পরপর দুটি স্মৃতিকথা পড়া হয়। প্রথম বাশারাত পীর লিখিত ‘কার্ফ্যিউড নাইট’ এবং সেই সূত্রে রেফারেন্স পেয়েই বিপ্রতীপের আখ্যান রাহুল পন্ডিতা লিখিত ‘আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস’। পীরের লেখা আমাকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। আফস্পা নামক আইনটি এবং সেই রক্ষাকবচের আড়ালে কাশ্মীর বা মণিপুরে ভারতীয় সেনার দানবীয় রূপের কিছু কিছু কথা জানা ছিল, জানা ছিল না এই ভয়াবহ অত্যাচার আর অবিশ্বাসের আবহাওয়ার। জানা ছিল না সরকার তথা সেনাবাহিনী অথবা সন্ত্রাসবাদী তথা স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর এই দুই পক্ষের মধ্যে কোন একটির আওতায় থাকতে বাধ্য প্রতিটি মানুষ। জানা ছিল না এমনকি পক্ষাবলম্বনের পরেও সেই পক্ষের মধ্যে থাকতে পারে অজস্র ছোট পক্ষ যাদের মধ্যের বাদানুবাদে যেকোন মুহূর্তে বিপন্ন হতে পারে মানুষের সর্বস্ব। প্রায় নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে পীর লিখে গেছেন কাশ্মীরের অসহায় বিপন্ন দিনরাতের জ্বলেপুড়ে যাওয়ার কাহিনী। পন্ডিতা নিজে কাশ্মিরী পন্ডিত, লেখা সত্যি বলতে কি বড় বেশী পার্টিজান, খুব যে ভাল লেগেছে পড়তে তা নয়, কিন্তু এ বইও আমার জন্য আই ওপনার। কাশ্মীরি পন্ডিতদের আতঙ্ক ও অসহায় পলায়ন ঠিক এভাবে জানা ছিল না। ... ...
বীরেন শা'য়ের বাড়ীর দুইঘর ভাড়াটে নাকি গিয়ে সাতুদের দোতলায় উঠেছে। এদিকে দাদুদের গোয়ালঘরেও ভালই জল উঠেছে, প্রথমদিন তো লালি আর আকাইম্যা সারাদিনরাত দাঁড়িয়ে রইল। পরেরদিন ভোররাতে লালি কেমন অদ্ভুত আওয়াজ করে ডাকতে লাগল। তখন দাদু গিয়ে ওদের দড়ি ধরে এনে দাদুদের দিকের ভেতরের বারান্দায় তুলল। সে বেচারাদের কি ভয় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে, অর্ধেক সিঁড়ি তো জলে ডোবা, তড়বড় করে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আকাইম্যা একেবারে দাঁড়িয়ে গেল শক্ত হয়ে, কিছুতেই নড়েচড়ে না। দাদু শেষে ওকে পাঁজাকোলা করে বারান্দায় তুলে দিল। লালি বেচারীর শিগগিরই বাছুর হবে, পেটটা ফুলে একেবারে ঝুলে গেছে, প্রায় মাটি ছুঁইছুঁই। খুব কষ্ট করে বারান্দায় উঠল। বারান্দার কোণায় ছোট গামলা করে ওদের জাবনা দেবার ব্যবস্থা হল। লালি উঠেই সেই যে বসে পড়ল, সারাদিনে আর উঠে দাঁড়াল না। শেষে দাদু আর দিদা সন্ধ্যের আগে অনেকক্ষণ ধরে ছোবড়ার আগুন জ্বালিয়ে লালিকে সেঁক দেওয়ার পরে বেচারী একটু ধাতস্থ হয়ে জাবনায় মুখ দেয়। পরেরদিনটাও লালিরা বারান্দায়ই রইল, তার পরের দিন জল অনেক নেমে গেল; উঠোনে আধহাঁটু, গোয়ালে গোড়ালি ভেজে কি ভেজে না। লালি আর আকাইম্যা আবার গোয়ালে ফেরত গেল। বারান্দায় দুই বোতল ফিনাইল ঢেলে ধোয়া শুরু করল বড়মামীমা। লালির জন্য গোয়ালে একটা ভাঙা দরজা পেতে দেওয়া হল, যাতে শুকনো জায়গায় বসতে পারে। পাড়া থেকে কারা যেন জিটিরোডে গিয়ে ইলেকট্রিক অফিসে খবর দিয়ে এল। এই সময় শুরু হল উঠোনে মাছের আনাগোণা। এদিকে শ্রীপল্লীর মাঠের পেছনের অংশের পুকুরটা ভেসেছে, ওদিকে শ্রীদুর্গা মিলের পুকুর। এই শিউলি গাছের গোড়া বাটামাছের ঝাঁক তো নারকেল গাছের গোড়ায় কইমাছ কানে হাঁটছে। বাবু, সুবীর, রতন, বুম্বারা ছেঁড়া মশারি, গামছা আর মাটির হাঁড়ি নিয়ে হইহই করে সারাপাড়া জুড়ে মাছ ধরে বেড়াচ্ছে। বুড়ীর মা মাসি আজ কাজে এসেছে, পেয়ারাগাছের সামনে থেকে খপ করে একটা মাঝারি সাইজের শোলমাছ ধরে ফেলল। বড়মামীমা মাছ কাটতে কাটতে মা'কে বলে 'কালিয়া করব, ওদের জন্য দেব, আগেভাগেই ওদের ভাত খাইয়ে দিস না দিদি।' ভাই শুনতে পেয়ে মুখ বেজার করে, ও মাছ খেতে একদম ভালবাসে না। ছবিমাসি দিদাকে বলে ‘মাসিমা আফনে রান্ধেন, আফনের রান্ধা কালিয়ার সোয়াদ মুহঅ লাইগ্যা থাহে।' দিদা হাসিহাসিমুখে বলে ‘হ বৌমা তুমি অন্যটি দ্যাহ, মাছটা আমি দেখ্তাসি।' ... ...
হাইস্কুলের মণীষাদি খুবই মারকুটে ছিলেন, তিনিও আর বেত মারেন না, তবে অদ্ভুত অপমানজক শাস্তি উদ্ভাবনে এঁর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। ক্লাসে কথা বলায় দুজনকে দোতলার বারান্দায় নিয়ে একে অপরের কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ও পাশে মিনুদিকে পাহারাদার হিসাবে বসিয়ে রাখা, অঙ্ক না পারলে জুতো হাতে নিয়ে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, দুজন ছাত্রীর মধ্যে ঝগড়া ও মারামারির অভিযোগ পেয়ে নিজের নিজের জুতো দিয়ে একে অপরের গালে মারতে বাধ্য করা ইত্যাদি ছিল তাঁর উদ্ভাবন। ... ...
ক্যাম্পসাইট থেকে সকালের নরম আলোয় অ্যালুমিনিয়াম পাতের মত বরফচুড়ার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকি তাঁবুর বাইরের বসার ঘরে। পাতলা নেট ভেদ করে ঠান্ডা লাগে, কিন্তু কাল রাত্রের মত নয়। রাতে -২ অবধি নেমেছিল তাপমাত্রা। শ্বাস প্রশ্বাসও অনেক স্বাভাবিক আজ। একটু পরেই সুজ্জিমামা হালকা সোনালী রঙ দেয় চুড়ায়, মোটা ব্রাশে স্ট্রোকের পর স্ট্রোক – অ্যালুমিনিয়ামের পাতখানা কাঁসার রঙ ধরে। ক্যাম্পসাইটে ঘুরে বেড়াই এদিক ওদিক। মানসীরা উঠে পড়েছে অনেকক্ষণ, অভিও উঠে ছবি তুলছে এদিক ওদিক। রান্নার তাঁবুতে গিয়ে গরমজলের কথা জিজ্ঞাসা করতে ওঁরা সোলার গিজার দেখিয়ে দেন। একটা মাঝারি জলাধারের সাথে অনেককটা সোলার প্যানেল লাগানো আর একটা কল। ... ...
চন্দ্রতাল লেককে ঘিরে একাধিক উপকথা, লোককথা প্রচলিত। পুর্নিমার রাতে নাকি পরীরা নামে স্নান করতে। একটা গল্প চন্দ্রদেবের কন্যা চন্দ্রা আর সূর্যদেবের পুত্র ভাগা একে অপরের প্রেমে পড়ে, কিন্তু অভিভাবকরা নারাজ বিয়েতে। তাদের দেখা হয়েছিল বরলাচা-লায়, সেখান থেকে পালিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে বিস্তর বাধাবিঘ্নের পরে তান্ডিতে গিয়ে মিলন হয়। তো লুকিয়ে থাকার জন্য দুজনে দুটো হ্রদ বানিয়ে নেয়, চন্দ্রতাল আর সুরজতাল। দেবদেবীদের ছেলেপুলেরা কি পরিমাণ প্রিভিলেজড দেখুন, হুট বলতেই দুখানা কাকচক্ষু জলের হিমবাহী হ্রদ(গ্লেসিয়াল লেক) বানিয়ে ফেলল। আরেকটা গল্প প্রচলিত যে একে একে সব ভাই ও দ্রৌপদী মারা যাবার পরে ইন্দ্র তার রথ নিয়ে এসে যুধিষ্ঠিরকে চন্দ্রতাল হ্রদ থেকেই সরাসরি স্বর্গে নিয়ে গেছিল। ... ...
রেখাদি সামনে দাঁড়িয়ে ওকে বকছেন রাতের খাবার হজম না হওয়া সত্ত্বেও সকালের খাবার খাওয়ার জন্য, স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার না খেয়ে মুখরোচক খাবার খাওয়ার জন্য। উনি জানতেন না কল্পনার বেশীরভাগ দিনই রাত্রে খাওয়া হয় না, সকালেও না। ওর মা দুপুরের পর এসে রান্না করলে ওরা সবাই বিকেলের দিকে একবার খায়। কল্পনার মা যেসব বাড়ী কাজ করে তারা কেউ কোনওদিন রুটি বা মুড়ি দিলে রাত্রে ওরা একগাল খায়, নাহলে আবার সেই পরেরদিন বিকেলে। উনি জানতে চানও নি অবশ্য। মিনুদি কোত্থেকে একঠোঙা মুড়ি এনে ওর হাতে দিয়ে বলে 'তুই আস্তে আস্তে একটু করে জল দিয়ে দিয়ে খা দিকিনি'। রেখাদির দিকে তাকিয়ে বলে 'আপনি ক্লাসে যান দিদিমণি, এই মুড়িটুকু খাইয়েই আমি ওকে ক্লাসে দিয়ে আসছি'। আমরা চুপি চুপি ফিরে আসি। আমি জানি অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে পেটে খুব ব্যথা হয়, বাবা বলত রাত্রে না খেলে অনেকক্ষণ পেট্খালি থাকবে, পেটে খুব ব্যথা হবে। ... ...
একদিকের সবুজ ঘাসেভরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ভাই অনেকটা উঠে গিয়েছিল, পেছন পেছন আমিও। মা নীচ থেকে আমাদের নাম ধরে পরিত্রাহী চীৎকার শুরু করে নেমে আসার জন্য। সেজমামার হইহই হাসি, ছোট্ট বোনটার একদিকে আমাদের সাথে যাবার ইচ্ছে আরেকদিকে বাবা মা’কে ছেড়ে উপরে ওঠার দ্বিধা, প্রথম বরফ দেখার উচ্ছাসে কলকল করে সবাই মিলে একসাথে কথা বলা। দুপুর পার করে মানালি ফিরে কোথাও ভাত না পেয়ে হোটেলের দোতলার বারান্দার গা লাগোয়া আপেলগাছ থেকে আপেল পেড়ে কচমচিয়ে খেয়ে ফেলা, গোল্ডেন আপেলও সেই প্রথম চেনা ...চৌত্রিশ বছর আগের দিনটা তার তীব্র ঠান্ডা হাওয়া, ঝলমলে রোদ্দুর, সরুমোটা গলার আওয়াজ, হইহই হাসি, সব সঅব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আজ। ... ...