এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ইদবোশেখির লেখাপত্তর - গুরুচণ্ডা৯ | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়শীতকাল বইমেলা হইচই-এর দিনকাল ফুরিয়ে এসে গেল শান্ত হয়ে বসে লেখালেখির কাল। বাইরে তাপমাত্রা বাড়ছে রোদ্দুরের জন্য, নির্বাচনের জন্য। সাথে কোথাও প্যাচপ্যাচে ঘাম তো কোথাও ঝরঝর বৃষ্টি। সন্ধ্যের আবছায়ায় দোকানে ভিড় জমায় সারাদিন রোজা রাখা ক্লান্ত মানুষ, গাজনের প্রস্তুতি নেওয়া শ্রান্ত মানুষ, চৈত্রসেলের হাতছানিতে মুগ্ধ মানুষ। টুপটাপ জমে ওঠে গল্পেরা, কবিতারা। নির্বাচনী জনসভার কোণাকাঞ্চিতে, ইফতারির থালার পাশে, গাজনের সন্ন্যাসীর ঝোলায় চুপটি করে অপেক্ষা করে তারা মানুষের জন্য। আমরা আপনাদের কাছে ডাক পাঠিয়েছিলাম তাদের খপ করে ধরে ফেলে, ঝপ করে লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে। এসে গেছে তারা। আগামী কয়েকদিন ধরে রোজ দুটি-তিনটি করে তারা এসে হাজির হবে বুলবুলভাজার পাতায় - টাটকা ভাজা, গরমাগরম। পড়তে থাকুন। ভাল লাগলে বা না লাগলে দুই বা আরো অনেক লাইন মন্তব্য লিখে জানিয়ে দিন সে কথা। মন চাইলে, গ্রাহক হয়ে যান লেখকের। আর হ্যাঁ, আপনিও লেখা নিয়ে চলে আসুন গুরু আর চন্ডালের আড্ডা গুরুচন্ডা৯-র পাতায়।সূচীপত্রঃস্মৃতিচারণবর্ষশেষ, বর্ষশুরু: অমিতাভ চক্রবর্ত্তীকাব্যজলের সমাধি: জগন্নাথ দেব মন্ডলগিরগিটি ও অন্যান্য কবিতা: ফরিদাসমুদ্রে সনেট: সোমনাথ রায়পাঁচটি কবিতা: অমিতরূপ চক্রবর্তীতিনটি কবিতা: অরিত্র চ্যাটার্জি গপ্পোখুচরো: সুমন মুখার্জীসুফি: আফতাব হোসেন রতন, দ্য ব্যাকবেঞ্চার: নরেশ জানাডাক দিয়ে যায়: এস এস অরুন্ধতীমহারাজ ছনেন্দ্রনাথ ও মার্কণ্ডেয়র চিঠি: রমিত চট্টোপাধ্যায়পাখির অন্তর্ধান রহস্য: মৃণাল শতপথীএই ঘুম শারীরবৃত্তীয়: দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ওয়েথসাম: উপল মুখোপাধ্যায়নভেলাফকির ফয়জুল্লাহ: মুরাদুল ইসলামনিবন্ধ আজ নববর্ষের আখ্যান: সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
    ওয়েথসাম - উপল মুখোপাধ্যায় | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়বাড়ি কোথায় খুঁজে না পেয়ে অহনাকে বললাম, 'বাড়ি কোথায় বলত ?'-    কার?-    কার আবার। -    কার?-    আমার, আমার।-    অত আমার আমার করছ কেন?-    তবে কী করব?-    কিছুই করবে না।-    করব না?-    না।-    কিছু না করে থাকতে পারব কি?-    জানি না।এই বলে অহনা হাঁটতে আরম্ভ করে দিল। সে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের খাঁজে চলে গেল। দু পাহাড় যেখানে জোড় খেয়েছে আর দুটো দেশ তৈরি হয়েছে গাছেদের। হ্যাঁ, গাছেদের আর বৃষ্টিদের। সেখানে প্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেইখানে অহনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব বলে বলে ভাবছি আর দেখি সে অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটা দিয়েছে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকটা পাহাড় দেখার মত এক দূরত্ব। মনে হয় কাছে কিন্তু দূরত্বটা বেশ। যত কাছে যাওয়া যায় ততো দূরত্বটা থেকে যেতে থাকে, থেকে যেতে থাক – দূরত্বটা শেষ হয় না। বোঝা যায় না পাহাড়টা দূরে, বোঝা যায় না পাহাড়টা কাছে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়। সে রকমই হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না জোরে কথা বলব না আস্তে কথা বলব। তাই দেখতে লাগলাম। প্রথমে গাছেদের এ ওর পাশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তারা ফুল দেয় না আর দিলেও দেখাতে চায় না যে ফুল দিয়েছে। ছোট ছোট গাছ না কিন্তু তাদের ছোট ছোট লাগে। পাশে একটা বড়ো গাছ ছিল। সেই গাছ দেখে আশ্বস্ত হয়েছি, সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম গাছ কথা কইছে আর আওয়াজ হচ্ছে কথাদের। সেই আওয়াজে গাছ কেঁপে কেঁপে উঠল। আমি আরো হেলান দিয়ে সেই কম্পন বুঝছি। এমন সময় দেখি অহনা আসছে তার সঙ্গে একটা ছেলে আর মেয়ে। আমাকে ওইভাবে গাছে সম্পূর্ণ হেলান দিয়ে থাকতে দেখে সে হেসে উঠল। তার সঙ্গে সঙ্গে ওই দুটো ছেলেমেয়েও হাসতে লাগল। আমি হাসির আগের মুহূর্ত দেখতে থাকি। কেমন করে হাসি শুরু হয় সেটা লক্ষ্য করি। হাসির শুরু দেখতে পেয়ে আমার খুবই আনন্দ হয়। আর লক্ষ্য করি আমিই হাসছি। অহনা হাসি থামিয়ে দিয়ে, আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি হাসছ কেন?-    তোমাদের হাসতে দেখে।-    আমরা তো তোমাকে দেখে হাসছিলাম। কেমন অদ্ভুত ভাবে ভ্যাবাচ্যাকা মেরে দাঁড়িয়ে থাকছ তো থাকছই আর মাঝে মাঝে গাছটাকে প্রায় জড়িয়েই ধরছ আর ছেড়ে দিচ্ছ।-    তাই?-    নয়তো কী? এরা হল আমার বন্ধুরা। এরা জলপ্রপাত দেখতে দেখতে অনেকদূর চলে গিয়েছিল।-    তারপর?-     সেখান থেকে ফিরে আসার সময় রাস্তা হারিয়েছিল। -     তারপর ?-    তখনই হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আমি ওদের রাস্তা দেখাতে দেখাতে এখানে নিয়ে এসেছি। আমি বললাম, 'চলুন চা খাই। তারপর বাড়ি খুঁজতে হবে।' অহনার এক বন্ধু বলল, 'বাড়ি?' অহনা ওদের বোঝাতে থাকে, ‘তোরা যেমন জলপ্রপাত দেখতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলি। কিছুতেই এক রাস্তা থেকে ঠিক রাস্তায় না যেতে পারে কেবলই অন্য রাস্তার দিকে চলে যাচ্ছিলি, অনেকটা সে রকমই হয়ে গেছে আর কি। ওইজন্য বাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না বলে যাচ্ছে সমানে।’-    সত্যিই বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না।-    ওই দেখ বার বার একই কথা বলছে।এই শুনে অহনার বন্ধুরা আবার হাসতে আরম্ভ করে দিয়েছে আর গাছ যেন কেঁপে কেঁপে উঠেছে এটা বাস্তব। সেই সব কিছু থেকে ভুলে আমি আবার বললাম, 'চলুন।'-    কোথায়?-    চা খাই।-    চলুন।এই বলে আমরা সম্পূর্ণ অপরিচিত আর পরিচিতরা কিছুক্ষণের জন্য চা খেতে চললাম।সেদিন চা-এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা অপূর্ব বিস্কুটও খাই। তারপর হাঁটা দিই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'আমরা কোথায় যাচ্ছি?' অহনা বলল, 'জলপ্রপাত'। অহনার বন্ধুরা বলল, ‘হ্যাঁ, জলপ্রপাতেই বারবার যাওয়া যাক।' শুনে আমি বলেছি, সেকি!'-    কেন?-    বারবার ওরা জলপ্রপাতেই যাবে?-    তবে কোথায় যাবে?-    বাড়ির দিকে যাওয়া যায় না?-    জলপ্রপাতের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক বাড়ি পৌঁছে যাব।-    যাব?-    নিশ্চয় যাব।-    জলপ্রপাতের ব্যপারে এতটা নিশ্চিত হচ্ছ কেন?-    কারণ ওটা আছে।-    কোথায়?-    এসো দেখি।-    চল।এই বলে আমরা চারজনে হাঁটা শুরু করলাম। ঘন পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম আর জঙ্গল এসে গায়ে গায়ে পড়ছিল। সে পড়ায় গা শিরশির করে ওঠে আর আমি একটা অস্ত্র দিয়ে সেই গায়ে পড়া জঙ্গল কাটছিলাম। কাটার ফলে গাছেরা শিউরে ওঠে আর চারিদিকে কান্নার রোল উঠল। সে কান্না খুব আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে আর ফুলেরা সেই সকালে ফুটে উঠে আবার কান্নার আওয়াজে কুঁড়ি হয়ে গেল। চারিদিকে প্রচুর কুঁড়ি দেখে অহনা আশ্চর্য হল। যে বলল, 'দূর থেকে ফুল দেখছি আর কাছে আসতে না আসতে কুঁড়ি।' তার দুই বন্ধু, যারা একজন ছেলে ও অপরজন মেয়ে, একসঙ্গে কথা বলছে তারা, 'সত্যিই তো কুঁড়ির মতো লাগছে।'-    কুঁড়ির মতো লাগছে বলিস না।-    তবে?-    কুঁড়িই।-    এতো?-    হ্যাঁ।-    কী করে? -    ফুলগুলো কুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে।-    সে কী করে হবে?-    হচ্ছে তো।-    তাই?-    হ্যাঁ।আমি কিছু বলি না। শুধু দূর থেকে ফুল দেখি আর তার ডালপালা জঙ্গল হয়ে গায়ে পড়লে এক অদ্ভূত তলোয়ার দিয়ে কাটতে থাকি। সে কাটায় শিউরে শিউরে উঠে ফুলেরা কুঁড়িতে ফিরে যায়। সেটা বুঝতে পারছে না দেখে অহনা আর তার দুই বন্ধু আশ্চর্য হচ্ছে কিন্তু আমি হচ্ছিনা। এটা অহনা লক্ষ্য করেছিল। সে অনায়াসে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসছে বন্ধুদের সঙ্গে সঙ্গে আর আমি হেঁটে চলেছি আগে অথচ তারা কথা বলতেই থাকছে আশ্চর্য হতেই থাকছে এটা সে আর কতক্ষণ সহ্য করবে ? তাই সে বলে উঠল, 'তুমি কিছু বলছ না কেন? কোন কিছুই কি বলবে না বলে ঠিক করেছ?' আমি কোন উত্তর দিতে পারি না। জঙ্গল পরিষ্কার না হলে রাস্তা হবে না, রাস্তা না হলে আমরা এগোতে পারব না, পাহাড়েরা জলপ্রপাতেরা কত কাছে মনে হবে অথচ সেখানে পৌঁছনই যাবে না। অথচ জঙ্গল কাটলে গাছেরা শিউরে উঠবে, কান্নার বোল উঠবে, ফুলেরা আবার কুঁড়ি হয়ে যাবে এই সব দোটানায় আমি চুপ করে জঙ্গল কেটে যাই। কিন্তু অহনা ছাড়ার পাত্র নয় সে বলল, 'আমরা সবাই এতো আশ্চর্য হচ্ছি আর তুমি হবে না?' আমি বললাম, 'কেন হব?'-    মানে ?-    কেন হব?-    আশ্চর্য হবে না?-    কেন?-    দেখছ না?-    কী ?-    ফুলেরা কাছাকাছি এলে কুঁড়ি হয়ে যায়।-    আর জঙ্গল?-    সে তো অনবরত একটা হচ্ছে – তুমি কাটছ?-    আমি?-    হ্যাঁ।-    তুমিও তো কাটতে পার। এই নাও ধরো।এই বলে আমি এক অস্ত্র ধরিয়ে দিতে যাই অহনার দিকে। অহনা সেই অস্ত্রের বর্ণনায় আরো আশ্চর্য হয়। আমি বলি, 'ধরো।'-    কী করে ধরব।-    এই অস্ত্র দুজনে ধরতে পারে?-    মানে?-    এই দেখ দুটো ধরার জায়গা আছে।-    একই সঙ্গে?-    একই সঙ্গে দুজনে।-    এটা এতো লম্বা কেন?-    খুব।-    এতো লম্বা।-    হ্যাঁ।-    আর ধারালো?-    একটা দিকেই এর ধার।-    কেমন ধার?-    খুব। দেখছ না জঙ্গল সাফা হয়ে যাচ্ছে। গাছেরা শিউরে উঠছে।-    শিউরে?-    গাছেরা। তাই ফুলেরা সে জন্য কুঁড়িতে ফিরে যাচ্ছে।-    ফুলেরা ফেরে?-    হ্যাঁ, এই অস্ত্র ফেরাতে পারে।-    এতো লম্বা কেন?-    জানি না।-    লম্বা লম্বা গাছ তাড়াতাড়ি কাটতে পারে বলে?-    হবে। শুধু গাছ কেন আরো অনেক কিছু এ কাটে।-    এ একাই কাটে?-    একাই। দুজনে ধরতে পারে। তুমি ধরবে?অহনা এবার কুঁড়ি বা ফুল ছেড়ে অস্ত্রের দিকে তাকাতে থাকে। সেই তরবারি অথচ লম্বা বর্শার মত অস্ত্র, যা দুজনে ধরা যায় তার একটা নাম আছে আর সেই নামটা অহনার দিকে তাকিয়েছিল। সেই দেখে ও বলল, ' এ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছে কেন?-    কে?-    এই লম্বা মতো ধারালো অস্ত্র। এ যেন কথা বলতে চায়। আমি এর সঙ্গে কথা বলব। তুমি এর নাম বল।-    ওয়েথসাম।-    আমি ওয়েথসামের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাব।-    তুমি এর দুটো হাতলের একটা ধরতে পার।-    না। আমি একে ছুঁলে এ আর কথা বলে উঠবে না। -    আমি একাই কি জঙ্গল কাটব?অহনা বা তার বন্ধুরা কোন উত্তর দেয় না। আর শুনি পেছন পেছন ও ওই ওয়েথসাম অস্ত্রের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছে অথচ অস্ত্রটা আমার হাতেই ধরা। ওঠা অনবরত জঙ্গলে উঠছে আর পড়ছে। আমি দরদর করে ঘামতে থাকছি অস্ত্রের ভারে। আমার হাতের শিরারা ফুলে ফুলে উঠছে। পেশি টনটন করছে, সব টাকা আমি খরচ করে ফেলছি। সব পেট্রোল আমার পোড়ানো হয়ে গেছে। এক অলীক আগুনে নেভানোর জন্য আমি আরো পেট্রোল ঢেলে চলেছি তো চলেছিই। সেই আগুনের ভেতরে ও ভেতরে কোথাও অস্ত্র তৈরি হবার মতো উত্তাপ বেড়ে চলেছে তো চলেছেই। এমন এক অস্ত্র যার দুটো হাতল, দুজন ধরতে পারে অথচ ধরে না - লম্বা, একদিক ধারালো, ক্ষুরধার। প্রাচীন লোহা গলানোর যন্ত্রে সেই অস্ত্রের লোহাকে পোড় খাওয়ানো চলছে তো চলছেই। কোথায় সেই অস্ত্র বানানোর কাহিনি। সেই সন্ধান করতে করতে আমরা জঙ্গল পেরিয়ে পেরিয়ে অসংখ্য সিঁড়ির কাছাকাছি এসে পড়ি। হাজার হাজার সিঁড়ি আমাদের পেরতে হয়, তবু হাজার হাজার সিঁড়ি পেরনো বাকি থাকে। কে তাদের তৈরি করে আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখে দেয়। এতো সিঁড়ি দেখে অহনার বন্ধুরা উৎফুল্ল হয়। তারা ছুটে ছুটে নামতে থাকে আর আমরা ওদের পেছন পেছন যাই – আমি ও অহনা, অহনা ও আমি। আমার হাতে সেই প্রাচীন অস্ত্র ওয়েথসাম ধরা ছিল আর অহনা তার সঙ্গে কথা বলে বলে বেশ বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। সিঁড়ি এসে পড়ায় আর জঙ্গল কাটতে হয় না কারণ তা আগেই কাটা হয়ে গেছে। অহনা বলল, 'এবার ওকে ছেড়ে দাও?'-    কাকে?-    অস্ত্র। ওয়েথসাম।-    সে কী?-    হ্যাঁ।-    ও চলে যাবে।-    কী করে বুঝলে?-    আমার সঙ্গে কথা হয়েছে।-    কার?-    অস্ত্রের।-    কখন?-    এতক্ষণ আমি ওর সঙ্গেই কথা বলেছি।-    সে কী?-    হ্যাঁ।-    বুঝেছ?-    কী?-    ওর কথা?-    হ্যাঁ।-    সব?-    স্পষ্ট বুঝিনি কিন্তু ওকে তুমি ছেড়ে দিলে তখন আবার চলে যেতে পারবে সে বুঝেছি।-    আর যদি না আসে?-    আসবে।-    যদি জঙ্গল কাটার দরকার হয়?-    হবে না।-    যদি বাড়ি যাবার রাস্তা পরিষ্কার করতে হয়?-    সামনেই জলপ্রপাত, তার তার পাশেই আসলে বাড়ি।-    কে বলল?-    জলের শব্দ?-    কে?-    ওয়েথসাম। অস্ত্র বলেছে।-    কী?-    জলপ্রপাতের ধারে রাস্তা আর তার পাশেই আমাদের বাড়ি।-    ওই জন্য!-    কী ?-    ওই জন্য জঙ্গলের দিকে তাকাতেই শব্দ শুনছিলাম।-    কখন?-    যখন বাড়িতে ছিলাম।হাজার হাজার সিঁড়ির পর আরো সিঁড়ি পেরতে পেরতে অবশেষে আমরা জলপ্রপাতের সব কটা ধাপ শেষে পৌঁছলাম। তখন আর সিঁড়ি নেই এটা তো বুঝেছি। শুধু জলের স্পর্শ পাওয়া যায়। সে জলের ধারে বসলাম। কখনও জল আস্তে যাচ্ছিল, কখনও তীব্রতম স্রোত। সেই স্রোতে ওয়েথসামকে ফেলে দিলাম। ঝপাং করে আওয়াজ হল। খানিকটা জল এসে আমাদের চারজনের মুখে চোখে ছিটিয়ে গেল। সেই জলের ভেতর দিয়ে জল ছাড়া ওয়েথসামকে দেখা গেল স্থির হয়ে ভাসছে, নড়ছে না চড়ছে না। এক লম্বা স্থির, দুই হাতলওলা, প্রাচীন, পোড় খাওয়া ইস্পাতের তরবারির থেকে অনেক বছরের রক্ত ধুয়ে ধুয়ে জল লাল লাল হয়ে যাচ্ছে। তারপর সেই তীব্র রক্তের মতো জলেরা কমে আসায় আবার ধীরে জল বইছে, জলপ্রপাতের জল। আর ভেজা ভেজা চশমার বিন্দু বিন্দু জলকণার মধ্যে দিয়ে দেখছি ওয়েথসাম অস্ত্র ভেসে ভেসে যাচ্ছে। চারিদিক কুয়াশা। জলের শব্দ শুনতে পাই অথচ জলপ্রপাত দেখিনি। চারজন আমরা চারদিকে মুখ করে আছি অথচ পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম কোণটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সেই সব কোণের একটায় আমাদের দুজনের বাড়ি। অহনা আর আমার, তাতে আরো দুই বন্ধুকে নিয়ে যাবার জন্য আমরা পা বাড়ালাম। অসংখ্য সিঁড়ি সেই ঘন দূর্ভেদ্য কুয়াশার মধ্যে জেগে জেগে রয়েছে। সিড়িতে পা বাড়াতে যাব অহনা বলে ঊঠল, 'ওদিকে নয়, সিঁড়ি নয়।' আমি বললাম, 'জঙ্গল, গাছপালা, ফুলেরা, কুঁড়ি।' অহনা বলল, 'আর কাটতে হবে না।' নদীর কোল ঘেঁসে ঘেঁসে আমরা নদী ছেড়ে এক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। অথবা বাড়ি। বড় একটা জানলা ছিল বাথরুমে। সেখানে সুন্দর কপাট। আর কপাটের আগে, ওপরে পর্দা। সেই পর্দা সরানো যাচ্ছে না, সরালেই যদি রোদ্দুর এসে পড়ে। সেখানে এতো ছায়া আর বাষ্পময় সকাল যে বিকেলের আগে বাড়ি পৌঁছব বলে কিছুতেই মনে হচ্ছে না। আর বাড়ির কথা ভাবছি তো ভাবছিই। সকাল থেকে বিকেল তারপর রাত্রি আসে না। বাড়ি পৌঁছতে না পারায় ঘুরছি হ্রদের আশপাশ, প্রপাতের আগে ও পরে। ওয়েথসাম অস্ত্রের কথা মনে পড়ছে। অহনা কথা বলেছে। ওটা নাকি আর দরকার পড়বে না।(ওয়েথসাম হল বর্শার মতো সূঁচালো ও লম্বা দুই হাতল বিশিষ্ঠ প্রথাগত খাসি তলোয়ার)
    তিনটি কবিতা - অরিত্র চ্যাটার্জি | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়ভালোবাসার কাছেভালোবাসার কাছে যদি পারো, খুলে রেখো               তোমার মুখোশ ও দস্তানাএসব এমন, এমনই একটা সময়যখন নিজের কাছে নিজের উপস্থিতি সন্দিগ্ধ ঠেকছে খুবখানিক তফাত রেখে তোমায় নিরীক্ষণ করছে তোমারই পাথরের অবয়ব, ওইতার চোখের মণিহীন চাউনি, ধারালো পেরেকপ্রবণ দৃষ্টিতে দূরের নীলাকাশে, অনাগত মেঘের মত ওই তোমার ছায়া লম্বালম্বি বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেখো, সবুজাভ দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা তার টুকরো হাতের ছাপ, অঙ্গ ও মাংসপেশি, পড়ে আছে অবিন্যস্ত, নকশাকাটা স্ক্রু ও সেতারের সুরের মত এতদূর অবধি হেঁটে এসে এসে এইখানে তার পা’টুকু থেমে গিয়ে অবশেষে প্রকাণ্ড ও প্রস্তরেরহয়ে দেহ অবধি বিচ্ছিন্ন হয়েছে আজ, দেখো এমনই চৈত্রের দিনে তার কালো ও মসৃণ জ্যামিতি, দেখো নষ্ট ফুল, পড়ে থাকা ধূসর আতাফল দেখো,এবং তোমার এ নশ্বর হৃদয়ে অনুরূপ আকৃতিরক্রমশ বেড়ে ওঠা গোল, গভীর একটা গর্ত… ট্যুরিস্ট কাহিনীসানগ্লাস পরে নাও বন্ধুরা, পারলে সাথে রেখো টুপি ও টর্চ দেখো এখানে ঠিক একটা নদী ছিল, এখন শুকিয়ে গেছেআর একটা হরিণছানা এসব না জেনেই চলে এসেছে এত দূর – পাহাড়ের গায়ে তার খুরের ঘষা লেগে সেই নুন ও ধুলোর খানিক খাদে চলকে পড়ল – সেদিকে তাকিও না তুমি,আত্মহত্যার আগে, শোনো, আর কোনোদিকে তাকিও না তুমিবরং উঠে যাও সোজা, দ্রুততর এগিয়ে আসা একরৈখিক ট্রেনমুখোমুখি হওয়ার কথা মনে কর, মধ্যাহ্নের কালে তোমার সেই দারুণ জঙ্গম স্মৃতি, এতদিন পর কি পিছুটান জানাতে সক্ষম?এভাবে অন্যমনস্ক রাখো অপর ও নিজেকে, যেভাবে অহেতুক দুর্বোধ্যতা আমাদের আড়াল করেছে, পাতলা টিনের আস্তরণআমাদের মুখ ও ঠাণ্ডা খাবারের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট ব্যবধান আজ ভাবলে হাসি পায়, কেবলই শ্রী শ্রী কালীমাতা সহায় সম্বল করে ওই প্রৌঢ় দম্পতি পরবর্তী পদক্ষেপটুকু নেবে কিনা,ভাবতে ভাবতে পিচ্ছিল স্মৃতির মত নীলচে কাদায় তাদের আঙুল ডুবে যায় ওই, এ পৃথিবীতে সম্ভবত বিশুদ্ধ নীল বলে কিছু নেই-তবু ভেঙে পড়ার আগে পুরাতন গাছের নীরবতা লক্ষ্য কর তুমিলক্ষ্য কর, রাতের নিভু নিভু উত্তাপ জিইয়ে রাখতে তার টুকরোশরীর, হাড় এবং বিশুষ্ক মজ্জা অনায়াসে আগুনে গুঁজে দেয় যারা, যে প্রজন্ম এতদ্বারা খানিক উল্লাস করে, অধিকতর জটিল হওয়ার জন্য তাদের আলাদা করে পাহাড়ের আর কোনো প্রয়োজন নেই … এপ্রিল অবধি অপেক্ষা করা ভালোএপ্রিল অবধি অপেক্ষা করা ভালো-আধো ঘুমে যে অস্বস্তিকর সংলাপ হানা দেয় মাথার ভেতরআমি তাকে সন্দেহ করি, অপ্রস্তুতের মত তার শব্দগুলো এড়িয়ে যেতে চাই আর পেরিয়ে যেতে চাই বিষণ্ণ মার্চের দেওয়ালে সযত্নে টাঙানো ওই নীল পর্দার সারি -বড় পর্দার আড়ালে আরেকটা ছোট পর্দা সেখানে চলে যাওয়া একটা সংশয়ী মানুষ, ঘরের মধ্যে তার পরিত্যক্ত পোশাক হয়ে শেষপর্যন্ত রয়ে গেল- ঠিক সময় হলে নিজেকে খুব ভালবাসবে, এই ভয়ে ওরা তার হাতগুলোবেঁধে দিয়েছিল একদিন– সেসব বরফ ঋতুর কাল আর কাঠগুলো একটু পরেই আগুনে চলে যাবেজেনেও তাদের সন্নিকটে ওই তার তুমুল ভালবাসাবাসিআড়চোখে দেখে ফেলে, বলতে নেই, ভালো লাগেভালোই লাগে যখন দুহাতে কেউ কুড়িয়ে আনছে ফল, সাজিয়ে রাখছে গ্লাস, কিংবা বৃষ্টি নামার আগেইহাতছানি দিয়ে ঘরে ডেকে নিল কেউ- আসন্ন এপ্রিলের দুপুরে নদীর কিনার থেকে উঠে আসছে ওই নীরক্ত একজোড়া জঙ্ঘা ও জানু, মাটিতে উজ্জ্বল পদছাপ তার ভালো লাগে এই - তবু কেন এ’সকল চিন্তার প্রেক্ষিতেএকটি বেপরোয়া উদ্ধত ঘোড়া দেখি বারেবারে অনায়াসে পিষে চলে যায় যা কিছু, আজ হয়েছে ফলন্ত নীলাভ বসতজমি, ওই পড়ে থাকা সবুজ আপেল…
  • হরিদাস পালেরা...
    দোলজ‍্যোৎস্নায় শুশুনিয়া‌য় - ৪ - সমরেশ মুখার্জী | সুবাসে উতলা মনসেল্ফ ইন্ট্রোডাকশনের পর চা এসে গেল। চায়ের গ্লাস হাতে সবাই ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। সুমন চা খেয়ে একটু দুরে বারান্দা‌র উল্টো‌দিকের সিঁড়িতে বসে সিগারেট ধরায়। ছেলেদের মধ‍্যে সুমন,  গৌরব আর ইনস্ট্রাক্টররা ছাড়া আর কেউ সিগারেট খায় না। গৌরব বা ইনস্ট্রাক্টরদের কোনো ব্র‍্যান্ডের বাছবিচার নেই। যা পায় তাই খায়। বলাইদার দোকানে বিড়ি ছাড়া চারমিনার, পানামা, নাম্বার টেন গোছের সস্তা সিগারেট পাওয়া যায়। গোল্ড ফ্লেক, ক‍্যাপস্টান কিং সাইজ গোছের একটু দামি সিগারেট ওখানে অমিল। ওরা চারমিনার‌ খাচ্ছে। সুমন ধরায় ওর পছন্দের উইলস ফিল্টার। ওটা ছাড়া ওর চলে না। ও জানতো এসব জায়গায় তা পাওয়াও যাবে না তাই তিনদিনের ট্রিপের জন‍্য কলকাতা থেকেই কিনে এনেছে দশ প‍্যাকেট। এসেই তিন ইনস্ট্রাক্টরকে এক প‍্যাকেট ক‍রে দিয়ে দিয়েছে। খুব খুশি তারা। বলে, "আরে বাঃ! এতো মেঘ না চাইতে‌ই জল। বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে খাবো!" সামান্য কারণে সরল আনন্দের প্রকাশ দেখে ভালো লাগে। পর্বতারোহীদের সিগারেটের নেশা না থাকলে‌ই ভালো‌। দমে টান পড়ে। তবে থাকলে, এমন জায়গায় তার যোগান না পেলে মজাই মাটি। সুমন একটু বেশি এনেছি‌ল এই জন‍্য‌ই। তাছাড়া শৈলারোহণ সুমনের নিছক শখ। এ নিয়ে বেশীদুর যাওয়ার ইচ্ছা ওর নেই। তাই ও সিগারেট খেতেই পারে।মেয়েদের মধ‍্যে ঈশিতা‌কে আগের বার কোর্সেই মাঝে মধ‍্যে খেতে দেখেছে। পরে একটা প্র‍্যাকটিসে‌ও দেখেছে। বোধহয় হালকা নেশা আছে ওর। চুনি কচিৎ কখোনো একটু আধটু টান মারে। তুলির ওসব বালাই নেই। ঈশু পাশে এসে বসে। বলে, "জেঠু, কাউন্টারটা দিস।" - "দ‍্যাখ, ওসব কাউন্টার ফাউন্টার দেওয়া নেওয়া আমার পোষায় না। তুই একটা গোটাই নে।" প‍্যাকেট খুলে একটা গোটা সিগারেট ওর দিকে বাড়ায় সুমন।- "না, না, তোর স্টক শেষ হয়ে যাবে। আমি বলাইদার কাছে খোঁজ নিয়ে‌ছি এখানে পাওয়া‌ যায় না এটা"। একটু ইতস্ততঃ করে ঈশু।- "নে, নে, ধর, বেশি ফর্মালিটি করিস না। এখনো সাত প‍্যাকেট আছে। ভুলে যাস না  আমি চাকরি করি, মাইনে যদিও সাতশো টাকা, তবু তোদের মতো নির্ভেজাল বেকার ন‌ই। তুই বরং একটা গোটা প‍্যাকেট‌ই রাখ।"সিগারেট‌টা ঠোঁটে নিয়ে ঈশুর আর দেশলাই‌য়ের তর সয় না। সুমনের ঠোঁটে জ্বলা সিগারেট থেকে‌ই ধরানোর জন‍্য ঝুঁকে আসে। শিউরে ওঠে সুমন। ধারালো কাঁচের মতো মেয়েরা কেন যে এসব করে! এমন নৈকট্যে মিষ্টি পারফিউমের সুবাসে যে মন উতলা হয়ে উঠতে পারে তা কি বোঝে না ওরা?পারফিউম ব‍্যবহার করা ঈশুর শখ। ও বলে তাতে নাকি ওর মন ভালো থাকে। কিন্তু ও জানে না, তাতে কখনো অন‍্যের‌ মন খারাপ‌ও হয়ে যেতে পারে। তখন শুশুনিয়া পাহাড়ের রেখা ছাড়িয়ে চাঁদের আভা ক্রমশ বাড়ছে। চাঁদ অবশ‍্য তখনো পাহাড়ের আড়ালে। কাল দোল পূর্ণিমা।  কয়েকটা সুখটান মেরে ঈশু বলে - "না রে, তার চেয়ে এই ভালো। যখন ইচ্ছে হবে তোর কাছে চাইবো।"-"কী?" জেনে বুঝে ন‍্যাকা সাজে সুমন।-"কী মানে? সিগারেট। আবার কী?" -"ও তাই বল, আমি ভাবলাম বুঝি ..."-"জেঠু, ইউ আর জাস্ট ইনকরিজিবল, এমন ইন্সট‍্যান্ট ফিচলেমি তোর মাথায় আসে কী করে বলতো?" বলার ভঙ্গিতে মনে হয় চোখ পাকিয়ে তাকালো। পাহাড় চোঁয়ানো হালকা জ‍্যোৎস্নার পেলব আলো পড়েছে মুখে, চোখে তখনও আলোছায়া।নারীবাদীকে নাড়িয়ে- "এই, তোরা দুজনে মিলে হুইসপারিং গেম খেলছিস নাকি রে?" তুলি এসে বসে ওদের পাশে। গৌরব কোথায় ঘুরছে কে জানে। বরুণ, চিতা আর দুটো নতুন ছেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বারান্দায় তাস খেলতে বসেছে। ইনস্ট্রাক্টররা নিজেদের মধ‍্যে পাহাড়ের গল্প করছেন। এক‌ই দলের মধ‍্যে তৈরী হয়েছে কয়েকটি ছোট ছোট উপদল। যেন মেঝেতে পড়া ফোঁটা ফোঁটা গুড়ের পাশে জমা হ‌ওয়া পিঁপড়ে‌। চুনিও এসে যোগ দেয় ওদের উপদলে। কিছু করার নেই বলে সুমন ভাবে ঈশুকে একটু নাড়িয়ে দেখা যাক।- "আচ্ছা ঈশু, এই যে তুই নিজেকে ফেমিনিস্ট বলিস, এটা তো একটা মতবাদ। এ বিষয়ে কিছু বল না শুনি।"- "আগে বল, তুই কী জানিস।"- "কিছুই না। তবে আন্দাজে মনে হয় ফেমিনিজম মুভমেন্টের মূলে আছে সমাজে মহিলা‌দের প্রাপ‍্য স্বীকৃতি ও অধিকার আদায়ের লড়াই। যেহেতু সারা পৃথিবীতেই সমাজের নানান একপেশে নিয়মকানুন মূলত পুরুষদের দ্বারা‌ই তৈরী ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তাই আমার অনুমান প্রতিবাদ হিসেবে ফেমিনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত‌‌ হয়তো হয়েছে মহিলা‌দের দ্বারা‌ই। আর কিছু বলতে পারবো না।"- "সাধে কী আর তোকে আমরা জেঠু বলি"। ট্রেনে বলা তুলির কথাটা ঈশু‌ও পুনরাবৃত্তি করে। "কিছু না জেনেও তুই আন্দাজে‌ বুলস আইতে হিট করেছিস।" ঈশু সুমনের পিঠটা একটু চাপড়ে দেয়। তুলি সুমনের কলারটা তুলে নাচিয়ে দেয় কয়েকবার। ঈশু বলে, "পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলা‌রা চিরকাল পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও দমনের শিকার। তাই ফেমিনিস্ট আন্দোলনের মূলে আছে, যা তুই বললি, সমাজে পুরুষের সাথে মহিলা‌দের সমান অধিকারের দাবিতে লড়াই। কর্মক্ষেত্রে সুযোগ, অর্থ‌নৈতিক মুক্তি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা,  জীবনের নানান ব‍্যক্তিগত ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমানাধিকার, সামাজিক ন‍্যায়বিচার ইত‍্যাদির জন‍্য জনসচেতনতা গড়ে তোলা। এবং তা শুধু মহিলাদের মধ‍্যে নয়, পুরুষ‌দের মধ‍্যেও"। তুলি বলে, "কেন? পুরুষ যদি মেয়েদের ওপর অধিকার কায়েম রাখতে চায়, তাহলে পুরুষ‌রা মহিলা‌দের থেকে এসব কথা শুনতে চাইবে কেন?"ঈশু বলে, "কারণ প্রকৃতি‌গতভাবে দূর্বল নারী, পুরুষের বিরূদ্ধে গলাবাজি, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রত‍্যাখ‍্যান, সমালোচনা করে তাদের মূল লক্ষ্যে বেশিদূর এগোতে পারবে না। সমাজে এবং ব‍্যক্তিগত পরিসরে‌ও নারী‌র উন্নতি ও সুষ্ঠু জীবনযাপনের  জন‍্য পুরুষকে তার পাশে পাওয়া জরুরি। নারী ও পুরুষ যে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, পরিপূরক, এই ধারণার সার্বিক মান‍্যতা প্রতিষ্ঠা না করে পুরুষের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ফেমিনিস্ট‌রা কোনো বৃহত্তর সাফল‍্য পাবে বলে মনে হয় না। পুরুষদের বোঝাতে হবে যে পোষা কুকুরের মুখে ছুঁড়ে দেওয়া রুটি‌র টুকরো‌র মতো যুগ যুগান্ত ধরে মেয়েদের পুরুষের দিকে ভিক্ষের ঝুলি হাতে তাকিয়ে থাকতে বাধ‍্য করা আসলে পৌরুষের‌ই অপমান।" চুনি বলে, "ঠিক বলেছিস। শুধু‌ই পুরুষের বিরোধিতা নয়, ওদের বোঝা‌তে হবে। ওদের এটা অনুভব করতে প্রভাবিত করতে হবে"।ঈশু বলে, "সৌভাগ্যের কথা অনেক পুরুষ‌ই হীনমন্য, সঙ্কীর্ণ‌মনা, কুচুটে বা মেনীমুখো ধরণের নয়। অনেক পুরুষের মধ‍্যে‌ই কাজ করে মেল ইগো - মানে হিমালয়ের মতো চিন্তার মহানতা, সমূদ্রে‌র মতো দরাজ হৃদয় হবার প্রবণতা। এটা তাদের মেল সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স। এহেন উদারমনস্কতার ফলে তারা যদি মহিলা‌দের প্রতি অবিচার করার আগে দুবার ভাবে বা করে ফেললেও আত্মগ্লানি‌তে ভোগে তাও আখেরে মহিলা‌দের পক্ষে মঙ্গল‌জনক। তাই পুরুষ‌রা মহিলা‌দের ওপর দীর্ঘদিন ধরে অবিচার করে এসেছে বলে মহিলা‌রা‌ও যদি নিয়ত পুরুষদের সর্বসমক্ষে তুলোধোনা করতে থাকে তাহলে ব‍্যাপার‌টা এক‍‌ই ভুলের অন‍্যরকম পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে। বরং পুরুষ‌দের সেই উচ্চমন‍্যতা বোধ জাগিয়ে তুলে তাদেরকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যে তারা যা করছে সেটা ঠিক নয়। এটা মোটে‌ও সহজ কাজ নয়। চটজলদি সমাধান তো নয়‌ই।" মুগ্ধ হয়ে ওরা শুনছিল ঈশিতার কথা। মনে হচ্ছিল শুশুনিয়ায় কোলেবাংলোর সিঁড়িতে তিন বন্ধু‌র সাথে নয় যেন কোনো অডিটোরিয়ামের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে কিছু মনযোগী শ্রোতা‌র সামনে বক্তব্য পেশ করছে ঈশু। সুমন বলেই ফ‍্যালে, "ঈশু, তুই কিন্তু খুব ভালো বক্তা।"- "আসলে তুই আমার একটা প‍্যাশনেট জায়গায় টাচ করেছি‌স। তোরা মন দিয়ে শুনছিস বলে আমার‌ও বলতে ইচ্ছে করছে। তোরা‌ নিজেরা  কনভিন্স‌ড হলে, হয়তো এমন কথা কখোনো অন‍্য কোথাও বলবি। তোদের কথা শুনে‌ আরো কিছু মানুষ অনুপ্রাণিত হবে, হয়তো তাদের‌ ভাবনা চিন্তা‌য় প্রভাব পড়বে, আচরণ বদলাবে। এভাবেই ধীরে ধীরে আসে সামাজিক পরিবর্তন। বহুশতাব্দী প্রাচীন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, অভ‍্যাস তো আর কয়েক দশকে বদলাতে পারে না।"- "ঠিক বলেছিস। তোর যা বলতে ইচ্ছে করছে বল। আমরা শুনতে চাই। কী তাই তো?" সুমন তুলি আর চুনির দিকে তাকায়। ওরাও মনোযোগ দিয়ে শুনছি‌ল ঈশিতার কথা। সুমন কেবল সূত্রধরের কাজটা করছিল। দুজনেই একযোগে সম্মতি‌সূচক মাথা নাড়ে। - "আচ্ছা, শোন তাহলে। মাতৃত্বেই যদি নারীত্বের সম্পূর্ণ‌তা হয় তাহলে সন্তানধারনের ক্ষেত্রে মহিলা‌দের সম্পূর্ণ না হলেও সামান‍্য ইচ্ছার‌ও মূল‍্য থাকে না কেন? অনেক মহিলা কেবল স্বামী‌র অতিরিক্ত শরীরের ক্ষুধার প্রতিবাদ না করতে পেরে অগুনতি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে‌ই অকালে ফুরিয়ে যায়। যেমন ধর খুররম আর আর্জুমান্দ বানুর কথা।"অমর প্রেমের অন্তরালে- "খুররম! আর্জুমান্দ বানু! তাঁরা আবার কে? বলে‌ই ফ‍্যালে সুমন। মুখ দেখে বোঝা যায় চুনি, তুলি‌ও জানেনা।- "মহান মূঘল সম্রাট শাহজাহান ও তাঁর  প্রিয় পত্নী মুমতাজ মহল। শাহজাহান তো একটা রাজকীয় উপাধি, মানে জগতসম্রাট, যেমন ঔরঙজেব নিয়েছিলেন, আলমগীর। যেমন জাহাঙ্গীর পত্নী ও শাহজাহানের বিমাতা অপূর্ব সুন্দরী মেহেরুন্নিসা বেগম অধিক পরিচিত ছিলেন নূরজাহান বা জগতের আলো নামে, সেই রকম।" - "ওমা তাই নাকি, এটা তো জানতাম না" বলে তুলি।ঈশু বলে, "শাহজাহানের জন্মনাম ছিল - শাহাবুদ্দীন মহম্মদ খুররম। আর মূমতাজের আর্জুমান্দ বানু। তো যা বলছিলাম, শাহজাহানের অনন‍্য পত্নীপ্রেমের নিদর্শন তাজমহল, এক অসাধারন স্মৃতি‌সৌধ, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি, এসব‌ তো অনেকেই জানে। তবে উনিশ বছর দাম্পত্য জীবনে চতুর্দশতম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বুরহানপুর কেল্লায় তিরিশ ঘন্টা গর্ভযন্ত্রনা ভোগ করে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে যে মুমতাজের জীবনদীপ নিভে গেল - এটা হয়তো অনেকেই জানে না।"- "এ্যাঁ, তাই নাকি?" চোখ গোল হয়ে যায় চুনি‌র। "এ তো আমি‌ও জানতাম না। সত‍্যি ইতিহাসের কত কী যে জানিনা। কিন্তু ঈশু, তুই তো ইংরেজি সাহিত‍্য নিয়ে পড়ছিস অথচ ইতিহাসেও তো তোর খুব দখল দেখছি।"ঈশু বলে, "সব পড়াশোনা‌ই তো পরীক্ষা পাশ করার জন‍্য নয়। এসব আমি পড়ি ভালো লাগে বলে। তো, যা বলছিলাম। রাজকীয় হেকিম সম্রাটকে আগাম সতর্ক করেছিলেন, মুমতাজের যা শরীরের অবস্থা পরবর্তী সন্তানের জন্ম দিতে গেলে ওনার জীবনসংশয় হতে পারে। শুনলেন সে কথা পত্নী‌প্রেমে গদগদ মহান পতি শাহজাহান? সম্রাটের নিত‍্য স্বাদবদলের জন‍্য মূঘল হারেমে বন্দিনী ছিল বহু সুন্দরী রমণী। মুমতাজ ছাড়াও তাঁর ছিল আরো চারটি বৈধ পত্নী ও বেশ কিছু উপপত্নী। তা স্বত্তেও দুর্বল, রক্তাল্পতায় ভোগা মুমতাজ‌কে মাত্রাতিরিক্ত উপভোগ ক‍রে  মাত্র সাঁইত্রিশ বছরে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে মহান সম্রাট তাঁর অনন‍্য পত্নী‌প্রেমের ধ্বজা উড়িয়ে বেঁচে র‌ইলেন চুয়াত্তর বছর। কী আয়রনি বল তো!"- "এর নাম ভালো‌বাসা? পত্নী‌প্রেম?" তুলি রাগে গনগন করে। ঈশু বলে, "না রে, শাহজাহান কিন্তু সত‍্যি‌ই মুমতাজকে খুব ভালোবাসতেন। তাই পত্নীর মৃত্যুতে তিনি শোকে এমনই মূহ‍্যমান হয়ে যান যে রাজকার্য শিকেয় তুলে বুরহানপুর কেল্লার একটি ঘরে সাতদিন দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন। একমাত্র খাবার দেওয়ার জন‍্য খাস খিদমৎগার ছাড়া শোকার্ত সম্রাটের কাছে যাওয়ার হিম্মত আর কারুর হয়নি। সাতদিন পর তিনি যখন সে‌ই ঘর থেকে বেরোলেন তাঁর মাথার সব চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে! সবাই হতবাক। তবে মুমতাজের যদি আর সন্তান‌ধারণে অনিচ্ছা প্রকাশের বৈধ অধিকার থাকতো তাহলে এহেন অকালমৃত্যু তাঁকে গ্ৰাস করতো না। তুলির মতে এটা ভালো‌বাসা না ছাই, নির্লজ্জ শরীরের ক্ষিধে। তুই কী বলবি জেঠু?'সুমন ম্রিয়মান কণ্ঠে বলে, "আমি কী বলবো বল? শাহজাহানের প্রতিনিধি না হলেও, স্রেফ পুরুষসমাজের একজন হয়ে‌ও তো এসব শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। তুলির কথা তো ফেলে দেওয়ার নয়। রাজবৈদ‍্যর নিষেধ সত্ত্বেও এমন অবিবেচনা‌র কাজ করেন কী করে উনি? আর তুই যখন বললি সে ক্ষিধে মেটানোর আরো নানা উপায় ছিল তখন রুগ্ন মুমতাজকে রেহাই দিলেন না কেন সম্রাট? মুমতাজের প্রতি তাঁর যে কিংবদন্তী‌প্রায় প্রেমের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচারিত হয় এতো দেখা যাছে তা মূলতঃ ইন্দ্রিয়াসক্তি। কতজন শিক্ষিত মানুষ এসব জানে জানি না তবে স্বীকার করছি আমি‌‌ও এ ঘটনা জানতাম না।"  ঈশু বলে, "ঠিক আছে, সাড়ে তিনশো বছর আগে শাহজাহানের অসংবেদনশীল‌তার জন‍্য তোর লজ্জিত হ‌ওয়ার  কোনো কারণ নেই। তাছাড়া, তখন অনেক মন্ত্রী, রাজকর্মচারী বা প্রজাদের‌ও মনে হয়েছিল  এটা শাহজাহানের চূড়ান্ত স্বার্থপর‌তার নিদর্শন। তিনি কেবল নিজেকে ভালোবাসেন। কিন্তু কেউ ভয়ে তাঁর সামনে মুখ খুলতে পারেনি।" চিতার দৌলতে টি ব্রেকজল খেতে থামে ঈশিতা। একটু আগে এসেছিল চিতা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনে কপট বিষ্ময়ে বলে, "ওরে বাবা, তোরা তো হেব্বি সব টপিক নিয়ে কথা বলছিস! ওসব আমার মাথায় ঢুকবে না ভাই। আমি বরং তাস‌‌ই খেলি গিয়ে। তবে তোদের জন‍্য বলাইদাকে একটু চা বলে আসি। এ্যাতো গেরেমভারি আলোচনা কী চা ছাড়া জমে?" এই হচ্ছে টিপিক্যাল চিতা-সুলভ আচরণ। বন্ধুদের জন‍্য ওর মমতা অকৃত্রিম। কার কী দরকার সেসবের প্রতি তীক্ষ্ম নজর। চিতাকে বাদ দিয়ে তাই আউটিং জমে না। একটু বাদে চিতার বলে আসা চা কেটলি করে নিয়ে আসে বাবলু।ঈশিতা সুন্দর কথা বলছে। শুনলেই বোঝা যায় ওর অনেক পড়াশোনা। চিন্তার স্বচ্ছতা, বক্তব্যের সাবলীল‌তা‌ও প্রশংসনীয়। যেন ও এক অধ‍্যাপিকা আর ওরা ওর গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী। এমনি‌তে ইয়ারকী ফাজলামি মারলেও এরকম সঙ্গী পেলে সিরিয়াস আলোচনাতেও সুমনের দারুণ উৎসাহ। কোনো বিষয়-ভিত্তিক আলোচনা‌য় নিজের জানাটুকু অন‍্যের কাছে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করতে পারলে নিজের ধারণা আরো পরিষ্কার হয়। যা জানা নেই তা অন‍্যের কাছ থেকে জানা যায়। এভাবে‌‌ই জীবনে চলতে ফিরতে‌ও অনেক কিছু জানা যায়। শুধু জানার ইচ্ছা, বোঝার চেষ্টা, বিষয়ে‌র গভীরে গিয়ে ভাবনা চিন্তা করার আগ্ৰহটুকু থাকা চাই। চায়ের পর সিগারেট ছাড়া চলে না। ঈশুকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে সুমন বলে, "দিদিমণি, নাউ ইউ ডিজার্ভ ইট"। ঈশু ওর সুন্দর মুখে মুক্তোর মতো দন্তশোভার ঝিলিক তুলে লাজুক হাসে। বিরল উপহার। একটু আগে শাহজাহান-মুমতাজ কিসসা বলার সময় আবেগতাড়িত হয়ে ওকে একটু উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। এখন আবার স্বাভাবিক লাগছে।   সিগারেট‌টা ধরিয়ে ঈশু বলে, "চল না একটু পায়চারি ক‍রে আসা যাক। অনেকক্ষণ এক‌ জায়গায় বসে আছি।" চুনি‌ বলে, "ঈশু, শেষে একটু দিস, পুরো খাবো না। চা টা খুব ভালো বানিয়ে‌ছিলেন বলাইদা।"  নির্জন সন্ধ্যায় ফুটফুটে জোৎস্না‌য় ওরা ঝর্ণার দিকে হাঁটতে যায়। চাঁদ তখন পাহাড়ের রেখে ছাড়িয়ে সবে উঁকি দিয়েছে।
    মন - নিরমাল্লো | গুরু কি উপায় বলো না,তুমি সব খোল, মন খোল না... ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, মন অতি বিষম বস্তু। ছোট বাচ্চা যখন মা বাবাকে শুধায়, মন কোথায় থাকে? বাবা মা কি বলে? আমার ঈশ্বরবিশ্বাসী মা আমার বুকের দিকে আঙুল বাগিয়ে, যেখানে হার্টটা ধুকপুক করছে, সেটা দেখিয়ে বলত, এইখানে! এইখানেই নাকি মন থাকে। আবার যদি কখনো জিজ্ঞেস করতাম, ভগবান কোথায় থাকে; একই উত্তর পেতাম। আমার ছোট্ট কল্পনাশক্তিতে ভাবতাম ঐখানেই মন থাকে, আর মনের মধ্যে থাকে ঈশ্বর। আমার মধ্যবিত্ত মা-বাবা প্রত্যহ সকালে ঠাকুরপুজো করত। ছাতে ওঠার সিঁড়ির মাঝপথে একটা কুলুঙ্গি মত ছিল, সেখানেই ছিল আমাদের ঠাকুরের অবস্থান। ঠাকুর বলতে ছিল, একটা লক্ষীর পট আর একটা কালো রঙের শিবলিঙ্গ। আমার বাবা রোজ সকালে একবালতি জল হুশ হুশ করে মাথায় ঢেলে গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে, দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে, ত্রিভূবনতারিনী তরলতরঙ্গে... গুণগুণ করতে করতে দুটো ফুল বেলপাতা পটের গায়ে দিয়ে, একটা ছোট তেলের শিশি থেকে সর্ষের তেলে ঢেলে শিবের গায়ে মাখিয়ে দিত। তারপরে শীতকালে যেমন আমাকে আচ্ছা করে তেল মাখিয়ে দলাইমলাই করে আটা মাখা করত, তেমনি করে চটকে মটকে একটা পাথরের বাটিতে বসিয়ে গুপুশ করে একঘটি জল ঢেলে দিত মাথায়। তেল জল খেয়ে খেয়ে শিবঠাকুরের গায়ের কালো রঙ গুটি বসন্তের মত চাকা চাকা হয়ে ফুলে উঠেছিল। আমি যখন আরেকটু বড় হই, তখন একবার থাকতে না পেরে আমি মেজোকাকার পুরোনো ব্যাঙ কাটা ছুরি দিয়ে শিবঠাকুরকে আচ্ছা করে চেঁছে দিয়েছিলাম। দেখেছিলাম উপরে তেল কালি মাখা শ্যাওলা ছ্যাতলা পড়া শিবঠাকুরের চামড়ার তলায় একটা মেটে মেটে ছাই ছাই রঙের পাথুরে বডি আছে। আচ্ছা করে ছালচামড়া তুলে আমি শিবঠাকুরকে চাইনিস ওয়াটারপ্রুফ রঙ দিয়ে রঙ করে দি। এর জন্যে আমার অলরেডি অনন্ত নরকে বিনা এনাস্থিশিয়ায় স্কিন গ্রাফটিং বরাদ্দ হয়ে আছে নিগঘাত। কিন্তু আমি শিবঠাকুরের সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবেই একাজ করেছিলাম, আশা করি চিত্রগুপ্তের খাতায় একথা ফুটনোটে লেখা আছে। তা যা বলছিলাম মনের কথা - একটু বড় হয় জানতে পারলাম যে মন ধুকপুক করে বলে জানতাম, সেটা আসলে হার্ট। হার্ট আবার দুই রকম, একরকম হার্ট রক্ত পাম্প করে বডিতে, অন্যটা রুহিতন। সেটা আবার প্রেমপত্রের নিশানা। যেহেতু আমার ভগবৎ কল্পনা শিবলিঙ্গের বাইরে যেত না, তাই হার্টের আকার প্রকার দেখে আমার মনে হত শিবলিঙ্গ গৌরীপট্ট সমেত ওর মধ্যে আস্তানা গেঁড়েছে। নইলে ঈশ্বর তো হোমলেস হয়ে পড়ত, তাই ওরই মধ্যে গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকে,ঐ জন্যে হার্টের শেপটা ওরকম বেঢপ। এদিকে ক্লাসে বায়োলজির টিচারেরা শিবঠাকুরকে হার্ট থেকে তাড়াবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তাই আমি লেফেট এট্রিয়াম, রাইট এট্রিয়াম, লেফট ভেন্ট্রিকল, রাইট ভেন্ট্রিকল, পালমোনারি ভালভ, এওর্টা ইত্যাদি মুখস্ত করে চললাম। শিবঠাকুর ও মন দুইই হার্টের থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ল। ক্রমে ক্রমে বয়স বাড়তে লাগল, ক্লাস সিক্সে উঠে ডে স্কুলে পড়া ইস্তক পিউবার্টি এক্কেবারে চড়াৎ করে ছিটকে বেরুলো গালের উপরে বিদঘুটে ব্রণ, আর হার্টে চমক জাগিয়ে। যে সব ফ্রকপরা খুকীরা জঞ্জাল বলে পষ্ট বুঝতে পারতুম কদিন আগেও, তারা সব শকুন্তলা, প্রিয়ম্বদা বলে প্রতীত হতে লাগল। ইশকুলে চাচা ও জনা নামক দুই অবতার আমাদের নারীবিষয়ক জ্ঞানের ভান্ডার ছিলেন। তাদের কাছ থেকে বিশেষ জ্ঞানলাভ করে আমরা টিফিনটাইমে পাশের গার্লস স্কুলে, কলেজে উঁকি দিতুম। একদিক থেকে আমাদের স্কুলটা অত্যন্ত vantage point-এই ছিল। স্কুলে পুব দিকে পৌনে এক কিলোমিটারের মধ্যে ছিল কালীকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয়, পশ্চিমে একশ মিটারের মধ্যে ছিল সরকারী বালিকা বিদ্যালয়, যার নেটিব নাম গার্লস ইস্কুল। আর আমাদের স্কুলের খেলার মাঠের লাগোয়া ছিল বারাসাত সরকারী কলেজ। এই কলেজের সামনেই ছিল বারাসাত থানা। ফলে বারাসাতের ইশকুল কলেজযাত্রী মেয়েদের সিংহভাগ আমাদের স্কুলের সামনে দিয়ে যাতায়াত করত, এবং আমরাও ক্যাবলাকান্তর মত সকাল ও বিকেলের দিকে আলুকাবলি, ঝালমুড়ির স্টলে দাঁড়িয়ে বিঞ্জ ওয়াচিং করতুম। আমাদের মধ্যে যারা বেশ বীর গোছের বা কৃষ্টোফোর কলম্বস কিম্বা ভাস্কো ডি গামা গোছের সাহসী নাবিক টাইপের তারা কখন কখন মেয়েদের সাথে আলাপ করতে যেত ফুচকা বা আলুকাবলির স্টলে। আমরা দূর থেকে দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করতাম যে কি হচ্ছে, সামনে দাঁড়িয়ে ম্যানস্লটার দেখার অভ্যাস তখনো হয় নি। তারপরে তারা ফিরে এসে যা সব গল্প বলত, সে শুনে আমাদের সর্বাঙ্গের লোম খাড়া হয়ে যেত। চাচাই আমাদের শিখিয়েছিল, ট্রাই এন্ড ট্রাই এগেইন, আনটিল ইউ সাকসিড। এইসময়য়েই আমি আরামসে বুঝে গেলুম মনে পেরজাপতি কেমনি করে ওড়ে। পষ্ট বুঝতে পারলুম বায়োলজি স্যার বিস্তর ফাঁকি দিয়েছেন, হার্টের যায়গায় যদি মনই না থাকে তবে বুকে ব্যাথা লাগে কেন! এরকম একটা দোদুল্যমান অবস্থায় মার্কেটে বঙ্কিম হাসি হেসে প্রবেশ করলেন দুই ব্রাহ্মণসন্তান, বঙ্কিমচন্দ্র ও শরদিন্দু। আমার অশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ হৃদয় ভেসে গেল। আমি ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখতে লাগলুম। ট্রেনে, বাসে, রাস্তায় পাশে যাকেই দেখি মনে হয় আয়েশা কিম্বা দূর্গেশনন্দিনী। এই বুঝি বলে উঠল, এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর। এরকম করে বললে আমি জীবানন্দ যেরকম নবীনানন্দের সাথে মিষ্টালাপ করেছিলেন সেরকম কথা বলব, নাকি ' -এসেছিল বকনা গরু পরগোয়ালে জাবনা খেতে' বলে হিক্কা তুলব দুটোর কোনটাই ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না। এমন দোলাচলে জ্ঞান দিয়ে সিধে করে তুলবে এরকম ফাদার ফিগারও কেউ ছিল না। ফলে আমরা কাঁচামিঠে আমের মত অর্ধপক্কই হয়ে রইলাম বহুকাল। ডে-স্কুলে উঠে ইস্তক প্রাণটা হু হু করতে লাগল এমন যে সে আর বলার মত না। আগেই বলেছি ইস্কুল আমাদের এক্কবারে ভোগের উপরে কদমা মধ্যমণির মত বিরাজ করত। কিন্তু সে কদমায় দন্তস্ফুট না করতে পেরে সব বালিকারাই আমাদের মত নিরীহ বালকদের নিয়ে হাসাহাসি করত। হয়তো কদমার চুড়োতে তাদের টাগরায় সুড়সুড়ি লাগত! এ বিষয়ে সম্যক জ্ঞান আমি আজও অনুধাবন করতে পারি নি। তা এমনই এক শীতের সকালে আমি কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। আমাদের ওদিকে তখন অত অটো টোটো চলত না, ট্রেকার বলে এক ধরনের আধা জিপগাড়ি ধরনের গাড়ি শাটল ট্যাক্সির মত চলত। আমি কচি ছেলে, দুইপাশের গাবদা মুষকো দুই লোকের চাপে দলামোচা হয়ে আছি এমন সময় চোখে পড়ল রিয়ার ভিউ মিররে একটা মিষ্টি মত মেয়ের মুখ। বেশ শ্যামলা চেহারা, গরুর মত আয়ত দুখানি চোখ। সাদা শার্ট আর নীল জিনসের প্যান্ট পরেছে, মাথায় হাতে বোনা একটা বৌ টুপি। আমি লাজুক মুখে টুপুস করে মিটমিটিয়ে তাকালুম তার দিকে, দেখি সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এট্্টু হাসলাম, সেও হাসল। আমি তো এক্কেবারে রামহড়কান হড়কালাম, বুকের মধ্যে হার্টটা যেন ধোপার পাটে কেউ আছড়াচ্ছে, কিন্তু একটা কথা পষ্ট বুঝে গেলুম যে মনটা হার্টের মধ্যেই পোরা আছে, যে বিষয়ে সব রোমান্টিক সাহিত্যিকরাই পষ্টাপষ্টি বলে গেছেন। তা বেশ খানিক হাস-প্রত্যাহাস বিনিময়ের পরে বেশ গরম লাগছিল বলে মাফলারটা খুলতেই কেলো হয়ে গেল। হঠাৎ করে মিষ্টি মেয়েটা কেমন গাম্বাট মত হয়ে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমি আমাকেই এতক্ষণ ধরে...  বিধ্বস্ত মনে ফিরে এসে আমি বুঝলাম জগতে সকলি অসার, মন ফন বলে কিছু হয় না, সবই হরমোনাল ইমব্যালেন্স এবং অপ্টিক্যাল ইল্যুশান! সেই থেকে আমি খালি জিভে প্রেম করি।
    ফারাও-এর দেশে কয়েকদিন - পর্ব ৮ - সুদীপ্ত | “কবর দাও বা চিতায় পোড়াও, মরলে সবাই মাটি” না, প্রাচীন মিশরের মানুষ অবশ্যই এভাবে ভাবতেন না, বরং জীবনানন্দের কথা ধার করে বলা যায় “মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়”; আর মৃত্যুর পরের মানবটির জন্যে গড়ে ওঠে একের পর এক স্থাপত্য, ভাস্কর্য, শিল্পকলা! মরলে মানুষ কোথায় যায়, মৃতেরা এ-পৃথিবীতে না ফিরলেও প্রাচীন মিশরে আনুবিস আর ওসাইরিসের পরীক্ষায় পাশ করলে আর এক সুখের দুনিয়ায় (‘দুয়াত’) পৌঁছে যাওয়া যেত। যেখানে যমদূত-দের চাবুক খেতে না হলেও দেবতাদের তুষ্ট করার জন্যে চাষবাস ইত্যাদি করতে হতো আর মৃত্যুর পরেও জীবিতাবস্থার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা যেত। আত্মা নাকি অবিনশ্বর, তায় যদি পাওয়া যায় তিন তিনখানা আত্মা, তাহলে আর দেখে কে! প্রাচীন মিশরের মানুষ বিশ্বাস করতেন জীবিতাবস্থায় মানুষের একটি আত্মা থাকে, তা হল ‘কা’, এই কা শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর মৃত্যুর পর আরও দুই আত্মা এসে হাজির হয়, একজন হল ‘আখ’, আরেকজন ‘বা’। ‘বা’ পাখির রূপ ধরে সমাধি থেকে বেরিয়ে দিনের বেলায় বাইরের পৃথিবীতে ঘুরতে পারে (এরপর মিশরের আকাশে পাখি দেখলে কি মনে পড়বে ভাবুন একবার); আর আখ হল সেই আত্মা যাকে পরীক্ষায় বসতে হয় ওসাইরিস, আনুবিস, মাত প্রমুখ দেবদেবীর সামনে। এই যে পিরামিডে বা পরবর্তীতে ফারাও বা রাণীদের সমাধিতে মমির সঙ্গে কেটে রাখা প্রত্যঙ্গ, ধনদৌলত, ব্যবহৃত জিনিসপত্র এসব দেওয়া হত, তা ঐ কা-এর সুবিধার্থে। মমিফিকেশনের কথা তো আগেই দ্বিতীয় পর্বে বলেছি, এবার বুক অব দ্য ডেড-এর কথা, কারণ আজ আমরা যাব ভ্যালি অব দ্য কিংস-এ। আজ আমাদের ক্রুজের শেষ দিন। সেইমতো প্রাতঃরাশ সেরে সব ব্যাগপত্র সহ আমাদের ক্রুজ ‘নাইল স্টোরি’-কে বিদায় জানিয়ে উঠে বসলাম বাসে। আমাদের দলের কিছু পর্যটক অবশ্য্ ভোরবেলা চলে গেছেন নীলনদের অপর পারে, লাক্সর-এর হট এয়ার বেলুন-এ সওয়ারি হতে। এই বেলুন গুলো খুব বেশী এদিক ওদিক যায় না, শুধু উপরে ওঠে আর নীচে নামে, তাই বেলুনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সফর করার সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। তবে উপর থেকে পুরো লাক্সর-এর সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়, ঊষর মরুভূমি আর সবুজ শস্যক্ষেত্র পাশাপাশি রেখে, আর নীলনদ তো আছেই। আর শুধুমাত্র ভোরে আর গোধূলির সময় এই বেলুন ছাড়া হয়, কারণ বেলা বাড়লে বাতাসের বেগ বেড়ে গিয়ে বেলুনকে মাঝ-আকাশে বেকায়দায় ফেলতে পারে। আমরা এই বেলুনের বদলে পছন্দ করেছিলাম সাবমেরিন ডাইভ, সেটা হবে হুরগাদায় লোহিত সাগরের গভীরে। লাক্সরে নীলনদের পশ্চিম পাড়ের উর্বর ভূমি আর আকাশে হট এয়ার বেলুন লাক্সর বন্দর থেকে বেরিয়ে নীলনদ পার হয়ে আমরা এলাম পশ্চিম তীরে। কারণ প্রাচীন মিশরে মৃত্যু পরবর্তী অধ্যায়ের জন্যে পশ্চিম দিকই বরাদ্দ ছিল, যেহেতু আমুন অর্থাৎ সূর্যের দেবতার উদয় হয় পূর্বে আর অস্ত পশ্চিমে, সেইমতো ইহজীবনের তরী পূর্ব থেকে পশ্চিমে বইবার পর মৃত্যুর পরের জীবনের সূচনাও হয় পশ্চিমে। রাস্তার দুপাশে সবুজ ফসলের ক্ষেত আর দূর থেকে আকাশে হট এয়ার বেলুন-এর ওঠানামা দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম কলোসি অব মেমনন-এ। চতুর্দশ শতকে তৈরী ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের সমাধিমন্দির এটি। কিন্তু প্রবল ভূমিকম্পে বহুযুগ আগেই পুরো মন্দিরটিই প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। সমসাময়িক প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে বড় মন্দির ছিল এই মন্দির, এমনকি কার্নাকের মন্দির বা রামেসিয়াম-এর চেয়েও বড়, কিন্তু আজ দুটি আধভাঙ্গা দৈত্যাকার তৃতীয় আমেনহোটেপের প্রস্তরমূর্তি ছাড়া কিছুই তেমন অবশিষ্ট নেই। এই দুটি মুর্তি ছিল আসল মন্দিরের প্রবেশদ্বারের দু-পাশে। এগুলির উচ্চতা প্রায় ষাট ফুট। এদের পিছনে আরও দুটি মুর্তি দেখা গেল মন্দিরের জমিতে, সেগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। এর ঠিক পিছনেই দূরে দেখা যায় ভ্যালি অব দ্য কিংস এর পাহাড়। মূর্তির পায়ের দুপাশে রাণী টিয়ে আর রাজমাতার ছোটো মূর্তি। আর পাশের দিকে সেই নীলনদের দেবতা হাপির প্রচলিত রিলিফ খোদাই করা। এই সমাধি-মন্দিরের বহু মূর্তি এবং অন্যান্য ভাস্কর্য এখনও উদ্ধার করার কাজ চলছে। এই কলোসি অব মেমনন এর কাছেই হট এয়ার বেলুন থেকে ফিরে আসা আমাদের দলের বাকি পর্যটকরা মিলিত হলেন। কলোসি অব মেমনন - পিছনে আরও দুটি আধভাঙ্গা মূর্তি দেখা যাচ্ছে পায়ের কাছে রাণী টিয়ের মূর্তি পাশ থেকে, আর হাপির রিলিফএখান থেকে বেরিয়ে ভ্যালি অব দ্য কুইনস-কে বাম পাশে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম ভ্যালি অব দ্য কিংস-এর দিকে। পথে ডান পাশে দেখতে পেলাম রামেসিয়াম। ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস-এর সমাধিমন্দির। ভ্যালি অব দ্য কিংস-এর সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁর দেহ এই মন্দিরে রাখা হয়েছিল। এখন অবশ্য ভগ্নাবশেষ শুধু। বড় বড় থাম আর যথারীতি তাদের সামনে ফারাও-এর বিশালকায় মূর্তির ভগ্নদশা দেখা গেল।  কিছুদূর এগিয়ে আমাদের বাস বড় রাস্তা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত ছোটো রাস্তা ধরল, পাহাড়ের গা বেয়ে, এর নাম কিংস ভ্যালি রোড।  ভ্যালি-তে পৌঁছে পার্কিং এ নেমে নিরাপত্তা বলয় পার হয়ে একটি ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে ব্যাটারী-চালিত গাড়িতে আট থেকে দশজন করে পর্যটক-কে পাহাড়ি গলিপথ ধরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সমাধিক্ষেত্রগুলির সামনে। ভ্যালি অব দ্য কিংস-এ এখনও অবধি ৬২ টি উল্লেখযোগ্য সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে ছোটো এবং সবচেয়ে বিখ্যাত সমাধিটি হলো ফারাও তুতানখামুনের। এখানে বলে রাখি, মিশরের সব মন্দিরের টিকিটের মূল্য মোটামুটি ২০০ থেকে ৪৫০ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড। ভ্যালি অব দ্য কিংস-এর বাকি সব সমাধি একই টিকিটে দেখা গেলেও তুতানখামুনের সমাধির টিকিট আলাদা। সামাহ আমাদের তাই দুটো টিকিট ধরিয়ে দিয়েছিল প্রত্যেক-কে। এখানে প্রতিটি সমাধিক্ষেত্র-কে নাম দেওয়া হয়েছে ‘KV 1’ থেকে ‘KV62’ পর্যন্ত, কে ভি অর্থাৎ কিংস ভ্যালি। রামেসিয়াম-এর ভগ্নাবশেষ রামেসিয়াম-এর ভাঙা মন্দিরের কিছু অংশ  ভ্যালি অব দ্য কিংস-এর পথে - ব্যাটারি-চালিত গাড়ি  ব্যাটারি গাড়িতে চড়ে দুপাশের পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার চলার পর আমরা মূল সমাধিক্ষেত্রগুলোর কাছে পৌঁছোলাম। দ্বিতীয় রামেসিস-এর সমাধিক্ষেত্র অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ রয়েছে, পর্যটকদের জন্যে আর কখনো খুলবে কিনা জানা নেই,  তাই আমরা প্রথমে প্রবেশ করলাম ফারাও চতুর্থ রামেসিস-এর সমাধিক্ষেত্রে। চতুর্থ রামেসিস ছিলেন বিশতম রাজবংশের তৃতীয় ফারাও, কিন্তু অকালমৃত্যু হওয়ার কারণে তাঁর রাজত্বকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, সাড়ে ছয় বছরের। যেটুকু  পড়েছি বা শুনেছি প্রাচীন মিশরে শিশুর জন্ম আর মৃত্যু দুয়ের-ই হার ছিল অনেক বেশী, এমনকি অকালমৃত্যুও সংখ্যায় অনেক বেশী; এবং সে জিনিসে রাজা-প্রজায় ভেদাভেদ ছিল না। দেখে মনে হয় পুষ্টিজনিত সমস্যা লেগে থাকত দেশে। ফারাওদের তো কোলেস্টেরল আর দাঁত-মাড়ির সমস্যা ছিল-ই, এন এম ই সি-তে মমি দেখার সময় সেসব বলেছি। এখানে সবকটি সমাধিক্ষেত্রেই লম্বা টানা দালান  পেরিয়ে যেতে হয় মূল সমাধিগৃহে। পুরোটাই পাহাড় কেটে বানানো। আর দালানের দুপাশের দেওয়ালে হায়রোগ্লিফ লিপি আর রঙিন ছবির দুর্দান্ত সমাহার! কোথাও কোথাও নষ্ট হয়ে গেছে রঙ, কোথাও এখনও অটুট। শুধু বুক অব দ্য ডেড নয়, এখানে প্রাচীন বিভিন্ন স্ক্রোল-এর বিবরণ আর ঘটনা  থেকে নেওয়া হয়েছে অসংখ্য ছবি ও রিলিফ, ফারাও-এর নিজের জীবনের ঘটনা তো আছেই। এগুলি হলো বুক অব নুত, বুক অব দ্য নাইট, বুক অব দ্য আর্থ, বুক অব দ্য গেট এরকম আরও কিছু। তুতানখামেনের সমাধি বাদ দিলে বাকি অধিকাংশ সমাধিক্ষেত্রের ভিতরের কারুকার্য প্রায় ষাট শতাংশ একইরকম।  এখানে প্রথম দেখলাম ‘আপেপ’ এর ছবি। আপেপ হল প্রাচীন মিশরের সর্পদেবতা, ইনি হলেন সূর্যদেবতা রা-এর পরম শত্রু।  সূর্য পশ্চিমে অস্ত যাওয়ার পরে, মাটির নীচে সূর্যদেবতা রা-এর যাত্রা শুরু হয় পশ্চিম থেকে পূর্বে নৌকো বেয়ে। তখন তাকে বাধা দিতে আসে এই আপেপ। আপেপ-কে প্রতি রাতে রা যুদ্ধে হারিয়ে দিলে তবেই পূর্বে পরের দিন সূর্যের উদয় হয়। প্রতিটি দরজা বা ছাদে নেখবেত-এর ছবি, চতুর্থ রামেসিস-এর কার্তুশ এসব তো আছেই, সঙ্গে দেওয়ালের পর দেওয়াল জুড়ে হায়রোগ্লিফের গ্রাফিটি, দেবদেবীর ছবি, পরপারের নৌকো, ফারাও-এর রাজ্যাভিষেক, জীবনের গল্প এইসব। কত সময় আর যত্ন নিয়ে এই সমাধিকক্ষগুলি বানানো হয়েছিল ভাবলে অবাক হতে হয়! আর যে শিল্পীরা এই নির্মাণকার্যে নিযুক্ত থাকতেন তাঁদের রাখা হতো এই ভ্যালি অব দ্য কিংস-এর পাশেই দাইর-এল-মাদিনা নামে একটি গ্রামে। একমাত্র সোবেক ছাড়া প্রায় সব দেবদেবী যাঁদের কথা তৃতীয় পর্বে বলেছি, সকলেরই দেখা মিলল এই সমাধিক্ষেত্রগুলিতে। আর একজনের দেখা মিলল, তিনি হলেন আম্মিত। আম্মিতের মুখটি কুমীরের মতো, সামনের দিকের দেহটি সিংহের আর পিছনের দিকটি জলহস্তীর (সুকুমার রায় মিশরের দেবদেবীদের থেকে কোনোরকম অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কিনা কে জানে!)। ইনি উপস্থিত থাকেন যমরাজ ওসাইরিসের সভায়, যখন মৃতের হৃৎপিন্ড ওজন করেন আনুবিস। দেবী মাত-এর মুকুটের পালকের চেয়ে হালকা হলে তো কথাই নেই, কিন্তু ভারী হলেই এই দেবতা আম্মিত হৃৎপিন্ডটি খেয়ে ফেলেন আর মৃতের অনন্ত নরকবাস হয়। চতুর্থ রামেসিস-এর মূল সমাধিকক্ষে সার্কোফেগাসটি বেশ উঁচু, আর সেই ঘরের ছাদ জুড়ে রয়েছে দেবী নুত-এর সেই বিখ্যাত ছবিটি দুবার, পিঠোপিঠি, ঠিক যেন আয়নায় প্রতিফলন একে অন্যের। ভ্যালি অব দ্য কিংস-এর ম্যাপ ও পরিচিতি - জুম করে দেখলে ভালো বোঝা যাবে চতুর্থ রামেসিসের সমাধিগৃহের ছাদ     বারান্দা থেকে অ্যান্টিচেম্বার ও মূল সমাধিকক্ষ - জুম করে দেখলে নুত-এর ছবিটি সমাধিকক্ষের ছাদে বোঝা যাবেএখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম ফারাও মেরেনপিতাহ-র সমাধিতে, কে ভি ৮। মেরেনপিতাহ ছিলেন দ্বিতীয় রামেসিসের বংশধর। পাহাড়ের গায়ে কিছুটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রবেশপথ, তার উপরেই স্কারাব আর আমুন-রা-র ছবি। তারপর লম্বা বারান্দা বা করিডোর, দুপাশের দেওয়ালে অসাধারণ কারুকার্য। ফারাও-এর সঙ্গে রা-হোরাখতির কথোপকথনের একটি প্রায় অটুট থাকা ছবি, আর নেমে যাওয়ার পথ সেই কাঠের পাটাতন ফেলে, মাঝে মাঝে বিট দেওয়া। তবে বেশ কিছু কারুকার্য নষ্ট হয়ে গেছে, মূল গৃহের ছাদেও নুত এর ছবি আর নেই, দেওয়ালে কিছু ছবি এখনও রয়ে গেছে। আর ঘরের ঠিক মাঝে রয়েছে গ্র্যানাইটের উঁচু সার্কোফেগাস, তার বাঁদিকে ফারাও-এর অবয়বের আদলে কফিন। মমিটি অবশ্য এন এম ই সি-তে। মেরেনপিতাহ-র মমিকে অনেকে মোজেসের মমি বলে সন্দেহ করে থাকেন, যেহেতু মমিটি কিছুটা সাদাটে আর ফ্যাকাশে, আগে যেমন বলেছিলাম।  মেরেনপিতাহ-র সার্কোফেগাস মেরেনপিতাহ-র কফিন  মেরেনপিতাহ-র সমাধি থেকে বেরিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য ফারাও তুতানখামুনের সমাধি। সেখানে ঢোকার আগে এবার একটু আসা যাক তুতানখামুনের গল্পে। ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ অর্থাৎ আখেনাতেন-এর মৃত্যুর পর আমার্না (আখেনাতেনের নির্মিত রাজধানী) এবং গোটা মিশরে কিছুটা অরাজকতা দেখা দিয়েছিল, বেশ কয়েক বছর (প্রায় সতেরো বছর) উত্তরাধিকার নিয়েও চলেছিল সমস্যা, যার প্রধান কারণ ছিল ফারাও-দের আকস্মিক অথবা অকালমৃত্যু। হ্যাৎসেপশুট রাণীদের ফারাও হয়ে ওঠার যে দরজা খুলে দিয়েছিলেন, সে-দরজায় নেফারতিতি প্রবেশ করেছিলেন, আখেনাতেনের সহশাসক হয়ে, তিনি ছিলেন ফারাও-এর সম-মর্যাদাসম্পন্না। তাঁদের কন্যা নেফার-নেফেরু-আতেন এরপর হলেন ফারাও। কিন্তু সে মাত্র বছর তিনেক, তারপর হাতবদল হয়ে ক্ষমতা যায় তাঁদের জামাই স্মেনখেরের হাতে। আর এক বছরের মধ্যে দুই ফারাও-এর মৃত্যু ঘটলে (মৃত্যু বা কিভাবে সিংহাসনের হাতবদল হলো তা নিয়ে সংশয় আছে) নয় বছরের বালক তুতানখামুন বসলেন সিংহাসনে। আখেনাতেনের দুই প্রধানা মহিষী ছিলেন, প্রথমা স্ত্রী কিয়া, যিনি ছিলেন তাঁর সহোদরা, দ্বিতীয়া নেফারতিতি। আখেনাতেন এবং কিয়া-র সন্তান ছিলেন তুত-আঁখ-আতেন (আতেনের জীবিত আত্মা)। পরবর্তীতে, মিশরের বিক্ষুব্ধ পুরোহিত এবং ভিজির সম্প্রদায় আখেনাতেনের আতেন পুজো অভিশপ্ত বলে দাগিয়ে দিয়ে দেবতা আতেন-এর জায়গায় দেবতা আমুন পুনর্বহাল হওয়ার পর, সেই নাম বদলে রাখা হলো তুত-আঁখ-আমুন (আমুনের জীবিত আত্মা)। আমি সুবিধের জন্যে তুতানখামুন-ই বলছি। ওদিকে নেফারতিতি আর আখেনাতেনের সন্তান হলেন আনখেসেনামুন। তুতানখামুন তাঁর সৎ-বোন কে বিয়ে করে সিংহাসনে বসে রাজ্যশাসন শুরু করলেন; যদিও নেপথ্যে রইলেন নেফারতিতি এবং তাঁর পিতা (সম্ভবতঃ) ভিজির আই। দুর্বল স্বাস্থ্য ইত্যাদির কারণে যদিও মাত্র সাড়ে নয় বছর পরে তুতানখামুনের মৃত্যু হয়। তুতানখামুনের রাজত্বকাল ছিল আনুমানিক ১৩৩২ খ্রীষ্টপূর্ব থেকে ১৩২৩ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত। মিশরের ইতিহাস বললেই তুতানখামুনের নাম যে অঙ্গাঙ্গী-ভাবে উঠে আসে তেমনটা হওয়ার কথা ছিল না। সাড়ে তিন হাজার বছর আগের বাঘা বাঘা ফারাও-দের পাশে তিনি ছিলেন নিছক-ই এক অপটু এবং বালক ফারাও। কিন্তু তাঁর খ্যাতির মূল কারণ ছিল তাঁর সমাধি পুনরুদ্ধারের গল্প আর সমাধি থেকে উদ্ধার হওয়া সম্পদ। ভ্যালি অব দ্য কিংস-এর খননকার্যের পৃষ্ঠপোষক লর্ড কার্নারভন প্রশ্ন করলেন “Can you see anything?” হাওয়ার্ড কার্টার বলে উঠলেন “Yes, wonderful things!” ১৯২২ এর নভেম্বরে প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার এই সমাধি আবিষ্কার করেন একেবারে অক্ষত অবস্থায়, কে ভি ৬২, এটিই একমাত্র সমাধি বলে মনে করা হয়, যেখানে একেবারেই লুঠপাট হয় নি। তার কারণ হতে পারে বালির আস্তরণে চাপা পড়ে যাওয়া, অথবা বালক ফারাও-এর অভিশাপের ভয়। কাকতালীয়ভাবে এই আবিষ্কারের কিছুদিন পরেই কার্নারভনের মৃত্যু ঘটে, মশার কামড় এবং দাড়ি কাটতে গিয়ে সেই কামড়ের স্থান বিষিয়ে যাওয়ার ফলে, গল্প শুরু হয় ফারাও-এর অভিশাপ ইত্যাদি নিয়ে। কে ভি ৬২-তে ঢোকার আলাদা টিকিট (৪০০-৪৫০ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড)। এখানে প্রবেশপথ থেকে অনেকটা খাড়া নীচে নেমে গেছে সিঁড়ি; এই সমাধিক্ষেত্রের অলিন্দে কিন্তু সেভাবে কোনো কারুকার্য, ছবি বা হায়রোগ্লিফ, কিছুই নেই। দেখে মনে হয় যেন তাড়াহুড়ো করে অযত্ন নিয়ে বানানো। অবশ্য উনিশ বছরের ফারাও কবেই বা তাঁর নিজের সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করবেন! নীচে নেমে লম্বাটে হলঘরের বাঁদিকে শায়িত সেই সুবিখ্যাত মমি। মমি এক্স রে করে নাকি দেখা গিয়েছিল বাঁ-পায়ে সমস্যা ছিল, এমনকি ফারাও-এর মেরুদণ্ডেরও সমস্যা ছিল, যার ফলে ঘাড় ঘোরানো এবং পিঠ সোজা রাখার অসুবিধে ছিল। ম্যালেরিয়ার চিহ্ন-ও পাওয়া গিয়েছিল ডি এন এ-তে।  আর সমাধিক্ষেত্রে পাওয়া বেশ কিছু ব্যবহার্য লাঠি দেখে মনে করা হয় দুর্বল শরীরের তুতানখামুন-কে লাঠি নিয়েই চলাফেরা করতে হত। মমির বাঁ পায়ের পাতা দেখলে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে হয়। এই একটি মমি-ই এখনও ভ্যালি অব দ্য কিংস-এ রয়ে গেছে। এর ঠিক ডানদিকে গেলে আর একটি ঘর, এটি-ই ছিল মূল সমাধিকক্ষ, মাঝে রয়েছে কোয়ার্টজাইট পাথরে তৈরী সার্কোফেগাস, উপরের গ্র্যানাইটের আবরণটি যদিও ভাঙা; এর ভিতরে তিনটি কফিন, সোনার মুখোশ যা ছিল তা আমরা কায়রোতে ইজিপ্সিয়ান মিউজিয়ামে দেখে এসেছি। এই ঘরের চারদিকেই বেশ বড় আকারের কিছু সুন্দর ছবি, আর ঘরের ডানদিকে নীচের দিকে ছোটো একটি দরজা, এর ভিতরেই নাকি ছিল এই সমাধির অমূল্য সব সম্পদ অক্ষত অবস্থায়, এও আমরা সব কায়রোতেই দেখে এসেছি (দ্বিতীয় পর্ব দ্রষ্টব্য)। ছবিগুলোর কথা একটু বলি। পুরো ঘরেই দেওয়াল জুড়ে হলুদ রঙের প্রলেপ, তার উপরেই সব ছবিগুলি আঁকা। ঘরের ডানদিকের দেওয়ালে রয়েছে ফারাও-এর সার্কোফেগাস টেনে আনার ছবি। সামনের দেওয়ালে পরপর তিনটি ছবি; একেবারে ডানদিকে হবু ফারাও আই ‘ওপেনিং অব দ্য মাউথ’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করছেন তুতানখামুনের মমির (ওসাইরিড আদলে)। মাঝের ছবিতে দেবী নুত-কে অভিবাদন জানাচ্ছেন তুতানখামুন; আর বাঁদিকের শেষ ছবিতে দেবতা ওসাইরিস-কে  আলিঙ্গন করছেন তুতানখামুন, তাঁর ‘কা’ অর্থাৎ ইহকালের আত্মা অনুসরণ করছেন পিছনে। বাঁদিকের দেওয়ালে রয়েছে বারোটি বেবুনের ছবি আর সঙ্গে দেবতা রা-এর ‘দুয়াত’ নামে পরকালের পৃথিবীতে নৌকোভ্রমণের দৃশ্য। পিছনের দেওয়াল, যেটি রেলিং-এ বেশ ঝুঁকে দেখতে হলো, সেখানে আনুবিসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তুতানখামুন, তাঁকে অমরত্ব দিচ্ছেন দেবী হাথোর। আর আনুবিসের পিছনে রয়েছেন দেবী আইসিস। তুতানখামুনের সমাধিগৃহের প্রবেশপথ এই সেই মমি  তুতানখামুনের সার্কোফেগাস টেনে আনা হচ্ছে - এই ছবির নীচেই সেই লুকনো সম্পদ রাখা ঘরের প্রবেশপথ (জুম করে দেখলে 'ট্রেজারি' দেখা যাবে)  ভিজির আই (পরবর্তী ফারাও, ডানদিকে) তুতানখামুনের 'ওপেনিং অব দ্য মাউথ' অনুষ্ঠান সম্পন্ন করছেন তুতানখামুন ও দেবী নুত বাঁদিক থেকে - ওসাইরিস , তুতানখামুন আর তার 'কা'  একদিকের দেওয়ালে বেবুন আর নৌকো,আর একদিকে হাথোর , তুতানখামুন , আনুবিস এবং আইসিস (এঁকে ছবিতে ধরানো যায় নি) তুতানখামুনের সমাধিকক্ষ - সার্কোফেগাস-সহ এই সমাধিক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে দুজনেই খানিক থমকে দাঁড়ালাম, ঠিক পিরামিড ছুঁয়ে দেখা পর যেমনটি মনে হয়েছিল, দেখলাম তাহলে! দেখেই ফেললাম! কে ভি ৬২ লেখার সামনে দাঁড়িয়ে যখন ছবি তুলছি, তখনও যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না! কলকাতা মিউজিয়ামে আধা-অন্ধকার ইজিপ্ট-এর ঘরটা যেমন রহস্যে ভরা থাকত, সেই রহস্যের যেন উন্মোচন হলো একেবারে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অংশ, খাস ভ্যালি অব দ্য কিংস-এ এসে, তুতানখামুনের সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে, একেবারে অনির্বচনীয় অনুভূতি! আমাদের জন্যে বরাদ্দ ছিল এই তিনটি সমাধিক্ষেত্র। কিন্তু তখনও দলের অনেকের-ই তুতানখামুনের সমাধিতে প্রবেশ করা বাকি। তাই সামাহ আমাদের উৎসাহ দেখে বলল চট করে রাস্তার ওপারে কে ভি ৬ অর্থাৎ ফারাও নবম রামেসিস-এর সমাধিটাও দেখে আসতে। আর বেরিয়ে আমরা দুজন যেন সোজা ভ্যালি অব দ্য কিংস এর প্রবেশদ্বারের কাছে ফিরে যাই নিজেরা। ততক্ষণে ও বাকি সবাই কে নিয়ে পৌঁছোবে। এখানে বলে রাখি, ভ্যালি অব দ্য কিংস-এ কোনো সমাধিক্ষেত্রেই গাইড ভিতরে ঢোকা নিষেধ। তাই ওই বাইরেই যেটুকু গল্প শোনা আর বাকিটুকু নিজেদের পড়াশোনা। নবম রামেসিস-এর সমাধিক্ষেত্রে ঢুকে তার ছবি আর কারুকাজ দেখে সত্যি মন ভরে গেল। নবম রামেসিস ছিলেন বিংশতিতম রাজবংশের অষ্টম ফারাও। রাজত্ব করেছিলেন প্রায় আঠারো বছর, ১১২৯ খ্রীষ্টপূর্ব থেকে ১১১১ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত। এঁর আমলেই সমাধিক্ষেত্রে লুন্ঠনের কথা প্রথম সামনে আসে এবং অভিযুক্তদের বিচার হয় বলে জানা যায়। এই সমাধিক্ষেত্রের মূল কক্ষটিতে প্রবেশ করা নিষেধ, তুতানখামুনের মতোই, কিন্তু এই ঘরের ছাদে দেবী নুত-এর পিঠোপিঠি ছবি দুটি সবচেয়ে অক্ষত, আর ঘরে সার্কোফেগাস না থাকলেও তার জন্যে খনন করা গর্তটি এখনও বিদ্যমান।      নবম রামেসিস-এর সমাধিকক্ষ - ছাদে নুতের ছবিটি এখানে বেশ পরিষ্কার  এখান থেকে বাইরে এসে দেখি আমাদের দল ততক্ষণে চলে গেছে সামাহ-র সাথে। আমরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে উঠে বসলাম একটি ফিরতি ব্যাটারী-চালিত গাড়িতে। ভ্যালি অব দ্য কিংস-এর হাজার হাজার বছরের ইতিহাস-কে বিদায় জানিয়ে সেই পাহাড়ি উপত্যকা-কে পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম প্রবেশপথের দিকে, সেখানেই আমরা আমাদের দলের সঙ্গে মিলিত হবো।
  • জনতার খেরোর খাতা...
    বাঙালির জাতীয় নববর্ষ উৎসব নিয়ে একটু কথা - Eman Bhasha | ভাষা ও চেতনা সমিতি উদ্যোগে গত ২৬ ধরে সারাদিন জাতীয় নববর্ষ উৎসব উদযাপন হয় আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে রাণুচ্ছায়া মঞ্চে।নাচ গান কবিতা শ্রুতিনাটক নাটক হয়েছে।পথের আলপনা দেওয়া শুরু হয়েছে ১৯৯৯ থেকে।এবারও ছিল।পান্তা ভাত শুঁটকি, মাছভাত আলু পোস্ত খাবার ছিল।আর ছিল আমপোড়া শরবতের আয়োজন।সব মিলিয়ে তিনশোর বেশি শিল্পী অংশ নেন।গণগায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়, মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, কবি জিয়াদ আলী, বাংলাদেশের সাহিত্যিক জাফর ইকবাল, শিল্পী জয়শঙ্কর, মালবিকা চক্রবর্তী, দেবযানী বসু কুমার, সুপ্রিয় চক্রবর্তী, মধুছন্দা তরফদার, হানুফা বানু, মুক্তধারা বসু, বাংলাদেশের প্রাবন্ধিক মোহিদ হায়দার, মিল্টন বিশ্বাস, শিল্পী তৃষা,  আসামের সমাজকর্মী পারিজাত নন্দ, বিশ্বেন্দু নন্দ, অত্রি ভট্টাচার্য প্রমুখ অংশ নেন। নাচে অংশ নেন বর্ধমানের স্পন্দন-এর শিল্পীরা। উত্তরপাড়ার তা থৈ এবং কলকাতার চলন্তিকা।টানা সাড়ে ১২ ঘন্টা চলে অনুষ্ঠান।সকাল আটটার সময় পার্ক স্ট্রিট সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের সামনে থেকে বের হয় বর্ণাঢ্য বৈশাখী শোভাযাত্রা।শেষ হয় রাণুচ্ছায়া মঞ্চের সামনে।তারপর দিনভর অনুষ্ঠান।প্রচণ্ড দাবদাহেও এক মুহুর্ত থামেনি অনুষ্ঠান।ভাষা ও চেতনা সমিতির পক্ষ থেকে সম্পাদক বলেন,  বাঙালিকে কাঙালি বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে।এর বিরুদ্ধে আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই।খাদ্য পানীয় সংস্কৃতি সব রক্ষা করাই এখন জাতীয় কর্তব্য।পুরাতন জামাকাপড় কেচে ইস্ত্রি করে টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে ২০১৫ থেকে।এটাই কলকাতায় প্রথম এধরনের উদ্যোগ।
    বাংলা নামফলক আন্দোলন - Eman Bhasha | বাংলায় নামফলক আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম বিখ্যাত বলে সবাই বলেন, আসলে এই উদ্যোগ নবজাগরণ এবং ভাষা ও চেতনা সমিতির। পরে সুনীলদারা আমাদের অনুরোধে যুক্ত হোন।একটি কাগজ 'বাংলাবাজ দুর্বৃত্ত' লেখার পর সুনীলদা আর আসেননি। পরে টানা একবছর আমরা মাসে দুবার করে অভিযান চালিয়েছি ধর্মতলা পার্ক স্ট্রিট রবীন্দ্র সদন গড়িয়াহাট বেলেঘাটা উল্টোডাঙ্গা শ্যামবাজার কলেজ স্ট্রিট এলাকায়।।গোটা কলকাতা ঘুরেছি লরি ভর্তি করে।২০০৪ এর ১৯ মে শুরু।২০০৫ এর ১৯ মে এই অভিযান শেষ হয়।কলকাতা পুরসভা বিকাশ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে আইন তৈরি করে বাংলা লিখতে হবে।তারপর আন্দোলন থামে।
    হেদুয়ার ধারে - ১২০ - Anjan Banerjee | সাগরের পরামর্শ অনুযায়ী চৈতালির শ্বশুরবাড়িতে চিঠি লিখল অভয় পাল। লিখল যে তার মেয়ে স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চায়, তবে সে যেন নিজে এসে বৌকে নিয়ে যায়।----- ' দেখুন কি বলে ... তারপর ভাবব কি করা যায়। এখানে ওরা আসবে বলে মনে হয় না ... কিছু একটা করবে। দেখুন কি করে ... ' সাগর বলল।সাগর যাবার সময়ে বলে গেল, ' আমরা যাচ্ছি এখন ... কোন দরকার হলে পটলের দোকানে খবর দেবেন ... '----- ' পটলের দোকান মানে ... বিডন স্ট্রিটের মোড়ে ... সাইকেল টাইকেল সারায় .... ওটা ? '----- ' হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই ... '---- ' ওখানে খবর দিলেই হবে ... ঠিক আছে। এখন চললাম ... চল ... 'দুজনে বেরিয়ে গেল। দরজার কাছে চৈতালি তার মা বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।সাগর রাত্রিকে বলল, ' এখন কোথায় যাবে ? 'ঘন্টা দু তিনের মধ্যে দুজনে দুজনের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে।রাত্রি বলল, ' বাড়ি যেতে হবে। বাড়ি ফিরে অনেক কাজ আছে। বাবা ফিরবে এক্ষুণি। তুমি কোথায় যাবে ? '----- ' দেখি কোথায় যাই ... রাস্তায় নেমেছি, রাস্তা যেদিকে নিয়ে যায় ... '----- ' ও বাবা ... হঠাৎ বাউল বাউল ভাব ! বলি, এমন বাউল হয়ে গেলে এত লোককে আগলে রাখবে কে ? '----- ' না না বাউল টাউল না ... বলছি যে রাস্তাই তো রাস্তা দেখায়। আমার কি যাবার জায়গার কোন ঠিক আছে। মানুষ যেদিকে টানে আমায় সেদিকেই যাই ... '----- ' হমম্ .... কিছুটা বুঝলাম মশাই ... পুরোটা নয়। আর বুঝবই বা কি ? তুমি তো এক মহাসাগর ... এখনও তো ডুবই দিতে পারিনি ... '----- ' এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করে ফেলছ ... আমাকে লোকে গুন্ডা বলে তা জান ? 'রাত্রি দ্রুত উত্তর দিল, ' অবশ্যই জানি। আবার এটাও জানি বহু মানুষ তোমাকে দেবতা মানে। এটা জান তো ... '----- ' কি যে সব বল ... ওসব ফাঁপা কথা। কোন মানেই হয় না। আমি আবার একটা মানুষ ... '----- ' আমি বলছি না গো ... লোকে বলছে ... হ্যাঁ সত্যি লোকে বলছে .... তাদের কেউ বলতে বলেনি ... নিজেরাই বলছে। সাধারণ মানুষের কথা তুমি ফেলে দেবে কি করে ? 'সাগর রাত্রির পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।সাগর আর রাত্রি হাঁটতে হাঁটতে রঙমহল পর্যন্ত এসেছে। রঙমহলে আজ বোধহয় দুটো শো আছে। হলের সামনে বেশ জমজমাট পরিবেশ। এখনও মনে হয় টিকিট বিক্রি চলছে। দুজনে ভিড় কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল রূপবাণীর দিকে। এমন সময়ে একটা ব্যাপার ঘটল। এমন কিছু ঘটনা নয় অবশ্য। রাস্তাঘাটে আকছারই ঘটছে। লোকজনের এসব গা সওয়া হয়ে গেছে। কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় না। কিন্তু কেউ কেউ মাথা ঘামায়।দুই তরুণ তরুণী, মনে হয় কলেজের ছেলেমেয়ে, ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকাওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে আলুকাবলি খাচ্ছিল। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে মশগুল ছিল। এরমধ্যে ওদেরই বয়সী তিনটে গাট্টাগোট্টা ছেলে ওদের দুজনের মধ্যে ঢুকে পড়ে বলল, ' একটু মেরে দাঁড়ান ... মেরে দাঁড়ান ... অত মস্তি ভাল না ... ' বলে একজন ওদের দুজনের মাঝখানে ঢুকে পড়ে মেয়েটার গায়ে হাল্কা ধাক্কা মারল। ব্যাপারটা আচমকা ঘটায় মেয়েটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ' ননসেন্স ... 'ধাক্কা মারা ছেলেটা মেয়েটার প্রায় মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ' কি কি কি.... আর একবার বল তো সোনামণি... 'মেয়েটার সঙ্গী রুখে দাঁড়াল।---- ' অ্যাই অ্যাই ... কি হচ্ছে কি ? অসভ্যতার জায়গা পাওনি ? খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু ... 'ছেলেটা রোগা পাতলা। রাগে অপমানে তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু গাট্টাগোট্টা ছেলে তিনটের সামনে তাকে অসহায় লাগছিল। মেয়েটার গায়ে পড়া ছেলেটা ঘুরে গিয়ে ' চল হাট ... ' বলে মেয়েটার দুবলা পাতলা বন্ধুর বুকে এক ধাক্কা মারল। ছেলেটা হতচকিত অবস্থায় পিছনদিকে ছিটকে গেল বেশ খানিকটা। পড়েই যেত, একজনের গায়ে গিয়ে পড়ায় মাটিতে পড়ে গেল না। যার গায়ে গিয়ে পড়ল সে ধরে ফেলল তাকে। মেয়েটা ভয়বিস্ফারিত চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল সাহায্যের আশায়। কিন্তু রঙ্গালয়ের সামনে জমায়েত নাট্যপিপাসুরা সব দেখেও না দেখার ভান করে হলের দিকে তাকিয়ে ম্যাটিনি শো ভাঙ্গার অপেক্ষা করতে লাগল। তারা এসব নিত্যনৈমিত্তিক 'ক্যাচাল' -এর মধ্যে ঢুকে এই শীতের সন্ধেয় নিজেদের পরিপাটি মজা অপরিচ্ছন্ন করতে চাইল না।কিন্তু ওই ছেলেটি ধাক্কা খেয়ে যার শরীরে গিয়ে পড়ল এবং পতনের হাত থেকে রক্ষা পেল, ঘটনাক্রমে তার নাম সাগর মন্ডল। সাগরের বাঁ দিকটা পুরোপুরি সুস্থ থাকলেও ডান কাঁধে এখনও চিনচিনে ব্যথা আছে।সাগর রাত্রির পাশে ছেলেটাকে জমা করে দিয়ে বলল, ' এখানে একটু দাঁড়াও ... আমি এক্ষুণি আসছি ... 'মেয়েটার কাছে গিয়ে বলল, ' তুমি ওখানে গিয়ে দাঁড়াও ... 'মেয়েটা ওখানে যাচ্ছিল, এমন সময়ে সেই ঝামেলা পাকানো ছেলেটা বলে উঠল, ' তুই কে রে ... যা যা ... নিজের কাজে যা ... হিরোগিরি করতে আসিসনা ... '----- ' চিন্তা করিস না ... বাঁ সাইডটা ঠিক আছে ... ওটাই যথেষ্ট তোদের তিনটেকে নেবার জন্য ... আরে আরে আমি নিজের কাজই তো করছি ... অত গরম খাচ্ছিস কেন ? 'সাগর একেবারে আদি ও অকৃত্রিম সাগর মন্ডলে ফিরে গেল।একটা ছেলের মাথা সত্যি গরম হয়ে গেল সাগরের কথাবার্তা শুনে। সে তেড়ে এল সাগরের দিকে চোখমুখ পাকিয়ে। লোকজন ইতিমধ্যে উত্তেজক পথনাটিকা দেখার জন্য নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই মনে হয় সাগরকে চেনে।ড্রেনপাইপ প্যান্ট পরা বলিষ্ঠ চেহারার কালোমতো ওই ছেলেটা দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল, ' স্বরূপ খাঁড়ার নাম শুনেছিস তো ... আমরা তার লোক ... তোর বাবার নাম খগেন করে ছেড়ে দেবে ... 'এরপর আর শান্তি বজায় রাখতে পারল না সাগর। তার মাথায় আগুন জ্বলে গেল। সে তিন চার পা হেঁটে গেল দ্রুত পায়ে। চোখের পলক ফেলার আগে তার ভয়াবহ বাঁ হাতের একটা বজ্রের মতো পাঞ্চ গিয়ে আছড়ে পড়ল ছেলেটার ডান চোখের নীচে।প্রায় পঞ্চাশ জন লোক দেখে আঁতকে উঠল, প্রায় পঁয়ষট্টি কেজি ওজনের একটা যুবকের শরীর ছিটকে প্রায় সাতফুট দূরের ট্রামলাইনের ধারে গিয়ে পড়েছে। এরকম অবস্থায় বাকি দুজন সঙ্গীরএগিয়ে আসার কথা তাদের স্যাঙাতের সুরক্ষায়।কিন্তু তারা সাগরের সম্বন্ধে সাঙ্ঘাতিক কিছু আন্দাজ করে নিল এবং পাড়ার তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো হেদুয়ার দিকে ছুটতে লাগল তাদের সঙ্গীকে ভাঙাচোরা অবস্থায় ফেলে রেখে।সে প্রায় মিনিট তিনেক ধরে ট্রামলাইনের ওপর পড়ে আছে। রাস্তায় বাস ট্রাম দাঁড়িয়ে গেছে। আশপাশের জনগন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় উসখুস করছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।এই সময়ে সাগর নিজেই দায়িত্ব নিল রাস্তা পরিষ্কার করার।একটা মিষ্টির দোকান থেকে এক পাত্র জল নিয়ে গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলেটার মাথায় মুখে ঢেলে দিল। তাতে একটু নড়েচড়ে উঠল ও। মুখের ডানদিকটা বিশ্রীরকম ফুলে আছে রক্ত কালচে হয়ে জমাট বেঁধে।সাগর ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে বলল, ' ওঠ ওঠ ... অনেক হয়েছে। যা ঠেকে যা ... তোর বাপকে বলবি চিকিৎসা করিয়ে দিতে। এদিকে যেন আর না দেখি। যা ভাগ... 'বলে ওর পিঠে একটা হাল্কা ধাক্কা মারল। ছেলেটা কোন কথা না বলে টলতে টলতে ওপারের বৃন্দাবন বোস লেনের মধ্যে ঢুকে গেল। দৈহিক বা মানসিকভাবে ওর সুস্থ হতে সময় লাগবে এটা নিশ্চিত।সেই ছেলেমেয়ে দুটো যাদের আলুকাবলি খাওয়া অর্ধসমাপ্ত রইল তারা রাত্রির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রির একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ভাবল, আর একটা শত্রু বাড়ল সাগরের। অন্যের পাপের আর কত গরল পান করবে লোকটা ...ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। অনেকে রঙমহলে ঢুকে গেল। ইভনীং শোয়ের সময় হয়ে গেছে।সাগর এল রাত্রিদের কাছে। মেয়েটা বলল, ' কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব। আগেও দুবার এরকম করেছে আমাদের সঙ্গে। কি উদ্দেশ্য কে জানে ... '------ ' উদ্দেশ্য আর কি ... তোমাদের সফট টার্গেট ভেবেছে নিশ্চয়ই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে আরও অনেকের সঙ্গে এরকম করছে। আর একটা কথা ... উনি কোন ধন্যবাদ পাবার আশায় যুদ্ধে নামেন না। এই ধরণের প্রতিবাদ করাটাই ওনার ব্রত ... 'মেয়েটি বেশ গুছিয়ে বলল, ' হ্যাঁ সেটা খানিকটা বুঝতে পেরেছি। তবু আমাদের একটা ঋণ তো থেকে যায়। যদি কখনও কোন প্রয়োজন হয় দয়া করে দ্বিধা করবেন না। আমার বাবার নাম অ্যাডভোকেট অলোকেন্দু মিত্র। ঠিকানা উনত্রিশ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট ... শ্রীমানি বাজারের কাছে। আমার নাম সুমনা মিত্র। বেথুন কলেজে পড়ি।দুবলা পাতলা ছেলেটা হাতজোড় করে বলল, ' আমার নাম প্রতিবিম্ব। স্কটিশে পড়ি ... আপনার নামটা জানা হল না স্যার ... 'তাকে কেউ 'স্যার' সম্বোধন করতে পারে এটা সাগর আগের মুহুর্ত পর্যন্ত চিন্তা করেনি। সে আস্তে আস্তে তার দ্বিতীয় সত্ত্বায় রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। সে উত্তর দিতে সময় নিতে লাগল এই ভেবে যে তার নামটা সর্বসমক্ষে বলার যোগ্য নাম কিনা।রাত্রির কিন্তু ব্যাপারটা অনুভব করতে অসুবিধা হল না এবং সে কোনও সময়ও নিল না।সে দৃঢ়স্বরে বলল, ' ওনার নাম সাগর মন্ডল ... 'সুমনা আর প্রতিবিম্ব দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকাল।( চলবে )********************************************
  • ভাট...
    commenthummm | ছাগুটা ঘুরেফিরে ডিসিবাবুকে বুলি করার চেষ্টা করে যায়। সাউথিন্ডিয়া  নিয়ে ধ্যাতরামো করতে গিয়ে গুরুজনদের থাপ্পড় খেয়ে কদিন গা ঢাকা দিয়ে আবার উঠেছে।
    commentguru | উনিজির দশবছরের শাসনের অনেক খারাপ দিকগুলো এখানে গুরুতে অনেকে যেইভাবে বলেছেন সেদিকে সম্পূর্ণভাবে আমি একমত | গণতন্ত্রের জন্য হয়তো উনিজির না জেতা টাই উচিত এবারের ভোটে | কিন্তু আমি যে অলরেডি IRFC আর জিওফিনান্সের স্টকে টাকা ঢুকিয়ে বসে আছি উনিজি ২০২৯ পর্যন্ত থাকবেন তাই | কাজেই উনিজি হারলে আমার বেশ চাপ হবে | ডিসি বাবুর মতো বলতে ইচ্ছে করছে যে আমার পোর্টফোলিও আগে বাড়ুক অন্য কিছু আমার দেখার দরকার কি ? 
     
    আচ্ছা আমার মধ্যে এই confusion কাজ করছে বেশ | আমার মন বলছে উনিজি এবার জিতলে হয়তো দেশে গণতন্ত্রের শেষ কিন্তু মাথা বলছে যে আগে তো আমার পোর্টফোলিও তারপর অন্য কিছু ! আমি এখন কি করি বলুন তো আপনারা ? 
    commentহেহে | এসোশুই দাদুর দাঁতের গোড়াতে আবার বিষ জমেছে বুঝি?  ছুবলাতে চলে এসেছে দেখি। তুমি কী করেছ দাদু জিজ্ঞেস করলেই কেন্সারের কান্দুনি গাইবে আবার।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত