![]() বইমেলা হোক বা নাহোক চটপট নামিয়ে নিন রঙচঙে হাতে গরম গুরুর গাইড । |
বিকেলের রাঙা গল্প
Parthasarathi Giri
বিকেলের রাঙা গল্প
*****************
একটা উধাও হাইওয়ের পাশে একটা ডোবা। ডোবার পাড়ে একটা ঝাঁকড়া শিরিষ গাছ। ছায়া পড়েছে জলে। এক টুকরো জল ঘিরে একটি ইকোসিস্টেম।
জল দেখলে, বিশেষত কাদামাখা ঘোলাজল দেখলে আমার কানকো খলবল করে ওঠে। পায়ের নখের ধার বরাবর, কানের লতির নিচে সুড়সুড় করে শিরিষ-ফুল-ভাসা ডোবা দেখলে। মাঝে মাঝে স্থির জল তিরতির করে কেঁপে উঠছে। মনে হয় ফিসফিস নাকি বিড়বিড়; ডোবার ঘরে আমার খলসে বউয়ের গা ভারি হয়েছে বলে গজগজ করে?
পুরুষজাতটাই তো বজ্জাত। বলিনি আমি? কতবার করে বাবাকে বললুম, ওগো আমাকে যার তার হাতে তুলে দিওনি। আমারে বুঝবেনে। সেই তুলে দিল, আর দিল কিনা এমন আলা পাষণ্ডের ওপর।
জলের ওপরে একটি শিরিষ ফুলের পাশে আরেকটি ঝরে পড়া ফুল এসে শুয়ে পড়ে। ছোট ছোট কদম ফুলের মতো সুখ জলের গায়ে গায়ে আঁকা। হলদে সাদা রেণুগুলো সর সর করে ছড়ায় আর সরকি পোকারা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে যায়। হালকা শীত শীত রোদ ছলকাচ্ছে কি খলসে বউয়ের মুখরা ঠোঁটে?
একবার ফিরেও দেখে না গা বউটা মরল কি বাঁচল!
আমি জলের পাড়ে বসে ডোবার ভেতর নিজের ছোট ছোট হাড়, কেঁচো, মাংসের টুকরো, নাকের পোঁটা, হৃৎপিণ্ডের দ্রুম দ্রুম ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম, একটা বিকেল হাইওয়ের পাশে বসতে পেয়েছি বলে।
সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল কানে এলে দেখি কেরিয়ারে হেন্ডেলিয়ামের হাঁড়ি দড়ি দিয়ে বাঁধা। আলপথ বেয়ে সাইকেলটা উঠে আসছে সওয়ারি নিয়ে।
হ্যাঁ গো চাচা, এ গাঁয়ের নাম কী?
খলিসাডুবি।
তোমার নাম কী?
খলিল শেখ।
কোথায় যাও?
রানিবানির খালে জাল পড়েছে। আজ সারাদিন জল খালি হবে।
মানে?
পুরা মাছ ধরা হবে। নিলাম হবে।
ও।
রানিবানি রানিবানি রানিবানি। আমি গাঁয়ের নামটা বিড়বিড় করতে থাকি। কী সুন্দর অর্থহীন নাম। অযথা, তবুও বাঙ্ময়।
আমার গায়ের আঁশে একটা ছোট্ট পোকা উড়ে এসে বসেছে, নাকি জলের কেঁউট? আমি টোকা মেরে ফেলে দিলাম। ফের সেটি পিঠের আঁশে খুদে খুদে ঢুকে গেল। আমার কানকো চুলকে উঠল। আমি মুখ হাঁ করতে দু চারটে ছটা বুদবুদ হাওয়ায় উড়ে গেল। একটা দুর্গা টুনটুনি বোধহয় ইউফো ভেবে ঠোঁট খুঁটে বুদবুদ ভেঙে দিয়ে ফুড়ুৎ করে পালায়।
ডোবার ছায়াজলে ঘাই দিচ্ছে সতের শো বৃত্তান্তের মালাকর।
ও খলসে বউ, এখনও তোমার জিভে এত ভিয়েন? সেই যে সেই ডিম পাড়ার মরশুমে, জলের ওপর জল তার ওপরে জল, তার ওপরে তোমার ড্যাবডেবে ডাগর চোখে চোখ ছুঁয়ে বলছিলাম, ওগো কষ্ট হবে, তার চেয়ে চলো এই খোঁদলের পাঁক ছেড়ে পরের বাদলায় দত্তবাড়ির পুষ্কুরিণীতে যাই। ওখানে জলের মাটিভরা কত্তো পোকা থাকবে'খন, জলের ওপরে বাতাস গাছের শরীরের বাকল ডোকলার গুঁড়া এনে ফেললে দুজনে গাল ভরে খাব। তা তুমি গেলে?
গেলে? গেলে? বলি এ সংসার ছেড়ে যাবটা কেন শুনি? খলসে বউ হনহন করে ইদিক উদিক না জানি কত টুকিটাকি কাজে দৌড়োদৌড়ি করতে করতে হাঁফিয়ে কথা বলছে।
জলের তলায় অজস্র রঙিন বলের মতো পোকা, মাছ, লাল যুগান্তর, সবুজ পতাকার ওপর রক্তের ছিটে, সব উতল হয়ে ঘুরে ঘুরে যেন ত্রুবাদুর। বুড়বুড়ির ঝিলিকে কেলে কাঁকড়ার হাসি, কুচো চিংড়ির নখরা। চ্যাং মাছের ছানারা ডাংগুলি খেলছে। তাদের এখন হো হো অকারণ হাসি।
আমার খলসে বউয়ের চোখে জল নাকি? হ্যাঁ, জলের ভেতর জল।
চোখে জল কেন গো সই? ভুল দেখছি না তো?
খলসে বউ পেট উল্টিয়ে দেখায়, তুমি কী বুঝবে পেটে ধরার সুখ কষ্ট দম। তুমি তো চিরকাল পাখনা নেড়ে নেড়ে কীর্তন গেয়ে, কপালে রসকলি পরে পরের উঠোনে রাত ভোর করে এলে। আমারে তুমি কখনও ভালবাসো নাই। এদিকে এই পাঁচ গতরের সংসার ঠেলে ঠেলে আমার যে হাড়মাস কালি হল, বলি চোখে দেখতে পাও?
যুগের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে হাইওয়ের পাশে। এই সব হাইওয়ে কতদূর গেছে এ গাঁ ফেলে? অনেক দূর? হুই যে ম্লান চাঁদ দেখা যায়, অত দূর গেছে? পথ গা ভাঙে চড়চড় করে বিটুমেন অ্যাসফল্টের নিচে।
আমি এবং আমার খলসে বউয়ের কথা শুনে হাইওয়ে খ্যা খ্যা করে হাসল। যে যত পায়, তার তত খাঁই বেশি।
অমন করে বোলো না দীর্ঘতনু।
বলবনি? তুমি যে ওরে চোখে হারাও, আমার পাড়ে বসে ছিলিম একদিন ছুঁড়ে দিচ্ছিলে মনে আছে? বলছিলে, নেশা করে হেথা হোথা আমার শরীরে আর শোবেনিকো। বউটারে এবার নজর দিতে লাগে। সে বিহনে কোথা যেতে পারো তুমি?
জলের ওপর অজস্র মাংসের মতো, আলোর ফুলকির মতো শিরিষ ফুল ভাসে নিশ্চিন্তে। কে কাকে ঠাঁই দেয় বা কেড়ে নেয়? ঠাঁই নিয়ে নিয়েছে ফুলেরা জলের গায়ে গায়ে।
খলসে বউ জলতলে ঠোঁট মেলে একটা পূর্ণ ঘাই দিল। কী অপরূপ রূপখানি আমার সখীর! ডাগর ডাগর চোখে সৃষ্টির সমূহ কাজল মাখা। পাখনা নেড়ে নেড়ে সেই তার পোঁদদোলানি চলন। পেট ভরা ডিম। জলের ওপর অজস্র কুচকাওয়াজ যেন শুনতে পাচ্ছি। লঙ মার্চ। দূর্গপ্রাচীর হড়হড় করে ভেঙে পড়ছে। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বেজে উঠেছে হাজার বিউগলে। রক্তের রেণু ঘিরে কাচের পুঁতির মতো ডিম ফুটে বেরিয়েছে বলে সাদা সাদা পাখিরা ঠোঁটে ঘাস নিয়ে অভিবাদন জানাতে এসেছে আঁতুড়ের উঠোনে। এ তো আমাদেরই সব ছানাপোনা গো খলসে বউ!
তবে চলো কাদাজলে ভেসে যাই। এই ডোবা আমাদের। এই সব পোকাদের ওপর আমাদের অধিকার। এই সব ক্রীড়াময়, এই ক্ষুধা খাদ্য বাসস্থান আমাদের। এ জল আমার তোমার। এই সব যত যুগ যুগান্ত যুগান্তর সব আমরা এই হাইওয়ের পাশে বসে বসে হেঁটে হেঁটে সাঁতরে সাঁতরে খাব। তুমি মুখ করলে এই মুখপোড়া হাইওয়েকে দুচারটে গালি মেরে চুমা খেয়ে রাগ হাল্কা করব বটে, কিন্তু যে-সুর লক্ষ কণ্ঠকে জুড়ে দেয় উড্ডীন লাল নিশানে আঁশে পালকে, তাকে হারাই কেমনে!
জলের নিচে ডাগর চোখের ঠোঁট বুড়বুড়ি কেটে উঠল, ইনকিলাব...
আমি ডোবার পাড়ে পদপূরণ করলাম, জিন্দাবাদ।
বিকেলের রাঙা সূর্য এসেছে পশ্চিম দিগন্তরেখায়।
454
বার পঠিত (সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে)
শেয়ার করুন |
আপনার মতামত দেবার জন্য নিচের যেকোনো একটি লিংকে ক্লিক করুন