এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ইদবোশেখির লেখাপত্তর - গুরুচণ্ডা৯ | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়শীতকাল বইমেলা হইচই-এর দিনকাল ফুরিয়ে এসে গেল শান্ত হয়ে বসে লেখালেখির কাল। বাইরে তাপমাত্রা বাড়ছে রোদ্দুরের জন্য, নির্বাচনের জন্য। সাথে কোথাও প্যাচপ্যাচে ঘাম তো কোথাও ঝরঝর বৃষ্টি। সন্ধ্যের আবছায়ায় দোকানে ভিড় জমায় সারাদিন রোজা রাখা ক্লান্ত মানুষ, গাজনের প্রস্তুতি নেওয়া শ্রান্ত মানুষ, চৈত্রসেলের হাতছানিতে মুগ্ধ মানুষ। টুপটাপ জমে ওঠে গল্পেরা, কবিতারা। নির্বাচনী জনসভার কোণাকাঞ্চিতে, ইফতারির থালার পাশে, গাজনের সন্ন্যাসীর ঝোলায় চুপটি করে অপেক্ষা করে তারা মানুষের জন্য। আমরা আপনাদের কাছে ডাক পাঠিয়েছিলাম তাদের খপ করে ধরে ফেলে, ঝপ করে লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে। এসে গেছে তারা। আগামী কয়েকদিন ধরে রোজ দুটি-তিনটি করে তারা এসে হাজির হবে বুলবুলভাজার পাতায় - টাটকা ভাজা, গরমাগরম। পড়তে থাকুন। ভাল লাগলে বা না লাগলে দুই বা আরো অনেক লাইন মন্তব্য লিখে জানিয়ে দিন সে কথা। মন চাইলে, গ্রাহক হয়ে যান লেখকের। আর হ্যাঁ, আপনিও লেখা নিয়ে চলে আসুন গুরু আর চন্ডালের আড্ডা গুরুচন্ডা৯-র পাতায়।সূচীপত্রঃস্মৃতিচারণবর্ষশেষ, বর্ষশুরু: অমিতাভ চক্রবর্ত্তীও চাঁদ: সেমিমা হাকিমসারেতে থাই নববর্ষ: হীরেন সিংহরায়চান রাত: সাদেকুজ্জামানকাব্যজলের সমাধি: জগন্নাথ দেব মন্ডলগিরগিটি ও অন্যান্য কবিতা: ফরিদাসমুদ্রে সনেট: সোমনাথ রায়পাঁচটি কবিতা: অমিতরূপ চক্রবর্তীতিনটি কবিতা: অরিত্র চ্যাটার্জিউপগ্রহ: অমিত চট্টোপাধ্যায়আব্বু আব্বা বাবা: মাজুল হাসানশেষের কবিতা: দীপ্তেনকবিতাগুচ্ছ: মণিশংকর বিশ্বাসসিন্দবাদের গল্প ছড়ানো ছাদে: সুকান্ত ঘোষগপ্পোখুচরো: সুমন মুখার্জীসুফি: আফতাব হোসেন রতন, দ্য ব্যাকবেঞ্চার: নরেশ জানাডাক দিয়ে যায়: এস এস অরুন্ধতীমহারাজ ছনেন্দ্রনাথ ও মার্কণ্ডেয়র চিঠি: রমিত চট্টোপাধ্যায়পাখির অন্তর্ধান রহস্য: মৃণাল শতপথীএই ঘুম শারীরবৃত্তীয়: দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ওয়েথসাম: উপল মুখোপাধ্যায়কোশিশ কিজিয়ে: কিশোর ঘোষালটুনিমুনির জীবন: দময়ন্তীদৌড়বাজ হাউসকীপার: সমরেশ মুখোপাধ্যায়হন্য: সৈয়দ তৌশিফ আহমেদসীমান্তরেখা: প্রতিভা সরকারসাদা খাম: দীপেন ভট্টাচার্যসুর: অনুরাধা কুন্ডানভেলাফকির ফয়জুল্লাহ: মুরাদুল ইসলামনিবন্ধ আজ নববর্ষের আখ্যান: সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
    সুর - অনুরাধা কুন্ডা | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়ফোন বেজে উঠতেই শ্যামশ্রীর গলা ভেসে এলো। ছটফটে, তরতরে শ্যামশ্রীর গলা নয়। রাগী, কড়া শ্যামশ্রীর গলাও নয়। চটপটে, স্মার্ট নয়। একটু ভেজা ভেজা। দরদী। নরম।ত্রিলোকেশের এখন ঠিক যেমন দরকার তেমনটি।যখন যেমন দরকার, তেমনটি।যখন খোলামেলা চাই তখন খোলামেলা।যখন লাজুক চাই তখন লাজুক।যখন লাস্য চাই তখন লাস্য।এইভাবেই। ঠিক এইভাবেই প্রোগ্রাম করা আছে। কন্ঠস্বর, চলাফেরা, ওঠাবসা, ফুড হ্যাবিট, যৌনতা , এমনকি পটি টাইমিং পর্যন্ত।শ্যামশ্রী না। শ্যামশ্রীর ক্লোন। শ্যামশ্রী দত্তগুপ্ত টু। হাইট পাঁচ পাঁচ। রঙ মাজা। চুল স্ট্রেইট। গোল্ডেন হাইলাইট।অবিকল ওরিজিনাল শ্যামশ্রী।শ্যামশ্রীর চেহারা নিয়ে তো কোন সমস্যাই ছিল না ত্রিলোকেশের। এককথায় ভেরি অ্যাট্রাকটিভ। হাইলি ডিজায়ারেবল। শ্যামশ্রীর নিজের অবশ্য সেক্সি শব্দটা বেশি পছন্দ। এটা ত্রিলোকেশের একেবারে হজম হত না। যদিও পরের বৌকে সে হামেশা সেক্সি বলে কমপ্লিমেন্ট দিয়ে থাকে কিন্তু শ্যামশ্রী সম্পর্কে সে ভীষণ সেনসিটিভ ছিল। তার নিজের মতে। শ্যামশ্রীর মতে শব্দটা হবে পজেসিভ। ওভার পজেসিভ। সাফোকেটিংলি পজেসিভ।ছয় ফিট এক ইন্চির ত্রিলোকেশ দত্ত এইসব মতান্তর বরদাস্ত করে না। তার কথাই শেষ কথা। তার মা শুনেছে। ঠাকুমা শুনেছে। বাবা অবশ্য শোনেনি। ত্রিলোকেশের মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি গত হয়েছেন। ত্রিলোকেশ সেল্ফ মেড ম্যান। আই টি সেক্টরে প্রিটি ফেমাস। শ্যামশ্রীকে সে নিজেই পছন্দ করেছিল। শী ওয়জ আ ট্যালেন্টেড সিংগার।ওয়জ।ছিল। এখন নেই। কেন নেই? ত্রিলোকেশ তো কখনও শ্যামশ্রীকে গান ছাড়তে বলেনি! বরং সে বলেছে গো ফর রেকর্ডিংস। টেক মিউজিক লেসনস। প্রোগ্রাম করো।আসলে শ্যামশ্রী ঠিক প্রোগ্রাম বা রেকর্ডিং এর মেয়ে নয়। কেন নয় সেটা ত্রিলোকেশ ঠিক বুঝতে পারতো না।অথচ অসম্ভব ভালো টোনাল কোয়ালিটি। মসৃণ অথচ দানাদার গলা।ত্রিলোকেশ অত গান টান বোঝে না। কিন্তু সবাই বলতো শ্যামশ্রীর গলা অসামান্য। সো ডু রিওয়াজ। অনুষ্ঠান করো। নাম কামাও। লেট পিপল নো ইওর ট্যালেন্ট।ত্রিলোকেশের অফিসে হিউজ অ্যানুয়াল প্রোগ্রাম হয়। নাচ,গান। খানা পিনা। পার্টি টপ লেভেলের।। শুভা মুদ্গল আসেন। রশিদ খান এসেছেন। রেখা ভরদ্বাজ কি খুশি শ্যামশ্রীর গান শুনে।আরে ওয়াহ! ক্যা কোমল নিখাদ লগায়া। ব্যস। ঐ একবার।শ্যামশ্রী আর কখনো অ্যানুয়াল ইভেন্টে গেলই না।নাও হু কুড টলারেট দিস? পরের দুবছর একা গেল ত্রিলোকেশ।অ্যান্ড সাচ এমব্যারাসিং কোয়েশ্চনস! তিলুকে তাই ডিসিশনটা নিতেই হল।তিলু। হ্যাঁ।ঐ নামেই ত্রিলোকেশকে ডাকতো শ্যামশ্রী।অ্যান্ড হি হেটেড দ্যাট।আফটার টু ইয়ারস। এর বেশি ধৈর্য্য রাখা অসম্ভব। লং ড্রাইভে যেতে যেতে হুট করে গাড়ি থামিয়ে দিত শ্যামশ্রী। মাঠ। পুকুরের ধার। বাঁশঝাড়। ড্রাইভ করতে ভালোবাসত নিজে।ত্রিলোকেশ রিল্যাক্স করতো। শ্যামশ্রী ওয়ান।ওর দীঘল শরীর ঘিরে সাদা হলুদ ইক্কতের আবরণ। পায়ের রূপোর পায়জনিয়া।ও গেয়ে উঠতো..দেখিয়া সজলঘন...অথবা দূরে কোথায় দূরে দূরে....কেমন পেনসিভ সুর। ত্রিলোকেশের এসব ভালো লাগত না।ফাঁকা মাঠে কাকে গান শোনাচ্ছে তার বৌ?আরে বাবা, গাইতে হলে ইউ নিড অডিয়েন্স। হ্যায় না? চিরদিনের টপার ত্রিলোকেশ। পরীক্ষাতে টপার। চাকরিতে টপার। বৌয়ের সিলেকশনেও টপার হতে হবে। তাই তো শ্যামশ্রী ওয়জ সিলেক্টেড।কিন্তু এরকম বৌ নিয়ে সংসার প্রিটি ডিসগাস্টিং। এত মুডি। এত আনপ্রেডিকটেবল।একদিন শ্যামশ্রী নিজেই বললো।আমি চলে যাচ্ছি তিলু।হাউ অফেনসিভ! ত্রিলোকেশ দত্তকে কেউ ছেড়ে যেতে পারে! ইজ ইট পসিবল? রিসেপ্টিভ এন্ডে কখনো থাকেনি সে।কিন্তু শ্যামশ্রীকে আটকানো গেল না। মুম্বাই, তিনহাজার স্কোয়ার ফিটের দুপ্লে, শাঁসালো বর, পার্টি, কন্টিনেন্টাল ট্যুওর ছেড়ে সে চলে গেল বৃষ্টিগুড়ি নামে একটা জায়গাতে। সেখানে নাকি স্কুলে মাষ্টারি করে সে।পিওর ননসেন্।কিন্তু ডিভোর্স উড বি আ স্ক্যান্ডাল।রাম, শ্যাম, যদু, মধু নয়। ত্রিলোকেশ দত্ত। সি ই ও। আরহানহাসিস। শ্যামশ্রীকে লুজ করা যাবে না। শী ইজ আ প্রাইজ পিস।তাই গ্যাস, অম্বল, বদহজম নয়। ফোন কলস। মানি। এবং ক্ষমতা।অ্যাজ আ রেজাল্ট- শ্যামশ্রী টু।কেউ জানল না। বুঝল না। ত্রিলোকেশের মাও না।একদিন শ্যামশ্রী টু উবের করে চলে এলো ত্রিলোকেশেরবাড়িতে।ত্রিলোকেশ বললো- নাচো। রাম্বা হো রিমিক্স।শ্যামশ্রী টু নাচেত্রিলোকেশ বললো- আজ অফিস পার্টিতে তোমাকে গজল গাইতে হবে। চুলে ফুল দেবে।শ্যামশ্রী টু চুলে ফুল দিয়ে গাইল।বললো, তোমাকে কি বলে ডাকবো?ত্রিলোকেশ একটু ভেবে বললো- টিডি।শ্যামশ্রী টু ঘাড় নাড়লো।শ্যামশ্রী ওয়ানকেও ও তাইই ডাকতে বলেছিল। সে হেসে কুটিপাটি হয়ে বলেছিল, মাগো, তুমি কি আমার অনার্স ক্লাসের স্যর নাকি তিলু? ওর এই হেসে উড়িয়ে দেওয়া ব্যাপারটা জঘন্য লাগতো ত্রিলোকেশের। জঘন্য লাগতো ওর ইচ্ছেগুলো। অনিচ্ছেগুলো।ত্রিলোকেশ মধ্যরাতে শ্যামশ্রীর নাইটির স্ট্র্যাপ খুলতে চাইলে, কতরাত শ্যামশ্রী বলেছে, আজ ইচ্ছে করছে না।ত্রিলোকেশ নোংরা লোক নয়। কিন্তু তার ইগো হার্ট হত।শ্যামশ্রী টু কখনো না বলে না।ত্রিলোকেশ চাইলে সে আপেল কেটে দেয়, রসালো করে ভেজে দেয় সসেজ।শ্যামশ্রী ওয়ান ত্রিলোকেশ কফি খেতে চাইলে, তাকে কফি দিয়ে নিজে চা নিয়ে বসতো। ত্রিলোকেশ আপেল খেতে চাইলে একগাদা পেয়ারা কেটে নিয়ে এসে বলতো, বেশি ভিটামিন আছে। খাও।শ্যামশ্রী টু কখনো অবাধ্য হয় না।সে ত্রিলোকেশকে কখনো তিলু বলে না। চা চাইলে দুজনের জন্যই চা করে।অ্যাভোকাডো আর ব্রকোলি স্যালাড চাইলে মুড়িমাখা নিয়ে আসে না শ্যামশ্রী ওয়ানের মতোশরীর উন্মুক্ত করতে বললেই সে ত্রিলোকেশের জন্য বিছিয়ে দেয় তার মখমলসদৃশ দেহ।অতিথিদের সামনে গান গাইতে বললে সে গান গায়। রেকর্ডিং করবে জানুয়ারিতে।টিডির অফিস প্রোগ্রামে সে নিয়মিত গায়িকা।শুধু তার টোনাল কোয়ালিটি একটু সরু হয়ে গেছে। তার কোমরও সরু।ত্রিলোকেশের ইরিটেশন হয় না। আজ ফোন করে টিডি শ্যামশ্রী টু কে বললো, এমা দাৎসি খাবো। রেড ওয়াইন সহযোগে।শ্যামশ্রী টু মধুর কন্ঠে বললো, ইট উইল বি রেডি।বাড়ি ফিরে টিডি বললো , ওয়েস্টার্ণ শুনবো আজ।আর লেট আস প্ল্যান বেবি নেক্স্ট ইয়ার।শ্যামশ্রী টু একটা জেরেমি লোপেজের স্যাক্সোফোন চালিয়ে দিল।তারপর পুতুলের মতো ঘাড় নেড়ে বললো, ওকে। নেক্সট ইয়ার হুইচ মান্থ? টেবল পরিস্কার হয়ে গেলে শ্যামশ্রী টু স্নানে গেল। যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলো, টিডি, আজ কোন রঙের নাইটি পরবো?ত্রিলোকেশ দত্ত আজ কেমন যেন অন্যমনস্ক। অথচ সবকিছু তার পছন্দমতোই হয়ে চলেছে। আজ ঝিবঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। নভি মুম্বাইতে বৃষ্টি বড়ো সুন্দব।কিন্তু স্যাক্সোফোনের শব্দ পার হয়ে কি একটা সুর ত্রিলোকেশের কানে চলে আসছে।সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না।অন্যমনস্কভাবেই বললো, পিংক। বেবি।গানটা কি শ্যামশ্রী ওয়ান গাইতো?সে সুরটা ভাঁজবার চেষ্টা করলো। পারলো না।শ্যামশ্রী টু বাথরুমে চলে গেছে।ত্রিলোকেশ ফোনটা নিয়ে শ্যামশ্রী ওয়ানকে পেতে চাইল।যাস্ট ওয়ান্স। মাত্র একবার।ত্রিলোকেশকে মনে করতেই হবে।কিন্তু বৃষ্টিগুড়ি একটা ধ্যাধ্ধেড়ে গ্রাম। সেখানে কিছুতেই ত্রিলোকেশের কল পৌঁছালো না।স্যাক্সোফোন আরো জোরে করে দিল ত্রিলোকেশ।মুখ বিকৃত করে বললো. ডিসগাস্টিং!
    সাদা খাম - দীপেন ভট্টাচার্য | অলংকরণ: রমিতজানালাটা খুলে বাইরের পাহাড়ের খাড়া দেয়ালটা একবারই দেখানো হয়েছিল তাকে। মাঝে গভীর গিরিখাত। জানালায় ছিল কড়িবর্গা, সেটা ধরে গিরিখাতের তল সে দেখতে পায়নি। জানালাটা খোলা হয়েছিল, তাকে জানতে দেওয়া হয়েছিল জানালার ওই পাড়ে আছে শৈলশিরা, কারণ তারা জানত সে পাহাড় ভালোবাসে। এতো কাছে পাহাড় থাকা সত্ত্বেও সেটি সে দেখতে পাবে না – এটাও এক ধরণের নিপীড়ন। জানালাটা আর এক বার খোলা হয়েছিল পরে, তার জন্যই। তার স্ত্রী তাকে ফিরে আসতে না করেছিল, অনেক অনুনয় করেছিল, কিন্তু সে শোনেনি। বিমানবন্দরে নামামাত্রই তাকে আটক করা হয়েছিল। নিয়ে আসা হয়েছিল রাজধানী থেকে বহু দূরে এই বন্দিশিবিরে। সে জানত এরকমই হবে।সকালে তাকে নিয়ে যাওয়া হতো অন্য একটি ঘরে, পার হতে হতো একটি করিডর, এক পাশে দেয়াল, অন্য পাশে পর পর আটটি কামরা, এর মধ্যে একটি ছিল তার। কিন্তু সেটা সে বুঝতে পারত না, কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকত চোখ। ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগলে বুঝতে পারত বাড়িটি থেকে সে বের হয়েছে। এর পরে ত্রিশটি পদক্ষেপ, অন্য একটি বাড়িতে ঢোকা। সেখানে একটি ঘরে তাকে চেয়ারে বসিয়ে চোখের বাধন সরিয়ে নেওয়া হতো। মিনিট দশেক অপেক্ষার পর আসত কমিসার। প্রথম দিন সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমি কে আপনি জানেন?’ কমিসার বলেছিল, ‘আমি জানি আপনি জনগণের শত্রু, এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট।’ বেশি জানা কমিসারের জন্য ভালো নয়। বহুদূরে রাজধানী, সেখান থেকে একটা গাড়ির প্রায় পুরোটা দিন লেগে যায় এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছাতে। তবু দু দিন অন্তর একটি করে গাড়ি আসে। দুদিন অন্তর কমিসারের কাছে আটটি সাদা খাম পৌঁছে দেওয়া হয়। নির্দেশনামা। সেই নির্দেশ পালন করে কমিসার আবার আটটি খামে প্রমাণসহ উত্তর পাঠিয়ে দেয় দু দিন পরে।কমিসার তার কাছে থেকে কোনো উত্তর জানতে চাইত না, কোনো জবানবন্দী নয়। বেশিরভাগ দিনই তাকে বসিয়ে রাখা হতো, আর কোনো কোনো দিন আসত একটা শারীরিক আঘাত। আঘাতটা আসতো কোনোরকম অগ্রিম জানান না দিয়ে। কমিসার নিজ হাতেই সেটা করত। এমনই সব শর্ত – সাদা খামের শর্ত। আর এক দিন তার জানালাটা খোলা হয়েছিল। সার্জেন্ট এসে জানালাটা খোলে, একটা ভারি তালা দিয়ে বদ্ধ থাকে জানালা। সার্জেন্ট জানালা খুলে দিয়ে তাকে বলেছিল, আধ ঘন্টার মধ্যে আবার জানালা বন্ধ হয়ে যাবে, তাই লোভীর মতো সে বাইরের পাহাড়টা শুষে নিতে চাইছিল তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে। এরপর সে দেখতে পায় বাইরের শূন্যে উড়ন্ত এক মানুষকে, সমস্ত ভার থেকে মুক্ত হয়ে সে পড়ে যাচ্ছিল গিরিখাতে, তার দেহ আঁকছিল এক প্রাসের গতিপথ। সেদিন বাড়ির ছাদ থেকে আটজন বন্দীর একজনকে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলা হয়, যাতে সবক’টা কক্ষ থেকেই সেই গতিপথ দেখা যায়। সাদা খামে শুধু লেখা ছিল এই নির্দেশ, ‘সাত নম্বর বন্দীকে গিরিখাতে ফেলে দেবেন ছাদ থেকে। এর আধ ঘন্টা আগে সব কক্ষের বাইরের জানালা খুলে দেবেন। বন্দীকে এমনভাবে ফেলবেন যেন সবক’টা জানালা থেকে তা দেখা যায়। প্রমাণ পাঠাবেন।’একটি ক্যামেরা বরাদ্দ ছিল সেই শিবিরে। ছাদে সাত নম্বর কক্ষের বন্দীকে উঠিয়ে, দুজন সার্জেন্ট দু দিক থাকে তার হাত ও পা ধরে, চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে দিয়েছিল গিরিখাতে। কমিসার ছবি তুলেছিল। ছবির ক্যাসেটটি পরে গাড়িতে রাজধানী যাবে। যাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তার নাম ছিল আলাজিয়া। শূন্য উড়ে যাবার সময় তাকে চিনতে পেরেছিল সে। আলাজিয়া যে এই শিবিরেই ছিল সেটা সে তখনই জানল। পাঁচ বছর আগে দেশের সীমানার বাইরে চলে যাবার আগে তাদের শেষ দেখা, আলাজিয়াকে তার অল্প সময় পরেই আটক করা হয়।শূন্যে উড়ে যাওয়া আলাজিয়ার হৃদস্পন্দনকে ধারন করতে চাইল সে, যদিও সেই চিন্তার বেশ কয়েক মিনিট আগে, গভীর গিরিখাতের নিচে, আলাজিয়ার শরীর অভিকর্ষজ ত্বরণে ভূপাতিত হয়েছিল চরম বেগে। ‘আমি এখনো বেঁচে আছি, হয়তো আর একটা দিন, কিংবা সপ্তাহ, মাস, একটা বছরও হতে পারে, কিন্তু একদিন আলাজিয়ার মতো আমিও উড়ব,’ এরকম একটা চিন্তা তার মস্তিষ্কের কোনো এক কোনায় জেগে উঠে মিলিয়ে যায়, কিন্তু মিলিয়ে যাবার আগে সেটা তার অনুভবকে, অস্তিত্বকে স্বচ্ছতা দেয়।দুদিন পরে তাকে আবার কমিসারের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে চেয়ারে বসিয়ে সার্জেন্টরা চলে যায়। সামনে একটা টেবিল। দশ মিনিট পরে কমিসার ঘরে ঢোকে, কিন্তু সামনের চেয়ারটায় বসে না, বরং পেছনে থাকে। পেছনে থাকে, পায়চারি করে। মিনিটখানেক পরে বলে, ‘আমি যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম এমনভাবে যাতে কেউ সেটা খেয়াল করবে না।’ এরপরে সে পেছনের জানালাটা খোলে, এই প্রথম সেই জানালাটা খোলা হলো তার উপস্থিতে। রোদ একটা চতুষ্কোণ স্তম্ভ বেয়ে তার চেয়ারের পাশে একটা উজ্জ্বল আয়াতক্ষেত্র হয়ে থাকে। এরপরে খুব দ্রুত, এত দ্রুত যে চোখের দুটো পলকের মধ্যে যে সময়টা থাকে, সেই সময়টুকুর মধ্যে, কমিসার তার বাঁ হাতটিকে ধরে টেবিলের ওপর মেলে দিয়ে, একটা চাপাতি দিয়ে কনে আঙুলটাকে হাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ঘটনাটির চকিত বিহ্বলতা এমনই ছিল যে, সে প্রথমে কোনো ব্যথাই অনুভব করল না। আঙুলটা টেবিল থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ল। অনেক সময় নিয়ে যেন পড়ল। একজন সার্জেন্ট সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে আঙুলটা মেঝে থেকে তুলে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে টেবিলের ওপরই রাখল, তারপর দ্রুত কোথা থেকে ব্যান্ডেজের কাপড় বের করে তার বাঁ হাতটা মুড়িয়ে দিল। ব্যথাটা শুরু হতে কয়েক মিনিট লাগল, তার আগে সে টেবিলেই মাথা নিচু করে বসে ছিল। এক অদ্ভুত উদাসীনতায় সে কনিষ্ঠাকে জীবন থেকে ত্যাজ্য করে দিতে চাইল, মনে করল তাতে ব্যথার উপশম হবে। ব্যান্ডেজটা লাল হয়ে যেতে থাকে। দুই সার্জেন্ট তাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়, তার চোখ খোলা ছিল। এই প্রথম সে দেখত পেল তাদের শিবিরটি কেমন দেখতে। এখানে বিলাসিতার কোনো স্থান নেই, ন্যূনতম সরঞ্জামে বানানো হয়েছে তাদের একতলার কারাগারটি। চারদিকে মরু রুক্ষতা, কিছু পাথর, দু একটি অতি উষ্ণ আবহাওয়ার গাছ। না, রাজধানী থেকে এতদূরে তার কখনই আসা হয়নি। তাকে ছয় নম্বর কক্ষে ঢুকিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় সার্জেন্টরা। একটু পরে কমিসার ঢোকে, তার হাতে একটা বাক্স। বাক্স থেকে একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ বার করে সে, একটা শিশি থেকে সিরিঞ্জে তরল ঢোকায়, তারপর তার বাহুর ওপরে সিরিঞ্জের সুঁইটা প্রবেশ করায়।এরপরে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে বাইরের করিডরে তুমুল চেচামেচিতে। একটা ভোঁতা ব্যথা মনে করিয়ে দেয় সে একটা আঙুল হারিয়েছে। দরজা খুলে যায়, দুই তরুণ, তাদের সে চেনে না। তারা উত্তেজিত উচ্ছ্বসিত। ‘আমাদের বরেণ্য নেতা, নেতা!’ তারা চিৎকার করে, তাদের আনন্দকে ধরে রাখা যাচ্ছিল না। বিছানা থেকে তারা তাকে উঠতে সাহায্য করে। বাইরে রোদে নিয়ে যায়, সেখানে অপেক্ষা করছিল আর এক নেতা – তাকে তরুণেরা ‘কাপিতান’ বলে সম্বোধন করে। চত্বরের এক কোনায় দুটি দেহ পড়ে আছে।‘বিপ্লব সফল হয়েছে,’ কাপিতানের মুখমণ্ডল গর্বে স্ফীত, ‘আপনাকে আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি।’ কাপিতানের পেছনে ছজন প্রাক্তন বন্দী, তাদের কাউকেই সে চিনতে পারল না। আলাজিয়ার মতো এরা কেউই উড়তে পারেনি। ‘আপনাকে আমরা রাজধানীতে নিয়ে যাব।’ এই সময়ে কমিসারের ঘর থেকে একটি ফোনের আওয়াজ ভেসে আসে। আর একজন তরুণ সেই ঘর থেকে বের হয়ে আসে, ‘কাপিতান, আপনাকে চাইছে, রাজধানী থেকে।’ ফোন ধরে কাপিতান আবার ফিরে আসে, তার মুখমণ্ডল গম্ভীর। ‘স্যার, নতুন পরিচালনা পর্ষদ আপনাকে এই শিবিরের কমিসার নিয়োগ করেছে। অভিনন্দন, স্যার।’ উত্তর দিতে দেরি করে না সে। ‘আমি এই পদ প্রত্যাখান করছি, আমাকে রাজধানী নিয়ে চলুন।’ ‘আমার এতে কোনো হাত নেই, স্যার। আমি বিপ্লবের ছোটো এক যোদ্ধা মাত্র।’ কাপিতান তার তরুণ সহকর্মীদের মাথা নাড়িয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করে। তারা কমিসারের ঘরে গিয়ে পুরাতন কমিসারকে বের করে নিয়ে আসে, তার হাতে হাতকড়ি, মুখাবয়বে আঘাতের চিহ্ন। ‘এই লোকটি আপনার ওপর অত্যাচার করেছে, এখন থেকে সে আপনার অধীনে,’ বলে কাপিতান। তরুণদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘একে এক নম্বর কক্ষে নিয়ে যাও।’মাথার ওপরে প্রায় সূর্য, তার তাপ বাড়তে থাকে, হাতের ভোঁতা ব্যাথাটা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। ‘আমার চিকিৎসা লাগবে,’ সে বলে। তার কন্ঠস্বর শুষ্ক। তার হাতের দিকে তাকায় কাপিতান। ‘নিশ্চয়, আমি রাজধানী গিয়েই আপনার জন্য চিকিৎসক পাঠাবো। আর আপনার জন্য একজন নতুন সার্জেন্ট রেখে গেলাম, খুব করিৎকর্মা, ও আপনাকে দেখে রাখবে।’তাকে ফিরে যেতে না করেছিল তার স্ত্রী। স্ত্রীর অনেক অনুনয় – ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া কাপিতানের গাড়িটা দেখতে দেখতে - তার এখন মনে পড়ে। পরদিন সন্ধ্যায় রাজধানী থেকে একটা বড় গাড়ি আসে, তাতে সাতজন নতুন বন্দী। তাদের জন্য বরাদ্দ হলো সাতটি কক্ষ। গাড়ির সঙ্গে আসে আটটি সাদা খাম, আটজন কয়েদীর জন্য নির্দেশনামা। গাড়িতে কোনো চিকিৎসক ছিল না। তার পরদিন সকালে পুরাতন কমিসারের সঙ্গে দেখা করতে যায় সে, কারাগারের প্রথম কক্ষে। পুরাতন কমিসার বলে, ‘চাকার পাখি কী জিনিস জানেন? সেটা হল চাকার কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত বিস্তৃত যে শলাকা, চাকার গোলাকৃতি আকার এই পাখিগুলো ধরে থাকে। তবে এই পাখিগুলোর সেরকম দাম নেই।’চাবি দিয়ে বাইরের জানালার তালাটা সে খুলে দেয়। কারাগারের ছোটো চৌখুপি জানালার বাইরে গিরিখাতের মসৃণ দেয়াল। সকালের সূর্য মসৃণ পাথরের ওপর ঝলকায়। সেই ঝলকানিতে সে জীবন খোঁজে। পুরাতন কমিসার বলে, ‘আমার ঘরে টেবিলের সর্বনিম্ন ড্রয়ার খুললে নিচে যে পাটাতন, সেটা উঠিয়ে কিছু কাগজপত্র পাবেন। আমি চলে গেলে ওইগুলো যদি একটু পৌঁছে দেন …।’ কারাগারের জানালাটি সে বন্ধ করে না। কমিসারের ঘরে ফিরে এসে সে কাগজগুলো খুঁজে পায়। সেগুলোর একটিতে লেখা, ‘আমার সুপ্রিয়া, এখানে সূর্য কিছুই ক্ষমা করে না। সেই অগ্নিগোলক তোমরা কেমন আছ, কোথায় আছ, কীভাবে আছ – এসব কোনোকিছুই আমাকে ভাবতে দেয় না। রাজধানী থেকে নির্দেশনামা পাই, সেই নিদারুণ আদেশগুলো আমাকে এমন এক অস্তিত্বে রূপান্তর করে যাকে তুমি চিনবে না। তুমি জানো এই অপরিচিত হবার মূল্য হলো আমাদের ছোটো মেয়েটির আর তোমার জীবনের নিশ্চয়তা। ওরা তোমাকে কীভাবে রেখেছে জানিনা, শুধু আশা করতে পারি এই অন্ধকার একদিন দূর হবে।…’ আর একটি চিঠির কিছু অংশ – ‘এই চিঠি হয়তো কোনোদিন তুমি হাতে পাবে। ততদিনে আমাদের মেয়ে বড় হয়ে গেছে। তুমি বুঝতে পারছ এই দূর মরুবাস থেকে আমার আর ফেরা হবে না …’চাকার পাখি, এই মরুবাস থেকে তার কি আর ফেরা হবে? গতকাল সন্ধ্যায় পাওয়া নির্দেশনামাগুলো টেবিলে পড়ে আছে। এক নম্বর কক্ষের সাদা খামটা সে আবার খোলে। ভেতরে আরো শুভ্র, আরো সাদা একটি কাগজ, তাতে লাল কালিতে টাইপ করা – ‘এক নম্বর বন্দীর বাঁ হাতের ছোটো আঙুল কেটে, প্রমাণ হিসেবে সেটি একটি ব্যাগে করে পরের গাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন।’ নতুন কর্তৃপক্ষ কি তার স্ত্রীর খোঁজ পেয়েছে? টেবিল থেকে উঠে সে ঘরের কোনায় রাখা হিমায়কটি খোলে। একটি প্লাস্টিক ব্যাগে কাপড়ে মুড়িয়ে রাখে আছে তার কনিষ্ঠা আঙুলটি। পরের গাড়িতে প্রমাণ হিসেবে সে এটা পাঠিয়ে দিতে পারে, তার আরো কয়েকটা দিন লাগবে প্রস্তুত হতে, এই মরু কারাগার থেকে পালাতে। এর মধ্যে সূর্য থেকে দূরে থাকতে হবে। সূর্য তার স্ত্রী কোথায় আছে, কীভাবে আছে তা ভাবতে দেবে না।
  • হরিদাস পালেরা...
    ভোটুৎসবে ভাট - লক্ষ্মীবাবুর নকলি সোনার টিকলি - সমরেশ মুখার্জী | এখন বড় দুঃসময়। দূষণমুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত খাদ‍্য, পরিশ্রুত পানীয় এখন অধিকাংশ‌ মানুষের ভাগ‍্যে নেই। ভাগ‍্যচক্রে আমি অতোটা দুর্ভাগা ন‌ই। তবে নিত‍্য নানান তিক্ত, খবর, পোষ্ট দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়। অথচ কিছু করার নেই। কারণ SMW বা Social Media Warrior এর ভূমিকা ছেড়ে জমিতে 'কিছু' করার জন‍্য যে সব চারিত্রিক গুণাবলী‌র প্রয়োজন - সাহস, ক্ষমতা, উদ‍্যম, নিষ্ঠা, বিশ্বাস, সমর্পণ - সেসব কিছু‌‌ই আমার চরিত্রে নেই। আমার সম্বল ভয়, সংশয়, আত্মকেন্দ্রিক‌তা। ফলে বাড়তে থাকে হতাশা, চাপ।  চাপ কমাতে  ব‌ই পড়ি। ভারী নয় - হালকা। টিভি দেখি‌না বারো বছর। নেটে দেখি ডকু, ভ্রমণ ভিডিও। কিছুক্ষণ আত্মমগ্ন হয়ে থাকতে কিছু লিখি। বৃষ্টি‌ভেজা পথকুকুরের মাথা ঝাঁকিয়ে জল ঝাড়ার মতো আমার লেখাও মনে জমা চাপ ঝাড়তে। তাতে ঋদ্ধ পাঠকের কাঙ্খিত সারবস্তু নেই। এসব নিছক আমোদিত কালক্ষেপ। Pleasurable Pastime. সুনীল বলেছিলেন, মাতৃভাষা‌র চর্চায় মগজের পুষ্টি হয়। অসংলগ্ন ভাবনা গুছিয়ে ধরার প্রয়াস আমার কাছে cognitive exercise. তাই এসব লিখি।              * * * * * * * * * *  আটাত্তরের কাছাকাছি। নিউ এম্পায়ারে লবঙ্গলতিকা‌র প‍্যাঁচের মতো তিনথাক গ্ৰীলের লাইনে ভ‍্যাপসা গরমে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কাটতে হোতো ৭৫ পয়সার টিকিট। তার‌পর সিঁড়ি ভেঙ্গে পাঁচতলা‌য় উঠে দূর থেকে কাঠের সীটে বসে সিনেমা দেখার মজা ছিল অনবদ‍্য। ওটা আদতে ছিল থিয়েটার হল - পি সি সরকার সিনিয়র‌‌ ওখানে দেখিয়েছেন ম‍্যাজি‌ক। তাই গদী আঁটা দামি টিকিটের আসন ছিল নীচে, মঞ্চে‌র কাছে। সিনেমা হলে রূপান্তরিত হতে পাঁচতলা‌র গ‍্যালারী হয়ে গেলো গরীব দর্শকের ৭৫ পয়সার স্বর্গ। ১৯৭৬ থেকে ৯০ - সেই স্বর্ণালী ১৪ বছরে ওখানে অনেক সিনেমা দেখেছি। এই প্রসঙ্গে আসছে একটা সিনেমার কথা - The Spaghetti Western Classic - The Good, The Bad and The Ugly. তখনকার হলিউডি ওয়েস্টার্ন সিনেমার পটভূমি ছিল পশ্চিম আমেরিকার টেক্সাস, আ্যারিজোনা, নেভাডা, উটা, কলোরেডো, নিউ মেক্সিকো, মন্টানা রাজ‍্যের দিগন্ত‌বিস্তারি পাহাড়ি মরু অঞ্চল। ডাকাবুকো ডাকাত, ভাড়াটে খুনি, বাউন্টি হান্টার, জেল পালানো পলাতক - অর্থাৎ আইনকে কাঁচকলা দেখানো Outlaw বা দুর্বৃত্ত‌রাই হোতো ঐ ধরনের সিনেমার প্রোটাগনিস্ট। রুক্ষ, শৈলকঠিন মুখ। পেটানো চেহারা। গায়ে বাঁটুল বা অরণ‍্যদেবের মতো সাত জন্মে না খোলা চামড়ার জ‍্যাকেট। মাইলের পর মাইল মরুপথে ঘোড়া ছুটছে ধূলো উড়িয়ে। যেন অতিপ্রাকৃত দৃশ‍্যপট। ধূ-ধূ প্রান্তরের মাঝে দ্বীপের মতো গুটিকয় ঘরের কোনো জনপদ। সেখানে এসে হাজির হয় আগন্তুক। সরাইখানা‌র দরজায় ঝোলা ঘন্টি। ঢং আ‌ওয়াজ তুলে ঢুকলো ঘর্মাক্ত কলেবরে। তারপর ম‍্যাজিক - কাউন্টারে সরাই সেবিকা ভরা বসন্তের স্বর্ণ‌কেশী। কাউন্টারে ঝুঁকে  - she shows more than what she supposed to sell. মরুভূমিতে  দৃশ্যমান মোলায়েম মরুদ্যান। মেদুর কটাক্ষে হেলায় তাকায় তারা  আগন্তুক পানে। সেই  কটাক্ষাঘাতে দূর্ধর্ষ  দস‍্যুর‌ দৃষ্টি হয়ে আসে মিয়োনো পাঁপড়ের মতো নরম।  খেলা জমে ওঠার সম্ভাবনা‌য় ৭৫ পয়সার টিকিটের ৫০ শতাংশ ওতেই উশুল। আইন শৃঙ্খলা‌র বালাই নেই। পুলিশের টিকি দেখা যায় না। তাই আত্মরক্ষার্থে সবাই রাখে বন্দুক। দস‍্যুদের হাতে তা গ‍্যাস ওভেনে খটাস খটাস করে লম্বা পিজো-ইলেকট্রিক লাইটার জ্বালানোর মতো‌‌ চলে অবলীলায়। পলক ফেলার আগেই ছোটে কয়েক রাউন্ড গুলি। সোয়াটার (flyswatter) ব‍্যাটের চপেটাঘাতে ফটাস ফটাস করে নিমেষে মরা মশার মতো হেথা হোথা ছিটকে পড়ে জলজ্যান্ত মানুষ।    সেসব দৃশ‍্য বিস্মৃত জমানার। ফ‍্যাঁও ফ‍্যাঁও করে ম‍্যারিকান বুলি‌তে কী যে তারা বলতো তখন সিকিভাগ‌‌‌ও বুঝতাম‌ না। এখন কষ্টেসৃষ্টে কিঞ্চিৎ বুঝি। তবু তখন কথা না বুঝেও দেখতাম। মজা লাগতো বেশ। হিরো, ভিলেন, সবার মাথায় ঝুলবারান্দার মতো কাউবয় হ‍্যাট। তার নীচে মরুভূমি‌র উজ্জ্বল রোদে সরু চোখের দৃষ্টি। তাতে মেশা সাপের শীতলতা বা ঈগলের ক্রুরতা। নিভে যাওয়া চুরুট ভাবলেশহীন মুখে ওষ্ঠের কোনে অনর্থক চর্বিত হয়ে চলেছে। গলায় বাঁধা ব‍্যান্ডানা। কোমরে চামড়ার খাপে ঝিমোচ্ছে বিরাট নলের রিভলবার। দেখতে মোটেও শৌখিন নয় - তবে বহু ব‍্যবহারে চকচকে। হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে বিহারী কুটির‌শিল্প -  মুঙ্গেরী 'কাট্টা' গোছের।    কিন্তু না - হলিউড ওয়েস্টার্ন সিনেমা‌য় দেখানো সে সব যন্ত্র এক একটি রত্ন বিশেষ। যেমন কোল্ট 1873 সিঙ্গল এ্যাকশন আর্মি স্পেশাল, .45 লং ব‍্যারেল কোল্ট, রেমিংটন 1858 নিউ আর্মি, কোল্ট প‍্যাটারসন, স্মিথ এ্যান্ড ওয়েসন শোফিল্ড ইত‍্যাদি। অর্ধশতাব্দীর অধিক প্রাচীন সেই সব মডেলের নির্ভরযোগ্য‌তা প্রশ্নাতীত। ঠিক‌মতো চালালে অব‍্যর্থ যমদূত। মানুষ তো ছার বেজায়গায় লাগলে ঘোড়াও জমি নিতে পারে। মজবুত কব্জি, হিমশীতল কলিজা না হলে কিলো খানেক ওজনের সেসব মারণাস্ত্র হঠাৎ খাপ থেকে তুলে চোখের পলকে চালানো সোজা কথা নয়। যেমন জন ওয়েন ঘোড়ার বসে একহাতে টুসকিতে ঘোরাতে‌ন হেভি শটগান। দক্ষিণী রজনী অমন কায়দায় সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে-আঙ্গুলে কেরামতি দেখা‌তেন। তাতেই উল্লসিত দেশী পাবলিক দিতো সিটি। অধূনা অনেকে দু আঙ্গুলে স্মার্টফোন ঘোরায়, তেমনই কায়দার ডিজিটাল ভার্সন বোধহয়।   পুলিশ পিতার দৌলতে বছর আঠারো বয়সে একদা তাঁর স্মিথ এ্যান্ড ওয়েসন পুলিশ স্পেশাল সার্ভিস রিভলবারটি দেখা‌র সুযোগ হয়েছিল। হয়তো সেটা ছিল .38 ক‍্যালিবারের মডেল 10 বা 15. কিন্তু কিলোখানেক ওজনের সেই লং ব‍্যারেল ধূসর যন্ত্র‌টির গাম্ভীর্য‌ময় ধাতব শীতলতা ছিল বেশ সমীহ উদ্রেককারী। বলেছিলাম, একবার চালিয়ে দেখবো? বাবা বুলেট বার করে বললেন, চালা। তখন একটু ব‍্যায়াম ট‍্যায়াম করতাম, তাও একহাতে তুলে চালাতে কব্জি ও আঙুলে বেশ জোর লাগলো।  বাবা বললেন, এটা এভাবে চালায় না, রিকয়েলের ঝটকায় কব্জিতে সটকা লাগতে পারে। এটা চালাতে হয় দুহাতে ধরে, এভাবে। এটা মেয়েদের হ‍্যান্ডব‍্যাগে রাখার উপযোগী পুঁচকে পিস্তল নয় যা স্বল্প দুরত্বে আত্মরক্ষায় চালাতে হতে পারে। এটা আরক্ষাকর্মীদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আক্রমণের উদ্দেশ্যে নির্মিত। তাই তাক করে চালাতে পারলে ৫০ ফুট দুরে‌‌ও কোনো  পলাতক দুর্বৃত্ত ধরাশায়ী হতে পারে।  এখন নেট ঘেঁটে দেখলাম এর গুলি বেরোয় প্রায় ১০০০ ফুট/সেকেন্ড গতিতে। অর্থাৎ ৫০ ফুট দুরত্ব অতিক্রম করতে সময় নেবে ০.০৫ সেকেন্ড। মানুষের চোখের পলক ফেলার সময় ০.১০ সেকেন্ড। অর্থাৎ চোখের পাতা পড়ার অর্ধেক সময়ে ৫০ ফুট দুরে পলাতক ঘায়েল হবে। শুধু বুলেট গায়ে লাগা চাই। অভ‍্যাসে‌র অভাবে পুলিশের গুলি এদেশে প্রায়শই লাগে ফুটপাতে হাঁটা বালকের গায়ে। ডাকাত পালায় পাঁচিল টপকে।  তবে .38 পুলিশ স্পেশালের গুলি ৩০০ ফুট দুরত্বে‌‌ও কারুর গায়ে লাগলে‌ বেশ জখমের সম্ভাবনা। রাইফেলের গুলি পেড়ে ফেলতে পারে ১৬০০ ফুট দুরে কাউকে। টেলিস্কোপিক সাইট লাগানো হাই ক‍্যাপাসিটি স্নাইপার বা এ্যান্টি মেটেরিয়াল ব‍্যালাস্টিক রাইফেল তো ২কিমি দুরে কাউকে শু‌ইয়ে দিতে পারে চিরনিদ্রায়। এখনো অবধি সর্বাধিক দূরত্বে ঘায়েল করার রেকর্ড ২.৪৭ কিমি। তার গুলি‌ বেরোয় ৬৫০০  ফুট/সেকেন্ড গতিতে। দু কিমি দুরে কাউকে শোয়াতে সে বুলেট সময় নেবে মাত্র ১ সেকেন্ড। দুগ্গা দুগ্গা! প্রসঙ্গত বলি, এযাবৎ যাত্রী‌বাহী বিমানের সর্বাধিক গতির রেকর্ড আছে ব্রিটিশ এয়ার‌ওয়েজের অধুনালুপ্ত সুপারসোনিক কনকর্ড বিমানের - ঘন্টা‌য় ২১৮০ কিমি. এযাবৎ তৈরি সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্নাইপার রাইফেলের বুলেটের গতিবেগ সে জায়গায় ঘন্টা‌য় ৭১৫০ কিমি - কনকর্ড বিমানের ৩.৩ গুণ।      একদা ওয়েস্টার্ন ছবিতে দাপিয়ে বেরিয়ে‌ছেন ক্লিন্ট ইস্ট‌উড, জন ওয়েন, হেনরী ফন্ডা, ওমর শরীফ, বার্ট ল‍্যাঙ্কাস্টার,  চার্লস ব্রনসন, টেরেন্স হিল, বাড স্পেন্সার, জেমস কোবার্ন, এলি ওয়ালচ্, লী ভ‍্যান ক্লীফ, বার্ট রেনল্ডস, রোনাল্ড রেগন (আমেরিকার চল্লিশ‌তম রাষ্ট্রপতি হ‌ওয়া‌র আগে জীবনের শুরুয়াতি পর্বে) এবং কিয়দংশে গ্ৰেগরী পেক্, হামফ্রে বোগার্ট, ট‍্যালি স‍্যাভালস্, স্টিভ ম‍্যাকুইন, ইয়ুল ব্রে‌ইনারের মতো অন‍্য গোত্রে‌র অভিনেতা‌রা‌। সে তুলনায় সেই সব ছবির অভিনেত্রী‌কুল -  আমান্ডা ব্লেক, র‍্যাকোয়েল ওয়েল্চ, কেটি জুরাডো, রোন্ডা ফ্লেমিং, ডোনা রীড, ক্লেয়ার ট্রেভর - আপামর দর্শকদের স্মৃতি‌তে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেন নি।    স্প‍্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন সিনেমা বলতে বোঝাতো সেই‌সব ওয়েস্টার্ন ছবি যার মূল কলাকুশলীরা - প্রযোজক, পরিচালক, সম্পাদক, সঙ্গীত‌কার, ক‍্যামেরা‌ম‍্যান‌ হতেন ইতালিয়ান। যদিও বিশ্বের বাজারে বাণিজ্য করতে সেসব ছবির নায়ক নায়িকা হতেন মূলত হলিউডি। হলিউডে প্রতিষ্ঠিত ইতালিয়ান অভিনেতা‌ও ছিলেন - টেরেন্স হিল, বাড স্পেন্সার, (Django খ‍্যাত) ফ্রাংকো নিরো ইত্যাদি। সে সব ছবি নির্মিত ও বিশ্ব বাজারে বিতরিত হোতো  বিখ্যাত সব হলিউড প্রোডাকশন হাউস দ্বারা যেমন ওয়ার্নার ব্রাদার্স, এমজিএম, ইউনিভার্সাল পিকচার্স, কলম্বিয়া পিকচার্স, ইউনাইটেড আর্টিস্ট‌স্ ইত্যাদি। এসব ছবি ইংরেজি‌তে হলেও ইতালিয়ান, স্প‍্যানিশ, জার্মান ভাষায় ডাবিং বা সাবটাইটেল দিয়ে তৈরী হোতো তার মাল্টিলিঙ্গুয়াল ভার্সন। The Good, The Bad and The Ugly নির্মিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। পরিচালনায় ডিপ ক্লোজআপ ও লং ডিউরেশন শটের সাহায্যে সিচুয়েশন তৈরীতে সিদ্ধহস্ত বিখ্যাত ইতালিয়ান পরিচালক - সের্গি‌ও লিওন। পদবী‌টা চেনা চেনা লাগছে?  সানি লিওনের দৌলতে সেটা স্বাভাবিক তবে সের্গেইয়ের সাথে সানির কোনো যোগসূত্র‌ নেই।  সানি কানাডা প্রবাসী এক শিখ মেয়ে - করণজীৎ কৌর ভোরা। সানি তার ডাক নাম। ছোট থেকে খেলাধুলা‌য় উৎসাহী, টমবয় স্বভাবের সানি রাস্তায় ছেলেদের সাথে হকি খেলতো। এগারো বছরে পেলো প্রথম চুম্বনের স্বাদ। ষোলো বছরে এক বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের সৌজন্যে খেলাচ্ছলে‌ হারালো কুমারী‌ত্ব। একুশে পা দিয়ে ২০০১ সালের মার্চের পেন্টহাউস পত্রিকার প্রচ্ছদে নূন‍্যতম আচ্ছাদনে অপরিণত সম্পদে হাজির হয়ে‌ই পেলো 'পেন্টহাউস পেট' খেতাব। যেমন প্লেবয় ম‍্যাগাজিনে আবির্ভূতা মডেল‌রা পায় 'প্লেবয় প্লেমেট' তকমা। ২০০৭ সালে সানি বাণিজ্যিক প্রয়োজনে কৃত্রিম উপায়ে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হোলো। যেমন অধূনা হোয়াটস‌এ্যাপ ফরোয়ার্ডে‌ড পোষ্ট পড়ে (বা না পড়েই) সমৃদ্ধ হয় নেটিজেন। ২০১২তে পূজা ভাটের 'জিসম-2' দিয়ে বলিউডে হোলো সানি‌র সাহসী আত্মপ্রকাশ। ভূতপূর্ব জীবিকা পরিত্যাগ করে প্রাচুর্যময় প্রতিস্থাপিত উপস্থিতিতে বলিউডে নিজেকে নবরূপে উদ্ভাসিত করায় সানি‌র নিষ্ঠা ও শৈলী প্রশংসনীয়।  সানি‌র স্বামী ড‍্যানিয়েল ওয়েবারের সংস্কারহীনতা মধ‍্যবিত্ত মানসিক‌তায় অনুধাবনের অতীত।  সানি‌র লিওন পদবী‌টি দেন পেন্টহাউস পত্রিকার তদানীন্তন মালিক বব গুচ্চিয়ন। হয়তো তাঁর পদবী‌র শেষাংশে‌র সাথে সমধ্বনীয় সাযুজ‍্যে - গুচ্চিয়ন - লিওন। এই আর কী। ইতালিয়ান পরিচালক সের্গেই লিওনের সাথে সানি লিওনের কেবল এটুকুই যোগসূত্র - এক পদবী‌তে।   ফিরে আসি সের্গেই‌তে । তিনি বানিয়ে‌ছিলেন দুটি ট্রিলজি। প্রথমটি 'ডলার ট্রিলজি'। পরে 'ওয়ান্স আপন এ টাইম ট্রিলজি'। ডলার ট্রিলজির প্রথমটি ছিল A Fistful of Dollar (১৯৬৪)। দ্বিতীয়‌টি For a Few Dollars More (১৯৬৫) এবং শেষে ঐ TGTBATU (১৯৬৬). আগের দুটি ছবি তখন কেবল ইতালি‌তে মুক্তি পেয়েছে। দুটি‌তেই মুখ‍্য ভূমিকা‌য় ছিলেন ছ ফুট চার ইঞ্চির সুপুরুষ ম‍্যাচো ম‍্যান - ক্লিন্ট ইস্ট‌উড। প্রথম ছবিটি‌ আমেরিকা‌য় মুক্তি পাবে ১৯৬৭তে।   তবে তার আগে‌ই সের্গি‌ও বানাতে  চাইলেন ট্রিলজির শেষ ছবি - TGTBATU. ছবির বাজেট মাত্র ১২ লক্ষ ডলার - বাস্তবিক‌ই fistful - মুষ্টিমেয়। কিন্তু ততদিনে ক্লিন্ট বুঝে গেছেন নিজের বাজার‌দর। তাই চেয়ে বসলেন আড়াই লক্ষ ডলার - ছবির বাজেটের ২০% (আজকের দিনে ভারতীয় মূদ্রা‌য় প্রায় ৫০ কোটি টাকা) এবং আমেরিকা‌য় প্রদর্শনের লভ‍্যাংশের ১০%. কিঞ্চিৎ অসন্তুষ্ট হলেন সের্গেই। কিন্তু চাই তার ক্লিন্টকে‌ই - কারণ The Good চরিত্র যা ভেবেছেন, তাতে তিনি নিশ্চিত - ক্লিন্ট মাত করবে বক্স অফিস। তাই রাজী হয়ে গেলেন। পরিচালকের মুন্সীয়ানা, চমৎকার ওয়াইড স্ক্রিন ক‍্যামেরা‌র কাজ, সঙ্গীত পরিচালক এন্নিও মরিকনের অপূর্ব আবহ সঙ্গীত - পর্দায় ক্লিন্ট ও লী ভ‍্যান ক্লীফের চুম্বকীয় উপস্থিতি‌ - সব মিলিয়ে এক ডেডলি প‍্যাকেজ।    ক্লিন্টের এই ডলার ট্রিলজি‌র সাফল্য‌ই তাকে ১৯৭১ এ প্রতিষ্ঠিত করে আইকনিক 'ডার্টি হ‍্যারি' চরিত্রে। যার রেশ চলে ১৯৮৮ অবধি বিভিন্ন নামে মোট পাঁচটি ছবির সিরিজে। চতুর্থ‌টির পরিচালক‌ও ক্লিন্ট। ছবিতে তিনি সানফ্রানসিস্কো পুলিশ বিভাগের নির্ভীক এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট - হ‍্যারি ক‍্যালাহান। মুম্বাই ক্রাইম ব্রাঞ্চের রিয়েল লাইফ এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট দয়া নায়কের ওপরে তৈরি হয়েছিল 'অব তক ছপ্পন' সিনেমা। তাতে ইন্সপেক্টর সাধু আগাসের চরিত্রে ফাটিয়ে দিয়ে‌ছেন নানা। পরে ডলার ট্রিলজির প্রযোজকের বিনিয়োগ‌ও ফিরে এসেছে বহুগুণ হয়ে। সের্গেই বিখ্যাত হলেন Godfather of Spaghetti Western Movies হিসেবে।   ১৮৬২ সালে আমেরিকা‌ন সিভিল ওয়ারের পটভূমি‌কায় তৈরি কাহিনী‌ TGTBATU ছবির শেষে আছে একটি গোলাকার সমাধিক্ষেত্রের দৃশ‍্য - টানটান ক্ল‍্যাইম‍্যাক্সে ত্রিমূর্তীর মধ‍্যে সংঘটিত হবে ক্ল‍্যাসিক 'মেক্সিকান স্ট‍্যান্ড‌অফ' দৃশ‍্য। তাতে আহবান জানায় ক্লিন্ট (Good)। ডাকুদের মধ‍্যে অলিখিত নিয়মে পুরুষোচিত অহংকারে তাতে সাড়া দিতেই হয় লী ভ‍্যান ক্লীফ (Bad) এবং নিরুপায় হয়ে এলি ওয়ালচ্‌কেও (Ugly). ক্ল‍্যাসিক ব্রিটিশ ডুয়েল হোতো দুজনের মধ্যে যাতে দুজন বা একজনের মরার সম্ভাবনা অবধারিত। মেক্সিকান স্ট‍্যান্ড‌অফে সাধারণত তিনজন বন্দুকধারী নিজেদের মধ‍্যে হিসাব বরাবর করতে ১২০ ডিগ্ৰি কোনে দাঁড়িয়ে একে অপরকে মাপতে থাকে‌। যে আগে বন্দুক তুলবে সেই জ্বালবে স্ফুলিঙ্গ।   ছবিতে Sad Hill Cemetery নামে পরিচিত ঐ সমাধিক্ষেত্র‌টি সেই ১৯৬৬ সালে‌ই স্পেনের বুর্জোস প্রদেশে স্প‍্যানিশ সৈন‍্যদের দিয়ে পয়সার বিনিময়ে তৈরি হয়েছিল শুধুমাত্র ঐ একটি দৃশ্যে‌র জন‍্য। দৃশ‍্যটি আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি। এমন দীর্ঘায়িত নাটকীয় সাসপেন্স সৃষ্টিতে সের্গি‌ও ছিলেন বিখ‍্যাত। সিনেমা‌টির দৈর্ঘ্য‌ও তাই চার ঘন্টা।  (দৃশ‍্য‌টার লিংক র‌ইলো শেষে)।    শুটিংয়ের পর ঝোপঝাড় কেটে বানানো নকল সমাধিক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত হয়। ক্রমশ প্রকৃতি আবার অধিকার করে নেয় তাকে। তবে পৃথিবী‌ব‍্যাপী TGTBATU ফ‍্যানদের স্বেচ্ছা দানে স্পেনের The Sad Hill Cultural Association ২০১৭ সালে - মানে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর - বিস্মৃত, জঙ্গলাকীর্ণ সেই শ‍্যূটিং স্পটটি আবার খুঁজে বার করে। সাফ সাফাই করে সেটাকে রূপান্তরিত করে একটি নস্টালজিক পর্যটন‌স্থলে। পাঁচ দশক পরেও একটি পাতি এ্যাকশন সিনেমার প্রতি ফ‍্যানেদের এমন হৃদয়ের টান বেশ আশ্চর্য‌জনক।   ১৯৭০ সালে শোলে ছবির কাহিনী‌কার সেলিম-জাভেদ যে তিনটি ছবি থেকে সবিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন তার একটি ছিল সের্গেই লিওন পরিচালিত 'Once upon a time in the West' - মূখ‍্য ভূমিকা‌য় হেনরি ফন্ডা ও চার্লস ব্রনসন। সে ছবির কাহিনী নির্মাণে সের্গেই‌য়ের সাথে যুক্ত ছিলেন আর এক দিকপাল ইতালিয়ান পরিচালক - বার্নার্দো বেত্রোলুচি। বাকি দুটি ছবি কুরোশোয়ার 'Seven Samurai' ও জন স্ট্রাজেসের 'The Magnificent Seven'. রাজ কুমার সন্তোষীর 'China Gate' ছবিতে‌ও The Magnificent Seven এর সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ‍্য করা যায়।    শোলের শ‍্যূটিং‌য়ের জন‍্য‌ও ব‍্যাঙ্গালোর থেকে মাইশোরের পথে ৫০ কিমি দুরে রামনগরে হাইওয়ে থেকে ভেতরে ছবির প্রয়োজনে তৈরী হয়েছিল এক গ্ৰাম। প্রায় আড়াই বছর ধরে শ‍্যূটিং চলাকালে সেই অস্থায়ী গ্ৰামের নাম হয়ে গিয়েছিল 'সিপ্পি নগর'। স্থানীয় কিছু লোক কাজ পায়। তাদের দেখা গিয়েছিল সিনেমার পর্দায় গ্ৰামবাসী হিসেবে। ওখানেই জলের ট‍্যাঙ্কের ওপরে চড়ে  ধর্মেন্দ্র‌ করেছি‌লেন সেই বিখ্যাত সুইসাইড নাটক।    কাছেই রামদেবরা টিলায় হয়েছিল গব্বরের ডেরা। সেখানে আমজাদ রাগে গরগর করতে করতে হুঙ্কার ছেড়েছিল - আরে, এ সাম্বা, কিতনা ইনাম রখ্খে হ‍্যায় রে সরকার হম পর? খাড়া গ্ৰানাইট পাথরের টঙে পা ঝুলিয়ে বসে সাম্বা বলেছিল - পুরা পচাশ হাজার, সরকার। এসব সংলাপ এখন কিম্বদন্তীপ্রায়। এখন সেই শোলে গাঁওয়ের  কোনো অস্তিত্ব নেই সেখানে। সে জায়গা এখন বন‍্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ‌দের কাছে অন‍্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ। "রামদেবরা বেট্টা ভালচার স‍্যাংচুয়ারী" এখন বিলুপ্ত‌প্রায় ভারতীয় শকুনের সংরক্ষণের জন‍্য একমাত্র ঘোষিত ESZ (Notified Eco Sensitive Zone).  অবশ‍্য ভারতের নানা জায়গা এখন ঘাস, ফুল, পদ্ম শোভিত এবং গদা, তরোয়াল, ত্রিশূল আন্দোলিত অন‍্য জাতীয় শকুনের মুক্তাঞ্চল - কেবল তাদের ডানা নেই বলে চট করে চেনা যায় না। তবে খুবলে নিলে টের পাওয়া যায়।    তো যা বলছিলাম। সেই সমাধিক্ষেত্রের শেষ দৃশ‍্যে ক্লিন্ট ইস্ট‌উড এলি ওয়ালচ্‌কে একটা বিলিয়ন ডলার ডায়লগ ঝাড়ে - “You see, in this world, there’s two kinds of people, my friend. Those with loaded guns and those who dig. You dig.” কিন্তু what to dig? সিনেমা‌য় তা একটি বিশেষ কবরের নীচে লুক্কায়িত গুপ্তধন। বাস্তবে ক্ষমতাসীন‌দের শোষণে তাদের জন‍্য সম্পদ আহরণে নিম্নবর্গীয় মানুষের আমৃত্যু খুঁড়ে যাওয়া নিজেদের কবর। অথবা নির্মাণ করা নিজেদের জেল। যেমন আসামের দিনমজুর সরােজিনী হাজং। তিনি নিজেই নিজের জন্য বানাচ্ছেন জেল। সরােজিনীর মত অনেক দিনমজুর আসামে ডিটেনশন ক্যাম্প নির্মানে পেটের দায়ে ঘাম ঝড়াচ্ছেন, যাঁদের নাম আসামে চুড়ান্ত NRC তালিকা থেকে বাদ গেছে। তৈরী হলে ওখানেই স্থান হবে সরোজিনী‌দের।   ১৯৭৩ সালে আমেরিকা‌য় প্রতিষ্ঠিত হয় Grammy Hall of Fame. এখানে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন‍্য প্রতি বছর কিছু বাছাই করা উচ্চমানের বা ঐতিহাসিক‌‌ গুরুত্ব আছে এমন সঙ্গীত, বাদ‍্য, কন্ঠস্বর বা বক্তৃতা সংরক্ষণের জন‍্য মনোনীত হয়। তবে তা হতে হবে অন্ততপক্ষে ২৫ বছরের প্রাচীন - অর্থাৎ অবশ‍্য‌ই থাকতে হবে তার enduring appeal. অনেক নমিনেশনের মধ‍্যে বিশেষজ্ঞ‌দের ভোটাভুটির মাধ‍্যমে নির্বাচিত হয় অল্প কিছু।  এভাবেই এখানে সংরক্ষিত হয়েছে টমাস আলভা এডিসনের ১৮৭৮ সালের রেকর্ডিং, ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের "I have a Dream" বক্তৃতা। বব ডিলান, বীটলস, এলভিস প্রেসলি, পল রবসন, বব মার্লে, ফ্রাংক সিনাত্রা, ইহুদি মেনুহিন, জন ডেনভার, এলটন জন, জন লেনন, সাইমন ও গারফাঙ্কেলের 'সাউন্ড অফ সাইলেন্স', বার্‌বারা স্ট্রেসান্ড্ ও এমন নানা দিকপাল গায়ক, বাদ‍্যকার, বাগ্মী‌র রেকর্ডিং। এখানে আছে ১৯৫৬ সালে হিচকক্ পরিচালিত - মুখ‍্য ভূমিকা‌য় জেমস স্টূয়ার্ট ও ডোরিস ডে অভিনীত - The Man Who Knew Too Much সিনেমা‌য়  শেষ দৃশ‍্যে ডোরিসের স্বকণ্ঠে গাওয়া বিশ্ববিখ্যাত গান - Que Sera Sera - Whatever will be, will be গানটি, যার মর্মার্থ - বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই প্রযোজ্য - যা হবার, তাই হবে। (অহেতুক ভেবে কী হবে)। কিন্তু Grammy Hall of Fame এর অবতারণার কী হেতু? একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে এই গরুর রচনায় - সানি লিওন থেকে গ্ৰ‍্যামী হল অফ ফেম - কোনো প্রসঙ্গ‌ই সম্পূর্ণ সম্পর্কবিযুক্ত নয়। প্রতিটি প্রসঙ্গের দড়ি‌ই কোনো না কোনোভাবে একটি মুখ‍্য গরু‌র গলায় বাঁধা - শেষবেষ ঘুরে ফিরে - 'সেই ঘাস গরু খায়' - করে প্রসঙ্গ আবার ফিরে আসবেই সেই গরুতে। এখানে সেই গরুটি TGTBATU. এ ছবিতে সের্গেই‌য়ের প্রতিটি ছবির সঙ্গীত পরিচালক এন্নি‌ও মরিকনের একটি অনবদ‍্য থিম টিউন ছিল, যেটি পরে আইকনিক হয়ে যায়। সেটা আমি বহুবার শুনেছি - হয়তো অনেকেই শুনেছে। (তবু ড‍্যানিশ ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রা কর্তৃক সেটার রিক্রিয়েশনের ভিডিও লিংক র‌ইলো শেষে। অবাক হয়ে গেছি দেখে - একটি সিনেমার টিউন তৈরিতে এতো হ‍্যান্ডস লাগে!)   এন্নিও ছিলেন উঁচু দরের কম্পোজার। দীর্ঘ সঙ্গীত‌জীবনে তিনি ৭০টি পুরস্কার‌প্রাপ্ত সিনেমা‌য় ও টিভিতে প্রায় চারশো‌টি স্কোর ও একশোটি ক্ল‍্যাসিক সিম্ফনি কম্পোজ করেছেন। নিজে ছিলেন দক্ষ ট্রাম্পেট বাদক। TGTBATU সিনেমার সেই টিউনটি তাঁর পরিচালনায় পরিবেশন করে প্রাগ সিটি ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার শিল্পী‌বৃন্দ। এন্নি‌ও পান ইতালির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান - OMRI (Order of the Merit of the Italian Republic) - যা আমাদের দেশের ভারতরত্ন সদৃশ।  সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ‌টি ৬.৭.২০২০- পতনজনিত আঘাতে মারা যান ৯১ বছর বয়সে। তাঁর সুরকৃত TGTBATU সিনেমা‌র সেই বিখ‍্যাত থিম টিউনটি গ্ৰ‍্যামী হল অফ ফেমের (GHF) অন্তর্ভুক্ত হয় ২০০৯ সালে। এবার  হয়তো পাওয়া গেল GHF এর সাথে TGTBATU নিয়ে এই বাঁজা রচনার যোগসূত্র।   এই বাঁজা রচনায় আমি খাল বিল থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আমার হালহীন মনপানসি ইচ্ছা‌মতো ভাসিয়ে এমন ঘন্ট পাকিয়েছি যে মনযোগী পাঠক‌ও হয়তো এযাবৎ পড়ে খেই হারিয়ে ভুলে যেতে পারে এ লেখার শিরোনামে‌র তিলমাত্র তাৎপর্য তো এখনো অবধি বোঝা গেল না? চিন্তা নেই। এবার আসবে।    সেদিন আবার শুনছিলাম ভি শান্তারাম প্রযোজিত ও পরিচালিত 'জল বিন মছলি নৃত‍্য বিন বিজলী' সিনেমা‌য় মুকেশের কণ্ঠে আমার প্রিয় একটি গান - 'তারো মে সজকে'। বহুবার শুনে‌ও সাধ না মেটা অনেক গানের একটি।  ১৯৫৩ সালে সোহরাব মোদী প্রযোজিত, পরিচালিত 'ঝাঁসি কি রাণী'  ছিল ভারতে নির্মিত প্রথম টেকনিকালার ছবি। ১৯৭১ সালে 'জবিম-নৃবিবি' সিনেমার প্রতিটি গান স্টিরিওফোনিক সাউন্ডে রেকর্ড করে শান্তারাম‌ও করূছিলেন আর এক রেকর্ড। রিমিক্সিং করেছিলেন মঙ্গেশ দেশাই, শান্তারামের‌ রাজকমল কলামন্দির স্টুডিও‌তে।    মজরুহ সুলতানপুরীর সরল সুন্দর কথা। লক্ষীকান্ত প‍্যারেলালের অনবদ‍্য সুর। সেই গানের শুরুতে (prelude) এবং মাঝে (interlude) TGTBATU সিনেমার সেই আইকনিক থিম টিউনটির সিগনেচার শিসটি এই গানে হুবহু ব‍্যবহৃত হয়েছে। তাই এই লেখার শিরোনাম 'লক্ষীবাবুর নকলি সোনার টিকলি'। চৌরঙ্গী, এলগিন, মুন্সীবাজার রোডে গেলে দেখা যাবে পর পর কয়েকটি  'লক্ষী বাবুকা আসলি সোনা চাঁদি‌কা দোকান'। সবকটি‌ই প্রথম, একমাত্র এবং আসল। এই গানে ঐ শিস লক্ষ্মীদা জুটি প‍্যারসে নিজেদের  বলে চালিয়ে দিয়েছেন নাকি ভদ্রতার খাতিরে এন্নি‌ও‌র প্রতি অন্তত রোলিং ক্রেডিটে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন, জানা নেই।   প্রতিমা‌র মতো সুন্দর কপালে একটি ঝলমলে টিকলি ঝুললে ভালো‌ই লাগে দেখতে। তবে তা না থাকলেও অসুন্দর লাগে না। 'তারো মে সাজকে' গানটি‌ও তেমন। ঐ টিউনটি গানে অবশ্যই যোগ করেছে এক মনোহর মাত্রা। তবে তা না থাকলেও গানটি ভারতীয় আমেজের সুন্দর সুরের জন‍্য মোটেও খারাপ লাগতো না। মুকেশের গায়কীর গিটকিরি তো কান-মন জুড়ানো।   লক্ষীকান্ত‌-প‍্যারেলাল জুটি সুরকৃত গানে ঐ টুকলি করা টিউনে‌র টুকরোটা‌ই এই গরুর রচনার প্রেরণা। তাই শিরোনামে জ্ঞাপন করেছি কৃতজ্ঞতা। তবে শেষ অবধি না পড়লে তা বোঝা সম্ভব নয়। এই টুকলির কথা জেনেছি তিন দশক আগে।  দুঃসময়ে ছোট্ট স্ফূলিঙ্গ জোগায় অবান্তর রচনা লেখার প্রয়াসে আত্মমগ্নতায় ডুবে থাকা‌র দাওয়া‌ই। লেখার মশলা সংগ্ৰহকালে জানতে পারা যায় নানা আনন্দময় তথ‍্য। পলায়নবাদীরা এভাবে‌‌ও এড়িয়ে থাকতে পারে বিষাক্ত বর্তমানে‌র অভিঘাত। 
    চান রাত!  - মহম্মদ সাদেকুজ্জামান শরিফ | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়ইদের আসল মজা কখন? বয়স্ক মানুষ, বাড়ির মা খালাদের খবর জানি না, বাকি সবার সম্ভবত একটাই রা হবে, তা হচ্ছে ইদের আগের রাত মানে চান রাত! কোন কথা হবে না, সবাই মেনে নিবে যে আসল মজা আগের রাতেই। কী হয় এই রাতে? কিচ্ছু না, স্রেফ গুলতানি মারা চলে, লম্বা আড্ডা চলে। এই দিন সবাই দেরি করেই বাড়ি ফিরবে এইটা অলিখিত আইন। আড্ডার মধ্যেই আগামী দিনের নীতি নির্ধারণ হয়ে যাচ্ছে, নতুন কিছুর ইঙ্গিত তৈরি হচ্ছে, প্রেমের চাবি নাড়াচাড়া হচ্ছে, প্রাণ খোলা হাসি হচ্ছে! এই রাতে মন খারাপের কোন জায়গা নেই। মা খালাদের কথা জানি না কেন বললাম? কারণ এই রাতে তাঁদেরকে প্রচুর খাটাখাটনি করতে হয় ইদের প্রস্তুতি হিসেবে। তাই তাঁদের চান রাত খুব মজায় কাটবে এইটা সম্ভবত বেশি বেশি কল্পনা। তাই জানি না বললাম। কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণী, সবারই একই রকম অনুভূতি হবে। মেয়েরা হাত ভরতি করে মেহেদি দিচ্ছে, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি দৌড়াদৌড়ি চলছে। কারণ মেহেদি শিল্প হাতে গোনা দুই একজনই পারে, আর চান রাতে তাকে ঘিরেই বসে থাকে বাকিরা। উপগ্রহের মতো ঘুরপাক খেতে থাকে এরা যতক্ষণ না পর্যন্ত হাত মেহেদি দিয়ে পূর্ণ হচ্ছে। আবার আমাদের আড্ডায় ফিরি। ইদ যেহেতু আলাদা করে উদযাপনের কিছু না। সকালে ইদের নামাজ পড়লেই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যায়। তাই খাওয়া, আড্ডা, বেড়ানো আর ঘুম ছাড়া ইদের ছুটিতে আর কিছুই করা হয় না। বিশেষ করে রোজার ইদে। চান রাতে ছুটির কয়দিন কী করে কাটানো যায়, কী করা যায় এর পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি সময় যায়। যেমন এবার সারাদিন শুরু করে মধ্য রাত পর্যন্ত আমাদের কাটছে ইদের পরদিন কী করা যায় এই সলাপরামর্শ করেই। স্থান নির্বাচন হয় তো মানুষ হয় না, মানুষ, স্থান হয় তো যানবাহন মিল হয় না। ঠ্যালা ধাক্কা, ধুর শালা সব বাদ! এই চলছে, চলতে চলতে দেখি ঘড়িতে রাত বারোটা! শেষ পর্যন্ত কী করলাম, কী হইল, ছাতু মাখাইলাম গু হইল... যাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তাঁদের আমাদের মতো এমন সৌখিন চিন্তা ভাবনা করার ফুসরত নাই। শেষ মুহূর্তে কেনাকাটার হিড়িক লাগে কেন জানি। কিছু মানুষই আছে যারা কোন অজ্ঞাত কারণে সারা মাস কেনাকাটার আশপাশ দিয়েও যেতে রাজি না। প্রথম থেকেই নিয়ত পাকা যে তিনি যাবেন চান রাতেই! কেউ কেউ তো এমনও বলে যে চান রাত ছাড়া শপিং করে মজাই পাওয়া যায় না। কেউ চান রাত ছাড়া আবার ইদ শপিং হয় না কি? এমন প্রশ্নও করে। তো এই খদ্দেরদের জন্য চান রাতে চলে ভোর পর্যন্ত জমজমাট কেনাকাটা। রাত একটা দুইটা তিনটা যেন সন্ধ্যা রাত! ঢাকায় কোন দিন ইদ করা হয়নি। কিন্তু বন্ধুদের অনেকের কাছেই শুনেছি যে ঢাকায় চান রাতের জৌলুসের সাথে কোন কিছুর তুলনাই হয় না। দেড় দুই কোটি মানুষ চান রাতের আগে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। ঢাকা হাঁফ ছেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বের হচ্ছে তারা চলে ফিরে, দেখে শুনে, কিনে না কিনে আলাদা সুখ পাচ্ছে। ঢাকার জ্যাম ঘাম গরম যে দেখছে সে চান রাতে না থাকলেও অনুমান করতে পারে যে কতটা হালকা লাগছে সবার এই দিন! তবে সবার সমান না। শেষ মুহূর্তেও যারা কিছুই কেনাকাটা করতে পারে নাই আপনজনের জন্য তাঁদের চান রাত এক বিভীষিকার নাম! আমার জীবনে আমি এমন বেশ অনেক ইদ করছি যে ইদে একটা সুতাও কেনা হয়নি আমার জন্য। এমন বহু ঈদ কেটেছে যে কোন একটা দেওয়া হবে আমাকে এইটা আগেই বলা হয়েছে! হয় শুধু জুতা, না হয় শুধুই প্যান্ট বা শার্ট! আপদমস্তক নতুন, ইদের জন্য কেনা এইটা সম্ভবত বহু বহু পরে কপালে জুটেছে। তখন যখন নতুন কিছু না হলেও সমস্যা না, যখন জানি নতুন জামা কাপড়ে ইদ নাই, পুরোটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। যাই হোক, অপ্রাপ্তির ওই চান রাত গুলি কীভাবে কাটিয়েছি এখন চিন্তা করলে বুঝি যে কতটা কঠিন অনেকের জন্য এই রাত। এই বোধটা আমাকে উদার হতে শিখিয়েছে। হাত খুলে সাহায্য করতে শিখিয়েছে। ইদটা যেন সবার জন্য আনন্দের হয় এইটা ভাবতে শিখিয়েছে। এখন আমাদের একটা ফাউন্ডেশন হয়েছে, ওইখান থেকে এমন সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ইদের জন্য নানা সাহায্য করছে। এগুলা আলাদা তৃপ্তি দেয়। আরও কিছু মানুষের জন্য চান রাত অভিশাপ! যারা আপনজন হারিয়েছে! সবার সমান অনুভূতি হবে না আমি জানি। কিন্তু আমি আমার খবর জানি। চান রাতের ফুর্তি শেষ হচ্ছে যতক্ষণ সবার সাথে আছি ততক্ষণ। যখন বাড়ির পথে আগানো শুরু করছি তখন থেকে প্রতিটা পদক্ষেপ আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি যেখানে ফিরছি সেখানে যারা আমার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যকে যারা আলোকিত করে রেখেছিল, যারা কিছু নাই নাই করেও রঙিন করে দিয়ে গেছিল আমার ইদ গুলি তাঁরা কেউ নাই! আমার মা, যে খুব সাদাসিধে কিছু পদ রান্না করত ইদের দিন, সেই সামান্য আয়োজনই সম্ভবত স্বর্গীয় কোন উপদান ব্যবহার করে তৈরি করত। হয়ত আঁচল থেকে গোপনে মিশিয়ে দিত কোন জাদুকরী উপদান! হাতের স্পর্শে হয়ত পরশ পাথরের মতো কিছু ছিল, যার স্পর্শে সামান্য সেমাই হয়ে উঠত অমৃত! কাঁচা চুলায় রান্নার সময় আগুন ধরানোর জন্য বাঁশের চোঙায় যখন মা ফু দিত তখন হয়ত সেই ফুঁয়ের সাথে মিশে আম্মার অদ্ভুত স্নেহ, আদর্শ, ভালোবাসা, আর যার ফলে তৈরি হয় ইদের নানান বেহেশতি খাবার, যা আমাদের এখন পর্যন্ত বিস্ময়, এখন পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে বসে থাকি আমি। আমি জানি ভোরে সব সময়ের মতো, যা ছিল আশৈশবের সেরা স্মৃতি। আব্বা আমাদের ঘুম থেকে উঠার অনেক আগেই গোসল করে তৈরি হয়ে গেছেন, আতরের গন্ধ নাকে আসছে যেন এখনও, যা আর কোনদিন আসবে না। আমি জানি নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে আর কোনদিনই আম্মা আব্বাকে ইদের সালাম করা হবে না। আমি জানি এই বছর অনেকেই হতভম্ব হয়ে বসে আছে, হয়ত বুঝতেছেই না কেন এমন লাগছে, কোথা থেকে শূন্যতা এসে খোঁচা দিচ্ছে! আমি জানি দিনে দিনে এমন হতভম্ব হয়ে যাওয়াদের সংখ্যা বাড়বে। আর একদিন নিজেদের সময় এসে হাজির হবে! চান রাতে মন খারাপের জায়গা নেই শুরুতে লিখছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, শেষ লাইনে এসে আমি জানি মনটা খারাপ হবেই। মানুষ উৎসব আনন্দে একটা সময় স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করবেই, এই থেকে কি আর রেহাই আছে? সবাইকে শুভেচ্ছা ইদের। ইদ মুবারক। আমার আত্মীয়, বন্ধু সকলকে শুভেচ্ছা। কত দূর দূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার কত শুভাকাঙ্ক্ষী। সকলকে শুভেচ্ছা। অপাত্রে বুঝে না বুঝে যে স্নেহের নানা উপকরণ আমার প্রতি ঢেলে গেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ইদ মুবারক, ইদ মুবারক, ইদ মুবারক। সুখি সমৃদ্ধ হোক সকলের জীবন।
    ভারত -- শেষ ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে - Partha Banerjee | ভারত -- শেষ ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে। লেখক -- পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযান পাবলিশার্স, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা। মার্চ ২০২৪। দাম ৩০০ টাকা। বুক রিভিউ -- লেখক প্রশান্ত ভট্টাচার্য্য। প্রকাশিত হয়েছে "দৈনিক সুখবর" কাগজে। _____________________'...হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া 'হিন্দুরাজের' ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। ... শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তাহার কোনোটির সমাধান করিতে পারিবে কি? কীভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হইবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনো পথ নির্দেশ করিয়াছে কি?' ১৯৩৮ সালের ১৪ জুন কুমিল্লায় ভাষণে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজীর তথাকথিত ভক্তকুলের শিরোমণি নরেন্দ্র মোদী এখন ভারতের মূল সমস্যাকে ডেস্কের তলায় ফেলে দেশটাকে হিন্দু বানানোর যজ্ঞে আহুতি দিয়ে চলেছেন। এটা প্রায় সব বিরোধী নেতারা নিজেদের ভাষণে বলছেন, মোদী ফের ক্ষমতায় এলে, দেশে আর ভোট হবে না। অথচ মোদীর তৃতীয়বার মসনদে আসীন হওয়া ঠেকাতে তাঁদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব।  এমন পরিস্থিতিতে পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের  'ভারত শেষ ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে' বইটি হাতে এল। পার্থ মার্কিন প্রবাসী ভারতীয়। আরএসএসের গর্ভগৃহ থেকে জন্ম তাঁর। ফলে যে উৎকণ্ঠা থেকে এই বইয়ের প্রবন্ধ ক'টি পার্থ লিখেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সমাজে তো নেইই, এমনকী, অ্যাকাডেমিক ওয়ার্ল্ডেও নেই। এই দুই বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, এরা আরএসএস ও বিজেপির মধ্যে একটা বিভেদ রেখার কল্পনা করে নিয়ে, তাকেই মান্যতা দেয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কোনো এক সভায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবাইকে সচকিত করে জানালেন, 'আরএসএস নিয়ে তাঁর কিছু বলার নেই; ধর্ম নিয়ে তারা থাকেন, কাজ করে ইত্যাদি, প্রভৃতি।  অর্থাৎ সেই বিসমিল্লাহে গলদ। যত সঙ্কট ও হাঙ্গামা নাকি ভারতীয় জনতা পার্টি নামক রাজনৈতিক দলটিকে নিয়ে। আরও নির্দিষ্ট৷ করে, মোদী-শাহর বিজেপিকে নিয়ে, বাজপেয়ী-আদবানির বিজেপিটা যেন ছিল পাতে দেওয়ার মতো! যেমনটা, একসময়ে জ্যোতি বসুদের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী দলগুলো বুঝত। অনেকটাই সেই রবীন্দ্রনাথের 'ভালো ইংরেজ', 'খারাপ ইংরেজ' এর মতো, এঁরাও খোঁজেন 'ভালো-বিজেপি', 'খারাপ-বিজেপি'। আলোচ্য গ্রন্থের লেখকের ব্যথাটা এখানে। কেননা, 'দানবের পেটে দু-দশক' কাটিয়ে আসা পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় এই মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী দলটির বিষাক্ত নখ-দাঁত দেখে এসেছেন তার সঙ্গে ঘর করে। বিজেপির হিংস্র হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে নরম হিন্দুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। রামমন্দির নির্মাণের কালাপাহাড়ি হিন্দুত্বকে জগন্নাথ মন্দির গড়ে মোকাবিলা করা যায় না। বড়োজোর ভোটে জেতা যায়।  আলোচ্য গ্রন্থটিতে মোট ১৪টি প্রবন্ধ আছে। কোনো প্রবন্ধই অতিদীর্ঘ নয়। বেশির ভাগই ১২ থেকে ১৪ পাতায় শেষ। আমার বিবেচনায় এ বইয়ের সেরা প্রবন্ধটি হল --  ফাঁকা আওয়াজ, কিন্তু 'দেশপ্রেমমূলক' পজিটিভ বার্তা প্রচারের ফ্যাসিস্ট রাজনীতি-- শিরোনামের লেখাটি। প্রবন্ধটির শুরুতেই  লেখক তাঁর গুরু নোম চমস্কির কথা এনেছেন। এই মহান ভাবুক-অ্যাক্টিভিস্টের 'ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট' বা গণসম্মতি উৎপাদনের তত্ত্ব থেকে তিনি কী আহরণ করেছেন, তার পণ্ডিতি না ফলিয়ে ঢুকে পড়ছেন ঘটমান বর্তমানে।   লেখকের আলোকপাত, 'একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কীভাবে স্পোর্টসকে মনোপলি করে এবং তার বুক বাজানো উল্লাসকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে মেকি মেসেজ দেওয়া হয়, এবং ড্রাগের মতোই মানুষ হয় ঘুমিয়ে থাকে আর নয়তো বিকটভাবে দেশপ্রেম দেখায়, যার সঙ্গে দেশ বা প্রেম কোনোটারই সম্পর্ক নেই, শুধু মগজের ডোপামিন নামক হরমোনের হার্ডরক ড্যান্স আছে, তাঁর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ আমেরিকা, ব্রিটেন এবং আজকের ভারত। আমেরিকায় ফুটবল (যার সঙ্গে ফুটের কোনো সম্পর্কই নেই), ব্রিটেনে ফুটবল (যেখানে ভায়োলেন্স একেবারে প্রাতঃকৃত্যের মতোই অবশ্যম্ভাবী), আর ভারতে ক্রিকেট। দশ দেশের 'বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন'। লক্ষ কোটি টাকা জুয়া।' এই যে দেশপ্রেমের বা নিওনরম্যাল ন্যাশনালিজম, এরসঙ্গে না আছে জাতীয়তাবাদ, না আছে দেশপ্রেম। একটা মেকি ফানুস। এমনভাবে একটা 'গণচেতনা' ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যে রোটি-কাপড়া-মকান এর মতো জরুরি সমস্যা ও সঙ্কটগুলো রিসাইকল বিনে ফেলে, এই দেশপ্রেমে মেতে ওঠো। মোদী দেশের পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরদের সম্মান রক্ষার্থে না এগিয়ে, এবেলা-ওবেলা ট্যুইটবাজি করে যাচ্ছেন কারও সাফল্যে। বিজেপি ও তার রাজনৈতিক মেন্টর আরএসএস জানে, মানুষকে যদি শুধুমাত্র দেশপ্রেম বা হিন্দুত্ব বা রামমন্দির বা উগ্র ইসলাম বা ইউএসএ বা মোদী, বা ক্রিকেট-কোহলি-সচিন-ধোনি বা চন্দ্রযান বা বন্দে ভারত  বা সুপারপাওয়ার বা পুলওয়ামা -- যেটা যখন কাজে লাগে লাগিয়ে নাচানো যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে।এই ফ্যানাটিক ন্যাশনালিজমের জন্য সবসময় একটা অপর লাগে। দেশের মধ্যে মুসলিম আর বাইরে পাক-ই-স্তান আর চিন। অথচ কতকাল আগে ১৮৯৫ সালে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের 'স্বপ্নলব্ধ ভারতের ইতিহাস' ছাপা হয়।  তাতে তিনি লিখেছিলেন, 'আমাদের এই জন্মভূমি চিরকাল অন্তর্বিবাদানলে দগ্ধ হইয়া আসিতেছিল, আজি সেই বিবাদানল নির্বাপিত হইবে। আজি মাতৃভক্তিপরায়ণ পুত্রেরা সকলে মিলিত হইয়া ইহাকে শান্তিজলে অভিষিক্ত করিবেন। ভারতভূমি যদিও হিন্দুজাতীয়দেরই যথার্থ মাতৃভূমি, যদিও হিন্দুরাই ইঁহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তথাপি মুসলমানেরাও আর ইঁহার পর নহেন, ইনি উঁহাদিগকেও আপন বক্ষে ধারণ করিয়া বহুকাল প্রতিপালন করিয়া আসিতেছেন। অতএব মুসলমানেরাও ইঁহার পালিত সন্তান। এক মাতারই একটি গর্ভজাত আর একটি স্তন্যপালিত দুইটি সন্তানে কি ভ্রাতৃত্ব-সম্বন্ধ হয় না? অবশ্যই হয়- সব শাস্ত্র মতেই হয়।' কী অদ্ভুতভাবে সোশাল মিডিয়া দিয়ে মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে মিথ্যার ন্যারেটিভ। রীতিমতো পেশাদার ভক্তদের দিয়ে একাজ করানো হচ্ছে। বুস্ট করিয়ে লাইক বাড়ানো হচ্ছে৷ শেয়ার করা আর লাইকের ঠেলায় ভাইরাল করা হচ্ছে। লেখককে হন্ট করেছে, বাঙালির বদলে যাওয়া চেহারাটা। গত ৫০ বছরের শাসকদের অবিমৃষ্যকারিতায় আর ইদানীংকালের গোদিমিডিয়ার কল্যাণে একাংশ বাঙালি বিজেপিকে দুর্নীতিমুক্ত পার্টি হিসেবে ঠাউরে নিয়েছে।  লেখকের ভাষায় 'মিডিয়ার কল্যাণে বহু সাধারণ মানুষ মনে করেন যে, বিজেপি দুর্নীতিমুক্ত পার্টি, নরেন্দ্র মোদী পরিচ্ছন্ন নেতা এবং অমিত শাহ ভদ্র মানুষ। অনেক বাঙালি এদের ইতিহাস, রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের যোগসূত্র নিয়ে মোটেই ভাবেন না। আরএসএস যে বিজেপিকে চালায় এবং আরএসএস যে ফ্যাসিস্ট শক্তি, মানুষের সে বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা নেই। পশ্চিমবঙ্গে এমন কিছু মানুষও আছেন যাঁরা নাথুরাম গডসে কে, অথবা গডসে-সাভারকারের গান্ধিহত্যার বিষয়টি জানলেও বিষয়টা নিয়ে সরব নন। আর অন্য একদল নব্য বাঙালি গান্ধি-হত্যাকে সমর্থন করেন।' আমরা যার সর্বশেষ উদাহরণ দেখলাম অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে। তমলুকের এই বিজেপি প্রার্থী ভারতীয় জনতা পার্টিকে যেমন দুর্নীতিমুক্ত মনে করেন, তেমনই গান্ধী না গডসে প্রশ্নে গডসেতে আশ্রয় খোঁজেন। এ যদি ফ্যাসিস্টবান্ধব ও আত্মঘাতী বাঙালি না হয়, তবে কে?  বিজেপি ও তার দুধ খাওয়ানো আরএসএসের কতগুলো কায়দা আছে। ওদের সবচেয়ে বড়ো সুবিধে হল, আজকের দিনে এক বিশালসংখ্যক মানুষ-শিক্ষিত মানুষ কিছু পড়ে না। সুতরাং, মিডিয়াকে কিনে ফেলতে পারলেই, আর আইটি সেলের মাধ্যমে গার্বেজ ছড়িয়ে যেতে পারলেই ওদের কাজ অর্ধেক হয়ে গেল। বাকি অর্ধেক বিরোধীরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে গেছে এবং করে যাচ্ছে, মূলত তাদের অনৈক্য এবং মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতার অভাব প্রমাণ করে। এই বিপদে নিঠক ভোট রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করা যেতে পারে কিন্তু চূড়ান্তভাবে পারা যায় এই লড়াই আসলে মতাদর্শ বনাম মতাদর্শের নয় তাই বিজেপি মার্কা ফ্যাসিবাদ আটকানোর জন্য দরকার যেমন গণ আন্দোলন ঠিক তার পাশাপাশি দরকার চিন্তার স্বচ্ছতা।   ধর্মনিরপেক্ষ মন গণতন্ত্রের প্রতি ষোলআনা আস্থা ছাড়া কোনোভাবেই বিজেপিচারিত ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা সম্ভব নয়।  যদিও এই বইয়ের লেখক পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত এখনো অনেক আশাবাদী, কেননা বইয়ের নামকরণে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। তিনি এখনো মনে করছেন ভারত ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে, অতএব সেই সন্ধিক্ষণ দাঁড়িয়ে যদি সব লড়াইটাই মতাদর্শগতভাবে হয় তবে সুড়ঙ্গের শেষে আলো পাওয়া যাবে।  জার্মান কবি-দার্শনিক ফ্রেডরিখ হ্যেল্ডার্লিন বলেছিলেন, 'ভাষা মানুষের সবচেয়ে বিপজ্জনক সম্পত্তি'। একসময় বুঝিনি, এখন বুঝছি, যখন 'মোদীর গ্যারান্টি' মোদী নিজেই গেয়ে চলেছেন আর ভক্তরা প্রণিপাত করছেন।
  • জনতার খেরোর খাতা...
    " অকালবোধন" - বইটির আমার করা রিভিউ - Himadrisekhar Datta | না, মা দুগগার পূজো বা শ্রীরামচন্দ্র নিয়ে এ লেখা নয়। "অকালবোধন" একটি বই, যার লেখিকা, শ্রীমতী সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় (  সো ব)। বইটা এই বছর কলকাতা বই মেলায়, সৃষ্টিসুখ থেকে বেরিয়েছে। সেই স্টলে, ভদ্রমহিলা (সো ব) এসেছিলেন, তার বই এবং আরোও বই দেখতে। আমার কোন বই সৃষ্টিসুখ থেকে আর না বেরলেও, প্রতি বছর, আমার তুচ্ছ লেখক(?) জন্মের আঁতুড় ঘরে, একবার করে যাই। যদি আবার ভাল করে লেখার মিডাস টাচের খোঁজ পাই। এ ছাড়া রোহণ এবং সৌ এর প্রতিও আমার একটা অজানা তীব্র আকর্ষণ কাজ করে। স ব আসার বেশ খানিকটা পূর্বেই আমি সৃষ্টিসুখের স্টলে সেঁধিয়েছিলাম। বসার জায়গা আছে, দেখে গোটা কয়েক বই নিয়ে চেয়ারে বসে সংক্ষিপ্ত বিবরণি নোট করছিলাম মন দিয়ে। তার মধ্যে এই "অকালবোধন"-ও ছিল। স ব আমার পরিচিতা নন। বইয়ের প্রচ্ছদে তার ছবি ছিল না। তবুও আমি নিশ্চিত ছিলাম ইনি তিনিই। যাই হোক, খুবই অল্পভাষী ভদ্রমহিলা, আমার কেনা তার বইয়ে, আমাকে হিমাদ্রিবাবু সম্বোধনে নিজের সাক্ষর দিলেন।আজকে সেই বই এক সিটিং-এ পড়ে ফেললাম। বইটির নাম "অকালবোধন" প্রকাশক রেখেছেন, কেন রেখেছেন, তা তিনি তার কৈফিয়তে লিখেছেন। এটা যে তাৎক্ষণিক মুহুর্তের বশে রাখা একটি নাম, সেটা পরিষ্কার। যদিও, বইয়ের ভেতরে, লেখাগুলির সাথে, নামের, আমি কোন সার্থকতা খুঁজে পেলাম না। সাদা বুদ্ধিতে। সো ব খুবই আবেগপ্রবণতা এবং শব্দের জাদুকরি প্রয়োগে, সামান্য ঘটনা বা কোন কথাকে, অসামান্য ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি এক সময় বরানগরে থাকতেন, স্কুলের শিক্ষিকা থেকে হ্বড দিদিমণি হওয়া আর বার বার তার স্বপ্নের স্থান পুরীতে ফিরে ফির যাওয়ার যে বদলে বদলে যাওয়ার বর্ণনা রেখেছেন, তা বেশ ভাল লাগে পড়তে। স্কুল, পুরী বাদ দিলে, বাকি সব কাহিনীর জীবনের নিত্য চালচিত্র।কিন্তু তার মধ্যে ডুবে দেখার এবং একটা সময় ভিত্তিক যোগাযোগ টানার যে অকৃত্তিম চেষ্টা, তার লেখায়, সহজে ধরা পড়েছে, তা পাঠককে ভাবায়।প্রকাশক এই বইটিকে রম্য রচনা বলে শ্রেণীকরণ করলেও, আমার যেন কেবলই মনে হয়েছে, এই বইয়ের সব লেখাই আসলে, লেখিকার নিজের জীবনের কিছু যন্ত্রণা বা দু:খের ভস্ম থেকে উদ্ভুত- যেন ফিনিক্স পাখী। মা, বাবা, মেয়ে, সহকর্মী সকলের কথাই যেমন বলেছেন অনায়াসে, তেমনই অনায়াসে নিজেকে করেছেন আড়াল। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি, খানিকটা ব্যক্তিগত - আপনি কি স্যাগেটেরিয়ান? আমি তাই - তাই বোধহয়, আমার ভেতরে একটা প্রশ্ন, একটা উৎসুকতা বার বার ফিরে ফিরে আসছে, যা আপনার ভেতরটা বোঝার জানার চেষ্টা করছে, এই লেখাগুলির মাধ্যমে। সো ব খুবই আবেগপ্রবণতা এবং শব্দের জাদুকরি প্রয়োগে, সামান্য ঘটনা বা কোন কথাকে, অসামান্য ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি এক সময় বরানগরে থাকতেন, স্কুলের শিক্ষিকা থেকে হ্বড দিদিমণি হওয়া আর বার বার তার স্বপ্নের স্থান পুরীতে ফিরে ফির যাওয়ার যে বদলে বদলে যাওয়ার বর্ণনা রেখেছেন, তা বেশ ভাল লাগে পড়তে। স্কুল, পুরী বাদ দিলে, বাকি সব কাহিনীর জীবনের নিত্য চালচিত্র।কিন্তু তার মধ্যে ডুবে দেখার এবং একটা সময় ভিত্তিক যোগাযোগ টানার যে অকৃত্তিম চেষ্টা, তার লেখায়, সহজে ধরা পড়েছে, তা পাঠককে ভাবায়।আমাদের পূজোতে বসবার আগে, একটা সংকল্প করার নিয়ম আছে - আপনার  "অকালবোধনে" আপনি কিছুতেই সংকল্পচ্যুত হতে দেন নি নিজেকে।বিষয় বা স্থান পরিবর্তন যাই ঘটে থাকুক গল্পের হাত ধরে, চব্বিশটি পর্বে কখনই নিজেকে মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে দেন নি। আপনার আগের দুটি বই পড়ি নি।সত্যমের হারিয়ে যাওয়া বেশ অকাট্য নিদর্শন আওস্র সেই সেই থেকে শুরু করে এই আমাদের আধুনিক সমাজের। চোখের জলকে লুকিয়ে রেখে, মুখের হাসির অমলিন রূপদর্শন এই বইয়ের মূলকথা বলেই আমার মনে হয়েছে। কি জানি হয়ত, আমিও আমার মতই কেবল ভাবছি। ভাল থাকবেন। লিখবেন।
    গণতন্ত্র নয়া জমানা - Eman Bhasha | বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়!!! এতো কলেজ নির্বাচনে হতো!  বা পঞ্চায়েত নির্বাচনে।ত্রিপুরায় ৯৬% আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিন লাখ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এবার লোকসভাতেও।  এবার মনোনয়নপত্কর সবার বাতিল করানোর পালা। গুজরাটে। সুরাট কেন্দ্রে। অরুণাচল প্রদেশে ১০ জন এমএলএ একই কায়দায়!!! ২০১৯ এ বেনারসের সাধু ও সন্ত সমাজের প্রতিনিধি ভগবান দাস মহন্তের মনোনয়ন বাতিল করানো হয়েছিল।সেনা জওয়ানের মনোনয়নপত্র বাতিল করানো হয়েছিল। 
    বকবকস (বইদিবস) - Falguni Ghosh | আজ শেক্সপিয়ার সহ আরো অন্যান্য বিখ্যাত লেখকদের জন্ম নাহয় মৃত্যুদিবস। ক্লাসিক উপন্যাস 'লা মানচার দন কিহোতে'র স্রষ্টা লেখক মিগেল দে সারভেন্তেসের মৃত্যু দিবসকে স্মরণীয় রাখার উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সূচনা হয় বইদিবসের। পরবর্তীতে ইউনেস্কোর উদ্যোগে বইপড়া, বইছাপানো, কপিরাইট সংরক্ষণ -- এইসব ক্ষেত্রে জনসচেতনতা বাড়াতে পালিত হয় বইদিবস।  এখন দিবসের উপলক্ষ্য যদি যাপনের উৎসব হয় তাহলে বই তো ঈশ্বরের আরেক রূপ। মানুষের মন ঐশ্বরিক ঐশ্বর্যে ভরে ওঠে অথবা ঈশ্বর হাত বাড়িয়ে মানুষের অবচেতন - চেতনার সঙ্গম ঘটান, যাই হোক না কেন, বই একটি দুর্লভ এবং দুর্মূল্য আগ্রহ, কৌতূহল, উদ্দামতা, নীরবতা এবং সর্বপোরি নিজের সঙ্গে নিজের একাত্মতা।  এই যে এক আত্মা হওয়া এর ভিত্তিটি আজকের দিনে কেমন যেন নড়বড়ে হয়ে আসছে। শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত থাকার দৌলতে দেখি- বুঝি প্রায় প্রতিনিয়ত যে, আজকাল বাচ্চাদের চোখে সেই অবুঝ, অনবুঝ স্বপ্নের চাষবাস নেই!  কেন নেই!  তারা সবই ভিসুয়ালাইজ করে নিয়েছি। নন্টে ফন্টে, হাঁদা -ভোঁদা, ছোটা ভীম,  মিকি মাউস, টম-জেরি, আলাদিন সবই তারা দেখে নিয়েছে।  ফলত কল্পনার খাতা এদের হাতে শূন্য!  এসব দেখতে দেখতে একছুটে  রাশিয়া থেকে টুকি দেওয়া দুই ইয়ারের দোস্তির আজব বদমাশি বুদ্ধি আমার মাথায় কিলবিলিয়ে ওঠে।  শুধু কি হাঁদা ভোঁদা নন্টে ফন্টেই নাকি! এক পৃথিবী চষে বেড়ালে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায়, দেশে বিদেশে এইরকম দুষ্টু মিঠে জুটি যে কত তার ইয়ত্তা নেই।  আবার দাঁত ফোকলা ঠানদি, ঠাকুরমা আর দাদামশায়েরা তাঁদের থলে থেকে কতই না রূপকথার গল্প বিনিয়ে বিনিয়ে বুনতেন আমাদের মনে,  সে রূপকথা দেশ কাল ছাপিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ঘুরে জাপান, রাশিয়া হয়ে চীনদেশে এসে জিরিয়ে নিত।  আহা চীনদেশের গল্প বইয়ে কী সুন্দর পালকের মত নরম শিরশিরে রূপসীর আনাগোনা।  কেউ বা লোভী।  তার যে কী শাস্তি! কেউ বা খুব পরিশ্রমী, ভালো মানুষ -- তার জন্যই তো ফিনিক্স পাখির ডানা থেকে রঙিন পালক ঝরে পড়ে। ওদিকে আলোর ফুলকি,  সেরা সন্দেশ-- এসব তখন দীক্ষামন্ত্রের মত নিত্য জপ করে চলা। এক গ্রামীণ লাইব্রেরিই ছিল এসবে সম্বল। আর বাবার এনে দেওয়া রঙ বেরঙের বইয়ে ভর করে, সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল প্রায় সে ছোট বয়সেই চষে ফেলেছিলাম স্বপ্নে। কিন্তু চিরকাল তো স্বপ্ন জড়িয়ে দিন কাটে না!  ধীরে ধীরে বাস্তবের কঠোরতা ঠোক্কর দিতে থাকলেও বইকেই জড়িয়ে ধরেছি। বুঝেছি এই যে কত না সূক্ষাতিসুক্ষ আবেগ আমাদের নিত্য বাঁচায় এবং মারেও। কখনও যদি হেসে সুখ, কখনও প্রাণভরে কাঁদার জন্য প্রাণ আকুলিবিকুলি করে ওঠে। আর ভালোবাসা ঈশ্বরের আরেক ছদ্মরূপ। -- এইসব সবকিছুই বইয়ের আশ্রয়ে কোল পায়। আমাদের বাল্য, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্যের সমস্ত রঙ, রস, স্বাদ, বিস্বাদে আমরা বইকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারি। কেননা বই একমাত্র বই-ই পারে আমার, আমাদের প্রত্যেকের মনের কথা টেনে পৃথিবীর মাটিতে ভূমিষ্ঠ করাতে। বই যেমন স্বপ্নের জগতে ঠেলে দিতে পারে তেমনই বাস্তবের ধূ ধূ রুক্ষ মুরুভূমির মধ্যে একটুকরো স্বপ্নের মেঘ দমকা হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে আসতে পারে। যাতে মানুষেরা মরে যেতেও যেতেও খুব জোরে একবার শ্বাস নিয়ে বলে উঠতে পারে-- মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে.... ক্লাসরূমে ছেলেপিলের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া বোধ করি, দেখি এরা কথা বলে খুব, কিন্তু এদের ভাষার বড়ই অভাব। এদেরকে কেউ বলে নি, নিজেই নিজের সঙ্গে একাত্মা হয়ে দ্যাখোএরা শুধু সিলেবাস মুখস্থ করে! আর গ্রাম্য এক দিদিমণি সেই ইঁদুর দৌড়ের দৈনন্দিন বাস্তবতায় মাঝে মধ্যেই ছেলেপিলের আঙিনায় লাইব্রেরি,  বই আর রূপকথার স্বপ্নের মেঘ বুনতে থাকেন। আজকের দিনে এটুকুই আমার অর্ঘ্য। যে বইয়ের কাছে বড় ওঠার চিরঋণ, সেই বইয়ের জন্য এটুকুই হয়ত করতে পারি।
  • ভাট...
    commentdc | আচ্ছা। বড়পাসরাস নামটা খুব পছন্দ হলো :-) 
    commentb | ১৯৬১ সালে, পোয়েট টেগোরের বার্থ সেন্টিনারির সময়ে এই ফসিলটি  আবিস্কার হয় । 
     
    আর নারায়ণ স্যন্যালের মতে, আক্ষরিক অর্থেই বড় পা । মানে যিনি নামকরণ করেছিলেন তিনি সুকুমার রায় গুলে খাওয়া লোক। (অবশ্য স্যন্যালমশায় ইয়ার্কি মারছিলেন কি না , জানি না ) 
    commentSantanu | @s
     
    "কোর্ট পর্ষদকে যোগ্য অযোগ্য প্রার্থীর তালিকা বানাতে বলেছিল কিন্তু পর্ষদ সেই তালিকা বানায়নি"
    ফৌজদারি মামলা না করলেে ও, 
    কোর্ট আদালত অবমাননার মামলা করতে পারতো না? 
     
    এবার ও রায়ে বলেছে ভোটের ১৫ দিনের মধ্যে SSC কে অনেক কিছু করতে হবে - যদি না করে?
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত