![]() বইমেলা হোক বা নাহোক চটপট নামিয়ে নিন রঙচঙে হাতে গরম গুরুর গাইড । |
শিক্ষানবীশ
শক্তি দত্তরায় করভৌমিক
বুড়ো নিধুরাম আজকে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে গাছকালীবাড়িতে পুজো দিয়েছে। সোয়া পাঁচআনার নকুলদানা আর প্রসাদী বেলপাতা লাল সালুর রুমালে বেঁধে নিয়ে এসেছে। নিধুর বড়ছেলে নুটু স্নান করে শুদ্ধভাবে বাটিতে তেল আর কালি গুলছে। নুটুর বৌ বিরিঞ্চির মা রঙ্গময়ী কালো একটা জাঙিয়ার ফুটোফাটা যত্নে সেলাই করছে। সন্ধ্যেবেলা সবাই স্নান করে তুলসীতলায় বাতাসা দিয়ে হরির লুঠ দিয়েছে। আজকে এই প্রজন্মের প্রথম সন্তান তেরো বছরের বিরিঞ্চি কাজে বেরোবে। তার সঙ্গে বিরিঞ্চির পিতৃবন্ধু সিঁদেল হরি।
এলাকার নামকরা চোর নিধুরাম। এইদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট বড় মাঝারী চোরদের মধ্যে নিধুর খুব সম্মান, তারই নাতি বিরিঞ্চির আজ হাতেখড়ি। বিরিঞ্চির মনটা প্রথম চুরি করতে সায় দিচ্ছিলো না। ইস্কুলে হাতের লেখা লিখেছে চুরি করা মহাপাপ। কিন্তু তার ঠাকুরদার কথা হচ্ছে চুরি করা পাপ কিছু নয়। ভগবানের পৃথিবীতে সব জিনিসে সবার হক আছে। কিছু লোক নিজের ঘরে সবার সম্পত্তি জমা করেছে। সেগুলো উদ্ধার করে আনতেই চোরদের সৃষ্টি। চুরিবিদ্যা কম বিদ্যা? চোরদের শাস্ত্র আছে চৌরপঞ্চাশিকা। আগেকার দিনের রাজারা গুরুগৃহে চৌষট্টি কলার চর্চা করতেন। চৌরশাস্ত্রও পড়তেন তাঁরা। চুরি করা চাট্টিখানি কাজ নয়। কত কিছু শিখতে হয়। আগে খবর করতে হয় কার কাছে কি চুরিযোগ্য জিনিস আছে। জানতে হয় কখন গৃহস্থবাড়িতে সবাই ঘুমন্ত। পালাবার পথ আছে কি নেই বুঝতে হয়। কয়েকদিন ধরে বুড়ো নাতিকে চুরিবিদ্যার এক্সপার্ট করার প্রশিক্ষন দিচ্ছে। বাবা নুটুবিহারী যে খুব খুশি তা নয়। একাজে ঝুঁকি আছে, সরল অবুঝ কিশোর পুত্রকে একাজে নামাতে তার মন সরে না। বিরিঞ্চির মাও এই লাইনের নামকরা পকেটমারের মেয়ে। ছোটবেলায় মেলা কি পুজো প্যান্ডেলে একটু আধটু চুরিবিদ্যা প্র্যাকটিসও করেছে। রঙ্গময়ী বিশ্বাস করে ছেলে একটু বড় হলে ঠাকুরদা আর দাদামশাইএর মান রাখবে। রঙ্গময়ী আজ বেশ খুশি। ছেলের কাজের পোশাক হবে ঘোর কালো। রাতের আঁধারে দেখাই যাবেনা - গায়ে কালিমাখা, কালো পোশাক পরা চোরকে ধরা পড়লে পালাতে হবে দৌড়ে। রঙ্গময়ী কালো জাঙিয়াতে পরিপাটি করে একটা পকেট বসিয়ে দিচ্ছে। দরকার হতে পারে।
বিরিঞ্চির বিশেষ ট্রেনিং আছে। এদিকে বেশীরভাগ মাটির ভিত দিয়ে ঘর। সিঁদেল চোররা সিঁদকাঠি দিয়ে মাটির ভিতে গর্ত করে। ছোট বাচ্ছা ছেলেদের ঐ গর্ত দিয়ে ঢুকে যেতে হয় ঘরে। তারপর দরজার ছিটকিনি খুলে দেয় ওরাই। বড়মানুষ চোর সোনাদানা টাকাপয়সা যেটুকু পায় কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে দরজা দিয়ে পালায়। সবার গায়ে চুপচুপে তেল মাখা। ধরা পড়লে পালাবার সুবিধে হয়। কালো পোশাক বিজলীহীন অন্ধকার রাতে চোখে পড়েনা। এখন বাচ্ছা চোর বিরিঞ্চি তো সাজগোজ করে অভিযানে বেরোবার জন্য প্রস্তুত কিন্তু বড়চোর হরিলালের পাত্তা নেই। বিরিঞ্চি তেলচুপচুপে হয়ে অপেক্ষা করে ক্লান্ত। তার খিদেও পেয়ে গেছে। মা চারটি ভাত খাইয়ে দিল ডালের বড়া দিয়ে মেখে, হোক না চোর, মায়ের তো ছেলে। বিরিঞ্চি একটু ঘুমিয়েও নেয়, বড়চোর হরিলালের তবু দেখা নেই। কালো জাঙিয়া পরা তেলকালি মাখা বিরিঞ্চি গুটিগুটি বেরোয়, পায়ে পায়ে এগোয় ভটচাজ বাড়ির উঠোনের দিকে। চুরিতে তার মনও নেই। এবাড়িতে তালের বড়া বা সত্যনারায়ণের সিন্নী হলে বিরিঞ্চিও খেতে আসে। বাড়ির ভুলু কুকুর তাকে দেখে আওয়াজ তোলে ভুকভুক। বিরিঞ্চিকে বলে দেওয়া হয়েছে তুলসীমঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে খেয়াল রাখতে হবে বাড়ির সবাই যে যার ঘরে ঢুকে গেছে কিনা। বিরিঞ্চি সিঁদকাঠি হাতে তুলসীবেদীর পেছনে হরিলালের অপেক্ষা করে আর পাহারার মহড়া দেয়।
ভটচাযবাড়ির মেজদাদুর বয়েস হয়েছে, চোখের জোর কম; ভক্ত বৈষ্ণব মানুষ, গভীর রাতে কৃষ্ণনাম করে তুলসীতলা প্রদক্ষিণ করে ঘুমোতে যান। উঠোন থেকে নেমে মেজদাদুর ঠাহর করেন, কে রে ওখানে? হঠাৎ দাদুর আনন্দে বাকরোধ হয়ে যায় - এ কি! স্বয়ং রাখালরাজা বাঁশি হাতে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে! দুহাত বাড়িয়ে দাদু কিশোর কালাচাঁদকে জড়িয়ে ধরতে যান। কৃষ্ণঠাকুর যদিও বড়ই তেল চুপচুপে। দাদুর বাহুবন্ধনে ভীত কিশোর কৃষ্ণ শিক্ষানবিশী সিঁদকাঠি ফেলে ছুট লাগায়, পেছনে ছোটে ভুলু কুকুর, ভুক ভুক ভৌ!
হরিলাল রাতে আসতে পারেনি দারোগাবাবুর তলব পড়ায়। নিধুরামের মন খারাপ, নাতিটার হাতে বুঝি বংশের গৌরব রক্ষা হলো না। নুটুবিহারী অবশ্য মনে মনে অখুশি নয়। সকালে ভটচাজবাড়িতে দর্শনার্থীর ঢল - মেজদাদুকে কৃষ্ণঠাকুর দর্শন দিয়েছেন, ফেলে গেছেন তাঁর বাঁশিটি। বাঁশের বাঁশির বদলে লোহার কাঠি কেন আনলেন সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেজদাদু উদ্ধার করতে পারেননি, ঠাকুরের লীলা, সে কি আর বোঝা যায়, ননীচোরা বালক ভগবান। গ্রামের সবাই বিরিঞ্চির সিঁদকাঠিকে প্রনাম করতে এসেছে, দেখছে দূর থেকে ভক্তিভরে, চারদিকে উৎসবের ছোঁয়া। বিরিঞ্চিও এসেছে কৃষ্ণঠাকুরের প্রসাদ খেতে। ভুলু কুকুর ওকে দেখে লেজ নেড়ে ডেকে ওঠে ভুক ভুক।
এলাকার নামকরা চোর নিধুরাম। এইদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট বড় মাঝারী চোরদের মধ্যে নিধুর খুব সম্মান, তারই নাতি বিরিঞ্চির আজ হাতেখড়ি। বিরিঞ্চির মনটা প্রথম চুরি করতে সায় দিচ্ছিলো না। ইস্কুলে হাতের লেখা লিখেছে চুরি করা মহাপাপ। কিন্তু তার ঠাকুরদার কথা হচ্ছে চুরি করা পাপ কিছু নয়। ভগবানের পৃথিবীতে সব জিনিসে সবার হক আছে। কিছু লোক নিজের ঘরে সবার সম্পত্তি জমা করেছে। সেগুলো উদ্ধার করে আনতেই চোরদের সৃষ্টি। চুরিবিদ্যা কম বিদ্যা? চোরদের শাস্ত্র আছে চৌরপঞ্চাশিকা। আগেকার দিনের রাজারা গুরুগৃহে চৌষট্টি কলার চর্চা করতেন। চৌরশাস্ত্রও পড়তেন তাঁরা। চুরি করা চাট্টিখানি কাজ নয়। কত কিছু শিখতে হয়। আগে খবর করতে হয় কার কাছে কি চুরিযোগ্য জিনিস আছে। জানতে হয় কখন গৃহস্থবাড়িতে সবাই ঘুমন্ত। পালাবার পথ আছে কি নেই বুঝতে হয়। কয়েকদিন ধরে বুড়ো নাতিকে চুরিবিদ্যার এক্সপার্ট করার প্রশিক্ষন দিচ্ছে। বাবা নুটুবিহারী যে খুব খুশি তা নয়। একাজে ঝুঁকি আছে, সরল অবুঝ কিশোর পুত্রকে একাজে নামাতে তার মন সরে না। বিরিঞ্চির মাও এই লাইনের নামকরা পকেটমারের মেয়ে। ছোটবেলায় মেলা কি পুজো প্যান্ডেলে একটু আধটু চুরিবিদ্যা প্র্যাকটিসও করেছে। রঙ্গময়ী বিশ্বাস করে ছেলে একটু বড় হলে ঠাকুরদা আর দাদামশাইএর মান রাখবে। রঙ্গময়ী আজ বেশ খুশি। ছেলের কাজের পোশাক হবে ঘোর কালো। রাতের আঁধারে দেখাই যাবেনা - গায়ে কালিমাখা, কালো পোশাক পরা চোরকে ধরা পড়লে পালাতে হবে দৌড়ে। রঙ্গময়ী কালো জাঙিয়াতে পরিপাটি করে একটা পকেট বসিয়ে দিচ্ছে। দরকার হতে পারে।
বিরিঞ্চির বিশেষ ট্রেনিং আছে। এদিকে বেশীরভাগ মাটির ভিত দিয়ে ঘর। সিঁদেল চোররা সিঁদকাঠি দিয়ে মাটির ভিতে গর্ত করে। ছোট বাচ্ছা ছেলেদের ঐ গর্ত দিয়ে ঢুকে যেতে হয় ঘরে। তারপর দরজার ছিটকিনি খুলে দেয় ওরাই। বড়মানুষ চোর সোনাদানা টাকাপয়সা যেটুকু পায় কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে দরজা দিয়ে পালায়। সবার গায়ে চুপচুপে তেল মাখা। ধরা পড়লে পালাবার সুবিধে হয়। কালো পোশাক বিজলীহীন অন্ধকার রাতে চোখে পড়েনা। এখন বাচ্ছা চোর বিরিঞ্চি তো সাজগোজ করে অভিযানে বেরোবার জন্য প্রস্তুত কিন্তু বড়চোর হরিলালের পাত্তা নেই। বিরিঞ্চি তেলচুপচুপে হয়ে অপেক্ষা করে ক্লান্ত। তার খিদেও পেয়ে গেছে। মা চারটি ভাত খাইয়ে দিল ডালের বড়া দিয়ে মেখে, হোক না চোর, মায়ের তো ছেলে। বিরিঞ্চি একটু ঘুমিয়েও নেয়, বড়চোর হরিলালের তবু দেখা নেই। কালো জাঙিয়া পরা তেলকালি মাখা বিরিঞ্চি গুটিগুটি বেরোয়, পায়ে পায়ে এগোয় ভটচাজ বাড়ির উঠোনের দিকে। চুরিতে তার মনও নেই। এবাড়িতে তালের বড়া বা সত্যনারায়ণের সিন্নী হলে বিরিঞ্চিও খেতে আসে। বাড়ির ভুলু কুকুর তাকে দেখে আওয়াজ তোলে ভুকভুক। বিরিঞ্চিকে বলে দেওয়া হয়েছে তুলসীমঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে খেয়াল রাখতে হবে বাড়ির সবাই যে যার ঘরে ঢুকে গেছে কিনা। বিরিঞ্চি সিঁদকাঠি হাতে তুলসীবেদীর পেছনে হরিলালের অপেক্ষা করে আর পাহারার মহড়া দেয়।
ভটচাযবাড়ির মেজদাদুর বয়েস হয়েছে, চোখের জোর কম; ভক্ত বৈষ্ণব মানুষ, গভীর রাতে কৃষ্ণনাম করে তুলসীতলা প্রদক্ষিণ করে ঘুমোতে যান। উঠোন থেকে নেমে মেজদাদুর ঠাহর করেন, কে রে ওখানে? হঠাৎ দাদুর আনন্দে বাকরোধ হয়ে যায় - এ কি! স্বয়ং রাখালরাজা বাঁশি হাতে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে! দুহাত বাড়িয়ে দাদু কিশোর কালাচাঁদকে জড়িয়ে ধরতে যান। কৃষ্ণঠাকুর যদিও বড়ই তেল চুপচুপে। দাদুর বাহুবন্ধনে ভীত কিশোর কৃষ্ণ শিক্ষানবিশী সিঁদকাঠি ফেলে ছুট লাগায়, পেছনে ছোটে ভুলু কুকুর, ভুক ভুক ভৌ!
হরিলাল রাতে আসতে পারেনি দারোগাবাবুর তলব পড়ায়। নিধুরামের মন খারাপ, নাতিটার হাতে বুঝি বংশের গৌরব রক্ষা হলো না। নুটুবিহারী অবশ্য মনে মনে অখুশি নয়। সকালে ভটচাজবাড়িতে দর্শনার্থীর ঢল - মেজদাদুকে কৃষ্ণঠাকুর দর্শন দিয়েছেন, ফেলে গেছেন তাঁর বাঁশিটি। বাঁশের বাঁশির বদলে লোহার কাঠি কেন আনলেন সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেজদাদু উদ্ধার করতে পারেননি, ঠাকুরের লীলা, সে কি আর বোঝা যায়, ননীচোরা বালক ভগবান। গ্রামের সবাই বিরিঞ্চির সিঁদকাঠিকে প্রনাম করতে এসেছে, দেখছে দূর থেকে ভক্তিভরে, চারদিকে উৎসবের ছোঁয়া। বিরিঞ্চিও এসেছে কৃষ্ণঠাকুরের প্রসাদ খেতে। ভুলু কুকুর ওকে দেখে লেজ নেড়ে ডেকে ওঠে ভুক ভুক।
422
বার পঠিত (সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে)
শেয়ার করুন |
আপনার মতামত দেবার জন্য নিচের যেকোনো একটি লিংকে ক্লিক করুন