এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • রহস্য গল্প : প্রতিচ্ছায়া

    shrabani
    অন্যান্য | ১১ অক্টোবর ২০১১ | ২০৯৩০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৩ ১৮:২৫495886
  • সে ক্ষী ?
  • nina | 79.141.168.137 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ১০:০৬495887
  • সে যাই হোক আমি আছি কুমুর সঙ্গে------কেরালায় কি লেখা বারম ঃ-০
  • raatri | 24.96.152.190 | ৩১ জানুয়ারি ২০১৩ ১১:১৬495888
  • ঘোর ঘোর ঘোর অন্যায় এইসব!!আম্মো কুমুদির দলে!!
  • um | 125.113.42.99 | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৩:০০495889
  • তুলে দিলাম, মাস শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই।
  • Suhasini | 132.166.80.43 | ১২ মার্চ ২০১৩ ২২:৩৭495890
  • ও শ্রাবণী, ইদিকে একটু দেখো এবারে। রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার শেষ কবে হবে?
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ১৩ মার্চ ২০১৩ ১৫:৩৬495891
  • শ্রাবণীদি তারপরে কি হইলো????????
  • kumu | 132.176.32.39 | ২১ মার্চ ২০১৩ ১৮:০৭495892
  • তুলে দিয়ে দাঁইড়ে থাকলাম।
  • rabaahuta | 172.136.192.1 | ২৯ এপ্রিল ২০১৩ ২৩:১৮495893
  • `
  • nina | 79.141.168.137 | ৩০ এপ্রিল ২০১৩ ০৩:৩২495894
  • আম্মো---
  • Blank | 180.153.65.102 | ৩০ এপ্রিল ২০১৩ ১৪:০৪495896
  • হয় পাঠকদের ওয়েটিং ট্যাক্স দেওয়া হোক নইলে শ্রাবনী দি ফের লিখে ফেলুক। কাল শ্রাবনী দির আপিস ছুটি করে দিলুম এটা লেখার জন্য।
  • AR | 30.139.67.50 | ২৩ মে ২০১৩ ১৮:২৬495897
  • ইটা কি শেষ হবে না?
  • শ্রাবণী | 69.94.106.52 | ০২ জুন ২০১৩ ১৫:০৭495898
  • আজ হাতরি গ্রামে পঞ্চ বসেছে। পুরুষেরা সব কাজ থেকে ফিরে জড়ো হয়েছে গাঁয়ের মাঝে, তালাও মানে পুকুরের ধারে মন্দিরের চাতালে বিশাল শাল গাছের নীচে। বুড়োরা আগে থেকে হাজির সেখানে বেলা পড়তে না পড়তেই। তাদের আর ঘরে কাজটা কী, এমনিতেই রোজ বেলাশেষে রোদের তেজ একটু কমলে তারা এখানে এসে আড্ডা জমায়, বসে থাকে রাতপহর অবধি। এই পুকুর শুধু মন্দিরের পুকুর, মেয়েদের সরার নয়। মন্দিরও তেমনি, ছোট একটা মাটি আর ইঁট দিয়ে তোলা এবড়োখেবড়ো অসমান দেওয়ালের ঘর, ওপরের ভাগটা চুড়ার মত করে কোনাচ করা, তাতে একখানা সিঁদুর মাখা ত্রিশুল বসানো, মাটির চাতাল। ইদানীংকালে গ্রামের রোজগেরে ছেলেরা চাঁদা তুলে চুনকাম করাচ্ছে প্রতি বছর মন্দিরপুজোর সময়, তাই বেশ চকচক করে মন্দির আর চাতাল, পুকুরঘাট। ভেতরে সিঁদুরমাখানো নানা আকারের পাথর, দু একটা ছবিছাবাও আছে লাল ফেট্টি জড়ানো, অম্বে মাতা, গণেশজী, আধুনিক কালের ভক্তদের সংযোজন।

    সাধারণত মেয়েরা পঞ্চে আসেনা তবে আজ মঙ্গলা এসেছে, সবার থেকে একটু দুরে মন্দিরের দেওয়ালের আধো আড়ালে বসে আছে, কোলের কাছে কানহা। ছেলেটা বসে থাকতে চাইছেনা, ছটপট করছে, একহাত দিয়ে তার হাতটা ধরে আছে, অন্য হাতে অনভ্যাসের ঘোমটা সামলাচ্ছে আর মাঝে মাঝে বেশী বিরক্ত করলে ছেলের পিঠে মাথায় হালকা চাপড় দিচ্ছে।
    মঙ্গলার আসার দরকার ছিলনা, পঞ্চ তার বাপকে ডেকেছিল কিন্তু সে শোনেনি এসেছে বাপের সাথে। বাপের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে খুব একটা স্বস্তিতে আছে। অন্য দেশ, কুটুমের গাঁ,কিন্তু সদ্য বিধবা মেয়ের ও বাপহারা শিশু নাতির দিকটাও তাকে দেখতে হবে।
    যবে থেকে মঙ্গলা মোতির সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেতে চেয়েছে এবং শ্বশুরের বাড়ি ও জমি যা আছে তাতে কানহার ভাগের টাকা চেয়েছে, মোতিলালের বাড়িতে অশান্তি আর ঝগড়ার চোটে কাকচিল বসতে পারছেনা। গ্রামের লোকজনও ভাগ হয়ে গিয়ে কিছু মঙ্গলাকে সমর্থন করছে, কিছু আবার মোতির বাপ ভাইয়ের দলে। শেষমেশ ঠিক হয়েছে পঞ্চ বসে এর মীমাংসা হবে, সেইমত দুপক্ষকে হাজির হতে হয়েছে। মঙ্গলা জানে পের কথা মানতেই হবে, সেটাই এ দিককার নিয়ম, তাই সে বাবার সাথে এসেছে। তার শ্বশুরবাড়ির নিজের গাঁ, হলই বা পঞ্চ, বাবাকে ভালোমানুষ আর ভিনদেশী পেয়ে জোর করে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিয়ে শ্বশুরের পক্ষে রায় দিয়ে দেবেনা তার কোনো ঠিক আছে নাকি!
    সে থাকলে এরকমটা হতে দেবেনা, মেয়েছেলে, বউ মানুষ ওসব কিছু মানবেনা, চেঁচিয়ে বিষ ঝেড়ে দেবেনা সবার।
    মহিলারা যে একেবারে আসেনি তা নয়, তবে নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে, পুরুষদের চক্ষের আড়ালে। মূলত মঙ্গলার উপস্থিতিই তাদের কৌতূহলের কারণ নাহলে পাঁচজন বেটাছেলে বসে বসে কী ঠিক করছে না করছে তা সম্বন্ধে সাধারণত তাদের উৎসাহ দেখা যায়না। মন্দির চাতালের একেবারে কাছাকাছি শুধু আর একজন মহিলাই আছে, বুড়ি ভানমতী।
    ভানমতী গাঁয়ের শেষপ্রান্তে একখানা চালা ঘরে থাকে, একা। স্বামী অনেককাল হল মরে গেছে, এক ছেলে ছিল, সেও আজ কত বছর হল শহরে চলে গেছে, আসেও না, মায়ের খোঁজও করেনা। তবে বয়স হলে কী হবে সে এখনো ডাঁটো আছে, দিব্যি চলেফিরে বেড়ায়, কাঠ কুড়িয়ে ঘুঁটে দিয়ে ও আরো বিভিন্নভাবে নিজের পেট চালিয়ে নেয়। সে অনেক ওষুধ জানে, জড়িবুটি, সেই কারণে গাঁয়ের বউ মেয়েদের তার ঘরে আনাগোণা। এছাড়া সবাই বলে ভানমতী নাকি তুকতাক বশীকরণও পারে, এজন্য গাঁয়ের মাতব্বরেরাও তাকে সমঝে চলে।

    পঞ্চে প্রথমেই মোতির বাপকে ডাকল, তার কথা বলতে। এমনেতে সেও পঞ্চের একজন তবে আজ সে সেই আসনে নেই, তার জায়গায় অন্য লোক। মোতির বাপ এসে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে, রোজগেরে ছেলের হঠাৎ মৃত্যুতে তার কতবড় ক্ষতি হয়ে গেছে সেকথা। সবাই জানে জমি যেটুকু আছে তাতে ভাগ হলে তার ও তার বাকী তিন ছেলের ভাগে চাষ করার মত কিছুই থাকবেনা, মোতির বউ আর ব্যাটাকে তারা দেখতে রাজী, তাদেরই বংশধর, অন্য কোথায় মানুষ হবে, কিন্তু জমির ভাগ দিতে রাজী নয়। জিনিসপত্র যেমন মোতি করেছিল তেমনি সে ঘরে বেশী কিছু দিতনা নিজের সংসার হওয়ার পর থেকে, জমিতেও সে কোনোদিন খাটেনি। এতদিন এদের তিনজনের ভরনপোষন অন্য সবার রোজগারে, জমির আয়ে হয়েছে। এখন এই সব জিনিসপত্রে অধিকার একলা মোতির বউয়ের কিভাবে হয়, পঞ্চই বলুক বিচার করে।

    মঙ্গলা এই পর্যন্ত শুনে তেড়েফুড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার বাবা তাকে থামিয়ে দেয়। এরপরে মঙ্গলার বাবাকে ডাকা হয় তাদের তরফের বক্তব্য শোনবার জন্যে। মঙ্গলার বাবা ধীরস্থির লোক, আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিজের মেয়ের আর নাতির কথা বলে। এত অল্প বয়সে ছেলেটা পিতৃহারা হয়েছে, তাকে মানুষ করতে হবে মঙ্গলাকে। মোতির বাপ আর সে দুজনেই বুড়ো হয়েছে, তারা চোখ বুজলে অন্যরা কানহাকে ঠিকমত দেখবে তার কোনো স্থিরতা নেই, তাদেরও ছেলেপুলে আছে! তার চেয়ে মোতির বাপ থাকতে থাকতে কানহার ভাগ দিয়ে দেওয়া হোক। মোতির কোথাও কোনো টাকাপয়সা নেই, অথচ সবাই জানে নিখোঁজ হওয়ার কিছুকাল আগেও সে ভালো রোজগার করত। এর মানে হল তার টাকা সব সংসারে গেছে, যা টাকা মোতি এদের সংসারে ঢেলেছে তার তুলনায় এই কটা জিনিস তো কিছুই নয়।
    দু পক্ষের বক্তব্য শুনে সবাই আবার দ্বিধাবিভক্ত। বয়স্করা মঙ্গলার ভাগ চাওয়া একবারে পছন্দ করছেনা, তাদের সমাজে একটা মেয়েমানুষ হয়ে এত দুঃসাহস কীকরে হয় মঙ্গলার। আবার একটু কম বয়সী ছেলে ছোকরারা যাদের গায়ে শহরের হাওয়া লেগেছে, তারা মনে করছে মোতির ছেলে বউয়ের ন্যয্য ভাগ পাওয়া উচিত।

    শেষমেশ পঞ্চ রায় দিল মোতির সব জিনিস এক করে আধা আধা ভাগ হবে, এক ভাগ তার বাবা পাবে অন্য ভাগ ছেলে। পরদিন সকালে মোতিদের বাড়ি সবাই মিলে গিয়ে সব জিনিস ভাগ করে দেবে আর জমির ভাগ বাবদ এরা মঙ্গলার ছেলের নামে হাজার টাকা দেবে। মঙ্গলা রায় শুনে প্রথমটা হতবাক হয়ে রইল, ততখনে তার শ্বশুর আর্জি জুড়েছে, হাজার টাকা অনেক টাকা, তাদের হাতে কাঁচা টাকা কোথায়, ওটা অর্ধেক করা হোক।
    চারপাশে এত কলকারখানা এসে এখানে জমির দাম এখন বেড়ে গেছে, হাতরিতে দর অতটা না হলেও ভালৈ। এদের অল্প জমি যা আছে তাও এখন বেচলে ট্রান্সপোর্টনগরের মহাজনরা লাখ টাকা দিয়ে নেবে, একথা মঙ্গলা মোতির মুখে শুনেছে অনেকবার। যখন কথা হয়েছিল ওরা শহরে গিয়ে থাকবে তখনি মোতির মাথায় ছিল নিজের ভাগের জমি বাপের কাছ থেকে নিয়ে বেচে কোরবার আশেপাশে কোথাও একটা ঘর তুলবে। সেই জমির চার ভাগের একভাগে কানহার পাওনা মাত্র হাজার টাকা!
    সে তেড়েফুঁড়ে উঠল আঁচলটাকে কোমরে গুঁজে,এক হাতে ছেলের হাত ধরা, সোজা গিয়ে দাঁড়ায় গাছতলায় একেবারে পঞ্চের সামনে, চোখমুখ গনগনে আঁচের মত। উপস্থিত সবাই তার এই রূপ দেখে বাক্যিহারা। তারপর শুরু হল গালাগাল, আকাশ বাতাস গাছপালাকে সাক্ষী করে সে চেঁচাতে লাগল শ্বশুরবাড়ির সকলের নাম ধরে, সকলে মিলে মোতিকে মেরেছে, এখন কানহা আর তাকেও মেরে ফেলতে চায় এরা।
    সবাই দিশাহারা, কোনো বাড়ির বউয়ের এরকম ব্যবহার কেউ দেখেনি আগে এগাঁয়ে, দুরে দাঁড়ানো মেয়েরা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মঙ্গলাকে ধরতে চায়, সামলাতে চায়, পারেনা। তাদের ভয়, বাড়ির পুরুষেরা এই নিয়ে যদি পরে তাদেরকেই মারেবকে।

    কয়েক মুহূর্ত এরকম চলার পরে বুড়ি ভানমতী সম্বিত ফিরে পেয়ে এগিয়ে আসে মঙ্গলাকে ধরতে।
    -"চুপ কর, চুপ কর পোড়ারমুখী, পঞ্চের সামনে একী ব্যাভার! ছি ছি লাজলজ্জা আর কিছুই রইল না তোর, মানুষটার সাথে সাথে সেগুলোও খেয়ে বসে আছিস।"
    মঙ্গলা অবশ্য ভানমতী বুড়িকে পাত্তা দেয়না,
    -"আমি খেয়েছি, না এইলোকগুলো খেয়েছে তাকে? দিনরাত তার থেকে পয়সা নিয়ে নেশা করেছে, বড়মানুষী করেছে, এখন সে মরে গেছে, তার ছেলের হকের পাওনা মারছে। জমি এল কোত্থেকে এদের, সে মানুষটা পয়সা দিয়ে মহাজনের কাছে জমি না ছাড়ালে? বাপ ভাই সবসময় টাকা টাকা করে বলে লোকটা টাকার ধান্দায় গিয়ে আর বেঁচে ফিরল না গো। গাঁয়ের লোক জানেনা সত্যি কথাটা, এই পঞ্চ জানেনা? আবার মিছে কথা বলে তার নামে, বলে সে নাকি কিছু দিতনা, পোকা পড়বে মুখে, মরে সাত নরকে যাবি সব।"
    ভানমতী কেমন যেন কী বলছে খেয়াল না করে বলে ফেলে,
    -"শুধু ওদের দোষ দিয়ে কী লাভ, তোরা নিজে কম নাকি? মোতি যাবার আগের রাতে আমার কাছে এসে অত জড়িবুটির গোলি তৈরী করিয়ে নিয়ে গেল, সে কি এমনি এমনি , বদ মতলব না থাকলে? কোথায় কী পাপকাজ করতে গিয়ে মরেছে দেখগে যা।"
    মঙ্গলা থেমে গেল, একদম চুপ।
    অন্যরা এবার একটু নড়ল চড়ল। পঞ্চের একজন বুড়িকে ধমকের সুরে বলল,
    -"কী বলছিস তুই? মোতি পালাবার আগের দিন তোর কাছে জড়িবুটি বানিয়ে নিয়ে গেসল? তাতে কী ছিল?বিষ? একথা তুই গাঁয়ের লোকেদের এতদিন জানাসনি কেন?"
    ভানমতীর মুখে ভয়ের ছায়া, সেদিকে তাকিয়ে আর একজন বলে,
    -"তুই বিষ বানিয়ে দিলিই বা কেন? সেই নারায়ণের বউটা তোর থেকে বিষ নিয়ে খেয়ে মরবার পরে, তোকে আমরা বলেছিলাম না যে বিষ বানাবিনা, বানালে পুলিশে ধরিয়ে দেব।"
    -"বিষ নয় বিষ নয়, কম মাত্রায় খেলে ঘুমের দাওয়াই,কষ্ট কমে, ব্যথা কমে। বানাতে চাইনি, জোর করল মোতি। প্রথমে বলল তার মালিকের শরীরের ব্যথায় ঘুম হয়না, জড়িবুটি দিয়ে ঘুমের ওষুধ বানিয়ে দিতে। অল্প দিতে গেলাম, বলল অনেকটা চাই, ভালো পয়সা দেবে। নিয়ে যাওয়ার সময় আমি সাবধান করে দিতে গেলাম, একসাথে বেশী যেন না খায়। অবিশ্যি খেলে মরবেনা তবে কিছু মনে থাকবেনা,সব ভুলে যাবে। তাতে বদমাশের মত হেসে বলে গেল, সে জন্যেই তো চাই, একেবারে ঘুম পাড়িয়ে দিলে তো আরো ভালো হত। আমি তখন পিছন পিছন গিয়ে অনেক মানা করতে লাগলাম, পয়সা ফেরত দিয়ে ওষুধ ফিরে চাইলাম, শুনল না। উল্টে শাসিয়ে গেল, কাউকে বলে দিলে আমাকে জানে মেরে ফেলবে। বদমাশ ছেলে, বেশ হয়েছে মরেছে, আমার সঙ্গে শয়তানি, শিউজী শাস্তি দিয়েছে।"
    পঞ্চে এবার একটা সাড়া পড়ে গেল, নতুন তথ্য পাওয়া গেছে, সবাই একসাথে সে নিয়ে কথা বলতে থাকল। যে লোকটি বিদ্যুতনগরে প্ল্যান্টের কয়লার ডিব্বায় মোতির লাশ প্রথম দেখেছিল, সেও ছিল। তাদের কজনের মত পুলিশকে এ কথা জানানো উচিত, মোতি কোনো গলত কামে গেছিল জড়িবুটির দাওয়াই নিয়ে। কে একটা ভানমতীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
    -"সে শাস্তি পেয়েছে, তাহলে তোর শাস্তি আর বাকি থাকে কেন? এই পঞ্চেই ঠিক হয়ে যাক, এ ডাইন আছে, লোককে বিষ দিয়ে বদকাজে সাহায্য করছে, তুকতাক করে লোকের ক্ষতি করে, এর বিচার হোক।"
    ভানমতী এবারে দেখে বেকায়দা, সে তখন চেঁচাতে থাকে,
    -"আমি ডাইন আর তোমাদের বাড়ির সব বউমেয়েরা দুধে ধোয়া? তারা আসে কেন আমার কাছে বিষ নিতে, তুকতাক করাতে, মন্ত্র পড়াতে। এই মোতির বউটাই বা কম কিসে, সবাই জিজ্ঞেস কর ওকে, ওর এত তেজ কেন। আমি ওর মুখ দেখে বলতে পারি এই বউটা বদ আছে, ওর অন্য জায়গায় চক্কর আছে। নাহলে মরদ মরে গিয়ে একফোঁটা জল নেই চোখে। ওই ওর আশিকের সাথে মিলে মোতিকে মেরেছে, ওর বিচার কর তোমরা।"
    চেঁচামেচির মাঝে ভানমতীর কথা ভালো করে সবার কানে না ঢুকলেও মঙ্গলার মুখে কে যেন ছাই ঢেলে দিয়েছে।
    চারিদিকের বিশৃঙ্খলার মাঝে সে চুপিচুপি তার বাবাকে ডেকে নেয়, একহাতে ছেলেকে ধরে অন্যহাত বাবার হাতে, দ্রুত তিনজনে ওখান থেকে সরে যায়। আজ রাতেই এ গাঁ ছাড়তে হবে, কী থেকে কী বেরিয়ে যায়, শেষে তারা না বিপদে পড়ে!
  • শ্রাবণী | 69.94.106.52 | ০২ জুন ২০১৩ ১৫:২৫495899
  • *****************************************
    চোরগোড়ে ভাবতে পারছেনা এতবড় একজন উচ্চপদস্থ অফিসার তার মত একটা ছোট থানার মামুলী ইন চার্জের কথা এত গুরুত্ব দিয়ে শুনবে এবং প্রশংসা করবে তার। এতদিন থানার কাজকে সে রোজের কাজ হিসেবেই দেখে এসেছে, অতিরিক্ত কিছু না কিন্তু আজ গুপ্তা সাহেবের সঙ্গে গেস্টহাউসে কথা বলার পর কেমন উৎসাহ উদ্দীপনা প্রাণের ভেতরে টগবগ করে ফুটতে আরম্ভ করে দিল। ফলস্বরূপ রাতে প্রায় ঘুমই এলনা, কখন সকাল হবে, কখন সে কাজ শুরু করবে সেই চিন্তাতে রাত কেটে গেল। ভোরে থানায় এসে রাতের ডিউটির কনস্টেবলদের ঘুম থেকে তুলল, তার সঙ্গে বাকীদেরও ডেকে নিল, এই ঘুমন্ত ছোট্ট কসবার থানায় যেন সাজ সাজ রব। সূর্য ওঠার আগেই তারা বিরজুকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে এসে লক আপে ঢুকিয়ে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় বিরজুও হতভম্ব। তাকে, নেতাজীর খাস চেলাকে যে একটা মামুলী দারোগা আটক করতে পারে, এক নম্বর বিস্ময় সেটা, তার ওপরে থানায় এসে ঘুমের ঘোর কাটলে চিন্তা করেও হপ্তা দশদিনে কোনো সেরকম ঝামেলা কিছু করেছে বলে তার মনে পড়েনা। অবশ্য চোরগোড়ে তাকে ধরে নিয়ে আসার সময় কোনোরকমে জামা গায়ে গলাতে গলাতে বউকে বলেছিল ছোট ভাইটাকে ঘুম থেকে তুলে নেতাজীকে খবর দিতে, মোবাইলে নাম্বার আছে। বউ পড়ালিখা নয় তবু মোবাইলের ব্যাপারস্যাপার আজকাল গাঁঘরে সবাই বোঝে। তবে ঝামেলা হল নেতাজী এখন এখানে নেই কাল রাতে রায়পুর গেছে, সেখানে বড় নেতারা আসছে দিল্লি থেকে, পার্টির কী মিটিং আছে। বিরজুও যেত সঙ্গে কিন্তু মাসের প্রথম কারখানা কোলিয়ারী সর্বত্র আদায়পত্র আছে, সেসব আবার বিরজুর মত পাকা লোক ছাড়া পারবেনা, তাই সে যায়নি।

    অভিনব যখন থানায় এল তখন বাইরে একটা ছোটখাটো জটলা, বিরজুর দলের লোকেদের। সাধারণত এ থানা এলাকায় লোকের ভিড়ভাট্টা রোজ থাকেনা, রাস্তার উল্টোদিকের চা সমোসার দোকানে বিক্রি বেড়ে গেছে। তবে ভিড় মানে ঐ জনা ছয়েক লোক, দুটো বাইক আর একটা সাইকেল। জমায়েতের সবার কানে মোবাইল উঠছে আর নামছে ঘনঘন। দিল্লীর বড় সাহেবের কল্যাণে চোরগোড়ের বুকে এখন অসীম বল, সে বাইরে একজন কনস্টেবলকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, থানায় কাউকে ঢুকতে না দেয় যেন। বিরজুকে লক আপ খুলে নিয়ে এল আর একজন কনস্টেবল। সবাইকে ঘর থেকে বার করে দিয়ে ঘরে রইল শুধু বিরজু, অভিনব ও চোরগোড়ে। চোরগোড়ের কাছে বনোয়ারীর চেলাদের বয়ান ও মোতিলাল সংক্রান্ত সমস্ত বিশদ জেনেছিল আগেই, এখন সে ভালো করে দেখল লোকটাকে।
    একেবারে সাধারণ এদিককার স্থানীয় চেহারা, গাঁট্টাগোট্টা, কালো, বেঁটে, গুটকা খাওয়া দাঁত। ছোটছোট চোখদুটোতে একটু মিশ্র দৃষ্টি, বিস্ময়, রাগ, ভয়।
    অভিনবের হাতে বেশী সময় নেই, অন্যরা সুন্দরনগরের কারখানায় কথাবার্তা বলছে সবার সঙ্গে, সেদিনের মিটিংয়ে যারা ছিল। এছাড়া আগরওয়ালদের ব্যবসার কাগজপত্র দেখছে, দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ওরা কোলিয়ারীর দিকে যাবে।

    চোরগোড়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, অভিনব বলে,
    -"তুমিই বিরজু তো? হাতরি গাঁয়ের মোতিলালকে চিনতে, কিছুদিন আগে যে মারা গেছে?"
    বিরজু একটু চমকে গেল কি?
    -কী হল, সিধা জবাব দাও, চিনতে না?"
    -"হাঁ সাব, চিনতাম।"
    চোরগোড়ে অভিনবকে দেখিয়ে বিরজুকে বলে,
    -"বড়া সাব, দিল্লি থেকে এসেছে। যা যা জিজ্ঞেস করছেন ঠিকঠাক জবাব দে, নইলে তোর নিস্তার নেই। "
    বিরজু একথা শুনে কেমন একটা হাঁ করে অভিনবকে দেখতে থাকল, কথার জবাবে কী বলছে ন বলছে তা বোধহয় তার আর খেয়ালই রইল না।
    -"কীভাবে চিনতিস মোতিলাল কে?"
    -"এদিককার লোক, বনোয়ারীর সঙ্গে থাকত।"
    -"বনোয়ারীকে কিভাবে চিনতিস?"
    -"এক জায়গার লোক সব, চিনব না?"
    অভিনব বুঝতে পারল বিরজু নেতাজী বা পার্টির কথা তুলবেনা এ প্রসংগে। তখন সেই সোজাসুজি কথাটা তোলে।
    -"কোর্টে বনোয়ারীর সাজা হওয়ার দিন তুই নেতাজীর সঙ্গে কোর্টে ছিলি, সেখান থেকে মোতি তোর সঙ্গে জিপে চড়ে চলে গিয়েছিল। এর পরদিন সে বাড়ি থেকে পালি যাচ্ছে বলে বের হয়, আর ফেরেনা। পালিতে খোঁজ করে তার কোনো দোস্তের খবর পাওয়া যায়নি, বাসস্ট্যান্ডে কোথাও কেউ তাকে দেখেনি। তোর সাথে গাড়িতে যাওয়ার পরে পরেই সে বাড়ি থেকে পালি যাচ্ছে বলে বেরিয়ে যায়। ঠিক করে বল সেদিন মোতির সাথে তোর কী কথা হয়েছিল, কেন সে তোর সাথে গিয়েছিল?"
    -"তেমন কিছু কথা হয়নি সাব, আমরা গাড়িতে যাচ্ছিলাম, ওকে ওর গাঁয়ের কাছের রাস্তা অবধি ছেড়ে দিতে বলল তাই নিয়েছিলাম সঙ্গে। আমি আর কিছু জানিনা।"

    অভিনবের মনে হচ্ছিল যে বিরজুর সাথে মোতির নিখোঁজের কিছু সম্পর্ক আছে কিন্তু সেব্যাপারে বিরজু বা বনোয়ারী মুখ না খুললে জানা যাবেনা।
    মোতির মৃত্যুটা নিছক খনি অ্যাক্সিডেন্ট বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা, এতদিন সে গা ঢাকা দিয়ে কেন ছিল? এই নেতা ও দলের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? সেরকম কিছু গন্ডগোল এখানে হালে কিছু ধরা পড়েনি বা ইলেকশনের সময়ও নয় যে অকারন পলিটিক্যাল খুনোখুনি হবে। বিরজুকে চাপ দিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না কিছু কাজের কথা জানা যাচ্ছে। চোরগোড়ে জানিয়েছে নেতাজী এখন এখানে নেই, এই সময়টা কাজে লাগাতে হবে।
    -"তোর সঙ্গে সেদিন গাড়িতে আর কে কে ছিল মোতি ছাড়া?
    -"আমার ঠিক মনে নেই, দু তিনজন ছিল। অনেকদিন হয়ে গেল, খেয়াল হচ্ছেনা।"
    এবার চোরগোড়ে এক পেল্লাই পুলিশী ধমক দিল,
    -'এই কমাসের কথা মনে নেই? ইয়ার্কি হচ্ছে, বল শীগগির, নয়ত এমন কেসে অন্দর করে দেব কোনো বাপ বাঁচাতে পারবেনা তোকে।"
    বিরজু গোঁ গোঁকরে বলে,
    -জিপের "ড্রাইভার রামলাল আর বংশী।"
    অভিনব চোরগোড়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
    -"এক্ষুনি লোক পাঠিয়ে এদের ডেকে নাও। এ যখন সত্যি কথা বলবেনা তখন অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। আর মোতির কেসে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে একে এখন আটকে রাখো। কেউ এসে ছাড়াতে চাইলে আমার সঙ্গে কথা বল, আমি এর ব্যাপারে এখানকার পুলিশ সুপার আর ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি, কিভাবে কী করতে হবে তোমাকে বলে দেব।"
    বিরজু এদের কথা শুনছিল, চোখেমুখে এবার স্পষ্টতই ভয়ে ছায়া, তবে কিছু বলল না, শুধু বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। তাকে এদের হাত থেকে উদ্ধার করতে দলের লোকেরা এখনো আসছে না কেন!

    অভিনব বেরিয়ে পড়ল, চোরগোড়ে সঙ্গে সঙ্গে বাইরে এল,
    -"স্যর, আপনার কী মনে হচ্ছে, মোতিকে বিরজু বা ওর দল মেরেছে? কিন্তু কেন, মোটিভ কী? আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি, মোতির এদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না, গত ইলেকশনের সময় বনোয়ারীর চাকরি ছিলনা, সে এদের হয়ে কাজ করেছে কিন্তু মোতি তখনো নর্মদায়, সে তখনো বনোয়ারীর দলে ভেড়েনি।"
    অভিনব গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলে,
    -"মোতিকে বিরজু বা ওর দল মেরেছে কিনা বা কেন মেরেছে সেসব তো আরো পরের কথা। এখন তোমার কাছে এই একটাই সূত্র আছে যেটা মোতির ব্যাপারে কিছুটা অস্বাভাবিক ঠেকছে। মোতির এদের দলের সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই, বনোয়ারীর দলেও সে পুরোদস্তুর সদস্য ছিলনা তবু বিরজু কোর্টে অতলোকের মধ্যে থেকে মোতিকেই গাড়িতে লিফট দিল, এবং তার ঠিক পরেই মোতি বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে উধাও।
    তোমাকে এ লাইনেই তদন্ত করতে হবে কারণ এছাড়া একেসে আর কিছু নেই। মোতি কেন মারা গেল জানতে হলে মোতি কেন নিখোঁজ হল জানা দরকার মনে হয়। আর খনি এলাকায় সর্বত্র দুজন প্লেন ড্রেসে লোক পাঠিয়ে গোপনে খোঁজখবর নাও। মোতির একটা ফটো আছে?"
    -"হ্যাঁ স্যর, নর্মদা ট্রান্সপোর্টের ফাইলে ছিল, নিয়ে এসেছি।"
    -"গুড, তাহলে ঐ ফোটো দেখিয়ে খোঁজ কর মোতি কোথায় ছিল। বেশী খুঁজতে হবেনা, বিদ্যুতনগরের ওদিনকার কয়লার রেক যে রুটে এসেছিল, সেই রুটটায় আগে যাও। সুপারভাইজার বা খনির পদাধিকারীদের কাছে না গিয়ে মজদুর, কনট্রাকটরের লেবারদের কাছে খোঁজ নিতে বল। এমনিতে আমিও এখন ওমপ্রকাশ আগরওয়ালদের খনিতে যাচ্ছি, খোঁজখবর করতে, তবে সেখানে তো কাজকর্ম বন্ধ, সেখানে মোতি আত্মগোপন করেছিল বলে মনে হয়না।"
    -"কিন্তু স্যর, একটা কথা। এদিককার খনি এলাকায় নেতাজীর রাজ চলে, যদি কোনো কারণে মোতি ওদের ভয়ে লুকোয় তাহলে খনির দিকে লুকোবে কি?"
    অভিনব বেশ খুশী হল, চোরগোড়ে বুদ্ধিমান, যুক্তিটা ঠিক। এখানকার হালচাল চোরগোড়ে তার থেকে ভালো জানবে, হয়ত ঠিকই বলছে। তবে সেরকম হলে কয়লার রেকে লাশ এল কেন, জঙ্গলে কোথাও পুঁতে ফেললেই তো হত? একমাত্র খনি এলাকার আশেপাশেই জঙ্গল নেই নাহলে এদিকে তো একটু গেলেই জঙ্গল, পাহাড়।
    -"অবশ্য এমনটা হতেও পারে স্যর, বিরজুরা তোলা তুলতে খনিতে যায়না, বন্দোবস্ত আছে, শহরে এসে লোকে পয়সা দিয়ে যায়। সেই কথা ভেবেই হয়ত মোতি খনিতে গেছে, এখান থেকে দুর অনেক আর কাজও সহজে জুটে যায়। তাছাড়া কেউ যদি বিভিন্ন খনিতে কাজ করে বেড়ায় এক জায়গায় না থেকে তাহলেও খুঁজে বার করা মুশকিল হবে কারো পক্ষে।"
    -"ঠিক আছে, দ্যাখো ওদিকটা আর আমাকে ফোন করে জানিও বিরজুর ব্যাপারে কোনো সমস্যা হলে। আমি কাল চলে যাচ্ছি তবে যাবার আগে তোমার ওপরওয়ালার সাথে কথা বলে যাব।"

    -"স্যর, একটা কথা ছিল।"
    অভিনব ও চোরগোড়ে দুজনে নিজেদের কথা তে এত মগ্ন ছিল যে কখন লোকটা এসে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। দোহারা চেহারা, বেশী বয়স না বত্রিশ তেত্রিশ হবে, পরিস্কার কুর্তা পাজামা পরণে, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ একটা। এমনিতে মাজা ঘসা চেহারা হলেও মুখের গড়ন ও ধাঁচে এখানকার ভূমিপুত্রের ছাপ। চোরগোড়ে অবাক হলেও পরিচিত লোককে সম্বোধন করার স্বরে বলে ওঠে,
    -"আরে মাস্টার যে, কী ব্যাপার তুমি এখানে? স্যর, এ হোলো সন্তোষ মাস্টার, মনিয়ারীর প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার।"
    অভিনব লোকটিকে দেখে, ভালোমানুষ চেহারা তবে খুঁটিয়ে দেখলে একটা আদিম ব্যাপার আছে, মাটির সোঁদা গন্ধ মাখা। শান্ত চোখে খুব খেয়াল করলে কখনো সখনো ঝলকে দ্যুতি দেখা দেয়।
    সন্তোষ মাস্টার অভিনবের দিকে দুই হাত জড়ো করে,
    -"স্যর, বিরজুকে কেন থানায় আনা হল? কী করেছে ও?"
    অভিনব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোরগোড়ের দিকে তাকালে সে তাড়াতাড়ি বলে,
    -"মাস্টার আসলে বিরজুর পার্টির লোক, স্যর।"
    -"মোতিকে চিনতেন আপনি?" সন্তোষের হয়ে এবার চোরগোড়ে জবাব দেয়,
    -"আরে স্যর, এসব ছোট জায়গায় গ্রামে গ্‌ঞ্জে সবাই সবাইকে চেনে, তাছাড়া মোতির শ্বশুরবাড়ি তো মনিয়ারীতে, মাস্টারের ইস্কুল যেখানে।"
    অভিনব আর কিছু না বলে খুব সংক্ষেপে বলে ব্যাপারটা। সন্তোষকে বেশ অবাক দেখাল,
    -"মোতির ব্যাপারে বিরজুকে ধরে আনা হয়েছে? কে নালিশ করল, কেউ কিছু দেখেছে?"
    মোতির মত একজন লোকের মৃত্যুর তদন্ত হচ্ছে এটাই বোধহয় এদের কাছে একটা খবর।

    অভিনব বুঝতে পারছে এদের বিস্ময়ের কারণটা, সে নিজেও জানে এ ব্যাপার নিয়ে বেশীদুর এগোনো যাবেনা। সে এখানে বহিরাগত, আর চোরগোড়ের পক্ষে সম্ভব নয় এই তদন্ত বেশীদিন চালিয়ে যাওয়া। রাইয়ের অনুরোধে সে ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, এর এমনিতে কোনো যুক্তি নেই। শুধু শুরু করেছে আর চোরগোড়ের খুব উৎসাহ দেখা যাচ্ছে যখন কিছুদুর যাওয়া যাক! তবে এখন সন্তোষ মাস্টারকে দেখে একটু হাঁফ ছাড়ল সে, একে দেখে মনে হচ্ছে না এখনই বেশী গোলমাল হবে বিরজুকে নিয়ে। আশেপাশে দলবলও তেমন দেখা যাচ্ছেনা, থানা ঘেরাও টেরাও করলে ঝামেলা হয়ে যেত। বিরজু দলের সদস্য না শুধুই নেতার লেজুড় কে জানে!
    তাড়া আছে বেরোতে হবে, সে মাস্টারকে সংক্ষেপে বলে,
    -"বিরজুকে ঠিক গ্রেফতার করা হয়নি, কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আনা হয়েছে কেসের সুবিধার্থে। সব প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব পেয়ে গেলে ওকে ছেড়ে দেবে পুলিশ।"
    সন্তোষ উত্তরে কিছু বলার আগেই অভিনব গাড়িতে ওঠে। গাড়ি চালু হলে কী মনে করে চোরগোড়েকে ডেকে বলে ,
    -"মাস্টারকে একবার বিরজুর কাছে নিয়ে যান। দেখুন ওকে বুঝিয়ে বলে যাতে ও যা জানে মোতির ব্যাপারে ঠিকঠিক যেন বলে দেয়, তাহলেই ছাড়া পেয়ে যাবে শীগগির।"
    চোরগোড়ে আর সন্তোষ দুজনেই সায় দেয় একথায়।

    কী মনে করে চোরগোড়ে সন্তোষ মাস্টারকে বসিয়ে রাখল তা সে নিজেই জানেনা। হয়ত পরে এ নিয়ে নেতাজী ঝামেলা করলে ভালোমানুষ সন্তোষ মাস্টার তার হয়ে সাক্ষী দেবে, সে যে বিরজুকে তেমন মারধোর কিছু করেনি তা বলবে। মাস্টারের বসার ইচ্ছে ছিলনা তবু কিছুটা অনুরোধে আর কিছুটা কৌতূহলে বসে থাকে সে, বংশী আর রামলালকে আনতে লোক গেছে।
  • kumu | 132.161.155.200 | ০২ জুন ২০১৩ ১৯:০১495900
  • বংশী আর রামলালকে আনতে লোক কদ্দুর গেছে?কখন আসবে?
  • সায়ন | 59.249.139.203 | ০২ জুন ২০১৩ ১৯:০৬495901
  • নতুন সীজন শুরু হয়েছে! বেশ। শেষ হোক গোটাটা একসাথে পড়বো। :-P
  • rabaahuta | 172.136.192.1 | ০৩ জুন ২০১৩ ২১:২৭495902
  • ওঃ, এইতো নতুন পর্ব এসে গেছে
  • S | 139.115.2.75 | ১১ জুলাই ২০১৩ ০৪:০২495903
  • গপ্প কি শেষ হবেক লায়েক।
  • jhumjhumi | 127.194.251.182 | ১১ জুলাই ২০১৩ ১৭:১২495904
  • এতদিনেও বংশী আর রামলাল এলো না?
  • শ্রাবণী | 69.94.105.210 | ১৪ জুলাই ২০১৩ ১২:৫৭495905
  • *************************************
    রাই আর কোনো খবর পাঠালোনা, আসল দাসানিকে নিয়ে ওর বন্ধু আসবে বলল তাও এলনা। শ্রীমতীর আজকাল কেমন খুব অস্থির লাগে অথচ বলতে গেলে এখন তার দুশ্চিন্তা কম হওয়ার কথা। এবারের চেক আপে ডাক্তার ভীষন খুশী, জয়ন্তের রিকভারির প্রগ্রেস নাকি দারুন ভালো, ওর চেম্বারে কিছুটা ধরে ধরে চলালেন। ওয়াকিং স্টিক নিয়ে বাড়ির মধ্যে অল্প অল্প করে চলা প্র্যাকটিস করতে বলে দিলেন। সেইমত রোজ রামনিবাস জয়ন্তকে হাঁটাচ্ছে ধরে ধরে,জয়ন্তরও মেজাজপত্র আজকাল হয়ত সেই কারণেই বেশ ভালো।
    একদিন রাইকে ফোন করেছিল মোবাইলে, ওরা কোথায় যেন গিয়েছিল, রাস্তায় ছিল, ভালো করে কথা হয়নি। কিন্তু জয়ন্ত শুনতে পেয়ে খুব রাগ করছিল শ্রীমতীর ওপর, বারে বারে যেচে রাইকে ফোন করা কেন। রাই তো কোনোদিন ফোন করেনা, আসেও না বাড়িতে। এত তো বন্ধুদের বউয়েরা আছে তাদের কেন শ্রীমতী ফোন করেনা বা তারা এলে তেমন গল্প করেনা, রাইয়ের সঙ্গে কী এত কথা!
    যত সুস্থ হচ্ছে তত জয়ন্তের মধ্যে সেই আগেকার কড়া একরোখা ভাবটা ফিরে আসছে। এমনি কিছু না, অন্যায় মনে হলে প্রতিবাদ শ্রীমতী আগেও করেছে, এখনও করাই যায়। তবে জয়ন্তর এই অবস্থায় সে কোনোরকম অশান্তি ঝগড়ার মধ্যে যেতে চায়না বলেই যতটা সম্ভব চুপ করে থাকে এখন।

    তাতাইয়ের পরীক্ষা চলছে বলে একটু ব্যস্ততায় কাটে দিন, সন্ধ্যেয় ছেলের পড়ার কাছে বসতে হয় নাহলে একদিন বেরিয়ে চলে যেত রাইয়ের বাড়ি। আসলে আলোককে ভয়, সহজ মানুষ ঘোরপ্যাঁচে নেই, বারণ করলেও কখন গল্প করতে গিয়ে জয়ন্তর সামনে হয়ত ভুলে বলে দেবে শ্রীমতীর ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা। আজকাল জয়ন্ত মাঝেমাঝেই ফোনে এদিক ওদিক কথা বলে নানা লোকের সঙ্গে, ল্যাপটপও আজকাল বিছানাতেই থাকে অধিকাংশ সময়। মাঝখানে আবার নতুন ফ্ল্যাটের তিননম্বর ইনস্টলমেন্টের চিঠি এসেছিল, জয়ন্ত নিজের অ্যাকাউন্টের চেক লিখে দিল। শ্রীমতী দোমনা ছিল, এতগুলো টাকা এই সময় খরচ করা কি ঠিক হবে! জয়ন্ত উড়িয়ে দিল, আর কিছুদিনের মধ্যেই নাকি ও রেগুলার অফিস জয়েন করবে, অজিত আগরওয়ালের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। আপাতত ট্যুরে যাবেনা যতদিন না পুরোপুরি ঠিক হয়, অফিসে বসে ডিজাইন ইত্যাদির কাজ দেখবে। গাড়ি ড্রাইভার সব আগের মতই অফিস পাঠাবে। এমনকি অফিসে ওকে আলাদা কেবিন উইথ অ্যাটাচড ওয়াশরুম দেওয়া হবে যতদিন না পুরোপুরি ঠিক হয়ে লাঠি ছাড়া চলতে পারে।
    শুনে ভালোই লাগে তবে কেমন বিশ্বাস হয়না শ্রীমতীর অথচ জয়ন্তকে অবিশ্বাস করার মত কিছু হয়নি কোনোদিন, তবু প্রশ্ন জাগে। রাইয়ের মুখে শুনেছিল আগরওয়ালদের গন্ডগোলের কথা, সেসব কি তাহলে মিটমাট হয়ে গেল? তা যদি না হয় তাহলে সুন্দরনগর প্রজেক্ট এগোয় কী করে আর জয়ন্তর দায়িত্বে তো সুন্দরনগরের ডিজাইন ছিল। প্রোজেক্ট যদি বন্ধ থাকে তাহলে আগরওয়ালদের মত কম্পানি জয়ন্তকে এত সুযোগসুবিধে দিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বিশেষ করে সে পুরোপুরি সুস্থও নয় যেখানে, এটা একটু অদ্ভুত লাগছে ওর। চেনাজানাতে প্রাইভেট হাউসের এমন ব্যবহার খুব একটা শোনা যায়না। জয়ন্তকে একদিন এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলে ঠান্ডা গলায় বলল,
    -"তুমিও আজকাল অফিসের কাজকর্মের, কোন প্রজেক্টে কী কাজ কিভাবে হবে, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছ দেখছি। এসব কি রাইয়ের কাছে শিখছ নাকি!" গলার স্বরে শ্রীমতী অপমান আর তাচ্ছিল্যের আভাস পায়। সে সাধারণ আর্টসের গ্র্যাজুয়েট, তাই তার এসব বোঝার কথা নয়? কাজের খুঁটিনাটি না বুঝতে পারে কিন্তু এগুলো এমন কী বিষয় যে তাকে বুঝিয়ে বললে বুঝবেনা। সে আর এ নিয়ে কথা তোলেনি। সেদিনে ফোনে দিদিকে জানাতে ওরা খুশী হলেও সোমনাথদা বেশ অবাক হল, এত ভালো আগরওয়াল ইনডাস্ট্রীজ, জানা ছিল না তো!

    শ্রীমতী সেদিন ফোন করেছিল, কথা হয়নি, ওরা বিয়েবাড়ি যাচ্ছিল। তারপর থেকে নানা ব্যস্ততায় আর ফোন করা হচ্ছেনা, উইকেন্ডে করবে বলে ভেবে রেখেছিল। আসলে দেওয়ার মত কোনো খবরও তো নেই, অভি ফিরে আর যোগাযোগ করেনি, হয়ত ব্যস্ত আছে।
    শুক্রবার সন্ধ্যে এলে রাইয়ের মন ভালো হয়ে যায়, আসন্ন উইকেন্ডের খুশীতে। তখন থেকে সবকিছু ওর ঢিমেতালে চলতে শুরু করে। রান্নাঘরের দিকে বিশেষ যায় টায় না, টিভি দেখে, ইন্টারনেটে বসে, বেশী রাত জেগে গল্পের বই পড়ে, খুব দরকার না হলে বেরোয় না কোথাও। আলোক জানে বউয়ের এই স্বভাব তাই সেও বন্ধুবান্ধবদের ফ্রাইডে নাইট পার্টি ইত্যাদিতে বিশেষ যোগ দেয়না, সেজন্যে বন্ধুমহলে তার বদনাম আছে।
    আজও সন্ধ্যেয় নীচে লন থেকে একটু আড্ডা মেরে এসে মেয়ের পড়ার ওখানে একবার উঁকি মেরে টিভি খুলে বসল। আলোক সেইমাত্র মোবাইলে কথা শেষ করেছে, দু একবার কফি কফি করে ঘুরল, রাই কানে নেয়না। শেষমেশ নিজেই কফি করতে গেল রান্নাঘরে। ল্যান্ডলাইনে ফোন বাজতে টিভি মিউট করে রাই বিছানার ওপর রাখা কর্ডলেসটা তুলে নেয়, অচেনা নাম্বারের ফোন।
    -'হ্যালো"।
    -"অভি বলছি"।
    অভি সাধারণত ল্যান্ডলাইনে ফোন করেনা, রাই একটু অবাক হল।
    -"কিরে, তুই কোথা থেকে? এতদিন কোথায় ছিলিস, বেপাত্তা?"
    -"আরে দুদিন হল ফিরেছি, এখন দিল্লীতেই আছি। মোবাইলটা কিসব গড়বড় করে সব নাম্বার গায়েব। তোর নাম্বার, আলোকের নাম্বার কিছুই নেই। আজ এই এতদিনে একটু ফুরসতে বসে মনে হল তোকে ফোন করা যাক। অ্যাড্রেসটা সার্চ দিয়ে ল্যান্ডলাইনের নাম্বারটা কম্পিউটারে দেখে লাগালাম। তোদের নাম্বারগুলো মেসেজ করে দিস তো।"
    -"কী আশ্চর্য? তুই রেনুকে ফোন করে আমার নাম্বার নিস নি কেন? আমি কত চিন্তা করছিলাম জানিস। এই নাম্বারটা কোথাকার?"
    -"এটা এই দিল্লী অফিসের নাম্বার, এখন কিছুদিন এখানেই আছি। ঠিক, রেনুর কথাটা মনে আসেনি আমার।"
    রাই আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বিষয়ে যায়,
    -"অভি, রায়পুরে সুন্দরনগরে কী হল রে?"
    -"আরে সেসব অনেক কথা, প্রচুর গাড্ডা আছে। এদিকে প্রেশারও প্রচুর। সুন্দরনগরের প্রজেক্টের পুরো মালিকানা ওমপ্রকাশের একার, আগরওয়াল ইনডাস্ট্রীর আর ভাইপোদের তাতে অংশ নেই। এদিকে ভাইপোরা তা মানতে রাজী নয়, তারা কোর্টে যাচ্ছে। ওর ছেলে আর বউ উকিলের সঙ্গে মিলে সুন্দরনগরে নিজেদের একজন লোককে ইন চার্জ করে জেনারেল ম্যানেজারের ওপর বসিয়ে দিয়েছে। তাতে সেই জি এম খেপে গিয়ে কাজকারবার সব প্রায় বন্ধ।
    ওদিকে সুন্দরনগর প্রজেক্টে কয়লার যোগানের জন্যে ওমপ্রকাশ অনেক চেষ্টা করে কোল ব্লক যোগাড় করে খনির কাজ শুরু করে। খনির দায়িত্বে ছিল অজিত আগরওয়াল। ওমপ্রকাশ বিদেশে থাকাকালীন খনিতে একবিন্দুও কাজ হয়না, শেষে সব কোল ব্লক ডিঅ্যালোকেট হয়ে যায়। ওমপ্রকাশের সেক্রেটারী তাকে সব জানাতে সে তড়িঘড়ি ফিরে আসে বিদেশ থেকে। তখন যা হবার হয়ে গেছে।
    সস্তায় কয়লা না পেলে সুন্দরনগর প্রজেক্টও বসে যাবে, কোনো লাভ থাকবেনা। একটা ক্রাইসিস তো তৈরী হয়েছিলই। এই কোল ব্লক গুলো ওমপ্রকাশ খুব সহজ ভাবে পায়নি, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, সরকারের ঘরে ঘোরাফেরা করে, সংশ্লিষ্ট সকলকে নানাভাবে তুষ্ট করে পেয়েছিল।'
    -"তা, অজিত আগরওয়াল কারণ কী বলেছিল খনিতে কোনো প্রডাকশন না হওয়ার পেছনে?"
    -"কী আবার! লেবার ট্রাবল, নতুন পার্টি বলে রাজনৈতিক দলের তোলাবাজ নেতারা ঝামেলা করেছে, মাওবাদীদের ভয়ে কাজের লোক পাওয়া যায়নি, এসব নানা বাহানা।"
    -"তোরা কী বার করলি তদন্ত করে? এগুলো সত্যি?"
    -"সত্যি মানে এই সমস্যাগুলো ঐ এলাকায় প্রত্যেক ইনডাস্ট্রী ফেস করে, খনি এলাকায় একটু বেশী, তা সত্বেও কাজ তো চলছে। এখনো আমরা বাইরে কাউকে বলিনি কোনো রিপোর্টে, কারণ এ ব্যাপারে কার যে কোথায় কী ইনফ্লুয়েন্স আছে খোদাই জানেন, তাই খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে। তোকে বলছি, আলোচনা করিস না কারো সাথে, পারলে আলোকের সঙ্গেও না। তদন্তে মোটামুটি জানা গেছে ওখানকার লোক্যাল বিরোধী নেতার সাথে অজিতের একটা যোগাযোগ ছিল। খনিতে ঝামেলা মূলত তার লোকেরা পাকিয়েছে অবশ্য কাজটা পুরো বেনামে এমনভাবে হয়েছে, লোকজনের মুখের কথা ছাড়া কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই।

    মেশিন খারাপ হয়ে গেছে, কনট্রাক্টররা কাজ নিয়ে না করে পালিয়ে গেছে, লেবার সাপ্লায়াররা এদের লোক দেয়নি। এই নেতাটি সুন্দরনগর প্রজেক্টেও মাঝে মাঝে ধরনা দেয় লোকজন নিয়ে, জমির আরো দাম দিতে হবে, যাদের জমি তাদের সবাইকে চাকরি দিতে হবে, এইসব নানা দাবীতে।
    এদিকে ওদের উকিল বা সুন্দরনগরের জি এম জানিয়েছে যে, সব দলের সঙ্গে কথা বলে, তাদের তুষ্ট করে, সবাইয়ের সহমতে ওমপ্রকাশ এই প্রজেক্ট শুরু করে। দিল্লীতে বিরোধী দলের চাঁইয়েদের সঙ্গে তার ওঠাবসা কিছু কম ছিলনা।
    এই স্থানীয় নেতাটি ইদানীংকালে ভোটে হেরে যাবার পর দলের কর্তাদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিল। এর নানা কাজকর্মে দলের ভাবমূর্তি নাকি খারাপ হয়ে যাচ্ছিল তাই দল থেকে ওখানকার এক আদিবাসী মাস্টারকে আজকাল নেতা হিসেবে, দলের মুখ হিসেবে, প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। যতদুর মনে হয় সেই কারণে নেতা লোকটি ক্ষেপে গিয়ে অজিতের সঙ্গে মিলে দলের নির্দেশ অমান্য করে খনিতে গন্ডগোল পাকিয়েছিল যাতে কোল ব্লক ডিঅ্যালোকেট হয়ে যায়।"
    -"কিন্তু কোল ব্লক ডিঅ্যালোকেট হলে ওমপ্রকাশের ক্ষতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অজিতের লাভ কোথায় তাতো বুঝলাম না। যদি সুন্দরনগর প্রজেক্টে ওদের ভাইয়েদের শেয়ার নাও থাকে তবু অন্যান্য ব্যবসার ব্যাপারে তো ওরা কাকার সঙ্গে যুক্ত। আর এসব বিজনেস হাউসে তো এরকম অনেক থাকে, এখানকার পয়সা নিয়ে ওখানে লাগায়, শেষমেশ সবই এক। শুনেছি ওদের স্টীল কারখানাই আসল, ওমপ্রকাশের বাবার তৈরী। তাতে নিশ্চয় সবার ভাগ আছে?"
    -হুঁ, এইসব ব্যাপারে আমরা কাল ওদের উকিলের সঙ্গে বসছি, ওমপ্রকাশের উইল নিয়েও কথা হবে। এছাড়া আমরা অ্যাক্সিডেন্টের আগে খনিতে গোলমালের সময় থেকে অজিতের সমস্ত গতিবিধি, ফোন কল এসব সংগ্রহ করছি। ওর ভাই অমিত এমনিতে নিরীহ, কাজেও তেমন দড় নয়।
    অজিত ভদ্রলোক কিন্তু কাজের, তবে আবার খরচেও প্রচুর, কথাবার্তায় যা মনে হয় কাকার হাততোলা হয়ে থাকাটা খুব একটা পছন্দ ছিলনা কিন্তু কাকার থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ব্যবসা করার মত এলেমও ছিলনা। ওদের পৈত্রিক স্টীল কারখানাও বেড়েছে সে ওমপ্রকাশের আমলে, তার মেহনতে।
    অজিতের বাবা একেবারেই নালায়েক ছিল, অনেকটা অমিতের মত, কুঁড়ে প্রকৃতির। আগরওয়াল বিজনেস এম্পায়ার পুরো ওমপ্রকাশেরই তৈরী। তবে যতদুর মনে হচ্ছে ওমপ্রকাশ মরে গিয়ে এদের লাভ কম ক্ষতি বেশী হয়েছে। উকিল যা মুখে বলছে বেশীরভাগই এখন ওমপ্রকাশের ছেলে বউয়ের হাতে যাবে আর তারা যদি এদেরকে সরিয়ে দেয় তাহলে এদের হাতে ঐ স্টীল ফ্যাক্টরির কিছু শেয়ার ছাড়া আর তেমন কিছুই থাকবেনা। ওমপ্রকাশের আমলে কম্পানির বড় বড় পোস্টে বসে, বোর্ডে ডাইরেক্টর হয়ে মাইনেই পেত কত, ঠাটবাট সে থেকেই চলত। "
    -"কিন্তু এসব তো আইনের ব্যাপার। তোদের আসল ব্যাপারটায় কী হল, ওমপ্রকাশের মৃত্যু রহস্য?"
    অভি একটু চুপ করল।
    -"সেরকম কিছু না পেলেও খটকার কারণ আছে। তবে ঐ যে বললাম ভাইপোদের তেমন লাভ দেখিনা বরং কাকা মরে ক্ষতিই বেশী। ওমপ্রকাশ রায়পুরে মূলত গিয়েছিল খনির ব্যাপারে। ওর সেক্রেটারী সব জানত, সেও নেই। যতদুর আঁচ করা হচ্ছে যে কোল ব্লক সব সম্ভবত আবার রি অ্যালোকেট হয়েছিল বিস্তর দৌড়াদোড়ি ও খরচের পরে। কিন্তু অ্যালোকেশন বা রিঅ্যালোকেশনের কোনো কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছেনা, সরকার পক্ষের কেউ এ নিয়ে মুখ খুলছেনা। কাগজ আদৌ ছিল কিনা কে জানে! আর এইসব ডীল অনেক শেডি হয়, যাই হোক কাগজপত্র না পেলেও ঝামেলা , আবার সেরকম হাতে পড়লে পেলেও ঝামেলা হতে পারে!

    সম্ভবত এত জরুরী কাগজপত্র ওমপ্রকাশ নিজের কাছেই রেখেছিলেন। অ্যাক্সিডেন্টের পরে ওদের মালপত্র থেকে কিছুই পাওয়া যায়নি।
    -"এই কাগজের খোঁজেই সেই দাসানি সেজে বা দাসানি এসেছিল জয়ন্তের কাছে?"
    -"হুঁ,এ নিয়ে তোর সঙ্গে পরে কথা বলব, বুঝিয়ে, ফোনে নয়। দেখি, পরশু আসব, উইকেন্ডে এখানেই থাকতে হবে মনে হচ্ছে। তখন সব বলব, তোর সেই মোতিলালের কেসও কিছুটা এগিয়েছে। চোরগোড়ে বেশ ভালো লোক, বুদ্ধিমান। আর এই অজিত আগরওয়ালের বন্ধু নেতাজীর মোতির মৃত্যুর সঙ্গেও কিছু সম্পর্ক আছে মনে হচ্ছে।"

    রাই খুশী হল, ওর কথামত মোতির ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে বলে। পরশু সামনে কথা হবে, অভি বেশী আলোচনা ফোনে আর করতে চায়না, তাও বলে,
    -"তাই নাকি? কিছু জানা গেল, লোকটা খনিতেই কাজ করছিল এতদিন?"
    অভি এক ধমক দেয়,
    -"এই, বললাম না পরশু গিয়ে বলব। তোর জন্যে ওখানকার পুলিশ সুপার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এদের অনেক তেল মেরে কথা বলতে হয়েছে যাতে চোরগোড়েকে এই কেস চালিয়ে যেতে দেওয়া হয়। সেটা নয়, তোর সঙ্গে আমি আগরওয়ালদের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই, আসলে সবটা আস্তে আস্তে আমিও জানছি এখন, জট পাকানো। ওদের পারিবারিক গন্ডগোল বা ঝগড়া আসল ব্যাপার নয়, আরো অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। তোর তো এসব ব্যাপারে মাথা ভালো চলে, সমস্ত তথ্যাদি জানলে যদি কিছু আইডিয়া আসে মাথায়। তবে একটা কথা, আমি আসার আগে তোকে ফোন করে টাইমটা বলে দেব,সন্ধ্যের দিকে। আমি চাইনা সেসময় আলোক থাকুক। ব্যাপারগুলো এমন যে যত কমলোকে জানে তত ভালো, নাহলে বিপদ আছে। আশাকরি তুই বুঝবি এবং সেইমত ব্যবস্থা করবি।"

    ফোন রেখে একযোগে খুশী হল ও চিন্তায় পড়ল রাই। খুশী কারণ অভি বেপাত্তা হয়ে যায়নি। টিভির ভল্যুম বাড়িয়েও অন্যমনস্ক হয়ে অভির কথাগুলো ভাবতে লাগল। এমন কী ব্যাপার যে অভি আলোককেও জানাতে চায়না? রবিবারের সন্ধ্যেয় নেমন্তন্ন টন্ন না থাকলে আলোক বাড়ি থেকে বেরোয় না একেবারেই। কোথায় পাঠাবে আলোককে? অভি আসবে আগে থেকে বলা চলবেনা, তাহলে আলোক অভির সঙ্গে আড্ডা মারবে বলে আরৈ কোথাও যাবেনা। ভাবতে ভাবতে মোবাইলে শ্রীমতীর নাম্বারটা ডায়াল করে।
    **************************
  • শ্রাবণী | 69.94.105.210 | ১৪ জুলাই ২০১৩ ১৪:১৮495907
  • *************************************
    বিকেলে চোরগোড়ে একা একা থানায় বসে আছে, কিঞ্চিত মনমরা। বিরজুকে বোধহয় আর ধরে রাখা যাবেনা। কোর্ট থেকে চারদিনের অর্ডার পেয়েছিল, কাল তার মেয়াদ শেষ। ওদিকে সন্তোষ মাস্টারদের দলের উকিল বেলের জন্যে খুব ছোটাছুটি করছে, পেয়ে যাবে। এইকদিনে কিছু জানা যায়নি। বংশী আর রামলাল জানিয়েছে সেদিন জীপের পেছনে বিরজু আর মোতি বসেছিল, এরা সামনের সীটে। ওদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, আদৌ কোনো কথা হয়েছিল কিনা কিছুই ওরা শোনেনি। মোতির গাঁয়ের কাছের বড় রাস্তায় ওরা তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। এদিকে নেতাজীও ফিরেছে তবে সুখের কথা যে রায়পুরের মিটিংয়ে কী হয়েছে কে জানে, তার হাঁকডাক এখন একেবারে শোনা যাচ্ছেনা। যা করার সন্তোষ মাস্টারই করছে। শোনা যাচ্ছে এবারে ইলেকশনে মাস্টারই দলের হয়ে দাঁড়াবে।
    নেতাজী একদিন এসেছিল বিরজুর সঙ্গে দেখা করে গেল কিন্তু তার দিকে বিষ নজরে তাকালেও মুখে কিছু বলেনি, তাই চোরগোড়ে আপাতত শান্তিতে আছে। সন্তোষ মাস্টার অন্য ধাতের মানুষ, চার গাঁয়ে শুধু ব্যবহারের জন্যেই লোকে তাকে ভালোবাসে। অনাথ আদিবাসী ছেলে মিশনারীদের অনাথালয়ে বড় হয়েছে, পড়াশোনা শিখে এখন স্কুলের মাস্টার হয়েছে। এখানকার আদিবাসী গ্রামের লোকেরা মাস্টারকে নিজের লোক ভাবে, এমনি অন্য জাতের বাসিন্দারাও পছন্দ করে, মূল্‌ত নেতাজীর অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ আর সৎ রাজনীতিক এদিকে তেমন কেউ নেই । শাসক দলের যিনি তিনিও বাইরের লোক, বাইরে বাইরেই থাকে। সব মিলিয়ে পরের বার এ এলাকায় সন্তোষ মাস্টারের পাল্লা ভারী আর নেতাজী বেকায়দায়।
    -"স্যর, বাবুলাল এসেছে"।
    বাবুলাল থানার ইনফর্মার, খনি এলাকাতে মোতিলালের খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিল ওকে। চোরগোড়ে নড়েচড়ে বসে, বাবুলাল কাজের লোক, কাজ না হলে এমনি এমনি আসেনা। শান্তশিষ্ট মানুষটি, ভিড়ে নজরে পড়বেনা, যে কোনো জায়গায় যে কোনো ধরণের মানুষজনের মাঝে খাপ খেয়ে যায় এমন চেহারা। ভেতরে ভেতরে চোরগোড়ে জানে বাবুলালের মত তীক্ষ্ম নজর আর ক্ষুর বুদ্ধির লোক এই এলাকার এতগুলো থানার মধ্যে আর একটাও আছে কিনা সন্দেহ। বাবুলাল একা ভালো কাজ করে, দশজনের সাথে মিলে কাজ করতে পারেনা তাই চোরগোড়ে এ কাজে ওকে একা পাঠিয়েছিল। ঘরে ঢুকে "প্রণাম স্যর" বলে বেির এককোণে বসল। চোরগোড়ের তর সয়না,
    -"কী হে কী খবর? পেলে কোনো হদিশ?" ধীরে সুস্থে পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছে বাবুলাল বলে,
    -"খবর তো আছে সাব, আগে চায়ে হো জায়।"
    চোরগোড়ে ওর দিক থেকে চোখ না সরিয়ে বাইরে কনস্টেবল কে হাঁক দেয় দুকাপ চা পাঠানোর জন্যে। চা খেয়ে টেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাবুলাল দরজাটাকে আলতো করে ভেজিয়ে দিয়ে চোরগোড়ের টেবিলের কাছে আসে।
    -"স্যর, মোতি খনি এলাকার বস্তিতে থাকতনা। ওদিককার সব বস্তিতে খবর নিয়েছি, সবাই বলেছে এরকম লোক কেউ তাদের ওখানে ছিল না। কোলিয়ারীর কাজের জায়গায় মজদুরদের, একটু নীচুতলার কর্মচারীদের কেউ ছবি দেখে ঠিকঠাক চেনেনি ওকে। কাজ করতে গেলে কেউ না কেউ দেখবেনা বা দেখে চিনবেনা এ হতে পারেনা।"
    চোরগোড়ে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলনা, ওর কেমন ধারণা হয়েছিল কোলিয়ারীর দিকে খোঁজ করলে মোতির কিছু না কিছু খবর মিলবেই। কেমন নিজের মনেই বলে ওঠে,
    -"তাহলে কয়লার গাড়িতে লাশ এল কিভাবে, এ গাড়ীর তো দাঁড়াবার কোন ঠিকঠিকানা থাকেনা, তার মানে কি প্ল্যান করে ফেলেনি লাশ, রাস্তায় গাড়ি দেখে ফেলে দিয়েছে!"
    বাবুলাল মুখে একটু চু চু শব্দ করে,
    -"এমন হয় না স্যর। বেশীরভাগই লোকে যখন খুন করে তখন তার আগে লাশকে ঠিকানা লাগাবার কথা ভেবেই করে। মোতির লাশকে এত ভালোভাবে ঠিকানা লাগিয়েছিল, একটুর জন্যে গন্ডগোল হয়ে গেল। হাতরি গাঁয়ের ঐ ঠিকে মজদুর ওদিন বিদ্যুতনগরের কয়লা আনলোডিংয়ের কাজে না থাকলেই আর কোনো সমস্যা হত না। বেওয়ারিশ বলে লাশ আপনি চালান করে দিতেন আর মোতির ঘরের লোক ভাবত সে শহরে পালিয়ে গিয়ে আবার নতুন সংসার ফেঁদেছে। "
    -"সেই তো। তাহলে কি কোনোভাবে ওকে মাইনের ঐদিকে নিয়ে গিয়ে মেরেছে? মোতির পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়েছি, তাকে খালিহাতের এমন কায়দায় ঘাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। এরকম মিলিটারী কম্যান্ডো ট্রেনিংয়ে শেখানো হয়, হ্যাণ্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট। এখানকার লোক এমন কায়দা জানল কী করে? অবশ্য মোতির শরীরে অ্যালকোহল পাওয়া গেছে, সম্ভবত সে নেশার অবস্থায় ছিল তাই খুনী তাকে সহজে ঘায়েল করতে পেরেছে।"
    -"স্যর আপনি তো আমার পুরো কথা শোনেননি এখনো, পুরোটা শুনুন।"
    -"ঠিক আছে বল, তবে একটা কথা, খোঁজ পেয়েছ কি?"
    বাবুলাল দেখল চোরগোড়ের হতাশা আর উত্তেজনার মাঝের এক অবস্থা, সে তাই দেখে বেশী আর এদিক ওদিক না করে বলে,
    -"খোঁজ একটা পেয়েছি, নাহলে আপনার কাছে আসতাম নাকি?
    ঘুরতে ঘুরতে সুন্দরনগরের আগরওয়ালদের বন্ধ হয়ে যাওয়া কোলিয়ারীতেও গিয়েছিলাম, সেখানে কাজ হচ্ছেনা বলে এখ্ন লোক কম থাকে। তারা মোতির ফোটো দেখে শনাক্ত করেছে বনোয়ারীর সঙ্গে দুএকবার আসতে দেখেছে বলে। বনোয়ারী সেখানে মাঝে মাঝে যেত, যতদুর সম্ভব, খনি সংক্রান্ত খবরাখবর লেনদেন করত নেতাজীর হয়ে।
    নেতাজী ওই খনির গন্ডগোলের মূলে এরকমটা ওখানে সবাই মনে করে, অবশ্য মুখ ফুটে কেউ বলেনা একথা। তা যাইহোক খনিতে খবর নেওয়া শেষ হলে আমি কাছেপিঠের গ্রামগুলোতে খোঁজ নিই।
    কুশমুন্ডার ওদিকে খনি এলাকা থেকে পনের কিলোমিটার দুরে জঙ্গল যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে আদিবাসীদের একটা বসতি আছে। বেশী না পনের কুড়ি ঘর লোক হবে। এমনিতে এ অঞ্চলে বদনাম যে ঐ বসতির লোকেদের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগ আছে। সেজন্যে ওরা যেখানে কাজ করতে যায় সেখানকার লোকে ওদের বেশী ঘাঁটায়না, খনিতে কাজ করলে অন্যদের মত ওদের পয়সা কাটেনা ঠিকাদার, পুরো পয়সা দিয়ে দেয়।
    ওরাও আশেপাশের লোকজনের থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে চলে, আলাদা আর নিজেদের মধ্যে জোট বেঁধে থাকে, এককাট্টা। এমনিতে সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে তারা সবাই না বলে দেয়, মোতিকে কেউ চিনতে পারেনা। ওদের দু একজন মোড়ল গোছের লোকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে, গেলে খুব খাতির করে।
    সবাইকে ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞেস করে একটা ঘরে যাই, সেখানে খালি এক বাচ্চা ছেলে আর তার মা ছিল। মা কিছু বলার আগেই ছেলেটা আমাকে একটু দুরের একটেরে একটা চালা ঘর দেখিয়ে বলে ছবির লোকটা ঐঘরে থাকত।
    ওর মা কেমন ভয়ার্ত মুখে সঙ্গে সঙ্গে ওকে ধরে চুপ করিয়ে কথা ঘুরিয়ে দেয়। আমিও এটা নিয়ে আর জোর করিনা, চলে আসি। পরের দিন সবাই কাজে বেরিয়ে গেলে চুপিচুপি গিয়ে সেই ঘরটা দেখে আসি, খালি, বাঁশ আর মাটি দিয়ে তোলা, পাতার ছাউনি। কিছু না থাকলেও কেমন মনে হল অল্পদিনই খালি হয়েছে, কিছুকাল আগেও সেখানে কারুর বাস ছিল।
    আমি আমার বন্ধু মোড়লদের ঐ ছেলেটির কথা তুলে এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করি, কোনো কারণে ওরা আমার কাছে কথা লুকোচ্ছে কিনা। এমনি ওরা জানেনা আমি পুলিশের লোক, শুধু জানে আমি অনেকের দরকারে সংবাদ সংগ্রহ করে তাদের সাহায্য করি। তা তারা না বললেও পরের দিকে এমনভাবে কথা বলছিল, অকারণে রূঢ় হয়ে, নার্ভাস হয়ে গিয়ে, তাতে আমার দৃঢ় ধারণা যে মোতি ঐ খালি ঘরেই বাস করতে।
    খোঁজ নিয়েছি সেদিন বিদ্যুতনগরের কয়লাও এসেছিল কুশমুন্ডা থেকে।"
    এত কথা বলে বাবুলাল চুপ করল। চোরগোড়ে কিছুক্ষণ চুপ, তারপরে বলে
    -"তুমি ঘরটা ভালো করে দেখেছো? কিছু পাওনি, কোনো সূত্র?"
    -"না সাব, আজ এতদিন হয়ে গেল, পরিস্কার লেপাছোপা হয়ে গেছে। সেটাও একটা ব্যাপার বটে। কেউ না থাকলে ঘর অমন পরিস্কার হল কী করে? একটা বিড়ির টুকরোও নেই, জঙ্গলের কুকুর শিয়ালের আসার চিহ্নও নেই।"
    -"আমি বুঝতে পারছি তুমি কোন বস্তির কথা বলছ। খুব স্পর্শকাতর এলাকা, সেখানে আমরা পুলিশ গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তা নিয়ে হইচই হতে পারে। কিন্তু যদি তোমার কথা ঠিক হয় তাহলে মোতি ওখানে পৌঁছল, ওদের ওখানে আশ্রয় পেল কোন সুবাদে? সে তেমন আদর্শবান তো ছিলনা, মদ খেত, বনোয়ারীর দলে ভিড়ে হয়ত অল্পস্বল্প বজ্জাতিও শিখছিল, সে হঠাৎ মাওবাদীদের দলে ভিড়তে যাবে কেন?
    এক হতে পারে বস্তির লোকেদের টাকাপয়সা দিয়েছিল মোতি নিজে বা তার হয়ে অন্য কেউ। তাহলে এরা এখন সত্যি কথাটা বলছে না কেন, টাকা নিয়ে থাকতে দেওয়া তো দোষের নয়? এরা জানে তো মোতি মারা গেছে? তবে কী তার মৃত্যুতে এদের হাত আছে?"
    -"হ্যাঁ, আমি বলেছি। লাশ পাওয়া গেছে, তাই তার ঠিকানা খুঁজছি আমি, ঘরের লোকজনকে খবরটা দিতে হবে তো। অবশ্য যতই হোক, গাঁঘরের লোক তায় আদিবাসী মনে ঘোরপ্যাঁচ সেই অর্থে নেই। আমার কাছে মোতির পাসপোর্ট সাইজের ফোটো দেখেও সন্দেহ করেনি বলেই মনে হয়। নাহলে আমাকে ওখানে আর বারবার ঢুকতে হত না।
    তবে ওরা মোতিকে খুন করলে তার নিশ্চিত কারণ থাকবে, অন্তত ওদের হিসেবে আর লাশ কয়লার গাড়িতে ফেলে গায়েব করতেও হবেনা। এত ভয়ও পেতনা, তৈরী থাকত তদন্ত হলে মোকাবিলার জন্যে। "

    চোরগোড়ের এমনিতে কোনো নেশা নেই, পান বিড়ি বা মহুয়ারও। তবে আজ অন্যমনস্কেই বাবুলালের বাড়ানো হাতের বিড়ি নিয়ে ধরায়। এক একটা জানালা খুলে গিয়ে আরো বন্ধ জানালার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। মোতি লুকিয়েছিল কেন? তাকে মারলই বা কে?
    বাবুলালের কথা সত্যি হলে মোতির লুকোনোতে নেতাজী বা বিরজুদের কোনো হাত থাকতে পারেনা। ঐ আদিবাসী বস্তির লোকেরা নেতাজীদের মত নেতাদের অত্যাচারে তিতিবিরক্ত হয়েই বিদ্রোহী হয়েছে, তারা সেই নেতাজীর ব্যবস্থাপনায় মোতিকে আশ্রয় দেবেনা।

    বাবুলাল বসে বসে কীসব বলতে লাগল তাদের পুলিশদের কীর্তিকাহিনী। চোরগোড়ে শুনছিল না, একটা লোকের ধূর্ত মুখ ভাসছিল খালি তার মনে, বনোয়ারী।
    বনোয়ারী জেলে থাকলেও কোনোভাবে তার যোগসাজশ আছে এই সব ব্যাপারে। সে মহা চতুর লোক, নানা ধান্দা করে, ধান্দার কারণে যেমন তার নেতার সঙ্গে দহরম, ঠিক সেভাবেই মাওবাদীদের সঙ্গেও দহরম হতে বাধা কোথায়? তার ট্রাকে বে আইনী জিনিসপত্র পাচার করে, জঙ্গলে ঘোরাঘুরি, এসব মাওবাদীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলে এ অলে করা শক্ত আছে। সম্ভবত বনোয়ারীর কোনো কাজেই মোতি গা ঢাকা দিয়েছিল এবং সেই অনুযায়ী মাওবাদীদের ধরে ঐ বস্তিতে তার থাকার ব্যবস্থা।
    বনোয়ারীকে আর একবার জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা মনে এনেও নাকচ করে দেয়। মহা পাজী, এর আগের দিনেই বোঝা গেছে, কিছুতেই কিছু বার করা যাবেনা।
    -"বাবুলাল।"
    বাবুলাল কী একটা বলছিল, কথা থামিয়ে সাড়া দেয়,
    -"সাব।"
    -"বনোয়ারীকে চিনিস তো?"
    -"হ্যাঁ, খুব সেয়ানা আদমী।"
    -"জেলের মধ্যে থেকে মোতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে কী ভাবে করবে, আন্দাজ করতে পারিস।"
    -"অন্য কোনো লোকের মারফতে করবে। মোতি কে যারা মেরেছে তারা মোতির হদিশের জন্যে জেলে নজর রাখবে, মোতি নিজে বনোয়ারীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ঝুঁকি হয়ে যেত।"
    -"ঠিক। দুটো ব্যাপার হতে পারে। এক, মোতিকে যারা বা যে মেরেছে সে বা তারা মোতির পাত্তা জানত না, তাদের হাত থেকে বাঁচতেই মোতি গা ঢাকা দেয়। দ্বিতীয় হল, মোতি গা ঢাকা অন্য কারণে দিয়েছিল, অন্য কোনো গন্ডগোল হয়ে তাকে কেউ খুন করেছে। যদি দ্বিতীয় কারণ হয় তবে মোতির প্রাণের ভয় ছিলনা, তাই বনোয়ারীর সঙ্গে দেখা করায় বাধা ছিলনা। তবে প্রাণের ভয় না থাকলেও মোতি জেলে আসবেনা, কোনো কারনে সে বাড়িতেও আসেনি, বউ বাচ্চার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, অতএব ধরে নেওয়া যায় সে জেলে আসেনি। তার সঙ্গে যোগাযোগ গোপনে রাখবে আর তাই জেলের সরকারী বন্ধুদের সাহায্য বনোয়ারীর মত চালাক বান্দা নেবেনা। বাকী রইল কে?"
    -"বনোয়ারীর বাড়ির লোক। তার বাপ ভাই?"
    বাবুলালের বুদ্ধি নিয়ে চোরগোড়ের কোনো সন্দেহ ছিলনা। সে তাও প্রশংসার চোখে তাকালো,
    -"বাড়ি থেকে বনোয়ারীর বাবা নিয়মিত যায় ওর সঙ্গে দেখা করতে। আমি জেলরের কাছে জেনেছি।"
    -"বনোয়ারীর বাপকে থানায় ডেকে কড়কে দিন, বুড়ো ঠিক সব বলে দেবে।"
    -"হতে পারে আবার নাও হতে পারে। সে বনোয়ারীর বাপ হলেও যদি বনোয়ারী মনে করে তার বাপকে কেউ কড়কালেই সে গলগল করে সব বলে দেবে তাহলে তার কোনো গোপন কাজে সে বাপকে নেবেনা। বনোয়ারী খুব কানুনী, সম্ভবত তার বাপও ওরকম, হতে পারে বজ্জাতিতেও ছেলের মত, সেক্ষেত্রে কিছু লাভ হবেনা। তার চেয়ে তুমি একবার চেষ্টা করে দ্যাখো। কোনো ছুতোয় যদি ওর সাথে আলাপ করে মদ টদ খাইয়ে কিছু সন্ধান পাও। আর একটা কাজ করো।
    মোতির শ্বশুরের সঙ্গেও একটু কথা বলতে চেষ্টা করো। সেদিন হাতরিতে পঞ্চ বসেছিল, মোতির সম্পত্তি নিয়ে। একজন এসে আমায় জানিয়ে গেছে সব কথা।
    মোতি সেদিন জড়িবুটির ওষুধ নিয়ে কাকে ঘুম পাড়াতে গেছিল কে জানে? ওসময়ের এরকম কোনো অপরাধের খবর তো আমাদের কাছে নেই। পুরো ব্যাপারটাই কেমন ধোঁয়াশা।

    সব শুনে মনে হচ্ছে, মোতির বউ ঠিক গাঁ ঘরের আর পাঁচটা মেয়েবউয়ের মত নয়, বুদ্ধি আছে, একটু দজ্জালও। তার বাপ ভালোমানুষ, মেয়েই তাকে চালায়। হয়ত বউটা মিথ্যে কথা বলেছে, মোতি হয়ত ওদের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। তাই ওদিকেও একটু খোঁজখবর করা দরকার, শ্বশুরটার কাছ থেকে অসাবধানে কথা বেরোলেও বেরোতে পারে।"
    বাবুলাল তার কাজকে ভালোবাসে, প্রাণ দিয়ে, মাথা খাটিয়ে করতে চেষ্টা করে। সাহেব তাকে এত দায়িত্ব দিচ্ছে, সেও সাহেবকে নিশ্চিন্ত করে বেরিয়ে গেল, খবর কিছু থাকলে, তার হাত এড়িয়ে যেতে দেবেনা সে কিছুতেই!
  • netai | 131.241.98.225 | ১৫ জুলাই ২০১৩ ১৪:৫০495908
  • আমিও শেষ হলে একসাথে পড়বো।
    একটাই রিকোয়েস্ট- তাড়াহুড়ো করে শেষ কোরোনা।
  • ঐশিক | 24.140.33.186 | ১৫ জুলাই ২০১৩ ১৬:৫৯495909
  • শ্রাবনিদি দারুন লাগছে!!!!! আপনি ধীরে ধীরে লিখুন কোনো তাড়া নেই
  • de | 69.185.236.51 | ১৬ জুলাই ২০১৩ ১৩:২২495910
  • হ্যাঁ, তবে বেশীদিন হয়ে গেলে তোমার নিজেরই তাল কেটে যাবে -- তাই চলতে থাকুক!
  • শ্রাবণী | 69.94.106.177 | ১৬ জুলাই ২০১৩ ১৫:১৬495911
  • তাড়াহুড়ো কারে কয়?
    আমার লেখা ফেলে রাখতে ভালো লাগেনা, আর রহস্য গল্প অনেকদিন ধরে লেখা খুব টাফ। ঠিক করলাম রিটায়ার করা অবধি যদি গুরুতে থাকি তবেই আবার এইরকম লিখতে যাব।
    আর এই জ্বরের সপ্তাহে শেষ না হলে আবার ধরা খুব মুশকিল হবে। নিতাই বরং রুবিকে দিয়ে মুখরোচক বানিয়ে দিয়ে যা, মুখে কিচ্ছু ভাল্লাগছে না, বানানোরও শক্তি নেই!:)
    (খবর্দার আসিসনা এখন, আমাদের দুজনেরই ভাইর‌্যাল, আজ থেক ইনিও পড়েছেন)।
  • শ্রাবণী | 69.94.106.177 | ১৬ জুলাই ২০১৩ ১৫:১৯495912
  • *রুবিকে দিয়ে মানে রুবির সোনা হাত দিয়ে বানানো!
    *থেকে
    সবাই পড়া শেষের জন্যে তুলে রাখলে কেমন হচ্ছে বুঝব কেংকয়ে আর প্লট পাল্টাবোই বা কী করে? :(
  • শ্রাবণী | 69.94.106.177 | ১৬ জুলাই ২০১৩ ১৬:৩০495913
  • **************************************
    অভি এল সন্ধ্যের ঠিক মুখটাতে। আসার আগে ফোন করেছিল, আলোক তখন বেরিয়ে গেছে। শ্রীমতী তাতাইকে নিয়ে গেছে সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে, মিউজিক স্কুলের কোন একটা প্রোগ্রামে, মিউজিক টীচারের অনুরোধ ফেলতে পারেনি, টিকেট কিনতে হয়েছে। তাই আলোককে ফোন করে অনুরোধ করেছিল যদি সন্ধ্যে থেকে তারা না ফেরা পর্যন্ত ওদের বাড়িতে জয়ন্তর সঙ্গে কাটায়। জয়ন্ত অবশ্য এসব ব্যবস্থার কথা জানেনা। আলোক এমনিই ছুটির দিনে বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে এসেছে ভান করবে, শ্রীমতী বার বার বলে দিয়েছে সে যে আলোককে আসতে বলেছে এটা যেন জয়ন্তকে না জানানো হয়। অভির আসার কথা শুনে আলোক একটু মনমরা, অভির বিচিত্র কর্মকান্ডের গল্প তার খুব প্রিয়, নিজের বাড়ির দারুন আড্ডাটা মিস করবে বলে।

    অভিকে একটু অধৈর্য, একটু চঞ্চল মনে হল রাইয়ের। এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে প্রথমে স্বীকার করেনা তারপর বলে,
    -"হয়ত। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কেসটা শেষ করে নিজের কাজে ফিরতে চাই। এইসব পলিটিক্যাল ঝামেলা আমার একদম পছন্দ নয়।"
    -"কিন্তু ওমপ্রকাশের মৃত্যু তদন্তে এত পলিটিক্যাল প্রেশার কেন আমি সেটাই বুঝছিনা। বড় বাড়ির আভ্যন্তরীন পারিবারিক ঝামেলা তো কোর্টে যাবে এবং শেষমেশ মিটেও যাবে একদিন। তুই যা বলছিস সে হিসেবে তো ওমপ্রকাশের ছেলে বউ ভালো অবস্থায় আছে, সুন্দরনগরে লোক বসিয়ে দিয়েছে। ও ভালো কথা, জয়ন্ত অফিসে যোগ দিচ্ছে শীগগির, শ্রীমতী বলল, ও নাকি সুন্দরনগর প্রজেক্টেই কাজ করছিল।"
    অভি একটু সময় নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে চপে কামড় দেয়।
    -"আসল কথাটা তোকে গুছিয়ে একসাথে বলি এবার, ফোনে আভাস দিয়েছি, তুই হয়ত কিছুটা জানিস ইতিমধ্যেই। ওমপ্রকাশের কাছে কিছু কাগজপত্র ছিল কোল ব্লক অ্যালোকেশন ও রি অ্যালোকেশন সম্বন্ধীয়।
    এই কাগজপত্র কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। ওমপ্রকাশ ওগুলো নিয়ে রায়পুর আসছিল, তার রায়পুরে কিছুদিন থেকে খনিতে আবার কাজ শুরু করানোর বন্দোবস্ত করার কথা ছিল। আর ওরকম গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল ওমপ্রকাশ কখনো কাছছাড়া করবে মনে হয় না, তাই নিশ্চিত যে ওগুলো ওদিন ওনার সাথেই ছিল। অফিশিয়ালি এ কথা কেউ আলোচনা করেনা তবে যতদুর আন্দাজ করা যায়, ইদানীং কয়লা অ্যালোকেশন নিয়ে একটা চাপা টেনশন চলছে রাজনৈতিক মহলে, এই অবস্থায় ঐ কাগজপত্র বিরোধীদের হাতে পড়লে সরকার সমস্যায় পড়বে। কিন্তু কাগজগুলো অদ্ভুত ভাবে উধাও হয়ে গেছে। আমাদের শুধু ওমপ্রকাশের মৃত্যুর তদন্ত নয়, কাগজ খুঁজে বার করার কাজও করতে হবে। তবে একটাই আশার কথা যে বিরোধীরাও এখনো এরকম কোনো কাগজ হাতে পায়নি।"
    -"অভি, ঐ দাসানির ব্যাপারটা কী?"
    -"আরে ওটা একটা ফালতু ব্যাপার। সরকারী আদেশে খুব গোপনে কাগজগুলোর পাত্তা লাগাবার চেষ্টা করছিল গোয়েন্দা বিভাগের ওপরতলা। ওরাই জয়ন্তকে সন্দেহ করছিল, তার দিকে নজর রেখেছিল। আসলে ঐ অ্যাক্সিডেন্টে জয়ন্ত একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। পুলিশের গোয়েন্দার পরিচয়ে এসে লোক জানাতে চায়নি বলে নকল বেসরকারী গোয়েন্দা সেজে এসেছিল, আসল পুলিশের লোক। যে ভদ্রলোক এসেছিল সে দাসানির পরিচিত, ওর কার্ড নিয়ে এসেছিল। তবে ওরা ভাবেনি যে জয়ন্ত ক্রস চেক করবে। তেমন হলে ওরা দাসানিকে কোন একটা অজুহাতে শিখিয়ে পড়িয়ে রাখত। আসলে যত কম লোকে জানে এ ব্যাপারে ততই ভালো। আমি ওদের ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে অবশ্য ওদের দাসানির সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে গেছে। এবার কেউ ফোন করলে দাসানি আর অস্বীকার করবে না।
    ইন ফ্যাক্ট আমারও এটা একটু অদ্ভুত লাগছে জয়ন্ত ওদের সন্দেহ করল কেন! আমি রায়পুরে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছি ভালো করে, জয়ন্তকে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তখন শক বা ট্রমা থেকে তার পার্শিয়াল মেমরী লস মত হয়েছে। কিছুই নাকি বলতে পারছিলনা, শুধু নিজের নামটা ছাড়া। তবে ডাক্তারদের মতে এটা একটা সাময়িক সমস্যা ছিল, পরে মানে এখন ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। আবার এও হতে পারে যে অ্যাক্সিডেন্টের মুহূর্তের কথা ও এখনো মনে আনতে চায়না তাই মনে পড়ছেনা। কিন্তু তুই গুরুত্বটা বুঝতে পারছিস রাই, জয়ন্ত আমাদের এই জট খোলার এক ভাইটাল ক্লু। অ্যাক্সিডেন্টের সাইট থেকেই কাগজপত্র গায়েব হয়েছে।"
    -"কিন্তু জয়ন্ত তখন অজ্ঞান ছিল, সে কেমন করে জানবে তখন কে এসে কাগজ সরিয়েছে।"
    -"তুই ভালো করে ভেবে গোয়েন্দার মত কথা বলছিস না রাই। শুধু অ্যাক্সিডেন্টের পরের কথা ভাবছিস।"
    -"না রে আমি ভাবছি, তবে গোয়েন্দার মত কিনা জানিনা। যদিও তোর এ কেসটা আমায় তেমন টানছেনা তবু এনিয়ে যথেষ্ট ভেবেছি আমি। জয়ন্ত কাউকে অন দ্য স্পট কাগজ সরাতে না দেখলেও এই সম্পর্কীয় কিছু ওর জানা উচিত ছিল কারণ যদি কাগজ চুরি অ্যাক্সিডেন্ট ও হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার মাঝের সময়ে হয়ে থাকে তাহলে এটা একটা কাকতালীয় ঘটনা হবার চান্স কম। আমার মনে হচ্ছে অ্যাক্সিডেন্ট হবে যে এমনটা জানা ছিল মানে আগাম পরিকল্পনা ছিল এবং স্পট থেকে কাগজ সরানো হবে সেটাও ঠিক ছিল। এর মধ্যে শুধু একটাই ঘটনা পরিকল্পনার বাইরে হতে পারে তা হল জয়ন্তর ঐ গাড়িতে লিফট নেওয়া।"
    অভিনবকে এবার অনেক চাঙ্গা লাগল, হেসে বলল,
    -"গ্রেট, তুই আমার লাইনেই ভাবছিস। জয়ন্ত কে কেন সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল পুলিশ বুঝতে পারছিস নিশ্চয়ই। ও কিছুটা পথ চলেছিল, কিছুই কি ওর চোখে পড়েনি বা অস্বাভাবিক লাগেনি?"
    -"কিন্তু তুই আমাকে একটা কথা বল, এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অথচ এতদিন ফেলে রাখা ছিল, সেরকম ভাবে কোনো তদন্ত হয়নি কেন? ওমপ্রকাশের বউ ছেলে এসে তার মৃত্যুর তদন্ত না চাইলে তোরা কাগজ নিয়ে মাথা ঘামাতিস না?"
    -"গুড পয়েন্ট। সত্যিই প্রথমে কেউ সন্দেহ করেনি। এই কয়লার ব্যাপার নিয়ে গন্ডগোলের আশংকা সরকারে, এটাও একেবারে হালের ঘটনা। ওমপ্রকাশের বউ ছেলে দেশে আসার পরে সুন্দরনগর প্রজেক্ট নিয়ে কথা উঠলে তখন কোল ব্লকের খোঁজ পড়েছে। সরকারের এক বিভাগের গোপনীয় ব্যাপার সাধারণত অন্য বিভাগেরও ঠিকমত জানা থাকেনা। প্রথমে ভাবা হয়েছিল কাগজপত্র ভাইপোদের কাছে বা উকিলের কাছে আছে। আসলে যে কয়লা সংক্রান্ত কোনো কাগজের কোনো হদিশ নেই সেটা ভালো করে বুঝে উঠতে সময় চলে গেছে। এবার সেটা কতটা জরুরী কারণ বিরোধীরা এইসব ডকুমেন্ট হাতে পেলে বিপদ হতে পারে, তাও পরেই ভাবা হয়েছে। সরকারী চাপ আসার পর আমরা পুলিশের লোকেরা কাজ শুরু করেছি।

    এতটা সময় পেরিয়ে গেছে এও একটা সমস্যা তদন্তের ক্ষেত্রে। ছত্তিশগড়ের স্থানীয় পুলিশ ঐ অ্যাক্সিডেন্টটার সেরকম কোনো তদন্তই করেনি। ট্রাকটাকে খোঁজার কোনো চেষ্টা করেনি। গাড়িটা দেখে আমাদের ফরেন্সিক টীম মোটামুটি ট্রাকটার কী কী ড্যামেজ হতে পারে তার একটা স্কেচ বানিয়েছে। এটা তখনই করে ফেললে ট্রাকটাকে খুঁজে পাওয়া সহজ হত। এখন খোঁজ করা হচ্ছে কিন্তু কোনো খবর নেই, মাস আষ্টেক হয়ে গেছে, কোনো গ্যারাজই কিছু বলতে পারছেনা।"
    -"ট্রাকটা ড্যামেজ হলেও চলার অবস্থায় ছিল, অচল হয়ে পড়েনি। অতএব আমার মনে হয় সেই রাতে নির্ঘাত ট্রাকটা বর্ডার পেরিয়ে উড়িষ্যা নয় এম পি তে গিয়ে পরে কোথাও চেনা কোনো গ্যারাজে সারিয়েছে। অথবা মহারাষ্ট্রেও ঢুকে পড়তে পারে। তোরা এখন কোথায় কোথায় খুঁজবি? এমনও তো হতে পারে ট্রাকটা কোথাও বেওয়ারিশ ফেলে চলে গেছে, কোনো জঙ্গলে।"
    -"সেভাবে নয়, আমরা খোঁজ করছি হাইওয়ে ধরে ধরে। বড় পাঞ্জাব লরী, সম্ভবত হাইওয়ে ধরেই গেছে, ছোট রাস্তায় যেখানে এধরণের গাড়ি দেখা যায়না সেখানে ঢুকে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে মনে হয়না। জঙ্গলের কথাও মাথায় আছে, সবরকমই খোঁজ হচ্ছে।
    যাইহোক, অ্যাক্সিডেন্টের একটা মোটিভ পাওয়া যাবার পর এখন আমরা খুব ভালো করে খুঁটিয়ে ওদিকটায় তদন্ত করছি। অজিত আগরওয়ালের মোবাইলের কল ট্রেস করে ও ওর অ্যাক্সিডেন্টের আগের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেলসে কিছু গড়বড় পাওয়া গেছে। কয়েকটা ইনস্টলমেন্টে কিছু টাকা জমা হয়েছে যার কোনো হিসেব নেই। অবশ্য টাকার পরিমাণ খুব বেশী নয় তবু এটা যদি কোনো ডীলের হোয়াইট টোকেন অ্যামাউন্ট হয়।"
    -"তোরা অজিতকে সেভাবে ধরছিস না কেন? খনির দায়িত্বে ও ছিল, গন্ডগোলও সম্ভবত ওরই করানো তাহলে অ্যাক্সিডেন্টও ঐ করিয়েছে।"
    -"তোর কী মনে হয় সাধারণ চোর ছ্যাঁচড়দের মত এদের মত সমাজের ওপরতলার লোকেদের থানায় ধরে এনে লক আপে পুরে থার্ড ডিগ্রী দিয়ে দোষ স্বীকার করানো যায়? কাকার তুলনায় ভাইপোদের ধনসম্পত্তি কম হলেও আমাদের হিসেবে এরা ধরা ছোঁয়ার বাইরের লোক। উকিল নিয়ে এসে আমাদের এমন অবস্থা করবে যে ওর কিছু হোক না হোক আমাদের কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে।
    তবে হ্যাঁ,সঠিক সাবুদ প্রমাণ দেখিয়ে যদি এদের ধরতে পারি তাহলে উন্নতি কেউ রুখতে পারবেনা। লাভ বেশী বলে ঝুঁকিও বেশী আর তাই খুব সাবধানে কাজ করতে হবে।"

    রাইয়ের কী যেন মনে পড়তে বলে,
    -"জানিস অভি, শ্রীমতীর সঙ্গে কথা বলে আমার কেমন মনে হচ্ছে জয়ন্তের এই অফিসে যোগ দেবার ব্যাপারে ওর মনে খটকা লাগছে।"
    -"খটকা। কেন? এতো ভালো কথা, ওর তো আনন্দ হওয়া উচিত। তোর এই বান্ধবী কি একটু স্যাডিস্ট নাকি রে?"
    -"না, পুরোটা শোন না আগে। জয়ন্ত এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়, তাতেই আগরওয়ালরা ওকে প্রায় জামাই আদরে আবার ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ ওদের নিজেদেরই এখন তুই যা বলছিস তাতে টালমাটাল অবস্থা, অনিশ্চিত ভবিষ্যত। কোল ব্লক না পেলে সুন্দরনগর প্রজেক্ট লাভ করতে পারবেনা, প্রজেক্টের মালিকানা নিয়েও প্রশ্ন অথচ জয়ন্তকে সেই প্রজেক্টের জন্যে অনেক অতিরিক্ত সুবিধে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদেশে এক আধটা বড় বনেদী প্রাইভেট হাউস ছাড়া এমন বদান্যতা সচরাচর দেখা যায়না বলেই জানি।"
    অভির মুখটা কঠিন হয়ে ভ্রু কুঁচকে এল।
    -"এটা একটা পয়েন্ট। আমি জয়ন্তদের অফিসে খবর নিচ্ছি, ওর কলীগেরা এ ব্যাপার নিয়ে কী বলছে। আলোক তো বলছিল জয়ন্ত ওর ফিল্ডে খুব কৃতি, হতে পারে আগরওয়ালদের বানিয়া বুদ্ধি, ওরা জানে ভবিষ্যতে সব ঠিক হয়ে যাবে, ব্যবসার গন্ডগোল, তার জন্যে জয়ন্তকে সময় থাকতে ধরে রাখছে।"
    রাই এবার মোতিলালের কেসটার কথা জিজ্ঞেস করে। অভি ওকে সব বলে।
    -"কাল চোরগোড়ের ফোন এসেছিল। লোকটা সত্যিই করিতকর্মা, এইসব বুদ্ধিমান লোকেদের আমরা ঠিকমত ব্যবহারই করতে পারিনা। তবে দেখেশুনে মনে হচ্ছে পরের বার গিয়ে ঐ নেতাজীকে ধরব, ওকাজটা চোরগোড়েকে দিয়ে হবেনা, ব্যাটা দুটো কেসেই আছে। খনিতে গন্ডগোল পাকানোর মূলে ও আবার মোতির গুরু বনোয়ারীরও প্যাট্রন ও।"
    কথাটা অভি হাল্কা চালে বললেও রাই কেমন গম্ভীর হয়ে শোনে, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ইতিমধ্যে টুপাই অভির ঘাড়ে এসে পড়েছে, অভি মেয়ের সঙ্গে আদিখ্যেতায় ব্যস্ত, রাইয়ের পরিবর্তন খেয়াল করেনা। রাই একটু চুপ থেকে তারপর গলা তোলে,
    -"অভি, মোতি কবে নিখোঁজ হয়েছিল?"
    অভি টুপাইয়ের নতুন গেম দেখতে দেখতে উত্তর দেয়,
    -"মাসকয়েক আগে হবে। মনে নেই।"
    -"ক মাস আগে? আমিও সবসময় মাস কয়েক শুনেছি, ঠিক কবে কেউ বলেনি। তুই জানিস ঠিক কোন দিন থেকে নিখোঁজ ছিল মোতি"।
    ওর গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যাতে অভি টুপাইয়ের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে রাইয়ের দিকে তাকায়।
    -"মানে, আমিও ঠিক জানিনা। আসলে নিখোঁজের কোনো কেস ফাইল করা ছিল না তবে মার্ডারের রিপোর্ট ছিল বোধহয়, আমি পড়েছিলাম, এখন মনে নেই।"
    -"চোরগোড়ে তোকে ফোন করেছিল বললি না, ওর নাম্বার আছে তোর ফোনে?"
    -"হ্যাঁ আছে। এখনই জানতে হবে তোকে?"
    -"হ্যাঁ। প্লীজ। টুপাই এখন গেম সরাও, আঙ্কলের সঙ্গে আমার কাজ আছে, পরে দেখিও।"

    রাত আটটা বাজে, মফস্বলের হিসেবে রাত্রি, অভিনবের ঠিক ফোন করার ইচ্ছে ছিলনা, হয়ত কাজ নেই, ঘুমোচ্ছে লোকজন। তবু রাইয়ের কথা মানতেই হয়। চোরগোড়ে থানাতেই ছিল, দু চার কথায় কাগজপত্র দেখে দিনটা জানিয়ে দিল।
    রাই কে জানাতে সে বলে,
    -" তার মানে মোতি নিখোঁজ হয়েছিল ওমপ্রকাশের অ্যাক্সিডেন্টের আগের দিন।"
    অভি রাইয়ের দিকে কেমন একটা হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকে, রাই বলে যায়,
    -"অভি, ধর কোনোভাবে যদি নেতাজী এই অ্যাক্সিডেন্টে করিয়ে থাকে আর এরমধ্যে নেতাজীর বিশ্বস্ত বনোয়ারীর হয়ে হাতরির মোতিলাল জড়িত থাকে। নেতাজীর সঙ্গে অজিত আগরওয়ালেরও বোঝাপড়া ভালোই। খনি ওরা বন্ধ করে দিয়েছিল যে কারণেই হোক, অনেক চেষ্টা করে খরচপত্র করে। সেই খনি আবার চালু করতে যাচ্ছিল ওমপ্রকাশ, এটা তো নেতাজীর ইমেজের পক্ষেও খুব খারাপ। মোতিলালের নিখোঁজ হওয়া বা খুন হওয়ার কোনো মোটিভ আমরা পাচ্ছিনা, কিন্তু যদি ওমপ্রকাশের বিরূদ্ধে করা ষড়যন্ত্রের কোনো গুটি হয় মোতি। হয়ত সে কোনোভাবে এদের ব্ল্যাকমেল করছিল যার জন্যে তাকে মেরে ফেলা হল। হয়ত যারা তাকে লুকিয়ে রেখেছিল তারাই তাকে মেরেছে। হয়ত ঐ কাগজের হদিশ মোতি জানত।"

    অভিনব ভাবে, খুব একাগ্র হয়ে। মোতির নিখোঁজ হওয়ার সমসাময়িক কোনো অপরাধের ঘটনার কথা চোরগোড়েও ভেবেছিল কিন্তু সেরকম কিছু খুঁজে পায়নি। সত্যি কথা হল সেসময় একটা অপরাধের ঘটনা হয়েছে ঐ এলাকায় আর তা হল সুন্দরনগর প্রজেক্টের মালিক ওমপ্রকাশের অ্যাক্সিডেন্ট ও মৃত্যু এবং দরকারী কাগজ পত্র চুরির ঘটনা।
    -"অভি, জয়ন্তকে একবার মোতিলালের ছবি দেখালে হয়না? যদি ওর লোকটাকে কোনোভাবে সেদিন রাস্তায় কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়ে? মোতি যদি কাগজ চোর হয় তাহলে সে এদের ফলো করে থাকবে। ধাবায়, পেট্রল পাম্পে কোথাও যদি দেখে থাকে জয়ন্ত ওকে, অথবা সুন্দরনগরে ওদের অফিসের আশেপাশে।"
    -"সেটা করাই যায়, তোর যদি মনে হয় আমি যেতে পারি জয়ন্তর কাছে। তবে একটা কথা আমরা ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে চুরি যাওয়া ডকুমেন্ট এখনো বিরোধীদের হাতে পড়েনি এবং তারাও তাদের মত করে খোঁজ করছে পুলিশে তাদের সোর্স দিয়ে। মোতিলাল চুরি করে নেতাজীকে কাগজ দেওয়া মানে বিরোধী দলের হাতে দেওয়া।"
    -'নাও হতে পারে। নেতার সঙ্গে দলের গন্ডগোল, তুইই তো বললি, দল এখন সন্তোষ মাস্টারকে প্রাধান্য দিচ্ছে একে একধারে করে দিয়ে। হয়ত ইলেকশনের সময় টিকেট নিতে এই তুরূপের তাস ব্যবহার করবে নেতাজী। এখন সঙ্গে সঙ্গে দলের হাতে সব দিয়ে দিলে পরে দল ওকে টিকেট নাও দিতে পারে।"

    রাত হয়েছে, অভিনব উঠে পড়ে, অনেকটা যেতে হবে,
    -"একদিন শুধু আলোকের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে যাব, বলে দিস ওকে। আর মোতির ফোটো আনিয়ে নিচ্ছি, তোকে ফোন করব কাল, জয়ন্তের ওখানে তুইও যাবি।"
    -"আমার যাওয়া কি ঠিক হবে? তোকে তো বলেছি শ্রীমতীর কথা। জয়ন্ত আমাকে পছন্দ করেনা।"
    অভি হাসে,
    -"দুর, জয়ন্ত না পছন্দ করল তো কী হল। পুলিশদের তো কেউ পছন্দ করেনা, তবু আমরা সবার কাছে যাই। এ ভালৈ হল, জয়ন্ত আমাদের কাউকেই পছন্দ করেনা। বিরক্তিতে কিন্তু লোকে অনেক সময় সত্যি কথা বলে ফেলে। যদি জয়ন্ত কিছু লুকোয় বা বলার মত নয় বলে বলেনি এমন কিছু থাকে তাহলে আমাদের সামনে বলে ফেলতে পারে।"
    অভি বেরোনোর মিনিট দশেকের মধ্যে আলোক এসে ঢুকল, আফশোস করল দেখা হলনা বলে। শ্রীমতীদের দরজা খুলে দিয়েই নাকি ও বেরিয়ে এসেছে। একটু বিরক্তও, জয়ন্ত আজকাল বেশ ফিট,মোটামুটি চলছে লাঠি নিয়ে হলেও, ঘরের মধ্যে কোনৈ অসুবিধে নেই। পুরো সময়টা থাকার দরকার ছিলনা, শ্রীমতী অনেক করে বলেছিল বলে থাকতে হল। এমনিতে মেজাজও জয়ন্তর খুব শরীফ আজকাল, শীগগির অফিস জয়েন করতে যাচ্ছে।
    আলোক বাথরুমে ঢুকতেই রাই শ্রীমতীকে ফোন লাগায়, একটা বড় ধন্যবাদ দিয়ে সংক্ষেপে অভির আর ওর যাওয়ার ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়।
    ******************************************
  • শ্রাবণী | 69.94.106.177 | ১৬ জুলাই ২০১৩ ১৬:৫৮495914
  • সন্তোষ মাস্টার বিরজুকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে এসেছে, বাইরে দলের দু চারজন সাথী দাঁড়িয়ে, ভেতরে চোরগোড়ের কাছে শুধু মাস্টার একা। লক আপ খুলে বিরজুকে নিয়ে এলে সে কোনো কিছু বলেনা, এমনকী মাস্টারকে কোনো সম্বোধনও করে না। চোরগোড়ে বুঝতে পারে ব্যাপারটা, বিরজু নেতাজীর খাস লোক তারওপর আদিবাসী নয়, মাস্টারের নেতৃত্বের ওপর তার শ্রদ্ধা নেই। তবু মাস্টার নির্বিকার, একটু হেসে বলে,
    -"ফালতু ভুল বোঝাবুঝিতে হয়রানি হল। যা বাইরে যা, তোর দোস্তরা অপেক্ষা করছে, ওদের সঙ্গে বাড়ি চলে যা। বিকেলবেলা পার্টি অফিসে আসিস একবার।"
    বিরজু হ্যাঁ না কিছু না বলে সই করে বেরিয়ে গেল। এই কদিনে মাস্টারের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে দারোগার, লোকটি সৎ, ভালো, অনেক পড়াশোনা করেছে, দেশের লোকেদের খুব ভালোবাসে, তাদের ভালো করতে চায় বলে মনে হয়। চোরগোড়ের কেমন মনে হয়, এরকম লোক এই দলে মানায় না, আসলে এতকাল নেতাজীর মত লোকেদের দেখে দেখে অভ্যস্ত চোখে সন্তোষ মাস্টার খুব বেমানান ঠেকে। এক একবার মনে হয় এ লোকের তো মাওবাদী হওয়ার কথা, আবার ভাবে মাওবাদী হলে কী হত, চোর ডাকাতেরও অধম অবস্থা, পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো, লোকের শ্রদ্ধা কম শাপ বেশী কুড়নো।
    সেদিক থেকে মাস্টার ভালোই করেছে, বুদ্ধি আছে নিশ্চয়ই, নাহলে দলের নেতাদের আস্থাভাজন হয়েছে এই বয়সে, বড় দলে থেকে চাইলে সৎভাবে জনগণের ভালো অনেক ভালোভাবে করতে পারবে।
    -"চা হবে তো মাস্টার?"
    -"ইস্কুল যেতে হবে সাব, তবু আনান, খেয়ে যাই এক কাপ।"
    চা নিয়ে কনস্টেবল এসে যাবার আগে জানিয়ে গেল বাইরে মনিয়ারী থেকে মোতিলালের শ্বশুর আর বউ এসে অপেক্ষা করছে। চোরগোড়ে কাল রাতে মনিয়ারীর একটা লোককে দিয়ে খবর দিয়েছিল, আজ সকালেই এসে গেছে ওরা। ভালোই হয়েছে, আজ তেমন কাজ নেই, মঙ্গলাকে একটু ভয় দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এতদিনে মোতিলাল বউ ছেলের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করেনি, এটা অস্বাভাবিক, মঙ্গলা হয়ত লুকোচ্ছে কিছু।

    অবাক হল যখন সন্তোষ চায়ে চুমুক দিয়ে একটু ব্যঙ্গের স্বরে বলল,
    -"বিরজু ছাড়া পেয়ে এবার কি মোতির শ্বশুর আর বউয়ের পালা? আপনি সাহেব, দিশা না পেয়ে এদিক ওদিক ঢিল ছুঁড়ছেন মনে হচ্ছে, যদি কোনোদিকে লেগে যায়। মোতিলাল এমন কিছু ভালো মানুষ ছিলনা, বনোয়ারীর দলে ভালো লোক ভেড়েনা। কোথায় কী হাতহাফাইয়ে আড়েতাড়ে লেগে গিয়ে মরে গেছে, যে মেরেছে সে হয়ত মারতে চায়নি দেখুন গে। এ কেস নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা কি ঠিক হচ্ছে দারোগা সাব? ফি বছরে এরকম কয়লার গাড়িতে আসা কত লাশ বেওয়ারিশ বলে জ্বালিয়ে দেন আপনি, ছানবিনও করেন না। হঠাৎ মোতিকে নিয়ে পড়লেন কেন? কেউ আমাদের দলকে বিপাকে ফেলতে কলকাঠি নাড়ছে না তো?"
    মাস্টারের কথায় চোরগোড়ে অবাক, এরকম তীক্ষ্ম মন্তব্য এর মুখে আগে শোনেনি। পরক্ষণেই ভাবে, তারই ভুল, রাজনীতিতে উঠছে যে মানুষ সে সদাশয় টয় কিছু হতে পারে না, দরকারে তাদের কঠিন হতে হয়। বিরজু এতদিন ভেতরে ছিল তাই সন্তোষ মাস্টার তেমন মুখ খোলেনি, তাকে খাতির করেছে। এখন বিরজু বাইরে, এখন আর মুখ খুলতে বাধা নেই।
    সে ভালোই জানে যে কাল এম এল এ বা এম পি হলে চোরগোড়ের মত দারোগাকে সে অঙ্গুলিহেলনে এদিক ওদিক করাবে। তবু চোরগোড়ের ওপরে এখন দিল্লীর বড় সাহেবের আশীর্বাদ, তাই সেও সমান ডাঁটে জবাব দেয়,
    -"ছানবিন করিনা কথাটা ভুল বললেন মাস্টার, করতে দেওয়া হয়না, আপনাদের মত দলের লোকেরাই দেয়না, কোলিয়ারীর নমকের হিসেব মেটাতে, তখন প্রেশার থাকে। ধরে নিন এক্ষেত্রে বরং প্রেশার নেই বলেই ছানবিন হচ্ছে। আর আমরা ঢিল এমনি এমনি ছুঁড়ি না মাস্টার, পুলিশকে অত নালায়েক ভাববেন না। সময় এলে সব ঢিল গুনে গুনে দেখাব, চিন্তা করবেন না। পুছতাছ তো হবেই, নিয়ম হল যার দোষ নেই তার কোনো কিছুতেই ভয় করার কোনো কারণ নেই।"
    সন্তোষ এবার ফের চিরাচরিত সাদামাটা গলায় নেমে এসে বলে,
    -"কী যে বলেন সাব, আপনি জানেন না বিনাদোষে কত গরীব গারদে পচে আর দোষ করেও আমীর লোকেরা খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায়?"
    চোরগোড়ে জানে কথাটা ষোল আনা সত্যি তাই আপত্তি করেনা, শুধু হাত তুলে অভয় দেওয়ার ভঙ্গী করে, মাস্টার উঠে বাইরে যেতে যেতে বলে,
    -"আপনার ওপর আমার ভরসা আছে সাব, দেখবেন হতাশ করবেন না।"

    চোরগোড়ে টেবিলে রাখা জলের গেলাসে চুমুক দিতে গিয়ে গ্লাসের কাঁচে বাইরের বেঞ্চের প্রতিফলন দেখে থমকায়। মাস্টার মোতিলালের বউ আর শ্বশুরের সামনে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় কী সব বলছে, মঙ্গলা মাথা নীচু করে আছে, তার বাপ ঘাড় নাড়ছে। চোরগোড়ে বিরক্ত হল, এদের না দেখা হলেই ভালো হত। মাস্টারের আশীর্বাদ পেলে এরা কী আর মামুলী থানার দারোগার ভয়ে মুখ খুলে সত্যিটা বলবে?
    এমনিতে হয়ত কিছু মনে হত না কিন্তু মাস্টারের কিছুক্ষণ আগের কথার ধরণ ওর ভালো লাগেনি। দেখা যাক, মাস্টার চলে যেতে সে একা মঙ্গলাকে ডেকে পাঠালো ভেতরে। ছোট থানায় মহিলা পুলিশ নেই, পরে কোনো ঝামেলা না হয় তাই দরজা খোলা রাখে। বাইরে থেকে দেখা যাবে সব তবে আস্তে কথা বললে শোনা যাবেনা। তার অবশ্য আসল টার্গেট মঙ্গলা নয় তার বাবা। বাবুলাল এখনো কোনো খবর নিয়ে আসেনি, তাই সে নিজেই চেষ্টা করবে ঠিক করেছে। ওদিকে বিলাসপুর থেকে খবর পেয়েছে মোতির মৃত্যুর আগে থেকেই নেতাজী বনোয়ারীর প্যারোলের জন্যে ব্যবস্থা শুরু করেছে, ওর বউয়ের অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে। বউটাকে একটা সস্তার নার্সিংহোমে রাখা হয়েছে, সেখানেও নেতাজীর কিছু কারবার আছে। খুব তাড়াতাড়িই হয়ত বনোয়ারী বাইরে বেরোবে।

    -"তুই আমাকে জানিস তো?" মঙ্গলা ঘোমটাটা একটু টেনে ঘাড় নাড়ে।
    -"ভয়ের কিছু নেই, তুই আমার বোনের মত। তোর দুখে আমরা সবাই দুখী, অমন তরতাজা লোকটা তোর ছেলেকে অনাথ করে চলে গেল, বেঘোরে। আমি চাই মোতির হত্যাকারী শাস্তি পাক, তুই চাস না?"
    আবার সেই ঘাড় নড়ে।
    -"মোতি তোকে, ছেলেকে খুব ভালোবাসত, সবাই বলে। ছেলেকে দেখতে, তোর সঙ্গে দেখা করতে একবারও এলনা? তোর সঙ্গে যোগাযোগ করল না, এভাবে তোদের ফেলে চলে গেল,অথচ আমরা খবর পেয়েছি সে বেশী দুরে যায়নি, এ অঞ্চলেই কাছাকাছিই ছিল।
    কথাটা আমাদের বড় কর্তারা কেউ বিশ্বাস করছেনা, নেতাজীও তোকে সন্দেহ করে, তার কথাতেই এই তদন্ত চলছে এখনো। কোনোভাবে যদি জানা যায় মোতিকে তোর সাথে বা তোর বাড়ির আশেপাশে দেখা গেছিল তাহলে তোকে আটক করা ছাড়া উপায় থাকবেনা।
    নেতাজী সহায় হলে আমাদের কেউ আটকাতে পারবেনা। তাই বড় দাদা হিসেবে তোকে বলি এখনো সময় আছে, কিছু জানা থাকলে বলে দে, আমি সেদিন পঞ্চে কী হয়েছে সব শুনেছি। আমাকে সাহায্য করলে তোর নাম আমি এ তদন্তে আসতে দেব না, তোর শ্বশুরবাড়িকেও দেখে নেব।"
    মুখ দেখা যাচ্ছেনা তাই মঙ্গলার প্রতিক্রিয়া এসব শুনে কেমন হল বা আদৌ কিছু হল কিনা বোঝা গেল না। তবে সে ঘাড় আরো জোরে জোরে নেড়ে চলে। চোরগোড়ে এতগুলো কথা একসাথে বলে চুপ করে কিছুক্ষন। মঙ্গলা অপেক্ষা করে করে এবার মুখ তোলে,
    -"আমি কিছু জানিনা দারোগা সাব।" চোরগোড়ে এবার গলার স্বরকে আরো সহজ মোলায়েম করে বলে,
    -"কিন্তু মোতি না এলেও ওর খোঁজ করতেও কেউ তোর কাছে আসেনি? নেতাজীর লোকেরা?" এবার মঙ্গলাও কী একটু সহজ হয়,
    -"হাঁ আসত তো। বিরজু বদমাশটা এসে প্রায়ই খবর নিয়ে যেত। শেষদিকে আমাকে কুপ্রস্তাবও দিত, আমি শেষে বঁটি নিয়ে তেড়ে যেতে ভয়ে আর আসেনি কদিন, অন্য একজন আসত।"
    এটা নতুন খবর, তার মানে পরিস্কার নেতাজীর দল মোতিকে লুকিয়ে রাখেনি, তারা ওকে খুঁজছিল। চোরগোড়ে ঠিকই ধারণা করেছিল।
    -"শেষ কবে আসে খোঁজ নিতে? কখন?"
    মঙ্গলা এ কথায় একটু ভাবে, ঘোমটা সরে গিয়ে এখন অর্ধেক মুখ দেখা যাচ্ছে, আগের ভয় ভাবটা অনেকটা কেটে গেছে।
    -"ঠিক মনে নেই, তবে যেদিন খারাপ খবরটা এল তার দুতিনদিন আগে।"
    খবরটা মোতির শ্বশুরবাড়িতে গেছে লাশ পাওয়ার পরের দিন। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়েছে আন্দাজ লাশ পাওয়ার দুদিন আগে মৃত্যু হয়েছে।
    -"দিনটা ঠিক মনে আছে?"
    -" না সাব"।
    চোরগোড়ে হতাশ হয়। যদি জানা যেত মোতির মৃত্যুর পরে ওরা আর খোঁজ নিতে আসেনি তাহলে ওরাই খুন করেছে বলে সন্দেহ টা পাকা হত।
    -"তোদের চলে কী করে? তোর ভাইয়েরা তো শুনেছি বাপের জমিতে চাষ বাস করে যা আয় হয় তার থেকে মা বাপের খোরাক দেয় শুধু, তোর আর তোর ছেলে বাবদ কিছু দেয় না।"
    মঙ্গলার চোখ এবারে ছলোছলো হয়,
    -"কষ্টে চলে, আমি কিছু কাজ করে দিই পাড়ায় ডাকলে, বাবা মার যা আছে তাই দিয়ে চালিয়ে নিই। তখন তো ভাবিনি মানুষটা আর কোনোদিন ফিরবেনা। এমন শয়তান শ্বশুরবাড়ি সাব, কানহাকে কিছুই দিলনা পঞ্চের সঙ্গে ষড় করে। লোকটা কত দিত বাড়িতে তার ন্যয্য ভাগ দিলনি, নাতিকে ভিখারী করে ছেড়ে দিল।"
    -"ছেলে ইস্কুলে যায়?"
    -"হাঁ, পেরাইমারী ইস্কুলে। সেখানে পয়সা লাগেনা, বইখাতা পায়, খাবারও পায়।"
    -"মাস্টারকে চিনিস তোরা, সে তো ভালো লোক, তার কাছে সাহায্য চাসনা কেন? তোর শ্বশুরবাড়িকে শাসিয়ে দিত দলের লোক দিয়ে।" মঙ্গলার মুখ নির্বিকার।
    -"গাঁয়ের লোক, এখন নেতা হইছে, চিনি মানে ওরকমই, ইস্কুলে রাস্তায় দেখিটেখি। বাপু ভালো চেনে তবে বাপু এইসব ভোটের লোকেদের ঠিক বিশ্বাস করেনা, তাই এদের কাছে যায়নি। তার এখনো আশা শ্বশুরের মতি ফিরবে, কানহাকে তার উচিত প্রাপ্য ঐ বুড়োই দেবে, বংশধর বলে কথা।"

    চোরগোড়ে আর কথা না বলে মঙ্গলাকে বাইরে পাঠিয়ে ওর বাবাকে ডেকে পাঠায়। বয়স্ক লোক, চোখে ঘসা কাঁচের পুরনো চশমা, মুখে একরকম সারল্য আর অসহায়তা আছে। এর আগে থানায় যখন এসেছিল ভিড়ের মাঝে চোরগোড়ে মানুষটাকে খেয়াল করেনি। মোতির বাপ এর থেকে বয়সে হয়ত বড়ই হবে কিন্তু ডাঁটোসাঁটো আর সেয়ানা, পঞ্চের সদস্য, পুরো কানুনী।
    এই লোকটাকে দেখে ওর মায়া হতে লাগল, অন্যরকম সাদাসিধে। অথচ খুব সাবধানে কথা বলতে হবে, যাতে এ ঘাবড়িয়ে সত্যি কথা বলে। পুলিশ হলেও চোরগোড়ে ভালো লোক, এই সরলতার কাছে কেমন অসহায় বোধ করতে লাগল। একে বাবুলালের হাতে ছেড়ে দিলেই বোধহয় ভালো হত। নমস্কার করে দাঁড়িয়ে থাকে, চোরগোড়ের অস্বস্তি বাড়িয়ে, অনেক বলেকয়ে জোর করে বসায় মানুষটাকে।
    -"বুঝি, মোতির মৃত্যুতে তুমি খুব মুশকিলে পড়ে গেছ মেয়ে আর নাতির ভার এবয়সে এল তোমার ওপর। ছেলেগুলোও তোমার তেমন শোধেরবোধের নয় যে সাহায্য করবে আবার মোতিদের বাড়িতেও হাত ধুয়ে ফেলেছে।" লোকটি এই সহানুভূতির সুরে কাঁদ কাঁদ হয়ে ওঠে
    -"আমার ছেলেরা মেয়ে কেউ কথা শোনেনা সাহেব। মেয়ে যদি কানহা বড় হয়ে না ওঠা অবধি শ্বশুরবাড়িতে থাকত তাহলে কী আর ওরা ওকে এরকম কিছু না দিয়ে ফেলে দিত, ওদের বাড়ির ছেলে, বউ, ঠিকই দেখাশোনা করত,আর কিছু না হোক অন্তত গাঁয়ের লোকের কথা শোনার ভয়ে। আমার মেয়েই তো সেখানে থাকতে রাজী নয়, ভাগ চেয়ে পঞ্চের কাছে ঐ গেছে প্রথম, কুটুমের নামে মিছে কথা বলব না। ওর ঝগড়াঝাঁটিতে তিতিবিরক্ত হয়েই তারা ওর থেকে ছুটকারা পেতে চেয়েছে। কোথায় সদ্য বিধবা মাথা নীচু করে থাকবে তা না। আমার কপাল মন্দ, আমার বউ অসুস্থ, তার দেখাশোনা করে আবার নাতি মেয়ের দায়িত্ব, আমি নাজেহাল হয়ে গেলাম সাব।
    আবার এখন এই মোতির জন্যে থানা পুলিশ করা, শুনছি কোর্টেও কেস উঠবে, সেখানেও যেতে হবে। ছেলেরা কোনো সাহায্য করেনা উল্টে বোনের সঙ্গে দাদাবৌদিদের খালি চুলোচুলি। আমার মেয়ে মুখরা, জামাইও তেমন ভালো ছিলনা, কিন্তু নাতিটা অবোধ, কানহার মত পবিত্র, তার মুখ চেয়ে সয়ে আছি।"
    পরিস্থিতি একটু নরম হয়ে আসার পরে, চোরগোড়ে আস্তে করে তার কথা শুরু করে। গ্লাস দিয়ে দেখে মঙ্গলা হাঁ করে এদিকে তাকিয়ে আছে। ভালো না বোঝা গেলেও উৎকন্ঠা তেমন নেই মুখে। হয়ত চোরগোড়েকে খুব ভালো লোক বুঝে নিয়ে এই নিশ্চিন্তি।
    -"দেবতার নামে সত্যি করে বল তো , মোতি মাঝে তোমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে বা নাতিকে দেখতে এসেছিল কিনা। সত্য কখনো চাপা থাকেনা, একদিন বাহির হবেই, তুমি এই বয়সে আর পাপের ভাগী হবে কেন?
    মোতি খুব বড় কোনো চক্করে পড়েছিল, তবে মনে হয় না সে নিজে তেমন কিছু অন্যায় করেছিল। অন্য বড় অপরাধীদের বাঁচাতে সে প্রাণ দিল, তাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমরা এই লোকগুলোকে শাস্তি দিতে চাই। তুমি চাওনা তোমার নাতি বড় হয়ে মাস্টারের মত পড়ালিখা হোক, চাকরি করুক? তার বাবার সম্বন্ধে আজেবাজে কথা রটলে কি সে কোনোদিন সমাজে মাথা উঁচু করতে পারবে, উন্নতি করতে পারবে?"
    লোকটাকে কেমন দিশাহারা দেখায়,
    -"আমি জানিনা সাহব, আমি কোনোদিন তাকে আসতে দেখেনি মঙ্গলার কাছে। সে আমার ছেলেদের ভালো করে জানত, তারা দেখে ফেললে সে আর লুকিয়ে থাকতে পারত না, তাই আমার ঘরে সে আসবে না।
    তবে একদিন কানহা ইস্কুল থেকে ফিরে বলেছিল, ইস্কুলের পাশের বনে ঢোকার মুখে গাছতলায় বাবাকে দেখেছে, বাবা তাকে মিঠাই দিয়েছে। বাচ্চাটা মাকে খুব ভয় করত, তার সঙ্গে বেশী ভাব নেই, আমার সঙ্গেই ভাব। মাকে তাই বলেনি, আমাকেই বলেছিল।
    আমি শুনেও চুপ ছিলাম, অবোধ শিশু, অনেককাল বাবাকে না দেখে দুঃখে আছে, হয়ত কল্পনা করেছে। মঙ্গলা এমনিতেই উঠতে বসতে মরদকে গাল দেয়, ছেলের মুখে বাবার কথা শুনলে তাকেও চড়চাপড় লাগাবে, এই ভয়ে আমি কানহাকে বারণ করে দিয়েছিলাম কাউকে বাবার কথা বলতে। তার পর থেকে ছেলেটা আমাকেও আর কোনোদিন কিছু বলেনি।
    তাও সন্তোষ মাস্টারকে বলেছিলাম, তারই তো স্কুল, ভয় হয়েছিল, সে মানুষ কোথায় কোন দলে ভিড়েছে, ছেলে অন্তপ্রাণ ছিল যদি ছেলেটাকেও তুলে নিয়ে যায়। মাস্টার শুনে হেসে উড়িয়ে দেয়, ইস্কুল থেকে বাচ্চা তুলতে মাওবাদীরাও সাহস করবে না।
    তাও আমার কথায় কানহাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, তখন হয় সে ছেলে ভুলে গেছে নয় ভয়ে বাবার কথা আর তোলেনি।"

    চোরগোড়ে লোকটাকে বিশ্বাস করল। এতক্ষণে সবকিছু অনেক স্বাভাবিক লাগছে। মোতি এমনিতে যাই হোক স্নেহশীল পিতা ছিল, ছেলেকে এতদিন না দেখে থাকাটা অস্বাভাবিক লাগছিল। তবে মাস্টার তো এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। অবশ্য মোতির ব্যাপারে মাস্টারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কোথায়?
    দিল্লীতে গুপ্তা সাহেবকে সব জানাতে হবে, সে ছোটামোটা অফিসার, মাস্টার ও নেতাজীর মত বড় মাছকে জিজ্ঞাসাবাদের কাজটা বড় অফিসাররাই এসে করুক।
    মঙ্গলার বাবাকে আর পরিশান না করার আশ্বাস দিয়ে ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। তারপর প্রথমে বাবুলালের মোবাইলে ফোন লাগাল, বনোয়ারীর বাপের সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা জানতে, বনোয়ারীর প্যারোলে বেরোনোর কথাটা আর মঙ্গলার বাপের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন নেই সেটাও ওকে জানাতে হবে। মোবাইল সুইচড অফ এল, এই এক বিপদ, বাবুলাল কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়, সব জায়গায় ধরা যায়না সবসময়।

    এবার সে অভিনবকে ফোন করে, একটা রিং হতেই অভিনব ফোন তোলে যেন ওর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল।
    -"চোরগোড়ে, কী আশ্চর্য আমি আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম, খুব জরুরী কাজ, মন দিয়ে শুনুন কী করতে হবে।"
  • de | 69.185.236.52 | ১৬ জুলাই ২০১৩ ১৮:০১495915
  • পড়ছি! জ্বর নিয়ে বেশী স্ট্রেস না নিয়ে লেখো --
  • শ্রাবণী | 69.94.107.94 | ১৭ জুলাই ২০১৩ ১৮:৫৬495916
  • ********************************
    কাল অনেক রাত অবধি জেগেছিল রাই। মাথার মধ্যে অনেক কিছু গজগজ করছিল, বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে একটা খাতা আর পেন নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল। আলোক দু একবার উঁকি মেরে কী লিখেছে দেখতে গিয়ে বোর হয়ে গেল, শুধু কতগুলো আঁকিবুঁকি, লাইন টানা, গোল্লা কিছু এখানে ওখানে। সকালে তাই রোজের সময়ে উঠতে পারেনি, উঠল যখন তখন মেয়েকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে হাঁটতে চলে গেছে আলোক। অবশ্য কালই ঠিক করে নিয়েছিল আজ অফিস যাবেনা, অভির সঙ্গে জয়ন্তর ওখানে কখন কোন সময়ে যেতে হবে জানেনা, তবুও। আলোককে কাল রেখে ঢেকে যতটা বলা যায় অভির কেস সম্বন্ধে বলেছে, সত্যি আলোকের পেটে কথা থাকেনা, গপ্পবাজ, কোথায় গল্পে গল্পে কী বলে ফেলবে। কিন্তু জয়ন্তর বাড়ি যাওয়ার কথাটা বলতে পারেনি। অভি প্রথমদিন যখন এ ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিল তখন আলোককে নিয়ে জয়ন্তের ওখানে যেতে চেয়েছিল। তারপর ঘটনাপ্রবাহে এখন এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে যে আলোককে সব কিছু বলাও যাচ্ছেনা, কিন্তু জয়ন্তর বাড়ি গেলে আলোক ও না জানালেও জানতে পারবে। এমনিতে আলোকের মনে ঘোরপ্যাঁচ কম, সোজাসাপ্টা মানুষ, তবু ক্ষুন্ন হতে পারে, অভি ওকে নিলনা, ওর বন্ধুর ব্যাপারে। তাই রাই ঠিক করল আলোককে এখনি বলবেনা, ও অফিস যাক। পরে বলে দেবে তাড়া ছিল তাই অভি ওর জন্যে অপেক্ষা না করে রাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে।
    -"আজ না অফিস যাবনা ভাবছি। গেলেও কাজে মন দিতে পারব না, মাথার মধ্যে এত কিছু ঘুরছে, একটু চুপচাপ রিল্যাক্সড হয়ে বসা দরকার।"
    আলোক চা খেতে খেতে সায় দিল,
    -"কাল তো বোধহয় ঘুমিয়েছও অনেক দেরীতে, আজ রেস্ট নিয়ে নাও। তেমন কিছু জরুরী না থাকলে দুদিন বসে যাও, আমি তোমার বসকে বলে দেব।"
    -"অভি আজ কিছু খবর দেবে বলছিল। জানো আমার কেমন পাজলের মত লাগছে, কিছু টুকরো যেন ঠিক বসেছে, কিছু টুকরো কোথায় বসবে বুঝছি না আর কিছু এখন হাতে নেই। অবাক ব্যাপার, বড় ছবিটা আমার কাছে যেন অনেকটাই স্পষ্ট,কিন্তু টুকরোগুলো খুঁজে লাগিয়ে না দেখালে শুধু আমার মুখের কথায় কেউ ছবিটা সঠিক বলে মানতে চাইবেনা।"
    আলোক জানে রাইকে এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে না বলে কোনো লাভ হবেনা, এও জানে খুব সম্ভব রাইই ঠিক, ওরা দু বন্ধুতে বুঝে নিক ওদের ব্যাপার। তবু নিউজপেপারে পাতা উল্টোবার ফাঁকে বলল,
    -"তুমি যে বলছ ঐ কয়লার রেকে লাশের কেসটা তুমি মনে কর জয়ন্তর অ্যাক্সিডেন্টের কেসের সঙ্গে জড়িত, তা ওদিককার কিছু পাজলের টুকরো খুঁজতে দরকার হলে পার্থর সাহায্য নাও না কেন? ওকে ফোন করে দেখ, আমাদের কম্পানির ও অঞ্চলে ভালো প্রভাবপ্রতিপত্তি আছে, স্থানীয় গ্রাম প্রধান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, সব মহলে আমরা খাতির পেয়ে থাকি, পার্থর চেনাজানাও প্রচুর, এতদিন ধরে আছে। ও তোমাকে পুলিশী অ্যাঙ্গলের বাইরের ছবি দিতে পারবে।"
    এমনিই হয়, যখন সে নিজেকে প্রচুর বুদ্ধিমতী মনে করে তখনই এমন কিছু একটা হয় যা মনে করায় যে তার ঘরের লোকটিও কম যায়না। পার্থর কথাটা কেন ওর মনে হয়নি এতদিনে।
    অভি ব্যাপারটা হাতে নিয়ে চোরগোড়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছে ও খবর কিছু হলে তাকে বলছে, তাই সে পার্থকে স্রেফ ভুলে মেরে দিয়েছে অথচ পার্থই চোরগোড়ের সঙ্গে তার আলাপ করায়, চোরগোড়েকে রাজী করায় মোতিলালের কেসটা সম্পর্কে এগিয়ে তদন্ত করতে। আজই পার্থকে ফোন করবে ঠিক করল।

    দশটা নাগাদ অভির ফোনটা এল। তখন রাই স্নান টান সেরে কফি নিয়ে বাইরের ঘরে বসে নিউজপেপারে চোখ বোলাচ্ছে।
    -"তুই বাড়িতে? এখনি রেডি হতে পারবি? আমি অফিস থেকে বেরোচ্ছি এখুনি, তোকে তুলে নিয়ে জয়ন্তের ওখানে যাব। কালকে রাতেই বড় সাহেবকে মোতির কেসটা বললাম, তোর ধারণার কথাও। উনি এমনিতে খুব লজিক্যাল, ব্যাপারটা উড়িয়ে না দিয়ে ভালো করে খতিয়ে দেখতে বললেন। বাইরের লোকের দৃষ্টিভঙ্গী প্রচলিত পুলিশী সিস্টেমের থেকে আলাদা হয় বলে অনেক ক্ষেত্রে অনেক সময় সত্যি প্রমাণ হতে পারে।
    চোরগোড়েকে কাল রাতে তোর ওখান থেকে ফেরার পথে ফোন করে মোতিলালের ছবিটা পাঠাতে বলেছিলাম, সে আজ সকালে মোবাইল ক্যামেরা থেকে ফোটো তুলে আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দিয়েছে, লোকটা সত্যি দারুন।"
    রাই তৈরী হয়ে নিয়ে দুটো মেসেজ করে, আলোককে আর শ্রীমতীকে। আলোক সচরাচর মেসেজ টেসেজ সবসময় দেখেনা, তাই একটা বেশ "ইতি গজ" ব্যাপার হল, ফোন করলে অনেক কিছু প্রশ্ন করত।
    অভি এসে গেল আধঘন্টার মধ্যেই, এখন অফিস টাইমের ট্র্যাফিক নেই, তাই এত তাড়াতাড়ি এসে গেছে। নীচে থেকে ফোন করতে রাই বাড়িতে তালা লাগিয়ে নেমে গেল।
    -"তুই কি টেনশনে নাকি রে? চিন্তা করিসনা, আমি জয়ন্তকে ফোন করে বলে দিয়েছি ওকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসছি। তবে সঙ্গে তুই থাকবি সেটা বলিনি। আসলে লোকটা সম্বন্ধে যা খোঁজখবর পেয়েছি তাতে মনে হয়, খুবই বুদ্ধিমান এবং শ্রিউড। ওর অফিসের লোক প্লাস ঐ দাসানি সেজে যারা এসেছিল তাদের ধারণা আর কি। আলোকের বন্ধু হলেও তার মত সিধাসাদা নয়, ঘোরালো। তাই আমিও সমস্ত কিছু কানুন মেনে করব ওর সাথে, তুই ওখানে দর্শক থাকিস, একটাও কথা বলিস না, যা বলার আমি বলব। তেমন কিছু দরকার মনে হলে, জয়ন্তর কাছে জানার আছে মনে হয় যদি, ওখানেই আমায় এস এম এস করে দিস, আমি খেয়াল রাখব।"
    রাইয়ের বেশ মনঃপুত হল ব্যবস্থাটা, শ্রীমতী আর আলোক এই দুজনের মুখ চেয়ে ও জয়ন্তর সঙ্গে কোনো ঝামেলায় যেতে চায়না। জয়ন্ত ওকে পছন্দ করেনা সেটা ও আগেও বুঝত, ওর মধ্যে শভিনিস্ট চরিত্রটা খুব প্রকট, সে কারণেই হয়ত। তবে এতদিন তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, অনেকেই ওকে পছন্দ করেনা, তাতে কী! কিন্তু ইদানীং শ্রীমতীর ব্যবহারে কথাবার্তায়, সবকিছুতে জয়ন্তর ভয়, জয়ন্তের থেকে লুকিয়ে ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, এসবের মধ্যে জয়ন্তর ওকে অপছন্দের ব্যাপারটা কেমন সামনে আসছে আলাদা করে এবং এতে সে বিরক্ত, অদ্ভুত লোক তো!
    অভির কাছে আলোকের সঙ্গে বন্ধুত্বের ব্যাপারটা পরিস্কার করতে সে বলে,
    -"অভি, আলোক আর জয়ন্ত স্কুল কলেজে একসাথে পড়েছে, অনেককালের চেনাজানা।"
    -"জানি তো। আরে আলোক সাদাসিধে হলে তার বন্ধু ঘোরালো হতে পারেনা। এই যে আমি পুলিশে থেকেও এত সিধা, আর তুই আমার বন্ধু, পুলিশ না হয়েও এত ঘোরালো প্যাঁচালো, এরকমটা তো হতেই পারে। নাহলে কোথা থেকে কী সব ভেবে কার সাথে জুড়ে দিস, এসব ঐ মেয়েলী প্যাঁচালো মাথাতেই সম্ভব।"
    অভি পা টানছে, ঠোঁটের কোনে লুকোনো চাপা হাসি। ওরা এসে গেছে প্রায়,
    -"আমি প্যাঁচালো? অভি, তোর কোনো কেসে আমি আর ঢুকব না এবার থেকে, দ্যাখ। তুই না, সেই বাংলায় যাকে বলে "যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর"।"
    গাড়ি থেমেছে জয়ন্তদের সোস্যাইটির সামনে, নামতে গিয়ে অভি বলে,
    -"তুই কেসে ঢুকিস কোথায়, কেস তোতে ঢুকে পড়ে তো! ঝামেলা মিটুক, একদিন আলোকের সাথে বসে তোকে বুঝিয়ে দেব তুই ঠিক কতটা ঘোরালো।"
    -"দেখব। শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল আর তোর সাক্ষী আলোক, দুটোই অচল, ধোপে টিকবেনা। আমার পাড়াপড়শী, অফিস সবাই একবাক্যে বলবে আমি কত সরল, সাতেপাঁচে নেই টাইপের। বুঝলি?"

    গেটে অভিনব আই কার্ড দেখাতে ওরা আটকায়না, ফোন করে খবরও দেয়না, তাই কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে শ্রীমতী ওদের দেখে প্রথমটায় হকচকিয়ে যায়, তারপর অভিকে দেখে সামলে নিয়ে ভেতরে বসায়।
    রাই অনেকদিন এবাড়ীতে আসেনি। সাকুল্যে এসেছেই গোণাগুনতি কবার, নেমন্তন্নে, ছেলের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদিতে, তবে সেসবই জয়ন্তর নতুন চাকরি হয়ে আকাশছোঁয়া উন্নতির আগের কথা। তারপরে তো যা পার্টি দিয়েছে হোটেলে, ক্লাবে, বাড়িতে ডাকেনি, তাই ওর আসা হয়নি। অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করল, ফার্নিচার প্রায় সব বদলে গেছে, দামী আসবাবপত্র, দেওয়ালের পেন্ট, লাইট ফ্যান সবই আগের থেকে আলাদা। এই কমাসেও তাদের চমকজমক ম্লান হয়নি তেমন।
    জয়ন্তকে শ্রীমতী ডেকে দিয়ে রান্নাঘরে গেল চায়ের ব্যবস্থা করতে। রাইয়ের কথা বোধহয় বলেনি, ঘরে ঢুকে রাইকে দেখে জয়ন্তর ভ্রু কুঁচকে গেল প্রথমটায়, তারপরেই সহজ হয়ে অভি কিছু বলার আগে বলল,
    -"অভিনব গুপ্তা? আপনিই রাইয়ের বন্ধু? আলোকের মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি। তা তোমার আজ অফিস নেই রাই? নাকি কেসের ব্যাপারে তুমিও মিঃ গুপ্তাকে সাহায্য করছ?"
    তার উপস্থিতিতে জয়ন্ত ওপরে অন্তত কোনো সিন ক্রিয়েট করল না দেখে রাই আশ্বস্ত হল। তাকে করা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু হাসল একটু। স্মার্টনেসে অভিও কম যায়না,
    -"গুড, তাহলে তো আর আলাপ পরিচয়ের পর্বের দরকার হবেনা। সরাসরি কাজের কথায় আসতে পারি।"
    -"আপনি যদি আমার অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে কিছু জানতে চান তাহলে আমার এব্যাপারে নতুন কিছুই বলার নেই। রায়পুরের পুলিশকে জ্ঞান ফিরলে আমি বয়ান দিয়েছি, এখানেও পুলিশ এসে আমার বয়ান নিয়ে গেছে।"
    অভি পাত্তা দেয়না,
    -"ওটা আপনার মনে হচ্ছে জয়ন্ত। আমি আপনার সব বয়ান পড়েছি। যেগুলোকে বয়ান বলছেন সেগুলোতে আপনি আসলে কিছুই বলেননি, শুধু একটা কথাই বলেছেন যে আপনার কিছু মনে নেই।"
    -"হ্যাঁ, এখনো তাই বলছি।"
    -"কেন বলছেন?"
    -"মানে?" জয়ন্ত ঠিক বুঝতে না পারার মত মুখ করে।
    -"রায়পুরের ও দিল্লীর দু জায়গার ডাক্তারদের সাথেই আমার কথা হয়েছে। আপনার সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল, ঐ অবস্থায় সেটা একেবারে অস্বাভাবিক নয়। প্রথমে আপনার নাম ছাড়া কিছুই মনে পড়েনি, পরে আস্তে আস্তে সব মনে পড়েছে শুধু অ্যাক্সিডেন্টের ঠিক আগে পরের কথা ছাড়া। ডাক্তাররা মনে করে সময়ের সাথে সাথে শরীর যেমন ঠিক হয়ে আসবে, শক্ত হবে, তেমনি মনও ঠিক হবে আপনার।
    শরীর আপনার ঠিক হয়েছে অনেকটাই, আপনি এখন চলছেন ফিরছেন লাঠিও হয়ত আর কদিন পরে লাগবেনা। আশা করি আপনি খুব দ্রুত পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবেন। শরীর সেরে গেছে যখন হয়ত মনও আপনার আবার আগের মত চাঙ্গা। আমার কেমন মনে হচ্ছে আপনি চেষ্টা করলে ঐ হারানো সময়টুকুর কথাও আপনার মনে পড়ে যাবে। এটা জরুরী এজন্যে, কারণ আমি মনে করি আপনাদের অ্যাক্সিডেন্ট টা করানো হয়েছে, ওমপ্রকাশের কাছে কিছু দরকারী কাগজপত্র ছিল সেগুলোর জন্যে।"
    জয়ন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবে, তারপরে বলে,
    -"না, তেমন কিছুই মনে পড়ছেনা। গাড়ি খারাপ হতে আমি ড্রাইভার দীনেশকে বলছিলাম যে ট্রাক ছাড়া অন্য যে গাড়ি প্রথম আসবে সেটাই দাঁড় করাতে। দীনেশ জানিয়েছিল কাছেপিঠে কোথাও গ্যারাজ নেই, দুরে যা আছে তাও অত রাত্তিরে খোলা থাকবেনা। সেই শুনে মনে হল যা হোক কিছু করে রায়পুর বেরিয়ে যাব, ভোরের ফ্লাইট না হলে ধরা যাবেনা। তা ওমপ্রকাশের গাড়িই প্রথমে এসেছিল, দীনেশ গাড়ি থামিয়েও একটু ইতস্তত করছিল যখন চিনতে পেরেছিল বড় সাহেবের গাড়ি বলে, আমি নিজের পরিচয় দিতে ওনারা তুলে নেন আমাকে। এরপরে আমার আর কিছু মনে নেই, সারাদিনের ব্যস্ত কর্মকান্ডের পরে ক্লান্ত বোধ করছিলাম, হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই মনে নেই।"
    -"আপনি কী রাতে গাড়িতে এই প্রথম ট্র্যাভেল করলেন?"
    -"না।"
    -"তাহলে আপনি সজাগ থাকবেন না? বিশেষ করে ড্রাইভারের পাশে বসে ঘুমোবার ঝুঁকি আমরা কেউই নিই না, খুব কষ্ট হলেও চেষ্টা করে জেগে থাকি। আপনি করেন না?"
    -"এমনিতে তাই করি, তবে সেদিন হতে পারে আমি খুব টায়ার্ড ছিলাম। দেখুন মিঃ গুপ্তা, আমি কিন্তু সত্যি কথা বলছি আমার কিছু মনে পড়ে না, ট্রাকটা ঠিক কিভাবে কখন এসে ধাক্কা মারল। আমার মিথ্যে কথা বলার তো কোনো কারণ নেই। এই অ্যাক্সিডেন্টে আমার কম ক্ষতি হয়নি। এর সমাধানে কিছু সাহায্য করতে পারলে আমিই সবচেয়ে খুশী হতাম।"
    -"মিথ্যে বলছেন আমি বলছিনা। তবে হতে পারে আপনার একবার একজন ডাক্তার দেখানো দরকার, কোনো মনোবিদ। তাহলে একবার নিশ্‌চিত হওয়া যেত যে আপনি সত্যিই সেরকম কিছু দেখেননি না দুর্ঘটনার শকে আপনার ঐ সময়কার দেখাটা হারিয়ে গেছে। আমরা যদি কোনো বড় মনোবিদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করি, আপনি যাবেন তার কাছে দেখাতে? এমনিতে এ কেস কোর্টে এলে একসময় কোর্টই হয়ত এরকম আদেশ দেবে।"
    জয়ন্ত বেশ উৎসাহ দেখিয়েই বলল,
    -"নিশ্চয়, যাব না কেন? তবে আমি এ নিয়ে আগে আমার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নিই, তারপরে আপনাকে জানাব।"
    শ্রীমতী চা নিয়ে এসে ঘরের সহজ আবহাওয়া দেখে একগাল হেসে রাইয়ের পাশে বসল, ঠিক সেই মুহূর্তে অভিনবের ফোনে মেসেজের ঘন্টা বাজে।
    -"জয়ন্ত, দেখুন তো এই ছবির লোকটিকে আপনি সেদিন রাস্তায় কোথাও দেখেছিলেন বলে মনে পড়ছে কিনা? কিছুদিন আগে বিদ্যুতনগরে এর লাশ পাওয়া গেছে।"
    জয়ন্তকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখালো, মুখ নীচু করে কী যেন ভাবল। মুখ তুলে জয়ন্তর খেয়াল হল ঘরের বাকী সদস্যরা ওরই দিকে তাকিয়ে, অপেক্ষায়। রাই অবাক, জয়ন্ত মোতিকে চিনত? ওকে কেমন দেখাচ্ছে, খবরট পেয়ে আপসেট মতন। কেন?
    -"এ তো দীনেশ। সেরাতে এই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছিল আমায়। দীনেশের লাশ পাওয়া গেছে! তাই বোধহয়।" কথাটা শেষ করেনা অভিনবের দিকে জয়ন্তর চোখ পড়ে যায় তার আগে, এত স্মার্ট অফিসার কেমন হতভম্বের মত বলে,
    -"দীনেশ? এই আপনার সেদিনের ড্রাইভার? কী বলছেন আপনি? ভালো করে দেখুন।"
    রাই কেমন যেন অবাক হতে গিয়েও হয়না, একটা টুকরো বুঝি হাতে আসছে।
    জয়ন্ত সত্যি বলছে, তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তবে সে দীনেশ বা মোতির মৃত্যুসংবাদে এত আপসেট কেন সেটা বোঝা যাচ্ছেনা, একদিনের পরিচিত ড্রাইভারের জন্যে ব্যকুল হবার মত বান্দা জয়ন্ত নয়।
    খুব দ্রুত, বিদ্যুতগতিতে ভাবতে থাকে সে এসব আর তাই জয়ন্ত অভিনবের প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই সে চুপ থাকার কথা ভুলে গিয়ে বলে ওঠে,
    -"অভি, এক্ষুনি চোরগোড়েকে ফোন কর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে গিয়ে সুন্দরনগর প্রজেক্টের ড্রাইভার দীনেশকে অ্যারেস্ট করে থানায় আনতে বল।"
    জয়ন্ত আর শ্রীমতী অবাক হয়ে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, অভি সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের ওপর রাখা মোবাইল তুলে নিয়েছে আর তখনই ফোন বেজে ওঠে, চোরগোড়ের ফোন!
  • S | 109.26.201.94 | ১৮ জুলাই ২০১৩ ০৭:১২495918
  • আরো চাই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন