এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আঠের বছর - মনে হয় এই তো সেদিন

    shrabani
    অন্যান্য | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ | ১০৭৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shrabani | 117.239.15.28 | ২০ জানুয়ারি ২০১২ ১৭:১৯514835
  • শমীক, সতর্কীকরণের দরকারই ছিলনা! আজ সকাল থেকে মেল দেখারও ফুরসত ছিলনা!:) আর ছাতার চাগরী বলার পাপে কাল আমাকেও কুমুর মত ফরিদাবাদ যেতে হবে সকাল থেকে মিটিন করতে!:(
    এদিকে লিখতে গিয়ে সব মনে ছবির মত ভাসছিল আবার শঙ্কু মহারাজের আশীর্বাদে সব ভুলে না যাই!:((((
  • Reshmi | 203.101.108.91 | ২০ জানুয়ারি ২০১২ ১৮:০৭514836
  • দুর্দান্ত! পুরো সিনেমার মত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে। আর নিজের চাকরি জীবনের শুরুর দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে।
  • shrabani | 59.94.97.16 | ২০ জানুয়ারি ২০১২ ২৩:১৬514837
  • ছোট থেকেই এ লাইনে চলাফেরা করছি এবং দিনের বেলা এদিককার ট্রেনে স্লীপার ক্লাসে কী ভয়াবহ অবস্থা হয় তাও যে কোনোদিন দেখিনি তা নয়! কিন্তু সেই কবছরে বাংলার জোলো হাওয়ায় স্মৃতিতে বোধহয় মরচে ধরেছিল। মনে থাকলে অন্তত নিজেদের টিকিট দুটো এসি র কাটতাম তা ছেলেরা আমাদের যাই মনে করুক আর যাই বদনাম দিক।। এমনিতে সেই মুহূর্তে আমাদের মেয়েদের কারোরই অর্থনৈতিক অসুবিধা তত একটা ছিলনা, সঙ্গে পর্যাপ্ত টাকাপয়সা দিয়েই পাঠিয়েছিল বাড়ি থেকে। শুধুমাত্র দলধর্ম বজায় রাখতেই আমরা সবাই অন্যরা যা ব্যবস্থা করেছে তাতে সায় দিয়ে গেছি। তা কপালে আছে ভোগান্তি, কে রুধবে!
    নিউ দিল্লী স্টেশনে যখন ট্রেনে চড়ে বসলাম তখন কোনো সমস্যা হয়নি। শুধু শেষ মুহূর্তে টিকিট কাটার জন্যে, সীটগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে, দুজনের আবার কামরাও আলাদা। শক্তিনগরের যাত্রীদলে বাঙালী তিনজনের মধ্যে দুজন আমার ক্লাসমেট আর একজন অন্য কলেজের। এছাড়া বিন্ধ্যনগরের দলের দুজন বাঙালী, রফিক ও অমল। একসাথে দুটি পাশাপাশি সীটে দুজন মেয়েকে রেখে বাকি সবাই চলে গেল এদিক ওদিক, সঙ্গে নিয়ে গেল আমার বিছানার হোল্ড অল ও রেখার চারখানা ব্যগ।
    আমাকে তো একখানা জীবন্ত ব্যাগেজ সামলাতে হচ্ছে, তাই লাগেজের ভার আপাতত ওরাই নিল। দেখা গেল আমরা বাঙালীরাই শুধু সবাই বিছানা বেঁধে এনেছি, বাকিদের এসবের বালাই নেই। ওদিকে রেখার শুধু চারখানা ব্যগ ওদের জিম্মায়, পাঁচ নম্বরটি যেতে যেতেও পথ বদলে ফিরে এসেছে!

    অটোতে ঘুমন্ত রেখাকে দিল্লী স্টেশন এলে জাগানো হয়েছে। চোদ্দ জনের মালপত্র, দুটি তিনটি করে হলেও সব মিলিয়ে মালের পাহাড়। সেসব সামলে নিয়ে ট্রেনে উঠে বসা পর্যন্ত রেখা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে, যেখানে যেতে বলছি যাচ্ছে, যখন বসতে বলছি বসছে। একটু থিতু হয়ে বসার পর হঠাৎই জেগে, অস্থির হয়ে এদিক এদিক দেখে, "মাই পিঙ্ক ব্যাগ, মাই পিঙ্ক ব্যাগ" বলে চেঁচিয়ে উঠে মহা খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিল।
    ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে। যত বলি ব্যাগ সব ঠিক আছে ছেলেদের দায়িত্বে, সে শোনেনা, তার নাকি ঐ ব্যাগটি খুব দরকার। চলন্ত ট্রেনে কোথায় যাবে কাহিল শরীরে, তাই অগত্যা তাকে শান্ত করে বসিয়ে আমিই ছেলেদের কাছে যাই ব্যাগের খোঁজে। গেলাম বটে ব্যাগ খুঁজতে কিন্তু গিয়ে মনে হল না এলেই ভালো ছিল। আমাদের জিনিসপত্র আর তখন একটা জায়গায় নেই। এখানে সেখানে সীটের তলা, ওপর বার্থ মানে আশেপাশে যেখানেই ফাঁকফোকর পাওয়া গেছে সেখানেই আমাদের মাল গোঁজা! তাই নিয়ে বাকী সহযাত্রীদের মধ্যে প্রচুর অসন্তোষ, লোকজন গজগজ করেই যাচ্ছে, বেশরম টেশরম ও আরো কতকী ভালো ভালো শুদ্ধ সংস্কৃত ঘেঁষা নামে ভূষিত করছে আমাদের দলের ছেলেদের আর তারা সেই সব তিরস্কারের শব্দাবলী বুঝে বা না বুঝে অসহায় অপরাধীর মত মুখ করে বসে আছে। এইরকম একটা ক্রিটিক্যাল অবস্থার মাঝে আমি গিয়েছি ব্যাগের খোঁজে। কেউ তো উঠলই না আমাকে সাহায্য করতে, উলটে এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাতে থাকল যেন মাল সব আমারই, সহযাত্রীদের সব খার আমারই প্রাপ্য!
    রকম সকম দেখে ব্যাগ খোঁজা মুলতুবি রেখে পিঠটান দেওয়ারই কথা, কিন্তু অসুস্থ বন্ধুর বিনতি, উপেক্ষা করি কীভাবে। চক্ষুর মস্তক খাইয়া ঐ সব চোখরাঙানিতে দৃকপাত না করে, একা একাই খুঁজেপেতে সীটের নীচে এক কোণা থেকে সেই গোলাপী কাপড়ের পেটমোটা ব্যগটি খুঁজে এনে বন্ধুর হাতে দিলাম। সে শান্ত হয়ে সেটি মাথার পাশে রেখে সীটে লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল! না জানি কী অমুল্য রতনই না আছে ঐ পিঙ্ক ব্যাগে, কিন্তু খুলেও দেখল না একবার!

    এদিকে একটি দুটি স্টেশন পেরোতে না পেরোতেই শুরু হল স্থানীয় নিত্যযাত্রীদের হাঙ্গামা। কিছুক্ষণের মধ্যে করিডর আর খালি রইল না। ভিড় উপচে এসে রিজার্ভড সীটের কিউবিকলগুলোতে ধাক্কা মারতে লাগল। এইধরণের দিনেরবেলার যাত্রায় মনে পড়ে ভিড়ের উপদ্রব এড়াতে দু একজনকে চাদর ঢাকা দিয়ে অসুস্থ বলে শুইয়ে দেওয়ার রীতি ছিল। যার পালা পড়ত অসুস্থ সাজার তার ভারী যন্ত্রনা ছিল, কেউ চাইতনা ঐ রোলটা, তবু উপায়ও থাকতনা!
    তবে পরের দিকে দেখেছি তাতেও শেষ রক্ষা হতনা, খেলাটা ক্লিশে হয়ে পড়েছিল।
    বরং এরকম চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে দেখলে নানা দিক থেকে টিটকিরী ভেসে আসত। শুধু তাই নয় লোকে এমন ভাবে পায়ের দিকে, পেটের ভাঁজের পাশে মানে যেখানেই এক চিলতে খালি জায়গা পেত পেছন ঠেকিয়ে দিত, সে অসহনীয়। তখন এমনই যন্ত্রনাকর অবস্থার সৃষ্টি হত যে শেষমেশ অসুস্থতার ভান কী, সত্যিকারের অসুস্থ লোক হলে সেও "ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি" বলে উঠে বসত বোধহয়!
    কিছুটা বেলা অবধি এইরকম চলে, কোনোরকমে বসে থাকা, নিজেদের ঐ বসার জায়গাটুকু থেকে নড়া যায়না। তারপরে কিছুক্ষণের জন্যে সাময়িক শান্তি, আবার বিকেলে একই জিনিস শুরু হয়, তখন ওদের গন্তব্য শুধু উল্টো দিকে। এসব এলাকার এই নিত্যযাত্রীদের গাজোয়ারী অত্যাচার বছরের পর বছর চলে আসছে, কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। যাত্রীরা সব দুরের, সাহস দেখালেও কাউকে পাশে পাবেনা, তাই চুপচাপ সহ্য করে যেতে হয়!

    সে হিসেবে আমাকে অবিশ্যি মিথ্যেও বলতে হবেনা, হাতে গরম অসুস্থ যাত্রী আমার সঙ্গে!
    তবু বেশ ভয়ে ভয়ে রইলাম, একটা সীট জুড়ে রেখা শুয়ে। মাঝে মাঝেই লোকজন দলবেঁধে এসে উঁকি মেরে যাচ্ছে, সীটটা দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে কিসব বলাবলি করছে। কখনো এরাস্তায় এভাবে একলা চলিনি, সঙ্গে বড়রা থেকেছে, তারাই সামলেছে এধরণের সমস্যা। কিছুক্ষণ ঝড়ের আগের নীরবতা, তারপর দুটি ছেলে এল, হাতে খাতা পেন, কলেজযাত্রী।
    -"বসব, ওনাকে উঠিয়ে দিন।"
    উঠিয়ে দিতে সমস্যা খুব নেই কিন্তু তাহলে ছ ঘন্টার রাস্তায় আমার ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমোবে। স্টেশনে আসার সময় অটোর ঐটুকু রাস্তাতেই আমার ঘাড় টনটন করছিল। মনে মনে একবার ভাবলাম যুদ্ধের অবস্থান নেব না সাদা রুমাল ওড়াব। এই ভিড়ে সঙ্গীর দল সাহায্য করতে আসবেনা, এমনিতে তারা নিজেরাও বেকায়দায় নিশ্চয়। ছেলেগুলো ছোটই হবে, তবু আমার প্যাংলা হাড়গিলগিলে চেহারায়, করুন জ্যাবজেবে স্বরে "ভাইয়া" ডেকে উঠলাম। তারপরে গদগদ অশ্রুসজল চোখে বয়ান করলাম "বিমার বহেন", একা দুজনে(?) লখনৌ যাব, এইসব "হত ইতি গজ" মার্কা, আধা কাহিনী মুখে আধা যা বোঝবার বুঝে নাও টাইপের।
    এতে অবশ্য দুইখান ভয় ছিল। এক, রেখা না উঠে পড়ে ইংরেজী শুরু করে দেয়। বোনেরা অবশ্য ইংরেজীতে কথা বলতেই পারে নিজেদের মধ্যে, সেরকমটা হলে আবার ওদের সঙ্গে দুরত্ব হয়ে যাবে। সন্দেহও হতে পারে, আবার ভিনদেশী টের পেলে সহানুভূতি কমে যেতে পারে, কথা উঠলে ভেবে রেখেছি বলব বাড়ি রুরকী। এসবদিকে দেখেছি "আমি ইউ পির মেয়ে, রুরকী মে পলী বড়ী হু",ঁ ইত্যাদি স্টেটমেন্ট অবস্থা বিশেষে খুব কাজ দেয়।
    দ্বিতীয় ভয় হল এদের সামনে ছেলেদের কেউ আমাদের খোঁজ নিতে এলে। তার অবশ্য সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ, ভিড়ের অবস্থা দেখে সন্দেহ হচ্ছে লোকে তাদের স্টেশন এসে গেলেও নামার রিস্ক নিচ্ছে কিনা!
    যাইহোক, যতই ষন্ডাগুন্ডা দাদা ছেলে হোক, বেশীরভাগ আসলে তো কচিকাঁচাই, কলেজ পড়ুয়া, খেয়ে গেল। তারপর বোনেদের দেখভালের কী ধুম! আমিও অবশ্য দু একজনকে একটু সরে বসতে টসতে দিলাম। ভাগ্যিস, সারাদিনে এই ভাইয়েদের দৌলতেই অল্প কলা টলা জাতীয় খাবার পেটে পড়ে পিত্তি রক্ষা হল, ভিড় ঠেলে জলও এনে দিল ওরাই।

    বেলা বারোটা না সাড়ে বারোটায় আমাদের লখনৌ পৌঁছনোর কথা, সেখান থেকে আবার ট্রেন সেই বিকেল পাঁচটা নাগাদ। ঝামেলা টামেলা সব একটু কমলে, ভিড়টায় একটু অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর খেয়াল করে দেখতে গেলাম কোথায় পৌঁছলাম। পরের স্টেশনের নাম দেখে আমি ধন্দে, সময় বলছে কানপুরে পৌঁছনোর কথা কিন্তু মনে হচ্ছেনা আমরা তার আশেপাশেও পৌঁছেছি। পাশের ভাইকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, "ট্রেন তো লেট চল রহী হ্যায়"।
    তখন আমারও মনে হল সত্যিই তো ট্রেন টা যেন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলছে অনেকক্ষণ থেকেই।
    তারপরে যা হল তা হল ট্রেন প্রায় নড়েই না, লাইনে কাজ হচ্ছে, তাই ট্রেন স্পীড নিতে পারছেনা। বারোটা বাজল, একটা বাজল, কোথায় কানপুর, কোথায় লখনৌ। ততখনে শুভ সংবাদ সারা কামরায় ও বোধকরি সারা ট্রেনে ছড়িয়ে গেছে। মাঝেমাঝেই ট্রেন থেমে যাচ্ছে, লোকে নেমে পড়ছে খোঁজখবর করতে। একজায়গায় জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে আমাদের মক্কেলদেরও দেখলাম। হাত বাড়িয়ে অশোককে ডাকতে জানালায় এসে জানালো, কানপুর সামনেই। তারপর থেকে নাকি রাস্তা সাফ। খুব তারিফ করছিল নিজেদের বুদ্ধির, দুটো ট্রেনের মাঝখানে পাঁচ ঘন্টা ফাঁক রেখেছিল কত না বুদ্ধি করে, নাহলে আজ ত্রিবেণী ধরাই হতনা!
    রেখা উঠে বসেছে হট্টগোলের মাঝে, তাকে বিস্কিট আর কলা খেতে দিয়ে সুখবরটি জানালাম, লখনৌ শহরে ঘুরে চিকনের ড্রেস কেনার প্রোগ্রামটি বাতিলই মনে হচ্ছে। হ্যাঁ,তখনই ঐটুকুই, চিকন কেনা বা রেসিডেন্সী দেখা হবেনা, একটু ঘোরা হবেনা, এমন ঐতিহাসিক শহর, তার শুধু স্টেশন ছুঁয়েই চলে যাব!

    যত দুপুর বাড়ছিল তত আমাদের উদ্বেগ, সেই কানপুরের পরে সাফ রাস্তার আর দেখা নেই। একটু চলে ট্রেন দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে আবার চলে। যখন ভাবি এইবার বুঝি রাস্তা পরিস্কার, তখনি আবার দাঁড়িয়ে যায়। এমনি করে করে শেষে পুরো ওয়ান ডের শেষ বল শেষ রানের উত্তেজনা।
    অশোক আর আহমেদাবাদের দাভে গিয়ে ড্রাইভারের কেবিনে উঠে পড়েছে। "জোরে দাদা, আরো জোরে। একটু চালিয়ে দিন, ত্রিবেণী ছাড়তে কুড়ি মিনিট বাকী, লখনৌ দেখা যাচ্ছে। ট্রেন টা ধরিয়ে দিন"। রকম দেখে এদিক সেদিকে কামরায় ঝুলন্ত, ছাতের দর্শকেরাও "জোরে জোরে" বলে ড্রাইভার ও তাকে ড্রাইভ করার চেষ্টা করছে যারা অর্থাৎ আমাদের দলটাকে উৎসাহ দিতে থাকে স্টেডিয়ামের অনুগত দর্শকদের মত। আমরা, আমি ও রেখা জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে থাকি আর অন্যরা মালপত্র একজায়গায় করে দরজার দিকে যেতে থাকে, প্ল্যাটফর্মে গাড়ী ঠেকলেই নেমে ত্রিবেণীর দিকে দৌড়বে।

    শেষরক্ষে হলনা! আমাদের ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছুঁল, আর আমরা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম দুর থেকে ত্রিবেণী এক্সপ্রেস একটু একটু করে স্টেশনের বাঁকে মিলিয়ে গেল। ম্যাচের এমন শোচনীয় পরিণামে, পরাজিত দলের ওপর থেকে দর্শকগণের সমস্ত সহানুভূতি ভ্যানিশ! তারা আবার সেই ঠেলে ফেলে দেওয়া, পা মাড়িয়ে দেওয়া, এগোতে জায়গা না দেওয়া ভিড়ে পরিণত হল। সেই অসহযোগী ভিড়ের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাই রেখাকে নিয়ে, নামতে হবে, লখনৌ এসে গেছে। ছেলেরা সব মালপত্র নিয়ে নেমেছে আগেই। হালকা ভাবে চোখ বুলিয়ে নিজের জিনিসপত্র দেখে নিচ্ছি। প্ল্যাটফর্ম টা স্টেশনের বাইরে প্রায় ,একটেরে, সেই প্ল্যাটফর্মের আবার একেবারে শেষপ্রান্তে আমরা নেমেছি। আমরা নামার পর ভিড় যেন আরো বেড়ে গেল, দেরী করেছে ট্রেন, তাই ওঠবার লোক অনেক। আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে আছি, গাড়ি ধরার তো আর তাড়া নেই, ট্রেনটা চলে গেলে, হট্টগোল কমলে ধীরে সুস্থে পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করা যাবে!

    ট্রেন ছাড়তে তখন বোধহয় আর মিনিট তিনেক বাকী। হঠাৎ আমার পাশ থেকে একটা চিৎকার, "মাই পিঙ্ক ব্যাগ, শ্রাবণী, মাই পিঙ্ক ব্যাগ।"
    আমি পরেশান, চারিদিকে চেয়ে দেখি ব্যাগের ভীড়ে কোথাও পিঙ্ক ব্যাগ নেই। অবস্থাটা দ্রুত গতিতে অন্যদের বোঝাতে, কেউ কেউ ছুটে গেল দরজার কাছে, কেউ আমরা যে সীটে বসেছিলাম সেই জানালার কাছে। জানালা দিয়ে ভেতরের লোকজনকে কথাটা বোঝানোও গেল, ব্যাগটি দেখাও গেল। কিন্তু ভেতরে যারা ব্যাগ নিয়ে দেবার জন্যে প্রস্তুত ও দরজার কাছে যারা নেবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মাঝখানে এক সমুদ্র মানুষের ভীড়!
    আমার ক্লাসমেটরা এই ব্যাগ উদ্ধারের চেষ্টার ধারেকাছে না গিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আমাকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে, এমন সুযোগ ফস্কাতে দেওয়া যায়। " কী রে তোরা, কেন আসিস চাকরি করতে? দুটো ব্যাগের একটা ফেলে এলি। সাইটে কাজ করবি কী করে যে কে জানে!" জয়েনিংয়ের পর থেকেই ওরা সুযোগ পেলেই এই বাণী শোনাচ্ছে আমাকে, ছোট খাটো যাই ত্রুটি ঘটুক আমার তরফে,সে আমার হাত কেটে যাক বা আমি কনভেনশন সেন্টারের বাস মিস করি, সবেতেই শুরু হত "কী করে সাইটে কাজ করবি"। অথচ এরাই কলকাতাতে যখন শুনছিল আমার বাড়ি থেকে যেতে দিতে চাইছেনা তখন দিন রাত বলত, "কেন যে একটা সিট নষ্ট করলি, কেন যে তোরা পড়তে আসিস" ইত্যাদি!

    ত্রিবেণী ছেড়ে গেছে, আবার যদি রেখার ব্যাগ উদ্ধারের চেষ্টায় লখনৌ ছেড়েই যেতে হয় সে ভয়ে কেউ ট্রেনে উঠছেনা, রেখার দু গালে চশমার ফাঁক দিয়ে গঙ্গা যমুনা। সেই জলধারাতে ভিজে দ্রব হোক বা যে কারণেই হোক, আর দু মিনিট বাকী ট্রেন ছাড়তে, হঠাৎ কী হল টিমটিমে বাঙালী রফিক পুরো শের এ বঙ্গাল হয়ে ট্রেনের দরজা দিয়ে ভেতরের উত্তাল মানব সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল বা একখান হেডলং ডাইভ দিল।
    বীরভোগ্যা বসুন্ধরা, সাহস করে ঝাঁপ দেওয়াটাই বড় কথা ছিল, অল্প যেতেই ওদিকের বীরেরাও ব্যাগ নিয়ে মাঝপথে এসে পড়েছিল। স্ফীতোদর গোলাপী ব্যাগ হাতে, ঘেমে নেয়ে টাল ও টোল খেয়ে, রফিক যখন ব্যাগ নিয়ে নামল, ওদিকে ট্রেন ছেড়ে দিল আর এদিকে আমার কানে এল চারপাশ থেকে অদৃশ্য করতালির গুঞ্জন। রফিকের মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি, উপহারও পেল যথাযথ। হাসিকান্নার হীরাপান্নায় রেখার সলজ্জ সেই "থ্যাঙ্ক ইউ" রফিক কী ভুলতে পেরেছে, না কোনোদিন ভুলবে কখনো!
  • Nina | 12.149.39.84 | ২১ জানুয়ারি ২০১২ ০০:৫৯514838
  • হাজার কাজে মরবার ও ফুরসৎ নেই--কিন্তু এইটি না পড়ে থাকতে পল্লুম কই----আসা সার্থক---মনটাই ভাল হয়ে গেল--চাকরী আর রফিক জীবনে খুউব দরকার---:-) শ্রাবণী ও রফিক কে ব্রাভো!

    সিকি
    বলেই ফেল---আমার মনটার বয়স বাড়েনা তো--একদম আয়না দেখে বলে :-))
  • Nina | 12.149.39.84 | ২১ জানুয়ারি ২০১২ ০১:০০514839
  • * আয়না দেখে না বলে
    উফ ফ ফ ফ!
  • siki | 122.177.192.89 | ২১ জানুয়ারি ২০১২ ১৪:১৮514840
  • এই তো! এই রকম চাই। কনকনে শীতের ছুটির দুপুরে এমন লেখা পড়ে অনেক দু:খের মাঝেও মনটা কেমন ভালো হয়ে গেল।

    সোনার কলম হোক, সোনার কলম হোক।

    নীনাদি, এখন তো বলব না :-) আরেকটা ছাতার মাথা লিখে দ্যাখো ঐরকম, তখন এমন শোনাবো না ... :-)))
  • rimi | 75.76.118.96 | ২২ জানুয়ারি ২০১২ ০২:২৫514841
  • নীনাদিকে ক... দারুণ লাগছে।
  • shrabani | 117.239.15.28 | ২৪ জানুয়ারি ২০১২ ১১:৫৩514842
  • স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বেশীক্ষণ অপেক্ষায় বসে থাকলে নিজেকে কেমন বেচারা, ঘরছাড়া, অনাথ লাগে, বিশেষ করে আশপাশের অপেক্ষমান যাত্রীদের ভিড় যখন ক্রমাগত পরিবর্তনশীল হয়!
    লোকে যাচ্ছে আসছে, আমরা দুজন যেন আবহমানকাল স্থির বসে আছি, স্তুপাকার মালপত্রের মাঝখানে। অবশ্য বসে একজনই আছি, অন্যজন পা মেলে আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। সারাদিনের বিশ্রামের পরে যেটুকু ফিট হয়েছিল তাও ঐ ব্যাগ নিয়ে টানটান উত্তেজনাপূর্বক এপিসোডের ধকলে উধাও, আবার সে কাহিল হয়ে পড়েছে। তার ওপর সারাদিনে পেটে তেমন কিছু পড়েনি দুজনেরই, ঐ টুকটাক কলা বিস্কিট ছাড়া। খিদেয় পেট জ্বলছে,সঙ্গে কিছু নেই অবশিষ্ট। প্যাকেটের শেষ দুখানা বিস্কিট,মাঝখানে রেখা একবার চটকা ভেঙে "শ্রাবণী, আই অ্যাম হাঙ্গরি" বলে উঠতে, তাকে দিয়ে দিয়েছি।

    বাকীরা সব লাগেজের পাহারায় আমাদের বসিয়ে যাকে বলে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। সেই অবস্থায় আমি খাবারের সন্ধানে যেতে পারছিনা, যেখানে বসে আছি সেখানে আশেপাশেও কিছু নেই। স্টেশনের একেবারে বাইরের দিকে প্ল্যাটফর্ম, সেই প্ল্যাটফর্মেরও শেষ প্রান্তে আমরা। ঐ অত মালপত্রের একসাথে ঠাঁই আর অন্য কোথায় বা হত!
    ছেলেরা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারোরই দেখা নেই, তারা সবাই নাকি এখান থেকে অন্য কী উপায়ে শক্তিনগরে যাওয়া যায় তার তত্বতল্লাশ করছে। ঘুরছে যখন নিজেরা কী আর খাচ্ছে টাচ্ছে না, তবে খাবার সময় আমাদের কথা যে তাদের মনে পড়ছে, সেরকম লক্ষণ কিছু তখনও দেখলাম না! সেই যে সব গেছে, তো গেছেই,আর তাদের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না। শুধু একবার মাঝে রেখা যখন বিস্কিট খাচ্ছিল, দেবাশিস দুর থেকে কীভাবে যেন তা দেখতে পেয়ে এসে বলে গেল,
    -"বেশ আছিস তোরা, চিন্তাটিন্তা নেই, দুজনে আরাম করে বসে আছিস। আমাদের এদিকে ভাবনায় মাথার চুল ছেঁড়ার যোগাড়,(চুল অবশ্য সেই বয়সেই মাথায় বেশী ছিলনা, সিরিয়াসলি ভাবলাম বারণ করব, আর যাই কর, ঐ সবেধন চুলকটায় হাত দিসনা, এখনও বিয়ে থা বাকী আছে!) রাত হয়ে যাচ্ছে। আবার একা একা বিস্কিট খাচ্ছিস? সত্যি মেয়েরা যে এরকম লোকজনকে না দিয়ে একা একা বসে খায়, এই প্রথম দেখছি।" দেবাশিস আর অশোক আমার সেই দুই ক্লাসমেট। এমন অমৃত বাণী শোনার পর, আমাদের জন্যে খাবার এনে দেওয়ার কথা মুখে আনতে পারলাম না!

    কিন্তু পেটে ইঁদুরের লাফালাফি অব্যাহত, আর ক্রমশ তা সহ্যশক্তির প্রায় শেষ সীমার দিকে এগোচ্ছে। খাবার জোগাড়ের নানা অসম্ভব উপায় কল্পনা করছি মনে মনে। কুলিকে পয়সা দিয়ে অনুরোধ করব কিছু কিনে আনতে, কোনো যাত্রীকে রেখাকে আর মালপত্রকে একটু দেখতে বলে, নিজে গিয়ে খাবার কিনে আনব! সেরকম কোনো কুলি বা যাত্রী চোখে পড়ছেনা, যাকেই দেখি তার চেহারা আমার চোখে সন্দেহজনক ঠেকে। এরকম কিছু করলে পয়সা বা দু একটা ব্যাগ স্যুটকেস খোয়ানো ও তার জেরে সারা দলের তিরস্কার ছাড়া কিছু মিলবে বলে মনে হয় না!

    খুব কান্না পেতে লাগল একসময়, এত অসহায় লাগছিল। এতদিন বাইরে বেরোলে বাড়ির সবার আমার সবকিছুর দিকে নজর। সুবিধে অসুবিধের দিকে তাকিয়ে পুরো পরিবার, ঠিকসময়ে খাওয়া ঘুমনো, "ও এটা খায়না, ওর এটা সহ্য হয়না", কোথায় ঘুমোবো, কোথায় বিছানা, বালিশ! আমি শুধু বেড়িয়েই ধন্য করে এসেছি সকলকে। আর আজ এই ভ্রমণে সব কিছু কত আলাদা। অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া, পথের অনিশ্চয়তা, সারাদিনের ধকলে শারীরিক যা অসুবিধা তা তো ছিল, মনের জোরও একদম কেমন যেন তলানিতে ঠেকছিল। সারাদিন রেখাকে সাপোর্ট দিতে দিতে মানসিকভাবেও একরকম ক্লান্তি অনুভব করতে থাকলাম। আমার কাঁধে ওর মাথা, আর আমার তখন মনে হচ্ছে আমারও একটা কাঁধের দরকার, যেখানে মাথা রেখে একটু চোখ বুজতে পারি চিন্তাভাবনাকে দুরে সরিয়ে রেখে।

    লখনৌ স্টেশন তো অপরিচিত নয়, কলকাতা যাবার বা সেখান থেকে আসবার পথে কতবার এই স্টেশনে ট্রেন থামলে, প্ল্যাটফর্মে নেমে রেউড়ি কিনেছি, ভেন্ডরের কাছে গরম গরম দুধ কিনে খেয়েছি। একটু পরে পরেই তো একের পর এক কলকাতার ট্রেন সব আসতে শুরু করবে। কথাটা মনে হতেই প্রথম প্রতিক্রিয়াস্বরূপ নিজের স্যুটকেস আর হোল্ড অলের দিকে চোখ গেল। দুই হাতে দুটো নিয়ে হাঁটা দিই, একটা না একটা ট্রেন ঠিক পেয়ে যাব। কোনো একটা কামরায় চড়ে বসলেই শান্তি, কাল বাড়ি। ঢের হয়েছে, শুরুতেই এই, আগে আরও কী কী রয়েছে কে জানে, দরকার নেই চাকরির! সে এক ভয়ঙ্কর দোলাচলের নিমেষ, নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার।
    যেন হিন্দি সিনেমার সেই দুই বিবেক, শান্ত সাদা শাড়ি একদিকে আর চুল খোলা বড় বড় চোখে কালো শাড়ির দুরন্ত আর এক দিকে!
    একবার মনে হচ্ছে, ক্ষান্ত দিয়ে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যাই, পথেঘাটে এত বাধা, এ চাকরি আমার জন্যে নয়। সঙ্গের লোকজনও সব কী বাজে, স্বার্থপর। বাড়ি থেকে এত দুরে এইসব লোকেদের সাথে কতদিন কাটাতে হবে, কিসের জন্যে? চাকরির কি অভাব পড়েছে? মানে আসার আগে মায়ের কথাগুলৈ আমার কালো শাড়ির কথা হয়ে গেল, শুধু টোনটা মায়ের তুলনায় একটু বেশী জোরালো।
    এদিকে শান্ত সাদা শাড়ী বলে, এরকম হার মেনে চলে গেলে আর কোনোদিন জীবনে কোনো কিছু করে উঠতে পারব। বাধা বিপত্তি তো সব কাজে আসেই, অভিজ্ঞজনেরা বলে, সে সবের মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। রেখাকে একা এভাবে রেখে চলে যাব! আজ ও অসুস্থ বলে আমার এতটা খারাপ লাগছে, ও সুস্থ হয়ে উঠলেই তো আবার আমরা দুজনে দুজনকে দেখাশোনা করব, যেমনটি দিল্লীতে করতাম, আর কাউকে আমাদের দরকার হবেনা।
    এসবের মাঝে মনে মনে একটু কেঁদে নিয়ে, নিজেই নিজেকে বুঝিয়ে শান্ত করি। তাছাড়া বাড়ি যাব বললেই যাওয়া যায় নাকি, ট্রেনে উঠে বসব, রিজার্ভেশন নেই, মাঝরাস্তায় নামিয়ে দেয় যদি! একা মেয়ে বুঝলে আরো কী বিপদ আছে পথে কে বলতে পারে! এইসব নানা তর্কবিতর্কের শেষে, তখনের মত কালো শাড়ি বিদায় নিল, সাদা শাড়িকে আমার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললাম, এক্কেবারে হিন্দি সিনেমার মত, সত্যি বলছি!

    অন্ধকার হয়ে এসেছে, চারিদিকে আলো জ্বলে গেছে,অশোক এল। জানালো, এই প্ল্যাটফর্মেই বরুনা (নাকি বরুন?) এক্সপ্রেস আসবে কানপুর থেকে,তাতে করে বেনারস গিয়ে সেখান থেকে বাসে ছ সাত ঘন্টার রাস্তা শক্তিনগর। একেবারে জলের মত সোজা পরিকল্পনা। শুধু একটাই সমস্যা, নামে এক্সপ্রেস হলেও ট্রেনটি লোক্যাল ট্রেন ছাড়া কিছুই নয়, কতক্ষণে বেনারস পৌঁছবে তার কোনো ঠিক নেই। বেনারস থেকে শেষ বাস কটায় তা কেউ বলতে পারছেনা, তবে বেশী রাত অবধি চলে। সেরকম হলে অত রাতে বেনারস স্টেশনে বা রাস্তায় রাত কাটানো ছাড়া গতি নেই। এমনিতে লখনৌ থেকে সরাসরি যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই আজ। ঘন্টা দেড়েক বাকী ট্রেন আসতে, অন্যদের তখনো দেখা নেই, তবে সবাই নাকি জেনে গেছে প্ল্যান টা, সময়ে চলে আসবে।
    তখন এত খিদে পেয়েছে, যে বেনারসে গিয়ে কী হবে তা ভাবতেও আর ইচ্ছে করছেনা। অশোক আবার যাবার উপক্রম করতেই বলি,
    "দে না রে একটু পুরি সবজি বা ডিমসেদ্ধ ব্রেড যা হোক কিছু এনে, খুব খিদে পেয়েছে। রেখাও তখন থেকে খাবার চাইছে, শরীরটা খারাপ বেচারীর।"
    রেখার কথাটা যোগ করে দিই কারণ আমি তো গেঁয়ো যোগী ওদের কাছে, যদি নতুন পরিচিতাকে ইমপ্রেস করতে অন্তত কিছু এনে দেয়।
    "দাঁড়া দেখছি, তবে এদিকে কাছাকাছি কিছু নেই, অনেকদুরে যেতে হবে। এখন তো সময়ও বেশী নেই হাতে "।
    তবু যে "দেখছি" বলেছে এটাই আশার কথা।

    একটু পরে রেখার দেশে ছেলেদের (যারা ওর কলেজেরও, সিনিয়র আর ক্লাসমেট মিলিয়ে তিনজন) মধ্যে একজন হাজির। একটা ব্যাকাপ রাখা ভালো, আমার সহপাঠীদের কারোর ওপরেই পুরো ভরসা নেই আমার। বাবু রেখার কথা জিজ্ঞেস করে, কেমন আছে ইত্যাদি। আমি আশান্বিত, এ নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবে। সাহস করে খাবারের কথা বলেই ফেলি।
    "এখানের ভেন্ডররা ভেরি স্ট্রেঞ্জ, ওরা ইংরেজী বুঝতে পারেনা। ক্যান ইউ ইমাজিন, আবার ওরা কী বলে কিছুই বোঝা যায়না, ইটস নট লাইক রেগুলার হিন্দী। আমাদের খুব সমস্যা হচ্ছে। বাট, লেম্মি সি"।
    সত্যিতো, রেল স্টেশনের পুরি ভাজি বিক্রেতা ভেন্ডর ইংরেজী বুঝতে পারেনা, এ অন্যায় ছাড়া আর কী! ইংরেজী তো শেখেই নি আবার সরল হিন্দীও বলতে শেখেনি, সেওকি কম অপরাধ! যাইহোক, সেকেন্ড মিনিট চলে যাচ্ছে, "লেম্মি সি" আর "দেখছি" দের আর দেখা নেই।

    খিদে যত পাচ্ছে তত আবার মন দূর্বল হয়ে পড়ছে। অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে জম্মু তাওয়াইয়ের আর আমি আবার ভাবছি বাড়িই ফিরে যাই। রেখা উঠেছে, ওকে বুঝিয়ে বলেটলেই যাই।
    আসার আগে কলেজে মার্কশীট ইত্যাদি অয়াটেস্ট করাতে গেছিলাম, হেড ছিলেন না, এস কে বি অয়াকটিং হেড। উনি এমনিতে একদম বেশী কথাবার্তা বলতেন না ছাত্রদের সাথে, পড়াশোনার ব্যাপারে খুব কোনো দরকার না পড়লে ওনার কাছে যেতাম না কেউ। শুনলেন কোথায় যাচ্ছি চাকরি করতে। আমাকে অবাক করে বলে উঠলেন, "খুব ভালো। এগার বছর আগে সেই অরুনিমা গেছে, এবার এতদিন পরে তুমি দ্বিতীয় মেয়ে যাচ্ছ ওখানে আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে।" চলে আসছি ওনাকে প্রণাম করে, বললেন,
    -"সাতকাহন পড়েছ? পড়ো। বাইরে যাচ্ছ চাকরি করতে, দীপাবলীর মত শক্ত হতে হবে।"
    সাতকাহন পড়িনি, এক গল্পের বইয়ের পোকা বন্ধুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা কী, দীপাবলী কে! এস কে বি যে গল্পের উল্লেখ করেন সে না জানি কেমন কাহিনী! সে সংক্ষেপে গল্পটা শুনিয়ে দিল। যদিও কোনো মিল পেলাম না, তবুও মনে মনে হেভি গর্ব। স্যরের মত লোক কাজের কথার বাইরে গিয়ে এসব কথা বলেছেন আমার সঙ্গে, আবার এরকম একটা মহিলা চরিত্রের সঙ্গে মেলাতে চেয়েছেন, যে সে ব্যাপার!
    বাড়ি ফিরে যাবার চিন্তার মধ্যে এস কে বির কথাও মনে পড়ল। ফিরে গেলে স্যরের সামনে আর দাঁড়াতে পারব কোনোদিন! দীপাবলী হতে গিয়ে মুখে পুরো চুনকালি!

    কেরালা আর বঙ্গ তো দেখেশুনে খাবার নিয়ে ফিরলনা, গুজরাটের দুজন এল। এই দুজন সবসময় একসাথে ঘুরছিল, একটু সবার থেকে আলাদা আলাদা। কথাবার্তাও বিশেষ হয়নি আমার সাথে এর আগে। কিন্তু মুখ দেখে কিছু মনে হয়ে থাকবে, এগিয়ে এসে রেখাকে দেখিয়ে বলল, "তুমি তো খুব ঝামেলায় পড়ে গেছ। এতো বহুত উইক আছে। তুমি কিন্তু খুব স্ট্রং, দিল্লী থেকে দেখছি"।
    মাগো, আমি স্ট্রং হতে চাইনা, আমি চাই লোকে আমাকেও উইক ভাবুক, ভীষণ উইক। দুর্বল ভেবে একটু দেখভাল করুক, খাবার এনে দিক! কিন্তু কিন্তু সেই মন, অবুঝ অবোধ্য অবাধ্য মন। সহকর্মীরা আমাকে স্ট্রং বলছে, স্যর আমাকে দীপাবলী বলেছে, আর আমি ফিরে যাবার কথা ভাবছি কেমন করে, ছি ছি!
    জম্মু তাওয়াই স্টেশন ছেড়ে গেল, বরুনা আসার সময় হল। আমার আর ফেরা হল না, খিদের মুখে অন্য খাবার না পেয়ে বাড়ই খেয়ে ফেললাম!

    তাও প্রণব মানে আহমেদাবাদের ঐ বাচ্চা মতন ছেলেটি, যার সঙ্গে পরে আমাদের প্রচণ্ড ঘনিষ্ঠতা হবে, আর যে নিজেকে একটু বড় দেখাবার আশায় কচিপানা মুখে খুব ফানি একখানা চুটকি দাড়ি রেখেছে স্টাইল করে, সে কোথা থেকে দু কাপ কফি নিয়ে এল আমাদের জন্যে। আমরা দুজন ঐসময়ে ঐ কফিটুকু খেয়ে সত্যিই খুব চাঙ্গা হলাম। এর মধ্যে বলে রাখা ভালো যে রেখার ব্যাগ ভর্তি যে সব চিপস ও চানাচুর ছিল, নারকেল তেলের গন্ধ ভরা সেসব খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা,অসম্ভব খিদেতেও নয়। রেখাকে সেসব খেতে বললে সে জানালো শরীর খারাপ থাকলে ওরা নাকি ওসব ভাজাভুজি খায় না!

    এক এক করে সবাই ফিরতে লাগল, বরুনার আগমনের প্রতীক্ষায়। আমরাও উঠে দাঁড়ালাম নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে। তখনও অশোক আর দেবাশিসের পাত্তা নেই। ট্রেন ঢুকছে তখন ওরাও এল, এসেই অশোক বিজয়ীর হাসি হেসে আমার হাতে একটা ঠোঙা ধরিয়ে দিল, "নে ধর"।
    তখন ঠোঙা খুলে দেখবার সময় নেই, ট্রেনে উঠতে হবে। ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি, মনটা নরম হয়ে আসে। আহারে, হয়ত অনেক দুর থেকে আমাদের জন্যে কোনোরকমে খাবার এনেছে, যা পেয়েছে। সেজন্য দেরীও হয়ে গেল ওদের, তবু এনেছে তো, কথাবার্তা একটু ওধরণের হলে কী হয়, আসলে ছেলে কেউই মন্দ নয়।

    ট্রেন প্রায় খালি, কাঠের বেঞ্চি, আমাদের ওদিককার লোক্যাল ট্রেনের মত। তবে আলোটালো জ্বলছে। যে কামরায় আমরা উঠলাম তাতে আর অন্য কোনো প্যাসেঞ্জার নেই। গুছিয়ে মালপত্র রাখা হল, সবাই পছন্দসই জায়গায় বসা হল। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর আমি ব্যাগ থেকে অশোকের দেওয়া ঠোঙা বার করলাম, একটু খাওয়া যাক এবার। শুকনো জিনিস তা হাতে নিয়েই বোঝা গিয়েছিল আগে, এখন মুখটা খুলে আমি হতবাক! অশোক সামনেই বসেছিল। ওকে দেখিয়ে বলি, "এ কী এনেছিস তুই, আর কিছু পেলিনা"? দুচোখে এতক্ষণ আটকে রাখা জল ভরে এসে বোধহয় উপচে পড়েই যাবে।
    -"কেন, টাইমপাস মুঙ্গফলী। অনেকক্ষণ ধরে খেতে থাকবি, দেখবি আর খিদে পাবেনা, টাইম ও পাস হয়ে যাবে।"

    প্রথমে মনে হল হয় জানালা দিয়ে বাইরে নয় ওর ঐ দাঁত কেলানো মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলি চিনেবাদামের ঠোঙাটা। আমার অবস্থা দেখে একটু থতমত খেয়ে গিয়ে ঠোঙা থেকে একটা বাদাম তুলে খোলা ছাড়িয়ে রেখার হাতে দিয়ে বলল, "খাও, খুব ভালো খাবার, শক্তি হয়।"
    ওর ভাগ্য ভালো শক্তি ছিলনা তাই নাহলে যে কী করতাম বলা যায় না। রেখা প্রায় অচেনা ছেলের বাড়ানো বাদাম প্রত্যাখান করা অভদ্রতা হবে ভেবেই হয়ত বাদাম টি নিতেই অশোক ওর হাতে পুরো ঠোঙাটা তুলে দিয়ে সেখান থেকে পিঠটান দিল। আমি কিছু বলতে পারিনা, বলব কী মুখ দিয়ে গর র র আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরোচ্ছিল না!

    বাকিদেরও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দেখেশুনে জানালার ধারে গিয়ে মুখ করে বসলাম। তারই মধ্যে রেখা বাদামের ঠোঙা ধরে সবাইকে বাদাম অফার করছে। ট্রেন টা সব স্টেশনে থামলেও যাচ্ছিল খুবই ভালো স্পীডে। দু চারটে টিমটিম অন্ধকার গাঁয়ের স্টেশন পেরিয়ে একটা মোটামুটি একটু বড় আলোজ্বলা, লোকজন আছে এমন স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। ঢোকার মুখেই জানালা দিয়ে চোখে পড়ল ডিমসেদ্ধ বিক্রি হচ্ছে। থামতে না থামতেই দরজার কাছে গিয়ে ডিমসেদ্ধ ওয়ালা কে ইশারায় ডাকলাম। সেও দৌড়ে এল সেদ্ধ ডিম আর ঠোঙা নিয়ে। হাতে পয়সার ছোট পার্স রেডি। ট্রেন বেশীক্ষন থামেনা, তার মধ্যে সময়ের অনেক আগেই আমার হাতে ছখানা সেদ্ধ ডিম আর নুনের ঠোঙা এসে গেছে।

    কোনোদিকে না তাকিয়ে সিটে সবার নজরের সামনে দুই ভাগ করে রেখাকে অর্ধেক দিয়ে নিজে খেতে শুরু করি। সময়, অবস্থা,সর্বোপরি ক্ষুধা মানুষকে কী করে দেয়!
    রেখা ইতস্তত করছে দেখে চেঁচিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিই, কেউ ডিমসেদ্ধ খেলে, ছেলেটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, তার কাছ থেকে নিয়ে নিতে পারে।
    কেউ কেউ একটু অবাক হয়, কেউ মুখ বাঁকায়, দরজার দিকে কেউই এগোয় না, ওদের ক্ষিদে নেই!
    "সি, কেউ খেতে চায়না। এস, আমরা খাই, নাহলে এতক্ষণ ভুখা থেকে, শক্তিনগর পৌঁছনোর জায়গায় অন্য কোনো নগরে পৌঁছে যেতে পারি।"
    খিদে বড় বালাই, রেখার মত শান্ত শিষ্ট ভদ্র মেয়েও আর কথা না বাড়িয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে গপগপ করে ডিমসেদ্ধ খেতে থাকে।
    খাওয়া শেষ হলে বোতল থেকে জল খেয়ে শান্তি। এরপর প্রথমেই যে কাজটা করি তা হল রেখার হাত থেকে মুঙ্গফলীর ঠোঙাটা নিয়ে অশোক যেখানে বসেছিল সেখানে গিয়ে ওটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলি,
    "আমার তো খাওয়া হয়ে গেছে। আমি এবার এই পাঁচঘন্টার রাস্তা ঘুমিয়ে টাইমপাস করব। তুই বরং বাদাম চিবিয়ে টাইম, ফ্রিকোয়েন্সী, অ্যাম্পলিচিউড সব পাস করতে থাক বসে বসে।"

    সীটে লম্বা হই, খেয়েদেয়ে রেখা অনেকটাই তাজা। সে জানালার ধারে বসে থাকে আমার মাথার দিকে, যত্ন করে আমার মাথায় বালিশের জায়গায় ওর পিঙ্ক ব্যাগটা রাখে। এতক্ষণ পরে এই প্রথম আবার ভালো লাগে সবকিছু!
  • santanu | 217.164.218.151 | ২৪ জানুয়ারি ২০১২ ২২:৫৫514843
  • বা:
  • rimi | 168.26.205.19 | ২৪ জানুয়ারি ২০১২ ২৩:০৫514845
  • শ্রাবনীর গল্প পড়তে যে কি ভালো লাগছে! নিজের ছোটোবেলার কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই সাতকাহন - দেশে ধারাবাহিকভাবে বেরোতো। আমরা তখন স্কুলে পড়ি, দীপাবলীকে কি ভালো যে লাগত বলার নয়। হা পিত্যেশ করে বসে থাকতাম কবে নেক্সট দেশটা হাতে আসবে। অবশ্য দীপাবলীর বিয়ে হবার পরেই গল্পটা কেমন ছেতরে মেতরে গেল, আর তত ভালো লাগত না। অন্তত তখন তো তাই মনে হয়েছিল। :-((

    আর ট্রেনের গপ্পে নিজেদের কলকাতা থেকে দিল্লি আর দিল্লি থেকে কলকাতা যাবার কথা মনে পড়ছে। আমরাও দুটো মেয়েই ছিলাম। আর ৭-৮টা ছেলে ছিল মনে হয়। তারা কিন্তু আমাদের দুটো মেয়েকে দারুণ দেখাশোনা করত। স্টেশনে আমাদের নামতে দিত না কিছুতেই, জল খাবার যা কিছু আনার ওরাই দৌড়ে দৌড়ে এনে দিত। এদিকে আমার আবার স্টেশনে নামার বেজায় সখ ছিল। কিন্তু মহা পাকা পিসেমশাই প্যাটার্নের আকার গার্জেনগিরির জ্বালায় স্টেশনে নামার উপায় ছিল না। "ট্রেন ছেড়ে দিলে আর উঠতে পারবি না" বলে চোখ গোল গোল করে বকুনি দিত। যদিও কলেজে পড়ার সময় আমি রেগুলার শিয়াল্‌দা স্টেশনে রানিংএ উঠতাম, আর আকা সেটা ভালোমতনই জানত, কারণ ও-ও একই লাইনে যেত। শুধু মুঘলসরাইতে অনেকক্ষণ ট্রেন দাঁড়াত বলে ওখানে নামার পার্মিশন ছিল :-( বাড়ি থেকে দেওয়া গাদা গুচ্ছের খাবার আমরা ফেলে রাখতাম, মুঘলসরাইএর পুরি তরকারি খাবো বলে।

    যাক গে, শ্রাবনীর পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।
  • pi | 128.231.22.133 | ২৪ জানুয়ারি ২০১২ ২৩:৪৩514846
  • দীপাবলী নিয়ে রিমিদিকে ক।

    শ্রাবণীদি, দৌড়োক !
  • Nina | 69.141.168.183 | ২৫ জানুয়ারি ২০১২ ০৯:২২514847
  • শ্রাবণী
    পুরোটা পড়ে ---খুব ডিমসেদ্ধও খেতে ইচ্ছে করল---ক্ষিদে না পেলেও ডিম সেদ্ধ খেতে কি ভাল লাগল---তোমার সেদিনের আনন্দটা পুউরো বুঝতে পারছি এবার-----তোমার আর রেখার জন্য কি ভাল যে লাগছে ---

    আগে বঢ়ো দীপাবলী
  • shrabani | 124.124.244.107 | ২৫ জানুয়ারি ২০১২ ১১:৪৬514848
  • আমি জানি রেশমীরও গল্প আছে, হয়ত বা কিছুটা একইরকম! :) লিখে ফ্যালো।
    রিমি, তোমার ওটা তো বোধহয় কলেজ ট্রিপ। আমাদের ক্লাসের সবাইও নিশ্চয়ই একরকম ছিলনা। কিন্তু ঐ দলে দুজন মাত্র আমার ক্লাসমেট, একজায়গায় চাকরি করতে আসা। দলের অন্যরা সব বিভিন্ন প্রান্তের, ভাষাভাষীর,ভালো করে চেনা পরিচয়ই হয়নি তখনো।
  • siki | 122.177.239.87 | ২৫ জানুয়ারি ২০১২ ১২:০৫514849
  • অপূর্ব, অপূর্ব, অপূর্ব!
  • Bratin | 122.248.183.1 | ২৫ জানুয়ারি ২০১২ ১২:৪৯514850
  • দীপাবলি কে আমার ও খুব পছন্দ ছিল।
  • Reshmi | 203.101.108.91 | ২৫ জানুয়ারি ২০১২ ১৮:১৭514851
  • না গো শ্রাবণী, আমাকে এত কষ্ট করতে হয়নি। একা ফরিদবাদে থাকতে হয়েছিল বটে কিছুদিন, কিন্তু কয়েকজন এত ভালো বন্ধু পেয়েছিলাম যে কোনো অসুবিধা হয় নি। আর আমার সঙ্গে এত সব হয়ে থাকলেও আমি থোড়াই তোমার মত লিখতে পারতাম!

    আচ্ছা, দেবাশিস নামের সঙ্গে অল্প বয়সে টাক পড়ে যাবার কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? আমি যতজন দেবাশিস কে চিনি সবার-ই প্রায় তাই!
  • Bratin | 122.248.183.1 | ২৫ জানুয়ারি ২০১২ ১৮:২২514852
  • দেবাশিস মুখার্জ্জী নামে আমার এক পিস স্কুলের বন্ধু আছে। এখন ও দিব্যি মাথা ভর্তি চুল।
  • Bratin | 122.248.183.1 | ২৫ জানুয়ারি ২০১২ ২০:১৫514853
  • যদুপুরের কোন লোক? মিনি দি নাকি?
  • rimi | 168.26.205.19 | ২৬ জানুয়ারি ২০১২ ১৮:৫১514854
  • শ্রাবনী আবার কবে লিখবে?
  • Nina | 12.149.39.84 | ২৬ জানুয়ারি ২০১২ ২১:৪৭514856
  • একি :-০ !! ডিম খেলে এত্ত ঘুম পায়??
  • shrabani | 117.239.15.28 | ২৭ জানুয়ারি ২০১২ ১৫:৫৫514857
  • উত্তরপ্রদেশ রাজ্য পরিবহনের বাস, হালকা গাঢ় সবুজ রঙের কম্বিনেশন বাইরে রঙে, ভেতরে শক্ত শক্ত খাড়া খাড়া সবুজ রেক্সিন জড়ানো ধাতব সিট, মানে লাক্সারী কোচ নয় আর কী!
    তাবে হাতে আর কোনো সাধন নেই, এটিই আজকের শেষ বাস, বেনারসে রাত না কাটাতে চাইলে এই বাসেই যেতে হবে। আর এত রাতে অজানা শহরে রাত কাটাবার চেয়ে বসে দাঁড়িয়ে যেভাবে হোক এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে হল সবার।
    এত রাতেও লোক ভর্তি বাসে, ছাড়তে কিছুটা সময় বাকী আছে। অনেক যাত্রীই নিজেদের সিট দখল করে, মালপত্র গুছিয়ে রেখে বাইরে ঘুরছে। এদিকে গঙ্গাপারের হাওয়ায় বাইরে খোলা আকাশের নীচে ঠান্ডাটা জম্পেশ লাগছিল।
    আমাদের সবার মিলিত মালের গন্ধমাদন অবশ্যই বাসের মাথায় তুলতে হবে। কয়েকজন সে ব্যবস্থা করতে কন্ডাকটরকে খুঁজতে গেল, বাকীরা আমরা বাসে উঠলাম।
    কিন্তু উঠে কী হবে, ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। যে সিটেই বসতে যাই সেখানেই একটি পোঁটলা বা থলি, কোথাও ঘটি বা চটা ওঠা রেক্সিনের ব্যাগ জাতীয় কিছু না কিছু রাখা আছে। এমনকি একটি সিটে দেখি হলুদ ছেঁড়া মলাটে জাসুস কহানীর লাল বন্দুক আমাদের দিকে তাগ করা!

    অগত্যা সবাই মিলে এদিক ওদিকে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুনেছি প্রায় ছ ঘন্টার জার্নি। ছ ঘন্টা দাঁড়িয়ে শেষে কী অবস্থায় থাকব সে কথা কল্পনা করতেও ভয় হল। আশা করলাম তার আগেই বসতে পাব, যদিও লোকজনকে দেখে সেরকমটা মনে হলনা, সব দুরের যাত্রীই লাগছিল। মহিলাও কাউকে দেখছিলাম না আমরা দুজন ছাড়া। লোকজনের পোশাক আশাক কথাবার্তায় কেমন যেন মনে হচ্ছিল সভ্যতা থেকে অনেক দুরে এসে পড়েছি। দিনের বেলায় বেনারস পৌঁছলে হয়ত এমনটা লাগতনা, স্টেশনেও এরকম মনে হয়নি।
    বেশীরভাগেরই পরনে ধুতি, গায়ে কুর্তার ওপর চাদর জড়ানো। মাথায় পাগড়ি কারোর, কারো আবার চাদরটাকেই গায়ে মাথায় পাগড়ির মত জড়ানো, শুধু চোখদুটি দেখা যাচ্ছে। কারো কারো হাতে পাকা বাঁশের লাঠি। গন্ধ টন্ধও খুব ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছিলনা, কিছু কিছু চলনও ইষ্‌ৎ ট্যারাবাঁকা, মানে তরলের প্রভাবে হলেও হতে পারে। ঐরকম ভিড়ে দু চারটে "বেনারস কা ডাকু" থাকলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিলনা!

    তবে এখন ভেবে দেখি ভয় কিন্তু খুব একটা পাইনি সেরাতে। হ্যাঁ বসার জায়গা নেই, এতটা রাস্তা দাঁড়িয়ে যেতে হবে কিনা সে চিন্তা ছিল। লোকজনকে দেখে নানারকম মিশ্র অনুভূতির উদ্রেক হলেও সেরকম ভয় পাচ্ছিলাম না। তখন সেই বোধটাই ছিল না বোধহয়, কেন কে জানে!

    বাস ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হই হই করে কন্ডাকটর মশাই এলেন, সঙ্গে আমাদের পাবলিকরা, পেছন পেছন আরো যাত্রী। দেখা গেল আমাদের দলের লোকেদের সাথে কন্ডাকটরের হেভি দোস্তী হয়ে গেছে, চা টাও খাইয়ে দিয়েছে এরা তাকে। তাকে না ম্যানেজ করলে এত মালপত্র ছাদে ওঠানো যেতনা।
    মোটের ওপর তিনি বহুত সদয় আমাদের ওপর, ছেলেরাও ভাইয়া ভাইয়া বলে গলে পড়ছে। ভাইয়া প্রথমেই হাঁকডাক করে একে সরিয়ে, তাকে টেনে, মেয়ে দুজনকে ড্রাইভারের কেবিনের টানা সিটে বসালো অনেক চুক চুক দু:খ প্রকাশ করে। লেডিজরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, ছি ছি ছি ছি!

    একেবারে পেছনের টানা সিটে ঠেলেঠুলে কয়েকজনকে বসালো। বাকীদের এমন এমন স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে দাঁড় করালো যাতে তারা মিনিমাম সময় দাঁড়ানোর পরেই বসতে পেরে যায়। আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে পুরো ব্যবস্থাটা ঠিক উপলব্ধি করতে পারছিলাম না। শুধু বাস চলতে শুরু করার পর দেখলাম দেবাশিস কন্ডাকটরের সিটে, কন্ডাকটরের অ্যালুমিনিয়ামের স্যুটকেস তার কোলে। সেটা সেই আগেকার দিনের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার মত বাক্স, ভেতরে আবার খোপ খোপ করা তাতে নানা দামের নানা র ঙের টিকিট, পয়সা ইত্যাদি। স্যুটকেসটার ওপর মাথা রেখে রীতিমত নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে দেবাশিস, এদিকে কন্ডাকটর প্রথম দিকে দাপিয়ে সারা বাসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, শেষমেশ তার কোথায় ঠাঁই হল, সে আর অন্ধকারে বুঝতে পারলাম না।

    ঘুম ভাঙল চিৎকারে, "রেনুকূট, রেনুকূট"। ভোর হয়ে গেছে, বাসের বেশীরভাগ যাত্রীই ইতিমধ্যে নেমে গেছে। আমরা ছাড়া দু চারজন যা বাকী ছিল তারাও এখানে নেমে গেল। রাত্রিবেলা যেসব সহযাত্রীদের দেখে চোরডাকাত মনে হচ্ছিল, নানা ভয়ানক চিন্তা আসছিল মাথায়, ভোরের আলোয় তাদের নিরীহ দেহাতী ছাড়া আর কিছুই মনে হল না। আমাদের দলেরও কেউ কেউ জেগেছে দেখলাম, দু একজন নেমে বাসস্ট্যান্ডের চায়ের দোকানে ঢুকল। রেনুকূটের নামও শক্তিনগরের সঙ্গে প্রথম শুনেছিলাম। দিল্লী থেকে একটিমাত্র ট্রেন সরাসরি এখানেই আসে, খাতায় কলমে আমাদের সেই ট্রেনেই আসার কথা। আমরা যে ভাড়া টাড়া অফিস থেকে পাব এই জার্নির জন্য তা ঐ ট্রেনের এসি ফেয়ারের হিসেবে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে তবে সমস্যা একটাই, সে ট্রেনের দিল্লী থেকে ছাড়ার ও এখানে পৌঁছনোর কোনো নির্ধারিত সময় নেই। অনেকসময় ট্রেনের ড্রাইভার, টিটি ইত্যাদিরাও সঠিক বলতে পারেনা তারা কোন দিনের ট্রেন নিয়ে যাচ্ছে!

    আর একটি কারণে আমি উৎসাহভরে রেনুকূট শহর কে (ঐ নামেই) দেখতে থাকি, তা হল শুনেছি এখান থেকে ছাড়ে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস যা আমাকে নিয়ে যাবে কলকাতায়। বাস যখন স্টেশনের ধার দিয়ে যাচ্ছে, সতৃষ্ণ নয়নে স্টেশনটাকে দেখতে থাকি, কবে যে এখানে এসে বাড়ির ট্রেনে উঠব! পনের দিনও হয়নি, মনে হচ্ছিল পনের বছরেরও বেশী বোধহয় ঘরের বাইরে এমনিভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছি!

    শুনেছিলাম রেনুকূট বড় জায়গা, বড় বড় কল কারখানা আছে, বিড়লাদের ও আরো অনেকের। রাস্তার দুপাশের দোকানপাট দেখে তা কিন্তু একেবারেই মনে হয়না, কষ্টেসৃষ্টে মফস্বল শহর বলা চলে। পথের ধারের দোকানের সাইনবোর্ড দেখে জানলাম আমরা যে জেলায় এসেছি তার নাম সোনেভদ্রা। পরে তো চিঠিপত্রে ও নানা কাগজে ঠিকানা লিখতে লিখতে এ নামে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
    এলাকাটা কত চেনা, কত মনের কাছের তা কিন্তু প্রথম আবিস্কার করেছিলাম যখন মে মাসে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস চড়ে বসলাম, চাকরিতে যোগ দিয়ে প্রথম বাড়ি যাওয়ার জন্যে!

    রেনুকূট পেরোলেই শুরু হল চড়াই উৎরাই, উঁচু নীচু পথ। নিজের অজান্তেই কখন যেন ভালো লাগতে শুরু করেছে। দুপাশে জঙ্গল, তাতে কচি নতুন পাতায় সদ্য সাজা গাছের সারি, ভোরের হাওয়ায় দুলে দুলে আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। জানা ছিলনা যে শক্তিনগরের রাস্তা আসলে পাহাড়ী, সমুদ্র সীমার বেশ কিছুটা ওপরে। কিছুদুর যেতেই মাঝে মাঝে চড়াইয়ের পথের বাঁকে দেখা দিচ্ছিল, আকাশের বুকে মাথা উঁচু করে বিন্ধ্য পর্বতের রেখা। জঙ্গলের মাঝে মাঝেই ছোট ছোট জনপদ, খনি এলাকা, নর্দান কোলফিল্ডের কর্মকান্ড ছড়ানো বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। কখনো রুক্ষ, কখনো সবুজ বনরাজি, এই দুয়ের বৈচিত্রই যেন আরো সুন্দর, আরো মোহময় করে তুলেছে জায়গাটাকে। সকালের মিঠে প্রাণ জুড়ানো হাওয়ার সাথে মিলেছে বাতাসে কয়লা পোড়ার ওমজড়ানো গন্ধ। প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়ে নিয়েও যেন প্রাণ ভরেনা!

    তবে ভালোলাগা আর ভালোবাসার দুইয়েরই দুশমন দুনিয়া, একথা গুণীজনেরা নিশ্চয়ই বলে গেছেন কোথাও না কোথাও। রেখা এখন একেবারে ফিট, পাশে বসে ক্রমাগত গুনগুনিয়ে বলে যাচ্ছে, "গড, কিরকম জায়গা এটা? একদম ড্রাই, সো ফিউ গ্রিন! এখানে থাকতে হবে আমাদের? আমার বাড়িতে জানলে আসতেই দিতনা। ওরা ভেবেছিল আমি দিল্লীতে থাকব।".... ইত্যাদি ইত্যাদি। তার সাথে ফাঁকে ফাঁকে কেরালা কত সবুজ, কত গাছপালা, জল সমুদ্র এসবের কথা। তারপরেই আমাকে উদ্দেশ্য করে, "তোমাদের ওখানেও তো একেবারে আমাদেরই মতন, আমি বইয়ে পড়েছি। তোমার খারাপ লাগছে না?" আমার ভালো লাগছে শুনলে বেচারীর খারাপ লাগাটা আরো দুগুণ হয়ে যাবে তাই মিনমিন করে, "হ্যাঁ মানে সত্যি বড় রুক্ষ প্রকৃতি, তবে হাওয়াটা বেশ মনোরম" ইত্যাদি বলে ওকে থামাবার চেষ্টা করি।
    পাহাড়ের মাঝে ছোট ঝোরা, মাঝে মাঝে সবুজ হলুদ পাতার বনে একাকী লালে লাল দেমাকী পলাশ, দেখে দেখে আশ মেটেনা। ওদিকে রেখা চোখদুটোকে গোল করে, মুখটাকে ছুঁচোলো কড়া দিদিমনির মত জরিপ করছে চারপাশ। শেষমেশ হতাশায় রাগে বলে ওঠে, "একখানাও কলা বা নারকেল গাছ নেই কোথাও।" আমি এবার না শোনার ভান করে জানালার সঙ্গে সেঁটে যাই!

    শক্তিনগর বাসস্ট্যান্ডে যখন নামলাম তখনও সেখানের সকালের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়নি। বাসস্ট্যান্ড স্টেশনের কাছেই, চায়ের দোকানে সবে আগুন ধরানো হচ্ছে, ধোঁয়া উঠছে, জল বসানো হয় নি। দু চারটে লোক দেখা যাচ্ছে অলস পায়ে এদিক ওদিক, একমাত্র রিক্সাওয়ালারা সজাগ, এখন দুরপাল্লার ট্রেন ও বাসের আসার সময়, তাদের ব্যবসার পীক আওয়ার এটা।
    একে একে আমাদের মালপত্র নামিয়ে রিক্সায় তোলা হল, কন্ডাকটর ভাইয়াকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম ট্রেনিং সেন্টারের উদ্দেশ্যে।
    টাউনশিপে ঢোকার মুখেই বিশাল বড় বোর্ড স্বাগত জানাচ্ছে, ...শক্তিনগরে। মসৃণ পিচের রাস্তা, সাজানো গোছানো টাউনশিপ, ল্যান্ডস্কেপ উঁচুনীচু। এমনি দেখলে বোঝা যায়না কিন্তু রিক্সার গতির হেরফেরে ও রিক্সাওয়ালার হাঁপটানে মালুম হয় ঢেউখেলানো রাস্তার চেহারা। দুধারে নানা গাছের সারির ফাঁকে এক আধটা বাড়ির আভাস, তবে পরে দেখেছিলাম বেশীরভাগ কোয়ার্টার্স, স্কুল ইত্যাদি এই বড় রাস্তা থেকে একেবারে অন্য দিকে, শপিং সেন্টারও রাস্তা থেকে দেখা যায়না।
    স্টেডিয়াম, খোলা অ্যাম্ফিথিয়েটার ইত্যাদি পার হয়ে দুরে একটা ছোট রেলব্রিজ দেখা যায়, তার নীচে একটা সুড়ঙ্গপথ। কিন্তু ততদুর আমরা যাইনা, তার আগেই বাঁক নিয়ে রিক্সা চলতে থাকে এলোমেলো সর্পিল চড়াইয়ের পথে।

    আমি মুগ্‌ধ বললে কম বলা হয়। সামনে পাহাড়, বিশাল কিছু নয় তবু আস্ত একখান পাহাড়, আর তার গায়ে ট্রেনিং সেন্টারের ক্যাম্পাস, সমতল থেকে কিছুটা ওপরে।
    দু পাক ঘুরতেই রিক্সাওয়ালারা পরিশ্রান্ত, কিছুটা ওপরে গিয়ে ডানদিকে দুটো সিমেন্টের পিলারের মাঝে ছোট গেট, সিকিউরিটীর ছোট্ট কামরা,ক্যাম্পাসের শুরু।
    চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া, তবে বেড়ার আগল খুব কড়াকড়ি নয়। বড় রাস্তাটা সোজা চলে গেছে আরো দুরে (পরে জেনেছিলাম জ্বালাগাঁওর দিকে)। রাস্তার ওপারে ট্রেনিং ক্যাম্পাসের উল্টো দিকে ঝোপঝাড় আর কিছুটা খালি জমি পেরিয়ে রেললাইন!
    সেই রেললাইন একান্ত আমাদের নিজস্ব, দিনে দুবার কী তিনবার সেখান দিয়ে ট্রেন আসে কয়লা নিয়ে। এই ট্র্যাককে বলা হয় মেরি গো রাউন্ড বা এম জি আর।কত মন খারাপের দুপুরে এই লাইনের ধারে ঘাসে বসে আমি আর রেখা গলা ছেড়ে "ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস" গেয়েছি!

    দেখে দেখে আশ মেটেনা, একটা জঙ্গল পাহাড়ের মাঝে মাঝে সুন্দর রাস্তা, হাত বাড়ালেই চকচকে রেল লাইন, ছবির মত ট্রেনিং সেন্টার, হস্টেল। চারপাশের পরিবেশ দেখলে মনে হয় সেই মেয়েটির কথা যে সেজেছে অথচ সাজেনি সাজেনি ভাব!
    গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে, একটা একটু সরু পরিস্কার পিচের রাস্তা চলে গেচে যার শেষে রয়েছে স্যাটেলাইট কম্যুনিকেশন সেন্টার।
    রাস্তার বাঁদিকে হস্টেল, আর কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে একটু নীচে নেমে ট্রেনিং সেন্টার।
    রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার সারি। তিনতলা হস্টেল বাড়িটি খুবই সাধারণ, তবে বিশাল এলাকা জুড়ে। ঢোকার জায়গায় কোনো দরজা নেই। রিক্সা এসে একটা বাঁধানো চত্বরে দাঁড়াতেই এত সকালেও একজন ট্রেনিং ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী ছুটে এল ভেতর থেকে, হাতে খাতা নিয়ে।

    ঢুকেই বিরাট একটা প্রায় গোল উঠোন সিমেন্ট বাঁধানো। নীচ তলায় চার কোণের এক এক কোণে দুটো পাশাপাশি মোট আটটা ঘর। ঘরগুলোর সামনের দরজা সব উঠোনের দিকে, পিছন দিকে ব্যালকনি। বাকিটা দেওয়াল ঘেরা, এমনি দেওয়াল নয়, জাফরি কাটা। উঠোন থেকে একদিকে রাস্তার প্যারালেল একটা করিডর চলে গেছে বিল্ডিংয়ের শেষ অবধি, সেখানে বাঁ দিকে বড় ডাইনিং হল, সংলগ্ন রান্নাঘর, স্টোর রুম, ডান দিকে টিভি রুম, চেয়ার সোফা ইত্যাদি রাখা। একটি টিটি টেবিল, ক্যারম বোর্ড ইত্যাদিও রাখা আছে, সেই দরজা দিয়ে বাইরে গেলে সোজা ট্রেনিং সেন্টারের সামনে। সকালে ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট করে ওখান দিয়েই দৌড়নোর রীতি ছিল।
    মেন ঢোকার দরজাহীন গেটের পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলা ও তিনতলায়। খাতা হাতে লোকটি, কার কী নাম জেনে নিয়ে তাদের রুম নাম্বার জানাতে থাকল। আমরা দুজন খালি নীচের এক কোণের পাশাপাশি দুই ঘরে। ছেলেরা সবাই দোতলায় ও তিনতলায়। মেয়েদের আলাদা হস্টেল না থাকায় এই ব্যবস্থা, এটুকু পর্দা অনেক ভেবেচিন্তে বার করা হয়েছে।

    ঘর খোলা এবং মোটামুটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ঘরে ঢুকে প্রথমেই বারান্দার দরজা খুলি, সামনে পাহাড়, অনাদরের গাছগাছালিতে ভরা, শুকনো পাতায় আওয়াজ তুলে কাঠবেড়ালির দ্রুত ছুটে যাওয়া। নরম রোদ উঠেছে পাতার ফাঁকে মাকড়সার জাল চকচক করছে। ফড়িং প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। কেমন যেন আনমনে দাঁড়িয়েই থাকি, কোনোদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা শোরগোলে সম্বিত ফিরে পাই। কে যেন খুব জোরে জোরে কিছু বলছে, বাইরে উঠোনে। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখি, রেখার দরজায় রেখা আর সামনে সন্দীপ মহান্তি!

    সন্দীপ মহান্তি আমাদের ব্যাচের দুই ওড়িয়ার একজন। একটু সিনিয়র, কোন একটা প্রাইভেট কলেজে পড়াত এতদিন, দেখতেও সেরকম, বেশ তাগড়াই। ওর সাথে আছে পরেশ, সে আবার দলের সর্ব কনিষ্ঠ। ওরা আমাদের সঙ্গে আসেনি, অন্য কোনো রুটে সকালে আমাদের কিছু আগে এসেছে। সন্দীপের মত বাঙালী বিদ্বেষী ওড়িয়া আমি খুব কম দেখেছি। হয়ত আছে আরো অনেকেই কিন্তু তারা ওর মত এত খোলাখুলি ভাবে সেটা জাহির করে বেড়ায় না। মুখে সবসময় পান, হিন্দি ইংরেজী সবই বলে ওড়িয়া ভাষার মতো করে, আবার পান জড়ানো।
    দিল্লীতে বলা নেই কওয়া নেই একদিন আমার সামনে এসে বলে, "এই যে, সাউথ ইস্টার্ণ রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার কলকাতায় কেন হবে বল? তোমরা বাঙালীরা খালি পলিটিকস করে সব নিজেদের দিকে করে নাও। এইসব চাকরির পরীক্ষা দিতে কলকাতায় যেতে হবে কেন " ইত্যাদি নানা কথা। আমি তখন ওকে চিনিও না। আমি আবার অচেনা লোকেদের সাথে বেশি কথাবার্তা বলিনা তাই উত্তর করিনি। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই এরকম নানা উদ্ভট ইস্যু নিয়ে আমাকে পাকড়াও করত, সবই বাঙালীদের বদমায়েসী সংক্রান্ত। আর আমি চুপচাপ সেখান থেকে সরে যেতাম। বাঙালী ছেলেদের কাউকে নাম ধরে ডাকতনা, সবাইকে বলত " এই বংগালী"। রেখা সবসময় আমার পাশে পাশে থাকত, ও এইসব দেখে শুনে কেন জানিনা সন্দীপকে একটু ভয় খেত।

    দেখি সন্দীপ কিসব বলে যাচ্ছে আর রেখা আমার দেখানো পথে চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ঘর দুটো একেবারে পাশাপাশি নয়, একটু কায়দায় রেখার ঘরের দেওয়াল কিছুটা এগিয়ে আমার থেকে। তাই ওর দরজা থেকে আমার দরজা দেখা যায়না। আমি দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা।

    সন্দীপরা পৌঁছেছে অনেক ভোরে, সিকিউরিটীকে দিয়ে দুখানা ঘর খুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সাফাইয়ের লোকজন যখন এসেছে তখন ওরা ঘুমিয়ে, ঘর পরিস্কার হয়নি। এবার উঠে ও ঘর পরিস্কার করানোর জন্যে খুঁজে দেখে সাফাইয়ালারা চলে গেছে। অগত্যা নিজেই যাইহোক করবে বলে ঝাড়ুর খোঁজে বেরিয়েছে, এবং মেয়েদের ঘরে এসে নক করেছে। এবার আমি তো "শালা বংগালী", অতএব অপশন রেখা।

    রেখাকে ও "ঝড়ু" চেয়েছে, এবার রেখা ঐ বস্তুটিকে হিন্দিতে জানে "জাডু" বলে, নিজের ভাষায় অন্যকিছু। অবশ্য বুঝতে পারলেও কিছু হতনা, আমরা তো সেই সদ্য ঢুকেছি, ঝাড়ু ইত্যাদি আমাদের কাছে আসবে কোথা থেকে। রেখা কিছু না বুঝে চুপ আছে আর সন্দীপ সেই মৌনতাকে অসম্মতি ধরে নিয়ে মেয়েদের অধ:পতন সম্পর্কে লেকচারপর্ব শুরু করেছে। মেয়েদের কাছে ঝাড়ু থাকা উচিৎ, তাদের চারধার নিজেদেরই পরিস্কার করা উচিৎ সেই থেকে মেয়েদের পুজোপাঠ ও আরও কী কী করা উচিৎ অবধি চলে গেছে।

    আমি দরজা বন্ধ করলাম, এদের সঙ্গে ছমাস কমকরে থাকতে হবে, রেখা নিজেই বুঝে নিক। মনে এও ঘোর সন্দেহ জাগছিল, যে এটি সন্দীপের ফাজলামো ও কাইন্ড অফ র‌্যাগিং। দেখে মনে হয় না ও সকাল সকাল ঝাড়ু নিয়ে নিজের ঘর পরিস্কার করার মত বান্দা !
  • Nina | 12.149.39.84 | ২৮ জানুয়ারি ২০১২ ০২:৩০514858
  • শ্রাবণী
    তোমার মেমরিটা ফোটোজনিক! মনে হয় আমি পরিস্কার দেখতে পাছি---ঐ উড়ের পানখাওয়া তাচ্ছিল্যটা পর্য্যন্ত!I mean উড়িয়া ;-)
  • Tirthang | 128.103.11.202 | ২৮ জানুয়ারি ২০১২ ০৫:৩৬514859
  • অসাধারণ লেখা - ভীষণ ভালো লাগছে।
  • rimi | 75.76.118.96 | ২৮ জানুয়ারি ২০১২ ০৭:৩৮514860
  • সত্যি, এই লেখাটা জাস্ট অসা...
    আর শ্রাবনী যে কি করে বাংলার বাইরে থেকেও এত ভালো বাংলা শিখেছে ভেবে খুব অবাক লাগে আমার।
  • Nina | 12.149.39.84 | ৩০ জানুয়ারি ২০১২ ২২:২১514861
  • ঐ যে বল্লেম শ্রাবণীর মেমরিটা ফোটোজনিক--যা দেখে তা আরও সুন্দর করে ধরে রাখে
    আর মেমরিটা ফোটোগ্রাফিক তো বটেই--
    কি হল গো --আগে বঢ়ো
  • shrabani | 124.124.244.107 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১২:৩৬514862
  • শুরু হল ট্রেনিং পর্ব, ক্লাসরুম ট্রেনিং। প্রোগ্রামের উদ্বোধন করতে এলেন প্রজেক্টের বড় কর্তা, জেনারেল ম্যানেজার, বাঙালী। কনফারেন্স রুমের বিশাল ভারী ডিম্বাকৃতি টেবিল ঘিরে চেয়ারে বসে আমরা আঠেরো। কোঅর্ডিনেটরের সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পরিচয় প্রদানের পর পর জি এমের স্বাগত ভাষণ। অত্যন্ত সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক, দন্ডমুন্ডের কর্তার সেই ভারিক্কীপনাই নেই। হাসিমুখে নেমে এলেন প্রত্যেকের সঙ্গে হাত মেলাতে, পেছন পেছন ব্যস্তসমস্ত ট্রেনিং কোঅর্ডিনেটর ও কর্তার সঙ্গে আসা দু একজন চেলাচামুন্ডা। এমনি মুখে আলাদা কিছু বললেন না তবে বাঙালী নাম শুনে চোখে ক্ষণিকের একখানা ঝিলিক দেখলাম। বারবার বললেন সবার উদ্দেশ্যেই যে কোনো কিছু দরকার পড়লে সেরকম মনে হলে ওনার কাছে যেতে যেন দ্বিধা না করে কেউ, ওনার বাড়িতেও আমরা অলওয়েজ ওয়েলকাম।
    অবশ্যই আমরা তা কথার কথা হিসেবেই নিলাম, সাধারণ ট্রেনীদের সবাইকে ছেড়ে সোজা জি এমের কাছে ছুটতে হবে এরকম দরকার কখনো পড়বে বলে মনে হয়না!
    পরে ঘুরতে ঘুরতে বিশাল জি এম বাংলোর কাছে যখনই গিয়ে পড়েছি পাঁচিলের ধার থেকে দেখেছি,কখনো ধবধবে সাদা শাড়ি আটপৌরে করে পরে পাকা টুকটুকে বৃদ্ধা একটু নুয়ে বাগানে ফুল তুলছে অথবা গার্ডেন চেয়ারে একজন মহিলা, পরনে তাঁতের শাড়ি, ঘাড়ে আলগা খোঁপা, হয়ত বা মৃদু দুলছে ক্যাসেট প্লেয়ারের রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে, হাতে উলকাঁটা বা কোনো সেলাই। খুব ইচ্ছে হত ঢুকে পড়ি, ঘর থেকে দুরে এরকম একটা বাঙালী ঘরোয়া শান্ত পরিবেশকে একটু ছুঁয়ে আসি, তবে সাহস হয়নি কোনোদিন। ওনাদের সঙ্গে পরে আরও দুএকবার দেখা ও হাল্কা কথা হয়েছে, ঐরকম একখানা ভারী পদে আসীন কর্তার বা প্রোজেক্টের ফার্স্ট লেডি মহিলার এত সুভদ্র আচরণ আর কোনোকালে এই আঠেরো বছরে চোখে পড়েনি, বাঙালী বা অবাঙালী কারো মধ্যেই!

    ক্লাস শুরু হত নটা থেকে, এগারোটা বাজতে না বাজতেই আমরা লাফিয়ে উঠতাম, টী ব্রেক। ট্রেনিং সেন্টারে তখন পরিবেশ সচেতনতার হাওয়া, ফলস্বরূপ মাটির ভাঁড়ে চা (লালু প্রসাদের রেলের ভাঁড়, সে অনেক পরের কাহিনী!)। খাবার ঘরের একপাশে ডাঁই করে রাখা থাকত ভাঁড়, টেবিলে চায়ের বড় কন্টেনার আর প্লেটে বিস্কিট। সেন্টারের কর্মচারীরা (সংখ্যায় তারা অল্প, চা বিরতির সময়ও সবার ভিন্ন, মর্জিমাফিক) একটি দুটি তুলে নিত, আর আমরা নিতাম মুঠো মুঠো।

    আমার ভীষণ পছন্দের ছিল ভাঁড়ে চা নিয়ে সেন্টারের সামনের খাদের রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো। ফাঁকা চারধার, শুধু হাওয়ায় পাতার শব্দ, ফাঁকে ফাঁকে রোদের উঁকিঝুঁকি। কখনো পাকদন্ডী দিয়ে চলে যায় এক আধজন লোক বা একটা রিক্সা। মেসের জন্যে সবজির ভ্যান নিয়ে আসে বাজারের সবজিওয়ালা, সাইকেলে ব্যাগ ঝুলিয়ে চাল ডাল আটা মশলা নিয়ে লালার দোকানের ছেলে।
    সামনের রাস্তা দিয়ে গ্রামে যাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু গ্রামবাসীরা এ রাস্তা ব্যবহার করে না, এ আমাদের নিজস্ব রাস্তা তাই এমনি লোক চলাচল খুবই কম। নীচের বড় রাস্তার আওয়াজও আসেনা, অথচ গাড়ি দেখা যায় ঝোপঝাড় গাছপালার ফাঁক দিয়ে । চায়ে চুমুক দিতে দিতে সেই অলস বেলাকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে শরীর মনে চারিয়ে দিয়ে এক অদ্ভুত ভালোলাগায় আবিষ্ট হয়ে থাকি। এখন ফিরে তাকিয়ে মনে হয় শুধু ঐ ছমাসের জন্য, ওরকম একটা জায়গায় থাকার জন্য আরো কত সাড়ে সাতেরো বছর কাটাতে পারি প্রতিটা আঠেরোতে!

    ট্রেনিং কোঅর্ডিনেটর সিং সাব বিহারের লোক, ছোটখাটো চেহারায় বয়স্ক মানুষটি। কথা বলতে গিয়ে সবসময় হাতদুটো জড়ো হয়ে বুকের কাছে চলে আসে, মিনতি ভরা স্বর। দিল্লীর মালহোত্রার একদম বিপরীত, ছোট বড় সবাই ওকে দাবড়ে চুপ করিয়ে যায় অহরহ। পরে এই আমরাই অনেক জুলুম করেছি ওর ওপর, যখন ওর স্বভাবটা জেনেছি ভালো করে। এই এক অদ্ভুত নিয়ম কম্পানির, এখানের লোকের ভাষায় যত ঝরতি পড়তি মাল সব ট্রেনিং ডিপার্টমেন্টে, সব ব্যাপারেই এদের সঙ্গে দুয়োরানীর মত ব্যবহার করা হয়। যারা এখানে কাজ করে তাদের আর কোথাও যাবার জায়গা নেই, তাদের অন্য কোথাও নেয়না। ভুল করে কখনো ভালো কাজের লোক দুএকজন এসে পড়লেও তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাততাড়ি গোটায় এখান থেকে। আমাদের ঐ ছমাসেই দুজন হেড কে বদলি হতে দেখেছিলাম।

    তখনও গ্রীষ্ম আসেনি, মানে যাকে বলে বসন্তের মরশুম, তাই চলছে শক্তিনগরে। তবু দুপুরের দিকটা বেশ গরম লাগত। আমরা সিংসাব কে বলে কয়ে মানে চেঁচিয়ে চিৎকার করে এসি কনফারেন্স রুমে ক্লাসের ব্যবস্থা করলাম। যদিও আঠেরোর অনেক বেশি সংখ্যক চেয়ার ছিল ঘরে তবু প্রথম দিনেই লাঞ্চের পর ক্লাস নিতে যে এল তার সংখ্যার গরমিল বুঝতে অসুবিধে হল না। ফলে পরদিন থেকে হাজিরা খাতায় আফটারনুনের সইয়ের একটা কলাম যোগ করা হল। সিং সাবের নীচে ছিল বাসুবাবু, তিনি আবার সেই মালহোত্রার গোত্রের লোক, দাপটে মনে হত বসের সিংটা আসলে এই খুলে নিয়ে মাথায় পরেছে!

    তা ক্লাসে এলেই বা কী! পড়াতে আসত তো সেই প্ল্যান্টের লোকেরাই, এই পান্ডববর্জিত জায়গায় আবার বাইরের ফ্যাকাল্টি কোথা থেকে আনবে রোজরোজ? আর আনতে চাইলেই বা লোকে আসতে চাইবে কেন ওরকম রাস্তা ঠেঙিয়ে। তবু ম্যানেজমেন্ট মডিউলে এসেছিল অনেকেই, দিল্লী, বম্বে, বেনারস থেকে, নামকরা লোকজন। বাকি সব কিছুর জন্যে ঐ ঘরেই ব্যবস্থা।
    একজন মনে আছে বম্বের এক ম্যানেজমেন্ট গুরু, বয়স্ক ভদ্রলোক। নানা কথার ফাঁকে কী একটা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে বললেন যে বাঙালী মাত্রেই বুদ্ধিজীবি, সৃজনশীল বা শৈল্পিক ইহা একটি মিথ ও মিথ্যা, প্রমাণিত হয়ে গেছে। সেই শুনে সারা ক্লাস আমাদের চারজনকে ঘুরে ঘুরে দেখে আর সন্দীপ মহান্তির সে কী খৌয়া খৌয়া হাসি!
    ভদ্রলোক ব্যাপারটা অনুমান করে চার বাঙালীর দিকে দাঁত বার করে বলেন, "ও , তোমরা বাঙালী? কিছু মনে কোরোনা আমি তো একটা উদাহরণ দিচ্ছি মাত্র, সাধারণ বাঙালীদের চরিত্র সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করছি না।" রাগ হচ্ছিল, আর দেবার মত উদাহরণ পেল না!
    থাকতে না পেরে বললাম, "আপনি এটাও উল্লেখ করতে পারতেন যে এই মিথ বা মিথ্যা যারাই তৈরী করে থাকুক তারা বাঙালী নয়। আমরা জাতি হিসেবে এরকম কিছু দাবী করি বলে আমার জানা নেই। নিজেদের ভুল ধারণা নিজেরাই ভাঙছেন, এরমধ্যে বাঙালীদের কৃতিত্ব বা দোষ কোনোটাই নেই!"
    বয়স্ক ভদ্রলোক একগাল হেসে আমার কাছে এগিয়ে এসে মজা করে বললেন, "এটা আমার বিষয় নয়, তবু এখন মনে হচ্ছে বাঙালীদের সম্বন্ধে কথাগুলো হয়ত একেবারে ভুল নয়, তলিয়ে দেখতে হবে ব্যাপারটা।" উনি মজা করে বলছেন দেখে আমিও হেসে ফেলি, "ভুল প্রমাণ করতে আমার মত বাঙালীদের সাহায্যই নিতে হবে আপনাকে।"
    মহান্তি এবার পানের পিক ভরা মুখে খেউ খেউ করতে করতে বিচ্ছিরি ভঙ্গীতে বলে, "বংগালী লেডিজ লেকিন বুরা নহী হ্যায়"।

    লাঞ্চের পরে ক্লাস নিতে এলে দেখা যেত ট্রেনীদের মহা উৎসাহ, প্রজেক্টর সেট করে দিচ্ছে নিজেরাই, আলোটালো নিভিয়ে সুন্দর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। স্যরেরা পরে কী ভাবত না ভাবত জানা নেই, তবে পড়িয়ে যেত ঐ স্ক্রীন বা বোর্ডের দিকে তাকিয়েই, ক্লাসের দিকে ফিরেও তাকাতোনা। আসলে বেশীরভাগেরই তো নিজেদেরও এমন দিন গেছে। তবু এক আধজন ছিল বেয়াড়া।
    যেমন আর কুমার একদিন ঐ আলো আঁধারে মুখটাকে কাঠ কাঠ করে রেখাকে বললে, "মিস ভার্মা, বাইরে গিয়ে চোখে জল দিয়ে আসুন আর যদি মনে হয় আমার ক্লাসে জেগে থাকা সম্ভব নয় তাহলে একেবারেই বাইরে যান, ক্লাসে ফিরে আসার দরকার নেই।"
    আমরা ধন্য ধন্য করেছিলাম, কী চোখ! ঐ অন্ধকার, রেখার হর্লিক্সের কাঁচ চশমা, তা সত্বেও! তারপর থেকে ওনার ক্লাসে সবাই সাবধান হয়ে গেছিল, পরে সিংয়ের আর এক চেলা দত্তাজী (আসলে বাংলা দত্ত) র সঙ্গে বসে কুমারের ক্লাস যাতে লাঞ্চের পরে না রাখা হয় তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

    চলছিল প্ল্যান্টের নানা স্কীম, সিস্টেম ইত্যাদির থিওরি ক্লাস। রীতিমত সিলেবাস ধরে ধরে নানাজনে এসে পড়িয়ে যেত। এক ভদ্রলোক প্রথম দিন এল ক্লাস নিতে, কত কী বলে যাচ্ছিল, বোর্ডে এঁকে এঁকে আর একটুও জায়গা খালি নেই। শেষে দেখা গেল কয়লা যেখান থেকে আসে সেই জয়ন্ত মাইন আর আমাদের প্ল্যান্টের চিমনি এক্কেরে পাশাপাশি! মানে সেরম হলে এম জি আরের ট্র্যাকটাই বৃথা আর কি!
    আমরা থাকতে থাকতেই দেখলাম ভদ্রলোকের মুখ দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে ভরে যেতে থাকল। মাঝে মাঝেই ক্লাস নিতে আসত মানে না ডাকলেও চলে আসত। আসলে ঘোরাফেরা করত ট্রেনিং সেন্টারের আশেপাশে, ওর ডিপার্টমেন্টে তখন ওকে কোনো কাজ দিতনা। কখনও ক্লাস খালি থাকলে অর্থাৎ নির্ধারিত ফ্যাকাল্টি না এলে সেন্টারের লোকেরাই ওকে বলত ক্লাস নিতে, কখনও না বললেও ঢুকে পড়ত। যাই ক্লাস নিতে বলা হোক, শুরু ও শেষ করত জয়ন্ত মাইনস থেকে। ভালো সময়ে সে নাকি কোল হ্যানডলিংয়ের এক্সপার্ট ছিল।
    ওকে নিয়ে নানা গল্প ছিল, উঙ্কÄল ছাত্র, কর্মক্ষেত্রেও প্রতিভাবান। পড়াতে নাকি খুব ভালোবাসত। এই দুরদেশে ছেলেমেয়েদের ভালো পড়াশোনার সুযোগসুবিধে নেই বলে ওরা দুতিনজন বন্ধু মিলে টাউনশিপের স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিত এই ট্রেনিং সেন্টারেই। পড়াতে গিয়ে একটি বারো ক্লাসের ছাত্রীর প্রেমে পড়ে দুই বন্ধুই, মেয়েটি এর বন্ধুকে পছন্দ করে ও তাদের বিয়ে হয়। তারপর থেকেই এ এমনিধারা হয়ে গেছে। সে বন্ধুকেও দেখেছি, স্কুটারে চেপে কোনো কোনো বিকেলে তখনও ক্লাস নিতে আসত ছাত্রছাত্রীর দল নিয়ে। অন্যজন অবশ্য তখন আর স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়াত না। আবার কেউ কেউ বলত ওসব কিছু নয়, অতি বুদ্ধিতে ও ওরকম পাগলাটে হয়ে গেছে!

    এদিকে হস্টেলের একতলায় আমরা দুজন মেয়ে আর একা নই, আমাদের প্রতিবেশী এসে গেছে। ব্যাচে একজন ছিল পাণ্ডেজী, ইন্টারনাল ক্যান্ডিডেট। ডিপ্লোমা করে সুপারভাইজরের চাকরি করত দিল্লীতে, চাকরি করতে করতে এ এম আই ই করে। এখন পরীক্ষা দিয়ে আমাদের সাথে ট্রেনী হয়েছে। এরকম ক্যান্ডিডেটদের জন্য বয়সের ছাড় দেওয়া হত।
    তা পাণ্ডেজীর বয়স বেশ অনেকটাই বেশী বাকীদের থেকে, চেহারাও বিপুল। তিনি এলেন সবার পরে, দোতলায় একরাত্তির থাকার পরেই ঘোষণা করলে যে ওপরে তার গরম লাগছে, ঘুম হচ্ছেনা, সে নীচে একতলায় থাকবে। এই লোকটি আবার দিল্লীতে অয়াসোসিয়েশনের নেতা একজন। সিংজী মিনমিন করে আপত্তি জানিয়ে বিফল হয়ে শেষে এর জন্যে আমাদের ঠিক উল্টোদিকের কোণায় একখানা ঘর খুলিয়ে দিল। পাণ্ডেজী আসার পর যেটা হল তা হল প্রথমবার আমাদের মধ্যে কিছু ছেলের খেয়াল হল যে আমরা দুটি মেয়ে তাদের থেকে আলাদা জীব! আসলে সবাই তো প্রায় সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শেষ করে এসেছে, মেয়েদের দেখে সেই প্রথম কী দেখলাম ভাবখান কারুরই নেই। কিন্তু পাণ্ডেজীর তো আর তা নয়, সে পড়াশোনা ছেড়েছে বহুকাল, বিয়ে থা হয়ে ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে।বাড়ি থেকে দুরে ট্রেনিংয়ে এসে তার আবার সেই কলেজ স্টুডেন্ট সাজবার শখ চাগিয়েছে।

    সে এক বিরক্তিকর অবস্থা। খান চারেক ছেলে জুটল তার চেলা, অষ্টপ্রহর আমাদের ঘরের সামনে আড্ডা চলতে লাগল। অবশ্য উঠোনটা বড় ছিল বলে একেবারে মুখোমুখি ঘর ছিলনা তবু আমাদের দরজা খুলে রাখবার উপায় নেই। এদিকে আমি তো এমন ক্লাসে পড়েছি যেখানে আমরা মেয়ে ছিলাম চারজন বাকি সবাই ছেলে। কিন্তু ছেলেরা ,মেয়েদেরকে নাকি এতটাই ভয় করে চলত যে আমাদের আশেপাশে তাদের দেখা যেতনা। তাই এইসব আবছা আড়াল, ছেঁড়া কথা, টুকরো মন্তব্য ইঙ্গিত ধরণের অভিজ্ঞতা আমার একেবারেই ছিলনা।
    আমাদের জন্য একটি বাস ছিল, বুড়ো বাবা ড্রাইভার। কানে কম শুনত বলে ফুল ভলিউমে গান চলত। পাণ্ডেজী ও তার দলের ব্যবস্থাপনায় সারা ট্রেনিং পিরিয়ডে দুটি গান বাজত ঘুরে ফিরে, "লাল দুপট্টা ওয়ালী তেরা নাম তো বতা" আর "আচ্ছা সিলা দিয়া তুনে মেরে পেয়ার কা"। দোষের মধ্যে আমাদের দুজনেরই একরকমের লাল ওড়না ছিল শক্তিনগর বাজার থেকে কেনা!
    রেখার অবশ্য কোনো সমস্যা ছিলনা, সে এসব গানের কথা খুব ভালো বুঝতনা। আমি একাই বুঝতাম আর রাগে জ্বলতাম। কলেজে ক্লাসের ছেলেদের শাসন করা যায় স্যরেদের ভয় দেখিয়ে, কিন্তু এখানে কিছু করার নেই গায়ে না মাখা ছাড়া। বাবাকে বলে দু একবার ক্যাসেট পাল্টানোর চেষ্টা করলে, শুধু পাণ্ডের দলই নয় অন্য ছেলেরাও হল্লা জুড়েছে, সেসব কাঁদুনি গান বলে!

    রবিবারে ঘুম থেকে দেরী করে উঠে স্নান টান সেরে তৈরী হতে হতে বেলা হয়ে যেত অনেক। ব্রেকফাস্টও করতাম না বেশীরভাগ দিনই, সবাই জানত,রেখাও, তাই কেউ ডাকতনা। এরকমই এক রবিবারে অসময়ে দরজায় ঠকঠক শুনে খুলে দেখি, অশোক দাঁত বার করে হাসছে। "কীরে কী হল?" "পাণ্ডে টেপ রেকর্ডার কিনে এনেছে রেনুকুট থেকে। সকাল থেকে একই গান বাজাচ্ছে তোদের জন্য, সবাই বেরিয়ে পড়ল গানের গুঁতোয় আর তোরা ঘরে বসে আছিস?"
    আমারও একটা ছোট টেপরেকর্ডার ছিল, সেটা চলছিল আর দরজাও বন্ধ তাই পাণ্ডের গান শুনতে পাই নি। এখন খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সস্তা সিস্টেমের গাঁকগাঁক আওয়াজ কানে এল ( আমার দরজা খোলার আওয়াজে ভল্যুম টা বেড়ে গেল যেন) "মেরে সামনেওয়ালী খিড়কী মে, এক চাঁদ কা টুকড়া রহতা হ্যয়"। কী বলব, আপাদমস্তক রি রি করে উঠল । ততখনে অশোক রেখাকেও ডেকেছে, যেন একটা মহা ফুর্তির ব্যাপার!
    এই গানটি বুঝতে রেখারও অসুবিধে হলনা। হয়ত অন্য কেউ মানে পছন্দসই কেউ এই গান গাইলে বা বাজালে দুজনে ভাবতাম নির্ঘাত অন্যজনের জন্য গাইছে এবং ভেবে একটু হিংসে নয় সেই যাকে বলে জেলুসিলের চিনচিনে জ্বালা হত। কিন্তু এক্ষেত্রে গান বাজছে পেটমোটা মধ্যবয়স্ক দুই ছেলেমেয়ের বাবা পাণ্ডের ঘরে। দুজনেই ভাবলাম ঠিক বদমাইশ টা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বাজাচ্ছে!
    ঘরের দরজায় তালা দিয়ে দুজনে ব্রেকফাস্টের অবশিষ্টের আশায় ডাইনিং হলের দিকে যেতে যেতে ভাবতে থাকি এই পাণ্ডে এন্ড কোং কে চুপ করাবার একটা ফন্দি বার করতে হবে শীগগিরি!
  • siki | 155.136.80.81 | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১৫:০০514863
  • তারপর?
  • Nina | 69.141.168.183 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ০৩:০০514864
  • উফ! ফন্দিটা কি বেরোলো ????
  • titir | 128.210.80.42 | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ০২:০৩514865
  • শ্রাবনী,
    একবার ও হোঁচট খেতে হয় না তোমার লেখা পড়তে। বড় সাবলীল লেখা। অনেকক্ষণ ধরে রেশটা রয়ে যায় মনের মধ্যে।
  • de | 203.197.30.4 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১২:০৭514867
  • এই রত্ন আমি কাল গুরুতে খুঁজে পেয়েছি -- একটানা পড়ে গেলাম, পুরো ছবি! খুব ভালো হচ্ছে শ্রাবণী!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন