এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    সীমান্তরেখা - প্রতিভা সরকার | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়কলকাতার মানুষজনেরা এইসবের হুজ্জোতির খবর রাখে না। তাদের মন ভুলোবার হরেক চিজ আছে। এইরকম ঝামেলাওয়ালা জায়গায় দুদিনের ছুটি কাটাতেও কেউ আসে না, যতই জাগ্রত তীর্থস্থান হোক না কেন!এটা একেবারেই সীমান্ত-এলাকা, কাঁটা তারের এ পাশে লাল নিশান ওড়া ভ্রামরী দেবীর মন্দির, খুব জাগ্রত জ্যান্ত তীর্থ, ওপাশে সবুজ মাথাওয়ালা গম্বুজ, সোনা পীরের থান। মানত রাখলে নাকি কেউ খালি হাতে ফেরে না। দুপাশেই যতদূর চোখ যায় সবুজ খেত, যার বুক চিরে দৌড়ে চলে গেছে মানুষ সমান কাঁটাতার। ছুঁচলো কাঁটা, খুব শক্ত তার, আর দবেজ। সেই ছুটন্ত তারের লাইন বরাবর রাতবিরেতে বুটজুতোর মসমস, সন্দেহ জাগলেই ঘন ঘন হুইসিলের আওয়াজ। তবে তাতে কী আর কিছু বন্ধ থাকে! যার যা করার সে তাই করে যায়, কাজের মতো কাজকাম চলে, নদীর মতো নদী বহে যায়। শুধু মাঝেমধ্যে কাঁটাতারের এপাশে ওপাশে আচমকা দুম শব্দের সঙ্গে লাশ পড়ে। চাপা আর্তনাদ, দৌড়োদৌড়ির শব্দ। তারপর সব চুপচাপ।অবশ্য দুপারের গ্রামের মানুষের এখন সবই সয়ে গেছে। সবাই ভাগ্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে। তবুও এপারের মানুষকে কেউ গ্রামের নাম জিজ্ঞাসা করলে তারা একটু ঢোঁক গিলে বলে, তাদের নদীর নাম জলেশ্বর, গ্রামের নাম মধুগঞ্জ।নদীর নামটি আগে বলে, কারণ নামটি বড় সুন্দর, বিশ্বের প্রভু দেবাদিদেব মহেশ্বরের আর এক নাম, ধার্মিক মানুষজন কানে শুনেই বড় আরাম পায়। তাছাড়া এই নদীর বোরোলি মাছ খুব সুস্বাদু আর সেই কারণে বিখ্যাত। স্বচ্ছ ঢেউয়ের নীচে বোরোলিরা ঝাঁক বেঁধে চলে, সরু রূপোর পাতের মতো শরীর, জমাট আলোর ছোট ছোট টুকরো যেন জলের ওপর লাফিয়ে ওঠে। সাধারণ হাত-জালেই দেদার উঠে পড়ে তারা। ধরার জন্য বেশি কষ্টও করতে হয় না। গ্রামের নামটিও তো বড় সুন্দর, মধুগঞ্জ, একেবারে সামনের দুটি অক্ষরেই মধুভান্ড উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু মানুষের কন্ঠায় বিস্তর ঠেলাঠেলি করেও সে নামটি আবছা হয়ে বেরোয়, নদীর নামের পরে বেরোয়, কারণ মধুগঞ্জ এখন গরু পাচারের পীঠস্থান। এমনই দুর্নাম তার, যে লোকে ভুলেই গেছে এক কালে ভ্রামরী মন্দিরের খ্যাতিতেই তার খ্যাতি ছিল, পুজো দিতে দূরদূরান্ত থেকে লোক আসত। এখনও একেবারে আসে না এমন নয়।মন্দিরের ভেতর কালো কষ্টি পাথরের ভ্রামরী দেবীর দেড় হাত লম্বা সর্বাঙ্গে মৌমাছি আটকে আছে। পাথরে খোদাই ছোট ছোট উড়ন্ত কীট। কারিগরের কী হাতযশ, এতো যুগ ধরে দেবীপ্রতিমার গায়ে এন্তার তেল সিঁদুর মাখাবার পরও, তাদের ডানার খাঁজখোঁজগুলো কেমন স্পষ্ট বোঝা যায়! ওরা সবাই ভ্রামরী দেবীর পোষ্য। বাস্তবেও যেখানে যতো মৌমাছি, সব্বার ভালোমন্দের জিম্মেদার দেবী স্বয়ং। দেবীর মহিমা অশেষ। নাহলে কী আর এমনি এমনি মন্দিরের সামনে দুখানা রয়েল গাছ দুপাশে উঠে গেছে আকাশের দিকে, সিধে উঠতে উঠতে এক আশ্চর্য টানে ঝুঁকে পড়েছে পরস্পরের দিকে ! শাখাপ্রশাখায় ঠোকাঠুকি হয়ে দুই গাছের মাথা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে কতো যুগ ধরে কে জানে। থোকা থোকা সবুজ টক ফলে ভরে থাকা গাছদুটোকে দিবাকর তো জন্ম থেকেই অমন দেখছে। দুই গাছের গুঁড়ি তেরছা হয়ে থাকার ফলে তৈরি হয়েছে এক অতিকায় ত্রিভুজ, যেন প্রকৃতির নিজের হাতে বানানো তোরণ, ভ্রামরী দেবীর জন্য।আশ্চর্য হবার শেষ তো এইখানে নয়। ঐ রয়েল গাছদুটির প্রায় প্রত্যেক ডাল থেকে ঝুলছে আধখানা কলাপাতার মতো বড় বড় মৌচাক। এতো ঘন ঘন এতো চাক, তাদের ঘিরে মৌমাছিদের ব্যস্ত যাওয়া-আসা, গুনগুন গুঞ্জনে মন্দিরের চাতাল দিনেরাতে মুখর হয়ে থাকে। এ ডাল থেকে সে ডালে, দুটো গাছেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাসা বাঁধে শ্রমিক মৌমাছিরা, মধু এনে জমা করে, তাদের পায়ে জড়ানো হলুদ পরাগও নাকি সদ্যোজাত শিশুগুলির খাদ্য। চাকের অনেক গভীরে ছ' কোণা কোন গুপ্ত প্রকোষ্ঠে পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে মিলিত হবার অপেক্ষায় জেগে থাকে পৃথুলা রাণী মৌমাছি, তার জীবন কেটে যায় বেশি খেয়ে, বেশি পুষ্টি সঞ্চয় ক'রে অগুন্তি সন্তানের জন্ম দিতে দিতে। নিজের শিশুদের যত্নও সে নেয় না, প্রকৃতির কী যে রহস্য, নিষ্কর্মা আজ্ঞাবহ পুরুষদের সঙ্গে আকাশপথে উড়ানের সময় চূড়ান্ত মিলনের জন্যই তার সমস্ত পথ-চাওয়া। প্রায় রোজই দেখা যায় কোনো এক চাক থেকে বেরিয়ে এসেছে মোটাসোটা রাণী মৌমাছি, রয়াল গাছের মাথার ওপর তার স্লথ গতি। আর পেছন পেছন ছুটে বেড়াচ্ছে পুরুষ মৌমাছির দল। তাদের মধ্যে একটিই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হবে, নিষিক্ত রাণিটি শান্ত হয়ে ফিরে আসবে প্রকোষ্ঠে। সন্তানের জন্ম দেবার ধীর অপেক্ষা শুরু হবে। এই যে জীবনপ্রবাহের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে প্রত্যেক চাকের প্রতিটি প্রকোষ্ঠে, বাইরে ঐ গুঞ্জনটুকু ছাড়া কিন্তু তার আর কোনো প্রকাশ নেই, বাতাসে একটি অতিরিক্ত ঢেউয়ের কাঁপনও ওঠে না যেন। একটি মানুষও ফিরে তাকায় না। দু দুটো সমান্তরাল যাপন ধর্মাচরণের সুতোয় খুব পোক্ত ভাবে বাঁধা রয়েছে। দু পক্ষেরই সায় আছে এই সহাবস্থানে।আরও আশ্চর্য, মানুষের লোভের শেষ নেই, তবু ভ্রামরী দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণের মৌমাছিরা অবধ্য। শুধু মন্দিরে নয়, গোটা মধুগঞ্জ গ্রামেই কেউ মৌচাক ভাঙে না, কেউ মধু আহরণ করে না। এখানে বোতলে করে মধু কেনাবেচাও নিষিদ্ধ । সর্দিকাশি বা হালকা জ্বরে মধু দিয়ে তুলসি পাতার রস খেতে হলে বা শীতকালে বুড়ো মানুষের জন্য মকরধ্বজের পুরিয়া মধু দিয়ে মেড়ে নিতে হলে, সদর থেকে মধুর বোতল ব্যাগে লুকিয়ে আনতে হবে। তারপর সবচেয়ে নিরিবিলি জায়গায় সেটিকে সংরক্ষণ করাই নিয়ম। বোতল থেকে মধু ঢালতে হবে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে। মোদ্দা কথা, ভ্রামরী দেবী যেন না দেখেন, তাঁর সন্তানদের তিল তিল করে সংগ্রহ করা অমৃতরস, মানুষ লুটে নিয়ে নিজের কাজে লাগাচ্ছে। তাই মন্দির চত্বরে তো বটেই, মধুগঞ্জের কোথাও মৌচাক ভেঙে মধু নেওয়া হয়েছে, এরকম শোনা যায় না। কখনও কেউ অতি লোভে যদি করেও ফেলে, পরের একমাস জুড়ে গঞ্জ তো গঞ্জ, গোটা জেলাশহরে যেখানে যতো বিপদ ঘটে, তার প্রত্যেকটির কারণ বলে চিহ্নিত করা হয় ঘটনাটিকে। তারপর আস্তে আস্তে সেই স্মৃতি ফিকে হয়ে আসতে থাকে যতদিন না ফের বেপরোয়া মধু লুঠেরারা হানা দেয়।মধুগঞ্জের মৌমাছি আর মানুষেরা কেউ কাউকে ঘাঁটায় না। অনেক যুগ ধরে পারস্পরিক সহাবস্থানের মন্ত্র শিখে নিয়েছে দু পক্ষই। দিবাকর সাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতে যেতে এইসব ভাবে। ভাবতে ভাবতে দেবীমন্দিরকে পেছনে ফেলে জলেশ্বর নদীর দিকে বেঁকে যায়। এদিকে কাঁটাতার নেই, কারণ ওদিক থেকে নাচতে নাচতে আসা নদীটি এখানে এসে ইংরেজি ইউ বর্ণের আকার নিয়েছে এবং একটি প্রাকৃতিক সীমানা-চিহ্ন হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। জলভরা এই ইংরেজি ইউ অক্ষরের চ্যাপ্টা তলার দিকে বা দুই বাহুর ধারে ওপাশটা বাংলাদেশ, এপাশটা ভারত, যা আবার ওপাশে মুখে মুখে ইন্ডিয়া। ঐ ইউ-টুকুই ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত, নাহলে বাদবাকি নদী বিদেশী, যে বিদেশ আবার এককালে এদেশের বহু মানুষের স্বদেশ ছিল। এ এক জটিল ধাঁধা, এইসব ভাবতে ভাবতে, নাকি রোদের তাতে, মাথা ধরে যায় সাইকেল আরোহী দিবাকরের। কিন্তু যেতে তো তাকে হবেই। স্কুল তার প্রাথমিক হলেও নদীর খামখেয়ালি মোচড়ে এই গঞ্জে একমাত্র, তাই গুরুত্বপূর্ণও। কো-এড হাই স্কুল আছে বটে মাইল চারেক দূরে, ছেলেমেয়েরা সেখানে ভর্তিও হয়। তবে কোভিডের পর স্কুলছুটের সংখ্যা খুব বেড়েছে। মেয়েরা বেশির ভাগ বিয়ে করবে বলে একঘেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে, নয়তো তাদের রূপশ্রীর টাকা পেয়ে অথবা না পেয়ে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কড়ার এই, স্কুলে টাকা এলে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অনেক ছেলে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে গেছে, অবরে সবরে বাড়ি আসে, আবার অনেক ছেলে ঘরের খেয়ে গোরু পাচারে হাত লাগিয়েছে। এ লাইনে ঝুঁকি থাকলেও, পয়সা অঢেল। তাই লোভও বেশি।কিন্তু তাই বলে টাপু! অঙ্কে অমন ভালো মাথা, দিবাকরের শিক্ষক জীবনে আর চোখে পড়েছে কি? আর কী ভদ্র ছেলে! যে কোনও দিন, দিবাকরকে গোরুহাটার পাশ দিয়ে যেতে দেখলে টাপু সঙ্গে সঙ্গে গেঁজের টাকা গোণা বন্ধ করে হাতদুটো পেছনে নিয়ে যায়, বলে, "স্যার, ভালো আছেন?" টাকা পয়সা আঙুল গলে পড়ে গেল কিনা সেদিকে মন দেবে কী, মাস্টারমশাইয়ের পা ছোঁয়ার জন্য সে ব্যাকুল!সেদিন সদ্য শোনা একটি কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল বলে তাকে হঠাতই ডাকে দিবাকর, "ট্যাঁপা, এদিক আয় তো একটু। চল ঐখানে গিয়া বসি।"গোরুহাটা যেখানে শেষ, সেইখানে সীমানা আগলে অজস্র ঝুরি নামিয়েছে প্রাচীন বট, তার গুঁড়িতে ছুরি দিয়ে খোদাই করা ছেলেমেয়েদের নাম, সব জোড়া জোড়া, পাশাপাশি, মাঝে যোগচিহ্নের সেতু বাঁধা। নীচে সিঁদুর মাখা ছোট বড় পাথর। তেল গড়িয়ে পড়ছে। ধূপকাঠি জ্বলছে। ধূপের গন্ধমাখা সেই ছায়াতে গিয়ে বসল মাস্টার আর তার একদা ছাত্র। বসেই টাপুকে ধমক, "অমন ছটফট ছটফট করতেছিস ক্যান? হাগা পাইসে নাকি?"এমন অসংস্কৃত প্রশ্ন শিক্ষকের মুখে মানানসই কিনা, ছাত্র সেটাকে সঙ্গত ভাববে কিনা, এইরকম ভাবনা ভ্রামরী দেবীর কৃপায় মধুগঞ্জে কারও নেই। মানুষ ঐ বেগের কাছে সবচেয়ে বেশি অসহায়, তখনই সে সবচেয়ে বেশি ছটফট করে, একথা তো দিনের আলোর মতো সত্যি। তাই এর থেকে ভালো তুলনা আর কী হতে পারে ! টাপু প্রথমে উত্তর দেয় না। তারপর চোখ তুলে মাথার ওপরে সবুজ পাতার চাঁদোয়া দেখে, যেন নিজের নয়, কাকপক্ষীর বিষ্ঠাত্যাগের সম্ভাবনায় সে বিচলিত। শেষকালে আস্তে বলে, স্যার, আপনে তো জানেন সবই, তবু বার বার …!টাপু স্যারকে খুলে বলেছে, তার অসহায়তার কথা, পরিস্থিতির চাপের কথা, তবু মাস্টার বার বার তাকে কেন যে বোঝাতে আসে ! বুঝতে চায় না, এই কাজগুলো উঁচু নদীর ঢাল থেকে খেলাচ্ছলে জলের দিকে গড়িয়ে যাবার মতো। ঠান্ডা কালো জলকে যতো ভয়ই লাগুক, মাঝ রাস্তায় উল্টো বাগে উঠে আসা যায় না। শেষ সীমা অব্দি গড়িয়ে যেতেই হবে, তারপর জল তোমাকে ভিজিয়েই দিল যখন, আর কাপড় রোদে শুকোবার চেষ্টা করে কী হবে! প্রথম বারেই ভয় কেটে যায়, তারপর ভেজা কাপড়েই সারাদিনের খেলা। সারা জীবনের খেলা। যদি না বেঘোরে জীবনটাই চলে যায়।জীবন চলে যাবে, এই ভয় তো প্রতি মূহুর্তের। গভীর রাতে যতটা পারা যায় নি:শব্দে গরুহাটা থেকে লেজ মুচড়ে প্রাণীগুলোর যাত্রা শুরু করিয়ে দেওয়া হয়, অন্ধকার শুঁড়িপথ দিয়ে পালে পালে তারা নদীর কাছাকাছি এসে পড়ে। অনেক দূর দেশ থেকে ট্রাকে ট্রাকে লম্বা পাড়ি দেওয়া জানোয়ারগুলো ক্ষিধে, তৃষ্ণা, পথশ্রমের ধকল সইতে সইতে রোগা হয়ে যায়। শরীরে পুরো তাকত থাকে না, তাই এদিক ওদিক ছোটার কোনো চেষ্টা না করে, তারা শুধু সামনের জাতভাইকে অনুসরণ করতে থাকে অন্ধের মতো। যেন অর্ধচেতন জড়ভরত-প্রায় বিশাল মাংসপুঞ্জ এক। দেশের সীমানা পেরলেই যে পুঞ্জের প্রত্যেকটির মাথাপিছু লাভের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়াবে আট থেকে দশ হাজার টাকা।নদীর কাছে এসে ঠান্ডা হাওয়া আর মিঠে জলের গন্ধে এইবার গোরুগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু ডাকতে পারে না, মুখগুলো সব দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। টাপু আর অন্য রাখালরা গজগজ করে, "এইমাত্র গরুহাটায় জল খাওয়াইসি, দানা খাওয়াইসি, তবু শালাদের নোলা দ্যাখ! বেইমানেরও বেইমান! দাঁড়া, দাঁড়া, দাঁড়ায়া পড় এইখানে।"তারা প্রাণীগুলোকে এইবার বালির চরে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করায়। সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান গরু আর বলদগুলোকে আলাদা করে রেখে, যেগুলোর কপাল জুড়ে আলকাতরা দিয়ে বিশেষ চিহ্ন আঁকা তাদের লেজ মুচড়ে জলে নামিয়ে দেয়। পাচনের বাড়ি মারে, হ্যাট হ্যাট। অবোধ প্রাণীগুলি প্রাণভয়ে সাঁতরায়, যাতে তাদের কেউ এদিক ওদিক ছিটকে না যায় তাই পাশে পাশে সাঁতরায় রাখালরা। ওপাশের উঁচু নদীর ঘাটে জোনাকির মতো ছোট ছোট টর্চ জ্বলে উঠেই নিভে যায়। ওপারের রাখালরা প্রাণিগুলিকে নদী পার করাবে বলে অপেক্ষা করছে। কপালের ওপর টর্চ ফেলে চিহ্ন দেখে কোন ব্যবসায়ীর কোন পাল তা ঠিক করে সোজা খোয়াড়ে পাঠিয়ে দেবে।টাপু জানে, বখেরার পরিমাণে একটু বেশিকম হলেই যে কোনো মূহুর্তে গরম সীসার টুকরো গেঁথে যেতে পারে তার পাঁজরে। বা তার সঙ্গীসাথীদের। তবু সুরাতের ঘুপচি ঘরে ঘাড় হেঁট করে বারো ঘন্টার জরি সেলাই বা চিমটে দিয়ে গয়নার ছাঁচে আমেরিকান ডায়মন্ড বসাবার কাজ তাকে টানেনি। কেরালায় কন্সট্রাকশন লেবার হয়ে যেতে পারা তো মন্দের ভালো। ওরা ভালো টাকা দেয়, মানুষের মতো ব্যবহার করে, একপাল গরু ভাবে না। তবু টাপুর অঙ্ক-বোঝা সাফ মাথা অনেক টাকার হিসেব ক্যালকুলেটর ছাড়াই নির্ভুল মিলিয়ে দিয়ে যে উত্তেজনা বোধ করে, তা গরু পাচার ছাড়া আর কোনো কাজে সে পায়নি। পুলিশের পকেট, বিএসএফের পকেট, নেতাদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট সব ভরেও তারপর নিজের রাখালদের জন্য শতকরা কতো লাভ হল, নিজে ঘরে কতো নিয়ে যেতে পারল, নিখুঁত সেই অঙ্ক কষে ফেলে টাপুর এমন আনন্দ হয়, যে সারা গায়ে লোমকাঁটা ফুটে ওঠে। গরীবের ছেলে তো সে বটেই। বাবা নেই। মা পরের বাড়ি বাসন মেজে ছেলেকে বড় করে তুলেছে। কিন্তু সেটাই সব নয়, এই কাজের আঙ্কিক নির্ভুলতা, ভুল হলে বিশাল বিপদের ঝুঁকি, বিপুল লাভের পরিমাণ, তাকে কঠিন উত্তর মেলাবার জন্য ক্রমাগত উত্যক্ত করতে থাকে। কিছুদিন দূরে থাকার পর আবার সে বুক বাজিয়ে ফিরে আসে গরু পাচারে।"তা স্বাস্থ্যবান গরুগুলারে আলাদা কইরা কী করিস?" দিবাকর অন্যমনস্ক ছাত্রকে খোঁচায়, "আলাদাই বা করিস ক্যান?"এই মানুষটাকে টাপু বিশ্বাস করে সব কথা বলতে চায়। তাতে যেন তার খারাপ কাজের প্রায়শ্চিত্ত হবে, এইভাবে অপরাধী চোখ নীচু করে সে বলে, "বলি স্যার, বলি, কাউরে কইবেন না যেন।" তারপর অনর্গল উজাড় করে দিতে থাকে তার ব্যবসার গোপন কথা।এই বাছাই গরুগুলো অন্য পাচার হওয়া গরুদের মতো অসুস্থ বা বুড়ো নয়। বিয়োনো বা চাষবাসে সাহায্য করার ক্ষমতা হারানোও নয়। হয়ত দালাল বেশি লাভের আশায় তাদের কিনেছিল, কিম্বা গ্রামের গেরস্তবাড়ির গোয়াল ঘর থেকেই উঠিয়ে নিয়ে এসেছে রাতের অন্ধকারে। গরুচোরেরা সব রাজ্যের সীমান্ত বরাবর প্রত্যেকটি গ্রামে ভয়ংকর সংগঠিত এবং সক্রিয়। এই পশুগুলি স্বাস্থ্যবান, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, নরম তাজা মাংসল ভীরু প্রাণী, সীমান্ত পেরুলেই একেকটার দাম ওঠে দেড় লাখ, দুলাখ। তাই এদের জন্য সুপার স্পেশালিটি ব্যবস্থা। প্রথমে এদের প্রত্যেকের শিঙ-এ নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা হবে প্লাস্টিক-মোড়া অল্প দামের চাইনিজ মোবাইল। তাতে সেভ করা থাকবে আলাদা আলাদা রিং টোনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ওপারের ব্যবসায়ীদের আলাদা আলাদা নম্বর। জলে নামানোর পর এদের দেহের চারদিকে বেড় দেওয়া হবে মোটা সবুজ কলাগাছ দিয়ে, যেন চৌকো ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে দু/তিন লাখি মালগুলোকে। ওপারের রাখালরা কোমর জলে নেমেই থাকে, ভেলাগুলো কাছাকাছি এসে গেছে দেখলেই তারা মোবাইলে রিং করে। অন্ধকার নদীর ওপর ভাসমান শিঙ-এর মাথায় মাথায় আলো জ্বলে, হরেক গান বাজে। নির্দিষ্ট সুর শুনে পয়সার মাল ঠিকঠাক চিনে নিতে বড় সুবিধে হয়। একবার অন্ধকার ঢেউয়ের মাথায় টাপু পাশের গরুর শিং-এ বাঁধা মোবাইলের রিং টোন শুনে ফেলেছিল, তু ধার হ্যায় নদিয়া কি / ম্যা তেরা কিনারা হুঁ / তু মেরা সাহারা হ্যায়, ম্যয় তেরা সাহারা হুঁ…ঘোষপাড়ার কল্পনাকে মনে পড়ে তার ভেজা শরীরেও লোম-কাঁটা দিয়েছিল, মনে হয়েছিল, এবারই শেষ, আর এ কাজে নয়!সেসব ফুলটুস কথার বাসা নদীর ঢেউয়ের মাথার ক্ষণস্থায়ী বুদবুদেই। সকালের আলো ফুটলে আর তাদের কারও মনে থাকে না। এখন তাই যেন পরীক্ষার খাতায় সবচেয়ে কঠিন অঙ্কগুলো মিলিয়ে দিতে পেরেছে, এইভাবে স্যারের কোঁচকানো কপালে চোখ রেখে ঠা ঠা করে হাসতে থাকে জোয়ান মদ্দ টাপু, স্যারের আদরের ট্যাঁপা। সবই বলে, কিন্তু একটা কথা সে ভুল করেও স্যারকে বলে না কখনই। ঘোষপাড়ার যাদু ঘোষের মেয়ে কল্পনার জন্য তার পাঁজরের ভেতর লুকোনো অসীম দরদের কথা। মেয়ের এবার হাই স্কুলের পড়া শেষ হবে, তারপর তাকে টাপু মহকুমা শহরের কলেজে ভর্তি করবে, যাতায়াতের জন্য একটি স্কুটার কিনে দেবে। দোহারা চেহারা আর কোঁকড়াচুলো কল্পনা ঘোষেই তার পড়াশুনো শেখার ইতি আবার শুরুও, এইরকম লাগাম-ছাড়া কল্পনার কথা সে কী করে বলে এই পড়া-পাগল মাস্টারকে ! তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায় তাই, "যাইতেসি স্যার, আর থাকন যাইবে না, গরুগুলানরে খোলজল দিবার সময় বইয়া যায়।"মাস্টারও আর ছাত্রকে তার সদ্য শোনা কথাটি সময়াভাবে খোলসা করে বলতে গিয়েও বলতে পারে না। সে কথাটি গত সন্ধ্যায় ভ্রামরী মন্দিরে আরতির সময় তার কানে এসেছে। পড়াশুনো জানা ভালো মানুষ হবার সুবাদে এবং হোমিওপ্যাথি নিয়ে চর্চায় ইদানীং কিছু হাতযশ হওয়ায় বিএসএফ ক্যাম্প থেকে যদু ঘোষের ঘর অবধি সর্বত্র দিবাকরের অবাধ গতিবিধি। সব কথাই তার কানে আসে। তার কাছ থেকে পাঁচ কান হবার সম্ভাবনা নেই জেনেই মানুষ যেন তাকে বেশি করে সব গোপন কথা জানিয়ে যায়।যেমন বিএসএফ জওয়ান পবিত্র কুমার। প্রবল ধার্মিক এই দশাসই চেহারার মানুষটির সঙ্গে মন্দিরে আরতির সময় প্রায়ই দিবাকরের দেখা হয়। আরতি শেষ না হওয়া অব্দি হাত জোড় করে চক্ষু মুদে বসে থাকে পবিত্র কুমার। পঞ্চ প্রদীপ দেবী মূর্তির সামনে ঘোরানোর সময় প্রবল বিক্রমে জয় মাতাদি বলে চেঁচিয়ে উঠেই থম মেরে যায়, যেন আবার ধ্যানস্থ হয়ে পড়ল। মন্দির-ঘেরা ঘোর অন্ধকার ক্রমশ কাছিয়ে আসছে টিমটিমে বালবের আলোকে উপেক্ষা ক'রে, ছমছমে পরিবেশে পুরোহিত ছাড়া আর দু তিনজনই মাত্র ভালো করে পা ঢেকে বসে আছে, পাছে পুরোহিতের ছেটানো পবিত্র শান্তিজল পায়ে পড়ে। আধা অন্ধকারে তাদের মুখ দেখা যায় না, খালি অবয়ব, এইরকম রহস্যময়তার মধ্যে পবিত্র কুমারের আচমকা চিৎকার মাঝে মাঝে যেন শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়। দিবাকরের কলেজে পড়া নবকুমার কপালকুণ্ডলার কথা মনে পড়ে। এখানে সমুদ্র নেই, কিন্তু মন্দিরের পেছনেই ইউ শেপের নদী কুলুকুলু শব্দে বহে যায়। সেখানে কেউ কাঠ কুড়োয় না বটে, তবে জলের ওপর কাঁটাতার থাকে না বলে এই পথেই ইদানিং দেদার গরুচালান চলে। কারা ফিসফাস কথা কয়, মাছের ঘাই মারার মতো সন্তর্পণে বৈঠা চালায়। সব মিলিয়ে খুবই রহস্যময় গা ছমছমে পরিবেশ! পবিত্র কুমার কি মন্দির থেকে ক্যাম্প অব্দি একা যেতে ভয় পায়! রোজই সে দিবাকরকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে যেতে। ভ্রামরী মন্দিরের একেবারে লাগোয়া দিবাকরের বাড়ি। মন্দিরের সীমানার ঠিক পেছনে নদী আর কোনাকুনি সেপাইদের ক্যাম্প। সে অব্দি যেতে বড় জোর দশ মিনিট লাগে। বিয়ে থা করেনি ছেলে, বাড়িতে বুড়ি মা একা, দিবাকর ফিরলে তবে ভাত গরম হবে। তাই তাড়া নেই বলে রোজই সে ডরপোক পবিত্র কুমারের পাশে পাশে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যায় ক্যাম্পের গেট পর্যন্ত, যেতে যেতে নানা গল্পগাছা করে। কখনও পবিত্র ওষুধ বিষুধ চায়। কখনও ছেড়ে আসা হরিয়ালি গাঁও আর বালবাচ্চার গল্প করে। মাস্টারজির মতো নীরব শ্রোতা তার খুব পছন্দের। ক্যাম্পের গেটে পৌঁছে সে জোরে জোরে দিবাকরের হাত ঝাঁকিয়ে হ্যান্ডশেক করে, মুখে বলে থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ।ভুতের ভয়হীন দিবাকরের গত এক বছরের সান্ধ্য রুটিন পবিত্র কুমার সংসর্গে মোটামুটি এইরকমই।তা গতরাতেই মাস্টারজির কাছে দুঃখ করছিল পবিত্রকুমার, ছ' মাসের পোস্টিং-এ এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে বছর ঘুরে গেল, তবু তার আর ট্রান্সফার হল না। এদিকে সীমান্তে গরুচালান নিয়ে পার্লামেন্ট অব্দি কথা গড়িয়েছে। পার্টিগুলো সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে বিএসএফের ওপর। তাই ওপর মহলের চাপ বাড়ছে। শোনা যাচ্ছে আগামীকাল রাত থেকেই শ্যুট এট সাইট অর্ডার ইসু হবে। এদিক ওদিক চেয়ে ফিসফিস করে পবিত্র কুমার জানায়, এটা সঠিক খবর নাও হতে পারে। সাধারণ জওয়ানরা শুধু হুকুম তামিল করেই খালাস। অপারেশন শুরু হবার দশ মিনিট আগে ছাড়া তারা আসল ব্যাপার জানতে পারলে তো! পবিত্রের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, এখন তার আর এইসব ঝামেলা ভালো লাগে না! দিমাগ ঠান্ডা রাখবার কোনো ওষুধের কথা আছে নাকি মাস্টারজির হোমিওপ্যাথি কিতাবে? তাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরতি পথে প্যাঁচার ডাক, শেয়ালের হুক্কাহুয়া, রাতচরা পাখির ডানার আওয়াজ, নদীর ছলাৎছল, কিছুই কানে ঢুকছিল না দিবাকরের। সাইকেল চালাতে চালাতে সে কেবল ভাবতে থাকে টাপুর কথা, তার আরও ছাত্রদের কথা, যারা এই গ্যাং-এ সামিল হয়েছে। তার মনে পড়ে যায় দেড় বছর আগে এক রাতে গুলি চলার আওয়াজ শোনা গিয়েছিল মধুগঞ্জে। বুড়ি মা দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বলেছিল, "এহন তুই বাইরালে আর জেবন্ত ফিরতি পারবি না।"তবুও তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছুদূর গিয়েছিল দিবাকর, দূর থেকেই অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখেছে জওয়ানরা ঘিরে রেখেছে জায়গাটা, কিন্তু তাদের বড় গোল টর্চের আলো পড়েছে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা একটা ছেলের ওপর, সে কেমন যেন ছেতরে পড়ে আছে, একটা পা ঈষৎ ভাঁজ করা, হাতদুটো ছড়ানো, দেখেই বোঝা যাচ্ছে গুলি খাবার সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। ওরই পাশে পড়ে আছে বড় শিংওয়ালা একটা সাদা গরু। তারও ঘাড় মোচড় খেয়ে আকাশমুখো হয়ে আছে। অন্ধকারে আচমকা গুলি চলতে ওটারও পেট ফুটো হয়ে গেছে। নদীর চরের বালি লেগে ছিল মৃত মানুষ, পশু দুইয়েরই রক্তমাখা চামড়ায়। বড় স্টিল টর্চের জোরালো আলোতে এতো দূর থেকেও দেখা যাচ্ছিল লালের ওপর সাদা অভ্রের মতো কুচি কুচি ঝলকানি। ভাগো হিঁয়াসে, আপনা ঘর চলে যানা, আভি, ইসি ওয়ক্ত, জওয়ানদের বিরক্ত চিৎকারে আর সবার সঙ্গে দিবাকরও চলে এসেছিল। কপালের ঘাম আঁচলে মুছতে মুছতে মা ভাত বেড়ে দিচ্ছিল। মরা ছেলেটাকে সে চিনতো না, চারটে গ্রাম ছেড়ে তবে নাকি ওদের বাড়ি, তবুও কিন্তু সে রাতে দিবাকর না খেয়েই উঠে চলে যায়।আবার সেইরকম হবে! এবার কার পালা? কে বলি চড়বে? টাপু? গণেশ? নাকি গাছ থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে একটু জড়বুদ্ধি মতো হয়ে গেছে যে, সেই আসলাম? সারাদিন ভাবতে থাকল দিবাকর। দুপুরে স্কুল যাবার সময় দেখা হলেও টাপুর কাজের তাড়ায় কথাটা বলা হল না। গত সন্ধ্যায় পবিত্র কুমার বলেছিল, আজ রাত থেকে অর্ডার লাগু হতে পারে। হয়েছে নিশ্চয়ই, কারণ আজ ভ্রামরী মন্দিরে পবিত্রকে খুব অন্যমনস্ক লাগল, কথা কম বলছিল, বেজায় গম্ভীর। নাকি মাঝরাত থেকে বেলা বারটা অবদি ওর এমারজেন্সি ডিউটি। দেবীমায়ের আশির্বাদ চাইতে এসেছে। সবাইকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, এই বলে মাথা ঠান্ডা রাখা ওষুধের পুরিয়া চেয়ে নিয়ে সাগ্রহে গলায় ঢেলেই আজ সে প্রথম বার একা একা ক্যাম্পের দিকে দৌড়ল।সব লক্ষণগুলিই প্রতিকূল, তাই আর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। বাহিনীর কাছে নিশ্চয়ই খবর আছে, আজ বিশাল পাল ওপারে চালান হবে। ওবেলা বটের ছায়ায় বসে যে কথা মুখোমুখি টাপুকে সে বলতে পারেনি, এখন তাই-ই বলবে বলে মন্দিরের আরতি ফেরত দিবাকর সাইকেলটা উঠোনে দাঁড় করিয়েই বুক পকেট থেকে ফোনটা তুলে নেয়, "হ্যালো, ট্যাঁপা, আইজ ঘরেই থাক বাবা। হাওয়া খুব গরম। কয় দিন আর নদীর দিকে যাইস না রে।"ওপাশ থেকে চাপা গলা ভেসে আসে, "ক্যান স্যার, আপনে কিসু শুনছেননি? হ, আমিও ট্যার পাইছি, হাওয়া খুব গরম স্যার, শুনসি আইজ গুলি চইলতে পারে, কিন্তু আপনারে তখন কইলাম যে, দুইশ গরু জমা হইছে গরুহাটায়। কলাগাছের ভ্যালা ট্যালা সব রেডি। ঐ পারের রাখালরা সব টর্চ জ্বালাইয়া খাড়াইয়া আছে। এহন কি আর ক্যানসেল করা যায়? দশ মিনিট পরেই আপনাগো বাসার ধার দিয়া আমি, গণেশ আর আসলাম একসাথে নদীর দিকে যাব। যাওনের সময় মা ভ্রামরীরে পেন্নাম কইরা যাব স্যার। দ্যাখবেন আমাগো আর কুনো বিপদ হইবে না।"হায় মা ভ্রামরী, তুমি যে চোরাচালানীদের মা নও, এই অবোধ শিশুগুলো তা জানে না! দিবাকরের মনটা যেন ডুকরে ওঠে। কিন্তু আজ ওদেরকে বাঁচাতেই হবে। দু হাত জড়ো করে দেবীকে প্রণাম করে দিবাকর, তারপর এক মূহুর্তে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নেয়। গলা বন্ধ জামা, লম্বা প্যান্ট সে আগে থেকেই পরে ছিল। মাথায় এবার পরে নিল টুপি, হাতে দস্তানা। গলায় মাফলার। এই গরমে কিম্ভুত লাগছিল তাকে, তা দিবাকর বুড়ি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝল। কথা না বাড়িয়ে সে উঠোনের একপাশে স্তূপ করে রাখা কাঠকুটো থেকে বেছে নিল একটা লম্বা বাঁশ। শক্তপোক্ত, প্রমাণ-সাইজ। তারপর দৌড়ে চলে গেল মন্দিরের দিকে।অন্ধকারে দিবাকরকে দেখাচ্ছিল যেন দন্ড হাতে এক বিশাল প্রেত। নাক মুখ চোখ কিছু নেই শুধু দীর্ঘ একটা সচল ছায়া। এমনকি তার হাতে ধরা বিশাল বাঁশটিকেও গিলে ফেলেছিল রয়েল গাছের নীচের অন্ধকার। সে অন্ধকার খুব জাঁকালো, কারণ জনশূন্য মন্দিরে তখন দেবীর সামনে একটি মাত্র তেলের প্রদীপ জ্বলছে। জনশ্রুতি, সারা রাত ভ্রামরী দেবী নিজেই মন্দিরের দেখভাল করেন। নিজেই সারা রাত সলতে উসকে দিয়ে মূর্তির সামনের প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রাখেন। তাই মন্দির প্রাঙ্গণে আর কোনও রকম প্রদীপ বা ইলেকট্রিকের আলো প্রজ্জ্বলন নিষিদ্ধ। টিমটিমে হলদে বালবটাকেও পুরুতমশাই যাবার সময় নিভিয়ে দিয়ে যান।এ কথা মনে হতেই দিবাকর যেন পরিষ্কার দেখতে পেল, নদীর দিকের বন্ধ দরজা ভেদ করে ভেতরে ঢুকলো একঢাল কোঁকড়া চুলের এক শ্যামলা কিশোরী। নিজের রক্তবর্ণ শাড়িটি সামলে পেতলের প্রদীপে সলতেটুকুকে উসকে দিল, তারপর কোশাকুশির ওপর সোনার কঙ্কণ-পরা হাতখানি ঝেড়ে নিতেই সেই নিটোল হাতের ওপর থেকে দিবাকরের দিকে গুঞ্জন তুলে উড়ে এল অজস্র মধুমক্ষিকা! তার রাত-জাগা চোখ আর উত্তপ্ত মস্তিষ্ক তাকে কতো কী-ই না দেখাবে! দেবীকে দেখার মতো কোন পুণ্য সে কখনও অর্জন করেনি, একথা জেনে দিবাকরের ভক্তি জাগে না, বরং ভয়ংকর এক রাগে তার ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। এইরকমটা বিশ্বাস করতে পারলে তার ভালো হত যে এমন কেউ আজ তার সঙ্গে আছেন, যিনি পাপের শাস্তিতে শুধু মৃত্যু বিধানই করেন না, অসীম আদরে ভালো মন্দ সকলকেই নিজের মধ্যে লগ্ন হবার অনুমতি দেন। কিন্তু বাস্তবে যা দেখেছে সে, তার সবই এই বিশ্বাসের বিপরীতে অবস্থান করে। কেউ কোত্থাও নেই যখন, তখন তিন তিনটে বিভ্রান্তিকে শেষ বারের মতো বাঁচানোর চেষ্টা তাকেই করতে হবে। দরকার নেই তার কোনো দৈবী মহিমা বা লোকবলের। তার দীর্ঘকায় দেহ আর এই মস্ত লম্বা বাঁশ, এই দুইয়ে মিলে মরীয়া শেষ চেষ্টার ক্ষণ নিকটবর্তী হতে থাকে। দিবাকর নিজের বুকের ঢিপঢিপ শোনে, নাকি হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির টিকটিক, তা সে নিজেই ভালো বুঝতে পারে না। তার কান হঠাৎ সেই শব্দ শুনতে পায়, যার জন্য সে এতোক্ষণ চরম উৎকর্ণ হয়েছিল। তার বাড়ির পাশের রাস্তার ঝরা পাতায় মৃদু শব্দ তুলে কারা যেন এগিয়ে আসছে ! এই একই পথ দুভাগ হয়ে বাঁয়ের রাস্তা যায় মন্দিরে, ডাইনেরটা ক্যাম্প থেকে দূরে নদীর যে অংশ, সেইদিকে। কানের পেছনে হাত নিয়ে সে আঁচ করার চেষ্টা করে পায়ের শব্দটা কোনদিকে যাচ্ছে।বাঁয়ে, নির্ভুল বোঝা যাচ্ছে বাঁ দিক পানেই আসছে ওরা, সোজা ভ্রামরী মন্দিরের দিকে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে ওরা তিনজন। একেবারে নি:শব্দে সাবধানী পা ফেলে ওরা মন্দিরের চৌহদ্দিতে ঢুকে এল। রয়েল গাছের আড়ালে লুকিয়ে দিবাকর দেখছে, একটু বাদেই দুজন উঠে গেল মন্দিরের দাওয়ায়, একজন জোড় হাতে নীচে দাঁড়িয়ে রইল। এ নিশ্চয়ই আসলাম। এখানে হিন্দু মুসলমান, সবাই ভ্রামরী দেবীকে সমীহ করে, মেনে চলে। টাপুর বলা কথাগুলো আবার যেন শুনতে পায় দিবাকর, "যাওনের সময় মা ভ্রামরীরে পেন্নাম কইরা যাব, স্যার। দ্যাখবেন, আমাগো আর কুনো বিপদ হইবে না।" এইবার নিজের ভেতরের ক্রুদ্ধ দৈত্যটিকে এক ঝটকায় জাগিয়ে তোলে দিবাকর। বাঁশ ধরা দুই হাত তোলে মাথার ওপরে। তার অতর্কিত আক্রমণে চাক ছেড়ে মুহূর্তে উড়াল দেবে অজস্র মৌমাছি। আক্রান্ত হয়ে তারা ভুলে যাবে বহু যুগের শান্তি, ঘিরে ধরবে কাছেই দাঁড়ানো বিপথগামী টাপুদের, প্রাণ বাঁচানোর জন্য অন্যদিকে দৌড়ে পালাবে ছেলেগুলো। তারা তো আর দিবাকরের মতো আপাদমস্তক ঢেকে প্রস্তুত হয়ে আসেনি। তবু তাদের জন্য মৌমাছির হুল সিসার বুলেটের থেকে নিশ্চিত ভাবে কম বিপজ্জনক।তারপর সেই সচল জীবন্ত কীট-মেঘ মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে গর্জনরত অবস্থায় বেরিয়ে যাবে, ছেয়ে ফেলবে বন্দুকধারীদের ক্যাম্প। চোরাগোপ্তা এই আক্রমণে বিপর্যস্ত হবে তারাও। যারা এক মুহূর্ত পর মানুষ মারার জন্য বন্দুক উঁচিয়ে ধরবে বলে তৈরি হচ্ছিল, তারাই মার ডালা রে বলে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে, টেনে ছিঁড়তে চাইবে গায়ের মোটা উর্দি। নীল ঝকঝকে রাতের আকাশে ছড়িয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু গ্রহ, তারা, এলিয়ে পড়া আকাশগঙ্গা আর নীহারিকা মন্ডলীকে যেন তছনছ করে দেবে এইভাবে দিবাকর মাথার ওপর বাঁশটি তোলে। তার নিশ্চিত লক্ষ্যে থাকে মাথার ওপরের সবচেয়ে বড় মৌচাকটি।
    শেষের কবিতা - দীপ্তেন | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়হলুদ ফুল ছিলো চোখের পাতা ছুঁয়েশহরও আলোময় পাপে ও উত্তাপেসে ছিলো মধুমাস, মেলাতে কত লোককেনো যে স্মৃতিরতি, কেনো যে নীরবতাকেনো যে মনে পড়ে, পাথুরে অবকাশে ও নদী, বহে যাও , গলাও হিমবাহও নদী বহে যাও , ভাসাও পারাবারও নদী বহে যাও, সাগরে মিলে যাও ও নদী ,একাকীই আকাশে মেঘ হওফিরো না, চিরদিন সান্দ্র মেঘমালা
    হন্য - সৈয়দ তৌশিফ আহমেদ | খুব সম্ভবত খুন হব আমি।মারণাঘাত আজই হানবে ঘাতক, একথা জোর দিয়ে বলা না গেলেও, খুন হওয়াটা একরকমের নিশ্চিত। মৃত্যু নিয়ে ইদানীং হয়তো আমার আর তেমন উৎকণ্ঠা নেই, তবে দীর্ঘ যন্ত্রণায় প্রবল আতঙ্ক আছে। মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণে রাজি, যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি চাই শুধু। ঘুমের ভিতর আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে মন্দ কী, তবে সেরকম আরামদায়ক মৃত্যুর বরণডালা সাজিয়ে আততায়ী কি অভ্যর্থনা দেবে আমাকে? জানা নেই!যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর সৌভাগ্য বোধহয় আমার কপালে নেই।অবশ্য, মরতে আমাকে হবেই। বাড়ির চেনা চৌহদ্দিতে হোক, কি বিপুলা পৃথিবীর কোন নির্জন কোণায়। খোলা আকাশের নীচে কিংবা দুর্ভেদ্য গুমঘরের খাঁচায়। পৃথিবীর প্রতিটা ইঞ্চিই আমার কাছে এখন যমের দক্ষিণ দুয়ার ! তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না আর ! মৃত্যুই যখন অবধারিত সেখানে এসব সৌখিনতা নেহাতই অবান্তর , বাড়তি। আমার প্রাণপাখি ডানা মেলে শরীর ছাড়লে যে দীর্ঘ অবশ অন্ধকার নামবে তা নিয়ে আমার তেমন দুশ্চিন্তা না থাকলেও, মৃত্যু যন্ত্রণার দীর্ঘ কাতরানিতে ঘোর ভীতি আছে।প্রশ্নটা হল, কিভাবে নিকেশ করবে আমায় ? গলা টিপে শ্বাসরোধের সাবেকি পন্থায়? আমার কুতকুতে চোখগুলো কি তখন বল্লমে গাঁথা শুয়োরের মতো ঠিকরে বেড়িয়ে আসবে ? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বিস্ফারিত দৃষ্টি প্রাণপণে ধরে রাখতে চাইবে আততায়ীর শেষ ছবি? নাকি মরবো খাদ্যে বিষক্রিয়ার মতো দীর্ঘ যন্ত্রণাময় কদর্য কায়দায়? কাটা পাঁঠার মতো জগঝম্প জুড়ে, শ্বেত পাথরের তেলা মেঝেয় বমি -পায়খানায় একাকার হয়ে ? আর নাকি প্রকাশ্য রাস্তায় পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জের গরম বুলেট ফুঁড়ে দিয়ে যাবে মগজ? কিছু রক্তমাখা ঘিলু ছিটকে গিয়ে লাগবে কি কোন বেনামী ল্যাম্পপোস্টের গায়ে? কে জানে হয়তো দু একটা অশ্লীল স্মৃতিও তখন গড়িয়ে নামলো পোস্টের গা থেকে। আমার পড়ে থাকা নিথর লাশের দিকে চেয়ে রাস্তার লোক কি চমকাবে খুব? খুব ? বোধহয় পুরনো প্রফেসিকে সমর্থন জানিয়ে বলে উঠবে, – এ তো জানাই ছিল! আজ নয়তো কাল এটা হওয়ারই কথা! বেশ হয়েছে শালা!আমি আক্রান্ত হতে পারি যে কোনও দিন, এ খবরটা বাসি হলেও খুনের সম্ভাবনাটা একেবারে হালের অগ্রগতি , ব্রেকিং নিউজটি কাকপক্ষীতেও টের পায়নি এখনো। খুনটা হবার পরেও সত্যের নাগাল পাবে মানুষ, তারই বা গ্যারান্টি কোথায়। বরং লটকে থাকা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসে আমারই কোনও টাটকা কলঙ্কের দাগকে হয়ত রং চড়িয়ে আরেকটু চওড়া বানাবে! আমার বিরুদ্ধ শিবিরে চাওর হওয়া কোনও সাবেকী ঝাল, পুষে রাখা কোনও প্রাচীন বৈরিতায় নির্ঘাত জল মেশাবে আরও দু’দাগ। খুনটা হতে দেরি, মোড়ের জটলায় পুরনো কেচ্ছার রগরগে খেঁউড় চলবে, তা কি আর বলে দিতে হবে। তবে, আসল অপরাধীর টিকিটিও ধরতে পারবে না কোনও মামু। কারণ, আমিই জানতে দেবো না কে এবং কেন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রচেছে। ইচ্ছেটা একান্ত ব্যক্তিগত। ইচ্ছে হলে ঝেড়ে কাশবো পরে, না হলে এটুকু মগজ খাটিয়ে বুঝে নিতে হবে।তাতে মানুষের একরকম খুশিই থাকার কথা। এমনিতেই বিবেক-কাতর জনগণের বহু প্রতীক্ষিত আকাঙ্ক্ষা ,কেউ আমাকে অন্তত দু চার ঘা দিক। প্যাঁচে ফেলে হেনস্থা করুক। আমার রেওয়াজি কেচ্ছা কেলেঙ্কারি নিয়ে কেউ অন্তত এবার একটা বোমা ফাটাক সজোরে। সঙ্গত কারণেই আমাকে নিয়ে সকলের তীব্র ক্ষোভ , তাদের কলরবের পিছনে হাজারটা কারণ নেহাত যুক্তিহীনও নয়। এত বছরের এত খুচরো পাপ নিয়েও আমি পার পেয়ে যাচ্ছি কোন অন্যায্য যুক্তিতে! আর কীভাবে? শয়তানের আরাধনায়, নাকি ঈশ্বরের উপেক্ষায়?“তবে পেটি অপরাধ নয়, খুন হব একেবারে অন্য কারণে!”, বোধহয় মুখ ফসকে আলগোছে বেরিয়ে এসেছে কথাটা, তাও আবার বিপজ্জনক ‘খুন’ শব্দটাই।পেল্লায় সসপেনে মুঠোভরা চিনি ছুঁড়ে দিয়ে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়েছে জগদ্দল, - কোথায় খুন হয়েছে?দীর্ঘ সময় চারদেয়ালে নিজেকে বন্দি রাখার পর সবে কটাদিন চৌকাঠ ডিঙিয়ে সদর সংলগ্ন রাস্তায় পায়চারি করছি। এযাবৎ আমার চলাফেরা সীমাবদ্ধ থাকছিল সদর থেকে সামনের ল্যাম্পপোস্টের মাপাজোপা দূরত্ব টুকুতেই। আজ দেখছি ভাবনার পাকদণ্ডিতে খেই হারিয়ে অন্যমনস্ক হেঁটে মোড়ের চায়ের দোকান অবধি এসে পৌঁছেছি।জগদ্দলের প্রশ্নে পলকের জন্য গুম হয়ে যাই। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে অবাক হওয়ার ভান করি, - আ্যঁ!- কে খুন হয়েছে?আমার নির্লিপ্ত জবাব, - খুন! কই, তেমন কেউ না তো! কাগজে দেখছিলাম তখন। বলে ফাঁকা বেঞ্চে বসতেই খবরের কাগজের পিছন থেকে একটা মাথা উঁকি দিয়েছে। ষণ্ডামার্কা চেহারা। অচেনা মুখ। এ তল্লাটে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না । প্রখর চাউনি। ঘন ভুরু জুড়ে গিয়ে চেহারায় একটা বিজাতীয় কাঠিন্য। আততায়ী হবার যোগ্য দাবিবার সন্দেহ নেই। নতুন মুখ দেখলেই আজকাল আমার উদ্বেগের পারদ চড়ে যায়। বিশেষ করে এরকম মুখ। এই লোকটাই অন্ধকারে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে, কদিন থেকে আমার জানালার দিকে ঠাই চেয়ে থাকে? অসম্ভব নয়। একটু মুখ চেনা ঠেকছে যেন।পাড়ার মোড়ে জগদ্দলের চায়ের টঙ। মুখোমুখি জোড়া বেঞ্চ পাতা। সামনেই সংলগ্ন পিচ রাস্তা। পিছনে ঝাঁকড়া হয়ে থাকা দেশী শিমুল। গাঢ় সন্ধে নামছে ভুসো কালি ছড়িয়ে। এপ্রিল মাস , তাও এখন থেকেই যেন বাতাসে একটা জোলো ভাব। কদিন আগে একটা আনসান ধুলোর ঝড় এসেছিল , দু একবার গর্জে সেই যে চুপ করেছে আকাশ, আর কোনও উচ্চবাচ্য নেই । গাছের পাতায় মৃদু কাঁপন পর্যন্ত গায়েব।সোমবার বলেই আজ জগদ্দলের দোকানে খদ্দেরের বায়নাক্কা নেই , তাই কিছুক্ষণ বসলেও লোকজনের প্রশ্নে জেরবার হতে হবে না। তাছাড়া মুখের উপর কাগজ তুলে রাখা এই লোকটা পট্টিবাজ কিনা , জানতে কৌতূহল হচ্ছে বড্ড।দেবীপুর অঞ্চলের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু পাড়া এই নবপল্লী। জগদ্দলের টঙ ছাড়িয়ে পিচ রাস্তা ধরে মিনিট খানেক হাঁটলে একটা অকেজো আখাম্বা ল্যাম্পপোস্ট , সেই ল্যাম্পপোস্টের উল্টো দিকে কিছুটা এগিয়েই আমার সদর। আর ঠিক ওই ল্যাম্পপোস্টের নিচেই এক বা একাধিক ছায়ামূর্তির আনাগোনা আজকাল। সন্ধ্যার পর সামনের রাস্তায় পায়চারি সেরে আমি বাড়ি ঢোকা মাত্র তাদের গতিবিধি শুরু হয়ে যায় , আশেপাশেই নির্ঘাত ডেরা আছে কোথাও। করে না কিছুই , পোষা পেয়াদার মতো দাঁড়িয়ে থাকে, ক্রমান্বয়ে সিগারেট পোড়ায়। তীক্ষ্ণ চোখে নজর রাখে জানালায়। খবরের কাগজের পিছনের এই ভীষণ চেহারাটি কি সেই দলেরই পাণ্ডা ! এই কি তবে সেই আততায়ী! মুগুরের মতো তার কব্জি দেখে আমাকে টুটি টিপে মারার একটা ছবি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। নিজের ডান হাতটা কখন যে গলায় চলে গেছে, সে খেয়ালই নেই, নিজের অজান্তেই একটু চাপও দিচ্ছিলাম হয়তো টুঁটি সংলগ্ন অঞ্চলে।জগদ্দল চা ছেঁকে ফ্লাস্কে ভরে আমার দিকে আড়চোখে চাইতেই তার ভ্রু কুঁচকে গেছে, - গলায় কী হয়েছে?হাত সরিয়ে নিয়ে বিরক্তি চেপে বলি, - না রে ভাই! হবে আর কী! ওই ঠাণ্ডা গরম।সামনের ষণ্ডামার্কাটি কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে খর দৃষ্টিতে মুহূর্তক্ষণ আমাকে জরিপ করে ফের কাগজে মুখ গুঁজে দিয়েছে। ঝলকে উঠেছে তার লোমশ ডান হাতের পুরু সোনালী ব্যান্ড। এই যদি আমার যমদূত হয় তাহলে দুর্ভোগ আছে কপালে। সহজে আমার আত্মারামকে এ লোক খাঁচাছাড়া হতে দেবে কি? মনে তো হয় না। আমার মেরুদণ্ড বেয়ে আতঙ্কের একটা চোরা স্রোত নেমে গেল। মাথার ভিতরে, বুকের গভীরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা বোধ করছিলাম। লোকটা কে আমাকে তা জানতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? সরাসরি প্রশ্ন করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবো কি? হ্যাঁ, করাই যায়। ভদ্রতার পাঠ এমনিতেই আমার নেই , তায় যমদূত।- শুনছেন, নড়বড়ে স্বরে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি পাড়ায় নতুন এলেন?কাগজের মাথা ছুঁয়ে সেই কঠিন দৃষ্টি আমার দিকে স্থির, - আমাকে কিছু বলছেন কি? বাপরে! কী নিরেট কণ্ঠস্বর। শব্দগুলো যেন কাঁচের বয়ামে মুখ ঢুকিয়ে ধীরেসুস্থে এক এক করে উচ্চারণ করল কেউ। কণ্ঠস্বরটা বৈকালিক নিস্তব্ধতার গায়ে একটা স্থায়ী উল্কি টেনে দিয়ে গেল। উচ্চারণের প্রতিধ্বনি আমার কানে বাজছে এখনো।সাহস সঞ্চয় করে কিছু বলতে গিয়েও জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেছে আমার, ঢোঁক গিলে বললাম, - আপনাকে না। জগদ্দলকে চায়ের কথা বলছিলাম।ঠিক সময় মতই সাড়া দিয়েছে জগদ্দল, - একটু রোসো, হয়েই এসেছে।আর কত রোসবো রে ভাই! খোঁয়াড়ি ভেঙে দেখছি জীবনের রং তামাশা সব নিকড়ে ছিবড়ে হয়ে আছে। বুকভরা হিচককিয় সাসপেন্স নিয়ে রোসেই তো আছি বাপ। পেটের ভিতর একটানা গুরগুরানি, বুকের গভীরে আস্ত জিওল মাছের খলবলানি। মৃত্যু ভাবনায় শরীরের মধ্যে এত রহস্যময় খেলা চলবে কে জানত! এ যেন প্রথম যৌনতার পূর্ববর্তী অধ্যায়, শরীরের প্রতিটা রোমকূপই টানটান প্রস্তুত, কবে হবে, হলেই মোক্ষলাভ। শুনেছি মানুষ গলায় দড়ি দিলে নাকি বীর্য নিঃসরণ হয় । এ লোক আমার গলা টিপলে আমারও তাই হতে পারে। সেটা কি যন্ত্রণায় , নাকি উত্তেজনায়? কে জানে রে বাবা!জগদ্দল চা ধরিয়ে গেল।এককালে জগদ্দলের এই চায়ের গুমটিতেই বসত আমার সান্ধ্য আড্ডার মজলিশ। ছিল তখন দু চারটে তাঁবেদার , চামচা , গোলাম। একটা দুটো বান্ধবী। আমার লোহালক্কড়ের ব্যবসাটাও দাঁড়িয়েছে সদ্য । এলাকার তাবৎ মিস্ত্রীদের হাত করাতে খদ্দেরের লম্বা লাইন লেগেই থাকে। সাথে বরাবরের পৈতৃক চালের আড়ত থেকেও মুনাফা উঠছিল দুরন্ত। প্রথম স্ত্রীকে জোরজবরদস্তি ডিভোর্সে রাজি করিয়েছি । মৈথিলীর সঙ্গে নতুন সম্পর্কের তুরীয় নেশায় তখন বুঁদ। যাওয়ার জায়গা রয়েছে আরও দু একটা। পারলে যেন একটা হারেম খুলেই বসি। সেই সময় সান্ধ্যআসরের মধ্যমণিটি হয়ে আমাকে এখানে দেখা যেত প্রায়ই।এখন অবশ্য সবই ভোগে গেছে। মৈথিলী , ব্যবসা ,আড্ডা এবং চামচাকুল। সে নিয়ে অবশ্য আমার গ্লানি , ধিক্কার , আফসোসের কোনটাই নেই। জীবনে কোনও নীতির কাছে নত না হলেও , একটি উপদেশের সামনে আমি হাঁটু মুড়ে বসেছি , আজ আছে কাল নেই , সুতরাং যতটুকু যা জুটছে তা নির্দ্বিধায় ভোগ করে যাও , পরে হা পিত্যেশ করো না।শব্দ করে চায়ে চুমুক দিলাম।জগদ্দল বললো, - আপনাকে অনেকদিন দেখিনি যে! শরীর গতিক সব ঠিক তো ?মনে মনে না হেসে পারি না । যে মানুষ সারাজীবন শারীরিক হয়েই কাটালো , প্লেটোনিক চিনলই না , তার আবার শরীরে কী হবে !হুঁ ! চিন্তায় যেন ঘুম উড়ে গিয়েছিল সকলের। শালা ! জগদ্দলের কথাই ধরা যাক, থাকে তো আমার বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে। এতই যদি উতলা, তাহলে কৈ, সদরে কড়া নাড়লি না যে বড়! ব্যাটা, তোর দোকানের এই রমরমা, সে তো এককালে আমার দৌলতেই । হতে পারে বেশ ক’বার লোকাল কাউন্সিলরের দলবল এনে তোর দোকানে ফোকটে মজা মেরে গেছি, তাতেও আমার কন্ট্রিবিউশনটা কি মিথ্যে হয়ে গেছে? চড়া সুদে হলেও , দিয়েছিলাম তো ধার ! আগে হলে এমনটাই ভাবতাম হয়তো, শুনিয়েও দিতাম মনের সুখে, এই কটাদিন মনে আর ঠাঁই দিচ্ছি না এসব। বৈরাগ্য বলবো না , বলা চলে ক্লান্তি , নিঃস্পৃহতা। পুরনো বাদ্যযন্ত্র পড়ে থাকলে যেমন ডিটিউন হয়ে যায় .আমার ভিতরের আস্ত শয়তানটাও ঠিক সেরকমই বেসুরো ঠেকছে আজকাল। তেড়েফুঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সেই প্রণোদনা আমাকে ছেড়ে কোথায় যে পাড়ি জমালো। সময় ফুরিয়ে এলে মানুষ তবে কি চেনা পথ ভুলে বেপথু হয় এভাবেই? অচেনা লাগে রোজকার আকাশ ? এই কি তবে বৈরাগ্য ? নাকি ভয়ে জুজু? এতদিনের বুনো ওল কি তবে পড়েছে বাঘা তেঁতুলের পাল্লায়? আর তাতেই কমছে চুলকানির ধাত?বললাম , - না , শরীরে কিছু নয়। কদিন একটু বাড়ির কাজে মেতে ছিলাম।উত্তরটা বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক , অবিশ্বাসী চোখে একপলক তাকিয়ে রইল জগদ্দল ,তারপর আফসোসের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, - ব্যবসাটা কি একেবারেই তুলে দিলেন ?আমার কপালে ভাঁজ পড়েছে তৎক্ষণাৎ, - কেন বলতো?থতমত খেয়ে গেছে জগদ্দল, - না, আসলে এত বড় ব্যবসা, উঠিয়ে দিলেন?– উঠিয়ে দিয়েছি কে বলল, বন্ধ রেখেছি কিছুদিন।– আমরাও তাই বলাবলি করছি … এত বড় ব্যবসা… এত টাকার লেনদেন…কষ্ট করে হাসলাম। শিমুল গাছের পাতলা অন্ধকারের দিকে তাকাতেই বুক বেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল।– বৌদি ভালো আছেন?ন্যাকা! জানে না যেন। উত্তর না দিয়ে হাসিটা ধরে রাখলাম ঠোঁটে।কাঁচুমাচু মুখে প্রসঙ্গ পাল্টালো জগদ্দল, - জানি রাগ করবেন , তাও জিজ্ঞেস করা , ভালো দাম পেলে খালের পাড়ের জায়গাটা বেচবেন নাকি ? ভালো খদ্দের ছিল একটা।মাস কয়েক আগে হলে এই প্রস্তাবে আমি স্তম্ভিত হতাম, রুদ্রমূর্তি ধারণ করে প্যাঁচ কষতাম কীভাবে জব্দ করা যায় আহাম্মককে। এখন অবশ্য শুকনো হাসলাম, - হ্যাঁ, বেচলেই হয়। পড়েই তো আছে।এই উত্তর শুধু অপ্রত্যাশিত নয় , অভূতপূর্বও বটে।জগদ্দলের অবাক হওয়ার চেয়েও, আমার নিজেরই বিস্মিত হওয়াটাই এক্ষেত্রে নজর করার মতো। খালের পাড়ের ওই জায়গাটা করায়ত্ত করতে এককালে রায় পরিবারের উপর দেদার সন্ত্রাস চালিয়েছি আমি। লোকাল এমএলের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেও কাজটা সারতে লেগেছিল পাক্কা দেড়টা বছর। ঠিক ওখানেই ছোট্ট একটা অর্গানিক ফার্ম করার সাধকে লালন করছি আজ অনেকগুলো বছর। সে জায়গা অন্য কাউকে বেচার কথা উচ্চারণ করতে পারি, এ আমারই কল্পনা বহির্ভূত। মৃত্যু কাছে এলে অবশ্য অনেক আশ্চর্য কল্পনাই সাদামাটা বাস্তব বলে প্রতিপন্ন হয়। তাই তো দেখছি।জগদ্দল অবাক চোখে আবার শুধোলো, - বেচবেন?- হ্যাঁ।- সত্যি বলছেন? উত্তেজনায় সে এগিয়ে এসেছে কিছুটা।- হ্যাঁ, সত্যি নয়তো মিথ্যে নাকি। তুমি কথা বলে জানিও আমাকে। আমি রাজি।না! এখানে আর এক মুহূর্ত বসা যাবে না, জগদ্দল জেরবার করে দেবে।খবরের কাগজের দিকে একবার চোরা চোখে চেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। যে যা পারবি কর, মারবি সে তো জানি , শুধু বলে দে কীভাবে , মনকে খানিক বশে আনি।সন্ধের প্রায়ান্ধকারে রাস্তায় নেমে গেলাম। বাড়িমুখো নয়, উল্টো পথ ধরেছি। একবার সীতারাম'দার কাছে যাওয়া যাক। কাঁহাতক আর গর্তে ঢুকে দিন কাটানো যায়। ভয় নয়, বুক খামচে ধরছে একাকীত্ব। এর নখ আরও ধারালো। সীতারামদা আমার এককালের গুরু। একটা লোকাল নিউজ পেপার চালাতেন এককালে , সেই সূত্রেই আলাপ। এখন সেসব উঠে গেছে যদিও। কী যেন করেন টরেন আজকাল। যোগাযোগ নেই বহুদিন। এই একটি লোকই এখন আমার সহায়, কিছু একটা পথ যদি বাতলে দেন , যার সাথে আলাপের সান্নিধ্য , চলাফেরার অনুগ্রহ পেয়ে আমি কৃতার্থ হতাম এককালে। মানুষটির জীবনযাপন আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধের সঞ্চার করত। কখনো সখনো মনে হত , অলস পায়ে সমভূমি বরাবর হেঁটে যাওয়ার কাজটা সহজ , কিন্তু পাহাড় ডিঙনোর শপথ যারা নিয়েছে , কী পাচ্ছে তাঁরা সেই দমছুট পরিশ্রমে? এর মধ্যেও নিশ্চয় আরও একটা বৃহৎ জীবন রয়েছে, মহৎ বেঁচে থাকা রয়েছে , যার খোঁজ আমি জানি না। একটা এডভেঞ্চার , যা শরীরের এডভেঞ্চারের চেয়েও জোরালো , স্থায়ী। সীতারামদার কাছে দুদণ্ড বসলেই এসব উল্টোপাল্টা ভাবনা ভিড় করত মাথায়। এই একটি মানুষ আমাকে কক্ষনো মাপেন নি আলো অন্ধকারের বিচারে। হয়ত তাই আজ আবার সীতারামদাকে মনে পড়ছে।সীতারামদার কথা বাদ দিলে , অন্যান্য মানুষ অবশ্য আমাকে সচরাচর পরিমাপ করেছে স্বার্থপরতা , এবং শয়তানির এককে। লাম্পট্য এবং চরিত্রহীনতার নিরিখে। জানে লোকটা একলষেঁড়ে , মিথ্যুক, ধান্দাবাজ, লম্পট, জোচ্চোর, সর্বোপরি দুশ্চরিত্র। নিদারুণ এক ক্ষতিকারক জীব। এর প্রতিটাই অবশ্য পৃথিবীর প্রত্যেক গড় মানুষের জন্যই অল্পবিস্তর প্রযোজ্য , আমার ক্ষেত্রে সামান্য বেশি হতে পারে ফ্যাক্টরগুলো এই যা। তবে মূল রাগের কারণটা, আমাকে নিয়ে তাদের নিষ্কলুষ মনে তৈরি হওয়া প্রবল যৌন ঈর্ষা। সব অপরাধ ক্ষমা ঘেন্না করলেও আমার এককালের একাধিক অবৈধ সম্পর্ক , যতই সে চুকেবুকে যাক , তারা মেনে নিতে পারেন নি আজও। তাদের যাবতীয় ক্ষোভের উৎসমুখ যেন ওখানেই। আমার বহুগামিতা নিয়ে তাদের উদ্বেগ , উৎকণ্ঠা এবং দুর্ভাবনার রেশ কাটেনি আজও। পুরনো কথার কাসুন্দি ঘেঁটে, গেল গেল রব সম্ভবত আজও ধ্বনিত হয় এ তল্লাটের আনাচকানাচে। সে নিয়ে অবশ্য আমি প্রতিবাদ করবো না ,তর্কেও যাবো না। মুহুর্মুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকা একগামী , আপাদমস্তক বহুগামির বিরুদ্ধে লোক খ্যাপাবে এ আর নতুন কথা কী ! লোকের কথা থাক। আমি বরং আমার কথাই বলি শুধু, একথা মেনে নিয়ে যে, আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠার পর্যাপ্ত কারণ হয়তো তাদের রয়েছে। মানুষের ধারণা, যতরকম ক্ষতিসাধন একটা মানুষের দ্বারা সম্ভব, তার বেশিরভাগই আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জড় হয়েছে এক এক করে।হ্যাঁ , স্বীকার করছি , আমার সাথে ন্যায়পন্থার সখ্যতা হয় নি কোনোদিনই। নীতির ধার আমি ধারিনি এ জন্মে। সততার পাঠে আমার হাই উঠেছে ঘনঘন। স্কুল জীবনে দুর্বলদের বুলি করেছি , কলেজ জীবনে মেয়েদের উত্যক্ত। কর্মজীবনে শোষণ করেছি অধস্তনদের। মানুষ অকারণেই নাজেহাল হয়েছে আমার হাতে। খুচরো ফায়দা তুলতে দেদার লোক ঠকিয়েছি । সবাই ভাবে , এসব পরিকল্পিত শয়তানি। তবে এসব যে খুব ছক কষে , প্ল্যান ফেঁদে ঘটিয়েছি এমনটা কিন্তু নয়। সুযোগ এসে গেছে একের পর এক। যা করেছি তার সবটাই ঘটেছে আমার পুরনো ধাত থেকে। মানুষের দুর্বলতাগুলো যেন আমার সামনে এলেই হাট হয়ে খুলে গেছে। আর আমিও লেগে গেছি স্বভাবসিদ্ধ কাজে , তৎক্ষণাৎ। মানুষের দুর্বলতা দেখা মাত্রই সেটাকে খুঁচিয়ে দগদগে ঘা করে দেওয়ার স্বর্গীয় সুখের মায়াবী হাতছানি থেকে নিজেকে সংবরণ করতে পারি নি ।কী আর বলি ,সত্যিটা হল, দুর্বলকে পিষে দেওয়ায় ঝোঁক আমার রক্তের উপাদানেই। আমার বাবাও নেহাত অকারণেই , ছুতো খুঁজে মানুষকে চিরকাল হেনস্থা করতেন। তাঁর স্যাডিস্টিক মস্তিষ্ক ছেলেবেলায় আমাকে যে সব পাশবিক শাস্তির বিধান দিয়েছে , তা শুনলে আচ্ছা আচ্ছা নওজোয়ানের কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যাবে। একবার মুখ বেঁধে আমাকে একটা ট্রাঙ্কে ঘণ্টা দুয়েক আটকে রাখা হয় , ছাড়া পাবার পরেও পুরো সপ্তাহ জুড়ে আমি বিকারগ্রস্তদের মতো আচরণ করেছিলাম। আর একবার, স্কুল পালানোর অপরাধে ক্লাস সেভেনে আমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে বাড়ির রোয়াকে একটা বেলা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এই ছিল তাঁর শাস্তি বিধানের কিছু আটপৌরে নমুনা। এর প্রতিহিংসা স্বরূপ আমিও এমন কিছু নৃশংস আচরণ করতাম , যা শুনলে মানুষের মনে আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। বাবার প্রিয় বেড়াল জিমি’র দুটো চোখ স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে খুঁচিয়ে প্রথমে আমি তাকে অন্ধ করি, তারপর পিছনের দু পা দড়ি বেঁধে ফেলে দিই পরিত্যক্ত কুয়োতে।বাবার ক্ষেত্রে অবশ্য একটা সুবিধে ছিল , চারিত্রিক দিক দিয়ে তিনি টলেন নি কখনো। নেশার ধুনকিতে বউ পেটালে বা ছেলেকে চুরুটের ছ্যাঁকা দিলেও , কখনো বারমুখো হননি তো , তাই দুর্নামটা সেভাবে বাজারজাত হয়নি। সতীপনার খুব দাম বাজারে। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছে উল্টো। আমার টালমাটাল চরিত্রের দরুন কৃতকর্মের বিবর্ধিত অনুনাদ রটেছে বাজারে। যৌন ঈর্ষায় কাতর মানুষের চোখও টাটিয়েছে পাল্লা দিয়ে।দোষ আমারই , মানছি। কিন্তু একথাও বলতে হয় ,মানুষের বোকামিই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে আরেকটু অনৈতিক হতে। অন্যের অযাচিত ভালোমানুষি আমাকে প্রলোভন এবং আস্কারা জুগিয়েছে রেওয়াজি প্রতারক বনতে। যেমন কলেজে পড়াকালীন একটি মেয়েকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি তার বোনের সাথে যৌনতা করি। দিদির প্রেমিকের উপর নজর আছে যে বোনের , সে কথা বোঝার পরও , সেই বোনকেই প্রেমিকের বাড়িতে সামান্য নোটসের জন্য ভরদুপুরে ফাঁকা বাড়িতে কেউ পাঠায় ! ফলে যা হবার তাই হয়েছিল। এখানে আমার অপরাধের চেয়ে সেই মেয়েটির সরলতাকেই আমি দায়ী করবো ষোলআনা। একথা বললে মানুষ যদিও আমার ছাল গুটিয়ে নেবে। নিক ! খুনটা হয়ে গেলে এমনিতেই আমি নাগালের বাইরে। বলা কওয়ার অনেক ঊর্ধ্বে।যাই হোক, পরবর্তীকালে সেই মেয়েটি গর্ভবতী হলে আমি তাকে ফেলে চম্পট দিই অন্য শহরে। এতে অবশ্য আমার বাবার সায় ছিল। কেলেঙ্কারির ভয়ে , তিনিই আমাকে পার্সেল করে দেন পশ্চিম ভারতের এক শহরে। সেই বাবাকেই অবশ্য আমি সরকারি হাসপাতালে ফেলে রেখে পচিয়ে মারি। এবং বাপটা ফৌত হতেই সামান্য জায়গা জমি নিয়ে গলাধাক্কা দিই নিরীহ দাদাকে। যে যে প্রতিবেশী নৈতিকতার কোটেশন আউড়াত এই সময় , পরবর্তীকালে এক ইঞ্চি জায়গার জন্য আইনি বাঁশ কেটে তাদের জীবনে আমি নরক নামিয়ে এনেছি । এ তালিকা শেষ হওয়ার নয়। সকলেই জানে সবটা। দেখে , শোনে , আলোচনা করতে করতে নিষ্ফল আক্রোশে দাঁতে দাঁত পেষে। এদের প্রত্যেককেই আমি সরাসরি নাজেহাল করিনি যদিও , তবে তারা চায় কেউ এই সামগ্রিক অপরাধের একটা বিহিত করুক। যেভাবে হিন্দি ছবিতে ভিলেন প্যাঁদায় নায়ক ,সেভাবে কেউ এসে আমার সাথে একটু ভায়োলেন্সের চু কিতকিত খেলুক। অবশ্য খুনের খবরটা জানেনা কেউই , জানলে কে আমার বিরুদ্ধে সুপারি কিলার নিযুক্ত করবে , সেই নিয়ে ‘পাঁচ কা দশ’ লাগিয়ে দিত।হ্যাঁ, খুন আমাকে হতেই হবে। তবে সেটা এসব পেটি কারণে নয়। লোকের সাধ যতই হোক , কোনও পুরনো ভিক্টিম দশম অবতারের রূপে আবির্ভূত হবেন না। আমি মরবো আমারই কেটে রাখা খালের পাঁকে ডুবে। ঠিক যেমন অন্যের দুর্বলতায় আমি আঙ্গুল দিয়েছি এতকাল , আমার দুর্বলতায় এবার সেই আঙুলগুলোই বোধহয় কড়া পাঞ্চ হয়ে বিলো দ্য বেল্টের স্পর্শকাতর এলাকায় ঘুঁসোবে।এবং এর মূল হোতা , আর কেউ নয় , মৈথিলী- আমারই বর্তমান স্ত্রী । হ্যাঁ , বন্ধুবর। লজ্জার কথা কী আর বলি। যে মেয়েকে বিয়ে করবো বলে আগের বউয়ের মগজধোলাই করে ছেলেপুলে সমেত ছেঁটে ফেললাম, সেই মেয়েই যে আমাকে লটকাতে , পরপুরুষকে দিয়ে ফাঁসির ফান্দা বানাচ্ছে , তা আমি জানবো কী করে।সহজ কথায় বললে , আমি খুব দ্রুত না মরলে , আমার স্ত্রীর বেঁচে থাকার রাস্তাটা ঠিক সুগম হচ্ছে না । বাঘ যেমন ঘাড় মটকে রক্তের স্বাদ পায় , তেমনি আমার স্ত্রীও এত বছর পর অবদমনের ঘাড় মটকে বেঁচে থাকার স্বাদ চেখে ফেলেছে। আমাদের দুজনের ক্ষেত্রে তাই বাঁচা মরাটা এখন মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ বিষয়। দুই যাত্রী, তবে আসন একটিই। কিছুতেই আঁটবে না একসাথে। একজন থাকলে , অন্য জনকে সরতেই হবে। আমি টিকে যেতাম হয়তো , কিন্তু অপরাধের খুচখাচ পাঁচমিশালী পদে হাত পাকলেও , খুনের মতো গুরুপাক রান্নায় এখনো আমি হাত লাগাতে পারিনি। মার্ডার করার মতো না তো আমার কলজের জোর আছে , আর না পশ্চাতে দম। আমার প্রতিপক্ষও বেশ তাগড়াই। কাজেই দণ্ড অনিবার্য।এককালে মৈথিলীর শরীর দেখেই তার প্রেমে পড়ি। প্রেম শব্দটা বলতে কেমন লাগছে, কাম বললে খুব ভুল হবে কি? পাতলা দিঘল গড়নের যুবতী, যেমন ক্ষীণকটি, তেমনি উন্নত বুক। প্রেম টেম নয় , শরীর দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। চোখেমুখে কেমন এক বিদ্যুৎ চমকানো জৌলুষ। শরীরে মাতাল করা বুনো স্বেদগন্ধ। আমার তো পাগলপ্রায় অবস্থা। খেলিয়ে তুলতে সময় লেগেছিল। সহজে কি আর রাজি হয় ! বহু সাধ্য সাধনার ফল! সময় এবং অর্থের বছরভরের যুগপৎ খেল। তারপর পাখি পোষ মানল। মানল তবে খাঁচায় থাকতে আপত্তি, বিয়েতে অসম্মতি, যদিও বা নিমরাজি, আমার বসত বাড়িতে উঠে আসতে খুঁতখুঁতানি। আমি তখন তার উরুমূলের ভেজা অন্ধকারে দুবেলা নিজেকে উজাড় করে না দিতে পারলে নিজেকেই যেন ক্ষমা করতে পারছি না।মৈথিলী ঘোষণা করল, - আমি কিন্তু চাকরি ছাড়ব না!আমি আশ্বাস দিলাম, - কী যে বলো! এই কথা!প্রতিশ্রুতির সবচেয়ে বড় মজা এবং সুবিধা হল, ভাঙা যায় যখন খুশি। অস্বীকার করলেই বা প্রমাণ কোথায়।আমি নিজেকে যতটুকু বুঝেছি তাতে আমার চরিত্র দুই চরমপন্থী মেরুর যোগফল । অনেকটা পেন্ডুলামের সরল দোলগতির মতো । সময়ে সময়ে দুদিকের চরম বিন্দুকেই ছুঁয়ে দেখে। সম্পর্কের শুরুতে আমি উদার গণতান্ত্রিক, সাচ্চা মুক্তমনা, তারপর সম্পর্কে যেই না মরচে ধরল অমনি আমি পেশাদার ডিক্টেটর, পাঁড় রক্ষণশীল।চাকরি থেকে মৈথিলীকে জোরজবরদস্তি ছাড়িয়েই দিলাম। প্রথমটায় কেমন যেন হয়ে গেল সে। অসহায় ক্ষোভের সঙ্গে অপমান মিশে তার বুকে তখন ধস নেমেছে। খারাপ লাগছিল, কিন্তু উপায় কী! স্বাধীনচেতা মেয়েদের নিয়ে বড় ভয় আমার, কোথায় যে কী বাধিয়ে ফেলে। মৈথিলীর ধারেপাশে ছেলেবন্ধু দেখলেই আমার ভুরু কুঁচকে যেত। বাঘের পাশে পোষা ছাগল ছানাটিকে রাখতে আমি রাজি নই। মোবাইলে স্পাইওয়্যার রেখে সমস্ত গতিবিধির উপর নজর রাখতাম। বাড়ি থেকে হুটহাট বেরোনোর উপরও লাগু হল নিষেধাজ্ঞা। বেরোলেও পিছনে লেগে থাকত আমারই ফিট করা ফেউ।পরে অবশ্য বাড়ির চৌহদ্দিতে থেকেই তার নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার একটা উপায় আমি বের করে দিয়েছিলাম। তবে তার পুরোটাই আমার তত্ত্বাবধানে। একটা মন বোঝানো ব্যাপার আর কি । মৈথিলী তাতে সন্তুষ্ট হল না।বললাম, - এক কাজ করো , বাচ্চা নিয়ে নাও।রাজি হল না । বলল, - কিছুদিন পর।আমিও নাছোড়বান্দা। নিজস্ব সম্পত্তির উপর বিছানায় জোরজবরদস্তি করাটা কী আর এমন অন্যায়ের!যদিও, ক্যালেন্ডার মিলিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ মেনেও গর্ভসঞ্চারটা হচ্ছিল না। মহা সমস্যা! এদিকে পুকুরে ঢিল পড়লে ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠেও শেষমেশ যেমন স্তব্ধ হয়ে যায়, আমার অবস্থাও তাই। আগের মতন আর মুখিয়ে থাকি না। একই শরীর ঘাঁটতে বিরক্তই লাগে বরং। শরীর যে কেন একঘেয়ে হয়, এককালে যতটা উদগ্রীব, পরবর্তীতে ততটাই অনাসক্তি। এদিকে মৈথিলীর বুনো রক্তে সব যেন নদীর মাতন লেগেছে। আনকোরা ঝাঁপ খুলে ফেলে ভিতরের শঙ্খচূড় মাথা তুলছে। শরীর নিয়ে সে রোজই নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায়। আমার সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে পলকে ফণা তোলে। যৌন সুখ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, খিস্তিখেউড়ে উসকায়। আমি কেমন সংকুচিত হয়ে থাকি, বিপন্ন বোধ করি, মেয়েমানুষের মুখে খিস্তি শুনে মাঝেসাঝে লজ্জাও করে মাইরি! আমার বোলবোলা চুপসে যেতে থাকে। মনে মনে বলি, নারী হবে অবলা, আমি তার সাথে যথেচ্ছাচার করবো, সে থাকবে কুঁকড়ে, আমি তাকে আদেশ করবো, অথচ সে কিনা আমাকে চালনা করছে বিছানায়, কী কাণ্ড! আমি যদি শীৎকারে সম্মতি দিই, তবেই, নচেৎ সে স্পিকটি নট। মৈথিলীর এত বিছানা প্রীতিতে আমার মেজাজ খাপ্পা হয়ে থাকে। দেখেশুনে দুর্ভাবনা বেড়ে যায় মাইরি, প্রমাদ গুনি, উপেক্ষা অবহেলা পেলে, আর এ মেয়েমানুষকে চৌকাঠ টপকাতে দিলে কী কাণ্ডটাই না বেধে যেতে পারে। ব্যাপারটা আঁচ করে নজরদারির পাল্লা আরও বাড়িয়ে দিই।আমার শরীরও আর কথা বলছিল না তার নিজস্ব ভাষায়, রোদ না পাওয়া পাতার মতো স্যাঁতস্যাঁতে বিবর্ণ দশা, পর্যাপ্ত ইন্ধন জোগালেও পুরুষাঙ্গ সাড়া দেয় না চট করে। কাঁহাতক আর অভিনয়টা চালিয়ে যাবো। উড়ুক্কু মন অর্গল খুলে দেখতে চায় বাহারি দুনিয়ার রঙিন দৃশ্যাবলী। নিষিদ্ধ রোমাঞ্চ। পুরনো বান্ধবীদের কাছে কাঁদুনি গাইছি নিয়ম করে। ডবকা ছুঁড়ি হোক বা আলগা প্রৌঢ়া, রাস্তায় নামলেও চোখের কল্পনায় আশ্লেষে, চুম্বনে, গাঢ় কণ্ঠের ঝংকারে ভোগ করছি; সেই আবার আগের মতন।পুরুষ জনমের যন্ত্রণা বোঝা নারীর অসাধ্য। পুরুষ শালা আজন্ম ক্ষুধার্ত, আর তারই হাতের নাগালে সুস্বাদু, মুখে জল আনা মাংসপিণ্ডের ছড়াছড়ি। নারীর উর্বর পিচ্ছিলতায় এলোপাথাড়ি তুরপুন চালানোটা পুরুষের প্রাকৃতিক প্রোগ্রামিংয়েরই অংশ। সেই ক্ষুধা প্রবৃত্তি দমন করতে সভ্যতা , শিক্ষা এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তির নিরন্তর অভ্যেস লাগে। সেই পরিমিত সংস্কৃতি আমার চায়ের পেয়ালা নয়। অপরাধ বোধ হলে, দোষখণ্ডন করতে আলেকালে এসব গা জোয়ারি আত্মপক্ষ সমর্থন উগড়ে দিতাম। সেসব শুনে অবশ্য ধুয়ে কাপড় পরিয়ে দিত মৈথিলী। বরাবরই।শুধু শরীর নই , যুক্তি বিচার ভাবনা সাহস এবং আধুনিকতা এর কোনটাতেই আমি মৈথিলীর সাথে এঁটে উঠতে পারিনি কোনকালেই। শরীরে প্রজ্বলিত আগুনশিখার তেজ কমে আসতেই এসব বিষয় যেন আরও বেশি করে আঁতে ঘা মারছিল আমার। মৈথিলী আমার সব সীমাবদ্ধতা মেনে নিলেও , আমি ওর এই উজ্জ্বল উপস্থিতি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। অবশ্য ওর থাকা নিয়ে বাইরে জুটেও গিয়েছিল দু চারটে। রাঁড়বাজি করেই উড়িয়ে দিচ্ছিলাম সর্বস্ব।মৈথিলী একদিন বলল, - তুমি যে অন্যত্র যাতায়াত করো, তা আমি জানি।ধরা পড়তেই আমার শরীরের সমস্ত রোঁয়া ফুলে উঠল রাগে। কোণঠাসা হয়ে তড়পে উঠলাম।- আমার আপত্তি নেই, তবে আমিও পার্টিসিপেট করতে চাই। আমার খিদেও আছে, এক্সপেরিমেন্ট করার ইচ্ছেও। ওর কণ্ঠস্বর বরফ শীতল।শুনেই সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। পাগলের মত চিৎকার করে উঠলাম।মৈথিলীর মধ্যে তাতে অবশ্য বিন্দুমাত্র উদ্বেগ লক্ষ্য করা গেল না। সে নির্বিকার বলে গেল, - শোনো শরীর নিয়ে আমার কোন শুচিতা নেই। আমি তোমাদের সাথে যাবো, তুমি আমাদের সাথে। তোমার জন্য যা প্রযোজ্য, তা আমার জন্যও হবে না কেন!‘আমাদের’! মাথায় বাজ পড়ল আমার। রাগে ভাষা হারালাম।বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিচ্ছিল রোজই। যুক্তি তর্কে ল্যাজেগোবরে হয়ে আমার অবস্থাও বেশ সঙ্গিন। নিশ্ছিদ্র কারাগারের ঘুপচি ঘরে পারলে আটকে রাখতাম মাগিকে, ইচ্ছে করছিল বিষদাঁতগুলো নোড়া দিয়ে ভেঙে দিই, মুখে সেলোটেপ লাগিয়ে মুখ হাত পা বেঁধে ফেলে রাখি বিছানায়, কিন্তু কোথাও যেন একটা নৈতিক পরাজয় ঘটছে আমার, ভাবনাটা মাথায় এলেই গলা পর্যন্ত মদ ঢেলে নিই। তারপরই বুকের ভেতরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যায় , মাথায় ধোঁয়াটে অবসন্নতা। মেলা ভেঙে গেলে ফাঁকা মাঠে অবসানের যে নির্জনতা, আমার বুক জুড়ে তেমনই এক নির্জনতা থমথম করে প্রতিনিয়ত। মন বলছিল, একে আর আটকানো যাবে না হয়তো।সমস্ত রকম সতর্কতা জারি রেখেও মৈথিলীকে সত্যিই আটকানো গেল না, আমার আত্মবিশ্বাসকে সম্পূর্ণ তছনছ করবে বলেই নিজের পাওনা গণ্ডা বুঝে নিয়ে খাঁচার খিল খুলে একদিন চম্পট দিল পাখি। কষ্ট হয়েছিল যতটা, মানে লেগেছিল তার চেয়ে বেশি, অপমানবোধে ভিতরে একটা ছ্যাঁদা হয়ে রইল।আমারও রোখ চড়ে গেল। ভিতরের সেই দামাল নচ্ছার পুরুষটা তখনো কিন্তু একেবারে ফুরিয়ে যায় নি। সে অভিমানে কাতর হবে, ব্যর্থতার ক্ষীণ সুরে কথা বলবে, এমন ম্যাদামারা শিক্ষা আমিও তাকে দিইনি। যেখানে যাবি যা, এই বৈভব, এই ঐশ্বর্য, এই রাজকীয় আয়েশ , কে দেবে তোকে শালি! ফিরে তোকে আসতেই হবে। আমার বিছানায় রাত কাটিয়েছ, যতই তুমি উগ্র আধুনিকা হও, পরপুরুষের সামনে কাপড় খুলতে তোমার সাহসে কুলোবে না, সে আমি জানি। তাছাড়া কার এত হিম্মত আমার বিয়ে করা বউয়ের সাথে ভালোবাসা মাখবে।আমার এই প্রত্যাশা অবশ্য হাস্যকর প্রমাণিত হল। বাজারে হিম্মতওয়ালা পুরুষের কমতি নেই। বাপেরও বাপ থাকে। চিরকালই ছিল।সেই বাপের বাপই আমাকে বধ করবে। করুক। হাল ছেড়ে দিয়েছি, রণেভঙ্গ। এই গেরিলা যুদ্ধে এঁটে ওঠা আমার কম্ম নয়। তাছাড়া ,মরতে আমার আর অতটাও ভয় নেই, তবে যন্ত্রণায় হাড়হিম ত্রাস রয়েছে। আমি যে খুন হতে পারি, এই ভাবনা আচমকাই যেদিন সম্ভাবনা রূপে প্রকট হয়েছিল, তার পর থেকে অবশ্য কটাদিন মাথা জুড়ে ছিল শুধু বেবাক অন্ধকার। আমি থাকবো না, তার পরেও রয়ে যাবে এ ধরণী, এই ভাবনাটাই অসুস্থ করে দেওয়ার পক্ষে কিছু কম নয়। অনেক সময়, যাকে ভয় পাই, তার চেয়ে ভয়ের চিন্তাটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। আমি অবশ্য বোধহয় জীবনকেই ভয় পেয়ে এসেছি এতকাল, না হলে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলাম কেন।মৈথিলী চলে যাবার মাসখানেক পরের ঘটনা, গিয়েছিলাম ইভনিং ওয়াকে। মদ খেয়ে যা চর্বি জমে, সন্ধের পর দৌড়াদৌড়ি করে তা ঝরিয়ে ফেলি। এ আমার বরাবরের অভ্যেস। সেদিন কী মরতে, ছুটতে ছুটতে গিয়ে পৌঁছলাম একেবারে এক বিজন প্রান্তরে। চওড়া রাস্তা পীরের মাজারে বাঁক নিয়ে উঠেছে খোলা মাঠে। দু পাশে ক্ষেত, মধ্যিখানে মোরাম বিছানো পথ, ধার বরাবর কিছু ছাড়া ছাড়া গাছপালা। আশেপাশে লোকালয় নেই বললেই চলে। আকাশে নধর চাঁদ, ফুরফুরে দখিনা বাতাস। দূরের মাঠঘাটে পাতলা কুয়াশার ছোপ। চমৎকার লাগছিল।কিছু সময় পর খেয়াল হল, একটা গাড়ির হেডলাইট আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে এগিয়ে আসছে, এবং যেন একটু বেশিই সময় নিচ্ছে আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে। একবার পিছন ঘুরে দেখলামও। তারপর রাস্তার আরও প্রান্ত বরাবর দৌড়তে লাগলাম। দামী গাড়ি, ইঞ্জিন শিকারি নিশাচরের মতো নিঃশব্দ। একেবারে কাছে এসে পড়ছে না, একটু দূরত্ব বজায় রেখেই গতি কমিয়ে অনুসরণ করছে। আর যেন সুবিধার ঠেকছিল না ব্যাপারটা। গতি বাড়ালাম। গাড়ির গতিও বাড়ল সমানুপাতে। ঠিক যখন ভাবছি , মাঠের আলপথে নেমে যাবো, গাড়িটা একটা আগ্রাসী জন্তুর মতো সাঁ করে এসে আমার গায়ের কাছে ব্রেক কষল, সামলানোর চেষ্টা করেও টাল খেয়ে পড়েছি পাশের জমিতে।অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় নেমে এসেছে এক দৃঢ়দেহী। একটা দানবিক হাত আমার গলাটা সাঁড়াশির মতো শক্ত হাতে চেপে ধরে পুরো শরীরটাকেই টেনে তুলে মুচড়ে গাড়ির পিছনের সিটে ঠেলে দিল। শব্দ করে বন্ধ হল দরজা। ধুধু করে জ্বলছে চোখমুখ। জিভে নোনতা স্বাদ।কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না। কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে । স্নায়ু অবশ। কী হচ্ছে সে বিষয়ে তখনো সম্যক ধারনা নেই। চিরশত্রু আর শত্রুপক্ষের ছবিগুলো ঝলক দিচ্ছে মাথায়। কিন্তু কার এত সাহস! কোনক্রমে বলতে পারলাম, - কী চান কি আপনারা?কোন প্রত্যুত্তর নেই। কেবল শব্দ করে হাসলেন সামনের সিটে বসা চওড়া কাঁধের এক ভদ্রলোক। কৌতুক আর হেঁয়ালি ভরা হাসি। গাড়ির ভিতরের নিস্তেজ আলো আর উগ্র পারফিউমের গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করছিল। কী মনে হতে, দরজার হাতলে চাপ দিলাম। খুলল না।আবার সেই গা জ্বালানো হাসি। শুনলেই মাথায় খুন চড়ে যায়।- খুব ভুল করছেন কিন্তু! ফ্যাসফ্যাসে গলাতেই এবার চেঁচিয়ে উঠলাম, - কী চান আপনারা?লোকটা আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে গর্জে উঠল, - চোপ শালা! একদম চোপ। কী দিতে পারবি তুই একটা সই ছাড়া?- মানে! কে আপনি?- তোর যম।- আপনাদের সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। সব কটাকে পুলিসে দেবো আমি। কার সাথে লাগতে এসেছেন জানেন না! লোকটার কণ্ঠে সেই একই বেহায়ার হাসি। হাসিটা ধরে রেখেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, - পুলিশ! আমার নাম শুনলে পুলিশ মুতে ফেলে রে প্যান্টে। আর তুই যাদের পা চাটিস, তারাই আমার চটি সেলাই করে আনে।অন্ধকারে চোখটা সয়ে এসেছে আরেকটু। মাথাটাও সাফ হচ্ছে ক্রমশ। কে হতে পারে সেটা স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও, সই এর কথাটা শোনা ইস্তক সন্দেহ হচ্ছিল। মৈথিলী? যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই সে ডিভোর্সের পীড়াপীড়ি জুড়েছে। যোগাযোগ হলেই একই কথার পাখিপড়া আবৃত্তি। আমি সোজা হাঁকিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এত সাহস কি ওর হবে? এতটা সাহস? এই লোকটা কে, আর কেউ বা পাঠিয়েছে একে?আমার প্রশ্নগুলো যেন জিভের গোড়া থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে লোকটা। রুক্ষস্বরে বলল, - আমি কে, সে কথা শুনে তোর কোন লাভ নেই, শুধু এটুকু জেনে রাখ, ডিভোর্সের সই তোকে করতেই হবে।আশ্চর্য ছোটলোক তো। সমানে তুই তোকারি করে যাচ্ছে। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে এর পিছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য রয়েছে।- আসল কথাটা বলুন, কী চাই আপনাদের? টাকা?- তুই দিবি টাকা! তোর মতো ছারপোকাকে টিপলে কত আসে? কোটি? বলেই হাসির ছররা ছোটাল সে। তারপর গলার স্বরটা ঝপ করে খাদে নামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে, - বাঁচতে চাইলে মন দিয়ে শোন। মৈথিলী তোর মতন হাড় হারামির সাথে ওর নামটা আর জুড়ে রাখতে চাই না। আমি ওকে বিয়ে করবো। ভবিষ্যতে ইউরোপে সেটেল হব। কিছু আইনি জটিলতার জন্য বিয়েটা এখান থেকেই সেরে যেতে হবে। তোর হাতে দুটো অপশন। হয় ডিভোর্সে সাইন করবি, আর নয়তো অকালে মরবি। দুটো ক্ষেত্রেই তোর সাথে ওর নামটা আর জুড়ে থাকবে না।সম্পূর্ণ আকাশটাই যেন ভেঙে পড়ছিল মাথায়। পুরো অস্তিত্বই ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে। যথাসম্ভব স্বর অচঞ্চল রেখে বললাম, - ডিভোর্স! অসম্ভব! কিছুতেই দেবো না। লোকটা ক্রোধে ফেটে পড়ে জ্বলন্ত মুখ ঘুরিয়ে গলার নলি ছিঁড়ে চিৎকার করল, - তোর বাপ দেবে তো তুই কোন ছার। আর না হলে মরবি।আমার চেতনা জুড়ে তীব্র আশঙ্কা লাফিয়ে উঠছিল বারবার, তাও কড়া গলায় জানিয়ে দিলাম, -বেশ দেখা যাবে।একটা ইশারা মাত্র। বাইরের সেই দানব আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে আমাকে ছুঁড়ে দিল বাইরে। চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছিলাম। না করেও উপায় ছিল না, আমার বিয়ে করা বউকে নিয়ে যাবে পরপুরুষে, আর সেটা দেখবো দাঁড়িয়ে, তাহলে আমি কেমন বীর্যবান! হেরে যাওয়ার ভয় থেকেই জন্ম নেয় ক্ষমতা প্রদর্শনের নিদারুণ ইচ্ছে , তাই কিছু একটা করতে না পারলে আমি যেন তিষ্ঠতে পারছিলাম না। হারার ভয়ই আমাকে ক্ষিপ্ত রাখছিল , তাড়িয়ে মারছিল প্রতিটা মুহূর্তে। মৈথিলীর সাথে যোগাযোগের লাগাতার চেষ্টা সত্ত্বেও বরফ গলল না। বরং ওর তরফ থেকে লোক মারফত জানিয়ে দেওয়া হল , আমার দিক থেকে কোনরকম বাড়াবাড়ি করলে তার ফল ভালো হবে না। একমাত্র , ডিভোর্সের সইয়ের জন্য প্রস্তুত হলে তখনই যেন যোগাযোগ করা হয়। নচেৎ বধূ নির্যাতনে ফাঁসতে পারি। আচ্ছা খ্যাঁচাকলে পড়েছি।এদিকে উপদ্রব থামছিল না। মোবাইলে লাগাতার মেসেজ আসছে অচেনা নাম্বার থেকে। পুলিশকে জানিয়েও লাভ হল না বিশেষ। এ যেন একটা ঘোস্টের পিছু ধাওয়া করা। কল ট্রেস করবে কি, সব নাম্বারই নাকি ভুয়ো।তাও আমার মন বলছিল, হয়তো সামলে নিতে পারব এ যাত্রা। যতটা গর্জেছে, ততটা বর্ষাবে বলে মনে হয় না। যতদূর মনে হয় ওটা শো-অফ, ফ্লুক। কিন্তু আবারো ভুল প্রমাণিত হতে হবে আমাকে। সদরের লক ভেঙে, গভীর রাতে হানা দিল আততায়ী। জানালা দিয়ে মেলাটোনিনের মতো কোনও ঘুমের ওষুধ স্প্রে করেছিল । সকালে কাজের লোক আমাকে নগ্ন অবস্থায় মেঝেতে আবিষ্কার করে। আমার টেবিলে রাখা ছিল ইঁদুর মারার বিষ , সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছিল গলায় দেওয়ার মতো একটা মোটাসোটা রশি , আর রান্নাঘরের একগুচ্ছ ছুরি-চপার ছড়ানো ছিল আমারই বিছানায়। খবরটা বাইরে চাউর হতে পারে , এই আশঙ্কায় কিছু টাকা পয়সা দিয়ে কাজের লোকের মুখ বন্ধ রাখতে হয়।একবার নয়, এ ঘটনা ঘটল আরও কয়েকবার। আমার অবস্থা যে কতখানি ভালনারেবেল, প্রায় অসহায়ই বলা চলে, সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল ওরা। ইচ্ছে করলে একবার নয়, আমাকে খুন করতে পারে রাতের পর রাত, এই ভাবনাটাই নিঝুম ও ম্রিয়মাণ করে দেওয়ার পক্ষে ছিল যথেষ্ট। প্রায় সময়ই দেখছিলাম মৃত্যুচিন্তা দখল করে রাখছে আমায়। প্যারানয়েডের মতো আচরণ করছি। সব মিলিয়ে প্রতিকূল আবহাওয়া আমার সাহসে অনেকটাই ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে ততদিনে।অথচ লোকটা অধরা, কে সেটাই জানি না। কোন আন্দাজও লাগাতে পারি না। পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে ঘোরতর। আমার যোগাযোগে সবচেয়ে প্রভাবশালী যিনি, সেই এমএলএ সাহেবকেই গোপনে সবটা খুলে বলতে তিনি আশ্বাস দিলেন সাহায্য করবেন। উপযাচক হয়ে মৈথিলীর সাথে তাঁর লোক যোগাযোগের চেষ্টা করতেই, এমএলএর বাড়িতে ভিজিলেন্সের লোক হানা দেয়। এই দুই ঘটনার মধ্যে যোগসাজশ ছিল কিনা আমার জানা নেই , তবে এর পর থেকেই খুব অদ্ভুত ভাবে আমাকে তিনি এড়িয়ে গেছেন বারবার। লোকাল নেতাদের ধরে করেও তেমন উপকার পাই নি। কেউ যে এক সাথে অনেকগুলো কলকাঠি নাড়ছে অদৃশ্য সুতোর টানে তা ধরতে পারছিলাম, কিন্তু নিজেকে উদ্ধারের একটা ট্যাঁরাব্যাঁকা রাস্তাও নজরে ঠেকছিল না। এই দুর্দিনে কে সাহায্য করবে ? সবাই এতদিন আমার শিকার ছিল, এবার আমি শিকার হব, সেটাই সবাই তালি বাজিয়ে দেখবে। উপায় ছিল একটা - কিন্তু ডিভোর্স যে আমি দেবো না। এই কট্টর সিদ্ধান্ত থেকে এক ইঞ্চিও পিছু হটব না। অহংকার, পৌরুষ, মুর্খামি, গোঁয়ার্তুমি, আত্মহনন - যাই হোক না কেন, এই ছিল আমার সিদ্ধান্ত।সুইসাইড নোট! লেখাই যায়। আমাকে যদি খুনও হতে হয়, তাহলে কর্তৃপক্ষ জানতে পারবে কে বা কারা আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী। কিন্তু তারা খুনের শাস্তি পাবে কি ? আমি তো তখন বয়ান অনুযায়ী আত্মহত্যা করেছি। তাহলে জবানবন্দী লিখব? আমি খুন হতে পারি এই মর্মে। নাকি সোজা থানায় গিয়ে পুলিশ প্রোটেকশন চাইব? কিন্তু এ বড় কঠিন ঘাট, সেই পুলিশই যে চোরাগোপ্তা ঘাতক, তারই বা কী গ্যারান্টি!এই সময়টাতে শুধু মৃত্যুচিন্তা নয়, নিঃসঙ্গতাও পেয়ে বসছিল আমাকে। ভেবে দেখলাম আমার কোথাও যাওয়ার নেই, দিন পার করে দেওয়া ছাড়া বেঁচে থাকার কোন যথাযথ কারণ নেই। আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। বন্ধুদের সাথে দূরত্ব। দু একজন চামচা যাও বা ছিল, কটা মাসে তাদের সাথেও আলগা হয়েছে সখ্যতা। আর পাড়াতুতোরা তো এমনিতেই নাক সিটকোয়। ব্যবসাপাতি লাটে ওঠার অবস্থা। সুতরাং খদ্দেরের সাথেও চোখ চাওয়া-চাওয়ি নেই। এত একা , এতখানি বিচ্ছিন্নতা, তাও মনে হচ্ছিল, ভয়, নিঃসঙ্গতা, অবসাদ - এই তিনটে একযোগে আমার জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে গেলেও হয়তো আমি মরতে চাইব না তখনো।আমার ডিফেন্স মেকানিজম কয়েকটা মাস আমাকে কুঁকড়ে রাখল, আটকে দিল ঘরের চার দেওয়ালে। চেষ্টাও করলাম হাজার একটা উপায়ে বেঁচেবর্তে থাকার। জল কিনে খেলাম। রাঁধলাম নিজ হাতে। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য ফিট রইল মুশকো বিশ্বস্ত পাহারাদার। বাইরের দেওয়ালে গাঁথা হল সিসি ক্যামেরা। তারপর, এও যেন আরেক রেভিলিসন,আমি বেঁচে আছি একথা যেন অনুভব করছিলাম এই প্রথম, তাও আবার মৃত্যু আমার শিয়রে দাঁড়িয়েছে বলেই। এত অন্যমনস্ক হয়ে বেঁচে থেকেই বা কি প্রাপ্তি তাহলে ! মৃত্যু ভয় না থাকলে, আমি কি আবার ফিরে যাবো সেই ‘খাওয়া-শোয়ার’ যাচ্ছেতাই ছাঁচে। আনমনা দিন বইয়ে দেওয়াট যুক্তিহীন ক্লান্তিকর, যদি না সে জীবনে মোটা দাগেরও একখান তাৎপর্য থাকে - এসব ভাবনাও আমার মনের অনুর্বর জমিতে আজকাল শিকড় মিলছে। জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি মৃত্যু কি, নাকি উদ্দেশ্যহীনতা! আমার কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষ লক্ষ্যহীনতাকে পাখির চোখ করে তির মারে এবং লেগেও যায় সেই তির। আমি তাদের দলে। নিরাপত্তা আমার জীবনের অগ্রাধিকার এখন, এবং সে জীবন অতিশয়, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যাপন করেও যা পড়ে থাকছে তা তীব্র বিবমিষা এবং দীর্ঘশ্বাসের যোগফল।তাছাড়া , আমার অনুপস্থিতি কেউ লক্ষ্য করবে বলে তো মনে হয় না। আমার মৃত্যু কারোর কাছে দুঃসংবাদ হয়ে পৌঁছবে, এমন মানুষ তো আমি খুঁজে পেলাম না এই কমাসে। অপরাধবোধ বা অনুশোচনা থেকে অনুধাবন নয় , এ নেহাতই অপ্রয়োজনীয় বা বাড়তি বলে নিজেকে চিনতে শেখা । কোথাও যেন হাল ছেড়ে দিয়েছি আমি, রক্তে মন্থররা চলে এসেছে, ঝিমিয়ে পড়ছে স্নায়ু। নিয়তির সীমারেখায় পৌঁছে এই ছক্কা পাঞ্জাকে মেনে নেওয়াটাই আমার কাছে এখন স্বাভাবিক। তাই খুনখারাপি নিয়ে এখন আমার আর তেমন মাথাব্যথা নেই, তবে সেই একই কথা, মৃত্যু যন্ত্রণায় অনীহা রয়েছে। আর আপত্তি আছে ডিভোর্স পেপারে সইসাবুদে। মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণে রাজি, তবে মৈথিলীর বয়ফ্রেন্ডের হুঁশিয়ারির সামনে মাথা নোয়াতে নারাজ। তাতে যা হবে হোক।সীতারামদাকে পাওয়া গেল না। ভরসন্ধ্যায় বাড়িতে থাকার মানুষ উনি নন। মিটিং , মিছিল , শিবির এবং সমাবেশ - একটা কোথাও আছেন নিশ্চয়! ওঁর জীবনে ল্যাঠা এবং আঠা এই দুইয়েরই যুগপৎ ব্যস্ততা। পরিবার এবং পরিজনে ডুবে থাকা পরোপকারী মানুষ। আমারই উচিৎ ছিল খবর দিয়ে আসা।সীতারামদা না থাকলে কী করবো, ভেবে দেখিনি এতক্ষণ। গেটের সামনে বোকার মতন দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েকটা মুহূর্ত। মাথার মধ্যে বিচ্ছিন্ন চিন্তার অনর্গল প্রবাহ। এবং সেই চিন্তার মধ্যে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যু। মৃত্যু , যা আদপে আমাকে বাদ দিয়ে জীবনেরই একটা ধারাবাহিকতা মাত্র। আমি থাকবো না , বাকিরা থাকবে – এই দ্বিচারিতার মানে কী ? বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু যাই কোথায়? যাওয়ার গন্তব্যগুলো কবে যে এক এক করে মনের ম্যাপ থেকে মুছে গেল! তবে পা বাড়ালে, কোথাও একটা পৌঁছনটা নিশ্চিত। বাড়ির চেনা ঘেরাটোপের উদ্দেশ্যহীনতার জগতে ফিরলেই একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতার মতো শব্দগুলো ছেঁকে ধরবে।কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় সন্ধ্যারাতে টহল দেওয়াটাও কি খুব কাজের কথা হবে? তাতে কী! মৃত্যুর চৌকাঠে বসে ঢুলছি , এখন আর প্রতিরোধের সময় নয় , বরং ঘুমের ঘোরে , ভিতরে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে শরীর শিথিল করাটা আবশ্যক। নচেৎ যন্ত্রণা হয়ে উঠবে আরও বিভীষিকাময়। বিপদকে উপড়ে ফেলতে না পারি , ভয়টাকে কিছুক্ষণের জন্য অবশ করে রাখি , তাতে সুবিধা সব দিকেই। যতটুকু জীবন পড়ে আছে , মৃত্যুভয়ে সেটাকেই বা অবজ্ঞা করবো কেন।এক আচ্ছা গ্যাঁড়াকলে পড়েছি ! এত দীর্ঘ সময় বেঁচেও , মারা যেতে হবে একবারেই , কোনও কিস্তির গল্প নেই সেখানে। কী নাছোড়বান্দা নিয়ম।একটা গভীর শূন্যতার দিকে তলিয়ে যেতে যেতেই বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতে শুরু করেছিলাম , জলতরঙ্গের মতো হাসির শব্দে মুখ তুলে তাকিয়েছি। চেনা বাড়ি। রমিতদের উপরতলা থেকেই শব্দটা ভাসছে। উপরের জানালায় তাকিয়ে রইলাম এক পলক। লাল নীল আলোর ঝালর নেমেছে বারান্দা বেয়ে। পায়ের গতি শ্লথ হচ্ছে আমার। দাঁড়ালাম। ভিতরে একটা খুশির বাতাবরণ , কোন অনুষ্ঠান চলছে। এককালে এ বাড়িতে খুব যাতায়াত ছিল। রমিতের সাথে পার্টনারশিপে একটা ব্যবসা শুরু করি। বছরখানেকের মধ্যেই ভরাডুবি হয় তাতে। আমি খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হইনি যদিও, লোকসানের পুরো ওজনটাই ওর ঘাড়ে নামিয়ে দিয়ে সময়মত সরে পড়েছিলাম। আমি যেন কেমন ! ঘটনাক্রমে , আজ এই বাড়ির বাতাবরণে হাসির শব্দ শুনে ভালো লাগছে।শুধুই ভালোলাগা নয়, একেবারে অচেনা এক অনুভূতি। অস্তিত্ব লঘু হওয়ার তাগিদ, এমন কিছু যা আমি আগে কখনো অনুভব করিনি, মনে হচ্ছে আমার জীবনেও শব্দকল্লোল আছড়ে পড়বে, তবে তার সবটা জুড়ে শুধুই নীরবতা। কারণ, পরিপূর্ণ নীরবতা আসলে মৃত্যুরই শব্দ।সাপ যেমন আচমকা দংশায়, নিয়তি তেমনি আচমকা দংশেছে আমার সময়কে। প্রতিষেধক কী, জানা নেই । আছে কি আদৌ?মফঃস্বলের শেষ মাথায় একটা লেক। দোনামনা করেও ওদিকেই পা চালাচ্ছিলাম। আজ আমি বেপরোয়া। রাস্তার এক একটা বাঁকে, ঘাড় ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিচ্ছিলাম সম্ভাব্য বিপদকে, তেমন কিছু সন্দেহজনক ঠেকলে লোকালয়ের দিকে সরে যাবো। মনে তো হয় না কেউ পিছু নিয়েছে, তবে এত মানুষ, কার যে কী মতলব, তার ঠাওর করাটা কি আর চাট্টিখানি ব্যাপার, নেহাতই অসম্ভব।প্রায় পুরো লেক চক্কর দিয়ে, পশ্চিম পাড়ের একটা অন্ধকার বেঞ্চে ঝুম হয়ে বসে রইলাম। সিদ্ধান্তটা হঠকারী হল কি? হলে হবে। নিজের গতিবিধির উপর সেন্সরশিপটা যেন অসহ্য লাগছিল আজ।লেকের অন্য দিকগুলো যদিও বিক্ষিপ্ত খণ্ড অন্ধকার, এখান থেকে সাদাকালো স্বপ্ন দৃশ্যের মতো মনে হয়। বায়ুচঞ্চল লেক থেকে হাওয়া উঠে আসছে ধীর লয়ে। সন্ধ্যার পর থেকেই এই দিকটায় অসহ্য নির্জনতা। রাতের পাখিরা মাঝেসাঝে খদ্দের ধরে শরীর মেলে দেয় বেঞ্চে। কিছু পাতা খোরদেরও সমাগম হয়ে থাকে। এ তল্লাটে বিপদ হলেও কেউ বাঁচাবার নেই। মোবাইলও নেই সাথে। পাড় বরাবর হিজল গাছের কালো গুঁড়িগুলো অন্ধকারে এক একটা অদ্ভুত চেহারা নিয়েছে। আলকুশি বীজের মতন নিবিড় অন্ধকার এদিকটায়। নিয়ন আলোর কিছু দুরন্ত রেখা লেকের জলে থিরিথিরি নাচছে।ওই আলো, আমার এই জম্পেশ অন্ধকারকে ছিঁড়তে পারছে না, পারবেও না। সেই যে বিড়ালকে ফাঁসিতে চড়ানোর কথা বলেছিলাম, মনে আছে? শিশুর মধ্যে যে সহজাত নৃশংসতা , সেটা এই বয়সে পৌঁছেও আমার ভিতর থেকে যায় নি বোধহয়, বরং সদর্পে বিরাজ করেছে। উই যেমন পাতি কাঠকে কুড়ে কুড়ে খায় , নির্বিবেক আমিটাকে তেমনি ঝাঁঝরা করে দিয়েছে আমার স্বভাব এবং চরিত্রদোষ। ক্ষুদ্র অন্ধকার খুঁজতে গিয়ে প্রকাণ্ড আলোর উৎস থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছি।নাহ! এখন দার্শনিক আত্মসমীক্ষা করেও আসন্ন বিপদকে আর টলানো যাবে না! তার চেয়ে ওঠা যাক । বেশ রাত হয়েছে। কি জানি বাড়ির সামনে গিয়ে আজ হয়তো সেই পাহারাদারের মুখোমুখি হতে হবে। হোক! মনে জোর আনতে হবে। আমার কিসের ভয়, নিজের পাড়ায় লাশ ফেলবে, চালাকি নাকি! সিগারেটটা প্রায় শেষ করে এসেছি, এবার উঠবো, এমন সময় কে যেন খুক করে কাশল। বুকের ভিতরে একটা হিমের ঢিল গড়িয়ে গেল। কে ? কে আর হবে, দেখতে হবে না, সাক্ষাৎ যমদূত।এখানে আর একটা মুহূর্তও নয়, চটির গ্রিপ পায়ের আঙুলে শক্ত করে আঁকড়ে দ্রুত লম্বা পদক্ষেপে হাঁটা দিলাম। লেকের দু পাশে সারসার গাছপালা। সারা প্রাঙ্গণে ঝরা পাতার রাশি। খসখস শব্দ হচ্ছিল, কুকুর বিড়াল হলে বাঁচোয়া, মানুষেই বিপদ। পিছন ফিরে তাকাতেই মনে হল একটা ছায়ামূর্তি অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় সরে গেল।লেক ছাড়িয়ে সামনের রাস্তাতে নেমেই ভেবেছিলাম একটা টোটো অন্তত পেয়ে যাবো। কপাল খারাপ, রাস্তা শুনশান। আজ অবশ্য রবিবার, আইপিলের ফাইনাল চলছে, অন্যবার হলে আমিও জুয়ায় টাকা লাগাতাম। এ বছর অবশ্য জীবনটাকেই জুয়াতে লাগিয়ে দিয়েছি।একটা টোটো হেলতে দুলতে আসছে, - এই চালাও! ঝাঁপিয়ে উঠে পড়েছি।- কোথায়?- থানায়।টোটো সামান্য এগিয়েছি কি একটু সাহস করে মুখ ফেরাতে দেখি, লেকের মূল ফটক থেকে একটা দশাসই মূর্তি এদিকেই তাকিয়ে। শিট! এগোতে শুরু করেছে লোকটা, ঠিক এদিকেই।আতঙ্কের গলায় বললাম, - এই ভাই! একটু জোরে চালাও। এর থেকে তো হেঁটে যাওয়া ভালো।- জোর চলবে না। চার্জ নেই। তাড়া থাকলে নেমে যান।আমি নামছি না! একা রাস্তায় মরার চেয়ে, টোটোয় বসে থাকা ঢের নিরাপদের। তাছাড়া এই মাত্র মনে পড়ল, আমার পকেটে কানাকড়ি নেই। পাঞ্জাবির পকেটে একটাই দশ টাকার নোট ছিল, চায়ের দোকানে দিয়ে ফেলেছি।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার আর সাহস পাচ্ছি না, পিছু ধাওয়া যে করছে, সেটা না তাকিয়েও বলা যায়। বাজারের কোলাহলে পৌঁছতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলো ছিটিয়ে পড়লেও, বাজারহাট বন্ধ বলে অন্য দিনের তুলনায় আজ একটু আলোআঁধারি।টোটোর স্পিড আরও নেমে এলো। জবাব দেবে মনে হচ্ছে। ছোকরা ড্রাইভার হুকুম ছুঁড়ল, - নেমে যান। চার্জ শেষ।- আগে বলবে তো! কী গাড্ডায় ফেললে বলো তো! অসহায় আস্ফালনে মাথা ঝাঁকাই।- পিছনে আরেকটা আসছে!কী করে বোঝায় এ শালাকে, ওটাতে চড়ে কালান্তক যম আসছে নির্ঘাত। শালা আচ্ছা ফাঁসলাম। নেমে যাওয়াটাই কী বুদ্ধিমানের কাজ হবে? সামনেই একটা অন্ধকার গলি। কিছুটা এগিয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। তাছাড়া এই টোটোর ছোঁড়া ওদেরই লোক নয়, তাই বা কী মালুম। কথাটা মাথায় টোকা দিতেই বুক চমকে উঠল। উপায় নেই, নামতেই হবে। ছোকরাকে নামার আগে আমার পকেটের অবস্থা জানাতেই ধমকে উঠেছে সে, - টোটোতে উঠেছেন পকেট খালি রেখে! যত্তসব!আগুপিছু না ভেবে গলির অন্ধকারে ঢুকে গেলাম। ঘাপটি মেরে আছি, যদি দেখি, পিছনের টোটো থেকে সত্যিই তেমন কেউ ওখানে নামছে কিংবা এই গলির দিকে ওই ছোকরা আঙুল দেখাচ্ছে, তাহলে প্রাণপণে দৌড় লাগিয়ে পগারপার, তারপর কোথাও একটা গা ঢাকা দিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে দেওয়া। তবেই বাঁচলাম এ যাত্রা।বাঁচা কি এতই সহজ! যে প্লট রচনা হচ্ছে অলক্ষ্যে, আমার বাপ এলেও তা খণ্ডাতে পারবে না। দশাসই লোকটা শুধু নামেই নি, নিঃশব্দে গলির দিকেই এগিয়ে আসছে। ছ ফুট তিন চার ইঞ্চি তো হবেই, জলহস্তীর মতো অতিকায় অবয়ব, সাক্ষাৎ মনস্টার। আমার মাথাটা দু হাতে চেপে ধরলে ঘিলু কারোটি সমেত তাল-তোবড়া হয়ে যেতে পারে। আমার জানু দুটো কিছুক্ষণের জন্য পাষাণ হয়ে গিয়েছিল, সম্বিৎ ফিরতেই দৌড় দিলাম। কিন্তু যাবো কোথায়! কোন দিকটা মৃত্যুর আর কোনটাই বা জীবনের! আমার জন্য অবশ্য দুটোই এখন অন্ধকার। প্রভু আলো দাও! আর যদি তা না দাও, তাহলে যন্ত্রণাহীন মৃত্যু দিও।দৌড়ে কোথায় এসে উঠলাম কে জানে, এদিকটায় সব নতুন ঘরবাড়ি, আধুনিক মহল্লা। যেখানেই গিয়ে পৌঁছই, মনে হয় এখানটা নিরাপদ নয়, আরেকটু এগিয়ে যাই। এগোচ্ছি, তবে আততায়ীর থেকে দূরত্ব বাড়ছে না কমছে, তা আমার নিয়তিই বলতে পারে। পুরো পৃথিবীটাই আমার জন্য এখন আর নিরাপদ নয়। অবশ্য মানুষ বলেছে, আমিই নাকি পৃথিবীটার জন্য নিরাপদ ছিলাম না । একটা বসত বাড়ির খোলা প্রাঙ্গণে একটা ঝুপসি গাছের তলায় গুটিসুটি বসে রইলাম। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। শরীর অবসন্ন , তবে স্নায়ু টানটান। চোখ এবং কান দুইয়েরই পাল্লা বেড়ে গেছে যেন আচমকাই।অবিরাম ঢেঁকির পাড় পড়ছে বুকে। ভয়েরও কতরকম নমুনা। সবে গরম পড়ছে ,সাপ খোপের বড় বেশি উপদ্রব এই সময়টাতে। তবে সাপের বিষে আমার মরণ নেই, এর চেয়েও বিষধর জিনিস কাটবে আমায়। প্রতিষেধক ছিল, একটা সই করলেই মামলা চুকেবুকে যেত, কিন্তু সে রাস্তায় আমি ঢেঁড়া কেটে দিয়েছি।‘আউট’ বলে কেউ যেন হুঙ্কার ছাড়ল। পিলে চমকে উঠেছে। সাথে সাথেই জনাকয়েকের উল্লসিত কোরাস চিৎকার। সমবেত করতালি। গেল কেউ। কী মিল! আমিও আউট হয়ে গেছি জীবনের খেলা থেকে। মরা পিচ ছিল, সবাই সহজ শট খেলে সেঞ্চুরি হাঁকাল, আমি ট্যাড়া শটে ক্লিন বোল্ড। আম্পায়ারের দিকে তাকিয়ে আছি, যদি কোনভাবে নো বল হয়, তবে সে চান্স খুবই কম।একটা ঘোরের মধ্যে কতক্ষণ ওভাবে বসে ছিলাম হিসেব নেই। একটু আগেই দু চোখ জুড়ে শ্রান্তি নেমে আসছিল। চটকা যখন ভাঙছে আকাশে তখন আতশবাজির ঝলকানি। বুনো ফুলের গন্ধ রাতের ভেজা বাতাসে মিশে বুকের মধ্যে পাক দিয়ে যাচ্ছে।অবসন্নতার সংক্রমণ ছড়িয়ে যাচ্ছে মন থেকে শরীরে। তাও এবার উঠতেই হবে। লাইন এতক্ষণে ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ারই কথা। তবে যে পাল্লায় পড়েছি লাইনের ফিশপ্লেট খুলে রেখে গাড়ি উল্টে দিলেও অবাক হব না! এত সংকল্প এবং প্রত্যয় নিয়ে নামলে মানুষ ঈশ্বরকেও হনন করে ফেলবে তো আমি কোন ছাড়।গলি এবং তস্যগলির গোলকধাঁধা টপকে মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলাম। একটা মিষ্টি হাওয়া ছেড়েছে। এক পশলা এসে লাগল চোখেমুখে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হল এইমাত্র। এভাবে একটা বৃষ্টি এসে যদি ধুয়ে দিত আমার গ্লানি। বুকের ভিতরে একটা নির্ভরতার বাতাস যদি বয়ে যেত এভাবেই। জীবন থেকে এরকমও প্রত্যাশা ছিল আমার?আশ্চর্য!বড় রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষজন দেখে কিছুটা হলেও ফিরে পাচ্ছিলাম নিজেকে। ভিতরের চাপা উত্তেজনাটা আর যেন গুড়গুড় করে জানান দিচ্ছে না তার অস্তিত্ব। এই তো আমার চেনা পৃথিবী, এত প্রাণের চিহ্ন, এখান থেকে আজ আমাকে এই মুহূর্তে মুছে ফেলা সহজ হবে না। অন্তত আজকের রাতটা …আজকের রাতটাও যদি …পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে ফেলেছি, দেশলাই বের করবো…ঠিক তখনই একটা ভৌতিক কণ্ঠস্বর ঘাড়ের কাছে শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে বলে উঠল -, লেকের ওই দিকটায় বসতে বেশ লাগে বলুন!শিরদাঁড়ায় একটা ভারী কিছুর অস্তিত্ব। ধাতব নলের স্পর্শ বোধয়। কাঠ হয়ে যাচ্ছি। বুকটা শূন্য। একটা ভয়ের বুদবুদ অস্তিত্বের নাভিমূল থেকে বুজকুড়ি কেটে উঠে আসছে। পিছনে তাকাব না আমি , কিছুতেই না। ওই যে কিছু পথচলতি মানুষজন, ওরাই এখন আমার স্বজন- আত্মীয়, আমার ত্রাতা ভরসা। শরীরের সর্বস্ব খরচ করে আমি ওদের মাঝেই ঝাঁপিয়ে পড়ব। চেতনার জড়তা সরে গেল করজোড়ে আর্জি জানাব, - মৃত্যুদূত সব বন্ধন থেকে আমার অস্তিত্বকে ছুটি দিতে চাইছে , আজকেই। আজকের রাতটা অন্তত আমাকে অনুগ্রহ করো তোমরা … অন্তত আজকের এই রাতে আমি খুন হতে চাই না। আজ অন্তত না। আমি কি পাবো তোমাদের সমবেত করুণা? একটি রাতের জন্যও?
  • হরিদাস পালেরা...
    বৈঠকি আড্ডায় ১৩  - হীরেন সিংহরায় | বৈঠকি আড্ডায় ১৩ ভোটাভুটি খরচাপাতি পর্ব ৬ (ভোটে ) যদি লাগে টাকা , দেবে ক্রুপ দেবে থুসেন তখন বার্লিনে জার্মানির ভাবী পরিত্রাতার দুর্বার জয়রথ ছুটে চলে সারা দেশে । মন্ত্রমুগ্ধ জনতা সভায় হাজির হয় তাঁর দুটো কথা শোনার জন্য – তিনি বারবার বলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি জার্মানিকে ফিরিয়ে দেবেন তার গর্ব, ষাট লক্ষ বেকার মানুষকে দেবেন কাজের সুযোগ , দেশ গড়বেন নতুন করে । যুদ্ধে পরাজিত অপমানিত জার্মান জাতিকে দেবেন সামরিক সক্ষমতা । তারা  আবার  মাথা তুলে জগতসভায় দাঁড়াবে।  রাষ্ট্রশাসনের অধিকার পেতে হলে অন্তত ৫০.১% (অথবা ২৯১ আসন) জনমতের সমর্থন চাই । নাৎসি  ভোটের সংখ্যা ও পার্লামেন্টে সিটের সংখ্যা বাড়ে – ১৯২৪ সালে শূন্য আসন, ১৯২৮ সালে সালে ১২টি আসন ১৯৩০ সালে ১৮.৩৩% ভোট , ১০৭টি আসন । ভাইমার সংবিধানের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আইন মোতাবেক গরিষ্ঠতা  অর্জন করা  ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ।  বিশের বেশি দল : অতিবামে কমিউনিস্ট পার্টি  তার একটু ডাইনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল, অতি দক্ষিণে নাৎসি , মাঝে আছে জার্মান জাতীয় দল, ক্যাথলিক পার্টি - তারপরে আছে নানান বর্ণের দল।  নির্বাচনের আগে গঠ বন্ধনের বা নির্বাচনের পরে অন্য দলের হয়ে নির্বাচিত সদস্যকে কিনে নেবার রেওয়াজ নেই। একমাত্র গতি সম চিন্তক বা কাছাকাছি চিন্তক দল গুলির সঙ্গে জোট বাঁধা – কোয়ালিশন সেটাও ধোপে টেকে না, দিন দুয়েক  বাদে ঝগড়া ঝাঁটি শুরু হয়ে যায়।  তখন ফিল্ড মার্শাল রাষ্ট্রপতি হিনডেনবুরগ ফিল্ডে নামেন ।আনুপাতিক নির্বাচনের ঝামেলা থেকে বেরিয়ে দেশের হাওয়া কোনদিকে বইছে বুঝতে চাইলেন পরিত্রাতা আডলফ হিটলার :  ১৯৩২ সালের মার্চে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে  তিনি  ফিল্ড মার্শাল পাউল ফন হিনডেনবুরগের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তার আগে অবশ্য একটা ছোট্ট কাজ বাকি । তাঁর চোদ্দ পুরুষে কেউ জার্মান ছিলেন না, এই পবিত্র ভূখণ্ডে কেউ কখনো বসবাস অবধি করেন নি,  হিটলার স্বয়ং বে আইনি ভাবে । ১৯১৪ সালে যুদ্ধের বাজারে  সালে ব্যাভেরিয়ান সৈন্য বাহিনিতে ঢুকে পড়েছেন সেদিন কেউ কাগজ দেখতে চায় নি । এখন তিনি চাইছেন জার্মান পাসপোর্ট, নইলে দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া যায় না। কাগজে কলমে জার্মান নাগরিকত্ব অর্জন করলেন , বেআইনি ভাবে হলেও জার্মানিতে বাস করেছেন সেই সুবাদে ।  এন আর সি , সি এ এ টাইপের ঝামেলা কি ভাগ্যে তখন জার্মানিতে ছিল না  ।৫৪% ভোট পেয়ে হিনডেনবুরগ বিজয়ী হলেন , হিটলার পেলেন ৩৭% ভোট , কমিউনিস্ট পার্টি,   মরিয়া না মরে , তাঁদের নেতা থলমান পেলেন ১১% ভোট।  এবার উৎসাহিত হয়ে নাৎসি পার্টি লড়ল ১৯৩২ সালের পার্লামেন্ট ইলেকশন – পার্টির নামে নয়,  “ সব ক্ষমতা আডলফ হিটলারকে “ “ এক দেশ এক নেতা “ এই স্লোগানে পার্টির চেয়ে অনেক বড়ো তাঁদেরএবার  ৩৭% ভোট, ২৩০টি আসন পেয়ে  নাৎসি পার্টি দল কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠ নয় , পার্লামেন্টে কোন আইন পাস করা হয় না;  সম্ভব নয় । কয়েক  বছর যাবত প্রেসিডেন্ট  হিনডেনবুরগ ভাইমার সংবিধানে প্রদত্ত সেই অমোঘ অস্ত্র আর্টিকেল ৪৮ অনুযায়ী ( দেশ চালনা , নাগরিকদের সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষার  প্রয়োজন বোধে রাষ্ট্রপতি ডিক্রি জারি করতে পারেন- পার্লামেন্টের অনুমোদন ব্যতিরেকে ) কাজ সামলাচ্ছেন । চ্যান্সেলর বদলাতে থাকে : সেন্টার পার্টির ভিলহেলম মার্ক্স ( দু বছর , না তিনি সেই  মার্ক্সের আত্মীয়  নন ) , সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের হ্যারমান ম্যুলার (দেড় বছর ), সেন্টার পার্টির হাইনরিখ ব্র্যুনিং (দু বছর ) ,  নির্দলীয় ফ্রান্তস ফন পাপেন (ছ মাস )ফ্রন্ট স্টেজ – ডান দিকের উইং দিয়ে এবার যিনি প্রবেশ করলেন তাঁর নাম জার্মান রাজনীতির ইতিহাসে চিরদিন জড়িয়ে থাকবে আডলফ হিটলার ও নাৎসি অভ্যুদয়ের সঙ্গে।জেনারাল কুরট ফারদিনান্দ ফ্রিডরিখ হ্যারমান ফন শ্লাইখারনির্দলীয় কিন্তু জার্মান পিপলস পার্টি সমর্থিত রাইখসটাগ সদস্য জেনারাল ফন শ্লাইখার পুতুল নাচানোয় হাত পাকিয়েছিলেন ।  যুদ্ধ লড়েছিলেন অফিসে বসে , যুদ্ধ মন্ত্রকের মন্ত্রী হিসেবে।  প্রথমে ছিলেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট কিন্তু তাদের  যুদ্ধ বিরোধী ও শান্তি সন্ধানী মনোভাবের কারণে সে দল ত্যাগ করেন । ভয়ানক ভাবে অ্যান্টি কমিউনিস্ট ; খুঁজছিলেন কোন প্রখর জাতীয়তাবাদী পার্টি যারা ভাইমার সংবিধানকে কলা দেখিয়ে সেনা বাহিনী গড়ে তুলতে সাহায্য করবে  :তিনি ঝুঁকলেন নাৎসি পার্টির দিকে ।১৯৩০ থেকে কোন দলের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই – অশীতিপর  ফিল্ড মার্শাল পাউল ফন হিনডেনবুরগ দেশ চালান ধারা ৪৮ অনুযায়ী; এবার ফন শ্লাইখার মনে করিয়ে দিয়ে বললেন,  মাইন হের  ফিল্ডমার্শাল , আপনার হাতে যে আরও দুটো ধারা রয়েছে !  ধারা ৫৩ অনুযায়ী ইচ্ছেমত চ্যান্সেলর নিয়োগ করতে পারেন , রাইখসটাগ তার বিরোধিতা করলে  ২৫ নম্বর ধারা মাফিক আপনি রাইখসটাগকে ডিসমিস করতেও পারেন । ফন শ্লাইখার কল কাঠি নেড়ে সেন্টার পার্টির চ্যান্সেলর  ব্র্যুনিং,  সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ম্যুলার এবং সব শেষে ফন পাপেনকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিজে চ্যান্সেলর বনলেন – ৩ ডিসেম্বর ১৯৩২ ।  এতদিন পুতুল নাচাচ্ছিলেন এবার বাঘের ওপরে সওয়ার হয়ে বুঝলেন  প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রি দিয়ে এই জানোয়ারকে সামলানো শক্ত ।  তার ওপর নিজের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না । এবারে চেষ্টা করলেন নাৎসি পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করতে।  কিন্তু আডলফ হিটলার নয়, তাঁর সহকারী গ্রেগর স্ত্রাসারকে দলে এনে একটা কোয়ালিশন গড়ে তোলবার ।  তাতে স্ত্রাসারের পার্টি রাজি না হলে কমিউনিস্ট বাদে অন্য পার্টিদের নিয়ে একটা কোয়ালিশন বানানো যাবে মানে থার্ড ফ্রন্ট !   খবরটা কানে আসা মাত্র হিটলার বললেন, সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই বটে কিন্তু আমার দল রাইখস্টাগে বৃহত্তম – চ্যান্সেলর হবার অধিকার একমাত্র আমার।ফন শ্লাইখার হিনডেনবুরগকে বললেন আপনি দফা ২৫ মাফিক রাইখস্টাগকে বরখাস্ত করে নিজেই রাষ্ট্র শাসন করুন না হয় , সংবিধান সে অধিকার তো আপনাকে দিয়েছে।  রণক্লান্ত ফিল্ড মার্শাল বললেন, বার  দুয়েক করেছি  আর সে ঝামেলায় যেতে চাই না । শরীরে কুলোবে না । বরং দফা ৫৩ মেনে কাউকে চ্যান্সেলর বানাতে পারি।  পুতুল নাচিয়ে অভ্যস্ত জেনারাল ফন শ্লাইখার প্রস্তাব দিলেন ‘ তাহলে হের হিটলারকে কাজটা দিন; তাঁর দলের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নেই। রাইখস্টাগে বিল পাস করাতে গেলে জার্মান পিপলস পার্টির সঙ্গে একসাথে কাজ করতে হবে।  সে দলের নেতা আলফ্রেড হুগেনবেরগ আর আমি হিটলারকে সামলে রাখব ।১৯৩১ সালে প্রথমবার হিটলারের সঙ্গে মিটিঙের পর  থেকে ফিল্ড মার্শাল হিনডেনবুরগ হিটলারকে  ‘ ঐ অস্ট্রিয়ান কর্পোরাল’  , ‘ বোহেমিয়ান কর্পোরাল’  বলে  তুচ্ছ তাচ্ছিল্য এবং তাঁর অস্ট্রিয়ান ডায়ালেকটে জার্মান শুনে হাসি ঠাট্টা করে এসেছেন। হিটলার জনান্তিকে ফিল্ড মার্শালকে বৃদ্ধ ভাম (আলটার ইডিয়ট) আখ্যা দিতে ছাড়েন নি।ছাব্বিশে জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে যখন সাংবিধানিক অনিশ্চয়তা তুঙ্গে  তখনও হিনডেনবুরগ এক মিটিঙে বলেছিলেন , ভদ্রমহোদয়গণ আপনারা নিশ্চয় আশা করেন না যে আমি সেই অস্ট্রিয়ান কর্পোরালের হাতে দেশ চালানোর দায়িত্ব তুলে দেবো ?এবারে গতি না দেখে বললেন, কি দুর্গতি , শেষ পর্যন্ত সেই অস্ট্রিয়ান কর্পোরাল হবে জার্মানির চ্যান্সেলর ?ফন শ্লাইখার অভয় দিলেন তাকে বশে রাখার ভারটা আমার ওপরে ছেড়ে দিন -হিটলার একা শাসন করবেন না, ফন পাপেনকে  ভাইস চ্যান্সেলর ঘোষণা  করুন।   নাৎসি পার্টিকে তিনটে বেশি ক্যাবিনেট পোস্ট দেওয়া হবে না-।  তবে হ্যারমান গোয়েরিঙকে প্রাশিয়ার হোম মিনিস্টার করা বাদে আর  কোন দাবি হিটলার জানাবেন না । আর তিনি চাইলেই বা শুনছে কে ? ।হিনডেনবুরগের দোলাচল চিত্তের  ধন্দ মিটল যখন জার্মান শিল্পপতিরা সরাসরি তাঁকে একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন“ দেশের চ্যান্সেলরের কাজটা এই মুহূর্তে সহজ নয় কিন্তু এই কঠিন সময়ে জার্মান শিল্পসঙ্ঘ হিটলারের পাশে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াবে । “১৯৩১ সালের সাতাশে জানুয়ারি ডুসেলডরফের ইন্ডাস্ট্রি ক্লাবে ফ্রিতস থুসেন যাকে জার্মানির পরিত্রাতা বলে সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন এবং সমবেত শিল্পপতিদের সামনে জার্মানির এক  উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিকে এক সূত্রে বেঁধে দেওয়ার স্বপ্ন যিনি দেখিয়েছিলেন সেই আডলফ হিটলারকে নিঃশর্ত সমর্থন  জানালেন জার্মান বাণিজ্যিক জগতের নেতৃবৃন্দ ।তবে তাই হোক ।সোমবার তিরিশে জানুয়ারি ১৯৩৩:  ছিয়াশি বছরের ফিল্ড মার্শাল রাইখস্টাগে সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রমাণের প্রয়োজন  সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভাইমার সংবিধানের পঁচিশ  নম্বর ধারার বলে কম্পিত হস্তে সই করে অস্ট্রিয়ান  কর্পোরাল আডলফ হিটলারকে জার্মান চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত করলেন ।ভিলহেলম স্ত্রাসের ব্যালকনিতে বিজয়ী নেতা  গ্রহন লাগার আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট  বিশ্ববিদ্যালয় , জুন ১৯৩২ বিশ্ববিদ্যালয় দরজা বন্ধ । এটা কোন ছুটির দিন তো নয় ? খুব বেশি গরম পড়েছে তাই ? না, তাও নয় ।কিছু ছাত্র ব্রাউন নাৎসি ইউনিফরম পরে ক্লাসে আসতে চেয়েছিল ।  রেকটর বলেছেন এটা পাঠাভ্যাসের পুণ্যভূমি,  পলিটিকসের নয় । তৎক্ষণাৎ নাৎসি ইউনিফরম ধারী ছাত্ররা ‘ আমাদের পতাকা উঁচুতে থাকবে’  গান গেয়ে ভাঙচুর শুরু করে।  রেকটর বিশ্ববিদ্যালয়ের দরোজা বন্ধ করে দেন।  দু দিন বাদে খুলতে হয়। । কালক্রমে  হাইডেলবেরগ হামবুর্গ মিউনিক কোয়েনিগসবেরগ মারবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়ে , হানোভার ব্রাউনশোআইগের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ – সর্বত্র একই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হবে ।প্রাশিয়ান পার্লামেন্ট , মে ২৫ , ১৯৩২ এক ন্যাশনাল সোশ্যালিসট ডেপুটি প্রাশিয়ান স্টেট অ্যাটর্নির পদত্যাগ দাবি করলেন – তাঁর অপরাধ ? সেই অ্যাটর্নি কয়েকজন নাৎসি সদস্যকে হত্যার অভিযোগে  দোষী  সাব্যস্ত করেছেন।  এক কমিউনিস্ট ডেপুটি যেই বলেছেন ‘ নাৎসিদের দল তো  খুনিতে ভর্তি’,  অমনি তুলকালাম কাণ্ড । হাতাহাতি মারামারি ভাঙচুর চলল । কারো কোন শাস্তি হয় নি ।  এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকদিন বাদে সেই কাণ্ডের নেতা এক ন্যাশনাল সোশ্যালিসট ডেপুটিকে ভবিষ্যতে পার্লামেন্টে শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব দেওয়া হলো ।শোয়াইডনিতস , ১৯৩২ অস্ত্র নিয়ে হাঁটার অপরাধে পল ক্লিঙ্গেল নামের এক  কমিউনিস্ট পার্টি মেম্বারের পনেরো মাস কারাদণ্ড হলো।জনা দশেক নাৎসি মিলে বাঙ্কাউ গ্রামে বাশি নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করলে বিচারক তাদের বিনা শর্তে মুক্তি দিলেন – বাশি লোকটির চাল চলন সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল।মানহাইম , ১৯৩১ চারজন ন্যাশনাল সোশ্যালিসট বোমা সহ ধরা পড়লে মহামান্য কোর্ট তাদের বেকসুর খালাস করে দেন- তাদের স্বাস্থ্য খারাপ বলে ।বার্লিন,  ১৯৩২ ১৯৩১ সালে চ্যান্সেলর ব্র্যুনিং শান্তি বজায় রাখতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পথ চলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন । কিছু এই অভিযোগে ধৃত কয়েকজন ন্যাশনাল সোশ্যালিসট সদস্যের বিচারে  জার্মান সুপ্রিম কোর্ট ( রাইখসগেরিখট ) যুগান্তকারী রায় দিলেন – কোন মানুষ যদি মনে করেন তাঁরা পথে ঘাটে আক্রান্ত হতে পারেন তাহলে আত্মরক্ষার্থে যে কোন প্রকারের আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করতে পারেন।( আমেরিকান  সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী – রাইট টু ক্যারি আর্মস ভাইমার সংবিধানে তার প্রণিধান ছিল না )বয়থেন, সাইলেসিয়া  ( অধুনা বিটম, পোল্যান্ড ) ১৯৩২ এক কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে খুন করা হলো সাইলেশিয়ার পাবলিক অ্যাটর্নি বারন ফন স্টাইনেকার বিচারকদের প্রতি অনুরোধ জানালেন তাঁরা যেন দু ধরনের অপরাধের পার্থক্য বিবেচনা করে শাস্তি দেন – কম্যুনিস্টরা রাইখের সম্পদ এবং সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়, এই ন্যাশনাল সোশ্যালিসট কর্মীদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষা করা ।নাৎসিদের ক্ষমতায় আসতে এখনও বছর বাকি তখন হাটে বাজারে তিনি  দেখান ম্যাজিক লুকিয়ে চক এবং ডাস্টার কে কত ভোট পেলো তার খবর রাখে কে ? সারা দেশ তখন স্বপ্ন বিক্রেতা এক  জাদুকরের খেলা দেখছে, শুনছে।পার্টি মিটিং ১৯৩২মঞ্চের  প্রশ্ন / জনতার উত্তর আডলফ হিটলার আমাদের কাছে কিসের প্রতীক ?একটি বিশ্বাসের।  আর ?শেষ আশা।  আর ?আমাদের একমাত্র নেতা ! সামরিক ব্যান্ড বাজে । এবার নেতা মঞ্চে উঠে দাঁড়ান।  মিনিট খানেকের  নিস্তব্ধতা । তারপর তিনি বলা শুরু করেন কর্কশ কণ্ঠ, সুর কঠোর ।এক ঘণ্টা , দু ঘণ্টা , চার ঘণ্টাজনতা তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দকে আঁকড়ে ধরে । তাদের নিজস্ব ভাবনা চিন্তা লুপ্ত হয়েছে ।নেতা একবার থামেন । জনতা দাবি করে আরও কিছু বলুন,  আগে কহ আর ।তিনি বলে চলেন , তার খানিক সত্য , বাকিটা  সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ;  কিছু আজগুবি কাহিনি, কিছু অসত্য নাটক ।কখনো তাঁর কণ্ঠে বজ্র নির্ঘোষ , কখনো তিনি দু হাত জোড় করে অনুনয় বিনয় করেন ।কখনো কেঁদে ফেলেন ।তিনি সর্বদা প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন- কমিউনিস্ট , ইহুদি, বিদেশি । তিনি কখনো কোন বিশ্লেষণ করেন না , বিতর্কে যান না। কোন তথ্য , কোন প্রমাণিত সত্য  তাঁর  ভাবনার পথে বাধা হতে পারে না ।  তাঁর  মন্তব্যই  শেষ কথা।  সাধারণ মানুষের খুব কাছে পৌঁছে যান ।  যেন অত্যন্ত গোপন কথা তাঁদের সঙ্গে যেন ভাগ করে নিচ্ছেন , এমন ভাবে বলেন,“ বন্ধুগণ , আমাদের পরিকল্পনা প্রোগ্রাম নিয়ে কোন আলোচনা আমি এখানে করবো না । আপনারা অন্তরে অন্তরে তো  ঠিকই জানেন ক্ষমতায় এলে আমরা কি করবো ।“লক্ষ কি ?এক   বিপক্ষ এবং সকল প্রতিরোধকে  নির্মূলে বিনাশ করাদুই    ভাইমারে তৈরি  সাংবিধানিক বেড়াজাল চূর্ণ করাতিন   এমন এক দেশ গঠন করা যা  হবে হাজার বছর স্থায়ী তৃতীয় সাম্রাজ্য (        থার্ড রাইখ )  আম জনতা সম্মোহিত - হিটলার যখন বলছেন , ভেবে চিন্তেই বলছেন ।  পু: এমন ভাবা সম্পূর্ণ ভুল যে কোন একজন মানুষ জার্মান জাতির ওপরে একনায়কত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন.  জার্মান জাতির বিচিত্রতা গণতন্ত্রের দাবি রাখে - বেনো রাইফেনবের্গ .ফ্রান্কফুর্টার তসাইটুং জানুয়ারি ১৯৩৩  ঋণ  স্বীকারজার্মানি পুটস দি ক্লক ব্যাক                  এডগার মাউরারনাৎসি বিলিওনেয়ারস                         দাভিদ দে ইয়ং  
    যদি ডাকে লিন্ডসে ! - সমরেশ মুখার্জী |  উপরোক্ত ছবিতে তার RV’র (Recreational Vehicle) সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে লিন্ডসে। ওর মতো কিছু Free Spirited Traveler দের পোষ্ট করা এমন সব YT ভিডিও আমি মাঝে মধ‍্যে দেখি। তাদের কেউ সোলো, কেউ স্বামী স্ত্রী, একটি পিতা পুত্রের টিম‌ও আছে। ৪০% কাস্টমস ডিউটি দিয়ে আমদানি করে প্রায় ৩ কোটি টাকা দিয়ে Airstream Atlas Camper বা ১৮ কোটি দিয়ে Earthroamer XV-HD RV কেনার ক্ষমতা কেন - স্বপ্ন‌ও আমার নেই। ভিডিও দেখে দুধের সাধ ঘোলে মেটার কথা‌ নয়। তবু দেখি। সাধ না মিটিলে‌ও আনন্দ হয় দৃশ‍্যসুখে। 4x4 ডজ স‍্যাসীতে Overland Explorer কেবিন ফিট করে লিন্ডসে চার বছর ধরে একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে যেদিকে দুচোখ যায় মোডে। ঐ গাড়িঘরে বাস করেই স‍্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ডের মাধ‍্যমে ও প্রত‍্যন্ত জায়গা থেকেও আপেল ল‍্যাপটপে ওর কনসাইনমেন্ট শিপিং‌য়ের  ব‍্যবসাও চালিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ-দশের ঢ‍্যাঙা লিন্ডসের সংকল্পের তারিফ করতেই হয়। শুরুটা ও করেছিল একটা Airstream compact RV দিয়ে। ডজের পিঠে OE Cabin ফিট করা ওর অভিজ্ঞ হয়ে নেওয়া পরবর্তী পদক্ষেপ।ভাবছি‌লাম লিন্ডসেকে একটা মেল করবো। বলবো আমার‌ও আছে পচুর অবসর আর এমন কাছাখোলা মোডে বেড়ানোর খুব ইচ্ছে। আমাকে ডেকেই দ‍্যাখোনা একবার, মাইনে নয়, পরা নয়, কেবল খেতে দিলেই হবে। গাড়ি‌ও খারাপ চালাই না। ওটা আমার প‍্যাশন। হিমালয়, পশ্চিম‌ঘাটের পাহাড়ে‌ও চালিয়ে‌ছি। কখনো চাইলে - তোমায় একটু রিলিফ দিতে - ধরতে পারি ঐ দুম্বো গাড়ি‌র স্টিয়ারিং। অবশ‍্য‌ ওদেশে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তো আমার নেই। তাই চালাতে পারি বিরান কোনো জায়গায় অফ রোডে - যেখানে লালমুখো কপ এসে খপ করে ধরবে না আমায়। শোবো‌ও না তোমার চলমান ঘরের শয‍্যাকক্ষে। তুমি তোমার আপেল খুলে আঙুল চালিয়ে করবে বাণিজ্য। আমি শোবো ড্রাইভিং কেবিনের পিছনে টানা সীটে। আমি‌ও পাঁচ দশ - না হয় শুতে হবে একটু পা মুড়ে। তাতে কী?  ওভাবে তো একদা ছিলাম দশমাস - মাস তিনেকে কী‌ই বা এসে যায়? এমনি‌তেও মার্কিন অভিবাসন দপ্তর ছমাসের বেশী ট‍্যূরিস্ট ভিসায় ওদেশে থাকতে দেবে না।লিন্ডসের বিচরণ ক্ষেত্র মূলতঃ আমেরিকার পূর্ব উপকূলে। প‍্যাসিফিক ওয়েস্ট কোস্টে থাকে আমার এক অতীত বান্ধবী। অনেক‌দিন হয়ে গেল সে ওদেশে‌র নাগরিক হয়ে গেছে। বহুবার কল্পনায় শুনেছি ওর ডাক - "চলে আয় কদিনের জন‍্য এখানে - থাকবি আমার বাড়ি - শুবি আমার পাশে গেস্ট‌ রুমে। চুটিয়ে ঘুরবো দুজনে আমার MDX Acura SUVতে বা Lexus 350তে। আমার বরটা একটা বেরসিক - থাকবে ও আপেল খুলে কাজে মজে।"কোনো সকালে‌ই সে ডাক আসে নি। তাই যাওয়া‌ও হয়ে ওঠেনি। জীবনে বহু দিবাস্বপ্ন‌ই বাস্তবে সত‍্য হয় না। তা বলে কী কল্পনা‌বিলাসী মানুষ ভাবের ঘোরে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করে দেবে? আমি‌ও দিইনি। বরং আজ‌ও আশায় থাকি, সকাল গড়িয়ে দুপুর চলে গেলেও কেউ হয়তো কখনো ডাক দেবে গোধূলী‌তে - রাত্রি নামার আগে। সে হতে পারে বন্ধু বা পুত্র বা পরিচিত।। যদি আসে লিন্ডসের মতো সম্পূর্ণ অপরিচিত কারুর এমন একটা দিলখুশ করা মেল - আহা তা হবে হাতে চাঁদ পাওয়া।"চলে এসো সৌমেন - ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। যদি পারো হাত লাগাতে ফুটো টায়ার বদলাতে, ছাদে উঠে সোলার প‍্যানেল পরিস্কার করতে, খালি করতে ৪০ কিলোর গ্ৰে ওয়াটার ট‍্যাঙ্ক, মাঝে মধ‍্যে চলঘরের একটু সাফ সাফাই, কিছু DIY যোগাড়েপনা তাহলে তো খুবই ভালো। মনে হয় সুখী টাইপের নিষ্কর্মার ঢেঁকি তুমি ন‌ও - না হলে বুড়ো বয়সে একা একা ব‍্যাকপাকার স্টাইলে ঘুরে বেড়াতে না। এলে যতটুকু পারবে - ততটুকু‌ই সাহায্য করবে। আসবে তুমি ইস্ট কোস্টে - একটু আগে জানি‌য়ে - তখন আমি জর্জিয়া, মেইন, মেরিল‍্যান্ড, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক‍্যারোলাইনা যেখানেই থাকি। খামোখা পশ্চিম উপকূলে একদা বান্ধবী‌র কাছে কদিনের জন‍্য গিয়ে কী করবে? অতীত সুরের সাথে বর্তমান ছন্দ মিলবে না। তাল কেটে মন খারাপ হবে। মনে রেখো It is not wise to travel down the memory lane. Take it easy. Take care, Lindsey" Airstream Atlas 2020  Side Extension feature সহ এটি একটি HiFi আইটেম - তাই ওদেশে এর দাম প্রায় ২.৪ লাখ ডলার - ভারতীয় মূদ্রায় ২ কোটি - ৪০% কাস্টম ডিউটি সহ ৩ কোটি। তবে লিন্ডসে হয়তো শুরু করেছিল কোনো Compact Airstream RV দিয়ে তবে ১৭ লাখ ডলারের Earth Roamer XV-HD RV সম্প্রদায়ের বড়দা। এতে ছজন দিব‍্যি শুতে পারে। দূর্ঘটনা না হলে বিজ্ঞাপিত বলা আছে এর আয়ু  ৯০ বছর। Ford F-750 স‍্যাসীতে 6700 CC / 330 HP / 4x4 ইঞ্জিনের তাকতে ইনি যে কোনো ঋতু‌তে পাঁচপেঁচিদের অগ‍ম‍্য স্থানেও চলে যেতে সক্ষম। দাম কী এর এমনি নিচ্ছে? ভারতে এনাকে‌ই বরণ করতে প্রায় ২০ কোটি খসাতে হবে বলেছিলাম শুরুতে। তবে এতে থাকলে মনে‌ই হবে না আছো  চলমান বাড়িতেরান্না বান্না করে খাও আরামসেবা লিভিং রুমে মজাসে আড্ডা মারো ছ’জনে 
    বৈঠকি আড্ডায় ১২  - হীরেন সিংহরায় | ভোটাভুটি খরচাপাতি পর্ব ৬ (ভোটে)  যদি  লাগে টাকা,  দেবে ক্রুপ দেবে থুসেন ৯ নভেম্বর ১৯১৮ সালে বার্লিনে অনধের নগরী,  চৌপট রাজা ।নৌ বিদ্রোহ বন্দরে বন্দরে , ভিলহেলমসহাফেন , কীল , হামবুর্গ থেকে নৌসেনা হাঁটছেন বার্লিনের দিকে;   মিউনিক এমনকি  বার্লিনের নয় কোয়লন নিজেদের স্বাধীন রিপাবলিক বলে ঘোষণা করেছে -  পার্লামেন্টের  সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতৃত্ব তাদের দাবিতে অনড় , সম্রাটের পদত্যাগ চাই । ৯ নভেম্বর ১৯১৮ সকাল এগারোটায় বেলজিয়ামের স্পা থেকে টেলিফোন বার্তায়  সম্রাট ভিলহেলম তাঁর পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে ট্রেনে চড়ে  নিরপেক্ষ হল্যান্ডের ডুরণ রওয়ানা হলেন ; আর কোন দিন জার্মানিতে পা দেবেন না , বত্রিশ বছর বাদে ভগ্ন মনোরথ সম্রাট সেখানেই ধরণী থেকে  চির বিদায় নেবেন।বার্লিনে রাইখসটাগেরসামনে সমবেত জনতা উত্তাল- এবার তাহলে কি ? পার্লামেন্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট মন্ত্রী ফিলিপ শাইডেমান সমবেত জনতাকে বললেন“ হোহেনজোলারন সম্রাট পদত্যাগ করেছেন । এই দিনটি জার্মান ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে । জার্মান প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক ।এগারোই নভেম্বর এগারোটা বেজে এগারো মিনিটে প্যারিসের সত্তর মাইল উত্তর পূর্বে কম্পিয়েনে এক নির্জন বনের মাঝে টেনে আনা মার্শাল ফখের নিজস্ব ট্রেনের বগিতে জার্মানি  স্বাক্ষর করলো  সন্ধিচুক্তি-  পশ্চিম রণাঙ্গন হলো নিশ্চুপ।  শুরু হলো নভেম্বর বিপ্লব , পুলিশ দফতর দখল, যুদ্ধ ফেরত ফৌজ – ফ্রাইকরপস - বনাম কমিউনিস্ট বিপ্লবী,  স্পারটাসিসট , রোজা লুকসেমবুরগ কার্ল লিবককনেখট – যারা চাইলেন রাশিয়ান স্টাইলে সোভিয়েত গড়ে তুলতে।  খুন কা বদলা খুন মুখোমুখি লড়াইয়ে জিতল সরকারি সেনা; পথে পথে রক্তাক্ত অভিযান । ইতিমধ্যে দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে থাকে পাড়া।  সরকার প্রাগে পলাতক। জানুয়ারি মাসে বার্লিন থেকে নিরাপদ দূরত্বে , ভাইমারে নতুন সংবিধান রচিত হলো , জার্মানির ইতিহাসে গণতন্ত্রের প্রথম অভিষেক – অজানা অচেনা পথে একটা দেশের প্রথম পদক্ষেপ। এতদিন দেশটা চালিয়েছেন অভিজাত সমাজ এবং বনেদী জমিদারবর্গ ( ইউঙ্কার )  সেখান থেকে এসেছেন সেনাপতি , বিচারপতি ,সমাজপতি এবং অনেক শিল্পপতি। ।এখন এই নতুন ব্যবস্থায় প্রধান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ এবারট , তাঁর বাবা ঘোড়ার জিন বানাতেন।গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন এবং সেটি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হিসেবে – ষাট হাজার ভোট পেলে একটি সিট।  ১৯২০ সালর নির্বাচনে ছাব্বিশটি দল , আশি শতাংশ নাগরিক ভোট দিলেন । নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা মানে ৫০.১% ভোট কোন দল পেলেন না – সবচেয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠিত পার্টি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল ৩৮%, আসন সংখ্যা ১০৩ ।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় কোন জার্মান শহর গ্রামের ওপরে বোমা বর্ষণ হয় নি , শত্রু সৈন্য দেখা দেয় নি দুয়োরে। তাবৎ পরিকাঠামো,  রুর এলাকার কয়লাখনি ইস্পাত কারখানা বার্লিনের ব্যাঙ্ক মিউনিকের ব্রুয়ারি হামবুর্গ ব্রেমেনের জাহাজ কারখানা অক্ষত অটুট ।  ডুসেলডরফ কলোন ডরটমুণ্ডের শিল্পপতিরা যুদ্ধে হারান নি কোন সম্পদ কিন্তু বিজয়ী পক্ষ চাইছেন ক্ষতিপূরণ ( রেপারেশন )-সেটা আসবে তাঁদের ট্যাঁক থেকে।  ফ্রান্স বেলজিয়াম তাদের সেনা বসিয়ে রেখেছে রাইনল্যান্ডে , কারখানার দরোজায়, খনির মুখে । দেশে নিরঙ্কুশ অরাজকতা , কমিউনিস্টরা ট্রেড ইউনিয়নকে হাওয়া দিচ্ছে-  আমাদের দাবি মানতে হবে ঝাণ্ডা তুলে হেড অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন বিক্ষুদ্ধ জনতা । এবং স্ট্রাইক!   প্রাশিয়ান আমলে যা  ছিল অকল্পনীয় । দেশ চলত  একটা কঠোর ডিসিপ্লিনের শেকলে -সমাজে কারখানায় অফিসে সকলের স্থান ছিল নির্দিষ্ট।  সবাই তা মানতেন, সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই !  কোন বিকল্প ছিল নাঅন্য দেশের রাষ্ট্রীয় সৈন্য বাহিনী থাকে; প্রাশিয়াতে রাষ্ট্রীয় সৈন্য বাহিনীর একটা দেশ ছিল।*জার্মান শিল্পপতিরা কখনো শ্রমিক নেতার মুখোমুখি বসেন নি , সেটা সামলাত স্থানীয় প্রশাসন -বেতনের দাবিতে কেউ অফিসের সামনে দাঁড়ায় নি , জমিদাররা ভূমিহীন কৃষকদের যেমন ইচ্ছে এমনি মজুরি দিয়েছেন। । যুদ্ধের পরে এই এলোমেলো অবস্থার সুযোগে গড়ে উঠেছে কমিউনিস্ট পার্টি যারা রাশিয়ান কায়দার সোভিয়েত বানাতে বদ্ধ পরিকর।  সেটা ব্যর্থ হল এক বছর বাদে কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি খুঁটি গেড়ে বসল , পার্লামেন্টের ভোটে প্রার্থী দিলো ।  রুর বার্লিনের বিজনেস ম্যাগনেটরা কথা বলবেন কার সঙ্গে?তাঁদের আতঙ্ক কমিউনিস্টরা এবার শ্রেণি সংগ্রাম শুরু করবে , তার মানে শিল্পে অশান্তি, খরচা বেশি , বোর্ডরুমে কমিউনিস্ট কর্মীদের অনধিকার প্রবেশ। তাদের ঠেকায় কে ?  সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকের রক্ষা করেছেন কিন্তু এই আগ্রাসী শ্রমিকদের হাত থেকে শিল্পপতিদের রক্ষা করে কে ?  তাঁরা চান রাজনৈতিক স্থিরতা এবং শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখা-যেটা প্রাশিয়ান সরকার করে এসেছেন। তারই ছত্রছায়ায় জার্মান শিল্প, বাণিজ্য অতি দ্রুত উন্নতি করে দুনিয়ার ঈর্ষা অর্জন করেছে। আজ এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁরা খুঁজছেন একজন বিশ্বাসযোগ্য শক্ত রাজনৈতিক নেতা যার সঙ্গে   এই সফল  ধনী ব্যবসায়ীরা আলোচনায় বসে একটা বন্দোবস্ত করতে পারেন – সার  আপনি আমার কেসটা দেখুন আমি আপনার ব্যপারটা সামলে দেবো। নৈরাজ্য তখন এমন পর্যায়ে যে জার্মানির অন্যতম ধনী ব্যক্তি ফ্রিতস থুসেন ফ্রান্সের নরমান্দিতে তাঁর বাবার কয়লাখনির মালিকানা পাবার অভিলাষে শত্রুদেশ ফ্রান্সের নাগরিকত্ব নিতেও প্রস্তুত।নির্বাচন হয়, কোন দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় না।  কার সঙ্গে হাত মেলাবেন তাঁরা ? এলো অকল্পনীয় মুদ্রাস্ফীতি , আম জনতা হারালেন তাঁদের সঞ্চয় ; কিন্তু রুর মিউনিক বার্লিনের ধনপতিদের  সম্পদ অটুট  তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ গেলেন আমেরিকা- সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যের কি হালচাল ? নতুন নতুন যন্ত্রপাতি , কর্ম মুখর কল কারখানা দেখে চমকিত হয়ে দেশে ফিরে বললেন তাঁদেরও চাই ঐ সব খেলনা ।  কিন্তু তাঁদের স্বার্থ দেখার  ও অর্থ সরবরাহের জন্য কেউ নেই ।এমন সময়ে দক্ষিণ দিক থেকে উদিত হলেন এক অস্ট্রিয়ান নাগরিক , যুদ্ধে কর্পোরাল হয়েছিলেন , দ্বিতীয় শ্রেণির আয়রন ক্রস ঝোলানো থাকে গলায় ।  মিউনিকের পাবে তাঁর বক্তিমে শুনতে ভিড় জমে যায় ( হোফব্রয় হাউসের তিনতলায় সেই হলটি দেখতে পাবেন ) ; তাঁর মতে জার্মানি একটা জেতা গেমে হেরেছে কারণ সৈন্য বাহিনীর পিছন থেকে ছুরি মারা হয় । তার জন্য দায়ী কমিউনিস্ট , ইহুদি ও কিছু চক্রান্তকারী বিদেশি । ৯ নভেম্বর ১৯২৩  শখানেক লোক যোগাড় করে ব্যাভেরিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ব্যর্থ অভ্যুথানের পরে গ্রেপ্তার হলেন সেই নেতা , আডলফ হিটলার । সশস্ত্র রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে পাঁচ বছরের সাজা হয়েছিল ১৯২৩ সালে কিন্তু কোন অজানা কারণে তাঁর রেহাই হল নয়  মাস বাদে ।  তাঁর বহুল প্রচারিত ( এমনকি দুনিয়ার অনেক সংবাদ পত্রে ) বিচার পর্ব হিটলারকে রাতারাতি পরিচিত করাল সারা দেশে । তাঁর পার্টি,  জার্মান শ্রমিক দল  ( ডয়েচে আরবাইটার পারটাই ) প্রথম ইলেকশন লড়ে ১৯২৪ সালে, ব্যাভেরিয়ার বাইরে সম্পূর্ণ অচেনা এই দল পেলো ০.১২% ভোট , আসন শূন্য.  পার্টির নাম বদলাল -  হলো  নাতসিওনাল সোৎসিয়ালিস্তিশে ডয়েচে আরবাইটার পারটাই  সংক্ষেপে নাৎসি ( প্রথম দু  অক্ষর নিয়ে )।  মুদ্রাস্ফীতি ও যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের ঝক্কি কাটিয়ে জার্মান অর্থনীতি দুর্বার বেগে ঊর্ধ্বগামী । হিটলারের অগ্নিগর্ভ বাণী বাজারে কাটে না।  ১৯২৮ সালে নাৎসি পার্টি পেলো মাত্র ১২টি  আসন।  ১৯২৯ সালের অক্টোবরে ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজারে লঙ্কা কাণ্ড লাগলে যে ডিপ্রেশন দেখা দিলো জার্মানিতে তার প্রত্যক্ষ ফল দেখা গেলো ১৯৩০ সালের নির্বাচনে - ১৮% ভোট এবং ৯৫টি আসন পেলো নাৎসি দল । কিন্তু কোন দল সরকার গঠনে অক্ষম – শাসন চলে ভাইমার সংবিধানের সেই ৪৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী – রাষ্ট্রপতির ডিক্রি দ্বারা!  পার্লামেন্ট যখন সিদ্ধান্ত  নিতে অপারগ, রাষ্ট্রপতি হিনডেনবুরগ চ্যান্সেলরের পরামর্শ অনুযায়ী অথবা তা উপেক্ষা করে আপন ডিক্রি মাফিক দেশ শাসন করেন সেই মোতাবেক ।প্রসঙ্গত , যতদূর মনে পড়ে ভারতীয় সংবিধানে এই ধরণের একটি ক্লজ আছে- রাষ্ট্রপতি যুক্তিযুক্ত মনে করলে ( মনে করাটাই যথেষ্ট ) বা প্রধানমন্ত্রীর  পরামর্শ মতন পার্লামেন্ট ভাঙতে পারেন, ছ মাস নিজের  শাসন চালাতে পারেন, নতুন নির্বাচন ফলপ্রসূ নাহলে আবার রাষ্ট্রপতির শাসন ।  এটি কেউ দেখে দিলে কৃতজ্ঞ হব ।বার্লিন হামবুর্গ মিউনিকের পথে পথে লাল পতাকা বনাম সাদা কালো স্বস্তিকার লড়াই চলে ( উৎপল দত্তের ব্যারিকেড নাটকটি স্মরণ করুন) দেওয়াল লিখন দেখে জেনে নিতে হয় কাদের  পাড়ায় আছেন । তফাৎ এই যে কমিউনিস্ট বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল ছেঁড়া খোঁড়া জামা কাপড় পরে  হাতে কেবল পতাকা নিয়ে আওয়াজ তোলে - নাৎসি বাহিনী ব্রাউন ইউনিফরম পরিহিত , হরসট ওয়েসেলের ডি ফানে হোখ ( আমার পতাকা উচ্চে ) গান গেয়ে মার্চ করে লাইন দিয়ে, হাতে লাঠি , কোমরে পিস্তল , যেখানে সেখানে প্রতিপক্ষকে পেটায়, সভা ভাঙ্গে - তাদের উপস্থিতি রীতিমত উচ্চকিত ।লাইপজিগের এক সভায় (১৯৩০) নাৎসি প্রবক্তা গ্রেগর স্ত্রাসার বললেন , আমরা দশটা  আইন পাস করে এই গোলমালের সমাধা করে দিতে পারি – কেউ স্ট্রাইক করলে তাকে গুলি মারা হবে , বাকিরা কোন দেওয়ালের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে চাইবেন না “দেশের এই টালমাটাল অবস্থায় এক সবল কাণ্ডারির খোঁজে ব্যাভেরিয়ার কিছু ধনী মানুষ ইতিমধ্যেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন - যেমন কোবুরগের ডিউক, প্রিন্স হেঙ্কেল ভন ডোনারসমার্ক, ব্যাভেরিয়ান শিল্পসমিতির প্রধান প্রিন্স আরেনবেরগ।১৯৩১ সালে বেশ কয়েকজন জার্মান ব্যবসায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে এলেন- তাঁরা কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থার প্রচণ্ড বিরোধী কিন্তু আশ্চর্য হয়ে  দেখলেন কিভাবে শ্রমিক কৃষকের সেই সরকার শ্রমিক কৃষকদেরই   দাবিয়ে রেখেছে , সেখানে কারো  ঝাণ্ডা তুলে মাইনে বাড়ানোর দাবি করার হিম্মত নেই ।  ঠিক যেমন গ্রেগর স্ত্রাসার বললেন পার্টির নামের ভেতরে সোশ্যালিস্ট শব্দটা আছে বটে কিন্তু সেটা লোক দেখানো মাত্তর।আরও খানিকটা দূর থেকে নাৎসি জয়রথের অগ্রগতি লক্ষ করছিলেন কয়েকজন শিল্পপতি – তাঁরা চান স্টেবল গভর্নমেন্ট এবং এমন কাউকে যার সঙ্গে ইউ ক্যান ডু বিজনেস উইথ ! মহা ধনপতি ফ্রিতস থুসেন জনান্তিকে বলেছিলেন উদার উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্য আছে ,আমাদের ধন সম্পদ বাড়ানোর সুযোগ নেই ; কমিউনিস্টরা আয়ের সাম্য আনতে পারে কিন্তু আমাদের সম্পদের পরিমাণ শূন্যে দাঁড়াবে । ক্ষমতা  যদি কেন্দ্রীভূত হয় আমরা চাইব তার অংশীদার হতে।২৭শে জানুয়ারি ১৯৩১ ডুসেলডরফের হর্ম্য মণ্ডিত ইন্দুস্ত্রি ক্লুবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফ্রিতস থুসেন সমবেত ধনপতিদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমাদের দেশের ভাবি পরিত্রাতার সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই -ইনি আডলফ হিটলার ।লম্বা বক্তৃতা দেবার অভ্যেসটি ত্যাগ করে হিটলার মাত্র দশ মিনিট বললেন । তিনি শুরু করলেন  “অনেকে আমাকে বলেন আপনি  জাতীয়তাবাদী জার্মানির একক ঢোল বাদক । তাই কি ? আজ এক দেশভক্তের মতন আমি এই ঢোল আবার বাজাতে চাই , জার্মানিকে দিতে চাই এক  বিশ্বাস,  সেই  আস্থা যা জার্মানি হারিয়েছে “ ।শেষে বললেন“আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই  একটি  জাতীয়তাবাদী  সরকার । বারো বছর যাবত আমি এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত দলের নেতৃত্ব দিচ্ছি । আমরা এ দেশের রাজনীতির বিশুদ্ধিকরণ করে এমন একটি দেশ ও সরকার গড়ব যেখানে কোন প্রকারের দেশদ্রোহীর কোন ক্ষমা নেই । যদি কেউ আমাদের এই জাতীয়তাবাদী দেশনীতির বিরোধিতা করেন তাদের কঠিনতম  শাস্তি দেওয়া হবে । বন্ধুত্বের হাত যদি কেউ বাড়ান সেটি আমরা সাগ্রহে  গ্রহণ করবো.”  তুমুল করতালি ।ভাবী একনায়কের সঙ্গে শিল্পপতি ও ধনপতিদের সেতু বন্ধনের প্রারম্ভক্রমশ*”Some states have an army, the Prussian Army has a state” Voltaire  আউগুস্ট থুসেন স্ত্রাসে ১ডুসেলডরফ  ফ্রিডরিখ থুসেন (১৮৭৩-১৯৫১ )পিতা আউগুসট থুসেনের ইস্পাত ও খনিজ সাম্রাজ্যের একমাত্র অধীশ্বর ( জার্মানির ৭৫% আকরিক লোহা, দু লক্ষ কর্মী)।  ১৯২৩ সালে হিটলারের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে পাঁচ লক্ষ গোল্ড মার্ক দান করেন  -কমিউনিস্ট পার্টির অরাজকতা থেকে নাৎসি পার্টি জার্মান শিল্পকে বাঁচাবেন এই আস্থায় । পার্টি মেম্বারশিপ নম্বর ২, ৯১৭, ২৯২ । মোহভঙ্গ হতে দেরি হয় নি -ইহুদি এবং ক্যাথলিকদের প্রতি দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে হিটলারকে চিঠি লেখেন।  ফলং  পদচ্যুতি , দাখাউ কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে সাময়িক আবাস। সেই কারণে তাঁর নাৎসি মেম্বারশিপকে ক্ষমা ঘেন্নার চোখে দেখা হয়েছিল ।  সেই প্রতিষ্ঠান  এখন থুসেন ক্রুপ নামে পরিচিত ।  পরিবারের শেয়ার প্রায় শূন্য , ক্রুপের ২১% । স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ফ্রাঙ্কফুর্টে কাজ করার সময়ে জয়েন্ট ম্যানেজার হ্যারমান এরেনবেরগারের সঙ্গে ডুসেলডরফ অফিসে যেতাম ।  রিসেপশনের দেওয়ালে  তাঁর ছবি দেখেছি । আমার আলোচনার পার্টনার ছিলেন ফ্রিডহেলম বাবেরসকে । কোন কোম্পানীকে তিনি সবসময় "আউটফিট "বলতেন যেমন স্টেট ব্যাংক  অফ ইন্ডিয়া একটি আউটফিট ! 
  • জনতার খেরোর খাতা...
    ভারত সন্ধানে - Pradhanna Mitra | Post Truth: Relating to or denoting circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than appeals to emotion and personal belief.৬ এপ্রিল তারিখে একটি জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্রে একটি ছোট্ট কলাম চোখে পড়েছিল। তারা আবার ইংরেজী সংবাদপত্র থেকে জেনেছেন, স্কুলের সিলেবাস, বিশেষত, ইতিহাসের সিলেবাসে বেশ কিছু বড়োসড়ো রদবদল হচ্ছে, যা সত্য অর্থে আপত্তিকর। ১১ এপ্রিল তারিখ উক্ত সংবাদপত্রে হিন্দোল ভট্টাচার্য মহাশয়ের একটা বড়ো কলাম বের হয়, যেখানে এই রদবদলের উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমাদের এদিকে এ নিয়ে তেমন হইচই হচ্ছে না। কারণ, ইতিহাস সত্য হোক কিম্বা মিথ্যা, বাবা-মায়েরা কেবল একটাই জিনিস চান, আর তা হল এই যে, এইসব ইতিহাসপাঠ অত্যাবশ্যকরূপে তার সন্তানকে ভালো রেসাল্ট তথা উন্নত ‘চাকর’ বানাতে সক্ষম কি না। কিন্তু দেশ জুড়ে যে এর একটা বড়োরকম বিবাদ হচ্ছে, তা সর্বভারতীয় সংবাদপত্র, ব্লগ, ভ্লগ, ম্যাগাজিন, ইন্টারনেট ইত্যাদি দেখলে বেশ টের পাওয়া যায়।ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে --- এই দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে একটাই প্রশ্ন, প্রকৃত ইতিহাসটি তাহলে কি? যদি ‘প্রকৃত’ জানতে সক্ষম হই, তাহলে বিকৃতিকরণ আপনি এসে ধরা দেবে। এখন, সময়ের সাথে সাথে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত পরিবর্তন হয় বটে, কিন্তু ভাল করে স্টাডি করলে দেখা যাবে, তারও একটা ধারাবাহিকতা আছে, যা সত্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গিরগিটি বানায় না, যাকে আমরা ‘পোস্ট ট্রুথ’ বলি। তাই আমি, প্রকৃত-র খোঁজে যে বইটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম, তা হল টনি যোশেফের ‘আদি ভারতীয়’ বইটি, যা Early Indian নামে খ্যাত।এখন প্রশ্ন এই যে, এই বইটিও প্রোপাগান্ডা নয় তা কে বলল? আসুন একটু খতিয়ে দেখা যাক্‌ --- এই বইয়ের উদ্দেশ্য ভারতের উৎস সন্ধান করা। এখন এই উৎস সন্ধানের ভিত্তি কি? টনি যোসেফ তিনতে এভিডেন্স এনেছেন – ১) জেনেটিক এভিডেন্স, ২) আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স এবং ৩) লিঙ্গুইস্টিক এভিডেন্সজেনেটিক এভিডেন্সের দুটি মূল ভিত্তি --- ১) mtDNA, এবং ২) Y-DNA, প্রথমটি মা থেকে পরবর্তী প্রজন্মে, এবং দ্বিতীয়টি বাবা থেকে কেবলমাত্র ছেলের প্রজন্মে বংশানুক্রমে ধারারূপে এগিয়ে যায়। এখন আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স থেকে প্রাপ্ত মানব-অবশেষের জিন থেকে আমরা পিছোতে পারব অতীতের দিকে, এবং এইভাবে আস্তে আস্তে প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাক্রমকে জানতে পারব। বোঝাই যাচ্ছে, পুরো বিষয়টাই বিজ্ঞানসন্মত। এখানে কোনরকম কোন মহাকব্যিক কিম্বা শাস্ত্রোচিত দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এখন এই জেনেটিক এভিডেন্সের ব্যাপারেও টনি যোসেফ ডিটেইলসে জানিয়েছেন বটে, কিন্তু তা আমি, এখানে আলোচনা করলাম না। বইটি পড়তে পারেন, অথবা ইউটিউবে এ ব্যাপারে অনেক ডকুমেন্টারি পাবেন। সেখান থেকে ব্যাপারটা আরও খোলসা হবে। অন্যদিকে লিঙ্গুইস্টিক এভিডেন্স হল মূলত লিপি এবং ভাষার ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসকে জানার চেষ্টা, সেই ভাষা আধুনিক যুগে কীভাবে এসেছে সেটা একটা বড়ো গবেষণার পর্যায়। সেখানে আমরা তিনটে তত্ত্ব পাই --- ১) ইন্দো-ইউরোপিয়ান মাইগ্রেশান, ২) দ্রাভিডিয়ান সাবস্টেট এবং ৩) অস্ট্রোএশিয়াটিক ইনফ্লুয়েন্স। মূলত এই তিনটি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্টিত এই এভিডেন্স পূর্বোক্ত দুটো এভিডেন্সের সাথে সাজুয্য ঘটানোর চেষ্টা চলছে, অনেকাংশে সফলতা মিলেছে এবং আমরা একটা রূপরেখা আন্দাজ করতে পারছি।এই পদ্ধতিগুলো থেকে ভারতের ক্ষেত্রে ঠিক কি ক্রোনোলজি পাওয়া যাচ্ছে? মোট নটা সময়কাল পাওয়া যাচ্ছে --- প্যালেওলিথিক যুগ (২০ কোটি ~ ১০,০০০ খ্রীঃপূঃ), মেসলিথিক যুগ (১০,০০০ ~ ৬,০০০ খ্রীঃপূঃ), নিওলিথিক যুগ (৬,০০০ ~ ২,০০০ খ্রীঃপূঃ), ইন্দাস ভ্যালি সিভিলাইজেশান (৩৩০০ ~ ১৩০০ খ্রীঃপূঃ), বৈদিক যুগ (১৫০০ ~ ৬০০ খ্রীঃপূঃ), মৌর্য ও গুপ্ত যুগ (৩২২ খ্রীঃপূঃ ~ ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ), মধ্যযুগ (৫৫০ ~ ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ) এবং কলোনিয়াল যুগ (১৫২৬ ~ ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ)মোটামুটি এই যুগগুলোকে এবং পদ্ধতিগুলোকে ধরে নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলে দেখতে পাবো, টনি যোসেফ বলছেন, সূদূর আফ্রিকা থেকে মানুষের আগমন ঘটেছে এবং পরবর্তীকালে বেশ কতকগুলি মাইগ্রেশান ঘটেছে। সেগুলো হল ---১) আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশান --- আধুনিক মানব অভিবাসী, ২) এনশিয়েন্ট মাইগ্রেশান --- জার্গোসের অভিবাসী, ৩) ইন্দো-আরিয়ান মাইগ্রেশান --- স্তেপভূমির অভিবাসী, ৪) দ্রাভিডিয়ান মাইগ্র্যান্টস --- হরপ্পার অভিবাসী, ৫) পরবর্তীকালে আগত বিভিন্ন অভিবাসী।অর্থাৎ, এটা নিশ্চিত করছেন টনিভাই যে, আমাদের সভ্যতার সূচনা হরপ্পার হাত ধরে অন্তত নয়, কিম্বা মেহেরগড় থেকেও নয়। বরং হরপ্পা এবং মেহেরগড় নির্মাণে যাদের হাত ছিল, সেইসব অভিবাসীরা ধীরে ধীরে হাজার হাজার বছর ধরে এখানে আসে, ধীরে ধীরে বসতি স্থাপন হয়, ধীরে ধীরে নগর সভ্যতার পত্তন হয়, ধীরে ধীরে তার লয়-ও হয় এবং তারা সেখান থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে জম্বুদ্বীপের আরও গভীরে। তিনি লিখছেন, “ভারতীয় সংস্কৃতিতে জোর করে কৃত্রিম অভিন্নতা আরোপ করার জন্য অব্যাহত ও সর্বনাশা প্রচেষ্টার একটি কারণ আমাদের ইতিহাস রচনার ধরন, যেখানে প্রায়শই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে আত্মপক্ষ সমর্থন করা হয়েছে। যবে থেকে তথ্যাদি উপলব্ধ হয়েছে, ইতিহাস বইগুলি ঠিক সেই সময় থেকেই শুরু হয়; তার পূর্ববর্তী অংশগুলি হয় উপেক্ষা করা হয় বা খুব বেশি হলে সামান্য কয়েকটি অনুচ্ছেদ বা পৃষ্ঠার মধ্যে সেসব কথা সেরে ফেলা হয়।”এখন টনিভাইয়ের এই বইটির কতটা প্রোপাগান্ডা, কতটা পোস্ট ট্রুথ আর কতটাই বা সত্যতা আছে, সেটার বিচার করা দরকার। তবে তা অবশ্যই সনাতন পদ্ধতিতে নয়। বিজ্ঞাসন্মতভাবে। বিজ্ঞানের যুগে টেকনোলজিকে হাতিয়ার করে আমরা যদি সনাতন পদ্ধতির জয়গান করি, তাহলে সেটা বড়োই হাস্যকর। টনিভাই কিন্তু তা করেন নি। তিনি বিজ্ঞানসন্মত পদ্ধতিতেই এগিয়েছেন, তার বইটা পড়ে, অন্তত আমার, এইটুকুই মনে হল। মাঝখান থেকে ছোটবেলায় কাকাকে একটা ছড়া খুব বলতে শুনতাম, আমরা যখন জোরে জোরে ‘স্বরে অ’, ‘স্বরে আ’ পড়তাম তখন, সেইটাই বারবার করে আজ মনে পড়ছে, তবে তা আধুনিক পরিভাষায়, আর সেটা হল ---“ইতিহাসে পাতিহাস, ভূগোলেতে গোলপোস্ট ট্রুথে মাথা নেই, হয়েছি পাগোল।”======================Early IndiansTony josephJuggernaut PublicationPrice: 341/-বাংলা অনুবাদঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জীমঞ্জুল প্রকাশনমুদ্রিত মূল্যঃ ৩৯৯ টাকাছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
    ভারতে মুসলমান কি  বেশি জন্মায়?  - PRABIRJIT SARKAR | সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে ছিল। এসব মিথ। অর্থনীতির তত্বে আধুনিক যুগে তিনটে স্তর আছে (Theory of demographic transition)। প্রথমে প্রচুর বাচ্চা জন্মায় (অশিক্ষা আর অভাবে) আর মরে তাই জনসংখ্যা তেমন বাড়ে না। পরের ধাপে জন সংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি থাকে (চেতনার অভাবে) কিন্তু জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি তে মৃত্যুর হার কমে তাই জনসংখ্যা বাড়ে। শেষ ধাপে শিশু জন্ম মৃত্যুর হার দুটোই কম থাকায় জন সংখ্যা বিশেষ একটা বাড়ে না। গত একশ বছরের ইতিহাসে ভারতে ও দেখা গেছে। হিন্দু মুসলমান গল্প এখানে নেই। আছে অশিক্ষা আর দারিদ্য। তাই নিচের তলার হিন্দু মুসলিম সবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে তফাৎ বেশি নেই। আমার মত অনেক হিন্দুর একটা কিংবা দুটো এবং আমার মুসলিম বন্ধুদের ও তাই। কিন্তু আমাদের ভাই বোন ৫ বা ৭ জন। খেটে খাওয়া গরিব মানুষের (হিন্দু মুসলিন নির্বিশেষে) ৪ বা ৫ সন্তান। একটা দেশের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ভারতে হিন্দু মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত বাড়ছে বলে পাওয়া যায় নি। পাকিস্তানে হিন্দু খেদান হয়েছে তাই হিন্দুদের অনুপাত কমেছে ব্যাপক ভাবে।
    মুখোশ (কবিতা) - Tanusree Mukherjee | মুখোশ এক অদ্ভূত জিনিস তুমিও পরো, আমিও পরি ৷ওটা সরিয়ে নিলে ধরা পরবোতুমিও জানো,আমিও জানি ৷মুখোশের অন্তরালের বহুরূপতাতোমারও আছে,আমরও আছে ৷লালসা কামনা বাসনা -নিপুনতায় আড়াল করি,তুমি আর আমি ৷তুলাদন্ড হাতে নিয়ে ফিরি -পাল্লায় ভার বেশী কার,তোমার না আমার ৷মাপছি প্রতিনিয়ত মাপছিতুমি এগোলে,না আমি পিছোলাম ৷সুখ প্রদর্শনের খেলায় -তুমিও মজেছ,আমিও মজেছি ৷জেতা হারার লড়াই চলছেসামিল আছো তুমি,সামিল আছি আমি ৷মুখোশটা শক্ত করে এঁটে নাওআমি আর তুমি,কেউ যেন কাউকে না চিনি ৷দূষিত লোকটা আড়ালেই থাকনাহলে সর্বনাশ তোমারও,সর্বনাশ আমারও৷
  • ভাট...
    commentAranya | ঠিক, টোটাল ক্যাও
    commentArindam Basu | aranya, "
    • একাটা ভিডিও ক্লিপ পেলাম - নিউ ইয়র্ক টাইম স্কোয়ারে বাংলা নববর্ষ উদযাপন - গাওয়া হচ্ছে আগুনের পরশমণি। দারুণ "
    নিউইয়রকে গাইছে আগুণের পরশমণি, গরমে পুড়ছে কলকাতা, ক্যাও আর কাকে বলে?
    commentaranya | একাটা ভিডিও ক্লিপ পেলাম - নিউ ইয়র্ক টাইম স্কোয়ারে বাংলা নববর্ষ উদযাপন - গাওয়া হচ্ছে আগুনের পরশমণি। দারুণ 
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত