এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    বিশ্বজোড়া ফাঁদ - মহুয়া সেন | ছবি: রমিতবারো বছরের লালানি উইলসন- ক্লার্ক্সভিল, টেনেসি, আমেরিকা, দশ বছরের আন্তোনেলা পালমা- ইতালি, নয় বছরের আরিয়ানি মিলওয়াকি- উইসকনসিন, আমেরিকা- এরা সবাই সামাজিক মাধ্যম টিকটকের একটা খুব জনপ্রিয় খেলায় অংশগ্রহণ করেছিল। খেলাটির নাম 'ব্ল্যাক আউট'। কি সেই খেলা? দড়ি জাতীয় কোনো জিনিস গলায় বেঁধে চেতনার সীমা অতিক্রম করে গিয়ে আবার ফিরে আসা। একটা চ্যালেঞ্জ। সারা পৃথিবীতে বহু বাচ্চা এই প্রবল উত্তেজনাময় খেলায় অংশগ্রহন করে, কিন্তু এই তিনটি বাচ্চা আর ফিরতে পারে নি চেতনায়। তাদেরকে নিয়ে সারা পৃথিবীতে কুুুড়িটি বাচ্চা প্রাণ হারায় 'ব্ল্যাক আউট চালেঞ্জ' গেমে। এরকম আরো গেম চলে সোশ্যাল মিডিয়াতে- মাত্রাতিরিক্ত এলার্জির ওষুধ খাবার চ্যালেঞ্জ, স্কাল ব্রেকের চ্যালেঞ্জ, এরকম আরো অনেক। এই সমস্ত চ্যালেঞ্জের কারণে প্রাণ হারিয়েছে অথবা গুরুতর অসুস্থ হয়েছে, এরকম কয়েকজন বাচ্চার সেলফোনের ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা দেখেন, যে কিভাবে এই সামাজিক মাধ্যমগুলির অ্যালগরিদম এদেরকে এই বিপজ্জনক খেলাগুলোর দিকে ঠেলে দেয়।আর শুধু কি বিপজ্জনক খেলা?মুখোমুখি হেনস্থা করার থেকে সামাজিক মাধ্যমের আড়াল থেকে হেনস্থা করা সহজ, এটা একটি জানা বিষয়, কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে সেটা সহ্য করা খুব কঠিন । মেয়েদের সৌন্দর্যের একটা ভিত্তিহীন মাপকাঠি তৈরী করে তাদেরকে ওজন কমানোর একটা বিপজ্জনক সীমায় নিয়ে যাওয়া, যৌন হেনস্থা, ব্ল্যাকমেলিং,যৌন শোষণ এই সমস্ত কিছুকে হাতিয়ার করে মানসিক অবসাদ এবং আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া -বিষের মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা সাধারণ কৌতুহলী সার্চ থেকে ধীরে ধীরে অ্যালগরিদম করে, অপরিণত মস্তিষ্কের চারপাশে বুনে দেওয়া হয় মোহময় জাল…যার থেকে বেরোনো অত্যন্ত একটা শক্ত কাজ। যেটার বিরুদ্ধে পরিণত বয়সেই লড়তে পারিনা আমরা, সেটা ছোটরা করবে কিভাবে?আমেরিকার সার্জেন জেনারেল ডক্টর বিবেক মূর্তি, ২০২৩ সালের মে মাসে একটি অত্যন্ত সতর্কতামূলক বক্তব্য রাখেন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব নিয়ে। সামাজিক মাধ্যম ছোটদের মানসিক স্বাস্থ্যে কিছু ভালো প্রভাব রাখলেও, এর ক্ষতিকর দিক মারাত্মক। সার্জন জেনারেলের মতে, প্রত্যেক দিন এতটা পরিমাণ সময় সামাজিক মাধ্যমে থাকলে অপরিণত মস্তিষ্ক যেটা কম পায়, সেটা মহামূল্যবান, তা হলো ঘুম। যেটা কম হয়, সেটা পাশে থাকা প্রিয়জনের সাথে মানসিক যোগাযোগ। যেখানে তারা থাকে, বাঁচে, বড় হয়, তার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা- এই সবই এই বয়সের ছেলে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব উদ্বেগের কারণ। এই কথাগুলো আমাদের কাছে নতুন নয়, আমরা সবাই জানি, প্রত্যেকদিন এ বিষয়ে শুনি, আলোচনা করি, পড়ি - বলতে গেলে ক্লিশে হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, যখন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের ডাটা থেকে দেখা যায়, তেরো থেকে সতেরোর মধ্যে প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ ছেলে মেয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে আছে, আর তাদের এক তৃতীয়াংশ প্রায় আছে সবসময়- তখন সেটা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন শুনি আমেরিকায় ২০০৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েচে ৬২%। দক্ষিন কোরিয়াতে ২০২৩ এর প্রথমার্ধেই ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়স্ক ছেলে মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় আঠেরো শতাংশ। জাপান, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের সাথে বয়ঃসন্ধিকালে আত্মহত্যার সংখ্যা পৃথিবীর বহুদেশেই উর্দ্ধগামী। সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা আমাদের জীবনে উত্তরোত্তর বাড়ার সাথে সাথে এই আত্মহত্যা সংখ্যা বাড়ার একটা পরিষ্কার সম্পর্ক আছে, এরকমটাই মনে করেন অনেক সমাজবিদ এবং মনোবিদরা।এটা সত্যি, এই সমস্ত দেশের সাংস্কৃতিক, পারিবারিক পরিকাঠামো হয়তো খানিকটা আলাদা। জীবনযাত্রাতেও পার্থক্য আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে পরিমাণ সময় এই বয়সের ছেলেমেয়েরা তাদের ফোন, বিশেষত সামাজিক মাধ্যমে কাটায়, পৃথিবীর বহু দেশে তার কিন্তু তেমন কোনো তারতম্য নেই। জাপানে ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে ৯৩% সামাজিক মাধ্যমে আছে এবং তারা দিনে গড়ে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা ইন্টারনেটে কাটায়। ব্রাজিল আর মেক্সিকোর ছেলে মেয়েদের মধ্যে ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই সোশ্যাল মিডিয়াতে আছে। ব্রাজিলে ৬ থেকে ১১ বছর বয়সী বাচ্চারা চার থেকে পাঁচটি সামাজিক মাধ্যমে আছে। সেটা আইনী বয়সের অনেক নীচে। মেক্সিকোতে সেই সংখ্যা তিন থেকে চার। ব্রিটেনে ৯১% ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সীরা সামাজিক মাধ্যমে আছে; ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতি আছে। ভারতবর্ষে করা একটি জাতীয় সার্ভেতে দেখা গেছে প্রায় ৬০% টিনেজার তিনঘন্টা সময় কাটায় সামাজিক মাধ্যমে। দক্ষিণ কোরিয়াতে ওই একই বয়সের ছেলে মেয়েদের ওপর করা একটি রিসার্চে, তাদের সামাজিক মাধ্যমে করা পোস্ট বা ব্লগ থেকে যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুব্যবহৃত শব্দ পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো স্কুল, ডিপ্রেশন, কাউন্সেলিং, ডায়েট, সুইসাইড আর ওবেসিটি।সার্জেন জেনেরাল বিবেক মূর্তি এটার ওপর জোর দেন যে এই গভীর সমস্যার সাথে লড়াই করতে গেলে এই বয়সী ছেলেমেয়েদের, তাদের পরিবার, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি, সরকার সবাইকে এক সাথে লড়তে হবে।যখন কোনো একটি বাচ্চাকে হারিয়ে ফেলে একটি পরিবার, কোনো বিপজ্জনক খেলার চেষ্টায় অথবা আত্মহত্যায়, সেই পরিবারের মানুষগুলোর যন্ত্রণা, তাদের আত্মগ্লানির কোনো শেষ থাকে না। অবধারিতভাবে তাদের ওপর দোষারোপও করা হয়। কোন বয়সে বাচ্চারা হাতে সেলফোনে পাচ্ছে, কোন বয়স থেকে তারা সোশ্যাল মিডিয়াতে যোগ দিচ্ছে, কি দেখছে, কি শিখছে সে বিষয়ে,অবশ্যই অভিভাবকের দায়িত্ব থাকে। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে ভাবি যদি, গোটা পৃথিবীতে বিশাল অংশের অভিভাবকরা অর্থ উপার্জনে, পরিবারের রোজকার জীবনের চাহিদা সামলাতে এতো ব্যস্ত থাকেন, তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না এইভাবে খেয়াল রাখা, প্রত্যেক মূহুর্তে বাচ্চারা কি করছে। দৈনন্দিন জীবন যাদের কাছে সংগ্রাম, তাদের পক্ষে হয়তো এক জায়গায় বসে বাচ্চা একটি জিনিস একাগ্র হয়ে দেখলে, তারা নিশ্চিন্ত থাকেন কোনো বিপদ বা দুর্ঘটনা হবে না। অভিভাবকদেরকে একই মাপকাকাঠিতে বিচার করা যায় না। কিন্তু যে অভিভাবকদের কাছে সেই সময়টা থাকে, তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ছোটরা কিভাবে সময় কাটাবে; তারা যদি সচেতন ভাবে ঠিক করেন, একসাথে খেলে, কোনো সৃষ্টিশীল কাজ করে, একটা নিয়ম বানিয়ে ফোনে ব্যয়িত সময় নির্দিষ্ট করে দিতে- তাহলে সামাজিক মাধ্যমের কুপ্রভাব খানিকটা কমতে পারে। কিন্তু অনেক সময়েই আমরা বড়োরাই এই জগতের বাইরে নই, আমাদের বহুজনের জীবন আবর্তিত হয় ওই ভার্চুয়াল জগতে। আমরা নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, ছোটরা কি অনুসরণ করবে?সামাজিক মাধ্যম জগতে প্রথম সমস্যা হলো, সামাজিক মাধ্যমে যোগ দেবার জন্য ন্যূনতম বয়স তেরো। কিন্তু তেরো কি সত্যিই তেরো?সাত থেকে বারো বছরের বহু শিশু বেআইনী ভাবে সামাজিক মাধ্যমের সদস্য হয়, সদস্য হতে গেলে একটা স্বঘোষনাই যথেষ্ট, যে তাদের বয়স তেরো বছর। সেটা যাচাই করার জন্য কোনো ধরণের প্রমাণপত্র লাগে না। অভিভাবকের অনুমতি লাগে না। লেখার শুরুতে মৃত বাচ্চাগুলোর বয়স তেরোর কম- যা প্রমাণ করে কিছুভাবেই সামাজিক মাধ্যমে বয়স যাচাই করা হয় না।এরপরের সমস্যা ছোটরা কি দেখে? ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ১৬ বছর বয়সী লং আইল্যান্ড, নিউয়র্কের চেজ নাসাকা, আত্মহত্যা করে। সে মানসিক অবসাদে ভুগছিলো। তার মৃত্যুর পর তার মা তার টিকটক অ্যাকাউন্টে খুঁজে পান অজস্র ভিডিও- আশাহীনতার, সময় ফুরিয়ে যাওয়ার, বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে না পাবার, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া ভিডিও- যার সংখ্যা এক হাজারের ওপর। কিভাবে হতে পারে এটা? চেজের মা মিশেল কিছুতেই কোনো উত্তর খুঁজে পাননি। তিনি জানতেন টিকটকে মজার ভিডিও পোস্ট করা হয়- তিনি কিভাবে জানবেন একই ঘরে অবস্থানকারী পরিবারের সদস্যদের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা ভিডিও আসে? কিছুতেই বুঝতে পারেন না কিভাবে একটি বাচ্চা যে মানসিক অবসাদে ভুগছে তার কাছে অজস্র ভিডিও নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে আসতে থাকে, আস্তে আস্তে যা আত্মহত্যায় পথে ঠেলে দেয়? একটা ক্লিক, একটা সার্চের থেকেই তৈরী হতে থাকে এই অ্যালগরিদিমের জাল। আর ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে অপরিণত মস্তিস্ক। কিছুক্ষণ একটা বিষয় দেখলে বা সার্চ করলে আকৃষ্ট করার উপাদান দিয়ে সময় বাড়ানো- আর বিজ্ঞাপন থেকে আরো আরো রেভিনিউ।যদিও টিকটক সেটা স্বীকার করেনা, কিন্তু ২০২১ সালে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের করা একটি তদন্তে, টিকটকে একশোটি বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট খুলে একটি দুটি নেগেটিভ বা অবসাদের মেসেজ টাইপ করার ৩৬ মিনিট পর থেকে ফিড গুলি ভরে যায় ৯৩% অত্যন্ত বিষাদ ভরা নেগেটিভ কন্টেন্টে।একইভাবে মেটা তাদের ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম সাইটে যে বারো বছরের নীচে অসংখ্য সদস্য আছে সেটা ভালোভাবে জানে। ২০১৯ সালের প্রথম থেকে মেটার কাছে রিপোর্ট ছিলো যে তাদের প্ল্যাটফর্মে ১.১ মিলিয়ন বারো অনূর্ধ্ব সদস্য আছে। কিন্তু জানা সত্ত্বেও তার মধ্যে খুবই সামান্য পরিমান সদস্যদের একাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে। এখন বারো বছর অনুর্ধ্ব সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ থেকে ২.৫ মিলিয়ন। তাহলে মেটা এই বিশাল সংখ্যক বাচ্চাদের সমস্ত ডাটা সংগ্রহ করেছে তাদের অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া, এবং সেই ডাটা তারা ব্যবহার করছে। এছাড়া মেটার নিজস্ব রিসার্চ অনুযায়ী, ইনস্টাগ্রামের সদস্যদের মধ্যে ১৩.৫% টিনেজার মেয়েরা বলেছে ইনস্টাগ্রাম তাদের আত্মহত্যা করার ইচ্ছে বাড়িয়ে দিচ্ছে আর ১৭% বলেছে তাদের ইটিং ডিসঅর্ডার আরো খারাপ জায়গায় যাচ্ছে। এই সমস্ত তথ্যগুলিকে মেটা প্রধান জাকারবার্গ এবং সিনিয়র এক্জিকিউটিভরা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেন; ২০১৮ সালে মেটা থেকে তাদের প্রোডাক্ট ডিভিশনকে পাঠানো একটি ইমেইল লিক হয় যেটাতে বলা হয়- প্রোডাক্ট ডিজাইন করার সময় এটা মনে রাখতে হবে যে ‘তেরো বছর বয়স্ক একটি বাচ্চার সারা জীবনের দাম ২৭০ ডলার’- যে কথাটি মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড অভিঘাত সৃষ্টি করে।এছাড়া স্ন্যাপচ্যাট, যে মাধ্যম মূলত অল্পবয়সয়ীরা ব্যবহার করে এবং যেখান মেসেজ একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর মুছে যায়, সেই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে নেশা করার ব্যথানিরোধক ট্যাবলেটের জায়গায় বিক্রি হয়েছে চরম ক্ষতিকর ফেন্টান্যাল ড্রাগ, যাতে চলে গেছে ২০০র ওপর অল্পবয়সী প্রাণ, তার মধ্যে নয়জন শিশু।আমেরিকাতে বেশ কয়েক বছর মেটা , টিকটক, স্ন্যাপ, এই সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে কংগ্রেস পদক্ষেপ নেবার চেষ্টা করেছে, বিশেষতঃ বাচ্চাদের যৌন হেনস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য। যেখানে ছোট থেকে বয়ঃসন্ধির বাচ্চারা ক্রমাগত শিকার হচ্ছে যৌন হেনস্থার, মানসিক অত্যাচারের, তৈরী করে দেওয়া হচ্ছে জগৎ যার মধ্যে ঢুকে বাস্তব পৃথিবীর সাথে তাদের যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে- অবসাদে তলিয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবীটা তাদের চারপাশে তৈরী করে, এর দায়ভার এই সামাজিক মাধ্যম কোম্পানী অস্বীকার করতে পারে না। বেশ কয়েকটি এরকম সেশন হয়েছে যেখানে সামাজিক মাধ্যম কোম্পানির প্রধানরা কংগ্রেসে এসেছেন টেস্টিফাই করতে। ২০২৪ সালে একতিরিশে জানুয়ারী মেটার মার্ক জাকারবার্গ, টিকিটকের সাউ জি চেউ, স্ন্যাপের ইভান স্পিগেল, ডিসকর্ডের জেসন সিট্রন, এক্সের লিন্ডা ইয়াকরিনো এসেছিলেন সেনেট জুডিশিয়ারি কমিটির সামনে তাদের বয়ান দেবার জন্য। এইবার, সেখানে তারা শুধু কংগ্রেসম্যানদের কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হননি, সেখানে উপস্থিত ছিলেন সন্তান হারানো বা অত্যন্ত ক্ষতি হয়ে যাওয়া সন্তানদের মা বাবারা, তাদের বাচ্চাদের ছবি হাতে নিয়ে, প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে। তাদের উপস্থিতি সেদিন অনেক কথার থেকেও হাজারগুণ জোরালো আর ভারী প্রতিবাদ নিয়ে এসেছিলো। কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা এই কোম্পানী প্রধানদের তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সাথে এটাও বলেছেন সন্তানের বাবা মা হিসাবে এই অভিভাবকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে। এই অভিভাবকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জাকারবার্গ, স্পিগেল ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।মেটার প্রধানের বা স্ন্যাপের প্রধানের এই ক্ষমা প্রার্থনা বা প্রতিজ্ঞা, যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে কি তথ্য ভবিষ্যতে পৌঁছবে, সেই বিষয়ে কোম্পানি অনেক বেশি অনেক বেশি সচেতন হবে এবং বিধিনিষেধ কার্যকরী করবে- এই সমস্ত কিছুই ভালো পদক্ষেপ, কিন্তু সেটা না করলে আমেরিকান গভর্নমেন্ট বা সাধারণ মানুষ কি করতে পারবেন?করা খুব কঠিন- কারণ আইন। আঠাশ বছরের পুরোনো একটি কেন্দ্রীয় আইন, সেকশন ২৩০ অনুসারে সোশ্যাল মিডিয়া সাইট গুলিতে যে কনটেন্ট প্রকাশিত হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে কোম্পানীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। আর এই কোম্পানীদের বিরুদ্ধে মামলা না করা গেলে, এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি কোনো ন্যয় বিচার পাবে না। তাই রিপাবলিকান, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নির্বিশেষে প্রথমে এই সেকশন ২৩০-কে নিষিদ্ধ করার জন্য কংগ্রেসে বিল আনতে হবে। তারপরে দীর্ঘ পথ।তবে এখন খানিকটা আশার আলো দেখা গেছে। ২০২১ সালে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলো একত্রিত হয়ে রিপোর্ট করার পর ৪২টি রাজ্যের এটর্নি জেনারেলরা মেটার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তারা এই মর্মে মামলা করেছেন যে মেটার প্রোডাক্ট এমনভাবে বানানো হয়েছে যা অপ্রাপ্তবয়স্ক মনের জন্য ক্ষতিকর, তাদের আসক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই বছর জানুয়ারী মাসে ক্যালিফর্নিয়া সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এই মর্মে রায় দিয়েছেন যে অভিভাবকরা স্ন্যাপচ্যাটের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন ।তবে পৃথিবীর অন্যান্য কয়েকটি দেশে আইন সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিতে পারে। জার্মানিতে নেট জিডিজি আইন আছে যা তাদের দেশে রেজিস্টারড সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলির কাছে কোনো পোস্ট সম্পর্কিত কোনো ক্ষতিকর অভিযোগ এলে, ২৪ ঘন্টার মধ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে। পোস্ট বেআইনি প্রমাণিত হলে এবং পোস্ট না সরালে ২ থেকে ২০ মিলিয়ন ইউরো ফাইন হতে পারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে এই কনটেন্ট একঘন্টার মধ্যে সরানোর শর্ত দেওয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে ‘অ্যাভোরেন্ট ভায়োলেন্ট মেটিরিয়াল এক্ট ২০১৯’, সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল পেনাল্টি, এমনকি টেক এক্সেকিউটিভদেরকে তিন বছরের অব্দি জেলে পাঠানোর এবং কোম্পানির গ্লোবাল টার্নভারের ১০% অব্দি পেনাল্টির আইন করা হয়েছে।ভারতবর্ষে সামাজিক মাধ্যম সংক্রান্ত কোনো নির্দিষ্ট আইনাবলী নেই কিন্তু কিছু বিচ্ছিন্ন আইন আছে। ‘ডিজিটাল পার্সোনাল ডাটা প্রটেকশন এক্ট ২০২৩’ অনুযায়ী যেটা অনূর্ধ্ব আঠেরোর কেউ সামাজিক মাধ্যমে একাউন্ট খুলতে গেলে অভিভাবকের অনুমতি লাগবে এবং সেটা বৈধ কিনা যাচাই করা হবে। এই আইনটি এখনো চালু হয়নি। এছাড়া গেমিং ইন্টারমিডিয়ারি রেগুলেশন আছে যা ডিজিটাল গেম এবং সামাজিক মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অনুপযুক্ত কোনো বিষয় দেখা না যায়, সেই বিষয়টি খেয়াল রাখে। এডভার্টাইসিং স্ট্যান্ডার্ডস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া এই মর্মে বিধান দিয়েছে গেমিং এবং সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে যে সমস্ত বিজ্ঞাপনগুলি অপ্রাপ্তবয়স্করা দেখছে সেগুলি তাদের জন্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে বা কোনো বিপদের পথে না নিয়ে যায়, সেই বিষয়টি দেখতে হবে। এই সমস্ত রেগুলেশনগুলো একত্রিত হয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলিতে ছোটদের জন্য মানসিক ভাবে ক্ষতিকর বিষয়বস্তু বা বিজ্ঞাপন আসতে দেয় না, কোনোভাবে এলে বাধ্যতামূলক ভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়।আইন আপাতদৃষ্টিতে ভালো আছে কিন্তু, অন্যদিকে গত বছর টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে বেরোনো একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে ২০২৩ সালে, কর্ণাটক হাই কোর্টের জাজ নারিন্দার একটি বিবৃতি দিয়েছেন - আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েরা এতো সামাজিক মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়চে যে কত বয়সে তারা সামাজিক মাধ্যমে থাকবে এটা বিবেচনা করা দরকার। তিনি বলেন তার নিজের টিনেজার ছেলে প্রচুর পরিমান সময় ডিসকর্ডে কাটায় বা তার গোপন একাউন্ট ইনস্টাগ্রামে আছে, হয়তো আরো গোপন কার্যকলাপ করে ইন্টারনেটে যা তিনি জানেন না। ভারতবর্ষে, গড়ে মানুষ যাদের কাছে সামাজিক মাধ্যমে আছে, তারা ২.৪ ঘন্টা সামাজিক মাধ্যমে কাটায়। ভারতে ২৯০ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম প্লাটফর্ম ব্যবহার করে, তাই এই রোজকার হিসেবটা বেশ উঁচু।বয়ঃসন্ধিতে থাকা, ১৩-১৯ বছর বয়স্করা ৩১% সমস্ত সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে। ২০২২ এর ডাটা অনুযায়ী ফেসবুকে আছে ৩২৯ মিলিয়ন জন সদস্য, সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি।২০২২শে করা জাতীয় স্তরের সার্ভেতে, শুধুমাত্র মহারাষ্ট্রে ১৭ % অভিভাবকরা জানিয়েছেন তাদের বাচ্চারা ছয়ঘন্টার ওপর সময় ইন্টারনেটে কাটায়। সারা ভারতবর্ষে এই সংখ্যা ২২%এর ওপর। ছয়ঘন্টা ইন্টারনেটে কাটানোর জন্য অত্যন্ত লম্বা সময়। তাছাড়া পৃথিবীর আর সব দেশের মতো ভারবর্ষের বাচ্চারাও শারিরীক ভাবে সক্রিয়তা হারাচ্ছে, হারাচ্ছে ঘুম আর চারপাশের মানুষ আর পৃথিবীর সাথে সংযোগ। এছাড়া আছে সাইবার বুলিং, সারাক্ষন অন্যদের সাথে নিজেদের তুলনা ডিপ্রেশন ইত্যাদি। এগুলো প্রমান করে যে বাচ্চাদের আর বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের ওপর সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব ভালোর চেয়ে খারাপ।ডক্টর জোয়া আলী রিজভী, ডেপুটি কমিশনার অফ আডলসেন্ট হেলথ এর মতে- বয়োসন্ধির ছেলেমেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ফান্ডিং বাড়ানো খুব জরুরী আর এই খারাপ প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে প্রয়োজন বিভিন্ন সরকারি সংগঠন আর মন্ত্রালয়ের একটা সংগবদ্ধ লড়াই। তার মতে, এখন যদি আমরা না লড়ি, তাহলে আমরা হয়তো একটা গোটা প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলবো।এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় সরকারের কঠিন হস্তক্ষেপই কি তবে সঠিক পথ ?চীনে গনতন্ত্র নেই, চীনের অর্থনীতির প্রত্যেক ক্ষেত্রে, যার মধ্যে সামাজিক মাধ্যমও পড়ে, সরকারের প্রচুর বিধিনিষেধ আছে। সেই বিধিনিষেধ শুধু তাদের দেশের সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোর ওপর নয়, চীনের ছাত্রছাত্রীদের জন্যও। সাইবারস্পেস এডমিনিস্ট্রেশন অফ চায়না ২০২১ সাল থেকে সপ্তাহান্ত বা অন্য ছুটির দিন ছাড়া ছোটদের সারাদিনে শুধুমাত্র একঘন্টা অনলাইন গেম খেলার স্বাধীনতা দেয়। চায়নাতে টিক টক নেই, আছে তার সিস্টার প্ল্যাটফর্ম ডৌইন, যারা প্রায় একই সোর্স কোড ব্যবহার করে। চীনের ছেলে মেয়েদের ফিডে শুধুমাত্র, বিজ্ঞানের পরীক্ষা নিরীক্ষা, শিক্ষামূলক ভিডিও, মিউজিয়াম এক্সিবিট এসব ধরণের ভিডিও দেখা যায়, তাও আবার, অনুর্দ্ধ চোদ্দ বছর বয়সীরা শুধুমাত্র দিনে ৪০ মিনিট এই প্ল্যাটফর্ম দেখতে পারবে। ২০২৩ সালে সরকার প্রস্তাব আনছে যে অপ্রাপ্তবয়স্করা রাত্রি দশটা থেকে সকাল ছটার মধ্যে ফোনে কোনো ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে না। আট বছরের নীচে ছোটরা সারাদিনে চল্লিশ মিনিটের বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে না। এছাড়া ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মে একটা সম্পূর্ণ ইয়ুথ মোড তৈরী করা হয়েছে যেখানে শুধু তাদের বয়সের উপযুক্ত বিষয়বস্তু প্রকাশিত হয়। আর সেটা করার পর থেকে সাইবারস্পেস এডমিনিস্ট্রেশনের মতে, অল্প বয়সীদের মানসিক স্বাস্থ্যে যথেষ্ট সুফল দেখা যেতে শুরু হয়েছে।এটাই কি তবে ঠিক পথ?প্রদীপ থেকে বেরোনো দৈত্যকে কি ভাবে আয়ত্তে রাখা যাবে সেটা ভবিষ্যৎ বলে দেবে।
    লেখা আহ্বান - সংক্রান্তি, নববর্ষ ও ঈদ সংখ্যা - গুরুচণ্ডা৯ | ছবি: রমিতশীতকাল বইমেলা হইচইএর দিনকাল ফুরিয়ে এসে গেল শান্ত হয়ে বসে লেখালেখির কাল। বাইরে তাপমাত্রা বাড়ছে রোদ্দুরের জন্য, নির্বাচনের জন্য। সাথে কোথাও প্যাচপ্যাচে ঘাম তো কোথাও ঝরঝর বৃষ্টি। সন্ধ্যের আবছায়ায় দোকানে ভীড় জমায় সারাদিন রোজা রাখা ক্লান্ত মানুষ, গাজনের প্রস্তুতি নেওয়া শ্রান্ত মানুষ, চৈত্রসেলের হাতছানিতে মুগ্ধ মানুষ। টুপটাপ জমে ওঠে গল্পেরা, কবিতারা। নির্বাচনী জনসভার কোণাকাঞ্চিতে, ইফতারির থালার পাশে, গাজনের সন্ন্যাসীর ঝোলায় চুপটি করে অপেক্ষা করে তারা মানুষের জন্য। আপনি দেখতে পাচ্ছেন তাদের? তাহলে খপ করে ধরে ফেলুন, ঝপ করে লিখে আগামী দশদিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দিন আমাদের guruchandali@gmail ঠিকানায়।এত যত্ন করে আবেদনটা লিখে দিয়েছেন দময়ন্তী, লেখা পাঠাতে একদম দেরি করবেন না, তাহলে উনি রেগে যাবেন কিন্তু
    ক্যালিডোস্কোপে দেখি - দোল - অমিতাভ চক্রবর্তী | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়দোলদোল নিয়ে প্রথম স্মৃতি যা আমার মনে আসে সেটা একটা পিতলের পিচকারি, আমার হাতে নয় কিন্তু কার হাতে সে আর মনে পড়ে না। তার পরের ছবি আমার উত্তর বঙ্গের জীবনের। নতুন জায়গায় নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে আমি এক অতি এলেবেলে জীব। মার খাই নিজের ক্লাসের পড়ুয়াদের হাতে, খুবই স্বাভাবিক একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে – আমি নতুন, বহিরাগত। এই অভিজ্ঞতা আমার আগে ছিল না। মানিয়ে নিচ্ছিলাম, পাল্টা হাত-পা চালিয়ে। কিন্তু যিনি ক্লাস নিচ্ছেন, তিনি যখন পিট্টি লাগান, কিছু করার থাকে না। সেই শাস্তি আমার নিজের বিবেচনায় যতই অমূলক, অযৌক্তিক মনে হোক না কেন। অবশ্য পরে গোটা জীবন ধরে জানব যে শাস্তির ঐটিই দস্তুর, দুনিয়া জুড়ে, অনাদি কাল ধরে, ভবিষ্যতেও এর অন্যথা হবে – এখনও অবধি তেমন মনে হয়নি।উত্তরবঙ্গের প্রথম বছরটিতেই প্রথম জানা হল শীতের তীব্র ঠান্ডা কাকে বলে। আর সেই সুবাদেই, আঁকার জন্য পাওয়া রঙের বাক্সের বাইরে, নানা রঙের সাথে পরিচয় হল - উলের সুতোয় আর মেলায় কেনা রঙিন গরম পোষাকে। কিন্তু রঙ নিয়ে যে মাখামাখি করা যায়, করাই স্বাভাবিক সেইটি একেবারে জাপটা-জাপটি করে অনুভব করা গেল দোলের সকালে। ঠাকুমা সেদিন ঘুম ভাঙ্গিয়ে জানাল – উইঠ্যা পড়, আইজ দোল, রঙ খেলবা কখন, আর বাবা আগের কোন একদিন কিনে আনা লাল আর গোলাপি/বেগুনি রঙের আবির আর সম্ভবতঃ লাল এবং সবুজ গুঁড়ো রঙ কাগজের ঠোঙা খুলে বার করল। এই দিনটা আসার প্রস্তুতি অবশ্য কয়েক দিন আগে থেকেই চলছিল। প্রতিবেশিদের কারো কারো বাড়ির উঠানে বা চাষের জমিতে ছোট মাপে আর পাড়ার খেলার মাঠে বড় করে খড়-বাঁশ-গাছের ডালের কাঠামো বানানো হচ্ছিল। তারপর দোলের আগের দিন সেই কাঠামোয় আগুন ধরিয়ে দিয়ে তাকে ঘিরে ঘিরে হাত ধরাধরি করে গাওয়া – আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরিবোল। বাড়ি ফেরার পর বাবা ন্যাড়া পোড়ায় হোলিকা দহন, অশুভের বিনাশ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেছিল। সবটা বুঝিনি কিন্তু মনের মধ্যে কিছু অস্বস্তির জন্ম হয়েছিল। অমন রাক্ষসি কি আমাদের এখানে আছে? তাকেও কি পুড়িয়ে মারতে হবে? গুজিয়া আর কি কি যেন সব মিষ্টি এসে গিয়ে সেই সব সম্ভাব্য নৃশংসতার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। সেই দোলের সকালে ফুট দুই উচ্চতার মাঝারি মাপের দুই ধাতব বালতিতে লাল আর সবুজ রঙ অল্প অল্প জলে গুলে তারপর বেশি করে জল মিশিয়ে বাবা তাদের নিজের পছন্দ মত ঘনত্বে নিয়ে এল। আমাদের সেই সময়ের দিনযাত্রায় প্লাস্টিকের প্রবল আবির্ভাব ঘটেনি। বেশির ভাগই মাটি, কাপড়, কাঠ, কাগজ আর ধাতুর বানানো। সেই সকালে পরম বিষ্ময়ে কয়েকটি প্লাস্টিকের ছুঁচলো-মুখ ছিপি ওয়ালা কৌটো আমাদের তিন ভাইয়ের হৃদয় হরণ করে নিয়েছিল – তিনটি পিচকারি। পরবর্তীকালের হাল্কা, সহজে নষ্ট হয়ে যাওয়া খেলনা নয়, রীতিমত শক্ত সমর্থ কৌটো। দুই তালুতে বন্দি করে কৌটোর পেট চেপে ধরলে তীব্র স্রোতে রঙিন জল বেরিয়ে এসে কত দুর পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে, আর এত বড় অবাক কান্ড আমরা নিজেরা ঘটাচ্ছি!পিচকারি হাতে বাড়ি থেকে বের হয়েই আমরা বুঝলাম রণক্ষেত্র কাকে বলে, আমাদের অস্ত্র অন্যদের হাতেও আছে আর সেগুলো আমাদের দিকে তাক করা এবং ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের সুবিধা ছিল, তিন ভাইয়ের সম্মিলিত দলবদ্ধ আক্রমণ। কিন্তু তারও সীমাবদ্ধতা আছে, রসদ ফুরিয়ে যায়, তখন দৌড়ে ফিরে এসে আবার জল ভরে নিয়ে যাওয়া। আর সেই ফিরতি পথে গায়ে মাথায় প্রতিপক্ষের জলের ধারা। খুব ভালো হয় যদি পিচকারি বেশ বড় মাপের হয়, অনেকটা জল ধরে আর অনেক দূর যায়, ঐ ওদের কারো কারো হাতে ধরা পিতলের পিচকারিগুলোর মতন। কিন্তু আমাদের ত অমন পিচকারি নেই। বাবা বলল দেশভাগের আগে তাদের বাড়িতে তার নিজেরও ঐ পিচকারি ছিল। কিন্তু তাতে আমাদের ত কোন উপকার হচ্ছে না!এইবার বাবা তার কারিগরি দক্ষতার প্রকল্প চালু করল। লতানে গাছের জন্য মাচা বাঁধার খুঁটি বানাতে লাগবে বলে বেশ কিছু বাঁশের টুকরো রাখা ছিল। তারই একটাকে নিয়ে এসে দা, করাত, আর কি কি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাটাকাটি করে একটা নল বানিয়ে ফেলা, তারপর সেটার যেদিক থেকে রঙ বের হবে সেদিকের দেয়ালে, তুরপুন দিয়ে ছ্যাঁদা করা ইত্যাদির পরে একটা লম্বা টুকরোর দুই প্রান্তে দুই কাপড়ের টুকরো জড়িয়ে একটা দিক হাতলের কাজে আর অন্য দিকটা বাঁশের খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে রঙ টানা আর বের করার পিস্টন বানিয়ে ফেলতেই পিচকারি তৈরি হয়ে গেল। আর আমাদের পায় কে! কিন্তু তিনজনের জন্য দুটো পিচকারি করা হয়েছিল, এইটাতে সুবিধা হয়েছিল না অসুবিধা সেইটা এখন আর নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যেটা নিশ্চিত করে বলা যায় সেটা এই যে সমস্ত বাহুবলি সিনেমায় যেমন দেখায়, অস্ত্রশস্ত্র যতই ব্যবহার হোক, চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হাতাহাতি সম্মুখ সমরে। প্রয়োজনীয় রসদের অভাবে শক্তিশালি দলও হেরে যায়, আমারাও আমাদের সেই প্রথম বছরের যুদ্ধে মনে হয় না খুব সুবিধা করতে পেরেছিলাম। পরের বছর থেকে রসদ সংগ্রহের দায়িত্ব নিজেরা নিয়ে নিয়েছিলাম। হাতের তালুতে রঙ মেখে নিয়ে এগিয়ে চলো, যুদ্ধে হেরে যাওয়া কোন কাজের কথা না। মুস্কিল হল, এই রঙের যুদ্ধশেষে সবাই একই রকম হেরে বসে। সবাই রঙে রঙে রাঙা আজব প্রাণী। খেলা তো হল। এরপর সেই ভয়ানক সময়। স্তরে স্তরে চেপে বসা রঙ তুলতে গিয়ে তিন ভাই, সাথে মায়ের জেরবার অবস্থা। কখনো তেল দিয়ে মোছা, তারপর অনন্ত কাল ধরে বারে বারে সাবান ঘষা আর হাতে পাম্প করে তোলা ঠান্ডা জলে সেই সাবান ধুতে ধুতে মায়ের হাতের তালু আর সমস্ত আঙ্গুলগুলো সিঁটিয়ে ওঠা। উত্তরবঙ্গ ছেড়ে চলে আসার পর বড় হতে হতে অবশ্য দেখলাম রাঙিয়ে দেওয়ার শেষ পর্বটা বড়দের দখলে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পড়ে তারা বের হন, তারপর দু-এক বাড়ি ঘুরতে ঘুরতেই মাথার চুল থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত লাল আর অভ্রকুচি ঝিলিক দেওয়া গোলাপি/বেগুনি আবিরে মাখামাখি। আমাদের সময়ে সবুজ আবিরের তেমন একটা চল ছিল বলে মনে পড়ে না। বেলা বাড়ার সাথে আবিরের গুঁড়ো জায়গা ছেড়ে দেয় রঙের গুঁড়োকে। এই পর্ব বিভিন্ন বাড়ির, পাড়ার দস্তুর মেনে মৃদু অথবা উদ্দাম। অনেক সময় সেটা রঙ ফুরিয়ে কাদা গোলা জলে শেষ হত। মিশ্র ভাষাভাষীর পাড়ায় এমনও দেখেছি, প্রথম দিন রঙ্গিন জলে দোল আর দ্বিতীয় দিনে কাদা গোলা জলে হোলি। খুব ভাল লাগত বাতাসে আবির ছুঁড়ে চারপাশ রাঙিয়ে দেওয়া। যে আবির থালায় ঢেলে নেওয়া হয়েছে তার উদ্বৃত্ত আর ঠোঙ্গায় ফিরবে না। তারা ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় দশদিক রাঙিয়ে দেবে। পরিমাণ কম থাকায় এই খেলাটা অল্পই খেলা যেত। এখন অবশ্য নানা উল্লাসে বিশেষ বিশেষ রঙের অঢেল আবিরে নানা সময় আকাশ-বাতাস রাঙা হয়ে ওঠে। উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে আসার পর আমার বিশেষ প্রাপ্তি হয়েছিল একে একে ছয়টি খুড়তুত ভাইবোন, ফলে হামলাবাজির দল বেড়েছিল ভালোমতন। দোলের দিন-সপ্তাহ-মাস জুড়ে আরও কত টুকরো ছবি মনে পড়ে – কীর্তনের দল বের হত খোল-করতাল নিয়ে, ঠাকুমা হরিসভায় যেত, কাকি এক বছর দোলের বিকেলে পূজোর আয়োজন করেছিল আর তার পর থেকে সেটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয়ে গিয়েছিল। এই ছবিগুলোর কিছু আমার স্মৃতিতে কিছু আমার ভাই-বোনেদের স্মৃতিতে ঠাঁই করে নিয়েছে, গল্পে গল্পে ঊঠে আসে। কয়েক বছর পার করার পরে আমাদের অনেকেরই রঙ খেলার ইচ্ছেটা চলে গিয়েছিল। বিশেষ করে ছোট ছোট কাঁচের শিশিতে ভরা চকচকে রঙগুলো বাজারে জাঁকিয়ে বসার পর। ওগুলো শরীর থেকে ধুয়ে-মুছে দূর করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ত। তবে সেই কারণের থেকেও যেই জন্য বেশি অপছন্দের হয়ে উঠেছিল সেটা আবেগের, অনুভূতির পার্থক্য ঘটে যাওয়ায়। রঙ মাখানো – রীতির নামে জোর খাটানোর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। খুব কম করে হলেও আমার খুশিকে আমি জোর করে এক জনের ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া না করে তার উপর চাপিয়ে দিচ্ছি। এ তো অত্যাচার! তা বলে, স্বেচ্ছায় কি কেউ রঙ মাখে না? মাখে তো। রঙিন হয়ে ওঠার সেই আকাঙ্খা নিয়ে গান হয়, সাহিত্য হয়, শিল্প হয়। এম আর চুঘতাইয়ের একটি অপূর্ব ছবি আছে, কৃষ্ণ-রাধিকা সেখানে পরস্পরে আত্মহারা। অমন অবস্থায় ইচ্ছে হতেই পারে - প্রিয় মানুষের কাছ থেকে রঙ মাখার, ভালোবাসার রঙ, প্রেমের রঙ। সে দোল যাদের জীবনে এল তাদের পরম সৌভাগ্য। আর যারা মাখতে চায়নি সেই তাদের জন্য ও রঙ যন্ত্রণার, ঐ সকাল-দুপুর সরে থাকার, আড়ালে থাকার।বাবা-মা দেশভাগে বাস্তুহারা হয়েছিলেন। আমার জীবনে উৎখাতের বেদনা এসেছিল বাবার বদলির চাকরির ফলে। জ্ঞান হওয়া ইস্তক যে বাড়ি, যে রাস্তা-ঘাট, যে পাড়া, যে দুনিয়া নিজের বলে জেনে এসেছি সেখান থেকে উপড়ে গিয়ে কোচবিহারের এক অচেনা বাড়িতে, অচেনা জগতে ঠাঁই হয়েছিল। যতদিন সেখানে ছিলাম প্রতিদিন ভাবতাম কবে আবার পুরনো দিনে ফিরব। তিন বছর বাদে সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। কিন্তু পুরনো দিনে আর ফেরা হয়না, আমারও হয়নি। তখন যেটা বুঝিনি, এর পর থেকে ঐ তিন বছরকে আমি খুঁজে ফিরব বাকি জীবন। এই খুঁজে ফেরার এক পর্যায়ে এসে আমার স্মৃতিচারণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লিখে রাখতে শুরু করি। বিভিন্ন টুকিটাকি ঘটনাকে জুড়ে জুড়ে ক্যালিডোস্কোপে ছবি গড়ে তোলা। একটু ঘোরালেই অন্য ছবি। কয়েকটি পর্ব এইখানে গুরুচন্ডা৯তেও লিখেছি। এবার ইচ্ছে আছে অন্যত্র লেখা পর্বগুলিকেও এখানে নিয়ে আসার। এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ক্যালিডোস্কোপ ঘোরানোর আশা নিয়ে আজ এখানেই থামছি।ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    কিষেণজি মৃত্যু রহস্য - পর্ব ২  - বিতনু চট্টোপাধ্যায় | কিষেণজি মৃত্যু রহস্য আসলে ঝাড়গ্রামে মাওবাদী আন্দোলনের উৎস সন্ধানে পিছন দিকে এগোনোর চেষ্টা করা। হাজার-লক্ষ ঘটনার ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে যতটা এগনো আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে ততটা। সাংবাদিকতার সূত্রে বারবার বেলপাহাড়ি, বিনপুর, লালগড়, জামবনি সহ ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এই লেখা। কলাভৃত পাবলিশার্স ২০২১ সালে কিষেণজি মৃত্যু রহস্য বই হিসেবে প্রকাশ করে। প্রকাশকের সম্মতিক্রমে বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে গুরুচন্ডালীতে। কিষেণজি মৃত্যু রহস্যকে ময়ূরঝর্ণার আগের কথা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।     আগের পর্বের পর..  ঝাড়গ্রাম শহর থেকে মিনিট কুড়ি, বড়জোর আধ ঘন্টার রাস্তা। কিন্তু ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের অফিসের বাইরে তখন কয়েকজন সাংবাদিক দাঁড়িয়ে। তাঁদের যাতে কোনও সন্দেহ না হয় তার জন্য সরাসরি দহিজুড়ি মোড়ে যাওয়ার রাস্তা ধরলেন না। গাড়ি ঘোরালেন দহিজুড়ির উলটো রাস্তায়, মেদিনীপুর শহরের দিকে। কিছুটা গিয়েই শুরু হচ্ছে কলাবনি জঙ্গল। তাঁর আগে ডানদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে জামবনির রাস্তা ধরল পুলিশ সুপারের গাড়ি। সাদা স্করপিও’র পেছনের সিটে পাশাপাশি প্রভীন ত্রিপাঠী, অলোক রাজোরিয়া। অনেকটা রাস্তা অতিরিক্ত ঘুরে কুশবনিতে ঢোকার রাস্তায় খালের কাছে পৌঁছল পুলিশ সুপারের গাড়ি। খাল বরাবর গাড়ি একটু এগোতেই রাস্তায় ধারে দাঁড়িয়ে এক্স। মুহূর্তের জন্য থামল সাদা স্করপিও। এক সেকেন্ডে এক্স উঠে পড়লেন গাড়িতে। কালো কাচ। তবু এক্সকে পেছনের সিটে নিজেদের মাঝখানে বসিয়ে নিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার এবং ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। দুপুর ১২ টা বাজে। এক্স উঠতেই গাড়ি চলতে শুরু করল।  ‘আমরা গাড়ি জোরে চালিয়ে বেরিয়ে যাব। তুমি শুধু হাত দিয়ে দেখিয়ে দেবে কোথায় ওরা বসে আছে।’ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন এক্স। শুধু বললেল, ‘স্যার আমাকে কিন্তু তাড়াতড়ি ছেড়ে দেবেন। ওদের দুপুরের খাবার দিতে যেতে হবে।’ খালের পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুটা এগোলেই বাঁদিকে ঘুরে (দক্ষিণদিকে) একটা মাটির রাস্তা নেমে গিয়েছে। সেই মাটির রাস্তা ধরে এগোলে ডানদিকে (পশ্চিমদিকে) টানা জঙ্গলে, আর বাঁদিকে (পূর্বদিকে) কিছু বসতি। কুশবনি গ্রাম। এক্সের ইশারায় সেই মাটির রাস্তায় নেমে পড়ল সাদা স্করপিও। সাত-আট’শ মিটার গাড়ি এগোতেই ডানদিকের জঙ্গলে একটা জায়গা দেখিয়ে দিলেন এক্স। চোখের আন্দাজে মাটির রাস্তা থেকে শ’পাচেক মিটার দূরে একটা জায়গা। না থেমে দু’জন আইপিএস অফিসার এবং এক্সকে নিয়ে এগিয়ে গেল গাড়িটা। যাতে কারও সন্দেহ না হয়, অনেকটা এগিয়ে ফের মুখ ঘুরিয়ে গাড়ি ফিরে এল সেই খালের ধারে যেখানে তোলা হয়েছিল এক্সকে। গাড়িতে বসেই এক্সের হাতে একটা গ্লোবাল পজিশনিং ডিভাইস (জিপিএস) দিলেন অলোক রাজোরিয়া। দেখিয়ে দিলেন কীভাবে ডিভাইসটা অন করতে হয়। ‘তুমি যখন একটু বাদে খাবার দিতে যাবে ওদের আশপাশে কোথাও এটা আস্তে করে মাটিতে ফেলে দেবে।। ওরা যেন কেউ দেখতে না পায়। শুধু বাড়ি থেকে বেরনোর আগে এটা অন করে নেবে।’ জিপিএস ডিভাইসটা এক্সের হাতে দিয়ে তাঁকে ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন অলোক রাজোরিয়া।  ‘খাবার দিয়েই বেরিয়ে যাবে ওখান থেকে। একদম সময় নষ্ট করবে না। আর যাবে না কাছাকাছি।’ এক্সকে জিপিএস দিয়ে খালের ধারে নামিয়ে সাদা স্করপিও রওনা দিল ঝাড়গ্রাম শহরের দিকে। ১২ টা ১০। ঘন্টাখানেকের মধ্যে খাবার পৌঁছে যাবে কিষেণজির কাছে। আর তারপরই ফাইনাল অপারেশন……। কথা বলতে বলতে ঝাড়গ্রামে ফিরলেন প্রভীন ত্রিপাঠী, অলোক রাজোরিয়া।দুপুর পৌনে একটা। ঝাড়গ্রামে পৌঁছেই বিনীত গোয়েলের সঙ্গে ফাইনাল প্ল্যানিংয়ে বসলেন এসপি, অ্যাডিশনাল এসপি। বেসিক প্ল্যানিং রেডিই ছিল, শুধু স্পেসিফিক লোকেশন ধরে কথা হল। দিনের আলো থাকতে থাকতেই ফাইনাল অ্যাসল্টের নকশা চূড়ান্ত হচ্ছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরোবেন অফিসাররা। এবার আর অত লোক নয়। কোবরা, সিআরপিএফ এবং সিআইএফের বাছাই করা অফিসার এবং জওয়ানদের নিয়ে তৈরি হল স্পেশাল টিম। হঠাৎ টেলিভিশনের দিকে চোখ গেল অফিসারদের। একটা চ্যানেল ব্রেকিং নিউজ চালাতে শুরু করেছে, ‘কিষেণজিকে পালানোর প্যাসেজ করে দিয়েছে পুলিশ। পুলিশের মদতে ওড়িশায় পালিয়ে গেলেন কিষেণজি।’ টেলিভিশনের স্ক্রিনজুড়ে ব্রেকিং নিউজ চলছে। ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপারের ঘরে কারও মুখে কোনও কথা নেই। খবর দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন অফিসাররা। পিন পড়লে শোনা যাবে শব্দ। ঘরের নীরবতা ভাঙল হঠাৎ আসা একটা ফোনে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একবার বাজতেই কলটা রিসিভ করলেন প্রভীন ত্রিপাঠী। এক্স ফোন করছে। ‘স্যার, প্রবলেম হয়েছে। আমি সুচিত্রাদের জন্য খাবার নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ গ্রামে সিআরপিএফ ঢুকেছে মোটরসাইকেলে করে। তল্লাশি চালাচ্ছে।’ হাফাতে হাফাতে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন এক্স।‘কখন?’ উৎকন্ঠা মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের গলায়। এখন এক্সকে যদি সিআরপিএফ ধরে নেয় সর্বনাশ হবে। আর গ্রামে ফোর্স ঢোকার খবর পৌঁছে গেলে পালাবে কিষেণজি। এত সতর্কতা, প্ল্যানিং ফের জলে যাবে সব কিছু। ‘স্যার, আমাকে ওরা চেনে না। আমি খাবার নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলাম, সিআরপিএফ দেখে আবার ঘরে ঢুকে পড়েছি। এই তো এক মিনিট আগে।’‘ঠিক আছে, আমি দেখছি।’ দ্রুত ফোন কাটলেন পুলিশ সুপার। সময় নেই এক্কেবারে। এক্সের ফোন কেটেই সিআরপিএফের কমান্ডান্ট রবীন্দ্র ভগতকে ডায়াল করলেন।‘আপ আভি কুশবনি গাঁওসে ফোর্স উইথড্র কিজিয়ে। দে আর সার্চিং আওয়ার সোর্স। প্লিজ উইথড্র ইয়োর ফোর্স। ইটস ভেরি আর্জেন্ট। স্পেসিফিক ইনফর্মেশন ইস ম্যাচিওরিং। প্লিজ উইথড্র ইয়োর ফোর্স ফ্রম কুশবনি।’ ‘ওকে, ওকে।’ একদিকে টেলিভিশনে দেখাচ্ছে, রাজ্য পুলিশ গ্রেফতার না করে পালিয়ে যেতে দিয়েছে কিষেণজিকে, অন্যদিকে সিআরপিএফ তাড়া করছে তাদের সোর্সকে। যার কাছে দেওয়া আছে জিপিএস ডিভাইস। আর দু’ঘন্টার মধ্যেই ফাইনাল অপারেশনের জন্য রেডি হচ্ছিলেন তাঁরা। ঝাড়গ্রাম পুলিশ সুপারের অফিসে পাঁচ মিনিট আগেও আশা, উত্তেজনায় চকচক করছিল যাঁদের মুখ-চোখ, এক্সের একটা ফোনে আচমকা হাজির হয়েছে একরাশ দুশ্চিন্তা। সময় কাটতেই চাইছে না।ওদিকে প্রভীন ত্রিপাঠির ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কুশবনি গ্রামে সার্চিং অপারেশনে যাওয়া অফিসারকে ফোনে ধরলেন রবীব্দ্র ভগত। ‘তুম আভি নিকাল যাও উঁহাসে। কিসিকো উঠানেকা জরুরত নেহি।’ নির্দেশ তো দিলেন ফোর্সকে ওখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার, কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হল সিআরপিএফের কমান্ডান্টের। নিশ্চই তাঁদের না জানিয়ে স্পেসিফিক কিছু একটা করছে রাজ্য পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন এল পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের। ‘আই হ্যাভ উইথড্রন আওয়ার ফোর্স ফ্রম কুশবনি। দে আর লিভিং দ্য ভিলেজ।’‘থ্যাঙ্কস। আপ স্রেফ আপনা সিকিউরিটি লেকে কুশবনি ফরেস্টমে ক্যানেলকা পাস চলে আইয়ে। ম্যায় পৌঁউছ রাহা হু।’আর সময় নষ্ট করতে চাইলেন না প্রভীন ত্রিপাঠি। শুধু এক্সকে ফোন করে বলে দিলেন, নির্দিষ্ট জায়গায় খাবার পৌঁছে দিতে।পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের ফোন আসার আগেই অবশ্য গ্রামে সিআরপিএফ জওয়ানদের মোটরসাইকেলে টহলদারি থেমেছে। তাও বাড়ি থেকে বেরোতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। ফোনটা আসার মিনিট পাঁচেক বাদে এক্স খাবারের ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরলেন।বিকেল প্রায় তিনটে। একের পর এক গাড়ি গিয়ে থামতে শুরু করল দহিজুড়ি-জামবনি রাস্তার ওপর ক্যানেলের ধারে। পরপর পৌঁছোলেন বিনীত গোয়েল, প্রভীন ত্রিপাঠি, অলোক রাজোরিয়া, রবীন্দ্র ভগত, কোবরার কমান্ডান্ট দীপক ব্যানার্জি। পৌঁছোতে শুরু করলেন ফাইনাল অ্যাকশনের জন্য সিআরপিএফ, কোবরা এবং রাজ্য পুলিশের সিআইএফের বাছাই করা জওয়ানরা। আর গাড়ি নিয়ে এগনো যাবে না। ঠিক সাড়ে তিনটে নাগাদ ক্যানেল বরাবর পশ্চিমদিকে পায়ে হেঁটে এগোতে শুরু করল স্পেশাল ফোর্স। সঙ্গে অফিসাররা। কম-বেশি এক কিলোমিটার পর বাঁদিকে, অর্থাৎ দক্ষিণদিকে মাটির রাস্তাটা নেমে গিয়েছে। কয়েক ঘন্টা আগে এই রাস্তা দিয়েই রেকি করে গিয়েছিলেন প্রভীন কুমার ত্রিপাঠী এবং অলোক রাজোরিয়া। মাটির রাস্তার কাছে পৌঁছে থমকে দাঁড়াল পুরো ফোর্স। থামলেন অফিসাররাও। এখান থেকেই শুরু হচ্ছে বুড়িশোল গ্রাম। ঠিক গ্রাম নয়, জঙ্গলও নয়। তার মাঝামাঝি বলা যায়। তাড়াহুড়ো, উত্তেজনায় প্রভীন ত্রিপাঠী এবং অলোক রাজোরিয়া ভুলেই গিয়েছিলেন জিপিএসের কথা। জিপিএস তো একবারও সিগনাল দিল না! এক্সকে জিপিএস নিয়ে ধরে ফেলেনি তো কিষেণজি কিংবা সুচিত্রা? শেষ অপারেশন শুরুর আগে এই একটা প্রশ্নই কাঁটার মতো বিঁধল দুই অফিসারের গলায়। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।  আগে থেকেই ঠিক ছিল ফাইনাল অপারেশন লিড করবেন অলোক রাজোরিয়া। তাঁর নেতৃত্বে স্পেশালাইজড ফোর্স দক্ষিণদিকের মাটির রাস্তা ধরে নেমে পড়ল। সবার হাতে একে ৪৭। পকেটে পিস্তল, এক্সটা ম্যাগাজিন। হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরা অফিসার এবং জওয়ানরা যখন ফাইনাল অপারেশনের জন্য স্টার্ট করলেন তখন প্রায় চারটে বাজে। বাকি অফিসার এবং জওয়ানরা দাঁড়িয়ে থাকলেন ক্যানেলের ধারে। মাটির রাস্তা ধরে ফোর্সকে নিয়ে কয়েক’শ পা এগোলেন অলোক রাজোরিয়া। গাড়িতে বসে যেখান থেকে হাত দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে জায়গাটা দেখিয়েছিলেন এক্স, সেখানে পৌঁছে থামলেন ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। চোখের ইশারা করলেন স্পেশাল ফোর্সকে। তারপর পুরো ফোর্সটা শুয়ে পড়ল মাটিতে। শুধু স্পেশাল অ্যাসল্ট ফোর্সটা বুকে হেঁটে এগোতে শুরু করল জঙ্গলের ভেতরে। সবার হাত অটোমেটিক রাইফেলের ট্রিগারে। যাকে বলে ক্রল করা, সেইভাবে কনুইয়ে ঘষটে ঘষটে বুকে হেঁটে এগোল ছোট্ট একটা টিম। সেই ছোট্ট টিমটাই পাঁচটা দলে ভাগ হয়ে গেল জঙ্গলে ঢোকার সময়। এক একটা দলে দুই থেকে তিনজন। এভাবে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা লোকেশন দিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে শুরু করলেন সিআরপিএফ এবং কোবরা জওয়ানরা। তাঁরা কিছুটা এগোতেই আকাশ কাঁপিয়ে একটা শব্দ। প্রথম গুলিটা ছুঁড়ল কিষেণজি, সুচিত্রার সঙ্গে থাকা ১৬-১৭ বছরের ছেলেটা। পরে অফিসাররা জানতে পেরেছিলেন, ছেলেটার নাম মঙ্গল মাহাতো। কিষেণজির সেন্ট্রি। বন্দুক চালানোয় ওস্তাদ, আর কই মাছের জান ওর। বিকেল হচ্ছে জঙ্গলমহলে। চারদিকে কোথাও কোনও আওয়াজ ছিল না। পাখির দল সারাদিন চক্কর কেটে সবে গাছে এসে বসছে। এমন সময় হঠাৎ একটা গুলির শব্দ তোলপাড় ফেলে দিল পুরো এলাকায়। চিল চিৎকারে উড়তে শুরু করল পাখিগুলো। মিনিট খানেকের মধ্যে সব চুপচাপ। মঙ্গল মাহাতোর গুলির কোনও জবাব জওয়ানরা দিলেন না। এটাও যুদ্ধে একটা কৌশল। একটু দেখে নেওয়া, অপোনেন্ট কতটা অ্যাগ্রেসিভ মুডে আছে কিংবা কতটা প্রস্তুত আছে। পালটা গুলি না ছুঁড়ে বুকে হেঁটে আরও একটু এগোলেন দু’জন সিআরপিএফ জওয়ান। আর টার্গেট না করে গুলি ছোঁড়ার একটা সমস্যা হচ্ছে, আওয়াজ শুনে অপোনেন্ট বুঝে যাবে তাদের লোকেশন। তাছাড়া মঙ্গল মাহাতো কাউকে দেখে, না কোনও আওয়াজ শুনে প্রথম গুলিটা ছুঁড়েছে তা তখনও জওয়ানদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাই কিষেণজির সেন্ট্রির চালানো গুলির কোনও জবাব দিলেন না তাঁরা।   মঙ্গল মাহাতো প্রথম গুলিটা ছোঁড়ার পর ৩০-৪০ সেকেন্ড সব চুপ। সওয়া চারটে বাজে। দিনের আলো পুরোপুরি চলে যায়নি ঠিকই, কিন্তু জঙ্গলের ভেতরে অন্ধকার নামছে দ্রুত। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। গুলির আওয়াজ শুনে বুকে হেঁটে মাটিতে শুয়েই আর একটু এগোলেন কোবরার দুই জওয়ান। ফের গুলি চলল। এবার কিষেণজি। মাওয়িস্ট দলটাকে এবার রেঞ্জের মধ্যে পেয়ে গেল ফোর্স। তিনটে ছোট দল এবার ঘিরে নিল কিষেণজি, সুচিত্রা মাহাতো এবং সেন্ট্রি মঙ্গল মাহাতোকে। আর অপেক্ষা না করে পালটা গুলি চালালেন সিআরপিএফ জওয়ানরা। একসঙ্গে অনেকে। সঙ্গে সঙ্গেই পালটা জবাব এল। আর মঙ্গল মাহাতো একা নয়, উইয়ের ঢিবির আড়ালে দাঁড়িয়ে গুলি চালাতে শুরু করলেন কিষেণজি এবং সুচিত্রা। সঙ্গে সঙ্গে জওয়ানরা বুঝে নিলেন কিষেণজিদের এক্সাক্ট লোকেশন। মাটিতে শুয়ে গাছের আড়াল থেকে ঢিবি টার্গেট করে ঝড়ের গতিতে গুলি চালিয়ে চলেছেন জওয়ানরা। এক একটা সেকেন্ড যেন এক এক ঘন্টা। তিন থেকে চার মিনিট টানা গুলি এক্সচেঞ্জের পর জওয়ানরা দেখলেন মাটিতে ছিটকে পড়লেন এক মহিলা। আর মুহূর্তের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে ফের হাতে নিলেন বন্দুক। আর এরপরেই ঘটল সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা। যে কোনও এনকাউন্টারে যাকে বলে ‘কভার ফায়ারিং’, তাই করতে শুরু করলেন একটা বুড়ো লোক। ‘কভার ফায়ারিং’ মানে, কেউ একজন টানা গুলি চালিয়ে শত্রুপক্ষকে এনগেজ রাখবে, সেই সুযোগে তার দলের বাকিরা পালাবে। ‘পালাও সুচিত্রা, পালাও। তু ভি ভাগ মঙ্গল।’ জলপাই পোশাক পরা বয়স্ক মানুষটা বন্দুক হাতে বেরিয়ে এলেন উইয়ের ঢিবি এবং গাছের আড়াল থেকে। এ কে ৪৭ হাতে ৮-১০ জন জওয়ানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওয়িস্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা মাল্লুজোলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি। সুচিত্রা আর মঙ্গলকে পালানোর প্যাসেজ করে দিতে নিজেই শুরু করলেন ‘কভার ফায়ারিং।’‘তা হয় না, তোমাকে একা ছেড়ে যাব না আমরা।’ প্রতিবাদ করলেন সুচিত্রা মাহাতো, যাঁর সঙ্গে কিষেণজির সম্পর্ক নিয়ে গত ৮-১০ মাসে বহু চর্চা হয়েছে মাওবাদীদের অন্দরে। ‘হাম ভি নেহি যায়েঙ্গে’, দিদির সঙ্গে গলা মেলাল মঙ্গলও। ‘না, তুমি পালাও। আমি এমনিই অসুস্থ, বেশি দূর যেতে পারব না। তোমরা পালাও। আমি এদের দেখছি।’ ইস্পাত কঠিন গলায় চিৎকার করে সুচিত্রা আর মঙ্গলকে নির্দেশ দিলেন কিষেণজি। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলেন না সুচিত্রা মাহাতো এবং মঙ্গল। নেতার নির্দেশ। গুলি ছুঁড়তে, ছুঁড়তেই জঙ্গলের ভেতরে দৌড়লেন সুচিত্রা, সঙ্গে মঙ্গল মাহাতো। আলাদা দিকে দু’জনে। ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার দেখলেনও না কিষেণজি। একটা ম্যাগাজিন শেষ। এ কে ৪৭ রাইফেলে নতুন ম্যাগাজিন ভরলেন তিনি। ফের শুরু করলেন এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে। কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। জওয়ানরা কিন্তু জঙ্গলের ভেতরে আলাদা আলাদা জায়গায় পজিশন নিয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে। ঘিরে ফেলেছেন কিষেণজিকে। একজনের রেঞ্জের মধ্যে চলে এলেন তিনি। ব্যাস...। নিজের এ কে ৪৭ রাইফেলে সেকেন্ড ম্যাগাজিনটা শেষ করতেও পারলেন না। আধা সামরিক বাহিনীর ট্রেনড জওয়ানদের পরপর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল শরীরটা। ধুপ করে একটা শব্দ হল শুধু। ২৪ শে নভেম্বর, ২০১১। বিকেল প্রায় সাড়ে চারটে। কিষেণজির দীর্ঘ বছরের লড়াই থেমে গেল ঝাড়গ্রামের জামবনি থানার বুড়িশোল জঙ্গলে। উই ঢিবির ধারে উপুড় হয়ে পড়ে রইল তাঁর নিথর দেহ।  মিনিট পনেরো-কুড়ি অপেক্ষা করলেন জওয়ানরা। কোনও সাড়া শব্দ নেই। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন মাটি থেকে। অলোক রাজোরিয়ার নেতৃত্বে বাকি ফোর্সও তখন সিগনাল পেয়ে ঢুকতে শুরু করেছে জঙ্গলে। শক্তসমর্থ শরীরটা পড়ে আছে মাটিতে। হাতের পাশে পড়ে আছে বন্দুক। কয়েক ফুট দূরে পড়ে আছে একটা ব্যাগ। উই ঢিবির পেছনে মাটিতে চাদর পাতা। ভাঁজ করা কম্বল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছোলেন প্রভীন ত্রিপাঠি, রবীন্দ্র ভগত, দীপক ব্যানার্জি, বিনীত গোয়েলরা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো শরীর। শরীরজুড়ে অজস্র গুলির চিহ্ন। পোশাক শতচ্ছিন্ন। তার মধ্যেই পকেট থেকে কিষেণজির সাম্প্রতিক ছবি বের করলেন প্রভীন কুমার ত্রিপাঠী। মিলিয়ে দেখলেন মৃতদেহের সঙ্গে। দেখা হল পাশে পড়ে থাকা ব্যাগ খুলে। প্রচুর টাকা আর বিভিন্ন কাগজ। নিশ্চিত হলেন অফিসাররা, অপারেশন সাকসেসফুল। সুচিত্রা এবং আর একজন পালালেও, কিষেণজি ইজ নো মোর। খবর পাঠানো হল কলকাতায়। মহাকরণে। ‘স্যর, কিষেণজি ইজ ফিনিশড।’ প্রায় পাঁচটা বাজে। অন্ধকার নেমে গিয়েছে জঙ্গলে। অপারেশন মোটামুটি শেষ। কিন্তু অনেক কাজ বাকি।  বছরের পর বছর দেশের চার-পাঁচ রাজ্যের পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মাওবাদীদের বিভিন্ন স্কোয়াড লড়েছে যাঁর নেতৃত্বে, সেই কোটেশ্বর রাও কিনা শেষ যুদ্ধে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পালানোর সুযোগ করে দিলেন তাঁর দুই সঙ্গীকে! যাঁকে বাঁচাতে দিনের পর দিন কভার ফায়ারিং করেছে তাঁর সেন্ট্রিরা, তিনিই শেষ লড়াইয়ে একই কাজ করলেন সুচিত্রা মাহাতো এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী মঙ্গল মাহাতোকে বাঁচাতে। এ তো আত্মহত্যার শামিল! কেন তিনি সেদিন এমন করেছিলেন তা কোনওদিনই জানা যাবে না। মনস্তত্ত্বের আর পাঁচটা জটিল অমীমাংসিত বিষয়ের মতো এই রহস্যও অজানাই থেকে যাবে। কিন্তু অন্য একটা মৌলিক প্রশ্নের তো অন্তত জবাব মেলা জরুরি। ২৪  নভেম্বর, ২০১১, সন্ধে নামার মুখে ঝাড়গ্রাম মহকুমার জামবনিতে কিষেণজির মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে মাওয়িস্ট আন্দোলনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল মাত্র। কিন্তু তার সলতে পাকানো তো চারদিন আগে এক অজ্ঞাতপরিচয়ের সিআরপিএফ ক্যাম্পে ফোন করে কিষেণজির খবর দেওয়ার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়নি। কিষেণজির মৃত্যু তো স্রেফ চারদিন ধরে বিনপুর, জামবনির সীমানা বরাবর কুশবনির জঙ্গল কিংবা আশপাশের নাম না জানা কয়েকটা গ্রামে সিআরপিএফ এবং পুলিশের যৌথ অভিযানের ইতিহাস নয়। এই ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে রাজ্যের পশ্চিমপ্রান্তের তিন জেলার হাজার-লক্ষ মানুষের জীবনযাপনের কাহিনী। সেই কাহিনী কখনও কষ্টের, যন্ত্রনার। কখনও জীবন যুদ্ধের, সংগ্রামের। কখনও বদলা নেওয়ার, তীব্র প্রতিশোধের। কখনও বা ভালবাসার, ধামসা-মাদলেরও।  কিন্তু এই লেখা এপার বাংলার পশ্চিম প্রান্তে রুক্ষ জঙ্গলমহলের কোনও ইতিহাস রচনা নয়। এই লেখা সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এ’লেখার কোনও চরিত্রই কাল্পনিক নয়। এই লেখা আসলে সিপিআই মাওয়িস্ট পলিটব্যুরো সদস্য কিষেণজির মৃত্যু রহস্যকে তাড়া করা। যতটা সম্ভব পেছন দিকে হাঁটা। আর জঙ্গলের রুক্ষ, নতুন-নতুন রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দুই আর দুই যোগ করে কখনও উত্তর এসেছে পাঁচ, কখনও তিন। কখনও বা শূন্যও! কারণ, জঙ্গলমহলের এই যাত্রাপথ কোনও পাটিগণিত নয়। এটা রসায়ন। যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রভাব এক এক সময় এক এক রকমভাবে এখানকার গরিব, তফশিলি জাতি, উপজাতি এবং সাধারণ মানুষের বহুমাত্রিক জীবনের দিক পরিবর্তন করেছে। এবং সেই দিক পরিবর্তনকে যতটা গভীরে গিয়ে হদিস করা এই সাধারণ সাংবাদিকের যোগ্যতায় কুলিয়েছে, তা নিয়েই এই লেখা, ‘কিষেণজি মৃত্যু রহস্য’। যে রহস্য ২৪ নভেম্বর কিষেণজির মৃত্যুতে শেষ হচ্ছে না, শুরু হচ্ছে মাত্র। পরবর্তী অধ্যায়েও তাই ফিরে দেখা থাকবে ২৪ নভেম্বর, ২০১১ সালের অপারেশনের কিছু ঘটনার দিকে। ‘কিষেণজি মৃত্যু রহস্য’ আসলে সেই সময় এবং ঘটনাগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা, যাতে আন্দাজ করা যায় কবে, কেন, কোন পরিপ্রেক্ষিত কিংবা পরিস্থিতেতে ঝাড়গ্রাম মহকুমায় রক্তাক্ত মাওবাদী আন্দোলনের বীজ পোঁতা হয়েছিল। আর কোন আলো, বাতাস, জলেই বা সেই বীজ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে কালক্রমে রক্তস্নাত মহীরুহের চেহারা নিল।         ঝাড়গ্রাম, ১৯৬৬ তখন মেদিনীপুর জেলা অবিভক্ত। দেশের সবচাইতে বড় এই জেলার এক ছোট্ট মহকুমা ঝাড়গ্রাম। শীত এবং গ্রীষ্ম দুইই খুব চড়া এই লাল মাটির পাথুড়ে এলাকায়। বেশিরভাগ মানুষ আদিবাসী, তার মধ্যে আবার সাঁওতালই বেশি। অধিকাংশ জমিতেই চাষ-আবাদ হয় না। কল-কারখানাও নেই কিছু। করার মতো কাজ কোথায় এখানে? তাই পশ্চিমবঙ্গের এই প্রান্তিক এলাকার মানুষের হাতে তখন অঢেল সময়। গরমের লম্বা দুপুরগুলো কাটতেই চায় না। অফুরন্ত সময় ঝাড়গ্রাম শহরের অল্প কিছু সরকারি অফিসের কর্মীর হাতেও। তখন রাজ্যের প্রশাসনিক সদর দফতর মহাকরণ থেকে ঝাড়গ্রামের দূরত্ব যতটা না ভৌগোলিক, তার চেয়েও বেশি মানসিক। তাই রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের যে রোডম্যাপ, তার শেষ স্থানে  ঝাড়গ্রামের নাম।সেটা ১৯৬৬ সাল। দু’বছর আগে ভেঙেছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। তৈরি হয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদী বা সিপিআইএম। এই সময়ের কয়েক মাস বাদে পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হয়েছে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার। ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, স্লোগানের সলতে পাকানো শুরু হচ্ছে তখন। যদিও দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি আন্দোলনটা ঘটল আরও বছর খানেক বাদে। এই বছরই দু’চোখে আর একটা বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে বলিভিয়ায় পা রাখলেন চে গুয়েভারা। আর এই সময়ের প্রায় দশ বছর বাদে দেশে এল জরুরি অবস্থা।   ১৯৬৬র এমনই এক দুপুরে ঝাড়গ্রামের সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসারের (এসডিপিও) কাছে থানা থেকে খবর এল, ‘এক সাঁওতাল ব্যক্তি তার স্ত্রীকে খুন করেছে।’ সবে এসডিপিও ঝাড়গ্রাম পোষ্ট তৈরি হয়েছে। খবরটা শুনে একটু অবাকই হলেন ঝাড়গ্রামের প্রথম এসডিপিও তুষার তালুকদার। সাঁওতালরা খুবই শান্তিপ্রিয় মানুষ। স্বামী খুন করেছে স্ত্রীকে! ঝাড়গ্রাম থানার অফিসারকে নিয়ে এসডিপিও শহর থেকে কিছুটা দূরে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দিলেন। এসডিপিও’র না গেলেও চলত, কিন্তু গেলেন কৌতূহলে। একে কম বয়েস, তার ওপর নতুন চাকরি। দেখতে গেলেন, কেন এই খুন? তাছাড়া অফিসে বসে করার মতো কোনও কাজও নেই। অফিসাররা ঘটনাস্থলে গিয়ে শুনলেন, সারাদিন মাঠে খাটাখাটুনির পর বাড়ি ফিরে ক্ষুধার্ত সাঁওতাল মানুষটা স্ত্রীকে কিছু খাবার দিতে বলে। বাড়িতে কোনও খাবার ছিল না। অল্প যতটুকু ছিল তা ওই সাঁওতাল মহিলা তাদের ছোট্ট ছেলেকে দুপুরে খাইয়ে দিয়েছিল। খাবার না পেয়ে উত্তেজিত সাঁওতালটি স্ত্রীয়ের ওপর চিৎকার করে। দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরপর এই ঝগড়া-ঝামেলার মধ্যেই ওই সাঁওতাল ব্যক্তি স্ত্রীকে একটা ধাক্কা দেয়। টাল সামলাতে না পেরে মহিলা মাটিতে পড়ে যায় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হয়। ঘটনায় হতচকিত হয়ে যায় সাঁওতাল মানুষটা। নিজেই থানায় গিয়ে খবর দেয়। পুলিশ থানায় একটি খুনের মামলা চালু করে এবং লোকটাকে গ্রেফতার করে। এই সাঁওতাল বাড়ি এবং আশপাশের আরও অনেক বাড়িতেই দুপুরে, বিকেলে, রাতে খাবার নিয়ে ঝগড়া, মারপিট, চিৎকার প্রায় রোজের ঘটনা তখন। দু’বেলা তো দূর অস্ত, একবেলা ভরপেট খাবার আছে, এমন বাড়িই তখন ওই এলাকায় হাতে গোনা। কিন্তু এদিন যেটা ঘটল, সেটা সচরাচর ঘটে না। স্বামীর ধাক্কায় মাটিতে পড়ে আর উঠে দাঁড়াল না শান্তি মুর্মু। যে কারণে পুলিশ নিয়ে এসডিপিওকে যেতে হল ওই বাড়িতে। এসডিপিও ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলেন, বাড়ির দরজার সামনে উঠোনে মহিলার মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু প্রতিবেশী। কারও মুখে কোনও কথা নেই। সবাই মোটামুটি ঘটনাটা দেখেছে। জানে কী হয়েছে। তাছাড়া এসডিপিও বুঝলেন, কাউকে জিজ্ঞেস করারও তো নেই তেমন কিছু। লোকটা নিজেই পুরো ঘটনা জানিয়েছে থানায়। এরপরই এসডিপিও’র চোখ পড়ল ছোট্ট বাড়িটার ঘরের নীচু দরজার দিকে। অর্ধেক খোলা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে বছর ছয়েকের একটা বাচ্চা ছেলে। খালি গা, কোমরে একটা নেংটির মতো প্যান্ট। পিছনে ঘরটা অন্ধকার। বাচ্চাটা মুখও তাই। পোড়া তামাটে গায়ের রং। শূন্য দৃষ্টিতে বছর ছয়েকের সাঁওতাল শিশু দেখছে, দশ হাত দূরে মরে পড়ে আছে মা। মরা মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়িতে এসেছে কিছু অচেনা লোক। সবকটা লোকের গায়ে এক রকম জামা-প্যান্ট। তখনও ওই বাচ্চাটা জানত না, একই রকম পোশাক পরা এই অচেনা লোকগুলোকে পুলিশ বলে।চোখে জল নেই, মুখে কথা নেই, ফ্যাল ফ্যাল চোখে ছোট্ট ছেলেটা এদিক ওদিক দেখছে। বাবা-মা’র মধ্যে খাবার নিয়ে ঝগড়া-ঝামেলা তো সে রোজই দেখে। খিধে কাকে বলে, সে অভিজ্ঞতাও তার ছ’বছরের জীবনে হয়েছে বিস্তর। কিন্তু মা যে আর কোনও দিন উঠে দাঁড়াবে না তা তখন বোঝার বয়েস না হলেও ছোট্ট ছেলেটা বুঝছে, কিছু একটা গুরুতর ঘটেছে।একবার ছেলেটার দিকে, একবার মাটিতে পড়ে থেকে মৃত মহিলার দিকে তাকাচ্ছেন ঝাড়গ্রামের প্রথম এসডিপিও তুষার তালুকদার। মহিলার রুগ্ন, শীর্ণ চেহারা দেখে কলকাতায় বড় হওয়া এসডিপিও’র মনে হল, অনাহার, অপুষ্টিতে মহিলার শরীরে আর কিছুই ছিল না। এমন হাড়গিলে চেহারাও হয় মানুষের! তাছাড়া একটা বিষয়ে তুষার তালুকদারের মনটা খচখচ করছিল। মহিলা যেভাবে স্বামীর ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গিয়েছেন, তাতে বড় ইনজ্যুরি হওয়ার কথা নয়। হয়ওনি তেমন। এক্সটার্নাল ইনজ্যুরিও নেই কিছু। তবে আচমকা মহিলার মৃত্যু হল কীভাবে? এইভাবে পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তো মৃত্যু হওয়ার কথা নয়।    শান্তি মুর্মুর মৃতদেহ মহকুমা হাসপাতালে পাঠিয়ে ঝাড়গ্রাম শহরে ফিরলেন তরুণ এসডিপিও। অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে সন্ধে নাগাদ নিজে গেলেন ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে। পুরো ঘটনাটা বললেন মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিককে। তিনিই ওই মৃতদেহের ময়না তদন্ত করবেন।‘আপনি কী চাইছেন?’ এসডিপিও’র কাছে জানতে চাইলেন মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক।‘আমি চাই খুনের অভিযোগ থেকে লোকটার মুক্তি। আমি নিশ্চিত, লোকটা তার স্ত্রীকে খুন করতে চায়নি, করেওনি। মহিলার যা শারীরিক অবস্থা এমনিও পড়ে গিয়ে মৃত্যু হতে পারত। আর ওদের বাচ্চাটাকে দেখে বড় অসহায় লাগছিল। মা মারা গেছে, বাবা জেলে চলে গেলে তো ছেলেটা না খেতে পেয়ে মরে যাবে। তাছাড়া আমি জানতে চাই, ওই মহিলার মৃত্যু হল কীভাবে?’ টানা বলে থামলেন এসডিপিও।পরদিন মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক ঝাড়গ্রামের এসডিপিও’কে জানালেন, ‘ময়না তদন্তে দেখা গিয়েছে, দীর্ঘদিন যক্ষা রোগে ভুগে মহিলার ফুসফুস এমন ক্ষয়ে গিয়েছিল, ওই সামান্য ধাক্কা সামলাতে পারেনি তাঁর শরীর। ধাক্কায় পড়ে গেলেও, মৃত্যুর আসল কারণ, দীর্ঘদিনের অনাহার, দুর্বলতা এবং যক্ষা রোগ।’ এই ময়না তদন্ত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে মামলাটাকে একটু অন্যভাবে করার জন্য থানাকে নির্দেশ দিলেন তুষার তালুকদার। কিছুদিন পর সাঁওতাল লোকটির জামিন হল। সাঁওতাল লোকটার নাম মহাদেব মুর্মু। আর মহাদেব-শান্তির ছ’বছরের ছেলে রামজীবন তখন জানতেও পারল না, বাবার ধাক্কায় নয়, মায়ের মৃত্যু হয়েছে বহুদিনের অনাহারে। যক্ষা রোগে। কিন্তু এ আর সেই ১৯৬৬র ঝাড়গ্রামে নতুন কী?  ক্রমশ।.. 
    বারীন সাহার সিনেমাটি অবশেষে দেখা গেল  - সিএস | যে সিনেমা আদৌ দেখা যাবে কিনা, সে সন্দেহ ছিল দীর্ঘদিন ধরে, সেই সিনেমাটি অবশেষে দেখে উঠতে পারলাম। অতএব সে নিয়ে কিছু কথা ।১৯৬১ সালে বারীন সাহা 'তের নদীর পারে' সিনেমাটি বানিয়েছিলেন, রামধনু পিকচার্সের ব্যানারে, প্রডিউসার ছিলেন নিজের; ভাই রাজেন সাহা। বোঝাই যায়, নিজেরাই টাকা যোগাড় করে ঐ সিনেমাটি তৈরী করা। রিলিজ হয়েছিল আট বছর পরে, ১৯৬৯ তে, এক সপ্তাহ হলে চলেছিল, এরকম শোনা যায় যে কাউন্টারের কর্মীরা 'ঐ বোরিং সিনেমা' কী দেখবেন বলে দর্শকদের নিরস্ত করতেন, যাতে সিনেমাটি অরো কিছুদিন হলে চলে সেই জন্য রাজেন সাহার কথা মত তার ছেলে (বারীন সাহার ভাইপো) সিনেমাটির টিকিটও কিনে নিয়েছিল, কিন্তু বিশেষ কিছু ফল হয় নি, দর্শকধন্য হওয়ার জন্য ! বারীন সাহার মনে হয় একরকমের গোঁ ছিল, নিজের মত সিনেমা বানানোর গোঁ বা সিনেমা লাইনের নিয়মগুলোকে না মানার গোঁ, তার পরিণতি যেমন এই সিনেমাটি, তেমনই হয়ত আর দ্বিতীয় কোন সিনেমা না বানিয়ে উঠতে না পারা, দু'টি ডকুমেন্টারি বানানো এবং তারপরে সিনেমা ছেড়ে দিয়ে বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত জায়গায় স্কুল তৈরী ওর সেই কাজেই যুক্ত হয়ে থাকা। হয়ত, এই যে নিজস্বতা, নিজের কাজে বা জীবনে তার সাথে বামপন্থী রাজনীতিও যুক্ত, আইপিটিএর সাথে যুক্ত ছিলেন, ১৯৪৭-৪৮ সাল নাগাদ বিপ্লবাবাদী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়া, ক্রমশঃ সেসব থেকে দূরে চলে যাওয়া (বিপ্লব অত সহজে হয় না, এই বোধ তৈরী হওয়া)। এই সময়ের পরে, ১৯৫০ এর দশকে ইউরোপে যাওয়া সিনেমা শেখার জন্য, প্যারিস ও রোমের দুটি সংস্থাতে। ফলতঃ, নিজস্বতা হয়ত গড়ে উঠেছিল, দুটি দিক থেকে, রাজনীতি আর সমসাময়িক বিশ্ব সিনেমা থেকে, সরলভাবে বললে, ঋত্বিকের সাথে মিল আছে। তো সিরিয়াস সিনেমা নিয়ে লেখাপত্রে, বাংলা সিনেমা সংক্রান্ত, সেসবে 'তের নদীর পারে' সিনেমাটির উল্লেখ পেতাম, মনে পড়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর একটি লেখা, সিনেমা বানানোর ইচ্ছে যখন ওনার তৈরী হচ্ছে তখন এই সিনেমাটি ওনাকে প্ররোচনা দিত এই ছিল মন্তব্য, এরকম আরো কিছু লেখায় হয়ত সিনেমাটির কথা পড়েছিলাম। ক'বছর আগে 'মনফকিরা' থেকে 'চলচ্চিত্রাক্ষর' নামে একটি বই বেরিয়েছিল, বারীন সাহার সাক্ষাৎকার ও সিনেমা নিয়ে অল্প কিছু লেখাপত্র সমেত, সে বইও পড়েছিলাম, কিন্তু না সিনেমাটির খোঁজ পাইনি।ক'দিন আগে পেয়ে গেলাম সেই খোঁজ।কলকাতার SRFTI তে ফিল্ম আর্কাইভিং আর রেস্টোরেশন নিয়ে এক সপ্তাহের অনুষ্ঠান চলছিল ( https://arcurea.in ), সেই অনুষ্ঠানে কিছু পুরোন সিনেমা দেখানো হচ্ছিল যেগুলোকে বাঁচিয়ে তোলা গেছে, সেই সবের মধ্যে বারীন সাহার সিনেমাটিও ছিল, একটি শো ছিল এক বেস্পতিবারের সন্ধ্যেতে, অন্যটি পরের দিন সকাল ১০টায়, সন্ধ্যের শোটিতে সময় করা গেল না, অতএব পরের দিন সকালে দেখা গেল, ছুটি নিয়ে, সকালের দিকে বেরিয়ে। শোনা যায় ১৯৯২ তে গোর্কি সদনে একটি শো হয়েছিল, তারপর কলকাতায় এইবার, সেই জন্য ছুটি - সকাল ইত্যাদি বিশেষ কিছু নয়। এও ফেসবুক থেকে জানলাম যে সিনেমাটি ছিল ৮২ মিনিটের, গোর্কি সদনের শোতেও তাই দেখানো হয়েছিল, কিন্তু এবারে সিনেমাটি ছিল ৭৮ মিনিটের, ৪ মিনিট মনে হয় বাঁচানো যায় নি, হয়ত সিনেমার শেষটিতে সেই বাদ পড়া অংশ ছিল।সিনেমার ক্ষীণকায় গল্পটি একটি সার্কাস কোম্পানীকে নিয়ে, সেই সার্কাসের ক্লাউন (জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়) ও ম্যানেজার প্রধান দুই চরিত্র, পরে এদের সাথে যুক্ত হয়ে পড়বে এক নাচুনী মেয়ে (প্রিয়ম হাজারিকা, ভূপেন হাজারিকার প্রথম স্ত্রী), তিনজনের মধ্যে কন্ফ্লিক্ট এবং এই তিনজনকে ব্যবহার করে পরিচালকের 'বক্তব্য'। সিনেমাটির পুরো শুটিং-ই ছিল আউটডোরে, মেদিনীপুরে, প্রথমে কালী ব্যানার্জী ও রুমা গুহঠাকুরতা ছিলেন দুই চরিত্রে, কিন্তু কিছুদিনে শুটিং হওয়ার পরে বৃষ্টিতে শুটিং নষ্ট হয়, যা ছবি তোলা হয়েছিল সেসবও, অভিনেতারা কলকাতা ফিরে যান, তাদের ডেট আর পাওয়া যায়নি, ফলে নতুন করে শুটিং এবং অন্য দুই অভিনেতা ও অভিনেত্রীকে নিয়ে ! ক্লাউন চরিত্রটি আসলে এক আর্টিস্ট (ভাটিখানার বিশেষ এক দৃশ্যে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়), ম্যানেজারের সাথে তার যে কনফ্লিক্ট সে আর্ট/আর্টিস্ট আর ব্যবসার দ্বন্দ (ম্যানেজার সার্কাসে লোক টানার জন্য নাচুনী মেয়ে আনে, পাশের এক সার্কাসও একই পথ নিয়ে ভোক্তা বা দর্শকের সংস্থান করছে), অতএব সিনেমাটির একটি প্রচলিত পাঠ (পরিচালকের বক্তব্য) এই আর্ট ও কমার্শিয়ালাইজেশন নিয়ে, এরকমই ভাবা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি ভুল কিছু নয়, একটি বক্তব্য নিশ্চয়, কিন্তু অন্যদিকে নাচুনী মেয়েটির (প্রিয়ম হাজারিকা) সাথে ক্লাউনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, দীর্ঘ এক দৃশ্য আছে যেখানে নদীর জলের উচ্ছ্বলতার সাথে মেয়েটির উচ্ছ্বলতা মিশে যাচ্ছে, কিন্তু ক্লাউন/আর্টিস্ট কিছু দুরত্ব থেকেই ঐ দৃশ্য দেখে, যেন নাচুনী মেয়েটি প্রতিকায়িত হয় 'জীবন' আর 'আনন্দ' এই দুয়ের মধ্যে কিন্তু আর্টিস্ট যেন সেসবের সাথে পুরো যুক্ত হতে পারে না, সিনেমার শেষ দৃশ্যে ম্যানেজার ও নাচুনী, দু'জনেই সার্কাস থেকে চলে যায়, ক্লাউন ও আর্টিস্ট একা থেকে যায় সার্কাসটিকে নিয়ে।আর্টিস্টের নিয়তি একা হওয়া, সিনেমটি এই কথাও বলে?দীর্ঘ শট আছে রাতে, ফাঁকা বাজারের মধ্যে ক্লাউনের মদ্যপ অবস্থা, একাকী কথা বলা, বাড়ির ওপর থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভাঙা, তার ক্রাইসিস। তারও আগে, দীর্ঘ, দীর্ঘ শট আছে, নাচুনী মেয়েটি যখন গ্রামে আসবে, নদীর ঘাট থেকে চটি হাতে নিয়ে বাজারের মধ্যে দিয়ে তার হেঁটে যাওয়া, লোকজনের কাজ ফেলে মেয়েটিকে অনুসরণ করা, সামনে ম্যানেজার, তার পরে মেয়েটি, পেছনে লোকের বহর বাড়তে থাকা, রাস্তা, আলজমি, নদীর ধার দিয়ে সার্কাসের তাঁবুতে পৌঁছন, সাবজেক্টিভ এক দৃশ্য, পরিচালকের বক্তব্য এই দীর্ঘ শটটির মধ্যেও রয়ে গেছে। দেখার সময় মনে হয়েছে সিনেমাটির kinship ঋত্বিকের 'অযান্ত্রিক' সিনেমার সাথে আছে (সিনেমার দুই প্রধান চরিত্রর সমাজ থেকে আলাদা ও একা হয়ে যাওয়ার মধ্যে), হয়ত ফেলিনির 'লা স্ত্রাদা' সিনেমাটির সাথেও আছে (তিন চরিত্রের কনফ্লিক্টের মধ্যে)। সিনেমাটি দেখানোর আগে বারীন সাহার ভাইপো সিনেমা ও বারীন সাহাকে নিয়ে একটি লেখা পড়েন, জানান যে সিনেমার শুটিং যেখানে হয়েছিল তার নাম ছিল তেরপাখিয়া (নন্দীগ্রামের কাছে), সেখানে যে নদীটি তার নাম 'তের' নদী এবং সিনেমাটি ঐ তের নদীকে নিয়েই। এই মতটি আমার পছন্দ হয় নি, এ যেন নাম ও সিনেমাটিকে স্থানিক করে দেওয়া একটি তথ্য ব্যবহার করে, ফলে নামটির মধ্যে যে অনির্দিষ্টতা, যা দর্শকের সাথে সিনেমাটির বিষয় বা গল্পের দুরত্ব তৈরী করছে কিন্তু একই সাথে সিনেমাটিকে যা সিম্বলিক করে তুলছে (সমুদ্র আর তের নদীর পার যেভাবে করে), সিনেমার রিয়েলিস্ট দৃশ্য আর তার মধ্যে দিয়ে প্রতিকায়িত বক্তব্য, বারীন সাহার অন্বিষ্ট হয়ত তাই ছিল (কিন্ত বারীন সাহার বইটি বার করে দেখতে হবে সিনেমাটি নিয়ে নিজে কী বলেছিলেন)।সিনেমাটির নামলিপি নেটে পাওয়া যায়, দেওয়া গেল। (ইউটিউবে একটা ক্লিপিং ছিল ক'দিনে আগেও দেখেছিলাম কিন্তু এখন সার্চ করে আর নজরে আসছে না )
    সালাম সালাম হাজার সালাম  - Partha Banerjee | সালামদা, আপনাকে সালাম।আজকেই নিউ ইয়র্ক ফিরে যাচ্ছি। আজকেই এই সংবাদটা পেলাম। আমাদের বহুকালের দাদা ও বন্ধু ব্রুকলিনের সালাম সারওয়ার চলে গেলেন। বৌদিকে ও তাঁদের তিন ছেলেমেয়েকে সমবেদনা জানাই।সালামদা চলে গেলেন তাঁর প্রিয় ভাইয়ের কাছে, যে ভাইটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হারিয়ে গিয়েছিলো। যার ছবি তাঁর ম্যাকডোনাল্ড অ্যাভিনিউয়ের দোতলার অফিসের দেওয়ালে চিরকাল টাঙানো থাকতো। আর টাঙানো থাকতো ঢাকার এক কৃষ্ণচূড়ায় ঢাকা ঝিলের ছবি। আর থাকতো বাংলাদেশের এক মানচিত্র।সালামদাকে নিয়ে অনেক কিছু লেখার ইচ্ছে আছে। আজ আর মাত্র কয়েক ঘন্টা ভারতে। তাই খুব সংক্ষেপে লিখছি। এই মানুষটি ছিলেন বলতে গেলে আমাদের নিউ ইয়র্ক জীবনের প্রথম থেকে মেন্টর ও অভিভাবক। আমাদের বাড়ি কেনা হয়েছিল তাঁর সাহায্যে। আমার প্রথম বাংলাদেশ ভ্রমণ হয়েছিল তাঁর সাহায্যে। ব্রুকলিনের বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল তাঁর সাহায্যে।হ্যাঁ, বাংলাদেশী কমিউনিটি নয় শুধু, বাঙালি কমিউনিটি। ব্রুকলিনের পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের সংগঠন প্রবাসীর দুর্গাপুজোতে দীর্ঘকালের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সালামদা। ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন পঁচিশ বছর। তারপর এলো দিন বদলের পালা। নতুন যুগের নতুন প্রবাসী বাঙালিরা তাঁকে "মুসলমান" হওয়ার কারণে অসম্মানিত করলো। তিনি সরে গেলেন।আমরা সরে যাইনি। প্রতি সপ্তাহেই দেখা হয়েছে এতগুলো বছর ধরে, তাঁর অসুস্থতার আগে পর্যন্ত। তিনিও আমাদের বাড়ি অনেকবার এসেছেন। আমার বাবার নিউ ইয়র্ক সফরের সময়ে তাঁদের মধ্যে একটা আলগা সখ্য গড়ে উঠেছিল। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, আপাদমস্তক বাঙালি সালাম সারওয়ারের সান্নিধ্যে এসে আপাদমস্তক আরএসএস জিতেন্দ্রনাথের মনেও হয়তো একটু পরিবর্তন এসে থাকবে।তিনি কবিতা ভালোবাসতেন। লিখতেনও। আমরা কবিতা, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও বাঙালিত্ব নিয়ে অনেক গল্প করেছি তাঁর ম্যাকডোনাল্ড অ্যাভিনিউর সিপিএ অফিসে বসে। তিনি তাঁর কবিতা আমাকে শুনিয়েছেন। আবার আমার লেখা কবিতা আবৃত্তি করেও শুনিয়েছেন।বিজয়া দশমীর পরে প্রতি বছর আমি তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে এসেছি। তিনিও আশীর্বাদ করেছেন। আজ শেষ প্রণাম করে নিলাম আর একবার।কোনো কোনো মানুষকে কখনো ভোলা যায়না। তা তিনি যেখানেই থাকুন না কেন।সালামদা, আপনাকেও কখনো ভুলবো না।
  • জনতার খেরোর খাতা...
    একটি রাজনৈতিক ভক্তিগীতি  - Sandipan Majumder | আমি বিজেপি তুমি মোদী  হেভাতিছ ভারত মাঝে।।নদী সরযূতে  যেন  উজ্জ্বল  প্রভারামমন্দিরের বিরাজে।।তোমায় হেরিগো স্বপনে শয়নেবিশ্বগুরুর আসনেযদি অচিরেই যাই জিডিপেতেতৃতীয়  বৃহৎ  স্থানেতে।।তুমি যে নিখিল হিন্দুমম ভার্তীয় বক্ষে।না হেরিলে ওগো তোমারে টিভিতেতমসা ঘনায় চক্ষে।তুমি অগণিত  ছেলেপুলেদেরপ্রাণবায়ূ দাও জীবনেবেকার থাকিলেও তোমার  নামে জয়ধ্বনি  তারা রচে।। 
    ছেলেপিলেদের থেকে শিখুক - upal mukhopadhyay | কাউন্টার ন্যারেটিভের শক্তিশালী অস্তিত্ব দেশ জুড়েই আছে। সেই ন্যারেটিভের একটা এলিট, স্ট্রাকচার্ড প্রেজেন্টেশন হল জেএনইউ এসইউ নির্বাচনের ফলাফল। এটাকে বামপন্থার জয় বলার থেকে অন্য স্বরের আত্মঘোষণা হিসেবেই সবাই দেখছে, এমনকি গদি মিডিয়াও। এবিভিপি-র প্রতিনিধি আল জাজিরাতে বলেছেন এটা নাকি বামেদের নিভে যাওয়ার আগে জ্বলে ওঠা। ঠিকই, এটা এবিভিপি-র প্রার্থিত বাস্তবতা। সে অনুযায়ী পরিকল্পনার খামতি ছিল না হিন্দুত্ববাদীদের, ফলে বাম প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থীর নমিনেশন বাতিল হয়। কিন্তু বামেরা তাদের কঠোর সমালোচক বা প সা প্রার্থীকে সমর্থন করে প্রমান করল তারা কাউন্টার ন্যারেটিভের বিজয়ের পথ দেখাতে সমর্থ। এই নমনীয়তা বামেরা সর্বত্র দেখাক। এমনকি ঐতিহ্যশালী বামপন্থার ক্ষয়িষ্ণু দুর্গ পশ্চিমবঙ্গেও। ছেলেপিলেদের থেকে শিখুক।
    হেদুয়ার ধারে - ১১৪  - Anjan Banerjee | এর মধ্যে শ্রীলেখা কায়দা কৌশল করে চিঠিটা অসিতের হাতে গুঁজে দিতে পারল। ভাগ্যক্রমে আজকে ফাঁকায় পেয়ে গেল অসিতকে রিহার্সালের জন্য ওপরে ওঠার সময়।অসিত বলল, ' কি এটা ? '---- ' পরে পড়ে নিও ' বলে ধড়ফড় করতে করতে সরে গেল ঘরের ভিতর।অসিত ভাঁজ করা কাগজের টুকরোটা প্যান্টের পকেটে রেখে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ভাবতে লাগল, এ আবার কিরে বাবা ... এতদিন বাদে আবার নতুন ক'রে চোতা ধরানো কি জন্য ! কি কেস কে জানে। সে ভাবল, যাক এখন তো 'শেষরক্ষা' হোক ... এসব চিঠিচাপাটি পরে পড়া যাবে। ভাঁজ করা কাগজটা প্যান্টের পকেটেই রইল। আসলে প্রাপ্তি ঘটে যাওয়ার পর এসব সম্পর্কে তেমন কৌতূহল বা রোমাঞ্চ বিশেষ কিছু থাকে না, অন্তত ছেলেদের দিক থেকে। সবাই যে দায়িত্বজ্ঞানশূন্য হয়, তা না। অসিত এই অবশ্যই দায়িত্ববান শ্রেণীতে পড়ে। তবে, মেয়েদের ব্যাপারটা আলাদা, বিশেষ করে শ্রীলেখার বয়সী মেয়েদের। সামান্য বাড়াবাড়ি কোন ফুলঝুরি ফুলকি চলার রাস্তায় এসে পড়লে তারা দুর্ভাবনা আর আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে যায়। কারণে বা অকারণে একটা অস্বস্তির বুদ্বুদ উঠতে থাকে মনের ভিতর অবিরত।শ্রীলেখা চিঠিটা নির্জন সন্ধ্যার সিঁড়িতে কোনরকমে অসিতের হাতে গুঁজে দিয়ে ঘরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা অঞ্জলির চোখ এড়াল না এবং সে অবশ্যই কিছু একটা আন্দাজ করল।অসিত কিন্তু ওপরে গিয়ে নাটকের রিহার্সালে ঢুকে গেল পুরোপুরি। চিঠিটার কথা বেমালুম ভুলে গেল।রিহার্সালের শেষে অসিত যখন সদলবলে নীচে নামছে জন্মেজয়বাবুর পরিবার সমেত তখন শ্রীলেখা একবার অতি সন্তর্পণে তাদের ঘরের দরজার মুখে এসে দাঁড়াল। এক ফাঁকে দুজনের চোখাচোখি হ'ল। অসিত হাত উল্টে পাল্টে ইশারায় কিছু নির্বাক বার্তা পাঠাল, যার মানে হল --- এখনও পড়িনি ... পড়ে নেব ... চিন্তা নেই...শ্রীলেখা ঘরের ভিতর ঢুকে গেল। অসিতের ইশারাবার্তায় আশ্বস্ত হল কিনা ঠিক বোঝা গেল না। অঞ্জলি রান্নাঘরে ব্যস্ত আছে। ভাগ্যিস এসব কিছু তার চোখে পড়ল না।অসিত কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে চিঠিটার কথা বেমালুম ভুলে গেল। রাত প্রায় বারোটার সময় ঘুম ঘুম আসছে, নাটকের নানান দৃশ্যপট মাথার মধ্যে ঘুরছে, এমন সময়ে হঠাৎ শ্রীলেখার দেওয়া ভাঁজ করা কাগজটার কথা মনে পড়ে গেল। সে তড়াং করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল। ভাবল, এই রে ... সেটা পকেটে আছে তো ঠিকঠাক ... কোথাও পড়ে টড়ে যায়নি তো ...। আলো জ্বালিয়ে প্যান্টের পকেট হাতড়ে কাগজটা বার করল। তাড়াতাড়ি কাগজের ভাঁজ খুলে ফেলল। আর কেউ নেই। ঘরে সে একাই শোয়।কাগজটা প'ড়ে তার তো চক্ষু চড়কগাছ।ওতে যা লেখা আছে তা এরকম ----" মা কদিন ধরে খুব ঝামেলা করছে। কাল রাতে বাবার সঙ্গে খুব ঝগড়া করছিল। মা তোমাকে একদম পছন্দ করছে না কদিন ধরে। তোমার সঙ্গে মিশতে দেবে না মনে হয়। বোধহয় সেদিন কিছু দেখে ফেলেছে। অনেক বারণ করলাম, শুনলে না তুমি। চল আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি। তাছাড়া উপায় কি। তেমন কিছু হলে আমি আত্মহত্যা করব এটা জেনে রেখ "অসিত কাগজটা ভাঁজ করে আবার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবল, পাগল যে কতরকমের হয় ...সেদিন সাগর আর রাত্রি একসঙ্গে বেরল বটতলা থানার থেকে। সাগর একটু ইতস্তত করছিল। তার চমকের আবেশ, মানে যাকে বলে হ্যাংওভার এখনও কাটেনি। কিন্তু কালীবাবু ঠেলেঠুলে সাগরকে রাত্রির সঙ্গে পাঠালেন।---- ' আরে যান যান ... একটু আগায়ে দ্যান ... ম্যাডামের একটা প্রেস্টিজ আসে না ... কি বলে, একটা মিনিমাম ডেকোরাম তো মেনটেন করেন ... 'রাত্রি কোন কথা না বলে কালীবাবুর কথা শুনে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসল। সাগর তখনও বসে আছে দেখে রাত্রি সটান বলল, ' নিন নিন অনেক হয়েছে ... এবার চলুন তো ...অনেক কাজ পড়ে আছে ... 'সাগর মন্ডল এমনিতেই এখনও ঘটনা পরম্পরার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি তার ওপর এই মধুর তিরস্কার তাকে একেবারে অবশ করে দিল। সে উঠব উঠব করছে, এমন সময়ে কালীবাবু রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ' এইডা কিন্তু ঠিক করলেন না ... 'রাত্রি অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, 'কেন কি হল ?'----- ' এইবার আপনি ছাইড়্যা তুমিতে আসেন ... এখন আর কি ? আপনি আজ্ঞে বলা ছাড়েন এবার ... 'রাত্রি হেসে বলল, ' ও ... হোঃ হো ... হাঃ হাঃ হাঃ ... বুঝতে পারলাম ... কিন্তু একহাতে তো তালি বাজে না স্যার ... 'কালীবাবু এবার কড়া দৃষ্টিতে সাগরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ' আমি দুইজনেরেই কইত্যাসি ... নো পার্সিয়ালিটি ... যান এবার ভাগেন তো দুইজনে, অনেক হইসে ... আর হ্যাঁ ... নিখিল স্যারের লগে দেখা করার ডেটটা ফিক্স কইরা ফেলেন ... একসঙ্গেই যাব ... 'বাইরে বেরিয়ে এসে সাগর বলল, ' এবার কোনদিকে ? 'রাত্রির এবার আর ভুল হল না। সে বলল, ' সে বলল, ' তুমি যেদিকে বলবে ... '( চলবে )********************************************
  • ভাট...
    commentবকলম -এ অরিত্র | শোনা যাচ্ছে প্রথমে সিএএ ও তারপরে কেজরী নিয়ে নিজের পায়ে পর পর দুবার গুলি করে ফেলার পরে দলের পরামর্শে নরেন্দ্র মোদী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে জানতে চেয়ে বিল গেটস এর সঙ্গে দেখা করেছেন। রিপোর্ট অনুযায়ী গেটস তাকে জানিয়েছেন কৃবু অনেক কাজ খুব সহজেই করে ফেলতে পারে, যেমন প্রচুর পরিমাণে ফেক ভিডিও বা নিউজ জেনারেট করা, কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে যা কৃবু সহজেই করে দেবে মনে করার কোনো কারণ নেই। ওয়াকিবহাল মহল মনে করেছেন দ্বিতীয় ক্ষেত্রে গেটস নির্বাচনে জেতা আসনের সংখ্যা ধরে রাখার ব্যাপারই ঘুরিয়ে ইঙ্গিত করেছেন।
    commentঅরিন |
     
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত