![]() বইমেলা হোক বা নাহোক চটপট নামিয়ে নিন রঙচঙে হাতে গরম গুরুর গাইড । |
সেইসব দিনগুলি…
Jhuma Samadder
সেইসব দিনগুলি…
ঝুমা সমাদ্দার
…...তারপর তো 'গল্পদাদুর আসর'ও ফুরিয়ে গেল। "দাঁড়ি কমা সহ 'এসেছে শরৎ' লেখা" শেষ হতে না হতেই মা জোর করে সামনে বসিয়ে টেনে টেনে চুলে বেড়াবিনুনী বেঁধে দিতে লাগলেন । মা'র শাড়িতে কেমন একটা হলুদ-তেল-বসন্তমালতী'র গন্ধ। কাজল পরাতে গেলে 'উঁ' ‘উঁ' শব্দে তীব্র প্রতিবাদ।
"একদম চুপ করে বোসো। চোখ ডলে ডলে , দেখো , সমস্ত গালময় কালি করে ফেললে।" খেলতে পাঠিয়ে দিয়ে মা 'গা-ধুতে' যাবেন ।
বড়দিদিদের সঙ্গে খেলতে গেলে তারা চোখ মটকে ঈশারা করে , বলে ‘দুধ-ভাত'। কক্ষনো সে 'চোর' হয় না। শুধু কালেভদ্রে তার সুযোগ আসে 'ধাপ্পা' দেওয়ার। তাকে দিদিরা নিজেদের পেছনে আড়াল করে রাখে । বেরোতেই দেয় না ।
ওদের ছোটদের সঙ্গী কম । খেলা তেমন জমে না। ঝগড়া বেঁধে যায়।
"তোর ভাই'কে খেলায় নেব না। টলমল করে হাঁটে , ধাক্কা লাগলে পড়ে যায় ।" খুব ইচ্ছে, এই সুযোগে তাকে 'দুধ-ভাত' বানানোর । কিন্তু, সে চলবে না। তাকে 'দুধ-ভাত' বানালে তার দিদিরা চটে যায়। ব্যাস , খেলা বন্ধ । 'জিব-ভ্যাঙানো'তেই বরাদ্দ সময় ফুরিয়ে যায় ।
কী সুন্দর দেখতে উষা দিদিকে । ওর বোন ডেজি কেমন 'বেচারা' চোখে তাকায় ওদের দিকে। মাঝে মাঝে আসে "খেলতে নিব ?" বলে । একবার 'ডিপ' ‘ডিপ' ‘তেল' ‘তেল' খেলাতে 'কি রঙ' বলতে বলায় বলেছিল "আসমানী"। কারোর সোয়েটারে 'আসমানী' রঙ খুঁজে পায়নি ওরা ।
সন্ধ্যে হতেই 'লোডশেডিং' । বিশ্রী গন্ধের দুধের গ্লাসখানা মুখের কাছে ধরলেই দেওয়ালে কাঁপা কাঁপা রাক্ষুসে ছায়া পড়ে। বুক দুরু দুরু । আরো কাছাকাছি , আরও ঘেঁষাঘেষি করে বসা । দাদার কেমন রঙচঙে 'ছেলেদের রামায়ণ' … 'ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি'র মাথায় ,কেন কে জানে, শিং খুঁজে বেড়াত ও । রঙিন পশু-পাখির বই ‘চিড়িয়াখানা' । পরিস্কার বুঝতে পারে, ‘ঝুঁটি বুলবুলি' ওর সঙ্গে গল্প করতে আসে রোজ।
'সহজ পাঠে'র অদ্ভুত ছবিগুলো হ্যারিকেনের আলোয় আরো অদ্ভুত আকার ধারণ করে । ঠিক বোঝা যায় না । "উশ্রী নদীর ঝরণা’ দেখতে যাবে, মা ?” , "মা , 'চাটনি দিয়ে রুটি' খেতে কেমন লাগে ?” এসব প্রশ্নের একটাই উত্তর , ও জানে , "বানান করো, 'রেভারেণ্ড এণ্ডারসন" ।অথবা, "শ্রুতি লিখন’ লেখো , 'ভয় করতে লজ্জা করে না ?”
করে তো । নইলে কি এসব প্রশ্ন কেউ করে ? এসব প্রশ্ন যে একান্তই নিজের । 'বাঘ শিকারে যাওয়া'র কল্পনা , 'চিঁড়ে আর বনের মধু' খাওয়া, ‘আমলকী বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরু দুরু'…... আচ্ছা, 'আমলকী বন' কে ? সে কী ওরই বয়সী ? ওর মতই কী তারও ভয় করে ? তা করবে না ? অন্ধকার রাতে 'বেড়াল কাঁদলে' কার না ভয় করে ? কার না চোখ বন্ধ করলেই চোখের পাতায় নীল-হলুদ আলো ঘুরে বেড়ায় ?
বাবা অফিস থেকে ফিরলে মা স্টোভ ধরিয়ে চা বানান । স্টোভ নেভানোর বিশ্রী গন্ধেও ভয় ভয় ভাবটা কিছুটা কাটে । এইবার বাবা পাশের ঘরে গিয়ে রেডিও'তে খবর শুনবেন । না দেখেও ঠিক জানে ও , বাবার হাতে মোটা মতন একখানা ইংরিজি বই । কোনো ছবি নেই । সাদা কাগজ ঢোকানো রয়েছে তাতে । বাবা পড়তে পড়তে পেন দিয়ে দাগ দেবেন , সাদা কাগজে কি যেন লিখবেন । বাবার পেনটা কী সুন্দর ! একদিন 'ইকটুখানি' দাগ কেটেছিল কেবল । বাবা ঠিক ধরে ফেলেছিলেন । বাবার পেনে কেউ হাত দিলেই বাবা ঠিক বুঝে ফেলেন । 'উঁহ্' শব্দে বিরক্তি প্রকাশ করে পেনের নিব খুলে গরম জলে ধুয়ে 'সুলেখা কালি'র দোয়াত থেকে ড্রপারে করে কালি ভরেছিলেন বাবা ।
ন'টা বাজলেই মা হাতের সেলাইখানা নামিয়ে রান্না ঘরে যাবেন। গরম রুটি কেমন সুন্দর ফুলে ওঠে । সুন্দর গন্ধ ।
পুজোর আগেই রাতের দিকে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব বাতাসে । হাফ সোয়েটার থেকে টেনে টেনে উলের রোঁয়া তুলে উলের নুটি বানাতে বানাতে, রঙিন চকচকে গোলাপী লজেন্সের মতন দেখতে বোতামের উপর আঙুল ঘষে মিষ্টি লেবুর গন্ধ উঠলে শুঁকে দেখতে দেখতেই আলো চলে আসে ।
আরও একটা মজা হয় বেশ, আলো না থাকলে । রাজ্যের পোকা আসে পড়ার ঘরে। ধরে ধরে যত্ন করে পেনসিল বক্সে ভরে রাখে । একলা একলা কি করছে ওরা ? ওরই মতন কি একলা থাকলে ওরা দুষ্টুমি করে ? ও যেমন সুযোগ পেলেই চৌবাচ্চার জল মগ ভরে তোলে , আবার ফেলে, কেমন বুড়বুড়ি কাটে জলে….ফাটা পেনসিল বক্সের ফুটোয় চোখ রাখে । একটাকেও দেখতে পায় না। খুলে দেখে সব লাফিয়ে উঠেছে পেনসিল বক্সের ঢাকনায়। খুলতেই সব লাফিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
খাওয়া দাওয়া সেরে বাইরের বারান্দায় বেরোলেই মিষ্টি গন্ধের ঝাপটা । শীত শীত করে । ঝিরঝিরে সজনে পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ'টা মেঘের ভেলায় চড়ে 'শুভরাত্রি' জানিয়ে যায় ওকে । আকাশেরও কী কম কাজ ? ভোর না হতেই আবার আধফোটা শিউলি গুলোকে শিশিরের ফোঁটায় তরতাজা করে রাখতে হবে । ঘাসের উপর টলটলে হীরের নাকছাবি সাজিয়ে রাখতে হবে । মাকড়সার জালের উপর হালকা রূপোর তার সাজিয়ে ঝলমল করাতে হবে ।
সাবধানে পা ফেলে স্কুলে যেতে হয়। শিশিরের ঘুম ভাঙাতে নেই । শিউলিগুলোকে হাতে করে তুলে নিতে হয় । কক্ষনও পা দিয়ে মাড়াতে নেই ।
ঝুমা সমাদ্দার
…...তারপর তো 'গল্পদাদুর আসর'ও ফুরিয়ে গেল। "দাঁড়ি কমা সহ 'এসেছে শরৎ' লেখা" শেষ হতে না হতেই মা জোর করে সামনে বসিয়ে টেনে টেনে চুলে বেড়াবিনুনী বেঁধে দিতে লাগলেন । মা'র শাড়িতে কেমন একটা হলুদ-তেল-বসন্তমালতী'র গন্ধ। কাজল পরাতে গেলে 'উঁ' ‘উঁ' শব্দে তীব্র প্রতিবাদ।
"একদম চুপ করে বোসো। চোখ ডলে ডলে , দেখো , সমস্ত গালময় কালি করে ফেললে।" খেলতে পাঠিয়ে দিয়ে মা 'গা-ধুতে' যাবেন ।
বড়দিদিদের সঙ্গে খেলতে গেলে তারা চোখ মটকে ঈশারা করে , বলে ‘দুধ-ভাত'। কক্ষনো সে 'চোর' হয় না। শুধু কালেভদ্রে তার সুযোগ আসে 'ধাপ্পা' দেওয়ার। তাকে দিদিরা নিজেদের পেছনে আড়াল করে রাখে । বেরোতেই দেয় না ।
ওদের ছোটদের সঙ্গী কম । খেলা তেমন জমে না। ঝগড়া বেঁধে যায়।
"তোর ভাই'কে খেলায় নেব না। টলমল করে হাঁটে , ধাক্কা লাগলে পড়ে যায় ।" খুব ইচ্ছে, এই সুযোগে তাকে 'দুধ-ভাত' বানানোর । কিন্তু, সে চলবে না। তাকে 'দুধ-ভাত' বানালে তার দিদিরা চটে যায়। ব্যাস , খেলা বন্ধ । 'জিব-ভ্যাঙানো'তেই বরাদ্দ সময় ফুরিয়ে যায় ।
কী সুন্দর দেখতে উষা দিদিকে । ওর বোন ডেজি কেমন 'বেচারা' চোখে তাকায় ওদের দিকে। মাঝে মাঝে আসে "খেলতে নিব ?" বলে । একবার 'ডিপ' ‘ডিপ' ‘তেল' ‘তেল' খেলাতে 'কি রঙ' বলতে বলায় বলেছিল "আসমানী"। কারোর সোয়েটারে 'আসমানী' রঙ খুঁজে পায়নি ওরা ।
সন্ধ্যে হতেই 'লোডশেডিং' । বিশ্রী গন্ধের দুধের গ্লাসখানা মুখের কাছে ধরলেই দেওয়ালে কাঁপা কাঁপা রাক্ষুসে ছায়া পড়ে। বুক দুরু দুরু । আরো কাছাকাছি , আরও ঘেঁষাঘেষি করে বসা । দাদার কেমন রঙচঙে 'ছেলেদের রামায়ণ' … 'ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি'র মাথায় ,কেন কে জানে, শিং খুঁজে বেড়াত ও । রঙিন পশু-পাখির বই ‘চিড়িয়াখানা' । পরিস্কার বুঝতে পারে, ‘ঝুঁটি বুলবুলি' ওর সঙ্গে গল্প করতে আসে রোজ।
'সহজ পাঠে'র অদ্ভুত ছবিগুলো হ্যারিকেনের আলোয় আরো অদ্ভুত আকার ধারণ করে । ঠিক বোঝা যায় না । "উশ্রী নদীর ঝরণা’ দেখতে যাবে, মা ?” , "মা , 'চাটনি দিয়ে রুটি' খেতে কেমন লাগে ?” এসব প্রশ্নের একটাই উত্তর , ও জানে , "বানান করো, 'রেভারেণ্ড এণ্ডারসন" ।অথবা, "শ্রুতি লিখন’ লেখো , 'ভয় করতে লজ্জা করে না ?”
করে তো । নইলে কি এসব প্রশ্ন কেউ করে ? এসব প্রশ্ন যে একান্তই নিজের । 'বাঘ শিকারে যাওয়া'র কল্পনা , 'চিঁড়ে আর বনের মধু' খাওয়া, ‘আমলকী বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরু দুরু'…... আচ্ছা, 'আমলকী বন' কে ? সে কী ওরই বয়সী ? ওর মতই কী তারও ভয় করে ? তা করবে না ? অন্ধকার রাতে 'বেড়াল কাঁদলে' কার না ভয় করে ? কার না চোখ বন্ধ করলেই চোখের পাতায় নীল-হলুদ আলো ঘুরে বেড়ায় ?
বাবা অফিস থেকে ফিরলে মা স্টোভ ধরিয়ে চা বানান । স্টোভ নেভানোর বিশ্রী গন্ধেও ভয় ভয় ভাবটা কিছুটা কাটে । এইবার বাবা পাশের ঘরে গিয়ে রেডিও'তে খবর শুনবেন । না দেখেও ঠিক জানে ও , বাবার হাতে মোটা মতন একখানা ইংরিজি বই । কোনো ছবি নেই । সাদা কাগজ ঢোকানো রয়েছে তাতে । বাবা পড়তে পড়তে পেন দিয়ে দাগ দেবেন , সাদা কাগজে কি যেন লিখবেন । বাবার পেনটা কী সুন্দর ! একদিন 'ইকটুখানি' দাগ কেটেছিল কেবল । বাবা ঠিক ধরে ফেলেছিলেন । বাবার পেনে কেউ হাত দিলেই বাবা ঠিক বুঝে ফেলেন । 'উঁহ্' শব্দে বিরক্তি প্রকাশ করে পেনের নিব খুলে গরম জলে ধুয়ে 'সুলেখা কালি'র দোয়াত থেকে ড্রপারে করে কালি ভরেছিলেন বাবা ।
ন'টা বাজলেই মা হাতের সেলাইখানা নামিয়ে রান্না ঘরে যাবেন। গরম রুটি কেমন সুন্দর ফুলে ওঠে । সুন্দর গন্ধ ।
পুজোর আগেই রাতের দিকে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব বাতাসে । হাফ সোয়েটার থেকে টেনে টেনে উলের রোঁয়া তুলে উলের নুটি বানাতে বানাতে, রঙিন চকচকে গোলাপী লজেন্সের মতন দেখতে বোতামের উপর আঙুল ঘষে মিষ্টি লেবুর গন্ধ উঠলে শুঁকে দেখতে দেখতেই আলো চলে আসে ।
আরও একটা মজা হয় বেশ, আলো না থাকলে । রাজ্যের পোকা আসে পড়ার ঘরে। ধরে ধরে যত্ন করে পেনসিল বক্সে ভরে রাখে । একলা একলা কি করছে ওরা ? ওরই মতন কি একলা থাকলে ওরা দুষ্টুমি করে ? ও যেমন সুযোগ পেলেই চৌবাচ্চার জল মগ ভরে তোলে , আবার ফেলে, কেমন বুড়বুড়ি কাটে জলে….ফাটা পেনসিল বক্সের ফুটোয় চোখ রাখে । একটাকেও দেখতে পায় না। খুলে দেখে সব লাফিয়ে উঠেছে পেনসিল বক্সের ঢাকনায়। খুলতেই সব লাফিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
খাওয়া দাওয়া সেরে বাইরের বারান্দায় বেরোলেই মিষ্টি গন্ধের ঝাপটা । শীত শীত করে । ঝিরঝিরে সজনে পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ'টা মেঘের ভেলায় চড়ে 'শুভরাত্রি' জানিয়ে যায় ওকে । আকাশেরও কী কম কাজ ? ভোর না হতেই আবার আধফোটা শিউলি গুলোকে শিশিরের ফোঁটায় তরতাজা করে রাখতে হবে । ঘাসের উপর টলটলে হীরের নাকছাবি সাজিয়ে রাখতে হবে । মাকড়সার জালের উপর হালকা রূপোর তার সাজিয়ে ঝলমল করাতে হবে ।
সাবধানে পা ফেলে স্কুলে যেতে হয়। শিশিরের ঘুম ভাঙাতে নেই । শিউলিগুলোকে হাতে করে তুলে নিতে হয় । কক্ষনও পা দিয়ে মাড়াতে নেই ।
199
বার পঠিত (সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে)
শেয়ার করুন |
আপনার মতামত দেবার জন্য নিচের যেকোনো একটি লিংকে ক্লিক করুন