এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    সীমানা - ৪৫ - শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ছবি: সুনন্দ পাত্র ৪৫কেমন আছেন নজরুল?স্তব্ধ হয়ে বসে আছে নজরুল।অস্ত্রোপচারের পর আজ অষ্টম দিনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ঠিক বারটা দশ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ফেললেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। গত দু'দিন ধরেই প্রায় আচ্ছন্নের মতো ছিলেন কবি।অদূরেই টেলিফোন। মাঝে-মাঝেই কেউ ঢুকছে ঘরে, টেলিফোনে মৃদুকণ্ঠে কিছু কথা বলছে, তারপর যথাস্থানে যন্ত্রটা রেখে আবার চলে যাচ্ছে ঘর ছেড়ে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর এক সময় সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে কর্কশ টেলিফোনকণ্ঠ নোটিশ দেয়। নজরুল তাকায় ফোনটার দিকে, ওঠে না, বসেই থাকে। দ্রুতপদে ঘরে ঢোকেন সুরেশ চক্রবর্তী, বেতার জগতের তিনি নিয়ন্ত্রক। কয়েক সেকেণ্ড কথা বলার পর ফোনটা রেখে দিয়ে বলেন, সজনীকান্তবাবু ফোন করেছিলেন, বেরিয়ে পড়েছে।বলেই, নজরুলকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান সুরেশ। একটু পর ঘরে ঢোকে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়; নজরুলকে বলে, শুরু করিয়ে দিয়ে এলাম, কাজিদা। তুমি কি পারবে?নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে কাজি জানিয়ে দেয় সে পারবে না।ঠিক আছে, দুজন অ্যানাউন্সারকে আমি বলে দিয়েছি, ওদের মধ্যেই একজন চালাচ্ছে এখন। জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে এই মাত্র বেরিয়ে এখন সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুয়ের দিকে আসছে। তোমার কবিতাটা রেডি রেখ, আর পার যদি, একটু পরে কমেনট্রীতে এস একবার, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও। আজকের দিনে লোকে তোমার গলা তো নিশ্চয়ই শুনতে চাইবে, বলেই দ্রুতপদে বেরিয়ে যায় নৃপেন।নজরুল এবারেও কোন জবাব দেয়নি। সামনে একটা দড়ি-বাঁধা ফাইল, সে খোলে সেটা। একেবারে ওপরের কাগজখানা হাতে তুলে নেয়, যা লেখা আছে কাগজে তাতে চোখ বোলায় একটু, আবার রেখে দেয় ফাইলে। ঘরে আরেকবার ঢোকে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ; এবার একটু দ্রুততর, বলে, মানুষকে কন্ট্রোল করতে পারছে না পুলিশ, ধাক্কাধাক্কি হাতাহাতি চলছে। এবার ধারাবিবরণী একটু বন্ধ করে তোমার কবিতাটা পড়া দরকার। কোনরকমে এই কথাগুলো বলে নিজের একটা হাত সে বাড়িয়ে দেয় নজরুলের দিকে। নজরুল নৃপেনের হাতটা ধরে, ফাইলটাও সঙ্গে নেয়। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে স্টুডিওর ভেতরে যায় ওরা, পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে। যে দু'জন মাইকের সামনে বসেছিল, দুজনেরই কানে একটা করে ইয়ারফোন। শবযাত্রার সঙ্গে অতি ধীরগতিতে রেডিওর গাড়ি চলতে চলতে শবযাত্রার যে সংক্ষিপ্ত ধারাবিবরণী সরাসরি পাঠিয়ে দিচ্ছে রেডিওর স্টুডিওয়, ইয়ারফোনে তা শুনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সম্প্রচারযোগ্য ভাষায় তার তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে দুজন ঘোষকের একজন বেতারে তা পাঠিয়ে দিচ্ছে তার নিজস্ব কণ্ঠস্বরে। দ্বিতীয় জন, এখন যে শুধু ইয়ারফোনেই মনোযোগী, চেয়ারে বসে-থাকা নজরুল-নৃপেনের দিকে সে হাত তুলে ইঙ্গিত করতেই নৃপেন কাজির হাতে হাত রাখে। কাজি একটুও সময় নষ্ট না করে পড়তে শুরু করে: দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপথের কোলে শ্রাবণের মেঘ ছুটে এল দলে দলেউদাস গগনতলেবিশ্বের রবি ভারতের কবি.......নৃপেনের সদাসতর্ক কর্ণদ্বয় খেয়াল করে কাজির কণ্ঠস্বর কম্পিত এবং জিহ্বা স্খলিত, 'ভারতের' শব্দটিকে সে ভাওতেও উচ্চারণ করেছে। সময়ের একটুও অপচয় না-করে সে কাজির হস্তধৃত কাগজে চোখ রেখে কাজির সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যেতে থাকে: …...শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি তুমি চলে যাবে বলে।তব ধরিত্রী মাতার রোদন তুমি শুনেছিলে না কি,তাই কি রোগের ছলনা করিয়া মেলিলে না আর আঁখি? আজ বাংলার নাড়িতে নাড়িতে বেদনা উঠেছে জাগিকাঁদিছে সাগর-নদী-অরণ্য, হে কবি, তোমার লাগি।পড়তে পড়তেই নৃপেন কাজির জিহ্বার জড়তা-আরষ্টতার বৃদ্ধি খেয়াল করে এবং শেষ স্তবক পর্যন্ত তাকে সঙ্গ দেয়: ****** আমরা তোমারে ভেবেছি শ্রীভগবানের আশীর্বাদ, সে-আশিস যেন লয় নাহি করে মৃত্যুর অবসাদ।বিদায়ের বেলা চুম্বন লয়ে যাও তব শ্রীচরণে,যে লোকেই থাক হতভাগ্য এ জাতিরে রাখিও মনে। এই কবিতার আবৃত্তি শেষ হলেই সম্প্রচাররত ঘোষক দুজনকে হাত দেখিয়ে “আবার আসছি, তোমরা চালিয়ে যাও” ইঙ্গিত করে নজরুলের হাত ধরে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে আসে নৃপেন, সোজা ঢুকে যায় রিহার্স্যালের ঘরে। সেখানে তানপুরা এবং তবলাসহ বসে আছেন শিল্পীরা এবং একজন গায়িকা। গতকাল প্রায় সারাদিনই কবিগুরু সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন, অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যতের কথা ভেবে নজরুলকে দিয়ে ছোট একটা সঙ্গীতাঞ্জলি কালই লেখানো এবং সুরপ্রয়োগ করানো হয়েছিল। মহিলাটি গতকাল থেকেই অনেক বার অভ্যেস করেছেন গানটি। এখন নৃপেনের নির্দেশে গানটি তিনি একবার গাইলেন। নজরুলের আঁখিদ্বয় মুদিত এবং মূর্তিবৎ নির্বাক নিশ্চল দেহ। ইঙ্গিতে মহিলাকে আবার গাইবার নির্দেশ দেয় নৃপেন। তারপর আরও কয়েকবার। হঠাৎ এক সময় এই গানের মধ্যেই নিজের শরীরে একটা ঝটকা দিয়ে চোখ খোলে কাজি, কিছুক্ষণ বসে বসে শোনে গান, তারপর যোগও দেয়। মহিলার সঙ্গে নজরুলের কণ্ঠে সম্পূর্ণ গানটি একবার গীত হলে হাত দেখিয়ে মহিলাকে এবং যন্ত্রীদের থামায় নৃপেন। তারই নির্দেশে এবার স্টুডিওয় প্রবেশ করে ওরা। নিঃশব্দে তবলা এবং তানপুরা নিয়ে আসে একজন। সকলেই প্রস্তুত হয়ে বসে। ঘোষকরা ইঙ্গিত করলে গাওয়া হয় গান: ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না জাগায়ো না,সারা জীবন যে আলো দিল, ডেকে তার ঘুম ভাঙায়ো না।যে সহস্র করে রূপরস দিয়াজননীর কোলে পড়িল ঢলিয়া,তাহারে শান্তি-চন্দন দাও। ক্রন্দনে রাঙায়ো না।****জোড়াসাঁকো থেকে নিমতলা কতটাই বা! তবুও, যে-মানুষের মরদেহ, সেই মানুষের ক্ষেত্রে জনতার আকাঙ্ক্ষা তো তাঁকে শেষ দেখাই শুধু নয়, অতি আক্রমণাত্মক জনসাধারণ মরদেহ স্পর্শও করতে চায়। তথাকথিত সাধারণ ভদ্রলোকদের বোধ হয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। স্পর্শ শুধু নয়, এমন ঘটনা ঘটছে যার জন্যে লজ্জায় মুখ-ঢাকা উচিত বাঙালির। শুধু কবির চুল-দাড়িই নয়, এমনকি পরিহিত বস্ত্রেরও, পারলে ছোট একটু কণাও, সংগ্রহ করতে ব্যস্ত মানুষ। পুলিশ সামলাতে পারছে না, শববাহকরা দিশেহারা। কলকাতার রাস্তার এ-অবস্থায় নজরুলকে একা-একা ছাড়লেন না রেডিও অফিসের দায়িত্বশীল অধিকারীরা। একেই শরীর ভালো নয়, তার ওপর এই গণ্ডগোলে গার্স্টিন প্লেস থেকে উত্তর কলকাতায় নজরুলের বাড়ি পর্যন্ত সুস্থ দেহে পৌঁছনো অসম্ভব বলেই মনে হল তাঁদের। দুপুরের খাওয়া তাকে খাইয়ে দেওয়া হল রেডিওর অফিসেই, তার পর রেডিওরই একটা গাড়িতে নৃপেন সঙ্গে গিয়ে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসতে গেল নজরুলকে।নজরুলের বাড়িতে যখন পৌঁছল নৃপেন ততক্ষণে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছে নজরুল। ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে যাওয়া হল উপরে। আধো-জাগা নজরুল কোন রকমে নৃপেনের কাঁধে ভর দিয়ে ওপরে ওঠবার পর তাকে শুইয়ে দেওয়া হল বিছানায়। শুয়েই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে নজরুল।বাইরের ঘরে এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। তিনিও নৃপেনকে সাহায্য করলেন নজরুলকে বিছানায় তুলে দিতে। ভদ্রলোককে চেনে না নৃপেন। নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালা নৃপেনকে চা খাওয়াবার জন্যে বসিয়ে ভেতরে গেলেন। যে ভদ্রলোক বসেছিলেন আগের থেকেই, তাঁর সঙ্গে আলাপ জমে উঠল নৃপেনের। জানা গেল ভদ্রলোকের নাম জসীমউদ্‌দীন।আপনিই জসীমউদ্‌দীন? – খুশি স্পষ্ট নৃপেনের গলায়; আরে, আপনি তো বিখ্যাত মানুষ, কাজিদার খুব ঘনিষ্ঠও তো, কিন্তু শুনেছিলাম আপনি ঢাকায় থাকেন।ঠিকই শুনেছেন, ঢাকাতেই থাকি, যদিও আমার বাড়ি ফরিদপুরে। ঢাকার য়্যুনিভার্সিটিতে মাষ্টারি করি। কাজিদার সঙ্গে আমার আলাপ আমার প্রায় শৈশবেই, কাজিদা তখন সদ্য হাবিলদারি ছেড়ে কলকাতায় এসেছেন, থাকেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বাড়িতে। ঢাকা থেকে কলকাতায় এলে একবার অন্তত কাজিদার – আমি কিন্তু কাজিদা নামে কোনদিনই ডাকি না ওঁকে, আমি বলি কবি-ভাই – তো, কবি-ভাইয়ের সঙ্গে, দেখা করে যাই। এবার এখানে এসেছিলাম জোড়াসাঁকোয় গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করব মনে করে। ঢাকাতেই কবিগুরুর অসুস্থতার কথা শুনেছিলাম। কপাল মন্দ আমার, আর কোনদিনই দেখা হবে না।সে তো ঠিকই, বলে নৃপেন, কারো সঙ্গেই কবির দেখা হবে না আর কোনদিনই। কিন্তু দেখুন কেমন সৌভাগ্য আমার, কপালজোরে রেডিও অফিসে কাজিদা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তাই তাঁকে পৌঁছিয়ে দিতে এসে আপনার মতো মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। ঐ কী যেন বলে না, সব খারাপ এর পরেই ভালো একটা কিছু থাকে, মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে!আমাকে দেখেই যদি সূর্যের হাসির কথা মনে পড়ে আপনার তাহলে তো আমার খুবই খুশি হওয়া উচিত, জবাব দেন জসীমউদ্‌দীন, কিন্তু আপনি যখন ধরে ধরে কবি-ভাইকে নিয়ে এলেন, কেমন জানি হু হু করে উঠল আমার বুকের মধ্যে। কবি-ভাইয়ের এই চেহারা আমি দুঃস্বপ্নেও দেখিনি কখনও। আপনি বললেন উনি অসুস্থ, কী অসুস্থতা? কী হয়েছে ওঁর?কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতার পর এবারটা যখন শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে আসা হল কবিকে, নৃপেন বলে, প্রথমেএ-ব্যাপারে কিছু জানতই না কাজিদা, শুনেছে অনেক পরে। খবর পেয়ে যখন জোড়াসাঁকোয় যায় দেখা করতে, ততদিনে অপারেশন হয়ে গেছে। গিয়ে কবিকে দেখেছে, কিন্তু কথা বলতে পারেনি। কবি শুয়েছিলেন, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ দেখে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে চলে এসেছে, বলতে থাকে নৃপেন, কাজিদার নিজের মুখে শুনেছি, জীবনে প্রথমবার যখন গুরুদেবকে দেখেছে, তখন তাঁর পায়ে মাথা রেখে কতক্ষণ ছিল মনেও নেই তা। কবি যখন বললেন, ওরে, আমার পা যে ভিজে যাচ্ছে, তখন তাঁর পা ছেড়ে মুখ তুলে তাকিয়েছে তাঁর দিকে। এবারটা কিন্তু শুয়ে থাকা কবিকে সাহস করে ছুঁয়ে প্রণাম করতেও পারেনি। তারপর থেকেই কাজিদা কেমন জানি আচ্ছন্নের মতো, প্রায় স্তব্ধ। আমরাই তবুও জোর করে রেডিওয় নিয়ে আসছিলাম রোজ, কবিতা-টবিতা গান-টান লিখিয়ে নিচ্ছিলাম ওঁকে দিয়ে, গানে সুরও দিয়েছেন, কিন্তু আজ মৃত্যুর খবর শোনার পর মনে হল শক্‌টা আরও বেড়েছে।হ্যাঁ, কবি-ভাই স্বভাবতই আমুদে, বলে জসীমউদ্‌দীন, কোন কষ্টে কখনো হতাশ দেখিনি। আজ কিন্তু ওই মুখ দেখে আমার কান্না পাচ্ছে। আপনি জানেন, বছর দশ-বার আগে – কি, তারও বেশিই হয়তো হবে – কবি-ভাই একবার কেন্দ্রীয় আইনসভার ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিলেন? নমিনেশন দিয়েছিল কংগ্রেস, কিন্তু ওইটুকুই, তারপর কোন সাপোর্ট দেয়নি। তখন কবি-ভাই থাকতেন কৃষ্ণনগরে, শেষ পর্যন্ত একদিন কলকাতায় এসে বিধানবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন। সারাটা বিকেল বিধানবাবু বসিয়ে রাখলেন, তাঁর তখন প্র্যাকটিসের সময়, তারপর সেই বিকেলের প্র্যাকটিসের সমস্ত আয়, তিনশো টাকার কিছু বেশি, দিয়ে বিদায় করলেন কবি-ভাইকে। তখন বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দলের অফিস হ্যারিসন রোডে, সেখানে মুজফ্‌ফর হোসেন আর হালীম সাহেব থাকতেনও, সেই রাত্তিরটা ওঁদের সঙ্গে কাটালেন কবি-ভাই। মুজফ্‌ফর সাহেব বারবার করে কবি-ভাইকে বোঝালেন, পুব-বাংলার পাঁচ জেলা নিয়ে মাত্র আঠের হাজার ভোটার। প্রায় সব ভোটারই জমিদার-তালুকদার শ্রেণীর লোক, এদের সঙ্গে শুধু যোগাযোগ করারই খরচ হাজার-হাজার টাকা, মাত্র তিনশো টাকা পকেটে নিয়ে কবি-ভাই যেন এই ইলেকশনে না লড়ে। কিন্তু, কিছু মনে করবেন না ভাই যা বলব এখন তাই শুনে, বাঁদরকে সাঁকো নাড়াতে বারণ করলে সে কি কথা শোনে!ওদের কথার মধ্যেই এবার ঘরে ঢুকলেন গিরিবালা দেবী, তাঁর হাতে চা-বিস্কুট। জসীমউদ্‌দীনের শেষ কথাটা বোধ হয় শুনতে পেয়েছিলেন তিনি। হেসে বললেন, তোমার চেয়ে খানিকটা বড় যদিও নুরু, যা তুমি বলেছ কথাটা ঠিকই। মাথায় যদি ঢোকে কিছু একবার, তা করবেই। যতই বারণ কর, শুনবে না। তারপর নৃপেনকে বললেন, আমাকে তো তুমি চেন না বাবা, তোমাদের কাজিদার আমি শাশুড়ি। আমার নিজের একটিই মেয়ে, ছেলে নেই। নুরুকে আমি ছেলেই করে নিয়েছি। তারপর মুখটা একটু মাথার কাপড় টেনে আড়াল করে – মনে হল উদ্গতপ্রায় অশ্রু কোনরকমে দমন করে – বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন গিরিবালা।চা-বিস্কুট আগেই জসীমউদ্‌দীনের সামনের টেবিলটায় রেখে দিয়েছিলেন গিরিবালা, উনি ভেতরে যাবার পর বলতে থাকেন জসীমউদ্‌দীন, আমি কবি-ভাইয়ের চেয়ে সাড়ে তিন বছরের ছোট, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েস আমার তখন, মনে আছে তখন গরমের সময়, পদ্মাতীরে আমাদের বাড়িতে একদিন হঠাৎ হাজির কবি-ভাই। বললেন, ফরিদপুরে এসেছেন ইলেকশনের ক্যাম্পেইন করতে। সব শুনে আমি বললুম, করেছেন কী কবি-ভাই, এই ইলেকশনে দাঁড়াবার দুর্মতি কেন হল আপনার? আপনি জানেন না এ দেশের গোঁড়া মুসলিম সমাজ আপনাকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছে?আরে, সে ফতোয়ায় কী হবে, এই দেখ্‌ – বলে স্যুটকেস খুলে এক বাণ্ডিল কাগজ বের করে আমাকে দেখান কবি-ভাই। দেখি, পুব-বাংলার বিখ্যাত পীর বাদশা মিঞার সার্টিফিকেট। কবি-ভাই বললেন, তুই ভাবিস না জসীম, এই সার্টিফিকেটের পর সবাই আমাকে ভোট দেবে। ঢাকায় আমি নিরানব্বই পারসেন্ট ভোট পাব। তোদের ফরিদপুর থেকে কিছু ভোট পেলে এবার আইন-সভায় আমি যাবই যাব।এই সরল মানুষকে কী আর বলা যাবে! দু-দিন পর ইলেকশন। ফরিদপুর শহরের বিখ্যাত মৌলভী তমিজউদ্দিন খান সাহেব সেবার আইনসভায় নিম্ন-পরিষদের প্রার্থী। তাঁকেও বাদশা মিঞা সার্টিফিকেট দিয়েছেন। পরের দিন আমরা দুজন তাঁর বাড়িতে হাজির, বলতে থাকেন জসীমউদ্‌দীন, মিঞাসাহেব তখন তাঁর সমর্থক-পারিষদদের নিয়ে দরবার সাজিয়ে বসেছেন। কবি-ভাই বাদশা মিঞার সার্টিফিকেট খুলে দেখাতেই ওই পারিষদদের একজন রেগেমেগে বললেন, তুমি তো নজরুল ইসলাম? কোন মুসলমান তোমাকে ভোট দেবে না। তুমি তো কাফের।কবি-ভাই কিন্তু একটুও বিচলিত হলেন না। বললেন, সে ঠিক আছে, কাকে ভোট দেবেন সে পরের ব্যাপার, এখন আমার দুয়েকটা কবিতা শুনুন। বলেই, কারো অনুমতির জন্যে অপেক্ষা না-করেই কবি শুরু করলেন তাঁর মহরম কবিতার আবৃত্তি। সে কী আবৃত্তি, নিজের কানে না শুনলে বোঝা যাবে না কী তার আবেদন! যে পারিষদটি অত উগ্রভাবেকবি-ভাইকে কাফের বলেছিল, তার চোখ দিয়ে দেখা গেল অবিরল ধারা বইছে। এইভাবে আবৃত্তির পর আবৃত্তি চললই, মনে হল কবি-ভাইয়েরও মূড এসে গেছে, ইলেকশনের কথা বোধ হয় ভুলেই গেছেন তিনি! আমি আর পারলাম না, মাঝখানে এক সময় আমি বলে উঠলাম, কবিতার আবৃত্তি আপনারা শুনছেন, শুনুন। কবি কিন্তু আজ একটা বিশেষ কাজে এখানে এসেছেন। আসন্ন নির্বাচনে উনি আপনাদের ভোটপ্রার্থী।তাইতো তাইতো – বলতে বলতে তমিজউদ্দিন খান সাহেব তখন হাত ধরে কবি-ভাইকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ওঁরা ফিরে এলে আবার শুরু হল আবৃত্তি। চলছে তো চলছেই, সবাই যেন সেই স্রোতেই নিমজ্জিত। কেউ এমনকি খেতেও ডাকল না কবিকে। না ডাকুক, আমি মনে মনে ভাবলাম, যাক, নিশ্চিন্ত তো হওয়া গেল। ভোটটা তো অন্তত পাওয়া যাবে। তমিজ মিঞার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি পঁয়তাল্লিশ মিনিটের হাঁটাপথ। ফেরার পথে যেমন-তেমন একটা হোটেলে মাছি তাড়াতে তাড়াতে কবি-ভাইকে প্রায়-অখাদ্য দুপুরের খাবার খাইয়ে ফিরে এলাম।দুদিন পরেই ভোট। প্রিসাইডিং অফিসার মুখ-চেনা। কাজি নজরুল ইসলামের নামও শুনেছে সে। ভোটের সময় কবি-ভাই পোলিং বুথে বসে থাকতে চাইছেন শুনে সে তো মহাখুশি। খাবার-দাবার প্যাক করে কবি-ভাইকে ঠিক সময়ে বসিয়ে দিয়ে এলাম। একজন করে ভোটার ঢুকছে, কবির সঙ্গে গল্প করছে, তারপর নিজের মতো ভোট দিয়ে ফিরে আসছে। সেই রাত্তিরে কবি-ভাই ভারী খুশি। বললেন, জিতব তো ঠিকই, কথা হচ্ছে কত ভোটে জিতব। তারপর ছেলেমানুষের মতোমাথা-টাথা নেড়ে বললেন, জসীম, এবার থেকে প্রায়ই আমাকে দিল্লী যেতে হবে। আমি যখন যাব, তুইও যাবি সঙ্গে।আশ্চর্য মানুষ এই কবি-ভাই, পরের দিন আমরা সকাল বেলাতেই গোসল করতে গেলাম নদীতে। খানিকটা সাঁতার-টাতার কাটার পর কবি-ভাই আমার খুব কাছে এসে মুখ গম্ভীর করে বললেন, সেদিন তমিজ মিঞা আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে কী বলল জানিস? বলল, পীর বাদশা মিঞা যতই সার্টিফিকেট দিন আপনাকে, ইসলামি খবরের কাগজ-টাগজে যা লেখা হয়েছে আপনাকে নিয়ে এতদিন ধরে, আপনার কাফের নাম সহজে ঘুচবে না। মুখে আপনাকে না-বললেও আল্লার বান্দারা আপনাকে ভোট দেবে না কেউ। আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন, আমি যা বুঝি তা-ই বললাম। জানিস জসীম, আমারও মনে হচ্ছে তা-ই, কাফেরকে ভোট দেবে না কেউ। আমি আজ সকালেই ঢাকায় যাই, দেখি অন্তত জামানতটা বাঁচাতে পারি কিনা।যে লোক কাল রাত্তিরেও মাঝে-মাঝেই দিল্লী যেতে হবে বলে সঙ্গী জোটানোর কথা বলেছে, আজ সে নিরুত্তাপ মুখে ঢাকায় চলে গেল জামানত বাঁচাতে! মুখে কিন্তু সেই একই হাসিটি!কিন্তু কী হল ইলেকশনে শেষ অবধি?– ডুবন্ত নৌকোর শেষ যাত্রীটার মতো মুখে জিজ্ঞেস করে নৃপেন।যা হবার। হেরে গেলেন কবি-ভাই।আর জামানত?জব্দ। কিন্তু যেমন স্বভাব কবি-ভাইয়ের, কোন দুঃখ মনে রাখেননি কখনো। তার পরেও তো কত-কতবার দেখা হয়েছে। সব সময় একই রকমের উচ্ছ্বাস, একই হো হো অট্টহাসি, আর মুখে, দে গোরুর গা ধুইয়ে!কিন্তু এ-সব তো অনেক কম বয়েসে, বলে নৃপেন, ইদানিং কি সেই উচ্ছ্বাস, সেই নিয়ম-না-মানা প্রাণচাঞ্চল্য আর দেখেছেন?আপনার কথার কী জবাব দেব জানি না নৃপেনবাবু, আজকাল তো আমি অনেক কম আসি। আর আসি যখন, নিজের সুবিধে মতন। সব সময় যে কবি-ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় তা-ও নয়। এমন অনেক দিন হয়েছে, কবি-ভাইকে না পেয়ে খালা-আম্মা আর ভাবীর সঙ্গে গল্প করে ফিরে গেছি। তবে, আট মাস আগে একবার দেখা হয়েছিল। ঢাকায়।ঢাকা-রেডিওর উদ্বোধনে গত ডিসেম্বরে এসেছিলেন কবি-ভাই। পরের দিন ঢাকা য়্যুনিভার্সিটিতে সলিমুল্লাহ্‌ হল-এ তাঁর আসবার কথা সকাল আটটায়। সময়ানুবর্তী কবি-ভাই কোনদিনই ন'ন, সেদিনও এলেন ঘন্টাদুয়েক দেরি করে, দশটার সময়। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভারী খুশি। বললেন, এবারের এই চাকরিতে তোকে বেশ মানিয়েছে। ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তুই তাকাচ্ছিস, আর তোর চোখ-মুখ দিয়ে স্নেহ যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। আমি বলে দিচ্ছি মিলিয়ে নিস। মানুষ হবে তোর ছাত্রছাত্রীরা।এইসব বলার পর কবি-ভাই গান ধরলেন, আমি চলে গেলাম আমার ক্লাসে।তিনটে নাগাদ আমার শেষ ক্লাস। ক্লাসে দেখি ছেলের সংখ্যা খুবই কম, মেয়ে একজনও নেই। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সলিমুল্লাহ্‌ হলের পর কবি-ভাইকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ফজলুল হক হল-এ, সেখানে গান চলছে। অনুপস্থিত ছেলেমেয়েরা সবাই সেখানেই। ক্লাসে ছুটি দিয়ে আমি চলে গেলাম ফজলুল হক হলে, কবি-ভাই চোখ বুজে তন্ময় হয়ে গেয়ে চলেছেন গান। ছেলেমেয়েরা কী বুঝছিল আমি জানি না, আমার কিন্তু দেখেই মনে হল কবি-ভাইয়ের সমস্ত অঙ্গ ক্লান্তিতে ভরা। সকাল থেকে নিশ্চয়ই অভুক্তই আছেন। ফিসফিস করে একেবারে পেছনের সারির একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, কী খেয়েছেন কবি? সে বলল, খাননি। সেই যে সকালে বসেছেন, একনাগাড়ে বসেই আছেন, কখনও কথা বলছেন, কখনও গান। যেটা গাইছিলেন সেটা শেষ হলে কবি-ভাইয়ের অনুমতি না-নিয়েই আমি সভাভঙ্গ ঘোষণা করে দিলাম। সেটা অন্যায়, ওঁর অনুমতি আমার নিশ্চয়ই নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু রাগে তখন আমার গা রী রী করছে। ছেলেমেয়েরা সবাই চলে গেলে ওখানেই কিছু খাবার আনিয়ে খাওয়ালাম কবি-ভাইকে। উনি খেলেন, কিন্তু খুব শান্ত হাসিতে মুখ ভরিয়ে আমাকে বললেন, রাগ করিস না, ওরা ভারী সুন্দর, আল্লাহ্‌-র ওরা ভারী প্রিয়।এভাবে কবি-ভাইকে কথা বলতে আগে কখনো শুনিনি, মাথা নীচু করে চুপ করে রইলাম।পরে ছেলেদের কাছে শুনেছি, উনি নাকি ওদের বলেছেন, আল্লাহ্‌-র সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছে, কিন্তু সে-কথা জনসাধারণ্যে বলার সময় এখনও আসেনি। ওদের বলছেন, কারণ আল্লাহ্‌ নিজে ওদের ভারী ভালোবাসেন, আল্লাহ্‌-র ওরা খুব প্রিয়।ক্রমশ...
    কাদামাটির হাফলাইফ - ইট পাথরের জীবন - ইমানুল হক | নামাঙ্কনঃ ইমানুল হক। ছবিঃ র২হকথা - ২৫২০০০ সাল। আমরা কোক পেপসির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। এই সময় অর্থনীতিবিদ অমিয় বাগচীর বাড়ি গেছি। উনি বললেন, শুধু ভাঙলে হবে না, গড়তেও হবে। বলে খাওয়ালেন আমপোড়া শরবত। খেলাম। খেয়ে মনে হল এটা তো আমরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।তখন আমরা রবীন্দ্র সদনে কোকাকোলাকে স্টল দেওয়ার বিরোধিতা করে বাংলা কোলা বলে হাত মেশিনে তৈরি এক ধরনের পানীয় বেচছি।নাগেরবাজারের কাছে এক ভদ্রলোক ওই যন্ত্র বানাতেন। আমপোড়া শরবত আমি আগে খাই নি। নামও শুনিনি।পয়লা বৈশাখ নববর্ষ উৎসব উদযাপনে শুরু করলাম। একটু নতুন জিনিস সংযোজন করলাম, লেবু কাঁচালঙ্কা দিয়ে।গরম ছিল প্রচণ্ড।বানাচ্ছি।এক ভদ্রলোক মুখ মনে আছে, নাম জানা হয়নি। দুটো ঠান্ডা জলের বোতল ২০ টাকা দিয়ে কিনে এনে ঢেলে দিলেন।পাঁচটাকার আমপোড়া খেতে কুড়ি টাকা খরচ।এরপর নিজে কিনে খেলেন আরো চার গ্লাস।আস্তে আস্তে আমি ওস্তাদ হয়ে গেলাম আমপোড়া বানানোয়।আম পুড়িয়ে খোসা ছাড়িয়ে ক্কাথ ফ্রিজে রেখে দিতাম।এরসঙ্গে যুক্ত করলাম, গোটা জিরা ভাজা মশলা, গোলমরিচ গুঁড়া, বিট নুন, সৈন্ধব লবণ।আর শেষে দেওয়ার আগে একটু লেবুর রস ও শুকনো জিরা গুঁড়া।আহ।এই কাজ করেছি ১ বৈশাখ থেকে পঁচিশ বৈশাখ হয়ে ১১ জ্যৈষ্ঠ।টানা ছয় বছর বেচেছি রবীন্দ্র সদনে।পঁচিশে বৈশাখ তখন হতো সকালে জমজমাট।২৫ থেকে পঞ্চাশ কেজি আমের শরবত বিক্রি হতো।যাঁরাই কিনতে আসতেন আমরাও তৈরি করা পদ্ধতি শিখিয়ে দিতাম।২০০২-এ প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে কলকাতায় কোকপেপসি বিরোধী আন্দোলন করি।কলকাতায় দোকানে দোকানে ঘুরে প্রচার চালাই।লস্যি শরবত ডাব আমপোড়া শরবত বিক্রি করতে বলি।উল্টোডাঙ্গায় দুপুর রোদে এসে সংহতি জানিয়ে যান কবি শঙ্খ ঘোষ।আমপোড়া শরবত বিক্রি ও প্রচার প্রসারে ভূমিকা নেন কলকাতা দূরদর্শনের প্রযোজক বিভাসদা।এতে ভালো মন্দ দুই হয়।আমার আত্মীয় এক বাচ্চা বলে, দেখো আমাদের বংশের একটা সম্মান আছেআর তুমি প্রফেসার হয়ে আমপোড়া শরবত বেচো। লোকে কী বলবে বলো তো।কলকাতা দূরদর্শন প্রায়ই দেখাতো এটা।আর একটা ঘটনা। সত্যজিৎ রায়ের আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষ, শিল্পী উৎপলেন্দু চৌধুরী, চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার প্রায়ই এসে আমপোড়া শরবত নিয়ে যেতেন।এসে একটা বোতল দিয়ে যেতেন।ছয় গ্লাস।দু একবার ফেরৎ দিয়েছি।ভালো মানের নেই বলে।আপোস করি নি মানে।পরে সত্যদা, রাজু, বাপী, সুতপা শিখে যায় ভালো করে শরবত বানাতে।তো একবার হয়েছে কী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের উজ্জীবনী পাঠমালা।শীতকালে।উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছেন তরুণ মজুমদার।উনি আমাকে ওখানে দেখে বিস্মিত। তাকাচ্ছেন।বলতে কিছু পারছেন না।ভাব, আমপোড়া শরবত বিক্রি করনেওয়ালা এখানে কী করে?বিমলকুমার মুখোপাধ্যায় আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বললেন, চেনেন এঁকে?প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ায়।ভালো ছাত্র।তরুণ মজুমদারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গভীর হয়ে গেল।সৌজন্যে আমপোড়া শরবত।আমাদের ছোটবেলায় আমপোড়া শরবত ছিল না। ছিল ডাব। লস্যি পাওয়া যেত বর্ধমান শহরে কার্জন গেটের মুখে। সেখানে রামপ্রসাদের শরবত ও ঠান্ডা পানীয়ের দোকান। সেখানে কোল্ড কফিও মিলত। গ্রামে ছিল নানা রকম শরবত, এর মধ্যে নুন লেবু চিনি ছিল আজকের ভাষায় মারকাটারি, লা জবাব। আর ছিল ঘোল এবং ডাব। এই ডাব নিয়ে আজ চড়কের দিনে একটা ভালো ঘটনা মনে পড়ল। আমাদের গ্রাম দ্রাবিড় যুগের গ্রাম। প্রথম খণ্ডেই লিখেছি। মুসলিম বসতি কবে থেকে শুরু সে-নিয়ে পড়া কথা বলা যাবে। গ্রামের ৬৫ শতাংশ মুসলিম। গ্রামে ইদ বকরিদ দুর্গাপূজার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওলাইচণ্ডী পূজা আর গাজন। গাজন হতো চৈত্র মাসের শেষদিন। গাজনের দেবতা শিব। শিবকে সবাই মানেন। গ্রামের একমাত্র মন্দির ছিল, শিব মন্দির। তার পুরোহিত গন্তা বেনে। জাতে বেনে। আর গাজনের সন্ন্যাসী বেশিরভাগ মুচি সম্প্রদায়ের। সাতদিন ধরে উপোস করে গাজনের দিনে অনেক উঁচু থেকে ঝাঁপান দিতেন সন্ন্যাসীরা। তার আগে দণ্ডী কেটে আসতেন পুকুর থেকে। চৈত্র মাস। কাঠ ফাটা রোদ। সেই রোদে মাটিতে শুয়ে শুয়ে আসা। সন্ন্যাসীদের দলে থাকতো আমার গৌরদা। বাঙালি যাত্রাপালার নায়ক। সেই দেখে আমি তার অনুরাগী। গৌরদা না খেয়ে শুয়ে আছে, এটা আমাকে খুব কষ্ট দিত। তখন গরম বলে সকালে স্কুল। স্কুল থেকে ফিরে আমি শিব মন্দিরে গিয়ে বসতাম। তখন এসব নিয়ে কোনও ছুঁৎমার্গ ছিল না। গাজনের দিন হতো সবচেয়ে মজা। সবার শেষে অনেক উঁচু থেকে ঝাঁপ দেবে গৌরদা। নীচে কয়েকশো মানুষ। ধরে নেবে। নিয়ে মাথায় তুলে নাচবে। ওরাই তো তখন নায়ক। সন্ন্যাসীদের ধরার দলে হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের মানুষই থাকতেন।ঝাঁপ দেওয়ার আগে সন্ন্যাসীরা ছুঁড়তেন ফুল বেলপাতা। সেগুলো পাওয়ার জন্য সব ধর্মের মানুষ ব্যাকুল। বাবা শিবের ছোঁয়া পাওয়া পুণ্য বা নেকির কাজ।আর তারপরেই শুরু হতো আসল মজা।ডাব কাড়াকাড়ির খেলা। (ক্রমশঃ)
    ইদবোশেখির লেখাপত্তর - গুরুচণ্ডা৯ | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়শীতকাল বইমেলা হইচই-এর দিনকাল ফুরিয়ে এসে গেল শান্ত হয়ে বসে লেখালেখির কাল। বাইরে তাপমাত্রা বাড়ছে রোদ্দুরের জন্য, নির্বাচনের জন্য। সাথে কোথাও প্যাচপ্যাচে ঘাম তো কোথাও ঝরঝর বৃষ্টি। সন্ধ্যের আবছায়ায় দোকানে ভিড় জমায় সারাদিন রোজা রাখা ক্লান্ত মানুষ, গাজনের প্রস্তুতি নেওয়া শ্রান্ত মানুষ, চৈত্রসেলের হাতছানিতে মুগ্ধ মানুষ। টুপটাপ জমে ওঠে গল্পেরা, কবিতারা। নির্বাচনী জনসভার কোণাকাঞ্চিতে, ইফতারির থালার পাশে, গাজনের সন্ন্যাসীর ঝোলায় চুপটি করে অপেক্ষা করে তারা মানুষের জন্য। আমরা আপনাদের কাছে ডাক পাঠিয়েছিলাম তাদের খপ করে ধরে ফেলে, ঝপ করে লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে। এসে গেছে তারা। আগামী কয়েকদিন ধরে রোজ দুটি-তিনটি করে তারা এসে হাজির হবে বুলবুলভাজার পাতায় - টাটকা ভাজা, গরমাগরম। পড়তে থাকুন। ভাল লাগলে বা না লাগলে দুই বা আরো অনেক লাইন মন্তব্য লিখে জানিয়ে দিন সে কথা। মন চাইলে, গ্রাহক হয়ে যান লেখকের। আর হ্যাঁ, আপনিও লেখা নিয়ে চলে আসুন গুরু আর চন্ডালের আড্ডা গুরুচন্ডা৯-র পাতায়।সূচীপত্রঃস্মৃতিচারণবর্ষশেষ, বর্ষশুরু: অমিতাভ চক্রবর্ত্তীও চাঁদ: সেমিমা হাকিমসারেতে থাই নববর্ষ: হীরেন সিংহরায়কাব্যজলের সমাধি: জগন্নাথ দেব মন্ডলগিরগিটি ও অন্যান্য কবিতা: ফরিদাসমুদ্রে সনেট: সোমনাথ রায়পাঁচটি কবিতা: অমিতরূপ চক্রবর্তীতিনটি কবিতা: অরিত্র চ্যাটার্জিউপগ্রহ: অমিত চট্টোপাধ্যায়আব্বু আব্বা বাবা: মাজুল হাসানশেষের কবিতা: দীপ্তেনগপ্পোখুচরো: সুমন মুখার্জীসুফি: আফতাব হোসেন রতন, দ্য ব্যাকবেঞ্চার: নরেশ জানাডাক দিয়ে যায়: এস এস অরুন্ধতীমহারাজ ছনেন্দ্রনাথ ও মার্কণ্ডেয়র চিঠি: রমিত চট্টোপাধ্যায়পাখির অন্তর্ধান রহস্য: মৃণাল শতপথীএই ঘুম শারীরবৃত্তীয়: দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ওয়েথসাম: উপল মুখোপাধ্যায়কোশিশ কিজিয়ে: কিশোর ঘোষালটুনিমুনির জীবন: দময়ন্তীদৌড়বাজ হাউসকীপার: সমরেশ মুখোপাধ্যায়হন্য: সৈয়দ তৌশিফ আহমেদসীমান্তরেখা: প্রতিভা সরকারনভেলাফকির ফয়জুল্লাহ: মুরাদুল ইসলামনিবন্ধ আজ নববর্ষের আখ্যান: সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
  • হরিদাস পালেরা...
    কিষেণজি মৃত্যু রহস্য - পর্ব ৫  - বিতনু চট্টোপাধ্যায় | ‘সিপিআইএম কর্মীদের সঙ্গে ঝাড়খন্ড পার্টির রোজ সংঘর্ষ হোত। ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থন ছিল তখন কংগ্রেসের দিকে। ফলে একদিকে ঝাড়খন্ড পার্টি এবং কংগ্রেস, অন্যদিকে সিপিআইএম। এক্কেবারে সাপে-বেজিতে সম্পর্ক। জমিতে চাষ থেকে শুরু করে এলাকা দখল, পঞ্চায়েত ভোট থেকে মন্দির কমিটি গঠন, সব কিছু নিয়ে সংঘর্ষ, খুনোখুনি। কিন্তু পুলিশের ওপর গ্রামবাসীদের এত রাগ কেন? খবর নিয়ে জানলাম, কোনও সংঘর্ষ, মারপিটের পরই এক একটা ঘটনায় সিপিআইএম থেকে একদম ভোটার লিস্ট ধরে ঝাড়খন্ড পার্টির ২৫, ৩০, ৪০ জনের নামে মামলা করে দেওয়া হোতও থানায়। তারপর শাসক দলের পক্ষ থেকে শুরু হোত পুলিশের ওপর চাপ, গ্রামে তল্লাশি এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে যেত পুলিশ। পুলিশ আসবে জেনে গ্রাম খালি করে পালাত ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা, কর্মী, সমর্থকরা। আর পুলিশের তল্লাশির পর পরই গ্রামে ঢুকত সিপিআইএম বাহিনী। সিপিআইএম জানত, ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা-কর্মীরা থাকলে তারা গ্রামে ঢুকতে পারবে না, বাধা পাবে। তাই পুলিশের ভয়ে ঝাড়খন্ডি নেতারা গ্রাম ছাড়ার পর পরই এলাকায় ঢুকত সিপিআইএম বাহিনী। তারপর বেছে বেছে ঝাড়খন্ডিদের বাড়িতে আগুন, ভাঙচুর, লুঠপাট চালানো হোত। এর পুরোটা যে সব সময় পুলিশ এবং সিপিআইএম ষড়যন্ত্র করে করত তা হয়তো নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটত এমনটাই। বেশ কয়েকবারের অভিজ্ঞতা থেকে ঝাড়খন্ড পার্টি এবং আদিবাসীদের একটা বড় অংশের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়ে যায়, পুলিশ এবং সিপিআইএম ষড়যন্ত্র করে এমন করছে। ফলে পুলিশকে গ্রামে ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তখন ঝাড়গ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে সিপিআইএমের ততটা প্রভাব ছিল না। বরং আদিবাসীদের মধ্যে ঝাড়খন্ড পার্টির প্রভাব ছিল অনেক বেশি। আদিবাসীরা জানত, পুলিশের সাহায্য ছাড়া সিপিআইএম ক্যাডাররা গ্রামে ঢুকতে পারবে না। এই জায়গা থেকেই আদিবাসীরা পুলিশকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দিতে শুরু করেছিল। আমি যখন নয়ের দশকের মাঝামাঝি ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, জামবনি, কাঁকড়াঝোড়ের বিভিন্ন আদিবাসী এলাকায় যেতে শুরু করি, তখন তাদের মধ্যে এই পুলিশ বিরোধী মনোভাব তীব্র আকার নিয়েছে।’ টানা বলে সামান্য থামলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। তারপর ফের বলতে শুরু করলেন, ‘একবার কাপগাড়ির কাছে দু’জন ঝাড়খন্ডি কর্মী খুন হয়েছিলেন। কিন্তু মৃতদেহ তোলার জন্যও গ্রামে পুলিশকে ঢুকতে দেয়নি আদিবাসীরা। পুলিশ সুপার নিজে গিয়েছিলেন, তাও ঢুকতে পারেননি গ্রামে। তীর, ধনুক নিয়ে আদিবাসীরা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। নিজেদের লোক খুন হয়েছে, তাও মৃতদেহ নিতে কিংবা সিপিআইএমের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করার জন্যও গ্রামে পুলিশকে ঢুকতে দেয়নি তারা। এতটাই ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে রাগ। তাছাড়া ঝাড়খন্ডিদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, সিপিআইএমের বিরুদ্ধে পুলিশকে অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হবে না।  এরকম এক পরিস্থিতিতে ঝাড়গ্রামে ডিউটিতে গিয়ে প্রথমেই মনে হয়েছিল, এভাবে কাজ করা যাবে না। আদিবাসীদের আস্থা, বিশ্বাস অর্জন করতে হবে এবং গ্রামে ঢুকতে হবে। নয়তো কাজ করা অসম্ভব। এবং ঠিক করি, শুধুমাত্র কোনও ঘটনা ঘটলে, সংঘর্ষ-খুনোখুনি হলে গ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করব, এটা হবে না। কোনও ঘটনা ছাড়া সাধারণ দিনেও গ্রামে যেতে হবে। এবং বিরাট ফোর্স নিয়ে গ্রামে ঢোকা যাবে না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গাড়ি নিয়ে গ্রামের ভেতরে ঢোকা যাবে না। গ্রামে ঢুকতে হবে হেঁটে। এই তিনটে কাজ করতে পারলেই একমাত্র আদিবাসীরা আমাদের সম্পর্কে ধারণা কিছুটা পালটাতে পারে। এই পদ্ধতিই চালু করলাম। রোজ বিকেলে একটা করে গ্রামে যেতে শুরু করলাম। সঙ্গে শুধু এসডিপিও এবং ওসি। তিনজনে হেঁটে গ্রামে ঢুকতে শুরু করলাম। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। আদিবাসীরা অত্যন্ত সংবেদনশীল। অধিকাংশ বাড়িতেই উঠোনে থাকত ছোট মন্দির। পুরো উঠোন পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখত ওরা। জুতো পরে ওদের বাড়ির উঠোনে হাঁটাচলা করলে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হোত। পুলিশ তা করতও। রেগে গেলেও ওরা কিছু বলতে পারত না। আমরা গ্রামে ঢুকে কোনও বাড়ির উঠোনে ওঠার আগে জুতো খুলে নিতাম। তারপর বাড়ির দাওয়ায় বসে গল্প করতাম। আস্তে আস্তে লোক জড়ো হতে শুরু করল। ওসি অপূর্ব আমাকে জামবনির বুদ্ধেশ্বর টুডু নামে এক আদিবাসী নেতার কথা বলেছিলেন। বুদ্ধেশ্বর ভাল ফুটবল খেলতেন। কলকাতায় দ্বিতীয় ডিভিশন পর্যন্ত খেলেছেন। তারপর গ্রামে ফিরে যান। সিপিআইএমের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। ভালো কথা বলতেন, সহজাত নেতা। ঝাড়খন্ড পার্টির হয়ে পরে পঞ্চায়েত ভোটে লড়েছিলেন। জেতেনও। বুদ্ধেশ্বরের সঙ্গে কথা বলতাম, ঝাড়খন্ড পার্টির আরও কয়েকজন নেতা, জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আস্তে আস্তে সম্পর্ক গড়ে উঠল।’‘যে জায়গাগুলোর কথা বলছেন, সবই তো বেলপাহাড়ি, বিনপুর কিংবা জামবনি। লালগড়ের কী অবস্থা ছিল তখন?’ টানা বলছিলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম লালগড়ের কথা। কারণ, ২০০৮ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত রাজ্যে তো বটেই, দেশেও মাওবাদী অ্যাক্টিভিটির শিরোনামে লালগড়।  ‘না না, লালগড়ে আমাদের যেতেই হত না। সেই সময় নয়ের দশকের মাঝামাঝি ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সবচেয়ে শান্ত এলাকা ছিল লালগড়। কেউ মাওবাদী নাম তো শোনেইনি, কোনও সংঘর্ষ, মারামারিও ছিল না। মানুষও ছিল খুব শান্ত প্রকৃতির। তখন ঝাড়গ্রাম থেকে গাড়ি করে লালগড়ে যাওয়া যেত না। কংসাবতী নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি হয়নি। একদিন দুপুরে ঝাড়গ্রাম গিয়েছি, খবর পেলাম লালগড়ে একটি আদিবাসী মেয়ে খুন হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে নয়, কিন্তু খুন তো! তাছাড়া আমার এলাকাতেও পড়ে। ঠিক করলাম লালগড় যাব, দেখে আসব কী হয়েছে। জল কম ছিল, হেঁটে কংসাবতী পেরোলাম। লালগড় থানার ওসি গাড়ি নিয়ে নদীর অন্যপারে অপেক্ষা করছিলেন। ওসির গাড়িতে উঠে ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে শুরু করেছে। দূর থেকে হেড লাইটের আলোয় দেখলাম, রাস্তার ধারে দুটো লোক হাত জোড় করে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতুহল হল। ড্রাইভারকে বললাম, ওঁদের সামনে গাড়ি থামাতে। ওসি বললেন, ‘‘স্যার মাতাল। দুপুরেই মদ খেয়ে নিয়েছে।’’ গাড়ি থামার পরও দেখি মাথা নীচু করে হাত জোড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? ‘‘বাবু, তোরা ভগবান আছিস। তোরা ভগবান আছিস রে।’’দু’বার বলল একই কথা। দুজনেই। আমি তো প্রথমে বুঝতে পারিনি কেন বলছে একথা। কিছুক্ষণ পরে গ্রামে ঢুকে বুঝলাম এর মানে। লালগড় ছিল পিছিয়ে পড়া এলাকা। মানুষ প্রচণ্ড গরিব। পুলিশ, সরকারি অফিসাররা কোনও কাজের জন্য সেখানে গেলে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠত ওদের চোখে, মুখে। এত শান্ত এলাকা ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার জন্য সরকারি সহায়তা লালগড়ে পৌঁছাত কম। ওখানকার মানুষ বিশেষ কিছু আশাও করত না সরকারের কাছে। তাই একটি মেয়ের খুনের ঘটনায় এত দূর থেকে পুলিশ গ্রামে এসেছে, এটাই ছিল সেই সময় ওদের কাছে বিরাট ব্যাপার। এই ঘটনার ১০-১২ বছর পর কলকাতায় বসে দেখলাম, সেই লালগড়ে মানুষ পুলিশকে এলাকায় ঢুকতে দিচ্ছে না। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে এই শান্ত লালগড় এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। এতটাই শান্ত এলাকা ছিল লালগড়, আমরা এক সময় ভেবেওছিলাম, ওই এলাকাটাকে ঝাড়গ্রাম মহকুমা থেকে বের করে দেব। সরকারি স্তরে এমন আলোচনাও শুরু হয়েছিল। ২০০৮ সালের শেষে লালগড় আন্দোলন যখন শুরু হয়, আমি কলকাতায়। বারবারই মনে পড়েছে ১২ বছর আগের এক সন্ধ্যায় লালগড়ে রাস্তার ধারে দুজন স্থানীয় মানুষের হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। যাঁরা পুলিশ দেখে বলেছিল, ‘বাবু তোরা ভগবান আছিস।’ প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে একটা ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ সন্ধ্যায় যাচ্ছে এটাই ওদের কাছে তখন বিরাট প্রাপ্তি ছিল। কী ঘটে গেল ১০-১২ বছরের মধ্যে, এই সাধারণ, সরকারের কাছে কোনও প্রত্যাশাহীন মানুষগুলোই এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল!      তবে, লালগড় ছিল যতটা শান্ত, ততটাই ভয়ঙ্কর এলাকা ছিল মেদিনীপুরের কেশপুর। খড়গপুর থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তায় ধর্মার মোড় ২০-২২ কিলোমিটার গেলেই কেশপুর। রোজ ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএমের মধ্যে সংঘর্ষ হোত কেশপুরে। ভোর ৪টে-সাড়ে ৪টের মধ্যে দু’দল তীর ধনুক, বন্দুক নিয়ে রেডি হয়ে যেত। রীতিমতো শাঁখ, কাসর-ঘন্টা বাজিয়ে শুরু হয়ে যেত সংঘর্ষ। সারাদিন চলত মারামারি, সংঘর্ষ। রোজ নিয়ম করে দু’পক্ষ মিলে ২৫-৩০ জন জখম হোত। কেউ হাসপাতালে যেত, কেউ যেত না। সন্ধেবেলা যুদ্ধ বিরতি। এ ছিল প্রায় রোজকার ঘটনা।’ ‘ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের এই রোজ রোজ সংঘর্ষ হোত কী নিয়ে? একটা কারণ থাকবে তো!’ জিজ্ঞেস করলাম প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কে। ‘এক একদিন এক একটা কারণ। ধরাবাঁধা কিছু নেই। একদিন সন্ধ্যায় জামবনিতে ঝাড়খন্ড পার্টির এক কর্মী খুন হলেন। প্রায় মাঝরাতে মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারল পুলিশ। পরদিন সকাল থেকে এই নিয়ে উত্তেজনা পুরো জামবনি, বিনপুরে। সকালে অফিসে কিছু কাজ ছিল। তা শেষ করে দুপুরে মেদিনীপুর শহর থেকে রওনা দিলাম জামবনির উদ্দেশে। রাস্তায় যেতে যেতেই ওয়্যারলেসে খবর পেলাম বুদ্ধ ভকতের গুলি লেগেছে। তাঁকে ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হল, পরিস্থিতি আজ হাতের বাইরে চলে যাবে। আগের রাতে ঝাড়খন্ডি খুন। আর তার বদলায় আজ বুদ্ধ ভকত গুলিবিদ্ধ! বুদ্ধদেব ভকত তখন বিনপুরের সিপিআইএম বিধায়ক। অরিজিনাল বাড়ি জামবনির চুটিয়া গ্রামে। ঝাড়গ্রাম শহরেও বাড়ি আছে। তখন এলাকায় বুদ্ধ ভকতের যত না প্রভাব তার চেয়ে ঢের বেশি দাপট, প্রতিপত্তি তাঁর ভাই বাসুদেব ভকতের। বাসু ভকত নামেই সিপিআইএমের জামবনি লোকাল কমিটির নেতা, আসলে তিনিই জামবনির শেষ কথা। পার্টির মদতে এবং প্রশ্রয়ে ঝাড়গ্রাম মকুমার একছত্র নেতা, ঝাড়খন্ড পার্টির কাছে মূর্তিমান ত্রাসের নাম বাসু ভকত। ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থক আদিবাসীদের ওপর বাসু ভকত এবং তাঁর দলবলের অত্যাচারের কাহিনী তখন জামবনির লোকের মুখে মুখে। তাঁর সামান্যই গিয়ে পৌঁছত কলকাতায়। পেশি শক্তির জোরে এলাকা দখল এবং একাধিপত্য স্থাপনের যে রাজনীতি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় সিপিআইএম শুরু করেছিল, ঝাড়গ্রামে তার মুখ ছিলেন বাসু ভকত। ঝাড়গ্রাম শহরে ঢুকলাম, চারদিকে থমথমে পরিবেশ। ঠিক কেমন বলে বোঝানো মুশকিল, কিন্তু কোনওদিন ঝাড়গ্রাম না যাওয়া কেউ সেখানে হঠাৎই গিয়ে পড়লে বুঝবে কিছু গুরুতর ঘটেছে। একটা অঘোষিত বনধের চেহারা। অনেক দোকান-পাট বন্ধ। মোড়ে মোড়ে জটলা। ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে পৌঁছানোর পর প্রথমেই এসডিপিও বললেন, ‘স্যার, বুদ্ধ ভকতের কিন্তু গুলি লাগেনি। এলাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার জন্য সিপিআইএম গুলির কথা রটিয়ে দিয়েছে।’ হাসপাতালের ভেতরে ঢুকলাম। বাইরে, হাসপাতাল চত্বরে প্রচুর ভিড়। কয়েক’শো-হাজার সিপিআইএম কর্মী, সমর্থক বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জড়ো হয়েছে বিধায়কের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে। আরও লোকজন আসছে বুঝতে পারছি। ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে গণ্ডগোল, সংঘর্ষ শুরু করার জন্য একদম অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে বাসু ভকতের বাহিনী। হাসপাতালে ঢুকে খবর নিয়ে জানলাম, বিধায়ক বুদ্ধদেব ভকত এক দলীয় কর্মীর মোটরসাইকেলের পিছনে বসে যাচ্ছিলেন জঙ্গলের ভিতরের রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ কিছু একটা শব্দ হয়। গুলির শব্দ ভেবে মোটরসাইকেলের চালক ভয় পেয়ে রাস্তার ধারে পড়ে যান। পড়ে গিয়ে পায়ে হাঁটুর কাছে চোট পান বুদ্ধ ভকত। কিছু জায়গায় কেটে-ছড়েও যায়। এরপরই বুদ্ধ ভকতের আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে এলাকাজুড়ে। প্রথমে রটে যায়, বিধায়ক গুলিবিদ্ধ। তারপর সিপিআইএম রটিয়ে দেয়, বুদ্ধ ভকতকে আক্রমণ করেছে ঝাড়খন্ড পার্টি। তাঁকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। হাসপাতালেই শুনতে পেলাম, সিপিআইএম পরের দিন বন্‌ধ ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরের দিনের কর্মসূচি কী হবে তা নিয়ে ঝাড়গ্রামের নেতারা কথা বলছেন জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে আমি এসপিকে জানালাম, ‘বুদ্ধ ভকতের কিচ্ছু হয়নি। মোটরসাইকেল থেকে পড়ে চোট পেয়েছেন। গুলি চলেনি।’ সন্ধে নামছে। হাসপাতাল চত্বরে ভিড় বাড়ছে শাসক দলের কর্মীদের। ঝাড়গ্রাম থানার দিকে রওনা দিলাম। হাসপাতাল ছাড়ার আগে বুদ্ধ ভকত এবং সিপিআইএমের নেতাদের বলে গেলাম, থানায় গিয়ে অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য। কিন্তু এলাকার পরিবেশ, পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারছিলাম, সিপিআইএম এই ইস্যু সহজে ছাড়বে না। আমরা যাই বলি না কেন, সিপিআইএম তা মানবে না। বিধায়ক আক্রান্ত এই প্রচারকে সামনে রেখে নতুন করে অশান্ত করতে চাইবে জামবনি, বিনপুর এবং আশপাশের এলাকা। অনেক রাতে বুদ্ধদেব ভকতকে নিয়ে সিপিআইএমের বিরাট বাহিনী এল ঝাড়গ্রাম থানায়। তারপর জামবনি, বেলপাহাড়ি এলাকার ঝাড়খন্ড পার্টির ২৫-৩০ জন গুরত্বপূর্ণ নেতার নামে অভিযোগ লিখে জমা দিল। এলাকায় ঝাড়খন্ড পার্টির যত নেতা ছিল বেছে বেছে সবার নামে অভিযোগ করা হল। এও ওই জেলার সিপিআইএমের এক পুরনো কায়দা। বিরোধীদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দিয়ে তাদের হেনস্থা করার, এলাকাছাড়া করার কৌশল। বুদ্ধ ভকতকে বলে দিলাম, এই মিথ্যে অভিযোগ নিতে পারব না। গুলিই চলেনি, আর এতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ? সিপিআইএম কিছুতেই মানতে রাজি নয়। বেশ কিছুক্ষণ চলল এই নিয়ে টানাপোড়েন। সিপিআইএমের ভিড়টা হাসপাতাল থেকে আস্তে আস্তে থানার বাইরে এসে জড়ো হতে শুরু করেছে তখন। রাত প্রায় ১১টা নাগাদ একদম গোপনে বুদ্ধদেব ভকতের দেহরক্ষীর বয়ান রেকর্ড করলাম থানায়। বুদ্ধ ভকতের পিছনে অন্য একটা মোটরসাইকেলে বসেছিলেন তাঁর দেহরক্ষী। দেহরক্ষী বয়ানে লিখে দিলেন, একটা শব্দ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তা গুলির নয়। রাত প্রায় ১২টা নাগাদ সিপিআইএম নেতাদের সঙ্গে আবার বসলাম। জানিয়ে দিলাম, সত্যি ঘটনা লিখে অভিযোগ জমা দিতে। এভাবে যার তার নামে গণ-অভিযোগ জমা দেওয়া যাবে না। এও জানালাম, বুদ্ধদেব ভকতের দেহরক্ষীর লিখিত বয়ান আমাদের কাছে রয়েছে। মিথ্যে অভিযোগ করে কোনও লাভ হবে না। সেক্ষেত্রে আসল ঘটনা আদালতে জানাতে বাধ্য হব। একথা শুনে সিপিআইএমের নেতারা একটু থমকে গেলেন। তারপর যা ঘটেছে তার বিবরণ লিখে বেরোলেন থানা থেকে। সেই রাতের মতো ঝামেলা মেটানো গিয়েছে ভেবে থানা থেকে বেরোলাম। কিন্তু এই জেলার নাম মেদিনীপুর। এবং সেটা নয়ের দশকের মাঝামাঝি। ভোর ৫টা নাগাদ ফিরলাম মেদিনীপুর শহরের কোয়ার্টারে। ঠিক করলাম, আর শোব না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাবে। ছেলে স্কুলে চলে গেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেব। পোশাক বদল করে সবে একটু বসেছি, ল্যান্ডলাইন বাজল। ঝাড়গ্রাম এসডিপিওর ফোন। ‘‘স্যার, সর্বনাশ হয়েছে। সিপিআইএমের ছ’জন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যকে অপহরণ করেছে ঝাড়খন্ডিরা।’’‘‘মানে? কখন?’’ ‘‘স্যার, এখনই খবর পেলাম। কোথায় নিয়ে গিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। কাল মাঝরাত থেকে একটু আগে পর্যন্ত জামবনি, বেলপাহাড়ির ছ’জন সিপিআইএম পঞ্চায়েত প্রধান এবং সদস্যকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ঝাড়খন্ড পার্টির লোকজন। কারও কোনও হদিশ নেই। মেরে ফেলেছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না।’’‘‘ঠিক আছে। আসছি।’’ ফোন রেখেই পোশাক পরতে গেলাম। এই অশান্তি থামার নয়। দুইয়ে দুইয়ে চার। বুদ্ধ ভকত আক্রান্ত হওয়ার কথা গতকাল রাতে সিপিআইএম রটিয়ে দেওয়ার পর থেকেই আতঙ্কের প্রহর গুণছিলেন ঝাড়খন্ড পার্টির নেতারা। তাঁরা জানতেন, এই ঘটনা নিয়ে সিপিআইএম-পুলিশ তাঁদের গ্রামে হানা দেবে। তা থেকে বাঁচতে নিজেরাই পালটা আক্রমণের রাস্তা নিয়েছেন সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যদের অপহরণ করে। কিন্তু মাঝরাতে পুলিশ যে বুদ্ধ ভকত, বাসু ভকতদের চাপেও মিথ্যে অভিযোগ নেয়নি, তা ঝাড়খন্ড পার্টির নেতারা জানতেন না কিংবা আন্দাজ করতে পারেননি। তখনও মেদিনীপুরের জামবনি, বেলপাহাড়ি, লালগড়কে কলকাতার মানুষ জঙ্গলমহল বলত না। কিন্তু কী বিচিত্র হিংসা, প্রতিহিংসার রাজনীতি ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার এই জঙ্গল এলাকায়।বেরনোর জন্য রেডিও হতে পারিনি। আবার ল্যান্ডলাইন বাজল। এবার ফোন জেলার পুলিশ সুপার দেবকুমার বসুর। ‘‘কী হয়েছে বল তো? এই ভোর রাতে দীপক সরকার ফোন করে চিৎকার করছেন, যা তা বলছেন ফোনে।’’ ‘‘স্যার, ঝাড়খন্ড পার্টির লোকজন বেলপাহাড়ি, জামবনি থেকে সিপিআইএমের পঞ্চায়েত প্রধান এবং সদস্য মিলে ছ’জনকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে। আমি বেরোচ্ছি।’’‘‘ঠিক আছে, দীপক সরকারের সঙ্গে একবার কথা বলে নাও। আমি ওনাকে বলে দিয়েছি তোমার সঙ্গে কথা বলতে।’’‘‘আমি কী বলব। স্যার, আপনিই বলে দিন।’’‘‘না না, তুমি সব কিছু জান। তুমিই কথা বল।’’দীপক সরকার তখন মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পাদক। বিরোধী দল তো বটেই, নিজের দলেরও অনেকে তখন তাঁর ভয়ে কাঁপে।বেরনোর জন্য পুরো রেডি হয়ে ফোন করলাম দীপক সরকারকে। ফোন তুলেই চিৎকার শুরু করলেন সিপিআইএমের জেলা সম্পাদক।‘‘কী ভেবেছেনটা কী আপনারা? আমাদের ছ’জন পঞ্চায়েত সদস্যকে তুলে নিয়ে গেল। আর আপনি ঝাড়খন্ডিদের দালালি করছেন? কাল রাতে আমাদের অভিযোগ পর্যন্ত নেননি?’’আমি সাধারণত রাজনৈতিক লোকজনের সঙ্গে বেশি কথা বলতাম না। স্থানীয় স্তরে ওসি এবং ওপরতলায় পুলিশ সুপারই এসব করতেন। একে সারারাত জাগা। আবার বেরনোর জন্য রেডি হচ্ছি। এর মধ্যে দীপক সরকারের চিৎকার শুনে আমারও মাথা গরম হয়ে গেল। ‘‘কী বলছেন উলটো পালটা। আপনি কি পার্টির কোনও ক্যাডারের সঙ্গে কথা বলছেন নাকি? জানেন কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়?’’‘‘আপনি বাসু ভকতের সঙ্গে কথা বলেন না। আমাদের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন না। শুধু ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন।’’ ‘‘বাসু ভকতের সঙ্গে আমি কেন কথা বলব? ওনাকে বলবেন ওসির সঙ্গে কথা বলতে।’’‘‘আমাদের ছ’জনকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ঝাড়খন্ডিরা। আমাদের লোকজন না ফিরলে সব আগুন জ্বালিয়ে দেব।’’‘‘আমি ঝাড়গ্রাম যাচ্ছি। আপনার লোকদের বাঁচাতে পারব কিনা জানি না, তবে চেষ্টা করব।’’ এরপর সিপিআইএম জেলা সম্পাদকের ফোন রেখে বেরোলাম কোয়ার্টার থেকে। সকাল ৭টা নাগাদ পৌঁছালাম ঝাড়গ্রাম। সোজা চলে গেলাম জামবনি। কোনও ফোর্স ছাড়া ঝাড়খন্ড পার্টির শক্তিশালী এলাকায় গ্রামের ভেতরে ঢুকলাম পায়ে হেঁটে। গাড়ি রেখে দিলাম অনেক দূরে। যেভাবে এসডিপিও, ওসির সঙ্গে আদিবাসী গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতাম ঠিক সেভাবে। বুদ্ধেশ্বর টুডু এবং ঝাড়খন্ড পার্টির কয়েকজন নেতাকে খুঁজে বের করলাম ওই সকালে। ওরা সকলেই আমাকে বিশ্বাস করত। জানত, আমরা অন্তত ওদের কোনও ক্ষতি করব না। কিছুক্ষণ কথা বলে মনে হল, ওদের কেউই সিপিআইএমের ছয় পঞ্চায়েত সদস্যকে অপহরণের খবর পুরোপুরি জানে না। কিন্তু ঘটনা তো ঘটেছে। ওরাই তারপর নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে ওদের দলের আরও কিছু নেতাকে খবর দিল। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। সকাল ১০টা নাগাদ ঝাড়খন্ড পার্টির আরও কয়েকজন নেতা সেখানে এলেন। বোঝা গেল তাঁদের মধ্যে দু’একজন জানেন এই অপহরণের খবর। কিন্তু সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা কেউ জানেন না। জানলেও বললেন না তখন। এমনকী মেরে ফেলেছে কিনা তাও কারও জানা নেই। ওঁদের সঙ্গে আরও ভেতরে গ্রামে ঢুকলাম অনেকটা হেঁটে। যেখানে একদম ওদের ঘাঁটি। সেখানে আরও কয়েকজন ছিলেন নেতা টাইপের।  ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের বললাম, যেভাবে হোক সিপিআইএমের পঞ্চায়েত সদস্যদের উদ্ধার করতেই হবে। বুঝিয়ে বললাম, আগের দিন বিধায়ক বুদ্ধদেব ভকতের ঘটনায় একজন ঝাড়খন্ডির নামেও কেস হয়নি। কিন্তু তার বদলায় যদি ছ’জন সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যের কিছু হয়ে যায়, তা খুব খারাপ হবে। তখন আর আমাদের কিছু করার থাকবে না। প্রথমে ওঁরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না আমার কথা। বিশেষ করে বুদ্ধদেব ভকতের ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে কেস না হওয়ার ব্যাপারটা। দেখছি ওঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন নিজেদের ভাষায়। কী বলছেন তাও বুঝতে পারছি না সব। এরপর আমাদের বসতে বলে দু’তিনজন কোথাও একটা বেরিয়ে গেলেন। আমরা অপেক্ষা করছি। কী হচ্ছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। দুপুর হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে ওখানেই শুনলাম, সিপিআইএমের ছ’জনকে জামশেদপুরের দিকে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁরা বেঁচে আছেন কিনা ওখানকার ঝাড়খন্ডি নেতারা কেউ জানেন না। খবর নিতে লোক পাঠিয়েছেন। একদম সকালে প্রথম যে গ্রামে গিয়েছিলাম সেখানে আবার হেঁটে হেঁটে ফিরলাম। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তখনও বুঝতে পারছি না। শুধু বুঝতে পারছি, ছ’জন সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যকে ঝাড়খন্ডিরা খুন করে দিলে আগুন জ্বলবে জামবনি, বেলপাহাড়িতে। তা যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে কারও জানা নেই। আরও কতদিন চলবে এর রেশ কেউ জানে না। হঠাৎ ওয়্যারলেসে এসপির গলা পেলাম।‘‘কোথায় চলে গেছ তুমি? সকাল থেকে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। অফিসাররাও কেউ বলতে পারছে না তুমি কোথায়।’’‘‘স্যার আমি ঠিক আছি। গ্রামে ঢুকেছি সিপিআইএমের পঞ্চায়েত সদস্যদের খোঁজে। দেখা যাক কিছু করা যায় কিনা।’’‘‘বেশি ঝুঁকি নিও না। সাবধানে।’’ বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে হয়ে আসছে। ঝাড়খন্ড পার্টির নেতাদের সঙ্গে বসে আছি গ্রামের মধ্যে। কোনও খবর নেই। শুধু জানি, অপহৃত পঞ্চায়েত সদস্যদের জামশেদপুরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাঁদের খোঁজে কয়েকজন রওনা দিয়েছে। যারা ফেরানোর জন্য গিয়েছে তারা পৌঁছানোর আগেই যদি সিপিআইএম সদস্যদের মেরে ফেলে থাকে তবে সর্বনাশ। টেনশনে মাঠে পায়চারি করছি, সন্ধে সাতটা নাগাদ কয়েকজন মিলে সিপিআইএমের পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে এল। সবাইকে অক্ষত অবস্থায়। আমি তখন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। একদম সকালে শুরু হয়েছিল অপহৃতদের উদ্ধারের প্রক্রিয়া। প্রায় ১২ ঘন্টা বাদে ঝাড়খন্ড পার্টির নেতারা তাঁদের ফিরিয়ে দিলেন। সেই সময়ের ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংঘর্ষের পরিবেশে তা ছিল অবিশ্বাস্য ঘটনা। রাত আটটা নাগাদ অপহৃত সিপিআইএম পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে জামবনি থানায় ফিরলাম। ফোন করলাম দীপক সরকারকে। বললাম, ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে অনেক নেগোশিয়েট করে তাঁদের ফেরত নিয়ে এসেছি। চাই না কারও নামে কোনও মিথ্যে মামলা করা হোক। থানায় বসে ভোটার লিস্ট মিলিয়ে এর নাম দেবেন, ওর নাম দেবেন এই সব অ্যালাউ করব না। সিপিআইএম জেলা সম্পাদক বললেন, ‘‘বাসু ভকতকে থানায় পাঠাচ্ছি। ও আপনার সঙ্গে কথা বলে নেবে।’’ ‘‘না। ওনার সঙ্গে আমি দেখা করব না। আমার সঙ্গে কথা বলার কী দরকার?’’ ‘‘বুদ্ধ ভকতের ওপর আক্রমণের ঘটনাতেও আপনি আমাদের অভিযোগ নেননি।’’‘‘আমি জানি কী হয়েছে। বুদ্ধদেব ভকতের নিরাপত্তা রক্ষীর লিখিত বয়ান আছে আমাদের কাছে। গুলি চলেনি।’’ সেদিন রাত ১০টা নাগাদ পুরো ঝামেলা মিটল। তারপর মাঝরাতে মেদিনীপুর শহরে ফিরলাম।’ থামলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারে বসে আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছি তখন। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি জামবনি, বেলপাহাড়ির জঙ্গল ঘেরা গ্রাম, আদিবাসী ঝাড়খন্ডি যোদ্ধার শক্ত চোয়াল, সিপিআইএম বাহিনী, ঝাড়গ্রাম হাসপাতালের সামনে শাসক দলের জমায়েত, দীপক সরকারের মুখ-চোখ, সব কিছু।  ‘এ তো পুরো সিনেমার মতো। কিন্তু তার মানে, আপনি যখন ঝাড়গ্রামে জয়েন করেন, তারও অনেক আগে থেকেই ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের এই সংঘর্ষ, গণ্ডগোলের শুরু।’ প্রশ্ন করলাম প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কে।‘তা তো বটেই। আমি যখন গিয়েছি তখন তো ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে লড়াই, সংঘর্ষ চরমে। একদম শুরুর ঘটনা জানতে হলে আপনাকে আরও পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। অনেকটা পিছিয়ে যেতে হবে।’‘কে বলতে পারবে এই ইতিহাস? না বানিয়ে, ঠিকঠাক মতো।’‘নরেন হাঁসদা পারতেন। কিন্তু তিনি তো বেঁচে নেই। একজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। ডহরেশ্বর সেনকে চেনেন? বলবেন কিনা জানি না, কিন্তু উনি যদি চান, আপনাকে অনেক কিছু বলতে পারেন। ঝাড়গ্রাম ব্লকের আদিবাসীদের, ঝাড়খন্ডিদের, সিপিআইএমের কথা উনি অনেকের থেকেই বেশি জানেন।’প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য শেষ। উঠে আসছি তাঁর অফিস থেকে। ভাবছি, ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের এই লড়াই-সংঘর্ষের শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে হবে। আরও পিছিয়ে যেতে হবে তার জন্য। ‘আর একটা ঘটনা বলি শুনুন, তবে খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন কী অবস্থা ছিল সেই সময় অবিভক্ত মেদিনীপুরের।’ ফের বললেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।আবার বসে গেলাম। এই অজানা ঘটনাগুলো জানতেই তো তাঁর সাক্ষ্য নেওয়া।‘হ্যাঁ, বলুন।’ আবার বলতে শুরু করলেন আইপিএস প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। ‘তখন, মানে নয়ের দশকের মাঝামাঝি জামবনি, বেলপাহাড়ি বিনপুরের তুলনায় কোনও অংশে কম ছিল না কেশপুর। কেশপুরে তখন রোজ সংঘর্ষ হোতও ঝাড়খন্ড পার্টির সঙ্গে সিপিআইএমের। অথচ কেশপুরে বেশি আদিবাসী ছিল না। কিন্তু কংগ্রেসের সব লোক সিপিআইএমকে ঠেকাতে ঝাড়খন্ডিদের সমর্থক হয়ে গিয়েছিল। কেশপুরের ৩৫-৪০টা গ্রামে রোজ সকাল থেকে মারপিট হোতও দুই দলের মধ্যে। আর বিকেলে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হোতও দু’দলের জখম লোকজন। মেদিনীপুরে পোস্টিংয়ের পর কেশপুরের ওসির কাছে এমনই রিপোর্ট পেলাম। ওসিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘রোজ মারপিট হচ্ছে, সংঘর্ষ হচ্ছে দু’দলের। থামানো যাচ্ছে না কেন?’’ ওসি বললেন, ‘‘এত বড় এলাকা। কম ফোর্স। কী করে ঠেকাব?’’ তাঁর কথাও খানিকটা ঠিক। এসপির সঙ্গে কথা বললাম। ঠিক হল কেশপুরে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ক্যাম্প করা হবে।  ক্রমশ...।  
    জিনগত পাপক্ষয় সহ অন্যান্যরা  - ফরিদা | ১খেলনার ভিতরের ঘর খেলনার ভিতরের ঘরে কথাবার্তা চলে - কতদিন এইভাবে আর?আজকাল শিশুটা জিনিস ছুড়ে ফেলতে শিখেছে সেদিন একটা কান খুলে গেল, যন্ত্রণা ।   রঙ চটে গেছে জায়গায় জায়গায়অর্ধেক পৃথিবীর লোম উঠে গেলএ বাড়ির সবাই কি তালকানা?  ২প্রেমের সঙ্গে আজকাল প্রেমের সঙ্গে তেমন গল্প হয় না আজকাল - সে অফিস থেকে ফিরলে চা বসাই টুকটাক টিফিনের জোগাড় করে রাখিআমাদের কথার মাঝখানে ফোন আসে, অথবা - জরুরী কাজ মনে পড়ে  - খেই হারিয়ে যায় অবশ্য তাকে চলতে দিলে আর এক বিপদ সে মাতালের মতো এলোপাথাড়ি হেঁটে হেঁটে রাস্তার ধারে নয়ানজুলিতে আসীনদুর্গন্ধ কাদা মাখামাখি - জোড় হাতে বলে ক্ষমা কর প্রেম তবু থাকে আজকাল -  দেওয়াল ঘড়িতে টিকটিকিঅদূরে আরশোলাটি  - জড়সড়। ৩জিনগত পাপক্ষয়শিয়রে যখন ঘুম কড়া নাড়ে -ট্রেন ছাড়ে উদ্দেশ্যবিহীন অন্য পোশাকে অন্য কোথাও আমিক্রমশঃ ফের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠিপালানর পথ নেই, জিনগত পাপক্ষয় - ফলতঃ ফুল বাগানের দেওয়ালে আগাছার সংসারে কুঁড়ি হয়ে ফুটি।৪আমি নইআমি নই, হয়ত অন্য কেউ হবে যে তোমাকে চিঠি লিখে বলেছিল কক্ষণও পড়িস না এইসব ছাইপাঁশহয়ত সে লিখেছিল অন্য কাউকে সে-কথা ঠিকানা ছিল না বলে তোমাকে পাঠিয়েছিল। হয়ত রোদ্দুর খুব তখন, পয়সাকড়ির টানাটানি তার ওপর অনেকদিন বাড়ি যেতে পায়নি  - হয়ত খামোখা আবার তার ছুটি বাতিল হ'ল। আমি নই, অন্য কেউ হবে - যে তোমায় একবার হয়ত  ভালোবেসেছিল। 
    বৈঠকি আড্ডায় ১৩  - হীরেন সিংহরায় | বৈঠকি আড্ডায় ১৩ ভোটাভুটি খরচাপাতি পর্ব ৬ (ভোটে ) যদি লাগে টাকা , দেবে ক্রুপ দেবে থুসেন তখন বার্লিনে জার্মানির ভাবী পরিত্রাতার দুর্বার জয়রথ ছুটে চলে সারা দেশে । মন্ত্রমুগ্ধ জনতা সভায় হাজির হয় তাঁর দুটো কথা শোনার জন্য – তিনি বারবার বলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি জার্মানিকে ফিরিয়ে দেবেন তার গর্ব, ষাট লক্ষ বেকার মানুষকে দেবেন কাজের সুযোগ , দেশ গড়বেন নতুন করে । যুদ্ধে পরাজিত অপমানিত জার্মান জাতিকে দেবেন সামরিক সক্ষমতা । তারা  আবার  মাথা তুলে জগতসভায় দাঁড়াবে।  রাষ্ট্রশাসনের অধিকার পেতে হলে অন্তত ৫০.১% (অথবা ২৯১ আসন) জনমতের সমর্থন চাই । নাৎসি  ভোটের সংখ্যা ও পার্লামেন্টে সিটের সংখ্যা বাড়ে – ১৯২৪ সালে শূন্য আসন, ১৯২৮ সালে সালে ১২টি আসন ১৯৩০ সালে ১৮.৩৩% ভোট , ১০৭টি আসন । ভাইমার সংবিধানের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আইন মোতাবেক গরিষ্ঠতা  অর্জন করা  ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ।  বিশের বেশি দল : অতিবামে কমিউনিস্ট পার্টি  তার একটু ডাইনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল, অতি দক্ষিণে নাৎসি , মাঝে আছে জার্মান জাতীয় দল, ক্যাথলিক পার্টি - তারপরে আছে নানান বর্ণের দল।  নির্বাচনের আগে গঠ বন্ধনের বা নির্বাচনের পরে অন্য দলের হয়ে নির্বাচিত সদস্যকে কিনে নেবার রেওয়াজ নেই। একমাত্র গতি সম চিন্তক বা কাছাকাছি চিন্তক দল গুলির সঙ্গে জোট বাঁধা – কোয়ালিশন সেটাও ধোপে টেকে না, দিন দুয়েক  বাদে ঝগড়া ঝাঁটি শুরু হয়ে যায়।  তখন ফিল্ড মার্শাল রাষ্ট্রপতি হিনডেনবুরগ ফিল্ডে নামেন ।আনুপাতিক নির্বাচনের ঝামেলা থেকে বেরিয়ে দেশের হাওয়া কোনদিকে বইছে বুঝতে চাইলেন পরিত্রাতা আডলফ হিটলার :  ১৯৩২ সালের মার্চে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে  তিনি  ফিল্ড মার্শাল পাউল ফন হিনডেনবুরগের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তার আগে অবশ্য একটা ছোট্ট কাজ বাকি । তাঁর চোদ্দ পুরুষে কেউ জার্মান ছিলেন না, এই পবিত্র ভূখণ্ডে কেউ কখনো বসবাস অবধি করেন নি,  হিটলার স্বয়ং বে আইনি ভাবে । ১৯১৪ সালে যুদ্ধের বাজারে  সালে ব্যাভেরিয়ান সৈন্য বাহিনিতে ঢুকে পড়েছেন সেদিন কেউ কাগজ দেখতে চায় নি । এখন তিনি চাইছেন জার্মান পাসপোর্ট, নইলে দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া যায় না। কাগজে কলমে জার্মান নাগরিকত্ব অর্জন করলেন , বেআইনি ভাবে হলেও জার্মানিতে বাস করেছেন সেই সুবাদে ।  এন আর সি , সি এ এ টাইপের ঝামেলা কি ভাগ্যে তখন জার্মানিতে ছিল না  ।৫৪% ভোট পেয়ে হিনডেনবুরগ বিজয়ী হলেন , হিটলার পেলেন ৩৭% ভোট , কমিউনিস্ট পার্টি,   মরিয়া না মরে , তাঁদের নেতা থলমান পেলেন ১১% ভোট।  এবার উৎসাহিত হয়ে নাৎসি পার্টি লড়ল ১৯৩২ সালের পার্লামেন্ট ইলেকশন – পার্টির নামে নয়,  “ সব ক্ষমতা আডলফ হিটলারকে “ “ এক দেশ এক নেতা “ এই স্লোগানে- পার্টির চেয়ে হিটলার অনেক বড়ো।  তাঁদের এবার  ৩৭% ভোট, ২৩০টি আসন পেয়ে  নাৎসি পার্টি দল কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠ নয় , পার্লামেন্টে কোন আইন পাস করা হয় না;  সম্ভব নয় । কয়েক  বছর যাবত প্রেসিডেন্ট  হিনডেনবুরগ ভাইমার সংবিধানে প্রদত্ত সেই অমোঘ অস্ত্র আর্টিকেল ৪৮ অনুযায়ী ( দেশ চালনা , নাগরিকদের সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষার  প্রয়োজন বোধে রাষ্ট্রপতি ডিক্রি জারি করতে পারেন- পার্লামেন্টের অনুমোদন ব্যতিরেকে ) কাজ সামলাচ্ছেন । চ্যান্সেলর বদলাতে থাকে : সেন্টার পার্টির ভিলহেলম মার্ক্স ( দু বছর , না তিনি সেই  মার্ক্সের আত্মীয়  নন ) , সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের হ্যারমান ম্যুলার (দেড় বছর ), সেন্টার পার্টির হাইনরিখ ব্র্যুনিং (দু বছর ) ,  নির্দলীয় ফ্রান্তস ফন পাপেন (ছ মাস )ফ্রন্ট স্টেজ – ডান দিকের উইং দিয়ে এবার যিনি প্রবেশ করলেন তাঁর নাম জার্মান রাজনীতির ইতিহাসে চিরদিন জড়িয়ে থাকবে আডলফ হিটলার ও নাৎসি অভ্যুদয়ের সঙ্গে।জেনারাল কুরট ফারদিনান্দ ফ্রিডরিখ হ্যারমান ফন শ্লাইখারনির্দলীয় কিন্তু জার্মান পিপলস পার্টি সমর্থিত রাইখসটাগ সদস্য জেনারাল ফন শ্লাইখার পুতুল নাচানোয় হাত পাকিয়েছিলেন ।  যুদ্ধ লড়েছিলেন অফিসে বসে , যুদ্ধ মন্ত্রকের মন্ত্রী হিসেবে।  প্রথমে ছিলেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট কিন্তু তাদের  যুদ্ধ বিরোধী ও শান্তি সন্ধানী মনোভাবের কারণে সে দল ত্যাগ করেন । ভয়ানক ভাবে অ্যান্টি কমিউনিস্ট ; খুঁজছিলেন কোন প্রখর জাতীয়তাবাদী পার্টি যারা ভাইমার সংবিধানকে কলা দেখিয়ে সেনা বাহিনী গড়ে তুলতে সাহায্য করবে  :তিনি ঝুঁকলেন নাৎসি পার্টির দিকে ।১৯৩০ থেকে কোন দলের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই – অশীতিপর  ফিল্ড মার্শাল পাউল ফন হিনডেনবুরগ দেশ চালান ধারা ৪৮ অনুযায়ী; এবার ফন শ্লাইখার মনে করিয়ে দিয়ে বললেন,  মাইন হের  ফিল্ডমার্শাল , আপনার হাতে যে আরও দুটো ধারা রয়েছে !  ধারা ৫৩ অনুযায়ী ইচ্ছেমত চ্যান্সেলর নিয়োগ করতে পারেন , রাইখসটাগ তার বিরোধিতা করলে  ২৫ নম্বর ধারা মাফিক আপনি রাইখসটাগকে ডিসমিস করতেও পারেন । ফন শ্লাইখার কল কাঠি নেড়ে সেন্টার পার্টির চ্যান্সেলর  ব্র্যুনিং,  সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ম্যুলার এবং সব শেষে ফন পাপেনকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিজে চ্যান্সেলর বনলেন – ৩ ডিসেম্বর ১৯৩২ ।  এতদিন পুতুল নাচাচ্ছিলেন এবার বাঘের ওপরে সওয়ার হয়ে বুঝলেন  প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রি দিয়ে এই জানোয়ারকে সামলানো শক্ত ।  তার ওপর নিজের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না । এবারে চেষ্টা করলেন নাৎসি পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করতে।  কিন্তু আডলফ হিটলার নয়, তাঁর সহকারী গ্রেগর স্ত্রাসারকে দলে এনে একটা কোয়ালিশন গড়ে তোলবার ।  তাতে স্ত্রাসারের পার্টি রাজি না হলে কমিউনিস্ট বাদে অন্য পার্টিদের নিয়ে একটা কোয়ালিশন বানানো যাবে মানে থার্ড ফ্রন্ট !   খবরটা কানে আসা মাত্র হিটলার বললেন, সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই বটে কিন্তু আমার দল রাইখস্টাগে বৃহত্তম – চ্যান্সেলর হবার অধিকার একমাত্র আমার।ফন শ্লাইখার হিনডেনবুরগকে বললেন আপনি দফা ২৫ মাফিক রাইখস্টাগকে বরখাস্ত করে নিজেই রাষ্ট্র শাসন করুন না হয় , সংবিধান সে অধিকার তো আপনাকে দিয়েছে।  রণক্লান্ত ফিল্ড মার্শাল বললেন, বার  দুয়েক করেছি  আর সে ঝামেলায় যেতে চাই না । শরীরে কুলোবে না । বরং দফা ৫৩ মেনে কাউকে চ্যান্সেলর বানাতে পারি।  পুতুল নাচিয়ে অভ্যস্ত জেনারাল ফন শ্লাইখার প্রস্তাব দিলেন ‘ তাহলে হের হিটলারকে কাজটা দিন; তাঁর দলের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই। রাইখস্টাগে বিল পাস করাতে গেলে জার্মান পিপলস পার্টির সঙ্গে একসাথে কাজ করতে হবে।  সে দলের নেতা আলফ্রেড হুগেনবেরগ আর আমি হিটলারকে সামলে রাখব ।১৯৩১ সালে প্রথমবার হিটলারের সঙ্গে মিটিঙের পর  থেকে ফিল্ড মার্শাল হিনডেনবুরগ হিটলারকে  ‘ ঐ অস্ট্রিয়ান কর্পোরাল’  , ‘ বোহেমিয়ান কর্পোরাল’  বলে  তুচ্ছ তাচ্ছিল্য এবং তাঁর অস্ট্রিয়ান ডায়ালেকটে জার্মান শুনে হাসি ঠাট্টা করে এসেছেন। হিটলার জনান্তিকে ফিল্ড মার্শালকে বৃদ্ধ ভাম (আলটার ইডিয়ট) আখ্যা দিতে ছাড়েন নি।ছাব্বিশে জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে যখন সাংবিধানিক অনিশ্চয়তা তুঙ্গে  তখনও হিনডেনবুরগ এক মিটিঙে বলেছিলেন , ভদ্রমহোদয়গণ আপনারা নিশ্চয় আশা করেন না যে আমি সেই অস্ট্রিয়ান কর্পোরালের হাতে দেশ চালানোর দায়িত্ব তুলে দেবো ?এবারে গতি না দেখে বললেন, কি দুর্গতি , শেষ পর্যন্ত সেই অস্ট্রিয়ান কর্পোরাল হবে জার্মানির চ্যান্সেলর ?ফন শ্লাইখার অভয় দিলেন তাকে বশে রাখার ভারটা আমার ওপরে ছেড়ে দিন -হিটলার একা শাসন করবেন না, ফন পাপেনকে  ভাইস চ্যান্সেলর ঘোষণা  করুন।   নাৎসি পার্টিকে তিনটে বেশি ক্যাবিনেট পোস্ট দেওয়া হবে না-।  তবে হ্যারমান গোয়েরিঙকে প্রাশিয়ার হোম মিনিস্টার করা বাদে আর  কোন দাবি হিটলার জানাবেন না । আর তিনি চাইলেই বা শুনছে কে ? ।হিনডেনবুরগের দোলাচল চিত্তের  ধন্দ মিটল যখন জার্মান শিল্পপতিরা সরাসরি তাঁকে একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন“ দেশের চ্যান্সেলরের কাজটা এই মুহূর্তে সহজ নয় কিন্তু এই কঠিন সময়ে জার্মান শিল্পসঙ্ঘ হিটলারের পাশে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াবে । “১৯৩১ সালের সাতাশে জানুয়ারি ডুসেলডরফের ইন্ডাস্ট্রি ক্লাবে ফ্রিতস থুসেন যাকে জার্মানির পরিত্রাতা বলে সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন এবং সমবেত শিল্পপতিদের সামনে জার্মানির এক  উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিকে এক সূত্রে বেঁধে দেওয়ার স্বপ্ন যিনি দেখিয়েছিলেন সেই আডলফ হিটলারকে নিঃশর্ত সমর্থন  জানালেন জার্মান বাণিজ্যিক জগতের নেতৃবৃন্দ ।তবে তাই হোক ।সোমবার তিরিশে জানুয়ারি ১৯৩৩:  ছিয়াশি বছরের ফিল্ড মার্শাল রাইখস্টাগে সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রমাণের প্রয়োজন  সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভাইমার সংবিধানের পঁচিশ  নম্বর ধারার বলে কম্পিত হস্তে সই করে অস্ট্রিয়ান  কর্পোরাল আডলফ হিটলারকে জার্মান চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত করলেন ।ভিলহেলম স্ত্রাসের ব্যালকনিতে বিজয়ী নেতা  গ্রহন লাগার আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট  বিশ্ববিদ্যালয় , জুন ১৯৩২ বিশ্ববিদ্যালয় দরজা বন্ধ । এটা কোন ছুটির দিন তো নয় ? খুব বেশি গরম পড়েছে তাই ? না, তাও নয় ।কিছু ছাত্র ব্রাউন নাৎসি ইউনিফরম পরে ক্লাসে আসতে চেয়েছিল ।  রেকটর বলেছেন এটা পাঠাভ্যাসের পুণ্যভূমি,  পলিটিকসের নয় । তৎক্ষণাৎ নাৎসি ইউনিফরম ধারী ছাত্ররা ‘ আমাদের পতাকা উঁচুতে থাকবে’  গান গেয়ে ভাঙচুর শুরু করে।  রেকটর বিশ্ববিদ্যালয়ের দরোজা বন্ধ করে দেন।  দু দিন বাদে খুলতে হয়। । কালক্রমে  হাইডেলবেরগ হামবুর্গ মিউনিক কোয়েনিগসবেরগ মারবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়ে , হানোভার ব্রাউনশোআইগের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ – সর্বত্র একই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হবে ।প্রাশিয়ান পার্লামেন্ট , মে ২৫ , ১৯৩২ এক ন্যাশনাল সোশ্যালিসট ডেপুটি প্রাশিয়ান স্টেট অ্যাটর্নির পদত্যাগ দাবি করলেন – তাঁর অপরাধ ? সেই অ্যাটর্নি কয়েকজন নাৎসি সদস্যকে হত্যার অভিযোগে  দোষী  সাব্যস্ত করেছেন।  এক কমিউনিস্ট ডেপুটি যেই বলেছেন ‘ নাৎসিদের দল তো  খুনিতে ভর্তি’,  অমনি তুলকালাম কাণ্ড । হাতাহাতি মারামারি ভাঙচুর চলল । কারো কোন শাস্তি হয় নি ।  এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকদিন বাদে সেই কাণ্ডের নেতা এক ন্যাশনাল সোশ্যালিসট ডেপুটিকে ভবিষ্যতে পার্লামেন্টে শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব দেওয়া হলো ।শোয়াইডনিতস , ১৯৩২ অস্ত্র নিয়ে হাঁটার অপরাধে পল ক্লিঙ্গেল নামের এক  কমিউনিস্ট পার্টি মেম্বারের পনেরো মাস কারাদণ্ড হলো।জনা দশেক নাৎসি মিলে বাঙ্কাউ গ্রামে বাশি নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করলে বিচারক তাদের বিনা শর্তে মুক্তি দিলেন – বাশি লোকটির চাল চলন সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল।মানহাইম , ১৯৩১ চারজন ন্যাশনাল সোশ্যালিসট বোমা সহ ধরা পড়লে মহামান্য কোর্ট তাদের বেকসুর খালাস করে দেন- তাদের স্বাস্থ্য খারাপ বলে ।বার্লিন,  ১৯৩২ ১৯৩১ সালে চ্যান্সেলর ব্র্যুনিং শান্তি বজায় রাখতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পথ চলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ।  এই অভিযোগে ধৃত কয়েকজন ন্যাশনাল সোশ্যালিসট সদস্যের বিচারে  জার্মান সুপ্রিম কোর্ট ( রাইখসগেরিখট ) যুগান্তকারী রায় দিলেন – কোন মানুষ যদি মনে করেন তাঁরা পথে ঘাটে আক্রান্ত হতে পারেন তাহলে আত্মরক্ষার্থে যে কোন প্রকারের আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করতে পারেন।( আমেরিকান  সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী – রাইট টু ক্যারি আর্মস!  ভাইমার সংবিধানে তার প্রণিধান ছিল না )বয়থেন, সাইলেসিয়া  ( অধুনা বিটম, পোল্যান্ড ) ১৯৩২ এক কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে খুন করা হলো সাইলেশিয়ার পাবলিক অ্যাটর্নি বারন ফন স্টাইনেকার বিচারকদের প্রতি অনুরোধ জানালেন তাঁরা যেন দু ধরনের অপরাধের পার্থক্য বিবেচনা করে শাস্তি দেন – কম্যুনিস্টরা রাইখের সম্পদ এবং সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়, এই ন্যাশনাল সোশ্যালিসট কর্মীদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষা করা ।নাৎসিদের ক্ষমতায় আসতে এখনও বছর বাকি তখন হাটে বাজারে তিনি  দেখান ম্যাজিক লুকিয়ে চক এবং ডাস্টার কে কত ভোট পেলো তার খবর রাখে কে ? সারা দেশ তখন স্বপ্ন বিক্রেতা এক  জাদুকরের খেলা দেখছে, শুনছে।পার্টি মিটিং ১৯৩২মঞ্চের  প্রশ্ন / জনতার উত্তর আডলফ হিটলার আমাদের কাছে কিসের প্রতীক ?একটি বিশ্বাসের।  আর ?শেষ আশা।  আর ?আমাদের একমাত্র নেতা সামরিক ব্যান্ড বাজে । এবার নেতা মঞ্চে উঠে দাঁড়ান।  মিনিট খানেকের  নিস্তব্ধতা । তারপর তিনি বলা শুরু করেন কর্কশ কণ্ঠ, সুর কঠোর ।এক ঘণ্টা , দু ঘণ্টা , চার ঘণ্টাজনতা তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দকে আঁকড়ে ধরে । তাদের নিজস্ব ভাবনা চিন্তা লুপ্ত হয়েছে ।নেতা একবার থামেন । জনতা দাবি করে আরও কিছু বলুন,  আগে কহ আর ।তিনি বলে চলেন , তার খানিক সত্য , বাকিটা  সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ;  কিছু আজগুবি কাহিনি, কিছু অসত্য নাটক ।কখনো তাঁর কণ্ঠে বজ্র নির্ঘোষ , কখনো তিনি দু হাত জোড় করে অনুনয় বিনয় করেন ।কখনো কেঁদে ফেলেন ।তিনি সর্বদা প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন- কমিউনিস্ট , ইহুদি, বিদেশি । তিনি কখনো কোন বিশ্লেষণ করেন না , বিতর্কে যান না। কোন তথ্য , কোন প্রমাণিত সত্য  তাঁর  ভাবনার পথে বাধা হতে পারে না ।  তাঁর  মন্তব্যই  শেষ কথা।  সাধারণ মানুষের খুব কাছে পৌঁছে যান ।  যেন অত্যন্ত গোপন কথা তাঁদের সঙ্গে যেন ভাগ করে নিচ্ছেন , এমন ভাবে বলেন,“ বন্ধুগণ , আমাদের পরিকল্পনা প্রোগ্রাম নিয়ে কোন আলোচনা আমি এখানে করবো না । আপনারা অন্তরে অন্তরে তো  ঠিকই জানেন ক্ষমতায় এলে আমরা কি করবো ।“লক্ষ কি ?এক   বিপক্ষ এবং সকল প্রতিরোধকে  নির্মূলে বিনাশ করাদুই    ভাইমারে তৈরি  সাংবিধানিক বেড়াজাল চূর্ণ করাতিন   এমন এক দেশ গঠন করা যা  হবে হাজার বছর স্থায়ী তৃতীয় সাম্রাজ্য (        থার্ড রাইখ )  আম জনতা সম্মোহিত - হিটলার যখন বলছেন , ভেবে চিন্তেই বলছেন ।  পু: এমন ভাবা সম্পূর্ণ ভুল যে কোন একজন মানুষ জার্মান জাতির ওপরে একনায়কত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন।জার্মান জাতির বিচিত্রতা গণতন্ত্রের দাবি রাখে - বেনো রাইফেনবের্গ .ফ্রান্কফুর্টার তসাইটুং জানুয়ারি ১৯৩৩  ঋণ  স্বীকারজার্মানি পুটস দি ক্লক ব্যাক                  এডগার মাউরারনাৎসি বিলিওনেয়ারস                         দাভিদ দে ইয়ং  
  • জনতার খেরোর খাতা...
    হেদুয়ার ধারে - ১২২  - Anjan Banerjee |                  কালীবাবু হিসেব করে একটু দেরি করেই গেলেন নিখিল ব্যানার্জীর বাড়ি যাতে তার কোচিং ক্লাস শেষ হবার সময় হয়ে যায় । সেটাই হল । কালীবাবু ওখানে পৌঁছন মাত্র ক্লাস শেষ হয়ে গেল ।  একতলার ঘর থেকে এই ব্যাচের জনা পনের ছাত্রী বেরিয়ে এল । তার মধ্যে সুমনা আর কাবেরীও ছিল । কালীবাবু অবশ্য তাদের কাউকেই চেনেন না ।সুমনা স্যারের কাছে সেদিনের রঙমহলের সামনের  ঘটনার কথাটা তুলেছিল । ঘটনাক্রমে সাগর  মন্ডলের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রসঙ্গটাও বলল সুমনা ।শুনে নিখিল স্যারের চোখেমুখে একটা আলোর ঝিলিক দেখা দিল ।তিনি বললেন, ' লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে ফিজিক্যাল রেজিসট্যান্স তো এসেনশিয়াল । তবে সেটা আনরেসট্রেন্ড না হয় , একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স দরকার । তবে সাগর ইস দা পারফেক্ট  এমবডিমেন্ট অফ ব্যালান্স অ্যান্ড স্পিরিট । হি ইজ দা পারফেক্টলি ভায়াবল মেটিরিরিয়াল সট  আফটার  ফর দা পারপাজ ... দেয়ার ইজ নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট ... হমম্ ... হি শুড বি দা ফ্ল্যাগ বিয়ারার লিডিং দা ওয়ে ... হিস প্রোয়েস  মাস্ট বি অ্যাপ্টলি হারনেসড... 'কথাগুলো খানিকটা স্বগতোক্তির মতো শোনাল । সুমনা এবং কাবেরী কিছুটা শুনতে পেল, কিছুটা পেল না । কিন্তু দেখল যে স্যারের মুখে কোন আকাশ থেকে যেন একটা আলোর রশ্মি এসে পড়েছে । তিনি আপনমনে কি চিন্তা করে চলেছেন । অন্য সকলে চলে গেছে । শুধু সুমনা আর কাবেরী দাঁড়িয়ে আছে ।কাবেরী বলল, ' স্যার ... আমরা তা'লে আসছি ... 'নিখিলবাবুর যেন হঠাৎ ধ্যানভঙ্গ হল । তিনি লজ্জিত স্বরে বললেন, ' ওঃহো ... সরি সরি ... ঠিক আছে এস তোমরা ... পরে কথা হবে ... 'সুমনা আর কাবেরী দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার পরই কালীবাবু সেখানে ঢুকলেন । নিখিলবাবু তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন । তিনি হঠাৎ কালীকিঙ্করের দর্শন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তিনি বলে উঠলেন, ' আরে ... কালীদা যে ... কি সৌভাগ্য ... আসুন আসুন ... 'কালীবাবু একগাল হেসে বললেন, ' কি যে বলেন স্যার ... লোকে পুলিশের লোকের থেকে শতহস্ত দূরে পালাতে চায় । পুলিশে ছুঁলে কত ঘা যেন বলে ... আর আপনি কিনা ... হাঃ হাঃ হাঃ ... '----- ' আরে ... কালীদা ... সে হল সাধারণ পুলিশ ... তারা কেউ কালীকিঙ্কর ভটচাজ নয় ... আর কালী ভটচাজ পুলিশ তবু পুলিশ নয় ... '----- ' এই  রে ... আপনে বুড়াবয়সে আমার চাকরি খাইবেন দেখত্যাসি ... কি যে সব বলেন ... যাক আপনার লগে কিসু কথা সিল ... যদি দশ মিনিট সময় হয় ... 'নিখিলবাবু বললেন, ' আরে ... এসব কি বলছেন কালীদা  ... আমি কি এতই গুরুত্বপূর্ণ লোক নাকি ... 'তারপর কালীবাবুর দেশজ ভাষার মতো করে নিখিলবাবু বললেন, ' চলেন চলেন ... ঘরের ভিতরে গিয়া বসি ... 'কালীবাবু বললেন, ' হ্যাঁ সলেন ... '     সুমনা বলল , ' অনেকদিন সিনেমা দেখা হয়নি । আমি তো এখন অনেক রিল্যাক্সড । মানে, আগের মতো গার্ড দেবার কেউ তো নেই।  বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে । আর মেজদির তো কলেজের পাট চুকতে চলেছে । পরীক্ষার পড়া ছাড়া আর কোন কিছু নিয়ে সে মাথাই ঘামাচ্ছে না । সুতরাং গোল্ডেন অপরচুনিটি এখন ... 'প্রতিবিম্ব বলল, ' তা ঠিক । কিন্তু জীবন্ত সিনেমা তো সেদিন রঙমহলের সামনে হয়ে গেল । আমরা দুজন কিন্তু শুধু সাইড রোলে ছিলাম । আসল হিরো হল সাগর মন্ডল ... '----- ' হ্যাঁ , সে তো অবশ্যই । এরকম ক্যারেক্টার যদি আরও থাকত ... আর একটা ক্যারেক্টার হলেন নিখিল ব্যানার্জী স্যার ... কত নতুন নতুন কথা বলেন জান তো ... । কত ভাবনা চিন্তা করেন উনি । এসব কথা কারো মুখে শুনিইনি । কি অদ্ভুত একটা জগতে নিয়ে যান স্যার । আমরা নতুন কোন কিছু ভাবতেও পারিনা আর জীবনকে, সমাজকে ঠিকমতো দেখার চোখই তৈরি হয়নি আমাদের ... '----- ' একদম ঠিক । দেখার চোখই তৈরি হয়নি আমাদের ... শুধু পরীক্ষার পড়া আর জোড়া গন্ধরাজের উদ্ভট ন্যাকামি ছাড়া আমাদের জীবনে আর কিছু নেই  ... 'সুমনা সমর্থন করল প্রতিবিম্বকে, ' ঠিক কথা । একদম বাজে ব্যাপার সব । ফালতু ন্যাকামো । তুমি একদম ওইসব ভাঁড়ামো করবে না । তাতে যা হয় হবে । আমি বাপির সঙ্গে কথা বলব ... '----- ' উঃ ... বাঁচালে... '----- ' নিখিল স্যারের সঙ্গে দেখা করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে । খুব ইন্ট্রেস্টিং পার্সোনালিটি ... সিটি কলেজে প্রথম দিন দেখেই মনে হয়েছিল ... '----- ' ঠিক আছে চল না একদিন ... স্যারকে বলে রাখব আগে থেকে ... কাবেরীও থাকবে । স্যারের কথা শুনে সেদিন মনে হল যে, যে সংগঠন তৈরি করার কথা বলছেন সে ব্যাপারে তিনি সাগরবাবুর ওপর অনেকটাই ডিপেনডেন্ট ... 'প্রতিবিম্ব বলল, ' এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় । এমন একটা মেটিরিয়াল পাওয়া তো সহজ ব্যাপার নয় ... দারুণ একটা ক্যারেক্টার... এরকম সুপার্ব  পাওয়ারহাউস অফ সাবলাইম এনার্জি আমাদের জানার মধ্যে নেই ... তাই  ... '----- ' সে না হয় হল ... স্যারের সঙ্গে কথা বলে না হয় মিটিংয়ের একটা ডেট ঠিক করা যাবে , কিন্তু আমি যেটা বললাম সেটার কি হবে ? ' সুমনা বলল।----- ' মানে , ওই সিনেমা দেখার ব্যাপারটা ? '----- ' হ্যাঁ ... তাছাড়া আর কি ? '----- ' কাল ম্যাটিনিতে চল মুঘল ই আজম দেখে আসি  ... ' প্রতিবিম্ব প্রস্তাব দেয় । ------ ' তাই চল ... সময় লাগবে কিন্তু ... বড় ছবি ...'----- ' হ্যাঁ তা জানি ... দেখ কিভাবে ম্যানেজ করবে ....'----- ' কাবেরীকে বলব নাকি ? ' সুমনা বলে ।---- ' তা বলতে পার । দল একটু ভারি থাকাই ভাল ... তবে আমি একটা কথা চিন্তা করছি ... '------ ' কি ? '----- ' একটু রিস্ক আছে কিন্তু কিছুদিন ... ওরা ওই অপমান হজম করে নেবে না কিন্তু । সাগর স্যার তো আর সবসময়ে আমাদের গার্ড দিয়ে বেড়াবে না ... ম্যাডামও বললেন কিছুদিন সাবধানে  চলাফেরা করতে ... তাই  ভাবছি ... ' আচমকা কথাগুলো শুনে সুমনার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল । রঙমহলের সামনে সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল । সাগর মন্ডল না থাকলে কি হত সেদিন । রাস্তার একটা লোকও তো এগিয়ে আসেনি । সিনেমা হলেও যদি এরকম বিশ্রী কিছু ঘটে ... ' সুমনা একটু চিন্তা করে বলল, ' আচ্ছা থাক তালে ... এখন একটু সাবধানে থাকাই মনে হয় ভাল হবে ... কিছু বলা তো যায় না ... '----- ' ঠিক আছে ... নিখিল স্যারের কাছে তা'লে কবে যাব ? '----- ' কাল ক্লাস আছে । স্যারকে জিজ্ঞেস করব ...'সুমনা বলে ।      জন্মেজয়বাবুর আজ খুব আনন্দ । তার ছেলে অখিল একটা সেগুন কাঠের খাট তৈরি করিয়েছে ।আজ দুপুরে খাটটা খাটিয়ে দিয়ে গেছে মিস্ত্রিরা । তিনজন শুতে পারে তাতে ।তিনি বিভূতিবাবুকে খবরটা দিলেন বিকেলের দিকে গঙ্গার দোকানের সামনে ।শুনে বিভূতিবাবু বললেন, ' যাক ... ভালই হল । ঠান্ডার সময়ে  শোয়ার সুবিধে হবে ... অখিল সোনার চাঁদ ছেলে আপনার ... খুব ভাল ... 'বৃদ্ধ জন্মেজয়বাবু খুশিমাখা গলায় বললেন , ' তা বটে ... বাবা মায়ের খুব খেয়াল রাখে । আমার জন্য দুইখান ধুতি কিন্যা আনসে । অর মায়েরেও দুটা শাড়ি দিসে । আমার তো এখন কোন রোজগার নাই।  সব তো ওই পারে ফেইল্যা আইসি বুঝলেন কিনা ... 'বিভূতিবাবু বললেন, ' ওসব নিয়ে দুঃখ করবেন না দাদা । আমরা আর কদিনই বা আছি ... জীবন তো কাটিয়েই দিয়েছি প্রায় । বাকিটা যদি এভাবেই কেটে যায় তা হলেই যথেষ্ট ... '------ ' হ, তা ঠিকই কইসেন দত্তবাবু । চইল্যা যাবার পর তো আর কিছু নাই । কেউ কারো নয় । কোথাও কিসু নাই।  তবু আমরা হাঁকপাঁক করি যদি কোনমতে আর একটু সুখ পাওয়া যায় ... আকিঙ্খেটা সাড়তে পারি না আমরা ... হ্যাঃ হ্যাঃ ... 'বিভূতিবাবু বিমর্ষ মুখে বললেন, ' হুঁ , খাঁটি কথা বলেছেন । সব জেনে বুঝেও  বেঁচে থাকতে থাকতে আকাঙ্খাগুলো ছাড়তে পারি না আমরা । আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই ... খালি মনে হয় মরার আগে যদি আর একটু কিছু পাওয়া যায়  ... কি বিপদ ... ' দুই  প্রবীণ এ জীবনের সারাৎসার নিয়ে গভীর  কিছু উপলব্ধি প্রকাশের পর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে বোধহয় পরের বাক্যসূত্র খুঁজছিলেন ।  তাতে নিশ্চিতভাবে কোন বিপ্লব বা প্রতিবাদী  অভ্যুত্থানের কথা নেই।  আছে শুধু এ অনন্ত জীবনপ্রবাহের এক বহুচর্চিত উপলব্ধি ।    ওদিক থেকে গঙ্গার গলা শোনা গেল , ' মেশোমশাই ... দত্তদা ... আসুন আসুন ... একটু চা খেয়ে যান ... '    ( চলবে )********************************************   
    শপথ  - Prolay Adhikary | অনেকটা পথ বাড়তি হাঁটি,অনেক লেখাই বাহুল্য,হাজার কথাই অ-দরকারী,কানে না হয় না তুললেও...একটা কথায় ভরসা রেখোযেমন রাখো ইশ্বরে !" শিরদাঁড়াটাই বাঁচিয়ে রাখেসব হারানো নিঃস্ব'রে ।"হাতছানি তাই যতই আসুকসমঝোতা নয় সেইখানে,তোমার বীজেই ফলবে ফসল নবান্ন হোক সম্মানের ।
    ভারত সন্ধানে - Pradhanna Mitra | Post Truth: Relating to or denoting circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than appeals to emotion and personal belief.৬ এপ্রিল তারিখে একটি জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্রে একটি ছোট্ট কলাম চোখে পড়েছিল। তারা আবার ইংরেজী সংবাদপত্র থেকে জেনেছেন, স্কুলের সিলেবাস, বিশেষত, ইতিহাসের সিলেবাসে বেশ কিছু বড়োসড়ো রদবদল হচ্ছে, যা সত্য অর্থে আপত্তিকর। ১১ এপ্রিল তারিখ উক্ত সংবাদপত্রে হিন্দোল ভট্টাচার্য মহাশয়ের একটা বড়ো কলাম বের হয়, যেখানে এই রদবদলের উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমাদের এদিকে এ নিয়ে তেমন হইচই হচ্ছে না। কারণ, ইতিহাস সত্য হোক কিম্বা মিথ্যা, বাবা-মায়েরা কেবল একটাই জিনিস চান, আর তা হল এই যে, এইসব ইতিহাসপাঠ অত্যাবশ্যকরূপে তার সন্তানকে ভালো রেসাল্ট তথা উন্নত ‘চাকর’ বানাতে সক্ষম কি না। কিন্তু দেশ জুড়ে যে এর একটা বড়োরকম বিবাদ হচ্ছে, তা সর্বভারতীয় সংবাদপত্র, ব্লগ, ভ্লগ, ম্যাগাজিন, ইন্টারনেট ইত্যাদি দেখলে বেশ টের পাওয়া যায়।ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে --- এই দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে একটাই প্রশ্ন, প্রকৃত ইতিহাসটি তাহলে কি? যদি ‘প্রকৃত’ জানতে সক্ষম হই, তাহলে বিকৃতিকরণ আপনি এসে ধরা দেবে। এখন, সময়ের সাথে সাথে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত পরিবর্তন হয় বটে, কিন্তু ভাল করে স্টাডি করলে দেখা যাবে, তারও একটা ধারাবাহিকতা আছে, যা সত্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গিরগিটি বানায় না, যাকে আমরা ‘পোস্ট ট্রুথ’ বলি। তাই আমি, প্রকৃত-র খোঁজে যে বইটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম, তা হল টনি যোশেফের ‘আদি ভারতীয়’ বইটি, যা Early Indian নামে খ্যাত।এখন প্রশ্ন এই যে, এই বইটিও প্রোপাগান্ডা নয় তা কে বলল? আসুন একটু খতিয়ে দেখা যাক্‌ --- এই বইয়ের উদ্দেশ্য ভারতের উৎস সন্ধান করা। এখন এই উৎস সন্ধানের ভিত্তি কি? টনি যোসেফ তিনতে এভিডেন্স এনেছেন – ১) জেনেটিক এভিডেন্স, ২) আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স এবং ৩) লিঙ্গুইস্টিক এভিডেন্সজেনেটিক এভিডেন্সের দুটি মূল ভিত্তি --- ১) mtDNA, এবং ২) Y-DNA, প্রথমটি মা থেকে পরবর্তী প্রজন্মে, এবং দ্বিতীয়টি বাবা থেকে কেবলমাত্র ছেলের প্রজন্মে বংশানুক্রমে ধারারূপে এগিয়ে যায়। এখন আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স থেকে প্রাপ্ত মানব-অবশেষের জিন থেকে আমরা পিছোতে পারব অতীতের দিকে, এবং এইভাবে আস্তে আস্তে প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাক্রমকে জানতে পারব। বোঝাই যাচ্ছে, পুরো বিষয়টাই বিজ্ঞানসন্মত। এখানে কোনরকম কোন মহাকব্যিক কিম্বা শাস্ত্রোচিত দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এখন এই জেনেটিক এভিডেন্সের ব্যাপারেও টনি যোসেফ ডিটেইলসে জানিয়েছেন বটে, কিন্তু তা আমি, এখানে আলোচনা করলাম না। বইটি পড়তে পারেন, অথবা ইউটিউবে এ ব্যাপারে অনেক ডকুমেন্টারি পাবেন। সেখান থেকে ব্যাপারটা আরও খোলসা হবে। অন্যদিকে লিঙ্গুইস্টিক এভিডেন্স হল মূলত লিপি এবং ভাষার ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসকে জানার চেষ্টা, সেই ভাষা আধুনিক যুগে কীভাবে এসেছে সেটা একটা বড়ো গবেষণার পর্যায়। সেখানে আমরা তিনটে তত্ত্ব পাই --- ১) ইন্দো-ইউরোপিয়ান মাইগ্রেশান, ২) দ্রাভিডিয়ান সাবস্টেট এবং ৩) অস্ট্রোএশিয়াটিক ইনফ্লুয়েন্স। মূলত এই তিনটি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্টিত এই এভিডেন্স পূর্বোক্ত দুটো এভিডেন্সের সাথে সাজুয্য ঘটানোর চেষ্টা চলছে, অনেকাংশে সফলতা মিলেছে এবং আমরা একটা রূপরেখা আন্দাজ করতে পারছি।এই পদ্ধতিগুলো থেকে ভারতের ক্ষেত্রে ঠিক কি ক্রোনোলজি পাওয়া যাচ্ছে? মোট নটা সময়কাল পাওয়া যাচ্ছে --- প্যালেওলিথিক যুগ (২০ কোটি ~ ১০,০০০ খ্রীঃপূঃ), মেসলিথিক যুগ (১০,০০০ ~ ৬,০০০ খ্রীঃপূঃ), নিওলিথিক যুগ (৬,০০০ ~ ২,০০০ খ্রীঃপূঃ), ইন্দাস ভ্যালি সিভিলাইজেশান (৩৩০০ ~ ১৩০০ খ্রীঃপূঃ), বৈদিক যুগ (১৫০০ ~ ৬০০ খ্রীঃপূঃ), মৌর্য ও গুপ্ত যুগ (৩২২ খ্রীঃপূঃ ~ ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ), মধ্যযুগ (৫৫০ ~ ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ) এবং কলোনিয়াল যুগ (১৫২৬ ~ ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ)মোটামুটি এই যুগগুলোকে এবং পদ্ধতিগুলোকে ধরে নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলে দেখতে পাবো, টনি যোসেফ বলছেন, সূদূর আফ্রিকা থেকে মানুষের আগমন ঘটেছে এবং পরবর্তীকালে বেশ কতকগুলি মাইগ্রেশান ঘটেছে। সেগুলো হল ---১) আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশান --- আধুনিক মানব অভিবাসী, ২) এনশিয়েন্ট মাইগ্রেশান --- জার্গোসের অভিবাসী, ৩) ইন্দো-আরিয়ান মাইগ্রেশান --- স্তেপভূমির অভিবাসী, ৪) দ্রাভিডিয়ান মাইগ্র্যান্টস --- হরপ্পার অভিবাসী, ৫) পরবর্তীকালে আগত বিভিন্ন অভিবাসী।অর্থাৎ, এটা নিশ্চিত করছেন টনিভাই যে, আমাদের সভ্যতার সূচনা হরপ্পার হাত ধরে অন্তত নয়, কিম্বা মেহেরগড় থেকেও নয়। বরং হরপ্পা এবং মেহেরগড় নির্মাণে যাদের হাত ছিল, সেইসব অভিবাসীরা ধীরে ধীরে হাজার হাজার বছর ধরে এখানে আসে, ধীরে ধীরে বসতি স্থাপন হয়, ধীরে ধীরে নগর সভ্যতার পত্তন হয়, ধীরে ধীরে তার লয়-ও হয় এবং তারা সেখান থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে জম্বুদ্বীপের আরও গভীরে। তিনি লিখছেন, “ভারতীয় সংস্কৃতিতে জোর করে কৃত্রিম অভিন্নতা আরোপ করার জন্য অব্যাহত ও সর্বনাশা প্রচেষ্টার একটি কারণ আমাদের ইতিহাস রচনার ধরন, যেখানে প্রায়শই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে আত্মপক্ষ সমর্থন করা হয়েছে। যবে থেকে তথ্যাদি উপলব্ধ হয়েছে, ইতিহাস বইগুলি ঠিক সেই সময় থেকেই শুরু হয়; তার পূর্ববর্তী অংশগুলি হয় উপেক্ষা করা হয় বা খুব বেশি হলে সামান্য কয়েকটি অনুচ্ছেদ বা পৃষ্ঠার মধ্যে সেসব কথা সেরে ফেলা হয়।”এখন টনিভাইয়ের এই বইটির কতটা প্রোপাগান্ডা, কতটা পোস্ট ট্রুথ আর কতটাই বা সত্যতা আছে, সেটার বিচার করা দরকার। তবে তা অবশ্যই সনাতন পদ্ধতিতে নয়। বিজ্ঞাসন্মতভাবে। বিজ্ঞানের যুগে টেকনোলজিকে হাতিয়ার করে আমরা যদি সনাতন পদ্ধতির জয়গান করি, তাহলে সেটা বড়োই হাস্যকর। টনিভাই কিন্তু তা করেন নি। তিনি বিজ্ঞানসন্মত পদ্ধতিতেই এগিয়েছেন, তার বইটা পড়ে, অন্তত আমার, এইটুকুই মনে হল। মাঝখান থেকে ছোটবেলায় কাকাকে একটা ছড়া খুব বলতে শুনতাম, আমরা যখন জোরে জোরে ‘স্বরে অ’, ‘স্বরে আ’ পড়তাম তখন, সেইটাই বারবার করে আজ মনে পড়ছে, তবে তা আধুনিক পরিভাষায়, আর সেটা হল ---“ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোলপোস্ট ট্রুথে মাথা নেই, হয়েছি পাগোল।”======================Early IndiansTony josephJuggernaut PublicationPrice: 341/-বাংলা অনুবাদঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জীমঞ্জুল প্রকাশনমুদ্রিত মূল্যঃ ৩৯৯ টাকাছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
  • ভাট...
    commentযোষিতা | আমি কিন্তু ডাক্তার বলে ডাকি। ডাক্তার আমার চেয়ে বয়সে ছোট ।
    commentঅরিন | "যদিও অরিন্দম বসু অনেক সিনিয়র সেটা বুঝি, প্রায় সবাই দেখেছি তাঁকে অরিনদা বলেই ডাকেন। আশা করি এবি বা অন্যকেউ কিছু মনে করছেন না।"
     
    সব বয়সের বাঙালি নারী পুরুষ নির্বিশেষে নিজেদের খোকা খুকু ভাবতে ভালবাসেন, তাই নিজেরা বাদে সবাই অমুক-দা বা অমুক-দি হয়ে যান। মনে করার কিছু নেই। এ হচ্ছে বাঙালির সাবেক রীতি রেওয়াজ। 
    commentবকলম -এ অরিত্র | হ্যাঁ, আপনার যেটা পছন্দ হয়।
     
    এই সুযোগে বলি, আমি আসলে যেহেতু কাউকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনি না কাজেই দাদা/দা এগুলো ব্যবহার করি না। অনেক ক্ষেত্রে অন্যজন বয়সে বড় না ছোট তাও বুঝি না। যদিও অরিন্দম বসু অনেক সিনিয়র সেটা বুঝি, প্রায় সবাই দেখেছি তাঁকে অরিনদা বলেই ডাকেন। আশা করি এবি বা অন্যকেউ কিছু মনে করছেন না।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত