এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • নিউনর্মাল করোনাকালীন পর্ব চল্লিশ

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৫ জুলাই ২০২৩ | ৪১২ বার পঠিত
  • এই নিরবিচ্ছিন্ন চাঁদের আলো। শান্ত ছাত। ফুল আছে টুকটাক। বাবুর স্নান সেরে আসা গায়ে ল্যাভেন্ডারের গন্ধ। ল্যাভেন্ডার পুরুষের গন্ধ নয়। মালবিকার এরকম একটা ধারণা ছিল। কিন্ত বাবু বোধহয় নিচের স্নানঘরে আর কিছু পায়নি। চাবি ওর কাছেই থাকে। একেবারে ফ্রেশ হয়ে ওপরে এসেছে। আপাতত ছেলের কাঁধে মাথা রেখে মালবিকা। ছাতের আলসেতে টুপুর। নিচে কিছু কুকুর ডাকাডাকি করছে। খাওয়ার সময় হয়েছে ওদের। শ্যামা নিচে গিয়ে ভাত চাপিয়েছে।সেদ্ধ ভাত খাবে দেবরূপ। যে কোনো জার্নি হোক, ট্রেন বা ফ্লাইট। নেমে ওর সেদ্ধ ভাত চাই। চাল ফোটার একটা আশ্চর্য সুগন্ধ থাকে। ওম। নরম। মৃদু। স্নিগ্ধ। সিঁড়িতে, ল্যান্ডিং এ ভাতের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। দুধের সর চালে জুঁইফুলের মতো ভাত হয়।টিকটিকি ভাতের গন্ধ নিচ্ছিল।
    ঈশান এসে নিচ থেকে হাত নাড়ল। টুপুর হাতের ইশারাতে বলল, ছাতে চলে এসো।
    মালবিকার মনে হচ্ছে না, আপাতত পৃথিবীতে ভাইরাস বলে কিছু আছে। সকালে যে অত কান্নাকাটি করেছিলেন তাও মনে নেই। ত্রিদিবের জ্বর কমেছে। নার্সিংহোম ভালো। নার্সদের ব্যবহার ভালো। ঈশানের বন্ধু ডাক্তার। তাঁর মনে অপার শান্তি।
    মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল টুপুর। মালবিকার মত এইরকম  হওয়া একদিক থেকে ভালো। অনেক ভালো। কিংবা কে জানে, ভেতরে কী কুরে কুরে খাচ্ছে মা' কে যে মা ছেলের হাত অমন আষ্টেপিষ্টে ধরে রেখেছে।
    দাদার দমবন্ধ লাগে না?
    - আমাদের ভ্যাকসিন কবে আসছে রে?
    মালবিকা দেবরূপের কাঁধে মাথা রেখেই জিজ্ঞেস করলেন।
    - এসে যাবে মা। সিনিয়র সিটিজেনদের আগে। তারপর তোমরা পাবে।নিয়ে নেবে কিন্ত। দেরি করবে না।
    মালবিকা যেন বাবুর ছোট্ট মেয়েটি। এমনভাবে মাথা নাড়লেন।
    দেবরূপ জানে আর এন এ ভাইরাসের ভ্যাকসিন হয় না। এরা এত দ্রুত চেঞ্জ করে যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার সম্ভব নয়। ভ্যাকসিন বলে মানুষ যেটা পাবে সেটা আসলে ইমিউনিটি বুস্টার। ফলে ভ্যাকসিন নিলেই পোলিওর মত লাইফলং নিরাপত্তার কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্ত সেসব কথা এখন থাক।
    এই পারিবারিক যোগ, ত্রিদিব ছাড়া বাকি সবাই একসঙ্গে, ভাতের গন্ধ, পাতলা কাপড়ে মুসুরির ডাল সেদ্ধ দিয়েছে শ্যামা, বেরেস্তা দিয়ে আলুসেদ্ধ ডিমসেদ্ধ মাখা, এইসমস্ত উষ্ণতাকে নার্সিংহোমের একটা মাত্র ফোন ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে।
    মানুষ এত অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছে যে এখন আর তারা শরীরে কাজ করে না।বিষন্ন শরীর ধুঁকতে ধুঁকতে চলে। বাবু আজকাল নিজের শরীরে বিষন্নতা টের পায়। সেটা বাইরে থেকে কারুর বোঝার কথা নয়।একজন বোঝেন। তিনি আমেলিয়া।
    নিজস্ব পরিবৃত্তে, একদম নিজের মানুষদের সঙ্গে থেকেও আমেলিয়াকে খুব মনে পড়ছে বাবুর। এইসব চাঁদের আলোর মত স্নিগ্ধ উজ্জ্বল তাঁর চোখদুটি। অথচ সে কথা মালবিকার সামনে বলা যাবে না।মা সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাবে। ছেলেমানুষের মতো করবে। এখন ওরাই তোমার বেশি কাছের হয়ে গেছে বাবু? বাবু এসেই নার্সিংহোমে ফোন করেছে টুপুরের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে।
    ঘুমিয়ে আছেন ত্রিদিব।
    সুগার লেভেল বেশি। অক্সিজেন চলছে।
    বাবু জানে যে এইরকম অনেক ত্রিদিব এরপর অক্সিজেন পাবেন না। সময় চলে আসছে।সেকেন্ড ওয়েভ দিল্লি, মহারাষ্ট্রে আটকে থাকবে না। মহারাষ্ট্র নাইট কার্ফ্যু ডেকেছে অলরেডি।
    মালবিকার খুব ভালো লাগছে এই সময়টুকু।
    - ঈশান, তুমি সেদ্ধ ভাত খাবে তো? বাবু খুব ভালোবাসে জার্নি করে এসে সেদ্ধ খেতে। ওখানে তো আর সেদ্ধ ভাত খাওয়া হয় না ওর!
    মালবিকার চোখে কেমন যেন ঘোর। ছেলের যা পছন্দ, তাই সামনে ধরে দেওয়াতে কী সুখ।
    বাবু মুখ ফিরিয়ে নিল।
    মা জানে না। মা জানে না যে মেহতা হাউসে সেদ্ধ ভাত হয়।যেদিন পরমপ্রতাপ আর্লি ডিনার করে শুতে চলে যান, সুমন ওর ডায়েট খাদ্য খেয়ে নিজের ঘরে, সুনন্দিতা নিজেই সেদ্ধ ভাত বানান দু' জনের মতো। ভাতের পাতে কাঁচা লঙ্কায় একটা আলতো কামড় দিয়ে বলেন, আমার ছেলেমেয়েরা এসব খায় না। আর সেদ্ধ ভাত, জানো তো, একা খেতে ভালো লাগে না। মানি যখন ছিল, ওহ্, মানিকে তো দেখোনি। মাম্মিজি' র আয়া। তখন ও করতো আমরা দুজন খেতাম। আমেলিয়ার ঘরে আলো জ্বলে।নিকির ঘরে আলো। পাঞ্জাবীবাগের মেহতা হাউসে ঘি দিয়ে সেদ্ধ মাখা হয়েছে। সুনন্দিতা আর বাবু খাচ্ছে। সুনন্দিতা বলছেন, এই ছেলে, লজ্জা করে খাবি না। একটু আচার দেব? কাল তোকে মিষ্টি কুমড়োর ভর্তা করে দেব।
    গ্যাসে দুটো মিষ্টি কুমড়ো পুড়িয়ে নেন মালবিকা। দুটো শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে নেন। সামান্য তেলে ভেজে নেন পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা আর দু কোয়া রসুন। তারপর মেখে নেন। গরম ভাতে অমৃত।বাবু আর মালবিকার স্পেশ্যাল ডিশ এইসব।
    মালবিকাকে বলা যাবে না। শী উইল বি জেলাস। বাবু জানে।
    বরং বাবুর ওখানে খেতে কষ্ট হয়, এখানে এসে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে এইসব শুনলে তিনি যেন খুশি।
    বাবু মায়ের হাত ছাড়িয়ে ঈশানের পাশে এসে দাঁড়াল।
    - ঠিক কেমন অবস্থা বলো তো?
    - সুগার না থাকলে চিন্তার কিছু ছিল না। বাট দ্যাট সুগার ফ্যাক্টর ম্যাটারস।
    দুজনেই জানে ওরা। স্বাভাবিক রক্তশর্করাও বাড়িয়ে দিচ্ছে ভাইরাস। পেশেন্ট ডায়াবেটিক হলে রিস্ক অনেক অনেক বেশি।র ক্ত শর্করা থাকলে করোনা ভাইরাস আনন্দে বাস করে। বাবা কী ঠিকঠাক ওষুধ খাচ্ছিল?
    দেবরূপ ভাবলো। সে একবারও জিজ্ঞেস করেছিল কী? খুব বিরক্ত হয়েছিল ত্রিদিব দিল্লি যাওয়াতে।
    নার্সিংহোমে ইনসুলিন ঠিকঠাক দিয়েছে তো?
    মালবিকার দিকে ফিরে তাকালো। মালবিকা ফোনে ব্যস্ত। কোনো কলিগ ফোন করেছেন। ত্রিদিবের খবর জানতে চাইছেন বোধহয়। মালবিকা বেশ ডিটেইলসে বলছেন। বোঝা যাচ্ছে, সহজে ফোনালাপ শেষ হবে না। টুপুর অন্য আলসেতে ফোন নিয়ে।
    আকাশের দিকে তাকালে কিছু ফারাক বোঝা যায় না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একবার বলেছিলেন না, করোনা ভাইরাস উইল ভ্যানিশ। ইট উইল ভ্যানিশ লাইক আ মিরাক্ল। ভুল বলেছিলেন ট্রাম্প।তখনো সিংহাসনচ্যুত হননি তিনি। পরপর তিনটি করোনা ঢেউএ ভেসে গেছে আমেরিকা। বাইডেন এসেছেন।
    মালবিকার মত আরো হাজার হাজার মানুষ ভ্যাকসিনকে একটা মিরাকল ভাবছেন। অসুখ যেন ম্যাজিকের মত ভ্যানিশ হয়ে যাবে।
    ইট উইল নট। মানুষকে মানিয়ে চলতে হবে। যেমন সে মানিয়ে নিয়েছে ।অনেক কিছু। এখন কী স্কাইপেতে আমেলিয়া বা নিকির সঙ্গে কথা বলা যেত না?
    বাবু একটু নিরালা পেতে চায় অথচ পরিস্থিতি এখন সেটা অ্যালাউ করবে না।
    না। যেত না।
    সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক কিছু প্রোটোকল বেঁধে দেয়।
    মালবিকা ফোন থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, আন্টিকে জানিয়েছিস যে তুই পৌঁছেছিস?

    (চলছে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৫ জুলাই ২০২৩ | ৪১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন