এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘিরে কিছু ভাবনা

    নন্দিনী সেনগুপ্ত
    আলোচনা | রাজনীতি | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১১৯৮ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • সন্দেশখালির ঘটনা আমাদের সকলকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনার সত্যাসত্য নিরূপণ বা নিরপেক্ষ বিচার নয়, নিছকই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া দিলেন নন্দিনী সেনগুপ্ত।



    আউসভিৎসের কথা মনে পড়ছিল। সেখানে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে ইহুদিদের হত্যা করা হত। আমি বার্লিনে আউসভিৎস মেমোরিয়াল দেখতে গিয়েছিলাম বছর কুড়ি আগে। একটু পরে ছটফট করে বেরিয়ে এসেছিলাম। শরীর খারাপ লাগছিল। মনে হয়েছিল মানবতার অপমানের উদাহরণ এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে না। অনেকটা সময়ে লেগেছিল নিজেকে বিযুক্ত করতে সেই অস্থির অবস্থা থেকে। মনকে বুঝিয়েছিলাম যে ওই দেশ আমার নয়। যারা মারা গিয়েছিল, তারা আমার দেশের কেউ নয়। আমার মাতৃভাষা বলত না কেউ। বহুকাল আগের ঘটনা। তাছাড়া সেই পাপের মূল্য হিটলারকে চরমভাবে চুকিয়ে যেতে হয়েছিল। এখনও জার্মানিতে হিটলার একটি নিষিদ্ধ নাম। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত জার্মানি এখনও করছে। সারা পৃথিবীতে যে কোন বিপন্ন মানুষ, যদি তার অস্তিত্বে কোনো সঙ্কট থাকে, তাকে কোনো দেশ যদি আশ্রয় না দেয়, জার্মানি দেবে। সেই আইন এখনও বলবৎ। দেশের অর্থনীতিতে অনেক চাপ এসেছে। চেচেন, সিরিয়া, আফগানিস্তান… নানা দেশের শরণার্থীরা এসে জমা হয়েছে। কিন্তু সেই আইনে বদল ঘটেনি। এই ভাবনাগুলো আমাকে একটু শান্তি দিয়েছিল।

    কিন্তু এখন? এই মুহূর্তে নিজেকে কী ভাবে বোঝাব? আমার বাড়ি থেকে মাত্র ৭০ কিমি দূরে ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ঘটছে। প্রথমে জমিতে নোনাজল ঢুকিয়ে জমি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যে জমিতে ক্ষুদ্রচাষি হয়তো চাষ করে নিজের সারা বছরের ভাতের যোগান করতেন, সেই জমি তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ করে ফল হয়নি। পুলিশ কেস নেয়নি। তারপর একশো দিনের কাজে জুড়ে দিয়ে চাষিকে শ্রমিক বানানো হয়েছে। তারপর সেই টাকা তার অ্যাকাউন্‌টে জমা পড়বার পরে সেটাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ একটু একটু করে মানুষের জীবিকা, রোজগার, আত্মসম্মান নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গেলে জুটত প্রহার। এই দেশে এমনটা আগে হয়নি তা নয়। পরাধীন দেশের মাটিতে নীলচাষ করাবার জন্য নীলকর সাহেবরা চাষিদের দাদন দিতেন। ধানচাষের জমিতে চাষি নীলচাষ করতে বাধ্য হত চাষি। জমি নষ্ট হত। টান পড়ত পেটের ভাতে। প্রতিবাদ করলে তুলে নিয়ে যেত সাহেবের পেয়াদা লেঠেল। চাষির ঘরের মেয়েবউরাও রেহাই পেত না। তাদেরও দিতে হত চরম মূল্য। দীনবন্ধু মিত্রের লেখা ‘নীলদর্পণ’ নাটকে আমরা দেখতে পাই এই পরিস্থিতির প্রতিফলন। এই যে সাম্রাজ্য গড়ে তুলতেন সাদা চামড়ার ব্রিটিশ সাহেবরা, এই রাজত্ববিস্তার কিন্তু ভূমিপুত্রদের সাহায্য ছাড়া সম্ভব ছিল না। সেই সাহেবের ম্যানেজার নায়েবগোমস্তা থেকে শুরু করে লেঠেল, সবাই ছিল এই মাটিরই সন্তান। অর্থাৎ দেশের লোকের সাহায্যেই দেশের লোকের শোষণ, শাসন ইত্যাদি সংঘটিত হত। ব্রিটিশ রাজ কবে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী। সংবাদে শুনছিলাম যে হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে, নেশার সামগ্রী জুগিয়ে কী ভাবে যুবসম্প্রদায়কে অকর্মণ্য করে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য উত্তর বা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার রেলস্টেশনগুলির আশেপাশে পথেঘাটে নেশা করে ঘুরে বেড়ানো এমন অকর্মণ্য শিশু কিশোর/কিশোরীদের যে কেউ দেখতে পাবেন চোখ কান খোলা রাখলে। নেশা যে কী ভাবে নাশ করছে, গ্রাস করছে, সে খবর জানবার জন্য সংবাদ দেখবার বা শুনবার প্রয়োজন পড়ে না। এই নষ্ট হওয়া কর্মহীন যুবকদের নিয়েই ক্ষমতাবান মানুষেরা তৈরি করছেন ব্যক্তিগত লেঠেল বাহিনী। এই লেঠেলরা অত্যাচার চালাবে। দ্বীপ এখানে আক্ষরিক অর্থে একটা মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠছিল। কেউ জানত না? কোন অভিনেতা, কোন রাজনীতিবিদ শেষ পাতে টকদৈ নাকি ডায়বেটিক সন্দেশ… ঠিক কী খান, সেটা সংবাদমাধ্যম জানে, অথচ যে সন্দেশখালিতে কলকাতা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে দু ঘণ্টার মধ্যে গাড়ি চড়ে পোঁছানো সম্ভব, সেখানকার সন্দেশ জানত না? আসলে সন্দেশ শব্দের আরেকটা অর্থ সংবাদ। সেই জায়গাটা একদম খালি, শূন্য ছিল, সেটা একদম বিশ্বাস করতে পারছি না।

    প্রথমে অবশ্য খবরগুলোই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে হয়েছিল যে এটা কি কোনো রাজনৈতিক চক্রান্ত? সামনে লোকসভা নির্বাচন, কিছুদিন আগে এনফোর্সমেন্‌ট ডিরেক্টোরেটের সরকারি অফিসারেরা মার খেয়ে এসেছেন সেই জায়গা থেকে এবং সেই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতা শেখ শাজাহান ফেরার, এই ঘটনাপ্রবাহ তো জানা ছিল। কিন্তু নেতা যে আসলে নেতা নন, মাফিয়া, সেই বিষয়ে আমাদের বিস্তারিত জানা ছিল না। মাফিয়ার সম্পত্তি তো আর দ্বীপের মধ্যে আকাশ থেকে পড়েনা, মাটি থেকে সেখানে গজিয়ে ওঠে না টাকার গাছ। একটু একটু করে মানুষকে শোষণ করে ফুলেফেঁপে ওঠে ক্ষমতার ধ্বজাধারী। সম্পত্তি সেখানে ধ্রুবক, শুধু তার মেরুকরণ ঘটে।

    ‘পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে
    সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।
    বাকি সব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন
    কোথাও নদীর পানে উড়ে যেতে চায়,
    অথবা মাটির দিকে…’
    (১৯৪৬-৪৭, জীবনানন্দ দাশ)

    নাহ, বাকি মানুষদের মাটির দিকেও ঝরে পড়বার মত জায়গা ছিল না। কারণ পায়ের নিচের মাটি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের কাছ থেকে। কত মানুষ এরই মধ্যে মরে, ঝরে গেছে কি না, সে খবর আমরা এখনও জানি না। তবে যারা আছে, তারা জীবন্মৃত হয়ে আছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে আজ সেই নেতা ফেরার না হলে হয়তো এই খবর আমরা জানতে পারতাম না। মেয়েরা পথে নামত না।

    মেয়েদের পথে নামতে দেখে এবং খবরের ক্লিপিংগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যে আমার কানে কেউ গরম সিসে ঢেলে দিচ্ছে। প্রথমে মনে হচ্ছিল অবিশ্বাস্য ঘটনা। কী ভাবে এমন হওয়া সম্ভব? কী ভাবে এরকম মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠতে পারে, যেখানে মেয়েদের কোনো সম্ভ্রম নেই! সার বেঁধে মেয়েরা মুখ ঢেকে ক্যামেরার সামনে বলছে তাদের অসহায়তার কথা, লজ্জার কথা। তবুও তো মহিলা সাংবাদিকের সামনে হয়তো তারা কিছু ভরসা পেয়ে কথাগুলো বলেছে। কিন্তু শোনা গেছে যে প্রথমে যারা এসেছিল সংবাদমাধ্যমের সামনে, তাদের পরের রাতে পড়তে হয়েছিল প্রশাসনের হুমকির মুখে। সংবাদমাধ্যমে আমরা শুনতে পাচ্ছি যে বিবাহিত মহিলাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হত মধ্যরাতে। রাতের পর রাত সেবাদাসী করে রেখে দেওয়া হত। শাঁখা, পলা ভেঙে দেওয়া হত, অর্থাৎ প্রকারান্তরে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হত যে ক্ষমতাবানদের সন্তুষ্ট করে না চললে স্বামীর প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে হবে। বাড়িতে সাদা থান পাঠানো হত। তবে এই জায়গায় আমার মনে প্রশ্ন জাগছে যে শুধুই কি বিবাহিত মহিলাদের ডাকা হত? অল্পবয়সী মেয়েরা কি ছাড় পেত? নাকি তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা থেকে তাদের বিরত রাখা হয়েছে? নাকি তাদের একটা বড় অংশ এর মধ্যে চালান হয়ে গেছে দেশের অন্য প্রান্তে কিম্বা বিদেশের কোনো অন্ধকার জগতে?

    কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন এক মহিলা যে পুলিশের সামনেই হুমকি দেওয়া হত। যেহেতু একবার তাদের সম্ভ্রম নষ্ট করা হয়েছিল, ফলে তাদের বারে বারে পায়ের জুতোর মত ব্যবহার করবার লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছিল ক্ষমতাবানেরা এবং পুলিশও একই যুক্তিতে নালিশ নেয়নি। কী অদ্ভুত শোনাচ্ছে, তাই না? যেসব মেয়েদের সঙ্গে এমন বর্বরতা ঘটেছে, শুধু হিন্দু বলে তাদের চিহ্নিত করলে ভুল হবে। তাদের একটা বড় অংশ আদিবাসী জনজাতির অংশ। ভারতের সংবিধানে আদিবাসী সম্প্রদায়কে রক্ষা করবার জন্য কিছু বিশেষ ধারা আছে, মানবাধিকারের ধারার সঙ্গে সেই ধারাগুলিও এক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়েছে। কিছু বিশেষ সুযোগসুবিধে আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রাপ্য। সেগুলো এরা পায়নি, এমনকি মানুষ হিসেবে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকবার সব পথ এদের সামনে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ প্রশাসন নারীদের যে মানুষ বলে মনে করে না, সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমরা কিন্তু এখনও জানি না যে এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ইতিমধ্যে কোনো নারী অথবা পুরুষ খুন হয়েছেন কি না, কিম্বা কেউ আত্মহত্যা করেছেন কি না। সেক্ষেত্রে আরও কঠোর কেস দেওয়া উচিত। আইনের বিশেষজ্ঞ আমি নই। প্রশাসন বলছে যে ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়েনি। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে আমরা যেসব কথা শুনতে পাচ্ছি, তাতে এটা পরিষ্কার যে জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। একটা বিরাট অংশের মা বোনেরা নির্যাতিতা হয়েছেন। সেক্ষেত্রে কি মহিলা কমিশন, আদিবাসী সুরক্ষা কমিশন কিম্বা দেশের ন্যায়ালয় স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে মামলা রুজু করতে পারেন না? কেন অভিযোগের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে?

    এই দ্বীপের একটা বড় অংশের মানুষ হয়তো ইতিমধ্যে ছড়িয়ে রয়েছেন দেশের অন্য অংশে। হয়তো পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন ভারতের অন্য রাজ্যে। কিম্বা কাজের খোঁজে চলে গিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে কিম্বা অন্য কোনো দূর দেশে। আসলে এমন অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা তো যে কেউ করবেন। সেই সংখ্যা কিন্তু আমরা জানি না। আমরা জানি না এই ভূখণ্ডের মূল বাসিন্দা যারা, তাদের মধ্যে কত শতাংশ বেরিয়ে গিয়েছেন গত দশ, কুড়ি, তিরিশ বছরে। যাদের যাবার উপায় নেই কোথাও, হয়তো তারাই পড়ে আছেন মাটি কামড়ে। সম্মান সম্ভ্রম নেই, তবুও তো প্রাণ আছে। বেঁচে রয়েছেন তারা এখনও। হয়তো সুযোগসুবিধে পেলেই পালিয়ে যেতেন অন্য কোথাও। আরও একটা কথা মনে হচ্ছে বার বার। সত্যিই কি সন্দেশখালি একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাক্ষী? নাকি এই দেশে, এই রাজ্যে আরও কোথাও আছে এমন সন্দেশখালি, যেখানে প্রতিদিন এইভাবেই ঘটে চলেছে মানবতার অপমান? এমন নয় তো যে মানুষ বেরিয়ে আসবার সাহসটুকু জুটিয়ে উঠতে পারছেন না?

    সন্দেশখালির মেয়েরা গাছের ডাল, হাতা খুন্তি যা পেয়েছিল হাতের কাছে, সেটা নিয়েই পথে নেমেছিল। এটা যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পথে নেমে আসা, সাজিয়ে গুছিয়ে কোনো রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত নয়, সেটা যে কোনো সংবেদনশীল মানুষ বুঝবেন। এই মিছিলে যারা পা মিলিয়েছিলেন, সেই স্বয়ংসিদ্ধাদের জন্য আমি আমার অন্তরের প্রণাম রাখি। নানা বয়সের মেয়েরা নেমে এসেছিল সেদিন পথে থানা ঘেরাও করবার জন্য। আসলে ভয় পেতে পেতে এমন অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন ওঁরা, যে আর ভয়ের লেশমাত্র বাকি ছিল না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ খোলা আকাশের জন্য, মুক্ত বাতাসের জন্য হাঁকপাঁক করে। তখন আর মনে এই কথা থাকে না যে পথে নামলে লোকে কী বলবে। হ্যাঁ, শহুরে মেয়েদের পথে নামা আর গ্রামের মেয়েদের পথে নামা এক নিক্তিতে ওজন করা যায় না। শহরে আলোকপ্রাপ্তা নারীরা কথায় কথায় মিছিলে পথে নামতে পারেন। সেটা খুব বিরল ঘটনা বলে গণ্য হবে না। কিন্তু সেদিন যারা পথে নেমেছিলেন, তারা অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর অঞ্চলের বাসিন্দা। যারা পথে নেমেছিলেন, বেশিরভাগ ঘর সামলানো গৃহবধূ। একজন বলেছিলেন সংবাদমাধ্যমে… ‘আমাদের কি এভাবে পথে নামার কথা ছিল? আমরা তো ঘরে থাকতেই চেয়েছিলাম।’ আসলে ঘরে যে তারা থাকতে পারতেন না, রাতবিরেতে ডেকে পাঠানো হত, তাদের নিজের ঘরসংসার, এমনকি নিজের শরীরের উপরে পর্যন্ত কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকত না, এই কথা তাদের আত্মাকে আঘাত করেছিল।

    মেয়েদের এই অভ্যুত্থান বিনষ্ট করবার জন্য জারি করা হল ১৪৪ ধারা, যাতে তারা একত্র হয়ে পরামর্শ কিম্বা মিটিংমিছিল কিছুই না করতে পারেন। যে সময়ে আমি এই লেখা লিখছি, আদালতের নির্দেশে ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আবার যে কোনো সময়ে সেটা জারি করা হবে, এমনটাই শোনা যাচ্ছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে মেয়েদের, ‘সংবাদমাধ্যম আর কদ্দিন থাকবে? এরা চলে গেলেই দেখে নেব।’ এই যে দেখে নেওয়ার, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়ার আধিপত্যবাদ, জঙ্গলের রাজত্ব… এইসবের জন্যই কি ভারত স্বাধীনতা চেয়েছিল? কোনো সভ্য দেশে এমন হয়? ভারতের অন্য রাজ্য থেকে, বিদেশ থেকে বন্ধুবান্ধব ফোন কিম্বা মেসেজ করলে উত্তর দিতে পারছি না। মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। যে মেয়েরা ধর্ষিতা হয়েছেন দিনের পর দিন, তারা আমার রাজ্যের নারী, আমার ভাষাতেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তারা রাজ্যপালের পায়ে লুটিয়ে পড়ছেন। কতটা বিপন্ন হলে, কতখানি মরিয়া হলে পথে লুটিয়ে পড়ে মানুষ?

    রাজ্যপাল কী করবেন আমি জানি না। নানা মতের রাজনৈতিক নেতারা যাবেন, আসবেন। তারাও কী করবেন, আমি জানি না। তবে মানুষের অন্তরের শক্তি জাগ্রত হলে তাকে দমিয়ে রাখা মুশকিল। ভিড় সামলানো পুলিশদের চোখ কেউ লক্ষ্য করেছেন? ভিড় সামলাচ্ছেন বটে, কিন্তু চোখ নামিয়ে ফেলছেন বারে বারে। আসলে ওরা মানুষকে আটকাচ্ছেন উপরতলার নির্দেশে, অন্তরাত্মা হয়তো বিদ্রোহ করছে। মানুষের অন্তরাত্মার বিদ্রোহ যেদিন বাইরে বেরিয়ে আসবে আগ্নেয় পাহাড়ের লাভাস্রোতের মত, সেদিন সব অন্যায় নির্দেশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গলে যাবে, এই আশাতেই আমার মত অগণিত সাধারণ মানুষ জেগে থাকেন।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১১৯৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ঢেকুর  - Tanima Hazra
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৪৫528435
  • অসম্ভব ভাল লেখা।  এর ফল মমব্যান পাবে, পাবেই। 
     
    পুলিশের উপরে অবশ্য অত ভরসা আনার নেই। পুলিশ লজ্জা ফজ্জা পায় না, এক আধজন ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। 
  • | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৫০528436
  • আর একটা কথা, মম্ব্যান বারেবারে বলছেন  নাকি উস্কানি দিয়েছে। কথা হল রাজ্যে যাই ঘটুক সেটার দায় সম্পূর্ণই মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রশাসনের।  মতো হিলা কমিশান আবার সাইট ভিজিট করে বলেছে কোন অভিযোগ পায় নি।  অথচ   মহিলা কমিশানের স্বত:প্রণোদিত হয়ে কেস করা দরকার ছিল। সেইজন্যই আমাদের ট্যাক্সের টাকায় একটা মহিলা কমিশান হয়। 
  • | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৫১528437
  • *আমাদের ট্যাক্সের টাকায় একটা মহিলা কমিশান পোষা হয়।
  • Subhro Bhattacharyya | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০০:২৩528442
  • কয়েকদিন ধরে তো এটাই খবর , কাগজে- টিভিতে,  রকের আড্ডায়, চায়ের দোকানে, সর্বত্র। দেখছি,শুনছি, পড়ছি আর ভাবছিলাম এই আমার রাজ্য? আমি নিশ্চিত যে এই ঘটনা অন্য কোথাও ও ঘটেছে । কিছু লোক, তার মধ্যে প্রশাসনের লোক, শাসক দলের লোক এবং আরও কেউ কেউ,  উঠেপড়ে লেগেছেন  সব মিথ্যাচার প্রমাণ করার জন্য।  উস্কানির জন্যও এসব বলছে, ভুল বোঝানো হয়েছে, এসব কথাও শুনতে পাচ্ছি। দুটো অনুভূতি হচ্ছে আমার- লজ্জা আর ভয়। নিজেকে ওখানকার বাসিন্দা ভাবলেই ভয়ে বুকের ভেতর গুড়গুড় করছে, আর পরিচিত জন যারা বাইরে থাকে তাদের কাছে কি লজ্জায় পড়তে হচ্ছে। ভাবছিলাম এরা সব রাজনৈতিক নেতা ? আমার রাজ্য আর কোথায় নামবে ? নির্বাচন কমিশন আবার এত রাজ্যের ভোটের জন্য ৯০০ কোম্পানির ও বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে। ভোট হবে না কি খুনোখুনি !!  এই লোকগুলো অপরাধের শাস্তি পাবে না কি বোধহয় সম্মান দেওয়া হবে ? 
  • দীপ | 2402:3a80:a10:4b41:0:4b:c67:bd01 | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০০:৩৪528443
  • অত্যন্ত যথাযথ লেখা। সম্পূর্ণ সহমত।
  • রঞ্জন রায় | 2402:e280:3d02:20a:c14a:8b0d:ca9b:1a32 | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৪:৩১528448
  • সম্পূর্ণ সহমত।
  • Aranya | 2601:84:4600:5410:803:fe07:4e60:26bb | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:০২528458
  • ভাল লেখা 
  • সুদীপ্ত | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:১৪528462
  • ভালো লাগলো লেখাটি, সহমত! 
  • Kishore Ghosal | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:৩৯528487
  • @ নন্দিনী, ভীষণ নাড়া দিয়ে গেল আপনার প্রতিবেদনটি। 
     
    তবে আমার মনে হয় সন্দেশখালির ঘটনা কোন "বিছিন্ন দ্বীপের বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়", বরং বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের সুপরিকল্পিত বন্দোবস্ত।  মনে করে দেখুন, ২০০০ সালে সুটিয়ার  শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস এরকমই অত্যাচারের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে সময় ছিল বাম জমানা।  ২০১১ সালে রাজনৈতিক "পরিবর্তন" ঘটার পরে, ২০১২ সালে নিহত হলেন বরুণ বিশ্বাস। 
    শাসক বদলায় - শোষণ বদলায় না। মুখোস বদলায়, শাসকের কদর্য মুখ বদলায় না।   
  • শিবাংশু | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:১৪528488
  • সন্দেশখালি বা বরুণ বিশ্বাস হিমশৈলের চূড়া মাত্র। মানুষ জানে না, এর প্রতিকার কবে, কখন? 
  • Subhadeep Ghosh | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২৩:০৫528498
  • একদম সঠিক কথা। 
  • pokai | 42.110.174.75 | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৫৯528517
  • উনি বলে দিয়েছেন সব বাংলা বিরোধী চক্রান্ত - সংখ্যালঘু আর আদিবাসীদের লড়াই লাগাতে।
    হীরকের রানী ভগবান, আর বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজ ও চুপ !
    অতএব যাও সবে নিজ নিজ কাজে।
  • তৃষ্ণা বসাক | 2409:4060:38d:6fdf::16e7:20a4 | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:২৬528815
  • অসাধারণ সংবেদনশীল লেখা নন্দিনী।
  • Anirban | 2405:201:801c:90cc:c0b3:628f:9d93:5d8a | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৫৭528891
  • খুব সত্য কথা ... আমাদের মনের  কথা .. লিখেছেন 
  • Arindam Basu | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২৩:৩৪528895
  • "নাকি এই দেশে, এই রাজ্যে আরও কোথাও আছে এমন সন্দেশখালি, যেখানে প্রতিদিন এইভাবেই ঘটে চলেছে মানবতার অপমান? এমন নয় তো যে মানুষ বেরিয়ে আসবার সাহসটুকু জুটিয়ে উঠতে পারছেন না?"
    ভাল বলেছেন। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন