
মৃতের মাতৃমঙ্গল
দু’ চোখের পাথর ছিদ্র করে গড়িয়ে পড়ে জল
পৃথিবীর প্রাচীন কবরে
হায়! এ-আনন্দধারায় আমিও জেনে যাই- বর্ষা এসেছে, তাজা জলে ডুব দেবে কঠিন কাছিম…
.
পাতিহাড়ে পড়ে বৃষ্টির ফুল, চকিত হরিণ ভয় নেই তোমার
আদি বর্ষায় জল আর গহীন জঙ্গলে আমরা ছিলাম আদি ভাই বোন…
সর্বদা মানুষ থাকি না তাই
অর্ধেক চাতক, চাতকিনী…
প্রতিঅঙ্গে বৃষ্টির গজল মাখি আমি আর মৃত ঠাকুর মা (সঙ্গে তাঁর ধর্মান্তরিত প্রেমিক)
.
হায় বর্ষা! জীবিত আর মৃতের
অনন্ত মাতৃমঙ্গল…
.
২.
পৃথিবীর জানালায় ভর দিয়ে দেখছি
গাছের পাতাগুলো কাঁপছে, পাতার আড়ালে স্বর্গের ফল ঝুলে আছে
নদীতে নেমে-যাওয়া সেই রাস্তাটায় ঝিরঝির হাওয়ার মুখ ভেসে ভেসে ডুবে যায়…
অনেকটা ডুবন্ত মানুষের চোখে দ্রুত সরে যাচ্ছে জলের প্রবাহ
.
এভাবেই
রোকমচিন্তাহীন, ভাবেই এক জীবন…
.আবছা গোধূলির আলো ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই কেউ প্রথম বাতিটি জ্বালিয়ে দিলো
সে আলো জ্বলজ্বল করছে আয়নায়
যেন মহারাত্রির অপেক্ষায় একটি জোনাকিপোকা।
৩.
এবার সত্যি সত্যি বিদ্যুত চমকায়
খাঁচা থেকে পাখিগুলো বেরিয়ে আসে
বিদ্যুতের ছিদ্রে পাখিগুলো ঘুমিয়ে পড়ে আবার জেগে ওঠে।
ক্রমে পালক ঝরছে, পাতা ঝরছে, শিশির ঝরছে…
কতিপয় মানুষ পাখির শরীরে প্লাস্টিকের পালক লাগিয়ে দিয়ে যায়
পৃথিবীতে আবার ঝড় আসে
আর প্রতিটি ঝড়ের শেষে ভোর বেলা দেখি
ধর্মবিদ্যালয়ের আলখাল্লা পরা সেই ছাত্রদের মত পাখিগুলো আমার উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে I .
৪ .
ফ্লাক্সের মধ্যে তরল চা-বাগান লুকিয়ে রেখেছিলাম
এখন আফিমের গন্ধ পাচ্ছি; পান করছি পরমায়ু…
.বারান্দার মাথায় রঙিন কাচের স্কাইলাইট
ছায়াচিত্রটি ক্রমে মুছে যায়
টবে-ঝোলানো বারান্দা স্থায়ী হয়ে যায় ধূসর দেয়ালে দেয়ালে
ঘরের মধ্যভাগ ছিদ্র করে এক বাটি আলো স্থির পড়ে থাকে মেঝেতে।
বেতের চেয়ারে তুমি বসে আছো, স্বর্গ পলাতক
বাদামি চুলে যেনো পুরনো এক ফটোগ্রাফের পূর্ণিমা, পরিষ্কার হাওয়ার কোলাহল…
আর আমি হতে চাই সেইজন
যে তোমার অভিনয় আর গলার স্বরের ওপারে যেতে পারে।
.৫ .
সবুজ-সন্ত্রাসের অধিকার অপন করেছো
নিজের মতো করে
নিজের ভেতরে…
রক্তের পাশে ঝলসানো হৃৎপিণ্ড
এলোমেলো চাঁদের মাংস আর
আগুন-লাগা রক্তজবার যৌবন বাড়িয়ে দিয়েছো বহুবর্ষ।
.কে তুমি মহাকাল, ১৯১৭…
বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে চাওয়া নিম্মচাপ আজ বড়ই প্রবল…
কেনো এক বসন্তদিনে শুনেছিলাম, রাজপুত্র আসবে ঘোড়া-টানা-গাড়িতে করে…
সেই রাজপুত্র কোনোদিন আসেনি
প্রিয় রাক্ষস এসেছে, যার জন্ম হয়েছে আমার করোটী থেকে
.
৬ .
স্বপ্নেরও হাত আছে, চোখ আছে, ঠোঁট আছে…
দু’বছর আগের সেই শিউলি-ফোটা ভোরেরও অবয়ব ছিল
আজ গোপন পাঁজর খুলে দেখলাম
আমার জীবনের সেই একটা মাত্র ভোরের মুখখানা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে…
.আমি সঙ্গপনে ঠাকুর মা’র পিতলের কৌটা থেকে শরৎকাল বের করে নিয়ে আসি
স্বর্গের শিশির দিয়ে ধুয়ে দেই ভোরের দুইচোখ, মথুরা বৃন্দাবনের ঘুমসমগ্র।
.
৭ .
আজ এই পূর্ণিমার রাতে
পূর্বপুরুষের নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে গলিত কফিনের ভেতর
কাগজের পরতে নড়ে উঠছে জিরাফের মাথা, গোপন রক্তপ্রবাহ
প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা সাদা কাগজের মুখ মিলিয়ে যাচ্ছে গহীন কুয়াশায়।
.
স্থির দাঁড়িয়ে থাকি
গ্রহণ করি কুয়াশার কামড়…
.
একসময় সূর্য উঠে
কষ্টিপাথরের গন্ধ ফেটে পড়ে গর্ভবতী মায়ের জঠরে
জবাই-হওয়া শব্দের গলা বেয়ে সাদা রক্ত ঝরছে তো ঝরছে…
অবশিষ্ট তারা ফাঁসির জন্য ছটফট করে।
.শব্দের ফাঁসি দেবো বলে
কাগজ কলমের বদলে বিস্মৃতির মেহেকানন্দা নদী নিয়ে আসি
শব্দের বদলে ঝুলে পড়ে ঈশ্বরের গলা।
.
৮.
আমার ডায়রিতে একটুও জায়গা নেই
ব্লেড দিয়ে কাটা-রাত আর নার্ভ থেকে ঝরা-রক্ত চারদিকে।
কিছু রক্ত আবার পুড়ছে। কাটা-মাংস হতে শূকরের আর্তচিৎকার ভাসমান…
ছিলে-তোলা চাঁদের খোসা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে…
.
ডায়রিতে আছে হরিণের মাথা, কাক ও পেন্সিল, আমার প্রেমিকের কলিজা ও পাতিহাড়
মৃত ঈশ্বরের কবর ও চিতা পাশাপাশি
.আজ একপাল মৃত পাখি উড়ে এসেছে ব্যাবিলন থেকে, আরও একবার আত্মাহুতি দেবে বলে।
.আমি ডায়রির ভেতর লুকিয়ে পড়েছি
ছায়া ও শব্দের ছাইদানীর ভেতর ছাই হচ্ছি, ছাই।
.
৯.
আমি জেগে থাকি
কাটা-হাতখানা অন্য-হাতে নিয়ে সারারাত জাগি
অনন্ত ভোরের দিকে হাতের গহীনে জ্বলে ওঠে হাতের চিতা
.
হাড়-গলা গরম ঘন হয়ে এলে কেবল শীত শীত লাগে… ঘুম লাগে
.
এইসব মুনিরা ঘুমের ঘোরে কোথাও কোনো জানালা নেই; সই সই নয় দরজার বাতাস…
.১০.
ছায়া ছায়া, অন্ধকারে ডুবে হাওয়া, মুখ দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই
ছায়ার ভেতর মিশে যাওয়া দু’টি আবছা ছায়ামূর্তি
একই রকম অথচ কত আলাদা
একটি শরীর নিষ্ক্রিয়, নির্দোষ, নিস্পৃহা আর চরম উদাসীনতা নিয়ে চলছে মাটির ওপর…
আর
অন্যটি সামান্য ঝুঁকে, আবর্জনা আর ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টায় হাঁপাচ্ছে…
.
মাঝে-মধ্যে থেমে থেমে নি:শ্বাস নেয়ার চেষ্টা
তারপর আবার আরো ঝুঁকে টেনে টেনে চলে তার বোঝাখানি
হতচকিত হয়ে দেখতে পেলো কী সামান্য পথই না পের হয়েছে!
.ছায়া ডুবে গেলে
ঘরের ভেতরে ঘর আর চোখের ভেতরে চোখ ঘুমিয়ে পড়ে
হয়তো জোনাকী পোকার ভেতর পৃথিবীর অবশিষ্ট আলো জেগে আছে!
.
১১.
পাতার পরত বেয়ে বেয়ে ঝরে-পড়া ঝর্ণার আওয়াজ
হাড় হতে হাড়ের ভেতরে…
গাছের বুক হতে পাখিদের বুক বেয়ে ধাবমান, বৃষ্টির বিলাপ।
বিক্ষুদ্ধ
বাতাসের গান…
.
বাতাসের হাত-পা-আঙুল আমাদের কাঁচের জানালায় ডুবে ডুবে যায়
গ্রীষ্মের এই গহীন সন্ধ্যায়
.
অগ্নিকালো আকাশের নিচে দীর্ঘ দাঁড়াই
আমি আর আমার ছোটবোন আত্নহত্যা
.এখন কি পরিস্কার হলো তোমাদের আয়নার কুয়াশার আবরণ!
.
১২.
চোখ জোড়া যেনো ঘুমের মধ্যে গলে যায়…
উঁচু উঁচু বিশাল ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে নৌকা চালাই
নৌকায় আমার মৃত ঠাকুরমা আর মহাশূন্যের একটি পিঙ্কি বিড়াল
'
চোখবিহীন ঘুমের সর্বত্র শুধু ঘুম
কপালের দু’পাশে সাগরের ঢেউয়ের মতই নাড়ি টিপটিপ করে
মনে হয় দুই খন্ড ভাবনার সমুদ্র
.
এরপর কি হলো?
না, এর আগে কি হয়েছিলো?
অবশ্য আগে-পরে বলে কিছু নেই
যাত্রা সবসময়ই বর্তমানের
নৌকা, মৃত ঠাকুরমা আর পিঙ্কি সবকিছুই বর্তমান মুহূর্তের অস্তিত্বশীল
সবকিছুই স্থিরীকৃত
স্থির আবার চলমান
ঘুমের বিপুল ননীর মধ্যে সবকিছু দোলে…
.
মুখে চোখ নেই, চোখের তারা নেই
আছে কেবল সর্বব্যাপী ঘুম
দুই চোখের পাতা জুড়ে ঘুমের প্রপাত I
হেমন্তে রচিত হেমলক
১ মহাকালের ছবি দেয়ালে টাঙিয়ে ছিলাম সেই কবেকার ঘোরগ্রস্ত ভোরে, সেলাই করে করে... সেইসব ছায়া-চেহারাগুলো এখন ঝাপসা হয়ে গেছে... ছাদের উপর বৃষ্টির আঙুলগুলো ফেটে পড়ছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে না কি কান্নায়- ঠিক বুঝতে পারি না... কৈশোরে কাগজের নৌকা ভাসিয়েছিলাম পুকুরে... ভেবেছিলাম- নৌকাগুলো বড় হবে একদিন, দেখা হবে মেহেকসমুদ্রে...
আমার পাখিরা আর উড়াল দিলো না... দূর অতীতে পাখিদের ডানা কেটে দিয়েছিলাম পাখিদের ডানা রেখে দিয়েছিলাম ছোটবেলার অ্যালবামে...
২ এখন নৈঃশব্দের শব্দরা ঘুমিয়ে পড়েছে... চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে... মরুভূমিতে একা একা টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছি বালির নৌকো
দূরতম জানালার পাশে দেখি- চিরচেনা কারো ছায়া ভেসে ভেসে ডুবে যায় আয়নাগুলো গলে গলে যায়...
চক্ষু খুলে দেখি- কোথাও চক্ষু নেই, ছায়া নেই, বিম্ব-প্রতিবিম্ব নেই শূন্য কুঠরিতে পড়ে আছে মৃত সব মুনিরামায়া আমার অগ্নিমায়া...
৩ নরকের নীল আগুনের চারপাশে লেলিহান জিহ্বাগুলো উড়ছে উড়ন্ত জিহ্বায় গেঁথে যাচ্ছে আর্তনাদের ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি আমি যাই নি কোথাও আমার পাণ্ডুলিপি থেকে সবগুলো লেখা চলে গেছে
হাতখানি যে রক্তে ডুবে আছে... কী করে লিখি কথা ও মুনিরাকথা, নদী ও মেহেকানন্দার জল তবু- স্ফটিকের পাখি প্রত্নকলম তুলে দিচ্ছে হাতে
আমায় ক্ষমা করো পাখি, পাখির পালক, আমায় ক্ষমা করো নদী, নদীর দুইপাড় আমায় ক্ষমা করো ক্ষমা করো ক্ষমা করো ক্ষমা করো ক্ষমা করো রক্তকরবী আমি যে পাথর কুচি...
৪ ভেবে নাও তুমি- মঙ্গলরূপ কিছুটা পুড়ে গেছে পুড়ে-যাওয়া জলের ছোবলে ভোর বেলার আলোয় কোনো কমলা-রঙ নেই, ছাই-রঙা বালিকার গুড়া গুড়া শরীর ব্যতিরেকে ভাঙ্গা মন্দিরের পাশে আমাদের ভাঙ্গা-শঙ্খের আওয়াজ ভাঙছে তো ভাঙছে সখা হে, মমি হয়ে শুয়ে আছি অগ্নিঝর্ণার নিচে
আর জাগবো না আর জাগবো না
কেনো জাগাতে চাও তবে কেনো জাগাতে চাও ঘুমিয়ে-পড়া মৌমাছির ঝর্ণা
এই মমি আবার কি মানবী হবে মথুরা বৃন্দাবনে।
আয়না হতে পিছলে পড়েছে মুখগুলো
আজ তোমার মুখের গভীরে দেখি ভেঙে-যাওয়া সেই আয়নার দাগ।
বিবর্ণ থৈ থৈ
বিধবার শাদা চোখের মতো চারদিক…
হে দিন, হে রাত্রি, হে বসন্ত, হেমন্ত মৌসুম
হে প্রজাপতির ডানা, পাখির পালক, হে বৃন্দাবনের সিঁদুর
কোথাও কোনো রঙ নেই
আমাদের মেহদীবাগান কালো কুয়াশার নিচে ঢাকা পড়ে আছে।
শুনেছি পাথরে মেহদীপাতা ঘষলে রঙের হলাহল বের হয়ে আসে
আমি আজ হৃৎপিণ্ডকে পাথর বানিয়ে নিয়েছি।
আজ এই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ ফেটে গিয়ে
নীল-বর্ণ আলো ঝরছে
নরক প্রদেশে।
নরকের নয় দরজা খুলে বসে আছি আমি আর একটা অন্ধ হরিণী…
দু’চোখ ছিদ্র করে
গলিত চোখের রঙে চন্দ্রের পিঠে এঁকে দিয়েছি গাছের ছবি
এই গাছ স্বর্গের গাছ
এক একটা শিশু মৃত্যুর পর সেই গাছে একটা করে ফুল ফোটে
ওহ ঈশ্বর
সময় হলে কি তুমি দেখে যাবে
সেই গাছে অনেক অনেক ফুল ফুটেছে
তুমি কি একবারও শুঁকে যাবে না হাসনাহেনা অথবা মুনিরাহেনার গন্ধ!
১.
তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল নয় বছর আগে
এই নয় বছরে নয়-দরজার-নদী তৈরি করেছি
তুমি কি একবার সময় করে আসবে
জলের জানালাগুলো লাগিয়ে দিয়ে যাবে!
২.
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ছিপছিপে এক মাতামুহুরী নদী
নদী পেরিয়ে যাচ্ছে সময়
হাতের নীলবর্ণ রেখায় এ-কার ছায়া দেখা যায়!
ছাদের উপর বৃষ্টির গুঞ্জন থামছে না কিছুতেই
তানপুরার হৃৎপিণ্ডে আঙুল ফেটে গেলে বুঝতে পারি না
এ-কান্না উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের নাকি মাতামুহুরীর
ঘরের জানালা কিছুতেই বন্ধ হয় না
আমাদের জানালায় আটকে রয়েছে নদীর দরজা।
৩.
চাঁদের শরীর থেকে বের হচ্ছে ধূয়া ও শিশির
দুই হাজার বছর আগেকার রাত ছাই হবে দুই হাজার সতের সালে
দু’চোখের অন্ধ ছায়া উড়ে যাচ্ছে অন্ধকারে
পাখিরা নৌকা চালায় বাতাসের নদে
নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে ধীরে
গাছের
মানুষের…
ফাটা-নিঃশ্বাসে তুমি কি একবারও আত্নহত্যা করতে আসবে না!
৪.
বিষ পান করছি নাকি বিষের নিঃশ্বাস নিচ্ছি
পান করছি পরমায়ু
প্রজাপতির ডানা লাগিয়ে দিয়েছি
ধীরে চলো
ধীরে চলো
নিমাই সন্ন্যাসীর গ্রাম যে বহু দূর
ঐ দূরত্বে
নিভে যাচ্ছে অতলান্ত এক আত্মার ছায়া…
৫.
কে যেন আমার কন্ঠস্বর থেকে
নিদ্রাতুর কিছু শব্দ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায় নিধুয়া পাথারে
অতঃপর কাচের করাত দিয়ে শব্দগুলো কুচি কুচি করে ভাসিয়ে দেয়
আড়িয়াল খাঁ’র বুকে
ভাসে গলাকাটা নদী
ভাসে নারী
ভাসে গলাকাটা নক্ষত্র
শকুনের ডানায় চিৎকার ভাসে জল ও স্থলভূমে…
মৃত্যুর গন্ধ চৌদিকে
দূরে যাই
দূরে যাই
পৃথিবীর কোনো এক রান্নাঘরে আলু-পটল কাটতে ভুলে যাই
আমি আমাকে কেটে ফেলতে ভুল করি না
ওহ পাখি, পরমাত্মা…
সবুজ-সন্ত্রাসের অধিকার আপন করেছো
নিজের মতো করে
নিজের ভেতরে...
রক্তের পাশে ঝলসানো হৃৎপিণ্ড
এলোমেলো চাঁদের মাংস আর
আগুন-লাগা রক্তজবার যৌবন বাড়িয়ে দিয়েছো বহুবর্ষ।
কে তুমি মহাকাল, ২০১৭...
বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে-যাওয়া নিম্নচাপ আজ বড়োই প্রবল...
কেনো এক বসন্তদিনে শুনেছিলাম, রাজপুত্র আসবে ঘোড়া-টানা-গাড়িতে করে...
সেই রাজপুত্র কোনোদিন আসে নি
প্রিয় রাক্ষস এসেছে, যার জন্ম হয়েছে আমার করোটী থেকে
দিনান্তে
এ-যে কবিতা এক, চম্পাবতী নদীতীরে কেশর উড়িয়ে দেওয়া
বোবার না-বলা কথাগুলো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা, তারপর
পাখিদের ঠোঁটে তুলে দেওয়া…
হায়!
.
শব্দ বদল হতে হতে পাখির সঙ্গে পাখা বদল করে কবিতা…
.
নদীতীরে বটগাছের গর্তে কাঁচা-পাকা সময় বেড়ে উঠছে ধীরে
দুলছে শীর্ণ তরুলতা, সাপের বাচ্চা
.
দিনান্তে পাখি উড়ে যায়
নদীতীরে পড়ে থাকে মানুষের পালক। দিনান্তে
এ-যে কবিতা এক, চম্পাবতী নদীতীরে কেশর উড়িয়ে দেওয়া
বোবার না-বলা কথাগুলো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা, তারপর
পাখিদের ঠোঁটে তুলে দেওয়া…
হায়!
.
শব্দ বদল হতে হতে পাখির সঙ্গে পাখা বদল করে কবিতা…
.
নদীতীরে বটগাছের গর্তে কাঁচা-পাকা সময় বেড়ে উঠছে ধীরে
দুলছে শীর্ণ তরুলতা, সাপের বাচ্চা
.
দিনান্তে পাখি উড়ে যায়
নদীতীরে পড়ে থাকে মানুষের পালক।
এক.
আত্মহারা আমি— বেঁচে থাকবো নাকি মরে যাব
কে ডাকছে আমায়! তুমি না স্বয়ং ঈশ্বর!
পিয়ানোবাদক মঞ্চে এসে বসলেন। একটু কায়দা করে কাশলেন। এরপর একমুহূর্তের জন্য ধ্যানমগ্ন হলেন। ঘর আলো করা উজ্জ্বল ঝাড়বাতিটি একসময় ম্লান হয়ে একটা নরম আলোয় এসে থামে। আর স্তব্ধতার মধ্য থেকে জেগে ওঠে একটি সুরধ্বনি, ক্রমে যা সংযত ও পরিমিত বিস্তারের সঙ্গে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে।
‘মোৎসার্ট কি?’ ভাবি। যথারীতি প্রোগ্রামটা চাইতে ভুলে গেছি। ‘মোৎসার্ট বোধহয়, নাকি স্কারলাট্টি?" গানের ব্যাপার এত কম জানি! অবশ্য এমন নয় যে, গান বুঝি না বা ভালোবাসি না। শৈশবে পিয়ানো শেখার আবদার তো আমি-ই করেছিলাম। যে বছর শিখতে শুরু করেছিলাম সে বছরই ছেড়ে দিলাম। ছেড়ে দেবার কারণটি যেমন সোজা, তেমনি লজ্জারও।
কিছুতেই স্বরগ্রামের ‘মা’ ধ্বনিটি শিখে উঠতে পারিনি। কিছুতেই না। বুঝি না ‘মা’ এর পর কেন আর কিছুই মনে থাকে না। এই দেখে মা এর কী রাগ! না জানি কতটা কষ্ট পেয়েছেন! মেয়েটা অপদার্থ! তাই অপদার্থ হিসেবে দেখাই তার সহজ মনে হয়েছিল।
আমি আর কষ্ট করতে পারি না। কোনো লাভ নেই। থাকগে ও নিজের মতো পড়াশোনা না করলে নাই করুক। ওর যদি ভূতের গল্প শুনতেই ভালো লাগে, তাই সই। ষোলো বছরেও যদি পুতুল খেলতে চায়, খেলুক ও পুতুল নিয়ে।
না হলো পুতুল খেলা, না হলো পড়াশোনা। মূর্খ হওয়ার কী আনন্দ!
দুই.
আজ আমার কোনো কর্ম নেই
মেহেকানন্দা নদীতীরে কেবলই রোপণ করছি বৃষ্টি ও কৃষ্ণদাগ...
হঠাৎ শরীরটা কোনো একটা বিন্দুতে আটকে গেলে সে পেছন ফিরে তার পা দুটো ধরে দাঁত কামড়ে শক্ত মাটির ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে ঢালু জমিন ধরে চলতে লাগলো। টেনে নেয়া শরীরের মাথাখানি এদিক-ওদিক দুলছিল, যেন সে অবস্থান পাল্টানোর জন্য আনন্দ প্রকাশ করছে। হঠাৎ বাঁক নেয়া একখানা গাড়ির আলোর ঝলক আবর্জনা, ঝোপ আর আসমান ভূমির ওপর পড়ে চারপাশ উজালা করে তুললো। লোকটি তখন চট করে শুয়ে পড়ে অপরজনের পাশে। এক মুহূর্তের জন্য দুটো মুখের বৈশিষ্ট্য যেন আঁকা হয়ে রইলো, একটি ভয়ে নীলবর্ণ, অপরটি ধুলোয় ভরা, অনুভূতিহীন। আবার অন্ধকার গ্রাস করে নেয় দুজনকে। লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে আরও কিছুদূর টেনে নিয়ে গেল বোঝা, পথ রোধ করে দাঁড়ানো উঁচু ঝোপগুলো পর্যন্ত। তারপর আবর্জনা আর শুকনো ডালপাতা দিয়ে ঢেকে দিলো। যেন সে ভাগাড়ের দুর্গন্ধ আর আসন্ন বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে চাইছে। অতঃপর একটু থেমে কপালের ঘাম মুছে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে শব্দ করে থুথু ফেলে। এমন সময় শিশুর কান্নার শব্দে সে চমকে ওঠে। আবর্জনার মধ্য থেকে উঠে আসা ক্ষীণ চাপা কান্না, যেন তার নিচে চাপা পড়া মানুষটিই শিশুর রূপ ধরে কেঁদে উঠে অভিযোগ জানাচ্ছে।
সে পালাতে গিয়েও থেমে যায়। বিজলি চমকানোর আলোয় অন্ধকারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো পুলের লোহার মাস্তুল; আর সে হতচকিত হয়ে দেখতে পেল, কী সামান্য পথই না পার হয়েছে। পরাজয়ের গ্লানিতে তার মাথা নত হয়ে আসে। সে হাঁটু গেড়ে বসে গন্ধ শুঁকে শুঁকে সেই একঘেয়ে ক্ষীণ কান্নার উৎসের দিকে এগিয়ে চলে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক দলা শাদা বস্তু। হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে সে কিছুক্ষণ। তারপর চলে যাবার জন্য ইতস্তত কয়েক পা এগিয়েও বেশিদূর যেতে পারলো না। কান্নার শব্দ তাকে পেছনে টেনে ধরে রাখলো। সে একটু একটু করে আবার ফিরে এলো, ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকলো তার। আরেকবার হাঁটু গেড়ে বসলো সে, তখনো দ্বিধান্বিত। তারপর দু`হাত বাড়িয়ে দিলো। সেই শাদা পিণ্ডের মোড়কটি নড়েচড়ে ওঠে। সেখানে ছোট্ট এক মানবশিশু কতগুলো খবরের কাগজের পাতার মধ্যে যুদ্ধ করছে। লোকটি তাকে কোলে তুলে নেয়। তার ভাবভঙ্গি অনিশ্চিত, অনেকটা যেন প্রবৃত্তি তাড়িতের মতো, যেন সে কী করছে নিজেই জানে না, অথচ না করেও পারছে না। সে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। যেন তার এই আচমকা অপ্রত্যাশিত কোমল ভাবাবেগের জন্য নিজের ওপর বিরক্ত সে; তারপর নিজের অজ্ঞাতেই গায়ের জ্যাকেট খুলে সেই জলে ভেজা কান্নারত শিশুটির গায়ে জড়িয়ে দেয় এবং হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিয়ে অনেকটা দৌড়োনোর ভঙ্গিতে সে ওই কান্নাকে সঙ্গে নিয়ে ভাগাড় থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
অস্তিত্ব বিলীন হলো
অন্য কোনো সঙ্গ বা অনুষঙ্গে নয়
আমরা এক সঙ্গেই মারা যাব...
তিন.
কৃষ্ণদাগ ঘন হচ্ছে
খা খা করছে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া দুটি আবছা ছায়ামূর্তি
মুখ দেখা যাচ্ছিল তো দেখা যাচ্ছিল না...
একই রকম অথচ কত আলাদা
একটি শরীর নিষ্ক্রিয়, নির্দোষ, নিস্পৃহা আর চরম উদাসীনতা নিয়ে চলছে মাটির ওপর দিয়ে...
অন্যটি সামান্য ঝুঁকে তাকে আবর্জনা আর ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে চলার কষ্টে হাঁপাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে থেমে দম নেবার চেষ্টা
তারপর আরো ঝুঁকে টেনে চলে বোঝাখানি।
হাজামজা নালার পচা জলের গন্ধে চারদিক ক্রমে আরো দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে ভাগাড়ের মরচে ধরা জঞ্জাল আর মৃত প্রাণীর গলিত মাংসের বদবুতে, বাজে আবহাওয়ার দিনের মতো এই পচা থিকথিকে গন্ধই যেন ঝেড়ে ফেলতে চাইছে থেকে থেকে মুখ মোছার ভঙ্গি করে। ঘন ঝোপের গায়ে জড়াজড়ি করে পড়ে থাকা রুপালি ইস্পাত কিংবা কাঁচের টুকরোর ঘষা লেগে উদ্ভুত একঘেয়ে ভুতুড়ে সংগীত দুজনের কারোরই কানে যাবার কথা নয়। মাটির নিচ থেকে ভেসে ওঠা নগরের চাপা গুঞ্জনের শব্দও নয়। এমনকি যাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই নরম শরীরের সঙ্গে মাটি, ঝরাপাতা, কাগজের টুকরো, ছেঁড়া জুতো, দোমড়ানো টিনের প্যাটরা ও নুড়ি পাথরের ঘষটানোর শব্দও নয়। মাঝে মাঝে কোনো উঁচু পাথর কিংবা গাছের ডালে তার কাঁধ ঠেকে যাচ্ছিল। সে এখন গা ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছিলো, মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল ক্রুদ্ধ আওয়াজ, অনেকটা বিশাল বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া মুটেদের মুখ নিঃসৃত বায়বীয় ‘হাঁ’ ধ্বনির মতো। বোঝাখানি নির্ঘাৎ ভারি উঠছিল ক্রমশ। তবে শুধু নীরব প্রতিরোধই নয়, যতশীঘ্রি সম্ভৱ কার্যোদ্ধারের তাড়াতে সমস্ত শক্তি যে ক্ষয়ে যাচ্ছে সেটাও ভীত করে তুলছিল।
প্রথমে সে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলছিল। রাত্রি এতটা মেঘে ঢাকা না থাকলে কারোও চোখে পড়তো কোনো উদ্ধারকার্যের ওল্টানো নেগেটিভের মতো দু`জোড়া হাতের যুগল বন্দি। কৃষ্ণদাগ ঘন হচ্ছে করুণ কান্না ও কীর্তনের সুর...
আজ কোনো কর্ম নেই
মেহেকানন্দা নদীতীরে কেবলই রোপণ করছি বৃষ্টি ও কৃষ্ণদাগ…
ছায়াচিত্র
১.
দূর শৈশবে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে
কাচের টুকরো কুড়িয়ে পেয়েছিলাম
কাচের ভেতরে নিজের চেহারা লুকিয়ে রেখেছিলাম।
নিজের চেহারা লুকিয়ে রেখেছিলাম বাবা-মা, ঠাকুর মা, চন্দ্র-সূর্য্য হতে বহুদূর
দূরতম কোনো গ্রহের গভীরে...
তিরিশটি বছর ঘুমঘোরে ছিলাম
ঘুম-ভেঙ্গে দেখি-
আমি সেই কাচের টুকরো হারিয়ে ফেলেছি
আমি আপন চেহারা হারিয়ে ফেলেছি।
২.
ফ্লাক্সের মধ্যে তরল চা-বাগান লুকিয়ে রেখেছিলাম
এখন আফিমের গন্ধ পাচ্ছি; পান করছি পরমায়ু...
বারান্দার মাথায় রঙিন কাচের স্কাইলাইট
ছায়াচিত্রটি ক্রমে মুছে যায়
টবে-ঝোলানো বারান্দা স্থায়ী হয়ে যায় ধূসর দেয়ালে দেয়ালে
ঘরের মধ্যভাগ ছিদ্র করে এক বাটি আলো স্থির পড়ে থাকে মেঝেতে।
বেতের চেয়ারে তুমি বসে আছো, স্বর্গ পলাতক
বাদামি চুলে যেনো পুরনো এক ফটোগ্রাফের পূর্ণিমা, পরিষ্কার হাওয়ার কোলাহল...
আর আমি হতে চাই সেইজন
যে তোমার অভিনয় আর গলার স্বরের ওপারে যেতে পারে।
কীর্তন
১
মুনিরায়ানা কীর্তনীয়া সুরে
বাজে বাঁশি, করুণ বাঁশের বাঁশি, বাজে হাড়ের বাঁশি...
আয় তবে হাড় ভেঙ্গে ফেলি, নদীর দুই পাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়।
.
বাঁশির রসে এমন পূর্নিমাসুন্দরী ভাসে
ঘৃতকুমারীর বনে
.
সখা হে
আয়, মাঝ দরিয়ায় ভাঙ্গা তক্তা ও আমাদের কলিজার নৌকা ডুবিয়ে ফেলি
চিরতরে
চিরতরে।
‘
অহ সুর!
মুনিরায়ানা কীর্তনীয়া সুরে
মৃত্যু ও প্রেম একাকী দাঁড়িয়ে রয়
পৃথিবীর অনন্ত ভোরে।
২
নয়নে আনন্দ-বিষাদ, মরা নদীর জল...
ওহে মধুমূর্তি
নয়নের গভীরে বসো একবার
বসো কাঙ্গালের সভায়
.
আসিবে, আশায় হৃদি-পদ্মাসন পাতিয়া রাখিয়াছি
ধোয়াবো চরণ নয়নের জলে...এমন তো নয়
.
মুনিরাকথা
ঈশ্বর হও
তুমি কবি হও
পৃথিবীর যত গান, এইসব কবিতাবলী
গীত হোক, গীত হোক মৃতের সন্মানে…
মুনিরাকথা
বৃষ্টির সাথে কোনো এক নাইওরি এসেছিলো মেঘে-ঢাকা গ্রামের ঐপার থেকে
ভেজা চুলের বন্ধন খুলে বসেছিলো
আমার বারান্দায়...
উপরের দিকে তাকিয়ে বললো
সিন্দু মা, আকাশের গর্তগুলো ঝরে পড়ছে কেনো, খসে পড়ছে কেন নরম নাভীগুলো
আমি তবে কোথায় গিয়ে থাকবো!
তারপর সে নিমিষে নাই হয়ে যায়
দিন যায়
বছর যায়
নাইওরি আর আসে না...
আর আমার বুকের বারান্দায়
চিরদিনের জন্য লেগে থাকে নাইওরির গন্ধ, মৃত্যুর মতো...
২.
আয়না হতে পিছলে পড়েছে মুখগুলো
আজ তোমার মুখের গভীরে দেখি ভেঙে যাওয়া সেই আয়নার দাগ।
বিবর্ণ থৈ থৈ
বিধবার শাদা থানের মতো চারদিক...
হে দিন, হে রাত্রি, হে বসন্ত, হেমন্ত মৌসুম
হে প্রজাপতির ডানা, পাখির পালক, হে বৃন্দাবনের সিঁদুর
কোথাও কোনো রঙ নেই
আমাদের মেহদীবাগান কালো কুয়াশার নীচে ঢাকা পড়ে আছে-
শুনেছি পাথরে মেহদীপাতা ঘষলে রঙের হলাহল বের হয়ে আসে
আমি আজ হৃৎপিণ্ডকে পাথর বানিয়ে নিয়েছি।
৩.
কালো জ্বরে মৃত্যু হবে না হে পুত্র!
আমার মৃত্যু হবে বেঁচে থাকাতে…
নাইওরি
বৃষ্টির সাথে কোনো এক নাইওরি এসেছিল মেঘে-ঢাকা গ্রামের ঐ পাড় থেকে
ভেজাচুলের বন্ধন খুলে বসেছিল
আমার বারান্দায়…
উপরের দিকে তাকিয়ে বললো
সিন্ধু মা, আকাশের গর্তগুলো ঝরে পরছে কেন, খসে পড়ছে কেন নরম নাভীগুলো
আমি তবে কোথায় গিয়ে থাকবো!
তারপর সে নিমিষে নাই হয়ে যায়
দিন যায়
বছর যায়
নাইওরি আর আসে না…
আর আমার বুকের বারান্দায়
চিরদিনের জন্য লেগে থাকে নাইওরির গন্ধ, মৃত্যুর মতো…
পাখি-পল্লি
এবার সত্যি সত্যি বিদ্যুৎ চমকায়
খাঁচা থেকে পাখিগুলো বেরিয়ে আসে
বিদ্যুতের ছিদ্রে পাখিগুলো ঘুমিয়ে পড়ে আবার জেগে ওঠে।
ক্রমে পালক ঝরছে, পাতা ঝরছে, শিশির ঝরছে…
কতিপয় মানুষ পাখিদের শরীরে প্লাস্টিকের পালক লাগিয়ে দিয়ে যায়
পৃথিবীতে আবার ঝড় আসে
আর প্রতিটি ঝড়ের শেষে ভোর বেলা দেখি
ধর্ম বিদ্যালয়ের আলখাল্লা পরা সেই ছাত্রদের মতো
পাখিগুলো আমার উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ভবানীপুরের কবিতা
রক্তের ভেতর একটা নদী থেকে আরও একটা নদী
বিস্মৃতির ভবানীপুরে বৃষ্টি দিচ্ছে…
বৃষ্টি দিচ্ছে
বৃষ্টি দিচ্ছে
চোখ-ফাটা বৃষ্টির কান্না কোলে নিয়ে বসে আছি
আমার সিতানের বালিশের টুকরোগুলো এলোমেলো
ঘুম আসে…
ঘুম দাঁড়াতে পারে না কোথাও
ঘুম দৌড়াতে পারে না কোথাও
ঘুম বসতে পারে না কোথাও
ঘুম ঘুমুতে পারে না কোথাও
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে এলোমেলো আয়নার মুখ
মেহেকানন্দা কাব্য
১.
পুরনো বইয়ের পাতা উল্টে চোখে পড়লো
মমি হয়ে আছে কয়েকটা মাছি ও অচিন বৃক্ষের পাতা...
মমি হয়ে আছে পাতার স্পন্দন আর মাছির উড়াল
সাঁতার কাটি
নয়'শ বছরের পুরনো সমুদ্রে একা...
এ-কোন বিস্মৃতির জল কেবল ফেটে ফেটে যায়
এ-কোন কাহিনী গাঁথা- শবযাত্রী, সানাই আর ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ
স্বর্গের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
চুম্বন শেষে কেন তারা ঠোঁটগুলো ছুঁড়ে দিলো নরকের দিকে!
দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসে
দু'চোখে জন্ম নেয় অজস্র রক্তের ডালপালা...
মেহেকানন্দা নদীতীরে অহ ঈশ্বর
কোনো এক কুয়াশাভোরে তুমি কি রক্তডুমুরের ডালগুলো কেটে দেবে!
২.
কে যেন রাস্তার পাশে মলিন চাঁদটাকে রেখে গেছে
চাঁদের গায়ে হোচট খেলাম
শুধু পা নয়, সমস্থ "আমি" ভেঙ্গে গেলে চাঁদের শরীর থেকে চাঁদনী ও আগুন বের হয়...
জন্ম হয় দাউ দাউ চিতার...
মহাআনন্দে পুড়তে থাকি পৃথিবীর প্রথম মানুষ
ওহে শ্রীমতি. ঠাকুর মা আমার
আমিও চিতা জ্বালানোর কৌশল শিখে গেছি।
৩.
আয়না হতে পিছলে পড়েছে মুখগুলো
আজ তোমার মুখের গভীরে দেখি ভেঙ্গে-যাওয়া সেই আয়নার দাগ।
বিবর্ণ থৈ থৈ
বিধবার শাদা থানের মতো চারদিক...
হে দিন, হে রাত্রি, হে বসন্ত, হেমন্ত মৌসুম
হে প্রজাপতির ডানা, পাখির পালক, হে বৃন্দাবনের সিঁদুর
কোথাও কোনো রঙ নেই
আমাদের মেহদীবাগান কালো কুয়াশার নীচে ঢাকা পড়ে আছে।
শুনেছি পাথরে মেহদীপাতা ঘষলে রঙের হলাহল বের হয়ে আসে
আমি আজ হৃৎপিণ্ডকে পাথর বানিয়ে নিয়েছি।
৪.
আজ এই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ ফেটে গিয়ে
নীল-বর্ণ আলো ঝরছে
নরক প্রদেশে।
নরকের নয় দরজা খুলে বসে আছি আমি আর একটা অন্ধ হরিণী...
দু'চোখ ছিদ্র করে
গলিত চোখের রঙে চন্দ্রের পিঠে এঁকে দিয়েছি গাছের ছবি
এই গাছ স্বর্গের গাছ
এক একটা শিশু মৃত্যুর পর সেই গাছে একটা করে ফুল ফোটে
ওহ ইশ্বর
সময় হলে কি তুমি দেখে যাবে
সেই গাছে অনেক অনেক ফুল ফুটেছে
তুমি কি একবারও শুঁকে যাবে না হাস্নাহেনা অথবা মুনিরাহেনার গন্ধ!
৫.
চাঁদের শরীর থেকে বের হচ্ছে ধূয়া ও শিশির
দুই হাজার বছর আগেকার রাত ছাই হবে দুই হাজার পনেরো সালে
দু'চোখের অন্ধ ছায়া উড়ে যাচ্ছে অন্ধকারে
পাখিরা নৌকা চালায় বাতাসের নদে
নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে ধীরে গাছের, মানুষের
ফাটা-নিঃশ্বাসে তুমি কি একবারও আত্মহত্যা করতে আসবে না!
৬.
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ছিপছিপে এক মাতামুহুরী নদী
নদী পেরিয়ে যাচ্ছে সময়
হাতের নীলবর্ণ রেখায় এ-কার ছায়া দেখা যায়!
ছাদের উপর বৃষ্টির গুঞ্জণ থামছে না কিছুতেই
তানপুরার হৃৎপিণ্ডে আঙুল ফেটে গেলে বুজতে পারি না
এ-কান্না উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে নাকি মাতামুহুরীর
ঘরের জানালা কিছুতেই বন্ধ হয় না
আমাদের জানালায় আটকে রয়েছে নদীর দরজা।
বাসব রায় : মলয়ের জায়গা
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আত্মীয়-পরিজনের বাইরে আমি যাঁর নাম প্রথম শুনেছি, তিনি, মলয় রায়চৌধুরী। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ নন, মলয় রায়চৌধুরী। আমি যখন বড় হচ্ছি, ওই ১৯৬৬ থেকে, চারপাশে শুধু একজনের কথাই চর্চিত, তিনি, মলয় রায়চৌধুরী। ১৯৬৪ সালে মলয় নেমে আসছেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সিঁড়ি দিয়ে, একা। আর ধীরে ধীরে তিনি চর্চায় চলে আসছেন কলকাতা সন্নিহিত অঞ্চলের। তখন বেহালা, যেখানে আমার ছোটবেলা কেটেছে, কলকাতার মধ্যে ছিল না। বেহালার সাবর্ণপাড়ার দ্বাদশ মন্দিরের চাতালে কিংবা শখেরবাজার মোড়ের আড্ডায় শুধুই মলয়।
তো আমি মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে বড় হয়েছি বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হয় না। ইস্কুলে যাই, সেখানে শিক্ষকরা আলোচনা করেন মলয়কে নিয়ে ; ঘরে ফিরি, দাদা-কাকারা আলোচনা করেন মলয়কে নিয়ে ; একটু সন্ধ্যায় পাড়ার কালভার্টেও আলোচনার একটাই বিষয় - মলয়।
মলয়-বাসুদেব-ফাল্গুনী-শৈলেশ্বর-সুবো-সুবিমল-দেবী-অবনী-প্রদীপ প্রমুখ তখন আমাদের ঘরের ছেলে। তাঁদের লেখা যেখান থেকে হোক সংগ্রহ করে পড়ছেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। এই আবহে আমি বড় হয়েছি। আর তাই মূলধারার সাহিত্যের প্রতি কখনো আগ্রহ বোধ করিনি। ১৪-১৫ বছরের মধ্যেই আমি পড়ে নিয়েছি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বা ‘চর্মরোগ’। এবং সেখান থেকেই এই প্রতীতী সম্ভবত জন্মে যায় যে সাহিত্য বলতে এসবই, বাস্তবতা-জীবন-অন্ত্যজ-প্রান্তিক স্বর ছাড়া সাহিত্য হয় না।
এর বেশ কিছু পড়ে যখন আনন্দবাজারীয় লেখালিখি পড়তে গেছি, হাসি পেয়েছে। বাজারি আনন্দের প্রকাশিত সাহিত্য ওই সুখী মধ্যবিত্তের জন্য। সেখানে একটা কৃত্রিম ভাষা, নাটকীয় কিছু শব্দের সমাহার। সেখানে জীবন, অন্তত আমি, কখনো খুঁজে পাইনি। অথচ শিক্ষিত বাঙালি ওইসব পড়েই নিজেকে এলেমদার, পণ্ডিত মনে করেছে, করে।
আর ঠিক এখানেই মলয় ধাক্কা মারেন। বাংলা গদ্যের রীতি ঠিক কী হবে তা সম্ভবত ঠিক হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যে লিখলে ওই জোব্বা পরা বুড়োর মতোই লিখতে হবে। এবং এরপর যাঁরা লিখতে এসেছেন, যেমন শরৎ-তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতি-শরদিন্দু থেকে হালের সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশরা, কেউ ওই গদ্যের বাইরে যেতে পারেননি। বিষয় যাঁর যেমনই হোক, গদ্যের রীতি বা ভাষার আঙ্গিক ও প্রকরণ সেই রাবিন্দ্রিক। এবং বাজার বা বাংলা সাহিত্যের কলকাত্তাইয়া প্রতিষ্ঠান এই গদ্যকেই প্রমোট করেছে। পাঠকও খুশি থেকেছেন এই গদ্য পড়ে। এর বাইরে না লেখক না পাঠক কেউই ভাবতে পারেননি।
মলয় রায়চৌধুরী ঠিক এই জায়গাটাকেই ধাক্কা দিয়েছিলেন। তাঁর বহুচর্চিত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ থেকে হালের ‘ছোটলোকের ছেলেবেলা’ লেখাতেও ওই ধাক্কা স্পষ্ট। লেখালিখিতে বাস্তবতা-জীবন যেমন মলয় রায়চৌধুরী প্রথম বাংলা সাহিত্যে এনেছেন, ঠিক তেমনই গদ্যের ভাঙচুর তাঁর লেখাতেই আমরা প্রথম দেখতে পেয়েছি। আর এজন্যই প্রতিষ্ঠান তাঁকে ব্রাত্য করে রেখেছিল, হয়তো-বা এখনও করেই রেখেছে।
মলয়ের প্রথম প্রকাশিত বই সম্ভবত ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’। সেখানে মলয় কী লিখেছেন তা এখানে আলোচ্য নয়। বলার কথা হল, মলয় হাফ লিটারেট সাহিত্যিক নন, পড়াশোনা করেই লিখতে এসেছিলেন। আর সেজন্য মলয়ের লেখালিখি যতটা না আবেগের তার চেয়ে অনেক বেশি মেধাজারিত। কোনো এক সাক্ষাৎকারে মলয় জানিয়েছেন যে বৈদ্যুতিক ছুতার লিখতে লেগেছিল তিন মাস। কেন? না, প্রতিটি শব্দ অনেক চিন্তা করে বসাতে হয়েছে।
তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম
এই লাইন মলয়কে লিখতে হয়েছে, বাংলাভাষাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। আর কে না জানে ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সে-ই ভাষাকে বাঁচায়।’ মিথ্যে না বলতে কী, রক্তরস কমে যাওয়া বাংলাভাষাকে ওই মলয় রায়চৌধুরীই প্রথম আক্রমণ করেন। তাঁর সেই শক্তি ছিল বলেই প্রতিষ্ঠান তাঁকে উঠোনে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। বরং মলয়দের শক্তি পাঠক-সহ-প্রতিষ্ঠানকে গ্রাস করে নিতে পারে ভেবেই তাঁরা সম্মিলিত আক্রমণের সামনে পড়েন। যার ফলশ্রুতি কিছু বই নিষিদ্ধ, মামলা, মলয় দোষী সাব্যস্ত এবং তারপর ১৯৬৭ সালে মামলায় জয়।
এর ফলে মলয়ের কী হয়েছে সে বিচার অন্যরা করবেন, বাংলাভাষার যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেল তা অনস্বীকার্য। কেননা মলয় তো বটেই, ইদানীং অজিত রায়-রবীন্দ্র গুহ-রণবীর পুরকায়স্থরা তুলে আনছেন যে নিচুতলার সংস্কৃতি, জীবনযাপনের শৈলী, আচার-আচরণ, ক্রোধ-আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা... অসম্ভব দরকারি ছিল বাংলা সাহিত্যে। এগুলো বাদ দিয়ে সাহিত্য যেন একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে। মলয় রায়চৌধুরী প্রথম এই ভাবনা এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যে। কী? না, নিজেকে সাংস্কৃতিক জারজ ঘোষণা করে সরাসরি বলেছিলেন, অন্ত্যজ-প্রান্তিক স্বর উঠে আসা উচিত সাহিত্যে। এবং তা হবে সরাসরি। সেখানে কোনো ফাঁকি থাকবে না। আর তাই, মলয় রায়চৌধুরীর, ঠিক এই জায়গায় কাল্ট ফিগারের সম্মান প্রাপ্য।
মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, ভবিষ্যতেও লিখবেন, মলয় হলেন বাংলা সাহিত্যের জায়মান কিংবদন্তি, যাঁকে আনগ্ন শুষে নিলেও শেষ হয় না। কবি-প্রাবন্ধিক-উপন্যাসকার যেভাবেই তাঁকে অভিহিত করা হোক না কেন, কোনোটাই মলয় সম্পর্কে শেষ কথা নয়।
আর তাই একটা লেখায় সমগ্র মলয় রায়চৌধুরীকে ধরা আমি তো আমি, শিবের বাপেরও অসাধ্য কাজ! আর তাই আমি অন্য দু-একটি কথা বলি।
মলয়ের উদ্যোগে হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সকলে একে অচ্ছু্ৎ ঘোষণা করেছিলেন। আজ হাংরি আন্দোলনকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী আন্দোলনের মর্যাদা পাচ্ছে। আর তাই বিখ্যাতরা যেভাবেই হোক হাংরির ঝোল নিজের কোলে টানতে ব্যস্ত।
শৈলেশ্বর ঘোষ হাংরি-মামলার পর মুচলেকা দিয়েছিলেন, সবাই জানেন। পরে তিনিই হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে কলার তুলে হাঁটতে শুরু করেন, আমি দেখেছি।
আপাত-ঋষি শঙ্খ ঘোষ এমনভাবে এতদিন লেখালিখি করেছেন যে হাংরি শব্দটাই শোনেননি বা শুনলে তাঁর হার্টফেল হবে। তো তিনি সম্প্রতি একটি হাংরি সংকলনে নিজের কবিতা রেখে যার-পর-নেই আহ্লাদিত। সৌজন্য শৈলেশ্বর ঘোষ।
সাহিত্যিক-সততায় মলয় রায়চৌধুরীর পক্ষে আদালতে কথা বলে অনেকটা আলো পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তো তিনিই আমাকে রেকর্ডেড ইন্টারভিউতে বললেন ২০০৬ সালে যে ‘হাংরি আন্দোলনের জন্য মলয় ঠিক আমার আমেরিকা-বাসের সময়টাই বেছে নিয়েছিল।’ তো তাতে কী হল? সুনীল, ‘আমি থাকলে ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই আমার হাতে থাকত।’ এখান থেকে বোঝা যায়, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যেভাবেই হোক নাম জড়ানোর কী আকুল প্রচেষ্টা সুনীলের! ছো...
আর এই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই কৃত্তিবাস-এ মলয়ের কবিতা ছাপাননি। সাহিত্যিক সততা আর কাকে বলে!
যে কোনো আন্দোলনের একটা প্রকরণ আছে। আছে একটা স্ফুলিঙ্গ। আন্দোলনকে যত দমিয়ে রাখা হয় ততই আন্দোলনের অন্তঃশক্তি বাড়ে। আর সেটা হাংরি মুভমেন্টের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। আজও যখন কেউ ‘ছোটলোক’-এর সংস্কৃতি তুলে আনেন কবিতায়-গদ্যে, আমরা বলি বাঃ তুই তো হাংরিদের মতো লিখছিস।
এবং সত্তরের অরুণেশ, আটের অজিত রায়, নয়ের রাজা সরকার, শূন্য দশকের বিকাশ সরকার, প্রথম দশকের তিস্তা রায়, কিংবা বেশ আগের রবীন্দ্র গুহ, নবারুণ ভট্টাচার্য (যদিও কৃত্রিম ভাষা), দেবীপ্রসাদ সিংহ, সমরজিৎ সিংহ (গদ্য), আফসার আহমেদ, দুলাল ঘোষ, অলোক গোস্বামী, এমনকি স্বপ্নময় চক্রবর্তীও ; হালের কান্তারভূষণ নন্দী, মৃণাল দেবনাথ, ধীরাজ চক্রবর্তীরাও জেনে বা না-জেনে সেই হাংরিদের লিগ্যাসি হয়ে উঠেছেন। এঁরা ভেঙে ফেলেছেন মূলধারার বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় ফর্ম, তাঁদের লেখায় উঠে আসছে অন্ত্যজ জীবনযাপন, প্রেম-ক্রোধ-দুঃখ-আনন্দের কথা। এখানেই মলয় রায়চৌধুরী অমর হয়ে যান।
১. ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমিতাভ ঘোষাল - ‘গদ্য-পদ্য সংবাদ’ পত্রিকায় ১৯৮৬ অক্টোবরে প্রকাশিত :-
সুমিতাভ : ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ কতোটা ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না । আমি তখন কৃত্তিবাস নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা করতুম । কৃত্তিবাসের থেকে কয়েকজন এই আন্দোলন শুরু করে । এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা প্রথমে নিয়েছিল মলয় রায়চৌধুরী, সে ছিল আমার বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর ছোটো ভাই । সমীর রায়চৌধুরী কৃত্তিবাসের একজন লেখক এবং ওই গোষ্ঠীরই একজন । মলয়েরও কিছু কিছু লেখা কৃত্তিবাসে বেরিয়েছিল ।
সুমিতাভ : আচ্ছা শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো... ( কথায় বাধা দিয়ে )
সুনীল : হ্যাঁ, তারপরে মলয় প্রথমে শুরু করার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাতে যোগ দেয় এবং পরে উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আসেন । এইভাবে হাংরি আন্দোলন শুরু হয় । কিন্তু এই আন্দোলনের কোনো ইস্তাহার বা কোনো ব্যাপারে আমার কোনো নাম ছিল না বা আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না ।
২ ( Snehasis Roy : “হাংরির উত্থান ১৯৬২ সাল, মলয় ১৯৬১ সালের যে গল্প ফেঁদেছেন নকল ইস্তেহার বানিয়ে সেন্টুর তোরঙ্গ থেকে নাকি উদ্ধার হয়েছে পরে, এ-সব আসলে গাঁজাখুরি গল্প।
মলয়ের কবিতা তো হয়ই না, গদ্য, অনুবাদ ও কিছু ভালো প্রবন্ধ লিখেছেন, সমস্যা হল, সুভাষ ও শৈলেশ্বরের ভূত লোকটার পিছু ছাড়ে না। শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লিখছেন বা অন্য কোনো কবিকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ অবান্তরভাবে শৈলেশ্বর, সুভাষকে দায়ি করছেন তাঁর জেল হওয়ার জন্য।(মলয় বোঝাতে চান, ইস্, তোমরা শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষের লেখা পড়ো, এদের জন্য আমিহাংরিস্রষ্টা, আমার জেল হয়েছে!
সাহিত্যের জন্য জেল হয়েছে এমন আসামীর লেখা পড়ো তোমরা, মুচলেকা দানকারীদের লেখা কেন পড়বে! আমি বীর, সারা পাড়ার সামনে কোমরে দড়ি দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গেছে, ভ্যাঁ...........এসব বলে পাঠকের সিমপ্যাথি আদায় করার চেষ্টা)
ভাবটা এমন জেল যেন তাঁর একারই হয়েছিল, অথচ হাংরি সংক্রান্ত লেখালেখির কারণে প্রথম জেলে হয় শৈলেশ্বরের, পরে সুভাষেরও। লোকটা এমন চুতিয়া অরুণেশকে দু-রকম হাতের লেখায় চিঠি লেখে, সুভাষ ঘোষকেও তাই, সুভাষকে চিঠিতে জানায় আমার যারা সমালোচনা করে তাঁদের দেখে নেব। সেসব চিঠি সব আছে আমাদের কাছে। সময় ও জায়গা মতো প্রকাশিতও হবে।
মলয়ের 'আমি' 'আমি' করার পাশাপাশি বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত হাংরি জেনারেশন আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তাঁদের মুখপত্র ছিল 'ক্ষুধার্ত' পত্রিকা। মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম তিনটি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং পরের চারটি সংখ্যা শৈলেশ্বর ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।”
৩. ( উপরোক্ত Snehasis Roy : “হাংরির উত্থান ১৯৬২ সাল, মলয় ১৯৬১ সালের যে গল্প ফেঁদেছেন নকল ইস্তেহার বানিয়ে সেন্টুর তোরঙ্গ থেকে নাকি উদ্ধার হয়েছে পরে, এ-সব আসলে গাঁজাখুরি গল্প।
মলয়ের কবিতা তো হয়ই না, গদ্য, অনুবাদ ও কিছু ভালো প্রবন্ধ লিখেছেন, সমস্যা হল, সুভাষ ও শৈলেশ্বরের ভূত লোকটার পিছু ছাড়ে না। শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লিখছেন বা অন্য কোনো কবিকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ অবান্তরভাবে শৈলেশ্বর, সুভাষকে দায়ি করছেন তাঁর জেল হওয়ার জন্য।(মলয় বোঝাতে চান, ইস্, তোমরা শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষের লেখা পড়ো, এদের জন্য আমিহাংরিস্রষ্টা, আমার জেল হয়েছে!
সাহিত্যের জন্য জেল হয়েছে এমন আসামীর লেখা পড়ো তোমরা, মুচলেকা দানকারীদের লেখা কেন পড়বে! আমি বীর, সারা পাড়ার সামনে কোমরে দড়ি দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গেছে, ভ্যাঁ...........এসব বলে পাঠকের সিমপ্যাথি আদায় করার চেষ্টা)
ভাবটা এমন জেল যেন তাঁর একারই হয়েছিল, অথচ হাংরি সংক্রান্ত লেখালেখির কারণে প্রথম জেলে হয় শৈলেশ্বরের, পরে সুভাষেরও। লোকটা এমন চুতিয়া অরুণেশকে দু-রকম হাতের লেখায় চিঠি লেখে, সুভাষ ঘোষকেও তাই, সুভাষকে চিঠিতে জানায় আমার যারা সমালোচনা করে তাঁদের দেখে নেব। সেসব চিঠি সব আছে আমাদের কাছে। সময় ও জায়গা মতো প্রকাশিতও হবে।
মলয়ের 'আমি' 'আমি' করার পাশাপাশি বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত হাংরি জেনারেশন আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তাঁদের মুখপত্র ছিল 'ক্ষুধার্ত' পত্রিকা। মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম তিনটি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং পরের চারটি সংখ্যা শৈলেশ্বর ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। “)
৪. ( উপরোক্ত Snehasis Roy - “শৈলেশ্বরকে লেখা অরুণেশের প্রায় ৮০টির মতো দীর্ঘ চিঠি( INLAND LETTER CARD) উদ্ধার হল।
'সৃষ্টিক্ষমতাহীন কুকুরের দল এই ঘেউঘেউ চিরদিনই করে এসেছে'র পাশাপাশি অরুণেশ চাইছেন 'আত্মমগ্ন গর্ভবতীর মতো নিজেকে নিয়ে থাকতে'।
তাঁর সঙ্গে মিলারের লেখালিখির হাস্যকর তুলনা প্রসঙ্গে অরুণেশের মনে পড়ে যাচ্ছে জীবনানন্দকে ইয়েটস্ এর অনুকারক এমনকি পাশাপাশি রেখে উভয়ের লাইন তুলে মেলানোর প্রাণপণ চেষ্টার কথা!
আর্থিক সংকট, বেশ্যা ও না-বেশ্যা অসংখ্য সংগমে তিনি কি না-প্রেমিক। না, এসবের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতার সঙ্গে সহবাস করতে চাইছেন।
দেশ, আনন্দবাজার, আজকাল প্রভৃতি বাজারি কাগজ সম্পর্কে একহাত নিতে ছাড়ছেন না এবং কৃষ্ণ ধর ও অমিতাভ দাশগুপ্তকে হিজড়ে লেখক বলতে রেয়াত করছেন না।
হাংরি জেনারেশন সাহিত্য, রাজনীতি, কলকাতার সাহিত্য, পাণ্ডুলিপি করে শৈলেশ্বরকে পাঠানো। 'রোবট'(সম্পাদক : জীবতোষ দাশ) নিয়ে ভয়াবহ আবেগ।নিজের কাগজ 'জিরাফ' নিয়ে চিন্তাভাবনা। বাবার অসুখ। চিকিৎসকদের 'মাগী' বলা, টাকাও ধ্বংস করে রোগীও মারে।
উত্তরবঙ্গের তৎকালীন অন্যান্য পত্রিকার রাজনীতি। এমনকি নাম নিয়ে রাজা সরকারের(সম্পাদক : কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প) ঈর্ষা ও কূটনীতি সত্ত্বেও তাঁকে শোধরানোর চেষ্টা। আরও কত কী কথা বলেছেন চিঠিতে শৈলেশ্বরকে।
এই চিঠিগুলো নিয়েই একটা সাংঘাতিক বই হয়ে যায়।
একটা সময়, দীর্ঘ কবিতাযাপন, জৈব আততি ও ঐতিহাসিক দলিল তো বটেই।
বোমাটা ফেলব নাকি!” ]
৫. : ( দুই ফরেনারের কথাবার্তা : বেলাল চৌধুরী ও চয়ন খায়রুল হাবিব
চঃ এটা মজার, কৃত্তিবাসের একটা প্রধান অংশই সুনীলকে না জানিয়ে হাংরি আন্দোলনে জোগ দিয়েছিল।শক্তি, সন্দীপনও চলে গিয়েছিল।কিন্তু ঐসব ঈস্তাহারত পড়া যায় না, এতই পচা।সুনীলকে ওরা জানায় নি কেন?
বঃ ইর্ষা, ভয়।সমির আবার সুনীলদার বন্ধু ছিল।“ধর্মে আছি, জিরাফে আছি” নিয়ে শক্তির তখন সাঙ্ঘাতিক অবস্থা, এক বসায় দশটা কবিতা লিখে ফেলছে। ও বুঝে গিয়েছিল সমির, মলয়দের হাতে লেখা নেই।ও বুঝেছিল যে হাংরিদের সাথে থাকলে ওর কবিতা ধ্বংশ হয়ে ্যাবে।খুব সম্ভবত সেই প্রথম শক্তি সুনীলদার কবিতার ক্ষমতাও বুঝতে পেরেছিল।ও আবার কৃত্তিবাস বলয়ে ফিরে আসে।টাইম ম্যগাজিন বিটদের কথা বলতে গিয়ে হাংরিদের সম্পর্কে বলেছিল।ঐটুকুই। লেখা কই?বোগাস।
চঃ যে সুনীলকে ওরা ওদের সাথে ডাকেনি , জ়েলে নেবার পর তাকেই অনুনয় করছে আদালতে গিয়ে ওদের কবিতার পক্ষ্যে সাফাই গাইতে!
বঃ মলয় ওটা করেছিল।সুনীলদাকে নিজে গিয়ে ও সাক্ষ্য দিতে বলেছিল।ওর জ়েল দন্ড ঠেকাতেই সুনীলদা ওর কবিতাকে উত্তির্ন না মনে করলেও বলেছিল “সার্থক কবিতা”।
চঃ শক্তি কি করেছিল?
বঃ সমির, মলয়দের এক বোনের সাথে প্রেম করেছিল।ওদের অনেকগুলো বোন ছিল।
চঃ নাম কি বোনটার?
বঃ শিলা।
চঃ শিলা রায় চৌধুরি!শক্তির প্রেমিকা!হো হো হো. )
৬. : ( সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : মলয় রায়চৌধুরী খুব অদ্ভূত মানুষ। তিনি আমাকে উৎসর্গ করে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি পোষ্ট দিয়ে বললেন, ‘দুলাল, তোমার সাথে আমার ছবি নেই কেনো’?
তাঁর সাথে জীবনে কোনো দিন দেখা হয়নি। তিনি থাকেন বোম্বে আর আমি টরন্টোতে। ছবি থাকবে কি ভাবে? মলয় দা’র সাথে দেখা-সাক্ষাৎকার না হলেও তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২০১৪ সালে, আমার ‘সাতদিন’ ওয়েব পত্রিকার জন্য। )
৭. ( সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : ভালো লাগা কবিতা : মলয় দা, মলয় রায়চৌধুরী এক অদ্ভূত মানুষ। ৮২ বয়সেও ২৮ বছরের তরুণ কবিদের মতো তারুণ্য লালন করেন। আমি তাঁর এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তার জবাবে আরো তা টের পেয়েছি। তাঁর সাথে আমার দেখা হয়। বাংলাদেশে কবিদের দৌঁড় কলিকাতা পর্যন্ত। আমার মতো সাধারণ কবির পক্ষে কি স্বর্গীয় দিল্লি যাওয়া তো কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমার কবিতায় মলয় দা ঢুকে গেছেন, আবার মলয় দা আমাকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন, ফেইসবুক লাইভে আমার কবিতা পাঠ করেছেন।
কি সব অদ্ভূত কাণ্ডই না করেন মলয় দা। গুণ দা'র মতো তাঁর পাগলামির শেষ নাই। শাশুড়িকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেন। প্রেমিকাকে বলনে- ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’। আমি বলেছিলাম, মাথা নাকি নুনু? তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন, তাতেও টাশকি খেয়েছি। ‘১৯৬০-এর দশকের হাংরি আন্দোলন হাংরিয়ালিজম— তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক ১৯৬০-এর দশক থেকেই ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্যে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন।
সম্প্রতি তাঁর একটি কবিতা পড়ে থ মেরে যাই। সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং দেশ বিভাগ নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতার অসাধারণ মর্মান্তিক এবং ভায়াবহ চিত্রকল্প চমকে দেয়! ফাঁসিতে ঝুলন্ত লাশ ঝুলতে ঝুলতে এক বার পাকিস্তান আবার হিন্দুস্থানের দিকে ঝুলছে!
বিশ্বজিত সেন : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা
বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা ভাবাভাবি করেন, তাঁদের কিছু মজার প্রবণতা আছে। তাঁরা কবিতাকে গদ্য থেকে একেবারে আলাদা করে দেখেন, ও সেই দেখা চিরস্হায়ি করতে নানাবিধ সাংস্কৃতিক প্রপেরও আয়োজন রয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেরই নাম--- কবিপ্রণাম । রবীন্দ্রনাথকে মূলত দেখা হয় কবি হিসাবে। গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ তেমন গুরুত্বপূর্ণ লোক নন। আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলব, গল্পলেখক রবীন্দ্রনাথই আমার কাছে সর্বাধিক গ্রাহ্য । যদিও রবীন্দ্রনাথের গল্প লেখার দর্শন আমার কাছে একেবারেই গ্রহণীয় নয়, তবু 'কবি' রবীন্দ্রনাথের চেয়ে, এই লোকটি আমার চোখে ঢের বাস্তব।
কবিতাকে আলাদা করে দেখা, তাকে সুউচ্চ বেদিতে বসিয়ে রাখা, অহরহ গুজগুজ-ফিসফিস, আরে আজও যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে বাংলা সাহিত্যে ও মধ্যবিত্ত জনজীবনে । এ নিয়ে চিন্তা করেছি, আজও মাঝে-মাঝে করি। এ ভাবনার উৎস কোথায়?কিছুটা কি "ভারতীয় অতীত"- এর ব্যাপার রয়েছে এর মধ্যে। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত--- সবই কবিতায় । কবিকে রহস্যময় মানুষ মনে করা হত, যিনি নিজের চিন্তা-ভাবনাকে ছন্দবদ্ধ করতে সক্ষম। মনে করা হত স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর কাছে বার্তা পাঠিয়ে থাকেন। ভগবানের স্পেশাল মেসেঞ্জার তিনি, 'নট টু বি টেকন লাইটলি'। তার বহু পরে, 'ভক্তি' যুগে ভারতীয় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবিকে সাধক বানিয়ে কুলুঙ্গিতে লাল শালু মুড়ে রেখে দেওয়া হল।কবীর, দাদু, নানক, সুরদাস, রহিম, জয়দেব, চণ্ডীদাস । তুলসীদাসকে 'গোঁসাই' বানিয়ে তাঁরও একই হাল করা হল।'রামচরিতমানস'কে ধর্মগ্রন্হ মনে করে গদগদ আপামর হিন্দিভাষী জনসাধারণ। তার দোহায় দোহায় শব্দের যে অদ্ভুত খেলা, ভাষাকে কাদার মতো ব্যবহার করে তা থেকে বিচিত্র নানা মূর্তি গড়ে তোলা, সেদিকে দুচারজন ক্রিটিক ছাড়া কারো নজরই যায়নি প্রায়। হিন্দি সাহিত্য ঐশ্বরিক বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে কবে একাজে হাত দেবে জানি না । আজকে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, এ-কাজ করার সময় এসে গেছে ।
ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চল কিন্তু কবিকে অনেক সহজভাবে নিয়েছিল। কথক ও কবিয়াল ছিলেন, কবিগান ছিল। যাত্রার, পালার আসর ছিল, চণ্ডীতলা ছিল। অবশ্যই কবিকে স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ লোক মনে করা হত; তবে সাউক বা অবতার, বা ভগবান নয় । কবির লড়াইতে তো কবিতা তৈরি হত সর্বসমক্ষে, মুখে-মুখে। আর হারজিতও ছিল। কাজেই রহস্যের সেখানে কোনো ভূমিকাই ছিল না । কবি স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ বলে তাঁদের আদর-আপ্যায়নও হত, তবে তাঁকে একটি বেদিতে বসিয়ে তাঁর মুখের ওপর স্পটলাইট জ্বেলে রাখা ? নাঃ ! ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে তা করা হত না।
ইংরাজরা আসার পর বাংলা সাহিত্যে কবিতার রহস্যের আমদানি হয় । নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে ইংরাজদের কিছু ছিল না। যাকে তারা নিজের সংস্কৃতি বলত, তার খুঁটিগুলো সবই ছিল গ্রিস, রোম থেকে ধার করা। গ্রিসে 'বার্ড' বা ভ্রাম্যমান কবিদের নিয়ে রহস্য গড়ার অভ্যাস প্রচলিত ছিল। ভক্তি যুগের আদলেই প্রায় বলা যায়, তাঁদের 'ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা', ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী, ইত্যাদি মনে করা
হত। হোমারের স্হান গ্রিক মানসে প্রায় ঋষির জায়গাতেই ছিল, দাড়ি-টাড়ি সমেত। শেকসপিয়রও আরও কয়েকশো বছর আগে জন্মালে ঐ জায়গাতেই পৌঁছে যেতেন। আমাদের সৌভাগ্য, তিনি পরে জন্মানোর দরুন বিশ্বসাহিত্য একটি নিদারুণ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল।রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, সাহিত্যিক জীবনের পরবর্তীপর্বে, কবিতার বিশেষত্বের জায়গা থেকে অনেকটা সরে এসেছিলেন। যাকে সাহিত্যের বিশেষজ্ঞরা 'গদ্য কবিতা' বলেন, তা তাঁর এই বোধের সাক্ষ্য দেয়। তাঁর কিছু গদ্য কবিতা গল্পকেন্দ্রিক। সাহিত্যকর্ম ইশাবে অনেক উঁচু দরের কাজ সেগুলো। মোদ্দা ব্যাপার হল, আজ পাড়াব-পাড়ায় 'কবি প্রণাম' সত্ত্বেও সাহিত্যের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির মাঝখানের দেওয়াল ধ্বসিয়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তাঁকে বাঙালি এত বেশি 'কবি' বানিয়ে ফেলেছিল যে হাত খুলে এই কাজটি করা সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। তবে কাজের মধ্য দিয়ে ঠারে-ঠারে যতটা পেরেছেন, করেছেন। বিশেষ করে ছবি আঁকার মাধ্যমে।
কবিতাকে বা কবিকর্মকে ঘিরে একটা রহস্য সৃষ্টি করে রাখলে কবিতা কখনই সামাজিক পরিস্হিতির দলিল হয়ে উঠতে পারে না। কবিতার মিস্টিসিজমের প্রথম অসুবিধে এটা। কবিতা যদি সামাজিক পরিস্হিতির দলিল না হয়, তবে তাকে ড্রইংরুম সাজানোর ডলপুতুল বা অশ্রুমোছার রুমাল হয়ে থাকতে হয় কেবল।সেটা অবশ্য অনেকেরই মনঃপূত, বিশেষ করে যাঁরা 'সমাজ-টমাজ'কে দশ হাত দূরে রাখতে চান। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যেও লড়াই আছে, পক্ষ-প্রতিপক্ষ আছে। একটি পক্ষের বিশেষ দর্শন এটাই। কবিতার গায়ে গরম হাওয়ার ঝাপটা যেন না লাগে।
কবিতার মিস্টিসিজমের দ্বিতীয় অসুবিধে ভাষার স্তরে। ভাষা তো একটি নদী বিশেষ। একূল-ওকূল দুকূলই সে ভাসায়। তাকে সিমিলি, মেটাফর, ছন্দবৃত্ত, মাত্রা, পয়ার ইত্যাদির গণ্ডীর মধ্যে সর্বদা বেঁধে রাখা যায় না। কবিতার নিয়মানুবর্তিতা থেকেই কবিতার মিস্টিসিজমের জন্ম। এই নিয়মানুবর্তিতার দরুনই, একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রয়োজন অনুভূত হয়, যে কবিতা 'লিখতে পারে'। যে 'পারে না', তাকে দূর করো, দাঁড় করিয়ে রাখো দরজার বাইরে। তার ভাষাটিও ব্রাত্য।
তাই, কবিতার স্বার্থেই, কবিতার রহস্যময়তাকে ভাঙা অত্যন্ত প্রয়োজন।
বাংলা সাহিত্যের সিরিয়াস পাঠক সম্প্রতি নড়ে-চড়ে বসেছেন। ষাটের দশকে, যে একটি তুমুল ওলোট-পালোট ঘটে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে--- সেদিকে নজর গেছে তাঁদের। দেরিতে হলেও, এটাই কাম্য ছিল।'হাংরি আন্দোলন' নিয়ে ইতিপূর্বে 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' গোছের কথাবার্তা হয়েছে। 'হাংরি আন্দোলনকারীদের' গভীর মননশীল পঠন-পাঠন ছিল, যাকে বলা যায় ওভারভিউ। হাংরির পরেও আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন এসেছে, তবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঝাঁকুনি হিসাবে হাংরিই ছিল "প্রথম"। বাংলা সাহিত্যের অবস্হা, হাংরি আন্দোলনের আগে ছিল অকালবৃদ্ধ আফিংখোরের মতো। রবীন্দ্র ঐতিহ্য পুঁটুলি বেঁধে কোলে নিয়ে বসে ঝিমোনো আর মাঝে-মাঝে চটকা ভেঙে, "অ্যাই, গোল কোরো না বলচি, পড়াশুনো করো, পড়াশুনো..."। অথচ দেশে-বিদেশে তখন ঘটছে যুগান্তকারী ঘটনা । 'গ্রানমা' জাহাজে চড়ে বিপ্লব করতে আসা কয়েকজন যুবক হঠাৎ জয়ী হয়েছেন। ওয়াশিংটন থেকে মাত্র নব্বই মাইল দূরে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহের পতাকা। ওদিকে ঠাসবুনোট সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্রমে ঠোঙা বানাবার কাগজ বই আর কিছু নয়। স্হিতাবস্হাকামী বাণিজ্যিক সংবাদপত্র গোষ্ঠীর প্রচণ্ড একমাত্রিক দাপট বাংলা সাহিত্যে। তার দোরগোড়ায় মাথা না ঠুকলে কেউ মানুষই হবে না, সাহিত্যিক হওয়া তো দূরে রইল।
এইরকম সময়ে বাংলা সাহিত্যের 'পীঠস্হান' কলকাতা থেকে দূরে, পাটনা শহরে, যেখানে ঐশ্লামিক ধর্মশাস্ত্র পড়তে গিয়েছিলেন রামমোহন রায়, আর বেশ কয়েক বছর চাকরি করে গেছেন দীনবন্ধু মিত্র, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটি অপরিচিত গরিব পরিবারের যুবক মলয় রায়চৌধুরী আই আন্দোলনটির ছক কষেন। দাদা সমীর রায়চৌধুরী কলকাতায় সিটি কলেজে পড়েন, সেই সুবাদে যুবা বাঙালি লেখক-কবিদের সাথে আলাপ-পরিচয় । দেশ-দুনিয়ে জুড়ে উথালপাথাল সত্ত্বেও কলকাতা, ব্রিটিশের প্রিয় 'কালকুত্তা' তখনও শীতল। বামপন্হী দলগুলোর বিরুদ্ধে গান্ধীবাবার কংগ্রেস প্রতিপালিত গোপাল পাঁঠা, ইনু মিত্তিরদের দাপাদাপি; কলকাতা শীতল। কবিতা ভবন (!) থেকে 'কবিতা' বেরোয় । বুদ্ধদেব বসুর পরিশীলিত আঙুল কবি বাছাই করে, ফতোয়া দেয়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই উপস্হিতি। এককালে...'না না অমন বলবেন না । সুকান্তও কবি। ছন্দ বোঝে। এই দেখুন আমি দেখাচ্ছি --- পতা/কায় পতা/কায় ফেরমিল/আনবে ফেব্রু/য়ারি। দেখলেন ?
অট্টহাসি উদ্রেক করা সেই সময়। সমীর রায়চৌধুরীর 'পাটনাই' হওয়ার দরুন কলকাতার যুবক কবিদের পাটনায় আনাগোনা। এঁদের মধ্যে অন্যতম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যাঁর বিষয়ে বাসব দাশগুপ্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মলয় বলেছেন, "শক্তির কবিতা সম্পূর্ণ নিজস্ব ও অসাধারণ। কেননা তিনি পাঁড় অশিক্ষিত, কোনো লেখাপড়া করেন না, এবং দর্শন, ইতিহাস, সমাজবোধ এসব ছিটেফোঁটা তাঁর মধ্যে নেই। নিজের খাঁটি বোধ থেকে তিনি লেখেন, তখন তাঁকে জীবনানন্দের পরের প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন মনে হয়।" মনে রাখা প্রয়োজন, এই সাক্ষাৎকারটি যখন দিচ্ছেন মলয়, তখনও হাংরি আন্দোলনের স্মৃতি, তজ্জনিত তিক্ততা, সব কিছু মলয়ের মস্তিষ্ককোষে উপস্হিত। কিছুই ক্ষমা করেননি। অথচ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে মলয়ের চোখা, টান-টান মূল্যায়ন। ব্যক্তিগত তিক্ততা সেখানে ছায়া ফেলেনি।
হাংরি আন্দোলনের পরিকল্পনাপর্বে এই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মলয় সঙ্গে পেয়েছিলেন, আর পেয়েছিলেন দেবী রায় ( হারাধন ধাড়া) কে। পাটনার সুবিমল বসাক এসে যোগ দেন কিছুকাল পরে।একটি সাহিত্য আন্দোলন, যা বাংলা সাহিত্যের হাল-হকিকত পালটে দিয়েছিল, কত সামান্যভাবে শুরু হয়েছিল, ভাবলে অবাক লাগে। প্রেস পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই মিষ্টির দোকানের বাকসো যে জব প্রেস ছাপতো, সেখানেই ছাপতে হয় হাংরি বুলেটিন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে মলয় তখন লোয়ার গ্রেড কেরানির চাকরিতে, কত মাইনে পেতেন জানা নেই, তবে প্রায় সম্পূণফ মাইনেটাই মনে হয় হাংরি বুলেটিনের পেছনে ঢালতে হত। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথম কাগজ বেরোনোর আরম্ভটা এইরকম। 'শতভিষা' পত্রিকার তুলনায় 'কৃত্তিবাস' ও নিজেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজই বলত, তবে হাংরি বুলেটিনের সাথে তার ছিল মৌলিক প্রভেদ। 'কৃত্তিবাস' ছিল সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্খীদের কাগজ। তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে সুরে সুর মিলিয়ে। প্রতিষ্ঠান কখন যশ, প্রতিপত্তি, বৈভব, টাকাকড়ি, সামাজিক সুবিধার কাজে লেগে যায়, বলা তো যায় না। হাংরি বুলেটিনের উদ্দেশ্যই ছিল যুদ্ধ। আপসের জন্যে সেখানে কোনও জায়গাজমি রাখা হয়নি।
অনেকের মতে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি গিমিকের আশ্রয় নিয়েছিলেন রাতারাতি খ্যাত হবার জন্য, যেমন শাদা দিস্তা কাকজ, জুতোর বাকসো ইত্যাদি রিভিউএর জন্য পাঠানো, টপলেস প্রদর্শনীর আয়োজন ( টপলেসের অর্থ যে মুন্ড বা মস্তিষ্কবিহীনও হয়, এই বোধটুকু কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের হয়নি), জীবজন্তু-জোকারের মুখোশ বিলি ইত্যাদি। 'হাংরি কিংবদন্তি'তে মলয় উদ্ধৃত করেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের যে মন্তব্য, তা এ-প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারে।কিন্তু মলয় বা তাঁর সঙ্গীরা কি জানতেন না যে প্রতিষ্ঠান ও প্রসাশন কতদূর হিংস্র হতে পারে? এ জানা সত্ত্বেও একজন চাকুরিজীবী ( মলয় ) নিজেকে এই ঝুঁকির সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন কেন ? শুধুই প্রচারের জন্য? না কি কিছু মূল্যবোধের ব্যাপারও ছিল ? মলয় তাঁর 'সাক্ষাৎকারমালা'র এক জায়গায় বলেছেন, 'ষাট দশকের সুস্হতা স্বাভাবিক ছিল না।' এই অস্বাভাবিক সুস্হতাকে ভালোমতো একটা ঝাঁকুনি দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। তার জন্য দুহাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি পরে চোর-ডাকাতের সঙ্গে সার বেঁধে পাটনা শহরের রাস্তায় অতিপরিচিতজনের মাঝে হাঁটা, চাকুরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, পঁয়ত্রিশ মাস প্রতি সপ্তাহে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো--- সবই। প্রচার পাওয়ার জন্য যদি এত করতে হয়, তাহলে তো মুশকিল। এর চেয়ে সহজ রাস্তা তো কতই ছিল। বিশেষত, 'কৃত্তিবাস' গোষ্ঠীতে তাঁর দাদার বন্ধুরাই যখন সর্বেসর্বা। সমসাময়িক অন্যান্যদের মতন একটু মিঠে ব্যবহার রাখলেই আর দেখতে হচ্ছিল না। আর, 'কৃত্তিবাস'ও তেমন-তেন বৈশিষ্টহীন ও লুপ্ত হবার পথে এগিয়েছে। সাহিত্য আন্দোলন সম্পর্কে 'কৃত্তিবাসীয়'দের সততার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে ?
( দ্রষ্টব্য: কবিতীর্থ, মাঘ ১৪১০)
বলা যেতে পারে যে 'কৃত্তিবাস' যদি সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে না টিকে থাকে তবে 'হাংরি বুলেটিন'ও তো টেকেনি। হ্যাঁ, হাংরি বুলেটিন উঠে গিয়েছিল মামলা-মকদ্দমার দরুন, অন্তর্কলহের দরুন। কিন্তু হাংরিদের ঝগড়াঝাঁটি ছিল খোলাখুলি, তাতে মধ্যবিত্তের চাপ-চাপ ঢাক-ঢাক ছিল না। মামলা-মকদ্দমার ভয়ে কেউ রাজসাক্ষী হয়েছিলেন ( সুভাষ ঘোষ,শৈলেশ্বর ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ ), কেউ ভেবড়ে গিয়ে কলকাতার বাইরে কেটে পড়েছিলেন ( প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য প্রমুখ )। সেগুলোকে দেখার কোনও অর্থ হয় না।'হাংরি বুলেটিন' বন্ধ হবার পর অগনণ পেশিবহুল বাহু এগিয়ে এসেছে আন্দোলনের পতাকা তুলে নিতে।জেব্রা, উন্মার্গ, ফুঃ, স্বকাল, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ওয়েস্ট পেপার, চিহ্ণ, প্রতিদ্বন্দী ইত্যাদি পত্রিকাও হাংরি বুলেটিনই। মলয় কোনোদিন বলেননি যে হাংরি আন্দোলনের কপিরাইট একমাত্র তাঁর। হ্যাঁ, আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও দার্শনিক প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর কিছু বক্তব্য থাকতেই পারে, যা তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পাঠকদের সামনে রেখেছেন।এই অধিকার থেকে তো আর তাঁকে বঞ্চিত করা যায় না। মলয়ের পরবর্তীকালীনরা হাংরি মতাদর্শকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন।এটিও একটি আন্দোলনের প্রাণশক্তির প্রমাণ। মলয়, হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর, পড়ালেখার নিজস্ব পৃথিবী গড়ে তুলেছেন, মন দিয়ে এবং চুটিয়ে বিভিন্ন শহরে চাকরি করেছেন, সংসার করেছেন, ভারতীয় জনজীবনকে দেখেছেন, জীবন থেকে শিখেছেন। আজ গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধের যে হতচকিত-করা ফসল তিনি আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তা সম্ভব হতে পেরেছে এরই দরুন। বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের গদি-আঁটা চেয়ারে বসে আঙুলে চাবির রিং ঘোরাননি মলয়। এর জন্য তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। অন্তত একটি আকাশ এমন রয়েছে, যাকে ঢেকে ফেলতে পারেনি কালো মেঘ।
মলয়কে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটির দরুন মামলায় পড়তে হয়। কবিতাটি বর্তমানে বহুল প্রচারিত, তাই তাকে আর সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই। তবে এই কবিতাটিকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এর পেছনে কোনো অসূয়া কাজ করছিল না, একটি কৌতুকপ্রদ মাইন্ডসেট-এর দিকে ইঙ্গিত করে। এই মাইন্ডসেটটি তদানীন্তন বুদ্ধিজীবী বাঙালির, যিনি পুজোর ছুটিতে সস্ত্রীক খাজোরাহো দেখতে যান। তাহলে মলয়ের কবিতা কেন গ্রহণীয় নয় ? মজা কেবল এই জায়গাটুকুতে নয়, অন্যত্রও আছে। "আমরা যখন অসভ্য ছিলুম তখন ওইগুলো বানিয়েছি। এখন আমরা সভ্য, এখন তো আর এসব চলতে দেওয়া যায় না ।" এও মানলাম, কিন্তু মাই ডিয়ার, ব্যাপারটা যে আদপে তা নয় একেবারেই। ব্যাপার আগাগোড়া অন্যরকম। যৌন রূপকল্প, দ্যোতক ও বিম্ব কেবল ব্যবহার করেছেন মলয়, সেগুলির মাধ্যমে নিজের কথা বলেছেন। এও চলবে না ? তাহলে শিবলিঙ্গ তুলে দিন, গৌরীপট্ট নাকচ করুন, অম্বুবাচী ব্যান করুন। কামাখ্যা মন্দিরে মা-কামাখ্যার মাসিক যেন আর না হয়। কি বলেন ? যাঁরা "অশ্লীল অশ্লীল" চিল্লিয়েছিলেন, তাঁরা সম্ভবত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-এর এই লাইনগুলো নজর করে দেখেননি--
১.
জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে কিছুকাল ঘুমোতে দাও শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
২.
হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না
তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহ্যতায়
সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
শিল্পর জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোবো
কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই...
৩.
এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
আমি মরে যাব...
৪.
৩০০০০০ লক্ষ শিশি উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
ঝাঁকেঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
হিপ্নটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি
এই পঙক্তিগুলো একটু মন দিয়ে পড়লে বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর পক্ষে বোঝা দুষ্কর ছিল না যে নিছক যৌনতা নয়, আরো গূঢ় কোনো বোধের দ্যোতনা এই পঙক্তিগুলোয় রয়েছে।'সাত বছর আগের একদিন' কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছিলেন, "অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয় আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত ক্লান্ত করে। লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই..."। এই পঙক্তিগুলোকে উদ্ধৃত করে জীবনানন্দকে শবসাধক সাব্যস্ত করা অবশ্যই উচিত হবে না, অথবা ঘোর অঘোরপন্হী। তেমনই হাস্যকর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ যৌনতার বহিঃপ্রকাশ খোঁজা। আসলে মলয়ের বিরুদ্ধে যখন ষাটের দশকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতার মকদ্দমা দায়ের করা হয়, তখন ষাটের দশকের 'অস্বাভাবিক সুস্হতা' রাজত্ব করছে পুরোদমে।'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে প্রবোধকুমার সান্যালের 'দেবতাত্মা হিমালয়' আর মেট্রো সিনেমার ফুটে রিফিউজি যুবতীদের শরীর নিয়ে চলছে অবাধ বাণিজ্য! পায়ের চটি ঘষটাচ্ছে রিফিউজি যুবক, 'মাই ওন সিসটার স্যার, ভেরি সুইট, ওনলি সিক্সটিন'। অথচ বাঙালি পাঠক 'কত অজানারে'র বারবেল সাহেব আর 'সখী সংবাদ' এর মিষ্টিদিদি, নতুন দিদি, এদের নিয়েই মুগ্ধ। সমাজ কোথাও নেই; সমাজের জ্ধবলাপোড়া, আর্তি, চিৎকার এগুলোও কোথাও নেই। বামপন্হীরা 'পরিচয়' পত্রিকা চালাচ্ছেন, তাতেও এন্ট্রি পারমিট নিয়ে ঢুকতে হয়। এইরকম এক সময়ে 'হাংরি বুলেটিন' এর দরকার ছিল, প্রয়োজন ছিল 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এর। মূল্যবোধ ভেঙে খানখান হওয়ার যে হরর, শিল্পপ্রতীক জোলো হয়ে যাওয়ার যে শক, তাকে যথার্থ ফুটিয়ে তুতে গেলে এই কবিতাই তো লিখতে হবে। মলয় তাই করেছিলেন।
অবশ্য বিপদ চেনার ব্যাপারে প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের সূক্ষ্মদৃষ্টির প্রশংসা করতেই হয়। কেই বা পড়ে তখন 'হাংরি বুলেটিন', কটা লোক ? পাটনার দুই যুবক, একজন হাওড়ার, একজন বিষ্ণুপুরের, একজন শান্তিনিকেতনের, এদের বুলেটিন বেরোয়। তার জন্যও আবার এই প্রেস, ওই প্রেসের হাতে-পায়ে ধরাধরি। তাহলে? এমন কী ক্ষমতাসম্পন্ন এরা, যে ক্ষেপে উঠল গোটা কলকাতার বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রশাসন ? মলয়ের বিরুদ্ধে কেবল মামলাই নয়, তাঁকে ও অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করে অপমান করা হল চরম, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন এই জাতীয় প্রবণতা মাথা তোলার হিম্মত না করে ।
বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন যে সমাজকে বুঝতেন না তা নয়, ভালোমতোই বুঝতেন। তাঁরাও জানতেন যে, যে-বদমায়েশি তাঁরা শিল্প, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতির সর্বত্র বিছিয়ে রেখেছেন, তা মানুষের জন্য নয় । তবে শ্রেণী স্বার্থে এর প্রয়োজন তাঁদের ছিল। যেমন ইংরেজরা, আই.সি.এস.কে লৌহ কাঠামো হিসাবে গড়ে তুলতে ছেয়েছিল, তেমনই উত্তর-স্বাধীনতা যুগের ভারতীয় পুঁজিবাদ, আমলাতন্ত্র ও তার মিডিয়া-খানসামাদের লক্ষ ছিল একটি জড়, নির্বোধ, সংবেদনহীন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে তোলা। তাদের রুচি, জীবনযাপন, মূল্যবোধ, সব কিছু হবে ছাঁচে ঢালা, সিনথেটিক। তারা হাসবে, কাঁদবে, গাইবে, সঙ্গম করবে একটি বিশিষ্ট কায়দায়। 'হাংরি প্রজন্ম'এর হুড়মুড় করে এসে পড়ায় এই গোটা গেমপ্ল্যানটি ধ্বসে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মলয় এবং অন্যান্যদের ওপর আক্রমণ সেই কারণেই।
প্রজাপতি-আঁকা বিয়ের কার্ডে হাংরি প্রজন্ম ধ্বনি তুলেছিল, "গাঙশালিক কাব্যস্কুলের জারজদের ধর্ষণ করো"। এই ধ্বনিটিতে অন্তর্নিহিত ছিল তদানীন্তন কাব্যধারার প্রতি বিবমিষা।
প্রকৃতি, নিসর্গ এই ব্যাপারগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো বাংলা কবিতার কলোনোয়াল রোগবিশেষ। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ ছিল একটা কমপালশান, যেমন লেখালিখি ছিল তাঁর কমপালশান। সেজন্য তাঁর লেখায় প্রকৃতি, নিসর্গ বিশেষভাবে উপস্হিত--- কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে। আঁকার সময়ে তিনি এগুলো বর্জন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে, বাংলা কাব্যধারায় এই ব্যাপারগুলো প্রয়োজনীয় অনুপান হয়ে ওঠে। এবং অনুপানেরও অধিক, অভ্যাস।জীবনানন্দ লেখেন 'রূপসী বাংলা'। তাতেও নিসর্গ ছিল; তবে সেই নিসর্গ, প্রকৃতির প্রতিটি কমপোনেন্ট আবহমানের বাঙালিজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেছিল।মানুষের সাথে সম্পর্কবিহীন ছিল না সেই নিসর্গ, সেই প্রকৃতি।সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "একদা আষাঢ়ে এসেছি এখানে, মিলের ধোঁয়ায় পড়ল মনে; কালবৈশাখী নামবে যে কবে আমাদের হাত-মেলানো গানে"। এখানে মানুষের সংগ্রামকে আঁকা হয়েছে প্রাকৃতিক ঘটনার রং-তুলিতে। কিন্তু বাংলা ভাষার সেইসব কবিরা (গাঙশালিক কাব্যস্কুল) সৃষ্টি করছিলেন মনুষ্যবিহীন নিসর্গ, মানুষকে মাইনাস-করা প্রকৃতি। এ ছিল একজাতীয় পলায়নবাদ। শংকরের 'কত অজানারে' যেমন বাঙালি যুবকের বেকারত্ব থেকে পলায়ন করতে চেয়ে বারবেল সাহেবের মহানতায় বুঁদ হয়ে থাকা, বিমল মিত্রের মিষ্টি দিদি, নতুন বৌদি, ছোট বৌঠান যেমন নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক ফেস করতে না চাওয়ার যুক্তি, তেমনই 'গাঙশালিক কাব্যস্কুল' ছিল মানুষের দুঃখ, শোক, রোগ, ঘা-পাঁচড়া এগুলোকে দেখতে না চেয়ে স্টুডিওর পর্দায় আঁকা চাঁদ, তারা, নদী, ফুলে বিভোর হয়ে থাকা। ঠিক তখনই মানুষের জীবনধারণ কতদূর দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল, তা দেখতে পাওয়া যায় ঋত্বিক ঘটকের ফিলমগুলোতে। সেই দৈন্য, দুর্দশা, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের প্রতিফলন এই কবিতাগুলোতে কোথাও ছিল না। কেন ? কেননা, তা করার অসুবিধে ছিল। তা করতে গেলে দীর্ঘ একটা লাফ দিতে হত, বিশেষ করে ভাষার ক্ষেত্রে।ঋত্বিক যেমন 'মেঘে ঢাকা তারা' বা 'কোমল গান্ধার' -এ গোটা ইডিয়মটিকেই ভেঙেচুরে ফেলেছিলেন, তেমনই ষাটের দশকের বঙ্গসমাজ ও মানুষেকে তুলে আনতে গেলে বাংলা কবিতার গোটা ইডিয়মটিকেই ভাঙতে হত। খানিকটা শ্রেণী পরিপ্রেক্ষিত আর কিছুটা গাড্ডায় পড়ে যাওয়ার ভয়, উভয়ে মিলে এ-কাজ করতে দেয়নি বাংলা ভাষার কবিদের। অতএব চাঁদ, তারা, নদী, ফুল, মৌমাছি...
আরেকটি প্রশ্নও ছিল। কবি কি কেবল কবিতাই লিখবেন, না সামাজিক ভাষ্যকারও হবেন ? রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি নন, সামাজিক ভাষ্যকারও ছিলেন। জীবনানন্দও তাই ( জীবনানন্দকে নিবীঢ়ভাবে পড়লে এই ব্যাপারটি ধরা পড়ে) । কিন্তু উত্তরোত্তর সামাজিক ভাষ্যের ব্যাপারটি বাংলা কবিতা থেকে উঠে যেতে থাকে। "কবিতা কবিতাই। সামাজিক ভাষ্যটাষ্য আবার কী?" এ-জাতীয় একটী প্রবণতা বাংলা কবিতাকে পেয়ে বসতে থাকে। একে ক্রমাগত হাওয়া দিতে থাকে স্বার্থান্ধ বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান।
খুব স্বাভাবিকভাবেই নভেম্বর ১৯৬১-এর প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি প্রজন্ম এই প্রবণতার বিরুদ্ধে ছিল। সেই দিন থেকে আজ অব্দি মলয়, সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি কোনোদিনই হাতছাড়া করেননি। 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'এ যেমন সামাজিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে তাঁর তীব্র বিবমিষা, তামনই আজও। তাঁর হালের একটি কবিতা নেওয়া যেতে পারে, 'যা লাগবে বলবেন' সংকলন থেকে । কবিতাটির নাম 'ক্ষুধার্ত মেয়ে':
আমার আসক্তি নেই কোনো
চলে যা যেখানে যাবি
যার সঙ্গে শুতে চাস যা
আমি একা থাকতে চাই
ক্ষুধার্ত বা পেটুক মহিলা
যে ঘোরে সবার হাতে
খড়কুটোময় সংসারে
তার কোনো প্রয়োজন নেই।'
কবিতাটিতে জড়িয়ে আছে একটা ঈষৎ বোহেমিয়ান বাচনভঙ্গী। পড়লে মনে হবে কেউ একজন লিখছেন তাঁর শয্যাসঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে। এটি কিন্তু কবিতার প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে কবিতা ও সমাজ সম্পর্কে মলয়ের দার্শনিক বোধ সন্নিহিত। শয্যাসঙ্গিনী মহিলাটি আসলে কবিতাই। অথচ সবার হাতে ঘোরার প্রবণতা তার, সে হাত স্মাগলারের হোক বা বিপ্লবীর।কবিতার লয়ালটি সন্দিগ্ধ। ওদিকে সংসার অনিত্য, অতএব তার প্রয়োজন কিসের ?
'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতায় যে-কথা বলার জন্য মলয়কে অনেক বেশি জায়গা ব্যবহার করতে হয়েছে, 'যা লাগবে বলবেন' গ্রন্হে সেই কথাই তিনি বলেছেন অনেক সংক্ষিপ্ত পরিসরে। 'হাংরি আন্দোলন' থেকে সরে এসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইন্সপেক্টিং অফিসার হিসেবে ভারতের গ্রামে-গঞ্জে শহরে শহরে ঘোরা, তারপর এ.আর.ডি.সি. ও নাবার্ডের গ্রামোন্নয়ন বিশেষজ্ঞের উচ্চপদে। যদিও মলয় তাঁর এই পরিবর্তিত জীবনশৈলী নিয়ে 'হাংরি কিংবদন্তি' গ্রন্হের শেষে মশকরাও করেছেন, "ছাই-এর জায়গায় আসে টুথপেস্ট, কয়লার উনুনের বদলে গ্যাস, সর্ষের তেলের বদলে সূর্যমুখী, শার্ট-প্যান্টের বদলে সাফারি, মাদুরের স্হানে বিছানা, ঢাবার বদলে রেস্তরাঁ, দিশির জায়গায় স্কচ, কলেজস্ট্রিট ও বইপাড়ার বদলে বাংলার গ্রামশহর।" কিন্তু তবু জীবনের এই অধ্যায়টিও যে কবি হিসেবে মলয়কে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই।
'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ বাঁধন-ছেঁড়া রাগ ছিল মলয়ের কবিতার পরিচিত চিহ্ণ। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে জীবনের বহু কিছু দেখে-শুনে মলয়ের কন্ঠস্বর তেতো, অম্লকষায়, আর তার সাথে এসে জুটেছে আয়রনির অধুনান্তিক পরিহাসও। তবু তা মলয়ের কবিতাকে সর্বজনগ্রাহ্যও করে তোলে বটে।'যা লাগবে বলবেন'-এর আরও একটি কবিতাকে নেওয়া যেতে পারে, যেমন 'দ্রোহ':
এ-নৌকো ময়ূরপঙ্খী
তীর্থযাত্রী
ব্যাঁটরা থেকে যাবে হরিদ্বের
এই গাধা যেদিকে দুচোখ যায় যায়
যাযাবর
ঘাট বা আঘাটা যেখানে যেমন বোঝে
ঘুরতে চাই গর্দভের পিঠে
মাথায় কাগুজে টুপি মুখে চুনকালি
পেছনে ভিড়ের হল্লা ।
ব্যাস! কবিতা এইটুকুই। অথচ বাঙালি সমাজের যে একটি বিশেষ প্রবণতা, কবিকে বেদিতে বসিয়ে রাখার, তাকে কত সার্থক ভাবে ভাঙঅ হয়েছে এখানে। পাটনার অন্ত্যজ মহল্লাগুলোতে হোলির দুতিন দিন আগে থেকে চোখে-পড়া একটি সুপরিচিত দৃশ্যকে ব্যবহার করেছেন মলয়, প্রশ্নাতীত দক্ষতাসহ। তার সাথে মিশিয়েছেন তীর্থযাত্রার জন্য বাঙালি হিন্দুর চিরাচরিত আতুরতাটিকে, যাতে পোস্টমডার্ন পরিহাস আরও তীব্র হয় । আর... হাংরি মামলার সময়ে তাঁকে যে-সামাজিক অবমাননা সইতে হয়েছে, তাও উঠে এসেছে। মাত্র কয়েকটি পঙক্তির মধ্যে কত প্রসঙ্গ যে এসেছে, অথচ বলার ভঙ্গিটি এত সহজ যে ভাবাই যায় না ।
এই সংগ্রহের আরেকটি কবিতা 'যে পার্টি চাইছেন সে পার্টিই পাবেন'।
বিশ্বাস এক দুর্ঘটনা
বুকপকেটে শ্রেণী
প্রতিরোধী থাকেন জেলে
কাজু-ফলের ফেনি
বরং ভালো
ভুল অঙ্কের ডানা।
...মোড়ল দলের পাড়ার কেউ বা
আওড়ায় বেঘোরে
ছাদ ঢালায়ের সমরবাদ্য
কর্তাবাবার জানা
মেলাবেন তিনি অন্তরীক্ষে
মোক্ষ একখানা ।
কবিতার শেষ দুটি পঙক্তিতে অমিয় চক্রবর্তীর 'মেলাবেন তিনি মেলাবেন', এই শান্ত, স্হিত, প্রায় ব্রাহ্ম, উত্তর-রাবীন্দ্রিক বিশ্বাসের আদলটি একেবারে বিপরীত অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পার্টি আমলাতন্ত্রের যে প্রবল দাপত, যার দরুণ তেলে-জলে মিশ খেয়ে একেবারেই একাকার, পুতুল নাচের সুতোর শেষ প্রান্তটি ব্যক্তিবিশেষের হাতে, সেটিতে যেমন-যেমন টান পড়ছে, কাঠের পুতুলগুলো তেমন-তেমনই নাচছে; এই গোটা পরিবেশটি উঠে এসেছে কয়েকটি মাত্র পঙক্তির মাধ্যমে। মলয় বুঝিয়েছেন, যা বোঝাতে গেলে অন্তত কয়েকশো পাতার বই দরকার। আর? বিরোধীপক্ষ বলতে কিছু নেই আর। যারা বিরোধ করছে, তারাও বস্তুত নিজের-নিজের ছাদই ঢালাই করছে। সেই ছাদ ঢালাই-এর বাজনাকে মানুষ মনে করছে সমরবাদ্য।
এত সূক্ষ্ম যাঁর ভাষার পরিমিতিবোধ, তিনি কিন্তু 'চিৎকারসমগ্র' গ্রন্হে এসে আবার অন্যরকম হয়ে যান। দড়ি ঢিলে দেন একটু, যাতে তাঁর সংবাদবাহক ঘুরতে পারে জায়গা-বেজায়গায়। 'ভাঙনের ছায়াগাছ' কবিতাটির অংশ পড়া যেতে পারে এই প্রসঙ্গে:
হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া সেই প্রৌঢ় নদী
নাচছে দুর্গাবোঙার ফরসা কোমর জড়িয়ে
শহর-পুরুতের গামছা কাঁধে
তাককা হুরে
আরে হুরে তাককা হুরে
বোঙা আদিবাসী দেবতা-অপদেবতার সর্বনাম। দুর্গা বাঙালির আবহমানের দুর্গতিনাশিনী। তারই কোমর জড়িয়ে নাচছে হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া প্রৌঢ় নদী, কাঁধে শহর-পুরুষের গামছা। তাককা হুরে, আরে হুরে তাককা হুরে, শহুরে মাস্তানদের উল্লাসধ্বনি।
ভাঙনের ছায়াগাছ। এই ভাঙনকে সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় না, অথচ সে তার কাজ করে চলেছে। ভাঙন বস্তুত একটি সার্বিক প্রক্রিয়া। এর দরুন সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে মজাদার মিলমিশ। বুর্জোয়ার বক্তব্য আশ্রয় করে লুমপেনের ভাষাকে।লুমপেন অ্যাডপ্ট করে বুর্জোয়ার চালচলন। এর সংস্কৃতি ঢুকে পড়ে ওর উঠোনে। ওর 'রোনাধোনা'য় শোনা যায় এর অনুরণন।
চিৎকার করতে-করতে পড়ছে জলপ্রপাত চুলে
ঢাউসপেট পোয়াতি অফিস-বারান্দায় আইল হাতে
থ্যাতলানো ট্যাক্সিচালক হাওড়া স্টেশানে
যেখানে সাপের ফণা জমা রাখতে হয়
শহর বিষদাঁত খুলে নেয় প্রত্যেকের। ছোবলানো তো চলবেই না, ফোঁস করাও নয়। অফিস বারান্দায় ফাইল হাতে গর্ভিনী। কী প্রসব করতে চলেছে সে ? তারই মধ্যে ঝরে যেতে থাকা কেশপাশের চিৎকার। আলুলায়িত কেশপাশ বাঙালির আবহমানের সৌন্দর্য-মিথের অংশ।
মেঝেময় ছড়িয়ে-থাকা গোঙানির টুকরো তুলে
তারা বদলায়নি তবু আদল পালটেছে
হে নাইলন দড়ি বাড়িতে এখন কেউ নেই
কিন্তু বাইরে হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর
কবিতাটি পড়তে-পড়তে বহু পুরোনো টার্কিশ ফিলম 'কংকারার্স অফ দি গোলডেন সিটি'র কথা মনে পড়ে। নিষ্পাপ একটি গ্রাম্য পরিবার শহরে এসে সব কিছু ধিরে-ধিরে হারাল। তার মেয়েরা হয়ে গেল বেশ্যা, পুরুষেরা অপরাধি। হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর--- গোল্ডেন সিটি। সোনার শহর। নারকেল দড়ির বদলে নাইলন দড়ি, সভ্যতার অগ্রগতি। বাড়িতে কেউ নেই , শূন্যতা অপরিসীম।
কবিতাটির শেষ স্তবকে এসে মলয় দুর্বার ছুট লাগান--- এমন ছুট যে কবিতা ব্যাপারটাই দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
কচি বালক-পাছার নধরমাংস দেবদূত
মাখনমাখা ব্রয়লার যার শেষ খদ্দের
চলে গেছে তিন বছর তার ব্লাউজে সেফটিপিনগাঁথা হৃদয়
স্লুইস দরজা খুলে আলোর নারীশরীর
যে জীবন বুকের সামনে উঁচিয়ে অচেনা পিস্তল
তখনই সিঁড়িতে সাদা ছড়ির আওয়াজ তুলে
গামছায় মুখ ঢেকঢ গাঁও বালিকার কান্না
কেঁপে উঠেছে শিশুর গায়ে হাত ঠেকলে
ভাঙন যখন সব কিছুকেই ভাঙছে, তখন কবিতাকেও সে ভাঙবে। ভাঙতে-ভাঙতে কবিতাও মুক্ত হয়ে যাবে। তখনই বোধহয় বিদ্যুৎ ঝলকের মত এক অন্য কবিতার সৃষ্টিমুহূর্ত।'ভাঙনের ছায়াগাছ' কবিতায় আমরা সেই প্রক্রিয়াটি দেখতে পাচ্ছি, চাক্ষুষ।মলয় রায়চৌধুরী থেকে বোধ হয় এক নতুন কবিকুলের সৃষ্টি হল, যাঁরা কেবল কবি নন, আপোষহীন সামাজিক ভাষ্যকারও বটে। "ঘুম-ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত" এর ব্যকরণ ভেঙে চুরমার, পর্বত শিখরে সূর্যোদয়ের মতো শোনা যাচ্ছে সেই নতুন কবিতার বজ্রনির্ঘোষ।
'হাংরি সাক্ষাৎকারমালা'য় মলয় বলছেন বিবেকানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে, "যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন কবিতা ও গদ্যের চাকুতে একনাগাড় পালিশ দেওয়া দরকার।" হাংরি আন্দোলন ফুরোবার পর মলয় কেবল প্রথাগত জীবন যাপনই করেননি, একনাগাড়ে অনুশীলনও করেছেন। এই অনুশীলন ও পঠন-পাঠন ছিল একলব্য সদৃশ, অথচ সামনে ছিল না দ্রোণের মূর্তি।মলয়ের সাধনা এরকমই। তার ফলে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' ও তাঁর আজকের কবিতার মধ্যে গড়ে উঠেছে লক্ষণীয় দূরত্ব। 'লক্ষণীয়' বললাম, কারণ মলয়ের 'হাততালি' কবিতাটিতে এমনই কিছু পরীক্ষা ও নিরীক্ষা জ্বলজ্বল করছে। রেলওয়ে ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন ট্রেনের আলো-আঁধারি কামরাগুলো ঝটিতি চোখের সামনে দিয়ে বহুমাত্রিক অর্থময়তায় সরে-সরে যেতে থাকে, তেমনই এই কবিতার অজস্র ছবি, চিত্রকল্প, ইশারা এরা দ্রুত ছুটে চলেছে:
তারপর পলিতকেশ কাশফুলে
পইপই বারনের পুশতুভাষী দুর্যোধন বেরিয়ে পড়েছে
দগদগে রোদে
চন্দন রক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে
অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প
কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব
হাহ
রোগা পৃথিবীর শিয়রে রাতজাগা নেশুড়ে
হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেনি হাততালি
চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা
'হাততালি' প্রাথমিক স্তরে উল্লাসের বহিপ্রকাশ। প্রশ্ন উঠছে, সমাজ যখন পচছে-গলছে, তখন কবি এত উল্লসিত কেন ? কিসের এ-উল্লাস ? কেন উল্লাস ? বিশৃঙ্খলার মহোল্লাস ?
যা অচল, যা জড়, তাকে একদিন না একদিন ভেঙে জেতেই হবে। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন নতুন কিছু গড়ে উঠবে না, উঠতে পারে না। মানুষের ভাবনাচিন্তা কার্যকলাপের ইতিহাসে এই উল্লাস অন্যত্রও দেখা গেছে। তন্ত্রসাধনার যে দিকগুলো, বামাচারের যে চালচলনগুলোকে 'বিকৃতি' বলে মনে করা হয়েছে, বস্তুত তা ছিল বর্ণাশ্রমপন্থী ছুঁৎমার্গপ্রবণ সনাতন হিন্দুধর্মের গড়া বিভিন্ন আগড় ভেঙে ফেলার উল্লাস। ভিন্ন 'অন্ত্যজ' বা অস্পৃশ্য জাতির নারীদের সাধনসঙ্গিনী করা, এই উল্লসিত বিদ্রোহের একটি দিক। নালান্দা জেলার কিংবদন্তি অনুযায়ী বৌদ্ধতন্ত্রের ভিক্ষু 'পদ্মসম্ভব' একজন অন্ত্যজ নারীকে নিয়ে ইলোপ করেছিলেন, ও দীর্ঘকাল নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে উধাও ছিলেন।দাহসংস্কারকে নানা কর্মকাণ্ডে মুড়ে সনাতন হিন্দুরা চেয়েছিলেন, মানুষ যেন অতীতকে খুঁটিয়ে না দেখে। শবসাধনা ও অঘোরপন্থা ছিল পরোক্ষে এর বিরুদ্ধচারণ। অতীতকে বিশ্লেষণ করা ও তার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা, এই ছিল নানা তান্ত্রিক আচারের পেছনের অস্ফুট উত্তেজনা ও মহোল্লাস । মলয়ের 'হাততালি' কবিতার শিরোনাম ও ও প্রথম স্তবক এই আশ্চর্য নানার্থময় উল্লাসে মুখর। পুশতুভাষী দুর্যোধনের পৌরাণিক প্রাসঙ্গিকতাও আছে। একেবারে আলটপকা নয় এই অভিব্যক্তি। গান্ধার, কান্দাহার, পুরুষপুর, পেশাওয়ার, ভারত-পুরাণের এই অতিদীর্ঘ ছায়াবৃত যাত্রাপথের দূরত্ব নির্দেশকারী সংকেতগুলো মলয় ব্যবহার করেছেন স্হপতির নিপুণতায়, ইউক্লিডের নির্দেশ অমান্য করে। চন্দনরক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে। হিন্দুর পূজাসামগ্রী রক্তচন্দন। তাকে উল্টে চন্দনরক্ত। রক্ষীদের পোশাক পাথরের। অজর অনড় সনাতনী অতীত ভারত দেশের। অতীতকে না হয় মুছে ফেলা গেল, কিন্তু তারপর ?
"অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প/কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব/হাহ"। যে নতুন পৃথিবী তৈরি হয়েছে তা নারকীয়। অতীতের বিকল্প গড়ে তোলার নামে কেবল নরকই তৈরি হয়েছে, অন্য কিছু নয়।
আধুনিকতার লাফঝাঁপ আজ হাস্যকর।
আধুনিকতার হাতে গড়া সামাজিক প্রতিবাদের নানা যোগাড়যন্ত্র প্রতিবাদকে ব্যহতই করেছে, আর কিছু করেনি।"হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেনি হাততালি", তথাপি "চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা।" কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে মনুষ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা কোনটি, তবে আমি কিন্তু বলব না, 'পরমাণু বোমা আবিষ্কার'। বলব না 'ঔপনিবেশিকতা'। বলব না কলম্বাস অথবা ভাস্কো ডা গামার জন্ম। আমার উত্তর "মনুষ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা মার্কসবাদ ও জুডিও ক্রিশ্চিয়ানিটির সমার্থক হয়ে যাওয়া।" মার্কস একেবারে চাক্ষুষ দেখে ছিলেন বিশ্ব পুঁজিবাদের উদয়। সেই দেখা ছিল নিখুঁত। তাঁর অভুতপূর্ব মেধা খুঁজে পেয়েছিল সেই উদয়ের কারণগুলোকে। কিন্তু এক জীবনে তাঁকে করতে হয়েছিল বিপুল পরিমাণ কাজ।করাল দারিদ্রের সাথে প্রতিনিয়ত যুঝে, একমাত্র বন্ধো ও সহযোদ্ধা এঙ্গেলসের সাহায্যে, তাঁকে সমাজবাদী দর্শন, অর্থনীতি ও সমাজত্ত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করতে হয়েছিল। তাই ইউরোপীয় সমাজের বাইরে বড় একটা ছড়িয়ে পড়তে পারেনি তাঁর দৃষ্টি। তবু ভারতবর্ষকে বোঝবার চেষ্টা তিনি করেছিলেন, উল্লেখ করেছিলেন 'এশিয়াটিক মোড অফ প্রডাকশানে' এর কথা। যদি এই মোডকে বোঝাবার সময় তাঁর হাতে থাকত, তবে হয়ত, হয়ত কেন, অবশ্যই, পরবর্তীকালীন যান্ত্রিকতা থেকে মার্কসবাদের মুক্ত থাকার সম্ভাবনা হত অনেক বেশি প্রবল।তা না হবার দরুন, পরে জুডিওক্রিশ্চান নিয়তির সাথে মার্কসবাদও জড়িয়ে পড়ে। যেমন খ্রিস্টধর্ম দরিদ্র ইহুদি ক্রীতদাসের ধর্ম হিসাবে যাত্রা শুরু করে, পরে রোমক সম্রাটদের ধর্ম হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনিই, মার্কসবাদ, কাউটস্কি প্রমুখ সুবিধাবাদীর হাতে পড়ে অচিরেই ইউরোপীয় পুঁজিতন্ত্রের সেবাদাসের কাজে লেগে যায়।
মার্কসবাদের সামাজিক বিকাশের নিয়মটিকে তার দ্বান্দ্বিক অন্তর্বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমনই একটি যান্ত্রিক সিদ্ধান্তে পরিণত করা হয়েছিল যে, বলা হল, "ধাপে-ধাপে এগিয়ে পুঁজিবাদই সমাজবাদ (!) হয়ে উঠবে"--- এই হয়ে ওঠে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের দলগোলুর ধারণা।লেনিন, রোজা লুক্সেমবুর্গ প্রমুখেরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গড়ে সৃষ্টিশীল মার্কসবাদের গোড়াপত্তন না করলে, পরে মার্কসবাদকে পুঁজিবাদের দর্শন থেকে আলাদা করে আর চেনাই যেত না। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লেনিন ছিলেন অধুনান্তিক রাজনীতিবিদ, যিনি আধুনিকতার প্রবক্তা কাউটস্কির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কাউটস্কি প্রমুখরা মার্কসবাদকে অক্ষরসর্বস্ব করে তুলেছিলেন।কিন্তু যান্ত্রিকতা বোধহয় মানুষের একটি স্বাভিক ঝোঁক। পরে লেনিন-শিষ্যরাই আবার যান্ত্রিক হয়ে ওঠেন; রুশ মডেলটিকে ব্যবহার করতে থাকেন যত্রতত্র সর্বত্র। ভারতের মার্কসবাদীরাই হয়ে ওঠেন সবচেয়ে বেশি যান্ত্রিক।
'ইতিহাস' ভদ্রলোকটি নানাবিধ পরিহাসে যে ভালোরকম সিদ্ধহস্ত, তাতে আর সন্দেহ নেই। মলয়ের 'হাততালি' কবিতার ( এটি একটি দীর্ঘকবিতা ) দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় পঙক্তিতে আছে, "যাত্রীডুবির খবরে ডুকরে উঠেছেন লালশালু নৌকার হাততালি।" পরিস্হিতি বারবার ওলোটপালোট করে দিচ্ছে মার্কসবাদীদের কষা ছক। এর ঠিক আগের পঙক্তিতে আছে, "একথোকা অন্ধকারে জোর করে দেখানো স্বপ্নে...।" মার্কসবাদীরা ভবিষ্যতের একটি মনমোহক স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আপামর জনসাধারণকে। সেই ছবি বাস্তবসম্মত ছিল না। তাই ছক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হতপ্রভ মার্কসবাদী ভাবুক শিবির। "না খেতে পাওয়া হলুদ শীতে/গরম আলকাতরায় ফোটা ফরসা রজনীগন্ধা।" ওদিকে শোষণও অব্যাহত। তারই হাড়ে-মাংসে তৈরি হচ্ছে নবতম 'নন্দনতত্ত্ব'। "কাঁধে চাঁদ নিয়ে ভররাত শাসিয়েছে শ্যাওলাধরা করোটি।" অতীতের দুঃসহ চাপ আর বারবার সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার... "জ্বরগরম কপাল ছুঁইয়েছে তাঁর পশুপশম নাভিতে।" এরপর গুটিয়ে-রাখা একটি প্রাচীন, কীটদষ্ট মানচিত্র খোলার মতো একখানা গোটা উপমহাদেশ মলয় খুলে ধরেন আমাদের চোখের সামনে। সেই উপমহাদেশকে নষ্ট করেছে সাম্রাজ্যবাদ আর সামন্তবাদ। তাদের রূপক দ্যোতক প্রতীকগুলো বর্শাফলকের মতো বিদ্ধ হয়ে আছে উপমহাদেশটির হৃদয়ে।
"ব্যাবিলনের শাদা নরকহুরি/উত্রমুখো নকশিমেঘের ওষুধবড়ি গিলিয়েছে/রেড়িপ্রদীপে ঝুঁকে ঘুরঘুরে শুঁটিপোকা/
এলোচুলে ঢাকা রাজকন্যার মুকুট থেকে গানের টুকরো/
পায়ে রক্তমাখা রাজহাঁস/যখন-তখন চেয়েছে বাড়িফেরত সৈন্যের বসন্তকাল/সাজিয়েছে খেলাচ্ছলে মারা চরমযুবার মা-বাপের সবুজকাঁথা ধানক্ষেত/তুঁতেরঙা কুয়াশা এগিয়েছে সিংহচামড়া শিকারীর গোপন ঘাসপথে/বিবাহযোগ্য ঘুড়সওয়ার হাততালি/হেই হো"। এই নষ্ট প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে দানা বাঁধেনি, বাঁধতে পারেনি যথার্থ বিদ্রোহ, যদিচ দেখতে বিদ্রোহের মতন, এমন অনেক কিছুই ঘটেছে।"আগুন যখন ধোঁয়া থেকে আলাদা হচ্ছে/যেটুকু সময়ে/আলজিভ/দুই হৃৎস্পন্দনের মাঝে তেতো হয়ে ওঠে/জলপথে এসে আক্রমণ করেছে জ্বরবিদ্রোহী/গাছে-গাছে ঝড়কালীন পলাশের লাল সক্যতা/ঠিক যেন চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎহীন/শেষ হাওয়ায়/পটকা ফাটিয়েছে রাংতাপাড় মেঘ/যেন এক্ষুনি এসে পড়ল বলে হাততালি।" একটি নষ্ট প্রক্রিয়া, তার বিরুদ্ধে 'গড়ে ওঠা' বিপ্লবী আন্দোলনের দেউলেপনা, সবকিছু মিলে বিচিত্র এক পরিস্হিতি। বিপ্লবী আন্দোলনের সেই সততা নেই যে নিজের দেউলেপনা স্বীকার করে নেবে।"কবরে পাওয়া গেছে ভাত খাবার কাঁসি/অত্যাচারিতের কাতরানিতে পড়েছে হাড়ের খিলান/কেউ সুখি নয়/কেমন আছো জানতে চাইলে বলেছে /ভালো/পাকের পর পাক কাঁটাতার কোমর থেকে খুলে দিয়েছে"।
ভারতবর্ষে বিহারসদৃশ যে কয়টি আভ্যন্তরীণ উপনিবেশ আছে, সেখানে অবস্হা আরও ভয়াবহ।এই আভ্যন্তরীন উপনিবেশগুলোকে নিয়ে বিপ্লবীদের ভড়ংএরও শেষ নেই।"ওদিকে হাততালিবাদক/ভগ্নস্বাস্হ্য আকাশে/পাখিদের গান শুধরে দিতে চেয়েছে/তারা দপদপে অন্ধকারে/
বালিশ-জড়ানো বর্ষায়/পালামৌ জেহানাবাদ রোহুতাসে কাদাপেছল মাগুরের আঁশটে হাঁপানি/শামুক থুতনি বুড়ির চোখের পাতায় ধূসর সোরাগন্ধক।"
সবকিছুর শেষে, সমস্তকিছুর পরিণামে খিদে। খেতে চাইছে মানুষ আর নিরন্তর খাদ্য হয়ে যেতে হচ্ছে তাকেই। আর তার এই খাদ্য হয়ে যাওয়াকে নানা অং বং চং দিয়ে মহিমা মন্ডিত করা হচ্ছে। মলয় এই বিচিত্র প্রক্রিয়াকে প্রস্ফূট করতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন রূপকল্প, যাতে এই পরিস্হিতির দ্বৈততা যথার্থ ব্যাখ্যাত হয়। যে ক্ষুধার্ত, সে-ই খাদ্য। "এদিকপানে মুখ করে দাঁড়িয়েছে ছোকরা সূর্যমুখী/ গরম তেলে লাল দুহাত উড়িয়ে স্বাস্হ্যবতী কাঁকড়া/ভাতের হাঁড়িতে নেচেছে সফেদ-মসলিন নরম অপ্সরা/তখন অন্ধকারে কেঁদে নিয়ে আলোয় হেসেছে হাততালি/হাসপাতালের বিছানায় লোহার শেকলে বাঁধা শুনেছে/ টেবিল ঘড়িতে সারারাত গ্রেপ্তারের ঠক ঠক ঠক ঠক।"
আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যাঁরা ঔৎসুক্য রাখেন, তাঁদের অবশ্য পঠনীয় একটি বই "দি নিউ ক্লাস", লেখক মিলোভান জিলাস। জিলাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া আবশ্যক।মিলোভান জিলাস, তদানীন্তন যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্হানীয় নেতাদের একজন, স্ট্যালিন ও টিটোর অন্তরঙ্গ, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের 'কমিনফর্ম' পর্যায়ের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যতা ত্যাগ করেন ও এই বইটি ও আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই লেখেন, যেমন "কনভারসেশানস উইথ স্ট্যালিন" লেখেন। "দি নিউ ক্লাস" লেখার অপরাধে টিটো জিলাসকে সশ্রম কারাদন্ডে দম্ডিত করেন। দি নিউ ক্লাস বইটিতে জিলাস সমাজবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে একেবারে নতুন একটি অবদান রাখেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, মিনস অফ প্রোডাকশানের মালিকানা স্বত্ব কাগজে-কলমে না থাকলেও সমাজতন্ত্রী দেশগুলোতে একটি নিউ ক্লাস বা নতুন শ্রেণির উদয় হয়েছে, যারা উদ্বৃত্ত বা সারপ্লাস সংগ্রহ করতে সক্ষম। এই শ্রেণীটি ক্রমশ নিজেদের হাতে প্রভূত অর্থ ও ক্ষমতা কেন্দ্রিত করেছে, এবং পার্টি, শাসনতন্ত্র, সমস্তকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। জিলাসকে সেই যুগে সাম্রাজ্যবাদীর দালাল উত্যাদি আখ্যায় বদনাম করা হয়েছিল। তিনি কারাবাস করেন, এবং ধিরে-ধিরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। পরে যখন সোভিয়েট দেশ ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ধ্বস নামে, এক কালীন পার্টি আমলারাই সি.পি.এস.ইউ.কে ভোগে দিয়ে দেন, এবং রাতারাতি বিশাল-বিশাল কল-কারখানার মালিকের চেয়ারে জাঁকিয়ে বসেন, তখন আবার জিলাসকে খোঁজা আরম্ভ করেন যথার্থ মার্কসবাদীরা। পশ্চিমবঙ্গে বহুকাল বহুবছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার ফলে আমলাতন্ত্রের যে অভ্যুদয় ঘটেছে, তাকে যথাযথ বুঝতে যাঁরা চান, তাঁরা এই বইটির সাহাজ্য নিতে পারেন।
'কৌণপের লুচিমাংস' কাব্যগ্রন্হের ভূমিকায় মলয় বলেছেন, "বর্তমান কালখন্ডের বঙ্গসমাজটি অধিবাস্তব। আমি চেষ্টা করেছি তাকে উপস্হাপনের। সেকারণে কোথাও-কোথাও পঙক্তি এবং ছবিকে মনে হতে পারে জটপাকানো। আমার প্রতিভা দ্বারা কবিতাগুলোর সৃজন হয়েছে মনে করা ভুল।আমিই বরং সৃজিত হয়েছি কবিতাগুলোর দ্বারা। ভাষাসমাজের দ্বারা।"মলয়ের এই বক্তব্যটি কবিত্বের ধারণাটিকেই পালটে দেয় মূল থেকে। গলায় গাঁদাফুলের মালা, স্কুল-শিশুদের উদ্দেশ্যা নরম গলা, 'নারীত্বের' প্রতি সম্ভ্রমশীল, চোখ ঢুলুঢুলু, ভুলো মন, জীবন সম্বন্ধে উদাসীন--- স্বল্পকথায় একটি প্রবল নন্দনতাত্ত্বিক তালগোলের যে চিত্রটি চোখে ভেসে ওঠে 'কবি' শব্দটি উচ্চারণ করতেই, তা থেকে মলয় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন কিছুটা জোর করেই হয়ত। মলয় বলছেন, 'কোথাও-কোথাও পঙক্তি এবং ছবিকে মনে হতে পারে জটপাকানো'। এও বলছেন, একটি অধিবাস্তব সমাজকে উথ্থাপন করতে গিয়েই হয়ত এই জটিলতার সৃষ্টি। কৌনপ একজন পৌরাণিক রাক্ষস, যে কুনপ অর্থাৎ শব খেয়ে বেঁচে থাকে। 'কৌনপের লুচিমাংস' রাজনৈতিক কবিতার সংগ্রহ। সর্বসাকুল্যে বত্রিশটি কবিতা আছে সংকলনে। কবিতাগুলির প্রত্যেকটিই একটি করে হাহাকার। আজকের পশ্চিমবঙ্গ, তার সমাজ, তার সংস্কৃতি, তার পচন, সবকিছু নিয়ে হাহাকার; যদিও ওই একই ভূমিকায় মলয় বলেছেন, 'এই গ্রন্হের পাঠবস্তু আসলে বাঙালির পচনের হোলিখেলা'। কিন্তু মলয়ের কষ্ট ও বেদনা প্রতিটি কবিতায় প্রস্ফূট। তার আঙ্গিকটি যদিও উল্লাসের, হোলিখেলার। ব্যাপারটা কিছুটা চার্লি চ্যাপলিনের ফিলমের মত বলা যায়।অধুনান্তিক। 'রাঁঢ়বাজারে শততম প্রেমিকের আবির্ভাব হল/ অথচ ফুলের টবে মাটি নেই শেকড়ে-শেকড়ে ছয়লাপ সংসার'। রাঁঢ়বাজার শব্দটি প্রণিধানযোগ্য। মলয় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পরিস্হিতিকে 'রাজনীতিবিদ বনাম জনতা' এভাবে নিচ্ছেন না কিন্তু। আগেও বলেছি, সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি মলয় কখনই হাতছাড়া করেননি। সেই ভূমিকাটিই তাঁকে উৎসাহিত করেছে পশ্চিমবঙ্গের কলোনিয়াল অতীতকে খুঁটিয়ে দেখতে। তাঁর লেখা বহু গল্পে ও প্রবন্ধে এই দেখা খুব স্পষ্ট। মলয়ের অধুনান্তিক ধ্যান-ধারণার উৎপত্তিও বস্তুত এখান থেকেই। উপনিবেশবাদ পশ্চিমবঙ্গের মনোজগৎকে ভালো রকম ধামসে দিয়েছে বহু আগেই। তার ফলে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ফলাও রাঁঢ়বাজার, যেখানে কেবল প্রেমিক যায় আর আসে। বর্তমান কালখণ্ডের ক্যাডাররা সেই রাঁঢ়বাজারের শতশত প্রেমিক। ফুলের টবে মাটি নেই, অথচ শেকড় সেঁদিয়ে গেছে ভেতরে, প্রায় অতল পর্যন্ত।অনন্ত পর্যন্ত নানা কায়েমিস্বার্থ চারিয়ে দিয়েছে শেকড়।
সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেয়ার দরুনই মলয় খুঁটিয়ে দেখেন গলদ কোথায় ছিল আর আছে। কমিউনিস্ট-বিরোধীরা যেমন গোটা ব্যাপারটিকেই "আরে ও শালারা অমনধারাই" বলে সেরে নেন, মলয় কিন্তু তা করেননি। তিনি খু#টিয়ে দেখেন, জানতে এবং জানাতে চান।তার ফলে তাঁর চোখে ধরা পড়ে বহু বিচ্যুতি, যেগুলো হয়ত অনেকেই দেখেও দেখেননি। 'কাউন্টার ডিসকোর্স' কবিতায় মলয় বলছেন, "খাটের দুপাশ দিয়ে আলাদা বয়ে যাচ্ছিল মজুরের নদী কৃষকের নদী। যে কড়াকড়িতে সারাদিনে সূর্য শুধু একবারই ওঠে আর মিলিয়ে যায়।"
অক্টোবর বিপ্লবের সময় সহসা আবিষ্কৃত হয় যে বলশেভিক পার্টির হাতে কৃষক শ্রেণির জন্য কোনো আলাদা প্রোগ্রাম বা কর্মসূচী নেই। অথচ বিপ্লবের কর্মকান্ডে কৃষক শ্রেণির সহযোগীতা অপরিহার্য। লেনিন দ্বিধাহীনভাবে এস.আর. (শ্পেশাল রিভলিউশানারি)-দের প্রোগ্রামটিকেই সরকারের তরফ থেকে অ্যাডপ্ট করে নেন। কয়েকটি পার্টির যে যুক্তফ্রণ্ট অক্টোবর বিপ্লব ঘটাতে চলেছিল, তাদের মধ্যে এস.আর. দলটিও ছিল, তাই এই কাজটি কারো অবিপ্লবী মনে হয়নি। নিজের পার্টির ত্রুটি মেনে নেওয়া, স্বীকার করা, পরিমার্জনা করার ব্যাপারে লেনিন তো, প্রায় বলা চলে তুলনাহীনই ছিলেন। আজকের ভারতবর্ষের, আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, আজকের নানা রঙের বামনেতাদের মাইন্ডসেট কি একটুও এরকম? পুঁজিবাদী সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ওলোটপালোট ঘটাতে গেলে যে-দুটি শ্রেণীর হাত মেলানো প্রয়োজন, তারা দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা অবস্হানে।শ্রমিক ও কৃষকের উঠোন একেবারেই ভিন্ন। আবার মজুরদের বমধ্যেও পি.এস.ইউ.এর মজুর আর আনঅর্গানাইজড সেক্টরের মজুরের আলাদা হাঁড়ি। কৃষকদের মধ্যেও এই জাতীয় নানা ভাগাভাগি। অথচ এ নিয়ে 'মার্কাসবাদী' তাত্ত্বিকদের মাথাব্যথা আছে , ঔপচারিক বুকচাপড়ানো ছাড়া , এমন তো মনে হয় না। তাহলে রদবদলটা ঘটবে কীভাবে ?
রদবদলের আশা করাটাও কী উচিত ? যখন বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ এক হিমশীতল রুটিন মাত্র , তার রন্ধ্রে-রন্ধে বাসা বেঁধেছে নানা সাইজের ঘুঘু , পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রগামী দর্শনটি এক অকিচিঞ্চিৎকর উপচারে পর্যবসিত, তখন সত্যিই কি কোনো আশা কোথাও রয়েছে যে একদিন সব কিছু বদলাবে ? "শেষ ট্রেনের নাম তত্ত্ববিশ্ব" কবিতায় বলছেন মলয়, "আর ভাটার দুলুনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক ক্লান্ত স্টিমলঞ্চ/হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া হাড়গুলো দাঁতনদেঁতো প্যাংলার দুর্ভাবনায়/ডেরা ডেলে চুলখোলা বারান্দায় চোখ বুজে দেখবে এক তিন ঠেঙে বেড়াল/শ্যাল-চাদর মুড়ি দেয়ে/প্রতিধ্বনি নকল করতে ওস্তাদ তলপেট-ফোলা বোল্ডার/পিঁপড়ের খনি-টানেলে জড়ো করেছে টুসকি নির্দেশে/নামিয়ে-আনা তত্ত্ববিশ্ব।" তবু মানুষের আশা...। ধন্য আশা কুহকিনী। এখনও সে আশা রাখে রেলিতে যায়, ব্রিগেড জমায়েতে যায়। এখনও পার্টিদাদার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে যে তার আশা-হতাশার কথা দাদা শুনবেন। এখনও...। "খোঁড়া বরের টোপর" কবিতায় মলয় বলছেন, "দূরে শোনা যাচ্ছে/ নারকেল-পাতায় উড়ন্ত ঘোড়ার খুরধ্বনি/ বর আসছে বর আসছে বর আসছে একঠেঙে/ কাছিম-টেকো মাথায় ফর্দাফাঁই লালটোপর।"
"কৌনপের লুচিমাংস" সংগ্রহে এসে মলয়ের কবিতায় আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল ঘটেছে বলে আমার ধারণা। এই কথাটি মলয় নিজেও স্বীকার করেছেন সংগ্রহের ভূমিকায়, "বাঁকবদলের জন্যেই তো নতুন কাব্যগ্রন্হ, নইলে একঘেয়ে একের পর একের কোনো মানেই হয় না।" মলয়ের ভাষা আশ্চর্য দ্যুতিমান হয়ে উঠেছে এই সংগ্রহে এসে। "ভূমিপুত্রের জন্মস্হান বদলের দরখাস্ত" কবিতাটিতে মলয় বলছেন, "দাদু, কেন্দ্র কই, সেই গর্মাগরম ষাঁড়িত জান্তব সিংহাসন ?/এ তো দেখছি গ্যাংগ্রিনের শাশ্বত নালি ঘা!" দুটি মাত্র পঙক্তি। তার মধ্যেই বিধৃত একটি সমাজের গোটা ইতিহাস, তার অতীত, তার বর্তমান, আর বোধকরি তার ভবিষ্যতও। কি আশ্চর্য দক্ষতায় মলয় দেখিয়ে দেন সবকিছু; মাত্র দুটি পঙক্তিতে কত কথাই যে বলেন। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের আজকের হাল-হকিকত বোঝাতে...."এই একপশলা সন্ধ্যায় ট্রানজিসটারে লকাপ লোচ্চার লিট্যানি শুনতে/গুটিপোকার সবুজ দেহতরঙ্গের তুলতুলে গানে গাছের কোটরে/সঙ্গীত খুঁজছে কাঠঠোকরা তার নিলাম-ডাকা মেশিন ঠোঁটে/পিটিয়ে-মারা শেষ শেয়াল পঞ্চায়েতকে উন্নীত করেছে জেলাসদরে/ড্যাশবোর্ডে থ্যাঁতামাথা কুষ্ঠ-সাম্রাজ্যের সোনাজল ভোটার/ঠায় বসে আছেন কাদা-কুঁজোর কায়দায় ঘুরন্ত চাকে।"( ফ্রান্তস ফ্যানঁ ) । অথবা..."আমি যে কিনা কুহকঠুঁটো মেয়েদের মাঝে ছিলুম ট্রিগারলিঙ্গ যুবা/খড়খেতের সোঁদা-সোনালি চামচমকানো মকাইগুঁফো চাষার ছেলে/একটা চুল টানতেই বেরিয়ে পড়েছে রক্তপচা আঁতের ঝুরি/জ্ঞাতিদের মুখে পাঁঠার গলায় নেমে আসা খাঁড়ায় আঁকা চোখের কান্না/ দেখছি আর ভাবছি কি মজা শবশকটে আগে চড়িনি কক্ষুনো" (রূপসী বাংলার ভাতার )
অথবা..."আমি কিন্তু কুঁড়ে টাইপের বিকেলবেলায় যখন বেহেড/পাকস্হলি নিয়ে ফিরছি/ভুল সময়ে আগত শীতে বদন-বেচুনিদের চৌরঙ্গি স্যামপেলের ডেরায়/ম্যাপ খুলে দেখাবে, হ্যাঁ, ওই যে ওই তো ইউজারফ্রেন্ডলি বসন্তঋতু/ চিলের পেছন-পেছন উড়ে ব্লো-আপ হিরোর গায়ে/হাত ছুঁইয়ে ভিককে চাইছে/আমি কিন্তু অতীতকে নতুন করে গড়ে ফেলেছি জলফোঁটায় বেঁধে-বেঁধে/প্রকৃতি কি আর ভাবছেন জানত না লাশ গোঁজড়াতে একসেট অমাবস্যা চাই/তাই তো জলের ক্যাঁদরায় খুকি-পোনাদের ভাসিয়ে নিয়ে/চলল জোয়ার-বুড়ো" (ক্যাটাক্রিসিস)।
প্রথম-যৌবনে কবিতা লেখার জন্য লাঞ্ছিত ও নিন্দিত, পরে বহু বছর নৈঃশব্দের অতলে, আর আজ বাংলা কবিতার মধ্যগগনে সূর্যের মত ভাস্বর মলয় রায়চৌধুরী এখন পরিণত বয়স্ক। আয়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই মানুষের; শোনা যায় মলয়ের শরীরও খুব একটা সুস্হ নয়।বাংলা ভাষার যে অপরিমেয় সম্ভাবনা আছে, তার ঠাহর মলয়ের মত আর কারো হয়ত নেই। বাংলা ভাষার শব্দগুলোকে তিনি দিয়েছেন সম্পূর্ণ নতুন এক আয়তন, তাকে আজকের পৃথিবীর যোগ্য করে তুলেছেন।মলয়ের কবিতা নিয়ে কথাবার্তার এক নতুন পর্ব আরম্ভ হবে বলে প্রতীক্ষা করছি আমরা। সেই কবে কৃত্তিবাস ওঝা দ্বিধাজড়িত হাতে লেখা আরম্ভ করেছিলেন, "গোলকে বৈকুন্ঠপুরী সবার উপর।/ লক্ষ্মীসহ তথায় আছেন গদাধর।/তথায় অদ্ভু বৃক্ষ দেখিতে সুচারু।/যাহা চাই তাহা পাই নাম কল্পতরু।। দিবানিশি তথা চন্দ্র-সূর্যের প্রকাশ।/তার তলে আছে দিব্য বিচিত্র আবাস।।/নেতপাট সিঙহাসন উপরেতে তুলি।/বীরাসনে বসিয়ে আছেন বনমালী।।/মনে মনে প্রভুর হইল অভিলাষ।/এক অংশ চারি অংশ হইতে প্রকাশ।।" তেলের প্রদীপের আলোয় সামনের দিকে নুইয়ে পড়ে তিনি লিখেছিলেন। বাইরে চরাচরব্যাপী অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হয়ত বা জ্বলছিল-নিভছিল গুটিকয় জোনাকি। অশ্বথ্থের নিষের অমান্য করে হঠাৎ-হঠাৎ হাওয়া বইছিল। অসংখ্য কান প্রতীক্ষা করছিল বাংলা কবিতার জন্মের প্রথম কান্নাটি শুনবে বলে। খাগের কলমের খসখস শব্দ উঠছিল তুলোট কাগজে। তারপর দীর্ঘপথ। কত রাজত্ব, সাম্রাজ্যবাদের উথ্থানপতন। ধুলোয় গড়াগড়ি কত মুকুট, রাজদণ্ড। রক্তাপ্লুত, কাঁটা-বেঁধা পায়ে কেবল হেঁটেছে বাংলা কবিতা। হেঁটেছে, হেঁটেছে আর হেঁটেছে। এখনও চোখ খুললে সেই মানুষদের দেখতে পাওয়া যায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে, যাঁরা সেই শিশুটিকে বয়স্ক করে তুলতে অসহ্য দুঃখ স্বীকার করেছেন। সকল পার্থিব সুখ-সুবিধা তুচ্ছে করেছেন তাঁরা, নিজের জীবন, যৌবন, মান-সম্মান, সব কিছু ব্যয় করেছেন বাংলা কবিতার জন্য। যেদিন মলয় কবিতা লেখার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিনই, সবার অলক্ষ্যে, এই মানুষদের একজন হয়েগিয়েছিলেন তিনি। ভুল করেছিল বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন। বাংলা কবিতার জন্য সর্বস্বপণ যোদ্ধাকে অট সহজে পরাভূত করা যায় না। জয় মলয়েরই হয়েছিল। সেই জয় আজ প্রতিধ্বনিত মলয়ের প্রতিটি কবিতায়।
( প্রবন্ধটি ২০০৩ সালে কবিতীর্থ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর বিভিন্ন পত্রিকায় পুনঃপ্রকাশিত হয়ে চলেছে । সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আবার আসিব ফিরে পত্রিকায় ।)
----------------------------------------------------------------------------------
বিশ্বজিত সেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পার্টি বহু অংশে বিভাজিত হবার পর ও তাদের সদস্যদের নৈতিক পতনে আশাহত শ্রীসেন পার্টি ত্যাগ করেন।কিন্তু তিনি আজও নিজেকে একজন মার্কসবাদী ভাবুক বলে মনে করেন।তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্হ, গল্পগ্রন্হ ও প্রবন্ধের বই আছে।
হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়
মলয় রক্ষিত
ষাট দশকের সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্বস্ত পরিবেশ, অর্থনীতির ভাঙন এবং তারই ফলশ্রুতিতে তৈরি হওয়া সাংস্কৃতিক ব্যবধানের এলোমেলো চেহারাটা বাংলা কবিতায় আরেকরকম ভাবে এলো। আমি হাংরি, শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের কথা বলছি । ১৯৬১তে প্রকাশিত হলো হাংরি জেনারেশন এবং হাংরি-আন্দোলন সম্পর্কিত ইশতাহার । এই ইশতাহারগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় হাংরিরা এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন আমাদের ঔপনিবেশিক সূত্রে প্রাপ্ত নন্দনতাত্বিক বাস্তবতার যাবতীয় বোধ অথবা চিন্তাসূত্রকে আঘাতে আঘাতে চুরমার করে দিতে । হাংরি জেনারেশন ইশতাহার নং ১০-এ এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তৃতীয় সূত্রে লেখা হয়েছে----”ঠিক সেই রকম সৃষ্টি উন্মার্গে চালিত হতে হবে যাতে আগে থাকতে তৈরি পৃথিবীকে চুরমার করে পূনর্বার বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করা যায়।”
এই ইশতাহার কবিতা বা সাহিত্যের যে-কোনো ধরণের সনাতন ঐতিহ্য বা পরম্পরাকে অস্বীকার করে, প্রত্যাখ্যান করে। যে-কোনো ধরণের মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ জানায় । কবিতার নন্দনতত্বের যাবতীয় সূত্রগুলিকে অস্বীকার করেই তাঁরা কবিতার ভিন্নতর এক পরিসর তৈরি করতে চেয়েছিলেন । সে ছিল বাঙালির মনন ও চিন্তনের জগতে এমন এক ধাক্কা যার অনিবার্য পরিণতিতে হাংরি কবিদের রাষ্ট্রবিরোধী, অশ্লীল ইত্যাদি অভিযোগে গ্রেপতার হতে হয় ।
মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ তাই বৈদ্যুতিক শকের মতন আমাদের ধাক্কা দেয়, আমাদের যাপিত-জীবনের পচা-গলা-নোংরা চেহারাটা যেন আয়নার সামনে মেলে ধরে মলয় বলেন, “শাশ্বত অসুস্হতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফূলিঙ্গ/মা তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?” যখন মলয় প্রচণ্ড আত্মধিক্কারে উচ্চারণ করেন, “মরে যাবো কিনা বুঝতে পারছি না/তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়/সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাবো/শিল্পের জন্য সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোবো/কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই”, কিংবা বিস্ফোরণের তীব্র আবেগেই যখন অসহ্য উচ্চারণ করেন, “কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?/কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি?/কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায়?”
হাংরির সমস্ত কবিদের যাবতীয় কাউন্টার-কলোনিয়াল এসথেটিকস রিয়ালিটির পালটা কাউন্টার----তার গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসবার বিকল্প এক পরিসর তৈরির চেষ্টা, যেন বিদ্রোহ আর আত্মবিস্ফোরণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে-যাওয়া সব চেহারা, ছটফটানি --- মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি সেসব কিছু ধারণ করে আছে । সমীর রায়চৌধুরী, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, অরুণেশ ঘোষ কিংবা শৈলেশ্বর ঘোষ ও মলয় রায়চৌধুরীরা, এঁরা আসলে কেউই ব্যক্তি-নাম নন, যেন সংঘবদ্ধ এক ডিসকোর্স, স্বাধীনতা-উত্তর ধ্বস্ত পচনশীল ভারতভূমির এক বিকল্প পরিসর, বিকল্প টেক্সট ।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই বিকল্প পরিসরের কোথাও ছিলেন না । সুভাষ পার্টিলাইনের ধুয়ো যেমন ধরেননি, তেমনি হাংরি শিবিরের ধারও কোনোদিন মাড়াননি । আবার ষাট দশকের ওই সর্বব্যাপী হতাশা, সঙ্গে চীনের কাছে যুদ্ধে গোহারান হারার লজ্জা থেকে উদ্ভূত আত্মলাঞ্ছনা তাঁকে বিচলিত করলেও কোথাও তিনি নিজেকে সময়ের হাতে সঁপে দেননি ।
[ অনুষ্টুপ গ্রীষ্ম-বর্ষা সংখ্যা, ১৪২২ ]
১. ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমিতাভ ঘোষাল - ‘গদ্য-পদ্য সংবাদ’ পত্রিকায় ১৯৮৬ অক্টোবরে প্রকাশিত :-
সুমিতাভ : ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ কতোটা ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না । আমি তখন কৃত্তিবাস নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা করতুম । কৃত্তিবাসের থেকে কয়েকজন এই আন্দোলন শুরু করে । এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা প্রথমে নিয়েছিল মলয় রায়চৌধুরী, সে ছিল আমার বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর ছোটো ভাই । সমীর রায়চৌধুরী কৃত্তিবাসের একজন লেখক এবং ওই গোষ্ঠীরই একজন । মলয়েরও কিছু কিছু লেখা কৃত্তিবাসে বেরিয়েছিল ।
সুমিতাভ : আচ্ছা শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো... ( কথায় বাধা দিয়ে )
সুনীল : হ্যাঁ, তারপরে মলয় প্রথমে শুরু করার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাতে যোগ দেয় এবং পরে উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আসেন । এইভাবে হাংরি আন্দোলন শুরু হয় । কিন্তু এই আন্দোলনের কোনো ইস্তাহার বা কোনো ব্যাপারে আমার কোনো নাম ছিল না বা আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না ।
২ ( Snehasis Roy : “হাংরির উত্থান ১৯৬২ সাল, মলয় ১৯৬১ সালের যে গল্প ফেঁদেছেন নকল ইস্তেহার বানিয়ে সেন্টুর তোরঙ্গ থেকে নাকি উদ্ধার হয়েছে পরে, এ-সব আসলে গাঁজাখুরি গল্প।
মলয়ের কবিতা তো হয়ই না, গদ্য, অনুবাদ ও কিছু ভালো প্রবন্ধ লিখেছেন, সমস্যা হল, সুভাষ ও শৈলেশ্বরের ভূত লোকটার পিছু ছাড়ে না। শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লিখছেন বা অন্য কোনো কবিকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ অবান্তরভাবে শৈলেশ্বর, সুভাষকে দায়ি করছেন তাঁর জেল হওয়ার জন্য।(মলয় বোঝাতে চান, ইস্, তোমরা শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষের লেখা পড়ো, এদের জন্য আমিহাংরিস্রষ্টা, আমার জেল হয়েছে!
সাহিত্যের জন্য জেল হয়েছে এমন আসামীর লেখা পড়ো তোমরা, মুচলেকা দানকারীদের লেখা কেন পড়বে! আমি বীর, সারা পাড়ার সামনে কোমরে দড়ি দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গেছে, ভ্যাঁ...........এসব বলে পাঠকের সিমপ্যাথি আদায় করার চেষ্টা)
ভাবটা এমন জেল যেন তাঁর একারই হয়েছিল, অথচ হাংরি সংক্রান্ত লেখালেখির কারণে প্রথম জেলে হয় শৈলেশ্বরের, পরে সুভাষেরও। লোকটা এমন চুতিয়া অরুণেশকে দু-রকম হাতের লেখায় চিঠি লেখে, সুভাষ ঘোষকেও তাই, সুভাষকে চিঠিতে জানায় আমার যারা সমালোচনা করে তাঁদের দেখে নেব। সেসব চিঠি সব আছে আমাদের কাছে। সময় ও জায়গা মতো প্রকাশিতও হবে।
মলয়ের 'আমি' 'আমি' করার পাশাপাশি বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত হাংরি জেনারেশন আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তাঁদের মুখপত্র ছিল 'ক্ষুধার্ত' পত্রিকা। মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম তিনটি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং পরের চারটি সংখ্যা শৈলেশ্বর ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।”
৩. ( উপরোক্ত Snehasis Roy : “হাংরির উত্থান ১৯৬২ সাল, মলয় ১৯৬১ সালের যে গল্প ফেঁদেছেন নকল ইস্তেহার বানিয়ে সেন্টুর তোরঙ্গ থেকে নাকি উদ্ধার হয়েছে পরে, এ-সব আসলে গাঁজাখুরি গল্প।
মলয়ের কবিতা তো হয়ই না, গদ্য, অনুবাদ ও কিছু ভালো প্রবন্ধ লিখেছেন, সমস্যা হল, সুভাষ ও শৈলেশ্বরের ভূত লোকটার পিছু ছাড়ে না। শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লিখছেন বা অন্য কোনো কবিকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ অবান্তরভাবে শৈলেশ্বর, সুভাষকে দায়ি করছেন তাঁর জেল হওয়ার জন্য।(মলয় বোঝাতে চান, ইস্, তোমরা শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষের লেখা পড়ো, এদের জন্য আমিহাংরিস্রষ্টা, আমার জেল হয়েছে!
সাহিত্যের জন্য জেল হয়েছে এমন আসামীর লেখা পড়ো তোমরা, মুচলেকা দানকারীদের লেখা কেন পড়বে! আমি বীর, সারা পাড়ার সামনে কোমরে দড়ি দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গেছে, ভ্যাঁ...........এসব বলে পাঠকের সিমপ্যাথি আদায় করার চেষ্টা)
ভাবটা এমন জেল যেন তাঁর একারই হয়েছিল, অথচ হাংরি সংক্রান্ত লেখালেখির কারণে প্রথম জেলে হয় শৈলেশ্বরের, পরে সুভাষেরও। লোকটা এমন চুতিয়া অরুণেশকে দু-রকম হাতের লেখায় চিঠি লেখে, সুভাষ ঘোষকেও তাই, সুভাষকে চিঠিতে জানায় আমার যারা সমালোচনা করে তাঁদের দেখে নেব। সেসব চিঠি সব আছে আমাদের কাছে। সময় ও জায়গা মতো প্রকাশিতও হবে।
মলয়ের 'আমি' 'আমি' করার পাশাপাশি বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত হাংরি জেনারেশন আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তাঁদের মুখপত্র ছিল 'ক্ষুধার্ত' পত্রিকা। মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম তিনটি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং পরের চারটি সংখ্যা শৈলেশ্বর ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। “)
৪. ( উপরোক্ত Snehasis Roy - “শৈলেশ্বরকে লেখা অরুণেশের প্রায় ৮০টির মতো দীর্ঘ চিঠি( INLAND LETTER CARD) উদ্ধার হল।
'সৃষ্টিক্ষমতাহীন কুকুরের দল এই ঘেউঘেউ চিরদিনই করে এসেছে'র পাশাপাশি অরুণেশ চাইছেন 'আত্মমগ্ন গর্ভবতীর মতো নিজেকে নিয়ে থাকতে'।
তাঁর সঙ্গে মিলারের লেখালিখির হাস্যকর তুলনা প্রসঙ্গে অরুণেশের মনে পড়ে যাচ্ছে জীবনানন্দকে ইয়েটস্ এর অনুকারক এমনকি পাশাপাশি রেখে উভয়ের লাইন তুলে মেলানোর প্রাণপণ চেষ্টার কথা!
আর্থিক সংকট, বেশ্যা ও না-বেশ্যা অসংখ্য সংগমে তিনি কি না-প্রেমিক। না, এসবের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতার সঙ্গে সহবাস করতে চাইছেন।
দেশ, আনন্দবাজার, আজকাল প্রভৃতি বাজারি কাগজ সম্পর্কে একহাত নিতে ছাড়ছেন না এবং কৃষ্ণ ধর ও অমিতাভ দাশগুপ্তকে হিজড়ে লেখক বলতে রেয়াত করছেন না।
হাংরি জেনারেশন সাহিত্য, রাজনীতি, কলকাতার সাহিত্য, পাণ্ডুলিপি করে শৈলেশ্বরকে পাঠানো। 'রোবট'(সম্পাদক : জীবতোষ দাশ) নিয়ে ভয়াবহ আবেগ।নিজের কাগজ 'জিরাফ' নিয়ে চিন্তাভাবনা। বাবার অসুখ। চিকিৎসকদের 'মাগী' বলা, টাকাও ধ্বংস করে রোগীও মারে।
উত্তরবঙ্গের তৎকালীন অন্যান্য পত্রিকার রাজনীতি। এমনকি নাম নিয়ে রাজা সরকারের(সম্পাদক : কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প) ঈর্ষা ও কূটনীতি সত্ত্বেও তাঁকে শোধরানোর চেষ্টা। আরও কত কী কথা বলেছেন চিঠিতে শৈলেশ্বরকে।
এই চিঠিগুলো নিয়েই একটা সাংঘাতিক বই হয়ে যায়।
একটা সময়, দীর্ঘ কবিতাযাপন, জৈব আততি ও ঐতিহাসিক দলিল তো বটেই।
বোমাটা ফেলব নাকি!” ]
৫. : ( দুই ফরেনারের কথাবার্তা : বেলাল চৌধুরী ও চয়ন খায়রুল হাবিব
চঃ এটা মজার, কৃত্তিবাসের একটা প্রধান অংশই সুনীলকে না জানিয়ে হাংরি আন্দোলনে জোগ দিয়েছিল।শক্তি, সন্দীপনও চলে গিয়েছিল।কিন্তু ঐসব ঈস্তাহারত পড়া যায় না, এতই পচা।সুনীলকে ওরা জানায় নি কেন?
বঃ ইর্ষা, ভয়।সমির আবার সুনীলদার বন্ধু ছিল।“ধর্মে আছি, জিরাফে আছি” নিয়ে শক্তির তখন সাঙ্ঘাতিক অবস্থা, এক বসায় দশটা কবিতা লিখে ফেলছে। ও বুঝে গিয়েছিল সমির, মলয়দের হাতে লেখা নেই।ও বুঝেছিল যে হাংরিদের সাথে থাকলে ওর কবিতা ধ্বংশ হয়ে ্যাবে।খুব সম্ভবত সেই প্রথম শক্তি সুনীলদার কবিতার ক্ষমতাও বুঝতে পেরেছিল।ও আবার কৃত্তিবাস বলয়ে ফিরে আসে।টাইম ম্যগাজিন বিটদের কথা বলতে গিয়ে হাংরিদের সম্পর্কে বলেছিল।ঐটুকুই। লেখা কই?বোগাস।
চঃ যে সুনীলকে ওরা ওদের সাথে ডাকেনি , জ়েলে নেবার পর তাকেই অনুনয় করছে আদালতে গিয়ে ওদের কবিতার পক্ষ্যে সাফাই গাইতে!
বঃ মলয় ওটা করেছিল।সুনীলদাকে নিজে গিয়ে ও সাক্ষ্য দিতে বলেছিল।ওর জ়েল দন্ড ঠেকাতেই সুনীলদা ওর কবিতাকে উত্তির্ন না মনে করলেও বলেছিল “সার্থক কবিতা”।
চঃ শক্তি কি করেছিল?
বঃ সমির, মলয়দের এক বোনের সাথে প্রেম করেছিল।ওদের অনেকগুলো বোন ছিল।
চঃ নাম কি বোনটার?
বঃ শিলা।
চঃ শিলা রায় চৌধুরি!শক্তির প্রেমিকা!হো হো হো. )
৬. : ( সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : মলয় রায়চৌধুরী খুব অদ্ভূত মানুষ। তিনি আমাকে উৎসর্গ করে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি পোষ্ট দিয়ে বললেন, ‘দুলাল, তোমার সাথে আমার ছবি নেই কেনো’?
তাঁর সাথে জীবনে কোনো দিন দেখা হয়নি। তিনি থাকেন বোম্বে আর আমি টরন্টোতে। ছবি থাকবে কি ভাবে? মলয় দা’র সাথে দেখা-সাক্ষাৎকার না হলেও তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২০১৪ সালে, আমার ‘সাতদিন’ ওয়েব পত্রিকার জন্য। )
৭. ( সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : ভালো লাগা কবিতা : মলয় দা, মলয় রায়চৌধুরী এক অদ্ভূত মানুষ। ৮২ বয়সেও ২৮ বছরের তরুণ কবিদের মতো তারুণ্য লালন করেন। আমি তাঁর এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তার জবাবে আরো তা টের পেয়েছি। তাঁর সাথে আমার দেখা হয়। বাংলাদেশে কবিদের দৌঁড় কলিকাতা পর্যন্ত। আমার মতো সাধারণ কবির পক্ষে কি স্বর্গীয় দিল্লি যাওয়া তো কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমার কবিতায় মলয় দা ঢুকে গেছেন, আবার মলয় দা আমাকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন, ফেইসবুক লাইভে আমার কবিতা পাঠ করেছেন।
কি সব অদ্ভূত কাণ্ডই না করেন মলয় দা। গুণ দা'র মতো তাঁর পাগলামির শেষ নাই। শাশুড়িকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেন। প্রেমিকাকে বলনে- ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’। আমি বলেছিলাম, মাথা নাকি নুনু? তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন, তাতেও টাশকি খেয়েছি। ‘১৯৬০-এর দশকের হাংরি আন্দোলন হাংরিয়ালিজম— তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক ১৯৬০-এর দশক থেকেই ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্যে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন।
সম্প্রতি তাঁর একটি কবিতা পড়ে থ মেরে যাই। সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং দেশ বিভাগ নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতার অসাধারণ মর্মান্তিক এবং ভায়াবহ চিত্রকল্প চমকে দেয়! ফাঁসিতে ঝুলন্ত লাশ ঝুলতে ঝুলতে এক বার পাকিস্তান আবার হিন্দুস্থানের দিকে ঝুলছে!
কেন লিখি
মলয় রায়চৌধুরী
কেন লিখি ভাবনাটা আমার পক্ষে খাটে না । বলতে হবে কেন লিখতে শুরু করলুম । তার পৃষ্ঠপট হিসেবে আমার শৈশবের কথা বলতে হয় । আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ ( ১১.জানুয়ারি ১৮৬৬ - ৮ আগস্ট ১৯৩৩) সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের উত্তরপাড়া শাখার বংশধর হলেও জীবিকা আরম্ভ করেছিলেন ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার ও আর্টিস্ট হিসাবে; বেশির ভাগ সময় সপরিবারে কাটিয়েছিলেন আফগানিস্তান আর এখনকার পাকিস্তানে । হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দাদু পাটনায় মারা যান যার দরুন তাঁর ছয় ছেলে আর এক মেয়ের দায়ীত্ব বর্তায় ছেলেদের ওপর, যাঁরা কেউই স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পাননি। দাদু ফারসি, আরবি, সংস্কৃত জানতেন । দাদুর মৃত্যুর পর বাবা রঞ্জিত ( ১৯১২ - ১৯৯১ ) পাটনায় ফোটোগ্রাফি এবং তা থেকে তৈলচিত্র আঁকার ব্যবসায় আরম্ভ করেন । ভাইরা সবাই মিলে স্ত্রীর গয়নাগাটি বেচে ইমলিতলা নামে পাটনার এক বস্তিতে বাড়ি করেন । মানে, আমি ছিলুম ইমলিতলা পাড়ায় কুড়িজনের একান্নবর্তি পরিবারের সদস্য । ইমলিতলা পাড়া ছিল গোলটালির চালাবাড়ি-ঘেরা বিহারি নিম্নবর্ণের অতিদরিদ্র পরিবার ও লখনউ নবাবের হারেমের গরিব শিয়া বংশধর অধ্যুষিত, যারা একই পোশাকে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতো । পাড়ার লোকেরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি, বিড়ি তৈরি, দুধ বিক্রি, ডিম আর ছাগলবাচ্চা বেচে সংসার চালাতো । জাঠতুতো, খুড়তুতো ভাইবোন ছাড়া আমরা ছিলুম দুই ভাই । বড়োজেঠা দেড়শো টাকা দিয়ে এক বেশ্যার কাছ থেকে একটি শিশু কিনেছিলেন, সে ছিল আমাদের মেজদা, পাড়ার প্রভাবে গুণ্ডা হয়ে ওঠে আর কম বয়সে মারা যায়। ইমলিতলা পাড়ায় আমরা বাল্যকাল থেকে ইঁদুর-পোড়া, শুয়োর ও গোরুর মাংস, ছাগলের নাড়িভুঁড়ির বড়া, তাড়ি, দিশি মদ ও গাঁজা ফোঁকার সঙ্গে পরিচিত হই ।
পাটনার সম্ভ্রান্ত বাঙালিরা কেউই ইমলিতলায় আসতেন না ; আমার স্কুলের সহপাঠীরাও আসতো না, তার কারণ ইমলিতলা পাড়ার কুখ্যাতি । ফলে, আমরা ছিলুম বঙ্গসংস্কৃতির বাইরের মানুষ এবং আমাদের মনে করা হতো ‘ছোটোলোক’ । অর্থাৎ শৈশব থেকেই প্রতিষ্ঠানের মোকাবেলা করতে হয়েছে। পাটনায় ম্যাট্রিক পাশ করার পর দাদাকে কলকাতায় সিটি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা, যাতে ইমলিতলার কুসংসর্গে ‘খারাপ’ না হয়ে যান । দাদা উত্তরপাড়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের খণ্ডহর-বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে থাকতেন । আমাদের বাড়িতে প্রথম স্কুল-কলেজে পড়া সদস্য ছিলেন দাদা । সংবাদপত্র-নাটক-উপন্যাস পড়া আর সিনেমা দেখাকে ইমলিতলার বাড়িতে মনে করা হতো অধঃপতনের নিদর্শন । ইমলিতলার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন, কেননা বড়োজেঠা আর ঠাকুমা ব্রাহ্ম-বিরোধী ছিলেন । পাটনার বঙ্গসংস্কৃতির নিয়ন্ত্রকরা সেসময়ে ছিলেন ব্রাহ্ম। কলকাতায় গিয়ে দাদা সমীর রায়চৌধুরী ( ১৯৩৩ - ২০১৬ ) প্রথমে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন এবং পরে ১৯৬১ সালে আমার সঙ্গে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করেন ; নব্বুই দশকের প্রথম দিকে চাকুরি থেকে অবসরের পর দাদা কলকাতায় এসে “হাওয়া৪৯” পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন ।
আমিও ‘খারাপ’ হয়ে যাচ্ছি অনুমান করে বাবা দরিয়াপুর নামে পাড়ায় চালাঘর কিনে বাড়ি তৈরি করেন । আমরা সেখানে উঠে যাবার পর পাটনা শহরের বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে।
বস্তুত বঙ্গসংস্কৃতিতে জোর করে প্রবেশের জন্য আমি আর দাদা দুজনেই ইমলিতলার নিষেধগুলো উপেক্ষা করে সংবাদপত্র-নাটক-উপন্যাস পড়া আরম্ভ করেছিলুম । দাদা কলকাতা থেকে তিরিশের দশকের কবিদের বই আর খ্যাতিমান লেখকদের বই আনতেন । মায়ের জোরাজুরিতে আমাকে ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে ভর্তি করা হয় । এই স্কুলের গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর প্ররোচনায় আমি রবীন্দ্রনাথসহ বিভিন্ন ব্রাহ্ম ভাবুকদের বই বাড়িতে আনা আরম্ভ করেছিলুম । চাকুরিসূত্রে চল্লিশ বছর সারা ভারতের অজস্র গ্রাম ঘুরে-দেখে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের দাঁত-নখ প্রয়োগের ক্ষমতার সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় হয়েছে ।
বঙ্গসংস্কৃতিতে প্রবেশের আগল ভাঙার জন্য লেখালিখি জরুরি হয়ে গেল । বাবা একটা ডায়েরি দিয়েছিলেন । আমি তাতে মনের কথা লিখতুম । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর বুঝতে পারলুম যে কলকাতায় বিশেষ কিছু মানুষ নিজেদের মনে করেন বঙ্গসংস্কৃতির মালিক । সুতরাং কলকাতাতেও সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলা জরুরি হয়ে দেখা দিল । আমার লেখালিখি মূলত প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতার আধার । আমি টাকাকড়ি, পুরস্কার, সম্বর্ধনা ইত্যাদির জন্য লিখি না । লিখি প্রতিষ্ঠানের ঠেকগুলোর দেওয়াল ভেঙে ফেলার জন্য ।