![]() বইমেলা হোক বা নাহোক চটপট নামিয়ে নিন রঙচঙে হাতে গরম গুরুর গাইড । |
দক্ষিণের কড়চা
Parthasarathi Giri
(টিপ্পনি : দক্ষিণের কথ্যভাষার অনেক শব্দ রয়েছে। না বুঝতে পারলে বলে দেব।)
দক্ষিণের কড়চা
▶️
এখানে মেঘ ও ভূমি সঙ্গমরত ক্রীড়াময়। এখন ভূমি অনাবৃত মহিষের মতো সহস্রবাসনা, জলধারাস্নানে। সামাদভেড়ির এই ভাগে চিরহরিৎ বৃক্ষরাজি নুনের দিকে চুপিসারে এগিয়ে এসেছে যেন অ্যাডভেঞ্চারের লোভে। দুঃখের দিকে শরীর যখন এগোয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে, দীর্ণ কে বা হতে চায় পত্রহীনে, অপুষ্পক আঁধারে! জারুল, আম, মুচকুন্দ গাব নারকেল গাছগাছালির কুঞ্জে তাই এইক্ষণে বৃষ্টি সর্বাত্মক ঝেঁপে এসেছে।
বেলা দশটা বাজতে চলল কারোর বোঝার উপায় নেই এবং এখানে ঘড়ি টড়ির চিহ্নমাত্র কোথাও নেই।
কুন হাটে বেচব গো মিঞা?
গুমটির চালার একধারে মনিরুল উবু হয়ে বসে এতক্ষণ নাগাড়ে দুই হাঁড়ির জলে হাতের ছপটি মারছিল আর ভরা আকাশের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল। ডান হাঁড়ির ভিতর রুই মৃগেল পোনা, বামটিতে কাৎলা পোনা। এক ইঞ্চিটাক শরীরের প্রাণী মাত্র। হাতের ছপটিতে নাজেহাল। তবু শ্বাসবায়ু যখন, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে জানান দিচ্ছে হাঁড়ির ভিতর প্রাণের ভিড়।
নটেনের কথায় মনিরুল হাতের ছপটি থামাল। একটু চা পেলে বেশ হত। নটেন চায়ের দোকানের উনুনে পাখা মারছিল। ভেজা বাতাসে কাঠকুটায় আগুন ধরার ঝকমারি। গুচ্ছের ধোঁয়ায় ভেড়িবাজারের পুবপাড়ে ছাতিমতলায় কুয়াশা জমেছে। বৃষ্টির ছাঁট আর ধোঁয়ার মিশ্রণে নটেন খকর খকর কাশছিল।
সরগাছির হাটে যাবা। আগুন ধরবে মনে লয়?
নটেন হো হো হাসল। মিঞা, তুমি যেমন জল চেন, পোনার বুড়বুড়ি চেন, আমি বি কাঠ চিনি। ফুটা কাঠে আগুন লাগবই। কেনি, তুমি চা খাব?
মনিরুলের হঠাৎ যেন খুব শোক পেল। হাতের ছপটির তেজ বেড়ে গেল সেই অজুহাতে।
বৃষ্টি তো আইজ ছাড়বে বলিকি মন কয়টেনি। তুমি কী ভাব?
মনিরুলের শোক কিছুটা হয়ত স্তিমিত হল প্রাকৃতিক ঘনঘটার প্রসঙ্গে। না এ মেঘ সহজে যাবেনি। এ উল্টারথ লিকি যাবে।
কবি উল্টারথ?
মনিরুল এবার হো হো হেসে উঠল।
আচ্ছা দাসের পো, তুমি কিনা আমাকে জিগাওট কবি উল্টারথ?
নটেনের যেন চমক লাগল কিঞ্চিত। তাই তো মনিরুল কী করে জানবে উল্টারথ কবে।
তুমিই তো কইল এ বৃষ্টি উল্টারথ হাঁকড়িবে।
আলাভোলা যজমানকে যেমন গৃহপুরোহিত বিধান দেয়, মনিরুল দুই হাঁড়ির ভিতর থেকে দুই হাত বার করে সটান গম্ভীর উঠে দাঁড়াল।
পরশু। চা দও দিকি।
যেন দক্ষিণা চাই। বিধান নিয়ে দক্ষিণা দেবে যজমান।
টিকে রুঅ। আগুন ধরি যাইছে। মনিরুল আগুনের ধোঁয়া-মাখানো নবীন শিখার দিকে চেয়ে অস্ফুটে বলতে গেল, আইজ ট্যাঁকে একবারে পইসাকড়ি নাই গো দাসের পো। পরের হপ্তায় পইসা দিবা।
নটেন গুমটির চালার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক ছাতিমগাছের সহস্র পত্রে চোখ দিল। যেন সে আকাশ বিচার করবে। যেন সে মুদ্রা বিনিময় প্রসঙ্গে উদাসীন।
মিঞা তুমার শরীরে গটে গামছা সার। তুমি যখন বুসথল, তোমার ন্যাংটা এঁড়বিচা ঝুলছে দেখছি। সে বি ভিজিকি চুপসিছে। তুমার ট্যাঁকে কী আছে না আছে আমি বুজি লিছি। লও চা লও। জুত করিকি খাও তো ওউ ঠান্ডার বাজারে।
মনিরুল এবং নটেন সুড়ুৎ সুড়ুৎ চায়ে চুমুক মারছে। তাদের বৃষ্টি বিষয়ক আকাশ ভূমি হাঁ করে গিলছে এবং আনন্দিত রোরুদ্যমান। উনুনে আগুন ধরে উঠেছে জবরদস্ত।
নটেন ভাঙা ঝরঝরে রেডিওর নবটা অন করল। বিশেষ বিশেষ খবর, ধুলাগোড়ে দুই সম্প্রদায়ের রোষ আজও অব্যাহত। ধুস। নটেন ফড়াক করে নব ঘুরিয়ে দিল। এখন কে খবর শোনে!
'ও আকাশ সোনা সোনা এ মাটি সবুজ সবুজ'।
'ও আকাশ সোনা সোনা এ মাটি সবুজ সবুজ'।
গটে বিড়ি দও দাসের পো।
নটেন বিড়ি দিল। নিজে একটা ধরাল এক আগুনের ছিলকা থেকে। গুনগুনিয়ে বৃষ্টিবিঘ্নিত দুজন কী গাইছে ঈশ্বরাল্লা জানে।
যাও, বারাও মিঞা। আমি বি ঘর যাবা। আইজ আর কাস্টমার হবেনি। আগুন নিভিই দিই। ঘরে বউটার দুদিন জ্বর।
মনিরুল বাঁক তুলল কাঁধে। সহস্র প্রাণ সহসা ঝিলমিলিয়ে উঠল জলে। হাঁটার গতির ছন্দে ছন্দে দুলুনির ছপাৎ ঢেউয়ে তাদের বায়ু বরাদ্দ। নটেন এবার ছাতিমতলার গুমটিঘর বন্ধ করবে। মনিরুল জল পাতাপুতা পোকা নুন ছপছপিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নিজস্ব জলের ভুবনের দিকে।
দক্ষিণের কড়চা
▶️
এখানে মেঘ ও ভূমি সঙ্গমরত ক্রীড়াময়। এখন ভূমি অনাবৃত মহিষের মতো সহস্রবাসনা, জলধারাস্নানে। সামাদভেড়ির এই ভাগে চিরহরিৎ বৃক্ষরাজি নুনের দিকে চুপিসারে এগিয়ে এসেছে যেন অ্যাডভেঞ্চারের লোভে। দুঃখের দিকে শরীর যখন এগোয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে, দীর্ণ কে বা হতে চায় পত্রহীনে, অপুষ্পক আঁধারে! জারুল, আম, মুচকুন্দ গাব নারকেল গাছগাছালির কুঞ্জে তাই এইক্ষণে বৃষ্টি সর্বাত্মক ঝেঁপে এসেছে।
বেলা দশটা বাজতে চলল কারোর বোঝার উপায় নেই এবং এখানে ঘড়ি টড়ির চিহ্নমাত্র কোথাও নেই।
কুন হাটে বেচব গো মিঞা?
গুমটির চালার একধারে মনিরুল উবু হয়ে বসে এতক্ষণ নাগাড়ে দুই হাঁড়ির জলে হাতের ছপটি মারছিল আর ভরা আকাশের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল। ডান হাঁড়ির ভিতর রুই মৃগেল পোনা, বামটিতে কাৎলা পোনা। এক ইঞ্চিটাক শরীরের প্রাণী মাত্র। হাতের ছপটিতে নাজেহাল। তবু শ্বাসবায়ু যখন, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে জানান দিচ্ছে হাঁড়ির ভিতর প্রাণের ভিড়।
নটেনের কথায় মনিরুল হাতের ছপটি থামাল। একটু চা পেলে বেশ হত। নটেন চায়ের দোকানের উনুনে পাখা মারছিল। ভেজা বাতাসে কাঠকুটায় আগুন ধরার ঝকমারি। গুচ্ছের ধোঁয়ায় ভেড়িবাজারের পুবপাড়ে ছাতিমতলায় কুয়াশা জমেছে। বৃষ্টির ছাঁট আর ধোঁয়ার মিশ্রণে নটেন খকর খকর কাশছিল।
সরগাছির হাটে যাবা। আগুন ধরবে মনে লয়?
নটেন হো হো হাসল। মিঞা, তুমি যেমন জল চেন, পোনার বুড়বুড়ি চেন, আমি বি কাঠ চিনি। ফুটা কাঠে আগুন লাগবই। কেনি, তুমি চা খাব?
মনিরুলের হঠাৎ যেন খুব শোক পেল। হাতের ছপটির তেজ বেড়ে গেল সেই অজুহাতে।
বৃষ্টি তো আইজ ছাড়বে বলিকি মন কয়টেনি। তুমি কী ভাব?
মনিরুলের শোক কিছুটা হয়ত স্তিমিত হল প্রাকৃতিক ঘনঘটার প্রসঙ্গে। না এ মেঘ সহজে যাবেনি। এ উল্টারথ লিকি যাবে।
কবি উল্টারথ?
মনিরুল এবার হো হো হেসে উঠল।
আচ্ছা দাসের পো, তুমি কিনা আমাকে জিগাওট কবি উল্টারথ?
নটেনের যেন চমক লাগল কিঞ্চিত। তাই তো মনিরুল কী করে জানবে উল্টারথ কবে।
তুমিই তো কইল এ বৃষ্টি উল্টারথ হাঁকড়িবে।
আলাভোলা যজমানকে যেমন গৃহপুরোহিত বিধান দেয়, মনিরুল দুই হাঁড়ির ভিতর থেকে দুই হাত বার করে সটান গম্ভীর উঠে দাঁড়াল।
পরশু। চা দও দিকি।
যেন দক্ষিণা চাই। বিধান নিয়ে দক্ষিণা দেবে যজমান।
টিকে রুঅ। আগুন ধরি যাইছে। মনিরুল আগুনের ধোঁয়া-মাখানো নবীন শিখার দিকে চেয়ে অস্ফুটে বলতে গেল, আইজ ট্যাঁকে একবারে পইসাকড়ি নাই গো দাসের পো। পরের হপ্তায় পইসা দিবা।
নটেন গুমটির চালার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক ছাতিমগাছের সহস্র পত্রে চোখ দিল। যেন সে আকাশ বিচার করবে। যেন সে মুদ্রা বিনিময় প্রসঙ্গে উদাসীন।
মিঞা তুমার শরীরে গটে গামছা সার। তুমি যখন বুসথল, তোমার ন্যাংটা এঁড়বিচা ঝুলছে দেখছি। সে বি ভিজিকি চুপসিছে। তুমার ট্যাঁকে কী আছে না আছে আমি বুজি লিছি। লও চা লও। জুত করিকি খাও তো ওউ ঠান্ডার বাজারে।
মনিরুল এবং নটেন সুড়ুৎ সুড়ুৎ চায়ে চুমুক মারছে। তাদের বৃষ্টি বিষয়ক আকাশ ভূমি হাঁ করে গিলছে এবং আনন্দিত রোরুদ্যমান। উনুনে আগুন ধরে উঠেছে জবরদস্ত।
নটেন ভাঙা ঝরঝরে রেডিওর নবটা অন করল। বিশেষ বিশেষ খবর, ধুলাগোড়ে দুই সম্প্রদায়ের রোষ আজও অব্যাহত। ধুস। নটেন ফড়াক করে নব ঘুরিয়ে দিল। এখন কে খবর শোনে!
'ও আকাশ সোনা সোনা এ মাটি সবুজ সবুজ'।
'ও আকাশ সোনা সোনা এ মাটি সবুজ সবুজ'।
গটে বিড়ি দও দাসের পো।
নটেন বিড়ি দিল। নিজে একটা ধরাল এক আগুনের ছিলকা থেকে। গুনগুনিয়ে বৃষ্টিবিঘ্নিত দুজন কী গাইছে ঈশ্বরাল্লা জানে।
যাও, বারাও মিঞা। আমি বি ঘর যাবা। আইজ আর কাস্টমার হবেনি। আগুন নিভিই দিই। ঘরে বউটার দুদিন জ্বর।
মনিরুল বাঁক তুলল কাঁধে। সহস্র প্রাণ সহসা ঝিলমিলিয়ে উঠল জলে। হাঁটার গতির ছন্দে ছন্দে দুলুনির ছপাৎ ঢেউয়ে তাদের বায়ু বরাদ্দ। নটেন এবার ছাতিমতলার গুমটিঘর বন্ধ করবে। মনিরুল জল পাতাপুতা পোকা নুন ছপছপিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নিজস্ব জলের ভুবনের দিকে।
181
বার পঠিত (সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে)
শেয়ার করুন |
আপনার মতামত দেবার জন্য নিচের যেকোনো একটি লিংকে ক্লিক করুন