![]() |
হেমন্তের অরণ্যে, তুমি
ফরিদা
কিছুটা আচমকাই দেখা হল আজ – কয়েকটা কাঠচাঁপা, একটি আমগাছ ঘেরা একচিলতে ঘাসজমি শহরের ব্যস্ত রাস্তার ধারে। কিছু বদন্যতা দেখিয়েছে পাশের কালো কাচে ঘেরা অফিস বাড়িটি। এমনকি দৈনিক বরাদ্দ জল নিয়মিত পায় বলে ঘাসেরা সবুজ থাকে। পাতাদের গায়ে ধুলো কিছু কম রাস্তার বাকি অংশের তুলনায়। তবু নিজস্ব ঋতুটিতে সে রীতি মেনে ঝরিয়েছে একরাশ পাতা। আকাশ পরিষ্কার ছিল আজ। তাই হাওয়া ছিল বেশি হয়ত। তাই খরাপাতার ফসল আজ কিছু বেশি –
“হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক
তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিল ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতো...”
পাতাগুলি উড়ে যাচ্ছিল, মালি তার পিছু পিছু ঝাড়ু হাতে যেন খেলার মাঠ থেকে ধুলোমাখা শিশুগুলি ফেরৎ নিয়ে যাবে তাঁর পাঠশালায়।
“আমি দেখেছি, কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে বকের মতো নিভৃতে মাছ
এমন অসম্ভব রহস্যপূর্ণ সতর্ক ব্যস্ততা ওদের”।
হেমন্তের দিন এলে হয় বটে এমন। একটা আলগা ছেড়ে যাওয়া থাকে – প্রতিটি পাতার নিজস্ব গ্রন্থি থাকে যা তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে – যা গত বসন্তের শুরু থেকে তাকে বড় করে তুলেছিল – সারা বছরের রোদ্দুর বৃষ্টি বিষাদ আনন্দগুলি ভাগ করে নিয়েছিল – স্বভাব-উদাসীন হেমন্ত তাকে রেয়াত করে না বড় একটা। রঙ বদলিয়ে দেয় তার – আঙুল ছেড়ে দেয় অনায়াসে। যেমন কবিতাটি বলে ওঠে –
“আমরা ক্রমশই একে অপরের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি
আমরা ক্রমশই চিঠি পাওয়ার লোভে সরে যাচ্ছি দূরে
আমরা ক্রমশই দূর থেকে চিঠি পাচ্ছি অনেক
আমরা কালই তোমাদের কাছ থেকে দুরে গিয়ে ভালোবাসা ভরা চিঠি
ফেলে দিচ্ছি পোস্টম্যানের হাতে...”
যেন দুরে না গেলে তার সাধ মিটবে না, নাকি সে উপলব্ধি করতে চায় কাছে থাকার মুহূর্তগুলি আরো অন্য কোনও অমোঘ ভঙ্গিমায়? তা হলে “এরকমভাবে জামা খুলে রেখে আমরা একাকী ভেসে যাচ্ছি বস্তুত জ্যোৎস্নায়” বলার পরক্ষণেই বলা হল –
“অনেকদিন আমরা পরস্পর পরস্পরে আলিঙ্গন করিনি
অনেকদিন আমরা ভোগ করিনি চুম্বন মানুষের
অনেকদিন গান শুনিনি মানুষের
অনেকদিন আবোলতাবোল শিশু দেখিনি আমরা
আমরা অরণ্যের চেয়েও আরও পুরোনো অরণ্যের দিকে চলেছি ভেসে
অমর পাতার ছাপ যেখানে পাথরের চিবুকে লীন...”
অর্থাৎ, তার ছেড়ে যাওয়া অথবা ছেড়ে যেতে চাওয়াটি কি তার কাছাকাছি থাকাটিকে আরো কাছাকাছি আনতে চাওয়া হয় না? “ভেসে যাচ্ছি বস্তুত জ্যোৎস্নায়” বলেও জানান হল কোথায় – না সেই “অরণ্যের চেয়েও পুরোনো অরণ্যের দিকে”, “অমর পাতার ছাপ যেখানে পাথরের চিবুকে লীন”।
যেভাবে কাছাকাছি ছিল পাতাগুলি গাছের সঙ্গে গত বসন্ত থেকে ওতপ্রোত ভাবে সে আবার চলে যেতে গিয়ে পৌছে যেতে চায় দুরে – “অমর পাতার ছাপ যেখানে পাথরের চিবুকে লীন” – জানে, সেখানে একবার যেতে পারলেই হল, ব্যস, আর কোনও ক্ষয় নেই কোনও হেমন্ত এলেও তাকে চলে যেতে হবে না – ফিরতেও হবে না কোনও বসন্তে। দূরত্ব যা কিনা শুধুই ধারণামাত্র সেটা জানা হয়ে গিয়েছে কালেরও সীমানা জেনে নিয়ে লেখা হতে থাকে –
“কতকালে পুরোনো নতুন চিঠি খুঁজে পেয়েছে অই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি
একটি চিঠি হতে অন্য চিঠির দূরত্ব বেড়েছে কেবল
একটি গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি আমি।”
কবিতাটি অতদূর অবধি নিয়ে যায় আমাদের। হয়ত আরও দুরে নিয়ে যাবে পরবর্তী কোন পাঠ প্রক্রিয়ায় – হয়ত বা সম্পূর্ণ অন্য কোথাও। যেমন বিশ্বাস করি প্রকৃত কবিতা তার পাঠককে রাস্তায় নামিয়েই ছাড়ে – আমাকে যদি একটি কবিতা শিয়ালদা স্টেশনে দাঁড় করিয়ে চট করে ট্রেনে উঠে কেটে পড়ে অন্য কাউকে সেই কবিতাই হয়ত অন্ধকার নির্জনতম সৈকতে সারারাত কাউকে সঙ্গ দিয়েছে। তেমন ভাবে হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায় প্রতিটি কবিতাই অনেকটা বা কিছুটা হলেও আত্মজৈবনিক। আর ঠিক সেই জায়গাটিতে উড়ে যাওয়া পাতাগুলি দেখে মনে পড়ে এখন হেমন্তকাল। তারপরে মনে পড়ে তারিখটা ২৫শে নভেম্বর। জন্মদিন।
“হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক
তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিল ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতো...”
পাতাগুলি উড়ে যাচ্ছিল, মালি তার পিছু পিছু ঝাড়ু হাতে যেন খেলার মাঠ থেকে ধুলোমাখা শিশুগুলি ফেরৎ নিয়ে যাবে তাঁর পাঠশালায়।
“আমি দেখেছি, কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে বকের মতো নিভৃতে মাছ
এমন অসম্ভব রহস্যপূর্ণ সতর্ক ব্যস্ততা ওদের”।
হেমন্তের দিন এলে হয় বটে এমন। একটা আলগা ছেড়ে যাওয়া থাকে – প্রতিটি পাতার নিজস্ব গ্রন্থি থাকে যা তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে – যা গত বসন্তের শুরু থেকে তাকে বড় করে তুলেছিল – সারা বছরের রোদ্দুর বৃষ্টি বিষাদ আনন্দগুলি ভাগ করে নিয়েছিল – স্বভাব-উদাসীন হেমন্ত তাকে রেয়াত করে না বড় একটা। রঙ বদলিয়ে দেয় তার – আঙুল ছেড়ে দেয় অনায়াসে। যেমন কবিতাটি বলে ওঠে –
“আমরা ক্রমশই একে অপরের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি
আমরা ক্রমশই চিঠি পাওয়ার লোভে সরে যাচ্ছি দূরে
আমরা ক্রমশই দূর থেকে চিঠি পাচ্ছি অনেক
আমরা কালই তোমাদের কাছ থেকে দুরে গিয়ে ভালোবাসা ভরা চিঠি
ফেলে দিচ্ছি পোস্টম্যানের হাতে...”
যেন দুরে না গেলে তার সাধ মিটবে না, নাকি সে উপলব্ধি করতে চায় কাছে থাকার মুহূর্তগুলি আরো অন্য কোনও অমোঘ ভঙ্গিমায়? তা হলে “এরকমভাবে জামা খুলে রেখে আমরা একাকী ভেসে যাচ্ছি বস্তুত জ্যোৎস্নায়” বলার পরক্ষণেই বলা হল –
“অনেকদিন আমরা পরস্পর পরস্পরে আলিঙ্গন করিনি
অনেকদিন আমরা ভোগ করিনি চুম্বন মানুষের
অনেকদিন গান শুনিনি মানুষের
অনেকদিন আবোলতাবোল শিশু দেখিনি আমরা
আমরা অরণ্যের চেয়েও আরও পুরোনো অরণ্যের দিকে চলেছি ভেসে
অমর পাতার ছাপ যেখানে পাথরের চিবুকে লীন...”
অর্থাৎ, তার ছেড়ে যাওয়া অথবা ছেড়ে যেতে চাওয়াটি কি তার কাছাকাছি থাকাটিকে আরো কাছাকাছি আনতে চাওয়া হয় না? “ভেসে যাচ্ছি বস্তুত জ্যোৎস্নায়” বলেও জানান হল কোথায় – না সেই “অরণ্যের চেয়েও পুরোনো অরণ্যের দিকে”, “অমর পাতার ছাপ যেখানে পাথরের চিবুকে লীন”।
যেভাবে কাছাকাছি ছিল পাতাগুলি গাছের সঙ্গে গত বসন্ত থেকে ওতপ্রোত ভাবে সে আবার চলে যেতে গিয়ে পৌছে যেতে চায় দুরে – “অমর পাতার ছাপ যেখানে পাথরের চিবুকে লীন” – জানে, সেখানে একবার যেতে পারলেই হল, ব্যস, আর কোনও ক্ষয় নেই কোনও হেমন্ত এলেও তাকে চলে যেতে হবে না – ফিরতেও হবে না কোনও বসন্তে। দূরত্ব যা কিনা শুধুই ধারণামাত্র সেটা জানা হয়ে গিয়েছে কালেরও সীমানা জেনে নিয়ে লেখা হতে থাকে –
“কতকালে পুরোনো নতুন চিঠি খুঁজে পেয়েছে অই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি
একটি চিঠি হতে অন্য চিঠির দূরত্ব বেড়েছে কেবল
একটি গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি আমি।”
কবিতাটি অতদূর অবধি নিয়ে যায় আমাদের। হয়ত আরও দুরে নিয়ে যাবে পরবর্তী কোন পাঠ প্রক্রিয়ায় – হয়ত বা সম্পূর্ণ অন্য কোথাও। যেমন বিশ্বাস করি প্রকৃত কবিতা তার পাঠককে রাস্তায় নামিয়েই ছাড়ে – আমাকে যদি একটি কবিতা শিয়ালদা স্টেশনে দাঁড় করিয়ে চট করে ট্রেনে উঠে কেটে পড়ে অন্য কাউকে সেই কবিতাই হয়ত অন্ধকার নির্জনতম সৈকতে সারারাত কাউকে সঙ্গ দিয়েছে। তেমন ভাবে হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায় প্রতিটি কবিতাই অনেকটা বা কিছুটা হলেও আত্মজৈবনিক। আর ঠিক সেই জায়গাটিতে উড়ে যাওয়া পাতাগুলি দেখে মনে পড়ে এখন হেমন্তকাল। তারপরে মনে পড়ে তারিখটা ২৫শে নভেম্বর। জন্মদিন।
শেয়ার করুন |
আপনার মতামত দেবার জন্য নিচের যেকোনো একটি লিংকে ক্লিক করুন