![]() বইমেলা হোক বা নাহোক চটপট নামিয়ে নিন রঙচঙে হাতে গরম গুরুর গাইড । |
সেপিয়া টোনের চালচিত্তির
Parthasarathi Giri
🎎
আমার শিক্ষক জীবনটি নয় নয় করে আট দশ বছর জিইয়েছিল। কাজ পাচ্ছি না তো শিক্ষাদান কর। সুতরাং প্রাইভেট টিউশন নামক জীবিকায় ক্ষুন্নিবৃত্তি, কলাটা মুলোটা এবং সন্ধ্যের টিফিন।
যেহেতু গণিতশাস্তর পড়াতাম, তাই অধিকাংশের কাছে বেহ্মদত্যির মতো ছিলাম। আমাকে দেখামাত্তর ছাত্র-ছাত্রীর মা-বাবা যতটা নিশ্চিন্ত, খুদে নাগরিকটি ততোধিক মর্মাহত হত। মুখের আলোটি তৎক্ষণাৎ ঘনমেঘে অবলুপ্ত। কী মুশকিলেই না পড়তাম!
মুশকিলের আসান তো চাই।
প্রথমে ফাঁদ পাতলাম। তারপর চাঁদ পাতলাম।
সঙ্গে বিষয় বাংলা পড়ানো শুরু করলাম। বিষয় বাংলা!
ক্রমশ সে এক কান্ড হল বটে!
কোনো কিছু না বলেই ছাত্র ছাত্রীর আবদার, স্যার, তারপর বিভূতিভূষণ কি ম্যানেজারি ছেড়েই দিলেন? নাকি তাপ্পরও ঘোড়া ছুটিয়ে জঙ্গল পার হতেন?
শিক্ষা, স্বপ্ন, কল্পনা, গল্প, গুল, গুল্প এবং কীর্তিকে এক পাত্রে ঘেঁটে দধিকর্মার মতো রোজ খাওয়াতে থাকলাম। মাঝে মাঝে খেলাচ্ছলে ঐকিক নিয়ম কাকে বলে বদমাইশ বল।
1 টাকা = একশ পয়সা
1/2 টাকা=?
1/2 উল্টে যাবে নাকি সোজা বসে যাবে?
1/2 টাকা = পঞ্চাশ পয়সা
1টাকা =?
এখানে হাফ উল্টে যাবে নাকি সোজা বসবে?
অঙ্ক একটা খেলা। জীবনের আর পাঁচটা খেলার মতোই। কখনও মেলে কখনও ধ্যাড়ায় কখনও অসীম।
অঙ্ক কোনো বিষয় নয়। অঙ্ক একটি মেডিটেশন। অঙ্ক ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে গভীর সুড়ঙ্গে নামার একটি পথ মাত্র। আমি অঙ্ককে এভাবে দেখেছি। সেই সুড়ঙ্গ যা খুশি হতে পারে। সম্পর্ক, উৎকণ্ঠা, জীবিকা। খুব মন খারাপ হলে দাঁত-ভাঙা একটি মাল বার করে ডুব দিতাম। সময় কাবার। মাথা দমপোক্ত। একদম পাক্কা বন্দোবস্ত।
তো, শিক্ষার আপাত বারোটা পাঁচ। ছাত্র-ছাত্রী ক্রমশ পাগলের মতো, স্যার গল্প বলুন গল্প শুনি। সে সব গল্পের শুরু নেই শেষ নেই। চ্যাপলিন দিয়ে শুরু হল, শেষ হচ্ছে জীবনানন্দয়। মাঝে অস্কার ওয়াইল্ড ভৈকম বশির, যাকে পেরেছি ইচ্ছে মতন পেড়ে ফেলেছি। সিনেমা লড়াই কবিতা সবকিছুকে দেখতাম ঐ নবীন খুদে খুদে চোখের তারাগুলোয় জ্বাল দেওয়া দুধের সরের মতো পাক খাচ্ছে। নবীন ক্ষুধা জাগছে। স্বপ্ন পা ঠুকছে ঠকঠক করে বাগদাদি ঘোড়ার মতো। গতি চাই গতি দাও। আর রসদ দাও।
তখন আমিও তো বেমক্কা যুবক। আমারই ম্যারাথন শুরু হয়নি তো তায় আমার জ্ঞানদান। ধুস, ঠিকই আছে। কী থেকে কী মেলে কে বলতে পারে।
একসময় খুব সমস্যায় পড়লাম। টিউটোরিয়াল হোমের মালকিন বললেন, স্যার আপনি কী জাদু করলেন, আপনার দুটি দিনে ঘর ভর্তি। বাকি দিনে সব কোথায় পালাচ্ছে। কী জ্বালা!
আমার সহকর্মীরা ঈর্ষা করে কথা বলা বন্ধ করলেন। একসময় বলতে লাগলেন, আমি প্রেম-শিক্ষক।
আমি নয়নজলে ভাসিলাম। আহা রে! এ তো মেঘ না চাইতে একঘড়া জল। চৈতন্যের দেশে এ সেই জগাই-মাধাই কেস। তবে তাই হোক মহাপ্রভূ। ছাত্র-ছাত্রীরা গুচ্ছের জ্ঞান বয়ে বয়ে গর্দভ না হয়ে প্রেমিকই হোক তবে।
একদিন ভরা ক্লাসে বললাম, কাল থেকে আর আসছি না। বুঝলি?
সবক'টা বদমাশ আমার দিকে তাকিয়ে থ।
সে তো যা তা ব্যাপার। ধেড়ে ছেলেদের চোখে জল। কুচে মেয়েগুলো ধুপধাপ করে প্রণাম করতে আসছে।
ধমক দিলাম। খবরদার মাথা নোয়াবি না কারোর কাছে। এত প্রণামের ঘটা কিসের? বাবা মা ছাড়া আর সবাইকে কেবল নমষ্কারের শিষ্টতা দেখাবি। ক্ষণে ক্ষণে মাথা নোয়ালে ঘাড়ে ব্যথা হবে। মাথা উঁচু রাখলে কোনোদিন স্পন্ডিলাইসিস আর পরনির্ভরতা আসবে না।
এবার গণক্রন্দন। একটি মেয়ে, বোধহয় আমার প্রেমেই পড়েছিল, সে হাপুস বৃন্দাবন।
এমন হয়। আমি তার দেওয়ালের বাইরে প্রথম মানুষ, যে তার হাতে সোনার চাবি এনে দিচ্ছি। নবীন প্রাণের বিস্ময়কে একটা ভাঁড়ার ঘরের দরজার সামনে এনে ফেলছি। অনুভূতি সব চেনা স্বাদ পেরিয়ে উপচে নিজের অস্তিত্বের নাম জানতে চাইছে। কোনো অর্থ তৎক্ষণাৎ না পেলে সেটিই প্রেমে কনভার্টেড। নিজেকে বুঝতে পারিনি বলে ভালোবেসেছি। তোমাকেও বোঝাতে পারিনি বলে অগত্যা ভালোবেসেছি। সে তুমি যেই হও। অসম বিষম যা খুশি হতে পারো।
আমি ছাত্রাবস্থায় কলেজে এক দিদিমণির ডানকাঁধে প্রলম্বিত বিনুনীর ছবি রোজ চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে ইলাস্ট্রেট করতাম। কপালের বিঘৎ টিপটি যথাস্থানে রেখে। রোজ নানা ভঙ্গিতে। একদিন সেই সুন্দরী যুবতী দিদিমণি আর না পেরে বলেই ফেলেছিলেন, "এই অযাচিত শিল্পীটি কে একবার উঠে দাঁড়াও। আমি কিচ্ছু বলব না। খুব সুন্দর ছবি। টিপটা আরেকটু ছোট হবে। আমার টিপ এতটা বড় নয় মোটেও।"
আমি চিরকালের ব্যাকবেঞ্চার। উঠে দাঁড়ালাম। কিচ্ছু বললেন না। একটি ভুবন-ভাসান নিঃশব্দ হাসির ভান করলেন মাত্র। পরের দিন স্টাফরুমে দেখা করতে বললেন। গোটা ক্লাস সেদিন আমাকেই ব্ল্যাকবোর্ডে ছবি করে দিল।
পরের দিন যেতেই, সুন্দর বিনুনী আমার হাতে একটি বই দিলেন। মৃণাল সেনের 'আমার চ্যাপলিন'। আর গোলপার্কের কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে যেতে বললেন। তার বাবা বিমল মুখোপাধ্যায়। রেডিওতে সেতার বাজাতেন 'এ' ক্যাটেগরিতে।
একটি সন্ধ্যের ডাইনিং রুমের কার্পেটে মৃদু বেগনি আলোয় মারুবেহাগের সপাট তান, অদ্ভুত সুস্বাদু এঁচোড়ের চপ এবং ফেরার সময় পিছু ফিরে দেখা, সিঁড়ির মুখে সুন্দরী দিদিমণির পুনর্বার একটি ভুবন-ভেসে-যাওয়া নির্জন সুরভিত হাসি। সে নির্জন হাসিটিকে ব্ল্যাক মাম্বার বিষও মারতে পারবে না মাসাইমারার বুকে।
অদিতিদি বহুদিন নেদারল্যান্ডে। আফটার ডিভোর্স একা এবং একদম একা। স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে এখনও একটি চাকরি করেন। আমাকে বলেছেন, "জীবনের সব কাজ ফুরিয়ে গেলে আমার কাছে আসিস। তোর প্রথম প্রেমিকা যখন আমি, আসিস। আমার বরের জন্য বুনে রাখা আনইউজড্ নতুন সোয়েটারটা আর তোর প্রিয় নির্জন হাসি তোর জন্য জমিয়ে রাখব ফোকলা দাঁতের ফাঁকে। মেপল পাতা দিনরাত ঝরবে। দেখবি আমার বাড়ির লনে আমি শীতে ছড়িয়ে রয়েছি।
টেরেসে বসে কফি খেতে খেতে তোর জীবনের গল্পের সঙ্গে মিথ্যে মিথ্যে আমার গল্প সাজাব। আমি তোর চেয়ে বয়সে বেশ কিছুটা বড়। তাই তোর আগে মরে যাব। সেটা খেয়াল রেখে আসিস।"
আজ দেখছি, সেদিন সেইসব নবীন ঘোড়াদের একই কথা বলে এসেছিলাম।
সব ক'টা গল্পকে অসমাপ্ত রাখাই বেঁচে থাকার রসদ। নইলে হঠাৎ চোখ তুলে দেখলে পথের আসন্ন চড়াই দেখার বিস্ময় হারাবে তো! আমার জন্য সাজানো চিতাখানিও তো আমার বিস্ময়। আমি চড়ে বসব, শুয়ে পড়ব। এতদিন যে সর্বগ্রাসী পাবককে এড়িয়ে গিয়েছি ভয়ে সম্ভ্রমে, তার অন্তরের অন্তরঙ্গ পিকনিকটি যদি দেখে যাওয়া যেত, পুনর্বার মাটিতে অঙ্কুর খোলার সময় মনে পড়ে যেত অজস্র সূর্যসম্ভব আবাহন।
যে-গল্প ইচ্ছে করে অসমাপ্ত রেখে দিয়েছি, তার কী হল? সেই জমাট বরফের ঝাপসা অন্ধকার হ্রদটার সামনে যদি সঙ্গী ঘোড়া শেষ নিঃশ্বাস ফেলে, ভোর হতে অনেক দেরী, সামনের সরাইখানা বরফে ঢেকে হারিয়ে গেছে, সামারের আগে তার চূড়ো দেখা যাবেনা, তবে কি আবার ফিরে যাব নাকি আরেকবার চকমকি ঠুকব; সেই সব গল্প তাদের সামনে ছড়িয়ে দিয়েছি। তোরা নিজেরাই শেষ গড়ে নিবি নিজের মতন করে। সবার সামনে কাঁদবি না কক্ষণও। জাস্ট ফাইট অ্যান্ড ওয়াক এহেড।
সে কথায় কি আর ভবী ভোলে? একটি মেয়ে গম্ভীর হয়ে পাকা বুড়ির ভাষ্যে বলল, আমরা কী এতই খারাপ?
আমি হো হো। এবার আমি দুর্বল হচ্ছি। নবীন কিশোরীর চোখভর্তি জল। সেও আবার আমার মতো পঁচিশ ছাব্বিশের যুবকের জন্য। বালির বাঁধে ভরসা কম!
আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
সেলুনওয়ালার ছেলে কানে কানে কিছু বলতে এল। আমি আন্দাজ করতে পারলাম কী বলবে। কিন্তু এবার আমি তবে মারা পড়ব বেঘোরে।
শিক্ষক-জীবন তারপরও কিছুদিন ছিল। তারপর ট্র্যাক চেঞ্জ। অন্য জীবনীর মুসাবিদা।
এই একটু আগে জিজ্ঞেস করছিলাম, কোথায় চললি বুবলা?
--টিউশন।
-- টিফিন দেয়?
--কঞ্জুস। দুটো বিস্কুট আর চা।
--এহ্ আমি তো ভরপেট পেতাম রে! পৌষে পায়েস, গরমে লাল টুকটুকে তরমুজের ফালি।
মনে পড়ে গেল বদল তো সবখানে ঠাঁই নিয়েছে। এ আর নতুন কথা কী! আমার খুদে খুদে টাট্টু ঘোড়াগুলো নিশ্চয়ই ডার্বিতে ঢুকে পড়েছে। কে কেমন আছে কে জানে চিরচঞ্চল প্রবাহে।
তোরাও কি এখন গল্প বলিস?
🏇
আমার শিক্ষক জীবনটি নয় নয় করে আট দশ বছর জিইয়েছিল। কাজ পাচ্ছি না তো শিক্ষাদান কর। সুতরাং প্রাইভেট টিউশন নামক জীবিকায় ক্ষুন্নিবৃত্তি, কলাটা মুলোটা এবং সন্ধ্যের টিফিন।
যেহেতু গণিতশাস্তর পড়াতাম, তাই অধিকাংশের কাছে বেহ্মদত্যির মতো ছিলাম। আমাকে দেখামাত্তর ছাত্র-ছাত্রীর মা-বাবা যতটা নিশ্চিন্ত, খুদে নাগরিকটি ততোধিক মর্মাহত হত। মুখের আলোটি তৎক্ষণাৎ ঘনমেঘে অবলুপ্ত। কী মুশকিলেই না পড়তাম!
মুশকিলের আসান তো চাই।
প্রথমে ফাঁদ পাতলাম। তারপর চাঁদ পাতলাম।
সঙ্গে বিষয় বাংলা পড়ানো শুরু করলাম। বিষয় বাংলা!
ক্রমশ সে এক কান্ড হল বটে!
কোনো কিছু না বলেই ছাত্র ছাত্রীর আবদার, স্যার, তারপর বিভূতিভূষণ কি ম্যানেজারি ছেড়েই দিলেন? নাকি তাপ্পরও ঘোড়া ছুটিয়ে জঙ্গল পার হতেন?
শিক্ষা, স্বপ্ন, কল্পনা, গল্প, গুল, গুল্প এবং কীর্তিকে এক পাত্রে ঘেঁটে দধিকর্মার মতো রোজ খাওয়াতে থাকলাম। মাঝে মাঝে খেলাচ্ছলে ঐকিক নিয়ম কাকে বলে বদমাইশ বল।
1 টাকা = একশ পয়সা
1/2 টাকা=?
1/2 উল্টে যাবে নাকি সোজা বসে যাবে?
1/2 টাকা = পঞ্চাশ পয়সা
1টাকা =?
এখানে হাফ উল্টে যাবে নাকি সোজা বসবে?
অঙ্ক একটা খেলা। জীবনের আর পাঁচটা খেলার মতোই। কখনও মেলে কখনও ধ্যাড়ায় কখনও অসীম।
অঙ্ক কোনো বিষয় নয়। অঙ্ক একটি মেডিটেশন। অঙ্ক ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে গভীর সুড়ঙ্গে নামার একটি পথ মাত্র। আমি অঙ্ককে এভাবে দেখেছি। সেই সুড়ঙ্গ যা খুশি হতে পারে। সম্পর্ক, উৎকণ্ঠা, জীবিকা। খুব মন খারাপ হলে দাঁত-ভাঙা একটি মাল বার করে ডুব দিতাম। সময় কাবার। মাথা দমপোক্ত। একদম পাক্কা বন্দোবস্ত।
তো, শিক্ষার আপাত বারোটা পাঁচ। ছাত্র-ছাত্রী ক্রমশ পাগলের মতো, স্যার গল্প বলুন গল্প শুনি। সে সব গল্পের শুরু নেই শেষ নেই। চ্যাপলিন দিয়ে শুরু হল, শেষ হচ্ছে জীবনানন্দয়। মাঝে অস্কার ওয়াইল্ড ভৈকম বশির, যাকে পেরেছি ইচ্ছে মতন পেড়ে ফেলেছি। সিনেমা লড়াই কবিতা সবকিছুকে দেখতাম ঐ নবীন খুদে খুদে চোখের তারাগুলোয় জ্বাল দেওয়া দুধের সরের মতো পাক খাচ্ছে। নবীন ক্ষুধা জাগছে। স্বপ্ন পা ঠুকছে ঠকঠক করে বাগদাদি ঘোড়ার মতো। গতি চাই গতি দাও। আর রসদ দাও।
তখন আমিও তো বেমক্কা যুবক। আমারই ম্যারাথন শুরু হয়নি তো তায় আমার জ্ঞানদান। ধুস, ঠিকই আছে। কী থেকে কী মেলে কে বলতে পারে।
একসময় খুব সমস্যায় পড়লাম। টিউটোরিয়াল হোমের মালকিন বললেন, স্যার আপনি কী জাদু করলেন, আপনার দুটি দিনে ঘর ভর্তি। বাকি দিনে সব কোথায় পালাচ্ছে। কী জ্বালা!
আমার সহকর্মীরা ঈর্ষা করে কথা বলা বন্ধ করলেন। একসময় বলতে লাগলেন, আমি প্রেম-শিক্ষক।
আমি নয়নজলে ভাসিলাম। আহা রে! এ তো মেঘ না চাইতে একঘড়া জল। চৈতন্যের দেশে এ সেই জগাই-মাধাই কেস। তবে তাই হোক মহাপ্রভূ। ছাত্র-ছাত্রীরা গুচ্ছের জ্ঞান বয়ে বয়ে গর্দভ না হয়ে প্রেমিকই হোক তবে।
একদিন ভরা ক্লাসে বললাম, কাল থেকে আর আসছি না। বুঝলি?
সবক'টা বদমাশ আমার দিকে তাকিয়ে থ।
সে তো যা তা ব্যাপার। ধেড়ে ছেলেদের চোখে জল। কুচে মেয়েগুলো ধুপধাপ করে প্রণাম করতে আসছে।
ধমক দিলাম। খবরদার মাথা নোয়াবি না কারোর কাছে। এত প্রণামের ঘটা কিসের? বাবা মা ছাড়া আর সবাইকে কেবল নমষ্কারের শিষ্টতা দেখাবি। ক্ষণে ক্ষণে মাথা নোয়ালে ঘাড়ে ব্যথা হবে। মাথা উঁচু রাখলে কোনোদিন স্পন্ডিলাইসিস আর পরনির্ভরতা আসবে না।
এবার গণক্রন্দন। একটি মেয়ে, বোধহয় আমার প্রেমেই পড়েছিল, সে হাপুস বৃন্দাবন।
এমন হয়। আমি তার দেওয়ালের বাইরে প্রথম মানুষ, যে তার হাতে সোনার চাবি এনে দিচ্ছি। নবীন প্রাণের বিস্ময়কে একটা ভাঁড়ার ঘরের দরজার সামনে এনে ফেলছি। অনুভূতি সব চেনা স্বাদ পেরিয়ে উপচে নিজের অস্তিত্বের নাম জানতে চাইছে। কোনো অর্থ তৎক্ষণাৎ না পেলে সেটিই প্রেমে কনভার্টেড। নিজেকে বুঝতে পারিনি বলে ভালোবেসেছি। তোমাকেও বোঝাতে পারিনি বলে অগত্যা ভালোবেসেছি। সে তুমি যেই হও। অসম বিষম যা খুশি হতে পারো।
আমি ছাত্রাবস্থায় কলেজে এক দিদিমণির ডানকাঁধে প্রলম্বিত বিনুনীর ছবি রোজ চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে ইলাস্ট্রেট করতাম। কপালের বিঘৎ টিপটি যথাস্থানে রেখে। রোজ নানা ভঙ্গিতে। একদিন সেই সুন্দরী যুবতী দিদিমণি আর না পেরে বলেই ফেলেছিলেন, "এই অযাচিত শিল্পীটি কে একবার উঠে দাঁড়াও। আমি কিচ্ছু বলব না। খুব সুন্দর ছবি। টিপটা আরেকটু ছোট হবে। আমার টিপ এতটা বড় নয় মোটেও।"
আমি চিরকালের ব্যাকবেঞ্চার। উঠে দাঁড়ালাম। কিচ্ছু বললেন না। একটি ভুবন-ভাসান নিঃশব্দ হাসির ভান করলেন মাত্র। পরের দিন স্টাফরুমে দেখা করতে বললেন। গোটা ক্লাস সেদিন আমাকেই ব্ল্যাকবোর্ডে ছবি করে দিল।
পরের দিন যেতেই, সুন্দর বিনুনী আমার হাতে একটি বই দিলেন। মৃণাল সেনের 'আমার চ্যাপলিন'। আর গোলপার্কের কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে যেতে বললেন। তার বাবা বিমল মুখোপাধ্যায়। রেডিওতে সেতার বাজাতেন 'এ' ক্যাটেগরিতে।
একটি সন্ধ্যের ডাইনিং রুমের কার্পেটে মৃদু বেগনি আলোয় মারুবেহাগের সপাট তান, অদ্ভুত সুস্বাদু এঁচোড়ের চপ এবং ফেরার সময় পিছু ফিরে দেখা, সিঁড়ির মুখে সুন্দরী দিদিমণির পুনর্বার একটি ভুবন-ভেসে-যাওয়া নির্জন সুরভিত হাসি। সে নির্জন হাসিটিকে ব্ল্যাক মাম্বার বিষও মারতে পারবে না মাসাইমারার বুকে।
অদিতিদি বহুদিন নেদারল্যান্ডে। আফটার ডিভোর্স একা এবং একদম একা। স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে এখনও একটি চাকরি করেন। আমাকে বলেছেন, "জীবনের সব কাজ ফুরিয়ে গেলে আমার কাছে আসিস। তোর প্রথম প্রেমিকা যখন আমি, আসিস। আমার বরের জন্য বুনে রাখা আনইউজড্ নতুন সোয়েটারটা আর তোর প্রিয় নির্জন হাসি তোর জন্য জমিয়ে রাখব ফোকলা দাঁতের ফাঁকে। মেপল পাতা দিনরাত ঝরবে। দেখবি আমার বাড়ির লনে আমি শীতে ছড়িয়ে রয়েছি।
টেরেসে বসে কফি খেতে খেতে তোর জীবনের গল্পের সঙ্গে মিথ্যে মিথ্যে আমার গল্প সাজাব। আমি তোর চেয়ে বয়সে বেশ কিছুটা বড়। তাই তোর আগে মরে যাব। সেটা খেয়াল রেখে আসিস।"
আজ দেখছি, সেদিন সেইসব নবীন ঘোড়াদের একই কথা বলে এসেছিলাম।
সব ক'টা গল্পকে অসমাপ্ত রাখাই বেঁচে থাকার রসদ। নইলে হঠাৎ চোখ তুলে দেখলে পথের আসন্ন চড়াই দেখার বিস্ময় হারাবে তো! আমার জন্য সাজানো চিতাখানিও তো আমার বিস্ময়। আমি চড়ে বসব, শুয়ে পড়ব। এতদিন যে সর্বগ্রাসী পাবককে এড়িয়ে গিয়েছি ভয়ে সম্ভ্রমে, তার অন্তরের অন্তরঙ্গ পিকনিকটি যদি দেখে যাওয়া যেত, পুনর্বার মাটিতে অঙ্কুর খোলার সময় মনে পড়ে যেত অজস্র সূর্যসম্ভব আবাহন।
যে-গল্প ইচ্ছে করে অসমাপ্ত রেখে দিয়েছি, তার কী হল? সেই জমাট বরফের ঝাপসা অন্ধকার হ্রদটার সামনে যদি সঙ্গী ঘোড়া শেষ নিঃশ্বাস ফেলে, ভোর হতে অনেক দেরী, সামনের সরাইখানা বরফে ঢেকে হারিয়ে গেছে, সামারের আগে তার চূড়ো দেখা যাবেনা, তবে কি আবার ফিরে যাব নাকি আরেকবার চকমকি ঠুকব; সেই সব গল্প তাদের সামনে ছড়িয়ে দিয়েছি। তোরা নিজেরাই শেষ গড়ে নিবি নিজের মতন করে। সবার সামনে কাঁদবি না কক্ষণও। জাস্ট ফাইট অ্যান্ড ওয়াক এহেড।
সে কথায় কি আর ভবী ভোলে? একটি মেয়ে গম্ভীর হয়ে পাকা বুড়ির ভাষ্যে বলল, আমরা কী এতই খারাপ?
আমি হো হো। এবার আমি দুর্বল হচ্ছি। নবীন কিশোরীর চোখভর্তি জল। সেও আবার আমার মতো পঁচিশ ছাব্বিশের যুবকের জন্য। বালির বাঁধে ভরসা কম!
আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
সেলুনওয়ালার ছেলে কানে কানে কিছু বলতে এল। আমি আন্দাজ করতে পারলাম কী বলবে। কিন্তু এবার আমি তবে মারা পড়ব বেঘোরে।
শিক্ষক-জীবন তারপরও কিছুদিন ছিল। তারপর ট্র্যাক চেঞ্জ। অন্য জীবনীর মুসাবিদা।
এই একটু আগে জিজ্ঞেস করছিলাম, কোথায় চললি বুবলা?
--টিউশন।
-- টিফিন দেয়?
--কঞ্জুস। দুটো বিস্কুট আর চা।
--এহ্ আমি তো ভরপেট পেতাম রে! পৌষে পায়েস, গরমে লাল টুকটুকে তরমুজের ফালি।
মনে পড়ে গেল বদল তো সবখানে ঠাঁই নিয়েছে। এ আর নতুন কথা কী! আমার খুদে খুদে টাট্টু ঘোড়াগুলো নিশ্চয়ই ডার্বিতে ঢুকে পড়েছে। কে কেমন আছে কে জানে চিরচঞ্চল প্রবাহে।
তোরাও কি এখন গল্প বলিস?
🏇
585
বার পঠিত (সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে)
শেয়ার করুন |
আপনার মতামত দেবার জন্য নিচের যেকোনো একটি লিংকে ক্লিক করুন