• প্রথম পাতা
  • ভাটিয়া৯
  • টইপত্তর
  • বুলবুলভাজা
  • হরিদাস পাল
  • খেরোর খাতা
  • শ্রেণীবদ্ধ
  • প্রকাশনা
  • আমাদের কথা
  • গুরুভার
  • গুরুসন্ধান
গুরুচণ্ডা৯
লগ ইন

এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে গুরুচণ্ডা৯র বই পেতে চাইলে ফোন অথবা হোয়াটসঅ্যাপ করুনঃ +৯১ ৯৩৩০৩ ০৮০৪৩ অথবা +৯১ ৮৭৭৭৬ ৪২২৩৪ নাম্বারে।
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • মলয়ের লেখাপত্তর

    pi
    বইপত্তর | ২৪ মার্চ ২০১২ | ১৯৭১৯৭♦ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা : ৫৬৭৮৯১০১১১২১৩১৪১৫
  • মুনিরা চৌধুরী | 122.179.172.247 | ৩০ আগস্ট ২০২১ ১২:৪৮734914
  • মুনিরা চৌধুরীর কবিতা 

     

    মৃতের মাতৃমঙ্গল

    দু’ চোখের পাথর ছিদ্র করে গড়িয়ে পড়ে জল

    পৃথিবীর প্রাচীন কবরে

    হায়! এ-আনন্দধারায় আমিও জেনে যাই- বর্ষা এসেছে, তাজা জলে ডুব দেবে কঠিন কাছিম…

    .

    পাতিহাড়ে পড়ে বৃষ্টির ফুল, চকিত হরিণ ভয় নেই তোমার

    আদি বর্ষায় জল আর গহীন জঙ্গলে আমরা ছিলাম আদি ভাই বোন…

    সর্বদা মানুষ থাকি না তাই

    অর্ধেক চাতক, চাতকিনী…

    প্রতিঅঙ্গে বৃষ্টির গজল মাখি আমি আর মৃত ঠাকুর মা (সঙ্গে তাঁর ধর্মান্তরিত প্রেমিক)

    .

    হায় বর্ষা! জীবিত আর মৃতের

    অনন্ত মাতৃমঙ্গল…

    .

    ২.

    পৃথিবীর জানালায় ভর দিয়ে দেখছি

    গাছের পাতাগুলো কাঁপছে, পাতার আড়ালে স্বর্গের ফল ঝুলে আছে

    নদীতে নেমে-যাওয়া সেই রাস্তাটায় ঝিরঝির হাওয়ার মুখ ভেসে ভেসে ডুবে যায়…

    অনেকটা ডুবন্ত মানুষের চোখে দ্রুত সরে যাচ্ছে জলের প্রবাহ

    .

    এভাবেই

    রোকমচিন্তাহীন, ভাবেই এক জীবন…

    .আবছা গোধূলির আলো ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই কেউ প্রথম বাতিটি জ্বালিয়ে দিলো

    সে আলো জ্বলজ্বল করছে আয়নায়

    যেন মহারাত্রির অপেক্ষায় একটি জোনাকিপোকা।

    ৩.

    এবার সত্যি সত্যি বিদ্যুত চমকায়

    খাঁচা থেকে পাখিগুলো বেরিয়ে আসে

    বিদ্যুতের ছিদ্রে পাখিগুলো ঘুমিয়ে পড়ে আবার জেগে ওঠে।

    ক্রমে পালক ঝরছে, পাতা ঝরছে, শিশির ঝরছে…

    কতিপয় মানুষ পাখির শরীরে প্লাস্টিকের পালক লাগিয়ে দিয়ে যায়

    পৃথিবীতে আবার ঝড় আসে

    আর প্রতিটি ঝড়ের শেষে ভোর বেলা দেখি

    ধর্মবিদ্যালয়ের আলখাল্লা পরা সেই ছাত্রদের মত পাখিগুলো আমার উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে I .

    ৪ .

    ফ্লাক্সের মধ্যে তরল চা-বাগান লুকিয়ে রেখেছিলাম

    এখন আফিমের গন্ধ পাচ্ছি; পান করছি পরমায়ু…

    .বারান্দার মাথায় রঙিন কাচের স্কাইলাইট

    ছায়াচিত্রটি ক্রমে মুছে যায়

    টবে-ঝোলানো বারান্দা স্থায়ী হয়ে যায় ধূসর দেয়ালে দেয়ালে

    ঘরের মধ্যভাগ ছিদ্র করে এক বাটি আলো স্থির পড়ে থাকে মেঝেতে।

    বেতের চেয়ারে তুমি বসে আছো, স্বর্গ পলাতক

    বাদামি চুলে যেনো পুরনো এক ফটোগ্রাফের পূর্ণিমা, পরিষ্কার হাওয়ার কোলাহল…

    আর আমি হতে চাই সেইজন

    যে তোমার অভিনয় আর গলার স্বরের ওপারে যেতে পারে।

    .৫ .

    সবুজ-সন্ত্রাসের অধিকার অপন করেছো

    নিজের মতো করে

    নিজের ভেতরে…

    রক্তের পাশে ঝলসানো হৃৎপিণ্ড

    এলোমেলো চাঁদের মাংস আর

    আগুন-লাগা রক্তজবার যৌবন বাড়িয়ে দিয়েছো বহুবর্ষ।

    .কে তুমি মহাকাল, ১৯১৭…

    বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে চাওয়া নিম্মচাপ আজ বড়ই প্রবল…

    কেনো এক বসন্তদিনে শুনেছিলাম, রাজপুত্র আসবে ঘোড়া-টানা-গাড়িতে করে…

    সেই রাজপুত্র কোনোদিন আসেনি

    প্রিয় রাক্ষস এসেছে, যার জন্ম হয়েছে আমার করোটী থেকে

    .

    ৬ .

    স্বপ্নেরও হাত আছে, চোখ আছে, ঠোঁট আছে…

    দু’বছর আগের সেই শিউলি-ফোটা ভোরেরও অবয়ব ছিল

    আজ গোপন পাঁজর খুলে দেখলাম

    আমার জীবনের সেই একটা মাত্র ভোরের মুখখানা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে…

    .আমি সঙ্গপনে ঠাকুর মা’র পিতলের কৌটা থেকে শরৎকাল বের করে নিয়ে আসি

    স্বর্গের শিশির দিয়ে ধুয়ে দেই ভোরের দুইচোখ, মথুরা বৃন্দাবনের ঘুমসমগ্র।

    .

    ৭ .

    আজ এই পূর্ণিমার রাতে

    পূর্বপুরুষের নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে গলিত কফিনের ভেতর

    কাগজের পরতে নড়ে উঠছে জিরাফের মাথা, গোপন রক্তপ্রবাহ

    প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা সাদা কাগজের মুখ মিলিয়ে যাচ্ছে গহীন কুয়াশায়।

    .

    স্থির দাঁড়িয়ে থাকি

    গ্রহণ করি কুয়াশার কামড়…

    .

    একসময় সূর্য উঠে

    কষ্টিপাথরের গন্ধ ফেটে পড়ে গর্ভবতী মায়ের জঠরে

    জবাই-হওয়া শব্দের গলা বেয়ে সাদা রক্ত ঝরছে তো ঝরছে…

    অবশিষ্ট তারা ফাঁসির জন্য ছটফট করে।

    .শব্দের ফাঁসি দেবো বলে

    কাগজ কলমের বদলে বিস্মৃতির মেহেকানন্দা নদী নিয়ে আসি

    শব্দের বদলে ঝুলে পড়ে ঈশ্বরের গলা।

    .

    ৮.

    আমার ডায়রিতে একটুও জায়গা নেই

    ব্লেড দিয়ে কাটা-রাত আর নার্ভ থেকে ঝরা-রক্ত চারদিকে।

    কিছু রক্ত আবার পুড়ছে। কাটা-মাংস হতে শূকরের আর্তচিৎকার ভাসমান…

    ছিলে-তোলা চাঁদের খোসা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে…

    .

    ডায়রিতে আছে হরিণের মাথা, কাক ও পেন্সিল, আমার প্রেমিকের কলিজা ও পাতিহাড়

    মৃত ঈশ্বরের কবর ও চিতা পাশাপাশি

    .আজ একপাল মৃত পাখি উড়ে এসেছে ব্যাবিলন থেকে, আরও একবার আত্মাহুতি দেবে বলে।

    .আমি ডায়রির ভেতর লুকিয়ে পড়েছি

    ছায়া ও শব্দের ছাইদানীর ভেতর ছাই হচ্ছি, ছাই।

    .

    ৯.

    আমি জেগে থাকি

    কাটা-হাতখানা অন্য-হাতে নিয়ে সারারাত জাগি

    অনন্ত ভোরের দিকে হাতের গহীনে জ্বলে ওঠে হাতের চিতা

    .

    হাড়-গলা গরম ঘন হয়ে এলে কেবল শীত শীত লাগে… ঘুম লাগে

    .

    এইসব মুনিরা ঘুমের ঘোরে কোথাও কোনো জানালা নেই; সই সই নয় দরজার বাতাস…

    .১০.

    ছায়া ছায়া, অন্ধকারে ডুবে হাওয়া, মুখ দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই

    ছায়ার ভেতর মিশে যাওয়া দু’টি আবছা ছায়ামূর্তি

    একই রকম অথচ কত আলাদা

    একটি শরীর নিষ্ক্রিয়, নির্দোষ, নিস্পৃহা আর চরম উদাসীনতা নিয়ে চলছে মাটির ওপর…

    আর

    অন্যটি সামান্য ঝুঁকে, আবর্জনা আর ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টায় হাঁপাচ্ছে…

    .

    মাঝে-মধ্যে থেমে থেমে নি:শ্বাস নেয়ার চেষ্টা

    তারপর আবার আরো ঝুঁকে টেনে টেনে চলে তার বোঝাখানি

    হতচকিত হয়ে দেখতে পেলো কী সামান্য পথই না পের হয়েছে!

    .ছায়া ডুবে গেলে

    ঘরের ভেতরে ঘর আর চোখের ভেতরে চোখ ঘুমিয়ে পড়ে

    হয়তো জোনাকী পোকার ভেতর পৃথিবীর অবশিষ্ট আলো জেগে আছে!

    .

    ১১.

    পাতার পরত বেয়ে বেয়ে ঝরে-পড়া ঝর্ণার আওয়াজ

    হাড় হতে হাড়ের ভেতরে…

    গাছের বুক হতে পাখিদের বুক বেয়ে ধাবমান, বৃষ্টির বিলাপ।

    বিক্ষুদ্ধ

    বাতাসের গান…

    .

    বাতাসের হাত-পা-আঙুল আমাদের কাঁচের জানালায় ডুবে ডুবে যায়

    গ্রীষ্মের এই গহীন সন্ধ্যায়

    .

    অগ্নিকালো আকাশের নিচে দীর্ঘ দাঁড়াই

    আমি আর আমার ছোটবোন আত্নহত্যা

    .এখন কি পরিস্কার হলো তোমাদের আয়নার কুয়াশার আবরণ!

    .

    ১২.

    চোখ জোড়া যেনো ঘুমের মধ্যে গলে যায়…

    উঁচু উঁচু বিশাল ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে নৌকা চালাই

    নৌকায় আমার মৃত ঠাকুরমা আর মহাশূন্যের একটি পিঙ্কি বিড়াল

    '

    চোখবিহীন ঘুমের সর্বত্র শুধু ঘুম

    কপালের দু’পাশে সাগরের ঢেউয়ের মতই নাড়ি টিপটিপ করে

    মনে হয় দুই খন্ড ভাবনার সমুদ্র

    .

    এরপর কি হলো?

    না, এর আগে কি হয়েছিলো?

    অবশ্য আগে-পরে বলে কিছু নেই

    যাত্রা সবসময়ই বর্তমানের

    নৌকা, মৃত ঠাকুরমা আর পিঙ্কি সবকিছুই বর্তমান মুহূর্তের অস্তিত্বশীল

    সবকিছুই স্থিরীকৃত

    স্থির আবার চলমান

    ঘুমের বিপুল ননীর মধ্যে সবকিছু দোলে…

    .

    মুখে চোখ নেই, চোখের তারা নেই

    আছে কেবল সর্বব্যাপী ঘুম

    দুই চোখের পাতা জুড়ে ঘুমের প্রপাত I

    হেমন্তে রচিত হেমলক

    ১ মহাকালের ছবি দেয়ালে টাঙিয়ে ছিলাম সেই কবেকার ঘোরগ্রস্ত ভোরে, সেলাই করে করে... সেইসব ছায়া-চেহারাগুলো এখন ঝাপসা হয়ে গেছে... ছাদের উপর বৃষ্টির আঙুলগুলো ফেটে পড়ছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে না কি কান্নায়- ঠিক বুঝতে পারি না... কৈশোরে কাগজের নৌকা ভাসিয়েছিলাম পুকুরে... ভেবেছিলাম- নৌকাগুলো বড় হবে একদিন, দেখা হবে মেহেকসমুদ্রে...

    আমার পাখিরা আর উড়াল দিলো না... দূর অতীতে পাখিদের ডানা কেটে দিয়েছিলাম পাখিদের ডানা রেখে দিয়েছিলাম ছোটবেলার অ্যালবামে...

    ২ এখন নৈঃশব্দের শব্দরা ঘুমিয়ে পড়েছে... চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে... মরুভূমিতে একা একা টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছি বালির নৌকো

    দূরতম জানালার পাশে দেখি- চিরচেনা কারো ছায়া ভেসে ভেসে ডুবে যায় আয়নাগুলো গলে গলে যায়...

    চক্ষু খুলে দেখি- কোথাও চক্ষু নেই, ছায়া নেই, বিম্ব-প্রতিবিম্ব নেই শূন্য কুঠরিতে পড়ে আছে মৃত সব মুনিরামায়া আমার অগ্নিমায়া...

    ৩ নরকের নীল আগুনের চারপাশে লেলিহান জিহ্বাগুলো উড়ছে উড়ন্ত জিহ্বায় গেঁথে যাচ্ছে আর্তনাদের ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি আমি যাই নি কোথাও আমার পাণ্ডুলিপি থেকে সবগুলো লেখা চলে গেছে

    হাতখানি যে রক্তে ডুবে আছে... কী করে লিখি কথা ও মুনিরাকথা, নদী ও মেহেকানন্দার জল তবু- স্ফটিকের পাখি প্রত্নকলম তুলে দিচ্ছে হাতে

    আমায় ক্ষমা করো পাখি, পাখির পালক, আমায় ক্ষমা করো নদী, নদীর দুইপাড় আমায় ক্ষমা করো ক্ষমা করো ক্ষমা করো ক্ষমা করো ক্ষমা করো রক্তকরবী আমি যে পাথর কুচি...

    ৪ ভেবে নাও তুমি- মঙ্গলরূপ কিছুটা পুড়ে গেছে পুড়ে-যাওয়া জলের ছোবলে ভোর বেলার আলোয় কোনো কমলা-রঙ নেই, ছাই-রঙা বালিকার গুড়া গুড়া শরীর ব্যতিরেকে ভাঙ্গা মন্দিরের পাশে আমাদের ভাঙ্গা-শঙ্খের আওয়াজ ভাঙছে তো ভাঙছে সখা হে, মমি হয়ে শুয়ে আছি অগ্নিঝর্ণার নিচে

    আর জাগবো না আর জাগবো না

    কেনো জাগাতে চাও তবে কেনো জাগাতে চাও ঘুমিয়ে-পড়া মৌমাছির ঝর্ণা

    এই মমি আবার কি মানবী হবে মথুরা বৃন্দাবনে।

    মেহেরকান্দার কবিতা

     

    আয়নার দাগ


    আয়না হতে পিছলে পড়েছে মুখগুলো

    আজ তোমার মুখের গভীরে দেখি ভেঙে-যাওয়া সেই আয়নার দাগ।

    বিবর্ণ থৈ থৈ

    বিধবার শাদা চোখের মতো চারদিক…

    হে দিন, হে রাত্রি, হে বসন্ত, হেমন্ত মৌসুম

    হে প্রজাপতির ডানা, পাখির পালক, হে বৃন্দাবনের সিঁদুর

    কোথাও কোনো রঙ নেই

    আমাদের মেহদীবাগান কালো কুয়াশার নিচে ঢাকা পড়ে আছে।

    শুনেছি পাথরে মেহদীপাতা ঘষলে রঙের হলাহল বের হয়ে আসে

    আমি আজ হৃৎপিণ্ডকে পাথর বানিয়ে নিয়েছি।


    মৃত্যু, মুনিরাহেনা…


    আজ এই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ ফেটে গিয়ে

    নীল-বর্ণ আলো ঝরছে

    নরক প্রদেশে।

    নরকের নয় দরজা খুলে বসে আছি আমি আর একটা অন্ধ হরিণী…

    দু’চোখ ছিদ্র করে

    গলিত চোখের রঙে চন্দ্রের পিঠে এঁকে দিয়েছি গাছের ছবি

    এই গাছ স্বর্গের গাছ

    এক একটা শিশু মৃত্যুর পর সেই গাছে একটা করে ফুল ফোটে

    ওহ ঈশ্বর

    সময় হলে কি তুমি দেখে যাবে

    সেই গাছে অনেক অনেক ফুল ফুটেছে

    তুমি কি একবারও শুঁকে যাবে না হাসনাহেনা অথবা মুনিরাহেনার গন্ধ!


    নয় দরজার নদী


    ১.

    তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল নয় বছর আগে

    এই নয় বছরে নয়-দরজার-নদী তৈরি করেছি

    তুমি কি একবার সময় করে আসবে

    জলের জানালাগুলো লাগিয়ে দিয়ে যাবে!

    ২.

    সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ছিপছিপে এক মাতামুহুরী নদী

    নদী পেরিয়ে যাচ্ছে সময়

    হাতের নীলবর্ণ রেখায় এ-কার ছায়া দেখা যায়!

    ছাদের উপর বৃষ্টির গুঞ্জন থামছে না কিছুতেই

    তানপুরার হৃৎপিণ্ডে আঙুল ফেটে গেলে বুঝতে পারি না

    এ-কান্না উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের নাকি মাতামুহুরীর

    ঘরের জানালা কিছুতেই বন্ধ হয় না

    আমাদের জানালায় আটকে রয়েছে নদীর দরজা।

    ৩.

    চাঁদের শরীর থেকে বের হচ্ছে ধূয়া ও শিশির

    দুই হাজার বছর আগেকার রাত ছাই হবে দুই হাজার সতের সালে

    দু’চোখের অন্ধ ছায়া উড়ে যাচ্ছে অন্ধকারে

    পাখিরা নৌকা চালায় বাতাসের নদে

    নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে ধীরে

    গাছের

    মানুষের…

    ফাটা-নিঃশ্বাসে তুমি কি একবারও আত্নহত্যা করতে আসবে না!

    ৪.

    বিষ পান করছি নাকি বিষের নিঃশ্বাস নিচ্ছি

    পান করছি পরমায়ু

    প্রজাপতির ডানা লাগিয়ে দিয়েছি

    ধীরে চলো

    ধীরে চলো

    নিমাই সন্ন্যাসীর গ্রাম যে বহু দূর

    ঐ দূরত্বে

    নিভে যাচ্ছে অতলান্ত এক আত্মার ছায়া…

    ৫.

    কে যেন আমার কন্ঠস্বর থেকে

    নিদ্রাতুর কিছু শব্দ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায় নিধুয়া পাথারে

    অতঃপর কাচের করাত দিয়ে শব্দগুলো কুচি কুচি করে ভাসিয়ে দেয়

    আড়িয়াল খাঁ’র বুকে

    ভাসে গলাকাটা নদী

    ভাসে নারী

    ভাসে গলাকাটা নক্ষত্র

    শকুনের ডানায় চিৎকার ভাসে জল ও স্থলভূমে…

    মৃত্যুর গন্ধ চৌদিকে

    দূরে যাই

    দূরে যাই

    পৃথিবীর কোনো এক রান্নাঘরে আলু-পটল কাটতে ভুলে যাই

    আমি আমাকে কেটে ফেলতে ভুল করি না

    ওহ পাখি, পরমাত্মা…

    আট দরজার আগুন

    সবুজ-সন্ত্রাসের অধিকার আপন করেছো

    নিজের মতো করে

    নিজের ভেতরে...

    রক্তের পাশে ঝলসানো হৃৎপিণ্ড

    এলোমেলো চাঁদের মাংস আর

    আগুন-লাগা রক্তজবার যৌবন বাড়িয়ে দিয়েছো বহুবর্ষ।

    কে তুমি মহাকাল, ২০১৭...

    বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে-যাওয়া নিম্নচাপ আজ বড়োই প্রবল...

    কেনো এক বসন্তদিনে শুনেছিলাম, রাজপুত্র আসবে ঘোড়া-টানা-গাড়িতে করে...

    সেই রাজপুত্র কোনোদিন আসে নি

    প্রিয় রাক্ষস এসেছে, যার জন্ম হয়েছে আমার করোটী থেকে

     দিনান্তে

    এ-যে কবিতা এক, চম্পাবতী নদীতীরে কেশর উড়িয়ে দেওয়া

    বোবার না-বলা কথাগুলো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা, তারপর

    পাখিদের ঠোঁটে তুলে দেওয়া…

    হায়!

    .

    শব্দ বদল হতে হতে পাখির সঙ্গে পাখা বদল করে কবিতা…

    .

    নদীতীরে বটগাছের গর্তে কাঁচা-পাকা সময় বেড়ে উঠছে ধীরে

    দুলছে শীর্ণ তরুলতা, সাপের বাচ্চা

    .

    দিনান্তে পাখি উড়ে যায়

    নদীতীরে পড়ে থাকে মানুষের পালক। দিনান্তে

    এ-যে কবিতা এক, চম্পাবতী নদীতীরে কেশর উড়িয়ে দেওয়া

    বোবার না-বলা কথাগুলো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা, তারপর

    পাখিদের ঠোঁটে তুলে দেওয়া…

    হায়!

    .

    শব্দ বদল হতে হতে পাখির সঙ্গে পাখা বদল করে কবিতা…

    .

    নদীতীরে বটগাছের গর্তে কাঁচা-পাকা সময় বেড়ে উঠছে ধীরে

    দুলছে শীর্ণ তরুলতা, সাপের বাচ্চা

    .

    দিনান্তে পাখি উড়ে যায়

    নদীতীরে পড়ে থাকে মানুষের পালক।

     

    মেহেকনন্দা নদীতীরে

     এক.

    আত্মহারা আমি— বেঁচে থাকবো নাকি মরে যাব

    কে ডাকছে আমায়! তুমি না স্বয়ং ঈশ্বর!

     

    পিয়ানোবাদক মঞ্চে এসে বসলেন। একটু কায়দা করে কাশলেন। এরপর একমুহূর্তের জন্য ধ্যানমগ্ন হলেন। ঘর আলো করা উজ্জ্বল ঝাড়বাতিটি একসময় ম্লান হয়ে একটা নরম আলোয় এসে থামে। আর স্তব্ধতার মধ্য থেকে জেগে ওঠে একটি সুরধ্বনি, ক্রমে যা সংযত ও পরিমিত বিস্তারের সঙ্গে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে।

     

    ‘মোৎসার্ট কি?’ ভাবি। যথারীতি প্রোগ্রামটা চাইতে ভুলে গেছি। ‘মোৎসার্ট বোধহয়, নাকি স্কারলাট্টি?" গানের ব্যাপার এত কম জানি! অবশ্য এমন নয় যে, গান বুঝি না বা ভালোবাসি না। শৈশবে পিয়ানো শেখার আবদার তো আমি-ই করেছিলাম। যে বছর শিখতে শুরু করেছিলাম সে বছরই ছেড়ে দিলাম। ছেড়ে দেবার কারণটি যেমন সোজা, তেমনি লজ্জারও।

     

    কিছুতেই স্বরগ্রামের ‘মা’ ধ্বনিটি শিখে উঠতে পারিনি। কিছুতেই না। বুঝি না ‘মা’ এর পর কেন আর কিছুই মনে থাকে না। এই দেখে মা এর কী রাগ! না জানি কতটা কষ্ট পেয়েছেন! মেয়েটা অপদার্থ! তাই অপদার্থ হিসেবে দেখাই তার সহজ মনে হয়েছিল।

     

    আমি আর কষ্ট করতে পারি না। কোনো লাভ নেই। থাকগে ও নিজের মতো পড়াশোনা না করলে নাই করুক। ওর যদি ভূতের গল্প শুনতেই ভালো লাগে, তাই সই। ষোলো বছরেও যদি পুতুল খেলতে চায়, খেলুক ও পুতুল নিয়ে।

     

    না হলো পুতুল খেলা, না হলো পড়াশোনা। মূর্খ হওয়ার কী আনন্দ!

     

    দুই.

    আজ আমার কোনো কর্ম নেই

    মেহেকানন্দা নদীতীরে কেবলই রোপণ করছি বৃষ্টি ও কৃষ্ণদাগ...

     

    হঠাৎ শরীরটা কোনো একটা বিন্দুতে আটকে গেলে সে পেছন ফিরে তার পা দুটো ধরে দাঁত কামড়ে শক্ত মাটির ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে ঢালু জমিন ধরে চলতে লাগলো। টেনে নেয়া শরীরের মাথাখানি এদিক-ওদিক দুলছিল, যেন সে অবস্থান পাল্টানোর জন্য আনন্দ প্রকাশ করছে। হঠাৎ বাঁক নেয়া একখানা গাড়ির আলোর ঝলক আবর্জনা, ঝোপ আর আসমান ভূমির ওপর পড়ে চারপাশ উজালা করে তুললো। লোকটি তখন চট করে শুয়ে পড়ে অপরজনের পাশে। এক মুহূর্তের জন্য দুটো মুখের বৈশিষ্ট্য যেন আঁকা হয়ে রইলো, একটি ভয়ে নীলবর্ণ, অপরটি ধুলোয় ভরা, অনুভূতিহীন। আবার অন্ধকার গ্রাস করে নেয় দুজনকে। লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে আরও কিছুদূর টেনে নিয়ে গেল বোঝা, পথ রোধ করে দাঁড়ানো উঁচু ঝোপগুলো পর্যন্ত। তারপর আবর্জনা আর শুকনো ডালপাতা দিয়ে ঢেকে দিলো। যেন সে ভাগাড়ের দুর্গন্ধ আর আসন্ন বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে চাইছে। অতঃপর একটু থেমে কপালের ঘাম মুছে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে শব্দ করে থুথু ফেলে। এমন সময় শিশুর কান্নার শব্দে সে চমকে ওঠে। আবর্জনার মধ্য থেকে উঠে আসা ক্ষীণ চাপা কান্না, যেন তার নিচে চাপা পড়া মানুষটিই শিশুর রূপ ধরে কেঁদে উঠে অভিযোগ জানাচ্ছে।

     

    সে পালাতে গিয়েও থেমে যায়। বিজলি চমকানোর আলোয় অন্ধকারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো পুলের লোহার মাস্তুল; আর সে হতচকিত হয়ে দেখতে পেল, কী সামান্য পথই না পার হয়েছে। পরাজয়ের গ্লানিতে তার মাথা নত হয়ে আসে। সে হাঁটু গেড়ে বসে গন্ধ শুঁকে শুঁকে সেই একঘেয়ে ক্ষীণ কান্নার উৎসের দিকে এগিয়ে চলে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক দলা শাদা বস্তু। হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে সে কিছুক্ষণ। তারপর চলে যাবার জন্য ইতস্তত কয়েক পা এগিয়েও বেশিদূর যেতে পারলো না। কান্নার শব্দ তাকে পেছনে টেনে ধরে রাখলো। সে একটু একটু করে আবার ফিরে এলো, ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকলো তার। আরেকবার হাঁটু গেড়ে বসলো সে, তখনো দ্বিধান্বিত। তারপর দু`হাত বাড়িয়ে দিলো। সেই শাদা পিণ্ডের মোড়কটি নড়েচড়ে ওঠে। সেখানে ছোট্ট এক মানবশিশু কতগুলো খবরের কাগজের পাতার মধ্যে যুদ্ধ করছে। লোকটি তাকে কোলে তুলে নেয়। তার ভাবভঙ্গি অনিশ্চিত, অনেকটা যেন প্রবৃত্তি তাড়িতের মতো, যেন সে কী করছে নিজেই জানে না, অথচ না করেও পারছে না। সে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। যেন তার এই আচমকা অপ্রত্যাশিত কোমল ভাবাবেগের জন্য নিজের ওপর বিরক্ত সে; তারপর নিজের অজ্ঞাতেই গায়ের জ্যাকেট খুলে সেই জলে ভেজা কান্নারত শিশুটির গায়ে জড়িয়ে দেয় এবং হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিয়ে অনেকটা দৌড়োনোর ভঙ্গিতে সে ওই কান্নাকে সঙ্গে নিয়ে ভাগাড় থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

     

    অস্তিত্ব বিলীন হলো

    অন্য কোনো সঙ্গ বা অনুষঙ্গে নয়

    আমরা এক সঙ্গেই মারা যাব...

     

    তিন.

    কৃষ্ণদাগ ঘন হচ্ছে

    খা খা করছে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া দুটি আবছা ছায়ামূর্তি

    মুখ দেখা যাচ্ছিল তো দেখা যাচ্ছিল না...

    একই রকম অথচ কত আলাদা

    একটি শরীর নিষ্ক্রিয়, নির্দোষ, নিস্পৃহা আর চরম উদাসীনতা নিয়ে চলছে মাটির ওপর দিয়ে...

    অন্যটি সামান্য ঝুঁকে তাকে আবর্জনা আর ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে চলার কষ্টে হাঁপাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে থেমে দম নেবার চেষ্টা

    তারপর আরো ঝুঁকে টেনে চলে বোঝাখানি।

    হাজামজা নালার পচা জলের গন্ধে চারদিক ক্রমে আরো দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে ভাগাড়ের মরচে ধরা জঞ্জাল আর মৃত প্রাণীর গলিত মাংসের বদবুতে, বাজে আবহাওয়ার দিনের মতো এই পচা থিকথিকে গন্ধই যেন ঝেড়ে ফেলতে চাইছে থেকে থেকে মুখ মোছার ভঙ্গি করে। ঘন ঝোপের গায়ে জড়াজড়ি করে পড়ে থাকা রুপালি ইস্পাত কিংবা কাঁচের টুকরোর ঘষা লেগে উদ্ভুত একঘেয়ে ভুতুড়ে সংগীত দুজনের কারোরই কানে যাবার কথা নয়। মাটির নিচ থেকে ভেসে ওঠা নগরের চাপা গুঞ্জনের শব্দও নয়। এমনকি যাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই নরম শরীরের সঙ্গে মাটি, ঝরাপাতা, কাগজের টুকরো, ছেঁড়া জুতো, দোমড়ানো টিনের প্যাটরা ও নুড়ি পাথরের ঘষটানোর শব্দও নয়। মাঝে মাঝে কোনো উঁচু পাথর কিংবা গাছের ডালে তার কাঁধ ঠেকে যাচ্ছিল। সে এখন গা ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছিলো, মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল ক্রুদ্ধ আওয়াজ, অনেকটা বিশাল বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া মুটেদের মুখ নিঃসৃত বায়বীয় ‘হাঁ’ ধ্বনির মতো। বোঝাখানি নির্ঘাৎ ভারি উঠছিল ক্রমশ। তবে শুধু নীরব প্রতিরোধই নয়, যতশীঘ্রি সম্ভৱ কার্যোদ্ধারের তাড়াতে সমস্ত শক্তি যে ক্ষয়ে যাচ্ছে সেটাও ভীত করে তুলছিল।

     

    প্রথমে সে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলছিল। রাত্রি এতটা মেঘে ঢাকা না থাকলে কারোও চোখে পড়তো কোনো উদ্ধারকার্যের ওল্টানো নেগেটিভের মতো দু`জোড়া হাতের যুগল বন্দি। কৃষ্ণদাগ ঘন হচ্ছে করুণ কান্না ও কীর্তনের সুর...

     

    আজ কোনো কর্ম নেই

    মেহেকানন্দা নদীতীরে কেবলই রোপণ করছি বৃষ্টি ও কৃষ্ণদাগ…


    ছায়াচিত্র

    ১.

    দূর শৈশবে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে

    কাচের টুকরো কুড়িয়ে পেয়েছিলাম

    কাচের ভেতরে নিজের চেহারা লুকিয়ে রেখেছিলাম।

     

    নিজের চেহারা লুকিয়ে রেখেছিলাম বাবা-মা, ঠাকুর মা, চন্দ্র-সূর্য্য হতে বহুদূর

    দূরতম কোনো গ্রহের গভীরে...

     

    তিরিশটি বছর ঘুমঘোরে ছিলাম

     

    ঘুম-ভেঙ্গে দেখি-

    আমি সেই কাচের টুকরো হারিয়ে ফেলেছি   

    আমি আপন চেহারা হারিয়ে ফেলেছি।


    ২.

    ফ্লাক্সের মধ্যে তরল চা-বাগান লুকিয়ে রেখেছিলাম

    এখন আফিমের গন্ধ পাচ্ছি; পান করছি পরমায়ু...

     

    বারান্দার মাথায় রঙিন কাচের স্কাইলাইট

    ছায়াচিত্রটি ক্রমে মুছে যায়

    টবে-ঝোলানো বারান্দা স্থায়ী হয়ে যায় ধূসর দেয়ালে দেয়ালে

    ঘরের মধ্যভাগ ছিদ্র করে এক বাটি আলো স্থির পড়ে থাকে মেঝেতে।

    বেতের চেয়ারে তুমি বসে আছো, স্বর্গ পলাতক

    বাদামি চুলে যেনো পুরনো এক ফটোগ্রাফের পূর্ণিমা, পরিষ্কার হাওয়ার কোলাহল...

    আর আমি হতে চাই সেইজন

    যে তোমার অভিনয় আর গলার স্বরের ওপারে যেতে পারে।

    কীর্তন

    ১

    মুনিরায়ানা কীর্তনীয়া সুরে

    বাজে বাঁশি, করুণ বাঁশের বাঁশি, বাজে হাড়ের বাঁশি...

    আয় তবে হাড় ভেঙ্গে ফেলি, নদীর দুই পাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়।

    .

    বাঁশির রসে এমন পূর্নিমাসুন্দরী ভাসে

    ঘৃতকুমারীর বনে

    .

     

    সখা হে

    আয়, মাঝ দরিয়ায় ভাঙ্গা তক্তা ও আমাদের কলিজার নৌকা ডুবিয়ে ফেলি

    চিরতরে

    চিরতরে।

    ‘

    অহ সুর!

    মুনিরায়ানা কীর্তনীয়া সুরে

    মৃত্যু ও প্রেম একাকী দাঁড়িয়ে রয়

    পৃথিবীর অনন্ত ভোরে।

    ২

    নয়নে আনন্দ-বিষাদ, মরা নদীর জল... 

    ওহে মধুমূর্তি

    নয়নের গভীরে বসো একবার

    বসো কাঙ্গালের সভায়

    .

    আসিবে, আশায় হৃদি-পদ্মাসন পাতিয়া রাখিয়াছি

    ধোয়াবো চরণ নয়নের জলে...এমন তো নয়

    .

    মুনিরাকথা

    ঈশ্বর হও

    তুমি কবি হও

    পৃথিবীর যত গান, এইসব কবিতাবলী

    গীত হোক, গীত হোক মৃতের সন্মানে…

    মুনিরাকথা

    বৃষ্টির সাথে কোনো এক নাইওরি এসেছিলো মেঘে-ঢাকা গ্রামের ঐপার থেকে

    ভেজা চুলের বন্ধন খুলে বসেছিলো

    আমার বারান্দায়...

    উপরের দিকে তাকিয়ে বললো

    সিন্দু মা, আকাশের গর্তগুলো ঝরে পড়ছে কেনো, খসে পড়ছে কেন নরম নাভীগুলো

    আমি তবে কোথায় গিয়ে থাকবো!

    তারপর সে নিমিষে নাই হয়ে যায়

    দিন যায়

    বছর যায়

    নাইওরি আর আসে না...

    আর আমার বুকের বারান্দায়

    চিরদিনের জন্য লেগে থাকে নাইওরির গন্ধ, মৃত্যুর মতো...

    ২.

    আয়না হতে পিছলে পড়েছে মুখগুলো

    আজ তোমার মুখের গভীরে দেখি ভেঙে যাওয়া সেই আয়নার দাগ।

    বিবর্ণ থৈ থৈ

    বিধবার শাদা থানের মতো চারদিক...

    হে দিন, হে রাত্রি, হে বসন্ত, হেমন্ত মৌসুম

    হে প্রজাপতির ডানা, পাখির পালক, হে বৃন্দাবনের সিঁদুর

    কোথাও কোনো রঙ নেই

    আমাদের মেহদীবাগান কালো কুয়াশার নীচে ঢাকা পড়ে আছে-

    শুনেছি পাথরে মেহদীপাতা ঘষলে রঙের হলাহল বের হয়ে আসে

    আমি আজ হৃৎপিণ্ডকে পাথর বানিয়ে নিয়েছি।

    ৩.

    কালো জ্বরে মৃত্যু হবে না হে পুত্র!

    আমার মৃত্যু হবে বেঁচে থাকাতে…

    নাইওরি

    বৃষ্টির সাথে কোনো এক নাইওরি এসেছিল মেঘে-ঢাকা গ্রামের ঐ পাড় থেকে

    ভেজাচুলের বন্ধন খুলে বসেছিল

    আমার বারান্দায়…

    উপরের দিকে তাকিয়ে বললো

    সিন্ধু মা, আকাশের গর্তগুলো ঝরে পরছে কেন, খসে পড়ছে কেন নরম নাভীগুলো

    আমি তবে কোথায় গিয়ে থাকবো!

    তারপর সে নিমিষে নাই হয়ে যায়

    দিন যায়

    বছর যায়

    নাইওরি আর আসে না…

    আর আমার বুকের বারান্দায়

    চিরদিনের জন্য লেগে থাকে নাইওরির গন্ধ, মৃত্যুর মতো…

    পাখি-পল্লি

    এবার সত্যি সত্যি বিদ্যুৎ চমকায়

    খাঁচা থেকে পাখিগুলো বেরিয়ে আসে

    বিদ্যুতের ছিদ্রে পাখিগুলো ঘুমিয়ে পড়ে আবার জেগে ওঠে।

    ক্রমে পালক ঝরছে, পাতা ঝরছে, শিশির ঝরছে…

    কতিপয় মানুষ পাখিদের শরীরে প্লাস্টিকের পালক লাগিয়ে দিয়ে যায়

    পৃথিবীতে আবার ঝড় আসে

    আর প্রতিটি ঝড়ের শেষে ভোর বেলা দেখি

    ধর্ম বিদ্যালয়ের আলখাল্লা পরা সেই ছাত্রদের মতো

    পাখিগুলো আমার উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

    ভবানীপুরের কবিতা

    রক্তের ভেতর একটা নদী থেকে আরও একটা নদী

    বিস্মৃতির ভবানীপুরে বৃষ্টি দিচ্ছে…

    বৃষ্টি দিচ্ছে

    বৃষ্টি দিচ্ছে

    চোখ-ফাটা বৃষ্টির কান্না কোলে নিয়ে বসে আছি

    আমার সিতানের বালিশের টুকরোগুলো এলোমেলো

    ঘুম আসে…

    ঘুম দাঁড়াতে পারে না কোথাও

    ঘুম দৌড়াতে পারে না কোথাও

    ঘুম বসতে পারে না কোথাও

    ঘুম ঘুমুতে পারে না কোথাও

    অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে এলোমেলো আয়নার মুখ

    মেহেকানন্দা কাব্য

    ১.

    পুরনো বইয়ের পাতা উল্টে চোখে পড়লো

    মমি হয়ে আছে কয়েকটা মাছি ও অচিন বৃক্ষের পাতা...

    মমি হয়ে আছে পাতার স্পন্দন আর মাছির উড়াল

     

    সাঁতার কাটি

    নয়'শ বছরের পুরনো সমুদ্রে একা...

     

    এ-কোন বিস্মৃতির জল কেবল ফেটে ফেটে যায়

    এ-কোন কাহিনী গাঁথা- শবযাত্রী, সানাই আর ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ

     

    স্বর্গের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে

    চুম্বন শেষে কেন তারা ঠোঁটগুলো ছুঁড়ে দিলো নরকের দিকে!

     

    দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসে

    দু'চোখে জন্ম নেয় অজস্র রক্তের ডালপালা...

     

    মেহেকানন্দা নদীতীরে অহ ঈশ্বর

    কোনো এক কুয়াশাভোরে তুমি কি রক্তডুমুরের ডালগুলো কেটে দেবে!

     

     

    ২.

    কে যেন রাস্তার পাশে মলিন চাঁদটাকে রেখে গেছে

    চাঁদের গায়ে হোচট খেলাম

    শুধু পা নয়, সমস্থ "আমি" ভেঙ্গে গেলে চাঁদের শরীর থেকে চাঁদনী ও আগুন বের হয়...

    জন্ম হয় দাউ দাউ চিতার...

    মহাআনন্দে পুড়তে থাকি পৃথিবীর প্রথম মানুষ

     

    ওহে শ্রীমতি. ঠাকুর মা আমার

    আমিও চিতা জ্বালানোর কৌশল শিখে গেছি।

     

     

    ৩.

    আয়না হতে পিছলে পড়েছে মুখগুলো

    আজ তোমার মুখের গভীরে দেখি ভেঙ্গে-যাওয়া সেই আয়নার দাগ।

     

    বিবর্ণ থৈ থৈ

    বিধবার শাদা থানের মতো চারদিক...

    হে দিন, হে রাত্রি, হে বসন্ত, হেমন্ত মৌসুম

    হে প্রজাপতির ডানা, পাখির পালক, হে বৃন্দাবনের সিঁদুর

    কোথাও কোনো রঙ নেই

    আমাদের মেহদীবাগান কালো কুয়াশার নীচে ঢাকা পড়ে আছে।

    শুনেছি পাথরে মেহদীপাতা ঘষলে রঙের হলাহল বের হয়ে আসে

    আমি আজ হৃৎপিণ্ডকে পাথর বানিয়ে নিয়েছি।

     

     

    ৪.

    আজ এই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ ফেটে গিয়ে

    নীল-বর্ণ আলো ঝরছে

    নরক প্রদেশে।

     

    নরকের নয় দরজা খুলে বসে আছি আমি আর একটা অন্ধ হরিণী...

     

    দু'চোখ ছিদ্র করে

    গলিত চোখের রঙে চন্দ্রের পিঠে এঁকে দিয়েছি গাছের ছবি

    এই গাছ স্বর্গের গাছ

    এক একটা শিশু মৃত্যুর পর সেই গাছে একটা করে ফুল ফোটে

     

    ওহ ইশ্বর

    সময় হলে কি তুমি দেখে যাবে

    সেই গাছে অনেক অনেক ফুল ফুটেছে

     

    তুমি কি একবারও শুঁকে যাবে না হাস্নাহেনা অথবা মুনিরাহেনার গন্ধ!

     

     

     

    ৫.

    চাঁদের শরীর থেকে বের হচ্ছে ধূয়া ও শিশির

    দুই হাজার বছর আগেকার রাত ছাই হবে দুই হাজার পনেরো সালে

     

    দু'চোখের অন্ধ ছায়া উড়ে যাচ্ছে অন্ধকারে

    পাখিরা নৌকা চালায় বাতাসের নদে

     

    নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে ধীরে গাছের, মানুষের

    ফাটা-নিঃশ্বাসে তুমি কি একবারও আত্মহত্যা করতে আসবে না!

     

     

    ৬.

    সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ছিপছিপে এক মাতামুহুরী নদী

    নদী পেরিয়ে যাচ্ছে সময়

    হাতের নীলবর্ণ রেখায় এ-কার ছায়া দেখা যায়!

     

    ছাদের উপর বৃষ্টির গুঞ্জণ থামছে না কিছুতেই

    তানপুরার হৃৎপিণ্ডে আঙুল ফেটে গেলে বুজতে পারি না

    এ-কান্না উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে নাকি মাতামুহুরীর

     

    ঘরের জানালা কিছুতেই বন্ধ হয় না

    আমাদের জানালায় আটকে রয়েছে নদীর দরজা।

     

  • বাসব রায় | 122.179.172.247 | ৩০ আগস্ট ২০২১ ১২:৫১734915
  • বাসব রায় : মলয়ের জায়গা

     

    এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আত্মীয়-পরিজনের বাইরে আমি যাঁর নাম প্রথম শুনেছি, তিনি, মলয় রায়চৌধুরী। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ নন, মলয় রায়চৌধুরী। আমি যখন বড় হচ্ছি, ওই ১৯৬৬ থেকে, চারপাশে শুধু একজনের কথাই চর্চিত, তিনি, মলয় রায়চৌধুরী। ১৯৬৪ সালে মলয় নেমে আসছেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সিঁড়ি দিয়ে, একা। আর ধীরে ধীরে তিনি চর্চায় চলে আসছেন কলকাতা সন্নিহিত অঞ্চলের। তখন বেহালা, যেখানে আমার ছোটবেলা কেটেছে, কলকাতার মধ্যে ছিল না। বেহালার সাবর্ণপাড়ার দ্বাদশ মন্দিরের চাতালে কিংবা শখেরবাজার মোড়ের আড্ডায় শুধুই মলয়। 

    তো আমি মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে বড় হয়েছি বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হয় না। ইস্কুলে যাই, সেখানে শিক্ষকরা আলোচনা করেন মলয়কে নিয়ে ; ঘরে ফিরি, দাদা-কাকারা আলোচনা করেন মলয়কে নিয়ে ; একটু সন্ধ্যায় পাড়ার কালভার্টেও আলোচনার একটাই বিষয় - মলয়। 

    মলয়-বাসুদেব-ফাল্গুনী-শৈলেশ্বর-সুবো-সুবিমল-দেবী-অবনী-প্রদীপ প্রমুখ তখন আমাদের ঘরের ছেলে। তাঁদের লেখা যেখান থেকে হোক সংগ্রহ করে পড়ছেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। এই আবহে আমি বড় হয়েছি। আর তাই মূলধারার সাহিত্যের প্রতি কখনো আগ্রহ বোধ করিনি। ১৪-১৫ বছরের মধ্যেই আমি পড়ে নিয়েছি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বা ‘চর্মরোগ’। এবং সেখান থেকেই এই প্রতীতী সম্ভবত জন্মে যায় যে সাহিত্য বলতে এসবই, বাস্তবতা-জীবন-অন্ত্যজ-প্রান্তিক স্বর ছাড়া সাহিত্য হয় না। 

    এর বেশ কিছু পড়ে যখন আনন্দবাজারীয় লেখালিখি পড়তে গেছি, হাসি পেয়েছে। বাজারি আনন্দের প্রকাশিত সাহিত্য ওই সুখী মধ্যবিত্তের জন্য। সেখানে একটা কৃত্রিম ভাষা, নাটকীয় কিছু শব্দের সমাহার। সেখানে জীবন, অন্তত আমি, কখনো খুঁজে পাইনি। অথচ শিক্ষিত বাঙালি ওইসব পড়েই নিজেকে এলেমদার, পণ্ডিত মনে করেছে, করে। 

    আর ঠিক এখানেই মলয় ধাক্কা মারেন। বাংলা গদ্যের রীতি ঠিক কী হবে তা সম্ভবত ঠিক হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যে লিখলে ওই জোব্বা পরা বুড়োর মতোই লিখতে হবে। এবং এরপর যাঁরা লিখতে এসেছেন, যেমন শরৎ-তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতি-শরদিন্দু থেকে হালের সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশরা, কেউ ওই গদ্যের বাইরে যেতে পারেননি। বিষয় যাঁর যেমনই হোক, গদ্যের রীতি বা ভাষার আঙ্গিক ও প্রকরণ সেই রাবিন্দ্রিক। এবং বাজার বা বাংলা সাহিত্যের কলকাত্তাইয়া প্রতিষ্ঠান এই গদ্যকেই প্রমোট করেছে। পাঠকও খুশি থেকেছেন এই গদ্য পড়ে। এর বাইরে না লেখক না পাঠক কেউই ভাবতে পারেননি। 

    মলয় রায়চৌধুরী ঠিক এই জায়গাটাকেই ধাক্কা দিয়েছিলেন। তাঁর বহুচর্চিত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ থেকে হালের ‘ছোটলোকের ছেলেবেলা’ লেখাতেও ওই ধাক্কা স্পষ্ট। লেখালিখিতে বাস্তবতা-জীবন যেমন মলয় রায়চৌধুরী প্রথম বাংলা সাহিত্যে এনেছেন, ঠিক তেমনই গদ্যের ভাঙচুর তাঁর লেখাতেই আমরা প্রথম দেখতে পেয়েছি। আর এজন্যই প্রতিষ্ঠান তাঁকে ব্রাত্য করে রেখেছিল, হয়তো-বা এখনও করেই রেখেছে। 

    মলয়ের প্রথম প্রকাশিত বই সম্ভবত ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’। সেখানে মলয় কী লিখেছেন তা এখানে আলোচ্য নয়। বলার কথা হল, মলয় হাফ লিটারেট সাহিত্যিক নন, পড়াশোনা করেই লিখতে এসেছিলেন। আর সেজন্য মলয়ের লেখালিখি যতটা না আবেগের তার চেয়ে অনেক বেশি মেধাজারিত। কোনো এক সাক্ষাৎকারে মলয় জানিয়েছেন যে বৈদ্যুতিক ছুতার লিখতে লেগেছিল তিন মাস। কেন? না, প্রতিটি শব্দ অনেক চিন্তা করে বসাতে হয়েছে। 

    তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম

    এই লাইন মলয়কে লিখতে হয়েছে, বাংলাভাষাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। আর কে না জানে ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সে-ই ভাষাকে বাঁচায়।’ মিথ্যে না বলতে কী, রক্তরস কমে যাওয়া বাংলাভাষাকে ওই মলয় রায়চৌধুরীই প্রথম আক্রমণ করেন। তাঁর সেই শক্তি ছিল বলেই প্রতিষ্ঠান তাঁকে উঠোনে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। বরং মলয়দের শক্তি পাঠক-সহ-প্রতিষ্ঠানকে গ্রাস করে নিতে পারে ভেবেই তাঁরা সম্মিলিত আক্রমণের সামনে পড়েন। যার ফলশ্রুতি কিছু বই নিষিদ্ধ, মামলা, মলয় দোষী সাব্যস্ত এবং তারপর ১৯৬৭ সালে মামলায় জয়। 

    এর ফলে মলয়ের কী হয়েছে সে বিচার অন্যরা করবেন, বাংলাভাষার যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেল তা অনস্বীকার্য। কেননা মলয় তো বটেই, ইদানীং অজিত রায়-রবীন্দ্র গুহ-রণবীর পুরকায়স্থরা তুলে আনছেন যে নিচুতলার সংস্কৃতি, জীবনযাপনের শৈলী, আচার-আচরণ, ক্রোধ-আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা... অসম্ভব দরকারি ছিল বাংলা সাহিত্যে। এগুলো বাদ দিয়ে সাহিত্য যেন একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে। মলয় রায়চৌধুরী প্রথম এই ভাবনা এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যে। কী? না, নিজেকে সাংস্কৃতিক জারজ ঘোষণা করে সরাসরি বলেছিলেন, অন্ত্যজ-প্রান্তিক স্বর উঠে আসা উচিত সাহিত্যে। এবং তা হবে সরাসরি। সেখানে কোনো ফাঁকি থাকবে না। আর তাই, মলয় রায়চৌধুরীর, ঠিক এই জায়গায় কাল্ট ফিগারের সম্মান প্রাপ্য।

    মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, ভবিষ্যতেও লিখবেন, মলয় হলেন বাংলা সাহিত্যের জায়মান কিংবদন্তি, যাঁকে আনগ্ন শুষে নিলেও শেষ হয় না। কবি-প্রাবন্ধিক-উপন্যাসকার যেভাবেই তাঁকে অভিহিত করা হোক না কেন, কোনোটাই মলয় সম্পর্কে শেষ কথা নয়। 

    আর তাই একটা লেখায় সমগ্র মলয় রায়চৌধুরীকে ধরা আমি তো আমি, শিবের বাপেরও অসাধ্য কাজ! আর তাই আমি অন্য দু-একটি কথা বলি। 

    মলয়ের উদ্যোগে হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সকলে একে অচ্ছু্ৎ ঘোষণা করেছিলেন। আজ হাংরি আন্দোলনকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী আন্দোলনের মর্যাদা পাচ্ছে। আর তাই বিখ্যাতরা যেভাবেই হোক হাংরির ঝোল নিজের কোলে টানতে ব্যস্ত। 

    শৈলেশ্বর ঘোষ হাংরি-মামলার পর মুচলেকা দিয়েছিলেন, সবাই জানেন। পরে তিনিই হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে কলার তুলে হাঁটতে শুরু করেন, আমি দেখেছি। 

    আপাত-ঋষি শঙ্খ ঘোষ এমনভাবে এতদিন লেখালিখি করেছেন যে হাংরি শব্দটাই শোনেননি বা শুনলে তাঁর হার্টফেল হবে। তো তিনি সম্প্রতি একটি হাংরি সংকলনে নিজের কবিতা রেখে যার-পর-নেই আহ্লাদিত। সৌজন্য শৈলেশ্বর ঘোষ। 

    সাহিত্যিক-সততায় মলয় রায়চৌধুরীর পক্ষে আদালতে কথা বলে অনেকটা আলো পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তো তিনিই আমাকে রেকর্ডেড ইন্টারভিউতে বললেন ২০০৬ সালে যে ‘হাংরি আন্দোলনের জন্য মলয় ঠিক আমার আমেরিকা-বাসের সময়টাই বেছে নিয়েছিল।’ তো তাতে কী হল? সুনীল, ‘আমি থাকলে ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই আমার হাতে থাকত।’ এখান থেকে বোঝা যায়, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যেভাবেই হোক নাম জড়ানোর কী আকুল প্রচেষ্টা সুনীলের! ছো...

    আর এই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই কৃত্তিবাস-এ মলয়ের কবিতা ছাপাননি। সাহিত্যিক সততা আর কাকে বলে!

    যে কোনো আন্দোলনের একটা প্রকরণ আছে। আছে একটা স্ফুলিঙ্গ। আন্দোলনকে যত দমিয়ে রাখা হয় ততই আন্দোলনের অন্তঃশক্তি বাড়ে। আর সেটা হাংরি মুভমেন্টের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। আজও যখন কেউ ‘ছোটলোক’-এর সংস্কৃতি তুলে আনেন কবিতায়-গদ্যে, আমরা বলি বাঃ তুই তো হাংরিদের মতো লিখছিস। 

    এবং সত্তরের অরুণেশ, আটের অজিত রায়, নয়ের রাজা সরকার, শূন্য দশকের বিকাশ সরকার, প্রথম দশকের তিস্তা রায়, কিংবা বেশ আগের রবীন্দ্র গুহ, নবারুণ ভট্টাচার্য (যদিও কৃত্রিম ভাষা), দেবীপ্রসাদ সিংহ, সমরজিৎ সিংহ (গদ্য), আফসার আহমেদ, দুলাল ঘোষ, অলোক গোস্বামী, এমনকি স্বপ্নময় চক্রবর্তীও ; হালের কান্তারভূষণ নন্দী, মৃণাল দেবনাথ, ধীরাজ চক্রবর্তীরাও জেনে বা না-জেনে সেই হাংরিদের লিগ্যাসি হয়ে উঠেছেন। এঁরা ভেঙে ফেলেছেন মূলধারার বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় ফর্ম, তাঁদের লেখায় উঠে আসছে অন্ত্যজ জীবনযাপন, প্রেম-ক্রোধ-দুঃখ-আনন্দের কথা। এখানেই মলয় রায়চৌধুরী অমর হয়ে যান। 

  • একজন ডাইনি | 27.56.154.78 | ১৮ অক্টোবর ২০২১ ১৯:২১735048
  • কে, মলয় রায়চৌধুরী ? আর বলবেন না ! লোকে ওনার সম্পর্কে নানা কথা বলে ! নিজেই পড়ে দেখুন :

     

    ১. ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমিতাভ ঘোষাল -  ‘গদ্য-পদ্য সংবাদ’ পত্রিকায় ১৯৮৬ অক্টোবরে প্রকাশিত :-

    সুমিতাভ : ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ কতোটা ?

    সুনীল : হাংরি আন্দোলনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না । আমি তখন কৃত্তিবাস নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা করতুম । কৃত্তিবাসের থেকে কয়েকজন এই আন্দোলন শুরু করে । এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা প্রথমে নিয়েছিল মলয় রায়চৌধুরী, সে ছিল আমার বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর ছোটো ভাই । সমীর রায়চৌধুরী কৃত্তিবাসের একজন লেখক এবং ওই গোষ্ঠীরই একজন । মলয়েরও কিছু কিছু লেখা কৃত্তিবাসে বেরিয়েছিল ।

    সুমিতাভ : আচ্ছা শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো... ( কথায় বাধা দিয়ে )

    সুনীল : হ্যাঁ, তারপরে মলয় প্রথমে শুরু করার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাতে যোগ দেয় এবং পরে উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আসেন । এইভাবে হাংরি আন্দোলন শুরু হয় । কিন্তু এই আন্দোলনের কোনো ইস্তাহার বা কোনো ব্যাপারে আমার কোনো নাম ছিল না বা আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না ।

     

    ২ (  Snehasis Roy : “হাংরির উত্থান ১৯৬২ সাল, মলয় ১৯৬১ সালের যে গল্প ফেঁদেছেন নকল ইস্তেহার বানিয়ে সেন্টুর তোরঙ্গ থেকে নাকি উদ্ধার হয়েছে পরে, এ-সব আসলে গাঁজাখুরি গল্প।

    মলয়ের কবিতা তো হয়ই না, গদ্য, অনুবাদ ও কিছু ভালো প্রবন্ধ লিখেছেন, সমস্যা হল, সুভাষ ও শৈলেশ্বরের ভূত লোকটার পিছু ছাড়ে না। শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লিখছেন বা অন্য কোনো কবিকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ অবান্তরভাবে শৈলেশ্বর, সুভাষকে দায়ি করছেন তাঁর জেল হওয়ার জন্য।(মলয় বোঝাতে চান, ইস্, তোমরা শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষের লেখা পড়ো, এদের জন্য আমিহাংরিস্রষ্টা, আমার জেল হয়েছে!

    সাহিত্যের জন্য জেল হয়েছে এমন আসামীর লেখা পড়ো তোমরা, মুচলেকা দানকারীদের লেখা কেন পড়বে! আমি বীর, সারা পাড়ার সামনে কোমরে দড়ি দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গেছে, ভ্যাঁ...........এসব বলে পাঠকের সিমপ্যাথি আদায় করার চেষ্টা)

    ভাবটা এমন জেল যেন তাঁর একারই হয়েছিল, অথচ হাংরি সংক্রান্ত লেখালেখির কারণে প্রথম জেলে হয় শৈলেশ্বরের, পরে সুভাষেরও। লোকটা এমন চুতিয়া অরুণেশকে দু-রকম হাতের লেখায় চিঠি লেখে, সুভাষ ঘোষকেও তাই, সুভাষকে চিঠিতে জানায় আমার যারা সমালোচনা করে তাঁদের দেখে নেব। সেসব চিঠি সব আছে আমাদের কাছে। সময় ও জায়গা মতো প্রকাশিতও হবে।

    মলয়ের 'আমি' 'আমি' করার পাশাপাশি বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত হাংরি জেনারেশন আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তাঁদের মুখপত্র ছিল 'ক্ষুধার্ত' পত্রিকা। মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম তিনটি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং পরের চারটি সংখ্যা শৈলেশ্বর ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।”

     

    ৩. ( উপরোক্ত Snehasis Roy  : “হাংরির উত্থান ১৯৬২ সাল, মলয় ১৯৬১ সালের যে গল্প ফেঁদেছেন নকল ইস্তেহার বানিয়ে সেন্টুর তোরঙ্গ থেকে নাকি উদ্ধার হয়েছে পরে, এ-সব আসলে গাঁজাখুরি গল্প।

    মলয়ের কবিতা তো হয়ই না, গদ্য, অনুবাদ ও কিছু ভালো প্রবন্ধ লিখেছেন, সমস্যা হল, সুভাষ ও শৈলেশ্বরের ভূত লোকটার পিছু ছাড়ে না। শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লিখছেন বা অন্য কোনো কবিকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ অবান্তরভাবে শৈলেশ্বর, সুভাষকে দায়ি করছেন তাঁর জেল হওয়ার জন্য।(মলয় বোঝাতে চান, ইস্, তোমরা শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষের লেখা পড়ো, এদের জন্য আমিহাংরিস্রষ্টা, আমার জেল হয়েছে!

    সাহিত্যের জন্য জেল হয়েছে এমন আসামীর লেখা পড়ো তোমরা, মুচলেকা দানকারীদের লেখা কেন পড়বে! আমি বীর, সারা পাড়ার সামনে কোমরে দড়ি দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গেছে, ভ্যাঁ...........এসব বলে পাঠকের সিমপ্যাথি আদায় করার চেষ্টা)

    ভাবটা এমন জেল যেন তাঁর একারই হয়েছিল, অথচ হাংরি সংক্রান্ত লেখালেখির কারণে প্রথম জেলে হয় শৈলেশ্বরের, পরে সুভাষেরও। লোকটা এমন চুতিয়া অরুণেশকে দু-রকম হাতের লেখায় চিঠি লেখে, সুভাষ ঘোষকেও তাই, সুভাষকে চিঠিতে জানায় আমার যারা সমালোচনা করে তাঁদের দেখে নেব। সেসব চিঠি সব আছে আমাদের কাছে। সময় ও জায়গা মতো প্রকাশিতও হবে।

    মলয়ের 'আমি' 'আমি' করার পাশাপাশি বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত হাংরি জেনারেশন আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তাঁদের মুখপত্র ছিল 'ক্ষুধার্ত' পত্রিকা। মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম তিনটি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং পরের চারটি সংখ্যা শৈলেশ্বর ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। “) 

     

    ৪. ( উপরোক্ত Snehasis Roy - “শৈলেশ্বরকে লেখা অরুণেশের প্রায় ৮০টির মতো দীর্ঘ চিঠি( INLAND LETTER CARD) উদ্ধার হল।

    'সৃষ্টিক্ষমতাহীন কুকুরের দল এই ঘেউঘেউ চিরদিনই করে এসেছে'র পাশাপাশি অরুণেশ চাইছেন 'আত্মমগ্ন গর্ভবতীর মতো নিজেকে নিয়ে থাকতে'।

    তাঁর সঙ্গে মিলারের লেখালিখির হাস্যকর তুলনা প্রসঙ্গে অরুণেশের মনে পড়ে যাচ্ছে জীবনানন্দকে ইয়েটস্ এর অনুকারক এমনকি পাশাপাশি রেখে উভয়ের লাইন তুলে মেলানোর প্রাণপণ চেষ্টার কথা!

    আর্থিক সংকট, বেশ্যা ও না-বেশ্যা অসংখ্য সংগমে তিনি কি না-প্রেমিক। না, এসবের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতার সঙ্গে সহবাস করতে চাইছেন।

    দেশ, আনন্দবাজার, আজকাল প্রভৃতি বাজারি কাগজ সম্পর্কে একহাত নিতে ছাড়ছেন না এবং কৃষ্ণ ধর ও অমিতাভ দাশগুপ্তকে হিজড়ে লেখক বলতে রেয়াত করছেন না।

    হাংরি জেনারেশন সাহিত্য, রাজনীতি, কলকাতার সাহিত্য, পাণ্ডুলিপি করে শৈলেশ্বরকে পাঠানো। 'রোবট'(সম্পাদক : জীবতোষ দাশ) নিয়ে ভয়াবহ আবেগ।নিজের কাগজ 'জিরাফ' নিয়ে চিন্তাভাবনা। বাবার অসুখ। চিকিৎসকদের 'মাগী' বলা, টাকাও ধ্বংস করে রোগীও মারে।

    উত্তরবঙ্গের তৎকালীন অন্যান্য পত্রিকার রাজনীতি। এমনকি নাম নিয়ে রাজা সরকারের(সম্পাদক : কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প) ঈর্ষা ও কূটনীতি সত্ত্বেও তাঁকে শোধরানোর চেষ্টা। আরও কত কী কথা বলেছেন চিঠিতে শৈলেশ্বরকে।

    এই চিঠিগুলো নিয়েই একটা সাংঘাতিক বই হয়ে যায়।

    একটা সময়, দীর্ঘ কবিতাযাপন, জৈব আততি ও ঐতিহাসিক দলিল তো বটেই।

    বোমাটা ফেলব নাকি!” ]

     

    ৫. : ( দুই ফরেনারের কথাবার্তা : বেলাল চৌধুরী ও চয়ন খায়রুল হাবিব

    চঃ এটা মজার, কৃত্তিবাসের একটা প্রধান অংশই সুনীলকে না জানিয়ে হাংরি আন্দোলনে জোগ দিয়েছিল।শক্তি, সন্দীপনও চলে গিয়েছিল।কিন্তু ঐসব ঈস্তাহারত পড়া যায় না, এতই পচা।সুনীলকে ওরা জানায় নি কেন?

    বঃ ইর্ষা, ভয়।সমির আবার সুনীলদার বন্ধু ছিল।“ধর্মে আছি, জিরাফে আছি” নিয়ে শক্তির তখন সাঙ্ঘাতিক অবস্থা, এক বসায় দশটা কবিতা লিখে ফেলছে। ও বুঝে গিয়েছিল সমির, মলয়দের হাতে লেখা নেই।ও বুঝেছিল যে হাংরিদের সাথে থাকলে ওর কবিতা ধ্বংশ হয়ে ্যাবে।খুব সম্ভবত সেই প্রথম শক্তি সুনীলদার কবিতার ক্ষমতাও বুঝতে পেরেছিল।ও আবার কৃত্তিবাস বলয়ে ফিরে আসে।টাইম ম্যগাজিন বিটদের কথা বলতে গিয়ে হাংরিদের সম্পর্কে বলেছিল।ঐটুকুই। লেখা কই?বোগাস।

    চঃ যে সুনীলকে ওরা ওদের সাথে ডাকেনি , জ়েলে নেবার পর তাকেই অনুনয় করছে আদালতে গিয়ে ওদের কবিতার পক্ষ্যে সাফাই গাইতে!

    বঃ মলয় ওটা করেছিল।সুনীলদাকে নিজে গিয়ে ও সাক্ষ্য দিতে বলেছিল।ওর জ়েল দন্ড ঠেকাতেই সুনীলদা ওর কবিতাকে উত্তির্ন না মনে করলেও বলেছিল “সার্থক কবিতা”।

    চঃ শক্তি কি করেছিল?

    বঃ সমির, মলয়দের এক বোনের সাথে প্রেম করেছিল।ওদের অনেকগুলো বোন ছিল।

    চঃ নাম কি বোনটার?

    বঃ শিলা।

    চঃ শিলা রায় চৌধুরি!শক্তির প্রেমিকা!হো হো হো. )

     

    ৬. : ( সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : মলয় রায়চৌধুরী খুব অদ্ভূত মানুষ। তিনি আমাকে উৎসর্গ করে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি পোষ্ট দিয়ে বললেন, ‘দুলাল, তোমার সাথে আমার ছবি নেই কেনো’?

    তাঁর সাথে জীবনে কোনো দিন দেখা হয়নি। তিনি থাকেন বোম্বে আর আমি টরন্টোতে। ছবি থাকবে কি ভাবে? মলয় দা’র সাথে দেখা-সাক্ষাৎকার না হলেও তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২০১৪ সালে, আমার ‘সাতদিন’ ওয়েব পত্রিকার জন্য। )

    ৭. ( সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : ভালো লাগা কবিতা : মলয় দা, মলয় রায়চৌধুরী এক অদ্ভূত মানুষ। ৮২ বয়সেও ২৮ বছরের তরুণ কবিদের মতো তারুণ্য লালন করেন। আমি তাঁর এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তার জবাবে আরো তা টের পেয়েছি। তাঁর সাথে আমার দেখা হয়। বাংলাদেশে কবিদের দৌঁড় কলিকাতা পর্যন্ত। আমার মতো সাধারণ কবির পক্ষে কি স্বর্গীয় দিল্লি যাওয়া তো কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমার কবিতায় মলয় দা ঢুকে গেছেন, আবার মলয় দা আমাকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন, ফেইসবুক লাইভে আমার কবিতা পাঠ করেছেন।

    কি সব অদ্ভূত কাণ্ডই না করেন মলয় দা। গুণ দা'র মতো তাঁর পাগলামির শেষ নাই। শাশুড়িকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেন। প্রেমিকাকে বলনে- ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’। আমি বলেছিলাম, মাথা নাকি নুনু? তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন, তাতেও টাশকি খেয়েছি। ‘১৯৬০-এর দশকের হাংরি আন্দোলন হাংরিয়ালিজম— তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক ১৯৬০-এর দশক থেকেই ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্যে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন।

    সম্প্রতি তাঁর একটি কবিতা পড়ে থ মেরে যাই। সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং দেশ বিভাগ নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতার অসাধারণ মর্মান্তিক এবং ভায়াবহ চিত্রকল্প চমকে দেয়! ফাঁসিতে ঝুলন্ত লাশ ঝুলতে ঝুলতে এক বার পাকিস্তান আবার হিন্দুস্থানের দিকে ঝুলছে!</span></li></ul><ul class='list-group my-2 shadow rounded-0 d-print-none'><li class='list-group-item small'><img src=বিশ্বজিত সেন | 27.56.154.78 | ২০ অক্টোবর ২০২১ ১২:৪৩735054

  • বিশ্বজিত সেন : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা

    বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা ভাবাভাবি করেন, তাঁদের কিছু মজার প্রবণতা আছে। তাঁরা কবিতাকে গদ্য থেকে একেবারে আলাদা করে দেখেন, ও সেই দেখা চিরস্হায়ি করতে নানাবিধ সাংস্কৃতিক প্রপেরও আয়োজন রয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেরই নাম--- কবিপ্রণাম । রবীন্দ্রনাথকে মূলত দেখা হয় কবি হিসাবে। গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ তেমন গুরুত্বপূর্ণ লোক নন। আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলব, গল্পলেখক রবীন্দ্রনাথই আমার কাছে সর্বাধিক গ্রাহ্য । যদিও রবীন্দ্রনাথের গল্প লেখার দর্শন আমার কাছে একেবারেই গ্রহণীয় নয়, তবু 'কবি' রবীন্দ্রনাথের চেয়ে, এই লোকটি আমার চোখে ঢের বাস্তব।

    কবিতাকে আলাদা করে দেখা, তাকে সুউচ্চ বেদিতে বসিয়ে রাখা, অহরহ গুজগুজ-ফিসফিস, আরে আজও যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে বাংলা সাহিত্যে ও মধ্যবিত্ত জনজীবনে । এ নিয়ে চিন্তা করেছি, আজও মাঝে-মাঝে করি। এ ভাবনার উৎস কোথায়?কিছুটা কি "ভারতীয় অতীত"- এর ব্যাপার রয়েছে এর মধ্যে। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত--- সবই কবিতায় । কবিকে রহস্যময় মানুষ মনে করা হত, যিনি নিজের চিন্তা-ভাবনাকে ছন্দবদ্ধ করতে সক্ষম। মনে করা হত স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর কাছে বার্তা পাঠিয়ে থাকেন। ভগবানের স্পেশাল মেসেঞ্জার তিনি, 'নট টু বি টেকন লাইটলি'। তার বহু পরে, 'ভক্তি' যুগে ভারতীয় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবিকে সাধক বানিয়ে কুলুঙ্গিতে লাল শালু মুড়ে রেখে দেওয়া হল।কবীর, দাদু, নানক, সুরদাস, রহিম, জয়দেব, চণ্ডীদাস । তুলসীদাসকে 'গোঁসাই' বানিয়ে তাঁরও একই হাল করা হল।'রামচরিতমানস'কে ধর্মগ্রন্হ মনে করে গদগদ আপামর হিন্দিভাষী জনসাধারণ। তার দোহায় দোহায় শব্দের যে অদ্ভুত খেলা, ভাষাকে কাদার মতো ব্যবহার করে তা থেকে বিচিত্র নানা মূর্তি গড়ে তোলা, সেদিকে দুচারজন ক্রিটিক ছাড়া কারো নজরই যায়নি প্রায়। হিন্দি সাহিত্য ঐশ্বরিক বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে কবে একাজে হাত দেবে জানি না । আজকে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, এ-কাজ করার সময় এসে গেছে ।

    ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চল কিন্তু কবিকে অনেক সহজভাবে নিয়েছিল। কথক ও কবিয়াল ছিলেন, কবিগান ছিল। যাত্রার, পালার আসর ছিল, চণ্ডীতলা ছিল। অবশ্যই কবিকে স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ লোক মনে করা হত; তবে সাউক বা অবতার, বা ভগবান নয় । কবির লড়াইতে তো কবিতা তৈরি হত সর্বসমক্ষে, মুখে-মুখে। আর হারজিতও ছিল। কাজেই রহস্যের সেখানে কোনো ভূমিকাই ছিল না । কবি স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ বলে তাঁদের আদর-আপ্যায়নও হত, তবে তাঁকে একটি বেদিতে বসিয়ে তাঁর মুখের ওপর স্পটলাইট জ্বেলে রাখা ? নাঃ ! ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে তা করা হত না।

    ইংরাজরা আসার পর বাংলা সাহিত্যে কবিতার রহস্যের আমদানি হয় । নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে ইংরাজদের কিছু ছিল না। যাকে তারা নিজের সংস্কৃতি বলত, তার খুঁটিগুলো সবই ছিল গ্রিস, রোম থেকে ধার করা। গ্রিসে 'বার্ড' বা ভ্রাম্যমান কবিদের নিয়ে রহস্য গড়ার অভ্যাস প্রচলিত ছিল। ভক্তি যুগের আদলেই প্রায় বলা যায়, তাঁদের 'ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা', ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী, ইত্যাদি মনে করা হত। হোমারের স্হান গ্রিক মানসে প্রায় ঋষির জায়গাতেই ছিল, দাড়ি-টাড়ি সমেত। শেকসপিয়রও আরও কয়েকশো বছর আগে জন্মালে ঐ জায়গাতেই পৌঁছে যেতেন। আমাদের সৌভাগ্য, তিনি পরে জন্মানোর দরুন বিশ্বসাহিত্য একটি নিদারুণ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল।

    রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, সাহিত্যিক জীবনের পরবর্তীপর্বে, কবিতার বিশেষত্বের জায়গা থেকে অনেকটা সরে এসেছিলেন। যাকে সাহিত্যের বিশেষজ্ঞরা 'গদ্য কবিতা' বলেন, তা তাঁর এই বোধের সাক্ষ্য দেয়। তাঁর কিছু গদ্য কবিতা গল্পকেন্দ্রিক। সাহিত্যকর্ম ইশাবে অনেক উঁচু দরের কাজ সেগুলো। মোদ্দা ব্যাপার হল, আজ পাড়াব-পাড়ায় 'কবি প্রণাম' সত্ত্বেও সাহিত্যের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির মাঝখানের দেওয়াল ধ্বসিয়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তাঁকে বাঙালি এত বেশি 'কবি' বানিয়ে ফেলেছিল যে হাত খুলে এই কাজটি করা সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। তবে কাজের মধ্য দিয়ে ঠারে-ঠারে যতটা পেরেছেন, করেছেন। বিশেষ করে ছবি আঁকার মাধ্যমে।

    কবিতাকে বা কবিকর্মকে ঘিরে একটা রহস্য সৃষ্টি করে রাখলে কবিতা কখনই সামাজিক পরিস্হিতির দলিল হয়ে উঠতে পারে না। কবিতার মিস্টিসিজমের প্রথম অসুবিধে এটা। কবিতা যদি সামাজিক পরিস্হিতির দলিল না হয়, তবে তাকে ড্রইংরুম সাজানোর ডলপুতুল বা অশ্রুমোছার রুমাল হয়ে থাকতে হয় কেবল।সেটা অবশ্য অনেকেরই মনঃপূত, বিশেষ করে যাঁরা 'সমাজ-টমাজ'কে দশ হাত দূরে রাখতে চান। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যেও লড়াই আছে, পক্ষ-প্রতিপক্ষ আছে। একটি পক্ষের বিশেষ দর্শন এটাই। কবিতার গায়ে গরম হাওয়ার ঝাপটা যেন না লাগে।

    কবিতার মিস্টিসিজমের দ্বিতীয় অসুবিধে ভাষার স্তরে। ভাষা তো একটি নদী বিশেষ। একূল-ওকূল দুকূলই সে ভাসায়। তাকে সিমিলি, মেটাফর, ছন্দবৃত্ত, মাত্রা, পয়ার ইত্যাদির গণ্ডীর মধ্যে সর্বদা বেঁধে রাখা যায় না। কবিতার নিয়মানুবর্তিতা থেকেই কবিতার মিস্টিসিজমের জন্ম। এই নিয়মানুবর্তিতার দরুনই, একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রয়োজন অনুভূত হয়, যে কবিতা 'লিখতে পারে'। যে 'পারে না', তাকে দূর করো, দাঁড় করিয়ে রাখো দরজার বাইরে। তার ভাষাটিও ব্রাত্য।

    তাই, কবিতার স্বার্থেই, কবিতার রহস্যময়তাকে ভাঙা অত্যন্ত প্রয়োজন।

    বাংলা সাহিত্যের সিরিয়াস পাঠক সম্প্রতি নড়ে-চড়ে বসেছেন। ষাটের দশকে, যে একটি তুমুল ওলোট-পালোট ঘটে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে--- সেদিকে নজর গেছে তাঁদের। দেরিতে হলেও, এটাই কাম্য ছিল।'হাংরি আন্দোলন' নিয়ে ইতিপূর্বে 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' গোছের কথাবার্তা হয়েছে। 'হাংরি আন্দোলনকারীদের' গভীর মননশীল পঠন-পাঠন ছিল, যাকে বলা যায় ওভারভিউ। হাংরির পরেও আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন এসেছে, তবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঝাঁকুনি হিসাবে হাংরিই ছিল "প্রথম"। বাংলা সাহিত্যের অবস্হা, হাংরি আন্দোলনের আগে ছিল অকালবৃদ্ধ আফিংখোরের মতো। রবীন্দ্র ঐতিহ্য পুঁটুলি বেঁধে কোলে নিয়ে বসে ঝিমোনো আর মাঝে-মাঝে চটকা ভেঙে, "অ্যাই, গোল কোরো না বলচি, পড়াশুনো করো, পড়াশুনো..."। অথচ দেশে-বিদেশে তখন ঘটছে যুগান্তকারী ঘটনা । 'গ্রানমা' জাহাজে চড়ে বিপ্লব করতে আসা কয়েকজন যুবক হঠাৎ জয়ী হয়েছেন। ওয়াশিংটন থেকে মাত্র নব্বই মাইল দূরে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহের পতাকা। ওদিকে ঠাসবুনোট সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্রমে ঠোঙা বানাবার কাগজ বই আর কিছু নয়। স্হিতাবস্হাকামী বাণিজ্যিক সংবাদপত্র গোষ্ঠীর প্রচণ্ড একমাত্রিক দাপট বাংলা সাহিত্যে। তার দোরগোড়ায় মাথা না ঠুকলে কেউ মানুষই হবে না, সাহিত্যিক হওয়া তো দূরে রইল।

    এইরকম সময়ে বাংলা সাহিত্যের 'পীঠস্হান' কলকাতা থেকে দূরে, পাটনা শহরে, যেখানে ঐশ্লামিক ধর্মশাস্ত্র পড়তে গিয়েছিলেন রামমোহন রায়, আর বেশ কয়েক বছর চাকরি করে গেছেন দীনবন্ধু মিত্র, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটি অপরিচিত গরিব পরিবারের যুবক মলয় রায়চৌধুরী আই আন্দোলনটির ছক কষেন। দাদা সমীর রায়চৌধুরী কলকাতায় সিটি কলেজে পড়েন, সেই সুবাদে যুবা বাঙালি লেখক-কবিদের সাথে আলাপ-পরিচয় । দেশ-দুনিয়ে জুড়ে উথালপাথাল সত্ত্বেও কলকাতা, ব্রিটিশের প্রিয় 'কালকুত্তা' তখনও শীতল। বামপন্হী দলগুলোর বিরুদ্ধে গান্ধীবাবার কংগ্রেস প্রতিপালিত গোপাল পাঁঠা, ইনু মিত্তিরদের দাপাদাপি; কলকাতা শীতল। কবিতা ভবন (!) থেকে 'কবিতা' বেরোয় । বুদ্ধদেব বসুর পরিশীলিত আঙুল কবি বাছাই করে, ফতোয়া দেয়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই উপস্হিতি। এককালে...'না না অমন বলবেন না । সুকান্তও কবি। ছন্দ বোঝে। এই দেখুন আমি দেখাচ্ছি --- পতা/কায় পতা/কায় ফেরমিল/আনবে ফেব্রু/য়ারি। দেখলেন ?

    অট্টহাসি উদ্রেক করা সেই সময়। সমীর রায়চৌধুরীর 'পাটনাই' হওয়ার দরুন কলকাতার যুবক কবিদের পাটনায় আনাগোনা। এঁদের মধ্যে অন্যতম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যাঁর বিষয়ে বাসব দাশগুপ্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মলয় বলেছেন, "শক্তির কবিতা সম্পূর্ণ নিজস্ব ও অসাধারণ। কেননা তিনি পাঁড় অশিক্ষিত, কোনো লেখাপড়া করেন না, এবং দর্শন, ইতিহাস, সমাজবোধ এসব ছিটেফোঁটা তাঁর মধ্যে নেই। নিজের খাঁটি বোধ থেকে তিনি লেখেন, তখন তাঁকে জীবনানন্দের পরের প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন মনে হয়।" মনে রাখা প্রয়োজন, এই সাক্ষাৎকারটি যখন দিচ্ছেন মলয়, তখনও হাংরি আন্দোলনের স্মৃতি, তজ্জনিত তিক্ততা, সব কিছু মলয়ের মস্তিষ্ককোষে উপস্হিত। কিছুই ক্ষমা করেননি। অথচ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে মলয়ের চোখা, টান-টান মূল্যায়ন। ব্যক্তিগত তিক্ততা সেখানে ছায়া ফেলেনি।

    হাংরি আন্দোলনের পরিকল্পনাপর্বে এই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মলয় সঙ্গে পেয়েছিলেন, আর পেয়েছিলেন দেবী রায় ( হারাধন ধাড়া) কে। পাটনার সুবিমল বসাক এসে যোগ দেন কিছুকাল পরে।একটি সাহিত্য আন্দোলন, যা বাংলা সাহিত্যের হাল-হকিকত পালটে দিয়েছিল, কত সামান্যভাবে শুরু হয়েছিল, ভাবলে অবাক লাগে। প্রেস পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই মিষ্টির দোকানের বাকসো যে জব প্রেস ছাপতো, সেখানেই ছাপতে হয় হাংরি বুলেটিন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে মলয় তখন লোয়ার গ্রেড কেরানির চাকরিতে, কত মাইনে পেতেন জানা নেই, তবে প্রায় সম্পূণফ মাইনেটাই মনে হয় হাংরি বুলেটিনের পেছনে ঢালতে হত। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথম কাগজ বেরোনোর আরম্ভটা এইরকম। 'শতভিষা' পত্রিকার তুলনায় 'কৃত্তিবাস' ও নিজেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজই বলত, তবে হাংরি বুলেটিনের সাথে তার ছিল মৌলিক প্রভেদ। 'কৃত্তিবাস' ছিল সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্খীদের কাগজ। তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে সুরে সুর মিলিয়ে। প্রতিষ্ঠান কখন যশ, প্রতিপত্তি, বৈভব, টাকাকড়ি, সামাজিক সুবিধার কাজে লেগে যায়, বলা তো যায় না। হাংরি বুলেটিনের উদ্দেশ্যই ছিল যুদ্ধ। আপসের জন্যে সেখানে কোনও জায়গাজমি রাখা হয়নি।

    অনেকের মতে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি গিমিকের আশ্রয় নিয়েছিলেন রাতারাতি খ্যাত হবার জন্য, যেমন শাদা দিস্তা কাকজ, জুতোর বাকসো ইত্যাদি রিভিউএর জন্য পাঠানো, টপলেস প্রদর্শনীর আয়োজন ( টপলেসের অর্থ যে মুন্ড বা মস্তিষ্কবিহীনও হয়, এই বোধটুকু কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের হয়নি), জীবজন্তু-জোকারের মুখোশ বিলি ইত্যাদি। 'হাংরি কিংবদন্তি'তে মলয় উদ্ধৃত করেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের যে মন্তব্য, তা এ-প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারে।কিন্তু মলয় বা তাঁর সঙ্গীরা কি জানতেন না যে প্রতিষ্ঠান ও প্রসাশন কতদূর হিংস্র হতে পারে? এ জানা সত্ত্বেও একজন চাকুরিজীবী ( মলয় ) নিজেকে এই ঝুঁকির সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন কেন ? শুধুই প্রচারের জন্য? না কি কিছু মূল্যবোধের ব্যাপারও ছিল ? মলয় তাঁর 'সাক্ষাৎকারমালা'র এক জায়গায় বলেছেন, 'ষাট দশকের সুস্হতা স্বাভাবিক ছিল না।' এই অস্বাভাবিক সুস্হতাকে ভালোমতো একটা ঝাঁকুনি দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। তার জন্য দুহাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি পরে চোর-ডাকাতের সঙ্গে সার বেঁধে পাটনা শহরের রাস্তায় অতিপরিচিতজনের মাঝে হাঁটা, চাকুরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, পঁয়ত্রিশ মাস প্রতি সপ্তাহে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো--- সবই। প্রচার পাওয়ার জন্য যদি এত করতে হয়, তাহলে তো মুশকিল। এর চেয়ে সহজ রাস্তা তো কতই ছিল। বিশেষত, 'কৃত্তিবাস' গোষ্ঠীতে তাঁর দাদার বন্ধুরাই যখন সর্বেসর্বা। সমসাময়িক অন্যান্যদের মতন একটু মিঠে ব্যবহার রাখলেই আর দেখতে হচ্ছিল না। আর, 'কৃত্তিবাস'ও তেমন-তেন বৈশিষ্টহীন ও লুপ্ত হবার পথে এগিয়েছে। সাহিত্য আন্দোলন সম্পর্কে 'কৃত্তিবাসীয়'দের সততার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে ?

    ( দ্রষ্টব্য: কবিতীর্থ, মাঘ ১৪১০)

    বলা যেতে পারে যে 'কৃত্তিবাস' যদি সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে না টিকে থাকে তবে 'হাংরি বুলেটিন'ও তো টেকেনি। হ্যাঁ, হাংরি বুলেটিন উঠে গিয়েছিল মামলা-মকদ্দমার দরুন, অন্তর্কলহের দরুন। কিন্তু হাংরিদের ঝগড়াঝাঁটি ছিল খোলাখুলি, তাতে মধ্যবিত্তের চাপ-চাপ ঢাক-ঢাক ছিল না। মামলা-মকদ্দমার ভয়ে কেউ রাজসাক্ষী হয়েছিলেন ( সুভাষ ঘোষ,শৈলেশ্বর ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ ), কেউ ভেবড়ে গিয়ে কলকাতার বাইরে কেটে পড়েছিলেন ( প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য প্রমুখ )। সেগুলোকে দেখার কোনও অর্থ হয় না।'হাংরি বুলেটিন' বন্ধ হবার পর অগনণ পেশিবহুল বাহু এগিয়ে এসেছে আন্দোলনের পতাকা তুলে নিতে।জেব্রা, উন্মার্গ, ফুঃ, স্বকাল, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ওয়েস্ট পেপার, চিহ্ণ, প্রতিদ্বন্দী ইত্যাদি পত্রিকাও হাংরি বুলেটিনই। মলয় কোনোদিন বলেননি যে হাংরি আন্দোলনের কপিরাইট একমাত্র তাঁর। হ্যাঁ, আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও দার্শনিক প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর কিছু বক্তব্য থাকতেই পারে, যা তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পাঠকদের সামনে রেখেছেন।এই অধিকার থেকে তো আর তাঁকে বঞ্চিত করা যায় না। মলয়ের পরবর্তীকালীনরা হাংরি মতাদর্শকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন।এটিও একটি আন্দোলনের প্রাণশক্তির প্রমাণ। মলয়, হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর, পড়ালেখার নিজস্ব পৃথিবী গড়ে তুলেছেন, মন দিয়ে এবং চুটিয়ে বিভিন্ন শহরে চাকরি করেছেন, সংসার করেছেন, ভারতীয় জনজীবনকে দেখেছেন, জীবন থেকে শিখেছেন। আজ গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধের যে হতচকিত-করা ফসল তিনি আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তা সম্ভব হতে পেরেছে এরই দরুন। বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের গদি-আঁটা চেয়ারে বসে আঙুলে চাবির রিং ঘোরাননি মলয়। এর জন্য তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। অন্তত একটি আকাশ এমন রয়েছে, যাকে ঢেকে ফেলতে পারেনি কালো মেঘ।

    মলয়কে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটির দরুন মামলায় পড়তে হয়। কবিতাটি বর্তমানে বহুল প্রচারিত, তাই তাকে আর সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই। তবে এই কবিতাটিকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এর পেছনে কোনো অসূয়া কাজ করছিল না, একটি কৌতুকপ্রদ মাইন্ডসেট-এর দিকে ইঙ্গিত করে। এই মাইন্ডসেটটি তদানীন্তন বুদ্ধিজীবী বাঙালির, যিনি পুজোর ছুটিতে সস্ত্রীক খাজোরাহো দেখতে যান। তাহলে মলয়ের কবিতা কেন গ্রহণীয় নয় ? মজা কেবল এই জায়গাটুকুতে নয়, অন্যত্রও আছে। "আমরা যখন অসভ্য ছিলুম তখন ওইগুলো বানিয়েছি। এখন আমরা সভ্য, এখন তো আর এসব চলতে দেওয়া যায় না ।" এও মানলাম, কিন্তু মাই ডিয়ার, ব্যাপারটা যে আদপে তা নয় একেবারেই। ব্যাপার আগাগোড়া অন্যরকম। যৌন রূপকল্প, দ্যোতক ও বিম্ব কেবল ব্যবহার করেছেন মলয়, সেগুলির মাধ্যমে নিজের কথা বলেছেন। এও চলবে না ? তাহলে শিবলিঙ্গ তুলে দিন, গৌরীপট্ট নাকচ করুন, অম্বুবাচী ব্যান করুন। কামাখ্যা মন্দিরে মা-কামাখ্যার মাসিক যেন আর না হয়। কি বলেন ? যাঁরা "অশ্লীল অশ্লীল" চিল্লিয়েছিলেন, তাঁরা সম্ভবত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-এর এই লাইনগুলো নজর করে দেখেননি--

    ১.

    জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে

    আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই

    মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না

    তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে কিছুকাল ঘুমোতে দাও শুভা

    শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও

    ২.

    হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা

    আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ

    মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না

    তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহ্যতায়

    সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব

    শিল্পর জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোবো

    কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই...

    ৩.

    এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়

    আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই

    এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে

    মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে

    আমি মরে যাব...

    ৪.

    ৩০০০০০ লক্ষ শিশি উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে

    ঝাঁকেঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়

    এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে

    হিপ্নটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়

    ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি

    কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি

    এই পঙক্তিগুলো একটু মন দিয়ে পড়লে বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর পক্ষে বোঝা দুষ্কর ছিল না যে নিছক যৌনতা নয়, আরো গূঢ় কোনো বোধের দ্যোতনা এই পঙক্তিগুলোয় রয়েছে।'সাত বছর আগের একদিন' কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছিলেন, "অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয় আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত ক্লান্ত করে। লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই..."। এই পঙক্তিগুলোকে উদ্ধৃত করে জীবনানন্দকে শবসাধক সাব্যস্ত করা অবশ্যই উচিত হবে না, অথবা ঘোর অঘোরপন্হী। তেমনই হাস্যকর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ যৌনতার বহিঃপ্রকাশ খোঁজা। আসলে মলয়ের বিরুদ্ধে যখন ষাটের দশকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতার মকদ্দমা দায়ের করা হয়, তখন ষাটের দশকের 'অস্বাভাবিক সুস্হতা' রাজত্ব করছে পুরোদমে।'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে প্রবোধকুমার সান্যালের 'দেবতাত্মা হিমালয়' আর মেট্রো সিনেমার ফুটে রিফিউজি যুবতীদের শরীর নিয়ে চলছে অবাধ বাণিজ্য! পায়ের চটি ঘষটাচ্ছে রিফিউজি যুবক, 'মাই ওন সিসটার স্যার, ভেরি সুইট, ওনলি সিক্সটিন'। অথচ বাঙালি পাঠক 'কত অজানারে'র বারবেল সাহেব আর 'সখী সংবাদ' এর মিষ্টিদিদি, নতুন দিদি, এদের নিয়েই মুগ্ধ। সমাজ কোথাও নেই; সমাজের জ্ধবলাপোড়া, আর্তি, চিৎকার এগুলোও কোথাও নেই। বামপন্হীরা 'পরিচয়' পত্রিকা চালাচ্ছেন, তাতেও এন্ট্রি পারমিট নিয়ে ঢুকতে হয়। এইরকম এক সময়ে 'হাংরি বুলেটিন' এর দরকার ছিল, প্রয়োজন ছিল 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এর। মূল্যবোধ ভেঙে খানখান হওয়ার যে হরর, শিল্পপ্রতীক জোলো হয়ে যাওয়ার যে শক, তাকে যথার্থ ফুটিয়ে তুতে গেলে এই কবিতাই তো লিখতে হবে। মলয় তাই করেছিলেন।

    অবশ্য বিপদ চেনার ব্যাপারে প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের সূক্ষ্মদৃষ্টির প্রশংসা করতেই হয়। কেই বা পড়ে তখন 'হাংরি বুলেটিন', কটা লোক ? পাটনার দুই যুবক, একজন হাওড়ার, একজন বিষ্ণুপুরের, একজন শান্তিনিকেতনের, এদের বুলেটিন বেরোয়। তার জন্যও আবার এই প্রেস, ওই প্রেসের হাতে-পায়ে ধরাধরি। তাহলে? এমন কী ক্ষমতাসম্পন্ন এরা, যে ক্ষেপে উঠল গোটা কলকাতার বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রশাসন ? মলয়ের বিরুদ্ধে কেবল মামলাই নয়, তাঁকে ও অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করে অপমান করা হল চরম, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন এই জাতীয় প্রবণতা মাথা তোলার হিম্মত না করে ।

    বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন যে সমাজকে বুঝতেন না তা নয়, ভালোমতোই বুঝতেন। তাঁরাও জানতেন যে, যে-বদমায়েশি তাঁরা শিল্প, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতির সর্বত্র বিছিয়ে রেখেছেন, তা মানুষের জন্য নয় । তবে শ্রেণী স্বার্থে এর প্রয়োজন তাঁদের ছিল। যেমন ইংরেজরা, আই.সি.এস.কে লৌহ কাঠামো হিসাবে গড়ে তুলতে ছেয়েছিল, তেমনই উত্তর-স্বাধীনতা যুগের ভারতীয় পুঁজিবাদ, আমলাতন্ত্র ও তার মিডিয়া-খানসামাদের লক্ষ ছিল একটি জড়, নির্বোধ, সংবেদনহীন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে তোলা। তাদের রুচি, জীবনযাপন, মূল্যবোধ, সব কিছু হবে ছাঁচে ঢালা, সিনথেটিক। তারা হাসবে, কাঁদবে, গাইবে, সঙ্গম করবে একটি বিশিষ্ট কায়দায়। 'হাংরি প্রজন্ম'এর হুড়মুড় করে এসে পড়ায় এই গোটা গেমপ্ল্যানটি ধ্বসে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মলয় এবং অন্যান্যদের ওপর আক্রমণ সেই কারণেই।

    প্রজাপতি-আঁকা বিয়ের কার্ডে হাংরি প্রজন্ম ধ্বনি তুলেছিল, "গাঙশালিক কাব্যস্কুলের জারজদের ধর্ষণ করো"। এই ধ্বনিটিতে অন্তর্নিহিত ছিল তদানীন্তন কাব্যধারার প্রতি বিবমিষা।

    প্রকৃতি, নিসর্গ এই ব্যাপারগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো বাংলা কবিতার কলোনোয়াল রোগবিশেষ। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ ছিল একটা কমপালশান, যেমন লেখালিখি ছিল তাঁর কমপালশান। সেজন্য তাঁর লেখায় প্রকৃতি, নিসর্গ বিশেষভাবে উপস্হিত--- কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে। আঁকার সময়ে তিনি এগুলো বর্জন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে, বাংলা কাব্যধারায় এই ব্যাপারগুলো প্রয়োজনীয় অনুপান হয়ে ওঠে। এবং অনুপানেরও অধিক, অভ্যাস।জীবনানন্দ লেখেন 'রূপসী বাংলা'। তাতেও নিসর্গ ছিল; তবে সেই নিসর্গ, প্রকৃতির প্রতিটি কমপোনেন্ট আবহমানের বাঙালিজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেছিল।মানুষের সাথে সম্পর্কবিহীন ছিল না সেই নিসর্গ, সেই প্রকৃতি।সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "একদা আষাঢ়ে এসেছি এখানে, মিলের ধোঁয়ায় পড়ল মনে; কালবৈশাখী নামবে যে কবে আমাদের হাত-মেলানো গানে"। এখানে মানুষের সংগ্রামকে আঁকা হয়েছে প্রাকৃতিক ঘটনার রং-তুলিতে। কিন্তু বাংলা ভাষার সেইসব কবিরা (গাঙশালিক কাব্যস্কুল) সৃষ্টি করছিলেন মনুষ্যবিহীন নিসর্গ, মানুষকে মাইনাস-করা প্রকৃতি। এ ছিল একজাতীয় পলায়নবাদ। শংকরের 'কত অজানারে' যেমন বাঙালি যুবকের বেকারত্ব থেকে পলায়ন করতে চেয়ে বারবেল সাহেবের মহানতায় বুঁদ হয়ে থাকা, বিমল মিত্রের মিষ্টি দিদি, নতুন বৌদি, ছোট বৌঠান যেমন নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক ফেস করতে না চাওয়ার যুক্তি, তেমনই 'গাঙশালিক কাব্যস্কুল' ছিল মানুষের দুঃখ, শোক, রোগ, ঘা-পাঁচড়া এগুলোকে দেখতে না চেয়ে স্টুডিওর পর্দায় আঁকা চাঁদ, তারা, নদী, ফুলে বিভোর হয়ে থাকা। ঠিক তখনই মানুষের জীবনধারণ কতদূর দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল, তা দেখতে পাওয়া যায় ঋত্বিক ঘটকের ফিলমগুলোতে। সেই দৈন্য, দুর্দশা, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের প্রতিফলন এই কবিতাগুলোতে কোথাও ছিল না। কেন ? কেননা, তা করার অসুবিধে ছিল। তা করতে গেলে দীর্ঘ একটা লাফ দিতে হত, বিশেষ করে ভাষার ক্ষেত্রে।ঋত্বিক যেমন 'মেঘে ঢাকা তারা' বা 'কোমল গান্ধার' -এ গোটা ইডিয়মটিকেই ভেঙেচুরে ফেলেছিলেন, তেমনই ষাটের দশকের বঙ্গসমাজ ও মানুষেকে তুলে আনতে গেলে বাংলা কবিতার গোটা ইডিয়মটিকেই ভাঙতে হত। খানিকটা শ্রেণী পরিপ্রেক্ষিত আর কিছুটা গাড্ডায় পড়ে যাওয়ার ভয়, উভয়ে মিলে এ-কাজ করতে দেয়নি বাংলা ভাষার কবিদের। অতএব চাঁদ, তারা, নদী, ফুল, মৌমাছি...

    আরেকটি প্রশ্নও ছিল। কবি কি কেবল কবিতাই লিখবেন, না সামাজিক ভাষ্যকারও হবেন ? রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি নন, সামাজিক ভাষ্যকারও ছিলেন। জীবনানন্দও তাই ( জীবনানন্দকে নিবীঢ়ভাবে পড়লে এই ব্যাপারটি ধরা পড়ে) । কিন্তু উত্তরোত্তর সামাজিক ভাষ্যের ব্যাপারটি বাংলা কবিতা থেকে উঠে যেতে থাকে। "কবিতা কবিতাই। সামাজিক ভাষ্যটাষ্য আবার কী?" এ-জাতীয় একটী প্রবণতা বাংলা কবিতাকে পেয়ে বসতে থাকে। একে ক্রমাগত হাওয়া দিতে থাকে স্বার্থান্ধ বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান।

    খুব স্বাভাবিকভাবেই নভেম্বর ১৯৬১-এর প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি প্রজন্ম এই প্রবণতার বিরুদ্ধে ছিল। সেই দিন থেকে আজ অব্দি মলয়, সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি কোনোদিনই হাতছাড়া করেননি। 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'এ যেমন সামাজিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে তাঁর তীব্র বিবমিষা, তামনই আজও। তাঁর হালের একটি কবিতা নেওয়া যেতে পারে, 'যা লাগবে বলবেন' সংকলন থেকে । কবিতাটির নাম 'ক্ষুধার্ত মেয়ে':

    আমার আসক্তি নেই কোনো

    চলে যা যেখানে যাবি

    যার সঙ্গে শুতে চাস যা

    আমি একা থাকতে চাই

    ক্ষুধার্ত বা পেটুক মহিলা

    যে ঘোরে সবার হাতে

    খড়কুটোময় সংসারে

    তার কোনো প্রয়োজন নেই।'

    কবিতাটিতে জড়িয়ে আছে একটা ঈষৎ বোহেমিয়ান বাচনভঙ্গী। পড়লে মনে হবে কেউ একজন লিখছেন তাঁর শয্যাসঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে। এটি কিন্তু কবিতার প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে কবিতা ও সমাজ সম্পর্কে মলয়ের দার্শনিক বোধ সন্নিহিত। শয্যাসঙ্গিনী মহিলাটি আসলে কবিতাই। অথচ সবার হাতে ঘোরার প্রবণতা তার, সে হাত স্মাগলারের হোক বা বিপ্লবীর।কবিতার লয়ালটি সন্দিগ্ধ। ওদিকে সংসার অনিত্য, অতএব তার প্রয়োজন কিসের ?

    'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতায় যে-কথা বলার জন্য মলয়কে অনেক বেশি জায়গা ব্যবহার করতে হয়েছে, 'যা লাগবে বলবেন' গ্রন্হে সেই কথাই তিনি বলেছেন অনেক সংক্ষিপ্ত পরিসরে। 'হাংরি আন্দোলন' থেকে সরে এসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইন্সপেক্টিং অফিসার হিসেবে ভারতের গ্রামে-গঞ্জে শহরে শহরে ঘোরা, তারপর এ.আর.ডি.সি. ও নাবার্ডের গ্রামোন্নয়ন বিশেষজ্ঞের উচ্চপদে। যদিও মলয় তাঁর এই পরিবর্তিত জীবনশৈলী নিয়ে 'হাংরি কিংবদন্তি' গ্রন্হের শেষে মশকরাও করেছেন, "ছাই-এর জায়গায় আসে টুথপেস্ট, কয়লার উনুনের বদলে গ্যাস, সর্ষের তেলের বদলে সূর্যমুখী, শার্ট-প্যান্টের বদলে সাফারি, মাদুরের স্হানে বিছানা, ঢাবার বদলে রেস্তরাঁ, দিশির জায়গায় স্কচ, কলেজস্ট্রিট ও বইপাড়ার বদলে বাংলার গ্রামশহর।" কিন্তু তবু জীবনের এই অধ্যায়টিও যে কবি হিসেবে মলয়কে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই।

    'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ বাঁধন-ছেঁড়া রাগ ছিল মলয়ের কবিতার পরিচিত চিহ্ণ। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে জীবনের বহু কিছু দেখে-শুনে মলয়ের কন্ঠস্বর তেতো, অম্লকষায়, আর তার সাথে এসে জুটেছে আয়রনির অধুনান্তিক পরিহাসও। তবু তা মলয়ের কবিতাকে সর্বজনগ্রাহ্যও করে তোলে বটে।'যা লাগবে বলবেন'-এর আরও একটি কবিতাকে নেওয়া যেতে পারে, যেমন 'দ্রোহ':

    এ-নৌকো ময়ূরপঙ্খী

    তীর্থযাত্রী

    ব্যাঁটরা থেকে যাবে হরিদ্বের

    এই গাধা যেদিকে দুচোখ যায় যায়

    যাযাবর

    ঘাট বা আঘাটা যেখানে যেমন বোঝে

    ঘুরতে চাই গর্দভের পিঠে

    মাথায় কাগুজে টুপি মুখে চুনকালি

    পেছনে ভিড়ের হল্লা ।

    ব্যাস! কবিতা এইটুকুই। অথচ বাঙালি সমাজের যে একটি বিশেষ প্রবণতা, কবিকে বেদিতে বসিয়ে রাখার, তাকে কত সার্থক ভাবে ভাঙঅ হয়েছে এখানে। পাটনার অন্ত্যজ মহল্লাগুলোতে হোলির দুতিন দিন আগে থেকে চোখে-পড়া একটি সুপরিচিত দৃশ্যকে ব্যবহার করেছেন মলয়, প্রশ্নাতীত দক্ষতাসহ। তার সাথে মিশিয়েছেন তীর্থযাত্রার জন্য বাঙালি হিন্দুর চিরাচরিত আতুরতাটিকে, যাতে পোস্টমডার্ন পরিহাস আরও তীব্র হয় । আর... হাংরি মামলার সময়ে তাঁকে যে-সামাজিক অবমাননা সইতে হয়েছে, তাও উঠে এসেছে। মাত্র কয়েকটি পঙক্তির মধ্যে কত প্রসঙ্গ যে এসেছে, অথচ বলার ভঙ্গিটি এত সহজ যে ভাবাই যায় না ।

    এই সংগ্রহের আরেকটি কবিতা 'যে পার্টি চাইছেন সে পার্টিই পাবেন'।

    বিশ্বাস এক দুর্ঘটনা

    বুকপকেটে শ্রেণী

    প্রতিরোধী থাকেন জেলে

    কাজু-ফলের ফেনি

    বরং ভালো

    ভুল অঙ্কের ডানা।

    ...মোড়ল দলের পাড়ার কেউ বা

    আওড়ায় বেঘোরে

    ছাদ ঢালায়ের সমরবাদ্য

    কর্তাবাবার জানা

    মেলাবেন তিনি অন্তরীক্ষে

    মোক্ষ একখানা ।

    কবিতার শেষ দুটি পঙক্তিতে অমিয় চক্রবর্তীর 'মেলাবেন তিনি মেলাবেন', এই শান্ত, স্হিত, প্রায় ব্রাহ্ম, উত্তর-রাবীন্দ্রিক বিশ্বাসের আদলটি একেবারে বিপরীত অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পার্টি আমলাতন্ত্রের যে প্রবল দাপত, যার দরুণ তেলে-জলে মিশ খেয়ে একেবারেই একাকার, পুতুল নাচের সুতোর শেষ প্রান্তটি ব্যক্তিবিশেষের হাতে, সেটিতে যেমন-যেমন টান পড়ছে, কাঠের পুতুলগুলো তেমন-তেমনই নাচছে; এই গোটা পরিবেশটি উঠে এসেছে কয়েকটি মাত্র পঙক্তির মাধ্যমে। মলয় বুঝিয়েছেন, যা বোঝাতে গেলে অন্তত কয়েকশো পাতার বই দরকার। আর? বিরোধীপক্ষ বলতে কিছু নেই আর। যারা বিরোধ করছে, তারাও বস্তুত নিজের-নিজের ছাদই ঢালাই করছে। সেই ছাদ ঢালাই-এর বাজনাকে মানুষ মনে করছে সমরবাদ্য।

    এত সূক্ষ্ম যাঁর ভাষার পরিমিতিবোধ, তিনি কিন্তু 'চিৎকারসমগ্র' গ্রন্হে এসে আবার অন্যরকম হয়ে যান। দড়ি ঢিলে দেন একটু, যাতে তাঁর সংবাদবাহক ঘুরতে পারে জায়গা-বেজায়গায়। 'ভাঙনের ছায়াগাছ' কবিতাটির অংশ পড়া যেতে পারে এই প্রসঙ্গে:

    হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া সেই প্রৌঢ় নদী

    নাচছে দুর্গাবোঙার ফরসা কোমর জড়িয়ে

    শহর-পুরুতের গামছা কাঁধে

    তাককা হুরে

    আরে হুরে তাককা হুরে

    বোঙা আদিবাসী দেবতা-অপদেবতার সর্বনাম। দুর্গা বাঙালির আবহমানের দুর্গতিনাশিনী। তারই কোমর জড়িয়ে নাচছে হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া প্রৌঢ় নদী, কাঁধে শহর-পুরুষের গামছা। তাককা হুরে, আরে হুরে তাককা হুরে, শহুরে মাস্তানদের উল্লাসধ্বনি।

    ভাঙনের ছায়াগাছ। এই ভাঙনকে সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় না, অথচ সে তার কাজ করে চলেছে। ভাঙন বস্তুত একটি সার্বিক প্রক্রিয়া। এর দরুন সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে মজাদার মিলমিশ। বুর্জোয়ার বক্তব্য আশ্রয় করে লুমপেনের ভাষাকে।লুমপেন অ্যাডপ্ট করে বুর্জোয়ার চালচলন। এর সংস্কৃতি ঢুকে পড়ে ওর উঠোনে। ওর 'রোনাধোনা'য় শোনা যায় এর অনুরণন।

    চিৎকার করতে-করতে পড়ছে জলপ্রপাত চুলে

    ঢাউসপেট পোয়াতি অফিস-বারান্দায় আইল হাতে

    থ্যাতলানো ট্যাক্সিচালক হাওড়া স্টেশানে

    যেখানে সাপের ফণা জমা রাখতে হয়

    শহর বিষদাঁত খুলে নেয় প্রত্যেকের। ছোবলানো তো চলবেই না, ফোঁস করাও নয়। অফিস বারান্দায় ফাইল হাতে গর্ভিনী। কী প্রসব করতে চলেছে সে ? তারই মধ্যে ঝরে যেতে থাকা কেশপাশের চিৎকার। আলুলায়িত কেশপাশ বাঙালির আবহমানের সৌন্দর্য-মিথের অংশ।

    মেঝেময় ছড়িয়ে-থাকা গোঙানির টুকরো তুলে

    তারা বদলায়নি তবু আদল পালটেছে

    হে নাইলন দড়ি বাড়িতে এখন কেউ নেই

    কিন্তু বাইরে হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর

    কবিতাটি পড়তে-পড়তে বহু পুরোনো টার্কিশ ফিলম 'কংকারার্স অফ দি গোলডেন সিটি'র কথা মনে পড়ে। নিষ্পাপ একটি গ্রাম্য পরিবার শহরে এসে সব কিছু ধিরে-ধিরে হারাল। তার মেয়েরা হয়ে গেল বেশ্যা, পুরুষেরা অপরাধি। হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর--- গোল্ডেন সিটি। সোনার শহর। নারকেল দড়ির বদলে নাইলন দড়ি, সভ্যতার অগ্রগতি। বাড়িতে কেউ নেই , শূন্যতা অপরিসীম।

    কবিতাটির শেষ স্তবকে এসে মলয় দুর্বার ছুট লাগান--- এমন ছুট যে কবিতা ব্যাপারটাই দুমড়ে-মুচড়ে যায়।

    কচি বালক-পাছার নধরমাংস দেবদূত

    মাখনমাখা ব্রয়লার যার শেষ খদ্দের

    চলে গেছে তিন বছর তার ব্লাউজে সেফটিপিনগাঁথা হৃদয়

    স্লুইস দরজা খুলে আলোর নারীশরীর

    যে জীবন বুকের সামনে উঁচিয়ে অচেনা পিস্তল

    তখনই সিঁড়িতে সাদা ছড়ির আওয়াজ তুলে

    গামছায় মুখ ঢেকঢ গাঁও বালিকার কান্না

    কেঁপে উঠেছে শিশুর গায়ে হাত ঠেকলে

    ভাঙন যখন সব কিছুকেই ভাঙছে, তখন কবিতাকেও সে ভাঙবে। ভাঙতে-ভাঙতে কবিতাও মুক্ত হয়ে যাবে। তখনই বোধহয় বিদ্যুৎ ঝলকের মত এক অন্য কবিতার সৃষ্টিমুহূর্ত।'ভাঙনের ছায়াগাছ' কবিতায় আমরা সেই প্রক্রিয়াটি দেখতে পাচ্ছি, চাক্ষুষ।মলয় রায়চৌধুরী থেকে বোধ হয় এক নতুন কবিকুলের সৃষ্টি হল, যাঁরা কেবল কবি নন, আপোষহীন সামাজিক ভাষ্যকারও বটে। "ঘুম-ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত" এর ব্যকরণ ভেঙে চুরমার, পর্বত শিখরে সূর্যোদয়ের মতো শোনা যাচ্ছে সেই নতুন কবিতার বজ্রনির্ঘোষ।

    'হাংরি সাক্ষাৎকারমালা'য় মলয় বলছেন বিবেকানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে, "যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন কবিতা ও গদ্যের চাকুতে একনাগাড় পালিশ দেওয়া দরকার।" হাংরি আন্দোলন ফুরোবার পর মলয় কেবল প্রথাগত জীবন যাপনই করেননি, একনাগাড়ে অনুশীলনও করেছেন। এই অনুশীলন ও পঠন-পাঠন ছিল একলব্য সদৃশ, অথচ সামনে ছিল না দ্রোণের মূর্তি।মলয়ের সাধনা এরকমই। তার ফলে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' ও তাঁর আজকের কবিতার মধ্যে গড়ে উঠেছে লক্ষণীয় দূরত্ব। 'লক্ষণীয়' বললাম, কারণ মলয়ের 'হাততালি' কবিতাটিতে এমনই কিছু পরীক্ষা ও নিরীক্ষা জ্বলজ্বল করছে। রেলওয়ে ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন ট্রেনের আলো-আঁধারি কামরাগুলো ঝটিতি চোখের সামনে দিয়ে বহুমাত্রিক অর্থময়তায় সরে-সরে যেতে থাকে, তেমনই এই কবিতার অজস্র ছবি, চিত্রকল্প, ইশারা এরা দ্রুত ছুটে চলেছে:

    তারপর পলিতকেশ কাশফুলে

    পইপই বারনের পুশতুভাষী দুর্যোধন বেরিয়ে পড়েছে

    দগদগে রোদে

    চন্দন রক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে

    অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প

    কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব

    হাহ

    রোগা পৃথিবীর শিয়রে রাতজাগা নেশুড়ে

    হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেনি হাততালি

    চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা

    'হাততালি' প্রাথমিক স্তরে উল্লাসের বহিপ্রকাশ। প্রশ্ন উঠছে, সমাজ যখন পচছে-গলছে, তখন কবি এত উল্লসিত কেন ? কিসের এ-উল্লাস ? কেন উল্লাস ? বিশৃঙ্খলার মহোল্লাস ?

    যা অচল, যা জড়, তাকে একদিন না একদিন ভেঙে জেতেই হবে। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন নতুন কিছু গড়ে উঠবে না, উঠতে পারে না। মানুষের ভাবনাচিন্তা কার্যকলাপের ইতিহাসে এই উল্লাস অন্যত্রও দেখা গেছে। তন্ত্রসাধনার যে দিকগুলো, বামাচারের যে চালচলনগুলোকে 'বিকৃতি' বলে মনে করা হয়েছে, বস্তুত তা ছিল বর্ণাশ্রমপন্থী ছুঁৎমার্গপ্রবণ সনাতন হিন্দুধর্মের গড়া বিভিন্ন আগড় ভেঙে ফেলার উল্লাস। ভিন্ন 'অন্ত্যজ' বা অস্পৃশ্য জাতির নারীদের সাধনসঙ্গিনী করা, এই উল্লসিত বিদ্রোহের একটি দিক। নালান্দা জেলার কিংবদন্তি অনুযায়ী বৌদ্ধতন্ত্রের ভিক্ষু 'পদ্মসম্ভব' একজন অন্ত্যজ নারীকে নিয়ে ইলোপ করেছিলেন, ও দীর্ঘকাল নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে উধাও ছিলেন।দাহসংস্কারকে নানা কর্মকাণ্ডে মুড়ে সনাতন হিন্দুরা চেয়েছিলেন, মানুষ যেন অতীতকে খুঁটিয়ে না দেখে। শবসাধনা ও অঘোরপন্থা ছিল পরোক্ষে এর বিরুদ্ধচারণ। অতীতকে বিশ্লেষণ করা ও তার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা, এই ছিল নানা তান্ত্রিক আচারের পেছনের অস্ফুট উত্তেজনা ও মহোল্লাস । মলয়ের 'হাততালি' কবিতার শিরোনাম ও ও প্রথম স্তবক এই আশ্চর্য নানার্থময় উল্লাসে মুখর। পুশতুভাষী দুর্যোধনের পৌরাণিক প্রাসঙ্গিকতাও আছে। একেবারে আলটপকা নয় এই অভিব্যক্তি। গান্ধার, কান্দাহার, পুরুষপুর, পেশাওয়ার, ভারত-পুরাণের এই অতিদীর্ঘ ছায়াবৃত যাত্রাপথের দূরত্ব নির্দেশকারী সংকেতগুলো মলয় ব্যবহার করেছেন স্হপতির নিপুণতায়, ইউক্লিডের নির্দেশ অমান্য করে। চন্দনরক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে। হিন্দুর পূজাসামগ্রী রক্তচন্দন। তাকে উল্টে চন্দনরক্ত। রক্ষীদের পোশাক পাথরের। অজর অনড় সনাতনী অতীত ভারত দেশের। অতীতকে না হয় মুছে ফেলা গেল, কিন্তু তারপর ?

    "অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প/কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব/হাহ"। যে নতুন পৃথিবী তৈরি হয়েছে তা নারকীয়। অতীতের বিকল্প গড়ে তোলার নামে কেবল নরকই তৈরি হয়েছে, অন্য কিছু নয়।

    আধুনিকতার লাফঝাঁপ আজ হাস্যকর।

    আধুনিকতার হাতে গড়া সামাজিক প্রতিবাদের নানা যোগাড়যন্ত্র প্রতিবাদকে ব্যহতই করেছে, আর কিছু করেনি।"হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেনি হাততালি", তথাপি "চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা।" কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে মনুষ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা কোনটি, তবে আমি কিন্তু বলব না, 'পরমাণু বোমা আবিষ্কার'। বলব না 'ঔপনিবেশিকতা'। বলব না কলম্বাস অথবা ভাস্কো ডা গামার জন্ম। আমার উত্তর "মনুষ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা মার্কসবাদ ও জুডিও ক্রিশ্চিয়ানিটির সমার্থক হয়ে যাওয়া।" মার্কস একেবারে চাক্ষুষ দেখে ছিলেন বিশ্ব পুঁজিবাদের উদয়। সেই দেখা ছিল নিখুঁত। তাঁর অভুতপূর্ব মেধা খুঁজে পেয়েছিল সেই উদয়ের কারণগুলোকে। কিন্তু এক জীবনে তাঁকে করতে হয়েছিল বিপুল পরিমাণ কাজ।করাল দারিদ্রের সাথে প্রতিনিয়ত যুঝে, একমাত্র বন্ধো ও সহযোদ্ধা এঙ্গেলসের সাহায্যে, তাঁকে সমাজবাদী দর্শন, অর্থনীতি ও সমাজত্ত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করতে হয়েছিল। তাই ইউরোপীয় সমাজের বাইরে বড় একটা ছড়িয়ে পড়তে পারেনি তাঁর দৃষ্টি। তবু ভারতবর্ষকে বোঝবার চেষ্টা তিনি করেছিলেন, উল্লেখ করেছিলেন 'এশিয়াটিক মোড অফ প্রডাকশানে' এর কথা। যদি এই মোডকে বোঝাবার সময় তাঁর হাতে থাকত, তবে হয়ত, হয়ত কেন, অবশ্যই, পরবর্তীকালীন যান্ত্রিকতা থেকে মার্কসবাদের মুক্ত থাকার সম্ভাবনা হত অনেক বেশি প্রবল।তা না হবার দরুন, পরে জুডিওক্রিশ্চান নিয়তির সাথে মার্কসবাদও জড়িয়ে পড়ে। যেমন খ্রিস্টধর্ম দরিদ্র ইহুদি ক্রীতদাসের ধর্ম হিসাবে যাত্রা শুরু করে, পরে রোমক সম্রাটদের ধর্ম হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনিই, মার্কসবাদ, কাউটস্কি প্রমুখ সুবিধাবাদীর হাতে পড়ে অচিরেই ইউরোপীয় পুঁজিতন্ত্রের সেবাদাসের কাজে লেগে যায়।

    মার্কসবাদের সামাজিক বিকাশের নিয়মটিকে তার দ্বান্দ্বিক অন্তর্বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমনই একটি যান্ত্রিক সিদ্ধান্তে পরিণত করা হয়েছিল যে, বলা হল, "ধাপে-ধাপে এগিয়ে পুঁজিবাদই সমাজবাদ (!) হয়ে উঠবে"--- এই হয়ে ওঠে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের দলগোলুর ধারণা।লেনিন, রোজা লুক্সেমবুর্গ প্রমুখেরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গড়ে সৃষ্টিশীল মার্কসবাদের গোড়াপত্তন না করলে, পরে মার্কসবাদকে পুঁজিবাদের দর্শন থেকে আলাদা করে আর চেনাই যেত না। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লেনিন ছিলেন অধুনান্তিক রাজনীতিবিদ, যিনি আধুনিকতার প্রবক্তা কাউটস্কির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কাউটস্কি প্রমুখরা মার্কসবাদকে অক্ষরসর্বস্ব করে তুলেছিলেন।কিন্তু যান্ত্রিকতা বোধহয় মানুষের একটি স্বাভিক ঝোঁক। পরে লেনিন-শিষ্যরাই আবার যান্ত্রিক হয়ে ওঠেন; রুশ মডেলটিকে ব্যবহার করতে থাকেন যত্রতত্র সর্বত্র। ভারতের মার্কসবাদীরাই হয়ে ওঠেন সবচেয়ে বেশি যান্ত্রিক।

    'ইতিহাস' ভদ্রলোকটি নানাবিধ পরিহাসে যে ভালোরকম সিদ্ধহস্ত, তাতে আর সন্দেহ নেই। মলয়ের 'হাততালি' কবিতার ( এটি একটি দীর্ঘকবিতা ) দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় পঙক্তিতে আছে, "যাত্রীডুবির খবরে ডুকরে উঠেছেন লালশালু নৌকার হাততালি।" পরিস্হিতি বারবার ওলোটপালোট করে দিচ্ছে মার্কসবাদীদের কষা ছক। এর ঠিক আগের পঙক্তিতে আছে, "একথোকা অন্ধকারে জোর করে দেখানো স্বপ্নে...।" মার্কসবাদীরা ভবিষ্যতের একটি মনমোহক স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আপামর জনসাধারণকে। সেই ছবি বাস্তবসম্মত ছিল না। তাই ছক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হতপ্রভ মার্কসবাদী ভাবুক শিবির। "না খেতে পাওয়া হলুদ শীতে/গরম আলকাতরায় ফোটা ফরসা রজনীগন্ধা।" ওদিকে শোষণও অব্যাহত। তারই হাড়ে-মাংসে তৈরি হচ্ছে নবতম 'নন্দনতত্ত্ব'। "কাঁধে চাঁদ নিয়ে ভররাত শাসিয়েছে শ্যাওলাধরা করোটি।" অতীতের দুঃসহ চাপ আর বারবার সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার... "জ্বরগরম কপাল ছুঁইয়েছে তাঁর পশুপশম নাভিতে।" এরপর গুটিয়ে-রাখা একটি প্রাচীন, কীটদষ্ট মানচিত্র খোলার মতো একখানা গোটা উপমহাদেশ মলয় খুলে ধরেন আমাদের চোখের সামনে। সেই উপমহাদেশকে নষ্ট করেছে সাম্রাজ্যবাদ আর সামন্তবাদ। তাদের রূপক দ্যোতক প্রতীকগুলো বর্শাফলকের মতো বিদ্ধ হয়ে আছে উপমহাদেশটির হৃদয়ে।

    "ব্যাবিলনের শাদা নরকহুরি/উত্রমুখো নকশিমেঘের ওষুধবড়ি গিলিয়েছে/রেড়িপ্রদীপে ঝুঁকে ঘুরঘুরে শুঁটিপোকা/

    এলোচুলে ঢাকা রাজকন্যার মুকুট থেকে গানের টুকরো/

    পায়ে রক্তমাখা রাজহাঁস/যখন-তখন চেয়েছে বাড়িফেরত সৈন্যের বসন্তকাল/সাজিয়েছে খেলাচ্ছলে মারা চরমযুবার মা-বাপের সবুজকাঁথা ধানক্ষেত/তুঁতেরঙা কুয়াশা এগিয়েছে সিংহচামড়া শিকারীর গোপন ঘাসপথে/বিবাহযোগ্য ঘুড়সওয়ার হাততালি/হেই হো"। এই নষ্ট প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে দানা বাঁধেনি, বাঁধতে পারেনি যথার্থ বিদ্রোহ, যদিচ দেখতে বিদ্রোহের মতন, এমন অনেক কিছুই ঘটেছে।"আগুন যখন ধোঁয়া থেকে আলাদা হচ্ছে/যেটুকু সময়ে/আলজিভ/দুই হৃৎস্পন্দনের মাঝে তেতো হয়ে ওঠে/জলপথে এসে আক্রমণ করেছে জ্বরবিদ্রোহী/গাছে-গাছে ঝড়কালীন পলাশের লাল সক্যতা/ঠিক যেন চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎহীন/শেষ হাওয়ায়/পটকা ফাটিয়েছে রাংতাপাড় মেঘ/যেন এক্ষুনি এসে পড়ল বলে হাততালি।" একটি নষ্ট প্রক্রিয়া, তার বিরুদ্ধে 'গড়ে ওঠা' বিপ্লবী আন্দোলনের দেউলেপনা, সবকিছু মিলে বিচিত্র এক পরিস্হিতি। বিপ্লবী আন্দোলনের সেই সততা নেই যে নিজের দেউলেপনা স্বীকার করে নেবে।"কবরে পাওয়া গেছে ভাত খাবার কাঁসি/অত্যাচারিতের কাতরানিতে পড়েছে হাড়ের খিলান/কেউ সুখি নয়/কেমন আছো জানতে চাইলে বলেছে /ভালো/পাকের পর পাক কাঁটাতার কোমর থেকে খুলে দিয়েছে"।

    ভারতবর্ষে বিহারসদৃশ যে কয়টি আভ্যন্তরীণ উপনিবেশ আছে, সেখানে অবস্হা আরও ভয়াবহ।এই আভ্যন্তরীন উপনিবেশগুলোকে নিয়ে বিপ্লবীদের ভড়ংএরও শেষ নেই।"ওদিকে হাততালিবাদক/ভগ্নস্বাস্হ্য আকাশে/পাখিদের গান শুধরে দিতে চেয়েছে/তারা দপদপে অন্ধকারে/

    বালিশ-জড়ানো বর্ষায়/পালামৌ জেহানাবাদ রোহুতাসে কাদাপেছল মাগুরের আঁশটে হাঁপানি/শামুক থুতনি বুড়ির চোখের পাতায় ধূসর সোরাগন্ধক।"

    সবকিছুর শেষে, সমস্তকিছুর পরিণামে খিদে। খেতে চাইছে মানুষ আর নিরন্তর খাদ্য হয়ে যেতে হচ্ছে তাকেই। আর তার এই খাদ্য হয়ে যাওয়াকে নানা অং বং চং দিয়ে মহিমা মন্ডিত করা হচ্ছে। মলয় এই বিচিত্র প্রক্রিয়াকে প্রস্ফূট করতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন রূপকল্প, যাতে এই পরিস্হিতির দ্বৈততা যথার্থ ব্যাখ্যাত হয়। যে ক্ষুধার্ত, সে-ই খাদ্য। "এদিকপানে মুখ করে দাঁড়িয়েছে ছোকরা সূর্যমুখী/ গরম তেলে লাল দুহাত উড়িয়ে স্বাস্হ্যবতী কাঁকড়া/ভাতের হাঁড়িতে নেচেছে সফেদ-মসলিন নরম অপ্সরা/তখন অন্ধকারে কেঁদে নিয়ে আলোয় হেসেছে হাততালি/হাসপাতালের বিছানায় লোহার শেকলে বাঁধা শুনেছে/ টেবিল ঘড়িতে সারারাত গ্রেপ্তারের ঠক ঠক ঠক ঠক।"

    আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যাঁরা ঔৎসুক্য রাখেন, তাঁদের অবশ্য পঠনীয় একটি বই "দি নিউ ক্লাস", লেখক মিলোভান জিলাস। জিলাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া আবশ্যক।মিলোভান জিলাস, তদানীন্তন যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্হানীয় নেতাদের একজন, স্ট্যালিন ও টিটোর অন্তরঙ্গ, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের 'কমিনফর্ম' পর্যায়ের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যতা ত্যাগ করেন ও এই বইটি ও আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই লেখেন, যেমন "কনভারসেশানস উইথ স্ট্যালিন" লেখেন। "দি নিউ ক্লাস" লেখার অপরাধে টিটো জিলাসকে সশ্রম কারাদন্ডে দম্ডিত করেন। দি নিউ ক্লাস বইটিতে জিলাস সমাজবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে একেবারে নতুন একটি অবদান রাখেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, মিনস অফ প্রোডাকশানের মালিকানা স্বত্ব কাগজে-কলমে না থাকলেও সমাজতন্ত্রী দেশগুলোতে একটি নিউ ক্লাস বা নতুন শ্রেণির উদয় হয়েছে, যারা উদ্বৃত্ত বা সারপ্লাস সংগ্রহ করতে সক্ষম। এই শ্রেণীটি ক্রমশ নিজেদের হাতে প্রভূত অর্থ ও ক্ষমতা কেন্দ্রিত করেছে, এবং পার্টি, শাসনতন্ত্র, সমস্তকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। জিলাসকে সেই যুগে সাম্রাজ্যবাদীর দালাল উত্যাদি আখ্যায় বদনাম করা হয়েছিল। তিনি কারাবাস করেন, এবং ধিরে-ধিরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। পরে যখন সোভিয়েট দেশ ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ধ্বস নামে, এক কালীন পার্টি আমলারাই সি.পি.এস.ইউ.কে ভোগে দিয়ে দেন, এবং রাতারাতি বিশাল-বিশাল কল-কারখানার মালিকের চেয়ারে জাঁকিয়ে বসেন, তখন আবার জিলাসকে খোঁজা আরম্ভ করেন যথার্থ মার্কসবাদীরা। পশ্চিমবঙ্গে বহুকাল বহুবছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার ফলে আমলাতন্ত্রের যে অভ্যুদয় ঘটেছে, তাকে যথাযথ বুঝতে যাঁরা চান, তাঁরা এই বইটির সাহাজ্য নিতে পারেন।

    'কৌণপের লুচিমাংস' কাব্যগ্রন্হের ভূমিকায় মলয় বলেছেন, "বর্তমান কালখন্ডের বঙ্গসমাজটি অধিবাস্তব। আমি চেষ্টা করেছি তাকে উপস্হাপনের। সেকারণে কোথাও-কোথাও পঙক্তি এবং ছবিকে মনে হতে পারে জটপাকানো। আমার প্রতিভা দ্বারা কবিতাগুলোর সৃজন হয়েছে মনে করা ভুল।আমিই বরং সৃজিত হয়েছি কবিতাগুলোর দ্বারা। ভাষাসমাজের দ্বারা।"মলয়ের এই বক্তব্যটি কবিত্বের ধারণাটিকেই পালটে দেয় মূল থেকে। গলায় গাঁদাফুলের মালা, স্কুল-শিশুদের উদ্দেশ্যা নরম গলা, 'নারীত্বের' প্রতি সম্ভ্রমশীল, চোখ ঢুলুঢুলু, ভুলো মন, জীবন সম্বন্ধে উদাসীন--- স্বল্পকথায় একটি প্রবল নন্দনতাত্ত্বিক তালগোলের যে চিত্রটি চোখে ভেসে ওঠে 'কবি' শব্দটি উচ্চারণ করতেই, তা থেকে মলয় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন কিছুটা জোর করেই হয়ত। মলয় বলছেন, 'কোথাও-কোথাও পঙক্তি এবং ছবিকে মনে হতে পারে জটপাকানো'। এও বলছেন, একটি অধিবাস্তব সমাজকে উথ্থাপন করতে গিয়েই হয়ত এই জটিলতার সৃষ্টি। কৌনপ একজন পৌরাণিক রাক্ষস, যে কুনপ অর্থাৎ শব খেয়ে বেঁচে থাকে। 'কৌনপের লুচিমাংস' রাজনৈতিক কবিতার সংগ্রহ। সর্বসাকুল্যে বত্রিশটি কবিতা আছে সংকলনে। কবিতাগুলির প্রত্যেকটিই একটি করে হাহাকার। আজকের পশ্চিমবঙ্গ, তার সমাজ, তার সংস্কৃতি, তার পচন, সবকিছু নিয়ে হাহাকার; যদিও ওই একই ভূমিকায় মলয় বলেছেন, 'এই গ্রন্হের পাঠবস্তু আসলে বাঙালির পচনের হোলিখেলা'। কিন্তু মলয়ের কষ্ট ও বেদনা প্রতিটি কবিতায় প্রস্ফূট। তার আঙ্গিকটি যদিও উল্লাসের, হোলিখেলার। ব্যাপারটা কিছুটা চার্লি চ্যাপলিনের ফিলমের মত বলা যায়।অধুনান্তিক। 'রাঁঢ়বাজারে শততম প্রেমিকের আবির্ভাব হল/ অথচ ফুলের টবে মাটি নেই শেকড়ে-শেকড়ে ছয়লাপ সংসার'। রাঁঢ়বাজার শব্দটি প্রণিধানযোগ্য। মলয় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পরিস্হিতিকে 'রাজনীতিবিদ বনাম জনতা' এভাবে নিচ্ছেন না কিন্তু। আগেও বলেছি, সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি মলয় কখনই হাতছাড়া করেননি। সেই ভূমিকাটিই তাঁকে উৎসাহিত করেছে পশ্চিমবঙ্গের কলোনিয়াল অতীতকে খুঁটিয়ে দেখতে। তাঁর লেখা বহু গল্পে ও প্রবন্ধে এই দেখা খুব স্পষ্ট। মলয়ের অধুনান্তিক ধ্যান-ধারণার উৎপত্তিও বস্তুত এখান থেকেই। উপনিবেশবাদ পশ্চিমবঙ্গের মনোজগৎকে ভালো রকম ধামসে দিয়েছে বহু আগেই। তার ফলে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ফলাও রাঁঢ়বাজার, যেখানে কেবল প্রেমিক যায় আর আসে। বর্তমান কালখণ্ডের ক্যাডাররা সেই রাঁঢ়বাজারের শতশত প্রেমিক। ফুলের টবে মাটি নেই, অথচ শেকড় সেঁদিয়ে গেছে ভেতরে, প্রায় অতল পর্যন্ত।অনন্ত পর্যন্ত নানা কায়েমিস্বার্থ চারিয়ে দিয়েছে শেকড়।

    সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেয়ার দরুনই মলয় খুঁটিয়ে দেখেন গলদ কোথায় ছিল আর আছে। কমিউনিস্ট-বিরোধীরা যেমন গোটা ব্যাপারটিকেই "আরে ও শালারা অমনধারাই" বলে সেরে নেন, মলয় কিন্তু তা করেননি। তিনি খু#টিয়ে দেখেন, জানতে এবং জানাতে চান।তার ফলে তাঁর চোখে ধরা পড়ে বহু বিচ্যুতি, যেগুলো হয়ত অনেকেই দেখেও দেখেননি। 'কাউন্টার ডিসকোর্স' কবিতায় মলয় বলছেন, "খাটের দুপাশ দিয়ে আলাদা বয়ে যাচ্ছিল মজুরের নদী কৃষকের নদী। যে কড়াকড়িতে সারাদিনে সূর্য শুধু একবারই ওঠে আর মিলিয়ে যায়।"

    অক্টোবর বিপ্লবের সময় সহসা আবিষ্কৃত হয় যে বলশেভিক পার্টির হাতে কৃষক শ্রেণির জন্য কোনো আলাদা প্রোগ্রাম বা কর্মসূচী নেই। অথচ বিপ্লবের কর্মকান্ডে কৃষক শ্রেণির সহযোগীতা অপরিহার্য। লেনিন দ্বিধাহীনভাবে এস.আর. (শ্পেশাল রিভলিউশানারি)-দের প্রোগ্রামটিকেই সরকারের তরফ থেকে অ্যাডপ্ট করে নেন। কয়েকটি পার্টির যে যুক্তফ্রণ্ট অক্টোবর বিপ্লব ঘটাতে চলেছিল, তাদের মধ্যে এস.আর. দলটিও ছিল, তাই এই কাজটি কারো অবিপ্লবী মনে হয়নি। নিজের পার্টির ত্রুটি মেনে নেওয়া, স্বীকার করা, পরিমার্জনা করার ব্যাপারে লেনিন তো, প্রায় বলা চলে তুলনাহীনই ছিলেন। আজকের ভারতবর্ষের, আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, আজকের নানা রঙের বামনেতাদের মাইন্ডসেট কি একটুও এরকম? পুঁজিবাদী সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ওলোটপালোট ঘটাতে গেলে যে-দুটি শ্রেণীর হাত মেলানো প্রয়োজন, তারা দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা অবস্হানে।শ্রমিক ও কৃষকের উঠোন একেবারেই ভিন্ন। আবার মজুরদের বমধ্যেও পি.এস.ইউ.এর মজুর আর আনঅর্গানাইজড সেক্টরের মজুরের আলাদা হাঁড়ি। কৃষকদের মধ্যেও এই জাতীয় নানা ভাগাভাগি। অথচ এ নিয়ে 'মার্কাসবাদী' তাত্ত্বিকদের মাথাব্যথা আছে , ঔপচারিক বুকচাপড়ানো ছাড়া , এমন তো মনে হয় না। তাহলে রদবদলটা ঘটবে কীভাবে ?

    রদবদলের আশা করাটাও কী উচিত ? যখন বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ এক হিমশীতল রুটিন মাত্র , তার রন্ধ্রে-রন্ধে বাসা বেঁধেছে নানা সাইজের ঘুঘু , পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রগামী দর্শনটি এক অকিচিঞ্চিৎকর উপচারে পর্যবসিত, তখন সত্যিই কি কোনো আশা কোথাও রয়েছে যে একদিন সব কিছু বদলাবে ? "শেষ ট্রেনের নাম তত্ত্ববিশ্ব" কবিতায় বলছেন মলয়, "আর ভাটার দুলুনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক ক্লান্ত স্টিমলঞ্চ/হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া হাড়গুলো দাঁতনদেঁতো প্যাংলার দুর্ভাবনায়/ডেরা ডেলে চুলখোলা বারান্দায় চোখ বুজে দেখবে এক তিন ঠেঙে বেড়াল/শ্যাল-চাদর মুড়ি দেয়ে/প্রতিধ্বনি নকল করতে ওস্তাদ তলপেট-ফোলা বোল্ডার/পিঁপড়ের খনি-টানেলে জড়ো করেছে টুসকি নির্দেশে/নামিয়ে-আনা তত্ত্ববিশ্ব।" তবু মানুষের আশা...। ধন্য আশা কুহকিনী। এখনও সে আশা রাখে রেলিতে যায়, ব্রিগেড জমায়েতে যায়। এখনও পার্টিদাদার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে যে তার আশা-হতাশার কথা দাদা শুনবেন। এখনও...। "খোঁড়া বরের টোপর" কবিতায় মলয় বলছেন, "দূরে শোনা যাচ্ছে/ নারকেল-পাতায় উড়ন্ত ঘোড়ার খুরধ্বনি/ বর আসছে বর আসছে বর আসছে একঠেঙে/ কাছিম-টেকো মাথায় ফর্দাফাঁই লালটোপর।"

    "কৌনপের লুচিমাংস" সংগ্রহে এসে মলয়ের কবিতায় আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল ঘটেছে বলে আমার ধারণা। এই কথাটি মলয় নিজেও স্বীকার করেছেন সংগ্রহের ভূমিকায়, "বাঁকবদলের জন্যেই তো নতুন কাব্যগ্রন্হ, নইলে একঘেয়ে একের পর একের কোনো মানেই হয় না।" মলয়ের ভাষা আশ্চর্য দ্যুতিমান হয়ে উঠেছে এই সংগ্রহে এসে। "ভূমিপুত্রের জন্মস্হান বদলের দরখাস্ত" কবিতাটিতে মলয় বলছেন, "দাদু, কেন্দ্র কই, সেই গর্মাগরম ষাঁড়িত জান্তব সিংহাসন ?/এ তো দেখছি গ্যাংগ্রিনের শাশ্বত নালি ঘা!" দুটি মাত্র পঙক্তি। তার মধ্যেই বিধৃত একটি সমাজের গোটা ইতিহাস, তার অতীত, তার বর্তমান, আর বোধকরি তার ভবিষ্যতও। কি আশ্চর্য দক্ষতায় মলয় দেখিয়ে দেন সবকিছু; মাত্র দুটি পঙক্তিতে কত কথাই যে বলেন। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের আজকের হাল-হকিকত বোঝাতে...."এই একপশলা সন্ধ্যায় ট্রানজিসটারে লকাপ লোচ্চার লিট্যানি শুনতে/গুটিপোকার সবুজ দেহতরঙ্গের তুলতুলে গানে গাছের কোটরে/সঙ্গীত খুঁজছে কাঠঠোকরা তার নিলাম-ডাকা মেশিন ঠোঁটে/পিটিয়ে-মারা শেষ শেয়াল পঞ্চায়েতকে উন্নীত করেছে জেলাসদরে/ড্যাশবোর্ডে থ্যাঁতামাথা কুষ্ঠ-সাম্রাজ্যের সোনাজল ভোটার/ঠায় বসে আছেন কাদা-কুঁজোর কায়দায় ঘুরন্ত চাকে।"( ফ্রান্তস ফ্যানঁ ) । অথবা..."আমি যে কিনা কুহকঠুঁটো মেয়েদের মাঝে ছিলুম ট্রিগারলিঙ্গ যুবা/খড়খেতের সোঁদা-সোনালি চামচমকানো মকাইগুঁফো চাষার ছেলে/একটা চুল টানতেই বেরিয়ে পড়েছে রক্তপচা আঁতের ঝুরি/জ্ঞাতিদের মুখে পাঁঠার গলায় নেমে আসা খাঁড়ায় আঁকা চোখের কান্না/ দেখছি আর ভাবছি কি মজা শবশকটে আগে চড়িনি কক্ষুনো" (রূপসী বাংলার ভাতার )

    অথবা..."আমি কিন্তু কুঁড়ে টাইপের বিকেলবেলায় যখন বেহেড/পাকস্হলি নিয়ে ফিরছি/ভুল সময়ে আগত শীতে বদন-বেচুনিদের চৌরঙ্গি স্যামপেলের ডেরায়/ম্যাপ খুলে দেখাবে, হ্যাঁ, ওই যে ওই তো ইউজারফ্রেন্ডলি বসন্তঋতু/ চিলের পেছন-পেছন উড়ে ব্লো-আপ হিরোর গায়ে/হাত ছুঁইয়ে ভিককে চাইছে/আমি কিন্তু অতীতকে নতুন করে গড়ে ফেলেছি জলফোঁটায় বেঁধে-বেঁধে/প্রকৃতি কি আর ভাবছেন জানত না লাশ গোঁজড়াতে একসেট অমাবস্যা চাই/তাই তো জলের ক্যাঁদরায় খুকি-পোনাদের ভাসিয়ে নিয়ে/চলল জোয়ার-বুড়ো" (ক্যাটাক্রিসিস)।

    প্রথম-যৌবনে কবিতা লেখার জন্য লাঞ্ছিত ও নিন্দিত, পরে বহু বছর নৈঃশব্দের অতলে, আর আজ বাংলা কবিতার মধ্যগগনে সূর্যের মত ভাস্বর মলয় রায়চৌধুরী এখন পরিণত বয়স্ক। আয়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই মানুষের; শোনা যায় মলয়ের শরীরও খুব একটা সুস্হ নয়।বাংলা ভাষার যে অপরিমেয় সম্ভাবনা আছে, তার ঠাহর মলয়ের মত আর কারো হয়ত নেই। বাংলা ভাষার শব্দগুলোকে তিনি দিয়েছেন সম্পূর্ণ নতুন এক আয়তন, তাকে আজকের পৃথিবীর যোগ্য করে তুলেছেন।মলয়ের কবিতা নিয়ে কথাবার্তার এক নতুন পর্ব আরম্ভ হবে বলে প্রতীক্ষা করছি আমরা। সেই কবে কৃত্তিবাস ওঝা দ্বিধাজড়িত হাতে লেখা আরম্ভ করেছিলেন, "গোলকে বৈকুন্ঠপুরী সবার উপর।/ লক্ষ্মীসহ তথায় আছেন গদাধর।/তথায় অদ্ভু বৃক্ষ দেখিতে সুচারু।/যাহা চাই তাহা পাই নাম কল্পতরু।। দিবানিশি তথা চন্দ্র-সূর্যের প্রকাশ।/তার তলে আছে দিব্য বিচিত্র আবাস।।/নেতপাট সিঙহাসন উপরেতে তুলি।/বীরাসনে বসিয়ে আছেন বনমালী।।/মনে মনে প্রভুর হইল অভিলাষ।/এক অংশ চারি অংশ হইতে প্রকাশ।।" তেলের প্রদীপের আলোয় সামনের দিকে নুইয়ে পড়ে তিনি লিখেছিলেন। বাইরে চরাচরব্যাপী অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হয়ত বা জ্বলছিল-নিভছিল গুটিকয় জোনাকি। অশ্বথ্থের নিষের অমান্য করে হঠাৎ-হঠাৎ হাওয়া বইছিল। অসংখ্য কান প্রতীক্ষা করছিল বাংলা কবিতার জন্মের প্রথম কান্নাটি শুনবে বলে। খাগের কলমের খসখস শব্দ উঠছিল তুলোট কাগজে। তারপর দীর্ঘপথ। কত রাজত্ব, সাম্রাজ্যবাদের উথ্থানপতন। ধুলোয় গড়াগড়ি কত মুকুট, রাজদণ্ড। রক্তাপ্লুত, কাঁটা-বেঁধা পায়ে কেবল হেঁটেছে বাংলা কবিতা। হেঁটেছে, হেঁটেছে আর হেঁটেছে। এখনও চোখ খুললে সেই মানুষদের দেখতে পাওয়া যায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে, যাঁরা সেই শিশুটিকে বয়স্ক করে তুলতে অসহ্য দুঃখ স্বীকার করেছেন। সকল পার্থিব সুখ-সুবিধা তুচ্ছে করেছেন তাঁরা, নিজের জীবন, যৌবন, মান-সম্মান, সব কিছু ব্যয় করেছেন বাংলা কবিতার জন্য। যেদিন মলয় কবিতা লেখার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিনই, সবার অলক্ষ্যে, এই মানুষদের একজন হয়েগিয়েছিলেন তিনি। ভুল করেছিল বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন। বাংলা কবিতার জন্য সর্বস্বপণ যোদ্ধাকে অট সহজে পরাভূত করা যায় না। জয় মলয়েরই হয়েছিল। সেই জয় আজ প্রতিধ্বনিত মলয়ের প্রতিটি কবিতায়।

    ( প্রবন্ধটি ২০০৩ সালে কবিতীর্থ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর বিভিন্ন পত্রিকায় পুনঃপ্রকাশিত হয়ে চলেছে । সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আবার আসিব ফিরে পত্রিকায় ।)

    ----------------------------------------------------------------------------------

    বিশ্বজিত সেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পার্টি বহু অংশে বিভাজিত হবার পর ও তাদের সদস্যদের নৈতিক পতনে আশাহত শ্রীসেন পার্টি ত্যাগ করেন।কিন্তু তিনি আজও নিজেকে একজন মার্কসবাদী ভাবুক বলে মনে করেন।তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্হ, গল্পগ্রন্হ ও প্রবন্ধের বই আছে।


     

  • ম. | 27.56.154.78 | ২০ অক্টোবর ২০২১ ১২:৪৬735055
  • হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়

    মলয় রক্ষিত

    ষাট দশকের সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্বস্ত পরিবেশ, অর্থনীতির ভাঙন এবং তারই ফলশ্রুতিতে তৈরি হওয়া সাংস্কৃতিক ব্যবধানের এলোমেলো চেহারাটা বাংলা কবিতায় আরেকরকম ভাবে এলো। আমি হাংরি, শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের কথা বলছি । ১৯৬১তে প্রকাশিত হলো হাংরি জেনারেশন এবং হাংরি-আন্দোলন সম্পর্কিত ইশতাহার । এই ইশতাহারগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় হাংরিরা এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন আমাদের ঔপনিবেশিক সূত্রে প্রাপ্ত নন্দনতাত্বিক বাস্তবতার যাবতীয় বোধ অথবা চিন্তাসূত্রকে আঘাতে আঘাতে চুরমার করে দিতে । হাংরি জেনারেশন ইশতাহার নং ১০-এ এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তৃতীয় সূত্রে লেখা হয়েছে----”ঠিক সেই রকম সৃষ্টি উন্মার্গে চালিত হতে হবে যাতে আগে থাকতে তৈরি পৃথিবীকে চুরমার করে পূনর্বার বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করা যায়।” 

     

    এই ইশতাহার কবিতা বা সাহিত্যের যে-কোনো ধরণের সনাতন ঐতিহ্য বা পরম্পরাকে অস্বীকার করে, প্রত্যাখ্যান করে। যে-কোনো ধরণের মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ জানায় । কবিতার নন্দনতত্বের যাবতীয় সূত্রগুলিকে অস্বীকার করেই তাঁরা কবিতার ভিন্নতর এক পরিসর তৈরি করতে চেয়েছিলেন । সে ছিল বাঙালির মনন ও চিন্তনের জগতে এমন এক ধাক্কা যার অনিবার্য পরিণতিতে হাংরি কবিদের রাষ্ট্রবিরোধী, অশ্লীল ইত্যাদি অভিযোগে গ্রেপতার হতে হয় । 

     

    মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ তাই বৈদ্যুতিক শকের মতন আমাদের ধাক্কা দেয়, আমাদের যাপিত-জীবনের পচা-গলা-নোংরা চেহারাটা যেন আয়নার সামনে মেলে ধরে মলয় বলেন, “শাশ্বত অসুস্হতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফূলিঙ্গ/মা তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?” যখন মলয় প্রচণ্ড আত্মধিক্কারে উচ্চারণ করেন, “মরে যাবো কিনা বুঝতে পারছি না/তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়/সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাবো/শিল্পের জন্য সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোবো/কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই”, কিংবা বিস্ফোরণের তীব্র আবেগেই যখন অসহ্য উচ্চারণ করেন, “কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?/কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি?/কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায়?”

     

    হাংরির সমস্ত কবিদের যাবতীয় কাউন্টার-কলোনিয়াল এসথেটিকস রিয়ালিটির পালটা কাউন্টার----তার গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসবার বিকল্প এক পরিসর তৈরির চেষ্টা, যেন বিদ্রোহ আর আত্মবিস্ফোরণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে-যাওয়া সব চেহারা, ছটফটানি --- মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি সেসব কিছু ধারণ করে আছে । সমীর রায়চৌধুরী, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, অরুণেশ ঘোষ কিংবা শৈলেশ্বর ঘোষ ও মলয় রায়চৌধুরীরা, এঁরা আসলে কেউই ব্যক্তি-নাম নন, যেন সংঘবদ্ধ এক ডিসকোর্স, স্বাধীনতা-উত্তর ধ্বস্ত পচনশীল ভারতভূমির এক বিকল্প পরিসর, বিকল্প টেক্সট ।

     

    সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই বিকল্প পরিসরের কোথাও ছিলেন না । সুভাষ পার্টিলাইনের ধুয়ো যেমন ধরেননি, তেমনি হাংরি শিবিরের ধারও কোনোদিন মাড়াননি । আবার ষাট দশকের ওই সর্বব্যাপী হতাশা, সঙ্গে চীনের কাছে যুদ্ধে গোহারান হারার লজ্জা থেকে উদ্ভূত আত্মলাঞ্ছনা তাঁকে বিচলিত করলেও কোথাও তিনি নিজেকে সময়ের হাতে সঁপে দেননি ।

    [ অনুষ্টুপ গ্রীষ্ম-বর্ষা সংখ্যা, ১৪২২ ]

  • ম. | 27.56.154.78 | ২০ অক্টোবর ২০২১ ১২:৫০735056
  • কে, মলয় রায়চৌধুরী ? আর বলবেন না ! লোকে ওনার সম্পর্কে নানা কথা বলে ! নিজেই পড়ে দেখুন :

     

    ১. ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমিতাভ ঘোষাল -  ‘গদ্য-পদ্য সংবাদ’ পত্রিকায় ১৯৮৬ অক্টোবরে প্রকাশিত :-

    সুমিতাভ : ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ কতোটা ?

    সুনীল : হাংরি আন্দোলনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না । আমি তখন কৃত্তিবাস নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা করতুম । কৃত্তিবাসের থেকে কয়েকজন এই আন্দোলন শুরু করে । এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা প্রথমে নিয়েছিল মলয় রায়চৌধুরী, সে ছিল আমার বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর ছোটো ভাই । সমীর রায়চৌধুরী কৃত্তিবাসের একজন লেখক এবং ওই গোষ্ঠীরই একজন । মলয়েরও কিছু কিছু লেখা কৃত্তিবাসে বেরিয়েছিল ।

    সুমিতাভ : আচ্ছা শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো... ( কথায় বাধা দিয়ে )

    সুনীল : হ্যাঁ, তারপরে মলয় প্রথমে শুরু করার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাতে যোগ দেয় এবং পরে উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আসেন । এইভাবে হাংরি আন্দোলন শুরু হয় । কিন্তু এই আন্দোলনের কোনো ইস্তাহার বা কোনো ব্যাপারে আমার কোনো নাম ছিল না বা আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না ।

     

    ২ (  Snehasis Roy : “হাংরির উত্থান ১৯৬২ সাল, মলয় ১৯৬১ সালের যে গল্প ফেঁদেছেন নকল ইস্তেহার বানিয়ে সেন্টুর তোরঙ্গ থেকে নাকি উদ্ধার হয়েছে পরে, এ-সব আসলে গাঁজাখুরি গল্প।

    মলয়ের কবিতা তো হয়ই না, গদ্য, অনুবাদ ও কিছু ভালো প্রবন্ধ লিখেছেন, সমস্যা হল, সুভাষ ও শৈলেশ্বরের ভূত লোকটার পিছু ছাড়ে না। শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লিখছেন বা অন্য কোনো কবিকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ অবান্তরভাবে শৈলেশ্বর, সুভাষকে দায়ি করছেন তাঁর জেল হওয়ার জন্য।(মলয় বোঝাতে চান, ইস্, তোমরা শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষের লেখা পড়ো, এদের জন্য আমিহাংরিস্রষ্টা, আমার জেল হয়েছে!

    সাহিত্যের জন্য জেল হয়েছে এমন আসামীর লেখা পড়ো তোমরা, মুচলেকা দানকারীদের লেখা কেন পড়বে! আমি বীর, সারা পাড়ার সামনে কোমরে দড়ি দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গেছে, ভ্যাঁ...........এসব বলে পাঠকের সিমপ্যাথি আদায় করার চেষ্টা)

    ভাবটা এমন জেল যেন তাঁর একারই হয়েছিল, অথচ হাংরি সংক্রান্ত লেখালেখির কারণে প্রথম জেলে হয় শৈলেশ্বরের, পরে সুভাষেরও। লোকটা এমন চুতিয়া অরুণেশকে দু-রকম হাতের লেখায় চিঠি লেখে, সুভাষ ঘোষকেও তাই, সুভাষকে চিঠিতে জানায় আমার যারা সমালোচনা করে তাঁদের দেখে নেব। সেসব চিঠি সব আছে আমাদের কাছে। সময় ও জায়গা মতো প্রকাশিতও হবে।

    মলয়ের 'আমি' 'আমি' করার পাশাপাশি বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত হাংরি জেনারেশন আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তাঁদের মুখপত্র ছিল 'ক্ষুধার্ত' পত্রিকা। মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম তিনটি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং পরের চারটি সংখ্যা শৈলেশ্বর ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।”

     

    ৩. ( উপরোক্ত Snehasis Roy  : “হাংরির উত্থান ১৯৬২ সাল, মলয় ১৯৬১ সালের যে গল্প ফেঁদেছেন নকল ইস্তেহার বানিয়ে সেন্টুর তোরঙ্গ থেকে নাকি উদ্ধার হয়েছে পরে, এ-সব আসলে গাঁজাখুরি গল্প।

    মলয়ের কবিতা তো হয়ই না, গদ্য, অনুবাদ ও কিছু ভালো প্রবন্ধ লিখেছেন, সমস্যা হল, সুভাষ ও শৈলেশ্বরের ভূত লোকটার পিছু ছাড়ে না। শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লিখছেন বা অন্য কোনো কবিকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ অবান্তরভাবে শৈলেশ্বর, সুভাষকে দায়ি করছেন তাঁর জেল হওয়ার জন্য।(মলয় বোঝাতে চান, ইস্, তোমরা শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষের লেখা পড়ো, এদের জন্য আমিহাংরিস্রষ্টা, আমার জেল হয়েছে!

    সাহিত্যের জন্য জেল হয়েছে এমন আসামীর লেখা পড়ো তোমরা, মুচলেকা দানকারীদের লেখা কেন পড়বে! আমি বীর, সারা পাড়ার সামনে কোমরে দড়ি দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গেছে, ভ্যাঁ...........এসব বলে পাঠকের সিমপ্যাথি আদায় করার চেষ্টা)

    ভাবটা এমন জেল যেন তাঁর একারই হয়েছিল, অথচ হাংরি সংক্রান্ত লেখালেখির কারণে প্রথম জেলে হয় শৈলেশ্বরের, পরে সুভাষেরও। লোকটা এমন চুতিয়া অরুণেশকে দু-রকম হাতের লেখায় চিঠি লেখে, সুভাষ ঘোষকেও তাই, সুভাষকে চিঠিতে জানায় আমার যারা সমালোচনা করে তাঁদের দেখে নেব। সেসব চিঠি সব আছে আমাদের কাছে। সময় ও জায়গা মতো প্রকাশিতও হবে।

    মলয়ের 'আমি' 'আমি' করার পাশাপাশি বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত হাংরি জেনারেশন আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তাঁদের মুখপত্র ছিল 'ক্ষুধার্ত' পত্রিকা। মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম তিনটি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং পরের চারটি সংখ্যা শৈলেশ্বর ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। “) 

     

    ৪. ( উপরোক্ত Snehasis Roy - “শৈলেশ্বরকে লেখা অরুণেশের প্রায় ৮০টির মতো দীর্ঘ চিঠি( INLAND LETTER CARD) উদ্ধার হল।

    'সৃষ্টিক্ষমতাহীন কুকুরের দল এই ঘেউঘেউ চিরদিনই করে এসেছে'র পাশাপাশি অরুণেশ চাইছেন 'আত্মমগ্ন গর্ভবতীর মতো নিজেকে নিয়ে থাকতে'।

    তাঁর সঙ্গে মিলারের লেখালিখির হাস্যকর তুলনা প্রসঙ্গে অরুণেশের মনে পড়ে যাচ্ছে জীবনানন্দকে ইয়েটস্ এর অনুকারক এমনকি পাশাপাশি রেখে উভয়ের লাইন তুলে মেলানোর প্রাণপণ চেষ্টার কথা!

    আর্থিক সংকট, বেশ্যা ও না-বেশ্যা অসংখ্য সংগমে তিনি কি না-প্রেমিক। না, এসবের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতার সঙ্গে সহবাস করতে চাইছেন।

    দেশ, আনন্দবাজার, আজকাল প্রভৃতি বাজারি কাগজ সম্পর্কে একহাত নিতে ছাড়ছেন না এবং কৃষ্ণ ধর ও অমিতাভ দাশগুপ্তকে হিজড়ে লেখক বলতে রেয়াত করছেন না।

    হাংরি জেনারেশন সাহিত্য, রাজনীতি, কলকাতার সাহিত্য, পাণ্ডুলিপি করে শৈলেশ্বরকে পাঠানো। 'রোবট'(সম্পাদক : জীবতোষ দাশ) নিয়ে ভয়াবহ আবেগ।নিজের কাগজ 'জিরাফ' নিয়ে চিন্তাভাবনা। বাবার অসুখ। চিকিৎসকদের 'মাগী' বলা, টাকাও ধ্বংস করে রোগীও মারে।

    উত্তরবঙ্গের তৎকালীন অন্যান্য পত্রিকার রাজনীতি। এমনকি নাম নিয়ে রাজা সরকারের(সম্পাদক : কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প) ঈর্ষা ও কূটনীতি সত্ত্বেও তাঁকে শোধরানোর চেষ্টা। আরও কত কী কথা বলেছেন চিঠিতে শৈলেশ্বরকে।

    এই চিঠিগুলো নিয়েই একটা সাংঘাতিক বই হয়ে যায়।

    একটা সময়, দীর্ঘ কবিতাযাপন, জৈব আততি ও ঐতিহাসিক দলিল তো বটেই।

    বোমাটা ফেলব নাকি!” ]

     

    ৫. : ( দুই ফরেনারের কথাবার্তা : বেলাল চৌধুরী ও চয়ন খায়রুল হাবিব

    চঃ এটা মজার, কৃত্তিবাসের একটা প্রধান অংশই সুনীলকে না জানিয়ে হাংরি আন্দোলনে জোগ দিয়েছিল।শক্তি, সন্দীপনও চলে গিয়েছিল।কিন্তু ঐসব ঈস্তাহারত পড়া যায় না, এতই পচা।সুনীলকে ওরা জানায় নি কেন?

    বঃ ইর্ষা, ভয়।সমির আবার সুনীলদার বন্ধু ছিল।“ধর্মে আছি, জিরাফে আছি” নিয়ে শক্তির তখন সাঙ্ঘাতিক অবস্থা, এক বসায় দশটা কবিতা লিখে ফেলছে। ও বুঝে গিয়েছিল সমির, মলয়দের হাতে লেখা নেই।ও বুঝেছিল যে হাংরিদের সাথে থাকলে ওর কবিতা ধ্বংশ হয়ে ্যাবে।খুব সম্ভবত সেই প্রথম শক্তি সুনীলদার কবিতার ক্ষমতাও বুঝতে পেরেছিল।ও আবার কৃত্তিবাস বলয়ে ফিরে আসে।টাইম ম্যগাজিন বিটদের কথা বলতে গিয়ে হাংরিদের সম্পর্কে বলেছিল।ঐটুকুই। লেখা কই?বোগাস।

    চঃ যে সুনীলকে ওরা ওদের সাথে ডাকেনি , জ়েলে নেবার পর তাকেই অনুনয় করছে আদালতে গিয়ে ওদের কবিতার পক্ষ্যে সাফাই গাইতে!

    বঃ মলয় ওটা করেছিল।সুনীলদাকে নিজে গিয়ে ও সাক্ষ্য দিতে বলেছিল।ওর জ়েল দন্ড ঠেকাতেই সুনীলদা ওর কবিতাকে উত্তির্ন না মনে করলেও বলেছিল “সার্থক কবিতা”।

    চঃ শক্তি কি করেছিল?

    বঃ সমির, মলয়দের এক বোনের সাথে প্রেম করেছিল।ওদের অনেকগুলো বোন ছিল।

    চঃ নাম কি বোনটার?

    বঃ শিলা।

    চঃ শিলা রায় চৌধুরি!শক্তির প্রেমিকা!হো হো হো. )

     

    ৬. : ( সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : মলয় রায়চৌধুরী খুব অদ্ভূত মানুষ। তিনি আমাকে উৎসর্গ করে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি পোষ্ট দিয়ে বললেন, ‘দুলাল, তোমার সাথে আমার ছবি নেই কেনো’?

    তাঁর সাথে জীবনে কোনো দিন দেখা হয়নি। তিনি থাকেন বোম্বে আর আমি টরন্টোতে। ছবি থাকবে কি ভাবে? মলয় দা’র সাথে দেখা-সাক্ষাৎকার না হলেও তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২০১৪ সালে, আমার ‘সাতদিন’ ওয়েব পত্রিকার জন্য। )

    ৭. ( সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল : ভালো লাগা কবিতা : মলয় দা, মলয় রায়চৌধুরী এক অদ্ভূত মানুষ। ৮২ বয়সেও ২৮ বছরের তরুণ কবিদের মতো তারুণ্য লালন করেন। আমি তাঁর এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তার জবাবে আরো তা টের পেয়েছি। তাঁর সাথে আমার দেখা হয়। বাংলাদেশে কবিদের দৌঁড় কলিকাতা পর্যন্ত। আমার মতো সাধারণ কবির পক্ষে কি স্বর্গীয় দিল্লি যাওয়া তো কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমার কবিতায় মলয় দা ঢুকে গেছেন, আবার মলয় দা আমাকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন, ফেইসবুক লাইভে আমার কবিতা পাঠ করেছেন।

    কি সব অদ্ভূত কাণ্ডই না করেন মলয় দা। গুণ দা'র মতো তাঁর পাগলামির শেষ নাই। শাশুড়িকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেন। প্রেমিকাকে বলনে- ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’। আমি বলেছিলাম, মাথা নাকি নুনু? তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন, তাতেও টাশকি খেয়েছি। ‘১৯৬০-এর দশকের হাংরি আন্দোলন হাংরিয়ালিজম— তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক ১৯৬০-এর দশক থেকেই ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্যে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন।

    সম্প্রতি তাঁর একটি কবিতা পড়ে থ মেরে যাই। সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং দেশ বিভাগ নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতার অসাধারণ মর্মান্তিক এবং ভায়াবহ চিত্রকল্প চমকে দেয়! ফাঁসিতে ঝুলন্ত লাশ ঝুলতে ঝুলতে এক বার পাকিস্তান আবার হিন্দুস্থানের দিকে ঝুলছে!</span></li></ul><ul class='list-group my-2 shadow rounded-0 d-print-none'><li class='list-group-item small'><img src=মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:১৬735082

  • কেন লিখি

    মলয় রায়চৌধুরী

    কেন লিখি ভাবনাটা আমার পক্ষে খাটে না । বলতে হবে কেন লিখতে শুরু করলুম । তার পৃষ্ঠপট হিসেবে আমার শৈশবের কথা বলতে হয় । আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ ( ১১.জানুয়ারি ১৮৬৬ - ৮ আগস্ট ১৯৩৩)  সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের উত্তরপাড়া শাখার বংশধর হলেও জীবিকা আরম্ভ করেছিলেন ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার ও আর্টিস্ট হিসাবে; বেশির ভাগ সময় সপরিবারে কাটিয়েছিলেন আফগানিস্তান আর এখনকার পাকিস্তানে । হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দাদু পাটনায় মারা যান যার দরুন তাঁর ছয় ছেলে আর এক মেয়ের দায়ীত্ব বর্তায় ছেলেদের ওপর, যাঁরা কেউই স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পাননি। দাদু ফারসি, আরবি, সংস্কৃত জানতেন । দাদুর মৃত্যুর পর বাবা রঞ্জিত ( ১৯১২ - ১৯৯১ )  পাটনায় ফোটোগ্রাফি এবং তা থেকে তৈলচিত্র আঁকার ব্যবসায় আরম্ভ করেন । ভাইরা সবাই মিলে স্ত্রীর গয়নাগাটি বেচে ইমলিতলা নামে পাটনার এক বস্তিতে বাড়ি করেন । মানে, আমি ছিলুম ইমলিতলা পাড়ায় কুড়িজনের একান্নবর্তি পরিবারের সদস্য  । ইমলিতলা পাড়া ছিল গোলটালির চালাবাড়ি-ঘেরা বিহারি নিম্নবর্ণের অতিদরিদ্র পরিবার ও লখনউ নবাবের হারেমের গরিব শিয়া বংশধর অধ্যুষিত, যারা একই পোশাকে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতো । পাড়ার লোকেরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি, বিড়ি তৈরি, দুধ বিক্রি, ডিম আর ছাগলবাচ্চা বেচে সংসার চালাতো । জাঠতুতো, খুড়তুতো ভাইবোন ছাড়া আমরা ছিলুম দুই ভাই ।  বড়োজেঠা দেড়শো টাকা দিয়ে এক বেশ্যার কাছ থেকে একটি শিশু কিনেছিলেন, সে ছিল আমাদের মেজদা, পাড়ার প্রভাবে গুণ্ডা হয়ে ওঠে আর কম বয়সে মারা যায়। ইমলিতলা পাড়ায় আমরা বাল্যকাল থেকে ইঁদুর-পোড়া, শুয়োর ও গোরুর মাংস, ছাগলের নাড়িভুঁড়ির বড়া, তাড়ি, দিশি মদ ও গাঁজা ফোঁকার সঙ্গে পরিচিত হই । 

     

    পাটনার সম্ভ্রান্ত বাঙালিরা কেউই ইমলিতলায় আসতেন না ; আমার স্কুলের সহপাঠীরাও আসতো না, তার কারণ ইমলিতলা পাড়ার কুখ্যাতি । ফলে, আমরা ছিলুম বঙ্গসংস্কৃতির বাইরের মানুষ এবং আমাদের মনে করা হতো ‘ছোটোলোক’ । অর্থাৎ শৈশব থেকেই প্রতিষ্ঠানের মোকাবেলা করতে হয়েছে। পাটনায় ম্যাট্রিক পাশ করার পর দাদাকে কলকাতায়  সিটি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা, যাতে ইমলিতলার কুসংসর্গে ‘খারাপ’ না হয়ে যান । দাদা উত্তরপাড়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের খণ্ডহর-বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে  থাকতেন ।  আমাদের বাড়িতে প্রথম স্কুল-কলেজে পড়া সদস্য ছিলেন দাদা । সংবাদপত্র-নাটক-উপন্যাস পড়া আর সিনেমা দেখাকে ইমলিতলার বাড়িতে মনে করা হতো অধঃপতনের নিদর্শন । ইমলিতলার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন, কেননা বড়োজেঠা আর ঠাকুমা ব্রাহ্ম-বিরোধী ছিলেন । পাটনার বঙ্গসংস্কৃতির নিয়ন্ত্রকরা সেসময়ে ছিলেন ব্রাহ্ম। কলকাতায় গিয়ে দাদা সমীর রায়চৌধুরী ( ১৯৩৩ - ২০১৬ ) প্রথমে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন এবং পরে ১৯৬১ সালে আমার  সঙ্গে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করেন ; নব্বুই দশকের প্রথম দিকে চাকুরি থেকে অবসরের পর দাদা কলকাতায় এসে “হাওয়া৪৯” পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন ।

     

    আমিও ‘খারাপ’ হয়ে যাচ্ছি অনুমান করে বাবা দরিয়াপুর নামে পাড়ায় চালাঘর কিনে বাড়ি তৈরি করেন । আমরা সেখানে উঠে যাবার পর পাটনা শহরের বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে।

    বস্তুত বঙ্গসংস্কৃতিতে জোর করে প্রবেশের জন্য আমি আর দাদা দুজনেই ইমলিতলার নিষেধগুলো উপেক্ষা করে সংবাদপত্র-নাটক-উপন্যাস পড়া আরম্ভ করেছিলুম । দাদা কলকাতা থেকে তিরিশের দশকের কবিদের বই আর খ্যাতিমান লেখকদের বই আনতেন । মায়ের জোরাজুরিতে আমাকে ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে ভর্তি করা হয় । এই স্কুলের গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর প্ররোচনায় আমি রবীন্দ্রনাথসহ বিভিন্ন ব্রাহ্ম ভাবুকদের বই বাড়িতে আনা আরম্ভ করেছিলুম । চাকুরিসূত্রে চল্লিশ বছর সারা ভারতের অজস্র গ্রাম ঘুরে-দেখে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের দাঁত-নখ প্রয়োগের ক্ষমতার সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় হয়েছে ।

     

    বঙ্গসংস্কৃতিতে  প্রবেশের আগল ভাঙার জন্য লেখালিখি জরুরি হয়ে গেল । বাবা একটা ডায়েরি দিয়েছিলেন । আমি তাতে মনের কথা লিখতুম । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর বুঝতে পারলুম যে কলকাতায় বিশেষ কিছু মানুষ নিজেদের মনে করেন বঙ্গসংস্কৃতির মালিক । সুতরাং কলকাতাতেও সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলা জরুরি হয়ে দেখা দিল । আমার লেখালিখি মূলত প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতার আধার । আমি টাকাকড়ি, পুরস্কার, সম্বর্ধনা ইত্যাদির জন্য লিখি না । লিখি প্রতিষ্ঠানের ঠেকগুলোর দেওয়াল ভেঙে ফেলার জন্য ।

  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:১৯735083
  •  
     
    •  
     
     
     

    মলয় রায়চৌধুরী(Malay Roychoudhury)

    4.8 হাজার ফ্রেন্ডরা

    পোস্ট

     

    মলয় রায়চৌধুরী, Shalila RoyChoudhuri-এর সাথে আছেন।

    5 ঘণ্টা  ·
    সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
    সবাই
     
     
    0:00 / 0:46
     
     
     
     

    কৌস্তুভ দে সরকার

    6 নভেম্বর, 2020  ·
    কবি মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে আমার কবিতা -
     
     
     

    1টি কমেন্ট

     

    •  
    Siddhartha Sankar Dhar
    Great
     
    ফুল-এর একটি ছবি হতে পারে
    •  
      •  · 5 ঘণ্টা
      •  · 
        আপডেট করা হয়েছে
     

    মলয় রায়চৌধুরী

    5 ঘণ্টা  ·
    সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
    সবাই
    মলয় রায়চৌধুরী
    আভাঁ গার্দ ( Avant Garde ) কবিতা : চল্লিশ
    নিবেদিত : আবু’ল মুজ়ফ়্ফ়র মুঈনউদ্দীন মুহাম্মদ শাহ ফ়ার্রুখ়-সিয়ার আলিম আকবর সনি ওয়ালা শান
    মফসসলের মর্গে পড়ে আছে বেচারা-যুবক চেয়েছিল কবি হতে
    কবেই তো রিগর মরটিস আরম্ভ হয়ে এখন ধরেছে পোকায়...
    আরও দেখুন
     
     
     

    0টি কমেন্ট

     

     

    মলয় রায়চৌধুরী

    6 ঘণ্টা  ·
    সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
    সবাই
    https://sonchak.blogspot.com/
    সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা ও গদ্য
    sonchak.blogspot.com
    সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা ও গদ্য
      ফাত্রাতুন "শিবে রুষ্টে গুরুস্ত্রাতা গুরুরুষ্টে ন কশ্চন: ইতি কঙ্কালমালিনীতন্ত্রে..." শেষটুকু উচ্চারণের আগেই প্রা...
     
     
     

    0টি কমেন্ট

     

     

    মলয় রায়চৌধুরী

    7 ঘণ্টা  ·
    সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
    সবাই
     
     
    0:01 / 0:46
     
     
     
     

    কৌস্তুভ দে সরকার

    6 নভেম্বর, 2020  ·
    কবি মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে আমার কবিতা -
     

    0টি কমেন্ট

     

     

    মলয় রায়চৌধুরী

    7 ঘণ্টা  ·
    সবাই এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে
    সবাই
    মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস সম্পর্কে সুরজিৎ সেন-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গৌতম সেনগুপ্ত
    গৌতম সেনগুপ্ত: মলয় কী এমন লেখক যে ওঁর লেখা পড়তে হবে ? মানে কেন পড়ব ?
    সুরজিৎ সেন: কী পড়ব, কেন পড়ব বা পড়ব না --- এটা পাঠকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর অমুক জিনিস পড়তেই হবে, না পড়লে চলবে না --- এটা মডার্নিজমের সমস্যা। ইচ্ছে হলে পড়বেন, না হলে পড়বেন না।আর তাছাড়া আমি তো বাংলা সাহিত্যের জেলা-কমিটির মেম্বার নই যে গাইডলাইন অনুযায়ী ভালো-খারাপ বলতে না পারলে, আমায় কন্ট্রোল কমিশানের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তার চেয়ে একটা গল্প বলি শুনুন, দীপকদা, মানে দীপক মজুমদার, সমাজের প্রান্তবাসী অর্থাৎ মার্জিনালদের কথা বলতে গিয়ে আমায় গল্পটা বলেন। গল্পটা উনি শুনেছিলেন প্যারিসের এক ভবঘুরের কাছ থেকে। গল্পটা এরকম। দেবদূত কাথকাদ একদিন আকাশের গলিঘুঁজি পেরিয়ে, টাল খেয়ে, টপকে একটা আকাশছোঁয়া বাড়ির চুড়োয় গিয়ে দাঁড়াল। তারপর লাফ দিল নিচের অস্পষ্ট পৃথিবীর দিকে। নিচের পৃথিবী থেকে ভেসে এল অসংখ্য হাততালি, সেই সব দর্শকদের যারা ভেবেছিল এটা আত্মহত্যা। কাথকাদ ওই হাততালিকে অভিনন্দন বলে ভুল ভেবেছিল। এর পর সে আকাশচুড়ো থেকে লাফ দেয়াটাকে রীতিমত অভ্যাসে পরিণত করে ফেলল। ব্যাপারটা বুঝে শহরের মেয়র আঁতকে উঠলেন। এ-ধরণের জিনিস যদি শিশুরা নকল করতে শুরু করে ? কাথকাদকে গ্রেপ্তার করা হল। একটা দমবন্ধ-করা ঘরে রিসেপশানিস্টরা তাকে সেই চেয়ার এগিয়ে দিল, যেটা তার ডানা দুটো রাখার পক্ষে উপযুক্ত নকশায় তৈরি নয়। ইতিমধ্যে মেয়র ও শহরের অন্যান্য কর্তাবাবারা বিচার করে রায় দিল যে, কাথকাদ এক মহা চালিয়াত, তার ডানা দুটো আসলে তার পঙ্গুতারই নিদর্শন। সেই আত্মধিক্কার থেকেই লোকের নজর কাড়ার জন্যে সে এইসব কসরৎ দেখায়। সদ্ধান্ত হল: কাথকাদের গন্ডগোল আছে। ছয়ের দশকের শুরুতে মলয় কাথকাদের মতই লাফ মারেন বাংলা সাহিত্যের পৃথিবীর দিকে। ওই দশকের মাঝামাঝি বাংলা সাহিত্যের মেয়র ও অন্যান্য কর্তাবাবাদের কলকাঙিতে 'অশ্লীল' কবিতা লেখার দায়ে গ্রেপ্তার হন। এবং সিদ্ধান্ত হয় মলয়ের গন্ডগোল আছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যে. ছয়ের দশকের মাঝামাঝি, বাংলা সাহিত্য তখন যথেষ্ট সমৃদ্ধ [ অবশ্য জীবনানন্দের উপন্যাসের কথা তখনও জানি না, কমলবাবুর উপন্যাস বা আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস তখনও লেখা হয়নি], বামপন্হী আন্দোলন তখন আন্তর্জাতিক তত্ত্বের কচকচিতে ভর্তি, শিল্প-সাহিত্য তখন ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের নিত্যনতুন থিয়রির চর্বিতচর্বণ। সব মিলিয়ে ভাবখানা এরকম, যে, পশ্চিমবাংলা মননের দিক দিয়ে ভারতের সবচেয়ে আধুনিক রাজ্য, ওদিকে সত্যজিৎবাবুরও রমরমা। কিন্তু মলয়ের গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়ে বোঝা গেল সমস্ত ব্যাপারটা কী সাংঘাতিক ভিকটোরিয়ান ছিল। আধুনিকতা-ফতা সব ফালতু। অনেকদিন আগে মলয়ের একটা কথা পড়েছিলাম যে, "আধুনিকতা এক ধ্রুপদী জোচ্চোর"। এর মানে আজ বুঝতে পারি। এ হল ইউরোপিয় এনলাইটেনমেন্ট প্রসূত আধুনিকতা--- যা দিয়ে শাসকপ্রভূদের কলোনিমনন তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। যাতে প্রভূদের শিখিয়ে দেয়া গাইডলাইনের বাইরে কেউ কিছু না ভাবে। মলয় বাংলা ভাষায় লেখালিখির মধ্য দিয়ে ব্যাপারটায় একটা টোকা দেন। তাতেই হৈ হৈ ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত নকশালরা এই ব্যাপারটিকে ধাক্কা দেয়। পরে অবশ্য তারা আরেক ধরণের ভিকটোরিয়ানিজমের জন্ম দেয়। যা হোক, মলয় যে তখন থেকেই মেইনস্ট্রিমের বাইরেই রয়ে গেছেন --- মানে বুঝতেই পারছেন ছয়ের দশকের মেইনস্ট্রিম আর নয়ের দশকের মেইনস্ট্রিম --- এক নয়। এই জন্যেই মলয়ের লেখা পড়া দরকার।
    গৌতম সেনগুপ্ত: এত মেটাফরে কথা বললে তো খুব মুশকিল। মলয়ের গল্প-উপন্যাসের বৈশিষ্টটা কী ? যেখান থেকে ওই লাফ-টাফ বা কাথকাদের কথা আসছে।
    সুরজিৎ সেন: মেটাফরেই তো কথা বলতে হবে। জানেন না কোথায় বাস করছি ? যাকগে, যা বলছিলুম, শাসকপ্রভূরা আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়ে গেছেন ভাষা-কাঙামো, পদ্ধতি, বিন্যাস। এই দিয়েই যাবতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি। মলয় গল্প-উপন্যাসে শুরু থেকেই ওই মাস্টারদের তৈরি ল্যাঙ্গোয়েজ-জেল ব্রেক করে বেরোবার চেষ্টা করেছেন। কারণ লেখালিখির শুরুতেই যে ভাবেই হোক না কেন, বুঝতে পেরেছিলেন মলয়, যে, নেহেরুভিয়ান সরকারি খরচে যে বিশাল কেরানি-আমলা সমাজটির বাড়বাড়ন্ত, তাদের জন্যে উপনিবেশের ডিমটি ফেটে বেরিয়ে পড়েছেন কমার্শিয়াল কথাসাহিত্যিকরা, আধুনিকতার দুরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে।এই মানচিত্রের বাইরে মলয় চলে যেতে পেরেছেন। অবশ্য তার মানে এই নয় যে মলয় কোনও নবদিগন্ত উন্মোচন করেছেন। কিন্তু কতকগুলো ব্যাপার আছে। লেখার ব্যাপারে মলয় কাউকে পরোয়া করেন না, এমনকি নিজেকেও নয়। লেখার মধ্যে দিয়ে তত্ত্ব বিক্রি করেন না, আর প্রগতিশীল বামপন্হী হবার লোভ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। মলয় বোধহয় বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক যাঁর বইয়ের কোনো কপিরাইট থাকে না। এটা উনি করতে পেরেছেন তার কারণ গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখে কোনওদিন কোনও লেখক-প্রতিষ্ঠা চাননি--- মানে লেখক নিজেই একটি ব্র্যান্ড নেম, তাঁর লেখার প্যাকেজিং, রিভিউ ডিজাইন, সেলেবিলিটি, মিডিয়া হাইপ--- মলয় এসব চাননি। সোজা কথায়, লিখে বাড়ি গাড়ি বউ রাঁঢ় ট্রাকটর এসব করতে চাননি। এরপর প্রশ্ন উঠবে, চাইলেই কি পেতেন ? জানি না। খুব বড় সরকারি চাকরি করতেন --- এসব নিয়ে যাতে ভাবতে না হয়। সেই মেধা, যোগ্যতা ওঁর ছিল। আর এই দুহাজার সালেও তো বাংলা গল্প-উপন্যাসের পাঠক হিসেবে ৬০ পেরিয়ে-যাওয়া মলয়ের উপরউ ভরসা করে আছি। অথচ আমি চাই আমার বয়সের (৩৮/৩৯) কোনও লেখকের উপর ভরসা করতে। পারছি কই ? কেউ তো নজরে পড়ছে না।
    গৌতম সেনগুপ্ত: এ তো গেল মলয়ের গদ্য ইন জেনারাল, কিন্তু 'নামগন্ধ'টা নিয়ে আলাদা করে…
    সুরজিৎ সেন: মলয়ের প্রথম উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস', দ্বিতীয় উপন্যাস 'জলাঞ্জলি', তৃতীয় 'নামগন্ধ'--- একটা জার্নি 'ডুবজলে' শুরু হয়ে ভায়া 'জলাঞ্জলি' শেষ হচ্ছে 'নামগন্ধ'-এ। কিসের জার্নি ? না, অরিন্দম বলে একটি ছেলে খুব বড় সরকারি চাকরি করে পাটনায়, পাটনা থেকে বদলি হয়ে আসছে কলকাতায়। অবশ্য এর মানে এই নয় যে উপন্যাসগুলো আলাদা করে পড়া যাবে না। পড়া তো যাবেই; কারণ প্রতিটি উপন্যাসই স্বয়ংসম্পূর্ণ। অরিন্দম কলকাতায় আসার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের কথকতা শুরু হয়ে যায়। বালির ভোটবাগানে বজরং মার্কেটের (এশিয়ার বৃহত্তম স্ক্র্যাপ আয়রনের বাজার ) দখলদারির জন্যে একটা খুন দিয়ে উপন্যাসের শুরু। আর যা দলটি খুন করছে তাদের একজনের সবুজ টিশার্টে সাদা হরফে লাখা 'ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে'। মলয় কিন্তু আমাদের চারপাশের ভায়োলেন্সটাকে সব সময় লিখছেন। আর এই উপন্যাসে রিয়েলিটি আর প্রতীকের একটা নকশা তৈরি করেছেন। রিয়েলিটি হল, আদিত্য বারিক, যে, পুলিশের এ এস আই-এর চাকরি পেয়েছে, 'ওর আদর্শ হল রুণু গুহনিয়োগী নামে একজন প্রাক্তন অফিসার, যদিও তার সঙ্গে আদিত্যর পরিচয় নেই, কিংবদন্তি শুনেছে, কাগজে পড়েছে, আদালতে গিয়ে দেখেছে সহকর্মীদের সঙ্গে, জয়ধ্বনি করেছে, যখন অযথা বিচার চলছিল লোকটার। জ্যোতি বসুর মতন কর্মজীবী মুখ্যমন্ত্রী ওব্দি রুণু স্যারের কদর করে পদোন্নতির ধাপ একের পর এক এগিয়ে দিয়েছিলেন ওনার দিকে'। ( নামগন্ধ পৃ ৫ )। আপনি তো জানেন রুণু গুহনিয়োগী কে ? কী ব্যাপার ? আর প্রতীকটা হল ওই 'ভ্রূপল্লবে...', আশা করি বুঝেছেন। এখনকার পশ্চিমবঙ্গের সার সত্যটি মলয় জানিয়েছেন এই ভাবে, 'এ এস আই-এর চাকরি পেয়ে নিজেকে সুসজ্জিত করে তোলার অভ্যাসে কিছুটা রদবদল করেছে ও, আদিত্য। এখন ও জনসনের বেবি পাউডার, বাচ্চাদের সাবান, শ্যাম্পু, শিশুদের ক্রিম আর অলিভ অয়েল ব্যবহার করে। আগেকার এক আই জি, এখন দুটো কারখানার মালিক, শিখিয়ে ছিলেন জীবনদর্শনটা। নিষ্পাপ থাকার নিজস্ব গন্ধ আছে, বুঝলে হে, পুলিশ অফিসারের উচিত সেই গন্ধটাকে সবচেয়ে আগে দখল করা। ফি বছর পুজোয় অধস্তন অফিসারদের জন্য শিশুদের ব্যবহার্য সাবান-পাউডার-ক্রিম-শ্যাম্পুর সারা বছরের কোটা উপহার পাবার ব্যবস্হা করে দিতেন উনি...। আদিত্যর এখনকার চাকরিটা মাঙনায় হয়নি। দেড় লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল। বাড়ি বয়ে একজন প্যাংলা ডাকমাস্টার জানিয়ে গিয়েছিল কার সঙ্গে কখন দেখা করলে চাকরিটা হবে। ডাকমাস্টারহীন বাঙালিসমাজ ভাবা যায় না। এরা থানার জন্য টাকা তোলার অঞ্চলভিত্তিক ঠিকেদারি নেয়।পুলিশে ঢোকার আগে আদিত্য জানতোই না যা তথ্য আর সংস্কৃতির এরা বাঙালিজীবনে চাবিকাঠি' (নামগন্ধ পৃ ৭)। উপন্যাসের অন্যতম মহিলা চরিত্র খুশি, ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে যার বয়স পঞ্চাশ। খুশি তার নিজের দাদার বাড়ি চাকরানী হয়ে বন্দি। দাদা ভবেশ এখন গ্রামের রাজনীতির দন্ডমুন্ডের কর্তা। খুশির আজও বিয়ে হয়নি। প্রথম বিয়ের সম্বন্ধ হয় ১৯৭১ সালে, হবু বরের মুণ্ডহীন ধড় পাওয়া যায়--- সে নাকি নকশাল ছিল। দ্বিতীয় হবু বর সফল আড়তদার হঠাৎ পুড়ে মারা যায়। শেষ অবধি পূর্ব পরিচিত যিশু বিশ্বাস খুশির প্রেমে পড়ে তাকে দাদার হাত থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে ডাকাত সন্দেহে গণপ্রহারে মারা যায় গ্রামবাসীদের হাতে। খুশি যেন আমাদের ভারতবর্ষ। যারাই তাকে উদ্ধার করতে যায় তাদের কপালে বোধহয় অপঘাতে মৃত্যুই লেখা আছে। অরিন্দম বর্ণহিন্দু, আদিত্য নমশূদ্র, যিশু খ্রিস্টান । উপন্যাসের শুরুর খুনের পরেই আমরা দেখি ১৮/১৯ বছরের একটা ছেলেকে একদল লোক পিটিয়ে মেরে ফেলছে এবং তারপর 'ছেলেটা মরে গেছে নিশ্চয়। তবু ওকে পিটিয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। মৃতদেহ পিটিয়ে তার জীবন্ত অতীতের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা খুঁজছে লোকগুলো। অরিন্দম পড়ে গেছে সেই ভাষাসন্ত্রাসের খপ্পরে'।(নামগন্ধ পৃ ৭)।আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরাও কিন্তু এই ভাষাসন্ত্রাসের খপ্পরে পড়ে গেছি। ইংরেজরা লুটে-পুটে খেয়ে, ভাষার কিছু প্রণালিবদ্ধ কাঠামো অন্যান্য উচ্ছিষ্টের সঙ্গে আমাদের জন্য রেখে যায়।যেমন ইংরেজি Bitter Experience শব্দটির বাংলা হল 'তিক্ত অভিঞ্জতা' । মানে খুব খারাপ কিছু প্রত্যক্ষ বা অনুভব করা। অথচ আমাদের বাঙালি জিভে উচ্ছে নিম করলা সুক্তো--- এই সব তিক্ত স্বাদ বা অভিঞ্জতা খুবই উপাদেয়। যেহেতু সাহেবরা Bitter Experience বলতে খারাপ কিছু বোঝায়, তাই আমাদের ভাষাবিদরাও খারাপ কিছু বলতে 'তিক্ত অভিঞ্জতা'ই বুঝেছেন। ছোটগল্প-উপন্যাস বলতে কী বোঝায়, অক্সব্রিজসরবনের সাহেবরা যেমন-যেমন বলে গেছেন, আমাদের শিক্ষকরা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছেন। আজ সেই মৃত ভাষাটিকে হাজার পিটিয়েও তার জীবন্ত অতীতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে না। মলয় তাঁর লেখালিখির শুরু থেকেই এটা ধরতে পেরে সেটাকে ফাঁসিয়ে দেবার চেষ্টা করে গেছেন বরাবর। 'নামগন্ধ'ও তার ব্যতিক্রম নয়। আর রসবোধ--- যেটা বাংলা লেখালিখিতে ক্রমশ বিরল হয়ে এসেছে, সেটার একটা চমৎকার সূক্ষ্ম ব্যবহার মলয় করেছেন তাঁর উপন্যাসগুলোয়। এমনিতে মলয়ের লেখার কোনো মডেল নেই। চরিত্ররা নিজেরা নিজেদের গুরুত্বহীনতায় ভোগে, ভঙ্গুর, টাল-খাওয়া, পোস্টকলোনোয়াল মতদ্বন্দ্বের, জটিলতার, আলাপচারিতা--- এই হল মলয়ের লেখা। এই ভঙ্গীটা আমাদের ভাষায় নেই বললেই হয়। আর এই জায়গা থেকেই জমে যায় মলয়ের উপন্যাস। 'হিমঘরের পিওনটাও চড়া দামে বন্ড কেটেছে ইউনিট ম্যানেজারের চোখের সামনে। পিওনটা গ্রুপ থিয়েটার করে। ওদের নাটক দলটার নাম প্রতিবাদী সভা। একাডেমিতে নীলদর্পণে ভালো অভিনয় করেছিল'--- ( নামগন্ধ পৃ ৯৫ ) ক্লাস।এই হিমঘর---আলু চাষির দুর্দশা---আলু পচে যাওয়া---বামপন্হীদের বদমাইসি--- এই সব পাবেন 'নামগন্ধ' উপন্যাসে। সত্যিই একটা নিষিদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের ছবি। আম কেমন খেতে সেটা শোনার চেয়ে খেয়ে দেখা ভালো--- সোজা কথা, উপন্যাসটা পড়ে ফেলুন।
     
     
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:২১735084
  • পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্য
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রধান দৃষ্টিকোণ ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার । আর সেই সঙ্গে মলয় ‘সাহিত্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । মলয় রায়চৌধুরী মনে করেন, ‘প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান কোনো অরগানাইজেশান নয় । তা চাগিয়ে ওঠে শাসনের মূল্যবোধ থেকে । মলয় আরও বলেছেন, এই ইনট্রিনজিক ফ্যাসিজমই এসট্যাবলিশমেন্ট ।’ সব মিলিয়ে এটাই দাঁড়ায়, , মলয়ের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতা । আর প্রতিষ্ঠান মানে শাসকের, শাসনের মূল্যবোধ । মলয় প্রতিষ্ঠান বলতে কোনও দল, আমলাতন্ত্র, চার্চ-মসজিদ, হিন্দুধর্মকেন্দ্র, শিক্ষাব্যবস্হা ইত্যাদিকে পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করেন না ; করেন মূল্যবোধকে । শাসনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমাজ ও জনসমাজ যে-মূল্যবোধ, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে দমননীতি-সম্মতির বিভিন্ন হাতিয়ারকে ব্যবহার করে, তাকেই মলয় প্রতিষ্ঠান ভাবেন, এবং তা একটি প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে তার কর্ষিকাগুলি ছড়িয়ে দেয় । রাষ্ট্র থাকলে যেমন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থাকবে, সমাজ -- সে রাষ্ট্রীয় বা জন যাই হোক, থাকলেই প্রতিষ্ঠান থাকবে । আর প্রতিষ্ঠান থাকলেই তার কর্তৃত্ব থাকবে , যে-সমাজে প্রতিষ্ঠানটি শিকড় গাড়ে, শাঁসে-জলে বাড়ে, তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য হিংস্র ও অহিংস্র নানা উপায় সে অবলম্বন করে । এর বিরুদ্ধে লড়াই তাই মূল্যবোধের, চৈতন্যের । আর এ লড়াই সার্বিক ; ব্যক্তিগত ও বৃহত্তর মাত্রা উভয় স্তরেই ।
    মলয়ের জীবনকাহিনির যেটুকু অংশ তাঁর লেখাতেই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এই লড়াইয়ের একটা ছবি পাই । অবশ্য এ বৃত্তান্ত পরবর্তী সময়ের, ১৯৬১-১৯৬৫-এর মধ্যে তিনি তরতাজা যুবক হিসাবে কী ভাবতেন, তা জানা যায় না । সেই সময়ের দিনপঞ্জিকাটি থাকলে আরও বোঝা যেত । কারণ ওই যে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া, একটি মূল্যবোধ, তাতেই স্পষ্ট ১৯৬১-৬৫-এর মলয় রায়চৌধুরী আর ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মলয় রায়চৌধুরী যেমন এক নন, তেমনি সেই সময়ের প্রতিষ্ঠান আর এখনকার প্রতিষ্ঠান, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে হুবহু এক নয় ।
    ১৯৬৫ থেকে ২০০০-এর মধ্যে এখানে সময় খুব দ্রুত এগিয়েছে-পিছিয়েছে, একটা অপরিবর্তনীয় গতিতত্বে যেন নানা ওলটপালটের মধ্যে আবার আগের স্হিতাবস্হায় ফিরে গেছে, কিন্তু আরও চরিত্রহীন, আরও নপুংসক হয়ে । আমরা যারা মলয়ের সমবয়সী প্রায়, তাদের কাছে ১৯৬১-১৯৬৫-এর মলয়ের নৈরাজ্যিক প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, ওই সময়ে নঞর্থক মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল সামাজিক দায়হীন । কিন্তু আজকের অবসন্নতায় ওই
    বিদ্রোহকে সদর্থক মনে হয় । বিশেষ সময়ে অ্যানার্কিও তো সদর্থক বৈপ্লবিক হতে পারে ।
    মলয় রায়চৌথুরীর ১৯৬০র দশকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ও তারপরে নীরব থেকে ১৯৮০র দশকে অন্যভাবে দেখা দেওয়া, আমাদের মধ্যবিত্ত বিদ্রোহের এক প্রতীকি চিত্র । সেই ১৮২০-৩০এর দশকের ডিরোজিয়ানদের সময় থেকেই এই পরম্পরা আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেনিতে আছে । ওই বিদ্রোহটাও যেমন সত্যি আবার প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যাওয়াও তেমনি সত্যি । উপনিবেশ ও ১৯৪৭-এর পরের অব-উপনিবেশের বাস্তবে ক্রিয়াশীল উৎপাদন সম্পর্কশূন্য বৃহত্তর জনসমাজ ও জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত এই বিদ্রোহ , এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে তুচ্ছ করা অনৈতিহাসিক, কারণ মধ্যশ্রেনির ইতিহাসের নিরন্ধ্র অবসন্নতা ও করুণ আত্মসমর্পণে, ট্র্যাজেডি নয় ফার্সে,
    এই ক্ষণস্ফূলিঙ্গগুলিই একমাত্র বাঁচবার ইঙ্গিত । এদের ব্যক্তিক ও গোষ্ঠীগত ব্যর্থতা প্রায় অনিবার্যই ছিল । তবু, তারা যে কম্পন নিয়ে এসেছে, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে হয় ।
    মলয় রায়চৌধুরীর নিজের সাক্ষেই বোঝা যায়, একটা টানবাপোড়েন গোড়া থেকেই ছিল । মলয় দেখাতে চেয়েছেন তিনি প্রায় স্কুলে পড়াশুনা ন-করার ভূমি থেকে এসেছেন । তাঁর দাদা সমীরই তাঁদের বাড়ির প্রথম স্কুলে-পড়া, কলেজে-পড়া । অর্থাৎ যে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় বাঙালি মধ্যবিত্ত জারিত, তার শেকড় তাঁদের পরিবারে ছড়ায়নি, তাঁর প্রজন্মেই এর সূত্রপাত । কিন্তু ওই প্রথম প্রজন্মেই এই শিক্ষার ধার তীক্ষ্ণ হয় ; ‘এদিকে মলয় আমার ছোটোভাই তখন অর্থনীতির স্নাতকোত্তর ক্লাসের শেষ বছরের ছাত্র । সারাদিন ঘাড় গুঁজে বিস্তর বই পড়ে ; সমাজ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে অনেক ভাবনা,
    কথায়-কথায় এঙ্গেলস, কিয়ের্কেগার্দ, মার্কস, স্পেঙ্গলার ইত্যাদি থেকে উদ্ধৃতি দেয় । পাটনায় গেলে আমাকে কেবলই বলে, “সাহিত্য এইভাবে এলোমেলো হয় না ; একটা পরিকল্পনা মতো এগোনো উচিত । কী বলতে চাও, করতে চাও, সবার আগে সেটা ঠিক করো, আন্দোলন চালাও । আন্দোলন দরকার।”...’
    সমীরের এই ছবিতে কোনও নৈরাজ্যবাদী মলয়কে পাই না । বরঞ্চ ইয়োরোপমুখী এক যুবককে, যে পরিকল্পনা চায় । এই যুবক অব-উপনিবেশের যুদ্ধ-দাঙ্গে-দুর্ভিক্ষ-দেশভাগ ধর্ষিত কলকাতায় এসে পালটায়, কলকাতা তাঁকে পালটায় । তাঁর অ-নাগরিক অভ্যাস কলকাতায় বেমানান -- কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত অ-নাগরিক অভ্যাসকে তিনি প্রলেতারিয় ভাবছিলেন । নিজেকে শ্রেনিচ্যূত করতে চাইছিলেন । আর এই জন্যই একটা জীবনযাপন বেছে নিয়েছিলেন যা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পক্ষে দুঃসহনীয় । ঠিক যেমন একদা ডিরোজিয়ানরা বেছেছিলেন -- তখন মদ্যপান, গোমাংসভক্ষণ ছিল হিন্দু ভদ্রলোকের পক্ষে ক্রোধের কারণ, যদিও অনেক ভদ্রলোকই আড়ালে মদ্যপায়ী, বেশ্যাগমনে অভ্যস্ত । । কিন্তু ডিরোজিয়ানরা এসব করছিলেন প্রকাশ্যে, একটা বিদ্রোহের আদলে। মলয় নিজেদের অবস্হাকে বলেছেন ‘ষাট দশকীয় ফাটিচার’ । কলকাতার সাহিত্য মহলে আর্টেমিস-ক্রেসিডা-ইউলিসিস এসব নামে অস্বস্তিবোধ করতেন তিনি, কিন্তু “আমাদের মগজে রেজিস দেবরে, আরনেসতো চে ভারা, ফিদেল কাসত্রো নামগুলো বরঞ্চ মিহিন ঘণ্টাধ্বনি শোনাচ্ছে ।”
    এঁরাও সকলেই বিদেশের -- তবে অন্য ভূবনের । ষাট দশকের কলকাতার বিপরীত টানেই পাটনার সিরিয়াস যুবক মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রতিষ্ঠাবিরোধিতার নৈরাজ্যিক আকাশে মুক্তি চাইলেন । এই কলকাতাই তাঁকে বুঝিয়েছিল, ‘ষাটের দশকে সুস্হতা সত্যিই অবাস্তব ছিল।’ মলয়ের এই সিদ্ধান্ত ইতিহাস-বোধে উজ্বল। ষাটের দশকে যে সুস্হভাবে বাঁচা অবাস্তব ছিল, তার প্রমাণ সেই দশক জুড়ে নানা ধরনের বিদ্রোহ যার শীর্ষবিন্দু নকশাল অভ্যূথ্থান । মলয়দের আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনের একদিকের পূর্বাভাস । তিনি দেবরে, গ্বেভারা, কাসত্রোর কথা বলেছেন, তাতে বোঝা যায় তাঁর অন্তরে তিনি, ব্যক্তিগত নানা ট্যাবু ভাঙার মধ্যেই, একটা রাজনৈতিক বীক্ষা বহন করতেন । ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ নামে বইও লিখেছিলেন । এই বীক্ষা তাঁর বিদ্রোহে সেইভাবে উপরিস্তরে আসেনি, কিন্তু অনেক হাংরি যে পরে নকশাল হয়েছিল, তার কারণ কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত কারাগার ভেঙে ফেলার আগ্রহ । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, তিনিও গুণ্ডা-মাস্তান হয়ে যেতেন, কবিতা না-লিখলে । নিজেকে কবিতা লেখার ক্রিমিনাল বলেও অভিহিত করেছেন । আর এক -এক করে সেই কবিদের নাম করেছেন যাঁদের জেলে বা জেলের বাইরে খুন করা হয় । মলয় নকশাল প্রসঙ্গ আনেন তাঁর ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইতে । ঠিকই করেন । মলয়ের বিদ্রোহ ছিল দক্ষিণ ও বাম দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই -- অন্তত মলয় তাঁর পঠন-পাঠন থেকে, বুদ্ধিগত জগৎ জগৎ কোনও সময়েই রাজনৈতিক বীক্ষার অন্তঃসলিলা স্রোতকে ফেলে দিতে পারেননি । জীবনযাপনের নৈরাজ্যের মধ্যেই একটা বুদ্ধিগত, মননগত স্তর তাঁর থেকেই গিয়েছিল । কবিতা ও সাহিত্যকে কেন্দ্রবিন্দু রাখায় ব্যক্তিক জীবনযাপনের তীব্র নেশাগ্রস্ত নৈরাজ্যই তাঁর কাছে বিদ্রোহের মূল ধরণ হয়ে ওঠে ।
    এটাকে মেলাতে চান কবিতায় । কিন্তু হাংরি প্রজন্মের সাহিত্যগত কীর্তি কবিতায় নয়, গদ্যে । ওই কিংবদন্তি, ওই ছাপ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের মূল্যায়ন করলে, গদ্যই থাকবে ; অন্তত আমার মতো পাঠকের কাছে, যার চিন্তাভাবনাকে, নকশাল অভ্যূথ্থান, ব্যর্থ হলেও ওলোটপালট করে দিয়েছিল। ওই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা অবশ্যই স্পষ্ট, তবুও । তেমনি ষাটের দশকে একদল যুবকের ব্যক্তিক জীবনের নিরুদ্দেশযাত্রী হওয়ার তাৎপর্য এখন ধরা পড়ে । এই নিরুদ্দেশযাত্রার মূল্য অবশ্যই তাদের দিতে হয়েছে । তবে যেহেতু নকশাল বিদ্রোহ রাষ্ট্রকে খানিকটা ভীত করে তুলেছিল, তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জনসমাজের সমর্থনে এ-বিদ্রোহের ওপর ভয়াবহভাবে নেমে আসে । ওই বাস্তব অসহ্য-লাগা যুবকদের হত্যা করে, অনেককেই সারা জীবনের মতো পঙ্গু করে দেয় । এই বঙ্গে এ-আন্দোলন নির্মমভাবে দমিত হলেও, ওই প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটা প্রশ্ন, সংশয় ও আন্দোলন রেখে গেছে । তার আগের মলয়দের হাংরি আন্দোলন জেল-মামলাতেই শেষ হয় । মলয়ও সেই নকশালদের মতো, যাঁরা শেষ পর্যন্ত এই সমাজে, প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে আত্মস্হ হয়ে যান ; এমনকি ওই অতীতকে কাজে লাগিয়ে, পুঁজি করেন । এ সত্ত্বেও মলয় রায়চৌধুরীর ষাটের দশকের বিদ্রোহ মিথ্যা হয়ে যায় না,
    অন্তত তিনি তাকে তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের মতো ( সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ ) প্রকাশ্যে পুঁজিও করেননি । এ-প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানবিরোধি বিদ্রোহ যে পুলিশ-আদালত-জেল-মামলার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি কিন্তু প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপেই হয় । তাঁর বন্ধুরা তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য ও মুচলেকা দিয়ে মুক্তিলাভ করেন । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, “লালবাজারে পুলিশ কমিশনার বললেন, তিনি আমাকে সাব ইন্সপেক্টরের চাকরি দিতে চান, কারণ সাজা হবার ফলে ( দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড ) আর কোথাও চাকরি হওয়া মুশকিল । পরে জেনেছি অ্যালেন গিন্সবার্গ পুপুল জয়াকরকে চিঠি লেখার পর জয়াকর তা ইন্দিরা গান্ধিকে জানান ; দিল্লির নির্দেশে কলকাতার বাঙালি পুলিশ তখন ফাঁপরে।” মলয় রায়চৌধুরীর পাশে এসে দিল্লির প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছিল, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক স্তরভেদ আছে । আর লক্ষণীয় গিন্সবার্গের ভূমিকা । তিনি কিন্তু ‘কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রীডাম’-এর পাণ্ডাদের
    সাহায্য চেয়েছিলেন -- আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রত্যাখ্যান করেন এ সাহায্যের আবেদন । প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের নেতার এরকম আশ্রয় থেকে বোঝা যায় মলয়দের নিয়ে এসট্যাবলিশমেন্ট খেলছিল । নকশাল-আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে এই বঙ্গেও ওই খেলা নানাভাবে দেখা যায় । তার আগে সন্ত্রস্ত প্রতিষ্ঠান তাদের একের পর এক হত্যা করেছে -- আর সেই হত্যার এ-বঙ্গের প্রতিষ্ঠানের নায়করা পরবর্তী বাম-রাজত্বে থেকেছেন ; শুধু তা-ই নয়, উন্নতি করেছেন । যেমন, যে সোমেন চন্দকে নিয়ে আজ বামপন্হী মহল উচ্ছ্বসিত, যাঁর হত্যার বিরুদ্ধে ধিক্কার বারবার উচ্চারিত, তাঁর হত্যার ‘প্রকৃত ঘটনা হল এই যে, সোমেন চন্দ রেলওয়ে শ্রমিকদের নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে শুধু ফ্যাসিবিরোধী
    সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন । ঢাকার নারিন্দাপুল পার হয়ে বটগাছের কাছেই আর. এস. পির ঘাতকবাহিনী ঘিরে ফ্যালে সোমেন চন্দকে । তারপর নির্মমভাবে হত্যা করে।’ এই আর.এস.পি এখন বামফ্রণ্টের শরিক ও মন্ত্রী । এরাই ফ্যাসিস্ট বাহিনীর মদতদাতা ছিল । প্রতিষ্ঠান কতো খেলাই খেলে, কতো রঙই বদলায় ।
    মলয় রায়চৌধুরীও ওই খেলার পুতুল হয়ে ছিলেন । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় তিনি মামলা-আদালত জেল-জরিমানার যে ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন, প্রতিষ্ঠানই তার থেকে তাঁকে বাইরে নিয়ে আসে ।
    অবশ্য মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে এসব কথা এখন অবান্তর। কারণ তাঁর সম্পর্কে এখন আমি যে লিখছি তা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বা আদালত-মামলা জেল-জরিমানার বৃত্তান্তের জন্য নয় । মলয় নামক একজন কবি ও ঔপন্যাসিকই আমার আগ্রহের মূলে । তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্যই এই সূত্রে বিবেচ্য । এক একজন পাঠক এক একজন লেখক ও আন্দোলনকে নিজের নিজের মতন করে দেখেন । আমার কাছে শুধু মলয়ই নয়, গোটা হাংরি জেনারেশনের লেখকদেরই গদ্য যতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, কবিতাকে তেমন মনে হয়নি । যে-কোনও কারণেই হোক, কবিরা, বোধহয় ইয়োরোপ আমেরিকা কবিদের জীবনকাহিনি শুনে পঞ্চাশের দশক থেকে ব্যক্তিজীবনের হুল্লোড় ও নানারকম কাজ কারবারকে গুরুত্ব দিতে থাকেন, ফল হয় কবিতার অধঃপতন যা এখনও চলছে । মলয়ও তাই করেছিলেন । কিন্তু গদ্যে একেবারে বিপরীত ।
    হাংরি আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে মলয় লিখেছেন, ‘স্হিতাবস্হা ভাঙার ভাষাই নয় কেবল, ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার চেষ্টাই চালিয়েছেন ।’ গদ্যে এটাই প্রকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
    বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালার’ নামও করতে পারি । কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এটা আদৌ হয়নি। ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার কোনও লক্ষণই নেই । আর যেহেতু জীবনযাপন কবিতাকে চিৎ করে ফেলছিল, সেহেতু ওই জীবনযাপনের তাৎক্ষণিক অনুভূতি কবিতায় এমনভাবে অন্তত মলয়ের কবিতায় আসতে চাইছিল, যাতে কবিতার থেকে ওই অনুভূতিই বড়ো হয়ে ওঠে । জীবন কবিতাকে খেয়ে ফেললে মুশকিল, জীবনের ক্ষুধাকে কবিতার রসায়নে দাঁড়াতে হয় । আজ এই ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ভাবতে অবাক লাগে মলয়ের বেশ কাঁচা কবিতা
    ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ অতো হৈ-চৈ, অতো শিরঃপীড়ার কারণ কেন হয়েছিল । একেবারে মধ্যবিত্ত ভাষা জর্জরিত মধ্যবিত্ত কবিতা এটি :-
    “অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা
    যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা
    আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
    আমি বুঝতে পারছি না কি জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
    শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
    কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
    শুভা আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও
    দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
    বেসামাল হৃদয়বেত্তার স্বর্ণসবুজে”
    যে-নিম্নবর্গীয় ভাষার আক্রমণে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে বিপন্ন করার ভাবনা মলয়ের, এই উদ্ধৃতিতে তার কি কোনও চিহ্ণ আছে ? যোনি, স্তন, বীর্য -এসবই সংস্কৃত শব্দ । এদের নিম্নবর্গীয় শব্দ মলয় ব্যবহার করেননি । এসব শব্দ এলিট পরম্পরায় বহু ব্যহৃত । আর ‘অশ্লীল’ এই ধারণাটির স্হান-কাল-পাত্র আছে । এখন আর তথাকথিত অশ্লীল দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ঘুম কাড়া যায় না, কারণ সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানই তো অশ্লীল --- অশ্লীল অর্থনীতি, অশ্লীল রাজনীতি, অশ্লীল সমাজ, রাস্তায় ঘাটে একেবারে মধ্যবিত্ত ছোকরাই দু-তিন-চার অক্ষরের শব্দ প্রকাশ্যে বলে । নিম্নবর্গীয়দের অশ্লীল শব্দের যে পেশলতা, যে চিত্রকল্প, যে জোর, তা এই অশ্লীলতায় নেই -- মলয়ের কবিতায় ‘পাজামায় শুকিয়ে যাওয়া বীর্যের’ মতোই সৃষ্টিহীন, অসুস্হ । আসলে ষাটের দশকে মলয় রায়চৌধুরী এক ধরনের আরোপিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় মেতেছিলেন, অথচ তাঁর চৈতন্যে গভীর বোধ ছিল । সেই বোধ জীবনযাপনের তীব্রতায় হারিয়ে যেতে থাকে । তাঁর মনে হয়, অশ্লীলতা বুঝি শুধু যৌনতাবাচক শুধু কতকগুলি শব্দ । এটা যে সামগ্রিক মূল্যবোধ-জনিত, আর প্রতিষ্ঠান যে অশ্লীল হয়ে উঠেছে সব দিক দিয়ে, বাইরের পোশাকের আড়ালে অশ্লীল, সেটা হয়তো বুঝতে পারেননি । ১৯৬৫ সালের পর মলয় এর থেকে বেরিয়ে আসেন ।
    মলয় তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রত্যাখ্যানের যথার্ধ পরিচয় রাখেন তখন, যখন তিনি ওই ষাটের দশকের জীবনযাপনের গণ্ডি থেকে সরে এসেছেন, আপাতদৃষ্টিতে যেন প্রচলিত মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্যে এসেছেন । ‘তারপর দেড় দশক আমার লেখালিখি ছেড়ে যায় । জীবন কাটানোর ভাবনায় বন্ধুবান্ধবে আত্মপ্রকাশে আর্থিক অবস্হায় এই দেড় দশকে আমূল পরবর্তন ঘটে যায় আমার মগজে ও শরীরে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাসে ।’ ‘এখন তো আমার সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় । এখন ভালো চাকরির পাতি-বুর্জোয়া আরামে প্রতিবাদ প্রতিরোধের লেখালিখি অনেক আরামদায়ক আর সহজ।’ ‘ক্রমশ একলা থাকার মধ্যেই নিজের আরাম আনন্দ
    শান্তি টের পাই ।’ অর্থাৎ এখন জীবনযাপন মলয়ের লেখাকে ছাপিয়ে যায় না ।
    প্রতিবাদ-প্রতিরোধের লেখাই তো ষাটের দশকে মলয় লিখতে চেয়েছিলেন, তাতে পুলিশ, আদালত, অশ্লীলতার অভিযোগ, জেল-জরিমানা, লকাপে রাতকাটানো । এখন সেটা অনেক আরামদায়ক ও সহজ । কেন ? তবে কি প্রতিষ্ঠান তার মূল্যবোধ পালটেছে ? নাকি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান, ও তাঁর সহযোগীরা ( এমনকি হাংরি আন্দোলনকারীরা ) খড়্গহস্ত হয়েছিল, লেখার জন্য নয়, জীবনযাপনের জন্য । তুলনা করছি না, ডিরোজিয়ানদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, তারাও ঔপনিবেশিক সরকারি উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন, এমনকি ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়নের অন্যতম উদ্যোক্তার জীবনীও তাঁরা পরবর্তীকালে লিখেছেন ।
    সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় -- এখানেও জীবনের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া । শিল্পের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া বোধহয় এটাই যে ওই জীবনযাপন থেকে সরে আসার পর, পাতি-বুর্জোয়া জীবনে লগ্ন হওয়ার মধ্যেই মলয় যথার্থ প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা লিখলেন । আমার মতে কবিতায় নয়, গদ্যে । মলয় তাঁর শেষ জীবনে এখনও কোনও সরকারি-বেসরকারি শক্তিকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হননি, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সে-অর্থে হাত মেলাননি । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আসলে একটা প্রত্যাখ্যান ( তিনি অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন ) ।
    আমাদের অব-ঔপনিবেশিক বাস্তবে এখন এই প্রত্যাখ্যান বিশেষ জরুরি । মলয়ও জানেন, কোনও সামূহিকের সঙ্গে মেলা যায় না ; একলা হওয়া অনিবার্য মলয় ওই নিঃসঙ্গ প্রত্যাখ্যানের স্বপ্নে এখনও স্হির । দেড় দশক পরে যে কবিতা লেখেন, তাতে ওই প্রত্যাখ্যানের চেতনা, যা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার চেয়ে অনেক গভীরতলের :-
    ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
    শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজয় এনেছি এদেশে
    তথাকথিত অশ্লীলতা নেই, কিন্তু আছে নোকরশাহির চেতনা,
    আছে ভাষার প্রতিষ্ঠানকে ভাঙার ‘মুখচোরা’ সংকল্প ।
    হাতের কাছেই রয়েছে মলয়ের উপন্যাস ‘নামগন্ধ’ । প্রকাশিত ১৯৯৯ সালে । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রাতিষ্ঠানিক স্হিতাবস্হার মূল্যবোধের বিরুদ্ধের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস । স্হিতাবস্হা ও ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার মূল্যবোধের এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বোঝা যায় মলয় রায়চৌধুরী এখন কোথায় দাঁড়িয়ে ।
    “ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়ায়, গলির তলপেটের ঘিঞ্জি গলির ছমছমে অজানায়
    হনহনিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বড়ো রাস্তায় পৌঁছোবার পথ খুঁজে পায় না ওরা,
    আদিত্য আর অরিন্দম, খুঁজে পায় না শহরের নির্লিপ্ত নাগরিকতায় গিয়ে মিশে
    যাবার দরোজাটাকে । টাকরা শুকিয়ে গেছে অনভ্যস্ত অরিন্দমের । পা চালানোর
    ফাঁকে ফাঁকে ডানদিকে, এস.কে.চ্যাটার্জি লেন লেখা রাস্তাটায়, গোটা তিরিশেক
    লোকের মাথা-গিজগিজে ভিড়, চলছে ঝাড়পিটের তুমুল।”
    একটি খুনের পটভূমিতে এই ভাষা বাঙময়, স্হিতাবস্হাকে টলিয়ে দেয় :
    ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়া, এই সময়ের রাজনীতির ছবি হয়ে ওঠে ।
    ‘গলির তলপেট’ চিত্রকল্পটি ছমছমে, হনহনিয়ে শব্দ অর্থময় ; ‘চলছে ঝাড়পিটের তুমুল’ -- প্রায় কবিতার মতো ভাষা ধরিয়ে দেয় বাস্তবকে । মলয় শুরু করেন ওই রাস্তায় হত্যা ও উঁচু চাকরি-করা অরিন্দম ও পুলিশে চাকরি-করা আদিত্যকে দিয়ে, যাকে ‘ক্রনোটপ’ বলে, সেদিক থেকেও এই রাস্তা তাৎপর্যপূর্ণ । ‘নামগন্ধ’ গত কয়েক দশকের এই বঙ্গের সার্বিক চরিত্রহীন হয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত । এ বৃত্তান্তে অরিন্দম ও যিশু বিশ্বাস দুটি দিক । এই চরিত্রহীনতার মধ্যে এর সাক্ষী হয়েও তারা স্হিতাবস্হার বাইরে যেতে চেয়েছিল দুই নারীকে নিয়ে । বস্তুত ওই দুটি নারী মধ্যবিত্ত ও সামাজিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে যেন চিত্রকল্প । মধ্য চল্লিশের যিশু বিশ্বাস পঞ্চাশ বছরের খুশিদিকে নিয়ে চলে আসতে
    চেয়েছিল । খুশি তার ‘দাদা’ ভবেশ মণ্ডলের হাতে যেন বন্দিনী । ভবেশ মণ্ডল পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত সময়ের যেন বিবর্তনের প্রতিমূর্তি । বিদ্রোহ, অভ্যূথ্থানকারী ভবেশের পরিণতি তো এই সময়ের সাম্যবাদী দলেরই পরিণতি । এই পরিণতিতে খুশি বন্দী হয়ে যায় । যিশু যেন ওই বন্দিনীকে উদ্ধার করতে চায় । দীঘদিন পরে উধাও হয়ে যাওয়া ভবেশকাকে যিশু আবিষ্কার করে । পালটে যাওয়া ভবেশকাকা । আর তার হাতে বন্দি সেই খুশিদি, যে হয়তো শেষ বাঙালিনী । যিশু এই খুশির শরীরেই বাঁচতে চায়, এ কোনও শারীরিক টান নয়, এ যেন এক ঐতিহাসিক বাঁচবার আবেগ -- ভবেশকাকাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে । যিশুর হাত ধরে পাঠক পৌঁছে যায় এখনকার গ্রামীণ বাস্তবে --- আলু চাষ, হিমঘর, কিছুটা তাঁত, এসবের রাজনীতি-অর্থনীতিতে ধরা পড়ে এই সময়।
    আদিত্য নামক পুলিশ কর্মচারীর সূত্রে এই সময়ের শাসন, আমলা, এই বাস্তবের স্তরটি আসে । আদিত্যর ব্যক্তিগত বৃত্তান্তও দেখায় সময়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে । অন্য দিকে প্রমে পড়ার বাতিকগ্রস্ত উচ্চপদের অরিন্দম মধ্যবিত্ত পচনকে সরাসরিভাবে দেখায় । এই পচনের নানাছবির মধ্যে শেওড়াফুলিতে পিসিমার বাড়ির যে-ছবি আঁকা হয়, তাতে এই শ্রেনির পচে যাওয়ার কদর্য রূপ প্রকট হয়ে ওঠে ।
    “স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বড়ো বউদি, এমেবিয়েড, হাতে টলমলে গেলাস, ফর্সা,
    ভারিক্কি গতরকে একত্রিত করে পাছ-ঘেঁষটে উঠে বসে আর বাঁহাতে অরিন্দমের
    গলা আঁকড়ে, নিজের কানা ভরা গেলাস দাঁতে দাঁত অরিন্দমের ঠোঁটের ওপর উলটে দিলে ।
    খাবিনে মানে, তোর গুষ্টি খাবে, জানিস আজ আমার জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী ।
    বিশাল বুকের মধ্যে অরিন্দমের মাথা ঠাশা ।”
    তারপর শুরু হয় অশ্লীল গল্প বলার পর্ব । লেখকের মন্তব্য :
    ‘আমরা সবাই মিথ্যাগ্রস্ত মাতাল। বাঙালি মধ্যবিত্তের এ এক অদ্ভুত যাযাবর হামাগুড়ি।’ এই হামাগুড়ির প্রাক ইতিহাসও বলা হয় : এখন নোংরা নোংরা মোদো চুটকিতে মধ্যবিত্তের খোঁয়ারি উঠছে । অধ্যাপিকা ছুটকিও মাতাল, কোকা-কোলার সঙ্গে রাম ভালোবাসে । অরিন্দমের কোলে পা, অরিন্দম আলতা পরায় । সমগ্র মধ্যবিত্ত ল্যাংটো হয়ে যায় বিবরণে ।
    ‘নামগন্ধ’ এই বিবিধ পচনের প্রতিবাদ -- যিশুর খুশিদি আর অরিন্দমের কেটলিউলি সেই প্রতিবাদের, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের, গত চার-পাঁচ দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নারী । এরা মধ্যবিত্ত সীমার বাইরের । দু-জন এদের মধ্যেই মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠানেরই মূল্যবোধের কারাগার ভাঙতে চেয়েছিল । এই দুই নারীকে অবলম্বন করে এরা পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল তাদের শ্রেনিকে, ওই ভবেশকাকা তথা এই সমাজের ক্রিয়াকে । ওই শেওড়াফুলিতে প্রতিবিম্বিত
    মধ্যবিত্ত বাস্তবকে । কিন্তু পারল না । আকস্মিক দুর্ঘটনায় রিন্দম-কেটলিউলি আর ডাকাত-ডাকাত চিৎকারে যিশু বিশ্বাসের মৃত্যু হয় । আপাত আকস্মিক এই ঘটনা দুটি এই সময়ের গর্ভে স্বাভাবিক । যেমন স্বাভাবিক উপন্যাসের শুরুর হত্যাটি । আর শেষে আরেক ইতিহাসের স্তর আবিষ্কৃত । খুশি ভবেশ কাকার বোন নয় । যিশুর মৃত্যুর সময় একটা পুরোনো হলদে কাগজের পাতা উড়তে থাকে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের খবরের কাগজ । এক নাতনির হারিয়ে যাবার বিজ্ঞাপন, দিয়েছেন দাদু মিনহাজুদ্দিন । মেয়েটির নাম খুশবু । ডাক নাম খুশি । ভয়ংকর শব্দে ইতিহাস ফেটে পড়ে -- ইতিহাসের গন্ধ, ‘নামগন্ধ’ ছড়ায় --
    খুশি, পঞ্চাশ বছরের খুশি হয়ে ওঠে অর্ধশতাব্দীর সময়, ইতিহাস, আবেগ, শরীর । তাকে আমরা পাই না -- সময়ের আকস্মিক মোচড় হত্যা করে নানাভাবে । প্রতিষ্ঠান খেয়ে ফেলে তাদের । আর এর বিরুদ্ধে কবি মলয় রায়চৌধুরী দাঁড়ান এই গদ্যেই । কী অনবদ্য কবিতা উঠে আসে যিশুর আবিষ্কারে :-
    “খালি পায়ে, বাগানের ঘাসপথ বেয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়ায় যিশু । আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বাতাস । বাতাসের ডাঁটো স্ট্যাচু যেন । সব স্হির । ডানপাড়ের বিশাল গাছে তেঁতুলপাতাও কাঁপছে না । বাঁধানো ঘাটে বয়ঃসন্ধির বালিকার মতন একধাপ ওপরে তো একধাপ নীচে খেলা করবার পর ক্লান্ত হয়ে গেছে টলমলে পুকুর।”
    কিংবা :-
    “জনশ্রুতির মতন বাতাস বইছে।...মদগর্বিত ষাঁড়। মদিরেক্ষণা মৌমাছি ।
    ভিজে চিলের মতন ডানা ঝুলিয়ে রয়েছে ঝিমন্ত কলাগাছগুলোর ছেঁড়া পাতা।
    কঞ্জুস হাওয়ার তাপে বাবলাগাছগুলোর গায়ে কাঁটা দিয়েছে । পথিপার্শ্বে উইপোকাদের বিজয়স্তম্ভ । মার্জিত চেহারার খেজুর গাছ, গলায় খেজুর ছড়ার মালা।”
    অথবা :-
    “চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে কালবৈশাখির ছেতরানো মেঘে, কিন্তু পূর্ণিমার আগাম আভায় নির্জন বধির অন্ধকারকে মনে হয় হাস্যোজ্বল । নিরলস সাধনায় মগ্ন স্হির সন্ধ্যাবাতাস আচমকা হাওয়ার জন্য অপেক্ষমান । নেশাগ্রস্তের মতন মাথা ঝুঁকিয়ে আছে গাছগুলো । বুনো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে সিসলকাঁটার গুড়িসুড়ি ঝোপ।”
    এই উদ্ধৃতিগুলিতে, উপমা-চিত্রকল্পে, ভাষার স্বাতন্ত্র্যে, যে-কবিতাময়তা, তাতে থাকে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে আক্রমণ, অথবা নতুন স্হিতিস্হাপকতা গড়া । খুশি ও কেটলিউলি হিন্দু অরিন্দম আর খ্রিস্টান যিশুর, মধ্যবিত্তের বাঁচবার পথ, কেটলিউলি-মেয়েটার শরীর জুড়ে প্রাচীন নিষাদকুলের নাচ লুকিয়ে আছে যেন । এর চাউনি রৌদ্রোজ্জ্বল । চিরপ্রদোষ-মাখা শ্যামাঙ্গিনী । আর খুশিদিকে দেখে যিশুর মনে হয়, চাষি মেয়ের শ্রমসোহাগী পেশল বাহু ঝুলে আছে । ওই প্রাচীন নিষাদকুল, ওই শ্যামলিনী, চাষি মেয়ের পেশল বাহুই আমাদের প্রতিষ্ঠানের, কবন্ধ মূল্যবোধের বাইরে আনতে পারে । এ সম্ভাবনার দরোজা কি খুলবে ? মলয় রায়চৌধুরীর এ-প্রশ্নকেই রেখে দেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্য এখানেই । মলয় এভাবেই ষাটের দশক থেকে পালটেছেন -- যেতে চাইছেন সময়ের গভীরে, তার নাভিকেন্দ্রে ।
     
     
     

     

  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:২১735086
  • পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্য
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রধান দৃষ্টিকোণ ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার । আর সেই সঙ্গে মলয় ‘সাহিত্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । মলয় রায়চৌধুরী মনে করেন, ‘প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান কোনো অরগানাইজেশান নয় । তা চাগিয়ে ওঠে শাসনের মূল্যবোধ থেকে । মলয় আরও বলেছেন, এই ইনট্রিনজিক ফ্যাসিজমই এসট্যাবলিশমেন্ট ।’ সব মিলিয়ে এটাই দাঁড়ায়, , মলয়ের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতা । আর প্রতিষ্ঠান মানে শাসকের, শাসনের মূল্যবোধ । মলয় প্রতিষ্ঠান বলতে কোনও দল, আমলাতন্ত্র, চার্চ-মসজিদ, হিন্দুধর্মকেন্দ্র, শিক্ষাব্যবস্হা ইত্যাদিকে পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করেন না ; করেন মূল্যবোধকে । শাসনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমাজ ও জনসমাজ যে-মূল্যবোধ, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে দমননীতি-সম্মতির বিভিন্ন হাতিয়ারকে ব্যবহার করে, তাকেই মলয় প্রতিষ্ঠান ভাবেন, এবং তা একটি প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে তার কর্ষিকাগুলি ছড়িয়ে দেয় । রাষ্ট্র থাকলে যেমন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থাকবে, সমাজ -- সে রাষ্ট্রীয় বা জন যাই হোক, থাকলেই প্রতিষ্ঠান থাকবে । আর প্রতিষ্ঠান থাকলেই তার কর্তৃত্ব থাকবে , যে-সমাজে প্রতিষ্ঠানটি শিকড় গাড়ে, শাঁসে-জলে বাড়ে, তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য হিংস্র ও অহিংস্র নানা উপায় সে অবলম্বন করে । এর বিরুদ্ধে লড়াই তাই মূল্যবোধের, চৈতন্যের । আর এ লড়াই সার্বিক ; ব্যক্তিগত ও বৃহত্তর মাত্রা উভয় স্তরেই ।
    মলয়ের জীবনকাহিনির যেটুকু অংশ তাঁর লেখাতেই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এই লড়াইয়ের একটা ছবি পাই । অবশ্য এ বৃত্তান্ত পরবর্তী সময়ের, ১৯৬১-১৯৬৫-এর মধ্যে তিনি তরতাজা যুবক হিসাবে কী ভাবতেন, তা জানা যায় না । সেই সময়ের দিনপঞ্জিকাটি থাকলে আরও বোঝা যেত । কারণ ওই যে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া, একটি মূল্যবোধ, তাতেই স্পষ্ট ১৯৬১-৬৫-এর মলয় রায়চৌধুরী আর ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মলয় রায়চৌধুরী যেমন এক নন, তেমনি সেই সময়ের প্রতিষ্ঠান আর এখনকার প্রতিষ্ঠান, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে হুবহু এক নয় ।
    ১৯৬৫ থেকে ২০০০-এর মধ্যে এখানে সময় খুব দ্রুত এগিয়েছে-পিছিয়েছে, একটা অপরিবর্তনীয় গতিতত্বে যেন নানা ওলটপালটের মধ্যে আবার আগের স্হিতাবস্হায় ফিরে গেছে, কিন্তু আরও চরিত্রহীন, আরও নপুংসক হয়ে । আমরা যারা মলয়ের সমবয়সী প্রায়, তাদের কাছে ১৯৬১-১৯৬৫-এর মলয়ের নৈরাজ্যিক প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, ওই সময়ে নঞর্থক মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল সামাজিক দায়হীন । কিন্তু আজকের অবসন্নতায় ওই
    বিদ্রোহকে সদর্থক মনে হয় । বিশেষ সময়ে অ্যানার্কিও তো সদর্থক বৈপ্লবিক হতে পারে ।
    মলয় রায়চৌথুরীর ১৯৬০র দশকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ও তারপরে নীরব থেকে ১৯৮০র দশকে অন্যভাবে দেখা দেওয়া, আমাদের মধ্যবিত্ত বিদ্রোহের এক প্রতীকি চিত্র । সেই ১৮২০-৩০এর দশকের ডিরোজিয়ানদের সময় থেকেই এই পরম্পরা আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেনিতে আছে । ওই বিদ্রোহটাও যেমন সত্যি আবার প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যাওয়াও তেমনি সত্যি । উপনিবেশ ও ১৯৪৭-এর পরের অব-উপনিবেশের বাস্তবে ক্রিয়াশীল উৎপাদন সম্পর্কশূন্য বৃহত্তর জনসমাজ ও জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত এই বিদ্রোহ , এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে তুচ্ছ করা অনৈতিহাসিক, কারণ মধ্যশ্রেনির ইতিহাসের নিরন্ধ্র অবসন্নতা ও করুণ আত্মসমর্পণে, ট্র্যাজেডি নয় ফার্সে,
    এই ক্ষণস্ফূলিঙ্গগুলিই একমাত্র বাঁচবার ইঙ্গিত । এদের ব্যক্তিক ও গোষ্ঠীগত ব্যর্থতা প্রায় অনিবার্যই ছিল । তবু, তারা যে কম্পন নিয়ে এসেছে, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে হয় ।
    মলয় রায়চৌধুরীর নিজের সাক্ষেই বোঝা যায়, একটা টানবাপোড়েন গোড়া থেকেই ছিল । মলয় দেখাতে চেয়েছেন তিনি প্রায় স্কুলে পড়াশুনা ন-করার ভূমি থেকে এসেছেন । তাঁর দাদা সমীরই তাঁদের বাড়ির প্রথম স্কুলে-পড়া, কলেজে-পড়া । অর্থাৎ যে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় বাঙালি মধ্যবিত্ত জারিত, তার শেকড় তাঁদের পরিবারে ছড়ায়নি, তাঁর প্রজন্মেই এর সূত্রপাত । কিন্তু ওই প্রথম প্রজন্মেই এই শিক্ষার ধার তীক্ষ্ণ হয় ; ‘এদিকে মলয় আমার ছোটোভাই তখন অর্থনীতির স্নাতকোত্তর ক্লাসের শেষ বছরের ছাত্র । সারাদিন ঘাড় গুঁজে বিস্তর বই পড়ে ; সমাজ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে অনেক ভাবনা,
    কথায়-কথায় এঙ্গেলস, কিয়ের্কেগার্দ, মার্কস, স্পেঙ্গলার ইত্যাদি থেকে উদ্ধৃতি দেয় । পাটনায় গেলে আমাকে কেবলই বলে, “সাহিত্য এইভাবে এলোমেলো হয় না ; একটা পরিকল্পনা মতো এগোনো উচিত । কী বলতে চাও, করতে চাও, সবার আগে সেটা ঠিক করো, আন্দোলন চালাও । আন্দোলন দরকার।”...’
    সমীরের এই ছবিতে কোনও নৈরাজ্যবাদী মলয়কে পাই না । বরঞ্চ ইয়োরোপমুখী এক যুবককে, যে পরিকল্পনা চায় । এই যুবক অব-উপনিবেশের যুদ্ধ-দাঙ্গে-দুর্ভিক্ষ-দেশভাগ ধর্ষিত কলকাতায় এসে পালটায়, কলকাতা তাঁকে পালটায় । তাঁর অ-নাগরিক অভ্যাস কলকাতায় বেমানান -- কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত অ-নাগরিক অভ্যাসকে তিনি প্রলেতারিয় ভাবছিলেন । নিজেকে শ্রেনিচ্যূত করতে চাইছিলেন । আর এই জন্যই একটা জীবনযাপন বেছে নিয়েছিলেন যা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পক্ষে দুঃসহনীয় । ঠিক যেমন একদা ডিরোজিয়ানরা বেছেছিলেন -- তখন মদ্যপান, গোমাংসভক্ষণ ছিল হিন্দু ভদ্রলোকের পক্ষে ক্রোধের কারণ, যদিও অনেক ভদ্রলোকই আড়ালে মদ্যপায়ী, বেশ্যাগমনে অভ্যস্ত । । কিন্তু ডিরোজিয়ানরা এসব করছিলেন প্রকাশ্যে, একটা বিদ্রোহের আদলে। মলয় নিজেদের অবস্হাকে বলেছেন ‘ষাট দশকীয় ফাটিচার’ । কলকাতার সাহিত্য মহলে আর্টেমিস-ক্রেসিডা-ইউলিসিস এসব নামে অস্বস্তিবোধ করতেন তিনি, কিন্তু “আমাদের মগজে রেজিস দেবরে, আরনেসতো চে ভারা, ফিদেল কাসত্রো নামগুলো বরঞ্চ মিহিন ঘণ্টাধ্বনি শোনাচ্ছে ।”
    এঁরাও সকলেই বিদেশের -- তবে অন্য ভূবনের । ষাট দশকের কলকাতার বিপরীত টানেই পাটনার সিরিয়াস যুবক মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রতিষ্ঠাবিরোধিতার নৈরাজ্যিক আকাশে মুক্তি চাইলেন । এই কলকাতাই তাঁকে বুঝিয়েছিল, ‘ষাটের দশকে সুস্হতা সত্যিই অবাস্তব ছিল।’ মলয়ের এই সিদ্ধান্ত ইতিহাস-বোধে উজ্বল। ষাটের দশকে যে সুস্হভাবে বাঁচা অবাস্তব ছিল, তার প্রমাণ সেই দশক জুড়ে নানা ধরনের বিদ্রোহ যার শীর্ষবিন্দু নকশাল অভ্যূথ্থান । মলয়দের আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনের একদিকের পূর্বাভাস । তিনি দেবরে, গ্বেভারা, কাসত্রোর কথা বলেছেন, তাতে বোঝা যায় তাঁর অন্তরে তিনি, ব্যক্তিগত নানা ট্যাবু ভাঙার মধ্যেই, একটা রাজনৈতিক বীক্ষা বহন করতেন । ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ নামে বইও লিখেছিলেন । এই বীক্ষা তাঁর বিদ্রোহে সেইভাবে উপরিস্তরে আসেনি, কিন্তু অনেক হাংরি যে পরে নকশাল হয়েছিল, তার কারণ কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত কারাগার ভেঙে ফেলার আগ্রহ । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, তিনিও গুণ্ডা-মাস্তান হয়ে যেতেন, কবিতা না-লিখলে । নিজেকে কবিতা লেখার ক্রিমিনাল বলেও অভিহিত করেছেন । আর এক -এক করে সেই কবিদের নাম করেছেন যাঁদের জেলে বা জেলের বাইরে খুন করা হয় । মলয় নকশাল প্রসঙ্গ আনেন তাঁর ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইতে । ঠিকই করেন । মলয়ের বিদ্রোহ ছিল দক্ষিণ ও বাম দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই -- অন্তত মলয় তাঁর পঠন-পাঠন থেকে, বুদ্ধিগত জগৎ জগৎ কোনও সময়েই রাজনৈতিক বীক্ষার অন্তঃসলিলা স্রোতকে ফেলে দিতে পারেননি । জীবনযাপনের নৈরাজ্যের মধ্যেই একটা বুদ্ধিগত, মননগত স্তর তাঁর থেকেই গিয়েছিল । কবিতা ও সাহিত্যকে কেন্দ্রবিন্দু রাখায় ব্যক্তিক জীবনযাপনের তীব্র নেশাগ্রস্ত নৈরাজ্যই তাঁর কাছে বিদ্রোহের মূল ধরণ হয়ে ওঠে ।
    এটাকে মেলাতে চান কবিতায় । কিন্তু হাংরি প্রজন্মের সাহিত্যগত কীর্তি কবিতায় নয়, গদ্যে । ওই কিংবদন্তি, ওই ছাপ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের মূল্যায়ন করলে, গদ্যই থাকবে ; অন্তত আমার মতো পাঠকের কাছে, যার চিন্তাভাবনাকে, নকশাল অভ্যূথ্থান, ব্যর্থ হলেও ওলোটপালট করে দিয়েছিল। ওই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা অবশ্যই স্পষ্ট, তবুও । তেমনি ষাটের দশকে একদল যুবকের ব্যক্তিক জীবনের নিরুদ্দেশযাত্রী হওয়ার তাৎপর্য এখন ধরা পড়ে । এই নিরুদ্দেশযাত্রার মূল্য অবশ্যই তাদের দিতে হয়েছে । তবে যেহেতু নকশাল বিদ্রোহ রাষ্ট্রকে খানিকটা ভীত করে তুলেছিল, তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জনসমাজের সমর্থনে এ-বিদ্রোহের ওপর ভয়াবহভাবে নেমে আসে । ওই বাস্তব অসহ্য-লাগা যুবকদের হত্যা করে, অনেককেই সারা জীবনের মতো পঙ্গু করে দেয় । এই বঙ্গে এ-আন্দোলন নির্মমভাবে দমিত হলেও, ওই প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটা প্রশ্ন, সংশয় ও আন্দোলন রেখে গেছে । তার আগের মলয়দের হাংরি আন্দোলন জেল-মামলাতেই শেষ হয় । মলয়ও সেই নকশালদের মতো, যাঁরা শেষ পর্যন্ত এই সমাজে, প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে আত্মস্হ হয়ে যান ; এমনকি ওই অতীতকে কাজে লাগিয়ে, পুঁজি করেন । এ সত্ত্বেও মলয় রায়চৌধুরীর ষাটের দশকের বিদ্রোহ মিথ্যা হয়ে যায় না,
    অন্তত তিনি তাকে তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের মতো ( সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ ) প্রকাশ্যে পুঁজিও করেননি । এ-প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানবিরোধি বিদ্রোহ যে পুলিশ-আদালত-জেল-মামলার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি কিন্তু প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপেই হয় । তাঁর বন্ধুরা তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য ও মুচলেকা দিয়ে মুক্তিলাভ করেন । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, “লালবাজারে পুলিশ কমিশনার বললেন, তিনি আমাকে সাব ইন্সপেক্টরের চাকরি দিতে চান, কারণ সাজা হবার ফলে ( দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড ) আর কোথাও চাকরি হওয়া মুশকিল । পরে জেনেছি অ্যালেন গিন্সবার্গ পুপুল জয়াকরকে চিঠি লেখার পর জয়াকর তা ইন্দিরা গান্ধিকে জানান ; দিল্লির নির্দেশে কলকাতার বাঙালি পুলিশ তখন ফাঁপরে।” মলয় রায়চৌধুরীর পাশে এসে দিল্লির প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছিল, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক স্তরভেদ আছে । আর লক্ষণীয় গিন্সবার্গের ভূমিকা । তিনি কিন্তু ‘কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রীডাম’-এর পাণ্ডাদের
    সাহায্য চেয়েছিলেন -- আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রত্যাখ্যান করেন এ সাহায্যের আবেদন । প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের নেতার এরকম আশ্রয় থেকে বোঝা যায় মলয়দের নিয়ে এসট্যাবলিশমেন্ট খেলছিল । নকশাল-আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে এই বঙ্গেও ওই খেলা নানাভাবে দেখা যায় । তার আগে সন্ত্রস্ত প্রতিষ্ঠান তাদের একের পর এক হত্যা করেছে -- আর সেই হত্যার এ-বঙ্গের প্রতিষ্ঠানের নায়করা পরবর্তী বাম-রাজত্বে থেকেছেন ; শুধু তা-ই নয়, উন্নতি করেছেন । যেমন, যে সোমেন চন্দকে নিয়ে আজ বামপন্হী মহল উচ্ছ্বসিত, যাঁর হত্যার বিরুদ্ধে ধিক্কার বারবার উচ্চারিত, তাঁর হত্যার ‘প্রকৃত ঘটনা হল এই যে, সোমেন চন্দ রেলওয়ে শ্রমিকদের নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে শুধু ফ্যাসিবিরোধী
    সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন । ঢাকার নারিন্দাপুল পার হয়ে বটগাছের কাছেই আর. এস. পির ঘাতকবাহিনী ঘিরে ফ্যালে সোমেন চন্দকে । তারপর নির্মমভাবে হত্যা করে।’ এই আর.এস.পি এখন বামফ্রণ্টের শরিক ও মন্ত্রী । এরাই ফ্যাসিস্ট বাহিনীর মদতদাতা ছিল । প্রতিষ্ঠান কতো খেলাই খেলে, কতো রঙই বদলায় ।
    মলয় রায়চৌধুরীও ওই খেলার পুতুল হয়ে ছিলেন । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় তিনি মামলা-আদালত জেল-জরিমানার যে ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন, প্রতিষ্ঠানই তার থেকে তাঁকে বাইরে নিয়ে আসে ।
    অবশ্য মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে এসব কথা এখন অবান্তর। কারণ তাঁর সম্পর্কে এখন আমি যে লিখছি তা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বা আদালত-মামলা জেল-জরিমানার বৃত্তান্তের জন্য নয় । মলয় নামক একজন কবি ও ঔপন্যাসিকই আমার আগ্রহের মূলে । তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্যই এই সূত্রে বিবেচ্য । এক একজন পাঠক এক একজন লেখক ও আন্দোলনকে নিজের নিজের মতন করে দেখেন । আমার কাছে শুধু মলয়ই নয়, গোটা হাংরি জেনারেশনের লেখকদেরই গদ্য যতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, কবিতাকে তেমন মনে হয়নি । যে-কোনও কারণেই হোক, কবিরা, বোধহয় ইয়োরোপ আমেরিকা কবিদের জীবনকাহিনি শুনে পঞ্চাশের দশক থেকে ব্যক্তিজীবনের হুল্লোড় ও নানারকম কাজ কারবারকে গুরুত্ব দিতে থাকেন, ফল হয় কবিতার অধঃপতন যা এখনও চলছে । মলয়ও তাই করেছিলেন । কিন্তু গদ্যে একেবারে বিপরীত ।
    হাংরি আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে মলয় লিখেছেন, ‘স্হিতাবস্হা ভাঙার ভাষাই নয় কেবল, ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার চেষ্টাই চালিয়েছেন ।’ গদ্যে এটাই প্রকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
    বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালার’ নামও করতে পারি । কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এটা আদৌ হয়নি। ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার কোনও লক্ষণই নেই । আর যেহেতু জীবনযাপন কবিতাকে চিৎ করে ফেলছিল, সেহেতু ওই জীবনযাপনের তাৎক্ষণিক অনুভূতি কবিতায় এমনভাবে অন্তত মলয়ের কবিতায় আসতে চাইছিল, যাতে কবিতার থেকে ওই অনুভূতিই বড়ো হয়ে ওঠে । জীবন কবিতাকে খেয়ে ফেললে মুশকিল, জীবনের ক্ষুধাকে কবিতার রসায়নে দাঁড়াতে হয় । আজ এই ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ভাবতে অবাক লাগে মলয়ের বেশ কাঁচা কবিতা
    ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ অতো হৈ-চৈ, অতো শিরঃপীড়ার কারণ কেন হয়েছিল । একেবারে মধ্যবিত্ত ভাষা জর্জরিত মধ্যবিত্ত কবিতা এটি :-
    “অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা
    যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা
    আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
    আমি বুঝতে পারছি না কি জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
    শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
    কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
    শুভা আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও
    দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
    বেসামাল হৃদয়বেত্তার স্বর্ণসবুজে”
    যে-নিম্নবর্গীয় ভাষার আক্রমণে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে বিপন্ন করার ভাবনা মলয়ের, এই উদ্ধৃতিতে তার কি কোনও চিহ্ণ আছে ? যোনি, স্তন, বীর্য -এসবই সংস্কৃত শব্দ । এদের নিম্নবর্গীয় শব্দ মলয় ব্যবহার করেননি । এসব শব্দ এলিট পরম্পরায় বহু ব্যহৃত । আর ‘অশ্লীল’ এই ধারণাটির স্হান-কাল-পাত্র আছে । এখন আর তথাকথিত অশ্লীল দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ঘুম কাড়া যায় না, কারণ সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানই তো অশ্লীল --- অশ্লীল অর্থনীতি, অশ্লীল রাজনীতি, অশ্লীল সমাজ, রাস্তায় ঘাটে একেবারে মধ্যবিত্ত ছোকরাই দু-তিন-চার অক্ষরের শব্দ প্রকাশ্যে বলে । নিম্নবর্গীয়দের অশ্লীল শব্দের যে পেশলতা, যে চিত্রকল্প, যে জোর, তা এই অশ্লীলতায় নেই -- মলয়ের কবিতায় ‘পাজামায় শুকিয়ে যাওয়া বীর্যের’ মতোই সৃষ্টিহীন, অসুস্হ । আসলে ষাটের দশকে মলয় রায়চৌধুরী এক ধরনের আরোপিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় মেতেছিলেন, অথচ তাঁর চৈতন্যে গভীর বোধ ছিল । সেই বোধ জীবনযাপনের তীব্রতায় হারিয়ে যেতে থাকে । তাঁর মনে হয়, অশ্লীলতা বুঝি শুধু যৌনতাবাচক শুধু কতকগুলি শব্দ । এটা যে সামগ্রিক মূল্যবোধ-জনিত, আর প্রতিষ্ঠান যে অশ্লীল হয়ে উঠেছে সব দিক দিয়ে, বাইরের পোশাকের আড়ালে অশ্লীল, সেটা হয়তো বুঝতে পারেননি । ১৯৬৫ সালের পর মলয় এর থেকে বেরিয়ে আসেন ।
    মলয় তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রত্যাখ্যানের যথার্ধ পরিচয় রাখেন তখন, যখন তিনি ওই ষাটের দশকের জীবনযাপনের গণ্ডি থেকে সরে এসেছেন, আপাতদৃষ্টিতে যেন প্রচলিত মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্যে এসেছেন । ‘তারপর দেড় দশক আমার লেখালিখি ছেড়ে যায় । জীবন কাটানোর ভাবনায় বন্ধুবান্ধবে আত্মপ্রকাশে আর্থিক অবস্হায় এই দেড় দশকে আমূল পরবর্তন ঘটে যায় আমার মগজে ও শরীরে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাসে ।’ ‘এখন তো আমার সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় । এখন ভালো চাকরির পাতি-বুর্জোয়া আরামে প্রতিবাদ প্রতিরোধের লেখালিখি অনেক আরামদায়ক আর সহজ।’ ‘ক্রমশ একলা থাকার মধ্যেই নিজের আরাম আনন্দ
    শান্তি টের পাই ।’ অর্থাৎ এখন জীবনযাপন মলয়ের লেখাকে ছাপিয়ে যায় না ।
    প্রতিবাদ-প্রতিরোধের লেখাই তো ষাটের দশকে মলয় লিখতে চেয়েছিলেন, তাতে পুলিশ, আদালত, অশ্লীলতার অভিযোগ, জেল-জরিমানা, লকাপে রাতকাটানো । এখন সেটা অনেক আরামদায়ক ও সহজ । কেন ? তবে কি প্রতিষ্ঠান তার মূল্যবোধ পালটেছে ? নাকি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান, ও তাঁর সহযোগীরা ( এমনকি হাংরি আন্দোলনকারীরা ) খড়্গহস্ত হয়েছিল, লেখার জন্য নয়, জীবনযাপনের জন্য । তুলনা করছি না, ডিরোজিয়ানদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, তারাও ঔপনিবেশিক সরকারি উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন, এমনকি ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়নের অন্যতম উদ্যোক্তার জীবনীও তাঁরা পরবর্তীকালে লিখেছেন ।
    সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় -- এখানেও জীবনের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া । শিল্পের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া বোধহয় এটাই যে ওই জীবনযাপন থেকে সরে আসার পর, পাতি-বুর্জোয়া জীবনে লগ্ন হওয়ার মধ্যেই মলয় যথার্থ প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা লিখলেন । আমার মতে কবিতায় নয়, গদ্যে । মলয় তাঁর শেষ জীবনে এখনও কোনও সরকারি-বেসরকারি শক্তিকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হননি, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সে-অর্থে হাত মেলাননি । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আসলে একটা প্রত্যাখ্যান ( তিনি অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন ) ।
    আমাদের অব-ঔপনিবেশিক বাস্তবে এখন এই প্রত্যাখ্যান বিশেষ জরুরি । মলয়ও জানেন, কোনও সামূহিকের সঙ্গে মেলা যায় না ; একলা হওয়া অনিবার্য মলয় ওই নিঃসঙ্গ প্রত্যাখ্যানের স্বপ্নে এখনও স্হির । দেড় দশক পরে যে কবিতা লেখেন, তাতে ওই প্রত্যাখ্যানের চেতনা, যা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার চেয়ে অনেক গভীরতলের :-
    ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
    শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজয় এনেছি এদেশে
    তথাকথিত অশ্লীলতা নেই, কিন্তু আছে নোকরশাহির চেতনা,
    আছে ভাষার প্রতিষ্ঠানকে ভাঙার ‘মুখচোরা’ সংকল্প ।
    হাতের কাছেই রয়েছে মলয়ের উপন্যাস ‘নামগন্ধ’ । প্রকাশিত ১৯৯৯ সালে । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রাতিষ্ঠানিক স্হিতাবস্হার মূল্যবোধের বিরুদ্ধের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস । স্হিতাবস্হা ও ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার মূল্যবোধের এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বোঝা যায় মলয় রায়চৌধুরী এখন কোথায় দাঁড়িয়ে ।
    “ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়ায়, গলির তলপেটের ঘিঞ্জি গলির ছমছমে অজানায়
    হনহনিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বড়ো রাস্তায় পৌঁছোবার পথ খুঁজে পায় না ওরা,
    আদিত্য আর অরিন্দম, খুঁজে পায় না শহরের নির্লিপ্ত নাগরিকতায় গিয়ে মিশে
    যাবার দরোজাটাকে । টাকরা শুকিয়ে গেছে অনভ্যস্ত অরিন্দমের । পা চালানোর
    ফাঁকে ফাঁকে ডানদিকে, এস.কে.চ্যাটার্জি লেন লেখা রাস্তাটায়, গোটা তিরিশেক
    লোকের মাথা-গিজগিজে ভিড়, চলছে ঝাড়পিটের তুমুল।”
    একটি খুনের পটভূমিতে এই ভাষা বাঙময়, স্হিতাবস্হাকে টলিয়ে দেয় :
    ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়া, এই সময়ের রাজনীতির ছবি হয়ে ওঠে ।
    ‘গলির তলপেট’ চিত্রকল্পটি ছমছমে, হনহনিয়ে শব্দ অর্থময় ; ‘চলছে ঝাড়পিটের তুমুল’ -- প্রায় কবিতার মতো ভাষা ধরিয়ে দেয় বাস্তবকে । মলয় শুরু করেন ওই রাস্তায় হত্যা ও উঁচু চাকরি-করা অরিন্দম ও পুলিশে চাকরি-করা আদিত্যকে দিয়ে, যাকে ‘ক্রনোটপ’ বলে, সেদিক থেকেও এই রাস্তা তাৎপর্যপূর্ণ । ‘নামগন্ধ’ গত কয়েক দশকের এই বঙ্গের সার্বিক চরিত্রহীন হয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত । এ বৃত্তান্তে অরিন্দম ও যিশু বিশ্বাস দুটি দিক । এই চরিত্রহীনতার মধ্যে এর সাক্ষী হয়েও তারা স্হিতাবস্হার বাইরে যেতে চেয়েছিল দুই নারীকে নিয়ে । বস্তুত ওই দুটি নারী মধ্যবিত্ত ও সামাজিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে যেন চিত্রকল্প । মধ্য চল্লিশের যিশু বিশ্বাস পঞ্চাশ বছরের খুশিদিকে নিয়ে চলে আসতে
    চেয়েছিল । খুশি তার ‘দাদা’ ভবেশ মণ্ডলের হাতে যেন বন্দিনী । ভবেশ মণ্ডল পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত সময়ের যেন বিবর্তনের প্রতিমূর্তি । বিদ্রোহ, অভ্যূথ্থানকারী ভবেশের পরিণতি তো এই সময়ের সাম্যবাদী দলেরই পরিণতি । এই পরিণতিতে খুশি বন্দী হয়ে যায় । যিশু যেন ওই বন্দিনীকে উদ্ধার করতে চায় । দীঘদিন পরে উধাও হয়ে যাওয়া ভবেশকাকে যিশু আবিষ্কার করে । পালটে যাওয়া ভবেশকাকা । আর তার হাতে বন্দি সেই খুশিদি, যে হয়তো শেষ বাঙালিনী । যিশু এই খুশির শরীরেই বাঁচতে চায়, এ কোনও শারীরিক টান নয়, এ যেন এক ঐতিহাসিক বাঁচবার আবেগ -- ভবেশকাকাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে । যিশুর হাত ধরে পাঠক পৌঁছে যায় এখনকার গ্রামীণ বাস্তবে --- আলু চাষ, হিমঘর, কিছুটা তাঁত, এসবের রাজনীতি-অর্থনীতিতে ধরা পড়ে এই সময়।
    আদিত্য নামক পুলিশ কর্মচারীর সূত্রে এই সময়ের শাসন, আমলা, এই বাস্তবের স্তরটি আসে । আদিত্যর ব্যক্তিগত বৃত্তান্তও দেখায় সময়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে । অন্য দিকে প্রমে পড়ার বাতিকগ্রস্ত উচ্চপদের অরিন্দম মধ্যবিত্ত পচনকে সরাসরিভাবে দেখায় । এই পচনের নানাছবির মধ্যে শেওড়াফুলিতে পিসিমার বাড়ির যে-ছবি আঁকা হয়, তাতে এই শ্রেনির পচে যাওয়ার কদর্য রূপ প্রকট হয়ে ওঠে ।
    “স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বড়ো বউদি, এমেবিয়েড, হাতে টলমলে গেলাস, ফর্সা,
    ভারিক্কি গতরকে একত্রিত করে পাছ-ঘেঁষটে উঠে বসে আর বাঁহাতে অরিন্দমের
    গলা আঁকড়ে, নিজের কানা ভরা গেলাস দাঁতে দাঁত অরিন্দমের ঠোঁটের ওপর উলটে দিলে ।
    খাবিনে মানে, তোর গুষ্টি খাবে, জানিস আজ আমার জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী ।
    বিশাল বুকের মধ্যে অরিন্দমের মাথা ঠাশা ।”
    তারপর শুরু হয় অশ্লীল গল্প বলার পর্ব । লেখকের মন্তব্য :
    ‘আমরা সবাই মিথ্যাগ্রস্ত মাতাল। বাঙালি মধ্যবিত্তের এ এক অদ্ভুত যাযাবর হামাগুড়ি।’ এই হামাগুড়ির প্রাক ইতিহাসও বলা হয় : এখন নোংরা নোংরা মোদো চুটকিতে মধ্যবিত্তের খোঁয়ারি উঠছে । অধ্যাপিকা ছুটকিও মাতাল, কোকা-কোলার সঙ্গে রাম ভালোবাসে । অরিন্দমের কোলে পা, অরিন্দম আলতা পরায় । সমগ্র মধ্যবিত্ত ল্যাংটো হয়ে যায় বিবরণে ।
    ‘নামগন্ধ’ এই বিবিধ পচনের প্রতিবাদ -- যিশুর খুশিদি আর অরিন্দমের কেটলিউলি সেই প্রতিবাদের, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের, গত চার-পাঁচ দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নারী । এরা মধ্যবিত্ত সীমার বাইরের । দু-জন এদের মধ্যেই মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠানেরই মূল্যবোধের কারাগার ভাঙতে চেয়েছিল । এই দুই নারীকে অবলম্বন করে এরা পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল তাদের শ্রেনিকে, ওই ভবেশকাকা তথা এই সমাজের ক্রিয়াকে । ওই শেওড়াফুলিতে প্রতিবিম্বিত
    মধ্যবিত্ত বাস্তবকে । কিন্তু পারল না । আকস্মিক দুর্ঘটনায় রিন্দম-কেটলিউলি আর ডাকাত-ডাকাত চিৎকারে যিশু বিশ্বাসের মৃত্যু হয় । আপাত আকস্মিক এই ঘটনা দুটি এই সময়ের গর্ভে স্বাভাবিক । যেমন স্বাভাবিক উপন্যাসের শুরুর হত্যাটি । আর শেষে আরেক ইতিহাসের স্তর আবিষ্কৃত । খুশি ভবেশ কাকার বোন নয় । যিশুর মৃত্যুর সময় একটা পুরোনো হলদে কাগজের পাতা উড়তে থাকে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের খবরের কাগজ । এক নাতনির হারিয়ে যাবার বিজ্ঞাপন, দিয়েছেন দাদু মিনহাজুদ্দিন । মেয়েটির নাম খুশবু । ডাক নাম খুশি । ভয়ংকর শব্দে ইতিহাস ফেটে পড়ে -- ইতিহাসের গন্ধ, ‘নামগন্ধ’ ছড়ায় --
    খুশি, পঞ্চাশ বছরের খুশি হয়ে ওঠে অর্ধশতাব্দীর সময়, ইতিহাস, আবেগ, শরীর । তাকে আমরা পাই না -- সময়ের আকস্মিক মোচড় হত্যা করে নানাভাবে । প্রতিষ্ঠান খেয়ে ফেলে তাদের । আর এর বিরুদ্ধে কবি মলয় রায়চৌধুরী দাঁড়ান এই গদ্যেই । কী অনবদ্য কবিতা উঠে আসে যিশুর আবিষ্কারে :-
    “খালি পায়ে, বাগানের ঘাসপথ বেয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়ায় যিশু । আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বাতাস । বাতাসের ডাঁটো স্ট্যাচু যেন । সব স্হির । ডানপাড়ের বিশাল গাছে তেঁতুলপাতাও কাঁপছে না । বাঁধানো ঘাটে বয়ঃসন্ধির বালিকার মতন একধাপ ওপরে তো একধাপ নীচে খেলা করবার পর ক্লান্ত হয়ে গেছে টলমলে পুকুর।”
    কিংবা :-
    “জনশ্রুতির মতন বাতাস বইছে।...মদগর্বিত ষাঁড়। মদিরেক্ষণা মৌমাছি ।
    ভিজে চিলের মতন ডানা ঝুলিয়ে রয়েছে ঝিমন্ত কলাগাছগুলোর ছেঁড়া পাতা।
    কঞ্জুস হাওয়ার তাপে বাবলাগাছগুলোর গায়ে কাঁটা দিয়েছে । পথিপার্শ্বে উইপোকাদের বিজয়স্তম্ভ । মার্জিত চেহারার খেজুর গাছ, গলায় খেজুর ছড়ার মালা।”
    অথবা :-
    “চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে কালবৈশাখির ছেতরানো মেঘে, কিন্তু পূর্ণিমার আগাম আভায় নির্জন বধির অন্ধকারকে মনে হয় হাস্যোজ্বল । নিরলস সাধনায় মগ্ন স্হির সন্ধ্যাবাতাস আচমকা হাওয়ার জন্য অপেক্ষমান । নেশাগ্রস্তের মতন মাথা ঝুঁকিয়ে আছে গাছগুলো । বুনো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে সিসলকাঁটার গুড়িসুড়ি ঝোপ।”
    এই উদ্ধৃতিগুলিতে, উপমা-চিত্রকল্পে, ভাষার স্বাতন্ত্র্যে, যে-কবিতাময়তা, তাতে থাকে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে আক্রমণ, অথবা নতুন স্হিতিস্হাপকতা গড়া । খুশি ও কেটলিউলি হিন্দু অরিন্দম আর খ্রিস্টান যিশুর, মধ্যবিত্তের বাঁচবার পথ, কেটলিউলি-মেয়েটার শরীর জুড়ে প্রাচীন নিষাদকুলের নাচ লুকিয়ে আছে যেন । এর চাউনি রৌদ্রোজ্জ্বল । চিরপ্রদোষ-মাখা শ্যামাঙ্গিনী । আর খুশিদিকে দেখে যিশুর মনে হয়, চাষি মেয়ের শ্রমসোহাগী পেশল বাহু ঝুলে আছে । ওই প্রাচীন নিষাদকুল, ওই শ্যামলিনী, চাষি মেয়ের পেশল বাহুই আমাদের প্রতিষ্ঠানের, কবন্ধ মূল্যবোধের বাইরে আনতে পারে । এ সম্ভাবনার দরোজা কি খুলবে ? মলয় রায়চৌধুরীর এ-প্রশ্নকেই রেখে দেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্য এখানেই । মলয় এভাবেই ষাটের দশক থেকে পালটেছেন -- যেতে চাইছেন সময়ের গভীরে, তার নাভিকেন্দ্রে ।
     
     
     

     

  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:২১735085
  • পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্য
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রধান দৃষ্টিকোণ ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার । আর সেই সঙ্গে মলয় ‘সাহিত্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । মলয় রায়চৌধুরী মনে করেন, ‘প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান কোনো অরগানাইজেশান নয় । তা চাগিয়ে ওঠে শাসনের মূল্যবোধ থেকে । মলয় আরও বলেছেন, এই ইনট্রিনজিক ফ্যাসিজমই এসট্যাবলিশমেন্ট ।’ সব মিলিয়ে এটাই দাঁড়ায়, , মলয়ের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতা । আর প্রতিষ্ঠান মানে শাসকের, শাসনের মূল্যবোধ । মলয় প্রতিষ্ঠান বলতে কোনও দল, আমলাতন্ত্র, চার্চ-মসজিদ, হিন্দুধর্মকেন্দ্র, শিক্ষাব্যবস্হা ইত্যাদিকে পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করেন না ; করেন মূল্যবোধকে । শাসনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমাজ ও জনসমাজ যে-মূল্যবোধ, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে দমননীতি-সম্মতির বিভিন্ন হাতিয়ারকে ব্যবহার করে, তাকেই মলয় প্রতিষ্ঠান ভাবেন, এবং তা একটি প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে তার কর্ষিকাগুলি ছড়িয়ে দেয় । রাষ্ট্র থাকলে যেমন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থাকবে, সমাজ -- সে রাষ্ট্রীয় বা জন যাই হোক, থাকলেই প্রতিষ্ঠান থাকবে । আর প্রতিষ্ঠান থাকলেই তার কর্তৃত্ব থাকবে , যে-সমাজে প্রতিষ্ঠানটি শিকড় গাড়ে, শাঁসে-জলে বাড়ে, তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য হিংস্র ও অহিংস্র নানা উপায় সে অবলম্বন করে । এর বিরুদ্ধে লড়াই তাই মূল্যবোধের, চৈতন্যের । আর এ লড়াই সার্বিক ; ব্যক্তিগত ও বৃহত্তর মাত্রা উভয় স্তরেই ।
    মলয়ের জীবনকাহিনির যেটুকু অংশ তাঁর লেখাতেই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এই লড়াইয়ের একটা ছবি পাই । অবশ্য এ বৃত্তান্ত পরবর্তী সময়ের, ১৯৬১-১৯৬৫-এর মধ্যে তিনি তরতাজা যুবক হিসাবে কী ভাবতেন, তা জানা যায় না । সেই সময়ের দিনপঞ্জিকাটি থাকলে আরও বোঝা যেত । কারণ ওই যে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া, একটি মূল্যবোধ, তাতেই স্পষ্ট ১৯৬১-৬৫-এর মলয় রায়চৌধুরী আর ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মলয় রায়চৌধুরী যেমন এক নন, তেমনি সেই সময়ের প্রতিষ্ঠান আর এখনকার প্রতিষ্ঠান, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে হুবহু এক নয় ।
    ১৯৬৫ থেকে ২০০০-এর মধ্যে এখানে সময় খুব দ্রুত এগিয়েছে-পিছিয়েছে, একটা অপরিবর্তনীয় গতিতত্বে যেন নানা ওলটপালটের মধ্যে আবার আগের স্হিতাবস্হায় ফিরে গেছে, কিন্তু আরও চরিত্রহীন, আরও নপুংসক হয়ে । আমরা যারা মলয়ের সমবয়সী প্রায়, তাদের কাছে ১৯৬১-১৯৬৫-এর মলয়ের নৈরাজ্যিক প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, ওই সময়ে নঞর্থক মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল সামাজিক দায়হীন । কিন্তু আজকের অবসন্নতায় ওই
    বিদ্রোহকে সদর্থক মনে হয় । বিশেষ সময়ে অ্যানার্কিও তো সদর্থক বৈপ্লবিক হতে পারে ।
    মলয় রায়চৌথুরীর ১৯৬০র দশকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ও তারপরে নীরব থেকে ১৯৮০র দশকে অন্যভাবে দেখা দেওয়া, আমাদের মধ্যবিত্ত বিদ্রোহের এক প্রতীকি চিত্র । সেই ১৮২০-৩০এর দশকের ডিরোজিয়ানদের সময় থেকেই এই পরম্পরা আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেনিতে আছে । ওই বিদ্রোহটাও যেমন সত্যি আবার প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যাওয়াও তেমনি সত্যি । উপনিবেশ ও ১৯৪৭-এর পরের অব-উপনিবেশের বাস্তবে ক্রিয়াশীল উৎপাদন সম্পর্কশূন্য বৃহত্তর জনসমাজ ও জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত এই বিদ্রোহ , এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে তুচ্ছ করা অনৈতিহাসিক, কারণ মধ্যশ্রেনির ইতিহাসের নিরন্ধ্র অবসন্নতা ও করুণ আত্মসমর্পণে, ট্র্যাজেডি নয় ফার্সে,
    এই ক্ষণস্ফূলিঙ্গগুলিই একমাত্র বাঁচবার ইঙ্গিত । এদের ব্যক্তিক ও গোষ্ঠীগত ব্যর্থতা প্রায় অনিবার্যই ছিল । তবু, তারা যে কম্পন নিয়ে এসেছে, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে হয় ।
    মলয় রায়চৌধুরীর নিজের সাক্ষেই বোঝা যায়, একটা টানবাপোড়েন গোড়া থেকেই ছিল । মলয় দেখাতে চেয়েছেন তিনি প্রায় স্কুলে পড়াশুনা ন-করার ভূমি থেকে এসেছেন । তাঁর দাদা সমীরই তাঁদের বাড়ির প্রথম স্কুলে-পড়া, কলেজে-পড়া । অর্থাৎ যে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় বাঙালি মধ্যবিত্ত জারিত, তার শেকড় তাঁদের পরিবারে ছড়ায়নি, তাঁর প্রজন্মেই এর সূত্রপাত । কিন্তু ওই প্রথম প্রজন্মেই এই শিক্ষার ধার তীক্ষ্ণ হয় ; ‘এদিকে মলয় আমার ছোটোভাই তখন অর্থনীতির স্নাতকোত্তর ক্লাসের শেষ বছরের ছাত্র । সারাদিন ঘাড় গুঁজে বিস্তর বই পড়ে ; সমাজ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে অনেক ভাবনা,
    কথায়-কথায় এঙ্গেলস, কিয়ের্কেগার্দ, মার্কস, স্পেঙ্গলার ইত্যাদি থেকে উদ্ধৃতি দেয় । পাটনায় গেলে আমাকে কেবলই বলে, “সাহিত্য এইভাবে এলোমেলো হয় না ; একটা পরিকল্পনা মতো এগোনো উচিত । কী বলতে চাও, করতে চাও, সবার আগে সেটা ঠিক করো, আন্দোলন চালাও । আন্দোলন দরকার।”...’
    সমীরের এই ছবিতে কোনও নৈরাজ্যবাদী মলয়কে পাই না । বরঞ্চ ইয়োরোপমুখী এক যুবককে, যে পরিকল্পনা চায় । এই যুবক অব-উপনিবেশের যুদ্ধ-দাঙ্গে-দুর্ভিক্ষ-দেশভাগ ধর্ষিত কলকাতায় এসে পালটায়, কলকাতা তাঁকে পালটায় । তাঁর অ-নাগরিক অভ্যাস কলকাতায় বেমানান -- কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত অ-নাগরিক অভ্যাসকে তিনি প্রলেতারিয় ভাবছিলেন । নিজেকে শ্রেনিচ্যূত করতে চাইছিলেন । আর এই জন্যই একটা জীবনযাপন বেছে নিয়েছিলেন যা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পক্ষে দুঃসহনীয় । ঠিক যেমন একদা ডিরোজিয়ানরা বেছেছিলেন -- তখন মদ্যপান, গোমাংসভক্ষণ ছিল হিন্দু ভদ্রলোকের পক্ষে ক্রোধের কারণ, যদিও অনেক ভদ্রলোকই আড়ালে মদ্যপায়ী, বেশ্যাগমনে অভ্যস্ত । । কিন্তু ডিরোজিয়ানরা এসব করছিলেন প্রকাশ্যে, একটা বিদ্রোহের আদলে। মলয় নিজেদের অবস্হাকে বলেছেন ‘ষাট দশকীয় ফাটিচার’ । কলকাতার সাহিত্য মহলে আর্টেমিস-ক্রেসিডা-ইউলিসিস এসব নামে অস্বস্তিবোধ করতেন তিনি, কিন্তু “আমাদের মগজে রেজিস দেবরে, আরনেসতো চে ভারা, ফিদেল কাসত্রো নামগুলো বরঞ্চ মিহিন ঘণ্টাধ্বনি শোনাচ্ছে ।”
    এঁরাও সকলেই বিদেশের -- তবে অন্য ভূবনের । ষাট দশকের কলকাতার বিপরীত টানেই পাটনার সিরিয়াস যুবক মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রতিষ্ঠাবিরোধিতার নৈরাজ্যিক আকাশে মুক্তি চাইলেন । এই কলকাতাই তাঁকে বুঝিয়েছিল, ‘ষাটের দশকে সুস্হতা সত্যিই অবাস্তব ছিল।’ মলয়ের এই সিদ্ধান্ত ইতিহাস-বোধে উজ্বল। ষাটের দশকে যে সুস্হভাবে বাঁচা অবাস্তব ছিল, তার প্রমাণ সেই দশক জুড়ে নানা ধরনের বিদ্রোহ যার শীর্ষবিন্দু নকশাল অভ্যূথ্থান । মলয়দের আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনের একদিকের পূর্বাভাস । তিনি দেবরে, গ্বেভারা, কাসত্রোর কথা বলেছেন, তাতে বোঝা যায় তাঁর অন্তরে তিনি, ব্যক্তিগত নানা ট্যাবু ভাঙার মধ্যেই, একটা রাজনৈতিক বীক্ষা বহন করতেন । ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ নামে বইও লিখেছিলেন । এই বীক্ষা তাঁর বিদ্রোহে সেইভাবে উপরিস্তরে আসেনি, কিন্তু অনেক হাংরি যে পরে নকশাল হয়েছিল, তার কারণ কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত কারাগার ভেঙে ফেলার আগ্রহ । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, তিনিও গুণ্ডা-মাস্তান হয়ে যেতেন, কবিতা না-লিখলে । নিজেকে কবিতা লেখার ক্রিমিনাল বলেও অভিহিত করেছেন । আর এক -এক করে সেই কবিদের নাম করেছেন যাঁদের জেলে বা জেলের বাইরে খুন করা হয় । মলয় নকশাল প্রসঙ্গ আনেন তাঁর ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইতে । ঠিকই করেন । মলয়ের বিদ্রোহ ছিল দক্ষিণ ও বাম দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই -- অন্তত মলয় তাঁর পঠন-পাঠন থেকে, বুদ্ধিগত জগৎ জগৎ কোনও সময়েই রাজনৈতিক বীক্ষার অন্তঃসলিলা স্রোতকে ফেলে দিতে পারেননি । জীবনযাপনের নৈরাজ্যের মধ্যেই একটা বুদ্ধিগত, মননগত স্তর তাঁর থেকেই গিয়েছিল । কবিতা ও সাহিত্যকে কেন্দ্রবিন্দু রাখায় ব্যক্তিক জীবনযাপনের তীব্র নেশাগ্রস্ত নৈরাজ্যই তাঁর কাছে বিদ্রোহের মূল ধরণ হয়ে ওঠে ।
    এটাকে মেলাতে চান কবিতায় । কিন্তু হাংরি প্রজন্মের সাহিত্যগত কীর্তি কবিতায় নয়, গদ্যে । ওই কিংবদন্তি, ওই ছাপ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের মূল্যায়ন করলে, গদ্যই থাকবে ; অন্তত আমার মতো পাঠকের কাছে, যার চিন্তাভাবনাকে, নকশাল অভ্যূথ্থান, ব্যর্থ হলেও ওলোটপালট করে দিয়েছিল। ওই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা অবশ্যই স্পষ্ট, তবুও । তেমনি ষাটের দশকে একদল যুবকের ব্যক্তিক জীবনের নিরুদ্দেশযাত্রী হওয়ার তাৎপর্য এখন ধরা পড়ে । এই নিরুদ্দেশযাত্রার মূল্য অবশ্যই তাদের দিতে হয়েছে । তবে যেহেতু নকশাল বিদ্রোহ রাষ্ট্রকে খানিকটা ভীত করে তুলেছিল, তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জনসমাজের সমর্থনে এ-বিদ্রোহের ওপর ভয়াবহভাবে নেমে আসে । ওই বাস্তব অসহ্য-লাগা যুবকদের হত্যা করে, অনেককেই সারা জীবনের মতো পঙ্গু করে দেয় । এই বঙ্গে এ-আন্দোলন নির্মমভাবে দমিত হলেও, ওই প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটা প্রশ্ন, সংশয় ও আন্দোলন রেখে গেছে । তার আগের মলয়দের হাংরি আন্দোলন জেল-মামলাতেই শেষ হয় । মলয়ও সেই নকশালদের মতো, যাঁরা শেষ পর্যন্ত এই সমাজে, প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে আত্মস্হ হয়ে যান ; এমনকি ওই অতীতকে কাজে লাগিয়ে, পুঁজি করেন । এ সত্ত্বেও মলয় রায়চৌধুরীর ষাটের দশকের বিদ্রোহ মিথ্যা হয়ে যায় না,
    অন্তত তিনি তাকে তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের মতো ( সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ ) প্রকাশ্যে পুঁজিও করেননি । এ-প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানবিরোধি বিদ্রোহ যে পুলিশ-আদালত-জেল-মামলার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি কিন্তু প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপেই হয় । তাঁর বন্ধুরা তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য ও মুচলেকা দিয়ে মুক্তিলাভ করেন । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, “লালবাজারে পুলিশ কমিশনার বললেন, তিনি আমাকে সাব ইন্সপেক্টরের চাকরি দিতে চান, কারণ সাজা হবার ফলে ( দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড ) আর কোথাও চাকরি হওয়া মুশকিল । পরে জেনেছি অ্যালেন গিন্সবার্গ পুপুল জয়াকরকে চিঠি লেখার পর জয়াকর তা ইন্দিরা গান্ধিকে জানান ; দিল্লির নির্দেশে কলকাতার বাঙালি পুলিশ তখন ফাঁপরে।” মলয় রায়চৌধুরীর পাশে এসে দিল্লির প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছিল, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক স্তরভেদ আছে । আর লক্ষণীয় গিন্সবার্গের ভূমিকা । তিনি কিন্তু ‘কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রীডাম’-এর পাণ্ডাদের
    সাহায্য চেয়েছিলেন -- আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রত্যাখ্যান করেন এ সাহায্যের আবেদন । প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের নেতার এরকম আশ্রয় থেকে বোঝা যায় মলয়দের নিয়ে এসট্যাবলিশমেন্ট খেলছিল । নকশাল-আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে এই বঙ্গেও ওই খেলা নানাভাবে দেখা যায় । তার আগে সন্ত্রস্ত প্রতিষ্ঠান তাদের একের পর এক হত্যা করেছে -- আর সেই হত্যার এ-বঙ্গের প্রতিষ্ঠানের নায়করা পরবর্তী বাম-রাজত্বে থেকেছেন ; শুধু তা-ই নয়, উন্নতি করেছেন । যেমন, যে সোমেন চন্দকে নিয়ে আজ বামপন্হী মহল উচ্ছ্বসিত, যাঁর হত্যার বিরুদ্ধে ধিক্কার বারবার উচ্চারিত, তাঁর হত্যার ‘প্রকৃত ঘটনা হল এই যে, সোমেন চন্দ রেলওয়ে শ্রমিকদের নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে শুধু ফ্যাসিবিরোধী
    সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন । ঢাকার নারিন্দাপুল পার হয়ে বটগাছের কাছেই আর. এস. পির ঘাতকবাহিনী ঘিরে ফ্যালে সোমেন চন্দকে । তারপর নির্মমভাবে হত্যা করে।’ এই আর.এস.পি এখন বামফ্রণ্টের শরিক ও মন্ত্রী । এরাই ফ্যাসিস্ট বাহিনীর মদতদাতা ছিল । প্রতিষ্ঠান কতো খেলাই খেলে, কতো রঙই বদলায় ।
    মলয় রায়চৌধুরীও ওই খেলার পুতুল হয়ে ছিলেন । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় তিনি মামলা-আদালত জেল-জরিমানার যে ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন, প্রতিষ্ঠানই তার থেকে তাঁকে বাইরে নিয়ে আসে ।
    অবশ্য মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে এসব কথা এখন অবান্তর। কারণ তাঁর সম্পর্কে এখন আমি যে লিখছি তা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বা আদালত-মামলা জেল-জরিমানার বৃত্তান্তের জন্য নয় । মলয় নামক একজন কবি ও ঔপন্যাসিকই আমার আগ্রহের মূলে । তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্যই এই সূত্রে বিবেচ্য । এক একজন পাঠক এক একজন লেখক ও আন্দোলনকে নিজের নিজের মতন করে দেখেন । আমার কাছে শুধু মলয়ই নয়, গোটা হাংরি জেনারেশনের লেখকদেরই গদ্য যতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, কবিতাকে তেমন মনে হয়নি । যে-কোনও কারণেই হোক, কবিরা, বোধহয় ইয়োরোপ আমেরিকা কবিদের জীবনকাহিনি শুনে পঞ্চাশের দশক থেকে ব্যক্তিজীবনের হুল্লোড় ও নানারকম কাজ কারবারকে গুরুত্ব দিতে থাকেন, ফল হয় কবিতার অধঃপতন যা এখনও চলছে । মলয়ও তাই করেছিলেন । কিন্তু গদ্যে একেবারে বিপরীত ।
    হাংরি আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে মলয় লিখেছেন, ‘স্হিতাবস্হা ভাঙার ভাষাই নয় কেবল, ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার চেষ্টাই চালিয়েছেন ।’ গদ্যে এটাই প্রকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
    বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালার’ নামও করতে পারি । কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এটা আদৌ হয়নি। ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার কোনও লক্ষণই নেই । আর যেহেতু জীবনযাপন কবিতাকে চিৎ করে ফেলছিল, সেহেতু ওই জীবনযাপনের তাৎক্ষণিক অনুভূতি কবিতায় এমনভাবে অন্তত মলয়ের কবিতায় আসতে চাইছিল, যাতে কবিতার থেকে ওই অনুভূতিই বড়ো হয়ে ওঠে । জীবন কবিতাকে খেয়ে ফেললে মুশকিল, জীবনের ক্ষুধাকে কবিতার রসায়নে দাঁড়াতে হয় । আজ এই ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ভাবতে অবাক লাগে মলয়ের বেশ কাঁচা কবিতা
    ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ অতো হৈ-চৈ, অতো শিরঃপীড়ার কারণ কেন হয়েছিল । একেবারে মধ্যবিত্ত ভাষা জর্জরিত মধ্যবিত্ত কবিতা এটি :-
    “অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা
    যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা
    আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
    আমি বুঝতে পারছি না কি জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
    শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
    কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
    শুভা আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও
    দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
    বেসামাল হৃদয়বেত্তার স্বর্ণসবুজে”
    যে-নিম্নবর্গীয় ভাষার আক্রমণে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে বিপন্ন করার ভাবনা মলয়ের, এই উদ্ধৃতিতে তার কি কোনও চিহ্ণ আছে ? যোনি, স্তন, বীর্য -এসবই সংস্কৃত শব্দ । এদের নিম্নবর্গীয় শব্দ মলয় ব্যবহার করেননি । এসব শব্দ এলিট পরম্পরায় বহু ব্যহৃত । আর ‘অশ্লীল’ এই ধারণাটির স্হান-কাল-পাত্র আছে । এখন আর তথাকথিত অশ্লীল দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ঘুম কাড়া যায় না, কারণ সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানই তো অশ্লীল --- অশ্লীল অর্থনীতি, অশ্লীল রাজনীতি, অশ্লীল সমাজ, রাস্তায় ঘাটে একেবারে মধ্যবিত্ত ছোকরাই দু-তিন-চার অক্ষরের শব্দ প্রকাশ্যে বলে । নিম্নবর্গীয়দের অশ্লীল শব্দের যে পেশলতা, যে চিত্রকল্প, যে জোর, তা এই অশ্লীলতায় নেই -- মলয়ের কবিতায় ‘পাজামায় শুকিয়ে যাওয়া বীর্যের’ মতোই সৃষ্টিহীন, অসুস্হ । আসলে ষাটের দশকে মলয় রায়চৌধুরী এক ধরনের আরোপিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় মেতেছিলেন, অথচ তাঁর চৈতন্যে গভীর বোধ ছিল । সেই বোধ জীবনযাপনের তীব্রতায় হারিয়ে যেতে থাকে । তাঁর মনে হয়, অশ্লীলতা বুঝি শুধু যৌনতাবাচক শুধু কতকগুলি শব্দ । এটা যে সামগ্রিক মূল্যবোধ-জনিত, আর প্রতিষ্ঠান যে অশ্লীল হয়ে উঠেছে সব দিক দিয়ে, বাইরের পোশাকের আড়ালে অশ্লীল, সেটা হয়তো বুঝতে পারেননি । ১৯৬৫ সালের পর মলয় এর থেকে বেরিয়ে আসেন ।
    মলয় তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রত্যাখ্যানের যথার্ধ পরিচয় রাখেন তখন, যখন তিনি ওই ষাটের দশকের জীবনযাপনের গণ্ডি থেকে সরে এসেছেন, আপাতদৃষ্টিতে যেন প্রচলিত মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্যে এসেছেন । ‘তারপর দেড় দশক আমার লেখালিখি ছেড়ে যায় । জীবন কাটানোর ভাবনায় বন্ধুবান্ধবে আত্মপ্রকাশে আর্থিক অবস্হায় এই দেড় দশকে আমূল পরবর্তন ঘটে যায় আমার মগজে ও শরীরে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাসে ।’ ‘এখন তো আমার সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় । এখন ভালো চাকরির পাতি-বুর্জোয়া আরামে প্রতিবাদ প্রতিরোধের লেখালিখি অনেক আরামদায়ক আর সহজ।’ ‘ক্রমশ একলা থাকার মধ্যেই নিজের আরাম আনন্দ
    শান্তি টের পাই ।’ অর্থাৎ এখন জীবনযাপন মলয়ের লেখাকে ছাপিয়ে যায় না ।
    প্রতিবাদ-প্রতিরোধের লেখাই তো ষাটের দশকে মলয় লিখতে চেয়েছিলেন, তাতে পুলিশ, আদালত, অশ্লীলতার অভিযোগ, জেল-জরিমানা, লকাপে রাতকাটানো । এখন সেটা অনেক আরামদায়ক ও সহজ । কেন ? তবে কি প্রতিষ্ঠান তার মূল্যবোধ পালটেছে ? নাকি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান, ও তাঁর সহযোগীরা ( এমনকি হাংরি আন্দোলনকারীরা ) খড়্গহস্ত হয়েছিল, লেখার জন্য নয়, জীবনযাপনের জন্য । তুলনা করছি না, ডিরোজিয়ানদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, তারাও ঔপনিবেশিক সরকারি উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন, এমনকি ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়নের অন্যতম উদ্যোক্তার জীবনীও তাঁরা পরবর্তীকালে লিখেছেন ।
    সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় -- এখানেও জীবনের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া । শিল্পের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া বোধহয় এটাই যে ওই জীবনযাপন থেকে সরে আসার পর, পাতি-বুর্জোয়া জীবনে লগ্ন হওয়ার মধ্যেই মলয় যথার্থ প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা লিখলেন । আমার মতে কবিতায় নয়, গদ্যে । মলয় তাঁর শেষ জীবনে এখনও কোনও সরকারি-বেসরকারি শক্তিকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হননি, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সে-অর্থে হাত মেলাননি । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আসলে একটা প্রত্যাখ্যান ( তিনি অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন ) ।
    আমাদের অব-ঔপনিবেশিক বাস্তবে এখন এই প্রত্যাখ্যান বিশেষ জরুরি । মলয়ও জানেন, কোনও সামূহিকের সঙ্গে মেলা যায় না ; একলা হওয়া অনিবার্য মলয় ওই নিঃসঙ্গ প্রত্যাখ্যানের স্বপ্নে এখনও স্হির । দেড় দশক পরে যে কবিতা লেখেন, তাতে ওই প্রত্যাখ্যানের চেতনা, যা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার চেয়ে অনেক গভীরতলের :-
    ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
    শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজয় এনেছি এদেশে
    তথাকথিত অশ্লীলতা নেই, কিন্তু আছে নোকরশাহির চেতনা,
    আছে ভাষার প্রতিষ্ঠানকে ভাঙার ‘মুখচোরা’ সংকল্প ।
    হাতের কাছেই রয়েছে মলয়ের উপন্যাস ‘নামগন্ধ’ । প্রকাশিত ১৯৯৯ সালে । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রাতিষ্ঠানিক স্হিতাবস্হার মূল্যবোধের বিরুদ্ধের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস । স্হিতাবস্হা ও ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার মূল্যবোধের এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বোঝা যায় মলয় রায়চৌধুরী এখন কোথায় দাঁড়িয়ে ।
    “ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়ায়, গলির তলপেটের ঘিঞ্জি গলির ছমছমে অজানায়
    হনহনিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বড়ো রাস্তায় পৌঁছোবার পথ খুঁজে পায় না ওরা,
    আদিত্য আর অরিন্দম, খুঁজে পায় না শহরের নির্লিপ্ত নাগরিকতায় গিয়ে মিশে
    যাবার দরোজাটাকে । টাকরা শুকিয়ে গেছে অনভ্যস্ত অরিন্দমের । পা চালানোর
    ফাঁকে ফাঁকে ডানদিকে, এস.কে.চ্যাটার্জি লেন লেখা রাস্তাটায়, গোটা তিরিশেক
    লোকের মাথা-গিজগিজে ভিড়, চলছে ঝাড়পিটের তুমুল।”
    একটি খুনের পটভূমিতে এই ভাষা বাঙময়, স্হিতাবস্হাকে টলিয়ে দেয় :
    ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়া, এই সময়ের রাজনীতির ছবি হয়ে ওঠে ।
    ‘গলির তলপেট’ চিত্রকল্পটি ছমছমে, হনহনিয়ে শব্দ অর্থময় ; ‘চলছে ঝাড়পিটের তুমুল’ -- প্রায় কবিতার মতো ভাষা ধরিয়ে দেয় বাস্তবকে । মলয় শুরু করেন ওই রাস্তায় হত্যা ও উঁচু চাকরি-করা অরিন্দম ও পুলিশে চাকরি-করা আদিত্যকে দিয়ে, যাকে ‘ক্রনোটপ’ বলে, সেদিক থেকেও এই রাস্তা তাৎপর্যপূর্ণ । ‘নামগন্ধ’ গত কয়েক দশকের এই বঙ্গের সার্বিক চরিত্রহীন হয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত । এ বৃত্তান্তে অরিন্দম ও যিশু বিশ্বাস দুটি দিক । এই চরিত্রহীনতার মধ্যে এর সাক্ষী হয়েও তারা স্হিতাবস্হার বাইরে যেতে চেয়েছিল দুই নারীকে নিয়ে । বস্তুত ওই দুটি নারী মধ্যবিত্ত ও সামাজিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে যেন চিত্রকল্প । মধ্য চল্লিশের যিশু বিশ্বাস পঞ্চাশ বছরের খুশিদিকে নিয়ে চলে আসতে
    চেয়েছিল । খুশি তার ‘দাদা’ ভবেশ মণ্ডলের হাতে যেন বন্দিনী । ভবেশ মণ্ডল পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত সময়ের যেন বিবর্তনের প্রতিমূর্তি । বিদ্রোহ, অভ্যূথ্থানকারী ভবেশের পরিণতি তো এই সময়ের সাম্যবাদী দলেরই পরিণতি । এই পরিণতিতে খুশি বন্দী হয়ে যায় । যিশু যেন ওই বন্দিনীকে উদ্ধার করতে চায় । দীঘদিন পরে উধাও হয়ে যাওয়া ভবেশকাকে যিশু আবিষ্কার করে । পালটে যাওয়া ভবেশকাকা । আর তার হাতে বন্দি সেই খুশিদি, যে হয়তো শেষ বাঙালিনী । যিশু এই খুশির শরীরেই বাঁচতে চায়, এ কোনও শারীরিক টান নয়, এ যেন এক ঐতিহাসিক বাঁচবার আবেগ -- ভবেশকাকাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে । যিশুর হাত ধরে পাঠক পৌঁছে যায় এখনকার গ্রামীণ বাস্তবে --- আলু চাষ, হিমঘর, কিছুটা তাঁত, এসবের রাজনীতি-অর্থনীতিতে ধরা পড়ে এই সময়।
    আদিত্য নামক পুলিশ কর্মচারীর সূত্রে এই সময়ের শাসন, আমলা, এই বাস্তবের স্তরটি আসে । আদিত্যর ব্যক্তিগত বৃত্তান্তও দেখায় সময়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে । অন্য দিকে প্রমে পড়ার বাতিকগ্রস্ত উচ্চপদের অরিন্দম মধ্যবিত্ত পচনকে সরাসরিভাবে দেখায় । এই পচনের নানাছবির মধ্যে শেওড়াফুলিতে পিসিমার বাড়ির যে-ছবি আঁকা হয়, তাতে এই শ্রেনির পচে যাওয়ার কদর্য রূপ প্রকট হয়ে ওঠে ।
    “স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বড়ো বউদি, এমেবিয়েড, হাতে টলমলে গেলাস, ফর্সা,
    ভারিক্কি গতরকে একত্রিত করে পাছ-ঘেঁষটে উঠে বসে আর বাঁহাতে অরিন্দমের
    গলা আঁকড়ে, নিজের কানা ভরা গেলাস দাঁতে দাঁত অরিন্দমের ঠোঁটের ওপর উলটে দিলে ।
    খাবিনে মানে, তোর গুষ্টি খাবে, জানিস আজ আমার জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী ।
    বিশাল বুকের মধ্যে অরিন্দমের মাথা ঠাশা ।”
    তারপর শুরু হয় অশ্লীল গল্প বলার পর্ব । লেখকের মন্তব্য :
    ‘আমরা সবাই মিথ্যাগ্রস্ত মাতাল। বাঙালি মধ্যবিত্তের এ এক অদ্ভুত যাযাবর হামাগুড়ি।’ এই হামাগুড়ির প্রাক ইতিহাসও বলা হয় : এখন নোংরা নোংরা মোদো চুটকিতে মধ্যবিত্তের খোঁয়ারি উঠছে । অধ্যাপিকা ছুটকিও মাতাল, কোকা-কোলার সঙ্গে রাম ভালোবাসে । অরিন্দমের কোলে পা, অরিন্দম আলতা পরায় । সমগ্র মধ্যবিত্ত ল্যাংটো হয়ে যায় বিবরণে ।
    ‘নামগন্ধ’ এই বিবিধ পচনের প্রতিবাদ -- যিশুর খুশিদি আর অরিন্দমের কেটলিউলি সেই প্রতিবাদের, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের, গত চার-পাঁচ দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নারী । এরা মধ্যবিত্ত সীমার বাইরের । দু-জন এদের মধ্যেই মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠানেরই মূল্যবোধের কারাগার ভাঙতে চেয়েছিল । এই দুই নারীকে অবলম্বন করে এরা পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল তাদের শ্রেনিকে, ওই ভবেশকাকা তথা এই সমাজের ক্রিয়াকে । ওই শেওড়াফুলিতে প্রতিবিম্বিত
    মধ্যবিত্ত বাস্তবকে । কিন্তু পারল না । আকস্মিক দুর্ঘটনায় রিন্দম-কেটলিউলি আর ডাকাত-ডাকাত চিৎকারে যিশু বিশ্বাসের মৃত্যু হয় । আপাত আকস্মিক এই ঘটনা দুটি এই সময়ের গর্ভে স্বাভাবিক । যেমন স্বাভাবিক উপন্যাসের শুরুর হত্যাটি । আর শেষে আরেক ইতিহাসের স্তর আবিষ্কৃত । খুশি ভবেশ কাকার বোন নয় । যিশুর মৃত্যুর সময় একটা পুরোনো হলদে কাগজের পাতা উড়তে থাকে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের খবরের কাগজ । এক নাতনির হারিয়ে যাবার বিজ্ঞাপন, দিয়েছেন দাদু মিনহাজুদ্দিন । মেয়েটির নাম খুশবু । ডাক নাম খুশি । ভয়ংকর শব্দে ইতিহাস ফেটে পড়ে -- ইতিহাসের গন্ধ, ‘নামগন্ধ’ ছড়ায় --
    খুশি, পঞ্চাশ বছরের খুশি হয়ে ওঠে অর্ধশতাব্দীর সময়, ইতিহাস, আবেগ, শরীর । তাকে আমরা পাই না -- সময়ের আকস্মিক মোচড় হত্যা করে নানাভাবে । প্রতিষ্ঠান খেয়ে ফেলে তাদের । আর এর বিরুদ্ধে কবি মলয় রায়চৌধুরী দাঁড়ান এই গদ্যেই । কী অনবদ্য কবিতা উঠে আসে যিশুর আবিষ্কারে :-
    “খালি পায়ে, বাগানের ঘাসপথ বেয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়ায় যিশু । আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বাতাস । বাতাসের ডাঁটো স্ট্যাচু যেন । সব স্হির । ডানপাড়ের বিশাল গাছে তেঁতুলপাতাও কাঁপছে না । বাঁধানো ঘাটে বয়ঃসন্ধির বালিকার মতন একধাপ ওপরে তো একধাপ নীচে খেলা করবার পর ক্লান্ত হয়ে গেছে টলমলে পুকুর।”
    কিংবা :-
    “জনশ্রুতির মতন বাতাস বইছে।...মদগর্বিত ষাঁড়। মদিরেক্ষণা মৌমাছি ।
    ভিজে চিলের মতন ডানা ঝুলিয়ে রয়েছে ঝিমন্ত কলাগাছগুলোর ছেঁড়া পাতা।
    কঞ্জুস হাওয়ার তাপে বাবলাগাছগুলোর গায়ে কাঁটা দিয়েছে । পথিপার্শ্বে উইপোকাদের বিজয়স্তম্ভ । মার্জিত চেহারার খেজুর গাছ, গলায় খেজুর ছড়ার মালা।”
    অথবা :-
    “চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে কালবৈশাখির ছেতরানো মেঘে, কিন্তু পূর্ণিমার আগাম আভায় নির্জন বধির অন্ধকারকে মনে হয় হাস্যোজ্বল । নিরলস সাধনায় মগ্ন স্হির সন্ধ্যাবাতাস আচমকা হাওয়ার জন্য অপেক্ষমান । নেশাগ্রস্তের মতন মাথা ঝুঁকিয়ে আছে গাছগুলো । বুনো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে সিসলকাঁটার গুড়িসুড়ি ঝোপ।”
    এই উদ্ধৃতিগুলিতে, উপমা-চিত্রকল্পে, ভাষার স্বাতন্ত্র্যে, যে-কবিতাময়তা, তাতে থাকে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে আক্রমণ, অথবা নতুন স্হিতিস্হাপকতা গড়া । খুশি ও কেটলিউলি হিন্দু অরিন্দম আর খ্রিস্টান যিশুর, মধ্যবিত্তের বাঁচবার পথ, কেটলিউলি-মেয়েটার শরীর জুড়ে প্রাচীন নিষাদকুলের নাচ লুকিয়ে আছে যেন । এর চাউনি রৌদ্রোজ্জ্বল । চিরপ্রদোষ-মাখা শ্যামাঙ্গিনী । আর খুশিদিকে দেখে যিশুর মনে হয়, চাষি মেয়ের শ্রমসোহাগী পেশল বাহু ঝুলে আছে । ওই প্রাচীন নিষাদকুল, ওই শ্যামলিনী, চাষি মেয়ের পেশল বাহুই আমাদের প্রতিষ্ঠানের, কবন্ধ মূল্যবোধের বাইরে আনতে পারে । এ সম্ভাবনার দরোজা কি খুলবে ? মলয় রায়চৌধুরীর এ-প্রশ্নকেই রেখে দেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্য এখানেই । মলয় এভাবেই ষাটের দশক থেকে পালটেছেন -- যেতে চাইছেন সময়ের গভীরে, তার নাভিকেন্দ্রে ।
     
     
     

     

  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:২৩735087
  • Prof Nissim Ezekiel : The Hungry Generation
    The Hungry Generation Movement in Bengali literature, which took Calcutta by surprise in 1961, and became instantaneously known through TIME magazine, has withstood all odds, and is now a historical and cultural force to reckon with. The movement has grown to uncontrollable proportions. All sorts of groups have emerged at various places in West Bengal claiming to be of Hungry Strain.
    The major Hungry Generation writers and poets are in their late forties now: Subimal, Malay, Basudeb, Subhas, Saileswar, Pradip and others. They have always been at the receiving end from the media due to their uncompromising stand. Except for Debi Ray, who broke with the Hungries quite early, none of them are invited to participate in the national or regional TV and radio programmes, official workshops/seminars/recitals/readings.
    The Hungry writers, better known as the Hungry Generation, are immensely popular among students and young writers today, as they are considered the voice of conscience in a Bengali society shattered by internecine political struggles of the post-partition years. Interesting, though, the Hungry Generation writers, poets and artists do not function as a group any more. But they remain the only avant garde figures in Bengali literature, always experimenting, always questioning, expressing themselves in ultimate terms. “The Movement”, as the renowned critic Dr Uttam Das has said, “is an important event in the history of Bengal”.
    Malay Roychoudhury(b. 1939), the towering avant garde poet who pioneered the Hungry movement in Bengali literature, is a legend by himself. Still uncompromising, and therefore not supported by the Bengali media, all his collections have so far been published by his friends and relatives. Despite being hailed by TIME magazine as an outstanding poet, he remains as controversial as he was in 1961 when he entered the literary scene in Calcutta with a whiff of liberated form, and an uninhibited approach towards expression of Indian thought concerning self and society, love and destruction, politics and despair.
    Malay had given up writing sometime in 1966 after some of his friends has betrayed and testified against him. But he returned with a vengeance in 1983, and took the Bengali scene by storm. His poems have been translated into almost all Indian languages as well as into Spanish, German, French, Russian and Italian. He has translated Ginsberg, Lorca and Neruda into Bengali. Malay’s collection of verse includes Shoytaner Mukh, Jakham, Kabita Sankalan, and the recently published collection revealing violence, fear and agony, in Medhar Batanukul Ghungur.
    Although once the leader of the fierce Hungry Generation movement, Malay now lives the life of a recluse in Bombay. The poets of the younger generation look at him with awe and inspiration. We feel he is the ultimate representative of his kind of poetry.
    (Courtesy: Prof Nissim Ezekiel, Editor, The Indian P.E.N., Mumbai, 1987)
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:২৪735088
    • মলয় রায়চৌধুরীর ডুবজলে,জলাঞ্জলি, নামগন্ধ উপন্যাসত্রয়ী : সমীর সেনগুপ্ত
      যাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, আর যাকে চিনি না — তাদের কাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, বা এমনকি ভাবতে গেলেও — দৃষ্টিভঙ্গীতে একটা তুলনাত্মক পরিবর্তন এসে যেতে বাধ্য । আজ যদি আমাকে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা নরেন্দ্রনাথ মিত্র সম্পর্কে লিখতে বলা হয়, আমার রচনা কিছু পরিমাণে নিরঙ্কুশ হবেই — কারণ এঁদের কাউকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতুম না, এঁদের কাজ বিষয়ে আমার হাতে আছে শুধুই এঁদের কাজ, আর হয়তো কিছি দ্বৈতীয়িক তথ্য, মানুষটিকে আমার জানা নেই । অর্থাৎ একটি বিন্দুতে আছি আমি, আর একটি বিন্দুতে আছে তাঁর কাজ — সম্পর্কটা দ্বিমাত্রিক ; কিন্তু যে-মুহূর্তে আমি মানুষটিকে জানছি সেই মুহূর্তে সম্পাদ্যটি তৃতীয় একটি আয়তন পাচ্ছে, তাঁর কাজ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন প্রভাবিত হচ্ছে আমার মনের মধ্যে নির্মিত তাঁর ভাবমূর্তির দ্বারা । সঙ্গে সঙ্গেই অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা ।
      মলয় রায়চৌধুরীকে আমি চিনি — ঘনিষ্ঠতা যাকে বলে হয়তো নেই, কিন্তু মানুষটিকে জানি, এবং পছন্দ করি, তাঁর কাণ্ডজ্ঞান অত্যন্ত সূক্ষ্ম বলে এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধও আছে ভিতরে ভিতরে l তাছাড়া অনেক বিষয়েই মলয়ের পড়াশোনা ও অন্তর্দৃষ্টি আমাকে বিস্মিত করে, এবং লেখা পড়ে মনে হয় দুনিয়াদারির অভিজ্ঞতাতেও মলয় রায়চৌধুরী আমার চেয়ে এগিয়ে — কিন্তু মলয়ের কাজ আমি সাধারণভাবে পছন্দ করি না । মলয়ের সঙ্গে কোথাও আমার একটা আদর্শগত দূরত্ব আছে বলে মনে করি, এবং সে দূরত্ব অসেতুসম্ভব । তফাতটা সাহিত্যসংক্রান্ত বোধের, এবং রুচির । দীর্ঘ দিন ধরে, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমাকে এক দিকে নিয়ে গেছে, মলয়কে সম্পূর্ণ অন্য দিকে । ফলে, মলয় যাকে কবিতা বলে মনে করেন, আমার কাছে তা অগ্রাহ্য, মলয়ের যা সাহিত্যিক আদর্শ, আমার কাছে তা মনোযোগের যোগ্য নয়, এবং আমার বিচারে যা সাহিত্যের ধ্রুবপদ, মলয়ের বিচারে — মলয়ের লেখা পড়ে মনে হয়, তা শুচিবায়ুগ্রস্ত, উচ্চমন্য, গজদন্তমিনারবাসীদের জন্য, গজদন্তমিনারবাসীদের দ্বারা রচিত । এই যেখানে পরিস্হিতি, সেখানে মলয় রায়চৌধুরীর লেখার আলোচনার প্রস্তাব আমার বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা উচিত ছিল । কারণ বিরুদ্ধ আলোচনা স্বাগত হলেও, পক্ষপাতপূর্ণ আলোচনা না করাই উচিত । আর, মলয়ের লেখা আমার ভালো লাগে না, এটা এমনকিছু একটা জরুরি কথা নয় যে, ভুরি পরিমাণ কালি-কাগজ খরচ করে সে-কথাটা বলে বেড়াতে হবে ।
      কিন্তু আসল ব্যাপারটা অতো সরল নয় । মলয় রায়চৌধুরীর লেখা আমার ভালো লাগে না এতে কোনও ভুল নেই ঠিকই, কিন্তু বোধহয় কুড়ি বছর পর আমি একটি উপন্যাস রাত জেগে পড়ে উঠলাম, সেটি মলয় রায়চৌধুরীর ‘জলাঞ্জলি’ । রাত সাড়ে বারোটায় বইটা হাতে করে শুতে গিয়েছিলাম, যখন শেষ করে উঠলাম, তখন কাক ডাকতে আরম্ভ করেছে। এবং পড়তে পড়তে মনে পড়ল, বছর কয়েক আগে মলয় ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপহার দিয়েছিলেন, সেটি পড়তে আরম্ভ করেও সেদিন আপিস-টাপিস বাদ দিতে হয়েছিল ।
      কারণ মলয় প্রথম থেকেই এমন এক জগতে আমাকে নিয়ে প্রবেশ করেন, যা আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত — শুধু অপরিচিত নয়, অচিন্ত্যনীয় । এ কোন পৃথিবী যা বাতিল নোটের দুর্গন্ধ-স্তূপকে ঘিরে ঘিরে আবর্তিত হয় — বাস্তব সেখানে ওই টাকর ভাগাড়ের ভিতর থেকে ভাপের মতো ধোঁয়াতে থাকে । টাকা — কারেন্সি নোট, যা আমাদের সমস্ত সুখের-দুঃখের, প্রাপ্তির-অপ্রাপ্তির, সার্থকতার-অসার্থকতার জগদ্দল প্রতীকমাত্র, ওগুলোর মধ্যে চিরন্তনতা নেই । নেই যে, সেটা আমরা বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারলেই, কথাটা আমাদের উপলব্ধিকে স্পর্শ করে না । যেমন দশ কোটি টাকা মানে কত টাকা আমি বুদ্ধি দিয়ে বুঝি, কিন্তু পুরোপুরি বুঝি না, তেমনি কারেন্সি নোটের নশ্বরতার ব্যাপারটাও, মলয় না-বোঝালে, কোনও দিন সত্যি-সত্যি বুঝতে পারতুম কিনা সন্দেহ । আমরা সবাই জানি কারেন্সি নোট হাতে হাতে ঘুরে একদিন নোংরা হয়, ধারগুলো এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়, কাগজ ল্যাতপেতে হয়ে যায়, ভাঁজে ভাঁজে মাঝখানটা ফুটো হয়, ক্রমে সেই ফুটোটা বড় হতে হতে নোটতা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায় । তারপর কী হয় ? নিশ্চয়ই কোনও না কোনও ভাবে নষ্ট করে ফেলা হয় নোটখানা । কিন্তু সেই কোনও না কোনও ভাবে ব্যাপারটা যে কী ব্যাপার সেটা কখনই জানতে পারতুম না, মলয় রায়চৌধুরীর লেখা না পড়লে । ‘কারেন্সি’ মানেই আমরা জানি যেটা আছে, যেটা কারেন্ট অর্থাৎ বর্তমান, যেটা আমি ও আমার প্রতিবেশীর মধ্যে যোগসূত্র । এবং এইরকম একটা বিভ্রান্তি আমাদের মনে, ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়ে যায় যে, আজ যেটা বর্তমান আছে কালও সেটাই বর্তমান থাকবে । আমরা যারা টাকার বাজারের প্রত্যন্তসীমায় জীবন কাটাই, হঠাৎ হাতে এক গোছা চকচকে নোট এসে পড়লে তাদের মনটা খুশি হয়ে ওঠে, তাদের বউয়েরা সেগুলো পাট করে আলমারির ভেতরের দিকে রেখে দেয়, অথচ কোনও তো কারণ নেই, তেলতেলে অর্ধগলিত নোটের চেয়ে তার তো ক্রয় ক্ষমতা বেশি নয় । তাহলে কেন গ্রেশাম সাহেবের নিয়ম সারা পৃথিবী ভরে সত্য, নতুন নোট হাতে পেতে কেন সারা পৃথিবীর মানুষ লালায়িত ? জানি না ।
      আর মলয় যে মানুষগুলির বর্ণনা করেন, তারা ওই গলিত নোটের মতোই বহুব্যবহৃত পুরোনো ভাবনাচিন্তার জগতের মানুষ । তারা যা ভাবে, যেভাবে ভাবে তা বহু বহু পুরুষ ধরে তাদের পূর্বজরা ভেবে এসেছে । কিন্তু মলয় রায়চৌধুরীর লেখার তলায় তলায় এই বার্তা থাকে, যে এই ভাবনাটাই শেষ কথা নয়, ধ্রুব নয়, নতুনভাবেও চিন্তা করা সম্ভব — মলয় রায়চৌধুরীর অতনু হঠাৎ গলিত নোট গোনার আরামের চাকরি ছেড়ে, গ্যাজেটে ক্যাসেটে সাজানো ফ্ল্যাট ফেলে রেখে একদিন উধাও হয়ে যায়, অনেকদিন পর তার খোঁজ পাওয়া যায় গভীর জঙ্গলের মধ্যে রেডবুক থেকে মন্ত্র পড়ে নকশাল তরুণতরুণীদের গণবিবাহ দিচ্ছে । পুরোনো নোট ধ্বংস করে ফেলবার পদ্ধতিটা মলয় দেখান, নতুন নোট তৈরি হওয়ার পদ্ধতিটা দেখান না — সেটা আমাদের আন্দাজ করে নিতে হয় । মলয়ের উপন্যাসের জগতেও, বাতিল ভাবনার মানুষেরা রাজত্ব করে, মনে হয় তারাই রাজত্ব করে যাবে — কিন্তু না, অতনুরাও তাদের মধ্যে থাকে, তাদের রাজত্ব তলায় তলায় টলমল করছে । পুরোনো নোটের মতো তারাও একদিন বাতিল হয়ে যাবে — এটাই কি মলয় রায়চৌধুরীর বার্তা ?
      কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয় রাত জেগে মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস পড়ে ওঠার ।
      আমাদের ঘটনাহীন মধ্যবিত্ত জীবনের সবচেয়ে নীরস নীরক্ত নির্বর্ণ অংশ আমাদের চাকরিজীবনের কাহিনি । মলয়ও চাকরিটা করতেন একঘেয়ে ঘটনাহীন — ব্যাঙ্কের নিস্তরঙ্গ চাকরি । কিন্তু মলয় আরও একবার প্রমাণ করলেন, যে বেড়াতে জানে, তার কাছে লিলুয়াভ্রমণও রোমাঞ্চকর হতে পারে ; যে দেখতে জানে, তার কাছে ব্যঙ্কের আপিসঘর হয়ে উঠতে পারে আমাজন অববাহিকার চেয়েও রহস্যময় । চরিটপগুলি, শুধু জীবন্ত বললে কিছুই বলা হয় না, বাঁধা বুলি হয়ে গেছে– স্পন্দমান, তাদের কথোপকথন স্পষ্ট শোনা যায় এতো বেশি জীবন্ত । মলয়ের লেখা পড়তে পড়তে স্পষ্ট দেখতে পাই সেই সব যুবক যুবতীদের, যারা রাত জেগে পড়াশোনা করে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফল দেখিয়ে, প্রতিযোগীতামূক পরীক্ষায় অন্যদের হটিয়ে, অবশেষে একটা গালভরা ডেজিগনেশনওয়ালা চাকরিতে ঢুকলো । এবার যুবকটি একটি নারী সংগ্রহ করবে, যুবতীটি একটি পুরুষকে — তারপর একটা বাড়ি, তারপর সন্তান — অন্য পাঁচ সাধারণ মানুষ যেভাবে জীবন কাটায়, মানুষের পক্ষে যে-জীবন স্বাভাবিক বলে সামাজিকভাবে সীকৃত, সে-জীবনের মূলস্রোতের শরিক হবার পথে কঠিনতম বাধাটি অতিক্রম করল সে । কিন্তু কী চাকরি ? না, দিনের পর দিন একটা বন্ধ ঘরে বসে পুরোনো নোংরা নোট গোনা, সপ্তাহে পাঁচ-ছয় দিন, দিনে সাত-আট ঘণ্টা, আর কোনও কাজ নেই, শুধু নোংরা নোট বাণ্ডিল বেঁধে বেঁধে, গর্ত করে করে, পোড়াবার জন্য পাঠানো । এর চেয়ে অবাস্তব কোনও অবস্হার কথা কল্পনা করা কঠিন ।
      কাজ মানে এমনকিছু যা মানুষের সত্যিকারের বেঁচে থাকার পদ্ধতিটার সঙ্গে যুক্ত । কুমোর যখন হাঁড়ি গড়ে তখন হাঁড়িটার সঙ্গে মানবসমাজের যোগাযোগের সূত্রটি সে খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পায় — হয়তো জিগ্যেস করলে বুঝিয়ে দিতে পারে না, কিন্তু নিজে বোঝে তাতে কোনও সন্দেহ নেই । কিন্তু টাকা, কারেন্সি নোট — আধুনিক মানবসমাজের এই অপরিহার্য উপজাত, এর সঙ্গে মানুষের উপভোগের, অথবা প্রয়োজনের নিবৃত্তির, কোনও প্রত্যক্ষ যোগ নেই, কারণ এটি আদৌ কোনও ভোগ্যপণ্য নয় । টাকা চিবিয়ে খিদে মেটে না, টাকা গায়ে জড়ালে শীত কাটে না — পুড়িয়ে আগুন করলে খানিকটা কাটতে পারে হয়তো । অথচ খিদের সময়ে খাবার পেলে যত খুশি হই, টাকা হাতে পেলে ততটাই খিশি হই — কারণ টাকাটার সাহায্যে পৌঁছোনো যাবে পছন্দমতো খাবারের কাছে । ব্যাপারটার অন্তর্গত হেত্বাভাস যে কত সত্য তা টের পাওয়া যায় ঘটনাটাকে চরমে টেনে নিয়ে গেলে — ধরা যাক সেই ‘অশনিসংকেত’ ছবিতে — ভিখারিনী মেয়েটি যখন অনাহারে মৃত্যুপথযাত্রী, যখন তার শরীরে আর খাদ্যসন্ধানের বল অবশিষ্ট নেই, তখন তার পাশে এক বাণ্ডিল টাকা রেখে গেলে যা হতো । কিন্তু টাকা ও খাদ্যের পার্থক্যটা বুঝতে চাইলে ক্ষুধায় অমন মৃত্যুপথযাত্রী হতে হয় — যে অভিজ্ঞতা জীবনে, অন্তত মলয়ের গল্পের পাঠকদের জীবনে, ঘটবার সম্ভাবনা খুব বেশি বলে মনে হয় না ।
      আমি যে চাকরিটা করতাম সেটাও খুব বর্ণহীন চাকরি — কিন্তু সত্যিকারের বর্ণহীন চাকরি বলতে কী বোঝায় মলয়ের লেখা পড়ে তা বুঝতে পারলাম । আসলে আমরা তথাকথিত লেখাপড়া শিখে যেসব শাদা কলারের চাকরি করি তার কোনওটার সঙ্গেই তো আসলে বেঁচে থাকা ব্যাপারটার কোনও যেগ নেই, কাজেই তার মধ্যে থেকে কৃত্রিমতার কটূ স্বাদ ছাড়ানো যায় না কোনও মতেই । মনে আছে একবার ওপরওয়ালার সঙ্গে নিষ্ফল ঝগড়া করে নিজের ঘরে ফিরে এসে ভাবছিলাম কাল থেকে আর আপিসে না এলে কী হয় । ভাবতে ভাবতে জানলার পর্দা সরাতে দূরে ভারত ব্যাটারির কারখানার চিমনিটায় চোখ পড়ল । একটা লোক এই বৈশাখের ভরা দুপরে তেতে থাকা চিমনিটা বেয়ে উঠে যাচ্ছে । আমি দেখতে লাগলাম । ক্রমেই উঠে যাচ্ছে লোকটি, তারপর মাটি থেকে প্রায় একশো ফুট ওপরে দাঁড়িয়ে চিমনি সাফ করতে লাগল । নিয়নের আলো জ্বালা পর্দাটানা ঠাণ্ডা ঘরে বসে বসে আমি ভাবতে লাগলাম, ও লোকটি কি চাকরি ছেড়ে দেবার কথা ভাবে কখনও ?
      আর, শুধুই তো নোট গোনা নয়, ব্যবহারযোগ্য নোটে আলাদা করে, অব্যবহার্যগুলো বাণ্ডিল বেঁধে, সই মেরে, ফুটো করে পোড়াতে পাঠানো নয় ( এ পর্যন্ত তবু তো আমরা আন্দাজ করতে পারি ), তার মধ্যে থেকেও মানুষের বেঁচে থাকার বিচিত্র প্রয়াস কাজ করে যেতে থাকে । কীভাবে বিকট বিকারের ভিতর দিয়েও জীবন তার মূল ছন্দে ফিরে আসার চেষ্টা করে তার অসম্ভব বর্ণনা আমরা মলয়ের লেখা থেকে পেয়ে যাই ।
      ‘…শিমুলতলা দেওঘর থেকে ফেরার পর দিনই, অতনুর সেকশনে, ঝপাং শব্দে ডাইস মেশিনে গর্ত করে নোট নষ্ট করছিল রসিক পাসওয়ান, চাপরাশি । ব্যস্ততার মাঝে, অতনুর কপালে এসে ছিটকে লাগল রসিকের তর্জনীর কাটা ডগাটা, লেগে, ওর কপালে রক্তের টিপ পরিয়ে, ওরই টেবিলে পড়ল । বুঝে ওঠামাত্র ও স্তম্ভিত । পেটে মোচড় দিয়ে বমি উঠে আসছিল আরেকটু হলে । পকেট থেকে রুমাল বার করে প্রায়-নির্বিকার রসিক জড়িয়ে নিলে আঙুলে আর আঙুলের টুকরোটা দেখাতে গেল খাজাঞ্চিকে । সুশান্ত জানিয়েছিল, ওদের আঙুলটাঙুল বীমা করিয়ে রেখেছে অফিস । দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে বীমা করানো থাকে । আঙুলকাটার অঢেল ক্ষতিপূরণ দিতে হয় । তর্জনীর জন্যে মোটা টাকা পাবে ।…
      ….বরাদ্দ ছুটির শেষে রসিক পাসওয়ান কাজে যোগ দিলে সুশান্ত জানতে চেয়েছিল, “কী গো, আঙুলের ঘা শুকিয়ে গেছে তো ? কাটলে কেন আঙুলটা, জেনেশুনে ?”
      “…নাতনির বিয়ে দিলুম । ছুটিও পেলুম, টাকাও ।” রসিক পাসওয়ান অমায়িক ।
      এই ঘটনার পর অতনু লক্ষ করেছে, সুখচৈতি রাম, হরবিলাস, টাঙোয়া মাহতো, রামপুজন সিং, খলিল আহমেদ সকলেরই একটা বা দুটো আঙুল কাটা ।…’
      ( ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, পৃ. ৩১ )
      ঘটনাটা যে লক্ষ করছে, অতনু, তাকে লাক্ষণিকভাবে সুকুমার, বাঙালি মধ্যবিত্ত চরিত্রের প্রতিনিধি করে তুলে মলয় চমৎকার নাটকবোধের পরিচয় দিয়েছেন । অতনু এমনই এক যুবক, ‘নিজের মাইনের টাকা ওব্দি অন্যের সামনে গুনতে লজ্জা করে অতনুর । চাকরির প্রথম মাইনের একটা পাঁচ টাকার প্যাকেট, লুকিয়ে গুনতে গিয়ে, পায়খানায় পড়ে গিয়েছিল ।’ খাঁটি বাঙালি মধ্যবিত্ত চরিত্র, এই চরিত্রটিকে আমরা এতো ভালো করে চিনি যে বলার নয় । যে নিজের স্বার্থের গুরুতর হানি ঘটাতে রাজি আছে, কিন্তু নিজের সুকুমারত্ব বিসর্জন দিতে রাজি নয় । টাকা যে দিচ্ছে, তার সামনে গুনে না-নিলে গোনা না-গোনা সমান, এ-কথা ইকনমিকসের স্নাতকোত্তর দুনিয়াদারির মেধাবী ছাত্র অতনু বোঝে না এমন নয়, কিন্তু এই অনুশাসন পালন করতে তার মধ্যবিত্ত পারিপার্শ্বিকে বেড়ে ওঠা মূল্যবোধে ভয়ংকরভাবে আটকায় । তার চোখের সামনেই রসিক পাসওয়ানের আঙুল বিসর্জন দেবার ঘটনাটি ঘটে যায় বলে মলয়ের পাঠক, আমরা যারা মনে মনে অতনুর সগোত্র, ধাক্কাটা আমাদের আরও বেশি করে লাগে । আর টাকা গুনতে অতনুর কেমন লাগে তারও চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন মলয় :-
      ‘…রোজ সাড়ে দশটায় অফিসে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে ভেজা ভেজা হতদরিদ্র নিকষ নোটের বিষণ্ণ আমন্ত্রণ অতনুকে ছেয়ে ফ্যালে, ধূসর বিষাদমুখো নোটের ভেষজ অন্ধকূপে ও চাকরি করে চলে ভারাক্রান্ত, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, ঝেঁপে আসে নোটের খাঁ-খাঁ করা দুর্গন্ধ, ম ম করে ন্যাতানো শ্বাসরুদ্ধকর ছাতাপড়া নোট । যেন ওৎ পেতে থাকে হাড়হাভাতে নোটেরা ।’
      কিন্তু এই গদ্যভঙ্গী আমার পছন্দ নয়, অনেক শব্দের ব্যবহার আমার রুচিতে আটকায়, ‘হাড়হাভাতের’ ব্যবহার জীবনানন্দের ভুল প্রয়োগ বলে মনে হয় । তা ছাড়া, আমি ভেবে পাই না নোটের গন্ধ কী করে ‘ঝেঁপে আসে’, দুর্গন্ধ কেমন করে ‘খাঁ খাঁ’ করতে পারে ? কিন্তু এটাও সেই সঙ্গে মানতে হয় যে মলয় রায়চৌধুরীর অভ্যাসবিরোধী শব্দব্যবহার দিয়ে, শালীন বাংলার অচলিত বাক্যগঠন দিয়ে, মলয় একটা কোথাও পৌঁছোতে পারেন । কিন্তু সেটা কতখানি মলয়ের ভাষাব্যবহারের কারণে আর কতখানি মলয়ের অচেনা অভিজ্ঞতার, মলয়ের অজ্ঞাত জগতের কাহিনির অমোঘ আকর্ষণে তা নিয়ে তর্ক থেকে যেতে পারে । মলয় যেন প্রতিজ্ঞা করে কোমর বেঁধে বসেন যে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত বাংলা রচনাশৈলী কিছুতেই ব্যবহার করবেন না । তা মলয় না করুন, তবে চেষ্টাটা নতুন নয়, মলয়ের আগে অনেকে করেছেন এবং করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন — এবং মলয়ের পদ্ধতিতে আটপৌরে কথোপকথন রচনার কতখানি সাফল্য পাওয়া সম্ভব তা নিয়ে আমার সন্দেহ যায় না । অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, মলয় রায়চৌধুরীর ভাষা এমনিতেই যথেষ্ট লক্ষ্যভেদী, তাকে দুশ্চেতার দ্বারা আরও বেশি চোখা করবার কোনও তো দরকার দেখি না । কেন মলয় ‘ঠিক আছে’কে ‘ঠিকাছে’ লিখবেন, কোনও দরকার তো নেই । বাংলা উচ্চারণে আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতাই হচ্ছে, হলন্ত ব্যঞ্জনের পর স্বরবর্ণ থাকলেই, সন্ধির সামান্যতম সুযোগ থাকলেই তাকে সন্ধি করে উচ্চারণ করা হয় । কিন্তু লেখার সময় আমরা সেগুলো করি না । লিপিনির্দিষ্ট ভাষার একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ চেহারা আছে, প্রাদেশিক উচ্চারণ যাই হোক, লিপিকে তা প্রভাবিত করে না ; করলে অকারণ নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় । আর খুব নতুনও নয় চেষ্টাটা — আজ থেকে একশো বছর আগে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘করলে’ পরিবর্তে ‘কল্লে’ চালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন, এমনকি তাঁর সাহিত্যিক পুত্রও, অন্তত এ-ব্যাপারে তাঁকে অনুসরণ করেননি । মলয় কোথাও কথ্য উচ্চারণকে অনুসরণ করে অনাকাঙ্খিত সন্ধি করেছেন, কোথাও করেননি । ওই একই অনুচ্ছেদে আগের বাক্যেই ‘কুকুরের ল্যাজ’কে ‘কুকুরের্ল্যাজ’ করেননি, বা ‘কন্ঠস্বর শুনে’কে ‘কন্ঠস্বর্শুনে’ করেননি, বা পরের বাক্যে ‘ওর কাছে’কে ‘ওর্কাছে’ করেননি । এসব করে পাঠককে শুধু প্রতিহতই করা হয় । মলয় যদি বলেন উনি পাঠক টানতে চান না, তাহলে সম্পূর্ণ নিজের ডিকশন তৈরি করুন, যেমন করেছিলেন কমলকুমার মজুমদার তাঁর ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এ — শ্রেষ্ঠ উদাহরণটাই দিলুম । মলয় রায়চৌধুরীর হাতে অস্ত্র আছে, অন্তত যে পাঠক ‘একালের রক্তকরবী’তে প্রকাশিত তাঁর ‘জলাঞ্জলি’ উপন্যাস পড়বেন, তাদের ঘায়েল করার । যখন মলয় গ্রামে কাজ করতে যাওয়া শহুরে ছেলেমেয়েদের বিষয়ে লেখেন :-
      ‘…চাষের জমিতে দাঁড়িয়ে গম-যবের তফাৎ করতে পারে না । রবি-খরিফ জানে না । জানে না কদ্দিনে আখ হয়, পাট হয় । অড়রডাল গাছ দেখতে কেমন । এক হেকটরে কত জয়াধান সম্ভব । কত ঘণ্টার শ্রম লাগে এক কুইন্টাল টমাটো কিংবা চন্দ্রমুখী আলু তুল;তে । জলবিভাজক কাকে বলে । খাল আর নালার তফাৎ।…পানচাষে অনুখাদ্য মিশ্রণ কতটা হবে, কেমনভাবে পুঁততে হয় আলফা আলফা গাছ, নাবি বোনা আমন ধান কখন পাশকাঠি ছাড়ে, স্বর্ণকুমারী জাতের ধানে খোলপচা রোগ হলে কী করা উচিত।…’
      যে-পাঠকের উদ্দেশে এসব মলয় লিখেছেন, সে পাঠক তালগাছ আর নারকেল গাছে তফাৎ করতে পারে না, কাক শালিক ছাড়া পাখি চেনে না, চেহারা দেখে হাসাহাসি আলাদা করতে পারে না — তার কাছে প্রত্যেকটি মন্তব্য টাইসনের আপার কাট ।
      অথবা সেই অতনু, অতনু চক্রবর্তী, পায়খানায় লুকিয়ে মাইনের নোট গুনতে গিয়ে যার একতাড়া পাঁচ টাকার নোট নোংরায় পড়ে গিয়েছিল, সুখের চাকরি আর সাজানো ফ্ল্যাটবাড়ি ফেলে রেখে যে উধাও হয়ে গিয়েছিল একদিন, তাকে তার সহকর্মী আবিষ্কার করে হাজারিবাগে, হাণ্টারগঞ্জের কাছে ( সত্যি কি হান্টারগঞ্জ জায়গা আছে কোনও ? থাকতে পারে, জানি না ; এটুকু জানি ‘একালের রক্তকরবী’র বেশির ভাগ পাঠকই জানে না । আমার অবস্হান আমি গোপন করবার চেষ্টা করছি না, পাঠক লক্ষ করবেন ) গভীর জঙ্গলের মধ্যে ছয়-সাত জোড়া কিশোর-কিশোরীর গণবিবাহ দিচ্ছে ।
      ‘…বিয়ের কোনও দশকর্মের ব্যাপার নেই । পুরুতও তো নে । খদ্দরের ঘি-রঙা পাঞ্জাবি, নোংরা শাদা পায়জামা, পায়ে কেডস, ঘাড় ওব্দি উস্কোখুস্কো চুল, একজন লোক একটা ছোট্ট লাল মলাটের বই থেকে মন্তর পড়ছে আর বর কনেরা সবাই মিলে তা আউড়ে যাচ্ছে । লোকটার মাথার ওপর মশার ঘূর্ণায়মান হ্যালো । উৎকর্ণ হতে, অরিন্দম বুঝতে পারল, আরে, সংস্কৃত তো নয়, বিয়ের মন্তর নয় । লোকটাতো ইংরেজিতে মন্তর পড়ছে, পরিষ্কার ভালো ইংরেজিতে আর আবোল তাবোল উচ্চারণে সেগুলো তারস্বরে ওগরাচ্ছে হবু স্বামী-স্ত্রী ।
      …ইংরেজিতে কী পাঠ করছে কান পেতে শোনে অরিন্দম আর স্তম্ভিত হয়ে যায় । চীনে ছাপানো রেডবুক থেকে উদ্ধৃতি পাঠ করছে, বিখ্যাত সব কোটেশান, জানে ও।’
      সত্যি বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু অবিশ্বাস করাটা রক্তে বসে গেছে । মলয় রায়চৌধুরী কি সত্যি কথা বলছেন ? তাহলে মলয়ের সব কৌণিকতা ক্ষমার্হ, সকল চালিয়াতি অবহেলার যোগ্য । এই কারণেই ক্ষমার্হ, যে মলয় আমাদের , এই দুর্ভাগা কলকাতাবাসী জন্মস্নবদের, বিশ্বাসহীনতার পাকা দেয়ালে একটা ফুটো করতে পেরেছেন । মলয়ের লেখা পড়ে মুহূর্তের জন্যও মনে হয়, এমন কেন সত্যি হয় না, আহা । সত্যের একটা গরম হাওয়া বয়ে যায় আমাদের মিথ্যের সাজানো বাগানের ওপর দিয়ে, আমাদের সযত্নলালিত কালচেসবুজ গাছপালা পলকে শুকিয়ে ওঠে ।শুধু মনে হয়, এই কথাগুলো যদি পুরোপুরি আমাদের চেনা ও বিশ্বাস্য ভাষায় বলতেন মলয় ! মলয়ের কাহিনি ও মলয়ের পাঠকের মাঝখানে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে মলয়ের দেহরক্ষী মাস্তান মলয়ের বাংলাভাষা, তার কোমরে গোঁজা চেম্বার গুরুপাঞ্জাবির তলা থেকে উঁচু হয়ে আছে, তার বীরাপ্পনের মতো চৌগোঁফা স্পষ্ট দেখা যায় । পাঠককে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখলেই সে কড়া গলায় বলে, ‘ভিড় বাড়াবেন না দাদা, নিজের কাজে যান…’
      আর, মলয় রায়চৌধুরীর কোনও উপন্যাসেরই শেষটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, অবশ্য । প্রথম যখন ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ পড়েছিলাম, জুডি ও জুলিকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে হয়নি, বিশেষ করে ‘ভালোবাসা চিরকাল ক্ষণস্হায়ী’ জাতীয় মন্তব্যের সঙ্গে । মলয়ের বর্ণনার গুণ হচ্ছে ডিটেলের কাজ চমৎকার — যা দিয়ে একটা ঘটনা বিশ্বাসযোগ্যতা পায় । চারুলতা যে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল, তার জন্য ভূপতির খবরের কাগজের হরফগুলো অবধি তার সময়ের সপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছে । শুনেছি, শতরঞ্জকে খিলাড়িতে যে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো দেখানো হয়েছিল, যোধপুররাজের অস্ত্রাগার থেকে নিজের হাতে বেছে সেগুলোকে নির্বাচন করেছিলেন পরিচালক — আর কিছু নয়, বন্দুকের কুঁদোয় রিভলভারের হাতলে তৈরির তারিখটা লেখা থাকে, সেটা ১৮৫৮ বা তার আগেকার তারিখ হওয়া চাই । সে তারিখ কেউ পড়তে পারুক বা না পারুক । ডিটেলের ব্যাপারে মলয় রায়চৌধুরীও সেই একই পথের পথিক । চমৎকার ডিটেলের কাজ মলয়ের, বর্ণিত বিষয় ছবির মতোই স্পষ্ট হয়ে ওঠে । দুয়েকটা উদাহরণ দিই, মলয়ের লেখা যাঁরা পড়েননি, তাঁদের জন্যে, ‘নামগন্ধ’ থেকে :-
      ‘…ক্যামাক স্ট্রিট ভিড়ে ভিড়াক্কার । রাস্তার দুপাশে পুলিশের জিপ, লরি, খাকি, লাঠি, রেব্যান, খইনি, এলাহি । আদিত্যকে দেখতে পেল । আদিত্য যিশুকে আসতে দেখে, রেব্যান চশমা পরে নিলে । হাতে বেটন । বুকে নামের তকমা । গটগটিয়ে রোয়াব । প্রোমোশান পেয়ে গেল নাকি, ওপরওলাদের টাকা খাইয়ে । ওঃ, তুই তো একদম উত্তমকুমারের পাইরেটেড ভার্সান…’
      অথবা, পাটনার বারিপথের বর্ণনা, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’-এ । কোনও রাস্তার এমন জীবন্ত বর্ণনা, অন্তত বাংলায় ক্বচিৎ পড়েছি :-
      ‘…বারিপথের দুপাশে সমস্ত ফাঁকা জায়গায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে চট টাঙিয়ে অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িকুড়ির ষষ্ঠীপূজক ছটমাইয়ার সংসার, ভাত, ডাল, রুটির দোকান, চুলকাটার, তাড়ির, গাঁজার, জুয়ার, চেলেভাজার, খাজা আর বেসনলাড্ডুর, রিকশ আর ঠ্যালা রাখার, বাঁশ আর শালখুঁটির, টিপ-সিঁদুর-চুড়ির পশরা-দোকান, নানান দেবী-দেবতার মিনিমন্দির । বারিপথের সমান্তরাল, গঙ্গার পাশ দিয়ে, পশ্চিমে পাটনা সাহেব থেকে পুবে খগোল ওব্দি এগিয়ে গেছে, দুপাশে ঝকমকে দোকানপশরা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল টাউনহল গোলঘর সাজিয়ে অশোক রাজপথ । সারা পাটনা শহর দেখা যায় গোলঘরের টঙ থেকে, দুর্ভিক্ষের শস্যভাঁড়ার ছিল মন্বন্তরে, এখনও তাই, গর্ভগৃহে চেঁচালে তেইশবার প্রতিধ্বনি হয় । পায়ে পায়ে ক্ষয়ে গর্ত হয়ে গেছে গোলঘরের একশো চুয়াল্লিশটা সিঁড়ি । মেরামতের টাকা ফি-বছর ভাগাভাগি হয় । রাস্তা সারাবার বরাদ্দও তাই, নালি-নর্দমা পড়ে আছে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে…’
      ডিটেলের কাজে এর চেয়ে ভালো পথবর্ণনার একমাত্র দৃষ্টান্ত, বাংলায়, যা আমার মনে পড়ছে, তা হল সকাল বেলাকার চিৎপুর রোডের সেই বর্ণনাটি :-
      ‘… সকালবেলাকার প্রথম সূর্যকিরণ পড়িয়াছে শ্যাকরাগাড়ির আস্তাবলের মাথায়, আর এক সার বেলোয়াড়ি ঝাড়ওয়ালা মুসলমানদের দোকানের উপর । গ্যাসল্যাম্পগুলোর গায়ে সূর্যের আলো এমনি চিকমিক করিতেছে, সেদিকে চাহিবার জো নাই !…ম্যুনিসিপালিটির শকট কলিকাতার আবর্জনা বহন করিয়া অত্যন্ত মন্হর হইয়া চলিয়া যাইতেছে । ফুটপাথের পার্শ্বে সারি সারি শ্যাকরাগাড়ি আরোহীর অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ; সেই অবসরে অশ্বচর্মাবৃত চতুষ্পদ কঙ্কালগুলো ঘাড় হেঁট করিয়া অত্যন্ত শুকনো ঘাসের আঁটি অন্যমনস্কভাবে চিবাইতেছে ; তাহাদের সেই পারমার্থিক ভাব দেখিলে মনে হয় যে, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহারা তাহাদের সম্মুখস্হ ঘাসের আঁটির সঙ্গে সমস্ত জগৎসংসারের তুলনা করিয়া সারবত্তা ও সরসতা সম্বন্ধে কোনো প্রভেদ দেখিতে পায় নাই । দক্ষিণে হৃতচর্ম খাসির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কতক দড়িতে ঝুলিতেছে, কতক খণ্ড খণ্ড আকারে শলাকা আশ্রয় করিয়া অগ্নিশিখার উপরে ঘুষ খাইতেছে এবং বৃহৎকায় রক্তবর্ণ কেশবিহীন শ্মশ্রুলগণ বড়ো বড়ো হাতে মস্ত মস্ত রুটি সেঁকিয়া তুলিতেছে।…’
      কলকাতায় এত সাহিত্যিকের ভিড়, আজ পর্যন্ত কালীঘাটের মন্দিরে যাবার রাস্তাটার এরকম একটা বর্ণনা দিলেন না কেউ ।
      কিন্তু কথা হচ্ছিল মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসের শেষ করার পদ্ধতি নিয়ে । ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ পড়ে চমক লেগেছিল, মনে হয়েছিল খুব ঔচিত্যময় সমাপ্তি । কিন্তু ‘নামগন্ধ’ পড়ে খটকা লাগল একটা । কোথায় যেন একটা মিল আছে শেষটায়, আগের বইখানার সঙ্গে । খুশির সঙ্গে জুডি-জুলির একটা মিল আছে এটা মাথার পেছন দিকটায় মনে হচ্ছিল, কিন্তু মিলটা কোথায় ঠিক ধরতে পারছিলাম না । ‘জলাঞ্জলি’ পড়ে উঠে পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা । উপন্যাসের শেষে মলয় রায়চৌধুরী একটা রগরগে মোচড় দিতে ভালোবাসেন ।
      যে-উপকরণ, যে-দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী সাহিত্যে এসেছেন, সেই ঋদ্ধতা কম মানুষের থাকে । মলয়ের যা পশ্চাৎপট, মলয়ের স্মৃতিকথা পড়ে বুঝতে পারলাম, তা সাধারণ কলকাতাবাসী ঘটি বা বাঙাল মধ্যবিত্তের কল্পনার অতীত । উত্তরপাড়ার পড়ন্ত আভিজাত্যের বিলীয়মান ছায়া ছেড়ে পাটনার নিম্নমধ্যবিত্ত বস্তিপাড়া ঘুরে মলয় যেখানে পৌঁছোলেন তা ধারণায় আনতে পাঠকের কয়েক জন্ম কেটে যাবে ।
       
       
       
       
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:২৬735089
  • Pijush Biswas
    বাংলা সাহিত্যকে যদি নির্ভীক ও সততার বিচারে দেখা যায়, তাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মলয় রায়চৌধুরীর কাছে ঋণী থাকবে । বাংলা ভাষায় উনি কিছু দিয়েছেন । নিজস্ব চিন্তা, মৌলিকতা ও আন্দোলন । ব্যক্তিগত ভাবে অনেকেই হয়তো পছন্দ করেন না । যে ভাবে কবিকুলের অনেকেই অনুপম মুখোপাধ্যায়কে পছন্দ করেন না । তারা বলে থাকেন, ওদের নাক উঁচু । অপরকে আঘাত করে কথা বলেন ।
    আমি, মনে করি , আজকাল মানুষ একটু বেশী সেন্টিমেন্টাল । নিজের অপরের সমালোচনা করবেন । ভুল ধরবেন । উপদেশ দিতে আসবেন । এবার আপনি যদি, কোন এনালাইসিস দিয়ে কোন সত্য ব্যাখ্যা করে দেন , ওই হলো গিয়ে গণ্ডগোল । সেই হয়ে গেলো , বিরুদ্ধতা । অবমাননা ।
    সেই কারণে, ব্যক্তিগত মনুষ্যচরিত্র দুমিনিট সাইডে রেখে একবার দেখা যাক , বাংলা ভাষার জন্য, সাহিত্যের জন্য একজন কবি কি কন্ট্রিবিউশন । সেইটা মানুষ দেখেন না । কেন কি, সেখানে দেওয়া নেওয়ার কোন চিত্রকল্প নাই । পোস্টমডার্ণ সাহিত্যে মলয় রায়চৌধুরী অবশ্যই ফ্রন্ট রানার । এবং অনলাইন সাহিত্যে বাক্‌ এর সাফল্যের কথা কোন বাঙালি অস্বীকার করতে পারবে না । আমি, ব্যক্তিগত ভাবে, পুনরাধুনিক নিয়ে তত ভেবে দেখিনি, তবে এইটুকু বুঝতে অসুবিধা হয়না যে সেটা ভেবে চিনতে করা একটা প্রকল্প, হাওয়া থেকে পড়েনি । আধুনিক শব্দটা আমার নিজস্ব সমস্যার কথা আমি অন্য জায়গায় লিখেছি ও বিস্তারিত লেখার আরো সুযোগ রয়েছে ।
    আর । অনলাইন সাহিত্য নিয়ে বঙ্গপ্রদেশের মেজরিটির এখনো সমস্যা আছে । সেটা টেকনোলজীর সমস্যা না । বাঙ্গালির আলস্য । ডিজিটাল মাধ্যম আমাদের ভবিষ্যৎ , বাংলা পিছিয়ে আছে । আমাদের নিজস্ব আর্কাইভ গড়ে তোলা উচিত । আগামীতে যদি বঙ্গপ্রদেশ এই নিয়ে কোন কাজে না হাত দেয়, দিল্লি থেকে আমি কাজটা করবো । আমার কাজগুলি, প্যাটেন্ট করার জন্য জমা করা আছে । সেগুলির একটা উপসংহার হলেই, আমার কাজগুলি পাবলিক ডোমেনে আনা হবে ।
    ধন্যবাদ অনুপম, বাংলাভাষায় এতোটা কন্ট্রিবিউট করার জন্য । আপনার সঙ্গে আমার যদিও কোন দিন কথা বা দেখা হয়নি, মলয় রায় চৌধুরীর সংগেও আমার কোনদিন কথা হয়নি । তবু কেন মনে হয়, একাডেমী / জ্ঞানপীঠ পাওয়ার ম্যাটেরিয়াল দুজনের মধ্যেই আছে । আমি বললাম বটে এবং এতে আমার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ নেই ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:২৮735090
    • বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর ডিটেকটিভ উপন্যাস ‘অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস বা নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক’-এর আলোচনা
      উপন্যাস এর নামটা আমাকে বুঝতেই দেয় নি ভিতরের খনিজের উপস্থিতি । প্রচ্ছদে যুবতীর ছবি দেখে মনে হয় কোনো রগরগে রবিবাসরীয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছি। বুঝি নি এই অতি সংক্ষিপ্ত উপন্যাসের প্রতিটি লাইন এক বিরল জীবনদর্শনের মুখোমুখি করে দেবে আমাকে । এক অন্যধরণের সত্যানুসন্ধান , সাধারণ খুনের মামলার প্রেক্ষাপটে যা এক যুবক যুবতীর উৎকেন্দ্রিক আরণ্যক ভালোবাসা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে। তেলেগুতে এনক্রিপ্টেড, বাংলায় লেখা , সিডিতে সংরক্ষিত ডায়রিলেখনে বন্দী হয়ে থাকে সেই জীবনকাহিনী । আর কংকাল প্রেমিক এর জীবন ও মৃত্যু রহস্য উন্মোচিত হয় নোংরা পরীর হাতে।
      নোংরা পরী , ববিটাইজিং ভীতির কার্যকারিতা আর সারল্যের সংজ্ঞা
      নোংরা পরী বেরিয়ে এসেছে Edith Wharton এর বর্ণিত The Age of Innocence এর পর্দা কেটে । ইন্সপেক্টর রিমা খান অপরাধীর চোখের গতির ভিত্তিতে ক্রিমিনাল ঠ্যাঙায় । যে ক্রিমিনালরা জেরা করার সময়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের দু-ডিগ্রি , যারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের থার্ড ডিগ্রি । বুকের দিকে তাকিয়ে থাকারা নাকি তুলনামূলক ভাবে স্বাভাবিক, রিমা খানের ভাষায় তারা প্রকৃতির মাদার-সান-ইন্সটিংক্ট মেনে চলে। তাদের ঠেঙিয়ে কথা আদায় করে না , সাবইন্সপেক্টারের ওপর ছেড়ে দেয় ।
      রিমা খানকে উপন্যাসের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নাম দিয়েছে "নোংরা পরি" । নোংরা- কারণ সে সিমেন-দি-বভার সেকেণ্ড-সেক্স হতে রাজী নয়। সে আদ্যোপান্ত পুলিশ , প্রফেশনাল সমস্ত অর্থে , এমনকি ছুটকো ঘুষ নেবার ক্ষেত্রেও । সে দুর্দান্ত , দুঁদে । তার ভয়ে তার অঞ্চলের ক্রিমিনালরা লোক্যালিটি বদলে ফেলে ।
      বেটি ফ্রিড্যান যে ফেমিনিন-মিস্টিক কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তা এখনো আজকের সমাজেও পৃথিবী জুড়ে বর্তমান । এই নারীত্বের রহস্য শতকের পর শতক কখনো চীনে মেয়েদের পা জুতোয় ঢুকিয়ে ছোটো করতে বাধ্য করে , আফ্রিকার উপজাতির মেয়েদের মরাল গ্রীবাকে দীর্ঘায়িত করতে ধাতব বালায় বালায় বরবাদ করে দেয় ঘাড়ের মাথাকে ধরে রাখার কার্যকারীতাটুকু। এই নারীত্বের সন্ধানে ইউরোপের শিক্ষিতা মহিলা প্রেমপত্রে বানান ভুল করে, পদার্থবিদ্যার ডিগ্রি না নিয়ে পড়তে চায় সুললিত আর্টস।
      রিমা খানের মধ্যে সেই সারল্যটুকু নেই , সভ্যতা যে সারল্য শেখায় মেয়েদের, কাঁচের-পাথরবাটির মতো । যে শিক্ষিত সারল্যে মেয়েরা দুই বাচ্চার মা হয়ে গিয়েও সেক্সটকের অধিকার পায় না, বলে "ইস ছি ছি ছি", আজকের জমানাতেও । রিমা খান বিন্দাস গালিগালাজ করে। রিমা আবিষ্কার করে ফেলেছে যে ববিটাইজ করার ভয় দেখালে আবালবৃদ্ধ-ক্রিমিনাল খুব আকুল হয়ে পড়ে । তাতে অরগ্যাজম হয় রিমা খানের । এখন যে যুগ এ জিন্স এর সঙ্গে এক-হাত লাঠি-চুড়ি পরে মডার্ন ফেমিনিন ঘুরে বেড়ায় , স্ট্রিপটিজ দেখে আবার সন্তোষীমা-ও করে , সেখানে এই ডিলডো প্রেমী পুলিস অফিসারটি নোংরাও বটে পরীও বটে। তাকে কোথাও প্লেস করা যায় না, কোনো গ্রাফ এ ফেলা যায় না ! তার উলঙ্গ সত্ত্বায় কোনো কালো-দস্তানা-মোজা পরা লজ্জার ভেজাল ভঙ্গিমাও নেই । তাই সে মানুষী নয়। মানুষের ভোগ্যাও নয় হয়তো । বাঘিনী বাঘের জন্যে ভার্জিনিটি-টুকু বাঁচিয়ে রেখে ছিল । তা চারদিকে তো শুধুই ছাগল গবাদি পশু তার । তাই কুমারীত্ব ঘোচেনি কোনোদিন । এক ব্যতিক্রম কংকাল প্রেমিক ।
      যে কংকাল সে শুধু প্রেমিক
      প্রেম কয়প্রকারের হয়ে থাকে ? বহু প্রকারের হয়ে থাকে প্রেম। মেয়ে মাকড়শার সামনে পুরুষ মাকড়শার সুইসাইডাল প্রেম, মক্ষীরাণীর সামনে খুদে মৌমাছি শ্রমিকের প্রেম , রেপিস্ট হাঁসের প্রতি হংসিনীর প্রেম, ডলফিনের হরণ বা অপহরণ মূলক প্রেম , সতী নারীর পতিপ্রেম , বড়োলোকের বেশ্যাপ্রেম এবং সমান্তরাল ভাবে সন্তানের মায়ের প্রতি প্রেম এমন অনেক রকমের ।
      আমাদের কংকাল , যিনি কিনা ইন্সপেক্টর রিমা খানের আবার চাকরি ফিরে পাবার পাসপোর্ট, তিনি ছিলেন গণিতবিদ । এখানে মলয় রায়চৌধুরী বোধ হয় গণিতের অবতারণা করেছেন কুয়াসাহীন শুদ্ধচিন্তার প্রতীক হিসেবে। নিরঞ্জন, ওরফে কঙ্কাল , বুঝে গিয়েছিলেন তিনি বহুগামী । তাই কোন মহিলাকে এবং নিজেকে সমস্যা না দিতে চেয়ে , বিয়ে টিয়ে না করে , শুদ্ধ গণিত ও শুদ্ধ যৌনতার চর্চা করেছেন প্রেমে পড়ার আগে অব্দি। মলয় রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন তাঁর দুরকম প্রেম ।
      নিম্নগামী প্রেমটি (মস্তিষ্ক থেকে শীষ্ণ হয়ে এসে হৃদয়ে যা ইকুইলিব্রিয়াম পেলো , মাসিকের আবর্তনে মাপলো সময় )
      একজন জীবন খুঁজতে পালিয়েছিল , অন্যজন গিয়েছিল শুধু পলায়নপরাকে দেখে । মায়া পাল পুরোদস্তুর আধুনিক যুবতী , যিনি কুড়ুমুড়ে ইংরেজী বলতে বলতে অনায়াসে উচ্চপদের চাকরি পেতে পারেন , তিনি সুপুরুষ গণিতবিদের হাত ধরে বললেন "চলুন পালাই" । আর কামুক বিশ্বামিত্র ও তাঁর সঙ্গিনী চললেন অরূপের সন্ধানে, অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যারাইটস খনি অঞ্চলে । তাঁদের অতিপ্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃতিক প্রেম সেই অরণ্যে যাপিত হয়। অতিপ্রাকৃতিক কারণ মলয় রায়চৌধুরী এখানে খুঁজতে চেয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবী ভাবে যাপিত জীবনের দিকটি । বাছুরকে দুধ থেকে বঞ্চিত না করে, মুরগীর ছাল ছাড়িয়ে না নিয়ে, ভেড়ার লোম কেটে না নিয়ে বাঁচার পদ্ধতি । মায়ার এনভায়রনমেণ্টালিজম, জীবপ্রেম ।
      মলয় রায়চৌধুরী এখানে মনে করিয়ে দেন আমাদের ভুলে যাওয়া নারী পুরুষের প্রেমের রূপটিও । এখানে এক মানুষীর গায়ের গন্ধটি প্রেমিক চেনেন । প্রেমিক প্রেমিকাকে আলিঙ্গন করতে থাকেন মনের তাপে, আর রোজ আলিঙ্গন করতে করতে বুঝতে পারেন তাপের তারতম্য , ডিম্বাণুর আবির্ভাব। তাঁরা প্রেমটুকু চেয়েছিলেন , বীজটুকু নয়। তাই নিরোধ প্রক্রিয়া , অদ্ভুত আত্মনিয়ন্ত্রণ । মায়া নিরঞ্জনকে সেই প্রেম শেখান যাতে শরীর বড় হয়েও ওঠে না অযথা , ছোটও হয় না। যতটুকু আসে সহজে আসে। এই প্রথম নিরঞ্জন কোনো নারীর আলিঙ্গনে উত্তেজিত না হয়ে শান্ত হন।
      এখানে খুব সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে দুজন মানুষের একে অন্যকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার আনন্দ। এখানে নিরঞ্জন ঘড়ির অভাবে মায়ার মাসিক বা ঋতূস্রাব এর দিন গুলিকে গাছের গুঁড়িতে খোদাই করে রাখেন । আর হিসেব রাখেন দিন মাস বছরের । "Metaformic theorists also discuss how cultures, like the Romans and Gaelic used the same words for menstruation and the keeping of time, while the Mayan calendar was directly influenced by women's menstrual cycles."(উইকিপিডিয়া থেকে উদ্ধৃত) উইকিপিডিয়া আর গুগল আমাদের বলে দেবে , মহাজাগতিক ক্যালেণ্ডারটি অনেক ক্ষেত্রেই কিভাবে প্রাচীন কালে নারীর শরীরের ঋতূচক্রের দিকে তাকিয়ে বানানো হয়েছিল । কখনো উনত্রিশ কখনো ত্রিশ দিনের বিরতিতে।
      এই প্রেমে এক মানুষী বলেন আমি সবটুকু দেব, আর পুরুষটি বলেন আমি সবটুকু নেব । আর ঋতূস্রাবের পরে প্রেমিক ধুইয়ে দেন পরম আদরে প্রেমিকার রসস্থল , আরণ্যক দিনে ।
      ঊর্ধ্বগামী ভালোবাসা (সখীর জন্যে বীজ শুয়ে আছে বরফে)
      শরীরের ভালোবাসাকে আমরা মাঝে মাঝেই একটু নিম্নমানের বলি, পর্দা তুলে দিই । "রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়" । যেন কামগন্ধ খারাপ বস্তু । যেন আমাদের সব্বার উৎস্য লজ্জার । এই ক্রিশ্চান ওরিজিন্যাল-সিন এর পাপবোধ যা আমাদের উপরে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে , যে পাপবোধ থেকে আজ বহু মেয়ের অঙ্গ কেটে দেওয়া হয় যাতে তারা "শয়তানি আনন্দ" উপভোগ না করে শুধু সন্তান প্রসবের যন্ত্র হিসেবে নিজেদের বহন করতে পারে, সেখানে মিলি একদমকা খোলা হাওয়া । মিলি কিশোর আনাড়ি নিরঞ্জন কে "ভালোবাসতে" শেখায় । তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজেদের শরীর নিয়ে খেলে , জানতে পারে যান্ত্রিক ভঙ্গীতেই বিভিন্ন আনন্দের উৎস্যমুখ । সে তো সেতার বাজাবার আগে টুংটাং টুকু না করলেই নয়।
      মিলি ভালোবেসেছিল কংকালকে। নিরঞ্জন ভালোবাসেননি সেই অর্থে। তিনি তখন-ও পুরুষ নন। বৃন্দাবনবিলাসী কিশোর , যে পালিয়ে যাবে , পালিয়ে গেছে। কিন্তু মিলি বিয়ে করেন নি । আর নিরঞ্জনের সন্তান পাওয়ার জন্যে জোরাজুরিও করেছেন বহু বছর পরে দেখা হলে ।
      নিরঞ্জন ভালোবেসেছেন মায়াকে । কিন্তু মিলির জন্যে মৃত্যুর আগে রেখে গেছিলেন শুক্র, ডাক্তারের কাছে ।
      মিলি সন্তান চেয়েছিল, মায়া চায়নি । এখানে শিষ্ণ থেকে উঠে গেছে ভালোবাসা হার্ট এ । কি মন্ত্রে কে জানে।
      এক্ষেত্রে মলয় রায়চৌধুরীর একটি ইণ্টারভিউ মনে পড়ে গেল Alexander Jorgensen কে দেওয়া। " Alex: If you could walk a mile in whatever circumstance, where would you choose to do it ?
      Malay : I would go to the bank of river Ganges, at the place where I had kissed my Nepali classmate Bhuvanmohini Rana. My first and memorable kiss. I do not know where she is now. Must have become old or might have died ; she was two years older than me. I would sit at the same spot at the same time of autumn evening to revisit her tenderness." । আমার যেন মনে হয় ভুবনমোহিনী কোথাও মিলি , তার সমস্ত কোমলতা নিয়ে, যেখানে নিরঞ্জনের কৈশোর আটকে আছে।
      মায়ার সত্যি নিরঞ্জনের সত্যি , মায়ার জীবনদর্শন
      কাহিনীটি তো ডিটেকটিভকে নিয়ে। সত্যানুসন্ধান ! Akira Kurosawa র Rashomon যেমন দেখিয়ে দেয়, বিষয়গত তথ্য আর বিষয়ীগত সত্য এক নয় , প্রেমিক নিরঞ্জন ও প্রেমিকা মায়ার সত্যিও আলাদা।
      মায়া আধুনিক , কিন্তু পুনরাধুনিক। তিনি জানতে চেয়েছেন জীবনের যাপনগত সত্যটা । মানুষ ঠিক কোন আঙ্গিকে সভ্য , জীবহত্যার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবীতার মাধ্যমে বাঁচা যায় কিনা, তাই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই দুধের শিশুকে ছেড়ে, স্বামীর ও সমাজের দেওয়া অসহিষ্ণুতা ও অপমান থেকে পালিয়ে যেতে , তিনি "খপ করে" নিরঞ্জনএর হাত ধরে বলেছিলেন "চলুন পালাই " ।
      “No, it is impossible; it is impossible to convey the life-sensation of any given epoch of one’s existence--that which makes its truth, its meaning--its subtle and penetrating essence. It is impossible. We live, as we dream--alone.” -- Joseph Conrad এই জাতীয় উক্তি কে মেনে নিতে পারেননি ইংরাজির ছাত্রী মায়া পাল। নিরঞ্জন লিখেছেন , "সে আমাকে টমাস হবস, জোসেফ কনরাড, অ্যান্টনি বারজেস, উইলিয়াম গোলডিং আরো কারা কারা যেন, প্রতিটি নাম মনেও নেই এতদিন পর , এনাদের লেখালিখির কথা শোনাতো । তার জীবনের অতীতসূত্র কেবল এই সাহিত্যদর্শনকে ঘৃণা । তার অতীত সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানি না, সে বলতে চায়নি । বলত ওনারা জীবনের ভুল ব্যাখ্যা করে গেছেন । ওনারা নাকি বলে গেছেন একজন মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত, সে একাকী, কেউ নেই তার, যত বৈভব থাক না কেন সে প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র , পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল, জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট ও বর্বর । সে বলত, জীবনের এই আশাহীন দৃষ্টিকোণ অসত্য । "
      কিন্তু নিরঞ্জন এর সত্য আলাদা। তিনি মূলতঃ প্রেমিক । তিনি নিজেকে দেখেন এইভাবে -"মায়ার পাশে বসে একই ভাবনা ঘুরছিল আমার মগজে, যা বহুকাল থেকে বাসা বেঁধে আছে । তা এই যে, আমি একজন কুকুর । যে মালকিনির হাতে পড়েছি, সে যেরকম চেয়েছে, যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছি : প্রেমের কুকুর, কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর , পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, অনধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই আছে । থাকবে । এখন টাইপ করতে বসেও জানি, লেজটা অমনই রয়েছে ।" এই আকাশমুখী লেজ এই গণিতবিদের জীবনচেতনা ।
      নিরঞ্জনের জীবনচেতনার অন্য একটি দিক দেখা যায় , তাঁর চেতনায় "পবিত্র" শব্দটির অভিঘাতে । নিরঞ্জন লিখছেন - "আমার দিকে না তাকিয়েই মায়া বলেছিল, আমরা সারা জীবন নিজেদের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞের পবিত্র গভীরতায় রাখব । তুমি-তুমি ওগো-হ্যাঁগোর ছেঁদো নোংরা রুটিনে বাঁধা পড়ব না। বলেছিলুম, পবিত্র ? এই ধরণের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না প্লিজ । "
      নিরঞ্জন এক জমির মতন পড়ে থাকেন সমস্ত জীবন । নানান মেয়ে , মহিলা তাঁর উপর দিয়ে বয়ে যান , তাঁকে উর্বর করেন , তাঁকে ভেঙ্গে দেন । তাঁর ল্যাণ্ডস্কেপ পালটে দেন। এভাবেই মানবজমিনের চাষ করে গেছেন নিরঞ্জন । শেষ দিন অবধি। তিনি কোনো মহিলা কে "ডিমিন" করেন নি কখনো । দেহ ব্যবসায়িনীর "গিগলিং" টুকুকেও নয়। "পৃথিবী নামের ছোট্টো দ্বীপটায়, নারী ছাড়া আমি একা, নিঃসঙ্গ, অন্তরীণ । জীবনে নারী নেই ভাবলেই মনে হয় মরে যাবো, মরে যাচ্ছি, মরে গেছি ; ফাঁকা, ফোঁপরা, খালি । জানতেই পারতুম না আহ্লাদ কি, আঘাত কি, বেদনা কি, হাহাকার কি । " - নিরঞ্জন এমনই ভাবেন, বলেন , বাঁচেন। এই নারীসঙ্গ ইচ্ছা সামগ্রিক শারীরীক কাম নয় একেবারে। তিনি শেষ বয়সেও ‘শেষনীর’ সঙ্গ চান উত্থানরহিত অবস্থায় । যেমন "অ্যালিস ইন দ্য ওয়াণ্ডার ল্যাণ্ড" এর লেখক লুই ক্যারল এর স্নেহের ডাকে খোকারা সুবিধে করে উঠতে পারতো না। তিনি খুকিদের বলতেন গল্প শুনতে আসতে। আর বলতেন ভাইদের ঘরে রেখে এসো । যে তার যে সুরে বাজে, সে তার সেই সুরেই বাজে । অন্যথা পচে যায় , যেমন আমরা পচে যাই অহরহ ।
      সত্যানুসন্ধান কি? ভিলেন কারা কারা ? কাঠগড়ার এপারে ওপারে ।
      ফেলুদা, ব্যোমকেশ , কাকাবাবু সন্তু এই সব্বার থেকে আলাদা নোংরা পরী , ডিটেকটিভ রিমা খান । ১) তিনি পুলিশ , সখের গোয়েন্দা নন ২) তিনি মহিলা, প্রথম , একমাত্র মহিলা সত্যানুসন্ধানী বাংলা উপন্যাসের । তিনি ক্ষমতাশালী, ইনফর্ম্যার কনস্টেবল ইত্যাদি প্রয়োগে সমর্থ । যদিও তিনি সাসপেণ্ডেড । ববিটাইজ-করার ভয় দেখাবার প্রক্রিয়ায় নোংরা ।
      রাষ্ট্রই ভিলেন নম্বর ওয়ান
      এই উপন্যাসে, প্রথম বাংলা উপন্যাসে আমরা দেখতে পেলাম অপরাধ জগতের ব্যক্তিনির্ভরতার ঊর্ধ্বে সিস্টেমটাকে । আমরা দেখতে পেলাম রাষ্ট্র কোথায় অপরাধী । কিভাবে তুরুপ উপজাতির মানুষদের উৎখাত করে ফেলে খনি-মাফিয়া খনির লোভে । কিভাবে ক্যাপিটালিজম এর , ব্যবসায়িক উদারনীতির , শিকার হয় অরণ্যের মানুষ । যাদের রাষ্ট্র কিচ্ছু দেয় না, যাদের "সমাজ" ব্যবস্থা , নীতি ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র স্বীকারই করে না , যাদের ভোটাধিকার নেই, পৌরসুবিধা নেই , তাদের কিভাবে অনায়াসে একটি মাত্র পুলিশ চৌকির অন্তর্গত করে ফেলে রাষ্ট্র। মায়া ও নিরঞ্জন যখন তুরুপ গোষ্ঠীর বাচ্চাদের শিক্ষিত করতে থাকেন , কিভাবে সেই মানবিক প্রচেষ্টাকে পুলিশ অবলীলায় বলে "উপজাতিদের পড়াশুনা শিখিয়ে তোমরা যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছিলে সে সংবাদ আছে আমাদের কাছে ।" এই ভারসাম্য ফেরত আসে , যখন সমস্ত আদিবাসী অরণ্য ছাড়া হয়ে খনি শ্রমিকে পরিণত হয়। কনজিউমার সোসাইটির প্রয়োজন তো সত্যই , কিন্তু আরণ্যক উপজাতির সত্যটুকুর কোনো দাম থাকে না রাষ্ট্রের চোখে । সবুজ নষ্ট হয়ে যায় । মাটিতে বড় বড় হাঁ করা গর্ত তৈরি হয়। কারণ খুঁড়েছে মাফিয়া, কোন বিবেকবান রাষ্ট্র নয় ।
      মায়ার "আচ্ছা চলি"র পিছনে রাষ্ট্র নামক ভিলেনের কি অবদান তা বোঝার জন্যে পড়ে দেখুন উপন্যাসটা
      ভিলেন নম্বর দুই
      বলব না। তাহলে আর কী পড়ে দেখবেন । কিন্তু রিমা বুঝতে পেরেছিলেন ভিলেন কে। কংকাল প্রেমিকের ঘাতক কে । আর সেই ভিলেন কে বানিয়েছিল মধ্যবিত্ত সমাজের হাশহাশ নীতি, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা । যারা ভালবাসা দেখতে পায় না। ভালবাসার অভাব দেখতে পায় না । পবিত্র বিবাহগ্রন্থির নীচে চেপে রাখতে চায় সব রকম অতৃপ্তির চিৎকার । আর গ্রন্থিমুক্ত হতে চাইলে আঘাত করে সেই মানুষটিকে সুপরিকল্পিত ভাবে।
      ভিলেনের স্মৃতিসৌধ
      মায়ার "আচ্ছা চলির" পরে , মায়ালিঙ্গার পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হবার পরে , তুরুপ প্রজাতির জঙ্গুলে মানুষই পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনে নিরঞ্জনকে। মায়া ছিলেন তাদের জন্য শিক্ষিকা , মাতৃরূপিণী , জীবন্ত দেবী , আম্মা। আর মায়াগারু সেই দেবীর জীবনের অঙ্গ । তুরুপ গোষ্ঠীর এই মানুষদের সমাজচেতনা আলাদা। তারা মায়া-নিরঞ্জনকে গ্রহণ করেছিল খুব সহজ ভাবে , বর্তমানে নির্ভর করে, তাদের অতীত না খুঁড়ে। তাঁদের চলে যাওয়ার পরে তারা কুঁড়ে ঘরটাকে মন্দিরের সম্মান দেয় । কোন বিগ্রহহীন মন্দির। কিন্তু মায়ার আকস্মিক প্রস্থানের জন্য দায়ী ক্ষমতা গোষ্ঠী , কুঁড়েটাকে ধর্মের দোকান বানিয়ে ফেলে অচিরেই । বহু পরে রিমা খান অকুস্থলে গিয়ে দেখতে পান, এক অদ্ভুত মূর্তি সহকারে মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে । সেখানে মায়া পাল-এর ভাবমূর্তি বেচে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে খনি-মাফিয়ার দল বেশ দু পয়সা আয়ও করে নিচ্ছে ।
      এভাবেই আমাদের দেশে সতী প্রথা থেকে শুরু করে অনার-কিলিং অব্দি বিভিন্ন ভাবে একটি মেয়ের সত্ত্বা ও অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর তাকে "ধার্মিক" প্রমাণ ক'রে , দেবী প্রমাণ ক'রে, তার ব্যক্তিসত্তা ছিনিয়ে নিয়ে সমাজ তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় নিজের মধ্যে ।
      যৌনতার অর্ধেক আকাশ ,যান্ত্রিক ও মানবিক অরগ্যাজম , অশ্লীল মলয় রায়চৌধুরী
      মায়া
      মলয় রায়চৌধুরী সেই অর্থে অশ্লীল যে অর্থে ডি এইচ লরেন্স বা গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ অশ্লীল ছিলেন । যখন 'লেডি চ্যাটার্লিস লাভার্স-এ কনির মনে হয় নারীকে তার নারীত্ব থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে আজকের পুরুষ আর সমাজ , বহু বায়বীয় কথার মধ্যে দিয়ে তার শরীরী রহস্য আর দেহোত্তীর্ণতা দুটোকেই নষ্ট করছে, তখন কংকাল প্রেমিক পরম যত্নে ধুইয়ে দেন প্রেমিকার অঙ্গ প্রেমিকার অনুজ্ঞায় , ঋতূস্রাবের পর । এই স্পর্শ আমাদের পরিচিত যৌনতার থেকে অনেক ঊর্ধ্বে । এখানে ভালোবাসা যে-কোনো ইজমকে অতিক্রম করেছে। লজ্জা ঘৃণা ভয় ত্যাগ করেছেন কৃষ্ণ এখানে , শুধু রাধা বা গোপিনীর দল নয় । এই ভালোবাসায় নিরঞ্জন নিষিক্ত হতে থাকেন মায়ার সঙ্গে , সভ্যতা-ছেঁকে পাওয়া সভ্যতায় ।
      মিলি
      মেয়েদের যৌনতাকে সমাজ সাধারণতঃ অশ্লীল মনে করে। এই উপন্যাস-এ লেখক সেই ঢেকে যাওয়া অর্ধেক আকাশকে টেনে নিয়ে এসেছেন অনেকখানি । নিরঞ্জনের কৈশোরে মিলি , তাদের খেলাধূলোয় কেবল কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা দেখায় না। সে আগে নিজে তৃপ্ত হয়ে নেয় নিরঞ্জনের মাধ্যমে । তারপর নিরঞ্জনকে নিয়ে যায় শিখরে । এই দেয়া নেয়ার সহজ হিসেবটুকু এই টেণ্ডারনেসের সঙ্গে আমি সচরাচর পাই নি কোন বাংলা উপন্যাসে । এই প্রসঙ্গের অবতারণা যখনই হয়েছে, কিছু বিকৃতির সঙ্গে করা হয়েছে । আবার লরেন্সের থেকে ভাবটি উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করে- স্পর্শ ছাড়া কিই বা টিকে থাকে , শেষ পর্যন্ত দেহে মনে অস্তিত্বের শিকড়ে ? যদি স্পর্শ তেমন স্পর্শ হয় ।
      রিমা খান
      RACHEL P. MAINES এর "The Technology of Orgasm "Hysteria," the Vibrator, and Women's Sexual Satisfaction" রচনা যেটি Johns Hopkins University Press থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, তার প্রথম পরিচ্ছেদের নাম হলো " THE JOB NOBODY WANTED " যে-কাজটি-কেউ-চায়নি । শতকের পর শতক মেয়েরা তাদের যৌন চেতনাকে ঢেকে রেখেছে , সেবামূলক ও প্রদান-ভিত্তিক মিলনের আড়ালে। তাই তার চেপে রাখা "হিস্টিরিয়া" টুকুকে কখনোই অনুরণনে পরিণত হতে দেয় নি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ । সেটা শুধু চিকিৎসা-সাপেক্ষ গোঙ্গানি হয়ে থেকে গেছে। তাই রিমা খান যখন ডিলডো ব্যবহার করে খুশী হয়, তৃপ্ত হয় , ফুরফুরে হয় , আমি তখন আবার উদ্ধৃত করি " When the vibrator reemerged during the 1960s, it was no longer a medical instrument; it had been democratized to consumers to such an extent that by the seventies it was openly marketed as a sex aid. Its efficacy in producing orgasm in women became an explicit selling point in the consumer market. The women's movement completed what had begun with the introduction of the electromechanical vibrator into the home: it put into the hands of women themselves the job nobody else wanted. " RACHEL P. MAINES এর রচনা থেকে ।
      আমি এই "অশ্লীল" , নারীবাদী , মানবতাবাদী লেখককে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
      উপন্যাসের ফর্ম , Anachronism , সাহিত্যের ডিটেকটিভদের টাইম ট্রাভেল , রাজনৈতিক গণহত্যা ও ডিটেকটিভ বিলাসিতা
      টাইম ট্রাভেল ও ডিটেকটিভ দের চোখে সামাজিক অবক্ষয়
      এই উপন্যাসে বেশ কটি মজার পয়েণ্ট রয়েছে । Anachronism বা সময়ের হেরফের ব্যবহার করে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ কনফারেন্সে মলয় রায়চৌধুরী আবির্ভূত করেছেন দেশ বিদেশের বহু সত্যান্বেষীকে , সাহিত্যের পাতা থেকে উঠিয়ে তাদের জীবন্ত করে তুলে, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাতে চেয়েছেন আজকের সমাজে ডিটেকটিভদের অপ্রাসঙ্গিকতাটুকু ।
      দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ কনফারেন্সে "প্রায়ভেট ডিটেকটিভ এসেছিলেন চেন কাও , ডেভিড স্মল, নিও উল্ফ, ভি আই ওয়ারশসস্কি, শন স্পেনসার, স্যাম স্পেড, শার্লক হোমস, কিনসে মিলোনে, এরকিউল পয়েরো, লিউ আর্চার, পল আর্টিজান, লিন্ডসে গর্ডন, জো ক্যানোলি, রেক্স কার্ভার, এলভিস কোল, হ্যারি ড্রেসডেন, ড্যান ফরচুন, ডার্ক জেন্টলি, এলেনি কুইন, এমারসন কড, কেট ব্যানিংগান, ক্লিফ হার্ডি, মাইক হ্যামার, টমাস ম্যাগনাম, ভেরেনিকা মার্স, ফিলিপ মারলো, জিম রকফোর্ড, জন শাফ্ট আর ম্যাথিউ শাডার ।" দেবেন্দ্রবিজয় , অরিন্দম , বাংলাদেশের কিশোর পাশা, মাসুদ রাণা আর মুসা আমন; আমাদের হুকাকাশি, কল্কেকাশি, নিশীথ রায়, ইন্দ্রনাথ রুদ্র, জয়ন্ত-মাণিক-সিন্দরবাবু জুটি , গুপি-পানু-ছোটোমামা জুটি, গোন্ডালু, কিকিরা, পাণ্ডব গোয়েন্দা, ট্যাঁপা-মদনা জুটি, গোগোল এরাও সবাই দেখা দিয়েছেন কনফারেন্সে ।
      এঁরা সব্বাই একবাক্যে বলেছেন, যেখানে দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পচছে , রাজনৈতিক ফুসলানিতে তৈরী দাঙ্গায় মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ , সেখানে খুচরো দু একটা খুনের কিনারা করতে গোয়েন্দা পোষা , বিলাসিতা মাত্র, সরকারের ধুলো দেয়া জনতার চোখে । এইভাবে সাহিত্যের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সাহিত্যের সমালোচনা অভিনব ও বেনজির ।
      সংক্ষিপ্ত উপন্যাস এর সুবিশাল গণ্ডী
      এই উপন্যাসটি অত্যন্ত চটি , টানটান । এটি সম্ভব হয়েছে একটি বিশেষ ফর্মের কারণে । সেটা হলো , ফ্ল্যাশব্যাক বা ডায়রি-লিখনের মাধ্যমে উপন্যাস এর বেশীরভাগ অংশ বর্ণিত হয়েছে। কঙ্কাল প্রেমিকের অতীত , রিমাখানের বর্তমান, এই দুই এর মধ্যে ঘুরেছে সমস্ত ঘটনা । অতি স্বল্প পরিসরে ভালোবাসা, সামাজিক সমস্যা , রাজনৈতিক কূটকচালি আর একটা লোমহর্ষক গোয়েন্দাকাহিনী এক সাথে বর্ণিত হয়েছে । লেখকের "অরূপ তোমার এঁটোকাটা " উপন্যাসেও ডায়রি লিখনের মাধ্যমে খুব স্বল্প পরিসরে অনেকটা ক্ষেত্র দেখানো গিয়েছিল । এই পদ্ধতিটি বেশ অভিনব বাংলা সাহিত্যে , যদিও কিছু কিছু এমন নজির আছে (যেমন "স্ত্রীর পত্র" শুধু পত্র লিখনের মাধ্যমে জীবনের সত্যিটুকু তুলে ধরতে পেরেছিল )।
      পুলিশের গোয়েন্দাগিরির পদ্ধতিটাও খুব ভালো ভাবে ধরা পড়েছে এখানে, যে পদ্ধতি শখের বা প্রাইভেট গোয়েন্দার পদ্ধতির চেয়ে অনেক আলাদা। ইনফরম্যার-এর ব্যবহার, ছিঁচকে অপরাধীকে ভয় দেখিয়ে ছোটখাটো কাজ করিয়ে নেওয়া , ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট এর মতামত নিয়ে আইনতঃ প্রমাণ সাজানো , দরকার পড়লে অনিচ্ছুক লোকের বাড়ির ফোনের তার কেটে টেলিফোন কোম্পানির লোক সেজে ঢুকে পড়ার ফিকির ইত্যাদি অনেক রকম উপায় সম্পর্কে আমরা অবহিত হই ।
      আবার কোন একটি কেস হঠাত করে পুলিশের কাছে দরকারি হয়ে পড়ে কেন, জমির বা রিয়াল এস্টেটের মাফিয়া কেন চায় যে একটা কোন সম্পত্তি দুর্নাম মুক্ত হোক, তা সে সত্যি বার করেই হোক বা বিশ্বাসযোগ্য সত্যি ক'রে , এই নানান জটিলতা ধরা থাকে এই উপন্যাসে ।
      মলয় রায়চৌধুরী নিজেই এই উপন্যাসের একটি চরিত্র হয়ে শেষ দৃশ্যে উদয় হন ; কাহিনির সত্যতাকে পাঠকচেতনায় সংশয়ে রাখার প্রয়াসে । আর উপন্যাসের শেষে , অন্ততঃ একজন অপরাধীর উত্তরণ দেখা যায় মানুষ হিসেবে।
      শেষকথা
      সবটুকু মিলিয়ে বলা যায় যে এরকম প্রেমের উপন্যাস , যা কিনা অনেকগুলি বহুমুখী সত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা বহুভূজের মধ্যে আমাদের এক অন্যরকম জীবনচেতনার মুখোমুখি করে দেয়, খুব বেশী লেখা হয় নি বাংলা ভাষায় । বিষয় বৈচিত্র ও সাহসী মনোজ্ঞ বর্ণনায় এই উপন্যাসটি বড্ড আলাদা, উৎকেন্দ্রিক , ঠিক এর লেখকের মতোই । পড়ে দেখতে পারেন সময় করে । মনের জটগুলো খুলে যাবে (অন্ততঃ আমার তো গেছে ) , আলো আসবে মনে।
       
       
       
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.177.62.180 | ০৭ নভেম্বর ২০২১ ১৮:৩১735092
  • অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ অনেকান্ত কথকতা
    মলয় রায়চৌধুরীর ৪৬ পাতার নভেলা- অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা । উপন্যাসের চারটি কথক। লেখক মলয় রায়চৌধুরী, বারানসীর নকশালপন্থী পেইন্টার্স দলের এক সদস্য চিত্রকর নির্মল এর পিতা, সরকারী চাকুরে ও অতলান্ত প্রেম-বিলাসী শিশির ও বেনারসে মন্দির-ব্যবসা-সফল সাহসিনী কেকা। শুরুতে লেখক কথকতাটা নিজেই করেন, কাহিনীর চরিত্রগুলি ও সূত্র ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। এরপর বাকী তিন কথক তিনটি ভিন্ন সময়ে এই আখ্যান লিখে যাবেন। তিনজনই ডায়েরী লেখক। বলা ভালো একটিই ডায়েরী । মানে একই খাতা। আর তার কাগজে তিনটি ভিন্ন সময়ে তিন কথক আঁচড় কেটে রাখেন। তাই নিয়েই এগোয় আখ্যান। ডায়েরীটির প্রাথমিক এবং আসল মালিকানা বারানসীর নকশালপন্থী পেইন্টার্স দলের সদস্য নির্মল এর পিতার। এঁর কথকতাটি মূলত প্রাবন্ধিক ধাঁচার দিনলিপি । রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের র‍্যান্ডম নোট্স্‌। ডায়েরীটি হাতবদল হয় কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র শিশির মারফৎ। মানে শিশির ডায়েরীটি হাতসাফাই করে। নির্মলের বাবার নোট্স্‌ের খাঁজে খাঁজে ফাঁকা পাতা । সেই ফাঁকা স্পেইস- আর তা ভরে ওঠে শিশিরের বারানসী বসবাসের প্রায়-প্রাত্যহিক দিনলিপিতে । যা মুখ্যত দুই নারী- ভাইকিং বংশজাতা আমেরিকান তরুণী ম্যাডেলিন ও কেকা নাম্নী অন্ত্য-ত্রিশের বাঙ্গালিনীর সাথে তার শৃঙ্গার ও সঙ্গমের এরোটিক কলমদিহি।
    এই ডায়েরী-পাতায় মলয়ের কথকরা পাঠকের সাথে কথা বলে চলেন। মনোলগের ঢং তাতে। সেই কথা তাদের নিজেদের সাথেও। নির্মলের বাবার চরিত্রটি গড়ে তোলেন না লেখক। তিনি নেহাতই ইতিহাসের কথক। এর বেশী তার সম্পর্কে কোন তথ্য লেখক আমাদের দেননা। যাত্রা-ফর্মের বিবেকের মত এই কথকের সংযোজনে এক ব্রেশটীয় বিচ্ছিন্নতা তাই আমদানী সম্ভব হয়েছে। শৃঙ্গার, রতিক্রিয়ায় ভরপুর পাল্প-ফিকশনের ধাঁচায় যে ‘কজালিটির’ খেলা চলতে থাকতে পারত, তাকে প্রথমেই ভাঙ্গার কাজটি করছে এই বিচ্ছিন্নতার উপপাদ্য। যাকে পরে আরও ভাঙছে উপন্যাসটির উদ্দেশ্যমূলক ‘এরোটিকা’ । যা নির্মাণের উদ্দেশ্য- ‘মধ্যবিত্তের নীতিমুলে’ শৈল্পিক লাথ। কামসূত্রের দেশে, পোস্ট-কলোনিয়াল গো-মল আর গোমূতের ছানবিন, আর কলোনি-পুর্ব মোজা পরা ভিক্টোরীয় সমাজ-পুলিশীর লিগাসিকে মলয় প্রশ্ন করেছেন ষাটের দশক থেকেই।হাংরিদের এটি মুখ্য এজেন্ডাও বটে । কিন্তু বাংলাবাজারে সেক্সকে ট্যাবু-মুক্ত করতে লেখালিখিতে সেক্সিস্টও আখরও কেটে রেখেছেন। দুর্দান্ত প্রাবন্ধিক মলয়ের গদ্য-পদ্যের এটিই সর্বাপেক্ষা অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। এই উপন্যাসেও তা চোখে পড়েছে, তবে তা ছাপিয়ে ওঠার মত শান্‌-দার অধুনান্তিক মেহ্‌ফিলটিও তিনি রচনা করে দিয়েছেন।
    এবং উপন্যাসের ধাঁচাটি ক্রমে বিশ্ব-স্থানিক, বহু-কথক, এক্সটিক লোকেল, এরোটিকা ও তার বিনির্মান এসবের আন্তর্জাল থেকে বহুস্বরিক হয়ে উঠল। বাংলা সাহিত্যে এইভাবে বহুস্বরিক হয়ে ওঠার বা তার অবসর নির্মান করার ক্র্যাফটটি তেমন জনপ্রিয় নয়।
    “আমার কোন স্থির কেন্দ্র ছিলনা।”
    স্থির কেন্দ্র, ঘুর্ননের আপাত স্থির বিন্দু- যাকে জন অ্যাশবেরী ‘আ হিম টু পসিবিলিটি’ বলে থাকেন, তা এই নভেলাতে ঘেপ্‌টে আছে জটিল এক কেমোফ্ল্যাজে।
    তিনটি ভিন্ন ডেমোগ্রাফির তিন কথককে উপস্থিত করে যে আখ্যানের বুনন তার স্থির কেন্দ্র দুটিঃ এক- পোস্ট কোলোনিয়াল ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত। ভারতবর্ষ, তরুণতর মেধাবী বাঙ্গালীর রাজনৈতিক সচেতনতা আর তার উত্তাল অভিমুখ; দুইঃ গ্লোবাল কানেকশন- আমেরিকার হিপ্সটার আন্দোলনের তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছিল, ষাট থেকে সত্তরের প্রথম ভাগে- নেপাল থেকে বারানসী। গুরু থেকে গাঞ্জা। বেলাগম সেক্স। তুলকালাম মাদক। অব্যর্থ শূন্যের ভেতর অনিশ্চিত জীবনের মানে খোঁজা। ভারত তখন হয়ে উঠেছে ঘরছাড়া হিপিদের হতাশ-নিরঞ্জন অভয়াক্ষেত্র- ইহমুক্তি খুঁজতে আসা শয়ে শয়ে মার্কিনি তরুন-তরুণী বারানসীর গলিতে গলিতে। এই বেনারসকেই বেছে নিয়েছেন মলয় তার নভেলার স্থানিক পট হিসেবে। কলকাতা থেকে বিকেন্দ্রীকরণ । আবার কলকাতা ও প্রবাস, বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্র ও প্রান্তিক, এই দুই বাইনারি ছাপিয়ে তা মলয়ের আত্মজৈবনিক প্রয়াসও। ষাটের দশক। সত্তরের প্রথম ভাগ। সারা আমেরিকা উদ্বেল, অসংযত । যৌন-মুক্তি, ভালবাসায় বিভোল ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পোর্টল্যান্ড, কলোরাডো থেকে নিউ ইয়র্ক। মাথায় ফুল লাগানো তরুণীরা, যুদ্ধবাজ মার্কিনি নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। ভিয়েতনামের নামে প্রতিবাদে উচাটন হচ্ছে বার্কলি থেকে প্রগতিশীল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। মানবিক হত্যার কাছে আস্থা হারিয়ে ভালবাসা খুঁজতে জড় হয়েছেন হেইট অ্যাশবেরিতে। ‘ভালবাসার একটি গ্রীষ্ম’ তাদের আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে, তারা ঘর ছাড়তে শিখেছেন বহর্বিশ্বের ডাকে ।যেমন বীটরা। আমেরিকা জুড়ে তখন তেমনই চূড়ান্ত চলছে বীট আন্দোলন।
    বীটরা এসে যাবেন, কারণ- মলয় ও হাংরিদের বিট-কানেকশন ও মিথ পর্যায়ের। মলয় আমাকে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন- হাংরিরা নয়, বরং বীটরাই অনেকভাবে হাংরিদের প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন।
    আমি ডেনমার্কে বিট সাহিত্য সেমিনারে সেই সাক্ষাৎকার দেখাই। সন্ধ্যের পানশালায় মারিহুয়ানা ফুঁকতে ফুঁকতে নস্টালজিক হয়ে যেতে বসা অ্যালবয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সরেনসন আমাকে রামকৃষ্ণের মত হাতের ভঙ্গিমা করে বল্লেন- কে কার থেকে কি নিল, তাতে কিবা এসে যায়। ভারতে যাওয়ার আগেই বীটরা স্বমহিমায়। আমি তাকে বুঝিয়ে বলি- মলয় সম্ভবত বলতে চান যে ভারত থেকে ফিরে গিন্সবার্গ যেসব রচনা লিখছিলেন- কথ্য ভাষা সাহিত্যের আদলে, তাতে হাংরিদের প্রভাব আছে। তবে হাংরিদের ওপরও বিট-প্রভাবের আস্তরণ ছিল বা মলয়ের ওপর, তার একটি বড় লক্ষণ- তার হিপিবেলা, কারণ পুরো হিপি আন্দোলনের ওপরই বিটদের চূড়ান্ত প্রভাব ছিল। মলয় নিজেই তার মেময়ারকে ‘হিপিবেলা’ নাম দিয়েছেন। আর তা রাজনীতি হোক বা বীট বা বীটহীন হিপি- ঝড়টা আসলেই বহির্বিশ্বের।এরোটিকা লিখতে বসে, এই বহর্বিশ্বের ঝড়কে উপেক্ষা মলয়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ তা ফলিত হচ্ছে সমানুপাতিক ভাবে । একদিকে মাও এর রাজনীতি, অন্যদিকে হিপি সংস্কৃতি। ভারতে উত্তর উপনিবেশকালে, চীনের চেয়ারম্যানের নামে প্রলেতারিয়েত সমাজ গঠনের শপথ থেকে, মার্কিনি দাদাগিরিতে হতাশ, দেহ, নেশা, মুক্তি, ভালবাসার খোঁজে উত্তাল একাংশ মার্কিন সমাজের হাউই-বাতাস, উভয়ই মলয়কে পুষ্টি দিচ্ছে।
    সানফ্রানসিস্‌কো রেনেসান্স, ষাটের বৈপ্লবিক হিপি চরাচর ও ভালবাসার গ্রীষ্ম, বীটদের সাইকেডেলিক আন্দোলন, হিপিদের ভারত-অনুসন্ধান পর্ব ছাড়া এ উপন্যাসের প্রেক্ষিতই গড়ে উঠতনা।
    এসব জড়িবুটি পেরিয়ে মলয়ের কাছে চ্যালেঞ্জ হল- তার এই কেন্দ্র থেকে সরে এসে তাকে লিখতে হবে এরোটিকা, মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির ভিক্টোরিয় নৈতিক পাছার ফুটো দেখিয়ে- অ্যাস্‌হোল ঘোমটা-যৌনতার নিধন করা। আর শেষমেশ সেটি একটি প্রেমের আখ্যানই হবে- নয়তবা সিডাকশন, নিও-শৃঙ্গার-শাস্ত্র। আর ধুমাধার সেই দুয়েন্দেতে- অব্যর্থ ভাবে সফল এই পলিফনি। ভিন্ন ভিন্ন ডেমোগ্রাফির কোলাজ-কথন।
    “Depart from the tune” – বিযুক্ত কর
    পড়ছিলাম অ্যান লডেরবাক্‌। দেখছি তিনি বলেন- “Depart from the tune” – বিযুক্ত কর, ফর্মকে ভেঙ্গে যে ফর্ম, তার মধ্যে বিশ্বকে খোঁজো’। আবার বীটরা আসিয়া যাইতেছেন। বারোজে যেমন দেখি ন্যারেটিভ, ফ্যান্টাসি, স্বপ্ন, হ্যালুসিনেশন খেলা করে। এই উপন্যাসেও মারিহুয়ানা, কেমিক্যাল ড্রাগস ছাড়াও ‘নেকেড লাঞ্চ’ এর মতই উপন্যাসের নামকরণে ফুড-মেটাফর এনেছেন মলয়। এঁটোকাঁটা আর ব্রাহ্মসাহিত্যের মত ‘অরূপে’র ক্লাসিক সহাবস্থান, ভারতীয় যৌথ মনোনীতিতে গুরু আর চণ্ডালের অমসৃণ মিলনের মত। পৌষ্টিক ক্ষুধা, মাংস, রুটি, সুরা এবং শৃঙ্গার ও কাম-ক্ষুধার কেমোফ্ল্যাজ-
    মেঝেয় নামিয়া দুইজনে, আদিম মানব মানবীর ন্যায় পোশাকহীন, রুটি-মদ্য-মাংস খাইলাম । লঙ্কা দেয় নাই বলিয়া, মাংস, যদিও নরম, ছিঁড়িয়া-ছিঁড়িয়া খাইল ম্যাডেলিন , ছাড়া কাপড় টানিয়া হাত-মুখ পুঁছিল । ওই একই পরিত্যক্ত পোশাকে আমিও হাত-মুখ পুঁছিলাম ।
    বীটদের মত সাইকেডিলিক ফ্যান্টাসি ও নেশার অদেখা জগতও এসে পড়ছে- যদিও তেমন জোরালো নয় : –
    “গাঁজার ধোঁয়ায় মগজে কত যে খেলা তৈরি হয় ! আমি তাহলে অক্ষয়-অব্যয় অপ্সরা, মধুবালা আর মাধুরী দীক্ষিতের মতন সমুদ্র মন্হন থেকে উঠেছি , তপস্যা নষ্ট করতে এক্সপার্ট । ” —- কেকা উবাচ
    আর শিশিরের জবানীতে,
    “শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন আঙ্গিক এবং চরস, আফিম, মারিহুয়ানা, এল এস ডি ক্যাপসুল এবং অটুলস ফ্যাগের পরিচয় করাইয়াছে ম্যাডি । মাদকগুলি আমাকে মধ্যবিত্তের নীতিবোধের ভ্রান্তি হইতে মুক্তি দিতে সাহায্য করিয়াছে । ম্যাডিই প্রস্তাব দিয়াছিল, সজ্ঞানে তো বহুবার হইল ; মাদকের অপার্থিব জগতে প্রবেশ করিয়া অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা উচিত আমার । বালকসুলভ যৌনতার সীমা অতিক্রম করা সম্ভব হইবে তদ্বারা ।
    সে কি আলো বিচ্ছুরণ ! নিঃশব্দ ফুলকির বৃষ্টিফোঁটা রূপান্তরিত হইয়াছে নানা প্রকার ফুলে । ম্যাডিকে কখনও মনে হইয়াছে পালক, কখনও মাখন, কখনও অশরীরী অট্টালিকা, যাহার ভিতর প্রবেশ করিয়া পথ হারাইয়া সাঁতার কাটিতেছি ।”
    সারা উপন্যাসে এটুকুই মাত্র সাইকিডেলিক আয়োজন। আর তার বিবরণও নেহাতই নগণ্য। সেই দিক থেকে এটি মুখ্যভাবে সাইকুডেলিক ন্যারেটিভের চরিত্র ও গঠন বজায় রাখছেনা। যদিও মাদক ও ড্রাগস ও তার সেবন প্রথম দৃশ্য থেকেই প্রায় পুরো বারানসী বৃত্তান্তে ছড়িয়ে আছে। হাংরীরা বারবারই জানিয়েছেন যে তারা কেমিক্যাল ড্রাগস এর নেশায় ছিলেননা, বীটদের মত। তাই বীট বা অন্যান্য সাইকিডেলিক রচনার সাথে এ উপন্যাসের মিল খুঁজতে যাওয়া বৃথা। বর্ননা যেটুকু আছে তা গড় সাইকিডেলিক মোটিফ বা সিম্বলের সাথে বিশেষ মেলেনা। আলো ও ফুলের মোটিফটি ছাড়া। সেদিক থেকে পাঠককে নিয়ে এসেও মাদকের অপার্থিব স্তরে ভ্রমণ করাতে মলয় নিতান্তই কাঞ্জুশি করেছেন বলব।
    ফিরে আসি ফর্মের আলোচনায়- তিনজন কথকের ডেমোগ্রাফি ভিন্ন। তাই বাক্যান্যাসের ব্যাপারে লেখক যত্নবান হয়েছেন। বাখতিন তার The Dialogic Imagination এ একথা উল্লেখ করেছেন যে – ‘পৃথ্বীটা পলিগ্লট অর্থাৎ বহুভাষক, হয়ে গেছে। আর উপন্যাস খুব সক্রিয়ভাবেই এই পলিগ্লট বিশ্ব নির্মান করতে সক্ষম’। ভাষার ভিন্নতা বা বহু ভাষা বলতে এখানে আমি ‘স্বর’ বোঝাতে চাইছি। তা মূলত ডেমোগ্রাফির ভিন্নতার কারণে। এবং একই ঘটনার বা প্রেক্ষিতের দুটি পৃথক উপস্থাপনার কারণে। কিউবিজমের ধাঁচায়- দুটি বয়ান- একটি শিশিরের অপরটি কেকার।
    উত্তম বচনে লেখা এই দিনলিপি আখ্যানে কেকা ও শিশির একটিই ন্যারেটিভের দুইটি পার্সপেক্টিভ দেওয়ার কাজ করে বা পরস্পরকে কমপ্লিমেন্ট করে। এখানে যেমন শিশিরের বয়ানে পাচ্ছি-
    “প্রাতঃকালের নয়টা-দশটা হইবে । লাল তাঁতের শাড়ি-ব্লাউজ পরিহিত, সম্পূর্ণ সিক্ত, চুল হইতেও জল ঝরিতেছে, এক ভারতীয় রমণী ঘরে প্রবেশ করিয়াই খিল তুলিয়া দিল । গঙ্গায় ডুব দিয়া ভিজিয়া গিয়াছি , শুকাইতে হইবে, বলিয়া এক-এক করিয়া সবকিছু পরিত্যাগ করিল, এবং আমার তোয়ালে লইয়া গা-মাথা পুঁছিতে লাগিল ।…এতই বিস্ময়াহত হইলাম যে, উঠিয়া, স্হিতি বোধগম্য হইতে সময় লাগিল । আত্মস্হ হইলে কন্ঠ হইতে নির্গত হইল, কেকা বোউদি, করিতেছেন কী, করিতেছেন কী ! কেকা বলিল, বউদি শব্দটি বাদ দাও, এবং এগুলি ছাদে শুকাইয়া দিয়া আইস, তারপর বলিতেছি । শুকাইতে দিয়া ঘরে ফিরিয়া দেখিলাম , অতুলের স্ত্রী বিছানায় শুইয়া সিগারেট ফুঁকিতেছে । নারীর বহু পোশাক ঘরে মজুত । অথচ সে নগ্ন, কোনো লজ্জা-সংকোচ নাই । বুঝিতে পারিলাম আমার কন্ঠ শুকাইয়া গিয়াছে, মুখ দিয়া কথা ফুটিতে সময় লাগিবে ।”
    এই একই ঘটনা আবার লিপিবদ্ধ হতে দেখি কেকার জবানীতে, এক পুরুষত্বহীন স্বামী, আরেক লম্পট প্রেমিকের যৌন প্রত্যাখ্যানে অনশনক্লিষ্ট, যৌবনময়ী সে বেঁচে নিতে চায় জীবন-
    “প্রথম দিনের ব্যাপারটা লিখতে গিয়ে শিশির কিছুটা বাদ দিয়ে ফেলেছে , বোধহয় উত্তেজনার বশে কিংবা নেশার ঘোরে লিখেছে বলে । আমার মনে হয়, ও হুহু করে লিখে গেছে, তারপর আর পড়ে দেখেনি । তার ওপর মাস্টারি-মার্কা বাংলা ।ও যখন ঘরে ঢুকে খাটের পাশে এসে দাঁড়ালো, মুখচোখ দেখে বুঝলুম ভীষণ অপ্রস্তুত, কী করবে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না । একেবারে অস্হিরপঞ্চক । ওকে স্বাভাবিক করে তুলতে আমি সিগারেটের ধোঁয়ায় পর-পর দুটো রিং ওর দিকে উড়িয়ে বললুম, এই নাও বরমাল্য, তোমায় স্বয়ম্বর-সভায় বরণ করে নিচ্ছি ।শিশির কিছুটা স্বাভাবিক হল , কিন্তু জিগ্যেস করে বসল, তুমি আর গান গাও না ? এরকম গাড়লপুরুষ যে হতে পারে জানতুম না । সামনে শুয়ে রয়েছে এক নগ্ন মহিলা , সেদিকে নজর দেবে, প্রশংসা করবে, তা নয়, গান ! তবে বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে বঙড়শিতে মাছ আটকে পড়েছে, এখন যদি আমি মুখ থেকে বঁড়শি খুলে নিই তবেই ছাড়া পাবে, নয়তো আটকে নিয়ে খেলাবো, খেলাতে থাকবো । পুরুষরা ভাবে যে তারাই বুঝি ছিপ ফেলে গিঁথে তুলতে পারে।”
    এরপরই ডায়েরী মালিকের ক্লাসিক-জবানীতে প্রায় গোদারীয় জাম্পকাট। কেকার জবানী থেকে পাঠক এসে পড়ছে নির্মলের বাবার দিনলিপির পাতায়। তার বচনে-
    “উৎপাদন ব্যাপারটা হয়ে উঠেছে সতত পরিবর্তনরত । আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনের কারণে, প্রাযুক্তিক দ্রুতির কারণে, শ্রমের তুলনায় পুঁজি থেকে সর্বাধিক লাভের কারণে, এবং অবশ্যই ভোগ্যবস্তুর বিশ্বায়নের কারণে । আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের আদলটাই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে । বহুজাতিক সংস্হা ও তার মালিকদের স্বদেশ বলে কিছু থাকছে না । আবির্ভাব হয়েছে বিশ্বব্যাপী মাফিয়া-ভাতৃত্বের । বাজারের কতৃত্ব হয়ে চলেছে বিকেন্দ্রিত । অথচ বহুজাতিকগুলোর কর্মকাণ্ড কেবলমাত্র পুঁজি, মাল এবং উৎপাদনের আনাগোনায় সীমাবদ্ধ নয় । তারা বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক নকশাগুলোর হেরফেরকারীও বটে । ব্যক্তিমালিকের পক্ষে আর ঊৎপাদনের বিশাল কারবার চালানো সম্ভব নয় বলে, সমাজ-সম্প্রদায়-রাষ্ট্রের হাতে উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সীমিত । নিয়ন্ত্রণ, নিয়ম, নীতি এক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়ায় টলমলে । সেহেতু সংস্কৃতির সনাতন ভৌগলিক বাঁধন আলগা হয়ে যায় । সংস্কৃতি হয়ে যায় ভাসা-ভাসা । সংস্কৃতি হয়ে গেছে ধাবমান ও যাযাবর । ক্লাব, সমিতি, গোষ্ঠী, যারা সংস্কৃতির ধারক-বাহক বলে নিজেদের মনে করে, আসলে তারা উত্তরদার্শনিকতার প্রতিভূ।
    উৎপাদনের আন্তঃরাষ্ট্রিকতা একযোগে হয়ে উঠেছে অভূতপূর্ব বিশ্ব একতার সুত্র, আবার পুঁজিবাদের ইতিহাসে অচিন্ত্যনীয় ভঙ্গুরতার উৎস। পুঁজিবাদের এখনকার জায়মান গল্পটি আর ইউরোপীয় ইতিহাসের প্রসারিত গল্প নয় । এই গল্পের আর কেন্দ্র থাকছে না । অর্থনৈতক ভঙ্গুরতার শক্তিবিকিরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে সাংস্কৃতিক ভঙ্গুরতা বা বহুসাংস্কৃতিকতা । এর ফলে ঘটছে সাংস্কৃতিক দেশান্তরণ, সীমানাগুলোর ( ভাষা, দেশ, জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠী, লিঙ্গ ইত্যাদি ) অপলকাভাব, পার্থক্য ও অসাম্যের তৃণমূল পর্যন্ত প্রসার, সমাজের ভেতরে-বাইরে ওই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সমরূপী হবার চাপ, স্হানিক ও বিশ্বের পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবেশ । এগুলো উত্তরদার্শনিকতার লক্ষণ ।”
    ক্লাসিক প্রবন্ধের কেত্‌দার, চোস্ত্‌, আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ। প্রাবন্ধিক মলয় যিনি উপন্যাসের কলমে নির্মলের বাবা, এই বচনের কথক। এতে এসে গাড়ি জুতছেন কেকা ।
    “একে তো কামুক ভোঁদাটা বিটকেল বাংলায় নিজের কাশীবাসের স্মৃতি লিখেছে, তাও আবার এমন ইজগুড়ি-বিজগুড়ি হাতের লেখায় যে তরতর করে পড়া যায় না ; তার ওপর মাঝে-মধ্যে ঢোকানো নির্মলের বাবার জ্ঞানবাক্যি ! হাতসাফাই যখন করলি, তখন ফাঁকা দেখে একটা খাতা নিতিস । নয়তো ছিঁড়ে ফেলে দিতিস নির্মলের বাবার লেখা জ্ঞানবাক্যির পাতাগুলো । ওনার দুয়েকটা পাতা পড়লুম । কী যা মাথামুন্ডু কিছুই তো বুঝলুম না । শিশির যেমন বাংলায় মাস্টারি ফলিয়ে কাব্যি করেছে, উনি তেমনি নিজেই নিজেকে জ্ঞান দিয়েছেন ।”
    লেখকের সূত্র অনুযায়ী ইনিই ডায়েরী মালিক। এই মূল অথরের ডায়েরিতে ঢুঁসো মেরে ঢুকে পড়ছে শিশির। কিন্তু পাতা ছিঁড়ে নিচ্ছেনা। প্রাথমিক অথরকে মারছেনা। রেখে দিচ্ছে ফাঁকা, সাদা পাতা ইতস্তত। কোন পরিকল্পনা ছাড়া। সেখানে জমে উঠবে কেকা’র ‘আত্মনং বিদ্ধি’- তার নিজস্ব বাক্যশৈলীতে, যা জীবন-তরতরে- প্রচলিত অভিজ্ঞান মতে- চটুল ও অ-ক্লাসিক। স্বেদ,ঘাম ও হমজায়েদী। এভাবেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে- কোলাজ-কথন।
    “ফাঁকে-ফাঁকে যেখানটায় লেখা হয়নি, শিশির আর নির্মলের বাবা যে পাতাগুলো ছেড়ে দিয়েছে; হয়ত আমার জন্যেই । সেখানে আমার কথাগুলো ঢোকাবো ।”
    মলয়ের পরীক্ষা-নিরিক্ষায় বাংলা সাহিত্যে এই বহু কথকের, একে অপরকে নির্মান-বিনির্মানের অধুনান্তিক ফর্মটি সাফল্যের সাথে থেকে গেল।
    দেহ,মন, অপর
    ‘আমি শিশিরের প্রেমিকা নই । শিশির আমার প্রেমিক ছিল না । তাহলে আমরা পরস্পরের কী ? আমি শিশিরের দেহটাকে ভালোবেসেছি । শিশির আমার দেহটাকে ভালোবেসেছে । সত্যি কথা বলতে কি, আমরা দুজনে যে-যার নিজেকে ভালবেসেছি । অথচ আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা নই । এরকম কাণ্ড তো সিনেমাতেও সম্ভব নয় । দেখাতেই পারবে না । আমি সত্যিই অপ্সরা, ঝড় দিয়ে গড়া অপ্সরা । আর শিশির হল বরফের মতন ঠান্ডা অন্ধকার দিয়ে গড়া বিশ্বামিত্র ।’
    ওপরের জবানীটি কেকার। কাহিনীতে বারানসীর দুইটি মুখ্য নারী চরিত্র- ম্যাডেলিন ও কেকা। কিন্তু মলয়কাপল-ফর্মেশন ঘটাচ্ছেননা। এদের মধ্যে প্রেম বা বিবাহ সম্পর্ক হয়না। দেহ ও মনকে ব্যবচ্ছেদ করে, দেহ ও মনের এই কামরা-ভাগ, প্রেমিক ও যৌন সঙ্গীর আলাদায়ন, এই নবীনতা, পোস্ট-আধুনিক অগ্রসরতা, বাংলা কেন তামাম সাউথ এশিয়ায় যথেষ্ট কষ্ট-মুমকিন, ভুলে যাবেননা উপন্যাসের ঘটনা ঘটছে ষাটের শেষ গোড়ায়, সত্তরে।
    আবারো কথা হোল – মলয়, শিশিরের চরিত্রকে, কামরাজ-কাম-সাধু (কেকার উক্তিতে, বিশ্বামিত্র) গোছের এক সমসত্ব শিশির ভেজা রস-মণ্ড তৈরি করতে চেয়েছেন। শিশির নামক এই কথক চরিত্রটির হাতে জাদু আছে। সে জানে কামকলার ছলা। সে নারী শরীরের প্রতিটি আহ্লাদ-বিন্দুকে জাগিয়ে তুলতে পারে। আগাগোড়া দুটি নারী চরিত্রের সাথেই তার সঙ্গমের যে কামশস্ত্র মূলক রচনা, তাতে কামের, শৃঙ্গারের কলা পারদর্শিতায় পুরুষের ভূমিকাই মুখ্য। ম্যাডেলীন ও কেকা উভয়ই শিশিরের কামকলায় তৃপ্ত হয়। কিন্তু তাদের যৌনমুক্তির বা অরগ্যাজম বা উদ্দীপনের সুতোটি শিশিরের হাতে বাঁধা থাকে। মানে দাঁড়াচ্ছে- শিশির বা তার মত কোন পুরুষই পারে নারী শরীরকে বাজিয়ে তুলতে, (প্রসঙ্গতঃ নারীর সমসাময়িক যৌনচেতনা একথা স্বীকার করবেনা, এনিয়ে বিস্তরআলোচনার অবকাশ আছে, এই আলোচনায় তার বিস্তৃতি ঘটালাম না ) যেমন জিমি হেনড্রিক্সঃ
    “ওঃ, জিমি হেনড্রিক্স ! ইনডিয়ায় আসিয়া এই প্রথম একজন ভারতীয়ের কন্ঠে জিমি হেনড্রিক্সের নাম শুনিলাম । গিটার তাঁহার হাতে যৌনতায় উত্তেজিত রমণীদিগের ন্যায় হইয়া উঠে ; যেনবা গিটারের অরগ্যাজম ঘটে ! শরীরে আনন্দের ঢেউ তুলিয়া ম্যাডেলিন কহিল। তদ্ব্যাতীত, অরগ্যাজম শব্দটি শুনিয়া প্রীত হইলাম । ইতোপূর্বে কোনো নারীর কন্ঠে এই শব্দটি শুনি নাই; বস্তুত, ভাষার ভিতরে যে আরাম প্রদানের ক্ষমতা হাছে তাহা মাঝে-মধ্যে অন্যের কন্ঠস্বর নিঃসৃত শব্দে অনেকসময়ে ফুটিয়া উঠে ।”
    (বিদেশিনী নারী চরিত্র ম্যাডেলিন )
    মানে যৌনতায় উত্তেজিত হতে গেলে জিমিকে বা জিমির মত কাউকে বাজাতে হয়। লেখক নারীর চাহিদায় সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছেন, কেকাকে কথক হিসেবে খাড়া করে আখ্যান বুনেছেন। নারী শরীরকে পরম মমতায় যত্ন করতে চেয়েছেন। কিন্তু নারীর যৌনতাকে পুরুষের কেন্দ্র থেকে চালনা করার ইচ্ছাও বার বার প্রকাশ করেছেন । এমনকি তা যখন নারী চরিত্রটির জবানীতেও বসানো হচ্ছে। উপন্যাসে নারীর যৌনতৃপ্তির পক্ষে সহমর্মীতা আছে। তবে দুটি নারীর ক্ষত্রেই সে প্যাসিভ গ্রহীতা। সবটুকু চালনা করে শিশির। আর অনাকাঙ্ক্ষিত হোল-
    “তুমি নায়কের ভূমিকা পালন করিবে , খলনায়ক হহিতে পারিলে আরও ভালো, তাহারা অমিতবিক্রমে রেপ করিতে পারে ।তাহারা অমিতবিক্রমে রেপ করিতে পারে। ”
    অথবা,
    সিক্ত তোয়ালেতে কান্তা সুগন্ধী ছিটাইয়া ভালোভাবে পুঁছিলাম ম্যাডেলিনের দেহ । চোখ বুজিয়া শীতল স্পর্শের আরাম লইতে-লইতে বলিল, ব্রেকফাস্ট করিয়া, একটি অটুলস ফ্যাগ ফুঁকিয়া পরস্পরকে চতুষ্পদের মত রেপ করিবার লড়াই করিব, কী বল ?
    রেপের ধারণায় মলয় রায়চৌধুরী এতো মশগুল কেন তা আমার বোঝাতীত।
    ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ থেকেই এর ধারাবাহিকতা মলয় রেখে চলছেন। শৃঙ্গার, যৌনতার সাথে রেপের কি সম্বন্ধ একথা তার মত বিদগ্ধ মানুষ কেবলই গুলিয়ে গেলেন বলে আশ্চর্য হতে হয়। দুঃখিতও। রেপ একটি জঘন্য ঘোরতর ক্রাইম। রেপ থেকে চূড়ান্ত শারীরিক জখম এমনকি মৃত্যু হয়। রেপের মূল রয়েছে পানিশমেন্টের মারমুখী, খুনী, ক্ষতি-ইচ্ছা। অ্যাগ্রেসিভ-সেক্স বা ডমিনেটেড হওয়ার ফ্যান্টাসিকে ‘রেপ’ না বলে অন্য শব্দের কোন প্রতিস্থাপন তিনি খুঁজে পেলেননা না পেতে চাইলেননা, সেটি খোলসা করার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।
    পুরুষ লেখক, কথক হিসবে তিনি নারী চরিত্রের সংলাপেও তা হাজির করছেন। নারী সত্যিই কি চান- কোন নারী দুর্মর, বাধাহীন অরগ্যাজম্‌ পেতে চাইলে রেপড্‌ হতে চাইবেন কেন? হ্যাঁ, পরিসংখ্যান পাওয়া যায়- নারীরা সাবমিসিভ হতে চেয়ে বা পুরুষকে শরীরের বল প্রয়োগ করতে নির্দেশ দিয়ে শৃঙ্গার করতে চাইছেন। তাকে ‘রেপ-ফ্যান্টাসি’ বলার এক অদ্ভুত কিমাশ্চর্জম চলও লক্ষ্য করা যায়। যারা এটা করেন তারা কিছুতেই বুঝে উঠতে চান না – রেপটা কোন ফ্যান্টাসি নয়- সেটা ক্রাইম!
    মৃগাঙ্ক গাঙ