এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ইদবোশেখির লেখাপত্তর - গুরুচণ্ডা৯ | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়শীতকাল বইমেলা হইচই-এর দিনকাল ফুরিয়ে এসে গেল শান্ত হয়ে বসে লেখালেখির কাল। বাইরে তাপমাত্রা বাড়ছে রোদ্দুরের জন্য, নির্বাচনের জন্য। সাথে কোথাও প্যাচপ্যাচে ঘাম তো কোথাও ঝরঝর বৃষ্টি। সন্ধ্যের আবছায়ায় দোকানে ভিড় জমায় সারাদিন রোজা রাখা ক্লান্ত মানুষ, গাজনের প্রস্তুতি নেওয়া শ্রান্ত মানুষ, চৈত্রসেলের হাতছানিতে মুগ্ধ মানুষ। টুপটাপ জমে ওঠে গল্পেরা, কবিতারা। নির্বাচনী জনসভার কোণাকাঞ্চিতে, ইফতারির থালার পাশে, গাজনের সন্ন্যাসীর ঝোলায় চুপটি করে অপেক্ষা করে তারা মানুষের জন্য। আমরা আপনাদের কাছে ডাক পাঠিয়েছিলাম তাদের খপ করে ধরে ফেলে, ঝপ করে লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে। এসে গেছে তারা। আগামী কয়েকদিন ধরে রোজ দুটি-তিনটি করে তারা এসে হাজির হবে বুলবুলভাজার পাতায় - টাটকা ভাজা, গরমাগরম। পড়তে থাকুন। ভাল লাগলে বা না লাগলে দুই বা আরো অনেক লাইন মন্তব্য লিখে জানিয়ে দিন সে কথা। মন চাইলে, গ্রাহক হয়ে যান লেখকের। আর হ্যাঁ, আপনিও লেখা নিয়ে চলে আসুন গুরু আর চন্ডালের আড্ডা গুরুচন্ডা৯-র পাতায়।সূচীপত্রঃস্মৃতিচারণবর্ষশেষ, বর্ষশুরু: অমিতাভ চক্রবর্ত্তীও চাঁদ: সেমিমা হাকিমসারেতে থাই নববর্ষ: হীরেন সিংহরায়কাব্যজলের সমাধি: জগন্নাথ দেব মন্ডলগিরগিটি ও অন্যান্য কবিতা: ফরিদাসমুদ্রে সনেট: সোমনাথ রায়পাঁচটি কবিতা: অমিতরূপ চক্রবর্তীতিনটি কবিতা: অরিত্র চ্যাটার্জিউপগ্রহ: অমিত চট্টোপাধ্যায়আব্বু আব্বা বাবা: মাজুল হাসানশেষের কবিতা: দীপ্তেনগপ্পোখুচরো: সুমন মুখার্জীসুফি: আফতাব হোসেন রতন, দ্য ব্যাকবেঞ্চার: নরেশ জানাডাক দিয়ে যায়: এস এস অরুন্ধতীমহারাজ ছনেন্দ্রনাথ ও মার্কণ্ডেয়র চিঠি: রমিত চট্টোপাধ্যায়পাখির অন্তর্ধান রহস্য: মৃণাল শতপথীএই ঘুম শারীরবৃত্তীয়: দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ওয়েথসাম: উপল মুখোপাধ্যায়কোশিশ কিজিয়ে: কিশোর ঘোষালটুনিমুনির জীবন: দময়ন্তীদৌড়বাজ হাউসকীপার: সমরেশ মুখোপাধ্যায়হন্য: সৈয়দ তৌশিফ আহমেদসীমান্তরেখা: প্রতিভা সরকারনভেলাফকির ফয়জুল্লাহ: মুরাদুল ইসলামনিবন্ধ আজ নববর্ষের আখ্যান: সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
    সীমান্তরেখা - প্রতিভা সরকার | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়কলকাতার মানুষজনেরা এইসবের হুজ্জোতির খবর রাখে না। তাদের মন ভুলোবার হরেক চিজ আছে। এইরকম ঝামেলাওয়ালা জায়গায় দুদিনের ছুটি কাটাতেও কেউ আসে না, যতই জাগ্রত তীর্থস্থান হোক না কেন!এটা একেবারেই সীমান্ত-এলাকা, কাঁটা তারের এ পাশে লাল নিশান ওড়া ভ্রামরী দেবীর মন্দির, খুব জাগ্রত জ্যান্ত তীর্থ, ওপাশে সবুজ মাথাওয়ালা গম্বুজ, সোনা পীরের থান। মানত রাখলে নাকি কেউ খালি হাতে ফেরে না। দুপাশেই যতদূর চোখ যায় সবুজ খেত, যার বুক চিরে দৌড়ে চলে গেছে মানুষ সমান কাঁটাতার। ছুঁচলো কাঁটা, খুব শক্ত তার, আর দবেজ। সেই ছুটন্ত তারের লাইন বরাবর রাতবিরেতে বুটজুতোর মসমস, সন্দেহ জাগলেই ঘন ঘন হুইসিলের আওয়াজ। তবে তাতে কী আর কিছু বন্ধ থাকে! যার যা করার সে তাই করে যায়, কাজের মতো কাজকাম চলে, নদীর মতো নদী বহে যায়। শুধু মাঝেমধ্যে কাঁটাতারের এপাশে ওপাশে আচমকা দুম শব্দের সঙ্গে লাশ পড়ে। চাপা আর্তনাদ, দৌড়োদৌড়ির শব্দ। তারপর সব চুপচাপ।অবশ্য দুপারের গ্রামের মানুষের এখন সবই সয়ে গেছে। সবাই ভাগ্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে। তবুও এপারের মানুষকে কেউ গ্রামের নাম জিজ্ঞাসা করলে তারা একটু ঢোঁক গিলে বলে, তাদের নদীর নাম জলেশ্বর, গ্রামের নাম মধুগঞ্জ।নদীর নামটি আগে বলে, কারণ নামটি বড় সুন্দর, বিশ্বের প্রভু দেবাদিদেব মহেশ্বরের আর এক নাম, ধার্মিক মানুষজন কানে শুনেই বড় আরাম পায়। তাছাড়া এই নদীর বোরোলি মাছ খুব সুস্বাদু আর সেই কারণে বিখ্যাত। স্বচ্ছ ঢেউয়ের নীচে বোরোলিরা ঝাঁক বেঁধে চলে, সরু রূপোর পাতের মতো শরীর, জমাট আলোর ছোট ছোট টুকরো যেন জলের ওপর লাফিয়ে ওঠে। সাধারণ হাত-জালেই দেদার উঠে পড়ে তারা। ধরার জন্য বেশি কষ্টও করতে হয় না। গ্রামের নামটিও তো বড় সুন্দর, মধুগঞ্জ, একেবারে সামনের দুটি অক্ষরেই মধুভান্ড উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু মানুষের কন্ঠায় বিস্তর ঠেলাঠেলি করেও সে নামটি আবছা হয়ে বেরোয়, নদীর নামের পরে বেরোয়, কারণ মধুগঞ্জ এখন গরু পাচারের পীঠস্থান। এমনই দুর্নাম তার, যে লোকে ভুলেই গেছে এক কালে ভ্রামরী মন্দিরের খ্যাতিতেই তার খ্যাতি ছিল, পুজো দিতে দূরদূরান্ত থেকে লোক আসত। এখনও একেবারে আসে না এমন নয়।মন্দিরের ভেতর কালো কষ্টি পাথরের ভ্রামরী দেবীর দেড় হাত লম্বা সর্বাঙ্গে মৌমাছি আটকে আছে। পাথরে খোদাই ছোট ছোট উড়ন্ত কীট। কারিগরের কী হাতযশ, এতো যুগ ধরে দেবীপ্রতিমার গায়ে এন্তার তেল সিঁদুর মাখাবার পরও, তাদের ডানার খাঁজখোঁজগুলো কেমন স্পষ্ট বোঝা যায়! ওরা সবাই ভ্রামরী দেবীর পোষ্য। বাস্তবেও যেখানে যতো মৌমাছি, সব্বার ভালোমন্দের জিম্মেদার দেবী স্বয়ং। দেবীর মহিমা অশেষ। নাহলে কী আর এমনি এমনি মন্দিরের সামনে দুখানা রয়েল গাছ দুপাশে উঠে গেছে আকাশের দিকে, সিধে উঠতে উঠতে এক আশ্চর্য টানে ঝুঁকে পড়েছে পরস্পরের দিকে ! শাখাপ্রশাখায় ঠোকাঠুকি হয়ে দুই গাছের মাথা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে কতো যুগ ধরে কে জানে। থোকা থোকা সবুজ টক ফলে ভরে থাকা গাছদুটোকে দিবাকর তো জন্ম থেকেই অমন দেখছে। দুই গাছের গুঁড়ি তেরছা হয়ে থাকার ফলে তৈরি হয়েছে এক অতিকায় ত্রিভুজ, যেন প্রকৃতির নিজের হাতে বানানো তোরণ, ভ্রামরী দেবীর জন্য।আশ্চর্য হবার শেষ তো এইখানে নয়। ঐ রয়েল গাছদুটির প্রায় প্রত্যেক ডাল থেকে ঝুলছে আধখানা কলাপাতার মতো বড় বড় মৌচাক। এতো ঘন ঘন এতো চাক, তাদের ঘিরে মৌমাছিদের ব্যস্ত যাওয়া-আসা, গুনগুন গুঞ্জনে মন্দিরের চাতাল দিনেরাতে মুখর হয়ে থাকে। এ ডাল থেকে সে ডালে, দুটো গাছেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাসা বাঁধে শ্রমিক মৌমাছিরা, মধু এনে জমা করে, তাদের পায়ে জড়ানো হলুদ পরাগও নাকি সদ্যোজাত শিশুগুলির খাদ্য। চাকের অনেক গভীরে ছ' কোণা কোন গুপ্ত প্রকোষ্ঠে পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে মিলিত হবার অপেক্ষায় জেগে থাকে পৃথুলা রাণী মৌমাছি, তার জীবন কেটে যায় বেশি খেয়ে, বেশি পুষ্টি সঞ্চয় ক'রে অগুন্তি সন্তানের জন্ম দিতে দিতে। নিজের শিশুদের যত্নও সে নেয় না, প্রকৃতির কী যে রহস্য, নিষ্কর্মা আজ্ঞাবহ পুরুষদের সঙ্গে আকাশপথে উড়ানের সময় চূড়ান্ত মিলনের জন্যই তার সমস্ত পথ-চাওয়া। প্রায় রোজই দেখা যায় কোনো এক চাক থেকে বেরিয়ে এসেছে মোটাসোটা রাণী মৌমাছি, রয়াল গাছের মাথার ওপর তার স্লথ গতি। আর পেছন পেছন ছুটে বেড়াচ্ছে পুরুষ মৌমাছির দল। তাদের মধ্যে একটিই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হবে, নিষিক্ত রাণিটি শান্ত হয়ে ফিরে আসবে প্রকোষ্ঠে। সন্তানের জন্ম দেবার ধীর অপেক্ষা শুরু হবে। এই যে জীবনপ্রবাহের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে প্রত্যেক চাকের প্রতিটি প্রকোষ্ঠে, বাইরে ঐ গুঞ্জনটুকু ছাড়া কিন্তু তার আর কোনো প্রকাশ নেই, বাতাসে একটি অতিরিক্ত ঢেউয়ের কাঁপনও ওঠে না যেন। একটি মানুষও ফিরে তাকায় না। দু দুটো সমান্তরাল যাপন ধর্মাচরণের সুতোয় খুব পোক্ত ভাবে বাঁধা রয়েছে। দু পক্ষেরই সায় আছে এই সহাবস্থানে।আরও আশ্চর্য, মানুষের লোভের শেষ নেই, তবু ভ্রামরী দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণের মৌমাছিরা অবধ্য। শুধু মন্দিরে নয়, গোটা মধুগঞ্জ গ্রামেই কেউ মৌচাক ভাঙে না, কেউ মধু আহরণ করে না। এখানে বোতলে করে মধু কেনাবেচাও নিষিদ্ধ । সর্দিকাশি বা হালকা জ্বরে মধু দিয়ে তুলসি পাতার রস খেতে হলে বা শীতকালে বুড়ো মানুষের জন্য মকরধ্বজের পুরিয়া মধু দিয়ে মেড়ে নিতে হলে, সদর থেকে মধুর বোতল ব্যাগে লুকিয়ে আনতে হবে। তারপর সবচেয়ে নিরিবিলি জায়গায় সেটিকে সংরক্ষণ করাই নিয়ম। বোতল থেকে মধু ঢালতে হবে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে। মোদ্দা কথা, ভ্রামরী দেবী যেন না দেখেন, তাঁর সন্তানদের তিল তিল করে সংগ্রহ করা অমৃতরস, মানুষ লুটে নিয়ে নিজের কাজে লাগাচ্ছে। তাই মন্দির চত্বরে তো বটেই, মধুগঞ্জের কোথাও মৌচাক ভেঙে মধু নেওয়া হয়েছে, এরকম শোনা যায় না। কখনও কেউ অতি লোভে যদি করেও ফেলে, পরের একমাস জুড়ে গঞ্জ তো গঞ্জ, গোটা জেলাশহরে যেখানে যতো বিপদ ঘটে, তার প্রত্যেকটির কারণ বলে চিহ্নিত করা হয় ঘটনাটিকে। তারপর আস্তে আস্তে সেই স্মৃতি ফিকে হয়ে আসতে থাকে যতদিন না ফের বেপরোয়া মধু লুঠেরারা হানা দেয়।মধুগঞ্জের মৌমাছি আর মানুষেরা কেউ কাউকে ঘাঁটায় না। অনেক যুগ ধরে পারস্পরিক সহাবস্থানের মন্ত্র শিখে নিয়েছে দু পক্ষই। দিবাকর সাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতে যেতে এইসব ভাবে। ভাবতে ভাবতে দেবীমন্দিরকে পেছনে ফেলে জলেশ্বর নদীর দিকে বেঁকে যায়। এদিকে কাঁটাতার নেই, কারণ ওদিক থেকে নাচতে নাচতে আসা নদীটি এখানে এসে ইংরেজি ইউ বর্ণের আকার নিয়েছে এবং একটি প্রাকৃতিক সীমানা-চিহ্ন হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। জলভরা এই ইংরেজি ইউ অক্ষরের চ্যাপ্টা তলার দিকে বা দুই বাহুর ধারে ওপাশটা বাংলাদেশ, এপাশটা ভারত, যা আবার ওপাশে মুখে মুখে ইন্ডিয়া। ঐ ইউ-টুকুই ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত, নাহলে বাদবাকি নদী বিদেশী, যে বিদেশ আবার এককালে এদেশের বহু মানুষের স্বদেশ ছিল। এ এক জটিল ধাঁধা, এইসব ভাবতে ভাবতে, নাকি রোদের তাতে, মাথা ধরে যায় সাইকেল আরোহী দিবাকরের। কিন্তু যেতে তো তাকে হবেই। স্কুল তার প্রাথমিক হলেও নদীর খামখেয়ালি মোচড়ে এই গঞ্জে একমাত্র, তাই গুরুত্বপূর্ণও। কো-এড হাই স্কুল আছে বটে মাইল চারেক দূরে, ছেলেমেয়েরা সেখানে ভর্তিও হয়। তবে কোভিডের পর স্কুলছুটের সংখ্যা খুব বেড়েছে। মেয়েরা বেশির ভাগ বিয়ে করবে বলে একঘেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে, নয়তো তাদের রূপশ্রীর টাকা পেয়ে অথবা না পেয়ে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কড়ার এই, স্কুলে টাকা এলে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অনেক ছেলে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে গেছে, অবরে সবরে বাড়ি আসে, আবার অনেক ছেলে ঘরের খেয়ে গোরু পাচারে হাত লাগিয়েছে। এ লাইনে ঝুঁকি থাকলেও, পয়সা অঢেল। তাই লোভও বেশি।কিন্তু তাই বলে টাপু! অঙ্কে অমন ভালো মাথা, দিবাকরের শিক্ষক জীবনে আর চোখে পড়েছে কি? আর কী ভদ্র ছেলে! যে কোনও দিন, দিবাকরকে গোরুহাটার পাশ দিয়ে যেতে দেখলে টাপু সঙ্গে সঙ্গে গেঁজের টাকা গোণা বন্ধ করে হাতদুটো পেছনে নিয়ে যায়, বলে, "স্যার, ভালো আছেন?" টাকা পয়সা আঙুল গলে পড়ে গেল কিনা সেদিকে মন দেবে কী, মাস্টারমশাইয়ের পা ছোঁয়ার জন্য সে ব্যাকুল!সেদিন সদ্য শোনা একটি কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল বলে তাকে হঠাতই ডাকে দিবাকর, "ট্যাঁপা, এদিক আয় তো একটু। চল ঐখানে গিয়া বসি।"গোরুহাটা যেখানে শেষ, সেইখানে সীমানা আগলে অজস্র ঝুরি নামিয়েছে প্রাচীন বট, তার গুঁড়িতে ছুরি দিয়ে খোদাই করা ছেলেমেয়েদের নাম, সব জোড়া জোড়া, পাশাপাশি, মাঝে যোগচিহ্নের সেতু বাঁধা। নীচে সিঁদুর মাখা ছোট বড় পাথর। তেল গড়িয়ে পড়ছে। ধূপকাঠি জ্বলছে। ধূপের গন্ধমাখা সেই ছায়াতে গিয়ে বসল মাস্টার আর তার একদা ছাত্র। বসেই টাপুকে ধমক, "অমন ছটফট ছটফট করতেছিস ক্যান? হাগা পাইসে নাকি?"এমন অসংস্কৃত প্রশ্ন শিক্ষকের মুখে মানানসই কিনা, ছাত্র সেটাকে সঙ্গত ভাববে কিনা, এইরকম ভাবনা ভ্রামরী দেবীর কৃপায় মধুগঞ্জে কারও নেই। মানুষ ঐ বেগের কাছে সবচেয়ে বেশি অসহায়, তখনই সে সবচেয়ে বেশি ছটফট করে, একথা তো দিনের আলোর মতো সত্যি। তাই এর থেকে ভালো তুলনা আর কী হতে পারে ! টাপু প্রথমে উত্তর দেয় না। তারপর চোখ তুলে মাথার ওপরে সবুজ পাতার চাঁদোয়া দেখে, যেন নিজের নয়, কাকপক্ষীর বিষ্ঠাত্যাগের সম্ভাবনায় সে বিচলিত। শেষকালে আস্তে বলে, স্যার, আপনে তো জানেন সবই, তবু বার বার …!টাপু স্যারকে খুলে বলেছে, তার অসহায়তার কথা, পরিস্থিতির চাপের কথা, তবু মাস্টার বার বার তাকে কেন যে বোঝাতে আসে ! বুঝতে চায় না, এই কাজগুলো উঁচু নদীর ঢাল থেকে খেলাচ্ছলে জলের দিকে গড়িয়ে যাবার মতো। ঠান্ডা কালো জলকে যতো ভয়ই লাগুক, মাঝ রাস্তায় উল্টো বাগে উঠে আসা যায় না। শেষ সীমা অব্দি গড়িয়ে যেতেই হবে, তারপর জল তোমাকে ভিজিয়েই দিল যখন, আর কাপড় রোদে শুকোবার চেষ্টা করে কী হবে! প্রথম বারেই ভয় কেটে যায়, তারপর ভেজা কাপড়েই সারাদিনের খেলা। সারা জীবনের খেলা। যদি না বেঘোরে জীবনটাই চলে যায়।জীবন চলে যাবে, এই ভয় তো প্রতি মূহুর্তের। গভীর রাতে যতটা পারা যায় নি:শব্দে গরুহাটা থেকে লেজ মুচড়ে প্রাণীগুলোর যাত্রা শুরু করিয়ে দেওয়া হয়, অন্ধকার শুঁড়িপথ দিয়ে পালে পালে তারা নদীর কাছাকাছি এসে পড়ে। অনেক দূর দেশ থেকে ট্রাকে ট্রাকে লম্বা পাড়ি দেওয়া জানোয়ারগুলো ক্ষিধে, তৃষ্ণা, পথশ্রমের ধকল সইতে সইতে রোগা হয়ে যায়। শরীরে পুরো তাকত থাকে না, তাই এদিক ওদিক ছোটার কোনো চেষ্টা না করে, তারা শুধু সামনের জাতভাইকে অনুসরণ করতে থাকে অন্ধের মতো। যেন অর্ধচেতন জড়ভরত-প্রায় বিশাল মাংসপুঞ্জ এক। দেশের সীমানা পেরলেই যে পুঞ্জের প্রত্যেকটির মাথাপিছু লাভের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়াবে আট থেকে দশ হাজার টাকা।নদীর কাছে এসে ঠান্ডা হাওয়া আর মিঠে জলের গন্ধে এইবার গোরুগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু ডাকতে পারে না, মুখগুলো সব দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। টাপু আর অন্য রাখালরা গজগজ করে, "এইমাত্র গরুহাটায় জল খাওয়াইসি, দানা খাওয়াইসি, তবু শালাদের নোলা দ্যাখ! বেইমানেরও বেইমান! দাঁড়া, দাঁড়া, দাঁড়ায়া পড় এইখানে।"তারা প্রাণীগুলোকে এইবার বালির চরে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করায়। সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান গরু আর বলদগুলোকে আলাদা করে রেখে, যেগুলোর কপাল জুড়ে আলকাতরা দিয়ে বিশেষ চিহ্ন আঁকা তাদের লেজ মুচড়ে জলে নামিয়ে দেয়। পাচনের বাড়ি মারে, হ্যাট হ্যাট। অবোধ প্রাণীগুলি প্রাণভয়ে সাঁতরায়, যাতে তাদের কেউ এদিক ওদিক ছিটকে না যায় তাই পাশে পাশে সাঁতরায় রাখালরা। ওপাশের উঁচু নদীর ঘাটে জোনাকির মতো ছোট ছোট টর্চ জ্বলে উঠেই নিভে যায়। ওপারের রাখালরা প্রাণিগুলিকে নদী পার করাবে বলে অপেক্ষা করছে। কপালের ওপর টর্চ ফেলে চিহ্ন দেখে কোন ব্যবসায়ীর কোন পাল তা ঠিক করে সোজা খোয়াড়ে পাঠিয়ে দেবে।টাপু জানে, বখেরার পরিমাণে একটু বেশিকম হলেই যে কোনো মূহুর্তে গরম সীসার টুকরো গেঁথে যেতে পারে তার পাঁজরে। বা তার সঙ্গীসাথীদের। তবু সুরাতের ঘুপচি ঘরে ঘাড় হেঁট করে বারো ঘন্টার জরি সেলাই বা চিমটে দিয়ে গয়নার ছাঁচে আমেরিকান ডায়মন্ড বসাবার কাজ তাকে টানেনি। কেরালায় কন্সট্রাকশন লেবার হয়ে যেতে পারা তো মন্দের ভালো। ওরা ভালো টাকা দেয়, মানুষের মতো ব্যবহার করে, একপাল গরু ভাবে না। তবু টাপুর অঙ্ক-বোঝা সাফ মাথা অনেক টাকার হিসেব ক্যালকুলেটর ছাড়াই নির্ভুল মিলিয়ে দিয়ে যে উত্তেজনা বোধ করে, তা গরু পাচার ছাড়া আর কোনো কাজে সে পায়নি। পুলিশের পকেট, বিএসএফের পকেট, নেতাদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট সব ভরেও তারপর নিজের রাখালদের জন্য শতকরা কতো লাভ হল, নিজে ঘরে কতো নিয়ে যেতে পারল, নিখুঁত সেই অঙ্ক কষে ফেলে টাপুর এমন আনন্দ হয়, যে সারা গায়ে লোমকাঁটা ফুটে ওঠে। গরীবের ছেলে তো সে বটেই। বাবা নেই। মা পরের বাড়ি বাসন মেজে ছেলেকে বড় করে তুলেছে। কিন্তু সেটাই সব নয়, এই কাজের আঙ্কিক নির্ভুলতা, ভুল হলে বিশাল বিপদের ঝুঁকি, বিপুল লাভের পরিমাণ, তাকে কঠিন উত্তর মেলাবার জন্য ক্রমাগত উত্যক্ত করতে থাকে। কিছুদিন দূরে থাকার পর আবার সে বুক বাজিয়ে ফিরে আসে গরু পাচারে।"তা স্বাস্থ্যবান গরুগুলারে আলাদা কইরা কী করিস?" দিবাকর অন্যমনস্ক ছাত্রকে খোঁচায়, "আলাদাই বা করিস ক্যান?"এই মানুষটাকে টাপু বিশ্বাস করে সব কথা বলতে চায়। তাতে যেন তার খারাপ কাজের প্রায়শ্চিত্ত হবে, এইভাবে অপরাধী চোখ নীচু করে সে বলে, "বলি স্যার, বলি, কাউরে কইবেন না যেন।" তারপর অনর্গল উজাড় করে দিতে থাকে তার ব্যবসার গোপন কথা।এই বাছাই গরুগুলো অন্য পাচার হওয়া গরুদের মতো অসুস্থ বা বুড়ো নয়। বিয়োনো বা চাষবাসে সাহায্য করার ক্ষমতা হারানোও নয়। হয়ত দালাল বেশি লাভের আশায় তাদের কিনেছিল, কিম্বা গ্রামের গেরস্তবাড়ির গোয়াল ঘর থেকেই উঠিয়ে নিয়ে এসেছে রাতের অন্ধকারে। গরুচোরেরা সব রাজ্যের সীমান্ত বরাবর প্রত্যেকটি গ্রামে ভয়ংকর সংগঠিত এবং সক্রিয়। এই পশুগুলি স্বাস্থ্যবান, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, নরম তাজা মাংসল ভীরু প্রাণী, সীমান্ত পেরুলেই একেকটার দাম ওঠে দেড় লাখ, দুলাখ। তাই এদের জন্য সুপার স্পেশালিটি ব্যবস্থা। প্রথমে এদের প্রত্যেকের শিঙ-এ নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা হবে প্লাস্টিক-মোড়া অল্প দামের চাইনিজ মোবাইল। তাতে সেভ করা থাকবে আলাদা আলাদা রিং টোনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ওপারের ব্যবসায়ীদের আলাদা আলাদা নম্বর। জলে নামানোর পর এদের দেহের চারদিকে বেড় দেওয়া হবে মোটা সবুজ কলাগাছ দিয়ে, যেন চৌকো ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে দু/তিন লাখি মালগুলোকে। ওপারের রাখালরা কোমর জলে নেমেই থাকে, ভেলাগুলো কাছাকাছি এসে গেছে দেখলেই তারা মোবাইলে রিং করে। অন্ধকার নদীর ওপর ভাসমান শিঙ-এর মাথায় মাথায় আলো জ্বলে, হরেক গান বাজে। নির্দিষ্ট সুর শুনে পয়সার মাল ঠিকঠাক চিনে নিতে বড় সুবিধে হয়। একবার অন্ধকার ঢেউয়ের মাথায় টাপু পাশের গরুর শিং-এ বাঁধা মোবাইলের রিং টোন শুনে ফেলেছিল, তু ধার হ্যায় নদিয়া কি / ম্যা তেরা কিনারা হুঁ / তু মেরা সাহারা হ্যায়, ম্যয় তেরা সাহারা হুঁ…ঘোষপাড়ার কল্পনাকে মনে পড়ে তার ভেজা শরীরেও লোম-কাঁটা দিয়েছিল, মনে হয়েছিল, এবারই শেষ, আর এ কাজে নয়!সেসব ফুলটুস কথার বাসা নদীর ঢেউয়ের মাথার ক্ষণস্থায়ী বুদবুদেই। সকালের আলো ফুটলে আর তাদের কারও মনে থাকে না। এখন তাই যেন পরীক্ষার খাতায় সবচেয়ে কঠিন অঙ্কগুলো মিলিয়ে দিতে পেরেছে, এইভাবে স্যারের কোঁচকানো কপালে চোখ রেখে ঠা ঠা করে হাসতে থাকে জোয়ান মদ্দ টাপু, স্যারের আদরের ট্যাঁপা। সবই বলে, কিন্তু একটা কথা সে ভুল করেও স্যারকে বলে না কখনই। ঘোষপাড়ার যাদু ঘোষের মেয়ে কল্পনার জন্য তার পাঁজরের ভেতর লুকোনো অসীম দরদের কথা। মেয়ের এবার হাই স্কুলের পড়া শেষ হবে, তারপর তাকে টাপু মহকুমা শহরের কলেজে ভর্তি করবে, যাতায়াতের জন্য একটি স্কুটার কিনে দেবে। দোহারা চেহারা আর কোঁকড়াচুলো কল্পনা ঘোষেই তার পড়াশুনো শেখার ইতি আবার শুরুও, এইরকম লাগাম-ছাড়া কল্পনার কথা সে কী করে বলে এই পড়া-পাগল মাস্টারকে ! তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায় তাই, "যাইতেসি স্যার, আর থাকন যাইবে না, গরুগুলানরে খোলজল দিবার সময় বইয়া যায়।"মাস্টারও আর ছাত্রকে তার সদ্য শোনা কথাটি সময়াভাবে খোলসা করে বলতে গিয়েও বলতে পারে না। সে কথাটি গত সন্ধ্যায় ভ্রামরী মন্দিরে আরতির সময় তার কানে এসেছে। পড়াশুনো জানা ভালো মানুষ হবার সুবাদে এবং হোমিওপ্যাথি নিয়ে চর্চায় ইদানীং কিছু হাতযশ হওয়ায় বিএসএফ ক্যাম্প থেকে যদু ঘোষের ঘর অবধি সর্বত্র দিবাকরের অবাধ গতিবিধি। সব কথাই তার কানে আসে। তার কাছ থেকে পাঁচ কান হবার সম্ভাবনা নেই জেনেই মানুষ যেন তাকে বেশি করে সব গোপন কথা জানিয়ে যায়।যেমন বিএসএফ জওয়ান পবিত্র কুমার। প্রবল ধার্মিক এই দশাসই চেহারার মানুষটির সঙ্গে মন্দিরে আরতির সময় প্রায়ই দিবাকরের দেখা হয়। আরতি শেষ না হওয়া অব্দি হাত জোড় করে চক্ষু মুদে বসে থাকে পবিত্র কুমার। পঞ্চ প্রদীপ দেবী মূর্তির সামনে ঘোরানোর সময় প্রবল বিক্রমে জয় মাতাদি বলে চেঁচিয়ে উঠেই থম মেরে যায়, যেন আবার ধ্যানস্থ হয়ে পড়ল। মন্দির-ঘেরা ঘোর অন্ধকার ক্রমশ কাছিয়ে আসছে টিমটিমে বালবের আলোকে উপেক্ষা ক'রে, ছমছমে পরিবেশে পুরোহিত ছাড়া আর দু তিনজনই মাত্র ভালো করে পা ঢেকে বসে আছে, পাছে পুরোহিতের ছেটানো পবিত্র শান্তিজল পায়ে পড়ে। আধা অন্ধকারে তাদের মুখ দেখা যায় না, খালি অবয়ব, এইরকম রহস্যময়তার মধ্যে পবিত্র কুমারের আচমকা চিৎকার মাঝে মাঝে যেন শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়। দিবাকরের কলেজে পড়া নবকুমার কপালকুণ্ডলার কথা মনে পড়ে। এখানে সমুদ্র নেই, কিন্তু মন্দিরের পেছনেই ইউ শেপের নদী কুলুকুলু শব্দে বহে যায়। সেখানে কেউ কাঠ কুড়োয় না বটে, তবে জলের ওপর কাঁটাতার থাকে না বলে এই পথেই ইদানিং দেদার গরুচালান চলে। কারা ফিসফাস কথা কয়, মাছের ঘাই মারার মতো সন্তর্পণে বৈঠা চালায়। সব মিলিয়ে খুবই রহস্যময় গা ছমছমে পরিবেশ! পবিত্র কুমার কি মন্দির থেকে ক্যাম্প অব্দি একা যেতে ভয় পায়! রোজই সে দিবাকরকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে যেতে। ভ্রামরী মন্দিরের একেবারে লাগোয়া দিবাকরের বাড়ি। মন্দিরের সীমানার ঠিক পেছনে নদী আর কোনাকুনি সেপাইদের ক্যাম্প। সে অব্দি যেতে বড় জোর দশ মিনিট লাগে। বিয়ে থা করেনি ছেলে, বাড়িতে বুড়ি মা একা, দিবাকর ফিরলে তবে ভাত গরম হবে। তাই তাড়া নেই বলে রোজই সে ডরপোক পবিত্র কুমারের পাশে পাশে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যায় ক্যাম্পের গেট পর্যন্ত, যেতে যেতে নানা গল্পগাছা করে। কখনও পবিত্র ওষুধ বিষুধ চায়। কখনও ছেড়ে আসা হরিয়ালি গাঁও আর বালবাচ্চার গল্প করে। মাস্টারজির মতো নীরব শ্রোতা তার খুব পছন্দের। ক্যাম্পের গেটে পৌঁছে সে জোরে জোরে দিবাকরের হাত ঝাঁকিয়ে হ্যান্ডশেক করে, মুখে বলে থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ।ভুতের ভয়হীন দিবাকরের গত এক বছরের সান্ধ্য রুটিন পবিত্র কুমার সংসর্গে মোটামুটি এইরকমই।তা গতরাতেই মাস্টারজির কাছে দুঃখ করছিল পবিত্রকুমার, ছ' মাসের পোস্টিং-এ এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে বছর ঘুরে গেল, তবু তার আর ট্রান্সফার হল না। এদিকে সীমান্তে গরুচালান নিয়ে পার্লামেন্ট অব্দি কথা গড়িয়েছে। পার্টিগুলো সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে বিএসএফের ওপর। তাই ওপর মহলের চাপ বাড়ছে। শোনা যাচ্ছে আগামীকাল রাত থেকেই শ্যুট এট সাইট অর্ডার ইসু হবে। এদিক ওদিক চেয়ে ফিসফিস করে পবিত্র কুমার জানায়, এটা সঠিক খবর নাও হতে পারে। সাধারণ জওয়ানরা শুধু হুকুম তামিল করেই খালাস। অপারেশন শুরু হবার দশ মিনিট আগে ছাড়া তারা আসল ব্যাপার জানতে পারলে তো! পবিত্রের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, এখন তার আর এইসব ঝামেলা ভালো লাগে না! দিমাগ ঠান্ডা রাখবার কোনো ওষুধের কথা আছে নাকি মাস্টারজির হোমিওপ্যাথি কিতাবে? তাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরতি পথে প্যাঁচার ডাক, শেয়ালের হুক্কাহুয়া, রাতচরা পাখির ডানার আওয়াজ, নদীর ছলাৎছল, কিছুই কানে ঢুকছিল না দিবাকরের। সাইকেল চালাতে চালাতে সে কেবল ভাবতে থাকে টাপুর কথা, তার আরও ছাত্রদের কথা, যারা এই গ্যাং-এ সামিল হয়েছে। তার মনে পড়ে যায় দেড় বছর আগে এক রাতে গুলি চলার আওয়াজ শোনা গিয়েছিল মধুগঞ্জে। বুড়ি মা দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বলেছিল, "এহন তুই বাইরালে আর জেবন্ত ফিরতি পারবি না।"তবুও তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছুদূর গিয়েছিল দিবাকর, দূর থেকেই অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখেছে জওয়ানরা ঘিরে রেখেছে জায়গাটা, কিন্তু তাদের বড় গোল টর্চের আলো পড়েছে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা একটা ছেলের ওপর, সে কেমন যেন ছেতরে পড়ে আছে, একটা পা ঈষৎ ভাঁজ করা, হাতদুটো ছড়ানো, দেখেই বোঝা যাচ্ছে গুলি খাবার সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। ওরই পাশে পড়ে আছে বড় শিংওয়ালা একটা সাদা গরু। তারও ঘাড় মোচড় খেয়ে আকাশমুখো হয়ে আছে। অন্ধকারে আচমকা গুলি চলতে ওটারও পেট ফুটো হয়ে গেছে। নদীর চরের বালি লেগে ছিল মৃত মানুষ, পশু দুইয়েরই রক্তমাখা চামড়ায়। বড় স্টিল টর্চের জোরালো আলোতে এতো দূর থেকেও দেখা যাচ্ছিল লালের ওপর সাদা অভ্রের মতো কুচি কুচি ঝলকানি। ভাগো হিঁয়াসে, আপনা ঘর চলে যানা, আভি, ইসি ওয়ক্ত, জওয়ানদের বিরক্ত চিৎকারে আর সবার সঙ্গে দিবাকরও চলে এসেছিল। কপালের ঘাম আঁচলে মুছতে মুছতে মা ভাত বেড়ে দিচ্ছিল। মরা ছেলেটাকে সে চিনতো না, চারটে গ্রাম ছেড়ে তবে নাকি ওদের বাড়ি, তবুও কিন্তু সে রাতে দিবাকর না খেয়েই উঠে চলে যায়।আবার সেইরকম হবে! এবার কার পালা? কে বলি চড়বে? টাপু? গণেশ? নাকি গাছ থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে একটু জড়বুদ্ধি মতো হয়ে গেছে যে, সেই আসলাম? সারাদিন ভাবতে থাকল দিবাকর। দুপুরে স্কুল যাবার সময় দেখা হলেও টাপুর কাজের তাড়ায় কথাটা বলা হল না। গত সন্ধ্যায় পবিত্র কুমার বলেছিল, আজ রাত থেকে অর্ডার লাগু হতে পারে। হয়েছে নিশ্চয়ই, কারণ আজ ভ্রামরী মন্দিরে পবিত্রকে খুব অন্যমনস্ক লাগল, কথা কম বলছিল, বেজায় গম্ভীর। নাকি মাঝরাত থেকে বেলা বারটা অবদি ওর এমারজেন্সি ডিউটি। দেবীমায়ের আশির্বাদ চাইতে এসেছে। সবাইকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, এই বলে মাথা ঠান্ডা রাখা ওষুধের পুরিয়া চেয়ে নিয়ে সাগ্রহে গলায় ঢেলেই আজ সে প্রথম বার একা একা ক্যাম্পের দিকে দৌড়ল।সব লক্ষণগুলিই প্রতিকূল, তাই আর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। বাহিনীর কাছে নিশ্চয়ই খবর আছে, আজ বিশাল পাল ওপারে চালান হবে। ওবেলা বটের ছায়ায় বসে যে কথা মুখোমুখি টাপুকে সে বলতে পারেনি, এখন তাই-ই বলবে বলে মন্দিরের আরতি ফেরত দিবাকর সাইকেলটা উঠোনে দাঁড় করিয়েই বুক পকেট থেকে ফোনটা তুলে নেয়, "হ্যালো, ট্যাঁপা, আইজ ঘরেই থাক বাবা। হাওয়া খুব গরম। কয় দিন আর নদীর দিকে যাইস না রে।"ওপাশ থেকে চাপা গলা ভেসে আসে, "ক্যান স্যার, আপনে কিসু শুনছেননি? হ, আমিও ট্যার পাইছি, হাওয়া খুব গরম স্যার, শুনসি আইজ গুলি চইলতে পারে, কিন্তু আপনারে তখন কইলাম যে, দুইশ গরু জমা হইছে গরুহাটায়। কলাগাছের ভ্যালা ট্যালা সব রেডি। ঐ পারের রাখালরা সব টর্চ জ্বালাইয়া খাড়াইয়া আছে। এহন কি আর ক্যানসেল করা যায়? দশ মিনিট পরেই আপনাগো বাসার ধার দিয়া আমি, গণেশ আর আসলাম একসাথে নদীর দিকে যাব। যাওনের সময় মা ভ্রামরীরে পেন্নাম কইরা যাব স্যার। দ্যাখবেন আমাগো আর কুনো বিপদ হইবে না।"হায় মা ভ্রামরী, তুমি যে চোরাচালানীদের মা নও, এই অবোধ শিশুগুলো তা জানে না! দিবাকরের মনটা যেন ডুকরে ওঠে। কিন্তু আজ ওদেরকে বাঁচাতেই হবে। দু হাত জড়ো করে দেবীকে প্রণাম করে দিবাকর, তারপর এক মূহুর্তে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নেয়। গলা বন্ধ জামা, লম্বা প্যান্ট সে আগে থেকেই পরে ছিল। মাথায় এবার পরে নিল টুপি, হাতে দস্তানা। গলায় মাফলার। এই গরমে কিম্ভুত লাগছিল তাকে, তা দিবাকর বুড়ি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝল। কথা না বাড়িয়ে সে উঠোনের একপাশে স্তূপ করে রাখা কাঠকুটো থেকে বেছে নিল একটা লম্বা বাঁশ। শক্তপোক্ত, প্রমাণ-সাইজ। তারপর দৌড়ে চলে গেল মন্দিরের দিকে।অন্ধকারে দিবাকরকে দেখাচ্ছিল যেন দন্ড হাতে এক বিশাল প্রেত। নাক মুখ চোখ কিছু নেই শুধু দীর্ঘ একটা সচল ছায়া। এমনকি তার হাতে ধরা বিশাল বাঁশটিকেও গিলে ফেলেছিল রয়েল গাছের নীচের অন্ধকার। সে অন্ধকার খুব জাঁকালো, কারণ জনশূন্য মন্দিরে তখন দেবীর সামনে একটি মাত্র তেলের প্রদীপ জ্বলছে। জনশ্রুতি, সারা রাত ভ্রামরী দেবী নিজেই মন্দিরের দেখভাল করেন। নিজেই সারা রাত সলতে উসকে দিয়ে মূর্তির সামনের প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রাখেন। তাই মন্দির প্রাঙ্গণে আর কোনও রকম প্রদীপ বা ইলেকট্রিকের আলো প্রজ্জ্বলন নিষিদ্ধ। টিমটিমে হলদে বালবটাকেও পুরুতমশাই যাবার সময় নিভিয়ে দিয়ে যান।এ কথা মনে হতেই দিবাকর যেন পরিষ্কার দেখতে পেল, নদীর দিকের বন্ধ দরজা ভেদ করে ভেতরে ঢুকলো একঢাল কোঁকড়া চুলের এক শ্যামলা কিশোরী। নিজের রক্তবর্ণ শাড়িটি সামলে পেতলের প্রদীপে সলতেটুকুকে উসকে দিল, তারপর কোশাকুশির ওপর সোনার কঙ্কণ-পরা হাতখানি ঝেড়ে নিতেই সেই নিটোল হাতের ওপর থেকে দিবাকরের দিকে গুঞ্জন তুলে উড়ে এল অজস্র মধুমক্ষিকা! তার রাত-জাগা চোখ আর উত্তপ্ত মস্তিষ্ক তাকে কতো কী-ই না দেখাবে! দেবীকে দেখার মতো কোন পুণ্য সে কখনও অর্জন করেনি, একথা জেনে দিবাকরের ভক্তি জাগে না, বরং ভয়ংকর এক রাগে তার ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। এইরকমটা বিশ্বাস করতে পারলে তার ভালো হত যে এমন কেউ আজ তার সঙ্গে আছেন, যিনি পাপের শাস্তিতে শুধু মৃত্যু বিধানই করেন না, অসীম আদরে ভালো মন্দ সকলকেই নিজের মধ্যে লগ্ন হবার অনুমতি দেন। কিন্তু বাস্তবে যা দেখেছে সে, তার সবই এই বিশ্বাসের বিপরীতে অবস্থান করে। কেউ কোত্থাও নেই যখন, তখন তিন তিনটে বিভ্রান্তিকে শেষ বারের মতো বাঁচানোর চেষ্টা তাকেই করতে হবে। দরকার নেই তার কোনো দৈবী মহিমা বা লোকবলের। তার দীর্ঘকায় দেহ আর এই মস্ত লম্বা বাঁশ, এই দুইয়ে মিলে মরীয়া শেষ চেষ্টার ক্ষণ নিকটবর্তী হতে থাকে। দিবাকর নিজের বুকের ঢিপঢিপ শোনে, নাকি হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির টিকটিক, তা সে নিজেই ভালো বুঝতে পারে না। তার কান হঠাৎ সেই শব্দ শুনতে পায়, যার জন্য সে এতোক্ষণ চরম উৎকর্ণ হয়েছিল। তার বাড়ির পাশের রাস্তার ঝরা পাতায় মৃদু শব্দ তুলে কারা যেন এগিয়ে আসছে ! এই একই পথ দুভাগ হয়ে বাঁয়ের রাস্তা যায় মন্দিরে, ডাইনেরটা ক্যাম্প থেকে দূরে নদীর যে অংশ, সেইদিকে। কানের পেছনে হাত নিয়ে সে আঁচ করার চেষ্টা করে পায়ের শব্দটা কোনদিকে যাচ্ছে।বাঁয়ে, নির্ভুল বোঝা যাচ্ছে বাঁ দিক পানেই আসছে ওরা, সোজা ভ্রামরী মন্দিরের দিকে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে ওরা তিনজন। একেবারে নি:শব্দে সাবধানী পা ফেলে ওরা মন্দিরের চৌহদ্দিতে ঢুকে এল। রয়েল গাছের আড়ালে লুকিয়ে দিবাকর দেখছে, একটু বাদেই দুজন উঠে গেল মন্দিরের দাওয়ায়, একজন জোড় হাতে নীচে দাঁড়িয়ে রইল। এ নিশ্চয়ই আসলাম। এখানে হিন্দু মুসলমান, সবাই ভ্রামরী দেবীকে সমীহ করে, মেনে চলে। টাপুর বলা কথাগুলো আবার যেন শুনতে পায় দিবাকর, "যাওনের সময় মা ভ্রামরীরে পেন্নাম কইরা যাব, স্যার। দ্যাখবেন, আমাগো আর কুনো বিপদ হইবে না।" এইবার নিজের ভেতরের ক্রুদ্ধ দৈত্যটিকে এক ঝটকায় জাগিয়ে তোলে দিবাকর। বাঁশ ধরা দুই হাত তোলে মাথার ওপরে। তার অতর্কিত আক্রমণে চাক ছেড়ে মুহূর্তে উড়াল দেবে অজস্র মৌমাছি। আক্রান্ত হয়ে তারা ভুলে যাবে বহু যুগের শান্তি, ঘিরে ধরবে কাছেই দাঁড়ানো বিপথগামী টাপুদের, প্রাণ বাঁচানোর জন্য অন্যদিকে দৌড়ে পালাবে ছেলেগুলো। তারা তো আর দিবাকরের মতো আপাদমস্তক ঢেকে প্রস্তুত হয়ে আসেনি। তবু তাদের জন্য মৌমাছির হুল সিসার বুলেটের থেকে নিশ্চিত ভাবে কম বিপজ্জনক।তারপর সেই সচল জীবন্ত কীট-মেঘ মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে গর্জনরত অবস্থায় বেরিয়ে যাবে, ছেয়ে ফেলবে বন্দুকধারীদের ক্যাম্প। চোরাগোপ্তা এই আক্রমণে বিপর্যস্ত হবে তারাও। যারা এক মুহূর্ত পর মানুষ মারার জন্য বন্দুক উঁচিয়ে ধরবে বলে তৈরি হচ্ছিল, তারাই মার ডালা রে বলে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে, টেনে ছিঁড়তে চাইবে গায়ের মোটা উর্দি। নীল ঝকঝকে রাতের আকাশে ছড়িয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু গ্রহ, তারা, এলিয়ে পড়া আকাশগঙ্গা আর নীহারিকা মন্ডলীকে যেন তছনছ করে দেবে এইভাবে দিবাকর মাথার ওপর বাঁশটি তোলে। তার নিশ্চিত লক্ষ্যে থাকে মাথার ওপরের সবচেয়ে বড় মৌচাকটি।
    শেষের কবিতা - দীপ্তেন | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়হলুদ ফুল ছিলো চোখের পাতা ছুঁয়েশহরও আলোময় পাপে ও উত্তাপেসে ছিলো মধুমাস, মেলাতে কত লোককেনো যে স্মৃতিরতি, কেনো যে নীরবতাকেনো যে মনে পড়ে, পাথুরে অবকাশে ও নদী, বহে যাও, গলাও হিমবাহও নদী বহে যাও, ভাসাও পারাবারও নদী বহে যাও, সাগরে মিলে যাও ও নদী, একাকীই আকাশে মেঘ হওফিরো না, চিরদিন সান্দ্র মেঘমালা
  • হরিদাস পালেরা...
    বৈঠকি আড্ডায় ১৩  - হীরেন সিংহরায় | বৈঠকি আড্ডায় ১৩ ভোটাভুটি খরচাপাতি পর্ব ৬ (ভোটে ) যদি লাগে টাকা , দেবে ক্রুপ দেবে থুসেন তখন বার্লিনে জার্মানির ভাবী পরিত্রাতার দুর্বার জয়রথ ছুটে চলে সারা দেশে । মন্ত্রমুগ্ধ জনতা সভায় হাজির হয় তাঁর দুটো কথা শোনার জন্য – তিনি বারবার বলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি জার্মানিকে ফিরিয়ে দেবেন তার গর্ব, ষাট লক্ষ বেকার মানুষকে দেবেন কাজের সুযোগ , দেশ গড়বেন নতুন করে । যুদ্ধে পরাজিত অপমানিত জার্মান জাতিকে দেবেন সামরিক সক্ষমতা । তারা  আবার  মাথা তুলে জগতসভায় দাঁড়াবে।  রাষ্ট্রশাসনের অধিকার পেতে হলে অন্তত ৫০.১% (অথবা ২৯১ আসন) জনমতের সমর্থন চাই । নাৎসি  ভোটের সংখ্যা ও পার্লামেন্টে সিটের সংখ্যা বাড়ে – ১৯২৪ সালে শূন্য আসন, ১৯২৮ সালে সালে ১২টি আসন ১৯৩০ সালে ১৮.৩৩% ভোট , ১০৭টি আসন । ভাইমার সংবিধানের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আইন মোতাবেক গরিষ্ঠতা  অর্জন করা  ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ।  বিশের বেশি দল : অতিবামে কমিউনিস্ট পার্টি  তার একটু ডাইনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল, অতি দক্ষিণে নাৎসি , মাঝে আছে জার্মান জাতীয় দল, ক্যাথলিক পার্টি - তারপরে আছে নানান বর্ণের দল।  নির্বাচনের আগে গঠ বন্ধনের বা নির্বাচনের পরে অন্য দলের হয়ে নির্বাচিত সদস্যকে কিনে নেবার রেওয়াজ নেই। একমাত্র গতি সম চিন্তক বা কাছাকাছি চিন্তক দল গুলির সঙ্গে জোট বাঁধা – কোয়ালিশন সেটাও ধোপে টেকে না, দিন দুয়েক  বাদে ঝগড়া ঝাঁটি শুরু হয়ে যায়।  তখন ফিল্ড মার্শাল রাষ্ট্রপতি হিনডেনবুরগ ফিল্ডে নামেন ।আনুপাতিক নির্বাচনের ঝামেলা থেকে বেরিয়ে দেশের হাওয়া কোনদিকে বইছে বুঝতে চাইলেন পরিত্রাতা আডলফ হিটলার :  ১৯৩২ সালের মার্চে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে  তিনি  ফিল্ড মার্শাল পাউল ফন হিনডেনবুরগের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তার আগে অবশ্য একটা ছোট্ট কাজ বাকি । তাঁর চোদ্দ পুরুষে কেউ জার্মান ছিলেন না, এই পবিত্র ভূখণ্ডে কেউ কখনো বসবাস অবধি করেন নি,  হিটলার স্বয়ং বে আইনি ভাবে । ১৯১৪ সালে যুদ্ধের বাজারে  সালে ব্যাভেরিয়ান সৈন্য বাহিনিতে ঢুকে পড়েছেন সেদিন কেউ কাগজ দেখতে চায় নি । এখন তিনি চাইছেন জার্মান পাসপোর্ট, নইলে দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া যায় না। কাগজে কলমে জার্মান নাগরিকত্ব অর্জন করলেন , বেআইনি ভাবে হলেও জার্মানিতে বাস করেছেন সেই সুবাদে ।  এন আর সি , সি এ এ টাইপের ঝামেলা কি ভাগ্যে তখন জার্মানিতে ছিল না  ।৫৪% ভোট পেয়ে হিনডেনবুরগ বিজয়ী হলেন , হিটলার পেলেন ৩৭% ভোট , কমিউনিস্ট পার্টি,   মরিয়া না মরে , তাঁদের নেতা থলমান পেলেন ১১% ভোট।  এবার উৎসাহিত হয়ে নাৎসি পার্টি লড়ল ১৯৩২ সালের পার্লামেন্ট ইলেকশন – পার্টির নামে নয়,  “ সব ক্ষমতা আডলফ হিটলারকে “ “ এক দেশ এক নেতা “ এই স্লোগানে- পার্টির চেয়ে হিটলার অনেক বড়ো।  তাঁদের এবার  ৩৭% ভোট, ২৩০টি আসন পেয়ে  নাৎসি পার্টি দল কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠ নয় , পার্লামেন্টে কোন আইন পাস করা হয় না;  সম্ভব নয় । কয়েক  বছর যাবত প্রেসিডেন্ট  হিনডেনবুরগ ভাইমার সংবিধানে প্রদত্ত সেই অমোঘ অস্ত্র আর্টিকেল ৪৮ অনুযায়ী ( দেশ চালনা , নাগরিকদের সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষার  প্রয়োজন বোধে রাষ্ট্রপতি ডিক্রি জারি করতে পারেন- পার্লামেন্টের অনুমোদন ব্যতিরেকে ) কাজ সামলাচ্ছেন । চ্যান্সেলর বদলাতে থাকে : সেন্টার পার্টির ভিলহেলম মার্ক্স ( দু বছর , না তিনি সেই  মার্ক্সের আত্মীয়  নন ) , সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের হ্যারমান ম্যুলার (দেড় বছর ), সেন্টার পার্টির হাইনরিখ ব্র্যুনিং (দু বছর ) ,  নির্দলীয় ফ্রান্তস ফন পাপেন (ছ মাস )ফ্রন্ট স্টেজ – ডান দিকের উইং দিয়ে এবার যিনি প্রবেশ করলেন তাঁর নাম জার্মান রাজনীতির ইতিহাসে চিরদিন জড়িয়ে থাকবে আডলফ হিটলার ও নাৎসি অভ্যুদয়ের সঙ্গে।জেনারাল কুরট ফারদিনান্দ ফ্রিডরিখ হ্যারমান ফন শ্লাইখারনির্দলীয় কিন্তু জার্মান পিপলস পার্টি সমর্থিত রাইখসটাগ সদস্য জেনারাল ফন শ্লাইখার পুতুল নাচানোয় হাত পাকিয়েছিলেন ।  যুদ্ধ লড়েছিলেন অফিসে বসে , যুদ্ধ মন্ত্রকের মন্ত্রী হিসেবে।  প্রথমে ছিলেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট কিন্তু তাদের  যুদ্ধ বিরোধী ও শান্তি সন্ধানী মনোভাবের কারণে সে দল ত্যাগ করেন । ভয়ানক ভাবে অ্যান্টি কমিউনিস্ট ; খুঁজছিলেন কোন প্রখর জাতীয়তাবাদী পার্টি যারা ভাইমার সংবিধানকে কলা দেখিয়ে সেনা বাহিনী গড়ে তুলতে সাহায্য করবে  :তিনি ঝুঁকলেন নাৎসি পার্টির দিকে ।১৯৩০ থেকে কোন দলের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই – অশীতিপর  ফিল্ড মার্শাল পাউল ফন হিনডেনবুরগ দেশ চালান ধারা ৪৮ অনুযায়ী; এবার ফন শ্লাইখার মনে করিয়ে দিয়ে বললেন,  মাইন হের  ফিল্ডমার্শাল , আপনার হাতে যে আরও দুটো ধারা রয়েছে !  ধারা ৫৩ অনুযায়ী ইচ্ছেমত চ্যান্সেলর নিয়োগ করতে পারেন , রাইখসটাগ তার বিরোধিতা করলে  ২৫ নম্বর ধারা মাফিক আপনি রাইখসটাগকে ডিসমিস করতেও পারেন । ফন শ্লাইখার কল কাঠি নেড়ে সেন্টার পার্টির চ্যান্সেলর  ব্র্যুনিং,  সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ম্যুলার এবং সব শেষে ফন পাপেনকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিজে চ্যান্সেলর বনলেন – ৩ ডিসেম্বর ১৯৩২ ।  এতদিন পুতুল নাচাচ্ছিলেন এবার বাঘের ওপরে সওয়ার হয়ে বুঝলেন  প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রি দিয়ে এই জানোয়ারকে সামলানো শক্ত ।  তার ওপর নিজের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না । এবারে চেষ্টা করলেন নাৎসি পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করতে।  কিন্তু আডলফ হিটলার নয়, তাঁর সহকারী গ্রেগর স্ত্রাসারকে দলে এনে একটা কোয়ালিশন গড়ে তোলবার ।  তাতে স্ত্রাসারের পার্টি রাজি না হলে কমিউনিস্ট বাদে অন্য পার্টিদের নিয়ে একটা কোয়ালিশন বানানো যাবে মানে থার্ড ফ্রন্ট !   খবরটা কানে আসা মাত্র হিটলার বললেন, সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই বটে কিন্তু আমার দল রাইখস্টাগে বৃহত্তম – চ্যান্সেলর হবার অধিকার একমাত্র আমার।ফন শ্লাইখার হিনডেনবুরগকে বললেন আপনি দফা ২৫ মাফিক রাইখস্টাগকে বরখাস্ত করে নিজেই রাষ্ট্র শাসন করুন না হয় , সংবিধান সে অধিকার তো আপনাকে দিয়েছে।  রণক্লান্ত ফিল্ড মার্শাল বললেন, বার  দুয়েক করেছি  আর সে ঝামেলায় যেতে চাই না । শরীরে কুলোবে না । বরং দফা ৫৩ মেনে কাউকে চ্যান্সেলর বানাতে পারি।  পুতুল নাচিয়ে অভ্যস্ত জেনারাল ফন শ্লাইখার প্রস্তাব দিলেন ‘ তাহলে হের হিটলারকে কাজটা দিন; তাঁর দলের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই। রাইখস্টাগে বিল পাস করাতে গেলে জার্মান পিপলস পার্টির সঙ্গে একসাথে কাজ করতে হবে।  সে দলের নেতা আলফ্রেড হুগেনবেরগ আর আমি হিটলারকে সামলে রাখব ।১৯৩১ সালে প্রথমবার হিটলারের সঙ্গে মিটিঙের পর  থেকে ফিল্ড মার্শাল হিনডেনবুরগ হিটলারকে  ‘ ঐ অস্ট্রিয়ান কর্পোরাল’  , ‘ বোহেমিয়ান কর্পোরাল’  বলে  তুচ্ছ তাচ্ছিল্য এবং তাঁর অস্ট্রিয়ান ডায়ালেকটে জার্মান শুনে হাসি ঠাট্টা করে এসেছেন। হিটলার জনান্তিকে ফিল্ড মার্শালকে বৃদ্ধ ভাম (আলটার ইডিয়ট) আখ্যা দিতে ছাড়েন নি।ছাব্বিশে জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে যখন সাংবিধানিক অনিশ্চয়তা তুঙ্গে  তখনও হিনডেনবুরগ এক মিটিঙে বলেছিলেন , ভদ্রমহোদয়গণ আপনারা নিশ্চয় আশা করেন না যে আমি সেই অস্ট্রিয়ান কর্পোরালের হাতে দেশ চালানোর দায়িত্ব তুলে দেবো ?এবারে গতি না দেখে বললেন, কি দুর্গতি , শেষ পর্যন্ত সেই অস্ট্রিয়ান কর্পোরাল হবে জার্মানির চ্যান্সেলর ?ফন শ্লাইখার অভয় দিলেন তাকে বশে রাখার ভারটা আমার ওপরে ছেড়ে দিন -হিটলার একা শাসন করবেন না, ফন পাপেনকে  ভাইস চ্যান্সেলর ঘোষণা  করুন।   নাৎসি পার্টিকে তিনটে বেশি ক্যাবিনেট পোস্ট দেওয়া হবে না-।  তবে হ্যারমান গোয়েরিঙকে প্রাশিয়ার হোম মিনিস্টার করা বাদে আর  কোন দাবি হিটলার জানাবেন না । আর তিনি চাইলেই বা শুনছে কে ? ।হিনডেনবুরগের দোলাচল চিত্তের  ধন্দ মিটল যখন জার্মান শিল্পপতিরা সরাসরি তাঁকে একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন“ দেশের চ্যান্সেলরের কাজটা এই মুহূর্তে সহজ নয় কিন্তু এই কঠিন সময়ে জার্মান শিল্পসঙ্ঘ হিটলারের পাশে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াবে । “১৯৩১ সালের সাতাশে জানুয়ারি ডুসেলডরফের ইন্ডাস্ট্রি ক্লাবে ফ্রিতস থুসেন যাকে জার্মানির পরিত্রাতা বলে সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন এবং সমবেত শিল্পপতিদের সামনে জার্মানির এক  উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিকে এক সূত্রে বেঁধে দেওয়ার স্বপ্ন যিনি দেখিয়েছিলেন সেই আডলফ হিটলারকে নিঃশর্ত সমর্থন  জানালেন জার্মান বাণিজ্যিক জগতের নেতৃবৃন্দ ।তবে তাই হোক ।সোমবার তিরিশে জানুয়ারি ১৯৩৩:  ছিয়াশি বছরের ফিল্ড মার্শাল রাইখস্টাগে সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রমাণের প্রয়োজন  সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভাইমার সংবিধানের পঁচিশ  নম্বর ধারার বলে কম্পিত হস্তে সই করে অস্ট্রিয়ান  কর্পোরাল আডলফ হিটলারকে জার্মান চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত করলেন ।ভিলহেলম স্ত্রাসের ব্যালকনিতে বিজয়ী নেতা  গ্রহন লাগার আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট  বিশ্ববিদ্যালয় , জুন ১৯৩২ বিশ্ববিদ্যালয় দরজা বন্ধ । এটা কোন ছুটির দিন তো নয় ? খুব বেশি গরম পড়েছে তাই ? না, তাও নয় ।কিছু ছাত্র ব্রাউন নাৎসি ইউনিফরম পরে ক্লাসে আসতে চেয়েছিল ।  রেকটর বলেছেন এটা পাঠাভ্যাসের পুণ্যভূমি,  পলিটিকসের নয় । তৎক্ষণাৎ নাৎসি ইউনিফরম ধারী ছাত্ররা ‘ আমাদের পতাকা উঁচুতে থাকবে’  গান গেয়ে ভাঙচুর শুরু করে।  রেকটর বিশ্ববিদ্যালয়ের দরোজা বন্ধ করে দেন।  দু দিন বাদে খুলতে হয়। । কালক্রমে  হাইডেলবেরগ হামবুর্গ মিউনিক কোয়েনিগসবেরগ মারবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়ে , হানোভার ব্রাউনশোআইগের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ – সর্বত্র একই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হবে ।প্রাশিয়ান পার্লামেন্ট , মে ২৫ , ১৯৩২ এক ন্যাশনাল সোশ্যালিসট ডেপুটি প্রাশিয়ান স্টেট অ্যাটর্নির পদত্যাগ দাবি করলেন – তাঁর অপরাধ ? সেই অ্যাটর্নি কয়েকজন নাৎসি সদস্যকে হত্যার অভিযোগে  দোষী  সাব্যস্ত করেছেন।  এক কমিউনিস্ট ডেপুটি যেই বলেছেন ‘ নাৎসিদের দল তো  খুনিতে ভর্তি’,  অমনি তুলকালাম কাণ্ড । হাতাহাতি মারামারি ভাঙচুর চলল । কারো কোন শাস্তি হয় নি ।  এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকদিন বাদে সেই কাণ্ডের নেতা এক ন্যাশনাল সোশ্যালিসট ডেপুটিকে ভবিষ্যতে পার্লামেন্টে শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব দেওয়া হলো ।শোয়াইডনিতস , ১৯৩২ অস্ত্র নিয়ে হাঁটার অপরাধে পল ক্লিঙ্গেল নামের এক  কমিউনিস্ট পার্টি মেম্বারের পনেরো মাস কারাদণ্ড হলো।জনা দশেক নাৎসি মিলে বাঙ্কাউ গ্রামে বাশি নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করলে বিচারক তাদের বিনা শর্তে মুক্তি দিলেন – বাশি লোকটির চাল চলন সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল।মানহাইম , ১৯৩১ চারজন ন্যাশনাল সোশ্যালিসট বোমা সহ ধরা পড়লে মহামান্য কোর্ট তাদের বেকসুর খালাস করে দেন- তাদের স্বাস্থ্য খারাপ বলে ।বার্লিন,  ১৯৩২ ১৯৩১ সালে চ্যান্সেলর ব্র্যুনিং শান্তি বজায় রাখতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পথ চলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন । কিছু এই অভিযোগে ধৃত কয়েকজন ন্যাশনাল সোশ্যালিসট সদস্যের বিচারে  জার্মান সুপ্রিম কোর্ট ( রাইখসগেরিখট ) যুগান্তকারী রায় দিলেন – কোন মানুষ যদি মনে করেন তাঁরা পথে ঘাটে আক্রান্ত হতে পারেন তাহলে আত্মরক্ষার্থে যে কোন প্রকারের আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করতে পারেন।( আমেরিকান  সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী – রাইট টু ক্যারি আর্মস ভাইমার সংবিধানে তার প্রণিধান ছিল না )বয়থেন, সাইলেসিয়া  ( অধুনা বিটম, পোল্যান্ড ) ১৯৩২ এক কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে খুন করা হলো সাইলেশিয়ার পাবলিক অ্যাটর্নি বারন ফন স্টাইনেকার বিচারকদের প্রতি অনুরোধ জানালেন তাঁরা যেন দু ধরনের অপরাধের পার্থক্য বিবেচনা করে শাস্তি দেন – কম্যুনিস্টরা রাইখের সম্পদ এবং সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়, এই ন্যাশনাল সোশ্যালিসট কর্মীদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষা করা ।নাৎসিদের ক্ষমতায় আসতে এখনও বছর বাকি তখন হাটে বাজারে তিনি  দেখান ম্যাজিক লুকিয়ে চক এবং ডাস্টার কে কত ভোট পেলো তার খবর রাখে কে ? সারা দেশ তখন স্বপ্ন বিক্রেতা এক  জাদুকরের খেলা দেখছে, শুনছে।পার্টি মিটিং ১৯৩২মঞ্চের  প্রশ্ন / জনতার উত্তর আডলফ হিটলার আমাদের কাছে কিসের প্রতীক ?একটি বিশ্বাসের।  আর ?শেষ আশা।  আর ?আমাদের একমাত্র নেতা ! সামরিক ব্যান্ড বাজে । এবার নেতা মঞ্চে উঠে দাঁড়ান।  মিনিট খানেকের  নিস্তব্ধতা । তারপর তিনি বলা শুরু করেন কর্কশ কণ্ঠ, সুর কঠোর ।এক ঘণ্টা , দু ঘণ্টা , চার ঘণ্টাজনতা তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দকে আঁকড়ে ধরে । তাদের নিজস্ব ভাবনা চিন্তা লুপ্ত হয়েছে ।নেতা একবার থামেন । জনতা দাবি করে আরও কিছু বলুন,  আগে কহ আর ।তিনি বলে চলেন , তার খানিক সত্য , বাকিটা  সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ;  কিছু আজগুবি কাহিনি, কিছু অসত্য নাটক ।কখনো তাঁর কণ্ঠে বজ্র নির্ঘোষ , কখনো তিনি দু হাত জোড় করে অনুনয় বিনয় করেন ।কখনো কেঁদে ফেলেন ।তিনি সর্বদা প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন- কমিউনিস্ট , ইহুদি, বিদেশি । তিনি কখনো কোন বিশ্লেষণ করেন না , বিতর্কে যান না। কোন তথ্য , কোন প্রমাণিত সত্য  তাঁর  ভাবনার পথে বাধা হতে পারে না ।  তাঁর  মন্তব্যই  শেষ কথা।  সাধারণ মানুষের খুব কাছে পৌঁছে যান ।  যেন অত্যন্ত গোপন কথা তাঁদের সঙ্গে যেন ভাগ করে নিচ্ছেন , এমন ভাবে বলেন,“ বন্ধুগণ , আমাদের পরিকল্পনা প্রোগ্রাম নিয়ে কোন আলোচনা আমি এখানে করবো না । আপনারা অন্তরে অন্তরে তো  ঠিকই জানেন ক্ষমতায় এলে আমরা কি করবো ।“লক্ষ কি ?এক   বিপক্ষ এবং সকল প্রতিরোধকে  নির্মূলে বিনাশ করাদুই    ভাইমারে তৈরি  সাংবিধানিক বেড়াজাল চূর্ণ করাতিন   এমন এক দেশ গঠন করা যা  হবে হাজার বছর স্থায়ী তৃতীয় সাম্রাজ্য (        থার্ড রাইখ )  আম জনতা সম্মোহিত - হিটলার যখন বলছেন , ভেবে চিন্তেই বলছেন ।  পু: এমন ভাবা সম্পূর্ণ ভুল যে কোন একজন মানুষ জার্মান জাতির ওপরে একনায়কত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন.  জার্মান জাতির বিচিত্রতা গণতন্ত্রের দাবি রাখে - বেনো রাইফেনবের্গ .ফ্রান্কফুর্টার তসাইটুং জানুয়ারি ১৯৩৩  ঋণ  স্বীকারজার্মানি পুটস দি ক্লক ব্যাক                  এডগার মাউরারনাৎসি বিলিওনেয়ারস                         দাভিদ দে ইয়ং  
    যদি ডাকে লিন্ডসে ! - সমরেশ মুখার্জী |  উপরোক্ত ছবিতে তার RV’র (Recreational Vehicle) সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে লিন্ডসে। ওর মতো কিছু Free Spirited Traveler দের পোষ্ট করা এমন সব YT ভিডিও আমি মাঝে মধ‍্যে দেখি। তাদের কেউ সোলো, কেউ স্বামী স্ত্রী, একটি পিতা পুত্রের টিম‌ও আছে। ৪০% কাস্টমস ডিউটি দিয়ে আমদানি করে প্রায় ৩ কোটি টাকা দিয়ে Airstream Atlas Camper বা ১৮ কোটি দিয়ে Earthroamer XV-HD RV কেনার ক্ষমতা কেন - স্বপ্ন‌ও আমার নেই। ভিডিও দেখে দুধের সাধ ঘোলে মেটার কথা‌ নয়। তবু দেখি। সাধ না মিটিলে‌ও আনন্দ হয় দৃশ‍্যসুখে। 4x4 ডজ স‍্যাসীতে Overland Explorer কেবিন ফিট করে লিন্ডসে চার বছর ধরে একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে যেদিকে দুচোখ যায় মোডে। ঐ গাড়িঘরে বাস করেই স‍্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ডের মাধ‍্যমে ও প্রত‍্যন্ত জায়গা থেকেও আপেল ল‍্যাপটপে ওর কনসাইনমেন্ট শিপিং‌য়ের  ব‍্যবসাও চালিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ-দশের ঢ‍্যাঙা লিন্ডসের সংকল্পের তারিফ করতেই হয়। শুরুটা ও করেছিল একটা Airstream compact RV দিয়ে। ডজের পিঠে OE Cabin ফিট করা ওর অভিজ্ঞ হয়ে নেওয়া পরবর্তী পদক্ষেপ।ভাবছি‌লাম লিন্ডসেকে একটা মেল করবো। বলবো আমার‌ও আছে পচুর অবসর আর এমন কাছাখোলা মোডে বেড়ানোর খুব ইচ্ছে। আমাকে ডেকেই দ‍্যাখোনা একবার, মাইনে নয়, পরা নয়, কেবল খেতে দিলেই হবে। গাড়ি‌ও খারাপ চালাই না। ওটা আমার প‍্যাশন। হিমালয়, পশ্চিম‌ঘাটের পাহাড়ে‌ও চালিয়ে‌ছি। কখনো চাইলে - তোমায় একটু রিলিফ দিতে - ধরতে পারি ঐ দুম্বো গাড়ি‌র স্টিয়ারিং। অবশ‍্য‌ ওদেশে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তো আমার নেই। তাই চালাতে পারি বিরান কোনো জায়গায় অফ রোডে - যেখানে লালমুখো কপ এসে খপ করে ধরবে না আমায়। শোবো‌ও না তোমার চলমান ঘরের শয‍্যাকক্ষে। তুমি তোমার আপেল খুলে আঙুল চালিয়ে করবে বাণিজ্য। আমি শোবো ড্রাইভিং কেবিনের পিছনে টানা সীটে। আমি‌ও পাঁচ দশ - না হয় শুতে হবে একটু পা মুড়ে। তাতে কী?  ওভাবে তো একদা ছিলাম দশমাস - মাস তিনেকে কী‌ই বা এসে যায়? এমনি‌তেও মার্কিন অভিবাসন দপ্তর ছমাসের বেশী ট‍্যূরিস্ট ভিসায় ওদেশে থাকতে দেবে না।লিন্ডসের বিচরণ ক্ষেত্র মূলতঃ আমেরিকার পূর্ব উপকূলে। প‍্যাসিফিক ওয়েস্ট কোস্টে থাকে আমার এক অতীত বান্ধবী। অনেক‌দিন হয়ে গেল সে ওদেশে‌র নাগরিক হয়ে গেছে। বহুবার কল্পনায় শুনেছি ওর ডাক - "চলে আয় কদিনের জন‍্য এখানে - থাকবি আমার বাড়ি - শুবি আমার পাশে গেস্ট‌ রুমে। চুটিয়ে ঘুরবো দুজনে আমার MDX Acura SUVতে বা Lexus 350তে। আমার বরটা একটা বেরসিক - থাকবে ও আপেল খুলে কাজে মজে।"কোনো সকালে‌ই সে ডাক আসে নি। তাই যাওয়া‌ও হয়ে ওঠেনি। জীবনে বহু দিবাস্বপ্ন‌ই বাস্তবে সত‍্য হয় না। তা বলে কী কল্পনা‌বিলাসী মানুষ ভাবের ঘোরে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করে দেবে? আমি‌ও দিইনি। বরং আজ‌ও আশায় থাকি, সকাল গড়িয়ে দুপুর চলে গেলেও কেউ হয়তো কখনো ডাক দেবে গোধূলী‌তে - রাত্রি নামার আগে। সে হতে পারে বন্ধু বা পুত্র বা পরিচিত।। যদি আসে লিন্ডসের মতো সম্পূর্ণ অপরিচিত কারুর এমন একটা দিলখুশ করা মেল - আহা তা হবে হাতে চাঁদ পাওয়া।"চলে এসো সৌমেন - ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। যদি পারো হাত লাগাতে ফুটো টায়ার বদলাতে, ছাদে উঠে সোলার প‍্যানেল পরিস্কার করতে, খালি করতে ৪০ কিলোর গ্ৰে ওয়াটার ট‍্যাঙ্ক, মাঝে মধ‍্যে চলঘরের একটু সাফ সাফাই, কিছু DIY যোগাড়েপনা তাহলে তো খুবই ভালো। মনে হয় সুখী টাইপের নিষ্কর্মার ঢেঁকি তুমি ন‌ও - না হলে বুড়ো বয়সে একা একা ব‍্যাকপাকার স্টাইলে ঘুরে বেড়াতে না। এলে যতটুকু পারবে - ততটুকু‌ই সাহায্য করবে। আসবে তুমি ইস্ট কোস্টে - একটু আগে জানি‌য়ে - তখন আমি জর্জিয়া, মেইন, মেরিল‍্যান্ড, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক‍্যারোলাইনা যেখানেই থাকি। খামোখা পশ্চিম উপকূলে একদা বান্ধবী‌র কাছে কদিনের জন‍্য গিয়ে কী করবে? অতীত সুরের সাথে বর্তমান ছন্দ মিলবে না। তাল কেটে মন খারাপ হবে। মনে রেখো It is not wise to travel down the memory lane. Take it easy. Take care, Lindsey" Airstream Atlas 2020  Side Extension feature সহ এটি একটি HiFi আইটেম - তাই ওদেশে এর দাম প্রায় ২.৪ লাখ ডলার - ভারতীয় মূদ্রায় ২ কোটি - ৪০% কাস্টম ডিউটি সহ ৩ কোটি। তবে লিন্ডসে হয়তো শুরু করেছিল কোনো Compact Airstream RV দিয়ে তবে ১৭ লাখ ডলারের Earth Roamer XV-HD RV সম্প্রদায়ের বড়দা। এতে ছজন দিব‍্যি শুতে পারে। দূর্ঘটনা না হলে বিজ্ঞাপিত বলা আছে এর আয়ু  ৯০ বছর। Ford F-750 স‍্যাসীতে 6700 CC / 330 HP / 4x4 ইঞ্জিনের তাকতে ইনি যে কোনো ঋতু‌তে পাঁচপেঁচিদের অগ‍ম‍্য স্থানেও চলে যেতে সক্ষম। দাম কী এর এমনি নিচ্ছে? ভারতে এনাকে‌ই বরণ করতে প্রায় ২০ কোটি খসাতে হবে বলেছিলাম শুরুতে। তবে এতে থাকলে মনে‌ই হবে না আছো  চলমান বাড়িতেরান্না বান্না করে খাও আরামসেবা লিভিং রুমে মজাসে আড্ডা মারো ছ’জনে 
    বৈঠকি আড্ডায় ১২  - হীরেন সিংহরায় | ভোটাভুটি খরচাপাতি পর্ব ৬ (ভোটে)  যদি  লাগে টাকা,  দেবে ক্রুপ দেবে থুসেন ৯ নভেম্বর ১৯১৮ সালে বার্লিনে অনধের নগরী,  চৌপট রাজা ।নৌ বিদ্রোহ বন্দরে বন্দরে , ভিলহেলমসহাফেন , কীল , হামবুর্গ থেকে নৌসেনা হাঁটছেন বার্লিনের দিকে;   মিউনিক এমনকি  বার্লিনের নয় কোয়লন নিজেদের স্বাধীন রিপাবলিক বলে ঘোষণা করেছে -  পার্লামেন্টের  সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতৃত্ব তাদের দাবিতে অনড় , সম্রাটের পদত্যাগ চাই । ৯ নভেম্বর ১৯১৮ সকাল এগারোটায় বেলজিয়ামের স্পা থেকে টেলিফোন বার্তায়  সম্রাট ভিলহেলম তাঁর পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে ট্রেনে চড়ে  নিরপেক্ষ হল্যান্ডের ডুরণ রওয়ানা হলেন ; আর কোন দিন জার্মানিতে পা দেবেন না , বত্রিশ বছর বাদে ভগ্ন মনোরথ সম্রাট সেখানেই ধরণী থেকে  চির বিদায় নেবেন।বার্লিনে রাইখসটাগেরসামনে সমবেত জনতা উত্তাল- এবার তাহলে কি ? পার্লামেন্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট মন্ত্রী ফিলিপ শাইডেমান সমবেত জনতাকে বললেন“ হোহেনজোলারন সম্রাট পদত্যাগ করেছেন । এই দিনটি জার্মান ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে । জার্মান প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক ।এগারোই নভেম্বর এগারোটা বেজে এগারো মিনিটে প্যারিসের সত্তর মাইল উত্তর পূর্বে কম্পিয়েনে এক নির্জন বনের মাঝে টেনে আনা মার্শাল ফখের নিজস্ব ট্রেনের বগিতে জার্মানি  স্বাক্ষর করলো  সন্ধিচুক্তি-  পশ্চিম রণাঙ্গন হলো নিশ্চুপ।  শুরু হলো নভেম্বর বিপ্লব , পুলিশ দফতর দখল, যুদ্ধ ফেরত ফৌজ – ফ্রাইকরপস - বনাম কমিউনিস্ট বিপ্লবী,  স্পারটাসিসট , রোজা লুকসেমবুরগ কার্ল লিবককনেখট – যারা চাইলেন রাশিয়ান স্টাইলে সোভিয়েত গড়ে তুলতে।  খুন কা বদলা খুন মুখোমুখি লড়াইয়ে জিতল সরকারি সেনা; পথে পথে রক্তাক্ত অভিযান । ইতিমধ্যে দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে থাকে পাড়া।  সরকার প্রাগে পলাতক। জানুয়ারি মাসে বার্লিন থেকে নিরাপদ দূরত্বে , ভাইমারে নতুন সংবিধান রচিত হলো , জার্মানির ইতিহাসে গণতন্ত্রের প্রথম অভিষেক – অজানা অচেনা পথে একটা দেশের প্রথম পদক্ষেপ। এতদিন দেশটা চালিয়েছেন অভিজাত সমাজ এবং বনেদী জমিদারবর্গ ( ইউঙ্কার )  সেখান থেকে এসেছেন সেনাপতি , বিচারপতি ,সমাজপতি এবং অনেক শিল্পপতি। ।এখন এই নতুন ব্যবস্থায় প্রধান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ এবারট , তাঁর বাবা ঘোড়ার জিন বানাতেন।গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন এবং সেটি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হিসেবে – ষাট হাজার ভোট পেলে একটি সিট।  ১৯২০ সালর নির্বাচনে ছাব্বিশটি দল , আশি শতাংশ নাগরিক ভোট দিলেন । নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা মানে ৫০.১% ভোট কোন দল পেলেন না – সবচেয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠিত পার্টি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল ৩৮%, আসন সংখ্যা ১০৩ ।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় কোন জার্মান শহর গ্রামের ওপরে বোমা বর্ষণ হয় নি , শত্রু সৈন্য দেখা দেয় নি দুয়োরে। তাবৎ পরিকাঠামো,  রুর এলাকার কয়লাখনি ইস্পাত কারখানা বার্লিনের ব্যাঙ্ক মিউনিকের ব্রুয়ারি হামবুর্গ ব্রেমেনের জাহাজ কারখানা অক্ষত অটুট ।  ডুসেলডরফ কলোন ডরটমুণ্ডের শিল্পপতিরা যুদ্ধে হারান নি কোন সম্পদ কিন্তু বিজয়ী পক্ষ চাইছেন ক্ষতিপূরণ ( রেপারেশন )-সেটা আসবে তাঁদের ট্যাঁক থেকে।  ফ্রান্স বেলজিয়াম তাদের সেনা বসিয়ে রেখেছে রাইনল্যান্ডে , কারখানার দরোজায়, খনির মুখে । দেশে নিরঙ্কুশ অরাজকতা , কমিউনিস্টরা ট্রেড ইউনিয়নকে হাওয়া দিচ্ছে-  আমাদের দাবি মানতে হবে ঝাণ্ডা তুলে হেড অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন বিক্ষুদ্ধ জনতা । এবং স্ট্রাইক!   প্রাশিয়ান আমলে যা  ছিল অকল্পনীয় । দেশ চলত  একটা কঠোর ডিসিপ্লিনের শেকলে -সমাজে কারখানায় অফিসে সকলের স্থান ছিল নির্দিষ্ট।  সবাই তা মানতেন, সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই !  কোন বিকল্প ছিল নাঅন্য দেশের রাষ্ট্রীয় সৈন্য বাহিনী থাকে; প্রাশিয়াতে রাষ্ট্রীয় সৈন্য বাহিনীর একটা দেশ ছিল।*জার্মান শিল্পপতিরা কখনো শ্রমিক নেতার মুখোমুখি বসেন নি , সেটা সামলাত স্থানীয় প্রশাসন -বেতনের দাবিতে কেউ অফিসের সামনে দাঁড়ায় নি , জমিদাররা ভূমিহীন কৃষকদের যেমন ইচ্ছে এমনি মজুরি দিয়েছেন। । যুদ্ধের পরে এই এলোমেলো অবস্থার সুযোগে গড়ে উঠেছে কমিউনিস্ট পার্টি যারা রাশিয়ান কায়দার সোভিয়েত বানাতে বদ্ধ পরিকর।  সেটা ব্যর্থ হল এক বছর বাদে কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি খুঁটি গেড়ে বসল , পার্লামেন্টের ভোটে প্রার্থী দিলো ।  রুর বার্লিনের বিজনেস ম্যাগনেটরা কথা বলবেন কার সঙ্গে?তাঁদের আতঙ্ক কমিউনিস্টরা এবার শ্রেণি সংগ্রাম শুরু করবে , তার মানে শিল্পে অশান্তি, খরচা বেশি , বোর্ডরুমে কমিউনিস্ট কর্মীদের অনধিকার প্রবেশ। তাদের ঠেকায় কে ?  সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকের রক্ষা করেছেন কিন্তু এই আগ্রাসী শ্রমিকদের হাত থেকে শিল্পপতিদের রক্ষা করে কে ?  তাঁরা চান রাজনৈতিক স্থিরতা এবং শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখা-যেটা প্রাশিয়ান সরকার করে এসেছেন। তারই ছত্রছায়ায় জার্মান শিল্প, বাণিজ্য অতি দ্রুত উন্নতি করে দুনিয়ার ঈর্ষা অর্জন করেছে। আজ এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁরা খুঁজছেন একজন বিশ্বাসযোগ্য শক্ত রাজনৈতিক নেতা যার সঙ্গে   এই সফল  ধনী ব্যবসায়ীরা আলোচনায় বসে একটা বন্দোবস্ত করতে পারেন – সার  আপনি আমার কেসটা দেখুন আমি আপনার ব্যপারটা সামলে দেবো। নৈরাজ্য তখন এমন পর্যায়ে যে জার্মানির অন্যতম ধনী ব্যক্তি ফ্রিতস থুসেন ফ্রান্সের নরমান্দিতে তাঁর বাবার কয়লাখনির মালিকানা পাবার অভিলাষে শত্রুদেশ ফ্রান্সের নাগরিকত্ব নিতেও প্রস্তুত।নির্বাচন হয়, কোন দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় না।  কার সঙ্গে হাত মেলাবেন তাঁরা ? এলো অকল্পনীয় মুদ্রাস্ফীতি , আম জনতা হারালেন তাঁদের সঞ্চয় ; কিন্তু রুর মিউনিক বার্লিনের ধনপতিদের  সম্পদ অটুট  তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ গেলেন আমেরিকা- সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যের কি হালচাল ? নতুন নতুন যন্ত্রপাতি , কর্ম মুখর কল কারখানা দেখে চমকিত হয়ে দেশে ফিরে বললেন তাঁদেরও চাই ঐ সব খেলনা ।  কিন্তু তাঁদের স্বার্থ দেখার  ও অর্থ সরবরাহের জন্য কেউ নেই ।এমন সময়ে দক্ষিণ দিক থেকে উদিত হলেন এক অস্ট্রিয়ান নাগরিক , যুদ্ধে কর্পোরাল হয়েছিলেন , দ্বিতীয় শ্রেণির আয়রন ক্রস ঝোলানো থাকে গলায় ।  মিউনিকের পাবে তাঁর বক্তিমে শুনতে ভিড় জমে যায় ( হোফব্রয় হাউসের তিনতলায় সেই হলটি দেখতে পাবেন ) ; তাঁর মতে জার্মানি একটা জেতা গেমে হেরেছে কারণ সৈন্য বাহিনীর পিছন থেকে ছুরি মারা হয় । তার জন্য দায়ী কমিউনিস্ট , ইহুদি ও কিছু চক্রান্তকারী বিদেশি । ৯ নভেম্বর ১৯২৩  শখানেক লোক যোগাড় করে ব্যাভেরিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ব্যর্থ অভ্যুথানের পরে গ্রেপ্তার হলেন সেই নেতা , আডলফ হিটলার । সশস্ত্র রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে পাঁচ বছরের সাজা হয়েছিল ১৯২৩ সালে কিন্তু কোন অজানা কারণে তাঁর রেহাই হল নয়  মাস বাদে ।  তাঁর বহুল প্রচারিত ( এমনকি দুনিয়ার অনেক সংবাদ পত্রে ) বিচার পর্ব হিটলারকে রাতারাতি পরিচিত করাল সারা দেশে । তাঁর পার্টি,  জার্মান শ্রমিক দল  ( ডয়েচে আরবাইটার পারটাই ) প্রথম ইলেকশন লড়ে ১৯২৪ সালে, ব্যাভেরিয়ার বাইরে সম্পূর্ণ অচেনা এই দল পেলো ০.১২% ভোট , আসন শূন্য.  পার্টির নাম বদলাল -  হলো  নাতসিওনাল সোৎসিয়ালিস্তিশে ডয়েচে আরবাইটার পারটাই  সংক্ষেপে নাৎসি ( প্রথম দু  অক্ষর নিয়ে )।  মুদ্রাস্ফীতি ও যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের ঝক্কি কাটিয়ে জার্মান অর্থনীতি দুর্বার বেগে ঊর্ধ্বগামী । হিটলারের অগ্নিগর্ভ বাণী বাজারে কাটে না।  ১৯২৮ সালে নাৎসি পার্টি পেলো মাত্র ১২টি  আসন।  ১৯২৯ সালের অক্টোবরে ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজারে লঙ্কা কাণ্ড লাগলে যে ডিপ্রেশন দেখা দিলো জার্মানিতে তার প্রত্যক্ষ ফল দেখা গেলো ১৯৩০ সালের নির্বাচনে - ১৮% ভোট এবং ৯৫টি আসন পেলো নাৎসি দল । কিন্তু কোন দল সরকার গঠনে অক্ষম – শাসন চলে ভাইমার সংবিধানের সেই ৪৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী – রাষ্ট্রপতির ডিক্রি দ্বারা!  পার্লামেন্ট যখন সিদ্ধান্ত  নিতে অপারগ, রাষ্ট্রপতি হিনডেনবুরগ চ্যান্সেলরের পরামর্শ অনুযায়ী অথবা তা উপেক্ষা করে আপন ডিক্রি মাফিক দেশ শাসন করেন সেই মোতাবেক ।প্রসঙ্গত , যতদূর মনে পড়ে ভারতীয় সংবিধানে এই ধরণের একটি ক্লজ আছে- রাষ্ট্রপতি যুক্তিযুক্ত মনে করলে ( মনে করাটাই যথেষ্ট ) বা প্রধানমন্ত্রীর  পরামর্শ মতন পার্লামেন্ট ভাঙতে পারেন, ছ মাস নিজের  শাসন চালাতে পারেন, নতুন নির্বাচন ফলপ্রসূ নাহলে আবার রাষ্ট্রপতির শাসন ।  এটি কেউ দেখে দিলে কৃতজ্ঞ হব ।বার্লিন হামবুর্গ মিউনিকের পথে পথে লাল পতাকা বনাম সাদা কালো স্বস্তিকার লড়াই চলে ( উৎপল দত্তের ব্যারিকেড নাটকটি স্মরণ করুন) দেওয়াল লিখন দেখে জেনে নিতে হয় কাদের  পাড়ায় আছেন । তফাৎ এই যে কমিউনিস্ট বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল ছেঁড়া খোঁড়া জামা কাপড় পরে  হাতে কেবল পতাকা নিয়ে আওয়াজ তোলে - নাৎসি বাহিনী ব্রাউন ইউনিফরম পরিহিত , হরসট ওয়েসেলের ডি ফানে হোখ ( আমার পতাকা উচ্চে ) গান গেয়ে মার্চ করে লাইন দিয়ে, হাতে লাঠি , কোমরে পিস্তল , যেখানে সেখানে প্রতিপক্ষকে পেটায়, সভা ভাঙ্গে - তাদের উপস্থিতি রীতিমত উচ্চকিত ।লাইপজিগের এক সভায় (১৯৩০) নাৎসি প্রবক্তা গ্রেগর স্ত্রাসার বললেন , আমরা দশটা  আইন পাস করে এই গোলমালের সমাধা করে দিতে পারি – কেউ স্ট্রাইক করলে তাকে গুলি মারা হবে , বাকিরা কোন দেওয়ালের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে চাইবেন না “দেশের এই টালমাটাল অবস্থায় এক সবল কাণ্ডারির খোঁজে ব্যাভেরিয়ার কিছু ধনী মানুষ ইতিমধ্যেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন - যেমন কোবুরগের ডিউক, প্রিন্স হেঙ্কেল ভন ডোনারসমার্ক, ব্যাভেরিয়ান শিল্পসমিতির প্রধান প্রিন্স আরেনবেরগ।১৯৩১ সালে বেশ কয়েকজন জার্মান ব্যবসায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে এলেন- তাঁরা কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থার প্রচণ্ড বিরোধী কিন্তু আশ্চর্য হয়ে  দেখলেন কিভাবে শ্রমিক কৃষকের সেই সরকার শ্রমিক কৃষকদেরই   দাবিয়ে রেখেছে , সেখানে কারো  ঝাণ্ডা তুলে মাইনে বাড়ানোর দাবি করার হিম্মত নেই ।  ঠিক যেমন গ্রেগর স্ত্রাসার বললেন পার্টির নামের ভেতরে সোশ্যালিস্ট শব্দটা আছে বটে কিন্তু সেটা লোক দেখানো মাত্তর।আরও খানিকটা দূর থেকে নাৎসি জয়রথের অগ্রগতি লক্ষ করছিলেন কয়েকজন শিল্পপতি – তাঁরা চান স্টেবল গভর্নমেন্ট এবং এমন কাউকে যার সঙ্গে ইউ ক্যান ডু বিজনেস উইথ ! মহা ধনপতি ফ্রিতস থুসেন জনান্তিকে বলেছিলেন উদার উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্য আছে ,আমাদের ধন সম্পদ বাড়ানোর সুযোগ নেই ; কমিউনিস্টরা আয়ের সাম্য আনতে পারে কিন্তু আমাদের সম্পদের পরিমাণ শূন্যে দাঁড়াবে । ক্ষমতা  যদি কেন্দ্রীভূত হয় আমরা চাইব তার অংশীদার হতে।২৭শে জানুয়ারি ১৯৩১ ডুসেলডরফের হর্ম্য মণ্ডিত ইন্দুস্ত্রি ক্লুবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফ্রিতস থুসেন সমবেত ধনপতিদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমাদের দেশের ভাবি পরিত্রাতার সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই -ইনি আডলফ হিটলার ।লম্বা বক্তৃতা দেবার অভ্যেসটি ত্যাগ করে হিটলার মাত্র দশ মিনিট বললেন । তিনি শুরু করলেন  “অনেকে আমাকে বলেন আপনি  জাতীয়তাবাদী জার্মানির একক ঢোল বাদক । তাই কি ? আজ এক দেশভক্তের মতন আমি এই ঢোল আবার বাজাতে চাই , জার্মানিকে দিতে চাই এক  বিশ্বাস,  সেই  আস্থা যা জার্মানি হারিয়েছে “ ।শেষে বললেন“আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই  একটি  জাতীয়তাবাদী  সরকার । বারো বছর যাবত আমি এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত দলের নেতৃত্ব দিচ্ছি । আমরা এ দেশের রাজনীতির বিশুদ্ধিকরণ করে এমন একটি দেশ ও সরকার গড়ব যেখানে কোন প্রকারের দেশদ্রোহীর কোন ক্ষমা নেই । যদি কেউ আমাদের এই জাতীয়তাবাদী দেশনীতির বিরোধিতা করেন তাদের কঠিনতম  শাস্তি দেওয়া হবে । বন্ধুত্বের হাত যদি কেউ বাড়ান সেটি আমরা সাগ্রহে  গ্রহণ করবো.”  তুমুল করতালি ।ভাবী একনায়কের সঙ্গে শিল্পপতি ও ধনপতিদের সেতু বন্ধনের প্রারম্ভক্রমশ*”Some states have an army, the Prussian Army has a state” Voltaire  আউগুস্ট থুসেন স্ত্রাসে ১ডুসেলডরফ  ফ্রিডরিখ থুসেন (১৮৭৩-১৯৫১ )পিতা আউগুসট থুসেনের ইস্পাত ও খনিজ সাম্রাজ্যের একমাত্র অধীশ্বর ( জার্মানির ৭৫% আকরিক লোহা, দু লক্ষ কর্মী)।  ১৯২৩ সালে হিটলারের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে পাঁচ লক্ষ গোল্ড মার্ক দান করেন  -কমিউনিস্ট পার্টির অরাজকতা থেকে নাৎসি পার্টি জার্মান শিল্পকে বাঁচাবেন এই আস্থায় । পার্টি মেম্বারশিপ নম্বর ২, ৯১৭, ২৯২ । মোহভঙ্গ হতে দেরি হয় নি -ইহুদি এবং ক্যাথলিকদের প্রতি দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে হিটলারকে চিঠি লেখেন।  ফলং  পদচ্যুতি , দাখাউ কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে সাময়িক আবাস। সেই কারণে তাঁর নাৎসি মেম্বারশিপকে ক্ষমা ঘেন্নার চোখে দেখা হয়েছিল ।  সেই প্রতিষ্ঠান  এখন থুসেন ক্রুপ নামে পরিচিত ।  পরিবারের শেয়ার প্রায় শূন্য , ক্রুপের ২১% । স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ফ্রাঙ্কফুর্টে কাজ করার সময়ে জয়েন্ট ম্যানেজার হ্যারমান এরেনবেরগারের সঙ্গে ডুসেলডরফ অফিসে যেতাম ।  রিসেপশনের দেওয়ালে  তাঁর ছবি দেখেছি । আমার আলোচনার পার্টনার ছিলেন ফ্রিডহেলম বাবেরসকে । কোন কোম্পানীকে তিনি সবসময় "আউটফিট "বলতেন যেমন স্টেট ব্যাংক  অফ ইন্ডিয়া একটি আউটফিট ! 
  • জনতার খেরোর খাতা...
    শপথ  - Prolay Adhikary | অনেকটা পথ বাড়তি হাঁটি,অনেক লেখাই বাহুল্য,হাজার কথাই অ-দরকারী,কানে না হয় না তুললেও...একটা কথায় ভরসা রেখোযেমন রাখো ইশ্বরে !" শিরদাঁড়াটাই বাঁচিয়ে রাখেসব হারানো নিঃস্ব'রে ।"হাতছানি তাই যতই আসুকসমঝোতা নয় সেইখানে,তোমার বীজেই ফলবে ফসল নবান্ন হোক সম্মানের ।
    ভারত সন্ধানে - Pradhanna Mitra | Post Truth: Relating to or denoting circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than appeals to emotion and personal belief.৬ এপ্রিল তারিখে একটি জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্রে একটি ছোট্ট কলাম চোখে পড়েছিল। তারা আবার ইংরেজী সংবাদপত্র থেকে জেনেছেন, স্কুলের সিলেবাস, বিশেষত, ইতিহাসের সিলেবাসে বেশ কিছু বড়োসড়ো রদবদল হচ্ছে, যা সত্য অর্থে আপত্তিকর। ১১ এপ্রিল তারিখ উক্ত সংবাদপত্রে হিন্দোল ভট্টাচার্য মহাশয়ের একটা বড়ো কলাম বের হয়, যেখানে এই রদবদলের উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমাদের এদিকে এ নিয়ে তেমন হইচই হচ্ছে না। কারণ, ইতিহাস সত্য হোক কিম্বা মিথ্যা, বাবা-মায়েরা কেবল একটাই জিনিস চান, আর তা হল এই যে, এইসব ইতিহাসপাঠ অত্যাবশ্যকরূপে তার সন্তানকে ভালো রেসাল্ট তথা উন্নত ‘চাকর’ বানাতে সক্ষম কি না। কিন্তু দেশ জুড়ে যে এর একটা বড়োরকম বিবাদ হচ্ছে, তা সর্বভারতীয় সংবাদপত্র, ব্লগ, ভ্লগ, ম্যাগাজিন, ইন্টারনেট ইত্যাদি দেখলে বেশ টের পাওয়া যায়।ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে --- এই দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে একটাই প্রশ্ন, প্রকৃত ইতিহাসটি তাহলে কি? যদি ‘প্রকৃত’ জানতে সক্ষম হই, তাহলে বিকৃতিকরণ আপনি এসে ধরা দেবে। এখন, সময়ের সাথে সাথে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত পরিবর্তন হয় বটে, কিন্তু ভাল করে স্টাডি করলে দেখা যাবে, তারও একটা ধারাবাহিকতা আছে, যা সত্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গিরগিটি বানায় না, যাকে আমরা ‘পোস্ট ট্রুথ’ বলি। তাই আমি, প্রকৃত-র খোঁজে যে বইটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম, তা হল টনি যোশেফের ‘আদি ভারতীয়’ বইটি, যা Early Indian নামে খ্যাত।এখন প্রশ্ন এই যে, এই বইটিও প্রোপাগান্ডা নয় তা কে বলল? আসুন একটু খতিয়ে দেখা যাক্‌ --- এই বইয়ের উদ্দেশ্য ভারতের উৎস সন্ধান করা। এখন এই উৎস সন্ধানের ভিত্তি কি? টনি যোসেফ তিনতে এভিডেন্স এনেছেন – ১) জেনেটিক এভিডেন্স, ২) আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স এবং ৩) লিঙ্গুইস্টিক এভিডেন্সজেনেটিক এভিডেন্সের দুটি মূল ভিত্তি --- ১) mtDNA, এবং ২) Y-DNA, প্রথমটি মা থেকে পরবর্তী প্রজন্মে, এবং দ্বিতীয়টি বাবা থেকে কেবলমাত্র ছেলের প্রজন্মে বংশানুক্রমে ধারারূপে এগিয়ে যায়। এখন আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স থেকে প্রাপ্ত মানব-অবশেষের জিন থেকে আমরা পিছোতে পারব অতীতের দিকে, এবং এইভাবে আস্তে আস্তে প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাক্রমকে জানতে পারব। বোঝাই যাচ্ছে, পুরো বিষয়টাই বিজ্ঞানসন্মত। এখানে কোনরকম কোন মহাকব্যিক কিম্বা শাস্ত্রোচিত দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এখন এই জেনেটিক এভিডেন্সের ব্যাপারেও টনি যোসেফ ডিটেইলসে জানিয়েছেন বটে, কিন্তু তা আমি, এখানে আলোচনা করলাম না। বইটি পড়তে পারেন, অথবা ইউটিউবে এ ব্যাপারে অনেক ডকুমেন্টারি পাবেন। সেখান থেকে ব্যাপারটা আরও খোলসা হবে। অন্যদিকে লিঙ্গুইস্টিক এভিডেন্স হল মূলত লিপি এবং ভাষার ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসকে জানার চেষ্টা, সেই ভাষা আধুনিক যুগে কীভাবে এসেছে সেটা একটা বড়ো গবেষণার পর্যায়। সেখানে আমরা তিনটে তত্ত্ব পাই --- ১) ইন্দো-ইউরোপিয়ান মাইগ্রেশান, ২) দ্রাভিডিয়ান সাবস্টেট এবং ৩) অস্ট্রোএশিয়াটিক ইনফ্লুয়েন্স। মূলত এই তিনটি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্টিত এই এভিডেন্স পূর্বোক্ত দুটো এভিডেন্সের সাথে সাজুয্য ঘটানোর চেষ্টা চলছে, অনেকাংশে সফলতা মিলেছে এবং আমরা একটা রূপরেখা আন্দাজ করতে পারছি।এই পদ্ধতিগুলো থেকে ভারতের ক্ষেত্রে ঠিক কি ক্রোনোলজি পাওয়া যাচ্ছে? মোট নটা সময়কাল পাওয়া যাচ্ছে --- প্যালেওলিথিক যুগ (২০ কোটি ~ ১০,০০০ খ্রীঃপূঃ), মেসলিথিক যুগ (১০,০০০ ~ ৬,০০০ খ্রীঃপূঃ), নিওলিথিক যুগ (৬,০০০ ~ ২,০০০ খ্রীঃপূঃ), ইন্দাস ভ্যালি সিভিলাইজেশান (৩৩০০ ~ ১৩০০ খ্রীঃপূঃ), বৈদিক যুগ (১৫০০ ~ ৬০০ খ্রীঃপূঃ), মৌর্য ও গুপ্ত যুগ (৩২২ খ্রীঃপূঃ ~ ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ), মধ্যযুগ (৫৫০ ~ ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ) এবং কলোনিয়াল যুগ (১৫২৬ ~ ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ)মোটামুটি এই যুগগুলোকে এবং পদ্ধতিগুলোকে ধরে নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলে দেখতে পাবো, টনি যোসেফ বলছেন, সূদূর আফ্রিকা থেকে মানুষের আগমন ঘটেছে এবং পরবর্তীকালে বেশ কতকগুলি মাইগ্রেশান ঘটেছে। সেগুলো হল ---১) আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশান --- আধুনিক মানব অভিবাসী, ২) এনশিয়েন্ট মাইগ্রেশান --- জার্গোসের অভিবাসী, ৩) ইন্দো-আরিয়ান মাইগ্রেশান --- স্তেপভূমির অভিবাসী, ৪) দ্রাভিডিয়ান মাইগ্র্যান্টস --- হরপ্পার অভিবাসী, ৫) পরবর্তীকালে আগত বিভিন্ন অভিবাসী।অর্থাৎ, এটা নিশ্চিত করছেন টনিভাই যে, আমাদের সভ্যতার সূচনা হরপ্পার হাত ধরে অন্তত নয়, কিম্বা মেহেরগড় থেকেও নয়। বরং হরপ্পা এবং মেহেরগড় নির্মাণে যাদের হাত ছিল, সেইসব অভিবাসীরা ধীরে ধীরে হাজার হাজার বছর ধরে এখানে আসে, ধীরে ধীরে বসতি স্থাপন হয়, ধীরে ধীরে নগর সভ্যতার পত্তন হয়, ধীরে ধীরে তার লয়-ও হয় এবং তারা সেখান থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে জম্বুদ্বীপের আরও গভীরে। তিনি লিখছেন, “ভারতীয় সংস্কৃতিতে জোর করে কৃত্রিম অভিন্নতা আরোপ করার জন্য অব্যাহত ও সর্বনাশা প্রচেষ্টার একটি কারণ আমাদের ইতিহাস রচনার ধরন, যেখানে প্রায়শই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে আত্মপক্ষ সমর্থন করা হয়েছে। যবে থেকে তথ্যাদি উপলব্ধ হয়েছে, ইতিহাস বইগুলি ঠিক সেই সময় থেকেই শুরু হয়; তার পূর্ববর্তী অংশগুলি হয় উপেক্ষা করা হয় বা খুব বেশি হলে সামান্য কয়েকটি অনুচ্ছেদ বা পৃষ্ঠার মধ্যে সেসব কথা সেরে ফেলা হয়।”এখন টনিভাইয়ের এই বইটির কতটা প্রোপাগান্ডা, কতটা পোস্ট ট্রুথ আর কতটাই বা সত্যতা আছে, সেটার বিচার করা দরকার। তবে তা অবশ্যই সনাতন পদ্ধতিতে নয়। বিজ্ঞাসন্মতভাবে। বিজ্ঞানের যুগে টেকনোলজিকে হাতিয়ার করে আমরা যদি সনাতন পদ্ধতির জয়গান করি, তাহলে সেটা বড়োই হাস্যকর। টনিভাই কিন্তু তা করেন নি। তিনি বিজ্ঞানসন্মত পদ্ধতিতেই এগিয়েছেন, তার বইটা পড়ে, অন্তত আমার, এইটুকুই মনে হল। মাঝখান থেকে ছোটবেলায় কাকাকে একটা ছড়া খুব বলতে শুনতাম, আমরা যখন জোরে জোরে ‘স্বরে অ’, ‘স্বরে আ’ পড়তাম তখন, সেইটাই বারবার করে আজ মনে পড়ছে, তবে তা আধুনিক পরিভাষায়, আর সেটা হল ---“ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোলপোস্ট ট্রুথে মাথা নেই, হয়েছি পাগোল।”======================Early IndiansTony josephJuggernaut PublicationPrice: 341/-বাংলা অনুবাদঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জীমঞ্জুল প্রকাশনমুদ্রিত মূল্যঃ ৩৯৯ টাকাছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
    ভারতে মুসলমান কি  বেশি জন্মায়?  - PRABIRJIT SARKAR | সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে ছিল। এসব মিথ। অর্থনীতির তত্বে আধুনিক যুগে তিনটে স্তর আছে (Theory of demographic transition)। প্রথমে প্রচুর বাচ্চা জন্মায় (অশিক্ষা আর অভাবে) আর মরে তাই জনসংখ্যা তেমন বাড়ে না। পরের ধাপে জন সংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি থাকে (চেতনার অভাবে) কিন্তু জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি তে মৃত্যুর হার কমে তাই জনসংখ্যা বাড়ে। শেষ ধাপে শিশু জন্ম মৃত্যুর হার দুটোই কম থাকায় জন সংখ্যা বিশেষ একটা বাড়ে না। গত একশ বছরের ইতিহাসে ভারতে ও দেখা গেছে। হিন্দু মুসলমান গল্প এখানে নেই। আছে অশিক্ষা আর দারিদ্য। তাই নিচের তলার হিন্দু মুসলিম সবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে তফাৎ বেশি নেই। আমার মত অনেক হিন্দুর একটা কিংবা দুটো এবং আমার মুসলিম বন্ধুদের ও তাই। কিন্তু আমাদের ভাই বোন ৫ বা ৭ জন। খেটে খাওয়া গরিব মানুষের (হিন্দু মুসলিন নির্বিশেষে) ৪ বা ৫ সন্তান। একটা দেশের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ভারতে হিন্দু মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত বাড়ছে বলে পাওয়া যায় নি। পাকিস্তানে হিন্দু খেদান হয়েছে তাই হিন্দুদের অনুপাত কমেছে ব্যাপক ভাবে।
  • ভাট...
    commentdc | সরি, আটটা না। এক্সেলে বানিয়ে দেখাচ্ছি, কিন্তু এক ঘন্টা পরে। 
    commentপ্রত্যয় ভুক্ত | তিনটে ফ্যাক্টর, প্রত্যেকটার দুটো লেভেল, তাহলে তো 2^3 টা রান হবে প্রত্যেকটা ব্লক বা রেপ্লিকেট এ, অর্থাৎ 8 টাই
    commentপ্রত্যয় ভুক্ত | হ্যাঁ ওটাই তো, মন্টগোমারির ব‌ইতে পাইনি বলেই লিখলাম আরো, BIBD আমরা‌ পড়েছি eyedrop effectiveness experiment এর উদাহরণ দিয়ে, কিন্তু , partial balance আর full balance এর পার্থক্যটা comprehend করতে পারছিনা।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত