এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ক্যালিডোস্কোপে দেখি - জীবন নাটক - অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়ক্যালিডোস্কোপে স্মৃতির চল না একমুখী না সরলরৈখিক, এগিয়ে পিছিয়ে ঘুরতে থাকে।আমাদের ছোটবেলায় আমাদের তিন ভাইকে যদি প্রশ্ন করা হত তোমাদের একটিমাত্র জায়গায় যাওয়ার বর দেওয়া হচ্ছে, কোথায় যেতে চাও, আমরা এক কথায় জানিয়ে দিতাম দত্তপুকুরে আমাদের মামাবাড়িতে। সু্যোগ পেলেই আমরা মামাবাড়ি গিয়ে হাজির হতাম। মামাবাড়ির দিক থেকে আমাদের বাড়ি এসে থাকা, খোঁজখবর নেওয়া, বেশিরভাগ সময়ে করত মা আর বাবার মাঝামাঝি বয়সের, আমাদের ছোটমামা। তার বিয়ের পরে মামিও এসেছে আমাদের বাড়ি। আমার বিয়ের পর যখন এই যুগল আমাদের বাড়ি এসেছে আমার স্ত্রীও তাদের অপার স্নেহের ধারায় সিক্ত হয়েছে। তাই বলে আমাদের ছোটবেলায় ছোটমামার উপস্থিতি কিন্তু বাকি মামাদের সান্নিধ্যের মতন সদা-সুখের ছিল না। যখন তখন আমাদের বাবা এইটা পারে না, ঐটা পারে না ইত্যাদি হাবিজাবি অভিযোগ অথবা ঘোষণায়, যেগুলি এখন আর একেবারেই মনে পড়ে না, সে আমাদের অস্থির করে ফেলত। আমরা রীতিমত প্রতাপশালী বাবা কিংবা স্নেহশীলা মা এমন কি আমাদের ঠাকুমার কাছে এই নিয়ে অভিযোগ করতে গিয়ে দেখতাম তারা মামাকে ত কিছু বলছেই না, বরং মুখ-টেপা হাসিতে পরিস্থিতিটা উপভোগ করছে। ঠাকুমা বললও একদিন, ‘হ্যায় ত তোমাগো বাপের শালা, হ্যায় ঠাট্টা করতেই পারে।’ বড়দের এই নাটকটা আমি কিছুতেই ধরতে পারতাম না। আজ অবশ্য অতীতে তাকিয়ে সেই হাসির শরিক আমিও। তবে সেদিনের সেই শিশু তিনটির জন্য মায়া হয় খুব।সেই সময় ছোটমামা মানেই নাটক। থেকে থেকে অভিনয় করে বা না করে নাটকের সংলাপ বলে যাওয়া। তার প্রিয় সংলাপ ছিল – হাসি কিসের এত? এইটা কি নাট্যশালা? (না কি নাইট্যশালা, এই বিশেষ বাচনভঙ্গীতে বলত কি? হায় স্মৃতি, তুমি বড়ই প্রতারক!) কোন গল্পের বা কোন নাটকের থেকে এই সংলাপ, জানতাম না আমি, কিন্তু ছোটমামা বাড়িতে এসেছে আর এই সংলাপ শুনিনি এমন ঘটেনি কখনও। একটা সময় বুঝেছি জীবন যথার্থই নাট্যশালা। অভিনয়ে কিভাবে নিজের অনুভবকে দর্শকের কাছে পোঁছে দেওয়া যায়, ছোটমামা ছিল তার আদর্শ উদাহরণ। আমাদের কোন আব্দার কি দাবি নাকচ করতে হলে এমন ভাবে জিভ বার করে, চোখ আধবোজা করে অল্প মাথা নাড়িয়ে সেটা মানা করত যেন আমরা একটা ভয়ানক লজ্জার কাজ করে ফেলেছি বা করতে বলছি। হঠাৎ হঠাৎ করে উপযুক্ত মুখভাব আর গলার স্বরের ওঠা-নামা সহ বিভিন্ন চরিত্রের মনোলগ বলে যেত। কখনো কখনো একাধিক চরিত্রের ডায়ালগ। সিরাজের ভূমিকায় জেলে বন্দি নবাবের অন্তিম মুহুর্তের দৃশ্যায়নে কথা বলতে বলতে সহসা এমন ‘আঁক’ করে থেমে গিয়ে চোখ বড় করে তাকাত যে আমরা পরিষ্কার বুঝতাম ঘাতকের ছোরা সিরাজের পেটে ঢুকে গিয়েছে। মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম আমিও একদিন ছোটোমামার মত এমন অসাধারণ নাটক করব। কি কারণে জানা নেই, মঞ্চে মামার নাটক আমার কখনও দেখা হয়নি। আমার নিজের অবশ্য মঞ্চে ওঠার সু্যোগ অনেক ছোটবেলাতেই এসে গিয়েছিল। আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। ঠিক কি উপলক্ষে আজ আর মনে পড়ে না, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়-এর একটা বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল। রীতিমত মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল বেঁধে। সেই উপলক্ষে প্রচুর বক্তৃতা আর নাচ-গান-আবৃত্তির সাথে একটা নাটকের আয়োজন করা হয়েছিল। রবিবুড়োর ডাকঘর থেকে একটা ছোট অংশ ছিল আমাদের পাঠ্যবইয়ে, অমল ও দইওয়ালা শিরোনামে। দিদিমণিরা সেটাই বেছে নিলেন মঞ্চস্থ করার জন্য। সম্ভবত: প্রচুর পটর-পটর করার যোগ্যতায় আমি মনোনীত হলাম অমল-এর ভূমিকায়। চতুর্থ শ্রেণীর এক শ্রীমান হল দইওয়ালা।সেই প্রথম জেনেছিলাম রিহার্সাল কাকে বলে। শেষ ক্লাস-এর পরে শুরু হত। ভাল লাগত, তবে একটু ক্লান্ত হয়ে যেতাম – আমার তো কবে সব মুখস্থ হয়ে গেছে, ভাব ভঙ্গী সহ! দিদিমণিরা মাঝে মাঝে আলোচনা করতেন কেমন করে মঞ্চসজ্জা করলে বা আর কি কি করলে নাটকটা একেবারে সত্যির মত করে তোলা যায়। সেই সব কিছু কিছু শুনে আমার ধারণা হয়েছিল যে আসল অনুষ্ঠানের দিন আমাকে দইওয়ালা ছেলেটির হাত দিয়ে একটা সত্যি দই-য়ের ভাঁড় দেওয়া হবে। আমার কাছে নাটকের আসল আকর্ষণ ছিল সেটা এবং সেই নিয়ে ভিতরে ভিতরে খুব উৎফুল্ল থাকতাম।এসে গেল দিনটা। আমরা কলা-কুশলীরা প্রথম থেকেই গ্রীনরুম-এ। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছি – সামনে মাথার পর মাথা, লোকের পর লোক। কালে কালে সম্ভাব্যতার যুক্তিতে সে সমাবেশের আকার ছোট থেকে ছোটতর হয়েছে, কিন্তু অন্তরের অন্ত:পুরে সেটা বিশাল-ই রয়ে গেছে। আমার চেতনায় সেটিই ছিল জনসমুদ্রের প্রথম ধারণা। মজার বিষয়, সেই জনসমুদ্র দেখে আমার কোন ভয় বা দ্বিধা হল না। বরং নিজের ভিতর থেকে একটা অজানা শক্তির জেগে ওঠা টের পেলাম। সেদিনের সেই অনুভূতিটা ফিরে এসেছে বারে, বারে – যতবার মঞ্চে উঠেছি ততবার। লাইম লাইটের আলোয় আমি অন্য মানুষ – আমি-ই তখন নিয়ন্তা।কুচো ফর্মাটের সেই নিয়ন্তা একসময় মঞ্চে এসে বসল, ঘরের ভিতর জানালার পাশে। বসেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। এটা একটা মঞ্চ সজ্জা হল! আমার সামনে হাঁটুর উচ্চতায় একটা ছোট কাপড়ের আড়াআড়ি বেড়া আর তার দু’ধারে দুটো কাপড়ের টুকরো মেঝে থেকে ছাদের দিকে উঠে গেছে, একটা সরু লম্বাটে চৌখুপী বানানো হয়েছে। এটা একটা জানালা হল! একসময় সেই জানালার পাশের দিক থেকে আমার মুখের সামনে একটি মাইক্রোফোন এল। আমাকে বলা হল মাইকে কথা বলতে। ওনারা মাইক টেস্ট করবেন। আমি ভাবলাম আমাকেই বলছেন টেস্ট করে নিতে। কি করে করব! মঞ্চের সামনে থেকে বড্ড আওয়াজ আসছে। গোলমালের সমুদ্র চলছে যেন। ভেবে দেখলাম, নিশ্চয়-ই ছোট বাচ্ছারা বেশী কথা বলছে। আগেও কয়েকবার এই অবস্থায় যে ঘোষণাটি শোনা গেছে এবার আমি-ই সেটি দিয়ে দিলাম, সঙ্গে দিলাম নাটক শুরু করার বার্তা – ছোট বাচ্ছারা গোলমাল না করে চুপ করে বসে পড়, আমাদের নাটক এখন-ই শুরু হবে।ব্যাস! জনসমুদ্র যেন হো হো হাসির গর্জন-এ ফেটে পড়ল। এক মাস্টারমশাই উইংসের আড়াল থেকে ছুটে এসে আমায় বললেন এখন আর যেন মাইকে কিছু না বলি। আমি ত হতবাক! দোষটা কি করলাম! পরে বুঝেছি, মহা দোষ করেছিলাম। শান্ত ভাবে, উচ্চকিত আড্ডার কলতানে চারিদিক মথিত না করে অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করাটা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয়। গোলমাল তো আর ছোটরা ততটা করছিলনা, যতটা করছিল বড়রা! তাই আমার তিরস্কার আসলে বিঁধেছে তাদের-ই। অতএব উপহাস আর মজার উল্লাসে আমার দোষের শাস্তি দেওয়া ছাড়া আর কি-ই বা তারা করতে পারতেন, এমন কি গোটা উপমহাদেশ জুড়েই আজো পারেন! আর একটা আঘাত-ও সইতে হল – দই-এর ভাঁড়-এ কোন দই ছিল না! দই-জনিত সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে বড়রা হয়ত ঠিক ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন, কিন্তু নাটক শেষের হাততালির ঝড়-ও আমার ক্ষোভ আর অপ্রাপ্তির দু:খ মুছে দিতে পারে নি। সেই সন্ধ্যায় আমি প্রস্তুতি ছাড়াই একদফা বড় হয়ে গিয়েছিলাম!আর আশ্চর্যভাবে, আমার কোন শিক্ষা হয়নি। অনেক বছর বাদে আরেক বিদ্যায়তনে আবারো নাটকে অংশগ্রহণ করেছি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে মঞ্চে সন্দেশের বদলে কলার টুকরো ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদি সন্দেশ খেতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় গলায় আটকে বিপদ বেধে যায় তাই এই সতর্কতা। খুবই সঙ্গত ব্যবস্থা। কিন্তু আমার যে কি বিপুল হতাশ লেগেছিল, সে আর বলবার নয়। তারপর থেকে অন্যের নির্দেশনায় মঞ্চে ওঠায় খানিকটা অনীহা হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুরা মিলে যখন নাটকের দল তৈরী করেছিলাম, নির্দেশনা হত সবার মিলিত সিদ্ধান্তে, কোন পরিচালক ছিলনা আমাদের। অবশ্য বাদল সরকার বা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় কাজ করার যখন সু্যোগ এসেছে সেগুলো হাতছাড়া করিনি।ছোটবেলার যে সমস্ত ঘটনা স্মৃতির কন্দরে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ অনুভবে রয়ে গেছে তার একটি ছিল এক মেলায় যাওয়া আর তার পরিণতি। সঠিক সময়কাল এখন খানিকটা ঝাপসা হয়ে গেছে। তবে তিন থেকে সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে ঘটেছিল। বাবা আমি আর আমার পিঠোপিঠি মেজ ভাই তিন জনে মিলে মেলায় বেড়াতে গেলাম। মেলায় বেলুনওআলা বানিয়ে চলেছে নানা আশ্চর্য – কুকুর, মালা, মুকুট আরও কত কি! মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি আমি। এক সময় আবিষ্কার করি – আমি হারিয়ে গেছি। বাবা-ভাই কাউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তায় পড়ে গেলাম। তবে ভয় করে নি আমার। চারপাশে এত লোক! উপায় হয়ে যাবে কিছু একটা। কিন্তু কি ভাবে! মাথায় যে কিছু আসছে না! এবার হতাশায় চোখে জল চলে আসে আমার!হঠাৎ এগিয়ে আসে এক কাকু। প্রশ্ন করে করে বোঝার চেষ্টা করে বাড়ি কোথায় আমার। আমি যতটা পারি বলি। তারপর দুজনে মিলে রওনা হই বাড়ির উদ্দেশ্য। চলতে চলতেই মিলিয়ে নিতে থাকি পথ – হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই দিকে, এই ব্রীজ দিয়ে রেললাইন পার হতে হবে। এবার এই দিকে। একসময় বাড়ি এসে গেল। কাকুটা আমায় বলল, সাহসী ছেলে, ভাল ছেলে। আর সাহসের পুরস্কার হিসাবে আমায় একটা পয়সা দিল। সম্ভবত: পঞ্চাশ পয়সা ছিল সেটা। বাড়ির দরজায় আমায় পৌঁছে দিয়ে কাকু তার বাড়ি চলে গেল। আর, আমি বুক পকেটে পয়সা ভরে বিজয় গর্বে বাড়ি ঢুকে এলাম।মা আমার কাছে ঘটনা শুনে আঁতকে উঠল। তারপর জিজ্ঞেস করল নাম কি সে কাকুর, সে কি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? আমি বললাম – নাম জানি না, ভাল কাকু, বাড়ি চলে গেছে। মা অত্যন্ত হতাশ হয়ে জানাল এমন উপকারী মানুষের নাম না জানাটা আমার অত্যন্ত বোকামি হয়েছে। আর, এই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম কি অসাধারণ বেকুব ছেলে আমি! সেই সাথে মা-ঠাকুমা দুজনেই ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল বাবার অবস্থা ভেবে। তারা কথা বলতে বলতেই বাবা এসে পড়ল ভাইকে নিয়ে। আমায় দেখতে পেয়ে নিশ্চয়ই বিরাট এক আনন্দ হয়েছিল তার। কিন্তু মুখ দেখে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। মার কাছ থেকে খুঁটিয়ে সব জেনে নিয়ে আমায় বলল – “চল।” ভাই বাড়িতে রইল। আমি চললাম বাবার সাথে – কোথায় কে জানে!এ পথ সে পথ ঘুরে বাবা যেখানে আমায় নিয়ে এল তা দেখে আমি আর আমাতে নেই! চারিদিকে খাকি পোষাক। থানা। দারোগা টেবিলে বসে কি লিখছে। বাবা গিয়ে সামনে দাঁড়াল। আমার সামনেই গরাদ ঘেরা কি জায়গা ওটা? কি আবার? জেলখানা। জেলখানা ছাড়া আর কি হবে? বাবা কি যেন বলল দারোগাকে। আমি আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না। দারোগা ফিরল আমার দিকে। সব বুঝে গেছি আমি। বাবা আমায় শাস্তি দিচ্ছে। দারোগা এবার আমায় জেলে ভরে দেবে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি। বাবা ত থ। এত ঘুর-চক্কর খেয়ে যে ছেলের কোন উদ্বেগ দেখা গেল না এখন তার কি হল? আর কি হল। আমার হেঁচকি উঠতে রইল। অপ্রস্তুত বাবা কোনমতে কি সব সই-টই করে আমায় নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে এল। বাবা যে কি সব বলে যাচ্ছিল – ডাইরী, জানিয়ে যাওয়া – এতক্ষণে একটু একটু করে আমার মাথায় ঢুকতে শুরু করল। আর তার পরে লজ্জায় মাথাটা আমার নীচে, আরো নীচে। সে’দিন আমি ভয় আর লজ্জা দুটোর-ই মুখোমুখী হয়েছিলাম এমন তীব্রতায় যা এর আগে আর কখনো ঘটেনি। পরে বহুবার ঘটেছে। সেই দিনটা ছিল সূচনা বিন্দু। জীবন নাটকের কঠিনতর অধ্যায়ের।প্রচলিত মঞ্চ-নাটকের বাইরে আরেক নাটকের অভিজ্ঞতা মনে পড়ে মাঝে মাঝে। সেই সন্দেশের বদলে কলার টুকরোর স্কুলেই খুব ভাল লেগেছিল ঐ বিশেষ নাটকের অংশ হতে পেরে। ষষ্ঠ শ্রেণী। একদিন ভূগোলের ক্লাসে নিয়মিত শিক্ষকমশাইয়ের বদলে একজন তুলনায় কম বয়সের শিক্ষক এলেন। খুব উৎসাহী মানুষ। নিজে স্কুলের কাছাকাছি বি টি কলেজে পড়তে এসেছেন, পড়ানো শিখতে। শেখার প্রক্রিয়াটির একটি পর্‍যায় হাতে-কলমে শেখা, সেটিই উনি করতে এসেছেন আমাদের পড়িয়ে। পড়াবেন আফ্রিকার ভূগোল। তবে একটু অন্যভাবে পড়াবেন। আসলে উনি আমাদের পড়াবেনই না। আমাদের দিয়ে একটি নাটক করাবেন। একটি ছেলে আফ্রিকায় বেড়াতে এসেছে, এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক শহর থেকে আরেক শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সব জায়গায় স্থানীয় কোন ছেলেকে সেখানকার কিছু কথা বলে তারপর সেই নিয়ে প্রশ্ন করবে। সেই স্থানীয় ছেলেটি সেই সব প্রশ্নের সাধ্যমত উত্তর দেবে। ভাল করে পার্ট মুখস্ত করতে হবে আমাদের। ওনার পড়ানোর যে সময়কাল তার পুরোটা জুড়ে এই নাটকের রিহার্সাল চলবে, দরকার পড়লে উনি প্রম্পট করবেন। তার পর একদিন ওনার পরীক্ষকরা আসবেন। সেইদিন তাদের সামনে কোন প্রম্পট ছাড়া আমাদের নাটক চলবে। পরীক্ষকরা নিজেরাও আমাদের যাকে খুশি কিছু কিছু প্রশ্ন করতে পারেন। কাকে কি প্রশ্ন করবেন সেটা এই মাস্টারমশাইও জানেন না। তবে আমরা যদি নাটকটা বা তার পরে ঐসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি তাহলে তিনি ফেল করবেন। কিন্তু সেটা নিয়ে ওনার কোন দুশ্চিন্তা নেই কারণ উনি জানেন, আমরা নাটকটা এত ভাল ভাবে করব যে ওতেই উনি পাশ করে যাবেন। আর প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারলে ত আরও ভাল, অনেক ভাল পাশ হয়ে যাবেন। এসে গেল অপেক্ষায় থাকা দিনটি। আমি বেড়াতে আসা ছেলেটির পার্ট পেয়েছিলাম। সারা ক্লাসের কোথায় কারা কারা বসবে সেটা এমনভাবে ঠিক করা ছিল যাতে সব বেঞ্চ থেকেই অন্ততঃ একজন করে অভিনেতা থাকে। কিছু বকবক, কিছু প্রশ্ন। কিছু চটপট উত্তর, কিছু থেমে থেমে। কিছু উত্তর ভুলে যাওয়া, তখন বাকিদের মধ্য থেকে কেউ হাত তুলে সে উত্তর বলে দেওয়া। পরীক্ষকরাও কেউ একজন মনে হয় কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন, আমাকে এবং অন্যদের, উত্তর শুনে সম্মতিতে মাথা নেড়েছিলেন। পরীক্ষার্থী শিক্ষকমশাই চমৎকার ভাবে পাশ করেছিলেন, সেই আনন্দ উদবেল করেছিল নাটকের পরিচালক এবং কুশীলবদের সবাইকে।তবে কোন আনন্দ যে কিভাবে বিষাদ ডেকে আনে! অসাধারণ সাফল্যের আনন্দে মাস্টারমশাই ওনাদের হোস্টেলবাসের সমাপ্তি ভোজে সপ্তাহশেষের দুপুরে আমাকেও ডেকে নিয়েছিলেন। পৌঁছানোর পর খুব খুশি হয়ে সেখানে হাজির ওনার সহপাঠী অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার খুশির বেলুন ফুটো হতে বেশি সময় লাগেনি। একজন বললেন, হ্যাঁ, এখন ত সব জিনিয়াস মনে হয়, কালে কালে সেই ঢ্যাঁড়স না হয়ে যায়। বাড়িতে সব্জি বাগানে ঢ্যাঁড়স গাছ হতে দেখেছি। তার সাথে আমার কিসে মিল হতে পারে বুঝতে পারলাম না। ঘর ফাঁকা হতে ভূগোলের শিক্ষকমশাইকে জিজ্ঞাসা করলাম। উনি বিব্রতভাবে জানালেন, ঐ ঢ্যাঁড়স যেমন ছোটতে বেশ নরম সুখাদ্য থাকে আর বেশি পেকে গেলে শক্ত হয়ে অখাদ্য হয়ে যায় সেইটা বলেছে। ও লোক ঐরকমই। আমি যেন ওর কথায় দুঃখ না পাই। ভাবলাম, ভাগ্যিস ইনি আমাদের পড়াতে যাননি। কী খেয়েছিলাম সেদিন, মনে থাকেনি। দিনটাকেই মনে রাখতে চাইনি। ভুলতেও পারিনি।সেই দূর অতীতে একটি অপূর্ব নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। যা দেখেছিলাম তার বেশির ভাগই কালের প্রবাহে ঝাপসা হয়ে গেছে। ফলে, যা মনে থেকেছে তা যত দিন গেছে তত আরো উজ্জ্বল হয়েছে। হয়ত, আসলের থেকেও বেশি মহিমান্বিত হয়ে স্মৃতিতে ঠাঁই করে নিয়েছে।বিকেলের ঘুম দিয়ে উঠে এক সন্ধ্যায় আবিষ্কার করলাম বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ভাড়া বাড়ি। আশপাশের ঘরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সবাই গেছে বড় মাঠে, নাটক দেখতে। আমিও ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির। দেখি, নাটক শুরু হয়ে গেছে, মাঠ চুপচাপ শুনছে। বাড়ির কাউকে খুঁজে পাওয়ার অবস্থা নেই। আমি একেবারে সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। সে এক অদ্ভুত নাটক। গল্প এগোচ্ছে। মঞ্চটা একটা ঘর। মঞ্চে চরিত্ররা ঘোরাফেরা করছে, কথা বলছে আর টুকটুক করে একটার পর একটা দেয়ালের টুকরো পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে মঞ্চের পিছনের পর্দার থেকে কিছুটা সামনে, বাঁদিক থেকে ডান দিক গোটা মঞ্চ জুড়ে একটা লম্বা দেয়াল বানিয়ে ফেলছে! সেই দেয়ালটায় পর্দা টাঙান জানালা আছে, প্রতি দুই জানালার মাঝে খোলা-বন্ধ হয় এমন আসল দরজা আছে। জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে লোকেরা কথা বলছে। বন্ধ দরজার পাল্লা খুলে ঘরে ঢুকে আসছে, ঘর থেকে বের হয়ে দেয়ালের ওপাশে কোথাও চলে যাচ্ছে!কি নাটক ছিল সে প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনি, অথবা করে থাকলেও উত্তর এখন আর মনে নেই। যেটা মনে আছে তা হল, সেটা ছিল বড়দের নাটক। বড় হয়ে খোঁজ নিয়ে মনে হয়েছে সেটি ছিল কেয়া চক্রবর্ত্তী অভিনীত নান্দীকারের নাটক – ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। যারা সেই নাটক দেখেছেন তারা সঠিক বলতে পারবেন। নাটকের নানা টুকরো ছবি গেঁথে আছে স্মৃতির নানা স্তরে। মঞ্চসজ্জার পাশাপাশি এই নাটক আমাকে উপহার দ্যায় আরো এক আশ্চর্য সন্ধান – নায়িকার অস্তিত্ব। সেই অস্তিত্ব-র সাথে তখনো যুক্ত হয়নি নিজের কোন ভাল লাগা-মন্দ লাগা, কিন্তু চেতনার কোন আবছা স্তরে বড় মেয়েদের আবিষ্কার করি মেয়ে হিসেবে। বড় হয়ে যাই আরো একটু।বড়দের করা নাটক পুরোটা শুনে-বুঝে বেশ উপভোগ করেছিলাম কুচবিহারে ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ার সময়, বাবার অফিসের নাটক দেখতে গিয়ে। অফিসের কর্মচারিদের করা, চেনা কাকুদেরও কেউ কেউ ছিল মনে হয়। সেই প্রথম জানলাম কালো টাকা কাকে বলে – ঘুষের টাকা বিছানার তোষকের নিচে লুকিয়ে রাখে দুষ্টু সরকারি কর্মচারি। কিন্তু সে পার পায় না। নাটকের শেষ দৃশ্যে ঠিক পুলিশ চলে এসে বিছানার তোষক উল্টে ফেলে সব টাকা পেয়ে যায়। তারপর সেই দুষ্টু লোকটাকে কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া পড়িয়ে জেলে নিয়ে চলে যায়। সেই সাথে নিয়ে যায় যার কাছ থেকে সে ঘুষ নিয়েছিল সেই ব্যবসায়ীকে। তার সংলাপের বিশেষ ধরণের বাংলা উচ্চারণ আর মাথার বিশেষ টুপিটি নজর কেড়েছিল। প্রাদেশিক প্রভাবের অস্তিত্বের ধারণা মনে হয়, সেই প্রথম হয়েছিল। আর, ঘুষ ব্যাপারটির ধারণা ঐ নাটকেই পেয়েছিলাম এবং অত্যন্ত আশ্বস্ত হয়েছিলাম এই জেনে যে ঘুষ দিলে বা নিলে রেহাই নেই, তার শাস্তি হবেই। নূতন যুগের রূপকথায় নূতন ভিলেনরা জায়গা করে নিতে শুরু করেছিল। এক যুগের নায়ক, আরেক যুগের ভিলেনে বদলে যাচ্ছে। মঞ্চের রং, দেয়ালের লেখা, চিন্তার পরিসর বদলে যাচ্ছে। তার মধ্যেই কবির হুঁশিয়ারি জারি থাকছে, “এই রাজা আসে ওই রাজা যায়জামা কাপড়ের রং বদলায়দিন বদলায় না!”কিন্তু লড়াই জারি থাকে, নাটক চলতে থাকে। ধ্বংসের রকমারি আয়োজন, তবু জীবন বারে বারে তাকে হারিয়ে মঞ্চের দখল নিয়ে এগিয়ে চলছে।তৃতীয় শ্রেণীতে থাকতে থাকতেই বাবা তাঁর সরকারী চাকরীতে বদলী হয়ে গিয়েছিলেন উত্তর বঙ্গে। আমার স্কুলের বছর শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাঁর কাছে যেতে পারিনি। তিন সন্তান আর প্রতাপান্বিত বিধবা শাশুড়ি নিয়ে মা কি করে একা সামলেছিল সেই সব দিনগুলো, দুবার ট্রেন বদলে, মাঝে স্টীমার চেপে গঙ্গা পার হয়ে দমদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুচবিহারে গিয়ে পৌঁছেছিল, সে সব ভাবলে আজো আশ্চর্য লাগে। পরের দিনগুলোতেও যাত্রাপথ নানা বাঁকে কঠিন হয়েছে। তবে আমাদের সৌভাগ্য, এই সফর একেবারে একলার ছিল না। সমাজের নানা মানুষদের নানা সময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখেছি। জীবন নাটকের অপরাহ্নবেলায় পৌঁছে তাঁদের মহানুভবতার নানা টুকরো ছবি ক্যালিডোস্কোপে বর্নিল নকশা তৈরী করে স্মৃতিতে মিলিয়ে যায়।ক্রমশ...
    পলাণ্ডু সংহিতা - নন্দিনী সেনগুপ্ত | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়১স্তরে স্তরে খুলে যাচ্ছেখেলে যাচ্ছে ঝিলিমিলি আলোঝিরিঝিরি গোলাপি পরতের শরীরে শেষে সব একদম ফাঁকা, শূন্য কিচ্ছুটি নেইজীবন, এত কান্না পেল কেন?২-    ছোটবউমা, তুই কি আমার জাত নষ্ট করলি?      নিষ্ঠাবতী বিধবার জাত নষ্ট করলি?      কেন আমায় খাওয়ালি ওসব? -   না, পিসিমা, ওই ভর্তা মাখায় বিশ্বাস করুন…     পেঁয়াজ ছিল না।     আদাকুচি, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা আর একটু     আলুসেদ্ধ, তেঁতুলের আচার দিয়ে মেখে…     যদি অসুখের মুখে একটু ভালো লাগে…-   কী বলিস, ছিল না পেঁয়াজ?-   এক কুচিও নয়। আমি কি জানি না বলুন,     সে দিলে যে আমারও ভারি পাপ হবে। -   হ্যাঁ রে, ভর্তাহীন বিধবার ভর্তা খাওয়া কি উচিত?     বল না ছোটবউমা      বল… পেঁয়াজ দিসনি যদি,     সে ভর্তা খেয়ে এত কেন ভালো লাগল?     ভুলে যাওয়া ভাতারের চুমা যেন…৩ব্রেকফাস্ট টেবিলে স্যালাড কাটতে কাটতেআমার রিনার কথা মনে পড়ল।আমাদের বাচ্চারা একসঙ্গেনার্সারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক;এখন বাচ্চারা বড় হয়ে যে যার মতঅনেক দূরে, আলাদা আলাদা শহরে।রিনাও এখন অনেক দূরে। অন্য গ্যালাক্সিতে।রিনা গার্জিয়ানদের ভিড় থেকে দূরে দাঁড়াত।আমিও। রিনা একদিন বিড়বিড় করে বলল‘উফফ, এই এক ঝামেলা।রোজের রান্না আর টিফিন। কাজের লোক না এলে… ঝোলের স্বাদ কী ভাবে বাড়ানো যায় বলো তো?শুনেছি তুমি ভালো রাঁধো…টিফিন দাও একেক দিন একেক রকম।’ -    ‘একটু পেঁয়াজকুচি ভেজে দিও নাহয়— চটজলদি স্বাদ ভালো হবে…’ বলেছিলাম আমি।রিনার সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না।ফেসবুকে ছিল। কিন্তু সেভাবে একটিভ নয়।আসলে ও বরাবর নিজের মত থাকত।কী ভাবে জীবনের স্বাদ একটু বাড়িয়ে নিতে হবে,এটা ভাবতে ভাবতে আমরা কেউই খেয়াল করিনিজীবন হঠাৎ ফুরিয়ে যায়।৪অমৃত মিশে গিয়েছিল রক্তেযদিও সে রক্ত অসুরের…মোহিনীরূপী বিষ্ণু নামিয়ে রেখেছিলেন অমৃতের কুম্ভহাতে উঠে এসেছিল সুদর্শনচক্রমুণ্ডচ্ছেদ হবার পরেঅমৃত মেশানো সে রক্তমাটিতে পড়ে সৃষ্টি হল পলাণ্ডু ও শুদ্ধিকন্দ। হননেচ্ছার মধ্য দিয়ে তোমার জন্ম হল। তাই অভিশাপ লেগে আছে; অশ্রু ঢাকবে বলে রাহুগ্রস্ত মানুষ আজও তোমারই শরীরে অস্ত্রাঘাত করে। ৫মাটির নিচে, অন্ধকার থেকেই আসে।যেভাবে সীতা এসেছিলেন।আবার পাতালে চলে গেলেন তিনি।দেবী হতে হতেও দেবী হওয়াসেভাবে হয়ে উঠল না তার… তোমারও কি সেরকম অভিশাপ আছে কিছু?৬সংসারে মন নেই তোমার।কী করে ভুলে গেলেপেঁয়াজ ফুরিয়েছে আজ সকালেই।পেঁয়াজ ছাড়া কী ভাবেই বা রাঁধবে?ঢেকে দেবে তত ভালো রান্নাকরতে না পারার অক্ষমতা।৭স্যালাডে পেঁয়াজ দিওদরাজ হাতে হে সখিআমাকেই দিও হে হৃদয়…যদিও বেড়েছে দামট্রাক ট্রাক পচে গেছেএই দেশে কোথায় কী হয়।নানা অবতারে আছোভোট কিম্বা বিরহঝাঁঝেই ছিনিয়ে নাও জয়। ৮একটা নধর আকারের গোটা পেঁয়াজ,পান্তাভাতের থালার পাশে।এই স্বপ্নটা বিলাস ক’দিন ধরেই দেখছে।আসলে এখন গোটা একটা পেঁয়াজএকবেলায় কে আর খেতে পাবে?অর্ধেক বা সিকিভাগ বরাদ্দ,যা দাম বাড়ল… কিছু করার নেই। বাদ চলেও যেতে পারে একদম।তখন শুধু লঙ্কার আচার দিয়েই… বউ দু’আঙুল দিয়ে যেভাবে সিঁদুর পরত,সেভাবে একটিপ লাল লঙ্কার আচারকৌটো থেকে তুলে নেবে সে। বউ অনেকদিন আগেএকটা পেঁয়াজরঙা বেনারসি চেয়েছিল।এখন আর চায় না।কারণ বউ দু’বছর আগেইভিখু ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। বিলাসের মনে এখন ভাবনা ঢুকেছেবউ কিসের স্বপ্ন দেখত,পেঁয়াজের নাকি পেঁয়াজরঙা শাড়ির? ৯সাদাগুলোই নিতে হবে। ওগুলো আপাতত সস্তা। এখানে দেশের মত গোলাপি লালচে মিলবে না।তবে স্পেন থেকে চালান হয় মাঝেমধ্যে।সেরকম ঝাঁঝ হয় কি?শ্যালট, শ্যালট সুখ মিষ্টত্ব চেয়েছিলে বুঝিতুমি কি প্রবাসসুখ ফেলে ফিরে যাবে দেশে? জুলিয়েন জুলিয়েন কাটবে,তবে খোসা ছাড়ানোর আগে,মাটি লেগে থাকা রুটসগোল করে কেটে বাদ দিতে গিয়েসবসময় তোমার ‘শিকড়’ শব্দটা মনে পড়বে। ১০আসমুদ্রহিমাচল অনেক মানুষ,এবং পৃথিবী জুড়ে অনেকেইআহা, পলাণ্ডু, তোমারই কথা ভাবছেচেতনে, অবচেতনে।পৃথিবী জুড়ে কত উপাসনালয়ের গম্বুজ তোমারই আদলে গড়া। পৃথিবীটা দেখতে কমলালেবুর মত হলেওওর রঙরূপেগুণেতুমি আর ঈর্ষা কোর না।তাহলে তোমার ঝাঁঝ আরও বেড়ে যাবে।তখন বলো হে পলাণ্ডু,আমি তোমায় কী ভাবে সইব?১১-   সালফারের গন্ধ পাই রে, ছোটবউমা।-   সালফার কী ভাবে আসবে, পিসিমা?-   কিছুটা পেঁয়াজের মত… কেমিস্ট্রি পড়িয়েছি স্কুলে, ও গন্ধ আমি চিনি।-   কোথা থেকে পাচ্ছেন গন্ধটা?-   সব জায়গা থেকে আসছে। কেউ বশীকরণ করতে চায় আমায়।-   বশীকরণ?-   হ্যাঁ, সিঁড়িতে কে যেন রাখে সিঁদুরমাখা জবা…-   কিন্তু কী লাভ তার?-   এ বাড়ির দোতলার মালিকানা আমারই নামে। চলে গেলে…-   এ সব আপনার ভ্রান্তি পিসিমা।-   পেঁয়াজের গন্ধ, জবা… সব ভ্রান্তি?-   কিন্তু আমি যে গন্ধ পাচ্ছি না পিসিমা।-   তুই তো পাবি না। কেউ তোকে করবে না বশ।     আমারও যৌবন ছিল। কেউ পারেনি বশ করতে।    আজ বুঝি কাছে আসে যম। ঘিরে ধরে কালান্তক হাওয়া।-   ও কী কথা! সেরে উঠবেন শীগগির।-   না রে ছোটবউমা। আর সেরে উঠতে চাই না।     কারণ এই গন্ধটা আমার খারাপ লাগছে না।১২পেঁয়াজের প্রসঙ্গ উঠলেই আমার রিনার কথা মনে পড়ে।একদিন মসুর ডালে পেঁয়াজের ফোড়নের গন্ধটাআমার বেশ লাগছিল। সেদিন নেগেটিভ হলাম।দুটো গোলাপি দাগের বদলে স্পষ্ট একটা দাগ।অসুখ থেকে, অসুখের কাল থেকেআমরা সবাই বেরিয়ে এলাম ধীরে ধীরে।রিনা আসেনি। ও জানতেও পারল না নেগেটিভ হলে পেঁয়াজের গন্ধটা অন্যরকম ভালো লাগে।
    বিপ্লবের আগুন - কিশোর ঘোষাল | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়২পিপুলতলা গ্রামের ডামল বেশ কদিন বাড়িতে ছিল না। আজ সন্ধের বেশ একটু পরেই সে বাড়ি ফিরল। এরকমই তার স্বভাব। বাড়ি থেকে সে বেরোয় ভোরের আলো ফোটার আগে, আর ফেরে রাত্রি প্রথম প্রহরে। মাঝে মাঝে আবার বেশ কদিন তার পাত্তা থাকে না। গ্রামের লোক ডামলকে দেখতে পায়, তার বড়োসড়ো অসুখ হলে কিংবা বড়ো পালাপার্বণে। অবিশ্যি অসুখ তার করে না বললেই চলে। ডামলের যা স্বাস্থ্য অসুখ-বিসুখ তাকে তেমন কাবু করতে পারে না। লম্বা দোহারা চিতার মতো চেহারা। প্রবল শক্তি এবং অসম্ভব দ্রুত তার চলা ফেরা। লাঠি বা বল্লম খেলায় ওস্তাদ। রণপা নিয়ে সে যখন দৌড়য় – তেজি ঘোড়াও হার মানে তার গতিতে। উঠোনে এসে ডামল যখন দাঁড়াল, ডামলের বুড়ি মা আঁতকে উঠেছিলেন প্রথমে। ঘরের ভেতরে জ্বলা প্রদীপের আভাসে চিনতে না পেরে বুড়ি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, “কে র‍্যা ওখানে”। ডামল হেসে ফেলল, বলল, “নিজির ব্যাটারে চিনতি পারলিনি, কেমন মা বটে রে তুই?”শ্বাশুড়ি আর ডামালের গলা শুনে রান্নাঘরের দরজায় লম্ফ হাতে এসে দাঁড়াল মহুল, ডামালের বউ। লম্ফের আলোয় উঠোনের আঁধার কিছুটা ঘুঁচল। ডামলের মা একটু লজ্জা পেলেন, ছেলের কথায়, “তোরে চিনব কী করে রে, ড্যাকরা? মুখভর্তি দাড়ি, মাতায় চুলের বোজা...কি চেহারা করেছিস?”মাটির দাওয়ায় উঠে বসল ডামল, বুক খোলা ফতুয়াটা খুলে ঝুলিয়ে দিল, আড়ায়। বউকে বলল, “হুল, এক ঘটি জল দে দিনি। তেষ্টা পেয়েচে খুব”। আদরের বউকে ডামল হুল বলে ডাকে। ডামলের মা ছেলের পাশে বসলেন, “দিন দিন তুই বাপের মতন হয়ে উঠচিস। ভিটেতে তার মন বসত না। কোথায় যেত, কী করত কিচুই খোলসা করেনি কোনদিন। একলষেঁড়ে। আর ঠিক তোর মতোই হুট করে ঘরে ঢুকেই হ্যা হ্যা করে হাসত। হাড়জ্বালানে”।বউয়ের হাত থেকে এখো গুড়ের ডাবটা নিয়ে মুখে পুরল ডামল। তারপর মুখের উঁচুতে ঘটি তুলে গলায় ঢালতে গিয়েও থমকে গেল, হা হা করে হেসে বলল, “বাপের ব্যাটা বটি। বাপের মতো হব না তো কি, ও পাড়ার নাদু মোড়লের মতো হবো?” তারপর কলাৎ কলাৎ শব্দে ঘটির জল শেষ করে, খালি ঘটি দাওয়ায় রাখল। ডামলের মা একটু অপ্রস্তুত হলেন। মঝের পাড়ার নাদু, গাঁয়ে না মানে আপনি মোড়ল ছিল। ডামল তখন ছোট্ট। ডামলের বাপ ডামলের মতোই মাঝেমাঝেই হপ্তাভর, মাসভর বাড়ি থাকত না। তখন নাদু সন্ধের পর বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করত। ‘চোখ গেল’ পাখির শিস দিত। নাদুর ছিল ছোঁকছোঁকানি রোগ, একলা মেয়েছেলে দেখলেই হুলো হয়ে উঠত। ডামলের মা বেশ কিছুদিন দেখে দেখে থাকতে পারেননি। একদিন রামদা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেড়ার ধারের পেয়ারাগাছের আড়ালে। নাদু শিস দিয়ে দুবার ‘চোখ গেল’ ডাকতেই – খনখনিয়ে উঠেছিলেন ডামলের মা, “কোন আবাগির পুতের আঁতে চোক গেল পাকি সেঁদিয়েচে র‍্যা? আয় না, এই রামদার চোপে গলাটা ফাঁক করে দি। দেকবি? সে পাকি ক্যামনে উড়ে যায় খাঁচা ছেড়ে”? এমনিতেই ডামলের বাপকে নাদু ভয় পেত খুব। ওই দিনের পর সেই ‘চোখ গেল’ পাখি আর কোনদিন ফিরে আসেনি ওদের পাড়ায়। সেই ঘটনার কথাই আজ মনে করিয়ে দিল ডামল। বহুদিন হল নাদু যমের দখিন দুয়োরে গেছে। ডামলের বাপও চলে গেছে বছর তিনেক হল। ডামল বড়ো হয়েছে, সংসার হয়েছে, আর অবিকল বাপের মতোই হয়ে উঠছে দিন কে দিন। ভুরু কুঁচকে ডামলের দিকে তাকিয়ে ডামলের মা বললে, “আলঝাল বকে কতা ঘুরোস ক্যান? কোন চুলোয় ছিলি অ্যাদ্দিন – কী কাজ আমারে বল দিনি”। ডামল মায়ের দিকে তাকিয়ে চোক নাচিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আমার বাপ তোরে কোনদিন কয়েচিল, কোতা যায়, কী করে? শুধোলি কইত “আজকাজ”। আমারও সেই “আজকাজ”। তয় কোন আজা, কেমন আজা, তার আনি কে, সেটি বুলতে পারবনি। আমার বাপও ওই কাজই করত, সে কতা তুই, জানিস। তুই যে ওই ভুঁড়ো-শেয়াল নাদুটাকে ঢিট করেছিলি, সে কতাটা জেনেই বাপ আমার, তোকে-আমাকে ছেড়ে লিশ্চিন্তে বাইরে বাইরে কাজে ফিরতে পারত। তুই আমার বৌ হুলটার বুকেও অমন বল এনে দে দিকিন, মা”।“নে, নে আমারে আর বেশি ভালাই বুলোতি হবে নি। আজকাজ করিস না কি ছাইপাঁশ করিস, বুজি না বাপু। আজার সঙ্গের নোকেরাও দেকেচি – কেমন সোন্দর সাজপোশাক পরে, মাথায় পাগ বাঁধে, গলায় এতএত সোনার হার পরে। তোদের বাপ-ব্যাটার মতো অখদ্দ্যে চেহারার কাউকে কোনদিন দেকিনি”। ডামল অবাক হয়ে বলল, “তুই আবার আজা-আনিদের কবে চাক্ষুষ করলি, মা?”ডামলের মা মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, “ক্যানে? যাত্রাপালায় দেকায় না বুজি? আজা থাকে, আনি থাকে, তাদের সঙ্গে মহামন্তী, সেনাপতি, নগরপাল...দেকিনি নাকি?”ডামল হো হো করে হেসে উঠল, তারপর বলল, “কতাটা কয়েচিস ঠিকই মা, ওরা হল গে উঁচু থাকের মানুষ। ওরা সবাই মিলে আমাদের এই আজ্যটা চালায়। কিন্তু ওদের আদেশে আসল কাজগুলো করে নিচের তলার মানুষরা। আমাদের মতন মানুষরা। যেমন ধর, সেপাই, সান্ত্রী, ছোট কোটাল, বড় কোটাল...সে অনেক লোক”। ছেলেটা তার মাকে ফাঁকি দিতে পারেনি – ধরে ফেলেছে ঠিক, ডামলের মা এমন একটা হাসি মুখে নিয়ে বললেন, “তয় তুই কি? সেপাই? সান্ত্রী না কোটাল”? ডামল আবার হাসল, বলল, “অত সহজ লয় কো মা। আজ্য চালাতে কত নোকের যে কত কাজ থাকে – সে তোর শুনে কাজ নেই কো। এটুকুন জেনে রাক, আমার বাপ আর আমিও তাদেরই একজন”।ডামলের মা বুঝলেন, ছেলে শেষমেষ খোলসা করে কিছুই ভাঙল না। এড়িয়ে গেল কথাটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে রইলেন। ডামল মায়ের এই আকুতিটা বোঝে। এ গ্রামের কেউ চাষ করে, কেউ দোকান খুলে বাণিজ্য করে, কেউ মাটির হাঁড়ি কলসি বানায়, কেউ লোহার দা, কাটারি, শাবল বানায়। এই সব লোকদের চেনা যায়, বোঝা যায়। কিন্তু তার বাপ কী করত, এবং এখন সে কী করে - কেউ জানেও না, বোঝেও না। গ্রামের মণ্ডলসভায় তাদের নিয়ে জল্পনা হয়, সে জানে। কেউ ভাবে ডামলের বাপ ডাকাতি করত, কেউ বলে ঠগী। ডামলও এখন সেই দলেই নাম লিখিয়েছে। তা নাহলে তাদের পরিবারটা চলে কী করে? ডামলের বাপ কখনও কখনও দুমাস তিনমাস বাড়ি ফিরত না, কিন্তু তাতেও তার পরিবারকে কোনদিন অভাবে-আতান্তরে পড়তে হয় না। কেন? তাদের পেশার এই দুর্বোধ্যতার কারণেই গ্রামের কুচুটে দুর্জনেরা ওদের পরিবারটিকে সদাসর্বদা এড়িয়ে চলে। ঘনিষ্ঠ মিত্রতা করতেও যেমন কেউ আসে না, তেমনি আসে না সামান্যতম কলহ করতেও। ডামল মায়ের ডানহাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বিশ্বেস যা মা, আমরা যা করি খুব গোপন আজকাজ। সে কথা বুক ফুলিয়ে পাঁচজনকে বলার মতন লয়। ছেলেমানুষ কাল থেকে দেকেচি, তোর কাচে ভিনগাঁয়ের এক মেয়েমানুষ আসত, আমি বলতাম “ময়নামাসি”। মনে আচে? সে এসে আমাদের পরিবারের সকলের তত্ত্বতাবাস করত। পয়সা-কড়িও দিয়ে যেত। এখনও তো তাই করে – ময়নামাসির মেয়ে ফুলকিদিদি। করে না?”ডামলের মা ডামলের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। কিছু বললেন না, ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। ডামল উত্তরে বলল, “ওরাও কিন্তু আমাদেরই মতো আজকাজ করছে, মা। কিন্তু এ কতা কোনভাবেই যেন কারও কাছে পেকাশ করিস না, মা। পাঁচকান হলেই আমাদের সবার জেবনে বেপদ নামবে”।ডামলের মা কিছু বললেন না, চুপ করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ডামল মুখ তুলে দাওয়ার কোণের দিকে তাকাল। হুল বসে আছে উনুনের সামনে, কড়াইতে কিছু রান্না হচ্ছে - বেশ সুবাস ছেড়েছে বাড়িময়। হুল মুখ তুলে তাকাল – চোখাচোখি হল ডামলের সঙ্গে। লম্ফ আর উনুনের আভায় তার মুখখানিতে আলো-আঁধারি ছায়া, কিন্তু চোখ দুটি বেশ উজ্জ্বল। সেই মায়াবী মেদুর দৃষ্টিতে সে একটু আনমনা হয়ে গেল। এই ঘর, বুড়ি মা আর ওই যুবতী বউ নিয়ে তার সংসার – এই সব কিছু ছেড়ে তাকে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় সব কাজ ছেড়েছুড়ে দিয়ে গ্রামে এসে জমি-জায়গা নিয়ে চাষ করবে। গ্রামের আর সব লোকের মতো গতরে খেটে ফসল ফলাবে – শস্যে ভরে তুলবে গোলা। তার বুকে পিঠে খেলা করবে – তার আর হুলের সন্তানরা…। তাদের নির্মল হাসিতে ভরে উঠবে এই বাড়ির উঠোন, দাওয়া আর ঘরগুলি…। কিন্তু গ্রামে একটানা কিছুদিন থাকলেই তার মন-প্রাণ আনচান করতে থাকে। তার মন চলে যায় রাতের অন্ধকারে নির্জন পথে দৌড়ে চলায়। পথের ধারের চটিগুলিতে অপেক্ষা করে এক একজন অচেনা অজানা মানুষ – নির্দিষ্ট নির্দেশ নিয়ে – অচেনা পথের হদিস নিয়ে। এ রাজ্যের নগরে-বন্দরে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় নানান সংবাদের খোঁজে, বিচিত্র উদ্দেশে। ঠিক মানুষের থেকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে হয় রাজধানীতে। এই রহস্যময় অথচ গুরুত্বপূর্ণ কাজে তার যেন নেশা ধরে গেছে – এই ধরনের দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনাবিহীন গ্রাম্য জীবন তার জন্যে নয় – সেকথা বুঝে গিয়েছে বেশ ক’বছর। তাই আজকাল সে এই জীবনের জন্যে আর হাহুতাশ করে না। বরং বাড়িতে অবসর যাপনের সময়ও সে উদ্গ্রীব অপেক্ষায় থাকে কবে আসবে তার ডাক। এবারে অবশ্য সে এসেছে, মাত্র, দুটি রাতের ছুটি নিয়ে।ডামল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোন না মা, আমি কিন্তু পরশু ভোর থাকতেই বেরিয়ে যাব। আর এবার ফিরতে ফিরতে অন্ততঃ মাস চার-পাঁচ…”।ডামলের মা ডামলের হাত থেকে নিজের হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলেন, তারপর বেশ ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, “তাই বলি, মায়ের সঙ্গে তোর হঠাৎ এত নলপতা-সলপতা কেন? তুই বেরিয়ে যা, এখনই – পরশু কেন? তোকে থাকতে হবে না, আজই বেরিয়ে যা। অ বৌ, ভাত বেড়ে দে, ডামল বেরোবে…”। ডামলের মা হাঁফাতে থাকেন রাগে এবং হতাশায়। ডামল চোখ তুলে তাকাল হুলের দিকে, হুল একইভাবে তাকিয়ে আছে – মাটিতে গড়া মূর্তির মত। “ও মা, শোন না, রাগ করিস না। এবারটা যেতে দে। এ কাজটায় না গেলেই নয়। আমি কথা দিচ্ছি, এই কাজ সেরে অন্ততঃ ছমাস বাড়ির বাইরে পা রাখব না”।ডামলের মা পাগলের মত বলে উঠলেন, “তুই কি জানিস, আজ প্রায় দু’মাস হল তোর বৌ পোয়াতি? এসময় ওই মেয়েটার সোয়ামিকে কাছে পাওয়াটা কত দরকারি তুই বুজিস? আমি এই বুড়ো বয়সে তোর সংসার সামলাবো, আর তোর বউকে নিয়ে আতুপুতু করে দিন কাটাব? পাষণ্ড, পিশাচ – ওরে ওই বাচ্চাটা যে তোর, তার প্রতিও তোর কোন দয়ামায়া নেই, রে অলপ্পেয়ে আক্‌খুটে? তুই পরশু যাবি তো? বেশ কথা। আমি কাল ভোরেই বেরিয়ে যাব বাড়ি থেকে… তোর সংসার তুই বুঝে নে… আমি এই জ্বালা আর সইতে পারবনি”।তিন ধাপ পৈঠে ভেঙে মহুল দ্রুত নেমে এল উঠোনে, বুকে জড়িয়ে ধরল শাশুড়ি মাকে। কান্নাধরা গলায় বলল, “শান্ত হ, শান্ত হ, মা রে, এত রাগ করিসনি… নিজের বেটাকে গাল দেওয়া মানে আমার বাচ্চাকেও গাল দেওয়া, মা। ওর জন্ম যেমন ডামলের রক্তে, তেমনি তোর রক্তেও তো! ঠানদিদির গাল যে তার কাছে অভিশাপ, সেটা ভুলে গেলি কেন, মা? শান্ত হ, শান্ত হ…”। মহুলের কথায় এবং স্পর্শে ডামলের মায়ের রাগ অনেকটাই স্তিমিত হল। দু হাতে বউয়ের মুখখানি ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন, “এ সব আমি কি বলে ফেললাম রে, বউ, এ আমার কি হল…”। ডামল উঠোনের একধারে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যে অনুভব করল, তার বউ আর মায়ের পারষ্পরিক নির্ভরতা আর নিবিড় ভালোবাসা। সে স্বস্তির শ্বাস ফেলল নিঃশব্দে। তার মা আর বউয়ের মধ্যে, মমতা আর মায়ার এই যে নিবিড় সম্পর্ক, সে কি ওরা দুজনেই মা বলে? একজন অভিজ্ঞা জননী আর অন্যজন অপত্য-সম্ভবা। বাপ হয়ে এই মমতা সে কোনদিন অনুভব করতে পারবে কি? তার প্রতি তার বাপের কি এমন মমতা ছিল? কিছু একটা ছিল সেটা মমতা না হোক, অন্য কিছু। ছোটবেলায় বাড়ি ফিরলে, বাবা তাকে কোনসময়ই কাছছাড়া করত না। হাটে, ধ্বজাপূজার মেলায় কিংবা গ্রামসভায় যেত বেটাকে কাঁধে চাপিয়ে। নদীতে নিয়ে যেত সাঁতার শেখাতে। সেখানে সারা গায়ে কাদা মাখিয়ে কুস্তি শেখাত। বড় হতে হতে নিজের হাতে শিখিয়েছে নদীতে নৌকো বাইতে। তারপর তরোয়াল চালাতে, বল্লম চালাতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে রণপা চড়ে দৌড়ে বেড়াতে। শিক্ষায় সন্তুষ্ট হলে বুকে জড়িয়ে ধরেছে ডামলের ঘর্মাক্ত শরীর। ডামলের আজও মনে পড়ে, তার বাবার মুখের সেই তৃপ্তির হাসি আর দুই চোখের আশ্চর্য আলো। বাবার মতো সে কি পারবে তার সন্তানকে বুকে করে গড়ে তুলতে? ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    দোলজ‍্যোৎস্নায় শুশুনিয়া‌য় - ৫ - সমরেশ মুখার্জী | ঈশুর তুলোধোনাফিরে এসে ওরা আবার সেই রোয়াকে বসে। সুমন বলে, "ঈশু আমাদের আলোচনা‌টা কিন্তু অধুরা রয়ে গেছে। পুরুষদের তুলোধোনা করা তোর এখনো অনেক বাকি আছে মনে হয়। বলে ফ‍্যাল"।- "হ‍্যাঁ, যা বলছিলাম", বলে ঈশু আবার শুরু করে। ওকে আজ কথায় পেয়েছে। এতো কথা আজ অবধি কখোনো বলতে দেখা যায় নি ওকে। এর জন‍্য দায়ী সুমন। ওকে উস্কে দিয়েছে। ঈশু বলে, "দ‍্যাখ,  এটা তো অনেকদিন জানা গেছে নারী‌র বন্ধ‍্যাত্বর জন‍্য সে একা দায়ী নয়। পুত্রসন্তান না হ‌ওয়া তো জেনেটিক‍্যালি নারী‌র ওপর নির্ভর‌ই করে না। এ নিয়ে অনেক প্রচার‌ও হয়েছে। তবু আজ‌ও কেবলমাত্র এই দুটি কারণেই মেয়েদের অনেক দূর্ভোগ স‌ইতে হয়। গ্ৰামাঞ্চলে বেশি, কিছু উদারমনা পুরুষের জন‍্য শহরে তূলনামূলক ভাবে কম।" তুলি বলে, "একদম ঠিক বলেছিস তুই।"ঈশু বলে, "বিয়ের পর মঙ্গলসূত্র, শাঁখা, সিঁদুর পরে বিজ্ঞাপন করে মেয়েদেরকে জানাতে হয় সে সধবা। স্বামীর মৃত্যুতে সাদা কাপড় পড়ে জানাতে হয় সে বিধবা। কেন? বিবাহিত বা বিপত্নীক পুরুষের জন‍্য তো এমন কোনো নিয়ম নেই। বরং পুরুষরা চাইলে ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াতেই পারে। মেয়েদের বেলাতেই যতো নিয়মের বেড়াজাল। সুমন বলে, "অকাট‍্য যুক্তি"।ঈশু বলে, "আবার ধর, বরপণের জন‍্য বধূহত‍্যার ঘটনা তো আমরা নিত‍্য দেখছি। ১৯৫৬ সালে হিন্দু ম‍্যারেজ এ্যাক্ট হ‌ওয়ায় আগে অবধি তো হিন্দু পুরুষ‌রা বহুবিবাহ‌ও করতে পারতো। অতীতে মুসলমান‌ সমাজে স্বামী যতবার খুশি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে পরে চাইলে  আবার পূনর্বিবাহ ক‍রতে পারতো। পরে কোরান নির্ধারিত শরিয়তী আইনে স্বামী তার কোনো স্ত্রীকে তিন বার তালাক দিতে পারে। প্রথম দু বার তালাক দিয়ে তাকে পূনর্বিবাহ করতে পারে কিন্তু তৃতীয় বার তালাক দিয়ে ত‍্যাগ করলে তাকে আবার পূনর্বিবাহ ক‍রতে চাইলে প্রাক্তন স্ত্রীকে অন‍্য কাউকে বিবাহ করতে হবে। সেই অন‍্য স্বামী তাকে তালাক দিলে তবেই আগের স্বামী তাকে চতুর্থ‌বারের জন‍্য বিবাহ করতে পারে। সেই অন‍্য স্বামী‌র সাথে বিয়েটা‌ও শুধু নিয়মরক্ষার জন‍্য নয়, বিয়েটা consummate করতে হবে অর্থাৎ তিনতালাকি প্রাক্তন স্ত্রী কে তার খেলনা বিয়ের স্বামীর শয‍্যাসঙ্গিনী‌ও হতে হবে।"তুলি বলে, "তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বিয়ে নয়, শেয়ার মার্কেটে শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে।"ঈশু বলে, "অনেকটা‌ সেরকমই ব‍্যাপার। হিন্দু সমাজে গৌরী‌দান, সতীদাহ এসব তো অনেক কষ্টে বন্ধ হয়েছে। তবে পুরুষ‌রা যখন বহু‌বিবাহ করতে পারতো তখন‌ও মেয়েদের‌ সেই অধিকার ছিল না। কারণ পু্রুষের কাছে নারী চিরকাল‌ই আসবাবের মতো বস্তুবিশেষ এবং উপভোগের সামগ্ৰী। নারী কী করতে পারে বা পারে না সেটাও পুরুষ সমাজপতি‌রাই ঠিক করে দেবেন।"সুমন বলে, "তোর কথায় এমন ক্ষুরধার যুক্তি যে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই"।ঈশু বলে, "দ‍্যাখ জেঠু, এসব কথা বলতে কিন্তু আমার‌‌ও খারাপ লাগছে যেমন লাগছে তোর শুনতে। কিন্তু এসব তো বাস্তব সত‍্য। হয়তো ভবিষ্যত সমাজে এমন অসাম‍্য, অবিচার থাকবে না। তখন আমাদের মতো কেউ এমন আলোচনা করবে কেবল অতীত বিচ‍্যূতি পর্যালোচনার জন‍্য। তবে আমার জীবদ্দশায় তেমন দিন আমি দেখে যেতে পারবো বলে মনে হয় না। সুমন বলে, "না রে ঈশু, তোর কথা শুনে আমি কিচ্ছু মনে করছি না। বরং ভালো লাগছে আমাদের মধ‍্যে এমন একজন আছে যে এসব ব‍্যাপারে গভীর‌ভাবে চিন্তা করে। আমরা এ‌ই আলোচনা করছি‌ র‍্যাশনাল এ্যাঙ্গেল থেকে। এখানে ব‍্যক্তির বিচ‍্যূতি নয় সমষ্টিগত আচরণ‌ই বিচার্য। আর বাস্তব সত‍্য, তা যতো‌ই কঠিন, অস্বস্তি‌কর হোক, তার মুখোমুখি না হতে পারলে‌ যেভাবে হোক তা অস্বীকার‌ করতে হবে তেমন স্বভাব আমার নয়। তো এহেন বঞ্চনা, অবিচারের বিরুদ্ধে ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের শুরু‌টা কী ভাবে হয়েছিল?"নারীবাদের ধারণাঈশু বলে, "উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইংল‍্যান্ড, আমেরিকার কিছু উদ‍্যমী মহিলা শুরু করেন এই মুভমেন্ট। প্রথমে তা সীমিত ছিল বিবাহ, সন্তান প্রতিপালন, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত‍্যাদি‌তে সমানাধিকারের দাবিতে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তা বিস্তৃত হয় রাজনৈতিক ও আইনী ক্ষেত্রে‌ও।  গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মহিলাদের ভোটাধিকারের  দাবির স্বীকৃতি এই আন্দোলন‌কে জোরদার করে। ক্রমশ বাল‍্যবিবাহ, গৃহে বা কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা, অনৈতিক শোষন ইত্যাদি বিষয়গুলি জনআলোচনা, গণবিতর্কে  উঠে আসে। কিছু উদারমনস্ক পুরুষ‌ও মহিলা‌দের এই আন্দোলন সমর্থন করেন। তবে দেখা যায় কিছু  দ্বিচারিতা‌ও।চুনি বলে, "দ্বিচারিতা! মানে ডাবল স্ট‍্যান্ডার্ড? কীরকম?"ঈশু বলে, "যেমন ধর যে বছর ভারতে হিন্দু ম‍্যারেজ এ্যাক্ট পাশ হয় সেই ১৯৫৬ সালেই মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান গামাল আবদেল নাসের আইন করে  লিঙ্গভিত্তিক বৈষম‍্যমূলক আচরণ বা Gender Discrimination নিষিদ্ধ করেন। তবে এক‌ই সাথে তিনি ফেমিনিস্ট‌দের রাজনৈতিক সক্রিয়‌তা‌ও দৃঢ় হাতে দমন করেন। অর্থাৎ, আগে যা বলেছিলাম, পোষা কুকুরকে যতটুকু পাঁউরুটির টুকরো ছুঁড়ে দেবো তাতেই সে খুশিতে ল‍্যাজ নাড়বে। রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আবার মহিলাদের মাথা গলাবার দরকার কী বাপু। হয়তো নাসেরের সেই দমননীতির মূলে কাজ করেছিল মহিলাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ফলে ভবিষ্যতে পুরুষশাসকদের গদি টলে যাওয়ার ভয়।"মলয়দা এসে বলেন, "চিতার কাছে শুনলাম তোমরা নাকি সিরিয়াসলি কোনো আলোচনা‌য় মগ্ন। খুব ভালো‌। কেবল হালকা ঠাট্টা ইয়ারকীতে মজে না থেকে বাইরে বেড়াতে এসে খোলামেলা পরিবেশে কিছু বিষয়ে আলোচনা আমাদের বোধবুদ্ধি, ভাবনাচিন্তার পরিসর বিস্তারে সাহায্য করে। তবে চলো আমরা আগে খেয়ে আসি। তারপর যতক্ষণ খুশি আলোচনা কোরো।" তুলি বলে, "এত তাড়াতাড়ি? সবে তো আটটা বাজে!" মলয়দা বলেন, "বলাই আজ একটু তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করতে চায়। বাড়িতে কিছু কাজ আছে বলেছে। তবে আমি‌ও বলে দিয়েছি, কাল আমাদের ক‍্যাম্পফায়ার। কাল কিন্তু আমরা নটার আগে খাবো না।"  ওরা মলয়দার কথায় সায় দিয়ে খেতে যায়।রাতের খাওয়া সেরে ওরা সেই সিঁড়িতে ফিরে আসে। এতক্ষণ তুলি, চুনি মাঝে মধ‍্যে দু একটা প্রশ্ন করা ছাড়া আর কিছু বলে নি। ঈশু বলে, "জেঠুটা আমায় ঘাঁটাচ্ছে আর আমি‌ও সমানে বকবক করে যাচ্ছি। তোরা বোর হচ্ছিস না তো?" ওরা সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, না, না। তুলি বলে, "কোনো আউটিংয়ে এসে এরকম আলোচনার অভিজ্ঞতা আমার আজ অবধি হয়নি। বেশিরভাগ সময়‌‌ই মলয়দা যা বললেন তাই হয়। হালকা ইয়ার্কি ফাজলামি, এর তার পেছনে লাগা। নিছক টাইম পাস। তবে জানিস জেঠু, এক ক্লাসে পড়লেও, ঈশুর সাথে এভাবে কোনোদিন আলোচনা হয় নি। ও খুব চুপচাপ থাকে। আজ তুই এইসব প্রসঙ্গ তুললি বলে ও এতো কথা বলছে। নিজে থেকে তো ও কথাই বলে না প্রায়"। চুনি‌ও বলে, "আমার‌ও খুব ভালো লাগছে এই আলোচনা। কত কী জানতে পারছি।"জেঠুর জ‍্যাঠামি- "এতদূর আমরা ঈশুর থেকে যা শুনলাম" এবার সুমন আলোচনায় ঢোকে, "তা তথ‍্য এবং যুক্তি‌নির্ভর বিশ্লেষণ। দ্বিমত হ‌ওয়া‌র জায়গা নেই। তাই ঈশুর সাথে আমি একমত। তবে আমার‌ও কিছু ভাবনা আছে, পুরুষের হয়ে সাফাই দিতে নয়। বলতে চাই এমন কিছু প্রবৃত্তি‌গত প্রবণতা‌র কথা যার প্রভাব শুধুমাত্র পুরুষের জীবনে‌ই নয়, মানবজীবনে‌ও প্রায় নিয়তির মতো অমোঘ। আমি যা বলতে চাই তা সেই প্রবণতা‌র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পুরুষের বিচ‍্যূতিমূলক আচরণের যৌক্তিকতা খুঁজতে‌ও নয় বরং তার পশ্চাৎপট অনুধাবন করতে। আমি যা বলবো তা আমি যেভাবে ভাবি। আমি তা তথ‍্য, প্রমাণ দিয়ে ঈশুর মতো প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না। তবে যুক্তি, অনুসিদ্ধান্ত, উদাহরণ দিয়ে ব‍্যাখ‍্যা‌র চেষ্টা করতে পারি। তোরা মুক্ত মনে ভেবে দেখতে পারিস তা কতটা গ্ৰহণযোগ‍্য। কিছু প্রসঙ্গ কিন্তু বেশ অস্বস্তি‌কর‌‌ লাগতে পারে। তোরা যদি রাজি থাকিস তাহলে‌‌ই এগোনো যায়।"ঈশিতা বলে, "দ‍্যাখ জেঠু, আমরা চারজন‌ই প্রাপ্তবয়স্ক। যাদবপুর মূলতঃ একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও অপেক্ষাকৃত নবীন। তা প্রেসিডেন্সি বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাচীন, ঐতিহ্য‌ময় নয় তবু এখানেই বুদ্ধদেব বসু স্থাপনা করেছিলেন তুলনামূলক সাহিত‍্যের মতো একটি নতুন ও আধুনিক  বিভাগ। কবে? সেই ১৯৫৬ সালে। কী আশ্চর্য আপতন দ‍্যাখ, এই সালটা আমাদের আলোচনা‌য় তিনবার ঘুরেফিরে এলো। তাই একটি আধুনিক‌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাওয়ার সুযোগ পেয়ে আমরা নিজেদের ভাগ‍্যবান মনে করতে পারি। সেক্ষেত্রে তোর আলোচনা‌য় আমাদের অস্বস্তি হবে কেন?"তুলি বলে, "কিন্তু যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়‌ই তো নীতিগতভাবে হ‌ওয়া উচিত মুক্তচিন্তার পৃষ্ঠপোষক। আমাদের ভাবনা চিন্তা‌তেও তাই মুক্তচিন্তার প্রতিফলন ঘটা উচিত। কোনো প্রচলিত প্রথা বা মতবাদ যদি আমাদের রুচি, ধারণা‌য় যথার্থ না মনে হয় আমরা পাল্টা যুক্তি, তথ‍্য, বিশ্লেষণ সহকারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব‍্যক্ত করতে পারি। না হলে উপেক্ষা করতে পারি। এটাই যুক্তি‌বাদী এবং উদারনৈতিক মনোবৃত্তির পরিচয়। যুক্তি, বিশ্লেষণ শিকেয় তুলে উন্নাসিক‌তা দেখিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা বা অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হয়ে উগ্ৰতা, অশালীন‌তার প্রকাশ মোটে‌ই বাঞ্ছনীয় নয়। যদি আমরা সজ্ঞানে মুক্ত‌চিন্তার অনুশীলন না করতে পারি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কেবল ডিগ্ৰি হাসিলের করুণ কসরতে পরিণত হয় - তাই না?"ঈশু বলে, "একদম তাই। সিলেবাস ভিত্তিক পড়াশোনা হয় ক্লাসে - কিন্তু পাঠ‍্যপুস্তকের বাইরে ব‌ই পড়া, পারস্পরিক আলাপ আলোচনা, মতবিনিময় এসব‌ই তো আমাদের কলেক্টিভ কনসাসনেশ সমৃদ্ধ করার মাধ‍্যম। আউটিং‌য়ে এসে কেবল খেজুরে আড্ডা না মেরে যেভাবে আমাদের আলোচনা নৈর্ব‍্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হচ্ছে, আমার তো ভালো লাগছে। কিছুটা আন্দাজ ক‍রতে পারি এখান থেকে আলোচনা‌টা কোন দিকে যেতে পারে। তবু তোর মুখ থেকেই শুনতে চাই। তোর দ্বিধার কোনো কারণ নেই জেঠু। যা বলতে চাস আকারে ইংগিতে নয়, সোজাসুজি বলতে পারিস। মনে হয় আমরা সবাই তা নিতে পারবো। এতক্ষণ তো আমি‌‌ই কথা বলে গেলাম। তোর ভাবনা‌টাও তো আমাদের জানা উচিত। তোরা কী বলিস?" তুলি ও চুনি‌‌‌ও ঈশু‌র কথা‌য় সায় দেয়।
    কিষেণজি মৃত্যু রহস্য - পর্ব ৫  - বিতনু চট্টোপাধ্যায় | ‘সিপিআইএম কর্মীদের সঙ্গে ঝাড়খন্ড পার্টির রোজ সংঘর্ষ হোত। ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থন ছিল তখন কংগ্রেসের দিকে। ফলে একদিকে ঝাড়খন্ড পার্টি এবং কংগ্রেস, অন্যদিকে সিপিআইএম। এক্কেবারে সাপে-বেজিতে সম্পর্ক। জমিতে চাষ থেকে শুরু করে এলাকা দখল, পঞ্চায়েত ভোট থেকে মন্দির কমিটি গঠন, সব কিছু নিয়ে সংঘর্ষ, খুনোখুনি। কিন্তু পুলিশের ওপর গ্রামবাসীদের এত রাগ কেন? খবর নিয়ে জানলাম, কোনও সংঘর্ষ, মারপিটের পরই এক একটা ঘটনায় সিপিআইএম থেকে একদম ভোটার লিস্ট ধরে ঝাড়খন্ড পার্টির ২৫, ৩০, ৪০ জনের নামে মামলা করে দেওয়া হোতও থানায়। তারপর শাসক দলের পক্ষ থেকে শুরু হোত পুলিশের ওপর চাপ, গ্রামে তল্লাশি এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে যেত পুলিশ। পুলিশ আসবে জেনে গ্রাম খালি করে পালাত ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা, কর্মী, সমর্থকরা। আর পুলিশের তল্লাশির পর পরই গ্রামে ঢুকত সিপিআইএম বাহিনী। সিপিআইএম জানত, ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা-কর্মীরা থাকলে তারা গ্রামে ঢুকতে পারবে না, বাধা পাবে। তাই পুলিশের ভয়ে ঝাড়খন্ডি নেতারা গ্রাম ছাড়ার পর পরই এলাকায় ঢুকত সিপিআইএম বাহিনী। তারপর বেছে বেছে ঝাড়খন্ডিদের বাড়িতে আগুন, ভাঙচুর, লুঠপাট চালানো হোত। এর পুরোটা যে সব সময় পুলিশ এবং সিপিআইএম ষড়যন্ত্র করে করত তা হয়তো নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটত এমনটাই। বেশ কয়েকবারের অভিজ্ঞতা থেকে ঝাড়খন্ড পার্টি এবং আদিবাসীদের একটা বড় অংশের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়ে যায়, পুলিশ এবং সিপিআইএম ষড়যন্ত্র করে এমন করছে। ফলে পুলিশকে গ্রামে ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তখন ঝাড়গ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে সিপিআইএমের ততটা প্রভাব ছিল না। বরং আদিবাসীদের মধ্যে ঝাড়খন্ড পার্টির প্রভাব ছিল অনেক বেশি। আদিবাসীরা জানত, পুলিশের সাহায্য ছাড়া সিপিআইএম ক্যাডাররা গ্রামে ঢুকতে পারবে না। এই জায়গা থেকেই আদিবাসীরা পুলিশকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দিতে শুরু করেছিল। আমি যখন নয়ের দশকের মাঝামাঝি ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, জামবনি, কাঁকড়াঝোড়ের বিভিন্ন আদিবাসী এলাকায় যেতে শুরু করি, তখন তাদের মধ্যে এই পুলিশ বিরোধী মনোভাব তীব্র আকার নিয়েছে।’ টানা বলে সামান্য থামলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। তারপর ফের বলতে শুরু করলেন, ‘একবার কাপগাড়ির কাছে দু’জন ঝাড়খন্ডি কর্মী খুন হয়েছিলেন। কিন্তু মৃতদেহ তোলার জন্যও গ্রামে পুলিশকে ঢুকতে দেয়নি আদিবাসীরা। পুলিশ সুপার নিজে গিয়েছিলেন, তাও ঢুকতে পারেননি গ্রামে। তীর, ধনুক নিয়ে আদিবাসীরা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। নিজেদের লোক খুন হয়েছে, তাও মৃতদেহ নিতে কিংবা সিপিআইএমের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করার জন্যও গ্রামে পুলিশকে ঢুকতে দেয়নি তারা। এতটাই ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে রাগ। তাছাড়া ঝাড়খন্ডিদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, সিপিআইএমের বিরুদ্ধে পুলিশকে অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হবে না।  এরকম এক পরিস্থিতিতে ঝাড়গ্রামে ডিউটিতে গিয়ে প্রথমেই মনে হয়েছিল, এভাবে কাজ করা যাবে না। আদিবাসীদের আস্থা, বিশ্বাস অর্জন করতে হবে এবং গ্রামে ঢুকতে হবে। নয়তো কাজ করা অসম্ভব। এবং ঠিক করি, শুধুমাত্র কোনও ঘটনা ঘটলে, সংঘর্ষ-খুনোখুনি হলে গ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করব, এটা হবে না। কোনও ঘটনা ছাড়া সাধারণ দিনেও গ্রামে যেতে হবে। এবং বিরাট ফোর্স নিয়ে গ্রামে ঢোকা যাবে না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গাড়ি নিয়ে গ্রামের ভেতরে ঢোকা যাবে না। গ্রামে ঢুকতে হবে হেঁটে। এই তিনটে কাজ করতে পারলেই একমাত্র আদিবাসীরা আমাদের সম্পর্কে ধারণা কিছুটা পালটাতে পারে। এই পদ্ধতিই চালু করলাম। রোজ বিকেলে একটা করে গ্রামে যেতে শুরু করলাম। সঙ্গে শুধু এসডিপিও এবং ওসি। তিনজনে হেঁটে গ্রামে ঢুকতে শুরু করলাম। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। আদিবাসীরা অত্যন্ত সংবেদনশীল। অধিকাংশ বাড়িতেই উঠোনে থাকত ছোট মন্দির। পুরো উঠোন পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখত ওরা। জুতো পরে ওদের বাড়ির উঠোনে হাঁটাচলা করলে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হোত। পুলিশ তা করতও। রেগে গেলেও ওরা কিছু বলতে পারত না। আমরা গ্রামে ঢুকে কোনও বাড়ির উঠোনে ওঠার আগে জুতো খুলে নিতাম। তারপর বাড়ির দাওয়ায় বসে গল্প করতাম। আস্তে আস্তে লোক জড়ো হতে শুরু করল। ওসি অপূর্ব আমাকে জামবনির বুদ্ধেশ্বর টুডু নামে এক আদিবাসী নেতার কথা বলেছিলেন। বুদ্ধেশ্বর ভাল ফুটবল খেলতেন। কলকাতায় দ্বিতীয় ডিভিশন পর্যন্ত খেলেছেন। তারপর গ্রামে ফিরে যান। সিপিআইএমের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। ভালো কথা বলতেন, সহজাত নেতা। ঝাড়খন্ড পার্টির হয়ে পরে পঞ্চায়েত ভোটে লড়েছিলেন। জেতেনও। বুদ্ধেশ্বরের সঙ্গে কথা বলতাম, ঝাড়খন্ড পার্টির আরও কয়েকজন নেতা, জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আস্তে আস্তে সম্পর্ক গড়ে উঠল।’‘যে জায়গাগুলোর কথা বলছেন, সবই তো বেলপাহাড়ি, বিনপুর কিংবা জামবনি। লালগড়ের কী অবস্থা ছিল তখন?’ টানা বলছিলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম লালগড়ের কথা। কারণ, ২০০৮ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত রাজ্যে তো বটেই, দেশেও মাওবাদী অ্যাক্টিভিটির শিরোনামে লালগড়।  ‘না না, লালগড়ে আমাদের যেতেই হত না। সেই সময় নয়ের দশকের মাঝামাঝি ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সবচেয়ে শান্ত এলাকা ছিল লালগড়। কেউ মাওবাদী নাম তো শোনেইনি, কোনও সংঘর্ষ, মারামারিও ছিল না। মানুষও ছিল খুব শান্ত প্রকৃতির। তখন ঝাড়গ্রাম থেকে গাড়ি করে লালগড়ে যাওয়া যেত না। কংসাবতী নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি হয়নি। একদিন দুপুরে ঝাড়গ্রাম গিয়েছি, খবর পেলাম লালগড়ে একটি আদিবাসী মেয়ে খুন হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে নয়, কিন্তু খুন তো! তাছাড়া আমার এলাকাতেও পড়ে। ঠিক করলাম লালগড় যাব, দেখে আসব কী হয়েছে। জল কম ছিল, হেঁটে কংসাবতী পেরোলাম। লালগড় থানার ওসি গাড়ি নিয়ে নদীর অন্যপারে অপেক্ষা করছিলেন। ওসির গাড়িতে উঠে ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে শুরু করেছে। দূর থেকে হেড লাইটের আলোয় দেখলাম, রাস্তার ধারে দুটো লোক হাত জোড় করে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতুহল হল। ড্রাইভারকে বললাম, ওঁদের সামনে গাড়ি থামাতে। ওসি বললেন, ‘‘স্যার মাতাল। দুপুরেই মদ খেয়ে নিয়েছে।’’ গাড়ি থামার পরও দেখি মাথা নীচু করে হাত জোড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? ‘‘বাবু, তোরা ভগবান আছিস। তোরা ভগবান আছিস রে।’’দু’বার বলল একই কথা। দুজনেই। আমি তো প্রথমে বুঝতে পারিনি কেন বলছে একথা। কিছুক্ষণ পরে গ্রামে ঢুকে বুঝলাম এর মানে। লালগড় ছিল পিছিয়ে পড়া এলাকা। মানুষ প্রচণ্ড গরিব। পুলিশ, সরকারি অফিসাররা কোনও কাজের জন্য সেখানে গেলে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠত ওদের চোখে, মুখে। এত শান্ত এলাকা ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার জন্য সরকারি সহায়তা লালগড়ে পৌঁছাত কম। ওখানকার মানুষ বিশেষ কিছু আশাও করত না সরকারের কাছে। তাই একটি মেয়ের খুনের ঘটনায় এত দূর থেকে পুলিশ গ্রামে এসেছে, এটাই ছিল সেই সময় ওদের কাছে বিরাট ব্যাপার। এই ঘটনার ১০-১২ বছর পর কলকাতায় বসে দেখলাম, সেই লালগড়ে মানুষ পুলিশকে এলাকায় ঢুকতে দিচ্ছে না। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে এই শান্ত লালগড় এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। এতটাই শান্ত এলাকা ছিল লালগড়, আমরা এক সময় ভেবেওছিলাম, ওই এলাকাটাকে ঝাড়গ্রাম মহকুমা থেকে বের করে দেব। সরকারি স্তরে এমন আলোচনাও শুরু হয়েছিল। ২০০৮ সালের শেষে লালগড় আন্দোলন যখন শুরু হয়, আমি কলকাতায়। বারবারই মনে পড়েছে ১২ বছর আগের এক সন্ধ্যায় লালগড়ে রাস্তার ধারে দুজন স্থানীয় মানুষের হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। যাঁরা পুলিশ দেখে বলেছিল, ‘বাবু তোরা ভগবান আছিস।’ প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে একটা ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ সন্ধ্যায় যাচ্ছে এটাই ওদের কাছে তখন বিরাট প্রাপ্তি ছিল। কী ঘটে গেল ১০-১২ বছরের মধ্যে, এই সাধারণ, সরকারের কাছে কোনও প্রত্যাশাহীন মানুষগুলোই এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল!      তবে, লালগড় ছিল যতটা শান্ত, ততটাই ভয়ঙ্কর এলাকা ছিল মেদিনীপুরের কেশপুর। খড়গপুর থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তায় ধর্মার মোড় ২০-২২ কিলোমিটার গেলেই কেশপুর। রোজ ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএমের মধ্যে সংঘর্ষ হোত কেশপুরে। ভোর ৪টে-সাড়ে ৪টের মধ্যে দু’দল তীর ধনুক, বন্দুক নিয়ে রেডি হয়ে যেত। রীতিমতো শাঁখ, কাসর-ঘন্টা বাজিয়ে শুরু হয়ে যেত সংঘর্ষ। সারাদিন চলত মারামারি, সংঘর্ষ। রোজ নিয়ম করে দু’পক্ষ মিলে ২৫-৩০ জন জখম হোত। কেউ হাসপাতালে যেত, কেউ যেত না। সন্ধেবেলা যুদ্ধ বিরতি। এ ছিল প্রায় রোজকার ঘটনা।’ ‘ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের এই রোজ রোজ সংঘর্ষ হোত কী নিয়ে? একটা কারণ থাকবে তো!’ জিজ্ঞেস করলাম প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কে। ‘এক একদিন এক একটা কারণ। ধরাবাঁধা কিছু নেই। একদিন সন্ধ্যায় জামবনিতে ঝাড়খন্ড পার্টির এক কর্মী খুন হলেন। প্রায় মাঝরাতে মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারল পুলিশ। পরদিন সকাল থেকে এই নিয়ে উত্তেজনা পুরো জামবনি, বিনপুরে। সকালে অফিসে কিছু কাজ ছিল। তা শেষ করে দুপুরে মেদিনীপুর শহর থেকে রওনা দিলাম জামবনির উদ্দেশে। রাস্তায় যেতে যেতেই ওয়্যারলেসে খবর পেলাম বুদ্ধ ভকতের গুলি লেগেছে। তাঁকে ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হল, পরিস্থিতি আজ হাতের বাইরে চলে যাবে। আগের রাতে ঝাড়খন্ডি খুন। আর তার বদলায় আজ বুদ্ধ ভকত গুলিবিদ্ধ! বুদ্ধদেব ভকত তখন বিনপুরের সিপিআইএম বিধায়ক। অরিজিনাল বাড়ি জামবনির চুটিয়া গ্রামে। ঝাড়গ্রাম শহরেও বাড়ি আছে। তখন এলাকায় বুদ্ধ ভকতের যত না প্রভাব তার চেয়ে ঢের বেশি দাপট, প্রতিপত্তি তাঁর ভাই বাসুদেব ভকতের। বাসু ভকত নামেই সিপিআইএমের জামবনি লোকাল কমিটির নেতা, আসলে তিনিই জামবনির শেষ কথা। পার্টির মদতে এবং প্রশ্রয়ে ঝাড়গ্রাম মকুমার একছত্র নেতা, ঝাড়খন্ড পার্টির কাছে মূর্তিমান ত্রাসের নাম বাসু ভকত। ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থক আদিবাসীদের ওপর বাসু ভকত এবং তাঁর দলবলের অত্যাচারের কাহিনী তখন জামবনির লোকের মুখে মুখে। তাঁর সামান্যই গিয়ে পৌঁছত কলকাতায়। পেশি শক্তির জোরে এলাকা দখল এবং একাধিপত্য স্থাপনের যে রাজনীতি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় সিপিআইএম শুরু করেছিল, ঝাড়গ্রামে তার মুখ ছিলেন বাসু ভকত। ঝাড়গ্রাম শহরে ঢুকলাম, চারদিকে থমথমে পরিবেশ। ঠিক কেমন বলে বোঝানো মুশকিল, কিন্তু কোনওদিন ঝাড়গ্রাম না যাওয়া কেউ সেখানে হঠাৎই গিয়ে পড়লে বুঝবে কিছু গুরুতর ঘটেছে। একটা অঘোষিত বনধের চেহারা। অনেক দোকান-পাট বন্ধ। মোড়ে মোড়ে জটলা। ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে পৌঁছানোর পর প্রথমেই এসডিপিও বললেন, ‘স্যার, বুদ্ধ ভকতের কিন্তু গুলি লাগেনি। এলাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার জন্য সিপিআইএম গুলির কথা রটিয়ে দিয়েছে।’ হাসপাতালের ভেতরে ঢুকলাম। বাইরে, হাসপাতাল চত্বরে প্রচুর ভিড়। কয়েক’শো-হাজার সিপিআইএম কর্মী, সমর্থক বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জড়ো হয়েছে বিধায়কের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে। আরও লোকজন আসছে বুঝতে পারছি। ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে গণ্ডগোল, সংঘর্ষ শুরু করার জন্য একদম অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে বাসু ভকতের বাহিনী। হাসপাতালে ঢুকে খবর নিয়ে জানলাম, বিধায়ক বুদ্ধদেব ভকত এক দলীয় কর্মীর মোটরসাইকেলের পিছনে বসে যাচ্ছিলেন জঙ্গলের ভিতরের রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ কিছু একটা শব্দ হয়। গুলির শব্দ ভেবে মোটরসাইকেলের চালক ভয় পেয়ে রাস্তার ধারে পড়ে যান। পড়ে গিয়ে পায়ে হাঁটুর কাছে চোট পান বুদ্ধ ভকত। কিছু জায়গায় কেটে-ছড়েও যায়। এরপরই বুদ্ধ ভকতের আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে এলাকাজুড়ে। প্রথমে রটে যায়, বিধায়ক গুলিবিদ্ধ। তারপর সিপিআইএম রটিয়ে দেয়, বুদ্ধ ভকতকে আক্রমণ করেছে ঝাড়খন্ড পার্টি। তাঁকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। হাসপাতালেই শুনতে পেলাম, সিপিআইএম পরের দিন বন্‌ধ ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরের দিনের কর্মসূচি কী হবে তা নিয়ে ঝাড়গ্রামের নেতারা কথা বলছেন জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে আমি এসপিকে জানালাম, ‘বুদ্ধ ভকতের কিচ্ছু হয়নি। মোটরসাইকেল থেকে পড়ে চোট পেয়েছেন। গুলি চলেনি।’ সন্ধে নামছে। হাসপাতাল চত্বরে ভিড় বাড়ছে শাসক দলের কর্মীদের। ঝাড়গ্রাম থানার দিকে রওনা দিলাম। হাসপাতাল ছাড়ার আগে বুদ্ধ ভকত এবং সিপিআইএমের নেতাদের বলে গেলাম, থানায় গিয়ে অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য। কিন্তু এলাকার পরিবেশ, পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারছিলাম, সিপিআইএম এই ইস্যু সহজে ছাড়বে না। আমরা যাই বলি না কেন, সিপিআইএম তা মানবে না। বিধায়ক আক্রান্ত এই প্রচারকে সামনে রেখে নতুন করে অশান্ত করতে চাইবে জামবনি, বিনপুর এবং আশপাশের এলাকা। অনেক রাতে বুদ্ধদেব ভকতকে নিয়ে সিপিআইএমের বিরাট বাহিনী এল ঝাড়গ্রাম থানায়। তারপর জামবনি, বেলপাহাড়ি এলাকার ঝাড়খন্ড পার্টির ২৫-৩০ জন গুরত্বপূর্ণ নেতার নামে অভিযোগ লিখে জমা দিল। এলাকায় ঝাড়খন্ড পার্টির যত নেতা ছিল বেছে বেছে সবার নামে অভিযোগ করা হল। এও ওই জেলার সিপিআইএমের এক পুরনো কায়দা। বিরোধীদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দিয়ে তাদের হেনস্থা করার, এলাকাছাড়া করার কৌশল। বুদ্ধ ভকতকে বলে দিলাম, এই মিথ্যে অভিযোগ নিতে পারব না। গুলিই চলেনি, আর এতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ? সিপিআইএম কিছুতেই মানতে রাজি নয়। বেশ কিছুক্ষণ চলল এই নিয়ে টানাপোড়েন। সিপিআইএমের ভিড়টা হাসপাতাল থেকে আস্তে আস্তে থানার বাইরে এসে জড়ো হতে শুরু করেছে তখন। রাত প্রায় ১১টা নাগাদ একদম গোপনে বুদ্ধদেব ভকতের দেহরক্ষীর বয়ান রেকর্ড করলাম থানায়। বুদ্ধ ভকতের পিছনে অন্য একটা মোটরসাইকেলে বসেছিলেন তাঁর দেহরক্ষী। দেহরক্ষী বয়ানে লিখে দিলেন, একটা শব্দ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তা গুলির নয়। রাত প্রায় ১২টা নাগাদ সিপিআইএম নেতাদের সঙ্গে আবার বসলাম। জানিয়ে দিলাম, সত্যি ঘটনা লিখে অভিযোগ জমা দিতে। এভাবে যার তার নামে গণ-অভিযোগ জমা দেওয়া যাবে না। এও জানালাম, বুদ্ধদেব ভকতের দেহরক্ষীর লিখিত বয়ান আমাদের কাছে রয়েছে। মিথ্যে অভিযোগ করে কোনও লাভ হবে না। সেক্ষেত্রে আসল ঘটনা আদালতে জানাতে বাধ্য হব। একথা শুনে সিপিআইএমের নেতারা একটু থমকে গেলেন। তারপর যা ঘটেছে তার বিবরণ লিখে বেরোলেন থানা থেকে। সেই রাতের মতো ঝামেলা মেটানো গিয়েছে ভেবে থানা থেকে বেরোলাম। কিন্তু এই জেলার নাম মেদিনীপুর। এবং সেটা নয়ের দশকের মাঝামাঝি। ভোর ৫টা নাগাদ ফিরলাম মেদিনীপুর শহরের কোয়ার্টারে। ঠিক করলাম, আর শোব না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাবে। ছেলে স্কুলে চলে গেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেব। পোশাক বদল করে সবে একটু বসেছি, ল্যান্ডলাইন বাজল। ঝাড়গ্রাম এসডিপিওর ফোন। ‘‘স্যার, সর্বনাশ হয়েছে। সিপিআইএমের ছ’জন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যকে অপহরণ করেছে ঝাড়খন্ডিরা।’’‘‘মানে? কখন?’’ ‘‘স্যার, এখনই খবর পেলাম। কোথায় নিয়ে গিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। কাল মাঝরাত থেকে একটু আগে পর্যন্ত জামবনি, বেলপাহাড়ির ছ’জন সিপিআইএম পঞ্চায়েত প্রধান এবং সদস্যকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ঝাড়খন্ড পার্টির লোকজন। কারও কোনও হদিশ নেই। মেরে ফেলেছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না।’’‘‘ঠিক আছে। আসছি।’’ ফোন রেখেই পোশাক পরতে গেলাম। এই অশান্তি থামার নয়। দুইয়ে দুইয়ে চার। বুদ্ধ ভকত আক্রান্ত হওয়ার কথা গতকাল রাতে সিপিআইএম রটিয়ে দেওয়ার পর থেকেই আতঙ্কের প্রহর গুণছিলেন ঝাড়খন্ড পার্টির নেতারা। তাঁরা জানতেন, এই ঘটনা নিয়ে সিপিআইএম-পুলিশ তাঁদের গ্রামে হানা দেবে। তা থেকে বাঁচতে নিজেরাই পালটা আক্রমণের রাস্তা নিয়েছেন সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যদের অপহরণ করে। কিন্তু মাঝরাতে পুলিশ যে বুদ্ধ ভকত, বাসু ভকতদের চাপেও মিথ্যে অভিযোগ নেয়নি, তা ঝাড়খন্ড পার্টির নেতারা জানতেন না কিংবা আন্দাজ করতে পারেননি। তখনও মেদিনীপুরের জামবনি, বেলপাহাড়ি, লালগড়কে কলকাতার মানুষ জঙ্গলমহল বলত না। কিন্তু কী বিচিত্র হিংসা, প্রতিহিংসার রাজনীতি ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার এই জঙ্গল এলাকায়।বেরনোর জন্য রেডিও হতে পারিনি। আবার ল্যান্ডলাইন বাজল। এবার ফোন জেলার পুলিশ সুপার দেবকুমার বসুর। ‘‘কী হয়েছে বল তো? এই ভোর রাতে দীপক সরকার ফোন করে চিৎকার করছেন, যা তা বলছেন ফোনে।’’ ‘‘স্যার, ঝাড়খন্ড পার্টির লোকজন বেলপাহাড়ি, জামবনি থেকে সিপিআইএমের পঞ্চায়েত প্রধান এবং সদস্য মিলে ছ’জনকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে। আমি বেরোচ্ছি।’’‘‘ঠিক আছে, দীপক সরকারের সঙ্গে একবার কথা বলে নাও। আমি ওনাকে বলে দিয়েছি তোমার সঙ্গে কথা বলতে।’’‘‘আমি কী বলব। স্যার, আপনিই বলে দিন।’’‘‘না না, তুমি সব কিছু জান। তুমিই কথা বল।’’দীপক সরকার তখন মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পাদক। বিরোধী দল তো বটেই, নিজের দলেরও অনেকে তখন তাঁর ভয়ে কাঁপে।বেরনোর জন্য পুরো রেডি হয়ে ফোন করলাম দীপক সরকারকে। ফোন তুলেই চিৎকার শুরু করলেন সিপিআইএমের জেলা সম্পাদক।‘‘কী ভেবেছেনটা কী আপনারা? আমাদের ছ’জন পঞ্চায়েত সদস্যকে তুলে নিয়ে গেল। আর আপনি ঝাড়খন্ডিদের দালালি করছেন? কাল রাতে আমাদের অভিযোগ পর্যন্ত নেননি?’’আমি সাধারণত রাজনৈতিক লোকজনের সঙ্গে বেশি কথা বলতাম না। স্থানীয় স্তরে ওসি এবং ওপরতলায় পুলিশ সুপারই এসব করতেন। একে সারারাত জাগা। আবার বেরনোর জন্য রেডি হচ্ছি। এর মধ্যে দীপক সরকারের চিৎকার শুনে আমারও মাথা গরম হয়ে গেল। ‘‘কী বলছেন উলটো পালটা। আপনি কি পার্টির কোনও ক্যাডারের সঙ্গে কথা বলছেন নাকি? জানেন কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়?’’‘‘আপনি বাসু ভকতের সঙ্গে কথা বলেন না। আমাদের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন না। শুধু ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন।’’ ‘‘বাসু ভকতের সঙ্গে আমি কেন কথা বলব? ওনাকে বলবেন ওসির সঙ্গে কথা বলতে।’’‘‘আমাদের ছ’জনকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ঝাড়খন্ডিরা। আমাদের লোকজন না ফিরলে সব আগুন জ্বালিয়ে দেব।’’‘‘আমি ঝাড়গ্রাম যাচ্ছি। আপনার লোকদের বাঁচাতে পারব কিনা জানি না, তবে চেষ্টা করব।’’ এরপর সিপিআইএম জেলা সম্পাদকের ফোন রেখে বেরোলাম কোয়ার্টার থেকে। সকাল ৭টা নাগাদ পৌঁছালাম ঝাড়গ্রাম। সোজা চলে গেলাম জামবনি। কোনও ফোর্স ছাড়া ঝাড়খন্ড পার্টির শক্তিশালী এলাকায় গ্রামের ভেতরে ঢুকলাম পায়ে হেঁটে। গাড়ি রেখে দিলাম অনেক দূরে। যেভাবে এসডিপিও, ওসির সঙ্গে আদিবাসী গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতাম ঠিক সেভাবে। বুদ্ধেশ্বর টুডু এবং ঝাড়খন্ড পার্টির কয়েকজন নেতাকে খুঁজে বের করলাম ওই সকালে। ওরা সকলেই আমাকে বিশ্বাস করত। জানত, আমরা অন্তত ওদের কোনও ক্ষতি করব না। কিছুক্ষণ কথা বলে মনে হল, ওদের কেউই সিপিআইএমের ছয় পঞ্চায়েত সদস্যকে অপহরণের খবর পুরোপুরি জানে না। কিন্তু ঘটনা তো ঘটেছে। ওরাই তারপর নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে ওদের দলের আরও কিছু নেতাকে খবর দিল। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। সকাল ১০টা নাগাদ ঝাড়খন্ড পার্টির আরও কয়েকজন নেতা সেখানে এলেন। বোঝা গেল তাঁদের মধ্যে দু’একজন জানেন এই অপহরণের খবর। কিন্তু সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা কেউ জানেন না। জানলেও বললেন না তখন। এমনকী মেরে ফেলেছে কিনা তাও কারও জানা নেই। ওঁদের সঙ্গে আরও ভেতরে গ্রামে ঢুকলাম অনেকটা হেঁটে। যেখানে একদম ওদের ঘাঁটি। সেখানে আরও কয়েকজন ছিলেন নেতা টাইপের।  ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের বললাম, যেভাবে হোক সিপিআইএমের পঞ্চায়েত সদস্যদের উদ্ধার করতেই হবে। বুঝিয়ে বললাম, আগের দিন বিধায়ক বুদ্ধদেব ভকতের ঘটনায় একজন ঝাড়খন্ডির নামেও কেস হয়নি। কিন্তু তার বদলায় যদি ছ’জন সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যের কিছু হয়ে যায়, তা খুব খারাপ হবে। তখন আর আমাদের কিছু করার থাকবে না। প্রথমে ওঁরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না আমার কথা। বিশেষ করে বুদ্ধদেব ভকতের ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে কেস না হওয়ার ব্যাপারটা। দেখছি ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন নিজেদের ভাষায়। কী বলছেন তাও বুঝতে পারছি না সব। এরপর আমাদের বসতে বলে দু’তিনজন কোথাও একটা বেরিয়ে গেলেন। আমরা অপেক্ষা করছি। কী হচ্ছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। দুপুর হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে ওখানেই শুনলাম, সিপিআইএমের ছ’জনকে জামশেদপুরের দিকে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁরা বেঁচে আছেন কিনা ওখানকার ঝাড়খন্ডি নেতারা কেউ জানেন না। খবর নিতে লোক পাঠিয়েছেন। একদম সকালে প্রথম যে গ্রামে গিয়েছিলাম সেখানে আবার হেঁটে হেঁটে ফিরলাম। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তখনও বুঝতে পারছি না। শুধু বুঝতে পারছি, ছ’জন সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যকে ঝাড়খন্ডিরা খুন করে দিলে আগুন জ্বলবে জামবনি, বেলপাহাড়িতে। তা যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে কারও জানা নেই। আরও কতদিন চলবে এর রেশ কেউ জানে না। হঠাৎ ওয়্যারলেসে এসপির গলা পেলাম।‘‘কোথায় চলে গেছ তুমি? সকাল থেকে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। অফিসাররাও কেউ বলতে পারছে না তুমি কোথায়।’’‘‘স্যার আমি ঠিক আছি। গ্রামে ঢুকেছি সিপিআইএমের পঞ্চায়েত সদস্যদের খোঁজে। দেখা যাক কিছু করা যায় কিনা।’’‘‘বেশি ঝুঁকি নিও না। সাবধানে।’’ বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে হয়ে আসছে। ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের সঙ্গে বসে আছি গ্রামের মধ্যে। কোনও খবর নেই। শুধু জানি, অপহৃত পঞ্চায়েত সদস্যদের জামশেদপুরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাঁদের খোঁজে কয়েকজন রওনা দিয়েছে। যারা ফেরানোর জন্য গিয়েছে তারা পৌঁছানোর আগেই যদি সিপিআইএম সদস্যদের মেরে ফেলে থাকে তবে সর্বনাশ। টেনশনে মাঠে পায়চারি করছি, সন্ধে সাতটা নাগাদ কয়েকজন মিলে সিপিআইএমের পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে এল। সবাইকে অক্ষত অবস্থায়। আমি তখন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। একদম সকালে শুরু হয়েছিল অপহৃতদের উদ্ধারের প্রক্রিয়া। প্রায় ১২ ঘন্টা বাদে ঝাড়খন্ড পার্টির নেতারা তাঁদের ফিরিয়ে দিলেন। সেই সময়ের ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংঘর্ষের পরিবেশে তা ছিল অবিশ্বাস্য ঘটনা। রাত আটটা নাগাদ অপহৃত সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে জামবনি থানায় ফিরলাম। ফোন করলাম দীপক সরকারকে। বললাম, ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে অনেক নেগোশিয়েট করে তাঁদের ফেরত নিয়ে এসেছি। চাই না কারও নামে কোনও মিথ্যে মামলা করা হোক। থানায় বসে ভোটার লিস্ট মিলিয়ে এর নাম দেবেন, ওর নাম দেবেন এই সব অ্যালাউ করব না। সিপিআইএম জেলা সম্পাদক বললেন, ‘‘বাসু ভকতকে থানায় পাঠাচ্ছি। ও আপনার সঙ্গে কথা বলে নেবে।’’ ‘‘না। ওনার সঙ্গে আমি দেখা করব না। আমার সঙ্গে কথা বলার কী দরকার?’’ ‘‘বুদ্ধ ভকতের ওপর আক্রমণের ঘটনাতেও আপনি আমাদের অভিযোগ নেননি।’’‘‘আমি জানি কী হয়েছে। বুদ্ধদেব ভকতের নিরাপত্তা রক্ষীর লিখিত বয়ান আছে আমাদের কাছে। গুলি চলেনি।’’ সেদিন রাত ১০টা নাগাদ পুরো ঝামেলা মিটল। তারপর মাঝরাতে মেদিনীপুর শহরে ফিরলাম।’ থামলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারে বসে আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছি তখন। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি জামবনি, বেলপাহাড়ির জঙ্গল ঘেরা গ্রাম, আদিবাসী ঝাড়খন্ডি যোদ্ধার শক্ত চোয়াল, সিপিআইএম বাহিনী, ঝাড়গ্রাম হাসপাতালের সামনে শাসক দলের জমায়েত, দীপক সরকারের মুখ-চোখ, সব কিছু।  ‘এ তো পুরো সিনেমার মতো। কিন্তু তার মানে, আপনি যখন ঝাড়গ্রামে জয়েন করেন, তারও অনেক আগে থেকেই ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের এই সংঘর্ষ, গণ্ডগোলের শুরু।’ প্রশ্ন করলাম প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কে।‘তা তো বটেই। আমি যখন গিয়েছি তখন তো ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে লড়াই, সংঘর্ষ চরমে। একদম শুরুর ঘটনা জানতে হলে আপনাকে আরও পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। অনেকটা পিছিয়ে যেতে হবে।’‘কে বলতে পারবে এই ইতিহাস? না বানিয়ে, ঠিকঠাক মতো।’‘নরেন হাঁসদা পারতেন। কিন্তু তিনি তো বেঁচে নেই। একজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। ডহরেশ্বর সেনকে চেনেন? বলবেন কিনা জানি না, কিন্তু উনি যদি চান, আপনাকে অনেক কিছু বলতে পারেন। ঝাড়গ্রাম ব্লকের আদিবাসীদের, ঝাড়খন্ডিদের, সিপিআইএমের কথা উনি অনেকের থেকেই বেশি জানেন।’প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য শেষ। উঠে আসছি তাঁর অফিস থেকে। ভাবছি, ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের এই লড়াই-সংঘর্ষের শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে হবে। আরও পিছিয়ে যেতে হবে তার জন্য। ‘আর একটা ঘটনা বলি শুনুন, তবে খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন কী অবস্থা ছিল সেই সময় অবিভক্ত মেদিনীপুরের।’ ফের বললেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।আবার বসে গেলাম। এই অজানা ঘটনাগুলো জানতেই তো তাঁর সাক্ষ্য নেওয়া।‘হ্যাঁ, বলুন।’ আবার বলতে শুরু করলেন আইপিএস প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। ‘তখন, মানে নয়ের দশকের মাঝামাঝি জামবনি, বেলপাহাড়ি বিনপুরের তুলনায় কোনও অংশে কম ছিল না কেশপুর। কেশপুরে তখন রোজ সংঘর্ষ হোতও ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের। অথচ কেশপুরে বেশি আদিবাসী ছিল না। কিন্তু কংগ্রেসের সব লোক সিপিআইএমকে ঠেকাতে ঝাড়খন্ডিদের সমর্থক হয়ে গিয়েছিল। কেশপুরের ৩৫-৪০টা গ্রামে রোজ সকাল থেকে মারপিট হোতও দুই দলের মধ্যে। আর বিকেলে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হোতও দু’দলের জখম লোকজন। মেদিনীপুরে পোস্টিংয়ের পর কেশপুরের ওসির কাছে এমনই রিপোর্ট পেলাম। ওসিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘রোজ মারপিট হচ্ছে, সংঘর্ষ হচ্ছে দু’দলের। থামানো যাচ্ছে না কেন?’’ ওসি বললেন, ‘‘এত বড় এলাকা। কম ফোর্স। কী করে ঠেকাব?’’ তাঁর কথাও খানিকটা ঠিক। এসপির সঙ্গে কথা বললাম। ঠিক হল কেশপুরে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ক্যাম্প করা হবে।  ক্রমশ...।  
    জিনগত পাপক্ষয় সহ অন্যান্যরা  - ফরিদা | ১খেলনার ভিতরের ঘর খেলনার ভিতরের ঘরে কথাবার্তা চলে - কতদিন এইভাবে আর?আজকাল শিশুটা জিনিস ছুড়ে ফেলতে শিখেছে সেদিন একটা কান খুলে গেল, যন্ত্রণা ।   রঙ চটে গেছে জায়গায় জায়গায়অর্ধেক পৃথিবীর লোম উঠে গেলএ বাড়ির সবাই কি তালকানা?  ২প্রেমের সঙ্গে আজকাল প্রেমের সঙ্গে তেমন গল্প হয় না আজকাল - সে অফিস থেকে ফিরলে চা বসাই টুকটাক টিফিনের জোগাড় করে রাখিআমাদের কথার মাঝখানে ফোন আসে, অথবা - জরুরী কাজ মনে পড়ে  - খেই হারিয়ে যায় অবশ্য তাকে চলতে দিলে আর এক বিপদ সে মাতালের মতো এলোপাথাড়ি হেঁটে হেঁটে রাস্তার ধারে নয়ানজুলিতে আসীনদুর্গন্ধ কাদা মাখামাখি - জোড় হাতে বলে ক্ষমা কর প্রেম তবু থাকে আজকাল -  দেওয়াল ঘড়িতে টিকটিকিঅদূরে আরশোলাটি  - জড়সড়। ৩জিনগত পাপক্ষয়শিয়রে যখন ঘুম কড়া নাড়ে -ট্রেন ছাড়ে উদ্দেশ্যবিহীন অন্য পোশাকে অন্য কোথাও আমিক্রমশঃ ফের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠিপালানর পথ নেই, জিনগত পাপক্ষয় - ফলতঃ ফুল বাগানের দেওয়ালে আগাছার সংসারে কুঁড়ি হয়ে ফুটি।৪আমি নইআমি নই, হয়ত অন্য কেউ হবে যে তোমাকে চিঠি লিখে বলেছিল কক্ষণও পড়িস না এইসব ছাইপাঁশহয়ত সে লিখেছিল অন্য কাউকে সে-কথা ঠিকানা ছিল না বলে তোমাকে পাঠিয়েছিল। হয়ত রোদ্দুর খুব তখন, পয়সাকড়ির টানাটানি তার ওপর অনেকদিন বাড়ি যেতে পায়নি  - হয়ত খামোখা আবার তার ছুটি বাতিল হ'ল। আমি নই, অন্য কেউ হবে - যে তোমায় একবার হয়ত  ভালোবেসেছিল। 
  • জনতার খেরোর খাতা...
    ধ্রুব রাঠি - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | ধ্রুব রাঠি একজন হিন্দিভাষী ইউটিবার। মোদির স্বরূপ নিয়ে বানানো তাঁর কয়েকটি হিন্দি ভিডিও খুব হিট হয়েছে। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি বাংলা, তামিল মারাঠি এবং আরও কয়েকটি ভাষায় ইউটিউব চ্যানেল খুলছেন। কোনো দায়িত্ব ছিলনা খোলার, তবু খুলছেন, কারণ তিনি মানুষের কাছে বক্তব্য নিয়ে পৌঁছতে চান। এবং তিনি জানেন ভারতের বেশিরভাগ মানুষই হিন্দি বোঝেননা। ধ্রুব রাঠির ওই ভিডিওগুলো বিপুলভাবে শেয়ার হয়েছে। আমার পরিচিত প্রীতিভাজন বন্ধুবান্ধবরাও করেছেন। আমার হোয়াটস্যাপেই না হলেও বার দশেক ধাক্কা মেরেছে, ছড়িয়ে দেবার অনুরোধ সহ। কিন্তু কেউ ঘন্টাখানেক পরিশ্রম করে সাবটাইটল বানাননি। বা ঘন্টাচারেক পরিশ্রম করে ডাব করেননি। অনেকেরই প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আমাকেও কেউ করে দিতে বলেননি। ওটাই ছড়াতে বলেছেন। এমনকি অন্য হিন্দি ভিডিওও বানিয়ে পাঠিয়েছেন। কারণ, হয় তাঁরা সত্যিই মানুষের কাছে পৌঁছতে চাননা। কিংবা তাঁদের ধারণা পশ্চিমবঙ্গের মানুষমাত্রেই হিন্দি বোঝেন। চারদিকের ভদ্রলোক মধ্যবিত্তদের দেখলে তেমনটাই মনে হয় বটে, কিন্তু বিশ্বাস না হলেও, তারা তো জনসংখ্যার মোটামুটি এক দশমাংশ মাত্র। জনগণনা দেখলে পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ লোকই বাংলা ছাড়া আর কিছু বোঝেননা। আমার প্রীতিভাজন বন্ধুরা বেশিরভাগই এই কথাটা বিশ্বাস করে উঠতে পারেননা। তাঁরা ধ্রুব রাঠিকে ধ্রুব্রাঠি বলেন, তাঁর ভিডিও সকলকে দেখতে বলেন। তাঁরা সঙ্গত কারণেই রবীশ কুমারের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অবস্থানকে শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু অত্যন্ত অসঙ্গতভাবে ভুলে যান, যে রবীশ নেহাৎই হিন্দি নামক আঞ্চলিক একটি ভাষার সঞ্চালকমাত্র। ইংরিজিতে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিলে আপামর জনতা যতটা বুঝবে, হিন্দি ভাষাতেও প্রায় তাইই। এই ভাবেই আমাদের অর্ধেক স্লোগান হয়ে যায় হিন্দি, যার কোনো মানে অর্ধেক লোকই বোঝেনা। দিল্লির লোকেদের উদ্দেশ্যে বাণী দেওয়া হচ্ছে, না বাংলার, বোঝা দুষ্কর হয়ে যায় মাঝে মাঝে। এই আমিই, মোটামুটি হিন্দি বুঝি, অমুক-লোক-চোর-হ্যায় দিব্বি বুঝতে পারি, কিন্তু 'তানাশাহী নেহি চলেগা'র মতো সরল একটা জিনিস শুনে এই সেদিনও বুঝতে পারিনি, কী চলবেনা বলা হচ্ছে। কিংবা ধরুন রামনবমী। বস্তুটা কী, বাংলায় প্রায় কেউইই বোঝেনা। যারা বোঝে, তারা ওইটুকুই বোঝে, যে, ওইদিন মসজিদের সামনে গিয়ে নেত্য করতে হয়। কাদের জন্য রামনবমী পালন হচ্ছে, দিল্লির লোক না বাংলার তার মাথামুন্ডু বোঝা দুষ্কর।   এটা কোনো বিশেষ পার্টির চরিত্র না। নকশাল থেকে সিপিএম হয়ে তৃণমূল পর্যন্ত, সকলেই নানা কায়দায় এটার অংশ হয়ে গেছেন। যেমন হয়ে গেছে নেটফ্লিক্স থেকে অ্যামাজন। এমনকি এটা স্রেফ বাংলা ভাষার ব্যাপারও না। নেপালীদের মধ্যে প্রচার নেপালীতে, সাঁওতালিদের মধ্যে প্রচার সাঁওতালিতে, হিন্দিভাষীদের মধ্যে হিন্দিতে করা হবে এ তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়, যখন ধরে নেওয়া হয়, বাঙালি মাত্রেই হিন্দি বুঝবে, বা বলিউড বুঝবে এই অবাস্তব গল্পটা। দেয়াল লিখনে বা গাঁয়েগঞ্জে বক্তৃতায় যে এরকম করলে কোনো লাভ নেই, সেটা সক্কলে জানেন, কিন্তু যেই ইলেকট্রিক মাধ্যম কিংবা স্লোগান চলে আসে, তখনই ব্যাপারটা উল্টে যায়। অথচ সেই চলছে-চলবে, আমার-নাম-ভিয়েতনাম হয়ে খেলা-হবে পর্যন্ত সব হিট স্লোগানই বাংলায়। ওইসব আজাদি-ফাজাদি ইউনিভার্সিটির বাইরে কোথাও পৌঁছয়নি। অথচ হোককলরব দেখবেন, তুলনায় বেশি লোক জানে। কারণ আপামর জনতা বাংলা ছাড়া আর বিশেষ কিছু বোঝেনা। ভাষা, জাতিসতত্ত্বা সব বাদ দিন, এইটুকু প্রাথমিক জিনিস না বুঝলে আর লোকের কাছে যাবেন কীকরে কে জানে। এর পরেও বাংলায় বিজেপি হারলে, সেটা হবে স্রেফ ওই আনপড় লোকেদের চেতনার গুণে, যারা বাংলা ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনা।
    হেদুয়ার ধারে - ১২২ - Anjan Banerjee | কালীবাবু হিসেব করে একটু দেরি করেই গেলেন নিখিল ব্যানার্জীর বাড়ি যাতে তার কোচিং ক্লাস শেষ হবার সময় হয়ে যায়। সেটাই হল। কালীবাবু ওখানে পৌঁছন মাত্র ক্লাস শেষ হয়ে গেল। একতলার ঘর থেকে এই ব্যাচের জনা পনের ছাত্রী বেরিয়ে এল। তার মধ্যে সুমনা আর কাবেরীও ছিল। কালীবাবু অবশ্য তাদের কাউকেই চেনেন না।সুমনা স্যারের কাছে সেদিনের রঙমহলের সামনের ঘটনার কথাটা তুলেছিল। ঘটনাক্রমে সাগর মন্ডলের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রসঙ্গটাও বলল সুমনা।শুনে নিখিল স্যারের চোখেমুখে একটা আলোর ঝিলিক দেখা দিল।তিনি বললেন, ' লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে ফিজিক্যাল রেজিসট্যান্স তো এসেনশিয়াল। তবে সেটা আনরেসট্রেন্ড না হয়, একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স দরকার। তবে সাগর ইস দা পারফেক্ট এমবডিমেন্ট অফ ব্যালান্স অ্যান্ড স্পিরিট। হি ইজ দা পারফেক্টলি ভায়াবল মেটিরিরিয়াল সট আফটার ফর দা পারপাজ ... দেয়ার ইজ নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট ... হমম্ ... হি শুড বি দা ফ্ল্যাগ বিয়ারার লিডিং দা ওয়ে ... হিস প্রোয়েস মাস্ট বি অ্যাপ্টলি হারনেসড... 'কথাগুলো খানিকটা স্বগতোক্তির মতো শোনাল। সুমনা এবং কাবেরী কিছুটা শুনতে পেল, কিছুটা পেল না। কিন্তু দেখল যে স্যারের মুখে কোন আকাশ থেকে যেন একটা আলোর রশ্মি এসে পড়েছে। তিনি আপনমনে কি চিন্তা করে চলেছেন। অন্য সকলে চলে গেছে। শুধু সুমনা আর কাবেরী দাঁড়িয়ে আছে।কাবেরী বলল, ' স্যার ... আমরা তা'লে আসছি ... 'নিখিলবাবুর যেন হঠাৎ ধ্যানভঙ্গ হল। তিনি লজ্জিত স্বরে বললেন, ' ওঃহো ... সরি সরি ... ঠিক আছে এস তোমরা ... পরে কথা হবে ... 'সুমনা আর কাবেরী দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার পরই কালীবাবু সেখানে ঢুকলেন। নিখিলবাবু তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হঠাৎ কালীকিঙ্করের দর্শন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তিনি বলে উঠলেন, ' আরে ... কালীদা যে ... কি সৌভাগ্য ... আসুন আসুন ... 'কালীবাবু একগাল হেসে বললেন, ' কি যে বলেন স্যার ... লোকে পুলিশের লোকের থেকে শতহস্ত দূরে পালাতে চায়। পুলিশে ছুঁলে কত ঘা যেন বলে ... আর আপনি কিনা ... হাঃ হাঃ হাঃ ... '----- ' আরে ... কালীদা ... সে হল সাধারণ পুলিশ ... তারা কেউ কালীকিঙ্কর ভটচাজ নয় ... আর কালী ভটচাজ পুলিশ তবু পুলিশ নয় ... '----- ' এই রে ... আপনে বুড়াবয়সে আমার চাকরি খাইবেন দেখত্যাসি ... কি যে সব বলেন ... যাক আপনার লগে কিসু কথা সিল ... যদি দশ মিনিট সময় হয় ... 'নিখিলবাবু বললেন, ' আরে ... এসব কি বলছেন কালীদা ... আমি কি এতই গুরুত্বপূর্ণ লোক নাকি ... 'তারপর কালীবাবুর দেশজ ভাষার মতো করে নিখিলবাবু বললেন, ' চলেন চলেন ... ঘরের ভিতরে গিয়া বসি ... 'কালীবাবু বললেন, ' হ্যাঁ সলেন ... 'সুমনা বলল, ' অনেকদিন সিনেমা দেখা হয়নি। আমি তো এখন অনেক রিল্যাক্সড। মানে, আগের মতো গার্ড দেবার কেউ তো নেই। বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে। আর মেজদির তো কলেজের পাট চুকতে চলেছে। পরীক্ষার পড়া ছাড়া আর কোন কিছু নিয়ে সে মাথাই ঘামাচ্ছে না। সুতরাং গোল্ডেন অপরচুনিটি এখন ... 'প্রতিবিম্ব বলল, ' তা ঠিক। কিন্তু জীবন্ত সিনেমা তো সেদিন রঙমহলের সামনে হয়ে গেল। আমরা দুজন কিন্তু শুধু সাইড রোলে ছিলাম। আসল হিরো হল সাগর মন্ডল ... '----- ' হ্যাঁ, সে তো অবশ্যই। এরকম ক্যারেক্টার যদি আরও থাকত ... আর একটা ক্যারেক্টার হলেন নিখিল ব্যানার্জী স্যার ... কত নতুন নতুন কথা বলেন জান তো ...। কত ভাবনা চিন্তা করেন উনি। এসব কথা কারো মুখে শুনিইনি। কি অদ্ভুত একটা জগতে নিয়ে যান স্যার। আমরা নতুন কোন কিছু ভাবতেও পারিনা আর জীবনকে, সমাজকে ঠিকমতো দেখার চোখই তৈরি হয়নি আমাদের ... '----- ' একদম ঠিক। দেখার চোখই তৈরি হয়নি আমাদের ... শুধু পরীক্ষার পড়া আর জোড়া গন্ধরাজের উদ্ভট ন্যাকামি ছাড়া আমাদের জীবনে আর কিছু নেই ... 'সুমনা সমর্থন করল প্রতিবিম্বকে, ' ঠিক কথা। একদম বাজে ব্যাপার সব। ফালতু ন্যাকামো। তুমি একদম ওইসব ভাঁড়ামো করবে না। তাতে যা হয় হবে। আমি বাপির সঙ্গে কথা বলব ... '----- ' উঃ ... বাঁচালে... '----- ' নিখিল স্যারের সঙ্গে দেখা করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। খুব ইন্ট্রেস্টিং পার্সোনালিটি ... সিটি কলেজে প্রথম দিন দেখেই মনে হয়েছিল ... '----- ' ঠিক আছে চল না একদিন ... স্যারকে বলে রাখব আগে থেকে ... কাবেরীও থাকবে। স্যারের কথা শুনে সেদিন মনে হল যে, যে সংগঠন তৈরি করার কথা বলছেন সে ব্যাপারে তিনি সাগরবাবুর ওপর অনেকটাই ডিপেনডেন্ট ... 'প্রতিবিম্ব বলল, ' এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমন একটা মেটিরিয়াল পাওয়া তো সহজ ব্যাপার নয় ... দারুণ একটা ক্যারেক্টার... এরকম সুপার্ব পাওয়ারহাউস অফ সাবলাইম এনার্জি আমাদের জানার মধ্যে নেই ... তাই ... '----- ' সে না হয় হল ... স্যারের সঙ্গে কথা বলে না হয় মিটিংয়ের একটা ডেট ঠিক করা যাবে, কিন্তু আমি যেটা বললাম সেটার কি হবে ? ' সুমনা বলল।----- ' মানে, ওই সিনেমা দেখার ব্যাপারটা ? '----- ' হ্যাঁ ... তাছাড়া আর কি ? '----- ' কাল ম্যাটিনিতে চল মুঘল ই আজম দেখে আসি ... ' প্রতিবিম্ব প্রস্তাব দেয়।------ ' তাই চল ... সময় লাগবে কিন্তু ... বড় ছবি ...'----- ' হ্যাঁ তা জানি ... দেখ কিভাবে ম্যানেজ করবে ....'----- ' কাবেরীকে বলব নাকি ? ' সুমনা বলে।---- ' তা বলতে পার। দল একটু ভারি থাকাই ভাল ... তবে আমি একটা কথা চিন্তা করছি ... '------ ' কি ? '----- ' একটু রিস্ক আছে কিন্তু কিছুদিন ... ওরা ওই অপমান হজম করে নেবে না কিন্তু। সাগর স্যার তো আর সবসময়ে আমাদের গার্ড দিয়ে বেড়াবে না ... ম্যাডামও বললেন কিছুদিন সাবধানে চলাফেরা করতে ... তাই ভাবছি ... 'আচমকা কথাগুলো শুনে সুমনার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। রঙমহলের সামনে সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। সাগর মন্ডল না থাকলে কি হত সেদিন। রাস্তার একটা লোকও তো এগিয়ে আসেনি। সিনেমা হলেও যদি এরকম বিশ্রী কিছু ঘটে ... 'সুমনা একটু চিন্তা করে বলল, ' আচ্ছা থাক তালে ... এখন একটু সাবধানে থাকাই মনে হয় ভাল হবে ... কিছু বলা তো যায় না ... '----- ' ঠিক আছে ... নিখিল স্যারের কাছে তা'লে কবে যাব ? '----- ' কাল ক্লাস আছে। স্যারকে জিজ্ঞেস করব ...'সুমনা বলে।জন্মেজয়বাবুর আজ খুব আনন্দ। তার ছেলে অখিল একটা সেগুন কাঠের খাট তৈরি করিয়েছে।আজ দুপুরে খাটটা খাটিয়ে দিয়ে গেছে মিস্ত্রিরা। তিনজন শুতে পারে তাতে।তিনি বিভূতিবাবুকে খবরটা দিলেন বিকেলের দিকে গঙ্গার দোকানের সামনে।শুনে বিভূতিবাবু বললেন, ' যাক ... ভালই হল। ঠান্ডার সময়ে শোয়ার সুবিধে হবে ... অখিল সোনার চাঁদ ছেলে আপনার ... খুব ভাল ... 'বৃদ্ধ জন্মেজয়বাবু খুশিমাখা গলায় বললেন, ' তা বটে ... বাবা মায়ের খুব খেয়াল রাখে। আমার জন্য দুইখান ধুতি কিন্যা আনসে। অর মায়েরেও দুটা শাড়ি দিসে। আমার তো এখন কোন রোজগার নাই। সব তো ওই পারে ফেইল্যা আইসি বুঝলেন কিনা ... 'বিভূতিবাবু বললেন, ' ওসব নিয়ে দুঃখ করবেন না দাদা। আমরা আর কদিনই বা আছি ... জীবন তো কাটিয়েই দিয়েছি প্রায়। বাকিটা যদি এভাবেই কেটে যায় তা হলেই যথেষ্ট ... '------ ' হ, তা ঠিকই কইসেন দত্তবাবু। চইল্যা যাবার পর তো আর কিছু নাই। কেউ কারো নয়। কোথাও কিসু নাই। তবু আমরা হাঁকপাঁক করি যদি কোনমতে আর একটু সুখ পাওয়া যায় ... আকিঙ্খেটা সাড়তে পারি না আমরা ... হ্যাঃ হ্যাঃ ... 'বিভূতিবাবু বিমর্ষ মুখে বললেন, ' হুঁ, খাঁটি কথা বলেছেন। সব জেনে বুঝেও বেঁচে থাকতে থাকতে আকাঙ্খাগুলো ছাড়তে পারি না আমরা। আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই ... খালি মনে হয় মরার আগে যদি আর একটু কিছু পাওয়া যায় ... কি বিপদ ... 'দুই প্রবীণ এ জীবনের সারাৎসার নিয়ে গভীর কিছু উপলব্ধি প্রকাশের পর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে বোধহয় পরের বাক্যসূত্র খুঁজছিলেন। তাতে নিশ্চিতভাবে কোন বিপ্লব বা প্রতিবাদী অভ্যুত্থানের কথা নেই। আছে শুধু এ অনন্ত জীবনপ্রবাহের এক বহুচর্চিত উপলব্ধি।ওদিক থেকে গঙ্গার গলা শোনা গেল, ' মেশোমশাই ... দত্তদা ... আসুন আসুন ... একটু চা খেয়ে যান ... '( চলবে )********************************************
    শপথ  - Prolay Adhikary | অনেকটা পথ বাড়তি হাঁটি,অনেক লেখাই বাহুল্য,হাজার কথাই অ-দরকারী,কানে না হয় না তুললেও...একটা কথায় ভরসা রেখোযেমন রাখো ইশ্বরে !"শিরদাঁড়াটাই বাঁচিয়ে রাখেসব হারানো নিঃস্ব'রে।"হাতছানি তাই যতই আসুকসমঝোতা নয় সেইখানে,তোমার বীজেই ফলবে ফসল নবান্ন হোক সম্মানের।
  • ভাট...
    commentr2h | আমাদের দেশে যেমন, রাজাগজাদের বংশাবতংসদের নিয়েও যেমন কারো কোন আপত্তি দেখি না। একটা পরিনত গণতন্ত্রের দেশ, মহারাজা অমুক, রাজমাতা তমুকের নামে উলুতপ্লুত। বসুন্ধরারাজে সিন্ধিয়া কোন আমলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন - তাঁকে হার হাইনেসের বদলে ম্যাডাম সম্বোধন করায়। শ্রীমতী সিন্ধিয়ার গণতন্ত্রকে অপমান করার দায়ে কোন শাস্তি হয়েছে বলে তো শুনিনি। একটা দেশের গণতন্ত্রের প্রতি যার এই শ্রদ্ধাবোধ, তিনি মিমি চক্রবর্তীর থেকে যোগ্য হলেন কিসে, তার ঠাকুর্দা সামন্তপ্রভু ও বৃটিশ কোলাবোরেটর ছিলেন বলে? একই জিনিস দেখি মহারানী গায়ত্রী দেবীকে নিয়ে। তিনি অতীব সুন্দরী ছিলেন সন্দেহ নেই, তবে সুন্দরী ও ক্যারিশ্মাটিক হওয়া তো রানীদের জব প্রোফাইলের মধ্যেই পড়ে বলে জানতাম। তো, হোয়াট দা হেক?
    commentr2h | পাপাঙ্গুল, যোগ আছে। রাম মন্দিরের তালা খুলে দিলে দূর ভবিষ্যতে দেশ জুড়ে গণউন্মাদনা ও আইন শৃঙ্খ্লার ওপর তার প্রভাব এইসব বোঝার দরকার আছে। আজকের ভারতের সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির আগুনে ধুঁয়ো দেওয়া অনেকগুলি ঘটনা, যেমন শাহবানো মামলা, রাম মন্দিরের তালা খোলা, আদবানীর রথ না আটকানো, অযোধ্যাতে দাঙ্গাবাজদের জমায়েত না ভাঙা - এইগুলি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমলারা পরামর্শ দিতে পারেন, কিন্তু সেসব আত্মস্থ করার জন্যও একটু জ্ঞানগম্যি দরকার। গুজরাত তো ছেড়েই দিলাম। জনগণের কোন দাবিটা নিয়ে এগুতে হবে আর কোনটা প্যাসিফাই করতে হবে, কোনতা অ্যাকশনেবল আর কোনটা বাজে খরচ - সেসব বোঝাও রাজনীতিবিদের কাজ। জনগণের দাবী স্কুলের বদলে মূর্তি বানাতে হবে - রাজনীতিবিদ ঐ নিয়ে আমলার কাছে চলে গেলেন - এতে কী আর দেশ চলে। সফল রাজনীতিবিদরা অনেক সময়ই দক্ষ প্রশাসকও বটে। "এবার ভোট পাবার পর চিত্রতারকা যদি সবসময় মানুষের সঙ্গে থাকেন , কেউ তা নিয়ে অভিযোগ করবে না। অনেককেই জেতার পর আর এলাকায় দেখা যায় না।" সে তো বটেই। আমার বক্তব্য হলো, সেটাই সব সময় এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। ধরুন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ভোটে জিতলেন এবং সারাক্ষন এলাকায় পড়ে রইলেন। বা অনুব্রত মন্ডল, সর্বদাই এলাকায়। এদের থেকে এলাকায় না থাকা মুনমুন সেন অনেক উপকারী রাজনীতিবিদ। এলাকায় না থাকা অনুপযুক্ত রাজনীতিবিদের তুলনায় জাতিবিদ্বেষ ছড়ানো, খুনে গুন্ডা, বা মরালি করাপ্ট সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ অধিক পরিত্যায্য, তর্কযোগ্যভাবে।
    commentবকলম -এ অরিত্র | মহাশয় থেকে আসলে smiley
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত