এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    বুড়োশিবতলা - পায়েল চট্টোপাধ্যায় | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায় ১ জলের মধ্যে গোলা নীল রংটা নিজের গালে ঘষছে সুদাম।ঘষতে ঘষতে একটা মুখ মনে পড়ছে। সিনেমার মত। তারপর হঠাৎ নিজের আয়না দেখা মুখটা মনে পড়েছে। শুষ্ক, খড়খড়ে। একটা যন্ত্রণা ঠেলে উঠে আসছে। রংটা জোরেই ঘষে দিচ্ছে ও। হঠাৎ ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। ওঠারই কথা। তবে গালের ব্যথায় নয়, মনের ব্যথায়। গৌরী যদিও ইচ্ছে করে মারেনি। সুদাম এক বুক কাদার মধ্যে একেবারে পা ডুবিয়ে সিনেমার হিরোদের কায়দায় গৌরীকে কথাটা বলতে চেয়েছিল। "এখুনি আন্ধার নামবে, তুই পাড়ার ওই ম্যাদামারা ছেলেটা না! কথা বলার মুরোদ নেই, এমন গায়ের কাছে এসেছিস কেন? দেখছিস লা কাজ করতিছি ক্ষেতে! যা এখান থেকে!" কথাগুলো বলেই কোদালটা হাতে তুলে নিয়েছিল গৌরী। কাজ করার জন্যে। সুদাম এত কাছে এসে পড়েছিল যে কোদালের বাঁটের আঘাত লাগতে একটুও দেরী হয়নি।সুদামের ভেতরটা তখন নাছোড়বান্দা। ধূ-ধূ মাঠ, চাষের ক্ষেত। সেই কবে থেকে গৌরীর ডাগর ঠোঁট, উস্কো খুস্কো চুল, কাদামাখা হাতের ভেতর ধান গাছের শিসের ছায়া দেখতে পেত সুদাম। ঠিক সুদামের মায়ের মত। দিনরাত চোলাই খেয়ে ঝিমিয়ে পড়ে থাকা বাপকে সুদাম চেনে না ঠিক করে। শুধু সেদ্ধ ভাত টুকু বেড়ে দেয় দুবেলা। আর বাপ যখন মাটির দাওয়ায় বমি করে পড়ে থাকে, সুদাম জানে সব 'পোস্কার' করে দিতে হয়। মাও তাই করত। প্রথম প্রথম ঘেন্না করেছিল সুদামের। মায়ের মুখটা মনে করে নিত তখন।মা চলে যাওয়ার দিনও ওই করছিল। উঠোনটা ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করার সময় হঠাৎ করে মাথা ঘুরে বসে পড়ে সুদামের মা। মুখ দিয়ে সাদা ফেনার মত কী যেন বেরোচ্ছিল। বাপকে ঘরের ভেতর ডাকতে গেল সুদাম। তার জবা ফুলের মত চোখ দেখে সুদাম আর সাহস করেনি। এই বোধহয় তেড়ে এল সুদামকে। দরজার সামনে বেড়ালটা গুটিয়ে শুয়েছিল। সুদামের পায়ে লেগে ‘ম্যাও’ করে ওঠে। সুদামের পিছু পিছু আসে উঠোন পর্যন্ত। উঠোনে ফিরে সুদাম দেখে সব শেষ।মায়ের শান্ত দুটো চোখ তখনও তাকিয়েছিল। পৃথিবী যেন ছাড়তে চায় না। গৌরীকে দেখেও ঠিক এমন মনে হয় সুদানের। ফুলো মুখ, দুই চোখে জলের মতো প্রবাহ। সেই কোন বয়স থেকে সুদাম দেখছে ওকে। গৌরী তখনো ডাগর হয়ে ওঠেনি। এবার পয়লা বৈশাখের আগেই গৌরীকে নিজের মনের কথা বলবে ভেবেছিল সুদাম। গৌরী সাহসী। মা বলত " ও পাড়ার যে মেয়েটা রোজ জমিতে ধান রুইতে যায়, খুব সাহসী, নিজে ধান রুইতে পারে, জমিতে জল ছেচ দিতে পারে, আর আমার কপালে কেমন মরদ জুটলো দেখো, মাতাল! আরেকজন সারাদিন মাথা নামিয়ে বসে থাকে, আর আমায় লোকের বাড়ি কাজ করে খেতে হয়।" সুদাম তখন সন্ধ্যেবেলা পুকুরধার থেকে ফিরত। ‌ যেই থালায় বসে মুড়ি হাতে নিত, মায়ের কথায় থালা ফেলে উঠে যেত বেশিরভাগ দিন। মা আবার পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে খাবারের থালার সামনে বসাত সুদামকে। সুদামের কাজ করতে ইচ্ছে করত না। ওদের মাটির দেওয়ালে যখন চাঁদের আলো পড়ে, সুদামের উঠোনে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মায়ের আঁচলের মত ঠান্ডা মনে হয় ওর। মা বলত “ কাজ না করলে ভাত জুটবে কেমন করে বল দেখি বাপ আমার!” সুদাম উঠে বসত অমনি। গৌরীর মুখটা ভেসে উঠত। কাজ করার কথা মনে হলেই সবে বাপকে বলতে যাবে, বাপ ঘরে ঢুকে হড়হড় করে মদ উগরে দিচ্ছে তখন। আকাশের চাঁদের রংটা আরেকটু উজ্জ্বল ঠেকত সুদামের কাছে।মা চলে যাওয়ার পর মোহনপুর গ্রামের বাতাস সুদামের গতরখানাকে যেন আরো জড়িয়ে ধরেছে। একবার বসলে আর উঠতে চায় না। আজ বুকে অনেকখানি বল নিয়ে গৌরীর কাছে বলতে গিয়েছিল মনের কথা। গৌরী কি একেবারে মায়ের মত? ঝিমোনো বাপও ওকে বলে 'ম্যাদামারা'! আজ গৌরীও অমন করে বলল! গৌরীকে দেখলেই সুদামের বুকের ভেতর মেঠো হাওয়া বয়ে যায়। ‌ জীবন সরকারের জমিতে ধান রুইতে যায় গৌরী। লোকে বলে "গৌরী তো মা দুগ্গা"। দিব্যি আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। চাষ করে। সুদাম ভেবেছিল চড়কের মেলায় ওর হাত ধরে ঘুরবে। বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করেছিল সুদামের। তবুও এক বুক কাদা আর মনে বল যুগিয়ে দাঁড়িয়েছিল গৌরীর সামনে। কোদাল দিয়ে মাটি কোপাতে গিয়েছিল গৌরী, সুদাম অন্যপাশে মুখটা সরাতেই কোদালের বাড়ি। ইচ্ছে করে মারেনি হয়তো। কোদালের বাঁট অসাবধানে লেগে গেছে। তবুও বড় ব্যথা করে সুদামের। এই জুটিয়ে বাড়ি ফিরেছে সুদাম। ২জায়গাটার নাম যে কেন বুড়োশিবতলা হল তাই নিয়ে অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা দেয়। গৌরী কারোর কথাই মানে না। ও মানে এক রাজার গল্প। অনেক যুগ আগে এক রাজা বীরভূমের এই গ্রামে চড়ক উৎসব পালন শুরু করে। এই পুজোকে নীল পূজো বলা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে দুধ, মধু, তেল, ঘি দিয়ে শিবকে স্নান করিয়ে চড়ক গাছের তলায় রেখে দিত। পুজোর আগের দিন এই গাছকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে রাখা হত। তারপর একটা জলভরা বাটিতে শিবের প্রতিকী সিঁদুর মাখা লম্বা কাঠের তক্তা রাখা হতো। রাজার আদেশে এই কাঠের তক্তাকে সকলে বুড়ো শিব মেনে পুজো করেছিল। এই রাজা নাকি গ্রামের কোন এক গরীব মেয়েকে কোন দুর্ঘটনা থেকে উদ্ধার করে বিয়ে করে। কাঠের তক্তাখানা নাকি মানুষের মনের কথা শুনতে পায়! লোকে বলে। তাহলে গৌরীর মনের কথাখানা শুনতে পায় না কেন? একটা ব্যথার কথা কি শুনতে পাচ্ছে?বুড়ো শিবতলায় আজও চড়কের মেলা হয়। একটা কাঠের তক্তা পরিষ্কার করে তাতে সিঁদুর লাগিয়ে পুজো করে সকলে। গৌরীদের বাড়ির পাশে যে জঙ্গল, জায়গাটা তার কাছেই। গৌরী খানিকটা সিঁদুর এনে মাখিয়েছে তক্তায়। কাল এখানে পুজো হবে। ও এক মুঠো ফুল রেখে যায়। জবা গাছটা কী সুন্দর ফুল দিচ্ছে! লোকে বলে গৌরীর হাতে গাছ ঝিলমিল করে। ধানের শিষ আনন্দে ফল দেয়। তবুও ওর ভেতর ভেতর উচাটন কাজ করে। সারাদিন ক্ষেতের কাজ করে কাদা মেখে বাড়ি যায় গৌরী। বোন ঘরে বসে ঝাল ফুচকা খায়। গৌরী বাড়ি পৌঁছলেই বাটি করে নিয়ে আসে। গৌরীর সব বিস্বাদ লাগে। লম্ফ নিবিয়ে এক একদিন শুয়ে পড়ে। অন্ধকার ঘরে ছায়া-মানুষের মত দুটো চোখ ভেসে ওঠে। গৌরীকে দেখা দুটো চোখ। গৌরীর মনে হয় লোকটা যেন মানুষ নয়। অশরীরী। আদুল গায়ে শুধু তাকাত। সেই কোন কাল থেকে। গৌরীর দেখেছে। একটা ম্যাদামারা ছেলে। “শুধু পিটপিট করে তারিখেই জেবল কাটাবে!” বারান্দা থেকে বোনের খিলখিল করে হাসির শব্দ শোনা যায়। বোন তখন কারোর কথা মনে করে হাসছে। বোন হেসে ওঠে। গৌরীর রাগ হয়। খেঁকিয়ে ওঠে বোনকে। বাপের কাশির শব্দ শোনে গৌরী। শুনেই চলে। মা কলমি শাকের চচ্চড়ি রান্না করে গৌরীকে খেতে ডাকে। রান্নার ক্যাঁচ-কোচ শব্দে ক্লান্ত লাগে। আজ হাতে বড্ড জ্বালা করে গৌরীর। কোদাল ধরার জ্বালা নাকি যন্তন্ণা দেওয়ার ব্যথা? ও যে ইচ্ছে করে কিছুই করেনি!-"এই ন্যাতাপোনা ছেলে! ওঠ! আজ চড়কের মেলায় একেবারে বুক চিতিয়ে ঘুরবি। একা একা একেবারে মেলা কাঁপিয়ে দিবি, বুঝলি ! যখন লোহার শিক পিঠে ঢোকাবে লাফাতে পারবি তো? পিঠে বেতখানা মারলে সহ্য করতে পারবি তো?"ছিদাম মুদি লাল চোখ নিয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করে। প্রশ্ন করার সময় লোকটাকে দেখতে অনেকটা ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা রাক্ষসের মত লাগে। সুদাম মুখ নামিয়ে নেয়। এই গ্রামে নাকি ঘুসকি ভূত আছে, যারা একা একা থাকে তাদের ধরে। ছোটবেলায় সুদাম মায়ের কাছে শুনেছিল। সেই ভূতটা ওকেও ধরেছে বলে ওর মনে হচ্ছে। সুদামের খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে। ৩চৈত্র সংক্রান্তির দিন বুড়োশিবতলায় সবচেয়ে বড় চড়কের মেলা বসে। এই দিনে জায়গাটাকে আর চেনা যায় না। সুদামের বাবা ছিদাম মুদি এই মেলায় গরম লোহার শিক নিজের পিঠে গেঁথে দেয়। সুদামের মা স্বামীর পিঠে ঠান্ডা জলে ভেজানো কাপড় লাগিয়ে দিত। সুদাম বরাবর মেলায় আসে। দুটো চোখ দেখার জন্য। এই প্রথমবার ও অন্য কারণে মেলায় এসেছে। ওর ডান হাতের মুঠোটা তীব্র হয়। গালের ব্যথাটা জ্বলে ওঠে। চোখে জলের গরম অস্তিত্ব টের পায় গৌরী।একজন সন্ন্যাসী অনেকক্ষণ ধরে গৌরীর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। একটা লম্বা লোহার শিকের ফলা উঁচু হয়ে অন্য আরেকজনের পিঠ চিরে দিচ্ছে। মুখখানা শক্ত হচ্ছে ছেলেটার। গৌরী ছেলেটাকে চেনে না। ওর একজোড়া চোখের কথা মনে পড়ে। বোন একটা জিলিপির দোকানে দাঁড়িয়েছে। গৌরী ওর ছেঁড়া ব্যাগ থেকে খুচরো পয়সা বের করে দোকানিকে দেওয়ার আগেই একটা বলিষ্ঠ হাত গৌরীর বোনের হাত চেপে ধরে। ওরা ওপাশে সরে গিয়ে দুজনে মিলে জিলিপি কিনে খায়। গৌরীর চোখ ফেটে জল আসে। সুদামকে দেখেছে এই মেলায়। গৌরীর চোখে চোখ পড়তেই নামিয়ে নিয়েছে মুখখানা। গৌরীর হাতে জ্বালা করে। ওর চেঁচিয়ে ডাকতে ইচ্ছে করে। সুদামের শুকনো চোখ দেখে ভয় করে। ইস! কেন যে সেদিন অমন আঘাত দিল! "দিদি সুদামদা নাকি ওই দিকে কী সব সন্ন্যাসীর পুজো করছে!" বোন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে গৌরীকে বলে। গৌরীর ভেতর উচাটন শুরু হয়। "দিদি সুদামদা নাকি বেতো সন্ন্যাস নেবে?" গৌরী তাকায় বোনের দিকে। "বেতো সন্নেস কী রে?" হঠাৎ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই প্রশ্নটা করে গৌরী। আকাশে মেঘের রাশি। ‌ হুংকার দিচ্ছে সব। চড়কগাছটা দুলে দুলে বলছে ঝড় আসছে। বৃষ্টির বড় ফোঁটা এসে পড়ে গৌরীর চোখে মুখে। বুড়ো শিবতলায় চড়ক গাছের নিচে রাখা কাঠের তক্তাটার সামনে এসে দাঁড়ায় গৌরী। সিঁদুর লেপা তক্তা। পাশে দেখতে পায়, সুদাম সপ সপ করে নিজের পিঠে বেত মারছে। সুদামের কঠিন মুখ। চোখ শুকনো। গৌরীকে সব শক্তি দিয়ে কেউ যেন ঠেলে দেয় সুদামের বুকে। হাত থেকে বেত ছিটকে পড়ে মাটিতে। দুজনেই মাটিতে পড়ে যায়। গৌরী এঁটুলি হয়ে এঁটে থাকে সুদামের বুকে। "তোমার যন্তন্না হলে বুঝি আমার লাগে না, একদিনের যন্তন্না দেখে বাকি দিনের কষ্ট দেখতে পেলেনেকো?" সুদাম শুনতে পায় ওর বাবা চিৎকার করছে ‌ "শালা ন্যাতাপোনা ছেলে, তুই নাকি সন্নিসি হবি!" সুদামের কানে ঢোকে না কথাগুলো। মাঠে ভিড়। ভিড়, ব্যথা সব ছাড়িয়ে একটা মিঠে বাতাস সুদামের বুক জুড়ে বয়ে যায়।
    শাসককে প্রশ্ন করলেই দেশদ্রোহিতার তকমা! - ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য | গোকারাকণ্ডা নাগা (জি এন) সাঁইবাবা। পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে শৈশবকাল থেকেই শারীরিকভাবে পঙ্গু। ফলস্বরূপ, পাঁচ বছর বয়স থেকেই হুইল চেয়ার ছাড়া চলাচলে অক্ষম। মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। বিদগ্ধ লেখক। রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী। রাষ্ট্রীয় মদতে সংগঠিত ‘অপারেশন গ্রীনহান্টের’ কট্টর সমালোচক। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ রামলাল আনন্দ কলেজের ইংরাজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক। বর্তমান বয়স ৫৭ বছর। শারীরিকভাবে ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী এবং প্রায় চলৎশক্তি রহিত। আত্মগোপন করে থাকা মাওবাদীদের লেখাপড়া শিখিয়ে রাষ্ট্র বিরোধী হিংসাত্মক কার্যকলাপে প্ররোচিত করার অভিযোগে ২০১৪ সালের ৯ই মে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৫ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে মুম্বাই উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্তি পেলেও, ঐ বছরেরই ১৪ই ডিসেম্বর আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। ২০১৬ সালে দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশে পুনরায় তাঁর জামিন মেলে। ২০১৭ সালে মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি দায়রা আদালত অধ্যাপক সাঁইবাবা ও তাঁর পাঁচ সহযোগীকে ‘বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের’ (ইউএপিএ) ১৩, ১৮, ২০, ৩৮ ও ৩৯ ধারায় এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা ঘোষণা করে। ফলস্বরূপ, ২০১৭ সাল থেকেই অধ্যাপক সাঁইবাবা যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে নাগপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একটানা বন্দী। যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ডাজ্ঞা থাকায় ২০২১ সালে রামলাল আনন্দ কলেজে অধ্যাপনার চাকরি থেকে সাঁইবাবাকে পাকাপাকিভাবে বরখাস্ত করা হয়। ২০২২ সালের ১৪ই অক্টোবর মুম্বাই উচ্চ আদালতের নাগপুর বেঞ্চ, গড়চিরৌলি দায়রা আদালত ঘোষিত অধ্যাপক সাঁইবাবা ও তাঁর পাঁচ সহযোগীর যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ডাজ্ঞা রদ করে নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত সকলকেই কারাবাস থেকে মুক্তির নির্দেশ দেয়। গড়চিরৌলি দায়রা আদালত ঘোষিত শাস্তি রদ করার পেছনে উচ্চ আদালতের যুক্তি ছিল, নিম্ন আদালত কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়াই অধ্যাপক সাঁইবাবা ও তাঁর পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে ‘ইউএপিএ’ আইনের বিধানে অভিযোগ এনে তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করেছে; যা কিনা আইন বিরুদ্ধ। উচ্চ আদালতের এ হেন রায়ে অসহিষ্ণু শাসক উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। তৎকালীন মহারাষ্ট্র সরকার তৎক্ষণাৎ নাগপুর বেঞ্চের এই রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে দেশের শীর্ষ আদালতের কাছে জরুরী ভিত্তিতে শুনানির আবেদন জানায়। কিন্তু শীর্ষ আদালতের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি হিমা কোহলির ডিভিশন বেঞ্চ বিষয়টি জরুরী ভিত্তিতে শুনানির আবেদন নাকচ করে দেয়। তথাপি, রাত পোহাতে না পোহাতেই আবার নতুন চিত্রনাট্য রচিত হয়ে যায়। পরদিনই মহারাষ্ট্র সরকার নাগপুর বেঞ্চের এই শাস্তি রদের রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে শীর্ষ আদালতে পিটিশন ফাইল করে। ১৫ই অক্টোবর, শনিবার, ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও শীর্ষ আদালতের বিচারপতি এম আর শাহ ও বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদীকে নিয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার জরুরী ভিত্তিক শুনানি হয়। শুনানি অন্তে শীর্ষ আদালত সাঁইবাবা ও তাঁর পাঁচ সহযোগীর উচ্চ আদালত প্রদত্ত যাবজ্জীবন দণ্ডাজ্ঞা রদের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়। শীর্ষ আদালতের ঘোষিত রায়ে বলা হয় যে, উচ্চ আদালত সাঁইবাবা এবং তাঁর সঙ্গীদের শাস্তি মুকুবের আবেদনটি যোগ্যতার নিরিখে বিবেচনা করেনি; বরং দায়রা আদালতের রায়ের পদ্ধতিগত ত্রুটিকে বিবেচনা করেই উচ্চ আদালত তাঁদের শাস্তি রদ করেছে। এই প্রসঙ্গে শীর্ষ আদালতের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল, “সাজাপ্রাপ্তদের অপরাধগুলি অত্যন্ত সাংঘাতিক এবং রাষ্ট্র যদি এই সকল অপরাধ প্রমাণে যোগ্যতার ভিত্তিতে সফল হয়, তবে সমাজের স্বার্থে এবং ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রশ্নে এই অপরাধগুলো অত্যন্ত গুরুতর”। ফলস্বরূপ, অধ্যাপক সাঁইবাবা ও তাঁর পাঁচ সহযোগীর কারারুদ্ধ জীবন থেকে অব্যাহতির আলোর রেখা আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য নিভে যায়। শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ সাঁইবাবার উন্নততর চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁকে কারাগারে আটকে না রেখে গৃহবন্দী রাখার জন্য তাঁর আইনজীবী শীর্ষ আদালতের কাছে আবেদন করলেও, আদালত সেই আবেদনও খারিজ করে দেয়। অধ্যাপক সাঁইবাবাকে গৃহবন্দী রাখার আবেদনের তীব্র বিরোধিতা করে সরকারের সলিসিটর জেনারেল আদালতে বলেন যে, “শহুরে নকশালদের তরফ থেকে কারাগারের পরিবর্তে গৃহবন্দি থাকার আবেদনের প্রবণতা সাম্প্রতিক কালে প্রবলভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, তাহলে বাড়ির মধ্যে থেকেই, এমনকি ফোনেও, সবকিছু করা যায়। সেহেতু, এমন অপরাধীদের ক্ষেত্রে গৃহবন্দী কখনই কারাবাসের বিকল্প হতে পারে না”। অথচ সাম্প্রতিক অতীতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন যে, “শহুরে নকশাল বলতে ঠিক কি বোঝায় তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের জানা নেই। এমনকি এই শব্দবন্ধের কোন অর্থই তাদের অভিধানে নেই”। কিন্তু যে সকল প্রতিবাদীকে আইনের পরিধির আওতার মধ্যে এনে সরাসরি মাওবাদী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের আত্ম পরিচিতিতে ‘শহুরে নকশাল’ তকমা সেঁটে দেওয়ার কৌশল তো বর্তমান ভারতে আকচারই দেখা যাচ্ছে! তাই শীর্ষ আদালতের সওয়াল পর্বে অশীতিপর বিকলাঙ্গ এক অধ্যাপককে ‘শহুরে নকশাল’ হিসেবে দেগে দিতে সলিসিটর জেনারেলের কোথাও এতটুকুও বাঁধেনি! বোধহয় ‘কপটতাকে’ আড়ালে রাখার স্বার্থে সংসদ কক্ষে কিছুটা পট্টি পরানোর প্রয়াসটা প্রয়োজনীয় ছিল! শুধু তাই নয়, শুনানি চলাকালীন মাননীয় বিচারপতি শাহর অভূতপূর্ব মন্তব্য ছিল, “মানুষের মস্তিষ্কই হচ্ছে সব চেয়ে সাংঘাতিক। সন্ত্রাসবাদী ও মাওবাদীদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কই সব”! অবশেষে চলতি বছরের মার্চ মাসে মিলল সেই বহুপ্রতীক্ষিত মুক্তি। গত ৫ই মার্চ মুম্বাই উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে অধ্যাপক সাঁইবাবা সহ তাঁর বাকি পাঁচ সঙ্গীকে বেকসুর মুক্তি দেওয়া হয়। এই বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চের সুস্পষ্ট পর্যবেক্ষণ ছিল, “অভিযুক্তদের জেলে আটকে রাখার মতো কোন প্রমাণ রাষ্ট্রের কাছে নেই”। তথাপি, জীবনের অতি মূল্যবান দশ-দশটা বছর তাঁদের কারাগারের বদ্ধ কুঠুরিতে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন কাটাতে হল! জেল থেকে মুক্ত হয়েই অধ্যাপক সাঁইবাবা রাষ্ট্রের কাছে, নাগরিক সমাজের কাছে, বিচার ব্যবস্থার কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, “তাঁদের জীবনের অতি মূল্যবান দশটা বছর কে ফিরিয়ে দেবে?” সেই সঙ্গে অশীতিপর শারীরিক প্রতিবন্ধী অধ্যাপকের আক্ষেপ, “উচ্চতর আদালত একাধিকবার জানিয়েছে যে, এই মামলায় প্রামাণ্য কোন তথ্য নেই, আইনসিদ্ধ কোন উপাদান নেই। তথাপি, রাষ্ট্রশক্তি অজানা কোন কারণে এই মামলা এতদিন ধরে টেনে গেল!” রাষ্ট্রীয় রোষানলে তিলতিল করে জীবন্ত দগ্ধ করার প্রকৃষ্ট উদাহরণ অধ্যাপক সাঁইবাবার প্রতি রাষ্ট্রের এই নগ্ন আচরণের থেকে বেশি আর কিই বা হতে পারে! শারীরিকভাবে ৯০ শতাংশ অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় রোষানল বর্ষণের কোথাও কোন খামতি ছিল না! ভাগ্যিস, অন্যায়-অবিচারকে রুখে দেওয়ার জন্য এই বহুত্ববাদী দেশের মহান সংবিধান এবং, বিলম্বিত হলেও, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা আজও অটুট আছে। ইতিহাসের হলুদ পাতাগুলো সমস্বরে বলছে, অসহিষ্ণু স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপরিচালকরা নির্ভীক নাগরিক মতপ্রকাশকে যুগ যুগ ধরে ভয় পেয়ে এসেছে। বিশেষত সেই সকল শাসকেরা, যারা যুক্তিগ্রাহ্য মুক্তচিন্তার কণ্ঠ দুহাতে চেপে ধরে ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে থাকে। এ হেন রাষ্ট্রশক্তি এমন এক বিষবৃক্ষ সমাজ জমিনের স্তরে স্তরে সংগোপনে রোপণ করে ফেলে, যার প্রভাবে এক নতুন ‘গোয়েবেলসিও সত্য’ সৃষ্টি হয়ে যায়। সমাজ জীবনের আনাচে কানাচে নির্মাণ করা হয় দেশপ্রেমের অলীক মিথ। রাষ্ট্রশক্তির সুরে তাল মেলাতে পারলেই দেশপ্রেমী। আর রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে ফেললেই দেশদ্রোহী। অর্থাৎ, প্রতিবাদীকে দেশদ্রোহিতার মোড়কে মুড়ে ফেলার ধুরন্ধর ফ্যাসিবাদী কৌশল। অকুতোভয় প্রতিবাদীর কণ্ঠরোধ করার সুনিপুণ চিত্রনাট্য। কখনও তা ‘শহুরে নকশাল’-এর মোড়কে, কখনও বা ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর আচ্ছাদনে মুড়ে। তারপর, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রণীত কালা আইনের করাল প্রয়োগ এবং রুদ্ধ কারাগারে সন্ত্রস্ত অন্ধকার ভবিষ্যৎ। তাই, শারীরিকভাবে ৯০ শতাংশ অক্ষম, পঙ্গু, প্রায় চলৎশক্তি রহিত এক অশীতিপর ‘শহুরে নকশালের’ জন্যও প্রস্তুত থাকে কারাগারের অন্ধকার কুঠুরির আবর্তনে ধুঁকতে থাকা অমোঘ অদৃষ্ট! একই কৌশলে দুরারোগ্য ‘পারকিন্‌সন’ ব্যাধিতে ধুঁকতে থাকা মানবাধিকার ও সমাজকর্মী অশীতিপর বৃদ্ধ স্ট্যান স্বামীকে বিনা বিচারে দীর্ঘকাল কারাগারে অবরুদ্ধ রেখে মেরে তো ফেলা গেল! কিংবদন্তী ইংরেজ সাহিত্যিক আরনেস্ট হেমিংওয়ে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলেই চলেছেন ... “A man can be destroyed; but not defeated”। প্রতিবাদী কণ্ঠকে হারাতে না পারলেও, অনায়াসে ধ্বংস তো করে ফেলা যায়! তা না হলে, খুনের পর খুন ও ধর্ষণের পর ধর্ষণের অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত কুখ্যাত অপরাধী গুরমিত রাম রহিম অনায়াসে বারংবার প্যারোলে মুক্তি পেতে পারে! কিংবা গুজরাটের গোধরা কাণ্ডে গণধর্ষণ ও গণহত্যার অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন কুখ্যাত অপরাধীর সাজা মহামান্য সরকার বাহাদুর এক লহমায় মুকুব করে দিতে পারে! অথচ রাষ্ট্র শক্তির চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেই ‘দেশদ্রোহিতার’ জালে জড়িয়ে বছরের পর বছর বিচারাধীন বন্দী! এমনকি বিচারাধীন বন্দী অবস্থাতেই নিষ্ঠুর মৃত্যু ফাঁদের সুবন্দোবস্ত! বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের চরাচর জুড়ে এইখানেই বোধহয় “ট্র্যাভেস্টি অফ জাস্টিস”! এমনিভাবেই যদি কালা আইনের করাল প্রয়োগের জাঁতাকলে পিষে প্রথমে এক, তারপর আর এক, তারপর আরও এক প্রতিবাদীকে নিথর শব বা মস্তিষ্কহীন প্রাণে পরিণত করে ফেলা যায়, তাহলে হয়তো কোন একদিন বহুত্ববাদী এই দেশের মহান সংবিধানের পৃষ্ঠায় কালি ঢেলে দীর্ঘদিন ধরে লালিত গুপ্ত অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করা যাবে! গত ১০ই নভেম্বর, ২০২২, দেশের শীর্ষ আদালতে ভীমা কোরেগাঁও-এলগার পরিষদ মামলায় অভিযুক্ত বিশিষ্ট সমাজকর্মী গৌতম নওলাখার গৃহবন্দীর আবেদনের শুনানি চলাকালীন সরকারের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল এই মর্মে অভিযোগ আনেন যে, নওলাখার মত মানুষরা নাকি দেশকে ধ্বংস করতে চান! কিন্তু রাষ্ট্রের আনা এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালতের মাননীয় বিচারপতি কে এম জোসেফ ও হৃষীকেশ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চের মৌখিক পর্যবেক্ষণ ছিল - “আমরা মনে করি না নওলাখার মত মানুষরা দেশকে ধ্বংস করছে। এই দেশকে কারা ধ্বংস করছে? যারা দুর্নীতিবাজ তাঁরা”। তাই প্রজাতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আবর্তের প্রান্তে দাঁড়িয়েও আজও ন্যায়প্রার্থী আমজনতার অন্তিম আস্থার মরূদ্যান দেশের নির্ভীক নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থাই।
    ইদবোশেখির লেখাপত্তর - গুরুচণ্ডা৯ | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়শীতকাল বইমেলা হইচই-এর দিনকাল ফুরিয়ে এসে গেল শান্ত হয়ে বসে লেখালেখির কাল। বাইরে তাপমাত্রা বাড়ছে রোদ্দুরের জন্য, নির্বাচনের জন্য। সাথে কোথাও প্যাচপ্যাচে ঘাম তো কোথাও ঝরঝর বৃষ্টি। সন্ধ্যের আবছায়ায় দোকানে ভিড় জমায় সারাদিন রোজা রাখা ক্লান্ত মানুষ, গাজনের প্রস্তুতি নেওয়া শ্রান্ত মানুষ, চৈত্রসেলের হাতছানিতে মুগ্ধ মানুষ। টুপটাপ জমে ওঠে গল্পেরা, কবিতারা। নির্বাচনী জনসভার কোণাকাঞ্চিতে, ইফতারির থালার পাশে, গাজনের সন্ন্যাসীর ঝোলায় চুপটি করে অপেক্ষা করে তারা মানুষের জন্য। আমরা আপনাদের কাছে ডাক পাঠিয়েছিলাম তাদের খপ করে ধরে ফেলে, ঝপ করে লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে। এসে গেছে তারা। আগামী কয়েকদিন ধরে রোজ দুটি-তিনটি করে তারা এসে হাজির হবে বুলবুলভাজার পাতায় - টাটকা ভাজা, গরমাগরম। পড়তে থাকুন। ভাল লাগলে বা না লাগলে দুই বা আরো অনেক লাইন মন্তব্য লিখে জানিয়ে দিন সে কথা। মন চাইলে, গ্রাহক হয়ে যান লেখকের। আর হ্যাঁ, আপনিও লেখা নিয়ে চলে আসুন গুরু আর চন্ডালের আড্ডা গুরুচন্ডা৯-র পাতায়।সূচীপত্রঃস্মৃতিচারণবর্ষশেষ, বর্ষশুরু: অমিতাভ চক্রবর্ত্তীও চাঁদ: সেমিমা হাকিমসারেতে থাই নববর্ষ: হীরেন সিংহরায়চান রাত: সাদেকুজ্জামানকাব্যজলের সমাধি: জগন্নাথ দেব মন্ডলগিরগিটি ও অন্যান্য কবিতা: ফরিদাসমুদ্রে সনেট: সোমনাথ রায়পাঁচটি কবিতা: অমিতরূপ চক্রবর্তীতিনটি কবিতা: অরিত্র চ্যাটার্জিউপগ্রহ: অমিত চট্টোপাধ্যায়আব্বু আব্বা বাবা: মাজুল হাসানশেষের কবিতা: দীপ্তেনকবিতাগুচ্ছ: মণিশংকর বিশ্বাসসিন্দবাদের গল্প ছড়ানো ছাদে: সুকান্ত ঘোষগপ্পোখুচরো: সুমন মুখার্জীসুফি: আফতাব হোসেন রতন, দ্য ব্যাকবেঞ্চার: নরেশ জানাডাক দিয়ে যায়: এস এস অরুন্ধতীমহারাজ ছনেন্দ্রনাথ ও মার্কণ্ডেয়র চিঠি: রমিত চট্টোপাধ্যায়পাখির অন্তর্ধান রহস্য: মৃণাল শতপথীএই ঘুম শারীরবৃত্তীয়: দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ওয়েথসাম: উপল মুখোপাধ্যায়কোশিশ কিজিয়ে: কিশোর ঘোষালটুনিমুনির জীবন: দময়ন্তীদৌড়বাজ হাউসকীপার: সমরেশ মুখোপাধ্যায়হন্য: সৈয়দ তৌশিফ আহমেদসীমান্তরেখা: প্রতিভা সরকারসাদা খাম: দীপেন ভট্টাচার্যসুর: অনুরাধা কুন্ডানভেলাফকির ফয়জুল্লাহ: মুরাদুল ইসলামনিবন্ধ আজ নববর্ষের আখ্যান: সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
  • হরিদাস পালেরা...
    ভোটুৎসবে ভাট - লক্ষ্মীবাবুর নকলি সোনার টিকলি - সমরেশ মুখার্জী | এখন বড় দুঃসময়। দূষণমুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত খাদ‍্য, পরিশ্রুত পানীয় এখন অধিকাংশ‌ মানুষের ভাগ‍্যে নেই। ভাগ‍্যচক্রে আমি অতোটা দুর্ভাগা ন‌ই। তবে নিত‍্য নানান তিক্ত, খবর, পোষ্ট দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়। অথচ কিছু করার নেই। কারণ SMW বা Social Media Warrior এর ভূমিকা ছেড়ে জমিতে 'কিছু' করার জন‍্য যে সব চারিত্রিক গুণাবলী‌র প্রয়োজন - সাহস, ক্ষমতা, উদ‍্যম, নিষ্ঠা, বিশ্বাস, সমর্পণ - সেসব কিছু‌‌ই আমার চরিত্রে নেই। আমার সম্বল ভয়, সংশয়, আত্মকেন্দ্রিক‌তা। ফলে বাড়তে থাকে হতাশা, চাপ।  চাপ কমাতে  ব‌ই পড়ি। ভারী নয় - হালকা। টিভি দেখি‌না বারো বছর। নেটে দেখি ডকু, ভ্রমণ ভিডিও। কিছুক্ষণ আত্মমগ্ন হয়ে থাকতে কিছু লিখি। বৃষ্টি‌ভেজা পথকুকুরের মাথা ঝাঁকিয়ে জল ঝাড়ার মতো আমার লেখাও মনে জমা চাপ ঝাড়তে। তাতে ঋদ্ধ পাঠকের কাঙ্খিত সারবস্তু নেই। এসব নিছক আমোদিত কালক্ষেপ। Pleasurable Pastime. সুনীল বলেছিলেন, মাতৃভাষা‌র চর্চায় মগজের পুষ্টি হয়। অসংলগ্ন ভাবনা গুছিয়ে ধরার প্রয়াস আমার কাছে cognitive exercise. তাই এসব লিখি।              * * * * * * * * * *  আটাত্তরের কাছাকাছি। নিউ এম্পায়ারে লবঙ্গলতিকা‌র প‍্যাঁচের মতো তিনথাক গ্ৰীলের লাইনে ভ‍্যাপসা গরমে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কাটতে হোতো ৭৫ পয়সার টিকিট। তার‌পর সিঁড়ি ভেঙ্গে পাঁচতলা‌য় উঠে দূর থেকে কাঠের সীটে বসে সিনেমা দেখার মজা ছিল অনবদ‍্য। ওটা আদতে ছিল থিয়েটার হল - পি সি সরকার সিনিয়র‌‌ ওখানে দেখিয়েছেন ম‍্যাজি‌ক। তাই গদী আঁটা দামি টিকিটের আসন ছিল নীচে, মঞ্চে‌র কাছে। সিনেমা হলে রূপান্তরিত হতে পাঁচতলা‌র গ‍্যালারী হয়ে গেলো গরীব দর্শকের ৭৫ পয়সার স্বর্গ। ১৯৭৬ থেকে ৯০ - সেই স্বর্ণালী ১৪ বছরে ওখানে অনেক সিনেমা দেখেছি। এই প্রসঙ্গে আসছে একটা সিনেমার কথা - The Spaghetti Western Classic - The Good, The Bad and The Ugly. তখনকার হলিউডি ওয়েস্টার্ন সিনেমার পটভূমি ছিল পশ্চিম আমেরিকার টেক্সাস, আ্যারিজোনা, নেভাডা, উটা, কলোরেডো, নিউ মেক্সিকো, মন্টানা রাজ‍্যের দিগন্ত‌বিস্তারি পাহাড়ি মরু অঞ্চল। ডাকাবুকো ডাকাত, ভাড়াটে খুনি, বাউন্টি হান্টার, জেল পালানো পলাতক - অর্থাৎ আইনকে কাঁচকলা দেখানো Outlaw বা দুর্বৃত্ত‌রাই হোতো ঐ ধরনের সিনেমার প্রোটাগনিস্ট। রুক্ষ, শৈলকঠিন মুখ। পেটানো চেহারা। গায়ে বাঁটুল বা অরণ‍্যদেবের মতো সাত জন্মে না খোলা চামড়ার জ‍্যাকেট। মাইলের পর মাইল মরুপথে ঘোড়া ছুটছে ধূলো উড়িয়ে। যেন অতিপ্রাকৃত দৃশ‍্যপট। ধূ-ধূ প্রান্তরের মাঝে দ্বীপের মতো গুটিকয় ঘরের কোনো জনপদ। সেখানে এসে হাজির হয় আগন্তুক। সরাইখানা‌র দরজায় ঝোলা ঘন্টি। ঢং আ‌ওয়াজ তুলে ঢুকলো ঘর্মাক্ত কলেবরে। তারপর ম‍্যাজিক - কাউন্টারে সরাই সেবিকা ভরা বসন্তের স্বর্ণ‌কেশী। কাউন্টারে ঝুঁকে  - she shows more than what she supposed to sell. মরুভূমিতে  দৃশ্যমান মোলায়েম মরুদ্যান। মেদুর কটাক্ষে হেলায় তাকায় তারা  আগন্তুক পানে। সেই  কটাক্ষাঘাতে দূর্ধর্ষ  দস‍্যুর‌ দৃষ্টি হয়ে আসে মিয়োনো পাঁপড়ের মতো নরম।  খেলা জমে ওঠার সম্ভাবনা‌য় ৭৫ পয়সার টিকিটের ৫০ শতাংশ ওতেই উশুল। আইন শৃঙ্খলা‌র বালাই নেই। পুলিশের টিকি দেখা যায় না। তাই আত্মরক্ষার্থে সবাই রাখে বন্দুক। দস‍্যুদের হাতে তা গ‍্যাস ওভেনে খটাস খটাস করে লম্বা পিজো-ইলেকট্রিক লাইটার জ্বালানোর মতো‌‌ চলে অবলীলায়। পলক ফেলার আগেই ছোটে কয়েক রাউন্ড গুলি। সোয়াটার (flyswatter) ব‍্যাটের চপেটাঘাতে ফটাস ফটাস করে নিমেষে মরা মশার মতো হেথা হোথা ছিটকে পড়ে জলজ্যান্ত মানুষ।    সেসব দৃশ‍্য বিস্মৃত জমানার। ফ‍্যাঁও ফ‍্যাঁও করে ম‍্যারিকান বুলি‌তে কী যে তারা বলতো তখন সিকিভাগ‌‌‌ও বুঝতাম‌ না। এখন কষ্টেসৃষ্টে কিঞ্চিৎ বুঝি। তবু তখন কথা না বুঝেও দেখতাম। মজা লাগতো বেশ। হিরো, ভিলেন, সবার মাথায় ঝুলবারান্দার মতো কাউবয় হ‍্যাট। তার নীচে মরুভূমি‌র উজ্জ্বল রোদে সরু চোখের দৃষ্টি। তাতে মেশা সাপের শীতলতা বা ঈগলের ক্রুরতা। নিভে যাওয়া চুরুট ভাবলেশহীন মুখে ওষ্ঠের কোনে অনর্থক চর্বিত হয়ে চলেছে। গলায় বাঁধা ব‍্যান্ডানা। কোমরে চামড়ার খাপে ঝিমোচ্ছে বিরাট নলের রিভলবার। দেখতে মোটেও শৌখিন নয় - তবে বহু ব‍্যবহারে চকচকে। হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে বিহারী কুটির‌শিল্প -  মুঙ্গেরী 'কাট্টা' গোছের।    কিন্তু না - হলিউড ওয়েস্টার্ন সিনেমা‌য় দেখানো সে সব যন্ত্র এক একটি রত্ন বিশেষ। যেমন কোল্ট 1873 সিঙ্গল এ্যাকশন আর্মি স্পেশাল, .45 লং ব‍্যারেল কোল্ট, রেমিংটন 1858 নিউ আর্মি, কোল্ট প‍্যাটারসন, স্মিথ এ্যান্ড ওয়েসন শোফিল্ড ইত‍্যাদি। অর্ধশতাব্দীর অধিক প্রাচীন সেই সব মডেলের নির্ভরযোগ্য‌তা প্রশ্নাতীত। ঠিক‌মতো চালালে অব‍্যর্থ যমদূত। মানুষ তো ছার বেজায়গায় লাগলে ঘোড়াও জমি নিতে পারে। মজবুত কব্জি, হিমশীতল কলিজা না হলে কিলো খানেক ওজনের সেসব মারণাস্ত্র হঠাৎ খাপ থেকে তুলে চোখের পলকে চালানো সোজা কথা নয়। যেমন জন ওয়েন ঘোড়ার বসে একহাতে টুসকিতে ঘোরাতে‌ন হেভি শটগান। দক্ষিণী রজনী অমন কায়দায় সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে-আঙ্গুলে কেরামতি দেখা‌তেন। তাতেই উল্লসিত দেশী পাবলিক দিতো সিটি। অধূনা অনেকে দু আঙ্গুলে স্মার্টফোন ঘোরায়, তেমনই কায়দার ডিজিটাল ভার্সন বোধহয়।   পুলিশ পিতার দৌলতে বছর আঠারো বয়সে একদা তাঁর স্মিথ এ্যান্ড ওয়েসন পুলিশ স্পেশাল সার্ভিস রিভলবারটি দেখা‌র সুযোগ হয়েছিল। হয়তো সেটা ছিল .38 ক‍্যালিবারের মডেল 10 বা 15. কিন্তু কিলোখানেক ওজনের সেই লং ব‍্যারেল ধূসর যন্ত্র‌টির গাম্ভীর্য‌ময় ধাতব শীতলতা ছিল বেশ সমীহ উদ্রেককারী। বলেছিলাম, একবার চালিয়ে দেখবো? বাবা বুলেট বার করে বললেন, চালা। তখন একটু ব‍্যায়াম ট‍্যায়াম করতাম, তাও একহাতে তুলে চালাতে কব্জি ও আঙুলে বেশ জোর লাগলো।  বাবা বললেন, এটা এভাবে চালায় না, রিকয়েলের ঝটকায় কব্জিতে সটকা লাগতে পারে। এটা চালাতে হয় দুহাতে ধরে, এভাবে। এটা মেয়েদের হ‍্যান্ডব‍্যাগে রাখার উপযোগী পুঁচকে পিস্তল নয় যা স্বল্প দুরত্বে আত্মরক্ষায় চালাতে হতে পারে। এটা আরক্ষাকর্মীদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আক্রমণের উদ্দেশ্যে নির্মিত। তাই তাক করে চালাতে পারলে ৫০ ফুট দুরে‌‌ও কোনো  পলাতক দুর্বৃত্ত ধরাশায়ী হতে পারে।  এখন নেট ঘেঁটে দেখলাম এর গুলি বেরোয় প্রায় ১০০০ ফুট/সেকেন্ড গতিতে। অর্থাৎ ৫০ ফুট দুরত্ব অতিক্রম করতে সময় নেবে ০.০৫ সেকেন্ড। মানুষের চোখের পলক ফেলার সময় ০.১০ সেকেন্ড। অর্থাৎ চোখের পাতা পড়ার অর্ধেক সময়ে ৫০ ফুট দুরে পলাতক ঘায়েল হবে। শুধু বুলেট গায়ে লাগা চাই। অভ‍্যাসে‌র অভাবে পুলিশের গুলি এদেশে প্রায়শই লাগে ফুটপাতে হাঁটা বালকের গায়ে। ডাকাত পালায় পাঁচিল টপকে।  তবে .38 পুলিশ স্পেশালের গুলি ৩০০ ফুট দুরত্বে‌‌ও কারুর গায়ে লাগলে‌ বেশ জখমের সম্ভাবনা। রাইফেলের গুলি পেড়ে ফেলতে পারে ১৬০০ ফুট দুরে কাউকে। টেলিস্কোপিক সাইট লাগানো হাই ক‍্যাপাসিটি স্নাইপার বা এ্যান্টি মেটেরিয়াল ব‍্যালাস্টিক রাইফেল তো ২কিমি দুরে কাউকে শু‌ইয়ে দিতে পারে চিরনিদ্রায়। এখনো অবধি সর্বাধিক দূরত্বে ঘায়েল করার রেকর্ড ২.৪৭ কিমি। তার গুলি‌ বেরোয় ৬৫০০  ফুট/সেকেন্ড গতিতে। দু কিমি দুরে কাউকে শোয়াতে সে বুলেট সময় নেবে মাত্র ১ সেকেন্ড। দুগ্গা দুগ্গা! প্রসঙ্গত বলি, এযাবৎ যাত্রী‌বাহী বিমানের সর্বাধিক গতির রেকর্ড আছে ব্রিটিশ এয়ার‌ওয়েজের অধুনালুপ্ত সুপারসোনিক কনকর্ড বিমানের - ঘন্টা‌য় ২১৮০ কিমি. এযাবৎ তৈরি সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্নাইপার রাইফেলের বুলেটের গতিবেগ সে জায়গায় ঘন্টা‌য় ৭১৫০ কিমি - কনকর্ড বিমানের ৩.৩ গুণ।      একদা ওয়েস্টার্ন ছবিতে দাপিয়ে বেরিয়ে‌ছেন ক্লিন্ট ইস্ট‌উড, জন ওয়েন, হেনরী ফন্ডা, ওমর শরীফ, বার্ট ল‍্যাঙ্কাস্টার,  চার্লস ব্রনসন, টেরেন্স হিল, বাড স্পেন্সার, জেমস কোবার্ন, এলি ওয়ালচ্, লী ভ‍্যান ক্লীফ, বার্ট রেনল্ডস, রোনাল্ড রেগন (আমেরিকার চল্লিশ‌তম রাষ্ট্রপতি হ‌ওয়া‌র আগে জীবনের শুরুয়াতি পর্বে) এবং কিয়দংশে গ্ৰেগরী পেক্, হামফ্রে বোগার্ট, ট‍্যালি স‍্যাভালস্, স্টিভ ম‍্যাকুইন, ইয়ুল ব্রে‌ইনারের মতো অন‍্য গোত্রে‌র অভিনেতা‌রা‌। সে তুলনায় সেই সব ছবির অভিনেত্রী‌কুল -  আমান্ডা ব্লেক, র‍্যাকোয়েল ওয়েল্চ, কেটি জুরাডো, রোন্ডা ফ্লেমিং, ডোনা রীড, ক্লেয়ার ট্রেভর - আপামর দর্শকদের স্মৃতি‌তে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেন নি।    স্প‍্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন সিনেমা বলতে বোঝাতো সেই‌সব ওয়েস্টার্ন ছবি যার মূল কলাকুশলীরা - প্রযোজক, পরিচালক, সম্পাদক, সঙ্গীত‌কার, ক‍্যামেরা‌ম‍্যান‌ হতেন ইতালিয়ান। যদিও বিশ্বের বাজারে বাণিজ্য করতে সেসব ছবির নায়ক নায়িকা হতেন মূলত হলিউডি। হলিউডে প্রতিষ্ঠিত ইতালিয়ান অভিনেতা‌ও ছিলেন - টেরেন্স হিল, বাড স্পেন্সার, (Django খ‍্যাত) ফ্রাংকো নিরো ইত্যাদি। সে সব ছবি নির্মিত ও বিশ্ব বাজারে বিতরিত হোতো  বিখ্যাত সব হলিউড প্রোডাকশন হাউস দ্বারা যেমন ওয়ার্নার ব্রাদার্স, এমজিএম, ইউনিভার্সাল পিকচার্স, কলম্বিয়া পিকচার্স, ইউনাইটেড আর্টিস্ট‌স্ ইত্যাদি। এসব ছবি ইংরেজি‌তে হলেও ইতালিয়ান, স্প‍্যানিশ, জার্মান ভাষায় ডাবিং বা সাবটাইটেল দিয়ে তৈরী হোতো তার মাল্টিলিঙ্গুয়াল ভার্সন। The Good, The Bad and The Ugly নির্মিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। পরিচালনায় ডিপ ক্লোজআপ ও লং ডিউরেশন শটের সাহায্যে সিচুয়েশন তৈরীতে সিদ্ধহস্ত বিখ্যাত ইতালিয়ান পরিচালক - সের্গি‌ও লিওন। পদবী‌টা চেনা চেনা লাগছে?  সানি লিওনের দৌলতে সেটা স্বাভাবিক তবে সের্গেইয়ের সাথে সানির কোনো যোগসূত্র‌ নেই।  সানি কানাডা প্রবাসী এক শিখ মেয়ে - করণজীৎ কৌর ভোরা। সানি তার ডাক নাম। ছোট থেকে খেলাধুলা‌য় উৎসাহী, টমবয় স্বভাবের সানি রাস্তায় ছেলেদের সাথে হকি খেলতো। এগারো বছরে পেলো প্রথম চুম্বনের স্বাদ। ষোলো বছরে এক বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের সৌজন্যে খেলাচ্ছলে‌ হারালো কুমারী‌ত্ব। একুশে পা দিয়ে ২০০১ সালের মার্চের পেন্টহাউস পত্রিকার প্রচ্ছদে নূন‍্যতম আচ্ছাদনে অপরিণত সম্পদে হাজির হয়ে‌ই পেলো 'পেন্টহাউস পেট' খেতাব। যেমন প্লেবয় ম‍্যাগাজিনে আবির্ভূতা মডেল‌রা পায় 'প্লেবয় প্লেমেট' তকমা। ২০০৭ সালে সানি বাণিজ্যিক প্রয়োজনে কৃত্রিম উপায়ে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হোলো। যেমন অধূনা হোয়াটস‌এ্যাপ ফরোয়ার্ডে‌ড পোষ্ট পড়ে (বা না পড়েই) সমৃদ্ধ হয় নেটিজেন। ২০১২তে পূজা ভাটের 'জিসম-2' দিয়ে বলিউডে হোলো সানি‌র সাহসী আত্মপ্রকাশ। ভূতপূর্ব জীবিকা পরিত্যাগ করে প্রাচুর্যময় প্রতিস্থাপিত উপস্থিতিতে বলিউডে নিজেকে নবরূপে উদ্ভাসিত করায় সানি‌র নিষ্ঠা ও শৈলী প্রশংসনীয়।  সানি‌র স্বামী ড‍্যানিয়েল ওয়েবারের সংস্কারহীনতা মধ‍্যবিত্ত মানসিক‌তায় অনুধাবনের অতীত।  সানি‌র লিওন পদবী‌টি দেন পেন্টহাউস পত্রিকার তদানীন্তন মালিক বব গুচ্চিয়ন। হয়তো তাঁর পদবী‌র শেষাংশে‌র সাথে সমধ্বনীয় সাযুজ‍্যে - গুচ্চিয়ন - লিওন। এই আর কী। ইতালিয়ান পরিচালক সের্গেই লিওনের সাথে সানি লিওনের কেবল এটুকুই যোগসূত্র - এক পদবী‌তে।   ফিরে আসি সের্গেই‌তে । তিনি বানিয়ে‌ছিলেন দুটি ট্রিলজি। প্রথমটি 'ডলার ট্রিলজি'। পরে 'ওয়ান্স আপন এ টাইম ট্রিলজি'। ডলার ট্রিলজির প্রথমটি ছিল A Fistful of Dollar (১৯৬৪)। দ্বিতীয়‌টি For a Few Dollars More (১৯৬৫) এবং শেষে ঐ TGTBATU (১৯৬৬). আগের দুটি ছবি তখন কেবল ইতালি‌তে মুক্তি পেয়েছে। দুটি‌তেই মুখ‍্য ভূমিকা‌য় ছিলেন ছ ফুট চার ইঞ্চির সুপুরুষ ম‍্যাচো ম‍্যান - ক্লিন্ট ইস্ট‌উড। প্রথম ছবিটি‌ আমেরিকা‌য় মুক্তি পাবে ১৯৬৭তে।   তবে তার আগে‌ই সের্গি‌ও বানাতে  চাইলেন ট্রিলজির শেষ ছবি - TGTBATU. ছবির বাজেট মাত্র ১২ লক্ষ ডলার - বাস্তবিক‌ই fistful - মুষ্টিমেয়। কিন্তু ততদিনে ক্লিন্ট বুঝে গেছেন নিজের বাজার‌দর। তাই চেয়ে বসলেন আড়াই লক্ষ ডলার - ছবির বাজেটের ২০% (আজকের দিনে ভারতীয় মূদ্রা‌য় প্রায় ৫০ কোটি টাকা) এবং আমেরিকা‌য় প্রদর্শনের লভ‍্যাংশের ১০%. কিঞ্চিৎ অসন্তুষ্ট হলেন সের্গেই। কিন্তু চাই তার ক্লিন্টকে‌ই - কারণ The Good চরিত্র যা ভেবেছেন, তাতে তিনি নিশ্চিত - ক্লিন্ট মাত করবে বক্স অফিস। তাই রাজী হয়ে গেলেন। পরিচালকের মুন্সীয়ানা, চমৎকার ওয়াইড স্ক্রিন ক‍্যামেরা‌র কাজ, সঙ্গীত পরিচালক এন্নিও মরিকনের অপূর্ব আবহ সঙ্গীত - পর্দায় ক্লিন্ট ও লী ভ‍্যান ক্লীফের চুম্বকীয় উপস্থিতি‌ - সব মিলিয়ে এক ডেডলি প‍্যাকেজ।    ক্লিন্টের এই ডলার ট্রিলজি‌র সাফল্য‌ই তাকে ১৯৭১ এ প্রতিষ্ঠিত করে আইকনিক 'ডার্টি হ‍্যারি' চরিত্রে। যার রেশ চলে ১৯৮৮ অবধি বিভিন্ন নামে মোট পাঁচটি ছবির সিরিজে। চতুর্থ‌টির পরিচালক‌ও ক্লিন্ট। ছবিতে তিনি সানফ্রানসিস্কো পুলিশ বিভাগের নির্ভীক এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট - হ‍্যারি ক‍্যালাহান। মুম্বাই ক্রাইম ব্রাঞ্চের রিয়েল লাইফ এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট দয়া নায়কের ওপরে তৈরি হয়েছিল 'অব তক ছপ্পন' সিনেমা। তাতে ইন্সপেক্টর সাধু আগাসের চরিত্রে ফাটিয়ে দিয়ে‌ছেন নানা। পরে ডলার ট্রিলজির প্রযোজকের বিনিয়োগ‌ও ফিরে এসেছে বহুগুণ হয়ে। সের্গেই বিখ্যাত হলেন Godfather of Spaghetti Western Movies হিসেবে।   ১৮৬২ সালে আমেরিকা‌ন সিভিল ওয়ারের পটভূমি‌কায় তৈরি কাহিনী‌ TGTBATU ছবির শেষে আছে একটি গোলাকার সমাধিক্ষেত্রের দৃশ‍্য - টানটান ক্ল‍্যাইম‍্যাক্সে ত্রিমূর্তীর মধ‍্যে সংঘটিত হবে ক্ল‍্যাসিক 'মেক্সিকান স্ট‍্যান্ড‌অফ' দৃশ‍্য। তাতে আহবান জানায় ক্লিন্ট (Good)। ডাকুদের মধ‍্যে অলিখিত নিয়মে পুরুষোচিত অহংকারে তাতে সাড়া দিতেই হয় লী ভ‍্যান ক্লীফ (Bad) এবং নিরুপায় হয়ে এলি ওয়ালচ্‌কেও (Ugly). ক্ল‍্যাসিক ব্রিটিশ ডুয়েল হোতো দুজনের মধ্যে যাতে দুজন বা একজনের মরার সম্ভাবনা অবধারিত। মেক্সিকান স্ট‍্যান্ড‌অফে সাধারণত তিনজন বন্দুকধারী নিজেদের মধ‍্যে হিসাব বরাবর করতে ১২০ ডিগ্ৰি কোনে দাঁড়িয়ে একে অপরকে মাপতে থাকে‌। যে আগে বন্দুক তুলবে সেই জ্বালবে স্ফুলিঙ্গ।   ছবিতে Sad Hill Cemetery নামে পরিচিত ঐ সমাধিক্ষেত্র‌টি সেই ১৯৬৬ সালে‌ই স্পেনের বুর্জোস প্রদেশে স্প‍্যানিশ সৈন‍্যদের দিয়ে পয়সার বিনিময়ে তৈরি হয়েছিল শুধুমাত্র ঐ একটি দৃশ্যে‌র জন‍্য। দৃশ‍্যটি আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি। এমন দীর্ঘায়িত নাটকীয় সাসপেন্স সৃষ্টিতে সের্গি‌ও ছিলেন বিখ‍্যাত। সিনেমা‌টির দৈর্ঘ্য‌ও তাই চার ঘন্টা।  (দৃশ‍্য‌টার লিংক র‌ইলো শেষে)।    শুটিংয়ের পর ঝোপঝাড় কেটে বানানো নকল সমাধিক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত হয়। ক্রমশ প্রকৃতি আবার অধিকার করে নেয় তাকে। তবে পৃথিবী‌ব‍্যাপী TGTBATU ফ‍্যানদের স্বেচ্ছা দানে স্পেনের The Sad Hill Cultural Association ২০১৭ সালে - মানে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর - বিস্মৃত, জঙ্গলাকীর্ণ সেই শ‍্যূটিং স্পটটি আবার খুঁজে বার করে। সাফ সাফাই করে সেটাকে রূপান্তরিত করে একটি নস্টালজিক পর্যটন‌স্থলে। পাঁচ দশক পরেও একটি পাতি এ্যাকশন সিনেমার প্রতি ফ‍্যানেদের এমন হৃদয়ের টান বেশ আশ্চর্য‌জনক।   ১৯৭০ সালে শোলে ছবির কাহিনী‌কার সেলিম-জাভেদ যে তিনটি ছবি থেকে সবিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন তার একটি ছিল সের্গেই লিওন পরিচালিত 'Once upon a time in the West' - মূখ‍্য ভূমিকা‌য় হেনরি ফন্ডা ও চার্লস ব্রনসন। সে ছবির কাহিনী নির্মাণে সের্গেই‌য়ের সাথে যুক্ত ছিলেন আর এক দিকপাল ইতালিয়ান পরিচালক - বার্নার্দো বেত্রোলুচি। বাকি দুটি ছবি কুরোশোয়ার 'Seven Samurai' ও জন স্ট্রাজেসের 'The Magnificent Seven'. রাজ কুমার সন্তোষীর 'China Gate' ছবিতে‌ও The Magnificent Seven এর সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ‍্য করা যায়।    শোলের শ‍্যূটিং‌য়ের জন‍্য‌ও ব‍্যাঙ্গালোর থেকে মাইশোরের পথে ৫০ কিমি দুরে রামনগরে হাইওয়ে থেকে ভেতরে ছবির প্রয়োজনে তৈরী হয়েছিল এক গ্ৰাম। প্রায় আড়াই বছর ধরে শ‍্যূটিং চলাকালে সেই অস্থায়ী গ্ৰামের নাম হয়ে গিয়েছিল 'সিপ্পি নগর'। স্থানীয় কিছু লোক কাজ পায়। তাদের দেখা গিয়েছিল সিনেমার পর্দায় গ্ৰামবাসী হিসেবে। ওখানেই জলের ট‍্যাঙ্কের ওপরে চড়ে  ধর্মেন্দ্র‌ করেছি‌লেন সেই বিখ্যাত সুইসাইড নাটক।    কাছেই রামদেবরা টিলায় হয়েছিল গব্বরের ডেরা। সেখানে আমজাদ রাগে গরগর করতে করতে হুঙ্কার ছেড়েছিল - আরে, এ সাম্বা, কিতনা ইনাম রখ্খে হ‍্যায় রে সরকার হম পর? খাড়া গ্ৰানাইট পাথরের টঙে পা ঝুলিয়ে বসে সাম্বা বলেছিল - পুরা পচাশ হাজার, সরকার। এসব সংলাপ এখন কিম্বদন্তীপ্রায়। এখন সেই শোলে গাঁওয়ের  কোনো অস্তিত্ব নেই সেখানে। সে জায়গা এখন বন‍্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ‌দের কাছে অন‍্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ। "রামদেবরা বেট্টা ভালচার স‍্যাংচুয়ারী" এখন বিলুপ্ত‌প্রায় ভারতীয় শকুনের সংরক্ষণের জন‍্য একমাত্র ঘোষিত ESZ (Notified Eco Sensitive Zone).  অবশ‍্য ভারতের নানা জায়গা এখন ঘাস, ফুল, পদ্ম শোভিত এবং গদা, তরোয়াল, ত্রিশূল আন্দোলিত অন‍্য জাতীয় শকুনের মুক্তাঞ্চল - কেবল তাদের ডানা নেই বলে চট করে চেনা যায় না। তবে খুবলে নিলে টের পাওয়া যায়।    তো যা বলছিলাম। সেই সমাধিক্ষেত্রের শেষ দৃশ‍্যে ক্লিন্ট ইস্ট‌উড এলি ওয়ালচ্‌কে একটা বিলিয়ন ডলার ডায়লগ ঝাড়ে - “You see, in this world, there’s two kinds of people, my friend. Those with loaded guns and those who dig. You dig.” কিন্তু what to dig? সিনেমা‌য় তা একটি বিশেষ কবরের নীচে লুক্কায়িত গুপ্তধন। বাস্তবে ক্ষমতাসীন‌দের শোষণে তাদের জন‍্য সম্পদ আহরণে নিম্নবর্গীয় মানুষের আমৃত্যু খুঁড়ে যাওয়া নিজেদের কবর। অথবা নির্মাণ করা নিজেদের জেল। যেমন আসামের দিনমজুর সরােজিনী হাজং। তিনি নিজেই নিজের জন্য বানাচ্ছেন জেল। সরােজিনীর মত অনেক দিনমজুর আসামে ডিটেনশন ক্যাম্প নির্মানে পেটের দায়ে ঘাম ঝড়াচ্ছেন, যাঁদের নাম আসামে চুড়ান্ত NRC তালিকা থেকে বাদ গেছে। তৈরী হলে ওখানেই স্থান হবে সরোজিনী‌দের।   ১৯৭৩ সালে আমেরিকা‌য় প্রতিষ্ঠিত হয় Grammy Hall of Fame. এখানে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন‍্য প্রতি বছর কিছু বাছাই করা উচ্চমানের বা ঐতিহাসিক‌‌ গুরুত্ব আছে এমন সঙ্গীত, বাদ‍্য, কন্ঠস্বর বা বক্তৃতা সংরক্ষণের জন‍্য মনোনীত হয়। তবে তা হতে হবে অন্ততপক্ষে ২৫ বছরের প্রাচীন - অর্থাৎ অবশ‍্য‌ই থাকতে হবে তার enduring appeal. অনেক নমিনেশনের মধ‍্যে বিশেষজ্ঞ‌দের ভোটাভুটির মাধ‍্যমে নির্বাচিত হয় অল্প কিছু।  এভাবেই এখানে সংরক্ষিত হয়েছে টমাস আলভা এডিসনের ১৮৭৮ সালের রেকর্ডিং, ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের "I have a Dream" বক্তৃতা। বব ডিলান, বীটলস, এলভিস প্রেসলি, পল রবসন, বব মার্লে, ফ্রাংক সিনাত্রা, ইহুদি মেনুহিন, জন ডেনভার, এলটন জন, জন লেনন, সাইমন ও গারফাঙ্কেলের 'সাউন্ড অফ সাইলেন্স', বার্‌বারা স্ট্রেসান্ড্ ও এমন নানা দিকপাল গায়ক, বাদ‍্যকার, বাগ্মী‌র রেকর্ডিং। এখানে আছে ১৯৫৬ সালে হিচকক্ পরিচালিত - মুখ‍্য ভূমিকা‌য় জেমস স্টূয়ার্ট ও ডোরিস ডে অভিনীত - The Man Who Knew Too Much সিনেমা‌য়  শেষ দৃশ‍্যে ডোরিসের স্বকণ্ঠে গাওয়া বিশ্ববিখ্যাত গান - Que Sera Sera - Whatever will be, will be গানটি, যার মর্মার্থ - বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই প্রযোজ্য - যা হবার, তাই হবে। (অহেতুক ভেবে কী হবে)। কিন্তু Grammy Hall of Fame এর অবতারণার কী হেতু? একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে এই গরুর রচনায় - সানি লিওন থেকে গ্ৰ‍্যামী হল অফ ফেম - কোনো প্রসঙ্গ‌ই সম্পূর্ণ সম্পর্কবিযুক্ত নয়। প্রতিটি প্রসঙ্গের দড়ি‌ই কোনো না কোনোভাবে একটি মুখ‍্য গরু‌র গলায় বাঁধা - শেষবেষ ঘুরে ফিরে - 'সেই ঘাস গরু খায়' - করে প্রসঙ্গ আবার ফিরে আসবেই সেই গরুতে। এখানে সেই গরুটি TGTBATU. এ ছবিতে সের্গেই‌য়ের প্রতিটি ছবির সঙ্গীত পরিচালক এন্নি‌ও মরিকনের একটি অনবদ‍্য থিম টিউন ছিল, যেটি পরে আইকনিক হয়ে যায়। সেটা আমি বহুবার শুনেছি - হয়তো অনেকেই শুনেছে। (তবু ড‍্যানিশ ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রা কর্তৃক সেটার রিক্রিয়েশনের ভিডিও লিংক র‌ইলো শেষে। অবাক হয়ে গেছি দেখে - একটি সিনেমার টিউন তৈরিতে এতো হ‍্যান্ডস লাগে!)   এন্নিও ছিলেন উঁচু দরের কম্পোজার। দীর্ঘ সঙ্গীত‌জীবনে তিনি ৭০টি পুরস্কার‌প্রাপ্ত সিনেমা‌য় ও টিভিতে প্রায় চারশো‌টি স্কোর ও একশোটি ক্ল‍্যাসিক সিম্ফনি কম্পোজ করেছেন। নিজে ছিলেন দক্ষ ট্রাম্পেট বাদক। TGTBATU সিনেমার সেই টিউনটি তাঁর পরিচালনায় পরিবেশন করে প্রাগ সিটি ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার শিল্পী‌বৃন্দ। এন্নি‌ও পান ইতালির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান - OMRI (Order of the Merit of the Italian Republic) - যা আমাদের দেশের ভারতরত্ন সদৃশ।  সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ‌টি ৬.৭.২০২০- পতনজনিত আঘাতে মারা যান ৯১ বছর বয়সে। তাঁর সুরকৃত TGTBATU সিনেমা‌র সেই বিখ‍্যাত থিম টিউনটি গ্ৰ‍্যামী হল অফ ফেমের (GHF) অন্তর্ভুক্ত হয় ২০০৯ সালে। এবার  হয়তো পাওয়া গেল GHF এর সাথে TGTBATU নিয়ে এই বাঁজা রচনার যোগসূত্র।   এই বাঁজা রচনায় আমি খাল বিল থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আমার হালহীন মনপানসি ইচ্ছা‌মতো ভাসিয়ে এমন ঘন্ট পাকিয়েছি যে মনযোগী পাঠক‌ও হয়তো এযাবৎ পড়ে খেই হারিয়ে ভুলে যেতে পারে এ লেখার শিরোনামে‌র তিলমাত্র তাৎপর্য তো এখনো অবধি বোঝা গেল না? চিন্তা নেই। এবার আসবে।    সেদিন আবার শুনছিলাম ভি শান্তারাম প্রযোজিত ও পরিচালিত 'জল বিন মছলি নৃত‍্য বিন বিজলী' সিনেমা‌য় মুকেশের কণ্ঠে আমার প্রিয় একটি গান - 'তারো মে সজকে'। বহুবার শুনে‌ও সাধ না মেটা অনেক গানের একটি।  ১৯৫৩ সালে সোহরাব মোদী প্রযোজিত, পরিচালিত 'ঝাঁসি কি রাণী'  ছিল ভারতে নির্মিত প্রথম টেকনিকালার ছবি। ১৯৭১ সালে 'জবিম-নৃবিবি' সিনেমার প্রতিটি গান স্টিরিওফোনিক সাউন্ডে রেকর্ড করে শান্তারাম‌ও করূছিলেন আর এক রেকর্ড। রিমিক্সিং করেছিলেন মঙ্গেশ দেশাই, শান্তারামের‌ রাজকমল কলামন্দির স্টুডিও‌তে।    মজরুহ সুলতানপুরীর সরল সুন্দর কথা। লক্ষীকান্ত প‍্যারেলালের অনবদ‍্য সুর। সেই গানের শুরুতে (prelude) এবং মাঝে (interlude) TGTBATU সিনেমার সেই আইকনিক থিম টিউনটির সিগনেচার শিসটি এই গানে হুবহু ব‍্যবহৃত হয়েছে। তাই এই লেখার শিরোনাম 'লক্ষীবাবুর নকলি সোনার টিকলি'। চৌরঙ্গী, এলগিন, মুন্সীবাজার রোডে গেলে দেখা যাবে পর পর কয়েকটি  'লক্ষী বাবুকা আসলি সোনা চাঁদি‌কা দোকান'। সবকটি‌ই প্রথম, একমাত্র এবং আসল। এই গানে ঐ শিস লক্ষ্মীদা জুটি প‍্যারসে নিজেদের  বলে চালিয়ে দিয়েছেন নাকি ভদ্রতার খাতিরে এন্নি‌ও‌র প্রতি অন্তত রোলিং ক্রেডিটে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন, জানা নেই।   প্রতিমা‌র মতো সুন্দর কপালে একটি ঝলমলে টিকলি ঝুললে ভালো‌ই লাগে দেখতে। তবে তা না থাকলেও অসুন্দর লাগে না। 'তারো মে সাজকে' গানটি‌ও তেমন। ঐ টিউনটি গানে অবশ্যই যোগ করেছে এক মনোহর মাত্রা। তবে তা না থাকলেও গানটি ভারতীয় আমেজের সুন্দর সুরের জন‍্য মোটেও খারাপ লাগতো না। মুকেশের গায়কীর গিটকিরি তো কান-মন জুড়ানো।   লক্ষীকান্ত‌-প‍্যারেলাল জুটি সুরকৃত গানে ঐ টুকলি করা টিউনে‌র টুকরোটা‌ই এই গরুর রচনার প্রেরণা। তাই শিরোনামে জ্ঞাপন করেছি কৃতজ্ঞতা। তবে শেষ অবধি না পড়লে তা বোঝা সম্ভব নয়। এই টুকলির কথা জেনেছি তিন দশক আগে।  দুঃসময়ে ছোট্ট স্ফূলিঙ্গ জোগায় অবান্তর রচনা লেখার প্রয়াসে আত্মমগ্নতায় ডুবে থাকা‌র দাওয়া‌ই। লেখার মশলা সংগ্ৰহকালে জানতে পারা যায় নানা আনন্দময় তথ‍্য। পলায়নবাদীরা এভাবে‌‌ও এড়িয়ে থাকতে পারে বিষাক্ত বর্তমানে‌র অভিঘাত। 
    চান রাত!  - মহম্মদ সাদেকুজ্জামান শরিফ | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়ইদের আসল মজা কখন? বয়স্ক মানুষ, বাড়ির মা খালাদের খবর জানি না, বাকি সবার সম্ভবত একটাই রা হবে, তা হচ্ছে ইদের আগের রাত মানে চান রাত! কোন কথা হবে না, সবাই মেনে নিবে যে আসল মজা আগের রাতেই। কী হয় এই রাতে? কিচ্ছু না, স্রেফ গুলতানি মারা চলে, লম্বা আড্ডা চলে। এই দিন সবাই দেরি করেই বাড়ি ফিরবে এইটা অলিখিত আইন। আড্ডার মধ্যেই আগামী দিনের নীতি নির্ধারণ হয়ে যাচ্ছে, নতুন কিছুর ইঙ্গিত তৈরি হচ্ছে, প্রেমের চাবি নাড়াচাড়া হচ্ছে, প্রাণ খোলা হাসি হচ্ছে! এই রাতে মন খারাপের কোন জায়গা নেই। মা খালাদের কথা জানি না কেন বললাম? কারণ এই রাতে তাঁদেরকে প্রচুর খাটাখাটনি করতে হয় ইদের প্রস্তুতি হিসেবে। তাই তাঁদের চান রাত খুব মজায় কাটবে এইটা সম্ভবত বেশি বেশি কল্পনা। তাই জানি না বললাম। কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণী, সবারই একই রকম অনুভূতি হবে। মেয়েরা হাত ভরতি করে মেহেদি দিচ্ছে, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি দৌড়াদৌড়ি চলছে। কারণ মেহেদি শিল্প হাতে গোনা দুই একজনই পারে, আর চান রাতে তাকে ঘিরেই বসে থাকে বাকিরা। উপগ্রহের মতো ঘুরপাক খেতে থাকে এরা যতক্ষণ না পর্যন্ত হাত মেহেদি দিয়ে পূর্ণ হচ্ছে। আবার আমাদের আড্ডায় ফিরি। ইদ যেহেতু আলাদা করে উদযাপনের কিছু না। সকালে ইদের নামাজ পড়লেই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যায়। তাই খাওয়া, আড্ডা, বেড়ানো আর ঘুম ছাড়া ইদের ছুটিতে আর কিছুই করা হয় না। বিশেষ করে রোজার ইদে। চান রাতে ছুটির কয়দিন কী করে কাটানো যায়, কী করা যায় এর পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি সময় যায়। যেমন এবার সারাদিন শুরু করে মধ্য রাত পর্যন্ত আমাদের কাটছে ইদের পরদিন কী করা যায় এই সলাপরামর্শ করেই। স্থান নির্বাচন হয় তো মানুষ হয় না, মানুষ, স্থান হয় তো যানবাহন মিল হয় না। ঠ্যালা ধাক্কা, ধুর শালা সব বাদ! এই চলছে, চলতে চলতে দেখি ঘড়িতে রাত বারোটা! শেষ পর্যন্ত কী করলাম, কী হইল, ছাতু মাখাইলাম গু হইল... যাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তাঁদের আমাদের মতো এমন সৌখিন চিন্তা ভাবনা করার ফুসরত নাই। শেষ মুহূর্তে কেনাকাটার হিড়িক লাগে কেন জানি। কিছু মানুষই আছে যারা কোন অজ্ঞাত কারণে সারা মাস কেনাকাটার আশপাশ দিয়েও যেতে রাজি না। প্রথম থেকেই নিয়ত পাকা যে তিনি যাবেন চান রাতেই! কেউ কেউ তো এমনও বলে যে চান রাত ছাড়া শপিং করে মজাই পাওয়া যায় না। কেউ চান রাত ছাড়া আবার ইদ শপিং হয় না কি? এমন প্রশ্নও করে। তো এই খদ্দেরদের জন্য চান রাতে চলে ভোর পর্যন্ত জমজমাট কেনাকাটা। রাত একটা দুইটা তিনটা যেন সন্ধ্যা রাত! ঢাকায় কোন দিন ইদ করা হয়নি। কিন্তু বন্ধুদের অনেকের কাছেই শুনেছি যে ঢাকায় চান রাতের জৌলুসের সাথে কোন কিছুর তুলনাই হয় না। দেড় দুই কোটি মানুষ চান রাতের আগে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। ঢাকা হাঁফ ছেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বের হচ্ছে তারা চলে ফিরে, দেখে শুনে, কিনে না কিনে আলাদা সুখ পাচ্ছে। ঢাকার জ্যাম ঘাম গরম যে দেখছে সে চান রাতে না থাকলেও অনুমান করতে পারে যে কতটা হালকা লাগছে সবার এই দিন! তবে সবার সমান না। শেষ মুহূর্তেও যারা কিছুই কেনাকাটা করতে পারে নাই আপনজনের জন্য তাঁদের চান রাত এক বিভীষিকার নাম! আমার জীবনে আমি এমন বেশ অনেক ইদ করছি যে ইদে একটা সুতাও কেনা হয়নি আমার জন্য। এমন বহু ঈদ কেটেছে যে কোন একটা দেওয়া হবে আমাকে এইটা আগেই বলা হয়েছে! হয় শুধু জুতা, না হয় শুধুই প্যান্ট বা শার্ট! আপদমস্তক নতুন, ইদের জন্য কেনা এইটা সম্ভবত বহু বহু পরে কপালে জুটেছে। তখন যখন নতুন কিছু না হলেও সমস্যা না, যখন জানি নতুন জামা কাপড়ে ইদ নাই, পুরোটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। যাই হোক, অপ্রাপ্তির ওই চান রাত গুলি কীভাবে কাটিয়েছি এখন চিন্তা করলে বুঝি যে কতটা কঠিন অনেকের জন্য এই রাত। এই বোধটা আমাকে উদার হতে শিখিয়েছে। হাত খুলে সাহায্য করতে শিখিয়েছে। ইদটা যেন সবার জন্য আনন্দের হয় এইটা ভাবতে শিখিয়েছে। এখন আমাদের একটা ফাউন্ডেশন হয়েছে, ওইখান থেকে এমন সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ইদের জন্য নানা সাহায্য করছে। এগুলা আলাদা তৃপ্তি দেয়। আরও কিছু মানুষের জন্য চান রাত অভিশাপ! যারা আপনজন হারিয়েছে! সবার সমান অনুভূতি হবে না আমি জানি। কিন্তু আমি আমার খবর জানি। চান রাতের ফুর্তি শেষ হচ্ছে যতক্ষণ সবার সাথে আছি ততক্ষণ। যখন বাড়ির পথে আগানো শুরু করছি তখন থেকে প্রতিটা পদক্ষেপ আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি যেখানে ফিরছি সেখানে যারা আমার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যকে যারা আলোকিত করে রেখেছিল, যারা কিছু নাই নাই করেও রঙিন করে দিয়ে গেছিল আমার ইদ গুলি তাঁরা কেউ নাই! আমার মা, যে খুব সাদাসিধে কিছু পদ রান্না করত ইদের দিন, সেই সামান্য আয়োজনই সম্ভবত স্বর্গীয় কোন উপদান ব্যবহার করে তৈরি করত। হয়ত আঁচল থেকে গোপনে মিশিয়ে দিত কোন জাদুকরী উপদান! হাতের স্পর্শে হয়ত পরশ পাথরের মতো কিছু ছিল, যার স্পর্শে সামান্য সেমাই হয়ে উঠত অমৃত! কাঁচা চুলায় রান্নার সময় আগুন ধরানোর জন্য বাঁশের চোঙায় যখন মা ফু দিত তখন হয়ত সেই ফুঁয়ের সাথে মিশে আম্মার অদ্ভুত স্নেহ, আদর্শ, ভালোবাসা, আর যার ফলে তৈরি হয় ইদের নানান বেহেশতি খাবার, যা আমাদের এখন পর্যন্ত বিস্ময়, এখন পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে বসে থাকি আমি। আমি জানি ভোরে সব সময়ের মতো, যা ছিল আশৈশবের সেরা স্মৃতি। আব্বা আমাদের ঘুম থেকে উঠার অনেক আগেই গোসল করে তৈরি হয়ে গেছেন, আতরের গন্ধ নাকে আসছে যেন এখনও, যা আর কোনদিন আসবে না। আমি জানি নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে আর কোনদিনই আম্মা আব্বাকে ইদের সালাম করা হবে না। আমি জানি এই বছর অনেকেই হতভম্ব হয়ে বসে আছে, হয়ত বুঝতেছেই না কেন এমন লাগছে, কোথা থেকে শূন্যতা এসে খোঁচা দিচ্ছে! আমি জানি দিনে দিনে এমন হতভম্ব হয়ে যাওয়াদের সংখ্যা বাড়বে। আর একদিন নিজেদের সময় এসে হাজির হবে! চান রাতে মন খারাপের জায়গা নেই শুরুতে লিখছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, শেষ লাইনে এসে আমি জানি মনটা খারাপ হবেই। মানুষ উৎসব আনন্দে একটা সময় স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করবেই, এই থেকে কি আর রেহাই আছে? সবাইকে শুভেচ্ছা ইদের। ইদ মুবারক। আমার আত্মীয়, বন্ধু সকলকে শুভেচ্ছা। কত দূর দূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার কত শুভাকাঙ্ক্ষী। সকলকে শুভেচ্ছা। অপাত্রে বুঝে না বুঝে যে স্নেহের নানা উপকরণ আমার প্রতি ঢেলে গেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ইদ মুবারক, ইদ মুবারক, ইদ মুবারক। সুখি সমৃদ্ধ হোক সকলের জীবন।
    ভারত -- শেষ ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে - Partha Banerjee | ভারত -- শেষ ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে। লেখক -- পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযান পাবলিশার্স, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা। মার্চ ২০২৪। দাম ৩০০ টাকা। বুক রিভিউ -- লেখক প্রশান্ত ভট্টাচার্য্য। প্রকাশিত হয়েছে "দৈনিক সুখবর" কাগজে। _____________________'...হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া 'হিন্দুরাজের' ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। ... শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তাহার কোনোটির সমাধান করিতে পারিবে কি? কীভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হইবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনো পথ নির্দেশ করিয়াছে কি?' ১৯৩৮ সালের ১৪ জুন কুমিল্লায় ভাষণে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজীর তথাকথিত ভক্তকুলের শিরোমণি নরেন্দ্র মোদী এখন ভারতের মূল সমস্যাকে ডেস্কের তলায় ফেলে দেশটাকে হিন্দু বানানোর যজ্ঞে আহুতি দিয়ে চলেছেন। এটা প্রায় সব বিরোধী নেতারা নিজেদের ভাষণে বলছেন, মোদী ফের ক্ষমতায় এলে, দেশে আর ভোট হবে না। অথচ মোদীর তৃতীয়বার মসনদে আসীন হওয়া ঠেকাতে তাঁদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব।  এমন পরিস্থিতিতে পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের  'ভারত শেষ ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে' বইটি হাতে এল। পার্থ মার্কিন প্রবাসী ভারতীয়। আরএসএসের গর্ভগৃহ থেকে জন্ম তাঁর। ফলে যে উৎকণ্ঠা থেকে এই বইয়ের প্রবন্ধ ক'টি পার্থ লিখেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সমাজে তো নেইই, এমনকী, অ্যাকাডেমিক ওয়ার্ল্ডেও নেই। এই দুই বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, এরা আরএসএস ও বিজেপির মধ্যে একটা বিভেদ রেখার কল্পনা করে নিয়ে, তাকেই মান্যতা দেয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কোনো এক সভায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবাইকে সচকিত করে জানালেন, 'আরএসএস নিয়ে তাঁর কিছু বলার নেই; ধর্ম নিয়ে তারা থাকেন, কাজ করে ইত্যাদি, প্রভৃতি।  অর্থাৎ সেই বিসমিল্লাহে গলদ। যত সঙ্কট ও হাঙ্গামা নাকি ভারতীয় জনতা পার্টি নামক রাজনৈতিক দলটিকে নিয়ে। আরও নির্দিষ্ট৷ করে, মোদী-শাহর বিজেপিকে নিয়ে, বাজপেয়ী-আদবানির বিজেপিটা যেন ছিল পাতে দেওয়ার মতো! যেমনটা, একসময়ে জ্যোতি বসুদের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী দলগুলো বুঝত। অনেকটাই সেই রবীন্দ্রনাথের 'ভালো ইংরেজ', 'খারাপ ইংরেজ' এর মতো, এঁরাও খোঁজেন 'ভালো-বিজেপি', 'খারাপ-বিজেপি'। আলোচ্য গ্রন্থের লেখকের ব্যথাটা এখানে। কেননা, 'দানবের পেটে দু-দশক' কাটিয়ে আসা পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় এই মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী দলটির বিষাক্ত নখ-দাঁত দেখে এসেছেন তার সঙ্গে ঘর করে। বিজেপির হিংস্র হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে নরম হিন্দুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। রামমন্দির নির্মাণের কালাপাহাড়ি হিন্দুত্বকে জগন্নাথ মন্দির গড়ে মোকাবিলা করা যায় না। বড়োজোর ভোটে জেতা যায়।  আলোচ্য গ্রন্থটিতে মোট ১৪টি প্রবন্ধ আছে। কোনো প্রবন্ধই অতিদীর্ঘ নয়। বেশির ভাগই ১২ থেকে ১৪ পাতায় শেষ। আমার বিবেচনায় এ বইয়ের সেরা প্রবন্ধটি হল --  ফাঁকা আওয়াজ, কিন্তু 'দেশপ্রেমমূলক' পজিটিভ বার্তা প্রচারের ফ্যাসিস্ট রাজনীতি-- শিরোনামের লেখাটি। প্রবন্ধটির শুরুতেই  লেখক তাঁর গুরু নোম চমস্কির কথা এনেছেন। এই মহান ভাবুক-অ্যাক্টিভিস্টের 'ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট' বা গণসম্মতি উৎপাদনের তত্ত্ব থেকে তিনি কী আহরণ করেছেন, তার পণ্ডিতি না ফলিয়ে ঢুকে পড়ছেন ঘটমান বর্তমানে।   লেখকের আলোকপাত, 'একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কীভাবে স্পোর্টসকে মনোপলি করে এবং তার বুক বাজানো উল্লাসকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে মেকি মেসেজ দেওয়া হয়, এবং ড্রাগের মতোই মানুষ হয় ঘুমিয়ে থাকে আর নয়তো বিকটভাবে দেশপ্রেম দেখায়, যার সঙ্গে দেশ বা প্রেম কোনোটারই সম্পর্ক নেই, শুধু মগজের ডোপামিন নামক হরমোনের হার্ডরক ড্যান্স আছে, তাঁর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ আমেরিকা, ব্রিটেন এবং আজকের ভারত। আমেরিকায় ফুটবল (যার সঙ্গে ফুটের কোনো সম্পর্কই নেই), ব্রিটেনে ফুটবল (যেখানে ভায়োলেন্স একেবারে প্রাতঃকৃত্যের মতোই অবশ্যম্ভাবী), আর ভারতে ক্রিকেট। দশ দেশের 'বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন'। লক্ষ কোটি টাকা জুয়া।' এই যে দেশপ্রেমের বা নিওনরম্যাল ন্যাশনালিজম, এরসঙ্গে না আছে জাতীয়তাবাদ, না আছে দেশপ্রেম। একটা মেকি ফানুস। এমনভাবে একটা 'গণচেতনা' ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যে রোটি-কাপড়া-মকান এর মতো জরুরি সমস্যা ও সঙ্কটগুলো রিসাইকল বিনে ফেলে, এই দেশপ্রেমে মেতে ওঠো। মোদী দেশের পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরদের সম্মান রক্ষার্থে না এগিয়ে, এবেলা-ওবেলা ট্যুইটবাজি করে যাচ্ছেন কারও সাফল্যে। বিজেপি ও তার রাজনৈতিক মেন্টর আরএসএস জানে, মানুষকে যদি শুধুমাত্র দেশপ্রেম বা হিন্দুত্ব বা রামমন্দির বা উগ্র ইসলাম বা ইউএসএ বা মোদী, বা ক্রিকেট-কোহলি-সচিন-ধোনি বা চন্দ্রযান বা বন্দে ভারত  বা সুপারপাওয়ার বা পুলওয়ামা -- যেটা যখন কাজে লাগে লাগিয়ে নাচানো যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে।এই ফ্যানাটিক ন্যাশনালিজমের জন্য সবসময় একটা অপর লাগে। দেশের মধ্যে মুসলিম আর বাইরে পাক-ই-স্তান আর চিন। অথচ কতকাল আগে ১৮৯৫ সালে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের 'স্বপ্নলব্ধ ভারতের ইতিহাস' ছাপা হয়।  তাতে তিনি লিখেছিলেন, 'আমাদের এই জন্মভূমি চিরকাল অন্তর্বিবাদানলে দগ্ধ হইয়া আসিতেছিল, আজি সেই বিবাদানল নির্বাপিত হইবে। আজি মাতৃভক্তিপরায়ণ পুত্রেরা সকলে মিলিত হইয়া ইহাকে শান্তিজলে অভিষিক্ত করিবেন। ভারতভূমি যদিও হিন্দুজাতীয়দেরই যথার্থ মাতৃভূমি, যদিও হিন্দুরাই ইঁহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তথাপি মুসলমানেরাও আর ইঁহার পর নহেন, ইনি উঁহাদিগকেও আপন বক্ষে ধারণ করিয়া বহুকাল প্রতিপালন করিয়া আসিতেছেন। অতএব মুসলমানেরাও ইঁহার পালিত সন্তান। এক মাতারই একটি গর্ভজাত আর একটি স্তন্যপালিত দুইটি সন্তানে কি ভ্রাতৃত্ব-সম্বন্ধ হয় না? অবশ্যই হয়- সব শাস্ত্র মতেই হয়।' কী অদ্ভুতভাবে সোশাল মিডিয়া দিয়ে মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে মিথ্যার ন্যারেটিভ। রীতিমতো পেশাদার ভক্তদের দিয়ে একাজ করানো হচ্ছে। বুস্ট করিয়ে লাইক বাড়ানো হচ্ছে৷ শেয়ার করা আর লাইকের ঠেলায় ভাইরাল করা হচ্ছে। লেখককে হন্ট করেছে, বাঙালির বদলে যাওয়া চেহারাটা। গত ৫০ বছরের শাসকদের অবিমৃষ্যকারিতায় আর ইদানীংকালের গোদিমিডিয়ার কল্যাণে একাংশ বাঙালি বিজেপিকে দুর্নীতিমুক্ত পার্টি হিসেবে ঠাউরে নিয়েছে।  লেখকের ভাষায় 'মিডিয়ার কল্যাণে বহু সাধারণ মানুষ মনে করেন যে, বিজেপি দুর্নীতিমুক্ত পার্টি, নরেন্দ্র মোদী পরিচ্ছন্ন নেতা এবং অমিত শাহ ভদ্র মানুষ। অনেক বাঙালি এদের ইতিহাস, রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের যোগসূত্র নিয়ে মোটেই ভাবেন না। আরএসএস যে বিজেপিকে চালায় এবং আরএসএস যে ফ্যাসিস্ট শক্তি, মানুষের সে বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা নেই। পশ্চিমবঙ্গে এমন কিছু মানুষও আছেন যাঁরা নাথুরাম গডসে কে, অথবা গডসে-সাভারকারের গান্ধিহত্যার বিষয়টি জানলেও বিষয়টা নিয়ে সরব নন। আর অন্য একদল নব্য বাঙালি গান্ধি-হত্যাকে সমর্থন করেন।' আমরা যার সর্বশেষ উদাহরণ দেখলাম অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে। তমলুকের এই বিজেপি প্রার্থী ভারতীয় জনতা পার্টিকে যেমন দুর্নীতিমুক্ত মনে করেন, তেমনই গান্ধী না গডসে প্রশ্নে গডসেতে আশ্রয় খোঁজেন। এ যদি ফ্যাসিস্টবান্ধব ও আত্মঘাতী বাঙালি না হয়, তবে কে?  বিজেপি ও তার দুধ খাওয়ানো আরএসএসের কতগুলো কায়দা আছে। ওদের সবচেয়ে বড়ো সুবিধে হল, আজকের দিনে এক বিশালসংখ্যক মানুষ-শিক্ষিত মানুষ কিছু পড়ে না। সুতরাং, মিডিয়াকে কিনে ফেলতে পারলেই, আর আইটি সেলের মাধ্যমে গার্বেজ ছড়িয়ে যেতে পারলেই ওদের কাজ অর্ধেক হয়ে গেল। বাকি অর্ধেক বিরোধীরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে গেছে এবং করে যাচ্ছে, মূলত তাদের অনৈক্য এবং মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতার অভাব প্রমাণ করে। এই বিপদে নিঠক ভোট রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করা যেতে পারে কিন্তু চূড়ান্তভাবে পারা যায় এই লড়াই আসলে মতাদর্শ বনাম মতাদর্শের নয় তাই বিজেপি মার্কা ফ্যাসিবাদ আটকানোর জন্য দরকার যেমন গণ আন্দোলন ঠিক তার পাশাপাশি দরকার চিন্তার স্বচ্ছতা।   ধর্মনিরপেক্ষ মন গণতন্ত্রের প্রতি ষোলআনা আস্থা ছাড়া কোনোভাবেই বিজেপিচারিত ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা সম্ভব নয়।  যদিও এই বইয়ের লেখক পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত এখনো অনেক আশাবাদী, কেননা বইয়ের নামকরণে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। তিনি এখনো মনে করছেন ভারত ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে, অতএব সেই সন্ধিক্ষণ দাঁড়িয়ে যদি সব লড়াইটাই মতাদর্শগতভাবে হয় তবে সুড়ঙ্গের শেষে আলো পাওয়া যাবে।  জার্মান কবি-দার্শনিক ফ্রেডরিখ হ্যেল্ডার্লিন বলেছিলেন, 'ভাষা মানুষের সবচেয়ে বিপজ্জনক সম্পত্তি'। একসময় বুঝিনি, এখন বুঝছি, যখন 'মোদীর গ্যারান্টি' মোদী নিজেই গেয়ে চলেছেন আর ভক্তরা প্রণিপাত করছেন।
  • জনতার খেরোর খাতা...
    নমোসম্ভব কাব্য - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | লঙ্কায় তখন প্রচণ্ড যুদ্ধ। রামচন্দ্র হেবি বেকায়দায়। মোটাভাই বেআইনীভাবে ইন্দ্রজিৎকে মেরেছে বলে রাক্ষসরা হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে বলছে। সমস্যা সেটা নয়, হেগে তো ওরা বড়া ভাজবে। গোটা প্যানেলটাই আর্যদের, ওখানে রাক্ষসরা কখনও জিতবেনা। সমস্যা হল, পাবলিক এই সব খুচরো জিনিস নিয়ে বহুত ঝামেলা পাকায়। সেবার বালি-সুগ্রীবের বাওয়ালে বালিকে পাইয়ে দিয়েছিলেন বলে, এক ফচকে ছোঁড়া ছড়া কেটেছিল, "তুমিও বানর, আমিও বানর, তফাত শুধু ল্যাজনাড়ায়", সেটাই ভাইরাল। এবারও মধু বলে কোন এক কেরেস্তান রামের হাতে বাটি ধরিয়ে দিয়ে মিম বানিয়েছে "আমি কি ডরাই কভু ভিখারি রাঘবে?"। আদেখলা পাবলিক দেখছে আর শেয়ার করছে। দুই দিনেই দেড় কোটি ভিউ। ব্যাটাকে ঢিট করতে রামিও স্কোয়াড বা বজরঙ্গী ভাইজান কাকে নামাবেন ভাবছেন, এমন সময় আর এক দুঃসংবাদ। সুষেণ এসে বিটকেল মুখ করে বলল, রাবণ ফাঁকতালে মোটাভাইকে পাইয়ে দিয়েছে মহারাজ। এখন-তখন অবস্থা।শুনে তো রামচন্দ্রের মাথায় হাত। শূর্পনখার নাক কাটা থেকে, ইন্দ্রজিতকে নিকেশ পর্যন্ত, যত অপকর্ম সবই তো একে দিয়েই করিয়েছি। এবার কী করা যায়? আর তো রক্ষে নেই। রামচন্দ্র ধনুক টনুক ফেলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। সুষেণ মিউমিউ করে বলল, মহারাজ একটা উপায় হতে পারে। কিন্তু তার জন্য একটু অনুসন্ধান লাগবে। - কী উপায়?- বিশল্যকরণী বলে এক ওষধি আছে। লাগালেই মোটাভাই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।রামচন্দ্র ধড়মড় করে  উঠে বসে বললেন, তা এখানে বকবক করছ কেন, লাগাও।সুষেণ বিড়বিড় করে বলল, সে কি আর মুখের কথা। সে বস্তু আছে অনেক দূরে গন্ধমাদন পর্বতে। যেতে-আসতে সময় লাগবে। ততদিনে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে।কোনো উপায় কি নেই? রামচন্দ্র সব ব্যাটাকে ডেকে পাঠালেন। কোনো কাজে তো লাগেনা, একটু পরামর্শ অন্তত দিক। শুনে টুনে হনুমান বলল, আমি হেবি লাফাতে পারি স্যার। যদি অনুমতি দেন তো যাব আর আসব।এত ভালো তো ভালো না। রামচন্দ্র সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তা বাবা টিএ বিলে ক পয়সা পড়বে? হনুমান বলল, কী যে বলেন স্যার। আপনার আমার অচ্ছেদ্য বন্ড। নতুন আর কী লাগবে। আপনি শুধু একটু দেখবেন, তাহলেই হবে। যেমন কথা তেমন কাজ। হনুমান লাফ দিয়ে চলে গেল অনেক দূরে। ভেবেছিল এ এমনকি ব্যাপার। কিন্তু গিয়ে দেখে, সব অপরাধীরই যেমন দুটো পা, সব মানুষেরই যেমন দুটো হাত, সব গাছেরই তেমনই সবুজ পাতা। এর মধ্যে বিশল্যকরণী পাবে কোথায়। জীবজন্তুরাও তেমন। পাখিদের জিজ্ঞাসা করতে তারা বলে পিউপিউ। ছাগলদের জিজ্ঞাসা করতে তারা বলে ব্যা। সহযোগিতার নামগন্ধ নেই। কিন্তু হনুমান তো হনুমানই। এর আগে ল্যাজে আগুণ দিয়ে লঙ্কা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাকে ঠেকায় কে। খুঁজে না পেয়ে আস্ত গন্ধমাদনটাই উপড়ে নিল। চারদিকে হইচই পড়ে গেল। হরিণ বলে আমার বাড়ি কোথায় গেল। পাখিরা বলে বসব কোথায়। বর্বর লোকেরা বলল, চাষের জায়গা না থাকলে তো না খেয়ে মরব। কিন্তু হনুমান ততক্ষণে যা করার করে পগারপার।ওদিকে ততক্ষণে রামচন্দ্র খুবই অস্থির। যাব আর আসব বলে গেল, আসেইনা। হঠাৎ ঘাড়ে আস্ত পাহাড় নিয়ে  হনুমানকে আসতে দেখে তো তিনি হাঁ। করেছিস কী ব্যাটা। হনুমান ঘাড় থেকে পাহাড় নামিয়ে বলল, হেঁহেঁ, এ আর এমন কি।রামচন্দ্র ঘাড় ঘুরিয়ে সুষেণকে ডাকতে যাবেন, এমন সময় হনুমান আবার বলল, স্যার। - এবার কী? - আমার ব্যাপারটা দেখবেন বলেছিলেন যে। তাও তো বটে। রামচন্দ্র এক কথার মানুষ। সন্তুষ্ট হলে যে যা চায় তাকে তাইই দিয়ে দেন। হনুমানের মাথায় হাত ঠেকিয়ে বললেন, যা, তোকে হাইকোর্টের জজ করে দিলাম। সেই থেকে জগতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হল।
    মাননীয়  - Eman Bhasha | মাননীয় শব্দ নিয়ে বিতর্ক বেধেছে। মাননীয় তো নয় Honourable ! ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি গঠিত হয়। এর আগে ঔপনিবেশিক সরকারে কাজ করা বাবুরা নিজেদের জেন্টলম্যান বলে আখ্যায়িত করে নিজেদের হর্ষ বর্ধন করেন। বাকি দেশিয়রা ছোটলোক- নেটিভ। তাঁরা কেবল জেন্টলম্যান। ভদ্রলোক। ১৮৬১ তে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে যে চার ভদ্রলোক ঠাঁই পেলেন তাঁরা নিজেদের পেডিগ্রি এক ধাপ তুলতে চাইলেন। তাঁরা  চাইলেন নতুন শব্দ। ইতিমধ্যে সভা-সমিতার সভাপতি, পত্রিকা সম্পাদক, শিক্ষকদের উদ্দেশে মাননীয় শব্দ ব্যবহার সমাজে অল্পবিস্তর চালু হয়ে গেছে।এদিকে ইউরোপিয়ান সদস্যরাও জেন্টলম্যান বলে নিজেদের খাটো করতে চান না।অতএব ইংলিশ পার্লামেন্টের অনুসরণে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে আইন করা হল কাউন্সিল সদস্যরা এবার থেকে honourable.বাবলু দাদা তো ব্রিটিশদের লোক।অতএব অনারেবল না বলা ভারি অলেহ্য কথা।ঋণ: ঐতিহাসিকের নোটবুক।।সিরাজুল ইসলাম২০২১
    "অকালবোধন" - বইটির আমার করা রিভিউ - Himadrisekhar Datta | না, মা দুগগার পূজো বা শ্রীরামচন্দ্র নিয়ে এ লেখা নয়। "অকালবোধন" একটি বই, যার লেখিকা, শ্রীমতী সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় ( সো ব)। বইটা এই বছর কলকাতা বই মেলায়, সৃষ্টিসুখ থেকে বেরিয়েছে। সেই স্টলে, ভদ্রমহিলা (সো ব) এসেছিলেন, তার বই এবং আরোও বই দেখতে। আমার কোন বই সৃষ্টিসুখ থেকে আর না বেরলেও, প্রতি বছর, আমার তুচ্ছ লেখক(?) জন্মের আঁতুড় ঘরে, একবার করে যাই। যদি আবার ভাল করে লেখার মিডাস টাচের খোঁজ পাই।এ ছাড়া রোহণ এবং সৌ এর প্রতিও আমার একটা অজানা তীব্র আকর্ষণ কাজ করে। স ব আসার বেশ খানিকটা পূর্বেই আমি সৃষ্টিসুখের স্টলে সেঁধিয়েছিলাম। বসার জায়গা আছে, দেখে গোটা কয়েক বই নিয়ে চেয়ারে বসে সংক্ষিপ্ত বিবরণি নোট করছিলাম মন দিয়ে। তার মধ্যে এই "অকালবোধন"-ও ছিল। স ব আমার পরিচিতা নন। বইয়ের প্রচ্ছদে তার ছবি ছিল না। তবুও আমি নিশ্চিত ছিলাম ইনি তিনিই।যাই হোক, খুবই অল্পভাষী ভদ্রমহিলা, আমার কেনা তার বইয়ে, আমাকে হিমাদ্রিবাবু সম্বোধনে নিজের সাক্ষর দিলেন।আজকে সেই বই এক সিটিং-এ পড়ে ফেললাম। বইটির নাম "অকালবোধন" প্রকাশক রেখেছেন, কেন রেখেছেন, তা তিনি তার কৈফিয়তে লিখেছেন। এটা যে তাৎক্ষণিক মুহুর্তের বশে রাখা একটি নাম, সেটা পরিষ্কার। যদিও, বইয়ের ভেতরে, লেখাগুলির সাথে, নামের, আমি কোন সার্থকতা খুঁজে পেলাম না। সাদা বুদ্ধিতে।সো ব খুবই আবেগপ্রবণতা এবং শব্দের জাদুকরি প্রয়োগে, সামান্য ঘটনা বা কোন কথাকে, অসামান্য ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি এক সময় বরানগরে থাকতেন, স্কুলের শিক্ষিকা থেকে হ্বড দিদিমণি হওয়া আর বার বার তার স্বপ্নের স্থান পুরীতে ফিরে ফির যাওয়ার যে বদলে বদলে যাওয়ার বর্ণনা রেখেছেন, তা বেশ ভাল লাগে পড়তে। স্কুল, পুরী বাদ দিলে, বাকি সব কাহিনীর জীবনের নিত্য চালচিত্র।কিন্তু তার মধ্যে ডুবে দেখার এবং একটা সময় ভিত্তিক যোগাযোগ টানার যে অকৃত্তিম চেষ্টা, তার লেখায়, সহজে ধরা পড়েছে, তা পাঠককে ভাবায়।প্রকাশক এই বইটিকে রম্য রচনা বলে শ্রেণীকরণ করলেও, আমার যেন কেবলই মনে হয়েছে, এই বইয়ের সব লেখাই আসলে, লেখিকার নিজের জীবনের কিছু যন্ত্রণা বা দু:খের ভস্ম থেকে উদ্ভুত- যেন ফিনিক্স পাখী। মা, বাবা, মেয়ে, সহকর্মী সকলের কথাই যেমন বলেছেন অনায়াসে, তেমনই অনায়াসে নিজেকে করেছেন আড়াল। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি, খানিকটা ব্যক্তিগত - আপনি কি স্যাগেটেরিয়ান? আমি তাই - তাই বোধহয়, আমার ভেতরে একটা প্রশ্ন, একটা উৎসুকতা বার বার ফিরে ফিরে আসছে, যা আপনার ভেতরটা বোঝার জানার চেষ্টা করছে, এই লেখাগুলির মাধ্যমে।আমাদের পূজোতে বসবার আগে, একটা সংকল্প করার নিয়ম আছে - আপনার "অকালবোধনে" আপনি কিছুতেই সংকল্পচ্যুত হতে দেন নি নিজেকে।বিষয় বা স্থান পরিবর্তন যাই ঘটে থাকুক গল্পের হাত ধরে, চব্বিশটি পর্বে কখনই নিজেকে মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে দেন নি। আপনার আগের দুটি বই পড়ি নি।সত্যমের হারিয়ে যাওয়া বেশ অকাট্য নিদর্শন আওস্র সেই সেই থেকে শুরু করে এই আমাদের আধুনিক সমাজের। চোখের জলকে লুকিয়ে রেখে, মুখের হাসির অমলিন রূপদর্শন এই বইয়ের মূলকথা বলেই আমার মনে হয়েছে। কি জানি হয়ত, আমিও আমার মতই কেবল ভাবছি। ভাল থাকবেন। লিখবেন।
  • ভাট...
    commentসৃষ্টিছাড়া | সারদা হাওয়া, নারদা হওয়া, বাঙ্গালী ভাগাড়ের মাংস খেয়ে হজম করেছে, পৌরসভা থেকে, পঞ্চায়েত, রেশন, বালি, গরু পাচার, সর্বক্ষেত্রে চাকরি চুরি, ভুয়ো শিক্ষক রা দেখছি এসব বিস্মৃত হয়ে গুরুতে সমাহিত।
    পুলিশে পারিবারিক বিবাদ, থেকে মোবাইল চুরির অভিযোগ করতে আজ ঘুষ দিতে হয়, প্রশাসন আর শাসকদল সব দেখি গুরুতে! 
    commentএটা |
    ইটা থাক। আমি দেখলাম শুনলাম হাওয়াবাজির চেয়ে বেশি ভরসাযোগ্য।
    comment&/ | একটা একটু ইয়ে প্রশ্ন করি। যদিও করা না করা সমান। এই এতগুলো বছর, সাত আট বছর এই এত অবৈধ নিযুক্ত টিচাররা স্কুলে স্কুলে পড়িয়েছেন। কোনো কোনো স্টুডেন্টের ক্লাস ফাইভ থেকে টেন প্রায় পুরোটা সময়ই এদের হাতে। কীরকম পড়িয়েছেন এঁরা? এই এত ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে এঁদের কারণে? এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী দাঁড়াবে? যদিও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আপন সন্তানদের সরিয়ে নিয়েছেন সরকারি সিস্টেম থেকে, তবুও 'অপর' এর সন্তানদের জন্য হলেও, এই প্রশ্নটাও একটু ওঠা দরকার নয় কি? পুরোটাই কি মানুষদেরকে ঘুঁটি বানিয়ে দাবাখেলা?
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত