তখন আমার কাছে লেখা ব্যতীত আর কোনো লক্ষ্য ছিল না। যে কাজ করলে লেখায় ক্ষতি হবে। সময় কম দিতে পারব, সেই কাজ করব না, হোক না ক্ষমতা এবং বেতন বেশি। নিজের ডিপার্টমেন্ট আমাকে সম্মান করত। অন্তত বেশিরভাগ উপরওয়ালারা। সে কথা যাক। একটা কথাও বলতে হয় বড় চাকরি করা আমার সাধ্য ছিল না। মেধাবী তো ছিলাম না। রেজাল্ট খারাপ। কেমিস্ট্রির ময়লার, ফিনার-এর বই না পড়ে বিভূতিভূষণ পড়েছি। সুতরাং হবে কী ? চেষ্টা চরিত্র করলে কীই বা হত। কম বেতনের চাকরি, আমার পরিবারের সকলে কৃচ্ছ সাধন করেছে সমস্তজীবন। স্ত্রী মিতালি হাসি মুখে সব মেনে নিয়েছে। বুঝেছে যদি সম্মান আসে এতেই আসবে। যার যেটা পথ, সেই পথেই তিনি যান।
একটা ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে বাংলার সাথে একসূত্রে বাঁধা পাঁচটি থেরবাদী বৌদ্ধ প্রধান দেশ- মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কাম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, আর ভারতীয় উপমহাদেশের অনেকগুলি অঞ্চল- আসাম, ওড়িশা, মিথিলাঞ্চল, নেপাল, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, কেরল। এদের সবার নববর্ষ একসঙ্গে হয়- পয়লা বৈশাখ।
উঠোনে দিনের প্রথম রোদ আলগোছে এসে দাঁড়িয়েছে আমার পেছোনে। সে রোদে সর্ষে ওম নেবে। সকালে লাল আউশের ঘি ভাত উনুনে বসিয়েই ঠাকুমা লগি নিয়ে আমগাছ তলা গিয়ে দাঁড়ায়। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কাঁচা আম পাড়ে।
বোঝো, কাদের নিয়ে সংসার করছি। আমাকে উত্তর দিতে হলো না। তার আগেই শীর্ণ ভদ্রমহিলা ধমকে উঠলেন, 'এই অবস্থায় উপোষ করবি কিরে? উপোষ করলে তোর যা পূণ্য হবে, পেটের বাচ্চাটাকে না খাইয়ে রাখলে তার চেয়ে ঢের বেশি পাপ হবে।' এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন আমি হামেশাই হই। সুগারের রোগীরা, প্রেশারের রোগীরা বারবার নিষেধ সত্ত্বেও রোজা রাখেন এবং অসুস্থ হয়ে আমার দারস্থ হন। আমি গালাগালি দিয়ে রাগ মেটাই। ওনারা বিনা প্রতিবাদে সব শোনেন। মাথা নেড়ে মেনেও নেন। এবং একটু সুস্থ হলে আবার রোজা রাখেন। তবে এ ব্যাপারে হিন্দু ধর্মের বয়স্ক মহিলারাও কম যান না। তাঁরাও একাদশী বা যেকোনো ছুতোয় উপোষ করেন। নিজের শরীরের বারোটা বাজান।
যে বৃদ্ধাবাসের প্রস্তাবটা অরুণ দিচ্ছেন, ধরুন সেই একই বৃদ্ধাবাসে একটা ব্লক তৈরি করা হলো যেটা নিঃশুল্ক। আর, সেই ব্লকটায় থাকবেন শুধুমাত্র একা-হয়ে-যাওয়া ট্রাইবাল মানুষজন। এই ধরণের বৃদ্ধাবাসে সাধারণত নিয়মিত চিকিৎসার জন্যে একটা ব্যবস্থা থাকে। এ ক্ষেত্রেও সেটা থাকবে, কিন্তু অন্য বৃদ্ধাবাসের তুলনায় এটা একটু অন্যরকমের হতে পারে। এমন হতে পারে যে বৃদ্ধাবাসের আবাসিক যারা নয়, স্থানীয় সেই সব মানুষদের জন্যেও আউটডোর চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো এখান থেকে। সত্যি সত্যিই যদি এইরকমের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আপনাদের সমাজসেবার কাজটা এই বৃদ্ধাবাস দিয়েই শুরু হতে পারে।
সিম্পসন’স প্যারাডক্স ‘অমনিপ্রেজেন্ট’, কাজেই মোলাকাত তার সাথে হবেই, জানতে বা অজান্তে … তবে আশা এই যে, একবার গল্পের মত করে ব্যাপার-টা বুঝে নিলে তাকে দেখলে আঁতকে উঠবেন না। বরং একটা উদাহরণ মনে মনে গেঁতে নিন, কখন কোথায় চক-ডাস্টার হাতে জ্ঞানের গোঁসাই হয়ে ট্যান দিতে হবে কেউ বলতে পেরেছে?
অনেকদূরের ইতিহাসের গল্প যেন ঝাপসা পর্দার ওপারের অপসৃয়মাণ ছবির মতন, এই কেউ একটু পর্দাটা তুলে ধরলো আর অমনি হাজার-হাজার ঝালর, চৌকি, পাইক-বরকন্দাজ, রাজারাণীর এক অদ্ভুত জগতের একটা টুকরো ঠিক চোখের সামনে। তখন মনে হবে যেন আসলেতে কিছুই অতীত নয়, সময় যেন বিশাল একটা মানচিত্র, এই মুহূর্তটুকু যেন তাতে একটা নিকোনো ঠাকুরদালান, নাটক হবে বলে সেজেগুজে উঠেছে সকাল থেকে। সেই বিস্তীর্ণ রঙ্গমঞ্চে আজকের নাটকঃ ক্যারেনসেবিসের যুদ্ধ।
“দরকার হলে এক দেশ আবার পুনর্জন্ম নিতে পারে, কিন্তু দেশের সংস্কৃতি একবার ধ্বংস হয়ে গেলে তাকে পুনরায় উদ্ধার করা অসম্ভব”! তখনকার দিনের এক খুব প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ টি ভি সুং পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন এই কথা। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ২০,০০০ ক্রেট (বড় বাক্স) ভরা দুষ্প্রাপ্য চীনের অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা হবে প্যালেস মিউজিয়াম থেকে। সব কিছু প্যাকিং হয়ে যাবার পরে এবার অপেক্ষা – ঠিক কবে স্থানান্তর প্রক্রিয়া চালু করা হবে সেই নিয়ে নির্দেশ আসার জন্য মিউজিয়ামের স্টাফেরা অপেক্ষা করতে লাগলো। অবশেষে ৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৩ সালে নির্দেশ এল পরিবহন চালু করার। সকাল বেলা গোটা বারো চোদ্দ মোটর গাড়ী এবং ৩০০ মত রিক্স ঢুকলো ফরবিডেন সিটিতে। ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল চরম – সবাইকে ব্যাজ দেওয়া, গাড়িতে স্পেশাল নাম্বারিং করা – এই করতে করতে রাত হয়ে গেল। রাত আটটার সময় তিয়েনমেন স্কোয়ারের সামনের রাস্তা, যেটা সেখান থেকে জেনগ্যায়াংমেন ট্রেন স্টেশনের দিকে গেছে সেখানে কার্ফু-র মত জারি করে দেওয়া হল। একমাত্র পারমিশন নিয়ে এবং স্পেশাল ব্যাজের লোকেরাই এই এলাকায় ঢুকতে পারত সেই রাতের বেলা। রাত নটার সময় সারি দিয়ে গাড়ি গুলি প্যালেস মিউজিয়াম থেকে রওয়ানা দিল স্টেশনের উদ্দেশ্যে, সেই গাড়ির সাথে যোগ দিল আশে পাশের একজিবিশন হল থেকে বোঝাই গাড়িগুলিও। ট্রেন স্টেশনে গিয়ে সব কাঠের ক্রেট বোঝাই হল ২১টা ট্রেনের বগিতে।
এই অভিযোগের স্তূপের মধ্যেই নতুন করে কাল ভাইরাল হয়েছে একটি বিস্ফোরক ভিডিও। আলাদা করে তার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু নানা সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যেই সেটি প্রকাশ করে চলেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে উত্তেজিত জনতার জমায়েত, গুলির আওয়াজ, আর্তচিৎকার এবং রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েকজনকে পড়ে থাকতে। এখনও পর্যন্ত এর সত্যতা কেউ চ্যালেঞ্জ করেননি। ভিডিওটি যদি সত্যি হয়, তো কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘিরে ফেলার কোনো চিহ্ন সেখানে দেখা যাচ্ছেনা। শোনা যাচ্ছে গুলির আওয়াজ। তা একতরফা। কাঁদানে গ্যাস বা লাঠি চালনার কোনো চিহ্ন নেই। সামান্য বা একেবারেই বিনা প্ররোচনায় গুলি করে মারা হয়েছে সাধারণ ভোটারদের।
একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৪ বছরের প্রতিবন্ধী কিশোর শ্রীমান মৃণাল হক বলেছে যে, স্থানীয় বাজারের মধ্যে তাকে টুঁটি চেপে ধরে সিআইএসএফ কর্মীরা লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। মারের চোটে সে মাটিতে পড়ে গেলে কিছু গ্রামবাসী প্রতিবাদ করায় সে সিআইএসএফ কর্মীদের হাত থেকে ছাড়া পায়। আমাদের জেলা মানবাধিকার আধিকারিক নিহতদের পরিবারের সাথে কথা বলেছেন। জানা গেছে, শ্রী নূর ইসলাম তাঁর ৫ সদস্যের পরিবারের এমকমাত্র রোজগেরে সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রবাসী শ্রমিক। ৮ এপ্রিল ২০২১ তিনি দেশে ফেরেন ভোট দেওয়ার জন্য। বুকে গুলি লাগা অবস্থায় মাথাভাঙ্গা সাবডিভিশনাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর, তাঁকে মৃত বলে ঘোষনা করা হয়। শ্রী মণিরুল জামাল তাঁর ৭ সদস্যের পরিবারের মুখ্য রোজগেরে ছিলেন। তিনিও একজন প্রবাসী শ্রমিক ছিলেন। ৯ এপ্রিল ২০২১ গ্যাংটক থেকে নিজের গ্রামে ফেরেন ভোট দেবার জন্য। শ্রী চাইমূলও তাঁর ৫ সদস্যের পরিবারের প্রধান রোজগেরে ছিলেন। শ্রী হামিদুল মিয়াঁ তারঁ ৪ সদস্যের পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ছিলেন। তাঁ স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।
মুশকিল হচ্ছে দু'জায়গায়। এমনটা নয় যে আমাদের রাজ্যে খুব শান্তিপূর্ণ ভোট হয় এবং স্থানীয়রা বুথে গিয়ে ঝামেলা করেনা। কিন্তু, শীতলকুচির ঘটনায় যতগুলো ন্যারেটিভ বাজারে ঘুরছে তাতে আমরা মেনেই নিচ্ছি যে স্থানীয়রা ওখানে ঝামেলা করেছিল। এখন অব্দি কোনো প্রমাণ নেই। স্থানীয়রা এরকম কোনো ঘটনার কথা স্বীকার করছেন না। কিন্তু আমরা, ব্যানানা রিপাবলিকের ম্যাঙ্গো পাবলিকেরা প্রকারান্তে মেনে নিচ্ছি যে তারা ঝামেলা করেছিলেন। এবং এরাজ্যে যেহেতু, সংখ্যালঘুদের একটা অংশ বিভিন্ন পলিটিক্যাল পার্টির মাসলম্যান হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাতে এ ভাবনা আরও প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের মাসলম্যান হিসেবে ব্যবহার করার তালিকায় মুসলিম বিদ্বেষী প্রচার চালানো বিজেপিও পিছিয়ে নেই। চব্বিশ পরগণার ত্রাস ফিরোজ কামাল গাজী ওরফে বাবু মাস্টার এইমুহুর্তে বিজেপির সম্পদ। প্রসঙ্গত, আমাদের রাজ্যের সংখ্যালঘুরা প্রায়ই গলা ফাটান যে তাদের রাজনৈতিক দলগুলি ব্যবহার করে থাকে এবং অভিযোগটি অসত্য নয়। সমস্যা হচ্ছে তারা নিজেরা কোন যুক্তিতে নিজেদের এতদিন ধরে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছেন তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না।
আমি জয়দীপ ,যে মনে করে সেক্সুয়ালিটি তার পরিচয় না, তবুও নিজের যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে সোচ্চার। বহু বছর ধরে। একই সাথে এইচ এই ভি নিয়ে যাপন করছি ২০০৬ থেকে এবং এইচ আইভি নিয়েও কিভাবে ভালো থাকা যায় তার প্রচার ও এইচ আই ভি নিয়ে মিথ ও মিস কনসেপ্শন পরিবর্তনের কাজ আজ আমার কর্মজীবনের অঙ্গ। এতোগুলো বছরের লিঙ্গ রাজনীতির স্বপক্ষে বিপক্ষে চলতে চলতে কখন নিজের অজান্তেই জড়িয়ে গেছি আন্দোলনের সাথে তা আজ আমার জীবনের সাথে মিলে মিশে গেছে। সেই সঙ্গে নিজের জীবনের ছোটবেলা, বড়বেলা, হোমোবেলার স্মৃতি ভাগ করে নিতেই শুরু করছি পুরোনো কথার ঝাঁপি।
এটাও বুঝতে হবে যে আমার ১৩৫ কোটির দেশ। প্রতিদিন তার প্রত্যেকটা মানুষকে যদি দিনের শেষে দু-বেলা খাওয়াতে হয় তাহলে আমাকে কোথাও না কোথাও একটা ব্যালেন্স করতে হবে। যদি আপনি বলেন যে ব্যালেন্সটা কী হওয়া উচিত অভিষেক, সত্যি আমার কাছে তার কোনো উত্তর নেই। হয়তো অর্গানিক ফার্মিং একটা বিকল্প কিন্তু শুধু এই অর্গানিক ফার্মিং দিয়ে আমি ১৩৫ কোটি মানুষের মুখে অন্ন কালকেই জোগাতে পারব কি না আমার কাছে উত্তর নেই। তাই অবশ্যই আমাদের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে যারা হয়তো একটা ভালো ভবিষ্যৎ আমাদের উপহার দেবেন।
রোমহর্ষক আর নয়নাভিরাম-এর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। বাংলার ইতিহাসে হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের ঘটনাগুলি রোমহর্ষক, কিন্তু নয়নাভিরাম হয়ে থেকেছে সম্প্রীতির ছবিগুলি। পুকুরপাড়ে বসে নারকেল গাছের পাতার জলে বিলি দেখা নয়নাভিরাম, কিন্তু তা নিয়ে জনশ্রুতি রটে না, পুকুরে বিষ ঢেলে যখন মরা মাছ ভেসে ওঠে তা প্রজন্মান্তরের গল্প হয়ে ওঠে। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির টুকরো টুকরো ছবি এই সমাজে বহমান থেকেছে, সমাজচিত্রে সহজাত সৌন্দর্য এনেছে। আর কয়েক দশকে একবার দাঙ্গা-ফ্যাসাদের গল্প ইতিহাস বইয়ে এসেছে। কিন্তু, মানুষ পুকুরে বিষ দিতে ফিরে যায় না বরং ডাঙায় বসে পানকৌড়ি দেখে। তাই, দাঙ্গা হাঙ্গামার ইতিকথা সরিয়ে তার চিরন্তন জীবনে সে সম্প্রীতির কথাই বলেছে। দাঙ্গা-দেশভাগের পরেও তাই এই দেশের মানুষের যৌথচিন্তায় বিভেদ মাথা তুলতে পারে নি।
সইদুল তার ঘোড়াদের নিয়ে চলে যেতে যেতে একবার তাকাল ধ্রুবর দিকে। তারপর বলল, ‘আল্লার বল আর ভগমানেরই বল, দুনিয়া তো একটাই। কত জমি কেড়ে নেবে আমাদের কাছ থে? জমি থাকবে, মাঠও থাকবে। দৌড়ও থাকবে। দৌড় চললি তোর সাথে আমার মেলামেশাও চলবে। আমরা নড়বড়ে না হলিই হল।’ ঘোড়াগুলো যে পথে দৌড়ে আসবে তার দু’ধারে এখন ঘেঁষাঘেষি লোক। দূরে কলাগাছের সারির গায়ে গায়ে মানুষও সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। পুকুরপাড়ের উঁচু জমিতে জায়গা করে নিয়েছে অনেকে। যারা পেরেছে তারা চড়ে বসেছে আশপাশের গাছের মাথায়। দু-একটা পাকা বাড়ির ছাদেও উঠেছে। কাগজের ভেঁপু পোঁ পোঁ করে বাজছে নাগাড়ে। উত্তর দিকে, মাঠের শেষমাথায় দুটো বাঁশ দূরে দূরে খাড়া করে রাখা। তাদের মাঝখানের দড়িতে খিরীশ গাছের ছোট ছোট ভাঙা ডাল ঝোলানো পরপর। ওখানে পৌঁছতে পারলেই দৌড় শেষ। ধ্রুব সেই জায়গা থেকে বেশ কিছুটা দূরে ভিড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বউ, ছেলে-মেয়ে মাঠের উল্টোদিকে। দক্ষিণ দিক থেকে হইহই উঠল। দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই আওয়াজের ঢেউ ভেসে আসছে এদিকেও। ওই দেখা যাচ্ছে ঘোড়াদের। কেশর উড়ছে হাওয়ায়। খুরের দাপটে উড়ছে সাদা ধুলো আর কালো ছাই। ছিটকে যাচ্ছে ঘাস-পাতা-খড়ের কুচি। ধ্রুবর সামনে দিয়ে চলে গেল কয়েকটা ঘোড়া। তাদের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে যেন। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। ধ্রুব দেখতে পেল সইদুলের মাদি ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে আসছে। তার থেকে অনেক দূরে বাচ্চাটা। এই যাঃ, পাগলি তো দাঁড়িয়ে পড়ল। আরে, সে তো উল্টোবাগে চলেছে। হলটা কী?
মাননীয় মহোদয়, আমাদিগের দেশ নাই। দেশ নাই তাই কিছুই নাই। হাসপাতাল, ইস্কুল, ব্লক আপিস, পঞ্চায়েত, থানা, চৌকি, রেশন কার্ড, ইলেকট্রিক, জল কিছুই নাই। মোবাইলের সিমও নাই। ফলে গ্রাম হইতে বাহিরে ইন্ডিয়া গেলে ভয় হয় কখন অনুপ্রবেশের দায়ে ধরা পড়ি। অথচ আমরা তো ইন্ডিয়াই হইতাম, ভাগ্যের ফেরে হই নাই। অকাল বৃষ্টি আমাদিগে এই করিয়াছে। ইন্ডিয়ার ইস্কুল কলেজে পড়ার কোনো উপায় নাই মিথ্যা পরিচয় গ্রহণ করা ব্যতীত। ছিটমহলের কন্যার জন্য ইন্ডিয়া বা বাংলাদেশ, কোথাও পাত্র পাইবার উপায় নাই। ছিটমহলের পাত্রকে কেহ কন্যাদান করিতে চাহে না। যাহার কোনো দেশ নাই, তাহার চালও নাই, চুলাও নাই, তাহাদের মাথার আকাশ ফুটা হইয়াই আছে, ফলে গ্রীষ্মে প্রখর রৌদ্র, বর্ষায় প্রবল ধারাপাত হইয়াই থাকে। জানি দেশ পাইলে ইহা আর থাকিবে না। অনাথের নাথ হইবে।
আমাদিগের পাশের গ্রাম মদনাগুড়ির সব রহিয়াছে। সেই যুদ্ধের সময় মদনাগুড়ির আকাশ ভেঙে অকাল বৃষ্টি হয় নাই। তাই ফসলও মরে নাই। এখন মদনাগুড়ি যাইতে বাতৃগাছ পার হইতে হইবে। বাতৃগাছ বাংলাদেশ, মদনাগুড়ি ইন্ডিয়া। তাহার পাশে সিঙিমারি নদী ইন্ডিয়া। নদী লইয়া বাজি ধরেন নাই প্রভুগণ। কেন না নদীর ভিতরে প্রজা নাই। খাজনা দিবে কোনজন? মানুষ সমেত গ্রাম হস্তান্তরে সুখ অনেক।
আমরা যে রকম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঠা বের করি, গাছটি নড়েও না, চড়েও না, এই অচেনা বৃদ্ধও সে রকম প্রাণ থেকেও জড়ের মতো পড়ে থাকে। গাছের মতো একটি বারও নিজে থেকে প্রাণের প্রমাণ দিতে যায় না। এক দল হতাশ হয়, অন্য দল নতুন উদ্যম নিয়ে শুরু করে। একটা পরিপূর্ণ শব্দ ওর মুখ থেকে যে বের করতে পারবে, সে যেন গ্রামে বীরের মর্যাদা পাবে! আমরা যখন একঘেয়ে দৃশ্যে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম, তখনই আমাদের মধ্য থেকে বোমাটা ফাটাল কেউ। স্পাই! দেখোগে ভারতের স্পাই। বোবা-পাগলের ছদ্মবেশে তথ্য নি’ পালাচ্ছি। কেউ একজন বলল ভিড়ের ভেতর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে জনতা চাঙা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। মুহূর্তে সকলে যেন নিশ্চিত হয়ে গেল, লোকটি স্পাই ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। গ্রামের পশ্চিমে খাড়া মাইল ছয়েক হাঁটলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। আমাদের গোপন কোনো তথ্য নিয়ে সীমান্ত দিয়ে পালাচ্ছে বলে আমরা ধরে নিলাম। স্পাইদের নিয়ে গ্রামে অনেক গল্পের প্রচলন ছিল। একটা গল্পের কথা তখনই মনে পড়ল। এরা এমন কৌশলী ও নিবেদিত দেশপ্রেমিক হয় যে, কোনো দেশে স্পাইগিরি করতে গিয়ে বিয়ে-সংসার পর্যন্ত করে। তারপর মিশন শেষ হলে বিনা বাক্যে স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে স্বদেশে ফিরে যায়। এমনভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে তাদের এই ছদ্মবেশ ধরাও যায় না। আমাদের ভেতর থেকে কেউ কেউ এরই মধ্যে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। প্রথমেই একজন কঞ্চির মাথায় চুলগুলো পেঁচিয়ে টান মারল জোরে। নকল চুল হলে উঠে আসত। কিন্তু মাত্র কয়েকটা চুল ছিঁড়ে এল। বৃদ্ধের গায়ের রং আসল কি না, মুখে মেকআপ দেওয়া কি না, পরীক্ষা করার জন্য হাবু ভাই পেছনের গর্ত থেকে এক বালতি ঘোলা পানি তুলে ওর মাথায় ঢেলে দিল। গায়ের রং যেমন ছিল, তেমনই থাকল। মাঝখান থেকে সকলের সন্দেহটা থেকে গেল।
অগত্যা জামা টেনে পকেটে মানিব্যাগ ঠেসে বেরিয়ে পড়লুম। ফিরে মিষ্টির প্যাকেট রান্নাঘরে জমা করে বসলুম বারান্দায়। গল্প খুব জমে উঠেছে... ... আমরাও ঠিক করে ফেললাম, একজন হিন্দু মরলে দশজন মুসলমান মারব। আমাদের ভেতর তখন আগুন জ্বলছে। জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশন, লীগ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দির মুসলমান যুবসমাজকে সর্বশক্তি নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান, এক-একটা হিন্দুর দোকান লুট হচ্ছে– জওহরলাল পান্নালাল, কমলালয় স্টোর্স, কে.সি বিশ্বাসের মতো বড় দোকান। মুসলমান দোকান ওরা চিহ্ন দিয়ে রেখেছিল, লুটের হাত থেকে বাঁচাতে। এমন কি হাঙ্গামা হতে পারে ধরে নিয়ে মুসলমানদের জন্য এ্যাম্বুলেন্স মজুত রেখেছিল। লীগ প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে করে লীগের লোকদের জন্য ছোরাছুরি, পেট্রল, কেরোসিনও নিয়ে যাওয়া হয়। আমি সামুর ছেলের দিকে তাকাই। চোখ দুটো বড়। যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, ঠোঁট দুটো একটু ফাঁকা, শুকনো খট খট করছে। বুঝতে পারি মুখ দিয়েই এখন বাতাস চলছে ওর। নিচু স্বরে বলি, বাবা। কিন্তু ওরা বোঝেনি আমরাও ভেতরে ভেতরে তৈরি ছিলাম। ন্যাকড়ার বল বানিয়ে কেরোসিনে চোবানো হল। বোমা বাঁধা হল। এমনকি টেরিটরিয়াল আর্মিতে কাজ করে এরকম কিছু লোক বন্দুকের যোগান দিল। বোমা-লাঠি-বন্দুক নিয়ে গঠিত হল প্রতিরোধ বাহিনী। এরপর বাবা কী বলবে আমি জানি। বাবা আজ সংক্ষেপে বলছে, তবু আমি জানি বাবা কী বলবে। ছেলেটি কঠিন চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুকের ভেতর ছটফট করছে হাওয়া। বাবাকে থামাতেই হবে। গলা তুলে ডাকার চেষ্টা করি, বাবা, বাবা ও... ।
থকথক করে কেঁদে ফেলে ছেলেটি , আমি মোছলমান বলি মা আমারে বাঁচায় নাই স্যার— যাতি আসতি কতবার ভালো ভালো কলা দিছি দুগগা মার পায়ের তলায়—বলাইকাকার সাথি কতবার ডাকিছি মা, ওমা জগজ্জননী আমারে একটু বুদ্ধি দাও মা -- প্রাণ খুলে শ্বাস নেন নূরতাজ মন্ডল। যাক বলাই সাহা্রা তাহলে মিথ্যে বলেনি কাল মাঝরাতে। ছেলেটা সত্যি নিরীহ। বলাই সাহার বউ কি যেন বলেছিল, গোপাল। তা গোপালই বটে ! একটু বেশি ভালো মানুষ। সমাজের লোকেরা যাদের বোকা বলে তেমন সোজা সরল মানুষ। কৃস্টালের পেপার ওয়েটটা টেবিলের কাঁচের উপর ঘুরাতে ঘুরাতে নূরতাজ মন্ডল উপলব্ধি করেন, এই ছেলেটার ভালোমানুষি মনে এবার পাপ ঢুকে পড়বে। জেল বাস হয়ত তিনি রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু ছেলেটা এবার সাম্প্রদায়িক হয়ে যাবে। ওর মনে মানুষকে সহজে বিশ্বাস করার সরলতা মুছে গিয়ে অন্যদের মত জেঁকে বসবে আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবানকে ভাগ করে নেবার শিক্ষা। জন্ম নিবে ঘৃণা । মানুষকে ধর্ম দিয়ে ভাগ করতে শিখে যাবে ছেলেটা। এক হাতের চেটো দিয়ে অন্য হাত মুছে নিয়ে তিনি মনে মনে হাসেন, এই তো এই জগতের বাস্তব শিক্ষা। ছেলেটার বুদ্ধির কমতি ছিল। এবার তা পূর্ণ হলো
ছেলে বলেছিল আজ মায়ের হাতের রান্না খাবে।তাতেই নয়নতারার মাথাটা ধরেছিল। পার্টিশন! যত দোষ পার্টিশনের। না হলে এক গামলা ভাত রান্ধনের জন্য নয়নতারাকে ছেলে বৌ খোঁচা দিতে পারে? তাও যদি আরেকটা ছেলেপুলে হত। একটা মেয়ে নিয়ে দ্যাবাদেবী সারাক্ষণ আদিখ্যেতা করছে! মাণিকগণ্জের বাড়িতে নয়নতারা নিজের সাতটা ব্যাটা বেটির সঙ্গে কতগুলো ভাগ্নে ভাগ্নীও মানুষ করে ফেলেছেন। তবে ভাত রাঁধতে হত না। অতগুলো মানুষের ভাতের হাঁড়ি কি তেরো বছরের নতুন বউ সামলাতে পারে না মাড় গালতে পারে? বড় জা আর শাশুড়ি প্রায় সমবয়সী। তাঁরাই বলেছিলেন , এ বাড়িতে বউরা ভাতের মাড় গালে না। অত বড় হাঁড়ির ওজন বউ মানুষের নেওয়া নিষিদ্ধ। মাড় গালে মইনা নাগী। মণিভূষণ নিয়োগী।বাপ মা মরা ছেলে। ভাতের মাড় গালা থেকে শুরু করে তরতর করে নারকেল গাছে উঠে নারকেল পাড়া, সব পারে।এমনকী ইজারা নেওয়া পদ্মার বুকে জাল ফেলে যে কটি ইলিশ ওঠে, সবকটি ঘরে এনে তুলতে পারে মইনা নাগি।
আমি ওর কিউরোসিটি আরও বাড়িয়ে দিয়ে সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ বইটি খুলে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ চ্যাপ্টারটি পড়তে শরু করে দিলাম। দাদাজীর মৃত্যুর পর তার দেরাজ থেকে তরবারি হাতে জিন্নাহের একটি ছবি পাওয়া গেছিল। ছবিটি একটি প্রচারপত্র। তাতে কী লেখা ছিল তা ঠিক পড়া যাচ্ছিল না। তবে শিলা সেনের ‘মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল’ বইটিকে সূত্র হিসাবে ধরে নিলে এই প্রচারপত্রের ভাষা ছিল এই রকমঃ আশা ছেড়ো না। তলোয়ার তুলে নাও। ওহে কাফের, তোমার ধ্বংসের দিন বেশি দূরে নয়। আমার ভাবতে বেশ অসুবিধা হয় আমার পূর্বপুরুষ কোনও একসময় এই স্লোগানটির সঙ্গে একাত্মবোধ করেছিল। কিংবা এমনও তো হতে পারে, সময়ের উত্তেজনা তাঁকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছিল যে তিনি তাঁর স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলেন! ‘সময়ের উত্তেজনা’ শব্দবন্ধটির প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া জরুরি। এই শব্দবন্ধটি অনেকটা মদের মতো। এই শব্দবন্ধটি এমন এক পরিসর সৃষ্টি করে যেখানে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রকে অনায়াসেই ঊহ্য রাখা সম্ভব। ‘সময়ের উত্তেজনা’ একটি নেশা, যেখানে এই নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষগুলির আচরণকে আমরা তাদের নিজেদের দ্বারা সজ্ঞানে নির্বাচিত আচরণ হিসাবে ভাবতে চাই না। যেন কোনও মাতাল সুনসান রাতে গাল দিতে দিতে ঘরে ফিরছে। ‘সময়ের উত্তেজনা’ লঘু হয়ে এলে, তাই, একটি নিরাপদ আস্তানার সন্ধান আমরা পেয়ে যাব, এটুকু আশা করে থাকি। কিন্তু দাদাজী কি শেষপর্যন্ত কোনও নিরাপদ আস্তানার সন্ধান পেয়েছিলেন? কেনই বা তিনি জিন্নাহের ছবিটি কুটি কুটি করে কেটে ছিঁড়ে ফেলে দেননি?
জামাই আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসে বলে ‘যাক এলাকা থেকে প্রায় সবকটাকে ভাগানো গেছে। শয়তানের ছাওয়ালগুলো, পুড়িয়ে মারতে পারলে শান্তি হত!‘ প্রমদা ঠিক না খেয়াল করেই বলেন ‘হ্যাঁ যত গুন্ডা সব জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছে মনে হয়।‘ জামাই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, ‘না না আপনি জানেন না বাবা এই শেখের ব্যাটারা শয়তানের ছাওয়াল সব, আমাদের কটা ছিঁচকে চোরের সাধ্য কি ওদের মত হিংস্র জানোয়ার হয়? দ্যাখেননি ওদের দেশে ওরা কী করছে? যাক দূর হয়ে যাক ওরা নিজেদের জায়গায়।‘ প্রমদা থতিয়ে যান – জামাইরা তো আজ পঁচিশ ত্রিশ বচ্ছর হাওড়াতেই থিতু, তাঁর জানা মতে ওদের তো কিছু ক্ষতি হয় নি!
- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ লড়ছে এমন কিছু মুক্তিসেনা লুকিয়ে আছে ঐ ক্যাম্পগুলোতে। অস্ত্র চালান করা, আন্তর্জাতিক রেডিও স্টেশন অপারেট করা, সবেতে আছে ছেলেগুলো। শিতলখুচি বর্ডার দিয়ে ওরা পারাপার করে। আজ যাদের দেখছো, কাল গেলে দেখবে তাদের মুখগুলো পালটে গেছে। সে যাক, ওদের দেশের স্বাধীনতার লড়াই ওরা কেমনভাবে লড়বে ওরা বুঝবে। কিন্তু খুকি... - খুকি কী ? খুকি কেমন কইরা আসলো এইসবের মধ্যে ? মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে। - শোনো, তোমার খুকি না হাতে এতোদিন হাতকড়া পরতো, যদি ইন্দিরা গান্ধীর হুকুমে পুলিশ অন্যদিকে তাকিয়ে না থাকতো। রিলিফ দেবার নাম করে চরে যায়, ছেলেগুলোর সঙ্গে মেলামেশা করে। একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে নাকি সম্পর্কও হয়েছে। সারা টাউনে ঢি ঢি পড়ে গেছে তো। আর তার সঙ্গে তুমি মেয়েকে পাঠিয়ে দিলে!
আই সি সি ওয়ার্ল্ড কাপের পুল বির খেলা পড়ল ইন্ডিয়া ভার্সাস পাকিস্তান। ঠিক হ'ল, শহরে একটা পাবে জায়ান্ট স্ক্রীনে খেলা দেখবে যাবে রাজীব, ওর বন্ধু সন্তোষ আর পারভেজ। ডে নাইট ম্যাচ, ওদের ফিরতে দেরিই হবে। দুপুর হতেই দুই সখী ফিরোজ আর বকর কে নিয়ে নাসরীনের বাড়িতে টিভির সামনে বসেছে। ভারত ব্যাট করছিল প্রথমে। দুরন্ত খেলছিল ধবন, বিরাট আর রায়্না। বল উড়ে পড়ছিল বাউন্ডারির বাইরে। বাচ্চারা হাত তালি দিচ্ছিল-ওরা কোহলির ফ্যান। নাসরীন চুপচাপ-শান্ত, স্থিত উচ্ছ্বাসহীন। মায়া অস্বস্তিতে ভুগছিল-ভাবছিল, ইন্ডিয়া এত ভালো না খেললেই পারত আজ। ভাবছিল, বিরাট আউট হয়ে যাক, ইন্ডিয়া হারুক। বস্তুতঃ উল্টোটাই ঘটছিল। পাকিস্তান ৩০০ রান চেজ করছিল। শুরুটা ভালই ছিল। কিন্তু ১০২ থেকে ১০৩ রানের মধ্যে তিনটে উইকেট পড়ে আর তারপর শহীদ আফ্রিদির ক্যাচ বিরাট ধরে নিতেই মায়ার মুখ শুকিয়ে আসে। গলা খাঁকরে বলে, এবারে খেয়ে নিলে হত না? নাসরীন বলল, 'দোন্ট ওয়রি, দে আর এনজয়িং দ্য গেম।' বস্তুতঃ বকর আর ফিরোজের মধ্যে কোনৈ হেলদোল দেখছিল না মায়া। চার ছয় বা কেউ আউট হলেই ওরা সোফায় উঠে নাচছিল। খেলা শেষ হতে মায়া বাড়ি ফিরে এলো। ইন্ডিয়ার জয়ে ও কষ্ট পাচ্ছিল আর এই অনুভূতিটা আরও বড় কষ্টের জন্ম দিছিল ওর মনে। নাসরীনকে বলেছিল-' মাথা ধরে গেছে, আজ আর খাবো না'
তখন আমাদের ছোট শহর যেন নতুন সভ্যতার আলো দেখা আফ্রিকার কোনো গহীন জনপদ। পাহাড় থেকে নেমে আসা দাঁতাল হাতি শহরের রাস্তায় নেমে হুটোপাটি করে, নাম তার গনেশ। আদিবাসী দেবতার পূজার রাত্রে শহরের রাস্তায় কেউ বেরোলে প্রাণদন্ড হয়। রাজার রাজত্ব গেলেও তাঁকে সবাই মহারাজ বলে, তাঁর স্ত্রীকে মহারাণী। সে যাই হোক, আসল গল্পটা এটা নয়। এরও অনেকটা আগের ঘটনা। আমার বাবা তখন বালক। বাবার ছোটবেলা কেটেছে চা বাগান এলাকায়। দিনদুপুরে বাঘ বেরোয়। সপ্তাহে একবার স্থানীয় ডাক হরকরা ছাতুয়া বুড়ো আসে চিঠি নিয়ে। মোড়ের মাথায় তার তালপাতার তৈরি ছাতাখানা দেখতে পেলে 'চিঠি চিঠি' করে দৌড়ে যাওয়া তখন বাবাদের একমাত্র বিনোদন। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশপাশ হবে। আমার ঠাকুর্দা কলকাতায় চাকরি করতে গেলেন। সঙ্গে নিলেন আমার বাবাকে। কলকাতায় পিতাপুত্রের সংসার কিছুটা দাঁড়িয়ে যাবার পর ঠিক করলেন ঠাকুমা আর কাকা পিসিদের নিয়ে যাবেন।
নার্গিস ভাবছিল দিল্লির কথা; দাঙ্গার অদ্ভুত অদ্ভুত খবর আসছিল দিল্লিতে। ওসমান সাহেব তখনও দোনামোনায় ভুগছেন, কেননা দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, এটা যেন অবিশ্বাস্য ঠেকছিল তাঁর কাছে। করলবাগের বাড়িটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা। দলে দলে লোক চলেছে ট্রেনে করে পাকিস্তান, ওদিকে লাহোর থেকে শিখ পরিবাররা আসছে দিল্লি। যে যেখানে পারছে, ফাঁকা বাড়ীতে, বাগানে, রাস্তার পাশে উদ্বাস্তু মানুষেরা আশ্রয় খুঁজছে। কে যেন বলেছিল, নার্গিসের মনে পড়ে না, সীমান্ত পেরিয়ে অমৃতসরে শুধু খুন হওয়া লাশ নিয়ে ঢুকেছে একটা ট্রেন। একদিন বেলার দিকে ওসমান সাহেব বাইরের ঘরে বসে কিছু ব্যবসার কাগজপত্র দেখছিলেন। নার্গিস বাড়ীর ভেতরে ছিল। হঠাৎ রাস্তায় আর্তনাদ ও গোলমালের শব্দ শুনে সে ঘরের জানলার কাছে গিয়ে রাস্তাটা দেখার চেষ্টা করতে করতেই ওসমান সাহেবের চিৎকার তার কানে এল — জানলার কাছে যাস না। ততক্ষণে বাইরের দরজাটার গায়ে লোকগুলো লাথি মারতে শুরু করেছে। নার্গিস শুধু একঝলক দেখতে পেল একটা কনুই অব্দি কাটা হাত রাস্তায় পড়ে আছে, যেটা থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তখনও। তার বাবা ঘরে ঢুকেই তাকে জানলার কাছ থেকে টেনে এনে একটা থাপ্পড় মারলেন তার গালে। সেদিন তারা কোনোক্রমে বেঁচে যাবার পর দিল্লি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অনেক সহজ হয়ে যায় ওসমান সাহেবের কাছে।
কালবাদে পরশু দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো। সে কারণেই বােধ হয় অসম্ভব ভিড় বাজারটায়। ফাড়ির ঠিক উলটোদিকে ফুল বেলপাতা বিক্রি করে লক্ষ্মীমণি, তার পাশেই বসে আনােয়ারা। সপ্তাহে চারদিন করে আসে সে। লক্ষ্মীমণি অবশ্য জানত আনােয়ারার আজকে আসবার দিন না হলেও আজ সে আসবেই। গত বছরে এর অন্যথা হয়নি। এ বাজারেও এখন সকলে জেনে গেছে| এই বুড়িমার কাছে খাঁটি চোদ্দশাক পাওয়া যায়। আনােয়ারা আসলে লক্ষ্মীমণি খুশি হয়ে ওঠে। জিজ্ঞাসা করে -টেরেন কি লেট ছিল ? আনােয়ার শাকের বােঝা রেখে পিঠ সােজা করে দাঁড়ায় না গাে লক্ষ্মী। ফাস্ট টেরেনটা পেলাম না। লক্ষ্মীমণি খুব চটপটে মানুষ। পাশের অস্থায়ী চায়ের দোকান থেকে কাঁচের গ্লাসে দু’গ্লাস চা আর বিস্কুট নিয়ে আসে। একটা গ্লাস আর বিস্কুট আনােয়ারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে-- -ও নাও খেয়ে নাও আগে। কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে আনােয়ারা। তারপর আপন মনে বলে— কাইল রাত থেকে চান্দুর মা আমার মােমিনা বিটির মাথার পােকাটা নড়ে উঠেছে। আমায় গাল দিতেছে। ছেলেটারে পিটলাে। জ্যান্ত হারিকেনটা মাটিতে আছড় দিল। আফশােসের সঙ্গে মুখে চুক চু্ক শব্দ তােলে লক্ষ্মীমণি। -ই। ওরে বাবার ঘরে পাঠায়ে দাও। মাথা নেড়ে হাসে আনােয়ারা। গাে বু তা হয় না। কাঁচা বয়সে সােয়ামী হারালে কোন মেয়ের মাথার ঠিক থাকে বলাে। ঠিকঠাক ছেলে পেলি আমি মােমিনার বে’ দেব আবার। চায়ে চুমুক দেওয়া ভুলে লক্ষ্মীমণি তার বন্ধুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে-মনে মনে ভাবে।
গতকাল সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। এক দুশ্চিন্তায়। শেষ মুহূর্তে এখানে চলে আসার দুর্ভাবনা আমাকে পেয়ে বসেছিল। কেন না আমরা মুসলমান। হিন্দু এলাকায় থাকব। নিরাপত্তাহীন এক ভয় আমাকে গ্রাস করেছিল। কেন না এখন গুজরাতে ভয়াবহ দাঙ্গা চলছে। বীভৎস সব খবর বেরোচ্ছে সংবাদপত্রে। আমার স্ত্রী নাসিমা খবরের কাগজ পড়ে না, তার এ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। আমি একা একা নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, স্ত্রী পরিবারকে মহিষবাথানে যে নিয়ে যাচ্ছি, ঠিক করছি কি? এখানের পরিস্থিতি যে খারাপ হবে না, তার নিশ্চয়তা কি আছে। গ্রামে মুসলমান এলাকায় থাকি, খানিকটা মনে জোর পাই। মহিষবাথানে তো সবাই হিন্দু, আমরা একমাত্র মুসলমান। জায়গা কেনার সময় এ কথা মাথায় আসেনি। মানুষজন যেভাবে জায়গাজমি কেনে, বাড়ি ঘরদোর করার স্বপ্ন দেখে, আর পাঁচজনের সঙ্গে আমার কোনও তফাত ছিল না। বরং মনে হয়েছিল হিন্দু এলাকায় মুসলমানরাও থাকবে। সহাবস্থানের প্রেম খুঁজেছিলাম। আর সেই প্রেমকে শেষ পর্যন্ত লালন করতে পেরেছিলাম বলে গতরাত দুর্ভাবনায় কাটিয়েও আজ মহিষবাথানে চলে আসতে পেরেছি। গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশিত "নির্বাচিত গল্পপাঠ' গ্রন্থ থেকে।
“জানি না”, অস্থির সীতাপ্রসাদ মাথার চুল খামচে ধরল। “কিন্তু গত বছরের সব কটা ঘটনা পর পর খেয়াল করে দেখো। মে মাসে প্রভুজির হুকুম আসল। আমরা ত্রিশূল নিয়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরে কবরখানায় হামলা চালালাম। এখানে, ঠিক এই জায়গাতে,” সীতাপ্রসাদ এলোমেলো হাত চালাল চারপাশে, “এখানে আমাদের গোটা দল এসে কবরগুলো একটার পর একটা খুঁড়লাম। এমনকি পচে গলে যাওয়া বডিগুলোকেও ছাড়িনি । যেসব জেনানারা কংকাল হয়ে গিয়েছিল তাদের বাদ দিলাম শুধু। তারপর কাজ হয়ে গেলে লাশগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলাম যাতে সকলে দেখতে পায়। পরদিন থেকে টেনশন শুরু হল। বলা হল ওরা অ্যাটাক করবে, তাই পার্টি অফিস থেকে রাত্রিবেলা তলোয়ার আর ত্রিশূল বিলি হল। আমরা হামলা চালালাম। খুনখামারি যা হবার তা তো হল, ওদের সবাই চলে গেল রিফিউজি ক্যাম্পে। সব কিছুই জুন মাসের মধ্যে মিটে গেছে। ভোটার লিস্ট চেক করে দেখো, যে কয়খানা ঘর এখনো টিকে আছে তাদের একটাতেও কোনো জোয়ান মদ্দ নেই। আগাছা সাফ করে দেবার মত উপড়ে ফেলেছি। তাহলে এতদিন বাদে এই মার্চ মাসে এমন কাজ করল কে? কে এমনভাবে খুন করল তিনজনকে? আশেপাশের গাঁও গুলোর কেউ নয় কারণ এই কাজ করবার জন্য গায়ের যা শক্তি লাগে তা ওই কয়েকঘর বুড়োহাবড়াদের মধ্যে নেই। আর এমনভাবে বডিগুলো সাজিয়ে রাখল ঠিক যেভাবে আমরা ঐ লাশগুলোকে সাজিয়ে রেখেছিলাম।
প্রতিবেশী সবজে বা ক্যাটক্যাটে নীল চেক-লুঙ্গি যে শুধু পোষাক নয়, পুরোনো ঢাকার রিকসার মত একটা পশচাদমুখী, মধ্যযুগীয়, অন্ধকারাচ্ছন্ন মানসিক অবস্থা। সর্বস্তরের নতুন বাঙ্গালি নারী তাই পুরুষকে সাথে নিয়েই আর পিছিয়ে থাকতে রাজি নন। দৈনন্দিনে, সামাজিক অনুষ্ঠানে,সদর্থে খেলানো বা হাতে নেওয়া কুচি ধুতি বা নানা কাট পাজামারা তাই এগোচ্ছে। কিছু কিছু প্রযুক্তি যেমন প্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না, লুঙ্গিও পারলো না। দুটি সুবিধে কিন্তু ছিল। উত্থান সংক্রান্ত। প্রথমটি হল সম্প্রীতির আবহে খোলা আকাশের নীচে শিশিরে ভেজা গ্রাম বাংলায় প্রাত:কৃত্য। দ্বিতীয়টি হল ঘটনাচক্রে অনিচ্ছামৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে কোনো কোনো পুরুষের প্রাথমিক সামাজিক পরিচয় জেনে নেওয়ার সর্বজনীন সুবিধে। এই পদ্ধতি ১৯৪৬ নাগাদ মধ্য কলকাতায় আবিষ্কৃত হবার পর থেকেই জনপ্রিয়তার কারণে প্রায় জাতীয় ঐতিহ্য হয়ে উঠেছিল। অপিমোড-পুরনারীর বাচ্চা তথ্য সংগ্রাহক দের এতোটা জানার কথা নয়। যাই হোক লুঙ্গির বিরুদ্ধে এই প্রবল জনমত প্রতিষ্ঠার পরের নয়, তার অল্প পূর্বের ঘটনা নিয়েই আমাদের সুশান্ত-অনিতার গল্প। তখনো সমাজে তর্ক চলছিল। বিবর্তনের গতি তখনো হয়তো কিছুটা সহমর্মী-শ্লথ ছিল।
সাম্য অনেক বিষয়ে গল্প লিখেছে, কিন্তু দাঙ্গা বা সম্প্রীতি নিয়ে একটিও নয়। নয় মানে লিখতে পারেনি। লিখবে কী, আজ পর্যন্ত দাঙ্গার সঙ্গে ওর প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ ঘটেনি। খুব ছেলেবেলার একটা দৃশ্য ওর মনে আছে। ওরা যে শহরে থাকে, সেখানে হঠাৎ কী কারণে যেন গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। কী গণ্ডগোল, কোথায় হচ্ছে-- এসবের কিছুই জানা নেই সাম্যর। ও দেখল ওর বাবার চোখেমুখে আতঙ্কের ছবি। বাবা অফিস কোয়ার্টারের সিঁড়ি বেয়ে একবার উঠছেন, আবার নেমে আসছেন উদ্বিগ্ন মুখে। একটা আতঙ্কের পরিবেশ যেন। ওই ছোটোবেলায় এসব বোঝার কথা নয় ওর। বোঝেওনি। বাবার ওই সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামার মধ্যে কেমন মজা পেয়ে গিয়েছিল। আজও যখন দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে, তখনই চোখে ভেসে ওঠে সেই সিঁড়ি ভাঙার দৃশ্যটা। এরপর দাঙ্গার সঙ্গে ওর পরিচয় ঘটে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে। সেই ৬ ডিসেম্বর সাম্য ছিল স্বরূপনগরে, থানার উদ্যোগে একটা যাত্রা উৎসবে। সন্ধের সময়ও জানে না কী ঘটনা ঘটে গেছে দূরে অযোধ্যা নগরীতে। থানার ও সি পরিচিত। তিনি যেন কেমন অস্থির ছিলেন। মুসলমান অধ্যুষিত স্বরূপনগরে সেদিন ব্রজেন দে-র বাঙালি পালা খুব জমেছিল। হিন্দু-মুসলিম শিল্পীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভেরী বাজিয়েছিলেন রঙ্গমঞ্চে। মাঝরাতে সাম্যরা ফিরেছিল। রাস্তায় দেখেছিল যাত্রা ফেরত মানুষেরা ফিরে যাচ্ছে গল্প করতে করতে। তাদের মধ্যে হিন্দু ছিল, মুসলমানও ছিল। ইছামতী নদী পার হয়ে শহরে যখন প্রবেশ করল, তখনই আতঙ্কের সঙ্গে ওর পরিচয় ঘটল। মোড়ে মোড়ে পুলিশ। সাম্যদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে আসছেন, কী ব্যাপার ইত্যাদি। এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিল সাম্য। আতঙ্কের পরিবেশে মানুষের স্বাভাবিক আচরণের গল্প। এই স্বাভাবিকতা যেন দাঙ্গার বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদ। তবু সেখানে দাঙ্গা ছিল না। চেষ্টা করেও লিখতে পারেনি সাম্য। এখন যেন সেই সুযোগ এসে গেল সাম্যর।
আরে ধুর, ছেলেটা হাত দিয়ে যেন হাওয়া তাড়ায়। এক জায়গায় দুবার কখনও হবে না, টেররিস্টরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? আবার কোথাও করবে, পুলিশ টিকিও ছুঁতে পারবে না। পুলিশও কোন ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। দুই টেররিস্ট তো পরশুদিনই এনকাউন্টারে মারা গেছে। একটা তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পরে সুবিমলের মুখে। কিন্তু কি অডাসিটি , তারপরেও আবার ব্লাস্ট হয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছ? গমগম করে ওঠে সুবিমলের গলা। পাকিস্তানের মদত আর ট্রেনিং। সবকটা মুসলমানকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিলে তবে যদি কিছু হয়। কিন্তু এনকাউন্টার করল কেন? খবরের কাগজ থেকে মুখ সরাল উপরের বার্থের লোকটা এবার। ওদের ধরতে পারলে তো বরং কিছু খবর জানা যেতো। হয়তো পরের ব্লাস্টটা হত না। সবাইকে চমকে দিয়ে সালমা বলে ওঠে, আল্লা জানেন, পিছন থেকে গুলি করে মেরেছে ছেলেটাকে, ওদের হাতে তখন কোন হাতিয়ার ছিল না। তার জলভরা চোখ বোরখার সীমানা ছাড়ায়। হঠাত কামরাটা এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তে সুবিমল ঝাঁঝিয়ে ওঠে, বেশ করেছে, এতগুলো নিরীহ লোকের জান নিতে ওদের তো হাত কাঁপেনি। দেশের দুষমন সব। ধরে ধরে সবাইকে গুলি করে মারা উচিত। সালমার কান্না আর নিঃশব্দ রইল না। বাধ্য হয়ে রমাকে বলতে হল , তুমি থামো তো একটু। সব জায়গায় গিয়ে তোমাকে পুলিশগিরি করতে হবে না।
আমার বাবা জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও পূর্বপুরুষের আদিবাস ছিলো ভাটি অঞ্চলের ময়মনসিংহে। মাটির সূত্রে, ভাষার সূত্রে যাদের সঙ্গে আত্মীয়তা, নাইবা থাকলো ব্যক্তিগত পরিচয়, পারেননি দুর্ভাগ্যের দিনে তাদের প্রতি উদাসীন থাকতে। একটি পলায়নপর ক্ষুধাতুর, ক্লান্ত দলকে নিজের সীমিত ক্ষমতায় একটু বিশ্রাম একটু আহার দিতে চেষ্টা করেছেন। বাবা দুঃসাহস করেছিলেন। নিজে আক্রান্ত হতে পারতেন। বাগান আক্রান্ত হতে পারতো। ঘরছাড়া মানুষ যেটুকু সম্বল পারে নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলো অজানা নূতন ঠিকানার খোঁজে। পথেই ছেড়ে যেতেও হচ্ছিলো কিছু। এক দর্জি তার সেলাইকলটি --ফুটমেশিনটি নিয়ে যাত্রা করেছিলো, যেখানেই যাক করে খেতে তো হবে। পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে সেটি বাবার কাছে বিক্রি করে গেলো। ওটি বহন করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলনা আর, পাথেয়র প্রয়োজনও ছিল। আমাদের মা আমাদের সম্বতসরের জামাকাপড় সেই মেশিনে সেলাই করতেন। সেই মেশিনে জড়িয়ে ছিলো ঘরহারার দীর্ঘশ্বাস ।
এই তো গেল খাওয়াদাওয়া। আলতাফের আরও অনেক গুণ। সে গড়গড়িয়ে সংস্কৃত বলতে পারে, ইতিহাসের বৈদিক যুগ তার খুব পছন্দের, কেনোপনিষদে কত নম্বর সূক্তে যম নচিকেতাকে কী কী বলেছিল সে সব তো বটেই উর্দু আরবি কোরান হাদিসও একইরকম ভাবে হজম করে ফেলেছে মহাভারতের ইল্বল বাতাপির মতো। তারপর আগেই বলেছি তার পরোপকারের তুলনা নেই। আলতাফের খুব পছন্দের শব্দ হল ইত্তেফাক অর্থাৎ কিনা কোইন্সিডেন্স অর্থাৎ কিনা সমাপতন। ওতেই জীবনের সব রহস্য লুকিয়ে আছে বলে ওর মনে হয়। এই যেমন আমার বন্ধু রিনা আর্কাইভের গবেষণা করতে দিল্লিতে না এলে আলতাফের সঙ্গে আমার দেখাই হত না। এরকম অজস্র ইত্তেফাকের কাহিনি নিয়ে আলতাফের সোজা সরল মজার জীবন। আমি বললুম, চলো, হজরত নিজামুদ্দিনের দরগায় একদিন যাই। যেখানে উনি সাধনা করতেন সে নাকি খুব শান্তির জায়গা। আমার বন্ধুরা বলেছে। আলতাফ একটু চুপ করে রইল, বলল, আপনি বলছেন, আমি নিশ্চয়ই যাব কিন্তু আমি মসজিদ দরগায় যাই না, তাই আপনাকে হয়তো ভালো করে গুছিয়ে সব বলতে পারব না। আমি বললাম সে তো আমিও নিয়মিত মন্দিরে যাই না। তাতে কী এসে গেল? মেহবুব-এ- ইলাহি এই সুফিসাধকের দরগায় সব ধর্ম আর জাতের মানুষরা যায়। আর এখানেই পাশাপাশি চিরশান্তিতে শুয়ে আছেন মুরিদ আর মুরশিদ, শিষ্য আর গুরু। চিস্তি সুফিয়ানা সিলসিলা ধরে রেখেছে বিখ্যাত শায়ের, সংগীতজ্ঞ, কাওয়ালির স্রষ্টা, ভাষার জাদুকর আমির খুসরো আর তাঁর গুরু নিজামুদ্দিন আউলিয়ার গভীর প্রীতিময় আখ্যান।
সে কি আর নীতেশ রবিদাস জানে না? পৌরসভার নোটিশ পেয়ে কার কাছে না গিয়ে ধর্ণা দিয়েছে তারা। ব্রিটিশ আমল পার হয়ে পাকিস্তানি আমল, জয়বাংলা, কেউ তাদের ওঠাতে চায়নি। ফুলে ফেঁপে বড়ো হয়েছে তাদের পরিবার। বাঁশের বেড়া দিয়ে খোপ খোপ বিভক্ত হয়েছে পরিবার। চামড়া সেলাইয়ের কাজ ছেড়ে রংমিস্ত্রি, রিকশা মিস্ত্রি, কত পেশায় ছিড়িয়ে গেছে তারা। কিন্তু সন্ত ঋষি সন্তানদের ওঠানোর চিন্তা করেনি কেউ। দ্য প্যারাগন হাউজিংই প্রথম এদের উৎখাতের প্রসঙ্গ ওঠায়। কেউ তখন পাশে দাঁড়ায়নি একা বদরুল ছাড়া। তাও নিশীথের কারণে। সব জানা আছে নীতেশের। মনে আছে তখন আর কেউ এগিয়ে আসেনি। এ নিয়ে সীতেশবাবুর সাথে তর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই। সে এসেছে তারা এবার মা দুর্গার পূজা করবে এটা জানাতে। বাঙালি না হলেও দীর্ঘদিন এই বাঙালি সমাজে থেকে তারা মনেপ্রাণে বাঙালি সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। আর এ যেন সেই দুর্গোৎসব শুরুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, খেয়ে পরে সবাই ভালো আছে তাই উদ্বৃত্ত টাকায় শারদীয় ঊৎসবের আয়োজন। মূল স্রোতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা।
কমল বলে, “এই বাড়ি আপনাদের কাছ থেকে আমি কিনে নেব। দেখবেন আমি কেমন যত্ন করে রাখব। নতুন বাঁধন দেব, ভাঙ্গা ইঁট বদলাব, চুনকাম করব।” মজিবুল মাথা নেড়ে হাসে, বলে, “এমনই হবার কথা ছিল, কমলবাবু।” রেজওয়ানা বোঝে না মজিবুল কী বলতে চায়। তারপর কমল বলে, “কাল শুক্রবার। ছুটির দিন। আমার একটা অনুরোধ রাখুন আপনারা। আজ রাতে আপনারা এখানে থেকে যান। রাতের খাবার তৈরি। মনে করুন আপনারা আজ স্বাধীন, বেড়াতে এসেছেন আপনাদের শহরেরই আর এক প্রান্তে এক হোটেলে।” রেজওয়ানা কমলের দিকে তাকায়, একটা সন্ধ্যায় কমলের মুখটা মনে হয় বয়সে ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে। এমন ভাবে জীবনকে দেখা যেতে পারে, ভাবে রেজওয়ানা, এভাবেও বেঁচে থাকা যায়। দুজনে যে কখন কমলের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করল তারা নিজেরাই জানল না। সন্ধ্যাতারা কখন ডুবে গেছে। রেজওয়ানা কবির আর ড্রাইভার সেলিমকে ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিল।
সিন্ধু নদকে ছেড়ে ইসমত আর কীর্তনখোলা নদীকে ছেড়ে সআদত এসে পড়েছিল এক নতুন দেশে, যেখানে তারা সংখ্যালঘু। তবু তারা বেছে নিয়েছিল এই দেশটাকে, কেন-না, মাঝখানের এই দেশটাই জুড়ে রেখেছিল পরস্পরের জন্মভূমিকে। পালানোর আগে স্থির হয়েছিল, দু'জনের দেখা হবে দিল্লিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে─সবে পঁচিশ বছর বয়স তখন তার, সেভাবে সেজে ওঠেনি তখনও, ওরা চিঠিতে জানিয়েছিল, জেনেছিলও এমন-কি, সেই প্রায় সদ্যোজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনেই থাকবে তারা; সেখানেই দেখা হবে তাদের, বহুদিনের দাবদাহের পর বৃষ্টি নামবে চোখের পাতায়─আনন্দজল। সআদত তাকে বাংলা ভাষাশিক্ষার কিছু প্রাইমার রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠালেও ইসমত তখনও বাংলা ভাষাটা পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারেনি, কারণ যেহেতু তার বাড়িতে সবাই উর্দুতে কথা বলে, ফলত তার বাংলা বলার অক্ষম চেষ্টায় ক্রিয়াপদ গুলিয়ে যায় এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে উর্দু শব্দ। সআদত যে তাকে বাংলা শেখার জন্য জোরাজুরি করেছিল, তা নয়; বরং ইসমত নিজেই চেয়েছিল ভাষাটা শিখতে : ওদের বিয়ের পর সআদতের আম্মি-আব্বুর সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করে তোলার উপায় হিসাবেই বিষয়টাকে দেখেছিল ইসমত আর তাই বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই মোটামুটি চলনসই একটা কথোপকথনের ভাষা, নিজের মতো করে, তৈরি করে নিতে পেরেছিল সে।
এটা হবেই, জানা কথা। তাই গত দশ বছরে বেশ কয়েকবার একা বা ওর দলের সঙ্গে এই বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও ভেতরে কখনো পা রাখার কথা ভাবে নি রাজিয়া। তিনতলায় উঠে আসা তো দূরের কথা। ওকে ওর দীক্ষা মা বলেছিল পুর্বাশ্রমের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যেতে হয়। হিজড়া সমাজের এটাই নিয়ম। তাই রাজেশনারায়ণকে মুছে ফেলে ওকে দেওয়া হয়েছিল ওর নতুন নাম। দীক্ষা মা জিজ্ঞেস করেছিল, “কি নাম নিবি রে বেটি?” রাজেশের মনে পড়েছিল ছোটবেলার কথা। ইস্কুলে ইতিহাস পড়ার সময় কেমন কখনো নিজেকে মনে হত লক্ষীবাই, কখনো রাজিয়া সুলতানা। পুরনো নামের সঙ্গে মিলিয়ে তাই নিজের নতুন নাম রেখেছিল রাজিয়া। পূর্বাশ্রমের কথা এতদিন তো ভুলেই ছিল। তাই এমনকি পুজোর কদিন মনটা হু হু করলেও কখনও এদিকে পা মাড়ায় নি ও। কিন্তু আজ আর কিছু করার নেই। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই সিংহভবনের চৌকাঠ পেরোতে হল রাজিয়াকে। উকিল বলেছে, এনআরসিতে নাম তুলতে হলে বার্থ সার্টিফিকেটটা যেভাবেই হোক নিয়ে যেতে হবে। বাকি কাগজপত্র, অপারেশানের সার্টিফিকেট সব যোগাড় হয়ে গেছে। শুধু এইটাই বাকি। জীবনও কখনো কখনো কিছু কৌতুক করে। আজ রাজিয়ার নাগরিকত্ব প্রমাণের কাজে লাগবে দশ বছর আগে বিসর্জন হয়ে যাওয়া রাজেশনারায়ণের জন্মনথি। যাকে কেউ মনে রাখে নি। রাজিয়া নিজেও না।
রমজান মাস পড়ল। সে সময় চলছে বাগদি পাড়ার পুন্যি পুকুরে জবকার্ড থেকে মাটি কাটার কাজ। বেলা বারোটা। সব পাড়া থেকেই দু-চারজন করে কাজে লেগেছে। যারা রোজা রেখেছে, খালি পেটে টলছে। তখন বাগদি পাড়ার কেউ একজন বলে উঠল, তুমরা যারা রোজা রেখেছ, ঘর যাবে তো চলে যাও। বাকি কাজ আমরাই করে দিব। এত রোদে খালি পেটে আর খাটতে হয় না। দুগি বাগদির মেয়েটার বিয়ে লেগেছে মাছডোবায়। জামাইকে দিতে হবে একখানা নতুন সাইকেল, হাত ঘড়ি, আর নগদ পনেরো হাজার টাকা। কোথায় পাবে দুগি! খালেবিলে, নদীতে, মুয়ানে মাছ ধরে সে। দুগি গেল মল্লিকপাড়ার ঝড়ো মল্লিকের কাছে। গিয়ে সব কথা বলে আবদার করে বসল, ও চাচা, দুগিটার বিয়ে লাগাইছি। তুমি কিছু দিবে নাই? ঝড়ো মল্লিক বলল, ও মা, এ তো খুশির খবর! মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিস, কিছু দিতে হবে বইকি। তা কী দিলে খুশি হবি বলত? আবদুল চাচা তো সাইকেলটা দিচ্ছে, তুমি একখানা ভালো হাত ঘড়ি কিনে দিও তাইলে।
পায়ে শট ছিল না সেরকম। গায়েগতরে খেলা তো দূরের কথা। তবু গোলটা চিনতো। বক্সে বল পেলেই পায়ের ডগা দিয়ে টুক করে গোলে ঢুকিয়ে দিতো। মানস থাকলে বলতেন - সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকার। পল্লব থাকলে বলতেন - পরিভাষায় যাকে বলে, ফক্স ইন দ্য বক্স।
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে সিম্বামওয়েন্নি থেকে উগোগো অঞ্চলের চুন্যো জনপদের উদ্দেশে পথচলার কথা। তরজমায় স্বাতী রায়
দক্ষিণ ইওরোপের আইবেরিয়ান উপদ্বীপের দেশ। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য, মধ্যযুগীয় মুসলমান শাসন, প্রাক-আধুনিক ঔপনিবেশিক শক্তি, আধুনিক কালে দীর্ঘ স্বৈরতন্ত্র ও পরে গণতন্ত্রের মিশ্রণে বিচিত্র রঙিন সংস্কৃতি। ঠিক পর্যটক হয়ে সাইট-সিয়িং নয়। কখনও শিক্ষার্থী, পরে তরজমাকার হয়ে এদেশের নানা শহরের অন্দরমহলে উঁকি-ঝুঁকির অভিজ্ঞতা। এ কিস্তিতে কুইম্ব্রার কাফে, রেস্তোরাঁয় খাস পোর্তুগিজ খানা-পিনা। ঋতা রায়
রুংলি রাংলিয়াটের পর জুলি টি এস্টেট। তারপরে তিস্তা ভ্যালি টি এস্টেট। পরপর তিনটি চা বাগান পার করে পাহাড়ে তিন চারটে বাঁক ঘুরে আমরা এসে পড়লাম তিস্তাপাড়ে। তিস্তা ব্যারেজের পাশ দিয়ে সেবক রোড - তিস্তা বাজার থেকে সেবকের দিকে চলে এসেছে। এতক্ষণ বেশ ভালই আসছিলাম - করোনেশন ব্রিজের কাছাকাছি আসতে শুরু হল যানজট। সামনে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে যথারীতি - একটা যাত্রীবাহী ল্যান্ড রোভার একটা মিলিটারি ট্রাকের সাথে ঘষে গেছে। তেমন গুরুতর জখম কেউ হননি, এটাই বাঁচোয়া। এসব ছাড়িয়ে আর কিলোমিটার চারেক যেতেই ডানদিকে, আমার চির পরিচিত করোনেশান ব্রিজ। চির প্রিয়। আমার যোগসূত্র। ডানদিকে ঘুরে ব্রীজ পেরোলেই মালবাজারের রাস্তায়। কিন্তু এ যাত্রা আমরা সেন্ট্রিফ্যুজাল। কেন্দ্রাতীগ। সেতু পেরোনোর অবকাশ নেই। সেবক কালিবাড়ি ছাড়িয়ে, রেলব্রীজ বাঁয়ে রেখে বৈকুন্ঠপুরের জঙ্গল। শালুগাড়া। শিলিগুড়ি। চম্পাহাটি। মাটিগাড়া। স্মৃতিরা ভীড় করে। কেন যে ভীড় করে?
খুব রোমহর্ষক দিনকাল চারপাশে। বনগাঁ লোকালে সিট পাবো তাই ডিটেনশন ক্যাম্প চাইছি, ‘মেয়েদের স্বাধীনতা এনে দেবো’ এই বলে তাদের প্রেমিকদের ক্যালাচ্ছি, মন্দিরের লুঙ্গি তুলে দেখছি আগে বানানো কোনো মসজিদ নিচে ছিল কিনা আর মসজিদের কাছা খুলে ভাইসি-ভার্সা, জাঙিয়ার ভেতরেও ট্যাগলাইন দিচ্ছি ‘হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর দাবিতে গোরুমারা চলুন’, লোককে বলছি গোরুর মুত খান এদিকে কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতে নিজের বিমানে চড়ে যাচ্ছি ক্যালিফোর্নিয়া অবশ্য বিমানের নাম দিয়েছি ‘পুষ্পক’ কিন্তু ভেতরে ঢুকে কুলকুচি করছি ব্ল্যু লেবলে। এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়। সব সত্যি!
ন্যায়বিচারের প্রাথমিক শর্ত হল, যেকোনো আদশের পশ্চাতে যে কারণগুলো আছে তা ব্যাখ্যা করা। সকলকে জানানো। কারণ কমিশন নাগরিকের সমক্ষে দাঁড়িয়ে, মানুষের নজরদারির মধ্যে দাঁড়িয়ে কাজ করার অন্যতম স্বাধীন সংস্থা।কাজের স্বচ্ছতা তাই আবশ্যিক শর্ত। তা অনুসৃত হওয়ার মধ্য দিয়েই কমিশনের মত স্বাধীন সংস্থার জনগ্রাহ্যতা, বিশ্বাস, আস্থা গড়ে ওঠে। দায়বদ্ধতাহীন ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারের জন্ম দেয়।
নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালানো এবং হত্যার পর দেশের সর্ব বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতাদের এই সব মন্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর তা নিয়ে নীরব থাকা, একটাই কথা বলে। সেটা হল, ঘৃণা এখন ভারতে শাসকের রাজনীতির সব থেকে জরুরি উপাদান। এর সঙ্গে মিলিয়ে নিন আরও কয়েকটি তথ্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আন্দোলনকারীদের পোশাক দেখে চিনতে। মোদী মন্ত্রিসভার এক সদস্যকে শাহিনবাগকে উদ্দেশ্য করে জনতাকে দিয়ে বলাতে দেখা গিয়েছিল, ‘গোলি মারো সালোকো’। মোদী মন্ত্রিসভারই আরেক মন্ত্রীকে দেখা গিয়েছিল আখলাখ খুনে গ্রেফতার হওয়া এক অভিযুক্তের স্বাভাবিক মৃত্যুর পর, সেই শবযাত্রায় উপস্থিত থাকতে, যেখানে হত্যায় অভিযুক্তের ওই মৃতদেহ জাতীয় পতাকায় ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। সেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর টুইটে তাকে বলা হয়েছিল ‘শহিদ’। এই সব কিছু একই সুতোয় বাঁধা। আর এই মুহূর্তে তারা সবাই সক্রিয় শীতলকুচিতে।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, ঢেন্ডুপ প্রাক্তন সৈন্য - গোর্খা রেজিমেন্টের হাবিলদার পদে ছিলেন। দশ বছর হল অবসর নিয়েছেন। ওঁর এক ছেলে, এক মেয়ে - ছেলে থাকে প্যারিসে, মেয়ে কলকাতায় ছিল, এখন পুনেতে। আগামী মাসে (মে) ওদের ছেলের কাছে যাবার কথা ছিল - সেটা সম্ভবতঃ বাতিল করতে হচ্ছে, প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে। এসব কথা অবশ্য কিছু আগের শোনা, আর ওই যাওয়া ক্যান্সেলের ব্যাপারটা গত সপ্তাহে ফোনে জেনেছি। ডিকির সাথে মেঘের কথা হয় প্রায়ই, ভিডিও কলে