor’s job, forced him to leave the movement. Now, after Sunil Gangopadhyay’s death, when Sunil’s letters to his friends are being published, it is found that Sunil was goading his friends to leave Hungryalist Movement, as Sunil thought that my sole motive in launching the Hungryalist Movement was to destroy his ‘Krittibas’ group. Almost all of these letters spew venom against me. In these letters, Sunil wrote that to be an anti-establishment writer, you have to join the Establishment and work from within.
    TSC: Is there something akin to an anxiety of influence which informs the relationship between the two movements? In his Indian Journals, Ginsberg continues to profess adherence to the Blake vision. He mentions the harmonium but there is no indication he first learnt about it through the Hungryalists. At what point do you think he discarded the Blake vision and allowed the Indian influences to play out? Could you give some specific examples? I understand that his use of breath as a measuring unit for verse might be one?
    MRC: I don’t think we were bothered about influencing each others’ movements. In an interview to LIFE magazine, Ginsberg had said that the Blake vision departed from him when he was traveling in a train while returning from India and started weeping.
    When he had visited Bodhgaya, he had chanced upon a piece of stone wherein small replicas of Buddha were inscribed. He had told me that seated on two stones he was shitting, as at that time the Japanese had not developed Bodhgaya and it was almost a village. He said it was a divine direction from Buddha; thus he became interested in Buddhism and departed from mysticism. Due to archaeological restrictions, he could not carry the stone to USA. He had cleaned that stone with his tooth brush at our Patna residence.
    Bill Morgan, one of Ginsberg’s trustees, who visited me, had said that there were more than fifty copies from which edited pages were included in his Indian Journals. Ginsberg was spied upon by the Indian agents and a few of his copies were picked out of his shoulder sling-bag by some of these agents to find out what he was recording. Ginsberg himself told me about it. The harmonium story might have been in one of the fifty copies.
    Sunil Gangopadhyay, who was in the USA at the time of editing Indian Journals, tried his best to shut out the Hungryalist Movement from this book. Bill Morgan had told me that Ginsberg regularly mailed packets to his step-mother in New Jersey so that she could arrange the papers in the almirahs of their basement. Ginsberg had country-wise almirahs. He collected most of our manifestos and they are available in Stanford University.
    TSC: In his Indian Journals, Ginsberg does not allude to your movement, although he knew about it and took a deep interest. Do you think it was deliberate? Do you think he appropriated your techniques and attitudes regarding poetry and art in general?
    MRC: I think I have answered your question just now.
    TSC: Ginsberg met poets in Bombay also, including Kolatkar and others. How can then it be said that he was principally influenced by the Hungryalists?
    MRC: He met poets of other Indian languages for a day or two ; but he stayed in Kolkata for about two years, attended Bengali poetry readings, went to country liquor den Khalasitola, visited by Bengali poets, Sonagachhi visited by Bengali poets, and smoking joints, visited by Bengali poets.
    TSC: You have criticised Ginsberg for clicking pictures of beggars while he was here. Is that part of a larger disenchantment with your old friend? Do you think at the end of the day, he was as superficial as other white tourists?
    MRC: Yes, when Ferlinghetti sent me a copy of Indian Journals I felt quite ashamed. I did not show the book to my dad, who had admonished Ginsberg for taking photographs of beggars, lepers, lame men, naked sadhus, etc. I have visited other countries and never thought of making a mockery of poverty of certain people. In his Indian Journal, there is a photograph of Ginsberg himself in the guise of a beggar seated beside a beggar.
    Ginsberg had several photo exhibitions in USA, which highlighted Indian beggars, lepers, destitutes, almost naked sadhus, cows on the streets, stray dogs, goats, etc. Cards to these exhibitions were sold to patrons. When he revisited India during the Bangladesh War (1971), he shot photos of refugees fleeing the war zone.
    He did have the typical white tourist in him.
    Probably my childhood in Imlitala slum taught me to respect the poorest man.
    TSC: Could you tell us about the politics of the Hungryalists? Were there direct links back then between the Naxals and the Hungryalists?
    MRC: Hungryalist Movement had started in 1961; the Naxalite Movement started in the Seventies. I have already told you about the plight of Anil Karanjai and Karuna Nidhan. My first book was on Marxism. Saileswar Ghose, Subhas Ghose, Aloke Goswami had joined the CPI (M) for literary gains. I was disillusioned with Marxism after I started reading about the activities of the Soviet establishment as well as the activities of the lumpens of CPI (M). Strangely CPI (M) resorted to the same murderous activities of the earlier Bengal governments. Now the new Bengal government has co-opted the same lumpens and are resorting to same murderous activities.
    TSC: The Beats were criticised for their lack of gender awareness. How do the Hungryalists fare in your opinion on that count? Were there female hungry gen writers and artists? Also, did the movement display consciousness of caste issues?
    MRC: Young bold women writers were rare at that time. We had one lady member, Alo Mitra, who later married Tridib Mitra. They together used to edit two Hungryalist magazines, one in Bengali, named, UNMARGA, another in English named, WASTE PAPER.
    We were the first to bring lower and backward class writers and poets in literature. Prior to us, there was not a single poet to be seen on the pages of poetry magazines. Debi Roy, Subimal Basak, Abani Dhar, Rasaraj Nath belong to lower or backward class.
    TSC: Tell us a little about your poetic process? What influences and inspires you? Is the process of writing poems that deal with stark reality harder than facing the wrath of audience and editors?
    MRC: I was initiated into poetry in a strange way. Being a Brahmin family, at our Imlitala house we were not allowed to eat chicken eggs. I was sent to fetch duck eggs from our Shia Muslim neighbour quite frequently. I was ten. The elder girl of their house whom I called Kulsum Apa was fifteen-years-old. She used to recite Ghalib and Faiz Ahmed Faiz to me, whom I did not understand; but she explained those poems to me. She indirectly, through those poems, told me that she loves me. One day when I asked for the meat being cooked in their house because of the scent, she induced me into a sexual relation. The meat was wonderful and she licked clean my lips with her tongue. After a few days, due to painful scratches on my penis, I got scared and stopped going to Kulsum Apa’s house. However, the impact of the poems remained. I had told about this sexual relation to my grandmother, who told me to never talk about it to anyone in my life. I still miss Kulsum Apa. When I last visited Imlitala, I enquired of the family and was told that they had sold their house and left Imlitala.
    My next influence was again a girl of higher class named Namita Chakroborty at the Ram Mohun Roy Seminary, who doubled up as Librarian for the Bengali section. I had a great crush on her. She initiated me into Marxism and introduced me to works of Brahmo writers and poets, including Rabindranath Tagore and Jibanananda Das. One day I had kept a chit on her table in which I had written ‘I love you’. She had preserved the chit and showed it to one of my aunts after several years, when my name started appearing in magazines and papers. Both Kulsum Apa and Namitadi had dimples.
    At Imlitala house, we had two servants, Shivnanni and Ram Khelawan, who were paid in kind, that is food, dresses, and shelter. Since they were servants, they could not reprimand us children directly. Shivnanni knew Ramcharitmanas by heart. Ramkhelawan knew dohas of Kabir, Rahim, and Dadu. Both of them reprimanded through quotations and explained the lines as well. Shivnanni used to play a game called, Ramshalaka, that is a metal stick. You have to close your eyes, open a page and put the Ramshalaka on a line. Shivnanni explained how our day will pass based on the line.
    Imlitala was considered a bad influence by Dad as we were exposed to free sex, toddy, cannabis, country liquor, etc. He constructed a house in Dariapur and we shifted there. My elder brother Samir was packed off to Kolkata for post-school studies. It helped me. He joined groups of poets and brought lots of poetry collections and periodicals for me. Ginsberg had come to our Dariapur residence. Prior to that Ginsberg and Orlovsky had visited Samir at Chaibasa, Singhbhum and experienced Mahua drink.
    I am not bothered about editors in my life. Only when I am requested, do I send my poems and novels to them. Most of the editors are younger to me and they respect me. Yes, dealing with reality is harder. Earlier I used to maintain a bank of images, words, lines, sentences when I wrote with pen on paper, Now, because of arthritis of fingers, especially the thumb, the process has become difficult with the computer. Since I take a lot of medicines, including sleeping pills, I tend to forget these days.
    TSC: What is your opinion of the current writing scene in Bangla and English in India? Are there any writers you like in particular?
    MRC: I do not have much idea about what is happening in Indian Writing in English. As far as Bengali writing is concerned, lot of exciting things are happening in the little magazine world. Every year a Little Magazine Fair is held apart from the Kolkata Book Fair. Book Fairs are also held at the district headquarters. This gives us a glimpse into a wide range of creative writing.
    The poets whom I have noticed recently writing in a new way are Raka Dasgupta, Sridarshini Chakraborty, Mitul Dutta, Barin Ghoshal, Dhiman Chakraborty, Anupam Mukhopadhyay and Bahata Anshumali, to name a few.
    TSC: Are you concerned about the general rise of right-wing and other intolerant forces in India and elsewhere?
    MRC: Yes, I am very much disturbed by the latest events taking place all over India. It appears that a worthless government run by cheaters was better than one influenced by fundamentalist criminals baying for blood of the meek and helpless. I wonder how this country had once given us Khajuraho, Puri temple, Meenakshi temple, Konarak, Ajanta, Ellora; how kings enjoyed meat and wine after the Ashwamedh Yajna.
    TSC: Is Neera in Sunil’s poems and the one whose name appears in your poem, “Please Don’t tell my grandmother”, the same person? Was she real? Was she a writer/publisher who could be associated with the Generation? Is Mala in Debi Roy’s Malar Jonne real? Was she, too, a poet associated with the Generation?
    MRC: Yes, she is the same Neera. Sunil Gangopadhyay never asked for a poem from me for his magazine, Krittibas. After his death, his wife Swati Gangopadhyay became the editor of Krittibas, which Sunil used to edit. Krittibas asked me to contribute a poem. I had sent this poem but they were scared to publish it in Krittibas. They did not publish it and told me to replace it. Obviously I had to decline. But the fact became known to the little magazine circle of poets and writers in Kolkata.
    No, Debi Roy’s wife Mala was not a poet; she was a housewife. She died recently.
    The interview was first published in The Sunflower Collective on 10/11/15
    Bio:
    Malay Roy Choudhury is a Bengali poet and novelist, who founded the Hungryalist Movement that took the poetry scene in Bengal by storm in the 1960s. The Hungry Generation was a literary/art movement that Malay Roy Choudhury, along with Shakti
  • Tarun Mukhopadhyay | 012312.60.8912.247 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:১৮541362
  • মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ
    ---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    বিশ শতকের ষাট বা ছয় দশক বাংলা কবিতার ইতিহাসে যে কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে, তার মধ্যে 'হাংরি আন্দোলন' অন্যতম, এ বিষয়ে দ্বিমত নেই । আর সেই হাংরি আন্দোলনের অন্যতম নেতা মলয় রায়চৌধুরী, যিনি আজও সৃজনক্ষম । কারো আনুকূল্য বা হাততালির প্রশংসা করেন না । ভুল কি ঠিক, সে বিচার করবে ইতিহাস বা মহাকাল । পরোয়াহীন এই লেখককে তাঁর নিজস্ব ভাষামুদ্রা ও ভঙ্গির জন্য অভিবাদন জানাতেই হয় । তথাকথিত বিপ্লবী কবি না হয়েও, কবিতার অস্ত্র প্রয়োগে তিনি সংগ্রামী কবি হতে পেরেছেন ।

    ১৯৬১ সালের নভেম্বরে হাংরি আন্দোলনের যে বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে চোদ্দোদফা দাবি পেশ করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখ্য :-
    1. The merciless exposure of the self in its entirety.
    2. To present in all nakedness all aspects of the self and thinking before it.
    3. To challange every value with a view to accepting or rejecting the same.
    4. To use the same words in poetry as are used in ordinary conversation.
    5. To reject traditional forms of poetry and allow poetry to take its original forms.

    আমরা জানি প্রথা ভাঙার এই স্পর্ধা তখন সরকার মানতে পারেনি । কাব্যে অশ্লীলতার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয় ।

    বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পর নতুন সুর শুনিয়েছিলেন তিরিশের কবিরা । চল্লিশের কবিদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রতিবাদী ভঙ্গি আরেকমাত্রা যোগ করেছিল । আত্মকথন ও আত্মরতিকে সম্বল করে অন্য রকম স্বাদ নিয়ে এলেন পঞ্চাশের কবিরা । আর ষাটের কবিরা, বিশেষভাবে 'হাংরি আন্দোলন' আমূল নাড়া দিল বাংলা কবিতার সনাতন ঐতিহ্যকে, নিয়মানুবর্তিতাকে । কবিতার ভাষায়, ছন্দে, অলংকারে, স্তবকে, তুমুল ভাঙচুর পাঠকের অভ্যস্ত চোখ ও কানকে বিব্রত করে তুলল । বিশেষত মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় যৌনতার সঙ্গে এলো ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিষ্ফল যন্ত্রণা ।

    কিভাবে মলয় রায়চৌধুরী তাঁর কবিতায় আত্মপ্রক্ষেপণ ঘটিয়েও নিরপেক্ষ হয়ে যান, সামাজিক ঘটনার দ্রষ্টা হন, নির্মম সমালোচনায় শাণিত ইস্পাত হয়ে ওঠেন, তাঁর কবিতাগুলি পড়লে টের পাওয়া যায় । তাঁর "কবিতা সংকলন"-এর নানা মেজাজের আটটি কবিতা আলোচনা করে তাঁর কবি কৃতি ও কবিস্বরূপ বুঝতে ও বোঝাতে চেষ্টা করা যাক । আলোচিত কবিতাগুলি হলো -- কামড়, ফুলিয়ার হাতটান, উৎখাত, তুলকালাম আত্মহত্যা, কপর্দকহীনতা, লোহার রড, রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা, প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ।

    'কামড়' নামাঙ্কিত কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী যে ভঙ্গিতে ভারতবর্ষকে প্রশ্ন করেছেন, বিদ্রুপ করেছেন, পড়তে পড়তে মনে হয় সত্তরের কবি সুবোধ সরকার মলয়ের কাছে অধমর্ণ । ধান্ধাবাজ সুবিধাবাদী এই দেশের চরিত্র, মানুষের প্রকৃতি, নিপুণ ভঙ্গিতে তিনি তুলে ধরতে পেরেছেন--

    আর কোল্কাতা এখন নিম রেনেসঁসের ভেতর দিয়ে কোথায় যাচ্ছে জানি না
    ভারতবর্ষ দু'চারটে লেখা ছাপিয়ে দিন না উল্টোরথ, দেশ, নবকল্লোলে
    আমিও মনীষী হয়ে যাই, কিংবা শান্তিনিকেতনে নিয়ে চলুন
    সাহিত্যের সেবা করব, ধুতি-পাঞ্জাবি দেবেন একসেট
    আজ বিকেলে চলুন খালাসিটোলায় বঙ্গসংস্কৃতি করি ।

    শেষ পর্যন্ত মলয়ের সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, "নিজের হৃৎপিণ্ড খেয়ে নিজের সঙ্গে রফা করে নিলে কেমন হয়"? এই ব্যঙ্গাত্মক মনোভাবেই তিনি দেখেন, "পায়রার বুকে টাইম বোমা বেঁধে শান্তির জন্য ওড়ানো হচ্ছে" ( ফুলিয়ার হাতটান ) । পিকাসোর আঁকা শান্তিদূতও আজ নিরাপদ নয়, প্রতারক -- অন্তত নেতাদের হাতে । এই মর্মান্তিক সত্য মলয়ই পারেন উচ্চারণ করতে ।

    তাঁর অন্যান্য কবিতার মধ্যে পাই আত্মবীক্ষ্ণণ ও আত্মসমালোচনা । যেমন 'কপর্দকহীনতা' কবিতায় লিখেছেন--

    আদালতের পেঙ্গুইনদের সঙ্গে খেলা করে এলুম
    আমার এই কাঁতড়া চেহারা দেখে বুঝে নাও
    প্রজ্ঞাহীন হতে চেয়েও কিছু হল না ।
    * * *
    কাঠমগজ কাঠমগজ
    নিজেকে বিশ্বাস করা গেল না ।

    ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিশেল এখানে আছে । আদালত ও পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ কবি ঠাট্টা করে বলেন,

    এদের পুলিশ আমার চুলে সরেজমিন তল্লাশি চালিয়েছে
    এক জোড়া পাকাচুল ধরে নিয়ে গেছে ( লোহার রড )

    পৃথিবীর আকার, আয়তনের অভ্যস্ত ধারণায় ( 'পৃথিবী গোলাকার কমলালেবুর মতন' ) পদাঘাত করে মলয় লেখেন -- "অণ্ডকোষের কাছে বাড়া-কমা শিখছে পৃথিবী" । কিরকম জীবন তিনি কাটাচ্ছেন, কোন সমাজে ও পরিবেশে বাস করছেন, তারও ছবি অকপটে আঁকেন কবিতায় ---

    চশমার কাচে চুয়ে পড়ে কুয়াশায় হাওয়া-ধোনা শিশিরের ধাতুরস
    পিরানহা মাছের ঝাঁকে-ঝাঁকে সাঁতার কটি মনে হয় ( উৎখাত )

    যাঁরা মনে করেন আত্মরতিই এই কবির আশ্রয়, ভুল করেন । চারপাশের জীবন ও জগতকে তিনি গভীরভাবে দেখেছেন । জেনেছেন । 'বেঁচে থাকা বা প্রেম' এবং মৃত্যু তাই সমার্থক হয় তাঁর কাছে আর বুঝে যান 'হৃদয় নামে কিছু নেই' । দ্রষ্টা কবির বোধিলাভ এইরকম ---

    ছাপার অক্ষরের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেল এবার
    সভ্য ও সংস্কৃতিবান হয়ে মানুষের লাভ হয়নি
    মূর্খ বেড়েছে ( তুলকালাম আত্মহত্যা )

    সংবাদনশীল ও সামাজিক একজন কবির পক্ষে এই অভিজ্ঞতা মর্মান্তিক । কবিতার শেষাংশে মলয়ের হাহাকার সহৃদয় পাঠককে স্পর্শ করে, কষ্ট দেয়--

    এককালে সুন্দর ও শিব ছিল সত্য
    যুক্তি ছিল সত্য
    ঈশ্বর ছিল সত্য
    অ্যাজটেকরা মৃত্যুকে সত্য বলে মনে করেছিল
    এখন আত্মহত্যা ছাড়া সত্য নেই
    যুক্তিহীন দেহে দায়িত্বরহিত চুমো
    বাঁচতে দাও কিংবা মরে যেতে ( তুলকালাম আত্মহত্যা )

    এ যেন আলবেয়ার কামুর 'মিথ অফ সিসিফাস' -- অ্যাবসার্ড জগতে অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত হওয়ার আর্তনাদ । এই সুরই যেন একটু অন্য ভাবে পাই 'রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা' কবিতায় । তথাকথিত রবীন্দ্রবন্দনা ও বিরোধিতায় না গিয়ে ষাটের কবি আত্মকথনে মগ্ন হন । চারপাশের যে ভাঙন, হত্যা, সন্ত্রাস, হৃদয়হীনতা -- দেখতে দেখতে কবি অস্হির হয়ে ওঠেন ।

    হরিণের মাংস কাটা হয়েছিল কোদাল দিয়ে
    আমার ছেলেমেয়েরা খরগোশের চোখ উপড়ে
    খেলা করেছিল বেতলার দুর্গে

    নতুন প্রজন্ম কিভাবে হিংসা ও হিংস্রতায় দীক্ষা নিয়েছে, এ যেন তারই দলিল । যেখানে রবীন্দ্রনাথের সত্য-সুন্দর-মঙ্গল ব্যর্থ । বেঁচে থেকে পৃথিবীকে মধুময় বলা আর সম্ভব নয় । অসম্ভব চলে যাবার আগে পৃথিবীকে প্রণতি জানিয়ে তারই মাটির তিলক কপালে এঁকে নেওয়া । বরং কবি বলতে পারেন --

    অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে আমার লাশ বাঁচিয়ে তুলতে চাইছি
    আমাকে ক্ষমা করুন ।

    মলয় রায়চৌধুরীর খয়াত-অখ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা যে কবিতার জন্য তার নাম 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' । যে কবিতার পরতে পরতে মিশে আছে যৌনতার আমিষ গন্ধ । ১৯৬৩ লেখা এই কবিতা যখন ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়, তখন দেশকালের পরিস্হিতি কেমন ছিল, তা এক নজরে দেখে নিতে পারি ।

    ক) চীনে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ।
    খ) দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যাণ্ডেলার কারাদণ্ড ।
    গ) চিন-ভারত যুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন ।
    ঘ) হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ।
    ঙ) প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর মৃত্যু ।

    এই পটভূমিতে অতি-ব্যক্তিগত কবিতা লিখলেন মলয় । তাঁদের ইস্তাহারে যা বলেছিলেন -- Merciless exposure of the self বা Nakedness of all aspects of the self --- এখানে তা পাওয়া গেল, কবিতার ভাষায়, গঠনেও প্রথাভাঙা হলো । মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করলেন, অস্বীকৃত হলো Traditional form শুধু গদ্যকবিতা রূপে নয়, শব্দ ব্যবহারে তিনি নিজস্বতা মুদ্রিত করলেন । লিখলেন --- কোর্বো, তর্মুজ, পার্ছিনা, কোল্কাতা, ওর্ফে, চুর্মার, জাফ্রান ইত্যাদি শব্দ । অকথ্য শব্দ ব্যবহারেও তিনি অলজ্জিত --- 'ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম' । কবিতার মধ্যে যৌন রসাত্মক শব্দ, বাক্য ও ভাবনা অজস্র ছড়িয়ে আছে । কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পংক্তি উদ্ধৃত করছি ---

    ১. আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
    ২. শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
    ৩. তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও
    ৪. আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও
    ৫. পায়জামায় শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে

    শুভা নাম্নী নারীর কাছে এই ধরণের কাতরোক্তি কবি করলেও, আসলে যেন যৌনগাথা রচনা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না । যুগজ্বরে আক্রান্ত কবি যেন নিরাপত্তাহিনতায় ও আশ্রয় প্রার্থনায় আকূল হয়েছেন । যেমন, ষাটের আরেক কবি, ভাস্কর চক্রবর্তী নিরাশ্রয় মানসিকতায় বলেছিলেন, "শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব" । মলয় এই পলায়নী মনোভাবের বদলে অনুভব করেছেন, "নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই"। হতাশায় কবি বলেছেন, "কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই" । আমাদের সৌভাগ্য, মলয় রায়চৌধুরী কবিতার জন্য আজও বেঁচে আছেন ; যুদ্ধ করে চলেছেন । তাঁর সংগ্রামের হাতিয়ার কবিতাই ।
  • Sanchari Bhattacharya | 012312.60.8912.247 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:৫৭541363
  • Sanchari Bhattacharya ( Jadavpur University ) : No Hungry Generations Tread Thee Down
    "No Hungry Generations Tread Thee Down": Exploring the Poetics of Alterity
    --------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

    Abstract act: This essay discusses the Hungryalist Movement of the 1960swhich attempted to change the path of the early 20th century Bengali literature because it failed to represent the existential angst and pessimism of the youth of post-Partition Bengal. There is no doubt, of course, that the movement ushered in a violent surge of change that hit
    right at the outdated mode of conceiving literature and art according to a city-centric, western educated, bourgeois sense of taste. But despite their constant revolution for almost five years, the extent of success of the Hungryalist movement still remains questionable. It is argued
    here that although it set out to attack and disintegrate contemporary Bengali literature on the premise that it was unbearably imitative of the West, the movement itself seems to have been heavily inspired by certain revolutionary ideas conceptualized largely by the Occident.

    Keywords: Hungryalist movement, Hungryalism, Bengal,
    postcolonial, anti-canonical, socio-literary revolution.

    The Hungryalist Movement hit the complacent surface
    of mid 20th century mainstream Bengali literature in 1961 and the storm that would rage through the next four years in Bengal would alter the course of history of Bengali literature forever.
    Chronologically speaking, the Hungryalist movement
    continued from 1961 to 1965. The movement was Malay
    Roychoudhury’s brainchild whereas his elder brother Samir
    Roychoudhury, renowned poet Shakti Chattopadhyay and Debi Ray alias Haradhan Dhara led it on. Soon the movement gathered many other members from different sections of the society, e.g.,Utpal Kumar Basu, Binoy Majumdar, Sandipan Chattopadhyay, Basudeb Dasgupta, Falguni Roy, Subhas Ghosh, Saileshwar Ghosh, Tridib Mitra, Alo Mitra, Arunesh Ghosh, Ramananda Chattopadhyay, Anil Karanjai, Karunanidhan Mukhopadhyay, Subo Acharya etc. The goal of the Hunrgyalists was to offer a complete artistic alterity so as to devastate the readers’ normative taste that had been shaped by colonial canons. Their deviant
    poetry in terms of both form and content also influenced Hindi, Marathi, Assamese, Telegu and Urdu literatures. But the Establishment accused the movement of promoting perversion and obscenity in society and issued arrest warrants against Samir Roychoudhury, Malay Roychoudhury, Debi Ray, Subhash Ghosh, Saileshwar Ghosh, Pradip Choudhury, Utpal Kumar Basu, Ramananda Chattopadhyay, Basudeb Dasgupta, Subo Acharya and Subimal Basak. Although all of them were finally released, the movement slowly died down. There have been occasional claims about the revival of the movement by many writers of the post 70s period as also by practioners of other later streams of literature that resembled the Hungyalist genre in a
    few ways. In fact, Malay Roychoudhuri, who was the founder
    and life spirit of the movement, mentions that he is often
    requested by youngsters to help them re-launch the Hungryalist movement afresh. But he steadily rejects any such proposal. “I tell them to understand their own space and time”, he says, “and thereafter, devise their own platform to express themselves” (Roychoudhury, “A Sour Time of Putrefaction” Web. np).
    So, what was this alterity that the Hungryalists tried to
    forge through their movement? Alterity can briefly be defined
    as the state of being different, as a state of otherness as opposed to the self. The concept can be traced back to Descartes and his formulation of the relationship between the self and the other (Newman).But rather than engaging in the philosophical notion of alterity, I have here used the term to refer to the cultural difference that the movement symbolized from the mimetic tendencies of post-colonial socio-literary scenario of Bengal.
    In my paper, I have provided an elaborate idea about how
    the Hungryalists launched the movement as an attack on the
    status quo of the literary scenario during the 1960s, only to
    propose that despite being a revolutionary period in the history of Bengali literature that shocked the typical 19th century poetic sensibility of the Calcutta-based intelligentsia, the success of the Hungryalist movement seems questionable as the organized counter discourse developed by the Hungryalists are often found to rely on those very points of references that they set out to destroy and discard. I have divided my paper into four sections in order to discuss separately certain important aspects of the Movement. In the first section I have given a general overview of the movement by locating it in its social, cultural and political context. In the second part, I have talked about the fundamental
    characteristics of Hungryalist literature, its principles and beliefs, and how the movement promised an alternate form of poetics that shook the roots of the orthodox and sanitized tradition of postcolonial Bengali literature. I have taken examples of certain poems and prose pieces written by the Hungryalists to elaborate their theories through instances of their works and demonstrate their stark difference from the elitist, bourgeois literature. In the last section, I have attempted to examine the extent of success
    that the movement could achieve in freeing Bengali literature
    from the shackles of western notions of politics and aesthetics.

    1
    Bengali art and literature has always been deeply influenced
    by the different aesthetic movements of the West. Despite the presence of certain minor trends in parallel literature, the modern Bengali artistic and literary arena had been fed on Western colonial thought. Even little magazines like Kallol (1932) and Krittibas (1953) that appeared with promises of rebellion and change had failed to break completely away from the Bengali literary canons which were modeled largely on Western philosophical notions. They clearly depended on the colonial aesthetic reality for their creations. The Hungryalists started a movement against this boot-licking tendency of postcolonial Bengali art and literature by denying the basic premises of Western aesthetic theories in their works. According to Malay Roychoudhury, the name ‘hungry’ was taken from Chaucer’s phrase “In Sowre Hungry Tyme” (Ray 64). The philosophical basis for the movement was founded on Oswald Spengler’s idea of history not as a linear progression but rather, as a flourishing of self-contained individual cultures (1991). The Hungryalist movement was thus, the offspring of its sour and hungry time.
    The two Five Year Plans of 1951 and 1956 proved to be
    unsatisfactory for the progress of the newly independent nation. The dream of a free, ideal state which had kept the nation going in the pre-Independence era remained unfulfilled. Partition led to an unprecedented cultural bankruptcy in Bengal giving rise to stagnancy in creative endeavors. It is at this juncture that the Hungryalist movement first broke out in the form of an alterity
    in poetics and thought and posed a serious threat to the discursive practices of the mainstream elite culture of Bengal through the assertion of a counter discourse. The movement was first launched in November 1961 from the Patna residence of Malay and Samir Roychoudhury. The first bulletin however, was published in English since Bengali typefaces were hard to find in the Hindi speaking township of Patna and the only printer with the required typefaces refused to publish it. This first bulletin
    Goes:

    Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting
    of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent
    and somnambulistic jazzing of the hymning five, a
    sowing of the tempestual Hunger. […]Naturally, we
    have discarded the blanket-blank school of modern
    poetry, the darling of the press, where poetry does
    not resurrect itself in an orgasmic flow, but words
    come out bubbling in an artificial muddle. […]
    Saturated with self-consciousness, poems have begun
    to appear from the tomb of logic or the bier of unsexed
    Rhetoric.

    Debi Ray, who was in charge of strategically distributing
    the pamphlets, had arranged to disperse the bulletin at intellectual joints, offices of periodicals and college campuses within one single day. Such a movement being unprecedented in the history of Bengal, it had taken Calcutta by storm. It had struck each layer of the Establishment as it had aspired to and disturbed profoundly, the age old canons with its practice of systematic counter-canonization. The bulletin was reprinted with slight revisions in 1962 and then again in November 1963 under the heading “The Hungryalist Manifesto on Poetry”. By then, the movement had gathered quite a few members whose names were printed on the flipside of the reprinted pamphlet. Meanwhile many other bulletins and manifestoes were constantly being
    issued and distributed freely by the Hungryalists which caused the number of members to cross forty, by January 1964. Samir had introduced his friends Sandipan Chattopadhyay, Utpalkumar Basu and Binoy Majumdar; Malay had brought in his friends Subimal Basak, Sambhu Rakshit, Tapan Das, Anil Karanjai and Karunanidhan Mukhopadhyay; Subimal Basak had brought in his friends Tridib Mitra, AloMitra and Falguni Ray; Shakti had brought in Arupratan Basu, Pradip Choudhuri and Basudeb Dasgupta; Debi Ray had brought in Subo Acharya, Subhas Ghosh, Satindra Bhowmik, Haranath Ghose, Nihar Guha, Saileswar Ghosh, Amritatanay Gupta, Ramananda Chattopadhyay, Sunil Mitra, Shankar Sen, Bhanu Chattopadhyay, Ashok Chattopadhyay, Jogesh Panda and Manohar Das. The painters Anil and Karuna, brought in painters like Subir Chatterjee, Bibhuti Chakrabarty, Arun Datta and
    Bibhas Das into the fold of the movement. Before long, the
    Hungry Generation had become a socio-cultural force to deal
    with. Many contemporary critics were of the idea that
    Hungryalism was deeply influenced by Dadaism.
    The theoretical basis for the movement was borrowed
    from Oswald Spengler’s The Decline of the West, a two volume work that had influenced Malay greatly in his youth. According to Spengler, the history of a culture does not move in a linear progression but develops into a number of cultural preferences,each with its own typical spiritual tendency, or idea of space within which they operate (Spengler 4). This whole theory was revolutionary since it broke away completely from the traditional Hegelian concept of history being a process governed by reason. Spengler uses the metaphor of biology. He says that this is an organic process and so it’s impossible to predict towards which direction it would grow (Mitra Web). The cultures go through a
    process of growing, reaching a climax and then withering away. A culture is self-creative during ascendency, but once its creativity is exhausted, it starts absorbing random elements from without.Its demand for these external elements becomes insatiable during descent. It is this unquenchable thirst for ingredients outside self that was termed Hunger by Malay when he first launched the
    movement. The Hungryalists felt that after Partition, Bengal
    had reached that moment of rot and it was impossible to go back to the idealized position of the 19th century. That is why they devised the Hungryalist movement as a counter-culture
    movement and deliberately created their literature in a counter discourse. All the artistic and literary movements of the West had been arranged according to the functioning of a linear history. Groups like Parichay (1931), Kallol (1932), Krittibas (1953) and Notun Reeti (1958) which were founded with the promise of making a difference with their new literary experimentations also started replicating the colonial aesthetic reality and linear progression of narrative history in their works. Their writings were heavily dependent on logical progression of thoughts and the idea of self as one, whole and unified. Parichay and Kallol were formulated on the basis of Calcutta-centric, middle class values that identified themselves with occidental canons and discourses. Krittibas and Notun Reeti developed a method of counter-identification by remaining within the discursive control of the above ideas only with the incorporation of certain elements from the Soviet discourse in case of some writers. The Hungryalists aspired to go beyond this structure of conflicts and completely negated that discourse through de-identification.
    They also opposed aesthetic realism. In a poem, Shambhu Rakshit Writes:

    These coconut-leaf combs, even they threaten me as
    soon as I turn my back.
    Nothing, just a minute, nothing do I know about
    parliaments or rumors or.
    The shrieks of wild dogs surround me— and of course
    I should be informed, of course I
    Should be allowed to sink, allowed to go where I don’t
    want to, allowed to pace up and down.
    (My own translation of Ami Swechhachari by
    Shambhu Rakshit, Lines 1–4) (Hungry Bulletin O
    Patrika Theke (1961 - 1965)

    Instead of following a normative, logical sequence which
    is used to express realism, this movement sought to introduce chaos and disintegration in the very structure of a poem rendering it conventionally meaningless. To sum it up in the words of Professor Howard McCord, the Hungryalists composed “Poetry of Chaos and Death” (in Mitra Web).
    The Hungryalists generally brought out their bulletins in
    one page pamphlets. The ones that were published by Malay
    from Patna were in English due to the lack of Bengali typeface there. The address given on the pamphlets was generally of Haradhon Dhara, who was the editor, and whose slum residence in Howrah was used by the Hungryalists for correspondence. This decision was perhaps intentional since Dhara belonged to a subaltern caste and so his image aided in flouting the conservative sensibility that denied the subaltern any position in the space of its aestheticism. The Hungryalists published their precise, solidified commentary on various issues ranging from poetry, short story, drama to religion, politics, obscenity and even life and distributed them all across Calcutta— in the College Street Coffee House, many magazine and newspaper offices, in colleges,
    especially in the Bengali departments and libraries etc. Because a large body of writing was printed on handbills and leaflets, the Hungryalists were unable to preserve and archive much of their work which leads to some difficulty in carrying on extensive and detailed research on the movement. But it no doubt fulfilled their immediate objective— that of being noticed by both common people and those in power. It is not difficult to guess that their innovative use of different media generated far greater attention towards the movement than it would have done had the media been conventional and expected.
    In between 1963 to 1965, the Hungryalists had also started
    publishing a few magazines, e.g., Protidwondwi edited by Subimal Basak, Unmargo edited by Tridib Mitra, Jebra edited by Malay Roychoudhury, Chinho edited by Debi Ray, Phoo edited by Pradip Choudhury, Eshona edited by Satindra Bhowmick and the only English language magazine of the movement, The Waste Paper, edited by Alo Mitra.

    Except for Debi Ray, Tridib and Alo Mitra, who were
    stationed at Howrah, across Calcutta, most of the participants came from outside the city. They belonged to the fringe. Subimal, like Malay, came from Patna; Samir was Chaibasa-based; the Ghosh brothers, Subhas and Saileswar, were from Balurghat; Shakti was from Jaynagar-Majilpur; all the painters were from Benaras; Pradip Choudhuri, originally from Tripura, was based at Shantiniketan; Subo Acharya was based at Bishnupur and Ramananda Chattopadhyay at Bankura. The Hungryalist movement thus developed spatial qualities instead of timecentric features of earlier post-Tagore literary generations.
    Professor Howard McCord clearly states that although the
    serious, introspective Indian poetry before the Hungryalist
    movement had a certain merit, they seemed to lack any sense of space. “These are sincere and harmless poems, and aside from a little local colour, could have been written in Leeds or Philadelphia. The denatured cosmopolitanism that infects the poetry of the West prevails in India as well, and few of the poems carry any sense of place, or the sound of a man speaking, or the rasping smell of cow-dung fires”, he writes (in Mitra Web). On the other hand, in the guise of being spatially neutral, a large body of post-Tagore poetry remained too regional, focusing only on a privileged social group and their discourse. It was predominantly Kolkata-centric, epitomizing certain urban middle class values and considering them to be universally ‘perfect’, a proposition that directly reflects Matthew Arnold’s ideas about poetry in The Study of Poetry (Arnold 184). But defying this inheritance of Victorian conservatism, Hungryalism emerged as a post-colonial counter-discourse. In the first bulletin itself the movement gave a battle cry against modern poetry, as
    well as against the tyranny of logic. Till then the concept of
    syntactical and logical progression of the text was considered the ultimate poetics in literary canons. Following the narrative
    conventions of post-Enlightenment English literature that went on till the turn of the 19th century, the poets and writers of early 20th century Bengal were chiefly following a chronological and syntactical order in their writings. The reason for such linear progression of narratives was to produce proper meaning for the urban elite readers whose literary and cultural sensibility were deeply influenced by the three hundred years of colonial rule in India. That is why, when the Hungryalists moved out of this convention of representation, their works were considered vulgar
    and obscene by the erudite middle class population who had
    already hierarchized literature according to their notions of
    literary taste.

    But at the peak of the movement, Binoy Majumdar
    developed schizoid problems. Shakti was harried by literary
    guardians to leave the group and issue anti-Hungryalist
    proclamations. Sandipan Chattopadhyay was enticed by a mass circulation magazine with a promise to bring out his novel provided he quit the movement. Sunil Gangopadhyay, in his editorial in Krittibas, castigated the movement:
    We don’t know whether the Hungry Generation
    movement is good or bad. We have nothing to
    comment about its future. However, none of the
    leaflets circulated by them had shown any remarkable
    literary merit— ordinary writings aspiring to be
    different. Funnily enough, some are even juvenile.
    Other than that, the non-literary associations that
    the movement seems to have developed are indeed
    disgusting. We really couldn’t imagine that a few
    youths would attempt to create literature in Pidgin
    English even after 1960. But if the movement can
    give rise to a different kind of literature, we’ll definitely
    welcome it. (“Hungry Bulletin O Patrika Theke”
    [1961 – 1965]. Translation mine)

    As a result several fence-sitters were trapped in an
    intellectual bind. These writers in the end committed themselves to prolific commercial writing. By the middle of 1964 only Utpal, Samir, Malay, Debi, Subimal, Subhas, Saileshwar, Pradip, Karuna,Anil, Tridib, Alo, Falguni, Subo and Ramananda remained in the movement. The departure of fence-sitters proved to be a positive feature. The process accelerated the disintegration of aesthetic realism, leading to gradual dissolution of distinction between the elite and subaltern cultures. Hungryalist texts developed subversive and multiple semiotic and semantic characteristics. The mono-centric, unified truth as demanded by the then presiding academicians were persistently attacked by
    the participants. In their writings, prose writers such as Samir,
    Falguni, Subhas and Subimal, as well as in Malay (in his dramas), developed a kind of textual reality that was not oblivious to the problematics of heteroglossia (Vice 18).They accommodated not only different languages but also different dialects within the same language irrespective of how localized that dialect was. They were aware of the hierarchical relationship between different
    languages and even different forms of the same language. They used this awareness of heteroglossia to highlight their own minority status which defied contemporary literary poetics in favor of transgressive styles. Subimal Basak’s novel Chhata Matha is a good example of this transgression. It is written in its entirety in the language of East Bengali tongawalas which makes it a difficult read. However, being in a distinct East Bengali dialect, the novel could be understood easily by the illiterate common East Bengalis when read out loud.

    Hungryalists like Malay Roychoudhury, Subimal Basak
    and Debi Ray became well known through their radically anti-
    Establishment policies. They used different, innovative media
    to spread their manifestos and bulletins. “It had been a revolution from the very beginning. I had constantly sponsored the production of bulletins, masks, posters, poems in wedding cards, literary meets in red light areas, tribal women in Chowrangi, etc.”(My own translation) (Ray 64), said Malay Roychoudhury in an interview taken by Arunesh Ghosh during the 1980s. They would deliver paper masks of animals, monsters and gods to ministers, critics, publishers and other powerful people with the slogan ‘please remove your mask’. They would critique poets on wedding cards and make obscene sketches on papers and posters and distribute them for free. They would send shoeboxes for
    book review or blank paper in the name of short stories to wellknown commercial newspaper offices. They violently attacked the administration and media. They would often go to Benaras or Kathmandu and engage in sexual anarchy and drug abuse along with hippies. They would exhibit Hungryalist paintings and at the end of the exhibition, set fire to all of them. It was their firm belief that it was only through such brutality that the colonial hangover which the decadent Bengali culture had absorbed, could be shaken out of the Bengali socio-literary arena. Naturally, these meetings, exhibitions and promotion of such literature among
    the masses led to a socio-literary unrest which alarmed the
    government. Finally, the administration intervened. On 2nd
    September 1964, an arrest warrant was issued against eleven Hungryalists namely Samir Roychoudhury, Malay
    Roychoudhury, Debi Ray, Subhash Ghosh, Saileshwar Ghosh, Pradip Choudhury, Utpal Kumar Basu, Ramananda
    Chattopadhyay, Basudeb Dasgupta, Subo Acharya and Subimal Basak under IPC sections 120b and 292. Articles were seized from Samir and Malay’s ancestral home in Patna on 4th September. Consequently, a charge sheet against Malay was submitted at the Bankshal court by Calcutta Police on 3rd May 1965.

    The charge sheet goes:
    In August 1964 a printed booklet entitled Hungry
    Generation published by Samir Roychoudhury was
    found in circulation at Kolkata. The poetry captioned
    Prachanda Boidyutik Chhutar(Stark Electric Jesus)
    by Malay Roychoudhury was found obscene and the
    Director of Public Prosecution, West Bengal being
    consulted, observed that the book was actionable
    under Section 292 of Indian Penal Code, and
    suggested prosecution of Malay Roychoudhury, who
    is on criminal bail till today the 3rd May 1965, may
    be prosecuted against under Section 292 IPC. (Hungry
    Generation)

    Many of the fellow Hungryalists were coerced and
    persuaded by the police to bear witness against Malay. Shakti Chattapadhyay, one of the founding members of the movement himself spoke against the movement. Saileshwar Ghose and Shubhas Ghose also bore witness against Malay. But Malay appealed to the higher court and eventually was acquitted of all charges by July 1967. However, this court case against the Hungryalists had a tremendous impact on their individual lives. Utpal Kumar Basu was fired from his job of a professor; Pradip Choudhury was rusticated from Bishwabharati. Samir Roychoudhury was suspended from his government office; Debi Ray and Subimal Basak were transferred outside Calcutta. Subo Achrya and Ramananda Chattapadhyay became fugitives. Article 120b being that of conspiracy, the Calcutta detective department had issued dossiers for each and every Hungryalist member.
    During the arrests, the police mercilessly rummaged through each of their houses and the books, manuscripts, files, diaries and even letters that they had confiscated during that period were never given back to them.

    2
    Who would you acknowledge as the first poet? Some
    think that it was that Cro-Magnon who plucked a
    flower for his Eve twenty five thousand years ago. But
    for me, the first poet was that Zinjanthropus who
    lifted a stone millions of years ago and made it into a
    weapon. (My own translation) (Ray 41)
    This very comment of Malay makes it evident how the
    Hungryalist movement revolutionized the ways in which poetry was to be composed in postcolonial Bengal. The Hungryalists evolved a new ethos of diction breaking down the stagnancy and depravity of the sophisticated, artificial poetry that was constantly highlighted by the intelligentsia of the 40s, 50s and 60s in Calcutta. In one of his Hungry bulletins, Malay Roychoudhury clearly announces that poetry has to erupt in an orgasmic flow; hence it is essential to unlearn the education imposed by the institutionalized units of administration, religion, politics and society. Vision, which is fundamental to creativity, can come only to the raw, uneducated soul. Logic and rationality must be done away with, completely. It should be freed from the fetters of artistic hierarchies, from the manacles of neatly assigned
    watertight meters. While discussing the condition of
    contemporary Bengali literature Malay says:
    "those idealized and universalized noble passions,
    knowledge and expertise in art, all those academic
    hotchpotch, the artificialities dressed as
    subjectivism— if these are not gotten rid of, no poetry
    is possible…”(Roychoudhury, Ishtahar Sankalan 47.
    Translation mine).
    He bitterly condemns western aesthetic movements like
    “art of art’s sake”, art for technique’s sake, art for form’s sake, art for symbol’s sake etc. and the imitators of such movements in the Bengali bourgeois scholastic circle. Vision can be attained only through the mediation of the ‘native idiom’ and it is this native idiom that serves as the language of real poetry, the language of resistance. In the Hungryalist Manifesto, the objectives of the Movement have been clearly stated:
    1. To never emulate the reality of Aristotle, but to
    take the un-enameled whoring reality by shock under
    the genital of Art.
    2. To let speechlessness burst into communication
    without breaking the silence.
    3. To let free a creative ruckus, in order to unknot the
    knotted world and start afresh from chaos.
    4. To exploit every matrix of senses except that of a
    writer.
    5. To disclose the belief that world and existence are
    justified only as an aesthetic phenomenon.
    142 Margins: A Journal of Literature and Culture
    6. To accept all doubts and despairs rather than to be
    content to live with the sense made by others.
    7. To lash out against the values of the bi-legged careermaking animals.
    8. To abjure all meretricious blandishments for the
    sake of absolute sincerity.
    9. To stop writing and painting beyond the point of
    Self-realization.

    The Hungryalists, as mentioned before, had completely
    broken away from any kind of form, meter, style, mannerism,
    punctuation, line, pattern, symbol, genre, metaphor and logical arrangement of words. They believed that the only justification for writing is bursting out in passion. They were deeply inspired by Antonin Artaud’s views. “People who leave the obscure and try to define whatever it is that goes on in their heads, are pigs....
    Those for whom certain words have meaning, and certain
    manners of being; those who are so fussy; those for whom
    emotions are classifiable, and who quibble over some degree or other of their hilarious classifications; those who still believe in ‘terms’, those who brandish whatever ideologies belong to the hierarchy of the times, who talk of contemporary currents of thought; those who still believe in some orientation of the spirit, those who follow paths, who drop names, who fill books with screaming headlines ...are the worst kind of pigs” (Artaud 38).
    This principle of uncontrollable energy, welling out of the self
    without any pre-determined shape, form or purpose can be amply found in Hungryalist poetry:

    Oh I’ll die I’ll die I’ll die
    My skin is in blazing furore
    I do not know what I’ll do where I’ll go oh I am sick
    […]
    Oh Malay
    Calcutta seems to be a procession of wet and slippery
    organs today
    Margins: A Journal of Literature and Culture 143
    But I do not know what I’ll do now with my own self
    My power of recollection is withering away
    Let me ascend alone toward death
    I haven’t had to learn copulation and dying
    […]
    Aaaaaaaaaaaaaaaaaaaah
    I do not know whether I am going to die
    Squandering was roaring within heart’s exhaustive
    impatience
    I’ll disrupt and destroy
    I’ll split all into pieces for the sake of Art
    There isn’t any other way out for poetry except
    suicide… (Roychoudhury “Stark Electric Jesus”, Lines
    1-62)

    This poem ‘Prochondo Boidyutik Chhutar’, translated as
    ‘Stark Electric Jesus’ composed by Malay, was a ground-breaking one of its time. It elaborated unmistakably that the Hungryalists aimed not at changing or appropriating form, but at completely destructing any formal elements that have been thrust upon indigenous literature indiscriminately following the practice of occidental literary canons. In the original Bengali texts, the alteration of the spellings of certain words according to their pronunciations was a blasphemously revolutionary poetic innovation that sought to redefine the rules of quintessential Bengali grammar. The primary job of a poet is to declare war against art. The reader should first be alienated and made hostile, and then, through that same aggressive rhetoric and attitude, be provoked and scandalized. Poetry, in actuality is the embodiment
    of violent and destructive creativity. According to Dr. Indrajit
    Bhattacharjee, (Professor of English, Osmania University) the movement had reached a crescendo when it was on the brink of withdrawing itself completely from the western canon and discourse (Hungry Generation Blog). The stark difference of this revolutionary movement from the contemporary mainstream aesthetics was neatly categorized by Subimal Basak and Rajkamal Choudhary in their trilingual (Bengali-Hindi English) bulletin in 1963.

    Prevailing Canons
    1. Establishment 2. Tyranny 3. Insiders 4. Elite high-brow culture
    5. Satisfied 6. C ohesive 7. Showy 8. Sex as known 9. Socialite
    10. Lovers 11. Ecstasy 12. Unmoved 13. Hatred as camouflage
    14. Art films 15. Art 16. Sugam Sangeet (Tagore songs) 17.
    Dream 18. Tutored language 19. Redeemed 20. Framed 21.
    Conformist 22. Indifferent 23. Mainstream 24. Curiosity 25.
    Endocrine 26. Conclusions inevitable 27. Ceremony 28. Throne
    29. Entertainer 30. Self-projecting 31. How am I 32.
    Symmetrical 33. Accountants of prosody 34. Revising poems
    35. Fantasy’s game.

    Hungryalist Canons
    1. Anti-Establishment 2. Protester 3. Outsiders 4. Commoners’
    culture 5. Unsatisfied 6. Brittle 7. Raw-bone 8. Sex as unknown
    9. Sociable 10. Mourners 11. Agony 12. Turbulent 13. Real hatred
    14. All films 15. Life 16. Any song 17. Nightmare 18. Gut
    language 19. Unredeemed 20. Contestatory 21. Dissident 22.
    Struck ethically 23. Watershed 24. Anxiousness 25. Adrenalin
    26. No end to unfolding 27. Celebration 28. Abdication 29.
    Thought provoking 30. Self-effacing 31. How are you 32.
    Tattered and decanonized 33. Extravagance 34. Continuation
    revision of life 35. Imagination’s flight (Hungry Generation).

    Apart from their avant-garde theories on poetry, the
    Hungryalists also issued manifestos discussing politics and
    religion which alarmed the administration of Bengal and made them realize that Hungryalism had already become a cult in itself. In their ‘political manifesto’, the Hungryalists promoted that it is important to depoliticize the soul of every individual, in order to make him realize that existence is pre-political. They declared that all intellectual fakeries called political hypothesis are basically the sources of lethal and seductive lies exploding out of monstrous irresponsibility. In their religious manifesto, they propagated that god is garbage and that religion is nothing but murder, rape, suicide, drug-abuse, poison, perversion, addiction, insomnia and constant transformation.
    The Hungryalist Movement redefined the meaning of
    obscenity in contemporary Bengali literature. For the first time, it introduced the idea that there is nothing called obscenity. The Hungryalists felt that obscenity is an artificial construct; it is created, invented, made-up by a group of uneducated class conscious conspirators. These opportunistic conspirators have divided the vocabulary along class divisions. To the elite, the language of the subaltern is coarse, crude, obscene and his own language, an art. The Hungryalists deliberately attacked this double standard by subverting the very diction in which Bengali poetry was written during the 40s, 50s and 60s. The poem
    ‘Habijabi’, by Subimal Basak would have been a brilliant example to cite here, a poem which brings to life the colloquial Bengali of Dhaka, posing a direct challenge to the so called puritan guardians of mainstream Bengali literature. But unfortunately, the essence of the poem lies in its accent and delivery of words, so it loses its most important meaning in translation.
    The movement further launched the idea that sexuality is
    not obscene. In fact, sex is the only phenomenon which is beyond the pettiness of culture, tradition, religion, race, wealth, rituals, conventions and law. Sexuality is probably the only medium through which the unconscious can be realized and examined.

    Within my clasp, your absolute, exploding fetus
    Bursts again. I’m my own root, I’m food for the soil,
    earth
    Salty water, I’m grass and I smoke myself, look, my
    green body, my maroon limbs
    Maroon eyes, maroon abdomen and pale genital
    146 Margins: A Journal of Literature and Culture
    Hurling abuses of love among the yellow waves of
    blood
    The scent of fresh gunpowder numbs my body and
    perhaps life… (Siddhartha by Pradip Choudhury in
    “Hungry Bulletin O Patrika Theke” [1961 – 1965]
    Translation mine)

    The Hungryalists vehemently protested against the
    hypocrisy of the established literary culture which censored
    sexual content and language when used as an expression of
    unprocessed creativity and yet, itself indulged in sexuality for
    achieving certain commercial, capitalistic ends. It was them, who first exposed how the establishment promotes a society where sexuality can be used as a commodity but not as a weapon.

    3
    It is unnecessary to mention the huge legacy of alterity
    that the Hungryalist Movement has left to the history of
    postcolonial Bengali literature. The movement had shaken away the yoke of dominance imposed upon Bengali literature by the stalwarts of established literary canons; stalwarts, who replicated Western philosophical thought in their writings and criticism even many years after India had attained independence. It brought in a breath of fresh air through the brutally different ideas that were born out of it. Hungryalist literature, even in its initial stage,seemed to have been self conscious of its minority status and deliberately sought to locate itself as the ‘other’ which would question the very power structures associated with the ideas of majority and minority. Before 1961, most Bengali magazines
    had Sanskritized names which were probably supposed to mark their superiority over cheap Bengali literature, e.g., Kobita, Purbasha, Arani, Krittibas, Uttorsuri, Dhrupodi, Kranti, etc. After the movement such classical names were replaced by radical ones like Kaurab, Abar Esechhi Phire, Manusher Bachchha, Dhoper Kagoj, etc. Subaltern literature, a field so long intentionally left out of the scope of magazines like Kobita, Krittibas, Dhrupodi and others, found its voice for the first time in Hungryalist literature. The subaltern discourse was given as much importance as the dominant discourse or perhaps more. This further hastened the use of mixed diction in modern Bengali poetry. Poets started employing sexual metaphors and slangs of every kind to create striking and hard-hitting images in their works. The openness in rhythm, punctuation and order gave a new freedom to Bengali literature post 1965. Poems of Falguni Ray, Malay Roychoudhury, Saileshwar Ghose and Tridib Mitra
    are points of reference in poetry and the pieces by Subimal Basak and Malay Roychoudhury in prose. Expressions such as ‘uh’,‘ahh’, ‘aaaaaaaaaaah’, ‘oh’, ‘phooh’ etc. that were so long forbidden to be a part of the sophisticated postcolonial Bengali rhetoric,now began to be accommodated. Absence of a logical sequenceboth in terms of sentence structure and meaning was first usedby the Hungryalists, a process that became vital to the literatureof the 70s. As is evident from the lines of Roychoudhury’s “Stark Electric Jesus”, the Hungryalists also introduced the playful use of unstable imagery which collapsed into one another even before
    being fully formed. The Naxalite movement that ravaged Bengal towards the 1960s seems to be somewhat influenced by the subversion, the destructiveness and the urge to restart after complete collapse that the Hungryalist movement embodied.The revolutionary ideologies developed by the
    Hungryalists were however, not limited only to Bengal. It created a stir all over the world. Not only the English version of Time magazine, but the Spanish version too, wrote about the movement. Many international magazines and periodicals like City Lights Journal, Kulchur, Klactoveedsedsteen, Salted Feathers etc. printed, reprinted and brought out special issues on the Movement.

    In his letter to Malay Roychoudhury, American writer
    Howard McCord requests Malay to send him a copy of “Stark
    Electric Jesus” which he wished to publish in Contemporary
    Indian Poetry (Ghosh Dastidar np). The poem was first written in Bengali and translated by Malay himself. The poem was published in City Lights Journal with an introduction on the movement written by Prof McCord, and the same matter was republished in the Hungryalist commemorative issue of Salted Feathers edited by Dick Bakken. Salted Feathers featured most of the participants of the movement.

    As for the other Indian languages, in Hindi, Sharad Deora
    wrote a novel titled College Street Ka Naya Maseeha based on the life and works of Hungryalists; Phanishwarnath Renu wrote Ram Pathak Ki Diary Se; Dharmaveer Bharati and S.H.
    Vatsayana Ajneya wrote quite frequently about them in the
    periodicals they edited, i.e., Dharmayug and Dinaman; Ashok
    Shahane, Dilip Chitre and Arun Kolatkar hailed them in Marathi; Umashankar Joshi introduced them in Gujarat; Ameeq Hanfee translated and introduced them to Urdu readers. The Bengali intelligentsia had not bargained for this national and international exposure and publicity. Reputed academicians of the time, such as, Sukumar Sen, Asitkumar Bandyopadhyay, Haraprasad Mitra, Bhabatosh Datta, Ujjwalkumar Majumdar, Kshetra Gupta, Saroj Bandyopadhyay, Sashubhushan Dasgupta, Sukumar Bhattacharya, Debiprasad Bhattacharya, Bhudeb
    Choudhury, Tarapada Mukhopadhyay, Chinmohan Sehanobis
    and others preferred to ignore the turbulence created by the
    movement. Some academicians even persuaded academicians of other Indian languages to ignore the Hungryalist impact (Hungry Generation). Nevertheless, intellectuals from other countries, such as Gary Snyder, Octavio Paz and Ernesto Cardenal sought out the Hungryalists when they visited India.

    4
    One question must be asked in order to properly evaluate
    the Hungryalist Movement through a post colonial lens. Could the Hungryalists succeed completely in evolving a counter discourse against the colonial aesthetics practiced by the established literary culture? Perhaps not entirely. The name of the movement itself was a lift from the great medieval poet of England, Geoffrey Chaucer. The theoretical foundation on which the whole body of the movement stands is borrowed from Oswald Spengler, himself a German historian and philosopher who wrote his theories on the decline of the ‘west’. It is his theory that Malay and Shakti had imposed upon the postcolonial Indian reality. The justification of such an assumption of similarity is
    indeed questionable. In his letter to Malay on 22nd May 1965,
    Howard McCord writes:

    I have enjoyed very much reading your letter and
    coming in contact with your thoughts. Artaud, Genet,
    Burroughs: yes. They are the dialecticians of chaos
    presiding at the dissolution of the west. They
    describe, with joy and exactitude, the destruction in
    which they are themselves involved. Burroughs, to
    me, is a man performing an autopsy on himself. They
    are all quite mad, and therefore speak the truth. We
    can only trust the mad anymore. The West began to
    die around 1750, and it has been the function of poets
    to recite, in series, the long funeral oration. William
    Blake began it. Goethe, Baudelaire, Lautremont,
    Rimbaud, Huysmans (unknowingly), Pound, Eliot,
    Crane, and all the other familiar names have
    continued the chant. We are their heirs, and perhaps
    the culmination, for our anguish and despair, the
    aesthetic suicide of which we are capable, may mark
    the end. Perhaps it will go on. (in Ghosh Dastidar)
    Although we don’t have access to Malay’s letter to McCord,
    it is evident from this letter that Malay had indeed discussed the influence of these significant theoreticians with McCord. Both Antoine Artuad and Jean Genet are controversial thinkers of 20th century France, a typically colonial power and William S. Burroughs, a primary figure of the Beatnik movement that has always been notoriously aligned with the Hungryalist movement. Moreover, Hungryalists have repeatedly expressed their admiration for the 19th century Bengal renaissance literary personages like Michael Madhusudan Dutt and Bankim Chandra Chattapadhyay. The 19th century enlightenment was perceived by them to be a state of idealized history which has been lost forever. This indeed seems murky waters since 19th century was
    the age of western education and Cartesian philosophy of
    thought— two issues that the principles of Hungryalism clearly appears to negate, unlearn and cruelly annihilate. What are we to make of such contradictions?
    Poets like Pabitra Mukhopadhyay, Basudeb Dasgupta etc.
    have seen overt Beatnik influence in Malay’s poems of the
    Amimangshito and Jakham range poetry. I have already quoted McCord’s letter to Malay to demonstrate how indeed Malay seems to have discussed Burroughs in his correspondence with him. Some have even pointed towards the obvious similarity between Hungryalism and the Hippie culture of the west. When confronted with this charge, Malay had refuted it by saying that such a comment can only be the result of poor research. In an interview to Sayed Samidul Alam during the 1980s, he specifies the distinction between the Hungryalists and the hippies. He says that hippies were essentially a sect of upper-class dropouts; they represented a counter culture. But the Hungryalists, while also representing a counter culture, had always been lower class
    people, subaltern to the elites, complete ‘outsiders’ to mainstream society. Their bohemianism, unlike the hippies, was not by choice, but by compulsion. Any charge of the Hungryalists imitating the hippies must be taken as the ploy of the bourgeois Bengali society to dishonor the movement. On one hand, Malay says, “I think of my ancestor, the lascivious Sabarna Choudhury, I must do something new, something different” (‘Prochondo Boidyutik Chhutar’) – which is a total castigation of his ancestor. But on the other hand, there is a sense of unease associated with his own
    roots that he seems unable to justify to himself, an anxiety with respect to his present identity as the founding member of a subaltern movement.

    A close reading of the Hungryalist poems often reveals
    that after all, poetry does not actually well out of the self in an
    orgasmic fervor. It is a careful construct, a cautiously developed pattern of words placed one against the other in order to shock the readers. Most of the Hungryalist poems, in fact, clearly bear marks of being a manufactured product designed to create a certain affect. Every single image seems a meticulous choice to be juxtaposed against another image. The Hungryalist objective of making every word speak for itself gives special attention to the vividness and audibility of words, and the poets, while they erect
    the body of poetry with these words are quite conscious of thiswhole process of rigorous creation. Malay himself confesses, “An idea keeps revolving inside my head for a few days. I put it down on paper in a trance. And only after polishing it thoroughly does it become poetry” (Ray 13).

    So Malay, (who, in the Hungryalist manifestos ridicules
    poet and academician Buddhadeb Basu for his statement “any art is a construct and in that sense, artificial” (Roychoudhury, Ishtahar Sankalan) unwittingly confesses that he himself undergoes this same procedure of initial inspired passion and consequent thorough polishing and revision while composing, quite contrary to his propagated theory of making poetry the expression of bare, unmediated instincts.
    The claim that Hungryalism is different from the Western
    hippie culture since the former propagates a system of alternate ethos and the latter, a conscious conflict with the Establishment, hardly seems convincing. In many Hungryalist manifestos and bulletins, the members of the movement repeatedly use words like “counter-canonization”, “counter-discourse”, etc. In each of their writings, it becomes apparent that the whole cult of Hungryalism has been formulated as a reaction or counter-action to the prevailing, established aesthetics. It is undoubtedly a confrontation, an act of calculated flouting of ‘norm’. But in this act of ‘writing back’ the Hungryalists often seem to use those very points of reference (e.g., counter-discourse can be formulated only in reference to that of the ‘discourse’)that they had planned to undo at the very outset.

    Conclusion
    According to Pradip Choudhuri, a leading philosopher
    and poet of the time whose work has been extensively translated in French, the counter-discourse of the Hungryalist Generation of Bengal was the first voice of post-colonial freedom of pen and brush (Datta Web). The majority of Bengalis having almost an instinctive inclination for Marxist ideology during the post independence era, Oswald Spengler’s prophecy of doom and disaster was the first salvo of controversy which made the Hungryalists unacceptable to leftist media and professors for almost two decades. It was because of the individual genius of such authors as novelist Subimal Basak and poet Malay Roychoudhury that the barriers were broken. Subsequent researchers such as Dr. Uttam Das of Calcutta University, Prof.Nandalal Sharma of Chittagong University and Prof Howard McCord of Washington State University, however, have
    explained that the social commitment in the Hungryalist writers over the years alleviated the fear of political leftists (Mitra Web). It is the trace of nationalist feeling that has kept them in goodstead and cut through shallow political controversies.
    Nevertheless, very often their nationalism itself has led to
    controversy as the Hungryalists have been criticizing politicians of all kinds. In spite of trial and harassment, the Hungry Generation has continued to produce and publish poetry and prose. Sharp, caustic, dark, hallucinatory, nihilistic, offensive, obscene, angry, piercing— these characterize the terrifying and cleansing visions that the Hungryalists insist Indian literature must suffer. With a few exceptions, modern Indian literature is age old and tedious: pallid, otiose, and dull. It is timid and moralizing, and when it is not courteously realistic, it is idealistic and pointlessly and eternally philosophical (Mitra Web). But in the Hungry Generation, excluded from the academies and the
    literary aristocracy, the sense of urgency and anguish can be seen, for they, more than any other group have realized that there is possibly no hope for most indigenous literatures of India; that what lies ahead is disorder and disintegration. And it is through their movement that they had announced a declaration of freedom, of independence from any culture that is normative by compulsion and unaccommodating and snobbish by choice. There are indeed certain portions still unanswerable with regard to the combination of their theories and practice. Hopefully the Hungryalist poets, especially Roychoudhury himself, being still alive, would be able to shed some light on the murky issues discussed within the course of this paper and without, in the near Future.

    Works Cited
    Amader Bangla Kobita. n.d. Blog. 22 January 2013. <http://
    aamaaderbanglakabita.blogspot.in>.
    Amimangsito. Kolkata: Zebra Publications, 1965.
    Arnold, Matthew. “The Study of Poetry.” English Literature and
    Irish Politics (Complete Prose Works of Matthew Arnold). Ed. R.
    H. Super. Vol. 9. Ann Arbor: University of Michigan Press,
    1973. 161-188.
    Artaud, Antonin. Artaud Anthology. Ed. Jack Hirschman. Trans.
    Jack Hirschman. Paris: City Lights Books, 1965.
    Cocteau, Jean. Crucifixion (Translation). Kolkata: Kobita
    Prakshik, 1996.
    Das, Uttam. Hungry Shruti O Onyanyo Probondho. Kolkata:
    Mahadiganta Prokashoni, 1995.
    154 Margins: A Journal of Literature and Culture
    Datta, Ketaki. “Life & Letters.” 15 January 2012. The Statesman.
    Newspaper. 5 January 2013. <http://202.144.14.20/
    index.php?option=com_content&view=article&show=article&id=
    396937&catid=44&year=2012&month=1&day=15&Itemid=66>
    Dutta, Jyotirmoy. “Bangriji Sahitye Khudhito Bongsho.” Desh
    Sahitya Sankhya 1969.
    Ezekiel, Nissim. Hungry Generation. Mumbai: Indian P.E.N.,
    Marine Lines, 1987.
    Ferlinghetti, Lawrence, ed. City Lights Journal. SF, USA: City
    Lights, 1963.
    Ghosh Dastidar, Gargi. Letters to Malay Roychoudhury. 6 June
    2008. Blog. 21 August 2013. <http://
    letterstomalay.blogspot.in>.
    Ginsberg, Allen. Howl & Other Poems (Translation). Kolkata:
    Kobita Prakshik, 1996.
    —. Kaddish (Translation). Kolkata: Kabitirtha, 1995.
    Haque, Ebadul, ed. Hungry Andoloner Ishtahar. Murshidabad:
    Abar Esechhi Phire Prokashoni, 2008.
    History of Hungryalism. n.d. Wiki. 22 December 2012. <http://
    .
    “Hungry Bulletin O Patrika Theke (1961 - 1965).” 27 January
    2009. Hungry Andoloner Kobider Kobita. Blog. 2 February
    2013. <http://hungrykobita.blogspot.in/2009/01/blogpost.
    html>.
    Hungry Generation. 20 September 2010. Blog. 19 November 2012.
    <http://hungryalist.wordpress.com/2010/09/20/hungrygeneration/>.
    Hungryalist Manifestoes (Collection of Manifestos). Kolkata:
    Mahadiganta Prokashoni, 1986.
    Hungryialist Photos. n.d. Blog. 23 January 2013. <http://
    hungryderphoto.wordpress.com>.
    Marxbaader Uttoradhikar. Kolkata: Shakti Prokashon, 1962.
    Mitra, Tridib. “Hungry Generation.” 30 June 2008. Hungry
    Generation. Blog. 3 January 2013. <http://
    hungryalistgeneration.blogspot.in/2008/06/hungrygeneration.
    html>.
    Margins: A Journal of Literature and Culture 155
    Nandi, Bishwajit, ed. Milon Hungry Andolon Sankhya. Meghalaya:Milon Prokashoni, 2007.
    Newman, Lex. “Descartes’ Epistemology.” 10 July 2010. The
    Stanford Encyclopedia of Philosophy. Web. 21 June 2014.
    Poems of Hungryialist. n.d. Blog. 23 January 2013. <http://
    poetmalay.blogspot.com>.
    Postmodern Bangla Poetry 2003 : An Overview. Bansdroni, Kolkata:Haowa49 Publishers, 2003.
    Postmodernism. Bansdroni, Kolkata: Haowa49 Publishers, 1995.
    Ray, Ajit, ed. Hungry Sakkhatkarmala. Kolkata: Mahadiganta
    Prokashoni, 1999.
    Roychoudhury, Malay. A Sour Time of Putrefaction Nayanima Basu.
    10 December 2011. Web Archive. 12 January 2013. <http://

    of-putrefaction-111121000058_1.html>.
    —. Ishtahar Sankalan. Kolkata: Mahadiganta Prokashoni, 1985.
    —. Stark Electric Jesus. n.d. 21 August 2013. <http://redroom.com/
    member/malay-roychoudhury/writing/stark-electric-jesustranslation-
    of-bengali-poem-prachanda-boidyut>.
    Selected Poems. Kolkata: Writers’ Workshop, 1989.
    Sen, Prabir. Allen Ginsberg (Biographical Criticism). Kolkata:
    Kabitirtha, 2000.
    Shoytaner Mukh. Kolkata: Krittibash Prokashoni, 1963.
    Spengler, Oswald. The Decline of the West. Ed. Charles Francis
    Atkinson Helmut Werner. Trans. Charles Francis Atkinson.
    New York: Oxford University Press, 1991. Google Book Search.
    Web.
    Tristan Tzara’s Poems. Jamshedpur: Kalimati, 1996.
    Uttor Ouponibeshik Postmodernism. Medinipur: Bakpratima, 2001.
    Vice, Sue. Introducing Bakhtin. Manchester: Manchester UniversityPress, 1997.
    Weissner, Carl. Klactoveedsedsteen Hungryalist Issue. Germany,1966.
    Zakham. Kolkata: Zebra Publications, 1966.
    ( Published in "Margins: A Journal of Literature and Culture" )
  • Debi Roy | 012312.60.8912.247 | ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৮:০৩541364
  • The Hungryalist under-caste: A Conversation with Debi Roy
    Debayudh চ্যাটার্জী
    ----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    Debi Roy was born in 1938 as Haradhon Dhara
    to an impoverished under-caste household residing
    in a slum in Howrah. He had to discard his real name
    to survive in a literary establishment dominated and
    hegemonized by the upper-class elite. Roy was one of
    the four founder members of the Hungryalist movement.
    He was hailed to be the editor of the first manifesto
    of the movement that came out from Patna in 1961.
    His slum address was used for official correspondence
    during the movement. Pitching an under-caste in the forefront
    was conscious effort to lodge an attack on the Brahminical arena
    of Bengali poetry. Roy passed his school final in 1958 and IA in 1960
    before enrolling himself in a course on library science at
    the University of Calcutta.
    His first anthology Kolkata o Ami (Kolkata and I) came out in 1965.
    He was arrested later on the ground of obscenity
    along with other members of the Hungry generation.
    While he was suspended from his government job,
    the lower court soon acquitted him.
    After 1965, as the movement fizzed out and splintered
    into different groups, Roy continued writing as an individual
    in his own merit. Till date, he has authored more than
    ten titles in poetry, translated extensively from Hindi into Bengali,
    and wrote three books of non-fictional prose.
    ----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    Debayudh: Let me begin by asking why
    you changed your name to Debi Roy.
    Debi Roy: There wasn’t any other way apart
    from adopting that name. No way whatsoever.
    There was so much of Brahminism around me,
    so much of humiliation… When they cannot topple
    over you in any other way, they seek resort in caste.
    This is just a way of suppressing you. Some of my
    own friends can be accused for that crime. Some very
    close friends who used to frequent my slum once upon a time.
    They came at an hour when my mother couldn’t eat…
    But they were ones to humiliate me first. They still do it…
    even now… though their powers have ceased to exist.
    Debayudh: What I know about the movement is that
    after four years of its inception, it got fragmented.
    Some of the members denied their allegiance in the court,
    some pioneers changed their stance, a lot of other nasty
    things happened. You were one of those who actually
    faced the music. You were arrested, heckled,
    suspended from your job… Today, after more than
    fifty years, on retrospect, would you relate that as
    subtle form of caste oppression?
    Debi Roy: I despise caste. I have no words
    to condemn what happened to me. It’s just that
    I have to remain silent. My wife passed away last June, on 24th…
    I am not in the right state now. I am a self-made man.
    I was born in a slum and now I live in an apartment
    with an air-conditioner in each room.
    I never imagined I could climb such heights.
    Debayudh: Did you ever write directly on caste?
    Debi Roy: Nirendranath Chakrabarty
    once told me that I can skillfully enmesh my life in
    my poetry. He once asked me why I don’t write an
    autobiography. I mocked back, should I write a Jibansmriti?
    Tagore wasn’t any less humiliated for being a Brahmno…
    a fallen Brahmin… But why would I write? Who would be interested to read about me?
    Debayudh: I can share an anecdote with you.
    In 1926, Tagore attended a Namasudra conference
    in Dhaka. He was severely chastised by his folks
    at Viswabharati. He never went back to Dhaka again,
    that was his final visit. AK Biswas has written
    about it in detail.
    Debi Roy: Imagine. Such is the consequence
    of the caste system. But Bangladesh has been very
    hospitable to me. I have been there four times as of now.
    However, Tagore is zillion times greater than me. I owe my life to him.
    Debayudh: Although Tagore was preoccupied
    with discrimination throughout his life, he kept
    altering his views on the caste system. You can track
    that change from Gora to Home and the World to a
    couple of short stories to Chandalika. He preferred Gandhi
    over Ambedkar at the time of the Poona Pact.
    I find it deeply problematic.
    Debi Roy: Tagore championed the supremacy
    of the human spirit over anything else.
    He was in and out a humanist. There’s one thing that
    I can tell you. If you leave everything aside,
    the profound knowledge and love that
    the Geetabitan speaks of transcends any barrier
    imposed on humankind. Apart from the
    Ramkrishna Kathamrita, one book that keeps me alive
    and immensely influences me is the Geetabitan.
    Sri Ramkrishnadev didn’t have a single degree,
    but the kind of wisdom that runs through his words is
    amazing. Even Tagore didn’t have a university degree.
    But look at how these two men went on to shape
    the consciousness of the entire civilization.
    Debayudh: Yes, Sri Ramkrishnadev and, later on,
    Vivekananda, did play an important role in reforming
    Hinduism from within. They were strictly against caste
    discrimination albeit they never thought of annihilating it
    by its roots. I see a photograph of Vivekananda
    hanging on your walls. What’s his impact on your life?
    Debi Roy: My wife and I have been baptized by t
    he Ramkrishna Mission. We were going through a
    restless period, a lot of agony and pain. I subscribed to
    Udbodhon, their mouthpiece, and started reading the Kathamrita.
    I realized it was already too late, no point
    in delaying further, we decided to embrace the Mission.
    Debayudh: This leads me to my next question.
    If you think it’s too personal and uncomfortable,
    do refrain from answering. The Hungry Generation began
    by repudiating the existence of God.
    I remember that you wrote in one of your poems,
    “It’s more important for me to look for
    bread than run after an unnecessary God…”
    Debi Roy: That was solely Malay’s idea.
    Most of it was gimmick. Not mine. Whatever came from my
    side was youthful folly.
    Debayudh: Describe the initial years how you met
    Roychoudhury brothers, Shakti Chattopadhya,
    Subimal Basak in those early days of the movement.
    What it was like to be part of it?
    Debi Roy: The “Hungry Generation”
    was mostly conceived by Malay.
    He was the one who wrote to me.
    Later on we met face to face in Subarno Upadhyay’s
    rented apartment. Subsequently I was introduced
    to the other members of the movement. In 1962,
    in the month of April, Malay brought out
    the first Hungryalist bulletin and mailed it to me.
    It was published in English. Creator: Malay Roychoudhury,
    Leader: Shakti Chattopadhyay, Editor: Debi Ray.
    It’s natural to protest against convention, social evils,
    and injustice when you’re young, quite natural to be a non-conformist.
    Someone who accepts everything is a person who cannot question.
    That’s certainly not the trait of youth.
    Debayudh: Could you help us understand t
    he Hungry aesthetic better?
    Debi Roy: Immersed in youthful folly,
    the Hungry Generation dared to challenge
    the norms and ethics with whatever cultural capital it had.
    The movement opened up a lot of windows in our minds. T
    here was no hesitation, but pride.
    I used to read a lot, at times, a lot of random stuff at that age.
    John Keats made me thinking, “Thou was not born for death,
    immortal Bird! No hungry generation tread thee down…”
    Malay told me how he was influenced by
    the English poet Chaucer’s phrase, “In sowre hungry tyme”.
    Spenglar’s theory of cultural degradation
    provided the philosophical axis of the Hungry generation.
    Uttam Das researched on the theoretical
    and philosophical implications of the movement.
    Debayudh: Can the hungry aesthetic
    of breaking the state of art exist without the classical dictum?
    Debi Roy: Poetry or literature in general,
    is not a boxing ring that you need to knock
    somebody out to gain fame. I write by myself, for myself.
    Alone. Surrounded by stalwarts on all sides,
    I live a low-profile life. I do not have any sense of inferiority
    because of that. I ask myself, am I educated?
    I have never been educated in the institutional sense.
    I did not have the opportunity to. I prefer not to overload
    my writings with postmodernism and other theoretical
    back-scratching. My liaison with poetry is like my long conjugal life.
    I am still enamoured in her spell.
    I will be until I die. Is there an end to knowing one’s self?
    There is a need to bridge the gap between life and death.
    That is why you need poetry. It’s another name of
    delving deep into life. I have to leave this world someday
    even if I don’t want to. Death is inevitable, life ephemeral.
    But that does tamper with its charm? I find these ideas of
    ‘classic’ and ‘eternal’ quite problematic though.
    My real work is with poetry.
    Debayudh: Do you think the Beats and
    the Hungry generation had anything
    in common and if they have inspired each other?
    Tell us about your interactions with
    the Beat poets and publishers.
    Debi Roy: When the first bulletin came out,
    I went to the editorial office of Janasebak
    to hand a copy over to Sunil Gangopadhyay.
    He quickly went through it once and remarked,
    “So you’re bringing out all this?”
    Later on we got to know that he believed that
    our movement was completely influenced by Allen Ginsberg
    and the Beats. The Beats and the Hungryalists were similar
    only on the grounds of being anti-establishment.
    But one stemmed from the soil of a wealthy nation
    while another thrived in the dust of poverty.
    Debayudh: The leftists often view the movement
    as a middle class reaction that celebrates
    urban alienation and male sexual frustration.
    They accuse that the movement was politically wrong.
    They say you bring in a new order of morality
    while trying to tackle the classical Bengali bhodrotta
    with obscenity and rage of alienation.
    What is your opinion on that?
    Debi Roy: I’m not into politics.
    That’s not my cup of tea. Why don’t political leaders
    across party lines teach us to love people irrespective of differences?
    Aren’t the ones in opposition human beings too?
    Some of them travel enveloped in security,
    in bulletproof cars, instigate the common mass from a distance,
    and go back to their ivory towers.
    There are exceptions that must be respected.
    But why are there so many commandos around the leader
    of an impoverished backward country?
    Why can’t the peasants avail the irrigation and manure
    they deserve? Why do the workers out of work stare
    depressingly at the gates of factories that have been shut down?
    Why do trade unions end up being centres of other profitable trades?
    Why are the youth still unemployed?
    Why are they forced to choose such despicable ways of life?
    But, in the middle of all this, I know of a communist leader
    who refused to take more than a piece of fish on his platter.
    There was another who did his own laundry.
    You cannot imagine such a brand of politics in our times.
    Debayudh: Tell me more about your
    engagement with the Hungry Generation.
    Debi Roy: There are a lot of memories.
    Some of them are too sad to recount.
    I remember spending a month in Varanasi
    on a friend’s travel pass. Probably we hardly had any inhibition those days.
    I adjusted quite well in the household of a widow and her son.
    That’s where I met Anil Karanjai and Karunanidhan Mukhopadhyay.
    Once, after I wrote a piece on Subhash Ghosh,
    an Englishman, probably British rang me and asked whether
    I speak English. I replied that I obviously do,
    but I cannot speak in your accent. This is not my mother tongue.
    I am a poet from Bengal, I write in Bengali.
    I am quite satisfied with myself.
    Debayudh: Yes, English for most of us is
    an acquired language. We had to learn it from scratch.
    It’s obvious that our English will be different
    from her native speakers.
    Debi Roy: We are rather compelled to learn it to make a living.
    Not that I put much of my heart in it. Like Hindi,
    I had to master it to find a job.
    It had nothing to do with my love for that language.
    Debayudh: I can understand.
    I didn’t know a word of Hindi when I first came to Delhi.
    I had to acquire it.
    Debi Roy: Exactly. My bosses thought
    that they would put me into trouble by asking me
    to learn Hindi. But it became a boon in disguise.
    The lady who taught us Hindi came to know that
    I was a poet who tries to translate once a while.
    She advised me to take Pragya, the highest qualifying
    examination in that language, to find a better job.
    The College Street kept calling me, but why would I go?
    Debayudh: That echoes a famous poem
    by Shakti Chattopadhyay, your once upon a time comrade.
    Debi Roy: I have written about it in length.
    Despite Malay keeps bitching about him,
    I believe that he was a great poet:
    a poet in the truest sense of the term.
    There can be no qualms about it.
    I have not come across many who had so much
    dedication for poetry. The rest of the poets
    I know taught at different places, worked in myriad offices,
    but Shakti, he gambled his life for the sake of poetry.
    Debayudh: I read that he moved out for personal reasons.
    Once of his affairs didn’t work out and that placed him a
    gainst the Roychoudhury-s. Shakti Chattopadhyay, as I believe,
    was eccentric and mercurial to the core.
    May be that’s something that defines his poetry.
    Debi Roy: Very true.
    Debayudh: Could you please run us
    through a timeline of major events that led to Shakti’s
    parting ways with the movement,
    and the various fractures within the group
    until the arrest of the poets when the movement ended?
    Debi Roy: One of the reasons is what you said. Shakti
    fell for one of Malay’s relatives. Apart from that t
    here were personal clashes between Malay and Shakti.
    Shakti was also offered a job. But, at the end of the day,
    I believe he is great poet with a timeless appeal.
    Debayudh: Describe the last days of your time
    with Hungry generation. How was it to live with
    the threat of arrest and other threats
    that you all faced during the last phase.
    Debi Roy: I was suspended for a year from my job—
    I was working at the head post office in Burdwan then—
    for being involved in the Hungryalist movement.
    Some custodians of Bengali literature weren’t happy with us.
    I was arrested and put behind bars.
    I was acquitted at last after a lot of storm.
    My friend Samir Ray arranged for my bail.
    Our friendship is still intact. During the trials, Gourkishore Ghosh,
    Jyotirmoy Dutta, and Sunil Gangopadhyay among others
    stood by us. By then, the famous Times magazine
    brought us into limelight. Almost all the major magazines
    and newspapers across the nation started publishing gossips
    and news about us. Dharamveer Bharti, Khushwant Singh,
    Pupul Jayakar, all of them came out in our support,
    collected funds for us, and moved strings to secure our freedom.
    Pranab Kumar Sen, who was the police commissioner of Kolkata back then,
    also admitted later on that arresting the Hungryalists was wrong.
    Debayudh: Let me get back to the sixties again.
    The time in which you took up writing
    was just a few years after Babasaheb Ambedkar’s death.
    Jogendranath Mondal was back in India and was
    trying to consolidate his political career. He failed though…
    Debi Roy: Hasn’t Debesh Roy written a novel on him?
    Debayudh: Yes, Barishal-er Jogen Mandal [Jogen Mandal of Barishal].
    It got published from Dey’s. Anyway, it was that time,
    in the sixties, when you were forced to adopt a different name.
    I completely empathize with that.
    But weren’t you even drawn to their anti-caste ideologies?
    Didn’t they inspire you to fight back? What’s your take on Ambedkar?
    Debi Roy: I immensely respect them.
    The kind of struggle they put up against this system gave voice
    to thousands who were silenced for centuries.
    But I got to know of them much later in my life.
    At that time, in the sixties, I was hardly familiar with their names.
    I was far from being exposed to their life and works.
    Debayudh: I can understand.
    The middle class intelligentsia of Bengal
    after partition has always been very hostile to identity politics.
    As I just told you, Jogen Mandal fought a lost battle
    of reinforcing caste politics in the public sphere of West Bengal.
    With Congress on the one hand, and the Communist Party
    or the Hindu Mahasabha on the other, all the mainstream
    political forces tried to bring the scheduled castes into their fold.
    This was carefully done by appropriating,
    if not shrouding Ambedkar from the common masses.
    Debi Roy: Very true. That’s the reason.
    May be that’s why we never thought so intricately
    about caste assertion in our times.
    There’s another reason. In an impoverished land like ours,
    livelihood becomes an important matter to take care of. As you know,
    I come from a very humble origin. In the sixties, at the brim of my youth,
    I was desperately trying to make ends meet.
    I began my career by working as an errand boy who delivered water and tea.
    I wanted to get out of the muck at the any cost.
    I didn’t have much time to delve into other things.
    Whatever leisure I had, I devoted it to literature.
    Debayudh: Yes, it calls for a bit of privilege
    to actually engage in activism. Those coming
    from well-to-do families can think about losing
    their job and writing, distributing pamphlets for free,
    buying and sending masks to the pillars of the society.
    Obviously, none of it is free of cost.
    Debi Roy: Hahaha… and I had to face the brunt…
    Debayudh: …Even the regular doze of booze,
    weed, hash and travelling to different places
    need some amount of financial affluence…
    Debi Roy: All of these were gimmicks.
    Going to crematoriums and getting drunk… pure hoax!
    All of us have done that, the next generations will also do,
    there’s nothing wrong in that. But all these are gimmicks.
    These have no connection whatsoever with literature.
    Debayudh: Ginsberg once in an article that
    marijuana brings about an aesthetic experience
    that a writer requires…
    Debi Roy: I don’t believe in that.
    Literature has no connection with the use and abuse of substances.
    You can write without excess.
    I don’t think Tagore needed any drug to write.
    But Sarat Chandra was completely different.
    Michael Madhusudan had a life of excess.
    It varies from person to person. It’s a matter of individual choice.
    Besides, it doesn’t mean that all of us have to have a similar lifestyle
    for belonging to the same movement. You can go to Khalasitola
    and have a blast together, but writing itself is a solitary exercise.
    Debayudh: As I went through a lot of anthologies
    on the Hungry Generation, I noticed that you have been obnoxiously ignored.
    Not many of your poems have been included,
    there’s hardly any write-up on you.
    Although you were the editor of the first manifesto
    and your address was used for official correspondence,
    you have been strangely sidelined in the discussions later on.
    Debi Roy: All of it is because of jealousy.
    I achieved what most of them couldn’t. The Sahitya Academy,
    the ICCR took interest in my works, translated me,
    included my poems in their definitive anthologies.
    It is no wonder a group of ghettoized poets would be envious of me.
    They thought that I was being sold out to the establishment.
    I reminded Malay that he was promoted to the post of an officer from a clerk.
    It is the same process.
    But, leave it, there’s no point in resurrecting
    old wounds. Let the sleeping dogs lie as they are.
    There is no perfect job in the entire world,
    there’s no fun in humiliating others as well.
    Debayudh: Yes, opportunism and back-biting
    have perennially plagued the Bengali literary establishment.
    I have seen poets shamelessly advertizing themselves
    and buttering the ones who matter to go places.
    Debi Roy: Oh yes, I have a victim of it.
    A friend from Germany once asked me why I have made
    so many enemies. He held a powerful position.
    He was once asked why he never recommended me.
    He remarked that supporting me would lead to riots.
    Debayudh: Such miserable spinelessness.
    Debi Roy: Poets behave like bureaucrats these days.
    They’re running after publishing their pictures on
    mainstream dailies, inaugurating stupid programs…
    There’s no point in talking about them.
    There was one major poet who changed his jersey and made it big.
    He was after my life once though couldn’t do much.
    I pity these people. But his wife was a genuine poet.
    Debayudh: Let’s go back in time.
    You were telling me about your humble origins,
    the immense hard work you had to put in
    to materialize your aspirations.
    In the middle of all this, how did poetry happen?
    Debi Roy: There was a library near our place.
    I went there to while away my time or forget the pangs of hunger.
    I started reading, I read as much as I could.
    I still remember the librarian. He used to smirk and enquire
    whether I had no other work. There was another library
    near the Howrah Girls’ College. I spent hours there reading authors
    like Bankim Chandra. Not that I understood all of what I read but
    I realized that literature is my poison. I also loved music.
    But once literature takes over someone,
    his life and afterlife are perpetually destroyed. (laughs)
    Debayudh: Did you face any sort of caste
    discrimination from the other members of the movement
    or other writers when you started publishing?
    Debi Roy: There are things that I don’t want to recollect.
    So much of shit has been spewed. Shaileswar Ghosh
    used to think a lot about history. I was perpetually humiliated by him.
    Sub-altern-heaven-afterlife-soul-moksha-the four varnas- these are his truths.
    Some of those Hungryalists are doing the Vedas and worshipping now to make a living.
    Just as Jabali once told Ram, do not be blinded by deceitful Brahmins;
    only the dumb can pin his faith in spirits, afterlife,
    rituals, reconciliation, etc, even in post-modernism!
    Will these theories enable the lower castes and marginalized
    with two square meals a day? Will the roads be repaired after the elections?
    Proper drinking water? Will the peasants get irrigation, manure?
    Education for all? Light? Will the youth from ‘our homes’ get a job?
    Equal opportunities? Will the wheels of historical oppression
    come to an end? An end to discrimination? Prejudiced mentalities?
    Will all problems be solved if a percentage finds employed in software firms?
    Will the closed factories start producing again?
    People like me who have fought their way to privilege,
    do we carry out our duties? Such hullabaloo about caste!
    That Dalit, that OBC, that Yadav, all that discourse with names.
    Young progressive people laugh at it.
    One of them once asked me, is your ‘friend’—
    he was referring to Malay—from that time, a big fan of Manu?
    How could you tolerate him since the sixties?
    Debayudh: Do you have any regrets?
    Debi Roy: Once a friend told me that I made a major mistake in my life.
    He argued that had I passed my masters,
    I would have got a far better job and a lot more time
    to read and write. But people do make mistakes.
    One’s life is defined by his mistakes. There’s no point regretting them.
    Another mistake that I made was not to secure a medical insurance.
    I still haven’t been reimbursed for the heart surgery I had to undergo.
    This is the condition of a central government officer in an independent nation.
    Debayudh: Thank you Debida! That’s all for now.
    It was beautiful getting to know you.
    ------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    Debayudh Chatterjee (b 1991) is pursuing his MPhil at the Department of English, University of Delhi.
    While his dissertation looks at Dalit writing as a ground of contention between caste and class ideologies,
    he takes active interest in the avant-garde, counterculture,
    and 20th century Bengali literature. Apart from being employed
    as a Project Fellow at the department he is affiliated to,
    Chatterjee is a published poet in Bengali, having three titles to his credit.
  • মলয় রায়চৌধুরী | 012312.60.1234.23 | ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:০০541365
  • উপন্যাস : ঔরস
    মলয় রায়চৌধুরী
    জওয়ান : স্যার, দুজন সিভিলিয়ান হিট হয়ে খাদে পড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে ; কানে ইয়ারপ্লাগ লাগিয়ে গান শুনছিল মনে হয়, ট্র্যানসেন্ড বা মোবাইল থেকে, তাই আমাদের আর শত্রুদের ফায়ারিঙের আওয়াজ শুনতে পায়নি ।
    অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাণ্ডান্ট : মোবাইল ? এখানে মোবাইলের কোনো টাওয়ার একশ কিলোমিটারের মধ্যে নেই । যাকগে, যেতে দাও, অমন আনুষঙ্গিক দুর্ঘটনার জন্য আমরা দায়ি নই । বাস্টার্ডগুলো এই অঞ্চলে এসেছিলই বা কেন ! ডিসগাস্টিং ।
    জওয়ান : ওদের বডি কি রিকভার করা হবে ? উওমেন না মেন বুঝতে পারছি না ।
    অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাণ্ডান্ট : তোমার কি মাথা খারাপ ? থাকুক যেখানে পড়ে আছে । আমাদের অপারেশান ক্লোজ হলে স্হানীয় প্রসাশন বা বনবিভাগ গতি করবে ।
    জওয়ান : গ্রাম তো কাছে পিঠে নেই স্যার; দুজনেই জীবিত বলে সন্দেহ হচ্ছে ।
    অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাংণ্ডান্ট : বাজে ব্যাপারে মাথা ঘামিও না । ওটা সিভিল প্রশাসনের মাথাব্যথা ।

    দুই
    আগুনের ঢেউ-তোলা আর ফিনকি-ওড়ানো কয়েকটা জ্বলন্ত খোড়ো চালাঘরের সোনালি আলোয় , চারিদিকে ছিৎরে ছড়ানো লাশের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল ক্রুদ্ধ অপু, পোশাকি নাম অশ্বমেধ ঘোষ, যার বাবা সুশান্ত ঘোষকে অনেককাল আগে কিডন্যাপ করে, দশ লাখ টাকা ফিরৌতি বা র‌্যানসাম না পেয়ে, নিজের চোদ্দ বছরের কচি শ্যামলিমা নিরক্ষর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন তারিণী মণ্ডল, মহানন্দে, ধুমধাম করে, যেভাবে অপরাধ-জগতের ছাতিঠোক অখণ্ডপ্রতাপ বাহুবলি বীরেরা ভাগলপুর আর মাধেপুরা জেলার গঙ্গার চরের দিয়ারায় করে থাকে, করে আসছে বহুকাল যাবত, আর তারিণী মণ্ডল তো অপরাধিদের জগতে ছিল মহাজ্যোতিষ্ক, যার কদমছাঁট হাফটেকো মাথা ঘিরে ভনভন করত দুপুর গঙ্গার ঢেউ-গনগনে চনমনে রোদ, তেল-চুকচুকে সোঁটার পেতলমাথায় ধরা থাকত অমাবস্যার নদী-ছলছলে অন্ধকার । সে সোঁটার অভিজ্ঞতা তারিণী মণ্ডলের চেয়ে পুরোনো, ব্যাপক আর গভীর, কেননা ওটা উনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে, লাঠিয়াল বাবার কাছ থেকে, যে তার বাবার, সে তার বাবার । তারিণী মণ্ডলের দুঃখ যে ওনার ছেলে নেই, জামাই যদিও ঘরজামাই, তিনি ওসব সোঁটাসুটির প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্রে বিশ্বাস করেন না, আধুনিক পিস্তলও শুধু লুঙ্গির গেঁজেতে গুঁজে রাখেন, কখনও একটু-আধটু চালিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না । নাতি অপু বরং ওর বাবার চেয়ে আধুনিক, আজকালকার তেজিয়ান ছোকরা ।
    অপু জানতে পেয়েছিল, বেশ একটু দেরিতেই, আত্মীয়-স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টি দলচররা চেষ্টা করেছিল নানা-নানির অপঘাতে মৃত্যুর দুঃসংবাদটা ওর কানে যাতে দেরিতে পৌঁছোয়, যে, দাদু তারিণী মণ্ডল আর দিদিমা মন্হরা দেবী খুন হয়ে গেছে সকালবেলায়, একেবারে ছলনি । রোজকার মতন তেলমাখা লাঠি আর দুজন কালচে-কেঁদো খইনিঠোকা বন্দুকধারী দেহরক্ষীর গাঁট্টাগোট্টা পাহারায়, পটলের লোডিং তদারকি করতে বেরিয়েছিল, ট্রাকে পটলের পঞ্চাশটা বস্তা চালান হবার কথা ছিল ভোরবেলায় ।
    যে ট্রাক আসার কথা ছিল সেই নম্বরের ট্রাকই এসেছিল, বনেটে বজরংবলির গেরুয়া টুনিপতাকা উড়িয়ে, কিন্তু তা থেকে মুখে লাল গামছা বাঁধা চারজন লাফিয়ে নেমে তারিণী মণ্ডলকে লক্ষ করে একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস চালিয়ে চকাচৌঁধ ধুঁয়াধার অন্ধাধুন ব্রাশফায়ারে ছলনি করে, ট্রাক ফেলে রেখে, ট্রাকের পেছনে যে ছাইরঙা ইনোভা আসছিল, তাতে চেপে দক্ষিণের ভোররাতের গু-শোভিত আর মাটির সোঁদা দেয়ালে ঘুঁটেতে পাঁচ আঙুলের ছাপ-মারা গোবর-সুসজ্জিত কাঁচা রাস্তা ধরে আধাশীতেল অলস কুয়াশার সঙ্গে ধুলো মিশিয়ে উধাও।
    মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল দাদু , বাঁ-চোখের কোটর থেকে নকল সিনথেটিক মণি বেরিয়ে ছিটকে নর্দমায়, আর ডাকসাইটে দিদিমা ওপরমুখো চিৎ ; দেহরক্ষীরা পিছু ধাওয়া করে কাঁধ থেকে একে সানতালিস নামাতে-নামাতেই বেতাহাশা গুলি খেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে তারা দুজনেও মোরাম-পথের ওপর ঠ্যাং ছড়িয়ে লালজবজবে-চিৎ, আকাশের দিকে হাঁমুখ, চোখ-খোলা । দিদিমা, মানে নানি, নানিকে নিয়ে বেরোত না নানা সচরাচর । নানির হাঁটুর ব্যাথা সারাবার জন্যে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, যাতে পায়চারি করে জাম হয়ে থাকা হাঁটুর চাকতি আলগা হয় ।

    তিন
    চারজনের রক্ত গড়িয়ে মিশেছে মাছিদের আহ্লাদী জমায়েতে, মাছিরা তাদের এঁদো-পলটন ভাইবেরাদর সবাইকে ডেকে এনেছে, র‌্যালিতে-মিছিলে, যারা ভোরের দিয়ারায় ডোমপাড়ার শুয়োরদের আড্ডায় টাটকা-তাজা গু খেতে বেরিয়েছিল, তারাও তাজা রক্তের সু-বদবুর সংবাদ পেয়ে, হাঁফ-ফুরোনো বাংলা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দামড়া-চোয়াল ভাতচিকন সাংবাদিকের অনুকরণে, কুয়াশাভেজা ঘষাকাচ-ডানা নাচাতে-নাচাতে পৌঁছে গেছে ।
    --হ্যাঁ দীপঙ্করদা-মাছি, ঘটনাস্হলে কী দেখতে পাচ্ছেন ?
    --সুমিতা-মাছিনী, এখানে চারজনকে কে বা কারা খুন করে বডি ফেলে তিনচার দিকে দৌড়ে চলে গেছে বলে জানাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী মাছিরা ; ইশে, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে বিভিন্ন পাড়ার বিশেষজ্ঞ মাছি-মাছিনীদের । একজন মহিলা কেন খুন হলেন তা ভেবে দেখতে হবে, অ্যাবং খুন হলেও কেন তিনি লজ্জা নিবারণ করতে পারলেন না, তার জন্য সরকারকে জবাবদিহি করতে হতে পারে ।
    --দীপঙ্করদা-মাছি, আপনি কী স্বয়ং স্বাদ নিয়েছেন, রক্তের অ্যাবং গুয়ের ? না নিয়ে থাকলে ঘটনাস্হলে যাঁরা একত্রিত হয়েছেন, তাঁদের দিকে একটু ক্যামেরা প্যান করতে বলুন, আমরা মাছি-দর্শকদের দেখাতে চাই, যাতে মানুষের কাঁচা গু খেয়ে-খেয়ে বিরক্ত দর্শকরাও রক্তের স্বাদ নিতে পারেন ; চার-চার জনের রক্তের স্বাদ কীরকম তা আমাদের গুয়েমাছি চ্যানেলেই প্রথম দেখানো হচ্ছে । অ্যাবং নারীরক্তের স্বাদ সম্পর্কে একটু পরেই স্টুডিওর রাসায়নিক মাছি ও ফরেনসিক মাছিনী তাঁদের মূল্যবান মতামত গু-ঞ্জরিত করবেন ।
    --সুমিতা-মাছিনী, স্টুডিওতে যে গুসেবক অ্যাবং রক্তসেবক মাছিরা বিতর্কে অংশ নিতে এসেছেন, তাঁদের জন্য আরেকবার আমরা ক্যামেরা প্যান করে তারিণী মণ্ডল নামে মানব প্রজাতির জনৈক প্রতিকল্পের ছিৎরে-যাওয়া মগজ দেখাতে চাই ; ইশে, ঘিলুসেবন করার জন্য স্হানীয় নির্বাচনক্ষেত্রের নীলমাছি পৌঁছে গেছেন, তাঁর ভোজন সমাপ্ত হলে স্টুডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করব । ইশে, তারিণী মণ্ডলের স্ত্রীর শব দেখাতে পারছি না, কেননা স্তনদ্বয়ে গুলি খেয়ে পড়ার পর তাঁর শাড়ি ওপরে উঠে গিয়ে অকুস্হলের পাকাচুল বেরিয়ে পড়েছে । ইশে, রাজ্য প্রশাসন দেশের প্রগতি দাবি করে অথচ আজ পর্জন্ত অকুস্হলের পাকাচুলের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি ।
    --দীপঙ্করদা-মাছি, দ্রুত সংবাদের জন্য ধন্যবাদ । এতক্ষণ আপনারা ভাগলপুরের দিয়ারা-সম্রাট তারিণী মণ্ডল হত্যার দৃশ্য দেখছিলেন । সময়াভাবে আমরা পৃষ্ঠভূমি সঙ্গীত তৈরি করতে পারিনি । পরবর্তী কোনো হত্যাকাণ্ডে যাতে ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোর দেয়া যায় তার ব্যবস্হা করা হয়েছে । সঙ্গে থাকুন ; রক্তের অ্যাবং গুয়ের স্বাদ উপভোগ করুন ।
    --সুমিতা-মাছিনী : দর্শকগণ, কেউ একজন আমাদের সংবাদ পরিবেশনকে ঠাট্টা করে তার ঔরস উপন্যাসে যা নয় তাই লিখেছে । ল্যাখককে বিশ্বাস করবেন না, কেননা আপনারা ওনাকে দেখতে পাচ্ছেন না, আমাকে স্বচক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা দেখছেন । মনে রাখবেন, যা দেখছেন তা-ই সত্য ।

    চার
    সাড়ে ছ’ফিটের ছিয়াত্তুরে তাগড়া-কালো তারিণী মণ্ডলের টেকো খুলির হাড় গুলিতে ছিৎরে গিয়েছিল, মুখের আদরা চৌচির, টেরিকটের ফিকে-গেরুয়া পাঞ্জাবি রক্তে জবজবে, বুক পকেট থেকে উঁকি মারছে হাজার টাকার গোটাকয় করকরে নোট । ধুতি থেকে বেরিয়ে-থাকা পায়ের গোছের পাকাচুল ঘিরে লতানো ফুলে-ওঠা শিরা । ভারিভরকম মন্হরা দেবী হাঁটবার সময় শাড়ি দুহাতে সামান্য তুলে পা ফেলছিল বলে আচমকা গুলির চোট খেয়ে সম্পূর্ণই তুলে ফেলেছে । মাছিরা তার পাকাচুলশোভিত হাট করে খোলা হাটে বসে কী যে পান করছে তা মাছিগুলোই জানে ।
    অপু ক্লাস বাংক করে বাড়ি এসেছিল দিনকতকের জন্যে । দিল্লির জওয়াহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে, মানে জে এন ইউতে একই সঙ্গে, দিল্লির হবু দেশসেবকদের খাদিয়াল ঢঙে, সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর আর বামপন্হী ছাত্র ইউনিয়ান করছিল । বামপন্হী ছাত্র ইউনিয়ান করার সুবিধা এই যে পরে ইচ্ছেমতন এবং হাওয়া বুঝে ভিনপন্হী বিজয়ী দলে সেঁদিয়ে যাওয়া যায়, ভিনপন্হী হলে বামপন্হীতে ঢোকা একটু কঠিন কেননা ভিনপন্হীদের ছ্যাঁদা বড়ো, বামপন্হীদের ছ্যাঁদা ছোটো । এই করেই দিল্লি-গুড়গাঁওয়ার ছাত্ররা জীবনে এগিয়ে যেতে পারে, জানে ও, দেখেছে আগের ব্যাচের ফেলটু ছাত্ররাও দিল্লির রাজনীতিতে কেমন করেকম্মে টরটরিয়ে টঙে চড়ে গেছে, কোনো চাকরি-বাকরি না করেই ফাঁপিয়ে তুলছে দুদিকের পকেট, ডেনিম-প্যাণ্টের হোক বা খাদিয়াল পাঞ্জাবির, নিজের বা জ্ঞাতিগুষ্টির । ইউনিয়ানের নির্বাচনে টাকা দরকার বলে দাদুর কাছে এসেছিল অপু, ফোমচামড়ার ব্যাগ নিয়ে, কাঁচা টাকা নিয়ে যাবে, যা তারিণী মণ্ডলের তিজোরিতে সব সময়েই থাকে, কেননা দিয়ারার জীবন বেশ ঝুটঝামেলার, দরিন্দগির, লেনদেনের, কখন কী হয় কত টাকা ঝপ করে কার দরকার তার নিশ্চিতি নেই ।
    হাত-পা বাঁধা, গুটকাদেঁতো মুখে লিউকোপ্লাস্ট, বছর তিরিশের ঢাউসভুঁড়ি হুলোচোখ ট্রাক ড্রাইভারটা মার খেয়ে আধজখম হয়ে খড় কাটার যন্ত্রে সবুজ নাইলন দড়ি বাঁধা অবস্হায়, অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে ছিল, প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাশিদের পাড়ায় তোতারাম পাসওয়ানের মহাত্মা গান্ধি রাষ্ট্রিয় কর্মইয়োজনার টাকা মেরে তৈরি খামারে। ট্রাকচালক বৈসাখি যাদবের কাছ থেকেই তারিণীর সাঙ্গপাঙ্গরা আঁচ করতে পেরেছিল খুনের পেছনে কাদের হাত থাকতে পারে । আররে, বৈসাখি হ্যায় কংসায়তি যাদব, অসলি কৃষ্ণায়ত যাদব নহিঁ হ্যায়,মুহ খোলেগা ক্যায়সে নহিঁ ; ডরপোক কংসায়তি ফাট্টু কঁহিকা ।
    তারিণী মণ্ডলরা, তার নিজের দাবি অনুযায়ী, যখন সে সুশান্ত ঘোষকে অপহরণ করে বন্ধক রেখেছিল, তখন পোড়াটে-কালো বুকে ঘুষি ঠুকে বলেছিল, তার পূর্বপুরুষরা লালেলাল খাঁটি-রক্তের বাঙালি ছিল, তিন-চারশ বছর আগে, আংরেজদের জমানায় । যে পূর্বপুরুষ প্রথম খুন করে মহাঅপরাধীর খেতাব পেয়েছিল, সে শত্রুর জিগর বা হৃদয়ের রক্তে ভেজা পৈতে পরার চল আরম্ভ করলে, হলেই বা নিচু জাত, উত্তরপুরুষরাও প্রথাটা বজায় রেখেছিল, যদিও শত্রুর হৃদয়ের রক্তের বদলে অমাবস্যায় জবাই করা পাঁঠার দিল-কা-খুনে ভেজা পৈতে পরার চল করে গেছে কোনো পূর্বপুরুষ । তারিণী মন্ডলের পৈতেও অমাবস্যার দিন পাঁঠা কেটে জিগরের রক্তে ভিজিয়ে পরানো হয়েছিল । নাতি অপুকেও অমন পৈতে পরাবার চেষ্টা করেছিল তারিণী মন্ডল, জামাইয়ের প্রতিবাদের জন্য সফল হয়নি । জামাই বলেছে, মনে রাখবেন, ও সুশান্ত ঘোষের ছেলে, ঘোষরা যতই খুনোখুনি করুক না কেন, কায়স্হই থাকবে।
    বেবি নামের চোদ্দ বছরের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর মেয়েকে বিয়ে করে, ভাগলপুরের দিয়ারায় থেকে গিয়েছিলেন ছাপোষা বাঙালি বাড়ির কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক চাকুরে যুবক সুশান্ত ঘোষ, প্রথমে রোগাটে বাংগালি জামাই, তারপর দোহারা সুশান্তবাবু নামে, তারপর পেটমোটা গদাইলস্কর জামাইবাবা নামে অপরাধীদের রাজপুত্র হয়ে উঠেছেন গোপালপুরের ফলকিয়া, পরবত্তা, ডিমহা, কেলওয়ারি, তিনহেংগা আর কহলগাঁও-এর অনাদিপুর, আভাপুর আর অঠগম্মা দিয়ারায় ।
    সুশান্ত ঘোষ প্রথম দিকে ফিতেবাঁধা কুকুরবাচ্চার মতন গোমড়া মুখে বোবা সেজে থাকলেও, গ্রাম্য অশিক্ষিত বাংলা জানে না এমন, গংগোতা জাতের চোদ্দ বছরের কচি নিরক্ষর শ্যামলিমা তুলতুলে মাংসের মেয়ের সঙ্গে বাসা বেঁধে ফেলেছিলেন, ঠান্ডা মেঠো দেয়ালের সোঁদা-ছমছমে প্রায়ান্ধকারে, খালি গায়ে, মাদ্রাজি হাফ-লুঙ্গিতে, শাশুড়ির দেয়া কালো কাপড়ের চৌকো তাবিজ গলায় , ছত্রিশ ডিগ্রির বালি-ওড়ানো থমথমে গ্রীষ্মে, এগারো ডিগ্রির কম্বলচাপা হিহি ঠাণ্ডায়, বর্ষার মেঘপাগল ঝোড়ো ঝড়ের টালিভাঙা দাপটে । যখন কিডন্যাপ হয়েছিলেন, তখন দিয়ারার এই এলাকায় বিজলি ছিল না, যাতায়াতের রাস্তা ছিল না, পানীয় জল ছিল না । তারপর ওনার রাজত্ব ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে, স্কুল-কলেজের লিখাপড়হিকে কাজে লাগিয়ে বিজলি সড়ক পানি এনেছেন।
    দিয়ারার লোকেরা মনে করে উনি, সুশান্ত ঘোষ, আড়ালে কলকাঠি নাড়েন । সামনে সবসময় ভঁয়সাবদন কউয়াডোল তারিণী মণ্ডল । যদিও কখনও-কখনও, হয়ত নদীর ওপর বিদ্যুতের কিলবিলে কেউটে রুপোলি খোলোস ছেড়ে ঝাঁপিয়ে-পড়া সন্ধ্যায়, মগজের ব্যাস্টিলে নিজেকে পায়ে চেন-বাঁধা কয়েদির ঢঙে, ভেবে ফ্যালেন, তিনি আসলে একজন মহা-অপরাধীর জামাই, গংগোতা-ডন নামক এক ভয় উদ্রেককারী দুষিত চরিত্রের মানুষ, যে ওই মহাডনত্বে আটকা পড়ে ছটফট করতে পারে, নিজের কারাগার থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারে না । চারিদিকে এত সাঙ্গপাঙ্গের জি-হুজুরি, কচি নিরক্ষর স্নেহদেহ স্ত্রীর নিঃশর্ত আগুনযোনি-ভালোবাসা, শশুরশাশুড়ির অফুরন্ত আদরযত্ন সত্ত্বেও, তিনি নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের বিষে ক্ষয়ে চলেছেন । আসলে তিনি, সুশান্ত ঘোষ, মনে করেন যে এই ক্ষয়-রোগের আনন্দে সুফিসন্তের মতন অজানা ঐশ্বর্যে আলোকিত হয়ে চলেছেন প্রতিদিন।
    যে-সময়ে সুশান্ত ঘোষকে অপহরণ করা হয়েছিল, ভাগলপুরের ষোলোটা ব্লকের ছয়টায় দিয়ারা ছিল , যাদের গঙ্গা দয়া করে ছাড় দেয়ায়, চিকচিকে পলিমাটির চাদরে ঢাকা প্রায়-পাকা চেহারা নিয়েছে সেগুলো । গঙ্গার সুমতি বা দুর্মতি যা-ই হোক, আরও তেরোটা ব্লকে জেগে উঠেছে চর, যাকে লোকে বলে দিয়ারা । এই চরগুলো অনেক সময়ে বেগড়বাঁই করতে-করতে মেটেল জলের তলায় বর্ষায় ডুবকি মেরে লুকিয়ে পড়ে, আবার ফিরে আসে ঝিলিকদার হাসি ফুটিয়ে সারমাটি মাখা মাথা উঁচু করে । নারায়ণপুর, বিহপুর, খারিক, ফুলাউথ, নৌগাছিয়া, ইসমাইলপুর আর গোপালপুরে লোকবসতি জমে উঠেছে জামাইবাবার রাজত্বে ।
    হেমন্তে, ঝিরিঝিরি হাওয়ার আদুরে সুড়সুড়িতে, বালির ছোটোছোটো নাভি ঘিরে আলতো ঘুর্ণিরা দিয়ারাময় খেলে বেড়ায় । সেই হাওয়াই আবার গ্রীষ্মকালে বালির ঘোমটা মাথায় দল বেঁধে দেহাতি বউদের ঢঙে দৌড়োয় চরের ওপর দিয়ে । বসন্তকালের বালি ডেকে আনে পোয়াতি পাখিদের, তাদের খোকা-খুকুকে বাছাই পোকা, ফড়িং, প্রজাপতি খাওয়াবে বলে ।
    জামাইবাবা চোখে কালো রেব্যান চশমা, লাল বা নীল টিশার্ট আর ডেনিম-জিন্স পরে টাটা সুমোতে বা বোলেরোয় তবিয়ত খুশ করার জন্য ভাগলপুর শহর ঘোরেন, তমঞ্চাধারী দেহরক্ষীদের পাহারায় । বাবা-জ্যাঠার বাড়ি যেতে কি ইচ্ছে করে না ওনার ? করে । ছেলে হবার আগে আর পরে সবসুদ্দু পাটনার গর্দানিবাগের বাড়িতে গেছেন সাকুল্যে চারবার, বোলেরোয়, বন্দুকধারী দেহরক্ষী নিয়ে । কিন্তু দিয়ারার হারামখোর মৌজমস্তি আর শোধ-প্রতিশোধের আঘাত-প্রত্যাঘাত আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ তো নেই সেই ছাপোষা বাঙালি জীবনে, বেবি নামের মেঠোগন্ধা সুঠামবুক নধরউরু গাঁইয়া নিরক্ষর চোরাটান বউ নেই, যার আয়ত গোবেচারি চাউনি সেই চোদ্দ বছর বয়সেই আটক থেকে গেছে। বাবা মারা যাবার খবর পেয়ে গিয়েছিলেন বটে, তবে ওনাকে কাঁধ দিতে দেয়া হয়নি, ক্রিমিনাল পরিবারে ছোটো জাতে বিয়ে করে ওনার কাঁধ নিচে নেমে গেছে বলে । ওনার ছেলেকেও কাঁধ দিতে দেয়া হয়নি, তার কাঁধ জারজ বলে আরও তলায় । শোকার্ত বিষণ্ণতার মর্মপীড়া ফর্দাফাঁই করে, ওনার মা ঘোষণা করেছিলেন যে সুশান্তর কুকর্ম সহ্য করতে না পেরেই বাবা মারা গেলেন।
    বাবা মারা যাবার আগে যখন সুশান্ত ঘোষ পাটনার বাড়িতে গিয়েছিলেন, বাড়ির ছোটোবড়ো প্রতিটি সদস্যের জন্য হালআমলের স্মার্টফোন কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন, সিম কার্ড তোমরা যে-যার নিজেদের নামে কিনে নিও, আর যদি চাও তাহলে মাঝে-মাঝে ফোন কোরো । মেজজ্যাঠার নাতনি ইতু ছাড়া, প্রথমে ইতস্তত করলেও সকলেই নিয়ে নিয়েছিলেন, জেঠি-কাকি, ভাই-বউদি, ভাইপো-ভাইজি, এমনকি মা-বাবাও । বাবা মুখ গোমড়া করে বলেছিলেন, ঠিক আছে, টেবিলের ওপর রেখে দে । মা বলেছিলেন, এ তোর খুনোখুনির টাকায় কেনা নয়তো, দেখিস বাবা, তোর পাপের ভাগি করিসনি যেন আমাদের।
    জবাবে সুশান্ত বলেছিলেন, আমি সেখানে কোনো কাজই করি না মা , ঠ্যাং ছড়িয়ে আরাম করি, সারাদিন খবরের কাগজ পড়ি, বাংলাও, টিভি দেখি, ইনটারনেট ঘাঁটি, খাইদাই আর ঘুমোই, যেমন ঘরজামাইরা করে । একটু থেমে, যোগ করেছিলেন, পিঁজরেপোলের ষাঁড়ের মতন ।
    খোশগল্পপ্রিয় বড়জ্যাঠাইমা, প্রায়-ফোকলা হাসিমুখে, তখনই মোবাইলের কাগজ-বাক্স খুলে ফোনটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলেছিলেন, আমি তোর সঙ্গে প্রায়ই কথা কইব, তুই আমাকে তোর নম্বরটা দিয়ে যা। কথা কইবার টাকা ফুরিয়ে গেলে তোর ওখান থেকে ভরিয়ে দিস । কেউ তো অ্যাদ্দিন কিনে দেয়নি, তুই দিলি ।
    অমিত কোথায়, দেখছি না ? জানতে চেয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ । অমিত ওনার প্রথম যৌবনের বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলে, যাকে শৈশবে ওনাদের গর্দানিবাগের বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন অতনু চক্রবর্তী ও তাঁর সঙ্গিনী মানসী বর্মণ ; তাঁরা জানিয়েছিলেন যে, নওয়াদায়, যেখানে তাঁদের বাস, সেখানে অমিতকে পড়াশোনা করানো সম্ভব নয়, তাঁদের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে খাপ খাবেনা একটি শিশুর আধুনিক লালন-পালন, বুঝিয়েছিলেন অতনু-মানসী জুটি ।
    --অমিত উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বাড়ি থেকে চলে গেছে, কাউকে কিছু বলে যায়নি । কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল, হাসপাতাল, থানা-পুলিশ করা হয়েছিল, ওর কোনো পাত্তা নেই , বলেছিলেন ইতুর রাঙাকাকা, সুশান্তর ছোটো ভাই, যিনি অমিতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ; ওনার ছেলেপুলে হয়নি বলে বাড়ির সবাই অমিতকে পরিবারের সদস্য করে নিয়েছিল । সুশান্ত যখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিলেন, অকালমৃত ভাই অপাংশুর মেয়ে ইতুর সঙ্গে দেখা করার জন্য, সিঁড়ির বাঁকে অপেক্ষারত রাঙাবউ সুশান্তকে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, অমিত আর ইতুর মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তিন তলার ছাদে অন্ধকারে গাঁজাপাতা খেয়ে দুজন জড়াজড়ি করছিল, তখন সেজোকর্তা ধরে ফেলেছিলেন । জানাজানি হতে অমিতকে এমন অকথা-কুকথা বলা হয়েছিল যে যেদিন ওর উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল বেরোলো সেদিন রাতেই কাউকে না বলে কোথাও চলে গেছে । তোমার কিডন্যাপ হয়ে চলে যাবার পর এটা এই বাড়ির আরেক মর্মান্তিক অঘটন । বিজ্ঞাপন-ফিজ্ঞাপন, হাসপাতাল-পুলিশের গল্প সব বানানো, বিশ্বাস কোরোনি ।
    মানসী বর্মণ-অতনু চক্রবর্তীর ইচ্ছানুযায়ী, অমিতের পদবি স্কুলে বর্মণ হিসাবে নথি করানো হয়েছিল বলে বাবার সম্পর্কে অবজ্ঞামেশানো চাপা ক্রোধ পুষতো অমিত ।
    সুশান্তর মেজজেঠার নাতনি, অপাংশুর মেয়ে ইতান, অর্থাৎ ইতুর সঙ্গে ওর তিন তলার ছাদের ঘরে দেখা করতে গেলে বলেছিল, কী করব মোবাইল ফোন নিয়ে, আমার কে আছে জগত-সংসারে যার সঙ্গে কথা বলব, সামনা-সামনিই কথা হয় না কারোর সঙ্গে, তো ফোনে কার সঙ্গে কথা কইব, আর দরকার পড়লে বাড়িতে তো ল্যাণ্ডলাইন আছেই ; তুমি কখনও আমাকে ফোন করেছ, যে মোবাইল ফোন দিতে এসেছ বড়ো ।
    অমিত নিরুদ্দেশ হবার পর, ইতু মনে করে, ওর বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে ; ভ্রু কুঁচকে থাকার দরুন কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে, কোমর হয়ে গেছে ভেতো , বয়সের তুলনায় উঁচু বুক। অপাংশুর একমাত্র সন্তান । অপাংশু আর ওর বউ যখন ডাক্তার দেখিয়ে হাতেটানা রিকশা করে কংকরবাগ থেকে ফিরছিল, তখন একটা ট্রাক ওদের রিকশাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে, দুজনকেই চাপা দিয়ে, চলে যায় । ইনশিওরেন্সের টাকা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । সেই থেকে, মনে করে ইতু, একান্নবর্তী পরিবারে ওর জায়গা ক্রমশ নেমে-নেমে ডিলুক্স চাকরানির স্তরে চলে গেছে । বাবা-মা মারা যেতে, এম বি বি এস এক বছর পড়ে ছেড়ে দিতে হয়েছে, কে-ই বা খরচ যোগাবে? বেশ কিছুকাল দুঃখিত ক্রোধে আচ্ছন্ন থাকার পর নিজের প্রগলভা সদালাপী দুঃসাহসী নির্ভীক আন্তরিকতায় ফিরেছে । এম বি বি এস এর বিকল্প হিসাবে, বাবার রেখে যাওয়া সঞ্চয়ে, পড়েছে অলটারনেটিভ মেডিসিন । মানুষের জন্য কিছু করতে হবে, সমাজের জন্য কিছু করতে হবে, দেশের জন্য কিছু করতে হবে, অন্তত অলটারনেটিভ মেডিসিনের মাধ্যমেই করা যাক, ভেবেছিল ইতু ।
    সুশান্ত বেফাঁস বলে ফেলেছিলেন, বিয়ে করলি না কেন ?
    গোখরো সাপের ছোবলের আগে সতর্কবার্তার মতন ইতু বলে উঠল, বিয়ে ? চাইলেই বিয়ে করা যায় নাকি? বাড়ির কেউ কি কখনও চেষ্টা করেছে আমার বিয়ের ? তোমার ভাইরা তোমার ভাইপো-ভাইঝিদের বিয়ে দিয়েছে, তারা যে যার বিয়ে করে সংসার পেতে ফেলেছে, আর প্রায় সকলেই মা-বাপের দায়-দায়িত্ব এড়াবার জন্য এবাড়ি ছেড়ে, নানা অজুহাত দেখিয়ে, পালিয়েছে । তোমার জেঠা-কাকারা নিজের-নিজের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, ব্যাস, সবায়ের সব দায়িত্ব শেষ । সহানুভূতির জন্য টিকে আছে শুধু তিনজন বুড়ি, বটঠাকুমা, মেজঠাকুমা আর তোমার মা, মানে আমাদের অন্নমা, যাঁদের আর তেমন গুরুত্ব দেয় না এই একান্নবর্তী নৌটাংকি পরিবার । এরা এমন যে এদের সুবিধা হবে ভেবে রেলপার বস্তি থেকে একজন বাংলাদেশি বউকে এনেছিলুম রান্নাঘরের পুরো কাজ করার জন্য, থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে, তা তোমার কায়েত পরিবার বামুনগিরি ফলিয়ে বলল যে বাড়ির কাজে মুসলমান চলবে না ।
    --কেন, অলটারনেটিভ মেডিসিন পড়লি, তার একটা দাম তো আছে, কত লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করছিস ।
    --হুঃ, অলটারনেটিভ মেডিসিন । এম বি বি এস কোর্স পুরো করার মতন টাকা খরচ করতে চায়নি তোমার খুড়তুতো-জাঠতুতো ভাইরা, জ্যাঠা-বাবা-কাকারা, তোমার নিজের ভাই রাঙাকাকার কথা তো যত কম বলা যায় ততই ভালো , তাই ওই সস্তার ডাক্তারি পড়তে হল, তাও ডিপ্লোমা, একটা অখদ্দে প্রাইভেট কলেজে । তুমি তো এ-বাড়ির ত্যাজ্যপুত্র, নয়তো তোমার দিকে হাত বাড়াতে পারতুম । কিন্তু তুমি কখনও জানতে চাওনি যে মা-বাপ মরার পর ইতুটা কেমন আছে, কী করছে । আমার বাবা তো আর জেঠাদের মতন মাইনে পেত না, যেটুকু সঞ্চয় রেখে গেছে, তা থেকেই চেম্বার খুলেছি, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, বিহারি ডাক্তারদের মতন বড়ো-বড়ো করে ডাক্তার ইতু ঘোষ লিখে। মাসে একটা কি দুটো রোগি আসত, তাও তাদের পয়সাকড়ি খরচ করার যোগ্যতা নেই বলে আসত ; যারা আসত তারাও অবাক হতো যে আমি কেন রাংতায় মোড়া ট্যাবলেট দিচ্ছি না । খগোলের গরিব বস্তিতে গিয়ে ফোলডিং টেবিল পেতে রোগিদের সেবা করার চেষ্টা করেছি ; তারাও ভাবে ওষুধের বড়ি নেই, ইনজেকশান নেই, এ আবার কেমন ডাক্তার, জড়িবুটি দ্যায়, গা-হাত-পা টেপে, জলে মাথা ডোবাতে বলে । শুধু ভাড়াই গুণে যাচ্ছি । এবার বন্ধ করে দেবো । ভেবেছিলুম যে গরিবদুঃখিদের জন্য অন্তত এইটুকু তো করি, জীবনের একটা উদ্দেশ্য তো হোক । কিছুই হল না । আই অ্যাম জাস্ট এ ফেলিয়র ।
    --কেন, অলটারনেটিভ মেডিসিনের প্রচার তো ভারতের ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টও করে ।
    --সেই ডাক্তারদের চেম্বারে গিয়েছ কখনও, তাদের তো চেম্বার নয়, বিরাট দপতর থাকে, বাগানবাড়ি থাকে, কয়েকজন লোক খাটে, ওষুধের বিরাট ভাঁড়ার । ব্যবস্হাও ভালো । অলটারনেটিভ মেডিসিন জিনিসটা কী তা জানো ?
    --না । কী ?
    --হাইড্রোথেরাপি, অ্যাকুপাংচার, অ্যারোমাথেরাপি, আয়ুর্বেদ যাকে আমরা বলি হার্বালিজম, হিপনোথেরাপি, রেইকি, ম্যাগনেট থেরাপি, চিরোপ্র্যাকটিক এটসেটরা । একবার কেরলে গিয়ে দেখে এসো , তোমার যা ঝিল্লিদার চর্বি জমছে, ট্রিটমেন্ট করিয়ে এসো । অনেকে হোমিওপ্যাথিও করে , যদি কোর্সটা আলাদা করে পড়া থাকে । আমার সঙ্গে যারা অলটারনেটিভ মেডিসিন পাশ করেছিল তারা প্রায় সবাই ক্লিনিকে বসে অ্যালোপ্যাথিক মেডিসিনকে গুঁড়িয়ে পুরিয়া তৈরি করে রোগিদের রোগ সারাচ্ছে । আমি এখনও, আনফরচুনেটলি, বিবেক নামের ইডিয়সিটা ঝেড়ে ফেলতে পারিনি বলে গরিব মানুষদের ঠকাতে পারছি না। ট্রাই করে যাচ্ছি ।
    --বিয়ে করলি না কেন । অলটারনেটিভ মেডিসিন বাদ দে । এমনি হাউসওয়াইফ ম্যারেজ তো করতে পারতিস ।
    --কে বিয়ে করত আমায় । তোমার মতন গায়ের রং পাইনি । তোমার মায়ের মতন নাক, দিদিদির মতন চোখ, কিছুই তো পাইনি । শুধু একরাশ চুল পেয়েছি আমার মায়ের মতন । চুল দেখে কে-ই বা বিয়ে করে আজকাল ? লাখ দশেক টাকা ছড়ালে হয়তো দুচারটে কাক-চিলকে ফাঁসানো যেত । তা কে করবে ? তোমাকে যখন কিডন্যাপ করেছিল তখন তোমার শশুরবাড়ির লোকেরা দশ লাখ টাকা চেয়েছিল । দিতে পারেনি তোমার বাবা-জেঠারা । সবাই মিলে হয়ত যোগাড় করতে পারত টাকাটা, কিন্তু এ-বাড়ি হল মানসিক দারিদ্র্যে সমৃদ্ধ।
    --তুই কি কাউকে বিয়ে করতে চাইছিলি ?
    --বিয়ে করতে চাইলেই তো আর তাকে বিয়ে করা যায় না । পাত্র যদি বাপের পদবির বদলে তার মায়ের পদবি নিয়ে জন্মায়, যদি সেই পাত্রের মা তার বাবার নয়, অন্য কারোর বউ হয়, যদি সেই পাত্রকে তার মা-বাপ অনাগ্রহী এক দম্পতির কোলে ফেলে দিয়ে কেটে পড়ে, তাহলে সেই পাত্রকে কোন চোখে দেখা হয় জানো ? কুলের কলঙ্ক । আমি সেরকম এক পাত্রকে পছন্দ করেছিলুম, কিন্তু বাড়ির গুরুজনদের মতে, যদিও তারা পষ্টাপষ্টি সেকথা বলেনি, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছে যে অমন পাত্র এই বাড়ির সম্মানের উপযুক্ত নয় । তোমাকেই এরা আজ পর্যন্ত স্বীকার করতে পারল না তো যার বাবা-মায়ের সম্পর্ক সন্দেহজনক তাকে স্বীকার করবে কী ভাবে ? তোমারই তো নিকট বন্ধু ছিল অতনু চক্রবর্তী আর তোমার এককালের সহকর্মী ছিল মানসী বর্মণ । মানসী বর্মণ নাকি অতনু চক্রবর্তীর চেয়ে দশ বছর বড়ো, আর তাঁরা লিভ টুগেদার করতেন, মানসী বর্মণ আর অতনু চক্রবর্তী নাকি মানসীর স্বামীর সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন । তাতে তাদের ছেলে কী দোষ করল ? আর যদি তোমরা এতই রক্ষণশীল ছিলে তো শিশুটাকে এবাড়িতে রেখে মানুষ করবারই বা কী দরকার ছিল ? ওনারা কোথায় থাকেন তাও এবাড়ির কেউ জানে না, জানবার চেষ্টা করেনি । তোমার তো বন্ধু ছিল ওরা, এই অতনু-মানসী জুটিকে কেমন দেখতে বলোতো ? কেমনতর রাক্ষস-রাক্ষসী যে নিজেদের বাচ্চাকে অন্যের কোলে চাপিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে?
    --কেন, রাঙা আর রাঙাবউ তো অমিতকে নিজের ছেলের মতনই মানুষ করেছে বলে জানি ।
    --কিছুই জানো না । তোমার মায়ের পেটের ভাই, সে তোমার বিপরীত । অমিতকে দত্তক তো আর নেয়নি; এমনিই কোলে নিয়েছিল । আর তারপরেও বাচ্চা হবার জন্য আইভিএফ করাতে কলকাতা দৌড়োতো । কতবার যে সে আইভিএফ ফেল করল আর প্রতিবার লাখ খানেক করে গচ্চা গেল, তার কোনো হিসেব আছে ? ওই টাকায় ওরা অমিতকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারত । ওই যে বলে না, দাঁত নেই, চলেছে বিষকামড় দিতে, রাঙাকাকার অবস্হা তেমনই । আইভিএফ করালে সে বাচ্চাটা রাঙাকাকার হতো না, অন্য কারোর হতো, তাতেও আপত্তি নেই, অবশ্য দেখতে-শুনতে ভালো হতো, ফর্সা ঢ্যাঙা ডোনারের বীজ নিলে ।
    --আর গাঁজাটাজা খাস না তো ? কন্ঠস্বর নামিয়ে জানতে চেয়েছিলেন সুশান্ত, প্রশ্রয়দানকারী জেঠামশায়ের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টায় ।
    দীর্ঘ চুলের ঝাপট বুক থেকে পিঠে উড়িয়ে, উঁচু গলায় ইতুর জবাব, ওঃ, তোমাকে জানানো হয়ে গেছে, তোমারও দেখছি এজেন্ট রয়েছে এ-বাড়িতে । তারপর যোগ করেছিল, কলেজে পড়ার সময়ে মারিহুয়ানা ফোঁকেনি, এমন ছাত্রছাত্রী তোমাদের জুরাসিক যুগে ছিল, তোমার ছেলেও হয়ত খায় বা খেয়েছে, জিগ্যেস করে দেখো । কলেজ তো বহুদিন ছেড়েচি, মৌজমস্তি করার টাকাকড়ি কোথায়, যে ওসবে ইনডালজ করব ? বিরক্তি ধরে গেছে জীবনে, কিচ্ছু ভাল্লাগে না । আমার আইডেনটিটি কী ? গ্যাসভরা ফানুস !
    --কবে চলে গেছে অমিত ? সুশান্ত সরাসরি প্রশ্ন তুললেন, যে ভাবে উকিলরা সাক্ষীদের প্রশ্ন করে ।
    --চার বছরের বেশি । কে জানে বেঁচে আছে কি না । অপমানে হয়ত আত্মহত্যা করে থাকবে । প্রায় ফুঁপিয়ে ফেলেছিল ইতু, সামলে নিল ।
    সুশান্ত বললেন, মোবাইলটা নে, মন খারাপ হলে আমার সঙ্গে কথা বলিস । তোকে দেখতে যথেষ্ট ভালো ; কলেজে তোর ছেলে-বন্ধুরাই এককালে লাইন মারত বলে শুনেছি । তুই-ই কাউকে প্রশ্রয় দিসনি, এখন বুঝতে পারলুম যে তার কারণ অমিত বর্মণ ।
    সুশান্তকে স্তম্ভিত করে ইতু বলল, তুমি আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে দাও না, তোমার ওখানকার কারোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিও, সুখে ঘর করব, কথা দিচ্ছি, সিরিয়াসলি বলছি, তুমি আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে নাও, কবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে বল, সেই মতো অপেক্ষা করব । জীবনটা তো জীবনের মতন হয়ে উঠুক । একটা উদ্দেশ্য তো হোক বেঁচে থাকার । তুমি জানো , তথাকথিত এই একান্নবর্তী পরিবারে আমি সবচেয়ে বেশি বোল্ড, যা ভালো বুঝি তা-ই করি, সব্বাই কাওয়ার্ড, ইনক্লুডিং অমিত । মেজমাসির মেয়ে ফুলকিও বোল্ডনেস দেখালো । জানো তো ফুলকি বাচ্চা হবার পর ওর বরকে ডিভোর্স দিয়ে আবার সেই বরের কাছেই ফিরে গেছে, বাচ্চাও হয়েছে । আসলে পারপাস, জীবনের একটা পারপাস চাই, অভিমুখ চাই ।
    --আমার দিয়ারার গাঁয়ের যে কোনো যুবক তোকে বিয়ে করতে চাইবে, সম্রাজ্ঞী বানিয়ে রাখবে, কিন্তু বিয়ে করতে পারে এমন কেউ তোর বয়সী তো নেই । ওখানে ছেলেদের ছোটোবেলাতেই বিয়ে হয়ে যায় ।
    --তাতে কি । কম বয়সী বরও তো হয় অনেকের, কিংবা আমি কারোর দ্বিতীয় বউ হয়ে থাকব, সুখে-শান্তিতে তো থাকব, কারোর সংসারের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে, বেঁচে থাকার পারপাস তো হবে । আমার মাথার ভেতরে একজন ল্যাংটো ইতুকে তো শান্তি দিতে পারব । আমার কি সাধ-আহ্লাদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই ? প্রেমিককে চুমু খাওয়াও এরা সহ্য করতে পারে না, কেননা তাদের মতে সে প্রেমিক সম্ভবত বেজন্মা ।
    --কী বলছিস জানিস ? আমার ছেলেকেও একই সঙ্গে গালাগাল দিচ্ছিস ।
    --হ্যাঁ, এরা তো তা-ই মনে করে । তোমার ছেলের তো এ-বাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ । জানি না তুমি কেন আত্মসম্মান খোয়াবার জন্য যেচে এসেছ ।
    --সকলের জন্য মাঝে-মাঝে মনকেমন করে রে ।
    --এ-বাড়িতে আমি তো একজন শ্রদ্ধেয় চাকরানি, গ্লোরিফায়েড মেইড । সুশান্তকে উত্তরহীন বসে থাকতে দেখে ইতু বলল, দেখলে তো, সমাধান কারোর কাছে নেই, সবাই কেবল উপদেশ ঝাড়ে । তোমার বউকেই এরা আসতে দিতে চায় না এমন কনজারভেটিভের এঁটো-খাওয়া বংশ । কোন জগতে তুমি বাস করো গো ? এখনও মনকেমন টাইপ আবেগে ভোগো !
    মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে ইতু বলেছিল, সিমকার্ড কেনার টাকা দিয়ে যাও, আর মাঝে-মাঝে তোমার ওখান থেকেই রিচার্জ করিয়ে দিও । জানি এতে অনেক খেলা-টেলা থাকে, তাই করেই টাইমপাস করব, আমাদের বাড়ির কাজের বউয়েরও মোবাইল আছে যখন , আমি তো বললুম তোমাকে, আমি হলুম গ্লোরিফায়েড খাওয়াপরার মেয়ে, চব্বিশ ঘণ্টার।
    সুশান্তর প্রায়-ফোকলা বড়জ্যাঠাইমা অবশ্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন, নিয়ে আয় না তোর বউকে, কি হয়েছে, আমরা তো সবাই তোর বউয়ের ভাষায় কথা বলতে পারি । মোবাইলে বড়জেঠিই সুশান্তর সঙ্গে প্রথম কথা বলা আরম্ভ করেছিলেন, তখন উনি জামশেদপুরে ছেলের কাছে, হাসপাতাল থেকে ফোন করতেন । বড়জ্যাঠাইমার বড়ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে বদলি নিয়ে বউ-ছেলে-মেয়েসহ চলে গেছে জামশেদপুর । বড়জ্যাঠাইমা গিয়েছিলেন কিন্তু ছেলের বাড়িতে ওঠেননি, ওনাকে ছেলের বউ ফ্ল্যাটের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি । যে তিন মাস জামশেদপুরে ছিলেন সে তিন মাস ছেলে ওনাকে এক হাসপাতালের শীতাতপ আরামে ভর্তি করে দিয়েছিল ; প্রতিদিন সকাল বিকাল গিয়ে দেখা করত ; দুয়েকবার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল মার সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলার জন্য । হাসপাতালের স্বাস্হ্যকর খাবার খেয়ে সুশান্তর জেঠির চেহারার খোলতাই হয়ে গিয়েছিল । ছেলের বউ চেয়েছিল যে তার বুড়ি বিধবা মা, একা, চোখে ভালো দেখতে পান না, থাকুন পাটনায় ছেলের বাড়িতে ; তাতে সুশান্তর বাবা-কাকা-জেঠারা রাজি হননি । এসব ঝুটঝামেলা এড়াতে বড়জ্যাঠাইমার ছেলে বদলি নিয়ে পালিয়েছে জামশেদপুর । ছোটোছেলে আমেরিকায় পড়তে গিয়ে আর ফেরেনি ; ওখানের চিনা মেয়েকে বিয়ে করে থেকে গেছে, দুই মেয়ের চিনাভাষায় নাম রেখেছে ।
    সুশান্তর বাবা কখনও ফোন করেননি ওঁকে । ইতু ফোন করে জানিয়েছিল যে সুশান্তর মায়ের মোবাইলটার প্যাকিঙই খোলা হয়নি । যেখানে সুশান্ত রেখে গিয়েছিল ড্রইংরুমের সেই সাইড টেবিলেই ধুলোর ওপর পড়ে আছে । কাজের বউ সৌদামিনীও ঝাড়পোঁছ করার সময়ে তাতে হাত দেয় না ।
    তারপর সুশান্ত ঘোষের বাবা মারা গেলেন । হয়ত উনিও ফোনটা ব্যবহার করেননি ।

    পাঁচ
    পুড়তে-থাকা কুঁড়েঘরগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে, এ কে সানতালিস রাইফেলটা হাতে নিয়ে, সিলভারব্যাক গোরিলার ঢঙে বুক চাপড়ে, রগ বয়ে যৌবন-প্রাপ্তির মস্তির রস ঝরানো যুবক হাতির মতন, অপুর, অশ্বমেধ ঘোষ-এর, কন্ঠস্বর থেকে যে চিৎকার বেরিয়ে এলো তাকে বৃংহনের সঙ্গেই তুলনা করা যায় । তার কারণ অপু ক্রোধেও গালাগাল দিতে পারে না, দিতে না-পারার অতিরিক্ত আক্ষেপে ক্রোধ মাথায় উঠে যায় ; সে-উক্তিগুলো ওর সাঙ্গপাঙ্গরাই করছিল ।

    ছয়
    বাবা-মার জন্য স্মৃতির জারকে আচ্ছন্ন সুশান্তর মনকেমন করে মাঝেসাঝে, তখন গ্যাঁজানো তরমুজের চোলাই-করা সোমরস নিয়ে বসেন, সঙ্গে শুয়োরের মাংসের বড়া , আদা-রসুন-পেঁয়াজবাটা আর বেসন মাখা, হামান দিস্তায় থেঁতো করা মাংসের বড়া, সাদা তেলে যা রাঁধতে ওনার বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের ভারিভরকম মায়ের জুড়ি নেই । ওনার ছেলে অপু , যদিও বাংলা বলতে পারে, কিন্তু মাকে শুনিয়ে হিন্দিতেই বলে, হাঁ পিজিয়ে পিজিয়ে অওর গম গলত কিজিয়ে ; আরে অগর আপকা দিল নহিঁ লগতা থা তো ভাগ কেঁও নহিঁ গয়ে থে ? য়ঁহাসে নিকলকে ভাগলপুর স্টেশন, অওর ওঁয়াহাসে সিধে পটনা, স্টেশন ভি ঘর কে নজদিক । পর আপ নহিঁ ভাগে । লগতা হ্যায় আপকো অপনে বিবি সে জ্যাদা প্যার অপনে সসুর সে হ্যায় । বিবি কহিঁ ভি মিল জাতি, মগর তারিণী মণ্ডলকে তরহ মকখনভরা পহাড় নহিঁ মিলতা, য়হি হ্যায় না আপকা গম ?
    তারিণী মণ্ডলের হাঁটু-ডিংডং স্ত্রী, ফোকলা গুটকাদেঁতো হাসি হেসে নিজের মহিষ-কালো বরকে খুসুরফুসুর কন্ঠে বলেন, দোগলা হ্যায় না আপকা পোতা, ইসিলিয়ে বহুত দিমাগ রখতা হ্যায় । সাধারণ জারজ নয়, বাঙালি-বিহারি, উঁচুজাত-নিচুজাত, পড়াশোনাঅলা- মুখ্খু, শহুরে-গাঁইয়া, গরিব-মালদার, কানুনি-গয়েরকানুনি, কলমচি-খেতিহর, কত রকমের মিশেল ।
    --আরে মাথা তো খাটিয়েছিলুম আমি ছোঁড়াটাকে বন্ধক বানিয়ে, ঘরজামাইও পেলুম, আবার নসলও ভালো হয়ে গেল । এখন কয়েক পুরুষ চকচকে ফর্সা বাচ্চা পাবি ; অপুর মেয়েদের বিয়ে দিতে বেশি অসুবিধা হবে না। জামাইবাবার মেয়ে না হওয়াই ভালো, কী বল ? বলল তারিণী মণ্ডল, ডান চোখে হাসি মেলে । যখন সুশান্ত ঘোষকে কিডন্যাপ করেছিল, তখন অবশ্য দুটো চোখই ছিল,বাঁ চোখটা নষ্ট হয়নি রামধারী ধানুকের হামলায় ।
    --সে কথা ঠিক । আমি তি ভেবেছিলুম ছোঁড়াটা পালিয়ে যাবে ।
    --আমার মেয়ের সঙ্গে রাত কাটিয়ে পালিয়ে গেলেই হল ? ধরে এনে কেটে টুকরো করে দিয়ারার বালিতে পুঁতে দিতুম ।
    --ছোঁড়াটা ভালোবেসে ফেলেছে ওর গালফোলা বউকে । শোবার সময় রোজ রাতে খুশবুর টিন থেকে গ্যাস মারে তোমার মেয়ের গায়ে, দ্যাখো না কেমন গন্ধ ভুরভুর করে বেবির গা থেকে, মনে হয় চবুতরা জুড়ে ফুলের গাছ ? ভৌঁরাভৌঁরি জোড়ি ।
    --তাজ্জব ব্যাপার, না ? বকের সঙ্গে কোকিলের বিয়ে !
    --তাজ্জবের কি আছে । এরকম কচি কুচুরমুচুর মেয়ের সঙ্গে কি ওর বিয়ে হতো ওদের নিজেদের সমাজে ? কোনো দরকচা হেলাফেলা টিড্ডিছাপ বউ পেতো ।
    --কি যা তা বকছিস নিজের মেয়ের সম্পর্কে ।
    --সত্যি কথাটাই বলছি । নিজের বিয়ের কথা মনে করে দ্যাখো । তুমিও কচি কুচুরমুচুরই পেয়েছিলে । ওই কুচুরমুচুর জিনিসটাই হল মেয়েদের দুসরা দিল, যা মরদদের থাকে না । দ্বিতীয় হৃদয়ে রক্ত থাকে না, থাকে রসালো মাদকের ফাঁদ, যে ফাঁদে একবার পড়লে রোজ-রোজ পড়ার নেশায় মরদরা ভোগে, যতদিন সে মরদ থাকে ততদিন তো ভোগেই ।
    --তা ঠিক, ছিলিস ছাপ্পানছুরি-ছইলছবিলি । এটা কোনো টিভি সিরিয়ালের সংলাপ বললি নাকি ? ছোঁড়াটা নাকি প্রথম রাতেই রক্তারক্তি করে ফেলেছিল ?
    --হ্যাঁ । বেচারা । গলার শেকল খুলে-দেয়া শহুরে রামছাগল । কত দিনের বদবুদার তবিয়ত ।
    --ওদের বিয়ে দিতে এত দেরি করে কেন জানি না । কম বয়সের টাটকাতাজা রস সব বেকার বয়ে চলে যায় ।
    --দেরি করে বলেই তো পেলে ছোঁড়াটাকে ।
    তা নয় ; কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত ঘোষ হয়ে গেছেন দিয়ারাচরিত্রের উন্মূল মানুষ । যখন নোট গোণার চাকরি করতেন, তখন বিহারি জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভূমিহার কুরমি যারা, কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্হ বিহারি আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান আনতেন। ব্র্যাণ্ডেড জ্যাকেট জিন্স টিশার্ট উইন্ডচিটার । দপতরের গৃহবধু কর্মীদের চোখে সুশান্ত ঘোষ ছিলেন অবিনশ্বর জাদুখোকোন, লিচুকুসুম, মাগ-ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ । গেঁজিয়ে যেতে পারতেন, চোখে চোখ রেখে, ননস্টপ, যেন বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছেন পৌরাণিক কিন্নরে, সবায়ের অজান্তে । গায়কের ইশারায় যেভাবে ধ্বনিপরম্পরা টের পায় তবলাবাদকের আঙুলের ছান্দসিক অস্হিরতা, তেমনই, নৈশভোজে বেরোনো শীতঘুম-ভাঙা টিকটিকি যুবকের মতন, মহিলা সহকর্মীদের অবান্তর কথাবার্তা, ভোজপুরি বা হিন্দি বা বাংলায় বা ইংরেজিতে, বলার জন্যই বলা, শ্বাসছোঁয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে গিলতেন সুশান্ত ঘোষ ।
    এখন আর ওনার, সুশান্ত ঘোষের সম্পর্কে, আগাম বলা যায় না কিছু । চাকরি করতেন পচা টাকার নোট জ্বালিয়ে নষ্ট করার । এখন কাঁচা টাকার করকরে আরামে ঠ্যাং তুলে খালি গায়ে, ভুঁড়ির তলায় চেককাটা লুঙ্গি পরে, লুঙ্গির গেঁজেতে সেমিঅটোমেটিক পিস্তল, যা জীবনে কখনও চালাননি, শাশুড়ির পরানো কালো কাপড়ের ছোট্ট তাবিজ গলায় , নিজেকে অন্যমানুষে পালটে ফেলার আনন্দে তরমুজ-সোমরসের হেঁচকি তোলেন। যা একখানা চেহারা করেছেন, ওনার স্তাবকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময়ে ওনাকে বলে গেণ্ডা-মরদ অর্থাৎ আলফা গণ্ডার ।
    প্রতি রাতে শোবার আগে বিবসনা বউয়ের আগাপাশতলা বডি ডেওডোরেন্ট স্প্রে করেন সুশান্ত ঘোষ বা গেণ্ডা-মরদ, মানে আলফা গণ্ডার । এমন নয় যে বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের গায়ে দুর্গন্ধ ; প্রথম রাতেই সুশান্ত ঘোষ একটা স্যান্ডালউড সাবান কিনে বলে দিয়েছিলেন যে রোজ এই সাবান মেখে স্নান করতে হবে, সপ্তাহে একদিন শাম্পু করতে হবে । বউই আসক্ত হয়ে গেছে ডেওডোরেণ্টের, শ্যাম্পুর, লিপগ্লসের, লিপস্টিকের, ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলির, কমপ্যাক্ট পাউডারের, ওলে টোটাল এফেক্টের, নখপালিশের, পিচ-মিল্ক ময়েশ্চারাইজার আর নানা আঙ্গিকের শিশি-বোতল-কৌটোর-ডিবের সুগন্ধের নেশায় ।
    শহুরে দশলাখিয়া বরকে বশ করার জন্য, টিভিসুন্দরীরা যা মাখে, তা মেখে কৃষ্ণাঙ্গী-অপ্সরা হবার প্রয়াস করে বেবি, সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর শ্যামলিমা চির-তুলতুলে বউ, আর সুশান্তর শাশুড়ি বশ করার মন্ত্রপূত তাবিজ পরিয়ে জামাইকে বেঁধে রেখেছেন বেবির আপাত-বেবিত্বে ।
    কোনো রাতে মাতাল অবস্হায় সুশান্ত ঘুমিয়ে পড়লে, মাঝরাতে বউ ওনাকে ঠেলে জাগিয়ে দিয়ে বলে, উঠিয়ে না, নিন্দ নহিঁ আ রহল , জরা গ্যাস মার দিজিয়ে না । হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা একাধিক ডেওডোরেন্টের স্প্রে থেকে যেটা হাতে পান বউয়ের পোশাকহীন গায়ে সুগন্ধী বর্ষা ছিটিয়ে এক খেপ দ্রূত-প্রেম সেরে ফেলে দুজনে দুপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন । অনেক সময়ে বেবি নামের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ আগেই হুশিয়ারি দিয়ে রাখে, জল্দিবাজি মত কিজিয়ে, ধিরজ সে কিজিয়ে, বুডঢি নহিঁ না হো গয়ে হ্যাঁয় হম ।
    ডেস্কটপের মনিটারে , বেবি নামের মেঠোগন্ধা শ্যামলিমা বউকে, পর্নো ফিল্ম দেখিয়ে আরো বিপদ ডেকে এনেছেন নিজের । বেবি বলে, ফিলিম মেঁ জইসন কর রহা হ্যায় ওইসন কিজিয়ে না, উঠাইয়ে, লেটাইয়ে, গিরাইয়ে, গিরিয়ে, পটক দিজিয়ে, সাঁস ফুলাইয়ে, মুহ সে প্যার কিজিয়ে, হমকো ভি মৌকা দিজিয়ে । কেতনা দের তক ভোগ করতা হ্যায়, অওর আপ হ্যাঁয় কি কবুতরকে তরহ ঝপট লিয়ে বস সো গয়ে । শুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ । তারপর বলে, দেখেছেন তো ওরা কেউ পৈতে পরে না ; আপনি যদি পৈতে পরতেন তাহলে সুতোর লচ্ছা সামলাতেই আমাদের সময় চলে যেত , ভালো করেছেন পৈতে পরা বন্ধ করে ।
    ঘুমনেশার ঘোরে সুশান্ত বলেন, আরে ওরা সব সাহেব-মেম কিংবা হাবশি, কুমিরের মাংস, বনমানুষের মাংস, ঘোড়ার মাংস, হাতির মাংস খায়, গাধার মাংস খায় ।
    --হাঁ, সে-কথা ঠিক, হাতিদের মতন ; হাতিরা কেমন নিজেদের গোমোরের জিনিসকে লটকিয়ে হাঁটে, মাটিতে ছুঁয়ে যায়। আপনি অপুকে বিলেতে পড়াশুনা করতে পাঠাতে চাইছেন ; সেখানে গিয়ে ও যদি মেম বিয়ে করে তাহলে তো সঙ্গত দিতে-দিতে হালকান হয়ে যাবে ! বিয়ে দিয়ে পাঠাতে পারতেন ; ওর বউ থাকত দিয়ারায় আমাদের সঙ্গে ।
    --ওখানে বিয়ে করার দরকার হয় না ; না করেই একসঙ্গে থাকা যায় । সঙ্গত মনের মতন না হলে আরেকজনের কাছে চলে যাওয়া যায়, বুঝলি ?
    --তাহলে তো ভালোই, মন ভরে গেলে বাড়ি ফিরে আসবে ; তখন ওর বিয়ে দেবেন ।
    অপুর মা, সুশান্তর মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ, পর-পর কয়েকদিন মাঝ রাতে ঘুম ভাঙাবার পর বলে ফ্যালে, চাহিয়ে তো এক বংগালন বিবি শাদি করকে লাইয়ে না পটনা য়া কলকত্তা সে, সাহব-মেম খেলিয়েগা দোনো মিলকর, জইসন নঙ্গা-ফিলিম মেঁ দিখাতা হ্যায়, কেতনা মছলি পকড়া যাতা হ্যায় অপনে হি নদী মেঁ, বড়কা-বড়কা রোহু । ঘরকা বনা মিঠাই খাতে হম লোগ সব । আপ চখতে বংগালন বিবি কি মিঠি চুচি । হমরে বিছওনে মেঁ হি, লগাকে মচ্ছরদানি, পিলাসটিকবালা গুলাবি মচ্ছরদানি । নহিঁ তো কলকত্তা যাইয়ে না, বংগালন রণ্ডিলোগন কা বাজার নহিঁ হ্যায় ওয়াহাঁ কাআআআআআআ ? কমর হিলাকে আইয়ে, অইসন দুখি-দুখি মত রহিয়ে, অওর দারু মে মত ডুবে রহিয়ে রাত ভর ; দারু পিকে আপ একদম সঠিয়া যাতে হ্যাঁয় । দিন মেঁ পিজিয়ে দারু, কৌনো মনা কিয়া হ্যায় কাআআআআ ? রতিয়া কে বখত বদনওয়া ফিরি রখিয়ে জি ।
    বারবার শুনে বিরক্ত সুশান্ত একদিন বলেছিলেন, ঠিক আছে, নিয়ে আসবো একজন লেখাপড়া-শেখা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে । নাছোড়বান্দা বেবি, যাকে বলা যায় তৎক্ষণাত, প্রত্যুত্তর দিয়েছিল, নিয়ে এসে দেখুন না, আপনার আর আপনার বাঙালি বউয়ের মাথা, সেই দিনই হাসুয়া দিয়ে ধড় থেকে নামিয়ে দেবো ; জানেন তো আমি তারিণী মণ্ডলের মেয়ে ।
    --হ্যাঁ, জানি, তুই প্রথমে তারিণী মন্ডলের মেয়ে, তারপর আমার বউ । ধড়টা তো তোকে দিয়েই দিয়েছি, আর আলাদা করে নিয়ে কী করবি ? আর মুণ্ডুও অনেকসময়ে তোর উরুর ঝক্কি সামলায় ।
    --খারাপ লাগল শুনে ? তাহলে মাফ করে দিন । আমি বেবি ঘোষ, আপনিও জানেন, আমিও জানি, ভোটার লিস্টে দেখে নেবেন, আমি তো লিখাপড়হি জানি না, কিন্তু বেবি ঘোষই লেখা আছে আমার ফোটুর পাশে, ভোট দিতে গিয়ে জানতে পেরেছি । আমি বেবি মণ্ডল নই । আমার ছেলেও মণ্ডল নয় । আর বলব না, মাফ করেছেন কি না ? আঁয় ?
    --করে দিলুম । এখন যা । দরকার হলে ডেকে নেবো ।
    --দাঁড়ান চান করে আসি, তারপর । ভিজে-ভিজে শরীরে আপনি যখন ফোঁটায় ফোঁটায় গুটিপোকা ফ্যালেন তবিয়ত এতো মগন হয়, গুটিপোকাগুলো সব ভেতরে গিয়ে নানা রঙের প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায় ।
    --এই জন্যই তো থেকে গেলুম ; যখন বলি তখনই তুই তৈরি, ঘুম থেকে উঠে হোক, দুপুর হোক, সন্ধ্যা হোক, মাঝ রাত হোক ।
    --রান্না চাপিয়ে গ্যাস নিভিয়েও তো কতবার এসেছি আপনার গুটিপোকাদের ফোঁটা নিয়ে প্রজাপতি ওড়াবো বলে। ভাগ্যিস আপনাকে পেয়েছি, কোনো গংগোতা বর হলে তো যৌবন নষ্ট হয়ে যেত বছর-বছর বাচ্চা পয়দা করে ।
    দিয়ারা, দ্বীপের মতন চর, জেগে ওঠে, জলপ্রবাহকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে বছরের পর বছর, জামাইবাবার মতন, বেগুসরায় মুঙ্গের থেকে গঙ্গা নদীর কিনার বরাবর, ভাগলপুর কাটিহার অব্দি ; এক জায়গায় ডুবে আরেক জায়গায় কুমিরের মতন জেগে ওঠে, খেলা করে অজস্র মানুষের সুখ-শান্তি নিয়ে, তাদের দুর্ধর্ষ ক্রুর মমতাহীন আতঙ্কিত উদ্বিগ্ন করে রাখে আজীবন, ভালা বরছি গাঁড়াসা ভোজালি পাইপগান কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস একে-ছপ্পন দিয়ে ।
    আচমকা যদি কখনও ওনার, সুশান্ত ঘোষের, মগজে ঘুমিয়ে থাকা লোকটা ধড়মড় করে উঠে বসে জানতে চায় যে, ওহে খোকা, তুমি কি ছিলে আর কি হয়ে গেলে, তখন ছিপি খুলে গুড়ে চোলাইকরা তরমুজের সোমরসের বোতল নিয়ে বসেন, আর নিজেকে বলেন, ইতু জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে চলেছে, আমার উদ্দেশ্য আমাকে খুঁজতে হয়নি। উদ্দেশ্যই আমাকে খুঁজে নিয়েছে । আমারও কী আত্মপরিচয় আছে ? কী ? আমি তারিণী মণ্ডলের জামাই, বেবির স্বামী, গংগোতা ক্ল্যানের ডনের অভিনেতা ! আমি কে ? আমি, যার নাম সুশান্ত ঘোষ ? আই অ্যাম নাথিং ।
    ল্যাপটপে বা স্মার্টফোনে লোডকরা ওনার প্রিয় গান শোনেন, বারবার, বারবার, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন, ব্যায়ঠে রহে তসব্বুর-এ-জানা কিয়ে হুয়ে, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন...। শুনতে পান, বেবি বলছে, এরকম দুখি-দুখি গান শুনছেন কেন, অন্য গানটা শুনুন না, দো দিওয়ানে শহর মেঁ, রাত মেঁ য়া দোপহর মেঁ...। ঠিক আছে, শোন, জিন্দগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি হায়, কভি ইয়ে রুলায়ে, কভি ইয়ে হাসায়ে...।
    বেবি : কী-ই বা করবেন, আমাদের দুজনের অদৃষ্ট, আর সেই শুশুকটার ইশারা, আপনি রামচন্দ্রজীর মতন দরজায় এসে যেদিন দাঁড়ালেন, তার আগের দিন গঙ্গায় শুশুক দেখে সবাই বলেছিল যে আমার জন্য গঙ্গা মাইয়া একজন রাজপুত্রকে পাঠাচ্ছেন । হ্যায় নাআআআআআ ।
    দুপুরের প্যাচপেচে গরমে একা বসে-বসে স্বস্তি না পেলে ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে ট্রিপল এক্স । তাতেও স্বস্তি না পেলে বেবি বলে হাঁক পাড়েন, আর বেবি ঘরে ঢুকলে, বলেন, দরোজা বন্ধ করে দে, এই নে, দেখে একটু শরীর টাটকা-তাজা করে নে, তারপর তুই শুশুক ধরিস, আমি চুচুক ধরব, তাড়াহুড়ো করব না । বেবি উত্তর দ্যায়, তাড়াহুড়ো করলে আপনার গুটিপোকাগুলো থেকে তরমুজের গন্ধ বেরোতে থাকে, ভাল্লাগে না, গ্যাসের টিন বরবাদ ।
    জমিন, জল, জবরদস্তি-- এই তিনটের মালিকানা, একদা লালটুশ এখন ভুঁড়োকার্তিক সুশান্ত ঘোষকে করে তুলেছে বহু ফেরারির আশ্রয়দাতা । নর্থ বিহার লিবারেশান আর্মির নেতা শংকরদয়াল সিং, ফাইজান পার্টির অওধেশ মণ্ডল আর হোয়াইট অ্যান্ট পার্টির বিকরা পাসওয়ানদের পোঁদে বেয়নেট ঠেকিয়ে পুলিশ যখন তাড়িয়ে বেড়াবার খেলা খেলছিল, তখন সুশান্ত ওদের লুকিয়ে রেখেছিলেন দুষ্প্রবেশ্য নামহীন এক দিয়ারায়, গঙ্গামাটির প্রলেপ-দেয়া, ডিজেল ইনভার্টারে চালানো রুমকুলারে ঠাণ্ডাখড় আরামঘরে । ভাড়া সেভেনস্টার হোটেলের । রুম সার্ভিস চাইলে ওনার শশুর ডান্সবারের নাচিয়েদের আনান নৌকোয় চাপিয়ে, সার্ভিস হয়ে গেলে ডান্সগার্লদের ফেরত পাঠান ভোর রাতের নৌকোয় চাপিয়ে ।
    সুশান্ত ঘোষের পারিবারিক কিংবদন্ধি অনুযায়ী, ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিল ঠগি ; গুড়ে চোলাই করা তরমুজের মদ টেনে সুশান্ত ঘোষ ভেবে ফ্যালেন যে হয়ত তাই তিনিও শশুরের দেয়া সুপারঠগির সিংহাসন দখল করলেন ।
    পুলিশ যায় না অপরিচিত কোনো দিয়ারায় ; গুজব যে ভাগলপুর শহর থেকে চান করার মার্বেল-বাথটব এনে দিয়ারার বালিতে বসিয়ে রেখে গেছেন তারিণী মণ্ডলের বাবা । তাইতে নাইট্রিক অ্যাসিড ভরে একজন পুলিশের মুখবির বা ইনফরমারকে চুবিয়ে গলিয়ে ফ্যালা হয়েছিল ।

    সাত
    শেষবার যখন ইতু ওর ক্লিনিক থেকে নিজের সঙ্গে, একদা পালিয়ে-যাওয়া অমিতকে বাড়ি নিয়ে এলো, বিরোধের হল্কা প্রায় নিভে গিয়েছিল, কেননা ইতিমধ্যে একান্নবর্তী পরিবারের অধিকাংশ সদস্য একে আরেকের সঙ্গে কথাহীন বার্তা-বিনিময় করে নিয়েছিলেন, যে, ইতুটাকে ঘাড় থেকে যদি নামানো যায় তাহলে স্হান-কাল-পাত্রের যেমন সুবিধা পাওয়া যাবে, তেমনই, আর্থিক দায়টাও বাড়ির বাইরে চালান করে দেয়া যাবে। এর আগে যখন অমিত এসেছে, সেদিন বিকেলেই চলে গেছে বা থেকে গেছে একদিন, বহিরাগতের মতন, অতিথির মতন নয়, বাড়ির সদস্যের মতন তো নয়ই ।
    শেষবার যখন অমিত এসেছিল, কোথায় শোবে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল, ইতু প্রস্তাব দিল, তিনতলার ছাদে ওর ঘরেই রাতটা কাটাক অমিত, সঙ্গে টয়লেট-বাথরুম আছে, কোনো অসুবিধা হবে না ; দোতলার বারান্দায় যে খাট পাতা আছে তাতে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়বে ইতু, একটা রাতেরই তো ব্যাপার । আগে ঘরটা ছিল সুশান্তর বাবার, তিনি মারা যেতে জাঠতুতো ভাই সমরেন্দ্রর দখলে গিয়েছিল ; ওর বউ যমজ বাচ্চাদের ইতুদের বাড়ির জিম্মায় চাপিয়ে ঝাড়া হাত-পা ডিভোর্স দিয়ে নাচতে-গাইতে চলে গেছে, যার দরুণ নিজের বলার মতন একটা ঘর পেয়েছে ইতু ।
    অমিত যখন এই বাড়ির সদস্য ছিল, তখন ও একতলায় ওর রাঙাবাবা-রাঙামা, মানে ইতুর রাঙাকাকা-রাঙাকাকিমার ঘরে ওনাদের সঙ্গে থাকত । উধাও হবার পর প্রথমবার ফিরে, অমিত ওর রাঙাবাবা-রাঙামায়ের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখায়নি ; ওনারাও কুন্ঠিত, হয়তো অমিত চলে যাওয়ায় ওনারা যেচে-নেয়া দায়ভার থেকে ছাড়ান পেয়েছেন ।
    শুকগে তিনতলার ঘরে, মরুকগে যাক, মেয়েটা মা-বাপকে খেয়েছে, এবার ছেলেটাকে খাক, বয়স্কদের মুখ দেখে, তাদের ঘিলুর ভেতরের মেঘে সেরকমই রুপোলি পাড় দেখতে পেয়েছিল ইতু ।
    সকলকে শুনিয়ে ইতু বলল, তুই চল, বিছানা পেতে দিচ্ছি, জিনিসপত্র নেই দেখছি, শুধু এই কাঁধব্যাগ ?
    --হ্যাঁ, এতেই আমার পেন আর খাতা আছে, সংবাদ যা পাই টুকে নিই, পরে অফিসে গিয়ে তথ্যগুলো খাতা থেকে লিখে নিই আর যা দেখেছি বা শুনেছি তা স্মৃতি থেকে লিখে নিই । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --একটা ল্যাপটপ রাখলেই পারতিস, রিপোর্টাররা তো আজকাল ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন এই সব নিয়ে কাজ করেন । ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।
    --আমি এখনও টেকস্যাভি হতে পারিনি । হাতে কলম নিয়ে লিখতে ভালো লাগে আমার । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --তুই স্নানটান করে রেডি হয়ে নে, খাবার সময় হলে ডেকে নেব । ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।
    --আমার না খেলেও চলবে, রিপোর্টারের চাকরিতে সময়ে খাওয়া হয়ে ওঠে না, জানিসই তো, অভ্যাস হয়ে গেছে । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --ও লজ্জা পাচ্ছিস । এমব্যারাসড ফিল করার কী আছে, আমি তোর ডিনার ঘরেই পৌঁছে দিচ্ছি । ডিনার মানে রুটি আর আলু-পটলের তরকারি হয়েছে আজকে । ছয়টা রুটি চলবে তো ? ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।
    --না না, দুটো রুটি হলেই হবে । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    রাঙাকাকা আর সুশান্তজেঠুর মা, যাকে ওনার ছেলেরা, ভাসুরপো-দেওরপোরা, তাদের বাচ্চারা, অন্নমা বলে ডাকে, অমিতকে বললেন, তুমি আসো বেশ ভালো লাগে বাবা , তুমি সুশান্তর সবচেয়ে কাছের বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলে, এ-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েই বা কেন গিয়েছিলে , সব বাড়িতেই অমন মেলামেশা হয়, তাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় নাকি , কী আর বলব, আমার কোনো গুরুত্ব আর নেই, সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর কিছুই আর ভালো লাগে না । কিন্তু প্রতিবার অমন আপত্তি করো, আর যাই-যাই করো বলে মন খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই আমার মন বিষিয়ে থাকে, জানোই তো ।
    ইতু জানে, সুশান্তজেঠুর অভাব, জেঠুর বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলের মাধ্যমে কিছুটা মেটাবার চেষ্টা করেন অন্নমা । অতনুজেঠুকে ইতু দেখেছে ছোটোবেলায়, সুশান্তজেঠুর মোটরসাইকেলে বসে এ-বাড়িতে আসতে, কিন্তু ভুলে গেছে ওনার মুখ । সুশান্তজেঠু কিডন্যাপ হয়ে চলে গেলেন, তারপর অতনুজেঠু চাকরি-বাকরি ছেড়ে চলে গেলেন কোথাও । তখন সবাই বলত উনি সাধু হয়ে গেছেন, কুম্ভ মেলায় ওনাকে জটাজুট দেখা গেছে । শেষে উনি যখন অমিতকে এবাড়িতে রাখতে এলেন, ইতু তখন স্কুলে, জানা গিয়েছিল যে উনি নওয়াদা জেলার কোনো গ্রামে মানসী বর্মণের সঙ্গে সংসার পেতেছেন, সেই বাড়িতে আবার মানসী বর্মণের স্বামীও থাকেন । আরও পরে, যে অফিসে উনি কাজ করতেন, সেখানের কর্মীদের সূত্রে, কানাঘুষা শোনা গিয়েছিল যে ওনারা নকসল্লি-মালে আন্দোলন করতেন, পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন ; ওনাদের বিপ্লবী জীবনে শিশু অমিত খাপ খাবে না ভেবেই হয়ত রেখে গিয়েছিলেন ইতুদের বাড়িতে । বাবা-মাকে খুঁজে পাবার আগে পর্যন্ত অমিত ছিল বাবাহীন-মাহীন ।
    তিন তলার ঘরে পৌঁছে ইতু বলল, তোর মেসেঞ্জার আমাকে যে চিরকুট দিয়েছিল তাতে তো লেখা ছিল তুই কালকে সকালে আসবি ? মেসেঞ্জারদের দেখে বাড়ির লোকেদেরও খটকা লাগে ; বলেন ওরা কে রে, তোর পেশেন্ট, অথচ তুই তো বলতিস যে তোর রোগি জোটে না । বানচোদ, তোর জন্য কতো আর মিথ্যার সিনেমা করব ? আমি বিপদে পড়লে ক্ষতি নেই, বাড়িসুদ্দু লোকেরা যেন বিপদে না পড়ে ।
    --আমার বিহারশরিফে একটা কাজ ছিল । প্রতিবারের মতন আমি পাটনায় চলে এলুম । কতদিন তোর সঙ্গে দেখা হয়নি, মুখোমুখি কথা হয়নি । তোকে টাচ অ্যান্ড ফিল করতে ইচ্ছে করে ।
    ডিনারের বদলে একটু পরে ফোটো অ্যালবাম নিয়ে এলো ইতু । খাটের ওপর বসে, অ্যালবাম খুলে দ্যাখালো, এই দেখ, আমাদের দোল খেলার দিন তুই, তোর ক্লাসের বন্ধুরা সবাই এসেছিল, এই যে তোর ছবি, কতকাল হয়ে গেল, অবহেলায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ।
    গোটা দশেক ফোটো ছিল ওদের, সেগুলো প্লাসটিকের খাপ থেকে বের করে অমিত যখন বলল, আমি কি এগুলো রেখে নেব, তখন ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ইতু বলল, রেখে আবার কী করবি ? ডেসট্রয় করে ফেলতে চাইছিস তো ?
    --হ্যাঁ, এ-বাড়িতে আমার কোনো চিহ্ণ রাখতে চাই না ।
    --পরে কথা হবে, ফোটোগুলো ছিঁড়তে-ছিঁড়তে বলল ইতু । তারপর হাতের মুঠোয় দলাটা ধরে যোগ করল, জ্বালিয়ে ফেলতে হবে তো ? ডিনার আনছি, ঘুমিয়ে পড়িসনি যেন । ফোটোগুলো থাকলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি হতো না । এই বাড়িতে এসে কে-ই বা তোর ফোটো খুঁজবে । যাদের খোঁজবার তারা যদি সন্দেহ করে থাকে তাহলে তোর স্কুল-কলেজের রেকর্ড থেকেই যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে ডোসিয়ার বানিয়ে ফেলে থাকবে ।
    --ফোটোগুলো কেনই বা রেখেছিলিস, আননেসেসারিলি ।
    --ফোটোগুলো ছমাস যাবত প্রায়ই দেখতুম আর আশা করতুম যে তোর চিরকুট আসবে বা তুই নিজে আসবি। তার বদলে এসেছে তোর মেসেঞ্জার, একজন চিঠি দিয়ে যায়, তো আরেকজন নিয়ে যায় । ভাগ্যিস ক্লিনিকটা বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতে হল ।
    রাতভোজন এনে, সামনে বসে অমিতকে খাইয়ে, বাথরুম থেকে অমিত হাত ধুয়ে এলে, ইতু বলল, সকলের খাওয়া হয়ে গেছে, তোর আর কিছু চাই ?
    --না, এত করছিস আমার জন্য, না চাইতেই । কাল সকাল-সকাল বেরিয়ে যাবো ।
    --বার-বার অমন যাই-যাই কোরিসনি তো, ইউ ইডিয়ট । কতদিন পর তো এলি । বলেছিলিস সঙ্গে নিয়ে যাবি অথচ প্রতিবার এড়িয়ে যাস, ইউ লায়ার । আমার তো কেমন সন্দেহ হওয়া আরম্ভ হয়েছে । তোর হয়তো কিছুই চাই না, আমার চাই, আমি এবার তোর সঙ্গে যেতে চাই, পালাতে চাই এখান থেকে ।
    --কিন্তু..
    --থাম দিকিনি । ফোটো জ্বালিয়ে এলুম , আর এখন আবার গল্প ফাঁদবার তালে আছিস । তোর কাঁধব্যাগও দেখে নিয়েছি, শুধু একটা লুঙ্গি আর গামছা । জানতুম না যে সিক্রেট কাল্টের মানুষরাও মিথ্যাবাদী হয় । আমি এবার তোর সঙ্গে যাচ্ছিই । ফাইনাল ।
    অমিত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর আত্মগ্লানির মতন করে বলল, সিক্রেট কাল্ট বলে অপমান করিস না প্লিজ, চে গ্বেভারার নাম শুনেছিস ?
    --শুনেছি । বিপ্লবীদের রোমান্টিক মৃত্যু নিয়ে বেশ একটা মুখরোচক রহস্য তৈরি করে ফেলিস তোরা । গুয়েমুতে মরে পড়ে-থাকা স্তালিনকে নিয়ে, কই, তোদের মুখে কিছু শুনতে পাই না । পল পটের বিষয়েও শুনি না। কিম জং উন, কিম জং ইন, কিম জং হিং এটসেটরা, তাদের কথাও তো শুনি না । যাকগে যাক, কী হবে আমার ওসব জেনে ? তোর কাজের অংশীদার করার প্রয়োজন মনে করিসনি আমাকে । আমি যেন তোর ডাকবাক্স । একজন চিঠি দিয়ে যায়, আর আরেকজন এসে নিয়ে যায় । এতই যখন বিশ্বাস করেছিস আমাকে, তো সঙ্গে নিসনি কেন ? এ-বাড়ি ছেড়ে যখন উধাও হয়ে গেলি তখনই তো সঙ্গে নিতে পারতিস ? তোর নিজের বাবা-মাকে খুঁজে পেলি, তবু নিয়ে গেলি না ।
    --চেয়ার রয়েছে তো, বোস না আয়েস করে, গল্প করা যাক ।
    ইতু বিছানার ওপর নিজেকে, তেমনই মনে হল অমিতের, পাথর-চাঁইয়ের মতন ফেলে, বলে উঠল, তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে, চেয়ারে বসলে হবে না । অমিত অনুমান করতে পারেনি ইতু কী করতে চলেছে। ইউ কাওয়ার্ড আহাম্মক, অমিতকে সজোরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল প্রগলভা ইতু ; আঁকড়ে ধরে, ইতু নিজের ঠোঁট অমিতের ঠোঁটে চেপে ধরে রেখেই বলল, তুই হয় আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবি, নয়তো আমি আজকে রাতেই আত্মহত্যা করে তোর আরেকবার উধাও হয়ে যাওয়া ভণ্ডুল করে দেব ।
    --তুই কী করতে চাইছিস বল তো ? দু’জনে এভাবে ধরা পড়ে গিয়েছিলুম বলে, আমাকে তোদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল । এবার দেখে ফেললে ওনারা নির্ঘাত গলাধাক্কা দেবার আগে বেদম পিটুনি দেবেন । বলল উদ্বিগ্নবাক অমিত ।
    --ছাঁচি পেঁয়াজি মারিসনি । ভয়কে কাবু করতে শেখ, স্টুপিড । মার খেলে পালটা মার দিতে শেখ । নিজে তো মা-বাবার আদর-ভালোবাসা খাচ্ছিস । আমার কি ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে না ? জড়িয়ে ধর আমায়, হোল্ড মি ইন ইওর আর্মস, শক্ত করে ধর । প্রেম কর আমার সঙ্গে । জানি আমি প্রায় চটা-ওঠা, তামাটে, নাক-নকশা ভালো নয় । হলেই বা তুই কোনো সিক্রেট কাল্টের জানগুরু, আমিও তো মানুষ, না কি, অ্যাঁ । সাধারণ মানুষের জন্য, দেশের জন্য, কিছু করার কাজে কি আমার কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ? ইতুর নিঃশ্বাসে তাপ । অমিতকে জাপটে বিছানায় শুয়ে ইতু বলল, তোর মনে আছে নিশ্চই তোর মা তোকে ভালোবাসা সম্পর্কে কী বলেছিলেন ? তবে ?
    --অমিত বলল, মায়ের কথায় তো সঠিক উত্তর পাইনি । যতই যাই হোক, কেন মা-বাবা আমাকে, নিজের বাচ্চাকে, ফেলে চলে গিয়েছিলেন, আর কখনও পেছন ফিরে তাকাননি, তার সঠিক উত্তর আজও পাইনি ।
    --অত-শত জানি না, আই অ্যাম নট গ্রেট লাইক দেম ; নিজের আর্জের কথা জানি । অবদমনের মানসিক অশান্তির কথা জানি ।
    --এই বারই এত চাপ দিচ্ছিস কেন, ছমাস আগে তো এরকম বিহেভ করিসনি । আমার জন্যেই তুই সবায়ের দ্বারা অপমানিত হয়েছিলি। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর কার ছবি সামনে রেখে মিষ্টিবিষ্টি করতিস?
    --আহাআআ, আহাআআ, মেয়েদের কোড ওয়র্ডটাও জানিস দেখছি । বেগুন ব্যবহার করতুম, বুঝলি । নারকেল তেলে ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশান হয় না । আর কিছু ? বিব্রত করার চেষ্টা করিসনি । তুই কার ছবি মনে করে মিষ্টিবিষ্টি করতিস ? কোনো ফিল্মস্টারের বোধহয় ?
    --না, একটা বিশেষ অঙ্গ কল্পনা করে নিতুম, যা নেটে দেখেছি । একটু দেখতে দে না ।
    --দ্যাখ, দেখে নে, ইউ বিট্রেয়ার, চোখের জলের আলোয় দেখে নে, ইউ মেনিমুখো কাওয়ার্ড ।
    --মুখ দেবো ? আমার তো সিংহের কালো কেশর গজিয়েছে, দ্যাখ হাত দিয়ে ।
    --তোর চোখের জলে ভিজিয়ে ওখানে মুখ দিবি, হাঁটু গেড়ে বসে । গেট অন ইওর নিজ । কাঁদ, ফোঁপা, তোর ফোঁপানি শুনতে চাই আমি, কাঁদ, কাঁদ, কাঁদ, ইউ আনগ্রেটফুল ডেজার্টার । অমিতের চুল দু’মুঠোয় ধরে বলল ইতু ।
    ঘর্মাক্ত প্রেমের শেষে, প্রস্তুতির জন্য এনে-রাখা ওষুধের বড়ি গলায় ফেলে, বেডসাইড টেবলের গেলাস থেকে জল খেলো ইতু । বলল, ভিতুরা হল লাশের মতন, স্রোতের সঙ্গে ভাসে ; স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরাতে শেখ, তোর অস্তিত্বে প্রাণ আছে কিনা তা প্রমাণ করতে হলে তোকে স্রোতের বিরুদ্ধে ননস্টপ হাত-পা চালিয়ে যেতে হবে।
    --প্রথমবার প্রেম করতে গেলে যে ছড়ে যায়, জানতুম না, আমার ধারণা ছিল মেয়েদেরই ছেঁড়াছিঁড়ি হয়, বলল অমিত ; তারপর যোগ করল, এসেছিলুম এক রাত কাটিয়ে চলে যাবো, এই ভেবে ; তুই কি করলি জানিস? তুই আমাকে আইডেনটিটি দিলি, প্রেমিকের আইডেনটিটি, এ-ছাড়া আমার বলার মতো আত্মপরিচয় নেই । বাবা-মা বিসর্জন দিয়ে চলে গেল, তোদের বাড়ির লোকেরা যৌথ সম্পত্তিতে ভাগ বসাবো ভেবে দত্তক নিল না, পরিবারের অংশ বলে মনে করল না, প্রতি বছর আগের ছাত্রদের বই চেয়ে-চেয়ে পড়ে কোনো রকমে পাশ করতুম, স্কুলও ফালতু তকমা দিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসাতো । বাবা-মাকে যতটা বুঝেছি, ওনাদের কাছে আমি আরও হাজারখানেক কর্মীর একজন, গুরুত্বহীন । ওনারা যেসব তত্ত্বকথা আওড়ান, তা যে আমার জীবনে প্রযোজ্য, সেকথা ভুলে যান । বলতে-বলতে ছলছল-চোখ হয়ে গিয়েছিল অমিতের।
    --তখন কাঁদতে বলেছিলুম, জাস্ট এ মোমেন্টারি রিভেঞ্জ, দ্যাট ওয়াজ এনাফ, আর ধ্যাড়াসনি, প্লিজ । কেন করলুম জানিস, বলল ইতু, তুই এবার আমাকে নিয়ে যেতে বাধ্য হবি । তুই তো কাল্ট মেম্বার, কমিটেড, ডেডিকেটেড, আদর্শবাদী, অ্যান্ড হোয়াটএভার, ফেলে পালাতে তোর দায়বদ্ধ বিবেক বাধা দেবে । আই থিংক সো । আমাকে ধোকা দিয়ে পালাতেও পারবি না, আমি দোতলাতেই জেগে থাকব সারারাত, পাহারা দেব । বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই, তারপর দেখা যাবে ছাড়াছাড়ি এটসেটরা, আই ডোন্ট কেয়ার, আমি একাই এনাফ । আর, গুছিয়ে বলি, তোর প্রাপ্য তোকে দিয়ে দিলুম, পরে দেয়া হয়ে উঠবে কিনা, দেবার সময়-সুযোগ হবে কিনা, তা তো জানি না ।
    --অমন অদ্ভূত সব খুঁতখুতে শব্দ কোথায় পেলি ? না, তোকে ফেলে এবার পালাব না, পালাবার হলে আর আসতুমই না, তোদের বাড়ির গোমড়ামুখগুলো দেখতে ; পাহারা দেবার দরকার নেই, তুই জানিস তোর টান ছিন্ন করতে পারিনি । তুই এবার আমার সঙ্গে যাবি । তোর কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হয়ে গেছে । অকল্পনীয় কষ্টের জীবনে তোকে মানিয়ে নিতে হবে, শারীরিক কষ্টের । হয়ত পানীয় জল নেই, বিজলি বাতি নেই, শোবার ঘরবাড়ি নেই, প্রতিদিন খাবার জোটার সম্ভাবনা কম । পদে-পদে মৃত্যু ওৎ পেতে থাকতে পারে । সময়ে-অসময়ে ডাক্তারি করতে হতে পারে ।
    --বাড়ির কুচুটে নোংরা স্বার্থপর জঙ্গলে বসবাসের পর আমি আফ্রিকার সিংহ আর হায়েনাদের জঙ্গলে গিয়েও থাকতে পারব ।
    --জঙ্গলে নয়, ওরা সাভানার ঘাসভূমিতে থাকে ।
    --হোয়াটএভার, ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি । তোর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতুম ।
    --কেউ কোথাও আমাকে চিনে ফেললে, তুই বলবি তুই আমার সঙ্গী নোস, কোনো একটা জায়গায় যাবার নাম করে বলে দিস বাবা বা কাকার বাড়ি যাচ্ছিস ।
    --সে দেখা যাবে, কপি-পেস্ট সংলাপবাজি করিসনি । যখন অমন বিপদ আসবে তখন তার মোকাবিলা করব । তাছাড়া এটা পাটনা শহর। গয়া, নওয়াদা, সাসারাম, জেহানাবাদ, পালামউ নয় । এই শহরের জাতপ্রথার রাজনীতিকদের খেলা যতটা বুঝি, এখানে তোদের কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয় না ; অবশ্য খুনোখুনি হলে আলাদা কথা ।
    --না, ওই লাইনে ভাবিসনি ।
    --কোথায় যাব আমরা ? প্রশ্নটা এই জন্য করছি যে আমার যাবার সঙ্গে ইলোপ শব্দটা জুড়ে আছে ।
    --তুই যেখানে যাবি সেখানে যারা থাকে তারা মুরিয়া মারিয়া মাড় গোঁড় । দশ-পনেরো বছর আগে পর্যন্ত ওদের যুবতীরা পোশাক দিয়ে বুক ঢাকত না, খালি গায়ে গয়না পরে থাকত । কোনো-কোনো গ্রামে পৌঢ়ারা এখনও খালি গায়ে থাকে, যখন খুব গরম পড়ে । অবশ্য ওদের খুচরো জনবসতিগুলোকে গ্রাম বলা যায় না, এক জায়গায় চাষবাস করে আবার জনবসতি অন্য জায়গায় তুলে নিয়ে যেত, সেখানে গিয়ে এক ঋতু চাষবাস করে আবার অন্য কোথাও বসতি তুলে নিয়ে যেত । ব্রিটিশ গবেষকরা লিখে গেছেন ওদের মাড় শব্দটা নাকি এসেছে বনের আগুন, মানে, পলাশ ফুলের নাম থেকে । আমার তা মনে হয় না, কেননা গাছটাকে তো ওরা পুজো করে না । তার তুলনায় মহুয়াগাছকে শ্রদ্ধা করে ।
    --জঙ্গলমহলে ? ঝাড়খণ্ডের খবরও তো পড়ি কাগজে ।
    --ওয়েস্ট বেঙ্গলে আর ঝাড়খণ্ডে কী গোঁড় বা মাড়িয়া উপজাতির মানুষ থাকে ? আমি যাদের কথা বলছি তারা পশ্চিমবাংলার মানুষ নয় । সিলেবাসের বাইরে একটু-আধটু সাধারণ জ্ঞানের বই-টই পড়তে পারতিস । তুই যাবি দণ্ডকারণ্যের দুর্ভেদ্য, প্রায় দুর্ভেদ্য, জঙ্গলে । অবুঝমাড় ।
    --হ্যাঁ, অবুঝই ছিলাম এতকাল । অবুঝ জীবনে পড়ে-পড়ে মার খেয়েছি । তুই যাবি মানে ? তুই যাচ্ছিস না ? কিন্তু তুই ওরকম ব্লাডি মোরোনদের মতন বসে-বসে পা দোলাসনি ।
    --এই তো বললি যে সাধারণ দুস্হ গরিব মানুষের সেবা করতে চাস । আমার থাকা-না-থাকার সঙ্গে তোর জীবনের উদ্দেশ্যকে কেন জড়াচ্ছিস ? আমার মা-বাবা তো আমাকে এখনও পুরোপুরি জড়ায়নি তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, আলাদা দায়িত্ব দিয়েছেন ! আমি চিরকাল পরিত্যক্ত সন্তান থেকে যাবো, ফর দেয়ার কজ ।
    --আমিও ইনডিপেন্ডেন্টলি কাজ করতে চাই, তোর লেজুড় হবো বলিনি । আমি কারোর লেজুড় হতে চাই না । কিন্তু তুই না থাকলে কী করে জানবো যে কোথায় যেতে হবে, কাদের সেবা করতে হবে ? হোয়াট অ্যাবাউট টাকাকড়ি ?
    --গন্তব্য তো তোর, ঠিকই পৌঁছে যাবি । জানি তুই যথেষ্ট বোল্ড, আউটস্পোকন, সেল্ফ-মেড, এমনকি দুঃসাহসী । নিজেকে প্রয়োগ করে দ্যাখ-ই না । ভারতের এলোমেলো-হেলাফেলা মানুষদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হোক । টাকাকড়ির জন্য সুশান্তজেঠুর দরবারে ঢুঁ মারব ।
    --ওকে, তবে তা-ই হোক । এবার থেকে আমিই আমার গন্তব্য । কারেক্ট, আমার উদ্দেশ্য আমি নিজে । জানি, গন্তব্যের লক্ষ্যে চলতে থাকা জরুরি, চলাটাই সফলতা, লক্ষ্যবস্তুটা নয় । আজ থেকে আমার কাছে যুক্তি আর যুক্তিহীনতার পার্থক্য রইল না । আর তো ভার্জিন থাকার বিড়ম্বনা রইল না যে আগের মতন ওয়ান-ডে প্রেমিকদের দুর্ভাবনায় সিঁটিয়ে থাকবো ।
    ঘুমোতে যাবার আগে ইতু ড্রয়ার থেকে কাপড় কাটার কাঁচি এনে বলল, আমার আকর্ষণের কেন্দ্র বা ভ্যানিটি, যা-ই বল, তা হল আমার চুল, তুই তো জানিস, এই নে , ঘাড়ের কাছ থেকে ঘ্যাঁচাৎ করে কেটে দে দিকিনি ।
    --ভ্যানিটি ? আকর্ষণের কেন্দ্র ? তা তোর সুরাহিদার গর্দন, ভারি পাছা আর নিটোল বুক ।
    --শাট আপ, চাপলুসি করিসনি । হ্যাঁ, আমার বুক সম্পর্কে আমার গর্ব আছে । কিন্তু ওগুলো তো আর কেটে বাদ দিতে পারি না । চুল কেটে দিতে বলছি, কাট, এই নে ।
    --এরকম দীর্ঘ চুল, পুরো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আ্ছে, তাকে বাদ দিয়ে দিতে চাইছিস ?
    --হ্যাঁ, জাস্ট ডু ইট, কেটে ফ্যাল, এত বড়ো চুল বয়ে বেড়ানো যায় না । আমিও আর আয়নার মুখ দেখতে চাই না । যাদের মাঝে বড়ো হয়েছি, তাদেরই যদি বাদ দিতে পারি, তাহলে চুলটুকু কেন বাদ দিতে পারব না ?
    চুল কাটতে গিয়ে অমিতের নজরে পড়ল মাথার শিয়রে স্যাঁতসেতে দেয়ালে সেলোটেপ দিয়ে একটা ইংরেজি পোস্টার লাগানো, ফ্যাকাশে, পুরোনো, ছেঁড়া । রঙিন হরফে লাইনের তলায় লাইন উদ্ধৃতি । চুল কাটার শেষে লাইনগুলো জোরে পড়ে ফেলছিল, ইতু বলল, মনে-মনে পড়, ওটা ডাকবাংলো রোডের ফুটপাথ থেকে কিনে এনেছিলুম । বেশ ভালো, না ? অমিত অনুবাদ করে পড়ল :
    “কখনও নিজেকে গুরুত্বহীন মনে করবেন না
    কখনও উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন করবেন না
    কখনও সদর্থক দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন না
    কখনও শরীরে আরামের শিকড় গজাতে দেবেন না
    কখনও নিজেকে অক্ষম মনে করবেন না
    কখনও অসন্তোষে আপ্লুত হয়ে নিজের সঙ্গে মনে-মনে কথা কইবেন না
    কখনও আত্মাভিমান বর্জন করবেন না
    আনন্দের মুহূর্ত ছোট্ট হলেইবা তাকে সযত্নে উপভোগ করুন”
    চুলের কাটা গোছাটা ইতুর হাতে দিয়ে অমিত ইতুর মুখের দিকে অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ে তাকাতে, ইতু বলল, হ্যাঁ, জানি, আমার মুখময় ওই কথাগুলো লেখা আছে, বহুকাল, পাঁচ বছরের বেশি, লেখা আছে, মগজে গেঁথে গেছে ইন ফ্যাক্ট । এতক্ষণে বোধহয় তুই আমার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলি । ভাগ্যিস চুলটা কাটতে বলেছিলুম, নয়তো ওদিকে তোর চোখ যেত না ।
    রাত দুটোয় তিনতলার ঘর থেকে নেমে দোতলার বারান্দায় ইতুর বিছানায় অমিত মশারি তুলে ঢুকতে গেলে, ইতু বলল, তুই যে আসবি জানতুম, তোর ভয়কে যে কাবু করতে পারলি, দ্যাখ, আমার কাছে নেমে আসাই তার প্রমাণ, আরো বড়ো প্রমাণ যে তুই জামাকাপড় খুলেই নেমে এসেছিস । তোর কাওয়ার্ডাইস থেকে তোকে বের করে আনার জন্য আমাকে কী করতে হল, ভেবে দেখেছিস ? তুই আসবি জানতুম বলে আমিও শাড়ি-টাড়ি খুলে শুয়েছিলুম । দাঁড়া, এই খাটে আওয়াজ হয়, নিচের তলায় শোনা যায় । তিনতলার ছাদে চল, খোলা আকাশের তলায় শাড়ি পেতে সুহাগ-রাত করব । দ্বিতীয়বার আকুতিময় শ্বাসের ঘনঘটা আর স্পন্দনের লেনদেন শেষ হলে ইতু ওর দোতলার বিছানায় ফিরে যেতে যেতে বলল, স্কাউন্ড্রেল, কি তোড়ু লাভমেকিং করলি, বুকে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিস, হারামি কোথাকার ; তূরীয়-মুহূর্তে সিংহরা সিংহীর মাথায় দাঁত বসায়, বুকে নয় ।
    ভোরবেলা বাড়ির লোকেরা জাগবার আগেই সদরের ছিটকিনি আলতো খুলে বেরিয়ে পড়েছিল দুজনে । কাঁধের ঝোলায় স্টেথোস্কোপ, মশার কামড়ের প্রতিষেধক মলম, কয়েকটা জরুরি ওষুধ, এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন, গামছা , পেনসিল টর্চ, এক সেট ডেনিম ট্রাউজার আর কটন-টপ পুরে নিয়েছিল ইতু ; পায়ে জগিং করার কেডস । রাতের নোংরা হয়ে যাওয়া শাড়ি-শায়া আর চুলের গোছা দোতলার বিছানার ওপর ফেলে রেখে গেল, যাতে বাড়ির সদস্যরা আঁচ করতে পারেন যে ওরা দুজনে ষড় করে বাড়ি থেকে পালিয়েছে ।
    জানার পর আর ওনারা ইতুর খোঁজ করবেন না, জানে ইতু ।
    ইতুর পালানোর চাটনি-রসালো সংবাদ বাড়ির সদস্যরা শুনলেন কাজের বউয়ের মুখে । সকালে দরোজা খোলা পেয়ে সে অনুমান করেছিল যে বড়কর্তা প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে থাকবেন । তিনতলার ছাদে ইতুর ঘর থেকেই ঝ্যাঁটানো আর পোঁছা আরম্ভ করে । দেখলো ইতুদি বিছানা তোলেনি, দোতলাতেও আসার সময়ে দেখে এসেছে খাটের ওপর বিছানা গোটানো নেই, তার বদলে পড়ে আছে ইতুদির শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ । আর অনেকখানি চুল, দেখলেই বোঝা যায় ইতুদিদির চুল, বাড়িতে আর কারোর চুলই অমন কোঁকড়া আর লম্বা নয় । শাড়ি তুলে তাতে অতিপরিচিত আঠা দেখে, নাকের কাছে এনে মোহক গন্ধে আতঙ্কিত হয়ে উঠল বিহারি কাজের ব্‌উ রুকমিনি ।
    কাজের বউয়ের হাঁক, ইতুদিদি বিছৌনা তোলোনি কেন আজকে, ঘরে বসে খেয়েছ, বাসনও ফেলে রেখেছ, কলতলায় নিয়ে গিয়ে রাখেনি, ইতুদিদি, ইতুদিদি..
    বাড়ির মেজবুড়োর কন্ঠস্বর শোনা গেল, ইতু ওপরেই আছে দ্যাখ, দোতলায় এখনও মশারি ফেলে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ডেকে তোল । ইতুর ঘরে একজন অতিথি আছে, টয়লেটে গিয়ে থাকবে, অমিত, আমাদের বাড়িতে থাকত আগে, তুই বোধহয় দেখিসনি, সৌদামিনী কাজ করত তখন ।
    রুকমিনি টয়লেটে-বাথরুমে ঢুঁ মেরে দেখল ফাঁকা, কেউই নেই । চেঁচিয়ে বলল, কেউ নেই, অতিথিও নেই, দোতলার বিছানায় ইতুদিদিও নেই । শাড়ি-শায়া-বেলাউজ পড়ে আছে, সঙ্গে ওনার কাটা চুল ।
    রুকমিনির হাঁকডাকে, যে হাঁকডাকে শাড়ি-শায়ায় আঠামাখা গন্ধের প্রচ্ছন্ন আহ্লাদ ছিল, শুনে, বাড়ির অধিকাংশ সদস্য, বৃদ্ধরা ছাড়া, দৌড়ে প্রথমে দোতলার বিছানায় দোমড়ানো শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ-চুলের গোছা আর তারপর তিনতলায় পৌঁছোলে, রুকমিনি পান-খাওয়া দাঁতে হাসি মাখিয়ে যখন বলল যে বাড়ির সদর দরজা খোলা ছিল, তখন সকলে ঠাহর করতে পারল যে ইতু অতিথির সঙ্গে উধাও হয়েছে ।
    --বিয়ে দিলে না তোমরা সময় মতন, পালাবে না তো কি করবে ? বললেন সেজকর্তার গোলগাল ভারিভরকম স্ত্রী, সাতসকালে ওজনদার শরীর নিয়ে বাতের ব্যথা সত্ত্বেও তিনতলায় হাঁটু ভেঙে উঠতে হয়েছে বলে যিনি ক্লান্ত, হাঁপাচ্ছিলেন ।
    --অমিতের সঙ্গে ওদের সম্বন্ধটা করে ফেললেই হতো, তোমরাই অযথা ছেলেটার মা-বাবার সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে মেয়েটার জীবন গোলমাল করে দিলে । সুযোগ পেয়ে বলে নিলেন রাঙাকাকি । ওরা ভাইবোন নাকি ? তোমরা ভাইবোন-ভাইবোন আওড়াতে লাগলে । এখন হল তো সেই-ই ।
    --যাক ভালোই হল একদিক থেকে, দায়িত্বটা বড় খচখচ করত এদান্তি । বললেন মেজকর্তা ।
    মেজকর্তার দুই যমজ নাতি, পাঁচে পড়েছে সবে, যাদের মা, মানে মেজকর্তার বড় ছেলের স্ত্রী, ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে, নাতিরা একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, ঘরটা আমরা নেবো, আমাদের নিজেদের ঘর নেই, পড়াশোনার ডিসটার্বেন্স হয়, একতলার বারান্দায় বড্ড চেঁচামেচি করে সবাই ।
    --পড়াশুনোর নামে নিজেদের ঘর মানে তো দেয়ালে সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে জেনিফার লোপেজ. লেডি গাগা আর কাটরিনা কাইফের ব্লোআপ, সৌরভের হাফ-টেকো পোস্টারটা বদলে ফেলিস, এখন ওর মাথায় আবার চুল গজিয়েছে । বললে দুই খোকাটে নাতির বাবা, পরোক্ষে তাদের দাবির সমর্থনে । দুই নাতির দিকে তাকিয়ে মুখে পানপরাগি-হাসি খেলালো রুকমিনি ।
    ইতুর পলায়নে তৃপ্ত অভিভাবকরা সিঁড়ির ধাপে চোখ রেখে, এক-পা দু-পা করে নেমে চলে গেলেন যে যার ঘরে । নাতি দুজন তিনতলার ছাদের ঘরে ঢুকে ইতুর আর ইতুর আগে ওদের বাবার চাকরানি-প্রেমী যৌনতার স্মৃতিকে নিশ্চিহ্ণ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।
    --চুলটা আমি নিচ্ছি , খোঁপার ভেতরে ঢুকিয়ে বানখোঁপা বাঁধলে বেশ ভালো দেখাবে । নেবো তো ? জিগ্যেস করল রুকমিনি, নেমে যেতে থাকা সিঁড়ির উদ্দেশ্যে ।
    --নিয়ে নে, বিছানার ওপর যা শাড়ি-টাড়ি আছে সেগুলোও যাবার সময় নিয়ে যাস ।
    --আর যেগুলো ইতুদিদির আলমারিতে আছে ?
    --নিয়ে যাস সময় করে, কিন্তু গিটারটা নিসনি যেন, ওটা নবনীতার, ফাইনাল ঝগড়া করবে বলে রেখে গেছে । জবাব দিল নামতে-থাকা সিঁড়ি ।
    রুকমিনিকে রাখা হয়েছে তার আগের কাজের বউ সৌদামিনির সঙ্গে দুই নাতির বাবা সমরেন্দ্রর আঠালো সম্পর্ক ধরা পড়ে যাবার পর । সৌদামিনির সঙ্গে দুপুরে বিছানায়, ওদেরই বিছানায়, দুই নাতি তখন শিশু, সমরেন্দ্র রঙ্গিলা-রতির ম্যাটিনি শো করছিল । শিশুদের দেখাশোনার জন্যই রাখা হয়েছিল সৌদামিনীকে, যার বর আরেকটা বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে গেছে হরিয়ানার খেত-খলিহানে কাজ করতে । সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা অনুমান করেছিল যে কিছু একটা গোলমাল চলছে, কেননা যখনই সৌদামিনীকে বকুনি দেয় নবনীতা, তখনই সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে সমরেন্দ্র ঝগড়া করত নবনীতার সঙ্গে । একবার তো নবনীতার গালে চড় কষিয়ে দিয়েছিল সমরেন্দ্র, শিশু দুটোর কান্না সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে শুনে অফিসের পোশাকেই সোজা তিন তলার ছাদের ঘরে পৌঁছে দ্যাখে বাচ্চা দুটো গুয়েমুতে মাখামাখি । যে ডায়াপার নবনীতা পরিয়ে গিয়েছিল, দুটো বাচ্চাই সেগুলো পরে আছে, আলগা ডায়াপারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে গুয়ের স্রোত ।
    নবনীতা সৌদামিনিকে বকুনি দিতে, বুকে কাপড় চেপে ও সমরেন্দ্রর দিকে চোখ কুঁচকে তাকালে, সমরেন্দ্র সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল, কত কাজ করবে ও, সারা বাড়ির ফাই ফরমাস, তারপর দু-দুটো বাচ্চা সামলানো ।
    --ও, কাজের বউ তার মালিকের মুখ নিজের বুকে গুঁজে খাটছিল, তাই না ? দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল নবনীতা।
    --ও তুমি বুঝবে না, যাদের হৃদয় বড়ো হয় তাদের বুকের মাপও বড়ো হয় । সমরেন্দ্রর উত্তর ।
    --হৃদয় বড়ো না ছোটো তা বিয়ের আগে তো আন্দাজ করে থাকবে ?
    --তখন তো দেখে মনে হয়েছিল হৃদয় যথেষ্ট বড়ো । তা যে নকল কী করে জানব ?
    --নকল হৃদয়ের সুধারস পান করার সময় তো উচ্ছ্বসিত হতে ।
    হাঁ করে তাকিয়ে থাকা সৌদামিনীকে বুঝিয়েছিল সমরেন্দ্র, হৃদয় মতলব দিল, যিস অওরতকা দিল জিতনা বড়া, উস অওরতকা ছাতি ভি উতনাহি বড়া হোতা হ্যায় ।
    সমরেন্দ্র যখন ডিউটি আওয়ার্স পালটে রাতের শিফট নিল, সন্দেহে জারিত নবনীতা সেদিনই নির্ণয় নিয়েছিল যে ব্যাপারটাকে এবার ট্যাকল করতেই হবে । একদিন অফিস যাবার নাম করে অফিসে না গিয়ে বন্ধুদের বাড়িতে সময় কাটিয়ে দুপুর বারোটা নাগাদ পা টিপে-টিপে ওপরে উঠে দরোজা আলতো ফাঁক করে দ্যাখে সৌদামিনি আর সমরেন্দ্র দুজনে উলঙ্গ হয়ে ঘুমোচ্ছে বিছানায় । তিনতলার ছাদে কেউ আসে না ভেবে ওরা দুজনে বেপরোয়া হয়ে গিয়ে থাকবে, তাই দরোজা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেনি ।
    বড়জেঠি আর রাঙাকাকিকে চুপচাপ ডেকে এনে, দরোজা ঠেলে, সৌদামিনী পর্বের শেষ দৃশ্যের অভিনয় নবনীতা দেখিয়ে দিয়েছিল ওনাদের । তাৎক্ষণিক ঝগড়া, বড়ো-হৃদয়ের প্রাপ্তি সম্পর্কিত বুকের আদল, ইত্যাদি প্রগাঢ় মন্তব্য । তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে নবনীতা সোজা বাপের বাড়ি, কয়েকদিন পর ডিভোর্সের নোটিস, ব্যাস। সমরেন্দ্র চালান হল দুই শিশুর সঙ্গে একতলায়, কেননা শিশুদের দেখাশোনা যাঁরা করবেন তাঁদের একতলা-তিনতলা করার ক্ষমতা ছিল না ।
    ইতু পেয়ে গেল ঘরটা । রুকমিনি পেয়ে গেল চাকরি ।
    সমরেন্দ্র আর বিয়ে করেনি । এখনও নাইট ডিউটি করে । দুপুরে বেরিয়ে যায় খেয়েদেয়ে, যেখানে যায় সেখান থেকেই নাইট ডিউটি করতে চলে যায় । বাড়ির সবাই জানে কোথায় যায় । রুকমিনি পেছন-পেছন গিয়ে দেখে এসেছে, সৌদামিনীর বস্তির ঘরে ঢুকছে সমরেন্দ্র । সৌদামিনীর তিন মাসের বাচ্চাটা যে সমরেন্দ্রর তাতে কোনো সন্দেহ নেই, অত চেকনাই-মার্কা বাচ্চা কী করেই বা হবে ! সৌদামিনী সাঁওলা ওর পালিয়ে-যাওয়া বর কালো । বাচ্চা চেকনাই-মার্কা বলে সৌদামিনীর কত গর্ব, রুকমিনিকে বলেছিল, এরকম খোকা-বাচ্চা তোর কোনো কালেই হবে না ; পারিস তো করে দ্যাখা । অটোতে বসিয়ে সৌদামিনীকে কুর্জি হোলো ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সমরেন্দ্র, বাচ্চা হবার সময়ে, ফর্মে বাপের জায়গায় নিজের নামই লিখেছে, রুকমিনিকে জানিয়েছে সৌদামিনী, নিজের স্কুটারের পেছনে বসিয়ে পোলিও ড্রপস খাওয়াতে, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায় ওর বাংগালি আদমি, সাচ্চা দিলওয়ালা ।
    সমরবাবু বাচ্চাটার খাওয়াপরার খরচ দ্যায় আর বলেছে বড়ো হলে ওকে ভালো আংরেজি স্কুলে পড়াবে ।
    --কী করে শুরু হল তোদের প্যার-মোহোব্বত ? জানতে চেয়েছিল রুকমিনি ।
    --বাচ্চা দুটো একদিন ভিষণ কাঁদছিল, একেবারেই চুপ করছিল না, কী করব ভেবে পাচ্ছিলুম না, তো সমরবাবু বলল, তোর দুই বুকে বাচ্চা দুটোর মুখ গুঁজে দে না, তোর বুক তো নবনীতা মেমসাবের চেয়ে বড়-বড় । আমি বললুম আমার বুকে তো দুধ নেই, ওরা কি হাওয়া খেয়ে চুপ করবে ? জবাবে সমরবাবু বললে, বাচ্চারা যেভাবে চুষিকাঠি চুষে ঘুমিয়ে পড়ে, তুই ওদের মুখে তোর বুক গুঁজে দ্যাখ চুপ করে যাবে, ঘুমিয়েও পড়বে । সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল বাচ্চা দুটো । সমরবাবু আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল । আমি বললুম, আমি রোজ-রোজ একাজ করতে পারব না । সমরবাবু জিগ্যেস করল, কেন, তোর অসুবিধা কিসের । আমি বললুম, বাচ্চারা আমার বুক চুষলে গা থিরথিরিয়ে যায়, মনে হয় কাউকে জড়িয়ে ধরি । তা সমরবাবু তক্ষুনি আমায় জড়িয়ে ধরলে পেছন থেকে আর বললে, যখনই তোর শরীর থিরথিরোবে, আমাকে বলবি, আমি শান্ত করে দেব । তারপর তো সমরবাবু দিনের বেলার অফিসের ডিউটিকে রাতের ডিউটি করে নিলে, আমরা দুজনে মিলে বাচ্চা দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে, নবনীতা দিদির বিছানায় শুয়ে পড়তুম । কত রকম ভাবে প্যার-মোহোব্বত করতে পারে সমরবাবু ; কাঁইচিমার মোহোব্বত করতে শিখিয়েছে । চুল ওঠাবার কিরিম, বগলের পাউডার, বুকের কিরিম, গায়ে গন্ধমাখার গ্যাসের টিন, শ্যাম্পু, লিসটিপ, প্যার-মোহোব্বত করতে গেলে এসব জিনিস কত দরকার তা সমরবাবুর চেয়ে ভালো কেউ জানে না । নবনীতা দিদি জানবার পর আমাকে যখন বকুনি দিচ্ছিল, সমরবাবু নবনীতাকে গালে কষে দিয়েছে এক থাপ্পড়, এইসান, ধাঁয় । ওনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, আমি সমরবাবুকে পেয়ে গেলুম, এখন আমি ডবল মাইনে পাই, কাজও করতে হয় না ।
    ডিভোর্স দেয়া সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা এখন নিজের মারুতি গাড়ি চেপে অফিস যায়, নিজে চালায় । বলেছে, যাদের বাড়ির পদবি নিয়ে বাচ্চা দুটো জন্মেছে, তারাই মানুষ করুক । সৌদামিনীকে স্কুটারে পেছনে বসিয়ে, রাজপথে নবনীতার গাড়ি দেখতে পেলে, তার পাশাপাশি চালায় সমরেন্দ্র । নবনীতার দিকে বাচ্চাটাকে তুলে দেখিয়েছে সৌদামিনী, বত্রিশপাটি হাসি ফুটিয়ে । সেই ঘটনার পর, আইনত নিষিদ্ধ হলেও, গাড়ির কাচে কালচে সানফিল্ম লাগিয়েছে নবনীতা ।

    আট
    ইতুকে দেখে অবাক হননি সুশান্ত ঘোষ, কেননা ইতু বাসে বসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে গর্দানিবাগের বাড়িতে অমিত বর্মণ এসেছে আর ও আজকেই অমিতের সঙ্গে পালাচ্ছে, সুশান্তজেঠুর বাড়িতে যাবে, বাসস্ট্যাণ্ডে সুশান্তজেঠু যেন ওদের নিতে আসেন । তার আগে সুশান্তর বড়জেঠি, মানে ইতুর বটঠাকুমা, ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, দ্যাখ ইতু আর তোর ছেলেবেলাকার বন্ধু অতনুর ছেলে অমিত তোর বাড়ি পৌঁছোল বলে, এখানে হইচই ফেলে চলে গেছে, যা করেছে একশবার ভালো করেছে, ওদের মুখেই শুনিস ।
    বাসস্ট্যাণ্ডে বোলেরো নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সুশান্ত ঘোষ। দিয়ারায় পৌঁছে, পটলের পাহাড়, তরমুজ-শসা-ফুটির ডাঁই দেখে ইতু বলল, এ তো বেশ ভালো জায়গা গো, ভিলেজ-ভিলেজ টাইপ, যেমন টিভিতে দেখি । দিনকতক থেকে গেলে হয়না এখানে ?
    --না না, প্রায় আঁৎকে বলে উঠল অমিত, যত তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যায় ততই সবায়ের মঙ্গল ।
    --ঠিক আছে, যাসখন, কালকে সকালে তোদের জন্যে নৌকো করে দেব । আজকে রেস্ট নিয়ে নে । আমরা কি খাই কোথায় শুই এসব দেখে যা । আমাদের জীবন কম রঙিন নয় । আমার বউ, শশুর, শাশুড়ির সঙ্গে আগে পরিচয় করিয়ে দিই তোদের ।
    --হ্যাঁ, আমি তো আজ পর্যন্ত তোমার শশুরমশায়কে দেখিনি, শুনেছি যে উনি গর্দানিবাগের বাড়িতে এসে তোমাকে ফেরত দেবার জন্য দশ লাখ টাকা চেয়েছিলেন ।
    --উনি যখন জেঠা-বাবা-কাকার কাছে র‌্যানসাম চাইতে গিয়েছিলেন, তার আগেই বেবির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। উনি জানতেন যে বাবা-জেঠারা ফোতো-বড়োলোক, আর দশ লাখ টাকা দেবার মতো ক্ষমতা বাবা আর জেঠাদের নেই ।
    অমিত বলল, তোমার লাইফটা আনবিলিভেবল । অ্যাডভেঞ্চারস ।
    --এখানে এসে টের পাচ্ছি গো, কী ধরনের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছ নিজের জীবনে । ইতু বলেছিল ।
    সুশান্ত, এই যে আমার বউ বেবি, বলতে, একজন ঢ্যাঙা কালচে কৃশতনু যুবতী, দেখলেই বোঝা যায় সাজগোজ করে পারফিউম মেখে এলো, অমিত আর ইতুর পায়ে দুহাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল । সুশান্তর বউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করল ইতু, কেঁপে-কেঁপে কাঁদতে লাগল । ইতু বলল, হিন্দিতে, তুমি আমাদের পায়ে হাত দিচ্ছ কেন ? বয়সে তুমি আমাদের বড়ো, তুমি তো আমার জেঠিমা হও ।
    বেবি : এই প্রথম শশুরবাড়ির লোক আমাদের বাড়ি এলো । শশুর শাশুড়িকে তো দেখিনি ; তাদের প্রণাম তোমাদের পায়ে রাখলুম ।
    সুশান্তর শশুর তারিণী মণ্ডল আর শাশুড়ি মন্হরা দেবী ইতুদের আসার খবর পেয়ে হাজির হলে, ছফিটের ঋজু পালোয়ানি কালো তারিণী মণ্ডলকে দেখে ইতু বলে ফেলল, তোমার শশুর তো একেবারে কোমোডো ড্র্যাগন গো, সেরকমই জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছেন । বলে ফেলে, বলল, সরি , ওনাকে দেখে বেফাঁস বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।
    --বেফাঁস বেরোয়নি, উত্তর দিল সুশান্ত, তারপর যোগ করল, ইতু তোর অবচেতনে ওনার সম্পর্কে যে ভীতি জমে আছে তা থেকেই বেরিয়ে এলো কোমোডো ড্র্যাগনটা । ঘাবড়াসনি, উনি কোনো ড্র্যাগনের কথাই জানেন না, নিজেকে ছাড়া ।
    তারিণী মণ্ডলের শাশুড়ি বলল, এতদিন পরে আত্মীয়দের সঙ্গে জামাইবাবার খাঁটি বাংলায় কথা বলার সুযোগ হল । বলে নাও, বলে নাও, তারপর আমাদের পালা । অমিত-ইতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার নাতিও বাংলা, আংরেজি, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলি বলতে পারে ।
    তারিণী মণ্ডল গমগমে কন্ঠস্বরে গর্ব ঝরিয়ে বলল, আমার নাতি বাংলা বলতে, লিখতে আর পড়তে পারে। ইংলিশে কথা বলতে পারে, একদম আংরেজ পলটন জইসন ।
    বেবির প্রশ্নাতুর ভ্রু দেখে অমিতের মনে হল, এনারা বোধহয় প্রণাম বা নমস্কার আশা করছেন ওদের তরফ থেকে ; বেবি এসেই ঝপ করে দুজনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে । ইতু নির্ঘাত প্রণাম করতে চাইছে না, হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করতেও ওর বাধো-বাধো ঠেকবে, একে বিহারি তায় আবার শিডুলড কাস্ট, হয়ত জীবনে কোনো বিহারির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেনি । হাতজোড় করে নমস্কার করাটাও বিসদৃশ । অমিত আচমকা সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুঠো পাকিয়ে নির্বাক রেড স্যালুট দিল সুশান্তর শশুর-শাশুড়িকে । দেখাদেখি ইতুও তাই করল ।
    তারিণী মণ্ডল বলল, চাবস চাবস, এই তো চাই, নেতাজির মতন স্যালুট দেবে, বলে, সুভাষচন্দ্র বসুর নাম উচ্চারিত হলেই যা করে থাকে, উরুতে চাপড় মেরে বিব্রত করল নিজের জামাই আর তার অতিথিদের । মন্হরা দেবী বেবিকে হুকুম দিল, এই বেবি, আজকে ওদের জন্য একটা কচি শুয়োর কাটতে বল, গরম-গরম শুয়োরের মাংস আর পুদিনার চাটনি দিয়ে ভুট্টার রুটি খেয়ে যাক ।
    শুয়োরের মাংস খেতে হবে শুনে অমিতের কব্জি আঁকড়ে ফেলেছিল ইতু । অমিত ফিসফিস করে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে হয়ত মহুয়ার রুটি আর ভাল্লুকের মাংস খেতে হতে পারে । পরে, নৌকোয় করে যাবার সময়ে, ছইয়ের ভেতরে বসে, নদীর ছলাৎছলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অমিত গল্প করেছিল মুরিয়া, মাড়িয়া, গোঁড় উপজাতিদের জীবন নিয়ে । অবুঝমাড়ের পাহাড়ি মানুষদের বিভিন্ন গোষ্ঠীদেবতা আছে । নাগবংশ, যারা কেউটে সাপের পুজো করে বলে কোনো সাপ খায় না, মরা সাপ দেখতে পেলে সেদিন শোক পালন করে গোষ্ঠীর সবাই । তেমনই আছে কাছিমবংশ, বকরাবংশ, বাঘবংশ, আর বোধমিকবংশ, মানে মাছের বংশ ।
    --হ্যাঁ, তাহলে আজকে থেকে অভ্যাস করে নিই । বমি পায় পাক, বমি করতে-করতে তো পোয়াতিরাও অভ্যস্ত হয়ে যায় ; প্রসবের অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে বারবার বাচ্চার জন্ম দেয় । ইতু বলল ফিসফিসিয়ে । শুয়োরের মাংস তবু খেলো না ইতু, বলল, এখন পারছি না, ক্রমশ অভ্যাস করব । সুশান্তর ঘরে খেতে বসে বেবির দেয়া সিম আর ফুলকপির আচার দিয়ে মকাইয়ের রুটি খেলো । বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের বডি পারফিউম দেখে ইতু বলল, তুমিও তো তোমার এই জীবনে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারোনি দেখছি ।
    বেবি : ওই সব গ্যাসগুলো নাআআআ ? ফিকফিকে দাঁতে বলল বেবি, ডেওডেরেন্টের দিকে তাকিয়ে ইতুকে কথা বলতে দেখে, ওই গ্যাস আমার গায়ে না মারলে আমার ঘুম আসে না ।
    ইতু : কার ঘুম আসে না ? তোমার না আমার জেঠুর ?
    বেবি : আমাদের দুজনেরই । তুমি নিয়ে যাও না কয়েকটা গ্যাস, বেশ ভালো লাগবে । দুজনে ঘুমোতে পারবে ।
    --আর ওই কসমেটিকসগুলো ? বউকে তো হাল ফ্যাশানের সাজগোজের জিনিস কিনে দাও দেখছি, বলল ইতু ।
    --আমি কিনে দিই না, বেবি টিভিতে দ্যাখে আর কিনতে লোক পাঠায় । বলল সুশান্ত, শুয়োর মাংসের বড়ার ঢেঁকুর তুলে ।
    --সুশান্তজেঠু তোমার কাছে যদি থাকে তো তুমি ইতুকে মশা থেকে বাঁচার ক্রিম দিতে পারো, গিয়েই হয়তো অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না । অমিতের প্রস্তাব ।
    --আমি নিয়ে নিয়েছি সঙ্গে, কোথায় থাকবো শোবো কিছুই তো জানি না, প্রথম-প্রথম লাগবে । ওষুধ-বিষুধও নিয়েছি ।
    --অ্যালোপ্যাথিক ? প্রশ্ন করল অমিত ।
    --হ্যাঁ, হারবাল মেডিসিন তোদের চারপাশ থেকে যোগাড় করে নেব ।
    --তোর দলের ডাক্তারের অভাব পুরণ করে দিল ইতু। বলল সুশান্ত ।
    --তোমার ছেলের নাম কি গো, গর্দানিবাগে তোমরা যখন এসেছিলে, আমি ছিলুম না ? জানতে চাইল অমিত ।
    --অপু, সুশান্ত বলার আগেই জবাব দিল ইতু ।
    --ওর নাম আপ্রাধি ঘোষ, বলল বেবি, অপু আর নাম এই শব্দ দুটো থেকে প্রশ্নটা অনুমান করে ।
    সুশান্ত বলল, সামান্য হেসে, বেবি টের পাবে না এমন করে, ওর দাদুর মতে মহাকবি বাল্মিকী ছিলেন ওনার মতনই অপরাধী, তিনি যদি পূজিত হন, তাহলে কারোর নাম অপরাধী হলে সে পূজিত হবে না কেন । এরা সবাই জানে যে আমার ছেলের নাম আপ্রাধি : আমি স্কুলে ওকে অশ্বমেধ নামে ভর্তি করেছি, স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট, বি এ পাশের ডিগ্রিতে আমার দেয়া নামটাই আছে । ছেলেকে বলা আছে যে এ-কথা এনাদের কাছে ফাঁস করার প্রয়োজন নেই, ওনারা যে নামে ডাকতে চান ডাকুন, পরিচয় করাতে চান, করুন ।
    --তুমি কিন্তু একেবারে বদলে গেছ, তাই না, উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বাড়ি ছেড়ে ? অমিতকে বলল সুশান্ত । ইতুর কাছে শুনলুম এন জি ওতে ঢুকে দেশোদ্ধারের কাজ নিয়েছ।
    --দেশোদ্ধার ? এই দেশের ব্যবস্হাকে আমূল উপড়ে না ফেললে, কারোর উদ্ধার হবে না । বাবার আওড়ানো বুলিকে, প্রয়োগ করল অমিত, তারপর বলল, তুমিও তো অন্যমানুষ হয়ে গেছ , দেখে মনে হচ্ছে, নিজের মতন করে শোষণের বিরুদ্ধে লড়ছ ।
    --না আমি সেই লোকটাই আছি, কেবল অভ্যাসগুলো পালটেছে । টাকাকড়ি করার লোভ ছিল, তা করেছি, আয়েস করার লোভ ছিল তা করছি । মানুষের ওপর আধিপত্যের নেশাই আলাদা, ও তুমি বুঝবে না, কারোর বিরুদ্ধেই লড়ছি না ; আর শোষণের বিরুদ্ধে ? কই ? বরং শোষকের সিংহাসনে বসে পড়েছি হে । শোষিতরা শোষকের আনন্দের মজা বুঝতে পারে না । ধার্মিক গুরুদের দেখেছ তো ? অনেকটা সেরকম । নিজেকে নিঃশব্দে বললেন, আমি আমার বিরুদ্ধে লড়ছি ।
    --ঈশ্বরে বিশ্বাস এটসেটরা হিন্দুগিরি করছ নাকি, চারিপাশে তাকিয়ে টের পাচ্ছি । রসুন, পেঁয়াজ, আদাবাটা, বেসন মাখানো, হামান দিস্তেতে থেঁতো করা শুয়োরের মাংসের বড়ে খেতে-খেতে বলল অমিত ।
    --ইসওয়র নাআআআআ ? ছট পুজা করতে হ্যাঁয় ইনকে খাতির, বলে, সুশান্তর দিকে ইঙ্গিত করল বেবি ; আপ ভি কিজিয়েগা ইতু দিদি, আপকে আদমি কা লমবিইইইই জিন্দগি কে লিয়ে ।
    --ঈশ্বর ? ইউ মিন গড ? ইয়েস, গড ইজ ওমনিকমপিটেন্ট ওমনিপ্রেজেন্ট । আই অ্যাম গোইং টু গেট হিম ইরেজড ওয়ান ডে, ওনার অবসান পৃথিবীতে অবধারিত । বক্তব্য রাখতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন সুশান্ত ।
    --বদলাওনি দেখছি, বলল ইতু, আগে গর্দানিবাগের বাড়িতে যেমন বলতে, তেমন ধরনের কথাই বলছ, ভগবানের ওপর বেশ চটে আছ, তাই না ? এখন আর কি, এখন তো তুমিই-ই ভক্তের ভগবান, দেখতেই পাচ্ছি এসে অব্দি ।
    --হ্যাঁ, শুধু ঈশ্বর বদলে-বদলে যেতে থাকে । তারপর জিগ্যেস করলেন, আমার আর অতনুর বন্ধুবান্ধব, যেমন অরিন্দম মুখার্জি , মৌলিনাথ, মাহমুদ জোহের, এরিক পেজ, মলয় রায়চৌধুরী, ওদের খবর জানিস নাকি ইতু ? দেখা-সাক্ষাৎ হয় ? সবাই বুড়ো হয়ে গিয়ে থাকবে বোধহয় ; আমিই কেবল যুবক থেকে গেলুম, বেবি আর বেবির বাবা-মায়ের খাঁচার খাবার-পানীয় সেঁটে ।
    --তোমাদের অফিসের শ্যামলী কর্মকারকে মনে আছে ? যার পিঠে শিরদাঁড়ার দুপাশে জড়ুল, যেন প্রজাপতির ডানা, দেখাবার জন্য পিঠখোলা ব্লাউজ পরেন ? ওনার মেয়ে তো আমার বন্ধু । সব খবরই পাই । অরিন্দম ওনার সাঁওতাল গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে কার অ্যাকসিডেন্টে পুড়ে মরে গেছেন, কলকাতায় । মৌলিনাথ কিডনি ফেল করে মরে গেছেন, কলকাতায় । মাহমুদ জোহের দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন, করে, সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পা ভেঙে হুইলচেয়ারে জীবন কাটাচ্ছিলেন ; একদিন এক যুবক এসে মাহমুদ জোহেরের চোখের সামনেই ছোরা মেরে-মেরে ওনার দ্বিত্বীয় বউটাকে মেরে ফেললে, পাটনায় ; যুবক ছিল দ্বিতীয় বউয়ের প্রেমিক ।
    --সে কি !
    --হ্যাঁ গো । এরিক পেজ পাগল হয়ে গেছেন, বাড়িতে ওনাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে, মোকামায় ; শুনেছি যে যখন বেশি চেঁচামেচি-গোলমাল করেন তখন ওনার হাতে একটা ব্রিটিশ আমলের রুপোর টাকা গুঁজে দিলে চুপ করে যান, আর টাকাটাকে শুধিয়ে-শুধিয়ে, হ্যালো মাউন্টব্যাটেন সাহেব, আপনি চলে গেলেন কেন, এখন আমাদের কী হবে, ইনডিয়াকে ফ্রিডাম দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু বেইমানি করে চলে গেলেন, কেউ-কেউ ফ্রি হল, সবাই কেন হল না, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, এই ধরনের কথা বলে নিজের মনে বকবক করেন ।
    --পাগল হয়ে গেল ? অতনুদের গ্যাঙের তো ও লিডার ছিল রে ! অমিতের দিকে ফিরে বললেন, সরি অমিত, তোমার বাবার অন্যধরণের বন্ধুবান্ধবও ছিল, নারী-নারকটিক গ্যাঙ বলত সবাই ।
    --মলয় রায়চৌধুরী, নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে, পাটনার বাড়ি ছেড়ে, গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরি নিয়ে কলকাতা চলে গেছেন; পাটনায় এসে হোটেলে উঠেছিলেন, এসেছিলেন আমাদের বাড়ি, বউকে নিয়ে । পাটনার বাড়িটা আর বসবাসের মতন নেই জানিয়েছিলেন, ওনার পাটনার বাড়ির লাইব্রেরি থেকে হাজার খানেক বই রঞ্জিত ভট্টাচার্য নামে ওনাদের এক আত্মীয় চুরি করে নিয়ে চলে গেছে । কলকাতায় আবার নাকি অনেক বই জড়ো করেছিলেন, মুম্বাই যাবার সময় সেসব বই যাকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই লোকটাকে রাজনৈতিক মাস্তানরা এমন পিটুনি দিয়েছিল যে মরো-মরো লোকটা প্রায় ছয় মাস ভেলোরে ট্রিটমেন্টের পর সুস্হ হয়েছে, কিন্তু হিন্দু বাঙালিদের ওপর চটে গিয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছে, চার্চ-টার্চ যায়।
    -- ওঃ, তুই তো অনেক খবর রাখিস রে । সমরেন্দ্রর কী খবর ?
    --সমরজেঠুর গোলমালের কথা তুমি কী করে জানলে ? জিগ্যেস করল ইতু ।
    --বড়জেঠিমাকে মোবাইল কিনে দিয়ে এই সুযোগটা পেয়েছি, উনি বহুক্ষণ আমার সঙ্গে গ্যাঁজাতে ভালোবাসেন । ওনার কাছ থেকে বাড়ির সব খবর পেয়ে যাই । বাংলায় কথা বলার সুযোগ পাই । আমি ওনার বেশ কিছু গল্প মোবাইলে রেকর্ড করে ল্যাপটপে ধরে রেখেছি । শুনি মাঝে-মাঝে ।
    --সমরজেঠুর লেটেস্ট সমস্যার কথা বলেছে জেঠি ?
    --কী সমস্যা ?
    --সৌদামিনীর বাচ্চাটাতো বেশ ফুটফুটে ক্যালেণ্ডার-খোকা হয়েছে । নবনীতাজেঠির দুই যমজ ছেলের চেয়ে ভালো দেখতে । তো সেই বাচ্চাটাকে মহাবীর নেমিচাঁদ নামে একজন বিলডার-কনট্রাক্টার লিফ্ট করিয়ে নিয়েছিল । বিলডারটার দুটো মেয়ে আছে, নয় বছর আর চোদ্দো বছরের ; তবু ব্যাটা ছেলে-ছেলে করে অবসেসড ছিল । সৌদামিনী একদিন অটো করে বাচ্চাটাকে খগোলে ওর বাপের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল মা-বাবাকে দেখাবার জন্য, তখন মোটর সাইকেলে দুজন লোক বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিয়ে দে চম্পট । সৌদামিনী, জানো বোধহয়, কেমন চালাকচতুর মেয়ে, মোটর সাইকেলের নম্বরটা মনে রেখেছিল । সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে কোতোয়ালিতে কমপ্লেন করার বারো ঘন্টার মধ্যে বাচ্চাটাকে ফেরত পায় ওরা । সবসুদ্দু সাতজন লোক ধরা পড়েছে । নেমিচাঁদ নাকি ওর বউকে সঙ্গে নিয়ে দানাপুরের এক মন্দিরে পুজো দিয়ে বেরোবার সময় সিঁড়িতে বাচ্চাটাকে পেয়ে ওর বউকে বুঝিয়ে ছিল যে বাচ্চাটা ঈশ্বরের দান । যে গুণ্ডাগুলোকে দিয়ে লিফ্ট করার কাজে লাগিয়েছিল, তারা, পরিকল্পনা অনুযায়ী বাচ্চাটাকে মন্দিরের সিঁড়িতে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে বাকি পেমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনই পুলিশ ওদের পাকড়াও করেছে । নেমিচাঁদ সৌদামিনিকে প্রোপোজাল দিয়েছে যে মামলাটা তুলে নিলে দুলাখ টাকা দেবে । সৌদামিনী সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে নেমিচাঁদের বাড়ি গিয়েছিল, এক লাখ টাকা নিয়ে নিয়েছে বিল্ডারটার কাছ থেকে, কিন্তু মামলা এখনও ফেরত নেয়নি সৌদামিনী, সমরজেঠু চাপ দিচ্ছে অ্যামাউন্ট বাড়াবার জন্য । পাটনার হিন্দি কাগজে তো সৌদামিনী আর সমরজেঠুর কোলে ওর বাচ্চা নিয়ে ফোটো বেরিয়েছিল, দেখোনি ?
    অমিত অবাক তাকিয়েছিল ইতুর দিকে । গল্প শেষ হলে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে কোনো গল্প পাবে না, কেবল শোষণ, অস্বাস্হ্য, মৃত্যু আর গুলিবারুদের রক্ত হিম করা গল্প পাবে । দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শোষণ আর বঞ্চনার প্রতিদিনকার সত্যকার ঘটনা স্বচক্ষে দেখবে ; তোমার এই গোপ্পুড়ে মস্তিষ্ক এখানে দিয়ারার গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে যাও । বাবার বক্তৃতার কয়েকটা কথা, যে কথাগুলোকে, শুনে-শুনে, অমিত মনে করে কিতাবি-বাকোয়াস, ব্যবহার করার সুযোগ ছাড়ল না ।
    উচ্ছ্বাসকে সামলে ইতু বলল, সরি, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেই ছোটোবেলায় ফিরে গিয়েছিলুম, যখন ডাইনিং টেবিলে বসে বড়োরা সবাই মিলে শহরের নানা কেচ্ছা আলোচনা করত, আর আমরা ছোটোরা শুনতুম, তুইও তো হাঁ করে শুনতিস, ভুলে গেলি কেন ।
    --দু-দুটো মেয়ে রয়েছে লোকটার, আবার ছেলের কী দরকার ? মেরে ফেলা মেয়ের কথা মনে পড়ল সুশান্তর, ওকে তো সেই মেয়ের মুখও দেখতে দেয়া হয়নি ।
    --সৌদামিনীর বডি দেখলে মাথা বিগড়োবেই । বটঠাকুমা বলেছিল যে একে রেখো না, এর ভাবগতিক ভালো নয়, কাজের বউয়ের অমন খাঁজ-দেখানো লোকাট ব্লাউজ কেন ? কিন্তু সকলে মিলে সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল যে তিন তলা বাড়ি ঝ্যাঁটানো, পোঁছা আর এতগুলো লোকের বাসন মাজার জন্য উপযুক্ত স্বাস্হ্য থাকা জরুরি ।
    সুশান্ত : আমার কাছে অমরেন্দ্রর গল্পটাও রেকর্ড করা আছে । বড়জেঠি বলেছিল একদিন, শুনবি ?
    ইতু : শোনাও, বড় জেঠি ভেতরের খবর আরো বেশি জানেন । অমরকাকু চলে গেছে ব্যাঙ্গালোর । কী করবে বল ? বউ পালিয়ে গেলে পুরুষদের যে কী অবস্হা, যেন জাঁতিকলে পড়া জ্যান্ত ইঁদুর । অমিতের দিকে ফিরে ইতু বলল, তুই তো জানিস, অমরেন্দ্রকাকু আমাদের নতুনদাদুর ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট ছিল, খড়গপুরে পড়েছে, নতুনদাদু ওকে পড়াবার জন্য মেমারির তিন কাঠা জমি বিক্রি করে টাকা তুলেছিলেন ।
    অমিতের উদাসীন মুখের পানে তাকিয়ে ইতু টের পেল যে প্রসঙ্গটা তোলা উচিত হয়নি । অমিতের মা মানসী বর্মণ, পালিয়ে না গেলেও, স্বামীর উপস্হিতিতেই আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে অমিতের জন্ম দিয়েছেন । হয়ত অমিতের বাবা-মা সেই কারণেই অমিতকে মানুষ করার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন রাঙাকাকু-কাকিমার ওপর ; ওনারা অমিতকে আইনত দত্তক নিয়ে নিলে অমিত নিশ্চই গর্দানিবাগের বাড়ি থেকে অমনভাবে উধাও হয়ে যেত না ।
    সুশান্ত : শোন । স্পিকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দিই ।
    ইতু : তোমার তরমুজ মদ দাও তো একটু, খেয়ে দেখি, হুইস্কি, রাম, ব্র্যাণ্ডি, জিন, ভোদকা খেয়েছি, চিড়াইয়াটাঁড়ের দেশিদারুও খেয়েছি, এই ধরণের রঙিন কান্ট্রি লিকার খাইনি । বার্থ ডে সেলিব্রেট করতে বার-রেস্তরাঁয় গেলে, বাবা বিয়ার এলাউ করত, বড় জোর, দু’পেগ প্রিমিয়াম হুইস্কি ।
    সুশান্ত । এই নে, চুমুক দিতে-দিতে শোন ।
    ...এদিকে কী হয়েছে জানিস তো...অ্যাঁ...অমরের বউটা একজনের সঙ্গে পালিয়েছে...অমর রে...অমরেন্দ্র...প্রেম করে বিয়ে করেছিল...আই আই টিতে পড়ার সময়ে...বামুন বাড়ির মেয়ে...তুই তো দেখিসনি….বাবা...কী দেমাগ...মাটিতে পা পড়ে না...পালিয়েছে এক ব্যাটা তামিলিয়ানের সঙ্গে...কোথায় জানিস...আমেরিকা...অমর কেন জানতে পারেনি...তুই-ই বল...পাসপোর্ট ওর বউয়ের আগে থাকতেই ছিল...কবে ভিসা হল...কবে টিকিট হল...কাকপক্ষীও টের পায়নি...আচ্ছা তুই আমাকে বল...অমর কেন জানতে পারেনি না যে ওর বউ কার সঙ্গে মিশছে...কোথায় যাচ্ছে...রাত করে কেন ফিরছে...অমরের মতন পুরুষদের উচিত শাস্তি...ওরা বউকে মনে করে যেন ফলের গাছ...যখন ইচ্ছে এই ডাল থেকে আম খাচ্ছি..ওই ডাল থেকে লিচু খাচ্ছি...সেই ডাল থেকে আপেল খাচ্ছি...তা খাচ্ছিস তো খা না...কে বারণ করেছে...কিন্তু বউ তো আর গাছ নয়...যে এক জায়গায় শেকড় বসিয়ে সারা জীবন তোমার পোঁতা মাটিতে থেকে যাবে...আর তুমি আজ হিল্লিতে কাল দিল্লিতে যত্তো নচ্ছার বন্ধুদের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করে বেড়াবে...বউয়েরও তা সাদ আহ্লাদ আছে...শরীর আছে...রসের চাহিদা আছে...তাকেও তো সময় দিতে হবে...বউকে অবহেলার ন্যায্য পুরস্কার পেয়েছে ব্যাটা...তুই তোর বউকে সময় দিস তো...তোর বউ অবশ্য পালাবে না...বউ তো গাছের মতন নয় যে নট নড়ন-চড়ন এক জায়গায় থেকে যাবে...এখন বোঝো...গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ঘুমোও...আর গাছের গুণকেত্তন করো খঞ্জনি বাজিয়ে...পরে আবার গল্প করব, অ্যাঁ...পার্কে বসে তোকে ফোন করছি রে...বাড়িতে কে আড়ি পেতে শুনবে...তার চেয়ে পার্কে আসি সকালে...ডায়াবেটিস কমাতে হলে নাকি দুবেলা হাঁটতে হবে...এই এক বেলাই হাঁটি...বিকেলে টিভিতে একটা প্রোগ্রাম হয়...মেজকত্তা কচুর লতি এনেছিল ভুল করে...লতির ঘণ্ট তোর প্রিয় ছিল বলে কাজের বউকে বললুম ফেলে দিয়ে আসতে… ও কী আর ফেলে দেবে...নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজেদের মতন করে রাঁধবে….রাঁধলে তোর মা কান্না সামলাতে পারবে না….বিকেলে টিভির জন্য সময় পাইনা...ভালো থাকিস...তোর বউ ছেলেকে আশীর্বাদ দিস...সকালে পুজো-আচ্চা আছে...জানিস তো...
    ইশারায় বেবিকে ডেকে ইতুদের গিফ্ট দিতে বলল সুশান্ত, ইতু বলল, আরে তুমি বিয়ে করলে, নতুনবউকে গিফ্ট তো আমরাই দেবো, তোমার বউ কেন দেবে ? তুমি বরং আমাদের কিছু মোটা টাকা দিও । তোমার বউকে দেবার মতন আমার সঙ্গে অবশ্য কিছুই নেই । তোমার বউয়ের গালে বরং একটা চুমু দিই ।
    বেবি হাজার টাকার দুটো প্যাকেট এনেছিল । সুশান্ত বলল, ওরা যেখানে গিয়ে সংসার পাতবে সেখানে বোধহয় লোকে একশ টাকার নোটও দেখতে পায় না । শুনে, বেবি প্রকৃতই হতবাক, বলল, বাংগালের লোকেরা কি বিহারিদের চেয়েও কাংগাল ?
    সুশান্ত বলল, একশ আর দশ-পাঁচ টাকার প্যাকেট নিয়ে আয়, হাজার টাকা প্যাকেট খুলে নিয়ে আয় । এনে ইতুর ঝোলাতে রেখে দে ।
    --জি । আচ্ছা ।
    ইতু : এরকম করকরে টাটকা হাজার টাকার নোটের প্যাকেট ? এ তো আমিও দেখিনি গো !
    সুশান্ত : পলিটিশিয়ান আর ঠিকেদারদের দেয়া ডোনেশান । শশুরমশাই মাসোহারা পান ।
    ইতু : এরকম রাজত্ব পেয়েছ, সঙ্গে দীঘলচাউনি রাজকন্যা পেয়েছ । ও, তাই তো ভাবি, কীসের টানে আটকে রইলে । তোমার বউতো একেবারে হরিণী, অমন বড়-বড় চোখ, এই বয়সে ফিগারও মেইনটেইন করেছে, গায়ের রঙের কী করার আছে ! ওনার ব্যবহার অনেক মিষ্টি । ট্রফি বলে একটা কথা আছে, জানো তো, তোমার বউ হল সেই ট্রফি ।
    বেবি : হরণ ? না ওনাকে বাবা হরণ করে আনেননি, উনি নিজেই এখানে বাবার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন । তখন ওনাকে দেখতে অনেক ভালো ছিল, এখন মদ আর শুয়োরের মাংস খেয়ে-খেয়ে ভমচৌলা কুম্ভকরণ হয়ে গেছেন । ওনাকে দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল । আমি কেন দিয়ারার অন্য কাউকে বিয়ে করতুম, বলুন, যখন এত ভালো পাত্র আমাদের দরোজায় শ্রীরামচন্দ্রের মতন এসেছে !
    সুশান্ত : আমাকে হরণ করার কথা বলছে না । বলছে যে তুই হরিণের মতন সুন্দরী ।
    বেবি হাঁটু মুড়ে ইতুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল, এতদিনে শশুরবাড়ির আশীর্বাদ পেলুম । ইতু ওর মাথা ধরে কপালে একটা চুমো দিল, বলল, তুমি তো বাক্যবাগীশ হরিণী গো, আমি ভাবতুম আমিই বুঝি গায়েপড়া বেহায়া ; সুশান্তজেঠু, আমার হয়ে তোমার বউকে একটা মুখরোচক চুমু দিও । নিজের দুই হাত থেকে চারগাছা চুড়ি আর কান থেকে টপ খুলে বেবিকে দিয়ে ইতু বলল, যেখানে যাচ্ছি সেখানে এগুলোর প্রয়োজন হবে না, তুমি রেখে নাও । বেবি সুশান্তর দিকে চাইতে, সুশান্ত বলল, লে লে, কুছ তো তুঝে তেরে সসুরাল সে মিলা ।
    --এই ছিঃ, গুরুজন না, ইতুর চুমু প্রসঙ্গে বলল অমিত ।
    --কোনো-কোনো গুরুজন ঝাঁসু হন, ইয়ার্কিকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসেন । সুশান্তজেঠু তাদের এক ও অদ্বিতীয় । করে নিচ্ছি ইয়ার্কি । আর তো বোধহয় দেখা হবে না । তাছাড়া এই মদটা বেশ কড়া । তোমার ছেলে অপুকে দেখছি না, তোমার শশুরবাড়ির ট্র্যাডিশান ফলো করে ওর বিয়ে দাওনি এখনও ?
    বেবি বলল, আপ্পু নাআআআআ ? ওকে বিলেতে পাঠাতে চান উনি, আরও পড়াশুনা করার জন্য ; বিলেতে গেলে কি আর ফিরবে ? থেকে যাবে সেখানেই, টিভিতে দেখি, কত সুন্দর ওদেশের মেমরা, বুড়িরাও জোয়ান ।
    অপুর সঙ্গে ওদের দেখা হল না । অপু তো দিল্লিতে ।
    সুশান্ত ওদের নৌকোয় চাপিয়ে দিলে, গর্দানিবাগের বাড়িতে দেয়া মোবাইলটা গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিল ইতু । সুশান্ত ওকে একটা চোরাই মোবাইল আর চারটে বেনামি সিমকার্ড দিয়েছেন ।
    অমিতরা চলে যাবার পর সুশান্তকে মনমরা দেখে মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বেবি জানতে চাইল, পুরোনো দিনের জন্য আপনার মন খারাপ লাগছে ?
    অমিত আর ইতু চলে যাবার পর সুশান্ত ঘোষের মনে হচ্ছিল যে উনি প্রকৃতপক্ষে একা, নিঃসঙ্গে । ওনার বউ রয়েছে, চারিপাশে হুকুমবরদার রয়েছে, শশুর-শাশুড়ি রয়েছে, তবু উনি একা বোধ করেন নিজেকে । কেন এমন হয় ? কিছুরই তো অভাব নেই । ঠাণ্ডা একটা চাঞ্চল্য, বিক্ষোভ, অজানা অসন্তোষ লুকিয়ে রয়েছে , সেন্স অব বিলংগিং নেই ওনার, সদা সন্ত্রস্ত থাকেন, ভয়ে নয়, সন্ত্রস্ত থাকার অবস্হানকে ভালোবেসে ফেলেছেন বলে । মনে করেন যে ওনার বাইরের সঙ্গে ভেতরের মিল নেই । হোক না অস্বাস্হ্যকর, তবু একা থাকতে ওনার ভালোলাগে । উনি তো সেই চাকরি করার সময় থেকে মিশে আসছেন সবায়ের সঙ্গে, ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে, কিন্তু দিয়ারায় স্হায়ী হবার পর থেকে আসেপাশের সবাই ওনাকে হতাশ করে চলেছে । উনি যেমন জগতসংসারের পরোয়া করেন না, তেমনই পৃথিবী ওনার পরোয়া করে না, জানেন উনি । এই যে অমিত বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে চাইছে, রাষ্ট্রকাঠামো বদলে ফেলে ইউটোপিয়া আনার স্বপ্ন দেখছে, তাতে জগতসংসারের বয়েই গেছে । কাটার সময় শুয়োরগুলো যেমন আতঙ্কিত চিৎকার দেয়, তেমনই নিঃশব্দ চিৎকার ওঠে ওনার অস্তিত্ব জুড়ে । তিনি যেন তাঁর নিজের মগজের ফাঁকা পোড়োবাড়ির একমাত্র ভাড়াটে । কিসের সঙ্গে যে সংঘর্ষ করে চলেছেন তা উনি নিজেই জানেন না । কে জানে কোন আড়ালে ওৎ পেতে আছে বিষণ্ণ আতঙ্ক, ঘষা কাচের ভঙ্গুর আদলে ভেসে বেড়াচ্ছে শরীরময়, পেটের ভেতরের কুনকি-হাঁস, যাকে তরমুজের মদ প্রতিদিন গিলিয়েও বশে আনা যাচ্ছে না । বেবির সমর্পিত ভালোবাসার অতিউন্নত খোঁয়াড় সত্ত্বেও নিজেকে কেন অসম্পূর্ণ মনে হয়, পার্থিব সব কিছু পাবার পরও, চাহিদা মেটার পরও, নিজেকে অতৃপ্ত মনে হয়, আর এগুলো তো স্হায়ী হয়ে গেছে। এ থেকে যে মুক্তি নেই, তা আরও বিষময় যন্ত্রণাদায়ক এক সমস্যা ।

    নয়
    দিয়ারার আসেপাশের জলে মাছ ধরতে হলে, নৌকো বাইতে হলে, সুশান্তকে, মানে জামাইবাবার নামে তাঁর শশুরকে, রংদারি ট্যাক্স দিতে হয় । এই মহার্ঘ বালিয়াড়িতে সরকার বলতে বোঝায় তারিণী মণ্ডলের জামাই, যাকে গ্রামের লোক আর প্রশাসনের লোকেরা যে-যার আতঙ্কের মাধ্যমে চেনে-জানে । অঞ্চলের অন্য গুণ্ডারা, যেমন দীনা যাদব, দমদমি যাদব, রাসবিহারি মণ্ডল, দারা মিয়াঁ, সৎইয়া মণ্ডল প্রতিমাসে জামাইখোরাকি দিয়ে যায় ওনার শশুর বা শাশুড়িকে । ওনার দলের সবায়ের কাছে কাট্টা,তমঞ্চা, একনল্লা, দুনল্লা আছে, কয়েকজনের কাছে একে-সানতালিস আর একে-ছপ্পন ।
    যে দিয়ারাগুলোর পলি প্রায় পাকা জমির চেহারা নিয়েছে, সেখানে সরকারি স্কুল আছে বটে কিন্তু বর্ষায় তারা ডুববে না ভাসবে তা কেউ আগাম বলতে পারে না বলে সারা বছর ক্লাস হয় না । ছেলে অপুকে তাই ভাগলপুর শহরে রেখে সেইন্ট জোসেফ কনভেন্টে ভর্তি করে দিয়েছিলেন জামাইবাবা । তারিণী মণ্ডলও চেয়েছিলেন নাতি আজকালকার খ্যাতনামা অপরাধীদের মতন স্যুটটাই পরে দেশে-বিদেশে নাম করুক । স্কুলে যে চারটে গ্রুপ ছিল লাল, হলুদ, সবুজ আর নীল, তাতে লাল গ্রুপে ছিল অপু, বাদশাহি লাল । ওর, অপুর, নামটা তারিণী মণ্ডলের দেয়া, আদর করে, আপ্রাধি ঘোষ, তারিণীর মতে জগতসংসারে অপরাধীর চেয়ে বড়ো আর কেউ হতে পারে না, তা মহারাজ বাল্মিকীর জীবন থেকে জানা যায় । এককালের ডাকাত সর্দার, পরে রামায়ণের লেখক, তাঁর নাম যদি উইয়ের ঢিবি হতে পারে তাহলে তারিণী মণ্ডলের একমাত্র নাতির নাম কেন রামায়ণ রচয়িতার অনুকরণে হবে না । তাই আপ্রাধি ; সুশান্ত নিজের মতো করে তাকে বাঙালিয়ানা দিয়ে অপু করলেও, কেউই ওকে অপু বলে ডাকে না, এমনকি সুশান্তর বিড়িসেবিকা মেঠোগন্ধা নিরক্ষর ডাগরচোখ শ্যামলিমা বউও নয় । বেবি ডাকে আপ্পু বলে ।
    ওর ডাকনাম হয়ে গেছে আপ্পু । আড়ালে, আপ্পু দোগলা । স্কুলেতে সহপাঠীরা ‘আবে আপ্পু’ ডাকটাকে ‘এবি আপ্পু’তে, মানে ‘এ বাস্টার্ড আপ্পুতে’, পালটে তাতাতে চেষ্টা করলে, অপুর সরাসরি উত্তর, হ্যাঁ, তো কি হয়েছে ?
    অশ্বমেধ হোষ নামে ডাকে না কেউ, টিচাররাও বলেন আপ্পু ।
    বুক চিতিয়ে অপু জানায়, আমি বাঙালি, বুঝলি বাঙালি ।
    --বাংগালি ? সে তো আরও কমজোর, দল বেঁধে চেঁচায় । দুজন এক সঙ্গে না হলে লড়তে ভয় পায় । আর কায়স্হ মানে তো মুনশিগিরি, যমরাজের কেরানি চিত্রগুপ্ত জাতে কায়স্হ । দেখিস না কায়স্হগুলো চিত্রগুপ্ত পুজো করে ।
    --বাড়ি গিয়ে পুরাণ-শাস্ত্র পড়গে যা । চিত্রগুপ্ত হল বিহারি কেরানি, আর যমরাজ হল বাঙালি ।
    --আচ্ছা ?
    --হ্যাঁ । নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের নাম শুনিসনি তোরা । ইংরেজদের এমন বাঁশ দিয়েছিল যে সে বাঁশ কাংরেসিরা ধামাচাপা দিয়ে পুঁতে রেখেছে । একদিন ওই বাঁশের চারা বেরোবে চারপাশ থেকে, তখন দেখিস কী হয়।
    সুভাষচন্দ্র বসুর নামটা তারিণী মণ্ডল মুখস্হ করে রেখেছেন । নাতিকে যখনই উৎসাহিত করার দরকার হয়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের গল্প আরম্ভ করেন, সবই গাঁজাখুরি, কেননা উনি কেবল নামটুকুই জানেন আর ফোটো দেখেছেন । বলেন, আরে ওনার ফোটুর দিকে দ্যাখ, লম্বা-চওড়া গাবরু জওয়ান, প্যান্ট-শার্ট পরে স্যালুট নিচ্ছে । আর আজকালকার নেতাদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, ভয়ে সবায়ের ল্যাজ পোঁদে এমন ঢুকে থাকে যে দশটা বন্দুকধারি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ; আমি তো শুধু দুটো পহলওয়ানকে রেখেছি, আমার ওপর রামধারি ধানুক একবার হামলা চালিয়েছিল বলে, রামধারীর জন্যই আমার বাঁচোখটা নষ্ট হয়ে গেল ।
    --জানি দাদু, রামধারিকে তুমি লোক পাঠিয়ে কলকাতায় মারিয়েছিলে ; দুই রাজ্যের ঝগড়ায় সে ব্যাটার লাশ পনেরোদিন কলকাতার মর্গে পড়ে পচে পোকা ধরে গিয়েছিল ।
    --আরে, এই দিয়ারার জমিজমা সবই গংগোতা আর মাল্লাহদের ছিল ।
    --জানি, বাবা সেকথা বলেছিল তোমায় । এচ এচ রিজালে নামে একজন সায়েব ১৮৯১ সালে লোকগণনা করে লিখে গেছে সেসব । কিন্তু উঁচু জাতের আফসাররা টাকা খেয়ে ভূমিহার, রাজপুত, যাদব, কোয়েরি, কুর্মিদের হাতে দিয়ারার জমি তুলে দিত । গংগোতারা ফেরত নেবার চেষ্টা করতে গেলে তাদের চোখে ছুঁচ ফুটিয়ে অ্যাসিড ঢেলে দেয়া হয়েছিল, ক্রিমিনাল দেগে দেয়া হয়েছিল ।
    --ক্রিমিনাল খারাপ হতে যাবে কেন ? রামায়ণ লিখেছিলেন মহারাজ বাল্মিকী, উনি কি ক্রিমিনাল ছিলেন? উনি ছিলেন মহাআপ্রাধি । তুই বড়ো হয়ে মহাআপ্রাধি হয়ে দেখা দিকিনি ।
    গঙ্গার তো মতিগতির ঠিকঠিকানা নেই ; এই বর্ষায় এক দিয়ারা ডোবায় তো আরেক বর্ষায় আরেক । যে খেতি করে তার জমি ডুবলে যে নতুন জমি ভেসে উঠল সেটা তার পাওনা, কিন্তু ইংরেজরা যাবার পর উঁচু জাতের লোকেরা নতুন ভেসে-ওঠা দিয়ারা নিজেদের নামে লিখিয়ে নিত । কী আর করা যাবে, বল । তাই আমরা হাথিয়ার তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি । বন্দুক যার, জল-জমিন তার । কৈলাশ মণ্ডল নামে একজন গংগোতা নকসল্লি কামকাজ করে চেষ্টা করেছিল সব ঘোটালা বন্ধ করতে, সেই ১৯৬৭ সালে ; কিন্তু সেও তো কোথায় গায়েব হয়ে গেল ।
    --গায়েব হয়নি, আমাদের ইউনিভারসিটির একজন টিচার বলেছে যে তাকে গায়েব করে দেয়া হয়েছিল । তখন নকসল্লি ধরে-ধরে গায়েব করার সরকারি কারিয়াকরম চলছিল ।
    --আরে সব বেকার । লুকিয়ে-লুকিয়ে যদি কিছু করতেই হয় তো সুভাষচন্দ্র বোসের মতন করো । আংরেজরা অব্দি পালিয়ে গেল ভয়ে । কথা কটা বলে উরুতে কুস্তিগিরের চাপড় দাদুর ।
    --দাদু, আমাদের মতন ছিল না সুভাষচন্দ্র বোস । ওর জন্যে জান দেবার অনেক সঙ্গীসাথী ছিল । আমরা তো নিজেরাই লড়ে মরি ।
    বাবা সুশান্ত ঘোষ মনে করেন ওনার কোনো প্রত্যক্ষ অবদান নেই অপুর চরিত্র গঠনে । পরোক্ষ অবদান আছে । অপু নিজেও তাই মনে করে । বাবা বাংলা বলতে আর ভাগলপুর শহর থেকে বই এনে বাংলা পড়তে শিখিয়েছেন, সাধারণ জ্ঞানের বই কিনে দিতেন ছোটোবেলা থেকে । বাংলা শেখানোর সময়েই চটে যেতেন বাবা, কান মুলে দিতেন, চড় মারতেন । বাংলা শেখার দরুণ আলটপকা কথা বলে বিব্রত হতে হয়েছে অনেক সময়ে । জে এন ইউয়ের বন্ধুরা তো আর জানে না যে ওর মা দিয়ারার গংগোতা বিহারিন । পদবি দেখে অনুমান করে নেয় যে এ. ঘোষ মানে শহুরে বাঙালি ।
    সনাতন সরকার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল অপুর। গায়ের রং বেশ ময়লা, কোঁকড়া উস্কো-খুস্কো চুল, রোগা, সাড়ে পাঁচ ফিটের, কালো ফ্রেমের চশমা-চোখ সনাতন দিল্লিতেও ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বজায় রেখেছে, পায়ে কোলহাপুরি, বাংলা কথায় ওড়িয়া টান । বিড়ি ফোঁকে । প্রথম পরিচয়ের পর প্রায়ই সনাতনের সঙ্গে আড্ডা মারে অপু ।
    --হাই সনাতন, আপনিও কি সোকলড প্রবাসী ? প্রথমবার পরিচয় করার জন্য শুরু করেছিল অপু ।
    --পশ্চিমবাংলার বর্ণহিন্দু হাফগাণ্ডুরা আমাদের অমনভাবে গালাগাল দেয়, ইসকি মাকা সালে…... ; তুইও কেন সেকথা পাড়ছিস । তুই তো ভাগলপুরি খোটুয়া বলে জানি । কথায় বিড়ির ধোঁয়া মিশিয়ে বলল সনাতন সরকার ।
    --না, পুজোপাণ্ডালে, দিল্লি হাটে বা কোনো ফাংশানে দিল্লির বাঙালিদের সঙ্গে আলাপ হলে, যখন ওনারা জানতে পারেন যে আমি ভাগলপুরের তখন অমন প্রশ্ন তোলেন । আপনি তো উড়িষ্যা থেকে ?
    --না, টু বি স্পেসিফিক, আমি দণ্ডকারণ্য থেকে । শুনেছিস কি দণ্ডকারণ্য ?
    --বাবার কাছে গল্প শুনেছিলুম, রামায়ণ না মহাভারতের গল্প ঠিক জানি না, নর্মদা আর গোদাবরী নদীর তীরে দণ্ডক রাজার রাজ্য ছিল । কোনো ঋষির অভিশাপে জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল ।
    --আবে সালে হাফউইট, আমি সেই আদ্যিকালের গাঁজাখুরি এরিয়ান গল্পের কথা বলছি না ।
    --দেন হোয়াট ?
    --দণ্ডকারন্য জায়গাটা হল ভারতের কয়েকটা রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত নয়টা জেলা , মাটির তলায় প্রচুর মিনারালস আছে ; গড়চিরোলি, ভাণ্ডারা, বালাঘাট, রাজনন্দগাঁও, কাউকের, বস্তার, নারায়ণপুর, দাঁতেওয়াড়া আর মালকানগিরি । আমি মালকানগিরি প্রডাক্ট, সুভাষপল্লিতে থাকতাম, এখনও আছে সুভাষপল্লী, জঙ্গল পরিষ্কার করে আমরাই বসত গড়েছিলাম, আর এখন চুতিয়াগুলো আমাদেরই ঘরছাড়া করে দিতে চাইছে, ইসকি মাকা... । কিন্তু এখন চলে গেছি ছত্তিসগড়ের নারাণপুরে ।
    --মালকানগিরি ? অমন অড, গড ফরসেকন জায়গায় ?
    --দেশভাগের পর কী হয়েছিল জানিস না, চামগাদড় কঁহিকা ?
    --হ্যাঁ, জানি-জানি, বাস্তুহারাদের দণ্ডকারণ্যে সেটল করানো হয়েছিল ।
    --কোন ভোঁসড়িকে-জনা তোকে বুঝিয়েছে, ইসকি মাকা... ? কিছুই জানিস না তুই । আমাদের, নমঃশূদ্র বাঙালিদের, আনসেটল করা হয়েছিল, ডেসট্রয় করা হয়েছিল, ইসকি মাকা…. । বাঙালির প্রত্নতাত্ত্বিক রুইনস যদি দেখতে চাস তো ঘুরে আয় একবার, ইসকি মাকা...। স্বাধীনতার লাৎ খেয়ে আমরা সেই সব মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছি যাদের অতীত লোপাট, বর্তমান গায়েব আর ভবিষ্যৎ নেই । আইডেনটিটিলেস । আমাদের ইতিহাস প্রতিদিন রিপিট হয়, কেননা আমরা ইতিহাসহীন, বিমূর্ত । বিমূর্ত বুঝিস ? অ্যাবসট্র্যাক্ট !
    …চুপ করে যায় অপু । টের পায় যে সারেনি এমন আঘাতের রক্তপূঁজের খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছে ।
    --আমরা ১৯৪৭-এ, ১৯৬৪-৬৫-তে, ১৯৭১-এ, ১৯৭৫-এ মার খেয়েছি, যখনই ওপার বাঙালির কসাইদের প্রবৃত্তি সালভাদর দালির পেইনটিঙের মতন হয় , তখনই ওরা আমাদের পোঁদে জ্বলন্ত জিরাফ ঢোকায়। অপর জানিস তো, দি আদার, পড়ছিস বোধহয়, তোদের কোর্সে আছে তো, দি আদার, ইসকি মাকা... । সম্প্রতি নাস্তিক আর আস্তিকদের খুনিখুনি হল ঢাকায়-চট্টগ্রামে, তাতেও ঘরছাড়া করা হল আমাদের, আমাদের ইয়ানেকি নিম্নবর্ণের লোকেদের । ওদেশের রাজনীতির বনেদ হয়ে গেছে খেদাও, খেদাও, খেদাও, মেইনলি রিমেইনিং নিম্নবর্ণদের খেদাও।
    ...চুপ করেই থাকে অপু ।
    --মরিচঝাঁপি শুনেছিস, মরিচঝাঁপি ?
    --হ্যাঁ, জানি ঘটনাটা, বাবা বলেছিলেন, দণ্ডকারণ্য থেকে কয়েক হাজার পরিবার গিয়েছিল সুন্দরবনের ওই দ্বীপে বসতি গড়তে ।
    --ওই দ্বীপেই, ১৯৭৯ এর ৩১ জানুয়ারি আমার বাবা-মাকে খুন করেছিল ইসকি... । মরিচঝাঁপি দ্বীপটাকে চারিদিক থেকে তিরিশটা পুলিশ-লঞ্চ ঘিরে রেখেছিল যাতে খাবার আর পানীয় জল না পোঁছোয় ; তারপর যুদ্ধক্ষেত্রের ঢঙে ব্রাশফায়ার করেছিল, ইসকি... । দণ্ডকারণ্যের অনেকের বাড়িতে ৩১ জানুয়ারির দিনটা তাদের কোনো-না-কোনো আত্মীয়ের মৃত্যু দিন হিসাবে পালিত হয় । আমাদের বাড়িতে পালিত হয় আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুদিন হিসাবে । যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল তাদের কেউ-কেউ কলকাতার বারাসাতের কাছে মরিচঝাঁপি কলোনি গড়ে থেকে গেল, কেউ-কেউ থেকে গেল ক্যানিঙের হিঙ্গলগঞ্জে কলোনি গড়ে, কেউ রেললাইনের ধারে, কেউ খালপাড়ে । আমাকে মরিচঝাঁপি থেকে দণ্ডকারণ্যে নিয়ে এসেছিলেন আমার পিসেমশায়, নিজের পিসেমশায় নন, তবু আপন । নয় বছর বয়সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম, ইসকি... । তোরা হয়তো ভাবিস তোদের চেয়ে আমার বয়স এত বেশি, ইউনিয়ানবাজি করার জন্য গাণ্ডুগর্দি চালিয়ে ইউনিভার্সিটিতে টাইম পাস করছি, হয়তো মনে করিস পি এইচ ডি করতে এত বছর লাগছে কেন, ইসকি... ।
    ...আবার চুপ করে যায় অপু ।
    --আমাকে আবার দণ্ডকারণ্যে এনে লালন-পালন বলতে যা বোঝায় তা করেছেন, স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন, এখনও পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন, আমার পিসতুতো বোন যাকে ১৯৭১ সালে রেপ করেছিল পাকিস্তানি রাজাকারগুলো, ইসকি...। সেও আমার নিজের পিসতুতো বোন নয়, কিন্তু আপন । ও দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি যায়নি । ওর বর, আমার অভিভাবক জামাইবাবু গণেশচন্দ্র সরকার যেতে চাননি ; উনি তখনই বলেছিলেন ওই টেঁটিয়া গিরগিটিমার্কা বর্ণহিন্দু বাঙালিগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না, ইসকি...। আন্দামানে যাবার জেটিতে গিয়ে ওদের ছাতুবাবুরা কালাপানি-দ্বীপান্তরের আতঙ্ক ছড়িয়ে ভাষণবাজি করে হাজার-হাজার মানুষের আন্দামানে যাওয়া ভণ্ডুল করে দিয়েছিল । নেহেরু আমাদের ঠুঁসে দিল আদিবাসীদের জংলি এলাকাগুলোয়, আর বর্ণহিন্দু বাঙালিরা পেলো চিত্তরঞ্জন পার্ক, তুই তো এসব সাপসিঁড়ির পলিটিক্স জানিস না। বাড়ি থেকে কাঁচা টাকা আনিস, আর নাইটক্লাব-ডিসকোবাজি করে বেড়াস ।
    ...অপু চুপ করে রইল । বুঝতে পারছিল যে সনাতন সরকার সম্ভবত মন খুলে ঝাল ঝাড়ার অবসর তৈরি করে ফেলতে পেরেছে ওর প্রশ্নগুলোর চোট খেয়ে । অপু আরও ভয়ঙ্কর হিন্দি গালাগাল জানে, ব্যবহার করে না কখনও, ছোটোবেলা থেকে বাবার চড়-খাওয়া নির্দেশ ।
    --ওই নেতাগুলোর বেশ কয়েকজন বেঙ্গলের ডিভিজান করে পাকিস্তান সৃষ্টি সমর্থন করেছিল । যেই পাকিস্তান হল অমনি বর্ণহিন্দু লোকগুলো আগেভাগে পালিয়ে এলো ; এসে, এ আজাদি ঝুটা হ্যায় জিগির তুলে ট্রাম-বাস পোড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর আমরা ? আমরা তো নমঃশূদ্র, নিম্নবর্ণ, আনটাচেবল, ইসকি...। বর্ণহিন্দু পরিবারগুলো পশ্চিমবাংলায় বাড়িঘর তৈরি করে থেকে গেল, পার্টিগুলোকে দখল করে নিল । নিম্নবর্ণের জন্যে দণ্ডকারণ্য, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান, ইসকি...। বর্ণহিন্দু ভাড়ুয়াগুলোই আমাদের আন্দামানে যেতে দেয়নি । এখন আন্দামানে গিয়ে দ্যাখ, সাউথ ইনডিয়ান আর পাঞ্জাবিরা গুছিয়ে নিয়েছে । বাংলা তো পড়তে পারিস । তোর ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে মনোরঞ্জন ব্যাপারির লেখা চণ্ডালের চোখে চণ্ডাল বইটা আছে, পড়িস । জঁ জেনে সম্পর্কে জাঁ পল সার্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা করে সেইন্ট জেনে নামে একটা বই-ই লিখে ফেলেছেন । কোনো বাঙালি কি মনোরঞ্জন ব্যাপারিকে নিয়ে বই লিখেছে ? শালা বর্ণহিন্দু চুতিয়া ইনটেলেকচুয়ালদের দল, ইসকি...।
    ক্যান্টিনের অন্য টেবল থেকে একজন সহপাঠির মন্তব্য শোনা গেল, আবে সানি, হিন্দি মেঁ গালি কিঁউ ? তু বংলা গালি নহিঁ জানতা হ্যায় ক্যা ? সুনা, সুনা, দো-চার, ইয়াদ করকে রখুঁ ।
    সনাতন জবাব দিল, যাদের দিচ্ছি তাদের জন্য এই গালাগালগুলোই উপযুক্ত মনে হল । বাংলা গালাগাল কয়েকটা জানি, কিন্তু সেগুলোয় তেমন তেজ নেই । মালকানগিরিতে বাংলা বলার চল শেষ হয়ে গেছে, ইসকি...। উড়িষ্যা সরকার বাংলা শেখানো তুলে দিয়ে ওড়িয়া শেখাচ্ছে । মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলি জঙ্গলের উদ্বাস্তু গ্রামে বাঙালিরা আছে, তাদের বাচ্চাদের স্কুলে মারাঠি শিখতে বাধ্য করা হয়েছে, সাতচল্লিশটা স্কুলে, বুঝলি, আমরাই এসট্যাবলিশ করেছিলাম ওগুলো। চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলিতে বাংলা বলার মতন বাঙালি আর পাবি না, দশ-পনেরো বছর পর, ইসকি...। কোথাও কোথাও ইলেকট্রিসিট পৌঁছেচে বটে, কিন্তু চাষের জল, সেচের ব্যবস্হা নেই, সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র নেই । গালাগাল দেবো না তো কী দেবো, ভ্যালেন্টাইনের খামে পুরে আমাশার মিক্সড ফ্রুট জ্যাম ?
    অপু বলল, আরে আপনি ওদের ছাড়ুন, শালারা সারাদিন লন্দিফন্দি করে আর চকরলস কাটে ; ছোলে-ভাটুরে খাতে, অওর লিডারকে দুম চাটতে ।
    --এখন দণ্ডকারণ্যে পোলাভরম ড্যাম তৈরি হবে নয় হাজার কোটি টাকা খরচ করে, চুতিয়া শালা ইসকি...। উপজাতি আর উদ্বাস্তু অধ্যুষিত দুশো ছিয়াত্তরটা গ্রামের দু লাখ মানুষ ভেসে যাবে, উৎখাত করা হবে তাদের, দাঁতেওয়াডায় সাবরি নদীর ধারে চাষের সব জমি ভেসে যাবে, ইসকি...। কারোর দুশ্চিন্তা নেই, তার কারণ যারা ভেসে যাবে তারা হয় শিডুল্ড ট্রাইব বা বাঙালি শিডুল্ড কাস্ট । এই যে সেনসাস হল, তাতে আমরা যে শিডুলড কাস্ট তা চাপা দিয়ে দেখানো হল আমরা বাঙালি, ইসকি...। কেন ? যাতে আমরা শিডুলড কাস্টের সুবিধাগুলো না পাই । ভোঁসড়িকে, পোলাভরমের জল যাবে ভিশাখাপটনমের কারখানাগুলোয়, স্টিল প্ল্যান্টে, হাইড্রোপাওয়ারে,শহরে । ক্যান ইউ ইম্যাজিন ? লক্ষ-লক্ষ মানুষ পানীয় জল পাবে না, ইসকি...। আর কলকাতায় গিয়ে দ্যাখ ; বর্ণহিন্দু লৌণ্ডাগুলো আমরা বাঙালি আমরা বাঙালি করে ধুতি খুলে লুঙ্গি ড্যান্স নেচে চলেছে। দেশভাগের দরুণ আমরা শুধু তাদের সাংস্কৃতিক গর্বের বাল ওপড়াবার জন্য নিশ্চিহ্ণ হয়ে চলেছি, ইসকি...। দণ্ডকারণ্যের দলিতরাও তাদের দলে আমাদের নিতে চায় না । আমরা ইতিহাসের গার্বেজ ডাম্প, ইসকি...।
    সনাতন সরকার নিজের রোষকে সামাল দিয়েছে আঁচ করে অপু বলল, বাংলাদেশ কিন্তু দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিচ্ছে, এতকাল পরে হলেও নিচ্ছে । সেখানের জনসাধারণের মধ্যে থেকেই সরকারকে নাড়া দেয়া হচ্ছে, মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা হচ্ছে ।
    --কী রকম শুনি ?
    --শাহবাগে এককাট্টা হয়ে মেয়েরা পর্যন্ত প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে, বোরখা পরে নয়, ওপনলি । আমাদের এখানে চুরাশির শিখ নিধন, নেলি গণহত্যা, গোধরার পর আহমেদাবাদের দাঙ্গা, কয়েকমাস আগে মুজফফরনগরে আর শ্যামলিতে যে দাঙ্গা হল, কই এখানে তো শাহবাগের মতন রাস্তার মোড়ে নামতে দেখা গেল না ছেলে-মেয়েদের ।
    --ওদের দেশে বিয়াল্লিশ বছর লেগেছে কাদের মোল্লাকে কাঠগড়ায় তুলতে, যে লোকটা শুধু মীরপুরেই সাড়ে তিনশ মানুষকে খুন করিয়েছিল । আসল শয়তান বাচ্চু রাজাকরটা আগেই পাকিস্তানে পালিয়েছিল, ইসকি...। তুই আমার তর্কটাকে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছিস । আমাদের এখানে যতই দাঙ্গা হোক না কেন, আমরা কাউকে পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে তাড়া করে নিয়ে যাই না । আমাদের কোনো রাজাকরের ইকুইভ্যালেন্ট নেই । রাজাকর কাদের বলে জানিস ?
    --ধার্মিক স্বেচ্ছাসেবকদের । যতদূর জানি হায়দ্রাবাদের নিজামের টাকায় তৈরি মিলিশিয়া ।
    --আবে ঘড়িয়ালকে চামড়া, তর্ক চলছে পূর্ব পাকিস্তান আর নিম্নবর্ণের বাঙালি নিয়ে , তুই তার মধ্যে নিয়ে এলি হায়দ্রাবাদ। রাজাকার হল খুনি মিলিশিয়া, যাদের অর্ডিনান্সের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছিল টিক্কা খান, ইসকি... । পূর্ব পাকিস্তানে, আই মিন বাংলাদেশে, তুই ঘরে-ঘরে রাজাকার পাবি। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান এমনকি দণ্ডকারণ্যেও বাঙালিদের মধ্যে তুই অমন জাতকসাই পাবি না । আমাদের এখানে সরকার কোনো দিনই ধর্মান্ধ মিলিশিয়া তৈরি করবে না, আমরা দেবো না তৈরি করতে, গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে , ব্লাডি সিভিল ওয়র । হুমায়ুন আজাদের নাম শুনেছিস ?
    --হ্যাঁ, আমার বাবা হুমায়ুন আহমেদের অনেক বড়ো ফ্যান । যে গংগোতা বাংলাদেশ-ইনডিয়া সীমার ব্যবসা দেখভাল করে আর থার্মোকোল আইসবক্সে বাবার জন্যে ইলিশ আনে, শুঁটকি-মাছ আনে, সে বাবাকে বইপত্র এনে দ্যায় । ইলিশ-টিলিশ বাবা নিজেই রাঁধেন ।
    সনাতন সরকার, স্তম্ভিত, অপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আবে, তেলচাট্টা ঘাসলেট, আমি একজন ভাবুকের কথা বলছি, পাল্প ফিকশান রাইটারের কথা বলছি না। হুমায়ুন আজাদকে পাক সার জমিন সাদ বাদ নামে একটা বই লেখার জন্য রাজাকাররা খচাখচ-খচাখচ ছুরি-ছোরা-চপার মারার কিছুদিন পর উনি মারা যান। যাকগে, তোর মতন অ্যায়রা-গ্যায়রা নাৎথু-খায়রাকে এসব বলে কোনো লাভ নেই ; কী জানতে চাইছিলিস যেন ?
    --এমন লেকচার দিলেন যে যা বলতে চাইছিলুম, তা-ই ভুলে গেলুম । গালাগালের তোড়ে ভেসে গেলুম ।

    দশ
    মংরুরাম নুনেতি ( কানাগাঁও-এর প্রাক্তন সরপঞ্চ ): আরে, আরে, খাদেতে দুজন লোক পড়ে আছে । সাপের কামড়ে নাকি অন্য কোনো জন্তু জানোয়ার মেরে ফেলে রেখে গেছে, পরে এসে খাবে ?
    গাসসুরাম ( গ্রামবাসী ) : গ্রামের তাতিম গোঁড় বলছিল যে এই জঙ্গলে সেদিন সন্ধ্যাবেলা গুলিগোলা চলেছিল । গুলি লেগে মরেছে বোধহয় ।
    মংরুরাম : রক্ত লেগে নেই কেন তাহলে ? গুলি লাগলে রক্ত থাকত জামাকাপড়ে ।
    গাসসুরাম : চলুন চলুন, শেষে আধামিলিট্রি জওয়ানরা দেখতে পেলে আমাদেই জেলে পুরবে । মাওওয়াদিরা দেখতে পেলে ধরেবেঁধে নিয়ে গিয়ে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে শেয়ালের মাংস ঢুকিয়ে দেবে ।
    মংরুরাম : যে-ই ধরুক, নিখালিস উড়িয়ে দেবে ।
    গাসসুরাম : বাপ রে । তাকাবেন না ও দিকে ।
    মংরুরাম : তাড়াতাড়ি চল, তুই তো ভাঙা পা নিয়ে হাঁটতেই পারিস না ।

    এগারো
    দণ্ডকারণ্যে যাবো আপনার বাড়ি, যদি নিয়ে যান কখনও । আর হ্যাঁ, আমি কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যাবো, আপনি আমার অ্যাবসেন্সটা ম্যানেজ করে দেবেন । আপনি তো পি এইচ ডি করছেন , অসুবিধা হবার কথা নয় । অপু বলল সনাতন সরকারকে ।
    --চলিস আমার সঙ্গে, একা তুই রাস্তা গোলমাল করে ফেলবি । নারায়ণপুর জেলাসদর হলেও, এখনও ডেভেলাপ করেনি ।
    --আমার বাবার পদবি ঘোষ হলেও, আমার মা বিহারি গংগোতা পরিবারের মেয়ে, ভাগলপুর শহরে নয়, আমাদের বাড়ি গঙ্গার চরে, দিয়ারায় । দিয়ারা শুনেছেন তো ? মলম লাগাবার মতো করে কথাগুলো বলল অপু, ক্যান্টিনে বসে মসালা দোসা খেতে-খেতে, সনাতনকে ।
    --গংগোতা ? কাস্ট ? তোর পাঞ্জাবি গার্লফ্রেণ্ড সে-কথা জানে, যে মেয়েটা সব সময় তোর সঙ্গে চিপকে থাকে ?
    --হ্যাঁ, বিহারের লোয়েস্ট নিম্নবর্ণ । হ্যাঃ, নিকিতা মাখিজা পাঞ্জাবি নয় , ও সিন্ধি । ওকে আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানিয়েছি, বিশ্বাস করে না, ভাবে কাটিয়ে দেবার জন্য গুল মারছি । বলেছি প্রায়ভেট ডিটেকটিভ দিয়ে ইনভেসটিগেট করাতে, সে-প্রস্তাবকেও মনে করে ওকে ছেড়ে দেবার আরেক চাল । দিল্লির নাইটলাইফ এনজয় করা-মেয়ে, প্রায়ই ডিসকোয় গিয়ে টাল্লি হয়ে যায়, আর বাড়ি পৌঁছে দিতে হয় আমাকে । ওর বাবা-মা কেন যে অমন ছুট দিয়ে রেখেছেন, জানি না । ওকে আমাদের দিয়ারায় নিয়ে গেলে ওর হার্টফেল করবে।
    --নিম্নবর্ণের আবার হাই-লো আছে নাকি রে, বওড়া ? এনিওয়ে, তোর বাবার প্রেম তো স্যালুট করার মতন অসমসাহসী ঘটনা রে । তোর বাপ পারলেন, তোর গার্লফ্রেণ্ডও পারবে, সিন্ধিরা বেশ সহজে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে, ওরাও উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল, কিন্তু সরকার ওদের ধরে-ধরে আদিবাসীদের মাঝখানে পোঁতেনি, যেমন আমাদের পুঁতেছে । তবে টাকাকড়িকে ওরা মানুষের চেয়ে বেশি ভালোবাসে ; চেক করে দেখেনিস তোর কাঁচা টাকা ওড়ানো দেখে তোকে ফাঁসিয়েছে কি না । সেক্স-টেক্স করলে কনডোম পরে করিস, মনে রাখিস এটা ইনডিয়ার রাজধানি, এখানে মানুষের মুখের লালায় যত সায়েনাইড, তার চেয়ে বেশি সায়েনাইড তাদের চুতে আর লাঁড়ে।
    --প্রেম নয়, আমার মায়ের বাবা আমার বাবাকে কিডন্যাপ করে আমার মায়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন । মায়ের বয়স তখন চোদ্দ বছর আর বাবার একুশ । মা লেখাপড়া শেখেননি, স্কুলের কোনো বিল্ডিংও দেখেননি আজ পর্যন্ত ; বাবা কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক । সেই থেকে বাবা শশুরবাড়িতে আমার নানা, মানে দাদুর সঙ্গে থাকেন, দিয়ারায় চাষবাসের উন্নতির কাজ দেখেন । বাবা আমার মাকে নিজের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাননি, একাই গিয়েছিলেন বিয়ের পরে। গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে মাকে ওই বাড়িতে অ্যাকসেপ্ট করা হবে না । তারপরে আমাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাকেও অ্যাকসেপ্ট করা হয়নি ।
    --স্ট্রেঞ্জ । আমি ভাবছিলাম আমার জীবনের ঘটনাটাই ইউনিক । তুই তো নিজেই একটা ইউনিক সোশিওলজিকাল প্রডাক্ট । তো তুই বাংলা শিখলি কী করে ?
    --বাবার কাছে । আমি বলতে, পড়তে, লিখতে পারি ।
    --বাবা বাঙালি হলে না শেখার কারণ নেই, যদিও আমরা মাতৃভাষার, মানে মায়ের ভাষার কথা বলি, আদপে কিন্তু বাবার ভাষাটাই শিখি সবাই । তুই তো গ্রেট ।
    --আপনার জামাইবাবুর বাড়ির ঠিকানাটা দেবেন আমায় । নিকিতাকে প্রথমেই দিয়ারায় আমাদের বাড়ি নিয়ে গেলে ওর মাথা খারাপ হয়ে যাবে । আমার তো বাঙালি আত্মীয়স্বজন নেই, আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবো ওকে । যদি আপনার ফ্যামিলিকে দেখে অ্যাডজাস্ট করতে পারে, তাহলে নিয়ে যাব দিয়ারার গংগোতা পাড়ায় ।
    --লিখে নে না । আমি বরং জামাইবাবুকে একটা চিঠি লিখে তোকে দিয়ে রাখছি, যখনই তোর গার্লফ্রেণ্ডকে নিয়ে যাবি চিঠিটা সঙ্গে নিয়ে যাস । তোর নাম জানিয়ে ফোন করে দেব । আমরা মালকানগিরি থেকে চলে গেছি ছত্তিশগড়ে, আমার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান এড়াবার জন্য। দিদি-জামাইবাবু নারায়ণপুরে বাড়ি করেছেন, এখন তো নারায়ণপুর জেলা শহর, আগে যাতায়াতে বেশ অসুবিধা হতো । সরি ফর দ্য অ্যাবিউজেস । সামলাতে পারি না, বুঝলি । এত ছোটো ছিলাম যে মা-বাবার মুখও মনে নেই । ওনাদের মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। পুলিশের লোকেরা লোপাট করার জন্য শব তুলে-তুলে জলে ফেলে দিয়েছিল ।
    --ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান ? অসুবিধা না থাকলে বলতে পারেন ।
    --১৯৭১-এ ঢাকায় আমার দিদিকে চারজন রাজাকার রেপ করেছিল, জামাইবাবু অ্যাবর্ট করাতে দেননি। ইন ফ্যাক্ট, জামাইবাবু দিদিকে মালকানগিরিতে বিয়ে করেছিলেন, দিদি যখন প্রেগন্যান্ট, বিষ খেয়ে সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন দিদি। তখন মালাকানগিরিতে ডাক্তার-ফাক্তার ছিল না, জঙ্গল এলাকা, নব্বুই বছরের একজন বুড়ি ওকে জড়িবুটি খাইয়ে বিষ বের করে দিলে, জামাইবাবু দিদিকে ইমোশানাল সাপোর্ট দ্যান, বাচ্চা হবার কয়েকমাস আগে বিয়ে করেন ।
    --আমি তাই ভাবতুম যে আপনি দলিতদের এক্সট্রিম লেফটিস্ট ইউনিয়ানে কেন ঢুকেছেন । আপনার পারসোনাল ব্যাকগ্রাউণ্ড তো জানা ছিল না ।
    --এক্সট্রিম লেফটিস্ট ? স্ট্রেঞ্জ ওয়র্ড । দিল্লির সংসদবাজ লেফটিস্টদের দেখছিস তো ? অনেকে জে এন ইউতে এসে কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছে মাঝে-সাঝে, হোয়াট ফর ?
    --দণ্ডকারণ্য তো এখন শুনি আলট্রা লেফটিস্টদের ঘাঁটি ।
    --এই লেফটিস্ট ওয়র্ডটা কাইন্ডলি বারবার উচ্চারণ করিসনি । পোঁদ জ্বালা করে । আই হেট দেম ।
    --অলটারনেটিভ ওয়র্ড কী ?
    --প্রতিশব্দ নেই । মাওওয়াদকে প্রতিশব্দ বলা যায় না । মাওওয়াদ ইজ এ সেল্ফকনফিউজড ডগমা ।
    --কেন ? আমি যদিও মাওওয়াদ সম্পর্কে বিশেষ জানি না, কাগজে পড়ি, ব্যাস ওইটুকু । সিলেবাসে্ও নেই।
    --ওদের লক্ষ্য হল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক জবরদস্ত গণআন্দোলন, ইংরেজি মাইটিকে বাংলায় জবরদস্ত বলা ছাড়া অন্য ওয়র্ড আছে কিনা জানি না ।
    --আমার বাংলা নলেজ আপনার চেয়ে খারাপ, হাফ বেকড । ইন ফ্যাক্ট সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারটাই যে কী তা ঠিকমতন বুঝি না । সবকটা রাজনীতিককেই তো মনে হয় সাম্রাজ্যবাদী, যে যার নিজের এমপায়ার খাড়া করে চলেছে ।
    --কী করে তুই স্নাতক হলি রে ? টুকলি ? না তোর হয়ে অন্য কেউ পরীক্ষায় বসেছিল ? মওকাপরস্ত তেঁদুয়া কহিঁকা । হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে বিধ্বস্ত করতে চায় মাওওয়াদিরা, গড়ে তুলতে চায় পাওয়ারফুল আর্বান মুভমেন্ট, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির সাহায্যে, কেননা কেতাবি মার্কসবাদ মেনে সশস্ত্র কৃষকদের সংঘর্ষ এদেশের কৃষিকাঠামোয় দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয় । ভারতীয় বহুত্বওয়াদি বাস্তবতার ক্ষেত্রে ওগুলো কোনোটাই লাগু হয় না ; তাছাড়া পৃথিবীতে কী ঘটছে সেদিকেও তো তাকাতে হবে । পৃথিবী তো রামচন্দ্রের বনবাসের দণ্ডকারণ্যে আটকে নেই, রামচন্দ্রের নির্বাসনের পথটাই নাকি রেড করিডর ।
    --রিয়্যালি ? এই ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা জিনিসটাও বুঝলুম না ।
    --যা যতটা বুঝেছিস, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক । জে এন ইউতে কয়েকজন নেপালি ছাত্র আছে, ওই তুই যাদের বলছিস একস্ট্রিম বা আলট্রা লেফটিস্ট । তাদের একজন, চিনিস বোধহয়, জনক বহুছা, ওর মতে রেড করিডর হল যে পথে গৌতম বুদ্ধ নেপাল থেকে বেরিয়ে তাঁর বাণী বিলিয়েছিলেন ভারতবর্ষের গ্রাম-গঞ্জ-বনপথে।
    --বলুন না, থামলেন কেন ? ইনটারেসটিং ।
    --দণ্ডকারণ্যে ওরা বৌদ্ধবিহার বানায় না, যা বানায় তার নাম দলম । দলমরা বানায় জনতম সরকার। দলম, জনতম এটসেটরা শব্দ থেকে বুঝতে পারছিস যে ডিসকোর্সটা তেলুগু ডমিনেটেড । ডিসকোর্স বুঝিস তো, না তাতেও গাড্ডুস ? এর আগে মানুষের ইতিহাসে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতরা সন্ত্রাসের সাহায্য নেয়নি । ওদের মতে শোষিতদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এখন সন্ত্রাস ।
    অপু নিজেকে নিঃশব্দে বলতে শুনল, সনাতন বোধহয় মায়াবতীর দলের ভাবুক, আর এগোনো উচিত হবে না । বলল, আপনার পিসতুতো দিদির কথা বলছিলেন, যিনি আপনার অভিভাবক, তাঁর গল্প বলুন না , আপনার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশানের, যদি অসুবিধা না থাকে।
    --বললাম বোধহয় একটু আগে, দিদি বাচ্চাটাকে অ্যাবর্ট করায়নি, জামাইবাবু করাতে দেননি । ভাগ্নেটা জানতে পেরে দু-দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল । ভাগ্নের বয়স অবভিয়াসলি আমার চেয়ে বেশি, সেভেন্টিটুতে জন্মেছিল, আর আমি জন্মেছি ওর পাঁচ বছর পর, ভাগ্নেদা বলে ডাকি । ওকে ওর বাবার নাম জিগ্যেস করলে ও আনকনট্রোলেবলি উন্মত্ত হয়ে যায়, বলে, আমার বাবা একজন নয় চারজন, বাবাদের নাম জানি না । দিদি-জামাইবাবুর চোখাচোখি বড় একটা হতে চায় না কার্তিক, বাড়ির বাইরে সময় কাটায় । আমার ভাগ্নের নাম কার্তিক সরকার । ওকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিল, নারায়ণপুর থেকে রায়পুর, কিংবা অন্যা নন-মোটোরেবল জায়গায় যাত্রীদের নিয়ে যায় ; সব জায়গায় তো বাস যায় না, মোটোরেবল রোডও বিশেষ নেই নারায়ণপুর জেলার ফরেস্ট এরিয়ায় । আগে তো রেসট্রিকশান ছিল ফরেস্ট এরিয়ায় যাবার, মুরিয়া, মাড়িয়া আর গোঁড় উপজাতির লোকেরা থাকে ওখানে, ষাট বছরে কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়নি, সার্ভে হয়নি, সেনসাস হয়নি ।
    --সরকারি অফিসাররা যেতে চায় না, না ? সব রাজ্যে একই ব্যাপার ।
    --যেটুকু কাজ তা রামকৃষ্ণ মিশন করে, এমন কি রেশনের দোকান আর স্কুলও মিশনই চালায় । বিজলি নেই, পানীয় জল নেই, মাসে এক-আধ লিটার কেরোসিন, ব্যাস ।
    --ফরেস্ট এরিয়ায় গেছেন ?
    --না তেমন করে যাইনি, রেসট্রিকশান ছিল এতদিন । নদীর জল নিয়ে, জঙ্গলের গাছ নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি হয়েছে । তারপর গোপনীয় সৈনিক, স্পেশাল পুলিশ অফিসার, অগজিলিয়ারি ফোর্স আর সালওয়া জুড়ুমের নামে উপজাতিদের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করানো হল । ভারতের সংবিধান ওই অঞ্চলে অস্তিত্বহীন । সালওয়া জুড়ুম আর আধামিলিট্রির সাহায্যে জঙ্গলে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা হল জাস্ট নাইটমেয়ার । কতকাল যে চলবে লড়াইটা, কেউই জানে না । ইনডিয়ার আকরিক খনিজের মানচিত্র আর ট্রাইবাল ডেনসিটির মানচিত্র একই, বুঝলি ? যারা আকরিক খনিজ চায় তারা আদিবাসিদের উৎখাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে ; তাদের চাই-ই চাই । প্রতিরোধ করার জন্য যা-যা করা দরকার তা আদিবাসীরা করে চলেছে , এসপার নয়তো ওসপার । ইয়াতো করনা হ্যায়, নহিঁতো মরনা হ্যায় ।
    অপু চুপ করে রইল, যে বিষয়ে কিছুই জানে না সে ব্যাপারে বেফাঁস কিছু যাতে না বলে ফ্যালে । প্রসঙ্গের খোঁচা ভোঁতা করার জন্য বলল, কী-কী গাছ হয় জঙ্গলে ?
    --সব তো আর জানি না, তবে প্রচুর পলাশ, মহুয়া, আমড়া গাছ দেখেছি । আর আছে চিকরাসি, জিলন, শিমুল, উলি, বডুলা, কড়ুয়া পাঙার, পিছলা, জারুল, জংলি বাদাম, ছাতিম এইসব ।
    শুনে, বুঝতে পারল অপু, ওর বাংলা জ্ঞান দিয়ে গাছের নাম চিনতে পারছে না । দিয়ারায় বসবাস করে গাছের নাম জানতে চাওয়া বোকামি হয়ে গেছে । কেবল মাথা দুলিয়ে সায় দিল, বোঝার ভান করে ।
    --মালিক মকবুজা শুনেছিস ?
    --না, কার লেখা ?
    --তুই তো পুরো চুতিয়াছাপ মূর্খ থেকে গেছিস রে, পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল গাণ্ডু । মালিক মকবুজা হল একটা স্ক্যাণ্ডালের নাম ।
    --না শুনিনি । বিহারে রোজ এতো স্ক্যাণ্ডাল হয় যে অন্য রাজ্যের স্ক্যাণ্ডাল পড়ার দরকার হয় না ।
    --ট্রাইবালদের ওনারশিপের নাম মালিক মকবুজা । দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে প্রচুর সেগুনকাঠের গাছ ছিল আর সেসবের মালিক ছিল স্হানীয় আদিবাসীরা । টিমবার মাফিয়ারা প্রশাসন আর রাজনীতিকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আদিবাসীদের ঠকিয়ে সেগুনের গাছগুলো কেটে পাচার করে দিত, ইসকি... । সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে লোকায়ুক্ত একটা কমিটি গড়ে রিপোর্ট চেয়েছিল । রিপোর্টে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে নিচেতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত প্রশাসন সেগুনগাছ কাটায় আর ট্রাইবালদের ঠকানোয় ইনভলভড । সেসময়ের বস্তারের কমিশনার নারায়ণ সিং আর সালওয়া জুড়ুমের জন্মদাতা মহেন্দর করমার বিরুদ্ধে ছিল প্রধান অভিযোগ । কিন্তু অ্যাজ ইউজুয়াল সে রিপোর্ট ধামা চাপা পড়ে গেল, কারোর কিছু হল না, মাঝখান থেকে আদিবাসীগুলো জমিও হারালো আর জমির ওপরের সেগুনকাঠের গাছগুলোও, ইসকি...। রিপোর্টে দেখানো হয়েছিল যে আদিবাসীদের শহরে নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখিয়ে বা ধমক দিয়ে বা চকচকে বোতলের মদ খাইয়ে চুক্তিতে টিপছাপ করিয়ে নেয়া হয়েছিল । যখন হইচই হয়েছিল তখন সেগুনগাছের গুঁড়িগুলোর চালান বন্ধ ছিল, তারপর সংবাদ মাধ্যম ভুলে গেল, পাবলিকও ভুলে গেল । সংবাদ মাধ্যম যে কাদের, তুই তো জানিস, ইসকি...।
    --কিছুদিন আগে মারা গেছে, সেই লোকটাই মহেন্দর করমা, না ?
    --হ্যাঁ, মাওওয়াদিদের অনেকদিনের পেয়ারা সনম ছিল । সালওয়া জুড়ুমের ভয়ে প্রচুর আদিবাসী ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে অন্ধ্র আর মহারাষ্ট্রে ; ওদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হতো, ফসল কেটে নেয়া হতো । সরকারি অফিসাররা বলে যে মাওওয়াদিদের ভয়ে ওরা ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে । দাঁতেওয়াড়ায় হাই টেনশান লাইন উড়িয়ে দশদিন অন্ধকার করে দিয়েছিল মাওওয়াদিরা । সত্যি-মিথ্যে একাকার হয়ে গেছে আমাদের দণ্ডকারণ্যে । নিম্নবর্ণের বাঙালি উদ্বাস্তুদের অভিশাপ থেকে রাঘব বোয়ালের বংশই মুক্তি পেলো না, এরা তো সব চিতি-কাঁকড়া, ইসকি...।
    --এ তো দেখছি কিছুটা আমাদের দিয়ারার মতন ব্যাপার । উঁচু জাত আর উঁচু চাকরির মতলবখোরি !
    --আদিবাসীদের জমিজমার কোনো রেকর্ডও সরকারি দপতরে পাওয়া যায় না, ইসকি...। একবার ছানবিন করে জানা গিয়েছিল যে দুজন মুখিয়ার পাঁচশ একর করে জমির মালিকানার পাট্টা আছে, আর কারোর নামে কোনো প্রমাণ নেই। জমি নেই তো কিষাণ ক্রেডিট কার্ড হবে না । অনেকে ভোটার কার্ড কাকে বলে জানে না, বি পি এল কাকে বলে জানে না ।
    --ওফ, বড় বেশি কমপ্লিকেটেড আপনার এনভিরন । যাকগে, রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যেতে কোন কোন শহর পড়ে বলুন ? আপনার দিদিকে দেখতে ইচ্ছে করছে । সেলাম জানাতে ইচ্ছে করছে ।
    --কথাটা সেলাম নয়, প্রণাম ।
    --হ্যাঁ, হ্যাঁ, কারেক্ট, সরি ।
    --ভিলাই, দুর্গ, দাল্লি রাজহরা, ভানুপ্রতাপপুর, তারপর নারায়ণপুর । তবে রায়পুর থেকে মোটোরেবল রোডও আছে । কোন রাস্তায় যাবি তার ওপর নির্ভর করে দূরত্ব, ২২৫ থেকে ২৭৫ কিলোমিটার খানেক হবে । শর্টকাট রাস্তা হল রাওঘাট হয়ে । এখন অবশ্য বয়লাডিলার খনির জন্যে এলাকাটায় চহলপহল দেখা দিয়েছে । আগে মাওওয়াদিরা কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিল, এখনও ওড়ায় মাঝে-মধ্যে, রাস্তার মাঝখানে লাশ পড়ে থাকে, পুলিশ ভয়ে সরায় না, সরাতে গেলেই বোমা ফাটার সম্ভাবনা ; মরেওছে অনেক সিপাহি জওয়ান । আসাম থেকে, হরিয়ানা থেকে, তামিলনাডু থেকে, চাকরি করতে এসে বেচারাদের কি বিপত্তি ।
    অপুর জ্ঞান সীমিত, টের পেল অপু, দিয়ারাও তো প্রায় আদিনিবাসীদের অঞ্চল ।

    বারো
    পৃথিবীর উঠাপটক-জোড়তোড় সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর রাখেন অপুর বাবা, অখবার পড়েন, আংরেজি টিভি দ্যাখেন, স্কুলে আর কালেজে যা শেখানো হতো সেসব বাবা জানেন, পড়া বুঝিয়ে দিতেন । মারোয়াড়ি কলেজে পড়ার সময়ে অনেক সাহায্য করেছেন বাবা । সকলে শহরে কোচিং পড়তে অঢেল টাকা খরচ করে, ওকে, অপুকে, করতে হয়নি । দাদু কিছুই জানেন না, খেতের রোপনি, কাটাই, মাল বিক্রি, লেন-দেন, পহলওয়ান সাপলাই আর রংদারি ট্যাক্স ছাড়া। অপুকে কোনো কথা বোঝাতে হলে মায়ের মাধ্যমে বোঝান বাবা। মা যদি তা না বোঝেন তখনই বাবা নিজে বিষয়টা নিয়ে অপুর সঙ্গে কথা বলেন ।
    --আরে উ অব বচ্চা-বুতরু হ্যায় কাআআআআআ ? করনে দিজিয়ে জো মন মেঁ আবে । কৌনো মৌগি কে সাথ নহিঁ না ফঁসা হ্যায়, না আপকে তরহ দিন-দহারে দারু কা নিসা করতা হ্যায় । কহিয়েএএএএএ ।
    --সসুরজি উসকো এতনা রুপয়া দে-দেকে খরাব কর রহে হ্যাঁয় ।
    --আরে রুপয়া হ্যায় কিস লিয়ে ? আপ কোই সোনে কা মুরত হ্যাঁয় কি আপকা বেটা হীরা-জওহারাত কা মুরত হোগা ? মগর ডরপোক নহিঁ হ্যায় আপকে তরহ । পহলওয়ান লেকে নহিঁ ঘুমতা হ্যায় মেরা বেটা । কা কহ রহেঁ হ্যাঁয় হম, সুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ ? আপনার আর আমার বাবার চাপে পড়ে আমার ছেলের ঘাড়ে দুটো মাথা গজিয়েছে, বিষ্ণু ভগওয়ানের আর ভস্মলোচনের , ও নিজেই বুঝতে পারে না যে কোন মাথাটার নির্দেশ কখন শুনবে। মাথা দুটোর লড়াই একদিন ওকে ডোবাবে । দুটো মাথার একটাও আমার কথা শোনে না । যখনই ফোন করি ফোন কেটে দিয়ে বলে ব্যস্ত আছি, এখন বিরক্ত কোরো না । ছেলেটা দিল্লি গিয়ে একদম সরফিরা হয়ে গেছে ।
    --মেরে তরহ গোরাচিট্টা হ্যায় উ । বাল ভি মেরে তরহ ঘুংরালি । অন্য কাউকে বিয়ে করতিস তো কয়লার খাদান থেকে বেরোনো কুলির চেহারা নিয়ে জন্মাতো ।
    --কয়লা খাদানের মজা লুটবেন বলেই তো থেকে গেলেন । এমন কচি কয়লাখনি তো আর পেতেন না, যাতে ঢুকতে দু’ঘণ্টা ধরে গলদঘর্ম হয়েছিলেন । লেকিন লম্বাই-চওড়াই ওকর নানাকে তরহ হ্যায় নাআআআআআ?
    --মজা ? কেঁচোর মাটিখাওয়া আবার মজা নাকি !
    --তবে না তো কী ? প্রথম রাত আমি দাঁতে দাঁত দিয়ে, মুঠো শক্ত করে, চুপচাপ সহ্য করেছিলুম, আপনি কতক্ষণ চেষ্টা করে সফল হয়েছিলেন, ভুলে যাচ্ছেন কেন । আমি জানতুম যে আপনি সফল মানেই দিয়ারায় ঘরজামাই হয়ে থাকা আপনার পাক্কা । মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিলুম যে, গঙ্গায় শুশুক ভেসে উঠেছে মানে আপনাকে আমার চাই-ই চাই, চিরে রক্তারক্তি হলেও, একফোঁটা চোখের জল ফেলব না। আপনার সফলতা আমার সফলতার সঙ্গে মিশে গেল, ছোটোবেলা থেকে স্নান করে-করে গঙ্গার যতগুলো ঢেউ আমার গায়ে জমা হয়েছিল, সেগুলো সেদিন ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল ।
    --হ্যাঁ, তোর ঢেউ তবু ফুরোয়নি । গঙ্গায় স্নান করিস আর নতুন-নতুন ঢেউ গায়ে করে তুলে আনিস ।
    --আপনি তো দেওয়ি-দেওতায় বিসওয়াস করেন না, গঙ্গায় স্নান করে দেখুন না একদিন, সব পাপ ধুয়ে যাবে।
    --কোনো পাপই করিনি আমি যে পাপ ধোবার জন্য তোর গঙ্গায় স্নান করতে হবে । পাপ অন্যেরা করে, আমি তার পূণ্য ভোগ করি ।
    জামাইবাবা সুশান্ত ঘোষের মেয়েও হয়েছিল, অপুর জন্মের এগার বছর পর । ওনাকে বোঝানো হয়েছিল, দিয়ারায় মেয়ে-বাচ্চা অশুভ বলে তাকে একদিনের বেশি বাঁচতে দেয়নি তারিণী মণ্ডলের বউ, মানে জামাইবাবার শাশুড়ি । দিয়ারার খেত এত উর্বরা কেন , যুক্তি দিয়েছেন শাশুড়িমাইয়া ; তার কারণ দিয়ারায়-দিয়ারায় পোঁতা আছে সীতামাইয়ার কন্যা-সন্তানরা, তারা মাটির তলায় নাল ফেলে-ফেলে জমিকে উর্বরা করে দ্যায় । জানতে পেরে, যদিও সুশান্ত ঘোষের গেঁয়ো বউয়ের ততটা মনখারাপ হয়নি, জামাইবাবার হয়েছিল । তারপর উনি নিজেকে স্তোক দিয়েছিলেন, যে, শহুরে মগজ নিয়ে দিয়ারার নৈতিকতা যাচাই করা অনুচিত ; যেমন ভুঁইসমাজ তেমন তার আচার-বিচার, তেমন তার সত্য, তার নৈতিক নিয়মাবলী ; কে বাঁচবে কে মরবে তার নির্ণয় নেবার অধিকার তো যে নিচ্ছে তার ।
    ওনার শশুর, তারিণী মণ্ডল, কাউকে উড়িয়ে দেবার হুকুম দিলে, যাকে ওড়ানো হচ্ছে তাতে তার কোনো নির্ণয় নেবার নৈতিক অধিকার থাকে না, কেননা সে এমন কাজই করেছে যে তাকে চলে যেতে হবে । তিনি কিডন্যাপ হলেন, তাতে তো তাঁর নিজের কিছু করার ছিল না । নির্ণয় নিয়েছিলেন হবু-শশুর ।
    মেয়ের মুখটুকু দেখা হল না বলে আপশোষ থেকে গেছে অপুর বাবার । যখনই মনে পড়ে, শরীর খারাপ হয়ে যায় । তরমুজের গুলাবি মদ নিয়ে বসেন ।
    আসল কারণটা অবশ্য সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা বউই ফাঁস করে দিয়েছিল, সারা গায়ে ডেওডেরেন্ট উড়িয়ে, যখন একদিন রাতে মরা মেয়ের শোকে তরমুজের চোলাই করা মদ খেয়ে একা-একা কাঁদছিলেন । বউ বলেছিল, কেঁদে আর কী হবে ? ছেলে জারজ হলেও তার বিয়ের সমস্যা হয় না । কিন্তু জারজ মেয়েকে কে বিয়ে করত ? আপনি তো এমন মানুষ যে মনের মতন পাত্র কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে দিতে পারতেন না ; আজকালকার ছেলে, কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে দিলেও সে পালিয়ে যেত কিনা বলা যায় না । তারপর আবার কাজিয়া-খুনোখুনি, বিশ-পচিশ লাশ ইধর তো বিশ-পচিশ লাশ উধর ।
    ভাগলপুরের দিয়ারা অঞ্চলে সুশান্ত ঘোষ নিজে একাই এসেছিলেন, বাড়ির কাউকে না জানিয়ে, তারিণী মণ্ডলের খুংখার ক্রিমিনাল দলের সাহায্য নিয়ে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় বেদখল হয়ে-যাওয়া জমিজমার পুনর্দখল নেবার মতলব নিয়ে । সুশান্ত ঘোষ অফিসের বিহারি সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে ভাগলপুরের নাথনগর, আর বিহপুর থানার কসমাবাদ, দুধলা, বৈকুন্ঠপুর, তেতিস, অমরি, নকরটিয়া, অজমেরিপুর, ভগবতীপুর, দিলদারপুর, রত্তিপুর, ওদেদিয়া, কাহেওয়ারা, গিরিপুর, চোওহদ্দি, রাঘোপুর, গঙ্গাপুর, রসতপুর আর শাহপুরের গ্রামগুলোতে রাজত্ব করে একদল খুনি, তারিণী মণ্ডল, মলহারিয়া মণ্ডল, লালে মণ্ডল, ডুব্বা মণ্ডল আর সন্তান মণ্ডলের পহলওয়ানরা -- আধুনিক সমাজের বাইরে মারকাট অঞ্চল ।
    ইংরেজদের সময় থেকে কোনো তারতম্য হয়নি এই দিয়ারার মানুষদের জীবনধারায়, সংঘর্ষে, দারিদ্র্যে, শোষণে । যার যত পেশিশক্তি তার তত জমিন আর জলপ্রবাহ, গঙ্গার ধারের জমিন, গঙ্গার মাঝে জেগে ওঠা জমিন, আর গঙ্গার জলপ্রবাহ । ১৯৫৯ থেকে ভাগলপুরে গঙ্গানদীর তীরে একশো আটত্রিশটা গ্রামে ভূমিসংস্কারের চেষ্টা বারবার ভেঙে গেছে । কাগজে-কলমে যে-ই মালিক হোক না কেন, খুংখার খুনি গিরোহদের সমর্থনে দখলে রাখতে হয় ছুঁচের ডগার সমান জমি আর তর্জনী-বুড়ো আঙুলে ছেটানোর সমান জল । সুশান্ত ঘোষ ব্রিফকেস ভরে লাখ দেড়েক টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের সাহায্যে নিজেদের পিপারিয়ার জমিদারির জমিজমা ফেরত পাবার ষড় কষতে ।
    জমিজমার দখল নিতে গিয়ে নিজেই জবরদখল হয়ে গিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ । সেই কাঁচা যৌবনে, তখনই, তাঁর চেহারার খোলতাই ছিল অবাঙালি, প্রায় মারোয়াড়ি । পাঁচ ফুটের ফর্সা গালফোলা ঘাড়ে-গর্দান কোঁকড়াচুল চনমনে । অথচ বাঙালি বলে, মুঙ্গেরের পিপারিয়া গ্রামে, যেখানে ওঁদের জমিজমা, সেখানে যাওয়া, ফসল তোলা, এতোয়ারি হাটের খাজনা আদায় সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । ওনার বাবার ঠাকুর্দা, মানে ঠাকুর্দার বাবা, হাইকোর্টে, তখন কলকাতায় মামলা লড়তে হতো, ভূমিহার রাজনাথ সিংকে ফৌজদারি মামলায় জিতিয়ে দেয়ায়, মুঙ্গেরের রোমহর্ষক দিয়ারায়, দুশো একর জমি আর সাত একর আনাজ বাগান, আর এতোয়ারি হাট ওনার ঠাকুর্দার নামে করে দিয়েছিল ।
    সুশান্ত ঘোষ আগে যাননি কখনও পিপারিয়া । ছোটোবেলায় চাল মুসুর অড়র ভুট্টা সর্ষে পটল কচু আম রাঙা-আলু গাওয়া-ঘি আর হাটের টাকা আসত । তারপর ওখানে কৈলু যাদব, কজ্জল ধানুকদের দলের অপহরণকারী অপরাধীরা এমন জ্বালাতন আরম্ভ করলে যে সুশান্তদের বাড়ির কেউই ওমুখো হবার সাহস যোগাতে পারেননি । কাদের হাতে যে সেই বিশাল সবুজ খেতখামার তা কেবল কানাঘুষোয় শুনতে পাওয়া যেত। বাংগালি-তাংগালি বলে সুশান্ত ঘোষের জ্যাঠা-কাকা-বাবা সেখানে পাত্তা পেতেন না ।
    সত্তরে পৌঁছে বাঁচোখ কানা তারিণী মণ্ডল পাকাপাকিভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন জামাইবাবার হাতে ।
    তারিণী মণ্ডলের সিংহাসনে বসার দিনকতক পর, একদিন রাতে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় তাঁর দলের বাছাই পালোয়ানদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ, বাপ-ঠাকুর্দার জমিজমা দখলের জন্য নয়, সেই জমিজমা যারা দখল করে ওনাদের বেদখল করে দিয়েছে, তাদের সাফায়া করে প্রতিশোধ নেবার জন্য । সাফায়া করার পর তাদেরই তিনটে লাশ আর বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র বোমাবারুদ ফেলে এসেছিল মাধেপুরার আরেকটা দলের অঞ্চলে, যাতে তাদের পারস্পরিক খুনোখুনিটা চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের চেহারা নিতে পারে । নিয়েও ছিল । সেই থেকে মুঙ্গেরের আর মাধেপুরার অপরাধীরা লড়ে মরে জামাইবাবাকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছিল । মারকাট এড়াবার জন্যে শলা করতে বসে ওরা জানতে পারে যে ওদের মধ্যে লড়াইটা বাধিয়েছিল তারিণী মণ্ডলের জামাই ।
    ভোঁসড়িকে ক্যা বাংগালি দিমাগ, হমনিলোগকে চালিস আদমি মর গেলই আপস মেঁ লড়ঝগড়কে । প্রকৃত ব্যাপার জেনে ফেলার পর, পিপারিয়া গিরোহ লোক পাঠিয়েছিল তারিণী মণ্ডল আর তার বাংগালি জামাইকে খুন করার জন্য । সাতসকালে ট্রাক চালিয়ে এসে, সামনেই তারিণী মণ্ডল আর মন্হরা দেবীকে পেয়ে যাওয়ায় শশুর আর তার বউকে সাফায়া করার লোভ সামলাতে পারেনি তারা।
    বালিয়াড়িতে দুই চিতার ওপর সাজানো দাদু-দিদিমার শব দেখে পর্যন্ত অপু নিজেকে বুঝিয়েছিল যে বদলা নিতে হলে আজকেই নিতে হবে । শোক-ফোকে ডুবে থাকলে চলবে না । দাদু তো শিখিয়ে গেছেন যে পৃথিবীতে ভয় নামে কোনো ব্যাপার নেই । মনের ভেতরে পোষা অজানা আতঙ্ক ছাড়া বাইরের কোনো কিছুকে ভয় করতে নেই । বুলেটই হল চিরসত্য ।
    একবার নিজের মাথার ওপর খেত থেকে সদ্য তোলা পটল রেখে, তখন ওর বারো বছর বয়স, দাদুকে বলেছিল, চালান গুলি, দেখি কে ভয় পায়, আপনি না আমি । উত্তরে তারিণী মণ্ডল বলেছিল, আমার বাঁচোখ নেই, ডান চোখ এখন খারাপ হয়ে গেছে, জোয়ান বয়স হলে চালাতুম গুলি, দেখিয়ে দিতুম তোকে, চশমা পরে তো আর এক-নল্লা চালানো যায় না । অপু বলেছিল, ডরপোক কহিঁকা ।
    --আমি আর ডরপোক ? আমার নাম শুনলে সরকারি অফিসাররাও হেগে ফ্যালে, জানিস তো, আমি হলুম মূর্তিমান ত্রাস । আচ্ছা, আমি রাখছি পটলটা মাথার ওপর, তুই চালা ।
    --আমার তো আর এখন অত টিপ হয়নি । পাঁচদশ বছর যাক তখন দেখবেন, দেয়ালের পিঁপড়েকেও একশ মিটার দূর থেকে গুলি চালিয়ে মেরে দেখাবো । পিস্তল-বন্দুক চালাতে শেখাচ্ছেন তো আপনিই ; দেবো গুরুদকছিণা, চিন্তা করবেন না।
    --তোর বাপকে আর মাকে বলিসনি যেন যে তুই পিস্তল-বন্দুক চালাতে শিখছিস । শসার শাঁষ দিয়ে হাত পুঁছে নে, নয়তো তোর মা হাত শুঁকলে বারুদের গন্ধ পেয়ে যাবে ।
    --জানি ।

    তেরো
    রাত নামতেই চারটে মেছো নৌকো আর একটা গাদাবোটে নম্বরপ্লেট-খোলা মোটরসাইকেল চাপিয়ে, বাবা সুশান্ত ঘোষকে না জানিয়ে, গংগোতা গ্যাঙের দলবল নিয়ে চুপচাপ মাধেপুরায় পৌঁছে গিয়েছিল অপু । সঙ্গে দশটা জেরিক্যানে পেট্রল । পটলের পাহাড়, তরমুজের ঢিবি, ভুট্টাগাছের কাটা আঁটির ডাঁই আর শুয়োর-ছাগলের খোঁয়াড়ে পেট্রল ঢেলে বোমা মেরে আগুন যখন দাউ-দাউ, অপু একে-সানতালিস চালিয়েছে ঝোপড়িগুলোকে লক্ষ্য করে ।
    মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে ঠেলে দিয়েছে উল্টো দিকে, আর নিজেরা চুপচাপ ফিরেছে নৌকোয় চেপে ।
    --আপ্পু, চল অব, ছোড় দে, সব মর গয়া হোগা । সঙ্গীদের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে, থেমেছিল অপু । অন্ধকারে কোনো কিছু নড়তে দেখলেই গুলি চালিয়েছিল, বেরহম । সবুজ পটলের পাহাড় পেট্রলের আগুনে ঠিশ-ঠাশ লাফিয়েছে দিকবিদিক, পাকা পটলগুলো হলদে ছ্যাদলামাখা কালো দাঁত থেকে আগুনের ফিনকি বের করে অট্টহাসিতে গলা ফাটিয়েছে। কালচে তরমুজরা শ্মশানে চিতায় শোয়া খুলির মতন ফেটে লাল রঙের ঘিলু উড়িয়েছে অন্ধকারের মহোল্লাসে । ভুট্টার খোসার ভেতরে গচ্ছিত পাকা দানাগুলো হাতবোমায় ভরা ছররার ঢঙে ফরফরিয়েছে ।
    পরের দিনই স্হানীয় সংবাদপত্রের শিরোনামে তারিণী মণ্ডল ও তার স্ত্রীর হত্যা আর মাধেপুরায় নারীশিশু মিলিয়ে তেত্রিশজনের জ্বলেপুড়ে বা গুলি খেয়ে মরার খবর । তার পরের দিন সর্বভারতীয় মুদ্রিত আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, আতংকওয়াদি নেতা আপ্রাধি ঘোষের নেতৃত্বে অতর্কিত হামলায় শতাধিক নিহত । পুলিশের ডিজিকে ওপরতলা থেকে গোপন হুকুম দেয়া হয়েছে যে আতংকওয়াদিদের নেতাকে যদি ধরা যায়, তাহলে, যদি সে ধরা দিতে না চায়, তাহলে, দেখামাত্র তাকে, আপ জানতে হ্যাঁয় কেয়া করনা হ্যায় । একটা মুদ্রিত মাধ্যমে নামকরা সাংবাদিক উত্তরসম্পাদকীয়তে লিখেছে, বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে যে লোকটা প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল, আর ওর প্রকৃত নাম আপ্রাধী ঘোষ নয় ।
    অপু নিজেকে তারিণী মণ্ডলের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে, শুনে, খেপে গেলেন সুশান্ত ঘোষ । ভ্যাপসা অন্ধকারে বসে, মেঠোগন্ধা স্ত্রী বেবিকে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে, যেভাবে উনি কখনও আজ পর্যন্ত কথা বলেননি, বললেন, আমি নিজে কোনোদিন বন্দুক-পিস্তল চালাইনি, আমার লুঙ্গিতে এই অটোমেটিক পিসতলটা শুধু গোঁজাই থাকে, চালিয়ে মাঝে-সাঝে টেস্ট করার হলে রামশরণ করে, আমি ট্রিগারও ছুঁয়ে দেখিনি । আমি অপুকে কোনো অস্ত্র-শস্ত্রে হাত দিতে দিইনি, তোর মাথায় ছোটোবেলায় হাত রেখে ও শপথ করেছিল যে জীবনে কোনোদিন ও বোমাবারুদ গুলিগোলা বন্দুক রাইফেলে হাত দেবে না । এটা কী করে হল ? কে শেখাল ওকে ? নিশ্চই ওর দাদু কোনো ফাঁকা দিয়ারায় নিয়ে গিয়ে নিশানার অভ্যাস করিয়েছে ; তুই আমায় জানতে দিসনি, তুইও চেয়েছিস যে তোর ছেলে আমার মতো নয়, তোর বাবার মতন খুনি কিডন্যাপার অপরাধী হোক । এখন কী করবি ? তোর ছেলেকে খুন করার জন্য নিশ্চই বেরিয়ে পড়েছে শত্রুরা ।
    সতত কলহাস্যময় বেবি এখন নিঃশব্দে, দুঃখ-মেশানো ক্রোধে, চোখের জল ফেলছিল ; সম্ভবত বাবা-মার অপঘাতে মৃত্যুর কারণে। চোখ মুছে, দাঁতে দাঁত রেখে, বিরক্তির স্বাচ্ছন্দ্যে, বলল, আমিও জানতাম না যে ও বন্দুক চালানো শিখেছে ; দিয়ারায় বাচ্চারা ছোটোবেলা থেকেই কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা চালাতে শেখে । ও-ও হয়তো সেভাবেই শিখেছে ।
    নৃশংস ঘটনার অতর্কিত বিহ্বলতায় বিচলিত ও বিমূঢ় সুশান্ত বসেছিলেন দাওয়ায় বাঁশের বেঞ্চে, ফলসা আর খিরনিগাছের তলায় । অপুকে কি ভাবে বাঁচানো যায় চিন্তা করছিলেন ।
    বেবির পরবর্তী কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সুশান্ত ঘোষ ।
    ঠোঁটের কোনে উত্তজনার দুঃসাহসী ফেনায় হতচেতন বেবি, ভয়ার্ত শ্রদ্ধায়, বলল, আপনি তো খুশিই হলেন আমার বাবা ওভাবে খুন হওয়ায়, রাস্তার মাঝখানে জানোয়ারের মতন, মুখ দেখে আর চেনার উপায় ছিল না যে ওই লোকটাই তারিণী মণ্ডল । আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করে আপনার জমিদারি বেদখলের বদলা নিতে লোক পাঠিয়েছিলেন । অন্য সবাইকে বোকা বানাতে পারেন, আমাকে নয়, আমি আপনার সঙ্গে প্রতিদিন-প্রতিরাত থাকি, জানি আপনকে, কখন কোন গান শুনছেন তা থেকে আপনার মনের অবস্হা বুঝে যাই, কেন বেশি মদ খাচ্ছেন তার আসল কারণ টের পেয়ে যাই । কী দরকার ছিল ? বেশ ভালোই তো ছিলেন, দিয়ারার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে । আসলে আপনি জানতেন যে পিপারিয়াকে আক্রমণ করলে ওরা তারিণী মণ্ডলকে নির্ঘাত খুন করবে । আর আমার বাবা আপনাকে কিডন্যাপ করে আমার সঙ্গে যে জোর করে, চারিদিকে পাহারাদার বসিয়ে, বিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রতিশোধ নেয়া হবে । নয়কি ? নিশ্চই আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করেছেন বিয়ের পর থেকেই, কী করে আপনার কিডন্যাপিঙের আর মুখ্যু কালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ের বদলা নেবেন।
    বেবির কথাগুলো ওনাকে, সুশান্ত ঘোষকে, অবাক করল । তিনি যাকে মেঠোগন্ধা বোকা মেয়ে ভাবছিলেন, সে তো তা নয় । সে ওনার গোপন ইচ্ছের কথা জানে ! কখনও কি ঘুমের ঘোরে বা অত্যধিক মদ খেয়ে বলে ফেলেছেন মনের কথা ? কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক যুবককে রাজধানীর ব্যাপক জীবন থেকে উপড়ে তুলে এনে ফালতু একটা জায়গায় পুঁতে বনসাই করে দেবার কাজের বিরুদ্ধে পুষে রাখা রোষের আগ্নেয়গিরির মুখকে খুলে ড্র্যাগনের আগুন-নিঃশ্বাস ছড়িয়ে সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেবার পরিকল্পনা ?
    বেবির মর্মপীড়া প্রতিবন্ধকহীন, বলতে থাকল, খুন-করার ঋণ খুনের মাধ্যমেই প্রতিশোধ হয়, জানি, ছোটোবেলা থেকে ; বদলা যে নেয় তার মাথার দাম বদলা নেবার সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায় । আপনি তো আলাদা মানুষ ছিলেন, সাক্ষাৎ দেওতা, কী করলেন আপনি ? বিষ খেতে-খেতে ভাবলেন যে আপনি বিষ খেলে যার কাছ থেকে বিষ কিনেছিলেন সেই দোকানদার মারা যাবে, আপনার কিছুই হবে না ।
    সুশান্ত , উদাসীন ক্ষোভে, বাকরুদ্ধ, শুনছিলেন, বেবির উদ্গীরণ, কে জানে কোথায় চাপা দেয়া ছিল, যাকে উনি মেঠোগন্ধা বোকা কথাকিপটে মেয়ে ভেবেছিলেন, তার অন্তরঙ্গ মিশুকে সংযমের আড়ালে ছিল আরেক বেবি।
    বেবি বলল, আপনি আপনার ছেলেকে বসিয়ে বাংলা বলতে পড়তে লিখতে শেখালেন, আমাকে তো শেখালেন না, আমি তো হিন্দিতেও আনপঢ়, আপনি চাইলে আমাকে চোদ্দ বছর বয়স থেকে আপনার বাঙালি বউ করে তুলতে পারতেন । আমাকে আপনি আপনার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাননি । মিষ্টি কথা বলে-বলে আমায় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, তা কি আমি বুঝতুম না ? আজ আপনার কাছে অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।
    সুশান্ত বেবির কথাগুলোর উত্তর দিলেন না, কেবল বললেন, কোথায় অপু, ওর এখানে থাকা চলবে না, এখানে ও হয়তো আজকেই খুন হয়ে যাবে । ওকে একটা মিডিয়া আতংকওয়াদি, আরেকটা মিডিয়া মাওওয়াদি বানিয়ে দিয়েছে ।
    অপু এলে সুশান্ত ঘোষ বললেন, গেট রেডি টু গেট লস্ট । গো ফ্রম দিস প্লেস । যেখানে কেউ তোকে খুঁজে পাবে না এমন জায়গায় চলে যা ।
    অপু কিছু বলতে চাইছিল । ওর নিরক্ষর মা, ইংরেজির একটিও শব্দ না জানা সত্ত্বেও, সুশান্তর মনোভাব আঁচ করে, অবিচলিত কন্ঠে বলল, তোর বাবা যা বলছেন, তা-ই কর । তোর এখানে থাকা চলবে না । তোর দাদুর মতন তুইও রাস্তায় গাড়ি চাপা শুয়োরের মতন মরে পড়ে থাক তা দেখার আগে আমি গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে নেবো।
    ডেস্কটপের মনিটারে গুগল ম্যাপ খুলে, বাবা সুশান্ত ঘোষ অপুকে বোঝালেন , তুই পালা, এই দ্যাখ, ইতুদিদি আর অমিত বর্মণ নামের লোকটা যে জঙ্গলে গেছে তার ম্যাপ, জায়গাটার নাম অবুঝমাড়, কেউ যায় না আদিবাসীদের ওই অঞ্চলে, গুগল সার্চ করে দেখেছি, ইমপ্রেগনেবল ফরেস্ট । প্রথমে দণ্ডকারণ্যের নারায়ণপুরে যাবি, সেখান থেকে হদিশ নিয়ে অবুঝমাড় ।
    সুশান্ত ঘোষ অনুমান করেছিলেন যে পুলিশ এসে ওনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করবে । ছেলেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্হা করে দিয়ে বেবিকে সঙ্গে নিয়ে নিজেও পালালেন দিয়ারার চরে, যেখানে পলিমাটির প্রলেপ-দেয়া চ্যাঁচারির বেড়ায় ঘেরা ঢেউতোলা অ্যাসবেসটসের চালাঘরে দাগি অপরাধীরা, পুলিশ-প্রশাসনকে এড়াবার জন্য, এসে লুকোয় । তারা এসে লুকোলে শহর থেকে নাচানিয়াওয়ালি আনিয়ে তাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্হা করত তারিণী মণ্ডল ।
    সুশান্ত ঘোষ ভেবে দেখলেন যে, যতদিনে পুলিশ ওনাকে ধরবে ততদিনে অপু পৌঁছে যেতে পারবে নাগালের বাইরে । অবুঝমাড়ে পালিয়ে গেছে শুনলে পুলিশের আর কিছু করার থাকবে না ।
    দিয়ারায় বানানো গঙ্গামাটি-লেপা বাঁশের কাঠামোর ওপর বেছানো অ্যাসবেসটসে পাতা খড়ের ছাদের তলায় ফেরারি অপরাধীদের কুকর্মশালায় আশ্রয় নিলেন সুশান্ত ঘোষ । ডিজেল জেনারেটারে চালানো কুলারের ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে ছিলেন চেয়ারে । ওনার চালাঘর ঘিরে, আর নৌকোয় বসে, কুড়ি-পঁচিশজন বন্দুকধারী পাহারাদার, তারা পুলিশের আর শত্রু গ্যাঙদের আক্রমণ প্রতিহত করবে যতক্ষণ পারবে । বেবি আর ওনার মাঝে কথা বলার বিষয় হতে পারত ওনাদের ছেলে অপুর সুরক্ষিত থাকা, নির্ধারিত জায়গায় পোঁছানো । কিন্তু বিবাহ নামের কর্মকাণ্ডের দ্বারা দুজনের যোগাযোগের যে মাধ্যমটি ছিল, যা কিডন্যাপিঙের সূত্রে জোর করে তৈরি সম্পর্কে গড়ে উঠেছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে তারিণী মণ্ডলের মৃত্যুতে। বেবির নিঃশর্ত ভালোবাসা তাঁর সমস্যার সমাধান করতে পারেনি । দেখনপ্রেম হোক বা মাংসঘর্ষণ ভালোবাসা, সেসবের প্রলেপ লাগিয়ে কোনো ঘা শুকোয় না । শশুরের মৃত্যুতে তিনি যেমন গোপন আহ্লাদে মাতোয়ারা, তেমনই ছেলে অপুর অবধারিত গ্রেপ্তার, বিচার ও কারাদণ্ডের, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের, দুশ্চিন্তার চাপা আতঙ্কে বিপর্যস্ত । পারস্পরিক সম্পর্কের সমস্যার সমাধান এই ভাবেই করতে হল, বোঝাচ্ছেন নিজেকে, এ ছাড়া উপায় ছিল না । কিন্তু সে সমস্যার সমাধান হতে দিল না তাঁরই ছেলে। ছোঁ-মারা কিডন্যাপিঙের সময় যেমন আলাদা ছিলেন, এতকাল একসঙ্গে ঘর করে সেই আলাদাই রয়ে গেছেন, মাংসাশী জানোয়ারের হাইবারনেশানে, রেকলুজ, কাস্টঅ্যাওয়ে ।

    চোদ্দ
    মুঙ্গেরের দিয়ারার ঝোপড়িগুলোয় সাতসকালে তাজা রক্তের গন্ধে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বেলেমাছি চ্যানেল, ঘোড়ামাছি চ্যানেল, হোবারমাছি চ্যানেল, সিসিডামাছি চ্যানেল পলিমাটির দরদালানে পৌঁছে গিয়েছিল । ওঃ এত লোক গুলি খেয়ে, আগুনে পুড়ে মরেছে, আর কি থাকা যায়, প্রতিটি মাছি চ্যানেল ভনভনিয়ে ওবি ভ্যান চালিয়ে তড়িঘড়ি দুর্ঘটনার জায়গায় ।
    ঘোড়ামাছি : আপনারা দেখতে পাচ্ছেন এই মুহূর্তে, জনগণমাছিদের ডুমোচোখের সামনে তিরিশ-চল্লিশটি হত্যা হয়েছে অ্যাবং সেই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ড। কিন্তু রাতের অন্ধকারে কারা এই লজ্জাজনক বীরত্ব দেখিয়েছে, তা কেউ বলতে রাজি নন, কেননা স্হানটি অসামাজিক চরিত্রের মাছিদের নিয়ন্ত্রণে । এই যে, ফলেরমাছি, আপনি তো প্রত্যক্ষদর্শী, আপনি কী দেখলেন ?
    ফলেরমাছি : আমি কিছুই দেখিনি, তখন তরমুজের খোসার ভেতরে রাতের ঘুম দিচ্ছিলাম ; আমি গুলির শব্দে বিরক্ত হয়ে পচা তরমুজের ভেতর থেকে উড়তে বাধ্য হয়েছি, তাই আমার গায়ে লাল রং লেগে আছে । আমি এর ঘোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি । আমরা ফলের মাছিরা নির্ণয় নিয়েছে যে আমরা এইপ্রকার আওয়াজ অ্যাবং আগুন, যা শান্তি নষ্ট করে, তার বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবো । তবে গুজবমিশ্রিত অনুমান যে একজন যুবক বদলা নেবার হাতিহাঁক পেড়েছিলেন।
    বেলেমাছি : নীল মাছির দল পৌঁছে গেছেন অকুস্হলে । আপনারা দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই, মানব প্রজাতির একাধিক মহিলার বক্ষস্হল নির্মল আকাশের তলায় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে অ্যাবং তাঁদের যাবতীয় অভিমান নিঃশব্দ বিলাপ হয়ে দৃশ্যমান । দীপঙ্করদামাছি, ক্যামেরাটা একটু প্যান করে দেখান ঘরের মাছিরা ঘরের কাজকর্ম ফেলে কোন আঙ্গিকে এই সামগ্রিক রসপানে অংশ নিতে র‌্যালির পর র‌্যালিতে আসছেন ।
    নীলমাছি : বন্ধুগণ, আপনারা জানেন যে গত কয়েক দশক যাবত ডানার রঙ পালটে পালটে কায়েমিস্বার্থান্বেষী দলবদলু অ্যাবং রংবদলু গুয়েমাছিরা ভুল সংবাদ পরিবেশন করে চলেছেন । রক্তপাত ঘটলেও তাঁরা বলছেন যে রেতঃপাত হয়েছিল...আচ্ছা আমরা এখান থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছি, কেননা মানবপ্রজাতির বহু নমুনা পৌঁছে গেছেন এবং তাঁরা মাছিসমাজ সম্পর্কে অভদ্র কথাবার্তা বলছেন । ব্যাক টু স্টুডিও ।
    হোবারমাছি : সঙ্গে থাকুন ।
    মোদোমাছি : সঙ্গে তো থাকতে চাই গো, কিন্তু কী করে তোমাদের কাঁচের বাক্সটার ভেতরে ঢুকবো তার উপায় তো বাতলাও না ।
    সরকারিমাছি : মানব সম্প্রদায়ের এক প্রতিকল্প তার ঔরস উপন্যাসে, আপনাদের সম্পর্কে যাচ্ছেতাই কথাবার্তা লিখেছে । আপনারা তাকে গিয়ে বিরক্ত করুন, সে-ই আপনাদের সবার সামনে ল্যাংটো করে ছেড়েচে।

    পনেরো

    দিল্লির ওপন টিকিট কাটাই ছিল অপুর । ফোমচামড়ার ব্যাগে তারিণী মণ্ডলের তিজোরি থেকে করকরে নোটের বাণ্ডিল আর কয়েকটা জামাপ্যান্ট নিয়ে, পাটনা গিয়ে সোজা দিল্লি, দিল্লি বিমানবন্দর থেকে রায়পুরে একরাত হোটেলে । পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে আতংকওয়াদি বা মাওওয়াদি আপ্রাধি ঘোষকে । সিকিউরিটি চেকে অশ্বমেধ ঘোষের অসুবিধা হল না । ভাগলপুর স্টেশানের টেলিফোন বুথ থেকে নিকিতাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে ওর ম্যালেরিয়া হয়েছে, ফিরতে মাসখানেক লেগে যাবে । নিকিতা জানতে চাইছিল কী করে ভাগলপুরে অপুর বাড়ি যাবে । অপু বোঝালো, অনেকের ম্যালেরিয়া হয়েছে, শেষে নিকিতা আসলে ওর-ও হতে পারে । নিকিতা বলল, হরওয়খৎ ধোখা দেনে কে চক্কর মেঁ রহতে হো, মুঝে গিনতি মত পঢ়াও, ম্যায় জরুর পহুঁচ জাউঙ্গি, তুমহারে মাতা-পিতা সে মিলনা হ্যায় ।
    অপু মোবাইলের সিম কার্ড বের করে ট্রেনলাইনে ফেলে দিল ।
    রায়পুরে, বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে, বাসস্ট্যাণ্ডের সামনে, ফালতু হোটেল, ওর কাছে পরিচয়পত্র চাইল না, চাইলে ইউনিভার্সিটির পরিচয়পত্র দেখাবে বলে তৈরি ছিল , রেজিস্টারে লেখালিখিও করতে বলল না । রেজিস্টার চাইতে বেঁটে-মোটা-টেকো হোটেল মালিক বললে, আরে এখন ছাড়ুন ওসব ; এখন নদীর নিলাম হবে বলে লোক আসছে আর যাচ্ছে, আসছে আর যাচ্ছে । আপনার ভাগ্য ভালো যে ঘরটা আজ সকালেই খালি হয়েছে।
    --নদীর নিলাম ? অনেক মাছ হয় নাকি ? না নৌকো যাতায়াত করে ?
    --জলের জন্য নিলাম ।
    --জলের জন্য ?
    --শোনেননি আপনি ? রায়গড়ে কুরকেত নদী, দাঁতেওয়াডাতে সাবরি নদী, রায়পুর জেলায় খারুন নদী, কোরবাতে হাদেও নদী, ঝাঙ্গির-চম্পায় মাঁড নদী নিলাম হয়ে গেছে । সাবরি বা কোলাভ নদীর ধারে চিন্তালনাডের জঙ্গলে মাওওয়াদীরা ছিয়াত্তর জওয়ানকে মটিয়ামেট করে দিয়েছিল, কাগজে পড়েননি ? সাবরি নদীই তো উড়িষা আর ছত্তিসগড়কে আলাদা করেছে । উড়িষ্যার কোরাপুট থেকে চালু হয়েছে ।
    --নদী যে নিলাম হয়, এই প্রথম শুনলুম । কোথায় গিয়ে মিশেছে নদীটা ?
    --সাবরি নদী নারায়ণপুর-দাঁতেওয়াডায় প্রথমে পশ্চিম থেকে পুবে, তারপর উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে ভদ্রাচলমের কাছে গোদাবরীতে গিয়ে মিশেছে ।
    --নৌকো চলে ?
    --হ্যাঁ, কিন্তু বন্যার সময়ে নদীর চেহারা পালটে যায় । কখনও-কখনও আঠাশ ফিট পর্যন্ত জল ওঠে । আসেপাশে সব ডুবে যায় । যাতায়াত, এখন যেটুকু দেখছেন, তাও বন্ধ হয়ে যায় ।
    ...অপু আরেকটু হলে অবুঝমাড় শব্দটা উচ্চরণ করে ফেলত । গিলে ফেলল মগজ থেকে জিভে এসে নামা কথাটা।
    --নদীর পাড়ে জংলিরাই থাকে । দণ্ডকারণ্যে কে যে আসলি জংলি আর কে যে মাওওয়াদী জংলি তা আপনি বুঝতে পারবেন না । পুরো দণ্ডকারণ্য জঙ্গলে হয় মাওওয়াদী নয়তো সিপাহিদের জামাত । আর ছিটপুট রিফিউজি, সোয়াধিনতার টাইমে ওরা বাংগালি ছিল।
    --নদী কিনে করবে কি লোকে ?
    --ফ্যাকটিরি বসছে । আপনি কিনতে পারবেন না, অনেক টাকা খাওয়াতে হয় এসব ব্যাপারে । করোড় করোড় । করোড়-করোড় ক্যাশ । নিলাম একটাকায়, পিছুয়াড়িতে করোড়-করোড়, পেটি ভর-ভরকে, খুল্লমখুল্লা।
    --সব জল কি ফ্যাকট্রিই নিয়ে নেবে ? এতগুলো নদীর ?
    --ওই তো কুরকেতি নদীর ধারে গারিয়া জাতের জংলিরা তরমুজ, শশা তারপর রবির মরশুমে রবি চাষ করত, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত, কিন্তু রাবো গ্রামের কাছে ড্যাম তৈরি হল, ব্যাস, জাঁপলি, কিকরিচোলি, দেহজান গ্রামের খেতি বন্ধ হয়ে গেল । এক হাজার মেগাওয়াটের পাওয়ার প্ল্যান্ট বসেছে তামনারে, সব জল খেয়ে নিচ্ছে ফ্যাকটিরি । জংলিদের খাবার জল নিয়ে চলছে হল্লাগুল্লা ।
    --জংলি ?
    --গারিয়া, গোঁড়, মাড়িয়া, মুরিয়া লোকেরা থাকে, গায়ে এক চিলতে জামা-কাপড় নেই, শর্মনাক, শর্মনাক, পুরুষগুলো দিনেরবেলাতেও সালফি মদ খেয়ে টপ্পাগুল বেহুঁশ ।
    --আচ্ছা নারায়ণপুর যাবার সহজ উপায় বলুন তো ।
    --বাসে করে চলে যান । তবে বাসগুলো সবকটা সিটে প্যাসেঞ্জার না পেলে যেতে চায় না । নৌকরওয়ালা বাসেও যেতে পারেন, ওটা রেগুলার, সরকারি নৌকরি করে যারা, নারায়ণপুর জেলা হেডকোয়ার্টার হবার পর পোস্টিং হয়েছে, বউ-বাচ্চা রায়পুরে, তাদের বাসে যেতে পারেন ।
    --মোটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় না ?
    --ভাড়া তো পাওয়া যায় না, তবে আপনার মতন একজন বাংগালি আদমি আছে, নারায়ণপুরে বাড়ি, সে নিয়ে যেতে পারে। ও অনেক ফোটোগ্রাফার আর সাংবাদিককে নিয়ে গেছে, ওই দিকের অলিগলি চেনে ।
    --লোকটাকে খবর দিন না ; আজকেই বেরিয়ে পড়ব তাহলে ।
    --আগে ও মালকানগিরির যে গ্রামে থাকত তার নাম একানওয়ে ।
    --একানওয়ে ? নাইনটিওয়ান ? এরকম নাম কেন ?
    --বাংগালি রিফিউজিরা এসেছিল, সানতালিস, একাওয়ান, পঁয়ষট আর একহত্তর সালে, পরেও এসেছে ছিটপুট । জঙ্গল কেটে বানানো তাদের ঝোপড়পট্টিগুলোর তো নাম ছিল না । এক দুই তিন চার করে হবে বোধহয়, একানওয়ে বানওয়া এমনি করে একশো দুশো, কে জানে, সে অনেকদিন আগের কথা। যুগ কেটে গেছে কিন্তু বাংগালি লোকগুলো রিফিউজির মতনই গরিব থেকে গেছে । মাওওয়াদীরাও ওদের কাছ থেকে…
    --রংদারি ট্যাক্স নেয় ?
    --রংদারি ট্যাক্স । ভালো বলেছেন ।
    --নাম কি ছেলেটার ?
    --কাতিক, কার্তিক ছিল বোধহয়, লেখাপড়া শেখেনি তো, কার্তিককে কাতিক করে ফেলেছে । দেয়োই-দেওতাদেরও সম্মান করে না আনপড় বাংগালিগুলো ।
    --ওর বাবার নাম কি গণেশচন্দ্র সরকার ?
    --জি হাঁ । আংরেজি পড়ান । লেকিন কাতিক অপনে বাপ কো আব্বা পুকারতা হ্যায়, অওর মা কো অম্মি। অজব বাংগালি ।
    --একটু ফোন করে দেখুন না । গণেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতেই যাবো ।
    --এসে যাবে, এসে যাবে, কজনই বা প্যাসেঞ্জার হয়, মোটর সাইকেল সওয়ারি করতে অনেক প্যাসেঞ্জারের সাহস হয় না ।
    --আচ্ছা । তাহলে অপেক্ষা করি ।
    --আপনি কী করেন ?
    --আমি ফিউজিটিভ ?
    --ফিউজিটিভ মতলব ?
    --ভগোড়া ।
    --হেঁঃ হেঁঃ, আচ্ছা-খাসা মজাক কর লেতে হ্যাঁয় আপ ।
    ঘণ্টাখানেক পরে মোটর সাইকেলে গেরুয়া মাটির ধুলো উড়িয়ে কাটাঢ়েঁড়া জিন্সের প্যান্ট আর হাতকাটা লাল গেঞ্জিতে, পাঁচ ফিটের, বছর চল্লিশের একজন দোহারা লোক হোটেলের সামনে পৌঁছে হর্ন দিতে, হোটেল মালিক বলল, নিন, এসে গেছে কাতিক । লোকটাকে দেখে, বাবা একটা শব্দ শেখাতে কয়েকটা চড় মেরেছিলেন, সেই শব্দটা অপুর মগজে ভেসে উঠল, অকুতোভয় ।
    কয়েকটা ধাপ নেমে অপু বলল, হিন্দিতে, আমি নারায়ণপুরের ইংলিশ টিচার গণেশচন্দ্র সরকারের বাড়ি যেতে চাই । উকোখুস্কো চুল লোকটা জিগ্যেস করল, গণেশচন্দ্র সরকার ? তার সঙ্গে কী কাজ ? আজ পর্যন্ত কাউকে দেখিনি তাঁর খোঁজে আসতে । অপু জবাবে বলল, সনাতন সরকার একটা চিঠি দিয়েছেন তাঁকে দেবার জন্য । ছেলেটার চোখ কটা, লক্ষ করল অপু ।
    --সনাতনভাই ? তাঁর সঙ্গে কী করে পরিচয় হল, জানতে চাইল কার্তিক ।
    অপু বলল, ওনার সঙ্গে পড়ি ।
    --আপনি এখন কী করেন ? ভ্রু কোঁচকায় কার্তিক, নিশ্চিন্ত যে ওর মোটর সাইকেলের একজন সওয়ারি পাওয়া গেল । মোটর সাইকলের ধুলো পুঁছতে-পুঁছতে বলল, হাজার টাকা নিই ।
    --ঠিক আছে, নো প্রবলেম, বলে অপু যোগ করল, কিছুই করি না । আমি ফিউজিটিভ ।
    --ফিউজিটিভ ইয়ানে কি ?
    --ভগোড়া । আমি আইনের চোখে ধুলো দিয়ে পালাচ্ছি । ওনার সাহায্য নিয়ে অবুঝমাড় জঙ্গলে গিয়ে লুকোবো । জঙ্গলটা নাকি দুর্ভেদ্য, পুলিশও যায় না সেখানে ।
    কোমরে হাত দিয়ে গেরুয়া ধুলোর পাশাপাশি অট্টহাসি ওড়ালো কার্তিক । বলল, আরে ইয়ার, মাওওয়াদি, বনবিভাগ, রেভেন্যু ডিপাট আর আধামিলিট্রি মিলে জবরদস্ত কাহানি ছড়িয়েছে, হাউয়া খাড়া করে দিয়েছে । ভারতীয় জওয়ানরা কার্ল গুস্তাভ রাইফেল, আনডারব্যারেল গ্রেনেড হাতে ভেতরে ঢুকে বুড়বক বেনে গেছে । গিয়ে দ্যাখে হাড্ডিসার ঝোপড়পট্টি, গাছের পাতা আর সরু বাঁশে তৈরি ভুখমরিতে বেচয়েন অনজান আদমিদের গ্রাম, আর তংগ দড়িদঙ্কা আদিবাসী । অবুঝমাড়ে এখন যার ইচ্ছে সে ঢুকে যেতে পারে । শুধু মাওওয়াদিদের আর আধামিলিট্রির তিকড়মবাজিতে পড়ে চকনাচুর হয়ে যাবার মওকা থাকে, এই যা, বাদবাকি সব মনোহর কাহানিয়াঁ । চলুন, বসুন, ফিউজিটিভ মহাশয়জি ।
    প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা জামা-ট্রাউজারে, ফোমচামড়ার ব্যাগে, চুলে, ভুরুতে ধুলোর চাদরে ঢাকা পড়ার পর অপু পৌঁছোল রায়গড় থেকে নারায়ণপুর ।
    কার্তিকের বাবাকে সনাতন সরকারের চিঠিটা দিয়ে, গংগোতা প্রথা অনুযায়ী গণেশচন্দ্র সরকার আর তাঁর স্ত্রীর হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করে অপু ওনাদের জানালো যে চিঠিতে ওর যে বান্ধবীর উল্লেখ রয়েছে, তাকে সঙ্গে আনতে পারেনি ।
    গণেশচন্দ্র সরকার সনাতনের চিঠি পড়ে অপুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, দ্যাখো, কতদূর থেকে তুমি এলে, সনাতনের বন্ধু বলে, জায়গাটা দেখার ইচ্ছা হয়েছে তোমার ; কেউ আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না, কে-ই বা নেবে, কেউ তো নেই। সনাতন নিশ্চয়ই ওর গালাগালের স্টক তোমার মাথায় উপুড় করে দিয়েছে? ভীষণ রগচটা । যত বেশি পড়াশোনা করছে তত ওর হিন্দি গালাগালের স্টক বাড়ছে । তুমি খাও-দাও, যতদিন ইচ্ছা থাকো, আমাদের ভালো লাগবে, তার আগে স্নান করে নাও, লাল চালের ভাত খাও, মাছ-টাছ পাবে না ।
    অপু ওনাকে বলল, আপনি বসুন, প্রথমে শুনুন, আমার জীবনে কী ঘটেছে, আমি কেন এসেছি, কেন আমার বান্ধবীকে সঙ্গে আনিনি, আর এখন আমি কেন অবুঝমাড় জঙ্গলে যেতে চাইছি । শুনে, গণেশচন্দ্র সরকার, কোলে হাত রেখে, কিছুক্ষণ বসে রইলেন, পাশে দাঁড়িয়ে ওনার স্ত্রী । অপুর মনে হল, রোগা, ময়লা, টাকমাথা গণেশচন্দ্র সরকারের বয়স ওনার স্ত্রীর চেয়ে বেশ কম । ওনার স্ত্রী বললেন, তোমাকে কে বুঝিয়েছে যে অবুঝমাড় দুর্ভেদ্য? আমার ছেলে ওই জঙ্গলে তিন বছর ছিল ; মাওওয়াদিরা ওর গোঁড়-মাড়িয়া বউকে গুলি করে মারার পর ও পালিয়ে এসেছে । বাড়িতে প্রায় থাকেই না কার্তিক । রাতে ফেরে, খায়, ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ভোর না হতেই বেরিয়ে পড়ে ; যদি রায়পুরে থেকে যায় তাহলে সে-রাতে ফেরেই না ।
    অপু স্তম্ভিত ।
    কার্তিক সরকার অপুকে পৌঁছে দিয়ে নতুন যাত্রীর খোঁজে মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ।
    কার্তিকের বাবা-মা ওর জীবনের ঘটনা, থেমে-থেমে, কন্ঠস্বরে শ্লেষ্মা মিশিয়ে, অপুকে বলতে আরম্ভ করলেন। কার্তিক এক মাড়িয়া-গোঁড় মেয়ের প্রেমে পড়েছিল ; মেয়েটি মাঝে-মাঝে কোকোমেত্তায় ডিম, মুর্গি, শুয়োর বাচ্চা, বিয়ার বাহুতি পোকা, মহুয়ার ফুল, সালফি মদ বিক্রি করতে আসত । কার্তিক ওর ডিম কিনত, মুর্গি কিনত, সালফি খেতো আর যত দাম তার চেয়ে বেশি টাকা দিত । একদিন মেয়েটা কার্তিককে জানালো মাওওয়াদিরা ফতোয়া জারি করেছে যে জঙ্গলের বাইরে আর যাওয়া চলবে না । যারা যাবে তাদের পুলিশের চর বলে সন্দেহ করা হবে ; ফিরে আসলে জন আদালতে তাদের বিচার হবে । মেয়েটার নাম ছিল কুমিয়া খোসা।
    ---ছিল মানে ?
    --কইছি, কইছি, কার্তিক কুমিয়াকে মোটর সাইকেলে বসিয়ে, আমাদের কাছে এনে জানালো যে ও চলে যাচ্ছে মেয়েটার সঙ্গে ঘর করতে, কুমিয়ার হিকোনার গ্রামে । আমরা কার্তিককে কোনো কাজে বাধা দিই না, ওর জন্মের কথা আরেকদিন শুনো । মনে হয়েছিল, যাচ্ছে যাক, কোথাও তো সংসার পাতবে, নারায়ণপুরে একা-একা অস্হির হয়ে, মাথা খারাপ করে, দুঃখে-দুঃখে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে, ঘুরে বেড়াবার চেয়ে ঢের ভালো ।
    হিকোনারে যাবার পর ওদের বিয়ে দেয়া হয়েছিল গোঁড়-মাড়িয়া রীতি অনুযায়ী , দুজনকে রঙিন কাপড়ে আগাপাশতলা মুড়ে ওদের ওপর দুধ ঢেলে বিয়ে হল ; আমরা দুধ, গায়ে জড়াবার শাড়ি, গোটা পাঁঠার মাংস কিনে নিয়ে গিয়াছিলাম । গোঁড়-মাড়িয়া সমাজে বিয়ে না করলেও চলে, অনেক ছেলে-মেয়ে বিয়ে করে না, তাদের কয়েকটা বাচ্চা হয়ে যাবার পরও বিয়ে করতে পারে না, দুধের টাকা, নতুন কাপড়ের টাকা, মাংস খাওয়াবার টাকা, সালফি খাওয়াবার টাকা, কোথা থেকে পাবে, বলো । পঁচিশ তিরিশটা চালাঘর নিয়ে এক-একটা গ্রাম, যদিও সেগুলো পাশাপাশি নয়, ছড়ানো-ছেটানো । তুমি ভেবো না যে অবুঝমাড় অ্যামাজনের মতন ঘন জঙ্গল, মোটেই নয়, সুন্দরবনের মতনও নয়, খোলামেলা ধরণের জঙ্গল, দূর থেকে গাছের ফাঁকে দেখতে পাবে, কে আসছে, ভাল্লুক, শেয়াল, বনবিড়াল আসছে কি না।
    আমরা ওর সংসার শুরু করার কয়েক মাসের খরচ দিয়ে ফিরে এসেছিলাম । ওরা তেল-মশলা দিয়ে আমাদের মতো রান্না করে না, বেশির ভাগ মাংস পুড়িয়ে খায় । একদিক থেকে ভাল, খরচের বোঝা কম । ভালই ছিল দুজনে, ওদের চালাঘরে, মুর্গি, খরগোশ আর শুয়োর পুষেছিল । কুমিয়া তীর-ধনুক দিয়ে খরগোশ, বেঁজি, কাঠবেরালি, সাপ, পাখি শিকার করে আনলে দুজনে মিলে খেতো । পেণ্ডা খেতি, মানে শিফটিং কালটিভেশান বা জুম চাষের সময়ে পাহাড়ের ঝোপঝাড় পোড়ানোয়, ফসল পোঁতা আর কাটায়, অংশ নিত । শিকারের ফাঁদ পাতায়, জংলি পাখি শিকারে, মহুয়ার ফুল কুড়োনোয়, অংশ নিত ।
    সকলের দেখাদেখি কার্তিকও পাঁচ টাকা দিয়ে মাওওয়াদি জনতম সরকারের নাগরিক হয়ে গেল । জন আদালতের সদস্য করা হল ওকে । কার্তিক ভেবেছিল সদস্য হয়ে গেলে জঙ্গলের কোনো অংশের পাট্টা পাবার সুবিধা হবে । পাট্টার জন্য জনতম সরকারের অধ্যক্ষকে বলতে গিয়ে বিপদে পড়ল । পাট্টা দেয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট । জনতম সরকারের নেতারা ভাবল যে কার্তিক যেহেতু গোঁড়-মাড়িয়া নয়, তাই গোঁড়-মাড়িয়া মেয়ের সঙ্গে বসবাস করে, বাচ্চা পয়দা করে, বন বিভাগ-রাজস্ব বিভাগে যোগাযোগের নামে ফিরে যাবার তাল করছে, ফিরে গিয়ে হয়ত পুলিশের সঙ্গে যোগসাজস করে জনতম সরকারকে বিপদে ফেলে দেবে ।
    তার আগে সেরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে, কোনো-কোনো গ্রামবাসী জনতম সরকারের হুকুম পছন্দ হয়নি বলে পালিয়েছে জঙ্গলের বাইরে, নারায়ণপুরে, বা আরও দূরে অন্ধ্র কিংবা মহারাষ্ট্রতে । পুলিশ তাদের সাহায্য নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার চেষ্টা করেছে, ঢুকেছে, খুনোখুনি হয়েছে, গুলিগোলা চলেছে । এই তো সেদিন সতেরো বছরের একটা মেয়ে ধরা পড়ল, সে আইইডি বানাতো ; সে জানিয়েছে যে তার চেয়ে কম বয়সী মেয়েরা আইইডি বানায় ।
    গোঁড়-মাড়িয়ারা নির্লোভ, সরল প্রকৃতির, বুঝলে, খায়, নেশা করে, জংলি জানোয়ার বা পাখি শিকার করে, পেণ্ডা খেতি করে সবাই মিলে, ফসল তোলে, এই ভাবেই জীবন চলে যায় । সহযোগীতার ক্ষেত্রে ইজরায়েলের কোঅপারেটিভের চেয়ে ভালো । ওরা পড়ে গেছে মাওওয়াদি আর সরকারের জাঁতাকলে । আদিবাসীরা প্রথমে ভেবেছিল যে মাওওয়াদিরা ওদের সরকারি অত্যাচার-অবিচার থেকে বাঁচাবে। তার বদলে সেই একই শাসনপ্রথা নতুন ভুত হয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে ।
    ওখানে সরকারি স্কুল আছে, আঙনওয়াডিও আছে, সোলার পাওয়ার আছে, পাহাড়ে ওঠার আগে পর্যন্ত হ্যাণ্ড পাম্প আছে । স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না করার কাজ পেয়েছিল ওর বউ । রান্না করার দরকার হতো না । শুনে তুমি অবাক হবে যে স্কুলের প্রার্থনা হয় গায়ত্রী মন্ত্র গেয়ে, কারণ স্কুলটা সরকারি, আমি দেখে এসেছি । স্কুল থেকে বরাদ্দ র‌্যাশন মাওওয়াদিরা নিয়ে চলে যেত, তাদের বন্দুকধারি ক্যাডারদের জন্য, তাতে কারোরই আপত্তি ছিল না । ওরা জানতে পারেনি যে ওদের ওপর জনতম সরকারের জন মিলিশিয়া নজর রেখেছে ; কার্তিক তো রিফিউজির ছেলে । মালকানগিরিতেও লক্ষ করতুম যে মাওওয়াদিরা বাঙালি রিফিউজিদের পছন্দ করে না । জন মিলিশিয়ারা বন্দুকধারী গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর ক্যাডারদের থেকে আলাদা । জন আদালতে কাউকে মেরে ফেলার হুকুম হলে জন মিলিশিয়ার লোক তা পালন করে । জন মিলিশিয়ার ছোকরাদের কাছে ট্রানজিসটার আর ল্যাপটপ দেখেছি । ল্যাপটপে ওরা সিনেমাও দ্যাখে, হলিউডের হিন্দিতে ডাব করা সব ফিল্ম, হিরোগিরির ফিল্ম, যদিও বেশির ভাগ গোঁড়-মাড়িয়া হিন্দি ভালো জানে না । কুমিয়া, কার্তিকের বউও, তেমন হিন্দি জানত না । কার্তিক অবশ্য ছোটোবেলা থেকে ওদের সঙ্গে মিশেছে বলে গোঁড়-মাড়িয়ায় কথা বলতে পারে, আমরা দুজনেও তত ভালো পারি না ।
    বাচ্চা হবার পর কুমিয়াকে নিয়ে তিন-চার মাসে একবার আসত আমাদের কাছে । গোঁড়-মাড়িয়া মেয়েদের গয়নার খুব শখ । কুমিয়ারও গয়না পরার শখ ছিল । সোনার চেয়ে রুপোর জল-দেয়া ব্রোঞ্জের গয়না ওদের বেশি পছন্দ । আমরা ভাবলাম ব্রোঞ্জের কেন দেবো, ছেলের বউকে দিচ্ছি যখন তখন রুপোর গয়নাই দিই। ওদের ওপর যে জন মিলিশিয়ার জাসুসরা নজর রাখত তা ওরা টের পায়নি । গয়না পরে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল কুমিয়াকে । কার্তিক ভাবল যে বার-বার কষ্ট করে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে প্রায় আট-দশ কিলোমিটার হেঁটে আসা আর আবার আট-দশ কিলোমিটার হেঁটে ফেরত যাওয়ার চেয়ে মোটর সাইকেলটাই গ্রামে নিয়ে গিয়ে রাখবে, ছাগল-চরানো রাস্তাতেও কার্তিক মোটর সাইকেল চালাতে পারে । ওর বউ আগে চলে গেল বাচ্চা নিয়ে যাতে জনতম সরকারের কোপে না পড়ে । কার্তিকের যেতে দু’দিন দেরি হয়ে গিয়েছিল, মোটর সাইকেলের সারভিসিং করাতে গিয়ে ।
    গ্রামে পৌঁছে কার্তিক জানতে পারল যে জন আদালতের বিচারে কুমিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে । গুলি করে মারা হয়েছিল কুমিয়াকে । কার্তিক যাবার আগেই ওরা কুমিয়াকে কবরও দিয়ে দিয়েছিল । বাচ্চা ছেলেটা কার কাছে আছে জানতে চাইলে কেউ কার্তিকের সঙ্গে কথা বলেনি । ওকে বলা হয়েছিল তক্ষুনি নারায়ণপুরে ফিরে যেতে নয়তো ওরও কুমিয়ার দশা হবে । কুমিয়ার কবরের কাছে গাছের ডালে নিজের শার্ট খুলে বেঁধে খালি গায়ে চলে এসেছিল ।
    সেই যে ও জঙ্গল থেকে মোটর সাইকেলে চেপে পালিয়ে এসেছে, আর ও-মুখো হয়নি । আমাদের মনে হয় পালিয়ে এসে বেঁচে গেছে । এই কিছুদিন আগে অপারেশান হাক্কা করেছিল সরকার, টোকে নামের পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল। হেলিকপ্টারের ডানার বাতাসে অনেকের চালাঘরের ছাদ উড়ে গেছে । আসলে অবুঝমাড় নিয়ে সবাই এতকাল এমন গল্প ফেঁদেছিল যে প্রচার হয়ে গিয়েছিল জায়গাটা দুর্ভেদ্য । সরকার তো ড্রোন উড়িয়ে ফোটো তুলেছিল আর ভেবেছিল যে কালো-কালো দেখতে জায়গাগুলো বুঝি ট্রেঞ্চ আর মাওওয়াদিদের ক্যাম্প । কোবরা-ফোবরা, সিআরপিএফ, পুলিশের লোকজন অপারেশান হাক্কা চালিয়ে ভেতরে ঢুকে বুঝতে পেরেছে যে সবই ফক্কিকারি, মাওওয়াদি, টিম্বার মাফিয়া আর সরকারি কর্মচারীদের স্বার্থান্বেষী প্রচার ।
    --কিন্তু আমি তো এরকমই শুনে এখানে এসেছি । এটাই সেফেস্ট জায়গা মনে হয়েছিল ।
    গণেশচন্দ্র সরকার বললেন, আশির দশকের শুরুতে বিদেশি টিভি চ্যানেল অবুঝমাড়ে ঢুকে ওদের ঘোটুল নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তৈরি করে প্রচার করেছিল । এখন গোঁড়-মাড়িয়া মেয়েরা সকলেই পোশাক পরে, শাড়ি-ব্লাউজ-শায়া, ভেতরের জামা । এখনও ঘোটুল আছে, সেখানে পোশাক পরে ঢোকে ছেলে-মেয়েরা ; সেক্সের ব্যাপারে ওদের সমাজ ইউরোপ আমেরিকার চেয়েও প্রগ্রেসিভ আর পারমিসিভ । যখন তথ্যচিত্র তোলা হয়েছিল তখন ওদের ঘোটুলে ওরা পোশাক পরে যেত না । ভারত সরকার ভাবল যে এটা ভারতবিরোধী প্রচারের ষড়যন্ত্র, ভারতের ইমেজ বিদেশে নষ্ট হচ্ছে । ব্যাস, হাঁটু-কাঁপা প্রতিক্রিয়ায় অবুঝমাড়কে প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করে দেয়া হল । এতকাল নো একট্রি জোনই ছিল, এই কিছুদিন হল নিষেধ তুলে নেয়া হয়েছে । নিষেধের ফায়দা লুটত মাওওয়াদি, টিমবার মাফিয়া, বন বিভাগ, তেন্দু পাতার ব্যাপারি, রেভেনিউ ডিপার্টমেন্ট । নিষেধের দরুণ একদিকে তো নানা গল্প ছড়িয়েছে, অন্যদিকে দেশের অন্য আদিবাসীরা যে সুযোগ-সুবিধা পায় তা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থেকেছে অবুঝমাড়ের আদিবাসীরা ।
    আমার প্রতিবারই এলেকশান ডিউটি পড়ে । গত বিধানসভা নির্বাচনে কোকোমেত্তায় ভোট দেবার জন্য কুরসুনার, জিলাপুর, সোনাপুর, কুদলা, কাছাপাল, ঝারাবাহি, মাঙ্গুর, বোলাবেড়া, মাস্তুর, সাহাকাগোড়া থেকে গোঁড়-মাড়িয়া আর মুরিয়ারা হেঁটে ভোট দিতে এসেছিল, বাচ্চা কোলে মেয়েরা, বুড়ো-বুড়িরাও । ভোটের জন্য ঢেড়া পেটানো হয়েছিল গ্রামে-গ্রামে, যাকে ওরা বলে মুনাড়ি । অনেকে আগের দিন রাতের বেলাই পৌঁছে গিয়েছিল বলে তাঁবু খাটিয়ে শোবার ব্যবস্হা করতে হয়েছিল ।
    এবারের সংসদ নির্বাচনেও গোঁড় মাড়িয়া মুরিয়ারা দলে-দলে ভোট দিতে এসেছিল । তা ভোট শেষে ফেরার সময়ে পোলিং পার্টির আটজন আর আধামিলিট্রির পাঁচজনকে কেতুলনার গ্রামের কাছে ল্যাণ্ডমাইন পেতে উড়িয়ে দিল আশি-নব্বই জনের মাওওয়াদি জামাত । ঈশ্বরের কৃপায় আমার এলেকশান ডিউটি এখানেই পড়েছিল । তুমি বলো, ওভাবে কি বিপ্লব হবে ? গোঁড়-মাড়িয়াদের জীবনের উন্নতি হবে ? আমি তো কিছুই বুঝি না বাবা ।
    --বিপ্লব ? বিপ্লবের আমি তেমন কিছু বুঝি না । যুক্তাক্ষর শব্দগুলো সব বেকার ।
    হ্যাঁ, একটা কাজ ওরা করছে, তা হল সেগুনগাছ, শিশুগাছ, শালগাছগুলো টিম্বার মাফিয়াদের করাত থেকে বেঁচেছে ; তখন যদি ওরা থাকত তাহলে মালিক মকবুজার মতন জঘন্য ঘটনা ঘটত না । আরেকটা হল, সব আদিবাসী এলাকার মতন অবুঝমাড়েও তো মাটির তলায় খনিজে ভরা । যতদিন ওরা পাহারা দিতে পারবে ততদিন কর্নাটকের আকরিক লোহার মতন লুকিয়ে-লুকিয়ে জাহাজ ভরে-ভরে মাও-এর দেশ চিনে চোরাচালান করা হবে না । দেখা যাক কারা শেষ পর্যন্ত জেতে ।
    কার্তিকের সঙ্গে কথা বললেই টের পাবে যে জঙ্গলের ভেতরে কে যে আদিবাসী, কে মাওওয়াদি জন মিলিশিয়া, কে জন আদালতের সদস্য, কে মাওওয়াদি তাত্ত্বিক, কে কেন্দুপাতার ফড়ে, আর কে বনদপতর বা রাজস্ব বিভাগের কর্মী তা তুমি পার্থক্য করতে পারবে না । শুধু পিএলজিএ, মানে গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর ক্যাডারদের, চিনতে পারবে, ওরা জওয়ানদের মতন জলপাইরঙের পোশাক পরে । আমার-তোমার মতন সাধারণ মানুষের সামনে ওরা বেরোয় না বড়ো একটা । আদিবাসীরা দুপক্ষের শাসনের-হুমকির আতঙ্কে জীবন কাটাচ্ছে ।
    তুমি ফিউজিটিভ হয়ে এখানেই থাকো । বিহারে সবই কালক্রমে ধামাচাপা পড়ে যায়, তিন হাজার কোটি টাকার চারাঘোটালাই চাপা পড়ে গেল । এবারের এলেকশানে রাবড়ি দেবী এফিডেভিট দিয়ে জানিয়েছেন যে ওনার সম্পত্তি হল পঁয়ষট্টি কোটি টাকা, ওনার মেয়ে মিশার চার কোটি টাকা । তবেই বোঝো । সম্প্রতি প্রাক্তন কয়লা সচিব পি সি পারিখের স্মৃতিকথা সময় পেলে পোড়ো । উনি লিখেছেন যে কয়লা মন্ত্রী শিবু সোরেন আর ওনার উপমন্ত্রী দাসারি নারায়ণ রাও কোল ইনডিয়া লিমিটেডের পদে পোস্টিঙের জন্য শশী কুমার-এর কাছ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা একলপ্তে আর প্রতিমাসে দশ লাখ টাকা করে চেয়েছিল । এই তো দেশ, যার স্বাধীনতার জন্য আজও আমরা লাৎ খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি । আমাদের কোনো আইডেনটিটি নেই । সনাতন যে গালাগাল দেয়, তা ইমপোটেন্ট রেজ । ও গালমন্দ করে শরীর সুস্হ রাখে । ইমপোটেন্ট রেজে ভুগে-ভুগে আমার কন্সটিপেশানের ব্যারাম হয়ে গেছে ; রাতে ল্যাক্সেটিভ খাই আর সকালে চোখ বুজে বসে থাকি, যারা আমাদের দুরবস্হার জন্য দায়ি তাদের মাথার ওপর ।
    --আমার রেজ ইমপোটেন্ট নয় বলে আমি ফিউজিটিভ, গংগোতা মায়ের গরম রক্ত আর বাঙালি বাবার ঠাণ্ডা রক্তের গুণ । বলল অপু ।
    --কার্তিক তোমায় ওর মোটর সাইকেলে বসিয়ে একদিন অবুঝমাড় ঘুরিয়ে আনবে । কুমিয়া মারা যাবার বাৎসরিকে গাছে নতুন কাপড় বাঁধতে যাবার জন্য গোঁ ধরেছিল, আমরা যেতে দিইনি। তুমি সঙ্গে থাকলে সুবিধা হবে, চারিদিকে নজর রাখতে পারবে।

    ষোলো
    বনবিভাগের বিট মার্শাল : দুজন পোচারের বডি পড়ে আছে স্যার ।
    বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : দেখে তো পোচার মনে হচ্ছে না । টিম্বার মাফিয়ার এজেন্ট শালারা, নিশ্চই ।
    বনবিভাগের বিট মার্শাল : টিম্বার মাফিয়ার এজেন্টদের আমি চিনি স্যার । এরা বাইরের লোক । কী করে ওখানে গিয়ে পড়ল ? বেঁচে আছে না মরে গেছে !
    বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : কেন মিছিমিছি নিজের বিপদ ডেকে আনছ । যা রেগুলার রিপোর্টিং তাই রেকর্ড করে দিও ।
    বনবিভাগের বিট মার্শাল : ব্যাস স্যার, কুরুসনার ছেড়ে অনেকটা চলে এসেছি, আর ভেতরে যাওয়া সুবিধার নয়।
    বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : চলো ।

    সতেরো
    রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যাবার বাসে ইতুকে তুলে দিয়ে অমিত বলে দিয়েছিল, বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকবি; সুশান্তজেঠুর দেয়া তোর মোবাইল থেকে একটা ছেলেকে ফোন করে দিয়েছি । তুই মিশনের গেটের কাছে পৌঁছে এই নম্বরে একটা মিস কল দিবি । নারায়ণপুরে নেটওয়র্ক তত ভালো কাজ করে না । ছেলেটা রেসপণ্ড করে ওর নাম বলবে বীরবল মাড়িয়া । হিরো হণ্ডার কালো রঙের স্পেলনডার মোটর সাইকেলে আসবে । ও তোকে নমস্তে ইতু দিদি বললে কোনো বাক্যব্যায় না করে পিলিয়নে বসে পড়িস । ও তোকে যেখানে পোঁছে দেবে, সেখানে তোর সঙ্গে আমার পরিচিতদের দেখা হবে, হয়তো তোর পরিচিতও থাকতে পারে কেউ । চিন্তা করিসনি না, মনে রাখিস, যেখানে ঢুকতে যাচ্ছিস সেটাকে প্রশাসনের লোকেরা বলে জংলি পাকিস্তান।
    বাসডিপোয় ইতুর কান্না পায়নি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল । কেঁদে ফেলেছিল অমিত, রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছিল যাত্রীদের চোখ এড়িয়ে । বলেছিল, আর দেখা হবে না, জানি, তোকে শেষবার দেখে নিচ্ছি । উত্তরে ইতু বলেছিল, আমি আমার অতীতকে কলকাতা বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার সময় থেকে কাট-অফ করে দিয়েছি, তুইও তাই করে ফ্যাল । সবাইকে ভুলে গিয়ে যা করবার কর, বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাদের ভুলে যা । গেট রিড অফ অলল মেমরিজ ।
    ডেনিমের ট্রাউজার আর ঢিলেঢালা টপ পরেছিল ইতু, পায়ে জগিং করার কেডস, কাঁধে ওর ঝোলা । রায়পুরে দু’বোতল মিনারেল ওয়াটার আর বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে নিয়েছে ।
    যে-বাসটায় চেপেছিল সেটার নাম, ইতুর অবাক লাগল শুনে, নৌকরওয়ালা বাস । কন্ডাক্টার টিকিট দিল না কাউকে । স্কুলের অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার হাতে প্রত্যেক যাত্রির কাছে গিয়ে তাদের নামের সামনে ছককাটা ঘরে সই নিয়ে নিল । মাসের শেষে টাকা নেবে । প্যাসেঞ্জারদের পোস্টিং হয়েছে নতুন জেলা-সদর নারায়ণপুরে ; তাদের পরিবারকে নিয়ে যায়নি, নারায়ণপুরে ভালো স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল, মল, মাল্টিপ্লেক্স কিছুই গড়ে ওঠেনি এখনও । ইতুকে কন্ডাক্টার বলল, দিতে হবে না ।
    বাস থেকে নেমে হাতেটানা রিকশয় চেপে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে বীরবল মাড়িয়াকে মিসড কল দিয়ে অর্জুন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ইতু ।
    নমস্তে ইতু দিদি, শুনে, কালো মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে, ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবনগ্রন্হির ঝাপটের উগ্র গন্ধ নাকে এসে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল ; উফ, ফেরোমোন । মুখে থলেটা চাপা দিয়ে সামলাল । কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারল যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আরেক হাতে মোটর সাইকেলের হ্যাণ্ডল, নয়তো সড়কের যা অবস্হা, নির্ঘাত ছিটকে পড়বে কোনো পাথরে চাকা পড়লেই । ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, ঠিক করে বসুন, রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়ণপুর জেলা তৈরি হয়েছে । ইতুর মনে পড়ল অমিত এভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে সুড়সুড়ি দিয়েছিল ।
    যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হবে, গায়ের রং মুখের গড়ন দেখে আদিবাসী বলেই মনে হল । ইতু জিগ্যেস করল, দান্তেশ্বরীর মন্দির পড়বে কি রাস্তায় ।
    --না দিদি, দান্তেশ্বরী হল বস্তারের দেবী । নারায়ণপুরে অবুঝমাড়িয়াদের দেবী হল কাকসার । বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে । উত্তর শুনে যুবকটিকে কোনো পালটা প্রশ্ন করল না ইতু । নিজেকেই প্রশ্ন করল, মেঘনাদ, এ কোন মেঘনাদ, রামায়ণের মেঘনাদ, যে মেঘনাদকে নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্য লিখেছিলেন ?
    যুবকটি বলল, আমার নাম বীরবল মাড়িয়া নয়, আমার ট্রাইবের নাম ওটা । অবুঝমাড়ে দুজাতের গোঁড় থাকে, মাড়িয়া গোঁড় আর মুরিয়া গোঁড় । শহরের লোকেরা মনে করে অবুঝমাড় মানে যে জায়গাকে এখনও জানা হয়ে ওঠেনি । ঠিকই, অবুঝমাড়কে কেউ জানে না । কিন্তু তা অবুঝমাড়ের মানে নয় । মাড় একরকমের শেকড় ।
    --ও, বলল ইতু, ভাবল রোদ বাঁচাতে মাথায় গামছা চাপা দেবে কিনা । নাঃ, এখন থেকে তো রোদ বৃষ্টি ঝড় যা-ই হোক, কোনো কিছুর দ্বারা পরাস্ত হলে চলবে না । সহ্য করবে । সহ্য করবেই । সহ্য করতে হবে । ছেলেটিকে বলল, তুমি সামনে দিকে তাকিয়ে চালাও, যা রাস্তার অবস্হা ।
    এভাবে কখনও বাইরে-দূরে বেরোয়নি ও, ইতু । সঙ্গে টুথব্রাশ, চিরুনি, তোয়ালে, সাবান অবশ্যই নিত, বাবা-মার সঙ্গে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবার সময় । বটঠাকুমা বড়দাদু ইউরোপে বেড়াতে যাবার সময়, সেখানে টয়লেট পেপার ব্যবহার করতে হবে শুনে, সঙ্গে একটা প্লাসটিকের মগ নিয়েছিলেন । ও কী করবে, কোথায়ই বা করবে ?
    --জানেন, এখানে কেউ আসে না , বেশ দূরে-দূরে প্রায় দুশো তিরিশটা গ্রাম আছে, চার হাজার একর জঙ্গলে ছড়িয়ে, তিরিশ হাজারের বেশি মানুষ, বেশির ভাগই বীরবল মাড়িয়া আর গোঁড়, যাদের খোঁজখবর সরকার নেয় না, জানেই না সরকারি আফসররা । কেন বলুন তো ? হোল ইনডিয়ায় শুধু এইটুকু এলাকার কোনো সার্ভে আজ পর্যন্ত হয়নি, সেনসাস হয়নি । রিপোর্টাররাও বস্তার যেতে চায়, নারায়ণপুরে আসতে চায় না, তাই আমার রোজগার তেমন হয় না । নারায়ণপুর, বিজাপুর আর বস্তার, এই তিন জেলার জঙ্গল এলাকা হল অবুঝমাড় । আপনাকে এ-সব বলছি কেন বলুন তো ? যিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন তিনি বলেছেন যে আপনাকে জায়গাটার ছবি বুঝিয়ে দিতে ।
    --ও, আচ্ছা । মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল বলে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল ইতু । তারপর নিজের মোবাইলটা বীরবল মাড়িয়ার হিপ পকেটে ঢুকিয়ে বলল, যিনি তোমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি বলেছিলেন মোবাইলটা তোমাকে দিয়ে দিতে ।
    --হ্যাঁ, আচ্ছা, ঠিক আছে । অবুঝমাড়কে ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল আর মাওওয়াদিরা । গ্রামের লোকেদের সঙ্গে মাওওয়াদিরা মেশার চেষ্টা করে । সিপাহি জওয়ানরা এড়িয়ে চলে । আপনাদের শহরের ভিখমাংগা বস্তির চেয়েও বদতর এখানকার জীবন । বিজলি নেই, খাবার জল নেই, স্কুল নেই, ডাক্তার-বইদ নেই, কারোর কিছু হলে চিকিৎসার কোনো উপায় নেই, তা সে আধামিলিট্রি জওয়ান হোক বা মাওওয়াদি জওয়ান, গ্রামের লোকেদের কথা তো ছেড়েই দিন, ওরা জানেই না কাকে ডাক্তার বলে, হাসপাতাল বলে । আফ্রিকাতেও এরকম গয়াগুজরা এলাকা পাবেন না । তবে, শ্বাস নিয়ে, বলল বীরবল মাড়িয়া, শহর মানেই তো চাপা দুর্গন্ধের ম্যানহোল ; যতো বড়ো শহর, তত বেশি ম্যানহোল । এখানের আকাশে যেমন রাতের তারা, আপনাদের শহরে তেমন মাটিতে পাতা ম্যানহোল ।
    ইতু নিজেকে প্রশ্ন করল, এখানে কেন আসতে চাইলুম ? বাড়িতে কী ভালো ছিলুম না ? কত বাঙালি বাড়িতেই তো অবিবাহিতা মেয়েরা থাকে যারা সকলের অবহেলায় অবরে-সবরে মুখঝামটা খেয়ে তাদের মাঝে বসবাস করে ক্রমশ ন্যাড়ামাথা বুড়ি হয়ে যায়, স্বজনদের বাচ্চা হলে তাদের সঙ্গে খেলে, সময় কাটায়, বাড়িতে কোনো উৎসব হলে সে-ই খাটাখাটুনি করে, আর অতিথি অভ্যাগতদের সাবাশি পায়, অসুস্হ হয়ে সিঁড়ির তলায় চটে বা সতরঞ্চিতে শুয়ে মরে ভুত হয়ে যায় । নাঃ, একেবারে ভালো ছিলুম না, তার কারণ কোনো কাজই নিজের জন্য করছিলুম না, শুধু বেগার খাটছিলুম । এবার নিজের জন্য কিছু করব । যা হবার হোকগে, সিআরপিএফ-এর গুলি খেয়ে, না খেতে পেয়ে, মাওওয়াদিদের বিশ্বাস অর্জন করতে না পেরে, গ্রামবাসীদের সন্তুষ্ট করতে না পেরে, মরে যেতে হলে মরে যাবো, নিজের জন্য তো মরব । ছেলেটিকে বলল, তুমি চুপ করে গেলে কেন, বেশ ভালোই তো লাগছে শুনতে ।
    --কুরসুনার গ্রাম এসে গেল তো, তাই । যে অনজান দুনিয়ায় আপনি ঢুকতে চলেছেন, এই গ্রাম হল তার প্রবেশপথ । ভারত সরকার বলুন, ছত্তিশগড় সরকার বলুন, এখান পর্যন্তই তারা ছিল, অপারেশান হাক্কার পরে কিছুটা বদলালেও, মানুষের মনের ভেতরটা বদলাতে অনেক সময় লাগে । ওই যে স্কুল বিল্ডিং দেখছেন, ওখানে আগে আধামিলিট্রি জওয়ানরা থাকত, তাই স্কুলটা চলে গেছে, ওই যে, ওখানে যে চালাঘর দেখতে পাচ্ছেন, ওখানে । আসলে স্কুলটাকে টেনে নিয়ে গেছে মাড়িয়াদের আৎমা, পূর্ণিমার দিন যদি আসেন, তাহলে নিজের চোখে দেখতে পাবেন যে স্কুলটা একটু-একটু করে দক্ষিণে সরে যাচ্ছে । নতুন স্কুল বিল্ডিংটা পুরো তৈরি হয়নি, অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে । মাওওয়াদিরা নাকি ঠিকেদারকে এমন হুমকি দিয়েছিল যে সে প্রাণ বাঁচিয়ে ভাগলবা । তা নয়, আসলে মাড়িয়াদের আৎমা ঠিকেদারকে বলেছিল যে চলে যাও, নয়ত গুলি খেয়ে মরবে । তবে মাওওয়াদিরা ঠিকেদারের ট্র্যাক্টরটাও কেড়ে নিয়েছিল । ট্র্যাক্টর নিয়ে মাওওয়াদিরা কী করবে জানি না ; এরপর তো ট্র্যাক্টর চালাবার মতন রাস্তা পাহাড় শুরু হবার আগে পর্যন্ত, তারপর ছাগল-গরু চরাবার সরু হাঁটা-পথ ।
    কিছুক্ষণ থেমে, শ্বাস নিয়ে, ছেলেটি বলা বজায় রাখল । অবুঝমাড় এমন ভুতাহা জায়গা যে মাওওয়াদিদের শরীরকেও অদৃশ্য ডাইনরা আক্রমণ করে, যতই বন্দুক-কামান থাক, কিছুদিনের মধ্যে খারাপ হয়ে যায়, ওদের কামচলাউ ডাক্তার আছে, আনপঢ়, সে কি আর ডাইনদের সঙ্গে পারে, বলুন । কুরুসনার আধামিলিট্রি ভুতাহা ক্যাম্প দেখলেন, ওখানে একবার হামলা চালিয়েছিল মাওওয়াদিরা ; যারা চালিয়েছিল তারা আন্ধ্রার, এখানকার জঙ্গলে তাদের দুজনের শরীর এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তারা আন্ধ্রার আদিলাবাদে গিয়ে সারেনডার করেছিল, তাও লোকটার বয়স মোটে পঁয়ত্রিশ, নাম ছিল রায়সিদম জাওয়েন্দ্রা রাও উর্ফ লালচন্দ, মেয়েটার বয়স আরো কম, তিরিশ বছর, নাম ছিল কোনগাতি করুণা উর্ফ লতা । মাওওয়াদিরা নিজের বড়ো-বড়ো নাম বদলে নিয়ে ছোটো করে ফ্যালে, অন্য নাম নিয়ে নেয়, নিজের মা-বাপের আদর করে দেয়া নামকে কেন ওদের বন্দুকবাজির সঙ্গে জড়াবে, বলুন ? অবুঝমাড়ের আদিবাসীরা হালউই ভাষায় কথা বলে ; ওরা ছত্তিশগড়িয়া, হিন্দি, তেলেগু কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে না, বললে বুঝতেও পারে না ।
    --তুমি তো ভালই হিন্দি বলছ ।
    --আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়েছিলুম ।
    --ছেড়ে দিলে কেন ?
    --আধামিলিট্রিরা আমার মাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল আমার মা নাকি মাওওয়াদিদের চর । মাওওয়াদিরাও ভেবেছিল আমার মা নিশ্চই সরকারের চর, নয়তো কেন্দ্রীয় রিজর্ভ পুলিশ বলের ক্যাম্পে কেন গেছে । একবার দু-পার্টির গুলিগোলা চলার সময় মায়ের গায়ে গুলি লাগে । সরকার বলেছিল মাওওয়াদিদের গুলিতে মরেছে । মাওওয়াদিরা বলেছিল, আধামিলিট্রির গুলিতে মরেছে। মা মরে যেতে আমি এক লাখ টাকা মুয়াবজা পেয়েছিলুম, সেই টাকা থেকেই তো এই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মোটর সাইকেলটা কিনেছি । আপনাদের মতন প্যাসেঞ্জারদের নানা জায়গায় নিয়ে যাই, নিয়ে আসি, তা থেকেই সংসার চলে যায় । আপনাকে ভাড়া দিতে হবে না , আপনার ভাড়ার টাকা আমি কালকেই পেয়ে গেছি ।
    --তোমার বাড়িতে কে আছে ?
    --বাবা আছে, দিনভর মদ খেয়ে পড়ে থাকে, সালফি মদ, এতো নেশা হয় যে লোকে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় ; ওরকম মদখোরকে কে-ই বা বিয়ে করবে, বলুন, লোকটা যদি সারাদিন আকাশে উড়তে থাকে তাহলে কোনো মেয়েই আসবে না, বৃষ্টি না পড়লে কী করেই বা আকাশ থেকে নামাবে, বলুন । বৃষ্টি শুরু হলে পেণ্ডা খেতি করবে, না নিজের আদমিকে আকাশ থেকে নামাতে ছুটবে । বাবা আমাকেই বলছিল বিয়ে করে নিতে । দুটো ছোটো-ছোটো বোন আছে, তাদের দেখাশোনা করব, বিয়ে দেব, তবে তো আমি বিয়ে করব, কি না ?
    --বিয়ে করলে আমায় ডেকো ।
    --হ্যাঁ, ডাকব, সে তো এখন অনেক দেরি, দেখুন আপনি কতদিন অবুঝমাড়ে টিকতে পারেন । টিকতে হলে সালফি খেতে হবে ; নোংরা জলের চেয়ে সালফি খাওয়া ভালো, সকাল হবার আগেই খেয়ে নেবেন, সকালের সালফি খেলে আকাশ তাকে নেয় না । সকালের পর সালফি মেঘ হয়ে যায় ।
    --সালফি ?
    --হ্যাঁ, সালফি হল তাড়ির মতন দেখতে একরকম মদ । তালগাছ বা খেজুরগাছের মতন দেখতে হয় গাছগুলো , যেমন করে চেঁচে নিয়ে তালের বা খেজুরের রস বেরোয়, তেমন করে বের করে গ্রামের লোকেরা । তালের রস পচলে তাড়ি হয়, তেমনই সালফির রস চব্বিশ ঘণ্টার পর সাদা রঙের মেঘ হয়ে যায় । তবে মাওওয়াদিরা হুকুম জারি করে মাড় বাজারে গুটকা, গুড়াকু, বিড়ি, সিগারেট, সালফি বিক্রি বন্ধের কাগজ সেঁটেছে। ওরা যদি কাউকে খেতে দ্যাখে তাহলে তাকে একশো টাকা জরিমানা করে । জরিমানার টাকাটা মাওওয়াদিদের ওষুধ কেনার কাজে লাগায় । বাতের আর গা-হাতপা ব্যথার রোগ খুব হয় অবুঝমাড়ে । আমরা তাই বিয়ার বাহুতি পোকা থেকে তেল বের করে বাড়িতে রাখি । যাদের নতুন বিয়ে হয়েছে তারা ওগুলো শুকিয়ে খায় । নারায়ণপুর বাজারে কিনতে পাবেন ।
    --কী পোকা ? কী করকম দেখতে ?
    --বিয়ার বাহেতি, লাল টকটকে । সরকারি আফসাররা বলে রেড ভেলভেট মাইট ।
    --ওঃ, ট্রমবিডাইডা পোকা । হ্যাঁ, ওর তেলকে হিন্দিতে তিজ বলে, বাতে বা প্যারালিসিসে ব্যবহার করে আয়ুর্বেদিক ডাক্তাররা ।
    গাঁয়ের লোকেরা পোকাগুলো শুকিয়ে ইনডিয়ান ভায়াগ্রা হিসেবে খায়, তা জানে ইতু, পড়েছে অলটারনেটিভ মেডিসিনের কোর্সে । পুরুষ পাখিরাও বসন্তঋতুতে খায় পোকাগুলো, প্রজননের জন্য ।
    --এর পর আমাদের হাঁটতে হবে ।
    --এত ভারি মোটর সাইকেল ঠেলে হাঁটবে কী করে ?
    --না, কাছে আধামিলিট্রি চেকপোস্ট আছে ; তারা আপনাকে আমার সঙ্গে দেখে ফেললে যেতে দেবে না । আপনি চুপচাপ এগিয়ে চলে যান, আমি মোটর সাইকেল একটু পরে স্টার্ট দিয়ে আসব ।
    পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেরুমাটির পথ আরম্ভ হল, গরুর গাড়ি বা ট্র্যাক্টর চলার মতন চওড়া কাঁচা রাস্তা। শুকিয়ে যাওয়া সরু নদী পেরোবার পর বীরবল মাড়িয়া মোটর সাইকেল চালিয়ে এলে ইতু বসে পড়ল পিলিয়নে । বীরবলের পেট আরও ঘেমেছে, কিন্তু উপায় নেই । দু’পাশে শালগাছের সারি, যাক, ছায়া পাওয়া গেল এতক্ষণে, জংলি জঙ্গলের জংলা ঝাউ । কই, ল্যাণ্ডমাইন, বোমাফাঁদ, মাওওয়াদি, আদিবাসী, কিছুরই তো দেখা নেই । গাছগাছালির রংছড়ানো সৌন্দর্য্যে বেশ খাপছাড়া, লেবুসবুজ পাতাগুলো বনের আশ মেটাতে পারছে না । কোনো গ্রামে পৌঁছোল ওরা, পাটনা শহরে গঙ্গায় যাবার ঘাটের দুধারের ভিকিরিদের ঝোপড়ির মতন কুঁড়েঘর, একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে-দূরে।
    --ওগুলো কী ? ঢিবিগুলো । রঙিন কাপড়ে উড়ছে ? একটায় শার্টও ঝোলানো রয়েছে । ইতু জিগ্যেস করল বীরবল মাড়িয়াকে, কয়েকটা ঢিবির দিকে আঙুল দেখিয়ে ।
    আঙুল দেখাবেন না, আঙুল দেখাবেন না, আৎমার অপমান হবে । ওগুলো মাড়িয়াদের কবর । কোনো আত্মীয় আৎমার শান্তির জন্য কাপড়ের টুকরো বেঁধে গেছে, কাপড়গুলো অমাবসের রাকছসদের থেকে আৎমাদের রক্ষা করে । বলল বীরবল মাড়িয়া ।
    লোহার তোরণের মত দেখতে একটা জায়গায় থামল বীরবল । তোরণের ওপরের টিনে সবুজ রঙের ওপর সাদা রঙে হিন্দিতে লেখা রয়েছে, ভারতীয় সেনা ওয়াপস যাও, বস্তরওয়াসী বাহরি নহিঁ হ্যাঁয় । জঙ মত লড়ো । টিনের সাইনবোর্ডের পেছনে লেখা, বস্তরকে য়ুবায়োঁ, সরকার কে নাজায়জ জঙ কে খিলাফ জনয়ুধ মেঁ শামিল হো জাও ।
    মোটর সাইকেল থামিয়ে বাক্সে রাখা একটা কাঁধে ঝোলাবার ব্যাগ বের করে ইতুর দিকে এগিয়ে দিল বীরবল, ইতু বলল, আমার কাছে তো রয়েছে কাঁধে ঝোলাবার থলে ।
    বীরবল মাড়িয়া বলল, আপনার ঝোলাটা এই কাঁধব্যাগে ঢুকিয়ে নিন, এটায় ডাক্তারের ক্রস চিহ্ণ আঁকা আছে । আপনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে ডাক্তারের লাল ক্রস চিহ্ণ আঁকা ঝোলাটা দিই আপনাকে । নিজের ঝোলাটা বীরবলের দেয়া ঝোলায় পুরে নিল ইতু । থ্যাংকস জানিয়ে জিগ্যেস করল, ওই চালাঘরটার ছায়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসা যায় কি ?
    --ওটা র‌্যাশানের দোকান ছিল । যে লোকটা চালাত সে ছিল বস্তারের গোঁড় , মাওওয়াদিদের আৎমার ভয়ে দোকান তুলে দিয়ে, নারায়ণপুরে চলে গেছে, মরে গেলে মাওওয়াদিরা তাদের আৎমাকে এই জঙ্গলে ছেড়ে যায় । আগে র‌্যাশানের কাজ রামকৃষ্ণ মিশন করত । সরকার ওদের হাত থেকে নিয়ে দোকানদারদের হাতে দেবার পর চালাতে না পেরে আবার রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়েছে ; মিশনের পাঁচটা সেন্টার আছে অবুঝমাড়ে । আসলে দোকানদাররা গড়বড়ি করে টাকা বানাতো র‌্যাশান থেকে, ভাবতো যে গোঁড়-মাড়িয়ারা তো জংলি, ওদের নিয়মমত র‌্যাশান না দিলে টের পাবে না, গোঁড়-মাড়িয়ারা তো আর জানে না যে কত র‌্যাশান ওরা পায় । কিন্তু মাওওয়াদিরা দোকানদারদের গড়বড়ি ধরে ফেলেছিল । হুমকি খেয়ে কেউই আর দোকান চালাবার সাহস করেনি । র‌্যাশান মানে পঁয়ত্রিশ কিলো চাল আর কেরোসিন তেল ।
    ছায়ায় আধঘণ্টা জিরিয়ে কয়েক ঢোঁক জল খাবার পর, মোটর সাইকেলটা চালাঘরের কাছে রেখে বীরবল বলল চলুন, আরেকটু এগিয়ে দিই ।
    মিনিট পনেরো হাঁটার পর, দুটো নিচুছাদ চালাঘরের গ্রামের মতন একটা জায়গায় পোঁছোলো ইতু আর বীরবল মাড়িয়া । উলঙ্গ বাচ্চারা খেলা করছে, ছেলে-মেয়ে দুই-ই, রুক্ষ চুল, দেখেই বোঝা যায় বহুদিন, বা হয়ত কখনও, স্নান করেনি । শহরে এই বয়সের মেয়েরা কুঁচকি আর বুকঢাকা পোশাক পরে । কয়েকজন শিড়িঙ্গে শিথিল-দাবনা পুরুষ বসে আছে, তারাও প্রায় উলঙ্গ, কৌপিনগোছের ন্যাকড়ায় লিঙ্গ ঢাকা ; বৃন্দাবনের বিধবাদের অনেকে এরকমই শিড়িঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন গিয়েছিল, তখন দেখেছিল ইতু । লোকগুলোর কোনো আগ্রহ হল না ওদের উপস্হিতিতে, সম্পূর্ণ উদাসীন , যেন সত্যিই আকাশে ভেসে রয়েছে । ওদের মধ্যে একজন যুবকও ছিল, তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বীরবল গোঁড় মাড়িয়া ভাষায় কথা বলল । ইতুর দিকে ফিরে বলল, এর পরের গ্রামে যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে । ওরাও এ গ্রামের নয়, কুরুসনারে গিয়ে সালফি খেয়ে এখানে মৌতাত নিচ্ছে । এই অবস্হায় ওরা ভেতরে গেলে মাওওয়াদিরা ধরে ফেললে ফাইন করবে ।
    বড় ধাপ থেকে ছোটো হতে থাকা সিঁড়ির মতন ওঠা লাল আর সাদা কয়েকটা স্তুপের দিকে ইশারা করে বীরবল মাড়িয়া বলল, ওগুলো শহিদ-বেদি ; যারা আধামিলিট্রির গুলিতে মারা গেছে তাদের ইয়াদগারে বানানো, বেশিরভাগ বেদি আসলে সমাধি, দেখছেন না বেদির ওপরে টিনের কাস্তে-হাতুড়ি । ইতু নিজেকে বলল, এখানে তার মানে ইঁট, বালি, সিমেন্ট এনে ঘর তোলা যায় ; জায়গাটাকে দুর্ভেদ্য করে না রাখলে হয়ত গ্রামের লোকেরা পাকা আস্তানা তৈরি করতে পারত, যেমন অন্য প্রদেশের আদিবাসীদের বাড়িগুলো ।
    মায়ের বাবা-মা, মানে দাদু-দিদা, বেঁচে থাকতে, ছোটোবেলায়, একবার বাবার সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিল ইতু ; সেখানে পাড়ার রাস্তায় ওইরকমই, কিন্তু ছোটো মাপের, কয়েকটা ক্ষয়ে-যাওয়া ইঁটদেঁতো বেদি দেখতে পেয়ে জানতে চাইলে, দাদু বলেছিলেন, ওগুলো শহিদ বেদি, যারা বসিয়েছে তারা নিজেদের, আর যে মারা গেছে তাকে, বোকা বানাবার স্মৃতিকে জিইয়ে রেখেছে । আজকে দাদুর বলা কথাটার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারল ও, ইতু ।
    মানুষ যদি এরকমই থাকতে চায়, তাহলে তাতে পৃথিবীর ক্ষতি ছিল কোনো, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল ইতু । এই লোকগুলো এখনও বিস্মিত হবার ক্ষমতা রাখে, এখনও এরা কলাকৌশলের ইঁদুরকলে আটকে পড়েনি, এখনও এরা ভড়ংশূন্য, সরল, স্বাভাবিক ; প্রযুক্তির প্রগতিতে এসে যায় না কিছু । সভ্যতা যতো বুড়ো হয়েছে তত বিমূর্ত আর অবাস্তব হয়ে গেছে শহুরে মানুষ, শিকড় থেকে ওপড়ানো, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, যেমন আমি নিজে । মেট্রপলিসের মানুষ আর জৈবিক হৃদয়ের প্রাণী রইল না, তার আবেগের স্বাভাবিকতা আর আন্তরিকতা উবে গেছে । বোধহয় এটা মানুষের নৃবৈজ্ঞানিক ভবিতব্য । সভ্যতা যত সভ্যতর হয়ে চলেছে ততই আমরা হয়ে চলেছি জটিল, খারাপ, অনৈতিক, ভয়াবহ । এই লোকগুলোর আনন্দের পরিভাষা তো এরাই তৈরি করবে, নাকি আমি বাইরে থেকে এসে তাকে বোঝাবো কিসে তাদের আনন্দ । সভ্যতা হয়তো মানুষের যৌবনকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে । মানুষ আসলে ভঙ্গুর, ঠুনকো, নশ্বর, তার শরীর অসুস্হ হবেই, ঋতুদের প্রকোপ সামলে চলতে হবে তাকে, সভ্য থাকার কাঁচামাল ফুরিয়ে যাচ্ছে, না-খেয়ে বা আধপেটা-খেয়ে থাকতে হচ্ছে, তার ওপর আবার সন্ত্রাসের আতঙ্ক । কে জানে, আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই । দেখি কী হয় । অন্যদের সুখে-আনন্দে-সুস্হতায় যদি জীবন উৎসর্গ করতে পারি, তাহলেই যথেষ্ট ।
    ইতুর দোভাষীর কাজ চালিয়ে বীরবল বলল, যুবকটির নাম হরিয়া, ও বলছে যে ওর কোনো কিছুরই দরকার নেই, সবই আছে, রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসলে, পঁয়ত্রিশ কিলো চাল নিয়ে আসে । এক টাকা কিলো চাল কিনতে অসুবিধা হয়না, শুয়োরবাচ্চা , মুরগি, মুরগির ডিম, মহুয়ার ফুল বিক্রি করে যথেষ্ট টাকা হয়ে যায় মাসে । রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসার আগে খবর পাঠিয়ে দেয় ।
    গ্রামটার পর পথ ক্রমে ওপর দিকে ওঠা আরম্ভ হল । অঝোর বৃষ্টিতে খসে-পড়া পাথরকে সিঁড়ির মতন সাজিয়ে নেয়া হয়েছে । দুপাশে নানা রকমের চেনা-অচেনা গাছ, ছায়ায় হাঁটতে ভালো লাগছিল ইতুর । তখনই বীরবল বলল, দিদি, আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, বিকেল হয়ে গেছে । আপনি আগে যে গ্রাম পাবেন সেখানে অপেক্ষা করুন কিংবা এই সরু পাহাড়ি বনপথ ধরে এগিয়ে যান, আরেকটা বড় গ্রাম আসবে , আমার সেরকমটাই মনে আছে, কয়েক বছর আগে গিয়েছিলুম তো । অন্ধকার হয়ে গেলে কোনো গাছে হাত দেবেন না ; সন্ধ্যার পরে গাছ আর গাছের ডালপালাগুলো সাপ হয়ে যায়, নানা রকমের সাপ, সবুজ, কালো, হলদে, মোটা, রোগা, চিত্তিদার ; আপনাকে সাবধানে হাঁটতে হবে । টর্চ এনে থাকলে জ্বালাবেন না, সাপেরা আলোয় বিরক্ত হয় ।
    --সে কি, তুমি যাবে না ? ইতু বুঝতে পারল যে ও এই ছেলেটির ওপর নির্ভর করছিল এতক্ষণ, ওর কল্পকাহিনী খাচ্ছিল । এবার ওকে আত্মনির্ভর হয়ে নির্ণয় নিয়ে এগোতে হবে । কারোর ঘাড়ে চাপার জন্য তো ও বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি । কিছুক্ষণেই সূর্য অস্ত যাবে । একা-একা কী করব এখানে । চিনি না, জানি না কাউকে।
    --না, আমি ফিরে যাই, এখানে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না । মাড়িয়া গোঁড়রা জানেই না কাকে ক্ষতি করা বলে । জঙ্গলের ভেতরে শহরের মানুষ পাবেন না । যদি পান তো নিজেকে দূরে-দূরে রাখবেন ।
    ইতু হাত তুলে ফির মিলুংগি জানিয়ে এগোলো বনের পথ ধরে । বীরবল চলে গেলে, জুতো আর জিন্স খুলে, প্যান্টিটা ফেলে দিয়ে, পেচ্ছাপ করে নিল । অবিরাম হাঁটার দরুণ প্যাণ্টির ঘষা লাগছিল কুঁচকিতে । ওহ, কতক্ষণ চেপে রেখেছিলুম, বলল হলুদ ফুলের চুমকি-বসানো ঘন-সবুজ ঝোপকে, যে ঝোপটা হয়তো কোনো ভবঘুরে পাখির গু থেকে বৃষ্টির ছাটে দু’হাত মেলে জন্মেছিল । টপ খুলে বডিসও ফেলে দিল । সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যাস, বাইরে থেকে এসে সবচে আগে এই দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া ।
    বাঁদিকের বুকটা তুলে দেখল, দ্বিতীয়বার উত্তেজিত হয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল অমিত, তাই ঘামের দরুন জ্বালা করছিল । একটা ঘৃতকুমারী পাতা ভেঙে, কুঁচকিতে আর বুকে, গোলাপি-জ্বালায় লাগিয়ে নিল ।
    বনের ভেতরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় ভালোলাগা পেয়ে বসল ইতুকে । দুহাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমি ইতুউউউউ..., আমি ইতান..., পৃথিবীর মাটিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন... । দুদিকে দুহাত মেলে দিয়ে, আবার চেঁচালো, আমি ইতু..., আমি আদিমানবী..., আমি ইতু...আমি ইতু...আমি ইতুউউউউ...।
    শুকনো পাতার ওপর থেকে পোশাক তুলতে গিয়ে ইতু দেখল, একটা কাঠবিড়ালি নতজানু হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । ইতু, নগ্ন, শুকনো পাতার ওপর বসে কাঠবিড়ালিটাকে বলল, সেতু বাঁধতে এসে থাকলে ভুল করছিস, সব সেতু ভেঙে চলে এসেছি । কাঠবিড়ালিটা পালিয়ে গেলে, জুতো আর পোশাক পরে নিল, কাঁধে ঝোলা, এগোলো বনপথে । হালকা হয়ে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল না আর । এটা জঙ্গল, না বনানীর ধ্বংসাবশেষ, কেমন যেন ছড়ানো-ছেতরানো !
    সোফানরম শুকনো-পচা পাতার ওপর হাঁটতে-হাঁটতে ইতুর মনে হল এই জায়গাটা তো ওর চেনা । ওই তো ডুমুর গাছে থোকা-থোকা পাকা ডুমুর হয়ে রয়েছে, পায়ের কাছে বনপথের পাশে-পাশে ঘৃতকুমারীর জঙ্গল, ঘৃতকুমারী, যা এখন কতো দাম দিয়ে কেনে পাবলিক, বহেড়া গাছ, অশোকফুল গোছা-গোছা, ভরাঙ্গিপাতা, ডেভিলস কটন বা উলটকম্বলের গাছ, ইগল উড বা অগরু গাছ, আরে, এলিফ্যাণ্ট ক্রিপার বা সমুদ্রাশোক, সুগন্ধমূল বা গ্রেটার গলাঙ্গল, উইনটার চেরি যাকে সিলেবাসে অশ্বগন্ধা বলা হতো, কত পরিচিত গাছ-গাছড়া, পাটনায় পেতুম শুকনো, কবে কোথা থেকে অশোক রাজপথের ইউনানি দোকানে আসত কে জানে । এখানে দিব্বি রয়েছে অবহেলার ঐশ্বর্যে ঝিলমিলিয়ে, শিশি-বোতল-বয়ামের বাইরে মাথা তুলে, হাতপা ছড়িয়ে।
    ঘণ্টাখানেক চলার পর, সন্ধ্যা নেমে আসায়, অজানা এক গাছের গুঁড়ির কাছে, ছায়ায় , জুতো খুলে, বসে পড়েছিল ইতু, বুকের ভেতরে বাজানো ভীতির দামামা দূর থেকে কানের ভেতরে উঠে আসছিল। ওপর থেকে ঝরঝর করে কয়েকটা শুকনো ফুল ঝরে পড়তে চমকে উঠেছিল, তারপর টের পেল যে এটা মহুয়ার গাছ ; তাইতো অমন গন্ধ বেরুচ্ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে যদি ভাল্লুক আসে, তাহলে ? কোথায় যেতে হবে সুস্পষ্ট বলে দেয়নি অমিত । বলেছিল হাঁটতে থেকো যতটা পারো । পরিচিত কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবে । তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। গাছে ঠেসান দিয়ে ঢুলতে লাগল । সারাদিনের রোদের আমেজে বুঁদ গাছের পাতাগুলো অবসাদে ঝিমিয়ে ।
    ঘুম ভাঙতে, দেখল, অন্ধকার, আজকে বোধহয় চাঁদ ওঠার রাত নয় । জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অন্ধকারে গাছে ডান হাত ঠেকতেই মনে হল সাপের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে, নরম, মাংসল । দ্রুত হাত সরিয়ে নিল । কী করবে ? গাছগুলো রাতে সাপের আকার নিয়ে নিচ্ছে ! কেউ এলে তাকে দেখতেও তো পাবো না জঙ্গলের অন্ধকারে । হয়তো বিভ্রম, মনে করে, বাঁহাত বাড়িয়ে গাছ অনুমান করে হাত বাড়াতে, সাপের গায়ে ঠেকল, ঠাণ্ডা । সাপের ভয়ে ইতুর বুকের ভেতরের ইঁদুরগুলো দাপাদাপি আরম্ভ করে দিয়েছিল । বুঝতে পারল যে যা ওর অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তা আতঙ্ক, সাপের আকার পাওয়া গাছগাছালির আতঙ্ক ।
    হঠাৎ ওর মুখের ওপর সরু নিয়ন আলো পড়তে চোখ ধাঁধিয়ে গেল । কোনো ময়ালের চোখ ?
    আওয়াজ আর কন্ঠস্বর শুনে সন্দিগ্ধ ভয়ে সিঁটিয়ে উঠল ইতু । ভাল্লুক ? আরও তিনটে টর্চ জ্বলতে, আঁচ করল ওর চারপাশে জলপাই রঙের উর্দিতে চারজন যুবক আর একজন যুবতী । প্রত্যেকের কাঁধে বন্দুক বা রাইফেল, কে জানে কী, জওয়ানদের কাঁধে ঝুলতে দেখেছে অমন অস্ত্র । আধামিলিট্রি জওয়ান নয়তো ? একজন যুবতী রয়েছে যখন তার মানে এরা সি আর পি এফ জওয়ান নয় বলেই মনে হচ্ছে । যুবতী তো খোঁপাও বেঁধেছে, চুলে তেল দেয় নিশ্চয়ই, চকচক করছে। এখানে জঙ্গলে মাথায় দেবার তেলও পাওয়া যায় নাকি ! চুলটা কেটে ফেললুম, না কাটলেও বোধহয় চলত ।
    একজন যুবক এগিয়ে এলো, যাকে দেখে চিনতে পারল ইতু, আরে, এই ছেলেটা তো ওর ক্লিনিকে একবার খাম দিতে আর ওর বাড়িতে একবার খাম নিতে এসেছিল । যাক এরা তাহলে অমিতের পরিচিত । অমিতও এরকম কাঁধে বন্দুক ঝোলায় নাকি ? আমাকেও বন্দুক ঝোলাতে হবে নাকি ? তা তো চাইনি ।
    --ডক্টর ঘোষ, ওয়েলকাম, বলল ছেলেটি ।
    ইতুর মুখ দিয়ে বেরোল, থ্যাংকস , ম্যায় বহুত ডরি হুই থি, কোই দিখাই নহিঁ দে রহা থা, কাফি অন্ধেরা ভি হো চলা হ্যায় ।
    --জানতি হুঁ, আপ সো গয়ে থে দেখকর হম লোগোঁনে নিন্দ সে নহিঁ জাগায়া আপকো । আপ জব অপনা নাম লেকর চিল্লায়েঁ, তভি সে হমলোগ আপকে সাথ হ্যাঁয় । আপ হম লোগোঁ কে সাথ আইয়ে, বলল ওদের সঙ্গের যুবতী । সে-ই বোধহয় এদের নেতা । পিঠের ব্যাগ থেকে দুশো এম এল জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, লাইফ ইজ টাফ ফর অল ইন দিস প্লেস, অ্যান্ড ভেরি ডেঞ্জারাস টু, ইউ হ্যাভ টু গ্র্যাজুয়ালি অ্যাডজাস্ট ।
    জল খেয়ে তৃপ্ত বোধ করল ইতু । ওর উলঙ্গ চিৎকার এরা দেখেছে তাহলে । দেখুকগে, কীই বা এসে যায়। এতক্ষণ পর মানুষ দেখতে পেয়ে অসুরক্ষিত থাকার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত লাগল নিজেকে ।
    মেয়েটি বলল, আপনি হাঁটার সময়ে মাঝখানে থাকবেন, আমি আপনার দেহরক্ষী, আমার নাম সোনারি । ওদের সঙ্গে হাঁটা আরম্ভ করল, ওর সামনে তিন জন, পেছনে দুজন । গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশে তারা দেখতে পেয়ে দেহরক্ষীদের চেয়ে তাদের টিমটিমে আলোদের বেশি আপন মনে হল ইতুর । সেই সকাল থেকে বেরিয়েছে, রোদের জন্য দ্বিতীয়বার আর পেচ্ছাপ পায়নি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আর কতক্ষণ হাটঁতে হবে কে জানে, কয়েকটা বিস্কিট আগেই খেয়ে নিলে ভালো হতো । এরা কেউ কথাবার্তাও বলছে না । নিজে থেকে কোন প্রসঙ্গেই বা কথা বলবে, নানা ভাবনা মগজে ঘুরছিল ইতুর। দেহের আলো জ্বালিয়ে পুরুষ জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে মাদি-জোনাকিদের আকৃষ্ট করার জন্য । বনের পাতারা গন্ধ বিলোচ্ছে । নয়নাভিরাম নির্বাক অন্ধকার । বনপথের সহযাত্রীদের পাহারায় হয়ত আরও দেড় ঘন্টা হেঁটেছিল ইতু ।
    তখনই, অন্ধকারকে হুশিয়ারি দিয়ে কয়েকবার হুইসিল বেজে থেমে গেল ।
    আচমকা গুলিচলার শব্দ আরম্ভ হতে, ইতুর ওপর ঝাঁপিয়ে একজন সঙ্গী যুবক ওকে জঙ্গলের শুকনো পাতার ওপরে উপুড় করে শুইয়ে দিল, ইতুকে বাঁচাবার জন্য দুদিক থেকে ওর দেহকে নিজেদের শরীর দিয়ে ঢেকে নিল বাকি দুজন যুবক । মেয়েটি শুকনো পাতার ওপর উপুড় হয়ে কোনো অচেনা শত্রুর দিকে তাক করে বন্দুক উঁচিয়ে শুয়ে পড়ল ইতুর মাথার কাছে।
    অবিশ্বাস্য । এরা আমার কেউ নয়, তবু আমাকে বাঁচাবার জন্য নিজেদের শরীরকে আমার দেহের বর্মে পালটে ফেলল ! মানুষ না রোবোট এরা !
    ইতু অনুমান করল দুদিক থেকে গুলি চলছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, গুলির আগুন-ফিনকিও দেখতে পাচ্ছে না । ওর মুখ মাটির দিকে, জিভেতে ভয়ার্ত আহ্লাদের স্বাদ । নিজেকে নিঃশব্দে বলল, বোধহয় নতুন জীবন আরম্ভ হল, কিংবা জীবন হয়তো কিছুক্ষণেই শেষ হয়ে যাবে । আর আশ্চর্য, এক্ষুনি হয়তো মরে যাবো, এই ভেবেও ভেতরে-ভেতরে আনন্দ খেলছে।
    শুকনো পাতার ছোঁয়াচে গন্ধে, বাড়ি থেকে পালাবার পর প্রথম যখন অমিত ওর ক্লিনিকে এসেছিল সেই দিনকার ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগল ইতুর, হুবহু ।

    আঠারো
    মালগুজার কর্মচারী : ওই দ্যাখো । সালফি খাবার জন্যে জঙ্গলে ঢুকেছিল, ভ্যায়েনচো, সামলাতে পারেনি, মাতাল হয়ে পড়ে রয়েছে ।
    কেন্দুপাতার ফড়ে : সালফি খেয়ে মাতাল হলে তো যেখানে খেয়েছে, তার কাছাকাছি পড়ে থাকত । এখানে আসপাশে কোনো গ্রাম নেই, সালপিখোরদের গেঁয়ো জামাতও নেই ।
    মালগুজার কর্মচারী : ভ্যায়েনচো, কেন্দুপাতার চোরাকারবারি নয়তো ?
    কেন্দুপাতার ফড়ে : কেন্দুপাতার ব্যাবসার সবাইকে চিনি, চোরাকারবারিদেরও । ওখানে, রাস্তার ধারে খাদে পড়ে থাকবে কেন ?
    মালগুজার কর্মচারী : মরুকগে বেওড়াগুলো, ভ্যায়েনচো । আমাদের কী করার আছে ।
    কেন্দুপাতার ফড়ে : হ্যাঁ, উঠিয়ে নিয়ে যাবার হলে বনদপতরের লোক বা সিআরপিএফ নিয়ে যাবে । নয়তো খাবে জন্তু-জানোয়াররা । চলুন, চলুন । কদম চলাকে চলিয়ে ।

    উনিশ
    অমিত বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথম বার যখন ইতুর সঙ্গে দেখা করতে ওর ক্লিনিকে এসেছিল, সে ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে ইতুর । অবুঝমাড়ের জঙ্গলে, মাটিতে শুকনো জঞ্জালের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে, গুলির অধারাবাহিক শব্দ শেষ হবার পরও, বহুক্ষণ ওভাবে শুয়ে থেকে, সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছিল ইতুর, হুবহু ; পাতাগুলো বোধহয় বয়ে এনেছে অমিতের যৌবনগ্রন্হির নিঃসরনের বুনো গন্ধ ।
    অমিতের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না । হয়তো কেন, নিশ্চিত হবে না ।
    বছর আড়াই আগে,আনিসাবাদে, নিজের ক্লিনিকে রোগি আসার অপেক্ষায় হতাশ বসেছিল ইতু, ইতু ঘোষ ; দেখল, ফুটপাতে, ওর ক্লিনিকের সামনেই চেককাটা শার্ট আর ধূসর ট্রাউজার পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে, ওপরে মুখ তুলে । দাড়ি-গোঁফ আর বাবরি চুলে মুখ প্রায় ঢাকা, ইতু বয়স আন্দাজ করল বাইশ-তেইশ হবে, রোগকে যেচে ডেকে আনার সবচেয়ে উদ্দীপক বয়স । উঠে দাঁড়িয়ে, সাদা গাউন পরেই ছিল, টেবিলে রাখা স্টেথোস্কোপটা গলায় ঝুলিয়ে, এগিয়ে গিয়ে ডাকল লোকটাকে, হিন্দিতে, আসুন না, আসুন, আপনাকে দেখেই তো বুঝতে পারছি আপনি বেশ ক্লান্ত, হয়ত কোনো রোগের কারণে ।
    সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল তুলে লোকটা বলল, ডাক্টর ইতু ঘোষ কা ক্লিনিক, য়ঁহা সভি রোগোঁকা ইলাজ কিয়া জাতা হ্যায়, তারপর ইতুর দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল, তুই ইতু ঘোষ, গর্দানিবাগের ঘোষবাড়ির মেয়ে, তাই না ?
    যুবকের মুখের দিকে না তাকিয়ে, পেছন ফিরে তাকে বলল, হ্যাঁ, আমি ঘোষবাড়ির মেয়ে ইতু, অনেকে ইতি বা ইতান বলেও ডাকে । আপনি ভেতরে আসুন না, শুনবো আপনার শারীরিক সমস্যার কথা, কোনো চিন্তা করবেন না, হেভি অ্যালোপ্যাথিক ডোজের ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসা আমি করি না, আসুন, ভেতরে আসুন ।
    লোকটা ভেতরে ঢুকে, ইতুর টেবিলের উল্টো দিকে, রোগির চেয়ারে বসলে, নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে, স্টেথোটা টেবিলে রেখে, টেবিলে ছড়ানো জিনিসগুলো, খোলা-সংবাদপত্র, সাজাতে-সাজাতে ইতু বলল, কি হয়েছে শুনবো, তার আগে আপনার ব্লাড প্রেশার আর পাল্স চেক করে নিই । রোগি তার সমস্যা বর্ণনা করার আগেই, ইতু বলল, দিন আপনার বাঁ হাতখানা এখানে রাখুন তো, বলে ব্লাড প্রেশার মাপার জন্য ফ্ল্যাপটা হাতে জড়িয়ে বলল, আপনি ওনাদের চেনেন ?
    --আমি তোকেও চিনি, বলল লোকটা, তুইও আমাকে চিনিস, মুখের পানে আগে তাকিয়ে দ্যাখ, ইডিয়ট । আমার গলার আওয়াজও এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি নাকি ?
    যুবকের কথা শুনে তার মুখের দিকে চেয়ে সঞ্চিত বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ইতু, আরে অমিত, চিনতেই পারিনি, দাড়ি গোঁফ রেখে এমন ভোল পাল্টে ফেলেছিস রাসকেল, গলার আওয়াজও বড়দের মতন হয়ে গেছে, সন্ন্যাসী হয়ে গেছিস নাকি ? ফুঁপিয়ে ফেলেছিল, সামলে নিয়ে বলল, সেই যে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলি, আমাকে বলে যাবার প্রয়োজন বোধ করলি না।
    --হ্যাঁ, সাধুই হয়ে গেছি প্রায় ?
    --বাড়িতে গিয়ে আমার ক্লিনিকের ঠিকানা পেলি ? টিশ্যু পেপারে চোখ পুঁছে বলল ইতু ।
    -- গিয়েছিলুম একটু আগে, ভেতরে ঢুকিনি , তাই আমাকে দেখে রোগীর মতন মনে হয়ে থাকবে, হাঁটছি তো অনেকক্ষণ যাবত । বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে চলে এলুম । তোদের প্রতিবেশী গোবর্ধন মিশ্রর কাছে খোঁজ করে তোর ক্লিনিকের ঠিকানা পেলুম । মন কেমন করছিল রে সবায়ের জন্য, কিন্তু ওই বাড়িতে আমি তো আনওয়ান্টেড কলঙ্ক । কিছুক্ষণ থেমে, মাথা নামিয়ে অমিত বলল, ওই বাড়িতে আমি একজন বেজন্মা ।
    --স্টপ ইট, ভাট প্যাঁদাসনি । কেউই তোকে বেজন্মা বলেননি ।
    --তা না হলে তোর সঙ্গে আমার সম্পর্কের স্বীকৃতি দিতে বাধা ছিল কোথায় ? আমার বাবার চেয়ে আমার মা দশ বছরের বড়, আর আমার মা আমার বাবার স্ত্রী নন, অন্য আরেকজনের স্ত্রী, এই তো ? এই কারণেই তো ওনাদের আপত্তি ?
    ইতু চিৎকার করে উঠল, না, না, না, না । ক্লিনিকে বসে অমনভাবে চেঁচিয়ে ফেলে, হুঁশ হল, যে, ফুটপাথ দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা ওর দিকে অবাক ঔৎসুক্যে তাকাচ্ছে, সম্ভবত ভাবছে যে এ কেমন ডাক্তারনি, রোগিকে বকুনি দিয়ে ভয় পাওয়াচ্ছে । উঠে গিয়ে শাটার নামিয়ে, অমিতের মুখের কাছে মুখ এনে ইতু বলল, ওনাদের বক্তব্য ছিল আমরা দুজনে ছোটোবেলা থেকে ভাইবোনের মতো বড়ো হয়েছি, আমরা বিয়ে করলে ভাইবোনের বিয়ে বলে মনে করবে পাড়াপড়শিরা, বলেছিলেন সকলে । আফটার অল রাঙাকাকু-রাঙাকাকিমা তোর দায়িত্ব নিয়েছিল, ছেলের মতন মানুষ করছিল, তাই । শুনে রাখ, তুই যদি আমার মায়ের পেটের ভাইও হতিস, ইনসেসচুয়াস হলেও, তোর সঙ্গেই রিলেশানশিপ করতুম, কিংবা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে তোর সঙ্গে লিভ ইন করতুম ।
    --তুইও জানিস, আমিও জানি ইতু, তোদের বাড়িতে কী ধরণের ট্রিটমেন্ট হতো আমার । তারপর যখন ওনারা জানতে পারলেন যে তুই আমাকে ভালোবাসিস তখন ওনারা ঘেন্না আর রাগ সামলাতে পারেননি ।
    অমিতের জামার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তাই তুই আমাকে ফেলে পালিয়ে গেলি; ইনফর্মটুকু করতে পারলি না ? বেশ ককিয়ে কেঁদে ফেলল ইতু, ফিরে গিয়ে বসল নিজের চেয়ারে, টিশ্যু দিয়ে চোখ পুঁছল , মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, কাওয়ার্ড রেনিগেড ।
    অমিত : আমি আমার বাবা আর মায়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলুম রে, বিশ্বাস কর, ওনাদের কাছ থেকে জবাবদিহি পাওয়া জরুরি ছিল । কেন ওনারা জাস্ট একজন বন্ধুর বাড়ি আমাকে ডাম্প করে চলে গেলেন, তাও সেই বন্ধু নিজেই কিডন্যাপ হয়ে গিয়েছিল বলে যে বাড়ি তার বউ-বাচ্চাকে স্বীকৃতি দেয়নি ।
    চেয়ার ছেড়ে অমিতের কাছে পৌঁছে, এবার ওর দীর্ঘ চুল দু’হাতে ধরে ইতু বলল, তাই বলে তুই আমাকে ডিচ করবি ? আমি কি দোষ করেছিলুম ? আমিই বা কোন রাজকন্যার মতন আছি ওই বাড়িতে ?
    অমিত : ডাক্তার হয়েছিস তো ! কনভেন্ট এজুকেশান ঝাড়ার অভ্যাস ছাড়তে পারিসনি দেখছি ।
    ইতু : এটা ডাক্তারি ? ভালো করে পড়েছিস বাইরে সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে, ইউ ফুল ? বাবা-মা অ্যাকসিডেন্টে মারা যাবার দরুণ এক বছর এম বি বি এস পড়ে ছেড়ে দিতে হয়েছিল । আমি যেটা করেছি সেটা অলটারনেটিভ মেডিসিন । রোগি আসে না, যাও দুচারটে আসে তারা দ্বিতীয়বার আসে না, কেননা আমি রাংতায় মোড়া অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ দিই না ।
    অমিত : মিশ্রাজির কাছে শুনেছি, তোর মা-বাবার অ্যাকসিডেন্টের কথা । হ্যাঁ, সাইনবোর্ড দেখেছি, তুই অলটারনেটিভ মেডিসিনের ডাক্তার । বাবা-মায়ের খোঁজে গিয়েছিলুম, অথচ সে বিষয়ে জানতে চাইছিস না ? কেবল নিজের চিন্তা করছিস ?
    ইতু, মুঠো থেকে অমিতের চুল আলগা করে বলল, তুই ছাড়া আমার আপন বলতে কে আছে বলতো ওই ফাকিং একান্নবর্তী পরিবারে ? আই অ্যাম সরি, এতদিনে তোকে পেয়ে ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে গিয়েছিলুম । তোর বাবা-মা কোথায় আছেন ? খুঁজে পেয়েছিস ওনাদের ? কী করে পেলি ?
    অমিত : আমাকে কথাই বলতে দিচ্ছিস না । বোস, গিয়ে নিজের চেয়ারে বোস । তোকে আমার দরকার।
    অমিত : বাবা আর মা দুজনকেই খুঁজে পেয়েছি । মায়ের হাজবেন্ডকেও খুঁজে পেয়েছি ।
    অমিত : আমার মা এই বয়সেও সুন্দরী, পাকাচুল-সুন্দরী । শি ইজ সো সিরিন অ্যাণ্ড ডিগনিফায়েড, কী বলব তোকে, কিন্তু ডিসট্যান্ট, হ্যাঁ, এক্সট্রিমলি ডিসট্যান্ট । জানিস, আমি কলকাতায় নার্সিং হোমে জন্মেছিলুম । নার্সিং হোমের আর কলকাতা কর্পোরেশানের বার্থ সার্টিফিকেট আছে রাঙাবাবার কাছে, অথচ, কখনও সে কথা বলেনি আমাকে । বার্থ সার্টিফিকেটে আমার নাম অমিত বর্মণই লেখানো হয়েছিল ।
    ইতু : এই ডাফার, পা দোলাসনি, পা ব্যথা করছে তো চেয়ারে পা তুলে বোস ।
    অমিত : ওকে, ওকে, পা তুলেই বসছি । যেদিন সকালে তোদের বাড়ি ছাড়লুম, সোজা বাবার অফিসের কর্মীদের কাছে গিয়েছিলুম, বাবার কনটেমপোরারি একজন বললেন, যে উনি কোনো নকসল্লি ফ্যাকশানের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিলেন । অফিসের এক ক্লাস ফোর স্টাফের কাছে রসিক পাসওয়ান নামে এক পিওনের নাম-ঠিকানা পেয়ে তার কোচাগাঁও গ্রামের দলিত টোলার বাড়িতে গিয়েছিলুম ; সে ওই ফ্যাকশানে ছিল । গিয়ে শুনলুম যে রসিক পাসওয়ান পুলিশের গুলিতে মারা গেছে । শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল । আশঙ্কা করেছিলুম যে তাহলে বাবাও হয়ত মারা গিয়ে থাকবেন আর মাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া হয়ে থাকবে ।
    অমিত : ওয়ারিস আলি গঞ্জে স্টেশানে বসে ভাবছিলুম যে এর পর কী করব, কোথায় সুত্র পাবো, যাবোই বা কোথায় ? গর্দানিবাগের বাড়িতে বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় নাকি বলে গিয়েছিলেন যে ওনার আর আমার মায়ের খোঁজখবর যেন কখনও করা না হয় । বাড়িতে কেউ কখনও আলোচনা করেনি ; করল প্রথম যখন ওনারা তোর-আমার সম্পর্কের কথা জানতে পারল । আমার বাবার নাম অতনু চক্রবর্তী আর মায়ের নাম মানসী বর্মণ, ওনারাই সেদিন উত্তেজনার মুখে বলেছিলেন, মনে আছে তোর ? আমি তোর রাঙাকাকুকে কতবার জিগ্যেস করতুম যে আমার পদবী বর্মণ কেন, উনি এড়িয়ে যেতেন, বলতেন কী করবি জেনে ।
    অমিত : স্টেশানে প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল পরের ট্রেনের জন্য । ভাবছিলুম শালা যে ট্রেনই আসুক, যেখানেই যাক, চেপে যাব । হঠাৎ কাঁধে কেউ একজন হাত রাখতে, পেছন ফিরে দেখি, বুড়োটে কদমছাঁট বিহারি , মাথায় লাল গামছা বাঁধা, বলল যে তুমি রসিক পাসোয়ানকে খুঁজছ কেন ? আমি বললুম, উনি আমার বাবাকে আর মাকে চেনেন, তাই, আমি ওনার কাছে জানবার জন্য এসেছিলুম যে আমার বাবা-মাকে কোথায় পাবো, তাঁরা বেঁচে আছেন কি না । উনি বললেন, তোমার মুখ অনেকটা তোমার বাবার মতনই । আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি কে, আমার বাবা-মাকে চেনেন ?
    অমিত : উনি বললেন ওনার নাম রসিক পাসওয়ান । ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেই একই দলিত টোলায়, সেই বাড়িতেই, যেখানে আমাকে বলা হয়েছিল যে রসিক পাসওয়ান মারা গেছে । রসিক পাসওয়ান নামে সত্যি একজন মারা গিয়েছিল পুলিশের সঙ্গে নকসল্লিদের লড়াইতে, কিন্তু সে অন্য রসিক পাসওয়ান ।
    ইতু : যাই হোক, বাবা মাকে কোথায় পেলি, কী করেই বা পেলি ? ওনাদের বাড়িতেই ছিলি এতকাল ? আমাকে নিয়ে চল, আমি তোর সঙ্গে ওনাদের বাড়িতেই থাকব ।
    ইতু : আমার আর এখানে একদম ভাল্লাগছে না । এখানে থাকতে হলে আমি মরেই যাবো ।
    অমিত : আবার তুই নিজের প্রসঙ্গে ফিরে এলি । বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা হল, সে কথা তো জানতেই চাইছিস না । রসিক পাসওয়ান বলল যে আমার বাড়িতে দুচারদিন থাকো, আমি খোঁজখবর নিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো ওনাদের কাছে । দশ দিন থেকে গেলুম ।
    ইতু : একজন অচেনা বিহারির বাড়ি দশ দিন থেকে গেলি ? তোকে কিছু করেনি তো ?
    অমিত : আমাকে আবার কী করবে ? আমার কাছে পয়সাকড়িও ছিল না তেমন যে লুটপাট করে কেড়ে নেবে । বটঠাকুমা মাঝে-সাঝে যে হাতখরচ দিতেন সেটুকু জমানো টাকাই ছিল । রসিক পাসওয়ানের সঙ্গে দেখা না হলে ভিক্কে করতে হত ।
    ইতু : তা নয় । যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলি তখন খিচ্চা-কওলা-চিকনা-লালটু, ইনোসেন্ট-ইনোসেন্ট টাইপ, ছিলি । ওইসব এরিয়ায় ছেলেদের সঙ্গে জোর করে সেক্স করে শুনেছি । এই ক’বছরে অবশ্য রোদে পুড়ে কিছুটা চেবানো-চোয়াড়ে আর ছিবড়ে-মাসকুলার হয়ে গেছিস, যে জন্য দেখামাত্র চিনতে পারিনি ।
    অমিত : আমি সিরিয়াস আলোচনা করছি আর তুই তার মাঝে গল্পগাছা নিয়ে আসছিস । লোকটা আর ওর বউ অনেক ভালো । তোদের বাড়িতেও আমার অমন আদর-যত্ন হয়নি । দশদিন পরে, সকালে আমরা বাসে করে গেলুম গয়া । গয়া থেকে ট্রেনে করে লাতেহার, ওটা ঝাড়খণ্ডে পড়ে । দিনের বেলাটা তেতিয়া বিরহোর নামে একজন আদিবাসীর মাটির বাড়িতে কাটিয়ে বিকালে হাঁটা দিলুম তিনজনে । সারারাত উবড়-খাবড় রাস্তা ঠেঙিয়েছি, ভেবে দ্যাখ ।
    অমিত : পৌঁছোলুম কাতিয়া নামে একটা জঙ্গলে, রিয়্যাল ঘন-জঙ্গল, গাছের পর গাছ আর ঝোপঝাড়। তাতিয়া ফিরে গেল ; আমাদের আরেকজন কম বয়সী আদিবাসীর জিম্মায় দিয়ে, তার নাম ঝুনাই । সেখান থেকে অনেকটা ওপর দিকে উঠে, অনেকটা, অনেকটা, জঙ্গলের আরও ভেতরে গিয়ে ঝুনাই ফিরে গেল । আরেকজন, তার নামও তেতিয়া, আমাদের নিয়ে গেল আরও ভেতরে খোলামতন একটা জায়গায়, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ব্যাডমিন্টন কোর্টের মতন অমন একটা খোলা জায়গা রয়েছে, ন্যাচারাল জায়গা । কয়েকটা পলিথিনের তাঁবু দেখতে পেলুম, দু’জন লোক কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে পাহারা দিচ্ছিল । কীরকম তাঁবু জানিস, তোর ক্লিনিকের একটু আগে ফুটপাথে চায়ের দোকান আর ভাতের দোকানে যেমন পলিথিনের তেরপল আছে, তেমন । একটা তাঁবুতে ঢুকে তেতিয়া আস্তে ডাক দিতে, একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন, তিনি বললেন, আবার ম্যালেরিয়া হল নাকি রে, সেরে তো গিয়েছিলি । তেতিয়ার পেছনে আমাদের দেখতে পেয়ে রসিককে বললেন, আচ্ছা, রসিক একজন নতুন ছাত্র এনেছে বলে মনে হচ্ছে । মাস্টারসাহেবকে খুঁজছ তো ? উনি ওইদিকের ছাউনিটায় মিটিং করছেন । শুনেছ তো কয়েকদিন আগে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল-এর লোকেরা জওয়ানদের শব তোলার কাজে কয়েকজন গ্রামবাসীকে লাগিয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বোমা ফেটে মারা গেছে আর কয়েকজনের অঙ্গহানি হয়েছে ।
    ইতু : জঙ্গলে স্কুল-মাস্টার কী করেন রে ?
    অমিত : ধৈয্য ধর না, সবই তো বলছি । ওই মহিলা আমার মা আর মাস্টারসাহেব আমার বাবা ।
    ইতু : মাই গড ! আমি যাবো ওখানে, তুই আমাকে আজই নিয়ে চল । আমি ওনাদের বলব যে আমি তোকে চাই বলে তুই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিস, তোর কোনো দোষ নেই ।
    অমিত : মা আমাকে দেখে চিনতেই পারলেন না যে আমি ওনার ছেলে ; শালা মাতৃত্ব নিয়ে লেকচারবাজি সবই ফালতু । আমার তক্ষুনি এত খারাপ লেগেছিল যে হয়ত কেঁদেই ফেলতুম । উনি হিন্দিতে বললেন, তোমাকে বেশ ডিপ্রেসড দেখাচ্ছে । অনেকটা হেঁটে এসেছ তো, ক্লান্ত হয়ে গেছ, ওই শেডটায় যাও, মাস্টারসাহেব আছেন, যাও দেখা করে নাও, ক্লান্তি জুড়িয়ে নাও । রসিক পাসওয়ান ওনাকে বললই না যে আমি ওনার ছেলে । পাশের তেরপলে ঢুকেছি, রসিক পাসওয়ান ওনাকে লাল সেলাম মাস্টারসাহেব বলতেই, উনিও একইভাবে প্রত্যুত্তর দিলেন, আর আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন, গভীরভাবে আমার মুখের পানে তাকিয়ে দেখে তক্ষুনি জড়িয়ে ধরলেন , বাংলাতেই বললেন, এখানে কেন এলে, যেখানে ছিলে ভালোই তো ছিলে । তুমি আমার ছেলে, ওনারা নিশ্চয় তোমাকে বলে থাকবেন, যে কারণে তুমি কমরেড রসিককে সন্ধান করে এখানে ছুটে এসেছ, দাঁড়াও তোমার মাকে ডাকছি, উনি প্রায়ই তোমার প্রসঙ্গ তোলেন আর বলেন যে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিলুম আমরা । আমি বললুম যে আমার নাম অমিত । ওনাকে ঘিরে যে আদিবাসীরা ছিল, জিগ্যেস করল, আপকা বেটা ? বাবা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু হারিয়ে-যাওয়া ছেলেকে দেখে একজন বাবার যেমন রিঅ্যাকশান এক্সপেক্ট করেছিলুম, তেমন প্রতিক্রিয়া হল না দেখে, মনটা খারাপ হয়ে গেল, ডিফিটেড ফিল করলুম রে ।
    অমিত : উনি বলতে লাগলেন, আমি কিন্তু মনে করি কিছুই ভুল করিনি । দেখছ তো অঞ্চলটা ? এখানে একজন শিশুকে লালন করা অসম্ভব । উনি তারপর মানসী মানসী বলে কয়েকবার ডাক দিতে আমার মা এলে, বাবা বললেন, একে চিনতে পারছ ? তোমার ছেলে । মা আমার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, আমিও মায়ের দিকে । উনি কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, ব্যাস, জীবনে প্রথমবার নিজের গ্রোনআপ ছেলেকে দেখে, জড়িয়ে, কাঁদাবার কথা । উল্টে, আমারই কান্না পেয়ে গেল । মায়েরা জড়িয়ে ধরলে মগজের মধ্যে যে তুফান আরম্ভ হয় তা জানতে পারিনি কখনও । মা বললেন, তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ, জবাবদিহি চাইতে, না? আমার কাছে দেবার মতো ব্যাখ্যা নেই । আমি জবাবে বলেছিলুম, আপনি আমাকে এভাবে অনেকক্ষণ জড়িয়ে থাকুন, তাহলে আমার কান্না পাবে না । ওনার হৃৎস্পন্দন যে দ্রুত হয়ে চলেছে, তা টের পেয়ে মনে হচ্ছিল যে যাক, জবাবদিহি পাওয়া গেল । দূরত্ব কিন্তু থেকেই গেছে রে ।
    অমিত : বাবা বললেন, মানসী, ডাক্তারসাহেবের কাছে নিয়ে যাও ওকে, দেখাও তোমার ছেলে কত বড় হয়ে গেছে । আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, অমিত, তুমি এখানেই থাকবে, আমাদের সঙ্গে কাজ করবে, আর ফিরে যাবার দরকার নেই ।
    অমিত : মা আমাকে অন্য একটা পলিথিনের তেরপলে নিয়ে গেলেন । সেখানে রোগা, পাকাচুল, চশমাপরা, ফর্সা একজন বসে টেবিলে কিছু লিখছিলেন, তাঁর সামনে দুজন আদিবাসী বসেছিল । মা তাঁকে বললেন, একে চিনতে পারছ ? এ আমার ছেলে । উনি এমনভাবে আমার ছেলে কথাটা বললেন যে বুঝতে পারলুম তার ভেতরে গোপন গর্ব লুকিয়ে আছে, আর কিছুটা ওই পাকাচুল লোকটার প্রতি অবজ্ঞা । লোকটা উঠে আমার মুখের কাছে মুখ এনে চশমা কপালে তুলে বলল, তুই কমরেড অতনুর ছেলে ? কী নাম রেখেছে তোর, অমিতই আছে তো ? ডাক্তারসাহেবের কথা শুনে আমার বেশ ভালো লাগল রে । বাবা-মা তুমি-তুমি করে কথা বলছিলেন, ইন ফ্যাক্ট আজও ওনারা আমার সঙ্গে তুমি-তুমি করে কথা বলেন, আর আমি ওনাদের আপনি-আপনি করে কথা বলি, কিছুতেই তুমি বেরোয় না মুখ থেকে । বুঝতে পারি যে ওনারা একটা অদৃশ্য পর্দা টাঙিয়ে আলাদা করে রেখেছেন আমাকে ।
    ইতু : আমি হলে দেখা হতেই বলতুম, মা, বাবা, তোমরা আমাকে অন্যের কোলে ফেলে দিয়ে আর কখনও ফিরে তাকাওনি কেন । তারপর কী হল ? ঘ্যাঙাচ্ছিস কেন, শিট, তাড়াতাড়ি বল ? তুই ওনাদের সঙ্গেই ছিলি এতকাল ? কী করতিস ? আমায় কবে নিয়ে যাবি ?
    অমিত : হ্যাঁ, থেকে গেলুম । ডাক্তারসাহেব কী করেন জানিস ? যে সব আদিবাসী ছেলেরা স্কুলে ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত পড়েছে, তাদের ডাক্তারির প্রথমপাঠ পড়ান, অ্যান্টিবায়টিক দেয়া, কখন অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ দিতে হবে, ইনজেকশান দেয়া, ওষুধের নাম, জখম হলে কী ভাবে পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে হবে, এইসব । গরিবদের জন্য, বিশেষ করে আদিবাসীদের জন্য কিলোমিটার-কিলোমিটার তো ডাক্তার পাওয়া যায় না। তাই হাতে-নাতে প্রাথমিক ডাক্তারি শিখে তারা গ্রামে-গ্রামে ডাক্তারি করে, বেয়ারফুট ডাক্তার ।
    ইতু : আর তোর বাবা-মা, ওনারা ওই জঙ্গলে কী করেন ?
    অমিত : বাবা ক্লাস নেন, আদিবাসী ছেলে-মেয়ে-জোয়ান সবায়ের । হিন্দি, ইংরেজি আর অঙ্ক শেখান । এছাড়া উনি রাজনীতি সম্পর্কে সহজ বিশ্লেষণ করে বোঝান কেন গরিবরা ষাট বছর পরও গরিব থেকে গেল ; তা থেকে মুক্তি পেতে গেলে কী করতে হবে, এইসব তত্ত্বকথা । ওনারা কিন্তু একই জায়গায় থাকেন না ; প্রায় রোজই পলিথিনের তাঁবু আর জিনিসপত্তর গুটিয়ে অন্য কোথাও তাঁবু খাটান । বন্দুকধারীরা পাহারা দ্যায়, কুচকাওয়াজ করে, বন্দুক চালাতে শেখে । অনেক লোক আছে, প্রথম দিন কোনো আইডিয়া হয়নি । একটু-একটু করে জানতে পারলুম ।
    ইতু : আর মা ?
    অমিত : মা যে ঠিক কী করেন জানি না । আমি তো বাবার তাঁবুতে শুই । মাঝে-মাঝে অলিভ রঙের পোশাকে বন্দুকধারী লোকজন আসে, তারা মায়ের সঙ্গে খুসুরফুসুর কথা বলে, তারপর চলে যায় । সাধারন পোশাকের বন্দুকধারীও দেখেছি আসতে । তখন ওনার ছাউনিতে ঢোকা নিষেধ । বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলুম যে লোকগুলো কারা, কেন আসে, উনি বলেছিলেন, সময় হলে জানতে পারবে, যদি বোধবুদ্ধি গড়ে ওঠে তাহলে তোমাকে ওই কাজগুলোই করতে হতে পারে যা তোমার মা এখন করছেন । আপাতত তুমি দেখতে থাকো আমি কী ভাবে পড়াই, কোন বই পড়ি ; তুমি সেই বইগুলো পড়ো । মাঝে-মাঝে আমিও অঙ্কের ক্লাস নিই, বাবা উপস্হিত থাকেন, আমাকে গাইড করেন । ব্যাস ওইটুকুই, উনি বাবার মতন বিহেভ করেন না । তত্ত্বফত্ত্ব যতটা বুঝেছি, সব ফালতু ।
    ইতু : হাঃ, তুই ক্লাস নিস, পড়াশুনায় লো সেকেন্ড ক্লাস ! যাকগে, পড়াচ্ছিস, পড়া । তুই তো বললি এই বয়সেও তোর মা অপরূপ সুন্দরী ?
    অমিত : হ্যাঁ, সত্যিই সুন্দরী ; চুল পাকলেই বা । আমি ওনাকে একদিন সাহস করে জিগ্যেস করেছিলুম যে, আপনি তো ডাক্তারসাহেবকে ডিভোর্স দিয়ে বাবাকে বিয়ে করলেই পারতেন, তাহলে আমাকে জন্মের গঞ্জনা শুনতে হতো না । উনি কী বললেন জানিস ?
    ইতু : কী ?
    অমিত : বললেন, আমি অতনুর এত কাছে চলে গিয়েছিলুম, এত ভালোবেসে ফেলেছিলুম যে বিয়ের প্রয়োজন ছিল না; অতনুও বাড়ি-চাকরি সবকিছু ছেড়ে আমার খোঁজে বেরিয়ে চলে এসেছিল আমার আস্তানায়, তখন আমি আর ডাক্তারসাহেব নওয়াদায় থাকতুম । বললেন, তুমি আমাদের প্রেম থেকে জন্মেছ, গতানুগতিক দৈহিক সম্পর্ক থেকে নয় । তোমার ছোটোবেলায় যদি আমাদের সঙ্গে তোমাকে রেখে মানুষ করতুম তাহলে আমরাও গতানুগতিক সম্পর্কের রুটিনে জড়িয়ে পড়তুম । দেশের জন্য, মানুষের জন্য, যে স্বপ্ন দেখি, তা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠত ।
    ইতু : হোয়াট ডাজ শি মিন ? উনি একটা পোয়েটিক অ্যালিবাই খাড়া করে তোকে বুঝিয়ে দিলেন, আর তুই বুঝে গেলি ? রাবিশ । আমি তো তোর ফ্লেশকে আমার ফ্লেশ দিয়ে কারনিভোরের মতন ভালোবাসি । তুই যখন চলে গেলি তখন এমন হয়ে গিয়েছিল যে তোকে রাস্তায় পেলে সত্যি খুন করে ফেলতুম । একদম ভেঙে পড়েছিলুম ।
    অমিত : এখন সামলে নিয়েছিস তো ? আমার বাবাকে তোর কথা বলেছিলুম । উনি বলেছেন, তুই যেহেতু আমার বিশ্বাসের পাত্রী, আমাদের হয়ে কাজ করতে পারবি ।
    ইতু : কাজ ? না, না, আমি তোর সঙ্গে যেতে চাই, কাজ-ফাজ করার হয় ওখানে গিয়ে করব, তোর মাকে হেল্প করব, ডাক্তারি করব, আমি তো বেয়ারফুট ডাক্তারের চেয়ে বেশি কমপিট্যান্ট । আমি যে-কোনো অবস্হার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি, তুই তা জানিস । আই জাস্ট ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস মিনিংলেস লাইফ।
    অমিত : মানুষের-সেবা, সমাজের-সেবা, গরিবদের সেবা, ওয়েলবিইং অফ ম্যানকাইন্ড, এইসব বক্তৃতা ঝাড়তিস, আর এখন শুধু আমার সঙ্গে যাবার বায়না করছিস । তুই যাবি, তবে এখনই নয় । এখন তুই বাবা-মার জন্য কিছু-কিছু কাজ করবি । সহজ, কিন্তু বিপজ্জনক কাজ । তোর ক্লিনিকে মাঝে-সাঝে একজন লোক সবুজ বা নীল টিশার্ট পরে খাম দিয়ে যাবে, তুই সেটা নিজের কাছে রাখবি, পরে ধূসর বা ছাইরঙের টিশার্ট পরা একজন লোক এসে ওটা কালেক্ট করে নেবে । এটা অত্যম্ত গোপন কাজ ; এ-বিষয়ে তুই কখনও কারোর সঙ্গে আলোচনা করবি না । ভেবে নে, চিন্তা করে বল । আবার বলছি, এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক । যদি ওৎ-পাতা পুলিশ তোকে ওই খামসুদ্দু ধরে তো কী যে হবে তা জানিস তো, মেয়েদের ধরে লকাপে যা-যা হয় ।
    ইতু : তোর জন্য সবকিছু করতে পারি । ধরেবেঁধে রেপও যদি ওরা করতে চায়, তো করবে । কিন্তু, দাঁড়া, স্তোক দিয়ে তুই কেটে পড়ছিস না তো ?
    অমিত : না । বি সিরিয়াস । এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । ইয়ার্কি হাসিঠাট্টার নয় ।
    ইতু : তাহলে বাড়ি চল । চান-টান করে খেয়ে-দেয়ে তারপর যাস । আমি স্কুটার কিনেছি, চল না একবার পুরো গান্ধি ময়দানের চক্কর মেরে গোলঘরের পেছন দিয়ে ঘুরে আসি ; তুই জড়িয়ে বসে থাকবি, আর আমি হ্যাপি ফিলিং নেবো । চল, চল ।
    অমিত : কী যে বলিস, এমনিতেই আমি ক্লান্ত । ওই বাড়িতে আমি আর ঢুকতে চাই না রে।
    ইতু : সুশান্তজেঠু অত অপমান সহ্য করে, হেনস্হা সহ্য করে, অবহেলা সহ্য করে আসেন । তোকে তো শুধু বলা হয়েছিল যে আমি তোর বোন, তুই যাদের ছেলে তারা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করেনি । তোর তো একটা স্পেস আছে বাড়িটায় । এত তাড়াতাড়ি হেরে যাবি কেন ? বি পজেসিভ অ্যাণ্ড অ্যাগ্রেসিভ লাইক মি । বটঠাকুমা আর অন্নমা তো তোকে ভালোবাসেন । ওনারা দুজনে কাঁদছিলেন, যেদিন তুই বাড়ি ছেড়ে চুপচাপ কেটে পড়লি । চল, চল ।
    অমিত : ঠিক আছে, চল তাহলে, দেখি ওনাদের প্রতিক্রয়া, আমি তো জন্মেছি লাৎখোর হয়ে, অপমান-ফপমান সব মাথার ভেতর থেকে হাপিশ করে দিয়েছি ।
    ইতুর স্কুটারে বসে অমিত ওদের বাড়িতে পৌঁছলে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া তেমন হল না । বটঠাকুমা আর অন্নমা বুকে জড়িয়ে আদর করলেন অমিতকে । বললেন, যে যাই বলুক, যতদিন আমরা দুই বুড়ি বেঁচে আছি ততদিন তুই এই বাড়ির ছেলে । যা চান-টান করে আয়, ব্রেকফাস্ট করা হয়নি তো ?
    ইতু টয়লেটে টাওয়েল সাবান রেখে এসেছিল । সুশান্তজেঠুর মা টয়লেটে সুশান্তজেঠুর সযত্নে রাখা অতিপুরোনো পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি রেখে এলেন । স্নান করে আসার পর ডাইনিং টেবিলে অমিতকে ঘিরে বাড়িতে উপস্হিত সবাই ওর উধাও হয়ে যাবার গল্প শুনতে চাইছিলেন, হয়তো ওনাদের অভিনয় । রাঙামা লুচি ভেজে নিয়ে এলেন, সঙ্গে আগের দিন ইতুর রাঁধা আলু দিয়ে ডিমের ডালনা, আর আচার । অমিত ভাবল, একবার জিগ্যেস করে, ওর পোশাক-আশাক জামাকাপড়গুলো কী হল, যে সুশান্তজেঠুর কম বয়সের পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরতে হচ্ছে । আর কী-ই বা হবে, যাকগে, আমি তো আউটসাইডার, নিজেকে বলল ।
    --সত্যিই আমি ভবঘুরে সাংবাদিক হয়ে গেছি , ঘুরে বেড়াই, আজ এখানে, কাল সেখানে, কোনো নির্দিষ্ট জায়গা আর নেই । আমি কিন্তু আজকেই চলে যাব । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --আজ আর যেতে হবে না, কত দিন পরে হারিয়ে যাওয়া ছেলে বাড়ি ফিরল, বললেন বটঠাকুমা । এটা কি তোর বাড়ি নয় নাকি, বল, আমরা কি তোর পর ? আমাদের কোনো অসুবিধা নেই । সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর ওনার ঘরটা তো পড়েই আছে, আমি আর ওই ঘরে শুতে পারি না, ইতু শোয়, বললেন সুশান্তজেঠুর মা।
    --হ্যাঁ, আমি এই বাড়ির মিউজিকাল চেয়ার । একজনের বিয়ে হয়, তার জন্য ঘর ছাড়তে হয়, আবার আরেকজনের বিয়ে বা বাচ্চা হয়, বা কারোর পরীক্ষা, ব্যাস, নির্দেশ আসে, ইতু এবার বারান্দায় শো, দালানে শো, রান্নাঘরে শো, ডাইনিং টেবিলের পাশে শো, সিঁড়ির তলায় শো । রাঁধুনি না এলে, এটা রাঁধ, সেটা রাঁধ। জমিয়ে রাখা ক্ষোভ চারিয়ে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করল না ইতু ।
    --ওঃ, এই অবস্হায় আমি কেন আবার জমির লড়াইতে শরিক হই । অমিতের কথায় পরিবেশ ফিরল স্বাভাবিকতায় । বলল, বহুকাল বাড়িতে তৈরি লুচি আর ডিমের ডালনা খাইনি । দুপুরে আর লাঞ্চ করার দরকার হবে না । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
    --বাড়ির রান্না খাসনি বলছিস, দুপুরে মাছের ঝোল আর ভাতও তো খেতে হবে তাহলে । বলল ইতু, তারপর অমিতকে বলল, চল মাছের বাজারে যাওয়া যাক, তোর পছন্দের মাছ কেনা যাবে । লুঙ্গি পরেই চল, লজ্জা পাসনি, নেতারা পর্যন্ত লুঙ্গি পরে গান্ধি ময়দানে ভাষণ দিচ্ছে, মিছিলে হাঁটছে , অমিতের হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে বলল ইতু । বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তুই এসেই যাই-যাই করছিস কেন বলতো ?
    সিঁড়ির পাশের স্লোপ দিয়ে স্কুটার নামাতে-নামাতে বাড়ির উল্টো দিকের গেটের দিকে মুখ তুলে ইতু বলল, মিশ্রাজির ছেলেটা অন্ধকার থাকতে সকাল পাঁচটা থেকে মারুতি গাড়ি রিভার্স করতে শেখে আর ঘুম ভাঙিয়ে দ্যায়, রিভার্স হর্নে ভোর থেকে একঘেয়ে সারে জাহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা বাজায় ।
    একদিকে পা ঝুলিয়ে বসার কারণে ইতুর পেটে অমিতের জাপট কিছুটা নিকটতর হল । ইতু বলল, এই, নাভিতে সুড়সুড়ি দিসনি, ব্যালান্স গোলমাল হয়ে যাবে । অলরেডি তুই আমার জীবনের ব্যালান্স গোলমাল করে দিয়েছিস ।
    -- মাছের বাজার এসে গেছে, নাম আর বল কোন মাছ খেতে চাস । তখন প্রস্তাব দিয়েছিলুম যে শহরটা এক পাক ঘুরে নিই, রাজি হলি না, ফর হোয়াটএভার রিজনস ।
    --বলব আবার কি, ইলিশ পাওয়া গেলে ইলিশ কেন, খেয়ে নিই, কে জানে আবার কখনও খাওয়া হবে কিনা, ইলিশ কেমন দেখতে তা-ই তো ভুলে গেছি।
    ইলিশ কিনে, কাটিয়ে, স্কুটারে পা ঝুলিয়ে বসে, অমিত বলল ইতুকে, রাতটা থেকেই যাবো, বুঝলি । তোকে কিছু-কিছু দায়িত্ব দিয়ে যাবো ।
    --তোর নিজের দায়িত্বটাই দে না, এত ভিতু কেন তুই ? অমিতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল ইতু। গান গাইতে শিখিনি, নয়তো মন খুলে একখানা পেলব-পেলব ঢিললা-হিললা টাইপ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতুম । কোন গান জানিস ?
    --না, কী করে জানবো ? স্কুলের বন্ধুরা তো সব ছিল হিন্দি গান আর হিন্দি সিনেমার কীট । রাঙামা হিন্দি টিভি সিরিয়ালের পোকা । নবনীতাবৌদি গিটারে হিন্দি ফিলমের সুর বাজাতো ।
    --হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে…
    --শুনতে পাবে পাবলিক । মাছের বাজার মানেই বাঙালির জমায়েত ; অনেকে তোকে-আমাকে ভালোই চেনে ; হয়ত আমাদের রিলেশানশিপের খবরও ছড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে ।
    --বুলশিট, তুই এখনও আমাকে নেগলেক্ট করার ডিজাইন বজায় রেখেছিস কেন বল তো ? তোর দায়িত্ব চাইছি বলে ভয় পেয়ে গেলি নাকি, কাওয়ার্ড ?
    --ক্লাস টেন থেকেই তো কত ছেলে তোকে লাইন মারত, নিজেই ঢিল দিসনি, নয়তো দায়িত্ব পেয়ে যেতিস এতদিনে। স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর লাইনে ভোর রাত থেকে দাঁড়িয়ে থাকতিস ।
    --স্টপ ইওর জিবারিশ । যত্তোসব ফালতু ছোকরার দল । তোর তো ক্লাস টেনেই গোঁফের রেখা আবছা বেরিয়ে এসেছিল, তবু তুই লাইন মারার সাহসটুকু দেখাতে পারিসনি । আমি না এগোলে তুই বোধহয় চেপেই রাখতিস নিজেকে ।
    --তখন বেশ ক্যাবলা ছিলুম রে, তোকে দেখলেই তোর বুকের দিকে চোখ চলে যেত, আড়ষ্ট ফিল করতুম, কথা বলতে পারতুম না, ভাবতুম কোন বিষয়ে কথা বলব । তাছাড়া, মগজে ঢুকে গিয়েছিল যে আমি তোদের বাড়ির চাকরের স্তরের । মালিকের মেয়েকে প্রণয়-প্রস্তাব কোন চাকরেই বা দ্যায় ? ওসব নাটক-নভেলে হয় ।
    --শাট আপ, ইউ সাকার..., গালাগাল এসে যাচ্ছে মুখে ।
    --কেমন বোকা-বোকা কথা বলছি না আমরা ?
    --হ্যাঁ, বর-বউ হতে পারত কিন্তু হল না, এরকম একজোড়া বোকা-বোকির গল্প ।
    রাতে, খাওয়া-দাওয়ার পর, ইতুকে বলল অমিত, ও একটা মিটিঙে , বিহারশরিফে, এসেছিল, বাবার সঙ্গে।
    --হোলি শিট, তোর বাবাও এসেছিলেন ?
    --হ্যাঁ । উনি তো মেশেন না কারোর সঙ্গে ।
    --দায়িত্বটা কী তা বললি না তো ? বিছানায় বসে জিগ্যেস করল ইতি ।
    --এতো ঘেঁষে বসিস না, আবার গোলমাল হবে শেষকালে ? ভাববেন, ছাড় দেয়া হয়েছে, ব্যাস, মাখামাখি করছে রাতদুপুরে ।
    --কারোর অমন মাথাব্যথা নেই; ওসব নিয়ে চিন্তা করিসনি । বরং তোর ঘাড়ে চেপে যদি কেটে পড়ি তো ওনারা বেঁচে যান । হয়তো ওনারা আমাকে এই স্পেসটা সেকারণেই ছেড়ে দিলেন । এখন দেখার যে তুই কীভাবে রেসপণ্ড করিস ।
    --এই তো সবে এতদিন পর দেখা হল, তুই বেশ ফ্রিলি গল্প করতে পারছিস , মনের কথা খুলে বলতে পারছিস । আগেই বলেছি, আমি যে কাজটা দেবো সেটা বেশ সিম্পল কিন্তু বিপজ্জনক । ভেবে উত্তর দিস । কাল সকালে আমার যাওয়া পর্যন্ত তোর হাতে সময় থাকবে ।
    --কী কাজ, শুনি, ঘোড়ার ডিম বিপজ্জনক । কাউকে বোমা মারতে বা গুলি মারতে বলবি নাকি ? কিংবা সোনার বিস্কুট এখান-ওখান । তা আমি পারব না, আগেই বলে রাখলুম ।
    --বলেছি তো, মনে করে রাখ । তোর ক্লিনিকে বা বাড়িতে সবুজ বা নীল শার্ট বা টিশার্ট পরা একজন একটা চিঠি দিয়ে যাবে, হয়ত স্মার্ট নয়, বিহারি বা বাঙালি না-ও হতে পারে সে, ইংরেজিতে একটা-দুটো কথা বলে চিঠিটা দিয়ে চলে যাবে । তুই তা নিজের কাছে রেখে দিবি । পরে, দু-এক সপ্তাহের ভেতর বা মাসখানেক পরেও হতে পারে, ওই খামটা আরেকজন নিতে আসবে, তার গায়ে ছাইরঙা বা ধূসর শার্ট বা টিশার্ট থাকবে ।
    --ওঃ, ডাকবাক্সের কাজ, পারব না কেন ? স্মাগলিং-টাগলিং নয়তো ? যেরকম দাড়ি-গোঁফ বাবরিচুল চেহারা করেছিস, দেখে তো স্মাগলার বলেই মনে করবে লোকে । লুঙ্গি পরে তোকে মানিয়েও গেছে ।
    --না, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের কাজ ।
    --তুই আসবি না ? তুইও তো আসবি, দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে, হলুদ টিশার্ট আর জিন্স পরে, স্মার্টলি । ফর মি ?
    --সিরিয়াস ইশ্যু ।
    --ওকে, টেকন । কিন্তু আমি কেবল তোর ওই প্রক্সিদের নিয়ে ডিল কোরবো নাকি ? তুই যদি না আসিস তাহলে কেন বেগার খাটতে যাবো উটকো লোকেদের জন্য ?
    --তা-ই কর কিছুদিন । কিন্তু আবার বলছি, অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ । ওই খামসুদ্দু তুই ধরা পড়লে যে ধরণের ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বি তা মোটেই সুখকর নয় ।
    ইতু নিঃশব্দে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলল, অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে । তারপর অমিতের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, দায়িত্ব নিলুম, কিন্তু এক শর্তে, ন’মাসে-ছ’মাসে তোকেও আসতে হবে । ইউ মাস্ট, আদারওয়াইজ দি ডিল ইজ ক্যানসেল্ড ।
    অমিত আবার এসেছিল, প্রায় এক বছর পরে, ক্লিনিকে, বিনা দাড়ি-গোঁফে, হলুদ টিশার্ট আর জিনস পরে, চোখে রোদ চশমা । তার মাঝে নীল-টিশার্ট ধূসর-টিশার্ট যুবকেরা ক্লিনিকে খাম দিয়ে গেছে আর নিয়ে গেছে, বেশ কয়েকবার । ইতুর কি খাম খুলে দেখতে ইচ্ছে হয়নি কী আছে ভেতরে ? হয়েছে । কিন্তু সেলোটেপে মোড়া চিঠি খোলেনি । নিজেকে বুঝিয়েছে যে অমিতকে জানতে হলে ওর মুখোমুখি বসেই জানতে হবে, গোপন কাজকর্ম, তা যাই হোক, স্মাগলিং বা লুকিয়ে বেড়ানো বিপ্লব, না সিক্রেটিভ কোনো ধার্মিক কাল্ট, কথা বলে জেনে নিতে হবে ।
    অমিতের চেহারা বেশ রোদঝামা হয়ে গেছে, স্মার্ট পোশাক সত্বেও, আঁচ করল, ইতির মগজের ডাক্তার । অমিত ক্লিনিকে ঢুকে চেয়ারে বসে স্মিত হাসি ফোটাবার চেষ্টা করলে, ইতি বলল, প্রায় শিশুর আদুরেপনা মিশিয়ে, তোর একটা খাম পড়ে আছে, কেউ নিতে আসেনি তো ?
    --খাম, কই দেখা, বিস্ময়ে বলল অমিত ।
    --এই যে, দ্যাখ, পড়ে আছে সেই কবে থেকে ।
    -- কই দে তো, দেখি ।
    টেবিলের ওপর চারভাঁজ করা প্রেসকিপশানের কাগজে, দেখল অমিত, লেখা রয়েছে, ‘যদি বিপদ শেয়ার করি, তাহলে বেডশিট শেয়ার করব না কেন’ ? ইতি বলল, তারিখ দেখেছিস, ছয় মাস আগের । কত এক্সপেক্ট করেছি তোকে । ইন ফ্যাক্ট আমার এই ক্লিনিক চলে না, রোগি আসে মাসে হয়ত দুজন, কখনও আসেই না, তবু খুলে রেখেছি, স্রেফ তুই একদিন হঠাৎ আসবি বলে । আজ থেকে ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেল । চল , বাড়ি চল, বাড়িতেও সবাই বলে যে কেন মাছি মারছিস বসে-বসে, ভাড়া গুনছিস, বাবার দেয়া জমানো টাকা নষ্ট করছিস। তারপর, প্রায় কান্নামাখা কন্ঠস্বরে বলল, কী করে ওনাদের বলতুম যে আমি তোর অপেক্ষায় বোকার মতন হাঁ করে বসে থাকি ।
    অমিত থ । অনুমান করতে পারেনি যে রহস্যময় খামগুলোর মাধ্যমে নৈকট্যকে বিপজ্জনক করে ফেলেছে। কাগজের লেখাটার দিকে তাকিয়ে, চুপ করে রইল । বলল, যে ভালোবাসার কথা বলছিস, তা আমি যে জীবন কাটাই, তাতে কতটা প্রযোজ্য, তা যারা এই জীবন যাপন করে কেবল তারাই বুঝতে পারবে । আমি তো ভবঘুরে, বলেইছিলুম তোকে । তোকে তো বলেছি কী ধরণের লাইফ লিড করছি । বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাঁদের সঙ্গে নেই, তাঁরা আমার কেউ নন । এখন মনে হয় আত্মপরিচয়ের সন্ধানে তাঁদের খোঁজে বেরোনোটাই ছিল ব্লাণ্ডার ।
    ইতি ক্লিনিকের চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলল, চল, চল, যেতে যেতে কথা বলা যাবে । ক্লিনিক আমি বন্ধ করে দিচ্ছি আজ থেকে, তোর এই মোবাইল ডাকবাক্সে বার্তা ফেলতে হলে মেসেঞ্জারদের আমার বাড়ি আসতে হবে । ইতুর কব্জি শক্ত করে ধরে অমিত বলল, তোর নির্দেশমতো যে পোশাক পরে এলুম সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলি না ।
    --তুই তাহলে শুনতে পাসনি ; চোখ দিয়ে করা মন্তব্য শোনার মতন ইন্দ্রিয় হারিয়ে ফেলেছিস । বোতাম খুলে তোর বুকের চুলও দেখাচ্ছিস, তোর বুকে যে চুল গজিয়েছে কী করে জানব । তা জানার জন্যও তো করাঘাতের অধিকার দরকার, নয়কি, বিপদ শেয়ার করার অধিকার থেকে সামান্য পৃথক অধিকার ?
    --তোদের বাড়িতে চড়ুইপাখির বাসা আছে, মনে আছে, দালানের কড়িকাঠের ফাঁকে ? কখনও লক্ষ করেছিস কি যে মাদি চড়ুইপাখিকে ইমপ্রেস করার জন্য পুরুষ চড়ুইপাখিরা তাদের কালো বুক দেখাবার প্রতিযোগীতা করে ?
    ক্লিনিকের শাটার নামিয়ে, তালা দিয়ে, ফুটপাতে নেমে, অমিতের দিকে তাকিয়ে ইতু বলেছিল, ঠিক কী বলতে চাইছিস বুঝতে পারলুম না । তুই কি বলতে চাইছিস যে তোর হৃদয় উনিশ শতকের গৌরবগাথায় বর্ণিত মসীলিপ্ত ভিলেনের মতন হয়ে গেছে ? নাকি বলতে চাইছিস যে তুই মাদি চড়ুইপাখিটাকে জয় করতে এসেছিস ? ভুলে যাচ্ছিস কেন যে মাদি চড়ুইপাখিটাই তোকে জয় করার জন্য যুদ্ধ করেছিল । ওহ, ইনটলারেবল, জাস্ট ইনটলারেবল ।
    --না সত্যিই অনুমান করতে পারিনি । না, অনুভব করতে পারিনি বললে যুৎসই হয় ।
    --বাঃ, আমার কথামতন পোশাক পরে এক বছর পর উদয় হলি, আর অনুভব করতে পারিসনি, ইউ সেল্ফসার্ভিং জোকার ? নিজেকে ভুল বুঝিয়েই কি তুই তোর রহস্যময় জীবনকে মিনিংফুল করে তুলতে চাইছিস?
    তারপর যোগ করল, স্কুটারটা বেচে দিয়েছি । ভাড়া গোনার জন্য টাকার দরকার ছিল । বলল ইতু, ফুটপাতে পড়ে-থাকা শালপাতার দিকে তাকিয়ে ।
    একটা রিকশাকে হাত দেখিয়ে থামতে বলল অমিত । ইতু বলল, রিকশা ডাকছিস কেন, হাঁট না পাশাপাশি । চল গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি, কতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাইনি । গিয়ে বসি কিছুক্ষণ । কিছু কথা স্পষ্ট করে নে্য়া দরকার, বাড়িতে গেলে দোতলার বারান্দায় বসে গল্প করতে হবে । প্রিভেসি নেই ।
    --বিশ্ববিদ্যালয় ? গঙ্গার ধারের কথা ভাবছিস ? কিন্তু গঙ্গা তো দূরে সরে গেছে, সরকার ভাবছে গঙ্গার ধার দিয়ে মেরিন ড্রাইভের মতন পথ বানাবে । তুই তোর শহরে থেকেও জানিস না, দ্যাখ, আমি বাইরে-বাইরে থাকি, থাকি বলা ভুল হল, অ্যাকচুয়ালি থাকিই না কোথাও, তবু জানি শহরের কথা ।
    --ও, তুই তাহলে শহরে আসিস, আর দেখা না করে কেটে পড়িস ? আর ইউ চিটিং অন মি ?
    --না, শহরে আজকেই এলুম, সেদিনকার পর, এবারেও বাবার সঙ্গে নালান্দাতেই এসেছিলুম, এর-তার মুখে শহরের পরিবর্তনের কথা শুনতে পাই । তোর সঙ্গে দেখা করব বলেই এলুম পাটনায় । এত কাছে এসে ফিরে যেতে পারলুম না । মনের ভেতরের ব্ল্যাংক স্পেসটায় তুই ক্রমশ জায়গা করে নিয়েছিস, বাবা-মায়ের সঙ্গে তো এখনও আপনি থেকে তুমিতে যেতে পারিনি ; ওনারাও তুমি থেকে তুইতে আসতে চাননি । শুধু তুই-ই একমাত্র যে আমার কাছে একই সঙ্গে তুমি আর তুই । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমিত বলল, চল ওই অমলতাস গাছটার তলায় বসি, রাস্তার দিকে পেছন ফিরে বসা যাবে ।
    --কেন ? আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে ?
    --তুই আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে, তোর সঙ্গে আমি নয় ।
    অমলতাসের হলুদ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো চারিদিকে । সিটের ওপর পাখিতে হেগে রেখেছে । তার ওপরই বসল দুজনে । অমিত জিগ্যেস করল, কী বলবি বল ?
    অতনুর হাত নিজের কোলে নিয়ে ইতু বলল, আমি সেল্ফ ডেসট্রয় করার জন্য ডেসপারেট হয়ে গেছি । জীবন সম্পর্কে তিতিবিরক্ত । জানি না কী করব । এনজিও জয়েন করার কথা ভাবি । কোনো পারপাস নেই জীবনে । এর চেয়ে কমার্স পড়লে টাকাকড়ির গুণ ভাগ যোগ বিয়োগ নিয়ে থাকতে পারতুম । বাবা-মা মারা যাবার পর আমি রাডারলেস হয়ে গেছি, কোনো নোঙর নেই । ওনাদের ইনশিওরেন্সের টাকাটা এখনও পেলুম না।
    অমিতের হাত নিজের ঠোঁটের ওপর চেপে ধরেছিল ইতু, ছাড়িয়ে অমিত বলল, চল, তোর ক্লিনিক আরেকবার খুলতে হবে । পাটনা শহরের পথে, অমলতাস গাছের তলায়, এভাবে কাছ-ঘেঁষটে বসে থাকার চেয়ে তোর ক্লিনিকের নিভৃতি ভালো ।
    --হ্যাঁ, আমাদের বাড়ির দোতলার বারান্দার চেয়ে তো অবশ্যই ভালো। আসলে আমার কথাগুলো কী ভাবে তোকে বলব, কোথায় গিয়ে বলব, তোকে দেখামাত্র যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তাতে শাটার নামিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলুম । চল, ক্লিনিকেই যাই ।
    রিকশা থেকে নেমে, ক্লিনিকের তালা খুলে শাটার ওঠাতে সাহায্য করল অতনু, বলল, বেশ ভারি তো, রোজই এভাবে খুলিস আর বন্ধ করিস, বলে, শাটারটা নামিয়ে দিল অমিত । নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে ইতু বলল, এবার বল, যা জানতে চাইছি তা বল, কেউ নেই এখানে, কেউ তোর পেছু নেয়নি, রাস্তা একেবারে ফাঁকা ছিল ।
    --আমি রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি করি । তোকে তাতে ব্যবহার করি ।
    --তাতে কী হয়েছে ! রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি তো আজকাল সবাই করছে, কে করছে না শুনি ? রাষ্ট্রবিরোধী-ফিরোধি বলে কিছু হয় না । দুশ্চিন্তার কী আছে ? সরকার যারা চালায় তাদের কুকর্ম দেখে, আর ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের স্ক্যাম প্রতিদিন কাগজে পড়ে, সব পাবলিকই মনে-মনে রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে পড়েছে । ধর্ষক, খুনি, ডাকাত সকলেই তো দিল্লির তখত-এ-তাউসে পৌঁছোচ্ছে । এই তো সেদিন মহাত্মা গান্ধির নাতি গোপালকৃষ্ণ গান্ধি দিল্লিতে ওনার বক্তৃতায় বলেছেন যে রিলায়েন্স কোম্পানি এত বেশি ক্ষমতা রাখে যে ভারতে তারা একটা সমান্তরাল রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে । তবে ? তুই ভাবছিস বোধহয় আমি কোনো খবরই রাখি না । সারাদিন ক্লিনিকে বসে কী করি ? পাশের কাপড়ের দোকানটা থেকে হিন্দি আর ইংরেজি কাগজ তিনটে এনে সারাদিন পড়ি ।
    --বাবা-মা যে রাজনীতি করেন, তা-ই করি ।
    --জানি, অতটা বোঝার মতো জ্ঞান আছে আমার । প্রশ্ন হল, আমি কি এখানে একা পড়ে থাকব, তোর ডাকবাক্স হয়ে ?
    --আমি তো কোনো নির্ণয় নিতে পারি না, আই অ্যাম জাস্ট এ ওয়ার্কার, ওনারা যে নির্ণয় নিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তুই ভালোই কাজ করছিস । তাছাড়া, কোনো বিষয়ে কথা বলার কোনো ক্ষমতাই নেই আমার । নেতারা কয়েকজন মিলে নির্ণয় নেন, তাঁরা যে কারা তাও আমি জানি না । তবে, শুনেছি, তাঁদের দুজন তোকে যাচাই করে গেছেন । তুই আমার জন্য নয়, তাঁদের জন্য ডাকবাক্সের কাজ করছিলিস। রোগি সেজে তোর অলটারনেটিভ মেডিসিনের ক্লিনিকও তাঁরা দেখে গেছেন ; তোর মতন ডাক্তারই ওনাদের প্রয়োজন, কেননা তুই আসেপাশে যা পাওয়া যায় তাই প্রয়োগ করে উপশম ঘটাবার চিকিৎসাবিদ্যা আয়ত্ত করেছিস, এম বি বি এসও এক বছর পড়েছিলি ।
    --তাহলে কবে তুই আমাকে তোদের সঙ্গে নিবি, আই ওয়ান্ট এ ক্লিয়ার আনসার, নো মোর ডিলিড্যালিং ? ক্লিনিকটা আমাকে বন্ধ করতেই হবে, কেননা বাড়ি থেকে কোনো সাহায্য পাই না, ভাড়া দিই বাবা যে টাকা আমার ভাগ্যে বরাদ্দ করে গেছেন তা থেকে, ফিক্সড ডিপোজিট ফুরিয়ে গেছে, তাই স্কুটারটা বিক্রি করতে হল । ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, আই ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস রাট, আমার বডি একটু-একটু করে শবের আদল পাচ্ছে ।
    রিভলভিং চেয়ারের কাছে গিয়ে মুখ নামিয়ে ইতুর চোখে চোখ রেখে, অমিত বলল, আমি কি তোকে চুমু খাবো ?
    ইতু কেঁদে ফেলেছিল, বলল, চড়ুইপাখি তো কালো বুক দেখিয়ে জিতে গেছে । অমিতের অনুমতির অপেক্ষা না করে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে অতনুর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল ইতু, কয়েক সেকেন্ড পর তুলে নিয়ে, রিভলভিং চেয়ারে বসে, ফুঁপিয়ে কাঁদা আরম্ভ করল । বলল, কেঁদে নিই, অনেক দিনের কান্না জমে আছে । কান্না থামার পর সামলে নিয়ে বলল, চল বাড়ি যাই, অন্নমা, মানে সুশান্তজেঠুর মা, তোকে দেখে খুশি হবেন । সুশান্তজেঠু ওনার ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন, তারপর থেকে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন ।
    --তাহলে না যাওয়াই ভালো । সুশান্তজেঠুর অভাব আমাকে দিয়ে মিটবে না। বরং ঘায়ে খোঁচা লেগে আঘাত বেড়ে যাবে । তোদের বাড়ির সবাই শুরুতেই মানিয়ে নিলে অবস্হা এতটা নিরাশাজনক হতো না । সুশান্তজেঠু আর ওনার বউ-ছেলেকে অ্যাকসেপ্ট না করার তো কারণ ছিল না । তোর বাড়ির লোকেরা তো আর ক্রিমিনাল গ্যাঙটাকে নেমন্তন্ন করে আনছিল না ।
    --না, সুশান্তজেঠু নাকি ওদের ক্রিমিনাল দলের ডন হয়ে গিয়েছেন, ওনার শশুর নিজের নেতৃত্ব সুশান্তজেঠুর হাতে দিয়ে দিয়েছে।
    --হ্যাঃ, ওসব তো তোরা এর-তার মুখে শুনেছিস । তোদের বাড়ি থেকে কেউ কি গিয়েছিল একবার ? গিয়ে দেখতে কে বারণ করেছিল ? ওরা তো তোদের বাড়ির কাউকে খুন বা কিডন্যাপ করত না । যা করার তা তো করেই ফেলেছিল ওরা, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে ওদের গ্যাঙ লিডারের মেয়ের বিয়ে দিয়ে । সম্বন্ধটা শুধরে নিলে সকলেরই মঙ্গল হতো ।
    --কত রেসপনসিবলি কথা বলছিস রে, ইউ হ্যাভ রিয়্যালি গ্রোন আপ উইথ ইওর চেস্ট হেয়ার । চল না সুশান্তজেঠুর আস্তানায় ট্রিপ মারি ।
    --যাবো । সময় হলে যাবো । এবার আমি যাই ।
    --এক্ষুনি ?
    --হ্যাঁ, আবার তো আসব ।
    --ক্লিনিক কিন্তু বন্ধ করে দিচ্ছি । তোর মেসেঞ্জাররা কি আমাদের বাড়ি চিনে নিতে পারবে ? আমাকে চিনতে পারবে ? কয়েকবার তো নতুন মেসেঞ্জার দেখেছি ।
    --তারা সব কিছুই পারে ।
    --তাহলে পুরোটা কেঁদে নিতে দে, বলে, সান্নিধ্যের সঙ্কোচ কাটিয়ে, অমিতকে জড়িয়ে ধরেছিল ইতু । কান্না শেষ হলে চোখ পুঁছে বলেছিল, চড়ুইপাখিরা বসন্তঋতুতে একশকুড়িবার প্রেম করে, তা জানিস ?
    --না, জানা ছিল না ; তবে, সিংহের কেশর কখন বাদামি থেকে কালো হয়ে ওঠে তা জানি ।
    --হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস । পরের বার যখন আসবি তখন কাঁধের ওপর অদৃশ্য কালো কেশর নিয়ে আসিস, মনে থাকে যেন । জাস্ট টু রিমাইণ্ড ইউ, সিংহিগন্ধের ঋতুতে সিংহরা দিনভর পনেরো মিনিট অন্তর প্রেম করে ।

    শেষ
    মোবাইলে বড়জেঠিকে রিং দিয়ে সুশান্ত ঘোষ শুনতে পেলেন ওনার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর, সুশান্ত...সুশান্ত...কাল থেকে তোকে রিং দিচ্ছি...কতবার চেষ্টা করছি...সুইচ অফ আসছিল….তুই কোথায়...অপু কোথায়...কাগজে খবর পড়ে অব্দি ঘুমোতে পারিনি...খেতে বসে রুচি হল না...শুনছিস তো…সাড়া দিচ্ছিস না কেন...সুশান্ত… অপুকে পাঠিয়ে দে...আমি ওকে আমার ঘরে লুকিয়ে রাখব...সুশান্ত শুনতে পাচ্ছিস...কথা বলছিস না কেন...আমার কথা শোন...তুই চলে আয়...বউকেও নিয়ে আয়...আবার সব আগের মতন ঠিক হয়ে যাবে...তিনজনেই চলে আয়...পুলিশ তোদের এখানে খুঁজবে না...পুলিশ জানে তুই ত্যাজ্যপুত্র...শুনতে পাচ্ছিস ? উদ্বেগ উৎকন্ঠা ক্রমে ফোঁপানি এবং ফোঁপানি ক্রমে কান্নায় রূপান্তরিত হলে, সুশান্ত ঘোষ বললেন, এই নাও, শোনো ।
    লুঙ্গিতে গোঁজা সেমিঅটোমেটিক পিস্তলটা বের করে একটা গুলি ওপর দিকে চালিয়ে পরখ করলেন কাজ করছে কিনা । গুড, করছে ।
    শোকার্ত আতঙ্কিত বেবি, দড়ির খাটে, রাতের পর রাত ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি-মাখা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে, পাশ ফিরে শুয়ে, চাপা ফোঁপানি ছড়িয়ে দিচ্ছিল শরীর জুড়ে, খাটের শিয়র থেকে দীর্ঘ এলোচুল নামিয়ে, কী হল, কী হল, বলতে-বলতে খাট থেকে নেমে, ওনার, সুশান্ত ঘোষের দিকে ছুটে এলে, বেবিকে লক্ষ করে পর-পর দুটো গুলি চালালেন, বুকে আর মাথায় ।
    তারিণী মণ্ডলের মতনই, বেবির খুলি ফেটে দুধে-আলতা মগজ ছিৎরে পড়ল । মুখ থুবড়ে পড়ে গেল বেবি, প্রতিদিন শাম্পু-করা সুগন্ধিত চুল উড়িয়ে ।
    দেহরক্ষীরা, যারা সুশান্ত ঘোষের পাহারায় চ্যাঁচারির বেড়ার বাইরে আর নৌকোয় বন্দুক হাতে বসেছিল, তারাও কী হল, কী হল, কারা ফায়ার করছে, বলতে-বলতে চালাঘরের দিকে দৌড়োল ।
    সেমিঅটোম্যাটিক পিস্তলের নল নিজের ডান কানের ওপর করোটিতে চেপে , তাকিয়ে দেখলেন বালির ওপড় পড়ে-থাকা তাঁর এত বছরের সঙ্গিনী, তারিণী মণ্ডলের মেয়ে বেবির মৃতদেহের দিকে, তারপর ট্রিগার টিপলেন সুশান্ত ঘোষ ।
    বালিতে ছিটকে পড়ে-যাওয়া মোবাইলে বড়জেঠির কান্না-মেশানো কন্ঠস্বর আতঙ্কিত আর্তনাদে বলে চলেছে, গুলির আওয়াজ কেন...কী হচ্ছে ওখানে...সাড়া দিচ্ছিস না কেন...সুশান্ত..শুনতে পাচ্ছিস...গুলিগোলা চলছে কেন...কথা বলছিস না কেন...ঠিক আছিস তো...তোর ছেলে কোথায়...সুশান্ত...সুশান্ত...বলছি তো অপুকে পাঠিয়ে দে...তোর বউকে নিয়ে চলে আয়...সুশান্ত...সুশান্ত…
    মোবাইলটা উচ্চকন্ঠে কাঁদা আরম্ভ করল উড়ন্ত বালির সদালাপী হাওয়ায়, ঝিরি-ঝিরি রঙ্গপ্রিয় বালির অবাক হাসিখুশি দিয়ে হয়তো ক্রমে ঢাকা পড়ে যাবে আজ রাতের অমনোযোগী অন্ধকারে । বর্ষায় দিয়ারার সঙ্গেই হয়তো চলে যাবে জলের তলায় শেষ কান্নার বর্ষীয়ান স্মৃতি নিয়ে, তারপর একদিন চিকচিকে বসন্তে মাথাচাড়া দেয়া নতুন চরের পলিমাটির ওপর বোবা জেগে উঠবে কোথাও, খুরপি দিয়ে কেয়ারি-করা পলতালতা বা তরমুজলতার হলুদ ফুলের আড়ালে ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 012312.60.5634.239 | ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:১৪541366
  • চশমরঙ্গ
    বাইলাইন : অ্যাকাডেমি অফ দি পারফরমিং ফ্লেশ
    মলয় রায়চৌধুরী
    নগেন দত্ত নিজের মগজের ভেতরের গোলাপি অন্ধকারকে বলছিলেন, আমি তো একজন সাধারণ ল্যাওড়াকান্তি মানুষ মাত্র, তবে কেন সবাই আমাকে প্রতিভাধর বলে, চেনা কিশোররা প্রতিভাধারী নগেন বলে পঞ্চাশ একশো দেড়শো বছর আগে ক্ষ্যাপাতো, এখনও ক্ষ্যাপায়, এখন, যখন তাঁর বয়স চব্বিশ পেরিয়ে সবে পঁচিশ ; প্রায় তিরিশ বছর আটকে ছিলেন চব্বিশতম বয়সে, তাঁর দাদামশায়ের ফারসি ভাষায় লেখা উইলে সেরকমই নির্দেশ ছিল, কত বছর বয়সে কোন বয়সে কতোকালের জন্যে আটকে থাকতে হবে, নগেন দত্ত তা মেনে চলেছেন !
    ওনার, দাদামশায়ের, যিনি ছিলেন ছয় ফিট লম্বা, চওড়া কপাল, কাঁধ পর্যন্ত চুল, জোড়াভুরু, সিক্সপ্যাক অ্যাব, যদিও সময়ের প্রথা অস্বীকার করে একটিই বিয়ে করেছিলেন, উইলে ‘কী করিতে পারিবে’ আর কী করিতে পারিবে না’, তার দুটি তালিকা আছে, ‘কী করিতে পারিবে না’ তালিকার কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন নগেন দত্ত যে তিনি তা সত্যিই পারেননি, যেমন একবার এক কুকুরীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন যখন তাঁর সজীব বয়স উত্তাল নয় বছরে আটকে ছিল ।
    যারা ওনাকে, মানে নগেন দত্তকে, প্রতিভাধারী বলে ক্ষ্যাপায়, তাদের উনি ইচ্ছে করলেই উন্মাদ করে দিতে পারেন, স্রেফ লম্পটের শিস দিয়ে, করেন না, কেননা জিনিয়াসগিরি হল দানবিক আর দৈব প্রাপ্তির মিশেল, সকলের জীবনে জোটে না ।
    নগেন দত্ত, ছটফটে তারুণ্যের অনিশ্চয়তায় যখন প্রেসিডেন্সি কালেজে পড়তেন, হেনরি মেইনে ছিলেন ভাইস চ্যান্সেলার, সহপাঠী নবীনচন্দ্র সেন, যিনি তাঁর সঙ্গেই ১৮৬৫ সালে এফ এ পাশ করেছিলেন, তাঁকে বলতেন, ‘তোমার মাথায় কীট প্রবেশ করিয়াছে, সত্বর বৈদ্যের নিকট যাও।’
    নগেন দত্ত উত্তরে বলেছিলেন, ‘মাথায় কীট আছে বলেই আমি নগেন দত্ত, নয়তো বাংলার নাগরিক আমায় নুনুযুবক বলে চিনতো ।’
    তখনও নুড়িপূজক আর কাটানেড়েরা মারামারি কাটাকাটি করে আলাদা হয়নি, একই জালে ধরা দুই সের ওজনের ইলিশ খেতো, একই খেতের ধানের পান্তা-ভাত খেতো, একই বানভাসিতে ডুবে পচে ভেসে উঠতো হাত ধরাধরি করে সুন্দরবনের মোহনায়, তারপর হারিয়ে যেতো, একই দুর্ভিক্ষে কেঁদেকেটে ‘একটু ফ্যান দাও গো মা’ বলে গেরস্তের দোরে কঙ্কালসার পরিবার নিয়ে হাজিরা দিতো, একই মড়কে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতো, যার ওপর একই নীল মাছি ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গাইতে গাইতে মরে যেতো ।
    নিজের জীবনীতে নগেন দত্ত সম্পর্কে লিখেছিলেন নবীনচন্দ্র সেন, যদিও পাণ্ডুলিপির সেই পৃষ্ঠা হারিয়ে গিয়েছিল হাতে সাজানো সীসার অক্ষরের ছাপাখানা থেকে, নবীনচন্দ্র সেনের সন্দেহ ছিল যে এই কুকীর্তি স্বয়ং নগেন দত্তের, উনি অমরত্ব নিজে চান না, অন্যদের বিলিয়ে থাকেন।
    নবীনচন্দ্র সেন লিখেছিলেন যে, “নগেন দত্ত নামের তরুণটি লুডউইগ বিঠোফেনের সি শার্প মাইনরে বাজানো চোদ্দো নম্বর পিয়ানো সোনাটা শুনিলে উন্মাদের ন্যায় আচরণ করিতেন, তখন তাঁহাকে সামলাইবার জন্য তিরিশ হাজারিনীর দেশে লইয়া যাইতে হইত।”
    তিরিশ হাজারিনীর দেশে কেবল বুদ্ধিমান আর সাহসী পুরুষরাই যাতায়াত করে ।
    তিনি, নগেন দত্ত, কখনও কদমছাঁট, কখনও ব্যাকব্রাশ তেলচুকচুক, কখনও বাবরিছাঁট, কখনও পিগটেল নুটি, আকাশে বসন্তকালের কালবৈশাখির হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কালো মেঘ আর আওয়াজহীন মেয়াদি বিদ্দ্যুচমক সত্ত্বেও, কোনো বাড়িতে চেনবাঁধা নেড়ি-কুকুরের অনুনয়ী ডাক শুনতে-শুনতে, বৃষ্টির আগের রাশ-টানা শীৎশিতে হাওয়া মুখে মেখে, মনে করার চেষ্টা করছিলেন, দেড়-দুশো বছর আগের আকুলি-বিকুলি ঘটনা, বা তারও আগের হতে পারে, ঝোড়ো ঝড় এড়িয়ে আলোকপ্রাপ্তির জন্যে নৌকো থেকে নেমে তিরিশ হাজারিনীর দেশে যখন এসেছিলেন উনি, মাত্র কয়েকটা পাকা দোতলা বাড়ি ছিল, জমিদারি আয়েসের হাঁসজারু স্হাপত্যের বাড়ি, এলাকাটা তখন এরকম বহুযোনিক ছিল না, পাড়া নামের বিদকুটে ব্যারিকেড অঞ্চল হয়নি বলে, আজ কালো টয়োটা এটিওস সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে পার্ক করে, হঠাৎ লোডশেডিঙের নানাবিধ অন্ধকার হাতড়িয়ে, মুঠোয়ধরা মোবাইলে দেড়-দুশো বছর আগে রেকর্ড করা, জিপিএস পথনির্দেশ দেখতে-দেখতে, আর ইয়ার ফোনে তা শুনতে-শুনতে, এগোচ্ছিলেন, রেকর্ড করা কন্ঠস্বর ওনার নিজের, অথচ যাকে কালেজের শিক্ষকরা মনে করেন তা এক ডেপুটি ম্যাজিসট্রেটের ।
    তখনকার, যখন লোকে তাঁকে, তিনি সাধারণ মানুষ নন বলে, প্রতিভাধর কিংবা অতিমানুষ আখ্যা দিতো, সেইসব অচেনা-আধাচেনা মানুষের কথাগুলো শুনে, নগেন দত্ত নিজের মগজের ভেতরের গোলাপি অন্ধকারে, প্রতিক্রিয়ায় বলে ওঠতেন, “যতো সব অ্যাঁড়গ্যাঁজানে পেঁচো মালের গুষ্টি।”
    তিরিশ হাজারিনীর দেশের পথে, তিল ধারণের জায়গা নেই এমন জমাট অন্ধকারে, ওনার কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো ওনার কাছে, তা শুনে টের পেলেন, কেউ উনোনে চাপানো কড়াইতে সর্ষের গরম তেলে হিঙের ফোড়ন দিলো, হয়তো ধোকার ডালনা বানাবে, যেমন ওনার স্ত্রী সূর্যমুখী, আশি বছর আগে কচিসবুজ তুঁতে-বিষ খেয়ে আত্মহত্যার আগে রাঁধতো ।
    হেডফোনে যা উনি শুনছিলেন :
    “আকাশে মেঘাড়ম্বরকারণ রাত্রি প্রদোষকালেই ঘনান্ধতমোময়ী হইল । গ্রাম, গৃহ, প্রান্তর, পথ, নদী, কিছুই লক্ষ্য হয় না । কেবল বনবিটপী সকল, সহস্র সহস্র খদ্যোতমালাপরিমণ্ডিত হইয়া হীরকখচিত কৃত্রিম বৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতেছিল । কেবলমাত্র গর্জনবিরত শ্বেতকৃষ্ণাভ মেঘমালার মধ্যে হ্রস্বদীপ্তি সৌদামিনি মধ্যে মধ্যে চমকিতেছিল --- স্ত্রীলোকের ক্রোধ একেবারে হ্রাসপ্রাপ্তি হয় না । কেবলমাত্র নববারিসমাগমপ্রফুল্ল ভেকেরা উৎসব করিতেছিল । ঝিল্লিরব মনোযোগপূর্বক লক্ষ্য করিলে শুনা যায়, রাবণের চিতার ন্যায় অশ্রান্ত রব করিতেছে, কিন্তু বিশেষ মনোযোগ না করিলে লক্ষ্য হয় না । শব্দের মধ্যে বৃক্ষাগ্র হইতে বৃক্ষপত্রের উপর বর্ষাবিশিষ্ট বারিবিন্দুর পতনশব্দ, বৃক্ষতলস্হ, বর্ষাজলে পত্রচূত জলবিন্দু পতনশব্দ, পথিস্হ অনিঃসৃত জলে শৃগালের পদসঞ্চরণশব্দ, কদাচিৎ বৃক্ষারূঢ় পক্ষীর আর্দ্র পক্ষের জল মোচনার্থ পক্ষবিধূনন শব্দ । মধ্যে মধ্যে শমিতপ্রায় বায়ুর ক্ষণিক গর্জন, তৎসঙ্গে বৃক্ষপত্রচূত বারিবিন্দু সকলের এককালীন পতনশব্দ । ক্রমে নগেন্দ্র দূরে একটা আলো দেখিতে পাইলেন । জলপ্লাবিত ভূমি অতিক্রম করিয়া, বৃক্ষচ্যূত বারি কতৃক সিক্ত হইয়া, বৃক্ষতলস্হ শৃগালের ভীতি বিধান করিয়া, নগেন্দ্র সেই আলোকাভিমুখে চলিলেন । বহু কষ্টে আলোক সন্নিধি উপস্হিত হইলেন । দেখিলেন এক ইষ্টকনির্মিত প্রাচীন বাসগৃহ হইতে আলো নির্গত হইতেছে । গৃহের দ্বার মুক্ত ।”
    ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছি, তিরিশ হাজারিনীর দেশে, নিজের মগজের ভেতরে নিজেকে ফিসফিস করে বললেন নগেন দত্ত, যেন পারিবারিক মানদণ্ডের অলিখিত অথচ সর্বমান্য সীমালঙ্ঘন করতে চলেছেন এমন সাবধানি সন্তর্পণে, খরগোশের গর্তের মুখে শেয়ালের অপেক্ষারত ঔৎসুক্যের মতন, যদিও দাদামশায়ের বাঁধা সীমা উনি পেরোন না, পেরোবার উপায় নেই, তা এক মহাজাগতিক সীমা । কোনো মামণিকে যে পিং করবেন তাও প্রেমের শেমে বাঁধা ।
    বেশ দূরে, ঝিমন্ত-হলুদ আলো জ্বলছিল দেখে, নিশ্চিন্ত হলেন নগেন দত্ত, লন্ঠনের আলো, হ্যাজাকের নয়, ওই তো একটা বাড়ির সদরের কপাট হাঁ করে খোলা, নাগরদের গিলে ফেলার অপেক্ষায়, যারা এই পাড়ায় আরেকটু রাত হলেই আসা আরম্ভ করবে । কিন্তু জঙ্গলের বদলে রয়েছে ইঁটের দাঁত-বেরোনো ফুটপাথ-ঘেঁষা দিনকয়েকের পচা জঞ্জাল, শেয়ালের বদলে খ্যাংরাটে হাড়গিলে ভেড়ুয়াদের ঘ্যানঘ্যানানি, রয়েছে বুড়িয়ে হেলে পড়া বৃষ্টি-বাদলার মার খাওয়া নোংরা কুঁজো বাড়ি, কার্নিশের ফাঁকে বেবি অশথ্থগাছ, অন্ধকারে যেটুকু দেখা যায়, বাড়িগুলোর সামনে কচি-পাকা নানা রকমের চংকুমণি ঢলঢলে-যৌবন যুবতী আর উঠতি-যুবতীরা দাঁড়িয়ে আছে, পোশাকও অদ্ভুত, যেন হাফশেমিজের তলা কেটে কোমরে বেঁধেছে, যেন শেমিজের ওপরটা কেটে ওপরে পরেছে যাতে তাদের বুকের খাঁজের মনমাতানো আলো আর কোমরের হাতমাতানো বেড় দেখতে পাওয়া যায় ,ওপরের সঙ্গে তলাকার পোশাকের মিল নেই কোনো, অন্তত তাই মনে হল অন্ধকারে ।
    যাতায়াত-মুখর ল্যাদখোর রাস্তায় আরেকটু খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন নগেন দত্ত, যাকে উনি কাটা-শেমিজ বলে ভাবছিলেন, তা ওদের ত্বকে আঁকা, কয়েকটা পেইনটিঙ উনি ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যাণ্ড, আমেরিকায় দেখেছেন, যখন পতৃদেবের হাত ধরে গিয়েছিলেন ওই দেশগুলোয়, ভ্যানগঘের ‘স্টারি নাইটস’, সান্দ্রা বত্তিচেলির ‘বার্থ অফ ভেনাস’, গুস্তাভ ক্লিমটের ‘দি কিস’, গেওর্গে সেরার ‘এ সানডে আফটারনুন’, দিয়েগো ভেলাকোয়েজের ‘লা মেনিনাস’, জ্যাকসন পোলকের ‘নম্বর ফাইভ’, দিয়েগো রেভেরার ‘দি ফ্লাওয়ার ক্যারিয়ার’, আরও অনেকের । ছবিগুলোর নিউড দেখে নগেন দত্ত বাবাকে বলেছিলেন, ইশ কি ভীষণ বাজে সুন্দর মেয়েরা। উত্তরে বাবা বলেছিলেন, ছবি দেখে ক্রাশ খাসনি, এখন অনেক বছর বাঁচবি, অপেক্ষায় শিমুল পলাশ রঙ ধরে।
    অন্ধকারে ভেসে বেড়াচ্ছে মেয়েগুলোর কাঁচা মাংসের ডাক, কতোরকমের পাখির ডাকের গন্ধ, গত দুশো বছর যাবত শুনে এসেছেন নগেন দত্ত, বাদাতিতির, লালগলা-বাতাই, রাজসরালি, ধলাকপাল রাজহাঁস, চকাচকি, মেটেহাঁস, মেটেধনেশ, নাটাবটের, কুটিকুড়ালি, নীলকন্ঠ, সুইচোরা, পাপিয়া, কোকিল, মালকোয়া, কুবোপাখি, চন্দনা, ঘরবাতাসি, রাতচরা. তিলাঘুঘু, হরিয়াল, ডাহর, সারস, ডাহুক, নেউপিপি, সোনাজিরিয়া, গাঙচিল, মধুবাজ, চড়ুই, ঈগল, শাহিন, পানকৌড়ি, কানিবক, কাস্তেচরা, মদনটাক, শুমচা, বেনেবউ, ফিঙে, ফটিকজল, দোয়েল --- তাদের ডানা-ঝাপটানো ডাকের মিহিমিহি সুবাস রয়ে গেছে নগেন দত্তের শরীরে ।
    উনি, নগেন দত্ত, কয়েকশো বছর যাবত খুঁজে ফিরছেন কুন্দনন্দিনী নামে কুমারীফাটল এক তরুণীকে । জীবনের উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন মনে করে নয়, খুঁজে চলেছেন মেয়েটিকে ভালোবাসবেন বলে, তাকে আজও ভালোবাসতে পারেননি নগেন দত্ত ; আসলে ভালোবাসাই ওনার জীবনের উদ্দেশ্য, বেঁচে থাকার মানে । বেঁচে থাকার জন্যে ওনাকে কিছুই করতে হয় না, কিন্তু জানেন যে ভালোবাসার জন্যে অনেককিছু করতে হবে । জীবন ওনার তারিখহীন হয়ে গেছে ।
    মগজের ভেতরে যে গানটা তাঁকে বিনবিনে উনকির মতন ছেঁকে ধরেছিল, অন্ধকারকে চটচটে একাকীত্ব থেকে বের করে আনার জন্য, তা মুখ দিয়ে জগন্ময় মিত্রের কন্ঠস্বরে বেরিয়ে আসছে শুনে অবাক হলেন না নগেন দত্ত, বেরোতে দিলেন গানখানা, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকসুদ্দু, কেননা ওনার মুখের ভেতরে হেন বাঙালি-অবাঙালি পুরুষ নেই যার কন্ঠস্বর সময়ে-অসময়ে বেরিয়ে আসেনি গত পঞ্চাশ একশো দেড়শো বছর যাবত, উনি যদি আজ ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে জিনস-টিশার্ট পরে থাকতেন, তাহলে হয়তো গলার ভেতরে নাচতে আরম্ভ করতেন এলভিস প্রিসলে তাঁর ‘জেল হাউস রক’ গানখানা গাইতে-গাইতে, কিংবা হয়তো মাইকেল জ্যাকসনের ‘আই জাস্ট কান্ট স্টপ লাভিং ইউ’ গাইতে গাইতে, এখন ধুতি-পাঞ্জাবি-কোলহাপুরি পরে আছেন বলে জগন্ময় মিত্রের গানখানা আচমকাই বেরিয়ে এলো, নয়তো বড়ে গুলাম আলির ‘কা করুঁ সজনা আয়ে না বালম’ ও বেরোতে পারত, কার গান যে কখন বেরোবে তার ওপর ওনার, নগেন দত্তর বড়ো একটা নিয়ন্ত্রণ নেই, তা উনি মুখ বন্ধকরে রেখেও দেখেছেন, গান এসে গেলে তা বেরোবেই বেরোবে, আর ভালোবাসার গান হলে তা থামানো অসম্ভব :
    ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
    তোমারে করেছি রানি ।
    তোমারই দুয়ারে কুড়াতে এসেছি
    ফেলে দেওয়া মালাখানি
    নয়নের জলে যেকথা জানাই
    সে ব্যথা আমার কেহ বোঝে নাই
    মেঘের মরমে যে মিনতি কাঁদে
    চাঁদ বুঝিবে না জানি ;
    ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
    তোমারে করেছে রানি
    মাধবীলতা গো আজ তুমি
    আছ ফুলের স্বপনসুখে
    একদিন যবে ফুল ঝরে যাবে
    লুটাবে ধূলির বুকে ।
    খেয়ালি প্রেমের খেলা বোঝা দায়
    কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়
    মুক হয়ে যায় কারও মুখরতা
    কারও মুখে জাগে বাণী
    ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
    তোমারে করেছে রানি….
    ভালোবাসা, নগেন দত্ত চেয়েছেন, বিপথে যাবার মতন হোক, পথে যা পাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরমার করে, নারকেল গাছের মাথা থেকে পাতা মুড়িয়ে, ডাবের কাঁদি ছিঁড়ে ফেলে, চিলের বাসার ডিম ফাটিয়ে, বটগাছকে ঝুরি-শেকড়সুদ্দু উপড়ে ফেলে, মেছোবকের ঘুমন্ত ঝাঁক উড়িয়ে, নদীর জলে বান এনে, মাছের ঝাঁকেদের মধ্যে ঘুর্ণির মতন ঢুকে যাক, চালাবাড়িসুদ্দু গ্রামের পর গ্রাম এক জায়গা থেকে নিয়ে গিয়ে আরেক জায়গায় বসিয়ে দিক, শহরের বাড়িগুলো হেলে পড়ুক ভালোবাসার ভূমিকম্পে, ঝড়ে উড়তে থাকুক মিছিল ফেরত মানুষের দল, সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাক তাঁর প্রাপ্য ভালোবাসার পাত্রীর জন্যে ।
    আশা ছাড়ে না অনুভূতির দালাল পেশাদার কোটনারা, খ্যাংরাটে পিম্পদের ঢ্যামনাকাত্তিক চেল্লাচিল্লির ঘ্যানঘ্যানানি ছেঁকে ধরেছিল ওনাকে, ঠিক যেমন ওদের হাড়ের সঙ্গে কোনোরকমে চিপকে আছে চামড়াটে মাংস, মুখের ভেতরে সেকারণেই থেমে গিয়েছিল গানখানা, ব্যাটারা দেখেছে নগেন দত্ত নেমেছেন টয়োটা গাড়ি থেকে, ওরা জানে খদ্দেরটা মালদার হাবলা, রসের নাগর, খাজা পাবলিক নয়, টাকার টাইমকল, সহজে ইল্লি খায় না, দশ কুড়ি চল্লিশ একশো দেড়শো বছরে অবিরাম কয়েকদিনের জন্যে আসে আর তারপর কোথায় হারিয়ে যায়, কোনো মেয়ে এনাকে ভালো কাস্টমার সার্ভিস দিলে তার একশো-দুশো বছরের জন্যে জীবনের বীমা করিয়ে দ্যান।
    কাচরাদের ক্যাচাল ভ্যানতারা এড়িয়ে, অন্ধকারে বাঁহাতে মোবাইল দেখে এগোচ্ছেন , ডানহাতে অ্যাটাচিকেস, যাতে হয়তো অনেক টাকা আছে, তবু লুটপাটের চেষ্টা করে না দালালরা, তুকতাক করে এমন ক্ষতি করে দিতে পারেন যে হঠাৎ চিৎপটাঙ হয়ে মরে পড়বে গলিতে, মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত, এর আগে দুজন নাঙের সঙ্গে ঘটেছে অমন ঘটনা, একজনকে তো আকাশের চিল বানিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই থেকে দালালটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, থানায় নালিশ করতে গেলে ওসি বলেছিল, “এই, এই মালগুলোকে লকআপে বন্ধ করে দুচার ঘা দিয়ে হুঁশ ফিরিয়ে আন তো।” যখন তাদের হুঁশ ফিরেছিল তখন ওরা দেখল যে কেষ্টপুরের খালের পাঁকে পোঁদ উল্টে উলঙ্গ পড়ে আছে, চারিদিকে অশ্লীল আধুনিক বাংলা ভাষার শহুরে ডিগডিগে কিচাইন ।
    আকাশের মেঘ আর কালবৈশাখিও যে নগেন দত্তই নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সে ব্যাপারে কয়েকজন পুরোনো ভেড়ুয়া নিশ্চিন্ত, নয়তো এখন তো কালবৈশাখির মরসুম নয় ।
    লেগেই আছে পিটপিটে-চোখ ফ্যাঁচফ্যাঁচে সর্দি দাঁতক্যালানে দালালরা, যেমনটা ওরা প্রতিবার নগেন দত্তকে দেখলেই বিস্কুটখেকো নেড়ি-কুকুরের মতন পেছনে দৌড়োয়, মেজাজ চটকে যাবার যোগাড়, স্যার যেমন চান তেমন পাইয়ে দেবো, এই বাড়িতে আসুন, ফর্সা ধবধবে পাঞ্জাবি পাবেন, গুলশন কৌর, ফুরসত মাজিঠিয়া, সিমরন সিং, গালফোলা ঢাউসবুক নেপালি চান পাবেন, ছিনমুন থাপা, চম্পক গুরুং, কুচর কইরালা, ঘড়ঘড়ে সর্দিবন্ধ গলার স্বরে, না স্যার, আমাদের বাড়িতে আসুন, মারোয়াড়ি বউয়ের সঙ্গে শুয়েছেন কখনও, জগৎশেঠের বাঁদির মেয়ের মেয়ের মেয়ের মেয়ে, ছয়েলছবিলি ঝুনঝুনওয়ালি, রাজস্হান থেকে টাটকা আমদানি, ব্রিটিশ সায়েবদের আমলের মারোয়াড়ি বউ, শিফনশাড়ি, কানে ঝমঝমে দুল, এয়ার কান্ডিশান ঘর, ঠোঁটে ল্যাকমে, গায়ে ডিওডোরেন্ট, ঘরে রুম ফ্রেশেনার, নাকি সুরে, লোকটার গালে ছুরি খাওয়ার দাগ, স্যার ওদের ছাড়ুন, আমি টিভিস্টার পাইয়ে দেবো, বাংলা চান বাংলা, হিন্দি চান হিন্দি, এক্সট্রা লার্জ বুকের সাইজ হুজুর, এক্সট্রা লার্জ পাছা, একবার এসে দেখুন না হয় তারপর যা ভালো বোঝেন করবেন, সারা রাত চান, ঘণ্টাখানেক চান, এমনকি দশ-পনেরো মিনিটের জন্যেও পাবেন হুজুর, বড়ো ছ্যাঁদা চান পাবেন, ছোটো ছ্যাঁদা চান পাবেন, যেন কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙেছে, হাই তোলা বন্ধ রেখে ।
    নাহ, এ পাগল কাউকে পাত্তা দেবে না, বলল একজন কমবয়সী দালাল, ফিসফিস, হাঁ-মুখে চোলাই সাঁটা হাওয়া, চোঙা প্যান্ট । এই দালাল পঁচাত্তর বছর আগে, যখন ওর বয়স কুড়ি ছিল, নাইট-ভিউ গ্যালারির দরোজায় গেট-মিটিং করে পিম্পদের হরতাল ডেকেছিল, তবে তাতে অন্য পিম্পরা যোগ না দেয়ায় পাড়ার নেতা হতে পারেনি, বাইরের এক পালোয়ান এসে পাড়ার নেতা হয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ল নগেন দত্তর। পালোয়ানের নাতি এখন মোহোল্লা কমিটির মুখ্য-কোটনা ।
    নগেন দত্ত কাউকে পাত্তা দিচ্ছেন না দেখে একজন খ্যাংরাকাঠি লুঙ্গিপরা গুটকামুখ দালাল টিটকিরি মারল, ওর বড়ো ছ্যাঁদার পাল্লায় পড়বেন না হুজুর, ঝাণ্ডা নিয়ে বড়ো ছ্যাঁদায় ঢুকবেন আর পুরো পার্টি দলবল নিয়ে মিছিলের স্লোগান দিতে-দিতে বেরিয়ে আসবে আবনার পিছন-পিছন ।
    নগেন দত্ত জানেন যে লোকটা সঠিক কথা বলেছে, ওনার ক্ষমতা আছে তা করার, একবার রাস্তা পেরোতে আধ ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল বলে, ময়দানমুখো র‌্যালিকে সেই মিছিলের একজন মহিলার গর্ভে লোপাট করে দিয়েছিলেন, গর্ভের ভেতরে স্লোগানের দপদপানি শুনে সিজার করতে হয়েছিল মেডিকাল বোর্ডকে । এক ইঞ্চি মাপের মানুষেরা গর্ভ থেকে ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়’ স্লোগান দিতে-দিতে বেরিয়েছিল।
    আমি শুতে আসিনি, জীবনে হাজার-হাজার বার শুয়েছি, দিনে দুতিনবার দুতিন জনের সঙ্গে শুয়েছি, বাৎসায়নের সবগুলো শোয়া শুয়ে নিয়েছি, এখন ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে এসেছি, এবার শুধু ভালোবাসার পাত্রীর ভালোবাসা চাইছি, বললেন নগেন দত্ত ।
    খেটে-খাওয়া মা আর খুঁটে খাওয়া বাপের ঝুপ্পুসলীলায় পয়দা-হওয়া দালালগুলো নাছোড়, মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মুখে পুরে কথা বলার ঢঙে, পাবেন স্যার, ভালোবাসা পাবেন, যেমন করে ভালোবাসতে চান পাবেন, দাঁড়িয়ে, বসে, পা ছড়িয়ে, উপুড় হয়ে, কুকুরের পোজে, সিংহের পোজে, গণ্ডারের পোজে, হাতির পোজে, বাসুন না যেমন ভাবে চান, একবার এসে তো দেখুন, দেখবেন ভালোবাসবার জন্য মুখিয়ে আছে, আপনার মন ভরে যাবে, রোজ আসতে ইচ্ছে করবে, বেশি রেট নয় স্যার, চলুন না, একবার নিজের চোখে দেখে তো নিন, যাদের দেখছেন এরা ভালো কোয়ালিটির আইটেম নয় স্যার, সস্তা, রোগ বাধিয়ে দেবে, ওপরে চলুন, নামি-দামি পাইয়ে দেব আপনাকে ।
    মোবাইলকে লাউডস্পিকার মোডে লাগিয়ে নরেন দত্ত পিম্পগুলোকে বললেন, শোন শোন, তোরা শোন, আমি এই মেয়েকে খুজছি, তাকেই ভালোবাসতে চেয়েছি, ভালোবাসতে এসেছি, তা দুশো বছর আগের কথা তো হবেই, বেশি তো কম নয় ।
    দালালগুলো নগেন দত্তকে ঘিরে মোবাইলে রেকর্ড করা কথা শুনতে লাগল, এতো কাছ থেকে যে নগেন দত্ত নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন, ব্যাটারা ষাট-সত্তর বছর স্নানটান করে নি, গায়ে কি দুর্গন্ধ, এখন থেকেই ধেনো টেনে রেখেছে, বা হয়তো দশ বছর আগে যে ধেনো টেনেছে তার খোঁয়ারির বদবুতে মুখ ম-ম করছে ।
    একজন দালাল বলল, স্যার এর আগে কি এই মেয়েটাকেই খুঁজেছিলেন ?
    নগেন দত্ত বললেন দুশো বছর যাবত খুঁজে চলেছি, তোরা মন দিয়ে শোন :
    “সকলেই বিস্মিত হইয়া দেখিল যে যুবতীর শরীরে আর রূপ ধরে না । সেই বহুসুন্দরীশোভিত রমণীমণ্ডলেও, কুন্দনন্দিনী ব্যতীত তাহা হইতে সমধিক রূপবতী কেহই নহে । তাহার স্ফুরিত বিম্বাধর, সুগঠিত নাসা, বিস্ফারিত ফুল্লিন্দীবরতুল্য চক্ষু, চিত্ররেখাবৎ ভ্রুযুগ, নিটোল ললাট, বাহুযুগের মৃণালবৎ গঠন, এবং চম্পকদামবৎ বর্ণ, রমণীকুলদুর্লভ ।”
    মোবাইল অফ করে নগেন দত্ত বললেন, বুঝেছ, এই মেয়েকেই খুঁজছি ।
    একজন দালাল, গলায় মাফলার জড়ানো, এই গরমেও, বলল, স্যার এটা কি সরকারি হিন্দি, দূরদর্শনে খবর পড়ে, সেরকম মনে হল, শুনি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারি না । এর আগে তো আপনি কুঁদি নামে একটা মেয়েকে খুঁজতে আসতেন ।
    আরে, না রে ল্যাওড়ার ক্যাওড়া, মালায়ুলি মালায়ুলি, নীলকমল গ্যালারিতে আছে, দেখিছিস তো, এমনি করেই কতাটতা বলে, রেমড়িঁআম্মা, চলুন স্যার, নিয়ে যাচ্ছি মালায়ুলির কাছে, তবে ওর গায়ের যা রঙ, আবনার পাঞ্জাবি-ধুতি শাদা থাগলে হয়, ঘড়ঘড়ে গলার দালাল ।
    মালায়ুলি নয়, মালায়ুলি নয়, হায়দ্রাবাদি, কাইকু কাইকু করে কতা বলে, মোচোরমান চলবে তো হুজুর, ওর চেয়ে ভালো মোচোরমান মেয়ে পাইয়ে দেবো, আরবদেশের চেয়ে ফর্সা, চলুন আমার সঙ্গে, বুকে মুখ গুঁজে পিথ্থিবির সব দুখ্খু ভুলে যাবেন , অবশ্যি মেয়েদের হিন্দু-মোচোরমান বলে কিছু নেই স্যার, ওসব আস্ত-খোসা আর ছাড়ানো-খোসা পুরুষদের ব্যাপার স্যার, চলুন না, একবারটি দেখে নিন, নাকিসুর দালাল ।
    কারেন্ট চলে আসতে, ভেড়ুয়াগুলোকে দেখলেন নগেন দত্ত, নাঃ, কর্নওয়ালিসের দেয়া জমিদারি উঠে যাবার আগে এদের কেউই তাঁর মোসাহেব ছিল না, এরা তো সংসদীয় গণতন্ত্রের বাইপ্রডাক্ট, একেবারে ভিকিরি, দুবেলা নালির চোলাই আর পচাই-তাড়ি খেয়ে পড়ে থাকে । এরা কুন্দনন্দিনী উচ্চারণ করতে পারবে না ভেবে কুন্দনন্দিনীর ডাকনামটার কথা বলেছিলেন ।
    আরেকজন ভেড়ুয়া, গমগমে গলায় বলল, হুজুর, শুনে তো কিছুই বুঝতে পারিনি, তবে কুন্দনন্দিনী শুনতে পেলুম । আমার মাসিপিসির গ্যালারিতে যতোগুলো মেয়ে আছে সকলের নামই কুন্দনন্দিনী । ওই যে গন্ধরানির বাড়ি দেখছেন, সেখানে। আপনি আগের বার গিসলেন বোধয় স্যার ।
    মাসিপিসির গ্যালারি ? মুখময় পানিবসন্তের আলপনাদেয়া কোটনাটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে, জানতে চাইলেন নগেন দত্ত, মাসি আর পিসি একই সঙ্গে ! যতোদূর জানি, আগে তো মাসি বলেই ডাকা হতো বাড়িউলিকে । তার বাড়িতে একজন নয়, দুজন নয়, সবাই কুন্দনন্দিনী ! কেমন করে জানা যাবে আসল কুন্দনন্দিনী কে ! ভালোবাসার পাত্রীকে কেমন করে খুঁজে পাবো ?
    না স্যার, উনি আগে কালেজে পড়াতেন, প্রফেসার চক্কোত্তি, কালেজের ছেলে-মেয়েরা ওনাকে পিসি বলে ডাকতো, কালেজে পড়িয়ে আর বেনামে বই লিখে তেমন রোজগারপাতি হতো না বলে এই লাইনে এয়েচেন, ওনার মালিক অনেক ট্যাকা ঢেলেচেন, আগের মাসি ছোটোবেলায় ওনার বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো, তাপ্পরে কেউ ফুসলিয়ে ঝিকে বেচে দিলে দিল্লির মেড়ো পার্টিকে, সে আর ছাড়ে কেন, হেভি দাম দিয়ে কুমারী মেয়ের পরদা ছিঁড়তে পেলো । প্রফেসার চক্কোত্তি অ্যাগবার এসেছিলেন গন্ধরানির কাছে, বছর তিরিশ-চল্লিশ আগে, নকশাল করবার সময়ে গন্ধরানির খাটের তলায় পনেরোদিন লুক্কে ছিলেন, দুজনের এমন সখি-সখি ভাবভালোবাসা হল যে প্রফেসর চক্কোত্তি গন্ধরানির ব্যবসা অনেক ট্যাকা দিয়ে কিনে নিলেন, লোকে বলে ট্যাকাটা ওনার গুরু-মহারাজের। অ্যাগবারে নতুন ঢঙে সাজিয়েচেন স্যার । গন্ধরানিকে রেখে এয়েচেন বুড়োবুড়ি আবাসে ।
    ---ওঃ, ছোটো থেকে প্রোমোশান পেয়ে-পেয়ে এই বাড়িটা দখল করে নিলেন ?
    ---জি হুজুর, আগের মাসির নামই গন্ধরানি । পাড়ার মেয়েরা বাড়িটাকে মাসিপিসির গ্যালারি বলে জানে । ঘড়ঘড়ে কন্ঠস্বরের দালাল ।
    ---চলো, নিয়ে চলো, আসল কুন্দনন্দিনীকে যদি পাই, দেড়শো বছরের কান্না চোখের তলার থলিতে জমে আছে ।
    ---পাবেন, পাবেন, সুদু এপার বাংলা-ওপার বাংলার মেয়ে পাবেন মাসিপিসির গ্যালারিতে, সকলের নামই কুন্দনন্দিনী ।
    ---চলো, নিয়ে চলো, কতকাল হয়ে গেল বাংলা ভাষার সঙ্গে শুইনি, বাংলা ভাষার অরগ্যাজমের আনন্দ উপভোগ করিনি, ঠোঁটে বাংলা ভাষার থুতু পাইনি, বুকে বাংলা মাংসের জাপট পাইনি, বোধহয় পঞ্চাশ আশি একশো বছর হয়ে গেল । সেই কবে তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদারের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করার দিনকালে যেটুকু আয়েশ করেছিলুম ।
    নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে ফিসফিস করে বললেন, যে মেয়েগুলোকে দোরগোড়ায় দেখছি, এরা বাঙালিনী নয় বলেই তো মনে হচ্ছে, ত্বকে শ্যামল কোমলতা নেই, চোখ ডাগর নয়, পাছা অব্দি কোঁকড়ানো চুল নয়, কেবল ফর্সা দিয়ে নগেন দত্তের মন ভরে না, অবাঙালিনী হলে আবোলতাবোল কথা বলার আনন্দের তো উপায় নেই, কেবল দুদণ্ড জড়িয়ে শোয়া আর ইল্লি করে উঠে পড়ার জন্যে তো আসেননি, ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে এসেছেন, যে ভালোবাসা কুন্দনন্দিনী দেবে বলে কথা দিয়েছিল বহুকাল আগে । অ্যাটাচিকেসটা সেই জন্যেই তো এনেছেন সঙ্গে ।
    রাস্তার মুখে নীলের ওপর সাদা অক্ষরে লেখা কোবরেজ হরিদাস পাল সরণী ।
    মনে পড়ল নগেন দত্তর, জঙ্গলের মধ্যে শিশু গাছের তলায় বসে-থাকা নাকে-নস্যি হরিদাস পাল কোবরেজের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল ।
    ---তুমি কি ?
    ---আমি জীব ।
    ---তুমি কোন জীব ?
    ---আমি তটস্হ জীব ।
    ---থাকেন কোথায় ?
    ---ভাণ্ডে ।
    ---ভাণ্ড কিরূপে হৈল ?
    ---তত্ববস্তু হইতে ।
    ---তত্ববস্তু কি ?
    ---পঞ্চ আত্মা, একাদশেন্দ্র, ছয় রিপু, ইচ্ছা, এই সকল য়েক যোগে ভাণ্ড হইল । আমি সেহেতু চিরযুবক।
    নগেন দত্তর উত্তর শুনে হরিদাস পাল কোবরেজ বলেছিলেন, সঠিক উত্তর দিয়েছ, আলোকপ্রাপ্তির জন্যে জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারো ।
    আলোকপ্রাপ্তি শব্দের সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর কোথাও মিল আছে, মনে হল নগেন দত্তর।
    আজকে রাস্তাটায় ঢুকে সবই গুলিয়ে যাচ্ছিল নগেন দত্তর । ময়নামতির বাড়ির নাম হয়েছে নীলকমল গ্যালারি, সুখরানির বাড়ির নাম হয়েছে প্রেমকমল গ্যালারি, হরিমতির বাড়ির নাম হয়েছে প্রেমবন্ধন গ্যালারি, হেমনন্দিনীর বাড়ির নাম হয়েছে গঙ্গাজমুনা গ্যালারি, নলিনীবালার বাড়ির নাম হয়েছে নাইট লাভার্স গ্যালারি, যশোমতির বাড়ির নাম পালটে কি হয়েছে দেখতে হবে , পিসির বাড়ির ঝিয়ের কথা বলছে, তাহলে কি যশোমতির কথা বলছে ! তবে বাড়ির দরজায় একটা নম্বর দেয়া, লোডশেডিঙের সময়ে অন্ধকার ফুটো-করা আলো দেখা যাচ্ছিল এই বাড়ির দরোজায় ।
    আরেকটু ভেতরে ঢুকতে পারতেন নগেন দত্ত, চিনতে পারলেন, দুর্গাবরণ মিত্র সরণী, হ্যাঁ, এই জমিদারবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বলে মনে পড়ছে, ওনার কাছারিবাড়িতে রামপ্রসাদ সেন নামে একটি ছেলে ভালো শ্যামাসঙ্গীত গাইত। মগজের ভেতরে রামপ্রসাদ সেনের কন্ঠস্বর গেয়ে উঠতে চেয়েছিল, শ্লেষ্মা দিয়ে চাপা দিলেন এখনকার মতন, পরে ওনাকে গলায় গাইতে দেওয়া যাবে, আপাতত কালীবন্দনার প্রয়োজন ঘটেনি ।
    তারপর হামাম বক্স সরণী, নাঃ, এনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি । এই এলাকায় যারা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তারা তেমন আকর্ষক নয় । তাদের গায়ে কালিঘাটের পট আঁকা ।
    এদের কাউকে বেছে নিয়ে কুন্দনন্দিনীর রূপ দিতে পারি, নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে বললেন নগেন দত্ত, কিন্তু তার ভেতরটা, যাকে আগেকার লোকেরা বলত অন্তরজগত, তা তো পালটে কুন্দনন্দিনীর করে দিতে পারব না । আমার চাই আসল কুন্দনন্দিনী, যাকে দুশো বছর যাবত খুঁজছি ।
    মনে পড়ল ওনার, কাজী জহির রায়হান নামে এক মুসলমান যুবকের সঙ্গে বছর পঁয়তাল্লিশ আগে পরিচয় হয়েছিল বটে, বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে যারা মুক্তি যুদ্ধ এড়িয়ে তিরিশ হাজারিনীর দেশে আলোকপ্রাপ্তির জন্যে আসত, লুকিয়ে-লুকিয়ে তাদের মুভি ফিল্ম তুলেছিল, সেই থেকে কাজী জহির রায়হানকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি । দেশটা তখন পাকিস্তান ছিল, এখন বাংলাদেশ হয়েছে ; বাংলাদেশ হলেও অনেকের অন্তরজগতে পাকিস্তান রয়ে গেছে ।
    নগেন দত্তের একবার মনে হয়েছিল কাজী জহির রায়হানকে জীবন্ত করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবেন, তা আর করেননি, শেষে ওপার বাংলার লোকেরাও তাঁকে প্রতিভাবান মনে করবে, এই আতঙ্কে ।
    পিসিমাসির গ্যালারির বাড়ির দরোজা খোলা দেখে, দালালটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে, ওপরে দোতলায় ওঠার সময়ে নগেন দত্ত বাইরে হাত নাড়িয়ে শিলাবৃষ্টি আরম্ভ করে দিলেন, তিরিশ হাজারিনীর শহরে শিলাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হবার সমস্যা নেই, পিম্পগুলো অন্তত আড়ালে আশ্রয় নেবে ।
    সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে, হাজার-হাজার পুরুষেরা উঠে-উঠে সিঁড়ির গোলাপি দেয়ালকে ছুঁয়ে মসৃণ করে দিয়েছে, স্লেট-রঙের সিঁড়িগুলো ক্ষইয়ে দিয়েছে, দেখলেন দেয়ালজুড়ে বাংলায় লেখা রয়েছে ‘বিইং অ্যাণ্ড নাথিংনেস’, বিইং-এর ওপর পুরুষের বিশাল লিঙ্গ আঁকা আর নাথিংনেসের ওপরে ফাটল-স্ফীত ভগ ।
    সিঁড়িতে কোথাও লুকোনো স্পিকার থেকে জি-মাইনরে য়োহানেস ব্রাহমসের পাঁচ নম্বর হাংগেরিয়ান নাচ বাজছিল মৃদুস্বরে, আগত নাগরদের মেজাজকে আহ্লাদে চুবিয়ে দেবার খাতিরে ।
    নিজের মগজের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে নগেন দত্ত বললেন, ঠিক বাড়িতেই এসে পড়েছি, বছর আশি আগে যখন এসেছিলেন তখন সিঁড়ির দেয়ালে এই লেখা আর লিঙ্গ-যোনির হাতে আঁকা রঙিন ছবি ছিল, বাজনাও এইটেই ছিল।
    বিইং মানে যা ‘আছে’, নাথিংনেস মানে যা ‘নেই’। আঁকা লিঙ্গ দাঁড়িয়ে থেকে প্রমাণ করছে যে সে ‘আছে’, শিশ্নকে গোলাপি রঙ করে গেছেন কোনো আন্তর্জাতিক বহুজাতিক প্রেমিক ছবি-আঁকিয়ে, হয়তো এদেশেরই, হয়তো ফরাসি দেশের, হয়তো ইতালির রেনেসঁসের সময়কার, যাঁদের তুলির মাপ একহাত সাতইঞ্চি ছিল, বিখ্যাত ছবি-আঁকিয়েরা, যশোমতির বাড়িতে প্রেম করতে এলে ছবিগুলোকে চাঁঙ্গা করে দিয়ে যান । টুকরো দু-পাট লাবিয়ার মাঝে গোলাপি ভগাঙ্কুর প্রমাণ করছে যে সেখানে বিইং জিনিসটা ‘নেই’ ।
    দালালটা ঠিকই বলেছিল, ‘নেই’ এর হিন্দু-মুসলমান হয় না ।
    সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে নগেন দত্ত অনুভব করতে পারছিলেন যে তিনি উলুপি-সুবাসের হ্রদের হাফঠাণ্ডা তলদেশ থেকে ওপরের দিকে উঠছেন, আলোকপ্রাপ্তির আধুনিকতায় ধুয়ে যাচ্ছে তাঁর পোশাক, যেমন দুশো বছর আগে হয়েছিল, তখন বাবার সঙ্গে এসেছিলেন, বাবা নিয়ে এসেছিলেন ছেলেকে যৌনকর্মে সুদক্ষ করে তোলার জন্য ।
    নগেন দত্তের বাবা ভাব-ভালোবাসায় বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন যৌনখেলার দক্ষতায়, যেমন তাঁর পূর্বপুরুষরা তিন-চারশো বছর আগে দশবারোজন বউ রাখতেন আর আনন্দ করতেন ।
    বাবা একটি যুবতীকে চিৎ করিয়ে শুইয়ে, ছেলেকে বলেছিলেন, তুমি যতোই প্রেমের রসবিজ্ঞান পড়ো, লিঙ্গের স্মৃতির কাছে সবই তুচ্ছ, যে লিঙ্গের নিজস্ব স্মৃতি নেই, বুঝতে হবে তাতে মনুষ্যত্বের অভাব রয়েছে, এইভাবে দশ বছরের ছেলেকে শিক্ষা দিয়েছিলেন :
    বাবা : এই দুটো হল ঠোঁট, তোর যেমন আছে তেমন মেয়েদেরও থাকে, দেখেইছিস, তা এই দুটো ঠোঁটে তুই নিজের দুটো ঠোঁট রেখে ডাবের জল খাবি ।
    ছেলে : ডাব তো আমাদের শেতলপুরের জমিদারিতে কাঁদি কাঁদি হয় বাবা, একজন মেয়ের ঠোঁটে কেন খাবো, ডাবের জল তো পাবো না, কী পাবো তাহলে ?
    বাবা : যখন খাবি তখন বুঝতে পারবি, লালার সঙ্গে লালা মিশলে জ্বালা বাড়ার জ্বালা কমে ।
    ছেলে : আচ্ছা, তুমি বলছ যখন তখন খেতেই হবে ।
    বাবা : এই দ্যাখ, এদুটো হল মাই, কিন্তু শক্তপোক্ত হলে তাকে বলে স্তন, ছোটো বেলায় যেমন করে চাকরানিদের দুধ খেয়েছিস, এখনও তেমন করেই খাবি ।
    ছেলে : এখন আর কেন দুধ খাবো বাবা, বাড়িতে গোরুর খাঁটি দুধ তো খাইই ।
    বাবা : দুধ খাবার মতন করে খাবি, কিন্তু দুধ বেরোবে না, আনন্দ খাবি, দুধ থাকলে একরকমের আনন্দ হয়, আবার দুধ না থাকলে আরেকরকমের আনন্দ ।
    ছেলে : দুধের বদলে কী বেরোবে তাহলে ?
    বাবা : কিছুই বেরোবে না, তুই যখন খাবি তখন বুঝতে পারবি ।
    ছেলে : বাবা, এনাকে এরকম উলঙ্গ দেখে আমার কুঁচকির জায়গায় টিং-টিং করে শিরশিরানি আরম্ভ হয়ে গেছে ।
    বাবা : গেছে তো ? এই যে কুঁচকির মাঝে যা দেখছিস, সেখানে শিরশিরানির সঙ্গে শিরশিরানি মেশালে তোর আনন্দধারা প্রবাহিত হবে, তোর মন ভালো হয়ে যাবে, অন্ধকার থেকে আলোয় পৌঁছোবি, আলোকপ্রাপ্তি ঘটবে ।
    যে মেয়েটি শুয়েছিল সে আচমকা উঠে বসে বলেছিল, ওভাবে বোঝালে হবে না কত্তা, শেষে বন্দরের বদলে খেয়াঘাটে জাহাজ ভেড়াবে তোমার ছেলে, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, ও আমি হাতে-নাতে শিখিয়ে দেবো, যেমন করে তোমায় শিখিয়েছিলুম, তোমার শশুরের উইল অনুযায়ী । এখন তুমি বাইরে গিয়ে অপিক্ষে করো, আমরা মহড়া দিয়ে নিই । ওকে জানতে হবে তো দুটো শরীরকে কেমন করে স্হিতাবস্হা থেকে স্ফীতির অবস্হায় নিয়ে যায় প্রেম, ওতো এখনও জানে না যে প্রেম হল স্হিতাবস্হার বিরুদ্ধে প্রথম উল্লাস ।
    ছেলে বলেছিল, জানি গো জানি, প্রেমিকার সবকিছু জেনে ফেললেই প্রেম গুবলেট ।
    শিক্ষিকা মেয়েটি বলেছিল, নগেন দত্তর চুলে বিলি কেটে, অ্যাই তো কতার মতোন কতা ।
    ছেলে সেইমতো জীবন কাটাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎই কুন্দনন্দিনীকে দেখে তার প্রতি ভালোবাসায় আক্রান্ত হলেন নগেন দত্ত।
    ছেলেকে ভালোবাসায় আক্রান্ত হতে দেখে হঠাৎ মারা গিয়েছিলেন নগেন দত্তের বাবা ।
    শেষ শয্যায় শুয়ে উনি, নগেন দত্তের বাবা, বলেছিলেন, আমার আর কোনো আপশোষ নেই, পরশুই দেখে এলুম মোহনবাগান ফুটবলাররা খালি পায়ে আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে কেমন গুহারান হারালো ।
    ১৯১১ সালের সে-কথা মনে আছে নগেন দত্তর । তবে পরাজয়ের সঙ্গে গুয়ের সম্পর্কের রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি আজও ।
    আজকে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়ে টের পেলেন, ‘আছের’ সঙ্গে ‘নেইয়ের’ মিলনে আলোকপ্রাপ্তি ঘটে এই গ্যালারিতে, নগেন দত্ত নিজের মোবাইলে বিইং অ্যাণ্ড নাথিংনেসর ফোটো তুলে নিলেন, দেড়-দুশো বছর পরে আবার যখন আসবেন তখন মিলিয়ে দেখার জন্য, বিইং কতোটা উন্নতশির হলো আর নাথিংনেস কতোটা ডাকসাইটে গোলাপি ।
    দেশ-বিদেশের কতো কতো ‘আছে’ এখানে আসে ‘নেইদের’ সঙ্গে মিলন করতে, নিজেকে আলোয় আলো করে তুলতে । ‘নেইরা’ কতো কতো ‘আছেকে’ আলোয় ভরে দ্যায় ।
    সিঁড়ি দিয়ে উঠে, দোতলার বারান্দায় ঢোকার মুখে চারিধারে লাল টুনিআলো ঝোলানো একটা সাইনবোর্ড টাঙানো, তাতে সাদার ওপরে গেরুয়া রঙে লেখা “দি অ্যাকাডেমি অফ পারফরমিং ফ্লেশ” । সাইনবোর্ডেরও ছবি তুলে নিলেন মোবাইলে, তুলে, মনে পড়ে গেল সেই গানটা, কে যেন গেয়েছিল, মগজের ভেতরে তার গুনগুন শুনতে পাচ্ছিলেন নগেন দত্ত :
    পা গা মা রে সা নি
    পা নি সা রে মা গা রে
    রে মা পা নি ধা মা পা না সা রে নি সা
    পা ধা মা পা নি ধা মা গা গা সা নি সা
    ঘষা-কাচের আড়াল-তোলা মাসিপিসি গ্যালারির কিউবিকলের পাশ দিয়ে দোতলার বারান্দায় পৌঁছোলেন নগেন দত্ত, মাসিপিসির সঙ্গে কথা পরে বলবেন ।
    যে কোনে একশো বছর আগে এই বাড়ির মাসি জলচৌকিতে বসে দোক্তাদেয়া পানের খিলি সাজাতো, আর মেয়ে বাছাই নিয়ে দরাদরি করত, সেখানটা ফাঁকা, সেই জলচৌকির ওপরে মাসির দোক্তামুখ হাসির ফোটো, তাতে যে রজনীগন্ধার মালা পরানো, তা দশ বছর আগে শুকিয়ে গেছে, মাসি তবুও দোক্তামুখে হাসি বজায় রেখেছে ।
    নগেন দত্ত দেখলেন, বারান্দায় দুটো খাটে দুঃখকাতর দুটো কাটা-মুণ্ডু রাখা , তাদের মলম ধরণের কিছু মাখানো হয়েছে, দুই খাটের পাশে মুণ্ডুদের শিয়রে দুজন যুবক মেঝেয় বসে, যেন কাটা মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের ধড়হীনতার দুঃখ কমাবার চেষ্টা করছে ।
    মুণ্ডুদের মুখে গোঁজা সিগারেটের ফিকে নীল ধোঁয়া জিজ্ঞাসার চিহ্ণ হয়ে উঠে যাচ্ছে প্রেমালাপে ব্যস্ত কড়িকাঠের টিকটিকিদের মাঝে, মুণ্ডুদের খাটের পাশে চায়ের কাপে ফোঁকা সিগারেট গোঁজা, কিন্তু সিগারেটের ধোঁয়া বেরোচ্ছে যুবকদের মুখ থেকে, মুণ্ডুদের মুখ থেকে নয়, ধোঁয়ার গন্ধে নগেন দত্ত টের পেলেন ওরা চরস ফুঁকছে ।
    বোঝা গেল না জিজ্ঞাসায় আক্রান্ত কারা, মুণ্ডুদুটো নাকি পাশে বসে থাকা যুবকেরা ।
    টিকটিকি আর টিকটিকিনী বিরক্ত হল তাদের প্রেমে ব্যাঘাত ঘটায়, ক্লাইম্যাক্সে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল, বাধ সাধলো চরসের ধোঁয়া ; বিরক্তি জানাতে বাধ্য হল
    টিকটিকি : এই বাঞ্চোত মানুষগুলো আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না, আমাদের সবকিছু দখল করে নিয়েছে, কোথাও যাবার যো নেই, ওদের বাড়ির বউগুলো তো আমাদের দেখলেই অজ্ঞান হবার যোগাড়, যাও বা একটু দূরত্ব রেখে প্রেম করছি, তাও করতে দেবে না । এদিকে নিজেরা বাজার খুলে বসে আছে ।
    টিকটিকিনী : ওদের কথা আর বোলো না, ঘরের ভেতরে দেখেছি তো, মরদগুলো চুর হয়ে থাকে, পায়ের ফাঁকে গেল না বালিশের ফাঁকে গেল, সেসব টের পায় না, ব্যাস, নিজের শকড়ি বয়ে গেলেই হলো । মাগিগুলোও চুষে পকেট ফাঁকা করে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে । সেদিন তো একজনকে সিঁড়ি দিয়ে লাথিয়ে বের করে দিলে, যন্তর দিয়ে “আই লাভ ইউ” বলতে পারেনি বলে ।
    টিকটিকি : ওদের সংস্কৃতি হল গোলাপায়রার সংস্কৃতি, চোপরদিন বকরবকম বকরবকম ছাড়া অন্য কাজ নেই ।
    টিকটিকিনী : ওদের সমাজে যারা দুর্বল তাদের ওরা বলে ভালো