এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • রহস্য গল্প : প্রতিচ্ছায়া

    shrabani
    অন্যান্য | ১১ অক্টোবর ২০১১ | ২০৯৯৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shrabani | 124.124.86.101 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ১১:১৪495728
  • **************************************
    তেমাথার সিগন্যালের আগেই ডান দিকে পড়ে বাজারের টার্ন টা। সিগন্যালে আজ গাড়ীর লাইন লেগেছে, সন্ধ্যের সময় অফিস ফেরতাদের ভীড়। লাইনটা না নড়লে গাড়িটাকে বাজারের রাস্তায় ঢোকাতে পারছেনা অর্ক। বিরক্ত হয়ে হর্ন বাজায়, পাশে রাজীও বিরক্তিতে ভ্রু কোঁচকায়। রাজীর বিরক্তিটা অবশ্য অন্য কারণে এবং ওরই উদ্দেশ্যে সেটা না তাকিয়েও বুঝতে পারে। অর্ক একটু চঞ্চল, অস্থির প্রকৃতির, রাজী একদম উল্টো। শান্ত ধীর, সব কাজই করে ধীরেসুস্থে। অর্কর এই সবতাতেই তাড়াহুড়ো, অসহিষ্ণুতার ভাব রাজীর একেবারেই পছন্দ নয়।

    সিগন্যাল সবুজ হতেই গাড়ীগুলো প্যাঁ পোঁ হর্ন বাজিয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছে, অর্ক রাগটাকে চাপা দিতে ধড়াম করে টার্ন করলো। সরু রাস্তা, গলির থেকে একটু বড়, একটা রিক্সাকে প্রায় ধাক্কা দিতে দিতে সামলে নিল। কিছুটা গিয়ে আনন্দ হসপিটালটা পেরিয়ে শান্তি বিহারের বাজার এলাকা শুরু। চারিদিকে অসংখ্য ছোট ছোট দোকান, ঘিঞ্জি মত, হকাররা ফুটপাথ উপচে রাস্তার ওপর এসে পড়েছে। তার ওপরে কোথাও সবজি, ফল, ভুট্টাপোড়া, কোথাও বা মেয়েদের নানা কসমেটিক আর জামাকাপড়ের সম্ভার নিয়ে রাস্তা জুড়ে ঠেলারা দাঁড়িয়ে। একেবারে বাংলার ছোট মফস্বল শহরের বাজারের মত। তারই মধ্যে রাস্তা দিয়ে অবিরত রিক্সা, ট্যু হুইলার আর গাড়ি আসছে যাচ্ছে। একটা মেন রোড আছে এই রাস্তার সমান্তরাল, কিন্তু লোকে তবু এই সরু রাস্তাতেই ঢুকবে। রাস্তাটা দেখতে গেলে হয়ত খুব সরু নয়, অর্ধেকটা এই হকার আর ঠেলার কবলে চলে গিয়েই এমন একটা গলির চেহারা নিয়েছে।

    চারদিকে তাকিয়ে পার্কিং এর জন্য একটা মোটামুটি ফাঁকা জায়গা খুঁজতে লাগল অর্ক, গাড়িটার গতি ধীরে করে। মেন রোড আর এই রাস্তাটাকে যুক্ত করছে একটা ছোট গলিপথ। সেই অন্ধকার পথের ধারে এক জায়গায় একটা পাঁচিল ভাঙা ছোট্ট পার্ক মত আছে,সবুজ অঞঅল। ভেতরটায় দেখলে অবিশ্যি সবুজের খুব বেশী কিছু অবশিষ্ট নেই, কয়েকটা বড় বড় গাছ আছে যদিও পাঁচিলের সীমানা ঘিরে। বাকি পুরো পার্কটাতেই বাজারের যত জঞ্জাল তাই জমা হয়েছে। পার্কের পাশে অন্ধকার গলিটায় অনেক গাড়ী রাখা আছে। এই দিকটায় ভীড় তেমন নেই। ভাঙা পাঁচিলের ধারে খালি একটা জায়গা দেখে অর্ক গাড়ী পার্ক করল। চারদিকটা নোংরা,উল্টোদিকে একটা তিনতলা বাড়ীতে রাজ্যের সাইনবোর্ডে দেওয়াল প্রায় দেখাই যায় না, নীচেতলায় অন্ধকারমত চাতাল ঘিরে ছোট ছোট দোকানের খুপরি। রাজী কোনোরকমে নাকমুখ কুঁচকে, সালওয়ার গুটিয়ে লাফ দিয়ে নর্দমা পেরিয়ে উল্টোদিকে ব্লাউজের দোকানটার সামনে দাঁড়াল।
    অর্ক গাড়ী লক করে এল। দুজনে কেউ কোনো কথা না বলে রাস্তা ধরে বাজারের দিকে হাঁটতে থাকল। অর্কর মুখটা থম মেরে রয়েছে। প্রতিমাসে সাত আট কিলোমিটার ঠেঙিয়ে অন্য রাজ্যে আসতে হয় তাকে বাড়ির গ্রসারী আইটেম কিনতে এই বিচ্ছিরি বাজারটায়। অথচ ওদের বাড়ির পাশেই কি সুন্দর মল, সেখানে একাধিক সুপারমার্কেট। তা পছন্দ না হলে সেক্টরে সেক্টরে শপিং কমপ্লেক্স। দোকানে ফোন করে দিলে লিস্টি মিলিয়ে জিনিস ঘরে পৌঁছে দিয়ে যাবে। তার বন্ধুবান্ধব পড়শীরা সবাই তাই করে। কিন্তু তাকে প্রতিমাসে আসতে হবে এই ঘিঞ্জি বাজারে। প্রতিমাসেই সে এনিয়ে প্রচুর তর্ক করে, কথা কাটাকাটি হয় তবু শেষপর্যন্ত এখানেই আসতে হয়। শান্তিবিহারে এসে রাজীর ছোটোবেলার দোকান থেকে জিনিস না কিনলে তার পরিবারে শান্তি থাকবেনা।

    শান্তিবিহারের এই এলাকা দিল্লীর মধ্যবিত্ত সরকারী চাকুরে আর প্রবাসী কেরালাইট দের একটা বড় ঘাঁটি সেই পুরনো আমল থেকে। রাজীর বাবা মাও এখানেই থাকতেন, রাজী জন্মেছে এখানেই, বিয়ের আগে অবধি এখানেই থাকত। রাজীর বাবা কেরালার, মা বাঙালী। এখন অবশ্য অবসর নিয়ে বাবা মা কেরালায় ফিরে গেছে। যাবার আগে ওরা ওদের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছে। ছোট দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট ছিল। প্রথমে বিক্রি করতে চায়নি, যতই হোক এতবছর ছিল ঐ বাড়িতে, মায়া পড়ে গেছিল। অর্কদের বলেছিল এসে থাকতে, কিন্তু অর্ক রাজী হয়নি। দিল্লী হলেও অর্কর এই জায়গাটা পছন্দ নয়, ফ্ল্যাটটাও এত ছোট। ওর নিজের ফ্ল্যাট কত বড়, তিন বেডরুমের, স্পেশিয়াস। অফিসের কাছেই অভিজাত এলাকা, চারিদিকে সবুজ, চারটে পার্ক, কত গাছপালা। সেসব ছেড়ে ও আসবেনা, রাজীরও সেরকমই মত ছিল। সেইই বাবামাকে জোর করে তাদের পুরনো ফ্ল্যাট বিক্রি করিয়েছিল। ভাড়াটাড়া দিলে ওদেরই দেখাশোনা করতে হবে, সেসব অনেক ঝঞ্ঝাটের, অত সময় কার আছে!

    অর্কর বাবা আর রাজীর বাবার অফিসসুত্রে দুবাড়িতে জানাশোনা। ছোট থেকেই পরস্পরকে চেনে, তবে ঐটুকুই। রাজীদের বাড়ি থেকেই বিয়ের প্রস্তাব আসে। বাবা মার তো রাজীকে দারুন পছন্দ ছিল। শান্ত সংযত, দিল্লীতে জন্মেছে, বড় হয়েছে তবু আজকালকার দিল্লীওয়ালিদের মতো নয়। রাজীদের বাড়িতে ওর ঠাকুমার মত ছিলনা, তিনি চাইতেন কোনো পরিচিত মালয়ালী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হোক রাজীর। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি নিজের বিরাদরীতে রাজীর পাত্র যোগাড় করতে পারেননি। রাজীর মা বাঙালী, গোঁড়া দক্ষিণীরা তাই দোআঁশলা রাজীকে বউ করে তাদের রক্তের কৌলিণ্য নষ্ট করতে রাজী হয়নি, মোটা পণের লোভেও নয়।
    অর্ক ছোট থেকেই রাজীকে দেখেছে, তবে দুজনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক বিয়ের আগে হয়নি। ও কেরিয়ারকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিল, ইঞ্জিনীয়ারিং তারপরে ম্যানেজমেন্ট, পড়াশোনাতেই কতগুলো বছর কিভাবে কেটে গেছে। অবশ্য তার মাঝে দু একটা খুচরো প্রেম যে করেনি তা নয়, তবে কোনোটাই বিয়ে অবধি গড়ায়নি। চাকরি পেল যখন তখন দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, সুজনদা আর দিদি দুজনে ব্যাঙ্গালোরে, ফ্ল্যাটট্যাট কিনে একেবারে সেট ওখানে । বাবা রিটায়ার করে কলকাতায় বাড়ী করেছে। ওর বাবা রাজীর বাবার থেকে সিনিয়র ছিলেন। মা বাবা চলে যাওয়ার পরে এখানে ভাড়া বাড়ীতে এদিক ওদিক করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। সেইসময় অফিসের কজন মিলে একটা সোস্যাইটী শুরু করেছিল, খবর পেয়ে ও সেখানেই ফ্ল্যাট বুক করল। মা বাবা পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় যাবার আগেই রাজীর মা বিয়ের প্রস্তাবটা দেয়।

    সেই প্রথম ও রাজীকে খেয়াল করে দেখে। রঙটা একটু চাপা, মাজা মাজা, তবে চোখ মুখ নাক খুবই সুন্দর, সাবেক দক্ষিণী চেহারায় বাংলার শ্যামল ছোঁয়া। প্রথম আনুষ্ঠানিক পাত্রী দেখার দিনে খোলা রেশম কালো চুলে, কচি কলাপাতা কাঞ্জিভরমে রাজীকে দেখে ওর কেমন যেন পুজোর সময় কলকাতা যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে দেখা ভরা বর্ষার পরের মাঠের ধারের শ্যামলিমার কথা মনে হয়েছিল। মনে ঠিক সেইরকম ঘরে ফেরার,বচ্ছরকার পুজোর আনন্দের অনুভব।
    রাজী, ভালো নাম রাজেশ্বরী। বিয়ের কিছুদিন পরে ওরা নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করে, অর্কর একটা প্রোমোশনও হয়। সব মিলিয়ে ওরা তখন আর মাটিতে নেই, আকাশে উড়ছে। মাঝে মাঝে মা বাবা আসে, এতকালের জায়গা ভুলতে পারেনা। ছেলেমেয়ে ছাড়া কলকাতায় গিয়ে ওদের মন বসেনা। দু বাড়ী মিলে তখন হই হই, সব মিলিয়ে দারুন কাটছিল প্রথম দিন গুলো। রাজী রান্না জানতনা, মা হাতে ধরে শেখায় অর্কর প্রিয় রান্না সব, ইলিশের ভাপা, চিংড়ীর মালাইকারী, আলু পোস্ত।
    ওদের বিয়ের দুবছরের মাথায় হঠাৎ বাবা চলে গেলেন। অর্কর কেমন যেন মনে হয় তারপর থেকেই সব কিরকম অন্য রকম হয়ে যেতে থাকল। মাকে একা আত্মীয়স্বজনের ভরসায় রাখা ঠিক হবেনা বলে প্রথমে দিদি নিয়ে গেল ওর কাছে ব্যাঙ্গালোরে। সেখানে কয়েকমাস থাকার পর অর্ক নিয়ে এল এখানে। মা একদম চুপচাপ হয়ে গেছিল, সংসারের কোনো ব্যাপারে থাকতনা। ততদিনে রাজীর বাবামাও কেরালায় চলে গিয়েছিল, ওর ঠাকুমাও মারা গেলেন অর্কর বাবা যাওয়ার কিছুদিন বাদে। রাজী এসময় গিয়ে প্রায়ই মা বাবার কাছে কেরালায় থাকছিল, ঠাকুমার অসুখ ও বাবা মাকে ওখানে সেটল করতে সাহায্য করার জন্য। এদিকে অর্ক বাবার চলে যাওয়া,বাড়ী, বিষন্ন মা, এসব ভাবনায় এতই ব্যস্ত ছিল যে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকে একটু অমনযোগী হয়ে পড়েছিল। রাজীর এতদিন বাপের বাড়ী থাকাটা ওর সেসময় সুবিধেজনকই মনে হয়েছিল। মাকে সময় দেওয়া, হুটহাট করে কলকাতা চলে যাওয়া, দিদির সঙ্গে নানা আলোচনায় লম্বা লম্বা ফোনকল, এসব নিয়ে নাহলে হয়ত দাম্পত্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হত।

  • shrabani | 124.124.86.101 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ১১:১৯495839
  • মা মোটামুটি একটু সামলে নিয়ে, কলকাতায় একা একা থাকাতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে, ঐদিকের সমস্যা মিটল যখন তখন অর্ক নিজের ঘরের দিকে তাকাল। হয়ত অনেকদিন মন দেয়নি বলেই ওপরে সব ঠিক থাকলেও ভেতরে ভেতরে কেমন একটা অস্বস্তি, কোথায় যেন তাদের জীবনে পরিবর্তন ঘটে গেছে নীরবে। রাজী একটা প্লে স্কুলে চাকরি নিয়েছে, লাঞ্চে যখন অর্ক বাড়ী আসে, সে তখনও ফেরেনা। একা একাই মাইক্রো তে খাবার গরম করে খায়। খাওয়ার মেনু গুলোও কেমন আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিল। প্রথমদিকে ধরে নিয়েছিল বাপের বাড়ীতে নতুন রান্না শিখে এক্সপেরিমেন্ট করছে বউ। কিন্তু যত দিন গেল ঐ কেরালার ডিশগুলৈ তাদের নিত্য খাবার হয়ে গেল। অর্ক অফিস থেকে দেরী করে ফেরে, মাঝে মাঝেই ট্যুরে বাইরে যায়। আগে রাজী নিজে গিয়ে মাছ মাংস কিনে আনত। ইদানীং মাছ আসেই না প্রায়। অর্ক আনলেও রাজী রাঁধেনা,খায়না, রান্নার মেয়েকে দিয়ে কোনোরকমে কিছু বানানো হয়। রাজীর মা বাঙালী, ও ছোটোবেলা থেকে বাংলাদেশের খাবারে অভ্যস্ত। অর্কর মায়ের রান্না ওর একসময় ভীষণ পছন্দের ছিল। কিন্তু এখন যেন ওর যা কিছু বাঙালীয়ানা সবেতেই একটা অয়ালার্জী। এসব ছাড়াও নানা অজুহাতে প্রায়ই বাবা মার কাছে চলে যায়।

    কিভাবে কী হচ্ছিল অর্ক বুঝতেও পারেনা। সামান্য খাওয়াদাওয়া নিয়ে বা বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে তার আধুনিকমনস্কতায় বাধে। অর্ক, রাজী দুজনেই বলতে গেলে দিল্লীরই ছেলেমেয়ে। ওদের মধ্যে প্রাদেশিকতার আঁচ তেমন নেই, হিন্দী বলে স্বচ্ছন্দে, পোশাকাআশাকেও এদিককার মতই। ইদানীং রাজীর হাবে ভাবে চালচলনে যেন কেমন দক্ষিণের ছোঁয়া। এসব অনুভব করলেও, অফিসে সে এত ব্যস্ত থাকে, নিজের কেরিয়ার নিয়ে, এর ওপরে বাড়ী নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় বিশেষ থাকেনা। তাই রাজীর এরকম পরিবর্তন দেখলেও সে চুপ করে থাকে। শুধু মা কখনো এলে একটা চাপা টেনশন অনুভব করে। রাজী মায়ের দেখাশোনা সবই ঠিকঠাক করে তবু বোধহয় আগের সেই আন্তরিকতা আর থাকেনা, কেমন যান্ত্রিক সব। তার মা মুখে কোনো কিছু বলেনা, তবু আজকাল আসতে চায়না। জোর করে নিয়ে এলেও দু সপ্তাহের বেশী মাকে রাখা যায়না। অথচ দিদির ওখানে গিয়ে মা মাসের পর মাস থাকে। অর্ক চায় মা কিছুদিন থাকুক, মা থাকলে খাওয়াদাওয়াটা একটু স্বাভাবিক হয়, আগের মত। তবে নিজের জীবনের দুই গুরুত্বপুর্ণ মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে সে এ নিয়ে কিছু বলেনা, দুরে থেকে শান্তি বজায় রাখাই ভালো।
    চারবছর হল তাদের বিয়ে হয়েছে। এমনিতে বাইরে থেকে দেখলে সুখের সংসার। বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা সবাই বলে, রাম মিলায়ে জোড়ী। রাজী শান্ত, অত্যন্ত সুন্দর ব্যবহার, ঝগড়াঝাঁটী নেই, গোছানো বাড়ী। তবু অর্ক জানে, হয়ত বা রাজীও, যে তাদের মধ্যে কিছু আছে বা কিছু নেই যার জন্য তারা সম্পূর্ণ নয়।

    দোকানদারটা অর্ককে দেখলেই মালয়ালামে কথা বলবে, অর্ক হিন্দী বললেও লোকটা উত্তর ওদের ভাষায় দেবে। এই নিয়ে কিছুক্ষণ গোলমাল হয় প্রতিবারেই। রাজী দোকানে এসেই যেন নিজের জায়গায় এসে গেছে এমন একটা ভঙ্গী করে দোকানের একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এটা সেটা নানা জিনিস নিতে থাকে, আদ্ধেকের নামও জানেনা অর্ক। সে শুধু চাল ডাল তেল নুন মশলা এসব হিসেব করে নেয়। প্রায় তিরিশ চল্লিশ মিনিট লেগে গেল, সব নিয়ে হিসেব করে টাকাপয়সা মেটাতে। দুটো ছেলে মালপত্রের ভারী ভারী ক্যারি ব্যাগ গুলো বয়ে নিয়ে চলল ওর সঙ্গে গাড়ীতে তুলে দিতে। অর্ক যেতে যেতে রাজীকে ডাক দিল। রাজী তখন দোকানের সামনের ফুলওয়ালির কাছে দাঁড়িয়ে মালার দর করছে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে ইশারায় ওকে যেতে বলল, সে আসছে। এই এক ঢং জুড়েছে প্রতিমাসে, এক গুচ্ছ মালা কিনে নিয়ে গিয়ে ফ্রিজে রেখে রোজ বিকেলে মাথায় দেবে সাউথের বউ মেয়েদের মতো। অর্কর এই ফুলের গন্ধটা একেবারেই ভালো লাগেনা, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে এত উগ্র লাগে। অথচ এখন থেকে কমকরে হপ্তাখানেক তার ঘরের আনাচে কানাচে, বিছানায়, বউয়ের গায়ে এই গন্ধ!

    গাড়ীর ডিকিটা মালে ভরে গেল। রাজীর তখনও দেখা নেই। ছেলে দুটোর হাতে দুটো দশটাকার নোট বকশিশ দিয়ে অর্ক গাড়ীতে গিয়ে বসল। কাজ হয়ে যাওয়ার পর এক মুহুর্তও আর তার এই জায়গাটায় থাকতে ভালো লাগছেনা। প্রতিবার রাজী এরকম করে, মালা কিনবে, এদোকান ওদোকানে উঁকি মারবে। এখানে এলে কেমন একটা মিডল ক্লাস গাঁইয়া গাঁইয়া আচরণ করে ও। অথচ রাজী এমনিতে যথেষ্ট স্মার্ট, পার্টি টার্টিতে বা বাইরে হোটেলে গিয়ে যথাযথ ব্যবহার করে, তখন কেউ বলবেনা বাড়ীতে আজকাল এই রাজীর সারা শরীরে নারকেল তেল আর মল্লিকা ফুলের গন্ধ জড়ানো থাকে। তবে অনেক চেষ্টা করেও রাজী রান্নার তেলের জায়গায় নারকেল তেল ঢোকাতে পারেনি, এটাই বাঁচোয়া। এই একটা ব্যাপারে অর্ক প্রচন্ড আপত্তি জানিয়েছে।

    প্রায় কুড়ি মিনিট পেরিয়ে গেল, জানালার কাঁচ খুললে একটা বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ আসছে পাশের নোংরার স্তুপ থেকে। এদিকে সব বন্ধ করে ভেতরে বসলে অস্বস্তি হচ্ছে। আজ এমনিতেই মেজাজ খারাপ, তারওপর রাজীর এই ব্যবহার। অর্ক মনে মনে একটা গালাগালি করে উঠল কোনো অজানা কারুর উদ্দেশ্যে, আর কোনোদিন সে এখানে আসবেনা। রাজীকে সোজা বলে দেবে সামনের মাস থেকে অন্যদের মত কাছাকাছি কোথাও থেকে জিনিসপত্র নিতে। ওসব পেঁয়াজ, কচু, কলা, মোটা চাল খেতে হয় কেরালায় গিয়ে খাও। এখানে যেমন আর পাঁচটা লোকে যা খায় তাই খেতে হবে।

    অনেকক্ষণ হয়ে গেল, এবার দু:শ্‌চিন্তা হচ্ছে। রাজীর কাছে মোবাইল আছে, অর্ক কল করল। কোথায় আটকে রয়েছে এতক্ষণ! রিং হয়ে গেল, কেউ তুলছেনা। মনে পড়ল মোবাইল রাজীর পার্সের ভেতরে, হয়ত শুনতে পাচ্ছেনা বাজারের ভীড়ে, আওয়াজে। অর্ক নেমে এল গাড়ি থেকে, লক করে দরজার হাতলটা টেনে দেখে আবার বাজারের দিকে পা বাড়াল। কপালে বেশ কয়েকটা রেখা ফুটে উঠেছে, আর বিরক্তির নয়, চিন্তার।
    ******************************************
  • shrabani | 124.124.86.101 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ১১:৩৮495950
  • ******************************************************
    এদেশে পুজোর আগে আগে এই সময়টা রাইয়ের সবচেয়ে ভালো লাগে, না ঠান্ডা না গরম, শরতের দিন। এসময় বাইরেটা এত সুন্দর হয়ে ওঠে, রোদ ঝলমল অথচ রোদের আঁচ লাগেনা গায়ে। গাড়ী থেকে নেমে ও আলোকের হাতে ব্যাগটা দিয়ে দিল। আলোক হাসল, রাই এখন কিছুক্ষণ গিয়ে পার্কে বসবে। বাচ্চারা খেলছে, মহিলারা জোট বেঁধে গল্প করছে। আসলে ওপরে নিজেদের ফ্ল্যাটে উঠে গিয়ে একবার ঘরের কাজে লেগে গেলে আর নীচে আসার ফুরসত হবেনা। তাই ও অফিস থেকে ফিরে কিছুক্ষণ নীচে খোলা হাওয়ায় কাটিয়ে তবে ওপরে যায়। আলোক ওপরে গিয়ে টুপাইকে পাঠিয়ে দেবে। যতক্ষন তারা কেউ না ফেরে মেয়ের নীচে এসে খেলার অনুমতি নেই। আলোক তৈরী হয়ে চা টা বানাবে যদি না রান্নার মেয়েটা এসে গিয়ে থাকে। রাই ওপরে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে চা খেয়ে রান্নার মেয়েটার সঙ্গে লাগবে, টুপাই ফিরলে তার হোমওয়র্ক নিয়ে বসবে, নিত্য কর্ম।
    এই আধঘন্টা ও একটু ঘাসে পা রেখে দাঁড়িয়ে মহিলাদের গসিপ, বাচ্চাদের হুল্লোড় এসবের মধ্যে সারাদিনের স্ট্রেসটাকে রিলিজ করে ফ্রেশ হতে চেষ্টা করে। মিসেস গুপ্তার কাছে তার বোনের শ্বশুরবাড়ীর গল্প শুনছে এমন সময় টুপাই এসে হাত ধরল,
    -"মাম্মা ওপরে যাও এক্ষুনি, বাবা ডাকছে।"
    রাই বিরক্ত হল। আলোক জানে ও একটু পরেই যাবে, আবার ডাকাডাকি কেন! মেয়েকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
    -"ঠিক আছে, তুমি খেলতে যাও। আমি একটু পরে যাচ্ছি।"
    মিসেস গুপ্তা গল্পে বাধা পড়ায় একটু বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে টুপাইয়ের দিকে তাকালো। মেয়ে তাও নাছোড়বান্দা,
    -"এক্ষুনি যেতে বলল বাবা, সাততলার আন্টি বসে আছে।"
    ও, তারমানে কেউ এসেছে তাই আলোক ডাকছে। সাততলার আন্টি মানে কোন আন্টি জিজ্ঞেস করতে যাবে ততক্ষন বন্ধুদের ডাকে মেয়ে দৌড় দিয়েছে। ওদের ব্লকে প্রতিটা ফ্লোরে পাঁচটা করে ফ্ল্যাট, যে কেউ হতে পারে। মিসেস গুপ্তার কাছে বিদায় নিয়ে ও লিফটের দিকে যায়, আজকের বৈকালিক আড্ডা শুরুতেই ঘেঁটে গেল বলে মুখের ভাবটা একটু অপ্রসন্ন।

    সদর দরজাটা খোলা, সাততলার কোন প্রতিবেশিনীর তার ঘরে শুভাগমন হয়েছে, কে কোন দরকারে এইসময় নীচের আড্ডায় না গিয়ে তার কাছে এসেছে ইত্যাদি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঢুকে দেখল সামনের কৌচে আলোক বসে, অফিসের ড্রেসেই। পেছন থেকে দেখেই বুঝতে পারল, আলোকের সামনে সোফায় বসে মুনিয়া। মুনিয়া ওদের ওপরেই থাকে, ওর স্বামী ভাস্কর আগে রাইদের কোলীগ ছিল, এখন বছরখানেক হল অন্য একটা কোম্পানী জয়েন করেছে। একটু চালিয়াৎ গোছের,তাই রাইয়ের ঠিক পোষায় না এদের সঙ্গে। তবু মুনিয়া মাঝেসাঝে আসে, ওর একমাত্র ছেলেকে হস্টেলে রেখে দিয়েছে, বাড়িতে একা সময় কাটেনা। এবারে অনেকদিন পরে এল।
    আসলে অনেকদিন ছিলনা, কলকাতায় গেছিল, বোধহয় দুতিনদিন আগেই ফিরেছে। ওর মায়ের অসুখ শুনেছিল, রাইয়ের খোঁজ নেওয়াও হয়নি। ওকে ঢুকতে দেখে আলোক উঠে দাঁড়ালো, মুনিয়াও মাথা ঘুরিয়ে তাকালো।
    -"আরে মুনিয়া, কবে ফিরলে? মাসিমা কেমন আছেন এখন?"
    মুনিয়া হাসি হাসি মুখে বলল,
    -"পর্শু। মা এখন অনেকটা ভালো। এই বয়সে পা ভাঙা, বুঝতেই পারছ। তাই এত তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াবে ভাবিনি আমরা।"
    আলোকের দায়িত্ব শেষ, সে ভেতরে ঢুকে গেল। রান্নার মেয়েটা রান্নাঘরে, রাই মুনিয়াকে একটু অপেক্ষা করতে বলে দ্রুত মেয়েটাকে কী কী হবে বুঝিয়ে দিয়ে চা বসাতে বলে তারপর লিভিং রুমে এসে বসল। গুরুতর ব্যাপার আছে বলেই মনে হয়, নাহলে মুনিয়া এতদিন পর নীচের জমাটি আড্ডায় না গিয়ে ওর কাছে এসেছে!
    মুনিয়ার চোখ গোল গোল ঘুরছে, সারা বাড়ির যতটা দেখা যাচ্ছে সব দিকে। অনেকদিন পরে এসেছে, নতুন কী কী হয়েছে তার জরীপ করে নিচ্ছে। রাই আসতেই বলল,
    -"শোনোনা, এই ঘড়িটা নতুন কিনলে। আগে তো দেখিনি। বেশ লাগছে কিন্তু, অয়ান্টিক পিসের মতো।"
    -"হ্যাঁ, ঐ মেলা বসেছিল না স্টেডিয়ামে নতুন বছরে, সেখান থেকে নিয়েছি। বাপন কেমন আছে? ওর এবারে ইলেভেন হল না?" বাপন মুনিয়ার ছেলের নাম।
    ছেলের নামে মুনিয়া একটু উদাস হয়ে পড়ল।
    -"হ্যাঁ,ইলেভেন হল। পড়াশোনার খুব চাপ পড়েছে। হস্টেল থেকে কোচিং যাতায়াত করতেও খুব স্ট্রেন পড়ছে। ভাবছি সামনের বছর হস্টেল থেকে নিয়ে এসে মার কাছে রাখব। আমিও মাঝে মাঝে গিয়ে থাকব।"
    রাইয়ের এখন খোশগল্পের সময় নেই। মুনিয়া কিজন্য অসময়ে তার বাড়ীতে তা আগে জানতে হবে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করাটা অভদ্রতা। কথা ঘুরোতে বলল,
    -"মুনিয়া, তুমি আজ নীচে যাওনি? আমরা সবাই তো নীচে আড্ডা মারছিলাম।"
    কাজের মেয়েটা চা নিয়ে এল। আলোক শোবার ঘরে টিভি খুলে বসেছে, তার চা সেখানেই পাঠিয়ে দিল। মুনিয়া একটু আপত্তি করে শেষে জোরাজোরিতে কাপ তুলে নিল হাতে।
    -"আরে আমি নীচেই যাচ্ছিলাম। ভাস্কর পাঠালো তোমার কাছে। তুমি অর্ককে চেন?"
    রাই বুঝতে পারলনা, মুনিয়ার বর কেন তাকে ওর কাছে পাঠাবে। কোনো অফিসিয়্যাল ব্যাপার হলে নিজে কেন আসবেনা! তবে মুনিয়াকে দেখে মনে হচ্ছেনা কোনো সিরিয়াস ব্যাপার, ও বেশ গল্পের মুডেই। রাইও তাই একটু এলিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
    -"না গো। কে অর্ক? আমাদের অফিসের? তা ভাস্করও এল না কেন?"
    -"ভাস্কর বাজারে গেছে, চুলটুল কেটে আসবে,দেরী হয়ে যাবে। অত রাতে তো তোমার বাড়ি আসা ঠিক হবেনা তাই। অর্ক বাঙালী, ভাস্করদের ওখানেই কাজ করে । ওর বউ সাউথ ইন্ডিয়ান, পুজোর সময় দেখোনি? কালো হলেও খুব মিষ্টিমতন মুখটা, দারুন দারুন কাঞ্জিভরম পরে আর ভালো বাংলা বলে। পরে শুনলুম ওর মা নাকি বাঙালী তাই এত ভালো বাংলা বলে।"

    রাই এরকম কোনো মেয়েকে মনে করতে পারল না। অর্ককেও সে চেনেনা। সে আর আলোক দুজনেই ছোট থেকে প্রবাসী,বাঙালীয়ানার বাড়াবাড়ি নেই,পুজো টুজোতে যায় এই পর্যন্ত।
    মুনিয়াকে এখন বেশী জিজ্ঞেস করলেই সে এককথায় দশটা কথা বলবে। তাই বেশী এদিকসেদিক না করে ও সরাসরিই জিজ্ঞেস করে,
    -"তা কী হয়েছে সেই অর্কর? আমার কাছে কেন?"
    ওর মনে অফিসের চিন্তাটাই আসছে। ভাস্করদের কোম্পানী এই প্রথম নতুন সেক্টরে ঢুকছে, তার জন্য তাদের অফিস থেকে বেশ কিছু লোককে ভালো অফার দিয়ে নিয়ে গেছে। অনেক ব্যাপারে ভাস্করের পুরনো অফিস থেকে কোনো কিছু দরকার হলে সে তার বা আলোকের শরণাপন্ন হয়। রাই বিরক্ত হল, ভাস্কর নিজে না আসতে পারলেও ফোন করতে পারত। মুনিয়াকে পাঠানো মানে সময় নষ্ট। এমনও হতে পারে মুনিয়া নিজেই যেচে ভাস্করের জায়গায় এসেছে, রাইদের হাঁড়ির খবর পায়নি অনেকদিন তাই।
    -"অর্কর বউ মানে রাজী আজ দিন পাঁচেক হল নিখোঁজ। দুজনে শান্তিবিহার গিয়েছিল দোকান করতে। ফেরার সময় অর্ক আর বউকে খুঁজে পায়নি।"
    রাই এবার ভালো করে উঠে বসল। হাতের কাপটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে তাকালো মুনিয়ার দিকে।
    -"খুঁজে পায়নি মানে? শান্তিবিহারে গিয়েছিল দোকান করতে, অত দূরে কেন? বউটার অয়াফেয়ার ট্যাফেয়ার ছিল নাকি,কারো সঙ্গে পালিয়ে যায়নি তো ?"
    এতগুলো প্রশ্ন একসাথে শুনে মুনিয়া হেসে ফেলল।
    -"আরে বললাম না ওর বউ সাউথ ইন্ডিয়ান। শান্তি বিহার তো ওদেরই এলাকা। ওর বউ তো বিয়ের আগে বাবা মার সাথে শান্তিবিহারেই থাকত। এখন রিটায়ার করে ওর বাবা দেশে চলে গেছে। ওদিকের কোন সাউথ ইন্ডিয়ান দোকানে ওরা মাসকাবারী দোকান করতে যায় প্রত্যেক মাসে।
    ভাস্করের সঙ্গে অর্কর আলাপ অল্পদিনেরই। আমাদের সঙ্গে এমনি পারিবারিক যোগাযোগ খুব একটা নেই। অনেক জুনিয়র, সার্কল আলাদা। ভাস্কর একবার আমার সঙ্গে অফিসের একটা অনুষ্ঠানে অর্ক আর তার বউয়ের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। এই আমাদের পাশের সেক্টরেই থাকে, ঐ নতুন সোস্যাইটী, গার্ডেন সিটীতে। বছর তিনেক হল বোধহয়,নিজেদের কেনা ফ্ল্যাট। কাজেকম্মে আমাদের শপিং কমপ্লেক্সেই আসে তো। দেখা হলে একটা দুটো কথাও বলেছি। এমনিতে তো সবাই হ্যাপী কাপল বলেই জানে, গোপন কিছু থাকলে জানিনা। তবে কাউকে কিছু বলতে শুনিনি কখনো।"

    রাই একটু ভাবল। সেই তো, মুনিয়া, শম্পা এদের মত পাবলিককে লুকিয়ে অয়াফেয়ার চালানো এ এলাকায় অসম্ভব। ওদের চ্যানেলে কোথাও না কোথাও থেকে ধরা পড়ে খবর ছড়াবেই। কিন্তু দোকান করতে গিয়ে ছেলেটার বউ হারিয়ে গেছে বা পালিয়ে গেছে যাই হোক তা তাতে রাইই বা কী করবে?
    -"তা তুমি আমাকে বলতে এলে কেন? আমি এতে কী করব? পুলিশে খবর দিয়েছে?"
    মুনিয়া মুখটাকে সিরিয়াস করে বলে,
    -"হ্যাঁ,সমস্যা তো সেখানেই। দুদিন ধরে সব জায়গায় খোঁজ করে শেষে পুলিশে খবর দেয়। মেয়েটার বাবামা চলে এসেছে, তারা এসে ছেলেটাকেই দোষ দিচ্ছে। পুলিশের কাছে সেইমত বলেছে, অফিসেও নালিশ করেছে। এখন সবাই অর্ককেই সন্দেহ করছে, এরকম বাজার করতে গিয়ে কেউ নিখোঁজ হয় নাকি! সবার ধারণা অর্ক কিছু লুকোচ্ছে। পুলিশ ওকে শহরের বাইরে যেতে বারণ করে দিয়েছে। রেগুলার হ্যারাস করছে। অর্কর মা এসেছেন, উনি খুব কান্নাকাটি করছেন। ভাস্কর গেছিল ওদের বাড়ি।
    ভাস্কর বলছে অর্ক ভালো ছেলে, একটু সিরিয়াস আর অয়ামবিশাস, আর কোনো দোষ নেই। তোমার তো পুলিশের সাথে জানাশোনা আছে, সোস্যাইটীর সবাই জানে। একটু বলে দেখবে।"
    রাই বিব্রত হল। শম্পার দৌলতে আগের ঘটনাটা জেনে ফেলে এদিকের সবাই তাকে গোয়েন্দা ও পুলিশের লোক ঠাউরেছে! এদিকে মুশকিল হল তার বন্ধু অফিসার অভিনব বদলি হয়ে চলে গেছে এখান থেকে। ওর সাথে যোগাযোগ অবশ্য আছে কিন্তু এতদুর থেকে ও কিভাবে সাহায্য করবে! তবু একটু কৌতূহল হচ্ছে পুরো ঘটনাটা জানতে। মেয়েটাকে কি দেখেছে ও, কেজানে! হয়ত মুখ দেখলে চিনতে পারবে! পুরো ব্যাপারটা জানতে হবে, আর সেটা ঠিক মুনিয়া বলতে পারবে বলে মনে হয়না।
  • shrabani | 124.124.86.101 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ১১:৪২495966
  • ঘরের কাজ পড়ে আছে অনেক, বসে গপ্প করলে চলবেনা। তাই ও বলে,
    -"মুনিয়া, আমার বন্ধু অভি তো এখন এখানে নেই, বদলি হয়ে গেছে। আমি আর পুলিশের কাউকেই সেরকম চিনিনা। তবু তুমি একবার ভাস্কর ফিরলে বোলো আমাকে ফোন করতে।"

    কিছুক্ষণ গল্প করে মুনিয়া চলে যেতে রাই জামাকাপড় ছেড়ে ঘরের কাজে লেগে পড়ল। নানা কাজে আর খেয়ালই রইলনা মুনিয়ার কথাটা। রাত তখন প্রায় দশটা বাজে। খাওয়াদাওয়া সেরে টিভিতে নিউজ দেখছে দুজনে। টুপাই নিজের ঘরে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে। ইন্টারকম বেজে উঠল, আলোক একবার ওর দিকে তাকালো। রাই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে, ওঠার লক্ষণ নেই। আলোক রাজ্যের বিরক্তি দুচোখে জড়ো করে বসার ঘরে গেল ফোন তুলতে।
    -"রাই, ভাস্কর। তোমাকে ডাকছে।" জোরে হাঁক শুনেই রাইয়ের মনে পড়ে গেল সন্ধ্যের কথা। তাই তো, সে মুনিয়াকে বলে দিয়েছিল ভাস্কর যেন ফোন করে।
    রাই ফোনের কাছে যেতে যেতে ততক্ষনে আলোক আর ভাস্কর নিজেদের অফিসের গপ্প জুড়ে দিয়েছে। দুমিনিট কথা বলার পর আলোক রাইকে ফোনটা দিল।
    হেলো বলতেই ওদিক থেকে ভাস্করের গলা,
    -"আরে রাই, ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি? এত দেরী হল ফোনে আসতে? নাকি অসময়ে বিরক্ত করলাম?"
    হ্যা হ্যা করে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল। রাই ভাস্করের এধরণের কথাকে খুব একটা পাত্তা দেয়না। সোজাসুজি কাজের কথায় এল।
    -"ভাস্কর, মুনিয়া ঐ তোমার পরিচিত অর্কর কথা সব বলল। ও তো দেখলাম খুব বেশী কিছু জানেনা। আমি পুরো ব্যাপারটা জানতে চাই, এমনিই ইন্টারেস্টিং লাগছে। তবে পুলিশের ব্যাপারে সাহায্য কিছু করতে পারবনা। আমার বন্ধু তো আর এখানে নেই, গোরখপুরে বদলি হয়ে গেছে।"
    ভাস্কর একটু হতাশ ভঙ্গী করল।
    -"কিছু করতে পারলে ভালো হত। ছেলেটা ভালই, একটু ফেঁসে গেছে। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, সবাই ওকেই সন্দেহ করছে।"
    -"তা ওদের মধ্যে কি কোনো গন্ডগোল চলছিল, কিছু জানো?"
    -"যতদুর জানি সেরকম কিছুই না। আসলে সমস্যাটা সেখানেই। ওর বন্ধু, প্রতিবেশী সবাই বলছে ওদের মধ্যে কোনো গন্ডগোল ছিল না, অন্তত থাকলেও কেউ কিছু জানতে পারেনি। মেয়েটা খুব ভাল ছিল, নরমসরম ভদ্র, বাচ্চা মেয়ে। বছর চারেকের মত বিয়ে হয়েছে, দুই পরিবারে অনেকদিনের জানাশোনা। অর্কর মাও কিছুই জানেন না, উনি তো মাঝে মাঝে এসে থাকতেন।"
    -"তাহলে যে মুনিয়া বলল মেয়েটার মাবাবা অর্ককে দুষছে?"
    -"সেটা খুব একটা সিরিয়াস কিছু না। এমনিতে ওরাও কোনো গন্ডগোলের কথা জানেনা। তবে একমাত্র মেয়ে, এভাবে নিখোঁজ, স্বভাবতই তাদের মাথার ঠিক নেই। আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি, সবই ভেগ। দোকানদার পুলিশের কাছে বলেছে অর্ককে মাল দেওয়ার কথা, রাজীও সঙ্গে ছিল। দোকানের দুটো ছেলে অর্কর সঙ্গে গিয়ে মাল তুলেছে গাড়ীতে। এর কিছুক্ষণ পরে অর্ক এসে দোকানে রাজীর খোঁজ করে, তারপরে সামনের ফুলওয়ালিকে জিজ্ঞেস করে। অর্ক যখন মাল নিয়ে গাড়ীর দিকে যাচ্ছিল, রাজী তখন ফুলবিক্রেতা মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে মালার দর করছিল। ফুলওয়ালি অবশ্য কিছু বলতে পারেনি, তার কাছে সন্ধ্যে থেকে অনেক মেয়েই ভীড় করেছে, সে অর্ককে চেনেনা।
    এরপর ওখানে আশেপাশের দোকান গুলোতে অর্ক খুঁজেছে। পুলিশ খোঁজখবর করে জেনেছে।"
    -"অর্ক সেই রাতেই কেন পুলিশকে খবর দিলনা?"
    ভাস্কর একটু ভাবল, তারপরে বলল,
    -"রাই, আমি ঠিক জেরা করিনি অর্ককে, আমার সে এলেমও নেই। পুলিশ ওকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমি অর্ককে এমনি চিনি, খুব ক্লোজ না। আমার তো ঐ অফিসে বেশীদিন হয়নি। অফিসে দেখাসাক্ষাত হলে একটু কথা, ক্যান্টিনে কখনো বসেছি একসাথে চা নিয়ে। তবে বিদেশে বাঙালী ঝামেলায় পড়েছে, একটু দেখতে তো হয়ই, আবার অফিসেরই ছেলে। খুবই ভেঙে পড়েছে, একে বউয়ের কী হল সে নিয়ে দু:শ্‌চিন্তা তারওপরে এই পুলিশের ঝামেলা। পুলিশ ঠিক কী ভাবছে, সেটাও যদি পরিস্কার হত তাহলে ওদের সন্দেহটা দুর করার চেষ্টা করা যেত। রাজী কে আমি দেখেছি দু চারটে অফিসের ফাংশানে, পার্টিতে। খুবই ভালো লেগেছে, দুজনে চম্‌ৎকার মিলমিশ। এই তো কবছর বিয়ে হয়েছে, আনন্দ করার বয়স সব।"
    রাই একটু অন্যমনস্ক, কী যেন ভাবছে ভাস্করের কথার মাঝেই। শেষ বাক্যটা ভাস্কর জোরে বলতেই একটু হুঁশ হল।
    -"মেয়েটার নাম রাজী? খুব সুন্দর নাম তো।"
    ভাস্কর হাসল,
    -"আসলে রাজেশ্বরী, ডাকে সব রাজী বলে। মেয়েটাও সুন্দর, ভালোয় ভালোয় ফিরলে বাঁচি। পুলিশের উচিৎ অর্ককে ছেড়ে আগে মেয়েটার হদিশ করা।"

    রাই আর কিছু বলেনা, ভাস্করকে কোনো আশ্বাসই দিতে পারেনা। অভি আশেপাশে কোথাও থাকলে তবু নাহয় চেষ্টা করা যেত। ফোন রেখে শুতে গেল যখন আলোক নাক ডাকাচ্ছিল। টিভি বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুতে যাবে, আলোক জেগে গেল।
    -"কেসটা কী? ভাস্কর আবার কী ঝামেলা পাকাচ্ছে?"
    রাই ওকে সব কথা বলল,
    -"তুমি চেন এই অর্ককে?"
    আলোক ঘাড় নেড়ে বলল,
    -"তবে কেসটা বেশ মিস্টিরিয়াস তো। ধরা গেল মেয়েটা কোনো প্রাক্তনের সাথে ভেগেছে, কিন্তু ব্যাকড্রপটা এমন চুজ করল কেন? শান্তিবিহারের ভীড় বাজার! অর্ক তো ট্যুরে যায়, অফিসেও অনেকক্ষন থাকে। সেইসময় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত। অথবা বাপের বাড়ি যাবার নাম করে বেরিয়ে যেতে পারত। ইন ফ্যাক্ট, এভাবে বাজার থেকে গায়েব হওয়া তো রিস্কের। অর্ক ওকে একা নাও ছাড়তে পারত। ওর সঙ্গে সঙ্গে থেকে ওকে নিয়েই গাড়ী অবধি যেতে পারত। এতো একটা চান্সের ব্যাপার হয়ে গেল।"
    রাই ও আলোকের বিশ্লেষণে সায় দিল।
    -"ভাস্কর খুব কিছু জানেনা। পুলিশ কী ভাবছে জানতে পারলে হত! আমি শান্তিবিহারের বাজার দেখেছি। সেখান থেকে ঐ ভর সন্ধ্যেয় ভীড়ের মাঝে মেয়েটাকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে, এটাও খুবই আনলাইকলি। মেয়েটা নিজের ইচ্ছেয় হারানোর ব্যাপারে তোমার যুক্তিগুলো আছে। পাঁচদিন হয়ে গেছে, মেয়েটা নিজে গেলে বাবা মার সাথে যোগাযোগ করবে না?"
    আলোক বিছানায় উঠে বসল,
    -"এমন তো নয়, ওর বাবা মা সব জানে। ছেলেটাকে প্ল্যান করে হ্যারাস করা হচ্ছে। তুমি এক কাজ কর না, অভিকে একবার ফোন কর। যতই হোক পুলিশের বড় অফিসার, এদিকে ছিল তিনবছর। চেনাশোনা নিশচয়ই আছে। ভেতরের ব্যাপারটা জেনে নিয়ে তোমাকে জানাতে পারবে।"
    রাইয়ের কথাটা মনে ধরল। অভিরা এখান থেকে চলে যাওয়ার পর প্রথম দিকে খুবই ফোন হত। এখন একটু কমে এসেছে, তাও হয় রেনুর সাথে। ওখানে অভি খুবই ব্যস্ত, ক্রাইম খুব বেশী, বিহার নেপাল বর্ডার কাছাকাছি। তবু একবার চেষ্টা করতে দোষ কী!

  • shrabani | 117.239.15.102 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ১২:৪৬495977
  • ******************************************
    সকালের হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা, গা শিরশির করে উঠল রমার, পায়ের দিকে রাখা চাদরটা টেনে গায়ে জড়ালেন। রাতে কদিন ঘুমই হচ্ছেনা ঠিক মত। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সাড়ে পাঁচটা বাজে। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর আর ইচ্ছে করলনা। উঠে পড়লে, পায়ে পায়ে হল পেরিয়ে বারান্দায় দিকের দরজাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালে। ভোরের আকাশটা কী সুন্দর লাগছে, চারিদিক কী শান্ত। এমন একটা সকালে নিস্তব্ধ এই বাড়ী দেখলে কেউ বুঝতেই পারবেনা এখানকার বাসিন্দাদের মনে উথালপাথাল সমুদ্রের ঝড়। মনে পড়তেই মাথার মধ্যে কেমন করে উঠল, রেলিং ধরে টাল সামলালে, ঝর ঝর করে দুচোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল। কোথায় যে গেল মেয়েটা! সবাইকে কাঁদিয়ে এভাবে লুকোচুরি খেলছে কেন, কেন!
    দুটো শক্ত হাত পিছন থেকে সবলে জড়িয়ে ধরল রমাকে।
    -"মা, প্লিজ তুমি আবার এমন করছ? এবারে কিন্তু তোমাকে ব্যাঙ্গালোরে পাঠিয়ে দেব। এখানে এভাবে থাকলে তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে।"
    ছেলের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন আস্তে আস্তে। চোখ মুছে বললেন,
    -"তুই উঠে পড়েছিস? কিছু ভাবতে হবেনা,আমি ঠিক আছি রে। যাই চা বসাই।"
    অর্ক আর কিছু বলল না। মাকে ছেড়ে লিভিং রুমে গিয়ে বসল, কাগজ আসেনি এখনো। একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল সেন্টার টেবিল থেকে। মা এল চা নিয়ে।
    -"কাল রাতে জিনুর সঙ্গে কী কথা হল রে? সুজনের কোন আত্মীয় যে কলকাতা পুলিশে আছে, কিছু যোগাযোগ করা গেল তার সঙ্গে।"
    অর্ক একটু ভাবল। মা দিনরাত এইসব নিয়ে চিন্তা করে চলেছে, এটা ঠিক নয়। এমনিতেই বাবা চলে যাবার পর থেকে মা মনমরা হয়ে থাকে, তারওপর এই ব্যাপার। সে একটু হাল্কা সুরে বলল,
    -"কলকাতা পুলিশের লোককে এদিককার পুলিশ পাত্তা দেবে কেন! ও আমি সুজনদাকে বারণ করে দিয়েছি কিছু বলতে। দিদি পরের সপ্তাহে আসছে। ওর এক বন্ধু টাইমসএ জার্নালিস্ট। তার সঙ্গে প্রাথমিক কথা বলেছে। এসে দেখা করবে। পুলিশ রাজীকে না খুঁজে যদি আমাদের হয়রান করতেই থাকে তাহলে কাগজে নিউজ করার চেষ্টা করতে হবে। অফিসের ভাস্করদা এসেছিল না? ওর এক পরিচিতা আছে এখানেই, তারও নাকি পুলিশে জানাশোনা আছে। ভাস্করদা বলছিল ভদ্রমহিলা ডিটেকশন করে কেস সলভও করেছে। রাজীকে খোঁজার জন্য ওর সাহায্য নেওয়ার কথা বলছিল।"
    মা একটু আনমনা হয়ে বলল,
    -"শুভা আর গিরীশ যে এরকম অবুঝ হবে শেষমেশ আমি ভাবতেও পারিনি। শুভাকে আমি বোনের মত দেখতাম। ওর অনুরোধেই রাজীকে বউ করি, নাহলে বাঙালী মেয়ের কি অভাব পড়ে গেছিল! ওরা কী করে ভাবল তুই রাজীর ক্ষতি করেছিস? আমি তো জানি তুই কিরকম সহ্য করিস। রাজীর ইদানীংকার ব্যবহার যা হয়েছিল, আমার ছেলে বলে সব সয়েছিল। ওরা সেসবের খবর রাখেনা, নিজের মেয়ের দোষ দেখতে পেল না এখন তোকে দুষতে এসেছে।"
    অর্ক উত্তর করল না। বাইরে কাগজ ফেলার শব্দ হল। ও উঠে গিয়ে কাগজটা নিয়ে এল। মা খালি চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘরে রাখতে গেল। সাড়ে ছটা বেজে গেছে। একটু পরেই কাজের মেয়ে এসে যাবে। অর্কর চোখ গেল পুজোর জায়গাটার দিকে। সকালে স্কুল থাকত বলে রাজীর এতক্ষণে রেডি হয়ে পুজো টুজো সারা হয়ে যেত। অর্ক যখন ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ আর কাগজ নিয়ে বসত তখন সারা বাড়ীময় মাইসোর ধুপের গন্ধের সাথে মিশত প্রদীপের তেলের সুবাস। এখন মা সারাদিন বাড়িতে, তাই সে অফিস গেলে ধীরেসুস্থে চানটান করে পুজো করে, দেরীতে। ভোরের সেই পুজোর গন্ধ, একটা কেমন পবিত্র চারধার, রাজীর খোলা চুলের গিঁট, সে মিস করছে, হ্যাঁ ভীষণ মিস করছে!
    কাগজ আদ্যোপান্ত শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালো, চানের সময় হয়ে গেছে। মা কাজের মেয়েটাকে নিয়ে রান্নাঘরে ব্রেকফাস্ট তৈরীতে ব্যস্ত। উঠতে যাবে এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল। ভাস্করের ফোন। কথাটথা বলে চানে ঢুকছে মা এল।
    -"কার ফোন এল রে?"
    মা এখন ফোন এলেই উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে।
    -"ভাস্করদার।"
    একটু শান্তি, ডাইনিং টেবিলে রুটির ক্যাসারোল রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করল,
    -"কী বলল?"
    অর্ক একবার ভাবল মাকে বলবে কিনা। তারপরে মনস্থির করে বলে,
    -"মা, ঐ ভদ্রমহিলার কথা বলেছিলাম, ভাস্করদার চেনা, ওর আগের অফিসের। উনি হয়ত আজকালের মধ্যে বাড়ি আসবেন। পুরো ব্যাপারটা আমার বা আমাদের মুখে শুনতে চান।"
    মুখ দেখে মনে হল মার ঠিক ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছেনা। অর্ক আর না দাঁড়িয়ে চানে ঢুকে গেল। শাওয়ারের ধারার নীচে দাঁড়িয়ে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সামনের দেওয়ালের ব্লু টাইলসের দিকে। সেই কী সব বুঝতে পারছে? কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে তার জীবনে এসব!
    ***********************************
  • PM | 86.96.228.84 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ১৬:৪৫495988
  • ভীষন ভাল লেখা হচ্ছে। চরিত্রগুলোকে যেন ছুঁতে পারছি।

    এর পরেরটুকু জানার জন্য ছট্‌ফট করছি
  • a | 208.240.243.170 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ১৬:৪৭495999
  • জমে গেছে। তাপ্পর?
  • a | 208.240.243.170 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ১৬:৪৯496010
  • একটা কুইক রিকোয়েস্ট, লেখিকাকে। আগের বার, যদ্দুর মনে পড়ে, শেষটা একটু যেন তাড়াহুড়ো করে লেখা মনে হয়েছিল। এবার টাইম নিয়ে নামাও, দারুন হচ্ছে।
  • Netai | 121.241.98.225 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ১৭:১৫496021
  • খুব ভালো লাগছে।
  • Nina | 68.45.76.170 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ২০:৩০495729
  • সকালে উঠিয়া এ লেখা পড়িনু
    দিনযাবে আজি ভাল :-))
    শ্রাবণী , শুভ বিজয়ার ভালবাসা, কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা জানাই---

  • ranjan roy | 121.245.128.2 | ১২ অক্টোবর ২০১১ ০৪:৩৬495740
  • বহুদিন পর শ্রাবণীর রহস্য গল্প, চমৎকার লাগছে। কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম খোলাপাতায় অনুরোধ করি।
    ভিলাইয়ের মালয়ালী সমাজকে কাছ থেকে দেখেছি, বাজারে আয়লা এবং অন্যান্য সি-ফিশ, ছোট্ট মালয়ালী পেঁয়াজের স্বাদ,স্বাদু দক্ষিণী ওলকচু(একেবারেই গলা চুলকোয় না) এবং সব শেষে অবশ্যি সন্ধ্যেয় কম্পালসারি মল্লিকার মালা-- সব ছবির মতন দেখতে পারছি।
    আমিও ভাবছি-- কেন হারিয়ে গেল রাজী? শান্তিবিহারের ভরা বাজারেই কেন?
  • i | 137.157.8.253 | ১২ অক্টোবর ২০১১ ০৭:৩৩495751
  • মনে মনে রহস্যভেদের চেষ্টা চালাচ্ছি। একটা না দুটো সূত্র পেয়েছি মনে হচ্ছে এযাবৎ লেখার মধ্য থেকে-দেখি মেলে কি না।
    অপেক্ষায় আছি অধীর আগ্রহে।কি হয় কি হয়।
  • kumu | 122.160.159.184 | ১২ অক্টোবর ২০১১ ১১:০৭495762
  • রাজী কি অর্কর চাপা বিরক্তি বুঝতে পেরে অভিমানে ইচ্ছে করেই--?
  • PM | 86.96.228.84 | ১২ অক্টোবর ২০১১ ১৭:৫৫495773
  • বসে আছি পথ চেয়ে.........
  • Nina | 12.149.39.84 | ১২ অক্টোবর ২০১১ ২১:২৩495784
  • ও শ্রাবণী
    কাজে মন বসছে না যে ----কবে এগোবে গো? দোলে দোদুল হয়ে বসে আছি :-((
  • shrabani | 124.124.244.107 | ১৩ অক্টোবর ২০১১ ১১:১৪495795
  • রাই আজ কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুধুই ঘড়ি দেখছে। আলোক কাগজ পড়তে পড়তে একবার মুখ তুলে তার হাবভাব দেখে হেসে ফেলল।
    -"কেসটা কী? তুমি প্রাণের বন্ধুকে ফোন করবে তা এত সময় দেখার কী আছে, এখুনি কর।"
    রাই ধরা পড়ে গিয়ে হেসে ফেলল। তারপরে সোফায় বসে মোবাইলের বাটনে চাপ দিল। একবারেই লেগে গেল লাইন, দুতিনবার রিং হয়ে যাবার পর রাই কেটে দিল।
    -"কে জানে, হয়ত কাজের চাপে ঘুমোতে দেরী হয়েছে অথবা সকালে উঠেই কোথাও কারো পেছনে তাড়া করেছে। এভাবে সাতসকালে কাজের লোককে ফোন করে বিরক্ত করতে আমার খুব অস্বস্তি হয়।"
    একথার জবাবে আলোক মজা করে কী একটা বলতে যাবে, ফোন বেজে উঠল। অভির ফোন। রাই একগাল হেসে ফোন তুলে নিল।
    -"হেলো, তুই কোথায়? বাড়িতে?"
    অভিকে বেশ চিন্তিত শোনাল, এত সকালে বন্ধুর ফোন পেয়ে।
    -"কিরে কী ব্যাপার? হঠাৎ এত সকালে ফোন করলি যে? সব ঠিক আছে তো?"
    রাই বন্ধুকে আশ্বস্ত করে। সবাই ঠিক আছে, সব ঠিক আছে। চিন্তা দুর হলে অভির সেই পরিচিত হাসি, সাতসকালে আশাতীতভাবে রাইয়ের গলা শুনে মেজাজ খুশ! কিছুক্ষণ এদিক ওদিক কথা হল। একবার ফোন আলোকও নিল। সব শেষে রাই অভিকে অর্কর কথা বলল। সবকথা শুনে অভি প্রথমে একটু মজা করল। সে নেই তবু রাইয়ের মাথায় গোয়েন্দাগিরির ভুত এখনও রয়ে গেছে। ঠাট্টার মাঝেও কিন্তু পুলিশী মাথা সজাগ।
    -"কোথায় হয়েছে বললি, শান্তিবিহারে? তা কেসটা কারা দেখছে, তোদের ওখানকার থানা না শান্তিবিহার?"
    রাই এতসব জানেনা, ভাস্করের কাছে এসব বিশদ জানা হয়নি। অভি একটু ভেবে বলল,
    -"ঠিক আছে। আমি এক কাজ করছি, ভার্মাকে ফোন করছি। ভার্মা এখন তোদের ওখানকার থানা ইন-চার্জ, তোকে ও চেনে। যদি ওদের কেস নাও হয় তবু ও খোঁজখবর নিয়ে তোকে জানাবে। ওতো তোর খুব ফ্যানও, অসুবিধে হবেনা।"

    রাই এবার হাত কামড়ালো। এই বুদ্ধি নিয়ে ও গোয়েন্দাগিরি করবে! ভার্মার কথাটা ওর মনেই আসেনি। ওর জানা ছিলনা যে ভার্মা এখন এখানে ইন-চার্জ। অবশ্য ফোন নাম্বারও নেই ওর কাছে, অভি দেবে। অভির কাছ থেকে ভার্মার ফোন নাম্বারটা নিয়ে নিল। তবু ও অভিকে অনুরোধ করল ভার্মার সঙ্গে কথা বলতে, যতই হোক অভি ভার্মার সিনিয়র, তার কথার ওজন বেশী।
    অভির সঙ্গে কথা বলে মেজাজ তর হয়ে ফটাফট কাজকম্ম সেরে নিয়ে অফিস যাবার জন্য তৈরী হয়ে নিল। যেতে যেতে রাস্তায় তার একটা কথা মনে হল, এতদিন হয়ে গেছে, এবিষয়ে কোন আলোচনা শোনেনি কেন কে জানে! গার্ডেন সিটীতে তো তাদের অফিসের অনেকে আছে, বাঙালীও আছে, আর এরকম গসিপ তো হাওয়ায় ওড়ে। আলোককে বলতে সে বলল,
    -"একেবারে যে কানাঘুষো হচ্ছেনা তা বোধহয় নয়। ঐদিন ক্যান্টিনে গার্ডেন সিটীর বাসুদা এই নিয়েই কী সব বলছিল। আমি অন্য টেবিলে ছিলাম, ঠিক কান করিনি। এখন মনে পড়ল।"

    বিকেল চারটে বাজে তখন। রাই একটা ফাইলে ডুবে আছে, মোবাইল বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখে অচেনা নাম্বার,ল্যান্ডলাইনের। এরকম সচরাচর ব্যাঙ্ক, ক্রেডিট কার্ড এসবের ফোন হয়। কাজের সময় বিরক্ত হল, কাটতে গিয়েও কী ভেবে তুলল ফোনটা, চোখ ফাইলের পাতায়।
    -"ম্যাডাম, নমস্তে। ভার্মা বলছি, ভাল আছেন তো?"
    ব্যস, রাইয়ের মন একধাক্কায় ফাইল থেকে বেরিয়ে এল। ভাগ্যিস ফোনটা কাটে নি!
    -"ভার্মা, কেমন আছেন আপনি? খুব ভালো লাগছে আপনার ফোন পেয়ে।"
    -"গুপ্তা সাব ফোন করেছিলেন, আপনার নাম্বার দিলেন। আপনি মিসেস রাজেশ্বরী ব্যানার্জীর নিখোঁজ হওয়ার কেসটা নিয়ে ইন্টারেস্টেড বললেন।"
    অর্করা তাহলে ব্যানার্জী। রাই জিভ কাটল, এটাও সে জানতনা।
    -"আসলে ওর হাজব্যান্ডের কোলীগ আমাদের খুব বন্ধু, এছাড়া কাছেই পাশের সেক্টরে থাকে ওরা। তাই একটু ইন্টারেস্ট নিচ্ছি আর কি। যদি কোনো অসুবিধে না থাকে, আপনি যা জানেন, মানে পুলিশে যা ব্যবস্থা নিয়েছে এখনও অবধি, এসব ব্যাপারে একটু জানা গেলে ভালো হত।"
    ভার্মা একটু সময় নিল পরের কথাটা বলতে।
    -"এমনিতে ম্যাডাম আমার কাছেই কেসটা আছে। ভদ্রলোক এই থানাতেই এফ আই আর করে। তবে যেহেতু ঘটনাটা শান্তিবিহারে ঘটেছে, শুধু যে থানা আলাদা তাই নয়, অন্য রাজ্য, আমাদের ওদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হচ্ছে। আর সেটাই এ কেসে সমস্যা হয়ে গেছে। ওরা খুব একটা কোঅপারেট করছেনা, যদিও এমনি সামনে ভালোই ব্যবহার করছে, কমপ্লেন করার মত নয়। মহিলার বাবা মাও আবার ঐ থানায় অভিযোগ করেছে তাদের মেয়ে নিখোঁজ বলে। ওরা নাকি জামাইকেই সন্দেহ করছে, জামাইয়ের অত্যাচারে মেয়ে চলে গেছে বলছে। সব মিলিয়ে ব্যাপারটায় বেশ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমি যা জানি তা আপনাকে বলতে কোনো অসুবিধে নেই।"
    রাই দ্রুত চিন্তা করল, ভার্মার সাথে দেখা করা দরকার, ফোনে সব কথা হয় না।
    -"আপনার কখন সুবিধে হবে, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে নেব?" সে জিজ্ঞেস করল ভার্মাকে।
    তাই শুনে ভার্মা একটু ইতস্তত করতে লাগল,
    -"আপনি থানায় আসবেন ম্যাডাম, অসুবিধে হবে আপনার? তাছাড়া আমার এভাবে টাইম দেওয়া একটু রিস্কের, হঠাৎ কোনো জরুরী তলব এসে গেলে। তারচেয়ে আমি আপনার বাড়ি চিনি, সময় করে চলে যাব কালপরশুর মধ্যে। যাওয়ার আগে ফোন করে নেব,যদি আপনি ব্যস্ত থাকেন।"
    উত্তম প্রস্তাব, এর থেকে ভালো কিছুই হয়না। এমনিতেও অভি এখানে নেই, এখন থানায় যেতে রাইয়ের খুব একটা ইচ্ছে ছিলনা।
    এবার পুলিশের সঙ্গে কথা বলার আগে অর্কদের সঙ্গে দেখা করবে না পরে সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কাজে মন দিল।
    *****************************************

  • shrabani | 124.124.244.107 | ১৩ অক্টোবর ২০১১ ১১:২৭495806
  • ****************************
    অর্ক ঘরে ঢুকে সোফায় বসা মহিলার দিকে তাকালো। তার চোখে নিজের অজান্তেই বোধহয় একটা অবিশ্বাসের দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল, রাই সে দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। রাইয়ের চেহারা ছোটখাটো, নরমসরম মায়াবী। সন্দেহ স্বাভাবিক, দুই থানার বাঘা বাঘা পুলিশেরা এখনও কিছু করতে পারলনা আর এই মহিলা নাকি রাজীকে খুঁজে বার করবে!
    ভাস্কর আগেই ফোনে বলে দিয়েছিল। রাই একাই এসেছে, তার বাড়ি থেকে হাঁটাপথ। রমার এক দেখাতেই মেয়েটিকে ভালো লেগে গেছিল। চা আর পাটিসাপটা নিয়ে দুজনে বেশ গল্পে মেতে গেছে,দেখে মনে হল অর্কর। কারোর সঙ্গে কথা বলতে পেরে মায়ের মুখচোখ অনেক স্বাভাবিক, অর্ক খুশী হল।
    রাই অর্ককে নিজের পরিচয় দিল, একটু গল্প হল, অফিস ইত্যাদি নিয়ে টুকটাক কথা। রমা ছেলের জন্য চা বসাতে গেলেন। অর্ক ওর অনুমতি নিয়ে পোষাক পাল্টাতে ভেতরে গেল।
    রাই উঠে একটু ঘুরে ঘুরে আশপাশ দেখতে থাকল। ছিমছাম সাজানো ফ্ল্যাট, বসার ঘরের একপাশে পুজোর জায়গা, ঘন্টা, বড় পিতলের প্রদীপ, দক্ষিণের স্টাইলে সাজানো। সাইড টেবিলে অর্ক আর রাজীর যুগল ফোটো ফ্রেমে। সত্যিই খুব সুইট জোড়ী, মেয়েটার মুখটা কী মিষ্টি!

    অর্কর মায়ের সঙ্গে ওর কথা হয়ে গেছিল। সবাই যা বাইরে থেকে দেখে তা যে পুরোপুরি সত্যি নয়, সেরকম একটা আঁচ সে পেয়ে গেছে। উনিও ঠিক জানেননা কী হয়েছে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তবে রাজীর মধ্যে ইদানীং অনেক পরিবর্তন এসেছিল। সবকিছুতে বাড়াবাড়ি রকমের গোঁড়া মালয়ালীর মত ব্যবহার করত এ অর্কই বলেছে মাকে। রমাও দেখেছেন, খাওয়াদাওয়া, আচার ব্যবহারে রাজীর গোঁড়ামি বেড়ে গিয়েছিল। রাজীর বাবার বাড়ি আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ পরিবার, আমিষ চলেনা, যদিও ওর বাবা মা সবই খেত এখানে থাকাকালীন, এখন দেশে গিয়ে হয়ত খায়না। রাজী মাছ মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, চাইত অর্কও না খাক। অর্কর খুব অসুবিধে হচ্ছিল। রমার খুবই খারাপ লাগত তবু কিছু বলতেও পারতেন না, নিজেকেই দোষী মনে হত। ইদানীং এও মনে হত যে রাজীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে না দিলেই হত। ওর ঠাকুমা খুবই গোঁড়া দক্ষিণী ছিলেন, রাজীর মাকে উনি কোনোদিনই ঠিক মেনে নেন নি। একমাত্র ছেলের মেয়ে, তাই রাজীর প্রতি অবশ্য স্নেহের কমতি ছিলনা। তবু তার বাঙালীর সঙ্গে বিয়েতে উনি খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এসব জেনেও রমা বিয়েতে রাজী হয়েছিলেন এই ভেবে যে যতই হোক বাঙালী মায়ের মেয়ে, অর্ধেকটা তো আছেই বাকীটা ওদের বাড়িতে এসে হয়ে যাবে। কিন্তু ও যে ওর মায়ের মেয়ে না হয়ে হঠাৎ করে এরকম ঠাকুমার মত ব্যবহার শুরু করবে রমা কল্পনাও করেন নি!

    রাই একটু চিন্তা করে, আপাতদৃষ্টিতে সকলের কাছে ব্যাপারটা সেরকম কিছু না মনে হলেও, ভাববার মত বিষয়। চারবছর বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীর বাড়ির ধরনধারনে অসুবিধে হলে সে তো প্রথম থেকেই হবে। আড়াই তিনবছর সবকিছু মানিয়ে থাকার পরে হঠাৎ কেন এ বিদ্রোহ! এছাড়া, মেয়ে দেখতে সুন্দর, মোটামুটি অবস্থাপন্ন বাপমায়ের একমাত্র মেয়ে, সেরকম বুঝলে সেতো এরকম একটা ফ্যামিলিতে বিয়ে নাই করতে পারত।
    যে যাই বলুক কিছু একটা হয়েছে, কোনো ঘটনা,যার জন্য মেয়েটার এ পরিবর্তন।
    অর্ক এল, পাজামা পাঞ্জাবি পরে বেশ দেখাচ্ছে। রমা চা নিয়ে এলেন,
    -"রাই, তুমি আর একটু নেবে চা, আধ কাপ?"
    রাই বারণ করল, সে বেশী চা খায়না। ওদের দুজনকে কথা বলতে দিয়ে রমা গেলেন সন্ধ্যে দিতে।
    রাই ভনিতা না করে সরাসরি প্রসঙ্গে এল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেদিন সন্ধ্যের কথা জেনে নিল অর্কর কাছ থেকে।
    -"তোমরা তো প্রতিমাসে যেতে দোকান করতে, তা প্রতিমাসেই কি রাজী ফুলের মালা কিনত দোকানের পরে?"
    -"হ্যাঁ, মালা প্রতিমাসেই কিনত, বেশ অনেকগুলো, বাড়ি এসে ফ্রিজে রেখে দিত।"
    -"আচ্ছা অর্ক, তুমি সেদিন রাতেই কেন পুলিশে গেলেনা? দুদিন অপেক্ষা করলে কেন? তোমার মা আমাকে বলেছেন রাই ইদানীং বদলে গিয়েছিল, আচার বিচারে বাবার দেশের হয়ে উঠেছিল। অবশ্য সেটা এমনিতে এমন কিছু গুরুতর অপরাধ নয়। তবু এনিয়ে কি তোমাদের মধ্যে অশান্তি হচ্ছিল? সেইদিন বিশেষ কিছু সমস্যা হয়েছিল, ঝগড়াঝাঁটি?"
    অর্ক একটু গম্ভীর হয়ে গেল, খানিক চুপ। হয়ত ভাবছিল কতটা কি বলবে। রাই অপেক্ষায় নীরব।

    -"মার কাছে যা শুনেছেন মোটামুটি ঠিক। তবে আসলে আপনি যা বললেন তাই, এটা এমন কিছু গুরুতর অপরাধ নয়। মায়ের বয়স হয়েছে, বাবা মারা গেছেন বেশী দিন হয়নি, অল্পতেই আপসেট হয়ে পড়ে। রাজীর বাবামা কেরালা শিফট হয়েছেন ওর বাবা রিটায়ার করার পরে। রাজী তারপরেই বেশ কিছুদিন করে কয়েকবার গিয়ে ওদের কাছে থেকে আসে। ওখানে ও নানারকম ওদেশীয় রান্নাবান্না, আচার ইত্যাদির সঙ্গে এই প্রথম বড় হওয়ার পর ভালো করে পরিচিত হয়, আত্মীয়স্বজনের সাথেও। হয়ত ওর সেসব ভালো লাগে, এখানে ফিরে ও আমাদের সংসারে সেসব চালু করতে চায়। হ্যাঁ, আমার অসুবিধে হয়েছে, এনিয়ে কথা কাটাকাটিও হয়েছে কয়েকবার। তবে সিরিয়াস কিছু নয়। আমি এটাকে ওর সাময়িক খেয়াল বলেই মনে করেছি, কিছুদিন পরে আপসেই ঠিক হয়ে যেত। সেইজন্যেই আমিও ওর কথামত ওকে শান্তিবিহারের দোকানে নিয়ে যেতাম। যদি আমি জোর দিয়ে বারণ করতাম রাজী হয়ত মেনে নিত, আমি তা চাইনি।"

    রাই দেখল অর্কর এক্সপ্ল্যানেশন যথেষ্ট ফেয়ার। ও এ নিয়ে আর কিছু বলল না।

  • shrabani | 124.124.244.107 | ১৩ অক্টোবর ২০১১ ১১:৩৭495817
  • -"আর পুলিশের ব্যাপারটা? দুদিন পরে গেলে কেন?"
    -"দিদি, আমি আপনাকে দিদিই বলছি, আমি অনেক ছোট। আসলে রাজীর মধ্যে অনেক বাচ্চা বাচ্চা ব্যাপার আছে। এমনি আমার মা বা বাইরের কারোর সামনে ও খুব দায়িত্বশীল দেখাত, কিন্তু আমার সঙ্গে একান্তে ও একটু আদুরে ইমম্যাচিওর ধরণের ব্যবহার করত কখনো। বাবামায়ের খুবই আদরের একমাত্র মেয়ে তো। আমার কেমন মনে হচ্ছিল ওর হয়ত পুরনো জায়গায় গিয়ে মন কেমন করেছে মাবাবার জন্যে। আসলে বিয়ের পরেও অনেকদিন ওর মা বাবা তো এখানেই ছিল, কাছাকাছি । ওঁরা পাকাপাকিভাবে কেরালা চলে যাওয়ার পর থেকেই রাজী ওদেরকে খুব মিস করে, মন খারাপ করে। ইদানীং ওর ঠাকুমার অসুখের সময় থেকেই খুব ঘন ঘন যাচ্ছিল কেরালায়। তাই ভেবেছিলাম যা ছেলেমানুষ, স্টেশন খুব বেশী দুরে নয়, রাত্রে ঐ সময় একটা ট্রেনও আছে, হয়ত স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চড়ে বসেছে। টাকাপয়সা ওর পার্সে সবসময় ভালোই থাকত, সেদিক থেকে অসুবিধে নেই।
    কিছুদিন আগেই ফিরেছে, এক্ষুনি আবার যাবার কথা আমায় বলতে পারেনা। আমি এই কারণেই অপেক্ষা করেছিলাম, ওর বাবা মাকেও জানাইনি, পুলিশকেও নয়। দুদিন পরে ঐদিনের ট্রেন পৌঁছনোর খবর নিয়ে তারপরে ওর বাড়ীতে ফোন করেছি। ওরা যখন বলল ওখানে যায়নি, তখন আর দেরী করিনি পুলিশে খবর দিয়েছি, সবাইকে খবর দিয়েছি। হয়ত ভুল করেছি। হয়ত কেন এখন মনে হয় ভুলই করেছি। ওর বাবা মা পুলিশ সবাই আমাকে ভুল বুঝছে। আসলে রাজী নিজে এভাবে আর কোথাও চলে যাবে বা ঐ ভীড় থেকে কেউ ওকে তুলে নিয়ে যাবে এ সম্ভাবনা আমার মাথাতেই আসেনি। অন্য কারোর সাথে এমনটা হলে হয়ত আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না।"

    এ পর্যন্ত বলে অর্ক মাথা নীচু করে বসে রইল। রাই কী বলবে ভেবে পেলনা। ওর ভাই নেই, শুনেছে অর্কর এক দিদি আছে। খুবই খারাপ লাগছিল। তবু রাজীর বাবা মার জন্য মনখারাপ ও হুট করে এভাবে ট্রেনে চড়ে বসার সম্ভাবনার ব্যাপারে অর্কর যুক্তিটা সেরকম জোরালো মনে হলনা। একী বাচ্চা মেয়ে নাকি আর কেরালা কী এইটুকু রাস্তা! রাজীর সম্বন্ধে সব শুনে তাকে এতটা খামখেয়ালী ভাবা যাচ্ছেনা। যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নেয় যে সাময়িক খেয়ালে বা ঝোঁকে সে এরকম স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চেপে বসতে পারে, তবু স্বামীর সঙ্গে মোবাইলেও একবার যোগাযোগ করবেনা ঐ দুদিনে, এটা বেশ অস্বাভাবিক!
    একমাত্র সম্ভব যে ওদের মধ্যে সেদিন কিছু সিরিয়াস ঝামেলা হয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতেই অর্ক অনুমান করেছিল রাজী রাগ করে বাপের বাড়ীর ট্রেনে উঠেছে!
    তবু অর্ককে ঠিক কোনোভাবে দোষী মনে হচ্ছে না, কী যে করা!
    চেয়ে দেখল অর্কর মা ওদের কথা ঠিকমত শুনতে হয়ত পাচ্ছেনা, কিন্তু রান্নাঘর থেকে এদিকেই তাকিয়ে আছে হাতের কাজ থামিয়ে।রাই ঘড়ি দেখল, এবার উঠতে হবে। অর্ক সামলে নিয়েছে, মুখ তুলে বলল,
    -"আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে, না?"
    -"না,না, কাছেই যাব। আর দু চারটে জিনিস জেনে নিয়েই চলে যাব। অর্ক, কিছু মনে কোরোনা, এই প্রশ্ন গুলো এক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই আসে। হয়ত পুলিশ তোমাকে অলরেডী জিজ্ঞেস করেছে। রাজীর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাছাকাছিতে কে বা কারা আছে? তাদের কাছে কি তুমি খোঁজ করেছিলে? বিয়ের আগে বা পরে কারো সাথে কি ওর কোনো বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল বা হয়েছিল? তোমার কি কখনো কিছু মনে হয়েছে এ নিয়ে?"

    এবার অর্কর আগের সেই ইমোশন্যাল ভাবটা চলে গিয়ে মুখে একটা রাগী যুবকের ভঙ্গিমা এল। একটু কঠিন স্বরে বলল,
    -"আপনি যা বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি। এরকম কিছুই ছিলনা। রাজী এমনিতে অত্যন্ত মডার্ন ও স্মার্ট মেয়ে, ওর মা বাবাও তাই। আগে কারো সঙ্গে সেরকম সম্পর্ক থাকলে ও তাকেই বিয়ে করত, কোনো বাধাই ছিলনা। আমাদের দুজনের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। ছোটখাটো যা সমস্যা নিয়ে মা বলেছে, সেগুলো আমাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কোনো গুরুত্ব পায়নি, ওগুলো খুবই মামুলী ব্যাপার।রাজীর বন্ধু বলতে ওর স্কুলের দু একজন টীচার, বাকী বিয়ের আগের, কলেজের বন্ধুরা সব এদিক ওদিক চলে গেছে। এখানে কারোর সাথে সেরকম যোগাযোগ দেখিনি। ও আসলে ওর মায়ের সাথে খুব ক্লোজ, বন্ধুর মত। বিয়ের পরে আমার সাথেও তাই, সবকথা আমাকে বলত।"
    রাই অর্কর আগের কথা গায়ে মাখলনা। এরকম কথায় এ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক।
    -"ওর কোনো আত্মীয় স্বজন আছে কাছে পিঠে? ওর বাবামা এখানে এসেছেন শুনেছি, কোথায় উঠেছেন ওরা?"
    -"ওর মামার বাড়ী সি আর পার্কে। কিন্তু সেখানে এখন কেউ থাকেনা। বড়মামা বিদেশে, ছোটমামা সন্ন্যাসী। বাড়ি ভাড়া দেওয়া আছে। শুধু ছাতের ওপর দুটো ছোট রুমের একটা বর্ষাতি খালি পড়ে থাকে। ওর ছোটমামা যখন দিল্লীতে আসেন, তখন থাকেন। ওর মায়ের কাছেও চাবি থাকত, উনি মাঝেসাঝে যেতেন বাড়ির তদারকি করতে। এখন ওর বাবা মা সেখানেই উঠেছেন।"
    -"তা ওর মা তো এখন দিল্লীতে থাকেননা, ঐ বাড়ির চাবি কি রাজীর কাছে থাকত?"
    -"হ্যাঁ, একটা চাবি রাজীর কাছে থাকত, তবে ও কোনোদিন যেতনা। একজন গার্ড রেখেছে মামারা, সেই পুরো বাড়ীর দেখাশোনা করে। আমি পরদিনই গিয়ে ওবাড়ীতে খোঁজ করেছিলাম, রাজী ওখানে ছিলনা।"

    বৌ ট্রেনে চেপে বসেছে সন্দেহে পুলিশে খবর দেয়নি বা তার বাপের বাড়িতে জানায়নি অথচ নিজে খোঁজখবর করতে করতে তার খালি মামাবাড়ি পৌঁছে গেছে। রাই আবার নি:সন্দেহ হল অর্ক পুলিশে না যাবার যে কারণটা বলছে সেটা যথেষ্ট নয়, হয়ত ভয় পেয়ে যায়নি বা চটকরে পুলিশের চক্করে পড়তে চায়নি!

    অর্কের মার কাছে বিদায় নিয়ে ও উঠে পড়ল। অর্ক ওর সঙ্গে নীচে গেট অবধি এল। রাই দোনোমোনো করে শেষমেশ ওকে ভার্মার কথা কিছুটা বলল। অর্কর মুখটা উঙ্কÄল হয়ে গেল ওর কথা শুনে,
    -"এখানকার পুলিশ অফিসার আপনার চেনা? প্লীজ, আপনি ওদের একটু রিকোয়েস্ট করুন যাতে ওরা রাজীকে আগে খুঁজে বার করে । কতদিন হয়ে গেছে, কী হতে পারে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আপনার কী মনে হয়, ওর কি কিছু হয়েছে?"
    রাই ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গীতে বলল,
    -"ওরা চেষ্টা করছে, পুলিশকে আমরা যতটা ভাবি ততটা বুরবক ওরা নয়। কিছু হলে তো সেটা আগে জানা যেত। কিছু জানা যখন যায়নি, তখন আমার তো মনে হচ্ছে রাজী ঠিকই আছে।"
    অর্কর কৃতজ্ঞ দৃষ্টির থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির রাস্তায় পা বাড়াল। সে কী সত্যিই মনে করে মেয়েটা ঠিক আছে বলেই কোনো খবর নেই?
    ভার্মার সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত রাইয়ের দেখা সম্পূর্ণ হবেনা, এখনো ও এক চোখেই দেখছে, অর্ক ও তার শুভানুধ্যায়ীদের চোখ। রাজীর চোখটা দরকার, তবেই ঘটনাটা আন্দাজ করার মতো অবস্থায় আসবে।
    *********************************
  • shrabani | 124.124.244.107 | ১৩ অক্টোবর ২০১১ ১২:৪০495828
  • ************************
    কুন্দনের ভৈঁসটার তবিয়ত আজ ঠিক নেই। গেলবছর গায়ভৈঁসদের কী যেন মড়ক লেগেছিল গাঁয়ে। ওদের দুটো ভৈঁস তখন মরে গিয়েছিল। বাপুর অনেক নুকসান হয়ে গিয়েছিল। ফসল ওঠার পর এই নতুন ভৈঁসটা কেনা হয়েছিল সেই কতদূরে খতৌলীর পশু হাটে গিয়ে। বরাবরই ভৈঁসের দেখভাল, তাদের চান করানো, খাওয়ানো সব কুন্দনই করে। ও তো বাপ ভাইদের মত ক্ষেতে কাজ করতে পারেনা, একটা পা ওর বিকল, পোলিও না কী বলে তাই হয়েছিল। ইস্কুলে পড়েছিল কিছুদিন, কিন্তু মাথায় তেমন কিছু ঢুকতনা। পন্ডিতজীর নিত্য ডান্ডা আর ফেল করলে বাড়িতে বাপের মার, শেষকালে গোঁ ধরল আর ইস্কুল যাবেনা। পড়ালিখা করবেনা তো এরকম ছেলে করবে টা কী! শেষে সবাই পরামর্শ করে ওকে ভৈঁসের দেখাশোনার কাজ দেওয়া হল। নাহলে ওর ছোট ভাই তো ইস্কুলে পড়ে, ভালো ছাত্র,তাকে কেউ বাড়ির কোনো কাজ করতে দেয়না।

    ভৈঁস চরাতে কুন্দনের খুব ভালো লাগে। সকাল বেলায় নিজে নাস্তা করে ভৈঁসকে চারা খাইয়ে নিয়ে আসে এই যমুনার নহর পারে। যমুনা তো আর নদী নয় এখানে, নালা মাত্র। এই নহরটা কিন্তু বেশ চওড়া, পাড় বাঁধানো, দুধারে সবুজের সমারোহ। পাড়ের ধারে রাস্তাটা এককালে পিচের ছিল কিন্তু এখন ভেঙেভুঙে গিয়ে মাটির রাস্তার মত। রাস্তাটা সোজা যায় সেই দিল্লী। রাস্তা থেকে নেমে পাড় ঘেঁসে ঘাসের বনে ভৈঁসকে বেঁধে দিয়ে সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। কিছুটা গেলেই বনবিভাগের সংরক্ষিত এলাকা। ঢোকার মুখেই গার্ডদের চৌকি, সেখানে গিয়ে আড্ডা মারে, ওদের ফাইফরমাস খেটে দেয়। ক্ষেতে যখন কাজ চলে বাপ ভাইয়েদের কাছে চলে যায় পায়ে পায়ে। হাল্কা কাজে ওদের সাহায্য করে দেয়, দুপুরে ওদের সাথেই খায়। আবার অনেক সময় সারাদিনটা শুধু আলস্যেই কাটিয়ে দেয়, কোনো গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে নেয়। দুটো রুটি আর আচার বেঁধে নিয়ে আসে, দুপুরেও বাড়ি যায়না।

    আজ ভৈঁসটা তেমন খেল না বলে কুন্দনেরও মন ভার। ভৈঁসদের সে খুব ভালোবাসে,মানুষের চেয়ে বেশী। ওদের ডাকের মানে, ওদের তাকানো সব বুঝতে পারে। তাই আজ কোথাও না গিয়ে ভৈঁস কে বেঁধে দিয়ে কাছের একটা গাছের তলায় গায়ের কাপড় বিছিয়ে শুয়ে রইল। ঠান্ডা হাওয়ায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। দুপুরে সূর্য যখন মাথার ওপরে তখন রোদের তেজও বেশী, মুখে রোদ এসে পড়ল সরাসরি। রোদের আঁচে তার ঘুম ভেঙে গেল। উঠেই তার চোখ গেল ভৈঁসের দিকে, না: বাঁধাই আছে সে নিজের জায়গায়।
    তড়িঘড়ি উঠে পড়ল, মেঠো রাস্তা পেরিয়ে নহরের দিকে গেল। মুখ হাত ধুয়ে এসে রুটি খাবে, তারপর নাহয় চৌকি থেকে ঘুরে আসবে একবার। তার পায়ের জন্য সে যেখান সেখান দিয়ে জলে নামতে পারেনা। একটু এগিয়ে গিয়ে একটা ঘাট মত আছে, গাছের শিকড় ছড়ানো সিঁড়ি। গাছের গুঁড়ি ধরে ধরে আস্তে আস্তে সেখান দিয়ে নামে। নেমেই একটা চর মত আছে, ভৈঁসকে চান করায় যেদিন সেদিন সে এখানেই আসে। আজ একাই এল, মাথাটা রোদের গরমে তেতে গেছে, মুখে চোখে জল দিয়ে মাথাটা ধুয়ে নেবে।
    নেমে জলের দিকে এগোতে গিয়েই থমকে গেল কুন্দন।

    একটা লাশ, চরের যেখানটায় কাঁটা ঝোপ তাতে আটকে আছে। নদীতে ভেসে এসেছে মনে হয়। চারিদিকে একটা কেমন আঁশটে দুর্গন্ধ। প্রথমেই পেয়েছিল তবে যমুনা নালায় এরকম বদবু অস্বাভাবিক কিছু নয় তাই কিছু মনে হয়নি। এখন লাশ দেখে কুন্দনের গন্ধটা আরও তীব্র মনে হল, সারা গা গুলিয়ে উঠল। সে আর পারলনা, একপাশে গিয়ে বসে পড়ে উলটি করতে লাগল।
    বমি হয়ে যাওয়ার পরে নিজেকে একটু হালকা লাগল, আর সে ওখানে দাঁড়াল না। কোনোরকমে হাঁচোড়পাচোড় করে শিকড়ে পা রেখে রাস্তায় উঠে এল। একটু দিশেহারা, কী করবে বুঝতে পারছিলনা। একবার মনে হোলো বাড়ি গিয়ে গাঁয়ের লোকেদের ডেকে আনে। কী মনে করে শেষে খুঁতো পা টাকে জোরে টেনে টেনে হাঁটা দিল গার্ডেদের চৌকির দিকে।

    বনের চৌকির দুই গার্ড বিরজু আর সুখরাম সবে তখন দুপুরের খানা খেতে বসেছে চৌকির সামনে আমগাছের তলার চারপাইয়ে, দেখে মুসেরী গাঁয়ের ল্যাংড়া কুন্দন হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে। একটু অবাক হল, এটা ওর আসার সময় নয়, এলে সকালেই আসে নয়ত বেলা পড়লে। দুজনেই উঠে দাঁড়াল, ছেলেটা কাছে আসতে দেখে মুখখানা একদম ফ্যাকাশে।
    -"কী হয়েছে রে, এ কুন্দন?"
    -"লাশ, ভাইয়া একটা লাশ ভেসে এসেছে, ঐ পিপল গাছের কাছের ঘাটের চরায়।"
    সুখরাম কুন্দনকে বসতে দিল, লোটা থেকে জল দিল খেতে। কুন্দন জলটা খেয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। বিরজু ওদের মধ্যে সিনিয়র, সে খুব একটা ঘাবড়ালো না। যমুনার নহরে বছরে এরকম দু একটা লাশ ভাসতে দেখা যায়। আজ অবশ্য লাশ ভেসে এসে তাদের এলাকায় ঠেকেছে, তাই একটু ঝামেলা। সে বসে পড়ে খেতে শুরু করল, সুখরাম কেও ইশারা করল খেয়ে নিতে। সুখরামের বয়স কম, উত্তেজনা বেশী। সে খেতে বসলনা, বলল,
    -"বিরজুভাই যাবেনা দেখতে? সাহেবকে খবর দিতে হবে তো।"
    বিরজু মুখে রুটি পুরে পেঁয়াজে একটা বড় কামড় দিয়ে বলল,
    -"যাব, আগে খানা খেয়ে নে। অত পরেশান হওয়ার কিছু নেই, নহরে লাশ ভেসে আসা কি নতুন নাকি! কুন্দন তুইও একটা রোটি খা।"
    কুন্দন না না করেও তুলে নিল একটা রুটি সবজি জড়িয়ে। বমি করেছে বলেই হয়ত তার এখন খিদে খিদে লাগছে। সুখরামও আর কিছু না বলে খেয়ে নিল। খাওয়াদাওয়া সারা হওয়ার পর কিন্তু বিরজুর অন্য রূপ। সুখরামকে পাঠিয়ে দিল সাইকেলে দু কিলোমিটার আগে ওদের বনবিভাগের অফিসে। সেখানে ফরেস্ট অফিসারকে খবর দিয়ে, ওনাকে বলে, থানায় গিয়ে পুলিশ নিয়ে আসতে হবে।
    নিজে কুন্দনকে নিয়ে চলল লাশের ওখানে। পথে দেখল কুন্দনের ভৈঁস বসে আয়েশ করে জাবর কাটছে, চোখ বোজা। কুন্দনের সেদিকে নজর নেই, জোরে জোরে চলল বিরজুর সাথে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে। ঘাটে নেমে বিরজু লাশের কাছে গেল, কুন্দন নামেনি, সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল। বিরজু ভালো করে দেখল, জলে ভেসে ফুলে গেছে, গন্ধ ছাড়ছে।..............যুবতী মেয়েছেলের লাশ.............। মনে হচ্ছে বেশ কয়েকদিনের হবে!

  • Netai | 121.241.98.225 | ১৩ অক্টোবর ২০১১ ১৪:০৭495840
  • যা:। মরেই গেল।
  • Nina | 12.149.39.84 | ১৩ অক্টোবর ২০১১ ২০:৪৮495851
  • এ বাবা, এখানে থেমে গেলে :-((((((((((
    এবার আমি কি করি---মাথায় কি আর কিছু ঢুকবে? যতক্ষণ না তুমি বলছ--তারপর কি হল--ও শ্রাবণী :-((
  • Nina | 68.45.76.170 | ১৪ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৩১495862
  • বসে আছি পথ চেয়ে
  • debu | 72.130.151.116 | ১৪ অক্টোবর ২০১১ ০৯:১২495873
  • ফুল ওআলা কে আমার সন্দেহ হচ্ছে
  • pharida | 61.16.232.26 | ১৪ অক্টোবর ২০১১ ০৯:৫৪495884
  • অর্ক কেন এতো বেশি অতীত কাল ব্যবহার করছিল তার নিরুদ্দিষ্ট স্ত্রীর ব্যাপারে কথা বলার সময়ে? ভেবে দেখার।
  • Shn | 59.144.10.250 | ১৭ অক্টোবর ২০১১ ১৪:৫২495895
  • পরের কিস্তি কই?
  • Nina | 12.149.39.84 | ১৮ অক্টোবর ২০১১ ০০:১৮495906
  • কি হল? কোথায় গেলে?
    ও শ্রাবণী??
  • shrabani | 117.239.15.28 | ১৮ অক্টোবর ২০১১ ১২:১৩495917
  • শনিবারে ছুটির দিন হলেও হাজারটা কাজ থাকে। একটু ব্যাঙ্কে যাওয়া ছিল, যদি ভার্মা আসে তাই রাই গেলনা। আলোক একাই বেরিয়ে গেল, দু চারটে আরো অন্য কাজ সেরে আসবে। একা বাড়িতে বসে অধৈর্য্য হয়ে পড়ছিল। একবার ভার্মাকে ফোন করবে কিনা এই ভাবনাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ঠিক সেই সময়ই থানা থেকে একটি লোক এল। ভার্মা পাঠিয়েছে, হাতে একটা বেশ বড়সড় খাম। ভেতরে বসলনা, খামটা দিয়ে বলল ভার্মাসাব বলে দিয়েছেন ম্যাডাম যেন খামটা পেলে একবার ফোন করে নেন সাবকে।
    লোকটাকে বিদায় দিয়ে খামটা হাতে নিয়ে বসার ঘরে এল। সেলোটেপের বন্ধনমুক্ত করেও কী ভেবে খামের ভেতরে দেখার আগে ফোনের বোতাম টিপল রাই।
    -"হ্যালো, ভার্মাজী।"
    -"আরে ম্যাডাম নমস্তে। খাম পেয়েছেন?"
    -"হ্যাঁ, এই তো আমার হাতে। কী আছে এতে?"
    -"ম্যাডাম,ওতে সবার জবানবন্দির কপি আছে, এফ আই আরেরও একটা কপি আছে। আমার কিছু নোটস আছে। আপনি এগুলো দেখুন আগে। আশা করছি সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে আপনার সঙ্গে দেখা করে আপনার আর যা জিজ্ঞাস্য সেসব নিয়ে আলোচনা করব।"
    জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবেনা মনে হলেও রাই কৌতূহল চাপতে পারেনা।
    -"আপনি এখন কোথায়? খুব ব্যস্ত কি?"
    -"আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, দূরে না, ঘন্টা দুয়েকের পথ। ফিরে এসে আপনার ওখানে আসব, সন্ধ্যেবেলায়। ঠিক আছে?"
    ভার্মা কিছু খুলে বলল না, আর কথা বাড়ানো অভদ্রতা হয়। ফোন রেখে রাই খাম খোলে, ভেতরে একতাড়া কাগজ। ওপর ওপর চোখ বোলাল, এফ আই আর ও আরও কিসব হিন্দীতে, হাতে লেখা, পুলিশী ভাষা। ভালো করে খুঁটিয়ে পড়তে হবে। সে সব তুলে রেখে দিল। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ধীরে সুস্থে বসা যাবে।

    অর্ক আর তার মায়ের বয়ানে খুব একটা কিছু নতুন নেই। বরং ওরা তার কাছে যা বলেছে রাজীর ইদানীংকার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে সেসব কিছু পুলিশকে বলেনি কেউ। রাজীর বাবা মার বক্তব্য পড়ে যা মনে হয় তা হল ওরাও খুব কিছু জানেনা, যেন অভিযোগ করতে হয় তাই করা। অর্ককে ওরা দায়ী তো করছে কিন্তু তার কোনো ভিত্তি নেই। ওদের কথা হল সেদিন বাজারে অর্ক কেন রাজীর ওপর লক্ষ্য রাখেনি। এটা একেবারেই হাস্যকর, একটা পূর্ণবয়স্কা মহিলা, বাচ্চা নয়, তার ওপর নজর না রাখলে সে বাজারে হারিয়ে যাবে!

    এমনিতে অর্ক আর রাজীর সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নতে ওদের উত্তর থেকে মেয়ে জামাইয়ের মধ্যে কোনো গন্ডগোলের কথা ওরা জানে এমন মনে হয় না।
    এরা ছাড়া পুলিশ অর্কদের ফ্লোরের দুদিকের প্রতিবেশী ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের জবানবন্দি নিয়েছে, রাজীর স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ও দুজন কোলীগের, শান্তিবিহারের সেই দোকানদারের। কোনো কিছুতেই কোনো বিশেষত্ব নেই। খুব ভালো মেয়ে, ভালো বন্ধু প্রতিবেশিনী, মুখে হাসি লেগেই আছে। দুজনের মধ্যে সেরকম কোনো গোলযোগ কারো চোখে পড়েনি। অর্কর অনুপস্থিতিতে রাজীর কোনো বন্ধু বিশেষ করে ছেলে বন্ধুকেও আসতে দেখেনি কেউ। এ কোনো গুন্ডার দলের বা বদমাইশ লোকের কাজ বলে তাদের ধারণা।

    ভার্মার নোটে শান্তিবিহার বাজারের আরও নানা লোকের উল্লেখ আছে, ফুলওয়ালী, দোকানের দুটো ছেলে ইত্যাদি। কেউ সেদিন কোনো গাড়িতে কাউকে জোর করে তোলা হচ্ছে এরকম কিছু দেখেনি। তবে ঐ বাজারের মধ্যে এদিক সেদিক করে অনেক অন্ধকার গলি আছে। সেখানে সবার অলক্ষ্যে কিছু হলে কেউ টেরও পাবেনা। অর্ক যে জায়গাটায় গাড়ী রেখেছিল সেটাও এরকমই একটা অন্ধকার গলিমত ছিল। এফ আই আরে তেও সেরকম কিছু নেই, অর্ক কোনো সন্দেহের কথা বলতে পারেনি।
    রাই একটু বোর হল পড়তে পড়তে। এত কষ্ট করে পুলিশের ভাষা থেকে সার উদ্ধার করতে গিয়ে দুপুরের ঘুমটা মাটি করল, কিন্তু সেরকম লাভ কিছু হলনা। এখন ভার্মাই ভরসা, যদি সন্ধ্যেয় এসে নতুন কিছু বলতে পারে। রাজীর স্কুলটা এদিককার বেশ পুরনো স্কুল, আগে খালি প্লে স্কুল ছিল এখন কেজি সেকশনও খুলেছে। রাইয়েদের সোস্যাইটীর মিসেস সঙ্গীতা গোয়েল আগে ওখানে পড়াত, তবে এখন বোধহয় ছেড়ে অন্য স্কুলে আছে। ডাইরেক্টরী দেখে রাই ইন্টারকমে মিসেস গোয়েলকে ফোন লাগাল।
  • shrabani | 117.239.15.28 | ১৮ অক্টোবর ২০১১ ১২:৩৮495928
  • ভার্মা আসার আগে ফোন করেছিল, এল বেশ দেরীতেই, প্রায় রাত নটায়। ফোন পেয়ে ভার্মা আসছে শুনে রাই তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া মিটিয়ে নিয়েছিল। ভার্মা এল যখন কফি রেডী। তিনটে মাগে কফি নিয়ে এসে বসল ও, ততক্ষনে আলোক ভার্মাকে বসিয়েছে।
    ওর সঙ্গে দেখা হয়ে ভার্মার গলা বেশ খুশী খুশী,
    -"অনেকদিন পরে দেখা হল ম্যাডাম। সরি, এত রাত হয়ে গেল আসতে। আপনারা ভালো তো? কফির কোনো দরকার ছিল না।"
    ভার্মার সঙ্গে এর আগেরবারে ভালো পরিচয় হয়ে গেছিল, তখনই দেখেছে পুলিশের অফিসার হয়েও আপাদমস্তক ভদ্র লোকটি। রাই ওকে আশ্বস্ত করে,
    -"আরে সামান্য কফিই তো, আর কিছু না। আপনি কী এখন সোজা আসছেন, না থানা হয়ে? কিছু খাবেন?"
    ভার্মা হাঁহাঁ করে উঠল।
    -"না না ম্যাডাম ব্যস্ত হবেন না, আমি নাস্তা করেছি। আসলে আমি সন্ধ্যেয় ফিরেছি, থানায় দেরী হয়ে গেল।" ভার্মা একটু ইতস্তত করছে বুঝতে পেরে আলোক উঠে পড়ল।
    -"ভার্মাজী সরি, আমার কিছু কাজ ছিল, আমি ভেতরে যাই। আপনারা আলোচনা করুন, পরে দেখা হবে।" ভার্মা এবার একটু স্বচ্ছন্দ হল মনে হল। আসলে আলোকের সঙ্গে আজই তার প্রথম আলাপ হয়েছে, তাই একটু কিন্তু ভাব। রাই চুপ করে ভার্মার মুখ খোলার অপেক্ষা করতে থাকল কফি খেতে খেতে।
    -"ম্যাডাম, মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলার লাশ পাওয়া গেছে।"
    -"সেকী?"
    রাইয়ের সারা শরীর কেমন একটা অবশ হয়ে এল! ও এটা আশা করেনি। তারপরেই খেয়াল করল ভার্মার কথাগুলো।
    -"মনে হচ্ছে মানে? আপনারা শিওর নন?"
    -"যমুনার ক্যানালে ভেসে আসা এক মহিলার লাশ পাওয়া গেছে এখান থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দুরে পালওয়ালের কাছে। জায়গাটা জঙ্গলের মধ্যে, বনদপ্তরের আওতায় পড়ে। এদিককার জঙ্গল তো,খুব গভীর নয়। একদিকে আবার গাছটাছ কেটে ক্ষেত হয়ে গেছে অনেককাল। এখন বনবিভাগ একটু মাথাটাথা ঘামাচ্ছে বন সংরক্ষণের ব্যাপারে।
    গতকাল দুপুরে কাছের গ্রামের একটা ছেলে ক্যানালের ধারের ঘাসজমিতে ভৈঁস চরাতে এসেছিল, সেই দেখে লাশ। সে দেখতে পেয়ে সামনের চৌকিতে বনকর্মীদের খবর দেয়। সেখান থেকে খবর পেয়ে লোক্যাল থানার পুলিশ আসে। আমরা থানায় থানায় মিসেস ব্যানার্জীর খবর পাঠিয়েছিলাম আগেই। ওদের সন্দেহ হওয়াতে খবর দেয়। আমি ও শান্তিবিহার থানার ওসি রাজপাল দুজনে খবর পেয়েই রওনা হই।
    মনে হচ্ছে এজন্য বলছি ম্যাডাম, লাশ এতদিন জলে ভেসেছে, ফুলেটুলে বীভৎস অবস্থা, চেনা যায়না। পরনের পোষাকের রঙও আদতে কী ছিল বোঝা যাচ্ছেনা। অবশ্য এ ব্যাপারে মি: ব্যানার্জী প্রথম থেকেই খুব একটা নিশ্চিত নয়। শুধু সালোয়ার কামিজ পরনে ছিল এটুকুই উনি বলেছিলেন, রঙ ঠিক বলতে পারেন নি। মহিলার গলায় একটা সোনার মঙ্গলসূত্র আছে, মিসেস ব্যানার্জীর গলায় চেন বা মঙ্গলসূত্র কিছু একটা ছিল বলে এফ আই আরে লিখিয়েছেন মি: ব্যানার্জী।

    এ অন্য কেউও হতে পারে, তবুও সবরকম দেখে আমার সন্দেহ এ মিসেস ব্যানার্জীরই লাশ।লাশ আনা হচ্ছে শান্তিবিহারে। মি: ব্যানার্জী আর ভদ্রমহিলার বাবাকে খবর দেওয়া হয়েছে। কাল সকালে এসে লাশ দেখে যদি আইডেন্টিফাই করতে পারে। তারপর পোস্টমর্টেম করতে পাঠানো হবে। "
    -"সোনার মঙ্গলসূত্র গলায় আছে এতদিন জলে ভাসার পরেও, কেউ নিয়ে নেয়নি? বনকর্মীরা বা ঐ রাখাল ছেলেটি বেশ সৎ বলতে হবে তো!"
    একজন মেয়ে হয়ে প্রথমেই গয়নার কথাটা মনে হোলো রাইয়ের। ভার্মা হেসে ফেলল,
    -"সোনা বলেই তো মনে হল, অবশ্য পরীক্ষা করে দেখবে ফরেনসিক রা। আমার কাছে নেই এখন, বডি ও আর সবকিছু শান্তিবিহারের রাজপালের ব্যবস্থাপনায় দিল্লীতে গেছে। ওদের ওখানে ফরেনসিক পদ্ধতি অনেক আধুনিক, পোস্টমর্টেমের দিকটাও ওরাই দেখবে। রাজপাল আমার আগেই পৌঁছে গেছিল লাশের ওখানে, ঐ সব বন্দোবস্ত করেছে। ডিটেল রিপোর্ট আমার হাতে এলে আপনাকে জানাব।"

    এসব শুনতে রাইয়ের খুব খারাপ লাগলেও সে ভাবটা ঝেড়ে ফেলে সে পাকা গোয়েন্দার মত কাজের কথায় এল।
    -"ভার্মাজী, আমি আপনার পাঠানো কাগজ গুলো পড়লাম। ওনিয়ে কথা বলব, কিন্তু তার আগে আপনি পুরো ব্যাপারটা আপনার মতো করে বলুন তো।"
    ভার্মা মোটামুটি গুছিয়ে যেভাবে ঘটনাটা যা বলল তার সবটাই প্রায় রাই আগেই জেনেছে। শুধু একটা নতুন কথা শুনল। শান্তিবিহারের বাজার থেকে কিছুটা এগিয়ে আইয়াপ্পা মন্দির আছে। অর্ক ও রাজী মাঝেসাঝে এই মন্দিরেও যেত বাজার করে ফেরার পথে। এটা অর্কই বলেছে।
    মন্দিরের সামনে একটি অনাথ মেয়ে বসে ভিক্ষা করে সকাল বিকেল, এমনিতে সবাই বলে মেয়েটির অল্পবিস্তর মাথার দোষ আছে। রাজীর মা যখন এখানে ছিলেন এই মেয়েটিকে কাপড় পয়সা খাবার এসব তিনি দিতেন। মা চলে যাবার পর রাজীও যখনই মন্দিরে যায় একে কিছু না কিছু দেয়। মন্দিরে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে কেউই তেমন কিছু বলতে পারেনা যদিও অনেকে ফোটো দেখে রাজীর মুখ চিনতে পারে। মন্দিরের এক পূজারী পরে শান্তিবিহারের পুলিশকে জানায় যে ঐ মেয়েটি সেদিন সন্ধ্যেয় নাকি রাজীকে মন্দিরে আসতে দেখেছিল।
    পরে ভার্মা গিয়ে মেয়েটিকে প্রশ্ন করতে সে বলে ঐদিন সন্ধ্যেয় দিদি মন্দিরের বাইরের গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিল, সে ডাকতেও তার কাছে আসেনি বা তাকে কিছু দেয়নি। পরে একটা গাড়ীতে উঠে চলে যায়। মেয়েটি এই চোদ্দ পনের বছর বয়সী হবে, একেবারে পাগল না হলেও বয়সের তুলনায় অপরিণত,কথাবার্তাও ঠিক গোছানো নয়, অসঙ্গতি আছে। অতএব কথাটা সত্যিও হতে পারে আবার প্রলাপও হতে পারে। মন্দিরের বাইরের গাছতলার দিকটা অন্ধকার, তার নীচে দাঁড়ানো মানুষকে চিনতে ভুল করা বিশেষ করে অপরণিত মনস্ক কারুর পক্ষে, অসম্ভব নয়!

    তবে ঘটনাটা যদি সত্যি হয় তাহলে ভাববার বিষয় আছে। সবচেয়ে যেটা গোলমেলে সেটা হল মেয়েটি রাজীদের গাড়ী ভালোই চিনত,কালো রঙের স্যানট্রো গাড়ি সে দেখিয়ে বলেছে, এতে কোনো ভুল নেই। তার কথা অনুযায়ী রাজী যে গাড়ীতে গেছে সেটা ওদেরই গাড়ী,যদিও সে অর্ককে ঠিকমত দেখেছে বলেনি। অবশ্য এরকম গাড়ি এরাস্তায় অনেক চলে, এতে কিছু প্রমাণ হয়না তবু এই ব্যাপার থেকেই পুলিশের সন্দেহ অর্কর ওপর আরো পড়েছে। সাক্ষী এধরণের না হলে আর ঠিকমত মোটিভ পাওয়া গেলে হয়ত অর্ক এতদিনে গ্রেফতার হয়ে যেত!

    রাই সব শুনে একটু অবাক হয়, অর্করা এনিয়ে তাকে কিছু বলেনি।
    -"ভার্মাজী, আপনারা অর্ককে এনিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন?"
    -"করেছিলাম, তবে সরাসরি নয়। জানতে চেয়েছিলাম সে সেরাতে মন্দিরের রাস্তা দিয়ে ফিরেছিল কিনা আর মেয়েটিকে চেনে কিনা। অর্ক সেদিন ঐ রাস্তা দিয়েই ফিরেছিল, মেয়েটীকেও সে চেনে, রাজী ওকে প্রায়ই পয়সা এটাসেটা দেয়। তবে সেদিন সে ওর দিকে লক্ষ্য করেনি, রাজীর জন্য ভাবনাতে অন্যমনস্ক ছিল।"
    রাই একটু বিস্ময়ের গলায় বলল,
    -"সেক্ষেত্রে অর্ক মন্দিরে খোঁজ করলনা কেন? রাজী তো মন্দিরেও থাকতে পারত। এত জায়গায় দেখল বাজারে, প্রতিটি দোকানে, আর মন্দির যেখানে তারা প্রায় যেত সেখানে খুঁজে দেখলনা। এটা তো খুবই অস্বাভাবিক।"
    ভার্মা একটু হাসল,
    -"ঠিক বলেছেন ম্যাডাম, আমরাও এই কথাই জিজ্ঞেস করি ওনাকে। উনি বললেন মন্দির আটটায় বন্ধ হয়ে যায়, তখন নটা বেজে গেছিল। অত রাত্তিরে কাউকেই মন্দিরের ভেতরে যেতে দেওয়া হয়না। তাই মি: ব্যানার্জী মন্দিরে যাননি বা খেয়াল করেননি।"
    রাই একটু চিন্তা করে ঘাড় নাড়ল।
    -"সবই ঠিক, তবু এটা একটু ভাবার মত। মন্দির বন্ধ হোক, মন্দিরের আশেপাশেও একবার দেখবেনা এটা কেমন যেন!"
    -"আপনিও কি তাহলে ভদ্রলোককেই সন্দেহ করেন?"
    রাই এবার হেসে ফেলল,
    -"আর কাউকেই যে সন্দেহ করার মত পাচ্ছিনা ভার্মাজী। যাইহোক, লাশ শনাক্ত হলে আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এলে একটু জানাবেন।"
    ভার্মা ওকে আশ্বস্ত করল, তাড়াহুড়ো করে ওরা কিছু করবেনা। এই মৃতদেহটি যদি রাজীর বলে প্রমাণ হয়ে যায় তাহলে তদন্তের দিকটাই ঘুরে যাবে। সে এখন থেকে যা হবে তা রাইকে জানিয়ে যাবে।

    ****************************
  • shrabani | 117.239.15.28 | ১৮ অক্টোবর ২০১১ ১৫:৫৯495939
  • ********************************
    আকবরপুরে এতবছর কাটানোর পরে যখন দিল্লীর এই থানায় বদলি হয়ে এলো, রাজপালের মেজাজ গিয়েছিল বিগড়ে। দিল্লী শহর এমনিতেই তার নাপসন্দ, তায় শান্তিবিহারের মত জায়গা। দিল্লী শহরে এত ভালো ভালো এলাকা আছে, গুন্ডাগিরি রাহাজানি ও আরও কত রকমের কাণ্ডকারখানার জন্য বিখ্যাত, কত ওস্তাদ ক্রিমিন্যালদের আড্ডা, সেসব ছেড়ে তার জায়গা হল কিনা এইখানে! পুলিশ মহলে এ অঞ্চলের বিরাট বদনাম নামে ও কাজে এক হওয়ার জন্য। এমন শান্তিপূর্ণ এলাকা কখনো রাজপালের মত খানদানী থানেদারের কাম্য হতে পারেনা। আশেপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কখনো কিস্যু হয়না। এই এলাকায় ঢুকলেই যেন লোক ভেড়ুয়া হয়ে যায়,দায়িত্বশীল নাগরিক সব!
    রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়ায় টক্কর আর তা নিয়ে দাঙ্গা যা এ শহরে হমেশাই দেখা যায় তাও নয়। হাত নিশপিশ করে চোরের মার মারার জন্য, কিন্তু তেমন চোর কোথায়! ভীষণ ভীষণ বোরিয়ত হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু কিছু করার নেই। আগের থানায় সামান্য গড়বড় করে ফেলায় সাসপেন্ড হতে হতে বেঁচেছে কর্তাদের হাতেপায়ে ধরে। এই শান্তিবিহার থানায় পোস্টিং হয়েছে সেই গলদ কাজের শাস্তি স্বরূপ। এদিকে বেশ বদনাম হয়ে গেছে তার, তাই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যদি আবার বদলির আর্জি নিয়ে যায় কেউ শুনতেই চাইবেনা।
    এদিকে শহরে খরচখরচা বেশী অথচ আয়ের পথ তেমন নেই, মেজাজ তাই সবসময় খিঁচড়ে থাকে। ছেলেমেয়েদের বায়নাক্কার আর শেষ নেই! অবিশ্যি একেবারে যে আয় হয়না তা নয় তবে তা বেশীরভাগই দলীয় আয়, ভাগবাঁটোয়ারা হয়ে হাতে যা আসে তা তেমন কিছু বলার মতো নয়। সেসব দিয়ে রাজপালের মত সিংহের খোরাক হতে পারেনা।

    এই প্রথম একটা কেসের মত কেস এসেছে। যা বুঝছে ভদ্রলোকের ভালই পয়সাকড়ি আছে। একমাত্র মেয়ের খোঁজ পেতে ভালই খরচপাতি করবে। প্রথমে যখন সেক্টর আটত্রিশ থানার ভার্মা ফোন করে এ কেস সম্বন্ধে কথা বলে তখন রাজপাল তেমন পাত্তা দেয়নি। বাজার থেকে এক মহিলা উধাও হয়ে গেছে। মেয়েটার স্বামী এফ আই আর করেছে ওদের কাছে। খুঁজলে দেখা যাবে দুজনে ঝগড়াটগড়া হয়েছে, দুদিন বাদে মাথা ঠান্ডা হলে ফিরে আসবে। ভার্মাকে সে চেনে, তার থেকে জুনিয়র, তবে সুনাম আছে ভদ্র সৎ অফিসার বলে, বড় কর্তাদের পছন্দের লোক। রাজপাল এধরণের পুলিশদের পছন্দ না করলেও সামনাসামনি খুবই খাতিরটাতির করে।
    এক রাজ্যের বাসিন্দা, ঘটনা ঘটেছে অন্য রাজ্যে। তবে এখানে এরকম প্রায়শই হয়, বর্ডারের কাছে বলে, নতুন কিছু নয়। সেও ভার্মা এলে তার সাথে বাজার ঘোরে, লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। স্বামীটা একেবারে আনকোরা, বয়স বেশী না, একটু ভয়টয় দেখিয়ে কিছু খিঁচে নেওয়াও কঠিন হতনা যদি না মাঝখানে ভার্মা থাকত।

    এই জন্যে বেশী উৎসাহ দেখায় নি প্রথমে। কিন্তু দুদিন পরে যখন মেয়েটীর বাবা মা এসে তার সঙ্গে দেখা করে, তখন তার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়ে যায়। এই পরিবার দীর্ঘদিন এ এলাকায় বাস করে গেছে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরে, চেনাজানা আছে নানা মহলে, এখানকার এম এল এ স্বয়ং ফোন করে নির্দেশ দিয়েছে এদের সবরকম সাহায্য করতে। ব্যস, রাজপালের মাথায় পোকা নড়ে ওঠে, সে দুপক্ষ থেকে উপরির জোগাড়ের বন্দোবস্ত করতে লেগে যায়।
    গিরীশের মাথায় রাজপালই বুদ্ধি দেয় জামাইয়ের নামে প্রাথমিকভাবে একটা পাকাপাকি অভিযোগ করে রাখতে। ভদ্রলোক একটু নিমরাজী মত ছিলেন প্রথমে তবে শেষমেশ এফ আই আর করেই ফেলেন। তারপরেই রাজপাল অর্ককে থানায় ডেকে পাঠিয়ে বেশ করে কড়কে দেয়। ভার্মা অবশ্য এ নিয়ে কিছু বলেনি তবু রাজপাল ঠিক করেছে ভার্মা যদি অর্কর তরফদারী করে সে ছেড়ে কথা কইবেনা। চাই কি ওপরওয়ালাদের কাছে ভার্মার বিরুদ্ধে নালিশও করে ফেলবে। ভার্মা শান্ত কমকথার লোক, ওর মনে কী আছে রাজপাল ঠিক বুঝতে পারেনা। হতে পারে ভার্মাও অর্ককেই সন্দেহ করছে। মন্দিরের ঐ মেয়েটা যদি ঠিকঠাক ভরসার সাক্ষী হত, এতদিনে লক আপে ঢুকিয়েই দিতে পারত লোকটাকে!

    হপ্তা ঘুরে এখনও মেয়েটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। ওর বাবা মা দুজনে অথবা কখনো বাবা একাই থানায় এসে ঘুরে যাচ্ছে রোজ। রাজপাল নিজে খুব একটা উদ্যোগ নিচ্ছে না, খাটাখাটনি যা করার ভার্মাই করুক। সে মাঝে মাঝে শুধু ভার্মাকে ফোন করে খবরাখবর জেনে নেয়, কদ্দুর কী এগোলো। কাল রাতে খবর এসেছে যে পালওয়ালের কাছে একটা যুবতী মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। রাজপাল বেশ খুশী মনে সকাল সকাল থানায় এসেই গাড়ী তৈরী করতে বলে, পালওয়াল যেতে হবে। ভার্মাকে ফোন করে নেয় একবার। তাকেও খবর দিয়েছে পালওয়াল থানা থেকে, সেও যাচ্ছে।
    গাড়ির অপেক্ষায় বসে কী মনে করে মেয়েটার বাবা গিরীশকে ফোন লাগায়, সবই আছে রিপোর্টে তবু আর একবার খুঁটিয়ে জেনে নেয় মেয়েটিকে চেনার উপায়, লাশ পাওয়ার কথা অবশ্য বলেনা। লাশ যদি ঐ মেয়েটারই হয় তাহলে কেসটা বেশ জমে যাবে, ছেলেটাকে লক আপে পুরে ফেলতে পারলে আর দেখতে হবে না। ভালো চাকরি করে, তিনদিন লকাপে থাকলে সার্ভিস রেকর্ডে উঠে যাবে এই ভয় দেখিয়ে মোটা টাকা আদায় করা যাবে।
    দেওয়ালীর খরচখরচার জোগাড় তাহলে মোটামুটি হয়ে যাবে, বউ একটা সোনার হার তো কিনবেই ধনতেরাসে, এছাড়া ছেলেমেয়ের চাই এলসিডি টিভি। কী করে কী করবে ভেবে ভেবে তার ঘুম হচ্ছিলনা কদিন!
  • shrabani | 117.239.15.28 | ১৮ অক্টোবর ২০১১ ১৬:০৯495951
  • ছোট অফিসার ধাওয়ান আসতে রাজপাল তাকে সব বুঝিয়ে স্টেশনে থাকতে বলল আজ। পালওয়াল এখান থেকে কম দুর নয়, রাস্তাও ভালো নয়। ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যাবে মনে হচ্ছে। কনস্টেবল সালিখরাম এসে খবর দিল জীপ রেডি, সালিখরাম সঙ্গে যাবে। বাইরে এসে দেখে অন্য কনস্টেবল যতিন্দর একজন বয়স্কা মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। রাজপাল পাশ কাটিয়ে গাড়ীতে উঠতে যাচ্ছিল, যতিন্দর ডাকল,
    -"স্যর।"
    আদ্ধেকটা শরীর জীপে ড্রাইভারের পাশে ঢুকিয়ে দিয়ে রাজপাল একটু খেঁকিয়ে উঠল,কাজে বেরোনোর সময় পিছুডাক সে পছন্দ করেনা,
    -"কী? কী হয়েছে?"
    -"স্যর, এই ম্যাডামজী আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান ঐ যে মহিলা নিখোঁজ হয়ে গেছে সে আগে এনাদের বিল্ডিংয়ে থাকত।"
    গাড়ীতে বসেই রাজপাল মহিলার দিকে তাকায়, প্রায় পঁচাত্তর আশির কাছাকাছি বয়স হবে। কী আর বলবে, নির্ঘাত মেয়েটাকে ঐদিন কোথাও দেখেছে বলবে। আদৌ দেখেছে কী ভীমরতি তাই বা কে বলে! সে যতিন্দরকে মহিলাকে ধাওয়ানের কাছে নিয়ে যেতে বলে গাড়ী ছেড়ে দিতে ইশারা করল।

    ধাওয়ান তার সামনে চেয়ারে বসা মহিলাটিকে দেখছিল। সে অনেকদিন আছে এই থানায়। বয়স বেশী নয়,কাজে খুব বেশী উৎসাহ দেখায় না, তবে উপরওয়ালা যা নির্দেশ দেয় তা শোনে। তার বাড়ি বেশী দুরে নয়, বাড়ির কাছে পোস্টিং, এতেই সে খুশী। বেশী ভালো কাজ বা খারাপ কাজ কোনোটাই করে সে এখান থেকে অন্য জায়গায় যাবার ব্যবস্থা করতে রাজী নয়। এই মহিলাকে দেখে কেমন চেনা লাগে তবে মনে পড়েনা, চেষ্টাও করেনা মনে করার। মহিলার বয়স হয়েছে প্রায় আশির কাছেই হবে, চেহারায় খুব মোটা না, রং ফরসা টুকটুক করছে, মাথার সাদা চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। পরণে ঢোলা মত কামিজ আর রঙিন পাজামা, হাতে একটি ওয়াকিং স্টিক।
    ভদ্রমহিলাও চশমার ফাঁক দিয়ে ধাওয়ানকে জরিপ করছিলেন। ধাওয়ানের কথাবার্তা এমনিতে ভদ্র,ব্যবহার সভ্য, রাজপালের মত কাঠখোট্টা অভদ্র নয়। সে একটু অপেক্ষা করল ও তরফের মুখ খোলার জন্য। কিন্তু দেখল ইনি এনার বয়সী অন্যান্য মহিলার মত বলিয়ে টাইপের নয়। উনিও যেন ধাওয়ানেরই শুরু করার অপেক্ষায়।
    -"আমাদের ইন চার্জ এখন একটু কাজে বেরিয়েছেন। আপনার যা বলার আমাকে বলতে পারেন, আমিও এ থানার একজন অফিসার। আপনার পরিচয়টা?"
    মহিলাটি এবার একটু সোজা হলেন, তারপর আশপাশ দেখলেন। তাদের আশেপাশে কেউ ছিলনা। কনস্টেবলরা বাইরে গুলতানী করছিল, বড় সাহেব নেই। আরো দু একজন এদিক সেদিক ছিটিয়ে ছিল।
    গলা একটু সাফ করে বললেন,
    -" আমি বেটা, মিসেস থমাস, শেলী থমাস। এখানে ঐ সি ব্লকে অভিজ্ঞান অ্যাপার্টমেন্টসে থাকি, একশ বারো নম্বরে। আমি একাই থাকি, ছেলে গাল্ফে আর মেয়ে গুরগাঁওতে থাকে। এমনিতে আমাদেরও বাড়ী কেরালাতে, তবে সেখানে এখন কেউ নেই, সব বিক্রি হয়ে গেছে। স্বামী এখানেই চাকরি করতেন, ছেলেমেয়ে এদিকেই বড় হয়েছে। আমিও এখানেই থেকে গেছি মেয়ের কাছাকাছি থাকব বলে।
    যে মেয়েটী নিখোঁজ হয়েছে, রাজী, ওর ঠাকুমা আমার বন্ধু ছিল। আমাদের সোস্যাইটীতেই থাকত ওরা, ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি।"

    ধাওয়ান খুব একটা উৎসাহিত হলনা, কেসটা মূলত রাজপাল নিজে দেখছে। সে এব্যাপারে খুব কিছু জানেটানে না। তবু কিছু না বললে এই ভদ্রমহিলা হয়ত তাকে সারাদিন বসিয়ে ঐ মেয়েটীর ছোটবেলার গল্প শোনাবে। সে বুঝে নিল একা বয়স্ক মহিলা, জীবনে কোনো রকমফের নেই। এসময়ে এরকম একটা ঘটনা যার কুশীলবরা মহিলার একদা পরিচিত। উনি বোধহয় ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা অনুভব করে আর ধৈর্য্য ধরতে পারেননি, থানায় ছুটে এসেছেন সব জানার জন্য।
    সে মুখটাকে নীরস করে উৎসাহে জল ঢালা গলায় বলল,
    -"আপনি কি কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন এ ব্যাপারে? যা বলার একটু চটপট বলুন, আমি নোট করে রেখে দেব, বড় সাহেব এলে তাকে দিয়ে দেব। তারপর তিনি যদি মনে করেন আপনার সঙ্গে কথা বলে নেবেন। ঠিকানাটা কী যেন?"
    মিসেস থমাস এখানেই হোলি চাইল্ড স্কুলে পড়াতেন, সারাজীবন অনেক ছাত্রছাত্রী ও তাদের গার্জিয়ানদের চরিয়ে মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে জ্ঞান অসীম। উনি ধাওয়ানের ইঙ্গিতগুলো বুঝতে ভুল করলেন না। মুখটাকে শক্ত করে উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে,
    -"অফিসার, আপনি যখন এ কেস সম্বন্ধে কিছু জানেন না তখন আপনার সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয়না। এক কাজ করুন, আমার বক্তব্যের জায়গায় শুধু আমার নাম শেলী থমাস ও ঠিকানা একশ বারো অভিজ্ঞান অ্যাপার্টমেন্ট লিখে রেখে দিন। ও আর তার সাথে এও লিখুন যে আমি নিখোঁজ রাজেশ্বরীর পরিবারকে অনেক দিন ধরে ভালোভাবে চিনতাম, তাই তাদের সম্বন্ধে কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলে পুলিশ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এবার আমি আসি।"

    উনি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে একহাতে স্টিকটাকে শক্ত করে ধরে আর অন্যহাতে কাপড়ের ঝোলাটা নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন। ধাওয়ান এই আকস্মিক ব্যবহারে একটু হতভম্ব হয়ে গেল, তাই যতিন্দর মিসেস থমাসকে যেতে দেখে "কী হয়েছে" বলে যখন এগিয়ে এল তখন সে হাত দুটো উল্টে দিল, মুখে কিছু বলল না।
    যতিন্দর ছোট সাহেবের দিকে তাকিয়ে যেন অবস্থাটা অনুভব করে একটা চুক চুক শব্দ বের করল মুখ থেকে,
    -"এই মেমসাব তো খুব ভালো, অনেককাল এলাকায় আছেন। টীচার ছিলেন, লোকে খুব শ্রদ্ধা করে। কোনো ব্যাপার না হলে এমনি এমনি উনি সময় বরবাদ করতে থানায় আসবেনা।"

    ধাওয়ান এমনিতে সহজে বিচলিত হয়না, পুলিশের চাকরিতে তার উচ্চাশা কিছু নেই, যতটুকু না করলে নয় ততটুকু করে। তবু আজকের এই ব্যাপারটা একটু কেমন কেমন লাগল, মুখটায় একটা তেতো ভাব! সে চিন্তা করতে থাকল ঘটনাটা রাজপালকে বলা ঠিক হবে কিনা।
    রাজপাল যখন ফিরল রাত্তিরে তখন সকালের ঐ বয়স্ক মহিলা তার মাথার কোথাও নেই। সে তখন ব্যস্ত লাশের পোস্টমর্টেম ও ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের সাথে আলোচনা নিয়ে। এমনিতে অনেক কথা বলল,বেশ চনমনে, খুশী খুশী। থানার কিছু মামুলী ব্যাপার নিয়েও কথা হল ধাওয়ানের সাথে,কিন্তু এবিষয়ে কোনো কিছুই বলল না। তাই দেখে ধাওয়ানও ব্যাপারটা চেপে যাওয়াই স্থির করল, তবে কী ভেবে নাম ঠিকানা লেখা কাগজটা ফেলে না দিয়ে ড্রয়ারের ভেতর দিকে ঠেলে দিল!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন