এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আঠের বছর - মনে হয় এই তো সেদিন

    shrabani
    অন্যান্য | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ | ১০৭৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shrabani | 124.124.244.107 | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ ১২:২৫514778
  • -"কত দিন হল বলোতো?"
    -"এই মার্চে আঠের হবে"
    -"আঠের! বাবা, সত্যি মনেই হয়না এতগুলো দিন চলে গেছে। সেই তোমাকে প্রথম দেখলাম ট্রেনিং সেন্টারের পাশের এস টি ডি বুথে। রাত্রি বেলা, তখন তো টাউনশিপের মধ্যে ঐ একটাই বুথ, সবাই খেয়েদেয়ে রাত্রি দশটার পরে হাঁটতে হাঁটতে যেতাম ফোন করতে। কী ভিড় হত! টেবিলটার ওদিকে বুথের ছেলেটা বসে নম্বর মেলাতো আর এদিকে একটা সরু বেঞ্চি, ঘেঁসাঘেঁসি করেও চারজনের বেশী বসার জায়গা হতনা।
    আমি বসেছিলাম, তোমার দাদা দাঁড়িয়েছিল। তুমি ঢুকে এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলে। চোখে পড়েছিল কারণ তোমার হাইট। তবে তখনও জানিনা এই সেই নতুন বাঙালী মেয়ে এক্সিকিউটিভ ট্রেনি। তোমাকে নিয়ে খুব আলোচনা হত মহিলা মহলে, তোমার নাকি খুব ডাঁট, সবার সঙ্গে কথা কওনা। বাঙালীদের থেকে অবাঙালীদের সঙ্গেই ভাব বেশী, বাংলাও জানোনা ভালো, সবসময় হিন্দী আর ইংরিজী বল, আরো কত কী!
    সেদিন ফিরছি যখন তোমার দাদা বলল, "ঐ তো শ্রাবণী"। খুব আফসোস হচ্ছিল, একটু কথা বলে দেখলে হত। আমি জিজ্ঞেস করলাম "হ্যাঁগো, খুব অহংকারী?" তোমার দাদা রেগে বলল, "ধ্যাত, তোমাদের যত উল্টোপাল্টা কথা, বাচ্চা মেয়ে, সবে এসেছে। এরমধ্যেই তোমরা তার খুঁত বার করে ফেললে।" তারপর তো সেই পিকনিকে তোমার সঙ্গে আলাপ, কত গল্প।যখন শুনলাম বিয়ের পর তোমরা আমাদের পাশের কোয়ার্টারের ওপরে আসছ, খুব ভালো লাগল।".........ইত্যাদি

    শুনতে শুনতে আমিও কেমন সেই দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছিলাম, সত্যিই তো আঠের বছর হয়ে গেল! কত সুন্দর সেই সব দিন, কত কঠিন আবার মধুর স্মৃতি। লিখতে শুরু করি একটু একটু করে, যা মনে পড়ে---ফিরে দেখা!

    তবু এটা একা আমার টই নয়। আমার চাকরীজীবনের কথা লিখব বলে খুলেছি.... সেটা আর যে কারুরও হতে পারে, থাকতে পারে অনেক কথা! এখনও জানিনা কোথায় শেষ করব, তবে শুরুটা জানি......এখান থেকে, এই শহর থেকে, দিল্লী দিলওয়ালোঁ কী নগরী......

  • shrabani | 124.124.244.107 | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ ১২:৪১514822
  • **********************************

    ভূগোলের জ্ঞান কোনোদিনই খুব মারাত্মক ভালো ছিলনা, বিশেষ করে দেশের ভূগোল। তাই প্রথম যখন শক্তিনগরের নাম শুনলাম বেশ একটা হোঁচট খেলাম। সেটা আবার কোন দেশে!
    ট্রেনিং কোঅর্ডিনেটরের মুখখানা সর্বদাই বাংলার পাঁচ। এই কদিনে কখনো কেউ ওমুখে হাসির আভাস টুকুও দেখেনি। দিল্লীতে জয়েন করার পর সাতদিনের একটা প্রাথমিক ট্রেনিং প্রোগ্রাম চলছিল। হৈহৈ করে কাটছিল, থাকার ব্যবস্থা গেস্টহাউসে, শহরের কেন্দ্রে। সকালে বাস এসে নিয়ে যায় কনভেনশন সেন্টারে। বিশাল অডিটোরিয়াম, স্টেজে নানা বড় বড় হোমরাচোমরা রা নানাদিন এসে গম্ভীর লেকচার দিয়ে যাচ্ছে, ম্যানেজমেন্ট ইঞ্জিনীয়ারিং, ফাইন্যান্স ইত্যাদি হাবিজাবি বিষয়ে।
    সেসব খুব যে শোনা হচ্ছে তা কিছু নয়, মোদের ওপর নেই ভুবনের ভার--তাই এসব জেনে কী ছাই পাঁশ হবে!অতএব অন্ধকার হলে আরাম করে গদিআঁটা চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজে বিশ্রাম, কখনো বা হাল্কা ঘুম দিয়ে নেওয়া। রোজকার দের রাতের আড্ডা আর হুটোপাটির ক্লান্তি দুর করতে এরকম আদর্শ বিশ্রামের জায়গা আর হয়না।
    মাঝে মাঝে কফি ব্রেক ও ভরপেট লাঞ্চ ইত্যাদি পেরিয়ে বিকেল নাগাদ সবাই একদম তরতাজা, লিপটনের বিজ্ঞাপনের মতো। ছুটির পরে দলবল মিলে শহরের নানা দিকে দাপিয়ে বেড়াতে বেরোনো হয় যখন , তখন সবাই একেবারে তৈরী, অন ইয়োর মার্ক!

    সময়টা মার্চের মাঝামাঝি, ভরা বসন্ত বেলা। দিল্লীতে তখন যাকে বলে বেইমান মৌসম,না ঠান্ডা না গরম। সদ্য পেরিয়েছে রঙের মহোৎসব, আকাশে বাতাসে ঘাসে ঘাসে পাতায় পাতায় তখনো রঙের ছাপ অমলিন। আর যে বয়সে মনে নিত্যই ফাগুন মাস, সেই বয়সের একশ কুড়ি জনের সমাবেশে দিল্লী শহরেরও মন মাতাল সাঁঝসকাল!
    সেসময় এমনি করেই দিনগুলো যদি কেটে যায় কারোর আপত্তি হতে পারেনা, আমাদেরও ছিলনা। মস্তি করে বেড়ানোর জন্য টাকা পাচ্ছি ভাবতেই একটা স্বর্গীয় অনুভূতিতে ভরে যেত মনটা। অবশ্য ব্যতিক্রম সর্বত্রই থাকে তাই এখেনেও দু একজন সিরিয়াস গোছের পাবলিক একঘেয়েমির কথা তোলে। তবে তারা হাতে গোণা, যুগপ্‌ৎ হ্যাটা এবং হুটিং খেয়ে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থাশেষে স্রোতে গা ভাসিয়ে তবে রেহাই পায়!
  • siki | 123.242.242.16 | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ ১৩:৪৪514833
  • ইয়েস্‌স্‌স্‌স্‌স্‌স্‌স্‌।

    চলুক। :)
  • shrabani | 117.239.15.102 | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ ১৫:১৬514844
  • বিজ্ঞজনে বলে গেছে সব দিনেরই শেষ আছে, সুখের দিন বা দুখের দিন যাই হোক না কেন। এক্ষেত্রেও সেই শেষ এল, সাতদিন পরে এক বিকেলে, ট্রেনিং কোঅর্ডিনেটরের রূপ ধরে।
    লেকচার শেষ হওয়ার পরে পরেই মালহোত্রাকে দেখা গেল স্টেজে, হাতে কাগজের তাড়া নিয়ে নাকের ডগায় চশমা বাগিয়ে। এই সাতদিন ও তার আগের দিন তিনেক মিলিয়ে এই ভদ্রলোকটির ওপরে মোটামুটি দলের প্রত্যেকেরই একটা বিরাগ জন্মে গেছিল। সচরাচর খুব গাড্ডায় না পড়লে এর ঘরে ঢোকাকে বাঘের গুহায় পা দেওয়ার সমগোত্রীয় বিপজ্জনক মনে করে এড়িয়ে চলত সবাই।
    প্রতিটি পদক্ষেপে লোকটির নিজের স্বল্প ক্ষমতায় যতদুর সম্ভব বাধা বিঘ্নসৃষ্টি করার প্রচেষ্টা আমাদের মস্তির পূর্ণিমায় রাহুর ছায়ার মত লাগত। পুরো গল্প না জেনেই তখনো সংসার ও পৃথিবী অনভিজ্ঞ ছেলেমেয়ের দলের এটা বুঝতে দেরী হয়নি যে ভদ্রলোক যাকে ভদ্রভাষায় বলে চরম ফ্রাস্টু!
    পরে অবশ্য হাতেকলমে মিলে গিয়েছিল এ তথ্য, বছরের পর বছর একই অবতার,ট্রেনিং ব্যবস্থাপক! প্রোমোশনহীন, বদলিরহিত বঞ্চিত জীবনে কতদিনে যে একটু একটু করে হাসি অদৃশ্য হয় বা ঠিক কবে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে তার চকমকির ছিটে আশেপাশে ছড়িয়ে দিয়ে নিত্য একঘেয়ে জীবনে উত্তেজনার নিমিত্ত ট্রেনীদের অবস্থান উত্তপ্ত করতে সচেষ্ট হয়--- সেইসব সালতামামির হিসেব না পাওয়া গেলেও, গল্পটা মোটামুটি সর্বজনবিদিত। প্রতিটি ব্যাচ তাদের পরবর্তীদের এ গল্প শুনিয়ে থাকে প্রথম সুযোগেই!
    আর আমরা সব জানার পর এই চাকরীর বিগ ব্যাড জগতে সদ্য প্রবেশকারীরা যে অন্তত লোক চেনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে সফল হয়েছি, তার প্রমান পেয়ে নিজেদের মতামতের উপর বিশ্বাসটা বেশ দৃঢ় হয়। অবশ্য তা পরে কতটা ফলদায়ী হয় এই জগতে সফলভাবে টিকে থাকতে বা উন্নতিতে, তার বিশদ ঠিকভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টায় কেউ কোনোদিন গেছে বলে শোনা যায়নি, ফলাফলেরও তাই কোনো দস্তাবেজ নেই।

    যাইহোক, প্রতিদিন লেকচার শেষের থ্যাঙ্ক ইউ, গুডনাইট ইত্যাদি মিষ্ট সম্ভাষণ আসলে অ্যালার্মের কাজ করে থাকত। সেদিনও ঐসব মধুর শব্দাবলী কানে যাবার পরে আড়মোড়া ভেঙে, হাই তুলে উঠতে, মেয়েদের পার্স ফাইল গুছিয়ে নিতে যে টুকু দেরী তার মধ্যেই স্টেজে কায়েম হয়ে গেছে মালহোত্রাজী। শুধু তাই নয়, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতের তালিকা থেকে গড়গড় করে পড়ে চলেছে নাম ও তার সংযুক্ত সব আজব জায়গার নাম। উপস্থিত শ্রোতাদের খোঁয়ার খোয়াব ইত্যাদি কাটতে না কাটতে দশ বারোটা নাম পড়া হয়ে গেল। ওগুলো আসলে যে কে কোন জায়গায় ট্রেনীং করতে যাবে তার হিসেব সেটাও বোঝা যায় তখনই। সোজা কথায় সুখের দিনের শেষ ঘন্টা!

    এরকম একটা কিছু যে আসবে, চিরদিন যে সমান যাবেনা তার আভাস ছিল তবে স্বীকৃতি ছিলনা। ভবিষ্যতের পায়ের আওয়াজকে উপেক্ষা করেই বর্তমানে মেতে ছিল সবাই। কারণ বলতে, চলতে ফিরতে বা অন্য কোনো সূত্রে যখনই কোনো অল্প সিনিয়রদের সাড়া বা দেখা পাওয়া যেত,নভিসদের প্রতি তাদের একটাই বাণী শোনা গেছে - এই শ্রেষ্ঠ সময়, এ আর ফিরে আসবেনা, অতএব সব ভুলে মেতে যা, এনজয়। আমরাও প্রকৃত ভারতীয় সংস্কৃতির ধারা বজায় রেখে জেষ্ঠ্যের উপদেশের এতটুকু অমর্যাদা হতে দিচ্ছিলাম না।

  • a | 125.16.135.194 | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ ১৬:৩১514855
  • যত দিন যাচ্ছে শ্রাবণীদির কলম সোনার হয়ে উঠছে। চলুক চলুক
  • Lama | 117.194.234.253 | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ ১৭:০৬514866
  • তারপর?

    আমিও আমার আঠারো নিয়ে লিখব- সে ছিল বাইশ বছর আগে। তবে এখনই লিখব না। এই লেখাটার স্বাভাবিক গতি ব্যহত হবে তাতে।

    খুব ভাল লাগছে পড়তে। আমার নিজের সঙ্গে কিছুকিছু মিলেও যাচ্ছে- গড়গড়িয়ে চলুক
  • shrabani | 124.124.244.107 | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ ১৭:৪২514877
  • বয়স এবং কালের প্রভাবে সেই সব দিনরাত্রিতে মনে শোকসন্তাপের আয়ু অবশ্য প্রায় পদ্মপাতায় জলের সমান!
    ততক্ষণে তালিকা পড়া শেষ করে,সারা হলে বেশ একটা বিভ্রান্তির ভাব ছড়িয়ে দিয়ে প্রশান্ত ভঙ্গীতে স্টেজে দাঁড়িয়ে মালহোত্রা চশমার ফাঁক দিয়ে দলটার প্রতিক্রিয়া দেখতে থাকে।
    এদিকে সমস্যার নাম ও মুখ অনেক, তার মধ্যে প্রধান হল রওনা হতে হবে কালই। সেই হিসেবে ট্র্যাভেল টাইম বাদ দিয়ে যা অতিরিক্ত সময় লাগবে তা প্রজেক্টে অনুপস্থিত বলে গণ্য হবে। দেরীর সঠিক কারণ দর্শাতে না পারলে, স্থানীয় ট্রেনিং কোঅর্ডিনেটরের মর্জিতে ছুটী মঞ্জুর না হয়ে লীভ উইদাউট পে বা এলডাব্লিউপি হবার ঘোর সম্ভাবনা।
    এতদিনের লেকচারের মোড়কে চাকরির প্রথম পাঠ যা দেওয়া হয়েছিল তা সবসময় ঠিকঠাক না শুনলে বা বুঝলেও যেসব বৃদ্ধাঙ্গুলির নিয়মাবলী বক্তারা শ্রোতাদের মরমে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছিল তার একটি হচ্ছে লীভ উইদাউট পে সম্বন্ধীয়। যতদূর সম্ভব সার্ভিস লাইফে এটিকে এড়িয়ে চলাই নাকি মঙ্গল, না হলে ভবিষ্যতের উন্নতির সোপানে এটি বেশ বড়সড় রকমের বাধাসৃষ্টকারী প্রমাণ হতে পারে। একাধিক লোকে এটি বেশ সময় নিয়ে বুঝ্যে গেছিল কারণ এই চাকরির প্রথম দিকেই নাকি এটি হওয়ার ঝোঁক প্রবল থাকে। তখন বয়স কম থাকে, পাওনা জমা ছুটী থাকেনা অথচ এক কেরিয়ারে থিতু না হয়ে এদিক ওদিক নানা সুযোগ পরীক্ষানিরীক্ষা করার প্রবণতা থাকে ছেলেপিলেদের মধ্যে অত্যধিক! মোদ্দা কথা হল তখনো ভবিষ্যত চাকরি জীবনের কোনো কিছু নিয়ে চিন্তাটিন্তা না করলেও প্রায় সব বড় বড় লোকের দেখানো এই জুজু বা ভুতটি নিয়ে আমরা সবাই স্লাইট কনফিউজড ছিলাম!

    অন্য আর কিছু না, কম্পিউটার রিজার্ভেশন চালু হলেও সে যুগ অনলাইনের ছিলনা। ঐ পড়ন্ত বিকেলে কোনদিকে দৌড়লে পরদিনের দুরপাল্লার ট্রেনের টিকিট সুনিশ্চিত হবে সে সম্বন্ধে কেউই ঠিক নি:সন্দেহ নয়। রিজার্ভেশন না পেয়ে দেরী করাটা ছুটি মঞ্জুর হওয়ার যুক্তি হতে পারে কিনা তার উত্তর পাওয়ার আশায় আলোকিত মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আরও আঁধার দেখে সবাই।
    দর্শকাসন থেকে স্টেজে ওঠার যে গুটিকয়েক সিঁড়ি দুদিকে ছিল সেখানে মালহোত্রার দুই চেলা দাঁড়িয়ে প্রহরায়। তাদের বস, দ্য গ্রেট কোঅর্ডিনেটরের দিকে যাতে কেউ ঘেঁসতে না পারে তাই সিঁড়ির মুখ আগলে রয়েছে। অথচ নীচে দাঁড়িয়ে আমরা তাদের জিজ্ঞেস করলে উত্তরে মিটি হেসে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, " আমরা কী জানি, স্যর জানে, স্যর কে জিগান।"
    স্যর তো জানে, কিন্তু সেই জ্ঞানটা নীচের লোকেদের কাছে কিভাবে স্থানান্তরিত হবে, তারা ঘাঁটি আগলে এভাবে দাঁড়িয়ে রইলে তা কেউ বলছেনা। সাহসী কিছু জন চেঁচিয়ে স্টেজের ওপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেও স্যর নির্বিকার, সবার সবকথার উত্তর দেওয়ার কিছু ঠেকা নিয়ে রাখেননি তিনি!
    কিছুক্ষণ এভাবে সমস্যাকূল চেহারা গুলির দিকে আপাদমস্তক আনাচকানাচ দৃষ্টিপাত করতে করতে দর্শকাসনে একটা বিশৃঙ্খলার অবস্থা সৃষ্টি করে শেষে তিনি মঞ্চ ত্যাগ করলেন। মুখের ভাবখানি প্রায় হাসিহাসি, সামনের বছর আবার যতদিন না নতুন দল আসছে বা এই দলটা আবার মিড অ্যাপ্রেজালের ইন্টারভিউয়ের জন্য না আসছে,ততদিনের আমোদের খোরাক সংগ্রহ হয়ে গেল!
  • Nina | 69.141.168.183 | ১৬ জানুয়ারি ২০১২ ২৩:২১514888
  • নতুন করে কিছু বলার নেই---তবে শ্রাবণী, এখন লেখাগুলো আরও পড়তে ভাল লাগছে কারণ তোমার মুখটিও ভেসে উঠছে তো মনে মধ্যে :-)
    সোনার হাতে সোনার কলম--আমার সব শোনা সোনা হয়ে যায় :-)))
  • shrabani | 117.239.15.28 | ১৭ জানুয়ারি ২০১২ ১২:৩৫514899
  • একশ কুড়ি জনের মধ্যে দশ জন মেয়ে, এটা রেকর্ড, এতবছরে এই প্রথম একসাথে এতগুলো মেয়ে ইঞ্জিনীয়র যোগ দিচ্ছে!
    এসে থেকে নানাজনে নানাভাবে দন্তবিকশিত করে এই অভুতপূর্ব সংবাদটি পরিবেশন করে যাচ্ছিল আমাদের কাছে।
    জয়েনিং এর সব ফর্ম্যালিটি মিটে যাবার পরেই আমাদের পাঠানো হয় এই কনভেনশন সেন্টারে। সেখানে তখন জোর প্রস্তুতি চলছে পরদিন ট্রেনিং প্রোগ্রামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের। শহর যেহেতু দিল্লী, অতএব কথায় কথায় মন্ত্রী সান্ত্রীর কমে কেউ কথা কয় না। এখানেও তার অন্যথা নেই। হলের মধ্যে সবাই বসে আছি, প্রথম দিন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত, রাজ্য থেকে এসেছে সবাই, নিজেদের মধ্যে আলাপ পরিচয়ও ঠিকভাবে হয়ে ওঠেনি তখনো। তবু মেয়েরা কেমন যেন অলিখিত নিয়ম মেনে একসাথে একধারে বসেছি।
    মালহোত্রার প্রবেশ---চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জরিপ করতে করতে প্রথমে আমার দিকে আঙুল তোলে, "আপনি, আসুন উঠে আসুন।" কিছু না বুঝে থতমত খেয়ে উঠে এসে একদিকে দাঁড়াই, ততখনে আরো দুজন মেয়ে অনুরূপ আহ্বানে উঠে এসেছে আমার পিছু পিছু। আমাদের তিনজনকে বাইরে নিয়ে গিয়ে একজন অত্যন্ত ঝকঝকে স্মার্ট পা থেকে মাথা পর্যন্ত ইস্ত্রি করা মহিলার হাতে সঁপে দিলে। দুদিন ধরে সবকিছুতে শুধু মালহোত্রার প্যাঁচা মুখ দেখা ও গর্জন শোনার পর এই ভদ্রমহিলা আমাদের কাছে স্বর্গের পরী সদৃশ মনে হল!

    ইনি একজন এইচ আর অফিসার, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদের তিনজনকে দুই মন্ত্রী ও এক সেক্রেটারীকে বোকে দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে হবে স্টেজে উঠে, ইনি আমাদের সে বিষয়ে বোঝাবেন। এবারে এত মেয়ে আছে তাই ট্রেনিদের মধ্যে থেকেই মেয়েদের দিয়ে এই কাজ করানো হবে স্থির হয়েছে।
    এদিকে আমাদের তিনজনেরই এনাকে দেখে অবস্থা শোচনীয়। সেই প্রথম কোনো মহিলা অফসর এল আমাদের সামনে, এই কদিনে দুচারজন রিসেপশনিস্ট ইত্যাদি ছাড়া কেউ চোখে পড়েনি। তা তাদের সাজপোষাক নিয়ে আমরা অত মাথা ঘামাইনি, কিন্তু এনাকে দেখে আমরা হাঁ।
    একীরে বাবা, এই কম্পানিতে চাকরী করতে গেলে এরকম ইস্ত্রীমার্কা হয়ে থাকতে হবে নাকি সর্বদা!
    আবার শুধু ইস্ত্রীই নয়, ক্লোজ আপ দন্তরাজির কান এঁটো করা হাসি। আমরা যাই বলি, জিজ্ঞেস করি, শুধু হাসেন তবে সমাধান, কাজের কাজ কিছুই হয়না। আসলে উনি ঐ অনুষ্ঠানের দায়িত্বে, ঐ দিনটির জন্য যা দরকার তা ছাড়া আমাদের নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। বাকি সব কিছুর জন্যে আমরা মালহোত্রার কব্জায়, এবং সেই মুহূর্তে বিশ বাঁও জলে এক বিশেষ কারণে।

    গন্ডগোলটা যেটা হয়েছিল তা হল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের সঙ্গে মোটাসোটা নিয়মাবলী ও কর্তব্য করণীয়র যে বইটি এসেছিল তাতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পোশাকের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা ছিল, কালো ট্রাউজার, সাদা শার্ট ও টাই। আমার কাছে এ পোশাক ছিলনা। তখনো দেশের আনাচেকানাচে মল শপিং সেন্টার গজিয়ে ওঠেনি, আর তাই চাইলেই পাওয়া যেতনা অঢেল রকমারি সাইজ শেপ রঙের যেকোনো পোশাক, যে কোনো চেহারার জন্যে, রেডিমেড।
    একটি কালো জিনস ও কালো সালোয়ার ছিল সম্পত্তিতে, তাদের নিয়েই রওনা হয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম লোকজনের সঙ্গে বার্গেন করে দুটির একটিকে অ্যাপ্রুভ করিয়ে নেব, একটা দিনের তো ব্যাপার!
    এখানে এসে মালহোত্রার রকম সকম দেখে আর সাহস করিনি এবিষয়ে কথা তোলবার। একটাই সান্ত্বনা যে একজন ছাড়া বাকি নজন মেয়েরও আমার মতই অবস্থা। ছেলেদের সমস্যা নেই, কালো ট্রাউজার সাদা শার্টবোধহয় সবারই থাকে, যাদের নিজের নেই তাদেরও ভাই বন্ধু আত্মীয় মোটকথা যার হোক একজনের থাকেই!
    তখন তো ভাবিনি এরকম একটা গাড্ডায় পড়তে হবে, যে কারণেই হোক যতটুকু সময়ই হোক,রাজ্যের লোকের ড্যাবডেবে দৃষ্টি পেরিয়ে স্টেজে উঠতে গেলে পোশাকের ওপর নজর আলাদা করে পড়বেই। আর সেই পোষাকই যদি ঠিকঠাক নিয়ম মেনে না হয়..........

    অনুষ্ঠানের রিহার্সাল শুরু হল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও আরও কত তাবড় লোকজন থাকবে স্টেজে, সেখানে একটি পদক্ষেপও ভুল বা সময় বহির্ভূত হওয়া কাম্য নয়। আমাদের তিনজনের রোল সামান্যই, স্টেজে একদিক দিয়ে ওঠা, দেঁতো হাসি হেসে ফুল দেওয়া, আরেক দিক দিয়ে নামা, ব্যস। তবু সাবধানের মার নেই, উঠতে গিয়ে যদি নেমে যাই বা নামতে গিয়ে উঠে (মানে এতে এছাড়া আর কী ভুল হতে পারে!) পড়ি, ঝুঁকি নেওয়া যায়! সারাদিন ধরে নানা কাজের ফাঁকে ঐ ম্যাডাম আর মালহোত্রা মিলে নিজেরা আরাম করে গদি আঁটা চেয়ারে পা মেলে বসে, ঘড়ি ধরে আমাদের ওঠালেন আর নামালেন।
    বিকেলে যখন ছাড়া পেলাম তখন চলার অবস্থাতেও নেই, পরদিন সকালে আসল অনুষ্ঠানে ঠিকঠাক উঠতে নামতে পারব কিনা তা নিয়ে নিজেরাই ঘোর সন্দেহে! ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে মুখ চুন করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরোতে যাব, মালহোত্রার ডাক পেছন থেকে,
    -"তোমাদের ড্রেস রেডি আছে তো?"
    বাঘের ভয় আর সন্ধ্যে হওয়ার সম্পর্কটা এমন খাপে খাপ কখনো এর আগে লাগেনি। আর ঐ পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের লাল মুখটা কেমন যেন বাঘের আদলেরই।
    আমতা আমতা করে "হ্যাঁ, মানে ট্রাউজারের জায়গায় জিনস আর সাদা টপ একটা কিনে নেব, টাই না পরলে হবেনা?" এসবের মাঝেই মালহোত্রা হুঙ্কার দিয়ে ওঠে "জিনস? ওসব চলবেনা। তোমরা মেয়েরা সবাই কালোপাড় সাদা শাড়ি পরবে।"
    সারাদিনের ঐ ওঠবোসের পরে শ্রান্ত ক্লান্ত মন আর নিতে পারলনা।বিদ্রোহী মন জেগে উঠে ভয়টয় ব্যাকসীট নিল। আমি এবার ঝাঁজিয়ে উঠি, "শাড়ির কথা কোথাও লেখা ছিলনা।" ওরা জানে লেখা ছিলনা, তবু তেজ কম হয়না,
    -"মেয়েরা শাড়িই পরে, ওটাই নিয়ম।" তবে আমিও তখন দুজনকে সঙ্গী পেয়ে গেছি, তিনজনের প্রতিবাদে, মালহোত্রার প্রতিরোধের দেওয়াল কিঞ্চিত নড়বড়ে দেখায়।
    খুব চেঁচাই কারণ, আমরা তখন শাড়ি আতঙ্কে মরিয়া। শাড়ি তো আর একটা জিনিস নয়, সায়া ব্লাউজ আরো কত কী, তারপরে সেসব কোনদিক দিয়ে শুরু করে পরে কোথায় গিয়ে শেষ হয়,তাই বা সঠিক কে জানে, মা দিদিরা নেই, নিজেরা এতকান্ড করে পরবই বা কিকরে সকাল সকাল! তাও না হয় কোনোভাবে পরলাম, সারাদিন ওসব পরে থাকব কেমন করে, খুলে যায় যদি!
    অনেক করে আমরা অপশন দিতে থাকি মালহোত্রাকে, কালো সালওয়ার সাদা কুর্তা, সাদা সালোয়ার কুর্তা, কালো ওড়না ইত্যাদি নানা কম্বিনেশন। সেও শুনবেনা, আমরাও ছাড়বনা। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে লাল মুখকে আরও লাল করে মালহোত্রা শাসিয়ে গেল যদি পরদিন অনুষ্ঠানে শাড়ি না পরে আসি আমাদের হলে ঢুকতে দেবেনা।

    এই তর্কবিতর্কে লাভ হল, আমাদের মালহোত্রা ভীতি চলে গিয়ে, বিরক্তি ও জেদ কায়েম হল। নিজেরাই ঠিক করে বাজার থেকে লটে ন খানা কালো ওড়না কিনে নিয়ে ঢুকলাম। একটি মেয়ে সাদা শার্ট আর কালো ট্রাউজার বানিয়ে নিয়ে এসেছিল, একজন চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে দিল্লীর আত্মীয় বাড়ি থেকে কালোপাড় সাদা শাড়ি জোগাড় করল। বাকি আটজন পরদিন বিদ্রোহিনীর মত মুখখানাকে গম্ভীর করে সাদা সালোয়ার কুর্তার সঙ্গে একই প্রিন্টের কালো ওড়না একই স্টাইলে নিয়ে বাস থেকে নামলাম। মালহোত্রা মুখ হাঁড়ি করে দেখল আমাদের হলে ঢুকতে। সেখানে তখন সব বড় বড় লোকেরা, মালহোত্রা তাদের তুলনায় কিছুই নয়, সাহস করে তাই গোলমাল করতে পারলনা। তবে আগামী একবছরের জন্য মানে যতদিন আমরা ট্রেনিং ডিপার্টমেন্টের হাতে থাকব, মালহোত্রার পাঙ্গার লিস্টের টপে চলে গেলাম মেয়েরা!

    এইরকমই দিন দশেকের নানা অভিজ্ঞতা ভান্ডারে সবার, তই মালহোত্রা কম্পানির এধরণের ব্যবহারের অন্যথা কেউ আশা করেনি। শুধু এইকদিনের জীবনযাত্রা ও সেইদিনের তন্দ্রাজড়িত আলস্যের আমেজ কাটিয়ে ওঠার দন্ডে মালহোত্রার হঠাৎ আবির্ভাব ও তদ্দন্ডে যাত্রার শমন ধরানোর ঘটনার আকস্মিকতায় একটা প্রাথমিক বিহ্বলতার সৃষ্টি হয়েছিল, তারই ফলস্বরূপ খবরাখবরের জন্য ঐ গোষ্ঠীকে অনুনয়। নাহলে এরকম কাজ করে সময় নষ্ট করার কথা ভাবতে পারত না কেউই!
  • ranjan roy | 115.118.240.145 | ১৮ জানুয়ারি ২০১২ ০৯:৩৭514779
  • শ্রাবণী,
    গ্র্যান্ডো! এক্সেলেন্টো!
    সমস্ত ট্রেনিং গুলো তার আনন্দ-বেদনা সব নিয়ে কী আকর্ষণীয়!
    আমার মনে পড়ছে শুরুর দিকে দেরাদুনে স্টেট ব্যাংক স্টাফ ট্রেনিং সেন্টারের দু'মাসের ফুল মস্তি!
    আমি দশ বছরের বিনিময়ে আবার সেই দু'মাস ফিরে পেতে রাজি।
    চলুক, চলুক!
  • Bratin | 122.248.183.1 | ১৮ জানুয়ারি ২০১২ ১৩:৫৪514790
  • শ্রাবনী দি। খুব ভালো লাগছে। এত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে হারবো না এই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া কে সেলাম ।
  • shrabani | 124.124.244.107 | ১৮ জানুয়ারি ২০১২ ১৬:৩৭514801
  • ভারত ভাগ হয়ে গেল!
    এতদিন একশ কুড়ি জন গো পালের ন্যয় মালহোত্রা নামক রাখালের অঙ্গুলিহেলনে একযোগে এদিক ওদিকে, এঘর ওঘর, এ করিডর ও করিডর করেছে। আজ একটি তালিকা তাদের ছত্রাকার করে দিল। প্রথমে কিছুক্ষণ সবাই উদ্দেশ্য বিধেয় হীন ভাবে সারা হলে ঘুরতে থাকল গোরু খোঁজার মত,মুখে বাসের কন্ডাকটরের রব "শক্তিনগর?", "বিন্ধ্যনগর এনিওয়ান?", "কারা কারা কোরবা যাচ্ছে?" "সাউথ?" ইত্যাদি।

    ঘন্টাখানেক এ অবস্থা চলার পরে দেখা গেল মোটামুটি সবাই নিজ নিজ পালের গোরু খুঁজে পেতে সমর্থ হয়েছে। হল আর অন্ধকার নেই, সবকটা আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে আনাচে কানাচে খুঁজে লুকোনো সুইচ বার করে। আলস্য ঝেড়ে উঠে পড়ে দলে দলে সবাই আলোচনায় ব্যস্ত হল আসন্ন যাত্রার বন্দোবস্ত ও তদসম্বন্ধীয় ভবিষ্যত কর্মপন্থা নিয়ে। এই কনভেনশন সেন্টারের ওপরেই আমাদের হেড অফিস বা কোর অফিস, কিন্তু সেখানেও সবাই ঝাঁপ প্রায় বন্ধ করার মুখে।
    তবু তারই মধ্যে কেঁদে ককিয়ে অনুনয় বিনয়ে কয়েকটা রেলওয়ে টাইমটেবলের জোগাড় হয়েছে। তবে তাতেই বা কী! প্রজেক্ট বা স্টেশন সাইট বলে যেসব নাম আমাদের নামের পাশে লেখা আছে মালহোত্রার তালিকায়, সেসব নাম টাইমটেবলে নেই। এরপরে যা হল তা দেখলে পার্টি গেমের বা ছোটদের খেলাধূলোর কথা মনে পড়বে।সাইটের নাম বনাম স্টেশন বা শহরের নাম খুঁজে বার করার খেলা!
    জ্যোতিনগর - রামাগুন্ডম, শক্তিনগর - সিংরৌলী ইত্যাদি। যেসব জায়গার নাম ঠিকঠাক সেও আবার এমন পাণ্ডববর্জিত অঞ্চল সব, কোন দিকে পড়ে উত্তর দক্ষিণ না পুব পশ্চিম, মহা ধন্দে মাথার চুল ছেঁড়া অবস্থা!

    আবার কয়েকজন ছুটল অফিসের লোকেদের কাছে ঐ সাইটের নামগুলোর কাছাকাছি স্টেশনের নাম জানতে। মুশকিল হল এই হেড অফিসে নীচু লেভেলের বেশীরভাগ লোকই দিল্লীর বাইরে পা দেয়নি কোনোদিন, এইসব নাম তাদের কাছে যান্ত্রিক শব্দ মাত্র। ফোন ফ্যাক্স নাম্বার চাইলে পাওয়া যাবে কারণ তা ডায়েরিতে আছে, কিন্তু স্টেশনের নাম!
    বড় অফিসারেরা হয়ত জানে কিন্তু তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করার মত সাহস তখনও ট্রেনি দলের আসেনি। আমাদের সব ব্যাপারে সাহায্য করার কথা যে গ্রুপের অর্থাৎ মালহোত্রা অ্যান্ড কোং, তারা ইতিমধ্যেই পাততাড়ি গুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে, আমরা তাদের দেওয়া অতর্কিত ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই।
    ট্রেনিং ডিপার্টমেন্টের ওপর রাগে গা চিড়বিড় করলেও কিছু করার নেই, আপাতত আগের কাজ আগে, টিকিটের ব্যবস্থা।

    মোটামুটি ঠিক হল প্রত্যেক দলে কিছু লোকে টাকাপয়সা বুঝে নিয়ে নিজামুদ্দিনে রেলওয়ে রিজার্ভেশন কাউন্টারে যাবে টিকিট কাটতে। বাকীরা গেস্টহাউসের দিকে, গোছগাছ সেরে নিতে। ভোরের ট্রেনে বেরোতে হবে। সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ঘন্টাখানেকের লড়াইয়ের পরে প্ল্যান প্রোগ্রাম প্রায় রেডি। প্রায় বলছি এই জন্য যে অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যে। সদ্য চাকরিতে জয়েন করেছে সবাই, অনেকেই হাতে টাকাপয়সা খুব বেশী নিয়ে আসেনি। এইকদিন দিল্লীতে থেকে খরচখরচা হয়েছে।
    পরদিন ভোরে বেরিয়ে যেতে হবে, এদিকে অফিস বন্ধের মুখে, সরকারী প্রক্রিয়া অর্থাৎ ফর্ম ভরে এরওর সিগনেচার করিয়ে অ্যাডভান্স নেওয়ার সময় নেই, ফাইন্যান্সের ঝাঁপও বন্ধ। সকলের ধারণা মালহোত্রা এই সব অসুবিধের সৃষ্টি করবে বলেই স্থান কাল এমন বেছেছে ট্রেনিংস্থলের ঘোষণা করার। সকালেই বলে দিলে সারাদিন দহরে এসব কাজ অনায়াসে সারা যেত, কোনো বিশেষ বাধাবিপত্তি ছাড়াই। আপাতত একটু দুরের ট্রেনে এসি বা ফার্স্ট ক্লাসের টিকেট কাটার মত পয়সা সবার নেই।

    শক্তিনগর - এরকম জায়গা যে এদেশের ভূগোলে আছে তাই জানতামনা সেই দিনের আগে। বিভাগ হিসেবে দল ভাগ করা হয়েছে, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল,ইন্সট্রুমেন্টেসন ইত্যাদি। এক একটি সাইটে যাবে এক এক দল। যে বিভাগে আবার লোক বেশী তাদের একাধিক দল।
    আমরা আঠের জন যাব শক্তিনগরে। ষোল জন ছেলে ও দুজন মেয়ে। খোঁজখবর যতটা সম্ভব করে জায়গাটি সম্বন্ধে খানিকটা আন্দাজও পাওয়া গেল। কত অজানারে জানাইল সেই বিকেল! শুনলাম উত্তরপ্রদেশের শক্তিনগর আর মধ্যপ্রদেশের বিন্ধ্যনগর আসলে পাশাপাশি দুটি জায়গা। অতএব আমাদের সঙ্গে জুড়ে গেল বিন্ধ্যনগরের দলেরও কেউ কেউ। অবশ্য আমাদের দলের সবাই একসাথে যাবেনা,জায়গাটার ভৌগোলিক অবস্থান জানার পর নানা মুনি নানা মত নিয়ে বা অমত নিয়ে দুই তিন করে আরো ভাগাভাগি হয়ে গেল।
    উত্তর ও মধ্য ভারতের লোকজন এসব দিক আমাদের থেকে ভালো চেনে। তারা যাত্রাপথে বাড়ি, দাদুর বাড়ি, মামাবাড়ি এরকম নানা গন্তব্য ঢোকানো যায় এমন সব ট্রেন বাস খুঁজতে লাগল। আমরা বঙ্গের চার আর কেরালার চার ও গুজরাটের দুই ঠিক করলাম কোনো ঝুঁকি না নিয়ে সোজা ও শর্টেস্ট রুটে যাব। আমাদের সঙ্গ নিল বিন্ধ্যনগরের চারজন।
    দিল্লী থেকে লখনৌ, সেখান থেকে বিকেলের ত্রিবেণী এক্সপ্রেস ধরে সকালে শক্তিনগর স্টেশন (এই স্টেশনে এই একটি ট্রেনই যায়, তাও হপ্তায় দুদিন। বাকী দিনগুলিতে ত্রিবেণী সিংরৌলীতে থেমে যায়!)।
    পয়সাকড়ির হিসেব করে ঠিক হল,লখনৌ অবধি দিনের জার্নি স্লীপার ক্লাসে ও রাতের জার্নি ত্রিবেণীর ফার্স্ট ক্লাসে। তখন ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস উঠে যাওয়ার দিন, ত্রিবেণীর মত গুটিকয়েক ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস রয়ে গেছে। আমার মহা আনন্দ, ফার্স্ট ক্লাসে চড়ব। তখন কী জানি কোন ফার্স্ট ক্লাস অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্যে লখনৌ স্টেশনে!
  • rimi | 168.26.205.19 | ১৮ জানুয়ারি ২০১২ ২০:০৮514812
  • অ-সা-ধা-র-ণ!!! একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতার গল্প!
    তবে শ্রাবনী বাংলা ভালো জানে না?? এইটা যদি বাংলা ভালো না জানার উদাহরণ হয় তবে তো কেউই বাংলা ভালো জানে না!!!!!!!
  • Nina | 12.149.39.84 | ১৮ জানুয়ারি ২০১২ ২০:২৯514816
  • এইটির টানে সক্কালবেলা গুরুগৃহে আসা----
    যথারীতি অসা আ আ আ
  • siki | 122.177.192.89 | ১৮ জানুয়ারি ২০১২ ২১:৩১514817
  • আমিও ঠিক এই কথাটাই জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম। শ্রাবণী উত্তর ভারতে বহুদিন কাটানো, এত ভালো নির্ভুল বাংলা কী করে লেখে? পশ্চিমবঙ্গবাসী বাংলা মিডিয়ম বহু লোক এখানে লেখে, তাদের অনেকেরই বাংলা বানানের ঠিকঠিকানা থাকে না, টাইপ করতে গেলে গুলিয়ে যায়, কিন্তু শ্রাবণী একেবারে প্রথমদিন থেকেই ঝরঝরে বাংলা লেখে, অলমোস্ট একটাও বানান ভুল ছাড়া। কী করে পারো, গুরু?
  • T | 14.139.128.11 | ১৮ জানুয়ারি ২০১২ ২২:০৮514818
  • সোনার কেল্লায় মন্দার বোসকে ফেলুদা এই কথাই জিগিয়েছিল? মন্দার বোসের উত্তর দ্রষ্টব্য।
  • shrabani | 59.94.108.184 | ১৮ জানুয়ারি ২০১২ ২২:২৫514819
  • আরে, আমি বেগুনী হয়ে যাচ্ছি...তবে গুরুজনেদের কাছ থে একখান বাংলার জন্যে সাট্টিফিকেট নিয়ে আমার বাড়ির লোকদের দেখাব ভাবছি, তারা কেউ আমার লেখা পড়েনি, পড়তে চায়ওনা!বাংলায় লিখি শুনলে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়, দিদিকে দিল্লী হাট নিয়ে গিয়ে গুরুর লোকজন দেখানোর পরেও!:((
    রিমি, নীনাদি, আমার এই টই লিখতে পেরে খুব ভালো লাগছে, কতদিনের কতকিছু জমা হয়ে গেছে, যা সবসময় বলা যায়না, বললে কেউ বুঝবেও না বোধহয়....নারীদিবসের সময় থেকে ভাবছিলাম একদিন লিখব, জানিনা কতদুর যাব, তবে যদি পারি, মেয়েদেরে জন্যে......টু ইউ অল!
  • Lama | 117.194.242.228 | ১৮ জানুয়ারি ২০১২ ২২:৪৭514820
  • ইসে,

    কিছু কিছু ছেলেরাও পড়িবারে চাহে।
    কোনো দিকে না চাহিয়া লিখে যান বাহে।

    কে বলে পইদ্য ল্যাখা কঠিন
  • siki | 123.242.248.130 | ১৯ জানুয়ারি ২০১২ ১০:৪২514821
  • টি-কে সেইটাই বলার ছিল। মন্দার বোস আর শ্রাবণী এক ক্যাটেগরিতে পড়েন্না। মন্দার বোসের বেড়ে ওঠা পুরোটাই উত্তর কলকাতায়, শ্রাবণীর তা নয়।

    অত্যন্ত ভালো লাগছে। সেদিন এসেও পালিয়ে গেলে, করিমসে তোমার একদিন ভরপেট ডিউ হয়ে রয়েছে সেই কবেত্থেকে, পরপর অনেকগুলো ভোজ জমে যাচ্ছে।

    আরামসে লেখো। সোনার কলম হোক।
  • shrabani | 117.239.15.103 | ১৯ জানুয়ারি ২০১২ ১২:১৭514823
  • গেস্টহাউসে এসে বাড়িতে ফোন করে জানালাম বৃত্তান্ত। দাদার এক কলীগ মীর্জাপুরের লোক, শক্তিনগর যাচ্ছি শুনে হা হা করে গলা খুলে হেসে বললেন, "ওতো ওপেন জেল, ঢুকলে আর বেরোবার রাস্তা পাবেনা"!
    কেন ঠিক বুঝতে না পারলেও বেজার মুখটা আরও ঝুলে গেল। পাশে রেখা দাঁড়িয়েছিল, ওর চোখদুটো মোটা কাঁচের চশমার ভেতর দিয়ে গোল গোল দেখাত, একদম গারফিল্ড লাগে তখন। আমার মুখের ভঙ্গী দেখে চোখকে আরও গোল করে জানতে চাইল ব্যাপারখানা। ওকে বোঝাতে গিয়েও সামলে নিলাম।

    রেখার সঙ্গে আমার আলাপ সেই দিল্লীতে ইন্টার্ভিউয়ের সময় থেকে। প্রথম দেখাতেই বেশ ভাব হয়ে গেছিল দুজনে । তাই জয়েনিংয়ের সময় দুজনে দুজনকে দেখে হেভী খুশ। এদিকে একই বিভাগে আমরা দুজন মেয়ে, তাই সবজায়গায় একসাথে, গেস্টহাউসেও রুমমেট। দিল্লী পরবর্তী ব্যাপারে যদিও আমি নিজে খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলাম না তবু ওকে সাহস দিয়ে যাচ্ছিলাম কারণ কেরালার মেয়ে,আমার থেকে ও বেশী নাজেহাল ছিল ভাষা সমস্যায়। রেখা যে হিন্দী জানেনা তা কিন্তু নয়, ওদের রাজ্যে স্কুলের সিলেবাসে হিন্দি আবশ্যিক, তারওপরে হিন্দি সিনেমার প্রভাবও কিছু কম নেই। কিন্তু বইয়ের শুদ্ধ হিন্দি গ্রামার সহযোগে ও ফিল্মি ডায়ালগ মিলিয়ে যে হিন্দি ওর আয়ত্তে তা এই উত্তর ভারতের সাধারণ মানুষের চলতি সহজ খিচুড়ী হিন্দি কখনোই নয়। এত কথা বলার এই কারণ যে দলে আমার যে কজন বাঙালী সাথী আছে তাদের বাংলা মেশানো অদ্ভুত উচ্চারণের হিন্দির থেকে রেখার হিন্দি অনেক শুদ্ধ ও পরিশীলিত, কিন্তু ও এদিকের চলতি ভাষা শুনে কিছুতেই আর সাহস করে বলতে পারেনা বা কোনখানে কী বলতে হয় সেটা ঠিক সময়ে ঠাহর করে উঠতে পারেনা।

    যেমন একদিন ওকে বাসে তুলতে গেছি, যাবে সাকেত, আত্মীয়র বাড়ি। দিল্লীর পাবলিক বাসে কলকাতার মত কনডাক্টরকে গন্তব্য বলে দিয়ে যদি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যান, তাহলে শেষ স্টপ পর্যন্ত যেতে হবে আর তখনও যদি ঘুম না ভাঙে তো পরের ট্রিপেও বাসে বসে থাকার চরম সম্ভাবনা। সন্দেহের বশে যদি জিজ্ঞেস করেন কিছু, বিড়বিড় করে এমন কিছু একটা বলবে যাতে আপনি আর ঝুঁকি না নিয়ে পরবর্তী স্টপেজেই নেমে যাবেন, যা হয় আপনার স্টপেজ থেকে অনেক আগে বা অনেক পরে!
    এরকমই বাসে হিন্দী না জানা, দিল্লী না চেনা রেখাকে চড়াতে গিয়ে আমি বেশ নার্ভাস। কোন স্টপেজে উঠে দাঁড়াবে, কোথায় থামলেই টুক করে নেমে পড়তে হবে এসব নিয়ে ক্র্যাশ কোর্স চলছে। তার মাঝেই বললাম যে ভীড় থাকলে আগে থেকে উঠে লোককে সরতে অনুরোধ করতে করতে দরজার দিকে এগোতে। তা অনুরোধ তো কিছু একটা বলে করতে হবে। নিজেকে আশ্বাস দিই, এমন নয় যে ও প্রথম দিল্লীতে বাসে উঠছে, এইকদিনে আমরা দিল্লী চষে বেরিয়েছি, বাসে অটোতে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
    তাই ভাবলাম বলে দেওয়ার আগে একবার দেখি তো ও জানে কিনা!
    -"হিন্দীতে কী বলে লোককে সরে জায়গা করে দিতে বলবে জানো?"
    মোটা হর্লিক্সের কাঁচের মধ্যে থেকে গোল গোল চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে শেষে ভেবেচিন্তে জবাব দেয়,
    -"হ্যাঁ, বলব,হট জাও ও ও ও মেরে রাস্তে সে"।
    আমি হতবাক! ফুলন দেবী বাসে উঠে এরমটা বললে সারা বাস খালি হয়ে যেত, এক্ষেত্রে ছোটখাটো ফর্সা বাচ্চা মেয়ে ভীড় বাসে চেঁচিয়ে এই ডায়ালগ আওড়ালে, কিছু লোকে হাসবে বাকীরা ওকে ঠেলেঠুলে স্টপেজের আগেই নামিয়ে দেবে!

    গেস্টহাউসে মেয়েরা সবাই এসে এক এক করে আমাদের ঘরে জুটল, এই ঘরটা আমাদের এ কদিনের আড্ডাঘর ছিল, বড় আর একটা অতিরিক্ত বিছানা আছে বলে। ভিআইপি গেস্ট হাউসে মেয়েরা ছিলাম, একটু দুরে আর একটা গেস্টহাউসে ছেলেরা।
    এই ভিআইপি গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার ছিল একজন বাঙালী ভদ্রলোক। এতদিন দুটি তিনটি মেয়ে এক্সিকিউটিভ ট্রেনি আসত বলে তাদের দিল্লীতেই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হত আর পুরো বছরটাই তাদের থাকবার ব্যবস্থা হত এই গেস্ট হাউসে।
    এই ভদ্রলোক ভিআইপি লোকেদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে করতে নিজেকে একখানা হনু ভাবত। তবে দিল্লীতে এব্যাপারটা খুব আম ব্যাপার, এখানে সবাই কম বেশী হনু। যে আবার যত কম, তত বেশী হনু।
    এছাড়া ভদ্রলোকের অন্যান্য অনেক দোষ ছিল, মেয়েদের খুব সাবধানে সামলে থাকতে হত এখানে। মেয়েদের চিঠি খুলে পড়ত, পাশের বাথরুম থেকে স্কাইলাইট দিয়ে উঁকি মারত ইত্যাদি। এসব খবর জানাবার লোকের অভাব থাকেনা, তাই আমাদের কানেও এসব উঠতে দেরী হয়নি।প্রথম দিনেই সবাই দায়িত্ব নিয়ে বাথরুমের স্কাইলাইট দড়িদড়া দিয়ে এক্সট্রা যত্ন নিয়ে বন্ধ করেছিলাম!
    তবে লোকটির প্রতি একটা ভয় আর বিতৃষ্ণা জন্মে গেছিল। আরো যখন দেখলাম মেয়েদের সাথে প্রথমে গায়ে পড়ে ভাব জমাতে চেষ্টা করল, পরে পাত্তা না পেয়ে মেজাজ দেখিয়ে শাসানির সুরে কথা বলতে শুরু করল, তখন আরো বিরক্তি!
    অবশ্য এ শুধু সেই প্রথম বারেই, পরে ফিরে এলাম যখন, তখন আমাদেরও মেজাজ কম নয়, নিজেদের ওজন ও লোকটির অসারতাও পরিস্কার। তাই তখন দেখতাম তার অন্য রূপ, "সাব", "ম্যাডাম" ডাকে গলে গলে বিনয়ের অবতার।
    আর সেই প্রথমবারে কিছু না পেয়ে সবচেয়ে গোলমাল করত ব্যাচের ছেলেরা কোনো দরকারে আমাদের কাছে এলে। ঘরে যাওয়া তো নিয়ম ছিলনা, রিসেপশনেও বসতে দিতনা, গেটে দাঁড় করিয়ে রাখত, যেন কে না কে এসেছে! এহেন লোকটিকে দেখলেই আমাদের মুখ কোনো চেষ্টা ছাড়াই বেঁকে যেত আর ও সেটা বুঝতে পেরে তখন শাসানি মোডে ছিল।
    সেই মোডেই আমাকে আর রেখাকে দেখলেই শোনাতো যে আমরা তিনজনের ঘরে আছি, আর একজন সেদিনই সে ঢোকাবে। তবে ঐ পর্যন্তই, সেযাত্রায় শেষ অবধি আমরা দুজনই রয়ে গেছিলাম, আর তাই সবাই মিলে হই হট্টগোল সবকিছুর ভেনু ছিল ঐ রুমটা।

    সবারই মনে মিশ্র অনুভূতি। জীবনে প্রথম অচেনা সব জায়গায় যাওয়া, কেমন অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার মত উত্তেজনা। এদিকে ভয়ও আছে, আবার এই কদিনের দিল্লীর মস্তি, নতুন সব বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদের ব্যথা, সেসবও আছে। সবাই তাড়াতাড়ি গোছগাছ সেরে নিয়ে এক ঘরে এসে জুটলাম। তার আগে অবশ্য গেস্টহাউসের অখাদ্য ডিনার মুখে ছুঁইয়ে এসেছি সবাই নিয়মরক্ষে।
    আমাদের এই কদিনের গেস্টহাউস বাসের সময়েই সুদুর উড়িষ্যা থেকে এক প্রজেক্টের জেনারেল ম্যানেজার এসে এখানে বাসা বেঁধেছিলেন চিকিৎসার জন্য। তিনি ছিলেন এক বয়স্ক সর্দার, সারা গেস্টহাউসটাকে নিজের ঘরবাড়ী জ্ঞান করতেন এবং সেখানকার স্টাফেদের নিজের ব্যক্তিগত কর্মচারী। সারাদিন ধরে দিল্লী ও তার আশেপাশ থেকে প্রচুর আত্মীয়বন্ধুর সমাগম হত, সঙ্গে বউ মেয়ে জামাই তো ছিলই। রিসেপশন, লাউঞ্জ প্রত্যেক জায়গায় সবসময়েই এদের গাদা গাদা লোকজন বসে উচ্চকিত স্বরে গল্প গাল করত, কারুর সেখানে যাওয়ার উপায় ছিলনা। কিচেনে লোকে সবসময় এদের জন্য চা পকোড়া বানাতে ব্যস্ত থাকত, অন্য কারোর অর্ডারের দিকে বিশেষ করে আমাদের মত জুনিয়র সবে ঢোকা ট্রেনীদের দিকে দেখার তাদের ফুরসত হতনা।
    কোনো কিছু চেয়ে পাওয়া যেত না, সবচেয়ে যেটা ভুলভাল হত তা হল এই তথাকথিত অসুস্থ বড় সাহেবের জন্য রান্না হত ঝালমশলা ছাড়া, তেল কম, বেসোয়াদী কাঁচা শশা মুলোর মেনু। এইগুলো ওনার সাথে আমাদেরও খেতে হত, আলাদা আমাদের জন্যে আবার কে রান্না করবে!
    অবশ্য ওনার সঙ্গীসাথীদের জন্য রোজই কোথাও না কোথাও থেকে বিশাল বিশাল ডাব্বা আসত বাটার চিকেন, পনীর পসন্দা দাল মাখানি ভরা, সর্দারদের ভাই বিরাদরী দিল্লীর হাটেবাজারে ছড়িয়ে, তাদের অসুবিধে হতনা। মুশকিল টা হত আমাদের, দিনের খাওয়াটা তো কম্পনীর ব্যবস্থাপনায় কনভেনশন সেন্টারে, কিন্তু রাতে সেই গেস্টহাউসই ভরসা। আমরা বাটার চিকেন, পনীর পসন্দার গন্ধওয়ালা ডাইনিং হলে বসে বসে সেদ্ধ অড়হর ডাল, সবজির নামে বীনস গাজর সেদ্ধ আর বাঁধাকপির মুলোর স্যালাড খেতাম। সে খাবার এমনই, খেলে যেন খিদে কমার জায়গায় আরো বেড়ে যেত!

    শেষ দিনে তাই আমরা মেয়েরা সবাই চাঁদা তুলে গেস্টহাউসের পেছনের মার্কেট থেকে ভালো ভালো পেস্ট্রি, মিষ্টি ফল ইত্যাদি কিনে আনলাম। দশজনের মধ্যে তিনজন কেমিস্ট্রির, তাদের ট্রেনিং দিল্লীরই এক প্রজেক্টে, তারা তাই গেস্টহাউসেই রয়ে যাবে। কেমিস্ট্রিতে একজন বাঙালী মেয়ে ছিল, দুর্গাপুরের। তার দাদা এই কম্পানিতেই চাকরি করে, দাদা বোনকে নিয়ে এসেছে জয়েন করাতে।
    সে আমাদের বিশেষ পাত্তাটাত্তা দিতনা, দাদার কম্পানি বলে কথা, আমাদের দলে থাকতনা! তা কাল তো সবাই চলেই যাচ্ছি, তাই খাবার টাবার কিনে এনে ওকেও ওর রুম থেকে ডেকে নিলাম (তখন দাদাও ফিরে গেছে তার কাজের জায়গায়)।
    সে এসে খুব দু:খ প্রকাশ করল, কেমিস্ট্রি না পড়লে এই হয়। কোথায় তারা দিল্লীতে অ্যায়েশ (আয়েস নয়, হিন্দি পড়তে হবে) করবে আর কোথায় আমরা কোন সব ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে ছাই কয়লা মাখব!
    তারপরে হিসেব করে নিজে যা খেয়েছে সেই আধখানা আপেল, একটা পেস্ট্রি ও আধখানা মিষ্টির দাম আমাদের দিয়ে, শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেল। ব্যাপারটা এতটাই অভাবনীয় যে আমরা না করবার মত অবকাশও পেলাম না। তারপর থেকে বৎসর কাল যখনই একত্র হয়েছি অন্য মেয়েরা আমাকে "আধা অ্যাপেল" বলে ডেকেছে, অপরাধ আমি বাঙালী মেয়ে!

    রাত একটা অবধি আড্ডা টাড্ডা মেরে গোছগাছে লেগেছি যখন রেখার মনে হল তার স্নান করা দরকার। স্নান করে জামাকাপড় কেচে, তোয়ালে কেচে বেরোলো যখন রাত আর বেশী নেই। এবার ফ্যান চালানো হল সব শুকোতে। দিল্লীতে মার্চের রাতে আর যাই হোক গরম থাকেনা। ফ্যানের হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে কম্বল মুড়ি বাকী রাত ঘুমনোর চেষ্টা। সকাল সাতটায় ট্রেন, তৈরী হয়ে বেরোতে হবে ছটা নাগাদ। ভোরে অ্যালার্মের ডাকে উঠে দেখি, যা সর্বনাশ হবার হয়ে গেছে। ভেজা চুলে, পাখার হাওয়ায়, রেখার অসহ্য মাইগ্রেন শুরু হয়েছে, তার সাথে বমি। এদিকে তার মোট পাঁচটা ব্যাগ, সবকটাই তখনো অগোছালো!

    জীবনে নিজের ব্যাগটাও গুছোই নি কোনোদিন, আর সেই আমি নিজের গোছানো সেরে, ওর জিনিসপত্র যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তা এক করে হাতের কাছে যা ব্যাগট্যাগ পেলাম তাতেই ভরে দিলাম কোনোরকমে। কী আনেনি সে, ইস্ত্রি, ইমার্সন হিটার, বড় বড় শিশি বোতল ভর্তি আচার, নারকেলের তেলের গন্ধভরা চিপস, নোনতা!
    ফাঁকে ফাঁকে চলল রোগীর সেবা, গরমজল, বাম, ওষুধ ইত্যাদি। কিভাবে যে ছেলেরা ডাকতে এলে মালপত্র নিয়ে নেমে অটোতে উঠেছিলাম তা আজ কল্পনাও করতে পারিনা। এদিকে রেখা অচৈতন্য প্রায়, কোনোরকমে নিজের পার্সটা ধরে আছে, দশদিনের পরিচিত একজনের কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পুরো যাত্রাপথ কাটিয়ে দিল, কোনোদিকে না তাকিয়ে, কোথায় তার মালপত্র, কোথায় সে, কাদের সঙ্গে চলেছে। এরকমটা বোধহয় শুধু সেই বয়সেই, সেই কেয়ারফ্রী দিনগুলোতেই সম্ভব হয়!
  • Lama | 117.194.238.174 | ১৯ জানুয়ারি ২০১২ ১২:২৯514824
  • ইলেক্ট্রিশিয়ান বাপিদা, আপনি যেখানেই থাকুন, মেলা কমিটির কার্যালয়ে এসে আঠারো বছরের টই এর তলায় একটা লাইক বাটন, নিদেনপক্ষে একটা "কেয়াবাৎ" বাটন লাগানোর ব্যবস্থা করুন

    এ বিষয়ে মেলা কমিটির চেয়ারম্যান পাই, মামু, সিকি এবং আরো অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে।
  • siki | 123.242.248.130 | ১৯ জানুয়ারি ২০১২ ১৪:০০514825
  • বিশেষ সতর্কীকরণ,

    শ্রাবণী যেন এই লেখা অফিসটাইমে পোস্ট না করে, এবং কোনও গুরু বা চণ্ডাল যেন অফিস টাইমে এই লেখা পড়ার চেষ্টা না করে।

    অফিসের কাজ সমস্ত চৌপাট হয়ে যাঅবার ভয়ানক আশঙ্কা। আমার এখনই ক্লায়েন্ট কল শুরু হবে, আমি কী বলব, বেমালুম ভুলে গেছি।
  • shrabani | 117.239.15.103 | ১৯ জানুয়ারি ২০১২ ১৫:৪৩514826
  • লামা :))
    শমীক কিন্তু দিল্লীকে টেনে খেলায়....টই সাক্ষী! কিন্তু বাবা এই ঠান্ডায় সে¾ট্রাল হিটিং ছাড়া বেরোয় না, লিখলে কাজের ফাঁকেই লিখব.....ডাবল কাজ করাচ্ছে ছাতার অফিস, এটুকু ফাঁকি দেবই দেব!
  • phutki | 121.241.218.132 | ১৯ জানুয়ারি ২০১২ ১৭:৩৭514827
  • পড়ার পরে সিকির সাবধানবাণী দেখলাম। আমিও কেমন ঘেঁটে গেলাম। শ্রাবণী, বড় ভাল লেখেন। এর বেশী আর কী যে বলি।
  • shanku | 117.207.226.172 | ১৯ জানুয়ারি ২০১২ ২০:২৭514828
  • শ্রাবনী এসব কতদিন আগের কথা লিখছে ?
    আমি চেষ্টা করেও আমার চাকরিজীবনের প্রথমদিকের কথার এতো অনুপুঙ্খ স্মরন করতে পারলাম না । হয় আমি ভুলো নাহলে বেশী বুড়ো হয়ে গেছি ।
    শ্রাবনীকে 'টুপিখোলা' ।
  • siki | 122.177.192.89 | ১৯ জানুয়ারি ২০১২ ২১:৪৩514829
  • তবে এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে "ছাতার অফিস' হওয়া কত ভালো ব্যাপার। নিত্যি নিত্যি এরকমের মণিমুক্তো ঝরে পড়ে গুরুর পাতায়।

    সবার এমন ছাতার অফিস হোক। সব্বার হোক।
  • kd | 59.93.245.152 | ১৯ জানুয়ারি ২০১২ ২৩:৪৩514830
  • শুধু ছাতার আপিস হ'লেই হয় না, ছাতা খুলতেও জানতে হয়।
  • Nina | 12.149.39.84 | ২০ জানুয়ারি ২০১২ ০০:১৮514831
  • কাব্লিদাকে ক্ক! ছাতার মাথা হয়ে ও যেতে পারে অন্য কলমে--মানে আমার মতন কলম যদি হয় :-(
    একই সোনা সবাই পরে
    অঙ্গগুণে ঝলক মারে
  • titir | 128.210.80.42 | ২০ জানুয়ারি ২০১২ ০১:৫৬514832
  • শ্রাবণী,
    মন্ত্রমুগে্‌ধর মতো পড়ে গেলাম। কি সাবলীল লেখা! বসে থাকলাম প্রতীক্ষায়।
  • siki | 123.242.248.130 | ২০ জানুয়ারি ২০১২ ১২:৫৯514834
  • নীনাদি নেহাৎ বয়েসে বড়, তাই কিছু বল্লাম না। :)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন